Categories
2021-June-Translation অনুবাদ

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

ভাষান্তর: অগ্নি রায়

লাতিন আমেরিকার নিঃসঙ্গতা

ফ্লোরেন্সের নাবিক আন্তোনিও পিগাফেত্তা, বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন ম্যাগেলানকে সঙ্গে নিয়ে। আমেরিকার দক্ষিণ ভাগের যাত্রার সেই বিবরণ তিনি লিখে রেখে গিয়েছেন। সেই ভ্রমণকথা একদিকে যেমন খুঁটিনাটি তথ্যে ভরা, অন্য দিকে কল্প-অভিযানের মতোই মুচমুচে তার স্বাদ। ওই বিবরণে তিনি লিখেছেন এক বিচিত্রদর্শন বরাহের কাহিনি! যার নাভি নাকি ছিল পশ্চাদদেশে! লিখেছেন নখহীন পাখি, জিভহীন পেলিক্যানদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কথা। এক আশ্চর্জন্তুর কথাও বলা হচ্ছে, যার মাথা এবং কান খচ্চরের মতন, ধড়টা উটের, পাগুলো হরিণের! পাটাগোনিয়ায় এক আদিবাসীর সঙ্গে সংঘাতের বিবরণ রয়েছে ওই দলিলে। শুধুমাত্র একটা আয়না সামনে ধরে যার আক্রমণ রুখে দেওয়া গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে জ্ঞান হারায় সেই দানবের মতো চেহারার আদিবাসী সর্দার।

ওই সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার বইটিতে এক আধুনিক উপন্যাসের বীজ সুপ্ত। সেই সময়ের সংগ্রামী বাস্তবের সে এক দলিলও বটে। আমাদের কাছে যা মায়ারাজ্য, সেই এল ডোরাডোর কথাও রয়েছে তাঁর বইতে। ওই এল ডোরাডো, মানচিত্রে বার বার নিজের জায়গা পালটেছে সমসাময়িক ভৌগলিকদের আন্দাজ ও কল্পনার সঙ্গে তাল রেখে। উত্তর মেক্সিকোয় আট বছর বিফল মনোরথ এক অভিযান চালিয়েছিলেন আলভার নুনেজ কাবেজা ডি ভাকা। তাঁর ছ-শো সঙ্গীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন প্রাণ হাতে ফিরতে পেরেছিলেন। ওই সময়কালীন বহু রহস্যময় কল্পকাহিনির মধ্যে একটি সেই প্রখ্যাত এগারো হাজার খচ্চরের গপ্পো।

স্প্যানিশ আধিপত্য থেকে আমরা আজ মুক্ত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেই উন্মাদ মনোজগৎ থেকে কত দূরেই-বা যেতে পেরেছি! মেক্সিকোর স্বৈরতন্ত্রী নায়ক জেনারেল আন্তোনিও লেপেজ ড সান্তা জাঁকজমক করে তাঁর ডান পায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিলেন! সে-সময়কার প্যাস্ট্রির যুদ্ধে যা খোওয়া গিয়েছিল। টানা ষোলো বছর ইকুয়েডরের শাসক ছিলেন জেনারেল গ্যার্বিয়াল গার্সিয়া মোরেনা। তিনি ঘুম থেকে ওঠার সময় তাঁর চারপাশের প্রেসিডেন্সিয়াল চেয়ারগুলোতে শবদেহ বসানো থাকত ইউনিফর্ম এবং মেডেল-সহ।

চিলি নিবাসী পাবলো নেরুদা, যিনি আমাদের সময়ের এক অনন্য কবি, এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর শব্দমায়ায় শ্রোতাদের প্রণোদিত করে গিয়েছেন এগারো বছর আগে। সেই থেকে ইউরোপের মানুষ আরও বেশি করে শিহরিত হচ্ছে লাতিন আমেরিকার অলৌকিক স্পন্দনে। এখানকার নারী ইতিহাসসিদ্ধা এবং তাড়া খাওয়ায় অভ্যস্ত পুরুষের মাথা না ঝোঁকানোর স্পর্ধা আজ কিংবদন্তীতে পরিণত। ক্ষণিক বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশও ছিল না আমাদের। একবার এক অসমসাহসী প্রেসিডেন্ট জ্বলন্ত প্রাসাদে আটকে পড়েও একলা বিপক্ষ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান, যতক্ষণ তাঁর প্রাণ ছিল। দু-টি রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ যার কূলকিনারা করা আজও সম্ভব হয়নি। ওই দুর্ঘটনায় মারা যান এক মহাত্মা প্রেসিডেন্ট এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়াই করা এক সেনাও। এর পর পাঁচ পাঁচটি যুদ্ধ, সতেরোটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর উঠে আসে এক নিষ্ঠুর নির্দয় স্বৈরতন্ত্রী, যে প্রথমবারের মতো আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় জাতিদাঙ্গা ও গণহত্যার বীজ। বিশ লক্ষ শিশুর মৃত্যু ঘটে। আর্জেন্টিনার কারাগারে বলপূর্বক কয়েদ করা হয় গর্ভবতী মহিলাদের। সেখানে ভূমিষ্ঠ হয় সন্তানেরা। সামরিক শাসকের নির্দেশে তাদের পাঠানো হয় অনাথাশ্রমে। কাউকে কাউকে দত্তকও নেওয়া হয়। নির্যাতনের প্রকোপে স্রেফ মুছে যান দু-লাখ মানুষ। তাঁদের অপরাধ ছিল একটাই— তাঁরা সমাজ বদল করতে চেয়েছিলেন। এইসবের জেরে লাতিন আমেরিকার তিনটি ছোটো এবং বর্ণময় রাষ্ট্র নিকারাগুয়া, এল সালভাদোর এবং গোয়াতেমালা থেকেই উদ্বাস্তু হতে হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

আতিথ্যের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে যে-রাষ্ট্রের, সেই চিলি থেকে পালিয়ে গিয়েছেন দশ লাখ মানুষ। দেশের মোট জনসংখ্যার যা প্রায দশ শতাংশ। মহাদেশের সবচেয়ে সভ্য দেশ হিসাবে যার খ্যাতি সেই পঁচিশ লাখ মানুষের ছোট্ট দেশ উরুগুয়ে। সেখানেও প্রতি পাঁচ নাগরিকের মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি নির্বাসিত! ১৯৭৯ সালের পর থেকে এল সালভাদোর-এর গৃহযুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছেন প্রতি কুড়ি মিনিটে একজন। লাতিন আমেরিকার এই বিপুল সংখ্যক নির্বাসিত ও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে একত্র করলে তা হয়তো নরওয়ের জনসংখ্যার চেয়ে বেশিই হবে।

আজ এটা আমি ভেবে নিতেই পারি শুধুমাত্র সাহিত্যগুণের জন্য নয়, এখানকার বাস্তবতার বেঢপ সাইজ সুইডিশ আকাদেমির নজর কেড়েছে। এই বাস্তব শুধুমাত্র কাগুজে নয়। এই বাস্তবতা আমাদের ভিতরে লালিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যহের অসংখ্য মৃত্যু দিয়ে যা তৈরি। কখনোই তৃপ্ত না হওয়া সৃজনের আঁচকে যা লালন করেছে। বিষাদ এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত, ভবঘুরে এবং স্মৃতিমেদুর কলম্বিয়ার নাগরিককে মনোনয়ন করা হয়েছে নেহাতই ভাগ্যক্রমে। যেখানকার কবি এবং ভিক্ষুক, সংগীতকার এবং সন্ন্যাসী, সেনা এবং বাউণ্ডুলে— সকলেই এবং প্রত্যেকেই এখানকার এক অন্য বাস্তবের কুশিলব। আমাদের জীবনকে সব্বার বোধগম্য করে তোলার মতো প্রথামাফিক মালমশলার বড়োই অভাব আসলে। বন্ধুগণ সেটাই আমাদের নিঃসঙ্গতার মোদ্দা কথা।

আমাদের সংকটের ইটপাথরগুলোই আমাদের ঘিরে দেওয়াল রচনা করেছে। পৃথিবীর এই অংশের মানুষ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চশমা পরে উপায় খুঁজে পান না, আমাদের বুঝে ওঠার। খুবই স্বাভাবিক যে, তাঁরা নিজেদের যে-বাটখারায় বিচার করেন, সেই একই বাটখারা ব্যবহার করেন আমাদের মাপতেও। সব সংঘাত যে এক নয়, সেটা তাঁরা বিস্মৃত হন। আমাদের নিজস্ব শিকড়ের সন্ধানের যাত্রা যতটা রক্তাক্ত এবং এবং ঝঞ্ঝাময়, তা ওদের থেকে কিছু কম নয়। কিন্তু আমাদের নিজস্ব নয়, এমনই কোনো নকশায় আমাদের জীবনকে ধরতে চাওয়ার সেই চেষ্টা, আমাদের ক্রমশ আরও নির্জন, আরও অজ্ঞাত এবং পরাধীন করে তোলে। বরং ইউরোপ যদি তাদের নিজের অতীত ছেনে আমাদের বুঝতে চেষ্টা করে তাহলে তা অনেকটাই যাথার্থ পাবে। লন্ডন শহরের প্রথম দেওয়ালটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল তিনশো বছর। আরও তিনশো বছর চলে যায় শহরের প্রথম বিশপকে বেছে নিতে।

তিপান্ন বছর আগে এই মঞ্চেই টমাস মান তাঁর লেখা উপন্যাস টোনিও ক্রোগার থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আশা জাগিয়েছিলেন, সংযমী উত্তর একদিন আবেগময় দক্ষিণের সঙ্গে করমর্দন করবে। এই তত্ত্বে আমার আস্থা ছিল না। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করি যে, ইউরোপে যে-সব মানুষের দৃষ্ট স্বচ্ছ আজও তাঁদের লাগাতার উদ্যোগ, আমাদের সাহায্য করতে সক্ষম। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁদের দেখার চোখ বদলাতে হবে। শুধুমাত্র আমাদের স্বপ্নের প্রতি তাঁদের মমতা থাকলেই যে, আমাদের নিঃসঙ্গতা ধুয়ে যাবে, ব্যাপারটা তো এমন নয়। বিশ্বের বন্টনে সমস্ত মানুষের জীবন যাপন করার যে-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তাকে যদি হাতে কলমে সাহায্য না করা হয়, তাহলে কোনো বদল আসবে না।

নিজস্ব ধ্যানধারণাকে গচ্ছিত রেখে লাতিন আমেরিকা কারো দাবার বোড়ে হয়ে থাকতে চায়নি। এমনটা চাওয়ার কোনো কারণও নেই। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় তার অভিযান এবং মৌলিক বোধ পশ্চিমের চাওয়া পাওয়ার ছকে পর্যবসিত এটা ভাবা মূর্খামি। নৌ পরিবহনের সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার ভৌগলিক দূরত্ব কম হয়েছে এটা ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব কিন্তু ক্রমশ বেড়েই গিয়েছে। সাহিত্যে ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিকত্বকে সহজেই স্বীকৃতি দিয়েও, সমাজ বদলের প্রশ্নে আমাদের কঠিন প্রয়াসকে কেন গ্রাহ্য করা হবে না। নিজেদের দেশগুলির সামাজিক ন্যায় প্রবর্তনের যে-লক্ষ্য রয়েছে প্রগতিশীল ইউরোপিয়ানদের, তা কেন লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও প্রবর্তিত হবে না। সেই লক্ষ্য পূরণের কৌশল ভিন্ন হতে পারে, কারণ, পরিবেশ ভিন্ন। আমাদের ইতিহাসের অপরিমেয় হিংসা এবং বেদনার কারণ হল যুগবাহিত অসাম্য এবং তিক্ততা, যা এখনও বজায় রয়েছে। আমাদের ঘর থেকে তিন হাজার মাইল দূরের কোনো ষড়যন্ত্রকের ফলশ্রুতি নয় তা। ইউরোপের বহু নেতা এবং চিন্তাবিদ কিন্তু এমন ভুলটাই করেছেন। নিজেদের যৌবনের সক্রিয় আন্দোলনকে ভুলে মেরে দিয়ে এইসব বৃদ্ধেরা বালখিল্যের মতো ভেবেছেন, বিশ্বের দুই মহাশক্তির দয়ার হাতে নিজেদের ছেড়ে দেওয়ার বাইরে কোনো কিছু করার নেই। প্রিয়বরেষু, এটাই আমাদের নিঃসঙ্গতার মূল কথা।

এ-সব সত্ত্বে নিপীড়ন, লুঠপাট এবং একঘরে করে দেওয়ার সতত চেষ্টার মধ্যেও আমরা জীবনের ডাকে বার বার সাড়া দিয়েছি. বন্যা অথবা প্লেগ, দুর্ভিক্ষ অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এমনকী শতকের পর শতক ধরে চলা যুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছে মৃত্যুর কাছে জীবনকে হারিয়ে দিতে। প্রতি বছর মৃত্যুর তুলনায় থেকে জন্মের সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি বেশি। জন্মের হার দরিদ্র দেশগুলিতেই বেশি, লাতিন আমেরিকার দেশগুলিও যার মধ্যে পড়ে। অন্য দিকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলি এমন ধ্বংসাত্মক শক্তি করায়ত্ত করতে পেরেছে যা গোটা বিশ্বের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য, আগের তুলনায় একশোগুণ শক্তিশালীই শুধু নয়, এই গ্রহের সমস্ত জীবিত সত্তাকে নিকেশ করে দেওয়ার জন্য তা আগের তুলনায় অধিক ক্ষমতা নিয়ে হাজির।

আজকের মতনই একটি দিনে আমার শিক্ষক উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, “মানুষ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মানতে রাজি নই।” ছত্রিশ বছর আগে কোনো মহাকায় ট্র্যাজেডিকে তিনি কেন মেনে নিতে চাননি, কেন তা অস্বীকার করেছিলেন, তা যদি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি, কেবলমাত্র তাহলেই আজ এই মঞ্চে দাঁড়ানোর যোগ্যতা আমাতে বর্তাবে। সভ্যতার ইতিহাসে ওই ট্র্যাজেডি আজ বিজ্ঞানের এক সহজ সম্ভাবনা মাত্র। মানবজাতি চিরকাল যাকে কল্পকাহিনি ভেবে এসেছে, আজ সেই অভূতপূর্ব বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে মনে সমান্তরাল এক বিশ্বাস ও কল্পকাহিনি তৈরি করার অধিকারও কিন্তু তৈরি হয়েছে। এখনও দেরি হয়ে যায়নি। সে এক নতুন এবং সর্বগ্রাসী এক ইউটোপিয়া, যা জীবনের কথা বলবে। যেখানে কেউ অন্যের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করবে না। যেখানে ভালোবাসাই একমাত্র সত্য হয়ে উঠবে। আনন্দের দিনরাত বোনা সম্ভব হবে। যে-জাতি একশো বছরের নিঃসঙ্গতার অভিশাপ ভোগ করেছে, তারা শাশ্বতকালের জন্য পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়

জাপানি কবিতার কয়েকটি ফর্ম

হাইকু
(Haiku)

ধ্রুপদী জাপানি কবিতা হাইকু।

তিনটি পর্বে রচিত এই কবিতা, পর্বগুলির মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ৫, ৭ ও ৫ (মোট ১৭) ‘অন’। অন হল জাপানি ধ্বনি-একক, Mora বা ‘কলা’-র সমতুল্য।

জাপানে পরম্পরাগতভাবে একটি উল্লম্ব পঙ্ক্তিতে হাইকু লেখার রীতিই স্বীকৃত। ইংরেজি ও অন্য ভাষায় তিন লাইনের হাইকু লেখার চল দেখা যায়, মাত্রাগণনায় কলা-র বদলে কেউ কেউ ব্যবহার করেন ৫-৭-৫ ‘দল’ (Syllable)।

কোনো দৃশ্য, যা আমাদের চেতনায় মূহূর্তে উদ্ভাসিত করে সত্যকে, প্রণোদিত করে হাইকুকে। হাইকু-মুহূর্তই এই হ্রস্বকবিতার প্রাণ, স্বল্প উচারণে প্রকৃতির দু-টি ছবির কাব্যিক প্রকাশে তা ফুটে ওঠে। ছবিদুটো জোড়া থাকে ‘কিরেজি’ দিয়ে; কিরেজিকে বলা যায় ছেদশব্দ, তা ছবিদুটোর ভেতর সমান্তরাল-ভাব বা জাক্সটাপজিশন তৈরি করে। হাইকুর অপরিহার্য অংশ হল কিরেজি; আর একটি ‘কিগো’। কিগো হল ঋতু-সম্পর্কিত শব্দ, যা নেওয়া হয় ‘সাইজিকি’ বা কিগো-অভিধান থেকে।হাইকুতে একটি কিগো থাকবেই।

হাইকুতে সাধারণত থাকে না কোনো মানুষের কথা, মানবিক ক্রিয়াকর্মের বিষয়। পরম্পরাগত জাপানি হাইকুতে থাকে না কোনো যতিচিহ্ন, অন্ত্যমিল, রূপক, চিত্রকল্প বা অন্য কোনো অলংকার। শুধু প্রকৃতির দু-টি ছবি আর তাদের অন্তর্গত অভিঘাতে জন্ম-নেওয়া বোধ— এই হল হাইকু।

হাইকু তাই ঋতুর কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, মুহূর্তের কবিতা, সত্যের কবিতা। জেন ধর্মবিশ্বাস ও যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এর। গুরুত্বপূর্ণ হাইকুকাররা এই ধর্মাবলম্বী।

জাপানি কবিতা ‘রেঙ্গা’-র প্রারম্ভিক স্তবক ‘হোক্কু’-র থেকে এর জন্ম। মাসাওকা সিকি (১৮৬৭খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) এই আঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন। মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ), ইয়োসা বুসান (১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ), কোবায়াসি ইসা (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ) ও সিকি-কে শ্রেষ্ঠ হাইকুকার হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকু লিখেছেন অজস্র কবি, লেখা হয়েছে অসংখ্য তিন-পর্বের আলোকিত শব্দসুষমা।

আমাদের সঙ্গে এই আঙ্গিকের পরিচয় করান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ)। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাপান ভ্রমণকালে তিনি এর সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং ‘জাপানযাত্রী’ (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে এর সম্পর্কে লেখেন, সঙ্গে বাসোর দু-টি হাইকুর অনুবাদ:

পুরোনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ,
জলের শব্দ।

এবং

পচা ডাল,
একটা কাক,
শরৎকাল।

বিশ্বকবি অবশ্য এই লেখাগুলিকে ‘হাইকু’ না, ‘তিন লাইনের কাব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলা হাইকুর প্রথম বই সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর ‘জাপানী ঝিনুক’ (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলা ভাষায় হাইকুচর্চার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নানা কবি লিখেছেন নানা সময়ে। সবক্ষেত্রে যে হাইকুর নিয়মবিধি ঠিকঠাক পালিত হয়েছে এমন নয়।

তবে বাংলাতে নিয়মনিষ্ঠ হাইকুও আমরা পাই:

মাতাল চাঁদ
নিশার দারোয়ান
দাঁতাল শীত
(মুজিব মেহদী)

হাইকুকে বাংলা ভাষার উপযোগী করে মুজিব মেহদী (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ- ) ‘বাইকু’ ফর্মটি তৈরি করেছেন। তাঁর লেখা:

বাগানে ভর্তি হলাম পাখিদের ক্লাসে
শিখছি পাতা কাঁপানো ও ফুল ফোটানো
এখনো অনেক দূরে পাতাঝরা দিন
(বাইকুসহায়/৪৯)

বাংলা হাইকু বা বাইকু তিন লাইনের কবিতা, কিন্তু কাঠামোগতভাবে মুক্ত, অর্থাৎ, কলাবৃত্তে ৫-৭-৫ রীতির অনুসারী নয়; এটি মুক্তক হাইকু হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

সারা পৃথিবীর কবিরাই মেতেছেন হাইকুর সৌব্দর্যে। হাইকু থকে জন্ম নিয়েছে আরও নানা ফর্ম। বিষয়ের দিক থেকেও হাইকু এখন অনেক বেশি প্রসারিত ও মানবিক।

হাইবুন
(Haibun)

সম্মিলিত গদ্য আর কবিতার একটি ফর্ম হাইবুন। এর জন্ম জাপানে। প্রথমে থাকে গদ্যটি, যা হতে পারে ভ্রমণকথা, দিনপঞ্জি, আত্মজীবনী, নিবন্ধ, গদ্যকবিতা— এইরকম কিছু। আর তার পরে থাকে একটি হাইকু।

১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর শিষ্য কোরাই-কে লেখা একটি চিঠিতে হাইবুন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বাসোর ‘গভীর উত্তরের দংকীর্ণ পথ’ (ওকু নো হোসোমচি) বইতে আমরা বেশ কিছু হাইবুন পাই। তা থেকে:

নাতোরি নদী পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেন্দাই-তে। সেই সময়ে তো লোকজন ঘরের চালের নীচে নীল আইরিশ টাঙিয়ে রাখে। একটা সরাইখানা খুঁজে নিয়ে কাটিয়েছিলাম চারপাঁচটা দিন।
কিমোন নামে এক আঁকিয়ে থাকত শহরটায়। তাঁর নিখাদ শিল্পবোধের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আলাপও হল। কবিতায় উল্লেখিত জায়গাগুলোর খোঁজে তিনি অনেকগুলো বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন, বলেছিলেন আমাকে। সে সব ঠিকঠাক চিনতে পারা বেশ কঠিন। একদিন আমাদের নিয়ে গেলেন তেমনই কিছু জায়গা দেখাতে। ক্লোভারের ঝোপে ভরা মিয়াগিনো-র মাঠ; ভাবলাম, শরতে দেখতে কেমন হবে। তখন তো তামাদা, ইয়োকোনো, সুৎসুজি-গা-ওকা-র চারপাশে পিয়েরিসের ফুল। আমরা গেলাম এক পাইনবনের ভেতর দিয়ে, এত ঘন যে সূর্যের আলো একদমই ঢুকতে পারে না। নাম জানলাম, কোনোসিতা [গাছের তলা]। শিশির এখানে বহুকাল থেকেই পুরু খুব, একটি কবিতায় ভৃত্য তার মনিবকে বলছে, খড়ের টুপি নেওয়ার কথা। দিন শেষ হওয়ার আগে ইয়াকুসিদো আর তেনজিনের মঠে প্রার্থনা করলাম আমরা।

আসার সময় কিমোন আমদের মাৎসুসিমা, সিওগামা আর স্থানীয় কিছু জায়গার স্কেচ উপহার দিলেন। আর দিলেন ঘন আইরিশ-নীল ফিতেওলা দু-জোড়া খড়ের চটি। এই সব উপহার থেকেই বোঝা যায়, একজন মানুষের রুচি কতটা সমৃদ্ধ।

পায়ে বেঁধেছি
আইরিশের ফুল—
চটির ফিতে

পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য হাইবুন লিখেছেন ইয়োসা বুসোন, কোবায়াশি ইসা, মাসাউকা সিকি প্রমুখেরা।

জাপানের বাইরেও হাইবুনের চর্চা আমরা দেখতে পাই। আমেরিকান কবিজেমস মেরিল (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর ‘অন্তরের স্থান’ (The Inner Room)-এর ‘প্রস্থানের গদ্য’ (Prose to Departure) প্রথম দিকের ইংরেজি হাইবুনের একটি উদাহরণ।

বাংলাতেও সম্প্রতি আমরা হাইবুন নিয়ে উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি।

সেনরু
(Senryu)

৫-৭-৫-এর আর একটি জাপানি কবিতার ফর্ম সেনরু। হাইকুর মতো মাত্রাগঠন হলেও সেনরু হাইকু থেকে আলাদা।

হাইকুর মতো কিরেজি (ছেদ-শব্দ) ও কিগো (ঋতুগত শব্দ) থাকে না এতে।

হাইকুর বিষয় প্রকৃতি, মানুষ স্থান পায় না।

সেনরু মানুষের কথা নিয়েই, বলা যায় ‘মানবিক হাইকু’। মনুষ্যচরিত্রের অসংগতি এখানে উপজীব্য।

হাইকুর প্রশান্তি, গাম্ভীর্য থাকে না সেনরুতে। বরং স্থূল রসিকতা লেখা হয় তির্যক ভঙ্গিতে।

কারাই হাচিমন (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ-১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ, ছদ্মনাম সেনরু, কারাই সেনরু নামেও পরিচিত) এইরকম হাস্যরস আর বিদ্রুপাত্মক ছোটো কবিতাগুলির সংকলন ‘হাইফুইয়ানাগিদারু’ প্রকাশ করেন যা সে সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেনরু ও অন্য সম্পাদকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধ্রুপদী হাইকু আর পাঠকের মন ভোলাতে পারছে না, মানবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে একটু মজার কবিতা হিসেবে সেনরু পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়।

কারাই সেনরু-র সংকলন থেকে একটি সেনরু:

ধরেছি যাকে
ডাকাত ভেবে এ কী
খোকা আমার

হাইকুর মতো বিষয় ও উপস্থনা নিয়ে নিয়মের নিগড় নেই এতে, ছন্দকাঠামো মেনে অনেকটা উন্মুক্ত মনে এই ধারায় পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা লিখে চলেছেন। এবং এই ধারাটি আজ যথেষ্টই জনপ্রিয়।

বাংলাতেও সেনরু লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বল্প কথায় শাণিত বিদ্রূপে এই ফর্ম বাংলা কাব্যজগতে বেশ মানিয়ে যায়।

নাটক শেষ
মৃত সৈনিকটি
শুয়েই আছে

বা

ভাজা মাছটি
উলটে খেয়ে নেয়
ভেজা বেড়াল

কাতাউতা
(Katauta)

জাপানি কবিতার আর একটি ফর্ম কাতাউতা, তিন পর্বে রচিত, পর্বগুলির মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৫ অন; কখনো ৫-৭-৭ অনেও লেখা হয়েছে এই কবিতা।

কাতাউতা প্রেমের কবিতা, প্রিয়জনের উদ্দেশে লেখা, অন্ত্যমিলহীন।

ওঠো, ও প্রেম
ঘৃণার ঢেউ থেকে
না রবে বিছানাতে?

অষ্টম শতাব্দীর পর থেকে এই ফর্মের ব্যবহার বিরল। সম্প্রতি নানা ভাষায় নতুন করে এর চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাতেও প্রেমের অনুকবিতা হিসেবে এই ফর্ম গৃহীত হতে পারে:

চোখের জলে
শেষ হয় না নুন
সাগর তোমার কে?

কাতাউতাকে বলা হয় ‘অর্ধেক কবিতা’, পরপর দু-টি কাতাউতা মিলে তৈরি হয় সেদোকা।

সেদোকা
(Sedoka)

সেদোকা দু-টি কাতাউতার সমষ্টি। মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭। সাধারণত অন্ত্যমিল থাকে না। প্রথম তিন লাইনে একটি দৃশ্য বর্ণিত হয় আর পরের তিন লাইনে অন্য প্রেক্ষিত থেকে দেখা হয় দৃশ্যটিকে। দু-টি অংশের মধ্যে একটি শাণিত ছেদ থাকে আর অংশদুটো স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে পড়া যায়। কখনো তা সংলাপধর্মী, প্রথম অংশে প্রশ্ন, উত্তর পরে।

একে ‘শীর্ষ-পুনরাবৃত্তির কবিতা’ও বলা হয়।

জাপানি কবি কাকিনোমোতো নো হিতোমারো (৬৬২ খ্রিস্টাব্দ-৭০৮ বা ৭১০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সেদোকাগুলির জন্য খ্যাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ অংশে বলেছেন সেদোকার বিষয়ে, আছে একটি উদাহরণও:

সাগরতীরে
শোণিত-মেঘে হল
নিশীথ অবসান
পুবের পাখি
পূরব মহিমারে
শুনায় জয়গান

অন্ত্যমিল আছে। আর সে-বিষয়ে কবিগুরুর মন্তব্য, “বাঙালি পাঠকের অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া নিজের অনুকৃতিগুলির মধ্যে একটু মিলের আভাস রাখা গেছে।”

অষ্টম শতাব্দীর জাপানি কাব্যসঞ্চয়ন ‘মানিওশু’-তে কাতাউতা-র দেখা মেলে। পরবর্তীতে এর চর্চা প্রায় বিলোপ পায়। ছয় লাইনে, তিন-তিন দুই স্তবকে, মোট ৩৮ মাত্রায় (৫-৭-৭-৫-৭-৭) সেদোকা লেখার প্রয়াস ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষায়।

এর সৌন্দর্য বাংলা ভাষাতেও ফুটে উঠতে পারে:

এক শেয়াল
গোধূলির উঠোন
পেরিয়ে গেল ছুটে

বোঝা গেল না
সেইদিকে খাবার
না পেছনে খাদক

মনদো
(Mondo)

আর একটি জাপানি ফর্ম মনদো।

জেন ধর্মানুশীলন থেকে এর উৎপত্তি। লেখা হয় দু-টি তিন লাইনের স্তবকে।

প্রথম স্তবকে প্রশ্ন, উত্তর পরেরটিতে। মত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭ অন, বা কখনো ৫-৭-৫-৫৭-৫ অন।

সাধারণত দু-জন কবি লেখেন একটি একটি করে স্তবক।

সংলাপমূলক কবিতা হিসেবে বাংলায় এর ব্যবহার আমরা আশা করতে পারি।

মেঘ তো কালো
বৃষ্টিফোঁটা কেন
এমন ধবধবে?

মাটির দিকে
যা কিছু নেমে আসে
বাড়তি ঝেড়ে ফেলে

তনকা
(Tanka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতা আর একটি ফর্ম ‘তনকা’-র পাঁচটি পর্ব লেখা হয় যথাক্রমে ৫-৭-৫-৭-৭ অন মাত্রাবিন্যাসে। অনুবাদে, জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় পাঁচটি লাইনে প্রকাশিত হয় তনকা। ওপরের ৫-৭-৫-এর অংশটিকে বলা হয় ‘কামি-নো-কু’ আর নীচের ৭-৭-এর অংশটিকে ‘সিমো-নো-কু’।

মনিওশু-তে দীর্ঘ কবিতাকে চোকা আর হ্রস্ব কবিতাকে তনকা বলা হত। পরবর্তীতে সাধারণভাবে হ্রস্ব কবিতাকে ‘ওয়াকা’ বলা শুরু হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানি কবি মাসাওকা সিকি (১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) তনকা সম্পর্কিত ধারণার পুনর্মূল্যায়ণ করেন।

সিকির লেখা:

সেই লোকটি
মুকুরে হত দেখা
আর সে নেই
নষ্ট মুখ দেখি
অশ্রু ঝরে যায়

তাকুবোকু ইসিকায়া (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)-র লেখা একটি তনকা:

পুব সাগরে
ছোট্ট এক দ্বীপে
সাদা বালিতে
অশ্রুভেজা মুখে
খেলি কাঁকড়া নিয়ে

বাংলা তনকাচর্চাও আমরা লক্ষ করছি বেশ কিছুদিন। তা লেখা হয় পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে, পর্বের চরিত্র বজায় রেখে।

হাসির মাঝে
একটু করে থামি
আর দম নি’
নীরবতার ফাঁকে
কান্নাকে লুকোই

সমনকা
(Somonka)

জাপানি কবিতার আরেকটি ফর্ম সমনকা। দু-টি তনকা নিয়ে রচিত হয় সমনকা।

সমনকায় তনকাদুটোর কেন্দ্রীয় ভাবনা প্রেম আর তা লেখা হয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথোপকথনের চালে, প্রথমটির যে-বক্তব্য তার প্রতক্রিয়া থাকে দ্বিতিয়টিতে। নরনারীর প্রেম ছাড়াও অন্য সম্পর্কভাবনায় এই শৈলীর কবিতা পাওয়া যায়।

এতে শিরোনাম থাকে, অন্ত্যমিল থাকে না। দু-জন কবি মিলে একটি সমনকা লেখেন।

ফর্মটি বেশ পুরোনো, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত সমনকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

৭০০ খিস্টাব্দের আশেপাশে মিকাতো নো সামি ও তাঁর স্ত্রীর রচিত একটি সমনকা:

বাঁধো, শিথিল
না বাঁধলে দীর্ঘ
প্রিয়ার চুল
দেখি না আজকাল
বেঁধে রেখেছে সে কি?

বলে সবাই
এমন লম্বা যে
বাঁধাই ভালো
যেটুকু দেখো তুমি
খোঁপায় জড়িয়েছি

সমকালীন বাংলা প্রেমের কবিতায় এই কবিতার আবেদন হয়ে উঠতে পারে চিত্তাকর্ষক। আর দুই কবি, প্রেমিক-প্রেমিকা যদি লেখেন একটি একটি করে স্তবক, তাহলে তো কথাই নেই:

মেঘের গায়ে
কার সে স্বাক্ষর
ফুটে উঠল
এমন আঁকাবাঁকা
চিনতে পারছ কি?

তা আমারই তো
তোমার ছোঁয়া লেগে
জ্বলেছে হাত
আর সে বিদ্যুতে
আঙুল গেছে কেঁপে

চোকা
(Choka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতার ফর্ম চোকা। লেখা হয় পর্যায়ক্রমে ৫-৭-৫-৭ অনে। শেষে থাকে ৫-৫-৭-এর একটি পর্ব। ‘মানিওশু’তে সংকলিত এই চোকাটির রচয়িতা কবি ইয়ামানোউ নো অকুরা (৬৬০? খ্রিস্টাব্দ-৭৭৩? খ্রিস্টাব্দ):

তরমুজ তো
খেলেই মনে পড়ে
বাচ্চাদের,
আরও মনখারাপ
বাদাম খেলে,
ভাবনাগুলো আসে
কোত্থেকে যে?
রাতের পরে রাত
ঘুম আসে না চোখে।

এই চোকাটির পরে আছে অকুরারই লেখা একটি তনকা যাকে হানকা বা অনুকথন বলতে পারি:

দাম কত হে
কণক, রূপা, হীরে?
অমূল্য না,
সন্তানের সাথে
তুলনীয় তো নয়

রবীন্দ্রনথ ঠাকুরের ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ আমরা একটি চোকা পাই:

সাহসী বীর
দেখেছি কত অরি
করেছে জয়।
দেখিনি তমাসম
এমন ধীর—
জয়ের ধ্বজা ধরি
স্তবধ হয়ে রয় ।।

দোদোইৎসু
(Dodoitsu)

৭-৭-৭-৫ মাত্রাবিন্যাসের জাপানি কবিতা দোদোইসু। বিষয় প্রেম বা মানবিক ব্যাপার-স্যাপার। ভাবনার একটি মোচড় থাকে সাধারণত।

অনুবাদে একটি:

যখন রেগে যাই
নাড়াই পেয়ালাটি
নড়ে চোখের জল
দীর্ঘশ্বাস?

এদো (১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) কালখণ্ডের শেষ দিকে এর উদ্ভব। মনে করা হয় জাপানি লোকসংগীত থেকে বিকশিত এই ফর্মটি।

জাপানি ছাড়াও অন্য ভাষার কবিরা এই আঙ্গিক নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বাংলাতেও এর সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সচেষ্ট হতে পারি:

তোমার প্রতিটি না
সম্মতির কাছে
চোখ বন্ধ করে
দাঁড়িয়ে থাকে

বুসোকুসেকিকা
(Bussokuseki)

জাপানের নারা শহরের ইয়াকুসি মন্দিরে সুপরিচিত স্তম্ভ বুসোকুসেকি-কাহি। সেখানে রয়েছে একুশটি কবিতা খোদিত ‘বুদ্ধের পদচ্ছাপ’। কবিতাগুলি ৫-৭-৫-৭-৭-৭ মাত্রার, বুদ্ধের গুণগান, জীবনের অনিত্যতা ও বৌদ্ধমতের প্রচার সংক্রান্ত।

২০ সংখ্যক রচনাটি:

ঝোড়ো আকাশে
ক্ষণিক বিদ্যুৎ
এই শরীরে
মৃত্যুমহারাজ
দাঁড়িয়ে চিরকাল
কাঁপব না কি ভয়ে?

ইয়াকুসি মন্দির স্থাপিত হয় ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কবিতাগুলি রচনাকাল তার আশেপাশে। এই মন্দির ছাড়া কয়েকটি সংকলনে আমরা এই জাতীয় কবিতা দেখতে পাই। একে বলা যায় ওয়াকার আদিরূপ।

জাপ্পাই
(Zappai)

হাইকুর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে আমরা জানি, কিন্তু তার বাইরে, সতেরো অন-মাত্রার অন্য কবিতাও আমরা দেখলাম। সতেরো অনের যে-সব কবিতা হাইকুর প্রকৃত নিয়মনিষ্ঠ ও কারুকৃতির চরিত্রের সাথে মানায় না তারাই হল জাপ্পাই। জাপ্পাইয়ের ঐতিহ্যও সমৃদ্ধ, এটি একটি স্বতন্ত্র আঙ্গিক; হাইকু লেখার ব্যর্থ প্রয়াস থেকে যে জাপ্পাই নয়, বুঝতে পারা যায়। আবার তা সবসময় সেনরুর মতো বিদ্রূপাত্মক হয় না।

৫-৭-৫ মাত্রার সঙ্গে ৭-৭-এও লেখা হয় জাপ্পাই।

অলসভাবে
শুনি ভোরবৃষ্টি
সেই মাঝির
(মিসাতোকেন)

চোখ-মু-কান নাই
বউ সৎমা বেশ
(ইসায়িতা ইয়ুমিকো)

বাংলায় হাইকু হিসেবে লেখা অনেক কবিতাই এই শ্রেণির। আবার সতেরো মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে তিন লাইনে লেখা কবিতা হিসেবে জাপ্পাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মন ও মন
আয়নার দুপাশে
ছুঁতে পারে না

সিনতাইসি
(Shintaishi)

জাপানি ভাষায় ‘সিনতাইসি’ শব্দটির অর্থ ‘নব আঙ্গিকের কবিতা’; হাইকু, তনকার মতো পরম্পরাগত জাপানি কবিতার মাত্রাবিন্যাস ও আঙ্গিকের বাইরে লেখা এই কবিতাকে, বলা যেতে পারে মুক্ত কবিতা। উদীয়মান সূর্যের দেশে ‘মেজি’ (১৮৬৮ খৃস্টাব্দ-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) যুগে ‘আধুনিক’ অনুভূতিকে প্রকাশের তাগিদে এর উদ্ভব।

সিনতাইসি ধ্রুপদী জাপানি ভাষায় লিখিত। ওচিয়াই নাওবুমি ( ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই রীতির উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর লেখা ‘কোজো সিরাগিকু নো উতা’ (সাদা তারাফুল/White Aster) কাব্যকে এর প্রারম্ভিক উদাহরণ ধরা হয়।

শুরুর লাইনগুলি:

আসো পর্বতের এক জনমানবশূন্য দূর গ্রামে সূর্য অস্ত যাচ্ছে
আর ক্রন্দনরত পাখিরা পড়ছে ঘুমিয়ে
বৃষ্টির জলে-ভেজা কয়েকটি নীচু গাছ; শোনা যাচ্ছে দূরের মন্দিরের ঘণ্টা
একটি বাড়ির দুয়ারে বছর চোদ্দর এক মেয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে
বাবা গেছেন পশুশিকারে
সে খুবই ছোট্ট, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে পড়ে সুন্দর এক ফুলের কথা
হাওয়ায় এলোমেলো তার চুল, বাবার চিন্তায় বেশ কয়েকদিন ঘুম হয়নি তার

এই মেয়েটির কাহিনিই এই ‘সাদা তারাফুল’-এর বিষয়।

Categories
2021-May-Poem কবিতা

দেবাশিস বিশ্বাস

তাস ও রক্তের স্পট: একটি অমেরুদণ্ডী নোট

[মহোদয়, আমি অসমের জঙ্গলে যাইনি। কিন্তু সামনের বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে তর্ক শুনছি গণ্ডারের। অণ্ডকোষের আশায় গণ্ডারকে হত্যা করা হবে। এবং তার মিহি দাঁতের ফুঁ ছড়িয়ে দেওয়া হবে সবুজ কাষ্ঠলে…]

মস্তিষ্কের খোঁজে লণ্ডভণ্ড করেছে বাগান
তরমুজের জেদ ফাটিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে
‘মুক্ত করো জনজাতি মানবসভ্যতা’
জোনাকির মিটি মিটি টাইমের বর্গ
জড়িয়ে থাকে যারা তাদের অস্তিত্ব অজগরের মতন

*
লোম ছুঁয়ে পালিয়ে যাওয়া হাওয়া
‘ভাল্লুক থাবা চাটছে’—
তাকে পাশ কাটিয়ে
ট্রাক
ধাতুকে ধাক্কা দেয়

বরফের উপরে আছড়ে পড়ে OZONE
মস্তিষ্ক,
ও কিছুই না।
দুর্বল পাখি তাড়ানোর মেশিন।

দ্রাঘিমা টেনে রেখে পালিয়ে গিয়েছে ম্যাকাও,
তার জঙ্গলে মুক্ত চুমু
ভাবো, পরশু থেকে, আজ দাবার প্রত্যেক ঘরে কোনো খেলা নেই।
দু-বার না উড়ে একবারেই
মাথার চুলগুলো কমে যাচ্ছে… ডুবে যাচ্ছে যাদের অস্তিত্ব অজগরের মতো

একদল হরিণ,
কখনোই ভাবিনি রাস্তা তার পিতামহের স্মৃতি নিয়ে যাবে

অস্থির সময়ে, টেবিলের অন্ধকারে পাখির ডাক
লালায় অ্যাসিড…! দাঁতের তড়িৎক্ষরণ বিলাসিতার কারণ।
কল্পনায় দোষ নেই, যতবার খুশি গলায় ফাঁস পড়তে পারো
ক্ষেপে উঠছে টলটলে হাত
চাবুক
মাছি
তেলের ব্যাড়েল গড়ানো
এই তোলা হল, সাজিভরতি, জবাফুল। মন্দির।

[তারপর পবিত্র কুসুমের ডাল ছিঁড়ে মায়াহীন বিষুবতলে হলুদ সূর্যমুখী ফুল থেঁতলে তুমি ঠিক পালিয়ে যাচ্ছ অণ্ডকোষ জ্বালিয়ে। একটু বোসো, নিরিবিলি সন্তানের নড়ে ওঠা দাঁতের মিথ্যায় ইঁদুরকে আন্দাজ করো। তুমি কি ভাগ্যবান! জমি বন্ধকের অজুহাতে ড্রিল করছ নাভিতে। সে-নাভি দুর্গন্ধময়।
ভাবছ, এবার রোপওয়ে থেকে ঝাঁপ দেবে?]

তুলতুলে পোঁদ-পাকা বুলবুলি অরাজনৈতিক
বহু পুরোনো প্লাস্টিক জানলায় বাঁধা আছে,
ওখানে ফোন ঝোলানো থাকে
ট্রান্সফরমার ফ্ল্যাশ করে। দু-একটা বাঁদুরের বার্স্ট।
নেমে গেলে শ্রমিকের কালো ধোন, বিশেষরূপে তার যৌনতার কোনো দাম নেই।
লক্ষ লক্ষ যুগের রূপান্তর, মানুষ গাছের শাখাপ্রশাখা খোঁজে।
মনে পড়ছে, হাতকাটা ৫০ হাজার মিলিয়নের থেকেও বেশি রক্তের মুঠি।
চা পাতা চেবাতেও জল ওড়ে, অরোগ্রাফিকভ্রান্তি
বুকে হাঁটা বালি, অর্ধেক আংলি ছাড়া কিছুই নয়

[কটেজের সামনেই বাদামের খোসা। কিছু তাস ও রক্তের স্পট। ইয়া, বিশাল লোহার গেটে ঘাতকের তড়িঘড়ি ছুটে পালানোর রেখা। লতিয়ে সন্ধ্যা নামে বা ভেঙে পড়ে সকালের সূর্য। জন্তু তো, রড কোষ দিয়ে দ্যাখে, কটেজের আকাশ দিয়ে জেট বিমান উড়ে যায়…]

আমি পলাতক হাজার হাজার কচ্ছপের পিঠের শ্যাওলায়
কেউ টিপে দিয়ে স্যুইং খায়
অযথা গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কলোনিবিমুখ হয়ে পড়ি
তারা খসা ও মেরুন কালারের হাতুড়ি-মুখো তিমির পেটে অজস্র মাছ
বলেছিল, শান্তি এক দুর্ভিক্ষের নাম…
ভাবুক অনায়াসে গাছগুলো ছেঁটে দেয়… বাড়তি খনিজ
লম্বা লম্বা পা… এ-সব রূপকথারই গল্প।
সেও একা

জলে জলে ঘোরে
পৃষ্ঠটানের জন্যই সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
গৃহহীন পিছলে যাওয়া সৌরে আচমকা দেখা হয়ে যায় দেয়াল। চুনের রেখায় বুদ্ধি… লা লা লা

এবারের মতো প্রথম আবিষ্কারের খাতা থেকে তোমায় বাদ দেওয়া হল

ঐরাবতের কাহিনি


মোচড়ানো বৃক্ষের জাহাজ, উড়ে গেছে কি — কবিতার
ফাঁকা অনিঃশেষে দাঁড়ানো ঐরাবত, চুলগুলো বারুদ
কোথায় ছিল সে, অনুমানে তিনটে খুন হয়
যতই রটানো হোক তিলখেতে বাঙালার পাখি ধরা হয়—
বদমেজাজি লোক সে, সীসার হৃদয় থেকে ভার নিয়ে নেয়
ধরা যাক, শ্বাসরুদ্ধ
অপর পাশে কবিতার খেত

উচ্ছে কবিতার কাছে, ঘেঁষে আছে খুনি নিবারণ—


যথাসম্ভব টান দিলেই পুকুরের নলি ছিঁড়ে যাবে, শান্ত মৌরলার চঞ্চল
মাথাদের বিশ্রাম চাই… এই অজুহাতে আঁশ তোলা হয়
কঠোরের দিক ওইদিকে, একটু কান ঘেঁষে গেলেই বাড়ি ঘর জঙ্গলে, মাতৃ হাঁ শ্বাসের আওয়াজ
শোনো, অবিকল জিতে যাওয়া ট্রফির চিক্কন—
ছুঁড়ে কেউ জমেছে এমন… মা-মরা সন্ধ্যার একায়?
আবহাওয়া মাছেদেরই থাকে
তবু কোনো চোর আসে, যথাসম্ভব টান দিয়ে মৌরলার ঠোঁট ছিঁড়ে নেয়


যতটা ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি, মাফলার জমে যাওয়া বরফ
আমি তা কুকুর চোদার মতো দেখি
এই গরল, তামার পাত্র উপচে ওঠে দোকানের ঘরে
বিধিসম্মত কফিনের পেরেকে খুঁচিয়ে তুলছে সে কবেকার জমে থাকা ফ্লেশ!
কালো জাদুতে বিশ্বাসী, ঐরাবত
গন্ধের অভাব বোঝে, নাসারন্ধ্র থেকেও দূরে, সূর্যের প্রজ্জ্বলন
এ কেমন মহামায়া রুপোর জলের কাছে আবেদন যেন
মৃত পশুদের দল স্টিল হয়ে আছে, ধীর হয়ে আছে
ঘাসের ক্রমশ হাত মানুষ তুচ্ছ করে
যেন সে পশু নয়
কফিন বানানো তার কাজ, অদৃশ্য জাতক!

Categories
2021-May-Poem কবিতা

সুস্মিতা কৌশিকী

সময়

কোথাও তীব্র বাজছে মুহূর্ত
নদী না, ডোডো পাখির সঙ্গম না, প্রচ্ছন্ন আভাস না
ব্যবহারিক অথবা অপেক্ষাকৃত জান্তব গতির অসঙ্গতি
মর্মান্তিক ভুলের কাছে গুটিয়ে যাচ্ছে চিৎ কণিকারা

মনে হয় হার মানতে নারাজ; এক ডানাভর
ঝুপ করে নেমে আসা মাছরাঙা ঠোঁট
তখনও কিছুই তেমন গুছিয়ে তোলা হয়নি
ছোঁ মেরে নিয়ে গেল

দেখে কাতর লাগে; তৃষ্ণার ছিল কিছু বাকি
আপৎকালীন, প্রিয়তার মুখ, যাপনের যৎকিঞ্চিৎ সঞ্চয়
প্রত্যাশার জন্ম-জড়ুল ছুঁয়ে ছেলেমানুষি জিদ

তবু একরোখা; বর্তুলের ভিতর ঢুকে পড়া ছিপ
তুলে নিল নিখুঁত ব্যবধানে
নিমেষ, শূন্যতা, অনাদী, বিষণ্ণ।

বৃদ্ধ গাছ ও স্বতন্ত্র কুঠার

গাছটার বয়স হয়েছে যথেষ্ট
গায়ে ধরা পোকা খুঁটে খায় রঙিন কাঠঠোকরা
এদিক ওদিক সুযোগসন্ধানী পরগাছা ধরেছে জাপটে
দুটো ডাল দুঃখের স্মৃতির মতো আটকে রয়েছে বেহায়া শরীরে

তবু সামান্য স্নেহগন্ধ বৃষ্টিতে এখনও কেমন মেলে ধরে ডানা
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আকাঙ্ক্ষার নবপত্রিকা
ফল মুখে উড়ে আসে বিবিধ গোপন পাখি
ডালে বসে, গান গায়
আহ্লাদের খড়কুটো নীড় গড়ে তোলে
সালতামামির প্রজনন শেষে সুখের উড়াল

এ-সবই ক্ষণকালের জাদুবাস্তবতা— গ্রাহ্য করে না
সারাবেলা সজাগ অতন্দ্র কাঠুরিয়া,
হাতে নিয়ে স্বতন্ত্র কঠিন কুঠার।

অক্ষয় বৃক্ষচরিত

যেটুকু দিয়েছ ভোগ সেটুকুই, এর বেশি যাঞ্চা করিনি
ফিরেয়ে দিতে পেরেছি লাবণ্য আকর, মাটি ও উর্বরতা
অনীহা উদাসীনতপ উপেক্ষার অনুপূর্ব যাতায়াতে
মুখ ঘুরিয়ে চলে যাইনি ইচ্ছামৃত্যুর ললিতসভায়
হাতে ধরানো ফেরারি সুইসাইডনোট নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি একা—
ত্রিভুবন শয্যার পাশে দৃশ্যহীন বাহুডোরে, যেমন দ্যুতিহীন শ্লীল কঠোরতা আপন হয় অক্লেশে।

মানুষের স্বার্থপরতা দেখেছি, পরশ্রীকাতরতা, উল্লাস
সব ছেড়ে নিজস্ব নির্বান ঘিরে ঐশী বিভার পরন্তপ
দেহপল্লব, সুতনু ঘ্রাণ, চিন্তার মণিকোঠায় জলজ প্রকরণ।

সুদৃশ্য মাইলফলকে অতিক্রমহীন দূরত্ব জ্ঞাপক গেঁথে
পাড়ি দিয়েছি দুরূহ প্রব্রজ্যা, ঋতুপর্ণ মন্থনের কালে
এই দেহ সন্ন্যাসে গোপনে রাখিনি কোনো যৌন-শঙ্খল সাপ।

কেবল হাওয়ার আদলে বদলে গেছি থেকে থেকে, আর
শব্দযোনী খুঁড়ে তুলে এনেছি ওঁ-কার
ব্যথা ভুলবার মন্ত্রে রচিত হয়েছে অক্ষয় বৃক্ষচরিত।

কণ্ঠিবদল

ভেঙে ছিল আবাল্য প্রেম তারুণ্য বিভাজিকায়
দোহাই সৌন্দর্যহীনতা
তারপর একে একে গেছে সব প্রেম, সংসার আবিল
ভেঙেছে যাবতীয় ক্ষোভে ও অভাবে
পথে পথে ঘুরে হাতবদলের ফেরে হয়েছে পতিতা
শরীর ছুঁয়েছে অযুতে, অধরাই থেকে গেছে মন
নেই মান
মানুষের সমাজে ঘৃণ্য সমান।

শেষে এক অন্ধ বাউল
হাত ধরে নিয়ে যায় মাটির কুটিরে
আকাশপ্রদীপ জ্বলে, উদ্ভাসিত একতারা
মন দিয়ে ছুঁয়ে দেয় মন, মাটির নিরালায়
শত শঙ্খ বাজে যে-আঁধারে, অলৌকিক উলু,
তুলসী কাঠের মালা হিরেমোতি আলোর বাহক
যাপন বিন্যাসে গেয়ে ফেরে পথে পথে
বাজে খঞ্জনি দেহতত্ত্ব গানে
সুন্দর হয়েছে সত্য, সত্য‌ অমর্ত্য।

বেঁচে থাক আত্মার বাঙ্ময় আলো, দেহকাঁচা, ফকিরাত।

ব্যক্তিগত জার্নাল

জানাও— কতটুকু আঁধার, কতটুকু অনালোক। আঁধারে বাজুক সেতার সর্বভুক, অনালোক ছুঁয়ে ফেলো সন্ন্যাস জোছনায়। তলিয়ে যেতে যেতে তোমার সিংহকেশর পৌরুষ শাসন করুক আমার ভূলোক দ্যুর্লোক। অমার্জিত প্রেমে বনেচর জীবন ডায়নার খরস্রোত। আমাকে বখে যেতে দাও।

পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। আহা! জলজ মীন জীবন। পলকহীন চোখে দর্পণের পিপাসা। ইন্দ্রিয়গুলো একে একে মরে যেতে থাকে। স্পর্শ পাখনা ক্ষতিগ্রস্থ হলে জলতল ভুল হয়ে যায়, যেভাবে গন্ধ মরে গেলে বাঁচেনা প্রেম। প্রতিকূল নয় কিছুই, কেবল ধর্মের শিঙা বাজাতে শিখিনি বলে…

আমাকে থামিয়ে দিয়েছ বিনাশরেখা থেকে সংকটপূর্ণ দুরত্বে। রোজ একটু একটু পরখ করে নিই, কতটা অবলম্বনহীন বেড়ে ওঠে বিরুৎজীবন। মুখ লুকোবার পরিসরে পাথর খাদান। তবু ব্যভিচারী আঙুলগুলো সেজে ওঠে অভয়মুদ্রায়।

Categories
অন্যান্য

উৎসব সংখ্যা ২০২০

প্রচ্ছদ ছবি: ইনামুল কবীর

সম্পাদকীয়

আমরা কেউ ভালো নেই। ভালো থাকার চেষ্টা করেও ভালো থাকতে পারছি না। আসলে সময়টাই এমন। একদিকে করোনা অতিমারি আরেকদিকে রাষ্ট্রের শোষণ। এত মানুষ কর্মহীন! আজ মানুষ ঠিক আছে তো কাল কী হবে জানে না। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে যার মতো লড়ে যাচ্ছে। এবছর ‘উৎসব সংখ্যা’ প্রকাশ করতে পারব ভাবিনি। ‘টিম তবুও প্রয়াস’ তিনমাস ধরে দীর্ঘ পরিশ্রম করেছে, যাতে  ‘উৎসব সংখ্যা ২০২০’ প্রকাশ করা যায়। সমস্ত  অন্ধকার বা বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের এটুকুই আলো। এবারের উৎসব সংখ্যায় আমরা কিছু বিষয়কে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। চেষ্টা করেছি— অনেকগুলো নতুন মুখকে পত্রিকার পাতায় রাখতে। সেইসঙ্গে পাঠকদের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের সংযোগ ঘটাতে। উৎপলকুমার বসুর অগ্রন্থিত লেখা ও অরুণেশ ঘোষের অপ্রকাশিত চিঠি এই সংখ্যাকে পাঠকের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে বলে আশা করা যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে এ সংখ্যায় রাখতে পারিনি। আগামীতে তাঁদের নিয়ে পরিকল্পনা আছে।

মুদ্রিত সংখ্যার মতো এই সংখ্যার পিছনে ‘টিম তবুও প্রয়াস’ একই শ্রম দিয়েছে। কোনোভাবেই যাতে গুণগতমান নষ্ট না হয় সেদিকে রাখা হয়েছে খেয়াল। পাঠকদের কাছে অনুরোধ করছি লেখার নীচে মন্তব্য জানাবেন। আপনাদের মতামত আগামীদিনে আমাদের কাজ করতে আরও উৎসাহ দেবে। লেখকদেরও অনুরোধ করছি আপনার ও পছন্দের লেখা শেয়ার করতে— যাতে বহু সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছায়।

সূচিপত্র দেওয়ার পর আমাদের কাছে অনেক অনুরোধ এসেছিল— সংখ্যাটি যেন প্রিন্ট করা হয়। সত্যি বলতে এত বড়ো কলেবরে সংখ্যা এই মুহূর্তে ছাপা সম্ভব নয়। অনলাইনে যে-কেউ ফ্রি পড়তে পারবেন সংখ্যাটি। তবে কারো যদি ইচ্ছে হয় পত্রিকার উন্নতিকল্পে আর্থিক সহায়তা করতে পারেন। প্রচ্ছদ, প্রুফ, ওয়েবজিন পরিবেশকদের আমরা যথাযথ মূল্য দিতে পারব। এমনকী লেখকদেরও।

মোনালিসা ও রাজদীপ পুরীকে বিশেষ ধন্যবাদ। তাঁদের কারিগরী সহায়তা সংখ্যাটিকে আরও প্রাণ দিয়েছে।

সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

♦ প্রবন্ধ

পুজোর গানের গৌরবময় অতীত
গোপাল দাস

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড
অলক রায়চৌধুরী

কলকাতা একটি শ্রমতালুক
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে
জয়ন্ত ঘোষাল

মুর্শিদাবাদের বোলান গান
সুজিৎ দে

মিথ ও ট্যাবুতে সাত সংখ্যা: আফ্রিকান মিথোলজি
রবিউল ইসলাম

গল্প

লক্ষ্মী দিঘা পক্ষী দিঘা কুলদা রায়

সেইসব বাড়িয়ে বলা গল্পগুলো যশোধরা রায়চৌধুরী

জলময়ূরীর সংসার পাপড়ি রহমান

ভয় হিন্দোল ভট্টাচার্য

শীতঘুম শুভদীপ ঘোষ

দংশন বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

হাতটি সেলিম মণ্ডল

 গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা পঙ্কজ চক্রবর্তী

কে জন্মায় হে বিপ্লব? তমাল রায়

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ রণজিৎ অধিকারী

অতিমারির উৎসব ও এক ছদ্মকবি শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

সাদা রোগ ঈশিতা দেসরকার

অগ্রন্থিত গদ্য

শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে উৎপলকুমার বসু

কবিতা

বিজয় দে  •  বিপ্লব চৌধুরী  •  পল্লব ভট্টাচার্য   কমলকুমার দত্ত  •  কল্যাণ মিত্র  •   অনিন্দ্য রায় • সুদীপ্ত মাজি  অগ্নি রায়কুন্তল মুখোপাধ্যায়  নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়  •  শৌভ চট্টোপাধ্যায় •  হাসনাত শোয়েব  • ইন্দ্রনীল ঘোষ  • শাশ্বতী সান্যাল  • প্রীতম বসাক  • পঙ্কজকুমার বড়াল •  তথাগত  • দেবোত্তম গায়েন  • শতানীক রায়  • শুভম চক্রবর্তী  • শাশ্বতী সরকার • প্রবীর মজুমদারগৌরাঙ্গ মণ্ডল  • সঞ্চিতা দাস  তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

অনুবাদ গল্প

আসল-নকল
ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস

অনুবাদ গদ্য

পাওলো কোয়েলহোর গদ্য
ভাষান্তর: অমিতাভ মৈত্র

লেভ তলস্তয়ের একটি আত্মজ্ঞানের খসড়া
ভাষান্তর: রূপক বর্ধন রায়

অনুবাদ কবিতা

জেন কবিতা
ভাষান্তর: রাজীব দত্ত

কাশ্মীরের কবিতা
ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম

লোকগল্প

আরও কিছু আছে বাকি
সুব্রত ঘোষ

সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির সাক্ষাৎকার
ভাষান্তর: রিপন হালদার

অপ্রকাশিত চিঠি

অরুণেশ ঘোষের লেখা গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি

চিত্রকলা

তন্ময় মুখার্জীর চিত্রকলা

——————————————————————————————————————–

সকলের সুবিধার্থে সংখ্যাটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কোনো সাবক্রিপশন মূল্য রাখা হয়নি। যদি কেউ মনে করেন সংখ্যাটি মূল্য দিয়ে পড়বেন সেক্ষেত্রে আপনার খুশিমতো ৮৬৮১৯৩৭৩৫৬ নম্বরে phonePay বা gPay করতে পারেন। অথবা অ্যাকাউন্টেও পে করতে পারেন। 

ব্যাঙ্ক  অ্যাকাউন্ট
TOBUO PROYAS PROKASHONI
Bank Of India
Chapra Branch
IFSC- BKID0004123
CHAPRA BRANCH
Account No- 412320110000151

Categories
গল্প

পাপড়ি রহমানের গল্প

জলময়ূরীর সংসার

মাদারজানি গ্রামের সকলে কালেভদ্রে কদমফুল চোখে দেখে! এ-তল্লাটেই কোনো কদমের গাছটাছ বিলকুল নাই। অথচ ঝুলমুলির কিনা খামাখাই কদমফুলের কথা স্মরণে আসে! তার সইয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর ঝুলমুলির আঙুলে চোখ ধরা মেয়েটির কপালে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো টোকা মেরে যায়! ঝুলমুলি তাকে ছেড়ে দিলে সে চোখ কচলে তাকায়। কিন্তু কে তার কপালে টোকা দিয়ে গেছে সে তা কিছুতেই বলতে পারে না। এমনকী অনুমানও করতে পারে না।

ঝুলমুলি ফের অন্য একজন সইয়ের চোখ দুই হাতে আড়াল করে ডাক দেয়—

‘আয়রে আমার কদমফুল’

একই ফুলের নাম ধরে বারংবার ডাকাতে ‘ফুলটোক্কা’ খেলা ভণ্ডুল হয়ে যায়।

ঝুলমুলির সইয়েরা বিরক্ত হয়। কিন্তু তা তারা প্রকাশ করতে চায় না। ফলে খেলা কেন ভুণ্ডুল হল তা ঝুলমুলিও ধরতে পারে না। সইয়েরা ঘরে ফেরার কালে আড়নয়নে ঝুলমুলির বিনুনির আগার পদ্মফুলের দুলুনি দেখে। বিকেলের মরা আলোতে ফুলটা ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঝুলমুলির গায়ের কুচকুচে কালো রংকে ওই ফুলটাই যেন গোলাপি আভাযুক্ত করে তুলেছে! মাদারজানির সকলেই দেখে, ছলিমুদ্দির কুচকুচে কালো মেয়েটা হঠাৎ করে গোলাপি রঙে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে!

বাঘিয়ার বিলে হঠাৎ করে এতসব ভজঘট শুরু হয় যে, ছলিমুদ্দির তৃতীয় মেয়েটির কথা মাদারজানির লোকেরা প্রায় বিস্মৃত হয়ে যায়। এমনকী তার বিনুনির আগায় দেখা নেতানো পদ্মফুলের কথাও তাদের আর স্মরণ হয় না! বা হঠাৎ করে কেন তার কুচকুচে কালো মুখে গোলাপি আভা ফুটে উঠেছিল, সে-কথাও তাদের আর মনে থাকে না! অবশ্য ঝুলমুলির কথা বিস্মৃত না হয়ে তাদের উপায়ও থাকে না। কারণ, ততদিনে বাঘিয়ার বিলের পদ্মবনে নতুন কিছু পক্ষীর আগমন ঘটেছে। পানকৌড়ি, কানিবক আর ধলাবকের মাঝে ওইসব পক্ষীরা মাথা নেড়ে নেড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মাথায় ময়ূরের মতো ঝুঁটি আর লেজের দিকে ছড়ানো পুচ্ছও তখন নেচে ওঠে! এই পাখিগুলার গায়ে্র বরণ কোকিলের মতো কালো। কিন্তু কণ্ঠ বেসুরো! তারা পদ্মফুলের পাপড়ি খেয়ে বেঁচে থাকে। পদ্মপাতা জোড়া দিয়ে সংসার পাতে। পদ্মের বড়োসড়ো পাতার উপর তিড়িংবিড়িং করে নেচে বেড়ায়। আর জোড়া বেঁধে মিলন হলে নারী পাখিটার ডিম দিতে লাগে চব্বিশ দিন। এই চব্বিশ দিনই থাকে তার সংসারের আয়ু। ডিম পাড়া সারা হলে সংসার ফেলে অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যায়। তখন নারীটির পরিত্যক্ত পুরুষসঙ্গীটি আর কী করে? নিয়ম করে সে-ই ডিমে তা দেয়। তা দিয়ে দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। মাদারজানির লোকেরা এমন আজব-গজব কায়-কারবার দেখে একেবারে তবদা মেরে যায়! ইতোপূর্বে এমন করে বিল জুড়ে পদ্মফুল ফুটতে তারা দেখে নাই। এমনকী ডিম না-ফুটিয়ে অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত পক্ষীও তারা দেখে নাই!

ঝুলমুলির চোখে বিস্ময়ের পাহাড় জমতে থাকে।

মেয়ের আনমনা ভাব লক্ষ করে আম্বিয়া খাতুন কী ভাবে সেই জানে? সে নিজ থেকেই মেয়েকে বলে— এইগুলা হইল জলময়ূরী। পানির মইদ্যে সংসার পাতে। পানিতই সংসার ভাঙে। ফের পানিতেই পয়দা দেয়। পানির ফুল খাইয়াই এরা বাঁইচা থাহে।

ঝুলমুলির চক্ষে তখন বিস্ময় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। বাঘিয়ার বিলের রহস্য দেখতে দেখতে সে এতটাই বেভুলো হয় যে, নিজের তলপেটটা কখন ঢিবি হয়ে ওঠে সে খেয়াল করে না। ঢিবি হতে হতে ফুলে ওঠে। এতটাই ফুলে ওঠে যে, ঝুলমুলি সেই পেটের আড়ালে পড়ে যাওয়া নিজের দুইখানা পা-ও দেখতে পায় না।

আম্বিয়া খাতুন একদিন মেয়ের ওই বেঢপ পেট দেখে চমকে ওঠে!

ঝুলমুলির ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবে সেই জানে?

ঝুলমুলির কালো শরীরে মারের দাগ স্পষ্ট বুঝা না গেলেও কালসিটে চিহ্ন দেখে মাদারজানির লোকেরা জড়ো হয়ে যায়। ঝুলমুলিকে এমন মারধর কে করল তা জানতে তারা ছলিমুদ্দির উঠানে ভিড় জমায়। এত লোকজনের জমায়েত দেখে ঝুলমুলির মনে হয়— আইচ্ছা বিলের বাড়ন্ত পানির বেবাক কি আমাগোরে উডানে ঢুইক্যা পড়ল? নইলে এমুন কইরা ঢেউয়ের শব্দ হুনা যাইতাছে ক্যান?

ঝুলমুলি যাকে ঢেউয়ের শব্দ মনে করে তা আদতে আম্বিয়া বেগমের কান্না। মুখের ভেতর আঁচল গুঁজে দিয়ে সে চাপা কণ্ঠে কেঁদে চলে আর বলে—

হায় হায় গো! আমাগোরে এত বড়ো সব্বোনাশ কে করল গো?

অকস্মাৎ মাদারজানির লোকেদের ঝুলমুলির বিনুনির কথা মনে পড়ে। লম্বা বিনুনির আগায় ঝুলন্ত পদ্মফুলের কথা মনে পড়ে। এবং সেই সাথে তারা এটাও স্মরণ করতে পারে যে, একদা ছলিমুদ্দির কন্যা ঝুলমুলির মুখমণ্ডলে গোলাপি আভা দেখা দিয়েছিল। যার ফলে ছলিমুদ্দির কালোকিষ্টি মেয়েটা অপূর্ব লাবণ্যে ঝলমল করে উঠেছিল।


মাদারজানি গ্রামের লোকেরা যা হোক একটা কিছু বিহিতের চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয় না। ইস্কান্দারও অবশ্য প্রথম প্রথম কিছুই স্বীকার করতেই চাইল না। সেও নানান কিছুর দোহাই দিতে থাকে। যেমন—

দেইহুন তহন এমুন মাছ উজাইয়া আইল, ঝাঁকে ঝাঁক মাছ। এত মাছ! আমি তো কস্মিনকালেও এত মাছ দেহি নাই। এমুন মাছের আমদানি দেইখ্যা আমার মাথাত কিছু গণ্ডগোল পাহাইয়া থাকতে পারে। আমার কাছে তহন ওই কালি ঝুলমুলিরেই কিনা এক্করে পরি মনত অইছিল! দেইহুন মাইনষের হগল কামেই মাইনষের আত থাহে নাহি? এই যে বাঘিয়ার বিল পদ্মফুলে সয়লাব অইয়া গেল এইডাও তো আঁতকা ঘটনা মানে কুনু গায়েবী ব্যাপারেও অইতে পারে! তাই আমিও হয়তো মাছেগুলার কারবারে বা পদ্মফুলের ঘোরে পইড়া এই কামডা কইরা ফেলাইতে পারি।

মাদারজানির লোকেরা তখন একসাথে কথা বলে উঠে। এত লোক কথা বললে কিছুই বুঝার উপায় থাকে না, শুধু গমগম শব্দ শোনা যায়। আর ইস্কান্দার পলকে বুঝে যায় ঘটনা গুরতর! অবশ্য এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো ঝুলমুলির ম্লান-মলিন-ক্লান্ত চেহারা দেখে নিজের সংযুক্তি স্বীকার করে নেয়। হয়তো ঝুলমুলির গর্ভস্থ শিশুটির জন্য তার মন দয়ার্দ্র হয়ে ওঠে। বা ঝুলমুলির নিঃশব্দ অশ্রুপাত তাকে বিচলিত করে তোলে! ইস্কান্দার নিজের সন্তানের জন্য এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ঘটনার ইতি ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সালিসি ক্রমশ নিষ্পত্তির দিকে এগোতে থাকলে জমির চেয়ারম্যান একেবারে বেঁকে বসে। ওই চালচুলাহীন ছলিমুদ্দির মেয়ে কোনোদিন তার ছেলের বউ হতে পারে না। সে ইস্কান্দারকে তেড়েফুঁড়ে মারতে গেলে গ্রামবাসী বাধা দেয়।

আরে করতাছুইন কী? ভাই না ভালা, হোনেন এইবার মাতাডা ঠান্ডা কইরা ভাইব্যা দেহুন। এহন এই মাইয়াডার গতিক কী অইব? মাইয়াডার তো জলে কুম্ভির আর ডাঙ্গায় বাঘ খাড়াইয়া রইছে। মাইয়াডা অহন যাইব কই?

লোকজনের এইসব উপযাচক কথাবার্তায় উপশম কিছু হয় না, উলটা চেয়ারম্যানের মেজাজ টঙ হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু জনরোষের ভয়ে তেমন গলা চড়ে না তার।

বাপের তোপের মুখে দাঁড়িয়ে ইস্কান্দার রা করতে পারে না। যেহেতু সেও এখনও বেকার, বিষয়টা সহসা সে একাকী সামলাতে পারবে তেমনও তার মনে হয় না। প্রায় বোবা হয়ে থাকা ইস্কান্দারকে জমির চেয়ারম্যান প্রায় হিড়িহিড়িয়ে টেনে নিয়ে যায়। কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ সে দেয় না! ইস্কান্দারও ঠিক সদ্যোজাত বাছুরের মতো বাপের পিছু পিছু হেঁটে চলে যায়। ইস্কান্দার জানে, জমির মিয়া এই বিষয় কিছুতেই মেনে নেবে না! ছলিমুদ্দির হাড়হাভাতে ঘরের ওই কালোকোলো মেয়েকে সে পুত্রবধূ রূপে কিছুতেই গ্রহণ করবে না।

জমির চেয়ারম্যান সত্য সত্যই তার রোখ থেকে এক পা-ও নড়ে না। মাদারজানির লোকেরা বিষম সংকটে পতিত হয়। এক্ষণে তারা কী করবে? ছলিমুদ্দির পাশে গ্রামের দুই/একজন দাড়িয়ে যায়। মেম্বার লস্করের পুত্র তাজুল লস্করও দাঁড়িয়ে যায়। সে-ই দুই/একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে ঝুলমুলিকে মামলা ঠুকতে বলে। মামলা করার সংবাদ শুনে জমির চেয়ারম্যান রাতের অন্ধকারে ছলিমুদ্দির বাড়িতে আসে। যা হোক কিছু একটা যদি দফা রফা করা যায়— কোর্টকাছারি বড়ো হুজ্জতের ব্যাপার।

আম্বিয়া খাতুন আঁচলে মুখ ঢেকে বিনবিনিয়ে কাঁদে। এত বড়ো সব্বোনাশ কি টেকা দিয়াফয়সালা করন যায় নাহি? চেয়ারম্যান সাহেব কী কয় এইগুলা? মাইয়াডা এম্নেই কালা। এত বড়ো কলংকের পরে তারে আর বিয়া করব কেডায়?

রাগে-দুঃখে অপমানে আম্বিয়া খাতুন ঝুলমুলির পিঠে গাম্মুরগুম্মুর করে দুই ঘা বসিয়ে দেয়।

মরারশুকির কপালে কি আজরাইলও জুটে না? যা মর গিয়া। গলায় দড়ি দিয়া মর গিয়া। আমারই দুষ। আমিই তোরে আস্কারা দিয়া মাতায় উডাইছি।

ঝুলমুলি বুঝতে পারে না মা কেন তাকে মরতে বলছে? সে মারা গেলে গর্ভের বাচ্চাটার কী হবে? তাহলে তো সেও মারা যাবে।

বাংলা সিনেমায় কতবার সে দেখেছে নায়ক এসে ঠিকই নায়িকাকে উদ্ধার করে। ইস্কান্দার ঠিকই তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু ঝুলমুলির এই আশা দিবাস্বপনের মতোই মিলিয়ে যায়। ইস্কান্দার আসে না। বদলে দুই লাখ টাকায় কিছু একটা রফা হয়। রফাটা কী হয় তা ঝুলমুলি জানতে পারে না।

আম্বিয়া খাতুনের ফোঁপানিও ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। আঁচল চেপে কান্নার বদলে তার মুখে পানের রস টসটস করে।


চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া সেই দুই লাখ টাকায় তরমুজের ফলন বাড়ে। তবে এই ফলন ছলিমুদ্দির জমিতে নয়। আম্বিয়া খাতুনের বোনের ছেলে শফিকুল্লাহ সুদের বিনিময়ে ওই টাকাটা নিয়ে তরমুজের ক্ষেতিতে লাগিয়েছে। ঝুলমুলির ইজ্জতের দামে তরমুজের কালচে রূপ পরিমিত মাটি-সারে খোলতাই হয়। সবুজ সবুজ পত্র-শাখা ফনফনিয়ে বাড়ে। শফিকুল্লাহ সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে!

এইবার ফলন ভালো অইলে খালুজানরে সুদের কিছু টেকা বেশি দিয়া আইমু। বাচ্চাডার খায়-খইরচা আছে। মাইয়াডাও ঘাড়ের উপর চাইপ্যা আছে।

ঝুলমুলির কোলে কুসুমকলি খলখলিয়ে হাসে। কুসুমকলির উচ্ছ্বল হাসির মাঝেই মাদারজানিতে ফের বাদলার কাল এসে পড়ে। আসমান ফুটো করে অবিরাম জল ঝরে পড়ে। আর বাঘিয়ার বিলে জল থইথই করে। কচুরিপানার বেগুনি রঙের ঘোর পাশ কাটিয়ে এন্তার পদ্মফুলও ফোটে। মাদারজানির জোয়ান ছেলে-ছোকরারা ফের জাল-পলো-বঁড়শি নিয়ে বিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেম্বারের তাগড়া ছেলে তাজুল লস্কর কই-শিঙ্গির ঝাঁক তুলে খালুই ভরে ফেলে। কই-শিঙ্গির সাথে সে কিছু ভুতকিয়া মাছ জালে তোলে। ওই ভুতকিয়া মাছ মারার কোন ফাঁকে জলে ডুব দিয়ে সে একটা পদ্মফুলও তুলে আনে। সেদিন ঝুলমুলির লম্বা বিনুনির আগায় ফের গোলাপি রঙের আভা দেখা দেয়।

মাদারজানির লোকেরা চমকে ওঠে! তাদের পলকে মনে পড়ে যায় ঝুলমুলির কন্যা কুসুমকলি জন্মানোর পূর্বে তারা এ-মতো দৃশ্য দেখেছিল!

বাঘিয়ার বিলের জলস্তম্ভ দেখে ঝুলমুলি ফের উদাস হয়। ঢেউয়ের পর ঢেউ দেখে সে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। এবার তার বিনুনির আগায় ঘন ঘন পদ্মফুলের শোভা দেখা যায়। এর কয়েকদিন বাদেই চেয়ারম্যান বাড়িতে আচনক শিশুর কান্না শোনা যায়। শিশুর কান্না শুনে মাদারজানির লোকেরা উন্মুখ হয়ে ওই বাড়ির দিকে ধাবিত হয়।

একদিন মেম্বারের ছেলে তাজুল লস্করকে মাদারজানির কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে ছলিমুদ্দির কন্যা ঝুলমুলিকেও কোথাও কেউ দেখে না।

বাঘিয়ার বিলে আগের মতোই ঢেউয়ের পর ঢেউ ওঠে। ঢেউয়েরা যখন ভেঙে পড়ে তখন পদ্মফুলের ছেঁড়াখোঁড়া পাপড়ি ভাসতে দেখা যায়। আর পদ্মের বিশাল বিশাল সবুজ পাতার উপর জলময়ূরীরা আনন্দিত চিত্তে নেচে বেড়ায়…

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

অন্তর আর বাহির। আশাকরি তাঁর নগ্নতার প্রেক্ষিতটা কেমনভাবে দেখা উচিত কিছুটা বোঝা গেল।

উওমেন স্টাডিস, সোসিওলজি এইসব ডিসিপ্লিনের পোকা মাথায় রেখে লাল দেদের বাক পড়তে গেলে খণ্ড দর্শন হবে। তিনি দল গড়েননি, ভক্তও দলও নন। তিনি মুখে মুখে বাক রচনা করেছেন কিন্তু প্রথাগত ঢং-এ কাব্য লেখেননি। কিন্তু মুখে মুখে যা বলেছেন সেইসব বাকের কাব্য সুষমা বজায় রাখতে একজন সচেতন কবির সৃষ্টির মতোই শব্দের নিপুণ প্রয়োগ করেছেন, ছন্দ বেঁধেছেন। তাঁর বাক গভীর দর্শন ও ভাবের সুতোয় গড়া তবু প্রথাগতভাবে তিনি কবি বলে পরিচিত নন তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন কবীরও তো দোঁহা বলার কারণে নিছক কবি পরিচয়ে সুখ্যাত নন কিন্তু তাঁর দোঁহা কী কাব্য মাধুর্যহীন? হলে’তো কেবল একজন গুরুর মতাদর্শের দাসত্ব করার কারণেই অনেক আগেই লোকমানসের হৃদয় থেকে ঝরে যেত। লাল দেদ, কবি এবং একজন ইন্টেলেকচুয়ালের সব বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় শিশুকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনের মধ্যে বড়ো হয়েছেন এবং সেই পরম্পরার টানে সাধিকা হয়েছেন, কিন্তু সেটা ছিল তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু একজন একাধারে বড়ো কবি ও ইন্টেলেকচুয়াল তো কোনো ডিসিপ্লিনকে নিছক রিপ্রেজেন্ট করে ক্ষান্ত হতে পারেন না, সে-সব বিপ্লবী বা রিফর্মিস্টদের কাজ। এমন মন নিয়ে অনেকেই লাল দেদ, কবীর পড়েন, কিন্তু বিশ্বাসের কাব্যময়তাকে না বুঝে আবোলতাবোল বলেন, লেখেন।

“ইম পাড় লাল্লি ভা’নি তিম হৃদি আঁখ”

লাল্লা যা বলেছে—

“তোমার হৃদকমলে তা আখর চিহ্ন হয়ে আছে”

এরপরে যেটা বলার লাল দেদ গান লেখেনেনি এবং তিনি যে গান গাইতেন এমন কোনো তথ্য কোনো মান্য সংকলনে নেই। অনেক পরে মুখে মুখে চলে আসা তাঁর বাক কাশ্মীরের সুফিয়ানা কালাম-এ গীত হত, তার মানে এই নয় এগুলো গান অথবা লাল দেদ গান গাইতেন। জয়লাল কাউলের কথায়, “কখনো কখন গ্রীয়ারসন বাকগুলোকে, গান বলে উল্লেখ করেছেন। এটা বলা দরকার যে-কোনো পদ এবং সে-প্রেক্ষিতে, বা কোনো টেনে আনা গদ্যাংশও সুর লাগিয়ে গীত হতেই পারে, এবং তা গানে পর্যবসিত হয়, কিন্তু যে-অর্থে নানকের স্তব গুরুবাণী, বা মীরার ভজন বা অন্যান্য ভক্তিবাদী সাধক-কবিদের গান, সেই নিরিখে লাল দেদের বাক গান হিসেবে গীত হবে সেই উদ্দিষ্টের কারণে ‘গান’ নয়। বা বলা যেতে পারে প্রচলিত লোকগান (চকরি) বা কাশ্মীরি ভস্তন গানগুলো যেমন নিজেরাই শিল্পানুগ জিগিরেই গান হয়ে ওঠে, এই বাকগুলো নিজেরাই গান হয়ে ওঠে না। লাল দেদের বাকগুলো প্রধানত ভারী ভাবনার নিগূঢ়তায় আর গভীরতায়, কিন্তু সে-অর্থে সাংগীতিক গুণসম্পন্ন নয়। এগুলো গান হয়ে বিস্ফোট ঘটানোর চেয়ে আমাদের অন্তরের দিকে তাকাতে বলে, বলে চিন্তা করতে আর প্রতিবিম্বিত হতে। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাকগুলি প্রায়শই আমাদের আতুর অনুভবকে নাড়া দেয়।”

“আমি সাতবার হ্রদটিকে দেখেছি শূন্যে উধাও হয়ে যেতে”

কাশ্মীরি ভাষাকে গড়ে তোলার গড়ার কারিগর হিসেবে, এবং ভাষা ও সাহিত্যে এই দুই ক্ষেত্রে লাল দেদের যা ভূমিকা তার প্রেক্ষিতে আধুনিক কাশ্মীরির জননী হিসেবে লাল দেদকে দাবি করার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। কেবল মাত্র কালানুক্রমে নয়, বরং আধুনিক কাব্যের মেজাজ ও শৈলীর নিরিখে তিনি কাশ্মীরি ভাষার আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রথমা। তাঁর কবিতা আধুনিক, কারণ তা জায়মান আজও। বস্তুত তিনি কাশ্মীরিদের, তাঁদের মাতৃভাষাকে এবং গণজন হিসেবে নিজেদের আত্মাকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছেন। লাল দেদের জীবনকালের পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে কাশ্মীরি ভাষা হয়তো সুলতানদের বা সামন্ত প্রভুদের কৃপা পায়নি, হয়তো এটি সরকারি ও উচ্চকোটির ভাষা, ফারসির, দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও একে দাবিয়ে রাখা যায়নি, কারণ, এর পিছনে ছিল গণজনের সমর্থন এবং লালা দেদের বাকের প্রভাবে, সাধারণ কাশ্মীরি লোকেরা, যারা এতদিন নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা পদগুলোকে কেবল গুপ্তবিদ্যা মনে রাখার কারণে, অথবা সেইসব গুপ্তবিদ্যাকে ধরে রাখতে, স্মৃতিবৃদ্ধির ব্যবহারিক হিসেবে লিখত, তাদের গভীরতম ভাবনা আর অনুভবকে নিজেদের মাতৃভাষায় ব্যাক্ত করতে, ব্যবহার করতে শুরু করল। সে-কারণেই হিন্দু কী মুসলমান এমন একজনও কাশ্মীরি নেই যার জিভের ডগায় লালা দেদের কোনো-না-কোনো বাককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথবা এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে না। লালা দেদের বাকেই প্রথমবার কথ্য ও লৌকিক কাশ্মীরি ভাষা ও বুলি, ধর্মীয় বা রাজকার্যের ধরাবাঁধা পথে নয়, ব্যবহৃত হয়েছিল আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা ভাবনা ও অনুভবকে ব্যক্ত করতে। জয়কাল কাউলের ভাষায়, “উচ্চকোটির সঙ্গে সাধারণের, বিশেষত সাধারণের নিজেদের মধ্যে, যোগাযোগের তিনি নতুন নতুন প্রণালী খুলে দিয়ে ছিলেন। তাঁর গুরুত্ব কেবলমাত্র ঐতিহাসিক নয়। অন্তর্নিহিত কারণ হল, তিনি কাশ্মীরি ভাষার আজও অবধি মান্য অগ্রগণ্য কবিদের একজন হিসেবে রয়ে গেছেন এবং কাশ্মীরি ভাষার এক কারীগর, যা একজন অসাধারণ মৌলিক কবিই পারেন, এমন একজন কবি যাঁর কবিত্ব, স্যার রিচার্ড টেম্পলের ভাষায় ‘বহ্নিমান, পোড়ায় এমন এক ভাবনার রক্তিম আগুন।” আর গ্রীয়ারসনের বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণে, লাল দেদের বাক হল, “পূর্বে কেবল যা তত্ত্বে আবদ্ধ ছিল তেমন এক ধর্মের বাস্তবিক অনুশীলন করে দেখানো, প্রাণবন্ত ও চিত্রল ভাষার এক বিবরণে। ভারতবর্ষের অন্যতম অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রণালীর ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনার প্রামাণিকতাকে কায়া দিতে, যা অবশ্যই ভিত্তি গড়ে দেবে, এর অবদান অনন্য। এখানেই আধ্যাত্মিকতার দস্তাবেজ বা প্রমাণ হিসেবে এর স্বাতন্ত্র্য নিহিত, এবং আপনি যদি, একইসঙ্গে কবিতা ও আধ্যাত্মিকতার ব্যবহারিক মূল্যের প্রতি তীব্র অন্বেষী হন, তবে মৌলবী রুমির ভাষায়, নিহিত যা—

“এমন দৃষ্টি দিয়ে, যা বাকের শক্তিকে বৃদ্ধি করে
অনুপ্রাণিত বাক দিয়ে, যা দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ করে।”

এবং এটা আমাদের হৃদয়ের গরাদহীন জানালাগুলো খুলে দেয় আত্মার “পরিরেখাহীন অপরিমেয় দৃশ্যমানতা”-র দিকে।

লাল দেদ কোথায় আলাদা, এটা বুঝতে তাঁর মানস-শিষ্য নুর-উদ-দিন ঋষি বা নুন্দ ঋষির সুরুখ বা বাকের (যা ঋষিনামা বা নুরনামা পুঁথি হিসেবে লিখিত হয় নুন্দ ঋষির মৃত্যুর প্রায় দু-শো বছর পরে, এবং সুফি সাধকদের ক্ষেত্রে এমনটা প্রায়শই হতে দেখা গেছে) সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, বিষয়ের দিক থেকে তাঁর সুরুখ ছিল মুখ্যত নীতিমূলক এবং স্বরের দিক থেকে উপদেশমূলক যেখানে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে বলেছেন, বলেছেন এর সুখময়তা নিয়ে এবং মানুষকে আত্মসংযম ও ভক্তি কীভাবে কর্ষণ করতে পারে সে-ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রাজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি আর বলিষ্ঠ কথনে ঋদ্ধ করেছে ভাষাকে এবং প্রবাদতুল্য হয়ে উঠেছে। রহমান রাহির ভাষায়, “কিন্তু লাল দেদ হলেন আলাদা: এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যালোপদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে বাগধারার শক্তিতে, এবং ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত বাক্যালংকার আজও অতুলনীয় যা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে… তাঁর বাকে পাই রহস্যময় সত্যের প্রতি এক স্বপ্রত্যয়নকারী প্রগাঢ় চেতনাকে, যা ঈশ্বর-উপলদ্ধিকারী সন্তের পরিচায়ক।” রহমান রাহি, আরও স্পষ্ট তুলনা টেনেছেন তার ভাষায়, “এমনকি শেখ নুর-উদ-দিন’এর বাক, যাকে সুরুখ বলে, ভাবের দিকে ভাসা ভাসা এবং বিষয়বস্তু লাল দেদের বাকের সঙ্গে মেলে, যদিও লালা দেদের বাকের সঙ্গে তুলনীয় নয়। লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, যেখানে শেখের সুরুখ গতায়ু ছাইয়ের স্ফুলিঙ্গ। উভয়ের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এই দুই রহস্যবাদী কবির। শেখের সুরুখে যতটা নীতিমূলক ততটা জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে না, তাঁর সুরুখ আমাদের মর্মে আঘাত করে হৃদয়ে আলোড়ন তোলে না। যে-উপমা ও রূপক তিনি ব্যবহার করেছেন তা বিশদকারী ও ব্যাখ্যামূলক কিন্তু যাপিত অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জল প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি।” “এর বাইরেও, ছন্দোগত তফাত আছে, লাল দেদের বাকের তুলনায়, সুরুখগুলো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ও নির্ভুল, স্পষ্টত ফারসি বাহার (মাত্রিক)-এর ধাঁচায় নির্মিত। লাল দেদের বাকগুলো অনেকখানি নমনীয় ও শিথিল, এবং স্যার গ্রীয়ারসন তাঁর বাকে বাচনভঙ্গির (শ্বাসাঘাতের) ওপর জোর দেওয়াটাকে বুঝতে পেরেছেন, প্রতি প্যারা বা লাইনের ওপর চারবার শ্বাসাঘাত। যদিও লালা দেদের বাকের ক্ষেত্রে যা হয়ছে তা নুন্দ ঋষি বা অন্যদের ক্ষেত্রেও হয়েছে, অর্থাৎ, অনুগামীরা, চারণেরা, নকলনবীশিরা, নুন্দ ঋষির মৃত্যুর সময় থেকে দু-তিনশো বছর গত হবার পরেও যখন সুরুখগুলো নুরনামায় লিখিত হল, সেই একই দূষণ ঘটিয়েছিল। পরিচিত শব্দ দিয়ে মূল শব্দের বদল, এমনকী কখনো আরও ‘উত্তম’ কোনো শব্দ, যেমন, এমনটা একটা শব্দ যা ধর্মীয় গোঁড়ামির পক্ষে বেশি উপযুক্ত, এতে সুরুখটিকে ছন্দের দিক থেকে আরও নির্ভুল করে তোলে, যদিও তা পদটির অন্তর্গতভাবকে উন্নতভাবে প্রকাশ করতে দরকারি ছিল না।

“সুই মাস মে’ লাল্লি কভ পানুনুই বাক”

“আমি, লাল্লা, আমি নিজের বাকের সুরা পান করেছি।”

মানুষ পুরোনো কিছু রাখে না, লাল দেদ প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি, যেমনটা পাহারের গুহার ছবি প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি বলে দেখি, আর এটাই চলমান নতুনত্ব। লাল দেদের কবিতা মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী কবিদের বচন বা কবিতা থেকে আলাদা, তিনি কৃষ্ণের বঁধুয়াদের, যেমন দক্ষিণ ভারতের সন্ত অন্ডাল এবং রাজপুতানার রাজকুমারী মীরার প্রেক্ষিতে ছিলেন এক সম্পূর্ণ বিপরীত গোত্রের। তিনি সম্ভবত, আমরা বলতে পারি, সমস্ত ‘স্ত্রী’ ঈশ্বর অন্বেষীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরুষালী। ভক্তিবাদী কবিতার চেয়ে বরং লালা দেদের অবদান হল আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সংকলনে আর অন্তরদৃষ্টিতে। তিনি লোকজনকে অনায়াসে প্রাপ্ত কোনো ধর্ম দেননি, তিনি যাকে বলে, “অনতিশীল সন্ত-কবি” ছিলেন না। তিনি মধ্যযুগের প্রথম নন বরং প্রাচীন ভারতের সন্তদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর বাক অনেকখানি উপনিষদের মতো, ডঃ ভি রাঘবন যেমন বলেছেন, “‘মধ্যযুগের সন্ত-কবিদের’ ভক্তিবাদী গানের মতো নয়, বরং প্রবচনাত্বক এমনকী কখনো বিরল আধ্যাত্মিক পর্যবেক্ষণে অঙ্গীভূত রহস্যপূর্ণ।” লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী সন্তদের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু লাল দেদের কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে অন্যান্যদের থেকে। লাল দেদের জীবনের কেন্দ্রীয় ঘটনা হল প্রতিভাস, তার সর্বোত্তম পাওয়া, কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। তবুও তিনি যেন নিজের সঙ্গে তর্ক জোড়েন, এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে, কিছু একটা আছে, যা আমাদের জানতে হবে। জয়লাল কাউলের ভাষায়, “… তাঁর বাকের ছন্দ অনেক অবিন্যস্ত আর অন্তমিলের বিন্যাস অনেক বেশি অসম। এ-কারণে সম্ভবত অনুমানপূর্বক ঝুঁকি নিয়ে বলা যায় লাল দেদের বাক, এমনি মূলের গঠনেও, কাশ্মীরি ভাষার পুরোনো থেকে নবরূপে রূপান্তরে একটা গুরুত্বপূর্ণ আখর চিহ্ন… নিছক ভাবনা কী মতবাদ বা অভিজ্ঞতা কবিতা নয়। তারা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন কবির কল্পনার “শরীরি জোর” থাকে, সেটাই সে-সবকে মূর্ত করে, এবং “আকার দেয়”। এখানে কল্পনা ভিন্ন চেহারায় গভীর আধাত্মিকবোধের শব্দ ও রূপকে আর তাদের দীপ্তিতে একজনের অনুভূত সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রকাশিত। এছাড়া অন্য আরেকটা ভাব আছে যা সত্যি। তাঁর বাকগুলো বারে বারে পড়লে, অন্তরে একটা শ্রদ্ধার ভাব উদ্ভুত হয় এবং শোধনের নীরব প্রক্রিয়ায় গহন আত্মোপলব্ধি জায়গা করে নেয়।” সে-কারণেই তাঁর প্রভাব এমন কালোত্তীর্ণ ও সুদূরপ্রসারী, যদিও তিনি কোনো কৌম, উপদল বা সম্প্রদায় গড়েননি, যেখানে তাঁর অগ্রপথিক, মহান শৈব দার্শনিক ও গুরুরা একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। লাল দেদ এক পৃথক গোত্রের যাঁর কাছে জীবন তার অর্থ হারিয়েছে, আর মৃত্যু হারিয়েছে তার আতঙ্ক। লাল দেদের স্বয়ং এই ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’, সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। “তসু না বো না ধ্যায়ে না ধ্যান…” এখানে না সে আছে, না আমি/না, ‘ভঙ্গি চিন্তার’,/না দরকার নেই ধ্যানের,/এমনকী সবকিছুর স্রষ্টাও ভুলে গেছেন।

লাল দেদ সাহিত্যে বা দর্শনে ইচ্ছাকৃত কোনো অবদান হিসেবে বাকগুলো রচনা করেননি, না তিনি গেয়েছিলেন এইসব বাক, না ভক্তিমূলক শ্লোক বা গান কীর্তনের জন্যে কিছু করেছিলেন, যেমনটা করেছিলেন পরবর্তীর সাধক-গায়কেরা। তিনি না ছিলেন ধর্মপ্রচারক বা সংস্কারক। তাঁর বাকগুলো ছিল প্রধানত তাঁর আত্মার প্রসারণ, তাঁর অন্তরের অভিজ্ঞতার এক প্রকাশ, বা কখনো, সেটা যদিও খুবই কম ঘটেছে, তা হল তাঁর চারপাশের বহির্জগতের ঘটমানতা। এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যোপলদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনন্যসাধারণ বাগধারার শক্তিতে। ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত, এক অতুলনীয় বিভা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে। তিনি শিব ও শক্তিকে দূর থেকে অমৃত সারসের মতো মিলিত হতে দেখেন কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। প্রকৃতি আর পুরুষ, নাম আর রূপের সদা পরিবর্তনের প্রকাশ আর স্ব-স্থায়ীত্বের নির্লিপ্ততার সাক্ষী হওয়া, সম্পূর্ণ দুটো অসম বাস্তবতা নয়, না অখণ্ড চিৎ নিষ্ক্রিয়। লাল দেদের ‘স্বয়ং’-এর ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’। সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। তিনি বলেন—

“তারপর, আমি ভেতরের আলো বাইরে ঝাড়লাম।”

না, লাল দেদ বিতৃষ্ণা থেকে মানব শরীর অন্তর্নিহিত পাপী এবং দুষ্ট এমন কিছু বলেন এবং না তিনি কঠোর সংযম বা শরীরের রিপুদমনের পরামর্শও দেন, বরং বলেন—

“শীত থেকে বাঁচতে কাপড় চাপাও
খুদা নিবৃত্ত করতে খাবার খাও”

তিনি বলেন শরীর আধ্যাত্মিক বিকাশের এক যান, এটা একটা ধর্মাক্ষেত্র, ধর্মের জমিন।

“যখন বেঁচে, তখন তাঁকে দেখতে পাও না
তবে মরার পর তাঁকে দেখবে কেমনে”

অথবা

“এটাই ঈশ্বরের আবাস
আমি দেখেছি তাঁকে আমার নিজের গেহে”
‘এই যে শরীর’ তিনি বলেন, “এর আলো আর দ্যুতি আছে।”

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

“সামসারাস আয়াস তাপসি
বোধা-প্রকাশা লো বুম সহজ”

“এসেছি বসুন্ধরায় এক তপস্বিনী আমি,
‘আমি’-র পথে ‘বোধ’ আলো দেখিয়েছে আমাকে”

লাল দেদের সঙ্গে কিংবদন্তি আর আশ্চর্য গল্পের সহবাস জন্ম থেকেই। পণ্ডিত আনন্দ কাউল (১৮৬৮-১৯৪১), তাঁর জন্ম সম্পর্কিত এমন কিছু অদ্ভুত কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন, তাঁর পূর্বজন্মে লাল দেদের বিয়ে হয়েছিল পানদ্রেনথানের জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে, যেখানে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের এগারোতম দিন, কহ্নেথুর অনুষ্ঠানে, তাঁদের পারিবারিক পূজারী সিদ্ধা শ্রীকান্তকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই শিশুটা আমার কে?’— ‘কেন?’, সিদ্ধা বলেন, ‘এ তো তোমার ছেলে’।— ‘না’, লাল দেদ বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি মারা যাব আর মারহম গ্রামে এক বাচ্চা ঘোটকি হয়ে জন্ম নেব, এই এই চিহ্ন নিয়ে। যদি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে উৎসুক হন, এক বছর পরে মারহম গ্রামে এসে দেখতে পারেন।’ শ্রীকান্ত সেই গ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সেই চিহ্ন-সংবলিত বাচ্চা ঘোটকির সন্ধানও পান। তাকে প্রশ্ন করতেই, সেই বাচ্চা ঘোটকি তাঁকে বলল যে, সে এখুনি মারা যাবে। সে বলে, আরও ছয় মাস পর ভেজিব্রর গ্রামে কুকুরছানা হয়ে সে জন্ম নেবে আবার, আর তিনি সেখানে গিয়েই তখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। অবিলম্বে, হঠাৎ করে, নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটি বাঘ তীব্র বেগে এসে বাচ্চা ঘোটকিটিকে খেয়ে ফেলে। শ্রীকান্তের উৎসুকতা অত্যন্ত প্রবুদ্ধ হয়ে পড়ায়, তিনি কেবল ভেজিব্রর গ্রামে নয় তাঁকে অনুধাবন করতে যেখানে চিহ্ন-সংবলিত কুকুরছানা দেখতে পাওয়া গেল সেখানে গেলেন আর সেখানে গিয়ে তিনি কুকুরছানাটিকে আবার কোন জন্মে অন্য কোথায় দেখা হবে, এই প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর এটা চলল তাঁর ষষ্টজন্ম অবধি। তারপর, সপ্তমবার, লাল দেদের পুনর্জন্ম হল পানদ্রেনথানের সেই একই পরিবারে, যেখানে তিনি প্রসবের এগারোতম দিবসে মারা গিয়েছিলেন। যেখানে বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হল পাম্পোরের দ্রাঙ্গাবালমহলে বসবাসকারী নিচাভাট নামের ব্রাহ্মণ পরিবারের এক যুবকের সঙ্গে। যে-পাম্পোর হল রাজা অজতপুরার মন্ত্রী পদ্মর (৮১২-৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপন করা প্রাচীন পদমপুর। এটা তখন, যখন তাঁর বাপের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, বধূবেশী লাল্লা শ্রীকান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেন: ‘ছেলেটি আমার কোনো এক পূর্বজন্মে আমার কোলে জন্ম নিয়েছিল, আপনি জানেন সেই আজ এখানে আমার বর।’ শ্রীকান্তের সব মনে পড়ে যায় আর বিস্মিত হয়ে পড়েন।

সন্তবৃত্তের কিংবদন্তিগুলোর সূত্রের খোঁজ পাওয়া অথবা তাদের গুরুত্ব, যদি কিছু থাকে, অনুধাবন করা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। মৃত্যুর পরে আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে লাল দেদ বিশ্বাস করতেন। তাঁর বাকেও নিজের পূর্বজীবনের ঘটনাবলির উল্লেখের নজির আছে। এই নিত্য সময়কালের ধারায় তিনি স্মরণ করেন, তিনি জগতের এবং অন্যান্য সব বিদ্যমান বস্তুর লয় প্রত্যক্ষ করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের পুনর্গঠনও। আরও অনেক কিংবদন্তি আছে লাল দেদকে নিয়ে, যেমন, শ্রীকান্ত ‘চান্দ্রায়ণ’ নিয়েছিলেন, এ হল চল্লিশ দিনের উপবাস আর রিপু দমনের উগ্র প্রায়শ্চিত্ত। একদিন সকালে লাল্লা তাঁর বাড়ি আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন কোথায় ছিলেন তিনি। তিনি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন এ-কথা জানার পর, লাল্লা মৃদু বিদ্রূপের সঙ্গে বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখছিলাম তার ঘোড়াটা লাথাচ্ছে নন্দমার্গের তৃণভূমিতে।’ সামান্য ভিন্ন আরেকটি মন্তব্য পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ, নন্দমার্গে তার ঘোড়াটাকে নুন খাওয়াচ্ছিল।’ শ্রীকান্ত তার মন্তব্য শুনে অপমানিত বোধ করলেন, কারণ, তাঁর মন সত্যিই উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, গ্রীষ্মকালে তৃণভূমিতে তাঁর ঘোড়াটাকে অন্য একটা ঘোড়া লাথি মারছে। তারপর লাল দেদ সিদ্ধাকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকৃত কেমন হওয়া উচিত তার নমুনা করে দেখান, তিনি মাথার উপর একটা মাটির হাঁড়ি রাখেন আর অন্য একটা হাঁড়ি পায়ের উপর এবং ক্ষীয়মান চাঁদের মতো, তাঁর শরীর ক্ষীয়মান হতে থাকে, পনেরো দিনের দিন ঘোর অমাবস্যায় তাঁর শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এক ফোঁটা কম্পমান পারদ ছাড়া, তারপর শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় তাঁর শরীর আবার পূর্ণতা পায় ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিনে। আশ্চর্য হয়ে গুরু জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁড়ির মধ্যে সর্বদা পারদের মতো তরলটা কী ছিল?’ ‘এটা ছিলাম আমি,’ লাল দেদ উত্তর দেন। অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা মন ও অহম, শরীরের সব উপাঙ্গ কর্তিত করেও আমি কাঁপছিলাম এই ভেবে যে, আমি হয়তো গৃহীত হব না, নিছক আত্মরিপু দমনে কোনো মুক্তি নেই। শেষমেশ ঈশ্বরের কৃপায় তা মেলে। গুরু বুঝতে পারেন শিষ্যা গুরুকে পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুসলিম আখ্যানকার, পীর গুলাম হাসানও এই কাহিনির অন্য এক চেহারা দিয়েছেন। বলা হয় লাল দেদ শুদ্ধাচারি শব্দ আবৃত্তির প্রথাগত ভঙ্গির বদলে রহস্যময় আচার, নফি-ও-ইসবত, (অর্থাৎ, না বা ‘লা ইলাহ’, ও হ্যাঁ বা ‘ইল্ল-লাল-লাহ’), করে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের নমুনা এক মুসলিমের কাছে পেশ করেছিলেন।

লাল দেদ ধার্য আচার আর অনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনিয়তা এমনকী বিগ্রহ ও ছবি পুজোকেও ছাপিয়ে গেছিলেন। বস্তুত, মূর্তি পুজো, বলি, তীর্থযাত্রী হয়ে দেবতার থান ও পবিত্র স্থানে যাওয়া, নিছক শাস্ত্র আওড়ানো, উপবাস, বা নির্দিষ্ট আচার, এ-সব বাহ্যিক ক্রিয়া করেই যারা তৃপ্ত হতেন তাদের ভর্ৎসনাও করতেন। আসলে অসার ক্রিয়াকর্মকে গুরুত্ব না দেওয়াটা একজন শৈব যোগিনীর কাছে না ছিল কিছু অধর্ম, না ছিল অস্বাভাবিক। ত্রিক পন্থার গুরু বা আগমরাও এমনটাই বলছেন। যোগী তাঁর প্রাত্যহিক অর্চনা, মন্ত্রোচ্চারণ ও জল ব্যতিরেকেই করেন, তাঁর হোমও জপমালা ছাড়াই, তাঁর ধ্যান এমনি আচারহীন সম্পাদন, ফুল ও আনুষাঙ্গিক জিনিসের পুজো ব্যতিরেকেই তাঁর যজ্ঞ। ত্রিক মতে, মালা জপা কী ঠাকুরের নামোচ্চারণ এবং পুজোর নিমিত্তে শ্লোক আওড়ানো এ-সব নিম্ন স্তরের অর্চনা, আবার হোমে ও পুজোয় নৈবেদ্য চড়ানো আরও নিম্নের থেকেও নিম্ন স্তরের অর্চনা। নিম্ন মেধার লোকের কাছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান বিগ্রহে অথবা প্রতীক চিহ্নে আর একইরকম নিরর্থক উপবাসের তুচ্ছ মান ও মূল্য। ঈশ্বরকে সাধনা করতে হবে সেই একজনের মতো ভেবে যার হাত পা পেট বা কোনো অঙ্গই নেই, কেবল সচ্চিদানন্দ ও প্রকাশ।

ধর্মের আনুষ্ঠানিক ভক্তির এই অন্তঃসারশূন্যতাকে লাল দেদ তাঁর বাকে এভাবে দেখান—

“হে মূর্খ, প্রকৃত কাজ নিহিত থাকে না
উপবাস বা কী অন্য অনুষ্ঠানিক আচারে
অথবা
মূর্তি নিছক পাথর
মন্দিরও পাথর বৈ কিছু না
মাথা থেকে পা অবধি পাথর।”

একদিন লাল দেদ বড়ো মাটির শঙ্কু আকৃতি (তাগারা) ঘড়ার মধ্যে বসেছিলেন আর মাথায় চাপিয়ে ছিলেন অনুরূপ আরেকটি ঘড়া, আর নিজে ছিলেন এই দুই-এর মধ্যে লুক্কিয়ায়িত। যারাই তাঁকে এমনটা করতে দেখেছিলেন হতভম্ব হয়েছিলেন এবং এর কিছুক্ষণ পরে ওপরের ঘড়াটা সরানো হলে তাঁরা দেখেন সেখানে আর কিচ্ছু নেই আর এই কিবংদন্তি অনুয়ায়ী এইভাবেই তাঁর মহাপ্রস্থান হয়।

লাল দেদ চলে গেলেন, কোনো প্রথাগত পরম্পরা না রেখেই। তাঁর দেহটি যেখানে পোড়ানো বা কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে কোনো সমাধি বা মন্দির অথবা মকবরা কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। স্মৃতিচিহ্ন বলতে একটা তরাগ বা জলাশয়, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা লাল্লা তরাগ বলে পরিচিত ছিল, যেখানে অমরনাথ যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা ডুবকি দিত।

“মারায়াম না কুনহ তা মারা না কাঁসি
মারা নেচ তা লাসা নেচ”

“আমার কাছে জীবন মৃত্যু সমান
আনন্দে বাঁচা আর আনন্দে মরা
আমি কারোর জন্যে শোকাহত নই,
না শোকাহত কেহ আমার জন্যে।”

আমার গুরু এক নিদান দিয়েছেন কর্মবিধির—

“চোখ না ফিরিয়ে চেয়ে থেকো অন্তরের দিকে,
সেঁটে রেখো অন্তরাত্মায় অটল।”

আমি, লাল্লা, হৃদয়ে নিয়েছি নিদানখানি, নগ্ন তাই জগৎময় আমি নৃত্য করেছি শুরু—

আমাদের পক্ষে লাল দেদের জীবন ও তাঁর বাকের সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তাঁর জীবনকাহিনি রহস্যে আর কিবদংন্তির চাদরে ঢাকা, যাদিও আজও নানা কাশ্মীরি প্রবাদে ও লৌকিক বুলিতে এমন কিছু বাক্য পাওয়া যায় যা লাল দেদের জীবন সম্পর্কিত কোনো-না-কোনো কিবদংন্তির সঙ্গে জুড়ে আছে। তাঁর মুখে মুখে বলা বাক বলে যা পরিচিত সে-সবের প্রামাণিকতা নিয়েও নানা দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

লালা দেদ, না কিছু লিখে রেখে গেছিলেন, না কেউ স্বকর্ণে শুনে সে-সবের প্রতিলিপি করে রেখেছিলেন। তাঁর সমকালে তো দূর, যে-প্রাচীন কাশ্মীরিতে লাল দেদ বলেছিলেন, তা কখনো কেউ লিখে রেখেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। যে-কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের বাকগুলো প্রাপ্ত হয়েছিল তা আধুনিক কাশ্মীরি এবং কালের প্রভাবে, নিরক্ষর চারণ কবিদের বদলে যাওয়া ধর্মীয় আনুগত্যের চাপে, ফারসি শব্দের ভেজালে, হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পূর্বতন যোগ ও ত্রিক পন্থায় ব্যবহৃত নানা শব্দ ও আচার বিস্মৃত হওয়ায় মূলের শব্দ ও বাক্য অর্থ হারিয়ে ফেলায় প্রাপ্ত বাকগুলো বহু ক্ষেত্রেই মূলের থেকে সরে এসেছিল এবং তাপ্পি বা গোঁজ শব্দ জায়গা করে নিল অনেকখানি, ফলত লাল দেদের বাকের প্রামাণিকতার দ্বন্দ্ব জারিই থাকল, এবং নুন্দ ঋষির ‘নুরনামা’ কী রূপ ভবানীর ‘রহস্যাপদেশা’-য় অন্তর্ভুক্ত অনেক বাকই লালা দেদের বাক বলেও প্রচারিত ও পরিচিত, এমনকী এর উলটোটাও ঘটেছে।

যদিও লালা দেদের পক্ষে কিছু লেখা বা লিখিত কোনো পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া কোনো অসম্ভব কিছু ছিল না। তিনি লিখতে চাননি, হয়তো এটাই একমাত্র কারণ। উদাহরণস্বরূপ লাল দেদের প্রায় সমকালের শিথিকান্তার মহান্যায়াপক্ষার পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি যেমন পাওয়া গেছে। লালা দেদ না প্রকাশের জন্য কিছু লিখেছেন, না করেছেন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কিছু। বস্তুত, তিনি বাকগুলো শুধু আওড়াতেন এবং সে-সময়ের প্রথানুযায়ী, মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এ-সবই আমাদের অনুমান। কেউ, হয়তো লিপিবদ্ধ করেছিলেন সে-সব বাকগুলো ছাড়াও আরও কিছু, অন্য কয়েকটি, যা তিনি হয়তো ঘটনাচক্রে নিজে অথবা অন্যের থেকে শুনেছিলেন। এবং এভাবেই চলেছে যতদিন না এ-সব কথকতার অঙ্গীভূত হয়ে গ্রাম্য ভ্রামণিক চারণদের গানে, এবং পরবর্তীতে আজও কাশ্মীরি ধ্রুপদি সংগীত, সুফিয়ানা কালামে মজলিস-এ-মা’রিফিম, বা সুফি বা আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের জমায়েতের শুরুতে পবিত্র আবাহন হিসেবে গীত হতে শুরু করল। এত দুষণ সত্ত্বেও লাল দেদের বাক বেঁচে রয়েছে এবং এর মধ্যেও অন্তত প্রায় শ-দেড়েকের বেশি বাককে লালা দেদের বাক বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু কেউ কেউ বলতেই পারেন সেটারই বা কী প্রামাণিকতা?

আমাদের লালা দেদের বাকের অন্তর্গত নিজস্ব প্রমাণাদির কাছে ফিরে আসতে হবে, এর যা কিছু প্রমাণকারী বলো, নিহিত আছে এর ভাষ্যে ও শৈলীতে। তথাপী এরও অনেকানেক সীমাবধ্যতা আছে। রাজরাজাদের উত্থান পতনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত গ্রাম্য নারী লাল্লার বাকে সমসাময়িক ঘটনাবলীর কোনো ইশারা বা প্রাসঙ্গিক উল্লেখ নেই অথবা না আছে কোনো ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট দিনাঙ্ক। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ধারণের, জন্য আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে শুধু লাল দেদের কিছু রচনাশৈলীর প্রমাণ আর ছন্দ এবং চিন্তার বিন্যাস ও গুনাগুণ, যেভাবে এগুলো কোনো একটা ভাব প্রকাশে সংগঠিত হয়েছিল, এক কথায়, লাল দেদের শৈলীর বিশিষ্টতা। এগুলো আর অন্য কিছু নয়, তাঁর বাক থেকে, অন্যের দ্বারা রচিত বা ভ্রমবশত তাঁর নামে প্রচারিত বা লাল দেদের শৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করে না এমন রচনাগুলো থেকে তফাত করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো একটি বাক যে সামগ্রিক ছাপ রেখেছে তার বৈশিষ্ট্যগুলোর সামগ্রিকতার বিচারে। যে-কাশ্মীরি সাহিত্যই আমাদের সমকালে পাই না কেন, তার সঙ্গে লাল্লার বাকের পূর্বের ও পরবর্তীর ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক তুলনা করতে গেলে যেটা দরকার তা হল, তাঁর যুগের পূর্বের ও পরের কাশ্মীরি সাহিত্যের নানাবিধ গ্রন্থ পাঠের সক্ষম জ্ঞান, এছাড়া, প্রাচীন কাশ্মীরি ভাষা থেকে ছিঁড়ে আনা টুকরোগুলো যা ত্রিক দর্শনের বিবিধ পুঁথিগুলোর প্রশ্নাবলীগুলোর মধ্যে নিহিত। সন্দেহাতীতভাবে, লাল্লার বাক রচিত হয়েছিল, যাকে সঠিকভাবে বলতে পারি প্রাচীন কাশ্মীরিতে, কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে এসেছে যে-ভাষায় তা আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক। এগুলো মুখে মুখে ছড়িয়েছে এবং বদল ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভাষার বদল ঘটেছে যেমন সেই মোতাবিক। তবু লালা দেদের বাক সমন্ধে স্যার গ্রীয়ারসনের অনুধাবন করেছেন, “লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং গানগুলোর ছন্দময়তা অটুট রেখেছিল বহুসংখ্যক সেকেলে প্রকাশভঙ্গিগুলো। এবং আমি এখানে যুক্ত করতে পারি, এই সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল কারণ কিছু পুরুষ ও নারী গুরুশিষ্য পরম্পরার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেই সরাসরি সূত্র, অর্থাৎ, গুরু ও শিষ্যের পরম্পরা, বাকগুলোকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত করেছিল, তাঁদের প্রাত্যহিক প্রত্যুষের প্রার্থনার অঙ্গ হয়ে, তাদের নিজ-পাঠের। স্পষ্টত, এঁরা, তাঁরা, যাঁরা এগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন, ধার্মিক যত্নে ও যথার্থতায়, এমনি অনেক শব্দ ও বাক্যবন্ধের অর্থ না বুঝেও, “এবং তাদের সেই শততা ছিল, বিরত ছিলেন, বাকগুলোকে বোধগম্য করার জন্য কোনো অনুমানমূলক সংশোধন থেকে।” এ-কারণেই স্যার গ্রীয়ারসন বলেন, “এই ধরনের সরংক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে লিখিত পাণ্ডুলিপির চেয়েও বেশি মূল্যবান।”

লাল দেদ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতেন এমন একটা প্রসঙ্গকে সামনে রেখে আলোচনা করাটা একটা খারাপ সংস্কার। শুনেছি উলঙ্গিনীর গান বলে একটি গানের সিডিও বেরিয়েছে। এভাবে লাল দেদকে দাগানো অনুচিত বলে মনে করি, কেন-না লাল দেদের বাকগুলোর কাব্যগুণ বিচার করতে গেলে, প্রাচীন ভারতীয় কবিতার ছন্দকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে যিনি বলেছেন, তাঁর মেধা ও মননকে, জানতে হবে তাঁর সময়কালীন ইতিহাস ও বাকগুলির সঙ্গে অদ্বৈতবাদী ত্রিকপন্থা শৈবসাধনার ‘প্রতি-অভি-জ্ঞান’-এর ধারণার সম্পর্ককে, যে-ধারা পুষ্ট হয়েছিল কাশ্মীরি শৈব তন্ত্রের বিখ্যাত দার্শনিক অভিনবগুপ্তের দ্বারা। আবার বুঝতে হবে, লাল দেদের বাকের কাব্য মাধুর্য ও গভীর দার্শনিক বোধ কেমন করে সুফি সিলসিলা ‘ঋষি পন্থা’-র বিশিষ্ট সাধক নুর-উদ-দিন ঋষি ও সামগ্রিকভাবে ঋষি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। সে-সব বুঝেই এগোতে হবে। সেখানে তাঁর পোশাক নিয়ে কাব্য আলোচনা শুরু হলে একধরনের শহুরে সাবঅর্ল্টান-স্টাডিসের চেহারা নেয়, ফলত সাহিত্য আলোচনা যে-পথে হওয়া দরকার সে-পথ হারিয়ে যায়। ভারতের শৈব সাধনার নানা ধারা সমন্ধে যাঁরা কিছুমাত্র খবর রাখেন তাঁরা জানেন লাল দেদ বা আক্কা মহাদেবীরা নগ্ন ছিলেন বা নগ্ন হয়ে ঘুরতেন এটা একটা তথ্য মাত্র না হলেও, সেইসব কাব্যধারার রসাস্বাদনের জন্য মূল বিচার্য বিষয় নয়। একটি ইংরাজি সংকলনও আছে ন্যাকেড সেইন্ট, এরকম নামে। এতে একটা ওপর ওপর দেখানো সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা চলে, যে-সবের ধার ধারতেন না লাল দেদ। কিংবদন্তিগুলোর নির্যাস নিয়ে বাকগুলো পড়তে হবে কোন পূর্বনির্ধারিত কোনো মতবাদের তোয়াক্কা না করেই। প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছে শৈব পন্থাগুলো, দার্শনিক বিতণ্ডা করেছে, খারিজ হয়েছে সমকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিবৃত্তে বা সন্তবৃত্তে। আনন্দ কাউলের অনুবাদ ও টীকা থেকে দেখতে পাই তিনি সুলতানদের ক্ষমতার বলে ইসলামীকরণের নিমিত্তে নতুন ধর্মান্তরিতদের দিয়ে চরবৃত্তি করানোকেও কটাক্ষ করেছেন। দুই ধর্মের প্রথাগত মেইন্সট্রিম তাই তাঁকে শতকে পর শতক নাকচ করেছে। লাল দেদের সেই নগ্নতা, নিয়ে মানী গবেষক জয়লাল কাউল কি লিখেছেন দেখি— “একটা কিংবদন্তি গড়ে ওঠে, এবং নাছোড় হয়ে থাকে যে, তিনি ঘুরে বেড়ান নগ্ন হয়ে, নৃত্য করে, গান গেয়ে পরমানন্দ ক্ষিপ্ততায়, যেমন করতেন পুরাণের হিব্রু নবি আর তুলনামূলকভাবে এখনকার দরবেশরা, যে তিনি ঘুরে বেড়াতেন প্রায় নগ্ন হয়ে। সেটা সত্য হতেই পারে কিন্তু তিনি যে দরবেশদের মতন ঘূর্ণনাচ নেচে বেড়াতেন, এটা এমন এক প্রতিবেদন যে, কাশ্মীরি শব্দ নৎসুনের সঙ্গে যায় না। শব্দটা বোঝায়, কোনো কোনো প্রসঙ্গে নৃত্য করা, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হয় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরে বেড়ানো বোঝাতে; বাকের প্রেক্ষিতে পরের অর্থটাই বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর কাছে বেশি মূল্যবান ছিল যে, তাঁর অন্তরাত্মার জন্য তিনি আর নিজের বহিরাবরণের দিকে ফিরে তাকাবেন না। সেই জন্যই তাঁর কিছুই মনে হবে না, যদি তিনি নগ্ন হয়েই চলে যান যেদিকে খেয়াল তাঁকে নিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কী-ই-বা আছে নৃত্য করার? যার জন্য তিনি অন্তরের দিকে চেয়ে থাকবেন? এটা ঠিক প্রত্যয়জনিতও নয়। পরে সত্যিই একটা সময় আসে যখন তাঁর নৃত্যের সেই প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে যায়। “পরমানন্দে ঈশ্বরের সঙ্গে বিত্তবিনিময়ের”: মে’ সে’ তা পানাস দ্যুতুম শোহ। কিন্তু তখনও সেটা আসেনি, সে-সময় আসেনি। তখনও অবধি তাঁর গুরুর বাণী, আত্মজ্ঞান অর্জন করতে পার্থিব এই জগৎকে হারিয়ে ফেলতে হবে, যা ছিল তাঁর কাছে এক বেদনাদায়ক ‘সব হারানোর ফোসকা (রাভান তভ’ল)”। গ্রিয়ারসন যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন ভাবাটা ভাষার ওপরে জুলুমই হবে অতিশয়। উপরন্তু, এই শ্লোকের কল্যাণেই এর পর থেকে পাম্পোরের পদ্মাবতী লাল দেদ (লাল ঠাকুরমা) বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁর পেটের নীচ দিকের থলথলে ভাবের জন্য, যা ঢিলে হয়ে তাঁর তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে ঝুলে থাকত। তাঁর নামের বিষয়ে এই তথ্য মেনে নেওয়া যদিও খুব কঠিন। বা, সাম্প্রতিক কিছু লেখকের যেমন অনুমান, লাল্লা লীলা বা লোল শব্দদ্বয়ের অপভ্রংশ। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পক্ষে এমন ভাবনা অন্যায্য। লাল্লা, মনে হয়, প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটা নাম। আর, খুব সম্ভবত এটা ছিল তাঁর কুমারী নাম। তিনি এই নাম ব্যবহার করতেন তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলার সময়, এই নামটা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজেকে উল্লেখ করার সময়। যেমন, যখন তাঁর বন্ধুদের তিনি বলেছেন, “লালি নালাবথ সালি না যানহ”, যেখানে নিজেকে বললেন, লালি, (লাল্লাকে), সে-সময় লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন, একজন গৃহবধূ, ‘পরিব্রাজক তপস্বিনী’ নন। তাছাড়াও, নিজের বাকে নিজেকে যখন উল্লেখ করেছেন, তিনি এই একই নাম, লাল (বা লালি, লা’লি, যেটা কাশ্মীরি ব্যাকরণে অন্য আরেক রূপ) ব্যবহার করেছেন, আর এই নাম তাঁর ১৮৪টি বাকে অন্ততঃপক্ষে ২১বার উচ্চারিত হয়েছে, ১০৯টি গ্রিয়ারসনের, ৭৫টি আনন্দ কাউলের। শব্দচর্চায় এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মূল কাশ্মীরি ভাষায় লাল বা লাল্লা-র উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন।”

শেষ পাতা

Categories
প্রবন্ধ

অলক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড

ভারতীয় সংগীতের প্রতিটি অলিগলি আলাউদ্দিনের শ্রুতিতে উজ্জ্বল তো ছিলই। তার সঙ্গে তিনি মিশিয়ে ছিলেন বাংলার লোকায়ত মেজাজকে। বাংলার মাঠ ঘাট এমনকী ফুটপাথেও তো তাঁর কেটেছে বহু বিনিদ্র রাত। এছাড়াও ছিল প্রত্যক্ষভাবে ব্যান্ডে বাজানোর অভিজ্ঞতা। দেশি ও বিদেশি যন্ত্রে। হাবু দত্তর থিয়েটারে বিভিন্ন দেশি যন্ত্রের বাজানোর অভ্যাস, ফোর্ট উলিয়ামের এক সাহেবের কাছে বেহালায় নিখুঁত পশ্চিমী হার্মনির শিক্ষা, উজির খাঁর থিয়েটার দলে পার্শ্বসংগীত সংযোজনার দায়িত্ব— এ-সবই চলছিল শাস্ত্রীয় গানবাজনা অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গেই। সে-অভিজ্ঞতা মাইহার ব্যান্ডে আশীর্বাদ হয়ে গেল। সারাজীবন ঘুরেছেনও প্রচুর। দেশের বাইরে অনেক জায়গায়। ভলগা নদীর পাড়ে বসে বেঁধেছিলেন ‘ভলগা ধুন’। সুরের সেই নিরীক্ষা অসামান্য। পাশাপাশি ‘কাফি ধুন’ (ওয়েস্টার্ন)— শুনতে কিছুটা সোনার পাথরবাটি মনে হলেও জ্যাজ-এর রিদম আর কাফির আরোহণ-অবরোহণের কাটাকাটি সুরানুলেপন— এতেই চমৎকার বৃন্দাবাদন। আসলে পাশ্চাত্য হার্মনিকে অত্মস্থ করতে আলাউদ্দিনের সময় লাগেনি বেশি। ‘দেশ’ রাগটিকে দুইভাবে ভাবলেন আলাউদ্দিন। প্রথমে ছয় মাত্রার সাধারণ দাদরায় কোমল বা শান্ত ছবি। এবং সেই অনুযায়ী সম্মিলিত বৃন্দবাদনে খানিক নমিত স্বরানুশীলন। তারপরে তার চেহারা অন্য। একই সরগমে ঝোড়ো ‘দেশ’। এ-হেন অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই আনকোরা। নিরীহ সব দেশি যন্ত্রে আমাদের অভ্যস্ত শ্রবণ একক যন্ত্রসংগীত শুনতেই শিখেছে কেবল। ব্যান্ড বা অর্কেস্ট্রা বলতে সাধারণভাবে এখন বোঝায় বিপুল গ্র্যাঞ্জারকে। রিলায়েন্স কাপ বা সাফ গেমসে কত যন্ত্রীর সহযোগিতায়, সর্বাধুনিক স্টুডিওতে কত লক্ষ টাকার বিনিময়ে কী মহৎ সৃষ্টি সম্ভব হল, সে নিয়ে কাগজে স্কুপ রিপোর্টিং-এর ছড়াছড়ি। তাদের পাশে মাইহার ব্যান্ডের জায়গা না হওয়ারই কথা।

একদিক থেকে তা বোধহয় ভালোই হল। বাংলার কীর্তনের অমন বিশ্বাসযোগ্য সমবেত রূপ এমন সান্তুর, অনুভূতিকে উসকে দেওয়া প্রসন্নতায় শোনাতে পারতেন কি তাহলে মাইহার ব্যান্ডের সদস্যরা? অ-প্রচারেই ওঁদের গৌরব। ‘সখি বহে গেল বেলা’-র আকর সংগীত বাংলা পুরাতনীর ‘উঠিতে যুবতী বসিতে যুবতী’। তাকে বন্দিশ করেই এই কম্পোজিশন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যে-নলতরঙ্গ বিপুল বিক্রমে ঝড়ের গতিতে দেখিয়েছে তার সাধ্যের নমুনা, এই মধ্যলয়ের দাদরা কম্পোজিশনে তার ভূমিকা তখন কেবলমাত্র মন্দিরায়। আশ্চর্য মমতায় কতিপয় মধ্যপ্রদেশীয় যুবক কীর্তনের মূল মেজাজের উজ্জ্বল উদ্ধারে নেমে পড়েছে যেন। চেলোর গাম্ভীর্যের পাশাপাশি সেতার, সরোদ আর বেহালার ক্ষীণ সুর (ইচ্ছে করেই আঙুলে তার চেপে ধরে স্বরকে অর্ধস্ফুট করছিলেন ওরা), প্রায় থেমে আসা তবলার শীতল সৌন্দর্য সুরস্রষ্টার ভাবনা আর শিল্পীদের অধ্যাবসায়ের জ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছিল যেন। আর শুনেছি ‘মালকোষ’, ‘মালহূয়া কেদার’, ‘সিংহ’, ‘ইমন’, ‘হেমবেহাগ’। শুধু মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানেই নয়, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন বা কালীঘাট কালীবাড়ির আয়োজনেও। নিবেদনের মুনশিয়ানায় বাস্তবিকই চমৎকৃত হতে হয়।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাকেই ওদের এক-আধজনের সময় সুযোগ মতো পাকড়াও করেছি। রামলাখন পাণ্ডে। চোস্ত ইংরেজি বলেন। কোনো স্কোপ যদি পাওয়া যায়, এই আশায় এটা ওটা প্রশ্ন করতে করতে তাকিয়ে দেখি জুটে গেছে আমার মতো অনেকেই। তাঁদের একজন, আগ্রহের অতিশয্যেই সম্ভবত এগিয়ে দেয় এক নামি ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট। এবং সঙ্গে সঙ্গে— ‘না দাদা, বহুত শুক্রিয়া। আই লাইক দিস ভেরি মাচ’ বলেই জামার পকেট থেকে বের করেন আদি অকৃত্রিম একটি বিড়ি। ভিড় হটিয়ে ওঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পথে মনে হচ্ছিল, এইভাবেই বোধ করি ওঁরা সবরকম প্রলোভন জয় করে স্বস্থানে আছেন আজও। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিখেছেন পাণ্ডেজি। কিছু স্মৃতিচারণ আশা করছিলাম। স্পষ্ট জানালেন— ‘না ভাই, বলার মতো তেমন কিছু নেই। দেখলেই পালাতাম। অসম্ভব ভয়। আমিও শিখব না, উনিও শেখাবেন’। বলেই পিঠের দিকে নির্দেশ করেন। বহু চড়-কিল আর অপার স্নেহস্পর্শের দাগ সেখানে। কথার মাঝেই হাজির শৈলেন শর্মা। মধ্য-ত্রিশের ছটফটে ব্যক্তিত্ব। ওঁর নলতরঙ্গ বাদনের মতোই। জানালেন— ‘আমার কিন্তু মনে আছে। বাবা প্রথমে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সরোদ। তো, কিছুতেই সুর বেরোয় না। আর যা বেরোয় তাই বেসুরো। বাবা হঠাৎ এমন এক প্রশ্ন করলেন যা শুনে আমার মতো অনেকেই হতবাক। শুনবেন সে-কথা? ওঁর প্রশ্ন ছিল, শরীরে দুধ কোথায় থাকে? লজ্জায় কান-চোখ লাল, তবু মার খাওয়ার ভয়ে নির্দেশ অনুযায়ী দেখাই। ব্যাস, অমনি আমার কানটি ধরে বলেন, মা যেমনভাবে দুধ খাওয়ায় ছেলেকে, হাতে সরোদ নিতে হবে ঠিক সেই ভঙ্গিতে। এই হলেন বাবা’। বেশ গুছিয়ে বলে শৈলেন। ওঁকেই প্রশ্ন করি, আপনারা তো লেখাপড়া শিখেছেন, স্বরলিপি-পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তবে কেন এইসব অমূল্য সুরারোপকে নোটেশনে আনছেন না? ভেবেছিলাম, বেকায়দায় পড়ে যাবেন এ-প্রশ্নে। উলটে আমাকেই ফেলে দিলেন বেকায়দায়। পৃথিবীর প্রধান অর্কেস্ট্রা দলগুলির বিষয়ে সুনিশ্চিত খবর রাখেন ওঁরা। তুলনায় এলেন এইভাবে— ‘বাজানোর পদ্ধতি হল দুটো, একটা অ্যাকটিভিটিস, অপরটি আবহন। নোটেশন-ভিত্তিক বিবিধ ক্রিয়াকলাপে গড়ে ওঠে প্রথমে ধরনের পদ্ধতি। আর আমরা স্মৃতির দরজায় ঘা মেরে সুরকে আবাহন করি। দুইয়ের একটা পার্থক্য থাকবে না? এবার আসি আপনার প্রশ্নের উত্তরে। আমরা সকলেই বাজাতে জানি একাধিক যন্ত্র। মানে, আজ আমি যদি অসুস্থ থাকি, কাল রাম সুমন সেতারব্যাঞ্জো ছেড়ে নলতরঙ্গে এসে ঠিক কাজ চালিয়ে দেবে। এছাড়া, প্রতিদিনের অভ্যাসে কোনোরকম ভুলচুক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পণ্ডিতজিও এ-সবের বিরুদ্ধে। স্বরলিপি একবার হয়ে গেলে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার পরিবর্তন বিরাট প্রমাণ হিসাবে পরে গণ্ডগোল বাঁধাতে পারে। তার থেকে আমাদের শ্রুতিই বেশি অথেনটিক; আর সত্যি কথা বলতে কি, এতে মেধা বাড়ে, বাড়ে শ্রদ্ধাবোধ, সংগীতকে সর্বদাই ভালোবাসতে হয়। তাই, বাবার যা কম্পোজিশন ছিল তা আজও অটুট আছে। একটি সরগমও পালটে যায়নি। অনেকে বলেছেন, এর জায়গায় অমুক করলে ভালো শোনাত। আমাদের পণ্ডিতজি বলেন, গীতাকে কেউ পালটাতে পারবে? কেউই নয়। বাবার শেখানো সব কিছুই আমাদের কাছে সাক্ষাৎ গীতা। শত চেষ্টাতে তা পারব না পালটাতে’। চমৎকার কথা বলেন গিরিধারীলালও, অথচ কিছুতেই ওঁর সামনাসামনি হতে পারছি না। কোনোমতে পাওয়া গেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ৫৭ হরিশ মুখার্জি রোডে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই ধরতে হবে গিরিধারীলালজিকে। খেয়েদেয়ে অনেকে বেড়িয়ে পড়বেন কলকাতা দেখতে। বিশ্রাম নেবেন খালি গিরিধারীলাল। বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছে যাই যথাসময়ে। কিন্তু কোথায় তাঁরা? শুনলাম বাহাদুর খাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন সবাই। আর দুপুরে ধ্যানেশ খাঁর ওখানে সকলের নেমন্তন্ন। তবে, গিরিধারীলাল বলে গেছেন, এখুনি ফিরবেন। সুতরাং রকে বসে ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা। অতঃপর ধ্যানেশ খাঁর বাড়ি থেকে খবর আসে, বাবা আলাউদ্দিনের দুর্লভ ভিডিয়ো দেখছেন ওঁরা। কেউ আসবেননা এখন। বিফল মনোরথ যাকে বলে। কিন্তু জাগছিল বিস্ময়ও। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় ছোটো-বড়ো যে-কোনো শিল্পীর আগ্রহ ওপার। এখনও খ্যাতিমান গায়ক-বাদকের ছাপার হরফে কাগজের পাতায় নিজের নাম কিংবা ছবি দেখতে কী কাণ্ডই না বাধান! অথচ, মাইহারে এই মানুষগুলি, টিভি-র ক্যামেরা, সংবাদপত্রের শিরোনাম, বিদেশ ভ্রমণ— এ-সব লোভ থেকে মুক্ত আছেন! পরক্ষণেই ভাবি, বাবা আলাউদ্দিনকে দেখেছেন ওঁরা। এর পাশে যাবতীয় আকর্ষণ তো নিতান্তই তুচ্ছ!

সুতরাং পরদিন আবার দৌড়। দুরদর্শন জোগাড় করেছেন মাইহার সরকারের অনুমতি। প্রসাদ স্টুডিয়োতে করে রাখলেন রেকর্ডিং, তিনটি আইটেমের। তাই ন-টার আগেই বেড়িয়ে পড়েছেন ওঁরা। ভবানীপুরের প্রসাদ স্টুডিয়োতে আজ খালি অডিয়ো-রেকর্ডিং। পরে একদিন ছবি তোলা হবে। উপস্থিত অন্য সকলের সঙ্গে হতবাক হয়ে গিয়েছেন খোদ স্টুডিয়ো-কর্তৃপক্ষও। যে-রেকর্ডিং দিন গড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত নিত্যদিন বিরক্তি উৎপাদন করে, তা শেষ কয়ে গেল লাঞ্চের আগেই। রিহার্সাল দরকার হয়নি, একবারের জন্যেও কোনো যন্ত্র ভুল বাজেনি। তাই প্রথম টেকেই ওকে। সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরেই ওঁরা ছোটেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামী লোকেশ্বরানন্দজির ডাকে আজ বিবেকানন্দ হলে ওঁদের বাজনা। সুতরাং গিরিধারীলালকে আজ ছাড়ার প্রশ্ন নেই। আলাউদ্দিনের বাড়ি ‘মদিনামঞ্জরী’-তেই থাকেন উনি। আর তো কেউ দেখার নেই। সাত বছর বয়সে ধরেছিলেন বাবার হাত। তখন ওঁর সঙ্গী রাজা ব্রিজনাথ সিং। বয়সে ব্রিজনাথ অবশ্য অনেক বড়ো। ছিলেন আমাদের তিমিরবরণও। আর কার কার কথা মনে পড়ে? খানিক ঘুরেই বিস্তৃত করি প্রসঙ্গ। একটু যেন ভাবেন, খানিক থামেনও। তারপর— ‘আনোয়ার খাঁ, রামস্বরূপ, ঝুররালাল, দশরথ প্রসাদ… আউর কেউ কোই’। কীভাবে শেখাতেন বাবা? বলতে না বলতে উত্তর— ‘বহুত পিটতা’। তারপরই খানিক লজ্জা পেয়ে বোধহয়— ‘সকলকেই শিখতে হত সবকিছু। রিহার্সাল হত বাবার বাড়িতে। কেউ হয়তো রিহার্সালে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র গিয়েছে, বাবা ঠিক সেখানে হাজির। বাবাকে দেখে সে দৌড় লাগিয়েছে, দৌড়াচ্ছেন বাবাও। তাঁকে ধরে বকে-মেরে, যন্ত্রের সামনে বসিয়ে শেষে আদর। আর খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সর্বক্ষণই শুধু এই বাজনা। বাবা শেখাতেন গান গেয়ে। আমাদের তা তুলতে হত যন্ত্রে, গলাতেও। না পারলে দেখিয়ে দিতেন যন্ত্রেই। ভোরবেলা নিয়ম করে রোজ শুরু করতাম পরপর ‘আহির ভায়রো’ আর ‘যোগিয়া’ দিয়ে।

অনেকের কাছেই আছে এক বড়ো মাপের ভুল ধারণা, মাইহার ব্যান্ডের মোট সদস্য সংখ্যা না কি আশি-পঁচাশি। সে-প্রসঙ্গ তুলতেই ফোকলা দাঁতে হেসে ফেলেন গিরিধারীলাল। মোট পনেরোজন, ঝুররালালই শুধু আসতে পারেননি। মাইহার সরকারের অবশ্য একটা স্কুল আছে। তবে তার সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক একেবারেই নেই। সরকার ওঁদের দিয়েছেন রিহার্সালের জায়গা। সেখানে অনুশীলন চলে রোজ, সকাল আটটা থেকে এগারোটা। ছুটির দিনেও। যন্ত্র দেন সরকার। ‘শুধু একটা জিনিসই সেই মাপে পাই না আমরা,’ বলছিলেন দুই তবলিয়া। অনুষ্ঠানের টাকায় তাঁদের কোনো অধিকার নেই। ব্যক্তিগতভাবে বাজানোর ক্ষেত্র কম। সারা মাসের পরিশ্রমের বদলে ওঁরা পান গ্রাসাচ্ছাদনের ন্যুনতম ভাতা— সরকারি স্কেলে। ওঁদের দাবি অবশ্য কিছু বেশিই। এ নিয়ে অসন্তোষ যে ক্রমশ দানা বাঁধছে, তা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

সেতারব্যাঞ্জোর তার পরীক্ষা করছেন রামসুন্দর চৌরাশিয়া। চন্দ্রসারং সারাঙ্গা— এইসব যন্ত্র নিয়ে কথা চালানোর ইচ্ছে। বললেন— ‘বাহাদুর খাঁর বাবা আয়েত আলী খাঁ মাইহারে গিয়ে বাবাকে উপহার দিলেন ওঁর উদ্ভাবন সেতার-সারোদ। একটিই যন্ত্র। বাবা তাতে লাগালেন চামড়া, দিলেন ব্যাঞ্জোর এফেক্ট। তৈরি হল নতুন যন্ত্র সেতার-ব্যাঞ্জো। প্রথমে বাজাতেন রামস্বরূপ। এখন আমি। ‘হেমন্ত’, ‘হেম বেহাগ’, ‘মরাগ মঞ্জরী’— এ-সবই ছিল বাবার প্রিয়। আমিও শিখেছি ওঁর কাছে’। কোনো বিশেষ ঘটনা? মহাজাতি সদনের কথা আগেই জানি। উনি দিলেন আর এক খবর। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে গুরুপূর্ণিমায় সকলে গিয়েছেন ওঁর বাড়িতে বাজাতে। পাণ্ডেজি (রামলাখন পাণ্ডে) হঠাৎ বলে বসলেন, আমরা ‘মেঘ’ বাজালেই বৃষ্টি হয়। ‘অমনি সকলের ধরাধরি। বেকায়দায় ফেলা যাবে, এমনটাও কেউ কেউ ভেবেছিলেন নিশ্চিত। রোদ আর আকাশের নীলে বৃষ্টি বা মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। মুখ কাঁচুমাচু করে বাজনা সুরু করেছি, অর্ধেকও হয়নি বাজানো। এমন বৃষ্টি নামল যে, ঘরদোর সব বানভাসি। অনুষ্ঠানই চালানো যায়নি।’ কী এর ব্যাখ্যা?

সে-প্রশ্নে বা প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো দরকারও বোধহয় থাকে না। বিশেষত, যারা সামনাসামনি শুনছেন মাইহার ব্যান্ড। প্রচলিত রাগ-রাগিণীর অচেনা বন্দিশের পাশাপাশি মাইহার ব্যান্ডের পাঁচ যুগের যত্নসঞ্চিত যক্ষের ধনে আড়াইশোরও বেশি রাগিণী, যেগুলির সৃষ্টিকর্তা বাবা আলাউদ্দিন। কাজে কাজেই এ-সিদ্ধান্তে আসা বোধহয় অনুচিত হবে না। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য সংগীতকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে তাদের মধ্যে মিলমিশ খাওয়ানোর সাম্প্রতিক যে-চেষ্টা ক্রমবর্ধমান, তা সার্থকতায় সম্পূর্ণ করে গেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, তার জন্য গাল বা বগল বাজানোর দরকার পড়েনি। মাইহার ব্যান্ডের এখনকার প্রজন্ম সেই মিশ্রণকে শুদ্ধ এবং অবিকৃত রাখার কাজে দৈনিক মহড়ায় প্রাণপাত করেছেন। আত্মপরিচয়ের গ্লানি ছাপিয়ে সংগীতকেই ওঁরা করে তুলেছেন পরিচয়ের হাতিয়ার। পৃথিবীর গানবাজনার ইতিহাসে এ-উদাহরণ দ্বিতীয়টি মিলবে কি? সেই পরিণাম স্বীকৃতি অবশ্য ওঁরা আজও পাননি। যেমন পাননি বাবা আলাউদ্দিন। আর তাই আলাউদ্দিন খাঁর জন্মের একশো পঁচিশতম বর্ষে সুদূর মাইহার থেকে ছুটে এসে যাঁরা শুনিয়ে গেলেন অবিস্মরণীয় সংগীত, তাঁরা হয়তো দেখেও গেলেন, মহাজাতি সদন অর্ধেক ভরেনি। এই বিস্মৃতির কোনো ক্ষমা নেই।

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

অলক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড

‘মালকোষ’ বা ‘কাফি’ আমাদের জানা বা শোনা রাগ। কিন্তু ‘মালকোষ’ কিংবা ‘কাফি’ কতটা ওয়েস্টার্ন? কী এবং কেন? আপাত দৃষ্টিতে যা সোনার পাথরবাটি, সেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সংগীতরসের মূল বার্তায় ঐক্য খুঁজে পেয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বলা যায়, সৃজনী ইমপ্রোভাইজেশনে নিজস্ব ভাবনায় রাঙিয়ে নিতে পেরেছিলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলোডি এবং হার্মনিকে। তাই ‘কাফি ওয়েস্টার্ন’ ‘ভল্গা ধুন’— রাগ-রাগিণীর এমন আপাত অশাস্ত্রীয় নামকরণ আজও উৎসাহীর অনিঃশেষ কৌতূহলের কারণ।

গেল শতকের গোড়ার ঘটনা। মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ সিং ডেকে পাঠালেন ওঁর সভা-গায়ক এবং গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-কে। মাইহারের সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষে দেশ ছেড়েছেন অনেকে। বাস্তুহারা, পরিচয়হীন কতিপয় শিশু শুধু অনাদরে অনাথ অবস্থায় এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাদের দেখবার কেউ নেই। রাজার অনুরোধ, সুর শেখাতে হবে এদের। মানে, নাড়া বাঁধিয়ে জবরদস্তি গানবাজনার পাঠ। জুটে গেল আঠাশটি ছেলে। নিতান্তই কিশোর সব। সংগীত কী এবং কেন, সেটাই জানা নেই অনেকের। ওঁদের বাবা হলেন আলাউদ্দিন। কী যে খেয়াল মাথায় চেপে গেল ওঁর। প্রথমে কোলে বসিয়ে, হাতে ধরে যন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ। তারপরে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে বাজানো। দলের নামও হল জবরদস্ত। ‘মাইহার ব্যান্ড’। মাইহার ব্যান্ড— এ আবার কী নাম? দুই শব্দের জোড়টি যেন কেমন অসঙ্গত। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সামনেও পড়তে হয়েছে আলাউদ্দিনকে। একবার বলেছিলেন তিমিরবরণ— ‘আসলে, বাবার চিন্তা ছিল একদম আলাদা। অতটুকু সব দামাল ছেলে, লেখা জানে না, পড়া জানে না, তাদের ধরে বেঁধে যদি শুদ্ধ শাস্ত্রীয় গান-বাজনার পাঠ দেওয়া হয়, সে-জবরদস্তি কি তারা শুনবে? বাবা ভাবলেন তাই অন্য পথে। শ্যামও থাকুক, কূলও। সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার ধাঁচে মাইহার ব্যান্ড। আলাপের দিকটা একদম বাদ গেল। উনি মন দিলেন তালের এক-একটি পকড় ধরে সুর রচনায়। ছোটোদের মনের উপযোগী করে শেখাতেন। খুব ভালো বুঝতেন তাদের চাহিদা। প্রথমে বন্দিশটি গলায় তুলে দেওয়া। সকলকেই গাইতে হবে, বাধ্যতামূলকভাবে। সে এক দেখার জিনিস। গলায় উঠলে পরে যন্ত্রের পাঠ। এবং সেখানেই ওঁর দূরদৃষ্টির পরিচয়। সকলকেই সব বাজনা বাজাতে হত। রিহার্সালের সময় সকাল আটটা থেকে। এখনও সে-রেওয়াজ আছে বলে শুনেছি’। শুধু বাজনাই নয়, মাইহার ব্যান্ডের গোড়ার পর্বে গানের ভূমিকাও ছিল। স্বর-সাধনা করতেন আটজন, পাঁচজন হাতে ধরতেন সরোদ, সেতারেও পাঁচজন, একটি করে বাঁশি এবং সানাই, তিনটি তবলা, একজোড়া বেহালা। চেলো, ক্ল্যারিওনেট, স্যাক্সোফোন, ইত্যাদি সবই একটি করে। একটা ব্যাপার আপাত দৃষ্টিতে পরিষ্কার। দু-একটি পাশ্চাত্য যন্ত্র, এমনকী কণ্ঠ ব্যবহারের যে-নিরীক্ষা আলাউদ্দিন করেছিলেন, তা কিন্তু ব্যান্ডের সনাতন ধারণার বিপরীতেই যায়। ধীরে ধীরে অবশ্য সে-ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের ব্যান্ড, দল হিসেবে অনেক সংহত, ছোটোও। সেখানে কণ্ঠের ব্যবহার নেই, অনুপস্থিত অত্যাধুনিক পাশ্চাত্যের যন্ত্রও। এবং সবচাইতে বড়ো কথা, যন্ত্রগুলি সবই প্রায় তার-যন্ত্র। এই অবস্থা অবশ্য একদিনে আসেনি। কয়েক দশকের অবিরাম ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনার ফসল তা।

একটু পিছনে ফেরা যাক। ১৯২৬-এ লখনৌর ভাতখণ্ডে সংগীত মহাবিদ্যালয়ে বসল ব্যান্ডের প্রথম আসর। আঠাশটি দুরন্ত বালক তখন রীতিমতো তুখোড় বাজিয়ে। তাঁদের দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন বাবা আলাউদ্দিন। এক-আধ ঘণ্টার কম্পোজিশন মনে রাখতে তাঁদের না দরকার হয় কোনো কন্ডাকটারের, না স্ট্যান্ডে ঝোলানো নোটেশন-বোর্ডের। কাজে কাজেই সংগীতচর্চা স্মৃতিনির্ভর। অধিকাংশেরই অক্ষরজ্ঞান হয়নি। এইভাবে সাত-আট বছর ধরে চলল ঘষামাজা। তারপর একদিন আলাউদ্দিন সকলকে নিয়ে সটান কলকাতায়। ১৯৩৪-এর সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অতঃপর দীর্ঘ বিরতি। ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, বোম্বাই, সার্ক সম্মেলন— হাতে গোনা কয়েকটি অনুষ্ঠানে কেবল অংশগ্রহণ। বাকি ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাবসায়ের।

আর তাই, পাঁচ বছর ‘মদিনা মঞ্জরী’-র ঘরে বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিক্ষাগ্রহণ শেষে কলকাতায় ফিরে তিমিরবরণ সেই আদর্শেই তৈরি করলেন ওঁর ‘ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা’। অমিয়কান্তি, শিবব্রত, ললিতা, সবিতা প্রমুখ ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নী সমাবেশে তিমিরবরণের পারিবারিক অর্কেস্ট্রা সমাদৃত হয় সারা ভারতবর্ষে। উৎসাহিত হন স্বয়ং উদয় শংকরও। কিন্তু, সে-অন্য কাহিনি। বাবা আলাউদ্দিনের মাইহার ব্যান্ডের ধাঁচে গুণী ছেলে আলী আকবর খাঁ-ও দেশান্তরে গড়ে তুলেছেন এমনই এক সংস্থা। জর্জ রুকার্ট, ভি-জি-যোগ প্রমুখের সাহায্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘দ্য নিউ মাইহার ব্যান্ড’ সংস্থাটি। পশ্চিমী কিছু যন্ত্র এবং কণ্ঠের ব্যবহারে আলী আকবর খাঁ মাইহার ব্যান্ডের আদি রূপটি চালু রাখার যে-পরিকল্পনা নিয়েছেন, তা ডকুমেন্টেশনের কাজে আসবে। আমেরিকায় জনাদশেক ছাত্র এই নিউ মাইহার ব্যান্ডের ক্রমাগত অনুশীলনে তৈরি হয়ে উঠেছেন। এখানেই অবশ্য শেষ নয়। সুইজারল্যান্ডে কেন জুকারম্যানও আশির গোড়ায় তৈরি করলেন ‘বাসেল মাইহার ব্যান্ড’। ভারতীয় সংগীতের বিপুল ঐশ্বর্য এইভাবেই বিদেশের দরবারেও পরম আদরণীয় হয়ে উঠল।

বাহাত্তরে সুরলোকে গেলেন আলাউদ্দিন। ৮০-র গোড়ায় দু-বার; তারপর ফের ৮৭-র নভেম্বরে কলকাতায় এলেন মাইহার ব্যান্ড। উপলক্ষ, বাবা আলাউদ্দিনেরই জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি স্মারক উৎসব। তাঁদের ডেকেছেন যথারীতি আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক। ১২ নভেম্বর। হাওড়া স্টেশন। সকলেই নামলেন ট্রেন থেকে। কিন্তু কোথায় সেই দু-জন? বলতে না বলতেই কামরার দরজায় এক বৃদ্ধ। ‘ম্যায় হুঁ গিরিধারীলাল’। দেখে আলী আকবর কলেজ অফ মিউজিক-এর নবীন প্রজন্ম আহ্লাদে আটখানা। ১৯৮৪-র সেই ভয়ংকর সুন্দর বৃষ্টির সন্ধ্যাকে যে ওঁরা ভুলতে পারেননি। সে-আলোচনা না হয় পরে। কিন্তু কোথায় গেলেন ঝুররা মহারাজ? না, আসেননি তিনি। আসার জন্য সবরকম চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও শরীরে অনুমতি মেলেনি। তাহলে কে বাজাবেন নলতরঙ্গ? সে-উত্তর অবশ্য মিলেছে যথা সময়েই।

৫৭, হরিশ মুখার্জি রোডের ছিমছাম একতলায় বসে গল্প শোনাচ্ছিলেন শেখর রায়চৌধুরী। মাইহার ব্যান্ডের স্থানীয় ম্যানেজার থেকে কেয়ার-টেকার— সবই তিনি। ব্যান্ডের চোদ্দজন সদস্য ট্রেনের ক্লান্তিতে কিছুটা অবসন্ন। ভাদুয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি আর নিখুঁত নিরামিষ রান্নার গন্ধ ভাসছে। ইতিমধ্যে দু-জন গোঁ ধরেছেন— ‘শেখরবাবু, ভায়োলিন খরিদ করনে হোগা। বহুৎ জরুরত’। ওঁদের থামিয়ে ফের একবার শুরু করেন শেখরবাবু— ‘৮৪-তে মহাজাতি সদনে ওঁদের শেষ আইটেম, রাগ ‘মেঘ’। অনুষ্ঠান শেষ হল; আর আপনাকে কী বলব, বৃষ্টিতে মানুষ সমান জল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। রিক্‌শা করে একে একে ওঁদের ডেরায় ফেরত পাঠাই। এরই মধ্যে হারিয়ে গেলেন ঐ দু-জন, ঝুররা মহারাজ আর গিরিধারীলাল’। বলেই বেহালার খোঁজে ছোটেন শেখরদা।

ঝুররালাল থেকে ঝুররা মহারাজ— দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সাধনার দুই প্রান্ত। সাধারণ রাগের আরোহণ-অবরোহণে যাঁর গা দিয়ে ঘাম ছুটত, সেই ঝুররালালকে আলাউদ্দিন প্রায় সব যন্ত্রেই পারদর্শী করিয়েছিলেন। তিনি আর গিরিধারীলাল— প্রথম আঠাশের মধ্যে বেঁচে আছেন তো মাত্র এই দু-জনই। কত বয়স হল আপনার? জিজ্ঞাসা করি গিরিধারীজিকে। ছিপছিপে, ঋজু অবয়ব। মাথায় গান্ধি টুপি। দৃষ্টি সিধে। মাইহার ব্যান্ডের সকলের ‘পণ্ডিতজি’। কানে বোধহয় ইদানীং শুনছেন একটু কম। দ্বিতীয়বার বলতে হল একগাল হেসে— ‘ইয়াদ নেহি। সত্তর সে কুছ যাদাই হোগা’। কী কী বাজাতে পারেন আপনি? প্রশ্নের পরেই বুঝেছি, একেবারে সাদামাটা মেঠো হয়ে গেল ব্যাপারটা। পণ্ডিতজি বলেননি কিছু। বললেন দলের অন্যান্য সদস্যরা। সব, সব যন্ত্রে সমান অধিকার ওঁর। এখন অবশ্য বসেন দলের মাঝখানে হারমোনিয়াম হাতে। সাধারণ তিন অক্টেভের অতি নিরীহ-দর্শন একখানি যন্ত্র, মাইহার ব্যান্ডের প্রাণ যা।

রামলখন পাণ্ডে (সেতার), সুশীলকুমার শুক্লা (হারমোনিয়াম), রামলখন শর্মা (সরোদ), গুণাকর শামলে (হারমোনিয়াম), বিজয়কুমার শুক্লা (বেহালা), গোকারণ প্রসাদ পাণ্ডে (বেহালা), সুরেশকুমার চতুর্বেদী (এসরাজ), রামসুমন চৌরাশিয়া (সেতারব্যাঞ্জো), অশোককুমার বডোলিয়া (তবলা), বিজয় দেব সিং (চেলো), রামায়ণ প্রসাদ চতুর্বেদী (সেতার), শৈলেন শর্মা (নলতরঙ্গ) এবং গিরিধারীলাল (হারমোনিয়াম)— চোদ্দজন যন্ত্রি। তিনটি হারমোনিয়াম আর একজোড়া তবলা, একটি নলতরঙ্গ। বাদবাকি সব তারের যন্ত্র। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় মহাজাতি সদনে ওঁদের শুরুর নিবেদন রাগ ‘শ্যামকল্যাণ’। কিন্তু, শ্রোতা ক-জন? বড়োজোর শ-চারেক। এরকম কেন? চমৎকার জবাব দিলেন আলী আকবর কলেজ অব মিউজিকের বর্তমান প্রধান উমা গুহ— ‘বিনি-পয়সার অনুষ্ঠান তো! বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কার্ড দিয়ে এসেছি। লোক কেন হবে ভাই?’ বাস্তবিকই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। প্রায় একক চেষ্টায় এই নিয়ে তিনবার মাইহার ব্যান্ডকে উমা গুহ কলকাতায় আনলেন। এবং আনলেন মধ্যপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করে। মাইহার ব্যান্ড মধ্যপ্রদেশ কলা পরিষদের পরিচালনাধীন। সরাসরি সরকারি সংস্থা এটি। সুতরাং তাঁদের অনুমতি পাওয়াটা যে কী কঠিন বিষয় তা উমা গুহর থেকে বেশি কেউ জানেন না। সম্পূর্ণ অ-ব্যবসায়িক এই সাংগীতিক দৌড়-ঝাঁপকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন এবং দায় তাই ছিলই। বাস্তবে কী হল? কাগজের বিজ্ঞাপনের জন্য পাওয়া যায়নি স্পনসর, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে অনেকেই আগাগোড়া নিলেন নীরব শ্রোতার ভূমিকা।

রাগ ‘শ্যামকল্যাণ’। চৌতালের আদিতে দুই মাত্রা যোগ করে চোদ্দ মাত্রার আড়া চৌতাল। তাতে সুর বেঁধেছেন আলাউদ্দিন। লয় মধ্য। যুগল তবলার ঠেকা আর বেহালা-সারোদ-সেতারের একমুখী ওঠানামা। বন্দিশটি চমৎকার। মাঝে নলতরঙ্গ। ছোটো-বড়ো বাইশটি বন্দুকের নল। সাধারণ লোহার শিক দিয়ে তাতে ঘা মেরে শুদ্ধ, কড়ি, কোমল অনুষঙ্গ কানে মেপেছিলেন আলাউদ্দিন। ঘষে, মসৃণ করে সুর অনুসারে তা বসানো কাঠের পাটাতনের ওপর। সেখান থেকে আসছে জলতরঙ্গের সুরাভাষ। একটু কড়া, হয়তো কিছুটা ধাতব, সব মিলিয়ে নিখুঁত সুরের উন্মাদনা, যা ব্যান্ডের লয়কে প্রতি মুহূর্তে বাড়িয়ে দিচ্ছে, অথচ বাড়ানোর সেই মুহূর্তটিকে আলাদা করে ধরা যাচ্ছে না। এই যন্ত্রই তাহলে বাজান ঝুররা মহারাজ। শৈলেন শর্মা কিন্তু কখনোই তার অনুপস্থিতি মনে করাচ্ছে না। অনবদ্য ভঙ্গি। দ্রুতলয়ে যখন একের পর এক কঠিন-কঠিন মাত্রায় দুরূহ তেহাইয়ের কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা তখন হঠাৎ করেই মনে এল একজন ভারতীয় জুবিন মেহেতার কথা। তার দলে শত জোড়া বেহালা, স্যাক্সোফোন, ড্রাম সেট, পারকাশান, বিবিধ বাঁশি— এ-সবের সামনে আড়াল হয়ে থাকে পাতার পর পাতা নোটেশন। বিশেষ মাইক্রোফোন, বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চ এবং বিশেষ প্রবেশমূল্য ছাড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রশ্ন ওঠে না। অথচ এই সাধারণ পোশাকের অতি-অসাধারণ ভারতীয় সংগীতজ্ঞরা শুধুমাত্র শ্রুতিতে ধরে রেখেছেন আলাউদ্দিনের রচনাকে, বংশ পরম্পরায়। এক চুল এদিক ওদিক হয়নি। ওরাই বলছিলেন, অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন এটাসেটা বদল করতে। পণ্ডিতজি অবশ্য সে-পরামর্শ মানেননি। অনুষ্ঠানের পরদিন জানালেন গিরিধারীলালও— ‘দেওয়ার আছে এখনও অনেক কিছু। বয়স হয়েছে, সেটাই ভয়। স্মৃতি তঞ্চকতা করবে না তো?’

শুধু মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানেই নয়, কালীঘাট কালীবাড়ি-প্রাঙ্গণ, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন— সর্বত্রই শুনে বুঝেছি, ওঁদের পরিবেশনের গায়ে সেঁটে আছে অরিজিনালিটির শিলমোহর। যেমন, ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’। মুখ্য যন্ত্র বেহালা, নলতরঙ্গ যেন খানিকটা চাপা। সেরকমই কম্পোজিশন। আর শুধু লয় নয়, তালের পরিবর্তনও প্রতিমুহূর্তে। তিনতালে শুরু, মাঝে হঠাৎই দাদরায় কম্পোজিশনকে আমূল পালটে নেওয়া। আবার শেষ প্রান্তে তিনটি জবরদস্ত তেহাইয়ের সাহায্যে ফের তিনতালে আসা। আর সবই ওঁরা করছিলেন একে-অপরের দিকে না তাকিয়েই। সুরে সামান্যতম বিচ্যুতি নেই। তার প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎই নিখুঁত সরগম শুরু করলেন ওরা, পুরিয়া ধানেশ্রীতেই। যেন স্বরসাধনার প্রথম পাঠ। ক্রমশ ধরা যাচ্ছিল ব্যান্ডের কেন্দ্রীয় কৌশলটিকে।

শেষ পাতা