Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

প্রীতম বসাক

মাটির কবিতা


সুস্থির হও
একটা কৃষি জীবন— ফসলের রূপ
আলো

মাটির প্রতি
আজন্ম বিশ্বাস রাখো
প্রযত্নে তার নাম লিখ মায়া


অদূরে ছড়িয়ে আছে নিমফল

অই মাটিতেই চাঁদ নামে

মাই জুড়িয়া তখন
অঢেল বৈষ্ণব

লিখিত হয় পদ
লিখিত হয় পঞ্চব্যঞ্জন


কালো-মাটি রঙের দুঃখ

কাপাস গাছের থেকে
ঝুলে আছে
অতি সুস্বাদু বেদনা

কৃষাণী আসিয়া দাঁড়ালো
উহার চোখে তুমি
মধু ও মেঘ লিখে দিও


মাটি আর অগ্নি
এ-ও সেই আদিম পালাগান
পয়ারে রচিত

যত গাই—
দুঃখের নিকট আমাদের
ঋণ বেড়ে যায়


ধান হল—
এর চেয়ে সত্য
তুমি ছুঁয়েছ কখনো?

এই যে হাঁ হয়ে আছ
ক্ষুধায় আর জলে

আগে স্তব করো
মাটি হও…

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

পার্থজিৎ চন্দ

অশুভ লেখারা

অভিশাপ

এ অন্ধকার মরুবন্দর, এই তামস সন্ধে, ক্যারাভ্যান ও ব্ল্যাক-প্যান্থার
বালিয়াড়ির ভেতর যে লুপ্ত-সমুদ্রের রেখা… ধকধক করছে
অশুভ তারার আলো
এ সবের মধ্যে, রক্ত-কুয়াশার ভেতর দুলে উঠবে উন্মাদ মাতৃমূর্তি
ঘুমের ভেতর সে উন্মাদিনী সন্তানকে ঠেলে দেবে আগুন-নদীতে
কোনও এক সর্পসংকুল, শয়তান-রহস্য ঘেরা দ্বীপে
তাকে যেতে হবে বাবার সন্ধানে।
সেখানে ক্রুশকাঠ, পেরেকে মাখানো রক্ত, নীল কুয়াশাকে
লালাভ করছে বিষণ্ণ রুধির, আর প্রহরের পর প্রহর
বালি-সমুদ্রের বুক চিরে, সন্তানের দিকে ধেয়ে আসছে
উন্মাদিনীর গূঢ় অভিশাপ

অন্তিম

খিলান ফুরানো রাস্তা। পাখির চোখের দিকে ছুটে আসা বন শিস্‌ দিচ্ছে
দু’দিকের ফাঁকা মাঠে শাদা বক শূন্য থেকে উড়ে এসে
মিলিয়ে যাচ্ছে আবার শূন্যে। স্কুল ছুটি হল; বহুক্ষণ
লোহার ঘণ্টা বাজতে বাজতে স্থির হয়ে গেছে
এখন বিকেল; একটি স্থলচর নৌকার পাল দুলে উঠছে দিগন্তের কাছে—

তারপর এখানে নদীর ঘাট হবে, নৌকাভর্তি ছেলেমেয়ে
বনের ভেতর ঢুকে দেখবে যজ্ঞের রাত
তারামণ্ডলের দিকে উড়ে যাচ্ছে ধোঁয়া,
ধোঁয়ার ভেতর শিশুদের হাসি
ইন্ধনের দিকে এগিয়ে আসছে আগুনের রেখা;
শুনবে শিথিল কণ্ঠের নরনারী, কামাচ্ছন্ন, বলে উঠছে
‘হে, অঙ্গিরা, এ-কান্তার তোমার; এ-নদী ও নৌকা তোমার
আমরা দিন-রাত মাড়িয়ে এসেছি, রক্তাক্ত পা, এবার তোমার কোলে
আমাদের নাও… কাম দাও… ঘুমাই’

ঋক্ষ

রথ থেকে নেমে
তিনি ক্লান্ত ঘোড়ার শরীরে হাত রেখে,
ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন
হাওয়া দিচ্ছে
দূরে তারাদের বনে

সাতটি তারার দীর্ঘকেশ, ঋক্ষ…
ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখেছে
দীর্ঘ রাত,
ক্লান্ত রথস্বামীর মুখে
পড়ে আছে
তার শরীরের মৃদু প্রভা

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

ধুলোবালি

এক
মাঝে মাঝে মনে হয় শ্বাস নেওয়ার মতো ভারি পৃথিবীতে কিছু নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় অপেক্ষা শব্দের গায়ে যদি একটা চারা গাছ পুঁতে দিতে পারতাম। মাঝে মাঝে মনে হয় একবার চলে গেলে আর কারো সঙ্গেই দেখা হবে না? এ সমস্ত দিনে এও মনে হয় বড়ো বেশি ক্ষমাপ্রবণতা লঘু করে দেয়।

আজকাল প্রায়ই মনে হয়
কারণ ছাড়াও পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে…

দুই
সবুজ ল্যান্ডস্কেপ, মসে ঢাকা লোমশ গাছেরা, এসব পেরিয়ে অনেকটা দূর চলে গেলে পথ আর পা পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করে ঠিকানা। কেউই কিছু বলতে পারে না কাউকে।
একটা খরগোশ আর একটা শেয়াল পরস্পর বিপরীত দিকে দৌড়ে যাচ্ছে দেখি।
কার পায়ের চিহ্ন ধরে যাবে তুমি, তুমি ঠিক করো।
সোজা হাঁটতে গেলে মস্ত সরীসৃপ রাস্তা জুড়ে শুয়ে
কে কার বন্ধু এরা, শত্রু বা কার? জঙ্গল জঙ্গল বিস্তৃত সবুজ সমস্তটা গিলে ফেলে। আমাকেও।

কখন উগড়ে তুলে ফেলে দেয়, অপেক্ষায় থাকি।

তিন
ছোটো ছোটো গঞ্জের হাট ধুলো ও কাদামাটি মেখে ঘর ছাড়ার স্পৃহা কিরকম মায়া করে তোলে সব।
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় না।
তবু হাত প্রসারিত থাকে।
তবু দৃশ্যগুলো সরে সরে যায়।
অপ্রাকৃত শব্দের কাছাকাছি এত আলো জমে থাকে, খুব অলক্ষ্যে

ঘরে ফেরার পথ রূপকথা হয়ে যায়!

চার
ছবি আঁকতে বসেছ
রেখায় রঙে আলো আঁকতে গিয়ে ফুটিয়ে তুলেছো অন্ধকার—
যাকে ঘিরে ঘিরে
ওই কিছু না থাকাটুকুই আলো।
তাকে জায়গা দিয়েছ খেলাধুলো মেখে নিতে
কিছু নেই বোঝাতেও তো কিছু আছে বলতেই হল!
হাওয়াকে আঁকতে গিয়ে ঝরাপাতা কেঁপে ওঠা জল
উড়ো চুল যেভাবে এঁকেছ

আর হাওয়া তার পাশ দিয়ে চোখ মটকিয়ে দূরে সরে গেছে!

পাঁচ
অপরাজিতার নীলে হলুদ প্রজাপতি উড়ে উড়ে ঘোরে।পুরনো নদীর মতো তাপ তাদের ডানায়। হঠাৎ মনে হয় হুল নেই কান্না নেই ভাষা নেই। তবে কী ভাবে ফুলের কাছে রেখে যায় হয়ে ওঠবার ব্যথা? কুৎসিত কীট থেকে এমন ডানার আলো কতটা যন্ত্রণা সাঁতরে এসে এনেছিল সে, ফুল জানে, গাছ জানে, পাতাগুলো জানে?

যে খোলস ফাটিয়ে সে উড়ে এলো সেখানে সুতোয় কিছু বাঁধা রয়ে গেল— ছেঁড়া সুতো, জানো তুমি, তুমি জানো?

সমস্তই জানতে হবে, একথা কে কবে জেনেছে!

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

পঙ্কজ চক্রবর্তী

ইচ্ছাপত্র

কীই বা চেয়েছি এমন
দু- একজন সামান্য অবুঝ পাঠক
অথবা নিরক্ষর শ্রোতা
রেলপথে হাওয়া ছোটে দূরত্বের কাছের মানুষ

যে জটিল, সহজ চোখে দৃষ্টিপাত করে
মধ্যদুপুরে উনোনে স্নানের অবসর

অনাবৃষ্টির দিনে দু’চোখে যে বিরহ ঝরে

নকল মানুষের মেধা
আমার কবিতা যেন স্পর্শ না করে

বৈধব্য

যে নেই তার ভঙ্গিমাটুকু নিয়ে বাজার সেরে এলে
বলছ : দেখো তো রঙটা কেমন?
মানাবে এই বয়সে !

আয়নার গল্প ছড়িয়ে পড়ছে দুই দিকে

কে দেখছে ? দুপুর ?
এলোমেলো বিছানায়
মিথ্যে সাঁকোর ছায়া পেরোচ্ছে জোয়ারের জল

ঝড়ের ভুল

সুন্দর, আমি গিয়েছিলাম

তুমি তো বলনি : বাজাও আমারে বাজাও
তাই ফিরে আসা
বিষণ্ণ আমিষ ছায়া দরোজা স্পর্শ করেনি

তোমারও সংসার আছে
আছে জল, প্রিয় মুদ্রাদোষ, অন্তিম সাঁকোর চরিত্র

অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা নিয়ে
পৃথিবীর  সব গান ঘি ও আগুন মেপে
বিবাহরেখায় শেষ হবে ?
ধান ও যবের শিষে সূর্যাস্তের গান

সন্তান উৎপাদন জটিল হয়েছে

মিথের ওপারে

মহৎ তাঁর দুঃখ নিয়ে কিছুদিন সম্ভাবনা খোঁজে

চুল্লির ভিতর তাঁরও পয়তাল্লিশ মিনিট
উত্তরীয় ডানা ঝাপটায়
বেজে ওঠে স্মারকের টিনের পরাণ

সামান্য দূরত্বে পরামর্শ সেরে নিচ্ছে দুধওলা
দেবতা ও পাইলট কার
বদ্ধ ডোবার পাশে কিংবদন্তী উবু হয়ে বসে
দু-একজন নিরীহ মানুষ কারণে অকারণে বোঝে

মহৎ তাঁর দুঃখ নিয়ে প্রতিদিন সম্ভাবনা খোঁজে

বয়ন

জানালা বেয়ে নামছে কাঠবেড়ালির মৃত ছায়া
পুরনো ক্লার্কের ঘুম ভেঙে যায়

মাঠ থেকে উঠে এল একজন
দাঁড়িয়ে রইল  নিজের তৈরি করা মেঠো বাসস্টপে
তার নাভির কাছে তামার পয়সা টলোমলো

সমস্ত দূরত্ব আলোকবর্ষব্যাপী এক শ্বাপদ ভঙ্গিমা

দুজন মানুষ আলাদা অসুখে পড়ে আছে খড়ের গাদায়
যেন সব অস্থিরতায় গ্রহণ লেগেছে

যেন সূঁচই প্রকৃত বিদ্যা উন্মাদ ঘাসের জঙ্গলে

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

অনুপম মুখোপাধ্যায়

কমেডি অপেরা

এক কমেডি থেকে আরেক কমেডি অবধি আমাদের
চাওয়া পাওয়া

যেমন অদ্ভুত শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকে গরম হাওয়া
আর বৃক্ষের আপনজন শুকনো পাতাগুলো

আমরা পাহাড়ে গিয়ে দেখছি
সেখানে মনের মতো শীত নেই

আমরা সমুদ্রে গিয়ে দেখছি
যথেষ্ট জল পাওয়া যায় না

তোমার গলায় সেদিন শুনতে পেলাম
অবিকল আমারই আওয়াজ

আমাদের মধ্যকার বাতাসকে ভেঙে
ডিগবাজি খাচ্ছে কিছু গম্ভীর ক্লাউন

ভ্রমণ

জলের কিনারায় স্বচ্ছ হয়ে আছে বরফ
তাহলে আমরা সম্পর্কের কঠিনতার কথা বলি

যে কবিতায় চোখের জল থাকে
সেই কবিতাই স্পষ্ট পড়া যায়

বেড়াতে যাওয়ার চেয়েও বেড়াতে যাওয়া নিয়ে
কথা বলতে বেশি ভাল লাগে

অশ্রুপারের কুয়াশা নিয়ে যা বলবে
কবিতার মতোই শোনাবে

ভৌতিক

ভূত কখনো পরিষ্কার ঘর পছন্দ করে না
ভূত চায় বিছানায় তোমার পা ঠান্ডাই থাক

বাতাস যতটা নিঃসঙ্গ হয় জীবন তার চেয়ে
অনেক বেশি ফাঁকা হতে পারে

রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ফেরার পথে
তুমি একটা টিভি কিনে আনলে

ধপধপে সাদা একটা ঘরে উলঙ্গ এক মহিলা
চামচে ঢেলে কাফ সিরাপ খাচ্ছেন

টকটকে লাল কাফ সিরাপ

যেমন মৃত্যু নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোনো লেখক
জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখেন

জলের জাহাজ

ঘুমের মধ্যে বৃষ্টি হল তুমি জানতে পারলে না
একটা বিকেল তুমি এভাবেই কাটিয়ে দিলে

অথচ জলের জাহাজ তোমার ঘুমের মধ্যে ঢুকেছিল

স্বচ্ছ জাহাজভর্তি লবণাক্ত জল
চোখ আর মেঘের মধ্যে আকার নিচ্ছিল

রক্তে মিশে আছে নৌচালনা বিষয়ক সতর্কতা
রক্তে মিশে আছে জাহাজডুবির রাসায়নিক ধারণা

সমুদ্রকে এভাবে মোটেই হারানো যায় না

তোমার প্রিয় পুরুষকে তুমি কাগজের মতো
ভাঁজ করে রেখেছ

তার লাল টালির বাড়ি থেমে যাওয়া বৃষ্টিতে
কমলালেবুর খোসার মতো তেতো হয়ে আছে

মেঘের নীচের পৃথিবী

পথকে শক্ত করে ধরে রাখো যেন হারিয়ে না যায়
পাখিরাও ওড়ে কারণ তারা আকাশ ছাড়া বাঁচতে চায়

কালো মেঘের তলায় জলজমা ক্ষেতগুলো চকচক করছে

জল দিয়ে ঘেরা পৃথিবীতেই তোমাকে একটা
জীবন কাটাতে হবে

জল ভেঙে উঠে আসছে জন্মের আগের শূন্যতা
জল ভেঙে কেটে যাচ্ছে জন্মের পরের ফাঁকা স্বভাব

দিগন্ত থেকে হুহু করে ছুটে আসছে দমকা জোলো হাওয়া
তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে আরো বাঁচার জন্য

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

কৌশিক জোয়ারদার

পশুখামার-১

শকুন


মনের অর্ধেকটা নিয়েছে শেয়াল অর্ধেকটা শকুন
এখন আর সে মেয়ে নয়, মানুষও নয় আর
আপাদমস্তক মাংস পড়ে আছে প্লেটে
কাদের কুলের শেয়াল তুমি
লিঙ্গে শান দিচ্ছো কখন থেকে
ওদিকে অন্য দেশে অন্য শকুন বুঝি জিতে গেল
স্কোরবোর্ডে লেখা হলো তিন-দুই


বেশকিছু মানুষকে আপনি
শকুন হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবেন
মানুষেরা অনেকেই শেয়াল।
আসলে শকুন একটা ধারণামাত্র
যেমন এক নয় সব শেয়ালের রা
ফলে, শকুনের দলে হঠাৎ একজন
মানুষের দেখা পেয়ে গেলে
অবাক হবার কিছুই নেই

মুরগি

সকালবেলা দুটো ডিমসেদ্ধ খেয়েছি
মুরগির সম্ভাবনাও কী সুস্বাদু — আমি ভাবছিলাম
‘মুরগি’ শব্দটির দ্বারা আমরা মোরগকেও বুঝিয়ে থাকি
মোরগ ভোরবেলায় ডাকে
বাড়ির মালিক অথবা দিনকর, কে যে আগে
ঘুম থেকে ওঠে — আমি জানি না
পাশের বাড়ির ভাড়াটে অবশ্য জানে—
দিনের মধ্যে যখন তখন ডেকে উঠতে পারে মোরগ
দুপুরে ঘুমের ব্যাঘাত হলে
মোরগকে মুরগি করে ফেলতে ইচ্ছে করে—
মানে খেয়ে ফেলতে
মোরগের মাংসও আমরা খাই
কিন্তু মানুষ খেয়ে ফেললে আমরা বলি:
অমুককে মুরগি করা গেছে

গাধা

সব মাস্টারমশাইকেই আমার ধোপা মনে হতো
তারপর একদিন গাধাকে দেখেই বুঝেছি—
এ কিছুতেই ঘোড়া নয় জেব্রা নয় জিরাফ নয়
ইনিই হলেন সকাল বিকেল উচ্চারিত সেই পশু।
গাধাও জানে গাধাকে দেখাও অসহ্য ভার
তাই তারা পরস্পরের দিকে সরাসরি তাকায় না
তথাপি যতক্ষণ না আপনি বাড়ি ফিরে
আরেকজনের কানে চিৎকার ক’রে সঞ্চারিত করছেন—
“গাধা”, আপনার মুক্তি নেই
পৃথিবীর সকল মানুষ তাই দেখার আগেই
শুনে ফেলে— গাধা
গাধার জন্ম হয় তারপর ধোপার বাড়িতে

জেব্রা

পৃথিবীতে জেব্রার কোনো প্রভাব নেই
চিড়িয়াখানায় যে-দুয়েকবার তাকে দেখেছি—
দেহটি সুঠাম, স্মার্ট
সাদা-কালোয় চমৎকার রঙিন দেখতে সে
অথচ ঘোড়ার মতো রূপকথার গল্প হয়ে উঠতে পারেনি।
গাধা বলেও তাকে হেয় করে না অবশ্য কেউ
আজীবন ত্বকের গরাদের ভেতর বন্দী
অভুত এক ছায়াহীন নিরপেক্ষ প্রাণী।
তবে আমার কথা যদি বলো,
ব্যস্ত রাস্তার ওপারে তোমাকে দেখতে পেলে
সত্যি্ বলছি আমার ইচ্ছে করে
জেব্রা হয়ে শুয়ে পড়ি পথের উপর

গোরু

গোরু থাকে গোয়ালে
এখন তাকে যদি আপনি বনের রাজা হতে বলেন,
তাহলে সে কী করবে?
ল্যাজ তুলে কিছুটা গোবর থপাস করে মাটিতে।
গোবর থেকে ঘুঁটে হয়, ঘুঁটে থেকে জ্বালানি
গোরু দুধ দেয় গাড়ি টানে জমি চষে
সব ঠিক আছে, কিন্তু হলে কী হবে
গোরু তো আর বনের বাঘ নয় যে রাজা হবে
এক সকালের জলখাবারেই সে সাবার
কিন্তু এটাও ঠিক যে, বাঘের গায়ে এতটাই জোর
সেও হতে পারেনি ততটা বিতর্কিত

 

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

দেবজ্যোতি রায়

বাড়ি

দীর্ঘ ভ্রমণের পর রক্ত গড়াচ্ছে পা ফেটে
শরীরে বাতাস ঢুকে উড়ে গেল চৌহদ্দি, ঠিকানা।

এ পাড়ায় সব নেমপ্লেটই ঝাপসা
বাড়ির দরোজাগুলো একই ছুতোরের তৈরি!
সূর্যাস্ত রঙের বাড়ি শনাক্ত হলো না

বিস্মরণের ভেতর গৃহচেতনার আভাস পেয়েছি
খুঁজেছি যুবকবেলা, হারানো চোখের মৌতাতে
বাড়ির গঠন নিয়ে অলীক ধারণা।
সংসার ক্রমশ অশরীরী হয়ে উঠছে

রান্না হচ্ছে ফুলের পাপড়ি,
থালায় থালায় নীহারিকা আলো।
চলো, কুয়োর ভেতর খোঁজ করি
গৃহচ্যুত জীবনের ছেঁড়া অ্যালবাম

চালকবিহীন সাইকেল ছুটেছে দিগন্তপথে
তাকে জিজ্ঞাসা করি বাড়ির ঠিকানা!

চুল দাড়ি পাকছে, চোয়াল শিথিল হচ্ছে
সন্দেহ আরও তীব্র
একসময় নিজেই ঢুকে পড়ি সন্দেহ তালিকায়।
একখণ্ড আমি অন্য খন্ডকে সন্দেহ করে
এক টুকরো সাদা মেঘ সন্দেহ করে কালো টুকরোকে।

বাড়ির আপেক্ষিকতায় ভাসছে বাড়ি
ঘুঙুরের এক লহমা ধ্বনির মতো কম্পিত বর্তমান,
অতীত, সমুদ্রের জোয়ারভাটা
ভবিষ্যৎ, অন্তহীন চিৎসাঁতার।

মরণোত্তর

বুনোফল ফুটো ক’রে ঢুকেছে পোকা ও শূন্যতা

ফলের শরীর নিঃশেষ করতে চায় পোকা
শূন্যতা নিশ্বাস ফেলে
সারসের ঠোঁটে ভেসে আসে তিলক কামোদ

তুমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রেমে, রূপান্তরে।
প্রতিশ্রুতি ঘুরতে থাকে অ্যান্টিক্লকওয়াইজ
দূরে অরুন্ধতী আরও ম্লান

হারানো পথের রেখা রাত্রির আকাশে
আরেকটু উদাস হোক মন

টের পাওয়া যায় প্রতিশ্রুতির মধ্যে
বসে আছে পুরোনো ঘাতক
আত্মপক্ষ, মাংস, শোণিত ও ত্বক।

আশমানে ভাসছে বাকি কথাগুলো
কবে তোমাকে শোনাতে পারব?
আমার সব অবয়ব ভেঙে পড়ছে
দুই কানে শববাহকের পদধ্বনি

পান ও সুপুরি মুখে নিয়ে কথাগুলি
জেগে উঠতে চায় মরণোত্তর!

তুমিই পারদ, অধরাও তুমি

স্টেশন, বাজার, জনপদ ঘুরে দিনশেষে
বোবা ভিক্ষাপাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির প্রশ্নে বাটিটি সূচকমাত্র
চারপাশে বাজারের জলস্রোত, কলকোলাহল
উড়ালপুলের শীর্ষে, মন্দির চাতালে বাটি
বৃদ্ধ, পঙ্গু, জরাগ্রস্ত ভিখিরির হাতে হাতে ওড়ে।

চাল ও কাঁকর ছাড়া আর কোনো সঞ্চয়মাহাত্ম্য নেই
কয়েনের তালে তালে গাছে ফুল, ডালে পাখি
জলে মাছ, খেতে শস্যের হাওয়া।

বাটপাড় উৎসাহ হারায় চোরের ওপর
নিঃস্বতায় কোনো ফাঁকি নেই
এখন সমস্ত গান অরাজনৈতিক।

সৎকার সমিতির গাড়ি চড়ে আমরা বেড়াতে যাব
পকেটে রয়েছে মৃত্যুর সার্টিফিকেট।

স্বপ্নের ফাতনা কাঁপে। স্থির চোখ, আশ্রম আঙিনা।
অন্ধ দোহার মনে মনে দেখে—
জ্যোৎস্নায় স্নান করে বোবা হরিমতি

যুগলমূর্তির পরা ও অপরা
বাজারদরের মতো ওঠানামা করে
এক পাশে হরিমতি, জ্যোৎস্না, চরণমঞ্জীর
অন্যদিকে রাশি রাশি শূন্য থালা বাটি।

ফ্রেম

ফিরে এলাম স্টেশন থেকে বাড়ি
রেল-টিকিট উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল?
দরজা জুড়ে ঘুণের স্মৃতি আঁকা

ক্রুশকাঠের মরচে পড়া পেরেক
শরীরে গেঁথে দাঁড়িয়ে আছো, একা
চাবির গায়ে রক্তছাপগুলি…
কিছু শকুন পাক খাচ্ছে দূরে।

আমাকে ডাকে বেদনাহত শেকড়,
ছয়টি নদী, পদ্মফুলে ভ্রমর,
মনে পড়ছে? মহানিমের ছায়া
শিশিরভেজা ঘাসের আপ্যায়ন।

আকারহীন বাড়ির কার্নিশে
বালি, পাথর, ইটের শূন্যতা।
তোমার গানের দৈব স্বরলিপি
ভেসে যাচ্ছি, রোগা পাতার মতো

শালিক হাঁটে উঠোন জুড়ে পা
পেরিয়ে যায় ত্রিমাত্রিক ফ্রেম
ফিরে এলাম, বোবা দেয়াল বাড়ির
বিন্দু বিন্দু পিপাসা জমে আছে।

কীটাণুকীট

কুণ্ডলী পাকিয়ে আছ স্বপ্নে, আধখাওয়া ফলে :
সনাতন কীট ঢুকছি গরুর কানে, মৃতের শরীরে

দূর থেকে লক্ষ রাখে রাত্রিবর্ণ কাক—
কাকের ঐতিহ্য আমি কপালে ঠেকাই
আমার তিনকুল কাকের জঠরে বসে
অন্নজল গ্রহণ করেছে।

বায়ুভূত পরিচয় নিয়ে বন্ধুরাও আসে

যা চেয়েছি সবই কুণ্ডলিত,
সাপ ও কেঁচোর মধ্যে শরীর বদল হয়
বদলায় আধার, আধেয়।
সময়ের হতবাক প্রান্তে বসে ঝিমোয় গোরুর গাড়ি,
কালিমাখা লন্ঠনের আলো।

বুঝতে পারি না, তক্ষকের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল
নাকি, তোমাকে জড়িয়ে ধরছি রাক্ষসের হাতে!
তুমি সেই নিরাকার, অপরিবর্তিত
আকাশের রঙে ভাসমান

আমার বিভ্রম, রক্তের স্বাদ খোঁজে শেয়ালের জিভে,
দাবার চৌষট্টি খোপে বোড়ের ভূমিকা
থেকে সরে এসে
ষাঁড়ের অন্ডকোষে কান পেতে শোনে
আদি স্তব, ব্রহ্মকমলের।

Categories
কবিতা

নীলাঞ্জন দরিপা

অযুত পাগলামিপুঞ্জ


আমার দু-খানি দুঃখ, যদিও সদ্ভাব নেই, আমাকে নিস্তার দিতে তবু দু-জনেই
পথে নামে, ভিন্ন পথ, কিন্তু শেষে মিলে একই, কজনই-বা হতে পারে দুঃখ নিবারক
এখন দু-জনই থমকে, অনন্ত দু-হাত নিয়ে ম্যাজিক দেখায় মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ
কখন সংকেত দেবে সে-আশায় বসে থেকে এত বুদ্ধু ঘুণাক্ষরে চিনতেও পারে না
আমাকে অদ্ভুত বেশে। অতঃপর নিজেরাই হতোদ্যম হয়ে ধরে পরস্পরে হাত
দু-খানি বিচ্ছিন্ন দুঃখ, মুখদেখাদেখিটুকু ছিল না যাদের তারা একত্রে বাসায়
ফিরে এলে পাশবিক হাসি ছাড়ে ঠান্ডা হওয়া তড়কা-রুটির মতো ব্যাচেলর দিন


যা কিছু বলতাম, সব, অদ্ভুত বনজ শব্দে, তাই রেখে এসেছিলে গভীর বাদাড়ে
অথচ সে-ভাষা, ভাবো, জঙ্গলও বোঝেনি মোটে, আসল প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর ছায়া
আমার সময় জলে ও জঙ্গলে বইয়ে দিল, এ-সুযোগে শিখেছি সে ফ্যাল-ফ্যাল চোখ
বিচ্ছেদের পড়া ধরলে সেইভাবে চেয়ে থাকি যেন নষ্ট ছেলেবেলা চুটিয়ে ভুলেছি
বোবা বরফের ছন্দে এসব ঝঞ্ঝাট ভাষা ছুঁয়েও দেখবে না স্বভাবত
কারণ এখনও স্পর্শে নামে অন্ধকার সিঁড়ি, ক-ধাপ পেরোচ্ছি সে তো খেয়ালও থাকে না
অথচ আমাকে ত্রস্ত করে এ-অনুচ্চ স্বরে ফোটালে হঠাৎ কেন জান্তব আওয়াজ


বাঁ-হাতে স্বপ্নের ঘড়ি, সময় কেমন যাচ্ছে না জেনেই উড়ে এসে বসেছ ডায়ালে
খামোখা চকচক করছ, আমিও অভ্যেস বশে, কবজি তুলে দেখে নিচ্ছি আয়ু কতক্ষণ
ব্যাস, চোখে চোখ পড়ছে, সারাদিন কী অস্বস্তি, পাশে বন্ধু ঝাপটা দেয় যেন ধুয়ে ফেলবে এই অন্ধের কাজল
বেশি বয়সের মোহ, তোমাকে কীভাবে দেব, অযুত পাগলামিপুঞ্জ, সে তো কম বয়সের কাছে
না কাটা নেশার মতো সুসময়ে দুঃসময়ে মায়াবী খোরাক হয়ে আছে


তুমি তো জানোই আমি এই জল হাওয়া খেয়ে তবুও তোমায় সাজাব না
কখনো ঠগের শব্দে, যা বলার স্পষ্ট বলে যাব।
মাঝে মাঝে তবু জানি নিষ্ঠুর মায়ের মতো, রাতে
লুকিয়েছি কোনো এক নতুন পুরুষ বক্ষে, তোমার ধারণাটিকে মন্দির চাতালে
যখন এসেছি ফেলে, কান্নাকাটি তখনও থামেনি
ভেবেছি এই যে মোহ, কাম, লোভ এই মতে কাটাব জীবন
কিন্তু কী যে হয় কী যে ভয়ানক হয়ে যায় এখনও বুঝি না
চুলের কাঁটাটি তার হৃদয়ে আমূল গেঁথে বিছানায় ফেলে আসি রক্তমাখা লাশ
তোমাকে জুটিয়ে কোলে তবে শান্তি, জেগে ওঠো দুধের কান্নায়
তোমাকে বাজারে আমি বিখ্যাত করব না প্রিয় প্রতারক উচ্চারণে, নির্বোধ তারিফে
অর্ধযৌনসুখী এই স্তন ধরব ওই মুখে, সপাট ভাষায়


এমন অদ্ভুত ছায়া দিলে আর যাওয়াই হল না
রোদের বিস্তারে কোনোদিন। পুরোনো ছবির মতো সাদা সাদা দাগ নিয়ে
দুর্বিপাকে কারো হাতে আসি, এ-পাতা ও-পাতা ঘুরে
নিঃশব্দ দ্বিপ্রহরে মাকে ডেকে যে ফোটায় পৃথিবীর আশ্চর্য জিজ্ঞাসা
একদিন আমিও কি অমন সরল প্রশ্নে থরোথরো বুকে
চৈত্রের রোদ্দুর ভেঙে তোমাকে ডাকিনি


কী থাকে বলার? এত সামান্য কারণে যদি না হও কাতর
এই অভিযোগে মাথা নীচু করি, দেখি কত যত্ন আয়োজন
তোমার আঙুল থেকে ঝরে ঝরে পড়ে, কত শুশ্রূষা শব্দের
না শোনা হুল্লোড় জড়ো করে আছ নিভন্ত অধরে
অপচয়ে ব্যথা জাগে, ভাব ভুল, ভাব ফের অল্পেই জেগেছে
তাই চুপ, তাই সরে আসি
করুণা বিবর্ণ আজ, তোমাকে মলিন করব, সে-সাহসও নেই


যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে বলে দুঃখ হয় তার কাছে বসি
বয়ঃসন্ধির দুঃখ; সহজে ভাঙে না
রিফুর সূচের মতো ঢুকে পড়ি ছিঁড়ে যাওয়া বোতামের ঘরে
দেখি আজও বিপন্মুক্ত, রোমাঞ্চ চেনেনি। শুধু বুকের পকেট
এখনও হাতের লেখা আছড়ে ফেলে বুকের ভেতরে
ভাঁজে ভাঁজে কেটে গেছে, সেসব অক্ষর টুকরো নিয়ে
এত যে নষ্টামো, সব এক জন্মে শোধ তুলে নেবে
যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে তাকে চেনাব না দেহের সৌষ্ঠব


আসলে সাহস নেই, নইলে কি কবিতা লিখতাম
নইলে তো তল্লাট হত লণ্ডভণ্ড, কবিতাসদৃশ আমাকেই লেখা হত
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতো নয়া মহল্লায়, রকে, সভাঘরগুলি
কেঁপে উঠতো স্পর্ধা দেখে, ভাষার দৌরাত্ম্যে কেউ উচ্চারণে সাহস পেত না
আসলে আশঙ্কা, ভয়— কিছু নেই, তাই এত মলিন শব্দেও পারি ভালোবাসা লিখে
নিরীহ অক্ষরবৃত্তে, তোমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যেতে


বহুব্যবহারে, জানি, ক্ষয়ে যাবে মুগ্ধদিন, তবু এ-অস্পষ্ট শ্লোকে সন্দেহের চোখ
তখনও অটুট রাখবে, মেপে নেবে দু-হাতে ঝাঁকিয়ে
জীবনে রহস্যকথা কম নয়, তারও বেশি হতচ্ছাড়া ভাষার প্রশ্রয়
আমি তো লিখিনি বজ্র লিখিনি তো হারে-রেরে-রেরে
আমার সমস্ত কথা মাটির অতীতে সিঁদ কেটে
রেখে আসে কুলুঙ্গীতে পুরোনো বানানরীতি, আমাদের কথার অভ্যেস

১০
তোমাকে বলার জন্য যথাযথ শব্দ খুঁজে ফুরিয়ে ফেলেছি এই প্রিয় শীত, বাংলা ভাষার
অদৃষ্ট তামাশা জানে। এখন উথলে ওঠা বসন্তের ঠোঁটে
অযাচিত বাঙ্ময় করেছে
তুমি তো দূরেই ছিলে, এ-সুযোগে তোমার দুঃখও
মোহ-লালসার দিনে চুপিচুপি সরে গেছে উত্তর না পাওয়া সেই বন্ধুটির মতো
এখন নকল হাতে কীভাবে সাক্ষর রাখি বেহায়া ঋতুতে

১১
বদলি হওয়া প্রতিবেশী চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে
সিঁড়িঘরে সেই সবে কান্না ধরে এসেছে তখন
সন্ধে হব হব রং গালে এসে পড়ে
খুলেছে আলোর গুমটি এতক্ষণে মফস্সল জুড়ে,
সার সার আড্ডা চিরে দিয়ে
ও সাদা এম্বাস্যাডার কেন আসে,
                        কেন-বা কাঁদায়
উনিশশো নব্বই, আমি তোমার কিশোরীটিকে পড়াতে পারব না জানি
আমার কবিতা, তাই দুঃখ হয়, আলোর গুমটি খুঁজে ফিরি
আমাকে ফিরিয়ে দাও তার চোখ, সিঁড়িঘর, পবিত্র কান্নাটি

Categories
কবিতা

দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত

গুসবাম্পস

বাইরের আঘাত চিনিয়েছে ব্যথা কাকে বলে।

ছাপ রেখে গ্যাছে আদর।

বার বার ওদের কাছে ফুরিয়ে দিয়েছ নিজেকে।

অথচ কেউ ভিতর থেকে বুঝিয়েছে—
তোমার অস্তিত্ব শরীরের থেকে একচুল বেশি,
যাকে তুমিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না।

বারান্দা

প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে গড়া শরীরগৃহ।

হাত থেকে চোখ, চোখ থেকে ঠোঁটে অবাধ বিচরণ।

মনোরঞ্জন!

অবহেলিত উত্তরের বারান্দায় উদাসীন টান।

অতিথি আপ্যায়নে জ্বলে ওঠে আলো।
আর প্রত্যাবর্তনে,
মাংসল মেঝেতে এসে পড়ে হাড়ের নকশাখচিত জ্যোৎস্না-রোদ।

বোধ

সমস্ত ছেড়ে আসার থেকে চালাক হয়েছি।
যেখানে রয়েছি, তার থেকে বোকা।
দুয়ের মাঝখানে যা যা ঘটছে, সব বুঝতে পারছি।
স্রেফ এক কথায় প্রকাশ করার শব্দ পাচ্ছি না বলে,
কিছু সমাধান করা যাচ্ছে না।
প্রগাঢ় সমস্যা ফ্রেমে ধরে রেখেছে সময়।
আর তীক্ষ্ণ পেরেকের মতো খুচরো বিপত্তি,
রক্ত ঝরিয়ে গড়ে তুলছে তাকে।

ওষুধ

স্ট্র্যাপ খোলা জন্ম আমাদের।
বিস্বাদ মেখে দিনের পর দিন বসে থাকি একটা রোগের অপেক্ষায়।

পৃথিবীর ঠোঁট অবধি পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেড়ে গ্যাছে বয়স।

মৃত্যুর মুখে পিছনে ধেয়ে আসা অশ্রুস্রোত,
আমাদের নিয়ে যায় লক্ষ্যের কাছাকাছি।

অথচ সব ঠিক হয়ে গেলে অবাক চোখে দেখি—
স্বাদে, গন্ধে, রঙে না জড়িয়েও
সবসময় পাশে থেকে জল কীভাবে জীবন হয়ে ওঠে!

আরশিবয়স

কনফিউসড্ কৈশোর ও ফ্রাসট্রেটেড যৌবন,
দুটো ভোলাপচুয়াস কুকুরের মতো শৈশব নিয়ে টানাটানি করে।

সংখ্যার দিকবদল ব্যস্তানুপাত।

কাচের গুঁড়ো, সময়ের বালি
ঘড়ির কাঁটা, কাঁটার তার।
তারে মেলা কাপড় কাপড় সাল।

ভাঁজে ভাঁজে নতুন বালক বইয়ে মলাট দ্যায় মা।

 

Categories
কবিতা

তৈমুর খান

ভিখিরি

দুর্বোধ্যের দুয়ারে
আমার হেমন্তকাল ও আমি
নতুন ধানের ঘ্রাণ
শিশিরের ভেজানো আবেশ মেখে
দাঁড়ালাম

তোমার মুখের দিকে
কোন সূর্য চেয়ে আছে
আজ?

সেই তো হলুদ শাড়ি
গোলাপি কাঁচুলি
রজনীগন্ধার মতো ফিকে সাদা চুড়ি
বেজে ওঠে

ভাষা নেই আমার
আজও কিংবদন্তির পাড়ায়
আমি নৈঃশব্দ্যের ভিখিরি

আনন্দের খোঁজে

আনন্দরা কোথায় গেল?
ঘরদোর ফাঁকা পড়ে আছে
শোকেসে সাজানো আছে পুতুল
রঙিন বেলুন আর খেলনাপাতি
শেল্ফে সব বইগুলি গোছানো আছে
ওয়াল হুকে ঝুলছে পুরোনো শার্ট
জানালার কাচে জমে আছে ধুলো
ধুলোয় আঙুলের অজস্র দাগ…

সূর্য রোদ গুটিয়ে নিচ্ছে এখন
গোধূলির আবিররাঙা মেঘে
নীরবে ঝরে পড়ছে দিন বিদায়ের সুর

কাঠের চাকা লাগানো গোরুর গাড়িটি
এখন এখানে আর নেই
ধানমাড়া খড়গুলিও এখানে রাখে না কেউ
বিকেলের শীতে রোদপোহানো মানুষ বসে না এসে
গল্পগুলি সব হারিয়ে গেছে
দু-টান বিড়ি খেয়ে যেত তারা আগে…

আনন্দরা তখন ফিরে আসত রোজ
ধান সর্ষে গম অথবা ইক্ষুক্ষেত থেকে
আনন্দদের ছেলেমেয়েরা শিস দিত
পায়রা নামত হাঁস-মুরগির ভিড়ে

অবেলায় কালিমাখা ধানসেদ্ধ হাতে
আনন্দরা ভাত খেত একসাথে বসে
কুটুমেরা আসত দূর দূর থেকে
ধুলোমাখা পা ধুয়ে উঠে বসত খাটে

কখনো ভোর হত মুড়ি ভাজা ঘ্রাণে
কখনো খেজুর রসে জমত পাটালি
কখনো শুকনো মাছ আর পুঁইশাকে
রান্না হলে চেয়ে নিয়ে যেত প্রতিবেশী

আনন্দরা খড় বিছিয়ে তালাই পেতে
দিব্যি ঘুমাত শীতের রাতে
শিয়ালের ডাকে পার হত রাত
আনন্দরা স্বপ্ন পুষে ঘুমে কুপোকাত

আজ একা ফিরছি শুধু ওদের ডেকে ডেকে
কেউ আর জল তোলে না শান্ত দিঘির ঘাটে
কেউ আর সাঁতার কাটে না স্নানে এসে
শালুক ফুল তোলে নাকো প্রথম ভালোবেসে

আনন্দরা কোথায় গেল?
এক খাবলা মাটি তুলে শুঁকে শুঁকে দেখি
স্নেহের পরশ লেগে আছে
ঝরে পড়া শুকনো ঘাম আর ধুলো
হেঁটে যাওয়া খালি পায়ে…
হয়তো আর বাজে না বেল পুরোনো সাইকেলে!

একটি নিজস্ব কবিতা

তোমার কাজের মধ্যে আছি
তোমার আলোর মধ্যে আছি
আমার ক্ষতগুলি শুধু উপশম খোঁজে
বাইরের ভিড়ে যেতে চায় না কেউ আর
অনেক নষ্টের পর যেটুকু বেঁচে আছি
হৃদয় তাতেই বাঁধে ঘর

হয়তো বসন্ত নেই তবু তো কোথাও ঘ্রাণ আছে
স্মৃতির আয়নার পাশে হলুদ ডানার প্রজাপতি
শব্দে শব্দে গুঞ্জন ওঠে
চাক গড়ে উপলব্ধির মৌমাছি

মুখ দেখে নিই একান্ত নিজস্ব মুখখানি
হেসে ওঠো, যে-হাসি ভোরের দৃশ্যে মিশে যায়
শরতের নিভৃত উল্লাসে নীলাকাশ হয়
তোমাকেই খুঁজে খুঁজে পাই কাকলি-কূজনে

নিজেকে দেখেছি এবার

অসুখ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছি
দ্রুত মোটরগুলি চলে যাচ্ছে
পতাকা নেই আমার
হে মানুষ, পতাকা নেই!

ঘৃণার জলে ভিজতে ভিজতে
একটাও চালা নেই
সাইকেল নির্ভর জীবন
খণ্ডেৎ ত বিহীন বলে
উৎসব এল না আর

দূরের নকশা দেখে দেখে
কত পদ্ম ফুটল
চৈতন্য জাগল কলরবে
হাওয়ায় উড়ল সিংহাসন

একটা ভ্রমরের পেছনে পেছনে মধু সংগ্রহের উড়ান শুধু আর কিছু নয়

সংশয়

সংশয় একজন বালক বলে
ওকেও মাঝে মাঝে ভিরু মনে হয়
ব্রিজের উপর দিয়ে আমাদের গাড়িটি ছুটছে
ব্রিজও ছুটছে না তো?

আমরা ঝুলে আছি অনন্ত গভীরে
এখানে ভাঙা আকাশের টুকরো আর নিসর্গের নাভি স্বয়ংক্রিয় মায়াবী নিশীথ পড়ে আছে

যেতে যেতে ভাবনারা নড়ে উঠছে
ক্রমশ যেতে যেতে কেঁপে উঠছে আলো
সংশয় কিছুই বোঝে না—

ঝুলন্ত মহুল বনেও নিশ্চুপ কোকিল
টুপটাপ ঝরছে তার শৈল্পিক হৃদয়…

প্রস্তুতি

তোমার আঁচলে কত নক্ষত্র ফুটেছে
বিচিত্র আলোর ঝিকিমিকি
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি!

ওখানে হৃদয় রাখব তোমার আলোয়
ওখানেই রেখে দেব আমার বাঁশির সুর
ওখানে কখনো হবে না অন্ধকার!

শুধু রাত্রির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা যায়?
মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে জীবনের আয়ু হল ক্ষয়
অন্ধকারে নিজেকেও বিশ্বাসঘাতক মনে হয়

সারারাত যদিও জেগে থাকি
সারারাত যদিও নক্ষত্রফুল কুড়াই
তবু এক উজ্জীবনের ডাক আসে শুনি

দীর্ঘশ্বাসগুলি লুকিয়ে ফেলি
আর তৃষ্ণাগুলি অস্বীকার করি
গভীর নির্জনে একা চুপি চুপি যাই…

এই জন্ম

যে-শব্দ গান হয়নি
আমি সে-শব্দের কাছে যাইনি কোনোদিন;
যে-মেঘ বৃষ্টি দেয়নি
আমি কি সেই মেঘের কাছে গেছি?
আমার শস্যের খেতে শব্দ আর গান
আমার মাথার ওপর মেঘ আর বৃষ্টির সম্মোহন।

এই জন্ম শুধুই বাঁশি
এ-জীবন শুধুই ভেজা ভেজা অভিমান

দুপুর বিকেল হয়ে আসে
বিকেল রাত্রির ডাক পায়—
গেরুয়া আলোর পথে নামে রাঙাচেলি
রাত্রিতে হেসে উঠবে অদ্ভুত জ্যোৎস্নায়!

বিশ্বাসের ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
অলৌকিক সমুদ্রের নৌকাগুলি ছেড়ে যায়
একে একে সমস্ত নাবিকেরা সাদা পোশাক পরে
আমিও ধূসর গন্ধ মুছে ফেলি মনে মনে

উপলব্ধির সব জানালায়
আমার আসক্তি তীব্র হলে
আবার আবার মেঘ জমে
শব্দেরা গান হয়ে ফেরে।

পাটনি কথিত

ওগো নদী, আমি চলে যাচ্ছি
আর ফিরব না কোনোদিন
আমার নৌকা ভাসিয়ে দিলাম

এখন আমি বিপন্ন স্মৃতির ভেতর
বানিয়ে নিয়েছি ঘরবাড়ি
এখন কান্নার জলের পুকুরে স্নান সারি

বহুদিন দেবী আসে না আর
গাড়ি চেপে চলে যাচ্ছে সব দেবী
সেতুর বাঁধনে বন্দি সব নদী সভ্যতার

কার স্পর্শে কে-বা সোনা হয়
কার বরে কাদের সন্তান দুধ-ভাত খায়
কিছুরই হিসেব জানা নেই তার

শুধু পতাকা উড়ছে চারিদিকে
হানাহানি আর কুৎসার গানে হাততালি
সব রাস্তা জুড়ে নেমেছে বাহিনী

এই পথে কবে আসবে আবার
আমাদের নবজন্মের বিদ্যা ও সুন্দর?
ছেঁড়া অন্নদামঙ্গল হাতে দাঁড়িয়ে আছে রায়গুণাকর!