লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রমণ

সান্দাকফুর পথে কয়েকদিন

মেঘমার হাওয়ার ঝাপট বাঁচাতে পাথরের দেওয়াল খুঁজি। ঠেশ দি। পকেট থেকে বের করে খাই চিক্কি, আমসত্ব, লজেন্স (কলকাতা থেকে আনা। হাঁটলে বেশি খেয়ে বেরোলে বিপদ। সঙ্গে শুকনো খাবার রাখা দরকার। আর জল।

প্রায় চারটে বাজালাম পৌঁছোতে। দূর থেকে দেখে চেনা যায় শিখর লজের বাড়ি, গোলাপি চাল। আমরা তার পাশের পাশে উঠলাম। এক রাতের ঠিকানা। কুকুরগুলো ভরা বিকেলে অচেনা আমাদের দেখে বেশ ডাকল। আমরা সোফা সাজানো বসার ঘর পেয়ে বসেছি, বাকি দল এলে কাগজ দেখালে ঘর দেবে, ওমা! একজন এসে রাগ রাগ মুখে বকে গেলেন, জুতো খুলে যেন বসি সোফায়। ঠান্ডার দেশে চট করে এরকম জুতো খুলে বসার চাপ থাকে না জানি কিন্তু…

ভেবে-চিন্তে আমরা নেমে গেলাম রান্নাঘরে, কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে নীচে। গরম জল এগিয়ে দিলেন যেতে না যেতেই একজন টিপটপ লেডি। আমরা প্রাণ পেলাম। সারা রান্নাঘর জুড়ে তখন কাঠের জ্বালের ধোঁয়া। মেল ট্রেনের গতিতে রান্না হয়ে চলেছে গরম ভাত, ডাল, আলুকপির তরকারি আলুভাজা, পাপড়।

অপেক্ষা করতে করতে জানতে চাই কী কাঠে রান্না হচ্ছে!?

উত্তর এল: ভূর্জপত্র।

বেটুলা ইউটিলিস, আগের দিনে এ দিয়েই বানানো হত লেখার পাতা। অন্য ওষধি গুণের কথা না হয় বাদই থাক।

থাক দিয়ে ডাঁই করা রান্নাঘরের বাইরে। গাছ দেখতে চাইলে বললেন গুরদুমের রাস্তায় পাওয়া যাবে। এই গাছও একদিন হারিয়ে যাবে।

টুমলিং এর রাত

আজ অনেকটা হেঁটে এসে যে যার পফসেবায় মন দিলাম, আর খুশি খুশি গল্পে মেতে গেলাম। কার কখন কী অসুবিধে হচ্ছে, তা যেন আমাদের দলপতি দু-জনের দায়। শুনলাম সেই দাদার ঝুলিতে মাত্র ৩৭টা অভিযানের গল্প আছে। তাঁর আগামী ইচ্ছে জেনে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল!! মাউন্ট এলব্রুজটা যাওয়ার ইচ্ছে। আল্পস্‌ ইত্যাদি, মাঃ কিলিমাঞ্জারো সারা হয়ে গেছে। তখুনি মনে মনে ভাবলাম, আগামীকাল ওনার কাছাকাছি হাঁটব আর গল্প শুনব। এদিকে শীতে কাঁপুনি ধরেছে জোর। এমন সময় এক দলপতি দাদার প্রবেশ। কী সব ঠিকঠাক তো! বলতে না বলতেই নজর গেল আমাদের মেয়েদলের একজনের দিকে, সবে লেপ গায়ে বিছানায় ঠেশান থেকে শয়নে তার স্থান পরিবর্তন হয়েছিল। দাদা অসম্ভব সিরিয়াস গলায় ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ টাইপের বকেঝকে তাকে সটান বসিয়ে দিলেন। অল্প অল্প গরম জলের দাওয়াই দিয়ে নিজেই আনতে চললেন। আমরা অবাক।

পরে জানলাম হেঁটে এসে শুয়ে পড়লে altitude sickness-এর শিকার হতে হবে। তাই এই কড়া দাওয়াই। সে বেচারী সত্যিই খুব কষ্ট পাচ্ছিল, মাথা ধরা এ-সবে। তাও উঠে বসে, রুটি খায়। পরদিন বিলকুল সুস্থ।

রাতে অসম্ভব নরম রুটি আর সবজি (আলু) যেন অমৃত।

আজ১৩ ফেব্রুয়ারি।

টুমলিং থেকে কালাপোখরির দিকে।

ভোর না হতেই আকাশ লাল দেখতে সবাই ছুটলাম ঘর ছেড়ে। ভিউ পয়েন্টে গেলে পিক দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সকাল ফুটে উঠল। রান্নাঘরে তখন ডিম ময়দা বেকিং দিয়ে বানানো মিষ্টি মিষ্টি রুটি ভাজার গন্ধ আসছে। কাঠের জ্বালে চোখ জ্বালা করে তবু সবাই নামি গরম জল চা আর নাস্তার টানে। হাসি মুখে বড়ো কাঠের টেবলের চারপাশে গোল হয়ে বসি।

কেউ কোনো তাড়া দেন না। সুস্থিরভাবে সবাই সব গুছিয়ে বেরোই। সামনে ঢেউ-এর মতো পাহাড় সারির পিছনে দেখা যাচ্ছে কালাপোখরি টপ। সবুজ সবুজ পাহাড়ের মাথায় একটা সিনক্লাইনাল স্ট্রাকচার। তারও পিছনে খাঁজকাটা সান্দাকফু আবছা।

সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান গিয়েছে টুমলিং-এর পাশ দিয়েই। একটা চেকপোস্ট রয়েছে শুরুতে। পথেই পড়বে নেপালে ভারত সীমায় জৌবাড়ি।


আজকের পথে পাহাড়গুলো কালো ঝোপে ঢাকা। ওই কালো ঝোপগুলো সম্ভবত র‍্যাস্পবেরি, স্থানীয় ভাষায় বলে আসিলু, ছোট্ট লাল ফল হয়, খায় মানুষ।

আর ছিল রডডেন্ড্রন (গুরাস) প্রতিটায় মাথায় পাতায় কুঁড়ি। এবার আরও উঁচুতে উঠছি বলে গাছগুলো বৃক্ষ থেকে গুল্ম হয়ে যাচ্ছে, মানে আকারে ছোটো, পাতারা একটু সরু এরকম।

কালাপোখরির দিকে।

হাঁটছি তো হাঁটছি। চড়াই আর উতরাই তবে খুব খাড়াই নয়। হাঁপিয়ে গেলেও সামলে নেওয়া যায়। জলের বোতল খালি হয়ে যায়, কালাপোখরি তো দূর অস্ত, আমাদের নাকি গৈরিবাস-এ নামতে হবে আগে, তারপর ওইইইইইইই যে বলে লিডার একটা উঁচু পাহাড় দেখান।

যা দেখান তাতে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আর অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হতে লাগল। দূরে এক সবুজে ছাওয়া পাহাড়ের গা বেয়ে চকচকে সরীসৃপের মতো এক পথ উঠেছে অন্তত ৭০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। ওটাই আমাদের পথ। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখি তখনও কে জানত ওই পথেই দেখা মিলবে রেড পান্ডা, জায়ান্ট স্কুইরেল, বরফ হয়ে যাওয়া ঝরনা আর… পাখির!!!!

চলতে চলতে স্বাতিদি বলে ওঠে, জানিস পিয়ালি এ পথ আর ফুরোবে না, ওই গৈরিবাস বলে আসলে কিসসু নেই, আমরা শুধু হেঁটেই চলছি। হাসাহাসি করি আর লাঠি ঠুকে ঠুকে চলি। একসময় অনেক নীচে দেখা যায় গৈরিবাস। দুপুর তখন একটা। নামতে থাকি।

আজ দলের দুই দিদির যেন ডানা লেগেছিল গায়ে, সবার আগে এগিয়ে যে কোথায় গেছে, দেখাই পাইনি আর সবচেয়ে ছোটও টিপু তো পথ হারিয়ে নেপালে চলে যেতে গিয়ে মানে মানে ফেরত এসছে, তাও সে দাবি করেছে রেড পান্ডা দেখেছে, সবাই ওকে বলেছে ওটা নিশ্চয়ই বড়ো লাল মুরগি-টুরগি হবে।

এ-সব শোনা গেল গৈরিবাসে নেমে মোমো খেতে খেতে…

গৈরিবাসের পর…

এবার সেই সবুজ পাহাড় সামনে। বেলা দেড়টায় হাঁটা শুরু করি। ওই যে পিচের রাস্তা খাড়াই উঠে গেছে। একদল এগিয়ে গেছেন ততক্ষণে। একদল খুব দক্ষ যাঁরা, তাঁরা রয়ে গেলেন পিছনে। পেটে গরম ভেজ মোমো।

চড়াই এমন যে হাজার প্রশ্ন আসে মনে। কী করে কাটল পাহাড়, এত খাড়াইতে কেমন করে প্লাস্টার করে রাস্তা। জনমানব নেই কোত্থাও, শুধু সবুজ বাঁশের ঘন জঙ্গল দু-ধারে। আর রডোডেন্ড্রন, পাতায় পাতায় কুঁড়ি সাজানো। পাকদণ্ডীতে হৃদয় মুঠোয় চলে আসতে চায়। সারা রাস্তা জুড়ে শুধু পাখির ডাক। অনেকটা উঠে আসি আর এক ধাপের ওপর পথটা দু-দিকে চলে গেছে। কাকে জিজ্ঞেস করি। লাঠির আওয়াজ প্রতিধ্বনি শোনায় শুধু। বসি। ওমা! ঠিক কোত্থেকে হাজির হয় করণ, আমাদের পোর্টার, পথ বলে দেয় আর বলে সোজা যাবেন, নো শর্টকাট। এদিকে নেপাল যাওয়ার কিছু চোরাগোপ্তা পথ আছে। কাঁয়াকাট্টা থেকে ডান দিকে ঘুরবেন, বলে দেয়। বলে কোনো দিক দিয়ে আবার গায়েব।

জঙ্গুলে পথে মাঝে একটা মাইলস্টোন, সাদা। কতটা এলাম কে জানে।

এক সময় কাঁয়াকাট্টা এসে গেল। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সাড়ে তিনটে বাজে প্রায়। বিকেল গড়ায়। তিনজন নেপালি ছেলেমেয়ে গল্প করছিল, একটা দোকান বাড়ির সামনে। চা হবে? জানতে চাই। পনেরো টাকা। খেয়ে আবার হাঁটা। এমন সময় টিপু হাজির। ওপরে পৌঁছে আগের দলকে বসিয়ে আবার নেমেছে চলতি একটা বনদপ্তরের গাড়িতে।

বাকি পথটুকু আমাদের হাঁটা শুরু হল। কেউ নেই শুধু আমরাই।

রাস্তাটা পাথরে বাঁধানো। কটর-মটর করে আমাদের লাঠির আওয়াজ। আর কিছু নেই। পাখিগুলো নিশ্চিন্তে ডাকে, তাই থামতে হয়… দেখলাম কী!? ফায়ারটেল মাইযরনিস, কিংবা কালিজ ফেজ্যান্ট!! বিকেলে হয়েছে বলে ওদের এত ওড়াউড়ি। কেউ একটু আওয়াজ নকলের চেষ্টা করে। টিপু বকবকানি করে আমাদের পথ চলার এনার্জি জোগানোর চেষ্টা করতে করতে কখনো শান্ত হয়ে যায়। একটা ঢেউ-এর মতো বাঁক পেরিয়েছি, হঠাৎ ওর উত্তেজিত গলা! রেড পান্ডা! রেড পান্ডা!!

সত্যিই তাই, মুহূর্তে ভ্যানিশ। পিছনের দল আরও ভালও দেখেছে, একটা স্থানীয় বাচ্চা মেয়ে তাকে তাড়া করায় ঝটপট বাঁশের জঙ্গলে পালায়। ছবি নেই কিন্তু মনে আঁকা রয়ে গেল ওই অপূর্ব সুন্দর লাল ভালুক।

এরপর থেকে টিপু বারবার আমাদের মনে করিয়েছে আমরা যেন ওর পক্ষে সাক্ষ্য দি। আর এর বদলে ওকে mango bite খাওয়াতে হল বেশ ক-বার।

স্বপ্নের মতো আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে হারিয়ে গেল রেড পান্ডা, ভালো করে বুঝে উঠতে না উঠতেই… তাই আমার বেশ মন খারাপ হল। তখন আমায় মিমো জানায় ভূগোল দিদিমণির জন্যে আরও আশ্চর্য জিনিস আছে সামনে!

সত্যিই দেখলাম বরফ হয়ে যাওয়া ঝরনার পথ। আনন্দে আটখানা আমি ওই বরফে পা দেবই, টিপু এবার বড়ো দাদা হয়ে হুকুম দিল বেকায়দায় পড়বে, তার চেয়ে চলো, এগোই… সামনে আরও কঅঅত কী!

বিকেল পড়ে আসে, কালাপোখরি মেঘে ঢেকে যায়, দূর থেকে দেখা যায় না। টিপু তাড়া লাগায়। পশ্চিমের লাল হয়ে ওঠা আকাশ আর পুবের মেঘলা হাওয়া কনকন করে ফুঁড়ে দেয় অ্যাল্পাইনের উইঞ্চিটার। হাতের আঙুল লালচে ব্যথা ব্যথা।

বাতাসে চেকপোস্টের কাছে আসতেই শুনলাম আর বেশি বাকি নেই, প্রাণে নতুন বল এল। টিপুর অনন্ত এনার্জি আমাদের মশগুল করে রাখে। ছবি তুলতে দাঁড়াই ওই সীমান্ত প্রহরীদের নিয়ে। আমি যখন ভাবছি কালাপোখরি আর কত দূর! ওরা হয়তও ভাবছেন নিজের নিজের ঘর, সঙ্গী বা সন্তানের কথা। হাসি বিনিময় হয়। আবার চলি। এই এতক্ষণ পর মানুষ পেলাম। এর আগে পেয়েছি পাখি ভালুক আর জায়েন্ট স্কুইরেল।

একটা বাঁক ঘুরতেই কালাপোখরি।

তৃতীয় পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই