Categories
কবিতা

বিজয় দে’র কবিতা

সান্ধ্য কবিতাগুচ্ছ

গেস্টাপো

যাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে সেই মিস্টার এক্সকে আমি কি চিনি? এই শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শতাব্দীর ওপার থেকেই যেন উত্তর এল “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয় চেনো”
আমার তো প্রশ্নের শেষ নেই।
“মিস্টার এক্স কি এই দেশেতেই থাকেন? বসবাস করছেন? নাকি অন্য কোনও দেশ থেকে এখানে আসবেন?”
কাটা কাটা উত্তর এল “ তিনি ভূত ও ঈশ্বরের মতো সর্বত্র বিরাজমান। তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি থাকবেন”

“আমি কি ধর্ম ধুয়ে জল খাব?” চায়ের দোকানে বসে যিনি টেবিল চাপড়ে এই কথাটা বললেন, তার উলটোদিকেই আরেকজন, তিনি কিন্তু কথাটা শুনলেন তারপর, খুব শান্ত স্বরেই বললেন “চুপ। চুপ্। মিস্টার এক্স এসব কথা শুনলে খুবই রাগ করবেন, দেয়ালেরও দু-কান আছে। তিনি নিশ্চয় কাছাকাছি কোথাও আছেন”

“একটা পিয়ানোর তার গলায় পেঁচিয়ে যদি সিলিং থেকে আপনাকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, তবে আপনার কীরকম লাগবে? খরচ একেবারে নেই, সময়ও মোটামুটি কম, ধড় থেকে মুন্ডুটা কেটে বেরিয়ে আসতে যেটুকু। বিচ্ছিন্ন হওয়ার, এই ফাঁকে আপনি একটু ছোটোখাটো স্বপ্নও দেখে নিতে পারেন”

তিনি অন্ধকারে আছেন। মুখ দ্যাখা যাচ্ছে না। আমিও আরেক অন্ধকার থেকে এই প্রথম তাকে জিজ্ঞেস করলাম “তাহলে আপনিই মিস্টার এক্স? নাকি অন্য কিছু?
যেন শতাব্দীর ওপারের অন্ধকার থেকে একটি উত্তর ভেসে এল “আমি গেস্টাপো”

সাদা জামা
“একদিন এই বাড়িগুলো সব ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে”

ইদানীং এরকম একটা কথা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে
ম্যুনিসিপ্যালিটির লোকজন এই দিকে আসে। তাদের গায়ে সাদা পোশাক। হাতে সাদা চক

কোনো বাড়ি ভূতগ্রস্ত হলেই তারা নাকি দরোজায় দাগ দিয়ে যাবে

কিন্তু ভূত হবে কী করে? এখানে কেউ ভূত-প্রস্তুত প্রণালী জানে বলে শুনিনি

সকাল-বিকাল ব্যালকনি থেকে সামনের সরু গলিটির দিকে তাকিয়ে থাকি…
ওই, ওই বুঝি ওরা এল

গা শিউরে ওঠে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সজোরে স্ত্রী আমার হাত চেপে রাখে

এতটাই আতঙ্ক যে, সে ঘরের ভেতরের সব সাদা জামা কাপড় কোথাও না
কোথাও লুকিয়ে রাখে

“একটাও সাদা জামা যেন চোখের সামনে না থাকে”

আর আমি মনে মনে আমার সব সাদা জামাকে মৃত বলে ঘোষণা করি

চোপা

আপনি নিজের কবিতার ভেতরে নিজেরই আগাপাশতলা বমি আপনি জমি দখলের লড়াইয়ে একজন চতুর ও সহজ পলাতক
আপনি গর্তে গর্তে যতদূর আপনি ইঁদূরের ভেতরে ইঁদুরও ততদূর আপনি নিজের মৃতদেহের চামড়ায় লেগে থাকা স্বদেশের মানচিত্র

তুমি পুস্তকের একশো চল্লিশ পৃষ্ঠায় লিপ্ত গোপন সংক্রমণ তুমি হাজার মেঘের ভিড়ে একমাত্র মাছের বাজার
তুমি অন্ধকার বটপাতার ওপরে একাকী মূহ্যমান শামুক তুমি সবুজ পূর্ণিমার স্রোতে ভাসমান ভুতুম প্যাঁচার নির্যাস

তুই একটা ভাঙা দোতারা থেকে ছিট্‌কে-পড়া গানের কঙ্কাল তুই একটা কাচের বোতলের ভেতরে নষ্ট চাঁদের কুলকুচি
তুই সমস্ত হর্ষধ্বনির ভেতরে উড়তে থাকা ছাই-সমগ্র তুই দিনান্তে পাখিটোলার ভেতরে ডাহুক-শালিখের ওলাওঠা

অ্যান্টার্কটিকা

এই সুগন্ধ শিশু, সাদা ও সমৃদ্ধ। শিশুটির হাত ছুঁয়ে ফেলতেই সুগন্ধ সাতকাহন
তেঁতুলতলার মাঠ পেরিয়ে খোলাবাজারের দিকে চলে যায়
শিশুটি বলল “চলো তোমাকে একটা ধবধবে সাদা ও শীতল দেশ দেখাই ওখানে
আমি কখনও কখনও স্বর্গের গন্ধ হয়ে বসবাস করি
তখন এক সুদূরের বালক এসে আমার দুই হাতে নতুন নতুন পালক লাগিয়ে দিয়ে
চলে গেল, যেন আমি একটা পাখি। সুগন্ধ আমার পথপ্রদর্শক

এমন যে একটি দেশ আছে, জানতাম না, যেখানে গোটা দেশটাকেই সমাধিক্ষেত্র
মনে হয়। আমি এখানে পৌঁছে দেখি আগেই সুগন্ধ বরফ হয়ে বসে আছে

এতদিন আমি কোনও কথা বলিনি। আজ বললাম “তুমি কি শুধুই শিশু নাকি শুধু
সুগন্ধ নাকি সমাধিক্ষেত্রের চাতালে নিছক এক পাতা বরফ

উত্তর এল “আমিই একমাত্র দেশ, আমি একমাত্র সুগন্ধ, আমি একমাত্র শিশু
এই দেশ থেকে তোমাদের দেশের বাড়ি যেতে আমার মাত্র দেড় মিনিট

গাছবন্দি

গাছ কখনো জামা-কাপড় পরে না। তার কোনো লজ্জাবোধ নেই। গাছকে একদিন পোশাক-আশাকের
দোকানে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে

গাছ কি কখনো ঘেউ ঘেউ করতে পারে? আমি অন্তত শুনিনি। কিন্তু কেউ কেউ নাকি শুনতে পায়। এবং
তাদের কেউ কেউ গভীর রাতে গাছের মুখে জাল গলায় শেকল পরিয়ে দিয়ে আসে

গাছের কিন্তু খুব খিদে আছে। তবে তারা যা খায় সব অনুবাদ করে খায়। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা
চাঁদ বা সূর্য গিলে খেতে পারে না

গাছে গাছে নাকি খুব প্রেম। যারা প্রেমের কবিতা লিখতে পারে না তাদের চিবুক ছুঁয়ে গাছ একটা ছোট্ট মন্ত্র
পড়ে “লেবুপাতা করম চা শরীর চায় গরম চা”। তারপর কবিতা আসে সপ্রেমে

তোমরা কি কেউ তুতুলগাছ চেন? এই একটি গাছ, যার সামনে দাঁড়ালে মন ভালো। না দাঁড়ালেও। মন
খারাপ হলে দু’মিনিট দাঁড়াই; কথা বলি। তুতুলগাছের সাথে মন বিনিময় সব গাছ জানে

আমাকে গাউচ্ছা বলতে পারো কিম্বা গাছুয়া। অসুবিধে নেই। কিন্তু গাছকে কেউ বৃক্ষ বললে গাছ খুব লজ্জা
পায়। আর কেন যে আমার চোখমুখ লাল হয়ে আসে জানি না

টাঙ্কি

— তুমি একটু কুসুমবনে মেঘের ঘনঘটা… এই গানটা গাইতে পারবে?
— আহা, তোর বুকটা এত ফাঁকা ফাঁকা কেন রে? তুই কি অসুখ?
— তোমার মুখটা যেন ঠিক লবণদানি, এবার একটু পানিয়াল হয়ে যাও
— এবার বসন্তে আমরা সব হসন্ত বিসর্জন দিয়ে দেব

ব্যালকনির হুকে একটি নীল তোয়ালে ঝুলছে। ঝুলছে মানে ভেজা তোয়ালেটি
হাওয়ায় শুকোচ্ছে। নীল তোয়ালের লোমে বা পশমে অনেকদিনের ঘুম ও জাগরণ
তাদের গায়েও লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক হাওয়া

উলটোদিকের বারান্দায় একটি লাল রঙের তোয়ালে। তার গায়েও অনেক কথা লেখা। সে
কিন্তু একটু বেশিই বলতে চায়। সেইসব কথার অনেক চোখ আছে। সেইসব চোখের অনেক
মরিয়া দৃষ্টি আছে। সেইসব দৃষ্টি থেকে কুসুম কুসুম অনেক গল্প

আমি ওদের মাঝখানে যেতেই দু-টি তোয়ালে
আকাশের দু-রকম মুখ হয়ে গেল

নীল তোয়ালের বুক থেকে লজ্জ্বা আর
লজ্জ্বার বুক থেকে ব-ফলা খসে গিয়ে উড়ে গেল
লাল তোয়ালের বুকের দিকে

তোয়ালেও মানুষ; আর তোয়ালেকে মানুষ ভেবে
আমার জীবনে যে কত ভুল

কবি যখন

কবি যখন ছবি আঁকে তখন সেটা ট্রামলাইন না হয়ে আর উপায় থাকে না

আমার চোখের সামনে একটি ছবি; কাচ দিয়ে বাঁধানো ট্রামলাইন। চোখের সামনে থেকে
দৃশ্য শুরু হয় তারপর ট্রামলাইন ক্রমশ মিশে যায় দিগন্তের দিকে

ট্রামলাইন দেখতে দেখতে আমার ঘুমে অনেক চাঁদের উদয়, আবার দেখতে দেখতে
অনেক চাঁদের অস্ত। একটা ঘণ্টাধ্বনি টিংটিংটিং চলতে থাকে আমার ঘুমের সঙ্গে

আমাদের জলপাইগুড়িতে শেষে ট্রামলাইন পাতা হয়ে গেল? খবরটা শুনেই আমি রাস্তায়। ট্রামলাইন খুঁজতে আমি
এপথে-সেপথে। একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা আমার পিছে পিছে আসছে

কবি যখন ছবি আঁকে তখন ট্রামলাইন মুছে দেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না

Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

শীতঘুম

বাপ ঠাকুরদার ঠিকুজি কোষ্ঠী নিয়ে ভারত সরকারের পার্লামেন্টে আনা যে-বিলটা তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর অবশেষে পাস হয়ে গেল সেই নিয়ে অনিমেষদের তর্কাতর্কির শেষ ছিল না। গোবলয়ের হিন্দুত্ব, রাডিক্যাল ইসলাম, ভারতবর্ষের পেরিনিয়াল হিন্দু মুসলমান সমস্যা এইসব নিয়ে দুপুরের খাওয়ার টেবিল গরম হয়ে থাকত। একটা ছোটোখাটো গ্রুপ ছিল অনিদের, যাবতীয় প্রলোভন, যুগের মুদ্রাদোষ এইসবের পরেও মাথার কিছু জায়গা খালি থাকত কিংবা বলা যেতে পারে জিনগত ত্রুটির কারণে এইসব অর্বাচীন ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার বদভ্যাস ছিল ওদের। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও ক্রমপাতনশীল অর্থনীতি না কি হিন্দু মুসলমান সমস্যা কোনটা আসল কোনটা বানানো, কোনটা অগ্রাধিকার যোগ্য কোনটা তুচ্ছ, হ্যাঁ বেশ মনে আছে সেই সময় খুব কথা হত এইসব নিয়ে। কিন্তু পরা-বাস্তবতার আভাস সে-সময় বাতাসে একটা কোথাও ছিলই! অনি এসে খাওয়ার টেবিলে সোমকে বলে ‘ব্যাপার মোটেই সুবিধের নয়, অলরেডি ইউরোপ ইনফেক্টেড, ইরান, ইতালি, চীন তো আছেই, এখন শুধু পায়ের নীচের গলিগুলো দিয়ে এখানে ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা, সেটা হলে কিন্তু আমাদের কমপ্লিট মারা যাবে!’ চারপাশে তাকিয়ে হাতের ভঙ্গিতে দেখায় অনি। নকশাল পন্থী যে-দলটা মার্কসবাদী লেনিনবাদী নামে পার্লামেন্টের রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় সোমের বাবা সেই পার্টির হোল টাইমার ছিল। অফিসে এসেছে থেকে অনি দেখেছে সোমও যে-কোনো ব্যাপারে সেই পার্টির ব্যাখ্যাটাই আগে দিত। কিন্তু বিগত এক-দু-বছরে এর পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যক্তিগত কোনো কারণ থাকতে পারে এবং তা হয়তো এমনই যে, তাতে ব্যক্তিগতও হয়ে যেতে পারত, তাই এই পরিবর্তন। এইসব ঠিকই ছিল, ছেচল্লিশের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও তৎপরবর্তী দাঙ্গা, চরম-নরমপন্থী কংগ্রেস, শক্তির সমতুল্যতা এই পর্যন্তও চলছিল, কিন্তু গৈরিক ভারতবর্ষের একপেশে ধারণা নিয়ে একবার তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর থেকে অনিরা সোমেশ্বর ওরফে সোমের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা একটু বুঝেশুঝে করত। ‘আমাদের এখানে তো তেমন প্রভাব পড়বে না বলছে, ওয়েদারের জন্য’— পাশের টেবিল থেকে গলা ভেসে আসে। অনিরা যেখানে খাওয়া দাওয়া করে সেটা ওদের অফিস কমপ্লেক্সের কমনগ্রাউন্ড, ওরা কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করেছে অনেকেরই মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে। অতনুর অফিস পাশেই। অতনুও মাঝে মাঝে খেতে আসে ওদের সঙ্গে, বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে প্রতিদিন দেখা হয়। সেদিন চা খেতে বেরিয়েও ওই একই ছবি।

এর হপ্তা তিনেক পর। বিকেলের শেষ সূর্যের আলোয় অনিমেষ অফিস থেকে সময়ের আগে বেড়িয়ে পড়ে। অতনুর কাউনসেলর বলেছিল রিপ্রেশন নির্জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। এমন কোনো ইচ্ছে যা অবদমিত কিন্তু আপনাকে মাঝে মাঝেই পীড়ন করছে। মানুষের সেইসব শারীরিক ও মানসিক অভিজ্ঞতা না কি অতিদ্বেষাত্মক। নন্দনচর্চার কথা শুনে অনিকে ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘সব কিছুর শেষে দেখবেন একজন কবি বসে থাকেন’, ওঁর কথা নয়। অবাধ যোগসাজশ যদিও বলা যাবে না মানে যাকে ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন বলে, তবে অতনু বলেছিল মালটা পাক্কা চালিয়াত। অফিসপাড়ার মোড় থেকে ট্যাক্সি নিতে নিতে অনির মনে পড়ছিল এই কথাগুলো। সকালবেলা ফোন করে অতনু খবর দেয়, ওদের দলের নাটক আছে সন্ধ্যেবেলা দক্ষিণ কলকাতার একটি হলে। গোড়ার দিকে অনি সব ফ্রি পাসেই দেখতে যেত। কিন্তু ইদানীং অতনু দিনক্ষণ বলে দেয়, অনি টিকিট কেটে যায়। ওই দিন একটু দোনোমনা করে মোবাইল থেকে টিকিট কাটার সময় অনি দেখে পেছন দিকের দুটো রো মাঝখান থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। অনি মাঝামাঝি দেখে দু-দিক থেকে আট নটা চেয়ার ছেড়ে একটা টিকিট কাটে। রুপা আসতে পারবে না, ওঁর এক পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে এরকমই জানিয়েছিল। অনি ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে লোক সব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মনে হয়, দু-চারজন যারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের দেখে রুমাল বের করে মুখে বেঁধে নেয়। হলে অর্ধেকেরও কম লোক, দু-দিকে সিট ফাঁকাই পড়েছিল। নাটক শুরু হওয়ার একটু আগে বাঁ-দিকের শেষ ফাঁকা সিটটায় একজন ভদ্রমহিলা এসে বসেন, মুখ মাস্কে ঢাকা। প্রায়ান্ধকারে বেশ কয়েকবার ওনার সঙ্গে চোখাচোখি হয় অনির। আলো সম্পূর্ণ নিভে যাওয়া ও মঞ্চের পর্দা উত্তোলনের মধ্যে অনি টের পায় ওনার পাশে এসে লোক বসেছে। ব্লাউজের উপরের দুটো হুক খোলা রেণু, যে-দৃশ্যে গলাকাটা ছাগলের মুণ্ডুর মতো ছটফট করতে করতে বিজন ওরফে অতনুকে বলছে, ‘নিক, নিয়ে যাক। আমার আসবাবপত্র সব বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিক ওরা!’ অনির মনে হয়েছিল এবার এই ধরনের চরিত্রে অতনুর অভিনয় বন্ধ করাই ভালো। রুবিকে, সাগরিকা হোটেলের ছাদ থেকে আগের একটি নাটকে যে-দৃশ্যে অতনু মিলোনন্মত্ত বানের শব্দ শোনাচ্ছে, সেই একই অভিব্যক্তি আবারও দেখা গেল এই দৃশ্যে। মানুষ কতদূর পর্যন্ত নীতি মেনে চলবে! নৈতিকতা তাকে যতটা অ্যালাউ করবে ততটাই তো! কিন্তু এর কী শ্রেণি নির্বিশেষে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে! সমস্ত মানসিক সমস্যার একটা মূল জায়গা দেখা যায় ভালোবাসার অভাব। ভালোবাসা নীতি নৈতিকতা মেনে চলে কিন্তু তার রেপ্রেসিভ আউটকাম আছে। এই রেপ্রেসন না থাকলে কিনশিপ তৈরি হত কী! যৌনপ্রেম সভ্যতার কোন পর্যায়ে থাকত তাহলে এতদিনে, কোন পর্যায়েই-বা এখন আছে কেউ কী হলফ করে বলতে পারে! অনি অতনুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর এক্স্যাক্ট অসুবিধেটা কী হয়?’ অতনু পরিষ্কার বলতে পারেনি। অনুমানে অনি বুঝেছিল দীর্ঘক্ষণ গুম মেরে থাকাটা সম্ভবত ওর একটা মানিফেসটেশান। বিরতির আলো জ্বলার পর অনি তাকিয়ে দেখে ভদ্রমহিলা একা বসে আছেন। এরপর আর কারো আসা টের পায়নি অনি। সো-এর পর গ্রিনরুমে যায় অনি। ভালোলাগা, খারাপলাগা, এরম এলোমেলো কিছু কথার মাঝখানে অতনু হঠাৎ অনিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর বিমলদাকে মনে আছে?’ অনি ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে বলে, ‘বিমলদা! মানে, গোর্কির বিমলদা! অবশ্যই মনে আছে, কেন কী ব্যাপার?’ ‘সো-এর আগে ফোন করেছিলেন, ব্যস্ত আছি শুনে ফোন কেটে দিলেন, করে দেখব পরে আবার’। বিমলদার স্মৃতি রোমন্থনের তেমন সুযোগ সেদিন পায়নি অনিরা, আচমকা ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় সবাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে, ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা ক্রস করে উলটো পাড়ে যাওয়ার সময় সেই মহিলাকে অনি অতনু দু-জনেই দেখতে পায় ব্রিজের মাঝখানে, সিক্তবসনা।

এর সপ্তাহ দু-য়েক পর ‘প্যানডেমিক’ শব্দটা প্রায় খিস্তির পর্যায় পুনরুক্ত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। অতনু ও সোমের মোবাইল থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন নিউজ ফিড আসতে থাকে অনির মোবাইলে, অনিও সেগুলি ফরওয়ার্ড করতে থাকে ইতিউতি। সংক্রমণের মরটালিটি সংক্রান্ত আলোচনায় অনি লেখে, ‘মরটালিটির প্রশ্নে এইচ আই ভির কথা মনে এল। যে-রোগ শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে আবধ্য ছিল, আমেরিকাতে আশির দশকে তা প্রায় মহামারির চেহারা নেয়। মরটালিটি রেট অল মোস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এলজিবিটি কমিউনিটিকে আইসোলেট করা হয় ও মূল অভিযুক্ত ঠাউরে কাঠগড়ায় তোলা হয় সে-সময়’। উত্তরে অতনু লেখে, ‘এতে ওই কমিউনিটির প্রতি পরবর্তীকালে অদ্ভুতভাবে সলিদারিটি বাড়ে, দে বিকেম দ্য পার্ট অফ দ্য সিস্টেম স্লোলি। প্রশ্নটা হল ‘প্যানডেমিক’-এর নাম করে যেভাবে সরকার মানুষের গতিবিধির উপর নজরদারি শুরু করেছে ইভেন বাই ইউজিং মোবাইল অ্যাপ তাতে ইফ উই আর নট কশাস, ইন দ্য ফিউচার ‘প্যানডেমিক’ চলে যাবে তার নিজের নিয়মে একদিন হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে, কিন্তু রাষ্ট্র! স্বৈরতন্ত্র!’ মৌনতা সন্মতির লক্ষণ মানে অনি। এর দু-একদিন বাদে ওদের পুরানো বাড়ির দরজার সামনে বাইকে বসা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ওকে জিজ্ঞেস করে ‘১১/সি-টা কোনটা হবে?’ মুখে বাধ্যতামূলক মাস্ক ও হাতে গ্লাভস, অনি হাত দেখিয়ে দূরের একটা বাড়ি দেখিয়ে দেয়, বিষ্ণুদের বাড়ি। লোকটা চলে গেলে, উলটো দিকের ব্যালকনি থেকে রাশভারী গলা শোনা যায়, ’বাইরে থেকে ফিরেছে মনে হচ্ছে?’। দূর থেকে সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে, বেচারা প্রসন্য নায়েবকে যেন বিশ্বম্ভর জিজ্ঞেস করছেন, ‘বন্দে আলির সানাই না?’ অনি ঘরে ঢুকে যায়।

এই বিষ্ণু এক অর্থে ওর ছোটোবেলার বন্ধু। যা হয় বড়ো হয়ে যাওয়ার পর বন্ধু থাকে কিন্তু বন্ধুত্ব থাকে না। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার, অতি শীর্ণকায় চেহারা, পাজামা পরত কোমরে গার্ডার দিয়ে, অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত অন্তর্বাস পরত না অনিরা লক্ষ করেছে। একবার একমাত্র সন্ধ্যার শুকতারাকে সাক্ষী রেখে এই ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। প্রায় কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর জটলার মাঝখানে আচমকা প্রেতের আগমন, বাড়ির পেছন দিকের সেফটি ট্যাঙ্কের উপর এতক্ষণ বসে ছিল! উলটো দিকের বাড়ির স্নেহশীলা অবিবাহিত যে-দিদির বাড়িতে অন্তর্বাসহীন বিষ্ণুর অবাধ যাতায়াত ছিল, তিনি চোখের জল মুছে স্নেহে ওকে বুকে টেনে নেন। বাবা মায়ের মুখে ফ্লুরোসেন্ট জ্বেলে এ-ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যায় চাকরির সুবাদে। সম্ভবত এই ভোরে বাধ্যতামূলক চোদ্দ দিনের কোয়ারেন্টিইন সেন্টারকে এড়িয়ে নিরপরাধী বিষ্ণু পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি চলে আসে, তাই এই শিকারির আগমন। প্রশাসন একটিভ তাহলে, পাড়ার লোক খবর দেয় পুলিশ এসে মা ছেলে দু-জনকেই তৈরি হতে বলে গেছে, নাইসেড টেস্টের জন্য যেতে হবে সম্ভবত, বাবা আগেই মারা গেছেন। ‘এদেরকে শিক্ষিত বলে! কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই সোজা বাড়ি চলে এসেছে!’— পাশের বাড়ির গলা। পুলিশ আবার আসে, কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অনি বারান্দায় গিয়ে দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সি ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিকে চলে যাচ্ছে, ভিতরে নিরাপদ দূরত্বে বিষ্ণু আর ওর মা বসে আছেন, মুখে মাস্ক, অনি হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে রাখে, পুলিশের বাইকটা উলটো দিকের রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যায়। অনির মনে পড়ে বিষ্ণুর ঠাকুমা বেঁচে থাকাকালীন মাছ তো দূরস্থান, বিধবা ছিলেন, পেঁয়াজ রসুনও খেতেন না, এমনকী যে-জায়গায় বসে একবার আমিষ ভোজন হয়েছে জ্ঞানত তিনি সেই স্থানে গিয়ে কখনো বসতেন না। মানুষ রোগ থেকে রুগীকে কি কোনোদিনও আলাদা করতে পেরেছে, পাপ থেকে পাপী যেমন! অনি ঘরে এসে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।

এরই কিছুদিন আগে অনিদের অফিস বন্ধ হয়ে যায়। অতনুদেরও। বাড়ি থেকে কাজ, অতনুদের নয় অবশ্য। এর মধ্যে ফোনে সোমের সঙ্গে অনির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের এবং সোমের রাজনৈতিক তরজা অনির মাথা ধরিয়ে দিয়েছিল। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, রেমডিসিভির সোম জানিয়েছিল, কিছু উন্নতির কেস দেখা যাওয়াতে, ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। রেমডিসিভির না কি ভাইরাল শেডিংটাকে কমাতে সক্ষম। অনি জানায় মার্কিনদেশে সংক্রমণ সব থেকে বেশি হওয়ায় সিনিয়র সিটিজেন না হলে হাসপাতালে ভর্তি নিতে চাইছে না, লক্ষণ লঘু হলে তো আরওই নয়। অতনুর এক দিদি জামাইবাবু ওখানকার ডাক্তার, দু-জনেই সংক্রমিত কিন্তু বয়স কম বলে হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। ওনারা বাড়িতেই নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করেন, গোড়ায় ক্লোরোকুইন খেয়ে ওদের বমি শুরু হয়। এখন দু-জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। এই লকডাউনের মধ্যে অতনু একদিন ফোনে জানায় ওদের নাটকের দলগুলির যে-এসোসিয়েসান আছে তার বাইরে অতনুরা একটা ফান্ড তৈরি করেছে টেকনিশিয়ান ও প্রতিদিন অভিনয় করে যারা সংসার চালায় তাদের জন্য। বিমলের কথা ওঠে এই সূত্রে আবার, স্কুলের মাস্টারির বাইরে সখে থিয়েটারে অভিনয় ও ফিল্ম ক্লাব এইসব করে বেড়াতেন। এরকম বিচিত্র মানুষ অনিরা জীবনে খুব বেশি দেখেনি। ভীষণ সমস্যাশঙ্কুল জীবন কিন্তু এমন একটা অনড় ভাব ছিল, আদিরস মিশ্রিত মুখের ভাষা কিঞ্চিৎ প্রগলভতায় ভরা, অদ্ভুত ভঙ্গি কিন্তু কথার মধ্যে পারস্পেকটিভ পাওয়া যেত নানা ধরনের। স্কুলের মাস্টারমশাই হিসেবে একেবারেই ভাবা যেত না। কলকাতায় থাকতেন হেদোর কাছে, পুরানো বাড়ি ছিল নদিয়া জেলায়, রানাঘাটের কাছে। অনিদের সাথে প্রথম দেখা দু-হাজার সালের আশেপাশে। সম্ভবত গোর্কি সদনের মাসিক সিনেমা প্রদর্শনীতে। ডিসিকার বাইসাইকেল থিফ দেখার শেষে। ছবি শেষ হলে, অনিরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দীর্ঘকায় মৃণাল সেন কৌতূহলী ও নাছোড় বিমলকে বলছেন, ‘ভাবতে পারেন এ-ছবি চল্লিশের দশকে বানানো, আজও দেখলে মনে হয় এই কালকে বানানো হয়েছে!’ শোনা কথার মধ্যে যখন আকাঙ্ক্ষিত কথা থাকে তখন কথায় কথা বাড়ে। মৃণাল সেন তাঁর সাগরেদ সমেত হাঁটা দিলে বাইরে চা খেতে এসে অনিরা দেখে বিমল মৃণাল সেনের চেনা কেউ নন এবং প্রায় বিনা পরিচয়েই ওদের বলছে, ‘মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কোথাও শুনেছ অপমানে বাপ ছেলে একসঙ্গে কেঁদে ভাসাচ্ছে! এ শুধু শালা নিম্নবিত্তেরই বারমাস্যা, পৃথিবীর যেখানে যাও! আমার জানতে ইচ্ছে করে এ-ঘটনা ওঁর ছেলের জীবনেও ঘটবে কি না!’ এর মাসখানেক পরে, পরের বছর হবে হয়তো, নাম মনে নেই, ইতালির ছবি, অতনু বলে, ‘পার্সোনাল সিনেমা বলে যদি কিছু থেকে থাকে এ একেবারে তাই, একজন মানুষের অবসেসন, তার পায়ুকাম, পৃথুলা রমণীদের প্রতি আকর্ষণ এ-সব কি কোনো এস্থেটিক্স এনে দিতে পারে? কোন অ্যালকেমির জন্য লোকে এ আবার দেখতে চাইবে!’ অনিমেষ ভাবতে থাকে।

উল্লাসের হাসি-মাখা অরুণ অধর
গোপ-সীমন্তিনী-গণে চুম্বে নিরন্তর।
আলিঙ্গনে আমোদিনী নিতম্বিনী-দল,
তিমির অঙ্গের মণি করে ঝলমল।
বিশাল বক্ষেতে কিবা বিমর্দ্দিত আজি
গোপ-নিতম্বিনী-গণ-উচ্চ-কুচ-রাজি।

আমার তো এই মনে এল, এর জন্য আবার দেখব কী?’ বারোশো শতকে লেখা জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে আবৃত্তি করে শোনায় বিমল। রসময় দাস নয়, শ্রী শরচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রণীত ও প্রকাশিত গীতগোবিন্দের এই বাংলা পদ্যানুবাদটি বিমলের কাছে আছে। আজ যা রেপ্রেসেড হয় ক্ষমতার নৈতিক অনুশাসনে কাল তা আকুপাকু করে নতুন চেহারায় ফিরে আসে, সাবভারসানের চেহারা নিয়ে, ক্ষমতার অলিন্দে অন্তর্ঘাত ঘটানোর অভিপ্রায়। বিমল চুকচুক করে চায়ে চুমুক দেয় আর চোখ পিটপিট করতে থাকে, পয়সা মেটায় প্রতিবারের মতো অনিরা। ‘তোমার বাড়ি যেন কোথায় বলেছিলে?’, অতনু উত্তর দেয়, ‘রানাঘাট’। ‘রানাঘাট টকিজের পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা এঁকবেঁকে চূর্ণীর দিকে চলে গেছে ওই দিকে একসময় নিয়মিত যেতে হয়েছে বুঝলে’। মানুষের কিছু অনিবার্য অসহায়তা থাকে, যা ক্রমউন্মোচিত হতে থাকে প্রকাশের আধার পেলে। জ্যান্ত পুড়ে যাওয়ার আগে প্লেগাক্রান্ত মেয়েটির আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে পরিচালক জানতে চেয়েছিলেন, ‘ইস ইট দ্য আঙ্গেলস ওর গড ওর স্যাটান ওর জাস্ট এম্পটিনেস, হু উইল টেক কেয়ার অফ দ্যাট চাইলড?’ দ্য সেভেন্থ সীল ছবিতে, এ-দেশের মানুষ এই প্রশ্ন করার অবকাশই পায় না। সেই দিনের ও পরের দিনের বেঁচে থাকা, ব্যাধি, অপমান, কোটি কোটি মানুষের অবমানবের জীবন, তাদের জন্মান্তরের অশান্তি দিতে পারে কেবল, তার চাইতে মরনোত্তর সেটেলমেন্টের সেমিটিক ভাবনা এখন মনে হয় অনেক বেশি ভালো বোঝাপড়া, এই সন্দর্ভ তৈরি করে বিমল অনিদের সঙ্গে সেই দিন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পরপর শ্লেষ্মা দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে বিমলের, সেই সময়ই এই ডাক্তার সেই ডাক্তার ঘুরে অবশেষে যৌবনের অনিবার্য টানে রানাঘাটে আসা শুরু হয়। চম্পার সঙ্গে প্রেম তার আগে থেকেই ছিল। গোঁড়ায় কিছু না জানালেও একদিন খয়েরি রক্তের ছাপ দেখে ও চাপা কাশির দমক দেখে বিমলকে চুমু খেতে বাধা দেয় পয়োধরা চম্পা। বিমল জোর করে চুমু খায়, উপরন্তু স্তনে মুখ দেয়। এর পরেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। সম্পর্কে সম্পূর্ণ ছেদ ঘটার আগে চম্পার বাবা চেয়েছিলেন দৈবক্রমে পাওয়া এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিমলের গায়ে অসন্মান স্থায়ীভাবে লেপে দিতে। বিমলকে কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় চূর্ণীর শেষ মাথার গলির ডাক্তারের কাছে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বিমলকে ভর্তি করে দেওয়া হয় ধুবুলিয়ার টিবি হাসপাতালে। এই শোকে বিমলের বাবার একটা ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়, দু-একদিন বাদেই উনি মারা যান। ‘সেই সময়ের কথা, ষাটের দশকের শুরুর দিক, স্ত্রেপটোমাইসিন দেওয়া শুরু হয়েছে কিন্তু ফুল প্রুফ নয়, আর ভরসা সেই চিরাচরিত রোদ্দুরের আলো আর ট্যাঁকের জোর থাকলে পশ্চিমে গিয়ে মাসের পর মাস ভালো জল হাওয়া খাওয়া আর শরীরে এন্তার রোদ লাগান।’ — অনর্গল বমনক্রিয়ার মতো, অনিদের কথাগুলো বলে যায় বিমল। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে বিমল জানতে পারে ফিমেল ওয়ার্ডে চম্পা ভর্তি হয়েছে। দাদা এসে বিমলকে বলে যায় ওর সঙ্গে দেখা করার কোনোরকম চেষ্টা না করতে। দুই বাড়ির মধ্যে অশান্তি প্রায় হুমকি হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিমলকে প্রায় দু-বছর থাকতে হয়েছিল ধুবুলিয়াতে। স্ত্রেপটোমাইসিন কাজে আসে, বিমল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু চম্পা, বিমল ছাড়া পাওয়ার বছরখানেক বাদে মারা যায়। সুস্থ হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত তীব্র মাথা ঘোরা ও বমি ছিল বিমলের নিত্তসঙ্গী। মা দাদারা বিমলকে আর পড়াশুনো করতে দিতে চায়না, পেয়ারাপাড়া গ্রামে ওদের যে জমিজায়গা ছিল তাই দেখাশুনো করতে বলে। তথাপি দু-বছরের ব্যবধানে বিমল এসে ভর্তি হয় উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি বিভাগে। পিজি বিএড দু-টিই শেষ করে অবশেষে চাকরি নেয় স্কুলে। এরই মধ্যে একদিন পেছন থেকে বিমল ভেবে ভুল করে ওর দাদার উপর কিছু লোক চড়াও হয়, কিঞ্চিৎ হাতাহাতির মধ্যেই ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটে যায়, তাই পুনরায় পড়াশুনো করার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও কলকাতায় চলে আসার বা বলা ভালো বাড়ির লোকের পাঠানোর পিছনে আর একটা কারণ ছিল পূর্বের প্রেম ও অশান্তির আবহ থেকে বিমলকে দূরে সরিয়ে রাখা। মেয়ে ও মদের নেশা বিমলের অল্পবিস্তর থেকেই যায়। বিয়ে করে, একটি মেয়েও হয়। সখে থিয়েটারে অভিনয় এর কিছু কাল পরে শুরু হয়, নব্বই-এর দশক থেকে ফিল্ম ক্লাব, থিয়েটার ছেড়ে দিলেও ফিল্ম ক্লাবে যাতায়াত অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। গত দশকের মাঝামাঝি বেশ কিছু দিনের অ্যাবসেন্সে একদিন বিমলের এসএমএস পায় অতনু। লেখা ছিল, ‘অতনু— ১৫/০৪/২০০৬, ৭:০০ পিএম— ৯:০০ পিএম, সাডেনলি, অকারড ৩-৪ টিএসএফ ব্লাড উইথ কাফ (৫৪ ইয়ার্স এগো ১৯৬২-৬৪ ইয়ার: কেএসআর–ধুবুলিয়া–ক্রি–সদর–এমসিএইছ), মেডিক্যাল কলেজ ইমারজেনসি ডায়গনোনসিস: হেমপটিসিস (পাস্ট হিস্ট্রি + টুডে— সিমস সেম: আই ই: নরমাল); সোয়ালিং অফ ফিট; বিপি— ১২৫/৭৫; নেক্সট চেকআপ: আফটার ওয়ান উইক;’।

শেষ পাতা

Categories
গল্প

সেলিম মণ্ডলের গল্প

হাতটি

আকাশে একটিও তারা নেই। গুমোট। বৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আকাশের কি ভালো লাগে এত ভারী মেঘ বয়ে বেড়াতে? আকাশভারী মেঘের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়— অন্ধকার আকাশটা এখুনি ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে চেপে মারবে। কতদিন কিছু লেখা হয় না! পড়াতেও মনোযোগ বসে না। কতদিন নতুন উপন্যাস পড়িনি! বিছানায় নেরুদার প্রশ্নপুঁথি, মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্যসংগ্রহের প্রথম খণ্ড, উৎপলের কবিতা সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড ছড়িয়ে… কোনোটি দু-পাতা পড়ব তার ইচ্ছেও হচ্ছে না। বালিশের পাশে একটা ডায়েরি ও লাল কালো দু-খানা কলম পড়ে। ডায়েরিতে লিখি না। কাটাকুটি করি। নিজেকে যখন ভীষণ একা লাগে ওই ডায়েরির পাতায় অজস্র বক্ররেখা টানি। তারপর মুখগুলো মিলিয়ে দিই। আজ কিছুই ইচ্ছে করছে না। ল্যাপটপটা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ করে রেখেছি। স্পিকারটাও অফ। খেয়েছিও অনেকটা দেরিতে। রাতে খাওয়ার সময় একমাত্র টিভির ঘরে ঢুকি। খেতে খেতে খবরের চ্যানেলগুলো স্ক্রল করি। চ্যানেলগুলো বড্ড বোরিং। এই বিপর্যয়ে মানুষজনের কী অবস্থা তা যত না খবর করে তার থেকে বেশি খবর করে এ-সরকার কী করছে, ও-সরকার কী করছে! কোন সেলেব্রটি পেগন্যান্ট! গঙ্গায় তিমি ভাসছে!

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, মাথায় কী সব উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরছে—

তারাদের কি অভিমান হয়?

ধারে কেনা যায় কি তারার ছটফটানি?

তারাদের বিয়েতে কি চাঁদের নিমন্ত্রণ থাকে?

হঠাৎ, মনে হল পিছন থেকে কেউ একজন ঘাড়ে হাত রাখল। আমি একটুও চমকে গেলাম না। পিছন ফিরেও তাকালাম না। আমি আগের মতোই আছি। ছোটোবেলা থেকেই ঘাড় ধরতে পছন্দ করি। কেউ ঘাড়ে হাত রাখলেও ভালো লাগে। প্রেমিকার সঙ্গে যখন বেরোতাম, হাত না ধরে ঘাড় ধরতাম।

আজ আমার ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। লাইট অফ। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। অন্ধকার আকাশে কিছুই দেখা যায় না। না-দেখাটাও অনেক সময় আনন্দের। আমরা যত না দেখব, পৃথিবী বোধহয় ততই রহস্যময় সুন্দর।

হাতটি আস্তে আস্তে আরও চাপ দিয়ে স্পর্শ করছে। আমার মন্দ লাগছে না। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। এত রাতে আমার ঘরে কেউ আসবে না। আসলেও এভাবে আচমকা এসে ঘাড়ে হাত দেবে না। কিন্তু এ-নিয়ে আমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতাই নেই। একইরকমভাবে আকাশ দেখছি তো দেখছিই। ঘড়ির ব্যাটারি বহুদিন শেষ হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যে কেনাও হয়নি। সত্যি বলতে আজকাল ঘড়ি দেখার প্রয়োজনই হয় না। সারাক্ষণ হাতের কাছে মোবাইল থাকে। কিন্তু এখন মোবাইল কোথায় আছে জানি না। অন্ধকারে খুঁজে পাওয়াও যাবে না। মা, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে, বেশি রাত করবি না। এখন ক-টা বাজে আমার আইডিয়া নেই। রাতে খেয়েছি তাও ঘণ্টা ৩-৪ হবে। সেই সূত্রে অন্তত ২টো বা ৩টে বাজে। ঘুম আসছে না। এবার ঘুমোতে যাওয়া দরকার। আমি অনুভব করলাম ঘাড় থেকে হাতটি সরে গেছে। আকাশেও যেন মেঘের ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটি তারা। হতেও পারে দূরের কোনো জোনাকি। আমি মাঝে মধ্যেই তারার সঙ্গে জোনাকি গুলিয়ে ফেলি।

ঢক ঢক করে কয়েক গ্লাস জল খেয়ে, মোবাইলটাও খুঁজতে লাগলাম। পেলাম না। বোধহয় টিভির ঘরে রেখে এসেছি। খাটের একপাশেই কোনোরকমে বইয়ের ওপর বই চাপিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিলাম। এই বিরক্তিকর কাজ আমাকে একটি কারণে করতে হয়। যাতে মায়ের বকা না খেতে হয়।

সঠিক ক-টা বাজে, এখনও জানি না। অন্যান্য দিন শোবার সময় মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। মশারির মধ্যে চুপচাপ আছি। ঘুম আসছে না। আমার ঘরটাই মনে হচ্ছে আকাশ। একটাও তারা নেই। গুমোট। খালি ফ্যানের হাওয়ায় অল্প অল্প মশারির নড়াচড়া টের পাচ্ছি। একটা সময় আমার ঘুম নিয়ে অহংকার ছিল। বিছানায় পড়লেই ঘুমিয়ে যেতাম। আজকাল কী হয়েছে, শুলেও ঘুম আসে না। ঘুম আসে, আবার ভেঙে যায়। এখন আমি ঘরের মধ্যেই আকাশ দেখছি। কখন তারারা আসবে অপেক্ষা করছি।

এর মধ্যে একটা কালো বিড়াল এসে জানালার ধারে কুৎসিতভাবে ডাকছে। জানালার একটা পাল্লা খোলা। তা দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বলতে— তার উজ্জ্বল দু-টি চোখ। এত তীব্র আলো মনে হচ্ছে এই তো দু-টি তারা জ্বলছে আকাশে। কিন্তু ওই ডাকটা আরও পাগল করে তুলছে। কিছুক্ষণ পর বিড়ালটা নিজেই চলে গেল।

চোখটা আস্তে আস্তে একটু ভার লাগছে। চুপচাপ আছি। আকাশটা আরও ঝাপসা হয়ে আসছে। পাশ ফিরে কোনোরকম চোখটা বুজলাম। আবার যেন পিঠে কারো হাত স্পর্শ করল। কিছুই বললাম না। এবার সে নিজে থেকেই বলল, তারাদের দেখা পাবে না। আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই কণ্ঠস্বর আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

— কথা বলো।

— আজ তুমি চলে যাও। চলে যাও প্লিজ।

— তুমি তারাদের দেখা পাবে না। দেখো, আকাশ থেকে ওই অন্ধকারে ঝরে পড়ছে রক্ত। টের পাও, ওই রক্ত কাদের? শুনতে পাও কি কোনো আর্তনাদ।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। ফ্যান চলছে। ঘরের দরজা বন্ধ, পাশের ঘর অবধি শব্দ হয়তো পৌঁছায়নি। তবে কোনোরকমে নিজে সামলে বললাম, আজ তুমি চলে যাও, প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। পাশের ঘরে কিছুক্ষণ আগেই বাবার কাশির আওয়াজ পেয়েছি। জেগে যেতে পারে। ও নাছোড়। কিছুতেই যাবে না। মাথায় হাত বোলাতে থাকে আর বলে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও। মাথায় হাত বোলাতে থাকে, মাঝে মাঝে কপালে চুমু খায়। এই আদর আমার সহ্য হচ্ছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে। আমার কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে উঠছি। রাতের পর রাত ঘুম নেই। কিছু সহ্য হচ্ছে না। গভীর রাতে স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে না। অন্ধকার গুমোট আকাশে তারা খুঁজছি!

যেভাবে হোক একে তাড়াতে হবে। না হলে আমি আরও পাগল হয়ে যাব। চিৎকার করে উঠব। কয়েকবার ঘুরে লাথি মারলাম। তার কিছুই যেন হল না। একইভাবে আমার পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। আজ রাতে আমার সঙ্গে থাকবে। গল্প করতে চায়। বিরক্ত হচ্ছি বলে চুপচাপ গায়ের গন্ধ নেবে। মাথায় হাত বোলাবে। কিন্তু সে যাবে না…

হঠাৎ, একটা শব্দ কানে এল। গেট খোলার শব্দ। একটু স্বস্তি পেলাম। মা বোধহয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠেছে। আমার ঘরে আলো জ্বললে মা এসে দেখে যায়। আজ অন্ধকার। আসার প্রশ্নই নেই। মা-কে কি ডাকব? এত বিরক্ত লাগছে কেন? মা এসে কি একে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে? আমি কি সত্যিই চাই, একে দূর দূর করতে? আজ তো প্রথম নয়, তাহলে কেন বারবার সে আসে?

কিছুক্ষণ পর আবার দু-বার আওয়াজ পেলাম। একবার বাইরের গেট লাগানোর, আরেকবার আরেকবার শোবার ঘরের সিটকানি মারার।

— তুই কি যাবি বাল?

— আমি তোমার কি ক্ষতি করছি? ঘুম পাড়িয়েই তো দিচ্ছি।

— দ্যাখ, বাল; তোর এই আদর আমি চাই না।

— তাহলে জানালার ধারে গিয়ে কেন, কেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলে?

— তা তোর কী?

— তুমি, তারার দ্যাখা চাও। অথচ, তারা তোমার কাছে এলে তাকে দূর ছাই করো।

— আমি তোর মতো তারা চাই না। নীল আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা দেখতে চাই।

— যে-আকাশে তুমিই মেঘ ঘনিয়ে আনলে সেই আকাশেই তারা দেখবে? আর যে-রাতে অন্ধকার তারাদের গিলে নেয়, সেই রাতকে, না তারাকে; তুমি বিশ্বাস করো না?

তুই তোকারি পর্যায়ের তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। আমি পাশ ফিরে একইরকমভাবেই শুয়ে আছি। ও মাথায় যতই হাত বুলিয়ে দিক, কিছুতেই ঘুম ধরে না।

ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীরটা আগের চেয়ে অনেকটা হালকা লাগছে। ঘরটা আগের মতো অতটা অন্ধকার নয়। জানালার একটা পাল্লা দিয়ে অল্প অল্প আলো ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল হবে। জানালার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে— পাঁচিলে ঝিমোচ্ছে একটা পাখি। ও কি আমায় সারারাত পাহারা দিচ্ছিল? পাশেই নারকেল গাছ। প্রতিদিন কত পাখি ওর পাতায় বসে খেলা করে। পেচ্ছাপের বেগ পেয়েছে কিন্তু বালিশ ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই। তিনরাত টানা ঘুম নেই। হাতের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি গতকাল। ঘুম এতই গভীর ছিল কিছুই টের পাইনি। মাথার পাশেই পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র। মা এসে কোনোরকমে লাইট অফ করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। তবে আমার ডায়েরির একটি ছেঁড়া পাতা বুকের ওপর লেপটে ছিল। স্পষ্ট ছিল তার দাগ। মনে হচ্ছিল— সদ্য ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবী…

Categories
গদ্য

রণজিৎ অধিকারীর গদ্য

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ


শুশুনিয়া পাহাড়ের পায়ের কাছে রাস্তা, আর রাস্তার পর থেকেই গ্রাম শুরু হয়েছে। ঢালু রাস্তা নেমে গেছে, রাস্তার দু-দিকেই ছড়িয়ে বাড়ি, এইভাবে কিছু দূর গ্রাম ছাড়িয়ে গেলেই গন্ধেশ্বরী নদী। গ্রীষ্মে প্রায় জল থাকে না, অতি শীর্ণ। এই গ্রামে একবার মাসাধিক কাল ছিলাম এক দরিদ্র মূর্তিশিল্পীর বাড়িতে। শুশুনিয়া পাহাড়ের গা থেকে পাথর কেটে এনে বাড়িতে বাড়িতে এই মূর্তিশিল্প। রোজগারের একটা সহজ শিল্পিত পথ। এখানে অনেক রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পীর বাড়ি ঘুরে ঘুরে তাঁদের কাজ করা দেখেছি বসে বসে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে প্রায় প্রতি ঘর থেকেই পাথর কাটার ঠুকঠুক শব্দ কানে আসবে।

যাঁরা খুব নিপুণ শিল্পী তাঁরা খুব ছোটো ছোটো মূর্তি আর সূক্ষ্ম কাজ করেন।

আমার সংগ্রহে আছে তেমন কিছু মূর্তি। কিন্তু যাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি আমরা তাঁরা শিল্পী হিসেবে তেমন কিছু নন, ভালো করে দেখলে তাঁদের কাজের অনেক ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা।

শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে যেখানে মন্দির আর প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড়, সেখানে তাদের পাতা দোকান। যতটুকু যা বিক্রি।

তো ওঁদের বাড়িতেই দেখেছি মূর্তি তৈরির আগে ছোটো ছোটো করে মাপমতো পাথর কেটে রাখা— তারপর একেকটাতে ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তোলা হয় একেক দেব দেবীর মূর্তি।

মাত্র দুটো ঘর, আর ঘেরা দুয়ার নিয়ে কানু কর্মকারের বাড়িখানা, সামনে বেড়া দেওয়া সামান্য উঠোন। স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে সংসার।

বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঠুকঠুক করে পাথর কাটেন শিল্পী, কিছুক্ষণ পরই একটা মূর্তি হয়ে যায়, স্ত্রী সেটাকে সরিয়ে রাখেন। তেমন সৌখিন কাজ নয় তাঁর।

রাতে একটা ঘরে তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে আমি আর বাবা শুই।

একদিন খুব রাতে ঠুকঠুক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, বিছানা থেকে নেমে দুয়ারের কোণের ছোট্ট কুঠুরিটাতে উঁকি দিই, এত ছোটো যে সেখানে একজন বসে কেবল কাজ করতে পারে, বাকিটা নানা আকারের পাথরে ভরতি।

একটা হ্যারিকেন-এর আলোয় শিল্পী কানু যেন একটা ঘোরের ভেতর ঝুঁকে পড়ে পাথর কাটছেন।

আমিও পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জগতে যেন আর কোথাও কিছু ঘটছে না, খুব দূর থেকে কোনো মাতালের জড়ানো চিৎকার নৈঃশব্দ্যেরই একটা অংশ মনে হয়, আর এখানে ঠুক ঠুক…।

পাথরের টুকরো আর সাদা গুঁড়ো শিল্পীর দু-পায়ের ফাঁকে জমছে। কিছুক্ষণ পরই মূর্তিটা একটু রূপ পেল, ক্রমে শিল্পীর হস্তচালনা আরো সাবধানী হয়ে উঠল।

খুব মগ্ন হয়ে কাজ করছেন তিনি, কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন এক মস্ত বড়ো সাধনা। আরও একটু পরে যখন মূর্তিটা সম্পূর্ণ হয়ে এল, তখন সেই অল্প লালাভ আলোয় দেবী মূর্তি যেন ঝিকমিক করে উঠল। একটু আগে যা ছিল পাথরের টুকরো, তারও আগে পাহাড়ের ভেতর স্তব্ধ জমাট অন্ধ, কোটি কোটি বছর… আজ তার মুক্তি ঘটল। অল্পবয়সী চোখে দেখা সেই দৃশ্য সেই উপলব্ধি আজও আমার কাছে অলৌকিক।

সেই জ্যোতিতে ভরে যাওয়া মলিন কুঠুরি, সেই মুহূর্ত আমি কখনো ভুলব না। দিনের আলোয় পরে ওই মূর্তি দেখে হতাশই হয়েছি। ত্রুটি ধরা পড়ে যে-চড়া বাস্তবের আলোয়, সেই বাস্তবই তো আমাদের জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যায়, তার থেকে মুক্তি নেই। তবু একেকটি দিনের উদ্ভাস অবাস্তব সুন্দর হয়ে থেকে যায় মনে।


শুশুনিয়া গ্রামের এক দিকে পাহাড়, উলটো দিকে গন্ধেশ্বরী নদী। সন্ধ্যের আগে আগে বাবার সঙ্গে নদীর দিকে নেমে যাই। নদীর দিকটাতে বেশ কয়েকটি বড়ো পুকুর। বিকেলের দিকে যাতায়াতের পথে দেখেছি— পুকুরের একদিকে নারীরা স্নানের জন্য ব্যবহার করে, কিছু দূরে পুরুষেরা। আমাদের যাতায়াতের পথে স্নানের জায়গাগুলো পড়ে। আর এখন বিকেলের পর মহিলাদের ভিড় জমে পুকুরে। উঁচু আলপথ দিয়ে আমি একটু আগে আগে চলেছি। বাবা বেশ পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেনই-বা আমি সেদিন অতখানি এগিয়ে গিয়েছিলাম এতদিন পর আর বলা সম্ভব নয়। মনে কোনো পাপচিন্তা ছিল!—

মনের অন্য দিকটা আজও তা মানতে চায় না। স্নানরতা নারীকে দেখার অনীহা সাধুতার পর্যায়ে পড়ে, আর আমি সাধু নই। সামনের ঝোপটা পেরোলেই পুকুর, সমবেত নারীদের হাসি আর কথার শব্দ আসছে।

তবে আমি যে অন্যমনস্ক ছিলাম— সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আলপথ থেকে নীচে নেমে কিছুটা জমি পেরিয়েই পুকুরপাড়। পা-টা নামাতে গিয়েই চকিতে তুলে নিলাম আর স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে, শ্বাস বন্ধ করে আমি দাঁড়িয়ে— ফণা তুলে যে আমার সামনে— অত বড়ো বিষধর কি জীবনে আর কখনো দেখেছি?

বাবা এখনও কেন আসছে না! এত কান্না পাচ্ছে।

আর কখনো একা একা এভাবে এগিয়ে আসব না। পুকুর থেকে উঠে একজন প্রৌঢ়া এদিকে পা বাড়াতেই ফণা নামিয়ে সে চলে গেল। আমি তখনও দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করিনি।— কী হল? চলো। আমি ভয়ে ভয়ে ঘটনাটির কথা বলতেই বাবা বলল— তোমার মনের মধ্যে কোনো কুচিন্তা ছিল। এসো।— বলেই বাবা এগিয়ে গেল।

আমি কিচ্ছু না বলে চুপচাপ বাবার পেছনে চলতে লাগলাম। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে।

বাকি পথ, এমনকী নদী থেকে ফেরার পথেও বাবা এ-বিষয়ে আর একটি কথাও বলল না। কিন্তু তারপর থেকে যখনই বাবার সামনে যাই, মনে হয় আমার যা কিছু গোপন ভাবনা তার সবকিছুই বাবা স্পষ্ট পড়ে নিতে পারছে।


বর্ষায় শালবনের সে এক রূপ হয়। বেলপাহাড়ি পেরোলেই বৃষ্টিভেজা শালপাতার রং মনকে এক সজীবতায় ভরে দেয়। শুধু বাসের জানালার দিকে বসতে পাওয়া চাই, দক্ষিণ-পশ্চিমে তাকিয়ে মন কেমন করে ওঠে— থরে থরে মেঘের মতো পাহাড়ের শিরা। কিছুটা এগিয়ে বাঁ-দিকে রাস্তা গেছে ওদলচূয়ার দিকে— কী নির্জন আর রাস্তার দু-দিকে প্রকৃতির রূপ আশ্চর্য সুন্দর।

ভাবি, ভ্রমণবিলাসী বাঙালি কত কত দূর বেড়াতে যায় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য অথচ বাড়ির কাছে ওদলচূয়া কাকরাঝোড় দলমা পাহাড় অবহেলায় চুপ করে পড়ে থাকে অভিমানে।

যাক, বাঁ-দিকে না বেঁকে সোজা রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে নেমে চলে গেছে ভূলাভেদা হয়ে বাঁশপাহাড়ি। বাঁশপাহাড়ি থেকে ঝিলিমিলি খুব কাছে। এইসব অঞ্চলের নিবিড় প্রকৃতির ভেতরে আমি দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছি।

ভূলাভেদার পরের ছোট্ট স্টপেজ তামাজুড়ি, দু-একটা দোকান ছাড়া তখন কিছু ছিল না, তবে বাঁ-দিকে যে-সরু পাথুরে রাস্তাটা ঢুকে গেছে তার দু-দিকে বেশ কিছু বাড়ি।

১৯৯০-৯১ সালে আমার বাবা এই নির্জন শান্ত পরিবেশে একটি আশ্রম গড়ে তোলে। বাবা তার কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে বছরের অনেকটা সময় এখানেই কাটাত।

আমি এই আশ্রমে আসি তারও দু-একবছর পরে।

স্কুলের ছুটি থাকলে আমি এখানে এসেই থাকতাম।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রায় টানা দু-মাস ছিলাম মনে আছে। পরবর্তী কালে আমার মধ্যে যখন ধর্ম বিষয়ে সংশয় দেখা দিতে শুরু করে, উপবীত ত্যাগ করি, তারপর থেকে ওই আশ্রমে আর যাইনি বললেই চলে। কিন্তু সে-সব অনেক পরের কাহিনি।

বাল্যে মনের মধ্যে যখন এ-সব জটিলতা দেখা দেয়নি, সহজ দৃষ্টিতে চারপাশটাকে দেখি ও নির্মল আনন্দ পাই, তখনকার স্মৃতিগুলি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আশ্রমে সারাদিন শিষ্যদের আনাগোনা আর সন্ধ্যেতে কীর্তনের আসর বসে। এই আসরে গানের চেয়ে কথা বা তত্ত্ব আলোচনা হয় বেশি, শিষ্যদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয় বাবা।

ফলে আমার ছুটি, বাজাতে হয় না। সারাদিনই প্রায় আমি লাগামহীন ঘুরে বেড়াই, আশেপাশের গ্রাম, কারুর উঠোনে গিয়ে বসে থাকি দড়ির খাটিয়ায়। কোথাও নির্জন একটা গাছের তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এই সময়গুলোই আমার জীবনকে শান্ত এক তারে বেঁধে দেয়।

একটা ঘটনার কথা বলি। ওইসব অঞ্চলে দেখেছি পুরুষেরা খুব অল্পবয়স থেকেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

এখানে যারাই বাবার শিষ্য হয়েছে, তাদের অধিকাংশই নেশায় আচ্ছন্ন থাকত এককালে, বাবার সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে নেশা থেকে মুক্ত হত।

অবশ্য এমন উদাহরণও আছে যে, কেউ পুনরায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আবার কান্নাকাটি করে নেশা ছাড়ার শপথ করেছে… আবার… আবার।

এদের স্ত্রীদের যন্ত্রণার শেষ থাকত না। স্বামী নেশা করে সারা সারা দিন ঘরে, এদিকে হাঁড়ি চড়ে না। প্রায়ই তারা বাবার কাছে এসে পায়ে পড়ত। কিন্তু এ-সব ক্ষেত্রে বাবাই-বা কী করতে পারে— বুঝতাম না!

কখনো তারা স্বামীকে আশ্রমে আনত, বাবা সারাদিন ধরে তাদের বোঝাত, দেখেছি।

তবে একবার একটা ঘটনায় আমি আশ্চর্য হই, এবং বাবাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করি।

পাশের গ্রাম থেকে একটি রুগ্ন বউ এক সন্ধ্যায় এসে কান্নাকাটি করে বাবার কাছে। বাবা তাকে কথা দেয় যে যাবে তার বাড়ি কোনো একদিন।

দু-একদিন পরেই বাবা সেখানে গেল, এবং আমাকে কোনোমতেই সঙ্গে নিতে চাইল না।

আমি সারা সকাল এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালাম, দুপুরে স্নান করে খেলাম। কিন্তু দুপুর গড়ালে আর ভালো লাগল না। এক শিষ্যের সঙ্গে গেলাম সেখানে।

গিয়ে দেখি, তার ছোট্ট ঘর, সামনেটা ফাঁকা অনেকটা জায়গা। একদিকে অনেকগুলো মহিষ, অন্য দিকে একটা গাছের নীচে খাটিয়ায় বাবা শুয়ে, নীচে একটি লোক চোখ লাল, ইনিয়েবিনিয়ে কী সব বলে চলেছে।

বাবা কিছুক্ষণ পর বলল, তুই যদি নেশা না ছাড়িস এখানেই শুয়ে থাকব, জলগ্রহণও করব না তোর ঘরে।

স্পষ্ট সব কথা মনে নেই, তবে সন্ধ্যের পর আমরা ফিরে আসছিলাম, বাবা চুপচাপ সামনে হেঁটে যাচ্ছিল। বাবার মুখেই পরে শুনেছি, সে না কি নেশা ছেড়ে দিয়েছিল। যদিও অনেকেই পুনরায় আগের জীবনে ফিরে যেত সঙ্গদোষে— এরকম আক্ষেপ করতেও শুনেছি বাবাকে।

ধর্মে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু সেদিন সারাদিন রোদে খাটিয়ায় শুয়ে যে-চেষ্টা বাবা করেছিল, তার সাফল্য ব্যর্থতা মাথায় রেখেও বাবার ওই রূপকে শ্রদ্ধা না করে পারি না। কেন-না নেশা ধ্বংস করে দেয় এক-একটা সংসারকে— নিজের চোখে দেখেছি।


আরেকটি ঘটনার কথা বলি, তাকে দৃশ্য বলাই ভালো— যা আমাকে এক ঝটকায় অনেকটা বড়ো করে দিয়েছিল। যা ছিল এতদিন রহস্য আমার কাছে আর বাল্যের কৌতূহল মাত্র, শরীরে একটা অনুভূতি আনে কিন্তু কুয়াশাচ্ছন্ন হয়েই থেকে যায়— তা হঠাৎই স্পষ্ট প্রকট রহস্যহীন হয়ে ওঠে সেই দৃশ্য দেখবার পর।

একটা সাইকেল জোগাড় করতে পারলেই হল, তামাজুড়ি হয়ে যে-পিচ রাস্তা পশ্চিমে বাঁশপাহাড়ির দিকে চলে গেছে, ওই পথে কয়েক কিমি গেলেই চাকাডোবা। তার একটু আগে ডান দিকে রাস্তা ঢুকেছে, পায়ে চলা পথ, নুড়ি পাথরময় সেই পথে সাইকেল চালানো খুব কঠিন। ঘন জঙ্গল, দূরের কিছু দেখা যায় না।

দিনের বেলাও এত শান্ত চুপচাপ চারিদিক, মনে হয় একটা পাথরে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিই। ওই পথে কিছুটা এগোলেই লালজল পাহাড়। অমন নাম কেন জানি না। পাহাড়ের অনতিদূরে একটি গ্রাম— পাহাড়ে উঠলে পুরো গ্রামটা ছবির মতো স্পষ্ট দেখা যায়। ছোট্ট পাহাড়, যেন বড়ো বড়ো আখাম্বা কালো পাথর এলোমেলোভাবে কেউ সাজিয়ে তুলেছে।

লোকবিশ্বাসের ওপর কথা চলে না। ওই পাহাড়ের গুহায় না কি কোনো সাধু এককালে সাধনা করত। আমি নিজে চোখে দেখেছি— সেই গুহা এত সংকীর্ণ যে, সেখানে বছরের পর বছর কারুর পক্ষে বাস করা অসম্ভব মনে হয়। তার ওপর লম্বা চ্যাটালো পাথরগুলোর বিন্যাস এমন যে, দেখলে মনে হবে এই বুঝি ধ্বসে পড়বে একটু ধাক্কা দিলেই। ভয়ে ভয়ে কতবার উঠেছি, কখনো একা, কখনো সঙ্গে দু-একজন থাকত।

একেবারে ওপরের পাথরটা এমনভাবে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে, যেন একটা বারান্দা। একটু ঢালু কিন্তু বেশ বসা যায়। তাতে যে কত অজস্র প্রেমিক-প্রেমিকার আঁচড়! সবাই নিজেদের প্রেমকে স্থায়ী করতে চেয়েছে তাদের নাম লিখে। কিছু পড়া যায়, কিছু দুর্বোধ্য লিপির মতো, পড়া যায় না।

এর নীচেই একটা পাথর আছে, ওপর থেকে চট করে দেখা যায় না। সেবার একাই গিয়েছি, আনমনে পাথরটার ওপরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাই।

কিন্তু যেন একটা ঘষটানির শব্দ আর ফিসফাস, খুব কাছেই।

কীসের শব্দ বুঝতে না পেরে পাথরের এক প্রান্তে সরে যাই— আর চমকে উঠি। যে-দৃশ্য দেখবার জন্য মন প্রস্তুত ছিল না তেমন কিছু যদি ঘটতে দেখা যায় তাতে মনের যে-অবস্থা হয়, আমার সেই বর্ণনাতীত অবস্থা তখন। সেইসঙ্গে বহুদিন মনের ভেতর জমতে থাকা শরীরী রহস্য— দুটো নগ্ন শরীরের আঁচড়কামড় আর ছন্দোময় ওঠানামায় যেন সেই রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। ওরা তখন ভ্রূক্ষেপহীন, তাদের হুটোপাটিতে যেন আস্ত পাথরটাই ধ্বসে পড়বে অনেক পরে একটা লেখায় পড়েছিলাম, পিকাসো ষোলো বছর বয়সে গুস্তাভ কুর্বে-র আঁকা একটি নগ্ন ছবি (Origin of the World) দেখে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন, আমারও সেই দশা তখন।

একটা যৌনক্রিয়া— যা বালকের দেখা প্রথম যৌনদৃশ্য যে কীভাবে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে তা টের পেয়েছিলাম আমি। বহুদিন পর্যন্ত ওই দৃশ্য আমার মাথাজুড়ে উথাল-পাথাল করত। অমন উন্মুক্ত, অমন উদ্দামতা। যখনই একা থাকতাম তাদের শীৎকারধ্বনিগুলো আমাকে উত্তেজিত করে দিত।

ওই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অমন মুক্ত যৌনতা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে গেছে আজও— এবং তা আমার মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে, অর্গলবদ্ধ অন্ধকার ঘরের ভেতর ঘটে চলা যৌনক্রিয়া কখনো পূর্ণতায় উন্নীত হতে পারে না।

প্রথম পাতা

Categories
গদ্য

রণজিৎ অধিকারীর গদ্য

বাল্যকাল কিংবা এক কাল্পনিক অতিভুজ

কিন্তু হারমোনিয়ামটা গেল কোথায়! মালপত্র নামানোর সময় দেখা গেল বাকি সবই আছে— ডুগি তবলা, খোল, বাঁশির লম্বা ব্যাগ, তার সানাই, আমাদের পোশাক-আশাকের ব্যাগ… শুধু হারমোনিয়াম নেই।

এদিকে গানের আসরের সময় হয়ে এল, এখন উপায়!

গ্রামের নাম মনে নেই, ঝাড়গ্রাম থেকে শিলদা যাওয়ার পথে, শিলদার একটু আগের একটা বাস স্টপে নেমে ডান দিকে জঙ্গল পেরিয়ে কয়েক মাইল ঢুকে এসেছি আমরা। সন্ধ্যের আগে আগে আমাদের মালপত্র আনার জন্য এখান থেকে গোরুর গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। সবকিছু গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা ঝাড়া হাত পা পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছি। বাবা দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আমি একটু আগে আগে। দু-দিকে শালের জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে, আধো জ্যোৎস্নায় সেই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছে বছর পনেরোর চোখ। নুড়িভরা উঁচু নীচু পথে চলতে হোঁচট খেতে হয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর চোখ সয়ে গেলে অসুবিধা হয় না। কথা বলতে বলতে আমরা কখনো গাড়ির চেয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ি, আবার কাছাকাছি হই… বয়স্করা এত কথা বলে কেন?

ওরা দেখে কম, বলে বেশি।

গ্রাম থেকে যে-লোকটি আমাদের আনতে এসেছিলেন, তিনি শোনাচ্ছেন, কেমন ধর্মপ্রাণ তাঁর গ্রাম, কবে কোন কীর্তনীয়া এসে পরপর পনেরো দিন আসর করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শ্রোতারা কেমন মুগ্ধ হয়ে রাত জেগে গান শোনে… দেখবেন আসন ছেড়ে কেউ উঠে যায় না… আপনার গান হবে বলে সকাল থেকে মাইকে প্রচার চলছে। টুকরো টুকরো এমন সব কথাই মনে আছে। অন্তত ২৬-২৭ বছর আগের কথা।

কিন্তু এখন উপায়? বাবার খুব সখের চেঞ্জার হারমোনিয়াম। চেঞ্জার হারমোনিয়ামে কীর্তন গাইতে তখন আর কোনো কীর্তনীয়াকে আমি দেখিনি।

সাধারণত কীর্তনে সিঙ্গল বা ডাবল হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হত। শুধু জুড়ি বা জুড়ি হায়ার রিডের প্রচলন ছিল।

অবশ্য হারমোনিয়াম নিয়ে বাবাকে খুব চিন্তা করতে দেখলাম না। বলল— গ্রামে কোনো হারমোনিয়াম নেই? এনে দিন, তাতেই গান হবে।

পাওয়া গেল কেষ্টযাত্রার দলের একটা সিঙ্গল হারমোনিয়াম।

সারা গ্রাম ভেঙে লোক এসেছিল সেদিন পালাকীর্তন শুনতে। বাবা অনেকবার বলেছে আমাকে যে— সেদিন না কি আমি চমৎকার খোল বাজিয়েছিলাম। অবশ্য ওই বয়সে যা-ই বাজাই শ্রোতারা প্রশংসা করত। পরপর তিন দিন সেখানে আসর হল, তারপর আবার চললাম ফুলকুসমার পথে। কিন্তু সেদিনের সে-হারমোনিয়াম রহস্যের উন্মোচন আজও হয়নি।

এই মধ্যবয়স থেকে যখনই নিজের লম্বিত জীবনের দিকে তাকাই— অবাক হই। কেমন ছিল সেই বাল্যকালের চোখে দেখা জগৎ? আজকে যা দেখি, যেভাবে চারপাশের জগৎ আমার সামনে প্রতিভাত হয়— তা এতটাই আলাদা যে, বুঝি সেইসব দিনের সঙ্গে একটা বড়োসড়ো ফারাক ঘটে গেছে কীভাবে যেন! আমি, আমার দেখা দৃশ্য আর উপলব্ধির। সেদিনের ‘আমি’ থেকে আজকের ‘আমি’ পর্যন্ত যদি একটা রেখা টানা যায় আর সেদিনের ‘আমি’-র থেকে সেইসব দিনের উপলব্ধ জগৎ পর্যন্ত আরেকটা রেখা আঁকি— দুটো রেখা মিলে একটা কোণ তৈরি করে না কি? যত দিন যায় বাল্যে দেখা জগতের সঙ্গে এই আমি-র দূরত্ব বাড়তেই থাকে, যেন একটা ক্রমপ্রসারমান কাল্পনিক অতিভুজ… হায়, কখনোই যা যুক্ত হবে না, কোনো রেখা দ্বারাই!

কত কিছুই যে বদলে যায়! ধারণাগুলো পালটায়… মনোভঙ্গি, বিশ্বাসের ধরন…।

তবু সেইসব দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে, হারায় না। আমার… আমাদের মতো সাধারণের তুচ্ছের জীবনেও তারা কত ঝলমলে। কোনটা লাল, কে-বা গাঢ় নীল, মুখ করুণ করে থাকা দিন, বাঁকাচোরা, বেদনার, তুমুল সুখের কিংবা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করা ভালো লাগার দিন…। এক বালক শালবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একা, বনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভয় পায়, ছোটে… হয়তো এটুকুই মনে পড়ছে এত দূর থেকে, তার আগের পরের আর কিছুই মনে নেই, অন্ধকার।

তবু সেই ছবিটির কী অসীম মূল্য আমার কাছে!

বাবার এক অল্পবয়সী শিষ্য, তার কথা মনে পড়ছে। তখন সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো, পড়া ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতে থাকে না, টো টো করে ঘুরে বেড়ায় তাই বাবা তাকে সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু আমার তাকে ভালো লাগেনা একটুও, একেবারেই সহ্য করতে পারি না।

সে বাবার আজ্ঞা পালন করে, আমাকে খুশি করার চেষ্টায় থাকে। বাবার কথামতো তার সঙ্গেই ঘুরতে বেরোতে হয়, একা কোথাও যাওয়ার সুখ নেই আর। বিরক্ত হয়ে থাকি তার ওপর। হারমোনিয়ামটা আমি তুলতে পারি না, সে অনায়াসে সেটা তুলে আসরের মাঝখানে রেখে আসে। আমি অল্পবয়সের ঈর্ষায় পুড়তে থাকি। মনে অশান্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, খাই, বাজাই।

বাবা অবসরে তাকে তবলা শেখাতে বসে, তার খ্যাংরা কাঠি আঙুলে কোনো বোল ফোটে না দেখে আমার আনন্দ হয়। আড়ালে হাসি। কী বিচিত্র মানুষের মনের রূপ!

মেট্যালা থেকে লাল রাস্তা ঢুকে গেছে গভীর জঙ্গলের ভেতর, আমরা ওই পথেই সেদিন হুমগড়ের কাছাকাছি একটা গ্রামে যাচ্ছি। বড়ো শালগাছগুলো কেটে নেওয়ায় কোথাও কোথাও বেশ ফাঁকা। হয়তো কাছাকাছি কোনো গ্রাম আছে, কিন্তু দেখা যায় না, ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে, মহিষ চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল শেষ হয়ে আসছে, তখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছই, রাস্তাটা নেমে গেছে, ঝোরামতো, জল পেরিয়ে যেতে হবে।

বাকিরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে পেরোনোর প্রস্তুতি নেয়।

কিন্তু আমি? বাবা বলল— মনু, তুমি ভাইকে ধরে পার করে দাও। বলা হল ধরতে কিন্তু সে তখন আচমকাই আমাকে ঘাড়ে তুলে নিল, ওই শরীরে কী শক্তি তার!

কিন্তু আমি কেন পারলাম না একাই জল পেরোতে?

এই সুযোগে ও আমাকে কব্জা করতে চায়? কিন্তু কয়েক মিনিট ওর কাঁধে চেপে জল পেরোতে পেরোতেই ওকে ভালোবেসে ফেললাম। বাল্যকালের চোখের জল কী বিশুদ্ধ! তারপর থেকে সে যে কী আপন হয়ে উঠল আমার! যেখানে যাই, সে সঙ্গে যায়, যে-কোনো সমস্যা থেকে সেই উদ্ধার করে। যোগাযোগ ছিল অনেক দিন।

পরে একসময় খবর পাই বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকে না কি মাওবাদীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দেয়। তারপর কিছুদিন তার খোঁজ কেউই পায় না। বেশ কিছুদিন পর জঙ্গলের ভেতর তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। কেন কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল? কে তার উত্তর দেবে?

তার কথা যখনই মনে পড়ে— বাল্যকাল থেকে আজকের এই আমি পর্যন্ত টানা যে-কাল্পনিক রেখা তা আরও টানটান হয়ে ওঠে, ব্যথায় টনটন করে ওঠে।

না, তার জন্য নয়, এই কান্না এক বিশুদ্ধ উপলব্ধির।


ঘটনাটি ঘটেছিল কোথায়— ছাতনা না কি বিষ্ণুপুরে?

ও-সব দিকে তখন রামায়ণ গান বা পালাগান শুনতে লোক হত দেখবার মতো। মাঝে মাঝে আমার ভয়-ভয়ই করত, বুক দুরুদুরু…। পারব তো এতজনের সামনে বাজাতে? অবশ্য গান শুরুর কিছুক্ষণ পরেই বেশ হাত জমে যেত, তখন এত এত দৃষ্টির সামনে বাজাতে ভালোই লাগত।

কিন্তু সেদিন গান শুরুর অল্প কিছু পরেই বিপত্তি ঘটল।

এমন আর কখনো ঘটেনি।

একজন সমীহ করবার মতো বনেদি চেহারার প্রৌঢ় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জোড় হাত করে বললেন— এভাবে আপনি পালাগান করতে পারেন না।

বাবা থামিয়ে দিলেন গান, ভালো করে বুঝতে চাইল তাঁর বক্তব্য।

যা বুঝলাম, বাবা গানের মধ্যে যে-রাগরাগিণীর আরোপ করছে, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণবিষয়ক গান বিশুদ্ধ সুরে গাওয়া উচিত ইত্যাদি।

বাবা কীর্তন শিখবার আগে কিছুকাল মার্গ সংগীতের চর্চা করেছে। শুনেছি, বাবার ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে ধ্রুপদী সংগীতের চর্চা, তার প্রভাব পড়েছিল বাবার মধ্যে। আমি লক্ষ করতাম, একেকদিন বাবা একটু বেশিই রাগ-রাগিণীর ব্যবহার করত। আর সেদিন আমাকে খোল রেখে বেশি তবলা বাজাতে হত।

তবে সেদিনের মতো আর কখনো ঘটেনি। বাবা তৎক্ষনাৎ আসর ত্যাগ করল, একটা গুঞ্জন শুরু হল শ্রোতাদের মধ্যে। অনেকে সেই মানুষটির ওপর বিরক্ত হলেন। কর্তৃপক্ষ এসে বারবার অনুরোধ করলেও বাবা কারো কথাই শুনলেন না।


একটি মতে বাঁকুড়ার ছাতনা শহরে যে-বাশুলী মন্দির আছে, সেখানেই চণ্ডীদাস সাধনা করতেন। সেই মন্দিরের পিছনে একটি লাগোয়া ঘর, আমরা একবার ওই ঘরটিতে টানা পনেরো দিন থেকেছি। মন্দিরের সামনে আটচালা তারপর মাঠ, মাঠ ঘেঁষে পিচ রাস্তা চলে গেছে, রাস্তার ওপারে একটি ছোটো পুকুর। কথিত যে, ওই পুকুরেই রামী রজকিনী কাপড় কাচতে আসত। আমরা দিনের পর দিন ওই পুকুরে স্নান করেছি। কিন্তু সবসময়ই মনে হত, গল্পে শোনা পুকুর কেন এত ছোটো হয়! কল্পনা আমার বাধা পেত।

অবশ্য আমার এই বালকোচিত কল্পনার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের কীই-বা সম্পর্ক!

এখানে আসর বসত সন্ধ্যের মুখে মুখে এবং গান শেষ হত রাত দশটার মধ্যেই।

প্রচুর নানা বয়সের মহিলা গান শুনতে আসত।

তারা কখনোই বাজনার মান বিচার করত না।

একটি অল্পবয়সী ছেলে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কখনো শ্রীখোল কখনো তবলা বাজাচ্ছে— এটাকে তারা বিস্ময়মিশ্রিত মুগ্ধতা দিয়ে দেখত।

পুরুষ শ্রোতারা এই ব্যাপারটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না। বরং তাদের মধ্যে অনেকেই থাকত কীর্তনের প্রকৃত সমঝদার।

তো তখন সাধিকা রাধার চরণ পাবে বলে কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলছে…

চূড়া বামে-এ-এ হে-এ-লে-এ বামে হেলে-এ।

কৃষ্ণের চরণ পাবে বলে।

বামে হেলে চূড়া-আ-আ বা-আ-মে-এ হেলে-এ।

কৃষ্ণের চর-অ-অ-ণ পা-আ-বে-এ বলে…

আর গলার মালা তখন?

আপনি দোলে মালা আপনি দোলে

গলার গুণ কি মালার গুণ…

দোলে মালা সে যে

ধীর লয় থেকে পরের গানেই আমার হাত দ্রুত লয়ে বোল তুলত খোলে।

প্রাণ খুলে বাজিয়েছিলাম কি সেদিন? গানের আসর ভাঙতেই প্রৌঢ়া ক-জন মা মাসির মতো আদল তাদের— এসে আমাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয়। আর বল লোফালুফির মতো এ-কোল ও-কোল হতে হতে কখন তুলনায় অল্পবয়সীদের কোলে পৌঁছে গেছি। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল কিন্তু এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি, অজস্র নারীর চুম্বন আর তাদের শরীরের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ আমাকে এক নতুন সুখানুভূতির কাছে নিয়ে গিয়েছিল— অনেক পরে যখন স্পষ্ট যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, যৌবনের দিনগুলিতে তা যেন একটা আর্তিই বয়ে এনেছে আমার কাছে কিন্তু সেদিনকার সেই দমবন্ধ হয়ে আসা সুখানুভূতি আমাকে নতুন অপূর্ব একটা জগতের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি— সেদিনের সেই সমবেত আদরের কথা যখনই মনে পড়ে, আবিষ্ট হয়ে পড়ি। ভাবি যে, আমার এই ছোট্ট সংগীতজীবনের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার হয়তো পেয়েছিলাম সেদিনই।

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

তমাল রায়ের গদ্য

কে জন্মায় হে বিপ্লব?

‘লুকিং আউটসাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং’

দাদুর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, ছ-বছরের মেয়েটি। সম্পর্ক হয়তো একটা কিছু আছে। এও সত্য সব সম্পর্কের নাম হয় না। পথ যেমন হয় উঁচু বা নীচু। সব পথেরই শেষ থাকে। অথবা থাকে না। এও হাইপোথিসিস! সে তুমি গল্পই লেখো বা ছবি আঁকো বা মুভি নির্মাণের সময় কিছু স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মাস্ট। কিন্তু চূড়ান্ত নয়! ধরো দাদুর নাম ইগো আর শিশুকন্যা কনসাসনেস। বাকিটা সময় বলবে। মানে কাহিনিতে রং ঢং লাগাবে সময়। ধরা যাক দাদুর স্ত্রী বিগত হয়েছেন প্রায় বছর ত্রিশ। তার নাম ছিল আনকনসাস। তার সন্তানদের কেউ ছিল লিবিডো, কেউ ইডিপাস বা ইলেক্ট্রা। সময় নামক গণৎকার এদের বড়ো করায় বাঁধা হননি। কেবল যার গর্ভ থেকেই কনসাসনেসের বাপ কাকার জন্ম, সেই আনকনসাসকে তুলে নিয়েছিলেন ঈশ্বর। ঈশ্বরও এক আপেক্ষিকতা। যে থাকলে আমাদের মত খেঁদা, প্যাঁচা বা টেঁপা, টেঁপিদের সুবিধে। যা বলার প্রয়োজন তা হল, যে-কোনো জার্নিই হল একটা ইনডেফিনাইট মেকিং! যাতে বাতাসের মিহিগুঁড়োর মতো অজান্তেই লেগে থাকে সাররিয়েল বা সুপার রিয়েল। দূরে একটা পাহাড়। ধরা যাক তারও উত্তরে জনপদ। পাহাড় টাহার যদি এনসার হয় খামখেয়ালির, তাহলে বলা যাক, এনারা উত্তরেই জেনারালি অভিষিক্ত। যেমন ধ্রুব তারা। যদিও ধ্রুব এক ফলস্‌হুড। এখানে বলা বাহুল্য মিসোজিনি আছে। মিথোজীবিতাও আছে। ধরা যাক পাহাড়ের কোলে একটি গ্রাম, গ্রামের নাম ইচ্ছেবাড়ি অথবা নকশালবাড়ি। আর ইগো নামক প্রৌঢ় কনসাসকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন স্মৃতিসৌধ প্রদর্শনে। নাত্নি কনসাসনেস। আপাতত আঙুল তুলে দেখাচ্ছে একটি নদী। জল বয়ে যেত কখনো। এখন খটখটে শুকনো। দাদু অবশ্য আকাশ ভরা সূর্য তারার নীচে দাঁড়িয়ে সে-সব কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ, সন্ধ্যে নামছে, পাখিরা ঘরে ফিরছে। আর কুয়াশা জড়ো হয়েছে অনেক। শীত আসার আগে যেমন হয়। ধানক্ষেতে মৃত্যুর নোটিস বা বিপ্লব! কেবল কুয়াশায় হারিয়ে গেল কনসাসনেস। স্বজন হারানোর দুঃখে শোকে ইগো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না-কো কিছু। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে চলেছেন: ‘কালেক্টিভ কনসাসনেসের কথা। আর কনসাসনেস শুকনো নদী পেরিয়ে ইগোকে খুঁজতে গিয়ে হাতে পেয়েছে চিরকুট। লেখা লুকিং আউট সাইড ইজ ড্রিমিং, লুকিং ইনসাইড ইজ এওকেনিং। শেষ আলোটুকু সম্বল করে, কনসাসনেস এপারে, আসতে চেষ্টা করছে। পেরে উঠছে না। বয়সোচিত কারণেই সে নিরুদ্বিগ্ন। ইগোকে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে দেখে, সে হাসছে। ভাবছে এও এক খেলাই। সমাজ সভ্যতা বা বিপ্লবের ইতিহাসে যেমন হয় আরকী!

ফ্রেদরিকোর তেমন ভরসা ছিল না বর্ষায়। গ্রীষ্ম আরামদায়ক হলে সে বসে থাকত সমুদ্রতীরে। একা বসে থাকার সময় আলো আঁধারিতে চোখে পড়ত, একটা উজ্জ্বল আলোর অবিরাম ঘুরে যাওয়া। মার কাছেই শোনা, বাবা না কি অমনটাই ছিলেন, শুনে সরে যাওয়া আলোর সিঁড়ি বেয়ে সে পৌঁছতে চেয়েছিল টাওয়ারে। সেখান থেকে সমুদ্রকে চেনা যায়। দূরত্ব যেভাবে চেনায় সময়কে। একটানা সোঁ সোঁ সুরের মাঝে অক্ষরের পর অক্ষর গাঁথলে জন্ম নেয় ব্যালাড। যুদ্ধ তেমন বৃহৎ হয়ে ওঠে না কখনোই। কিন্তু লড়াইটা থেকে যায়। ফলে টবে লঙ্কা গাছ, তার পাশে নয়নতারা, তারও পাশে ক্রিসানথিমাম। চিঠি আর আসত না। পাগলের মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফ্রেদরিকো সময়ের কাঁটা কে উলটো করে দিতে চাইত। সে চাইত হাতদুটো হোক আরও লম্বা, প্রেম বা বিরহে দীর্ঘ হাতই একমাত্র অবলম্বন অথবা আলিঙ্গন। তারপর ফট ফট কিছু শব্দ। আর ঘুম ছড়িয়ে গেল শহরে। বৃষ্টির ছাঁট লাগতে যখন হুঁশ ফিরল টবে ফুটেছে মৃতদেহ। সমুদ্র থেকে টবের দূরত্ব মাত্র কয়েক মিটার। বাকিটা ক্যামেরায় দেখানো হয়নি। কেবল বিশাল তারাভরতি কসমিক এম্ফিথিয়েটারে তখন কেবল সমুদ্র গর্জন। ক্যাওসের জন্ম হচ্ছে ফ্রেদরিকো ফুলের পাশেই…

যে বা যারা ভীতু, সর্বদা দর্শনকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করে, এছাড়া উপায়ই বা কী!

: কাম্যু।
: হুঁ
: সত্য বড়ো প্রকট, আলোর মতোই। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মিথ্যে বরং দূর নক্ষত্রের মতো, যা আশপাশের অনেক কিছুই চেনায়।
: কে?
: বলো দেখি।
: বুঝি না।
: কে, সার্‌ত্র? সিমন দি বোভোয়া?
: কাম্যু।
: সত্যি বলে কি সত্যি কিছু আছে?
: জানি না।
: কেন?
: আর মিথ্যে?
: এত জেনে কী হয়?
: কিছুই হয় না হয়তো। তবু তো মানুষ জানে।
: ইয়ং ইটালি কে গঠন করেন?
: জানি না।
: মাৎসিনি।
: ইউ এন ও কবে প্রতিষ্ঠা হয়?
: জানি না।
: ১৯২০, ১০ জানুয়ারি।
: আচ্ছা!
: পৃথিবীর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ কোনটি?
: জানি না।
: ১৮৯৬। ব্রিটেন আর জাঞ্জিবার। ৩৮ মিনিট। ব্রিটেন জিতেছিল।
: আচ্ছা!
: আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটান কে?
: জানি না!
: আব্রাহাম লিঙ্কন।
: বুঝলাম। জাতি সংঘ বলে কি আদৌ কিছু আছে? না কি বড়োলোক দেশের দালালি করাই জাতি সংঘ!
: হুঁ
: কী হুঁ?
: যুদ্ধ কি শেষ হয় আদতে?
: কী জানি!
: ক্রীতদাস প্রথার অবসান হয়েছে? ইজ ইট?
: তোমার কী মনে হয়?
: এপ্রিল ১৪, ১৮৬৫। গুড ফ্রাইডের প্রেয়ারে তাকে কেন খুন হতে হল?
: বেশ!
: আর জানো, যুদ্ধ টুদ্ধ কখনোই শেষ হয় না। চলতেই থাকে।
: আর মৃত্যু?
: কী?
: কিস্যু না, যেদিন প্রেম থাকবে না। আত্মমর্যাদাবোধ থাকবে না, সেটাই মৃত্যু! সে তুমি যতই বেঁচে থাকো। আপাতত ছায়ার সাথে ছায়ার যুদ্ধ ল্যান্ডস্কেপে। কেবল বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। কেউ হয়তো কাঁদছে। কেউ কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগোপনে।

ভিজে ক্যানভাসে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট চড়াই। ধোঁয়া উঠছে। জীবন না মৃত্যুর কে জানে!


চলন্ত জানলার রডে আপাতত বসে একটি পাখি। ট্রেনের গতি খুব মন্থর! উপায়ও নেই। লাইনের দু-ধার জুড়েই অসংখ্য মানুষ অভিনন্দন জানাচ্ছে… ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে… পাখি খানিক ঘাবড়ে কামরার মধ্যে ঢুকে ওড়াউড়ি করল। ধাক্কা খেল, সার দিয়ে রাখা বন্দুকে। তারপর কী করে যেন উড়ে গেল বাইরে! যাবার আগে পিচিৎ করে খানিকটা পায়খানাও করে দিয়ে গেল। ভেতরে গান চলছে, চেনা সুর, মনে পড়ছে না কিছুতেই… কেউ খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ-বা সদ্য কেনা জামা বা ট্রাউজার্স। মাইকিং হচ্ছে। ফুল ছুঁড়ছে লোকজন, কী উন্মাদনা। ওরা বিশ্বাস করে, এ-দেশ তাদের মাতৃভূমি, আর মাতৃভূমির বীর সন্তানরা এই ট্রেনে করে এগিয়ে চলেছে… প্রশস্তিমূলক কথা আর গানের মাঝেই পোয়াতি মেয়েটা কী কুক্ষণে কেঁদে উঠল এরই মাঝে, কে জানে! হঠাৎ ভাবগম্ভীর পরিবেশ! সকলের চোখেই জল। কুমারী মেয়েটা তার ইউ এস জি রিপোর্টের প্যাকেটটা ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো যার হাতে তুলে দিল তার বাম বগলের তলায় ধরা ক্রাচ! ট্রেন চলছে। আবার স্লো বিটে প্যাট্রিওটিক সং বাজছে। ট্রেন এগোচ্ছে, সামনে কিছু দূরেই তো ওয়ার ফ্রন্ট…

Categories
গদ্য

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর গদ্য

অতিমারির উৎসব ও এক ছদ্মকবি

মানুষের মন বিবর্তনশীল। ঠিক তেমনই তার সৃজনশীলতাও। মনের অনুভূতি ও সৃজনশীলতার প্রক্ষেপণ অভিন্ন। ঠিক তেমনই অভিন্ন মনের অবসাদ ও সৃষ্টির অবক্ষয়। মানবজীবন স্বল্পায়ু। তবু এই স্বল্পায়ু সম্বল করেই মানুষ বলতে পারে দার্শনিক রেনে ডেকার্টের মতো ‘আমি ভাবি, তাই আমার অস্তিত্বও আছে’। আবার কখনো-বা সে বলে ওঠে ‘এ মায়া প্রপঞ্চময়’। মানুষের আয়ুকাল সীমিত হলেও তার ভাবনার পরিধি ও কল্পনার ব্যাপ্তি মহাকাশের মতোই অনন্তপ্রসারী। মনোজগৎ ও বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্প, শিল্প ও সাহিত্যর মধ্যে কোনো অন্তরায় সভ্যতার জন্মলগ্নে ছিল না। এই সীমানা প্রতীষ্ঠা আধুনিক সভ্যতার অপচেষ্টা। প্রতিটি মানুষের মনের কোণে একজন কবি লুকিয়ে থাকেই। তিনি প্রবল হিসেবি গহনাকারই হোন, বা দোর্দণ্ডপ্রতাপ একনায়ক। সারাজীবন এক পঙ্‌ক্তি কবিতা না লিখলেও মানুষমাত্রই কবি। শুধু সেই কবিত্বকে পরিস্থিতি প্রবৃত্তি ঋণীঋতির আবর্তে কেউ কেউ চিরকালের জন্য কণ্ঠরোধ করে দেন। কবিতা যে শুধু লিখতেই হবে এমন কথা কে বলল? আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির সূত্র কি পৃথিবীর সুন্দরতম কবিতার একটি নয়? বা মোৎজার্টের যন্ত্রালেখ্য! কবিমন ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব। তিনি যখন মা, তখনও তিনি কবি। আবার যখন শিশু, তখনও। তবু সেই কবি হওয়া কি সহজ? চারিপাশের অতিমারি। তার ভ্রূকুটি আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা কতটা নিস্পৃহ থাকতে পারবে সেই কবিসত্তাটি? কবি অরুণ মিত্র তাঁর ‘কবিতা, আমি ও আমরা’ প্রবন্ধ শুরু করছেন এইভাবে, ‘আমি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি। যে-সময়ে লিখি না, মাঝেসাঝে ভাবি কেন কবিতা লিখি। নিশ্চিন্ত হতে পারি এমন উত্তর কখনো পাই না। আধুনিক কবিতার কোনো লেখক কি পান? জনসমষ্টির সঙ্গে কবিতার যখন আর যোগ নেই তখন এক মোক্ষলাভ ছাড়া বস্তুত আর কোনো লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘এই ভয়াবহ সময় কে জানে, সেই ‘মোক্ষলাভ’-এর আশাতেই কি না, কয়েকটি লিখে ফেলা পঙ্‌ক্তি নিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছি এই লেখাটি।’

তখন অতিমারির খবর সবে আসতে শুরু করেছে। ইউরোপে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। উড়ে উড়ে ভেসে আসছে ভয়ের শব্দ। কোথাও লটারি করে ঠিক হচ্ছে ভেন্টিলেটর কে পাবে, কোথাও গণকবরের ওপর তৈরি হচ্ছে রাস্তা। সেইরকম এক সময়ে হাসপাতালে রাতে ডিউটির সময় একচিলতে সুযোগ পেয়ে লিখেছিলাম এই কবিতাটি।

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে যে-শব্দগুলি
আজ আমার কথোপকথন শুধু তাদেরই সাথে
আমি প্রশ্ন করি ওদের
ফাল্গুন ঝড়ের কথা
দখিনাবাতাসের কথা
জানতে চাই কবে আসবে তুষারপাত
উত্তর ফিরিয়ে দেয় রংচটা গোলাপি দেয়াল
আমি সেই উত্তর শুনতে পাই স্পষ্ট
কিন্তু তাদের অর্থ বুঝতে পারি না কিছুতেই

কবিতার সঙ্গে স্যানিটাইজার দিয়ে ভাবলাম অনেকগুলো ছোটো ছোটো স্কুলপড়ুয়া শিশুর ছবি আঁকব। কিন্তু কী হল কে জানে। ছবি শেষ হলে দেখলাম, প্রতিটি পড়ুয়ার চোখেমুখে ভয়। এটা তো আমি সচেতনভাবে চাইনি! তাহলে কি অবচেতনে আমারও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তার ভয় ঢুকে বসেছে? যেমন লিখতে চাইনি ‘রংচটা গোলাপি দেয়াল’। আমি লিখতে চাইনি। তাহলে কে লেখাল! আমি কি তবে হ্যালুসিনেট করছি? অতিবায়বীয় অতিমারির জিনপরি ভর করছে আমার ভিতর!

এর কিছুদিন পর ঘটে গেল একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা যাঁরা মাঝেমধ্যে শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য যাই, তাঁরা জানি, সেখানকার সেবায় ব্রতি নার্সরা অধিকাংশই হয় মণিপুরী, নয় কেরলবাসী। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই সেবিকারা অসম্ভব পরিশ্রমী ও মেধাবী হন। চব্বিশ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর অনায়াসে আবার আরও এক চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করতে পারেন। ভাষাগত যে-কাঠিন্যটুকু থাকে তা অতিক্রম করতে তাঁরা হয়ে ওঠেন অতিরিক্ত স্নেহশীলা। সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা রোগিকে পরম যত্নে হাতে করে খাইয়ে দিতেও দেখেছি আমি। বিনিময়ে আমরা যারা ‘বুদ্ধিজীবী’ জাতি বলে মনে করি নিজেদের, কী দিয়েছি ওদের? সম্মান? স্বীকৃতি? অধিকার? সুরক্ষা? না। এর কোনোটাই হয়তো পারিনি দিতে। শপিংমলে ওদের দেখে আড়ালে ‘চিঙ্কি’ বলেছি, রিসেপশনে ওদের কথা বলার ধরন নকল করে টোনটিটকিরি কেটেছি। সেদিন তেমনই বেশ কিছু সিস্টারদিদিমণি অভিমান করে ফিরে গেলেন তাদের নিজের রাজ্যে। মন ভালো ছিল না আমার। একদিকে অতিমারির মনখারাপের লকডাউন। অন্য দিকে শহরের কোল খালি করে চলে যাওয়া এই সেবিকারা। সেদিন হঠাৎ লিখলাম।

পরবাস

ওরা চলে গেল শূন্য দেউল রেখে
দেউলের বুকে সময়হরণ চাকা
ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
যুদ্ধক্ষেত্রে রইল চাদর ঢাকা।

ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
আমাদের ব্রত বুদ্ধিজীবীর মতো
ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
দেউলের চাকা নিয়তি শরণাগত।

ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
আমাদের যত পথ্য শোধনাগার
ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
ওরা চলে গেল স্তব্ধ করল হাওয়া।

ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
এতোদিন শুধু পিছে ডাক দিয়ে গেছি
যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
ওদের দু-চোখ করেছি অশ্রুজাত।

যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
আমরা ওদের পরবাসে ঠেলে দিলেম
আমরা আবার নেমে আসি সমতলে
ওরা চলে যায় স্বপ্ন বোনার দেশে।

হাসপাতাল তো দেউলই আমার কাছে। মনে হল এই হঠাৎ চলে যাওয়া অনেকটা তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধে ভরতপুরের জাঠ রাজা সুরজমলের মারাঠাদের একলা ফেলে চলে যাবার মতো। এরপর কী করে যুদ্ধে লড়ব আমরা!

ক্রমশ মৃত্যুর সরণি বয়ে আসছিল আমার দেশের দিকেও। প্রথমে কিছু বিখ্যাত মানুষ। তারপর পাশের রাজ্য। তারপর পাশের পাড়া। তারপর একদিন নিজের আত্মীয়স্বজন। মৃত্যু তখন ঘরে ঘরে। সে এক মৃত্যুনদীর স্রোত যেন। সেই বিষাদঘন আবেশে বয়ে এল নতুন মহামারি আইন। মৃত্যুর পর মৃতদেহ তার নিকটজন দেখতে পারবেন মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। তারপর পলিথিন মুড়ে তাকে ফেলে দেওয়া হবে লাশঘরে। সেখানে মৃতদেহর স্তূপ। সেখান থেকে গণদাহর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। এই যন্ত্রণা অসহনীয়। মনোবিজ্ঞান বলে মৃত্যুর পর মৃতদেহ ঘিরে আপনজনদের আর্তি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক। সেই আর্তিতে যাঁরা স্বজনহারা হলেন তাঁরা অবচেতনে স্বীকার করে নেন বাস্তব। মনোবিদ এলিজাবেথ কুবলার রোজ এই ঘূর্ণিপাকের কথা বলেছেন। ত্রিশ সেকেন্ডে তা কতটা সম্ভব? তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমার শিক্ষকের শাশুড়িমা মা গেলেন অতিমারির সংক্রমণে। তার মৃতদেহ কাচের দেওয়ালের ওপার থেকে দেখার অনুমতি মিলল মাত্র ত্রিশমিনিট। কিন্তু তাঁরাই বা দেখবেন কী করে? তাঁরা নিজেরাও তো তখন ঘরবন্দি। তাঁদের দেহেও সংক্রমণ। সেদিন রাতে লিখলাম এই কবিতাটি।

চরণিক

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
যাচ্ছি রেখে কৃষ্ণচূড়ার পাতা
আমার এ-পথ নদ হবে না জেনো
আমি হলাম শেষ না হওয়া খাতা

তোমার জন্য ফুলেল উঠোন রাখি
আমায় তুমি মুড়ছ পলিথিনে
আমার জন্য অন্তমিলের পদ
সাজিয়ে রেখো অন্য টুকিটাকি।

তুমি যাবে সদর সড়ক দিয়ে
তোমার জন্য খুলছি ব্যারিকেড
এতটুকুই আমার কণ্ঠনালি
আর কটা ধাপ বলব আশা নিয়ে।

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
আমার চলা দখিন দুয়ার দিয়ে
ভোগ লেগেছে জগন্নাথের বাসায়
আমার কথা ফুরিয়ে গেল ঘিয়ে।

কবিতাটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছু মানুষ প্রশংসা করলেন, কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া জানালেন। কিন্তু লক্ষ করলাম, আমার মন সেইসব স্পর্শ করছে না। নিস্পৃহ লাগছে সবকিছু। তবে কি এভাবেই শেষ হবে মানবসভ্যতা!

ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা। মহাকাশে চলতে থাকা যানের মতোই। আলাদা হয়ে গেল সম্পর্কর মডিউলগুলো। হাতে রসায়ন ঘষি, মুখে আবরণ পরি। এই আবরণের একটি সুবিধা। মনের অন্তরের দোলাচলকে আর কষ্ট করে লুকিয়ে রাখতে হয় না। কবিতা আসে না আর। কবিতা ফুরিয়ে আসে। ক্রমশ ক্লান্ত হই। ক্রমশ নিজেকে মনে হয় পরাভূত। তবু জাহাঙ্গীরের দরবারে একটি পাখির ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বিচ্ছিন্নতা তার মায়াজাল বিস্তার করেছে। ঘরে ঘরে অবিশ্বাস। ভাইয়ে ভাইয়ে পাড়ায় পাড়ায় অবিশ্বাস। এত বিষ নিয়ে কবি লিখতে পারেন। আমি লিখব কী করে? আমি তো ছদ্মকবি। যাত্রাপালার বিদুষকের মতো আমার বেশভূষা পাগড়ি জহরত, সবটুকুই যে ‘ছদ্ম’। ভাবতে ভাবতে লিখে ফেলি আমার শেষ কবিতা।

মস্যাধার

আমার আঙুলে আর লেখনিশক্তি নেই
তুমি সেই অন্ধকার আগলে রেখেছ কবি
আমি ভগ্ন রাজ উঠোনের একপাশে
ভগ্নচোয়াল ঘিরে জীর্ণ মলিন রাজবেশ।

আমার গোলাপবাগে বেদখল কলতান অসহ্য মনে হয় না আর।
ওদের বেড়ে উঠতে দেখি আমি আঙুলের কোনায় নিভৃতে
ওরা তুলে নেয় রং
আমারই মস্যাধার থাকে
আমার লেখনি নেই
অবিশ্বাস বাস করে সেই শূন্য ঘরটুকু জুড়ে।

লিখে ফেলি। কিন্তু মানবসভ্যতার ওপর বিশ্বাস হারাই না। মনে মনে ভাবি, আমরা কাটিয়ে উঠবই। সেদিন আবার লিখব। কারণ, যতই ছদ্মবেশ হোক, বিদূষকের চলনবলন আমার রক্তে, অনুভূতিতে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবি। আমি আবার লিখব। নতুন সূর্যের দিনে লিখব। কারণ, লেখা ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা নেই। কোনো মানুষেরই হয়তো থাকে না।

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা

শুধুমাত্র গোটা জীবনভর একটা অলীক পথের রেখা আমি লুকিয়ে রেখেছি দুপুরের বুকের ভিতর। যেন সে নিজেই এসে বলে: দগ্ধ শালিকের ডানায় এই মুখ আমি প্রথম দেখেছি! অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হব বলে কত ঝড়জল পেরিয়ে এসেছি— দেখেছি পাহাড় দেখে জটিল হয়েছি। আজও আমার সাদা পাতার কাঙালপনা, কবে সে নিজেই ফুটে উঠবে। তখন মনে পড়বে না প্রবীণ কবির ছলনা। একটি ভাঙা সাঁকো জুড়ে যাবে চারপাশে। মনে পড়বে প্রথম রোদ্দুরের স্মৃতি। মনে পড়বে বিষণ্ণ গোধূলির পিছনে লুকিয়ে আছে হলুদ বাথরুম; চারপাশে বেহিসেবি জঙ্গল। আর আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে দু-টি শরীর গভীর উত্তাপে। সেই প্রথম চোখ ফেলা হলুদ স্তনের ভাস্কর্যে। বিকেলের অভিশাপ তার মুখ বিষণ্ণ বড়দির মতো। শুধু কিছু করার ছিল না। যখন নিজের দু-হাত স্বপ্নের হত‍্যাদৃশ‍্য লেখে। আমি টের পাই ফাঁকা বাড়ির গর্ভে সন্তান এসেছে।

কথায় কথায় এসে পড়ে ছোটোবেলার গান। অনুরোধের আসর। বিবিধ ভারতী। অনিবার্য শ্রাবন্তী মজুমদার গাইছেন— ‘মাথার ঘন চুল যখন, মরুভূমি হয়ে যায়, ওয়েসিস নিয়ে আসে মরূদ্যান মেঘের ছায়ায় ছায়ায়’। একটি বিজ্ঞাপন জুড়ে এমন অপ্রত্যাশিত সুরের আশ্চর্য বিষাদে ভরে ওঠে দুপুর। আর মাঝে মাঝে ভাবি আরেকটু বড়ো হলে একদিন ওয়েসিস কিনে আনব ঝক্‌ঝকে স্টেশনারি দোকান থেকে। গুপ্তচরের মতো ঘুরে বেড়াব অলৌকিক নীল দোতলা বাড়ির জানলার ছায়ায়। অপ্রত্যাশিত চোখের আলো চোখের বাহিরে এসে পৌঁছবে একদিন। তারপর একদিন এই বাড়ি বিক্রি করে তারা উঠে যাবে সোদপুর স্টেশনের কাছে। বিকেলের পুকুরের গরম জলের ঘনশ্বাসে সেইসব উপকথা একদিন ফেলে এসেছি আমি।


মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানের শেষে শ্রোতারা মুগ্ধ। শুধু এক বৃদ্ধা পথ রোধ করে দাঁড়ালেন তাঁর। অনেক দূর থেকে এসেছেন তিনি। হাতের ঠোঙায় প্রিয় শিল্পীর জন‍্য বাড়ির তৈরি নাড়ু। হেমন্তর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বাবা কত গান গাইলে কিন্তু আমার প্রিয় গান তো গাইলে না? চোখে জল নিয়ে আবার মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে গাইলেন— ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই’। আরেকবার ফাংশন শেষ করে গাড়িতে উঠছেন হেমন্ত। হঠাৎই খালি গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি ছোটো ছেলে। বলে অসুস্থ বাবার কথা। মৃত‍্যুশয‍্যায় একবার তিনি চোখের দেখা দেখতে চান প্রিয় শিল্পীকে। হেমন্ত বিষণ্ণ ছেলেটিকে গাড়িতে তুলে নেন। তারপর হাজির হন ছোটো এক গলির জীর্ণ কুটিরে। মৃত‍্যুশয‍্যায় শুয়ে এক অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হন শিল্পী ও শ্রোতা। পরে হেমন্ত বলেছিলেন কী এমন আছে আমার যার জন্য মানুষের এমন ভালোবাসা আমি পেতে পারি! এখনও পৃথিবীতে আছে জীবনের বিষণ্ণ সন্ধ্যায় একপশলা অপ্রত্যাশিত। না বলে আসে। না বলেই চলে যায়। মানুষ যখন টের পায় তখন হেমন্তের পৃথিবী জীবনানন্দের ডায়েরিতে লুকিয়ে পড়েছে।


সমৃদ্ধ বনান্তরে সকল শস‍্য আলো দেয়। উৎপাদন রহস‍্যের কাছাকাছি। জমির সীমানা মেপে নেয় একদা প্রাচীন মালিক। তবু কি ঝড়েজলে পাওয়া গেল তাকে? হাইরোডের পাশে গচ্ছিত ঋতুরহস‍্য। এই সমৃদ্ধি দেখছে বাঁকা চোখে শেষ কুশীলব। যখন বাতাসে বিধবা নাভির আকুলতা। বহুদিন পর ছায়ার নদী ভেঙে এগিয়ে এসেছে বনভোজন। নিজেকে তার মনে হয় নাবিক। চারদিকে জলের ভিতরে আলপথ বেয়ে যথার্থ ভ্রমণ। এবং এইসব অতিশয়োক্তি গিলে নিজের বয়স সুস্পষ্ট হয়।

এবার গরম ভাতের উপর সামান্য মাংসের ছোঁয়া পেলে আমি লিখে দেব সন্দেহজনক এই পিছনের বাড়ি। রোগা ছেলে উদাসীন জ‍্যামিতি আঁকে মাঠের দুপুরে। তারপর চৌমাথার মোড়ে ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে দু-একটি মানুষ চোখের সামনে দেখে ফেলে মৃত ধান, রক্তে মেশানো এক জন্তুর ছায়া। উৎপাদিত শহরের চারপাশে, এই ঝড়ে জলে যা কিছু আচ্ছাদিত তারা বাদলের সংসারে ভেসে ওঠে। তখন হাইরোডের দু-পাশে অকালমৃত ঝরে পড়ছে গান।

ক্রমশ ভোরের দিকে দেখে ফেলি। সায়া ও সেমিজ ফেলে অর্ধনগ্ন দেহ মিশে যায় মাটির শরীরে। শুধু গৃহস্থটুকু পড়ে রইল। একটি সোনার কলস ভরে সিন্দুকে রাখা হল চরিত্রের আমিষাশী নখ। এখন দু-টি সন্তানের দায়িত্ব, চাষবাস, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি— এক হাতে সব দিয়ে, বলুন দেখি সে কোথায় পালাল? যাত্রাপালার এই কথাগুলি ভোররাতে লণ্ঠনের পিছু পিছু চলে এসেছে আমার ঘরে। চায়ের জল চাপিয়ে তন্ন তন্ন খুঁজে চলেছে অসুখের বৃত্তান্ত।


তারপর একদিন ভোরে এসে পৌঁছল নবীন দম্পতি। নির্জন পাহাড়ের কোলে মধুচন্দ্রিমা। যে-বাংলোয় উঠেছে তারা সেখানে পর্যটক নেই। শুধু এক প্রবীণ দম্পতিকে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সকালের রোদ্দুরের ঋণ শোধ করে দেয় গোধূলির আলো। তরুণ স্বামী স্ত্রীকে সাবধান করে দেয়— যেন তাদের নতুন জীবনে ওই প্রবীণ দম্পতি আলাপ জমাতে না আসে। তবুও আলাপ হয়। একদিন সন্ধ্যায় প্রবীণ দম্পতির ঘরে চায়ের নিমন্ত্রণ আসে। নবীন দম্পতি সন্ধ্যায় পৌঁছে যথারীতি অপ্রস্তুত। বৃদ্ধা অসুস্থ। আর তাঁর মাথার পাশে বসে সেবা করে চলেছেন প্রবীণ স্বামী। সারাজীবন নিঃসন্তান, বহুবার অসুস্থ স্ত্রীকে সেবা করে আসছেন তিনি। একসময় ঘরে ফিরে আসে নবীন দম্পতি। তরুণ স্বামী টের পায় অবরুদ্ধ কান্নার স্বর। এক অপ্রত্যাশিত রূঢ় জীবনের ধাক্কায় বিশ্বাস টলে যায় তরুণীর। আজ তার যৌবন আছে। শরীরের লাস‍্য আছে। আজ ভালোবাসার কথা বলা অনেক সহজ। একদিন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই ভালোবাসা এমন অবিশ্বাস্য সুখের সন্ধান দেবে কি? না কি অর্থহীন নীরবতায় চরাচর জুড়ে নেমে আসবে অবলুপ্ত শরীরের শোক?

এমন করেই আবার একদিন গল্পের চরিত্রের মুখোমুখি হয় একজন সুদূর ‘আমি’ উদাসীন সংসারে। আমি মানুষটির সংসারে অথবা সমাজে সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেই। আসলে তার কোনো ব‍্যক্তিত্ব নেই। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত সংসারে তার কথার কোনো মূল্য দেয় না। গোটা জীবন জুড়ে শেষপর্যন্ত তিনি যেন এক অতিরিক্ত— উচ্ছিষ্ট। তবুও একদিন সকালে তিনি ফিরে পেলেন মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক নিজস্ব স্বর। বাজারে মাছওলাকে ধমকালেন। প্রতিবেশী এক কর্ণেলকে ব‍্যঙ্গের উপযুক্ত জবাব দিলেন। তারপর এসে দাঁড়ালেন বাড়ির দরজার সামনে। কলিংবেল টিপলেন। ভিতর থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করে উঠল— কে? তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুধু বললেন— ‘আমি’। এই স্বর সত‍্যিই কি চেনে তার স্ত্রী অথবা সমাজ। তবু সে আছে। গোপন অমোঘ এক শুশ্রূষার মতো এই একরত্তি জীবনে।


তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার কী? এই প্রশ্নের উত্তরে বনফুল শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য গল্প। ভাগলপুর থেকে জরুরি কাজে কলকাতা যাবেন বনফুল। কুলি নিয়ে যখন স্টেশনে পৌঁছলেন প্ল‍্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বনফুল হতাশ হয়ে বসে পড়লেন একটি বেঞ্চে। এদিকে কলকাতায় না-গেলেই নয়। ট্রেন আবার পরের দিন। হঠাৎ শুরু হল হইচই। যে-ট্রেন প্ল‍্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই ট্রেন আবার ব‍্যাক করে প্ল‍্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। নেমে এলেন ড্রাইভার। বনফুলের সামনে এসে বললেন, আমি আপনাকে ডাক্তার হিসেবে চিনি তবে আপনার সমস্ত লেখা আমি পড়েছি। আপনাকে ছুটতে দেখেই বুঝেছি আপনি কলকাতা যাবেন বলে আসছেন। তাই আমি গাড়ি ব‍্যাক করে নিয়ে এলাম। চলুন স‍্যার। একজন লেখকের জীবনে এর চেয়ে অপ্রত্যাশিত পুরস্কার আর কী হতে পারে? ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই অবিশ্বাস্য ঘটনার হয়তো আর পুনরাবৃত্তি হবে না। একজন দক্ষ ড্রাইভারের দেখা মিলবে হয়তো, কিন্তু তিনি একজন পাঠক হিসেবে লেখককে এই স্বীকৃতি দেবেন কি?

সেবার আমেরিকার বঙ্গসম্মেলনে গিয়েছেন পঞ্চাশের একজন জনপ্রিয় কবি। এইসব অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিরা চান শিকড়ের গন্ধ। কিন্তু সাহিত্যের চেয়ে গান নাচেই থাকে প্রধান আকর্ষণ। একসময় এল কবিতাপাঠের পালা। দর্শকমণ্ডলী সুযোগ বুঝে মেতে উঠলেন গল্পে। কবিতা শোনার আগ্রহ নেই। সেই কবি যখন কবিতা পড়ছেন তখন রীতিমতো হইচই চলছে। সুযোগ বুঝে কবিও মাঝখান থেকে অনেকগুলি লাইন বাদ দিয়ে কোনোরকমে কবিতাপাঠ শেষ করলেন। ফেরার সময় প্রেক্ষাগৃহের বাইরে কথা বলছেন কবি। একজন যুবক বললেন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আপনার কবিতা শুনছিলাম। কিন্তু আপনি মাঝখানে অনকগুলি লাইন বাদ দিলেন কেন? এই অবিশ্বাস্য পাঠকের জন‍্য কবির সেদিন মনে হয়েছিল তাঁর কবিতা লেখা সার্থক। এইভাবেই কাগজের নৌকো সব আলোবাতাসের জলে প্রাণ পায়।

আসুন শুনে নিই সেই অন্ধ মানুষটির কথা। রোজ অনেকটা পথ পেরিয়ে, অনেক কষ্ট করে তিনি মন্দিরে যান। প্রতিদিন একজন যুবক তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে পৌঁছে দেয় মন্দিরে। রোজ একই কাজ করতে করতে শেষপর্যন্ত কৌতূহলবশত যুবকটি সেই অন্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আপনি তো ঠাকুরকে দেখতে পান না, তাহলে রোজ রোজ এত কষ্ট করেন কেন? অন্ধ মানুষটি গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আসি তার কারণ আমি ঠাকুরকে দেখতে না পেলেও, ঠাকুর তো আমাকে দেখতে পান! এই বিশ্বাসের পাশে কোনো অবিশ্বাস নেই, অন্তরের চোখদু-টি যেন সদাজাগ্রত! তিনি জীবন দিয়ে সত‍্য করে তোলেন ‘অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে’।


এসো এই অপরিমিত শস‍্যের গায়ে হাত বোলাও। যতক্ষণ রূপকথা দণ্ডিত মানুষের আয়ুরেখা আঁকে। সূর্যাস্তে উড়ছে সব ধুলোমাখা স্মৃতি। মৃত মেয়ের কথা মনে পড়ছে যখন ওর মতো বিড়বিড় করে জুড়ে দাও অহেতুক অপাপবিদ্ধ খেলা। দণ্ডিত সবুজের দেশে কুসুমের রং। গর্ডকেশর। সেই দিনের রাজার গল্পটা বলো। যার শরীর জুড়ে পলাতক মানুষের চোখ। প্রহরীর মৃত‍্যুদণ্ড। তারপর মনে পড়ুক ঘুমের ভিতর কীভাবে বদলে গেছে পথ। সেই পথে ধীবরের জাল খেলা করে। মনে মনে একটি প্রকাণ্ড বাঘ সাক্ষী রইল তোমার রূপের। আর এক পেপে গাছের মলিন স্তনভার। বুকজোড়া দুধের পিপাসা। তারপর নীরবতা জলের সমান।

এখন সবুজ তিথি। বংশানুক্রমিক ওই ব‍্যক্তিগত অভিমান— পাঁচিলের দুষ্প্রাপ্য বই।

মৃত মেয়ের ছবির চেয়ে সুদর্শন পাখিসমাচার। গণআদালতে ছুটির মহড়া। একচিলতে রোদ্দুরের গায়ে এই মৃত বনপথ।

স্রোতের বিরুদ্ধে এই স্পর্শের হাত। লিখে রাখি। মৃতদেহ নিয়ে ম‍্যাটাডোর ছুটে য়ায় অন্ধকারে। বহুদিন খোঁজ নেই। একটা বারো বছরের না মিশে যাচ্ছে কুয়াশার ভিতর। যা কিছু দৃশ‍্যাতীত সেই দিকে দু-চোখের বাধা। এবার প্রহর মেপে ধানের উপর বসে আছে ক্লান্ত চড়াই। রূপকথা অসম্ভব দামি। নদীর জল ফিরিয়ে দিচ্ছে ঠোঁটের চুমুক।

এইসব দিনরাত মানুষের কথার পিছু পিছু উঠে বসেছে বিছানায়। বারো বছর পেরিয়ে একজন অচেনা পুরুষ দেখে ঘুমন্ত শিশুর মুখ, ছেঁড়া কাঁথা সর্বস্ব আমার। এখনও সাঁতার। ঝোলায় রয়েছে ভ্রমণ— লাল নীল টিকিটের আশ্চর্য ধুকপুক। ভেঙে পড়ার আগে এই সমর্পণ। কচুরিপানার মতো মিথ্যে লেগে আছে।

ও যদি এসেই পড়ে, ভাঙা ডানার ছায়ায় পেতে রাখে নিবিড় যৌনতা আমি তবে এলোমেলো জ্বরের বিকার। সন্তানের বুকে একশো আট রকম মিথ‍্যে বুনে ফুল ফোটাই মধ‍্যরাতে। সে এসে দেখুক একটা শরীর জুড়ে নিশিদিন মোমবাতি জ্বলে। একটা শরীর রহস‍্যের ক্রমাগত ব‍্যবহার ভুলে গেছে আজ।

একটা না-ঘটনা ছুটে যাচ্ছে কাহিনির দিকে। চারদিকে জলের অশৌচ। কথায় কথায় ঢেকে যাচ্ছে খড়ের মানুষ। অবলুপ্ত দেহ— তবুও সুন্দর তোমাকে ছেড়ে যায়নি। ছোটো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে দূরদেশের গাড়ি। তুমি বাথরুমে সাবান রেখে সেই যে ছুটে এলে…

আড়চোখের ভাষা সিগন্যাল পেরোচ্ছে। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে যতদূর…

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা


রবীন্দ্রনাথের গান আমায় ঘুমোতে দেয় না। আশ্চর্য সুরে শব্দের প্রান্তর ছেড়ে কতবার ছুটে গেছি। তারপর একসময় দেখি শব্দের দিকে, অর্থের দিকে পৌঁছতে বড়ো বেশি দেরি হয়ে গেছে। তবুও জেগে থাকি। কত অপ্রত্যাশিত শব্দ ছুটে আসে। ভাবি আমি কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের মতো ‘শ্রাবণসন্ন‍্যাসী’-র মতো শব্দ দিয়ে গান রচনা করতে পারতাম কি? কত আশ্চর্য এক অনুভবে তিনি লিখতে পারেন— ‘ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে/অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে’। অন্ধকারের জপের মালা সেই অপ্রত্যাশিত এক অনুভূতির মায়ায় ছুটিয়ে বেড়ায়। যখন গাই— ‘ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ‍্যের পায়ে’ তখন মনেই থাকে না এই গানটির একটি কবিতা রূপ আছে ‘সানাই’ কাব‍্যগ্রন্থে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘জাগায়ো না ওরে, জাগায়ো না।/ও আজি মেনেছে হার/ক্রূর বিধাতার কাছে।’ চমকে উঠতে হয় এমন অরাবীন্দ্রিক ‘ক্রূর’ শব্দের ব‍্যবহারে। আবার যখন লেখেন ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানটি, তখন অনায়াসে কবিতারূপে ঢুকে যায় ‘উপহাসভরে’-র মতো শব্দ। শুষ্ক পাতার সাজাই তরুণী থেকে শুধুমাত্র মাইক্রোফোনের কথা ভেবে যখন ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’ লেখেন তখন ওই ছিন্ন শব্দ ঘিরেই এক অপ্রত্যাশিত ভাবনার আলিপন শুরু হয়ে যায়। ‘এসেছিলে তবু আস নাই’— এই বিরোধাভাস পেরিয়ে একদিন যখন সুর থেমে যায় তখন ফুটে ওঠে অবগুণ্ঠিত এক ছবি: ‘তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,/শ‍্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।’

তারপর একদিন শুরু হল স্বর্ণযুগের গান। কয়েক দশক জুড়ে আকাশবাণীর অবশ‍্যম্ভাবী অনুরোধের আসর। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার অনুষ্ঠানের পরিচিতিতে লেখা হল ‘আধুনিক বাংলা’ গান। ১৯৩০ সালের ২৭শে এপ্রিল। শিল্পী হৃদয়রঞ্জন রায়। রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ-নজরুল পরবর্তী গানের দিন। যখন কথায় একই রবীন্দ্র নির্ভরতা। সুর আর শিল্পীর গায়কীর আধুনিকতা কথার গায়ে লাগেনি। কিছুটা ব‍্যতিক্রমী সলিল চৌধুরী। আর মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত শব্দের ব‍্যবহার। মনে পড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটির কথা। যেখানে অনায়াসে কবিতার মতো এসে পড়ে ‘অশান্ত সৃষ্টির প্রশান্ত মন্থর অবকাশ’ কিংবা ‘একফালি নাগরিক আকাশে’-র মতো শব্দব‍্যবহার শ্রোতার কানের তোয়াক্কা না করেই। সলিল চৌধুরীর সুরে এই গানের কথা লেখেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ। এই বিমলচন্দ্র ঘোষেরই লেখা ‘শাপমোচন’ ছবির ‘শোনো বন্ধু শোনো’ গানটি। রবীন্দ্রনাথ যে-শব্দ গানে রাখেননি, এখানে অনায়াসে এল ‘ক্রূর’ শব্দটি। তিনি লিখলেন আর উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত গাইলেন— ‘জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে সুকঠিন ফুটপাতে/অতি সঞ্চয়ী ক্রূর দানবের উদ্ধত পদাঘাতে’। সুবীর সেনের গলায় একদিন ভেসে এল ‘নগর জীবন ছবির মতো হয়তো’ গানটি। আর সেখানে কথার একটুকরো আধুনিকতা: ‘রাজপথে পোষা কৃষ্ণচূড়ায় বসন্ত আসে নেমে/তবু এখানে হৃদয় বাঁধবে না কেউ শকুন্তলার প্রেমে।’ কৃষ্ণচূড়ার আগে পোষা শব্দের এই অপ্রত্যাশিত ব‍্যবহার বাংলাগানের কথার সামর্থ্যের একটুকরো উজ্জ্বল দলিল। কত আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সত্তরের দশকে লেখা হয়— ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলা/তুমি ভোরের বেলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে’। ভোরের বেলা হয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে একটা গোটা জীবন, একটা গোটা দশকের গান। মাঝে মাঝে মনে হয় যখন জীবনানন্দ ‘শতভিষা’ পত্রিকার পাতায় লেখেন— ‘আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;/সূর্য না কি সূর্যের চপ্পলে/পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে/পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়।’ এই অপ্রত‍্যাশিত চপ্পলের মতো শব্দটিকে ধারণের মতো শক্তি সেই পঞ্চাশের দশকে স্বর্ণযুগের বাংলা গানের ছিল কি?


কচ্ছপ বুকে নিয়ে মানুষ বেরিয়েছে অফিসের পথে। মুখের উপর দিয়ে চলে যায় লেডিস স্পেশাল। হাঁটু অবধি জড়ানো কাপড়ে একটি মৃত মানুষ বাথরুমের বিজ্ঞাপনের পাশে উবু হয়ে বসে। তবু একান্ত রোদ্দুরের অভাব এই গন‍্যমান‍্যের দেশে। বহুদূর পথ। গন্তব্য ভিজে আছে বর্ষাবাদলে। এইবার কথা হোক। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের হাতে আছে আগ্নেয়গিরির সমান লাভা নিঃসরণ। তারপর সন্ধ‍্যার ভিড় পেরিয়ে থলেভরতি রঙিন আপেল নিয়ে বাড়ি ফেরা। ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে তোমার হলুদ বাড়ি লুকিয়ে রেখেছি অপ্রস্তুত গেঞ্জির ভিতরে। আজ উড়োজাহাজের দিনলিপি উড়ছে খেলনার চারপাশে। লিপিকর জানে রাতের শরীর দু-জনের মাঝখানে, অবুঝ সন্তান, প্রতিটি ভোরের রাতে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ।

আটটা দশের লোকাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি পানের দোকানে। বাথরুম সারি। দু-একটা ফোন আসে নগ্ন বাহু মেলে। এই বিপুল সংসারে আমি চাই নিছক অজুহাত। পালাবার নগন্য রেখা সুযোগসন্ধানী। সন্ধ‍্যার মেঘে আলোর পোকায় আমি নষ্ট হয়ে যাই।

ছলনার ডানা তুমি জানো যে-কোনো ফলের দু-দিকে রয়েছে ঢালু পথ। তর্কচূড়ামণি জানেন গাছের সন্দেহ। জানলায় বসে দেখি সামান্য উঠোনের ডালপালা সেও চলেছে পরবাসে।


আমরা মফস্‌সলের ছেলে। সেখানে তখন কথায় কথায় রুমাল, সেন্ট, পাউডার, সাবান দেখা যেত না। আমার মাসির দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে লতিকাদি। দিল্লির রাইসিনা কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কথায় কথায় পাউডার, সেন্ট মাখত লতিকাদি। আমি নীচু ক্লাসের বালক। লতিকাদির সুগন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। একদিন দেশভাগ হয়ে গেল। আমরা সপরিবারে কলকাতায় এলাম। মেসো এলেন কলকাতায় বদলি হয়ে। লতিকাদির বিয়ে হয়ে গেল। লতিকাদি আমার স্বপ্নের প্রথম রমণী। কলকাতা যাবার পথে প্ল‍্যাটফর্মে পড়ে গিয়েছিল লতিকাদির রুমাল। সেই সুগন্ধী রুমাল স্বপ্নের ভিতর বহুদিন যত্নে রেখেছিলাম আমি। আমার প্রথম প্রেম লতিকাদির কুহকে আচ্ছন্ন।

একদিন মাসি মারা গেলেন। মেসোমশাই একা। ব‍্যাঙ্কে ছেলেদের পাঠানো টাকা পড়ে থাকে। তোলার কেউ নেই। ছেলেরা বাবার দায়িত্ব নিতে চায় না। বরং পাউন্ড ডবল করে দেয়। অনিচ্ছুক লতিকাদি শেষপর্যন্ত বাবাকে হাওড়ার নিজের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে রাখে। একদিন তার চিঠি পেয়ে হাওড়ায় লতিকাদির বাড়িতে গেলাম। স্বপ্নের লতিকাদি এখন গিন্নিবান্নি। বড়োছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। দোতলায় মেসোকে দেখে চমকে উঠলাম। লতিকাদির অত‍্যাচারে মরণাপন্ন। স্মৃতিভ্রষ্ট একজন মানুষ। লতিকাদি দুই ভাইকে বঞ্চিত করে বাবাকে দিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়। তারপর একদিন হুইল চেয়ারে বসিয়ে স্মৃতিলুপ্ত বাবাকে বেওয়ারিশ তুলে দেয় কালকা মেলে। পরদিন নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন। আমার স্বপ্নের নারী কাজ হাসিল করে বাবাকে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কত অমানবিক, কত নিষ্ঠুর। এই রমণী আজ এক পাষাণ। শুধু সেই অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুরতার সাক্ষী আমি আর একটি ডুমুর গাছ।

সকালে উঠে একদিন অমিতাভ বুঝতে পারল সে কথা বলতে পারছে না। অথচ গতকাল রাতপর্যন্ত সে কথা বলেছে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ নয় শুধু বাষ্প বেরোচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়ল অমিতাভ। সমস্ত শব্দ তার কণ্ঠ ছেড়ে গেছে। তার কান্না পেল। তারপর চুপচাপ বসে রইল বিছানায়। স্ত্রী রমলাকে এখনই কিছু বলা দরকার। অথচ শব্দ নেই। মনোবিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও যায় না সে শেষপর্যন্ত। শুধু রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারপর অনেক দৃশ্যের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে অমিতাভ। রমলা জানতে চায় ডাক্তারের কাছে সে গেছে কি না। অমিতাভ মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ পর অপ্রত্যাশিত অমিতাভ বুঝতে পারে অনেক কথা বলছে তার হাত আর প্রতিটি আঙুল। আবার শুরু হয়েছে নতুন এক কথা বলা। চৌত্রিশ বছর পর আর এক অপরূপ আনন্দ বেদনায় বোবা ভাষার অবচেতনায় অপ্রত্যাশিত আলো এসে পড়ে। শুরু হয় না-কথার এক ভাষাতীত জীবন।

১০
কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সবসময়ই শিল্প সৃষ্টি করার আগ্রহ, চিন্তার দুশ্ছেদ‍্য অঙ্কুরিত বোঝা বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে। আজও কারেন্টের বিল পড়ে আছে তোষকের নীচে। যাওয়া হয়নি। কত উদ‍্যম নষ্ট হয়ে গেছে। আজ সন্ধ‍্যার অলৌকিক বিছানা পেরিয়ে আমি টের পাই জলের অশৌচে ভরে উঠেছে শহর। সামান্য খ‍্যাতির জন‍্য মনে হয় দাঁড়াই বৃত্তের ভিতরে; তবু পথ শেষ হয় না। সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে আজ আমি ভুলে যেতে চাই সমস্ত মনোবেদনার কথা। জানলার বাইরে অসুখ। দরজা পেরিয়ে দেখি শৈশবের অন্ধকার বসে আছে হেলানো বটগাছের গায়ে। কত অপরাধ সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে ফেলেছি একদিন। আজ এতদিন পর সমস্ত উদাসীন দুপুরের চারপাশে আমি জানলা খুলে দিই। কী চেয়েছিলাম আমি! যেন সমস্ত অপ্রত্যাশিত চুম্বন এসে জড়ো হয় সভ‍্যতার উলটো দিকের সাদা পাতায়। সেই দিন ছলনার বিরুদ্ধে আমি মেলে দেব জন্মের দু-কূল ঘেরা রঙিন পোশাক। তোমার অবলুপ্ত ভাষার শরীরে পেতে দেব সাঁকো। সে আরেক জীবনের বৃত্তান্ত। যখন বাসি বিস্কুটের ছায়া পেরিয়ে উটের মালিকের জন্য আমরা দরজা খুলে দিই।

ঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বনফুল, বিমল কর, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সলিল চৌধুরী, অমিতাভ সমাজপতি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ‍্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, রাধানাথ মণ্ডল, সুকান্ত সিংহ।

প্রথম পাতা

Categories
গদ্য

ঈশিতা দেসরকারের গদ্য

সাদা রোগ

গাছে সাদা চুল। চুল জড়িয়ে আছে চোখে। কখনো তুলো কখনো উপুড় হওয়া কলমের ডগায় রামপ্রসাদী বেড়া। বেড়া বাঁধতে গিয়ে মন থেকে খসে যায় এক টুকরো আতস বাজি। স্বরলিপি না মেনে আতাফল খুলবে তার গোপন না পাওয়া। না পাওয়া থেকে যতটা জল চুঁইয়ে পড়ে; ততটুকু জমিয়ে ঢালি আমার ছাদ বাগানের পাণ্ডুলিপিতে। চুষে নেওয়ার তুমুল সাক্ষাৎকার দেখি রোজ। একটা খয়েরি সংক্রমণ আমার না লেখা কবিতা থেকে দৌড়োয় টবের কোমড়ে। টব সরালে বরাদ্দ ঘুমের স্বস্তি। স্থল পদ্মের মাথায় গুঁড়ো ক্ষত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে নুন জল খায়। জবার আঙুলে আমের কাঁধে পেয়ারা পাতার চিবুকে তোলপাড়ের ষড়যন্ত্র আমার ছাদবাগানেও। যদিও ছাদ রাষ্ট্র এখানে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলছে না; দু-এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ওদের ক্ষতি হারিয়ে যাবে চিলেকোঠার সিগারেটে। বৃষ্টির অপেক্ষায় কুচো চারা ডেপুটেশনের বিবৃতি লিখছে। নীলকণ্ঠের লতানো নাভি কিছুটা বোঝে। কিছুটা সময় এলে জবাব দেওয়া গানের রেওয়াজে মন দেয়। গাছেরা সেদ্ধ ভাত খায় শুধু। পথ্য ছাড়াই লাফিয়ে যায় মানুষের দিকে। মানুষ তখন দরজার হেরে যাওয়া দেখছে। মুখস্থ করছে আইসোলেশনের চতুর্থ সূত্র।

বাইরে তখন ধুম ফাগুনের গীতিনাট্য। রাস্তার ইটের সখ্য বেড়েছে হেলে পড়া ঘাসের। হাওয়া এলে টবে টবে খুলে যায় গাছের অন্তর্বাস। কুর্চি ফুল গা সেঁকে নেয় এই সুযোগে। পেটভরতি খিদে পুরু মেঘের মতো।

ওদের ফেলে আসা আলোয় আমার অপারগতার চিরাগ রোজ সন্ধ্যায় গীর্জার নিঝুমে জ্বলে। পোড়া বন্দরের নিঃশ্বাসে গাছ বসায় রাতের ভাত। গাছেরা শক্তিনগরের কালিমন্দিরের আলো; কুমারডাঙ্গির মসজিদের আতরের সাথে উড়ে গেল। শুকনো পাতায় আমার কুঞ্চিত প্রেম নাম। এক। অধিক। সর্বাধিক। চিরাগ জ্বলত গাছে গাছেও। জ্বালাত রতনদা। রতনদা এখন সাদা জোব্বা পরে থাকে। সাদা রোগের সাথে ম্যাচিং করে। প্রতি মাসে টবের গা ধোয় রতনদা। ছাদের উঠোন লেপে দেয়। অবাঞ্ছিত কথাবার্তা সরিয়ে শেকড়ে ঢালে তামরসের হকিকত। পাতার মাথা আঁচড়ায়। দুটো বিনুনি বাঁধে সন্ধ্যা তারা ফুল রঙে;… শেষ ট্রেকার ধরার আগে। সাদা রোগ নিরাময়ের উড়ো চুমু টাঙিয়ে রোগারে জল মিশিয়ে যন্ত্রণাকে করে ‘পাখি হুস…’।

ডেপুটেশনের খসড়ায় রতনদার অনুপস্থিতি ও অপর্যাপ্ত শস্য সংলাপ উঠে আসছে বারবার। গাছ ও রতনদা উভয়েই অদেখার অশান্তিতে কম ঘুমোয়। বেশি রাতে গাছের হৃদয় পায়চারি করাকালীন গায় ‘বনমালী তুমি; পরজনমে হইয়ো রাধা’।

লকডাউনে স্নান বেড়েছে। জলের যোগ্য সন্তান যেন আমরা। স্নানঘরে ফেনার দুঃখ দেখি। কীভাবে মুহূর্তের লাস্য নিকাশি ব্যবস্থায় ফুরিয়ে যায়। এতক্ষণ জন্মসুন্দরী কখনো দেখিনি। যাদের স্নান ঘর নেই; কলতলায় রূপসি ফেনা দ্রুত হারিয়ে যায় অনাবিষ্কৃত শ্যাওলায়।

স্নানের ঘণ্টা বাজছে চারদিকে। তারই মাঝে ডাক শোনা যায় কার যেন!… জলের পেছল আগলে দরজায় যাই। রতনদা দরজার সামনে গণসংগীত রেখে গেছে। ৪৫ দিন ঘরে বসে থাকাত পর নয় কিমি হেঁটে গ্রামের বাড়ি থেকে কাজের খোঁজে শহরের গলিতে কাজফুল কুড়োয়। পরিচিত ছাদবাগানগুলোতে গাছের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চায় টিফিনবক্স। মেহনতি হাত দরজার বাইরে হাতুড়ি খুরপির ছাঁচটুকু রাখে। গাছ জল খায়। দলা মাটি ভিজিয়ে খায়। রতনদা খায় অপেক্ষা। জলে মুড়ি ভেজানোর কৃষি কাজ শেখে। মোবাইল ক্যানভাসে রতনদা এবড়ো খেবড়ো রং জড়িয়েছে কেমন!

রতনদা হাঁটছে। হেঁটে আসে। হেঁটে ফিরে যায়। ১৮ কিমি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে। ওর বুকের হারমোনিয়াম; গুপ্তধনে ঢুকে যাওয়া পেটের গন্ধ টের পাই। হাঁফাতে হাঁফাতে ওর বলা কথারা একে-অপরের গায়ে চেপে বসছে। ঘ্যানর ঘ্যানর কোকিলের ডাককে দূরভাষ শাসন করেছে অগ্রিম। ফাগুনের ধুনকর আমার কানে গুঁজে দিয়েছে শিমুল বীজ। শ্বাসগুলো শিশুর মতো নরম। কানের পাটাতনে যে-খিদে-করতাল বাজে; আমি আজ তার সওয়ারি। ছাদে যাই। পাতায় ঝুঁকে পড়া পেটের আর্তি। তুলো ভেদ করে কার্লভাট ডিঙিয়ে চিৎকার আমার ক্লিপে মিশে গেছে কখন!

নিজেকে ছোটো করে জলের ট্যাঙ্কের নীচে বসি। লালন সমগ্র এনে দিচ্ছে না কেউ। সাঁইজি আমার কখন খেলে এই খেলা! প্রতিটা আর্তরব রতনদার। প্রতিটা শব্দে মেনে না নাওয়ার তারস্বর। রতনদা ভাত বেশি খায়। ও গাছের যত্ন করতে এলে দু-কৌটা চাল বেশি লাগে।

‘গতর খাটি তো; ভাতলা বেশি নাগে; ভাতের তানে এঠিনা কাম করতি আসি।’ হাসতে হাসতে বলে রতনদা। বলতে বলতে মুখে গ্রাস তোলার সময় রতনদাকে গ্রিক পুরুষের মতো দেখায়। এত সুন্দর দেখতে রতনদা?! রতনদার ঘেমে যাওয়া কালো পিঠে স্বদেশের সুজলা সুফলা জমিন। এই আবাদ কাজ ঈশিতা জানে না। ব্যর্থ স্বার্থপর আঙুলে একলব্যর অভিমান ঘুমের ওষুধে রান্নাবাটি খেলে কেবল। ওদিকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে গাছের সাদা রোগ। পতাকা বদলে যাচ্ছে অধিকারের নামাবলীতে। গাছ অধিকার ফিরে ফেলে রতনদার দুয়ারে বারবার লক্ষ্মী ছাপ আঁকবে পড়ুয়া। লক্ষ্মী রতনদার বড়ো মেয়ে: যে-নামের আমাদের বাড়ির সাদা সন্ধ্যাতারাকে ডাকে রতনদা। আজান শুরু হলে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখি মাঝে মাঝে।

সাহস করে জানতে চাইনি।

জানি না কি অথই বেদনা আজানের ডালপালায় পায় রতনদা; আমি জানি না; আমার ছাদবাগানের ডালপালারা জানে ঠিক…