Categories
2021-Aug-Story

ঝুমুর পাণ্ডে

ভিখারি বুড়োউয়া

এক

বলবেন নাই বাবু কাল হামি দুইটা মার্ডার করলাম।

মার্ডার?

হঁ বাবু তার বাদে নিজেও মার্ডার হইলাম।

ভোটবাবু পান চিবোতে ছিল। এখন সব পানসুপুরি গলায় আটকে গেল। আজকাল সব দামি দামি গাড়ি চলছে এই জংলা রাস্তা দিয়ে। আহা রে কত রঙের, কত কিসিমের গাড়ি, ভোটপরব বলে কথা। কত মানুষ এখন বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে। শ্যামবতীর ঘরের মদ ছেড়ে বিলাতি ঢালছে গলায়। তবে অবশ্য বিলাতি এক দু-জনের ভাগ্যেই জুটছে। জুটুক। বিলাতি মালে কি আর নেশা হয়? আর ঠিকমতো নেশা না হলে আর খাওয়া কেনে?

হঁ ভালা।

হঁ ভালা খাওয়া কেনে?

নিজের মনে মনেই দু-তিনবার আওড়াল ভিখারি।

হই দেখ ভিখারি বুড়োউয়া যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো আবার বলে— ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। বুড়োউয়া বলছিস। ব্যাগ কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল ভিখারি। কী বললিস। বুড়োউয়া? হামি বুড়োউয়া। তোদের মাই বুড়োউয়া বাপ বুড়োউয়া। তোদের চৌদ্দোগোষ্ঠী বুড়োউয়া। বুড়োউয়া বলছে। বয়স হামার দুই কুড়িও হইল নাই বুঝলিস। হামার দাঁতে সোহাগা লাগাইছিলি ওই রামধনীর মায়ের কথায়। হই যে পাতি তোলে রামধনীর মা। হঁ। দাঁত একটায় দরদ হতেছিল। হ্যাঁ সত্যিই রোজ ভেরেন্ডার কষ দিয়ে দাঁতন দিয়ে ঘষত তবুও। আর সোহাগা লাগাতেই দাঁতগুলো নাকি পড়ে গেল সব খসখস করে।

তখন বাচ্চাগুলো বলত পিছু পিছু— ফোকলা বুড়হা যাচ্ছে। ফোকলা বুড়া হুতোমপেঁচা। আর বাচ্চাগুলোর দোষ কী? ওদের সব শিখিয়ে দেয় ওই যে নকলা! নকলা রিকিয়াসন। যেমন একবার বাসন্তীর মাকে বলার জন্য শিখিয়েছিল বাচ্চাদের। ওকে দেখলেই বাচ্চাগুলো বলত—

বাসন্তীয়াকে মায়ি

শাগ রোটি খায়ি…

তবে রাগত না বাসন্তীর মা। উলটে সবাইকে দাঁড়িয়ে বলত— দে লেইকন দে। শাক রোটি দে। খাইব।

বড়ো হাসিখুশি থাকত এই বাসন্তীর মা। জঙ্গল থেকে মাটি খুঁড়ে জংলি আলু আনত। জংলি বেগুন আনত। আনত কচু শাক। বাবুভাজি। কিন্তু একবার রক্ত আমাশা হয়ে মরে গেল বাসন্তীর মা। বাসন্তীরও জানি কোথায় বিয়ে হয়ে গেল।

ভিখারির প্রায় কাঁধ ঘেঁষে একটা গাড়ি চলে গেল। একটু হলেই মরত। কী গাড়ি কী জানি। আজকাল তো কত কিসিমের গাড়ি। সব গাড়ির নামও জানে না ভিখারি। আগে তো ওই বাস, ট্রাক আর জিপগাড়ি। সাহেবেরও একটা জিপগাড়ি ছিল। কখনো কখনো ওকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে হত। ভিখারিও কত বার ধাক্কা দিয়েছে। কখনো কখনো বাসগাড়িও বড়োরাস্তায় খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে বাচ্চারা ছুটত ধাক্কা দিতে। ওই ধাক্কা মারাটাই একটা বিরাট মজা ছিল ওদের কাছে। অনেকক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পর গাড়িটা যখন চলতে শুরু করত তখন আহা রে কী যে আনন্দ হত, মনে হত যেন কত বড়ো যুদ্ধ জয় করল। তবে যুদ্ধ আর কোথায় দেখল ভিখারি। ওই যাত্রা দেখতে গিয়ে দেখত। ওরা অবশ্য গান বলত, কেউ নাচও বলত। বগলে পিঁড়ি নিয়ে মা যেত মাথায় চুপচুপ করে গন্ধ তেল মেখে। সর্দার সুমন্ত তখন লাঠি দিয়ে বলত হেই হাল্লা। হেই হাল্লা। স্টেজে তখন পেট্রোমাক্স বাতির আলোয় যুদ্ধ চলত। আহা রে তরোয়াল নিয়ে সে কী যুদ্ধ। একবার তো ওই যুদ্ধ করতে করতে রাজার ধুতি খুলে গেল। ওই যে পোস্টমাস্টার ছিল গো কী যেন নাম বউয়ের বিয়ের বেনারসি শাড়ি এনে ধুতি করে পরে রাজা সেজেছিল। সে আর এক বৃত্তান্ত। নিজেরাও চুরি করা আলতা, সিন্দুর ঠোঁটে গালে মেখে গাছের ডাল দিয়ে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলত। সে কী আনন্দ। সে কী উত্তেজনা। ওইরকম খেলতে খেলতেই একদিন খবর পেল চা ঘরে মেশিনে পাতি ঢালতে ঢালতে বাপের হাত ঢুকে গেছে মেশিনে। ওই দিনের কথা মনে হলে এখনও গা-টা থরথর করে কাঁপে। মা তখন চলে গেছিল বাপের ঘরে। আবার একটা গাড়ি হুস্ করে গেল। বড়োরাস্তা দিয়ে। এখন আল ধরে হাঁটছে ভিখারি। দুটো বাচ্চা ছেলে ওদিকে কাঁকড়ার গর্তে হাত ঢুকিয়েছে। একজন হাত দিয়ে টেনে একটা কাঁকড়া বের করে আনল। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া।

তোদের মা বুড়োউয়া। বাপ বুড়োউয়া।

বাচ্চাগুলো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে।

হামি বুড়হা লাগি?

তোর চুল যে গো ধলা। দাঁতও নেই একটাও।

সত্যিই জন্ম থেকেই ভিখারির চুলটা সাদা। মানে একদম রুপালি রং। গায়ের রংটা আবার কালো। কে জানে কার কোন সাহেবের জিন বহন করছে ভিখারি। এদিকে মানে এই চা বাগানে অনেকের রং কালো। সোনালি চুল। কেউ সাদা রং নিয়ে জন্মেও পরে রোদে-জলে কাজ করতে করতে রংটা কেমন তামাটে হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো এখন আর একটা কাঁকড়া বের করল। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। না— এদের সঙ্গে মুখ চালিয়ে আর লাভ নেই মিছেমিছি। ওদিকে কাজললতা তুলছে পরাণের মা। ছেলাগিলান বহুত বদমায়েশ হয়েছে হঁ। দেখনো কেমন বুড়োউয়া বলছে। হামি বুড়োউয়া লাগি। তুহেই বলনো গো?

আরে তোর জনম দেখলি। তোর ধাই কলৌতি এখনও বাঁচে আছে। নিজের হাতে রান্ধাবাড়া করে খাছে। বলনো ভালা। আর তোখে মানুষ… কাজললতাগুলো এখন শাড়ির আঁচলে বেঁধে নিচ্ছে পরাণের মা। রোদটা এখন বেশ তেতে উঠেছে। পরাণকে বললাম যা জালটা লিয়ে। দুটা পুটি চিংড়ি ধরে আন। হামি কাজললতা লিয়ে আসছি। বাকিন যেই উ বাহরাইল একটা ভুটের গাড়ি উওয়াকে উঠায় করে লিয়ে গেল।

এ মা কাঁহা গেল গো?

কী জানি বাবা। কাল তো পয়সা পায়ে একটা মুরগি কিনেছিল।

খাইলি?

নাই। নাই। রান্ধার বাদে ওই ভুটের ইয়ার গিলানেই সব খায়ে লিল।

এ মা?

হঁ বাদে হামি তো খালি ঝোল দিয়ে ভাত খাইলি।

বাচ্চাগুলো আবার বলছে ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া।

বল বল কত বলবিস বল? ওদিকে এখন গান গেয়ে গেয়ে আসছে শ্যাম রবিদাস।

সারাদিন রোজি করলি

এক রুপিয়া পাইনু হো

দাদা হো তেনি সাদা দা।

এখন কোনে এক রুপিয়ার যুগ আছে গো? ব্রিটিশ যুগের গান বলছিস? শ্যাম রবিদাসের এ-সব কিছুই কানে ঢুকছে না। আবার গাইছে আরও জোরে জোরে—

বারো আনা কে চাওল কিনলু

চার আনা কে দাল হো

দাদা হো তেনি সাদা দা…

এই শ্যাম রবিদাসের চারা বাড়ির কাছে কিছু জমি ছিল চা বাগানের ইংরেজ সাহেবের দেওয়া। কিন্তু এই দেশি সাহেব কয়েক বছর আগে সব জমি হাতিয়ে নিল। একটা ঘোড়া ছিল ওটাও মরল। বউও বিছানায়। হাঁটতে পারে না। এইসব দুঃখেই বোধহয় শ্যাম রবিদাস সবসময় গান করে। রাতে ঢোলকও বাজায়। তখন ওর সাঙ্গপাঙ্গরাও জড়ো হয়। আগে শীতটা যাব যাব করলেই সেই ফাগুন মাসে একজন হিজরা এসে ওর ঘরে থাকত। লম্বা বিনুনি ডান হাতে দুলাতে দুলাতে বাঁ-হাত কোমরে রেখে নাচত আর ভাল লাগে না বাবু বান্ধা কবির তরকারি। শ্যাম তখন ঢোলক ছেড়ে হারমোনিয়মের রিড ধরত। ভিখারি তখন বোতাম ছাড়া প্যান্ট এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে কুল খেতে খেতে ওদের পিছু পিছু ঘুরত। আকাশের দিকে তাকালো। অনেক সাদা সাদা মেঘ। দল ছাড়া একটা বক একা একা উড়ে যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে শ্যামবতী দেখি কতটা গুগলি নিয়ে আসছে কচুপাতায় করে— আবার গান গাইছে—

ঝিঙ্গা ফুল উড়িল বাতাসে গো

হাতে ধরি চুমা খাব তোখে

ঝিঙ্গা ফুলে মধু আছে…

গুগলি কাঁহা পাইলিস?

গান থেমে গেল শ্যামবতীর।

হামার মাও বলে গুগলি লিয়ে দিতে।

হঁ তো দিস নাই কেনে লিয়ে? হইতো চারা বাড়ির নালায় কত ঘুরাঘুরি করছে। ঝিনুকও আছে।

সচ বলছিস?

সচ না তো কী? খাকড়িও আছে।

বুড়হা মা চোখে দেখছে না। কতদিন থেকে। তবু শাকপাতা ছিঁড়ে আনে। আনে জংলি বেগুন। চাম কাঁঠালের বিচি কুড়োয়। সবই আন্দাজে। আগে তো জংলি আলু খুঁড়ে আনত জঙ্গল থেকে। খাম আলু, চুন আলু। মা-বেটা মিলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে খেত। বউটা তো আর দুদিনও থাকল না। চলে গেল। আবার কী কাণ্ড। আবার সাঙা করে এখানেই এসেছে। ওই পল্টু চারা বাড়িতে নম্বরে জল খাওয়ায়। ওই পল্টুর সঙ্গেই সাঙা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। লজ্জায় না ঘৃণায় কে জানে। পল্টু অবশ্য দেখলেই বলে কেমন আছ ভায়া? আর কীর্তনেও মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। গাঁজার ছিলিমটা যখন কীর্তনে এক হাত থেকে আর এক হাতে ঘুরে তখন ছিলিমটাও এগিয়ে দেয় পল্টু। পঞ্চায়েতের ঘরে টিভি দেখতে যেত সে অনেক আগে। যখন রবিবারে সারা হপ্তায় শুধু একটা সিনেমা তখন পঞ্চায়েতের ঘরে গিয়ে মাটিতে পাশাপাশি বসে টিভিতে সিনেমা দেখত। কত মানুষ গিজগিজ করত। তবু পল্টু ওর পাশেই বসত। আর আজ কিনা ওর বউকে সাঙা করল? করুক। ওর আর কী দোষ? বউটাই তো ছেডে চলে গেল। আর ঝগড়া না কাজিয়া। যাওয়ার সময় ওর মায়ের রুপার হাঁসলিটাও নিয়ে গেল। যাক। কী আর করা। সব কিছুকে কি ধরে রাখা যায়? কিছু কিছু জিনিস তো এমনি আলগা হয়ে খসে পড়ে। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। আবার কারা বলছে। কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। ব্যাগ কাঁধে দুটো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ভিখারি। না, কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। বেজন্মার ছেলারা। হেই কে বলছিস বাইরাহ। হঁ বাইরাহ বলছি। কতবার ভাবে ভিখারি মুখ খারাপ করবে না, তবু ওই বুড়োউয়া শুনলেই মাথাটা কেমন চনচন করে উঠে। এক একবার মনে হয় হাতের সুখ মিটিয়ে নেয় দু-চার থাপ্পড় মেরে। যেমন সেই সনৎ মাস্টারের ইশকুলে পড়ার সময় বাচ্চাগুলো বলত দে দে ভিখারি আইসেছে। এক টুকুন ভিখ আনে দে। কেউ বলত— চাল লিবি ন পয়সা লিবি? অন্যরা তখন কেউ হি হি কেউ হো হো কেউ বা হা হা করে হাসত। ওই জন্য শেষে দ্বিতীয় ভাগ পড়েই ইশকুল ছাড়ল ভিখারি। আর যায়নি। সনৎ মাস্টার ঘরে এল। তবু না। বাগানে লেড়কা দফায় কাজে ঢুকল। নম্বরে গেলেই সাথীরা বলত ভিখারি আইল হি হি হি… আর একবার করমপূজায় নাচ হচ্ছিল— সবাই হাত ধরাধরি করে নাচছিল—

পাতি তুললি কিনি কিনি

কলে ওজন দিয়েছি

নয় পণ পাতি ছয় পণ হইল

হায় রে মনের দুখে রয়েছি…

বীরসা বাজাচ্ছিল মাদল। ভিখারি ওর বাঁশের বাঁশিটা নিয়ে গেছিল। যেটা বাগাল বুড়োর সঙ্গে গোরু চরাতে চরাতে বাজাত। এ মা যেই বাঁশিটা বের করল। ওই যে সনাতন আজকাল চারাবাড়িতে চা বানায়। ওই সনাতন বলল ভিখারি আইল। ভিখারি।

এ মা কাঁহা লে বাঁশি মাঙে আনলি রে ভিখারি। বলে, হো হো করে হাসল। ভিখারির মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল। শেষে অতি কষ্টে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। সুধবি তখন গান ধরেছিল—

ফুটেছে শালুকের ফুল

গহন জলে আছে

ও সই আনে দে হামাকে

সুধবির জন্য মনটা আগে কেমন আকুলি বিকুলি করত। কিন্তু পাত্তাই দিত না সুধবি। এখনও দেয় না। মরদটা তো ওর রোজ রাতে মদ খেয়ে হল্লা করে। মারপিটও করে। কোনোদিন সুধবিও দু-চার ঘা বসিয়ে দেয়। বীরসা তখন মাদল বাজায়। আহা রে গহিন রাতে মাদলটা শুনলে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। দাদির কথা খুব মনে পড়ে। টুসু রাখত দাদি। তখন রোজ সন্ধ্যের সময় গান হত। কেউ সাদা মলতে মলতে কেউ পান চিবোতে চিবোতে গান ধরত—

হামদের টুসু মুড়ি ভাজে

শাঁখা ঝলমল করে গো

তোদের টুসু বড়ো বেহায়া

আঁচল পাতে মাঙ্গে গো

ছি ছি লাজ লাগে না

সবাই আবার একসঙ্গে গাইত ছি ছি লাজ লাগে না। দাদি আবার গান বাঁধতেও পারত। টুসুকে নিয়ে ছোটোবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে গাইত—

ছোটোবাবুর ভাঙা ঘরে

ভূতে ঢেলা মাইরেছে

কে দেইখেছে কে দেইখেছে

জনার বেটি দেইখেছে…

চা ঘরে শব্দ হচ্ছে। ফ্যাক্টরি চলছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে চা-পাতার ঘ্রাণ। প্রাণভরে গন্ধটা বুকে ভরল ভিখারি।

ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। হই দেখ ভাইলে ভিখারি বুড়োউয়া যাছে। ও তো কারো সাতে পাঁচে থাকে না তবু কেন যে লোকে ওর পেছনে লাগে। কে জানে? এই তো কাল ভোট অফিসের সামনে সাত পাঁচ কথা বলছিল লোকে। শেষে ওই যে নাম হ্যাঁ তো নানকা বলল— কত পয়সা পাইলি এবার ভিখারি?

কীসের পয়সা?

আরে ভোটের পয়সা।

ভোটের?

হঁ ভোটের পয়সা মাঙলি নাই? মাঙলি নাই ভিখারি?

তখন মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারেনি ভিখারি। দু-ঘা বসিয়ে দিয়েছিল। শেষে পচা আর বিকর্ণ আসতে ওদেরও দু-ঘা দিয়েছিল। তাই না ভোটবাবুকে বলছিল কাল তিনটা মার্ডার করলাম বাবু। তবে ওরাও কি আর ছাড়ল? ওরাও বেশ ভালোই মার দিল। এখনও শরীরের ব্যথাটা যায়নি। লম্বা শ্বাস ফেলল ভিখারি। ওর এই ভিখারি নামটা কি ও নিজে ধারণ করেছে! ওর দাদিই না আগের ওর তিন-চারজন ভাই-বোন জন্মের পর পরই মরে যেতে ওর নাম ভিখারি রেখেছিল তাতে ওর কী দোষ? আবার আকাশে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। ওদিকে তাকাল ভিখারি। আহা রে পাখিদের জীবনটা কত সুন্দর। আহা রে ভিখারি যদি পাখি হতে পারত? এখন জঙ্গলের কাছে চাম কাঁঠাল গাছটার নীচে চলে এসেছে। এখানেই তো নানকার কচি মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল কোন নানুষ নেকড়ে আহা রে… আজও ধরা পড়ল না প্রকৃত দোষী। একটু সময় এখানে থম মেরে দাঁড়াল ভিখারি। কত পাখি ডাকছে। এদিক দিয়েই তো পুঞ্জির রাস্তা। যেখানে ভোটবাবুর সেন্টার। জোরে জোরে পা চালায় ভিখারি…

দুই

মার্ডার হয়ে গেল।

কে? কে মার্ডার হল?

ওই যে গো ভিখারি। ভিখারি বুড়োউয়া।

এ মা কে মারল গো ওকে।

এই সাদা-সিধা ভোলাভালা মানুষটাকে?

কী জানি কে মারল।

আহা রে আহা রে…

কিন্তু যে-কারণে মারল ওদের উদ্দেশ্য তো আর সফল হবে না।

কেন? কেন?

আরে ও তো হিন্দুও ছিল না মুসলিমও না বাঙালিও না; বিহারি, অসমীয়া, নেপালি, নাগা, বড়ো, মিজো, মণিপুরিও না।

তবে কী ছিল? কী ছিল ভিখারি বুড়োউয়া? ও তো চা বাগানের লেবার ছিল গো। কুলি।

কুলি মনসার বেটা ভিখারি। ভিখারি বুড়োউয়া। তবে ভুল করে মেরেছে।

হতে পারে! হতে পারে!

আরে গত পরশুই তো ভোটবাবুর ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতেছিল গো।

হ্যাঁ গো হ্যাঁ।

আর পুলিশও ধরল কিনা নিরপরাধ নানকা, পচা আর বিকর্ণকে।

ধুর। ধুর। ধুর।

বীরসা আবার মাদল বাজায়…

সুধবি আবার গান ধরে—

ও ভাই প্রাণের লখন

জানিলে আসিতাম না আর।

পঞ্চবটী বন।

Categories
2021-Aug-Traslation

পিটার মার্কাস

বব অথবা নৌকায় থাকা লোকটা
[Bob, or Man on Boat]

ভাষান্তর: অত্রি ভট্টাচার্য

ভূমিকা: হেরাক্লিটাস-এর প্রবাদবাক্য: “কোনো মানুষই এক নদীতে দু-বার পা ডোবায় না”। এর লাজবাব প্রত্যুত্তরে পিটার মার্কাস এক বিপ্রতীপ কথন তুলে ধরেছেন; নদী সে একাই এবং একটিই, যে-মানুষ তাতে পা ডোবায় সে-ই নদী হয়ে যায়। শুধুমাত্র এক সহজ চোখে চেয়ে থাকাই নদী ও কর্দমাক্ততার গভীরের রহস্যকে খোলতাই করতে থাকে। এখানে, মার্কাসের এই নদীবিশ্বে সকল চরিত্রের নামই বব। এখানে মানুষ মাছ হয়ে যায়। মাছ হয়ে যায় মানুষ। যেখানে জাদুর সবুজ আলো কাদার ভিতরে। যেখানে স্বপ্নে ছেলেরা পোশাকের মতো গায়ে চাপিয়ে নেয় বাবার চামড়া। ‘বব, অর ম্যান অন বোট’ বইটির উৎসর্গপত্রে পিটার তাঁর নদীপথ চেনানো বাবা ও নক্ষত্রের গল্প শোনানো মায়ের কথা বলেছেন। দু-চার মিনিট গুগ্ল করলেই পিটার মার্কাস সম্পর্কে যৎসামান্য যা জানা যাবেই সেই দুর্গম পথ ধরে অনুসন্ধিৎসু বাঙালি পাঠক অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে পৌঁছে যাবেন বোধহয়। এই উপন্যাসের অংশবিশেষ এখানে অনুবাদ করা হয়েছে।

*
কখনো কখনো, রাতের বেলা যখন মাছেরা ছিপে কামড় দিতে দেরি করে, বব নদীর ওপর থেকে মুখ সরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তোলে নক্ষত্র দেখবে বলে।

সেরকম রাতে, বব দেখে আকাশে ক-টা নক্ষত্র সে গুনতে পারে।

এক-একদিন রাতে বব দু-হাজার বাইশটা নক্ষত্র গুনে ফেলে।

সেই রাতগুলো মাছ ধরার জন্য খারাপ।

সেই রাতগুলো নক্ষত্র গোনার জন্য উপযুক্ত।

বেশিরভাগ রাতেই বব দশটা নক্ষত্র গোনার আগেই মাছেরা ছিপ কামড়ে ধরে।

মাছ ধরার জন্য উপযুক্ত একটি রাতে, যে-রাত নক্ষত্র গোনার জন্য অনুপযুক্ত, সেরকম রাতে বব নিজের নৌকা ভরে ফেলে আকাশে যত নক্ষত্র আছে তার থেকেও বেশি মাছে।

এই রাতগুলোতে, ববের নৌকা আর শুধুমাত্র একটা নৌকা থাকে না, হয়ে ওঠে মাছেদের নক্ষত্রসমাবেশ।

*
একবার বড়ো শহরে ঘুরতে গিয়ে আমি একটা লোককে রাস্তায় নিজের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলাম।

ওই একই শহরে একই রাস্তায় আমি আরও একজনকে গান গেয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম।

আমাকে ওই শহরের ওই সময়ের এক বাসিন্দা বলেছিল, এদের উভয়েরই মাথায় ছিট আছে।

ওই কথার উত্তরে, আমি বলেছিলাম, আমাদের মধ্যে কে আছে যে অমন নয়?

বেশিরভাগ লোক যাদের যাদের আমি এ-কথা বলেছিলাম, যখন এদের বলেছিলাম, তখন সবাই মাথা হ্যাঁ-এর দিকে ঝুঁকিয়েছিল।

বব অন্য কারোর থেকে বেশি ছিটগ্রস্ত নয়।

সোজাসাপ্টা কথা হল, বব জানে ওর কী ভালো লাগে।

আর বব তা-ই করে যা ওর সবথেকে বেশি পছন্দ
বব নিজের মনের কথা শোনে।

ববের মনটা একটি মাছের মতন।

*
এটা একটা আলাদাই ব্যাপার যে, বব একই নদীতে ওর পাশের মাছ ধরা জেলেটার থেকে বেশি মাছ ধরে।

বব নদীতে থুতু ফেলতে পছন্দ করে।

বব নদীতে মুততে পছন্দ করে।

সৌভাগ্যের জন্য।

*
সেই রাতে বিছানায় আমার বউ আবার ওই একই কথা বলে উঠল।

‘আমি নিশ্চয়ই একটা জেলেকে বিয়ে করিনি’

ও মুখ ঘুরিয়ে নিল ওর নিজের দিকে।

ওর পিঠে ঠেকে গেছে আমার পেট।

এভাবেই, ও গন্তব্যে পৌঁছায় আর নিভিয়ে দেয় আলো।

*
সেই রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম বব মাছ ধরছে।

সেই স্বপ্নের ভিতরে আমিও ববের সাথে মাছ ধরছিলাম।

আমি মাছ ধরছিলাম ববের নৌকাতে বসে।

বব আমাকে কীভাবে মাছ ধরতে হয় শেখাচ্ছিল।

সে আঙুল তুলে ইঙ্গিত দিচ্ছিল নদীর ভেতরে সেইসব জায়গার দিকে যেখানে ধরবার জন্য সবসময় একটার বেশি মাছ থাকে।

তারপর বব আমাকে বলল, হাতদুটো বাড়িয়ে দাও।

তাই আমার হাতদুটো আমি বাড়িয়ে দিলাম।

ও আমার হাত নিজের হাতে নিল।

ও দেখতে থাকল আমার হাতদুটো।

আমি বলতে পারি ও দেখছিল।

আমি ওর হাতের দিকে তাকালাম।

ওর হাত ছিল মাছের আঁশ আর ছাল।

ওর হাত ছিল মাছের পাখনা।

আমি নিজের হাতটা ববের থেকে ছিনিয়ে নিলাম

‘কি ব্যাপারটা কী?’

বব জিজ্ঞেস করল।

‘তুমি কি কখনো মাছের সঙ্গে হাত মেলাওনি নাকি?’

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।

ওটাই তোমার সমস্যা, বব আমায় বলল।

বব ঘুরল আর বলতে-না-বলতেই নিজের নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিল।

নদীর ভিতরে।

সে সাঁতরে এগোচ্ছিল।

আর তখন আমি একা হয়ে গেলাম নদীতে ভাসতে থাকা ববের নৌকায়।

*
সকালে আমি নিজের নৌকা নিয়ে ববের নৌকার কাছে গেলাম।

বব সেখানে ছিল না।

আমি চারপাশে ববকে খুঁজলাম।

সকালে সাধারণত বব মাছের গা সাফ করে।

সূর্য উঠেছে নদীর ওপরে।

নদীর ওপরে একটু ধোঁয়াশা এনেছে সূর্যটা।

বব, নাম ধরে চেঁচালাম।

আমার কণ্ঠস্বর একটা পাথরের মতো নদীর ওপরে বেঁকে চলে গেল।

আমি মাছ-ধরা নৌকায় বসে থাকা একটা লোককে জিজ্ঞেস করলাম ববকে দেখেছে কিনা

সে মাথা নেড়ে না বলল।

আমি বাড়ি চলে এলাম।

বাড়ি এসে ফোনটা তুললাম।

আমার জানা ছিল না কী অথবা কাকে আমার ফোন করা উচিত। অথবা আমাকে কথাই যদি বলতে হয় তবে কী বলব।

বব কি তার নৌকাতে নেই?

বব কি আমার স্বপ্নে মাছ হয়ে গেছে?

*
ওই রাতে আমি ঘুমাতে ঘুমাতে সোফা থেকে পড়ে গেছিলাম।

আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না।

আমি চোখ বুজলাম আর মাথার ভিতরে সাঁতার কাটতে থাকা মাছগুলো গুনতে থাকলাম।

আকাশে যত নক্ষত্র তার থেকেও বেশি মাছ ছিল সেদিন আমার মাথায়।

সারারাত্তির ধরে আমি এই শব্দগুলোই শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম

আমি একটি মাছ

আমি একটি মাছ

আমি একটি মাছ

এটা ছাড়াও শুনতে পাচ্ছিলাম আমার ছেলের গলা, ‘বাবা আমি চাই না তুমি মাছ হয়ে যাও’

*
রাতের বেলা একদিন সেটা আমায় ধাক্কা মেরেছিল।

হয়তো আমার ছেলেই ঠিক বলেছে।

হয়তো আমি একটা মাছ।

ববের জন্য নির্দিষ্ট মাছ।

সেই মাছ যার জন্য বব এখন নদীতে মাছ ধরে চলেছে।

Categories
2021-Aug-Prabandha

রাহুল হালদার

বুড়িবালামের তীরে রচিত হল জাতীয় বীরগাথা

সময়টা বিগত শতকের আট-নয়ের দশক। সরকারি বিদ্যালয়ের কর্মশিক্ষা ক্লাসে শেখানো হত বাঁশপাতা কাগজের খাম তৈরি, দেশের বিখ্যাত মনীষীদের ছবি দিয়ে প্লাস্টার তৈরি, মোমের পুতুল, মোমবাতি তৈরি প্রভৃতি। সেই সঙ্গে আমরা তৈরি করতাম একটি খাতা। যে-খাতাতে দেশের বরণীয় কবি, সাহিত্যিকদের সাথে সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি খাতার বাঁ-দিকের সাদা পৃষ্ঠায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে ডান দিকের পৃষ্ঠায় তাঁদের জীবনী লিখতে হত। কে কার কার ছবি, কতগুলি ছবি সংগ্রহ করত সেগুলি বন্ধুদের খাতা নিয়ে একে-অপরেরটা দেখতাম।

সেই সময়ে ছবিতে ছোটো পোস্টকার্ডের মাপের ছবিতে বাঘা যতীনকে দেখি আর হন্যে হয়ে খুঁজতাম কোন ক্লাসের রচনা বইতে তাঁর জীবনী খুঁজে পাওয়া যাবে। সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ে অবাক বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকতাম যখন জানলাম তিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘ মেরেছিলেন। তাই তিনি বাঘা যতীন নামে পরিচিত ছিলেন।

শুধু স্বাধীনোত্তর সময়ে আমাদের সকলে নয়, স্বাধীনতাপূর্বে ও বাঘা যতীনের সমসাময়িক সময়ে অনেকেই তাঁর বীরত্বে অভিভূত হতেন এবং গর্ববোধ করতেন। যেমন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁর ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন— “আমার বাবা আঠারো বছর বয়েসে গোরা ঠেঙিয়েছিলেন। আমার ছোটকাকা গৌরবাবু বাঘের সঙ্গে লড়েছিলেন। এই জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম। মনে মনে একটা গৌরবও ছিল। কিছুদিন বাদে গৌরবের স্থলে জন্ম নিল বিষাদ। মনে হল আগের যুগে বীর জন্মাত, আমার যুগে কই জন্মায়? এমন সময় ১৯০৬ সালে খবরের কাগজে বের হল একজন যুবক একপ্রকার খালি হাতেই একটা ছোরার সাহায্যে একটা বাঘ মেরেছে। গৌরবে বুক দশ হাত হল। কারণ, আমি বীরের যুগের লোক হয়ে গেছি। পরে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁকে সপ্রশংস নয়নে অনেকদিন দেখতাম। নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।”

উনিশ শতকের শেষের দিকের কুষ্টিয়া শহর। পদ্মার গড়ুই নদীর উত্তর পাড়ে ছোটো সুন্দর গ্রাম কয়া। কয়া গ্রামেই সেইসময় নামকরা বাড়ি, চট্টোপাধ্যায়দের। বাড়িতে বিরাট আঙিনা, অনেকটা অংশ নিয়ে বড়ো বড়ো বাড়িঘর, চণ্ডীমণ্ডপের দালান। এই সাবেকি আমলের বাড়িতেই ইংরেজি ১৮৭৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বড়োমেয়ে শরৎশশী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

যতীন্দ্রনাথের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কয়া গ্রামের মামার বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক ভিটা যশোর জেলার ঝিনাইদা মহকুমার সাধুহাটি রিসখালি গ্রামে। যতীনের ছোটোমামা ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন— “যশোর জেলা। ঝিনাইদা মহকুমার সাধুহাটি রিসখালি গ্রাম। কাছেই নদী নবগঙ্গা। নদীর ধারে সিঁদরে গ্রামে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নীলকর সাহেবদের কুঠি।… ঘোড়ায় চড়ে সাহেবরা পথে বার হলে বিনয়ে আনুগত্যে বেঁকে দাঁড়ান প্রতিবেশী সকলেই।… কিন্তু একটি লোক, যুবক ব্রাহ্মণ— কোনোদিন ফিরে তাকান না সাহেবদের দিকে, ভেদ মানেন না কালো সাদার, মাথা তাঁর উঁচু।… আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত এই তেজস্বী ব্রাহ্মণকে সবাই চেনে। বিঘা কয়েক জমির অধিকারী এই শিক্ষিত ব্রাহ্মণের নাম শ্রী উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।” যিনি যতীন্দ্রনাথের পিতা। যখন যতীনের বয়স পাঁচ তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ হলে বড়োমামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় এসে প্রথমে যতীনকে এবং তার কিছু পরে বোন শরৎশশী এবং যতীনের দিদি বিনোদবালাকে বিনোদবালার পৈতৃক ভিটে থেকে কয়া গ্রামের মামার বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে আমরা যে-শিক্ষিত ও নির্ভীক পরোপকারী যতীনকে দেখি সেটা যে তাঁর পিতার কাছ থেকে পাওয়া, সেটা মামা ললিতকুমারের দ্বারা যতীনের পিতার পরিচয় থেকেই বুঝতে পারি।

মামার বাড়ির গ্রামের গোপাল পণ্ডিতের পাঠশালাতে যতীনের লেখাপড়া শুরু হয়। ছোটোবেলাতেই গ্রামে পড়াশোনার পাশাপাশি গ্রামের বালকদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ, সাঁতার, খেলাধূলাতে দক্ষ হতে থাকেন। তাঁর ন’মামা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নদিয়া রাজবাড়ির সুপারিন্টেনডেন্ট। ভারি শৌখিন মানুষ তিনি।

খেলাধূলা, জিমনাস্টিক, ঘোড়া চড়া, বন্দুক চালানো, মাছধরায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এই ন’মামার একটি ঘোড়া ছিল যার নাম ‘সুন্দরী’। তখন যতীনের বয়স আট কি নয় বছর, একদিন মামার কাছে আবদার করে বলল, মামা ঘোড়ায় চড়া শিখব। ভাগ্নের শখকে মামা না বলতে পারল না। বাড়ির পাশ দিয়ে জেলা বোর্ডের যে-পাকা সড়ক গিয়েছিল কুষ্টিয়ায় উত্তর দিক পার হয়ে সোজা কুমারখালি পর্যন্ত সেই রাস্তায় কিছুদিন মামার দ্বারা ঘোড়ায় চড়া তালিম চলল। অল্প কিছুদিনেই ঘোড়ায় চড়া আয়ত্ত করে যতীন এরপর একা একাই ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে লাগল। গড়ুই নদীর জলে সাঁতরে পার হত আট-দশ মাইল। এমন করেই যতীন বড়ো হতে লাগল। তাঁর বড়োমামা যতীন আর বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের কুস্তি, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, তরোয়াল শেখানোর জন্য বাড়িতে ফেরাজ খান নামে এক ওস্তাদকে মাইনে দিয়ে রেখে দিলেন।

এদিকে যতীনের বড়োমামা বসন্তকুমার আইনের অধ্যয়ন শেষ হলে কৃষ্ণনগরে জেলা বোর্ডের ওকালতিতে নিযুক্ত হলেন। অল্প সময়েই তিনি ওকালতিতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেন। যতীন্দ্রনাথ তখন বারো বছরে পড়েছে। গ্রামের পাঠ শেষ হলে বড়োমামা গ্রামের পণ্ডিতের কথামতো এন্ট্রান্স পড়বার জন্য কৃষ্ণনগরে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়ে দেন সেখানকার অ্যাংলো ভার্নেকুলার (এ ভি স্কুল) বিদ্যালয়ে। সেখানে অতি অল্প সময়েই যতীন সকলের প্রিয় হয়ে গেলেন এবং হয়ে উঠলেন তাদের অবিসংবাদী নেতা। তিনি যেহেতু আগে থেকেই সাঁতার, খেলাধূলা, পড়াশোনায় দক্ষ ছিলেন। কৃষ্ণনগরে এসে সেই গুণের সঙ্গে যুক্ত হল পরোপকার আর সমাজসেবা। এইসমস্ত কাজে যতীন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় ‘যতীনদা’। এই ‘যতীনদা’ সম্পর্কে মানবেন্দ্র রায় পরবর্তীকালে বলেছিলেন— “আমরা তাঁকে সোজাসুজি দাদা বলেই ডাকতাম। দাদাদের দেশে আর দাদাদের যুগে তিনি ছিলেন অতুলনীয়— তাঁর মতো দ্বিতীয়টি আর কাউকে আমি দেখিনি। আধুনিক শিল্পে যেমন, তেমনি আমাদের রাজনীতির সেই শৈশবকালে দাদাবাদ ছিল একটি যুক্তিহীন মতবাদ। যতীনদা কিন্তু দাদাবাদের ধার ধারতেন না, কিংবা তিনি এর প্রবক্তা ছিলেন না। আর সব দাদাদের দেখেছি অপরকে আকর্ষণ করবার বিদ্যা অভ্যেস করতে; একমাত্র যতীন মুখার্জি ছিলেন এর ব্যতিক্রম।… যে-বিশাল দৈহিকশক্তির তিনি অধিকারী ছিলেন এবং যা পরিণত হয়েছিল একটি কিংবদন্তীতে, সেটা কিন্তু তার আকৃতি দেখলে প্রতীয়মান হত না, যদিও তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ কুস্তিগীর”।

তিনি যে ভীষণই সাহসী আর শক্তিশালী ছিলেন সেটা তাঁর কীর্তি দেখেই বোঝা যেত। একবার তিনি নদিয়া ট্রেডিং কোম্পানি নামে কৃষ্ণনগরের একটি দোকানে যখন পেন্সিল কিনতে গিয়েছিলেন তখন তাঁর কানে এল চিৎকার ‘পালাও পালাও’। কী ব্যাপার দেখতে যখন তিনি রাস্তার দিকে তাকালেন দেখলেন রাজবাড়ির (বারাণসী রায়ের) একটি ঘোড়া বাঁধন ছিঁড়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে এবং ঘোড়াটিকে কেউ ধরবার চেষ্টা না করে সবাই পালাচ্ছে অথচ ঘোড়াটিকে না থামালে যখন-তখন বিপদ ঘটে যেতে পারে। এই ভেবে তিনি নিজের জখম হওয়ার কথা না ভেবে ঘোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে চলন্ত ঘোড়াটির কপালের কেশর ধরে ঘোড়াটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

এন্ট্রান্স পাশ করে যতীন কলকাতায় শোভাবাজার চিৎপুর রোডে মেজমামা, এল. এম. এস ডাক্তার হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে থেকে সেন্ট্রাল কলেজে এফ. এ. পড়েছেন। পড়ার সময় যাতে অর্থোপার্জন করতে পারেন তার জন্য তিনি শিখতে লাগলেন শর্টহ্যান্ড আর টাইপরাইটিং।

একদিন কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসে শুনলেন কাছের এক গ্রামে বাঘের উপদ্রব হওয়াতে সকালে যতীনের মামাতো ভাই ফণিভূষণ বন্দুক নিয়ে বাঘ মারতে গেছে। কথাটা শুনে যতীন শুধুমাত্র একটি ভোজালি হাতে করে সেখানে গিয়ে দেখলেন যেখানে বাঘ আছে সেই জঙ্গল থেকে বাঘ বেরোলে ফণি বন্দুকের গুলি চালালে বাঘের গায়ে ঘর্ষণ করে বেরিয়ে যায়। তখন বাঘটি তাঁর দিকে এগিয়ে এলে যতীন্দ্রনাথ বাঘটির গলা বাম বগলে চেপে ধরে ভোজালির দ্বারা মাথায় আঘাত করতে লাগলেন। সেই লড়াইয়ে অবশেষে বাঘটি মেরে ফেললেও বাঘের আক্রমণে যতীন্দ্রনাথও প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে গেলেন। মেজমামা তখন তাঁকে কলকাতায় বিখ্যাত সার্জন সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে দিয়ে প্রায় ছয়মাস চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যতীন্দ্রনাথ তাঁর নবজীবনদাতাকে উপহার দিয়েছিলেন সেই মারা বাঘের চামড়াখানি। এই সময়ে যতীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়ায় হৃত স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ছোটোমামা ললিতকুমার কুস্তিগীর ক্ষেত্রনাথ গুহের আখড়ায় ভর্তি করিয়ে দেন।

যতীন্দ্রনাথ শর্টহ্যান্ড আর টাইপরাইটিং শেখবার পর প্রথমে কলকাতার অমহুটি অ্যান্ড কোম্পানি, তারপর মজঃফরপুর এবং শেষে সেখানে চাকরি ছেড়ে শেষে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে মি. এ. এইচ. হুইলার নামে একজন আই-সি-এসের অধীনে চাকরিতে নিযুক্ত হন।

বিংশ শতকের সূচনায় এক নব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বাংলার বুকে। যতীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সরকারের একজন বেতনভুক কর্মচারী। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে স্বদেশ আন্দোলনের সূচনা হয়। বাঙালির কণ্ঠে গর্জন শোনা গেল লর্ড কার্জনের এই ষড়যন্ত্র আমরা রোধ করবই। ১৯০৫ সালের শেষভাগে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হল গুপ্ত সমিতি এবং ১৯০৬ সালে এই সমিতিতে যোগদান করলেন যতীন্দ্রনাথ। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন— “১৯০৩ সালে যোগেন বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের বাড়িতে ভাবী যুগান্তকারীদের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটল। বিদ্যাভূষণ আগে থেকে কেবল বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে বেড়াতেন।… এঁর বাড়িতে শ্রী অরবিন্দ ও যতীন্দ্রনাথ আসেন। সেখানে ললিতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভাবী কালের ‘বাঘা যতীন’ এঁদের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে যতীন্দ্রনাথের কাছে ধরা দিলেন বাঘা যতীন।”

আলিপুর বোমা মামলা আরম্ভ হওয়ার পর থেকে বাঘা যতীনের প্রকৃত বিপ্লবী জীবনের সূত্রপাত হয় বাঙালি দারোগা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি প্রফুল্ল চাকীকে মোকামা স্টেশনে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয় ঘটনা আলিপুর বোমা মামলার সরকারি উকিল আশুতোষ নিধন এবং তৃতীয় ঘটনা তৎকালীন কলকাতা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ সামশুল নিধনের কর্মকাণ্ড দিয়ে। এই ঘটনার পরে যতীন্দ্রনাথের সরকারি চাকরি চলে গেলে তিনি জেলা বোর্ডের ঠিকাদারি কাজ নিযুক্ত হয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় গুপ্তসমিতি গঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেন।

১৯১৪ সালে জার্মানির সঙ্গে ব্রিটিশ ও অন্যান্যর যুদ্ধ লাগলে জার্মানিতে থাকা ভারতীয়রা ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহ করবার জন্য সাহায্য চাইলে জার্মানি অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দেয়। জার্মানির সহায়তায় ১৯১৫ সালে যতীন্দ্রনাথ সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলবার ব্যবস্থা করতে থাকেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে যে-সমস্ত ভারতীয় সৈন্য ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন যাতে ফোর্ট উইলিয়াম দখল করা যায় কিন্তু একজন ভারতীয়র বিশ্বাসঘাতকতায় সেই পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়েছিল।

পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েননি যতীন্দ্রনাথ। এরপর যখন জার্মানদের সহায়তায় ‘এস. এস. ম্যাভারিক’ নামে একটি জাহাজে করে ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য ত্রিশ হাজার রাইফেল, প্রত্যেক রাইফেলের জন্য চারশো করে গুলি আর তার সঙ্গে দু-লক্ষ টাকা আসবে সেইসমস্ত কিছু পূর্ববঙ্গে, কলকাতা আর বালেশ্বর এই তিন জায়গায় পাঠানোর বন্দোবস্ত করবার জন্য যতীন্দ্রনাথ নিজে এবং চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরি, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত আর জ্যোতিষ পালকে নিয়ে বালেশ্বরের কাপ্তিপোদায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে-সংবাদ ব্রিটিশের কাছে চলে যায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি, পুলিশ সাহেব খোদাবক্স, ডি. আই. জি. ই. বি রাইল্যান্ড সাহেব সমস্ত সশস্ত্র পুলিশ এবং মিলিটারি নিয়ে রদারফোর্ডের নেতৃত্ব চলল যতীন্দ্রনাথদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান। সরকার পক্ষের দুড়ুম দুড়ুম গুলির শব্দে সিপাহিরা এগিয়ে আসতেই দেশের জাতীয় বীরদের তরফ থেকে ব্রিটিশদের ভীত, স্তম্ভিত করে কটাকট কটাকট করে চলতে শুরু করল মসার পিস্তলের গুলি। দেশের বীরদের তরফ থেকে প্রত্যুত্তরে ব্রিটিশ সিপাহি সমেত রদারফোর্ড হতাহত হয়ে পালাতে লাগল, জলকাদা মেখে মাটিতে শুয়ে পড়ল অন্য সিপাহিরা। প্রায় দু-তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলতে লাগল বুড়িবালামের তীরে। এই সময় এক সুবেদারের গুলিতে চিত্তপ্রিয় বীরের মতন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যতীন্দ্রনাথ বাঁ-হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে গুলিবিদ্ধ হয়েও এক হাতে মসার পিস্তল চালাতে লাগলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, সেই সময়ে আর একটা গুলি এসে লাগল তাঁর পেটে।

এর পর ৩রা আশ্বিন ১৩৬৫ সালের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ডাঃ সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি সে-সময়কার বালেশ্বর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি লিখেছিলেন শহিদ হওয়ার আগে যতীন্দ্রনাথের শেষ বক্তব্য—“এবার আমার পালা ডাক্তার। আজ আমাদের জীবন দেবার শুভ সুযোগ এসেছে। শুরু হলো আবার গুলি বিনিময়-সন্মুখে পিছনে, দক্ষিণে, বাঁয়ে চারিদিক হতে আসছে গুলি— ওই যে আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে— ঐ জীবন-মরণের সেতু ভেঙ্গে আসছে। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছি। কতক্ষণে জ্ঞান হল জানি না… জানো ডাক্তার আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চয় আসবে — পরাধীনতার শিকল ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে।”

যতীন্দ্রনাথদের কাঙ্ক্ষিত দেশের স্বাধীনতা আজ এসেছে। সেই স্বাধীন দেশে আমরা যতীন্দ্রনাথকে কেমন স্মরণে রেখেছি সেই বিষয়ে শ্রীশচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন— “‘বাঘা যতীন’। হায়-রে এর চেয়েও তাঁর দীনতম প্রকাশ কি হতে পারে? গ্যারিবল্ডীর চেয়েও যাঁর দুঃসাহস ছিল বড়, হিটলারের চেয়েও যিনি ছিলেন অধিকতর দুর্বার, বিসমার্কের চেয়েও কুশলী ডিপ্লোম্যাট, সংগঠন শক্তিতে অদ্বিতীয়-সহকর্মী সতীর্থ এবং মানুষ মাত্রেরই প্রতি প্রীতি এবং করুণায় বিগলিত বিশাল হৃদয় তাঁর, দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে তাঁর অভিনব আত্মাহুতি, যার তুলনা বিরল ভারতের ইতিহাসে— সন্মিলিত বিপ্লবী দলের সেই সার্বভৌম সর্বাধিনায়ককে দেশ কতটুকু চিনল, কতটুকু উপলব্ধি করলো?”

এ শুধু শ্রী শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ নয়, এই আক্ষেপ বর্তমান সময়ে আমাদের সকলের। আজকের দিনে রাজনীতির তরজায় মেতে থাকা জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের বাঙালি কি ক্রমশ নিজেদের অতীত গৌরবকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে না?

Categories
2021-Aug-Prabandha

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

উর্দু সাহিত্য ও প্রগতিশীলতা

গল্পটি এইরকম, দু-জন ব্যক্তির আলাপচারিতা… একজন হাকিম, অন্যজন রোগী—

“ধর্ম আসলে খুব বড় ব্যাপার। কষ্টের সময়, বিপদে আপদে, হতাশার সময়, যখন আমাদের বোধবুদ্ধি কাজ করে না আর আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই; যখন আমরা কোনও ঘায়েল জানোয়ারের মতো ভয়ে ত্রাসে বিবশ দৃষ্টিতে চারিদিকে দৌড়ে বেড়াই— সেসময় কী এমন শক্তি থাকে যা আমাদের ডুবে যাওয়া হৃদয়কে ভরসা দিয়ে থাকে? তা হল ধর্ম। আর ধর্মের শিকড় হল ইমান। ভয় আর ইমান। ধর্মের প্রশংসা শুধু বাক্য দিয়ে করা সম্ভব না, একে আমরা বুদ্ধির প্রাবল্য দিয়েও বুঝতে পারব না। এটি একটি অন্তর্গত অবস্থা…”

“কী বললে? অন্তর্গত অবস্থা?”

“এটা কোনো হাস্যকর কথা নয়, ধর্ম এক স্বর্গীয় প্রভা— যার দীপ্তিতে আমরা সৃষ্টির উজ্জ্বল আড়ম্বরগুলি প্রত্যক্ষ করি। এটি এক অন্তর্গত…।”

“খোদার ওয়াস্তে আপনি অন্যকিছু কথা বলুন। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি আমার অন্তর্গত অবস্থা আন্দাজ করতে পারছেন না। আমার পেটে খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। এই সময় আমার স্বর্গীয় প্রভার প্রয়োজন একেবারেই নাই। আমার প্রয়োজন বিরেচক ওষুধ…”

বুদ্ধি আর ইমান, আকাশ আর পৃথিবী, মানুষ আর ফেরেশতা, খোদা আর শয়তান— এ-সব আমি কী ভেবে চলেছি? এ হল বর্ষার বৃষ্টি। যখন শুকনো নিরস জমি আর্দ্র হয়ে ওঠে আর সেখান থেকে অদ্ভুত সুন্দর সোঁদা সুগন্ধ আসতে থাকে। অথচ দুর্ভিক্ষে ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মরে। বুড়ো, শিশু, জোয়ান, নারী-পুরুষ সকলের চোখ গর্তে ঢুকে যায়। চেহারা হলুদ হয়, চামড়া ফেটে হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে আসে। ক্ষুধার জ্বালা, কলেরা, বমি, পাতলা পায়খানা, মাছি, মৃত্যু… মৃত লাশের দাফন করার বা পোড়ানোর লোক নেই। লাশগুলো পচতে থাকে আর তা থেকে অদ্ভুত রকমের দু্র্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

আর একটি গল্পে—

“— প্রিয় বোন, আমাদেরও তো আসতে দাও।”

বারান্দা থেকে কথাগুলো ভেসে এল। আর সেইসঙ্গে একটি মেয়ে তার কুর্তার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল।

তার পরিচিত জানাশোনার মধ্যে মল্লিকা বেগমই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি রেলগাড়িতে চড়েছিলেন। আর সেটাও ছিল ফরিদাবাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত। একদিনের সফর। মহল্লার সব মহিলা ওর সেই সফরের গল্প শোনার জন্য হাজির হয়েছিল।

“— ওহো, আসার ইচ্ছে হলে এসো। একই কথা বারবার বলতে বলতে আমার মুখে তো ব্যথা হয়ে গেল। আল্লাহ্‌ যেন আমাকে দিয়ে মিথ্যা না বলিয়ে নেয়। তো, হাজারবার তো শোনালাম। এখান থেকে রেলগাড়িতে চেপে দিল্লি পৌঁছালাম। সেখানে ওর পরিচিত হতভাগা ষ্টেশনমাষ্টারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে আসবাবপত্রের সঙ্গে রেখে তিনি উধাও হয়ে গেলেন। আর আমি বোরকায় সারা শরীর ঢেকে ওই আসবাবপত্রের উপর বসে রইলাম। একে তো বিরক্তিকর বোরকা আর দ্বিতীয় হল পুরুষমানুষেরা। পুরুষমানুষেরা এমনিতেই তো বদস্বভাবের হয়ে থাকে। তার উপর যদি কোনো স্ত্রীলোককে একভাবে বসে থাকতে দেখে তো তখন ওখানেই ঘুরঘুর করতে থাকে। একটা পান খাওয়ারও জো নেই। কোনও হতভাগা খুকখুক করে কাশতে থাকে, তো কেউ আবার গলা খাঁকারি দেয়। ভয়ে তো আমার দম বেরিয়ে আসার জোগার। আর খোদা জানেন, কী ভয়ানক খিদে যে লেগেছিল…”

একটি নাটকে দু-জন শরিফ মুসলিম পরিবারের জেনানার কথোপকথনটি ছিল এইরকম—

“আফতাব বেগম-ও, তাহলে এই কথা! এ-সব আমি কী করে জানব বল্‌! খোদা যেন এরকম পুরুষ মানুষের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করেন। জানোয়াররাও দেখি লজ্জা শরম করে, ভয় করে। কিন্তু এ তো দেখছি জানোয়ারের থেকেও বদস্বভাবের হয়ে গেছে। এরকম পুরুষমানুষের পাল্লায় কেউ যেন না পড়ে। এরকম ব্যাপার-স্যাপার আগে কিন্তু ছিল না বুয়া ! আর এখন প্রত্যেক পুরুষমানুষের বিষয়েই এই এক কথা শোনা যায়। হতভাগাদের নিয়ে এই হল আপদ। এই ত তোমার বেহনই-এর কথাই যদি বলতে হয়, যদিও এখন সে বুড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু যুবক বয়সেও কখনোও জোরজবরদস্তি করেনি… খোদার কসম, ঘন্টার পর ঘন্টা আমার পায়ে ধরে সাধত।

মহম্মদি বেগম— সবই নসিব। তোমার এই কথা শুনে মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ ওই ডাক্তারনির কথা তো শেষ হয়নি। কথা যে কোথা থেকে কোথায় গড়িয়ে যায়! ওই ডাক্তারনি যখন বললেন যে আমার দুই মাসের পেট… তারপর অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। বললেন– বেগাম সাহেবা আপনি তো বলছেন যে চারমাস থেকে আপনি বিছানায় পড়ে রয়েছেন! ডাক্তার গিয়াসও বলছিলেন আপনার রোজ সন্ধ্যায় ১০০ থেকে ১০১ পর্যন্ত জ্বর হয়। তবুও আপনি বলতে চান যে আপনার…। আমি বললাম— ও মিসসাহেবা, তুমি তো ভাগ্যবতী! নিজের রোজগারে খাও দাও আর শান্তিতে ঘুমাও। কিন্তু আমাদের মতো মেয়েরা মৃত্যুর পরে জান্নাতেই যাই বা দোজখে, নিজের হালুয়া নিজেকেই বানিয়ে খেতে হবে। বিবি মুখপুড়িদের শরীর সুস্থই থাক বা অসুস্থই থাক, অসুখ-বিসুখে মরে যাক— পুরুষদের শুধু নিজের ভোগবিলাস আর আনন্দ-ফুর্তির সাথে সম্পর্ক। সে বেচারি সব শুনে চুপ হয়ে গেলেন…”

উপরের গল্পগুলোকে, তাদের চরিত্র বা চরিত্রের মুখের কথাগুলোকে আজকের সমকালে দাঁড়িয়ে দেখলে হয়তো স্বাভাবিক বলেই মনে হবে, কতজন আজকের দিনে এরকম বা এর চেয়েও আরও তীব্র ভঙ্গিমায়, চটপটে টানটান বয়ানে গল্প বলে থাকেন। গদ্য-পদ্যের চাতুর্যে, ভাঙাগড়ায় কথাগুলোর আবেদন আরও নিপুণ লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় একশো বছরের ওপারে গত শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের দশকের চরম রক্ষনশীল সামাজিক পরিসরে দাঁড়িয়ে বিশেষ করে গোঁড়ামির বৃত্তে আটকে থাকা মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে এইসব কথাগুলো বলে ফেলা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। সহজ ব্যাপার হয়ওনি। অথচ সত্যিটা হল সেইসময়ই রক্ষনশীল পারিপার্শ্বিকতার অন্ধকার পর্দাটিকে স্রেফ কলমের জোরে ছিন্নভিন্ন করে তৎকালীন সাহিত্যের ফেনিল আবেগসর্বস্বতার বাইরে বেরিয়ে ঘোর বাস্তবকে নিয়ে লেখালেখির সূচনা হল, এবং তা উর্দুতে। এই আখ্যানে আমরা সেই সোনালি সময়ের গল্প বলতে চেষ্টা করব। বুঝতে চেষ্টা করব ইতিহাস যাকে প্রগতিশীল উর্দু সাহিত্য বলে চিহ্নিত করেছে। কী অসম্ভব বৈপ্লবিক এক সময়ের আখ্যান— যতটা না তার আঙ্গিকে, রচনাশৈলীতে তার চেয়েও বেশি তার বিষয়ধর্মীতায়, রাজনীতিতে, সামাজিক আবেদনে। এক অপরিচিত নতুন ভাষ্যে। তাতে যতটা কল্পনাশ্রিত আবেগ আছে তার চেয়েও বেশি আছে নিষ্ঠুর কঠোরতা, সমস্ত হিপক্রেসিকে মুহূর্তে নগ্ন করে দেওয়া সুতীব্র কশাঘাত। চমকে উঠেছিল সবাই। তারপর রাগে ফেটে পড়েছিল। তবুও কলম থামেনি। এই আলোচনার স্বল্পবিস্তৃত পরিধিতে সেই কথাগুলোকেই জেনেবুঝে নেওয়া যাক।

ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে সে-সময় শিক্ষার অভাব, অশিক্ষা-কুসংস্কারের কুপ্রভাব আর পুরুষ প্রধান সমাজে সুযোগের অভাবে ভারতীয় নারীরা বিশেষ করে মুসলিম নারীরা ছিলেন অধিকার বঞ্চিত এবং ঘরের কোণে পর্দার আড়ালে বন্দি বন্দী। এই সময়েই স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আহ্বানে আলিগড়ে আসেন শেখ আবদুল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী বেগ ওয়াহিদ জাহান বা আলা বি, দু-জনেই একটা অন্ধকার সময়ে আলোর খোঁজ এনেছিলেন। ওয়াহিদ জাহানের পিতা মির্জা ইব্রাহিম বেগ ছিলেন দিল্লি রেঁনেসার অন্যতম স্থপতি। দু-জনেই রক্ষনশীল মুসলিম সমাজের মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেন, এবং সারাজীবন নানান প্রতিবন্ধকতা, বিরোধের মোকাবিলা করেও মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রাণপাত করেন। গড়ে তোলেন এক স্কুল, ‘আলিগড় জেনানা মাদ্রাসা’, যা আলিগড়ে শুধু না সমগ্র উত্তর ভারতে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার ভরকেন্দ্রে পরিনত হয়। শেখ আব্দুল্লাহ আর ওয়াহিদ জাহানের উদ্যোগে প্রকাশিত পত্রিকা ‘খাতুন’ তাঁদের চিন্তাভাবনাকে, মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্বকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে থাকে। আবদুল্লার বাড়িতে যে-প্রগতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে নিয়মিত উপস্থিত হতেন হালি, নাজির আহমেদ, জাকারুল্লাহ, আতিয়া ফৈজীর মতো মুসলিম সমাজের নতুন চিন্তার নানা মানুষ, যারা একত্রে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রবল জনমত তৈরি করেন, পাশে পান মহমদিয়ান এডুকেশন কনফারেন্সকে, আর ভোপালের বেগমকে। এই সমস্তই তৈরি করেছিল বিপ্লবের এক উজ্জ্বল পটভূমি, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আলিগড়েই সেই আগুনে তপ্ত হয়ে অঙ্গার হয়ে ওঠে একদল তরুণ দামাল ছেলে-মেয়ে— সাজ্জাদ জাহির, আহমেদ আলি, রশিদ জাহাঁ (শেখ আবদুল্লার কন্যা) আর মাহমুদ-উজ-জাফর। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ লেখকের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ভারতের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন। তৈরি হবে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ। একে একে আসবেন, থাকবেন কৃষাণ চন্দর, ইসমত চুগতাই, সাদাত হাসান মন্টো, রাজিন্দর সিংহ বেদি-রা, যোগ দেবেন ফৈজ আহমেদ ফৈজ, আহমদ নাদিম কাসেমি, আলী সরদার জাফরি, সিবতে হাসান, এহতেশাম হোসেন, মমতাজ হোসেন, সাহির লুধিয়ানভি, কাইফি আজমি, আলী আব্বাস হুসাইনী, মাখদুম মহিউদ্দিন, ফারিগ বুখারী, খাতির গজনবী, রাজা হামদানি, অমৃতা প্রীতম, আলী সিকান্দার, জো আনসারী, মাজাজ লাকনাভি ও আরও অনেকে। যাঁদের হাতে তৈরি হবে, রক্ষিত থাকবে দেশভাগ-বিক্ষত, ভীত, ক্লিষ্ট এই উপমহাদেশের এক নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাষ্য। নিঃসন্দেহে উর্দু সাহিত্যে প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন স্যার সৈয়দের শিক্ষা আন্দোলনের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন ছিল।

প্রগতিবাদীরা উর্দু সাহিত্যে গদ্য ও কবিতায় বাস্তব ও কল্পনার চমৎকার মেলবন্ধন করেছিল। ইউরোপীয় রোমান্টিকতার পরবর্তীতে বাস্তববাদ বা রিয়্যালিজমের প্রভাব উর্দু সাহিত্যেও পড়ে। ঊনবিংশ শতকের শেষে বা বিংশ শতকের প্রথম দশকে রোমানিয়ত-এর পরম্পরা উর্দু সাহিত্যকে জারিত করেছিল, সমান্তরালে বাস্তববাদ প্রভাব ফেললেও বিংশ শতাব্দীর কয়েক দশকে দেখা যায় কালাকার বাস্তবতার গভীরতায় ডুবে থেকে রোমানিয়ত্‌-এর নতুন ধারার সন্ধান করছেন। প্রথাগত রোম্যান্টিকতাকে সরিয়ে এই নতুন বাস্তবধর্মী রোমানিয়ত্‌ সামাজিক বাস্তবতাগুলিকে সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলল।

শুরুটা একটু একটু করে হচ্ছিল আগে থেকেই। কিন্তু প্রথাগত উর্দু সাহিত্যের কোমল রোমান্টিক পরম্পরাকে, প্রেমোদ্যানের বুলবুল, আশিক-মাসুক আর শের-শায়েরির মৃদু নরম আঙিনা ছেড়ে সমাজবাস্তবতার কঠিন জমিনে প্রথম নামিয়ে আনলেন মুন্সি প্রেমচাঁদ, নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষের কাহিনি চিত্রিত করলেন। প্রেমচাঁদের কাছে হিন্দি ও উর্দু উভয় ক্ষেত্রেই ছোটোগল্প এবং উপন্যাসে নতুন ধরন তৈরি করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কার্যত একাকী তিনি উর্দু ও হিন্দী কথাসাহিত্যকে উর্বর তুলেছিলেন, তত্কালীন ইউরোপীয় কথাসাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয় এক বাস্তববাদী আখ্যানের রোমান্টিক ক্রনিকলগুলি রচনা করেছিলেন।

‘কাফন’ গল্পটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, গল্পের শুরুটা এইরকম—

“ঝুপড়ির দুয়ারে বাপ-বেটা দু’জন বসে আছে। চুপচাপ। সামনে একটা আগুনের কুণ্ডুলি নিভু নিভু জ্বলছে। ভেতরে বেটার যুবতী বউ বুধিয়া প্রসব বেদনায় উথাল পাথাল আছাড় খায়। থেকে থেকে তার মুখ থেকে এমন মর্মবিদারক আর্তনাদ বের হয়ে আসে যে, উভয়ের কলিজা পানি হয়ে যায়।

শীতের রাত। চারদিক নৈশব্দে ডোবা। সারা গ্রাম অন্ধকারের চাদরে ঢাকা।

— মনে হচচে বাঁচপে নাকো। দিনমানই তড়পি গেলো। যা তো যা, মাধু, একটু দিকি আয়। বাপ হাসু বললো।

— মরিই গিলি তো জলদি মরচে না ক্যান? কী দিকি আসপো গো? ভয়-খাওয়া পাখির মতো জবাব দিলো মাধু।

— তুই একটু শক্ত-মক্ত পাষাণ আচিস হে। বচ্ছর ভরি যার সাতন জীবনের সুকু-মুকু খেললি তার সাতে এমন অকরুণ করচিস?

— বললি-ই হবি? ওর ওই তড়পানি, তাতে আবার হাত-পার ছট-ফটি, ওসব আমি দিকতি পারি নাকো।

একে তো চামারের ঘর। তারপর আবার গাঁ জুড়ে তার বদনাম আছে। হাসু একদিন কাজ-কাম করে তো তিন দিন করে আয়েশ। মাধুও কম না। সে এমনই কামচোর, এক ঘণ্টা খেঁটে-ছিটে ফের এক ঘণ্টা চুরুট টানে। এ কারণে কেউই তাকে কাজে রাখে না। ঘরে যদি একমুঠ চাল, ডাল কিংবা একফোঁটা শালুনের ঝোল থাকে তো কসম খেলেও কাজে নামবে না মাধু। দিন দু-এক অনাহারে কাটলে পরে একদিন হাসু গাছের ডাল-পাতা ভেঙ্গে কুড়িয়ে মাধুর কাছে দেয়, আর মাধু সেগুলো নিয়ে বাজারে বেচে আসে। যে ক’দিন এ দিয়ে চলে সে ক’দিন আর রোজগার নেই। দু’জন নবাবের বদন নিয়ে দিনভর এদিক সেদিক ঘুরে বেরায়। আবার যখন খুদ-পিপাসা হবে তখন হয়তো আবার কাঠখড়ি ভাঙে, নয়তো অনিচ্ছায় কারো দু’চার আনার মজদুরির তালাশে যায়।

এমন না যে, গাঁয়ে এখন কাজের দুর্ভিক্ষ যাচ্ছে। কাজকামের কোনো অভাব নেই। কৃষাণকুলের গ্রাম। মেহনতি মানুষের জন্য পাচ-পঞ্চাশটা কাজ ছড়িয়েই থাকে। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ এদের কাজের জন্যে তখনই পায় যখন দু’জন থেকে অন্তত একজনের কাজ না করে আর কোনো উপায় থাকে না। ভাগ্যক্রমে এ দু’জন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হতো তবে ‘অল্পতুষ্টি’ আর ‘খোদাভরসা’র লাইনে এদের শুদ্ধ করতে কোনো সবকের দরকার হতো না কেননা, এসব তাদের স্বভাব জাত ‘গুণাবলি’…”

এইভাবেই চামার সমাজের কঠিন বাস্তবতার অভিব্যক্তি মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এই রচনায়। এভাবেই মানুষের বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, পাওয়া-না-পাওয়া ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। চরম দারিদ্র্য আর অভাবকে, দলিত সমাজ, জাতপাত নির্ভর জীবনের কঠিন রূপ— সমাজের নীচু তলার মানুষরাই তার লেখার মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছিল। মাধু, হাসু এরাই প্রথম সাহিত্যের চৌহদ্দিতে প্রবেশের সুযোগ পেল প্রেমচাঁদের হাত ধরে।

এর পরেই হুড়মুড় করে উর্দু সাহিত্যের দোরগোরায় হাজির হল সেই চারজন, জলন্ত অঙ্গার হয়ে। ১৯৩২ সালে ‘অঙ্গারে’ নামক উর্দু গল্পের যে-দুঃসাহসী সংকলনটি বাজারে বেরোনোর অল্প কিছুদিনের মধ্যে যুক্ত প্রদেশে নিষিদ্ধ করা হয়, তার চারজন নবীন বুদ্ধিচর্চায় উদ্বুদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দীপ্ত চার গল্পকার একত্রে পরিচিত অঙ্গার গ্রুপ নামে। চারজনই র‍্যাডিকাল, প্রগতিশীল, পরবর্তী সময়ে আহমেদ আলি বাদ দিয়ে বাকি তিনজনই প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সাহিত্যে বিধিনিষেধ এবং উত্তর ভারতের মুসলমান সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির মূলে প্রবল আঘাত করেছিল অঙ্গার। তাই আওয়াজ উঠল এ-বই ‘নোংরা’, ‘ভাষা ও ভঙ্গিতে নির্লজ্জ’, এবং ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আক্রমণাত্মক’। পরবর্তিতে এই ‘অঙ্গারে’ বিতর্ককে ঘিরে পালটা-আওয়াজ তুললেন নানা ভাষার প্রগতিশীল লেখকরা; ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে।

মূলত সাজ্জাদ জাহির-এর পাঁচটি ছোটোগল্প, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নিদ নেহি আতি’ ও ‘দুলারি’, আহমেদ আলি-র ‘বাদল নেহি আতি’ ও ‘মহাব্বতোঁ কি এক রাত’, মাহমুদ-এর ‘জওয়ানমর্দী’ এবং রশিদ জাহান-এর ছোটোগল্প ‘দিল্লি কি সয়ের’ ও নাটক ‘পর্দে কি পিছে’… এই দশটি লেখা নিয়ে ‘অঙ্গারে’।

এই রচনার উল্লিখিত একদম প্রথমের গল্পটি সাজ্জাদ জাহিরের ‘ফির ইয়ে হাঙ্গামা’। ধর্ম আর রক্ষণশীলতার শোষণের পেছনের ছলচাতুরি আর তার বাইরের ভয়ংকর রিয়্যালিজমকে দেখিয়েছেন সাজ্জাদ। পরের গল্প ‘দিল্লী কি সয়ের’ আর নাটকটি ‘পর্দে কে পিছে’, ‘লেখিকা, ডাক্তার এবং কমিউনিষ্ট’ রাশিদ জাহাঁ অঙ্গারেওয়ালির লেখা। যিনি ইসমত চুঘতাই-এর ‘রাশিদা আপা’। ‘দিল্লী কি সয়ের’ গল্পটিকে দেখা যাক— একটি মুসলিম রমণীর দিল্লী ভ্রমণের কাহিনি, তার স্বামী তাকে মালপত্রের স্তূপে বসিয়ে দিয়ে নিজে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে চলে গেছেন। বউটি সেই জনবহুল স্টেশনে কয়েক ঘণ্টা একা একা যে-সব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, সেগুলি ফিরে গিরে একটি মেয়েদের আড্ডায় বলছে… কিংবা ‘পর্দে কে পিছে’ নাটকটি, যেখানে দু-জন শরিফ মুসলিম পরিবারের রমণী তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে, তাদের যৌনতার সুখ-দুঃখের কথা বলছে, একটি চরিত্র মহমুদি বেগম তার বার বার গর্ভপাত ও খারাপ স্বাস্থের কার্যকারণ সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে লেডি ডাক্তারটিকে বলে ওঠে যে, সে ডাক্তার সাহিবার মতো স্বাধীন নয়, বরং তার পুরুষের অধীন, যে-পুরুষ শুধু নিজের সুখের পরোয়া করে, তার কাছে তার পত্নী বাঁচল কি মরল, কোনো গুরুত্ব পায় না। যেন সে শুধু যৌনদাসী মাত্র… অঙ্গারের ভাষ্য তাবৎ তৎকালীন উর্দু সাহিত্যের পরিসরে সত্যিই আগুন জ্বালিয়েছিল। নাড়িয়ে দিয়েছিল যাবতীয় সামাজিক হিপোক্রেসির শিকড়, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বাঁধন, পুরষতান্ত্রিকতার অহংকারকে।

অঙ্গার উর্দু সাহিত্যে একটা বাঁক। প্রগতিশীলতার দিকে। যেখানে পরতে পরতে মিশে আছে বামপন্থা আর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী বাস্তববাদের ভাবনা। আঙ্গারে গোষ্ঠীর লেখকরাও পরবর্তীতে (মেহমুদ আলি ছাড়া) জড়িয়ে পড়েছেন সক্রিয় রাজনীতিতে, সদস্য হয়েছেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। তাঁরা আলোচনাত্বক, সামাজিক এবং বৈপ্লবিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করতেন। লেখার গুণগত মান বা শৈলীর বিচারে অঙ্গারের অবস্থান যাইহোক না কেন, উর্দু সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারার জনক হিসেবে এই চটি বইটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদিও প্রগতিশীল আন্দোলনের সব লেখক-কবিই সমাজবাদী বা সাম্যবাদি ছিলেন না, তবুও তার প্রত্যেকেই সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ছিলেন। এই বৈশিষ্ট্য অঙ্গার বা পরবর্তী উর্দু প্রগতিশীল সাহিত্যের মধ্যেও ছিল।

উর্দু প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যের আর একটি গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এর মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের গভীর প্রভাব। পরবর্তীতে এই মনোবৈজ্ঞানিক ধারণা রহস্যবাদের সঙ্গে মিশে আধুনিক উর্দু সাহিত্যের নির্মাণ করেছে, কিন্তু সে ভিন্ন গল্প। প্রগতিশীলতার চরম উৎকর্ষতার সময়কালে উর্দু সাহিত্যিকরা লেখায় মানবিক সংবেদনকে দৃষ্টিগোচর করার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ইসমত চুঘতাই, মন্টো, কৃষণ চন্দর, রাজেন্দ্র সিং বেদী বা মুমতাজ মুফতি, হাসান অসকরি, মহসিন আজিমাবাদী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। একাধিক উদাহারণের মধ্যে ইসমত চুঘতাই-এর ‘দিল কি দুনিয়া’, মন্টো-র ‘তোবা টেক সিং’, কৃষণ চন্দরের ‘ভরা চাঁদের রাত’ বা রাজেন্দ্র সিং বেদী-র ‘লাজবন্তি’ নিয়ে কথা বললে মনোগত জটিলতার ভাঙাগড়ার ছবিটা স্পষ্ট হবে।

যেমন ইসমত চুঘতাই-এর ‘দিল কি দুনিয়া’ গল্পটি—

“কুদসিয়া বানো কচি বয়সেই স্বামী-পরিত্যক্তা, ফিট খেত ভক্তির সুর মিশ্রিত হামদ শুনলে, এত ইন্দ্রিয়জ কামনাতুর ছিল সেই সদ্যোযৌবনের হতাশার বোধ। শেষে তার একটু গর্ববোধও হতে থাকে যে, এক মেমের জন্য তার স্বামী তাকে ছেড়েছেন। অর্থাৎ, দেশের রাজার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে কিছু। পাড়ার লোকেও সশ্রদ্ধ ভাবে তাকায়। পাঠানি বুয়া তার বাবা-মা-স্বামীকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে চাঁপা গাছের ডালে বেপর্দা বসে থাকে, তাকে প্রলুব্ধ করে লোকগানের যে নাগর মেরঠে চলে গেছে, তার কথা গেয়ে বিলাপ করে সে। নিজেকে মনে করতে থাকে ওই গ্রামের যে পীর বালে মিয়াঁ, যার মৃত্যুদিনে ওরস হয়, তাঁরই রাধা, মত্ত, দিওয়ানি। এ ভাবে তার ভিতরের কামনাগুলি, যা কোনও দিন পূর্ণতা পাবে না, জানলে লোকে বেহুদা বেশরম বলে দোর বন্ধ করে রাখবে, তা বলতে পারা যায় জোরে জোরে। অন্য বৈধতায়। শরিয়তি ধর্মের দিক থেকে দেখলে শাস্ত্রে তার ঠাঁই নেই, কিন্তু এই উপমহাদেশের লোকজ মরমিয়া তত্ত্বের ইতিহাসে সম্পূর্ণ সিদ্ধ। এক দিকে উত্তরপ্রদেশের উর্দু আফসানা, তাকে এলিট অন্তঃপুরের নিজস্ব রূপে দেখান চুঘতাই, অন্য দিকে তাঁর লেখা যেন জানানার মধ্য থেকে দেখা,নানা-নানী-বড়ি-আব্বা-আম্মা-বাঈজী-ছোটি বুয়া-ভাবীজান-চাচা সন্ধেবেলা লণ্ঠন-হাতে আলি বকশ। যাদের দেখার জন্য তিনি বেছে নেন এক বালিকা কথককে। বালিকার চোখ থেকে দেখায় জানাচেনা জিনিসগুলি হয়ে দাঁড়ায় না-জানা, সংকেতময়, ভয়াবহ বা সারল্যে ভরা। ঝিয়ের মেয়ে গাইন্দাকে যে গর্ভবতী করেছে ভাইয়া, বা এটা যে লেপের নীচে বেগমজান আর তার পরিচারিকা রাব্বু— রোজ রাত্তিরে ভয় দেখানো পাগল হাতি না, বালিকা কথকদের এই সব ভয় আর অজানা দিয়েই তৈরি হয় একটা সমাজের অবসন্নতা, ক্ষয়িষ্ণুতার ছবি, তার সমালোচনাও। নারীবাদের তীব্র প্রতিবাদের স্বর এখানে অনেক মনস্তাত্ত্বিক, অন্তর্ঘাতমূলক।”

এভাবেই প্রগতিশীল উর্দু সাহিত্য ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। যা কেবল উর্দু সাহিত্যকেই পুষ্ট করেনি প্রতিটি ভারতীয় ভাষার সাহিত্যে তা আলোকবর্তিকার কাজ করেছিল। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন ১৯৩৬ সালে লখনউতে গঠিত হয়েছিল, ভারতীয় লেখকদের লন্ডন বৈঠকের ঠিক এক বছর পরে, এই সংস্থার পিছনে প্রেরণা হিসাবে সাজ্জাদ জহির-এর নেতৃত্বে ‘আঞ্জুমান তারককি পাসান্দ মুসান্নাফিন’ ছিল। শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য লেখকরা যাঁরা যুক্ত ছিলেন— ডঃ মুলক রাজ আনন্দ, ডাঃ জোশী পারশাদ, প্রমোদ রঞ্জন সেনগুপ্ত এবং ডাঃ এমডি তাসির ইত্যাদিরা। সাজ্জাদ জহির তাঁর বিখ্যাত বই ‘রোশনিতে’-র গঠনের বিবরণ সন্ধান করেছিলেন। বলা যেতে পারে যে, উর্দু লেখকরা ‘আঞ্জুমান তারককি পাসান্দ মুসান্নাফিন’-এর সর্বাগ্রে ছিলেন, তবে পরবর্তীকালে ভারতীয় ভাষার প্রায় সমস্ত লেখকেরা একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, দেশের অভ্যন্তরে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে, কৃষক-শ্রমিকের অধিকারের জন্য সংগঠনটি সমাজতন্ত্রকে যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করে, যা শোষণের অবসান ঘটাতে পারে। প্রগতিশীল সাহিত্যের লেখকগণ স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, জনগণের শাসনের দাবিকে লেখায় গুরুত্ব দিয়েছিল।

উর্দু তথা ভারতীয় সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারা একটি বহুধা বিস্তৃত আলোচনা। আজকের সমকালীনতায় সেই ইতিহাসকে জানা ও বোঝা খুব জরুরি। জরুরি এই আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

একবার বলা দরকার প্রিয় ফয়েজ-এর কথাও, বামপন্থী চিন্তাধারার বিপ্লবী উর্দু কবি ছিলেন ফয়েজ । সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সাম্যবাদী এই কবি সাম্রাজ্যবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, নির্বাসন দণ্ড ভোগ করেছেন। উর্দু কবিতা চর্চার প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আফ্রো-এশীয় মানুষের মুক্তি ও শান্তির সপক্ষে সংগ্রাম করেছেন…

“তারপর কেউ এলো বুঝি মুর্দা-মনের জানাজায়?
না তো, কেউ না পথভোলা মুসাফির হবে কোনো
চলে যাবে এখনই
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সুদীর্ঘ রাত, মুখ লুকাচ্ছে তারকারাজির মাহফিল মহলে মহলে কাঁপছে ঘুমাতুর প্রদীপশিখা
পথচারীর অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়েছে হরেক পথ অচেনা ধুলো ঢেকে দিয়েছে বাসি কদমের ছাপ।
প্রদীপ নেভাও ঢালো রত্নখচিত পেয়ালায় শরাব,
এরপর শিকল লাগিয়ে নাও তোমার স্বপ্নহীন সব দরজায়
কেউ না, কেউ আর আসবে না এই ঠিকানায়…।”

Categories
2021-July-dharabahik

মুদ্রণ যন্ত্রের আবির্ভাব

ভাষান্তর: নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়

আমরা যাঁরা পড়াশোনা করি অথবা ছোটো পত্রিকা চালাই, আমাদের বেশিরভাগ সময়েই মুদ্রণ বিষয়ের ইতিহাস জানা হয়ে ওঠে না। ‘The Foundation of Early Modern Europe, 1460-1559’, এ-বিষয়ে একটি প্রামাণ্য বই। এ-বইয়ের লেখক ইউজিন এফ রাইস (জুনিয়র) এবং অ্যান্‌থনি গ্রাফটন। এ-বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের একেবারে প্রথম অংশের উপনাম ‘The Invention of Printing’ (‘দ্য ইনভেনশন অব প্রিন্টিং’)। সেই শিরোনামের নীচের লিখিত অংশটুকু অনুবাদ করেছেন নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়। লেখাটি পরিমার্জন করেছেন স্নিগ্ধা বর্ধন।

১৪৯২ এবং ১৪৯৮ সাল আমাদের চেনা। ১৪৯৮-এ ভাস্কো দ্য গামা ভারতবর্ষের মালাবার উপকূলে এসে উপস্থিত হন। এই সময়েই আরও কিছু পরিচিত আর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। ১৫০০ সালের অর্ধশতাব্দী আগে ইউরোপের মানুষ প্রথম ছাপা বই পড়তে পেল, আর ১৪৫০ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে নতুন আগ্নেয়াস্ত্রগুলি যুদ্ধের পদ্ধতি পালটে দেয়। ১৫০০ সালে রোমে কোপারনিকাসের অঙ্কশাস্ত্রের উপর বক্তৃতা এবং এই সময়েই তাঁর ‘পৃথিবীর নিজের অক্ষের উপর আর সেইসঙ্গে সূর্যের চারপাশে পরিক্রমণ’ তত্ত্বের শিক্ষা দেওয়া শুরু। এই আবিষ্কার, অনুসন্ধান আর পুনরানুসন্ধান প্রভাবিত করতে পেরেছিল সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসকে। এই সমস্ত কিছু পালটাতে পেরেছিল ইউরোপের সম্পর্ককে যা ছিল তার নিজের অতীতের সঙ্গে ও অন্যান্য অ-ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে। শৈলী ও সংস্কৃতির দিক থেকে ষোড়শ শতাব্দী অবধি ইউরোপ প্রাচীন গ্রিক, রোমান আর দূর ও নিকটবর্তী প্রাচ্য সভ্যতার ছাত্র। কলম্বাস ও ভাস্কো দ্য গামা-র অভিযান সেই নির্ভরশীলতা দূর করে নতুন রাস্তা দেখায়। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাপটের সাথে সাথে ইউরোপ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা অনুশীলন ও অর্জন করছিল। ১৫০০ সালের আগে ইউরোপ শৈলী ও ভাবনার আমদানি করত; ১৫০০ সালের পর ইউরোপের মানুষ সাংস্কৃতিক লগ্নিকারী (creditor) হয়ে উঠেছিলেন।

১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরে চলন্ত ধাতব অক্ষরের (movable metal type) মাধ্যমে মুদ্রণকার্য শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে তিনটি নাম উল্লেখযোগ্য— যোহান গুটেনবার্গ (১৩৯৫-১৪৬৮), যোহান ফাস্ট (১৪০০-১৪৬৫) এবং পিটার স্কোফার (১৪২৫-১৫০২), যিনি ছিলেন ফাস্ট-এর জামাতা। এই সূত্রগুলি অপর্যাপ্ত, কখনো কখনো পরিষ্কার নয়, আর সংশয়াত্মক। অতএব মুদ্রণবিদ্যা ও অক্ষরশৈলীর পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারার জন্য কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তিরই অবদান আছে, এ-কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে মুদ্রণের উৎস বিষয়ে আপেক্ষিকভাবে আমাদের অজ্ঞতাই বিষয়টিকে জানার উৎসাহ দেয়। এই অজ্ঞতার ফলে আমরা ভুল করে ভাবি যে, একটি জটিল প্রযুক্তি আবিষ্কারের কৃতিত্ব একজন ব্যক্তিবিশেষের। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, একটি আবিষ্কার কোনোভাবেই একটি ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। একই কথা কবিতা বা ছবির ক্ষেত্রেও যা কিনা একটি সামাজিক উৎপাদন। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বা টেলিগ্রাফের ক্রম-অগ্রগতির মতোই একটি পাঠ্যবস্তুর হুবহু নকলের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও তার উদ্ভাবন ছিল একটি সমষ্টিগত প্রয়াস। ১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরের মুদ্রকেরা এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রস্তাবনা ছিল।

পশ্চিম ইউরোপে অক্ষরশৈলীর মুদ্রণ সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দু-টি চৈনিক আবিষ্কার— ব্লক প্রিন্টিং এবং কাগজ। কাঠখোদাই শিল্প (xylography) অথবা ব্লক প্রিন্টিং-এর উদ্ভব হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে, চীনে। মুদ্রক একখণ্ড কাঠের ব্লকে উলটো করে আঁকতেন ছবি অথবা বিষয় যা তিনি হুবহু ছাপতে চাইছেন। মুদ্রক কাঠখণ্ডটিকে এমনভাবে খোদাই করতেন যাতে তা রিলিফের এবং গ্রাফিক আকার নেয়। এবং তারপর তা কাগজে বদলি করতেন। ভাবনার দিক থেকে প্রক্রিয়াটি ছিল সরল, কিন্তু প্রয়োগের সময় জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল। এছাড়া পশ্চিমী বর্ণমালার সঙ্গে এই পদ্ধতিটি ঠিক ঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১২৫০ থেকে ১৩৫০ সালের মাঝামাঝি যখন ইউরোপের সঙ্গে চীনের সংযোগ অস্বাভাবিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল, তখনই পশ্চিমে এর প্রচার হয়। যদিও মুদ্রণপ্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই, তবু এর পরোক্ষ গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছিল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি: একটি পুরোনো কাঠের ব্লক বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী কাটা এবং তারপর তাকে নতুন পাঠ্যবস্তুর বানান পদ্ধতি অনুযায়ী পুর্নবিন্যস্ত করা। এই পদ্ধতিটি মুদ্রণের ধারণাটিকে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। তবে সরাসরি বাণিজ্যিক সাফল্য শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে। খেলার তাস (অন্য একটি চৈনিক আবিষ্কার), ধর্মীয় প্রিন্ট আর স্থুল কাঠখোদাই করা বই প্রথম বাজারের গুরুত্ব বোঝায়। সম্ভাব্য লাভের উপরও জোর দেয়।

অর্থনীতির থেকেও প্রযুক্তিগত কারণে কাগজ অপরিহার্য। হাতে লেখা বই সাধারণত পার্চমেন্টের (যা ভেড়ার চামড়া থেকে তৈরি) অথবা ভেলামের (বাছুরের চামড়া) উপরে লেখা হত। এগুলি ধাতব মুদ্রণকারীরাও ব্যবহার করতেন, বিশেষত যখন লক্ষ্য উপযোগিতার থেকে উৎকর্ষের দিকে ঝুঁকে থাকত। যখন কাগজ ছিল না, সে-সময় একটি বাইবেলের মতো বড়ো বই ছাপতে প্রয়োজন হত প্রায় ১৭০টি বাছুরের অথবা ৩০০টি ভেড়ার চামড়া। কাগজ না থাকলে হয়ত বাতিল হয়ে যেত এই সম্ভবনাময় যান্ত্রিক অনুকরণের প্রক্রিয়ায় সস্তা দ্রুত এবং প্রচুর পুস্তক প্রকাশনা। আরবরা চীন থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনে কাগজ উৎপাদন করতে শুরু করে। পরের দুই শতাব্দী ধরে আস্তে আস্তে এই পদ্ধতি ইউরোপের একটি বড়ো অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন ইতালি (১২৭০), ফ্রান্স (১৩৪০), জার্মানি (১৩৯০) এবং সুইজারল্যান্ড (১৪১১)। ইউরোপের প্রধান কাঁচা মাল ছিল পুরোনো কম্বল। কাগজ প্রস্তুতকারকেরা কম্বলগুলি একটি জলশক্তি চালিত স্টাম্পিং মেশিনের নীচে রাখতেন। শনজাতীয় গাছকে জলে ভিজিয়ে নরম করে, তার থেকে তৈরি ফাইবার মেশানো হত। এরপর তাকে ভিজিয়ে রেখে একটা কাঠের ফ্রেমের বিশাল চালুনি দিয়ে ঢেলে একটা তরল মণ্ড করে ফেলা হত। এবারে সেটাকে তারজালির উপরে সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে যখন তার ছিদ্রগুলির ভিতর দিয়ে জল চালনা করা হয়, সে-সময় সেই খণ্ডগুলিকে একটি ছাপাখানায় পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে চাপ দেওয়া হত। এরপর সেই খণ্ডগুলিকে শুকিয়ে মাপ করে কাটা হত। ওয়াগনরের অপেরা ‘মেইসটারসিঙ্গার ভন ন্যুরন্বার্গ’ (von Nürnberg)-এর নায়ক চর্মকার-কবি হান্স সাক্স (১৪৯৪-১৫৭৬) এই পদ্ধতিটিকে একটি কবিতায় বর্ণনা দিয়েছেন যেটা কাগজ তৈরির প্রথম দিকের ছবি দেয় আমাদের:
এই মিলে আমি ব্যবহার করি কম্বল
এইখানে স্রোত ঘুরিয়েছে চাকা-কল
সেই জল র‍্যাগ ছিঁড়ে করে বহুখণ্ড,
তারপর জলে, পাত্রে ভেজাই মণ্ড।
ঠিকঠাক করে মোল্ড করি সেই কাগজ
সারাদিন প্রেসে জল নিঙরাই, রোজ
ঝুলিয়েছি তাকে, শুকোনোর দরকার;
বরফের মতো ফর্সা এবং চকচকে ওটা
চোখের আরাম সবার

গুটেনবার্গের যৌবনকালেই কাগজ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত আর তা পার্চমেন্টের ছয় ভাগের একভাগে বা এক ষষ্ঠাংশ দামেই পাওয়া সম্ভব ছিল।

পশ্চিমী অক্ষরশৈলী নিয়ে এল ইউরোপীয় পদ্ধতিও এবং এইসব ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক। মেইন্‌জ্‌ শহরে গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফার (Schoffer) যেভাবে মুদ্রণ করতেন তার জন্য প্রয়োজন ছিল মানানসই কালি, কালি দিয়ে কাগজে বদলি করার ছাপযন্ত্র আর ধাতুর তৈরি অক্ষর (type)। সেই ধাতুর সঙ্গে সমভাবে আর মসৃণভাবে সেঁটে থাকতে হবে কালিটিকেও। সেজন্য তার উপাদানে তেলজাতীয় পদার্থ থাকা অবশ্যই জরুরি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্লেমিশ (Flemish; ফলান্ডার দেশের বাসিন্দারা) শিল্পীরা তেলচিত্র আঁকতে শুরু করেন। তেলচিত্র বলতে তখন বোঝাত মানানসই ছাপার কালি, যার মধ্যে থাকত পিগমেন্ট অর্থাৎ, ভুষোকালি বা কাঠকয়লা গুঁড়ো এবং তিসির তেলের সাহায্যে আনা ঔজ্জ্বল্য। দ্রুতই কাঠের ছাপাখানার উত্তরসূরিও পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। যে-প্রেসে জল নিংরে বের করা হত, সেই প্রেস ব্যবহার করে নতুন মুদ্রণের ক্ষেত্রে নতুন অভিযোজনের কথা হয়েছিল। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অক্ষরের (type) আবিষ্কার— বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের মুকুরকল্পের (Mirror Image) ধাতুনির্মিত ছাঁচের নিখুঁত নির্মাণ। এই দক্ষতা অক্ষর ঢালাইয়ের উন্নতিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে আর তা, স্পষ্টতই, ধাতুবিদ্যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন ধাতু খোদাইকারী, অথবা যিনি মুদ্রা এবং পদকের নকশা করতেন অথবা ছোটো-কিছু-তৈরিতে-দক্ষ স্বর্ণকার অথবা যাঁরা শীলমোহরের অক্ষর পেতলের উপরে খোদাই করতেন, দস্তার তৈরি পাত্রের উপরে কাজ করতেন এবং বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষ কারিগরেরা ইউরোপের বিভিন্ন অংশে টাইপ, অক্ষর, কালি, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন— এমন কল্পনা করা যায়। এও ভাবা যায় যে, মুদ্রণযন্ত্রের সঠিক উদ্ভাবন, তার কিছু পরিচিত কৌশলকে নতুন এবং কাজে সুবিধাজনক পদ্ধতিতে পালটে ফেলার নাটকীয় মিশ্রণ পদ্ধতি (যা আমাদের কাছে এখন সহজ মনে হয়, এ-সব হওয়ার আগে যা অকল্পনীয় ও দুরূহ ছিল) বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে হয়েছিল। সব শেষে, গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফারই প্রথম এই নতুন পদ্ধতিকে নিখুঁতভাবে সংগঠিত করে একটা ইন্ডাস্ট্রির (Industry, শিল্প ) রূপদান করতে পেরেছিলেন। তবে যেটা নিশ্চিত, সেটা হল এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো বই মুদ্রিত হয়েছিল সঞ্চরণশীল ধাতব অক্ষরের সাহায্যে (Movable metal type) এবং সেটা হয়েছিল মেইন্‌জ্‌ শহরেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বইগুলি এখনও টেকনিকের দিক থেকে নিখুঁত। এ থেকে এটা বলা যায় যে, মেইন্‌জের প্রকাশনা-বাড়িগুলি তাদের পূর্বসূরিদের থেকে এবং পূর্বসূরিকৃত প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে অনেকখানি দক্ষতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল। গুটেনবার্গ কৃত যে-লাতিন বাইবেল অত্যন্ত জনপ্রিয় বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে গ্রন্থপঞ্জিকারেরা যাকে বিয়াল্লিশ লাইন বাইবেল (forty-two-line Bible) বলেন (এবং তা অবশ্যি মেইন্‌জ্‌ শহরের প্রথম দিকের প্রকাশনা থেকে আলাদা করতে, কারণ, সেটা ছাপা হয়েছিল ছত্রিশ বাক্যের পাতায়) তা প্রকাশিত ও সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৪৫৫ সালে। এই বাইবেলের অক্ষরনৈপুণ্য, অক্ষর সংস্থাপনের কৌশল এবং মুদ্রণ নিখুঁত। স্পষ্টতই মেইন্‌জের মুদ্রণকারীরা মুদ্রণ প্রযুক্তিকে একটা শক্ত জমির উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যিই, পরবর্তী তিনশো বছর ধরে গুটেনবার্গের উত্তরসূরিরা খাঁজ তৈরি, ছাঁচ করা, অক্ষরঢালাই, অক্ষর বিন্যাস এবং মুদ্রণের ব্যাপারে গুটেনবার্গ যা করেছিলেন সংক্ষেপে সেটাই করছিলেন। এর পরের মুদ্রকেরাও উৎকর্ষের দিক দিয়ে ও নান্দনিকতায় এর প্রতিষ্ঠাতাদেরকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। ১৪৫৭ সালের ১৪ই অগস্ট ফাস্ট ও স্কোফার একটি সাম (The Psalms) স্তোত্র মুদ্রণ করেছিলেন। এই খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ভেলাম বা বাছুরের চামড়ার উপরে। লাল আর কালো কালিতে ছাপা অক্ষরগুলি সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছিল পাতার সঙ্গে। প্রতিটি সামের শেষে মুদ্রকেরা গর্বিতভাবে লিখেছিলেন ‘প্রথম বিশাল অক্ষরের সৌন্দর্যভূষণ-সহ’ (adorned with the beauty of large initial letters) এই অক্ষরটির ঝালরের রূপে বিন্যস্ত, যা লাল কালো রঙে বহু ফুল ও পশুর চিত্রের সাহায্যে অলঙ্কৃত হয়েছিল— সত্যিই ছিল অসাধারণ। ফাস্ট এবং স্কোফারের সাম্‌স্‌ সবচেয়ে পুরোনো সাক্ষরিত ও তারিখবিধৃত বই। সারা ইউরোপে এর সৌন্দর্যের তথা সৌকর্যের জন্য এটি এখনও অন্যতম সুন্দরী বই।

প্রথম দিকের মুদ্রিত বইগুলির একটি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক দিক ছিল। এদের পৃষ্ঠাগুলি ছিল প্রায়ই পাণ্ডুলিপির মতো দেখতে, ফলে অনভিজ্ঞ চোখে এইসব বই পাণ্ডুলিপির চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল না। স্পষ্টতই মুদ্রকের কৌশলগত, নান্দনিক এবং বাণিজ্যিক লক্ষ্য ছিল হুবহু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা। এবং ওরা সেটা শুধু যে অলসতা অথবা খরিদ্দারের হাতে পরিচিত জিনিস তুলে দেবার জন্যেই করত, তা নয়। আসলে প্রথম দিকের প্রকাশকেরা তাঁদের আবিষ্কারের নিঁখুত সম্ভবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না; তাঁরা মুদ্রণকে একটি নতুন অথচ নির্দিষ্ট ধরনের লেখা বলে মনে করতেন (“কলম ছাড়াই লেখার কৌশল”, বলেছেন স্কোফার); তাঁরা ভাবতেন যে, তাঁদের অল্প দামে প্রচুর সংখ্যক পাণ্ডুলিপি (manuscripts) বিক্রি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহিত এই ধারণা থেকে মুক্ত না হওয়ার সমস্যাটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যদিও অক্ষরশৈলীর আবিষ্কার রেনেসাঁর সবচেয়ে বড়ো ঘটনা, তবু এর প্রাথমিক উন্নতিবৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে চার্চ-সংক্রান্ত লোকজনের রুচি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। মুদ্রণের ভৌগোলিক উৎস ইতালি থেকে অনেক দূরে। অথচ পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ও কারুকলার কেন্দ্র ছিল এই দেশ। মুদ্রণই প্রথম প্রাদেশিক যাজকশ্রেণির মূলধনের সাহায্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল এবং এই ব্যাবসার প্রসার ছিল প্রায় ৩০০০ লোকের মধ্যে এবং খুব কম আর স্বতন্ত্র কিছু বুদ্ধিজীবি মহলে। মঠ এবং ক্যাথিড্রালের অধ্যায়গুলি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল লাতিন বাইবেলের জন্যে। আর গির্জার নিত্যকর্ম পদ্ধতির বই, তার গানের বই এবং বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত প্রার্থনা সংগীতের বই ছিল এইসব মুদ্রকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই মুদ্রণের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিল। যেমন চার্চের ক্ষমাপত্র-র (ইন্ডালজেন্স ফর্ম) জন্য একটি বরাত থাকত। প্রকাশকদের সস্তা বইয়ের তালিকায় (স্কোফারের) প্রাধান্য পাচ্ছিল সনাতন বিষয় যেমন— বাইবেলের সহজ ব্যাখ্যা, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের কাজ, সাধুসন্তদের জীবনী আর ‘ভালভাবে বাঁচা ও সুন্দরভাবে মারা যাওয়া’-র পথনির্দেশিকা এবং বীরত্বের রোমান্স কাহিনি।

মেইন্‌জ্‌ শহরে ১৪৬০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে বিস্ময়করভাবে প্রকাশনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হল বইয়ের অনন্ত চাহিদা। ব্যাবসায়ী-উকিল-কারিগর-সরকারি-কর্তা-ডাক্তার-শিক্ষকদের অনন্ত চাহিদা। ইউরোপের কৃষকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং পরের কয়েক শতাব্দী ধরে সেটাই চলবে। যাজক সম্প্রদায় ও নোব্‌ল শ্রেণির মানুষ এ-কথা মেনে নিতে শুরু করেছিলেন যে, রাজদরবারে এবং দেশোয়ালি জমিদারদের কাছে চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষিত হওয়াটা জরুরি। তবে তাঁদের প্রয়োজন এতদিন মিটিয়ে আসছিল ওয়ার্কশপের বহু নকলনবীশ, যাঁরা বইয়ের সংখ্যা বাড়াতেন হাতে লিখেই। এটা ঠিক যে, মুদ্রিত বইগুলি বেশ কিছু দশক ধরে ইতালির ধনবান ও কৃষিপ্রধান নায়েবদের থেকে স্বতঃস্ফূর্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে আমরা যাকে বলি, শহরের মধ্যবিত্তশ্রেণি— তাঁদের মধ্যে, এছাড়াও অন্যান্য মানুষের মধ্যে, তাঁদের ব্যাবসা ও নাগরিকতা রক্ষার জন্যে, লেখাপড়া ও হিসেবনিকেশের প্রয়োজন হত। এইসব মানুষ ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় শহরে ও গিল্ড স্কুলে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন এবং এঁরা পঞ্চদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগ বাড়িয়ে তুলছিলেন, মুদ্রিত বইয়ের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছিল। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মধ্যযুগে শুরু হওয়ায় নিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসারই মুদ্রণের ব্যাপ্তির পিছনে কাজ করেছিল। শহরের জনসংখ্যা, বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে লাগল শিক্ষা-সচেতনতা, সম্পদ, শক্তি, আত্মসচেতনতা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক চাহিদা। বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে স্বশিক্ষিত ও আত্মসমৃদ্ধি লাভ করার জন্য যে-অদম্য উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁরা কিনে নিতেন মনোরঞ্জক ও সবরকমের দরকারি বই: ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বই, লাতিন ভাষার ও মাতৃভাষার বই, ব্যাকরণ, অভিধান, বিশ্বকোষ, অঙ্কের মৌলিক বই, জ্যোতিষশাস্ত্রের বই, ওষুধপত্র এবং আইনসংক্রান্ত, আঞ্চলিক ও সামগ্রিক ইতিহাসের বই, আত্মত্যাগের জনপ্রিয় নির্দেশিকা আর কিছু হৃদয়-স্পর্শ-করা লাতিন ক্লাসিক— ভার্জিলের ঈনিড, সিসেরোর দি অফিসিস, টেরেন্স, প্লিনি আর সেনেকা। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের আগে শহরশাসিত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি শহরের মানুষের পড়ার প্রয়োজন পরিবেশন করত। স্টেলনার (লেখার উপকরণ ও তৎসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের বিক্রেতা) বলা হত তাঁদের। তাঁরা প্রয়োজনীয় বই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতেন। বিশাল মূলধন নিয়ে এঁরা লেখক/নকলনবীশও ব্যাখ্যাকার ভাড়া করতেন, তাঁদের বিষয় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিতেন। আর এঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ করে ফেলতেন সম্ভাব্য বইয়ের বিশাল বিশাল সব তালিকা। এইসব বই ব্যক্তির অগ্রিম টাকায় অর্ডারে খুচরো দোকানে (retail) বিক্রি করা হত। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা বিশাল মাপের সব কাজ করতেন। নিজের সংগ্রহের বিজ্ঞাপন করতে ডাইবল্ড লবার (ন্যুরেমবার্গের লেখক) ব্যবহার করছিলেন প্রায় একশোটা বিভিন্ন বিষয়ের হাতে লেখা তালিকা। এ-তালিকার textগুলি তাঁর দোকানেই পাওয়া যেত। ভেসপাসিয়ানো দ্য বিসটিচ্চি ছিলেন ফ্লোরেন্সের পুস্তকবিক্রেতা (cartolaio)। এই মানুষটি মুদ্রণের যুগে বেঁচে থেকেও মুদ্রণকে ঘেন্না করতেন। ইনিই পঁয়তাল্লিশ জন ‘লেখক’ ‘লাগিয়েছিলেন’ কুড়ি মাসে প্রায় দুইশোখানি বই লিখে ফেলতে কসিমো দ্য মেদিচি-র জন্যে। এঁর কাজের ব্যাপ্তিও ছিল বিশাল। অন্য দেশের শাসক ও সুদূরের কালেক্টরের জন্যেও কাজ করতেন। যেমন— ইংল্যান্ড। ভ্যাটিকান সিটি থেকে অক্সফোর্ডের লাইব্রেরি— সব জায়গায় ভেসপাসিয়ানোর শতাধিক অসাধারণ এবং ব্যাখ্যার বই (আলো করে রয়েছে) পাওয়া যেতে পারে। গ্রন্থাগারই হোক অথবা তাঁদের খরিদ্দার— সবার পছন্দের সুষ্ঠু নির্মাণ করতে এঁরা অনেক কিছু করেছিলেন। এঁরা হিউম্যানিস্টদের নতুন ও পরিষ্কার স্ক্রিপ্ট (script) রচনার ফ্যাশন চালু করেছিলেন। শিরোনামের পাতাটি, অর্থাৎ, প্রচ্ছদটিকে সাজানো, বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে তাকে ধ্রুপদী বিষয়বস্তুর ও আবক্ষছবির ছাপ দেওয়ার ফ্যাশনও এঁদেরই চালু করা। তাছাড়া এ-সব মুদ্রণের যুগ পর্যন্ত চালুও ছিল। তাঁদের তৈরি গ্রন্থাগার এবং দোকানগুলি হয়ে উঠেছিল তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ও বুদ্ধিজীবিদের আলোচনার ঝাঁ চকচকে কেন্দ্রবিন্দু। এইসব কেন্দ্রগুলি মঠ বা মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং এদের সমস্ত কিছুকে বাণিজ্যিক জীবনে সংহত করেছিল এই কেন্দ্রগুলি। ভেসপাসিয়ানো নন, তবে অন্যান্য কিছু বইবিক্রেতা নতুন বিশাল প্রকাশনের স্বার্থে (মুদ্রণ) নিজের অপছন্দ চেপে রাখতেন, আর কেউ কেউ এই নতুন প্রকাশনের দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

অক্ষরশিল্পের নিহিত সচলতা মুক্তি পেয়েছিল শহরের প্রচুর চাহিদা আর তৎকালীন অর্থব্যবস্থা ও তার বণ্টন পদ্ধতির সাহায্যে। ফলত দেখা গিয়েছিল বইয়ের অটল ও ক্রমবর্ধমান স্রোত। মুদ্রণ ছড়িয়ে পড়ছিল। মেইন্জ্ থেকে স্ট্রসবুর্গ (১৪৫৮), কোলন (১৪৬৫), অগস্বুর্গ (১৪৬৮), ন্যুরেমবার্গ (১৪৭০), লেইপজিগ (১৪৮১) এবং ভিয়েনায় (১৪৮২)। জার্মান মুদ্রকেরা অথবা তাঁদের ছাত্রেরা এই ‘স্বর্গীয়’ শিল্পটিকে ১৪৬৭ সালে ইতালিতে, সুইজারল্যান্ড ও বোহেমিয়ায় ১৪৬৮ সালে, ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ড্স্-এ ১৪৭০ সালে নিয়ে এলেন। ১৪৭৪ থেকে ১৪৭৬ সালের মধ্যে স্পেনে, ইংল্যান্ডে, হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ডে, ডেনমার্কে আর সুইডেনে ১৪৮২ থেকে ১৪৮৩ সালের মধ্যে। ১৫০০ সালের মধ্যে বেড়িয়ে গেল চল্লিশ হাজার সংস্করণ সমেত প্রায় ছয় লক্ষ বই; এবং আরও প্রচুর সংখ্যক বই যা সম্ভবত রোমের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে প্রকাশিতই হয়নি।

বইয়ের এতখানি সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল। সংস্কারের দিনগুলির আগে (the years before the Reformation) সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ছিল পাণ্ডিত্যের উপরে মুদ্রণের প্রভাব পাণ্ডুলিপির সবটাই নির্ভর করত লেখক/নকলকারীর শিক্ষা, দক্ষতা আর যত্নের উপরে। এবং তা সবসময়েই নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সর্বোপরি এই ত্রুটি ও আস্থাহীনতা হয়ে উঠছিল ক্রমবর্ধমান, কারণ, নকলকারীর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরসূরির ত্রুটিও নকল করে ফেলছিলেন এবং তৎসহ কিছু যোগও করছিলেন। মুদ্রণের মৌলিক অবদান, অন্য দিকে ছিল এই যে, এটা থামিয়ে দিয়েছিল এই চলতে থাকা পচনপ্রক্রিয়া এবং অতীতের মহতি পাঠ্যাংশকে তাদের আস্লি সংহতির কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ এবং অবিরাম প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারছিলেন মুদ্রকেরা। মুদ্রণ সারা ইউরোপের পণ্ডিত মানুষদের একইরকম পাঠ্যবস্তু দিচ্ছিল যা নিয়ে কাজ করা যায়। সংক্ষেপে একটি নির্দিষ্ট পাতার নির্দিষ্ট বাক্যের নির্দিষ্ট শব্দের উল্লেখ করে ব্যাসেলের (Basel) একজন পণ্ডিত একটি সংশোধনের প্রস্তাব দিতে পারতেন যা তাদের সহকারীরা রোমে অথবা ফ্লোরেন্সে সঙ্গে সঙ্গে দেখে নিতে পারছিলেন অথবা পারি শহরের মঠ-সংলগ্ন গ্রন্থাগারে একজন স্কলার আবিষ্কার করছিলেন একটি পাণ্ডুলিপি যার পাঠ্যাংশ বিচার করা সম্ভব হচ্ছিল এর আগের যে-কোনো জানা পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও সংক্ষেপিত পদ্ধতির সাহায্যে। এসে যাচ্ছিল এইসব আবিষ্কার ও সংশোধনের থেকে একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ যা বাতিল হয়ে যাচ্ছিল আরও এবং আরও একটি সংস্করণের আবির্ভাবে। এবং এই প্রক্রিয়া ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যতক্ষণ না একটি আদর্শ পাঠ্যাংশ পাওয়া যায়। অতীত তো কখনো কখনো বোঝা হয়েও যায়। আমরা তো কাজ করতে করতেই এটা জানি এবং এর অনেকখানির জন্যে আমরা মুদ্রণের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুদ্রণ যেভাবে পাঠ্যাংশের সমালোচনা একটি সমষ্টিগত বিজ্ঞানে পরিণত করেছিল, তা একদমই একটি সাধারণ ঘটনার বিশেষ অংশমাত্র। মুদ্রণ বুদ্ধিবৃত্তির কাজটি ব্যক্তির নিঃসঙ্গ কর্ম থেকে সামগ্রিকভাবে সমবায়ী কাজে পরিণত করেছিল। যেভাবে শিল্পবিপ্লবের সময় বাষ্পচালিত যন্ত্র মানুষের শারীরিক শ্রমের থেকে বহুগুণ উৎপাদনের ক্ষমতা দেখিয়েছিল, ঠিক সেরকম মুদ্রণও একটি ব্যক্তির প্রযুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রকৃতিবিজ্ঞান ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই ব্রেইন পাওয়ারের এমন মহতি মনোযোগ লক্ষ্যণীয় ছিল না। যেমন, কোপারনিকাস উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর সৌরকেন্দ্রিক প্রকল্পের তত্ত্ব ষোলোশো শতাব্দীর প্রথমার্ধে। কিন্তু ১৫৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি তা তিনি প্রকাশ করেননি। এই প্রধান বৈজ্ঞানিক সমস্যার উপর তিনি কাজ করেন ১৫০০ সাল থেকে ১৫৪৩ সালের মধ্যে, একা একা। ১৫৪৩ সালের পরে কোপারনিকাসের মুদ্রিত বইটি সে-সময় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের নজরে আসে। তা একটি সমবায়ী সমস্যার, বিতর্কের ও পড়াশোনার বিষয় হয়ে ওঠে। এর সমাধানও খুব দ্রুত পাওয়া যায়, অথচ অন্য কোনো ক্ষেত্রে (মুদ্রণ ছাড়া) হলে অন্য কিছুও হতে পারত। এই নতুন বুদ্ধির যন্ত্রের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর সব ধরনের পাণ্ডিত্য জনসাধারণের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। উপযুর্পরি পরীক্ষানিরীক্ষা, মনোযোগী এবং সমবায়ী পরীক্ষার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত ও মুদ্রিত মহান ফলাফল বিনিময়ও জনসাধারণের কথাবস্তুর কেন্দ্র হয়। এই বিষয়ে মুদ্রণের আবির্ভাবকে কেবলমাত্র একদিকে লেখালিখির (writing) অন্য দিকে কম্পিউটারের আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

মুদ্রণ কেবলমাত্র পাণ্ডিত্যকেই যে নিখুঁত আর সম্পূর্ণ করেছে তাই নয়, এটা বিদ্যা অর্জনের পদ্ধতিটিকে করে ফেলেছিল অনেকখানি সহজ। মুদ্রণের মানের আরও উন্নতির ফলে পড়াশোনা শেখা অনেক সহজ হয়েছিল। আগে যেখানে পুস্তকাদি ছিল মঠ ক্যাথিড্রাল ও মহাবিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া অধিকার, সেইখানে একজন ব্যক্তি কিছু বইয়ের মালিক হবার ক্ষমতা পেয়ে গেছিল। মধ্যযুগের ছাত্রদের নিজেদেরকেই নিজের অভিধান তৈরি করতে হত। করতে বাধ্য করা হত। লেকচার রুমেই বেশিরভাগ সময় এদের কাটত নিজের পাঠ্যাংশের অনুলিখন শিক্ষকের কাছে নিতে নিতে। লেকচার করা মানে ছিল একটি বই চিৎকার করে পড়া যাতে ছাত্ররা সেটা লিখে নিতে পারে। এখন ছাত্ররা সেই পাঠ্যাংশ বাড়িতে পড়তে পারবে। শেখার অর্থ ছিল স্মৃতিতে ধরে রাখা। মুদ্রণ স্মৃতির মুক্তি ঘটালো। একটা ঘটনা মনে রাখার প্রয়োজন কম ছিল বিশেষত ওটা যখন শেল্‌ফের উপরে থেকে পাওয়া যেতে পারে। অক্ষরশৈলীর আবিষ্কারের প্রায় একশো বছর পরে, ১৫৮০ সালে, ফরাসি প্রাবন্ধিক মিশেল দ্য মতাঁইয়ঁ (১৫৩৩-১৫৯২) রেনেসাঁ শিক্ষাতত্ত্বের প্রধান বিষয়টিকে আলংকারিকভাবে পুনর্বিবৃত করলেন। তিনি শিক্ষার অন্তিমতাকে সংজ্ঞায়িত করলেন তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানের বাহুল্যে নয় বরং শীলিত বুদ্ধি, গভীর অনুজ্ঞা ও চর্চিত রুচিময়তায়। মঁতাইয়ঁ-র কাছে একজন পণ্ডিত ছিলেন চলন্ত বিশ্বকোষ; কিন্তু তাঁকে তিনি যথার্থভাবে পণ্ডিতই বলবেন, কারণ, মুদ্রিত দরকারি বইগুলিই তখন স্মৃতিধরের ঐতিহ্যবাহী কাজটি করে যাচ্ছে।

বিশেষত ১৫০০ সালের পরেই যেটা সমানভাবে লক্ষ্যণীয় সেটা হল মুদ্রণ কিছু ইমেজ (বাক্‌প্রতিমা/রবীন্দ্রনাথ) ও ধারণার ব্যাপ্তিকে ত্বরাণিত করেছিল। দৃশ্যশিল্প (Visual Art) পৌঁছে যাচ্ছিল নতুন ও বিশাল অংশের মানুষের কাছে। ছাপচিত্র (Engraving) ছিল ফোটোগ্রাফি আবিষ্কারের আগে যে-কোনো শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি (reproducing method)। এই ছাপচিত্রের প্রতিমাচিত্র ও আলংকারিক বিষয়বস্তু এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, একজন শিল্পীর কাছ থেকে অন্যান্য শিল্পীর কাছে ছড়িয়ে পড়ছিল। যেমনভাবে রটরডমের ইরাসমাজের (২) মতো পণ্ডিত ব্যক্তির প্রভাব দ্রুত ছুঁয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের প্রায় সব বুদ্ধিজীবিদের বৃত্তগদি, তেমনি মিশেলএঞ্জেলোর কাজের ছাপচিত্র (Engravings) যেমন সিস্তিন চ্যাপেলের সিলিং-এ আয়োজিত নগ্নদেহের ভঙ্গিমাগুলি, তাঁর অতিদূরবর্তী সমসাময়িকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। তবে লুথারীয় ধর্মের প্রচার সর্বপ্রথম মুদ্রণকে ভয়াবহভাবে জয়ের গন্ধ-সহ বৈপ্লবিক গুরুত্বদান করেছিল, তার ধারণার প্রসারের জন্য। সংস্কারমুখী আন্দোলন প্রচারিত হয়েছিল আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে, মুদ্রণের মতোই দ্রুততায়। তার সাহায্য ছাড়া ওইরকম হওয়া সম্ভব ছিল না। সত্যিই ষোলোশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুদ্রণের ভূমিকা ভবিষ্যতের দ্বৈত ভূমিকার কথা ইঙ্গিত করে: তার আলোকিত করা ও জনশিক্ষার ইচ্ছা এবং বৈপ্লবিক সম্ভবনা ও বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তার হিংস্র বিরোধ। কিন্তু রাষ্ট্রদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও এ ছিল রেডিয়ো ও টেলিভিশনের আবিষ্কারের আগে কাজে লাগানোর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্র।

সেইজন্য মুদ্রণের আবির্ভাবের পরে সেন্সরশিল্প (অনুমোদন) পদ্ধতি চালু হয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে এটা খুবই কম চালু ছিল। পড়াশোনাকে গণতন্ত্রী করতে গিয়ে, মুদ্রণব্যবস্থা আধুনিক সেন্সর উৎপাদন করেছিল। যাজক কর্তৃপক্ষ ও নিরপেক্ষপন্থী— দু-পক্ষই পুস্তকগুলি সেন্সর করতেন। কারণ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি রাখতে বইয়ের নিষিদ্ধকরণ ও পুড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হত। ১৪৯২ থেকে ১৫০৩ সালের কার্যকালের মধ্যেকার পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার ১৫০১ সালের একটি বুলেটিনে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে বলছেন। “মুদ্রণ কৌশল” তিনি বলছেন “খুবই প্রয়োজনীয়, যতক্ষণ সেটা প্রয়োজনের ও রুচির বইয়ের প্রসার ঘটায়; কিন্তু এটা খুবই ক্ষতিকর হতে পারে যদি একে বিষাক্ত কিছু কাজের ব্যাপ্তি ঘটানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। সেইজন্য মুদ্রকদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, যাতে তাদেরকে ক্যাথলিক বিশ্বাসবিরোধী মুদ্রিত লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা যেতে পারে। অথবা যা বিশ্বাসীদের সমস্যায় ফেলতে পারে এমন লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা।” এমন ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে লুথারের ধর্মের সঙ্গে লড়াই করতে কয়েকটি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায়। এইসব তালিকাই শেষে রোমের নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় (১৫৫৯) পরিণত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরি ১৫২৬ সালে এরকম একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন। অন্যান্য প্রথম দিকের তালিকাগুলি করেছিল পারি ও লুঁভ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। নিরপেক্ষ শাহজাদারা যখন ধর্মীয় দায়বদ্ধতাকে তাদের মত থেকে শুধু আলাদা মতবিরোধী এবং রাজদ্রোহ বলতেন, সেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ঠিক ক্যাথলিক বিশপদের মতোই ভাবাবেগের সাথে বিশ্বাসীদের রক্ষা করতেন। ১৫৬০ সাল নাগাদ সবরকমের বইয়ের সেন্সরশিপ সর্বজনীনতা পেয়ে গেছিল পশ্চিম ইউরোপে। একদিকে লেখক মুদ্রক এবং প্রকাশকের লড়াই, অন্য দিকে সরকারি ও যাজক সম্পর্কিত সেন্সর সে-সংগ্রামের একদিকে ছিল। যে-সংগ্রাম ছিল বুদ্ধিগত উদারতার আর বিবেকের স্বাধীনতার। সেই সময়ে যা ছিল মৌলিক ধারণার সংঘর্ষের সময়।

Categories
2021- July-Prose

প্রীতম বসাক

খণ্ড কবিতার জীবন


“যখন শুনি জীবন দীর্ঘ হয়ে উঠছে,
একথা সত্যি নয়

যে নারীর শরীর হয়ে উঠছে ক্রমশ আরো বিশাল
আর গাছেরা
উঠে যাচ্ছে
মেঘের ওপরে,

ছোট ফুলকির মধ্যে অন্তঃস্যূত হয়ে যাচ্ছ তুমি,

অথবা প্রেমিক-যুগল ভালোবাসা-
বাসি করছে সমস্ত দিন!

খুব সরলভাবে বললে বলতে হয় এর মানে
সরলভাবে
বেঁচে থাকা শক্ত”

সহজ সরল জীবনের কথাই তো লিখতে চেয়েছি। সহজে যা পরিপাক হতে পারে। অনেকটা বড়ো হয়ে পর্যন্ত মনে পড়ে না কোনো দার্শনিক প্রশ্ন মনের মধ্যে রেখাপাত করেছিল কিনা! এই যেমন অস্তিত্ব বিষয়ক কোনো অতল জিজ্ঞাসা! কে আমি? কেন এই জন্ম-টন্ম? এই সকল প্রশ্নেরা আমাদের পাড়ায় পা রাখত না। আমাদের গায়ে দারিদ্র্যসীমার গন্ধ লেগে থাকত ঠিকই, না-পাওয়া কামরাঙা ফল নিয়ে আমাদের খুব ভাবনা ছিল না কখনোই। বরং সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত আমি এবং আমরা খুঁটে খুঁটে খেয়েছি ছড়িয়ে থাকা দানাশস্য। মা ও বাবার তরফ থেকে আমি যে-সম্পদ উত্তরাধিকারে পেয়েছি তা হল অনেক অনেক সম্পর্কের সাথে বসবাস। বাবারা দুই শরিক মিলে এগারোটি ভাই ও একমাত্র বোন। আমাদের জ্যোৎস্না পিসি। আর মায়ের তরফ থেকে পনেরো জন মামা মাসি ও তাদের অসংখ্য পাখি-সন্তান। আমি একদিনের জন্য একা হতে পারিনি। চাইওনি। সারাটা বছর সংসারে স্বজনের আনা-গোনা আমাদের উঠোনে পালকের যোগান দিত। না হলে কোন সাহসে, বাবা, আট আনার দলিল লেখা বাবা, বাড়ির নাম রাখেন ‘আনন্দ-আশ্রম’। দুটো টালির ঘর। চাটাইয়ের সিলিং। এক কোনায় কিছুটা শূন্যস্থান। আমার রহস্যের তিমিরময় এলাকা। বৃষ্টি হলে এখান ওখান থেকে জল পড়ছে। কোথাও পুরোনো ছাতা, কোথাও বালতি বসিয়ে রাখা। আমার ১৫ বছর বয়সে বাড়িতে বিদ্যুৎ এল। তার আগে লণ্ঠনের ঈষদুষ্ণ আলো। বড়োদাদা আর একমাত্র বোন দুই দিকে। আর ছায়ার দিকে আমি। একটা ডিম সুতো দিয়ে দুই ভাগ করে এবেলা আর ওবেলা। বছরে দু-বছরে একবার মাংস। সেদিন উৎসব। সময়ের আগে খিদা পাচ্ছে। দুপুরে চার টুকরো রাতে দু-টুকরো। সাথে বড়ো বড়ো আলু। মায়ের রান্না। ঈশ্বরপ্রদত্ত। সর্বত্র খ্যাতি। দুঃখ কোথা দিয়ে ঢুকবে। কোনো গ্লানি ছুঁতে পারে না এই বাড়িকে। তবেই না ‘আনন্দ আশ্রম’। কিন্তু সব ভালোর শেষ থাকে। দুঃখকে জায়গা করে দিতেই হয়। ছেলেপুলে বড়ো হয়। ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দের হাট ভেঙে যায়। তিন সন্তানের জননী একদিনও চোখের জল না ফেলে ভাত মুখে তোলেন না। এই সেদিন পুরোনো গেটটা ভেঙে ফেলতে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু এটাও ঠিক এ-বাড়িতে আর আনন্দ নেই। এ-বাড়ি এখন অশ্রুসজল। শ্যাওলা ধরা চোখে একজন পাহাড়া দেয় তাঁর স্মৃতি বিষয়ক রচনাগুলো। আমি এখনও জীবনকে প্রশ্ন করিনি কী পেলাম? কিন্তু তিনি, নিশ্চয় প্রতিদিন একবার তাঁর শূন্য ঘরের দিয়ে তাকিয়ে ভাবেন না কি তাহলে শেষপর্যন্ত কী মানে জীবনের? ভাবেন না কি—

“মৃত্যু ঐ যে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাত আমাকে ধরতে হবে।
তার গায়ে শশার গন্ধ,
সে অশরীরী নয়, না বোঝা কবিতার লাইন নয়,
আমার মায়ের মায়ের অল্প বয়সের গানের গলার মতোই মিষ্টি, সপ্রতিভ।
আমি আজ যখন বিকেলে বেড়াতে যাচ্ছিলাম
সে আমাকে বলল— এবার চলো।
একটা আলোকে সে গড়িয়ে দিয়েছে
আকাশের পারে অন্য ছায়ায়—
সে গতি বাতাসে উলটোয় না,কলস্বরা কান্নায় কাঁপে না,
কখনো থামে না,
তার রেখা সুপ্ত, রঙ অদৃশ্য সমুদ্র।

মৃত্যু আমার সঙ্গে কথা বলেনি,
তবু আমি বুঝি তার মন।
শক্ত স্বচ্ছ হিরে হয়ে
আমার বেদনাকে কাটতে কাটতে সে ভাবে
এটাও জীবন।”


আমার মামার বাড়ি ছিল সাত সাগর তেরো নদী পাড়ে। সত্যি বলছি। মাত্র ১২২ কিলোমিটার দূরে হলেও তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় তা গিয়ে দাঁড়াত যুদ্ধে যাওয়ার মত। ভোরের আলো ফুটবার আগে উঠে লটবহর নিয়ে বাস ধরতে আসা। তখন এক-একটা স্টপেজে কোনো বাস থামলে বাসের সব যাত্রী রাগে ফেটে পড়ার আগে পর্যন্ত বাস ছাড়ার ব্যাপারে কোনো হেলদোল দেখাত না কনডাক্টর বা ড্রাইভার। এত অনাবিল ক্ষোভ হজম করার শক্তি তারা কীভাবে পেত কে জানে? পেছনে যতক্ষণ না আর একটা বাস এসে দাঁড়াচ্ছে ততক্ষণ সে জগদ্দল হয়ে দণ্ডায়মান থাকত। বাসের ছোটো যাত্রীরা ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে কাঁদা। বিশেষ করে আমার বোনের অদ্ভুত ব্যাপার ছিল বাসে ওঠা মাত্র মায়ের বুকে মুখ রেখে ওই যে ঘুমে ঢলে পড়ত উঠত পার-পতিরামে। আমার বিশ্বাস ও এখনও তাই করে। ফলে বাস থেকে বাইরের জাড্য পৃথিবী কেমন দেখতে হয় সে আজও জানে না। আমার আবার ঠিক উলটো। বাসে ট্রেনে দিনের বেলা আমার চোখে ঘুম থাকে না। আমিও চলছি, বাইরেটাও চলছে— এই খেলা আমার আজও ভালো লাগে। বাসে উঠলে জানালার পাশে আমার ছেলেবেলাটা আমার আঙুল ধরে। সেদিন শিশু মনে একটা ভয় পেয়ে বসত। যদি বাসটা অ্যাকসিডেন্ট করে। যদি মরে যাই। ঠাকুরকে ডাকতে শুরু করতাম তখন। পাশের সিটে মা-ও বোনের সাথে ঘুমাচ্ছে। আমার ভয় করে। এখনও বাসে উঠলে, জানালয় মাথা রেখে মৃত্যুচিন্তা গ্রাস করে। মনে হয় এই বাসাটার মতো একদিন থেমে যাব আমিও নেমে যাব গন্তব্যে। নাকি পৌঁছোনোর আগেই। এই ভয়টা দার্শনিক। বুঝি এখন। নিজের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলি—

“প্রিয় মাটি, এখন মৃত্যুর কথা শুধু ভাবি,
তোমাকে ভাবি না।
তুমি গাছ-ফুল-লতা নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছ,
সমস্ত মানুষজন তোমার বুকের ওমে লুকিয়ে রয়েছে—
ট্রেন আসে যায়, যেন তুমি খেলনা গড়েছ,
তাই খেলা,
তাই খেলা রাত্রিদিন, এখানে ওখানে, আশে পাশে,
প্রিয় মাটি, তুমি ত্যাগ আমাকে করেছ, নাকি
আমিই তোমাকে?
এখন মৃত্যুর কথা শুধু ভাবি, তোমাকে ভাবি না”


কী করে একদিন কবিতার মেঘ জড়ো হয়েছিল আমার মাথায়! কে জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে গিলি গিলি ছু বলে পাখি ডেকে এনেছিল— ক্রোনোলজি মেনে বলতে পারব না! যে-কোনো স্মৃতির মধ্যে গিয়ে বসলেই মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। আর একটা লক্ষ্মীছাড়া দারিদ্র্য। টুনটুনির বাচ্চা হয়েছে গৃহস্থের বেগুন গাছে। পাতা সেলাই করে বানানো। রোজ আসে দুষ্টু বিড়াল আর টুনটুনি বলে পেন্নাম হই ঠাকুরণ। বিড়াল খুশি হয়ে চলে যায়! এভাবে চলতে চলতে টুনটুনির ছানারা বড়ো হয় আর মা বলে উড়তে পারবি? ছানারা মাথা নাড়ে। সায় দেয়। মাকে আস্বস্ত ও আশ্চর্য করে ডানা রওনা দেয়। সেদিন বিড়াল এলে দে লাথি বলে উড়ে যায় মা। বিড়াল লাফ দেয়। সূর্যকে হাতের মুঠোয় নিবে বলে। বাকিটা যে-কোনো মেইনস্ট্রিম সিনেমার ভিলেনের পরিণতি। রক্তপাত। তা বাচ্চাদের গল্পে রক্তপাত থাকবে না এটা কোনো বাস্তবতা নয়! আমাদেরও ছিল। তার মধ্যে থেকেই হয়তো কবিতার বীজাণু উঠে এসেছিল মাথায়। গরিব মানুষের ঘরে যেভাবে চন্দ্রবিন্দু ছাড়া চাঁদ ঢুকে পড়ে অনুমতি না নিয়ে!

আসলে আলাদা করে কোনো গুণ ছিল না। গানের কোনো ঐতিহ্য থাকার কথা ছিল না। আমার হাতেও কোনো সুর নেই। উচ্চতা এবং শরীর এতোটাই নিরীহ ছিল যে-কারো চোখে পড়ার কথাও ছিল না। কিন্তু কীভাবে যেন কবিতা জাতীয় কিছু একটা ছায়ার মতো ঘুরঘুর করত। ক্লাস নাইনের পাঠ্য বাংলা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় একদিন একটা কবিতার মতো কিছু লিখেছি, আর এক বন্ধু তা স্যারকে দেখিয়ে বলছে স্যার দেখুন ও বইতে কবিতা লিখেছে। ভূগোলের মাস্টারমশাই বইটি নিলেন, দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না। তবে আমার কবিতা লেখার কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। বিশেষ করে টিউশনের মেয়ে বন্ধুদের কাছে একটা আত্মপরিচয়ের প্রবল বাসনা পেয়ে বসল। যদিও এ-সবে তারা পাত্তা দিল না খুব একটা। কিন্তু আমি পালটে যেতে লাগলাম। অন্য আমি একটা। সবার থেকে আলাদা হওয়ার বোধ জেগে থাকল মাথায়। বাচ্চার দাঁত উঠলে যেমন চামচ থেকে জুতো সবেতেই কামড় বসাতে চায়, আমিও খাতার পর খাতা ভরিয়ে তুললাম হাবিজাবি লেখায়। আজও তা-ই লিখে যাচ্ছি। হিজবিজবিজ। হিং টিং ছট। স্তন সেই কবেই শুকিয়ে গেছে তবুও সন্তান অভ্যাসে চুষে যাচ্ছে ভাষার কষা বৃন্ত।


সবাই তো স্মৃতিই লেখে। অসংখ্য জিন পাহারা দেয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের মোহরগুলি। খুল যা সিমসিম। শুধু ছোট্ট একটা মন্ত্র। তবুও কেউ কেউ ভুলে যায়। বেশ করে। শান্তি পায় তাদের সামাজিক আত্মা। কিন্তু যাদের ঘুমের মধ্যে কামরাঙাগাছ ফুল ঝরায়। নিশি যাদের ডেকে নিয়ে যায় মেঘবসতি অবধি। কারুবাসনা তাদের স্মৃতির কবর খুলতে প্ররোচিত করে। প্রেত খুঁড়তে খুঁড়তে একটা ভীতু মানুষ তখন পরে নেয় আলখাল্লা। এক কোপ বসায় আর গলগল করে পুঁজ রক্ত মাছের মতো লাফিয়ে খাতায় এসে পড়ে। ও খাতা ও সাদাপাতা তুমি ওই মীনটিকে ধরো। গাঁথো কলমের ডগায়। লিখে নাও যা-কিছু ওর পেট থেকে পেলে। যা-কিছু ও খেয়েছিল তোমার অভিজ্ঞান। শকুন্ত লাবণ্য।

সেই লাবণ্যের খোঁজ আমার শুরু হয়েছিল ‘পাখি সব করে রব দিয়ে’, ‘সকালে উঠিয়া আমি’ দিয়ে। মামার বাড়ির দিনগুলোতে আমি নিজে রাখাল বালক হয়ে কতদিন গোরুর পাল নিয়ে মাঠে গেছি। দূরে তখন প্রাইমারি স্কুলের গরিব মাস্টার আমার দাদু নিমের দাঁতন ভেঙে নিচ্ছেন। মাজতে মাজতে স্কুলে পৌঁছে যাবেন। তার আগে পুকুরে নেমে ধুয়ে নেবেন বাসি লোভ। একটু ভালো করে দেখুন পাঠক ওঁর বাম হাতে বাঁশের কাঁচা কঞ্চি। গোপাল বড়ো ভালো ছেলে। ওই দেখুন রাখালের কমলালেবুর মতো নরম হাতে সপাটে পড়ল বুড়োর জীবনদর্শন। আমার পিঠেও পড়ল কি? না, আমি তার দাদার কন্যার সন্তান। শহরের মোরগ বাঁধা আছে মাথায়। শহরের স্কুলের ছুটি যার শেষ হয় না। আবার গ্রামের স্কুলও তাকে নেয় না। নেবে কেন গায়ে সাবানের গন্ধ লেগে আছে না! আমি অপেক্ষা করে থাকি কখন রাখালের টিফিন হবে। আর নতুন কোন আমগাছের খোঁজে সারাটা দুপুর আমরা পাখি হব। বালকের অবাক হব! এই অবাকই আমি মাতৃভাষায় অনুবাদ করেছি শুধু। আজও করে যাই। কেননা— “আমি ফুল ফোটা কোনোদিন দেখিনি। আমি ফুলের ফুটে ওঠা দেখতে চাই। এতবছর বাঁচলাম অথচ ফুলের, ফুলের পরাগ থেকে ফুটে ওঠা, প্রস্ফুটিত হওয়া দেখলাম না? আফশোস হয়। ফুল কখন ফোটে তাও তো জানি না। সকাল নাকি গভীর রাত্রে? সারাদিন সারারাত ফুল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। পরাগ তার পাপড়ি মেলে ধরেছে আমাদের সুন্দর পৃথিবীতে, সেই মূহূর্তটাকে আমি পেতে চাই… আমার শুধু দুটো চোখ আছে। তাই দিয়ে দেখব ফুল নিজের জন্য ফুটে উঠছে, গানের মতো,এক লয় থেকে আরেক লয়ে যাচ্ছে সে— কবিতার মতো, এক পঙ্‌ক্তি থেকে আর এক পঙ্‌ক্তি হয়ে সে পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে— ফুলের এই পূর্ণতার দিকে যাওয়া আমি দেখব।…”


“বোগদাদে এক খলিফা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল মনসুর। তিনি কবিতার বড়ই ভক্ত ছিলেন।…মনসুর কবিতা ভালোবাসেন শুনিয়া রাজ্যের যত কবি ভাল ভাল কবিতা লিখিয়া তাঁহাকে শুনাইতে আসিতেন। সেই সব কবিতায় বেশীর ভাগ কেবল খলিফার রূপগুণের প্রশংসা থাকিত। কে কত বেশী তারিফ করিয়া মনসুরকে খুশী করিতে পারেন, তাহাই লইয়া কবিদের ভিতর দস্তুরমত আড়াআড়ি চলিত। সকলের আশা, খলিফা খুশী হইয়া ভারি পুরস্কার দিয়া ফেলিবেন।”

দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা— আমার নীতিমালায় এমন বাক্য নেই। আমি বিশ্বাস রাখিনি কিছু পাওয়ায়। আমি লাফ দিইনি স্তনবৃন্ত ছাড়া কোনো ফলের মোহে। না-পাওয়ার দুঃখ আমার স্বপ্নের ভিতর এসে পালক ফেলে যায় না। খিদা পেলে মায়ের কাছে নীরবতাটুকু পৌঁছে দিতাম শুধু। কচি মুখের ম্লান আলোয় ভরে যেত বাসনকোসন। একটা অদৃশ্য বৃক্ষের গায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে ভাত ফোটা দেখতাম। ফ্যান গলানো দেখতাম। আর দেখতাম কাঁসার থালায় কী আশ্চর্য রূপকথা বেড়ে দিচ্ছেন স্নেহময়ী জবাফুল। ওই সাদা ফুলের মায়ায় আমি ফকির হওয়ার ডাক পেয়ে চলে গেছি পথের থেকে পথে। গাছের থেকে গাছে। মানুষ থেকে মানুষের সুগন্ধি রুমালে।

শুধু লেখা হওয়ার পর যে-দুঃখ আমি তার পাশে গিয়ে বসি। অঙ্কে ফেল করা ছেলের পাশে যেমন বসে তার বাবা! যেহেতু জানি সারাজীবনে আমার কবিতাও হয়নি অঙ্কও না তাই এই দুইয়েরই পাশে আমাকে বসে থাকতে হয়। মনখারাপ হলে যেমন কিশোর বসে থাকে রক্তকরবীর পাশে। বিশুপাগল তার গানের পাশে। লেখা যখন মাথার ভিতর থাকে তখন ফল ফেটে যাওয়ার মুহূর্তের যন্ত্রণা যেন। তা একরকম। আর হয়ে যাওয়ার পর, ফল ফেটে যাওয়ার পর, যখন তার রূপ রূপকথা থেকে বাস্তবে নেমে আসে তখন তার দিকে তাকিয়ে মনে হয় কেন আনলাম এই অসীম বিশ্বে তাকে অসহায় করে। একাকী করে। অপূর্ণ করে। হ্যাঁ, অপূর্ণ কেন-না যা লিখতে চেয়েছিলাম যেভাবে আঁকতে চেয়েছিলাম তার চোখের ছায়া— তা তো পারিনি! তখন ওই অসম্পূর্ণের পাশে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না আর। থাকতে থাকতে তারপর একবার দিকে ঝুঁকে পড়ি শ্রমিকের মেঘ নিয়ে। তার আঙুল ধরে বৃষ্টির ধারণা দিতে তাকে স্পর্শ করি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙলে বাজারে যাই। কচি লাউলগা খুঁজি।

ঋণ: য্যাজে‌ন গিলভিক, দেবারতি মিত্র, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, রাণা রায়চৌধুরী, ইমদাদুল হক।

Categories
2021-July-Story

রোদ্দুর মিত্র

বিলেদা

বিস্তর বছর এই পৃথিবীতে বেঁচে, একজন সুন্দর, অথবা একজন দুঃখী প্রাণপণে চাইছে ধুলো হয়ে যেতে।

যে-মানুষেরা তাকে জড়িয়ে ছিল— ধুলো হয়েছে কবেই। ভাঙতে ভাঙতে নিজের ছায়াটুকুও এখন মাটি, হয়তো কেউ এসে উড়িয়ে দেবে এক ফু-এ।

আছে বলতে নিজস্ব কিছু ক্ষত আর এই পার্থিব শরীরটা— অনেক সুতোর মাথায় কাটা খাওয়া ময়ূরপক্ষীর মতো, এতই অনুদ্বিগ্ন যেন চাইছেই না অ্যান্টেনায় জট পাকিয়ে আর ক-টা দিন উড়তে।

অথচ বিলেদা উড়তেই চেয়েছিল— আজীবন। স্বপ্নে যেমন প্রতি রাতে ঘুড়ি হয়ে যেত সে, পাশবালিশ হত লাটাই।

রংচটা দেওয়ালে ঝুলছিল পাহাড়ি উপত্যকার ছবি আঁকা একটা ক্যালেন্ডারে। সেখান থেকেই, কে জানে কখন, আশ্চর্য সব তুলো তুলো মেঘ চুপিচুপি নেমে এসে বিলেদাকে নিয়ে মস্ত উড়ান দিত। তার দু-কামরার ঘরে তখন হয়তো আলুথালু ছড়িয়ে ছিল তেলচিটে শাড়ি, ময়লা পায়জামা, আন্ডারওয়্যার, সায়া, গামছা… বিছানার পাশে উলটে পড়েছিল টিপ পরা ছোটো আয়না। ভূতের মতো দেখতে, ট্যাপ খাওয়া আলমারিটাও বিলেদাকে তখন ভয় দেখাতে পারে না। স্বপ্নে আবার ভয় কী! সেখানে যে সবাই নেচে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, পথ হারানোর পরে খুঁজে পায় একটা পাঁচতে ঘুড়ি। ছাদ থেকে পড়ে গেলেও স্বপ্নে তার মৃত্যু নেই— বোধহয় সে ঈশ্বর— ক্ষণিকের ঈশ্বর।

মাঘ মাসের আকাশ ঘন নীল। কাঁচা রোদের মাদুর বিছোনো পথে, শিরশিরে হাওয়া আলো ফোটা ইস্তক এই মেঘ সেই মেঘ করছে। দাঁত মাজতে মাজতে সেই যে বিলেদা ছাদে উঠল, এবার অনায়াসে কাটিয়ে দেবে গোটা একটা দিন। যতক্ষণ আলো আছে, বিলেদা ছাদে আছে। তার শরীরের একটা অংশ পেটকাটি হয়ে উড়ছে আকাশে, এই টান টান টান টান, ভোওওওওকাট্টা!

হ্যাঁ, শরীরেরই একটা অংশ, যে-অংশটুকু বিলেদা নিশ্চিন্তে ভাসিয়ে দিতে পারত হাওয়ায়। আবার আলো যখন নিভু নিভু— সুতো টেনে টেনে, নারকেল গাছ, শিরীষ গাছের করাল চাহনি সামলে নামিয়ে নিয়ে আসত ছাদে। অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়েই নিশ্চয়ই বিলেদা নিজের ভেতরে জুড়ে নিত সেই অংশ— অবিচ্ছেদ্য কিনা!

যে-সমস্ত ইচ্ছে-অভিলাষ-মেয়েমানুষ আমাদের অস্থির করে তোলে, উঁচু উঁচু বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে লাট খায়, বিলেদা ঠিক তাদের তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করত, ভালোবাসার চেষ্টা করত সামান্য ঘুড়ি দিয়ে।

আর এই সামান্য ঘুড়িই আজীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বিলেদাকে। কক্ষনো থিতু হতে দিচ্ছে না। না উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছে, না লোকাল চেয়ারম্যানকে ধরে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছে। সহজ কথায়, সে একজন বেকার, অন্যান্যদের মতো যুবক ঠিক নয়, বয়স পঞ্চাশের দোরগোড়ায়।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি বিলেদার রোজনামচাকে ভাগ করে ফেলা যায়, স্পষ্ট দেখা যাবে, সে কত অনিশ্চিত। এই যেমন সকালে সে হয়ে ওঠে পাড়ার সেইসমস্ত দাদাদের মতো, যারা শুধুমাত্র ক্যারামই খেলতে পারে, আড়চোখে মেয়ে দেখে, আর মানুষের জটলা হলেই অতিথির মতো হাজির হয়— কলার তোলে, রোয়াব নেয়, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন অঙ্কটাকেও তারা সমাধান করে দেবে বিড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়।

— “ধুর শালা, তুই চুপ করবি?”

— “চুপ কেন করব বিলেদা? চুপ করে ছিলাম বলেই তো আমার আজ এই হাল। বউটার হাতে দুটো পয়সা দিতে পারছি না, মাস শেষের আগে দেখবে আমিই হয়তো টেঁসে গেছি, আর এরা বলে কিনা আমি চোর?”

সাত-আটজনের একটা দল প্রায় কামড়াতে যায়, “চোর বলব না তো কি পোঙায় তুলে নাচব? রামু নিজের চোখে দেখেছে, কাল রাতে তুই আমাদের ভেড়ি থেকে মাছ চুরি করেছিস। এই রামু, তুই দেখিসনি বল?”

— “হ্যাঁ গো বিলেদা! মাঠের কোনায় হাগতে গিয়ে, আমাদের গজা গো, চাদর মুড়ি-টুড়ি দিয়ে সুরসুর করে ভেড়িতে নেমে গেল গো। হাতে আবার একটা ইয়াব্বড়ো টিনের ডেরাম। আমি তখনই গো সন্দেহ করেছিলাম, সবাইকে ডেকে এনে দেখি, ব্যাটা হাওয়া।”

— “সাড়ে সাতশো টাকার মাছ চুরি গেছে বিলেদা।”

— “গজার একার বাড়িতেই বউ নেই। আমরাও শালা মুখে রক্ত তুলে খাটি। আমাদের ট্যাঁকেও পয়সা থাকে না। গামছা বেঁধে রাখতে হয়।”

— “ব্যাটা চোর গো—”

— “ব্যাটা চোর গো! রামু তখন এত হাগছিল যে, কাকে দেখতে কাকে দেখেছে!”

— “চুরি করে এখন সতী সাজছিস বাঞ্চোত। মাল খেতে তো সেই আমাদের কাছেই আসবি, তখন এমন হুড়কো দেব না—”

— “কতবার বলব, কাল রাতে আমি পিসির বাড়ি গেছিলাম। পিসির খুব শরীর খারাপ, তাই—”

— “হয়েছে হয়েছে। কানের মাথা খেল হতভাগারা”, মোচ করে একটা আড়মোড়া পেড়ে বিলেদা বলল, “এবার সত্যি করে বল তো গজা, কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি, আমার দিব্যি।”

ব্যাস। এত চুলোচুলির মধ্যে বিলেদা নিজের মোক্ষম অস্ত্রখানা প্রয়োগ করেছে। অথচ চাইলেই সে ঝামেলার সূত্রপাতেই বলতে পারত, “সত্যি করে বল গজা, আমার দিব্যি।” তবু বলেনি, ইচ্ছে করেই বলেনি, আসলে বিলেদা ওদের কথা শুনতে চায়। গজার দুঃখ, রামুর গায়ের আঁশটে গন্ধ, গামছায় লেগে থাকা মাছের রক্ত বিলেদার বড়ো ভালো লাগে।

শুধু কি ভালো লাগে? তাকে ভাবায়ও তো। সাত-আটজন মিলে, হয়তো তিন দিনের ভাতের পয়সা বাঁচিয়েছে; মোরগ ডাকার আগেই হয়তো মাঠে গিয়ে ধান বুনেছে— দু-তিন টাকা বেশি পাওয়ায় আশায়। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে উজাড় করে দিয়েছিল একটা ভেড়ি কিনবে বলে। একসাথে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

এই যৌথ যাপনের ঘাম বিলেদাকে টানে, সে আষ্টেপৃষ্ঠে গায়ে মাখতে চায়, মনে মনে হাততালি দিয়ে ওঠে, যখন টাকা গুনতে গুনতে ওদের মুখে একচিলতে হাসি ফোটে। এই যে পৃথিবীর সকল মানুষ শুধু আমার আমার বলে উতলা, আরও চাই আরও চাই বলে হদ্দ পাগল, কেমন করে যেন বিলেদা এই পৃথিবীতেই, রামুদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে আমাদের শব্দটাকে। তাই শব্দকে সে বাঁচিয়ে রাখে— লালন করে— আগলে নেয়। অস্ফুটে বলে, তোমরা দীর্ঘজীবী হও।

সেই জন্যই তো দিব্যি দেওয়া। নইলে খামোখা কেউ নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়, পাতি মাছ চুরির গণ্ডগোলে। এবার গজা ভীষণভাবে চাইলেও আর বিলেদার সামনে মিথ্যে বলবে না— বলতে পারবে না— বিলেদা ওদের দিনান্তের আশ্রয়, মিথ্যে বললে আশ্রয়ও মিথ্যে হয়ে যাবে। অথবা আস্ত একটা ঘর, যে-ঘরে অনায়াসে বলা যায় মালিককে দিতে না পারা খিস্তি, উগড়ে দেওয়া যায় বউয়ের প্রতি ক্ষোভ, এই পচাগলা পণ্যমুখী সভ্যতার প্রতি অনন্ত ঘৃণা।

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সামান্যগুলোকে জড়ো করে যদি কেউ আকার দিত, প্রাণ ভরে দিত কেউ, তাহলে আমি নিশ্চিত, বিলেদা আবার জন্ম নিত।

— “কী হল, থম মেরে গেলি যে! বল কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি?”

— “তুমি দিব্যি তুলে নাও বিলেদা!”

— “তার মানে রামু সত্যিই তোকে কাল রাতে—”

— “হ্যাঁ দেখেছে। বেশ করেছে দেখেছে। ভূপেনদা বলেছিল চুরি করলে টাকা দেবে, তাই করেছি।”

সাত-আটজনের দল একসাথে বিস্মিত হয়, “ভূপেনদা!”

— “ভূপেন চক্কোত্তি? ওই ঢ্যামনার হাত টপকেই ভেড়িটা কিনেছিলি না তোরা?”

রামুর ভীষণ কান্না পায়। হতে পারে গজা তাদের দলের কেউ না, মাছ নিয়ে গজা অন্য বাজারে বসতেই পারে, তবু তো গজা তাদের মতোই মাছওয়ালা— চোর নয়। অল্প ক-টা টাকার লোভ দেখিয়ে ভূপেনদা এইভাবে নিজের জাত চেনাবে তাই বলে!

— “ভূপেনদা পরশুর আগের দিন বাড়িতে এসেছিল। বলল, আমায় নাকি একটা কাজ করে দিতে হবে। কাজ হাসিল হলে অনেক টাকা। মাছ বেচে বেচে আর দিন চলছে না বিলেদা, হাতে ক-টা পয়সাই-বা পড়ে থাকে বলো?”

— “তাই বলে শালা ভূপেন চক্কোত্তি চুরি করতে বললে সেটাই করবি? কেন বুঝিস না, ভূপেন চক্কোত্তিদের মতো কুত্তাগুলো হরবকত চাইছে তোরা নিজেরাই খেয়োখেয়ি করে মর। এতে ফায়দা হবে ওই ঢ্যামনার। ভেড়ির মালিকানা হাত ফসকেছে তো কী হয়েছে, গজার মতো আকাট-মুখ্যুদের পয়সার লোভ দেখিয়ে বদলা নেবে— মাছ নষ্ট করে দেবে— তোদের ভাত মেরে নিজে খাবে— বাঞ্চোত, এরা মানুষ?”

সমাজকে এতটা তলিয়ে দেখতে জানে যে-মানুষ, সে নিজের প্রতি যখন ভয়ানক রকমের উদাসীন হয়ে থাকে, তখন মনে হয়, বিলেদার এত জীবনবোধ আদপে ফক্কা— সে আসলে পাড়ার বাতেলাবাজ দাদাই, এর বেশি কিছু নয়।

এর চেয়ে বেশি কিছু হতে চাইলে দশ-বারো বছর আগে বিলেদার গা থেকে অগোছালোতার খোলস ঝেড়ে ফেলত হত, বাবার চাকরিটা নিয়ে ঢুকে পড়তে হত কারখানায়, ময়ূরপক্ষী আর চাপড়াসের ঢিলিপ্যাঁচ থেকে চোখ নামিয়ে কয়েক মুহূর্ত ঠায় তাকিয়ে থাকতে হত মায়ের কালি কালি মুখের দিকে— কী অপরিসীম অসহায়তা, উনুনের ধোঁয়ার সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করেছে এক ব্যর্থ মায়াবী সিল্যুয়েট।

— “তুই কি আমার মরামুখ দেখলে শান্তি পাবি?”

— “সকাল সকাল শুরু করলে দেখছি। বললাম তো, নারাণদার সাথে কালই কথা হয়েছে।”

— “তোর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তো রোজই নারাণদার সাথে কথা বলছিস। তারপরেও লোকের কাছে নির্লজ্জের মতো হাত পাততে হচ্ছে। তখন এতবার করে বললাম, বাবার চাকরিটা নিয়ে নে, নিয়ে নে—”

— “আচ্ছা মুশকিল হল তো! তোমার জ্বালায় বাড়িতে থাকাই দায় আমার।”

— “চলে যা, চলেই যা। কে বলেছে তোকে থাকতে হতচ্ছাড়া?”

বিলেদা আর কথা বাড়াল না। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাবার চাকরিটা বিলেদা চাইলেই নিতে পারত। শুধু একবার তুষারবাবুর সামনে গিয়ে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে হত, “স্যার, আমার চাকরিটা যদি করিয়ে দেন, তাহলে বেঁচে যাই।”

তুষারবাবু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলত, “কেন করিয়ে দেব না? নেতা হয়েছি কি এমনি এমনি!”

কুৎসিত হাসির পেছনে যে না-কথাগুলো থাকত, যে না-কথাগুলো ইশারায় বুঝে নিতে হত বিলেদাকে, “ওহে বুঝলে, তুমি আজ থেকে আমার বাঁধা!”

ঘেন্না করে বিলেদা— তুষারবাবু, ভূপেন চক্কোত্তির মতো প্রত্যেককে বিলেদা মনে মনে থুতু দেয়। তুষারবাবুর মুখের ওপর বলতে ইচ্ছে করে, “তোর চাকরি আমার চাই না।”

মনে পড়ে, সতেরো-আঠেরো বছর বয়সে কারা যেন শিখিয়েছিল, এরাই হচ্ছে শ্রেণিশত্রু— এদের খতম করো— নইলে আমরা মরে যাব— গরিব আরও গরিব হবে— ধনী আরও ধনী।

নকশাল আন্দোলনের আগুন সারা পশ্চিমবঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনে পাছা স্যাঁকার লোভে পাড়ার পাঁচুদাও শ্রেণিশত্রু নিধনযজ্ঞে সামিল— যদি বাড়িটার আর একতলা তুলে ফেলা যায়, কিছু কাঁচা টাকা পাওয়া গেলে সোনাদানা গড়িয়ে রাখা যায় এই সুযোগে।

— “কানার মতো ভ্যান চালাবি তাই বলে? দিয়েছিস তো বাগানটার পিণ্ডি চটকে!”

— “দ্যাখতে পাইনি বাবু। খড়ের গাদায় বোঝাই তো, পেছন দ্যাখা দায়।”

— “মুখে মুখে যতই তর্ক কর, আজ তোকে ছাড়া হবে না। চণ্ডী বাড়ি ফিরুক, তারপর নিজেই বুঝে নেবে।”

পরিস্থিতি আপাতত গম্ভীর।

চণ্ডীদা, এই তো গত পরশুই বাড়ির সামনে মরশুমি ফুল গাছ লাগিয়েছে। বেড়াও দিল বাঁশের। আজ সকালে, খড়বোঝাই একটা ভ্যান, মোড় ঘুরতে গিয়ে, নিতান্তই ভুলবশত বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়েছে বাগানে, মাড়িয়ে দিয়েছে সদ্য লাগানো চন্দ্রমল্লিকার চারা। চণ্ডীদা কাজে বেরিয়েছে, বাড়িতে তার বুড়ি মা একলা। তিনি বেজায় অনুদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন একমাত্র মোহিনী সান্যাল— চণ্ডীদার প্রতিবেশী— সরকারি চাকুরে, ঢালাও পয়সা, সেই সময়েই হাঁকিয়েছে তিনতলা বাড়ি। বাড়িতে বড়োসড়ো গোয়াল আছে।

মোহিনী সান্যাল ঘটনার সময় বারান্দায় বসে রেডিয়ো শুনছিল। চেঁচামেচি করে বিলেদার দলবলকে সেই ডেকে এনেছে।

— “ঐ ব্যাটাকে ধরে রাখ বিলে, একদম ছাড়বি না।”

— “ছাড়ব কেন মোহিনীদা, এবার দড়ি দিয়ে বাঁধব!”

ভ্যানচালকের প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। বিলেদার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, “আমারে ছেড়ে দ্যান বাবু। বেলা গড়ায়ে গেলে আর দাম পাবুনি। খড়ের আঁটিগুলা যে সব পচি যাবে।”

একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে এবার। চণ্ডীদার বুড়ি মা জানালায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বিলেদার দলবল রে রে করে তেড়ে যাচ্ছে ভ্যানচালকের দিকে, আবার পিছিয়ে আসছে।

— “দাম পাবি না, পাবি না! আনাড়ির মতো ভ্যান চালাবি, তাতে আমরা কী করব! সন্ধ্যে অবধি চুপ করে বসে থাক শালা।”

মোহিনী সান্যাল বেশ কিছুক্ষণ পর, বেশ বক্তৃতার ঢঙে বলল, “ছেড়ে দিতে পারি, যদি ঐ খড়ের আদ্ধেকটা আমায় দিয়ে দিস।”

— “এমনি এমনি দে দেব?”

— “নয়তো কী! ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিপূরণ। কী বিলে, তাই তো?”

জোর গলায় মোহিনী সান্যালকে সমর্থন করতে গিয়ে কোথায় যেন থমকাল বিলেদা, চমকালও বটে। অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে, গমগমে পরিবেশকে শান্ত করিয়ে দিয়ে, কারা যেন বলল— তুই নাকি নকশাল করিস! ছ্যা! ছ্যা! লজ্জা করে না? তোর সামনেই মোহিনী সান্যাল, হদ্দগরিব ভ্যানওয়ালাকে বাগে পেয়ে আদ্ধেক খড় বিনে পয়সায় নিজের গোয়ালে চালান করছে, আর তুই হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাচ্ছিস? তোরাই আবার শ্রেণিশত্রু খতমের কথা বলিস!

বিলেদা কেমন ভেবলে যায়। এতক্ষণ তার কানে কানে কে কথা বলছিল! হন্যে হয়ে ভিড়ের মাঝে বিলেদা তাঁকে খুঁজে বেড়ায়, পায় না, আবার খোঁজে, আবারও পায় না। বিলেদা তো হাওয়ায় ভেসে ভেসে নকশাল হয়েছে। পার্টির লাইন নিয়ে মাথা ঘামানোর সে কে! মিটিং-মিছিলে ভিড় বাড়ায়, চিৎকার করে, অস্পষ্ট কিছু কিছু কথা কানে আসে, ভুলেও যায়— ঠিক ভুলে যায় না, অবচেতনে তলিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সেইসমস্ত অস্পষ্ট কথা পৃথিবীতে নেমে আসে, বিলেদাকে ভেবলে দিয়ে চলে যায়— সে তন্নতন্ন করে খোঁজে তাদের, তারা ধরা দেয় না— অস্পষ্ট, আবছা, একটা জলীয় আস্তরণের ওপারে চলে যায়। বিলেদাও তো নিজেকে কোনোদিন আন্দোলনের কাছে ধরা দেয়নি, আলতো করে ছুঁয়েছে।

— “না মোহিনীদা। ক্ষতিপূরণ-টূরণের আর দরকার নেই। ওকে আমরা ছেড়ে দেব।”

— “ছেড়ে দিবি? চণ্ডীর বাগানটাকে ভেস্তে দেওয়ার পরে বেমালুম ছেড়ে দিবি? এই তোরা পাড়ার ছেলে? দায়িত্বজ্ঞানহীন অকম্মার—”

— “আদ্ধেক খড় দিয়েই-বা কী হবে মোহিনীদা। ওর ঢ্যাঙা শরীরটা আর একটু ঢ্যাঙা হবে, এই যা। বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি, আপনি বরং ঘরে যান। এই ব্যাটা, ওঠ, চল ভাগ এখান থেকে। ভাগ!”

— “যে যা খুশি করবে আর ছেড়ে দিবি! উচ্ছন্নে যাচ্ছে পাড়াটা, উচ্ছনে যাচ্ছে— এই আমি বলে দিলাম।”

সত্তরের দশক হোক বা আজকের অসময়— আখের গোছানোর ধান্দা তো ছোঁয়াচে রোগের মতো সভ্যতার অন্দরে অন্দরে! আর বিলেদা, বোকার মতো, যেখানে যত স্বার্থান্বেষী মানুষ ছিল, আছে, তাদের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে জানিয়ে গেছে তার একক প্রতিবাদ। হতে পারে সে-প্রতিবাদ বলিষ্ঠ নয়, তবু জানিয়েছে। আবার হয়তো শুনতে চেয়েছে সেই আশ্চর্য মানবের কথা।

আঠেরো বছরের বিলেদা সেদিন চুপিসারে বাবার পকেট থেকে দশ টাকা সরিয়ে চলে গিয়েছিল চণ্ডীদার বাড়ি। চণ্ডীদা বলেছিল, “ধুর পাগল! আমারই তো দোষ। আমিই বোকার মতো মোড়ের পাশে গাছ লাগিয়েছিলাম।”

— “তাও তুমি এই টাকাটা রেখে দাও চণ্ডীদা, ভ্যানওয়ালার ক্ষতিপূরণ!”

— “খুব পেকেছিস দেখছি। বাড়ি যা তো!”

তখন বয়স কম, সংসাসের প্রতি টানও হয়তো কম। একমাত্র তখনই নিজেকে কুড়িয়ে-কাঁচিয়ে উজাড় করে দেওয়া সম্ভব। ঘরে চাল বাড়ন্ত, মাসের শেষ তিনটে দিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হতে পারে, তবুও ভ্যানওয়ালার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যে হাত কাঁপে না।

বিলেদার টান ছিল— টেনে প্যাঁচ খেলার সময় বিলেদা তুড়ি মেরে মেরে পুরো আকাশ সাফ করে দিত— এই টান টান টান টান, ভোওওওওকাট্টা! তেমন টানে আকাশে দিব্যি টিঁকে থাকা যায়, মাটিতে ঠাঁই পাওয়া যায় না। মাটি তো স্থির হতে শেখায়, ধারণ করতে বলে, বলে চুপ করো— যদিও বিলেদা এ-সবের ধার ধারেনি কোনো কালেই।

বিলেদার যখন চল্লিশ বছর বয়স, বাবাকে হারাল সে। ঠিক দু-বছরের মধ্যে মাটাও এক অর্থে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করল। বোধহয় সেই প্রথম বিলেদাকে স্পর্শ করেছিল ছাদহীনতার কষ্ট। মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেলে নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশীদার মনে হলেও, ভাটা পড়ে ঘুড়ি ওড়ানোয়। তখন আর দুপুরে একমুঠ খেয়েই একছুট্টে ছাদে ওঠা যায় না। নিজের বোধের মধ্যে থেকে এক শক্তি তাকে আটকে দেয়, আটকে দেয়, অদৃশ্য খিল এঁটে দেয় ছাদের দরজায়, এদিকে ক্রমাগত ঠেলতে শুরু করে মুদির দোকানের দিকে— ওরা হিসেবের খাতা লেখার লোক খুঁজছে।

বিলেদা তাই হিসেবরক্ষক— পাড়ার সবচেয়ে বড়ো মুদির দোকানের। যাপনের প্রথম ভাগে, মানে সকালে সে পাড়ার দাদা, দুপুরে ঘুড়ি আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত হিসেবরক্ষক— ভেসে বেড়ানোর মতোই বিলেদা কী অনিয়ত, তার রূপ কত অনিশ্চিত!

বিলেদা দোকানে কাজ করছিল, ঠেলে গড়িয়ে চলছিল, ঘুড়িও ওড়াচ্ছিল ইচ্ছে হলে, ভারি আশা করে বসেছিল নারাণদার ওপর— খাতালেখার কাজ থেকে তাকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র নারাণদা। কিন্তু একদিন ভোররাতে খবর এল, নারাণদার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথটুকুও সে পেরোতে পারেনি। নারাণদার মৃতদেহের সামনে বসে, দূরে, ওই ভিড়ের মধ্যে, বিলেদার ভাসা ভাসা কিশোরসুলভ চোখদুটো কাউকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল— হতে পারে সেই আশ্চর্য মানবকে, যে এই শেষবারের মতো পৃথিবীতে নেমে এসে বিলেদাকে মুক্তি দিত: যা দূর হ! তুই মুক্ত… ফুঃ…

একটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ, একআকাশ অতৃপ্তির মেঘ, কিংবা কোনো বিষণ্ণ শূন্যস্থান— বিলেদাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গ্রাস করছিল দিনে দিনে। দোকান থেকে প্রায় লাথি মেরেই বের করে দিল। এখন ঘুড়ি ওড়াতে উঠে প্রায়শই লাটাই থেকে সমস্ত সুতো বের করে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। শরীরের একটা অংশ তো উড়ছেই, বাকিটা নিশ্চয়ই টেনে নেবে। মায়ের মুখঝামটা শোনার জন্যে জানলার ধারে চুপ করে বসে থাকে। মোহিনী সান্যাল, ভূপেন চক্কোত্তি কিংবা তুষারবাবুরা ভীষণ বোকা— আমিত্বের বাইরে বেরিয়ে কোনোদিন ঘুড়ি হতে পারবে না, সন্ধ্যাতারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলতে পারবে না, “নারাণদা, ক-টা টাকা দাও না, একদিন সব সুদসমেত ফেরত দেব, দেবই!”

এত ঘুড়ি, এত রং, এত নকশা, এত এত ভোকাট্টাকে টপকে, বিলেদা এখন চাইছে স্রেফ ধুলো হয়ে যেতে। পাড়ার ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ডেকে বলে, “ঘুড়ি নিবি? দিতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে। যদি আমি ধুলো হয়ে যাই, তাহলে আমাকে উড়িয়ে দিবি তো এক ফুঁ-এ?”

ভয় পেয়ে সবাই পালায়— সচরাচর কাছে ঘেঁষতে চায় না আর। রামু বলে, “আমাদের সাথে ভেড়িতে কাজ করবে বিলেদা? টাকাপয়সা কিচ্ছু দিতে হবে না, মাক্কালি!”

গজা বলে, “আমার ছেলেটাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে দেবে?”

গজা-রামু, ওরা সবাই বলে, “তুমি নকশাল করতে বিলেদা? তুষার ব্যানার্জীকে তোমরাই মেরেছিলে, না? বেশ করেছিলে মেরে!”

উষ্ণ রক্তের জ্বালাময় স্রোত আর অনুভব করতে চায় না বিলেদা। জোর করেই মনে করতে চায় না আশ্চর্য মানবের কথা। অবাঞ্ছিত পিছুটানগুলোকে সে যত এড়াতে চাইছে, ততই আরও জড়িয়ে পড়ছে— মায়ায়— জালে— মায়াজালে।

— “শোন গজা, আমি শালা যদি আজ রাতে ধুলো হয়ে যাই, কাল সকালে আমায় উড়িয়ে দিবি তোরা? অ্যাত্ত বড়ো ফু দিয়ে? একসাথে?”

নেশাজড়ানো গলায় গজা উত্তর দেয়, “তোমার জন্যে জান হাজির!”

তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে জ্বরাক্রান্তের মতো বিলেদা দৌড়োয় স্টেশানের দিকে, গায়ের ময়লা চাদর রামুর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে। দারুণ কুয়াশারাতে, একটা থ্রু ট্রেনের অ্যানাউন্স শুনে লাইনের ওপর শুয়ে পড়ে। মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়— জটের ভেতর জঞ্জাল— জঞ্জালে আস্তাকুঁড়ের শব্দ— আমার ছেলেটাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়ে দেবে বিলেদা— বেশ করেছিলে মেরেছিলে— টাকাপয়সা লাগবে না— মাক্কালি— তুমি নকশাল করতে— ভেড়িতে কাজ করবে— মাক্কালি— কিচ্ছু লাগবে না— মাক্কালি…

এ যেন অমোঘ কুয়াশায় চোখ-কান-মাথা দলা পাকিয়ে এক মাংসপিণ্ড হয়ে চেতনায় হাবুডুবু হাবুডুবু করে… একহাত দূরে মানুষ দাঁড়ালে টের পাওয়া অসম্ভব। হিমশীতল ধাতব পাতের ওপর মাথা রেখে বিলেদা বিড়বিড় করে, “চার নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে, কত নম্বরে গলা পেতেছি? কোন লাইনে? নিশ্চিত চারে তো? এক্ষুনি ট্রেন আসবে। ট্রেন। আসবে। আসবে তো? আসবে? আদৌ?”

Categories
2021-July-Story

নুজহাত ইসলাম নৌশিন

ডাহুকের কাল

রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে মোহনার মনে হল— পুরুষ মাত্রই পুরুষ। মহাপুরুষ একটা বানানো শব্দ। যা নেই তা নিয়ে মিথ্যা সান্ত্বনা। পুরুষ কখনো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না জেনেই নিজের গায়ে একটা তকমা লাগিয়ে দিল। অথচ নারীদের এমন ব্যাপার নেই। কখনো কোনো নারী কি দাবি করেছে সে মহানারী! শোনা কিংবা দেখা যায়নি। সে জানে প্রকৃতি তাকে মহা হবার উপাদান সবটা ঢেলে দিয়েছে তাই আলাদাভাবে মহা হওয়ার কিংবা তকমা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে না। এই কাড়াকাড়ি পুরুষরাই করে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে। ঢাকুক, যদি পারে।

হায়, সর্বনাশ!

কথাটা কানে আসতেই মোহনা সর্তক হল। ওড়নাটা অবাধ্য বাতাসে একটু সরে যেতেই পাশ থেকে একটা মন্তব্য। আচ্ছা এই “হায় সর্বনাশ” বলা লোকটা নিজের বাসায় কতবার এই শব্দটা বলে? তার তিন বছরের পুরোনো প্রেমিক কখনো কি রাস্তায় কোনো মেয়ে দেখে এমন বলেছে! হয়তো মুখে দিয়ে উচ্চারণ করেনি কিন্তু মন দিয়ে? কে জানে কী— এ-সব ভাবতে গেলে ভয় হয়। নিজের পছন্দ করা জামার মতো, পছন্দ হওয়া ছেলে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে কিছু দিন বাদে— তাকে নিয়ে এরকম সন্দেহ হওয়া ঠিক না। মন বিগড়ে যায়, কিন্তু যদি ওই রাস্তার প্রৌঢ় লোকটার মতো এমন অভ্যাস থাকে। সহ্য হবে কি—

শাহেদ কেমন! গত তিন বছরে অনেক বার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। কাটাকুটি আর যোগবিয়োগে শেষ অবধি ভেবেছে খারাপ না। চলে। কিন্তু সারাজীবন কি চলবে? একজন মানুষ প্রেমিক হিসেবে একরকম আর স্বামী হলে পুরো অন্য গ্রহের মানুষ। শাহেদ মনে হয় খুব শীঘ্রই অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যাবে।

মানুষ কত দ্রুত বদলায়। কাজটা করার পর ভেবে কোনো লাভ নেই। ইদানীং মনে হয় মানুষ কী বলবে ভেবেই সে শাহেদকে বিয়ে করেছে। “এত বছর প্রেম করলে বিয়ের বেলা অন্য ছেলে, লোভী, স্বার্থপর” এই গালিগুলো যেন শুনতে না হয় সেজন্য সে শাহেদকে বিয়ে করেছে। তাতে কী হল— এই কথাগুলো শোনা লাগছে না এখন। কিন্তু ভেতরে যে দাবানল জ্বলছে।

“মা, আমার শাহেদের সাথে যাচ্ছে না। ও ও”—

“কী, ও”— কাপড় আলমারিতে রাখতে গিয়ে বিরক্ত হলেন মেয়ের কথার ধরনে।বিয়ে কি ছেলে খেলা! তিন বছরের একটা মেয়ে আছে, দু-দিন পর স্কুলে ভর্তি করাবে, তারপর সেই মেয়ের পড়াশোনা, আরও পরে বিয়েশাদি— এখন তার মেয়ে বলছে জামাইয়ের সাথে যাচ্ছে না। বিরক্তই লাগে।
“ওর বাজে স্বভাব আছে। কাজের মেয়ের দিকে কেমন করে তাকায়, তোমায় বলতে রুচিতে বাঁধছে। আমি চাই না অমি এ-সব দেখে বড়ো হোক।”

মনোয়ারা চূড়ান্তরকম বিরক্ত হলেন এবার। তার মেয়ে এই কথা বলতে ছুটে এসেছে। তিনি ভেবেছিলেন কী না কী। “ব্যাটা ছেলে একটু এমনই হয়, তোর বাপও তো এমন। তাই বলে ছেড়ে চলে গিয়েছি নাকি! আর তুই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিস। এখন এ-সব ডিভোর্স নাকি এ-সব করলে লোকে কী বলবে! এ-সব কথা সাতখান হলে তখন”—

এরপর আসলে কিছু বলা চলে না। তার নিজের বাবা এমন— আর তার মা এটা গর্ব করে বলছে। রাজাবাদশাহী আমল হলে আরও ভালো হত, তার বাবার অনেকগুলো উপপত্নী থাকত। বর্তমান সময়ে রক্ষিতা। জিনিস একই শুধু মোড়ক বদলে নাম বদল।

“মা, আমরা কি বেড়াতে যাচ্ছি!”

অমির চুলগুলো গুছিয়ে ঝুঁটি করে বলল, “না, মা— আমরা এই বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।”

“বাবা—”

মোহনা শাহেদের দিকে তাকাল। হয়তো এটাই শেষ দেখা— কী সুন্দর ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। খেয়েই যাচ্ছে— নির্বিকার। মোহনার চলে যাওয়া এটাই যেন স্বাভাবিক। অথচ সাত বছর আগে, একটু অভিমান করলেই শাহেদের পৃথিবী উলটে যেত। এগুলো কি সত্যি নাকি অভিনয়! বিশ্বাস করতে এখন কষ্ট হয়।

“তোমার বাবা মাঝেমধ্যে যাবে তোমাকে দেখতে।” বাচ্চা মেয়েটার মন সত্যি বলে নোংরা করে কী লাভ— খারাপ একটা ধারণা নিয়ে বড়ো হবে। মিথ্যার প্রলেপে যদি সুখ পাওয়া যায় তবে তাতে মন্দ কী!

ব্যাগ গুছানো শেষ করে শেষ বার ঘরের দিকে তাকালো। এখানে এই ঘরে অন্য কেউ আসবে— শাহেদের অল্প বয়সি মেয়ে কলিগ সুফিয়াও আসতে পারে। শাহেদের সাথে বেশ মাখামাখি। মন্দ হবে না। অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেছিল শাহেদকে বদলাতে— হল না। কেউ আসলে বদলায় না, শুধু নিজেকে বদলানো যায়। মোহনা শেষ অবধি দ্বিতীয়টা বেছে নিল।

বাস চলছে। শীতের দুরন্ত বাতাস। অমির কান-গলা ভালো করে ঢেকে দিল। মেয়েটা ভীষণ ছটফটে। বার বার মাফলার খুলে জানলা দিয়ে বাইরে মাথা বের করছে।

“আহ্, শান্ত হয়ে বসো তো।”

“দেখি না একটু বাইরে—”

বাসে ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে একটা বাচ্চার পা ঘাড়ে লাগল। বিরক্ত হয়ে তাকালো মোহনা।

নাকের নীচে সর্দির শুকনো রেখা। দেখেই গা গুলিয়ে আসছে। বাচ্চা কোলে মহিলাকে দেখে অভাবের চূড়ান্ত রূপ চোখে ধাক্কা লাগে। এই ডিসেম্বরের শীতে আধময়লা ছেঁড়া শাড়ি। দ্বিতীয় বার এদের দিকে তাকানোর ইচ্ছে করে না বলে মোহনা অমির ঘুমন্ত মাথা কোলে চেপে রাখল।

“আফা কিছু টাকা দেন।”

মোহনার বিরক্তি লাগা সত্ত্বেও ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার কয়েকটা নোট বের করে দিল। উটকো ঝামেলা থেকে যত দ্রুত সারা যায়। বাস চলার পর থেকে ঘাড়ের পিছনে যে দাঁড়িয়েছে— নামার সময় এই ঘ্যান ঘ্যান।

পাঁচ টাকার কয়েকটা নোট দিতে গিয়ে আচমকাই প্রশ্ন বের হয়ে এল মুখে— “বাচ্চাটার একটা চিকিৎসা করাও না কেন? গায়ে তো খোসপাঁচড়ার বাসা হচ্ছে।”

আধছেঁড়া শাড়ি পড়া এবার ঝামটা দিয়ে উঠল— “চিকিৎসা কি গাছের ফল! পোলার বাপ আমারে তাড়ায়ে দিছে, ঘরে আর এক আবাগী বেটিকে তুলছে। খাইতে পাই না আবার—”

ময়লা শাড়ি অনেক দূর চলে গেছে। রিকশায় বসার পর মোহনার মনে হল তার আর ময়লা শাড়ির সাথে কোথায় যেন মিল আছে ।

সে শিক্ষিত এবং চাকুরির জোরে স্বামীকে ত্যাগ করতে পেরেছে। এবং শাহেদ সুন্দরভাবে বলেছে— “তোমার যেখানে সাধ চলিবার, চলে যাও।”

আর ময়লা শাড়িকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অভদ্রভাবে। যে যার খোলস অনুযায়ী ব্যবহার করেছে।

স্বামী পরিত্যক্ত দুই নারীর দুই দিকে গন্তব্য। একটা ভদ্রভাবে আর একটা নির্মমভাবে। দূরে কোথাও ডাহুকটা ডেকেই যাচ্ছে। দুপুর রোদে ডাহুক ডাকে না— গভীর রাতে ডাকে। কে জানে কেন ডাকছে এখন। ডাহুকের সংসারেও কি ভাঙন ধরে ভদ্র-অভদ্র ভেদে।

রিকশার ঝাঁকুনিতে মোহনার মনে হল ভাঙনটাই স্বাভাবিক।

Categories
2021-July-Story

সোহম দাস

আমকাঠ

আমাদের গ্রামে সেবার গরম পড়ল প্রচণ্ড। উত্তরের পাহাড়ের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া গ্রামের ঢোকার আগেই হারিয়ে যেতে লাগল। আমরা বলতাম, ওই কিলিমারা হাওয়া চুরি করছে।

আর সেই গরমের মধ্যেই গ্রামের লোকজন হঠাৎ পাগল হতে শুরু করল। কিন্তু তার কারণ গরম নয়। অন্য কিছু।

আমাদের গ্রামটা ছিল ভারি অদ্ভুত মধ্যবর্তীতে। গ্রামের উত্তর দিকে চনমন করত সবুজ, চিন্তিত পাহাড়। দক্ষিণ অংশের একদম শেষ প্রান্তে মিহির শয়তানের বাড়ি ছাড়িয়ে একটু খানি গেলেই আমরা শুনতে পেতাম এক জলদানবের নাসিকা গর্জন। পশ্চিমের দিকে ধু ধু করত মাঠ, সেখানে ঘাসের চেয়ে বালির ভাগ বেশি। কাকডাঙার মাঠ পেরিয়ে গেলেই ফুরিয়ে যেত সবুজের দেশ। হলুদ বালুভূমির প্রান্তরের শুরু। গ্রামের চাষবাস যা হত সব পুবে। একটা নদী ছিল, সেট আসত ওই পাহাড়ের কোনো এক গুহার মধ্যে থেকে। সে-নদীটার মতো একচোখা আমরা কাউকে দেখিনি। টিরির চেয়েও একচোখা। নদীটার যা তর্জন-গর্জন সব পুবের দিকে। পশ্চিমের দিকে ফিরেও তাকায়নি কখনো। আর এ-সব অদ্ভুতপানা উপদ্রবের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের গ্রাম।

পাহাড়ের কাছাকাছি অংশে ছিল ঘন জঙ্গল। জঙ্গলটা ছিল বিচিত্র সব বন্য জানোয়ারের সমষ্টি। ওপাশে আমরা যেতাম, কিন্তু ফিরে আসতাম সন্ধ্যে নামার আগেই। জঙ্গল থেকে মাঝে মধ্যে দু-একটা হরিণ-টরিণ বেরিয়ে আসত। আমরা তার পিছন পিছন ছুটতাম। ঢেলা, চ্যালাকাঠ, কাটারি, যা থাকত, সে-সব হাতে নিয়ে তাড়া করতাম তাকে। আর সে পায়ের গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দু-পেয়ে জীবের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করত। বেশিরভাগ সময়েই আমাদের চেয়ে বহুগুণ গতিতে ছুটে পালিয়ে যেত, আমাদের ধরার সাধ্যি হত না। ছুটতে ছুটতে ঢিল আর চ্যালাকাঠগুলো ছুড়তাম আমরা। সেগুলো বেশিরভাগ সময়েই লক্ষ্যভ্রষ্ট হত।

আমাদের এরকম হরিণ তাড়ার ঘটনার সঙ্গেই আরও একটা ব্যাপার ঘটত। সেটা আরও বিরক্তিকর। যে-কিলিমাদের কথা বললাম, ওরা থাকত ওই জঙ্গলের কাছেই। আমরা হরিণকে তাড়া করা শুরু করলেই কিলিমার সর্দার কিলি আর তার ছেলে টিরি আমাদের পিছন পিছন ছুটত। না, হরিণটাকে ওরা তাড়া করত না। ওরা আমাদের তাড়া করত। ‘হুইলা, হুইলা’ বলতে বলতে ছুটত। ঝাঁকড়া চুলে, খালি উদোম গায়ের লোক ওরা। সেই তারা আমাদের মতো ভদ্রঘরের ছেলেদের পিছনে এমনভাবে ছুটত, যেন আমরা চোর আর ওরা আমাদের ধরতে ছুটছে। কী বিশ্রী, অশ্রাব্য শোনাত ওদের ওই ‘হুইলা, হুইলা’ ডাক।

ওই টিরির একচোখামির উল্লেখই করছিলাম একটু আগে। টিরিরা কেউ আমাদেরকে পছন্দ করত না। আমাদের দেখলেই কেমন জানি আশ্চর্য রকমের ঘেন্না করত।

টিরিরা কেউ হরিণ মারত না। খরগোশ বা পাখি-টাখি মাঝেসাঝে মারত। আমরা দু-বার হরিণ মারায় সফল হয়েছিলাম। একবার একটা বুড়োটে হরিণ ঢুকে পড়েছিল, সে বেশিদূর দৌড়তে পারেনি। তাকে ঘিরে ধরে মারা হয়েছিল। কিন্তু সে-মাংস না ছিল তাজা, না ছিল তাতে স্বাদ। আমাদের ভালো লাগেনি। কবে একটা তাজা হরিণ দলছুট হয়ে চলে আসবে, আর তার মাংস খাব রসিয়ে রসিয়ে, এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা।

আমাদের পাঁচজনের একটা দল ছিল। আমরা গোটা গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব নিজেরাই নিয়েছিলাম। কোথায় কোন বাড়ির ছেলে পাশের পাড়ার মেয়ের সঙ্গে পুকুরঘাটে বসে ছেনালি করছে কিংবা কোথায় কে বসে মোড়লের নামে বাপান্ত করছে, তাদের শায়েস্তা করার ভার নিয়েছিলাম আমরা। মোড়লের কাছে এজন্য বেশ সুনাম ছিল। আমাদের পরিবারের লোকজনও বেশ গর্ব বোধ করত। শুধু একজন ছাড়া। দাশরথির বাবা অধিরথি। সে অবশ্য গ্রামেও থাকত না। বাইরে কোথায় কাজ করত। একটা খাতায় কী-সব হিজিবিজি লিখতও। বাড়িতে এলেও এক ছাদের তলায় বাপ-ছেলেকে আমরা কোনোদিন দেখিনি। মোড়লকে বা আমাদের এইসব গর্বের কাজকে সে অবজ্ঞা করত।

হরিণ মারার সুযোগ অবশেষে এসেছিল। একখানা হৃষ্টপুষ্ট হরিণ, বেশ তাজা। আমরা তার অপেক্ষাতেই তো ছিলাম। পাঁচজনে মিলে তাড়া করলাম তাকে। মনোহরের হাতে ছিল কাটারি। হরিণটা দৌড়তে পারছিল না, হাঁপাচ্ছিল। অথচ, পেছনে ব্রহ্মাস্ত্র হাতে তাড়া করে আসছে মৃত্যুবন্ধুরা। এঁকেবেঁকেও ছুটছিল সে। কিন্তু পারল না। মনোহরের ছোড়া কাটারি গিয়ে আমূল বসে গেল তার গলায়। আচমকা আঘাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। কাটারি বসে গেল আরও। গলা ফাঁক। আমরা উল্লাসে লাফিয়ে উঠলাম।

গোপী আর শ্যামসুন্দর কিছুক্ষণ পরেই ছুরি দিয়ে কাটতে বসল ছাল-চামড়া। আর তখনই সেই অভাবনীয় ঘটনাটা ঘটল। মনোহর চেঁচিয়ে উঠল— “একেবারে ডবল লাভ যে রে।” চেঁচানি শুনে তাকিয়ে দেখি, হরিণটার পেটে বাচ্চা, সেটারও আর প্রাণ নেই। ঠিকমতো দৌড়তে না পারার রহস্যটা এতক্ষণে পরিষ্কার হল। অল্প কষ্ট হলেও ভাবলাম, আমাদের জন্য মরেছে, পুণ্য হবে ওর।

টিরিরা সেদিন বস্তিতে ছিল না। উল, ছোনি, মাঙ্গেকরা জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল হরিণ-ছাড়ানোর পর্ব। মনোহর ওদের হাতে বাচ্চা হরিণটাকে দিয়ে ভাগিয়েছিল। প্রথমে ইতস্তত করলেও ওরা সেটাকে নিয়ে চলে যায়। টিরি থাকলে এ কাজ সহজে হত না।

তারপর আমরা মাদি হরিণের মৃতদেহ নিয়ে মিছিল করতে করতে যাই মোড়লের বাড়ির ওখানে। মহাভোজ হবে।

***
অথচ, গ্রামের লোকে পাগল হতেই থাকল। কেউ কেউ সঙ্গে বোবাও হয়ে গেল। বোবা লোকজন গ্রামে থেকে গেল। আর যারা ভুলভাল বকতে থাকল, তারা চলে গেল। আর এ-সব নিয়ে ঝামেলা শুরু করল মিহির। মিহির শয়তান।

অবশ্য ওদের কাজই ছিল ঝামেলা পাকানো। ওর ছেলেটাও তাই। সে ছিল আমাদের বয়সি। ওরা ছিল টিরিদের মতোই কালো, আর মানুষ-মারা বিদ্যে-জানা লোকের বংশ। সেজন্যেই ওই ‘শয়তান’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। না হলে এমনিতে নাকি ‘ডাক্তার’ না কী একটা বলা উচিত মিহিরকে। সেটাও ওই সতুই আমাদের বলেছিল। সেই কারণে সতুকে আমরা চারজন মিলে গ্রামের মোড়লের কাছে নাক খত দেওয়াই। মোড়ল সতুকে সাবধান করে দিয়েছিল, এ-সব কথা আর যেন সে না বলে। গোপী একবার ওদের ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিল। গোটা দেওয়াল জুড়ে নাকি কী-সব মোটা মোটা ইটের মতো জিনিস সাজিয়ে রেখেছে। সেই থেকে আমরা আর কেউ ওদিকে যেতাম না।

মাঝে মাঝেই মিহির বাইরে থেকে নানা লোককে নিয়ে আসত। অদ্ভুতদর্শন তাদের পোশাক, পিঠের ব্যাগে কী-সব যন্ত্রপাতি থাকত। ছুঁচ-টুচ ফোটানোর জন্যে তারা আসত। আবার প্লাস্টিকের শিশি, টিনের কৌটোতে করে কী-সব লাল কিংবা হলুদ কিংবা গোলাপী রঙের তরল পদার্থ নিয়ে আসত। সঙ্গে বড়ির মতো গোল গোল জিনিস। দেখলেই ভয় লাগত। সে-সব খাওয়াতে চাইত তারা। ওগুলো খেলে নাকি রোগ-ভোগ হবে না। সাদা প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা শিশি আনত মাঝেমধ্যেই। তার মাথায় ফুটো। তার মধ্যে কী একখানা ওষুধ ছিল, সেটা ওরা বাচ্চাদের খাওয়াতে চাইত। খাওয়ালে নাকি হাত-পা বেঁকার রোগ ধরে না। কী ভয়ের ব্যাপার সত্যিই! আমরা তাই দেখতে পেলেই ঘরে দোর দিয়ে খিল দিতাম।

আমাদের গ্রামের মোড়লের পোষা এক সন্ন্যাসী ছিল। অবতারবাবা বলতাম আমরা। আসল নামও কী একটা ছিল, মনে নেই। মোড়লের সভা হলেই সেই সন্ন্যাসী তার পাশেই বসত। মোড়লের যে-বড়ো বাগানবাড়িটা ছিল, তার লাগোয়া একটা সুন্দর বাড়িতে সে থাকত। সেই সন্ন্যাসীর কড়া হুকুম ছিল, মিহির শয়তান এ-সব লোক আনলে যেন আমরা একেবারেই তাদেরকে ঘরে ঢুকতে না দিই।

গরম পড়ার ঠিক আগে আগেই কলমিদের বাড়িতে ওর দাদু-বাপ-ঠাকুমা সব অসুস্থ হল। বাইরে কোথায় কাজ করতে গিয়েছিল ওর বাপ, সেখান থেকে ফিরেই সে অসুস্থ হল। ওরা অবতারবাবার কাছে না এসে নাকি মিহিরের কাছে গিয়েছিল। মিহির অমনি সেই অদ্ভুতপানা লোকগুলোকে আবার নিয়ে এল। কলমিরা ওদের ঢুকতে দিয়েছিল, তারপর থেকে তিনদিন পুকুরের জল ওরা ব্যবহার করতে পারেনি। তিন দিন পরে মোড়লের বাড়িতে গিয়ে সন্ন্যাসীর বানিয়ে দেওয়া এক বিশেষ ধরনের হলদেটে রঙের তরল দিয়ে ওদের স্নান করিয়ে অপরাধমুক্ত করা হয়। তারপর থেকে ওরা পুকুর ব্যবহারের অনুমতি পায়।

অবশ্য ক-দিন পরেই কলমির বাপ আর দাদু মরে গেল। ওরা নাকি পোড়াবার লোক খুঁজে পায়নি। মোড়ল বলল, পাপের শাস্তি। সত্যিই তো, মিহির শয়তানের আনা যমদূতদের দেওয়া বিষ খাওয়া তো পাপই তো বটে। অবতারবাবার পানীয় খেয়েও সেই পাপ কাটেনি। আমরা খুব ভয় পেলাম। এত বড়ো পাপ যে, অবতারবাবাও কিছু করতে পারল না। সেই থেকে আমরা আরও সাবধান হয়ে গেলাম। গ্রামের সীমানায় পাহারা বসানো হল। বাইরের লোক যাতে ঢুকতে না পারে। গাঁয়ে সমস্যা হলে তা মেটানোর জন্যে তো আমরাই আছি। খামোখা বাইরের লোক আনবারই-বা প্রয়োজন কী!

মিহিরকেও চোখে চোখে রাখবার নির্দেশ দেওয়া হল। সে ইতিমধ্যে লোকে কেন পাগল হচ্ছে, সেই নিয়ে টিকটিকিপনা শুরু করেছিল। তার গতিবিধি নজরবন্দি করে নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ এল আমাদের উপর।

***
কিন্তু মিহিরকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা গেল না। হঠাৎ একদিন বিচিত্র এক উপদ্রব শুরু হল।

কলমির বাপ আর দাদুর মরার পরে আরও কয়েকজন মরল, আর নয় অসুস্থ হল। মোড়লের মোটা ভ্রূ এবার অল্প কুঁচকোল। সে অবতারবাবার সঙ্গে বৈঠক করল। সে-বৈঠকে কী হল, আমরা জানতে পারিনি অবশ্য। তারপরেই শুনলাম, আমাদের লম্বা ছুটি। আমাদের মানে গ্রামের লোকদের। আমাদের পাঁচজনের তো আর ছুটি নেওয়ার উপায় ছিল না। কত দায়িত্ব আমাদের। এবার আমাদের বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়ল, লোকজনকে রাস্তায় দেখলেই বেতের ঘা দিতে।

শুনলাম, ছুটি না নিলেই নাকি শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মোড়লের খাস লোক চাটুয়ার কথায় হেসেছিলাম। শরীর খারাপ হবে, এতে আবার বিচলিত হওয়ার কী আছে! অবতারবাবার দেওয়া ওষুধ পেটে পড়লে যমের অসুখও সেরে যায়, এ-কথা তো মোড়লই আমাদের বলেছিল। মোড়লের অনুচর চাটুয়াকে সেকথা মনোহর বলল। কিন্তু চাটুয়া একটা অদ্ভুত কথা বলে বসল। মোড়ল নাকি নিজেও এবার একটু ভয়ে আছে। ভয়ে আছে অবতারবাবাও।

এটা ঠিক যে, আমরা চাটুয়ার কথা শুনে বেশ চমকেছিলাম। এবার তার মানে গপ্পো বেশ জোরালো। তাও আমরা চাটুয়াকে এই কথাটা বেশ জোরের সঙ্গে জানিয়েছিলাম যে, যাই হয়ে যাক, অবতারবাবার ওপর আমাদের যথেষ্ট ভরসা আছে। চাটুয়া বোধহয় এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল— “আরে সে কি আর বলতে! তোমরা আছো বলেই তো ভরসা।” তারপর খানিক মুখ নীচু করে (মুখের কাছে মুখ এনে নয়, ওটাও বারণ করেছিল চাটুয়া) বলেছিল— “এ-সবকে কাজে লাগিয়ে মিহির কিন্তু আবার ঝামেলা পাকাতে পারে। আবার ওই বাইরে থেকে লোকজন আনতে পারে। খুব সাবধান। তোমরা একটু ব্যাপারটা দেখ।”

এটা আমরা ভেবে দেখিনি। সত্যিই তো! মিহির তো এরকম তালই খোঁজে। মনোহর চাটুয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, চাটুয়া খানিক তফাতে সরে গিয়ে বলল— “উঁহু, উঁহু, ওইটি করো না। দূর থেকে বলো, যা বলার।”

মনোহর অতঃপর দূর থেকেই বলল— “ঘাবড়াও মত। আমরা আছি। ও শালা মিহিরকে নির্বংশ করে দেব ঝামেলা বাধাতে এলে।”

চাটুয়া বেশ খুশি হয়ে আবার ঢ্যাড়া পেটাতে চলে গেল।

কিন্তু মিহিরকে সত্যিই বেশিদিন দাবিয়ে রাখা গেল না।

***
চাটুয়ার ঘোষণার ঠিক দিন তিনেক পরের ঘটনা। এর মধ্যে আরও কয়েকজন মরল, হয়তো অসুস্থও হল। সব খবর আমরা রাখতাম না। আর, আরও কয়েকজন পাগলও হল। বিশেষত, যারা নদীর দিকে থাকত। এর আগে যারা পাগল হয়েছিল, তাদের কেউ আমরা চিনতাম না। এত বড়ো গাঁ, সেখানের সব লোককে চিনবই-বা কীভাবে! কিন্তু এবার দু-একজন চেনা লোকের নাম শোনা গেল। ওই কিলিমা বস্তির উলের দাদু পাগল হল, মাঙ্গেকের এক কাকা। সকলেই নাকি নদীর ধারে সকালে পায়খানায় গিয়ে পাগল হয়েছে। আমাদের কেউ পাগল হলে অবতারবাবার কাছে নিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু ওদের জন্য সে-সবের অনুমতি ছিল না। আমরা অবশ্য বেশ নিশ্চিন্তই ছিলাম। আমাদের কেউ পাগল হয়নি।

কিন্তু নিশ্চিন্ত বেশিদিন থাকা গেল না। পাগলদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকল। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসুস্থ হওয়ার সংখ্যাও। দক্ষিণে যেদিকে সেই জলদানবের আস্ফালন, সেদিকেও অনেকে অসুস্থ হল। পশ্চিমে যেখানে খুব বেশি জল পাওয়া যেত না, সেখানেও লোকে এই অসুখের কবলে পড়তে থাকল। গতিক যে খুব সুবিধের নয়, সেটা আমরাও বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবু আমাদের ভরসা ছিল, মোড়ল আছে। অবতারবাবা আছে।

অবশেষে যে-ঝামেলা লাগার, সেটা লাগল। আবারও সেই মিহির। সে জেদের সঙ্গে ঘোষণা করল, এবার যদি কেউ এদের কথা না শোনে, বা ওর কথা না শোনে, তবে সকলের কপালে বিপদ নাচছে। ওই অবতারবাবার হলদেটে জলে যে কিচ্ছু হবে না, উলটে ক্ষতি হবে, সে-কথা সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল। আমরা ভাবলাম, কী আস্পর্ধা রে বাবা! অবতারবাবাকে একেবারে সরাসরি চ্যালেঞ্জ!

একদিন বেলা এগারোটায় গোটা গ্রাম জুড়ে হুলুস্থূল। অবশ্য মূল ঝামেলাটা হচ্ছিল গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায়। যে-পাহারাদারদের বসানো হয়েছিল, তাদের সঙ্গে সেই লোকগুলোর প্রবল কথা-কাটাকাটি। আর লোকগুলোর হয়ে তড়পাচ্ছিল মিহির। সঙ্গে ওর ছেলে সতু, আর আরও অনেকে। বাইরের লোকগুলো অবশ্য খানিক বোঝানোর ভঙ্গিতেই বলছিল। কী-সব নাকি পরিষ্কার করবে আর শরীরে ছুঁচ ফোটাবে। এতে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, উলটে লাভই হবে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার।

খবর গেল মোড়লের বাড়িতে। মোড়ল নিজে বেরোল না, সে তখন নিজের নতুন বাড়ি তৈরি নিয়ে খুব ব্যস্ত। ঝাঁ চকচকে বাড়িটা বানাচ্ছিল বিরাট করে। সেটা নিয়ে সে খুবই ব্যস্ত তখন। এর মধ্যে এ-সব ঝামেলা কারই-বা ভালো লাগে! তাই সে আরও কিছু লোক পাঠাল। তাদের সঙ্গে আমরাও গেলাম। মনোহর বীরদর্পে ঘোষণা করল— “সেদিন চাটুয়াকে যে-কথা দিয়েছি, আজ সেই কথা আমি রাখবই। ও শালা মিহিরকে ঝাড়ে-বংশে খতম করব।”

ঝামেলার জায়গায় পৌঁছে আমরা দেখলাম, লোকে-লোকে ছয়লাপ। চাটুয়া ঢেঁড়া পিটিয়ে যে-কথা বলে গিয়েছিল, তার সিকিভাগও মানা হচ্ছে না। মিহির সমানে ওই লোকগুলোকে ঢোকাবার চেষ্টা করছে, আর তাকে রক্ষীরা বাধা দিচ্ছে। মিহিরের পাশে সতু ছাড়া আমরা টিরি, ছোনিদেরও দেখলাম। আমরা কাজে লেগে পড়লাম। লোকজনকে সরাতে লাগলাম। মোড়লের খাস লোকজনদের দেখে অনেকেই কেটে পড়ল। অত লোকের ব্যূহ ভেদ করে শ্যাম আর মনোহর একেবারে বাইরের অদ্ভুতদর্শন লোকগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মনোহর আগেই মিহিরকে এক ঝটকায় সামনে থেকে সরিয়ে এনে হাতের মোটা লাঠিটা দিয়ে গলাটা চেপে ধরল। রোগাপাতলা মিহিরের নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকল না। সতু তার বাপকে সাহায্য করতে মনোহরের হাতের লাঠিটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, তাকে ধরল গোপী। বাকিদের আমরা শায়েস্তা করলাম। টিরিদের জন্য পাহারাদারেরাই উপযুক্ত ছিল, ওদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠতাম না। যমদূতের মত দেখতে লোকগুলো আমাদের দেখে বুঝি যমের মতোই ভয় পেয়ে গেল। এতক্ষণ পাহারাদারদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলছিল, সেই আওয়াজ মিইয়ে এল। শ্যামের মাথা চিরকালই ঠান্ডা। সে এতক্ষণ নিজে কাউকে আঘাত করেনি। মনোহরের মতো অত মাথা গরম করে না। গম্ভীর গলায় লোকগুলোকে প্রশ্ন করল— “কী ব্যাপার?”

সাদা পোশাকের একজন বলল— “আমরা রোগ সারাতে এসেছি তোমাদের গ্রামে। এই গ্রামে অনেকে অসুস্থ হচ্ছে। আমরা এসেছি, যাতে তোমাদের আর রোগ না হয়। আমাদের কথা শোনো, আমরা খারাপ লোক নই।”

শ্যাম বলল— “কেউ তো আসতে বলেনি তোমাদের।”

লোকটা মিহিরের দিকে দেখিয়ে বলল— “ও বলেছে তো। আমরা তো ওকে অনেকদিন ধরে চিনি। ওকে বিশ্বাস করেই এসেছি।”

— “ওর কথায় চলে এলে? মোড়ল না বললে গ্রামে ঢোকার নিয়ম নেই। ফিরে যাও।”

— “কিন্তু আমাদের কাছে যে অনুমতিপত্র আছে। বড়োসাহেব নিজে দিয়েছেন।”

— “তোমাদের বড়োসাহেবকে বলো, আমাদের মোড়লসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি অনুমতি দিলে, তবে হবে। আমাদের অবতারবাবা আছে, তোমাদের দরকার নেই এখানে।”

— “কিন্তু এই গ্রামে তো অনেকে মরছে, সে-খবর আমাদের কাছে আছে।”

— “কে দিয়েছে সে-খবর? এটাও কি মিহিরের কীত্তি?”

— “না, সে খবর আমরা পেয়েছি নদীর কাছ থেকে।”

— “নদী? সে কে?”

— “নদীকে চেনো না? যেখানে তোমরা রোজকার কাজ সারতে যাও।”

— “আমরা যাই না। আমরা ভদ্দরলোক, আমাদের বাড়িতেই কাজ করার ব্যবস্থা আছে। ওখানে যায় ছোটোলোকরা।”

— “সে যাইহোক। আমরা খবর নদীর কাছ থেকেই পেয়েছি। আর খবরটা সত্যি। নদী কখনো মিথ্যে কথা বলে না।”

লোকটার এমন ধোঁয়াটে মার্কা কথায় আরও পিত্তি জ্বলে গেল। একে চারিদিকে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। লড়াই হতে বেশি দেরি নেই, তার মধ্যে এ-সব ধ্যাষ্টামো আর কারই-বা ভালো লাগে! অমন মাথা-ঠান্ডা যে, শ্যাম, সেও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল। গলা তুলে বলল— “এই এ-সব ছেঁদো কথা রাখো তো। আজেবাজে বকে আমাদের ভুলিয়ে দেওয়ার তাল, আমরা কিছু বুঝি না নাকি? শালা নদী কি তোমার বাপের চাকর যে সে কথা বলবে। এখানে আমাদের কেউ মরেনি। ও-সব নদী-ফদী বাজে কথা। আমরা জানি, মিহিরই তোমাদের বলেছে।”

মিহিরের দিকে তাকালাম সকলে। সে মনোহরের নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, মনোহর তার গলা এমনভাবে চেপে ধরেছে, অস্ফুট কিছু আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছে না। লোকটা বুঝল, ঝামেলা আছে। তাও শেষ চেষ্টা হিসেবে বলল— “এবার আমাদের কাজ করতে দাও ভাই। এ-সব ওই অবতারবাবা-টাবাকে দিয়ে হবে না। এ-রোগ যে সে রোগ নয়, একেবারে মহাকালের ব্যাপার। নইলে বড়ো বিপদ হয়ে যাবে।”

এই বলে তারা জোর করেই ঢুকে পড়তে চাইল। শ্যাম তার বলশালী হাত দিয়ে যে-লোকটা এতক্ষণ কথা বলছিল, তাকে এক ধাক্কা মারল, লোকটা ব্যাগ-সমেত ছিটকে পড়ল। বাকি লোকগুলো এই আক্রমণের সামনে প্রথমে কিছুক্ষণ হকচকিয়ে গেলেও পরে তারাও আক্রমণ করতে এগিয়ে এল। শেষপর্যন্ত খণ্ডযুদ্ধ বেধেই গেল। ইতিমধ্যে আরও লোক জড়ো হয়েছিল। কেউ কেউ ফিরে গেলেও তামাশাটা পুরোটা দেখার লোভ ছাড়তে পারেনি। কে যে কাদের দলে, বোঝা মুশকিল। পাহারাদাররাও এতক্ষণ খুব একটা হাতের সুখ করতে পারছিল না। এবার তারাও যোগ দিল।

মুহুর্মুহু লাঠি চলল শুধু। দলে ভারী ছিলাম আমরাই, আমাদের অস্ত্রও কম নয়। সাদা বিচিত্র পোশাকের লোকগুলো হাতের জিনিসগুলো দিয়েই খানিক প্রতিরোধের চেষ্টা করল। মূর্খের দল। লাঠির সামনে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। তাদের মেরে হাড় ভেঙে দেওয়া হল। মনোহর দু-জন লোকের মাথা ফাটিয়ে দিল। কিন্তু বাইরের লোক বলেই আর অন্য কিছু করা হল না। চলে যেতে বলা হল। ওরাও ভাবেনি, এমন মার খেতে হতে পারে। কিন্তু মোড়লের এলাকায় এ-সব নাকগলানো বরদাস্ত করা হয় না, কোনোদিনই। ওদেরকে সে-সব বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হল।

কিন্তু মিহিরকে ছাড়ার কোনো প্রশ্নই নেই। মনোহর তো ঠিক করেই ছিল, মিহিরের বংশ শেষ করবে। মিহির ততক্ষণে ধুঁকছে। মুখ দিয়ে লালা-রক্ত মিশ্রিত একটা তরল বেরিয়ে আসছে। সতুরও অবস্থা তদনুরূপ। কিন্তু মোড়লের কড়া নির্দেশ ছিল, ঝামেলা মিটলে মিহিরকে তার কাছে নিয়ে আসতে হবে। সেই নির্দেশমতো মিহিরকে, সতুকে, এবং ওদের বাড়ির সকলকে বেঁধে ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে যাওয়া হল। সঙ্গে টিরিদেরও। গ্রামদ্রোহীতার শাস্তি। অবশ্য ব্যাপারটা শুনতে যতটা চুপচাপ মনে হচ্ছে, ততটা চুপচাপ ছিল না মিহির বা টিরিরা কেউই। মোড়লের বাড়ির দিকে যখন ওদের হাঁটু ছেঁচতে ছেঁচতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তপ্ত গরমে খোয়াভরতি রাস্তায় ছিলে যাওয়া রক্তাক্ত হাঁটুতে লাল দাগ হয়ে যাচ্ছে, ওরা চেঁচাচ্ছিল। সঙ্গে স্লোগান— “যত খুশি মার আমাদের। যত খুশি রক্ত বার কর। এভাবে সত্যি চাপা যাবে না। সব বেরোবে একদিন। নদীর দিকে গেলেই সকলে কেন পাগল হচ্ছে, আমরা কি জানি না? ভোররাতে ওখানে কী হচ্ছে, আমরা কি দেখিনি?”

কোন সত্যির কথা যে বলছিল, নদী, ভোররাত, এ-সবের মাথামুণ্ডু কিছুই আমরা বুঝলাম না। আমরা বুঝছিলাম, মিহিররাও সব পাগল হতে শুরু করেছে। গ্রামের পাগল হওয়ার ছোঁয়াচ রোগ ওদেরকেও ধরেছে।

কিন্তু ওদের স্লোগান দিলে আমাদেরও তো দিতে হয়। আমরা এক দঙ্গল লোক আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করলাম— “অবতারবাবা জিন্দাবাদ।” আমাদের হাঁকডাকে বাড়ির উঠোনে, ছাতে, গেটের সামনে মেয়ে-বউ-বুড়ো-বাচ্চা-জোয়ান, যত ধরনের দু-পেয়ে জানোয়ার হয়, সব বেরিয়ে এল। স্লোগানের অসম প্রতিযোগিতা দেখতে তারাও দাঁড়িয়ে গেল। মোড়লবাড়ির দিকে এগোতে থাকল আমাদের শোভাযাত্রা।

***
সেদিনের পর আর মাত্র তিন দিন মিহিরকে দেখা গিয়েছিল। ওই তিন দিন ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলে।

মিহিরও যে পাগল হয়েছিল, সেই ব্যাপারে আমরা সকলেই বদ্ধমূল ছিলাম। মোড়লের উঠোনে ওদের বিচার হয়েছিল। মোড়লের নীতিকে অবজ্ঞা করা, বাইরের লোক ঢুকিয়ে মোড়লের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, শান্ত-নিরীহ লোককে খেপিয়ে তোলা, সর্বোপরি মানুষের ক্ষতি করতে চাওয়া, এমন কঠিন সব কারণ চাপানো হয়েছিল মিহিরের ওপর। মূল অভিযুক্ত সে ও তার পরিবার। টিরিরা যেহেতু তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম। কিন্তু শাস্তি সকলেরই। টিরিদের পাহাড়ের জঙ্গলে নির্বাসন দেওয়া হল। শাস্তি, রোজ হরিণ মেরে খেতে হবে। মিহিরদের শাস্তি আরও গুরুতর। একে এত প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছে, উপরন্তু মস্তিষ্কবিকৃতি। অপরাধের ওপর অপরাধ। অবতারবাবা বিধান দিল। কোথাও তাদের পাঠানো হবে, সেখানেই আজীবন থাকতে হবে। কোথায়, তা আর আমাদের জানতে দেওয়া হল না। সেটা রুদ্ধবেড়া বৈঠকে স্থির করা হয়। সেখানে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল না।

কয়েকদিন পরেই আমরা খবর পেলাম, মিহিরের নাকি ওই রোগটা হয়েছিল, তাতেই সে টেঁসে গেছে। আমাদের মোড়লের বড়ো চওড়া হৃদয়, তাই সে যারপরনাই চেষ্টা করেছিল মিহিরকে যথোপযুক্ত চিকিৎসা করাতে। কিন্তু মিহিরের এমনই জেদ যে, অবতারবাবার ওষুধ তাকে খাওয়ানো যায়নি। মিহির উবে যেতে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম, বলাই বাহুল্য। ও ছিল একটা আপদ। এমন আপদ গ্রামে না থাকাই ভালো। তার উপর পাগল হয়ে গিয়েছিল। আরও সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটতে পারত। আমাদের ভাগ্য ভালো, ও নিজেই ঝামেলা ডেকে এনে আমাদের সুবিধা করে দিল। তবে মনে মনে কিছুটা খারাপও লাগছিল এই ভেবে যে, তাকে আমরা সেভাবে ঠিক উচিত শিক্ষাটা দিতে পারলাম না। আমাদের ইচ্ছে ছিল, তাকে গোটা গ্রাম যদি মাথা মুড়িয়ে, উলঙ্গ করে ঘোরানো যায়। কিন্তু মোড়লের নির্দেশ ছিল, ওরকম কাজ করে ছোটোলোকেরা, আমরা ভদ্দরলোক বলে ও-সব করা যাবে না। সেই কথাই ক-দিন পরে মনোহর বলল— “আহা রে, বেচারা লোকটা ফালতু ফালতু আমাদের সঙ্গে বিলা দিতে এসে নিজেই পাগল হয়ে গেল। নির্বংশ করব বলেছিলাম, কিন্তু বেশ কষ্টই লাগছে মাইরি।”

গ্রামের পাহারা শেষ করে আমরা একপ্রান্তে বসে গুলতানি মারছিলাম। সকলের এখন বাড়িতে থাকার নিয়ম। আমরা অবশ্য যেখানে খুশি ঘুরতে পারি, কেউ আটকাবে না। হঠাৎ শুনি, দাশরথির নাম ধরে কেউ ডাকছে। মহিলার গলা। দাশরথি তাকিয়ে দেখে, তার মা আর ঠাকুমা। সে একটু অবাক হয়েই তার মা-কে জিজ্ঞাসা করল, কারণখানা কী? তার মা বলল— “তোর বাপ পাগল হয়ে গেছে, দাশু। বাড়িতে আয়।”

দাশরথির সঙ্গে তার বাপের বনিবনা ছিল না। তাই দাশুকে খুব একটা চিন্তিত লাগেনি। কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে সে বাড়ি ফিরে গেল। যাবার আগে আমি তাকে বললাম— “বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যাস, দাশু, কেসটা কী।” আমরাও ব্যাপারটা শুনে অবাক হলাম। কিন্তু দাশুর কাছ থেকে ছাড়া আর কারও কাছ থেকে জানতে পারার উপায় নেই। আমরা সকলে যে-যার বাড়ি ফিরে গেলাম।

সেদিনই দুপুরে দাশু আমার বাড়ি এল। ওর বাবার খবর জানতে চাইলাম। দাশু খুব একচোট হাসল। ওর বাবা নাকি ভোরে নদীর ধারে পায়খানায় গিয়েছিল। দাশুদের বাড়িতে বাঁধানো বাথরুম আছে, কিন্তু ওর বাবা তো বাড়ির থেকে আলাদা। অতএব, সে নদীতেই যায়। তখন নাকি ওর বাবা দেখেছে, মোড়লের লোকজন নদীতে লাশ ভাসাচ্ছে। একটা নয়, অনেকগুলো, প্রায় দশ-বারোটা লাশ। বাচ্চার লাশও আছে। কিন্তু পুরো মুড়ে রাখা বলে সেগুলো কাদের, তা বোঝার উপায় নেই। সে-কাজ তদারকি করছে চাটুয়া। দাশু এ-সব কথা শুনেই বুঝেছে, বাপের মাথা পুরো বিগড়েছে। “মাইরি, মোড়লসাহেবের শক্তিটা ভাব। ওকে যে-ই বিলা দিতে আসুক, সে মাইরি এমন টেরে যাচ্ছে।”

কথাটা খুব ভুল বলেনি, ঠিকই তাই, মিহিরেরও এক পরিণতি হল। সে যে কোথায়, আমরা কেউ জানি না। দাশুর বাপটারও না এই পরিণতি হয়। আমি বললাম— “বাপটাকে সামলে রাখ। এ-সব বললে গাঁয়ে টেঁকা যাবে না, সে-কথা বোঝা।”

— “আরে সে-মাল কি আর বোঝাবার পর্যায়ে আছে। সে তো পুরো ঢিলা হয়ে গেছে।”

— “তবু তোর বাপ তো।”

— “আরে অমন বাপের মুখে মুতি। দু-পয়সার মুরোদ নেই, এদিকে শালা তেজ। এখন মরুক গে।”

***
দাশুর বাবাকে আর কিছু করা যায়নি। সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল। দাশু বাপকে পছন্দ না করলেও লাথি-ঝাঁটা মেরে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে, এ-সব বললে কপালে দুঃখ আছে। কিন্তু সে বার বার বলতে থাকে, নদীতে সে কী দেখেছে, সব কথা সে গ্রামে রাষ্ট্র করে দেবে। দাশু তার মুখ চেপে ধরেছিল, কিন্তু সে দাশুর আঙুলে কামড়ে দাঁত বসিয়ে দেয়। দাশু রেগে গিয়ে তার বাপকে থাপ্পড় মারে। আমাদের বলে— “আর কিছু করার নেই। মালটা পুরো কুত্তা হয়ে গেছে। খ্যাপা কুত্তা। এমন কুত্তাকে বাড়িতে রাখলে বিপদ।”

দু-দিন ধরে এমন বাওয়াল চলার পর মোড়লের লোক এসে অধিরথিকে নিয়ে যায়। তার মনুষ্যবাসের শেষ দিনগুলোর ধ্বস্তাধ্বস্তির সাক্ষী হিসেবে পড়ে থাকে ঘূণ ধরা কাঠের বিছানা, ছেঁড়া এলোমেলো কাগজে লেখা হিজিবিজি অক্ষর, আর ভিজে যাওয়া দুর্গন্ধময় বালিশ আর চাদর। শেষ তিন-চার দিন সে নদীতে যেত না, পেচ্ছাপ-পায়খানা খাটেই করে ফেলত। তার কাগজগুলো সে খেয়ে ফেলতে লেগেছিল। মোড়লের লোক সেটা করতে দেয়নি। কয়েকটা টুকরো এদিক-ওদিক ছড়িয়েছিল। আমাদের মধ্যে গোপী কিছুটা লেখাপড়া জানত। সে পড়ে বলেছিল— “ধুর, সব পাগলের বাতেলা। নদীতে লাশ ভাসছে, সেই লাশের খবর পেয়ে যাচ্ছে বাইরের গ্রামের লোক, মিহিরকে নাকি গুমখুন করা হয়েছে, আসলে রোগ-ফোগ হয়নি— এ-সব গপ্পো শালা কোত্থেকে পায় মাইরি!”

দাশুর বাবাকেও আর তারপর থেকে আমরা দেখিনি। তবে দাশুর কথায় আমাদেরও খানিক কৌতূহল হয়েছিল। সত্যিই নদীর ধারে ভোররাতে কিছু হচ্ছে কিনা, একবার দেখলে হয়। ক্ষতি কী? আমাদের তো অবতারবাবা আছেই। এ-কথা আমিই প্রথম তুলি। বাকিদেরও দেখলাম, কৌতূহল আছে ভালোই। দাশুও বলল— “হ্যাঁ, চল তো, দেখেই আসি। বাপটার কথা ভেবে মায়াও লাগে। সত্যিই কিছু হচ্ছে কিনা, একবার দেখে আসাই যায়।”

সেইমতো আমরা গিয়েছিলাম। একদিন ভোররাতে। গিয়ে দেখলাম, দাশুর বাবার কথা কিছুটা সত্যি। মোড়লের লোকজন সত্যিই ছিল। সঙ্গে লাঠি নিয়ে চাটুয়া। চেনা লোক দেখে চাটুয়া হাসল— “এখানে এই সময়ে কী ব্যাপার ভাই?”

মনোহর বলল— “এই এলাম। আজ একটু ভোর ভোর বেড়াতে বেরোতে ইচ্ছা করল। তা এখানে কী হচ্ছে গো?’

চাটুয়া উত্তর দিল— “এই আমকাঠের গুঁড়ি ভাসাচ্ছি। রোজই ভাসানো হয়। জানোই তো, আমকাঠের গুঁড়ি ভাসালে রোগ-ভোগ কম হয়। অবতারবাবারই দাওয়াই। তা এই নিয়েই দেখ না, লোকজন কী-সব রটিয়ে বসল। এই তো তোমার বাবাই কী কাণ্ডটাই না করল।”

শেষ কথাটা সে দাশুর উদ্দেশ্যে বলেছিল। দাশু জিভ কেটে বলল – ‘আরে, কী আর করব বলো। আমার বাপটা চিরকালই ওরকম। বেশি তেজ দেখানো স্বভাব চিরকালই। আমাদের সঙ্গে থাকতও না। তাও তো নেহাত বাপ বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা আর হল কই। ও যাক গে, ওকে আমার বাপ বলতে এমনিও ঘেন্না হত।”

আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম ওদের কাজ। আমকাঠ ভাসাচ্ছে ওরা। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আর ক-দিন পরেই হয়তো রোগ বাপ-বাপ বলে পালাবে। মনোহর দাশুর দিকে চেয়ে ব্যঙ্গ করল— “শালা তোর বাপের মাথা খারাপ জানতাম। চোখও যে খারাপ জানতাম না তো। আমকাঠকে বেমালুম লাশ বানিয়ে দিল মাইরি। আজিব আদমি।’

আমরা সকলেই হেসে উঠলাম। প্রাথমিক হকচকানির পর দাশুও হেসে উঠল। তারপরেই সে একটা অদ্ভুত কথা বলল— “মিহির-সতুরা থাকলে ওরাও শালা এগুলোকে মানুষের লাশই বলত। আমাদের অত বড় শ্মশান থাকতে নাকি নদীতে লাশ ভাসাবে। বিলা দেওয়া আর কাকে বলে!”

সত্যি বেচারা মিহির। বেশি বাওয়াল দিতে এসে নিজের জীবনটাকেই চুকিয়ে দিল। অবতারবাবার কথামতো চললে, মোড়লের কথা শুনলে রাজার হালে থাকত। ফালতু ঝামেলা করে নিজেই কোথায় হারিয়ে গেল। ওর কথা মনে পড়তে নিজেদের অজান্তেই চুকচুক করে উঠলাম আমরা। আর ঠিক সেই সময়ে সামান্য কিছু মুহূর্তের জন্য যেন দেখলাম, আমকাঠগুলোর শরীর থেকে ঝুলে এসেছে হাত, নীচের দিকে গজিয়েছে পা, মুখগুলো ঢাকা চাদরে।

পরমুহূর্তেই বুঝলাম, দৃষ্টিভ্রম। ওই তো আমকাঠগুলো ভেসে চলেছে দূর পানে।

 

Categories
2021-July-Story

অমিতরূপ চক্রবর্তী

বাঁশি

জুনের গনগনে দুপুরে চওড়া পিচরাস্তার ওপর নিমাই মোহন্তকে লাগছিল একটা ধূমকেতুর মতো। ধূমকেতুর পেছনে যে-গ্যাস আর আগুনের পুচ্ছ থাকে, নিমাই মোহন্তের পেছনে সেখানে একদল নারী-পুরুষ। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সচেতনতামূলক একটি মিছিল বের করেছে নিমাই মোহন্ত। মিছিলটি শুরু হয়েছে চড়াইমল থেকে। যাবে ধারসি নদীর চৌপথি পর্যন্ত। চেপানি হল্টের মোড়ে দেবু ডাক্তারের হোমিয়ো ফার্মেসি যথারীতি খোলা। পুরোনো লালচে রঙের একটা টেবিল ক্লথ পাতা টেবিলে ছোটো বড়ো নানা আকৃতির হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের শিশি-বোতল সাজিয়ে কাঠের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে আজকের খবরের কাগজটা পড়ছিলেন দেবু ডাক্তার। দেবু ডাক্তারের কাঠের চেয়ারে একটা ময়লা, সাদা রঙের তোয়ালে পাতা। তার এক কোনা দেবু ডাক্তারের কোমর ও পাছার ঘষটানিতে ঝুলে পড়েছে ক্রমশ কাঠের প্ল্যাংকিনের দিকে। দেবু ডাক্তারের পায়ের পাতাদুটো টেবিল ক্লথের নীচে টেবিলের পায়ার ওপর ক্রস করে রাখা। ডান দিকে রোগিদের বসার জন্য দুটো কাঠের লো বেঞ্চ রাখা আছে। বেশিরভাগ দিনই সেই বেঞ্চিগুলো শূন্যতায় ঠা ঠা করে। আজও করছে। দেবু ডাক্তারের হোমিয়ো ফার্মেসির ডান দিকে প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে রতনের পানের দোকান। দোকানের সামনে পানমশলা, গুঠখা, চিপসের ঝালর। দোকানের ভেতরে রতনের পেছনে একটা কাঠের পাটাইয়ে বসে সিগারেট টানছে কয়েকটি ছেলেছোকরা।

পিচ রোড থেকে ক্ষুদে একটা মানুষের মিলিত গলার শব্দ পেয়ে দেবু ডাক্তার খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে শব্দ যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকে তাকালেন। মিছিলটা তখন চেপানি হল্টের চৌপথি ছাড়িয়ে দক্ষিণে ধারসি নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পাপেট শো-এর পাপেটের মতো মিছিলের মুখে নিমাই মোহন্ত বাতাসে হাত ছুড়ে কী যেন বলছে, আর সেই শব্দটা পেছনে থাকা মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে বা মানুষগুলোকে ফুঁড়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। পিচ রাস্তাটা আন্তঃরাজ্য ফোর লেন হবার দরুন এমন জুনের গনগনে দুপুরে সেই রাস্তায় উড়ছে তপ্ত ফুরফুরে হাওয়া। রাস্তার উত্তরে একটা মাঠের মধ্যে মানিক রায়ের দাদার বসতবাড়ির সুপুরিগাছগুলো সেই হাওয়ায় অল্প অল্প দোল খাচ্ছে। দেবু ডাক্তার খবরের কাগজে ফিরে আসতে আসতে মনে মনে বললেন, যত্তোসব আকামের কাম।

নিমাই মোহন্তের বাঁ-চোখটা নষ্ট। ছেলেবেলায় বাঁশের আর্চারি খেলতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। ঘেমে নেয়ে ওঠা চশমা দিয়ে নিমাই মোহন্ত ক্রমাগতই মুখটা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে লক্ষ্য করছিল আশেপাশের প্রতিক্রিয়া। তার নেতৃত্বে মিছিলটি এখন চওড়া রাস্তার বাঁ-দিকে গমগমে দোতলা স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসটাকে রেখে আরও দক্ষিণে ধারসি নদীর চৌপথির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চায়েত অফিসটা পার হলে এ-দিকে বসতভিটে খুব ছাড়া ছাড়া। জমি-জিরেতই বেশি। কিছু অর্ধসমাপ্ত দালানবাড়ির গাঁথুনি। পাটের পাঁজা। মাটি কাটার জেসিবি থামিয়ে নিথর করে রাখা। এগুলো পেরুলে ছায়ামণি পোদ্দারের দু-কামরার বাড়ি। প্রায় রাস্তার ধারেই। সামনে ঢেউটিনের বানানো ঢলঢলে গেট। নিমাই মোহন্ত মিছিলের লোকগুলোকে চাঙ্গা রাখতে একটা স্লোগান দিচ্ছে নির্দিষ্ট বিরতিতে, গাছ লাগাও/প্রাণ বাঁচাও কিংবা সবুজ নিধন বন্ধ করো ইত্যাদি। ইতিমধ্যে মিছিলটির পাশ দিয়ে বারোবিশার দিকে বা বারোবিশা থেকে আলিপুরদুয়ারের দিকে বেশ কতগুলো সরকারি বাস, যাত্রী বওয়া সুমো গাড়ি, কয়েকটি যুদ্ধব্যস্ত বাইক আর নিতান্তই শালিখ শালিখ চেহারার কয়েকটি সাইকেল চলে গেছে। নিমাই মোহন্ত মনে মনে যেন একটু হতাশ। যেন ভাবনার ভেতর প্রকাণ্ড ফোলা একটি বেলুন লিক করে চুপসে যাচ্ছে। চড়াইমল থেকে এই কড়া, চাঁদি- ফাটানো রোদ্দুরে বেশ কয়েক মাইল হাঁটা হয়ে গেছে। মানুষগুলোর চাপা বিরক্তি স্পষ্ট টের পাচ্ছে নিমাই মোহন্ত।

তা হোক— নিমাই মোহন্ত তার খুলিতে এসে বসা একটি কদাকার কাককে হুশ হুশ করে তাড়িয়ে দেয় যেন। মোহন্ত পাড়া ওয়েলফেয়ার সমিতির সে প্রেসিডেন্ট। পদের সুবাদে, জনসচেতনতার কথা ভেবে এমন কিছু কর্মসূচি পালন করতে হয়। আর এইসব চাষা-ভুষা লোকজনদের এইসব কর্মসূচিতে একটু জোর করেই আনতে হয়। আনিয়ে অভ্যাস করাতে হয়। মানুষকে বৃহত্তর চিন্তা-ভাবনা করতে শেখানোটা অনেকটা জলাতঙ্কের রোগিকে পুকুরে চুবিয়ে স্নান করানোর মতো। এটুকু করতে না পারলে তার কৃতিত্ব কোথায়?

এর আগে নিমাই মোহন্তের নেতৃত্বে যে-কর্মসূচিটি হয়েছে, তা রবীন্দ্র জন্মসার্ধশতবর্ষ পালন। চড়াইমল প্রাইমারি ইশকুলের বারান্দাই ডেকোরেশন করে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। মঞ্চের সামনে পলিথিন আর বাঁশ দিয়ে দো-চালার মতো করে দর্শকাসন। তিনটি বাঁশ সমান্তরালে বেঁধে তার এপারে বিশিষ্ট অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। দুই কোণ থেকে ফুঁ-দেওয়া ওঝার মতো দুটো মিশমিশে পেডেস্টাল ফ্যান। পাখার কী শব্দ তাদের! এতেই অতিষ্ঠ হয়েই তো এলাকার বিশিষ্ট ধনী নিরেন অধিকারী বলেই ফেললেন, এই দুটাকে কেউ বন্ধ কর তো! বন্ধ কর। এইগুলা ফ্যান না কড়াইয়ের কারখানা!

কাচের গ্লাসে কমলা রঙের শরবত পরিবেশন করা হয়েছিল অতিথিদের মধ্যে। ভেলভেটের কাপর বিছানো ট্রে-তে করে সেই শরবত বিশিষ্টদের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল হরেনের মেয়ে চুমকি। তাকে পরানো হয়েছিল ঠাসবুনোট চওড়া পাড়ের সিল্কের শাড়ি। ব্লাউজের ঢলঢলে হাতা বগলের নীচে টেনে সেফটিপিন দিয়ে আটকে খাপানো হয়েছিল। মাথার চুল তেল মেরে টান করে বেঁধে খোপায় আটকানো হয়েছিল ফুলঘর থেকে আনা নকল ফুলের একটি। এই সম্পূর্ণ বিষয়টার নেপথ্যে ছিল নিমাই মোহন্তের ভাবনা। শরবত পরিবেশন যখন প্রায় শেষের পথে, বসন্ত দাসের বড়োছেলে মঞ্চে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে ‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো’— তখনই চুমকি লুটোনো শাড়িতে পা আটকে ট্রে-সুদ্ধু হুমড়ি খেয়ে পড়ল শৈলেন মাস্টারের গায়ে, শরবতে শৈলেন মাস্টারের বাক্স বাক্স ছাপকাটা জামার বুক-পেট ভিজে জবজবে, তখন দর্শকাসনের ব্যারিকেডের বাইরে যে-সমস্ত মামুলি, অশিক্ষিত গু-গোবর খাওয়া লোক ভিড় করে অনুষ্ঠান নয়, তামশা দেখে— তাদের মধ্যে থেকে ঠোঁটকাটা ধজেন চিৎকার করে বলেছিল— ওই নিমাই মোহন্তরে ফাঁসি দ্যাও!

নিমাই মোহন্তর গায়ে জ্বলুনি ধরলেও মুখে কিছু বলেনি। একটা সুদীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে এসে নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখার এই আশ্চর্য শক্তিটা লাভ করেছে নিমাই। অন্তত সাত বছর আগে হলেও ধজেনের এই উক্তির পর পরিস্থিতি আমূল পালটে যেত। বাড়ি ফিরে হাতে একটা দাঁ নিয়ে বাড়ির সীমানার গেটের কাছে দৈত্যের মতো আচরণ করত নিমাই মোহন্ত। কোপ দিয়ে কেটে ফেলত সীমানার ধারে বাড়তে থাকা কোনো নিরপরাধ ঘোড়ানিমের ডাল। আর দরজায় দাঁড়িয়ে নিমাই মোহন্তের উচ্চমাধ্যমিক পড়া মেয়ে চারপাশের পরিস্থিতি আন্দাজ করে চরম বিরক্তিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকত, বাবা, তুমি ঘরে আসবা?

গায়ে শরবত উলটে পড়ার পর কিন্তু শৈলেন মাস্টারের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। নিমাই মোহন্ত লক্ষ করেছে কেমন যেন কোমল হয়ে এসেছে শৈলেন মাস্টারের বদরাগী মেজাজ। শৈলেন মাস্টারের বয়স প্রায় বাহান্নোর কাছাকাছি। বিয়ে-থা করেনি। এর কারণ হিসেবে লোকেরা পেছনে বলাবলি করে শৈলেন মাস্টারের যন্ত্রটাই নাকি খারাপ। শোনা যায়, কোনো একসময় শৈলেন মাস্টারের বিয়ের কথা অনেকদূর এগিয়েও তারপর ভেঙে যায়।

এই ব্যাপারে সবচেয়ে সরস মন্তব্যটি করে রথীন্দ্র। পেশায় সে নব্য প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক। পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে চাকরিটি পেয়েছে ও। সন্ধ্যায় নাদুর দোকানে চা খেতে খেতে বলে— হওয়ারই কথা। মেয়ের বাড়ি হয়তো টের পেয়ে গিয়েছিল শৈলেন মাস্টারের কলাটা আসলে বিচাকলা। কামের কাম হয় না। হাতে দিলে বান্দরেও খাবে না।

রথীন্দ্রর এই কথায় দীপাবলীর রাতে বাজি-পটকা পোড়ার মতো হাসির রোল ওঠে নাদুর চায়ের দোকানে। নাদু একটা পচন-ধরা টেবিলে এঁটো চায়ের গ্লাসগুলি দু-হাতে ধুতে ধুতে বলে, এখন না ওষুধ পাওয়া যায়?

— ওই ভোমরা পাঁঠার আর ওষুধেও কাজ করবে না। ওইটা নিয়া ওই ব্যাটা স্বর্গে যাবে। পার্টির লোকাল কমিটির চেয়ারম্যান হইয়া কম তো বদমাইশি করে নাই, এইটা তার ফল।

চায়ের দোকান থেকে পয়সা মিটিয়ে ঝড়ের মতো বাইক চালিয়ে উধাও হয়ে যায় রথীন। চায়ের দোকানে বসা সবাই জানে রথীন যাচ্ছে চেপানি চৌপথির কাছে নতুন খোলা একটি পার্টি অফিসে।

শৈলেন মাস্টারের ব্যবহারের কোমলতা নজর এড়ায় না নিমাই মোহন্তর। একদিন সন্ধ্যের সময় যখন নিমাই মোহন্ত খাপসাডাঙা বাজার থেকে ফিরছে, পিচ রাস্তা ক্রস করবে—তখনই বাইক নিয়ে পেছন থেকে নিমাই মোহন্তের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শৈলেন মাস্টার। দীর্ঘ পথশ্রমের পর বাইকটা তখন ধুকছে। গরগর করছে বাইকটার চোখের আলো। আকাশে তৃতীয়ার চাঁদ। পিচ রাস্তার ওপর প্রচণ্ড হাওয়া।

— কোথায় গেসিলা নিমাই?

— এই একটু বাজার থেকা ঘুইরা আসলাম।

— বাড়ির সব খবর ভালো তো? মেয়ের তো এমএ-তে রেজাল্ট ভালো হইছে শুনলাম।

— হ্যাঁ, তবে আর একটু বেটার হইতে পারত। পরীক্ষার আগে তিন মাস জন্ডিসে ভুগল।

— অসুখ তো আর পরীক্ষা বোঝে না। তবে তোমার মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। অসুখ ওরে হারাইতে পারবে না।

— দেখি।

— সেই দিনের ঘটনাটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। পরে আমি চুমকির খোঁজ নিছি। ব্যথা-বেদনা পায় নাই। তবে তোমার আইডিয়াটা ছিল ব্রিলিয়ান্ট। বিশিষ্ট মানুষের জন্য একটু বিশিষ্ট ব্যবস্থা করাই লাগে। লোকাল কমিটির চেয়ারম্যান থাকার সময় কলকাতা থেইকা আর্টিস্ট আনাইয়া খলিসামারির মাঠে প্রোগ্রাম করছিলাম তোমার মনে আছে? কত খরচ হইছিল কও তো? এক লক্ষ বাহাত্তুর হাজার টাকা। এক নয়া পয়সাও কোথাও নড়চড় হয় নাই। অ্যানুয়াল মিটিং-এ সেই আয়-ব্যয় আমি ক্যাশমেমো, ভাউচার দিয়া পেশ করছিলাম। কারো মুখে একটা কথা নাই। ভাবতে পারো?

আধো-অন্ধকারে নিমাই মোহন্ত হাসার চেষ্টা করে একটু।

— আমি কী করছিলাম জানো? আয়-ব্যয়ের হিসাব হ্যান্ডবিলের মতো কইরা ছাপায়া সবার হাতে ধরায়া দিসিলাম। তাতে লেজার খাতার পেজ নম্বর, ক্যাশমেমো নম্বর, ভাউচার নম্বর— এইগুলাও ছাপায়া দিসিলাম। নে, এখন কে কী কবি ক! তবে তোমাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। মিশনের সবে শুরু। যাই হউক, প্রোগ্রামটা ছোটো হইলেও বেশ ভাল হইছে। মাঝেমধ্যে এইসব অনুষ্ঠান কইরা সাংস্কৃতিক চেতনাটারে বাঁচায়া রাখবা। লোকে পিছনে অনেক কথাই বলবে, মনে নিবা না। মনীষীদের জন্মটন্ম পালনের পাশাপাশি জাতীয়, ইন্টার ন্যাশনাল ইসুগুলার দিকেও নজর রাইখো। আন্তর্জাতিক ভাবনাগুলার সঙ্গেও মানুষের পরিচয় করানোটা জরুরি। দরকার পড়লে ডাকবা, আমি আছি।

এর পরেও ঝিমন্ত বাইক জাগিয়ে আকাশে তৃতীয়ার চাঁদের নীচ দিয়ে পিচরাস্তা দিয়ে কোথাও চলে গেছিল শৈলেন মাস্টার। রথীনের কানে কথাটা গেলে রথীন নিমাই মোহন্তকে বলেছিল, কাকা, ঘটনাটা বুঝলা না?

ঠোঁটে একটু হাসি টেনে একচোখে কেমন বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়েছিল নিমাই মোহন্ত। রথীন বলল, তোমারে হ্যার ক্যালি শুনাইল। ওই প্রোগ্রামে নব্বই হাজার টাকার বেশি খরচা হয়-ই নাই। যে মাছচোর, সে-ই শাক দিয়া মাছ ঢাকার জন্য ওইসব করে। আমার তো এও মনে হয়, চুমকির গায়ের গন্ধও ব্যাটার ভাল্লাগছে। নাইলে অত দরদ কীসের। ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস-এ কামরুলের মেয়েটা যখন দৌড়াইতে গিয়া পা ভাঙল— তখন তো দেখতে আসে নাই! শালা, বদমাইশ ব্যাটা। চরিত্রহীন!


মুসুরির ডালে পেঁয়াজ ফোড়ন দিলে তার যা স্বাদ, যা গন্ধ— তাতেই মনটা চনমন করে ওঠে। গরম ভাতের সঙ্গে যদি এমন ডাল হয় আর সঙ্গে একটু আলুসেদ্ধ বা ছোটো মাছের চচ্চড়ি হয়, তাহলে দু-বেলার ভাত একবেলায়-ই খেয়ে ফেলতে পারে নিমাই। আজকের এই বিশেষ দিনটির জন্য সে তেমনই আয়োজন করেছিল। আগের দিনই খাপসাডাঙার সন্ধ্যের বাজার থেকে তাজা ছোটমাছ, বড়ো দানার লাল আলু এনে রেখেছিল নিমাই মোহন্ত। খরচের ব্যাপারে সে একটু হিসেবি, যে-চরিত্রটাকে লোকে বিকৃত করে বলে কৃপণ। লোকে বলতেই পারে, কিন্তু এই বিশেষণ একেবারেই মানতে নারাজ নিমাই মোহন্ত। কৃপণ তো সুবল দেবনাথ, যে পাঁচ পাঁচটা চালগুদামের মালিক হয়েও এইসব সাংস্কৃতিক বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে পঞ্চাশ টাকাও চাঁদা দেয় না। কৃপণ তো শান্তিশ্বরী হাইস্কুলের ক্লার্ক নিশীথ পাল। যে সাইড-এ আবার নার্সারির ব্যাবসা করে। অরণ্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে তার কাছে সমিতির পক্ষ থেকে জনসাধারণকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার জন্য একশো চারাগাছ চাইতে গিয়েছিল নিমাই মোহন্ত। প্রতি চারা পনেরো টাকা চেয়ে বসল নিশীথ পাল। নিমাই মোহন্ত মাথা চুলকে বলেছিল, এটা একটা সামাজিক কাজ, তাই যদি টাকাটা না নিতেন…।

— অসম্ভব! আমার পক্ষে অসম্ভব! সবে শেয়ারে বিজনেসটা শুরু করেছি। প্রায় পঞ্চাশ থেকে এক লাখ টাকা বাজারে পড়ে আছে। এখনও ওঠাতে পারিনি। উন্নত টেকনিকের চারা। গোড়ায় বেশ মোটা মাটি পাবে। কুড়ি টাকার কমে দেওয়াই যায় না, তবু তোমাদের উদ্দেশ্যটা ভালো দেখে পনেরো টাকায় দিচ্ছি, নিয়ে যাও। আর পয়সা কিন্তু ক্যাশ নেব। সই করা ব্ল্যাঙ্ক বিল নিলে আরও তিনশো টাকা এক্সট্রা।

নিশীথ পালের ঘরের মেঝেতে ঘি রঙা টাইলস বসানো। কোনার একটা টেবিলে রঙিন টেলিভিশন তখন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। একটা বেঁটে আলমারির ভেতর সাজিয়ে রাখা কাচের কাপ-ডিশ ইত্যাদি। সোফার সামনের টেবিলটায় পেতলের অ্যাশট্রে, তাতে অনেক দগ্ধ সিগারেট। নিশীথ পালের পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাঁটুসমান কালো একটা ঢলঢলে হাফপ্যান্ট। তখন বেলা সাড়ে আটটা বাজে। এককাপ চা পর্যন্ত ও-বাড়ি থেকে আসেনি নিমাই মোহন্তের জন্য। এরা কৃপণ না হলে কৃপণ কে?

মিছিল শুরু হবে বেলা সাড়ে দশটায় চড়াইমল প্রাইমারি স্কুলের মাঠ থেকে। আগের দিন শোবার সময় নিমাই মোহন্ত যখন একটা বিড়ি ধরিয়ে জানালার সামনে বসেছে, দেখতে পেল অনেক দূরে দিগন্তের অন্ধকার আকাশে ক্রুর হাসির মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। বিদ্যুৎ পড়ছে। জানালা দিয়ে আসা রাতের বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। পরদিন বৃষ্টি থাকলে মিছিলটা হবে না। এই কর্মসূচিটাও পণ্ড হবে। এই সমিতির রেজিস্ট্রেশন করানোর তোড়জোড় চলছে। একজনকে ধরে পয়সাও দেওয়া হয়েছে। এখন কিছু দিন নানান কর্মসূচি করে যেতে হবে। তবে একসময় গিয়ে সরকারি ফান্ড পাওয়া যাবে। নিমাই মোহন্ত এ-সব চিন্তা করেই প্রতি রাত্রে একটু একটু করে কর্মসূচির জাল বোনে, যেরকমভাবে নদীতে মাছ ধরতে যাবার আগে জাল বোনে মাঝি। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ পেয়ে নিমাই মোহন্ত একটু মুষড়ে পড়ল যেন।

এই ঠেঁটিয়া লোকগুলাকে বোঝানোই যায় না! তার ওপর বৃষ্টি হইলে তো আর আসবেই না। হারামজাদার হারামজাদা কপাল। বিড় বিড় করে বলল নিমাই মোহন্ত।

যদিও সেই রাতে বৃষ্টি হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙার পর নিমাই মোহন্ত দেখল নতুন বউয়ের মতো চিবুক অবধি ঘোমটা টেনে রোদ দুয়ারে এসেছে। সময় যতই গড়াবে, এই বউ-ই ঘোমটা সরিয়ে হয়ে উঠবে একেবারে যক্ষিণী।

স্নান-পায়খানা সেরে প্রস্তুত হতে হতে একটু দেরিই হয়ে গেল নিমাই মোহন্তর। পাতে সবে গরম ভাত, পেঁয়াজ দেওয়া ডালের সঙ্গে মেখে একটু আলুসেদ্ধর তাল ভেঙে মুখে দিয়েছে, সেই সময়েই বাইরে থেকে শ্যামলের ডাক- কাকা, ও নিমাইকাকা, আরে লোকজন তো আসছে। আর দেরি করলে হবে না।

একটু ঝোল-সহ মাছের চচ্চড়িটা মুখে দিয়ে উঠে পড়তে হল নিমাই মোহন্তকে। মুখের ভেতরটাও ভালো করে ধোওয়া হল না। সেটা নিমাই মোহন্ত এখন বুঝছে। গালের দাঁতের সারির ফাঁকে ভাতের কুচি, আলুসেদ্ধর টুকরো, মাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো- টাকরা আটকে আছে। স্লোগান দেবার সময় জিভের নড়াচড়ার ফলে, লালার আঘাতের ফলে সেগুলো বাইরে বেরিয়ে আসছে। আহ! কী স্বাদ হয়েছিল মাছের চচ্চড়িটা!

ছায়ামণি পোদ্দারের ঢললে টিনের গেটের কাছে এসে স্লোগানের তীব্রতা আরও বাড়ালো নিমাই মোহন্ত। মিছিল নিয়ে এই অ্যাতোখানি চড়া রোদ্দুরে হেঁটে আসার পরেও আশেপাশের ঘরদুয়ার, মানুষজনদের থেকে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। ঘরদুয়ার, মানুষজন বা গাই-বলদ, চাপাকল, ধানের মড়াই নিয়ে ছড়ানো সংসারগুলো যেন নিজেদের মধ্যে নিজেরাই ডুবে আছে। বাইরের কোনো আওয়াজ, শব্দ বা কম্পন— কোনোটাই ওদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। শুধু চড়াইমল থেকে ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে পিচরাস্তায় ওঠার সময় এক দঙ্গল বাচ্চা ছেলেমেয়ে মিছিলের পেছন পেছন দৌড়ে আসছিল, তাতে মিছিলটার গুরুত্ব কমছিল। নিমাই মোহন্ত তারস্বরে চেঁচিয়ে ওদের ভাগিয়ে দেয়।

কিন্তু ছায়ামণি পোদ্দারের ক্ষেত্রে এমনটা হবার কথাই নয়। বিধবা ছায়ামণি পোদ্দার কপাল থেকে নাকের ডগা অবধি রসকলি এঁকে, বাইফোকাল কাচের চশমা চোখে দিয়ে চষে বেড়ায় দুনিয়ার শেষ ঘাট অবধি। দূর কোনো বাড়ির গাছের নারকেল ঝুপ করে ডোবার জলে পড়লে, তার শব্দ পৌঁছে যায় ছায়ামণি পোদ্দারের কানে এবং সেটা সংবাদ হয়ে ইথারে ছড়াতে কোনো সময় লাগে না। ছায়ামণি পোদ্দারের বাড়িটার ওপর পেছন দিয়ে উঠে মাথা এল করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাবগাছ। সেখানে কী একটা পাখি স্লোগানটাকে নকল করেই যেন তেমনই সুরে ডাকছে।

বুড়া হরিপদ রোদে হেঁটে হেঁটে হাঁপিয়ে গিয়েছিল। সে বলল, নিমাই এককাপ চা খাওয়াবা না? একটু জিরানো দরকার। রোদটাও যে উঠছে, সেই রোদ।

পরেশের বউয়ের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। জুলপির কাছ দিয়ে টলটলে ঘামের ফোঁটা গাল বেয়ে নামছে— স্পষ্ট দেখা যায়। খোঁড়া গৌরহরির ধুতির গিঁট আলগা হয়ে ময়লা আন্ডারওয়্যার দেখা যাচ্ছে।

নিমাই মোহন্ত নোংরা হলুদ হলুদ দাঁতে হেসে বলল, আইসাই তো পড়ছি কাকা। ধারসি চৌপথিতে চায়ের দোকানে চা খাব।

বুড়া হরিপদ হলহল করে হেসে বলল, শুধু চা?

— না, পিস (পাউরুটি) আছে। পিস খাইতে পারো।

— লোকজনেরে তেমন পাওয়া গেল না নিমাই, কী কও?

— তাই তো দেখি।

— তাইলে আর হাঁটনের কাম কী? এইখানে একটু বইসা নেই, কী কও?

— এমন কথা কইয়ো না কাকা, আমরা একটা বৃহত্তর ইসুতে এই মিছিলটা বাইর করছি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ভাবো তো! পরিবেশ না থাকলে পৃথিবীটার কী হবে? আমাদের দেশের কী হবে? আমাদের কী হবে? আমাদের পরের প্রজন্মের কী হবে?ভাবতাছ ওরা বাঁইচা থাকবে? নিশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস থাকবে না। পাতালে গেলেও খাবার জল পাবা না। এই সুজলা-সুফলা দেশ সাহারা মরুভূমি হবে। লোকজনেরে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু তাতে তো কান দিয়া লাভ নাই! দেশ-দশের মঙ্গলে সবাই আসে না, আসে গুটিকয়টা মানুষ। তারাই পথ দেখায়। ইতিহাস তাদেরই মনে রাখে।

এইসব কথার ফাঁকে নিমাই মোহন্ত একবার চকিতে দেখল পরেশের বউকে। গনগনে হাওয়ায় ওর সিঁথিরদু’পাশে কিছু চুল উড়ছে। রাস্তার ডানদিকে বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে বহমান ধারসি নদী। একটা প্যাঁচানো রুপোলি শাড়ির মতো। নদীটা পুব থেকে এসে দক্ষিণে ঘুরে বয়ে গেছে। দক্ষিণে এই নদীটার ওপরেই বড়ো সেতু। সেই সেতু পেরোলে ধারসি চৌপথি। এই সেতু যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন গ্রামে গ্রামে প্রচণ্ড ছেলেধরার গুজব ছড়িয়েছিল। ছেলেধরারা নাকি কখনো সাধু বা বোষ্টমের বেশে বাড়িতে বাড়িতে ঘোরে। ঘোরে ঠিক দুপুরবেলা, যখন বাড়ি প্রায় পুরুষশূন্য। মন্ত্রবলে বাড়ির মেয়েলোকেদের অজ্ঞান করে কচি কচি ছেলেমেয়েগুলোকে তুলে নিয়ে হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে যায়। সেইসব হারানো ছেলেমেয়েদের মাথা কেটে, তা গুঁজে দেওয়া হয় সেতুর পিলারের নীচে। তাতে নাকি সেতু মজবুত হয়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেতুর কোনো ক্ষতি হয় না। এ-সব নেহাৎই গ্রাম্য গুজব। গুজব ছাড়া আর কী-ই-বা হতে পারে? তবে গুজবই হোক, বা আর যাই-ই হোক এই চেপানি এবং চেপানি সংলগ্ন সমস্ত গ্রাম জানে, তখনই পরেশর ছয় বছরের ছেলেটা একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় আর তারপর থেকেই যুবতী বউটার মাথায় একটু ছিট। কখন, কোথায় ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে যায়। হয়তো সন্ধ্যে পার করে বাড়ি ফেরে। গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না।

নিমাই মোহন্ত দেখে পরেশের বউ অপলক চোখে নদীটার দিকে চেয়ে আছে। বাতাসে সিঁথির দু-পাশের চুল উড়ছে কী এক বক্তব্যের মতো। চাষা-ভুষা লোকগুলি এরমধ্যেই বুড়ো উটের মতো রাস্তার পাশে এখানে-সেখানে বসে পড়েছে। খোঁড়া গৌরহরি শব্দ করে নাকে নস্যি টানছে।

নিমাই মোহন্ত দেখল মাথার ওপরে যে-সূর্যটা— তার গায়ে অসংখ্য চকচকে ধারালো ছুরির ফলা। এই সূর্যের বয়েস কত কে জানে! তবে বয়েস যাইহোক, এখনও তার শরীরে প্রবল রক্তস্রোত, অদম্য বুনো আকুতি! অনেকটা কখনো-সখনো নিমাই মোহন্তর যেমন পরেশের পাগল বউটাকে দেখলে হয়।

ছায়ামণি পোদ্দারের বাড়িতে তখনও নীরবতা। গাবগাছের পাখিটা অনেকক্ষণ কী কারণে চুপ করে থাকার পর এখন আবার ডেকে উঠল। তবে ঠিক স্লোগানের সুরে নয়, অন্য আর একটি নয়া সুরে। কীরকম যেন দূর থেকে ভেসে আসা লোহা-ভাঙারির ফেরিওলার হাঁকের মতো বিষাদ সেই সুরে।

ধারসি নদীর সেতুর ওপর দিয়ে মহামায়া ট্র্যাভেলস নামের একটি চকচকে খয়েরি রঙের বাস নতুন যন্ত্রাংশের শব্দ শুনিয়ে বারোবিশার দিকে চলে গেল। বাসটি চলে যেতেই দেখা গেল ধারসি চৌপথির উলটো দিকে একটা পানের দোকানে বাইক থামিয়ে গোটা একটা দোমা পান মুখে পুরেছে শৈলেন মাস্টার। রাস্তায় ছত্রাকের আকারে পানের পিক ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বলদ নিমাই মোহন্তের কাণ্ডকারখানা। হঠাৎ তার চেয়ারম্যান-চেতনা বলে উঠল এমন বলদের দরকার সবসময়ই আছে, ছিলও। পৃথিবীর খানিকটা ইতিহাস তো বলদেরই ইতিহাস।