Categories
2021-Utsob-Krorpotro

গৌতম সরকার

আইচুরা দে…

অন গোঁসাইকে বললাম, “গোঁসাই তোমরা তো আইচুরা জানেন? কেমন ছিল— কহ। কুনো ঠি নেখা নাই। কাহয় কহিবা পারেছে না”।

“দাউ”

“সব কি নেখা থাকে? মানুষের সাথে সাথে কিছু ইতিহাসও চলি যায়”।

এমন কথা শুনে মনে হয়, ইতিহাসও সব সত্য সবসময় সত্যি করে বলে না। আমাদের মতো যারা শুধুমাত্র ক্লাসের ইতিহাস বইয়ের পাঠক— তাদের কাছে এমনটা মনে হলেও অপরাধ নয়। একজন নিরক্ষর নিত্যানন্দ পন্থী বৈষ্ণবও এই সত্যকে অনুভব করেছেন। এমন কথা বলার পিছনে অনেকে কৌতূহল অনুভব করতে পারেন। অথবা মনে হতেই পারে— এটা একধরনের আত্মরক্ষার ঢাল। এ-প্রসঙ্গে আরও একটি বক্তব্য আয়োজন করে বলতে পারি যে, ক্ষেত্রসমীক্ষার পাঠক বলেই জানি, সব ক্ষেত্রকেই ক্ষেত্র করি না বরং নির্বাচন করি। এই নির্বাচন অনেকসময় সঠিক না-ও হতে পারে। এবং সিলেকশনও কিছু ভাঁড় তথ্য দিতে পারে। যে-প্রসঙ্গে এই কথা বলা— ইতিহাসে অনেক পরিব্রাজক ও গবেষকের খোঁজ পাই। তাঁরা নিরীক্ষণ করেছেন ভারতীয়দের নিবিড় যাপন— জাত, জাতি, ভাষা, পোশাক এমন আরও কত কী!! লিপিবদ্ধ করেছেন। এসবের এক একটা কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব।

তাঁদের কৃতিত্বকে মেনে নিয়েও দেবেশ রায়ের একটি মতকে প্রতিষ্ঠা করতে ভীষণ লোভ হয়— “ভারতবর্ষের বিশালতার সঙ্গে কোন সম্বন্ধ তৈরির ব্যক্তিগত অক্ষমতা বা সমষ্টিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছি ভারতবর্ষের কিছু টুকরো বা খণ্ড চেহেরা।… সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, সেনাবাহিনীর মত আমাদের সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানও বস্তুত কতটা সর্বভারতীয় সে-সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ নই”। অন্তত আমারও মনে এই ধারণা দৃঢ় হয়েছে।

উপরের আলোচ্য অংশ পড়ে অনেকেই ভেবে থাকতে পারেন— আমি আমার আলোচনার মূল থেকে সরে পরেছি। না, তা একেবারেই নয়। মূল বক্তব্যে যেতে গিয়ে কয়েকটা বিষয় আপাত সমস্যা তৈরি করেছে। কারণ, কোনো কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ চেয়ে বসেন— ‘কিছু জন’। এইসব তথ্য কোন বইয়ে লেখা আছে? আগে কেউ কিছু বলে গেছেন? ইত্যাদি। তাঁদের কাছেও এই বার্তা দিতে যে— এখানে সবার ভারতবর্ষ আছে। সবারটা সবার মতো নয়। বরং বিষয়ীর কাছে দ্বিমতের বিষয়। ফলে যা যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি। অথবা কারো লেখায় পাওয়া যায়নি। তা সবসময় মিথ্যে— এখানে এমন ভাববার এবং বলবার যৌক্তিকতা থাকবে না।

দীর্ঘ সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রাচীন গৌড়ের একটা ভৌগোলিক এলাকায় নিজেরা নিজেদের ‘গৌড়-দেশি’ অথবা ‘দেশি’ বলে সম্বোন্ধিত করে। আরও ভালো করে বললে ‘দেশিয়া’। দেশে টিকে থাকার আত্ম-গৌরবও আছে। অথচ অনুল্লিখিত।

প্রাচীন কিছু দলিল কিংবা ভোটার তালিকা দেখলে পাওয়া যায়— এদের পদবি ছিল দেশি। এদের ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে আমারই লেখা একটি প্রবন্ধে চিহ্নিত করেছি— “পূর্ণভবা নদীর পশ্চিম পাড় থেকে নাগর নদীর পূর্ব পাড় এবং মহানন্দা নদীর পূর্ব পাড় এই ভূখণ্ডটি ঐতিহাসিক ভূমি”২। খুব সম্প্রতিকাল থেকে এরা রাজবংশী হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। সাব-কাস্ট হিসেবে রাজবংশী লিখছে। অথচ আত্ম-পরিচয়ের সময় দেশি অথবা দেশিয়া বলে পরিচিত হচ্ছে। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। ভাষা আছে। নিজস্ব আচার-আচরণে এখনও সমৃদ্ধ। তারই মাঝে কিছু লুপ্ত। কিছু হারিয়ে যাবার পথে…। আজকে আমাদের ‘আইচুরা’ নিয়েই মূল বক্তব্য। দেশিদের নিজস্ব উৎসব। নিজস্ব রীতিনীতিতে…

অন গোঁসাই বললেন— “আইচুরা হইল্‌ মহা উৎসব। যেইমত দুর্গাপূজা। ওইটা হইল হামারলার আত্মমর্যাদা”।

উৎসবটা কেমন?

উত্তরটা অন গোঁসাইয়ের বয়ানে লিখবার ইচ্ছে ছিল। লিখলে লিখাই যেত। তবে পাঠক ফাঁপরে পড়ত। কারণ, ঐ যে, প্রত্যেকেরই গল্প বলার নিজস্ব আচরণ আছে। গল্প বলতে বলতেই অন গোঁসাই জানতে চাইতেন— “কেনে দাউ, জানি করিবু?”। আবার কিছু বাদে বিড়ি ফুঁকতেন। শুরু করতেন অন্য প্রসঙ্গ। দীর্ঘ সাংসারিক জীবন ও তার ক্লান্তি নিয়ে কিছু কথা বলতেন। ফলে এইসব বক্তব্যকে গ্রিনরুমে রেখে সরাসরি মূল বিষয় আলোচনা করাই শ্রেয়। আর সেলিম দেবোত্তমরাও অধিকারবশত আমার মুখের শব্দকে কাটছাঁট করতে বলে দিয়েছে। বলেছে ঐ উৎসব সম্পর্কে অল্প কয়েকটি শব্দে লিখো। এবং আমার কঠিন সময়েও এই লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছে— দুইরকম কৃতিত্বই ওদের প্রাপ্য। তবে মাঝে মাঝে অন গোঁসাইকে নিয়ে আসব আমার পরিশ্রম লুঘু করবার জন্যই।

‘দুর্গাপূজা’ এবং ‘আত্মমর্যাদা’ দুটোই মেদবহুল বিষয়। আছে জমজমাট আর স্বচ্ছলতা। আইচুরা তেমনি এক রমরমা পরব। সম্পদের প্রাচুর্য না থাকলে এই পরব করা সম্ভব নয়। তার কারণ, প্রতি বছরের একটা বিশেষ সময়ে মেয়ে-জামাই শ্বশুরবাড়ির সকলেরই সবকিছুরই (খাবার, পোশাক এবং ভ্রমণ) দায়িত্ব নেয় মাসাধিকের জন্য। অনুষ্ঠানের শেষে শ্বশুরবাড়ি যা দেয় সেও কম কী সে? গোরু ছাগল সোনা গহনা ভরতি। ফলে অন গোঁসাই দুর্গাপূজা ও আত্মমর্যাদা – বেশ চতুর ও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন বোঝা গেছে।

অন গোঁসাই— “খাবার দাবার বইল্‌তে কিন্তু ডাইল আর ভাত নাহায়। পত্যেক দিন মেলায় খাবার। নাহিরিও ভালো ভালো। মানে ঐ আর— খাবার-দাবারের বিহা বাড়ি”।

সে-কারণেই অন গোঁসাই প্রথম উপমা টেনেছেন দুর্গাপূজার সঙ্গে। অনেক আত্মীয় স্বজন কাকা কাকি ভাই বোন দিয়ে জনা তিরিশ থেকে পঞ্চাশেক। স্বভাবতই দুর্গাপূজার বিষয় আশয় চলে আসে। এই এতজন!! এতদিন!! আমাদের কাছে বিস্ময় বটেই। সম্প্রতি একটি গান লেখা হয়েছে। লিখেছেন অনিল কুমার সিংহ মহাশয়। সূর করেছেন নিমাই সরকার। খন ধর্মী গান।

“আইস কুটুম বইস আসনে
হামরা আছিক বেতালে
নবানি আষাঢ়ি মাইলা হামার
গেল যে কুনা
হাত মুখলা ধুবার টানে
জল দেও আনিয়া”

হাল আমলের লেখা এই গান হাল আমলকেই ধরেছে। বেতাল এখন হয়েছে। বেতালের সরল অর্থ ব্যস্ততা। আগে আত্মীয় আসা অর্থ রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার। এই দেশিরা সেই নিয়ে আত্মমর্যাদায় অনুভূতিশীল ছিল।

জানতে চাইলাম “আর গোঁসাই কহিলেন যে— আত্মমর্যাদা অইখান কেমন?”

যে যতদিন শ্বশুরবাড়ি খাওয়াতে পারবে তার তত বেশি ধন-দৌলত আছে এই পরিচয় দেয়। অবশ্য তখন এমন কেউই ছিল না, যার কোনো সম্পত্তি ছিল না। টাকাপয়সা ছিল না। সবাই আইচুরা পালন করত। এবং যে পারত না সেও চেষ্টা করত। কারণ, এতেই তার পরিচিত। এতেই তার গৌরব। বংশমর্যাদা।

অর্থশাস্ত্রের লোকেরা, একে, তাদের পরিভাষায় হয়তো অপচয় জাতীয় বিশেষণ দেবে। ইতিহাস পড়ার যতটুকু সৌভাগ্য হয়েছে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অর্থশাস্ত্রে তাও হয়নি। ফলে অপচয় বিষয়কে একরকম না-পাত্তা দিয়েই সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। এই যারা, এই আইচুরা পালন করত তারা এই এলাকায় ধনসম্পদের অধিকারী ছিল। জমিজমা সবই তাদের ছিল। নইলে বছরান্তে এমন পরব পালন করে, তেমন সাধ্য কার? ক্ষেত্রসমীক্ষাও তাই বলছে। এখানে অন গোঁসাই একক ব্যক্তি হলেও এক নয়। দেশিদের প্রতিনিধি। ক্ষেত্রসমীক্ষায় সাহায্যকারী সকল তথ্যদাতার সমাহার। উল্লেখিত ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী অন্য গোষ্ঠীরা হাল আমলের। আদিবাসী বাদে। সকলের বসবাসের ধরন দেখলেও বোঝা যায়। গুচ্ছাকারে সজ্জিত দেশিদের পাড়া-গাঁ। এক বাড়িতে ঢুকলে অন্য সমস্ত বাড়িতে যাওয়া যায়। যেন সুড়ঙ্গপথ। সমস্ত খবর সবাইকে পৌঁছে দেবার জন্য…। বাইরের শত্রু যাতে সহজে একক কোনো পরিবারকে আক্রমণ করতে না পারে। যেন গেরিলা শিবির। এমন গ্রামের দেখা এখনও মেলে।

“গোঁসাই এই অনুষ্ঠানগ্যালা কেনে হয়?”

গোঁসাই— প্রীতির বন্ধন। ভাই-বোনের বন্ধন। যেমন ভাইফোঁটা। সেখানে ভাইয়ের মঙ্গলকামনা করে। তেমনি এই অনুষ্ঠান। তবে একটু ফারাক আছে। আই মানে দিদি বা বোন। “মুই আইয়ের বাড়িত যাম”। এটা বোন বা দিদি ফোঁটা। বোন ও দিদির মঙ্গলকামনার অনুষ্ঠান। আজকালকার দিনে অবশ্য এমন কয়েকটা দৃশ্য দেখা গেছে বোনেরা বোনদের ফোঁটা দিচ্ছে। তবে দেশিদের এই অনুষ্ঠান যে একটি সামাজিক দলিল তা বোঝা যায়। স্বতন্ত্রতা বোঝা যায়। যে-কারণে এদের আত্ম-গৌরব।

“গোঁসাই!! এমন কাথা কহিলেন কেহয় বিশ্বাসে করিবা চাহিবেনায়!!!”

“সেইটা ওমার ব্যাপার— ঐ যে একখান কাথা আহি— বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর-তে বো এই হচ্ছে হামার অনুষ্ঠান। এই হছে হামারাল গৌরব”।

তথ্যসূত্র:
১। রায়, দেবেশ (সম্পা.)। ২০১৫। দলিত। দিল্লী; সাহিত্য অকাদেমি। পৃ. ১।

২। সরকার, গৌতম। ২০১৯। অত্মানুসন্ধানে দেশি-র সমীক্ষা ও পর্যালোচনা। হোসেন, জাহাঙ্গীর (সম্পা.)।বাংলার জনসংস্কৃতি ও সংস্কৃতি। রাজশাহী; বাংলাদেশ ফোকলোর গবেষণা কেন্দ্র। পৃ. ১৭।

Categories
2021-Utsob-Translation

মিয়া কোউতো

আগুন

ভাষান্তর: শৌভ চট্টোপাধ্যায়

বুড়ি বসেছিল মাদুরের ওপর, নিশ্চল হয়ে অপেক্ষা করছিল কখন তার মরদ জঙ্গল থেকে ঘরে ফেরে। তার পা-দুটো দ্বিবিধ ক্লান্তিতে অসাড়— সময়ের ছোপলাগা গলিঘুঁজি ধরে হেঁটে আসার ক্লান্তি আর অতিক্রান্ত সময়েরও।

তার যা-কিছু পার্থিব সম্বল, ছড়ানো ছিল মাটির ওপরে: থালাবাটি, বেতের ঝুড়ি, একটা হামানদিস্তা। আর তার চারপাশে ছিল শূন্যতা, এমনকী হাওয়াও বইছিল সঙ্গীহীন, একা।

বুড়ো ধীর পায়ে ফিরে এল, যেমন তার অভ্যাস। রাখালের মতো, সে তার বিষণ্ণতাকে নিজের সামনে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বহুকাল ধরেই, সেই যেদিন তার ছোট্ট ছেলেটাও না-ফেরার রাস্তা ধরে চলে গিয়েছিল, তাকে ছেড়ে।

‘মানুষটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে দিন-কে-দিন’, বুড়ি ভাবছিল। ‘যেন শুধু একটা ছায়া।’

হ্যাঁ, ছায়াই বটে। কিন্তু সে কেবল তার আত্মার ছায়া, কেন-না শরীর বলে আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই তার। কাছে এগিয়ে এসে, পাশে পড়ে থাকা আর একটা মাদুরে বুড়ো নিজের শীর্ণতাটুকু জড়িয়ে নেয়। মাথা তুলে, বুড়ির দিকে সোজাসুজি না তাকিয়েই সে বলে:

‘আমি ভাবছিলাম।’

‘কী ভাবছিলে গো?’

‘যদি তুই মরে যাস, তাহলে এই অসুস্থ, অশক্ত শরীরে আমি কীভাবে তোকে গোর দেব?’

কাঠির মতো আঙুলগুলো মাদুরের ওপর বোলাতে বোলাতে সে বলে চলল:

‘আমরা গরিব। থাকার মধ্যে তো শুধু এই না-থাকাটুকুই। বল-ভরসা বলতেও তিন কুলে কেউ নেই আমাদের। আমার মনে হয়, আমরা বরং এই বেলা, নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে রাখি।’

আবেগের বশে, বুড়ি অল্প হাসে:

‘বড়ো ভালো মানুষ গো তুমি! কপাল করে এমন মরদ পেয়েছিলাম, আমার আর ভাবনা কীসের!’

বুড়ো চুপ করে চিন্তায় ডুবে গেল ফের। বেশ কিছুক্ষণ পর, আবার মুখ খুলল সে:

‘যাই, দেখি যদি একটা কোদাল জোগাড় করতে পারি।’

‘কোথায় যাবে তুমি কোদাল খুঁজতে?’

‘দেখি ওদের দোকানে পাওয়া যায় কিনা।’

‘সেই দোকান অবধি ঠেঙিয়ে যাবে এখন? সে তো অনেক দূর।’

‘রাত্তির নামার আগেই ফিরে আসব।’

এমনকী নৈঃশব্দ্যও দমবন্ধ করে বসে রইল, যাতে তার মরদ ঘরে ফিরলে বুড়ি টের পায়। যখন সে ফিরল, ধুলোর ছেঁড়াফাটা কানাতে তখন সূর্যের শেষ আভাটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে।

‘কী হল গো?’

‘অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল’, আর সে তুলে ধরল তার হাতের কোদালখানা, যাতে বুড়ি ভালো করে দেখতে পায়। ‘কাল সকাল সকাল লেগে পড়ব তোর গোর খুঁড়তে।’

পাশাপাশি দুটো আলাদা মাদুরে শুয়ে পড়ল তারা। বুড়ির মৃদু গলা বুড়োকে বাধা দিল ঘুমে তলিয়ে যেতে:

‘কিন্তু, শোনো…’

‘কী?’

‘আমার শরীর এখনও ঠিকই আছে। খারাপ হয়নি তো!’

‘নিশ্চয় হয়েছে। বয়স কি কম হল?’

‘তাই হবে’, সে মেনে নিল। আর তারপর ঘুমিয়ে পড়ল দু-জনেই।

পরদিন সকালবেলা, বুড়ো খুব খর-চোখে নজর করছিল বুড়িকে।

‘তোকে মেপে দেখছি। যতটা ভেবেছিলাম, তুই দেখি তার চেয়ে আরও বড়ো।’

‘দুর, কী যে বলো! আমি তো এইটুকুন মোটে।’

কাঠের পাঁজার কাছে গিয়ে বুড়ি ক-টা লকড়ি টেনে বের করে।

‘কাঠ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আমি যাই, জঙ্গল থেকে কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আনিগে।’

‘তুই যা বউ। আমি এখানেই থাকি, তোর জন্যে গোর খুঁড়ি।’

বুড়ি বেরিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ যেন একটা অদৃশ্য হাত তার কাপুলানা১ ধরে টানল। আর, থমকে দাঁড়িয়ে, বুড়োর দিকে পেছন ফিরেই সে বলল:

‘শোনো। একটা কথা জিজ্ঞেস করি…’

‘কী চাই আবার?’

‘খুব যেন গভীর করে খুঁড়ো না গর্তটা। আমি ওপরের দিকেই থাকতে চাই, ঠিক ভুঁইয়ের নীচটায়, যাতে মনে হয়, হাত বাড়ালেই জীবনকে ছুঁতে পারব আবার।’

‘ঠিক আছে। তোর কবরে না হয় মাটি একটু কম দেব।’

দু-সপ্তাহ ধরে বুড়ো উদয়াস্ত ব্যস্ত রইল কবর খোঁড়ার কাজে। কাজ যত শেষের দিকে এগোয়, তত তার কাজের গতি কমে আসে। তারপর, হঠাৎ বৃষ্টি এল একদিন। গর্ত জলে ভরে উঠল। দেখে মনে হল একটা নির্লজ্জ কাদাজলের ডোবা। বুড়ো মেঘগুলোকে শাপশাপান্ত করতে লাগল, আর আকাশকেও, যে তাদের এখানে এনে জড়ো করেছে।

‘বোকার মতো কোরো না, পাপ লাগবে তোমার’, বুড়ি তাকে সাবধান করল। বৃষ্টি পড়েই চলল, শেষে কবরের দেয়াল ধসে পড়ার উপক্রম। বুড়ো গর্তের চারিদিকে ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। শেষে, ওইখানে দাঁড়িয়েই, সে সিদ্ধান্ত নেয় কাজ চালিয়ে যাবার। বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারায় ভিজে একশা হয়ে, বুড়ো গর্তের মধ্যে নামে আর ওঠে, ক্রমশ বাড়ে তার গোঙানির আওয়াজ, আর খুঁড়ে তোলা মাটির পরিমাণ পাল্লা দিয়ে কমে আসতে থাকে।

‘বৃষ্টির মধ্যে থেকো না আর, চলে এসো। এভাবে পারবে না তুমি।’

‘বাজে বকিস না মাগি’, বুড়ো হুকুম করে। কিছুক্ষণ অন্তর, সে কাজ থামিয়ে দেখে নেয় আকাশের অবস্থা। আসলে সে দেখতে চায়, কার কাজ বাকি আছে বেশি, তার, না বৃষ্টির।

পরদিন, বুড়োর ঘুম ভাঙল তীব্র বেদনায়, যেন হাড়গুলো তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের আরও ভেতরে টেনে নিতে চাইছে তাকে।

‘বড়ো যন্তন্না রে গায়ে। উঠতে পারি না।’

বউ তার দিকে ফিরে মুখ থেকে ঘামের ফোঁটাগুলো মুছিয়ে দেয়।

‘তোমার সারা গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। কাল অত ভিজলে, ওই জন্যে।’

‘না রে বউ, তা নয়। আসলে আগুনের ঠিক পাশ ঘেঁষে শুয়েছিলাম কি না, তাই।’

‘কীসের আগুন?’

উত্তরে বুড়োর মুখ থেকে শুধু গোঙানির আওয়াজ বেরোয়। বুড়ি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে: কোন আগুন দেখল তার মরদ, তারা তো কোনো আগুন জ্বালায়নি!

সে উঠল বুড়োকে একবাটি সেদ্ধ জাউ খেতে দেবে বলে। কিন্তু ঘুরে দেখে, বুড়ো ততক্ষণে উঠে পড়ে কোদাল খুঁজতে লেগেছে। সেখানা বাগিয়ে ধরে, পা ঘষটে বাইরে বেরোনোর তোড়জোড় করে। এক পা এগোয়, আর থমকে দাঁড়ায় শ্বাস নেবার জন্যে।

‘ওগো, যেয়ো না এভাবে। আগে মুখে কিছু দাও।’

বুড়ো শুধু হাত নাড়ল মাতালের মতো। বুড়ি তবু ছাড়ে না:

‘তোমার শরীরের এই হাল, ডান-বাঁয়ের হুঁশ নেই। বিশ্রাম নাও শুয়ে।’

বুড়ো ততক্ষণে গর্তের মধ্যে নেমে পড়েছে, আর কাজ শুরু করবে বলে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অসুখ তাকে তার জেদের শাস্তি দিতে ছাড়ে না, আচমকা মাথাটা ঘুরে যেতে তার মনে হল সারা দুনিয়া যেন চোখের সামনে নাচতে লেগেছে। হঠাৎ, সে চিৎকার করে উঠল হতাশায়:

‘বউ, বাঁচা আমাকে!’

গাছের কাটা ডালের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল বুড়ো, মেঘ ডাকল এমন যেন আকাশখানা দু-ফাঁক হয়ে ফেটে যাবে এইবার। বুড়ি দৌড়ে গেল বুড়োকে সাহায্য করবে বলে।

‘শরীর তো বেজায় খারাপ তোমার।’

হাত ধরে টানতে টানতে বুড়োকে এনে সে মাদুরে শোয়ায়। শুয়ে শুয়ে বুড়ো বড়ো বড়ো শ্বাস টানতে থাকে। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন জড়ো হয়েছে ওইখানে, হাপরের মতো ওঠা-নামা করা পাঁজরগুলোর মধ্যে। জীবন যেখানে ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করছে, মৃত্যু সেখানে আসে আচমকা বজ্রপাতের মতো, কিন্তু এখানে, এই নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে, মানুষ খুব চুপিসাড়ে ঢলে পড়ে মৃত্যুর ভেতর, যেভাবে পাখি তার ডানা ভাঁজ করে।

‘বউ’, কোথাও কোনো চিহ্ন রাখে না, এমন আবছা গলায় বুড়ো বলল, ‘আমি তোকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারব না।’

‘কী করার কথা ভাবছ তুমি এখন?’

‘কবরটা তো ফাঁকা ফেলে রাখতে পারি না। তোকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।’

‘ঠিকই বলেছ। এত কষ্ট করে খোঁড়া গর্ত, যদি শুধুমুদু খালি পড়ে থাকে, তবে সে ভারি দুঃখের কথা।’

‘হ্যাঁ, তোকে মেরেই ফেলব আমি; কিন্তু আজ নয়, গতরে আজ জোর পাচ্ছিনে মোটে।’

বুড়ি তখন তাকে ধরে সোজা করে বসায়, আর এককাপ চা করে আনে।

‘আস্তে আস্তে খেয়ে নাও দিকি। খেলে ভালো লাগবে। কাল কত কাজ পড়ে আছে, তাকত না পেলে চলবে?’

বুড়ো ঘুমিয়ে পড়ে, আর বুড়ি বসে থাকে ঘরের দোরগোড়ায়। তার বিশ্রামের ছায়ায়, সে দেখে, আলোর রাজাধিরাজ সূর্যের শরীরও কেমন আস্তে আস্তে বিবর্ণ হয়ে আসছে। সারাদিনের ঘটনাগুলো সে মনে-মনে নাড়াচাড়া করে, আর তাদের বৈপরীত্যের কথা ভেবে তার হাসি পায়: সে, যার জন্মের কোনো নথিপত্রই নেই, কী নির্ভুল নিশ্চয়তায় আজ জেনে ফেলেছে নিজের মৃত্যুর তারিখ। যখন চাঁদ উঠল, আর তার আলোয় জঙ্গলের গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল, বুড়ি তখন সেখানেই গা এলিয়ে দিল, আর তলিয়ে গেল ঘুমের ভেতর। সে স্বপ্ন দেখল এখান থেকে অনেক দূরের কোনো সময়ের: যেখানে তার ছেলেমেয়েরা রয়েছে, যারা মরে গেছে আর যারা বেঁচে আছে তারাও, মাচাম্বা২ ভরে উঠেছে ফসলে, সেই শ্যামলিমার গায়ে তার দৃষ্টি পিছলে যাচ্ছিল। বুড়োও রয়েছে সকলের মাঝখানটিতে, গলায় টাই বাঁধা, গল্প বলছে বিছানায় শুয়ে। সবাই রয়েছে সেখানে, তার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি। জীবন রয়েছে, ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে সে, কত অজস্র প্রতিশ্রুতির জন্ম হচ্ছে তার গর্ভে। সেই হাসিখুশির মেলায়, সবাই সত্যি বলে মেনে নেয় বড়োদের সমস্ত কথা, কারণ, ভুল তারা করতেই পারে না, আর কোনো মা-ই মৃত্যুর সামনে মেলে ধরে না নিজের রক্ত-মাংস। সকালের হরেক শোরগোল একসময়ে তাকে তার নিজের ভেতর থেকে ডেকে তুলতে চাইল, কিন্তু ঘুমের শেষ রেশটুকু ছেড়ে আসতে কী ভীষণ অনীহা তার। রাত্রিকে সে অনুনয় করে আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য, যাতে তার স্বপ্নগুলো আর একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়। ঠিক ততখানি আকুতি ঝরে পড়ে তার গলায়, যতটা আকুতি নিয়ে সে একদিন জীবনের কাছে মিনতি করেছিল, তার সন্তানদের যেন সে তার কাছ থেকে কেড়ে না নেয়।

আলো-আঁধারির ভেতর, বুড়ি তার স্বামীর হাতখানা ধরতে চাইছিল, যদি এই তীব্র কষ্টের কিছুটা সুরাহা হয়। যখন তার হাত ঠেকল বুড়োর গায়ে, তখন দেখল তার শরীর একেবারে ঠান্ডা, এতটাই ঠান্ডা যে মনে হচ্ছিল বুড়ো বুঝি সেই আগুনের থেকে বহু দূরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, যে-আগুন কখনো জ্বালেইনি কেউ, কোনোখানে।


কাপুলানা: মেয়েদের লম্বাঝুলের পোষাক, কতকটা সারং-এর মতো
মাচাম্বা: ছোট একফালি চাষের জমি

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সূচনাকথা

গৌতম সরকার

এই ক্রোড়পত্রে দু-টি বিষয়কে তুলে আনবার চেষ্টা করা হয়েছে—

এক) ভারতবর্ষের চার ভাষা গোষ্ঠী হল ইন্দো-ইউরোপীয়, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক এবং ভোট-বর্মী। এই চার ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের উৎসব তুলে আনা।

দুই) নিজেরা নিজের কথা বলবে। এখানে ভোট-বর্মী থেকে টোটো, রাভা, গারো। ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে রাজবংশী। দ্রাবিড় থেকে ওঁরাও, অস্ট্রিক থেকে বাউরি- ওরা নিজেদের কথা বলেছে।

প্রশ্ন হতে পারে— এখানে তো আদিবাসীরাও বলেছে। তাহলে এই ক্রোড়পত্রের নাম ‘লোকজ উৎসব’ কেন? আদিবাসী উৎসব নয় কেন। অনেকের কাছে এই জবাবদিহি করতে হতে পারে। দ্বন্দে না গিয়ে, ক্রোড়পত্রের নাম ‘আদিবাসী ও লোকউৎসব’ করা যেত নিশ্চয়। তবে লোক বিষয়কেই যেহেতু লোক (সাধারণ)-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেহেতু প্রবন্ধের বিষয়গুলো লোক। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা সকলেই বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।

উৎসব মানেই মিলন। আদানপ্রদান। ব্যাবসা বাণিজ্য।

উত্তর দিনাজপুর জেলায় ‘কাঁদাকাটির মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। দেশভাগের পর থেকে এই উৎসব হয়ে আসছে। মেলার উদ্দেশ্য দেশের ওপারে থাকা আপনজনদের একপলক দেখা এবং কান্নাকাটি করে মিলিত হওয়া। স্বজনের সুখ-সমৃদ্ধি চেয়ে প্রশান্তি লাভ করে ঘরে ফেরা। এই হল লোকউৎসব। এই হল লোকমেলা।

সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লোকউৎসব পালন করে, সেটা কখনো পারিবারিক, সামাজিক অথবা গোষ্ঠীগতভাবে। কথায় বলে ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে’ ঈশ্বরের হাতে। তাকে কেন্দ্র করে নানা আচার তৈরি হয়েছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে আলাদা। সম্প্রদায়গতভাবে ভিন্ন। যন্ত্রণা-শোক-আনন্দ সবকিছুর মিশেল নিয়ে লোকউৎসব আয়োজিত হয়। লোকউৎসব একটি গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরে। প্রাচীন ইতিহাস জানা যায়। জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস-ভয় ও সংস্কার নিয়ে লোকদেবতার প্রতিষ্ঠা হয়। তার পূজাচার, মন্ত্র, সংগীত, খাদ্যাভাস লোকসমাজকে যূথবদ্ধ করে তোলে। সংগীত খাদ্যাভাস পোশাক ইত্যাদি সবকিছু মিলেই এই লোকউৎসব।

এই সংখ্যায় আমাদের উদ্দেশ্যই হল ‘নিজেরা নিজের কথা বলবে’। আমরা সেটাই চেষ্টা করেছি। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানে প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহের অন্যতম পদ্ধতি হল ক্ষেত্রসমীক্ষা। সেই সমীক্ষা করি বিষয় অনুসারে। বিশেষ স্থান বিশেষ গোষ্ঠী নির্বাচন করি। সেখানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি। আলোচনা করি। তবে বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতি একটু ভাবা প্রয়োজন আছে। যেখানে শিক্ষার প্রসারতা বেড়েছে। মনোরঞ্জন ওঁরাও সম্প্রতি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করছেন। সঞ্চিতা টোটো একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। সংগীতা সাংমা যাদবপুরে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন। সুশীল কুমার রাভা ‘নাকচেংরেনি’ নৃত্য নিয়ে দিল্লির রাজপথে প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশগ্রহণ করেন। ভাস্বতী রায় ভাষা গবেষণা করছেন। জয়দেব বাউরি লেখক। এতে বোঝা যায় নিজেরা নিজেদের কথা বলতে সক্ষম। তাঁদের দিয়েই এই উৎসবগুলো লেখানো হয়েছে। এইসব লেখায় প্রাথমিকভাবে কিছু ক্রুটি থাকবে যেমন বাক্যগত, শব্দগঠনগত, পরিচ্ছেদ বিন্যাস এবং ভাবপ্রকাশে। অর্থাৎ, বাংলা লিখার ব্যাকরণগত ক্রুটি। কারণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষিক গোষ্ঠীর প্রাবন্ধিকত্রয় বাদে অন্যান্যদের ক্ষেত্রে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা।

এই ক্রোড়পত্রে লিখেছেন টোটো থেকে সঞ্চিতা টোটো— ‘টোটোদের ‘অউচু’’। গারো থেকে সংগীতা সাংমা— ‘ওয়ানগালা একটি উৎসব’। রাজবংশী থেকে ভাস্বতী রায়— ‘নন্দোৎসব: দধিকাদো ও পুরাতন রাজবংশী সংস্কৃতির অবক্ষেপ’। ওঁরাও থেকে মনোরঞ্জন ওঁরাও— ‘ওঁরাওদের কয়েকটি উৎসব’। রাভা থেকে সুশীল রাভা— ‘লোকধর্মের পীঠস্থান: আদি কামাখ্যাধাম’। বাউরী থেকে জয়দেব বাউরি— ‘বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব’। এবং আমি গৌতম সরকার দেশিদের ‘আইচুরা’-র কথা বলেছি।

যাঁরা প্রবন্ধ দিয়েছেন তাঁদেরকে কৃতজ্ঞতা জানালাম…

Categories
2021-Aug-Poem

সোহম বিশ্বাস

রোদ

এই শীতেও পোকা ঢোকেনি ঘরে

ওদের শিরদাঁড়া বেঁকে আছে,
ওরা শিখে গেছে,
ঠান্ডায় পচে যেতে হয়।

চামড়া ছিঁড়তে হয় তরল সূর্যাস্তের আগে

কবি

অঙ্ক বইটা বন্ধ করার পর,
চোখ গেল মাকড়সাটার দিকে।
বুঝলাম,
চার মিনিট আমার বইটা খুলতেই
নষ্ট হয়ে গেছে

সকাল

বয়স্করা পিছনে হেঁটে যাচ্ছে…

‘আমি একাই! যার পিছুটান নেই’
এবং
ছায়াটার হাসি পিষে গেল
ডোপামিন-এর ওজনে

দুপুর

অনেক দূর এসে গেছি
কয়েকজন বলেছিল, ফিরে যাও!
এখন এই ছায়াটার জায়গায়
এখন আমার স্বার্থপর পায়ের ছাপ

সন্ধ্যে

এখন সূর্যও আমার পিছনে।

পচা লিকলিকে অশরীরিগুলো
হাততালি দিচ্ছে…

তারায় মেশার আগে
ছায়াটা এগিয়ে দিয়ে আসছে
কোনো এক খেয়া পর্যন্ত…

আইনস্টাইন

আবার ব্যাসার্ধ বাড়ছে ঘড়িটার,
আজ ভগ্নাংশ জানি বলে
শবদেহগুলো দূরে হেঁটে বেড়ায়।

 

Categories
2021-Aug-Poem

অর্ঘ্য চক্রবর্তী

ভীষণ পূর্ণিমা রাত

জলে ডুবে চাঁদ মরে পড়ে আছে।
ছুঁয়ো না;
খানা তল্লাশি হোক,
পুলিশে মারুক আঠারো ঘা—
পরে না হয় “হরি বোল” বলে
কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যেয়ো দ্বিরাগমনে।

কাল রাতেও দেখেছি তাকে—
কলসী হাতে মুখ-গোমড়া করে বসে আছে,
ঘাটের কাছে।

প্রেম

থেমে যাক সময়!
থেমে যাক সর্পিনী হাওয়া;
এমন সময় আলো নিভে যাক,
থেমে যাক মানুষের কণ্ঠস্বর—
আর রাত্রির নিস্তব্ধতা খান-খান করুক—
রবীন্দ্রসংগীত।
তখন তুমি, হে প্রেম—
আমার পাশে এসে বসো চুপচাপ
ঘুমন্ত নিরীহ বেড়ালছানার মতো।

মৃত্যুভয়

মাঝে মাঝে মনে হয়, মৃত্যু এসে টেনে নিয়ে যাবে। তাই আপোস করে বন্ধুত্ব পাতাচ্ছি তার সাথে। এমনকী চালাকির ছলে দিচ্ছি ঘুষও! আর এই শরীর, তুলোর মতো নরম শরীর বিছানায় কুঁকড়ে শিথিল হয়ে পড়ে আছে— তাকে দিচ্ছি ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ, মাছ। জল খাওয়াচ্ছি সময়ে সময়ে; পড়াচ্ছি জামা, ঢেকে রাখছি শাল-চাদরে। যাতে ওই শয়তান মৃত্যু এসে টেনে না নিয়ে যায়।

উল্কাপিণ্ড

তুমি যেন লুব্ধক,
উজ্জ্বল হয়ে আছ পুব আকাশে।
দ্রুত ছুটে চলেছ শুক্রাণু-বেগে।

তুমি নিশ্ছেদ্র অতল;
অবলা মহাজাগতিক স্তনপিণ্ড এক।
ক্রমশ দূরতর, নিভু-নিভু—

আমারই নক্ষত্রবিলাপ নিহত দিনের পাশে।

উদ্বৃত্ত সময়

কিছুটা সময় আমি জমিয়ে রেখেছি
ফাটা, চ্যাপ্টা টিনের কৌটোয়।
সময়মতো বাগানে নিয়ে যাই,
উঁচু করে ধরি টিনের কৌটোর হাতল—
চারাগাছেদের গায়ে ঝরে ঝরে পড়ে,
ঝিরিঝিরি সময়।
ধুলোয় মলিন গাছের পাতার মাঝে
ছোট্ট বিন্দু, আমার সময়।

 

Categories
2021-Aug-Poem

আকাশ মুখার্জী

ন্যাড়া পোড়া

খানিকটা দূরে একটা মাঠ
ঠিক তার পাশেই শ্মশান

কালো আকাশের বুক চিরে
সাদা ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে…

দু-জনেই পুড়ছে
একজন শুয়ে
অপরজন
দাঁ
ড়ি
য়ে

নববর্ষ

পয়লা বৈশাখ, চারিদিকে কেনাকাটা চলছে
আট বছরের সুদীপ্তর নতুন জামা হয়ছে
তাও আবার হলুদ রঙের…

দোকানের পাশেই শুয়ে একটা ভিখিরি বাচ্ছা।
জন্ডিস হয়েছে।
চোখ-মুখ হলুদ হয়ে এসেছে

সমুদ্র

আমি জন্মাইনি
আমি মরবও না..

আমি পৃথিবীতে শুধু ছুটি কাটাতে এসেছি
কিছু বছর ছুটি কেটে গেছে

আর কিছু বছর বাকি…

ছুটি শেষ হলেই,
সমুদ্র আমার পায়ের ছাপ ধুয়ে দেবে

বাৎসরিক

সময়ের উত্তাপ সমস্ত ঘড়িকেই গলিয়ে দিয়েছে…
সমস্ত পাহাড়কেই ক্ষয় করেছে….

প্রতিটা বছর যায়, সময়ের চিতা আরও কতকিছুকে পুড়িয়ে দেয়…

এই চিতা কোনোদিনও নেভে না…
শুধু মানুষ খেয়ে নিজের খিদে মেটায়

মধ্যবিত্ত

প্রতিদিনই একটু একটু করে
শান্ত হচ্ছি।

শুধু ততটা শান্ত হচ্ছি না
যতটা হলে আমাকে মৃতপ্রায় মনে হবে।

ভিতরে একটা ড্যাম্প খাওয়া দেশলাই রেখে দিচ্ছি…
যাতে বারুদে বারুদে ঘষা খেলে,
আগ্নেয়গিরির মতো একবার জ্বলে উঠতে পারি

 

Categories
2021-Aug-Poem

মধুমিতা রায়

মধ‍্যাহ্ন সমীক্ষা


সাধ বলতে ভাত খাবে। খিদেকে দেবে ওম
ধূপ জ্বালে। ধুনো দেয়। মৃত কাঠে প্রাণ জড়ো করে
প্রদীপ জ্বালানো। ভর সন্ধ‍্যা। উবু হয়
হাঁটু গেড়ে বিশ্বাসের মালা জপা
কপালে হাত সরে না। হাত মুঠো হয় না।
মনে মনে রাগ। কলসি রাগে
খাবার গোছায় আকুতির জল


খিদে মায়া। আগুন জানে। জলের ছোঁয়ায়
দেখে না কেউ। বোঝে না কেউ। দূর থেকে দেখে
এমনি উপহার। রঙিন কাগজ
ছিঁড়ে করে টুকরো। খেদের গালিচা
মরা চাঁদ আরও মরে
শুকতারা বয়সের ভারে বোবা হয়ে যায়


জিভের কাছে যাই। বিস্বাদ চোখ
সব মিথ্যা। বাড়ে না। কাড়েও না
সার মেশাই। ফেলে রাখি
বর্ষা আসে। ভিজে গেছে
পুত্রের পোশাক। বারান্দায় ঝোলা
টপটপ শব্দ হলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা
জল নাকি লোভ… লোভ… লোভ…


খুন্তির আওয়াজ জানে?
ঠিকঠাক নিয়ম ব‍্যাকরণ ধুনির
শব্দ, বর্ণ, বাক‍্য ব‍্যয়। খুচরো পয়সার মতো। ঝনঝনে আওয়াজ। মৌলিক শব্দ
ভাঙে না। জুড়ে যায়। রৌদ্রে কড়কড়ে

হঠাৎ ঘাড় বেয়ে নেমে আসে হলুদ শরীর


কলাগাছ বড়ো হয়। পাতার ফাটল
হাওয়া বাধে। ঝড় হয়
মন ভাঙে। আর কেন? এই তো সময়
মেয়েদের বয়স! বোকা তুমি
গাছ কাটো। গোড়া থেকে
কাঁদুনি নামার আগে নিজেকেই পিণ্ডদান করো


মধ‍্যবিত্ত শরীর। শরীর গড়ানো জল
আঁধার নামে। আহ্নিক গতি
বেগে মৃত্যু। প্রাণ নেই। মান নেই
আছে শানিত আওয়াজ। লোডশেডিং
নিজের রক্তের স্বাদ নিজেই চাটে
অর্ধেক জিভে সব নোনা লাগে


বৈপরীত্য নামে। ছেলেখেলা জাগে
থালাভরতি ভাত। দুপুর গড়ানো
গেলার আগে আমায় গেলো
আঁশটে গন্ধ। মেছুনির নাচ
গ্রাস চটকিয়ে অসহ‍্যকর
কাদা মাড়াই খালি পায়ে
মশার শব্দ। ঘুম ভাঙে


কিছুটা মিথ। সামান‍্য বিশ্বাস
সুখি করে অলীক মায়া
পিতৃমুখ ডুব দেয়। রাশিফল সাঁতরে যায়
গা হেলানো। জন্মসুখ

কর্মসুখ ভেসে যায়। ডুবুজলে মুখ খোঁজে
কোন মেয়ে? কার অসুখ?
কারসাজি কিচ্ছু নেই! অসুখ সাজাই মুখোশ দিয়ে


বৃষ্টিভেজা জামা। হ‍্যাঙারে ঝোলা জল
গড়িয়ে পড়ে, ভিজিয়ে দেয়
চেনা জন্মদাগ
মতভেদ জাগে। উগড়ে দেয়
জমানো গরল। মন্থনে ওঠা
ছলনা ভেজা দাগ। কানামাছি খেলা
কুড়িয়ে নেয়। সেলাই করে
খোলা বোতাম
ইচ্ছার সাথে অনিচ্ছার মিশ্রণ
হু হু করে ডাক। শুকনো পাঁজর

১০
হারিয়ে ফেলার সমার্থক শব্দ নেই
যত ভাবি, ক্ষয়ে যায়
সরে যায়। নিজের থেকেই
ডাকটিকিট নিয়ে যায়, খোলা চিঠি
একনিঃশ্বাসে লিখে রেখেছিল যক্ষ
মেঘও ব‍্যর্থ হয়। পাথর বানায়
ঘুম পাড়িয়ে দেয় তুলোর মতো মেঘে

 

Categories
2021-Aug-Poem

অরিত্র সোম

অ্যাশট্রে প্রস্তুত রাখো

ডালটুকু দেখতে পেয়েছ; কিন্তু ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা পায়রাটিকে ভাবার মতো যোগ্য এখনও হয়ে ওঠোনি। আপাতত মনোযোগ দিই মঞ্চে। গিটার হাতে আলো করে রেখেছি কিছু নাগরিক। আমাদের গলায় ভাষা দাও, চলনে-বলনে সোচ্চার হও সংস্কৃতি।

এমনতর ইচ্ছের মধ্যেই ভিড় বাড়ে। গাড়ি আর সানগ্লাস যথাস্থানে রেখে মাননীয় উঠে যাচ্ছেন দেওয়ালে। এটুকু আওয়াজ সহ্য করে রাখো অন্তত। শুনেছি তোমার তো এখন কাজ-টাজ নেই বিশেষ কিছু…

নাগরিক সোচ্চার হয়। লাল-নীল মরসুমে আরও কৌতুক খোলে আকাশে। ছাদের দড়ি শুকনো সব; পাঁজরের বদলে পোস্টার উড়ছে। মাঝরাস্তা পেরোলেই সাফসুতরো মেজাজ। শ্লোগান নেই তবে দমকা কাশি ওঠে। সঙ্গে চাপ চাপ গন্ধ। রক্ত বেরোনোর মতো বোধহয় বিপ্লবী হয়নি ঠিক। বরং পলাশ কুড়িয়ে এগিয়ে দাও পাশের সিটে। আড়ালে খুচরো কয়েন— মানুষ, তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে।

মানুষ অকপট ঘুমিয়ে থাকে মানুষের পাশে
মানুষ ঘুম থেকে উঠে, লাঠি মারে
মানুষের মুখে

অতএব ইন্টারনেট চালাও। তুমি নাগরিক, শিক্ষিত ছন্দ মিলিয়ে গড়ে তোলো পবিত্র আশ্রয়…
আর পায়রার
ছাই উড়ে
উড়ে
উ ড়ে

অ্যাশট্রে, প্রস্তুত রাখো।

নিজস্ব শহরের ওপার হতে— ৫

স্বপ্নের মতো কিছু একটা যেন উড়ে যাচ্ছে। রিকশাস্ট্যান্ডের ঠুমরি ছায়া ফেলেছে গোটা ঘরে। মোটে সাতজন মানুষ— অ্যাশট্রে কালো করে পুড়েছে সব। শ্মশানযাত্রীর দল, হবিষ্যি ভুলে, এখনও চেয়ে আছে নদীটির দিকে। ওদের সবার বুক ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দুটো আলতা-ছাপ। পথ ভুল করে দৃশ্যে ঢুকে পড়েছে বিড়াল। কাউকে তোয়াক্কা না করে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো চেয়ারে। আস্তে আস্তে একটা বিকেল চলে এল ছাদে। মিস্তিরিরাও ফিরে গেছে যে যার মতো, স্বপ্নে। আমি ফিরতে পারছি না কেন— এই খচখচানি নিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অস্থি ভাসান দিতে গিয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরেছে হাত। ছাড়াতে চাই না; কিন্তু…

ঢিলের বৃত্তাকার যাপন বুঝিয়ে দিচ্ছে— তৈরি হও।

ঈশ্বরের সাদা পেরেক


দেওয়াল থেকে সজারুর মতো তাকিয়ে আছেন ঈশ্বর
একটা পেরেক পেলেই পাশের জমিটি
বেদখল হয়ে যাবে


গত পরশু থেকে পাপোষের কোণে রাখা
সাংসারিক ছবিটি


যিশুর পা থেকে, আপাতত
একটাই পেরেক তুলে নেওয়া হয়েছে

কাজ চালানোর জন্য

রক্তবীজ— ১

প্রতিটা জানলা বেয়ে, অজস্র পাতা আসে ঘরে
জড়ো হয়; চলেও যায় একসময়— মেনিটির মতো
ঘরে ঘুরে বেড়ায় মর্গের হাওয়া
তার গন্ধ নিতে
নিতে নিতে
দেওয়াল ভরে উঠেছে রক্তে

কাশির দমক যেখানে শেষ রাত্রির নিশ্বাসের মতো

রক্তবীজ— ২

তারপর পাগলেরও সাধ হল শেষ হওয়ার—
খানিক ট্রেনে, খানিকটা কাটাকলের পথে ছুঁড়ে দিয়ে
দেখে নিতে চাইল পৃথিবীর গন্ধ
কোনো বৃষ্টি এল না। শব্দ হল না।
শুধু কিছু কুকুর একে অপরের গা শুঁকে
চলে গেল বস্তির জঙ্গলে…

এতক্ষণে
গা বেয়ে উঠে পড়েছে মা-পিঁপড়ে ছেলে-পিঁপড়ে
ভিতরে ভিতরে চলছে
মাংস খাওয়ার প্রস্তুতি

Categories
2021-Aug-Poem

সোহম চক্রবর্তী

আমি

শহর থেকে অনেক দূরে গেলে ছোটো মফস্সল,
যেয়ো না অত দূর।
মফস্সল থেকে আরও অনেক দূরে অজ পাড়াগ্রাম,
যেও না অত দূর।

বরঞ্চ, দ্যাখ—

শহর থেকে অনেক দূরে ছোটো মফস্সল,
মফস্সল থেকে আরও অনেক দূরে অজ পাড়াগ্রাম
ছুটে যায় জাতীয় সড়ক।

জাতীয় সড়কের পাশে ফালি ফালি রোদের মতন
বসার জায়গা—
শানবাঁধানো, ছাউনি দেওয়া পঞ্চায়েতের; ছোট্ট দেয়ালে
গা-ঘেঁষা অক্ষরে লেখা: ‘দাঁড়াও, পথিক-বর…

…তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’

যেহেতু তুমি একটা-দুটো কবিতা পড়েছ, তাই ভাবছ
কেউ তো দাঁড়ায়, কেউ তো দাঁড়াবেই—
আরও অনেকগুলো পড়লে বুঝতে

আসলেতে দাঁড়ায় না কেউ।

কাম

জোনাকিকে পিষে মারলেও
আলো তার পেছন ছাড়ে না—

ফুলে ওঠে কপালের রগ,
জ্বর আসে— আর
তোমার না-আসা শুধু

দপ্ দপ্ করে গোটা দেহে।

আত্মঘাতরীতি

‘তোমাকে না-পেলে আর বাঁচব না আমি’।

এ-সহজ সত্যের বুকে
তৃতীয় শ্রেণির কিছু বাংলা সিনেমা
যুগে-যুগে ছুরি মেরে গেছে।

আমরা নায়ক নই, নায়িকাও নই,
একটি জীবনে
সাইড-রোলের বেশি আমাদের বরাত মেলে না।
রংচঙে মুখে তাই তোমাকে ও-কথা
জানাব, তা চিত্রনাট্যে নেই।

তোমাকে না-পেয়ে তাই নিশ্চিত মৃত্যুটি খুঁজি
একা-একা। খুঁজে আনি কবেকার
ব্লেড, দড়ি, ফলিডল— তবে
তৃতীয় শ্রেণির কিছু বাংলা সিনেমা
এইসব উপায়ের প্রতি আমাকে সন্দিহান করে।

তোমাকে না-পেয়ে আমাকে তো মরতেই হ’ত,
তাই আমি কবিতা লিখেছি।
তৃতীয় শ্রেণির কোনো বাংলা সিনেমা, ভাগ্যিস
ও-পথে হাঁটে না!

গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝরেছিল ফুল…

আমার বিছানায় এক শিউলিগাছ আছে।

এমনিতে চোখেও পড়ে না, শুধু
খরতপ্ত ঘুমে
সারা শরীর দিয়ে আমি শিউলিগাছ হই—

ডেঁয়োপিঁপড়েরা হাঁটে, সকরুণ
গানের পাখিরা
ঠুকরে ঠুকরে চলে এ-ডাল ও-ডাল;

গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝরেছিল ফুল।
এ-সকালে রোদ তাই চিকন-চিকন— ভ্রমরের মতো

কুসুম কুড়োতে আসে বালিকাটি কুসুমতুলহ,
ঝুঁকে পড়ে চোখের পাতায় এই দৃশ্যটিকে

আমি সবিশেষ ঈর্ষা করি, এই দৃশ্যে
প্রভু আমি অন্ধ হয়ে যাই…

গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝরেছিল ফুল

…একাই, একাই!

ফেব্রুয়ারি

একটি হাওয়া মনখারাপের, একটি হাওয়া সর্বনাশী—
একটি হাওয়া পার ক’রে ফের তোমায় কেবল দেখতে আসি…

একটি হাওয়া দূর শহরের বাসন্তী রং সরস্বতী,
কার হাতে কোন হাতের বাঁধন দেখেই আমার কী দুর্গতি

বুঝলে না আর, সব কথা কার কে-ই-বা কখন বুঝতে পারে…
একটি হাওয়া বছর ঘোরায়, বান্ধবীদের বয়স বাড়ে।

একটি হাওয়া দূর বয়সের সাইকেলে ঠেশ একলা ছেলে,
একটি হাওয়া গন্ধপুষ্পে পারফিউমের আভাস ফেলে

ঝড় তুলে যায় বুকের ভিতর দূর শহরের হলদে শাড়ি—
ফিরিয়ে দেওয়া সেই মেয়েটির চোখের মতন ফেব্রুয়ারি…

Categories
2021-Aug-Poem

রঙ্গন রায়

জানুয়ারি মাসের কবিতা


প্রিয় কবির কবিতা পড়ছি
প্রথম দিক কার কবিতা
তাঁর মেয়ের সাথে আমার
এক অলৌকিক বন্ধুত্ব আছে
কবিতায় ওর ছোটোবেলা দেখা যাচ্ছে
কবিতায় আমাদের অলৌকিক বন্ধুত্বের ছোটোবেলা দেখা যাচ্ছে


যে-সব কবিতাগুলোয় তুমি আছ
সে-সব কবিতা তোমার বাবা পড়ে
বলে, এত সুন্দর কবিতা তুমি লেখো কী করে!

চাঁদের হাসি বাধ ভেঙে যায়


করলা নদীর ধারে
সদর বালিকা বিদ্যালয়—
এই স্কুলে তুমি কোনোদিন পড়োনি
তবুও সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে এখানে এলে
তোমাকে তীব্র রূপসী মনে হয়


যোগমায়া কালীবাড়ির চাতালে চশমা খুলে রাখো
উত্তল লেন্সে মন্দির বড়ো হয়ে ওঠে
বড়ো হওয়া লক্ষ্য করে তাকাই তোমার দিকে
শ্বেতপাথরের মেঝেয় গোলাপি আঁচল
ঈশ্বর ধন্য হয়ে ওঠে


ইঞ্জেকশন নিতে হাসপাতালে এসেছি
শরীরের ভেতর কুলকুল করে ভয় ছড়িয়ে পড়ছে—
একদিন ইঞ্জেকশন নিয়ে ফিরে এসে তুমি
আমার দিকে তাকিয়েছিলে—
স্কার্ফের আড়াল দিয়ে কেয়োকার্পিনের গন্ধ
হাসপাতালকে পবিত্র করে তুলেছিল
আমাদের যাবতীয় তর্ক একপাশে রেখে
নদীর কাছে গিয়েছিলাম
ঘাসের শিষ মুখে দিয়ে বলেছিলে
বিড়াল তোমার সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী


আবেগপ্রবণ হওয়া আমাকে মানায়
তুমি অঙ্কের লোক, চুড়ির দর করতে জানো সঠিকভাবে
বাজারের হিসেব করতেও দক্ষ
আমি একদিন শিখে নেব এ-সব
তখন বাংলা হরফে চিঠি দেব
তুমি কমলালেবুর গন্ধ পাঠিও খামে ভরে


এই কবিতাগুলোর ভেতর তোমাকে রেখে দিলাম
পৃথিবী জুড়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়বে