লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

অরূপরতন হালদার

আমি সেই ধুলো যা বিকারগ্রস্ত হয়ে আছে, আর সূর্যের অতিক্রমকামী আলো আমাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এই সম্পর্কের মধ্যে তুমি ঢুকে পড়ো ও বিভ্রান্ত হও যেমন একটা ষাঁড় তার দৃষ্টির তির্যক আভায় দেখে লাল এবং ছুটে যায়। নারকীয় যা যা আছে তার সৌকর্য তোমাকে সুকুমারী এক ছায়ার কথা বলে ভুলিয়ে আনে সেই অসমাপ্ত প্রকৃতির মধ্যে, আর আদি ও অন্নপূর্ণা একাধারে খুলে যায়, এবং যতিচিহ্ন বলে তখন থাকে না কিছু, শুধু সাময়িক এক বিশ্রাম থাকে। তখন তামাকের স্বাদ আমাকে অতিলৌকিক এক পৃথিবীতে নিয়ে যায়, আর শাস্তিপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য প্রার্থনায় বসি আমি

হে বাসব, সমুদ্রঝড় বলো, বলো সেই আতুর আশ্রয়, কীভাবেই-বা আমি আমাকে আদমের পাপের কাছাকাছি নিয়ে যাব, আর নক্ষত্ররা গেয়ে উঠবে আমার জন্য। সব ভণ্ড, সুবাসিত সিঁড়িগুলো হাওয়ায় দোলে আর আমার মুখে এক প্রসন্ন হাসি খেলে যায়

হে পালিত পুত্র, মনে রেখো এই সীমানা যে অবোধ দিনের মধ্যে তোমাকে পেয়েছিল তার দেহ নিষ্কাম ছিল না, তবু তুমি সমস্ত আসবাব ত্যাগ করে যে খেলায় ফিরে যেতে চেয়েছিলে তার আরাধ্য আসলে তুমিই। এই পাবক, অস্থির ঠোঁট নিয়ে কেঁপে চলা প্যাঁচা ও অপার দেহবোধ ছলকে উঠেছিল নিয়তির ভেতর। তা তুমি প্রত্যক্ষ করেছিলে এনায়েতপুরের দরবেশের ম্লান মুখে। ছিন্ন কথিকাগুলি মরণের জল ছুঁয়ে ছিল কতকাল। আজ এই তূষ্ণীম্ভাব, এই মোহ গলে যাচ্ছে যে-শতরঞ্জের আগুনে সেখানে ক্ষুধার্ত কুকুরেরা কাঁদে। এই বিতৃষ্ণ জ্যামিতি ঘিরে আছে চৈতন্য আমার, অথচ সুগোল একটি পৃথিবী আমাকে প্ররোচিত করে, নিয়ে যায় দৈব অছিলায় যে-বনান্তে তার দহন আজ আর স্পর্শ করে না কাউকে

হে বলরাম, তোমার মুখনিঃসৃত অনন্ত সর্প আমাদের দমিত করুক। এই মেধা, ক্ষুন্নিবৃত্তির সকাল যেমন প্রমিত আজ তেমন আর কিছুই শ্রবণের এত অন্ধকার নিয়ে শব্দ বোনে না, কেবল অশক্ত মদিরা গড়িয়ে যায় নতমুখ চাঁদের শরীরে

আমার উন্মাদ উঠোনে তোমাকে দেখি, সে-দৃষ্টির মধ্যে ঘরের প্রলাপ, ছায়াময় বন্দর ঘুমিয়ে পড়েছে, আর এই সন্ধিক্ষণ বড়ো মমতাময়, চেনা শব্দদের ধরে ধরে চা গুমটিতে ডেকে নেয়। তারপর যে-আলাপ নামে ভূপালীর দেহে তেমন সকাতর নিদ্রাহরণী মেলে না সহজে। এই চুম্বিত শ্বাসাঘাত, আলেখ্যর নিরসন আমার কেন্দ্র যেন, তবু মাটির গর্ভ আমাকে ফিরিয়ে দেয় সে-করকমল, বিস্রস্ত হায়াসিন্থ। এই তো গোলাপের শেষ অশ্রু, পথের দাগ চলে গেছে অবোধ দিনের আলো পেরিয়ে, আর আমি যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আমার তুরগ থেকে, তৃণশীর্ষ থেকে সে-ইতিহাস ভেঙে পড়েছে কবে এক তৃষিত নয়নপথে

কবেকার কুসুমপ্রস্তাব যে-অবরোহের কথা বলেছিল তা প্রকৃত দৈব নয়। স্তবকের প্রতিরোধ আমাকে সীমান্ত চিনিয়েছিল, আর সব শুভ নাম মুছে গিয়েছিল শুশুকের স্মৃতি থেকে। এ-যাবৎ নিসর্গ এভাবেই সমগ্রতা চেয়েছে, আর আমি ডুবে গেছি নিরাসক্ত জলে

এই মায়াগন্ধ, মুঠোভরা সূচের উদ্গাতা আমি আজ। লেবুফুল আসে, শৃঙ্গার যেন প্রাচীন বাঘ আমার বিছানায়। যে ছিঁড়ে ফেলা বাকলের সদ্য সহচর আমি তার কুয়াশামাখা বছরগুলো উড়ে যায় মেরুন অন্ধকারে, জল চায়, অস্ত্রের গৌরব দখিনা হাওয়ায় ঘোরে, ঘোরে নিরর্থ আলোয়। অদাহ্য কিছুই নেই বুঝি যে গোপনে সেইখানে তুমি তৃণাঞ্জন আজ, তবু মরুর ভেতর স্তব্ধ বালিয়াড়ি ঘড়ির অন্ধকার মুছে নিয়ে আসে। সহনীয় জিভের উপর যে-জয়ভেরী বাজে তা আমাকে একদিন নিয়ে যায় অশক্ত সমুদ্রের কাছে। হায়, চন্দ্রাভিলাষ! মারীচ, তুমি রক্তে থিতু হবার পরেও আমাকে ঘুরিয়ে মারে গলিপথে। এই ধাতু, এই বিযুক্ত হাওয়া, ঊর্ণাজাল থেকে ভেসে আসা মদ আমাকে সম্পৃক্ত করে, তারপর শ্রমণের পায়ের শব্দ আধোঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় অবোধ পাখিটিকে মন্ত্রোচ্চারণে

সেই থেকে অপেক্ষা আরও বাষ্পময়। মোচনের নীচুস্বর সব বোঝাপড়া পার হয়ে শ্যাওলাপড়া, পিছল পথটি ধরে নেমে যায় চন্দনের বনে

আমি রোদের কৃষ্ণ অঞ্জন, স্নান সারি মৃদঙ্গের জলে, আর অসীম ঘুঘুটি উড়ে আসে কার্নিশে। অনেক নীচে আঁধারের পেয়ালা উথলে যায় যে-কোশে সে এক মুর্শিদ। বায়ুর স্থির হওয়া দেখি, দেখি তার রক্তে নিরসন হয় পায়ে লেগে থাকা ঘাসবিন্দু ও কাঁটার, আর স্বর্গীয় আপেলের বিভা মাটির নিঃসরণে মেশে। তোমাকে অপাঙ্গে দেখি, মুহূর্তের জল ছলকে যায় অজানায়, পেছনে বছরের লঘুতায় এলিয়ে পড়েছে স্বাদ; দুপুরের বিবশতা মৃদু সখ্যের কথা ভুলে চলে গেছে ভাঙা জাহাজের কাছে

তোমার পায়ের নীচে ধুলো দেখে স্তব্ধতা মঙ্গলময়, আর সহজ যে-পথ তার ছায়া পড়ে দক্ষিণ উপকূলে। করুণার স্তন কাঁদে বারুণী রাতে, পা ডুবে গেছে কবে হিমঠান্ডা জলে। এখন এক-একটা গুপ্তহত্যা যে-সান্নিধ্যের কথা বলে তার জন্য কোনো পানপাত্র পড়ে নেই আর। হে নির্বন্ধ, তোমার দৈবপ্রহরগুলো খুলে দাও, রিপুর বিনাশকাল ফিরে এল গঙ্গাসকাশে

 

Facebook Comments

পছন্দের বই