লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন

সান্দাকফু মানে হল ‘Height of the poisonous plant’ বা বিষাক্ত গুল্মের দেশ। সম্ভবত সেই গাছ হল একোনাইট যা থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ হয়, সেটা অনেকেরই জানা। ভারি সুন্দর বেগুনি ফুল, প্রচুর ফোটে পাহাড় ছেয়ে, অনেক উঁচুতে, প্রায় টপের কাছাকাছি। সেখান থেকে ১৮০° প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায় বিখ্যাত সব গিরিচূড়ার। মাকালু লোৎসে, এমনকী কপাল ভালো থাকলে এভারেস্ট। আর আমাদের কাঞ্চনজঙ্ঘা তো অপরূপ শয়ান বুদ্ধ (Sleeping Budhha) বা শিবের আদলে।

এই রাস্তায় মার্চ এপ্রিলে ফুটতে থাকে রডোডেনড্রন (গুরাস)। বৃক্ষ থেকে গুল্ম হয় যত ওপরে ওঠা যায় আর লাল বদলে যায় গোলাপি, সাদা বা বিভিন্ন রঙে। পাশাপাশি জায়ান্ট ম্যাগনোলিয়া, নানান অর্কিড, স্প্রুস।

সান্দাকফুর সঙ্গে সকলেরই প্রথম পরিচয় হয় ভূগোল বইতে। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান, দার্জিলিং হিমালয়ের সিঙ্গালীলা রেঞ্জে। দেশের মধ্যে এরকম এক অসাধারণ হাতছানি সেই কৈশোরের আমি-কে চুম্বকের মতো টেনেছিল। সুযোগ এল এতদিন পর। মজার ব্যাপার এই যে, গাড়ি গেলেও আমরা হেঁটেই উঠব এই পণ করেছি জনাকয়েক মহিলার দল। গাইড দু-জন কারোর দাদা বা বন্ধু। রাতের দার্জিলিং মেলে চাপো, ঘুমিয়ে পড়ো আর সক্কাল সক্কাল পৌঁছে যাও নিউ জলপাইগুড়ি। তারপর খানিকটা এগিয়ে যাওয়া গাড়িতে মানেভঞ্জন। সেখান থেকেই হাঁটার শুরু হয়। ইদানীং কেউ আরেকটু এগিয়ে যান ‘চিত্রে’-য়, সময় বাঁচাতে। আমাদেরও সেই প্ল্যান হল।

পথে পড়বে গোপালধারা চা বাগান। আর কে না জানে দার্জিলিং-এর চা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। ভূগোল দিদিমণি বলেই বোধহয় এইসব পথ চলার পাশাপাশি মানুষজন, তাদের স্বভাব, সংষ্কৃতি, পোশাক, জীবিকা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার চোখে পড়ে, যা সাধারণত গড়ে ওঠে ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া, স্থানীয় উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। আমার দলেও ভূগোল দিদিরাই ভারী। তাই এইসব আমাদের কাছে খুবই উপভোগ্য। কথায় কথায় এ-সব প্রসঙ্গ এসেই পড়ে।

কোনো আশা করে যাইনি। কিন্তু আশাতীত পাওনা হয়েছে। অনেকের হয়নি, হয় না। তাঁরা তিন দিন ধরে মেঘ আর মেঘলা দেখে নেমে গেছেন, শুনলাম। আমরা যেদিন দুপুর একটায় পৌঁছোলাম সেদিনও মেঘলা, প্রবল হাওয়া, ঝড়ের মতো ওই প্রায় বারো হাজার ফিট উঁচুতে। ভাতে ডাল মাখতে না মাখতে শুকিয়ে যায়, এমন ঠান্ডা, ফেব্রুয়ারির ১৪।

উঠেছি তিনদিন ধরে, হাতে সময় নিয়ে, সবকিছু দেখতে দেখতে। নেমেছি দু-দিনে। হাঁটতেই যাওয়া। তাতে খাওয়ার গল্প দিয়ে শুরু করেছি। কারণ বলতে গেলে ওটা ছাড়া চলে না। অত ওপরে, কী কষ্ট করে সব জোগাড় করে রাখেন ট্রেকার্স হাটের মানুষরা অতিথিকে পুরো পরিষেবা দিতে, যত্ন দেখে অবাক হই।

এমনি একজনকে দেখলাম কালাপোখরিতে। হাসিমুখ লোমো। ঠান্ডায় গরম জল, চা, দুধ চা, কফি, যেমন চান এসে যাচ্ছে। রুটি আর আলুর তরকারি কিংবা গরম ডাল, ভাত, সবজি, পাপড় সেঁকা, তখন অমৃত।

আমার আপনার শরীর ভালো রাখার দায় যেন ওঁদের। লিকার চা আসছে পাশে চিনি আর গোলমরিচের বাটি। চিনি বাদ দিয়ে মরিচ ছড়িয়ে খেয়ে দেখি, বেশ তো! সে-সব পরে বলব। এখন চিত্রে থেকে হাঁটার শুরু।

মানেভঞ্জন নাম এই যেন ঝঙ্কার। সেই আঁকা পথ আর পাইনের বন ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম চিত্রেয়। তখন দুপুর গড়িয়েছে। বিকেল ফুরোতেই রান্নাঘরে সবাই জমা হই। হালকা গরম জল প্রথমেই দেন। হাঁটলে তেষ্টা পাবে আর ঠান্ডা জল খেলেই বিপদ। খেতে খেতে বেশ গল্প হয়। একসময় মালকিন এসে রেখে যান একটা কাঠের ফুলদানির মতো জিনিস। তাতে মল্ট আর গরম জল ঢেলে দেন। আর কাঠের স্ট্র। আস্তে করে টানতে হবে। অল্প টক বার্লির মতো খেতে। ‘Thumba’. কেউ কেউ সন্দেহের বশে খেলেন না। কেউ তাঁদের ভরসা দিতে লাগলেন। প্রচুর হাসাহাসি হল এ-সব নিয়ে। প্রথম পাহাড়ের উচ্চতাকে মানিয়ে নিতে হবে কী না! অতএব…

লাঞ্চে ভেজ চাউ খাওয়ার পর আমরা এদিক ওদিক হাঁটতে গেলাম।

কেউ নীচে বৌদ্ধ চৈত্য দেখতে, কেউ সামনের রাস্তায়, আর এই সময় আমাদের একজন দাদার ডাকে আমরা দৌড়োলাম পাশের একটা ঘরে। সেখানে কী সব অপরূপ খাবার বানানো চলছে, সামনেই তিব্বতি নববর্ষ ১৬ই ফেব্রুয়ারি। ওরা ‘খাপসো’ নামে ময়দার রুটি বানাচ্ছেন, আর আমাদের সনাতন ‘এলোঝেলো’ (আউল্যা ঝাউল্যা)-র মতো ময়দার খাজা। কিন্তু তার অনেকরকম শেপ, গয়না বড়ির মতো। ওরা খুশি আমাদের হুমড়ি খেয়ে দেখা দেখে। হাত লাগালেও আপত্তি নেই। কিন্তু এ-সব এখন খাওয়া যাবে না, সেইদিন পুজো হলে পরে, তবেই…

NJP থেকে মানেভঞ্জন যাওয়ার পথে মিরিকের চা বাগান, গোপালধারা। এখানে একটা হল্ট নিতেই হয়। আর এক কাপ চা। সেটা চোখে দেখাও সুখ, এমনি তার রং। আর স্বাদের ব্যাপারটা উহ্যই থাক।

চিত্রের ভোর হওয়া


ভোর হতে বাকি তখনও। সঙ্গীদের হাল্কা হৈ চৈ… ওঠো ওঠো, আকাশ লাল হচ্ছে, শিগগির দ্যাখো।

সবাই উঠে সামনের মাঠে দেখি ঘাসগুলো সব সাদা, সামনে আকাশের একরকম অদ্ভুত লাল আমাদের বোবা করে রাখে, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না। শুধু আবছা অন্ধকারে কিছু ছায়ামানুষের মতো ইতিউতি দাঁড়িয়ে থাকি। দূরে একফালি চাঁদ প্রত্যেকের নিভৃত একাকিত্বের সাক্ষ্য রেখে দেয়।

বেলা গড়ায়, বেরিয়ে পড়ি।

টুমলিং-এর দিকে হাঁটছি

একটা কালো চকচকে রাস্তা বেরিয়ে গেছে নীচ দিয়ে। ওটা মোটোরেবেল রোড। খানিকটা হয়ে গেছে, খানিক বাকি। আগামী দিনে সহজেই সবাই যেতে পারবে সোজা ওই বঙ্গের সুইটজারল্যান্ডে।

আমরা হাঁটার জন্যে পাহাড়ের ঢাল বেছে নিয়েছি। ঘাস ঘাস, পাথর পাথর পথ।

পাশের পাহাড়গুলো এখন হলুদ ঘাসে ভরা। তাতে বাহার দিয়ে কিছু পর পর তুবড়ি যেমন ওঠে সেরকম ফুল। জিরোই অল্প সেই ফাঁকে স্কেচ করে রাখি, এ আমার সেই ছোটোবেলার অভ্যেস।

টুমলিং টুমলিং, যেন মন্দিরার তোলপাড় মনে মনে। মন্দিরাও তোলপাড় ফেলে মাঝে মাঝে, যদি তেমন করে বাজায় কেউ।

পাহাড় ওঠে, পাহাড় নামে, পাহাড় দাঁড়ায়, বসে। আমি যেন তাকে শুধু ছুঁয়ে থাকি। পা গুনি, তাল মেলাই। এ যেন রোদ্দুর মাখা পাহাড়ি পথ দিয়ে ভাসা।

টুমলিং এর পথ

রাস্তা উঠে যাচ্ছে বেশি, নামাতে ছন্দ বজায় রাখতে যেটুকু। টুমলিং প্রায় ৯০০০ ফুট। এক পাহাড়ের মাথায় চড়ার আগে জঙ্গল এল, এল সুঁড়িপথ। শেকড় বাঁচিয়ে এগিয়েই একটা খোলামেলা হিলটপ। ধুপধাপ স্যাক রেখে বসা। ছবি। এতক্ষণে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাঁটছি। প্রত্যেকটা মানুষের হাঁটার নিজস্ব ছন্দ আছে। পাহাড়ে এলে বোঝা যায়। ইচ্ছে করে কারোর সঙ্গে হাঁটা কঠিন। আবার অনিচ্ছেতেও কারোর সঙ্গে পা ফেলা মিলে যায়। তখন খুব আনন্দ হয়।

টুমলিং আসলে নেপালের গ্রাম। কিন্তু এখানে কাঁটাতারের কড়াকড়ি নেই। কয়েকটা মাত্র ঘর আর কিছু হোটেল। এর আগে একটা চেকপোস্ট পড়ে। সেখানে আইডি প্রুফ চায়। তারপর মেঘমা।

মেঘমার ধারে কাছে আসতেই কালো আর ছাইরঙা মেঘের রাশি উড়ে এসে সামনের রাস্তা আটকে দিল। সুনসান চারদিক আর শুধু মেঘ উড়ে আসার আওয়াজ। হ্যাঁ, উড়ে আসারই।

গাছপালা নেই তেমন। মেঘগুলো যায় কোথায়! রাস্তা দেখতে পাই না। পথটা ঠিক আছে তো! বেশ সন্দেহ হয়…

টুমলিং-এর কাছাকাছি

মেঘমা নামের সঙ্গে মেঘের কোনো সম্পর্ক কোনো কালে ছিল না বা নেই, বললেন টুমলিং-এর রান্নাঘরের কর্ত্রী। মেগমা বা ম্যাগপাই পাখি খুব দেখা যেত এখানে। এখন পাস্ট টেন্স। তাই স্থানীয়দের নামকরণ মেগমা। কবে থেকে ওটা মেঘের দেশ হয়ে গেছে তা ওঁরা জানেন না, এই বলে খুব হাসলেন।

মেঘমা পেরিয়ে এগোই। ‘শীতকাল আর কবে আসবে সুপর্ণা’-র মতো আমার মনে হয়, টুমলিং আর কবে…

চারপাশে কিছুই দেখার নেই। না কোনো ঘরবাড়ি, না গাছ। দূর থেকে একটা বাড়ি দেখে মন নেচে ওঠে, এল কি তবে!?

দেখি আমাদের পোর্টার করণ বসে। হাসছে। আমাদের হাঁপানি দেখে। সে কবে পৌঁছে ব্যাগ রেখেই শুধু এসছে তা নয়, রান্নাঘরে গিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই, কোনো রান্নাও নেই। ডাকাডাকি করে এক বুড়াকে পেয়ে তার সাহায্যে ভাত রান্না চাপিয়েছে আর খবর দিয়ে এসছে যে, আমরা ১৮জন আসছি। তখন বেলা দেড়টা। কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে তারা ভেবেছেন আমরা ১৩-তে আসব।

খিদে বেড়ে গেল এই শুনে। জানলাম এই ছোট্ট, সুনসান গ্রামের নাম ‘গুরাসে’। সে বলে চলে… কখনো অনেক গুরাস অর্থাৎ রোডোডেনড্রন ছিল প্রচুর। তাই না হলে এ নাম হয়!? কিন্তু সে-সব কই এখন!? যায় কোথায় এ-সব! লোকচক্ষুর আড়ালে কখন ধীরে ধীরে সবকিছু এক্সটিঙ্কট হয়ে যাচ্ছে। পরে একদিন আমরাও, আমাদের কাজের দোষেই হয়তো যাব।

উন্নয়ন ব্যাপারটা যেন ভয় ধরিয়ে দেয় মনে। কিন্তু তাও কতটা!? কীসের বিনিময়ে?

টুমলিং মানে ‘the top’.

দ্বিতীয় পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই