Categories
কবিতা

সুদীপ্ত মাজির কবিতা

অসমাপ্ত গানের খাতা : ১৮

গানে গানে বজ্রপাত—
এরকমও হয়?

যখন বিকেল ভেঙে সন্ধ্যা হয়!
খুব সন্ধ্যা হয়!

নিজের বাইরে যেতে ভয় করে, ভয় করে খুব!

বাইরে বিদ্যুৎগর্ভ মেঘ নামে
অসি হাতে
সন্ধ্যার সময়!

অসমাপ্ত গানের খাতা : ২০

সুর যাকে স্পর্শ করে গোধূলিতে
জেনো তার ব্রহ্মলাভ হয়

সমুদ্রস্নানে যাওয়া পুত্তলিকা
সন্ধ্যার সময়
বাড়িতে ফেরে না আর
কোজাগরী আলো হয়ে জ্বলে

কার্তিকের মাঠে ঘাটে জেগে থাকা
মানুষের
নির্জন ফসলে…

অসমাপ্ত গানের খাতা : ৩৫

অসীমের থেকে দূরে বসে আছে সীমা।

সুর সে আয়ুধ, যার লম্বচ্ছেদের দ্বারা
দু-জনের সম্পর্ক পরিমাপ করে
সীমা অসীমের যত ঝগড়াঝাটি পরিমাপ চলে।

এই চিররহস্যের ঠিক মাঝখানে একদিন
অনন্তও আবির্ভূত হলে
আরও দ্রবীভূত হয় গান— আর তন্দ্রার ভুবন
ঘেরাবারান্দার মধ্যে আরও কিছু স্বপ্নের আয়ুধ
সংগ্রহ করে যাতে আয়ুষ্কাল কিছু দূরব্যাপী
নতুন পেখম মেলে সঞ্চারী ও আভোগের
                          ডালে বসতে পারে !

Categories
কবিতা

ইন্দ্রনীল ঘোষের কবিতা

বাদল দিনে…

কী সমস্ত মেঘে
কী সমস্ত হরফ বাদলায়…

ইহ দিন কেটে কেটে সুগন্ধি রক্ত জমানো—
রক্ত ইলিশ করে
              আঁশ নড়ে
              কানকো নড়ে
হাল্লা হাকিম পীরে মোহনা ফেটে যায়…

তারপর, বেতার-তরঙ্গটুকু আঁকা
         ছোট্ট বিড়ালটিও আঁকা
দৃশ্য থেকে ক্লান্ত ফিরছে রং…
দু-এক পশলা তেল ফুটছে তখনো
সামান্য নুন লাগছে—
ছেতড়ে থাকা অপরাহ্ণ ডিমে

ভিলেইন

জলে ডুব দিতেই
জল, কুরে কুরে খেয়ে নিল আমার শরীর
হাড়গোড় টুকে লেখা হল
সূর্যাস্তের যৌন অপার

শেষ যেদিন ভিলেইনকে দেখি
মাছ কিনছিলাম বাজারে—
অনেক দূরে স্থির হয়ে আছে শত্রুতা…
পলিপ্যাক নিশপিশ করছে তার চোখে

Categories
কবিতা

অগ্নি রায়ের কবিতা

শ্বাপদকথা


এক মহাকাশ জুড়ে
তোমার মতন কোনো স্পন্দন দেখি।
ভাবি সে আমার ফেলে আসা বাতিল
কোনো রোমন্থন।
তাস পালটে দেখি
সেখানেও রংয়ের গোলাম!
বারান্দার ওপারে হাত নাড়ে উদ্ভট শ্বাপদ।
তবুও,
তোমার মতন কোনো শ্বাপদ দেখি না


তোমাকে পাব বলে
যে যে মাটির কাছে ধর্না দিয়েছি
তার কোনো জরিপ ছিল না।
সব শেষে ফিরে আসি লাল দাগ পেরিয়ে,
ভূমিক্ষয়ের স্মৃতি নিয়ে।
তোমা-বিনা নাশ নাই জেনে
শরীর পাত করে ডেকে ওঠে
রাতের শৃগাল।
হাঁ-মুখ তবু দূরেই থেকে যায়
গিলতে চায় না

Categories
কবিতা

কমলকুমার দত্তের কবিতা

বয়েস সাজিয়ে দিচ্ছে—
কত তার জোগাড়যন্তর
হাড় ঠুনকো করার, পেশি আলগা করার
চামড়া কোঁচকানোর যন্ত্রটা চিনতে পারলাম
ছোটোবেলায় দেখেছি— লন্ড্রিতে ওটা দিয়ে
পাঞ্জাবির হাতা গিলে করত প্রভাতজেঠু
এদিকে রঙের বাটিতে রং মোটে দুটো
সাদা ও ধূসর
বলি— লাল, গোলাপি, বাসন্তী, সবুজ, নীল
এসব লাগে না?
উত্তর দেয় না, একমনে সাজাতে থাকে
সাদা ও ধূসর— তার এই যথাসর্বস্ব দিয়ে
আমি তার নির্দেশমতো হাত মেলে ধরি
পা ছাড়িয়ে দিই
চোখ বন্ধ করি— আর
সি-গ্রিন, স্কাই-ব্লু, ফ্লেমিংগো পিঙ্ক, সিলভার গ্রে, ওয়াইন রেড
ঝাঁপিয়ে পড়ে
কানে কানে বলে— চোখ খুলো না, চোখ বন্ধ করে রাখো।

পথের গন্তব্য যেন বেয়াড়া সন্তান
আজ মুখে মুখে তর্ক করবে
আজ তাকে কিছু দিয়ে ভোলানো যাবে না
পথের নগন্য ফুল— সেও আজ মজা মারবে, বুঝে
আমি গলিপথ ধরি
গলির বাঁ-ধারে মন্টুর চায়ের দোকান
দু-দণ্ড সেখানে বসি, দেখি
দূর থেকে পথের গন্তব্য আসছে, খুঁজছে আমাকে
উঠে পড়ি
আর তো সময় নেই, নিজেকেই বলি
পথ শেষ হল আজ এবারের মতো
এই অনাথ বিকেলে খুঁজে নিতে হবে কানাগলি!

Categories
কবিতা

তথাগত’র কবিতা

বেহাগ, নিখিল ব্যানার্জী

এমন মন্দ্র বেহাগ, সখা, কখনো শুনিনি।
মেঘে মেঘে ঐ বিদ্যুৎ বাজে। সুরের মূর্ছনা এই নবীন আষাঢ়কে
দ্যাখো, ভরা শ্রাবণ করেছে। এ কি সত্য? এ কি ভ্রম?
এ কি তোমার বাড়ির হারিয়ে যাওয়া পথ?

চারদিন হলো আজ বর্ষাকাল, চারদিন হলো নিখিল বেহাগময়, ঘুমের ওষুধ খাইনি।

পূর্বরাগ

তোমাকে দেখার মতো সুখ ত্রিভুবনে নেই।
যে চুল হাওয়ায় ওড়ে তাকে শ্রাবনমেঘে উপমিত করা—
আমি অপারগ কবি। আমার অক্ষমতা তুমি জানো।
ওই ক্ষমাসুন্দর বুক, আমি দূর থেকে দেখি। যেন সুজাতার
হাতে ধরা পায়সের বাটি। আমি ক্লান্ত, শীর্ণ, অচল বুদ্ধ।
তুমি মাথে শাখা হও, শাখাবট, তাতে পাখি হয়ে বোসো।

পাখি তুমি। তোমার সতীন হোক গোলা পায়রা, ঈর্ষায়
ধূসরবর্ণ। তুমি শ্যামা, তন্বী, শিখরদশনা। ও পাড়ার
বাগদিদের মেয়ে। আমি ইস্কুল মাস্টার, কাব্য করি, পাখি
দেখি, কলঘরে একা চান করি। দেওয়ালে জলের ধারায়
তোমার নাম লিখেছি শ্যামা, দু-বেলা হাত পুড়িয়ে রাঁধি।

বর্ষা ও শরৎ

এসো হাত ধরো। যে হাত আষাঢ়ের মেঘ, শ্যামা, তাকে তুমি
দূরে কেন রাখো? জীবনসায়াহ্নে যদি ঝড় ওঠে, বৃষ্টি পড়ে,
চিতা নিভে যায়। মৃত উঠে বসে। এসো, এই মৃতের হাত হাতে তুলে নাও।

আকাশে ডমরু বাজে, তোমার সিঁথিতে রাঙা মেঘ।

বিপ্রলম্ভ

এই অঙ্গহীনতা তুমি। হাজার বছর ধরে আমার চোখের জল
পাথরে পাথরে ঝরে রুদ্রাক্ষ হলো— তুমি তার বকপাতি মালা;
আকাশের অনঙ্গ গলায় দুলেছ। তুমি বাতাস পুষ্পময়, নবমালিকায়
জলের ভৃঙ্গ তুমি, রতিকালে জয়দেব শ্লোক।

ভাগবত পাঠ করি, এক প্রহরে তিনশ এক টাকা।
বাসকসজ্জিকা ওগো, শ্রীরাধার অঙ্গরাগে আমি কার কথা ভাবি?
—ভাগবতে রাধা নেই? ন পাড়ার রাধিকা মণ্ডল?

তোমার তুলনা ঐ চন্দ্রশাখা আকাশমণি গাছ, সতের মাস চাকরিহীন বাবা।

শেষ কবিতা

সমুদ্র জেনেছে। তথাগত, তারও বুঝি জানবার কথা ছিল।
বিদেশি বাণিজ্য নিয়ে উৎসাহ ছিল। প্রাচীন বাঙ্গলার নৌবহর
সে স্বপ্নে দেখেছে, বহুবার। সৌভাগ্য যেন সতী-লক্ষ্মী স্ত্রী হয়ে
দুয়ারে রেখেছিল ব্রতের কলস।

আর পদ্মাবতী ছিল। সকল স্বপ্ন-ঘোরে পদ্মাবতী আসে।
জেলেদের মেয়ে। মাছুনি। আঁশগন্ধ যোনি। তার অভিশাপে
এই সাতমহলা নৌকো ফুটো হলো। উঁয়ে খেলো লাইব্রেরি ঘর।
কবিতার পাতা নিল অমঙ্গল হাওয়া।

দূর গাঁয়ে মাস্টারি করি। অনেক দূরের পথ সমুদ্রবন্দর,
তার সূর্য, তার চন্দ্র, জোয়ার আর ভাটা।

Categories
কবিতা

কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

মুখ

একটা মুখ আমি খুঁজছিলাম যার চোখে লেগে আছে অনন্তের ঘোর। যেহেতু জানি, চোখের ওইটুকু ঘরে ছায়া পড়ে সমস্ত আকাশের, সুদূর নক্ষত্রের। জানি মহাবিশ্বের অপাঠযোগ্য সংকেত ক্রমশ এসে ফিরে যাচ্ছে। একটা মুখ আমি চাইছিলাম যে মুখে লেগে থাকবে নির্জন জলাশয়ের পদ্মঢেউ। কিন্তু একের পর এক চোখে শুধু দেখেছিলাম পাথরের হাহাকার, অন্ধকারের নৌকাডুবি।

অন্ধের শহরে আমি তাই ফিস ফ্রাইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে জলের গভীরতা মাপার চেষ্টা করি, জলের ছায়া পড়েছে এমন কয়েকটা মুখ এসে আমায় আলেয়া হ্রদের কথা বলে। আমার নীল রক্ত ছলকে ওঠে ও সেইসব নেশারুর চোখে আগুন পিছলে যায় ।

একটা সাদা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে দেখতে পাই, দেখি নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ফোটন কণার স্রোত যা আমি একদিন দেখেছিলাম সার্কাসের আগুনবমিতে…

অনন্তের ঘোর আমি দেখতে পেয়েছিলাম বস্তুত এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চোখে যে একটা বাসের জানলায় বসে দূর দেশে যেতে যেতে প্রাণপণে ভোলার চেষ্টা করছিল তার মেয়ের অশ্রুভরা মুখ

ঘুম

সঙ্গম পরবর্তীকালে তোমার খোলা পিঠ হয়ে যায় আমার ক্যানভাস। বিশাল জলরাশির নীলে একটা জাহাজ ভাসতে ভাসতে নেমে যায়…আমার বিছানায় চারিদিকে সমুদ্রের জল, আলব্যাট্রস উড়ে আসে দিকশূন্যপুরের দিক থেকে

জাহাজের ডেক ধরে তুমি আর আমি দেখছি… সমুদ্রের জলে অজস্র গ্রূপছবি, মরা কাঠ দিয়ে বাঁধানো হাজার হাজার গ্রূপছবি, দূরে ঋতুমতি অসংখ্য নারীরা হাসছে আর ভাসছে

দেখ দেখ বউ এই বিপুল প্রেমের সাগরে ওই যে ভেসে যাচ্ছে জিপিএফ আর মিউচুয়াল ফান্ডের কাগজ দেখ দেখ বউ আমাদের কন্ডোমের ভিতরে ভাসছে সেইসব ইচ্ছে যারা জন্ম নিতে চেয়েছিল… সেইসব জননী যারা যুবতীশরীর থেকে জন্ম নিয়ে হাঁটতে চেয়েছিল দিগন্তের দিকে…

সঙ্গম পরবর্তী ঘুম তোমাকে বলে যায় মানুষ অনেক মৃত্যুর উপরে বেঁচে থাকে। বাঁচাই আসলে এক পিশাচ সাধনা!

মৃত্যু

এমন একটা পত্রিকা যেখানে কখনও লেখা পাঠাইনি নিজের কোনও লেখা প্রকাশিত হবার দূরতম সম্ভাবনাও নেই অথচ সূচিপত্রে তন্নতন্ন করে নিজের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছি যদি পাওয়া যায়

একদিন লাইন বাসের মতো চলতে চলতে আমার ঘর পেরিয়ে যেতে থাকলো জনপদ ছোটো গঞ্জ হাটবার… আমার ছেলে খালাসি, সে বলতে থাকল ডাইনে ঠিক ডাইনে ঠিক, আমি ড্রাইভার হঠাৎ পেচ্ছাপ পেল নেমে গেলাম, ঘর দাঁড়িয়ে থাকল অন্ধকার রাস্তায় অত্যল্প আলোয়

হেঁটে যেতে যেতে সুন্দরী বৌদি হঠাৎ একদিন মসজিদ মোড়ে আড়ালে আমাকে টেনে খুলে দিল তার বুক, আমি দেখলাম তার ডান স্তনে আড়াআড়ি একটা সার্জারির দাগ আমি দেখলাম সেই অন্ধকার রাস্তা ধরে আলো জ্বেলে আলো জ্বেলে পেরিয়ে যাচ্ছে রাতে রাতে অসংখ্য ট্রাক… মেয়েমানুষ পাচার হচ্ছে… সীমান্তে গুলির শব্দে চমকে উঠে লুটিয়ে পড়ছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা

অজস্র গোরুর দল খুরপায়ে ঢুকে পড়ল সন্ধ্যেবেলার শহরে আমার। ট্রাফিক, ব্যাবসায়ী আর আগন্তুকের গালি খেতে খেতে তারা চলতে লাগলো শহরের পেট দিয়ে বুক দিয়ে… এইভাবে তারা এসে পড়ল একটা খালের আর কালভার্টের সামনে—

একহাতে আমার ফুলের গুচ্ছ, অন্যহাতে ঝোলানো রংচঙে প্লাস্টিক পেপারে দুর্গন্ধময় বমি, যদি ফুল দিতে ভুল করে বমি দিয়ে ফেলি জান এই বসন্তদিন কেমন যাবে তোমার

মৃত্যু/দুই

পৃথিবীতে সব কিছুর নামেই একটা দিন থাকে, শুধু মৃত্যুর নামে কোনো দিন নেই , কারণ প্রতিটি দিনই তার একান্ত নিজের। প্রায় প্রতিটি দিনই কারো কারো চলে যাওয়ার দিন। বুকের বেদনা নিয়ে বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় আর তারপর স্মৃতিচারণ এক অব্যর্থ অসুখ যা আমাদের মৃত্যুর আঁধার ঘেরা পপলার পাতায় ভরা রাস্তায় নিয়ে চলে। সে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে উড়ে যায়। ফলে হাওয়াকে আর শূন্যতাকে প্রশ্ন করতে হয় কত তারিখ আজ।

আপনি কি জানেন মুহূর্তের মৃত্যু হয়? আপনি কি জানেন এই শতাব্দীতে শোকের আয়ু দুই থেকে তিন দিন? আপনি কি জানেন স্যর আপনার সমস্ত অতীত সময় রেখে দিচ্ছে অব্যর্থ এক এক্সটার্নাল হার্ড ডিস্কে? না জানলে এই যে আমাদের কোম্পানির নিজস্ব প্রডাক্ট কিনুন, এর নাম মৃত্যু, এটা গিলতে হয়, আর গিলে ফেললে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে সে আপনাকে নিয়ে যাবে মৃত্যুর পরের পৃথিবীতে। এই গাড়ির ডেলি প্যাসেঞ্জারেরা সবাই আমাকে চেনেন। আমার নাম জীবন।

সত্য

ধরুন একটা ঘরে আপনি থাকেন, কিন্তু আপনি জানেন এই ঘর দলিলে যতই লেখা থাক, সে আপনার নয়, ধরুন সেই ঘরে আপনার সঙ্গে যাঁরা যাঁরা থাকেন ভদ্রভাষায় তাঁদের প্রিয়জন বলা হয় কিন্তু আপনি জানেন সবাই নিজের স্বার্থে আছে, একপ্রকার ধান্দা যদি সঠিক পদ্ধতিতে মুড়ে ফেলা যায় তাহলে তারই নাম হবে সংসার, ধরুন সেই ঘরে আপনার যে ঘরটি আছে, একদিন রাত্রে দেখলেন তার মাথার উপরে ছাদ নেই উন্মুক্ত নক্ষত্রের আকাশ দেখা যাচ্ছে আর কানের কাছে কে যেন বলছে ওহে শরণার্থী শরণার্থী ওহে, ধরুন আপনার নারীটি আপনার প্রতিকৃতি আঁকতে গেলে একটা এটিএম মেশিন এঁকে নেয়, ধরুন আপনার সঙ্গে তার অযৌন জনন, ফুলের মতো শুধু রেণু নিয়ে যায় যে দালাল পতঙ্গ তাকে আপনি ধরতে পারছেন না, ধরুন আপনি জানেন যে আপনার এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা নির্বুদ্ধিতা কারণ ওই সিদ্ধান্তটুকুর জন্যে দাঁত পাজিয়ে বসে আছে আপনার প্রিয়জনেরা, তবু আপনি তেতলায় ছাদের কিনারে এসে বারবার দাঁড়াচ্ছেন, আর তখনই ধরুন আচার্য শংকর এসে কানে কানে বলে গেল ইহ জগৎ মিথ্যা আর ধরুন তখনই তাকে বোকাচোদা বলার ইচ্ছে হল আপনার

Categories
কবিতা

পঙ্কজকুমার বড়ালের কবিতা

নিঃঝুম শূন্যতা ওড়ে


রাতের ভেতর রাত৷ ক্রমশ গহীন বন, ছোটো ছোটো টিলা৷ মনোরম ঘাসের গালিচা পেতে শিশির ঘুমায়৷ গাছে গাছে জোনাকি আলপনা৷ একটি নদী, তার হাঁটু জলে হেঁটে যায় নুড়ি— কাঁকড়, ছোটো মাছের ঝাঁক৷ একসময় চকিতে উঁকিমারে বুনো চাঁদ, তারপর ডানা মেলে এগিয়ে আসতে থাকে৷ বাতাস ওড়ে, বাতাসের চুল থেকে খসে পড়ে অচেনা ফুলের সুবাস৷ সমীরণ টিলার বুকে মাথা রাখে, যেন তপস্যা ক্লিষ্ট কোনো ঋষি এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তার একটি হাত বুকের উপর পরম নিঃসঙ্গতায় লীন হয়ে আছে, অপরটি ঝরাপাতার মতো মাটির শরীর জুড়ে এলিয়ে রয়েছে— এখন চরাচর জুড়ে ঘুমের জগৎ৷ কোনো অপেক্ষা নেই, যন্ত্রণা বিবশ হয়ে আছে, ইচ্ছের দুয়ার এঁটে দিয়ে না পাওয়ারা গান হয়ে ভেসে গেছে অলীক আকাশে৷


জাগো হে, জাগো— চেতনা দোলা দিয়ে ওঠে৷ অজান্তেই হাত চলে যায় পাশে৷ কে ডাকে! পাশ বালিশের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে কোমল অভিমান৷ ধীরে ধীরে চোখ মেলে সমীরণ৷ জানলা দিয়ে চুঁইয়ে নামছে আলো৷ তার নরম ছোঁয়ায় উঠে বসে সে৷ কী এক স্বপ্নের ঘোর, যেন মাথার ভিতর রাশি রাশি তুলো গোঁজা৷ এক অদ্ভূত অনুভবে সে যেন ডুবে যেতে থাকে৷ বাইরে উঠোন জুড়ে শালিকের ডাক৷ গাছের শিরা বেয়ে নেমে যাচ্ছে রৌদ্র শিহরণ৷ একসময় দরজায় টোকা পড়তে থাকে৷ সমীরণ বুঝতে পারে না কোন দরজার কড়া নড়ে যায়৷ কেবল টোকা পড়ে৷ দরজার শরীর জুড়ে শব্দ ওঠে ঠক্..ঠক্..ঠক্৷


যেন কোথাও কিছু নেই, অশেষ আকাশ৷ একটি ঘুড়ি সুতোহীন উড়ে যেতে থাকে৷ ঘুড়ির পিছে পিছে ডানা মেলে দিনের ছায়ারা৷ সমীরণ বসে থাকে দীঘির পাড়ে৷ সমস্ত দীঘি জুড়ে হাঁসের সফেদ৷ তাদের চঞ্চুর ধারে ক্ষয়ে যায় বাতাসের আয়ু৷ সমীরণ সে সব দেখে অথবা দেখে না৷ সে শুধু বসে থাকে৷ যেন একটি প্রকাণ্ড চাকার উপর বসে আছে সে৷ চাকাটি ঘুরতে ঘুরতে নেমে যাচ্ছে মহাতলের দিকে৷


প্রাণপনে মাটি আকড়ায় সমীরণ৷ সে যেন একটি গাছ৷ একমাথা ডালপালা, শেকড়ে পলির উষ্ণ ঘ্রাণ৷ আর একটি লতা, ফুলে ফুলে ফলের আকুতি নিয়ে সে যেন জড়িয়ে আছে সমস্ত ভূবন৷ সবুজ রক্ত চলকে উঠছে তার৷ অতঃপর স্বপ্ন আসে, কত স্বপ্নের কথাবিতান পৃষ্ঠা মেলে দেয়৷ অভিমানের নিঃশ্বাসে লতা গাছটি গুমড়ে ওঠে— কথা বলো, কথা বলো গাছ৷


মনের বাগান জুড়ে টুপটাপ পাতা খসে যায়৷ ময়ালের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলে হাওয়া৷ সমীরণ বুঝতে পারে তার ভিতরে আর কোনো গান বেঁচে নেই, স্বপ্নের পাঠশালা ভেঙে গেছে কবে! ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া শিকড়ের ফাঁস ঢিলে হয়ে গেছে৷ এখন কেবল নিঃশেষের পালা৷ যে মনে ফোঁটেনি ফুল, সবুজের হাতছানি, যাবতীয় রঙের বাহার তার কাছে বোবা আয়োজন৷


তবুও এক স্পন্দন জেগে থাকে বুকে! কী আশ্চর্য, কী দারুণ যন্ত্রণাময়! জমে থাকা ঘন কালো মেঘে বিস্ফোরণ ঘটে গেলে যেমন হঠাৎ চলকে ওঠে আলো, তেমন এক স্পন্দন মাঝে মাঝে গুমড়ে ওঠে বুকে, নিঃশব্দে বজ্রপাত হয়৷ সমীরণ চোখ বন্ধ করে৷ তারপর দেখতে থাকে নিজের ভিতর৷ শত শত ছায়াপথ, ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে আরও দূর, গহীন দূরত্বে, যেখানে কেউ নেই, কেবল শূন্যতা৷ অথবা শূন্যতাহীন অপার স্পন্দন৷

Categories
কবিতা

শাশ্বতী সান্যালের কবিতা

পারদ-হে প্রিয়


এখন জ্বরের দিন। তোমার দাঁতের স্বাদ ভালো নেই

ডাঁসা আপেলের মাংসে ভরে আছে ফ্রুটবাস্কেট
তাদের গোলাপি স্তনে পুরুষের দংশনের দাগ
খুঁজে পায়নি নারীরক্ষা সমিতির হুজুগে বাবুরা…

এখন জ্বরের দিন। ডুমোডুমো নীল মাছি
বসে আছে ফলের দোকানে।


সোরা ও গন্ধক মিলে তৈরী হয় কোনো কোনো পুরুষ শরীর
সামান্য জ্বরের আঁচে লোহাচুর দুমুঠো মিশিয়ে
বিক্রিয়াকঠিন তার মুখ দেখতে ভালোবাসে মেয়েমানুষেরা

ডোরাকাটা গামছা দিয়ে গা মুছেছ কতদিন পরে…
প্রথম ভাতের স্বাদ আর তন্দ্রা নিয়ে
ভেজা বারুদের টিন মেলে দিয়ে বসেছ রোদ্দুরে

গোলাপি মুখের আভা। সাঁঝের পোহাল শেষে
খুব মৃদু কুপি জ্বলে উঠেছে কোথাও

রক্তের ভিতরে যে লোহা পুষে রেখেছি, সে কথা
জ্বরের বিকেলে আজ, ভুলে গেছ?
ভুলে যেতে চাও?


দু-এক ঘর পারদ উঠে গেলে আবার তো জড়িয়ে ধরবে
আবার বিষের মতো ঘুলিয়ে উঠবে নীল জল
আদিবাসী মেয়েটির গোড়ালির ক্ষত থেকে, পুঁজ থেকে,
হাঁড়িয়া অমনিবাস থেকে
তোমাকে শক্ত করে তুলে আনব বিছানায়, সফেন চাদরে

ভয় নিয়ে, আশঙ্কা নিয়ে,
ওষুধের স্ট্রিপে সেই পুরোনো সোঁদর গন্ধ নিয়ে
পাহাড়ে নদীতে বনে পেতে দেব শতরঞ্চিগুলো
দু-ঘর একঘর ক’রে
পুরোনো জলের নীচে দেখা দেবে কবেকার বিষ

সময় ভীষণ কম,
আবার তো জল খসে গেলে

খাদের উপর থেকে নীচে পড়ে যাবে কোলবালিশ…

ঊষা

এই সেই বিতর্কিত সূর্যোদয়

সহজ ধুলোর দেশে
মেয়েদের পায়ে পায়ে
ফুটে ওঠা সৌরকুসুম

তরল সোনালি রোদ? হেমলক?

আকন্ঠ পানের পর
জল আর পাথরে লুকোনো
অচেতন পুরুষের পাশে, এ ব্রাহ্মসময়ে
জেগে উঠছে একে একে
দৃশ্যপট, পাখিদের ঘুম…

দাহঘাট

যেকোনো মৃত্যুর গায়ে আপনার মুখ লেগে আছে।

ভাবি, কোনোদিন যদি ভোরে টেলিফোন বেজে ওঠে
প্রতিবেশীদের ঘরে
টেলিফোন বেজে ওঠে, আর… জেনে ফেলি যদি
ছাপাখানা থেকে দূরে, নিঝুম শ্মশানে
একে একে পুড়ে যাচ্ছে আপনার ধবল কবিতা

আমার প্রণাম নেই। পাপ নেই। দাবি নেই। ভাবি,

এত এত রং নিয়ে, সেই ভোরে, কার কাছে যাব?

বিশ্বাস

একমাত্র লেখা পারে উড়ে যাওয়া চাল বেঁধে নিতে

গেরস্থ ঘরের জল-থইথই মেঝে থেকে
খুদকুঁড়ো- খিদে শুদ্ধ, এনামেল থালা শুদ্ধ
তুলে এনে, শীতে
একমাত্র লেখা পারে গরম ভাতের হাঁড়ি
ফ্যান গেলে দিতে

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
বিশ্বাসে নদীর চরে ফুটে ওঠে কাশ

আজ না ফুটলে, কাল

একমাত্র লেখা পারে এতসব কুসুম বিন্যাস

লেখা পারে? পারে বুঝি? কবে পেরেছিল?

Categories
কবিতা

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

ধ্বংসের দিকে ফেরানো একটি মুখ


এসো, আলো জ্বালি। আর দেখো, কাচের ঢাকনার ওপর একটি মথ কেমন চুপ করে বসে আছে। আবার কখনো, আলোটিকে ঘিরে, উড়ে বেড়াচ্ছে পাগলের মতো। যেন এই আলোটুকুই তার সমগ্র অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। আসলে, একটা কেন্দ্র ছাড়া, অস্তিত্বের কল্পনাও অসম্ভব বলে মনে হয়। এমনকী অনুপস্থিতিও, ক্ষেত্রবিশেষে, একটা কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। পারে না কি?

আডর্নো বলেছিলেন, “আউশভিৎসের পর কবিতা লেখা, বর্বরতার নামান্তর।” যদিও, তাঁর এই কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমার বিশ্বাস, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তেও, কেউ না কেউ, নিশ্চয়ই একটি কবিতা লিখবে। যে-কবিতার কোনো পাঠক থাকবে না। যার শরীর থেকে, আস্তে আস্তে মুছে যাবে সমস্ত দৃশ্য, শব্দ, আলো আর ভাষা। শুধু এক অস্ফূট দীর্ঘশ্বাসের পালক, শূন্যের ভেতর, ভেসে বেড়্রাবে—ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে, ঘুরে…


ঘুরে-ঘুরে, কেবলই ভাষার কাছে ফিরে আসছি।
দেখছি, ভাষা দিয়ে, গোটা একটা পৃথিবী
বানানো সম্ভব কি না। যদিও আমি ছাড়া,
আপাতত, সেখানে আর কোনো জনপ্রাণী নেই,
শুধু কিছু নুড়ি-পাথর, একটা শুকিয়ে-আসা ঝর্ণা, আর
অচেনা উদ্ভিদ, গুল্ম, এটুকুই…

ভাষা আগে, না কি দৃশ্য ও বস্তুপুঞ্জের এই
প্রসিদ্ধ সমাবেশ? ভাবতে ভাবতেই দেখি, চারিদিক
কেমন অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। পায়ের তলায়,
মনে হল, মাটি কাঁপছে। তবে কি এবার
এই আলোটুকুও আর থাকবে না, নিভে যাবে?

মাঝেমধ্যে ভাবি, অন্ধরা ঠিক কীভাবে কবিতা লেখেন!


ছায়া যখন রয়েছে, তখন, কোথাও না কোথাও—তা সে যত দূরেই হোক, বা যতই ক্ষীণ—খানিকটা আলো যে এখনও রয়ে গেছে, এ-বিষয়ে আমাদের মনে আর কোনো সংশয় রইল না।

আমরা ঘাড় উঁচু করে, ওপরের দিকে তাকাই। ধূসর আকাশের গায়ে, নাম-না-জানা গাছের আঁকাবাঁকা আঙুল। ও তাদের কালো, গ্রন্থিময়, কুব্জ শরীর। একটা পাখি, কোথায় যেন, হঠাৎ চীৎকার করে ডেকে উঠল। এই হাওয়া—সাপের মতো ঠান্ডা, আর পিচ্ছিল—যার স্পর্শে, শরীর বিষিয়ে ওঠে।

এমন দিন কি সত্যিই আসবে, যখন কোনোখানে, আলোর এই সামান্য ইশারাটুকুও আর থাকবে না?

অন্ধকার মানুষকে যথার্থই সঙ্গীহীন করে। ভাবো, কী অসম্ভব সেই একাকীত্ব, যখন, এমনকী আমাদের ছায়াগুলিও, একে একে, আমাদের ছেড়ে চলে যায়!


ভাবো, কী অসম্ভব সেই মনস্তাপ, যখন তুমি
নিজের প্রিয় কুকুরটির মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে
আচমকা ট্রিগারে চাপ দাও, আর তারপর
একটা কেঁপে-ওঠা লালচে পর্দার ওপাশ থেকে,
একজোড়া ভাষাহীন চোখ, অপলক দৃষ্টিতে
তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আজীবন।

সমুদ্রের ধারে, দাউ-দাউ করে জ্বলছে
একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। কিছুদূরে, এক রুগ্ন বালক
শুকিয়ে আসা গাছের গোড়ায় জল দিতে-দিতে
আপন মনে কথা বলে উঠল, কতদিন পর!

“In the beginning was the Word.
Why is that, Papa?”

আমি চুপ করে থাকি। ধ্বংসের কিনারায়
একটা অদৃশ্য সুতোর মতো ঝুলে আছে
আমার নৈঃশব্দ্য।


নৈঃশব্দ্যেরও
নিজস্ব একটা ভাষা আছে।
ভাষাকে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে
লুকিয়ে থাকে যে-উচ্চারণ,
তা আসলে আরেকটা ভাষাই।
তুমি বুঝতে পারনি।

তুমি বুঝতে পারনি, একদিন
কালো আর সূর্যহীন একটা সকাল
তোমাকে জড়িয়ে ধরবে।
আর তখন,
বেমালুম ভুলে যাবে তুমি—
কাকে বলে ঘুম,
কাকেই বা জেগে ওঠা বলে।

Categories
কবিতা

শতানীক রায়ের কবিতা

যুদ্ধহীন যদি কোনো দেশ থাকে…


দ্বীপ যখন শুরু হয়
উঁচুতে তাকিয়ে কেউ পাখিকে ডাকে
একটার পর একটা ক্রিয়া ঘটতে থাকে
মাটি আর মানুষের রসায়ন ছত্রভঙ্গ হলে
মাঝরাতে ডাকতে ভুল করে পাখি
কীরকম করে শরীর দেওয়া নেওয়া হয়
ভূগোলের কাছে গিয়ে প্রার্থনা আরোপ করে
ক্রিয়াগুলো আলাদা হয়
সবকিছু একত্রে ঘটে, কখনো আলো
কখনো অন্ধকারই সব কথা বলে
আলো যেদিক দিয়ে ফিরে আসে
ফিরিয়ে নেওয়ার নদী ফিরিয়ে দেওয়ার মাটি
এরকম করে একদিন আবার দ্বীপমুখী হই
মূলে যে-কয়েকটি কথা আছে সেটাও ঘরমুখী হয়।


এমন একটি জগৎ
যার দরজা জানলা নেই
আলো অন্ধকার নেই
শুধু ধানক্ষেত পড়ে আছে
পাখি উড়ে আসে।
চৌকো চৌকো চিহ্ন নিয়ে
চিত্রকর্ম ফুটে ওঠে
কোনো পাখিকে বসাতে পারো
উদোম দরজার দিকে
জগৎ আড়াআড়ি হতে পারে
রেখা ধরে হেঁটে যাওয়ার ভেতর
সবকিছু। সবই অনন্ত সবই অপেক্ষা
ধরা পড়ে মানুষের বিপরীত কিছু
চিত্রের ভেতর এমনও হতে পারে
অপেক্ষারত পরি— ডানার দিকে
কেউ দেখেনি আর হঠাৎ সে উড়ে যাবে।


সব কিছু নিয়ে
একটা উদাসীন পুকুর।
জলাশয়ের অধিকাংশই পড়ে থাকে
দেখার জন্য এই ত্রিকোণ না
চতুষ্কোণও কিছু না
তেমনভাবে শহরের পর শহরে
কেউ গান গাইলে
পাখি ওড়া দেখলে
ঘুম ভাঙা— ঘুমোনো দেখলে
কে— কোন মানুষ
কী বলে উঠবে
সরল হিসেব নেই
মাছরাঙার যে কথা ছিল
পৃথিবীর যে ভিন্নতা ছিল
এবং বহুদিন পর
মূল কথা
বলার মাত্রা নিয়ে
যে-সব মানুষদের
সব… সবই চলে গিয়েছে
জল হয়েছে এত বড়ো
বিস্তারিত হয়ে বকুল গাছে
স্বপ্নের স্থপতি।
যারা শব বহন করে এনেছে
সিঁড়ি হয়ে নেমেছে দৃশ্য
অন্ধ করোটি
কিংবা শরীর
শরীরের সেই
কবিতা জমা থাক
বা উজাগর হোক।
বা না-হোক।


বাগানে একদিন…

তন্দ্রাঘোরে সে বাড়ি ফিরছে। ফেরার পথে অনেক আমবাগান লিচুবাগান পেরিয়ে আসতে হবে ওকে। সুন্দর নিকোনো উঠোন পাচ্ছে না সে। তাকে পাথরের কাছে মাথা ঠেকাতে হবে। একটু বসে জিরোতে হবে তারপর আবার উঠে যেতে হবে গৌর রঙের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারই কোনো কৈশোরের বিকেলে। অতৃপ্ত ঘোর বাসনা থেকে সে যখন মনে করেছিল আজকের গল্পটা পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুন করে একটা গল্প লিখবে। হয়ে ওঠেনি। এই আমবাগানেই সে এসে হাজির হয়েছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল আর হারিয়ে গেছিল। কেউ ডেকেছিল পাতার স্তূপের আড়াল থেকে কোনো পৃথিবীতে। জঙ্গল আর জলের সঙ্গমভূমিকে সে প্রথম বুঝেছিল। সে কীভাবে পুরুষ হতে গিয়ে নিজেকে দেখেছিল। গাছের ঝুলে থাকা ফল আবিষ্কারে। ঝড়ের ঝাপটায়। উপড়ে তোলার ক্রমশ সে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে কোনো এক সমান্তরালে মধু রাখবে। ঘুমোতে যাবে এরকম তো কথা ছিল না। কেউ তো বলেনি এভাবে পাখির নতুন কথা তৈরি করো। তার জঙ্গল প্রাপ্তি হয়েছিল। ঘন সবুজ আর শুকনো পাতা মেশানো একটা জঙ্গল।


ঘুমের কথা শুধু বলে চলেছি। কেউ শোনে না। গাছটাকে বারবার সাবধান করলেও সেই-ই একই ফল হয়। পুরোনো ব্রাহ্মণ্যলোকের যত ছবি। কত কিছু একটা সময় ঘুরে ফিরে পাক খেয়ে ল্যাম্পপোস্টের নীচে পড়ে থাকে। এরপর সারাদিন সারারাত জোড়া দিয়ে বছরের পর বছর দিনের পর দিন মাঘের পরে মাঘ। একটা সময় সবই মাটির ঘোড়া হয়ে ওঠে। একটা সময় দীর্ঘ ঘুমোনোর পর দীর্ঘ কথা বলার পর যখন একটা খণ্ড তৈরি হয় পাক খাওয়া আরশি তৈরি হয় মাঘ মাসের ফুল তৈরি হয়। এইসব নিয়ে। আসলে এই সবই কোনো-না-কোনো কথার অংশ হিসেবের মধ্যে আরও হিসেব সংকেতের ভেতর আরও সংকেত মাংসবাহী দিন মাংসবাহী রাত। মাখনের সঙ্গে মানুষ শরীরের সঙ্গে… এ কি ঘটনা এ কি তার ভ্রম বা আর কিছু। ঘুমের পর আরও একবার ঘটে যাওয়া এই সবকিছু। পরা আর অপরার খেলা।