লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

কলকাতা শ্রমতালুক

বাংলার কুটিরশিল্পের সমৃদ্ধি ও বৈভবের সাক্ষ্য হিসাবে বারবারা ও টমাস মেটকাফ-এর লেখা ‘এ কন্সাইজ হিস্ট্রি অফ মর্ডান ইন্ডিয়া’ বইটির একটি উচ্চারণ পেশ করব। মেটকাফ-দ্বয় মন্তব্য করেন যে, গাঙ্গেয় উপত্যকার এই অঞ্চলটি থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৭৫ ভাগ পণ্য সংগৃহীত হত সে-সময়ে। তৎকালীন বাংলার অর্থনৈতিক হাল সম্বন্ধে মেটকাফ-এর অভিমত হল— ‘Bengal’s wealth was thus at once made to appear nearly boundless, and made familiar by evoking Italy’s canal-laced ‘mistress of the seas’. it is not by accident that the figure representing Calcutta in The East Offering its Riches is placed at the centre of painting with the richest gift… From such images came an enduring picture of India for the British’— সুতরাং, অনস্বীকার্য যে, দেশীয় বাণিজ্যের আকার নেহাতই বিশাল মাপের ছিল, যে-কারণে শুধুমাত্র ইংরেজ নয়, পর্তুগিজ-ডাচ-ফরাসি-তুর্কি-দিনেমার-চীনা-আর্মেনি ইত্যাদি-প্রভৃতিরাও হাজির হয়েছিলেন কিপলিঙয়ের chaotic ও মুরহাউসের marshland of Bengal-এ।

শুরুতেই জানিয়েছি যে, জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতা একটি রপ্তানি-ভিত্তিক শহর। এ এমন এক শহর, জেন জেকবের ধারণার নিখুঁত প্রতিলিপির মতন যা— ‘create their own dynamic regions, and absorbs into new jobs the rural workers made redundant by improvements into agricultural productivity’. অ্যাডাম স্মিথের থেকে খানিক ভিন্নমত পোষণ করে প্রখ্যাত মার্কিনী শহর বিশেষজ্ঞ জেন তাঁর ‘সিটিজ অ্যান্ড ওয়েলথ অব নেশনস’ বইতে লিখেছেন— ‘increases in wealth of nations arise mainly from the expansion of import-replacing cities: cities in which people repeatedly create their own superior versions of goods… and then begin to export those superior goods (such import-replacing cities) we see the five great forces “unleashed”: markets, jobs, transplanted industry, technology and capital.’— প্রিয় পাঠক, আদি কলকাতা কি এই উদ্ধৃতির পাশে একেবারেই বেমানান? (জেকবের উদ্ধৃতিটি পেয়েছি চার্লস টিলির ‘গিলগামেশ’ প্রবন্ধের সূত্রে)। নগর কলকাতার ‘ডাইনামিক রিজিওন’ বা বিশাল হিন্টারল্যান্ড নিশ্চিতই কোনো কল্পকাহিনি নয়। রপ্তানি বাড়লে ধনবৃদ্ধি হয়— এ তো অর্থনীতির গোড়ার কথা। সুরাট, মসলিপত্তনম, সপ্তগ্রাম-কলকাতা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। শ্রমের বাজারও যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বর্ধিত মুনাফার কারণে মূলধনের বৃদ্ধি ঘটে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার পাশাপাশি কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্তার ঘটে। জেন বলছেন ‘রিপিটেডলি ক্রিয়েট’ বা বিরামহীন উৎপাদন— যে-নিরবচ্ছিন্নতার জন্যই ১৭৫২-র হলওয়েলীয় কলকাতায় চার লাখ নয় হাজার মানুষ! সারা বিশ্বের কোন উঠতি-উদ্যমী-উন্নতিকামী এবং (মোর ইম্পর্টানটলি,) সদ্যজন্মলব্ধ কোন জনপদে, ১৭৫০-এর উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে, এমন প্রাণসম্পদে ভরপুর জীবনজিজ্ঞাসা ছিল বা এ যুগেও আছে বা রয়েছে? খোদ লন্ডনেই ছিল কি? মিল ছিল না, মেশিনও না। এম.জে. টৌমের ‘এমপ্লয়মেন্ট ইন নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল’ বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কেম্ব্রিজ অধ্যাপক তীর্থঙ্কর রায় লিখেছেন—‘আঠারো শতকের শেষে ভারত ৫০ মিলিয়ন গজ বস্ত্র রপ্তানি করত। ভারত জুড়ে ১৮০০ থেকে ২০০০ মিলিয়ন গজ কাপড় তৈরি হত।’ সে-সময়ের বস্ত্র রপ্তানিকারক প্রধান অঞ্চলগুলো ছিল পাঞ্জাব-করোমণ্ডল-গুজরাট-বাংলা। এই প্রয়াসের জন্য জরুরি ছিল সচল মানি-মার্কেট। সেই প্রয়জন মেটাতে বাংলায় সক্রিয় ছিল হুন্ডি-চিরকুট কিংবা সেদিনের অর্থজগতে প্রবেশের ভিসা, ক্রেডিট-কার্ড বিলিকারী মাণিকচাঁদ, উমিচাঁদ নামধারী জগতশেঠ কোম্পানি।

১৫৩০-এ হুগলি-সপ্তগ্রামে পর্তুগিজদের পৌঁছে যাওয়া ছিল এক শ্রমসৃজনকারী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। রাতারাতি তারা সেখানে আসার সিদ্ধান্ত নেয়নি। টলেমির ‘গঙ্গারিডি’, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-সমতট-হরিকেলার যাপনচিত্রটি, বস্তুত, বহু শতাব্দী পুরোনো। বসত ছিল, বাণিজ্য ছিল। রোম-পারস্য-মালাক্কা-পূর্ব এশীয় অঞ্চল। সেই বাণিজ্য পরম্পরার সূত্র ধরেই পর্তুগিজরা এ-দেশে আসে। কৃষিশস্য-বস্ত্রপণ্যের জগতে বাংলার বহুকালের পরিচিতি। ১৬৩০-এ জলদস্যুতা, রাহাজানি, লুটমার প্রভৃতি অনর্থনৈতিক কাজকর্মের স্বাভাবিক বিক্রিয়ায় তারা বিতাড়িত হয়। তাদের শূন্যস্থান দখল করে নেয় স্থানীয় মুঘল শাসকবৃন্দ আর অন্যান্য ইওরোপীয় বণিকদল, যাদের মধ্যে ব্রিটিশরাও ছিল। বাংলার সুবাদার সুজা, মীরজুমলা, শায়েস্তা খাঁ, ঢাকা আর কটকের নবাব, ওড়িশার দেওয়ানের পাশাপাশি হুগলির হাবিলদারও জড়িত ছিলেন।

এই প্রবন্ধে বারংবার উচ্চারিত সন-তারিখের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়টি হল ১৭৬০, ১৭৫০, ১৮৪০। তারিখগুলোর ভিতরেই কিছু কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে। ১৭৬০: ইংলন্ডে শিল্পবিপ্লবের শুরু। বাংলায় একশো দশ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছে ব্রিটিশবাহিনী। কাকতালীয় মনে হবে কি যদি উল্লেখ রাখি যে, কাপড়ের কল দিয়েই ইংলন্ডে শিল্পবিপ্লবের শুভ মহরৎ হয়েছিল। আর সেই একই কালখণ্ডে ভারতে অবশিল্পায়নের ঘূর্ণিব্যাতাও হাজির হতে শুরু করে। ১৮৩৫: লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারত-প্রশাসক। ইংলন্ডের সুতো-ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তিনি কটন- আইন প্রণয়ন করেন। বিপদের মুখে পড়ে ভারতের সুতো-ব্যবসায়ী, চাষিরা। আর ১৭৫০: ভারত একাই পৃথিবীর ২৫ ভাগ পণ্য উৎপাদনকারী। কাপড় উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রটি ছিল বাংলায়।

আর ঠিক এর উলটো অবস্থাটাই হল ডি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজেশন বা অবশিল্পায়ন। সেই সূত্রে রপ্তানিহীনতা, বাজার হারানো, কাজ খোয়ানো অগুনতি মানুষের চাপ। (পরিকল্পিত) দৈন্য-দুর্দশায় ধ্বস্ত হয় নফরসমাজ। পরিকল্পনাহীন যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা মধ্যয়ুগীয় ঘরবাড়ি, আটচালা, ঘরেলু কারখানার ঢের। চওড়া জলীয় হাইওয়ের ধারে বিশাল বাজার, কুটির লাগোয়া গোয়াল-ধানক্ষেত। ভোরের চাষি, সাঁঝবেলার তাঁতি। ব্রিটিশবণিকের দ্বিতীয় আবেদন— সেইসূত্রে
কলকাতার লাগোয়া ৩৮-টি গ্রামও দখলে নেওয়ার দাবিপত্র পেশ। কেন ওই সকল ৩৮-টি গ্রাম? কেন-না, ওখানেই ছিল কুটিরশিল্পের আদত ঠিকানা। সি আর সাহেব তো আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছেন যে— সন ১৭০৪-এ কলকাতার লোকবল যেখানে ১৫০০০, শহরতলিতে তখনই দ্বিগুণ, ৩০০০০। তাহলে কি এই আবেদনও পরিকল্পিত যোজনা ছিল? ছলা-কলা-কৌশলহীন সাদামাটা খামখেয়াল অথবা নেহাতই ঘর গোছানোর ব্যাপারস্যাপার ছিল কি? প্রচুর শস্য জন্মাত। সত্য। কিন্তু স্রেফ উদরপূর্তি-তে মন দিলে ‘কলকাতা’-র সৃষ্টি হত? কবি কৃষ্ণরামদাস লিখেছিলেন, চার্ণক আসার একযুগ আগে— ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/ কলিকাতা পরগনা তায়/ধরণী নাহিক তুল/জাহ্নবীর পূর্বকূল/নিমিতা নামেতে গ্রাম যায়।’ পরগনা কলকাতার প্রশংসায় কবি পঞ্চমুখ। সেক্ষেত্রে, কবি কৃষ্ণরামদাস কথাটি কেন গুরুত্ব পাবে না যেভাবে বিবেচিত হয় মিল-বেন্থাম-মেকলে-ম্যালথাস?

সমুদ্রবণিকেরা আসার জন্য বস্ত্রশিল্পে আগের চেয়ে আরও বেশি মাত্রায় পুঁজিনিবেশ ঘটল, বিদেশি পুঁজির সঙ্গে যুক্ত হল গ্রামীণ পুঁজি আর মেশিনলুমের অবর্তমানে বর্ধিত চাহিদার যোগান সামাল দিতে আরও বেশি মাত্রায় হিউম্যান ক্যাপিটাল বা মানবসম্পদ নিয়োজিত হল। লোকলস্কর বাড়ল। নগর-বন্দর গড়ে ওঠাও শুরু হল। বর্ধিত বাণিজ্যের সূত্রে নদীর দু-পাড় যেমন ত্রিবিণী, রিসড়া, মগরা, চুঁচুড়া বা নদীর পুবপারে খড়দহ, ব্যারাকপুর ইত্যাদি এলাকা জনবহুল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, জনবল।

মানবসম্পদ। সুতরাং, অস্তিত্বের পূর্ণাবয়ব অনুসন্ধানে রাজি হয়ে যাই। দেহ-খাঁচাটির দ্বি-বাহুবিস্তারী হিমালয়-সদৃশ কলারবোন থেকে বিঘৎ-দেড়েক ওপরে— দর্শক, শ্রোতা, কোচ, দোভাষী, ভাষ্যকার, ইন্টারপ্রেটার, জজ, নার্স, ডাক্তার ইত্যাদি। এছাড়াও, বিনিময়-প্রথার অন্তিম প্রহরে ষোড়শ শতকীয় হাওয়ামোরগ— শ্রেষ্ঠী, ফড়ে, দালাল, মিডলম্যান, মজুতদার, পাইকার; কলারবোন থেকে বিঘৎখানেক নীচে, খাঁচাবন্দি হিসাবরক্ষক, চিত্রকর, নাটুয়া, সাক্ষী, গোলাম-লেখক আর কলারবোন জাতীয় হ্যাঙ্গারটির দু-পাশের ঢাল বেয়ে নেমে ঘড়ির আদিতম সংস্করণ— কর্মক্ষম দু-টি হাত, ঋজু অথবা স্থুল, যোড়হস্ত কখনো অথবা পূর্ণবিস্তৃত কায়িক পরিশ্রমীজন— নফরসমাজ: মুটে-মজদুর, লোহার-সোনার-ছুতোর-কর্মকার-ব্যাপারি-কৃষক-বাস্তুকার; এক কথায় বিশাল মাল্টিপ্লেক্স, জনবহুল। অবশিল্পায়নের মারপ্যাঁচে এরাই পোশাক বদলিয়ে রঙ্গমঞ্চে হাজির পুনর্বার। নতুন নির্দেশনায় তারা কেউ খানসামা, কেউ বাটলার, হরকরা, মশালচি, সহিস, দর্জি, ভিস্তি, মুচি-মেথর-হুঁকোবরদার। থরে থরে মজুত বিনিময়যোগ্য সময় ও শ্রম, ভিন্ন-বিভিন্ন দর ও মোড়কে— পণ্য অঢেল… খরজনস্রোতে, স্পন্দমান আসমুদ্র হিমাচল। পুনর্জন্মে এঁদেরই মধ্যে কেউ নিওন জ্যোৎস্নাসম চন্দ্রাতপের নীচে ‘আউটসোর্সিং’ রাতজাগা হুতোম, ভারতীয় অর্থনীতির সেবাধর্মী চুয়ান্ন পার্সেন্ট— নজরে রেখেছে ভিন গোলার্ধের সূর্যকিরণ।

মুম্বইয়ের সাইনবোর্ডে ‘সিটি নেভার স্লিপস’ ব্যবহৃত হতে দেখেছিলাম। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ‘যা নিশা সর্বভূতানাং, তস্মাৎ’ জেগে কাটান আই-টি-কর্মী। সুমন্ত ব্যানার্জী উক্ত নবযুগের ‘সাইবার-কুলি’, তথ্যপ্রয়ুক্তির ‘আই-টি’ বাহিনী।

২০২০ থেকে ফিরি বরং আদি সপ্তগ্রামে, ১৫৪০, ঔপনিবেশিকতার প্রথম প্রহরে। পুরোনো প্রশ্নে। শহর পদবাচ্য কি ষোড়শী কলকাতা? বাংলা কাব্যসাহিত্যের পাতায়, বিশেষত মঙ্গলকবিদের উচ্চারণে, নগরায়নের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দ লিখেছেন মুসলমানদের বসতি স্থাপনের কথা। কারিগরের গোষ্ঠীজীবন, দেবদেউল-মসজিদ ইত্যাদির নিপুণ বর্ণনা রয়েছে। মধ্যযুগীয় শহরের ব্যাখ্যা দিয়ে আবুল ফজল বলেছিলেন— a city may be defined as a place where artisans (pisha-var) of various kinds dwell। ঐতিহাসিক রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় মধ্যযুগের শহর সম্বন্ধে বাংলা কাব্যবিবরণীতে উচ্চারিত লক্ষণগুলোর উল্লেখ করার পাশাপাশি শহরের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বি.ডি. চট্টোপাধ্যায় চিহ্নিত পাঁচটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই শর্তগুলোর মধ্যে তিনটি প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক কলকাতায় ছিল যেমন মন্দির-রাস্তা –লোকজনের মেলামেশার জায়গা। সুরম্য হর্ম্য, অট্টালিকা-ই কি শহরের একমাত্র লক্ষণ? শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায় মধ্যযুগের বাংলার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, প্রাসাদ-অট্টালিকার বদলে বহুবিধ পণ্যের বাজার-বিশিষ্ট সুদক্ষ কারিগর শ্রেণির বসবাসের এলাকাকেই আদর্শ শহর বলা হত।

সংস্কৃত সাহিত্যে শহর হল রাজার বাসস্থান, ধনী ও অভিজাতদের আমোদ-প্রমোদ, বিলাসব্যসন, রঙ্গ-মেহফিল, খান-পানের জায়গা। আর বাংলা সাহিত্যে শহরের রূপ ভিন্ন। বাংলা সাহিত্যে শহর হল শিল্প-উৎপাদন, পণ্যসম্ভারের বাজার, ধর্মস্থান ও শাসককূলের আবাস নিয়ে গড়ে ওঠা এক নাগরিক-স্থল। এই পার্থক্যটি বিশেষ লক্ষণযুক্ত।

বাংলা সাহিত্যের শহরে সবার প্রবেশাধিকার। শিল্পকার সাধারণ মানুষও যেমন স্বীকৃত, তেমনই ধনিকশ্রেণির প্রতিনিধিবর্গ। কাজের সুযোগ এনে দিয়েছিল বহির্বাণিজ্য, দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা। ষোড়শ-সপ্তদশে বাণিজ্যের আড্ডা–স্থলটির ক্রমাগত বদল ঘটছিল। নিম্ন-ভাগীরথী অববাহিকায় কেন্দ্রিত হচ্ছিল সেই হুড়হুজ্জত। তেমনতর পরিস্থিতিতে পলিমাটি সিঞ্চিত ভাগীরথীকূলে বিরল জনবসতির ছবিটি সে-সময়ের আর্থ-সামাজিক-ভৌগোলিক পটভূমিকার সাথে একেবারেই মানানসই নয়। সরল সত্যটি বরং কর্ম-সংস্থানের সুযোগে মানুষের ভিড় বাড়ছিল। প্রখ্যাত চিন্তক, অর্থনীতিবিদ আন্দ্রে গুন্দা ফ্রাঙ্ক-য়ের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য— ‘world development between 1400 and 1800 reflects not Asia’s weakness but its– particularly China’s and India’s economic strength, and not Europe’s non-existent strength but rather it’s relative weakness in global economy.’ Andre Gunder Frank (Economic & Political Weekly, July 1996, Vol-31, pp. 30)। ‘সন ১৪০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত বিশ্ব উন্নয়নের গ্রাফচিত্র থেকে এশীয় দুর্বলতার কোনো চিহ্নই ফুটে ওঠে না— চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক সবলতাই বরং প্রতিভাত হয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইওরোপীয় সামর্থ্যের অনস্তিত্ব নয়, আপেক্ষিক দুর্বলতাই তুলে ধরে।’

‘সিটি অফ প্যালেসেস’ শীর্ষকে (১৮২৪) কবি জেমস অ্যাটকিনসন একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতায় গ্রিক-পুরাণের হেস্পেরিডিসের বাগানের দেউড়িতে কলকাতার স্থান। এই বাগানের সোনালি আপেলের আশীর্বাদ=অমরত্ব লাভ। এই একটি উপমার যদি অর্থনৈতিক ভাবানুবাদ করা যায়, তবে দেওয়ানির সনদ পাওয়াই হল সেই সোনার আপেল হাতে পাওয়া যার দৌলতে কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার পেল। এতদিন ইংল্যান্ড থেকে টাকার যোগান আসত (সোনারুপায়) খরিদ্দারির খরচ মিটানোর জন্য। কিন্তু এই অধিকার পাওয়ামাত্র পাশা পালটে গেল। এখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে যে-সমস্ত পণ্য কেনাকাটা করত তার দাম সংগৃহীত রাজস্ব থেকে দেওয়া শুরু হল। উপরন্তু, এই মাল বিক্রয় করে যে-অর্থ পাওয়া যেত তা ভারতে বিনিয়োগ না হয়ে বরং ইংল্যান্ডের রাজকোষে জমা পড়ত। এভাবেই শুরু হয়েছিল সম্পদের নিষ্ক্রমণ, যার স্বাভাবিক পরিণতি হল অবশিল্পায়ন।

ভারী পরিতাপের বিষয় যে, তথ্যসমৃদ্ধির এই সুদিনেও কর্মচঞ্চল জনপদ নয়, বিস্তৃত পরগণাটি নয়, উইলসনের আদিম অ্যানালসে যেমন, ঠিক তেমনই স্যাম মিলার-এর ‘এ স্ট্রেঞ্জ কাইন্ড অফ প্যারাডাইস’-এ (২০১৪) বা এরিকা বারবিয়ানির (২০০২)-এর পর্যালোচনায়, বারংবার, তথাকথিত ‘অখ্যাত গ্রাম’-টিই কেবল পুনরালোচিত হয়। যদি, জনমানবশূন্য চোরাবালি-অরণ্যই ছিল সে-সময়ের কলকাতা, তবে প্রভূতপরিমাণ অর্থব্যয় করে নিছকই এক গণ্ডগ্রামে দুর্গ বসানো, শতেক আবেদন-নিবেদনের দৌলতে ঘাঁটি গাড়া— চতুর ব্যবসায় বুদ্ধিসম্পন্ন যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির দাপুটে শেয়ার হোল্ডারগণের অর্থনৈতিক বিচারবিমর্ষ বহির্ভূত সিদ্ধান্ত ছিল কি? মূল সত্য তো কৃষিপণ্যের বিশাল লাভ ক্রমে পুঁজিতে বদল হয়ে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদনে/বস্ত্রবয়নে ব্যয়িত হত। এর ফলে কুটিরশিল্প প্রসার লাভ করেছিল। নেহাতই স্বল্পবিত্তের অধিকারী চাষিও বাণিজ্যের এ মহোৎসবে অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখতে পারত। তাই মেশিনলুমের সাহায্য ছাড়াই, কেবল লোকলস্করের যোগান বাড়িয়ে বহির্বাণিজ্যের অতিরিক্ত চাহিদা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কৃষিসমৃদ্ধির এমনতর সাফল্যের যুগে ভাগীরথীপলিসিঞ্চিত অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও জনহীন কলকাতা, গণ্ডগ্রাম কলকাতা, অর্থনৈতিক তৎপরতাহীন কয়ঘর-গুমটিবিশিষ্ট কলকাতা ইত্যাকার সুপ্রাচীন মন্তব্যগুলির আশু পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন, কেন-না, নদিয়ার আমিরাবাদ পরগনার অন্তর্গত ডিহি-মহাল-স্থানীয় শাসনকর্তাধীন নগর কলকাতা, ১৬৯০-এর শতবর্ষ পূর্বেই, খোদ নিজেই একটি পরগনা ছিল।

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই