Categories
2021-Aug-Poem

জাতিস্মর

বিড়ালচরিত


যা অদৃষ্ট তার কাছে গোপন করিনি
সন্দিগ্ধ আতর।

আমার প্রাণময়বিড়ালটি মৎস্য ধর্ম
ছেড়েছুড়ে বসে আছে— রোদসন্নিকটে—
আমার সন্দেহবিড়ালটি শিউরে উঠছে
স্বগন্ধহীন— দর্পণের দিকে…

ওই দর্পণ যেন প্রসব করছে তার চতুর্থ শ্বদন্ত


নীল চোখ বন্ধ রাখার স্বভাব
দরজার ওপারে গেলে আর থাকবে না

এমনই শিক্ষা দিয়েছি আমার ভক্তিবিড়ালটিকে

কাঁধের থেকে এক খাবলা মাংস
তুলে নিয়ে খেতে খেতে
আচমন মন্ত্র গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে
সুষুম্নাবিড়ালটির


পাথর হয়ে যাবার নির্দেশ অমান্য করে
স্বয়ং পাথরদেবতা আমাকে দান করেন
প্রচণ্ডবিড়ালটি

আমার বাহু দু-টি যে মজবুত হয়েছে আরও
এ ব্যাপারে আমার বাহুদ্বয় এখনও সন্দিহান

যেন প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসা
মর্মনখরের কাছে তারা
এখনও অভিসম্পাত মার্জনা চায়…


আমার ভ্রমণবিড়ালটি দেখি এখনও আমার
দু-চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে চলছে

সারাদিন জলের ওপর জল
নষ্ট ঢেউ, অশ্লীল পদচারণা
তারপরে বালি আর কাঁকড়ার আশ্চর্য মৈথুন দেখে
আমার চোখ কি ক্রমে ক্রমে

যৌনাঙ্গের মতো দৃঢ় হয়ে উঠছে?


এমন মন্দির আমি কখনো যাইনি
যেখানে যন্ত্রণার গর্ভগৃহ আছে

তবে আমার মস্তিষ্কবিড়ালটি
বার ছয়েক ঘুরে এসে আমার সুপ্রাচীন কানে
ফিসফিস করে জানিয়ে গেছে

যন্ত্রণা আসলে পদদলিত ফুল

Categories
2021-Aug-Poem

শীর্ষা মণ্ডল

অথ যাত্রাকথা


আমাদের সুরেলা কান্নার শব্দ শুষে নেয় কুকুরের গলা– দিন মরে যাওয়ার প্রলাপে এপাড়া-ওপাড়া জুড়ে বাজতে থাকে নিকষ শোকের বীণ, সমস্ত অন্ধকারের স্তন জুড়ে ফুটে ওঠে বেদনার বৃন্তকুসুম— এরকম অপরূপ সমাধিস্থলে জেগে থাকা চোখ গুনতে থাকে অগুনতি প্রহরের ছায়া; আর বেদনার্ত শিউলির ফ্যাকাশে শরীর মাতৃচ্যুত হয়ে রজনীদাইয়ের কোলে নির্বাক শ্মশানযাত্রা করে। এরূপ অনুপম যাত্রার পথে পড়ে থাকা খইয়ের মতো আমাদের সফেদ সুরেলা কান্নার শব্দ শুষে নেয় কুকুরের গলা। শুষে নেয় যুধিষ্ঠিরের একাকিত্ব শুঁকতে থাকা লেজ।


একটি বসন্তকে ছেড়ে দ্বিতীয় বসন্তের দিকে যাত্রা— অনেকটা যুধিষ্ঠির আর অনুগামী সারমেয়র যাত্রার মতোই। ক্ষীণ মৌন দৃষ্টি, ধীর পদক্ষেপ— একটি লোক থেকে দ্বিতীয় লোকে। একটি ইন্দ্রিয় থেকে দ্বিতীয় ইন্দ্রিয়ের দিকে। এমনই যাত্রা অনন্তের স্রোতে— আমরা চলেছি। হাঁটছি। পথ আর অনন্তকে সমার্থক করে তুলছি। মাতৃপক্ষীকুল ফিরে আসছে গার্হস্থ্যে। সুতো বুনে বুনে আরও নিবিড় করে তুলছে গার্হস্থ্যের রং। একটি বসন্তকে ছেড়ে দ্বিতীয় বসন্তের দিকে চলমান মানুষ সেই শিল্পীসত্তার নাগাল পেতে অসমর্থ— যাবতীয় প্রাণীজাতির প্রতি অক্লান্ত আক্ষেপ-দৃষ্টি মানুষকে নিরাসক্ত করে তুলছে। কিংবা আসক্তি অব্দি পৌঁছোতে না পারার যন্ত্রণাকাতরতা। নির্লিপ্ত যন্ত্রণা। যেহেতু যন্ত্রণার কোনো গন্ধ নেই। যন্ত্রণা নিজেই একটি শমীবৃক্ষ। জল বা সার ছাড়াই যে নিজেকে চড়চড় করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আকাশ ছোঁয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেখে। স্বর্গের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মাতৃপক্ষীকুল তার গায়ে উপেক্ষা মাখিয়ে চলে যায়। ফুল ফোটে। ফুলের ছায়া পর্যন্ত যন্ত্রণা পৌঁছে যায়। যন্ত্রণাফুল অনেকটা রংহীন, গন্ধহীন মনে হয়। আপাত মনে হওয়া। আদতে যন্ত্রণাগাছের জাইলেম-ফ্লোয়েম দিয়ে নুন-জল নয়, বসন্ত যাত্রা করে। একটি বসন্তের খোলস যন্ত্রণাগাছের পায়ের কাছে মরে পরে থাকে। যুধিষ্ঠিরের পার্থিব ত্যাগ করা কুকুরের হিসি লেগে থাকে সেই মরা বসন্তের শরীরে। দ্বিতীয় বসন্তটি তখন ঘাড় গুঁজে ওঠানামা করছে। আড়াল হচ্ছে সেই অসীম যাত্রার নিঃশব্দ বাঁশিটি। একটি স্বর্গীয়ফুলের দিকে যাত্রা করছে যুধিষ্ঠির আর তার সারমেয়। একটি অনন্ত লোভের দিকে যাত্রা করছে যুধিষ্ঠির আর তার সারমেয়। একটি অনন্ত যাত্রার দিকে যাত্রাপালা করছে জগতের সমস্ত যুধিষ্ঠির আর তাদের অস্থির সারমেয়দল।


যে-যাত্রার কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা দ্ব্যর্থক হতে পারত। কিংবা বহু-অর্থক? পাঠক নিজেই তার সাব্যস্তকারী। লেখকের দোয়াতে ব্যাখ্যার লাশ নির্বাক। লেখকের আস্ত কলমটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তাঁরই হৃৎপিণ্ড। রক্ত পাম্প করার যে-প্রত্যাশিত যন্ত্রটি লেখকের প্রতি শিরায় প্রতি কোশে জীবন পৌঁছে দিচ্ছে মিলিসেকেন্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, সেই যন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা পড়ে থাকে সাদা পাতায়— একটি বিকল জাহাজ যেন একবুক অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডেকে দাঁড়িয়ে লেখক। কিংবা রবিনহুড। হাতে দূরবিন। মগজে বাঁচার নিরুত্তাপ চিন্তা তার হাত-পা-লেজ কুকুরের মতো গুটিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অলস। জাহাজের চারিপাশে শুধুই নৌকা। লাইফবোট নয়, নিছক কাগজের সাদা সাদা নৌকা। যেন এক-একটি শ্বেতশুভ্র রাজহংস। সরস্বতীর কাপড় ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে দেশান্তরে। ডেকের রবিনহুড স্থিরনেত্রে দেখছে কীভাবে অজস্র সাদা রাজহাঁস দেশান্তরে চলেছে। কীভাবে তারা যাবতীয় রঙের পালক খসিয়ে ফেলে কষ্টের বজরা বানিয়ে নিজেদের ছুড়ে দিচ্ছে আকাশে। একে একে। দূরে পাহাড়ের মাথায় স্তব্ধ কুটির। কালিদাস একমনে যক্ষ রচনা করে চলেছে। মৃন্ময় যক্ষ। সারি দিয়ে দাঁড়ানো। তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ভাঁজ হওয়া সাদা মেঘের দল। ওরফে রাজহংস। ওরফে কাগজের নৌকো। রবিনহুডের দূরবিনের কাচ ঝাপসা হয়ে উঠছে জমাট বাঁধা উপেক্ষার ধোঁয়ায়। এরকম অবস্থায় সিগারেট ছাড়া রবিনহুডের আর কোনো সঙ্গী থাকার কথা না। এরকম অবস্থায় একটি যাত্রা কত-অর্থক হয়ে উঠতে পারে? রবিনহুড তা জানতে চায় না।


জানা এবং অজানার মধ্যবর্তী যে-রাস্তা, তার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকো তুমি। তোমার চোখ রবিনহুডের। পা-দুটো যুধিষ্ঠিরের। আর তোমার লেজ, যেটা আমি ছাড়া আর কেউ কখনো দেখতে পায়নি, তা সারমেয়র। একটি অজানার প্রতি নির্মিত অদৃশ্য সিঁড়ির দিকে উদাস তোমার চোখ। যাকে পড়তে চেয়ে রবিনহুড দূরবীন কিনে ফেলেছিল তার হৃৎপিণ্ড বন্ধক রেখে। তোমার যুধিষ্ঠির পা-দু-টি ঘুঙুরহীন— যে-অমৃতশব্দের ভারকে তুমি বিক্রি করেছ বসন্তরোগ চিকিৎসকের ক্যাম্বিসব্যাগের কাছে। অতঃপর তুমি একটি ভারহীন প্রাণী। সারমেয়র মতোই। জানা থেকে অজানার দিকে ধাবিত হওয়ার পথে তুমি ভারশূন্য। তোমার সারমেয় ভারশূন্য। বসন্তঋতুর বাতাসের মতো দায়হীন। আর সেই ভারশূন্যতার যাত্রাপথে দ্বিতীয় একটি তীব্র গতিসম্পন্ন হৃৎপিণ্ড কিংবা বসন্তকালীন নিঃসঙ্গতা তোমার গতিরোধ করছে। তোমার যুধিষ্ঠির পায়ের ছাপ নিঃসঙ্গতার শরীরে ধাক্কা লেগে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘনিষ্ঠ সারমেয়র ডাক তোমাকে গন্তব্যের ফুল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছে না। পথ দেখাতে পারছে না। একটি নিঃসঙ্গতার ভেতরে যে-স্থিতিশক্তির ভাণ্ডার, তা তোমার গতিজাড্যকে চূড়ান্ত হারিয়ে দিচ্ছে। তুমি হতাশার সিঁড়িতে ধপ্‌ করে বসে পড়ছ। তোমার সারমেয় তোমার পায়ের কাছে লেজ গুটিয়ে। তোমার এই পরাজয়ের আনন্দ, রবিনহুডের পরাজয়ের আনন্দ থালায় সাজিয়ে এগিয়ে আসছে দ্বিতীয় সেই জেদি বসন্তঋতুটি। রোগের পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে তোমার বরণ হচ্ছে সুমধুর। হে প্রেমিকা, হে জগতের সমস্ত দুর্বার পতঙ্গপ্রেমিকার দল— একটি যাত্রা কি শুধুই নিছক একটি যাত্রা হতে পারে না?

Categories
2021-Aug-Poem

রাজর্ষি মজুমদার

পশ্চিমঘাটের গান


কারখানা আজকের মতো শেষ— ফেরবার পথে তুমি আমি চলো পাহাড়ের দিকে যাই— চলো নিঃশব্দে টিটি পাখিদের বাসা খুঁজে দেখে আসি তাদের বিশ্রাম।

পুরোনো মানুষের গুহা পার হয়ে ডান দিকে গেলে সমস্ত প্রান্তর দৃশ্যমান হয়ে আসে—
তুমি সে-সব জানো। তুমি জানো বৃষ্টির পর ঘনশ্যাম মেঘ করে আসে বিরহের গায়ে, দু-একটি পোকা ওড়ে চিরন্তন তাপের সন্ধানে— তুমি ঠিক জানো প্রত্যেকের নাম— বুকের নিকটে এনে তাদের যাত্রা পূর্ণ করে দাও।

আর আমি কাঠ জড়ো করে রেখেছি গুহায়—
বৃষ্টি নামলে ফের আগুন জ্বালাব।


টুংটাং ভেসে আসছে নির্মীয়মাণ বহুতল থেকে, তার পেছনের আকাশ এখনও ধূসর— এবার কি তবে বৃষ্টি হবে? এবার কি আমরা খাবারদাবার সাজিয়ে বসে থাকব বারান্দায়?

সকাল হলে এই কিশোর শহরটির রাস্তায় নেমে আসে উড়ুক্কু ভেড়ার পাল— আর্দ্র বাতাসের স্পর্শে তাদের ডানাগুলো অদৃশ্য হয়ে থাকে, আর মেষপালকটি ঠিক যেন মারাঠি যুবা— পশ্চিমঘাটের সবুজ ঢালগুলি বেয়ে সিধে নেমে এসেছে এই কংক্রিটের রাস্তায়। হলদেটে পশম নিয়ে তারা এগলি সেগলি চক্কর কাটে ক্রমাগত— মেঘ করে এলে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।

সারাদিন আমরা এই ঘরে গান শুনি— শুয়ে শুয়ে ভেড়াদের গুনে চলি রোজ।


ছোটো শহরের মাঝে খুন হয়ে গেছে সদ্য যুবতি— সেই রহস্যকাহিনি আমাকে বিব্রত করে। অজানা গল্পে বুঁদ হয়ে অভ্যাসমতো খুঁজে বের করি কার কী অভিপ্রায়— কুয়াশায় কোন গাড়ির আলো দৃশ্যমান ছিল— কেনই-বা প্রেমিকটি বিছানা ছেড়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে গেছিল বাড়ির থেকে।

নানান প্রশ্ন ও উত্তর জানালাভরা এই ঘরটিতে জেঁকে বসে— ধোঁয়ার মধ্যে ফুটে ওঠে কুহকের কল্পনাজাল। সাড়া নেই ভেবে তুমি এসে দেখ অনুতপ্ত যাজকটি এককোণে বসে কাঁদছে— গোয়েন্দা পরিষ্কার করে নিচ্ছে ব্যবহৃত পিস্তলখানি— ঝরনার মাঝে পড়ে থাকা মেয়েটির চোখ খেয়ে যাচ্ছে সোনালি মাছেরা।

Categories
2021-Aug-Poem

সুতপা চক্রবর্তী

গ্রামের নাম শঙ্খনীল, নদীর নাম স্যেন


আমাদের দু-জনার স্নানযাত্রার সাক্ষী একমাত্র এই নদী।

এখন মধ্যরাত। পৃথিবীর কেউ তা
জানে না। জানে না কোনো
আচাভুয়া পাখি। এই যে নদীর
ধারে বসেছি আমরা, আর সারা
আশমান জুড়ে বিকট পূর্ণিমা
অঝোরে ঝরে পড়ছে আমাদের শরীরে
দেখ, কেউই তা দেখছে না।
আমরা কীভাবে নিজেদের
আড়াল করেছি, কীভাবে একে
অপরের দিকে ছুড়ে মারছি মুঠো
মুঠো বৃষ্টিস্নান
তা দেখার কোনো চোখ নেই। তা
শোনার কোনো কান নেই।
পৃথিবী এখনও দৃষ্টিহীন।
পৃথিবী এখনও শ্রবণশক্তিহীন


এসো, এই নদীর ধারে দু-জনার
বৃষ্টি সাজাই। ধরো, একখানা
কুঁড়েঘর, বাঁশের বেড়ি। এ-গ্রামের
নাম শঙ্খনীল । নদীর নাম স্যেন।
সে-নদীর ধারে আমাদের সংসার।
অবিরাম জোছনা পড়ে। অবিরাম
বৃষ্টি পড়ে। আমাদের সাতপুত্র
ডাগর ডাগর। আমি তুমি জোছনা
খাই। বৃষ্টি খাই।
রাজা, ওগো রাজা, এসো এসো,
এই নদীর ধারে দু-জনার বৃষ্টি সাজাই


বৃষ্টি সাজাতে গিয়ে মনে পড়ল
এখানে, এই নদীর ধারে বসে
আমাদের সারারাত ভেজার কথা
ছিল। এখন কি বৃষ্টি হবে, রাজা?
তোমার শরীরে এত আমার গন্ধ
কেন? আমার শরীরে এত
তোমার গন্ধ কেন? যদি কেউ টের
পায়! লুকোও রাজা, নিমেষে
লুকোও। তোমার ভেতরে
লুকোও আমায়


শোনো না। দাঁড়াও এবার। একটা
চুমু খাই!

কত কত বিরহের পর আমাদের
দেখা হল, রাজা! যত বলি তত
যেন কম পরে ভাগে। আমার
ভাগে তোমার ভাগে, সব
মিলেমিশে একাকার এখন।
চারদিকে তুমুল বৃষ্টি। তুমুল
তুফান। রাজার শরীরে আমি
আঁকি সংসার। সংসার। নিরাকার।
রাজা, রাজা, ও আমার জন্মের
রাজা। এসো, আচমন করি তোমার


দেখ, এই নদী এই দীর্ঘ রজনী
আমাদের কীভাবে আগলে
রেখেছে!

তুমি পরজন্মের কাছে মানত
করো আমারে। অথচ প্রতিটা
জন্মেই আমি এসে ধরা দিয়ে
যাই। রেখে যাই আমার ছাপ।
তোমার শরীরে দিয়ে যাই
আমারই বৃষ্টি, বন্যা। কী আবেশে
সেখানে ঘাই মারো তুমি! ঘাই
দেও আমারে। বোঝো না জন্ম। বোঝো না ইঙ্গিত। আমিই তো
তোমার একমাত্র শেকল,
সাতনরী সোনার হার। ওহ্ রাজা,
মানত করো। মানত করো। মানত
করো আমারে বার বার

Categories
2021-Aug-Poem

সোনালী চক্রবর্তী

গুস্তাখিয়া

“দুনিয়া মে দুখ অউর ভি হ্যায় মুহব্বতকে সিভা”

কিছু বিস্ময় রহিয়া গেল… এত যে চাঁদ পোড়ালাম, কিছুতেই বুলবুলি পেরিয়ে রাঙা দিঘিতে আলো জ্বলল না। জোনাকি ভেঙেচুরে ছিটিয়ে দিলাম শবাগারের মসৃণ দেওয়ালে, তবু শ্যাওলারা ডানা খুঁজে পেল না। আয়ত্বে এল না কোনো নাজুক হরকত। সংসারসিদ্ধ? অসাড়চিত্ত। অথচ এত হাঁস ফুটেছিল, কচুরিপানায় আধডোবা দেবীমুখ বেয়ে, সুখ শব্দের আগে প্রথম স্বরবর্ণ এত আদরে কেন জড়িয়ে থাকল, জারিন-এ-জুনেদের টের পাওয়া হল না।


“গিনতি উসি কি হোতি হ্যায় যো হাসিল না হো সকা”

ক্রিয়াপদহীন নির্ভরতা চাওয়ায় মণিপুরে কিছু আগুনের দান জমা হল, বিশেষণহীন মুক্ত হতে গিয়ে করতল উপুড় করে আমি অবান্তর ক্ষমা এঁকে দিলাম। খোয়াইশ না জাগুক অথবা আসুক বিতৃষ্ণা বেইমতেহা, নৌকাকে ঘনিষ্ঠ হতেই হয় তরঙ্গলীলায়। জীবন এমনই, চরাচর নির্লিপ্ত থাকে প্রত্যাশা পরাজয়ের এক্কা দোক্কায়। বিদ্ধ করতে বা সম্মাননায় ক্রুশের বক্তব্য কেউ শুনেছিল অথবা অলিভ পাতার?


“সস্তি জিন্দেগি, জিনে কে তরিকে মেহেঙ্গে”

চাঁদ ছিঁড়ে ছিঁড়ে কি আর ভাঙাচোরা অন্ধকারের দাবিদাওয়া ঢাকা যায়? আমি ভিজতে বসলেই শাসনের সাতকাহন বোনো, অথচ সূর্যপ্রণাম করে রোজই অজস্র শিশিরের মৃত্যুকে স্বীকৃতি দিয়ে থাক। ভেবে দেখ, পৃথিবীর কোথাও তা থৈ বলে কোনো গ্রাম আছে কি যেখানে আবরণ উদাস কোনো দিওয়ানি পা ফেলতে পারে নির্দ্বিধায়? হেন মন্দিরও তো দেখলাম না, যার ভাস্কর্যে ন্যূনতম আবরণে যক্ষীর নিজেকে মোড়ার অধিকার রাখা হয়। এখন বুঝি কতটা অন্ধত্বপ্রবণ হলে সহস্র সহস্র স্বাধীনতাকে চিড়িয়াখানায় কুপিয়ে উচ্ছ্বসিত করতালি চাওয়া যায়।


“দেখ কর আয়িনা তসল্লি হুয়ি কোই অউর ভি হ্যায় অকেলা”

ভাঙা ভাঙা শার্সির ভিতর যেভাবে প্রাসাদ হবে বলে ধুলো আর খড়কুটোরা পায়রার ঠোঁট বেয়ে আসে, দেখেছ এক কর্মী নির্ভর ভাঙা জাহাজের কারখানায় কীভাবে ছেনি হাতুড়িরা তাকিয়ে থাকে? আমিও একদিন বুড়ি ছোঁব বলে রূহ খুঁটে খুঁটে শিকড় ভাসিয়ে রাখি। দরিয়ার পরিণতি রেগিস্তান হবে একদিন, জলসাঘর ভেঙে গনিমতে বসবে যত আদিম পরিযায়ী, বাষ্পের বরফ হতে হতে পেরিয়ে যাব সভ্যতা, জেলিফিশ যতই নমনীয় হোক, ভাস্কর কি তার থেকে খাজুরাহো আশা করে?


“কুছ নেহি থি তো খুদা থা, কুছ নেহি হোতি তো খুদা হোতা”

আগুনের স্নান শেখা হবে বলে বার বার বরফের ছ্যাঁকা খেয়ে ফিরে আসি। বাঁচিয়ে রাখি সে-ক্ষতের নীল চকমকি সঙ্গোপনে। বিষাদের পাখি মাতাল হলে ঠুকে পুড়িয়ে নিয়ে বেড়ে দি কবিতার নামে তোমাদেরই পাতে। তোমরা বুঝতে পারো না, লবণ কোথা থেকে মিশলে মাংসই চিরদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখাদ্য হয়ে ওঠে।

Categories
2021-Aug-Poem

হাসান রোবায়েত

হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস

এক-একজন পাগলের থাকে এক-একরকম চরিত্র, যেমন পৃথিবীতে রাজাদের ইতিহাস আছে, আছে যুদ্ধের ইতিহাস তেমন পাগলদের জন্য কি কোনো ইতিহাস আছে? নিদেনপক্ষে পাগলকোষ? এই যেমন আমার মায়ের আপন চাচা ঝরু মণ্ডল, একদিন ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কামারজানির উপর পাগল হয়ে যান তিনি—

একদিন, সূর্যাস্তের পাশে দেখা গেল ঝরু মণ্ডল চুপচাপ বসে আছেন— হাতে পায়ে শেকল— তখন কী ভাবছিলেন তিনি? তার আত্মার চারপাশে ম ম করে প্রজাপতি উড়ছিল হয়তো— বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে ঝরু মণ্ডল বলছিলেন, ‘প্রজাপতিরা পাখা নাড়ালেই ঝমঝম করে বৃষ্টি আসে পৃথিবীতে আর একজন সালেহা বেগম পায়ে নূপুর পরে হেঁটে যায় ঠান্ডা বাতাসের দিকে—’

আমার মা আমাকে সাবধান করতেন— ‘প্রত্যেক কবিই আসলে ঝরু মণ্ডল যারা বৃষ্টির শব্দকেও মনে করে সালেহা বেগম—’

আরজু পাগলি

পাগলামি সম্বন্ধে পাগলদের চেয়েও বেশি জানে পুবালি বাতাস— সেদিনও হাওয়ায় কাঁপছিল আর্ত দুপুরের ছায়া— একটা প্রাইমারি স্কুলের রুমে ক্লাস নাইনের ব্যাচ পড়াতাম আমি— দরজা থেকে সোজা রাস্তা দেখা যায়, ছোটো টঙ দোকানে কাঁচা ভিড়— বোর্ডে লেখার এক ফাঁকে আমাদের রুমে ঢুকে পড়ে আরজু পাগলি— সোজা আমার হাত থেকে চক নিয়ে কালো বোর্ডের উপর লিখে ফেলে ‘সাইফুল’— আমি জিজ্ঞাসা করি— কে উনি?— আরজু পাগলি হাতের ভঙ্গিমায় প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখায়—

আমার ছাত্রদের মধ্যে একজন যা বলল তার সারমর্ম এই— সাইফুল দুবাই থাকে, বিয়ের পরপরই সে দুবাই ফিরে গেলে বউকে না করত মোবাইল না নিত কোনো খোঁজ! গ্রামের কয়েকজন যৌনবিষাদগ্রস্ত যুবক রাত বিরাতে জ্বালাতন করত তাকে— সাইফুলের জন্য সবুর করতে করতে একদিন পাগল হয়ে যায় আরজু— এরপর থেকেই গাছে মাটিতে শূন্যতা পেলেই লিখে দিত ‘সাইফুল’— যেন তার সমস্ত শূন্যতা থমথম করছে কেবল সাইফুল নামের পাশে—

এরপর গ্রামের ছেলেরা তাকে দেখলেই ক্ষ্যাপাত, ‘স্বামী বিদেশ’ আর আরজু পাগলি চিৎকার করে বলত— ‘সমস্ত গাছে গাছে ফুটে আছে আমার বিবাহ—’

সিদ্দিক পাগল

আমাদের গ্রামের সিদ্দিক পাগলের কথাই বলি না কেন—! একবার চূড়ান্ত রকমের পাগলামির পর তাকে ধরে-বেঁধে পাবনায় নিয়ে যাওয়া হল— সিদ্দিক পাগলকে দেখে ডাক্তার একটা চারদিক ফুটা বালতি দিয়ে বলল ‘এইটা ভরে আনো দেখি—’ সিদ্দিক তো মহাক্ষ্যাপা সে ডাক্তারকে বলল আপনাকে পাঁচটা জীবন দিলাম, পাঁচ জীবনেও বালতিটা ভরাতে পারেন কিনা দেখি—!

এখন আমার জীবন সিদ্দিক পাগলের সেই চারদিক ফুটা বালতিটার মতো, যতই জীবনকে আলো ও হাওয়া দিই না কেন জীবন ঝরে যায় দশদিক ফুটে থাকা অন্ধ ফুলের মতো—

রাবেয়া পারভীন

প্রতিটা পাড়াতেই নির্ঘাত একজন না একজন পাগল থাকে— তাদের প্রত্যেকেরই থাকে পাগলামির ভিন্ন ভিন্ন আর্ট— কেউ হয়তো কেবল দুই টাকা পেলেই শান্ত আবার কেউ হয়তো এক কাপ চা পেলেই খুশি— আমি একজন পাগলকে চিনতাম যে সারা রাস্তাভরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে রাখত ‘রাবেয়া পারভীন’— তার মায়ের নাম— একদিন যে তাকে রেখেই পালিয়ে গেছে তার বড়োচাচার সাথে—

কামনা

বদ্ধ উন্মাদেরা কীভাবে নারীকে কামনা করে আমি জানি না— শুধু বিষণ্ন দুপুরে চানখারপুলে দেখেছিলাম একজন অর্ধনগ্ন পাগল এক নারীর নাম ধরে শীৎকার করতে করতে মাস্টারবেট করছে রাস্তায়—তার চারপাশের রিকশা, গাছ, হাওয়া সবাই যেন তার কামনার নারী হয়ে তখন উড়ে বেড়াচ্ছে কল্পনায়—

Categories
2021-Aug-Poem

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

পাথরের ভ্রূণ

পৃথিবীকে উলটো করে ঝুলিয়েছি হিংস্র বাঘটির পাশে। সে অনন্তকাল ধরে বসে আছে সুতোর রাস্তায়। সুতোটি নম্র ভারি। এতকাল না ছিঁড়ে কীভাবে যে ধরে রাখে প্রান্তর, টিলা, বন্যপ্রাণ সব, সেই ভেবে গম্ভীর হয়ে যাই। সহাস্যে বলতে পারি না কোনো শ্লোক। দূরের পাহাড় থেকে নেমে আসে বরফের সিঁড়ি।

আমার উল্লাস আজ ফেলে দিয়ে যাব এই নিঃস্ব জঙ্গলে। যেখানে বৃক্ষের হাতে দু-টুকরো হয়ে পড়ে আছে মানুষ। আকাশ ফেটে গিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। সমস্ত ঝোরার ভেতর থেকে উঠে আসছে পাথরের ভ্রূণ। এমন স্থানের কাছে নতজানু হয়ে ফেলে দিয়ে যাব সব কাঙ্ক্ষিত ভুল।

আমাকে ক্ষমার কোনো প্রশ্ন তুলো না। তার চেয়ে জ্ঞানীর কাছে যাও৷ দেখ কোন কুটির থেকে বেরিয়ে এসে পাখিরা ছড়িয়ে দিচ্ছে বীজ। আগামী ক্ষুধার মাসে তার থেকে জন্ম নেবে শ’য়ে শ’য়ে নগ্ন তলোয়ার।

দাঁত খুব স্থির। হাঁ-এর মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শূন্যতার রং। একটি গর্জনে কেঁপে ওঠে শিরা। পৃথিবীকে উলটো ঝুলিয়ে রেখে আমি বাঘটির কাছে যাই অপার সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিতে।

হাড়ের ধনুক

এল মৃদু ঘ্রাণ সেই ঘৃতকুসুম জানালা পেরিয়ে। আমি সেই বসে আছি সহস্র রোদের মাথায়। কেউ আমাকে স্নান করিয়ে দেবে আজ মধুভাণ্ড ঢেলে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে যাব নিজের গভীরে। সেখানে সরল পথে একটি দু-টি হলুদের গাছ। গাছে গাছে টেনে রাখা মাটির চাদর। আমি কি আমাকে দেব গোধূলির বেড়া?

এসো নীচু মেঘ পেরিয়ে। দাও তুলে মন্দ কুঠার। যত আছে ভুলে যাওয়া আঘাতের নীরব কথন, তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শুধু এক হাওয়া জাল আটকে ধরে যাবতীয় আক্ষরিক ব্যথা।

প্রবল স্নেহের বশে নিজের করোটি শূন্যে তুলে ছুড়ে দিই জোৎস্নার ভেতর। থোকা থোকা গাছপাকা আলো ঝুঁকে পড়ে হাড়ের ধনুকে। তারপর শব্দ, জল। আমার সহজ কথা নিজেই হারাই।

এ-পর্যন্ত পড়ে কেউ থেমে যাবে জানালার ধারে। আমার স্নানের দৃশ্য ক্রমশ গভীর হয়ে চলে যাবে অন্তঃপুরে। বাইরে কিছুই নেই, কেবল হলুদ গাছে দু-খানি পাখির মতো সন্ধ্যা এসে বসে থাকবে হাহাকার করে।

খরগোশের দিনলিপি

জ্বরের নিষেধ মানো হে আমার সামান্য বাঁচা। পঞ্জিকা মতে সে এল কোন চতুর্ভুজ পেরিয়ে— আজ আর জানার উপায় নেই। শুধু তাকে আশ্রয় দাও শরীর কুটিরে। বেড়ে দাও শান্তি একথালা। যেন তার অভাব না থাকে।

জ্বরটি ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে খরগোশের মতো। তাকে দিই ঘাসের বড়ি। ছোলা ভেজানো মিক্সচার। সে খায় আর বেড়ে ওঠে কুটিরের ভেতর। চারিদিকে হুলুস্থূল ফেলে দেয়। কখন যে আমার চুলের মধ্যে বসে অন্যের নাক কামড়ে দিচ্ছে বোঝার আগেই সে আবার চুপ।

আমাকে ম্যাজিশিয়ান ভাবা এবার বন্ধ কর তোমরা। আমার কোনো টুপি নেই, রুমাল নেই। আমি অতি যত্নে এই খরগোশটিকে আমার অন্দরে ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দূরে একটি সাইকেল চলে গেল আলতা বিক্রি করতে করতে। আমার খরগোশকে লাল করার খুব ইচ্ছে কিন্তু সাইকেল আমার ডাকের বাইরে চলে গেছে৷

তবু তোমরা নিষেধ করছ তাই এই ক-টা দিন আমি একটি পালঙ্ক এনেছি। তাতে শুয়ে থাকব আর নিজের সমস্ত ভবিষ্যৎ মুছে ফেলে শুধুমাত্র লিখে যাব খরগোশের দিনলিপি।

ভ্রূকুটি

নির্ণায়ক ফুল, তাকে লিখেছি অনন্ত কারুকথা
কোন পথে পথ আছে, কোন মেঘে মেঘ, ধুলোবালি
যাও বাক্য, যাও, এই শব্দে আর ঘুরো না অযথা
ফুটেছে, এই তো বেশ, তার মধ্যে প্রবণতা ঢালি

আরও ঢালি পূর্ণ পাপ, ঢালি নগ্ন প্রাচীনের মায়া
তাকে কি আদর দেবে? দেবে কোনো শেকড়ের গ্লানি?
শরীরে শরীর ঢেকে যে-মানুষ নিখুঁত, বেহায়া
অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে কেউ তার পরিচয় জানি?

না জানা কি অপরাধ? নাকি শুধু নির্ণয়ের ভ্রমে
ক্রমাগত কেটে, ছিঁড়ে পাতাগুলি সাজাই বাতাসে
ফুল, তার আত্মরতি, ফোটার সাথেই বাড়ে, কমে
এবং দেহের ছায়া অতি ধীরে গ্রাহ্য হয়ে আসে

লেখার পরেও থাকে অবিশ্বাস, সন্দেহের ত্রুটি
ফুলেদের পক্ষ নাও, নীচে রাখ জীবন, ভ্রূকুটি

আত্মগোপন

আমি দেখছি, পুরানো কুসুম থেকে তাকিয়ে আছে
আমার গৃহত্যাগী আত্মা
জন্মের সময় যে আমার টুঁটি ধরে নিয়ে গিয়ে ছিল
মৃত গাছেদের জঙ্গলে

পরণে চামড়ার বল্কল জড়িয়ে আমি শুয়ে রইলাম
গাছেদের হাড় পাঁজরার মাঝে
আমার মুখে দুধের বদলে ঝরে পড়ল শুকনো পাতা
ধোয়া জল
আকাশে আঘাত করে বজ্র ফিরে এল মাটিতে

আমার আত্মা সব দেখল আর আমাকে নিরোগ করে
ফিরে গেল লোকালয়ে

আমাকে দেখছে যারা বাজারে, বেশ্যালয়ে
কিংবা পার্টি অফিসে, সে আমি নই
আমার গৃহত্যাগী আত্মা

যেখানে দেখবে কোনো মৃত গাছে
একটি দু-টি নতুন জীবন
বুঝবে তারই আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছি আমি

Categories
2021-Aug-Poem

সৌভিক গুহসরকার

ফরিদপুর, বিক্রমপুর


ফরিদপুরের আকাশে
খাঁ-খাঁ হাওয়ার দুপুর উড়ে আসে

পুকুরের ধারে তালগাছ
চিল এসে ঝাঁপিয়ে নিয়ে যায় কাতল মাছ

দুই বালিকা মাঠ পেরিয়ে দিচ্ছে দৌড়, দূরে
নদী গেছে খেতের ভেতর ঘুরে

বাংলার আলোছায়া দেবীপক্ষে ঢাক
চিলের পেছনে ওড়ে ছাতারের ঝাঁক

বালিকারা তখনও জানে না, হয়ে গেছে শেষ
তাদের ছোটার মাঠ, চিল আর মাছেদের দেশ


গল্প শুনে জল চিনেছি, দেশ চিনেছি মাঠ
চিনেছি গ্ৰাম সেন-পুকুরের ঘাট

এক বালিকা রাত্রিবেলা উঠোন পেরোয়, ছোটে
ভূতের মতো তেঁতুলতলায় শেয়াল ডেকে ওঠে

হিম নেমেছে দূরে
গল্পে-চেনা মাতামহীর সাধের ফরিদপুরে


ঢাকা বিক্রমপুরে সোনারং গ্ৰামের পুকুরে
ভেসেছিল চাকরের লাশ

চারপাশে কিছু হাঁস
ঠোঁটের আঘাত করে বুঝে নিতে চেয়েছিল
জীবিত না মৃত?

কাটামুণ্ডু শিখেছে সাঁতার অবশেষে?
না হলে রক্তজলে কীভাবে রয়েছে ভেসে?

জানলা দিয়ে ঠোঁট কামড়ে প্রৌঢ়া তাকায়
চোখের সামনে দেশ শেষ হয়ে যায়


ছোরা খেলা শিখেছেন বালিকার মা, লাঠিখেলা
রুদ্ধশ্বাস রোমহর্ষক মেয়েবেলা

শিরায় শিরায় দেশমাতৃকা, স্বদেশগীতি
মুকুন্দদাস ও অনুশীলন সমিতি

স্বামী গান্ধীবাদী, বাপুজির পাশে
নোয়াখালির ঘাসে

দেশ স্বাধীন হবে, স্বপ্ন কত
ফুলের মতো

সংসার তুচ্ছ, দেশ আগে
সব সাধনা নষ্ট হল অবিশ্বাস্য দেশভাগে


সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে যাচ্ছ, সঙ্গে কী নেবে―
পেয়েছ ভেবে?

সমস্ত যেখানে ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়
সেখান থেকে আর কী নেওয়া যায়?

দরকারি কোনটা? অদরকারি?
গাছে বেগুন― আজ রাতে বেগুনের তরকারি―

গোরুটাকে কী বলে যাব? তালগাছগুলোকে?
শ‍্যাম রায়ের মন্দিরের ধুলোকে?

জন্মপত্র, পরিচয়পত্র নিয়েছ? আমরা কারা?
গাড়োয়ান দিচ্ছে তাড়া

দুটো ট্রাঙ্ক শুধু, রইল সমস্ত আলমারি
জামাকাপড়, কতরকমের শাড়ি

গয়না লুকিয়ে নাও, ডাকাতি হতে পারে রাতে―
আর আমাদের তুলসীতলা― ওকে তুলে দিয়ে যাব কার হাতে?

Categories
2021-Aug-Poem

নিয়াজুল হক

হাহাকার

একটা গোটা জীবন
স্লাইস্ড পাউরুটির মতোই একসঙ্গে থেকে গেল

কোনো শব্দ হল না

তারপর একদিন ছন্নছাড়ার মতো
টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সে

আসলে
তুমি হঠাৎ রাক্ষসী হয়ে উঠেছিলে

আর আমি
রাক্ষস

আমরা রাক্ষস-রাক্ষসী পরস্পরকে গিলে নিয়ে
উগড়ে দিয়ে

হাহাকার করি

যে-ট্রেনগুলো নেই

দূরপাল্লার ট্রেনগুলো সব
আমার চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল

স্পষ্ট দেখতে পেলাম
তাদের ঝমঝম শব্দ

কিন্তু ট্রেনগুলো একটাও নেই

ট্রেনগুলো আছেও,

তাদের দেহ, যাত্রীসাধারণ, ড্রাইভার, গার্ড, হকার
সব আমার চোখ নির্মাণ করে নিল

সমুদ্রের তলা থেকে মাটি ধরাতে ধরাতে দূর থেকে
দেখতে পেলাম

গোটা ঘটনাপুঞ্জ

ট্রেনগুলো নেই
অথবা আছে

মাপ

আমার আকাঙ্ক্ষার একটা মাপ আছে
আমি তার মধ্যেই থাকি

আমি তার ছাদে উঠি
তার সিঁড়ি দিয়ে নেমে
উঠোনে পায়চারি করি

তার মধ্যেই আমার
প্রেম, লুকোচুরি, আনন্দ, বিষাদ

তার মধ্যেই
আমি মৃত্যুপিয়াসি

তার বাইরে যেতে চাইও না কোথাও

হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা
হাত-পা ভাঙা কতজনকেই তো দেখলাম

আজও

আটাচাকির গমেরা
আজও অপেক্ষা করছে

তাদের বিষয়ে
ভবিষৎ পর্যালোচনার মিটিং চলেছিল
কয়েক শতাব্দী

আরও কয়েক শতাব্দী
চা-বিস্কুট

আজও আটাচাকির হলারে গম ঢালা হয়

আজও সাদা আটা দেখে
রাক্ষসেরা হেসে ওঠে

আজও গম
রোদে শুকিয়ে
ঝাড়াই-বাছাই করা হয়

এই সবকিছুর ভেতরে
গোলাবারুদ অপেক্ষা করে আছে

এই টাইম বোমাটিকেই
আজও আমরা দেখতে পাইনি

হত্যা

কী আর বলি
প্রশ্ন অনেক

এই যে পিছমোড়া করে
গাছের সঙ্গে বাঁধলেন
চড়-থাপ্পড় মারলেন

তারপর আরও
লম্বা চওড়া গোল
কতরকম অপমান

হয়তো খালি চোখে দেখা যায় না

কিন্তু একে আপনারা হত্যা বলবেন না?

মুনিষ বিদেয়

কুমোরপাড়ায় মূর্তি গড়া হচ্ছে

মূর্তিগুলো ধাপে ধাপে
মানবমানবী এবং প্রাণী হয়ে যাচ্ছে

উদ্যোক্তা এবং দর্শকমণ্ডলীর হাততালিতে
ফেটে পড়ছে পুজোমণ্ডপ

কেউ ভুলেও জিজ্ঞেস করে না
মূর্তির ভেতরে যারা রক্তমাংস ভরে দেয়
তারা শ্রমিক না শিল্পী

মণ্ডপের পেছনে কিছুটা দূরে
কেউ অন্ধকার চাদর জড়িয়ে নেয় গায়ে

উৎসব শেষে আলো নিভে গেলে
মুনিষ বিদেয় হবে

পেশিশক্তি

হাত থেকে
কলম পড়ে যেতে দেখেছি

প্রায়শই

পড়ে যেতে দেখেছি
থালাবাসন, চায়ের কাপ
অথবা তরকারির বাটি

সব থাক জমা দিয়ে রেখে ভেবেছি
এ-সব নেহাতই দুর্ঘটনা

ভবিষ্যৎকালের কথা
স্বপ্নেও ভেবে দেখিনি কখনো

পঁয়ষট্টিতে এসে
একজন বুঝতে পারলেন
শিথিল মাস্‌ল পাওয়ারের
আসল রহস্য কী

একমাত্র ব্যতিক্রম

রাজা বৃদ্ধ হলেও
শেষপর্যন্ত তাঁর পেশিশক্তি অটুটই থাকে

এবাদত

নামাজ পড়তে গিয়ে
জান্নাতের প্রসঙ্গটুকু বাদ দিলে
আমাদের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া বলতে
পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্য

আমার ছেলে যেন
জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করে আমার মেয়েও যেন মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করতে পারে

এগুলোই চাওয়া;

দীন ও দুনিয়া
দুটোকেই কীভাবে কবজা করব
তার ছক কষতে কষতে
আমি কতটা কাফের হয়ে গেলাম

খেয়ালই নেই সেদিকে;

এবাদতের নামে
গোটা একটা সমাজকে বেঁটে করে রেখে

আমিই একমাত্র তালগাছ হয়ে উঠতে চাইছি;

ধুলোয় মিশে থাকা আল্লা স্বয়ংক্রিয় সিসি ক্যামেরায়

সব খেয়াল রাখছেন

Categories
2021-Aug-Poem

গৌতম দাস

বহুরূপী


কি এমন হলো বলো, ভোর হলে না যে
এভাবে চললে পাখিটা কতদিন বাঁচে

বগলদাবা হয়ে আছে জীবন যাপন


কবিতা পড়ে না উই
বর্ণমালা দাঁতে দাঁতে কাটে
বসতি বোঝে না গোত্রনাম
হৃদয় গ্রন্থের কথা
বাতাস মার্জনা করে মাঠে
মনে মনে জানাই প্রণাম


ভুল বানানে ভরা চিঠির মতো কাঁচা—
প্রেমের বিষয়, বার্তার অবলম্বন

যে-কোনো ভাষার ঠোঁটে ফুটে উঠে বাঁচা

জনপদে দেখা হয়, ও গ্রাসাচ্ছাদন


গলির পিঠে গলি একমুঠো কলাইভাজা—
চেবাতে চেবাতে ছাতু— ভালো-মন্দ সাজা

নাম করতে তৃষ্ণায় আ-কণ্ঠ শুকনো কাঠ
জীবন যেদিকে যায় দরোজা-কপাট

সটান বুজিয়া যায় ফাঁকা পেট ডাকে
জীবনানন্দ থেকে মুখস্থ বলি তাকে

আউটডোরে নাম লিখে দি ভালোবাসার
দু-একটা পিল-টিল গিলিয়ে পগারপার

মাইল মাইল হাওয়া ভিক্ষে চেয়ে চেয়ে—
অচেনা মুখের চেনাশোনা গান গেয়ে

একমুঠো কলাইভাজা গলির পিঠে গলি
জীবনানন্দ থেকে চিবিয়ে কথা বলি

ভিড়ের মাত্রা ধরে পা বাড়ায় রোদ্দুর
ভিড়ের মাত্রা খোঁটে ঘেমে ওঠার সুর


আবছা কথা আবছা রাস্তা আবছা ঘরবাড়ি আবছা গাছপালা
আবছা আলো আবছা যানবাহন আবছা মানুষজন আবছা
চলাচল আবছা ছ্যাবলামো আবছা সংসার প্রতিবেশী
আবছা দো-তারা আবছা ধুলোধুলি আবছা স্নানঘাট গামছা
আবছা স্বপ্ন আবছা জাগরণ আবছা বোঝাপড়া মুখ

আবছা আয়নার ভিতরে অনাবিল দু-চোখের ছলাৎ ভিক্ষুক


বলো, এ আমাদের কত তম আলাপ?
তত বাঁক ঘুরেছে সড়ক, তত তীর
ছাঁটলে তবে লোকে বলে— ভিখিরি স্বভাব

বলো, এ আমাদের কত তম ফিকির?


বৃত্তিমূলক চরণ রঙিন করেছে দিনে দিনে
প্রতিটি আলাপ আজও জনশ্রুতি গড়ে তোলে পিছে
ঘুম ভাঙা পৃথিবীর দু-পা সেইই বাঁধা আছে ঋণে
কোথায় পালাবে তুমি?আমি বিনা তুমি কিন্তু মিছে

লহর পাঠায় শঙ্খ গুজব রটায় জনপদ
বোঝ সাঁই, এ দুনিয়া প্রেমের আপদ…