Categories
কবিতা

হাসনাত শোয়েবের কবিতা

সন্তান প্রসবকালীন গান-৪

চিত্ররথ, এই নাও তোমার মহাভারত। গানের পাশে ফেলে গেছ ঢাল-তলোয়ার। বধ করো সুর ও সংহিতা। দক্ষিণে অগস্ত্য গেছে, তারও দক্ষিণে মৃগ। তাদের ফিরিয়ে নাও এবার। তুমুল হর্ষধ্বনির পাশে লিখে রাখো বৃহস্পতিবার সকাল, যখন সকল নারীই যোজন-গন্ধ্যা। গান্ধর্ব তাদের রীতি, কৃষ্ণ তাদের বর। সন্তান প্রসবকালীন গানে তারা ভুলে গেছে লয়-সুর। ওই দেখ, একা একা কাঁদছে তোমার হস্তিনাপুর।

***
সকলেই একা, তোমাদের পুত্রসমান। তাদের জন্য লিখো গান, সুর দাও, দাও অসুর। বিমর্ষ কৌরব পুত্রদেরও আছে হৃদয়। আহত বাঘের দাঁত ব্যথার যন্ত্রণাও তারা বুঝতে পারে। তারাও লিখেছে গান সুমহান। এই পথ ধনুর্বিদদের, অস্ত্রচালকরা তাই অযৌন; শিকারীরা বৃহন্নলা। মৎসান্যায়ীরা তাদের ঈশ্বর ও আপেল শিকার একমাত্র ধর্ম। তারা জানে না গান, সুরও ভুলে গেছে। আছে কেবল হৃদয়, তার ওপর জন্মানো মহাভারত।

***
যে হৃদয়, কালিকাপ্রাসাদে হারিয়ে ফেলেছিল সুর। তার পথ থেমে গেছে সেই প্রাসাদেই। ফেলে আসা ধুলো উড়ে গেছে দক্ষিণে, অগস্ত্যের খোঁজে, হারিয়ে ফেলেছিল বেণী। তার সন্ধানে গিয়েছিল শিখণ্ডীও। পড়ে আছি, যারা দুপুরের সিয়েস্তা। এখানে ফোরাত, এখানেই কুরু। তোমরা লিখেছ গান, দুপুরে হারানো সুরে। তার পিছু ছুটে গেছি মৃত ধনুর্বিদ। কুড়িয়ে নিয়েছি অসুখের ফল। নাম লেখা ছিল তোমার, মুছে দিয়েছি। ফল নিয়ে ফিরে আসি ঘরে।

***
সেই সব ফল, তাদের অসুখ। ক্রমশ ছুটে গেছে হাসপাতালের দিকে। সারি সারি মৃত লাশ শেষে পড়ে থাকে। অসুখের ফল তার বিমর্ষতা নিয়ে, ফিরে আসে তোমার ঘরে, যুদ্ধের ময়দানে। ঘোড়ার আস্তাবলে অসংখ্য সংসপ্তকের ভিড়ে পড়ি শুয়ে যাবতীয় ঈর্ষা নিয়ে। কালও যাবে সে রোগীর পথ্য হয়ে। গাণ্ডীব ছুঁড়ে পেড়ে নেবে আরো ফল। অট্টহাসি ছুঁড়ে দেবে তোমাদের ক্রুতার দিকে।

***
ক্রুতাকে বলো ফিরে যাও, তীব্র অসুখের পাশে গোল হয়ে বসো। মনে আছে সেইসব আলখাল্লাধারীদের, যারা তোমাদের কানে তুলে দিয়েছিল নকল গান, গ্রামোফোন ও মেঘমল্লার। ভাঙা রেকর্ডের পাশে গোল হয়ে বসো, তোমার মনে পড়বে তামুরা কাফকা, জ্যাজ ও বৃষ্টির পূর্বাভাস। এসবের ভেতর কেটে কেটে সাজানো শরীর, তার কাছেই হাত পেতেছে গান। নকল মিউজিয়াম, ঘুরে ঘুরে দেখি। গ্রামোফোন, গান শোনাও আবার। নকল গানে বৃষ্টি নামাবে মিঁয়া তানসেন।

***
নকল গান, কতকাল বাজাবে বিভৎস রেকর্ডার? যেটুকু দূরত্ব, ভিড় করে আছে বিপন্ন ড্রামার।, থ্রোনজুড়ে কেবল কাঁটা আর কাঁটা। তার সুর ও লয়ে তামাম দুনিয়া। আটকে আছে এই ভোর, ভোরের আজান। কোথাও ফুটছে ফের ক্রিসেনথেমাম। আহত দিন, গড়িয়ে যাবে আরও কিছুদূর? সাক্ষী দিচ্ছে দুপুর, তোমার আহার।

***
সাক্ষী দুপুরের বিষণ্ণ রং। যার নিচেই ফুটছে ফুল, পৃথিবীর ফুল। আসো, তোমায় এবার ফুল দেখাব। তীব্র সুগন্ধের আড়ালে তুমি ফেলে যাবে যৌনজীবন। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে, একটি পথকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব বসন্তের দিকে। ছোটো ছোটো ফুল, ভুলবশত ফুটে আছে। তাদের বকে দাও, দাও নিশানা। তাক করে রাখ বন্দুক, এক দুই তিন- দ্রিম। ফুটো হয়ে গেল ফুলের জীবন, তোমার যৌনতাও। না, এইখানে কোন গান নেই, সুর নেই, শব্দও নেই। নৈঃশব্দ্য পেরুনোর আগেই প্রাণত্যাগ করেছিল সমস্ত বান্দিশ। তুমিও তাই শোনোনি কোন গান, অমরত্বের সুসংবাদও।

***
অমরত্বই তোমাদের গন্তব্য। সুসংবাদ ছাড়াই পৌঁছে যাবে কোন এক বিকেলে। সব বিকেলই গেছে নিঃসন্তান দম্পতির দিকে, তারা জানে না কোন গান । তুমি পৌঁছে যাও গানের মাস্টার। তাদের শেখাও সন্তান প্রসবকালীন গান, কেড়ে নাও অমরত্ব। দুপরের পরই যেটুকু ঘুম, সেটুকুই গান। খরগোশ দেখার ছলে তারা হারিয়ে ফেলেছিল সমস্ত যন্ত্রসংগীত, এমনকি পুরুষত্বও। তবুও অমরত্ব তোমাদের গন্তব্য, পেয়ারা বাগান দেখতে দেখতে সে পথ পাড়ি দেবে একদিন।

Categories
অনুবাদ গদ্য

পাওলো কোয়েলহোর গদ্য

ভাষান্তর: অমিতাভ মৈত্র

মরুভূমির চোখের জল
[The Tears of the Desert]

মরক্কো থেকে আমার এক বন্ধু ফিরে এল একজন মিশনারির গল্প নিয়ে, মারাকেশে পৌঁছে যে-মিশনারি মনস্থ করেন প্রতিদিন খুব সকালে শহরের বাইরের মরুভূমিতে হাঁটবেন। প্রথম দিন বেরোনোর সময় তিনি দেখলেন মরুভূমির বালিতে কান পেতে শুয়ে একজন কোমলভাবে থাবা দিচ্ছে মরুভূমির বালিতে।

— ‘লোকটা নিশ্চয়ই উন্মাদ,’ মিশনারি ভাবলেন।

প্রতিদিন এই দৃশ্য চোখে পড়ত তাঁর, আর একমাস পরে এই দৃশ্যের অভিসন্ধি ও আকর্ষণ যেন হারিয়ে দিল তাঁকে। তিনি ঠিক করলেন কথা বলবেন লোকটার সাথে। আরবের ভাষায় তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। লোকটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তাই থেমে থেমে জানতে চাইলেন।

— ‘কী করছ তুমি?’

— ‘এই মরুভূমি খুব নিঃসঙ্গ। তার এ নিঃসঙ্গতা ও কান্নায় আমি একটু সঙ্গ দিচ্ছি, সান্ত্বনা দিচ্ছি, চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছি।’

— ‘মরুভূমি কাঁদে আমি জানতাম না।’

— ‘ও স্বপ্ন দেখে মানুষের সাহায্যে আসার, বিশাল একটা বাগান হতে চায় যেখানে তারা শস্য ফলাবে, ফুলের বাগান তৈরি করবে, ভেড়া চরাবে।’

— ‘বেশ, তুমি মরুভূমিকে বলো ও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে,’ মিশনারি বললেন। ‘যখনই আমি এই মরুভূমির সাথে থাকি, মানুষের সত্যিকারের আকার আমি বুঝতে পারি। তার অপরিমেয়তা আমাকে বলে যায় ঈশ্বরের কাছে আমরা কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ। যখন একটি বালুকণার দিকে তাকাই, আমি কল্পনা করি কোটি কোটি মানুষ যারা জন্মের মুহূর্তে সবাই ছিল সমান, কিন্তু পরে পৃথিবী যাদের সাথে সুবিচার করেনি। এখানকার পাহাড়েরা ধ্যানস্থ করে আমাকে, আর যখন দিগন্তে সূর্যের প্রথম আলো দেখা যায়, আনন্দে ভরে যায় আমার মন এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্যে হারিয়ে যাই আমি।’

লোকটিকে ছেড়ে মিশনারি তাঁর কাজের জগতে ফিরে গেলেন। পরদিন সকালে সবিস্ময়ে দেখলেন লোকটি সেই জায়গায়, একইভাবে কান পেতে শুয়ে আছে বালির ওপর।

— ‘তোমাকে যে-সব কথা বলেছিলাম, মরুভূমিকে বলেছ?’

মানুষটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

— ‘আর এখনও সে কাঁদছে?’

— ‘তার প্রতিটি ফুঁপিয়ে ওঠা শুনতে পাচ্ছি। এখন ও কাঁদছে এ-জন্য যে, হাজার হাজার বছর ও নিজের অস্তিত্বকে অর্থহীন মনে করে নিজের ভাগ্য আর ঈশ্বরকে দোষ দিয়ে এসেছে শুধু।’

— ‘ঠিক আছে, এবার মরুভূমিকে বলো মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনের সময় খুব কম, তবু আমাদের সেই মহার্ঘ সময়ের অনেকটা নিজেদের অর্থহীন মনে করে নষ্ট করি। আমাদের নিয়তি আমরা জানি না আর ভাবি ঈশ্বর অন্যায় করেছেন আমাদের সাথে। নিজেকে জানার সেই মুহূর্তটি শেষ পর্যন্ত আসে যখন আমরা জীবনের উদ্দেশ্য অনুভব করতে পারি, তখন অনুতাপ হয় সময় নেই ভেবে জীবনকে ঠিক পথে চালিত করার। মরুভূমির মতো আমরা তখন অভিশাপ দিই, নিজেদের সময় এভাবে নষ্ট করার জন্য।’

— ‘জানি না মরুভূমি শুনবে কি না এই কথা,’ লোকটি বলল। ‘সে যন্ত্রণাতেই অভ্যস্ত, অন্যভাবে দেখার চোখ তার নেই।’

— ‘তাহলে এসো, সেই কাজটাই করি আমরা, যে-কাজ বহুবার করতে হয় আমাকে। যখন টের পাই সবরকম আশা হারিয়েছে মানুষ— প্রার্থনা করি দু-জনে।’

হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করল দু-জনে। লোকটি ছিল মুসলিম, তাই তার মুখ মক্কার দিকে। মিশনারি ক্যাথলিক, দু-হাত জোড় করে প্রার্থনা শুরু করল। নিজেদের ধর্মের, নিজেদের ঈশ্বরের কাছে যিনি আসলে একই।

পরের দিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে মিশনারি দেখলেন লোকটি সেখানে নেই। শুধু যেখানে সে বালির ওপর কান পেতে শুয়ে থাকত, সেখানে বালি মরুভূমির ভেতর থেকে ভিজে উঠেছে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য মরুভূমি কাঁদছে।

কয়েকমাস পরে যখন জলস্রোত বেড়ে গেল অনেক, শহরের লোক তখন একটা কুয়ো তৈরি করল সেখানে আর বেদুইনরা তার নাম রাখল ‘মরুভূমির অশ্রু’। লোকে বলে এই কুয়োর জল যে খাবে, তার দুঃখের কারণ বদলে যাবে আনন্দে, আর এভাবেই নিজের জীবনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে তার কাছে।

ভোরের মুহূর্ত
[The Moment of Dawn]

একজন ইহুদি শিক্ষক তার চারপাশের ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন:

‘রাত্রি শেষ হয়ে দিনের শুরুর সঠিক মুহূর্তটি কীভাবে জানতে পারি আমরা?’

‘যখন আলো এমন থাকে যে, ভেড়া থেকে কুকুরকে আলাদা করতে পারে আমাদের চোখ,’ একটি ছেলে বলল।

আরেকটি ছাত্র বলল: ‘যখন জলপাই গাছ আর ডুমুর গাছকে আলাদা করতে পারে আমাদের চোখ।’

‘না, কোনো উত্তরই তেমন ভালো হল না।’ বললেন শিক্ষক।

‘ভালো উত্তর তাহলে কী?’ জানতে চাইল ছাত্ররা।

শিক্ষক বললেন: ‘যখন কোনো অচেনা মানুষ এগিয়ে আসে আর মনে হয় সে আমাদের ভাই, তখনই রাত্রি ভোর হয় আর আলো আসে।’

ধনুকের পথ
[The Way of the Bow]

পুনরাবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা
চিন্তাকে যখন প্রকাশ করা হয়, তখন কর্মের শুরু। ভঙ্গির ন্যূনতম পরিবর্তনও প্রতারণা করে আমাদের, সে-জন্য সবকিছু নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, প্রতিটি অনুপুঙ্খ যেন মনে থাকে। দক্ষতাকে নিয়ে যেতে হবে যান্ত্রিকতার এমন পর্যায়ে যেখানে স্বয়ংক্রিয় জ্ঞানই সব। কোনো নির্দিষ্ট নিয়মিত অনুশীলনে নয়, এই স্বয়ংক্রিয় জ্ঞান এক এমন মানসিক স্থিতি যা ভেতর থেকে জেগে ওঠে।

দীর্ঘ অভ্যাসের পর প্রয়োজনীয় সঞ্চালনগুলো নিয়ে আর ভাবার প্রয়োজন হয় না। অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে তারা। কিন্তু এই জায়গায় আসতে হলে অনুশীলন আর পুনরাবৃত্তি দরকার। সেটাও যথেষ্ট না হলে পুনরাবৃত্তি আর অনুশীলন শুরু করো।

যে নাল পরায় ঘোড়ার ক্ষুরে, তাকে মন দিয়ে লক্ষ করো। অনভিজ্ঞের চোখে মনে হবে একইভাবে হাতুড়ি পিটছে সে। কিন্তু দেখার চোখ আছে যার সেই শুধু বোঝে প্রতিবার হাতুড়ি তোলা আর আঘাত করার মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম তারতম্য থাকে। প্রতিবার লোহার ওপর নেমে আসার সময় হাত জানে কখন তাকে জোরে আর কখন কোমলভাবে আঘাত করতে হবে।

হাওয়াকলের দিকে মাত্র একবার যে তাকায় তার মনে হবে কলের পাখাগুলো একই গতিতে, একই রকম ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু যে অভিজ্ঞ সে জানে বাতাসের গতির তারতম্যে হাওয়াকলের পাখার গতি বদলে যায়।

যে নাল পরায় সে এই যান্ত্রিকতা আয়ত্ত করেছে হাজার হাজার বার হাতুড়ি ব্যবহার করে। জোরে বাতাসের সময় হাওয়াকলের পাখা দ্রুত ঘোরে, আর বোঝা যায় তার গিয়ার ঠিক আছে।

চাঁদমারির বাইরে যদি কিছু তির উড়ে যায় তিরন্দাজ বোঝে সেটা স্বাভাবিক। ধনুক, তির, ধনুকের ছিলা, চাঁদমারি, তার ধনুক ধরা আর তির নিক্ষেপের ভঙ্গি— সবকিছুর নিখুঁত যান্ত্রিক সমন্বয় আয়ত্ত হতে পারে হাজার হাজার বার একাগ্র অনুশীলনে। তারপর আসে সেই মুহূর্ত যখন সে নিজেই হয়ে ওঠে ধনুক, তির, চাঁদমারি গলে মিশে তৈরি হওয়া নতুন এক অস্তিত্ব।

ছুটে যাওয়া তিরকে কীভাবে দেখতে হয়
শূন্যে কোনো অভিপ্রায়ের দাগ হয়ে তির ছুটে যায়। তির ছোঁড়ার পর সেই তিরের গতিপথ ও লক্ষ্যস্থল অনুসরণ করা ছাড়া আর কোনো কাজ তিরন্দাজের নেই। ছোঁড়ার মুহূর্তের তীব্র টানটান অনুভূতি সেই মুহূর্তে সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেছে। স্থিরচোখে তাই সে অনুসরণ করছে তিরকে, তার মন বিশ্রাম নিচ্ছে, তখন হাসি লেগে আছে তার ঠোঁটে।

যদি যথেষ্ট হয়ে থাকে তার অনুশীলন, আর নিয়ন্ত্রণে থাকে তার সহজাত প্রবৃত্তি, তির ছোঁড়ার সময় তার মন যদি একাগ্র ও সহজ থাকে, মহাবিশ্বকে সে অনুভব করবে তার অস্তিত্বে। তার হাত যখন প্রস্তুত হচ্ছে, শ্বাস হয়ে উঠছে ধীর, আর চোখ স্থির হচ্ছে লক্ষ্যে— তার প্রশিক্ষণ আর দক্ষতা তখন কাজ করছে। কিন্তু তির নিক্ষেপের সঠিক মুহূর্ত তাকে জানায় তার সহজাত প্রবৃত্তি।

পাশ দিয়ে যেতে যেতে যদি কেউ এই মুহূর্তের তিরন্দাজকে দেখে তার এলিয়ে থাকা চিন্তাহীন হাত আর বাতাস কেটে ছুটে যাওয়া তিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে— তার মনে হবে কিছুই ঘটছে না। কিন্তু তার সঙ্গীরা জানে তির ছোঁড়ার পর তার মনে সমুদ্র পরিবর্তন ঘটে গেছে। সারা ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ছে তার মন। মন কাজ করে যাচ্ছে, তির ছোঁড়ার মুহূর্তে তার সক্রিয়তা, ইতিবাচকতা, ভুলের সম্ভাব্যতা বুঝে নেওয়া আর দেখা তিরের আঘাতে লক্ষ্যবস্তুর প্রতিক্রিয়া কেমন।

যখন তির ছোঁড়ে সে, তখন তার ধনুকে মহাবিশ্বকে অনুভব করে সে। যখন লক্ষ্যবস্তুর দিকে তির ছুটে যায়, মহাবিশ্ব যেন আরও কাছে চলে আসে তার, জড়িয়ে রাখে তাকে আর ঠিকভাবে সমাধা করা কাজের জন্য সুখী করে তাকে।

যখন তার কাজ শেষ, তার অভিপ্রায় যখন সফল, একজন আলোকিত যোদ্ধার আর কোনো ভয় নেই তখন। সে শেষ করেছে তার কাজ। নিজেকে ভয়ে অসাড় হতে দেয়নি সে। যদি লক্ষ্যস্থলে আঘাত নাও করে তার তির, তার সুযোগ থাকবে পরের বারের জন্য— কেন-না ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ায়নি সে।

মিয়ামি বন্দরে
[In Miami Harbour]

‘মাঝে মাঝেই মানুষজন সিনেমায় কিছু দেখে এত মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, শেষ পর্যন্ত আসল ঘটনাই মুছে যায় তার স্মৃতি থেকে।’ মিয়ামি বন্দরে যখন একসাথে দাঁড়িয়েছিলাম বন্ধুটি বললেন, ‘তোমার টেন কমান্ডমেন্টস মনে আছে?’

অবশ্যই মনে আছে। এক জায়গায় মোজেস— মানে চার্লিয়ন হেস্টন— হাতের লাঠি তুলে ধরেন আর জল দু-দিকে সরে যায়। ইজরায়েলের সন্তানরা তখন পার হয়ে যায়।’

‘বাইবেলে কিন্তু অন্য গল্প,’ বন্ধু বলল। ‘সেখানে ঈশ্বর, মোজেসকে বলেন, ‘ইজরায়েলের সন্তানদের বলো যেন তারা এগিয়ে যায়।’ তারা এগিয়ে যাবার পরেই তিনি মোজেসকে বলেন হাতের লাঠি তুলে ধরতে। আর তখন লোহিত সাগর দু-দিকে সরে যায়। পথের জন্য সদিচ্ছাই পথ তৈরি করে।’

মানুষ যখন মজারু
[The Funny Thing About Human Beings]

আমার বন্ধু জেসি কোহেনকে একজন প্রশ্ন করেছিল:

‘মানুষের সব থেকে মজাদার বিশেষত্ব কী?’

কোহেন বলেছিল, ‘আমাদের স্ববিরোধিতা। বড়ো হবার জন্য বিষম তাড়া থাকে আমাদের, পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলায় ফিরতে চাই আবার। টাকা উপার্জনের মরিয়া চেষ্টায় শরীরকে শেষ করে ফেলি, পরে সব অর্জন খরচ করি আরোগ্যের জন্য। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা এত উদ্বেগে থাকি যে, বর্তমানকে গ্রাহ্য করি না আমরা— আর এভাবে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কিছুই আর জানা হয় না আমাদের। যখন বেঁচে থাকি তখন মনে করি আমাদের মৃত্যু নেই। আর এমনভাবে মরি, যেন আমরা আদৌ বেঁচে ছিলাম না কখনো।’

হারানো ইট
[The Missing Brick]

আমি ও আমার স্ত্রী যখন ছুটিতে ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম আমার সেক্রেটারির থেকে একটা ফ্যাক্স এল।

‘রান্নাঘর সারানোর জন্য কাচের একটা ইট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আপনাকে মূল নকশা আর নির্মাণ সংস্থা যে-পরিবর্তিত নকশা দিয়েছে এই ক্ষতি সামলাতে, আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ সেক্রেটারি জানিয়েছেন।

একদিকে আমার স্ত্রীর তৈরি করা নকশা: ইটের সুসংবদ্ধ রেখা আর বাতাস চলাচলের জন্য খোলা জায়গা। অন্য দিকে হারিয়ে যাওয়া ইটের সমস্যা থেকে মুক্তির নতুন নকশা: একটা সত্যিকারের জিগ্ স পাজল যেখানে গ্লাস ব্রিকসগুলো সাজানো হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে নান্দনিকতাকে অগ্রাহ্য করে।

‘আর একটা কাচের ইট কিনুন,’ লিখে জানালেন আমার স্ত্রী। তাঁরা করলেন সেটা, আর আগের নকশাও বহাল থাকল।

সেদিন বিকেলে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম বিষয়টি নিয়ে। মাত্র একটা ইট নেই বলে কতবার আমরা আমাদের জীবনের মূল নকশাটিকে বিকৃত করে তুলি।

Categories
কবিতা

দেবোত্তম গায়েনের কবিতা

কমলালেবুর ভিতরটা নড়ছে…


শরীরী অস্তিত্বের জাগ্রত রূপ এই প্রাপ্তি। কিছুটা চেখে দেখে অনাড়ম্বর গাছের নাচ ও মুদ্রা কৌশল রপ্ত হলো। ঘুমের মধ্যে যে তুমি স্বপ্ন দেখবে তাকে বিচার করে অনাদর করা হয় নিজেকেই। সবটা সকাল সবটা মানুষরূপী! তোমাকে সেই ফিরে আসতেই হবে। হে ঋষি বীজের ধারনা আমার নেই। চাইলেও আমার মুক্তি পাথেয় নয়। জপের আড়ালে পাপ-প্রেম-শরীর সবটাই যে কর্পূরের মতো উবে যায়। নশ্বর নশ্বর!


অনেকটা দূর। জেগে আছি এটুকুই এযাবৎ আপেলের মধ্যে ধরা থাকবে। মানুষের জন্মের বহু আগেই তো ঠিক ছিল সে মানুষের থেকেই সরে যাবে। সরে যাবে পাখিরব সুরসমুদ্র থেকে। মেটালিক গাঢ় হচ্ছে ইতি টানছে বাঘের প্রিয় স্বাদ। খাদের কাছে খাদক এই দূরত্ব মিটিয়ে নিচ্ছে নির্বাচনের আদলে। খাদ্যের আগে সু জুড়ে দিলেই তা মানুষের অধিকারে; বাকি রাষ্ট্র যা ঠিক করবে।


প্রজাপতি। অলীক সে-রঙের প্রতি ছুটে যায়। রং চেতনার উলটোদিক। মানুষের বিভাজন হত্যা দিয়ে হলে ফুলের মরশুম পালটে যেত। প্রিয় শব্দের আড়ালে কত সত্য যে মারা যায়। জ্বলে দাউ দাউ করে মেঘ করে আসে এমন দাবানল। পাখিদের ছুটে যাওয়া মানে তানসেন দুঃখ পেয়েছেন। আপনি…


নিজের পাশে ঘুমিয়ে আছে সে। ভয়। রক্ত মিশে গেলে আয়না ঢেকে দিন। আপনি নিজে যে ভয়টা পেতেন না সেটা পাবেন এবার। প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ান। স্নানের ধর্ম শুধু ধুয়ে দেওয়া নয় এক জায়গার পাপ আরেক জায়গায় প্রবাহিতও হওয়া! চোখের আগে অসংখ্য মুদ্রা এভাবেই মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে যায় জল বড়ো বিপদসংকুল।


এই এমন এক স্বধর্মদ্বেষী আমি খুঁজে বেড়াই লড়াই করার অস্ত্র। সামনে অগণিত গুহা। গুহা থেকে কখনওই কিছু আবিষ্কার না হলে, আমিও এভাবে অস্ত্র খুঁজে খুঁজে— আমাকে কেউ একজন বিশ্বাস করুক চাইতাম না! আমি তো জানতাম পরে কখনও এই গল্প বোবা হয়ে করব। সংকেত যা আদিম এবং পবিত্র!


আছড়ে পরার আগে অস্তিত্বই যদি না থাকত টিকে থাকার সম্ভাবনা বীজের মধ্যে করে ঘুরে বেড়াতাম। যেভাবে এই সম্পর্কগুলো গুটিকয় খোলস এর মধ্যে। যারা বেরুতে চাইলেও দু-হাত দিয়ে দরজা খোলার কেউ নেই। স্বর প্রকাশ্যে আসার আগেই গাছ তার আধার ছেড়ে দেয় পালঙ্ক বিক্রেতার কাছে। আপনি জানতেন সবটা।


আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিয়া বলতে সবটাই মুক্তির জন্য। মানুষ এর আভাষটুকু পেয়েছিল বলেই একটা দিকে ভাগ হয়ে গেল। কিছুটা এইরকম; ফলের বীজের ধরন যা দেখে মানুষ কখনও চিন্তা করেনি শুধু অভ্যাস করেছে খাদ্য। দানা ও শস্য। তফাতটা বুঝতে পারছেন তো…


সেভাবে গতকালের মতো আর তাকে বলতে শুনলাম না, “বুকের মধ্যে দুঃখ জমিয়ে মানুষ পায় কেউ”— এই অভিব্যক্তি তে আমার কোনো হাত ছিল না। জলের গভীরতা মাপতে গিয়ে মানুষ রত্ন পায়, রত্নের গভীরতা খুঁজতে গিয়ে মানুষ ঋণী হয়ে পড়ে।


সময় পেরিয়ে যায়। মানুষের সঙ্গে কারুর যুদ্ধ হয়ে উঠল না। কী অবিরাম দুঃখ এই টলটল করে ধাক্কা খায় পাড়ে। নিকষকৃষ্ণ ধারা, ঝুপ করে কেউ পড়েছে চোখের মধ্যে। বিরহ জানাব জানাব নিশ্চুপে সে ঝিম নিয়ে আসে। মায়া পড়ে যায়! মনে হয়। মনে হয় মানুষের প্রেমের মধ্যে ভ্রমরের নজর পড়েছে। ক্রমশ সে চোখ থেকে বাসা বাঁধা শুরু করে, অন্ধ! অস্তিত্বটুকু মাটি বইকি!

১০
আজব, দেখছ কী আমাদের হাতে কোনো অবসর নেই এখন। ঘুরছি, ঘুরেই চলেছি। পরিক্রমার একটা শেষ থাকে মাঝে কতোগুলো হত্যা। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকলেই তা সেতু যেমন হয়ে যায় না, তলায় তলায় একটা শূন্যতা লাগে, ঠিক সেইভাবেই কমলালেবুর ভিতরটা নড়ছে। ঢক্ পক্। জলের আধার ভাঙলে মানুষ তার স্বর-স্বপ্ন-শয্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভেবে ভেবে সে-ও বেরিয়ে পড়ে এই আবাদে। আগে আগে পিঁপড়ের দল পিছনে সে…

Categories
অনুবাদ কবিতা

কাশ্মীরের কবিতা

ভাষান্তর: সোহেল ইসলাম

এখানে পাঁচজন কাশ্মীরির দুটো করে মোট দশটা জবানবন্দি থাকল। গত সাত-আট মাস কাশ্মীর নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কবিতাগুলোকে আমার জবানবন্দিই মনে হয়েছে। তাই তার উল্লেখ। কাশ্মীরে আমরা যা দেখি, তারচেয়ে বেশি কিছুই ঘটে প্রতিনিয়ত। গোটা কাশ্মীর জুড়ে মানুষের অভিজ্ঞতা একই। স্কুল বন্ধ, বাজারঘাট বন্ধ, ফোন বন্ধ, গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তায় বেরোনো বন্ধ, এমনকী সবচেয়ে দরকারেও এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায় না। এ তো গেল দিনের আলোর কথা। রাত তো আরও ঝুঁকি দিয়ে ভরা। ওষুধ কেনা এমনকী হাসপাতাল যাওয়ার মতো দরকারেও রাতের কাশ্মীর নিরাপদ নয় খোদ কাশ্মীরিদের কাছেও। কেন-না রাতের দখল থাকে সেনাবাহিনী আর পুলিশের হাতে। কাশ্মীরের অন্ধকার মানুষের অসহায়তার কথা বলে। ছাদের বুক থেকে চাঙর ভেঙে পড়লে যেমন ছাদ চুপচাপ থাকে, স্বাভাবিক হতে চায়, কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ঠিক একইরকমভাবে কাশ্মীরও শরীরে স্যালাইনের নিডিল নিয়ে ব্যথা, যন্ত্রণা, দুঃখ, না-পাওয়া একনিঃশ্বাসে ভুলিয়ে দিয়ে আবার বেঁচে উঠতে চায়। এই বেঁচে ওঠায় কোনো মিথ্যে নেই, কোনো নাটক নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু অপেক্ষা। সেই একই অপেক্ষা এখানকার ঘরবাড়ি, দরজা-জানলার এবং এখানকার মানুষের মতোই। একটু মন দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন, দেওয়ালগুলো বোমা আর বুলেটের অত্যাচার সহ্য করতে করতে নিথর হয়ে গেছে। আর দরজা-জানালাগুলো সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে নিতে বুড়ো হয়ে গেল। বাড়ির আলো ছুটে যে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে তার কোনো উপায় নেই। এখানে মুক্তির একমাত্র পথ হল মরে যাওয়া। তবে মজার ব্যাপার যে মরে গেল, মুক্তি কেবল তার। কিন্তু তারপর বাড়ির লোক পড়বে যাঁতাকলে। তল্লাশি, প্রশ্ন, রাতবিরেতে গলা ধাক্কা, সুরক্ষার অভাব, হয়রানি এসবই যেন তখন ওই বাড়ির রোজকার জীবন হয়ে ওঠে। আবার নতুন করে তারা তখন মৃত্যুর অপেক্ষায়, মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে।

লকডাউন, মারধোর, হেফাজত, কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া, পুরোনো FIR দেখিয়ে এনকাউন্টার, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, চেকিংয়ের নামে অসভ্যতা কাশ্মীরে নতুন কিছু নয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সাক্ষী। আপনি যদি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে লাল কাশ্মীর দেখে ফেলেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই কাশ্মীর এখন দুঃখে, কাঁদতে কাঁদতে, ক্ষতবিক্ষত শিশুর মৃতদেহের মতোই লাল। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তথ্য আর সরকারি আমলার বক্তব্যের উপর নির্ভর করে যে-কাশ্মীরের কথা আমরা মনে মনে কল্পনা করি তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। দেশের জনগণের কাছে কাশ্মীর মানেই ভিড়, উশৃঙ্খল, হাতে পাথর নিয়ে তেড়ে আসা জনতার ভিড়। কিন্তু উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকাদেরও যে একটা ভিড়, তারাও যে রাইফেল, প্যালেট গান, গ্রেনেড হাতে ভিড় তৈরি করেছে তা আর দেখানো হয় না। এই যে বারবার কয়েনের একপিঠ দেখিয়ে বিচারপতি বসিয়ে বিচার করে নেওয়ার মানসিকতার বিরুদ্ধেই কাশ্মীরের কলম জ্বলে উঠেছে, জ্বলে উঠছে। আর তাই কাশ্মীরের কবিরা সরাসরি মানবাধিকারের কথা বলছেন, মানবজাতির পক্ষে কথা বলছেন। ফলে কাশ্মীরের কবিতায় আপনি যত এগোতে থাকবেন, দেখবেন― মা, কারফিউ, রক্ত, হ্যান্ড গ্রেনেড, কাঁটাতার, নিষ্ঠুরতা, গণকবরের মতো শব্দ উঠে আসছে বারবার। আসাটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীর তার কবিতায় জীবন লেখে, বেঁচে থাকা, ঘুরে দাঁড়ানো, কাঁধে কাঁধ রেখে উঠে দাঁড়ানোর কথা লেখে। যা তাকে শিখতে হয়নি। জীবনচর্চার মধ্য দিয়েই তার কলম একে ধারণ করেছে।

আর একটা কথা আতহার জিয়া এবং হুজাইফা পণ্ডিতের সাহায্য না পেলে কাশ্মীরকে আমার জানাই হত না সেভাবে। শাম্মি কাপুরের ‘ইয়া হু’ বলে বরফে ঝাঁপিয়ে পড়া কাশ্মীর নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তা যে হওয়ার নয়, বেশ বুঝতে পারছি এখন।

আসিয়া জহুরের কবিতা

[পরিচিতি: আসিয়া জহুর বর্তমানে কাশ্মীরের বারামুল্লার একটি কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়ানোয় কর্মরত। কাশ্মীরি সাহিত্য, কবিতা, মনোবিজ্ঞান বিষয়ক বই এবং নিবন্ধ লিখেছেন।]

মিলিটারাইজড জোন

জিভ কেটে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দেওয়ার আগে
কিছু বলা যাক

মাথায় হাতুড়ির আঘাত নেমে আসার আগে
কিছু চিন্তার ফসল ফলানো যাক

ঘুমের দেওয়াল
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার আগে
কিছু স্বপ্ন বোনা যাক

অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই
চলো, অন্ধকারকেই আয়না বানিয়ে ফেলি

শব্দ মুছে দেওয়ার আগে
হাতের তালুতেই
লিপিবদ্ধ করি কাশ্মীরি ইতিহাস

নদী

একদিন নদী রাস্তা ভুল করে
ঢুকে পড়ল পাড়ায়
বাড়িতে
স্কুলে
দরজায় কড়া নাড়তে আরম্ভ করল
যত রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি
তত বাড়তে থাকে রাগ
সে কী একগুঁয়ে জেদ নদীর
দরজা-জানালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে
ফাটা দেওয়াল দিয়ে ঢুকতে লাগল ভেতরে
প্রথমে বইগুলো তাকে তুললাম
তারপর আসবাবপত্র
শেষে নিজেরাও
কিন্তু নদীর জেদ…
বই থেকে শব্দগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
পাড়া থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল প্রতিবেশী

আমরা এখন
হাসি-কান্না ভাগ করে নিতে নিতে
এক দেওয়ালহীন বিশ্বের বসবাসকারী

আমজাদ মজিদের কবিতা

[পরিচিতি: আমজাদ মজিদ ইনভার্স জার্নালের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে দক্ষিণ কাশ্মীরে থাকেন। সেখানে বসে চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সমালোচনা বইয়ের উপর কাজ করছেন।]

কাশ্মীরে কারফিউ

কারফিউ রাস্তায়
স্কুলে
ঘরবাড়িতে
রেডিয়ো, সংবাদপত্রে
ইন্টারনেটে
টিভি চ্যানেলে
আমাদের বক্তব্যে
আন্দোলনে
প্রতিবাদে
শোকে
এমনকী যে-স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন
কাশ্মীরে তাতেও কারফিউ
তবুও আমরা আশা ছাড়িনি
জীবনকে বাজি রেখে
মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
উন্মাদনা ভাগ করে
লড়াই জারি রেখেছি—
ঠিক একদিন কারফিউ মুক্ত কাশ্মীর গড়ব আমরা

পরিচয় পত্র

দরখাস্তের ভিড় থেকে আলাদা হয়ে
সেও প্রিন্ট হল অন্যদের মতো
নোটারিযুক্ত হয়ে
দেশের স্ট্যাম্প নিয়ে
ল্যামিনেশনে মুড়ে
এক সরকারি দপ্তর থেকে
আরেক সরকারি দপ্তরের টেবিলে চক্কর কাটতে লাগল
তারপর সত্যি সত্যিই একদিন
দাগী আমলাদের হাত থেকে মুক্তি ঘটল তার

আজও স্পষ্ট মনে আছে
সেই দিনটির কথা
কাগজের ভিড়ে মাথা তুলে তাকানো দরখাস্ত
লম্বা কিউয়ে উলঙ্গ মজিদ
আর তার রক্ত-মাংস দেশীয় হওয়ার প্রমাণ দিচ্ছে

তখন আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে
কাচের জানলা দিয়ে দেখছি দেশ

শাবির আহমেদ মীরের কবিতা

[পরিচিতি: শাবির আহমেদ মীর কাশ্মীরের পুলওয়ামায় থাকেন। একজন গদ্যকার, কবি ও ছোটোগল্প লেখক। বর্তমানে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত।]

যেদিন যুদ্ধ শেষ হবে

যুদ্ধ শেষ হলে
একবার আসুন আমাদের এখানে
বুলেট কিংবা প্যালেট গানে ফুটো হয়ে যাওয়া জায়গায়
আঙুল ঢুকিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে নেবেন
কতটা আহত
কতটা আঘাত সহ্য করেছি আমরা

যুদ্ধ থেমে গেলে
আপনাকে এনে দেব গন্ধ
ভয়ের গন্ধ
ধ্বংসস্তূপের গন্ধ
দেখে নেবেন কী জমকালো সেইসব অন্ধকারের গন্ধ

যুদ্ধ থেমে গেলে
বুটের দৌড়ঝাঁপের আবহ শোনাতে নিয়ে যাব আপনাদের
উপত্যকা ভাগ করা
কাঁটাতারের গর্জন শোনাতে নিয়ে যাব

যুদ্ধ থেমে গেলে
আপনাকে নিয়ে যাব ভেরিনাগ
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সুখনাগ
তারপর আমরা যাব ডাল লেকে
একটি দিন কাটাব বন্দুকের পাহারা ছাড়া
দেখবেন কী শান্তিপূর্ণ সেই ভ্রমণ

যুদ্ধ শেষ হলে
গণকবর খনন বন্ধ হলে
আপনাকে যোগদান করতে বলব
কাশ্মীরি সংগীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে
আপনি অনুভব করবেন
আমরা ঠিক কতটা খুশিতে থাকি
নিজেদের নিয়ে

সত্যি সত্যিই যেদিন যুদ্ধ থেমে যাবে চিরতরে
আপনাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাব
নোনতা, গোলাপি চা
আশা করি সেদিন বুঝবেন
আমরা কোনোদিনই
একে-অপরের শত্রু ছিলাম না

সিরিয়ায়

সোমবার,
আশার দিন
অপেক্ষা শেষ হওয়ার দিন
জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে
চকচকে রুপোর বাটিতে খাবার পরিবেশনের দিন
যেন একটা বিশেষ মুহূর্ত
যার জন্য আমরা
একে অন্যের মুখ চাওয়াচায়ি করে থাকি
ওই তো রূপকথা থেকে
আল্লাহ আর তাঁর দূত
আমাদের বাঁচাতে আসছেন
                           অবশেষে

মঙ্গলবার,
সতর্ক থাকার খবর আসছে
জরুরী সামান হাতের কাছে গুছিয়ে রাখার সতর্কবার্তা
যে-কোনো সময়
সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে হতে পারে

রেহানার কপাল
তাই তো পালিয়ে যেতে পেরেছে
চোখের মণি, আইলানকে মানুষ করার সুযোগ পেয়েছে
যে কি না এখন রেহানার একমাত্র ভরসা

বুধবার,
প্রথম মা হওয়া গাভীর মতো ছটফট করছি
স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না
গুজব ছড়িয়ে পড়ছে
বন্দুকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে
বোমায় টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি
বাইরে কারফিউ
এখন ধৈর্য্যই একমাত্র পথ
আমাদের অপেক্ষা করতে হবে
জুতসই পালানোর মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত

বৃহস্পতিবার,
আমাদের দুঃখের দিন
ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের মাঝখান থেকে
জিভের টুকরো
গোল গোল চোখ
ছোটো সরু হাড় কুড়িয়ে
বাড়ি ফেরার দিন

শুক্রবার,
আমাদের শোক এতটাই দগদগে যে
আমরা শিষ্টাচার ভুলে যাই
আপনি চান
আমরা দেওয়ালে মাথা ঠুকি
হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে থেমে যাই
জিভ অসাড় হয়ে আসুক
জল শুকিয়ে যাক চোখেই
কিন্তু আমাদের হাহাকার এতটাই নাছোড় যে
থামতে জানে না

শনিবার,
ক্ষোভ প্রকাশের দিন
এও এক নেশার মতো
আকাশের দিকে দু-হাত তুলে চিৎকার

দর্শকরা প্রথম প্রথম
সমবেদনা জানান
মাথা নীচু করে বিড়বিড় করেন
তারপর একটা সময় বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন
কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন
আমরা দিন শেষে
ঝাঁকে ঝাঁকে যে যার বাড়ি ফিরে আসি

রবিবার,
আমাদের নীরবতার দিন
নতুন সপ্তাহের প্রস্তুতির দিন

কায়সার বশিরের কবিতা
[পরিচিতি: কায়সার বশির কাশ্মীরের অনুবাদক, লেখক এবং কবি। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।]

মৃতদেহ

ওই দেখুন একটা মৃতদেহ
কোথায়?
ওই তো স্রোতে ভেসে আসছে
আমি তো দেখতে পাচ্ছি না
ওটা কী?
ওই দেখুন লাশ! আখরোট গাছের নীচে
ওটা দুর্ঘটনা না খুন, আপনি কী মনে করেন?
ওই দেখুন একটা বুলেট
কোথায় বুলেট?
এটা তো একটা মাথা
পাকা তুঁতের মতো ছেঁতরে গেছে
আমি বুঝতে পারছি না… একটু গুছিয়ে বলুন
শুনতে পাচ্ছেন?
কী?
মায়েরা উঠোনে বসে কাঁদছে
মৃতদেহের জন্য?
হতে পারে
চলুন, সান্ত্বনা দিয়ে আসি
কী করে, ওটা তো রেড জোন
আমি বিশ্বাস করি না
বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে
শুনুন
কী?
কণ্ঠস্বর
হ্যাঁ, একটা আওয়াজ
কণ্ঠস্বর না, ওটা চিৎকার
কীসের?
মিছিলের
ওরা কি লাশ তুলতে আসছে?
আমি জানি না
তবে, এদিকেই আসছে― যেন একটা হিংস্র নদী
চলুন, দৌড়ান
তা না হলে আমরা খুন হয়ে যাব
কেন? এটা ঠিক না
জানি, আপনি চলুন
লাশের কী হবে?
ভুলে যান, চলুন…
কোথায়?
যেখানে নিরাপদ মনে হবে
আমি দৌড়তে পারি না
আমার পা সেই কবে থেকে ঘুমিয়ে আছে
কেমন স্বপ্ন পছন্দের আপনার?
কার?
লাশের…
ভুলে যান, চলুন
ওরা এদিকেই আসছে
কোথায়?
আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
এত কুয়াশা কেন?
কোথায় কুয়াশা, এগুলো ধোঁয়া
আগুন ধরিয়ে দিয়েছে
কারা?
আমি জানি না
চলুন, পালাই
আপনি যান, আমি থাকব
কেন?
ওরা যে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে আসছে
ভাইকে একা ফেলে কোথায় যাব?

আমি

বৃষ্টির পরে
আগস্টের আকাশে রামধনু উঠল
আমি তার কাছ থেকে
কিছুটা লাল রং ধার করলাম
আমাদের দুঃখ লিখব বলে

সিদরা নাজিরের কবিতা

[পরিচিতি: সিদরা নাজির কাশ্মীরের কবি। কাশ্মীরের আন্তিপোড়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। সিদরার কাছে কবিতা একটা প্রার্থনা, যা তাকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।]

কাশ্মীর

দাসের মতো বাঁচা কাকে বলে― আপনি কি জানেন?
বাইরে বেরোলেই কাঁটাতারের ঘেরা
হায়নার চোখের মতো বন্দুকের নল
আপনার দিকে তাক করা
তখন কেমন অনুভব হয়
আপনি কি জানেন?

যখন কোনো কাশ্মীরি যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়
সেই বাড়ির মুকুট থেকে নিশ্চিত
একটা পালক খুলে পড়ে
মায়ের চোখ থেকে ঝরে পড়ে নোনা জল
জল নয় অভিশাপ
আপনি কি জানেন― কেমন সেই অনুভূতি
প্রতিটি কাশ্মীরি বোনের মনে ক্রোধের বাস
বাবাদের হাতে কবরের মাটি
আপনি কোনোদিনই জানতে পারবেন না
এই শাসন দেখতে দেখতে
কাশ্মীর আস্ত একটা কবরে পরিণত হচ্ছে

কবরের রাস্তায়

সাদা কাফন এল
আতরের গন্ধ এল নাকে
হাসি নিমেষে বদলে গেল কান্নায়
সেই বীরের সম্মানে
ইনকিলাবের নাড়া দিতে দিতে চলে গেল একদল যুবক
শুধু,
একজন বাবা কেঁদে উঠলেন
একজন মা কেঁদে উঠলেন
আর চারজনের কাঁধে করে
একটা কাঠের ফ্রেম চলল―
                       শীতের দেশে

Categories
কবিতা

কল্যাণ মিত্রের কবিতা

নখর দিনের কবিতা

স্নানঘর থেকে উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি
বোঝার ভুলে
          বয়স বাড়ছে আমার

এত ভুল আসছে কোথ্থেকে
ভুলের কি কোনো পূর্বপুরুষ আছে !
পশ্চিমপুরুষ?

স্নানঘর থেকে উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি
ছোট হয়ে আসছে চোখ
বিন্দুজলে বৃত্ত ভাসছে…

সে – ২

সন্তুর বাজিয়ে আসে
শিকারা ভাসিয়ে চলে যায়

রমণের ছদ্মবেশে যে জ্যা-টানি শব্দের চেতনা জাগ্রত করে
মুদিখানা দোকানের মাসকাবারি খাতার মতো
তার জের কি কখনও মেটে?

সব সৌভাগ্যের মধুকোষে একজন নারী
সব উত্থানপতনের নেপথ্যে একজন নারী

‘নারীর কোনো উদাহরণ হয় না’

ভাষা

ভাষা আমার মাতৃদুগ্ধ                         ভাষা ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক
ভাষা আমার ভোরের স্বপ্ন                     ভাষা বুড়ো আঙুলের টিপছাপ
ভিড়ের মধ্যে যে-হাত ধরব বলে চলন্ত বাসের পিছনে
ছুটছি – সেই হাত সাপের ল্যাজের মতো
ক্রমশ সরু হয়ে আসছে…

আমার আর্তনাদ-ই আমার ভাষা।

Categories
প্রবন্ধ

রবিউল ইসলামের প্রবন্ধ

মিথ ও ট্যাবুতে সাত সংখ্যা: আফ্রিকান মিথোলজি

সাত সংখ্যাটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে কখনো পবিত্র আবার কখনো অপবিত্র হিসাবে দেখা হয়েছে। আবার এটা বললে ভুল হবে না যে, পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সাত সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে প্যাট্রিসিয়া ফারা তাঁর ‘Science: Four Thousand Year History’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—

“Seven has always been a very special number. Sanskrit’s most ancient holy book, the Rig Veda, describes seven stars, seven concentric continents, and seven streams of soma, the drink of the gods. According to the Jewish and Christian Old Testament, the world was created in seven days and Noah’s dove returned seven days after the Flood. Similarly, the Egyptians mapped seven paths to heaven, Allah created a seven-layered Islamic heaven and earth, and the new-born Buddha took seven strides. […] For numerologists, seven signifies creation, because it is the sum of the spiritual three and the material four; for alchemists, there are clear parallels between the seven steps leading up to King Solomon’s temple and the seven successive stages of chemical and spiritual purification. Iranian cats have seven lives, seven deities bring good luck in Japan, and a traditional Jewish cure for fever entailed taking seven prickles from seven palm trees and seven nails from seven doors.”

হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্টান-সহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে সাত সংখ্যার গুরুত্ব আমরা দেখতে পাই। সাত সংখ্যাটি এমনভাবে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে যে, আমরা কথাতেও ‘সাত’ সংখ্যাটিকে ব্যবহার করি। যেমন— ‘সাত সতেরো’ ও ‘সাতে পাঁচে’— যার অর্থ হল বহুবিধ বা নানারকম। তবে আলোচ্য নিবন্ধে আমরা আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রাচীনকাল থেকে ‘সাত’ সংখ্যাটিকে ঘিরে যে-মিথ ও ট্যাবু গড়ে উঠেছে তা নিয়ে আলোচনা করব।

প্রাচীন সভ্যতা বললেই আমাদের সামনে মিশরীয়দের কথা ভেসে ওঠে। মিশরীয় ভাষায় সাতকে ‘Sephet’ বা ‘Seshat’ বলা হয়। আর সেশাত হল প্রাচীন মিশরীয় দেবতা ‘Thoth’-এর সঙ্গিনী। সেশাত হলেন সময় ও উত্তরণের দেবী। সেশাতের মাথায় সাতটি ফুলের পাপড়ি দেওয়া একটি মুকুট থাকে এবং তার চামড়া চিতাবাঘের। সেশাত জনসাধারণ দ্বারা পূজিত হতেন না। ইনি মূলত মিশরের ফ্যারাওদের দ্বারা পূজিত হতেন।

মিশরীয় মিথে সাত অর্থাৎ সেশাত সংখ্যাটি মূলত জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ, সেশাতের আরেক নাম ছিল ‘প্রথম গ্রন্থাগারিক’ এবং তার ভূমিকা ছিল মূলত তার স্বামীর বই সংরক্ষণ করা। এখানে লক্ষ করার মতো যে, সেশাতের মাথায় কিন্তু সাতটি ফুলের পাপড়িযুক্ত মুকুট পরা থাকত। এই কারণেই সেশাত অর্থাৎ সাতকে মিশরের ফ্যারাওরা পূজা করত।

মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্ব ও মিথে সাত সংখ্যাটিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী সাতটি প্রাথমিক শক্তির কথা বলা হয়েছে। এই প্রাথমিক শক্তিগুলি হল: অন্ধকার, আলো, বাতাস, পৃথিবী, জল, আগুন এবং রক্ত। মিশরীয় মিথ অনুযায়ী সাতটি হ্যাথোর (হ্যাথোর হলেন প্রাচীন মিশরীয় প্রেমের দেবী), সাতটি আত্মা, মিশরের সাতটি জেলা বা অংশ, সোলার বার্কের সাতটি স্তর। (সোলার বার্ক বলতে— the bark in which the sun is said to be carried across the sky-কে বোঝায়।), হ্যাথোরের সাতজন কর্মচারী, মেরুপ্রদেশে সাতজন আনুবিস, অটাম-রা-এর সাতটি আত্মা, মাত-এর সাতজন সহকারী কর্মচারী এমন অসংখ্য বিষয়ে সাত সংখ্যাটি মিশরীয় মিথে জড়িয়ে আছে। এমনকী মৃতদেহ সৎকারে সাতরকম তেল ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

পশ্চিম আফ্রিকার বামবারা ও ডোগোন জাতির মানুষদের মধ্যে ৭ সংখ্যা নিয়েও মিথ লক্ষ করা যায়। বামবারা ও ডোগোনদের মতে সাত হল ভারসাম্যের প্রতীক এবং এই ভারসাম্য হল নারী ও পুরুষের। ৩ সংখ্যাটিকে বামবারা ও ডোগান জাতিরা পুরুষত্ব ও ৪ সংখ্যাটিকে নারীত্বের প্রতীক হিসাবে তারা দেখে। আর দু-টি সংখ্যার মিলনে ৭ সংখ্যা সৃষ্টি হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পিরামিডকে ৭ সংখ্যার ভারসাম্যের নিদর্শন হিসাবে ধরা হয়। কারণ, পিরামিডের তলদেশ চতুর্ভুজ এবং তার উপরে ত্রিভুজ আকৃতির পিরামিড অবস্থিত। এই চতুর্ভুজ ও ত্রিভুজ মিলেই ৭ সংখ্যা নির্দেশ করছে।

আফ্রিকার আকান জাতিদের মধ্যে ৩ হল রানির সংখ্যা এবং ৪ হল রাজার সংখ্যা। এই দুইয়ে মিলিয়ে হল ৭ সংখ্যা। আকানদের ভবিষ্যৎ কথনের যে-প্রথা আছে সেখানেও ৭ সংখ্যা বিজোড় হিসাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

ডোগোন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে সাত সংখ্যাটির গুরুত্ব আছে। তাদের মতে পূর্বপুরুষদের সপ্তম আত্মা এই বিশ্বব্যবস্থার জন্য দায়ী। এই আত্মাটি একটি কাপড় বুনে মানবজাতিকে দেয় এবং এই কাপড়ে ‘soy’ নামের শব্দ লেখা ছিল। যার অর্থ হল— ‘এটি হল মৌখিক শব্দ’। এই ‘Soy’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হল সাত। এখানে আরও বলা যায় যে, ডোগানদের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী যখন এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হচ্ছিল তখন তাদের প্রধান দেবদেবী ‘আম্মা’ (Amma) এই বিশ্বকে সাত খণ্ড উপরে ও সাত খণ্ড নীচে কেটে ভাগ করেছিল। এখানে আরও বলা যায় যে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম বীজ ‘পো’-এর মধ্যে সাতবার কম্পন হয়েছিল। আর প্রতিটি কম্পন জীবনের এক-একটি স্তরকে নির্দেশ করে। ডোগোনদের এই সাত নারী ও পুরুষের মিলন হিসাবে দেখা হয়। সেখান থেকে নতুন প্রাণের জন্ম হয়।

সাত সংখ্যাটি মিশরীর গণিতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মিশরীয় মৌলিক সমীকরণ অনুযায়ী সাত হল— ১+২+৪=৭। এবং এই গণণার মূল ভিত্তি হল সংখ্যাকে দ্বিগুণ করা। আবার যখন সাতকে দ্বিগুণ করা হয় তখন প্রথম তিনটি সংখ্যা একই থাকে। এই সমীকরণটি মিশরের পিরামিড মাপার সময় ব্যবহার করা হত। এই হিসাব দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, সাত সংখ্যাটি মিশরীয় সভ্যতায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

দক্ষিণ-মধ্য ও দক্ষিণ নাইজেরিয়া ও গুয়েনাতে বসবাসকারী ইবো (Igbo) উপজাতিদের মধ্যেও সাত সংখ্যাটিকে নিয়ে নানা ধরনের বিশ্বাস আছে। ইবো উপজাতিরা মনে করে যে, মানুষের মৃত্যু সাতটি কারণে হয়ে থাকে। আফ্রিকান আরেকটি উপজাতি বামবারারা মনে করে যে, আমাদের জীবন সাতটি স্তরে বিভক্ত। এছাড়াও সাতটি স্বর্গ, সাতটি পৃথিবী, সাতটি সমুদ্র ও বৃদ্ধির সাতটি স্তর থাকে।

আফ্রিকারই আরেকটি উপজাতি হল টেডা উপজাতি। টেডা উপজাতিরা সাধারণত পূর্ব ও মধ্য সাহারার চাদ, নাইজের ও লিবিয়াতে বসবাস করে। এই টেডা উপজাতিদের ভাষার নামও টেডা। টেডা উপজাতিদের সাত নিয়ে মিথ আছে। টেডা উপজাতির মানুষেরা মনে করে বিয়ের পর নতুন দম্পতিদের সাত দিন বাইরে না বেরোলে মঙ্গল হয়। তাই নতুন দম্পতির বিয়ের পরের সাতদিন বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ। আবার আফ্রিকার বুইগুয়িনি জাতির মানুষেরা প্রতি সাত বছর পর পর তাদের দীক্ষা নেবার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। আকান উপজাতির মানুষেরা সাত সংখ্যাটিকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে। আকান সাতটি বংশ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি গোষ্ঠী সাতটি গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে। এদের সাত দিনে এক সপ্তাহ হয় এবং প্রতিটি দিন একজন করে দেবতা সামলায়।

তবে সাত যে শুধুমাত্র উন্নতি কিংবা সাতকে শুভ হিসাবেই ধরা হয় না। আফ্রিকার অনেক উপজাতি আছে যারা এই সাতকেই অশুভ মনে করে। ভুগুয়াস উপজাতির মানুষেরা সাতকে অশুভ ভাবে। জুলু উপজাতির মানুষেরা সাত সংখ্যাটিকে আবার দু-ভাবে দেখে। যদি পণ সংক্রান্ত কোনো বিষয় হয় তাহলে সাত সংখ্যাটিকে অশুভ ধরা হয় আর যদি মহিলা বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়ে সাত সংখ্যাটি আসে তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। কোলোকুমা জো জাতির মানুষেরা সাত সংখ্যাটিকে এড়িয়ে চলে। কারণ, তারা মনে করে সাত সংখ্যাটি দেবতাদের সঙ্গে জড়িত। তাই সাত সংখ্যাটি এড়িয়ে চলাই ভালো। মালিঙ্কে উপজাতির মধ্যেও সাত সংখ্যাটি একেবারে নিষিদ্ধ। এরা গণনার সময় সাত সংখ্যাটি উচ্চারণ পর্যন্ত করে না। এরা সাত উচ্চারণ করার পরিবর্তে ‘ছয়-এক’ উচ্চারণ করে। মালিঙ্কা উপজাতিরা মনে করে যে, সাত সংখ্যাটি উচ্চারণ করলে দুই কথকের মধ্যে বিবাদ হতে পারে। এই কারণেই এরা সাত সংখ্যাটি উচ্চারণ থেকে বিরত থাকে। কিকুয়ি (kikuyu) উপজাতির মানুষেরা সাত সংখ্যাটির পরিবর্তে ‘Mugwanja’ ব্যবহার করে এবং কখনোই সাত সংখ্যা দিয়ে কোনো কিছু ভাগ করে না। এমনকী বাচ্চারা গ্রুপে কোথাও বেড়াতে গেলে এক-একটি দলে সাতজনের পরিবর্তে অন্য কোনো সংখ্যায় দল করা হয়। কারণ হিসেবে এই উপিজাতিদের মধ্যে বিশ্বাস যে, যদি সাতজন বাচ্চা একসাথে যায় তাহলে সাতটি অভিশাপকে আহ্বান করা হয়। এই সাতটি অভিশাপ সাতটি লাঠিকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং অভিশপ্ত মানুষটির দিকে নিক্ষেপ করে। যদি কখনো দৈবজ্ঞ কাজে সাতটি পদ পরিবেশন করা হয় তাহলে সেটা মৃত্যুর সংকেত হিসাবে এই উপজাতির মানুষেরা ধরে নেয়।

কেনিয়ার কাম্বা বা আকাম্বা উপজাতিদের মধ্যে সাত সংখ্যাটিকে নিয়েও ট্যাবু আছে। কাম্বা উপজাতির মানুষেরা মনে করে বিজোড় সংখ্যা হল সঙ্গীহীন সংখ্যা। তাই কখনোই তারা বিজোড় সংখ্যার গ্রুপের সঙ্গে নিজেদের সন্তানদের কোথাও যেতে দেয় না। গোরুর রাখালদের ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম আছে। কোনো গোরুর রাখাল টানা ৬ দিনের বেশি গোরুকে দেখভাল করতে পারবে না। অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে সাত সংখ্যাটিকে এখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কাম্বা চাষীরা আঁখের গায়ে সাতটি শাজারুর কাঁটা জুলিয়ে রাখে যাতে চোরে ফসল না নিতে পারে। তবে কাম্বা জাতিদের মধ্যে সুন্নত-অনুষ্ঠান পর্বটি সাত দিন ধরে হয়। এছাড়া হাতি শিকারীরা চাবুককে সাতবার ভাঙে এতে না কি তাদের হাতি শিকারে সাফল্য এনে দেয়।

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, সাত সংখ্যাটি আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কখনো শুভ বা কখনো অশুভ হিসেবে এসেছে। আমরা যদি প্রাচীনতার নিরিখে দেখি তাহলে দেখা যাবে আফ্রিকার এই জনগোষ্ঠীরা যে-ধর্ম পালন করে তা বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে পালিত ধর্মগুলির চেয়েও প্রাচীন। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে আফ্রিকান মিথোলজির সংখ্যাতত্ত্বে কি অন্যান্য ধর্মে অনুসৃত হয়েছে না কি ‘সাত’ সংখ্যার মহত্ব অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে আছে? এ নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।

তথ্যসূত্র:
Fara Patricia, Science: Four Thousand Year History
Molefi Kete Asante (Ed), Ama Mazama, Encyclopaedia of African Religion
Encyclopaedia of Britannica (Online Edition)

Categories
গল্প

যশোধরা রায়চৌধুরীর গল্প

সেইসব বাড়িয়ে বলা গল্পগুলো

বাড়িয়ে বলা ছাড়া আমাদের হাতে আর কী-ই-বা ছিল, বলো। প্রতিদিন একশো হাজারটা আড়াল রচনা করা, প্রতিদিন ঊনসত্তরটা মিথ্যে বলা, প্রতিদিন আমাদের জীবনের গল্পকে একটু একটু করে ঘন করে দানাদার করে তোলা এবং জনসমক্ষে পেশ করা।
একটা নীল ফুল ছাপ ছাপ, বড়ো বড়ো ফুলের হালকা শাড়ি, ভয়েল না কী বলে যেন। সেই পরে গা ধুয়ে বিকেলে চুল আঁচড়ে আসত দিদিভাই। আর চোখ বড়ো করে করে গল্প বলত। গান গাইতে বসত তারপর। কিন্তু ওই বিকেলের ফেলা সময়টুকু ওর নিজের সঙ্গে কাটত, আমারও, আমরা বারান্দায় দাঁড়াতাম, আমরা হাসাহাসি করতাম, গল্প করতাম। “ছেলে দেখতাম।” ক্যাবলা ছেলে স্মার্ট ছেলে কালো ছেলে ফর্সা ছেলে সিগারেট খাওয়া ছেলে খেলোয়াড় ছেলে রোথো ছেলে সব দেখতাম।

দিদিভাই তখন এইভাবেই গল্প করত। কলেজের গল্প। যা ঘটেছে আর যা ঘটেনি সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে দিদিভাই বলত। আমি ইশকুলে তখন মাত্রই ক্লাস এইট। ভূগোল বইয়ের তলায় শরদিন্দুর প্রেমের গল্প লুকিয়ে পড়ছি। প্রতিভা বসু, আশুতোষ, বিভূতি মুখুজ্জে। প্রেমের শিহরণ আমার জানা নেই তখনও। দিদিভাই আমাকে ওর বন্ধুদের প্রেমের কথা বলত।

নিজে প্রেম করার সাহস ছিল না। ওর মা বাবা তাহলে পিঠের ছাল তুলে দেবে না? কলেজটা যে কো এড, তাতেই তো সবার কত আপত্তি। ঠিক বিকেল ছ-টার মধ্যে ঘাম মুছতে মুছতে গিয়ে কাকিমা দাঁড়ায় মোড়ের কাছে। দিদিভাই বাস থেকে নামলে গলির পথটা পাহারা দিয়ে দিয়ে নিয়ে আসবে। তখন কুলফিওয়ালার হাঁক শোনা যায়নি, কিন্তু রাস্তার বাতিগুলো জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে একটা আঁকশি হাতে লোক। ঝুপসি মতো সন্ধ্যে নামতে নামতে কলেজের সঙ্গে একটাই সংযোগ রক্ষাকারী বাস এসে দিদিভাইকে নামিয়ে দেয়। ঠিক কলেজ-টার শেষ ক্লাসের সঙ্গে বাস রাস্তাটুকুর সময় যোগ করলে যে-সময়টা হয় সেই সময়ে।

আমার হাসি পায়। দিদিভাই চাইলে তো ক্লাস ও কাটতে পারে। দিদিভাই দুষ্টুমি করে খাবার ফেলে, পাত থেকে ঝিঙে বা তেতো নিয়ে জানালার বাইরে ফেলতে পারে লুকিয়ে, এমনকী বাথরুমে দুধের গেলাস নিয়ে ফেলে দিতে পারে দুধ। সব কাকিমাকে লুকিয়ে। আর প্রেম করতে পারে না?

যার এত ইন্টারেস্ট অন্যদের প্রেমে?

দিদিভাই, নিজে প্রেম করত কিনা আমি আজ আর জানি না। জানি, একেবারে কিচ্ছু নেই যে-সম্পর্কে সে-সম্পর্ককেও বাড়িয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলতে পারত ও। মুখচোরা, কালো, কোঁকড়ানো চুলের দিদিভাই বাড়িতে হম্বিতম্বি করে ভাইবোনেদের ওপরে। কলেজে চুপটি করে যেত আর নোট নিয়ে চলে আসত। বড়োজোর শেষ দিকের এক-দু-খানা ক্লাস কেটে ক্যান্টিনে গিয়ে চপ আর চা সাঁটাত, অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে চোরা চোখে চাইত নিজের পছন্দের পলাশদার দিকে। এই ছিল দিদিভাইয়ের দৌড়।

দিদিদের ক্লাসের তাপসীদি তখন হোস্টেলে থাকে। সে হোস্টেলের গল্প শুনে ততদিনে পুরো পেকে গেছি আমি। তাপসীদিদের দুষ্টুমি। সিগারেট খাওয়া। অবিবাহিতা মোটা আর কালো (এই মোটা আর কালো শব্দদুটো বলার সময়ে ছেলে আর মেয়ে সবার মধ্যে কী পৈশাচিক উল্লাস যে কাজ করে!) সুপার ম্যাডামের গোঁফ আছে কি নেই সে-গল্প… একদিন হুট করে দিদিমণির ঘরে ঢুকে পড়ে সুপার ম্যাডামকে ব্লাউজ খোলা অবস্থায় দেখে ফেলার উল্লাস আর নিষিদ্ধতা… সে-সব বলার মধ্যে কত যে পেজোমি আর গুল্লি গুল্লি চোখের মজা ঢেলে ফেলত দিদিভাই।

তবু ছাপোষা আমরা। আমাদের জীবন ছাপোষাই হয়ে গেল তাই, তাপ্পর।

দিদিভাইকে বিয়ে দেওয়া হল। কথায় বলে, হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে, দুষ্টু মেয়ে জব্দ হয় বিয়ে দিয়ে দিলে। দিদিভাই ঠিক সময়ে খেত না, সকালে দাঁত মাজতে ভুলে যেত। খবরের কাগজের হেডলাইন আর প্রথমপাতাটা উলটে দ্বিতীয় পাতার কোণায় রিপ কার্বি আর অরণ্যদেব পড়ে সকালে ওর কাজ সারা। হরলিক্স কোনোদিন তলানি খেত না। তা নিয়ে কাকিমা খিটখিট করত। দিদিভাই বিকেলে বারান্দা থেকে আমার সঙ্গে গল্প আর ছেলেদেখা শেষ করে গান নিয়ে বসত কিন্তু তাতেও ফাঁকি। পড়াশুনো তো চিরদিন অন্যমনস্কভাবেই করে গেল। ক্লাস্ত ওয়ান থেকে টেন অঙ্ককে ভয় পেয়ে পেয়ে ইলেভেনে হোম সায়েন্স…। এই আমার দিদিভাই।
তবু তার কী ভীষণ জাঁদরেল আর সুপণ্ডিত এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। কে জানে কী কপালে। আসলে কাকা আর কাকিমার প্রচেষ্টায়।

যে-প্রচেষ্টায় কাকিমা দুপুরে ঘুমোত না, উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পর, দুপুরে খেয়ে উঠে গল্পবই না পড়ে রাশি রাশি জ্যাম জেলি আর আচার বানাত, ছাতে দিত তারপর ছাত থেকে পাড়ার সমস্ত দুষ্টু ছেলে আর মেয়েদের খর চোখে নজরদারি করত, চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে দুপুরের আধো অন্ধকার ঘরটিতে বসে সেলাই ফোঁড়াই করত, দূর থেকে ও বাড়ির টুম্পা ছেলেদের সঙ্গে চিরকুট চালাচালি করছে দেখে ভুরু কুঁচকে বলত হুঁ! সেই একই অধ্যবসায়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাকিমা চলে যেতে ঠিক ছটায় আমাদের সরু গলি পেরিয়ে বাসরাস্তায়, দিদিভাইকে বাস থেকে নামিয়ে সঙ্গে করে আনতে। সেই অধ্যবসায়েই চেনা পরিচিত থেকে শুরু করে কাগজের বিজ্ঞাপন সর্বত্র নজরদারি করে দিদিভাইকে এক অসামান্য পরিবারের রূপহীন, অর্ধটাকওয়ালা, কোলকুঁজো, ভারী চশমার পড়ুয়া পাত্রে পাত্রস্থ করল। পাত্রের বাবা মা দু-জনেই অধ্যাপক এবং প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের। বাবা অবিশ্যি মারা গেছেন সম্প্রতি। মা একাই ছেলেকে ব্যবস্থা করে বিয়ে দিচ্ছেন।

বিয়ের সন্ধ্যেতে দিদিভাই যখন সাজছিল তখন বান্ধবী আর বোনেরা, পাড়ার মেয়েরা হই হই করে বর দেখতে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল মুখ চুন করে। এরকম গল্প করে তিলকে তাল করতে পারা দিদিভাইটা, ওর বর রাজেশ খান্না বা নিদেনপক্ষে আমাদের শমিত ভঞ্জ বা স্বরূপ দত্তের মতো দেখতে হতেই হবে। দিদিভাইয়ের চোখ খঞ্জনার মতো ছিল, নাক সরু আর মোটের ওপর মুখশ্রী তো ভালোই। সেই মিষ্টি দিদিভাই বরের ছবি দেখে কতটা কষ্ট পেয়েছিল এখন বুঝি। তখনও বুঝেছিলাম।

ভয় ও পেয়েছিল। এতদিনের সিনেমা দেখা, এতদিনের দারুণ সব গল্পবই, এতদিনের কলেজের প্রেম প্রেম ভাব, পলাশদার প্রতি চোরা চাউনি, সবের পর, এই পণ্ডিত, বয়সে আট বছরের বড়ো রাগি রাগি দেখতে বরের চেয়েও, তাদের ওই সুবিশাল নামডাকের পরিবারে গিয়ে ভর্তি হতে হবে ভেবেই দিদিভাই কুঁকড়ে গেসল।

দিদিভাইয়ের শাশুড়ি ছিলেন এম এ পাশ। সদ্য বিধবা, তবে একাই একশো। ভীষণ ব্যক্তিত্ব। চোখা চেহারা। অধ্যাপক হিসেবে দারুণ নামডাক।

অথচ দিদিভাইকে বি এ থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দেবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল। বিদ্বান ছেলের বিয়ে দিতে ওঁরা সুশিক্ষিতা মেয়ে খোঁজেননি কেন? রূপসীও খোঁজেননি?

দিদির পাকাদেখার দিন আমি চারটে কমলাভোগ আর দুটো সিঙাড়া সাঁটাতে সাঁটাতে শুনেছিলাম দিদির হবু শাশুড়ি বলছেন, রূপ বিদ্যে দিয়ে কী করব আমি বলো তো? সে-সবের তো অভাব নেই আমাদের বাড়িতে? আমার শুধু একটা ঘরোয়া মেয়ে চাই, বাড়ির সব দায়িত্ব নিতে পারবে… নিজের মেয়ের মতো রাখব।

দিদিদের বাড়ির সদর দরজার চাবির দুটো ডুপ্লিকেট ছিল। একটা বাড়িতে থাকত। অন্যটা নিয়ে বেরুত জামাইবাবু। আর তৃতীয়টা দিদির ননদের কাছে থাকত। বেল টিপে মাকে বিরক্ত করবে না সে, সুন্দরী শিক্ষিতা উচ্চ পদে কর্মরতা ননদ দিনের যে-কোনো সময় “নিজের বাড়িতে” আসবে বলে ওর কাছে থাকত। ইয়েল লকের চাবি ঘোরালেই সে-বাড়ি ঢুকতে পারত।

দিদি বাজারে গেলে, শপিং, ছেলেকে স্কুলে দেওয়া… বা নিজের বাপের বাড়িতে কাকু কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে এলেও… নাহ্, ফিরে গিয়ে বেল টিপে বসে থাকত সিঁড়িতে। ভেতরে, অনেক দূর থেকে হাওয়াই চটি, ঘরে পরার, ফটর ফটর আওয়াজ করে শাশুড়ি আসতেন। লেখাপড়ার টেবিল থেকে উঠে আসতে হয়েছে বলে রীতিমত বিরক্ত। তবু, দিদির হাতে কখনো আরেকটা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারেনি।

এই মুহূর্তে দিদিভাই শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে। একা, সম্পূর্ণ একা। দিদিভাই মরণাপন্ন। একটু আগেই ফোন করেছিল ওদের কাজের লোক। দিদির মোবাইল ঘেঁটেই আমার নম্বর পেয়েছে।

ডাক্তার আমাকেই জিগ্যেস করলেন, ওঁর আধার কার্ড কোথায়? আইডেন্টিটি কার্ড কিচ্ছু আনেনি তো।

কে আনত? কাজের লোক ? জামাইবাবু? জামাইবাবু নিজের কার্ড ও খুঁজে পান কিনা সন্দেহ।

দিদি একা শুয়ে আছে। আমি এসেছি। আমার নিজের গল্প, নিজের সমস্যা, নিজের শ্বশুরবাড়ি, সব সামলে, পেছনে রেখে। দিদি টার্মিনাল। কত বোতল রক্ত যেন লাগবে। কতগুলো টেস্ট যেন করতে হবে। কে করায়, কে দায় নেয়?

এই শেষ সময়টা ওর বর পাশে নেই। ছেলেও বিদেশে। জামাইবাবুকে ফোন করি একটা। ওদিক থেকে বিস্রস্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত গলা শোনা যায়। বয়স যেন এক লাফে অনেক বছর বেড়ে গেছে জামাইবাবুর।

কে?

আমি, টুনি। জামাইবাবু দিদির ত রক্ত লাগবে/
অ্যাঁ, রক্ত?
দিদির আই কার্ডটা কি কেউ এসে দিয়ে যেতে পারে নার্সিং হোমে?
কেউ- কেউ ত-তো নেই টুনি। আমার, আমার না, নার্ভ ফেইল করছে টুনি।
তাহলে-তাহলে-দু-মুহূর্ত ভেবে নিই আমি। আচ্ছা জামাইবাবু আমিই যাচ্ছি আপনাদের ওখানে।

যাই। দ্রুত ট্যাক্সি ডেকে নিই। মুখে হু হু করে হাওয়া লাগছে আর আমার কান্না আসছে। ছোটবেলার সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দিদিভাইয়ের বানিয়ে বলা গল্পগুলো। বড় বড় চোখ করে। তেঁতুলের আচার চুরি করে এনে কাকির ভাঁড়ার থেকে।

ওদের বাড়িতে ছটা আলমারি। তার তিনটে লোহার। জামাইবাবু জানেন না দিদির আধারকার্ড কোথায় আছে। দিদিভাইই ত সব গুছিয়ে রাখে ।

ও-ও জানত।
পাস্ট টেন্স কেন বলছে জামাইবাবু? মাথাটা কি একেবারে গেছে?

চাবি কোথায় থাকে? চাবিগুলো? লকারে থাকা সম্ভব। দিদির বেডরুমে ঢুকে ড্রয়ার হাঁটকাই আমি।

সারাবাড়িতে, দিদির ঘরে, দেওয়ালে কত ফোটো। দিদির একটাও নেই। জামাইবাবুর অল্পবয়সের ডিগ্রি সেরিমোনির ছবি। ওদের ছেলের অসংখ্য নানা বয়সের। আর বাইরের ঘরে দেখে এসেছি মাসিমা মেসোমশাইয়ের ছবি। স্টুডিওতে তোলা মেধাবী মহিলাটি… শিক্ষিতা, সে যুগের এম এস সি। দিদির ননদের ও আছে। দিদি শুধু নেই। না ওই তো ভুটুকে জড়িয়ে ধরে একটা অস্পষ্ট।

ওহ, ওর বোধ হয় আধার হয়নি জানো টুনি। সেই সময়ে তো আসলে ভুটুর মাধ্যমিক, ও পড়াচ্ছিল। বলেছিল পরে কখনো করিয়ে নেবে। আর হয়নি।

দিদিভাইয়ের আধার নেই। আইডেন্টিটি কার্ড নেই। প্যান, ইলেকশন আই কার্ড? সেসব নেই? সেসব কোথায়?

হাত কাঁপছে জামাইবাবুর । করুণা হয় আমার ওঁর দিকে তাকিয়ে। জামাইবাবু বিদ্বান মানুষ। কোনোদিন জীবনের কোনো প্রাক্‌টিক্যাল সিদ্ধান্ত নিতে শেখেননি। ত্রিশ বছর বয়স অব্দি মায়ের শাসনে, মায়ের সিদ্ধান্তে চলেছেন। বিয়ের পরও, মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, মাতৃমুখাপেক্ষিতা ঘোচেনি।

দিদিভাই ধীরে ধীরে নিজের কালো হবার, বিদ্যাহীন হবার অপরাধ বোধ নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির সেবাতে সার্বিকভাবে আত্মনিয়োগ করেছিল। আর দক্ষতায়, যত্নে, প্রাণপণ চেষ্টায় পুতুলের মতো কর্মপটু আর অনিবার্যভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল ওদের সংসারে।

ফলত জামাইবাবু কখনো কুটো নাড়েননি। বছর দশেক আগে দিদিভাইয়ের শাশুড়ি মারা যাবার দিন ওঁকে হাউ হাউ করে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছিলাম। দিদিভাই সেদিন সমাগত আত্মীয়দের বড়ো বড়ো ট্রে ভর্তি করে চা আর সরবত এনে দিচ্ছিল। সে ব্যস্ততায় আমি শুধু লক্ষ করেছিলাম দিদিভাইয়ের মুখটা শুকনো। সাদা শাড়ির ভেতরে রুগ্ন একটা শরীর। কপালে দু-তিনটি চুল রুপোলি হয়ে এসেছে।

তুমি কিছু খাবে না?

দিদিভাই জামাইবাবুর সামনেও চা ধরেছিল। জামাইবাবুর চোখ দুটো ফুলে লাল, জবাফুলের মতো। মাথা নেড়ে না বলেছিল। সবাই ঘিরে ধরেছিল তাকে। আহা উহুর বন্যা। দিদিভাইয়ের পিসিশাশুড়ি বলেছিলেন, বউমা ওকে ডাবের জল টল কিছু দাও। এত বড়ো আঘাত…

ঐদিন মনে হয়েছিল দিদিও আর বেশিদিন বাঁচবে না। কিন্তু ঐ যে আমাদের বাড়িয়ে বলা স্বভাব। আমরা সবকিছু নাটকীয় করে ফেলি। সবকিছুকে বানিয়ে তুলি গল্পের মতো…

সেইদিনের পর দিদির শাশুড়ির শ্রাদ্ধের দিন, তার পরদিন, খুব খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। জামাইবাবু নিজের মায়ের সম্বন্ধে বই বার করেছিল একটা। আত্মীয়রা, নিজে , লিখেছিল স্মৃতিকথা। কত পন্ডিত, শিক্ষিত মানুষ ওই পরিবারে। ওঁর ছাত্রছাত্রীরাও লিখেছিল বইকি। দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে মাসিমার ফ্যান ক্লাব।

দিদির ছেলে ভুটু ঠাকুমার ডিজিটাল ছবির কোলাজ বানিয়ে ল্যাপটপে লাগিয়ে লুপে চালিয়ে রেখেছিল।

দিদিভাই মারা গেলে ওর ছবির কোলাজ বানাবে, ভুটু?

Categories
গল্প

হিন্দোল ভট্টাচার্যর গল্প

ভয়

“তুমি তো গল্প লিখতে বসে কোনও গল্পই রাখোনি। পাতার পর পাতা লিখে গেছ! একটি কাক তোমাকে লক্ষ্য করছে, এটা তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরির বিষয়বস্তু হতে পারে, কিন্তু এটা কোনো গল্প নয়”
“কিন্তু তরুণদা, আমি সকালবেলা উঠে দেখলাম একটা পোকা হয়ে গেছি, সেটা যদি একটা…”
“আরে সব বিষয়ে যদি তোমার কাফকা এসে পড়েন, কাম্যু এসে পড়েন, তার্কোভস্কি এসে পড়েন, তাহলে তো মুশকিল হে! তুমি তো এই কলকাতায় বসে গল্পটা লিখছ একটা খবর কাগজের সাহিত্যপত্রের জন্য। বাঙালিদের জন্য। বাঙালি পামুক পড়ে, দস্তুভয়স্কি পড়ে কিন্তু চায় শরৎরচনাবলি। তোমাকে আসল পাঞ্চটা করতে হবে এখানে। শরৎ এবং জয়েসে। না হলে তো এখানে জায়গাই পাবে না। কথাটা বলবে কোথায়?”

“কিন্তু দাদা, আমার জীবনে তো গল্প নেই। আমি আর বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারব না”।

“আহা! লক্ষ করো। ঢুকে যাও মানুষের ভিতরে। বস্তির মানুষেরা কেমনভাবে বেঁচে আছে। সাব অলটার্ন মানুষের জীবন কেমন! তোমার জীবন সম্পর্কে কারো কোনো আগ্রহ নেই। আর কোন কাক কার দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তা বাংলা সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না।”

“কিন্তু তরুণদা, যদি, বিষয়টা একটা রিভেঞ্জ হয়”

“ওরে বাবা, হিটলারের বার্ডস নাকি?”

গল্পটা ছাপা হয়নি। পার্থর একমাত্র এমন একটা লেখা সেই গল্প, ছাপা হয়নি। অবশ্য ছাপা যে হবে না, তা রুমেলা বলে দিয়েছিল আগেই। কারণ, গল্পের মধ্যে এমন কিছুই ছিল না, যা গল্পটাকে গল্প করে উঠতে পারে। কিন্তু পার্থর নিজের আর যে-কোনো কাহিনি নেই। আর যে গল্পও নেই। সে গল্প লিখবে কেমন করে? পার্থ শুধু জানে, সে ঠিক যেমনভাবে দেখে, তা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আর সে যে-জীবনযাপন করে না, সেই জীবন সম্পর্কে লেখার অধিকারীও সে না।

“নিজের থেকে বেরোও পার্থ। কত চরিত্র, তাদের মধ্যে আত্মার মতো ঢুকে পড়। একজন লেখক তো আসলে একটি বিদেহী আত্মা, যে, মানুষের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তার পর তার পোশাকগুলো পড়ে থাকে। সে থাকে না। সেই পোশাকগুলো কী? তার লেখা বিভিন্ন চরিত্র।”

“মানছি তরুণদা, কিন্তু, এত চরিত্র যার আশেপাশে কোনোদিন ছিল না, তার জীবনে গল্প নেই বলছেন? মানে, তার একটা বাগানের গাছ বা পোষা কুকুর কিংবা অপরিচিত কাক তার গল্পের চরিত্র হতে পারে না?”

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। একটা অসম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ নিয়ে পার্থর গল্প পার্থর ব্যাগের মধ্যেই ঘুরতে থাকল। কারণ, পার্থর মতোই পার্থর গল্পেরও আর অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল না।

কিন্তু এগুলিও পার্থর ভয়ের কারণ নয়। অবশ্য রুমেলা ঠিকই ধরেছিল, পার্থ আজকাল নিজেকেই ভয় পাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, তত যেন আরও বেশি করে এই ভয় চেপে বসছে পার্থর মনের ভিতরে। যেমন শীতকালের হালকা লাল রঙের রাস্তার আলোর সঙ্গে কুয়াশা মিলেমিশে একধরনের আলোর জন্ম দেয়। সেই আলোর চরিত্র একটাই। আর তা হল বিষাদ। পার্থ যে মানুষের চেয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, এ-কথা পার্থর নিজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। বরং, সে ক্রমশ বুঝতে পারল মানুষের প্রতি তার একধরনের বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে মনের ভিতরে। কিন্তু তাকে দেখতে কাক কিংবা শেয়াল বা কুকুরের মতো হয়ে যায়নি।
“কী বলছ, তোমাকে তোমার মতো দেখতে লাগছে কিনা?”

“হ্যাঁ, মানে, আমাকে কি আমার মতোই দেখতে লাগছে রুমেলা?”

আর ঠিক সে-সময়ে ডেকে উঠবে একটি কোকিল অযাচিতভাবে, সেটা পার্থ বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি বলেই সে চমকে উঠেছিল। রুমেলা উঠে পড়েছিল চেয়ার ছেড়ে আর তার পরেই তার সেই মন্তব্য, যা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল পার্থ। আর সেটি হল— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

এইটুকু পড়ার পরে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন একটা বিভ্রান্তিকর গদ্য ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারছেন না। কারণ, লেখাটি প্রথম বাক্য ছেড়ে আদৌ কোথাও এগোয়নি। পার্থও এগোত না, যদি না সেদিন রাতেই বাড়ি ফেরার সময়ে সে বুঝতে পারবে পাড়ার কুকুরগুলো আর তাকে দেখে তেড়ে আসছে না। আর এ-কথা খেয়াল করা মাত্র, তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাবে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে সব। আস্তে আস্তে পরিচিত সকলের কাছ থেকেই তার তৈরি হয়েছে এক দূরত্ব। এমনকী মানুষ দেখলে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে আজকাল। একধরনের বমি আসছে। জ্বর আসছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তরুণদা হোক বা রুমেলা বা বাজারের শংকরদা, বা, বাসের ভিড়। মানুষের কাছ থেকে দূরে একা থাকলেই সে স্বস্তি পাচ্ছে। যদি প্রকৃতির রোষ গিয়ে পড়ে মানুষের উপর, তাহলে সেও সেই রোষের কবলে পড়বেই। হয়তো একদিন সারিবদ্ধভাবে আক্রমণ করবে সমস্ত পাখি, সব কুকুর, সব বাঘ এমনকী সব ছাগল। এমন একধরনের অবাস্তবিক বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য কোনও রূপকথা বা কোনো গল্প বা কোনো চলচ্চিত্রও তৈরি থাকবে না নিশ্চয়। ফলে, না লিখতে পারার একাকিত্ব পার্থকে ঘিরে ধরবে। রাত একটার ফাঁকা রাস্তায় বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে এ-সব কথা ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ছিল রুমেলার সেই প্রশ্ন— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। অন্তত রাত একটায়। রাস্তার মোড়ের মাথায় ওই চার পাঁচটা কুকুরের ঠিকানা। সেখান থেকে ঠিক পাঁচশো কি এক কিলোমিটার তাদের সীমা। এই সীমার মধ্যেই তাদের জন্ম, যুদ্ধ, প্রেম, যৌনতা, মৃত্যু। রাতে যখন পার্থ ফেরে, তখন চেনা মানুষ হলেও তার দিকে তাকিয়ে একবার মুখ তোলে কুকুরগুলো। গলার ভিতর দিয়ে একটা চাপা ক্রোধের গরগর শুনতে শুনতে ঘামতে থাকে পার্থ। সেজানে, তাকে যদি আক্রমণ করে কুকুরগুলো, তাহলে, তার কিছুই করার নেই। কিন্তু প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কুকুরগুলো এবং তাদের সন্তানসন্ততিরা তাকে আক্রমণ করেনি কখনো। কিন্তু সেদিন ওই মোড়ের মাথা টিপে রোবার সময় যখন কুকুরগুলো একবার মুখ তুলেও তার দিকে তাকালো না, তখন পার্থ আন্দাজ করতে পারছিল কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। আর সে-সিদ্ধান্ত বদ্ধমূল হল, যখন দূর থেকে একটা তারই উচ্চতার লোক তার দিকে এগিয়ে এল ক্রমশ। ওই ফাঁকা রাস্তায়, সাধারণত কেউ উলটো দিক থেকে আসে না। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয়টি ছিল অন্য। লোকটিকে অবিকল তার মতোই দেখতে। আর তাকে দেখেই আবার তার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে গেল পার্থর। এটা তো কোনো কাহিনি নয়, একেবারে একটি গল্প হয়ে যাচ্ছে। একটি অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্প। কিন্তু ঘটনাটি ঘটছে। সেভাবে ভাবতে গেলে, আমাদের জীবনও একটা অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্পের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা হয়তো সেইসব গল্পগুলিকে নানা রঙের নানা দৈর্ঘ্যের সুতোয় বেঁধে সেগুলিকে একটা যুক্তির রূপ দিই মাত্র। ভাবতে ভালোবাসি, যে জীবনের একটা কোনো মানে আছে। কিন্তু প্রকৃতির সে-দায় নেই। পার্থর মনে হল প্রথমে, এই দেখাটা সম্পূর্ণভাবেই আজগুবি। কিন্তু তার এই মনে হওয়া পালটে গেল তখন, যখন সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “এটা ঠিক করছ না পার্থ। তুমি মানুষ না, ক্রমশ একটা জন্তু হয়ে যাচ্ছ। আমি তো মাকে জন্তু হতে দেব না”।

পার্থ প্রাণপণে বোঝাতে চাইল একবার, যে সে জন্তু হতে চাইছে না। পরমুহূর্তেই তার মনে হল, এই ভুলটা সে করতে পারে না। সে ফিসফিস করে বলে উঠল— আমি জন্তু। তুমিও জন্তু। তুমি আমাকে ধ্বংস করছ। আর আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছি।

পার্থর কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই সে শুনতে পেল পাড়ার সমস্ত কুকুর একসঙ্গে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। পার্থর মতোই দেখতে কিন্তু পার্থ নয় লোকটিকে একযোগে কুকুরগুলো আক্রমণ করল। লোকটি পালাতে পালাতে গলিটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে হারিয়ে গেল। লোকটির সঙ্গে হারিয়ে গেল কুকুরগুলোও।

পরদিন সকালে রুমেলা চা দিতে দিতে পার্থকে বলল— কাল রাতে এ-পাড়ায় নাকি চোর এসেছিল। তবে এ-পাড়ার কুকুরগুলো বাঘের বাচ্চা। লোকটাকে ছাড়েনি।

“মানে?” পার্থর বুকের ধুকপুকানি আবার বেড়ে গেল।

“লোকটার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। পুলিশ শণাক্ত করেছে দাগী চোর।

“চোর?”

“হ্যাঁ”

“কী করে শণাক্ত করল? লোকটা তো ভালো লোকও হতে পারে। একটা আস্ত মানুষকে কুকুরগুলো ছিঁড়ে ফেলল?”

“তুমিও তো রাতে ফেরো। অবশ্য কুকুরগুলো চেনা মানুষকে কিছু করে না”।

“আমি মানুষ?”

“কেন? কী যে হয় তোমার!”

“তুমি নিশ্চিত আমি মানুষ? জন্তুনই?”

‘‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

প্রশ্নটা শুনে, একটু মনে মনে অস্বস্তিতেই পড়ে গেল পার্থ। আসলে, রুমেলার এই এক সমস্যা। যখন তখন এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেগুলি সে খুব ভেবেচিন্তে করছে বলে মনে হয় না, অথচ, হয়তো ভেবেচিন্তেই করে রুমেলা। কারণ, রুমেলাকে খুব একটা বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমেলা যে-সব বোঝে, তার প্রমাণ রাখতে একটা বাক্যাংশই যথেষ্ট। কিন্তু ও বেশিক্ষণ একবাক্য নিয়ে পড়ে থাকে না। যেমন, জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে রুমেলা প্রসঙ্গই পালটে ফেলে বলল, “দেওয়ালের গায়ে কেমন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে, তাই না?”

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

হিন্দোল ভট্টাচার্যর গল্প

ভয়

‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?’

প্রশ্নটা শুনে, একটু মনে মনে অস্বস্তিতেই পড়ে গেল পার্থ। আসলে, রুমেলার এই এক সমস্যা। যখন তখন এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেগুলি সে খুব ভেবেচিন্তে করছে বলে মনে হয় না, অথচ, হয়তো ভেবেচিন্তেই করে রুমেলা। কারণ, রুমেলাকে খুব একটা বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমেলা যে-সব বোঝে, তার প্রমাণ রাখতে একটা বাক্যাংশই যথেষ্ট। কিন্তু ও বেশিক্ষণ এক বাক্য নিয়ে পড়ে থাকে না। যেমন, জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে রুমেলা প্রসঙ্গই পালটে ফেলে বলল, ‘দেওয়ালের গায়ে কেমন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে, তাই না?’

পার্থ বলল, হুঁ। কিন্তু তার মনে রুমেলার কথাটি গুনগুন করছে। যেন এক চেপে রাখা আশ্চর্য দমকা বাতাস আবার হুহু করে উঠছে বুকের ভিতর।

‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ’?

এই সত্যি কথাটা রুমেলার সামনে স্বীকার করার ক্ষমতা পার্থর নেই। বিকেলের আলোটা ক্রমশ মায়াবী হয়ে উঠেছে। এই সময়টা এমন হয়। আবাসনের পশ্চিম দিক এখনও খোলা। তাই অনেকটা আকাশ দেখা যায়। জীবনানন্দের পাখিদের দেখাও যায়। রুমেলা অবশ্য একদিন ভুল ভাঙিয়ে বলেছিল, ওরা বিকেলের ঘরে পেখা পাখি, জীবনানন্দ দেখেছিলেন।

পার্থ যে রুমেলাকে ভয় পায়, তার কারণ যে, রুমেলা পার্থর স্ত্রী তা নয়। বরং, তাদের দু-জনের মধ্যে একটা আশ্চর্য সম্পর্ক। আর সে-সম্পর্কের কথা রুমেলা জানে না। পার্থও জানত না। কিন্তু একদিন রাতে সব হিসেব পালটে গেল।

পার্থ যে কয়েকদিন ধরেই একটু ভয়ে ভয়ে আছে, এ-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না তার নিজেরও। কিন্তু ঠিক কাকে ভয় পাচ্ছে, এ-বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ ছিল না। হতে পারে, তার কাগজের অফিসের সম্পূর্ণ পরিবেশ, আবার হতে পারে সেই চিফ রিপোর্টার। আবার এও হতে পারে, মাথার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঘনিয়ে আসা চাকরি চলে যাওয়ার ভয়।

অফিস থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউইয়ে চা খেতে বেরিয়েছিল পার্থ। ক্রসিং-এর জায়গাটায় গাড়ি সিগন্যাল পেলেই খুব জোরে চলতে শুরু করে দেয়। সেদিনও শুরু করে দিয়েছিল। চা-টা সবে এক সিপ দিয়েছে, আর শুনতে পেল একটা গাড়ির ব্রেক কষা আর একটা কুকুরের চিৎকার।

এমন একটা জায়গায় চায়ের দোকানটা, যেখান থেকে রক্তাক্ত সেই কুকুরটার দেহ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। একটা কুকুরই তো মারা গেল, বিশেষ কিছুই নয়। একটা সাধারণ রাস্তার নেড়ি কুত্তা। অল্প পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য থেমেছিল ট্র্যাফিক। কিন্তু তার বেশি কিছুতেই নয়। সাধারণ একটা রাস্তার নেড়িকুত্তার জন্য বেশিক্ষণ থেমে থাকা যায় না। কিন্তু পার্থর বুকের ভিতরে ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল। চায়ের ভাঁড়টা হাতে ধরে রাখতে পারছিল না পার্থ। গরম চা চলকে গেল। আঙুলের উপরে গরম চা-টা পড়তেই আর ভাঁড়টা হাতে ধরে রাখা সম্ভব ছিল না পার্থর পক্ষে।

পায়ের তলার মাটি সরে যেতে সাধারণত কেউই দেখেনি। কিন্তু পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া একটা চেনা বাক্য হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। পার্থ এটুকু বুঝেছিল সেদিন, পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ। অথচ, কোনো কারণ ছিল না এই অহেতুক ভয়ের। কেউ তাকে শাসানি দেয়নি, কোনো টার্মিনাল লেটার আসেনি, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, পরিবারের কারোর সামনে অপারেশন নেই, হাসপাতালে ভর্তি নয় কেউ, পরকীয়া ঘটেনি জীবনে, রুমেলাও বলেনি ডিভোর্সের কথা, যদিও তার এ-কথা বলে ওঠার অনেকগুলো যুক্তি থাকাটা খুব স্বাভাবিক। এ-সব কিছুই হয়নি।

কিন্তু পার্থর পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। বুকের ভিতরে শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত ছটফটে অস্থির ভাব। এক শূন্যতা মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকে অধিকার করে নিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত জানলাকে তার মনে হচ্ছে যে-কোনো সময়ে ভেঙে পড়ে যেতে পারে। যেন জল উঠে এসেছে বিপদসীমায় আর একটা গোটা শহর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ঘাটে। কিন্তু এত সব রুমেলাকে বোঝানো সম্ভব নয়। রুমেলা আশাবাদের মতো করে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে উড়ে উড়ে বেড়ায়। কাজ না থাকলেও কোনো-না-কোনো কাজের মধ্যে ডুবে যায়। অথবা অকারণ তর্কের বিষয় খুঁজে বের করে। তা, সে মাছের বাজারদর হোক বা পরিবেশ দূষণ। রুমেলার এই চরম পজিটিভ এনার্জিও মাঝেমধ্যে সহ্য হয় না পার্থর। এক-একদিন ঘুমন্ত রুমেলার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় লাগে। মনে হয়, এই কি সেই রুমেলা, নাকি বহু আগে সে পরিবর্তিত হয়ে গেছে?

এই কথা পরদিন রুমেলাকে জিজ্ঞেস করতেই রুমেলা বলেছিল, “আমরা কি কেউ কখনোই একইরকম থাকি? তুমিও কি আছ? আজকের তুমি কি কালকের তুমিই থাকবে? এক ঘণ্টা পরেও কি তুমি এক ঘণ্টা আগের মতো থাকবে?”

“আমি তার কথা বলিনি রুমেলা। আমি তোমাকে কি হারিয়ে ফেলছি?”

“এ তো একটা প্রেমের গল্প হয়ে গেল। দাম্পত্যে আস্তে আস্তে নেমে আসা শীত। মাল্যবান আর কারুবাসনা থেকে একটু বেরোলে হয় না? ইলিয়াসেও তো ঢুকতে পার একটু!”

“তোমার কি মনে হয় আমাদের জীবনটা একটা ফিকশন?”

“আবার একটাতে আটকে আছ পার্থ। একটা নয়, অনেকগুলো ফিকশন। যেমন, কোনো নদীই আসলে অনন্তকাল ধরে একা নয়, অনেক। নদী মরে যাচ্ছে, আবার জন্ম নিচ্ছে। আবার সে-নদী প্রবাহিতও হচ্ছে। অনেক, অনেক, অনেক।”

“আমাদের চরিত্রগুলো তো আলাদা”।

“আমাদের জন্ম মৃত্যু বেঁচে থাকা ভালোবাসা যৌনতা সবকিছুই আলাদা। অনুভূতিই আলাদা। ফলে ফিকশনও আলাদা।”

“একটা কোনো গল্প নয়?”

“মনে হয় না”

কিন্তু এই এতকিছুর সঙ্গে পার্থর ভয় পাওয়ার কোনো সম্পর্কই তৈরি হত না, যদি না, পার্থ বুঝতে পারত গোটা মানবসভ্যতাই রয়েছে আর কয়েক মাসের জন্য। বেশ কিছুকাল ধরেই সে বুঝতে পারছিল সমস্ত জন্তু জানোয়ার তার দিকে ঘৃণা আর তিক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার কারো কারো চোখে রয়েছে এক অতিরিক্ত বিদ্রূপ। যেমন, যে কাকটা রোজ সকালে আসে বিস্কুট খেতে, সে আসার পর, পার্থ বিস্কুট দিল। কিন্তু কাকটা বিস্কুট মুখে তুলল না। বরং মুখ তুলে রাগত স্বরে কয়েকবার কা কা করে ডেকে চলে গেল। এমনকী কুকুরগুলিও এড়িয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হল। অফিস যাওয়ার পথে সমস্ত কাক বা শালিখ বা কুকুর বা বিড়াল তার দিকে তির্যকভাবে তাকাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল পার্থর। সে সেদিন এর কারণ বুঝতে পারছিল না। আর ঠিক তার পরেই কুকুরটার অমন দুর্ঘটনা। কুকুরটা মরে পড়েছিল, কিন্তু তার তির্যক দৃষ্টি ছিল তারই দিকে। রাস্তায় থেঁতলে যাওয়া কুকুরটার সেই মৃত অথচ অর্থবহ চোখের দৃষ্টি পার্থ সম্ভবত যতদিন বেঁচে থাকবে, মনে থাকবে। যদিও ভুলতে পারলেই ভালো লাগবে তার।

রুমেলা এত সব কিছুই জানে না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারে পার্থর মধ্যে একধরনের পরিবর্তন হয়েছে। কেমন যেন ফ্য্যাকাশে হয়ে গেছে পার্থ। এমনকী, পার্থর ভিতরে আর সেই স্পৃহা নেই, যে-স্পৃহা, তাকে একসময়ে বেশ উজ্জ্বল ছাত্র করে তুলেছিল। শুধু উজ্জ্বল ছাত্রই না, যে-কোনো বিষয়ে পথে নামতে যে একবিন্দু ভাবত না, কলেজস্ট্রিটের প্রায় প্রতিটি লিফলেটে যার অদৃশ্য কলম থেকে ঝরে পড়তে যুক্তি আর ভাবনার অনুচ্ছেদ, সেই পার্থ এখন কলমের দিকে ঘেঁষতে পারছে না। টেবিলের সামনে বসে কেমন যেন শব্দহীন একটা অস্তিত্ব হয়ে গেছে। সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে, রাতে, ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় কখনো ঘরের আলো জ্বালত না পার্থ। কিন্তু গত এক মাস ধরে ঘরের আলো জ্বেলে তারপর বাইরের আলো জ্বালছে পার্থ। পার্থ ঘুম থেকে উঠলে গোটা ফ্ল্যাটের আলো জ্বলে ওঠে। কাকে ভয় পাচ্ছে পার্থ? কেন ভয় পাচ্ছে?

“জানো, রুমেলা, পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্তত এই মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধ্বংসের পিছনে আছি আমরাই। আমার বারবার মনে হয় এই পৃথিবীটা আমাদের উপরে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু কীভাবে তা জানি না। হয়তো পাখিরা আক্রমণ করবে। একদিন দেখব মাটি ফেটে সব সাপেরা শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথবা কুকুরেরা আর মানুষকে ভালোবাসছে না। সমস্ত জন্তুজানোয়ার-পাখিরা ব্যারিকেড করে দিয়েছে। ঘিরে ধরে আমাদের আক্রমণ করছে। ওরা কত সহজেই আত্মহত্যা স্কোয়াড গড়ে তুলতে পারে জানো না। কারণ ওরা মরতে ভয় পায় না। জাটিঙ্গা পাখিদের দেখনি? নিদেনপক্ষে পিঁপড়ের যখন পাখা গজায়, তখন?”

রুমেলাকে জড়িয়ে ধরে এক ছুটির গোধূলিতে বলেছিল পার্থ। রুমেলা বুঝতে পারছিল অবস্থা বেশ ভয়ংকর। পরিচিত ডাক্তার পরিতোষদাকে ফোন করাও হল। কিন্তু পার্থ গেল না।

“তুমি গেলে না কেন ডাক্তারের কাছে? বুঝতে পারছ না তোমার একধরনের অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজর্ডার তৈরি হয়ে গেছে?”

“ওহ্‌ রুমেলা, আমরা বড়ো বেশি অসুখ সম্পর্কে জেনে গেছি। কিন্তু আমরা নিজেরাই অসুখ নয় তো?”

পার্থ, এই ভাবে এবং এইভাবে ক্রমশ নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল যে সে নিছক এক হত্যাকারী ছাড়া আর কিছু নয়। আর এর শাস্তি তাকে পেতেই হবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। কারণ, তার মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির আর মানুষের প্রতি কোনো দয়ামায়া অবশিষ্ট নেই। থাকতে পারে না। এই কথা রুমেলাকে বারবার বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পার্থ বলাই ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ, রুমেলা স্থির করে নিয়েছিল এইসব কথায় আর সে পাত্তাই দেবে না। কথাগুলো যত সত্যই হোক না কেন, তা যদি ক্রমশ তার মনের ভিতরে গেঁড়ে বসে যায়, তাহলে তার পক্ষে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মুশকিল।

ফলে, রুমেলা আর পাত্তা দিত না পার্থর এই সব কথাবার্তায়। পার্থও ক্রমশ একা হয়ে পড়তে শুরু করে নিজের ভিতরে ভিতরে। তার পক্ষে আর কারো সঙ্গে এইসব বিষয়ে আলোচনা করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশ এবং ক্রমশ তার মনে হয় একটি আরশোলা মায় একটি পিঁপড়েও তাকে ঘৃণা করছে। শুধু তাকে নয়, গোটা মানবসমাজকেই ঘৃণা করছে। কিন্তু এক আশ্চর্য লজিক অনুসরণ করে তাকেই বেছে নিয়েছে ঘৃণা প্রকাশের জন্য।

— এইসব তুমি কী লিখেছ পার্থ? সম্পাদক করুণ এবং কিছুটা রাগী চোখে তাকিয়েছিলেন পার্থর দিকে।

সম্পাদক শ্রী তরুণ সামন্ত। তাদের কাগজের সাহিত্যবিভাগের একজন নামজাদা লোক। নিজে ভালো গদ্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার। মানে, একধরনের ফিল গুড ব্যাপার তাঁর লেখার মধ্যে কাজ করায়, তাঁর লেখা বেশ পপুলার। পার্থ যে-দু-চারটে গল্প লিখতে পেরেছে, তার কারণ তরুণবাবুর সাহচর্য। তিনি পার্থকে যথেচ্ছ প্রশ্রয় দিয়েছেন। অবশ্য এও শুনিয়ে বা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি, যে এইসব পরীক্ষামূলক লেখালেখিরও একটা সীমা আছে। গল্প থেকে বেরোতেই পারো তুমি, কিন্তু কাহিনি থেকে বেরিয়ে গেলে চলবে না। ফের তোমাকে ঘুরে আসতে হবে গল্পের ভিতরেই। কারণ, পাঠক শেষ পর্যন্ত একটা নিটোল গল্প চায়।

শেষ পাতা

Categories
গল্প

বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর গল্প

দংশন

মৈনাক খুব আদর করে রুমির মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, ঘেঁটে দিচ্ছিল এদিক ওদিক। এই চুল নষ্ট হয়ে যাবে, এটা করছ কি?

আমি ক-দিন ছুটি নিই রুমি? 

এই তো এতদিন ছুটি নিলে আমার অ্যাক্সিডেন্টের পরে? বেড়াতে যেতে চাও কোথাও?

না, না এমনিই, তুমি বড়ো একা থাকো সারাদিন।

একা কোথায়? এই যে বললাম কুমড়ো পটাশের সঙ্গে কীরকম ভাব হয়েছে আমার! বলতে বলতে থমকে গেল রুমি। মৈনাক, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করোনি? ভাবছ ডিপ্রেশানে পাগল হয়ে যাচ্ছি? নিজের অজান্তেই গলা উঁচুতে চলে গেল, চিঁরে গেল উপরে উঠে। হাতের কাছে কিছু থাকলে ছুঁড়েই দিত বুঝি।

তেমন কিছু করল না রুমি, আবার বললও না শিঞ্জিনির কথা। এরকম ভারী নামের প্রাণীটি আসলে একটা ফড়িং। এত সুন্দর ফড়িং আগে কোনদিন দেখেনি রুমি। তুঁতে রঙের শরীরে কালো রঙ্গের ডানা, হয় না কি এমন? ঠিক মনে হয় তুঁতে পাড়ের কালো তাঁতের শাড়িতে কোনো সুন্দরী মেয়ে। ওর ডানা চালানোর ঝিনঝিন আওয়াজেই হয়তো শিঞ্জিনি নামটা টপ করে মাথায় এসে গেছিল। ফড়িংটা প্রথমে বুঝতেও পারেনি যে, এটা ওরই নাম। এর তো আবার গোল্লা দুটো চোখ ছাড়াও মাথার উপরে তিনটে। তবু যতদূর সম্ভব সব চোখকেই নিজের মায়ায় জড়ানোর চেষ্টায় রুমি ফিসফিস করে ডেকেছিল শিঞ্জিনি, শিঞ্জিনি! বারবার, অনেকবার। আঙুলের ডগায় একদানা চিনি রেখে লোভাতেও চেষ্টা করছিল। এখন রোজ আসে। তার যেমন ইচ্ছে হুকুমও তামিল করছে শিঞ্জিনি। হাতের তালু বাড়িয়ে দিলে সেখানেই বসে পড়ে। রুমির গালের কাছে ঘুরে ঘুরে তার ডানার গান শোনানোর চেষ্টা করে। তারপর রুমি যেই বলে, ব্যাস অনেক হয়েছে তখুনি আবার শান্ত হয়ে হাতের পাতায়। রুমি কি ওকে সত্যিই জাদু করেছে? না হলে আসে কেন রোজ সকাল হলেই? ফুলে ফুলে বসা ভুলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় রুমির সঙ্গে!

এদের কথা মৈনাককে আর বলে না রুমি। এরা তার গোপন ঘর। না হলে মৈনাক সকালে কফি ঢালতে ঢালতে যখন জিজ্ঞেস করল আর কার কার সঙ্গে আলাপ হল তোমার রুমি? কোনো পাখি বন্ধু হয়নি?

শিঞ্জিনির কথা বলেনি রুমি, বলেনি কানাইয়ের কথাও। কানাই একটা কেন্নো, কিন্তু ছোটোবেলায় দেখা কেন্নোগুলোর থেকে একটু আলাদা। গায়ের রং গাঢ় বাদামি, পায়ের রং হলদে মতন। দুটো দাঁড়া আছে। একদিন টেবিলের গা বেয়ে উঠছিল। ছোটোবেলায় কেন্নো দেখলে গা ঘিনঘিন করত রুমির। একবার মা গল্প শুনিয়েছিল কার না কি কানের ফুটো দিয়ে কেন্নো ঢুকে গেছিল আর সেই কেন্নো মাথায় ঢুকে ঘর সংসার পেতেছিল। তারপর বহুদিন রুমি কানে আঙুল চাপা দিয়ে শুয়েছে, সুযোগ পেলেই জুতোর তলায় পিষে মেরেছে পথ চলতি কেন্নোকে। আজ কিন্তু নিজের ক্ষমতা যাচাই করার লোভ সামলাতে পারল না। হুইল চেয়ার থেকে ঝুঁকে নিজের মাথাটা ওর কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করেছিল, এই তুই কে রে? কেন্নোটা চলা থামিয়ে শুঁড় ঘুরিয়েছিল রুমির দিকে। দেখেই রুমির শরীরে এক খুশির ঝিলিক। বুঝতে পারছে! রুমির চোখের দৃষ্টি ছুরির ধার পেল যেন। একা থাকলে মাথার ভাবনারা সরাসরি চোখে পৌঁছে যায় অনায়াসে।

কেন্নো যে এমন করে পোষ মানবে ভাবলেই অবাক হয় রুমি। ওর প্রতিটা কথা বোঝে। আঙুল বাড়িয়ে দিলে সুড়সুড় করে হাতে উঠে আসে। আঙুলে করে চোখের সামনে তুলে আনে ওকে, আমাকে যেন আবার দাঁড়া বসিয়ে দিস না কানাই। নিজের মনেই হেসে খানখান হল রুমি।

বাইরে এসবের কোনো প্রকাশ নেই রুমির।

তুমি আজকাল এত কম কথা বলো, কেন রুমি?

মৈনাকের অস্থির কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করল রুমি। তোমার আর আমার জগৎ যে আলাদা হয়ে গেছে মৈনাক। আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেছ তুমি। যেটা বলল না সেটা হল তুমি চলমান, আর আমি একটা হুইল চেয়ারে বন্দী। তোমার মহান হওয়া মানায়, লোক দেখানো বউ সোহাগ করে বাহবা পাবে। আমার জন্য শুধুই আহা উহু। এ-সব অবশ্য কিছুই বলল না রুমি, ভাবনাগুলো অনেক গভীরে টগবগ করে ফুটল শুধু।

আর ক-দিন রুমি, সেদিন ডাক্তার কী বললেন? তোমার পা সেরে এসেছে একদম। আর মাসখানেক হয়তো, তারপর তোমার প্রস্থেটিক পা লেগে গেলে তুমি আবার আগের মত—

আগের মতো কিছুই হবে না আর, রাত্রে শোবার সময় খুলে রেখেই তো শোব, তাই না?

নিজের অজান্তেই বাঁ-পাটাকে চেয়ারের আড়ালে লুকোনর চেষ্টা করে মৈনাক। আচ্ছা আমি কী করতে পারতাম বলো তো?

আমি কি কিছু বলেছি? তোমার যেমন লিয়ার সঙ্গে কফি শপে বসে গল্প করার করো না বসে। বারণ করেছি?

মানে?

ছন্দাদি আছে মৈনাকের অফিসে, সেদিন ফোন করে কথায় কথায় বলছিল, এই তো সেদিন মৈনাককে দেখলাম সাদা ছুঁড়িটার সঙ্গে কফি খাচ্ছে। ওইভাবেই কথা বলে ছন্দাদি সাদা ছুঁড়ি, কাল্লু ভাই, চিঙ্কি চামকি। আগে সবার সঙ্গে বসে এইরকম কথায় রুমির ঠোঁটে হাসি খেলত না, মনে মনে বিরক্ত হত। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল বোধহয় এই খবরটা দেওয়ার জন্যই ছন্দাদি আরও ফোন করেছে। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, নামও জেনেছিল। লিয়া।

রুমির নৈঃশব্দ্যে আরও রেগে গেল মৈনাক। তুমি কি বাড়িতে বসে বসে এই সবই ভাবছ রুমি? অফিসে কতজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, আগেও বলেছি তো। অফিসের কাফেটারিয়াতেও এমনি অনেক মিটিং থাকে।

চাপা কথার কয়েক ফোঁটা পাথর ঠেলে ছিটকে বেরোল এবার। তোমার বুদ্ধদেবপনাগুলো লিয়া, ক্যাথি আর শর্মিলাদের জন্য তুলে রাখো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার হুইল চেয়ারে বসে থাকার কপাল, থাকব। তাই বলে কৃষ্ণলীলা বন্ধ করতে বলিনি তোমায়।

মৈনাক রুমির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওর বাঁ-হাত রুমির ডান হাঁটুতে, ডান হাত রুমির গালের উপর আলতো করে রাখল মৈনাক। আজকে অফিসের ধড়াচুড়ো চাপায়নি, হাফপ্যান্ট আর টি শার্টে এখনও। তাই ঘাসে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে বসতে তুমি এমন করে? নিজের মনেই বলল রুমি। এরকম গা বাঁচানো আলগা আদর করা সহজ। যার হয়েছে শুধু সেই বোঝে। মৈনাকের আবেগ কিছুতেই উষ্ণ করতে পারছিল না রুমিকে। মৈনাকের সকাল বেলার উপচে পড়া ভালোবাসায় গা রিরি করে রুমির। কই রাত্রে শোবার সময় তো তাকে খুঁজতে আসে না মৈনাকের হাত, বরং সে এগোতে চাইলেও সরে যায়। বলে আরও ক-দিন যাক। আমার পায়ে ব্যথা লেগে যাওয়ার ভয় না হাতি! বোঝে না যেন রুমি। তার চেয়ে বলুক না কেন মুখে, এক পা না থাকা মেয়ের শরীর বিছানায় বিসদৃশ লাগে তার।

আমি কী করলে তুমি খুশি হও রুমি? যতদিন তুমি নিজের পা না পাচ্ছ, আমি বাড়ি থেকে কাজ করি?

হ্যাঁ, নিজের পা! এই উপহাসটা বুকের মধ্যে চেপে মুখে বলল, সে তো করবেই, না হলে আর আমার উপর নজর রাখা হবে কী করে?

মৈনাকের চোখ বিস্ময়ে স্তিমিত হয়ে গেল, একটু কি জলের ছোঁয়া? তাহলে তোমাকে আমি অফিসে পৌঁছে দিই, তুমি আবার অফিস শুরু করো।

আমি ঘণ্টা দুয়েকের বেশি বসে থাকতে পারি না মৈনাক, ক্লান্ত হয়ে পড়ি। না হলে বাড়ি থেকেই অফিস শুরু করতাম। মৈনাকের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রুমি, বেশি তাকালেই ওর মনটা নরম হয়ে যাচ্ছিল। মৈনাক ওর মাথা গুঁজে দিয়েছে রুমির কোলের মধ্যে, ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছিল। ওকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি হয়তো সত্যিই ভালো মৈনাক, আমিই আর পারছি না। এই পৃথিবীটা ঘুরে বেরাচ্ছে, আর আমি স্থবির হয়ে আছি। ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু এ-সব কিছুই না বলে চোখ সরিয়ে নিল রুমি। তখনই দেখল গুটি গুটি পায়ে কানাই আসছে। ঘাস সরিয়ে সরিয়ে টেবিলের পায়া অতিক্রম করে। একটু ঝুঁকে পড়ল রুমি, হাতের পাতা রাখল এবার মৈনাকের মাথায়। আদর বুঝে মৈনাক নিজের মাথাটাকে আরও গুঁজে দিল রুমির কোলের মধ্যে। কেমন অদ্ভূত একটা ঝিলিক এবার রুমির চোখে। ফিসফিস করে বলল, দে কানাই দে।

এমন বাধ্য ছেলে! দিল ঠিক দাঁড়াটা বসিয়ে মৈনাকের পায়ে।

প্রথম পাতা