লেখক নয় , লেখাই মূলধন

বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর গল্প

দংশন

মৈনাক খুব আদর করে রুমির মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, ঘেঁটে দিচ্ছিল এদিক ওদিক। এই চুল নষ্ট হয়ে যাবে, এটা করছ কি?

আমি ক-দিন ছুটি নিই রুমি? 

এই তো এতদিন ছুটি নিলে আমার অ্যাক্সিডেন্টের পরে? বেড়াতে যেতে চাও কোথাও?

না, না এমনিই, তুমি বড়ো একা থাকো সারাদিন।

একা কোথায়? এই যে বললাম কুমড়ো পটাশের সঙ্গে কীরকম ভাব হয়েছে আমার! বলতে বলতে থমকে গেল রুমি। মৈনাক, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করোনি? ভাবছ ডিপ্রেশানে পাগল হয়ে যাচ্ছি? নিজের অজান্তেই গলা উঁচুতে চলে গেল, চিঁরে গেল উপরে উঠে। হাতের কাছে কিছু থাকলে ছুঁড়েই দিত বুঝি।

তেমন কিছু করল না রুমি, আবার বললও না শিঞ্জিনির কথা। এরকম ভারী নামের প্রাণীটি আসলে একটা ফড়িং। এত সুন্দর ফড়িং আগে কোনদিন দেখেনি রুমি। তুঁতে রঙের শরীরে কালো রঙ্গের ডানা, হয় না কি এমন? ঠিক মনে হয় তুঁতে পাড়ের কালো তাঁতের শাড়িতে কোনো সুন্দরী মেয়ে। ওর ডানা চালানোর ঝিনঝিন আওয়াজেই হয়তো শিঞ্জিনি নামটা টপ করে মাথায় এসে গেছিল। ফড়িংটা প্রথমে বুঝতেও পারেনি যে, এটা ওরই নাম। এর তো আবার গোল্লা দুটো চোখ ছাড়াও মাথার উপরে তিনটে। তবু যতদূর সম্ভব সব চোখকেই নিজের মায়ায় জড়ানোর চেষ্টায় রুমি ফিসফিস করে ডেকেছিল শিঞ্জিনি, শিঞ্জিনি! বারবার, অনেকবার। আঙুলের ডগায় একদানা চিনি রেখে লোভাতেও চেষ্টা করছিল। এখন রোজ আসে। তার যেমন ইচ্ছে হুকুমও তামিল করছে শিঞ্জিনি। হাতের তালু বাড়িয়ে দিলে সেখানেই বসে পড়ে। রুমির গালের কাছে ঘুরে ঘুরে তার ডানার গান শোনানোর চেষ্টা করে। তারপর রুমি যেই বলে, ব্যাস অনেক হয়েছে তখুনি আবার শান্ত হয়ে হাতের পাতায়। রুমি কি ওকে সত্যিই জাদু করেছে? না হলে আসে কেন রোজ সকাল হলেই? ফুলে ফুলে বসা ভুলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় রুমির সঙ্গে!

এদের কথা মৈনাককে আর বলে না রুমি। এরা তার গোপন ঘর। না হলে মৈনাক সকালে কফি ঢালতে ঢালতে যখন জিজ্ঞেস করল আর কার কার সঙ্গে আলাপ হল তোমার রুমি? কোনো পাখি বন্ধু হয়নি?

শিঞ্জিনির কথা বলেনি রুমি, বলেনি কানাইয়ের কথাও। কানাই একটা কেন্নো, কিন্তু ছোটোবেলায় দেখা কেন্নোগুলোর থেকে একটু আলাদা। গায়ের রং গাঢ় বাদামি, পায়ের রং হলদে মতন। দুটো দাঁড়া আছে। একদিন টেবিলের গা বেয়ে উঠছিল। ছোটোবেলায় কেন্নো দেখলে গা ঘিনঘিন করত রুমির। একবার মা গল্প শুনিয়েছিল কার না কি কানের ফুটো দিয়ে কেন্নো ঢুকে গেছিল আর সেই কেন্নো মাথায় ঢুকে ঘর সংসার পেতেছিল। তারপর বহুদিন রুমি কানে আঙুল চাপা দিয়ে শুয়েছে, সুযোগ পেলেই জুতোর তলায় পিষে মেরেছে পথ চলতি কেন্নোকে। আজ কিন্তু নিজের ক্ষমতা যাচাই করার লোভ সামলাতে পারল না। হুইল চেয়ার থেকে ঝুঁকে নিজের মাথাটা ওর কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করেছিল, এই তুই কে রে? কেন্নোটা চলা থামিয়ে শুঁড় ঘুরিয়েছিল রুমির দিকে। দেখেই রুমির শরীরে এক খুশির ঝিলিক। বুঝতে পারছে! রুমির চোখের দৃষ্টি ছুরির ধার পেল যেন। একা থাকলে মাথার ভাবনারা সরাসরি চোখে পৌঁছে যায় অনায়াসে।

কেন্নো যে এমন করে পোষ মানবে ভাবলেই অবাক হয় রুমি। ওর প্রতিটা কথা বোঝে। আঙুল বাড়িয়ে দিলে সুড়সুড় করে হাতে উঠে আসে। আঙুলে করে চোখের সামনে তুলে আনে ওকে, আমাকে যেন আবার দাঁড়া বসিয়ে দিস না কানাই। নিজের মনেই হেসে খানখান হল রুমি।

বাইরে এসবের কোনো প্রকাশ নেই রুমির।

তুমি আজকাল এত কম কথা বলো, কেন রুমি?

মৈনাকের অস্থির কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করল রুমি। তোমার আর আমার জগৎ যে আলাদা হয়ে গেছে মৈনাক। আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেছ তুমি। যেটা বলল না সেটা হল তুমি চলমান, আর আমি একটা হুইল চেয়ারে বন্দী। তোমার মহান হওয়া মানায়, লোক দেখানো বউ সোহাগ করে বাহবা পাবে। আমার জন্য শুধুই আহা উহু। এ-সব অবশ্য কিছুই বলল না রুমি, ভাবনাগুলো অনেক গভীরে টগবগ করে ফুটল শুধু।

আর ক-দিন রুমি, সেদিন ডাক্তার কী বললেন? তোমার পা সেরে এসেছে একদম। আর মাসখানেক হয়তো, তারপর তোমার প্রস্থেটিক পা লেগে গেলে তুমি আবার আগের মত—

আগের মতো কিছুই হবে না আর, রাত্রে শোবার সময় খুলে রেখেই তো শোব, তাই না?

নিজের অজান্তেই বাঁ-পাটাকে চেয়ারের আড়ালে লুকোনর চেষ্টা করে মৈনাক। আচ্ছা আমি কী করতে পারতাম বলো তো?

আমি কি কিছু বলেছি? তোমার যেমন লিয়ার সঙ্গে কফি শপে বসে গল্প করার করো না বসে। বারণ করেছি?

মানে?

ছন্দাদি আছে মৈনাকের অফিসে, সেদিন ফোন করে কথায় কথায় বলছিল, এই তো সেদিন মৈনাককে দেখলাম সাদা ছুঁড়িটার সঙ্গে কফি খাচ্ছে। ওইভাবেই কথা বলে ছন্দাদি সাদা ছুঁড়ি, কাল্লু ভাই, চিঙ্কি চামকি। আগে সবার সঙ্গে বসে এইরকম কথায় রুমির ঠোঁটে হাসি খেলত না, মনে মনে বিরক্ত হত। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল বোধহয় এই খবরটা দেওয়ার জন্যই ছন্দাদি আরও ফোন করেছে। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, নামও জেনেছিল। লিয়া।

রুমির নৈঃশব্দ্যে আরও রেগে গেল মৈনাক। তুমি কি বাড়িতে বসে বসে এই সবই ভাবছ রুমি? অফিসে কতজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, আগেও বলেছি তো। অফিসের কাফেটারিয়াতেও এমনি অনেক মিটিং থাকে।

চাপা কথার কয়েক ফোঁটা পাথর ঠেলে ছিটকে বেরোল এবার। তোমার বুদ্ধদেবপনাগুলো লিয়া, ক্যাথি আর শর্মিলাদের জন্য তুলে রাখো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার হুইল চেয়ারে বসে থাকার কপাল, থাকব। তাই বলে কৃষ্ণলীলা বন্ধ করতে বলিনি তোমায়।

মৈনাক রুমির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওর বাঁ-হাত রুমির ডান হাঁটুতে, ডান হাত রুমির গালের উপর আলতো করে রাখল মৈনাক। আজকে অফিসের ধড়াচুড়ো চাপায়নি, হাফপ্যান্ট আর টি শার্টে এখনও। তাই ঘাসে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে বসতে তুমি এমন করে? নিজের মনেই বলল রুমি। এরকম গা বাঁচানো আলগা আদর করা সহজ। যার হয়েছে শুধু সেই বোঝে। মৈনাকের আবেগ কিছুতেই উষ্ণ করতে পারছিল না রুমিকে। মৈনাকের সকাল বেলার উপচে পড়া ভালোবাসায় গা রিরি করে রুমির। কই রাত্রে শোবার সময় তো তাকে খুঁজতে আসে না মৈনাকের হাত, বরং সে এগোতে চাইলেও সরে যায়। বলে আরও ক-দিন যাক। আমার পায়ে ব্যথা লেগে যাওয়ার ভয় না হাতি! বোঝে না যেন রুমি। তার চেয়ে বলুক না কেন মুখে, এক পা না থাকা মেয়ের শরীর বিছানায় বিসদৃশ লাগে তার।

আমি কী করলে তুমি খুশি হও রুমি? যতদিন তুমি নিজের পা না পাচ্ছ, আমি বাড়ি থেকে কাজ করি?

হ্যাঁ, নিজের পা! এই উপহাসটা বুকের মধ্যে চেপে মুখে বলল, সে তো করবেই, না হলে আর আমার উপর নজর রাখা হবে কী করে?

মৈনাকের চোখ বিস্ময়ে স্তিমিত হয়ে গেল, একটু কি জলের ছোঁয়া? তাহলে তোমাকে আমি অফিসে পৌঁছে দিই, তুমি আবার অফিস শুরু করো।

আমি ঘণ্টা দুয়েকের বেশি বসে থাকতে পারি না মৈনাক, ক্লান্ত হয়ে পড়ি। না হলে বাড়ি থেকেই অফিস শুরু করতাম। মৈনাকের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রুমি, বেশি তাকালেই ওর মনটা নরম হয়ে যাচ্ছিল। মৈনাক ওর মাথা গুঁজে দিয়েছে রুমির কোলের মধ্যে, ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছিল। ওকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি হয়তো সত্যিই ভালো মৈনাক, আমিই আর পারছি না। এই পৃথিবীটা ঘুরে বেরাচ্ছে, আর আমি স্থবির হয়ে আছি। ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু এ-সব কিছুই না বলে চোখ সরিয়ে নিল রুমি। তখনই দেখল গুটি গুটি পায়ে কানাই আসছে। ঘাস সরিয়ে সরিয়ে টেবিলের পায়া অতিক্রম করে। একটু ঝুঁকে পড়ল রুমি, হাতের পাতা রাখল এবার মৈনাকের মাথায়। আদর বুঝে মৈনাক নিজের মাথাটাকে আরও গুঁজে দিল রুমির কোলের মধ্যে। কেমন অদ্ভূত একটা ঝিলিক এবার রুমির চোখে। ফিসফিস করে বলল, দে কানাই দে।

এমন বাধ্য ছেলে! দিল ঠিক দাঁড়াটা বসিয়ে মৈনাকের পায়ে।

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই