Categories
অনুবাদ গল্প

আসল-নকল

সংগ্রাহক: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে

ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস

[সংগ্রাহক পরিচিতি: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে। জন্ম: ১৮ই ডিসেম্বর ১৮২৪, বর্ধমানের সোনাপলাশী গ্রামে। কয়েকবছর গ্রামের স্কুলে পড়াশুনোর পর ছোটোবেলাতেই বাবার সাথে কলকাতায় এসে ভর্তি হন, রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফের স্কুলে (এখন স্কটিশচার্চ স্কুল)। ছাত্রাবস্থাতেই খ্রীস্ট ধর্ম গ্ৰহণ। স্কুল কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতাও। আর গ্রামবাংলার জীবন সংস্কৃতি নিয়ে নিরলসভাবে রচনা করেছেন গ্রন্থ। কৃষকদের দুরবস্থা, জমিদারদের অত্যাচার নিয়ে ইংরেজিতে লিখেছেন— ‘Govinda Samanta’, ‘Bengal Peasant Life’-এর মতো গ্রন্থ। সংগ্রহ করেছেন বাংলার উপকথা। দিদিমা ঠাকুমারা যে-সব গল্প শুনিয়েছেন বংশ পরম্পরায়, সে-সব উপকথাই সংগ্ৰহ করে ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন— ‘Folk Tales of Bengal’s’। সম্ভবত এটিই বাংলার উপকথার প্রথম কোনো সংকলন। এই গ্রন্থেরই কাহিনি— ‘The Ghost-Brahman’-এর বাংলা অনুবাদ আমি করেছি। রেভারেন্ড লাল বিহারী দে মারা যান ১৮৯২ সালে কলকাতায়।]

সে বহুকাল আগের কথা। এক গাঁয়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন। ব্রাহ্মণ কুলীন ছিলেন না। তাই বিয়ে করে সংসার পাতা তাঁর জন্য বড়ো দুঃসাধ্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণ গাঁয়ের স্বচ্ছল মানুষদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে অর্থ সাহায্য চাইতে লাগলেন, যাতে অন্তত বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করতে পারেন। বিয়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। বিয়েতে জন্য বেশি কিছু খরচ না করলেও মেয়ের বাপ মাকে কিছু অর্থ তো দিতে হবে! ব্রাহ্মণ তাই গাঁয়ের দোরে দোরে ঘোরেন, গাঁয়ের বড়ো মানুষদের তোষামুদি করে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। শেষ অবধি এদিক-সেদিক করে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় হল। তারপর এক শুভ দিনে বিবাহ সম্পন্ন করে নতুন বউকে ঘরে তুললেন। ব্রাহ্মণ তাঁর মা আর নবোঢ়াকে নিয়ে একসাথে বাস করতে থাকলেন।

কয়েকদিন বাদে ব্রাহ্মণ মাকে বললেন— ‘দেখো মা, এবার তো আমায় তোমার পাশে, বউয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। তোমাদের সুখে শান্তিতে রাখব এমন অর্থ তো আমার নেই। তার জন্য, দূর দেশে গিয়ে যা হোক কিছু কাজকম্ম করে আমি অর্থ উপার্জন করব। কয়েক বছর দূর দেশে কাটাতে হবে আমায়, যতদিন না পর্যন্ত বেশ কিছু টাকা হাতে আসে। আমার কাছে এখন যা আছে, তা তোমায় দিয়ে যাব। ততদিন এই দিয়েই কষ্টে করে চালিয়ে নাও। সেই সাথে তোমার বৌমাকেও একটু দেখে শুনে রেখো।’

তারপর একদিন মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ পথে বেরিয়ে পড়লেন। আর ঠিক সেই দিনই সন্ধ্যেবেলায় এক প্রেত হবহু ব্রাহ্মণের রূপ ধরে ব্রাহ্মণের বাড়িতে হাজির হল। নববধূ প্রেতকে নিজের স্বামী ভেবে বসল। সে তো অবাক হয়ে বলল— ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে বড়ো! এই যে বললে, কয়েক বছর তুমি বাইরে থাকবে! এত তাড়াতাড়ি মন বদলে গেল!’

ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত ইতস্তত হয়ে জবাব দিল— ‘মানে… ওই… যাত্রা করার জন্য আজকের দিনটা ঠিক শুভ নয়। তাই ফিরে এলাম আরকী! তাছাড়া হঠাৎ করে হাতে বেশ কিছু টাকাও চলে এল… তাই আর…।’

ব্রাহ্মণের মা-ও প্রেতকে নিজে ছেলে ভেবে বসলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগল না। প্রেত ব্রাহ্মণের ভেক ধরে বাড়ির কর্তা সেজে দিব্যি থাকতে লাগল— সেই-ই যেন আসল ব্রাহ্মণ। বৃদ্ধা মায়ের সন্তান, নবোঢ়ার স্বামী। ব্রাহ্মণরূপী প্রেতকে দেখতে একেবারে আসল ব্রাহ্মণের মতো। কড়াইশুঁটির দুই দানার মতো হবহু এক। আলাদা করার উপায় নেই। পাড়া প্রতিবেশীরাও তাই প্রেতকেই ব্রাহ্মণ ভেবে ভুল করল।

বেশ কয়েকবছর বাদে দূরদেশ থেকে আসল ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ঢুকেই তো তাঁর চোখ কপালে। একি! বাড়িতে হুবহু তারই মতো দেখতে আরেকজন! প্রেত দাঁত কিড়মিড় করে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করল— ‘এই, তুই কে রে! আমার বাড়িতে তোর কী দরকার! ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে উত্তর দিল— ‘আমি কে মানে! আগে বলো তুমি কে? এটা তো আমার বাড়ি। ইনি আমার মা। এ আমার বউ’।

প্রেত ব্রাহ্মণকে বলল— ‘আরে, তুই তো আজব কথা বলছিস রে! গাঁয়ের সক্কলে জানে, এ আমার বাড়ি। এরা আমার মা, বউ। বহুদিন ধরে আমরা এ গাঁয়ে আছি। আর তুই আজ কোত্থেকে এসে এমন ভান করছিস, যেন এটা তোর বাড়ি, এরা তোর মা আর বউ! তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে ব্রাহ্মণ! যা যা, দূর হ এখান থেকে!’ এ-সব বলে প্রেত ব্রাহ্মণকেই তাঁর নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।

এমন অদ্ভুত ঘটনায় ব্রাহ্মণ বাক্যহারা হয়ে গেলেন। এখন কী করা উচিত, হতবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ভেবে কূল পেলেন না। শেষ অবধি ভেবেচিন্তে রাজার কাছে গিয়ে ব্রাহ্মণ সব ঘটনা খুলে বললেন। রাজা ঘটনার বিচার করতে এলেন। ব্রাহ্মণ আর ভেকধারী প্রেত দু-জনকে দেখেই রাজা অবাক বনে গেলেন। যেন দুই হবহু প্রতিলিপি। কী করে এ-দ্বন্দ্বের তিনি মীমাংসা করবেন সত্যিই তিনি কিছু ভেবে পেলেন না।

ব্রাহ্মণ দিনের পর দিন রাজার কাছে সুবিচারের আশায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। তাঁর বাড়ি ঘরদোর, বউ আর মাকে ফিরে পাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে, রাজাকে কত করে অনুরোধ করেন। রাজা ব্রাহ্মণকে কী বলে শান্ত করবেন বুঝে পান না। রাজা তাই প্রতিদিনই বলেন— ‘কাল এসো, দেখছি’। ব্রাহ্মণও প্রতিদিন রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে থাকেন— ‘কলির কাল! আমাকেই কি না আমার বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া হল! অন্য একটা বাইরের লোক আমার ঘরদোর স্ত্রী সবকিছু দখল করে নিল… হে ভগবান… আর রাজাই-বা কেমন! প্রজাদের সুবিচার দিতে পারেন না? আমার কপাল পুড়ল…’।

ব্রাহ্মণ প্রায় প্রতিদিনই রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে পথ চলেন। পথের মধ্যে একটা ছোট্ট মাঠ পড়ে। সেই মাঠে একদল রাখাল ছেলে খেলে বেড়ায়। গোরুগুলোকে চড়তে দিয়ে, একটা বড়ো গাছতলায় জটলা করে রাখাল ছেলেরা খেলা করে। বড়ো অদ্ভুত তাদের খেলা। ছেলেদের মধ্যেই কেউ সাজে রাজা, কেউ হয় মন্ত্রী, কেউ আবার হয় কোতোয়াল। রাখাল ছেলেরা প্রায় প্রতিদিনই ব্রাহ্মণকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখে।

যে-ছেলেটি রাখালদের রাজা, সে একদিন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল— ওই ব্রাহ্মণ প্রতিদিন কাঁদেন কেন? মন্ত্রী, তুমি কিছু জানো? মন্ত্রী ছেলেটি কিছু জানত না এ-ব্যাপারে। তাই উত্তর দিতে সে অপারগ। তখন রাখাল রাজা একজন কোতোয়ালকে নির্দেশ দিলেন, ব্রাহ্মণকে তার সামনে হাজির করতে। একজন কোতোয়াল তখন ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বলল— ‘আমাদের রাজা একবার এক্ষুণি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান’। ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে— ‘কেন কী ব্যাপার! এই তো রাজামশাইয়ের কাছ থেকে এলাম। উনি তো আমায় আগামীকাল আসতে বলে ভাগিয়ে দিলেন। এখন আবার আমায় ডাকছেন কেন?’

কোতোয়াল বলল— ‘না না রাজামশাই নন। এ আমাদের রাখাল রাজা।

ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বলল— ‘রাখাল রাজা! তিনি আবার কে? বলছ যখন, চলো গিয়েই দেখি’।

ব্রাহ্মণ রাখাল রাজার কাছে এলেন। রাখাল রাজা ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর প্রতিদিন এভাবে কাঁদার কারণ জানতে চাইল। ব্রাহ্মণ সবিস্তারে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন রাখাল রাজাকে।

রাখাল রাজা সব কিছু শুনে বলল— ‘হুম। বুঝতে পেরেছি কী সমস্যা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি নিশ্চয়ই নিজের সব কিছু ফেরত পাবেন। আপনি শুধু রাজামশায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসুন, উনি যাতে আপনার এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমাকে দেন’।

ব্রাহ্মণ আবার গেলেন রাজামশাইয়ের কাছে। রাজমশাইকে অনুরোধ করলেন, রাখাল রাজাকে তাঁর এই সমস্যা সমাধানের অনুমতি দিতে। রাজামশাই এমনিতেই ব্রাহ্মণের এই বিচিত্র সমস্যার সমাধান নিয়ে তিতিরিক্ত ছিলেন। তাই ব্রাহ্মণের অনুরোধে কোনো আপত্তি করলেন না।

ঠিক হল, আগামীকাল সকালেই এই সমস্যার নিষ্পত্তি করা হবে। রাখাল রাজা সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল। সে এক বুদ্ধি বার করল।

পরের দিন সকালে রাখাল রাজা হাজির হল। সঙ্গে সরু মুখের ছোট্ট একটা শিশি। ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত দু-জনই রাখাল রাজার বিচার সভায় উপস্থিত। রাখাল রাজা সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখল। পাড়া প্রতিবেশীদের কথাবার্তাও শোনা হল। তারপর রাখাল রাজা বলল— ‘ব্যস, অনেক কথা শুনলাম। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। এবার এক্ষুণি এ-সমস্যার নিষ্পত্তি করব। আমার হাতে এই যে-ছোট্ট শিশিটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন, দু-জন বিচারপ্রার্থীর মধ্যে যিনি এই শিশির ভেতর ঢুকতে পারবেন, আমার আদালত তাকেই সমস্ত সম্পত্তির প্ৰকৃত অধিকারী বলে ঘোষণা করবে এবং তিনিই হলেন আসল ব্রাহ্মণ। এখন দেখা যাক, কে এর মধ্যে ঢুকতে পারে’।

রাখাল রাজার এমন বিচারে ব্রাহ্মণ হতভম্ব হয়ে গেলেন। দুঃখ করে বললেন— ‘নাঃ… রাখাল রাজা, তুমি সত্যিই ছেলেমানুষ। এ না হলে কেমন বিচার! এইটুকু শিশির ভেতর কোনো মানুষ কি ঢুকতে পারে?’

রাখাল রাজা নির্বিকার কণ্ঠে বলল— ‘ও, আপনি তাহলে এর মধ্যে ঢুকতে পারবেন না? ঠিক আছে। আপনি যদি এর ভেতর ঢুকতে না পারেন, তাহলে সম্পত্তি, বাড়িঘর কোনো কিছুই আপনার নয়’।

‘আপনি কি পারেবন?’ প্রেতকে জিজ্ঞেস করল রাখাল রাজা। ‘যদি আপনি পারেন, তাহলে প্রমাণিত হবে, সম্পত্তি বাড়ি ঘর, স্ত্রী, মা সব আপনার। আপনিই আসল ব্যক্তি’।

রাখাল রাজার প্রস্তাবে, প্রেত একগাল হেসে বলল— ‘এ আর এমন কী! এ তো আমার বাঁ-হাতের খেলা’।

পরমুহূর্তেই সবাই দেখল, প্রেতের শরীর ছোটো হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বাদশ পর্ব 

আকাশপ্রদীপ ও ডিকটেটরের হাতে স্বপ্ন

হেমন্ত আসছে, বহুদূর থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে সে আসছে। বিকেলের রোদ্দুর আর হাওয়ার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে কার যেন উদাসীন কান্না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হেমন্তসন্ধ্যা বিচ্ছেদের, সে কাপ থেকে প্লেটকে আলাদা করে দেবে… নৌকা থেকে নদীকে।

Categories
প্রবন্ধ

গোপাল দাসের প্রবন্ধ

পুজোর গানের গৌরবময় অতীত

একটা সময় ছিল যখন দুর্গাপুজোর মহোৎসবে ঢাকের বাদ্যি, নতুন জামাকাপড়, পুজো সংখ্যা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে উচ্চারিত হত পুজোর গানের কথা। বাঙালি শ্রোতারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকত পুজোর সময় কোন শিল্পীর কী গান বেরোবে তা শোনার জন্য। রেকর্ড কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দিত তারা সে-বছর কোন কোন বিখ্যাত শিল্পীর কী কী গান শ্রোতাদের সামনে হাজির করতে চলেছেন। খবরের কাগজে বা পোস্টার-ফেস্টুনে ছাপানো বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি রেডিয়োর বিজ্ঞাপনে শোনা যেত গানের কিছুটা অংশও। লোকে পুজোর বাজার করতে গিয়ে তাঁদের পছন্দের গানের রেকর্ডটিও কিনে আনতেন। আয়েশ করে বসে কালো রঙের ডিস্ক বা রেকর্ডটি জ্যাকেটের মধ্যে থেকে সযত্নে বার করে রেকর্ড প্লেয়ারে চাপিয়ে দিয়ে গান শুনতে শুনতে বিভোর হতেন। বাড়ির সব সদস্যরা হাতের কাজ সেরে এক জায়গায় জড়ো হয়ে প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে শুনতেন সেইসব গান।

এভাবেই গুছিয়ে বসে শোনা হত সেকালের পুজোর গান। পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো মণ্ডপগুলিতেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাজানো হত পুরোনো দিনের গানের সঙ্গে সে-বছরের পুজোর নতুন গান। ফলে যাঁদের বাড়িতে গান শোনার যন্ত্রটি ছিল না তাঁরাও বাদ পড়তেন না গান শোনার আনন্দ থেকে। বারবার শুনে অনেকেরই গানগুলি মুখস্থ হয়ে যেত। প্রেমিক-প্রেমিকারা সে-সব গানের কলি গেয়ে বা প্রেমপত্রে ব্যবহার করে একে-অপরকে ইমপ্রেস করার প্রয়াস পেত। ফেসবুক, হোয়াট্‌সঅ্যাপের প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে এর রোম্যান্টিক আবেদন বলে বোঝানো যাবে না।

উপরের বর্ণনাটা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে এতক্ষণে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যুগের একটা ছবি নিশ্চয় ফুটে উঠেছে। এটা মোটামুটি গত শতকের কুড়ির দশক থেকে আশির দশকের ছবি। এবার আরও একটু পিছনে যাওয়া যাক। এই পুজোর গানের ব্যাপারটা কবে থেকে চালু হয়েছিল তার খুব প্রামাণ্য ইতিহাস না থাকলেও, সূচনা পর্বের কিছু কথা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যায়। ইতিহাসের সেই ধূসর পৃষ্ঠাগুলোতে একটু চোখ বোলানো যাক।

লন্ডনের গ্রামোফোন কোম্পানি ১৯০১ সালে কলকাতার এসপ্লানেড ইস্টে তাঁদের অফিস খোলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘দ্য গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার কোম্পানি লিমিটেড’। পরবর্তীকালে ‘টাইপরাইটার’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। যাইহোক লন্ডন থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির এজেন্ট হয়ে ১৯০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় এসেছিলেন ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেইসবার্গ। তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ক্লাসিক থিয়েটারের নর্তকী মিস্ শশীমুখীর একটি গান রেকর্ড করলেন। গানটি ছিল ‘কাঁহা জীবনধন’। আর তারিখটি ছিল সেই বছরের ৮ই নভেম্বর। শুরু হয়ে গেল কলকাতা তথা ভারতবর্ষে গান রেকর্ডিংয়ের জয়যাত্রা। এভাবেই কলকাতার থিয়েটারপাড়া আর বাঈজিপাড়া ঘুরে ঘুরে গেইসবার্গ বেশ কিছু গানবাজনা রেকর্ড করেছিলেন সেই সময়। সেইসব শিল্পীদের মধ্যে তাঁর সেরা আবিষ্কার গহরজান। জমিদার বাড়ি আর বাঈজিবাড়ির ঘেরাটোপ থেকে গানবাজনা এবার ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালে আসতে শুরু করল গ্রামোফোন রেকর্ডের দৌলতে।

বাণিজ্যিক সাফল্যের হাতছানিতে আরও কিছু বিদেশি কোম্পানি কলকাতায় এসে গান রেকর্ডিংয়ের ব্যবসা শুরু করে দিল। ‘কলম্বিয়া’, ‘ইনরেকো’, ‘অ্যাঞ্জেল’ প্রভৃতি ব্র্যান্ডের রেকর্ড বাজারে এসে গেল। আমাদের দেশিয় ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে রইলেন না। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নাম করতে হয় এইচ. বোসের। পরবর্তীতে জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ‘মেগাফোন’, চন্ডীচরণ সাহার ‘হিন্দুস্তান রেকর্ডস্’, বিভূতিভূষণ সেনের ‘সেনোলা’ কোম্পানির রেকর্ড। নানা ধরনের কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতের পাশাপাশি নাটক, যাত্রাপালা, গীতিনাট্য প্রভৃতি রেকর্ডবাহিত হয়ে পৌঁছে যেতে লাগল শ্রোতাদের গৃহকোণে। প্রতি মাসেই নতুন কিছু রেকর্ড বাজারে আসতে লাগল। ক্রমে কোম্পানিগুলোর নজর পড়ল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর দিকে। পুজোর বাজার ধরতে রেকর্ড কোম্পানিগুলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বছরের সেরা গান-বাজনার ডালি হাজির করতে লাগলেন শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য। শুরু হয়ে গেল বাঙালির পুজোর গান।

পুজোর গানের রেকর্ড কবে থেকে বেরোতে শুরু করেছিল তার নির্ভুল সাল তারিখ ঠিকমতো জানা যায় না। তবে নথিপত্র ঘেঁটে গবেষকরা আন্দাজ দিয়েছেন ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রামোফোন কোম্পানির ১৭টি পুজোর নতুন গানের রেকর্ড ক্যাটালগের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভায়োলেট কালারের এই রেকর্ডগুলি ছিল ১০ ইঞ্চি মাপের, দুই পিঠে রেকর্ডিং করা। দাম তিন টাকা। বাংলা ও ইংরেজিতে বিজ্ঞাপিত ওই তালিকায় শিল্পীদের নাম, গানের প্রথম লাইন, গানের পর্যায়, রাগ ইত্যাদি মুদ্রিত ছিল। ওই ক্যাটালগের কয়েকটি হল: মানদাসুন্দরী দাসীর— ‘এস এস বলে রসিক নেয়ে’ (কীর্তন), ‘আমার সুন্দর মা’ (কীর্তন), নারায়ণচন্দ্র মুখার্জির— ‘দেখ লো সজনী আসে ধীরি ধীরি (আগমনী, বেহাগ-খাম্বাজ), ‘ও মা ত্রিনয়না যেও না যেও না’ (বিজয়া-ভৈরবী), কে. মল্লিকের— ‘এ কী তব বিবেচনা (আগমনী, কাফী-মিশ্র), ‘কী হবে কী হবে উমা চলে যাবে’ (বিজয়া-ভৈরবী), ইত্যাদি।

সেই সময়ে ভক্তিমূলক গান, আগমনী-বিজয়ার গানই বেশি প্রাধান্য পেত। ওই বছরেই খ্যাতনামা নর্তকী-গায়িকা কৃষ্ণভামিনী গাইলেন ‘মাকে কে না জানে’ (মালকোষ) এবং ‘অলসে অবশে বল কালী’ (পূরবী)। এই গায়িকা গানের শেষে ‘মাই নাম ইজ কেষ্টভামিনী’ বলে রেকর্ডিং শেষ করতেন। পরবর্তীকালে ইন্দুবালা, আঙুরবালা প্রমুখ সে-যুগের অনেক মহিলা শিল্পীই নিজেদের পরিচয় জানান দেওয়ার উপায় হিসেবে এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। সে-বছরেই আরও যাঁদের রেকর্ড বেরিয়েছিল তাঁদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য নাম হল শশীভূষণ দে, চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরলা বাঈ, বেদানা দাসী, প্রভৃতি। হাসির গানের রেকর্ড করেছিলেন অভয়াপদ চট্টোপাধ্যায়— ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আদর’ ও ‘স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদর’। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ রেকর্ডবন্দী করেছিলেন— ‘হে মোর দেবতা’ (ইমনকল্যাণ) ও ‘প্রতিদিন আমি যে জীবনস্বামী’ (সিন্ধি-কাফী)। গান দু-টির কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘রবীন্দ্রসংগীত’ শব্দটির তখনও প্রচলন হয়নি। যে-যুগে গৃহস্থ ঘরের মহিলাদের গান শেখাটাই ছিল নিন্দনীয়, সে-যুগে অমলা দাশই প্রথম সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা যিনি রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছিলেন এবং তা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। রেকর্ড ক্যাটালগে তার নাম ছাপা হত ‘মিস দাস (অ্যামেচার)’ বলে।

শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য রেকর্ড কোম্পানিগুলো গানের পাশাপাশি থিয়েটার, যাত্রাপালা, গীতিনাট্য প্রভৃতির রেকর্ডও প্রকাশ করতেন পুজোর সময়। ১৯১৫ সালের পুজোতে বেরিয়েছিল ‘অন্নদামঙ্গল’ ৬টি রেকর্ডে। ১৯১৬-তে বেরিয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘আবুহোসেন’। এই দশকে একঝাঁক প্রতিভাধর শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলা গানের জগতে। অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, আশ্চর্যময়ী দাসী, কমলা ঝরিয়া, আঙুরবালা, ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রচন্দ্র দাস প্রমুখ শিল্পীদের গাওয়া গান বহুকাল পর্যন্ত শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছে। ১৯১৭ সালের পুজোয় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র দু-টি গান বেরোল— ‘আর চলে না চলে না মাগো’ এবং ‘মা তোর মুখ দেখে কি’। ১৯২২ সালে প্রথমবার পুজোর গান হিসেবে আঙুরবালা রেকর্ড করেছিলেন দু-টি ভক্তিগীতি। ১৯২৫ সালে হরেন্দ্রনাথ দত্ত গাইলেন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’। গানটির কথা সুর কাজী নজরুল ইসলামের। বিশেষজ্ঞদের মতে এটিই কাজী সাহেবের প্রথম রেকর্ডবন্দী গান। ১৯২৩ সালে ‘মেগাফোন’ কোম্পানির সূচনাই হয়েছিল নজরুলের স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ এবং ‘দিতে এলে ফুল হে প্রিয়’ গান দু-টি দিয়ে। ১৯৩১ সালের পুজোয় হীরেন বসুর কথা ও সুরে ধীরেন দাসের গাওয়া ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ এবং ১৯৩২ সালের পুজোয় মিস্ লাইটের গাওয়া ‘শেফালী তোমার আঁচলখানি’ আগমনী গান হিসেবে আজও সমাদৃত। সেই বছরেই (১৯৩২) সেপ্টেম্বরে ‘হিন্দুস্তান রেকর্ডস্’ থেকে বেরোল কুমার শচীনদেব বর্মণের গাওয়া ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’ এবং ‘এই পথে আজ এসো প্রিয়া’ গান দু-টি। সম্ভবত এই গান দু-টিই শচীনকর্তার প্রথম পুজোর গান।

এর মধ্যে সংগীত জগতে ঘটে গেছে দু-টি যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৩০ সালে কলকাতা বেতারে হৃদয়রঞ্জন রায় নামে এক শিল্পীর গানের অনুষ্ঠানে ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করা হল। আর সেই বছরেই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হল এবং সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। যদিও প্রথম দিকে বেশ কিছুকাল ছবি চলাকালীন প্রতিটি শোয়ে গায়ক-গায়িকাদের পর্দার আড়ালে বা পিছনে দাঁড়িয়ে ছবির সঙ্গে সঙ্গে ‘লাইভ’ গাইতে হত। এর থেকেই সম্ভবত ‘প্লে-ব্যাক’ শব্দটির উৎপত্তি। অনেক পরে রেকর্ড করা গান ছবির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। যাইহোক ১৯৩০ সালটিকে বলা যায় বাংলা সংগীত জগতে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ। একদিকে ‘আধুনিক বাংলা গান’, যাকে বেসিক ডিস্কের গানও বলা হয়, অন্য দিকে চলচ্চিত্র বা ছায়াছবির গান যা ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী নির্মিত। দু-ধরনের গানই শ্রোতাদের কাছে সমাদর পেয়ে এসেছে বরাবর।

চলচ্চিত্রে গান একটা বড়ো জায়গা করে নেওয়ার পরে সারা বছর ধরে যে-বেসিক গান প্রকাশ হত, তাতে ক্রমশ ভাটা পড়ল। কিন্তু শারদীয়া পুজোর প্রাক্কালে বাংলা গানের প্রকাশ সমান উৎসাহে অব্যাহত রইল। ততদিনে বাংলা গানের আঙিনায় চলে এসেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, শচীনদেব বর্মণ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ দিকপাল সুরকারেরা। অসাধারণ গান লিখেছেন শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মুকুল দত্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গীতিকারেরা। এইসব গীতিকার ও সুরকারদের সৃষ্টিকে কণ্ঠে রূপ দিয়েছেন কুন্দনলাল সায়গল, জগন্ময় মিত্র, অখিলবন্ধু ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, তালাত মামুদ (প্রথম দিকে তপনকুমার নামে খ্যাত), সুধীরলাল চক্রবর্তী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সনৎ সিংহ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, অখিলবন্ধু ঘোষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর সেন, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, নির্মলা মিশ্র, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, অনুপ ঘোষাল, পিন্টু ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেক জনপ্রিয় শিল্পী। সুরকারদের মধ্যে পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীনদেব বর্মণ, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ শিল্পীরা নিজেরাও বহু কালজয়ী গান গেয়েছেন নিজের এবং অন্যের করা সুরে। বলা বাহুল্য, এই তালিকার বাইরে আরও অনেক শিল্পীর নাম রয়েছে।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে স্বমহিমায় বাংলা গানের জগতে পা রাখলেন সলিল চৌধুরী। বাংলা গানের নতুন দিগন্ত খুলে গেল তাঁর লেখা ও সুরের যাদুতে। মূলত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জলদ-গম্ভীর কণ্ঠে রূপ পেতে থাকল সলিলের অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। পাশাপাশি কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরকে দিয়েও গাইয়েছিলেন বহু কালজয়ী গান। অন্যান্য শিল্পীরা তো ছিলেনই। অপর দিকে মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার প্রমুখ গায়ক-গায়িকারা নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রাহুলদেব বর্মণের সুরে একের পর এক মাইলস্টোন বাংলা গান উপহার দিয়ে গেছেন শ্রোতাদের। এক সময় এইচ. এম. ভি. থেকে পুজোর সময় রেকর্ড প্ৰকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘শারদ অর্ঘ্য’ নামে গানের বই বেরোত। তাতে শিল্পীদের ছবি, প্রতিটি গানের বাণী (কথা), গীতিকার ও সুরকারের নাম, রেকর্ডের নম্বর ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণ সুদৃশ্যভাবে ছাপা হতো। এ-সব এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে বহু বিচিত্র ধরনের গানে। যেহেতু বর্তমান লেখাটি পুজোর গান নিয়ে, তাই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গান, কীর্তন, বাউলগান, লোকগীতি, পল্লীগীতি ও সিনেমার গানকে এই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। তবে কোনো কোনো বছরে শারদীয়ার প্রাক্কালে এইসব গানও আলাদা করে প্রকাশিত হয়েছে। গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর পাল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল, অংশুমান রায়ের গাওয়া বহু জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের কাছে এসেছে পুজোর গান হিসেবে।

পুজোর গানের যে-ধারা একসময় আপন বেগে পাগলপারা ছিল আশির দশকে এসে তা ক্রমশ শীর্ণ হতে লাগল। আর এই দশকের শেষ দিকে এসে তা একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গেল। ততদিনে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে টেলিভিশন। প্রথমে একটি-দু-টি চ্যানেল, তারপরে কেবলের দৌলতে শত শত চ্যানেল। রিমোট কন্ট্রোলে আঙুলের একটু চাপে চোখের পলকে হাজির হয়ে যেতে লাগল দেশ-বিদেশের রকমারি বিনোদনের পসরা। পালটে গেল বিনোদনের সংজ্ঞা।

ইতিমধ্যে দিকপাল শিল্পী, সুরকার, গীতিকারেরাও অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। যে-সময়, নিষ্ঠা এবং শ্রম দিয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় তাঁরা এক-একটি কালজয়ী গান সৃষ্টি করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। সংগীত সৃষ্টির পরিবেশ এবং পরিকাঠামোতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। শ্রোতারাও যেন মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগলেন। তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন বিনোদনের নতুন নতুন আইটেমে। যদিও আশির দশকের শেষ দিকে সুমন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর পরবর্তী শিল্পীদের গাওয়া ‘জীবনমুখী গান’-এর হাত ধরে বাংলা গান তার হৃত গৌরব যেন কিছুটা ফিরে পাচ্ছিল। কিন্তু সেই ধারা বেশিদিন স্থায়ী হল না। একটা সময় এল স্বর্ণযুগের গানের রিমেকের জোয়ার। তা-ও বেশিদিন চলল না।

মাঝে মধ্যে কিছু ভালো গান এখনও যে তৈরি হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই সামান্য। সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জনপ্রিয় হলেও মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী কোনো ছাপ রাখতে পারছে না। ফলে অচিরেই হারিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পুজোর গান প্রকাশিত হয়েছে। হাতল ঘোরানো চোঙাওয়ালা কলের গান থেকে শুরু করে রেকর্ড প্লেয়ার (78, 33 & 45 RPM রেকর্ড বাজানো যেত), ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি হয়ে অধুনা মাইক্রোচিপ ও মোবাইল ফোন পর্যন্ত গান শোনার যন্ত্র এবং রেকর্ডিংয়ের প্রযুক্তিগত বহু বিবর্তনের পথ পার হয়ে এসেও স্বর্ণ যুগের সেইসব গান আজও আমাদের আনন্দ দেয়, ভরিয়ে দেয় সুখাবেশে। প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের করে তোলে নস্ট্যালজিক।

পরিশিষ্ট :
পুজোর গানের তালিকা করতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। সেই সাধ্যাতীত চেষ্টায় না গিয়ে ষাট থেকে আশির দশকের কিছু জনপ্রিয় গানের উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করছি। এইসব গানের লাইনগুলি পাঠকের মনে সেই সময়ের আরও অনেক গানের স্মৃতি উস্কে দেবে।

১. ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ১৯৬২)।
২. ‘আবার হবে তো দেখা’ (মান্না দে, ১৯৬৪)।
৩. ‘আজ মনে হয় এই নিরালায়’ (সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৪)।
৪. ‘রানার’/‘পালকির গান’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬)।
৫. ‘না বলে এসেছি, তা বলে ভেবোনা’/‘যদি আকাশ হতো আঁখি’ (আরতি মুখোপাধ্যায়, ১৯৬৭)।
৬. ‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে’ (শ্যামল মিত্র, ১৯৬৭)।
৭. ‘আকাশ কেন ডাকে’ (কিশোর কুমার, ১৯৬৮)।
৮. ‘চল না দিঘার সৈকত ছেড়ে’ (পিন্টু ভট্টাচার্য, ১৯৬৮)।
৯. ‘আঁধার আমার ভালো লাগে’ (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৬৮)।
১০. ‘ঝুমঝুম ময়না নাচো না’/‘মন মাতাল সাঁঝ সকাল’ (মুকেশ, ১৯৬৮)।
১১. ‘না মন লাগে না’ (লতা মঙ্গেশকর, ১৯৬৯)।
১২. ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ (রাহলদেব বর্মণ, ১৯৬৯)।
১৩. ‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে’ (ভূপেন হাজারিকা, ১৯৬৯)।
১৪. ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল্ না’/‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়’ (মান্না দে, ১৯৬৯)।
১৫. ‘তোমার চোখের কাজলে আমার ভালোবাসার কথা’ (বিশ্বজিৎ, ১৯৭০)।
১৬. ‘ননদী বিষের কাঁটা’ (অনুপ ঘোষাল, ১৯৭০)।
১৭. ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ (ভূপেন হাজারিকা, ১৯৭১)।
১৮. ‘না, আমার এ শশী চেয়ো না’ (শচীনদেব বর্মণ, ১৯৭২)।
১৯. ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’/‘কতদিন পরে এলে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ১৯৭৪)।
২০. ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’ (বনশ্রী সেনগুপ্ত, ১৯৭৬)।
২১. ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই’ (শ্রাবন্তী মজুমদার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ১৯৭৬)।
২২. ‘এই মোম জোছনায়’ (আরতি মুখো, ১৯৭৮)।
২৩. ‘আমার পূজার ফুল’/‘সে যেন আমার পাশে’ (কিশোর কুমার, ১৯৮০)।
২৪. ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখ’ (লতা মঙ্গেশকর, ১৯৮১)।
২৫. ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ (মান্না দে, ১৯৮৫)।
২৬. ‘হাওয়ায় মেঘ সরায়ে’ (কিশোরকুমার, ১৯৮৬)।
২৭. ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ (নির্মলা মিশ্র)।
২৮. ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’ (তালাত মামুদ)।
২৯. ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ (শ্যামল মিত্র)।
৩০. ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’/‘দুরন্ত ঘূর্ণির’/‘এক গোছা রজনীগন্ধা’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

একাদশ পর্ব

হেমন্তের দিনে নস্টালজিয়া

হেমন্তের বিষাদের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার একটি ট্র্যাজেডির কথা মনে হয়, আমাদের চেনা চারপাশ থেকে অনেক দূরে আধো-আলো আধো-অন্ধকারে হিমে-ভেজা এরিনায় অভিনীত হয়ে চলেছে সেই নাটক।

Categories
প্রবন্ধ

শাশ্বত ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ

গান্ধীজি ও শান্তিনিকেতন

তারিখটা ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, শান্তিনিকেতন জুড়ে চারিদিকে সাজোসাজো রব, যেন এক ব্যপক মহাযজ্ঞের আয়োজন চলছে,

Categories
জলসাঘর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

 একাদশ পর্ব

ভিলানেল
(Villanelle)

উনিশ পঙ্‌ক্তির কবিতা ভিলানেল, ছয়টি স্তবকের। প্রথম পাঁচটি স্তবক তিন পঙ্‌ক্তির এবং শেষেরটি চার পঙ্‌ক্তির।

Categories
কবিতা

শান্তমের কবিতা

ইস্কুল

কেউই আসে না

না ফেরা মানুষ; ভালোবাসাগুলি
ঠিকানা বদলে নেয় বার বার

Categories
জলসাঘর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

আগমনী ও বিজয়া সংগীত

বাংলার ঋতুচক্রে শরৎ ঋতু তথা আশ্বিন মাস বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের আগমন বার্তা বয়ে আনে। বর্ষা শেষের মেঘমুক্ত আকাশ ও মাঠে মাঠে কাশ ফুলের অনাবিল সৌন্দর্য উৎসবের চিত্রকল্প সৃষ্টি করে।

Categories
কবিতা

বঙ্কিমকুমার বর্মনের কবিতা

নমুনা

আমাদের বিবাহের পচাগলা সুর কেউ শুনছে না, না-একটা ফুল গাছ, না-একটি প্রজাপতি। সবাই কেটে পড়ছে দূর থেকে ভ্রূ কুঁচকে। অযথা আমরা বিবাহের খরচ বাড়িয়ে চলেছি দিনকে দিন।

Categories
অন্যান্য

একটি পুনরাধুনিক সন্ধ্যা

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশ

অংশগ্রহণে কবি ও কথাসাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরী, কবি ও কথাসাহিত্যিক অনুপম মুখোপাধ্যায়, কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব দত্ত এবং কবি ও প্রকাশক সেলিম মণ্ডল