কবিতা
অঞ্জলি দাশ
বোবা জল
মজা পুকুরের জলে ডুবে আছে অবুঝ বয়স,
চাঁদের ষোলোটি কলা কৌশলের জাল ফেলে
তীরে পাহারায়…
ঢিল ছুড়ছ,
আর বোবা পুকুরের বুক থেকে ব্যথার বুদ্বুদ উঠে
লুটিয়ে পড়ছে পায়ে।
ব্যথারা কি নীল?
নাকি স্পর্শভুক প্রেমের প্রান্ত ধরে বেড়ে ওঠা
জন্মান্ধের আলো?
ওইটুকু আলোর লোভেই অন্ধকারে বাঁধা পড়ে আছি।
বন্ধনের বিষ তুমি জানো,
জানো বন্ধনমুক্তির হাহাকার।
যে-সময় সমুদ্রে বাতাস ওঠে, বন্ধ পারাপার…
আমাদের দুঃখী পুকুরের বুক
জমানো কথার তোড়ে আছড়ে পড়ে ঘাটে।
বিবাহ বার্ষিকী
মুগ্ধ হাওয়া থেমেছে যেখানে, সেইখানে আমাদের মার্চ মাস। তার গায়ে টুকরো খিদে, আজও। বিমর্ষ ফুলের মতো ছোটো, তবুও বিশেষ।
যেন কোনো দীর্ঘ যাত্রা, ধীরগতি। সামনে কোথায় যেন সামান্যই আলো। জড়িয়ে আসা পথ, জুড়িয়ে আসা তাপ।
গতিবিলাসের মোহে স্বপ্ন ভুলেছে ঘুম। সে জানে না কোথায় কতটা রাত জাগা।
ট্রেনও বোঝেনি এখানে থামতে নেই। পথ নেই, তবু পলক নিবিয়ে দিয়ে উড়ে যেতে হয়।
কতদূর আর? কতটা পিছন দিকে মার্চ মাস আমাদের?
জলা পাহাড়ের পাশে চোরবাটো উঁকি মারে মাত্র একবার। সেইখানে শীত আর অন্ধকার পরস্পর আলিঙ্গনে।
ওই স্থিতি আমাদের নয়। আমাদের সূর্যোদয় অন্ধকারে সন্নিবিষ্ট। শুকনো পাতার গায়ে বাদামি রোদ্দুর লাগলে আমাদের ভাত ফোটে আজও।
বিষাদ প্রান্তর
১
সমস্ত মৃত্যুর স্বর একপাশে সরিয়ে রেখেছি।
আমার ভ্রমণ যত দূর, সেই অব্দি থেমে আছে পথ,
পাহাড় ততটা দূর অপেক্ষা করেছে।
তাহার ওপাশে কোনো দেশ নেই।
ধূ ধূ অবকাশে আছে হাওয়া… মানবিক গন্ধহীন,
নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কবিতারও মৃত্যু নিশ্চিত জেনে
ফিরে আসি।
সমস্ত ভ্রমণ শেষে বিন্দু বিন্দু আমি পড়ে থাকে পথে,
পাহাড়ের ভাঙা টুকরো তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি,
জীবনের পাশে একটি কলম অপেক্ষায়।
২
খানিকটা অল্পবয়স রেখে আসি পথে,
ছাদহীন বৃষ্টি ও শিশির পান, ধীরে বাড়ে অবোধ ডালপালা,
বেড়ে ওঠে আর প্রতি রাতে শীত করে
ষোলো বছরের পর জ্বর আসে তার, আগুন শরীরে পথ পোড়ে।
এ-ঘর এখন রোদ্দুরবিহীন, ভুলে যাই ঘাসের বয়স।
ছাদের ছায়ায় বন্ধ চোখের পাতা ক্রমে ক্রমে অন্ধকার সহ্য করে,
স্মৃতিহীন, একা লাগে।
৩
কিছু আগে কেউ যেন সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেছে
আকাশের দিকে, অনিচ্ছায়।
তার মনখারাপের ছায়া ভেঙে ভেঙে মেঘ খেলছে,
জানি বৃষ্টি হবে।
উঠোন পিছল হবে ফের, নীল হয়ে জেগে উঠবে ঘাসফুল
ওরা ব্যথা গিলে খায়।
আমাদের আনন্দ বিষাদ, প্রত্যেক পায়ের ছাপ,
লিখে রাখে জন্মকোষে।
বুঝি চুপ করে কান পেতে আছে দরজা জানালা
চিড় ধরা দেয়ালের তীক্ষ্ণ শিস, চিরে দিচ্ছে
গোপন অপেক্ষা
কার যেন খবর আসেনি কতদিন।
দীর্ঘ পথের হাহাকার,
চোখ থেকে মেঘ মুছে দেবে একদিন,
তার আগে ফিরিয়ে নেবেই কথা রাখবার দায়।
৪
সব পথ মুছে গেলে পৌরাণিক শিকড়ের কাছে ফিরে আসি,
ভেঙে পড়া ঘর,
জং ধরা শিকলের গায়ে হাত বোলাতেই
নখের ডগায় সামান্য রক্ত জমে,
ওইখানে লেগে আছে প্রতিশোধপরায়ণ প্রেম।
তবু শেষমেষ উনুন জ্বলেছে রান্নাঘরে,
সাত সতেরোর ব্যথা দিয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জন।
এ-ওষধি তোমাকে তো উপশম দেবে অগ্নি।
তার দিকে উড়ে যাবে মন পোড়ানোর ছাই
আসলে যে নিয়ম ভেঙেছে।
৫
একা আছে কেউ—
বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে অন্য কেউ মৃদুস্বরে ডেকে বলছে,
ওই যে অন্ধকার, ফাল্গুনের ছেঁড়া চিঠি আগলে বসে আছ,
ও-সব তো অন্য কারো জানি
তোমার কেবল ওই বিষণ্ণতাটুকু, তাকে রোদ দাও, বৃষ্টিস্নান দাও।
এ-যাপন অন্য পাণ্ডুলিপি,
আরও বেশি বেশি সাজিয়ে তোলে সে-পুরোনো অক্ষর
ভাঙাচোরা, তবু ছবি তৈরি হয়।
তবু অন্ধকারের শরীর জড়িয়ে
কোনো আশ্চর্য গানের পঙ্ক্তি বেজে বেজে
শূন্যতার আবাহন করে, বাঁশিটিও শ্বাস নিয়ে বাঁচে।
বন্ধ জানালার গায়ে নিশিডাক লাগে।
৬
বোঝা যায় এইমাত্র ভেজা গাল মুছে এল।
অশ্রু অথবা প্রেম
যে-কোনো দাগের পাশে প্রশ্নচিহ্ন থাকে।
ঘাসমাটি ভেবে তুমি কেন অবুঝের মতো
তার সামনে হাত পেতে থাকো?
সে কিন্তু নিরুত্তরে শাদা পাতা হাতে নিয়ে
কিছু অক্ষর ছড়িয়ে রাখে নির্বিকার।
ভিন্ন বর্ণ, রাগে বা বিরাগে
আমরা যে কাহিনি বানাই, বার বার দৃশ্যপট পালটে ফেলি,
তার যাপনচিত্রটি নিয়ে অকারণে কাটাকুটি খেলি।
খেলা শেষ হলে দেখি, অন্তঃসারশূন্য আমরাই।
৭
বিষাদ ধুতে ধুতে অন্ধকার জমে ওঠে বহমানতায়
আতঙ্কিত জলের জীবন… ঝিম ধরা, বিবমিষা,
আমরা আশ্রয় করি যাকে, সেই রাত পাথরের মতো,
জোনাকি অথবা চাঁদ সকলেই তার গায়ে মাথা কুটে অন্ধ হয়ে যায়।
আমাদেরও চোখ বুজে আসে,
দৃষ্টি বিভ্রমে প্রিয় মুখ ভেবে চাঁদকেই হাতের পাতায়
নিয়ে দেখি সেও ভয়ে গুটিসুটি মুখ গুঁজে আছে
জোনাকির বিপন্ন ডানার নীচে।
৮
নদী আর মন দুইয়ের সীমান্তে এক তটরেখা,
নৌকো বাঁধা আছে
অথচ কোথাও কোনো নদী নেই।
তীররেখা ঢেউয়ের স্পর্শ চেয়ে কেবলই নিজেকে ভাঙে,
আমি তাকে জলস্রোত দিতে চেয়ে
অশ্রুগ্রন্থি ছিঁড়ি, ভেসে যাই নিজে।
৯
অন্য জন্মে বিশ্বাস রাখিনি
চোখের আড়ালে কিছু রেখাচিত্র রং চায়, তাকে নাম দিই, স্মৃতি।
ঝাপসা দেয়ালে বিরহের চিত্রপট, তারই খুদকুঁড়ো সুখ জড়াই শরীরে।
পথ আজও নানাভাবে প্রলোভিত করে,
পরিব্রাজকের ঝুলি ছিঁড়ে ফেলে মাটিতেই শরীর গেঁথেছি।
বিরহ বেদনা ছাড়া অন্য নেশা ছোঁয়নি কখনো,
শুধু অক্ষর আশ্রয়।
প্রাণহীন রেখা বন্ধনের সঙ্গে ওঠা বসা হেতু ব্রাত্য।
ঘুমের মূল্য দিয়ে সামান্য যে-বোবাশব্দ
জড়ো করি ভেজা বালিশের পাশে,
তারা হাওয়ার শরীরে মেশে,
আমি একা বিরহবেদনা নিয়ে মাথুর রচনা করি।
১০
পূর্ণ আকাশ নেই, শুধু কিছু ছেঁড়া মেঘ পাশে,
তারা জানে ছাদ নিয়ে ভাবিনি কখনো।
মাটি খুঁড়ে নদীকে এনেছি দরজায়,
শরীরে জড়িয়ে গেছে জলের শিকল।
তৃষ্ণা লিখি জল দিয়ে, সুখ আঁকি জলে… মুছে যায়।
মুছে তো যাবেই, পণ্ডশ্রমের শাস্তি এই।
যদি চাও অশ্রুর সমস্ত উৎস ফিরিয়ে দিতেই পারি আজ।
দেয়ালে ফাটল, কষ্ট লুকোনোর কোনো অবকাশ নেই,
তবুও সে অবেলার রোদটুকু আত্মসাৎ করে।

অঞ্জলি দাশ
জন্ম: মে, ১৯৫৭। শিক্ষা: মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর কৈশোর থেকে কবিতা লেখার শুরু। পাশাপাশি গল্প উপন্যাসও। কবিতা গ্রন্থ: ‘পরীর জীবন’, ‘চির হরিতের বিষ’, ‘এই মাস নিশ্চুপ তাঁতের’, ‘সহজে বোঝো না’, ‘মুগ্ধ হয়ে থাকি’, ‘হৃদয়ের বোন’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ইত্যাদি। গল্প সংকলন: ‘এক প্রজাপতি ও বৃক্ষলতা’।