Categories
কবিতা

দেশিক হাজরা

সময়ে অসময়ে ঝরে পড়া পাতা

গুচ্ছ

আর একটু সরে এসে বসি
তেতলা থেকে ঝুলে আছে
আহারে বাহারি লতা।

আর একটু কমে আসে দুঃখ

পরম প্রজল্পে আরও কাছাকাছি
ঘেঁষে ঘেঁষে থাকা…

বেজন্মা

ভাঙ্গা কোলাজ, অস্পষ্ট স্মৃতি ধুয়ে
নেমে আসে মা আর মেয়ে, ওদের
কোনো বাবা নেই। ব্যঙ্গ; পিছিয়ে পড়ছে
শুভ দিন। তবুও এই সময়ে মিশে আছে
বাগানের কাছাকাছি দুরন্ত বালকের
কালো চামড়ার ভিতর জেগে ওঠা অজস্র
ইচ্ছামতি… চাটো চিনির ডেলা কিংবা পা
চুপিসারে অত্যান্ত চুপি চুপি মাথা। দেখে
ফেললাম এই ভেবে সরে গিয়ে বসো। চলো
একটু দূর থেকে হেঁটে আসি। নব পুরুষের
নতুন দণ্ড মিশে থাকা রাতের অন্ধকারে।

আবারো বলি ওদের কোনো বাবা নেই
ওদের শুধুই আছে নিজস্ব শব্দ…

অবস্থান্তর

ছেলেটি হয়ে উঠলো অলৌকিক,
নখের উপরে জমে ওঠেছে সবুজ
শ্যাওলা, চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে
বাদামি কালো শিরা/ উপশিরা।
অদ্ভুত রহস্যময় হয়ে পায়ে পায়ে
জোর লেগে গোল হয়ে যায়…

মাথাভর্তি চুল, হলুদ হয়ে ঝরে
পড়ে, জন্ম নেয় সবুজ নবপল্লব।
মাটি খামছে ধরে চেটো, হাতের
আঙুল ছোটো বড়ো বিভক্ত হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে, তাতে
পাখি বসে বিষ্ঠা ছড়ায়, নিজেদের
মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে, এই মুহূর্তে
আর অক্সিজেন গ্রহণ করে না;

এরপর। ওকে ভাবতে দাও : এই তো
জানালার ভেতর দিয়ে আর একটি
জানালা খুলে দিচ্ছে। এই তো বাতাসের
আঘাতে নুয়ে পড়ে আবার সোজা হয়ে
দাঁড়িয়ে পড়ছে—

P.N.P.C

কথার ভারে পেট ফুলে ওঠে
মাথা নুয়ে যায়। ঘাড়, আলতো
ক্লেশ-এর ওজনে ঝুঁকে আসে
পেটের দিকে। অদ্ভুত রহস্যময়
ঘোড়া দৌড়। আমাদের শরীর
থেকে শরীরের যে দূরত্ব তার মধ্যে
লুকিয়ে বেঁচে থাকে শব্দ। সেইসব
শব্দ ঘিরে আমি তুমি ও আমাদের…

Categories
কবিতা

নিয়াজুল হক

বিগ-ব্যাং

আমি
বর্তমানে
আগুনের ভেতর ঘর বানিয়ে
বিশ্রাম করছি

শাসন দেখছি

তোষণ দেখছি

এবং
নাশন দেখছি

আপাতত
সব হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখছি

বুঝতে পারছি
আমরা আর একটা বিগ-ব্যাংয়ের
প্রাক্কালে এসে হাজির হয়েছি

আবার
নতুন করে সূর্য সৃষ্টি হবে

আবার
চাঁদ হবে

আবার
মহাকাশ জন্ম নেবে

কবন্ধ কথা

একদা
একতাল লোহা
গোল চ্যাপ্টা এবং পুরু হয়ে

তৈরি হয়েছে
কোদাল গাঁইতি এবং শাবল

এরাই একদিন
তাপে চাপে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে
ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে দেখা দেবে

এরাই
তোমার চেয়ার-টেবিলের পায়া ভেঙে
তোমাকে উলটে দেবে

তোমার ধরমুণ্ডু আলাদা করবে

এরাই তোমাকে
মাথাকাটা কণিষ্কের মতো কবন্ধ বানাবে

তার আগে
তোমার লুকোনোর
গোপন আস্তানা খুঁজে নাও

হে দেবদেবী

ভূমিকম্প

নেহাত
উলটো দিক থেকে
পা পিছলে পড়ে গেছি

নেহাত
দু’পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারিনি

নেহাত
আমি পলকা হয়ে জন্মেছি

তাই কিছু বলিনি

এসবই কালক্রমে
মেঘের আড়ালে
পাহাড়-পর্বতের গুহায়
অথবা
সমুদ্রের তলদেশে
দীক্ষা নিয়ে
সামনে এসে দৈত্যের মতো দাঁড়াবে

এদের হাতেই থাকবে
ভূমিকম্প রচনার যাবতীয় কৃৎকৌশল

তুমি থরহরিকম্প হয়ে
থপাস করে মাটিতে সপাটে পড়ে যাবে

তোমার চারপাশে
তোমাকে তুলে ধরার মতো
একজনও কেউ থাকবে না

মধুসূদন

মাত্র
একটাই শর্ত

হয় মৃত্যুকে বেছে নাও

নয়তো
জীবন আমার হাতে সঁপে দাও

আমি তোমাকে
ইচ্ছেমতো
মাংসের মতো টুকরো করব
সবজির মতো কুটবো
অথবা
মাছের মতো পিস করব

তারপর
একদিন
পেস্ট করে কোপতা-কাবাব বানাব
ঘরে ঢুকব-বেরবো
আর একটা করে মুখে ফেলে দেব

তোমাকেই
কখনো ভিখিরির পাত্রে
খুচরো পয়সার মতো ছুঁড়ে দেব

কখনো
নোটের মতো ওড়াবো

আমার সাম্রাজ্যের
হর্ম্যরাজি দেখে চিনতেই পারবে না আমাকে

কখন আমি
মদনা থেকে মধুসূদন হয়ে গেছি

পুনর্জন্ম

জাতকের গল্পের মতো না হলেও
সমস্ত ব্যবহার্য দ্রব্যেরই পুনর্জন্ম আছে

প্রথমে
পা থেকে মাথা পর্যন্ত ধরুন

পায়ের জুতোমোজা চপ্পল প্যান্টশার্ট বেল্ট বুকপকেটের কলম হাতের আংটি স্টোন গলার চেন যা যা দেখছেন সবকিছুরই পুনর্জন্ম আছে

সবই ফুলে ওঠে অথবা চকচকে হয়

ব্যবহার্য যানবাহনেরও পুনর্জন্ম হয়
অর্থাৎ
বাস ট্রেন ফ্লাইট ইত্যাদি সবকিছুরই

অর্থাৎ
ঢিবি টিলা হয়
টিলা পাহাড়-পর্বত হয়

শুধুমাত্র
সব সাধারণ মানুষ এবং গরীবগুর্বোদের
কোনো পুনর্জন্ম নেই

তারা গরীবগুর্বো ও নিঃস্ব হয়ে জন্মায়
এবং গরীবগুর্বো ও নিঃস্ব হয়েই চলে যায়

তাদের জন্য একটাই অপশন
তারা লাঠিয়াল এবং আগ্নেয়াস্ত্রধারী হতে পারে শুধু

ভাঁজ

জগতের যা কিছু ভাঁজ করা থাকে না
তার সামনেই দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়

যা কিছু ভাজ করা থাকে
তার ভাঁজ খুলতে খুলতে
নানারকম বিষাক্ত পোকামাকড়
বেরিয়ে আসতে দেখি

হিংস্র পশুদের দেখে
ছুটে পালাতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াই
আর সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে

ভাঁজ খুলতে খুলতে
তোমাকে যে পাইনি তা কিন্তু নয়

পেয়েছি এবং হারিয়ে ফেলেছি

ভাঁজ খুলতে খুলতে
তোমাকে পাখির মতো
উড়িয়েও দিয়েছি

কখনো

Categories
কবিতা

যশোধরা রায়চৌধুরী

১ নভেম্বর রাত্রির কবিতা


কোনো কোনো রাতে হঠাৎ ফিরে আসে সেই জাগরণ
কোনো কোনো রাতে , নিদ্রাহারা , আমি পাই সেই চেতনা
ভাস্বর হয়ে ওঠার মুহূর্ত আর প্রাসাদোপম
কোনো এক মূর্খ আত্মকেন্দ্রিকতার ভেঙে পড়ার মুহূর্ত
এক সাথে মিলে মিশে যায়

ঘুমহীনতা এক অসুখ।
ভাস্বরতা এক সুখ।
আমি ত চেতন!! আহা, আমি কি চেতন।

তার দু-তিন ঘণ্টা পরে অবশ্যই
শুধু ঘুমের ওষুধ চেয়ে ক্রন্দনরোল ওঠে আমার।


কোনো কোনো রাতে ইন্দ্রিয় সব সতর্ক হয়ে ওঠে
বাতাসে বারুদের গন্ধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে
যাপনের মধ্যে সমস্ত ছেনালি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
মিথ্যা হয়ে ওঠে প্রকট

কোনো কোনো রাতে বাতাস স্বচ্ছ হয়ে ওঠে
প্রখর হয়ে ওঠে ঘ্রাণ
পোড়া পোড়া গন্ধ পাই
জানালায় চোখ ঠেকালে দেখতে পাই বাইরে
অন্ধকারেও নড়াচড়া করছে কারা

এই তীব্র বোধ নিয়ে এখন আমি কি করি
মগজের অক্সিজেন মাত্রা ছাড়া হয়ে গেলে কোনো কোনো রাতে
আমরা জেগে উঠি এবং জেগে থাকি এবং জানতে পারি
অনেক কিছু জানতে পারি
অনেক কিছু বুঝতে পারি


কোনো কোনো রাতে
আমরা জানতে পারি
যে, জীবনের অধিকাংশ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
আমরা খবরের কাগজে দেখেছি
ফ্লাইওভারের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের মুখ
যার কোনো পরিচয় নেই
যাকে বলি একটি নম্বরযুক্ত শবদেহ

কোনো কোনো রাতে
সমস্ত ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে
সমস্ত নশ্বরতা নম্বরযুক্ত হয়ে যায় আমার কাছে


এইসব রাতেই
আমি স্পষ্ট দেখি
আমরা কী করতে চাইছি আর কী করতে চলেছি
আমরা একটি পিছল রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছি
শিরদাঁড়ার বিনিময়মূল্যে বেঁচে আছি
আমরা খাড়াই বেয়ে উঠেছি
শুধু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি যাতে ফসকে না পড়ে যাই
আমরা শুধু আছি
সমাধানহীন সমস্যার সমাধানের জন্য
একরকমের অভ্যাসবশত হাত-পা নাড়তে নাড়তে

কোনো কোনো রাতে
আমি জানতে পেরেছি
পরতের পর পরত খুলে
একটার পর একটা নতুন গল্প আমরা দেখতে পাবো
প্রতিটি মিথ্যার পেছনে আছে আরও একটি মিথ্যা
সেই মিথ্যার পর্দার পেছনে আছে আরো একটি মিথ্যা।

সবার পিছনে আছে আরো একটি সত্য
স্পষ্ট জানতে যারা পারে,
তারা চিরতরে বধির ও অন্ধ হয়ে যায়
কেননা তারা জেনেছে
একটা সরু সুতোর ওপর কীভাবে রয়েছে সব
এই দুলছে মৃত্যুর দিকে
তো ওই দুলছে বেঁচে থাকার দিকে।


কোন কোন রাতে আমি নিজেই খুব স্বচ্ছ হয়ে গেছি
এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়িয়েছি প্রেতাত্মার মত
এবং জানতে পেরেছি যে আমার সমস্ত মিথ্যাচরণ
আসলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য

আমি জেনেছি যে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী দুটি পৃথিবী
চিরতরে ভাগ হয়ে গেছে
একদল রাস্তায় বসে পুরনো কাগজ নিয়ে আগুন জ্বলে এবং হাত গরম করে
তারা সভ্যতায় বিশ্বাস করে না
তারা সাম্য এবং সুবিচারে বিশ্বাসী নয়
তাদের উদ্ধার করতে হবে বলে
আরেক দল বেরিয়েছে বুলডোজার নিয়ে

তারা বন্ধ ঘরে থাকে
তাদের জানালায় নেই কোনো কাগজ আটকানো
তাদের ছিদ্রহীন ঘরে
গুনগুন করে মেশিন
তারা সকাল থেকে বিকেল
হাত সেঁকে নেয়
নিজেদের অনিবার্য ক্ষমতার আগুনে
কাঠ কুড়িয়ে আনতে হয় না তাদের
জল ভরে আনতে হয় না, অনেক দূর থেকে

তাই তারা বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে
এবং অবিশ্বাসীদের
বিশ্বাসে ফেরাবে বলে
অন্যায়কারীদের ন্যায় ফেরাবে বলে
তারা মস্ত মস্ত সব ধজা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে
যুদ্ধজয়ের জন্য

জয়ীদের সঙ্গে
এবং বিজিতদের সঙ্গে
কী কী হয় এবং কী কী হবে
কোনো কোনো রাতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়ে যাই।

সেই দিন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে

কিন্তু সেই দিন আমি সবচেয়ে বেশি জীবিত বোধ করি।

Categories
2023-sharodiyo-krorpatro amitava_smritikotha

বেবী সাউ

কবির অনস্তিত্ব ও কবিতার অস্তিত্ব

‘সময়টা ভালো নয় রে, সাবধানে থাকিস।’ সময়টা যে ভালো নয়, তা অমিতাভ মৈত্র-র চেয়ে আর কেই বা বেশি করে বুঝতেন, জানি না। কারণ খবরকাগজের পাতা থেকে বাস্তবতাকে যাঁরা জানেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হতেন সরকারি প্রশাসনের উচ্চ দপ্তরে কর্মরত এই কবি। তার জন্য বিস্তর যে সব কাঁটাঝোপ অতিক্রম করতে হতো তাঁকে, রক্তাক্ত হন তাঁর মন। বাইরে থেকে হাসিখুশি এই অনুভূতিপ্রবণ কবির মনের ভিতরে যে অস্থিরতা চলত, তা সহজে বোঝা যেত না। হয়তো সেই আগুনের মতো অস্থিরতাকেই তিনি লিখতেন তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতার জগতে তথাকথিত আলোর জন্য মাথা খুঁড়ে মরেননি এই কবি। কারণ প্রকৃত কবির মতোই তাঁর ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। নিজের ভাষার সাহিত্য, দেশের সাহিত্য, বিদেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্র নিয়ে সর্বদা তিনি নিমগ্ন থাকতেন নিজের পড়াশুনোয়। হয়তো এ কারণেও কবি অমিতাভ মৈত্রর কবিতাকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক বলে মনে হয়। মনে হয়, তাঁর কবিতার ভিতর যেমন মেদিনীপুর পুরুলিয়ার এক প্রান্তিক মানুষ কথা বলে উঠছেন, তেমনই স্বর শোনা যাচ্ছে এই সময়েরই প্যালেস্তাইন থেকে, সিরিয়া থেকে, ভেনেজুয়েলা থেকে। যখনই কথা হতো, মনে হতো, মনে মনে অস্থির এক কবি, বিদীর্ণ হয়ে আছেন সাম্প্রতিক সময় নিয়ে। প্রশাসনিক কাজ তাঁকে আরও রুক্ষ বাস্তবতার সামনে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে তাঁর কবিতা শুধুই সংবাদের বৃত্তান্ত হয়ে পড়েনি। হয়ে পড়েনি বিবৃতি।

কবিতা আসলে একটা ভ্রমণ। একটা সফর। পাঠকের সঙ্গে কবির। কিংবা বলা যেতে পারে কবি এবং পাঠক পরস্পর কবিতাটির পেছন পেছন যান, তাকে ছোঁয়ার জন্য। অনুভবের জন্য। আর তাতেই রহস্যময়ী হয়ে ওঠে সেও। একটা নতুন কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় পরিদর্শনে বেরিয়েছি। এক একটা দৃশ্য এসে বসছে। আবার এসে যাচ্ছে পরের দৃশ্যপট। চারপাশে অজস্র আলো-আঁধারের খেলা। এইসব রংকে কবি যেমন কিছু শব্দের মধ্যে বেঁধে রাখার সঙ্কল্প নেন, আবার পাঠক তাকে ছড়ায় বিস্তৃতির দিকে। হাঁটে। কবি আড়চোখে হাসেন। কবিও বেরিয়ে পড়াটুকু উপভোগ করেন। পাঠক রোমাঞ্চ বোধ করে। দেখে, শব্দ আর দৃশ্যের মতান্তর। সহযোগ। মুগ্ধ হয়। কখনও বিধ্বস্ত; বিভ্রান্ত। আবার বহুদিন পরে হঠাৎ কোনো দৃশ্যে নিজে খুঁজে পায় সেই কবিতাটির প্রকৃত আধার। তাই কবিতা যতটা না শব্দের ঠিক ততটাই স্বশব্দেরও। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা জীবন ঠিক এরকমই। দৃশ্যের জগত নেমে আসছে শব্দের কাছে। আবার শব্দের জগত মিশে যাচ্ছে দৃশ্যে। বাস্তব এসে গল্প করছে সাদা অ্যাপ্রোণ পরা নার্সদের সঙ্গে; একঘরে শব্দ চিৎকার করছে। আর বিরাট নার্সিংহোম থ মেরে আছে। ঠিক তখনই যেন হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত কবি যেখানে হাজির। দেখছেন এবং স্তব্ধ হয়ে আছেন। বুঝতেই পারছেন না, এই মুহূর্তে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত নাকি অর্ডার করা উচিত দায়িত্ব সূচি অনুযায়ী নাকি চিৎকার করে আউড়ে যাওয়া উচিত কোনও সংবিধানের সাজানো, সংযোজিত মুখস্থ করা লাইন!
“This long, this long dream, I’m awaking, no, I’m going to die, dawn is breaking” —Albert Camus এর এই লাইনগুলি কবিই ব্যবহার করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ “টোটেমভোজ”-এ। এইযে ভয়াবহতার প্রকৃত দৃশ্য কবি ব্যবহার করলেন সার্জিকল টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে— আর সাদা টকটকে একটা বলের সঙ্গে মেশালেন আসন্নমান মৃত্যুর দৃশ্যকে— আর এখানেই পালটে গেল এতদিনের নিয়ম কানুন। সাহিত্য রচনার ব্যাকরণ বিধি। কই বাংলা সাহিত্য তো কখনও এমনভাবে বাস্তবের সঙ্গে কথা বলেনি! শুধু ফল-ফুল-লতা-পাতা নিয়ে পড়ে থাকার মতো দিন যে আর নেই কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা পাঠের মাধ্যমে সেই অনুভূতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। কবিও বলতে পারেন ” প্রতিটি অপরাধের পাশে রক্তের হালকা ছোপ লেখে থাকা ট্রেন/একবার মাত্র আলো ফেলে ঘুরে যায়/আর ভয়ার্ত ঘাস আর ভয়ার্ত ভেড়াদের সামনে/আমরা বিচ্ছিন্ন এবং আত্মস্থ হতে চেষ্টা করি”( মনঃসমীক্ষকের স্বীকারক্তি)।

অমিতাভ মৈত্রর জন্ম ১৯৫২ সালে। যে সময়টাতে জন্মেছেন এখনকার আরও বিশিষ্ট কয়েকজন কবি। সমকালীন অবস্থানটিকে ধরলে দেখা যাচ্ছে, কবি অমিতাভ মৈত্রের রচনাকৌশল পুরোপুরি ভিন্ন। আঙ্গিক, বচন, কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য— সবকিছুতেই কবির নিজস্ব ছাপ; ‘বিভীষিকার জগৎ রক্তের আঁশটে ব্লান্ট-গন্ধ’ মাখা এক বাস্তব দুনিয়া। কবির নিজস্ব কথায়।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ “বিদ্ধ করো, তীর” প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। দীর্ঘ একটা সফরের কবিতা নিয়ে কবির এই কবিতার বই। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের মতো করে, ছন্দ, রূপ রসের সৌন্দর্যে মণ্ডিত এই সব কবিতাগুলি। কিন্তু কবির সন্তুষ্ট নন। কবি চাইছেন অন্য কিছু; ধরতে চাইছেন সেই বিরাট বাস্তবকে। মনের ভেতর চলছে অস্থিরতা; দ্বিধা-দ্বন্দ। এঁকে ফেলতে চাইছেন প্রকৃত বাস্তবকে। তখনই ব্যর্থ কবির মনে হয়েছে— “‘বিদ্ধ করো, তীর’-এর এইসব কবিতা থেকে আমার আত্মা বিযুক্ত হয়ে গেল। নিজের কবিতা বিষয়ে স্ফীত আস্থা নেই এমন মানুষ যা করতে পারেন, আমি তাই করলাম। এরিয়া ছেড়ে সরে গেলাম।”

দীর্ঘ দশ বছরের বিরতি। দীর্ঘ একটা পরাজিত মন? নাকি নিজেকে ভাঙার জন্য নির্জন কোনও সাধনা? দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে শব্দের কাছে কবি ফিরলেন। অসন্তুষ্টি; ক্রোধ; রাগ; অভিযোগ; অভিযোগ সবটুকু নিয়েই ফিরলেন। ততদিনে ভেঙে গেছে অনেক কিছু। ততদিনে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তলস্তয়ের “The death of IvanGlych” গল্পে ইভানইলিচের অদ্ভুত অসুখ ও যন্ত্রণা থেকে ব্যথার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর কাছে কবিতা শুধু শরতের মেঘোজ্জ্বল আনন্দ নয়; বরং কবিতা ধরা দিয়েছে এক রক্ত মাংস হিংসা দ্বেষ কলহ বাস্তব জীবনের প্রকৃত সত্য হিসেবে। শুধু সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে নয়; বরং মিলিত সত্ত্বার রূপ ধারণ করে। কবিও এটাই চাইছিলেন। কাফকার মতো তিনিও বলতে চান “সেই মানুষটির মতো লিখতে চাই আমি যে সেই হাতের আশ্রয়ে উন্মাদের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে নিজেকে। ” তবে যে বিপন্নতা কাজ করছিল কাফকার ভেতরে সেটি কি কবির ভেতরেও আছে? একটা বিরাট অস্বস্তি কাজ করছে কবির মধ্যে। একটা অনিশ্চয়তায় মোড়া রাত্রি; ঘাতকের মতো চোখ আর দমবন্ধ একটা অবস্থান থেকে কবি বেরোতে চাইছেন যেন। আর ওইসব অজস্র হিংস্র চোখ কবির চোখে ফোকাস করে চলেছে অবিরত। ওখান থেকে যেন মুক্তির সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতদিনের জমে থাকা মনের ভেতরে ক্রোধ মুক্তি চাইছে। কিন্তু এই পৃথিবী যে বড্ড নিস্পৃহ; নিঃসঙ্গ। কারোর কথা শোনার মতো অবসর নেই তার। কবি অসহায়। ফিরলেন শব্দের কাছে। বললেন, ” টোটেম’ এর ভাষা প্লাষ্টার করা হাতের মত শক্ত, আড়ষ্ট, কৃত্রিম। দাঁন্তের নরক ও পরিশুদ্ধিতে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম তখন।সঙ্গে বাইবেল এবং কাফকা। “Inferno” –তে নরকের দরজায় লেখা ছিল –“Leave every hope, ye, who enter.” আমি সেটি ব্যবহার করেছিলাম বইয়ের শুরুতেই।” ম্যাডাম এম. এর সঙ্গে। ম্যাডাম এম. দেখালেন টোটেম ভোজ এর প্রাকমুহূর্ত। আত্মহত্যার আগে একজন সুস্থ সবল মানুষের কী কী করণীয়। আর প্রাসঙ্গিকভাবেই কবি তুলে আনছেন Andre Hardellet এর উক্তি “Such detachment! Such relief.” কীরকম মুক্তি? নিজেকে আবিষ্কার? নাকি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা? এই আত্মহত্যার ছবি আঁকতে গিয়ে কবি জোগাড় করে আনলেন চোখের সামনে এক প্রোটাগনিস্ট নারীর বর্ণনা। “এগিয়ে আসছে আপেল আর লাফিয়ে কামড়ে ধরছে ম্যাডাম এম এর গলা/ দাঁতের ডাক্তারের মতো শ্লথ গ্যাস সিলিণ্ডার দু-পায়ের মাংসে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে”। চমকে উঠতে হয়। লাইনের পর লাইনে উঠে আসে সমাজের বাস্তবচিত্র। আর পাঠক ম্যাডাম এম এর মধ্যে দেখে সেই নারীটির যন্ত্রনাজর্জর দিনগুলির দৃশ্য চিত্র। আর এই ভারতীয় সমাজে হাঁটা ফেরা করে বেড়ায় কবি সৃষ্ট চরিত্রগুলি। কবিও তাঁর যাবতীয় চিন্তা ভাবনা; রাগ-অভিযোগ নিয়ে চরিত্রগুলির সঙ্গে সহবাস করেন।

২০১৫ সালে বেরোয় কবির ‘সি আর পি সি ভাষ্য’। ততদিনে কবি তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সিভিল সার্ভিসে চাকরির সূত্রে আইনের মারপ্যাঁচ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। কিন্তু এই কবিতার বইটিতে আছে কবির নিজস্ব অনুভূতি এবং উপলব্ধির প্রকাশ। ‘vision of evil’ থেকে তুলে আনা কবির বয়ান; স্বীকারোক্তি।

কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতাতে দেখা মেলে একজন তৃতীয় ব্যক্তির— কখনো তিনি ক্রিস্টোফার, কখনো ম্যাডাম এম, কোয়ারান্ট রিগ্রেসন অথবা আয়নাতে প্রতিবম্বিত ছায়া হেনরি। এবং তারা কেউ এদেশীয় নয়। তারা কেউ লেখক নন, কবি নন, এমনকি পাঠক নন। তৃতীয় জন। নিরপেক্ষ? যারা শুধু আসে এবং চলে যায়।

চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের বাস্তব চলচিত্র। অথচ দৃশ্যের সঙ্গে অনুবাদ হচ্ছে একটি শ্লথ-মন্থর যাতায়াতের। আবার সামনে বেজে উঠছে কোনও ফ্রেগর্যান্স অফ কালার-এর অতলান্ত স্পর্শে। মনে হচ্ছে এ যেন রসের ভিয়েন। এ যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য সমস্ত বাস্তবতা একটা আশ্চর্য গ্লোবের ওপর ঘুরছে। আবার মুহূর্তে তৈরী হওয়া সেই কালারের ফোকাস ভেঙে পড়ছে। এখানে পাঠকই সর্বত্র। নিজস্বতা আছে বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। আমি আছি বলেই রূপ রঙ রস স্পর্শ। আমার জন্যেই সমস্ত নিয়ম কানুন, ব্যস্ততা, ভাঙা-গড়া। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা এসব কথাই বলে যাচ্ছে। তাই হেনরির মধ্যে পাঠক নিজেকে খোঁজে; বাউণ্ডুলে জীবনকে খোঁজে। আর হাঁটে। আর এখানেই কবির কবিতার সার্থকতা। এখানেই কবি অমিতাভ মৈত্র-র কাব্যব্যক্তিত্ব।

এমন এক কবি এই রণ-রক্ত-সফলতা-ব্যর্থতার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। রয়ে গেল তাঁর কলম, যার রক্তের দাগ এখনও শুকোয়নি।

Categories
amitava_chitrokola

চিত্রকর্ম

 

 

 

Categories
2023-sharodiyo-sakkhatkar

শ্রীমতি গোপা কাঞ্জিলাল

সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী

আমাদের সংগীতের আদি রূপ শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে ধারা কয়েক শতক ধরে যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল বর্তমান সময়ে এসে সে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। সারা ভারতবর্ষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আজ থেকে কিছু বছর আগেও কলকাতা ও অন্যান্য জেলায় সারা বছরব্যাপী বিশেষ করে শীতের সময় জুড়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসতো এবং সেই অনুষ্ঠানে বাংলা তথা সারা ভারতের বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী উপস্থিত থাকতেন। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতেন যে কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলায় সমঝদার শ্রোতার আধিক্য অন্যান্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। কাজেই বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীরা মুখিয়ে থাকতেন এখানে সংগীত পরিবেশন করার জন্য।

কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতের সেই রস গ্রহণ করার মতো শ্রোতা আজকাল বিরল। বিভিন্ন যন্ত্রের উচ্চকিত ও অসংযমী প্রয়োগ ও তার সাথে গান গাওয়া— এখনকার প্রজন্মের মানুষের চিত্ত বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষার জন্য যতটা সময় দেওয়া দরকার, সঠিকভাবে তানপুরায় সুর বেঁধে কন্ঠ চর্চার প্রয়োজন ও যোগ্য গুরুর অধীনে থেকে নিবিড় শিক্ষা ও অনুশীলন— তার সদিচ্ছা বা আগ্রহ এই সময়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়।

আমরা তবুও প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নজরুলগীতি-র প্রথম সারির শিল্পী গোপা কাঞ্জিলাল-এর বারাসতের বাড়িতে গিয়েছিলাম তাঁর সংগীতজীবনের কিছু কথা শোনার জন্য। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে এই উপস্থাপনা।

আপনার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি কখন শুরু হয়েছিল? বাড়িতে কেউ কী সংগীত চর্চা করতেন? তাঁদের আগ্রহের কারণে কী আপনার সংগীত জীবন শুরু হয়েছিল?

আমি তখন খুব ছোটো। আমাদের পাশের বাড়িতে একজন শিক্ষক আসতেন গান শেখাতে। তাঁর নাম শ্রী গৌর গোপাল কুণ্ডু। তিনি এলেই আমি তাঁদের বাড়ি চলে যেতাম গান শুনতে। আমার খুব ভালো লাগতো। তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। একদিন আমি মায়ের কাছে বললাম যে আমি গান শিখতে চাই। মা বাবাকে আমার আগ্রহের কথা জানালেন। তারপর বাবা ওনার সঙ্গে কথা বলে আমার গান শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে আমার গান শেখা শুরু হলো। এভাবেই কিছুদিন চললো। উনি সব ধরণের গান শেখাতেন যেটা বাবার পছন্দ ছিল না। বাবা পছন্দ করতেন উচ্চাঙ্গ সংগীত। নানা ভাবনা চিন্তার পরে একদিন বাবা আসাম রওনা দিলেন। উদ্দেশ্য আমার দাদুর (বাবার কাকা) কাছে আমার গান শেখার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমার দাদু ছিলেন লখনৌ-র ম্যরিস কলেজ অফ মিউজিক (বর্তমানে ভাতখণ্ডে কলেজ অফ মিউজিক) এর ছাত্র। তিনি গান শিখেছিলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে ও পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ রতনজনকারের কাছে। পাহাড়ী সান্যাল, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, রবীন্দ্রলাল রায় (বিদুষী মালবিকা কান্নন-এর বাবা) ও আমার দাদু এঁরা সবাই এক সাথে সংগীতের পাঠ নিয়েছেন। যাইহোক, বাবা কিন্তু আসাম গিয়ে দেখলেন দাদুর ঘর তালাবন্ধ। উনি বাইরে কোথাও গেছেন। আসলে উনি সংসারী মানুষ ছিলেন না। তখন বাবা ওনার উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে রেখে আসেন।

 এর পরবর্তীতে কী হলো?

বাবা আসাম থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন দেখি আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামলো। রিকশা থেকে একজন অচেনা মানুষ নামলেন। তাঁর পরনে টকটকে লাল রঙের ধুতি ও জামা। ওনার সঙ্গে রয়েছে একটা ব্যাগ ও একটা তানপুরা। আমি তো এই রকম লাল রঙের পোষাক পরা মানুষ আগে দেখিনি। যথারীতি খুব ভয় পেয়ে গেলাম ও বাড়ির ভিতরে গিয়ে বললাম, তোমরা শিগগির এসো। দ্যাখো আমাদের বাড়িতে একটা কাপালিক এসেছে। আমার ঠাকুরমা তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন ও বলে উঠলেন, কাপালিক কোথায়! এ তো আমাদের স্মরজিৎ! ওনার নাম স্মরজিৎ কাঞ্জিলাল। উনি সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন এবং উনি স্বামী সচ্চিদানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন।

বেশ মজার ব্যাপার তো?

(হেসে উত্তর দিলেন) বাবা অফিস থেকে ফেরার পরে ওনাদের মধ্যে আমার গান শেখার বিষয়ে কথা হলো। সব শুনে উনি বললেন যে গান শেখানোর দায়িত্ব উনি নেবেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কেন? বাক্সবন্দি গান বাজনা চলবে না। প্রথমেই উনি ও বাবা হারমোনিয়াম বিক্রি করে তানপুরা কিনে আনলেন। সেই প্রথম তানপুরা নামটা শুনলাম ও স্বচক্ষে দেখলাম। এর আগে আমি তানপুরার ত-ও জানতাম না। শুরু হলো তানপুরায় সরগম শিক্ষা। প্রথম প্রথম তানপুরায় গান গাইতে অসুবিধা হতো বৈকি! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তানপুরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এভাবেই শিক্ষাগ্রহণ পর্ব চলছিল। কিন্তু দাদুর মন পড়েছিল সেই আসামে। উনি সেখানে ফেরার জন্য একটু অধীর হয়ে উঠছিলেন। হয়তো সেই কারণেই একদিন বাবাকে বললেন, আমাকে নিয়ে উনি বর্ধমান যেতে চান। সেইসময় পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী বর্ধমান থাকতেন। আমাকে নিয়ে দাদু যোশী-জির বাড়ি গেলেন। সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমার পরবর্তী সংগীতগুরু প্রশান্ত দাশগুপ্ত। ওখানে সবার সামনে আমাকে গান গাইতে হলো। তখন এতটাই ছোটো ছিলাম যে ঠিক না ভুল কী গিয়েছিলাম জানি না। তখন প্রশান্তবাবু দিল্লির নিবাস ছেড়ে কলকাতায় যতীন দাস রোডে বসবাস করছেন। দাদু প্রশান্তবাবুকে আমার সংগীত শিক্ষার দায়িত্ব দিলেন। সেই থেকে ওনার মৃত্যুকাল অবধি আমি ওনার কাছে সংগীতের পাঠ নিয়েছি। কয়েক বছর পরে আমি কলকাতার সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করলেও প্রশান্ত দাশগুপ্তের কাছে নিয়মিত গান শিখতে গিয়েছি। প্রশান্তবাবুর মৃত্যুর পরে আমি শ্যামচৌরাশি ঘরানার বিখ্যাত উস্তাদ সালামত আলি খাঁ সাহেবের ছাত্র শ্রদ্ধেয় শ্রী ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে তালিম নিয়েছি।

আপনি কি কখনো সংগীতের পরীক্ষা দিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমি ১৯৭২সালে এলাহাবাদের প্রয়াগ সংগীত সমিতি-র সর্বভারতীয় ‘সংগীত প্রবীণ’ (এম মিউজ এর সমতুল্য) দিয়েছিলাম এবং সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম।

এছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন?

আমি ১৯৭৩ সালে আকাশবাণী আয়োজিত All india classical music competition এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানেও আমি সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম স্থান লাভ করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেছিলাম।

এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে একটু বিশদে বলবেন?

আকাশবাণী আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা প্রতি বছর হতো। কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এই দুই বিষয়েই। ভারতবর্ষের যেকোনো রাজ্যের থেকে প্রতিযোগীরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতিযোগীদের জন্য তাদের স্থানীয় আকাশবাণী কেন্দ্রে (গান বা বাজনা) রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা থাকে। এই রেকর্ডেড পারফরম্যান্সগুলি দিল্লিতে পাঠানো হয়। ওখানে বিচারকদের নিয়ে একটা বোর্ড গঠিত হয়। রেকর্ডিং শুনে বিচারকেরা যোগ্যতা নির্ধারণ করেন।

আপনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি’ শ্রদ্ধেয় শ্রী ভি ভি গিরি মহাশয়ের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন?

না। সেবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি একাই পুরস্কার লাভ করেছিলাম। তাই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে একা আমাকে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণের অনুমোদন দেয়নি। পরে আমার পুরস্কার আমি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করেছিলাম। শ্রদ্ধেয় সংগীত ব্যক্তিত্ব শ্রী রাইচাঁদ বড়াল মহাশয় সেই পুরস্কার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু উনি পুরস্কারসহ আমার সাথে ছবি তুলতে রাজি হননি।

এই পুরস্কারের সূত্র ধরে নাকি আকাশবাণীতে গান গাইবার সুযোগ ঘটে? পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাকি আর অডিশন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না?

না। এটা সঠিক নয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তাঁদের রাজ্যের আকাশবাণী কেন্দ্র তিনটি প্রোগ্রাম করার সুযোগ দেয়। কিন্তু আকাশবাণীর গ্রেডেড আর্টিস্ট হতে গেলে তাঁকে অবশ্যই অডিশন দিতে হবে। তবে আমি এই সুযোগটা পাইনি। কারণ আমি প্রতিযোগিতার আগে অডিশন দিয়েছিলাম এবং প্রতিযোগিতার ফলাফল বেরোনোর আগেই আমি আকাশবাণীতে উচ্চাঙ্গ সংগীতে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

সেই সময় তো আকাশবাণীতে বিখ্যাত রথী মহারথীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। এমন কোনো বিখ্যাত মানুষের কথা মনে পড়ে যাঁদের সঙ্গতের সঙ্গে আপনি গান গেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিখ্যাত তবলাবাদক উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ ও পণ্ডিত শ্যামল বোসের সঙ্গে ও বিখ্যাত সারেঙ্গিবাদক উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের বাজনার সাথে গান গাওয়ার। (একটু হেসে বললেন) কেরামত খাঁ সাহেবের আফিম নেওয়ার অভ্যাস ছিল। উনি অনেকসময় বাজাতে বসে ঝিমোতেন। তখন পাশ থেকে অন্য কেউ ওনাকে জাগিয়ে দিতেন।

এর পরবর্তীতে পন্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সমীর চট্টোপাধ্যায়, গোবিন্দ বসু, আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সাহা, দুলাল নট্ট, উস্তাদ সাব্বির খাঁ ও হারমোনিয়ামে পণ্ডিত সোহনলাল শর্মা সারেঙ্গিতে রোশন আলী প্রমুখের সাথে অনুষ্ঠান করেছি। আরো অনেকে আছেন, এই মুহুর্তে তাঁদের নাম মনে পড়ছে না।

১৯৭৭ সালে কলকাতায় আই টি সি সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়। এঁদের একটা প্রয়াস ছিল প্রাচীন গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা পুনরায় শুরু করার। এই উদ্দেশ্যে সারা ভারতের স্ব স্ব ক্ষেত্রে যাঁরা বিখ্যাত তেমন সব দিকপাল শিল্পীদের তাঁরা নিযুক্ত করেছিলেন গুরু রূপে। এবং স্কলার হিসাবে উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচন করা হচ্ছিল। আপনি কীভাবে এই সংস্থার সাথে যুক্ত হলেন? এর জন্য কি আপনাকে অডিশন দিতে হয়েছিল?

আমি সংগীত রিসার্চ একাডেমির বিষয়ে কিছু জানতাম না। আমাকে শ্রীমতি মালবিকা কান্নন স্মরজিৎ কাঞ্জিলালের নাতনি বলে চিনতেন ও স্নেহ করতেন কারণ আমার দাদু ও ওনার বাবা একই সাথে সংগীত শিক্ষা করেছেন। এছাড়া এ টি কান্নন সাহেবও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে কান্নন ডেকে বললেন ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে যেতে হবে এবং গান শোনাতে হবে। কলকাতায় সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। ওখানে কিছু স্কলার নিয়োগ করা হবে। আমি চাই তুমি ওখানে যোগদান করো। সেই কারণে আমার বাড়িতে গানের আসরে তুমি সবাইকে গান শোনাবে। তো সেইমতো ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে গিয়েছি। গান গাইতে বসে দেখি শ্রোতার আসনে রয়েছেন কিচলু সাহেব, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ, উস্তাদ ইশতিয়াক হুসেন খাঁ, উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ, বিদুষী হীরাবাঈ বরদেকার, দীপালি নাগ, পন্ডিত ভি জি যোগ ইত্যাদি সংগীত ব্যক্তিত্ব। যাই হোক, গানের শেষে কান্নন সাহেব সবার কাছে জানতে চাইলেন, এই মেয়েটির গান কেমন লাগলো? সবাই বললেন যে তাঁদের খুব ভালো লেগেছে। হীরাবাঈ বরদেকার বললেন, এই মেয়েটি join করলে আমি ওর দায়িত্ব নেবো। তখন মালবিকা কান্নন আমাকে বললেন, দ্যাখ! তোর গানের যে ধারা তার সাথে হীরাজির গানের ধারার অনেক তফাৎ। ওঁদের গায়ন শৈলী তোর স্যুট করবে না। তুই বরং ইশতিয়াক হুসেন খাঁ-র কাছে তালিম নে। ওদের রামপুর-সহস্বান ঘরানার গায়কীর সাথে তোদের ঘরের গায়কীর কিছুটা মিল আছে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করবো? তখন এ টি কান্নন সাহেব বললেন, অবশ্যই যোগদান করবে। আমার সংগীত গুরু প্রশান্ত দাশগুপ্তও বললেন, যখন এ টি কান্নন বলছেন তখন তুমি ওখানে যোগদান করো।

আমি ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তত্বাবধানে ওখানে শিক্ষা শুরু করলাম।

ওখানে সংগীত শিক্ষার ধারা কেমন ছিল? এক একজনকে আলাদা ভাবে শেখানো হতো? নাকি গ্রুপ করে শেখানো হতো?

ওখানে আমাদের ক্লাসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকতো। সেই সময়ে আমাদের উস্তাদজির কাছে যেতে হতো এবং একাডেমিতে নিযুক্ত একজন তবলাবাদক কে নিয়ে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় পন্ডিত আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন তবলা সঙ্গতে। না, গ্রুপে গান শেখানো হতো না। স্বর্গীয় পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ী ও আমি – এই দুজন উস্তাদজির কাছে গান শিখতাম। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন শ্রী টি এন সিং। উনি বেনারসের মানুষ ছিলেন এবং খুবই সংগীত প্রিয় ছিলেন। কলকাতা রাজভবনে সেবার উস্তাদজির গানের আসর বসেছিল। উস্তাদজি অরুণবাবু ও আমাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন গাইবার জন্য। তবে উস্তাদজি বেশিদিন কলকাতায় থাকেন নি। উনি চলে যাবার পরে উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ আমাকে ডেকে নেন তালিম দেওয়ার জন্য। উনি আগ্রা-আত্রৌলি ঘরানার গায়ক ছিলেন। তবে আমার কাছে ওনার গায়ণশৈলী অতটা আকর্ষণীয় লাগতো না। ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তুলনায় লতাফৎ হুসেন খাঁ-এর গানে মাধুর্য্য কম ছিল। আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আপ্পাজির (বিদূষী গিরিজা দেবী) মেয়ে আমাদের হিন্দি পড়া, লেখা ও কথা বলার ট্রেনিং দিতো।

সংগীত রিসার্চ একাডেমীতে নাকি প্রায়ই সংগীত সম্মেলন হতো? এ কথা কি সত্যি?

হ্যাঁ। শুধু বহিরাগত শিল্পীদের নয়, যাঁরা স্কলার রূপে যোগদান করেছিলেন তাঁদেরও প্রায়ই স্টেজ পারফরম্যান্স করতে হতো। একবার একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল যেটার ভাবনায় খুব অভিনবত্ব ছিল। এই অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায় ছিলেন শ্রদ্ধেয় পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও বিদূষী দীপালি নাগ।

রাজ দরবারে গানের আসর বসেছে। সেখানে এক বাঈজি ও সভাগায়ক গান গাইছেন। রাজাও গান গাইছেন। রাজা হয়েছিলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও ওনার স্ত্রী হয়েছিলেন রানী। তখন সদ্য ওনাদের বিয়ে হয়েছে। আমি হয়েছিলাম বাঈজি। অরুণ ভাদুড়ী সভাগায়ক। এছাড়াও বকুল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গানে। আরো অনেকেই গান গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হয়েছিল।

আর একটা ঘটনা বলি। সেবারে জয়পুর-আত্রৌলী ঘরানার বিখ্যাত গায়িকা বিদূষী কিশোরী আমনকর এসেছেন সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে। আমরা যাঁরা স্কলার ছিলাম সবাই মিলে ওনার খিদমত করতাম। হাত পা টিপে দিতাম। উদ্দেশ্য একটাই। সামনে বসে ওনার গান শুনবো। উনি অত্যন্ত মুডি আর্টিস্ট ছিলেন। সহজে গান গাইতে চাইতেন না। তো সেবার উনি গান শোনাতে রাজি হয়েছিলেন। সারা কলকাতার বিখ্যাত সব মানুষ এসেছিলেন ওনার গান শুনতে। আমার মনে পড়ে সিনেমার জগতের শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় ও অপর্ণা সেনও সেদিন এসেছিলেন।

একটা সময় আপনার ও লীনা মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি খেয়াল গানের কথা সবার মুখে মুখে শোনা যেত। এবিষয়ে কিছু বলুন। আপনাদের আগে আর কোনো মহিলা শিল্পীরা কি যুগলবন্দি খেয়াল গেয়েছেন?

হ্যাঁ। একটা সময়ে আমাদের যুগলবন্দি খেয়াল বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। যুগলবন্দি খেয়াল গাইবার প্রধান শর্ত হল দু-জনের মধ্যে বোঝাপড়া। দু-জন শিল্পীকেই বুঝতে হবে কোথায় ধরতে হবে, কোথায় ছাড়তে হবে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর জন্য যুগলবন্দি গানে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়া অনুচিত। এছাড়াও সময় বুঝে শিল্পীদের নিজেদের দক্ষতার জায়গা দেখানো যেতে পারে।

সেইসময় মিডিয়ার এমন রমরমা ব্যাপার ছিল না। সেক্ষেত্রে অন্য কেউ গেয়েছেন কিনা আমার সঠিক জানা নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাইরে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছি।

উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে আপনার কাছে অনেক কিছু শুনলাম। আপনার কাছে এত কথা রয়েছে যে আরো কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের সময় তো নির্দিষ্ট করা আছে, তাই এবারে বরং আমরা নজরুলগীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আপনি নজরুলগীতি-র প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?

আমার নজরুলগীতি শিক্ষার ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা আছে। সেটা পরে বলছি।

আমি কিন্তু শুধুই উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছি ও তাই নিয়েই থাকতে ভালোবাসতাম। কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত গাইলে তো চলবে না। আর অধিকাংশ নজরুলগীতি যেহেতু রাগভিত্তিক তাই আমার এই ধরণের গানের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতো। আমাদের বাড়ির কাছেই আমার এক দাদা থাকতো। সে ছিল নজরুলগীতির ভক্ত। ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া নজরুলগীতির রেকর্ড কিনে আনতো আর আমাকে খবর দিতো শুনতে যাওয়ার জন্য। আমি শুনে শুনে সেই গানগুলি কণ্ঠে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। বারাসাতেই আমার এক বন্ধু ছিল – অনুপ রায়। ও ভালো তবলা বাজাতো এবং আমরা একসাথে গান বাজনা করতাম। ও যেত রাধাকান্ত নন্দীর তবলাবাদনকে অনুসরণ করার জন্য। আর আমি শুনতাম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গায়কী। কারণ তখন নজরুলগীতির জগতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। ওনার কাকা শ্রী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন কাজী সাহেবের শিষ্য এবং যতদিন কাজী সাহেব সুস্থ ছিলেন ততদিন অবধি উনি কাজী সাহেবের সাথে যুক্ত ছিলেন।

এর মধ্যে বারাসাত Toll Tax দফতর থেকে এক প্রভাতী সংগীতের আসরের আয়োজন করেছিলেন বারাসাতের বিজয়া সিনেমা হলে। সেখানে আমাকে গাইতে বলা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর গান সাথে রাধাকান্ত নন্দী-র তবলাবাদন। আমি গান গাইছি এমন সময় ওনারা দু’জন হলে প্রবেশ করলেন এবং সামনের সারিতে বসে আমার গান শুনলেন। অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পরে উদ্যোক্তাদের একজন এসে আমায় বললেন, আপনাকে গ্রীনরুমে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও রাধাকান্ত নন্দী ডাকছেন। শুনে আমি তো ভয়ে অস্থির। কী জানি, বোধহয় ভুলভাল গান গেয়েছি। তাই বোধহয় আমাকে ডাকছেন। তো গিয়ে আমি দুজনকে প্রণাম করলাম। দেখি মানবেন্দ্রবাবু হাসছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি শুধুই নজরুলগীতি গাই, নাকি অন্য গানও গেয়ে থাকি। আমি জানালাম আমি শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখি ও গেয়ে থাকি। এইসব গান আমি আপনার রেকর্ড শুনে তোলার চেষ্টা করেছি। ওনাদের সাথে ছিলেন বারাসতেরই একজন মানুষ -অনন্ত চ্যাটার্জী। রাধাকান্ত নন্দী ওনাকে বললেন, এই মেয়েটাকে চেনো? উনি বললেন, নাম শুনেছি তবে চিনিনা। তখন রাধাকান্ত নন্দী বললেন, একটু খোঁজ নাও। দেখি এর জন্য কী করতে পারি।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের বাড়ি একদিন হঠাৎ করে চলে এলেন রাধাকান্ত নন্দী সাথে ছিলেন নারায়ণ চৌধুরী ও অনন্ত চ্যাটার্জী। সবাইকে আবার গান শোনাতে হলো। এরপরে রাধুবাবু বাবাকে বললেন, আপনি কি মেয়েকে নজরুলগীতি শেখাতে চান? তাহলে আমি ওর গান শেখার ব্যবস্থা করে দেবো। বাবা বললেন, ও যদি শিখতে চায় তবে আমার আপত্তি থাকবে কেন?

এরপরে আমি নজরুলগীতি শেখা শুরু করি শ্রদ্ধেয় শ্রী বিমান মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। পরবর্তীতে পন্ডিত শ্রী সুকুমার মিত্রের কাছে শিখেছি এবং উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ওনার কাছে শিখেছি। এরপর আকাশবাণী কলকাতায় নজরুলগীতিতে অডিশন পাশ করলাম। সেই সূত্র ধরে দূরদর্শন এ অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলাম। ১৯৭৮ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রথম নজরুলগীতির চারটে গানের একটা E.P. রেকর্ড বেরোলো। এরপরে পলিডোর কোম্পানি (পরবর্তীতে মিউজিক ইন্ডিয়া) থেকে আরো একটা E.P. রেকর্ড বের হয়। এর পরে ইনরেকো কোম্পানি থেকে দুটো লং প্লেয়িং রেকর্ড বের হয়। তাতেও আমার গান ছিল। এরপরে এলো ক্যাসেটের যুগ। প্রথম ক্যাসেটটি প্রকাশিত হয়েছিল মেগাফোন কোম্পানি থেকে ও পরেরটা কিরণ কোম্পানি থেকে। তখন থেকেই নজরুলগীতি-র নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে শুরু করেছিল। নজরুলগীতি-র সুর নিয়ে তখন থেকে একটা চাপান-উতোর শুরু হয়েছিল। এই শুদ্ধ সুর ও বিকৃত সুরের দোটানায় পড়ে আমি আর গান রেকর্ড করতে আগ্রহী হই নি।

নজরুলগীতি নিয়ে এই যে অভিযোগ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ নজরুলের গানের শুদ্ধতা নিয়ে যে কাজ করছেন সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

অবশ্যই এটা খুব ভালো উদ্যোগ। একজন কবির গান ভিন্ন ভিন্ন সুরে কেন গাওয়া হবে? এ প্রশ্ন তো আমাদেরও? ওঁরা কাজী সাহেব সুস্থ থাকা অবস্থায় (অর্থাৎ ১৯৪২ সাল অবধি) রেকর্ড হওয়া বিভিন্ন গান সংগ্রহ করে সেই সব গানের স্বরলিপি করছেন এবং সাথে গানের শিল্পীর নাম, রেকর্ড নং ও কোন কোম্পানি থেকে কবে প্রকাশিত হয়েছিল সেইসব তথ্য উল্লেখ করছেন। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে। কাজী সাহেবের জীবদ্দশায় আরো অনেক গান সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলি রেকর্ড করা হয়নি। সেইসব গানের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে? বহু প্রবীণ শিল্পীরা সেসব গান পরবর্তীতে গেয়েছেন। যেমন শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, শ্রী সুকুমার মিত্র, শ্রীমতি সুপ্রভা সরকার। এঁরা নিশ্চয় বিকৃত সুরে গান গান নি। কাজেই এই ব্যাপারে একটা মস্ত সমস্যা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

এবারে একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি দীর্ঘদিন ধরে গান শেখাচ্ছেন। আগের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ফারাক চোখে পড়ছে কি?

অবশ্যই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি কেরিয়ার সচেতন। তারা কেউ তানপুরার সাথে কন্ঠ চর্চায় আগ্রহী নয়। এমনকি ভালো করে পালটা বা অলংকার চর্চার আগেই গান শেখার জন্য ব্যগ্র। সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব— এই ধ্রুবসত্য বোঝানো খুব কঠিন। এছাড়াও উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার ক্ষেত্রে অনেকেরই অনীহা রয়েছে।

গান শেখার ক্ষেত্রে কেন এমন অবস্থা? আপনার কী মনে হয়?

আমার মনে হয় এক্ষেত্রে টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো অনেকাংশে দায়ী। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ধারণা করে নিয়েছে রিয়েলিটি শো তে গান করতে পারলে যেন মোক্ষ লাভ করা হয়ে হবে। ওখানে গান গাইতে গেলেও যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটা বুঝতে চায় না। আর এখন তো ইউ টিউব সবার সংগীতগুরুর ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে।

আপনি কি তবে আগামী দিনের গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন?

একেবারেই নয়। অন্ততঃ উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্ষেত্রে। উচ্চাঙ্গ সংগীত হলো আসল ভিত্তি যার উপর নির্ভর করে সংগীতের পরবর্তী ধাপগুলিতে আরোহণ করা যায়। যদি ভিত নড়বড়ে হয়, তার উপরে কি প্রাসাদ নির্মাণ সম্ভব? বাংলা গানেরও সেই অবস্থা! আসলে রুচি এখন নিম্নগামী। বিগত দশ/পনেরো বছরে এমন কোনো গান সৃষ্টি হয়েছে কি যা আরো পঞ্চাশ বছর পরে মানুষ শুনবেন? এখন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো গানেরও তেমন অবস্থা হয়েছে। কিছুদিন পরেই সেটা বাতিলের দলে চলে যাচ্ছে। শাশ্বত বলে আর কিছু থাকছে না।

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

মহিউদ্দিন সাইফ

রিমিল-পিয়ং কথা


পিয়ং-এর মতো অস্ট্রিক কন্যা রিমিল কখনো দেখেনি।
ওড্রো দেবীর সাথে সুমার সে রূপ প্রাঞ্চ অভিঘাতে। খেরোয়াল ভাষার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে মুখোমুখি, মুলাকাত হল
আর সেই খ্যান নিরুপাখ্য মধুর ধারা
করমডাল থেকে টিপিটিপি ঝরে পড়ছে ফুল…
সেই দৃশ্য, পাগল জারহি, ছুটে বেরোচ্ছে
জলের ছাওয়াল খুশবু-হরিণ…

এসব মর্ম একা যখন একলা রিমিল,
ডাগর দুটি চোখ দিয়ে নির্মলা জল, দরিয়া নাজুক,
দেশ পেরিয়ে খজকামান আর হারাতা পাহাড়,
আরও দূরে জারপি-চায়চাম্পা ফেলে বয়ে যাচ্ছে
নদী, আরও দূর কোনো দেশে…


চিলেছাদে ভাতঘুমের অবসর,
আর দিদিবুড়ি গেছে বেনাকুচির বনে
ঘরপিছে আড়বাঁশি, রোদেভরা দিন
বাজিয়ে বাজিয়ে একঠার, দুলছে রিমিল
দেখে লেবাস শুকানোর ছলে পিয়ং এসেছে,
আর ‘সুই উড়… সুই উড়…’ বলে খিলে উঠল
বিমুগ্ধা রাধিকা…

আমের বোলের রীত মগ্না আকাশ হতে
দিব্য সাদম মস্ত এক, নেমে এল
প্রাচীন হৃদয়বারি পান করতে
আর যাবার খ্যানে ফেলে গেল মুখের ফেনাটি

সরিয়ে নাকাব, মধুর হাওয়ার স্রোত
নিরাময় স্রোত আর হাওয়ায়
ভেসে বেড়াচ্ছে রিমিল-পিয়ং, ফেনাটি মান্দাস
দুটি আদিঅন্তহীন পাখি
তেলেশমাতি ভেসে যাও পাখি, লিটার উঠান থেকে
ওই দূরে
মানুষ জন্মেছিল জেনে যেদিকে উদয় হচ্ছে
নরম সঘন দাড়ি মিহির দেবতা…


সারা রাতের নাচের ক্লান্তি পুষিয়ে নিচ্ছে ঘুম। আলগা জুড়াটি থেকে ফিরাক নিয়ে পড়ে আছে
বিছানায় গুলাব, চাম্পা আর সাদা তোয়া-বাহা।
পুন্নিমার রাতটুকু ওরা হাত ছুঁয়ে বসেছিল,
তারপর বিরহী জীবন এল, রেখে গেল দুইফোঁটা
সিপির উপরে অশ্রুজল…
মনে হল এই সেই জল যা কেবল ছিল সর্বপ্রথমে,
আপন হৃদয় চিরে বের করে এনেছিল
জনক-জননী, সেই হাঁস ও হাঁসিল…

পাশের মোড়াটিতে বসে রিমিল
না-বোঝা চোখ দেখছে গয়েবী, ঘুমন্ত পিয়ং
কেমন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শিরম-গাছের দিব্য শিকড়,
তার মোড়াটি এক বিশাল শিরমপাতা
নীচে অপরূপ অগাধ অথৈ জলরাশি…


বাস থেকে নামতেই টেনে ধরল হাত
অপেক্ষায় চুর দুই চোখ দেখল মর্ম
আর মর্মের ভেতরে মায়াবী পিয়ং

শ্বেতপদ্দের পারা দুবরাজি বাজু
কাঁকালের ঝালর চটুলা মদির,
গায়… হাসে…
কানের লতির খানে করঞ্জার ফুল
ষোড়শী বাতাসে বাসে বিস্ময় সুবাস

এই অপলক দেখাটুকু দেখতে দেখতে
আসমানে আবের চাকা মেঘ নিচে জানুমধুন
ছেয়ে গেল আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-পথ
পাশে ঘোঙার মতন টাঁড়, লসুৎ বুরুই
ওরা চেপে দেখল –
কে একজন মাথায় গামছা বেঁধে, প্রত্যুষ বদনে
বুনে চলেছে সাগাঘাস, সার্জম, মহুল, পিয়াল, বান্দলতা, কাশি আর আবহমান সময়ের বীজ
বুনে চলেছে আশ্চর্য জাহানে…


ভোরবেলা ঘুম ভাঙার আগেই এল সাবিলা পিয়ং

ঘরের মাঝারে সেই আদিম লোবানের  ঘ্রাণ
সেই শিল্পীত উন্মাদ সুবাস, প্রথম আশনাই
আর আলমের আনাচেকানাচে জাগা সুষমা আলপনা
যেন পায়ের নেউর হতে ছড়িয়ে পড়া মোতি
সামের শোলোক

এই স্বপনটুকুন দেখে
চোখ খুলতেই দেখল রিমিল ঝুঁকে আসা মুখ,
সটান গেল সরে—
এতদূরে, যে আর ছোঁয়া গেল না এ জনমে
এ জাহানে একবারও

তিরিল ডালের থেকে ঝরে গেল চাঁদ
নিচে আতশগুঁড়োর পারা ছড়ানো লিয়র
যতনে বেছে রাখা হলুদ
অমলতাস, হরিদ্রা, চাম্পার থেকে,
সব কালো হয়ে মিশে গেল রাতে—
যে রাত প্রথম জাগা আম পাতার পারা
যে রাত শুকিয়ে যাওয়া আম পাতার পারা…

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

সুমন সাধু

গুপ্ত পাখিবিদ্যা আর বেড়াল যাবতীয়

জীবনের যত গুপ্ত পাখিবিদ্যা আর বেড়াল যাবতীয়
ঠিকানা মজবুত সর্বস্ব পথে ক্লান্তির কুহক
যেন পাতার আড়ালে মুচকি হাসা আকন্দ ফুল
ঝরে পড়ে স্বজনহারানো এ বরষা মরশুমে
আর যত আকুল দীর্ঘশ্বাসের কাছে এসে বসে পড়ছে
না ফোটা ডিম্বপ্রণালী
এই রূপে হতশ্রী হই
যত পাপতাপ বিদ্ধ হোক কামিনী নাভিকুণ্ডে
জ্বালাটি জুড়োবার নয়, তবু রোজ আপনার
সঙ্গে কথা ফুরোয় না
কথার পিঠের ধুলো ঝেড়ে এ বরষায়
আপনি ঘুমাতে পারেন না
শরীরের সমস্ত জলে সুউচ্চ মেঘ জমে
বাষ্পলোকে যেন প্রসূতির কুয়াশাকঙ্কাল

একা এক ব্রহ্মাণ্ড

হাজার হাজার সূর্যের পাশে প্রকাণ্ড সব আলো
ভিড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া
কী হিমশীতল সেইসব শরীর, কী নিদারুণ লোভ
একা হয়ে আসা ঘর ক্রমশ বৃহৎ হয়
স্বভাবের জলতেষ্টা পায় হঠাৎ

এই বোকা ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি
চারপাশে উড়ন্ত সব ছাড়পোকা

ঘরের কথা

একটা বেডরুম
শতবর্ষ পুরনো খাটে লাল চাদর পেতে রাখা হয়েছে
দুটো চেয়ার ঘরের দৈর্ঘ্য প্রস্থকে দুইভাগ করেছে
হাওয়ায় উড়ছে সদ্য ভেজা তোয়ালে
ঘরের তিনদিকে পেরেক বিদ্ধ ফটোফ্রেম
মেঝেতে লুটানো তোমার টুপি, চায়ের কাপ
একটা ঘরে যা যা থাকার সব আছে
এমনকি তোমার ছায়া
শুধু এই ঘরে অত্যাচারিত হওয়ার প্রতিটি দাগ
আমার শরীর থেকে উধাও
তারপর থেকে আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করি

অনন্ত

জুন মাসের দেওয়াল বেয়ে নামছে নীল ফুলের ক্যালেন্ডার
সিনেমার আবহে তখন গর্ভবতী বেড়ালের কান্না
এমন বরষার দুপুরে অনন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে
শুদ্ধচারী মন্ত্রগুচ্ছ
তোমায় সেলাম ঠুকি
আর ওস্তাদের শেষ রাতে হুবহু পড়ে ফেলি ময়মনসিংহ-গীতিকা
তোমাকে তোমার নামে ডাকার মিথ শেষ হয়
আমার নধর শরীরের সেবা লাগে না আর
শুধু চোখের নীলমণি দিয়ে ঢেউ খেলে যায়
এ রোগের মেয়াদ বারোমাস
কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলেই মেপে নিই নাগরের শিশ্ন
শরীরের যুদ্ধ থামে

স্বাধীনতা

সমূহ সন্ধের মাঝে ভাবি আমাদের চিল-চিৎকার
রঙের হলদে থেকে গলে পড়ে ভিতরের কমলা
চারপাশে ভিড় করে মহীরুহরা
আমাদের কদমছাঁট চুলে আজ দৃশ্যমান কাঁচি
মরমে পরিপাটি ছোঁয়া
যেন কাঁটার আড়ালে আমাদের মা

কাল দেশ স্বাধীন হবে
মায়ের মধ্য গগনে ঘুরবে রেডিওর চাকা
তরঙ্গ পাড়ে ধাক্কা খাবে, ফিরে আসবে
একা এ দেশের প্রান্তরে এলোচুল, বিনুনি, সোমত্ত সিঁথি
চিল চিৎকারে ফেটে যাবে দেশপ্রেমের গান

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বাপি গাইন

গুচ্ছকবিতা


কিছু একটা হয়েছে এই পশ্চিম আকাশের
দেখো – তোমার মাথার ছায়া ছিটকে পড়ছে বালির ভেতর
এই কাঁধ তবে বিশ্রামের উপযোগী না।
এই ভিজে ওঠা আকাশও তবে আর নক্ষত্রের না।

দূরে পাথরের শহরে জ্বলে উঠছে নর্তকীর পা
হিসেবের খাতার ভেতর হাঁটতে গিয়ে শব্দ হচ্ছে খুব
এই শব্দ আমি চাইনি, যদিও
জীবনের দিকে হেঁটে যেতে
এতো অন্ধ মানুষ আমি চাইনি কখনো।


যেমন বীজের ভেতর ধ্যানস্হ থাকে গাছ
তোমার ভেতর তেমনই প্রোথিত আছি আমি।

যতক্ষণ না তোমার খিদে আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে
যতক্ষণ না আমি তোমার প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছি।


একার ভেতর কী এক পাগল কথা বলছে
এই মৃতদেহ বিষণ্ণ সেতু ভেবে তুমি ভেঙে ফেলতে পারো।

খুব সকালে একটা প্রজাপতি তোমার ক্ষত চাটতে আসে
আজ ওকে না করে দাও। আজ ওকে শিক্ষা নিতে বলো।

ফেলে দেওয়া মাংসের আলোয় সাদা হয়ে উঠছে এলোপাথারি কুকুর
আর কুকুরের গানে ফিরে আসছে আবার হত্যার প্রকরণগুলি।


যে খিদে মাংসের ঘুম ভাঙাতে পারে না তা কোনো খিদেই না।
যে জাগরণ কেবলমাত্র ঘুমের দিকে ঝুঁকে— তাকে প্রশ্ন করা উচিত।
প্রলাপ কি তবে বিপদসীমার উপর এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুধু?
সম্ভাবনা নয় কোনো গুপ্ত জন্মের?

অথচ খাদ্যের সংস্পর্শে এসে সব প্রানী আঘাতের তাৎপর্য ভুলে যায়
সব আঘাত খাদ্যকেই আবার গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
এভাবেই সমাজ রচিত হয়, বোঝাপড়া রচিত হয়ে থাকে।


ফুলের ঘ্রাণ দিয়ে ফুলকে শনাক্ত করা যায়।
অথচ হাওয়া ব্যতীত ঘ্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকে না।
ফলে ফুল আর ততোধিক ফুলও থাকে না।
এরকম পরিস্থিতিতে তোমাকে অনুভব করি
শ্বাসে ও বিশ্বাসে হাওয়াকেও সমর্থন করি তাই।
হাওয়ার ভূমিকা পালন করি
সর্বহারার ভূমিকা পালন করে যাই।

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

তন্ময় ভট্টাচার্য

তোতাপাখি

ঘুরিয়ে কিন্তু লেখাই যেত—
‘অনন্ত সৌন্দর্য ফুঁড়ে উঠেছ, কাঁকই,
পালকে জলের দাগ, হাত মোছো আঁচলে যেমন’

অথচ জল খেতে গিয়ে এইমাত্র নদী হল
গলা-বুক, হাত কাঁপছে থরথর করে

কবিতা নয়
সহজ কিছু পথ্যের প্রয়োজন আজ

জ্বরের পর জ্বর আসছে
গান বাজছে নির্মলা মিশ্রের

গাইডবুক

একটা বাসরুটের শুরু ও শেষ জুড়ে দিত আমাদের
অথচ বাসে চেপে কোনোদিন যাইনি তোমার কাছে
নিঃসঙ্গ কবর থেকে, ভিখারির প্রত্যাখ্যান থেকে
বেছে-বেছে জেনে নিতাম নামকরণের অপূর্ব স্টপেজ

বাসেরা অপেক্ষা করত, ফিরে আসতে চাইনি যেহেতু
সাবধান করেছিল, একদিন জলে পড়তে হবে

ওদের

এ-বাড়িতে কোনো বিড়াল বাঁচে না
এমন এক সত্যের বিপরীতে
দাঁড় করিয়ে দিলাম এই কবিতা

বহুদূর কোনো ধাপার মাঠে
ওরা বেঁচে উঠছে
একে একে অস্থি-চর্ম-প্রাণ

ফিরে এসে যদি জিজ্ঞেস করে
ফেলে এসেছিলাম কেন
আমাকেও ওভাবে বিদায় জানাতে চায়

তরুণ সেই কবিদের কী পরামর্শ দেব!

রি-শাফল

মায়ের এমন বয়সেই আমার জন্ম হয়েছিল
সেই বয়সে পৌঁছে, আজকাল ভাবার চেষ্টা করি
মায়ের সম্বন্ধ নিয়ে কেউ হাজির হলে
আমি কি রাজি হতাম বিয়েতে

পুরনো ছবির দিকে একেকটা দুপুর বয়ে যায়
জানলা দিয়ে উঁকি মারে বাম জমানার অবকাশ
মা হওয়ার আগে মা যে-তরুণী
তাকে কি আদৌ ভালোবাসতাম

বাবা হওয়ার আগে বাবা যে-যুবক
থই মেলে না
পুরনো ছবির মধ্যে হেসে ওঠে আমারই আদল

বহুদিন

একটি হাত যতদূর থেকে ডাকতে পারে, ততদূরই আলো
যত কাছে এসে নির্জীব হয়, ততটুকু আয়ু—

এইসব তত্ত্বে আমার বিশ্বাস ছিল না
হাতকে হাতের বাইরে চলে যেতে দেখেছি বহুবার

চাদরের বাইরে, এমনকী, চিতার বাইরেও

এত দূর—অথচ একটুও রাগ নেই
এসব ক্ষেত্রে আমার আঙুলগুলো নালিশ হয়ে ওঠে

বহুদিন সেই হাতে আঙুল বসেনি