Categories
কবিতা

গৌরাঙ্গ মণ্ডলের কবিতা

সমঝোতা

একঘাটে যতদিন স্নান করা যায়
তার চেয়ে দীর্ঘ না সময়

নিঙড়ে নেওয়ার জন্য হাত কি
জলের আজ্ঞা শোনে?

উদ্বাস্তু শ্যাওলায় আমাদের সূর্যোদয়
পিছলে যাওয়ার আগে শক্ত করে বাঁধো আলিঙ্গন

রাজা নই, চন্দ্র নই, কর্তৃকারকের দায়
এখনও পারি না

খুচরো মাংসের দিকে জিভডগা সাপের ফকিরি

ঘর বড়ো, ধড় বড়ো, হাঁড়ি, শূন্য, কাঁধ…
বয়স বেশির মেয়ে, পারাপার দেবে বলে
তুমিও তো নিয়ে চলো
কায়াভীতিতলে

বাংলা ভাষার থেকে সরে যাও
ব্যাকরণ বড়ো বেশি নিষ্ঠুর প্রেরণা

পদটির অনিচ্ছা জেনেও
ব্যাস বাক্য
ভেঙে ভেঙে রাখছ

এই বিচ্ছেদের দায় নাও। যত পারো দুঃখ করো। শোনো, কসাই হইয়ো না

আমার যা পছন্দের, তার
বাইরে তোমাকে খুঁজি
যা অপছন্দের, তার ভেতরেও…

বিস্তৃত সিঁথির মাঝে
বালকেচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে

সমস্ত রৌদ্রকে আজ স্তনের মাদুলি করে নাও
বৃক্ষহীন এ জীবনে বিদ্ধ হোক অপ্রস্তুত ছায়া

সময়

চিহ্ন দেখে নির্ধারণ
বিশ্বাস রাখিনি এই প্রাচীন প্রথায়

কাদা কি পায়ের কেউ!
সে কেন, সে কেন
নির্মাণে ভুলেছে বৃষ্টিকে

দৃশ্যেও গোপন থাকে, রঙের আড়ালও
ছুরির লাগে না কোনো সাজঘর, ব্যাধি

যা বলার, বলে নাও দ্রুত
তুমি তো চন্দন না যে, ক্ষয়ে গিয়ে ছড়াবে সুখ্যাতি

Categories
কবিতা

তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

খিদে

হরিণ লাফাক, তুমি সাপের গর্ভের কথা বলো। আমাদের মাঠে বসে গুণিন ছিলিম টানে ভোরে। ফের কিছু লোক এসে কোকুনের ছাল রেখে যাবে। নদীতে যে মড়া এসে কাল রাতে ঠেকেছে শ্মশানে, তার কোনো নাভি নেই, শুধু কিছু কুচো মাছ খুঁটে খুঁটে শ্যাওলা খেয়ে যায়। গুণিন জমিয়ে বসে, সাপের রভস ব্যাখ্যা করে। কীভাবে নক্ষত্র থাকে শঙ্খ হলে কৃষ্ণা প্রতিপদে… কীভাবে সাপের শুক্র উচাটনে স্থির হয়ে যায়… ফের ঘুম, ফের কিছু উপোসের বাটি নড়ে ওঠে। হরিণ শিথিল হয়ে মুচড়ে গেছে ছোটার আগেই।

একা বুড়ো গুণিনের ঘরের উনুনে ছাই ছুঁড়ে
মড়ার কণ্ঠার হাড় মাছ ভেবে ছিঁড়েছে সারস।

চাষ

মধ্যযামে রমণ। প্রতিবার ক্লান্ত স্ত্রী আরও যেন কুহক, আগামী।
প্রবেশ সংযম ধরে বীভৎস ঝাঁকিয়ে দিল,
যেন নিচে বিছানা নেই, মাধ্যাকর্ষণ নেই।

গতি তো ধ্রুবক নয়; ধীরে ধীরে নিভে যায় আয়ু।

যত চেনা ঘামগন্ধ, সিঁদুরগন্ধ, গৃহগন্ধ—
হাড় তত আগন্তুক শামুক।

সারাদিন বীজ পেটে ভাত রাঁধছে দানে পাওয়া গাছ।

অন্দরে মানতের জ্যান্ত, গাঢ় সুতো

ন’মাস

সুজাতা হয়ে ভাসে।

Categories
কবিতা

নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছায়ামানুষের খেলনাগাড়ি

১৬

আলো-না আলোয় বোনা পাতার পোশাক তারে মেলা

ফাঁকে ফাঁকে বাজনা থেমে আছে

নেভানো ঘরের জানলা উগরে দিচ্ছে দ্রাক্ষারস, ময়ূরের কেকা

পাড় ভাঙছে মাটির পেয়ালা

বারান্দা হারিয়ে যাচ্ছে দুপুরের নীরব মুঠোয়

জলরঙে আঁকা শূন্য থেকে

যা কখনও লাল নয় তবু তার লালের গভীরে
অস্থির প্যাডেল ঠেলে নেমে যাচ্ছে কাঙাল সেলাই

১৭

নিজেকে পিছন থেকে ধাওয়া করে ব্রহ্মবীজে ফিরেছে কুসুম

ভিতরে তারের বাজনা, বাজনার ভিতরে ডালপালা

ঘুঘু ডাকছে পাতার আড়ালে

দেউটির পিরান থেকে খসে পড়ছে গুলঞ্চ, টগর

কব্জি থেকে কাটা বালিঘড়ির জখমচিহ্ন শুষে
হাওয়া উঠছে ঘুরে ঘুরে ঘুরে

টলমলে গর্ভের ঘুম ভেঙে
গোলকের মুঠো খুলে ভেসে যাচ্ছে মাটির শাবক

Categories
কবিতা

প্রীতম বসাকের কবিতা

স্থিত হও। মধুর যে আলোক—চক্ষু মুদিয়া তাহার সংহিতা বুঝিয়া লও। প্রবীণ বাক্যের পার্শ্বে আমাদিগের সারল্য রাখিয়া দিয়াছি। ওলো কৃষাণীর দেহের কাঁচা লাবণি ভাসিয়া যায় স্রোতে! অধর ফাটিয়া জীবমণ্ডল প্রস্ফুটিত হইতে থাকে। একটি মানুষের দিনলিপির ভেতর ঢুকিয়া পড়ে ভিন্ন মানুষ। দুঃখের সনাতন কাঁপিয়া ওঠে। তুমি ধারণ করিও উহার সজল বায়ু। মেঘ নামাইয়ো আশার ছলনে। দুদণ্ড দাঁড়াইয়ো হে পথিন৷ নিকটে ঘুমাইয়া আছে আমাদিগের দীন সফলতা !

অতঃপর তাহারা পাখির উচ্চতায় আসিয়া বসিল। দেখিল কুঞ্জবনে ছড়াইয়া আছে কাহার নোলক। একটি অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীর অংশ ভাবিল কেহ। কেহ কেহ নদীর নিকট রাখিল দুঃখের তরজমা। একটি সহজ রচিত হইতে হইতে সহসা বাঁক লইয়া মানুষের পাড়ায় আসিয়া পড়িল। দেখিল ফুলের প্রতি সন্দেহ! শুশ্রূষা কেন্দ্রের নিকটে পথ হারাইয়াছে একাধিক ছোটোগল্প। একটি শিশুর দাঁতে আমি দেখিলাম চাঁদের টুকরো লাগিয়া আছে। তাহাকে একটি সরলরেখা উপহার দিতে গিয়া আমার হাসি হাসিগুলোর অপমৃত্যু হইল।

Categories
অনুবাদ গদ্য

একটি আত্মজ্ঞানের খসড়া

তলস্তয়

ভাষান্তর: রূপক বর্ধন রায়

জানুয়ারি ০১

বিস্তর অকেজো আর মধ্যবিত্ত জিনিসের থেকে অল্প কিছু উত্তম এবং প্রয়োজনীয় জিনিস জানা ভালো।

একটা ছোটো, নির্বাচিত বইয়ের পাঠাগারে কত বিরাট সম্পদ লুকিয়ে রাখা যায়! হাজার বছর ধরে, পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতিবান দেশগুলির সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান এবং সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের একটা অনুষঙ্গ, তাদের পড়াশোনা এবং জ্ঞানের ফল আমাদের কাছে উপলব্ধ হতে পারে। অপর শতাব্দীর কিছু মানুষ, যে-ভাবনা হয়তো তারা তাদের প্রিয়তম বন্ধুদের কাছেও প্রকাশ না করে থাকতে পারে তা আমাদের জন্য এখানে স্পষ্ট শব্দে লিখে রাখা আছে। হ্যাঁ, আমাদের শ্রেষ্ঠ বইগুলোর জন্য, আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক অর্জনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

— রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন

বহুল পরিমাণে বই আমাদের মনকে কেবল আনন্দ দেওয়ার জন্য মজুত রয়েছে। তাই, শুধু সেই বইগুলোই পড়ো যেগুলো কোনো প্রকার সন্দেহাতীতভাবে উৎকৃষ্ট।

— লুশিয়াস আন্নাইয়াস সেনেকা

শ্রেষ্ঠতম বইগুলো আগে পড়ো, না হলে দেখবে তোমার হাতে আর সময় নেই।

— হেনরি ডেভিড থরু

প্রকৃত জৈবিক বিষ ও বৌদ্ধিক বিষের মধ্যে পার্থক্য হল, বেশিরভাগ জৈবিক গরল অত্যন্ত বিস্বাদ, কিন্তু বৌদ্ধিক বিষ, যা কি না সস্তা খবরের কাগজ বা নিকৃষ্ট বইয়ের আকার নেয়, দূর্ভাগ্যক্রমে কখনো কখনো আকর্ষণীয় হতে পারে।

ফেব্রুয়ারি ১৫

প্রাকৃতিক সরলতা হয়, এবং আত্মজ্ঞানের সরলতা হয়। উভয়ই প্রেম এবং সম্ভ্রম দাবি করে।

যে-কোনো মহৎ সত্যই হল সরলতম।

মানুষ যখন অত্যন্ত বিস্তৃত এবং পরিশীলিতভাবে কথা বলে, তখন হয় সে মিথ্যে বলছে অথবা নিজের স্তুতি করতে চাইছে। এমন মানুষদের বিশাস কোরো না। ভালো অভিভাষণ সর্বদাই স্পষ্ট, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সর্বজনবিদিত।

সরলতা পরিশোধিত আবেগের একটি পরিণতি।

— জঁ ড’আলেমবার্ট

শব্দ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। তাই, স্পষ্টভাবে কথা বলতে চেষ্টা করো, এবং শুধু সত্যিটা বলো, কারণ, সত্য আর সারল্যের চেয়ে আর কোনো কিছুই মাবুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে না।

এপ্রিল ২৮

সুখের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তটি হল কাজ। প্রথমত, প্রিয় এবং স্বাধীন কাজ; দ্বিতীয়ত, কায়িক শ্রম যা তোমার খিদে বাড়ায় এবং পরবর্তীকালে তোমাকে শান্ত ও গভীর ঘুম প্রদান করে।

কায়িক কাজ বৌদ্ধিক ক্রিয়া বর্জিত নয়, বরং তার গুণবর্ধক এবং তাকে সাহায্যও করে।

অবিরাম আলস্যকে নরকের অত্যাচারগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, কিন্তু পক্ষান্তরে, সেটিকে স্বর্গের আমোদগুলির একটি বলে বিবেচিত করা হয়।

— চার্লস দি মন্টেসকিউ

একজন মানুষ যখন কাজে প্রবৃত্ত হয়, সে যতই সর্বোচ্চ পর্যায়ে অযোগ্য, আদিম, সহজ কাজই হোক না কেন, তার আত্মা শান্ত হয়। কাজ আরম্ভ করার সাথে সাথেই, সমস্ত অপদেবতা তাকে ছেড়ে যায় এবং কাছাকাছি ঘেঁষতে পারে না। একজন মানুষ, মানুষ হয়ে ওঠে।

— থোমাস কার্লায়েল

কাজ প্রয়োজনীয়। যদি তুমি তোমার মানসের সুস্বাস্থ প্রত্যাশা করো, পরিশ্রান্ত হওয়া অবধি কাজ করো। তবে অত্যধিক বেশি নয়। তুমি ব্যয়িত হওয়া অবধি নয়। আত্মিক সুস্বাস্থ্য অত্যধিক কাজের পাশাপাশি আলস্যেও বিনষ্ট হতে পারে।

জুন ১১

আমাদের আত্মিক জীবনের পরিবর্তনগুলোর তুলনায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত বস্তুবাদি পরিবর্তনগুলো ক্ষুদ্র। অনুভূতি ও কাজে একটা পরিবর্তন হতে পারে, চিন্তা ও ধারণায় একটা বদল আসতে পারে। তোমার চিন্তা ও ধারণায় পরিবর্তন আনতে হলে, তোমার সচেতন মনকে তোমার আত্মিক প্রয়োজনীয়তাগুলোর উপর কেন্দ্রীভূত করতে হবে।

প্রত্যেকটি চিন্তা যার উপর মানুষটির আবাস, তা সে প্রকাশ করুক অথবা না করুক, তার জীবনকে হয় ক্ষতিগ্রস্ত করে অথবা উন্নত করে।

— লুসি মালোরি

পাপকে পরাস্ত করতে হলে, তোমাকে মানতে হবে যে, প্রতিটি পাপের মূল একটি বদ ভাবনা। আমরা সকলে শুধুমাত্র আমাদের ভাবনারই অনুসারী।

— বুদ্ধ

আমরা একটি টাকাভরতি থলি হারানোয় অনুতাপ করি, কিন্তু একটা খাঁটি ভাবনা যা আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে, যা আমরা শুনেছি অথবা পড়েছি, একটা চিন্তা যা আমাদের মনে রেখে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করা উচিত ছিল, যা পৃথিবীকে উন্নত করতে পারত— আমরা এই ভাবনাটিকে হারিয়ে ফেলি এবং তৎক্ষণাৎ সেটির ব্যাপারে ভুলে যাই, এবং তার ব্যাপারে অনুতাপ করি না, যদিও চিন্তাটি লক্ষগুণে মূল্যবান।

জুন ১৬

ব্যক্তির নৈতিক উন্নতির মধ্যে দিয়েই সমাজের উম্মতি অর্জন করা সম্ভব।

আমরা শৃঙ্খল, সংস্কৃতি ও সভ্যতার যুগে বসবাস করি, কিন্তু নৈতিকতার যুগে নয়। বর্তমান পরিস্থিতে, আমরা বলতে পারি যে, মানুষের সুখ বৃদ্ধি হয়, তবু তার সাথে মানুষের অসুখের পরিমাণও বাড়ছে। আমরা মানুষকে কীভাবে সুখি করব যখন তারা উচ্চতর নৈতিকতার জন্য শিক্ষিত হচ্ছে না? তারা জ্ঞানী হয় না।

— ইমানুয়েল কান্ট

জীবনের যা কিছু সাধারণ অশুভতা তার সাথে লড়াই করার একটাই উপায় হতে পারে, তা তোমার জীবনের নৈতিক, ধার্মিক, এবং আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার মধ্যেই বিদ্যমান।

আগস্ট ০৬

মেধা মানব জীবনের একমাত্র উপযুক্ত পথপ্রদর্শক।

চোখ হল দেহের আলো: সুতরাং তোমার চোখ যখন একক তোমার সমস্ত শরীর আলোয় পূর্ণ; কিন্তু তোমার চোখ যখন দুর্বৃত্য, শরীরটাও অন্ধকারে পরিপূর্ণ। কাজেই সাবধান হও, তোমার মধ্যে যে-আলো রয়েছে তা যেন অন্ধকারে পরিবর্তিত না হয়।

— লিউক ১১: ৩৪-৩৫

বৌদ্ধিক জীবন যাপনকারী মানুষটি এমন একজন মানুষের মতো যে নিজের পথ আলোকিত করার জন্য সামনে একটি লণ্ঠন বহন করে। এমন একজন মানুষ কখনো অন্ধকার জায়গায় পৌঁছাবে না, কারণ, তার মেধার আলো তার সামনে সামনে চলে। এমন জীবনে কোনো মৃত্যুভয় নেই, কারণ, যে-লণ্ঠনটি তোমার সামনে চলেছে সে শেষ মুহূর্ত অবধি তোমার পথ আলোকিত করে, এবং তুমি তাকে শেষ অবধি অনুসরণ করো যেমন সারাজীবন ধীর স্থিরভাবে করে এসেছ।

কিছু মানুষ নিজের ভাবনা অনুসারে বাঁচে এবং কাজ করে, আর কিছু মানুষ অন্যের চিন্তা অনুসরণ করে; এটাই মানুষের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।

সেপ্টেম্বর ১৭

বিস্তীর্ণ জমির স্বতন্ত্র মালিকানা অন্য মানুষের মালিকানার মতোই অন্যায্য।

ভূমি মালিকানা সংক্রান্ত বিদ্যমান নিয়মকানুনগুলো আইনসঙ্গত তা তুমি বলতে পারো না। এই আইনগুলির মধ্যেই রয়েছে হিংসা, অপরাধ এবং ক্ষমতার উৎস।

— হার্বার্ট স্পেন্সার

মানুষের মাঝের প্রাকৃতিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে নয়, বরং দস্যুতার মধ্যে দিয়েই ভূমির স্বতন্ত্র মালিকানা এসেছে।

— হেনরি জর্জ

অন্যান্য অবিচারের মতই, বড়ো জমির টুকরোগুলোর স্বতন্ত্র মালিকানার অবিচার, তাকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত অন্য আরও অবিচারের সাথে অপরিহার্যভাবে সংযুক্ত।

নভেম্বর ০৯

আত্মপ্রশংসা অহংকারের প্রারম্ভ। অহং-বোধ হল অপসারিত আত্ম-উপাসনা।

যারা নিজের স্বার্থপরতাকে, নিজেদের বাকি পৃথিবীর থেকে উচ্চাসনে স্থাপন করাকে ঘৃণা করে না, তারা অন্ধ, কারণ, এই ক্রিয়া সত্যের বিরোধিতা করে।

— ব্লেইজ পাসকাল

একটি বস্তু যত হালকা এবং যত কম ঘনত্বের, সে তত সীমিত জায়গা অধিকার করে। এর সাথে একজন অহংকারী মানুষের নিজের চরিত্রের তুলনা করা চলে।

— প্রাচ্যের পাণ্ডিত্য

এমন বহু মানুষ রয়েছে যাদের নিজেদের প্রথমত শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও নিজেদেরকে অপরের শিক্ষক বলে দাবি করে।

জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পথ হল পরিপূর্ণতার পথ, এবং কোনো মানুষ যদি নিজেকে নিয়ে গর্বিত ও সন্তুষ্ট থাকে তবে কী ধরনের পরিপূর্ণতা অধিষ্ঠান করতে পারে?

ডিসেম্বর ১১

ভূমি কর্ষণে লিপ্ত চাষির শ্রমের মতো আনন্দদায়ক আর কিছুই নয়।

তুমি বা তোমার সন্তান নিজে হাতে যে-খাদ্য উৎপাদন করো তাই পরম খাদ্য।

— মহম্মদ

যারা নিজেদের খাবারের যোগান নিজেরাই করে তারা ধার্মিক বলে দাবি করা মানুষের থেকে বেশি সম্মানের যোগ্য।

— তালমূদ

জমির কাজ ও নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করা সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, তবে অন্য কোনো ধরনের কাজ মানবতার জন্য বেশি জরুরি নয়, এবং অন্য কোনো ধরনের কাজ বৃহত্তর মাত্রায় স্বাধীনতা এবং ভালোত্ব প্রদান করে না।

ডিসেম্বর ২৮

মানবজীবনের রীতি উদ্‌ঘাটনের কাজে ব্যবহৃত হলে বিজ্ঞান অত্যাবশ্যক রূপে গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হলে, আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে, কাজটি উপযোগী। সাধারণত বিজ্ঞানীরা দেখান যে, ওঁরা কিছু একটা করছেন এবং হয়তো কোনো সময়, কোনো একদিন, এটি ভবিষ্যতে মানুষের কাজে লাগবে।

মহাবিশ্ব সীমাহীন, এবং কারো পক্ষেই তাকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা অসম্ভব। সুতরাং, আমাদের পক্ষে আমাদের দৈহিক জীবনকেও পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।

— ব্লেইজ পাসকাল

“বিজ্ঞান” তেমন কোনো ধারণা নয় যেভাবে মানুষ এই শব্দটিকে শনাক্ত করে ব্যবহার করে; এটি আমাদের বোধগম্যের জন্য সর্বোচ্চ, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু।

Categories
কবিতা

প্রবীর মজুমদারের কবিতা

আজীবন

তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে
যাইনি বহুদিন।
অথচ জানালা থেকে উঁকি মারলেই
ঝুরঝুর করে তোমার খেলাঘর
ভেঙে যেতে দেখি
ধুলোবালিতে এতদূর থেকেও
শ্বাসকষ্ট টের পাই।

যেন আজীবন দু’জনেই
জানালায় মুখ রেখে বসে আছি।

চিঠি লেখার দিন

চিঠি লেখার দিন ফিরে আসুক আবার। স্কুল থেকে সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে ফাজিল ছেলেরা মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে দিক লাল-নীল-হলুদ রঙের অজস্র সব চিরকুট। গভীর রাতে জলতেষ্টা পেলে গোপন স্রোতের মতো সুধারসে ভিজে যাক সমস্ত হৃদয়। আর কোন এক বিকেলে কেটে যাওয়া ঘুড়ির সাথে কচি কলাপাতার খাম হয়ে খসে পড়ি তোমার ছাদে। দুড়াদাড় করে ছুটে এসে আমাকে তুলে নিতেই ব্জ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত।

জলসাঘর

তোমাকে একটা দরকারি কথা বলতে গিয়ে বারবার অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই। কিছুতেই বলা হয় না। আজ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে বলছি শোন— যেদিন তোমার খুব মন খারাপ, মনে হবে আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। সেদিন চোখ বুজলেই দেখতে পাবে মনের ভিতরেও এক জলসাঘর। সে ঘর জুড়ে দীন হয়ে আছে কত রংবেরঙের লতাপাতা। আর এমন দুপুরে তার আড়ালে বেজে ওঠে দিলরুবা।

Categories
কবিতা

শাশ্বতী সরকারের কবিতা

প্রবাস


ওই দেখো পড়ে আছে উল্কাখণ্ড, মৃত
অভিকর্ষ হারানোর কিছু নেই তার
ফিরে গেলে মনে হয়
সমস্তই জলপ্রিয়, সবই আজ শোকাকুল
পৃথিবীর মাটি থেকে এইহেতু কিছুটা উপরে ওঠা তার

বৃষ্টি আজ তোমার যাওয়াকে ঘিরে মহৎ হয়েছে


মেঘ শুধু দেবে অবিদ্যার পাঠ, ভুলশেখা
পাঠশালা হতে প্রত্যাগত নীচু মাথা বালকের দল
রোদ্দুরে তোমার মুখ পালংশাকের মতো
তরতাজা, এই দেখে তারা বিরহ শিখেছে

কতকাল কেটে গেল বিরহ অধীন
কেবল জলের দিকে চেয়ে থাকি
কিছু পুণ্যফল— তোমাকে চাওয়ার
ওই দূরে ফড়িংয়ের দেহ থেকে
বিচ্ছুরিত আলো, সে-ও জানে

মহর্ষির ঘর, সরযু নদীর তীর, কালো

Categories
কবিতা

শুভম চক্রবর্তীর কবিতা

অস্তিত্বের কথা

দেওয়ালে, উৎকর্ণ কেউ অপেক্ষায় রত। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, আর সমূহ বুড়বুড়ি কাটার শব্দ তার শোনা চাই৷ শুনে তিনি জাবর কাটবেন। আঁশে, বিদ্যুতে চলকে চলকে যাবে গণ্ডদেশ। স্থলনহীন অথচ মধুর জাবর কাটার শ্রান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। গোয়ালে বাঁধা এঁড়ে যেন। ক্লান্ত, গাভিন হবে না । হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপের ওপর চরে বেড়ানো ভাইবেরাদর সকল। নিউট্রনই মূলত তোমাদের শক্তি। এবং তা থেকেই তো হ্যাঁ আর না-এর প্রোটন, ইলেকট্রন হ’ল হে। অস্বীকার খুব গুরুত্বপূর্ণ যদিও। কিন্তু আমার দেহপটাশ্রিত অস্তিত্ব বুড়বুড়ি কাটছিল, ক্ষণকাল, আর শ্রান্তিতে নিভে আসা আমি শ্রাবণীপূর্ণিমার দোদুল চিদাকাশের দেওয়ালে কান পেতে শুনছিলাম সে বুড়বুড়ির শব্দ। নিভু, অস্তিত্ব ভাবনায় ভীত নিতান্ত বুড়বুড়ি। বৃত্তাকার ডিম্বানু প্লাসেন্টার অন্ধকার রক্তমাখানো স্বস্থানে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার জন্মমুহূর্ত মনে পড়ছে। মুখে চুল গুঁজে শুয়ে থাকা ভদ্রমহিলার হাত-পা ছোঁড়ার দৃশ্য মনে পড়ছে। হাসপাতালের বেডে রক্ত চলকে ওঠা মনে পড়ছে সেদিনের মতো। চাদরে ছোপছোপ রক্ত, আকাশে ছোপছোপ তারাই যেন। দেওয়ালে কান পেতে আছি, বুড়বুড়ির শব্দ আসছে। আমি আমার থেকে আলাদা। আমি আমার থেকে আলাদা নই। আমি আমার থেকে আলাদা।

অযোধ্যার দিকে তাকিয়ে

নিহত শম্বুক পাথরের চাতালে থেঁতলে পড়ে আছে । ইক্ষ্বাকু বংশের সূর্য আপনার, আপনাদের দাবদাহ ছেলেটার সহ্য হ’ল না। পাথরের গায়ে কালো ক্লট ক্লট রক্ত। হাঁদা শম্বুক বোকা শম্বুক তার আরাধনাকে প্রত্যয়িত করতে চেয়েছিল আপনাদের কাছে। সমগ্র আর্যাবর্তের হল্লারব সে তো শোনেনি। সে তো জানে না চিরসময়ের ভেতর কিছুক্ষণ পিছিয়ে শোননদের ধারে ছলছল করছিল আপনার মুখ। যেন প্রতিবিম্ব, যেন তার ভেতর আশফাক বিম্বিত, যেন তার ভেতর ছুঁয়ে ফেলার সুমহৎ পাপে থেঁতলে থেঁতলে মারা হচ্ছে দলিত যুবকদের আর তাদের রক্ত কী শীতল! কী নরম! কী সান্দ্র ! সূর্যাস্তের মতো। সিদ্ধাশ্রম কত দূর প্রভু? আপনাকে সোনা জহরতের চৌদোলায় চড়িয়ে চামর দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাবে পেটমোটা ব্রাহ্মণেরা। আর কোনো বনবাস নেই, সীতা নেই, রাবণের চিতা কেউ পেচ্ছাপ ক’রে ঠিক নিভিয়ে দেবে। সূর্যাস্তের দৃশ্যে আমরা দশরথকে আনব, ওঁর মুখে মাঝে মাঝে নিহত দলিতের বাপমায়ের মিশকালো ছায়া ঘনিয়ে তুলব। বেশ হবে। প্লট জমে ক্ষীর। রক্ত থইথই ভারতবর্ষের বুকে কাড়ানাগড়া বাজাতে বাজাতে, আপনার জয়ধ্বনি দিতে দিতে, কাঁদতে কাঁদতে, কাঁদাতে কাঁদাতে এক কলঙ্কিত ধূসরতার দিকে যাব আমরা, রক্ত সাঁতরে সাঁতরে।

Categories
চিত্রকলা

তন্ময় মুখার্জীর চিত্রকলা

নাম : Untitled
মিডিয়াম : Muliti Media
সময় : 2020

১০

Categories
কবিতা

সঞ্চিতা দাসের কবিতা

অঙ্ক

মশারির অনেক ফাঁক থেকে আমি সাদা আকাশকে দেখছি, আকাশ আমাকে উপহার দিয়েছে একখণ্ড মেঘ। মেঘ বলল— তুমি নিজেকে ভাঙো। খানিকটা ভাঙা শুরুতেই আয়নাতে দেখলাম একটা জলকাদার জীবন পড়ে আছে, ওর ভেতর আমি কবে থেকে ডুবে আছি জানি না…! এবং তার মধ্যে ঘিরে আছে কয়েকটি গ্রাম, ছোটো ছোটো টিনের চালার ঘর, দূরে তালগাছ, বাঁশবনের সারি, খোলা মাঠ, সরু পথের দু-পাশে ঘাস হাঁটলে পরে পা ছুঁয়ে মাথা নত করে রাখে, জীবজন্তুর বিষ্ঠা, পশুপাখির কোলাহল, আরও কত কী… গ্রাম আমাকে প্রদীপের নীচের অন্ধকার আর আলোর শতকরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। শহর কংক্রিটের শৌখিন আলো সারারাত জ্বালিয়ে রেখে অঙ্কের লাভ ক্ষতি শেখায়, বোঝাতে চায়। দু-জনেই ডাকছে। ওরা ব্যাকুল হয়ে ডাকছে।

তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে

অনেক দিন ধরেই ভিতরে ভিতরে একটা কামড় চিনচিন করে, ধরা পড়েছে গভীর সমুদ্রে ক্ষয় চলছে, ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। অনেক নিঃশ্বাস ফেলার ধাপ থেকে নেমে আসে ভাঙা গল্প, যারা মাটির পাত্রের মতো অবহেলায় পথের দু-পাশে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে। ওদের চোখের জলের ওপর সত্যের নতদৃষ্টি গড়িয়ে পড়ছে আর চকচক করে জ্বলে উঠল সেই আলো।

অনন্তকাল ধরে অভিশাপের গহ্বরে হাত ডুবিয়ে ভালোবাসা ভেবে একরাশ তেষ্টা নিবারণ করতে করতে এই অবধি আসা… শাবল, কোদাল দিয়ে খুঁড়েও প্রয়োজনের জলোচ্ছ্বাস আসে না!

আসে শুধু একটা ভাঙনের পদধ্বনি… থপ্ থপ্ থপ্।