Categories
2021-Utsob-Interview

সনাতন রুদ্র পাল

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী ও জাতিস্মর

[অবিভক্ত বঙ্গদেশে শারদীয় উৎসব বা দেবী দুর্গার আরাধনার প্রচলন হয়েছিল কয়েকশো বছর আগে। মূলত বিভিন্ন রাজপরিবার, জমিদার ও সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতেই সেই সময়ে দেবী পূজিতা হতেন। কারো বাড়ির নাটমন্দিরে মূর্তি নির্মাণ ক’রে পুজো করা হত আবার কোথাও ঘটপুজো করা হত। বারোয়ারি পূজার প্রচলন শুরু এর আরও অনেক পরে। যদিও কবে কোথায় প্রথম দেবীবন্দন শুরু হয়েছিল তার ইতিহাস আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আগ্রহ প্রতিমা নির্মাণশৈলীর ধারা নিয়ে। মনের গভীরে থাকা ভাবনাকে বাঁশ, খড়, কাদামাটির সমন্বয়ে একটা মূর্তিতে প্রকাশ। তাকে রং ও নানা ভূষণে অলংকৃত করে দেব-দেবীতে রূপদান যাঁরা করে থাকেন তেমন একজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতা ও কিছুটা সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে আমরা টিম ‘তবুও প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে হাজির হয়েছিলাম এই সময়ের অন্যতম মৃৎশিল্পী জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়ামের কর্ণধার সনাতন রুদ্র পালের স্টুডিয়োতে। বহু পুরস্কারে ভূষিত শিল্পী সাগ্রহে তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কিছুটা সময় বের করে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।

সনাতনবাবুর শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতার কথা ও তাঁর স্টুডিয়োতে মূর্তি নির্মাণের কিছু ছবি নিয়ে এই উপস্থাপনা।]

মাতৃ অবয়ব সৃজনে মগ্ন শিল্পী

প্রতিমা নির্মাণশিল্পের সঙ্গে আপনাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে যা ছোটোবেলা থেকে দেখে আপনারা বেড়ে উঠেছেন। আপনাদের ক-পুরুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত?
আমার পূর্বপুরুষ (ঠাকুরদা) ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। ওনারা প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সেই সময় বারোয়ারি দুর্গাপুজোর এত রমরমা ছিল না। তখন কিছু বর্ধিষ্ণু পরিবারে পুজো হত এবং দেখা যেত সারা গ্রামে হয়তো ওই একটি পরিবারেই পুজো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিমা তাঁদের বাড়িতে গিয়েও নির্মাণ করতে হত। কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব শিল্পালয় থেকে তৈরি হয়ে প্রতিমা কারো কারো বাড়ি নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু সেইসময় পুজোর সংখ্যা এতটাই কম ছিল যে, এই জীবিকার উপরে নির্ভর করে সারা বছর সংসার প্রতিপালন করা কঠিন ছিল। সে-জন্য প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈজসপত্র তৈরি করা হত। দেশবিভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কলকাতায় চলে আসেন এবং কুমোরটুলি অঞ্চলে তাঁদের স্থায়ী নিবাস হয়। সেইসময় রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর সঙ্গেই আমার বাবা ও জ্যাঠামশাইরা একত্রে কাজ করতেন। পরবর্তীতে রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে বেরিয়ে এসে আমার বাবা বিখ্যাত মৃৎশিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্র পাল একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই সময় থেকেই আমাদের বেড়ে ওঠা এবং এই শিল্পের সঙ্গে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমাদের মনের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছিল।

আপনি কবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন? এর জন্য কি আলাদা কোনো আবেগ বা মনের টান অনুভব করেছিলেন?
ঠিক কত বছর বয়স থেকে এই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন স্কুল-ফেরত প্রতিদিন আমাদের কর্মশালায় আসতাম এবং কিছু না কিছু কাজ সে মাটির হোক বা অন্য যাইহোক করতে হত। এইভাবেই ছোটো ছোটো কাজ শিখলাম। আমাদের বাবা জ্যাঠারা যখন দেখলেন আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি এবং করতে পারছি তখন তাঁরাও আমাদের উপর আস্তে আস্তে ভরসা করতে শুরু করলেন এবং দায়িত্বও বাড়িয়ে দিলেন। এইভাবে ছোটো ছোটো দায়িত্বগুলো পালন করতে করতে একসময় নিজেকে এই শিল্পের সঙ্গে একাত্ম করে ফেললাম। একক প্রচেষ্টায় মূর্তি নির্মাণ শুরু করলাম।

যখন এই মৃৎশিল্পকে অন্যতম পেশা বলে গ্রহণ করলেন তখন নিজের সৃষ্টি কি পারিবারিক যে-শিল্পধারা রয়েছে সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিল না কি নিজের সৃষ্টিকে পরিবারের অন্যদের থেকে একটু আলাদা করার কথা চিন্তা করেছিলেন?
যখন আমার ৪২ বছর বয়স, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠান মোহনবাঁশি রুদ্র পালের থেকে আলাদা হয়ে এসে আমি সনাতন রুদ্র পাল নিজের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান ‘জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়াম’ তৈরি করলাম। এবং ২৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চলে আসছে। আমাদের বাবা জ্যাঠামশাইদের যে-নির্মাণশৈলী চলে আসছিল তারই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ আমি আমার নিজের সৃষ্টির মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি এবং ভাবনার বিন্যাসে স্বতন্ত্র হবার চেষ্টা করেছি যা এখনও করে চলেছি।

কাঠামো- যার উপর ভিত্তি করে মূর্তি নির্মিত হয়

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও কি অ্যানাটমি বা শরীরের গঠনগত বৈশিষ্ট্য কাজ করে?
অবশ্যই করে। এবং এটা নির্ভর করে প্রতিমার উচ্চতা অনুযায়ী। ধরুন ১৫ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে গঠনগত পরিমাপ যা হবে ১০ ফুট বা ১২ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে সেটা হবে না। এখানে প্রথমেই নীচের কাঠামো বা মূল বেদীর এবং সিংহের উচ্চতার উপরে দেবীর গঠনগত পরিমাপ নির্ভর করে এবং এটা আমাদের কোনো মাপজোক বা এঁকে করতে হয় না। এটা আমাদের এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে যাই যে, শরীরের কোন অংশের পরিমাপ কত হবে এবং এটার জন্য একটি সূক্ষ্ণ নিরীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

বাঁশের কাঠামোর সঙ্গে খড় বেঁধে যে-প্রাথমিক অবয়ব তৈরি করা হয় সেই বাঁশ কি কোনো বিশেষ রকমের এবং কোথা থেকে আনা হয়?
মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে-বাঁশগুলো ব্যবহার করা হয় অন্যান্য বাঁশের থেকে তার কিছুটা তফাত অবশ্যই রয়েছে। মূলত এই ক্ষেত্রে ফাঁপা বাঁশ ব্যবহার করা হয় এবং যে-বাঁশের গাঁটগুলো ঘন থাকে সেই বাঁশই ব্যবহার করা হয়। তবে আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক সময়ই বাঁশ পরিপক্ক হওয়ার আগেই যোগানদাররা সেগুলি বিক্রি করছেন এবং আমরাও বাধ্য হচ্ছি সেগুলি নিতে। আগে যেখানে একটি বাঁশেই কাঠামো সম্পূর্ণ হয়ে যেত এখন গুণগত মানের তফাতের কারণে একটা কাঠামো তৈরি করতে দুই বা ততোধিক বাঁশের প্রয়োজন হয়। এই বাঁশের যোগানের অধিকাংশই আসে মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চল থেকে। এছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকেও কিছুটা আসে। এই ব্যাপারে যোগানদারেরা মূলত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা একত্রে এই বাঁশের যোগান দেন যা আমরা বরানগর কিংবা কুমোরটুলি ঘাট থেকে আমরা সংগ্রহ করে নিই।

আজকাল নাকি অনেক শিল্পী বাঁশের বদলে মেটাল স্ট্রাকচারে কাজ করছেন। এই পদ্ধতিতে কাজ করলে কি বিশেষ কোনো সুবিধা হয় বলে আপনার মনে হয়?
আমরা যে-ধরনের কাজ করে থাকি তাতে মেটাল স্ট্রাকচারের প্রয়োজনীয়তা এখনও অনুভব করিনি। তবে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা কিছু শিল্পীরা যে-সমস্ত আর্টের প্রতিমা নির্মাণ করছেন সেগুলোতে মেটাল স্ট্রাকচার ব্যবহার করছেন এবং অনেকসময় দেখা যাচ্ছে সেই মেটাল স্ট্রাকচারই প্রতিমার চালচিত্র হিসাবেও কাজ করছে।

কর্মব্যস্ত স্টুডিও

এখনও কি মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে সনাতনী রীতিনীতি মেনে অর্থাৎ, কোনো বিশেষ দিনে কাঠামো তৈরি করে প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়? তাহলে যে-সব বিদেশে পাঠানো সেক্ষেত্রে এই রীতি কীভাবে মানা সম্ভব হয়?
বর্তমানে প্রতিযোগিতার যুগে যেখানে আমাদের অনেকগুলি মূর্তি নির্মাণ করতে হয় সেখানে এই তথাকথিত তিথি নক্ষত্র মেনে যেমন ১লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া বা রথযাত্রা ইত্যাদি দিনে কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। আমরা পঞ্জিকা দেখে দেবীমূর্তি গঠনের কোনো বিশেষ দিনেই কাজ শুরু করে দিই এবং সেটা অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। বিদেশে মূর্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে তো এই রীতিনীতি একেবারেই মানা সম্ভব নয়।

বাজেট অনুযায়ী কি প্রতিমার গড়নে হেরফের ঘটে এবং সেটা কি নির্মাণগত তফাত নাকি বহিরঙ্গের সাজসজ্জার তফাত?
প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের একটি নির্দিষ্ট মান আছে যার সাথে আমরা আপোশ করি না। সেক্ষেত্রে বাজেট অনুযায়ী মূর্তির উচ্চতায় তারতম্য ঘটে। সাজসজ্জাতেও এটা প্রযোজ্য— যেমন কাপড়, গয়না, চালচিত্র ইত্যাদিতে কিছুটা তফাত হয়ে যায় এবং অনেকসময় দেখা যায় নিজেদের লোকসান হলেও আমরা নিজেদের কাজের মান বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকি।

প্রতিমা নির্মাণের সময় আপনারা কোন দিকটি বেশি গুরুত্ব দেন, দেবীর মাতৃরূপ নাকি রুদ্ররূপ?
এটি মূলত চাহিদা অনুযায়ী আমাদের রূপদান করতে হয়। তবে আমাদের এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি রুদ্ররূপের তুলনায় দেবীর শান্ত সমাহিত মাতৃরূপের চাহিদা বেশি। হয়তো সকলের মঙ্গল কামনায় যেহেতু মাতৃ আরাধনা করা হয়ে থাকে তাই দেবী মূর্তিতেও মাতৃরূপের চাহিদা বেশি।

আপনাদের সৃষ্টিতে কী কী বৈশিষ্ট্য আছে যা একান্তই আপনার ঘরানার এবং যা দেখে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে এ-সৃষ্টি আপনার?
ভালো প্রশ্ন করেছেন।

আমাদের সৃষ্ট দেব-দেবী মূর্তির চোখ, মুকুট, গয়না ও চালচিত্রের বৈচিত্র্য সবার থেকে আলাদা। এবং আমরা শুনেছি বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়ে অনেক দর্শক মূর্তি দেখেই বলে দেন যে, এটি সনাতন রুদ্র পালের সৃষ্টি। তার জন্য আমাদের আলাদা করে কোনো নামফলক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিনিয়ত এই ধারাকে ভাঙা গড়ার মাধ্যমে আমরা কাজকে আরো উন্নত ও আকর্ষণীয় করে তোলার কাজে ব্রতী থাকি।

প্রতিমার অঙ্গসজ্জার ভূষণ আপনাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে তৈরি করা হয় কি? মূলত কী ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়?
কিছু কাজ আমাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে অবশ্যই হয় বিশেষত চালচিত্রের। এছাড়া গয়নার বিশেষ ডিজাইন সৃষ্টি করে নিজস্ব কারিগরকে বুঝিয়ে দিই কী চাইছি। গয়না তৈরির ক্ষেত্রে শোলা, জরি, সলমা, চুমকি, মুক্তো, পুঁতি, আর্টিফিশিয়াল স্টোন ব্যবহার করি এবং এগুলো সব বড়োবাজার অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এবং একটি মূর্তির গয়না অন্যটির থেকে সামান্য হলেও তফাত রাখার চেষ্টা করি।

প্রতিমার রূপদানে যে-রং ব্যবহার করা হয় সেগুলো কি ভেষজ রং নাকি কেমিক্যাল?
এখন আর ভেষজ রঙের ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন নামি দামি কোম্পানি আজকাল এত উন্নত মানের রং সৃষ্টি করছেন যে, মূর্তির রূপদান করার সময় রং নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার দরকার পড়ে না। আর উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য আমাদের কোনো কৃত্রিম উপায় (বার্নিশ বা তেল) গ্রহণ করতে হয় না।

আপনার স্টুডিয়োতে যাঁরা কাজ করতে আসেন তাঁরা অধিকাংশই কি শিক্ষানবীশরূপে যোগদান করেন নাকি কাজের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন?
কিছু মানুষ আসেন একেবারেই শিক্ষানবীশ হিসাবে। এখানে স্টুডিয়োতে এসে ধীরে ধীরে কাঠামো গড়া, খড় বাঁধা, একমেটে, দো-মেটে ইত্যাদি কাজ কোনো অভিজ্ঞ কারিগরের তত্ত্বাবধানে থেকে ধীরে ধীরে শেখেন। এছাড়া আমাদের কাজের ধারা বোঝার জন্য পূর্ব-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষকেও অন্য কোনো কারিগরের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন কাজ শিখতে হয়।

দেবীর মুখাবয়ব

প্রতিমার চক্ষুদান এবং অঙ্গের বিশেষ বিশেষ অংশ তৈরির জন্য কি আলাদা কারিগর রয়েছেন নাকি তাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে একটি কাজ করতে পারেন?
কিছু কিছু শিল্পী আছেন যিনি হাতের আঙুল নির্মাণ, চক্ষুদান বা অন্যান্য বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ। এবং দক্ষতা অনুযায়ী তেমন কাজই তাঁদের দেওয়া হয় এবং কেউ কেউ আছেন যাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারেন। তবে কাজের পুরোটাই আমার তত্ত্বাবধানে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে আমি নির্দেশ দিয়ে থাকি।

আপনাদের ঘরানার দেবীমূর্তি এতটাই জনপ্রিয় যে, দেখা যায় অনেকেই আপনাদের এই সৃজনশীলতাকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে মূর্তি নির্মাণ করছেন। এই ব্যাপারটা আপনারা কীভাবে দেখেন?
প্রথমেই বলি আমাদের নিজস্ব যে-সৃষ্টি তার কোনো পেটেন্ট নেই। কাজেই ভালো কাজের অনুকরণ বা অনুসরণ হবে এটাই স্বাভাবিক এবং আমরাও এই ব্যাপারে সচেতন থাকি। আমাদের যে-ডাইসগুলো থাকে তার উপরে আমরা নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাই। একটা জিনিস জানবেন যে, শিল্পী নিজেই নিজের কাজের সবথেকে বড়ো সমালোচক। আমরা একটা কাজ করার পরে ভাবি যে, হয়তো দেবীর গালটা একটু ভারী লাগছে, মুখটা একটু বেশি গোল লাগছে সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আমরা এই জায়গাগুলোর দিকে নজর দিই। চোখ আঁকার ক্ষেত্রেও আমরা পরিবর্তন আনি আর যেটা বিশেষ করে আমরা করে থাকি সেটা হল গয়না, মুকুট এবং চালচিত্রের পরিবর্তন। নানারকম ডিজাইন আমরা নতুনভাবে তৈরি করে আগেরটাকে বাতিল করে দিই। কিন্তু যাঁরা আমাদের কাজের অনুকরণ করছেন তাঁরা কিন্তু সেই একই জায়গায় আটকে থাকেন। আমরা আমাদের নিজেদের কাজে প্রতিনিয়ত যে-সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারি অন্যেরা সেটা করে উঠতে পারেন না, যার জন্য তাঁদের কাজের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।

দুর্গা, লক্ষ্মী, শ্যামা ও সরস্বতী মূর্তি ছাড়া আপনাদের স্টুডিয়োতে আর কী কী কাজ হয়?
দুর্গাপুজোর আগেই আসে গণেশ পুজো। বেশ কিছু গণেশের মূর্তি তৈরি হয় আমাদের এখানে। বিশ্বকর্মা মূর্তি আমরা সেভাবে করি না। এছাড়া শ্যামাপুজার পরে আসে জগদ্ধাত্রী পূজা এবং বছরের প্রায় শেষে আসে সরস্বতী ও বাসন্তী পূজা। তবে বাসন্তী দেবীমূর্তি চাহিদা তুলনায় অনেক কম থাকে। এই মধ্যবর্তী ফাঁকা সময়ে আমরা পরবর্তী বছরের পূজার মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা এবং তার প্রাথমিক কাজ এগিয়ে রাখি।

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মিডিয়া (যেমন কাঠ, প্লাইউড, ফাইবার বা শোলা ইত্যাদি) ব্যবহার করেন?
না। আমরা মাটি ছাড়া শুধুমাত্র ফাইবার গ্লাসের কাজ করে থাকি। আসলে মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের মধ্যে যে-আনন্দ পেয়ে থাকি সেই তৃপ্তি বা শান্তি অন্য কোনো মিডিয়াতে কাজ করে পাই না।

পূর্ণতা পাবার আগের পর্যায়

বিগত ২০২০ সাল থেকেই করোনা আবহে পুজোর জৌলুস অনেকটাই ম্লান। এর প্রভাব কি আপনাদের জীবিকার উপরে কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
এই করোনা আবহে যদি কোনো শিল্প সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি হল মৃৎশিল্প। পুজোর সংখ্যা কম হবার সাথে সাথে পুজোর বাজেটও কমে যাওয়ায় আমাদের চাহিদামতো আমরা অর্ডার পাচ্ছি না এবং অর্ডার পেলেও সেখানে আমাদের কাজের নিজস্ব মান বজায় রাখার জন্য আমাদের লাভের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। অন্যান্য সামগ্রীর থেকে আমাদের এই কাজটার এতটাই তফাত যে-কোনো একটা বিশেষ উৎসবের পরে অবিক্রিত মুর্তিগুলির কোনো চাহিদা বা মূল্য থাকে না। যেহেতু অনেকরকম কারিগর নিয়ে আমাদের একটা বৃহৎ পরিবার এবং প্রত্যেকেই এই উপার্জনের উপর নির্ভরশীল কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই পরিবার এই পরিস্থিতিতে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বর্তমানে সরকার বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নানারকমভাবে সাহায্য করে থাকলেও মৃৎশিল্পীদের ব্যাপারে সেইভাবে এখন কোনো উদ্যোগ নেননি।

আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি এই পেশায় আগ্রহী? যাঁরা এই পেশায় আসছেন তাঁরা কি সবাই নিজ আগ্রহে আসছেন নাকি জীবিকার তাগিদে?
আমাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের মৃৎশিল্পের প্রতি সেরকম আগ্রহ বা ভালোবাসা দেখছি না। বরং তাঁরা অন্য পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করতে আগ্রহী। আবার বেশ কিছু তরুণ আসছে যারা কাজ শিখে ভালোবেসে এই পেশায় নিজেকে জড়াচ্ছেন যেমন বিভিন্ন কলাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিখে তারা কাজ করছে। আমি অন্তত এই মুহূর্তে পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে হতাশ হওয়ার মতো কিছু দেখছি না। বরং আমার মনে হয় তারা অনেকাংশে আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান বিশেষত ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে।

প্রতিমা নির্মাণের সময় কি সনাতনী রূপ নাকি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মূর্তিসৃজন— কোন ভাবনাকে আপনি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?
সনাতনী রূপ বলতে যেটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল একচালার মূর্তি। প্রতিমার মুখের আদল গোলাকৃতি। মুখের বর্ণ উজ্জ্বল হলুদ। টানা টানা চোখ ও সলমা জরির ডাকের সাজ। এক চালের মধ্যে সন্তান-সহ দেবী এটা কিন্তু যৌথ পরিবারের ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু কালের স্রোতে যৌথ পরিবারের ধারণা হারিয়ে গেছে। কিছু সর্বজনীন পূজা কমিটি তাদের পুজোয় সাবেকীয়ানা বজায় রাখলেও অধিকাংশ পুজোর উদ্যোক্তাদের চাহিদা প্রত্যেকটি মূর্তির পৃথক অবস্থান। আমরা সাধারণত চেষ্টা করি একই চালচিত্রের মাঝে আলাদাভাবে প্রতিটি মূর্তি সৃষ্টিতে। প্রয়োজনে পৃথক পৃথক চালচিত্রও করতে হয়। এছাড়াও আগে এক, তিন বা পাঁচ খন্তার মুকুটের যে-প্রচলন ছিল তাও এখন আর নেই পরিবর্তে মূর্তির গঠনবিন্যাস অনুযায়ী সামঞ্জস্য বজায় রেখে গয়না ও মুকুটের সৃষ্টি করতে হয়। সময়ের পরিবর্তন, রুচিবোধ ও চাহিদার কথা অবশ্যই মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে আপোষ করা সম্ভব হয় না।

সারিবদ্ধ প্রতিমা

একটা প্রতিমা নির্মাণের পিছনে সৃজনশীলতা ও প্রাণের আবেগ মিশে থাকে। প্রতিটা সৃষ্টিই একজন শিল্পীর কাছে সন্তানসম। কিন্তু আপনারা এই সত্যিটাও জানেন মাত্র কয়েকদিন পরেই এই নির্মাণ জলে ভেসে যাবে। এই নির্মম সত্য একজন শিল্পী হিসেবে কীভাবে মেনে নেন?
প্রতিমার কাঠামো নির্মাণের দিন থেকেই প্রতিটা সৃষ্টির প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা বা সৃজনশীলতা মিশে যেতে থাকে এবং দিনে দিনে প্রতিমা যখন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায় ভালোবাসা বা আকর্ষণ সেই কাজের প্রতি তত বেড়ে যায়। আমাদের সবথেকে শূন্য বা ব্যথা লাগে যখন দেখি যে, আমাদের এই স্টুডিয়ো থেকে একে একে সমস্ত মূর্তি নিয়ে উদ্যোক্তারা তাঁদের নির্দিষ্ট পুজোমণ্ডপের দিকে রওনা দিচ্ছেন। এই কাঠ কাটার শব্দ, খড়ের স্তূপ, মাটির ও রঙের গন্ধ, বিভিন্ন অঙ্গসজ্জার উপকরণ মিলিয়ে আমাদের স্টুডিয়োতে এই যে মাসাধিককাল ধরে কর্মব্যস্ততা তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসে এবং পঞ্চমী থেকে স্টুডিয়োর ভিতরে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও শূন্যতা বিরাজ করে। তখন থেকে আমাদের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট, বিয়োগব্যথা জন্ম নেয়। সেই ক্ষণ থেকেই আমাদের মনে বিজয়া দশমীর বিষাদ জন্ম নেয়। কাজেই দশমী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন আর নতুন করে কোনো ব্যথা আনে না।

Categories
2021-Utsob-Poem

দেবোত্তম গায়েন

প্রলাপ এক মধুর স্বর…


মায়ের সমস্ত সুরের প্রলেপ প্রতিপালনের মধ্যে ঘুমিয়ে রইল। আগাছার জন্ম এ-বাড়ির মধ্যে হলে তা শাকপাতাসন্তান। অকুণ্ঠ চেয়ে চেয়ে শেষে লাল হয়ে এলে তার নাম জবা, জবা-ই। মাটিরূপ। ভাষা দাও। শরীরের কষ্ট। প্রমাদের মধ্যে জীবন। আমি বুঝতে পারছি তুমি উলঙ্গ, ভীষণ ঠান্ডা মস্তিষ্কজীবী এক পরাভূতা, জেগে আছে প্রচণ্ড বৈভবে ঘ্রাণের শিউলি, এ-দেহ না থাকলেও হত।


নিজের মধ্যে অন্ধ জেগে উঠলে পিঠ ভারি হয়ে আসে না-দেখার বোঝা নিয়ে। তাই সে নম্র হতে চেয়েও শত্রু সেজে বাড়ি ফেরে। তার ‘কে’ আলো চাইতে গিয়ে লতা হয়ে যায় পড়শির নরম জানালায়। এই শোভা থেকে আমাকে মুক্ত করে আপদকালীন স্বপ্ন। চেয়ে আর দেখার মধ্যে অনেকটা ফারাক, আমি বুঝতে পারি না। ডুব নিয়ে নেয় তারপর…


পতনের আশ্চর্য চিত্র তুমি বয়ে নিয়ে চলেছ নিরন্তর। মহিমার নীল চাঁদ ফুটে উঠলে অপরাজিত তুলতুলে শরীর চিরে বেরিয়ে আসে আরও একটা মানুষ। পৃথিবীর উপর এই অভিমান শ্বাপদের মানায় না তাই। ফুলের মর্ম মৃত্যু থেকে ছুটে আসা মৌমাছির মতো। ভিজে পদ্মের খসখসে ধ্বনি যে শীৎকার হয়ে ওঠে; এ তেমন বর্ষার গানও নয়।


হরিণ এক শাবক। ধোঁয়া ওঠা শরীরের কঠিন পর্যবেক্ষক। নিমজ্জিত অন্ধকার থেকে সরে এসে মানুষের বিশ্রাম পোষ মানিয়ে গেল শস্যের ফলন এবং যৌথ পরিকাঠামো। ছুঁয়ে দেখার প্রকৌশল এক আদ্যাপিঠের গুপ্ত মূর্তি। গোলা ভরা উলঙ্গ পোকা ফসল খেয়ে গেলে নিয়ম হয়ে উঠল পর্যবেক্ষক।


এ ভরা ডাকের মাঝে পড়ে আছে গাছের শুকনো আদল। বাদল ওহে বাদল। শরীর যে নগ্ন করি পরম বিশুদ্ধ সে-ধ্বনি; প্রবালের অনুভূতি। গভীরে কেউ, দেখে না সে মানুষের আঁচ পাওয়া ঢেউ। খেতে খেতে ভরে আছে সোনা ধানের আবেগ; সেরে যায় শরীর, ভিতর। নিজেকে যে নগ্ন করি পরম সত্যি এই। আবহ গান হয়, হয়ে ওঠে সত্তা এক প্রতিধ্বনি।

Categories
2021-Utsob-Poem

সেলিম মণ্ডল

আপেল ও সিঁড়িভাঙা অঙ্ক

সম্পর্ক, এক সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। বাবা চেয়েছিল— আমি অঙ্কে অনার্স করি। ফিজিক্স নিয়েছিলাম। নিউটনের মতো পড়ে থাকা লাল আপেল তুলে বুঝে নিতে চেয়েছিলাম মাধ্যাকর্ষণ বল। আপেল কুড়োতে গিয়ে দেখেছি— এখানেও সেই সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। যতই উপরে ওঠার চেষ্টা করি— ছাদ দেখতে পাই না। শূন্যতার আলো অথবা হতাশা আমায় না-শিখিয়েছে অঙ্ক, না শিখিয়েছে ফিজিক্স। দূর থেকে শুধু যারা এসেছিল বা দূরে চলে গিয়েও যারা কাছে থেকে গেছে তারা আসলেই আপেলের প্রেমে পড়েছিল। তারা বার বার ছুরির অভাবে, না কেটেই খেয়ে নিয়েছে গোটাটা।

ভালোমন্দ

প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে দেখতে বৃদ্ধ হয়ে যায়। তারপর মৃত্যুবরণ করে। আবার কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে দেখতে চুল-দাড়ি সাদা করে ফেললেও বৃদ্ধ হয় না। আপনি এই দু-ধরনের মধ্যে কেউ একজন হবেন। আপনার চুল পাকেনি। দাড়িতে গজায়নি মেঘ। কিন্তু আপনার রক্তের মধ্যে বসেছে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, রক্ত দেবেন কি, দেবেন না… আপনার মন চায় মানুষের জন্য কাঁদতে, আপনার প্রাণ চায়— রক্ত বেচে আপনি স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখবেন…
এভাবেই একদিন কবরের সামনে দাঁড়াবেন… কবর থেকে উঠে আসা আরেকটি স্বপ্ন দেখা মানুষ আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে… তার সঙ্গে গল্প করতে মন্দ লাগবে না…

লম্ফ

একবারই ঝড়ে তছনছ হয়েছি। একবারই। কতবার চেয়েছি— এবার উঠে দাঁড়াব। ঘুরে দাঁড়াব। মাঝে মাঝে এমন ঝড় আসে, মনে হয়— ঘুরে না দাঁড়ানোই ভালো। এই ঝড় আগলে রাখি। ভেঙে যাওয়া শিকড় থেকে ছোটো ছোটো ডালপালা গজাক। তবুও আঁচড় থাকুক। থাকুক এই অন্ধকার। পুরোনো স্থাপত্যের মতো ধ্বংসাবশেষ নিয়ে। লোকে ভিড় করুক। দেখুক— ঝড় আসলে ঝঞ্ঝাট নয়। ঝড় হল স্মৃতিমহল। ঝড় হল হারিয়ে যাওয়া মানুষের ফেলা যাওয়া পুরোনো লম্ফ…

আহ্বান

তুমি নেই অথবা তুমি আছ— এই বিশ্বাসের মধ্যে একটি গাছ বড়ো হয়ে ওঠে, মুনাই। বৃক্ষরোপণের সময় হাতে দেওয়া হয়েছিল একটি কুঠার। নিজ গলা কেটেছি, হাত কেটেছি, পা কেটেছি… গাছকে বলেছি: বড়ো হও, বড়ো হও। পাখি এসে বসবে ডালে। তার ঠোঁটে চুমু খাব।
গাছ কই? একটা আসবাব হয়ে ওঠা তক্তা নিজেকে সাজাতে পারবে সেই আনন্দে বীজের কাছে মিছে গর্ভ চাইছে। ফুলের কাছে কে আত্মহত্যা করবে? ফলের পাকা ত্বকে চুইয়ে পড়ছে সময়। ডালে ডালে পাতায় পাতায় শোনো কি সেই আহ্বান?

হাওয়া

রুটির দোকান থেকে ফিরে এসে দেখি— খাবারে, মাছিদের বমি! দ্রুত হাওয়া করি। মাছি কই? মাছি কই? হাওয়া লাগে নিজ গায়ে৷ বমির গন্ধ নেই। নিজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে। খিদে আর পায় না। খালি রুটির দোকানের মেয়েটিকে মনে পড়ে… তার খাবারেও মাছি ছিল… তার খাবারেও হয়ত বমি ছিল… তবে হাওয়া করার কিচ্ছু ছিল না…

Categories
2021-Utsob-Poem

কুণাল বিশ্বাস

ঘুম

জলাশয় খুব ভালো, সকলের যোগাযোগ আছে
সহজে নিজের মুখ দেখে ফেলা যায়
মাছেদের খেলা ছাড়া পাতায় হলুদ এই ঘাট
গভীর গোপন হাওয়া ফাঁকতালে আসে
সমস্ত কেবলই ছবি— জল কমবেশি

শীতের সকালে চেনা দায়
মনে হয় শাদা ভূত শুয়েছিল সারারাত একা
এখনও কাটেনি তার ঘোর

আমিন

নীলগাই ছুটে আসে ঘরে
পিছু পিছু সব পোকা, জরিপের বন
আকাশের ভুল ধরে পাখিরা বিমুখ

মেঘ বিচারক…

ঢালো মদ… লেখো আমবাড়ি ফালাকাটা
টীকা লিখে যাও

খারিফ শস্য

আকাশের নীচে শুধু হাহুতাশ জারি
দুপুর অচল মনে হয়
কলতলা মেঝে
বাসনগুলি ধ্বনিপ্রবণ
গাছেরা গুটিয়ে আছে ভয়ে

বিবাদ এখন ভালো নয়
এই কথা বলে গেল পাখি

শিয়রে শ্রাবণ…

মাটি ও মেঘের কত যোগাযোগ রেখা
ভেঙে পড়ে বোরো ধান চাষের উপর

স্বপ্ন

সেই যে সেবার ঘন পুকুরের মেঘ
মহিষেরা ঘাড় গুঁজে জলে
মাঠের ছাউনি আর ঘাস কিছু দূর
বনপাউরুটি খেয়ে তোমাদের ঘুম ভেঙে গেল

অন্তিম

চোরাশিকারির বেশে রাত ঢুকে পড়ে
ভয়ে থম গাছের শাবক
ঘুরপথে বহুদূর হয়ে এখন পড়েছে মনে
তারাদের কথা

দেশের খবর শুনি ঠায়— দেশ মানে মহাকাল
সুদূর ফরিদকাঠি, পরগনা জেলা
দেওয়ালে গণেশ ঝোলা অনিতার রুটির দোকান
মাঝখানে পঞ্চায়েত বসে
ফেরে শীতকাল, রাঙা ডালিয়ার বন
পাখির ওড়ার পথ নীল

দেখি চাঁদ খুন করে ভোর
বড়ো হয় মেদিয়ায় আনাজের খেতে

Categories
2021-Utsob-Poem

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

ডাক

দু-হাতে আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তোমার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে
অনেক দূরের কোনো বালিকার পড়ার টেবিলে।
রোগা বসতির মধ্যে যেখান দিয়ে চলে গেছে
একখানা একহারা স্টেশন—
চা-ওয়ালা ডেকে যাচ্ছে,
ঝালমুড়ির মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে নারকোলের প্রেম,
সাইকেল-কিশোরদু-টি অপেক্ষা করছে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার।
যে-কোনো দিকেই ট্রেন চলে যেতে পারে এক্ষুনি।
বালিকাটি মন দিয়ে এসবের মধ্যে দিয়ে লিখে যাচ্ছে
অজস্র অক্ষর, শব্দ, পিছুডাক।
স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেন অথবা আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তুমি
সেই ডাক শুনতে পাচ্ছ না।

আজকের বিশেষ বিশেষ

ঝরে পড়া সংক্রান্ত সমস্ত শব্দবন্ধরা
মেঘেদের মন ভেঙে দিয়ে সাদাকালো খবর হয়ে যাচ্ছে।
খবর হয়ে যাচ্ছিস তুই, আমি, আমরা আর
দুপুরজানলার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা ফোঁটাদের কাটাকুটি খেলা।
যে-কোনো খেলাই তো শেষ হয়ে গেলে,
কাগজে— মগজে— শুধু ফলাফল হয়ে থেকে যায়।
রেফারির হুইস্‌ল থেকে শুরু করে ব্যাকপাস, ভলি থেকে ড্রিব্‌ল;
সমস্ত ঝাপসা রোমান্সের মতো ফোকাসের পিছনে মিলায়—
সেমিকোলনের মতো, স্তব্ধতা নেমে আসে রিমঝিম— মাঠের উপর।
বৃদ্ধ গ্রাউন্ড্‌সম্যান শিরা ওঠা হাত নিয়ে ঘাসের তবিয়ত দেখে রাখে,
আগামী খেলার কথা ভেবে।

অতিমারির গল্প

এখন তোমাদের মুখর কবিতাসন্ধ্যাগুলি ভেঙে যাচ্ছে বাইনারি ব্যথায়, কাগজ থেকে অক্ষর চুইয়ে পড়ছে দ্বিধাহীন এল.ই.ডি-র ঠোঁটে। বছরের পর বছর আলো ঝলমল করতে করতে ক্লান্ত ম্যয়খানাজুড়ে পড়ে আছে অনির্দিষ্ট ছুটির খেদ, থরে থরে সাজানো অব্যবহৃত তরল মৌতাত আর অজস্র বঙ্কিম সখ্য সম্ভাবনাগুলি; যেগুলি সপ্তাহান্তের পর আর রাস্তা পেরোতে পারেনি। ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাতগুলি যারা উল্লাস করেছিল, অফিসে অফিসে উদ্বিগ্ন মক্ষীসকল একাধিক চোখ জ্বেলে সন্দিহান ইতিউতি নজর ফিরিয়ে নিচ্ছে। ছোঁয়াছুয়ি খেলাগুলি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছে নিরুপায়, আর সাইকেল চালিয়ে যে-কিশোরটি বারান্দায় একটি শ্যামল মুখ খুঁজে খুঁজে চলে যাচ্ছে একা ওকে তুমি রক্ষা কোরো ঠাকুর, ওদের বহুদিন কোনো স্কুলপালানো নেই আপাতত।

ব্যবধান

এই এত গুমোট দিনলিপি
পড়ানো গেল না বলে
ইদানীং দুঃখ হয় না।
অথচ দুঃখ হয় দোয়াতের, কালি-কলমের –
কলসির ভেতরে যেমন কিশোরী জিয়ল মাছ
অবিরাম ছটফট করে—
ঢাকা খুলে দিলে তার সামান্য-জীবন বেড়ে যায়।
আরও কী অজস্র স্তো‌‍‌কে ডোবানো বয়স আছে;
এ-হেন জীবন নিয়ে কোথা থুই কোথা রাখি
মাথায় আসে না।
অকথ্য সমস্ত ওই মেলামেশা-লিপি খুলে দেখি
স্পর্শ পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যাবার আগে
সামান্য নখ রয়ে গেছে।

কথা ও কাহিনি

ঘেন্না আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে ড্রিব্‌ল করতে করতে
ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটি,
ওকে চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
ওর লাল রিব্‌ন তিন দশক পার করতে করতে এখন লাল পাড়,
সৈন্ধব লবণ আর কামরাঙা-দুপুরকে পেছনে ফেলে
সে একদিন হাঁটা লাগিয়েছিল হাইওয়ে ধরে।
হুহু ছুটে যাওয়া দৈত্য ট্রলারে ওর উড়তে থাকা ওড়নাসৌষ্ঠব
ছুলে গিয়ে রক্তপাত হয়েছিল বহুদিন,
বহুদিন রজঃস্বলা অবস্থায় ওর ব্যথার ভেতরে
গরম সীসার মতো প্রেম ঢেলে দিয়েছিল দোসর।
সঘন শ্রাবণে চুল এলো করে উইপিং উইলোর নীচে
দেহ মেলে ধরেছিল সে আদ্যন্ত বিস্বাদ ধুয়ে নিতে।
অথচ তার খাতার ভাঁজে অক্ষরজ্ঞান ছিল কবিতাপ্রতিম,
অথচ দু-চোখ তুলে চাইতে পারলে দেখতে পেত
গুটোনো ডানা মেলার মতো বিস্তর আকাশ আছে দিগন্তপ্রমাণ,
পুরোনো চিঠির মধ্যে এখনও ধক্‌ ধক্‌ করছে একখানা টাটকা হৃদয়।
সেখান থেকে এতদূর ঘেন্না, তাচ্ছিল্য আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে
ড্রিব্‌ল করতে করতে ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি,
ওকে তুমি চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

Categories
2021-Utsob-Poem

রুহুল মাহফুজ জয়

গন্দমোদ্যান


বিলাই ভালো। বিলাইয়ের কামড় আরও ভালো। তারও চেয়ে ভালো বৃক্ষজীবন। ধীরে, অতি ধীরে, চুমুকে চুমুকে শিকড়-ডালপালাসমেত তৃষিতযাপন। বৃক্ষের ধী, বিড়ালের অস্থিরতা নিয়া নিম্ফেট ছোট্ট গর্তে ফুটছে অন্ধকার। অই ব্ল্যাকহোলে ঢুকে প্রথম আবিষ্কার। প্রিয়তমা নারীই যুদ্ধবিমান। বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে অচেনা বারান্দায় বাতাসশোষিত পেটিকোটের ভিতরে হারায়ে গিয়ে যুদ্ধের অই রেতঃপাতে আমি কী করে এলাম!


মনে হল, অন্যমনস্ক হাঁটতে-হাঁটতে একটা বেহেশতে পড়ে গেলাম। যদিও, বেহেশত একটা ধারণামাত্র। যে-ধারণার ভিতরে একটা প্রশান্ত নদী বেয়ে কাগজের নৌকা বয়ে যায়। নৌকার ভিতরে নাকফুলসজ্জিত বউ। ঘোমটা সরায়ে যে ইতিউতি তাকায়। আর পানির গুঞ্জন ছাড়া তাকে অন্য কিছুই বিষাদগ্রস্ত করে না।


অই যে, একদল লোক প্রাচীন সংগীতের স্বরলিপির ভঙ্গিমায় হেঁটে যায়। হাটুরে। নিজেরাই গপ্পের চরিত্র— তাদেরও একটা পিঁপড়াজীবন আছে। মাথায় সদাইয়ের ঝুঁড়িটা লন্ঠনছায়ায় ফারাও সম্রাটদের মুকুটের মতন দেখায়। হতে পারে, ওরাই তুতেনখামেন। মমির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে আজ সবজির কারবারি। আর অই যে, স্কুলে কান ধরে খাড়ায়ে থাকা ছেলেটা, যার মনোযোগের নিচেই ওড়ে যত উড়োজাহাজ— পাখিদের বিদ্যালয়ে ওর নামে রোলকল হয়। অই যে, মেয়েটা, সেলাইয়ে কারো নাম লিখতে গিয়ে সুইয়ে ফুটা করেছে আঙুল— ওর অন্যমনস্ক হাসির ভিতরে একটা জানালা ক্রমশ নদী পাড় হয়ে পাহাড়ের দিকে ঘন-অরণ্যে বেঁকে যাচ্ছে। কোনো একদিন ও-ই রূপকথার কাজলরেখা ছিল।


পায়ে যেন মোজা নয়— শৈশবের শালবন এঁটে ঘুমাতে যাই। ঘনছায়া, তেজ খুলে ঘাপটি মেরে বসো। লুকানো মুখের দীর্ঘ শরম তোমার সূর্য হয়। আমার পায়ের মোজায় রাত নেমে এসেছে। দ্যাখো। নিরাকারের মতন পাতাগুলা পতনোন্মুখ। পচনশীল। কে লিখবে সেই অ-প্রশ্রয় অশ্রুর গান?


খননের এই যে বিদীর্ণ চিৎকার— তার ভিতরে অঘোরে তবলা বাজাচ্ছে নীলজ এক লোক। মনমালী রয়ে গেছে ধাঁধা। পাতাসকল হলুদ হয়ে এলো। বুঝি, আবার বাতাসের ঘূর্ণনে আমাদের দেখা হবে। দেখা মানেই বিদায়— অথচ তোমার পায়ের শব্দে তা লেখা নাই।


একটা শিউলি ঝরে গ্যালো জীবনের কিনার ঘেঁষে— কোনো ফুলই ফুটল না আর।


কোথাও আমার আয়ু লাফাচ্ছিল খরগোশের মেজবানে। আর তুমি কেমন দূর্বাদলে বসে গুনছিলা খসে যাওয়া শীতের লোম। আর ভাবছিলা, প্রেমিকটা পুরুষ রয়ে গিয়ে কবি-বনে ফেলে গ্যাছে শব্দের যৌনজীবন। আর আমার আত্মা তোমার আয়ুর ভিতরে পলক ফেলছে— তুমি জন্মের মতন পুরানা সত্য হয়ে যাও।


সুন্দরী। মহিলা অন্যের বউ। মেয়েটা প্রেমিকা। আরেকজনের। উভয়ে উভচর। জাহাজডুবির পর নাভির দিকে তাকায়ে আছে, যেন দ্বীপ। সাঁতরাও, ক্যাপ্টেন!


শাড়ি। পরনে নতুন। কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘোরের ঘুমে রয়। পরনে শাড়ি। নতুন। টুপটাপ। কাদা। পানিভরতি রাস্তা। রাস্তাভরতি নাগরিক অম্বল। কাদা লাগবে, ভিজবে শাড়ি। খিদা-ভয় নিয়া কুহু ঘুমায়ে রয়। পরনে নতুন, জারুলশাড়ি। নৌকা আঁকা— মাছেরা দেখিছে সাঁতার। তারও পরেও, কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘরের ঘুমে রয়।

১০
কারে যেন ডাকছিলাম। কে যেন ডাক দিছিল আমারে। অপরিচয়ের এই ডাক প্যাঁচার দোসর। কেউ না জানি, ভৌতিক সেই শিহরণরিপু কোথা হতে আসে। এমন ডাক ডাকিলাম— কথার জন্ম না হতেই ভাষা মরে যায়। এই ডাক হতে পারত ছবির সামনে দাঁড়ানো আর্ট না বোঝা মুগ্ধ চোখ, সূরার অর্থ না জেনে কুরান মুখস্থ করা হাফেজের দৃঢ় স্বর, কিংবা অন্ধের অনুভূতি— যার স্পর্শের ধ্বনিময়তার নিকটে সকল ভাষা মিছা হয়ে যায়, আঙুলের চোখ দিয়ে যে দ্যাখে গন্দমোদ্যান।

Categories
2021-Utsob-Poem

সুজয় ঘোষ

কফিহাউসের প্রকাণ্ড ঘুলঘুলিগুলো খুব অবাক করত। মনে হত, দূরে কোথাও ঝাউবন। ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে রোদ। ওখান থেকে দেখলে দেখবে আমরাও প্রকাণ্ড। তাঁরই মতো। মাটির কতগুলি মূর্তি। বনের প্রান্তে। একলা মন্দিরে। কান পেতে শুনি। কবিতার শব্দ। ওংকার। প্রসূতি। প্রসূন। হামাগুড়ি দিতে, উঠে দাঁড়াতে, মায়ের হাত দরকার, ঈশ্বরের হাত ছেড়ে। কবি উঠে দাঁড়ায়। বলি, তারপর! বলে, আরেকদিন হবে। আজ সন্ধ্যের আগে ঘরে না ফিরলে ফিনিশ! কী? আলো। মোমবাতি! লাইট!… এইভাবে গ্যেতেও চেয়েছিলেন, নাকি, মরার সময়… বড্ড লাউড! কফিহাউস তো! না, এই চিৎকার। কোথায় নেই! কবিতায়… শুনলেন না, টেবিলের নীচে বেড়াল বসে নিঃশব্দ! নাহ্‌, উঠি… ভালো লাগল, আপনার সাথে… আলাপ… প্রথম দিন তো। দ্বিতীয় দিন এলে লাগবে। লাগবেই বলছেন! আচ্ছা চলি… শোনালেন না তো! কী? কবিতা— বসে লিখছিলেন এখানে— আচ্ছা রাখুন… নতুন কবিতা!… উঁহু-হু— খুলবেন না— আমি যাই আগে… কবি ঘুলঘুলি দিয়ে চলে গেলেন। ঝাউবন মিলিয়ে গেল। আকাশের গায়ে এখন চিকচিকে জল। চিরকুট খুলে দেখি তাতে লেখা: কফির দামটা দিয়ে দেবেন, ধন্যবাদ!

একটা দুটো করে গাছ পুঁতে যায় অনেকে। ভিয়েতনামের গলিতে ধরে না। প্রেসিডেন্সির ছাদ থেকে দেখা যায়। স্থানাঙ্ক নির্মাণ। খালি হাতে আসে কবি হয়ে ফিরে যায়। ঝোলাব্যাগ চশমা কিনবে মায়ের কাছে বায়নায়। বাবার ছবি দেখিয়ে বলে, ঝুল ঝাড়েনি বাদল সরকার কটা পথনাটিকার পর! এবং ইন্দ্রজিৎ সময় করে পড়লে। বাবার চশমাটা হারিয়ে ফেলে! নাকি পকেটে করে পটলডাঙায় খুঁজতে যায় নকশাল স্পট। মেসের মাছের ঝোলের মতো দেয়ালে লেগে। ছিটকে গোপাল মল্লিক লেনে ঢুকল আলোবাবু। ধুতি হাঁটুতে তোলা, হাতে আঁকশি। অন্ধকারে সুইচ খোঁজে। খুঁটিতে গাঁথা পরপর কবিতার অন্ধকার। আলোবাবু আলো জ্বেলে দেয়। বিড়ির আলোয় দেখে একটা ঝাঁকড়া মাথা ছুটে পালাচ্ছে। একটা চারাগাছ, কয়েকটা পাতা। ঝিরঝিরে হাওয়া। আর জলপাই রঙের মুখ। প্রতিদিন লুকিয়ে চাঁদের জন্ম দেখে কবিতা লিখবে বলে। ইউনিভার্সিটির ছাদে কিংবা হাড়কাটার আকাশে।

কলেজ স্ট্রিটকে কলকাতা নাকছাবির মতো পরে থাকে। তার বিউটিগ্রাফ। কখনো কমে কখনো বাড়ে। কখনো লোক ডাকে কখনো ভড়কায় কখনো বিনা মৈথুনে কবজা করে কায়দায়। আঁচলে বেঁধে ফেলে। উঠতে বলে ওঠায় বসতে বলে বসায়। প্রয়োজনে দাড়ি সরিয়ে আঁচিল খুঁটে দেখে রক্তমাংসের মানুষ কিনা। গা শুঁকে বুঝে ফেলে জেলা: পশ্চিম দিনাজপুর, দুপুরে খায়নি, লোকসংস্কৃতি বইটার লেখককপি বেচেও গাড়িভাড়া ওঠেনি। অতএব রাত কাটানোর তদ্বির করতে যায় পুস্তনি রাখার গোডাউনের গলিতে। গাড়ির ভিড়ে ঢুকতে পায় না। পাঁচ টাকার মুড়ি একটা ফুলুরি কিনে কাজললঙ্কা চেয়ে তেলেভাজা দোকানির খিস্তি খায়। লঙ্কায় কামড় বসিয়ে সম্ভোগসুখ না পেয়ে ভেবে নিজের যৌনঅক্ষমতার ভূত দেখে মহাবোধির ছাদে একঝাঁক পায়রা উড়ে গেল। বেজে উঠল, ‘বুদ্ধং শরণং…’। আকাশে আলো ছড়িয়েছে। সন্ধ্যার বিউটি নামছে কলেজ স্কোয়ারের কালো জলে পা ডুবিয়ে।

পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করে অনেক দোকানিই করে খায়। বইয়ের দোকানদারও। এমনকী পাশের মিষ্টির দোকান মৌচাক কোথায় জানতে চাইলে, ও-ই তো পুঁটিরামের পরেই বললে লোকটি বুঝে চলে যায়। এই লাইনে পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করতে পারে এমন দোকান হয়নি। হত, বাঘা এক দু-জন প্রকাশক দোকান দিলে। কিন্তু এ-লাইনের দুর্ভাগ্য: অধিকাংশ নামি বইয়ের দোকান কলেজ স্কোয়ার টপকে। এ-লাইনে ছোটখাটো কয়েকটি প্রকাশনীর বিপণি। একসময় তো তাও ছিল না। আসলে বাঙলার সংস্কৃতি রোদ বাঁচিয়ে চলতে ভালোবাসত বোধহয়। এ-লাইনে বেলা অবধি রোদ থাকে। বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে দোকানে জল ঢুকে যায়। তাও নতুন কিছু গাছ গজিয়েছে। তারা রোদ-জল-ঝড়ে সমান লড়ে। তাদের মধ্যে হয়ে-ওঠা একটা ঝাঁকাল বটগাছ কে পুঁটিরাম কবে ল্যান্ডমার্ক করে দেখার।

ভাগাড়ে নতুন কী মড়া পড়ল যেমন আকাশে চক্কর দিতে দিতে চিল শুঁকে চলে যায়, তেমন কিছু লোক বই শুঁকতে আসে। তারা খরিদ্দার নয়, প্রকাশক নয়, সেলার নয়, লেখক। হয়তো পাঞ্জাবির বুকপকেটের কোণটা ছেঁড়া, কলমটা ঝুলতে ঝুলতেও আটকে আছে, পড়ছে না; কালি লিক করে বুকের কাছটা কালিময়। দাঁত দিয়ে মুড়ির ছিবড়ে খুঁটতে খুঁটতে ঘোলাটে চোখে বইয়ের মলাট উলটে দামটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দেয়। পাশের পেয়ারায়ালার কাছে পাঁচ টাকা দরের পেয়ারা কেনে। পেয়ারার বিচি দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যাওয়ার ভয়ে গায়ের সবুজ মাংসটুকু খেয়ে বাকিটা কলেজ স্ট্রিটের পায়রাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কলেজ স্কোয়ারে হাওয়া খেতে ঢোকে। রোদ থাকলে ডান দিকটায় বৃষ্টিতে বাম দিকে। অনেকসময় সন্ধ্যা-আরতি দেখে বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাশে মন্দিরটায় কীর্তনের দলে ভিড়ে যায়। হেয়ারের সমাধির কাছটায় প্রেমিকপ্রেমিকা থাকে বলে যায় না। প্রেম দেখলে লেখকের অসুখ করে।

Categories
2021-Utsob-Poem

বেবী সাউ

চাও করুণানয়নে


অন্ধকার তোমাকে কাঁদায়?
তার দিকে মুখ করে বসে আছ, বিষাদের ধ্বনি!

তোমার প্রেমিকা রাধা, উজ্জ্বলতা বেশি
চোখের সাগরে ঝাঁপ দিই,
বার বার মরি

তীক্ষ্ণ ট্রেন আসে… কাঁপো…
খান খান ভেঙে পড়ে
হৃদয় তোমার

অন্ধকার উড়ে যায়…
যেতে যেতে অভিশাপ ছুড়ে দিয়ে বলে,

আলোতে অধিক জ্বালা
যাও, ভোগ করো…


চুপ করে বসে থাকো, আলো বিপরীতে…

হাওয়া-বাতাসের শব্দ ভাসে
তাকে লেখো

শূন্যতার সুর নিয়ে হেঁটে যায় নিশাচরী সেই
ধরে রাখো তাকে, প্রেমোদক

কেউ তো তোমার নয়
তুমিও কারো না এ-যাবৎকাল

নূপুরের ধ্বনি বাজে শুধু
শুধু বলে, আছি… আছি…

বাঁশিটি আড়াল হল শ্যাম
কুঞ্জবন ভাঙা পড়ে থাক…


প্রার্থনার মন্ত্র দিয়ে তাকে বেঁধে রাখো। বোঝে সেও?

সে কি মায়ার অধিক ছায়া, গান, শব্দ!
সে কি যাতনার কাল ছুঁয়ে বার বার কাঁদায় তোমায়!

বাসনার ঘরে এনে তাকেই বসাই
দু-হাতে জড়িয়ে দিই এয়োতির সাজ, ধানদুর্বো…

দিন কেটে যায়… ফিকে হয় মন, দেহ…

প্রেম, অভিযোগ শেষ হলে
গলা তুলে বলি, ‘সর্বনাশ, তুই মর মুখপুড়ি…!’


যা কিছু জমানো আমার, সঞ্চিত মায়া
দেহ দিই, স্নেহ দিই, দিই তাকে অধিক যাতনা

ধীরে ধীরে তার কাছে নিজেকে বসাই… ভাবি…
বিচ্ছেদ প্রবল জেনে লিখে রাখি পদাবলী, শ্লোক

দেখেও দেখে না কিছু
উপেক্ষায় রাত কেটে যায়…

সমস্ত শহর জানে নদীটির গায়ে কাল
ভেসে যাবে উলঙ্গিনী বধূ…


আকাঙ্ক্ষার হাড়গোড় নিয়ে বসে আছি, একা

পালিত যাপন এই, লোভানীয় হয়ে ওঠে আরও

ঝিঁঝি ডাকে
নিঝুম ডালের ফাঁকে দেখা দেয় রহস্যের চাঁদ

কেউ নেই
কেউ নেই

ধ্বনি নেই শব্দ নেই
অক্ষরের কাচ ভেঙে চলে গেছে নিঝুম শূন্যতা

পাশ ফিরে শুই
ভয়ে ভয়ে ডাক দিই… ‘আছ… জেগে আছ…!’

বাঁশি বেজে ওঠে…


কত রক্ত ক্ষয়ে গেল, প্রিয়,
কত মন ভেঙে ছারখার…

পাওয়ার নেশাই তবু বার বার বাঁচিয়ে তুলেছে…
আর্তনাদে ভরে গেছে শস্যের শরীর…

এ-ভাদর আসলে পোড়া…
এই দেহে ফসলের মায়া নেই কোনো

তাহাকেই কৃষিকাজ ভেবে
এ-জন্ম জাতিস্মর হল…


নিজেকেই খুঁড়ি

নিজের শরীরে খুঁজি ক্ষিতি, তেজ, বায়ু…

আকাশ এখানে মেশে
জল বয়ে যায়…

প্রতিটি ধ্বনির মাঝে তুমিও নিপুণ
সাবধানে রেখে দাও, ক্ষত, রক্তপাত

খুঁড়ি আর খুঁড়ি
আমার আহত দেহে তুমি জন্ম নাও…


গৈরিক বসনে সাজাই, আলুলায়িত কেশরাশি
জটা পড়ে…

পাগলিনী বেশ এই… কঠিন, কঠোর
শহরের পথে পথে ভেসে যায় পূর্ণতার ধ্বনি
গাছ কাঁদে, মাটি কাঁদে; আকাশের পাখি…

সাধনায় ভরে যায় নীপবীথি বন
নীলের আঁচল ওড়ে, শূন্য চারিদিক

পাথুরে শহর গলে, জল হয়ে যায়

মীরার ভজনগীত তোমাকেও জ্বালায়, পোড়ায়…


তোমাকে জীবন মানি
তোমাকে মরণ

আলেয়ার দিকে ছুটে ছুটে মরি
সরণের পথ নেই কোনো
ভাব নেই

ছেঁড়া বসনের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছি যে-কবিতা
কীর্তনের সুর দিই
বাঁশি দিই

মাদলের রব ঘন হলে
অভিসার, মৃদু ইশারায় চোখ মারে…
ডাকো?

১০
যে-পথ তোমাকে চায়, তার পরে কাত হয়ে শুয়ে থাকি আমি

পদধ্বনি বাজে

প্রতিটি ধুলোয় গায় বেজে ওঠে রাধা রাধা রব

নীচু মুখ, অভিমানী
সে-সব ধুলোর গায়, ধীরে ধীরে লিখি ‘অশ্রুপাত… তাহাকে কাঁদাও…’

Categories
2021-Utsob-Poem

রণজিৎ অধিকারী

সময়

সময়ের অস্তিত্ব নেই না?
দীর্ঘ নীরবতার পর সময় আড়মোড়া ভাঙে আর বৃষ্টিপাতের শব্দ এসে তোমার জানালায় ধাক্কা দেয়।
তুমি তো জানোই না, এই এখানে আসার পর, তুমি
ঠিক কোনখানটায় আছ, দেখানোর ভঙ্গিতে
তোমার আঙুল বের করে হাওয়ায় ঘুরিয়ে আবার অন্যমনস্কভাবে মুড়ে রাখো মুঠোয়।

লিফ্‌টের শব্দ, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে কিছু,
যেন সময়ের বিপরীতে নীচের রাস্তায় অত গাড়ির
জট পড়েছে,— কোথায় যাবে ওরা?
যা-ই দেখ তুমি জানালা দিয়েই দেখ, তোমার জন্য ছাঁচে কাটা জানালা, তুমি এখানে আসার অনেক আগে বানানো — মাঝে মাঝে তুমি ক্ষেপে ওঠো
এই ভেবে,
যেন কোনো কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই!

তবু শেষমেষ যা পাও— একটা পাতার খসে পড়া,
সমুদ্র থেকে পাঠানো একটা জাহাজের ডাক, কিংবা কোথাও ভারী কিছু ঘষটানোর শব্দে… তোমার
মনে হয়, এই সবই সময়ের খুব বাজে অনুবাদ!

বিছানা

দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, যেন সবার অলক্ষ্যে
সেখানে একটা বিছানা পাতা, তারা প্রায়ই এসে
গড়াগড়ি খায় আর যখন তারা একে-অন্যের শরীরে
ঢুকে পড়ে তখনই বিশাল ঢেউগুলো এসে ঢেকে দেয়
তাদের সংগমস্থানটাকে।
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, সেখানে
মাঝে মাঝেই এক-একটা জাহাজ তলিয়ে যায়,
হয়তো নাবিক আবিষ্কার করে ফেলেছিল সেই বিছানা,
কিংবা উথাল-পাথাল সেই সংগমদৃশ্য!

সেইসব জাহাজের আর্তচিৎকার অত জলের তলায়
চাপা পড়ে আছে বহুকাল ধরে;
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে সেখানের আকাশে
ভারী ভারী মেঘগুলো এখনও দানবের মতো ঘুরে বেড়ায় আর গর্জন করে
কেবল সমুদ্রের শীৎকারধ্বনিকে চাপা দেওয়ার জন্য।

একটি সকাল

কিছুদিন রোগভোগ করে সকালের নরম রোদের সামনে এসে দুর্বল দাঁড়িয়ে বলি— ধন্যবাদ। যেন ফিরে এলাম আর সারা জগৎ দুশ্চিন্তা করেছে খুব
এ-ক-দিন, যেন আমি-হীন জগৎ সহ্য হবে না কারুর,

যেন কী কাঁপতে কাঁপতে এসে দুর্বলভাবে থেমে গেল
এবারের মতো…

এখন এই সপ্তাহপরের ভালোবাসার রোদ
পায়ের ওপর এবং আমি বলি— ধন্যবাদ।

আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো শ্রাবণের চিহ্ন বহন করছে না, জুলাইয়েরও না বরং ওরা এখন আমার
ভালো লাগার চিহ্ন গায়ে মেখে আছে। এবং
ওই সাদা শরীরের ইউক্যালিপটাস— যার মাথা থেকে
অনেকটা পৃথিবী দেখা যায়— ও আমাকে জানাল,
অনেক দূর দিয়ে চাকাগুলো খুব ধীরে আবার
গড়াতে শুরু করেছে…

আমি তক্ষুনি ওকে আর সেই দূর চাকাগুলোকে
ধন্যবাদ দিই

নির্ণয়

শেষে এমন হয় যে,
তুমি তিনটে দিন কোনোমতে পার করে দিতে চাইলে,
কিন্তু দুটো দিন পরই আটকে গেল,
একটা দিন দিগন্তের অনড় মেঘটার মতোই
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বুকের বাঁ-দিকে, কখনো

গলার একটু নীচে।
আসলে সবসময়ই জরুরি হল,
নিজের অবস্থানটাকে নির্ণয় করতে পারা।
তুমি কোথায় আর কখন সেটা ঘটছে।

যখনই খুঁজলে যেন দেখতে পাও, তুমি
এই বিশ্বের মাঝখানে, তোমাকেই ঘিরে এই
পাহাড় আর সমুদ্র, শব্দ আর নৈঃশব্দ্য,
তাপপ্রবাহ আর তুষারপাত…!

কিন্তু একদিন ঘড়ির কাঁটা কোনো একটা দিক
ইঙ্গিত করে থেমে যায়, তোমার গা থেকে রোদ
মুছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুমি হয়তো টেরই পেলে না,
ওই ঘষটানো দাগটাই তোমার সীমা, হয়তো

উঁচু ওই পাহাড়ের ওপাশে আটকে পড়েছে
তোমার দিনগুলো, বরফে চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে
এবং তুমি এই বিশ্বের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন…

Categories
2021-Utsob-Poem

সেলিম মল্লিক

তোমার মানিব্যাগ খুলে

আমার পড়ার টেবিলে লাল রঙের পার্স ফেলে গেছ, তার ভেতর থেকে
কয়েকটি কাগজি মুদ্রা বার হয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে
বাইরে উড়ে গেল— বুঝলাম, তোমার সঙ্গে
টাকাপয়সার সম্পর্ক নয় আমার। ঘুমের সময়
তোমার ঠোঁটের বর্ণনাতীত গাঢ়তার দিকে
তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না, ভাবছিলাম
দুপুর গড়িয়ে গেছে, ঘুম ভাঙিয়ে
তোমাকে আরও রঙিন ফল খেতে দেব।

আর এখন, তোমার মানিব্যাগ খুলে
আনমনে খেয়ে ফেলেছি ঘন খয়েরি লিপস্টিকের শাঁস।

তারার চেয়ে দূরে

হোম কোয়ারান্টিনের সন্ধ্যে বেলা শিশি খুলে
তোমার নেলপালিশের গন্ধ শুঁকছি, এইরকম
তাজা গন্ধের হালকা পিঙ্ক গোলাপ-ফোটা সময়ে
তোমাকে হাওয়াদের সহচরী মনে হয়, যে কিনা
আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের কাছে এসে
খুব ঠান্ডা অতি সূক্ষ্ম পালক দিয়ে নাকের ডগা স্পর্শ করে।
আজ আমি পাকা ফল ভেবে
তোমার লিপস্টিকের মাংস খেয়ে ফেলেছি।

আবার জ্বর আসছে, চোখের পাতা ভরে
ঈষৎ উষ্ণ জল ছলছল করে।

পাশের ঘর তারার চেয়েও দূরে, তুমি
অনেক কিছু অনুমান করতে করতে
নিজের জন্য বিছানা প্রস্তুত করছ, নীল প্রেক্ষাপটে
পড়ে রয়েছে একটি অপ্রতিভ সাদা বালিশ।

একটা গ্রাম আছে

ধোঁয়া দিয়ে তৈরি অনেকগুলো পাহাড় পেরিয়ে
আমাদের একটা গ্রাম আছে— কোনোদিন
যাইনি, কেবল যাওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করি।
গোটা কয়েক গান তুলে রেখেছি, ওখানে গিয়ে
গাইব আর নীল জলে ভাসাব লাল ফুল।
নিশ্চয় বিসংবাদ হবে না, যা বহুবার
আমাদের কথোপকথনের ভেতরে ঘটে যেতে দেখেছি— গাঁয়ের লোকেরা
পোশাক ছাড়াই এগিয়ে আসছে আমাদের দেখে এবং
তাদের সঙ্গে আমরাও ন্যাংটো হয়ে চাঁদ লুটিয়ে পড়া
শস্যখেতের দিকে দৌড়ে চলেছি, পেছনে পেছনে
নিরীহ পশুরা ছুটছে উৎফুল্ল জ্যোৎস্না।

দেশের কথা

ঘুমের আগে আমার হাত
স্বাধীনভাবে ছুঁয়ে আছে তোমাকে, কিন্তু তোমার নিশ্বাস
নিরুত্তাপ ঠাকুমার গল্পের মতো— নিদ্রাকালেও
রাষ্ট্রহীন মানুষেরা মুঠো শক্ত করে ধরে রাখে! যদিও
অনেক আগেই তাদের খোয়াতে হয়েছে
ফুল-ফোটা রুমাল, কাকচক্ষু আয়না, পূর্বপুরুষের সইসাবুদ,
নাম-লেখা তৈজসপত্র, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের শিস।
শুঁড়-তোলা হাতির নকশা-করা কাঠের বাক্সটা
আমরা কোথায় রেখেছি? ওর মধ্যেই তো রয়েছে
কালো পোকা সাদা ফুলের অসংখ্য দাগযুক্ত আমাদের যৌবনের চিরকুট।