লেখক নয় , লেখাই মূলধন

তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

পশুবিশ্ব


বেকসুর অশ্বদেবতা আবিষ্কার করতে পারিনি বলে প্রতিটি রেসের ট্র্যাকে ঘোড়াগুলি অনন্ত নাস্তিক। গড়ের মাঠে ঘাসে-ঘাসে শুয়ে আছে চেরাজিভ দেবীর কাঁচুলি; ঘোড়াগুলি মুখ দেয়। কামের পচুই উলটে পথে ঘাটে গড়িয়ে গেল ক্বাথ। ঘোড়াগুলি মুখ তোলে, লাগামের পেশি ঘেঁষে ফুটে ওঠে সূর্যমুখী রোজ। বেকসুর দেবতা আজও জন্মাল না বলে ঘোড়ার টোটেমচিহ্ন এলই না কখনো।


ভাল্লুকের নখ দ্যাখো, চোখে আসে চাঁদ? প্রতিটি ঝরনার পাশে খিদের শিলাখণ্ডে চকচক করছে এমন জ্যোৎস্না, কৌশিকী অমাবস্যার কথা মনেই পড়ে না। মাড়ির মৌতাত থেকে কাঁটা খুঁটে লোমশ ভৈরব শেষে হাঁ-মুখে মাছের গতি মাখে। মাছ একটি অবতার। দাঁতের শিবিরে শোওয়া পাঁকমাখা আঁশে ছুটে মরছে সাতটি কচি আলো। অনভিজ্ঞ চোখ চমকে যায়!


জলের কবিতা শুনি, মনে পড়ে কুমিরের মুখ। সুযোগ এগিয়ে দিলে খোরাকের মায়া, বেনজির পড়ে থাকা নিথরমুদ্রায়… এ-ব্যাপারে কখনো কোথাও কোনো ডকুমেন্টারির ভাবনা নেই। সুযোগ জল খায়, আর শিং যেন প্রিয় লখিন্দর। বাসরের ফুটো দিয়ে হু-হু করে হাওয়া ঢুকে আসে, কুমির বিদ্যুৎ মেরে জল-কাদায় হিঁচড়ে আনে ভেলা। প্রশস্ত সরণিমুখ পার ক’রে অমরাবতী খসখসে পেট। তুরীয় বেহুলা নাচে, লখিন্দরের গায়ে উৎসেচক। হজম পেরিয়ে গেলে কুমির দ্বীপের মতো শুয়ে থাকে ধূর্ত একা একা।


অসংখ্য হরিণের জন্য আমরা শিকারের মন্ত্র পড়ি। ধুনির চতুর্দিকে একনলা ও দোনলা বন্দুকগুলি সিঁদুর মাখিয়ে শুইয়ে রাখি। বেতাল জাগানোর জন্য এই যে এত পবিত্র সময়, এ বিষয়ে অভয়ারণ্যে কতটুকু মিথ আছে আজও? থাবার নির্মেদ লিপি গুহার ভেতরে ঢুকে গেছে। হরিণ-বশীকরণ চাইছি, কমপক্ষে এক পক্ষকাল। আমাদের চতুষ্পদ জ্ঞাতি-গুষ্টি বন্দুক সরিয়ে রেখে বসে আছে সাভানা-আড়ালে। বেতাল জাগলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে মাংসের গতরে। দেহের সমস্ত ডোরা নেচে উঠবে ঘেয়ো পশ্বাচারে।


লেজের প্রভুত্ব মেনে নড়ে যাচ্ছে রাতের কুকুর। সমবেত কান্নাধ্বনি পাড়াঘর কালো করে দেয়। বিয়েবাড়ি নিভে গেলে চোখের হলুদ টর্চে খিদেভর্তি মুখ এল এঁটো-কাঁটা নেড়ে দেখবে বলে। অল্পই রয়েছে টিকে। লরিচাপা এ-সপ্তাহে তিন। তাদের শ্বাপদ আত্মা যে-যার লাশের পাশে ঘোরে। ভাদ্রলেজে যোনি ঢেকে ছুটে মরছে মাদীসম্ভূত ভয়। পেছনে যুবকগোষ্ঠী। অস্ত্রকাঠ গোলাপি শাবল। প্রভুদের লীলা মেখে ওদেরও পারদে লোভ দোলে।


গাছের জান্তব স্পৃহা হোয়াইটেকার বোঝেননি কখনও। মজুর মৌমাছি জানে। আর জানে ভাইপো বলাই। রাতের পথিকপুঞ্জ ডুবে গেছে ছায়ার কুয়োয়। শেকড় নাড়ে ভূমিরক্ত; জোঁক ক্লীব নুনের পুতুল। গাছের মাৎসর্য্যস্পৃহা জনপদ বোঝেনি কখনো। দরজার শিরা সেজে দুপুরের ব্লেড টেনে আনে। বাড়ির জলীয় চোখে নড়ে ওঠে মুমূর্ষু ফ্লোয়েম।


উপসংহারে এসে নেতিয়ে গেছে কবিতালেখক। চোখের ভিতরে তার এত আয়না সমান্তরালে রাখা, যে-কোনো দৃশ্য এসে মুহুর্মুহু নিষিক্ত হয়ে যায়। আর কোনো খেলা নেই, আর কোনো সম্ভোগ জেগে নেই। বউ, ছেলে অনন্তনাগ। ঘিরে রাখে গলার গরল। পশুবিশ্বে ও-ই রোজ দোরে দোরে লেখা চেয়ে আনে। সারারাত হাঁড়ি পোড়ে। লেখাগুলো পোয়াতি আঁচে ফোটে। সেদ্ধ লেখা উড়ে যায়, মধ্যরাতে, তামস তরলে। কাঁচাগুলো প্রবাদ-কলসি, নুড়ি ফেলে তেষ্টা তোলে জল। ছোটোপত্রিকার মৃদু ছালে গেঁথে থাকে হাড়ের নিষাদ।

Facebook Comments

পছন্দের বই