লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

অমিতরূপ চক্রবর্তী

আরশি

আমার অন্ধকার থেকে কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে ওঠে তোমার উদ্দেশে। শেষ সন্ধ্যার রং এখন ফেটে, থেতলে যাওয়া জামের মতোই। কান্নার মতো টিপটিপে বৃষ্টি ধরে গিয়ে এখন শুধু উষ্ণ, উষ্ণতর নিঃশ্বাস জেগে আছে সবদিকে। মানুষের মুখ মানুষেরই মতো, ইতিউতি আলোয় দেখা যায়। আরও দেখা যায় মমতা চুইয়ে পড়া স্তন, সস্তা বাক্যের শেষে বসে থাকা আরক্তিম ঠোঁট। ইতিউতি আলোয় দেখা যায় জাহাজে চড়ে রাত্রি পাড়ি দেবার আগে এমন সব মানুষের ভিড়, দু-হাতে ডিম আঁকড়ে আছে। আজ হয়তো আমাদের পায়ে পা লেগে আলো আলো হবে না কোনো দিক। সবকিছুই অচঞ্চল থাকবে। ঠোকা খেয়ে খেয়ে একটি ক্যালেন্ডার ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো উড়বে। আকাশ থাকবে পাখির বুকের মতো সাদা হয়ে। তাতে কালো চাঁদ মরু অতিক্রম করবে। এই তো, এমনই সবকিছু। অচঞ্চল, অনুমেয়। রাত্রি পেরোলে যে নতুন ডাঙা, পায়ের নীচে মাটি— তা কি অন্যরকম? গলিতে নিশ্চয়ই তেমনই ইউরিনাল— যার কোনো দেওয়াল নেই। চাষাড়ে জঙ্ঘার মতো সব বাড়ির দেওয়াল। রাস্তায় কথা ছুটছে আগুনকে পরাস্ত করে, আলোকে পেছনে ফেলে— এমনই? বিরাট গহ্বরের মতো যোনি লোকসমক্ষে আড়াল করা? কতগুলি জিনিস আজ চিরদিনের জন্য লুপ্ত হয়ে গেল। অথচ আমার মনে হচ্ছে দ্যাখো, এই তো, এখানেই রাখা ছিল। এভাবেই বোধহয় মানুষ সহনশীল হয়। লোহার চেয়েও সহনশীল, পাথর অপেক্ষা পাথর। শীতল অপেক্ষা শীতল। নৈঃশব্দ্য অপেক্ষা নৈঃশব্দ্য

নিজের ছিরিছাঁদ ছুঁয়ে দেখি বিমর্ষ গালে আমার কোনো জন্মের কাটা দাগটি এখনও আছে। তার ইতিহাস উইয়ের পেটে গিয়ে এখন হয়তো বিশাল চড়ার মতো পড়ে আছে। তাতে ঘরবাড়ির আগমনও বিস্ময়কর নয়। কবেকার কথা, নয়? আজ কান্নার মতো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৃথিবী নতজানু হয়ে ভিজছে। গাছপালার গা বেয়ে একটি দিনের কাঁচা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কাটা দাগের জন্ম থেকে এ-জন্মে এসেছি তোমার কনিষ্ঠা ধরে। খানিকটা অন্ধের মতো। তাই পথঘাট-অলিগলি আমার মনে নেই। পেছনে কী কী রেখে এলাম— তাও মনে নেই। এখন তো আমি পাথর অপেক্ষা পাথর। শীতল অপেক্ষা শীতল। নৈঃশব্দ্য অপেক্ষা নৈঃশব্দ্য— নয়? অবশিষ্ট মানুষের সঙ্গে আমার বহু মিল আছে। ওদের চোখের মতোই আমারও চোখ। ঠোঁটের ফাটল। পায়ুকামী ঘোড়ার মতো সব হাতের আঙুল। ঝুরি নামানো বটগাছের মতো একটা অভিজ্ঞ দেহ। কপালে, চুলে পরিমিত তাপ— যা তোমার পছন্দের। এখন এই পড়ে, থেতলে যাওয়া জামের মতো সন্ধ্যার পথ ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখছি উড়ন্ত কানের পেছনে মানুষ অকারণে ছোটে। এই যে অ্যাত প্রাঞ্জল আয়োজন— তা কি যথেষ্ট নয়? ফটকের আড়ালে সিঁড়ি। সিঁড়ির পরে একটু ক্ষুদ্র বারান্দা, তারপরেই সেই দেওয়ালে মাংস লেপা ঘর। তোমার নির্বোধ আচরণ। শক্ত দড়িতে বাঁধা নুন-ভাতের শরীর। গাধার পিঠে চড়ে কেমন বসে থাকা একটা বিমূঢ় চাঁদ। এই কি যথেষ্ট নয়? নিরাবরণ হবার পর তোমার সেই বিশাল গহ্বরের মতো যোনি— যাতে শুধু সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠা চলে

এই কি যথেষ্ট নয়? সব দেশে, সব কালে এই কি যথেষ্ট নয়?

কলি

অন্য কোনোদিনও হয়তো তোমার দিকে তাকিয়ে দেখব এমন-ই একটা শীর্ণ হলুদ আলো একা একা জ্বলে আছে। আশেপাশের অন্ধকার তাতে খানিকটা পীতাভ। অন্য দিনটি হতে পারে এই বছরের ছোটো ছোটো মাছের মতো দিন, সপ্তাহ বা মাসগুলি পেরিয়ে গেলে। প্রগলভ ঘোড়ার মতো এইসব দিন, সপ্তাহ বা মাসগুলি পেরিয়ে গেলে। যে-হাওয়া আসন্ন কাল থেকে উচ্ছ্বসিত ডালপালা অতিক্রম করে আসে, তার গায়ে কেমন বোটকা গন্ধ। যেন গরম রক্তের পশু তাকে ছেড়ে এইমাত্র উঠে গেল। আসন্ন কাল যেন কতগুলি উন্নাসিক জাহাজের পল্টন। মানুষকে ক্ষুদ্র করে দেয় বা ক্ষুদ্র করে দেখায়। তোমার ঊরুতে কখনো হাত রাখলেও আমার এমনই মনে হয়। তোমার অকূল সব বিস্তারের কাছে কী ক্ষুদ্র, কী অসহায় আমি। তোমার অননুমেয় উচ্চতার কাছে, তোমার পরিণামদর্শিতার কাছে। তাই প্রগলভ ঘোড়ার মতো এই দিনগুলো। ছুটন্ত, বেপরোয়া ক্ষুরের মতো এই দিনগুলো। তোমার চোখে তাই হয়তো একটা শীর্ণ হলুদ আলো নিঃস্ব থেকে ঝুল খেয়ে নেমে একা একা জ্বলে, জ্বলে থাকে। চারপাশের ভুষো চাদরের মতো অন্ধকার তাতে একটু বুঝি পীতাভ হয়। হয়তো এই-ই আঁকড়ে কেউ কেউ যেন-বা ধীবর জাতির— বেঁচে থাকে। এমনই একটা শীর্ণ হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে, লতানো গলার সাহায্যে সবটুকু ঔৎসুক্য নিয়ে। গুটিয়ে যাওয়া ছোট্ট লিঙ্গ নিয়ে অথবা পরিত্যক্ত পাখিবাসার মতো হাড়-পাঁজর নিয়ে। আমিও কি তেমনই? শীর্ণ হলুদ আলো? অগণন তারার নীচে দুঃখিত কোনো ছায়া?

অথচ পৃথিবীতে তুষারপাত হয়। কর্তব্যনিষ্ঠ নদীর পাশে ঝরে থাকে কত প্রবাদ, কত রঙিন গাছের পাতা। পরনের হাওয়াই তাতে রেখে দিলে, তাকেও রঙিন তৃপ্ত পাতাদের মতোই মনে হয়। গরিষ্ঠ দেশে একি খুব আশ্চর্যের? খুব বিস্ময়ের? দরজায় যারা আড়ি পেতে ভেতরের নৈঃশব্দ্য শোনে— তাদেরও দেহকাণ্ড দু-পায়ের ভরে উঁচু হয়ে থাকে। অন্য মুখের মতো তাদেরও কি মুখ নয়? নীল শিরায় ঢাকা মস্তিষ্ক নয়? ভবনের মতো শরীরের গাঁথুনি নয়? অথচ পৃথিবীতে তুষারপাত হয়। জল জমাট বাঁধে, আবার গলেও যায়। নেটের বোরখা পরা মসলিন মহিলার মতো রোদ আসে। আকাশে আনন্দিত কাটাকুটি রেখে ওড়ে পাখি। প্রগলভ ঘোড়ার মতো এই দিনগুলি হয়তো-বা বহুদূরে অরবে ছুটতে থাকবে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাদের হয়তো-বা মনে হবে কোনোদিন আদ্যন্ত শিশুতোষ গল্পের মতো। মনে হবে? লতানো গলার সাহায্যে সবটুকু ঔৎসুক্য নিয়ে, এগিয়ে দিয়ে যারা বেঁচে আছে— তারাও কি এমনই ভাবে? মাছের অন্তর বোঝার মতো তারাও কি বুঝতে পারে এসব? এই গরিষ্ঠ দেশের ভাষা? ও শীর্ণ হলুদ আলো, আমি কি কোনো ধূর্ত শিকারিকে অনুকরণ করি বা করছি? তার রঙে, তার রেখায় আত্মাকে অলংকৃত করি? কূট বিষ রাখি দাঁতে? অতিকায় পাহাড়ের মতো পরিণামদর্শিতা, মমতাময় স্তনের দিকে কখনো হেঁটে ওঠা কাঠপিঁপড়ে বা জানালার বাইরে কখনো কুয়াশায় মোড়া ভোর দেখা দিলে মানুষ কি দেহবদল করে দেহান্তরে যায়? গরিষ্ঠ দেশের ভাষা পিঙ্গল, সবুজ বা কখনো রক্তবর্ণ। কখনো-বা পরিচ্ছন্ন ধূসর

বোঝে তা? সবাই লহমা খরচ করে বুঝে ফেলে?

ট্রাপিজ

দ্যাখো কেমন শূন্যে ঝুলে আছি। বিমানের জানালা থেকে মাটিকে যেমন পার্সিয়ান মাদুরের মতো মনে হয়, তেমনই দেখতে পাচ্ছি আমি আমার সংসারটিকে। আমার ধ্যাস্টানো বিছানা, মাথার চাপে চেপ্টে থাকা বালিশ, চারপেয়ে কাঁকড়ার মতো টেবিলটা বা নীরবে জল-তাপ সহ্য করে যাওয়া নকল ফুলগুলো। আর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত হেঁটে বা উড়ে বেড়ানো তোমাকে। উইয়ের ঢিবির মধ্যে একটি মানুষ বসে থাকে— তাকে। শূন্যে হাতড়ে হাতড়ে আমি সংসারের ওপরে যেতে চেষ্টা করি। ছায়া যদি পড়ে, একচিলতে সীসে রং মেঘের ছায়া। তুমি একটু শান্তি পাবে। ঘন ঘন আঁচলে মুখ মুছতে হবে না আর। এভাবে ঘন ঘন মুখ মুছতে মুছতে কখন যে তোমার মুখে বাঘের আঁচড়ের মতো লম্বা, তির্যক দাগ পড়েছে, তুমি তো জানোই না। চোখের নীচে কী বিশাল চরাচর। বাথরুমের মাথায় কেমন আদুরে একটা কী পাখি যেন এসে বসেছে। মাথা কাত করে জানো, তোমাকেই বোধহয় দেখছে। একটি ঘরে একা একা আলো-পাখা ঘুরে যাচ্ছে। বসার কৌচে সাদা কভারের ঝুল উড়ছে তাতে। তুমি দ্যাখোনি? শোনো, তোমাকে বলি বুকের কিন্তু ওপরের দিকে অনেকটা হাঁ। আমাদের ধস্তাধস্তি, হাঁচর-কামড়ের সব দেখা যাচ্ছে। পাখিটা যদি কোনো আত্মা হয়? সব কথা কিন্তু চাউর হয়ে যাবে! মৃতরাও পরলোক থেকে ফিরে এসে শুনে যাবে সে-কথা! উইয়ের ঢিবির ভেতরে যে-মানুষ, তার শর্করাহীন খাওয়া হল? জানো, গতরাতে তোমার চোখ উপড়ে নিতে যে-আঙুল ব্যবহার করেছিলাম— সে-আঙুলে এখন তীব্র ব্যথা

আহা, জানালা দিয়ে কেমন একদল ময়ূরের মতো রোদ ঘরে ঢুকেছে। এই শূন্য থেকে সংসারটাকে মনে হচ্ছে অবিকল একটা নদীপাড়ের জঙ্গল। মাথায় কী প্রদীপ্ত আকাশ, সভ্যতাবিরোধী মেঘ। বিছানায়, ঘরের মেঝেতে বা বারান্দায় কত পাতা ঝরে ঝরে পড়ে আছে। সেখানেই কোনো একটা কিছুর সম্ভাবনায় মৌমাছি এসেছে। তুমি যেন বনরমণী। কালো পিঠে চকচক করা মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ডে ভর দিয়েই তো তুমি আমাকে আক্রমণ করো। টিরানোসোরাসের মতো উড়ে আসো লম্বা লম্বা পাখা মেলে। আমি তো তেমন সশক্ত নই, তাই পাখার ঝাপটেই এমনভাবে টুকরো হয়ে যাই— যা কাউকে বলার নয়। যা একান্ত তোমার আমার। কোনো শাসক, কোনো রাষ্ট্রনায়কের নয়। কোনো ধর্মের নয়, কোনো দেশের নয়, কোনো শান্তি মিছিলেরও নয়। শুধু তোমার আমার। কুলুঙ্গিতে রাখা প্রদীপের মতো বা আড়ালের ওপারে জ্বলা মোমের মতো। আমি কখনো নীল অজস্র কণা দিয়ে তৈরি হাতে তোমাকে ছুঁই। তোমার ভাপ, অন্ধকার ছুঁই। নিতম্বে ছোটো ছোটো শাবকদের স্পর্শ করি— তা তো আমার সীমানা ছাড়িয়ে তোমারও সীমানায় পড়ে। তখনই তো তুমি শিউরে ওঠো, ওঠো না? সব রোমকূপ তাঁবুর মতো দাঁড়িয়ে যায়। নাকের অঞ্চল পেরিয়ে ঠোঁটে ঘাম চলে আসে, নোনতা নোনতা ঘাম— যা কোনো শাসকের নয়, রাষ্ট্রনায়কের নয়। কোনো ধর্মের নয়, কোনো দেশের নয়, কোনো কাঁটাতারের নয়। তুমিও তো ভাবো আমারই মতো, নয়?

শিউরে উঠতে উঠতে। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে। শ্রান্ত, ধিকিধিকি আগুনের মতো কখনো বারান্দায় দেওয়ালে বন্ধনহীন ঠেস দিয়ে

Facebook Comments

পছন্দের বই