Categories
প্রবন্ধ

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

বোলানের অন্য রূপটি হল পোড়ো বোলান বা পালা বোলান। বর্তমানে এই বোলানই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিবর্তিত হয়েছে। উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক গানই হল এ-ধরনের বোলান। বোলান গাওয়ার কৌশলটাও আগে ছিল একটু অন্যরকম। দলের সব সদস্যরা আসরে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে বোলান পরিবেশন করত। মাঝখানে থাকত বাদক, প্রম্পটার প্রমুখরা। দু-টি সারিতে দাঁড়িয়ে বন্দনা গান গাওয়া হত। প্রম্পটার প্রাধান গায়কের কানে কানে গানের পরবর্তী কলিটি শুনিয়ে দিত। প্রথম সারির গান গাওয়া হলে ওই একই লাইন গাইত পরের সারির সদস্যরা। আর ছিল দোহারী। দু-টি সারির লোকেদের একবার করে গান গাওয়ার পর দলের অন্যান্য সদস্য যারা আসরে বসে থাকত তারা গান ধরত।

মূল গায়কদের বিরতি দেওয়ার জন্যই এই প্রথা। বন্দনা থেকে শুরু করে পালা অংশ, সমাপ্তি গান সবই সংগীতের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হত।

বর্তমানে যে-বোলান পালা প্রচলিত আছে তা পোড়ো বা পালা বোলানের বিবর্তিত রূপ। এর কয়েকটি বিভাগ স্পষ্ট চোখে পড়ে—

১। বন্দনা
২। বোলান পালা
৩। পালার সমাপ্তি সূচক গান
৪। রং পাঁচালী।

বোলান পালা পরিবেশন করার আগে বিভিন্ন দেবতার বন্দনা করা হয়; যে-আসরে বোলান গাওয়া হয় সেখানে প্রকাশ হতে প্রার্থনা জানানো হয়—

“আমরা প্রথম আসরে মাগো করি বন্দনা
বাগবাদিনী বীণাপাণির চরণ দুখানা।
তুমি বিনে বাক্য কহে কোন জনের শক্তি নহে
ব্যাসাদি বাল্মিকী কহে গুণের বর্ণনা।
এস, সিদ্ধিদাতা গণপতি, পিতা যাহার পশুপতি
সিংহপৃষ্ঠে ভগবতীর চরণ দুখানা
এস ইন্দ্র চন্দ্র যম হুতাসন, যত আছেন দেবতাগণ
অরুণ বরুণ ষড়াণন করুন বন্দনা।” [৮]

কিংবা বন্দনা গাওয়া হয় এরকম—

“মঙ্গলময় তুমি শ্রীমধুসূদন
সঁপিলাম এই প্রাণ তব চরণতলে
তব কৃপা পাব বলে
এস মা সরস্বতী করি নতি করি নতি
এই আসরে দয়া করে।” [৯]

বন্দনা গাওয়ার পরেই দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া হয় আসরে কোন পালা পরিবেশিত হবে। এই ব্যাপারটাতে এখন অনেকটা যাত্রার ঢং এসে গেছে—

“শ্রী শ্রী ভোলানাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমরা শুরু করতে চলেছি এক সম্পূর্ণ পৌরাণিক বোলান পালা শঙ্খচূর বধ। রচনা গৌর নন্দী। নির্দেশনা সুবল নন্দী, পরিচালনায় বিমান নন্দী। সূধী দর্শকমণ্ডলীর শ্রীচরণধূলি মাথায় নিয়ে শুরু করছি এ বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ পৌরাণিক পালা শঙ্খচূড় বধ।” [১০]

এছাড়া কখনো কখনো অভিনেতাদের নাম ঘোষণা করতেও দেখা যায়।

এরপর শুরু হয় মূল বোলান পালা অর্থাৎ, কাহিনি অংশ। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে রচিত হয়ে থাকে তা।

বোলান পালা অভিনয়ের সময় যতটা সম্ভব গম্ভীর ও জোড়ালো কণ্ঠস্বরের আশ্রয় নেওয়া হয়। এই কারণেই স্বগতোক্তি প্রাধান্য পায়। চরিত্রের মনের প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ স্পৃহা অথবা তার পরবর্তী কার্যকলাপের প্রকাশ ঘটে সেখানে। এটা গানের মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়। লোকশিক্ষা বা নীতিশিক্ষা থেকেই যায় বোলানে। যেমন ‘শঙ্খচূড় বধ’ পালায় দর্পে অন্ধ তুলসীর স্বামীকে তুলসী পরনারীর প্রতি লোভ প্রদর্শন করতে বারণ করে। বলে—

“যে পরের নারীকে মায়ের মত দেখে, পরের জিনিসকে মাটির ঢিলা ভাবে, যে সবাইকে আপন ভাবে সেই তো পণ্ডিত।” [১১]

অথবা, চণ্ডাল হয়ে রাজার মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য যার হাত কেটে দেয় রাজা; সুযোগের পরিস্থিতিতে সেই রাজার দুর্দিনে চণ্ডাল ছেলেটি জাত পাতের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে কথা বলে এবং প্রতিবাদ করে—

“যখন দু-মুঠো ভাতের জন্য মানুষ হাহাকার করে, তখন দুঃখের কথা কেউ শোনে না। ভগবানের কাছে মনের ব্যথা জানায় যখন তখন আপনার জাতভেদ কোথায় থাকে মহারাজা।” [১২]

বোলান পালা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সেই মুহূর্তে আসরে যে-ক-জন কুশীলব উপস্থিত থাকেন তারাই সমাপ্তি গান গেয়ে থাকে। একদিকে যেমন দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া হয় বোলান পালা শেষ হয়েছে; তেমনি জানিয়ে দেওয়া হয় ‘বই বলে’ তথা প্রম্পটার, দলপতি, রচনাকারের নাম-সহ দলের ঠিকানা। যেমন ‘শঙ্খচূড় বধ’ পালার সমাপ্তি গানটি এইরকম—

“মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম
তপন নন্দী দলপতি বই বলে বিমান
রাজাপুরে মোদের বাড়ি ঠিকানা দিলাম
কয়েকজনা মিলে মোরা এদল গড়িলাম
মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম।।” [১৩]

এই গান গাওয়ার সময় অভিনেতাদের গোল করে ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়। চরিত্রের অবস্থান অনুযায়ী আচরণ এখানে আশা করা বৃথা। এই গানগুলি প্রায় একইরকম হয়ে থাকে। অন্য একটি পালার সমাপ্তি গান এইরকম—

“এখানেতে গান করি সমাধান
মহুলাতে মোদের বাড়ি।
জ্ঞানে অজ্ঞানে গাহি গো বোলান
সবে হয় যে আনাড়ি।
মহুলাতে মোদের বাড়ি।
সুখেনের রচনা করুন গো মার্জনা
হরি নামে যাবে ত্বরী।
মহুলাতে মোদের বাড়ি।” [১৪]

বোলান পালার শেষে হাস্যকৌতুক সমৃদ্ধ আদিরসাত্মক পাঁচালী পরিবেশিত হয়। তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশ্লীল হয়ে ওঠে। খিস্তি, খেউর স্বভাবতই স্থান করে নেয় সেখানে। কিন্তু গ্রামের মাটিতে লালিত, গ্রামের পুথিগতভাবে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত গ্রামবাসীকে আনন্দ দিতে সাহায্য করে এ-ধরনের পাঁচালী।

বর্তমানকালে শিক্ষার আলোয় আলোকিত একদল মানুষ বোলান দল গঠন করে লোকনাট্যের ধারাটি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও রং পাঁচালীর আদি রস থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চাইছে। আসরে বোলান পালা পরিবেশন করে দর্শকদের তারা খুব মুগ্ধ করে। কিন্তু ‘মোদের বোলান সাঙ্গ করিলাম’ বলার সাথে সাথে যখন তারা আসর ছাড়তে উদ্যোগী হয়, তখনই দর্শকদের চিৎকার ধ্বনি আসরে আছড়ে পড়ে— ‘রং পাঁচালী, রং পাঁচালী’ তাই ‘না, না’ করেও পার পাওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হয়। লোকনাট্যের একটা অন্যতম ধারা কিন্তু এই রং পাঁচালী। গ্রামীণ প্রহসন বললে খুব ভুল বলা হয় না। নিতান্তই হাস্যরসের সঙ্গে গ্রামীণ জমিদার, পাড়ার মোড়ল প্রভৃতি চরিত্রগুলিকে ব্যঙ্গ করা হয় এখানে। সে-ব্যঙ্গের ভাষায় অবশ্যই থাকে অতিরঞ্জনের সুর।

এবার আসা যাক বোলানের সঙ্গে যুক্ত লোকগুলির কথায়। কোনো তথাকথিত শিক্ষিত লোক বোলান রচনা করেন না। গ্রামেরই কোনো অল্পশিক্ষিত লোক যে সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, পৌরাণিক গল্প শুনে শুনে জেনেছে তিনিই তার আগ্রহ থেকে বোলান রচনা করেন। মূল পাঠের বানান বিভ্রান্তিই বোধ হয় তার বড়ো একটা প্রমাণ।

বোলানের কুশীলব বা শিল্পীরা দক্ষ অভিনেতা নন, অভিনয় এদের পেশা নয়, নেশা। শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষগুলি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মহড়া শুরু করেন। পারিশ্রমিক যা পায় তার হিসেব করলে পুরোটাই ‘লস’। এরা হয়তো বছরের এগারো মাস লাভ ক্ষতির হিসেব করেই চলে বা চলতে চায়। কিন্তু বোলানের সময় এরা খুশির জোয়ারে ভেসে ভুলে যায় লাভ ক্ষতির পাটিগণিত। সাধারণত পুরুষেরাই অভিনয় করে। তবে ইদানীং মহিলাদের প্রবেশ ঘটলেও তা অবাধ নয়। অন্য কোনো লোকনাট্যের দল (আলকাপ, কৃষ্ণযাত্রা প্রভৃতি) থেকে মহিলাদের ভাড়া করতে হয়। স্বভাবতই পারিশ্রমিক পুষিয়ে নেয় তারা। আর এদের অভিনয় পেশাগত।

প্রম্পটার বোলানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। অল্প কয়েকদিনের মহড়ায় বিশেষ কিছু হয় না। আসরে যেখানে অভিনয় হয় তার এককোনে প্রম্পটার বসে থাকে। বেশ জোড়েই সংলাপ ও গানের কথা বলতে হয়। তা শুনেই শিল্পীরা সংলাপ বলে ও গান করে।

মঞ্চ পরিকল্পনার ব্যাপারটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বাঁধাধরা সুনির্দিষ্ট মঞ্চ থাকে না বোলানের অভিনয়ের জন্য। মঞ্চসজ্জাও থাকে না কিছুই। শুধু কয়েকটি মাইক্রোফোন ঝোলানো হয় দড়ির সাহায্যে। শিব পূজার মণ্ডপের সামনে এর অভিনয় হয়। দর্শকেরা চারিপাশে সুবিধামতো বসে। মাঝখানে যে-অংশটুকু ফাঁকা থাকে সেখানেই বোলান পরিবেশিত হয়। চারিদিকের একটা দিকেই বোলান দল তথা গায়ক, বাদক, অভিনেতারা বসে থাকে। এটিই তাদের গ্রিনরুম। এক আসর থেকে আর এক আসরে এভাবেই বোলান গান করে মানুষকে আনন্দ দেয় তারা।

পৌরাণিক বা সামাজিক যে-কোনো পালার ভাষায় থাকে আঞ্চলিকতার ছাপ। রচনাকার যথাসম্ভব শুদ্ধ লিখতে চাইলেও কুশীলবরা আঞ্চলিক ভাষাকেই ব্যবহার করে সচেতনভাবেই। যেমন লিখিত পালায় আছে— ‘তুই ছাড়া আমার যে আর কেউ নায়’। [১৫] উচ্চারণে হয়ে যাচ্ছে— ‘তু ছাড়া আমার আর কেউ নাই’। সাধু চলিতের মিশ্রণটিও লক্ষণীয়—

“আমি তোমার অভিশাপ শিরোধার্য করিলাম, তবে আমি তোমায় অভিশাপ দেব না’। [১৬]

শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষগুলি বোলানকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়, বোলান দল গড়ে ওঠে। ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বিবাদ এ-সময় মিটে যায়। এক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা পস্পরের সঙ্গে। হয়তো কোনো বছর নিতাই সাজে মহিমের বৌদি, সারা বছরের জন্য মহিম নিতাইকে বৌদি বলেই ডাকে, সঙ্গে গ্রামের আরও পাঁচজন। রসিকতার সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য গ্রামের মানুষগুলোও নাওয়া খাওয়া ভুলে বোলান শোনে; আর শেষ হলে অপেক্ষা করে পরের বছরের।

নাগরিক সভ্যতা থেকে বহু দূরে, শহরের প্রান্তসীমার নাগালের বাইরে পল্লির মুক্তাঙ্গনের গীত বোলান গান। মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগের প্রভাব আজ গ্রামেও পড়েছে। তাই বোলান সেখানে অনেকটা মর্যাদা হারিয়েছে। তবে লোকসমাজের বাসিন্দারা আজও প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে বোলান গানকে টিকিয়ে রাখার। আর এ-জন্যই এত পরিবর্তনের ঘটা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সহযোগিতার অভাব আজ বৃহত্তর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি গ্রামীণ মানুষগুলির ভালোবাসা না থাকলে এ প্রকার সহযোগিতা সম্ভব নয়। অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত চাষাভুষো লোকগুলোকে মর্যাদা দিতে চায় না উচ্চবিত্তেরা। কিন্তু এরাই বাংলার এরকম এক ঐতিহ্যকে যেভাবে ধরে রাখবার চেষ্টা করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। লোকসাহিত্যের অঙ্গনে তাই আজও বেঁচে আছে ‘বোলান’। বেঁচে থাকবে যতদিন এই লোকসমাজ থাকবে আর বাঁচবে। তাই তো বিশ্বকবির আবেদন—

“সাহিত্যের ঐক্যতান সংগীত সভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়।” [১৭]

বলা বাহুল্য লোকসাহিত্যের অঙ্গনে ‘বোলান’ গান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। শুধু চাই গ্রামীণ মানুষগুলির এর প্রতি ভালোবাসা আর সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। একমুঠো ছাতু আর আধখানা রুটি বা একমুঠো ভাতের সংস্থান এরা নিজেরাই করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সম্মান আর মর্যাদা। তাহলেই লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র এই রূপ টিকে থাকবে, পা বাড়াবে যুগ থেকে যুগান্তরের পথে।

তথ্যসূত্র:
১। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ/ আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ড দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত/ প্রথম প্রকাশ-২০০৪/ পৃষ্ঠা-১৭০।
২। তদেব।
৩। তদেব।
৪। তদেব। পৃষ্ঠা-১৭১।
৫। সতীশ কুণ্ডু রচিত ‘ভিখারী ঈশ্বর’ নামক বোলানপালা/ পৃষ্ঠা-৩।
৬। বাংলার লোকসাহিত্য–প্রথম খণ্ড/ আশুতোষ ভট্টাচার্য/ পৃষ্ঠা-৫৯৭।
৭। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ/ আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা, ডঃ দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত/ প্রথম প্রকাশ-২০০৪/ পৃষ্ঠা-১৭২।
৮। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-১।
৯। সতীশ কুণ্ডু রচিত ‘ভিখারী ঈশ্বর’ নামক বোলানপালা/ পৃষ্ঠা-১।
১০। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২।
১১। তদেব/ পৃষ্ঠা-১৫।
১২। সুখেন হাজরা রচিত ‘চণ্ডাল রাজা’ বোলান পালা / পৃষ্ঠা-২২।
১৩। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২৭।
১৪। সুখেন হাজরা রচিত ‘সোনার সংসার’ বোলান পালা / পৃষ্ঠা-৫১।
১৫। তদেব/ পৃষ্ঠা-৮।
১৬। গৌড় নন্দী রচিত ‘শঙ্খচূড় বধ’ বোলান পালা/ পৃষ্ঠা-২৫।
১৭। সঞ্চয়িতা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ সাহিত্যম/ সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৩/ পৃষ্ঠা-৬২২।

সহায়ক গ্রন্থ:
১। বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ-ড দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত-আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা।
২। লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান-তত্ত্ব, পদ্ধতি ও প্রয়োগ-শেখ মকবুল ইসলাম-বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।
৩। বাংলার লোকসাহিত্য-শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য-প্রথম খণ্ড।
৪। বাংলার লোকসংস্কৃতি-শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য-ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি।
৫। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-সুকুমার সেন-প্রথম খণ্ড।
৬। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত-অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-দ্বিতীয় খণ্ড-মডার্ণ বুক এজেন্সী।

প্রথম পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: কেন আপনি রাজি হলেন?
মুরাকামি: তারা আমাকে বলেছিলেন যে আমি ইচ্ছামতো রেকর্ড বেছে নিতে পারি। এবং পঞ্চাশ মিনিট ধরে আমার পছন্দসই কথাবার্তা বলতে পারি। তো আমি ভাবলাম, কেন নয়! বিলি হলিডে থেকে ‘মারুন ৫’ পর্যন্ত সবকিছু থেকে আমি খুব বাছাই সংগীত পরিবেশন করি।

দেবোরা: মনে হয় আপনি একবার বলেছিলেন যে, জাপানে লেখক হওয়া খুব চটকদারি ব্যাপার। ভীষণ প্রকাশ্য জীবিকার প্রেক্ষাপটে আপনি নিজের সাধারণত্বে অবিচল থাকেন। এগুলো আপনি মেলান কীভাবে?

মুরাকামি: সত্যি বলতে শুরুর দিকে জাপানের সাহিত্য জগৎ সম্পর্কে আমি খুব একটা খুশি ছিলাম না। আমি ছিলাম একজন বহিরাগত। একটি কালো মেষ, মূলধারার জাপানি সাহিত্যে অনুপ্রবেশকারী। কিছু লোক বলেছিল যে, আমি জাপানি সাহিত্যে নতুন কণ্ঠ। এবং কিছু লোক আমাকে বাজে বলেছিল। তাই আমি একরকম বিভ্রান্ত ও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানতাম না কী হচ্ছে। আমি ‘ওয়ান্ডারল্যান্ডে এলিস’ এর মতো হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি জাপান থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেলাম। ইতালি এবং গ্রিসে গিয়ে দুই-তিন বছর কাটালাম। তারপর আমি লিখলাম ‘নরওয়েজিয়ান উড’। জাপানিরা বইটিকে ঘৃণা করেছিল।

দেবোরা: এটা দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল!

মুরাকামি: এত বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও লোকে আমাকে ঘৃণা করেছিল। তাই আবার আমি বিদেশে চলে গেলাম। আমি নিউ জার্সির প্রিন্সটনে গিয়ে উঠেছিলাম। জায়গাটি ছিল বিরক্তিকর। সুন্দর, তবে বিরক্তিকর। তারপরে বোস্টনের টাফট্‌স ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। সেখানকার ফেনওয়ে পার্কটি ভালো ছিল।

দেবোরা: ভূমিকম্প এবং সারিন গ্যাস আক্রমণের পরে আপনি কি আবার জাপানে ফিরে যাওয়ার মন স্থির করলেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৫ সালে আমি অনুভব করি নিজের দেশে ফিরে এসে মানুষের জন্য কিছু করতে পারি কিনা। দেশের জন্য নয়, জাতির জন্য নয়, সমাজের জন্য নয়, আমার বিশ্বাস ছিল জনগণের প্রতি।

দেবোরা: আপনার কাছে দেশ ও জনগণ, এই দু-টি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য কী?

মুরাকামি: মানুষ আমার বই কেনে, দেশ না।

দেবোরা: আপনি কি জাপানি হিসেবে আপনার লেখালেখিকে বিচার করেন না পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন?

মুরাকামি: আমি সেভাবে ভাবি না। আমার গল্প আমারই। এগুলো কোনো বিভাগের বিষয় নয়। তবে আমি জাপানি ভাষায় লিখি এবং আমার চরিত্রগুলো বেশিরভাগই জাপানি। তাই আমি মনে করি আমি একজন জাপানি লেখক। আমি মনে করি আমার লেখার শৈলী অন্যত্র থেকে নেওয়া নয়।

দেবোরা: জাপানে আপনার প্রথম দিকের পাঠকেরা বেশিরভাগই তরুণ ছিলেন। তরুণদের মধ্যে আপনার বিরাট প্রভাব ছিল।

মুরাকামি: হ্যাঁ। এটা খুবই অদ্ভুত। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠায় ছিলেন। এবং চল্লিশ বছর পরে আমার পাঠকেরা বিশ বা তিরিশের কোঠাতেই থেকে গেলেন! ভালো কথা হল আমার প্রথম প্রজন্মের কিছু অনুরাগী এখনও আমার বইগুলি পড়ছেন এবং তাদের ছেলেমেয়েরাও সেগুলি পড়ছে। একই পরিবারের তিন-চারজন একই বই পড়ছেন শুনে আমি খুব আনন্দিত হলাম। আমার এক বন্ধু তার অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে এমনিতে কথা খুবই কম বলে। কিন্তু জেনে খুব ভালো লেগেছে যে, তারা যখন কথা বলে তখন বিষয় থাকে আমার বই।

দেবোরা: ‘কিলিং কমেন্ডটর’ থেকে থেকে একটা দৃশ্য আমি উদ্ধৃত করতে চাই:

কমেন্ডেটর নিজ হাতের তালু দিয়ে দাড়ি ঘষতে লাগলেন যেন কিছু মনে পড়েছে। “ফ্রানজ কাফকা ঢালু স্থান বেশ পছন্দ করতেন”, সে বলল, “সবধরনের ঢালু স্থান তাকে আকৃষ্ট করত। ঢালের মাঝখানে নির্মিত বাড়িগুলির দিকে চেয়ে থাকতে তিনি পছন্দ করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার পাশে বসে তিনি ওই বাড়িগুলি দেখতেন। কখনোই এতে ক্লান্ত হয়ে উঠতেন না। প্রথমে মাথাটি একদিকে ঝুঁকিয়ে তিনি বসতেন পরে আবার সোজা করে নিতেন। অদ্ভুত মানুষের মতো ছিল তাঁর আচরণ। আপনি কি এটা জানতেন?” ফ্রানজ কাফকা এবং ঢালু স্থান? “না। আমি জানি না”। আমি বললাম। আমি এরকম কখনো শুনিনি। “তবে এটা জানার পর কি কেউ তাঁর কাজের আরো বেশি প্রশংসা করে?”

দেবোরা: উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা যদি আপনার কৌশল জানি যে আপনি ঢালু স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন, এতে কি আপনার কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে আমাদের সাহায্য করবে?

মুরাকামি: ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন, এটি মিথ্যা। এটি আমার তৈরি করা। তবে এটা করে কি ভালো করলাম? খুব সম্ভবত ফ্রানজ কাফকা ঢালু জায়গা পছন্দ করতেন।

দেবোরা: এটা সম্ভব।

মুরাকামি: কিছু লোক এই উদ্ধৃতি দেয়। তবে আমি এটি তৈরি করেছিলাম। আমি অনেক কিছুই তৈরি করেছি।

দেবোরা: কল্পকাহিনিতে আপনি এটা তৈরি করতেই পারেন। যদি আমরা জানতে পারি যে আপনি বিড়াল ভালোবাসেন, এটা কি আমাদের আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে?

মুরাকামি: আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন।

দেবোরা: তিনি আপনাকে চেনেন বলে কি আপনার কাজকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমি জানি না। সে বলে আমি তাঁর প্রিয় লেখক নই। তবে সে সবসময় আমার কাজকে খুব গুরুত্বের সাথে সমালোচনা করে। সে আমার প্রথম পাঠক। সুতরাং আমি যখন লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপিটা তাকে পাঠাই সে পড়ে এবং দু-শো ত্রুটি-সহ ফিরিয়ে দেয়। এই ত্রুটিগুলো আমি খুব অপছন্দ করি। সে বলে, “তোমার এই অংশগুলো পুনরায় লেখা উচিত!”

দেবোরা: তখন আপনি আবার লেখেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। তারপরে সেটা আবার তার কাছে পাঠিয়ে দিই। এবার সে একশোটি ত্রুটি-সহ পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দেয়। আগের থেকে কম ত্রুটি থাকে বলে ভালো লাগে।

প্রথম পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি যখন অনুবাদ করেন, আপনাকে অন্য লেখকদের কণ্ঠস্বর গ্রহণ করতে হয়। আপনাকে এক অর্থে ফিটসগেরাল্ড, চ্যান্ডলার বা শেভার হতে হয়। আপনি যখন নিজের একটি স্টাইল আয়ত্ত করে ফেলেছেন তখন কি এটি একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

মুরাকামি: হ্যাঁ। আমি স্কট ফিটসগারেল্ডকে ভালোবাসি। তাঁর অনেকগুলি বই অনুবাদ করেছি। তবে তাঁর শৈলী আমার থেকে অনেকটাই আলাদা, সুন্দর এবং জটিল। তবুও আমি তাঁর লেখা থেকে অনেক কিছু শিখেছি— তাঁর মনোভাব, বিশ্বজগতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। রেমন্ড কার্ভারের শৈলী এবং তাঁর লেখার জগৎ আমার থেকে অনেক আলাদা। তবে আমি তাঁর থেকেও শিখেছি।

দেবোরা: জন শেভারের লেখা বর্তমানে আপনি অনুবাদ করছেন। কেন শেভার?

মুরাকামি: কেন শেভার? আমি বহু বছর ধরে তাঁর ছোটোগল্পগুলি আনন্দের সঙ্গে পড়ে আসছি। তবে শেভার জাপানে জনপ্রিয় নন। এখানে খুব কম লোকই তাঁর লেখা পড়েছে। কারণ, তাঁর শৈলী ভীষণ আমেরিকাপন্থী। আমার ধারণা, উনিশশো পঞ্চাশের দশক এবং এর মাঝামাঝি সময় আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিই শুধু তাঁর লেখার উপজীব্য। আমি মনে করি না বেশি জাপানি পাঠক তাঁর লেখা পছন্দ করবে। তবে লেখাগুলো আমি খুবই ভালোবাসি। তাই এটি একধরনের চ্যালেঞ্জ।

দেবোরা: আপনি অন্য লেখকদের থেকে যা যা শেখেন সেগুলি আপনার লেখায় প্রবেশ করলে আপনি বুঝতে পারেন?

মুরাকামি: আমার মনে হয় একটু প্রভাব তো আছেই। আমি যখন লিখতে শুরু করি আমার কোনো পরামর্শদাতা ছিল না। আমার কোনো শিক্ষক ছিল না। আমার কোনো সাহিত্যিক বন্ধু ছিল না। আমার শুধু আমি ছিলাম। তাই আমাকে বই থেকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। ছোটোবেলায় আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম। বাড়িতে আমি একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার কোনো ভাই বা বোন ছিল না। অবশ্যই আমার কাছে বই এবং বিড়াল ছিল। সংগীত তো অবশ্যই ছিল। আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম না, পড়তে পছন্দ করতাম। কৈশোর বয়সে আমি রাশিয়ান উপন্যাস পড়ি। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আমার প্রিয় ছিল। আর এদের বইগুলি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমন অনেক সহপাঠী ছিল যারা লেখক হতে চেয়েছিল। তবে আমি বিশ্বাস করতাম না যে, আমার প্রতিভা আছে। তাই আমি একটি জ্যাজ ক্লাব খুলি আর সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।

দেবোরা: আপনি নিজে কখনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছিলেন?

মুরাকামি: ছোটোবেলায় আমি পিয়ানো বাজাতাম। তবে এতে আমার বিশেষ প্রতিভা ছিল না। আমার বয়স যখন পনেরো বছর তখন আর্ট ব্লেকি এবং জ্যাজ মাসেঞ্জাররা জাপানে এসেছিলেন। সেই কনসার্টে আমি গিয়েছিলাম। এর আগে আমি জানতাম না, জ্যাজ কী, তবে সেই রাত থেকেই আমি একজন উৎসাহী জ্যাজ ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রেকর্ড সংগ্রহ করে গেছি। আমার স্ত্রী সবসময় অভিযোগ করত। আমার বাড়িতে কত যে জ্যাজ রেকর্ড রয়েছে! তবে আমি লেখার বিষয়ে সংগীত থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। আমি মনে করি এতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, ছন্দ, সাংগীতিক ঐকতান আর তাৎক্ষণিক উন্নতিকরণ। আমি সাহিত্য থেকে নয়, সংগীত থেকে এই জিনিসগুলি শিখেছি। এবং যখন আমি লিখতে শুরু করি তখন ভাবটা এমন থাকে যেন আমি গান বাজনা করি।

দেবোরা: আপনার মা-বাবা দু-জনেই সাহিত্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরা কি আপনার লেখার সিদ্ধান্ত বিষয়ে খুশি হয়েছিলেন? তাঁরা কি আপনাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেছিলেন?

মুরাকামি: তা আমি মনে করি না। আমি জানি না তারা আমার কাছ থেকে কী আশা করেছিল।

দেবোরা: শেষবার আমরা যখন কথা বলেছিলাম আপনি বলেছিলেন, ৯/১১ বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। কেবল আসল পৃথিবীকেই নয়, আপনি যে পৃথিবী নিয়ে লিখতে চান সেখানেও এই সংকটগুলি প্রভাব ফেলেছিল মনে হয়। আপনি কি মনে করেন যে, জাপানের সুনামি এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের মতো ঘটনাগুলি আপনার কল্পকাহিনিগুলোকে বদলে দিয়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। ১৯৯৯ সালে কোবে ভূমিকম্পের পর আমি ‘আফটার কোয়েক’ নামে ছোটোগল্পের একটি সংকলন লিখেছিলাম। আমার মা-বাবার ঘর-সহ পুরো কোবে শহরটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ম্যাসাচুসেটসে ছিলাম। তারপর চার বছর কাটিয়েছি যুক্তরাজ্যে। বলতে গেলে তখন আমি একপ্রকার প্রবাসীই হয়ে পড়েছিলাম। তবে টিভিতে দেখেছিলাম দৃশ্যগুলো। ঔপন্যাসিক হিসেবে তখন আমি ভাবছিলাম, এই ভূমিকম্প বিষয়ে আমি কী করতে পারতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যা করতে পারি তা হল ভূমিকম্পের সময়টায় ঠিক কী হয়েছিল তা শুধু কল্পনা করতে। তাই এটা আমার কাছে কল্পনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন গবেষণা করি না। কারণ, কল্পনা আমার সম্পদ, আমার উপহার। আমি এটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। ওই একই বছর, এর দুই মাস পরে টোকিওর একটি পাতাল রেল ট্রেনে সারিন-গ্যাস দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল। আমি তখন জাপানে ছিলাম না। আমি খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনে এই বিষয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি যা পড়তে চেয়েছিলাম তা ওই লেখায় পাইনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম সত্যি কী ঘটেছিল সেদিন ওই ট্রেনে। ভরতি ট্রেনে গ্যাসের গন্ধ নেওয়ার মতো বাস্তব অবস্থাটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। তাই আমি নিজের মতো এই জিনিসগুলি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি সারিন-গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং তাদের প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি আসল ঘটনা। তারা আমাকে বলে আসলে কী ঘটেছিল। আমি এই বিষয়গুলি নিয়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে একটি প্রবন্ধধর্মী বই প্রকাশ করি। অন্য কেউ এটা করেনি বলে আমাকেই এটা করতে হয়েছে। তাছাড়া আমার নিজস্ব জিজ্ঞাস্য আর কৌতূহলও ছিল। এই সাক্ষাৎকারগুলি নিতে আমার একবছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি ওই একবছর আমাকে বদলে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাটা ছিল দারুণ। সেই একবছর আমি কিছুই লিখিনি। আমি কেবল সেই কণ্ঠস্বরগুলো শুনেছি। সেগুলি এখনও আমার মনের মধ্যে আছে। আমি সেই শুদ্ধ স্বরগুলোকে বিশ্বাস করি। ট্রেনে চড়া মানুষগুলো ছিল সাধারণ মানুষ। তারা টোকিয়োর এক সকালে ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই কেউ সারিন গ্যাসে ভরতি প্লাস্টিকের ড্রাম দ্বারা আক্রমণ করে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা যায়। পরিস্থিতি ছিল এমনই অতিবাস্তবিক। তবে তাদের কণ্ঠস্বর ছিল সাধারণ। আউম শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষেরা (যারা আক্রমণ করেছিল) সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁরা হয়তো এর মাধ্যমে একরকম সত্য বা পরম সত্যের সন্ধান করছিলেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা সাধারণ যাত্রী ছিলেন। আমি শিনরিকো সম্প্রদায়ের মানুষদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের কথা আমার মনে ধরেনি।

দেবোরা: গ্যাস আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় আপনি কঠিন সত্যের খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু ভূমিকম্পের কথা বলতে গিয়ে আপনি কেন আংশিক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন?

মুরাকামি: কারণ, কোবে আমার নিজের শহর এবং ঘটনাটা খুবই বেদনার। সেখানে আমার অনেক বন্ধু আছে। আমি যদি এই লোকগুলির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতাম তবে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু কাহিনিতে আমি আমার নিজস্ব জগৎ তৈরি করতে পারি। তাই এটি আমার পক্ষে সহজতর ছিল। সহিংসতা আপনার মন আর শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছুর বিনাশ হয়ে যেতে পারে এর ফলে। ভূমিকম্পের আগে আমরা ভেবেছিলাম ভূমিস্তর খুব শক্তপোক্ত। কিন্তু এখন আর তা নেই। এটা হয়ে উঠতে পারে অস্থির, অনির্দিষ্ট, নরম। আমি হয়তো এটাই লিখতে চেয়েছিলাম।

এরপর ৯/১১, সুনামি-সহ আরও অনেক বিপর্যয় ঘটেছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিপর্যস্ত মানুষগুলির জন্য আমি কী করতে পারি। উত্তরটা এইরকম যে, আমি শুধু পারি ভালো সাহিত্য রচনা করতে। কারণ, আমি যখন একটি ভালো গল্প লিখি তখন আমরা একে অন্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আপনি যদি পাঠক হন আমি একজন লেখক। আমি আপনাকে চিনি না। তবে সাহিত্যের অন্তর্জগতে আমাদের মধ্যে এক গোপন যোগাযোগের পথ রয়েছে। আমরা অবচেতন পথে একজন অন্যকে বার্তা পাঠাতে পারি। এইভাবে আমি মনে করি অবদান রাখতে পারি।

দেবোরা: আপনি লেখার মাধ্যমে বার্তা পাঠান। কিন্তু আপনি নিজে বার্তা ফিরে পান কী করে?

মুরাকামি: আমি জানি না। একটি উপায় হয়তো আমরা বের করতে পারব।

দেবোরা: ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর আপনার ওয়েবসাইটে বইটি সম্পর্কে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছিলেন। আপনি কেন এটা করলেন? শুধু এই বই নিয়ে কেন?

মুরাকামি: আমি পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানতে উৎসুক ছিলাম (২০১৫ সালেও এইরকম করেছিলাম)। সীমিত সময়ের জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। তবে আমি অনেকগুলো মেইল পেয়েছিলাম। আমার মনে নেই কতগুলো। ত্রিশ হাজার হবে সম্ভবত। তবে আমি সেগুলো পড়েছি এবং চোখের ক্ষতি করেছি। আমি সম্ভবত তিন হাজারের উত্তর দিয়েছি। খুব পরিশ্রমের ছিল ব্যাপারটা। তবে আমার মনে হয় আমি এটা জানতে পেরেছি যে, কী ধরনের পাঠক আমার বই পড়ছে। এবং আমার লেখা সম্পর্কে তারা কী ভাবছে সে সম্পর্কে আমি একটা অস্পষ্ট ধারণা পেয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু বোকা বোকা প্রশ্নও ছিল। একজন আমাকে স্কুইডের কর্ষিকা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। স্কুইডের দশটি কর্ষিকা রয়েছে এবং সে জানতে চেয়েছিল তাদের হাত পা আছে কিনা। তিনি কেন সে এইরকম প্রশ্ন করলেন? আমি উত্তর দিয়েছিলাম এইভাবে: স্কুইডের বিছানার পাশে আপনি দশটা গ্লাভ অথবা দশটা মোজা রেখে দিন। সে যখন জেগে উঠবে তখন হয় গ্লাভ নয়তো মোজা বেছে নেবে। এইভাবে আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্য জানি না স্কুইড বিছানায় ঘুমায় কিনা। তবে আমি বেশিরভাগ প্রশ্নই উপভোগ করেছিলাম।

দেবোরা: এটা ছিল পাঠকদের সংস্পর্শে থাকার একটা উপায়। আমি জানি যে আপনি জাপানে কোনো অনুষ্ঠান বা সেখানে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন না। কেন এমন?

মুরাকামি: আমি একজন লেখক। এবং আমার কাছে লেখাই একমাত্র কাজ। আমি একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, লেখালেখি ছাড়া আমি আর কিছুই করব না। তবে সম্প্রতি আমি ডিস্ক-জকির কাজ করছি। টোকিয়োর একটি এফএম রেডিয়ো স্টেশন থেকে আমাকে ডিস্ক-জকির কাজ করতে বলা হয়েছিল। আমি এখন ওই কাজটি করছি।

শেষ পাতা

Categories
অনুবাদ সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

দেবোরা: আপনি বলেছেন যে আপনার প্রথম বই দু-টি লেখা খুব সহজ ছিল। তারপর লেখা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি কীরকম সমস্যার সম্মুখীন হন?

মুরাকামি: আমার প্রথম দুটো বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’, ‘পিনবল ১৯৭৩’ লিখতে আমার সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু বইগুলো নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। এ-দুটো লেখার পর আমি উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠি। তারপর আমি লিখেছিলাম, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’, আমার প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাস (অন্য দু-টি উপন্যাসিকার মতো ছিল)। এটি লিখতে আমার তিন-চার বছরের মতো সময় লেগেছিল। আমার ধারণা, ওই প্রস্রবনের জন্য আমাকে সত্যি একটা গর্ত খুঁড়তে হয়েছিল। সুতরাং, আমি মনে করি ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ আমার কেরিয়ারের প্রকৃত সূচনাবিন্দু ছিল। প্রথম তিন বছর আমি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে কাজ করার সময় লিখেছিলাম। রাত দুটোয় ক্লাবের কাজ শেষ করে রান্না ঘরের টেবিলে লিখতে বসে যেতাম। এটা ছিল আমার পক্ষে খুব কষ্টের। প্রথম দুটো বইয়ের পর আমি সিদ্ধান্ত নেই যে ক্লাব বিক্রি করে দেব এবং পূর্ণ সময়ের লেখক হব। কিন্তু ক্লাবটি তখন ভালোই চলছিল এবং সবাই আমাকে ওটা বিক্রি করতে বারণ করেছিল। তারপরে আমি লিখতে পারলাম ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’। আমি এই ধরনের একটি বড়ো বই লিখতে চেয়েছিলাম।

দেবোরা: বড়ো বই লেখা সহজ ছিল, না আরও চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছিল?

মুরাকামি: আমি যখন ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লিখছিলাম তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। কারণ, আমি জানতাম না যে এর পরে কী ঘটবে। পরবর্তী ঘটনা জানার জন্য আমি পরের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম না। আমি পরের পৃষ্ঠাগুলি ওলটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে কোনো পৃষ্ঠা ছিল না, তাদেরকে আমায় লিখতে হয়েছিল।

দেবোরা: আপনার কি এমন কখনো হয়েছে যে, পরে কী ঘটবে তা আপনার অজানা ছিল এবং সেদিন আর লিখতে পারেননি?

মুরাকামি: আমি কখনো রাইটার্স ব্লক অনুভব করিনি। একবার আমি ডেস্কে বসতে পারলে জানি যে পরে কী ঘটবে। আমি লিখতে না চাইলে লিখি না। পত্রিকা সবসময় আমাকে কিছু না কিছু লিখতে বলে এবং আমি প্রতিবারই ‘না’ বলে দেই। আমি যখন লিখতে চাই তখনই লিখি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার ঘুমের মধ্যেও প্লটগুলি সক্রিয় থাকে?

মুরাকামি: না, এটা মনে করি না। আমি স্বপ্ন দেখি না। গল্প লেখা আর স্বপ্ন দেখা আলাদা জিনিস। আর আমার কাছে লেখা স্বপ্ন দেখার মতোই। আমি যখন লিখি তখন ইচ্ছা করে স্বপ্ন দেখতে পারি। শুরু করতে পারি আবার থামতেও পারি। এমনকী পরের দিনও সেটা চালিয়ে নিতে পারি। আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো একটি ভালো মাংসের খাবার, একটি ভালো বিয়ার বা একটি সুন্দর মেয়ের স্বপ্ন দেখেন এবং যখন জেগে ওঠেন তখন সব শেষ হয়ে যায়। আমি কিন্তু পরের দিন সেটা চালিয়ে নিতে পারি।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে আপনি বলেছিলেন যে, আপনি যখন কোনো উপন্যাস লেখেন তখন কিছু ধারণা বা বাক্যাংশের একটি তালিকা তৈরি করে নেন, যেমন, ‘কথাবলা বানর’ বা ‘সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লোক’ প্রভৃতি। আপনি যখন লিখতে বসেন, আপনি বলেছিলেন “প্রতিটা গল্পে অবশ্যই এই তালিকা থেকে দুই বা তিনটি জিনিস থাকতে হবে”। আপনি কি প্রায়শই এভাবে কাজ লেখালেখি করেন?

মুরাকামি: আমি তখন এক সময়ে ছয়টি গল্প লিখেছিলাম। তাই ওই লেখাগুলির সাহায্য নিতে হয়েছিল। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা দরকার হয় না। আমার চেষ্টা থাকে প্রতিবার নতুন কিছু করা। আমার বেশিরভাগ বই আমি প্রথম পুরুষে লিখেছিলাম। ‘১৯৮৪’ (1Q84)-তে আমি তিনটি চরিত্র প্রথম পুরুষে লিখেছি। এটা আমার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রায়শই আমার গল্পের কথক প্রধান চরিত্রটি এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয় যে কিনা আমি হতে পারতাম। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেটা হয় না। পরিবর্তে পরিণত হয় আমার একধরনের বিকল্পে। অবশ্যই বাস্তবে আমি নিজে অন্য মানুষে পরিণত হতে পারি না। তবে সাহিত্যে আমি যে কেউ হতে পারি। আমি অন্যের জুতোতে পা রাখতে পারি। একে একধরনের থেরাপি বলতে পারেন। আপনি যদি লিখতে পারেন তবে আপনার মধ্যে এমন এক সম্ভাবনা তৈরি হবে যে আপনি স্থির থাকতে পারবেন না, অন্য যে-কেউ হয়ে যেতে পারেন।

দেবোরা: আপনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন সেই একই সময়ে আপনি দৌড়ানোও শুরু করেন। আমি জানি কিছু মানুষ চলতে চলতে আপন মনে লিখতে পছন্দ করেন। হাঁটার ছন্দ তাদের এই কাজে সাহায্য করে। আপনি দৌড়ানোর সময় কখনো লেখার কথা ভেবেছেন?

মুরাকামি: একদম না। আমি দৌড়ানোর সময় শুধু দৌড়াই। তখন আমি মনকে খালি রাখি। দৌড়ানোর সময় আমি কী ভাবি সেই সম্পর্কে আমার কোনো পরিকল্পনা থাকে না। হয়তো কিছুই ভাবি না। তবে আপনি অবশ্যই জানেন যে দীর্ঘ সময় ধরে লিখতে গেলে আপনাকে দৃঢ় হতে হবে। একটি বই লিখে ফেলা এমনিতে কঠিন নয়, তবে অনেক বছর ধরে লেখা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আপনার একাগ্রতা আর সহনশীলতার শক্তি প্রয়োজন। আমি মাঝে মাঝে খুব আস্বাস্থ্যকর আর অদ্ভুত জিনিস লিখি। আমি মনে করি আপনি অস্বাস্থ্যকর জিনিস লিখতে চাইলে আপনাকে খুব স্বাস্থ্যবান হতে হবে। এটি একটি প্যারাডক্স, তবে সত্যি। বোদল্যেরের মতো কিছু লেখক খুব অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেছিলেন। তবে আমার মতে সেই দিন আর নেই। এখনকার বিশ্ব খুব কঠোর আর জটিল। এগুলো কাটিয়ে উঠে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে শক্তপোক্ত হতে হবে। আমি যখন তিরিশ বছর বয়সী তখন আমি লেখা শুরু করেছি। আমার যখন বত্রিশ বা তেত্রিশ বছর বয়স তখন দৌড়তে শুরু করি। আমি প্রতিদিন দৌড়ানো শুরু করলাম। কারণ, এর ফলে কী হয় তা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয় জীবন একধরনের পরীক্ষাগার, যেখানে আপনি যা কিছু করতে পারেন। এবং শেষ পর্যন্ত এটি আমার পক্ষে লাভদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমার শরীর এতে দৃঢ় হয়ে উঠেছিল।

দেবোরা: লেখা দৌড়ানোর মতো একটি নির্জন সাধনা। আপনি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিকের জীবন থেকে লেখায় চলে এসেছিলেন। সেখানে সবসময় আপনার চারপাশে লোকেরা ভিড় করে থাকত। কিন্তু তারপর লেখা আর পড়াশুনায় একদম একা হয়ে থাকতে কি আপনার ভালো লাগত?

মুরাকামি: আমি খুব একটা সামাজিক জীব নই। আমি প্রচুর রেকর্ড এবং সম্ভবত বিড়ালদের সাথে শান্ত জায়গায় একা থাকতে চাই। আর বেসবল খেলা দেখার জন্য কেবল টিভি। ব্যাস, আমি এইটুকুই চাই।

দেবোরা: আপনি একবার বলেছিলেন যে, আপনার জীবনের স্বপ্ন ছিল কূপের তলদেশে বসা। আপনার বেশ কয়েকটি চরিত্র ঠিক তেমনটি করেছে। ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এ মেনশিকিও এমন করেছে। কেন?

মুরাকামি: আমি কূপ খুব পছন্দ করি। আমি ফ্রিজ, হাতি এমন অনেক জিনিস পছন্দ করি। আমি যা পছন্দ করি সে-সম্পর্কে লিখে খুব আনন্দ পাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে একটি কূপ ছিল এবং আমি সবসময় সেই কূপটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাতে আমার কল্পনাশক্তি বেড়ে গিয়েছিল। শুকনো কূপে পড়ে যাওয়া নিয়ে রেমন্ড কার্ভারের একটি ছোটোগল্প আছে। আমি সেই গল্পটি খুব পছন্দ করি।

দেবোরা: আপনি কখনো কোনো কূপের নীচে যাবার চেষ্টা করেছেন?

মুরাকামি: না না। এটা বিপজ্জনক। এটা আমার কল্পনায় ঘটে। তবে আমি গুহাও পছন্দ করি। আমি যখন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করি, তখন যদি কোনো গুহা দেখি আমি তার মধ্যে প্রবেশ করি। উঁচু স্থান আমার পছন্দ হয় না।

দেবোরা: আপনি উপরে না উঠে নীচে যেতে চান?

মুরাকামি: কেউ বলে এটা অবচেতন মনের একধরনের রূপক। তবে আমি ভূ-গর্ভস্থ বিশ্ব সম্পর্কে খুবই আগ্রহী।

দেবোরা: কয়েক বছর আগে প্যারিস রিভিউ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, আপনার গল্পের চালিকাশক্তি হল “হারিয়ে যাওয়া এবং অনুসন্ধান এবং খুঁজতে থাকা”। আপনি কি এখনও এতে বিশ্বাস করেন?

মুরাকামি: হ্যাঁ। হারানো কিছুর সন্ধান করা আমার সাহিত্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ থিম। আমার চরিত্রগুলো প্রায়শই হারিয়ে গেছে এমন কিছুর সন্ধান করে থাকে। কখনো একটি মেয়ে, কখনো একটি কারণ, কখনো বা এটি একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু খোঁজে, যা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে সেটা খুঁজে পেলে একরকম হতাশা সৃষ্টি হবে। কেন তা আমি জানি না, তবে কোনো কিছুর অনুসন্ধান আমার গল্পের একধরনের মোটিফ। যদিও এটা কোনো আনন্দদায়ক সমাপ্তি নয়।

দেবোরা: প্রায়শই আপনি যে-পুরুষদের সম্পর্কে লেখেন তারা আবেগগতভাবে বা অস্তিত্বহীন হয়ে কোনোরকমভাবে হারিয়ে যায়। এগুলো পৃথিবীতে খুব একটা হয় বলে মনে হয় না।

মুরাকামি: আপনি অবশ্যই জানেন যে, গল্পের মূল চরিত্র যদি সুখী হয় তবে কোনো গল্প তৈরির সম্ভাবনা থাকে না।

দেবোরা: আপনার উপন্যাসগুলি সাধারণত একটি রহস্যের চারদিকে ঘোরে। কখনো আপনি সেই রহস্যটি সমাধান করেন এবং কখনো সমাধান না করে ছেড়ে দেন। আপনি কি পাঠকদের জন্য বিষয়গুলি উন্মুক্ত রাখতে চান, না আপনি নিজে সমাধান বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন না?

মুরাকামি: আমি যখন কোনো বই প্রকাশ করি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুরা ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, “এর পরে কী হবে?” আমি বলি, “এখানেই শেষ”। তবে পাঠকেরা এর সিক্যুয়েল আশা করে। ‘১৯৮৪’ (1Q84) প্রকাশিত হবার পর গল্পের পরবর্তীতে কী ঘটবে তার সমস্ত কিছুই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি একটি সিক্যুয়েল লিখতে পারতাম কিন্তু লিখিনি। আমি ভেবেছিলাম এটি ‘জুরাসিক পার্ক ৪’ বা ‘ডাই হার্ড ৮’-এর মতো হতে পারে। তাই আমি সেই গল্পটি কেবল আমার মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম এবং এটি আমি খুব উপভোগ করেছি।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন সেটা কখনো লিখবেন?

মুরাকামি: আমি তা মনে করি না। আমি শুধু জানি এটি আমার মনের মধ্যে থাকবে। তেঙ্গোর ষোলো বছরের মেয়ে সিক্যুয়েলের মূল চরিত্র হবে, এটি খুব আকর্ষণীয় গল্প।

দেবোরা: তারপরেও এটা কোনো ‘ডাই হার্ড ৮’ নয়!

মুরাকামি: এবং সেই বইয়ের একটি প্রিক্যুয়েল রয়েছে।

দেবোরা: শুধু আপনার মনের মধ্যে?

মুরাকামি: হ্যাঁ।

দেবোরা: কিছু লেখক প্রতিটি বইয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এবং কিছু লেখক যে পদ্ধতি তার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে সেটাই চেষ্টা করেন। আপনি কোনটির পক্ষে?

মুরাকামি: কাজুয়ো ইশিগুরোর লেখা আমি পছন্দ করি। সে আমার বন্ধু। যতবারই সে নতুন বই প্রকাশ করে সেটি আগের থেকে আলাদা হয়। এটি খুব আকর্ষণীয় বিষয়। তবে আমার পক্ষে থিম আর মোটিফগুলো এত আলাদা নয়। আমি সিক্যুয়েল লিখতে পছন্দ করি না। তবে বইগুলির পরিমণ্ডল একে-অপরের চেয়ে আলাদা নয়। আমি শুধু একজন ব্যক্তি এবং আমার নির্দিষ্ট উপায় আছে বলে মনে করি। এটা আমি পরিবর্তন করতে পারি না। তবে আমি একই জিনিস বারবার লিখতে চাই না।

দেবোরা: আপনার নিজস্ব শৈলীতে প্রায়শই জটিল বা গভীর কল্পনা থাকে কিন্তু লেখা সেরকম হয় না। বাক্যগুলি বেশ সহজ এবং হালকা। এই বৈপরীত্য কি উদ্দেশ্যমূলক?

মুরাকামি: অনেক লেখক জটিল জটিলতর স্টাইলে তুচ্ছ অগভীর জিনিস লেখেন। আমি চাই কঠিন ও জটিল জিনিসগুলি খুব সহজ শৈলীতে লিখতে, যা পড়া সহজতর এবং আরামদায়ক। এই কঠিন জিনিসগুলি লিখতে গেলে আপনাকে আরও গভীর আর গভীরতর হতে হবে। সুতরাং চল্লিশ বছর ধরে লিখতে লিখতে আমি তার জন্য একটি কৌশল তৈরি করেছি। এটি একটি শারীরিক কৌশলের মতো, কোনো বৌদ্ধিক কৌশল নয়। আমি মনে করি আপনি যদি কোনো কথাসাহিত্যিক হন এবং আপনি যদি খুব বুদ্ধিমান হন তবে আপনি লিখতে পারবেন না। আপনি যদি নির্বোধ হন তাহলেও লিখতে পারবেন না। এর মধ্য থেকে আপনাকে একটা অবস্থান খুঁজে নিতে হবে। এটা খুব কঠিন।

দেবোরা: আপনি কি মনে করেন আপনার লিখনশৈলী অনুবাদে ধরা পড়েছে?

মুরাকামি: হ্যাঁ। কেন জানি না, তবে যখন আমি আমার বইগুলি ইংরেজিতে পড়ি তখন আমার মনে হয়, ওহ্‌, এ তো আমিই! ছন্দ, গদ্যশৈলী একই— প্রায় একই।

দেবোরা: আপনি নিজেই একজন অনুবাদক। আপনি এফ. স্কট ফিটজগারেল্ড, ট্রুম্যান কাপোতে, রেমন্ড চ্যান্ডলার এবং অন্যন্যদের লেখা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এখন আপনি অনুবাদ করছেন জন শেভারের লেখা। লেখকদের কোন দিকগুলি আপনাকে অনুবাদে প্রণোদিত করে?

মুরাকামি: এটি বলা সহজ। আমি যা পড়তে চাই তা অনুবাদ করি। আমি রেমন্ড চ্যান্ডলারের সমস্ত উপন্যাস অনুবাদ করেছি। আমি তাঁর স্টাইলটি পছন্দ করি। আমি পাঁচ বা ছয়বার ‘দ্য লং গুডবাই’ পড়েছি।

তৃতীয় পাতা

Categories
প্রবন্ধ

সুজিৎ দে’র প্রবন্ধ

মুর্শিদাবাদের বোলান গান: সাধারণ পরিচয়

চৈত্র মাস শেষের দিকে। বছর শেষ হবে। সারা বছর ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলির মনে কীসের এত ফুর্তি! ও শিবের গাজন আসছে। শরতের চারদিন যেমন বাঙালির ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরে; চৈত্রের শেষ চারদিন তেমনি বুড়ো শিবের। এই শিবের গাজন আর তাকে কেন্দ্র করে ‘বোলান’ গান পল্লিমায়ের চিরদুঃখী সন্তানগুলিকে মাতিয়ে রাখে এ-সময়।

এমন চিত্র ছিল আগের বছর পর্যন্ত। আর এ-বছর করোনার মৃত্যু ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আজ তারা অসহায়। একটা একটা করে উৎসবকে ছেড়েছে তারা। মনমরা হয়ে ভাতে মরার দিন যেন সামনে এগিয়ে আসছে। থেমে যাওয়া উৎসবের স্মৃতিচারণায় এই প্রবন্ধের আয়োজন।

বোলান= বোল + আন। যার অর্থ কথা বলা, প্রতিবচন, উত্তর। বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্য যুগের অনেক ক্ষেত্রে ‘বোলান’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়—

“বোলান বুলিতে গেল ময়না বসতি” (রূপরাম চক্রবর্তী/ধর্মমঙ্গল) [১]

“ঘরে গেল্যা না দিয়া বুলান” (কবিকঙ্কণ) [২]

“ডাকিলে বোলান ন দেও” (মনসামঙ্গল/বিজয়গুপ্ত) [৩]

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে ‘বোলান’ হল মানসিক ব্রত। কবিকঙ্কণ ও বিজয়গুপ্তের রচনায় ‘বোলান’-এর অর্থ উত্তর-প্রত্যুত্তর বা কথা বলা। নাথপন্থী শৈব যোগী, পশ্চিম ভারতের নিরঞ্জন নাথপন্থী প্রমুখ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বোলান’-এর প্রচার দেখা যায়। ডঃ সুকুমার সেন মহাশয় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে উত্তর রাঢ়ের মনোহরশাহি পরগণা থেকে একটি ‘বোলান’ গানের নমুনা তুলে এনেছেন—

“যতগুলি বললাম বোলান গো
আরও বলতে পারি
ওস্তাদের নাম অকিঞ্চন
তেঁতুল তলায় বাড়ি
যার বাড়িতে জমি
তোমরা এবার বোলান বল
আমরা এবার বসি।।” [৪]

বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে-বোলান গান প্রচলিত আছে তা মূলত শিবের গাজনকে কেন্দ্র করেই। তবে কখনো কখনো অন্য কোনো অনুষ্ঠান বা মেলায় বোলানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। চৈত্রের শেষ চারদিন যে-শিবের গাজন হয় তার কিছুদিন আগে থেকেই বোলান দলগুলির মধ্যে সাজ সাজ রব ওঠে। তারা তিন-চার দিন ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে বোলান গান করে বেড়ায়। এ হল পালা বোলান। আর এক প্রকার বোলান আছে তাকে বলে ‘সাধলে বোলান’; বা ‘সাজলে বোলান’। শিবের গাজনের বা ধর্মরাজের ভক্তরাই এ-বোলান করে। অন্যদের এ-বোলান করার অধিকার নেই। শিবের গাজন ছাড়াও ‘সর্বমঙ্গলা’ বা ‘শেতলা’ পুজোর সময়ও বোলানের আয়োজন করা হয় অনেক সময়।

সাজলে বোলান ও পালা বোলান উভয়ই প্রচলিত আছে এখন। শিবের ভক্তরা করে সাজলে বোলান। তা মূলত পূজা পদ্ধতির অঙ্গ। আর পালা বোলানে একদিকে যেমন থাকে পালাবন্দী নাটক অন্য দিকে সংগীতের বহুল প্রয়োগ। আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নারীবেশী পুরুষের চটুল নৃত্য। বন্দনা গান, পালা অভিনয় আর রং পাঁচালির মধ্য দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করে থাকে কুশীলবরা। গানগুলি অবশ্যই লোকসংগীতের ধারাটিকে বজায় রেখে চলেছে।

বোলান গানকে বলতে হয় আনুষ্ঠিক বা পূজাকেন্দ্রিক লোকসংগীত। পালার প্রয়োজনে গানগুলি লোকসমাজের দ্বারাই রচিত হয়। কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা এ-গান রচিত হয় না। দলের বিভিন্ন সদস্যদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রসূত এই গান। গানগুলির প্রচার ও প্রসার ঘটে লোকমুখে। তাই পাঠভেদ লক্ষ করা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। সুরে থাকে আঞ্চলিকতার ছোঁয়া। প্রেম, আনন্দ, অভিমান বা চরম দুঃখ প্রকাশে এর প্রয়াগ। ‘ভিখারি ঈশ্বর’ নামক একটি সামাজিক পালায় দাদা ঈশ্বর তার ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে গান গাইছেন—

“আজকে আমার ভায়ের বিয়ে খুশীর সীমা নায়
আয়রে তোরা সবাই মিলে আয়রে ছুটে আয়
আনন্দেতে সবাই যখন শাঁক বাজাবে
পালকি এসে ভায়কে আমার নিয়ে যাবে।” [৫]

এর ভাষা নিতান্ত সহজ সরল। আর সুরে আঞ্চলিকতা থাকলেও বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গান কিংবা প্রচলিত জনপ্রিয় কোনো গানের সুরকে অনুসরণের চেষ্টা করা হয় লোক আকর্ষণের জন্যই। পদ বা পদসমষ্টির পুনরাবৃত্তি অবশ্যই থাকে গানে। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের লোকসমাজই এ লোকসংগীতের জন্মদাতা ও পৃষ্ঠপোষক।

সামাজিক নানা বিষয়, মনগড়া নানা কাল্পনিক কাহিনির পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনির দেখা মেলে বোলান পালায়। অবশ্যই লোকমুখে প্রচলিত পুরাণ। তাই কোনো গ্রন্থের সাথে এর সত্যতা যাচাই করা অর্বাচীনের কাজ হবে। শিল্প শাসনের বাধা মানে না বোলান। তাই লোকরুচি ও চাহিদা অনুযায়ী এর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নৃত্য এর একটি জরুরি অঙ্গ। সূক্ষ্ম ভাবের প্রকাশ করতে গিয়ে সুনিপুণ অভিনয় সেখানে হয় না। জোড়ালো ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সংলাপ ও গান পরিবেশিত হয়। পূজা মণ্ডপের মাঝে একটু জায়গা করে নিয়ে, চারিদিকে দর্শকের উপস্থিতিতে কুশীলবরা অভিনয় করে চলে।

একইসঙ্গে গান ও অভিনয়ের প্রাধান্যে বোলান লোকসংগীত ও লোকনাট্যের বিমিশ্র রূপ হয়ে উঠেছে। গানের মধ্য দিয়েই বোলানের সূচনা, গানের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি। মূল পালার মাঝেও সংগীতের ব্যবহার একটু বেশিই। বোলানের প্রাচীন রূপে সংগীত ছিল প্রধান। সংলাপ ছিল সংগীতের মেলবন্ধনকারী। বর্তমানে সংলাপের প্রাধান্য এলেও সংগীত তার নিজের জায়গাটি ছেড়ে দেয়নি। গীতিপ্রধান এই বোলানকে গীতিনাট্যও বলা যায়—

“বোলান গান গীতি প্রধান রচনা। সেই জন্য ইহাদের গীতিনাট্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে”। [৬]

ধর্মঠাকুর ও শিবের গাজনকে কেন্দ্র করে মূল সন্ন্যাসী গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে যে-তর্জা, ছড়া বলে তার নাম বোলান। শিবের গাজনের ভক্তরা তাদের পূজার অঙ্গ হিসেবে লোকের বাড়ি বাড়ি কিংবা তাদের ইষ্ট দেবতার সামনে যে-গান বা ছড়া পরিবেশন করে তাই সাজলে বোলান। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেছেন সাজলে বোলানই হল বোলানের আদি রূপ। সাজলে বোলানের একটি নমুনা—

“আরে সাজলে
ধুল ধুল সাজলে ধুল ধুল ধুল
পড়েছে মায়ের পাতা উদম করে চুল।
আরে সাজলে
শ্মশানে গিয়েছিলাম মশানে গিয়েছিলাম
সঙ্গে গিয়েছিল কে ?
কার্তিক গণেশ দুই ভাই সঙ্গে সেজেছে।
আরে সাজলে কাল বাঞ্ছা খেয়েছিল টুকই ভরা মুড়ি
আজ বাছার মুণ্ডু যায় ধুলায় গড়াগড়ি।।
আরে সাজলে
তুই তো মেরা ভাই সাজলে তুই তো মেরা ভাই
তোর সাথে গেলে সাজলে শিব দর্শন পাই।
আরে সাজলে
ভাল বাজালি ঢেকো ভেয়ে
তোর মা আমার মামি…” [৭]

সাজলে বোলান কেবলমাত্র গাজনের ভক্তরাই গাইতে পারে। অন্যদের অধিকার নেই। সাজলে বোলানের রূপটি বেশি পরিবর্তন হয়নি। দেবতাদের উদ্দেশে প্রণাম জানাতে এবং গ্রামবাসীর মঙ্গল কামনায় আজও এ-ধরনের গান গাওয়া হয়।

শেষ পাতা

Categories
সাক্ষাৎকার

হারুকি মুরাকামির অন্তর্জগৎ

ভাষান্তর: রিপন হালদার

[২০০৮ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘দি নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যাল’-এ হারুকি মুরাকামির সঙ্গে কথপোকথন থেকে এই সাক্ষাৎকার সংকলিত। ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেবোরা স্টেইনম্যান।]

মুরাকামি: আমি যখন দশ বছর আগে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম এবং এই দশ বছরে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। যেমন, এই দশ বছরে আমি দশ বছর বড়ো হয়েছি। এটা খুব গুরুতপূর্ণ বিষয়, অন্তত আমার কাছে। দিনের পর দিন আমি বয়স্ক হয়ে উঠছি আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে কৈশোরের দিনগুলো থেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আজকাল আমি ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন যে, ভদ্রলোক এবং ঔপন্যাসিক একইসঙ্গে হওয়া সহজ নয়। একজন রাজনীতিবিদের একইসঙ্গে ওবামা এবং ট্রাম্প হবার চেষ্টা করার মতো। তবে আমার কাছে ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকের সংজ্ঞা আছে। প্রথমত, তিনি যে আয়কর দিয়েছেন সেই বিষয়ে কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী বা প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে লেখেন না। এবং তৃতীয়ত, তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ সম্পর্কে ভাবেন না। সুতরাং, দেবোরা, দয়া করে আমাকে এই তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। আমি সমস্যায় পড়ে যাব।

দেবোরা: আপনি আমার প্রশ্নভাণ্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। আসলে আমি আপনার অতি সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডোটোর’ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। বইটি এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে এক পুরোনো চিত্রশিল্পীর বাড়িতে থাকা শুরু করে। সে যখন সেই বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করল তখন অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এর মধ্যে একটা হল কিছুটা কূপের মতো দেখতে একটি গর্তের দেখা পাওয়া। আমি ভাবছি আপনি কীভাবে উপন্যাসের এই ভিত্তিটি নির্মাণ করলেন?

মুরাকামি: আপনি জানেন যে এটি একটি বড়ো বই এবং এটা লিখতে আমার দেড় বছর বা তার বেশি সময় লেগেছিল। তবে এটি শুরু হয়েছিল একটি বা দু-টি অনুচ্ছেদ দিয়ে। আমি সেই অনুচ্ছেদগুলো লিখে আমার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম। তারপর, সম্ভবত তিন বা ছয় মাস পরে আমার ধারণা হয় যে, আমি ওই অনুচ্ছেদ্গুলো দিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে পারি। তারপর আমি লিখতে শুরু করি। আমার কোনো পরিকল্পনা বা প্লটও ছিল না। তারপর গল্পটি আমাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেল। যদি আপনার কোনো পরিকল্পনা থাকে, আপনি শুরু করার সময়ে যদি পরিণতি জানেন, উপন্যাস লিখে কোনো আনন্দ নেই। আপনি হয়তো জানেন, কোনো চিত্রশিল্পী চিত্রকর্ম শুরু করার আগে রূপরেখা এঁকে নেয়, তবে আমি তা করি না। আমার কাছে আছে একটি সাদা ক্যানভাস এবং একটি ব্রাশ। তাই দিয়ে আমি ছবি আঁকি।

দেবোরা: উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র বা ধারণা আছে, যা মোজার্টের অপেরা ‘ডন জিওভান্নি’ থেকে গড়ে উঠেছে। এই ধারণা বা চরিত্রটি বইয়ের কেন্দ্রে থাকার কারণ কী?

মুরাকামি: সাধারণত আমি আমার বইগুলি শিরোনাম দিয়ে শুরু করি। এই ক্ষেত্রে ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’ শিরোনাম আর প্রথম অনুচ্ছেদটা নিয়ে আমি ভাবলাম যে এগুলি দিয়ে আমি কী ধরনের গল্প লিখতে পারি! জাপানে ‘কমেন্ডেটোর’ বলে কোনো কিছু নেই। তবে আমি এই শিরোনামটির অদ্ভুতুরে মেজাজটি অনুভব করে মনে মনে পুলকিত হয়েছি।

দেবোরা: আপনার কাছে ‘ডন জিওভান্নি’ অপেরা কি গুরুত্বপূর্ণ?

মুরাকামি: চরিত্র আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সাধারণত মডেল ব্যবহার করি না। আমার কেরিয়ারে একবার মাত্র একটি চরিত্রের জন্য মডেল ব্যবহার করেছি। লোকটি খারাপ ছিল এবং তাকে আমি বেশি পছন্দ করতাম না। ওই লোকটি সম্পর্কে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। তবে মাত্র একবার। আমার বইগুলির অন্য সমস্ত চরিত্র আমি শূন্য থেকে তৈরি করেছি। আমি কোনো চরিত্র তৈরি করার পরে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং আমাকে তারপর তার চারপাশে ঘোরাফেরা করে তার সাথে কথা বলে যেতে হয়। একজন লেখক হিসেবে যখন আমি লিখি একইসঙ্গে আমার মনে হয় আমি কোনো আকর্ষণীয় বইও পড়ছি। এইভাবে আমি লেখাটি উপভোগ করি।

দেবোরা: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, বইটির মূল চরিত্র অপেরার পাশাপাশি অন্যান্য সংগীতও শোনে। প্রায়শই আপনার চরিত্রগুলি দেখি কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ড ও জোনারের সঙ্গীত শুনে থাকে। এগুলি কি আপনাকে লিখতে সাহায্য করে?

মুরাকামি: আমি লেখার সময় গান শুনি। সুতরাং সংগীত খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায় আসে। কী ধরনের সংগীত এটা নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, তবে সংগীত আমার কাছে একধরনের খাদ্য। সংগীত আমাকে লেখার শক্তি যোগায়। তাই আমি প্রায়শই সংগীত সম্পর্কে লিখি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার পছন্দের সংগীত সম্পর্কেই লিখি। আমার স্বাস্থ্যের পক্ষেও এটা মঙ্গলজনক।

দেবোরা: সংগীত কি আপনাকে সুস্থ রাখে?

মুরাকামি: হ্যাঁ, খুব। সংগীত এবং বিড়াল। তারা আমকে প্রচুর সাহায্য করেছে।

দেবোরা: আপনার কাছে কতগুলি বিড়াল আছে?

মুরাকামি: একটাও না। আমি প্রতিদিন সকালে আমার বাড়ির চারপাশে ঘুরতে গেলে তিন-চারটি বিড়াল দেখতে পাই, এরা আমার বন্ধু। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং তাদেরকে অভিবাদন জানাই। তারা আমার কাছে আসে। আমরা একে-অপরকে খুব ভালোভাবেই চিনি।

দেবোরা: যখন ‘নিউইয়র্কার’ ‘কিলিং কমেন্ডেটোর’-এর একটি অংশ প্রকাশ করেছে, আমি তখন আপনাকে আপনার কাজের অবাস্তব উপাদানগুলি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, “আমি যখন উপন্যাস লিখি, বাস্তবতা আর অবাস্তবতা একসাথে মিশে যায়। এটা আমার পরিকল্পনা মাফিক নয় এবং লেখার সাথে সাথে আমি এটি অনুসরণ করি। তবে আমি যতই বাস্তবতাকে বাস্তবসম্মতভাবে লেখার চেষ্টা করি ততই অবাস্তব পৃথিবীর উদয় হয়। আমার কাছে উপন্যাস পার্টির মতো। যে-কেউ যোগ দিতে চাইলে দিতে পারেন। এবং যখনই তাঁরা চলে যেতে চাইবেন, যেতে পারেন”। সুতরাং আপনি কীভাবে এই পার্টিতে অতিথি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে নিয়ে আসেন, অথবা আপনি যখন লিখছেন সেখানে কীভাবে এরা বাধাহীনভাবে আসতে পারে?

মুরাকামি: পাঠকেরা প্রায়শই আমাকে বলে থাকেন যে আমার কাজগুলিতে এমন একটা অবাস্তব জগৎ রয়েছে, যে-জগতে নায়ক অনায়াসেই যায় এবং আসল পৃথিবীতে ফিরেও আসে। তবে আমি সবসময় অবাস্তব বিশ্ব আর বাস্তববাদী বিশ্বের মধ্যে সীমারেখা দেখতে পাই না। সুতরাং, অনেক ক্ষেত্রে তারা মিশে গেছে। আমি মনে করি জাপানে এই অন্য বিশ্ব আমাদের বাস্তব জীবনের কাছাকাছি। এবং আমরা যদি সেই অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই সেটা আমাদের পক্ষে অতটা কঠিন হয় না। আমার মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বে এটা করা অত সহজ নয়, সেখানে অন্য বিশ্বে যেতে হলে আপনাকে কিছু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে জাপানে আপনি যেতে চাইলে সহজেই যেতে পারেন। সুতরাং, আমার গল্পগুলিতে, আপনি যদি কোনো কূপের নীচে যান, দেখতে পাবেন সেখানে একটা অন্য বিশ্ব আছে। এবং আপনি সেখানে দুই বিশ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবেন না।

দেবোরা: অন্য দিকটা সাধারণত অন্ধকারের জায়গা, তাই তো?

মুরাকামি: না-ও হতে পারে। আমার মনে হয় এটা আগ্রহের ব্যাপার। আপনি যদি কোনো দরজার সন্ধান পান এবং সেটা যদি খুলতে সক্ষম হন তবে আপনি সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন। এটি কেবল আগ্রহ থেকেই হতে পারে। ভিতরে কী? সেখানে কী আছে? এই প্রশ্ন করা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। আমি যখন কোনো উপন্যাস লিখি তখন ভোর চারটের দিকে উঠে আমার ডেস্কে গিয়ে লেখা শুরু করি। বাস্তব বিশ্বে এটা ঘটে। আমি আসল কফি পান করি। কিন্তু একবার লেখা শুরু করলে আমি অন্য কোথাও চলে যাই। আমি দরজাটা খুলি, সেখানে যাই এবং সেখানে কী ঘটে দেখতে পাই। আমি জানি না বা জানতে চেষ্টা করি না, এটা বাস্তব না অবাস্তব। যতই আমি লেখার মধ্যে গভীরভাবে ডুবে যাই ততই সেখানে ওদ্ভুত কিছু দেখতে পাই। আমি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখতে পাই বলে মনে হয়। সেখানে যদি কোনো অন্ধকারও থাকে তবে সেই অন্ধকারের কিছু বার্তা থাকে অবশ্যই। আমি সেই বার্তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি সেই বিশ্বকে ঘুরে দেখি, তার বর্ণনা করি, শেষে আমি ফিরে আসি। এই ফিরে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন তবে ভয়ের ব্যাপার। তবে যেহেতু আমি পেশাদার, আমি ফিরে আসতে পারি।

দেবোরা: এবং আপনি ওই জিনিসগুলি সঙ্গে নিয়ে আসেন?

মুরাকামি: না। এটা ভীতিজনক হবে। আমি যেখানেই সব ছেড়ে দেই। আমি যখন লিখি না, আমি খুব সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের রুটিনটাকে আমি মেনে চলি। আমি খুব সকালে উঠি এবং বেসবল খেলা না থাকলে রাত ন-টার দিকে শুতে যাই। সঙ্গে থাকে আমার দৌড় এবং সাঁতার কাটা। আমি একজন সাধারণ মানুষ, সুতরাং রাস্তায় যখন আমি হেঁটে চলি তখন যদি কেউ বলে, “মিস্টার মুরাকামি, আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল”, আমি বিব্রত বোধ করি। আমি এমন কিছু না। তাহলে কেন সে আমার সাথে দেখা হওয়ায় খুশি হল? তবে আমি যখন লেখার মধ্যে থাকি তখন অবশ্যই আমি একজন বিশেষ, অন্তত অদ্ভুত মানুষ।

দেবোরা: চল্লিশ বছর আগে, বেসবল খেলার মাঠে আপনি কীভাবে লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, গল্পটি বহুবার বলেছিলেন। হঠাৎ আপনি ভেবেছিলেন, “আমি একটা উপন্যাস লিখতে পারি”। যদিও এর আগে আপনি লেখার চেষ্টাও করেননি। এবং আপনি আপনার স্মৃতি কথা, “হোয়াট আই টক আবউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং”-এ বলেন, “মনে হয়েছিল আকাশ থেকে কোনো কিছু নেমে এসেছিল এবং সেটা আমি হাতে পেয়েছি”। আমরা ধরে নিতে পারি ওই জিনিসটি ছিল আপনার লেখার ক্ষমতা। সেটা কোথা থেকে এসেছিল বলে আপনার মনে হয়? আর আপনি এত সাধারণ হলে কেন এটা আপনার কাছে এসেছিল?

মুরাকামি: সেটা একধরনের বোধোদয় ছিল বলে মনে হয়। আমি বেসবল পছন্দ করি এবং আমি প্রায়শই বলপার্কে যাই। ১৯৭৮ সালে ঊনত্রিশ বছর বয়সে আমি টোকিয়োর বেসবল পার্কে আমার প্রিয় দল ‘ইয়াকাল্ট স্যালোজ’ (Yakult Swallows)-এর খেলা দেখার জন্য গিয়েছিলাম। সেই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় ছিল খেলার উদ্বোধন। আমি খেলাটি দেখছিলাম এবং প্রথম খেলোয়াড় একটি ডাবল মারল এবং সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম যে, আমি লিখতে পারি। তখন প্রচুর বিয়ার পান করেছিলাম বলে কিনা জানি না। তবে তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আমার মধ্যে একধরনের বোধের উদয় হয়েছে। এর আগে আমি কিছু লিখিনি। আমি একটি জ্যাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে সান্ডুইচ আর ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। আমি খুব ভালো সান্ডুইচ তৈরি করি। তবে সেই খেলার পরে আমি একটা ষ্টেশনারি দোকানে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম এবং শুরু করলাম লেখা। তারপর আমি লেখক হয়ে যাই।

দেবোরা: সেটা চল্লিশ বছর আগে। সেই সময় লেখা আপনাকে কীভাবে বদলে দিল?

মুরাকামি: আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। লেখা শুরু করার সময় আমি লিখতে জানতাম না। আমি খুব অদ্ভুত উপায়ে লিখেছিলাম। তবে পাঠক এটা পছন্দ করেছিল। এখন আমি আমার প্রথম বই ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’-এর জন্য তেমন একটা যত্ন নিই না। তখন আমি লেখা প্রকাশের উপযুক্ত ছিলাম না। বহুবছর আগে টোকিয়োর ট্রেনে বসে আমি একটি বই পড়ছিলাম এবং খুব সুন্দর একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বলল, “আপনি মিস্টার মুরাকামি?” “হ্যাঁ, আমি মিস্টার মুরাকামি”। “আমি আপনার বইয়ের বড়ো ফ্যান”। “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”। “আমি আপনার সমস্ত বই পড়েছি এবং আমি সেগুলো খুব ভালোবাসি”। আমি ধন্যবাদ জানাই। তারপর সে বলেছিল, “আমি আপনার প্রথম বইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। ওটাই আমার কাছে সেরা”। “ওহ্‌, তুমি তাই মনে করো?” সে বলল, “আপনার লেখা এখন খারাপ হয়ে যাচ্ছে”। এইভাবে আমি সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে আমার লেখা আগের থেকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে তা মনে করি না। আমি মনে করি সময়ের সাথে সাথে আরও ভালো হচ্ছে আমার লেখা। চল্লিশ বছর ধরে আমি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আমার বিশ্বাস যে, আমি সফল। ট্রেনের সেই মেয়েটি আমাকে জিন কুইল নামে এক জ্যাজ সংগীতকারের কথা মনে করায়। তিনি স্যাক্সোফোন বাজাতেন। উনিশ-শ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিখ্যাত ছিলেন। সেই সময় যে-কোনো স্যাক্সোফোন বাদকের মতো তিনিও চার্লি পার্কার দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন। একরাতে তিনি নিউ ইয়র্কের একটি জ্যাজ ক্লাবে বাজাচ্ছিলেন এবং যখন তিনি ব্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে নামলেন তখন এক যুবক এসে বলল, “আরে, আপনি তো চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন বললেন, “কী?” “আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন!” জিন তখন তাঁর অলটো সাক্সোফোন যন্ত্রটি তার কাছে তুলে বললেন, “এই যে, আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজিয়ে দেখান!” আমি মনে করি, এই গল্পটির তিনটি বিষয় আছে— এক, কারো সমালোচনা করা সহজ। দুই, মৌলিক কিছু তৈরি করা খুব কঠিন। তিন, কিন্তু কারো এটি করা দরকার। আমি চল্লিশ বছর ধরে করে আসছি। এটা আমার কাজ। আমি মনে করি, আমি এমন একজন লোক যে অন্যদের মতো কিছু কাজ করে চলেছে, যেমন নোংরা পরিষ্কার করা বা কর সংগ্রহ করা। সুতরাং, কেউ যদি আমার প্রতি কঠোর হয় তবে আমি আমার যন্ত্রটি তাকে ধরিয়ে বলব, “এই যে, আপনি এটা বাজিয়ে দেখান!”

দ্বিতীয় পাতা

Categories
গল্প

পাপড়ি রহমানের গল্প

জলময়ূরীর সংসার

জামগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দুই পা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল ঝুলমুলি। তার চোখের সামনে বাঘিয়ার বিলের থইথই জলরাশি। হাওয়া বেগে বইলে সমস্ত বিল যেন মুহূর্তে দুলে ওঠে। তারপর তারা ঢেউ হয়। ইয়া বড়ো বড়ো মস্তপানা ঢেউ। ঢেউ হয়, আর ছুটে যায় দূরে, বহুদূর। একেবারে দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। এ-মতো দৃশ্য শুধুমাত্র বাদলার কালেই দেখা যায়। উইন্যার মরশুমে কাদাপ্যাকলার রাজত্ব। তখন বিলের রুগ্ন চেহারা। কিছু জলজ উদ্ভিদ বেঁচে থাকার আশায় আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। কিছু শাদা ঘাস তখন মাথাডগা বের করে ভালো করে দুনিয়া দেখতে চায়। এই ঘাসেরা বাদলার কালে জলের তলায় ডুবে থেকে নিজেদের সবুজ বরণ খুইয়ে বসে আছে। এতক্ষণে দুনিয়াদারি দেখতে দেখতে ফের তারা সবুজ হয়ে উঠবে। ফের তারা তরতরিয়ে বিস্তার করে চলবে নিজেদের বংশ। বাঘিয়ার বিলের এমন রকমসকম ঝুলমুলি কোমরে কালোতাগা বাঁধা অবস্থা থেকেই দেখে এসেছে। রোগবালাই দূরে রাখার জন্য মা একটা কালোতাগা ঝুলমুলির কোমরে বেধে দিত। তাগার সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘুঙ্ঘুট। উঠানময় দৌড়ে বেড়ানোর সময় ওই ঘুঙ্ঘুট টুংটুং করে বেজে যেত। আর মা আম্বিয়া খাতুন কাজ ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত ঝুলমুলির উদোম গতর— মেয়েটার গায়ের রং মাজা হবে। গরিবের সংসারে কালো মেয়ের বড়ো অনাদর। কালো মেয়ে পরের ঘরে বিদায় করা বড়ো ঝক্কির। টিভি, মোটরসাইকেল দিতে চাইলেও কালো মেয়ের বাজারদর চড়া হয় না। সেরকম পাত্রও জোটে না। যদিও-বা জোটে তাও ম্যালাই দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হয় তারা! টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলের সঙ্গে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে বসে। ঝুলমুলির মা মেয়ের উদ্দাম চলা দেখেও তাই খুশি হতে পারত না। মনে শঙ্কা বাসা বাধত— কাইল্যা মাইয়াডারে পার করুম কেমতে?

কিন্তু ঝুলমুলির মায়ের নানান আশঙ্কা সত্ত্বেও ঝুলমুলি বড়ো হতে থাকে। তার দেহে লাবণ্য এসে হামলে পড়ে আর ঝুলমুলি সেয়ানা হয়ে ওঠে। আম্বিয়া খাতুনের মেয়ের এই ঝলমলে ছিরিছাঁদ দেখে মনে মনে আঁতকে ওঠে—

মরারশুকির গতরে য্যান বাইস্যা মাসের নয়া পানির মাছেগো খলবলানি। এত উজাইও না গো মা-জননী! বেশি উজাইলে বোয়াল মাছের প্যাডের ভিতর চইল্যা যাইবা, নইলে শইল মাছ তুমারে গিল্যা খাইব। তহন আর বারাইতে পারবা না। মাছের প্যাডের ভিতরের মাছ কবে আর তার নিজের পরান ফিরত পাইছে?।

না, আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু তার ভাবনা সে মনের লাটাইয়ে পেঁচিয়ে রাখে। এই লাটাইয়ের সুতার সন্ধান সে কিছুতেই দেবে না ঝুলমুলিকে। দিলে মেয়েটা আর নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারবে না। তার বাড়বাড়ন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। মেয়েটা অন্তত নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক। জমিনে শুয়ে থাকা মিষ্টিকুমড়ার ডগা যেমন আপন গতিতেই বাড়ে, লকলকিয়ে তরতরিয়ে বাড়ে— ঝুলমুলি না হয় তেমনিভাবেই বেড়ে উঠুক। আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু ছলিমুদ্দি এমন ভাবে না, বা ভাবতে পারে না। এর আগে দুই মেয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলি যখন সেয়ানা হয়েছিল, তখনও সে এমন ভাবে নাই। বা ভাবতে পারে নাই। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হালের চারটা বলদ ছলিমুদ্দিকে বিক্রি করতে হয়েছিল। গোয়াল ঘরের দিকে তাকালে আজও তার দুই নয়ন জলে ভরে যায়। গোরু বিক্রির টাকায় একটা হাতঘড়ি আর টেলিভিশন দেয়া গিয়েছিল। বাকি টাকায় ছেলেপক্ষকে শাদাভাতে গোরুর মাংসের সুরুয়া ঢেলে কোনোরকমে খাওয়ানো গেছে। এ নিয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলির শ্বশুরবাড়ি কম কথা শোনায় নাই!

‘মুরগার রুস্টের কতা কি আবার কইয়া বইল্যা নিতে অয় নাহি? বেবাক বিয়াতেই তো এইগুলা আকছার খাওন দেয়।’

ছলিমুদ্দি রা করতে গিয়েও যেন গিলে ফেলেছে। কষ্টেমষ্টে নিজেকে সামলেছে। মাইয়ার বাপ অইলে নীচা অইয়া থাকতে অয়! নীচা মাইনষেগো এত রাওউও করলে চলে নাহি?

নীচা মাইনষেগো মাতাডা আরও নীচা কইরা রাহন নাগে। মাতাডা মাটির লগে মিসমার কইরা রাহন নাগে। ছলিমুদ্দি তাই নীচা কইরাই রাখে নিজের মাথাডা। নীচাই রাখতে চায়। কিন্তু তাও কি মঞ্জুলি আর ফুলকলির সুখ মেলে? মেলে না! ছলিমুদ্দি তো কম চেষ্টা চালায় নাই। কথা সত্য, মুরগার রোস্ট সে খাওয়াতে পারে নাই। জনা পঞ্চাশেক লোক খাওয়ার পরেই মাংসের হাড়িতে টান পরে যায়। কিন্তু কী-ই-বা করবে ছলিমুদ্দি?

ভালো কোম্পানির টেলিভিশনের দাম তো তার একটা বলদ বিক্রির দামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কাল্লা, ধলা, লাল্লি আর সফেদাকে বিক্রি করতে গিয়ে ছলিমুদ্দির বুক ফেটে গিয়েছে। ছলিমুদ্দির ঘরদোর এতদিনে শূন্য-ময়দান। সহায়-সম্পত্তির খুদকুঁড়োও কোথাও পড়ে নাই। দিনমান হা হা করে ছলিমুদ্দির দুয়ার-আঙিনা। বাঁশঝাড়ে হাওয়া জোরে বইলে মনে হয়, কে যেন কেঁদে চলেছে! কে যেন গুনগুনিয়ে অথচ গোপনে কেঁদেই চলে। ছলিমুদ্দির মন মিথ্যে বলে না বা হয়তো তার কানও ভুল শো্নে না। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার হাম্বা হাম্বা রবের সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও গলা মিলিয়ে কাঁদে। ছলিমুদ্দির কানে তেমনভাবেই পৌঁছায়। ছলিমুদ্দি ইদানীং মানুষ আর জন্তুর বিভেদ করতে পারে না। সে কীভাবেই-বা বিভেদ করবে? ছলিমুদ্দির কাছে তো মানুষ আর জন্তুর মূল্য প্রায় সমান কাতারে। আর তার ঘরদোরও শূন্য ময়দান। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার সাথে সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও তার চোখের আড়ালে চলে গেছে! এটা ভেবেও ছলিমুদ্দি্রমন বড়ো বেচান হয়।

‘যাগো এত্তদিন বুকে ধইরা আগলাইয়াছি, হেরা দেহি বেবাকেই আমারে ফালায়া থুইয়া গেলগা! আমার কুনদিহে লাভ কিডা অইল? আমার আপনার আর থাকল কী? লাল্লির চক্ষু দুইটা দিয়া ক্যামতে যে পানি পড়বার নাগছিল! বুবা জানোয়ার, কিছু কইয়া যাইতে পারে নাই। মাইয়া দুইটার চক্ষু দিয়া পানি পড়বার নাগছিল, হেরাও তো আমারে ভালা কি মন্দ কি কুনু কতাই কইয়া গেল না!’

এ-সব ভেবে ভেবে কোনো কোনো রাতে ছলিমুদ্দি একেবারে বেঘোর কেঁদে ওঠে। তখন হয়তো আম্বিয়া খাতুনের ঘুম ভেঙে যায়। ছলিমুদ্দি তখন জোর করে কান্নার ফুঁপানি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু দম ফুরিয়ে যাবার মতো করে নতুন কান্না তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। আম্বিয়া খাতুন পরম মমতায় সোয়ামির পিঠে হাত রাখে। ধীরে ধীরে আঙুল বুলিয়ে বলে—

‘কীয়ের নাইগ্যা আফনে কাইন্দা মইরুন কন তো? হারাদিন তো ভালাই থাহুন। রাইত অইলেই কি জন্মের দুস্ক আফনেরে সজাগ কইরা তুলে? কীয়ের দুস্কে আফনে কাইন্দুন এমুন কইরা?’

ছলিমুদ্দি তখন বউয়ের এতসব প্রশ্নের জবাব দেবার অবস্থায় থাকে না। এত দুঃখ গলায় চেপে রেখে কোন মানুষই-বা কথা বলতে পারে? ছলিমুদ্দি আম্বিয়া খাতুনের উপর মনে মনে বিরক্ত হয়—

‘কীয়ের সোমসার যে আমি করি? হেয় তো বেবাকই জানে আর বুঝে, তাও কী না আমারে জিগায়? ঘুইরা ফিরা পত্যি আমার দুস্ক তালাশ করে! এই যে আমাগোরে বাড়িঘর, উঠান সব কেমতে ধূ ধূ ময়দান অইয়া গেল হের তালাশি তার মনে নাইক্কা। কিমুন বেহুশি মাইয়ানুক! যে কুনুদিন অন্তরের ভাও বুঝে না হের লগে জনমভর সোমাসার কেমতে করে মাইনষে?’

ছলিমুদ্দির অবিশ্রাম অথচ লুকানো কান্নার খোঁজখবর না করেই আম্বিয়া খাতুন ফের ঘুমে মরে যায়। নাকি দুম করে ঘুম এসে তাকে মেরে ফেলে? খানিক আগেই যে টসটসিয়ে কথা বলল, ভালোমন্দের খবরবার্তা জানতে চাইল, তার এমন আঁতকা ঘুমিয়ে পড়া দেখে ছলিমুদ্দির কান্না ফুরিয়ে যায়। ছলিমুদ্দি অনুভব করে, তার সকল কান্না কেমন ধুন্দুমার মিলিয়ে গেছে! তখন হয়তো পূবের আকাশে সামান্য শাদা শাদা আলো ফুটে উঠছে। ওই শাদাটে আলোর নীচে উঠানের জোয়ান শিউলি গাছটা বেশুমার ফুলেদের পাপড়ি মেলে দিয়েছে। ততক্ষণে আম্বিয়া খাতুনের খোঁয়াড়ের বড়ো রাতাটাও জেগে উঠেছে! জেগে উঠে ঘাড়ের কালো-সোনালি-খয়েরি রঙা পালক ফুলিয়ে সূর্যোদয়ের প্রথম বাগ দিচ্ছে।

এইবার আষাঢ় নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘিয়ার বিলে জল একেবারে উপচে উঠতে লাগল। ঝুলমুলি বিলের এরকম বাড়-বাড়ন্ত রূপ ম্যালাদিন চক্ষে দেখে নাই। ঝুলমুলি দেখেছে, লিলুয়া বাতাসে বিলের ছোটো ছোটো ঢেউদের জেগে উঠতে। তারপর তারা মৃদুমন্দ গতিতে, আয়েশ করে ক্রমশ সরে গেছে তীরের দিকে। অথবা ঢেউদের বুকের ভেতর, ঢেউদের শরীরের ভিতর দুলে দুলে মিশে যেতে। কিন্তু এইবার বাদলার জল ঝরে পড়ামাত্রই বিলের চেহারা গেল আমূল পালটে! স্বচ্ছ জলের স্তম্ভ ভেঙেচুরে চক্ষে একেবারে ধান্দা লাগিয়ে দিল। বাঘিয়ার বিলে রুই-কাতলা আর মৃগেলের পাখনা-লেজের ঝাপটানিতে রুপালি ঝিলিক উঠল ঘনঘন। শিঙ্গি-মাগুর আর পুঁটির ঘাঁইয়ে বুরবুরি উঠতে লাগল পার ঘেঁষে। ফি বছর শাদা শাদা এন্তার শাপলার মাঝে কিছু বেগুনি পানার ফুল অনাহূতের মতো তাকিয়ে থাকে। এবার কি না একেবারে অন্য দৃশ্য! পদ্মফুলের বড়ো বড়ো পাতা ছাতার মতো ভেসে রইল বিলের চারধারে। আর ফুটল অগণন ফুল। শাদা শাপলার ফুটে থাকাকে ম্লান করে পদ্মের গোলাপি আভা ঢেকে দিল স্বচ্ছ জলের বিস্তীর্ণ চাদর। ঝুলমুলির চক্ষে বিস্ময় আর ধরে না! আচানক এতকিছু দেখে শুনে তার মাথাটাও যেন আর আগের মতো কাজ করে না!

‘ই-ই-রে! এইডা কুন জমানা আইল? এতকাল দেখতাছি এই বিলের ছুরত! আইজ কুন কারণে হে্র ছুরত বদলায়া যায় রে? কত মাছের ঝাইকের খলবলানি আর ল্যাজ নাড়ানি দেইখ্যাই না সিয়ান অইলাম, অহন কিনা দেখি মাছগুলান ফাল দিয়া টানে উইঠা আইবার চায়! জাল ফেলাইলেই অহন খালুই ভইরা নেওন যাইব মনে লয়! বঁড়শিতে আদার দিলেই টপাটপ মাছ উইডা আইব!’

ঝুলমুলির আন্দাজ একেবারে মিথ্যে নয়। ছলিমুদ্দি এর মাঝে জাল ফেলে খালুই দুই মাছ নিয়ে গেছে। মাদারজানির মানুষজন ঝাপ্পুরঝুপ্পুর করে মাছ ধরার কায়দা-কানুন আবিষ্কার করে চলেছে।

ঝুলমুলির চক্ষু ভরা বিস্ময়ের মাঝে মাদারজানির জোয়ান ছেলে-ছোকরারাও জাল ফেলে। বঁড়শিতে আদার দিয়ে টপাটপ মাছ টানে তুলে আনে। ওই দলে জমির চেয়ারম্যানের পুত্র ইস্কান্দারকেও দেখা যায়, সে-ও জলে নেমে খুইয়া জালে কইয়ের ঝাঁক তুলে আনে। মাছগুলার লাফালাফির ফাঁকে খুব সন্তর্পনে একটা পদ্মফুলও উপড়ে আনে সে। ওই পদ্মফুল শোভা পেতে দেখা যায় ঝুলমুলির লম্বা বিনুনির আগায়।

ইস্কান্দারের তুলে আনা পদ্মফুল কোন ফাঁকে-বা কেন ঝুলমুলি বিনুনির শোভা বাড়ায় তা কেউ খেয়াল করে না। এমনকী আম্বিয়া খাতুন ও ছলিমুদ্দির চোখেও তা পড়ে না। ঝুলমুলির কালো মুখে কোথা থেকে যেন হলদেটে আলোর ছটা এসে পড়ে! ঝুলমুলির সইয়েরা বহুদিন বাদে তাকে ‘ফুলটোক্কা’ খেলতে দেখে। এক সইয়ের চোখ দুই হাতের আঙুলে ভালো করে চেপে ধরে ঝু্লমুলি ডাক ছাড়ে—

টাপটুপানি লোহারকাঠি
বৃন্দাবনে টিয়াপাখি
ছুটলোরে ছুট!
কচুর পাতা হলদি
ছুঁইয়া আয় জলদি
কোন ঘরে চোর গেছে ‘সাবধান!’

বলেই জোরে ডাক দেয়—
‘আয়রে আমার কদমফুল!’

শেষ পাতা

Categories
গল্প

লোকগল্প

আরও কিছু আছে বাকি

গল্প কথক: পার্থ হাজরা
সংগ্রহ ও লেখা: সুব্রত ঘোষ

কোন এক গ্রামে এক শখের সাধক বাস করতেন। সামান্য মন্ত্র বিদ্যার চর্চা করতেন তিনি। সাধক এবং সংসারী মানুষটির তাই জীবন নিয়ে কৌতূহল কম ছিল না। চাষাবাদ করে কোনো মতে দিন চালিয়েই খুশি থাকতে পারতেন না। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। আর নিজের মন্ত্র প্রয়োগ করে দেখতেন পশু পাখি গাছপালা এমনকী মানুষের উপর। এই কারণেই তাকে এড়িয়ে চলত গ্রামের লোক। এমনি একদিন বেড়াতে বেড়াতে তার চোখে পড়ল একটা মড়ার মাথার খুলি কাত হয়ে আলের ধারে পড়ে আছে। খুলি দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হায়, জীবনের এই তো পরিণতি হবে একদিন। এই ভেবে বিমর্ষ হয়েই ভাবলেন এই খুলি এখানে এল কী করে! কাছে পিঠে শ্মশান নেই। চোত-গাজন শেষ হয়েছে মাস চার হল। পচা ভাদ্র শুরু হবে এবার। ধরম পুজোও মিটে গেছে। গাজনের দলের কেউ যদি ভুল করে ফেলে গিয়েও থাকে খোঁজ খোঁজ রব উঠবে। তবে কি শেয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে এল? না, কাঁচা খুলি নয়। শুকনো খুলি। একটা কাঠি দিয়ে খুলিটা নাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে হল তার। কাঠি দিয়ে নেড়ে সোজা করতেই খুলিটার মুখোমুখি হতে হল তাকে। মানুষের মাথার খুলি। কিন্তু খুলির কপালের লেখন যেন তিনি পড়তে পারলেন। মন্ত্রবলে একটু চেষ্টা করেই পড়তে পারলেন লেখাটা— লেখা আছে— ‘আরও কিছু আছে বাকি’। এর পরেও বাকি থাকে কিছু জীবনে? মৃত্যুই জীবনের শেষ পরিণতি। তারপর আর কী? কর্মফলের কারণে আবার ফিরে আসা নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে। কিন্তু সেই আত্মা তো নশ্বর শরীর ছেড়ে গিয়েছে। জড় দেহ মিশে যাবে পঞ্চভূতে। এই খুলির তবে এমন কোন পরিণতি বাকি আছে? একটা সিদ্ধান্ত নিতে মানুষটি বিচলিত হলেন। কিন্তু নিজের কৌতূহলের কাছে হার মানলেন শেষ পর্যন্ত। এই খুলির শেষ পরিণতি না দেখে তিনি ছাড়বেন না। চারপাশে তাকিয়ে দেখে হেঁট হয়ে কুড়িয়ে নিলেন খুলিটা। খুব দ্রুত বেঁধে ফেললেন গামছায়। ঝুলিয়ে নিলেন পিঠে। তারপর হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে। বাড়ি না গিয়ে তিনি গিয়ে ঢুকলেন গোয়াল ঘরে। খুলিটাকে তুলে রাখলেন গোয়াল ঘরের মাচার ওপর, সবার চোখের আড়ালে।

কেউ খেয়াল না করলেও তার স্ত্রী খেয়াল করল স্বামীর চরিত্রে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আরও যেন সংসার বিমুখ হয়ে গেছে মানুষটা। জোর করে কাছে টানলেও কাছে আসতে চায় না। একদিন ভোর রাতে স্বামীকে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে সন্দেহ হল তার। একদিন গোয়াল ঘর থেকে ঘেমে নেয়ে বের হতে দেখল স্বামীকে, ফলে সন্দেহ আরও বাড়ল। একদিন দেখল স্বামী গোয়াল ঘরের মাচার উপর বসে আছে, সে যেতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। যে এক আড়া মঁইটা দেওয়াল লেপতে নিয়ে এসেছিল সে গোয়াল ঘর থেকে, দেখল ভর দুপুরে তার স্বামী সেই মঁই নিয়ে গোয়াল ঘরে ঢুকল, আবার কিছুক্ষণ পরে মঁই কাঁধে ফিরে এল বাড়িতে। সন্দেহ তখন মানুষ ছেড়ে গোয়াল ঘরের মাচার দিকে ধাবিত হল। একদিন স্বামী মাঠের দিকে যেতেই স্ত্রী ছুটে গেল গোয়ালে। মাচায় উঠে একটু খুঁজতেই সে দেখতে পেল খুলিটাকে। এই খুলির টানে মানুষ যুবতী স্ত্রী ছেড়ে ভোর রাতে গোয়াল ঘরের মাচায় ছুটে আসে!! সন্দেহ একটা হত। আজ তীব্র হল। এ নিশ্চয়ই তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকার খুলি। তন্ত্র মন্ত্রের নামে এইসব হচ্ছে দু-জনে। মরেও শান্তি দিচ্ছে না, এখনও তার আর তার স্বামীর মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে!! এর একটা হেস্তনেস্ত না হলেই নয়। খুলিটাকে বাড়িতে এনে শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভেঙে মশলার মতো বেটে ধুলো বানিয়ে ফেলল সে। তাতেও তার রাগ কমল না। সেই ধুলো ঝেটিয়ে ফেলে দিয়ে এল পাঁদাড়ে। যাক, এবার গিয়ে প্রেমিকার মুখোমুখি বসুক মাঝরাত্তিরে গোয়াল ঘরের মাচার ওপর।

সাধক মানুষটি এই ভেবেই চিন্তিত ছিলেন যে একটা মড়ার খুলির এমন কী পরিণতি বাকি থাকতে পারে। বিদ্যা তার গুরুমুখী নয়। মেলার মাঠে কেনা দশ বিশ টাকার বশীকরণ সংক্রান্ত পুঁথি পাঠেই সীমাবদ্ধ তার তন্ত্র মন্ত্রের জগৎ। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল তার মনে মনে। মড়ার খুলির কপালের লেখন পড়তে পেরে তার আস্থা জন্মেছিল নিজের উপর। কিন্তু গোয়াল ঘরের মাচায় রোজ ওঠেন আর হতাশ হন এই দেখে যে খুলির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দিন কয়েক যেতে না যেতেই আবার দেখতে ইচ্ছে করে। ছুটে যান। মাস খানেক কেটেও গেছে। আজ মাঠ থেকে ফিরে মাচায় উঠে চমকে উঠলেন তিনি। খুলি গেল কোথায়? সন্দেহের তির ছুটল স্ত্রীর দিকে। ছুটে এলেন বাড়িতে। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন— “মাচায় একটা খুলি রাখা ছিল। তুমি জান সেটা কোথায়?” স্ত্রী তাকে ভর্ৎসনা করে খুলির পরিণতির কথা বলে জানাল— “যাও কেন, গিয়ে বসো মাচার ওপর। যেটুকু ওর সাধ বাকি ছিল আজ মিটিয়ে দিয়েছি। আর তুমি যদি ফের ঐ মাচামুখ হয়েছ তবে তোমাকেও আস্ত রাখব না।”

গল্প সংগ্রহের স্থান: গ্রাম মোহনপুর, থানা নানুর, জেলা: বীরভূম, ২০১৮

Categories
কবিতা

অনিন্দ্য রায়ের কবিতা

হাসির সমার্থশব্দ

হাসির সমার্থশব্দ, তুমি তো ব্রুনেট

দেহাতি ডান্সবার, এখানে আয়না নিয়ে প্রবেশ নিষেধ
যদি নিজেকে খোলার ব্রীড়া নিজেই দেখতে

ওই ছুরি, শীতল খেলনা
ওই টারকোয়েজ রুমাল
          পরস্পরকে টুকরো করছে
               অবদমনের বশে যেভাবে ইন্দ্রিয় কাটা হয়
আর হ্যাজাকের পাশে চুপ করে বসেছে টিকটিকি
পোকারা বিপন্ন হচ্ছে
          পুরুষের চোখের মতো ছোটোছোটো পোকা

সমস্ত পোশাক খুলে শুধু হাসিটুকু পরে রয়েছ, তুমি দ্যু
আর দীর্ঘ কালোচুল যতখানি প্রহেলিকাপ্রিয়

বিরহ বুড়ির বাড়ি

বিরহ বুড়ির বাড়ি, স্বামী ও সতীন থাকে ওপাশের ঘরে
প্রেম কি ওখানে!
আজ কেউ আগুন ধরাবে?
কেউ বলবে, “ভালোবাসা বয়সের পোষা”?
সহসা শেকল খুলে বাইরে এনেছে, নগ্ন
               এবং মাংসাশী
বুক্কনের শেষে যে নৈঃশব্দ্য আসে
সেখানে রক্তের ছোপ উটকো তরুলতায় ছেটানো রয়েছে

Categories
গদ্য

উৎপলকুমার বসু

 

কোথায় যেন পড়েছিল— বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বহু অর্থহীন প্রবচনের মতো এরও আছে যুক্তিহীন অবিস্মরণীয়তা। এভাবে আমরা চমৎকার উপায়ে সমাজকে চিরদিনের মতো,  ছকে ফেলে, ভাগ করে দিতে পারি— জেলেরা জলে সুন্দর, ধোপারা সাইকেলের পিছনে বা শত্রুরা কারাগারে সুন্দর, নাগরিকতা ধর্মতলায়। হেন সৌন্দর্যবোধ ব্যতিক্রমকে অগ্রাহ্য করে। সঠিক ব্যতিক্রম-চিন্তা মাথায় না থাকার ফলে আকাশ থেকে খসে পড়া বহু আকর্ষণীয় ঘুড়ি আমরা শেষ পর্যন্ত ধরতে পারিনি। শুধু গতিবিক্রম এর জন্য দায়ী নয়, এর পিছনে ছিল ভুল জ্যামিতি জ্ঞান, ভুল উচ্চতা নির্ণয় এবং গ্রামের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছেলেটি, যে একইসঙ্গে ছিল বায়ুবিজ্ঞানী ও হঠকারী, মসজিদ হইতে পতনের ফলে যে ভবিতব্যতার দেখা পেয়েছিল— তাহলে তার সম্বন্ধে বলতে হয়, সে ছিল ছাদের সুন্দর। মুঙ্গেরের ভূমিকম্প অবশ্য মুঙ্গেরে সুন্দর বলা চলে না।

অনুরূপ, ব্যতিক্রমী একটি তালিকা যদি তৈরি করি তবে দেখা যাবে কত-না ভুল ধারণা আমরা বাস্তুসাপের মতো পুষে আসছি যেমন, আমরা ভাবি শিশুদের জন্য, কিশোরদের উপকারার্থে একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্য আছে বুঝি, যার নাম শিশুসাহিত্য। অতীতে যে রামায়ণ মহাভারত বুড়ো-বুড়িরা শুনত, তাই বালকের বা বালিকার পক্ষে ছিল পর্যাপ্ত। যে-নিসর্গের সঙ্গে চিরদিন প্রাপ্ত বয়স্করা যুদ্ধ ও মৈত্রী ঘোষণা করেছিল— ওরা তারই রণক্ষেত্রে অকুতোভয়ে ঘোরাফেরা করেছে। তার আলাদা জগৎ তৈরি করার প্রয়োজন হয়নি— কারণ, আলাদা জগৎ বলে কিছু নেই। যেমন, নেই বিশেষ সাহিত্য— শিশুসাহিত্য বা মহিলা সাহিত্য বা রেল কর্মচারীদের জন্য সাহিত্য।

শিশু সাহিত্য আসলে এক মরালিটি বোধ থেকে জাত শিল্প প্রচেষ্টা। এবং ভিক্টোরিয়ান আমলে এর বহুল প্রচার ঘটে। পাপবোধ বুঝি পাপের চেয়েও দুর্বল। তাই ভিক্টোরিয়ান দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গেই ‘শিশুসাহিত্য’ নামে এক সুনীতি প্রচার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। লিউইস ক্যারল গোপনে কিশোরীদের ফটোগ্রাফ তুলতেন সদ্য আবিষ্কৃত একটি বিস্ময়কর যন্ত্রের সাহায্যে যার নাম ক্যামেরা। তাঁর ডায়েরি এবং সমসায়িকদের চিঠিপত্র থেকে জানা গেল এই অকৃতদার, স্বল্পবাক্ অধ্যাপকের ঘরে ‘লজেন্স টফি’-র লোভে বালিকাদের আনাগোনা ছিল। অপর দিকে তাঁরই রচিত শিশুসাহিত্যে— যা মনোমোহন কাব্যের মতো উদার, জটিলতাময় ও উন্মুখর— সেই ভিক্টোরিয়ান যুগেরই নীতিসঞ্চান দেখতে পাই। ব্রহ্মা সুকুমার রায় সে-ধারার প্রচলন ঘটালেন আমাদের সাহিত্যে।

আজ মনে পড়ে, প্রবাসী বা ভারতবর্ষে একদা যে-কাহিনিগুলি ছাপা হত তা ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু, অর্ধনগ্না মহিলাদের ছবিগুলির কথা ভুলিনি। আমাদের যে সেনসুরালিটি তৈরি হয়েছিল— তাতে উভয়েরই অকৃপণ হস্তক্ষেপ ছিল। বুঝি-বা মনে হয়েছিল দূর আজমিড় পাহাড়ের মতো কোনো এক রহস্যময় উপত্যকায় ওই স্বপ্নময়ীদের সন্ধ্যাজল থেকে উঠে আসা।

শিশুসাহিত্যের আশ্চর্য ও অফুরন্ত প্রকাশ ঘটেছিল ওই ভিক্টোরিয়ান আমলে। অধুনালুপ্ত ‘বয়েজ ওন বুক’ জাতীয় কিশোর পত্রিকার এক্ষেত্রে উল্লেখ প্রয়োজন। আধুনিক কমিক‍্স— এর আদি রূপ এবং সামাজিকতা দেখা যায় এই সংগ্রহগুলিতে। সেকালের অরণ্যদেব ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, অসমসাহসী এবং প্রায়শ আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযানরত। তিনি বশংদ আফ্রিকানদের ত্রাণকর্তা— কিন্তু বিদ্রোহীদের যম। এই ঔপনিবেশিক আদর্শ পুরুষের আরেকটি রূপ দেখতে পাই পরবর্তীকালে টার্জান চরিত্রে এবং ফিল্মজগতে মূক পশুদের সাহায্যে সে, শ্বেতাঙ্গদের উপকারার্থে, কত-না অসম্ভব সম্ভব করেছে। সে-ও কিন্তু বর্ণবৈষম্যবাদী। চীন-বিরোধী ‘ফু-মান্-চু’ গল্পগুলিতে ছিল ওই জাতির বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, ঘৃণা ও অপপ্রচার। গোয়েন্দা শার্লক হোমসের হাতে ধরা-পড়া দুষ্কৃতকারীরা তো প্রায়ই স্বীকার করত যে, তাদের অভিনব কর্মপদ্ধতির নৃশংসতা আসলে ভারতীয় নেটিভদের কাছে শেখা। সাহেব-বালকদের যে-ঔপনিবেশিকতা শিক্ষা দেওয়া হত— তার প্রথম পাঠ ছিল তথাকথিত অ্যাডভেঞ্চারে।

অপরের কাছ থেকে গ্রহণ করায় আমরা, বাঙালিরা, বড়োই অপরিনামদর্শী। তাই বাংলা সাহিত্যে চালু হল ওই কাহিনিগুলির জাতিবর্ণ নির্বিশেষ অনুকরণ।

আজ এগুলি ফেলে দেওয়ার সময় এসেছে। শিশুসাহিত্য বা কিশোর সাহিত্য রচনার জন্য আর আমাদের বুড়ো-খোকা সাজার প্রয়োজন নেই। বড়োদের সাহিত্যে যে-আধুনিকতা, যে-সমসমায়িকতা প্রকাশ পেয়েছে তারই জ্যোতির্বিকাশ ঘটুক আজ যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের চোখের উপর। তাদের যেন আমরা খোলাখুলি বলতে পারি বাঘ দেখে ভয় পেয়ো না— তাকে সহজেই পুরোনো অস্ত্রে মারা যায়। কিন্তু সমাজের যারা অহরহ ক্ষতি করে চলেছে, যারা ভণ্ড, যারা শোষণবাদী, তাদের মারার জন্য নব নব হাতিয়ার তোমরা কল্পনাপ্রবণতার সাহায্যে তৈরি করে নাও।

ঋণ:
মহাযুদ্ধের ঘোড়া। প্রথম সংকলন, মে-জুন ১৯৭৮। সম্পা. দীপান্বিতা রায়।
(দাহপত্রের ফাইল থেকে)