Categories
কবিতা

সুবীর সরকার

বাজনা

তুমি বাজনা বাজাবে বলে খুলে এনেছি মৃতের
                                                হাড়
ঘোড়া আছে, অশ্বমেধ নেই।
ঘুঘুর ডানায় যখন রোদ
আমরা তখন কোনো না কোনো কর্মসূচি বেছে
                                                নিই
বিশ্রাম সেরে একটা ঘরে ফিরবার দুপুর
ঘামে ভেজা গামছা।
ধানখেতে জল জমলে উপচে ওঠে
                                                অভিমান
ডুব সাঁতারে আছি।
অবসর ভেঙে অবসাদ।

পুতুল

মনকেমনের দু-পাশে দোনলা বন্দুক।
পালকিতে যাত্রী নেই।
শোকেসে দুপুরের আলো
পুরোনো নদীবন্দরের গায়ে হেলান দেয়
                                                পুতুল

গ্রামার

গ্রাম ও গ্রামার ঘেরা নদী।
ভূগোলের ভেতর ইতিহাস হয়ে ঘুমিয়ে থাকে
                                                জঙ্গল আর জনপদ
আমাদের জেগে থাকতে হয়
অদ্ভুত এক কাচের পৃথিবীতে

লালশাক

উনুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছ।
এদিকে লালশাকের বাগানে সন্ধে নামে
হিম থেকে আমরা হেমন্তে সরে যাই
পেতে রাখা রাস্তা।
অন্ধকারে বিছিয়ে দেওয়া শোক।
বিকেলে হাডুডু খেলি
খুব চেনা মনে হয় সার্কাসের
                                                তাঁবু

হাসপাতাল

ব্যক্তিগত দোলনার পাশে ঘোড়াটি দাঁড়িয়ে
                                                থাকে
মৃতরা উঠে আসে শহরের রাস্তায়।
হাসপাতাল আর বাণিজ্যকেন্দ্র ঘিরে তারা শিস
                                                দেয়
এতসব ঘটে,ঘটেই চলে।
আমি লিখি, ভাঙা ডানার ইতিহাস।

Categories
কবিতা

শুভদীপ দত্ত প্রামাণিক

নেলপলিশ

ঘাড়ের ওপর ভাড়াবাড়ির রান্নাঘর।
অমিয়দা ফেরিঅলার গলাতে রেখে দিল চোরাই মৃতদেহ!
নিখুঁত খুনি কোথায় কিনতে পাওয়া যায়?
ডাকাত কাউন্টারে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস টিকিট,
             টিকিটে দূরত্বের জায়গায় পুরুষাঙ্গ।

নাভির ওপর টায়ার পার্ক।
গাড়ি দাঁড়াবে হাঁস-মুরগির ঘরে।
কালো মাছ পুড়িয়ে খেল অবিবাহিত নেলপলিশ।

আতপচালের উপর খড়ম পড়ে হাঁটে শ্যামবর্ণ বিছে।

ব্যাকটেরিয়া

হাতের খেঁজুর পাতার ছায়া।
কীভাবে দেব মৃত্যুর আনন্দসংবাদ,
                        মারা গিয়েছে নৌকা দেবীর কনিষ্ঠ কন্যা!

এখন সে মর্ত্যে— মানুষের মতো গায়ের রং,
                             নরম হাড়ে ব্যাকটেরিয়া জন্মাচ্ছে!

ধানের গোলা,
ঘামে ভেজা ফ্রক থেকে ঝরে পড়ছে
                             গোরুর দুধের গন্ধ।

খাদ্যনালী

ব্যাঙাচির ছায়া নারী কল্যাণ সমিতির অফিসে।
সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোড়া জানিয়েছে:
সে ভাতের ছায়া খাবে।
খাদ্যনালী দিয়ে দ্বীপ পৌঁছাল কাঙালের হাঁটুতে,
                             হাঁটুতেই রেশন ডিলারের বাড়ি।

আদি সূত্র ডাকছে।
আদি হোঁচট ডাকছে চোয়ালকে।
রেললাইনের পাথরে ছেঁড়া হারমোনিয়াম!

মকরক্রান্তিরেখায় প্রথম সভা করল পোড়া জ্ঞান।

জরুরি বৈঠক

টোটোভরতি ক্লাসমেট খাতা।
খাতার শেষ পাতায় বালিগঞ্জ প্লেস,
বালিগঞ্জ প্লেসে হিড়িম্বা তুলি সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ফ্যানের।
শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে কামবীজকে!
ডিম্বাশয় থেকে দেখা যাচ্ছে বস্তি-চটকল।
চটকল এখন শুধু রবিবার বন্ধ।

বৃদ্ধ বেশ্যাদের জরুরি বৈঠক শেষ হয়নি,
                             সিদ্ধ ডিম নিম্ন আদালতের ক্লার্ক।

জজ আপনি বলুন: কে আমার মা?
কুন্তীর ঠোঁটে অন্ধকার!

আয়ু মন্দির

মেঘ জমেছে সান্তাক্লজের এ্যাপেন্ডিক্সে!
ভৌতিক ইঁদুরের গর্তে আয়ু মন্দির।
                      চাতকের নিঃশ্বাসে কেয়া ফুলের ছায়া।
সাপ দুধ খাই গাভীর স্তনে।
সাপের বিষ অসুরগণের মধু,
অর্ধেক ইউরেনাস গোলাপে কোজাগরী।

পুকুরের পাড়ে টিকটিকির কাটা লেজ!
পেয়ারা গাছের আর্থিক অবস্থা পাথর।
নক্ষত্রের অন্তর্বাস বেনেবউটির চোখের মতো উজ্জ্বল।

গাঙচিল স্বেচ্ছাবসর নিয়ে পাতাললোকে কবিতা লিখবে,
কুমিরের পিঠে রাধাকুণ্ড।

 

 

Categories
কবিতা

সুমন জানা

বন্দর

নদীর গভীর থেকে দীর্ঘতম ক্রন্দনের মতো
উঠে আসে আজানের ধ্বনি,
বিষণ্ণ বন্দর জুড়ে সন্নাটা ছড়ায়—
মোহনায় চওড়া হতে থাকা স্যান্ড-হেড
মালবাহী জাহাজের পথে যত প্রাচীর তুলেছে
ততই বন্দর ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেছে—

কাজ-হারা শ্রমিকেরা তবুও কাজের খোঁজে আজও
ইউনিয়ানের সঙ্গে ঘোরে, চা খায়, পতাকা ধরে থাকে
দলীয় শ্লোগান মেরে অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে ওঠে।
নেতাদের প্রতিশ্রুতি পরিত্যক্ত কারখানার ঝোপে
শৃগালের মতো দ্রুত গা ঢাকা দিয়েছে—

বন্দরের কয়লা ও লোহা
বাতাসে মিশিয়ে দেয় নিজেদের প্রবণতাগুলি,
ভবিষ্যতে কোনো দিন স্ফুলিঙ্গ ছড়াবে!

কয়লার তপ্ত আঁচে গলে যাওয়া লোহার দৃঢ়তা
মানুষের সভ্যতা নির্মাণ করে দিয়ে আপাতত
ব্যবহারহীন হতে হতে মরচে ধরে খসে পড়ে গেছে

আমার অভ্যাসগুলি

আমার অভ্যাসগুলি খাপছাড়া, স্বভাব-জটিল।
তার সঙ্গে যদি কোনও নদীর তুলনা করি, তবে
সেই নদী সারাক্ষণ ভরা নদী ক্ষুরধারা নয়,
হতে পারে মজা নদীও তা,
বুকে যার পলিজমা উর্বরতা, ফসলের খেত।
চটে ঘেরা শৌচাগার, সবজির বাগান, কুঁড়ে ঘর। পলাতকা
নদীর স্মারক হয়ে থেকে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে
যে-কয়েকটি জেলে ডিঙি আজও টিকে আছে,
আমার অভ্যাসগুলি তাদের স্খলিত পাটাতন
কাপড় কাচার জন্য জেলে বউ যেগুলিকে ঘাটে পেতে রাখে।

গেঁড়ি ও গুগলির খোঁজে সারাদিন জলে পড়ে থাকা
আমার কর্তব্যগুলি তাতে বসে দু-দণ্ড জিরোক!

প্রাকৃত

বৈষ্ণব কাব্যের মত্ত দাদুরী পুকুর পাড়ে ডাকে।
অসংস্কৃত জল, তাতে প্রাকৃত পৈঙ্গল ছন্দে বাড়া
কচুরিপানার দামে কোথাও গোপনে
ডাহুকীর সদ্যফোটা বাচ্চা রাখা আছে,
মেঘ দেখে তাই তার এত চঞ্চলতা—
মেঘ দেখে আরও যার বুক কাঁপে,
গোবিন্দ দাসের মেয়ে, তারও নাম রাধা।
এরকম কোনো এক শ্রাবণেই যাকে পাড়ার ছেলেরা
একরাত কৃষ্ণ-সহ ক্লাবঘরে আটকে রেখেছিল,
সেখানেই ফুলশয্যা, সেখানে বাসর। পরদিনই
কৃষ্ণ তো স্বভাবমতো বৃন্দাবন ছেড়ে
রাধিকা-বিহীন কোনও মথুরায় গেছে,
এখানে রাধিকা একা বাচ্চা নিয়ে
বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করে, আর ভাবে
বড়ো হলে ছেলেও কি একদিন বাপের মতোই
অন্য কোনো রাধিকার হৃদয় পোড়াবে?

রাস্তা

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই
সে-সব রাস্তার কথা ধীরে ধীরে লোকে ভুলে যায়—
শুধু সড়কের সঙ্গে যোগ আছে, এই যোগ্যতায়
বাড়ির কানাচ দিয়ে যাওয়া সব গলিঘুঁজি রাস্তাও যখন
কংক্রিট বাঁধানো হয়ে গর্বে ফুলে ওঠে,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটির যত প্রশস্ততা
বুনো আগাছার ফাঁকে সম্ভ্রম হারায়

গলিতে তুফান তুলে যখন সদম্ভে ছোটে বাইক
সাইকেল উড়িয়ে নিয়ে বালকেরা যায়,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটিতে তখন মন্থর এক বুড়ো চাষি
অকাল বর্ষণে ভেজা পাকা ফসলের আঁটি রোদে মেলে দেয়

লোক চলাচল নেই বলে এসব রাস্তায়
মেঠো ইঁদুরেরা তার গর্ত থেকে নির্ভয়ে বেরোয়,
বাবলার হলুদ ফুলের পাশে নীলকণ্ঠ পাখি বসে থাকে,
রোদের আশকারা পেয়ে তার কাছে ঘেঁষে আসে ছায়া,
হাওয়ার চঞ্চল হাত গাছেদের বেণি খুলে দেয়।

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই,
সে-রাস্তা দিয়েই রোজ দুপুরের রোদ একাকী সন্ধ্যার দিকে যায়…

শিখর

যে যার পাহাড় নিয়ে বসে থাকি, অটল শিখর,
বুক ফেটে কত শত শতদ্রু বিপাশা ঝরে যায়…
কত বর্ষা চলে যায়, ধস নামে, খসে পড়ে শিলা,
বুকে যে-পাষাণভার জমা থাকে, কখনো নামে না—
মুখোমুখি বসে থাকা, তবু দুই মুখে দু-রকম মেঘ,
একের মুখের মেঘ অন্যের আজও নয় চেনা।

মেঘের রাজ্যেই বাস, মেঘ ফুঁড়ে ওঠা দুই চূড়া,
এ-চূড়া আগ্নেয় গিরি, ও-চূড়াতে গলেনি বরফ…

মিথ

সিমেন্টের সঙ্গে আরও এক ভাগ বেশি বালি গোপনে মিশিয়ে
জোগাড়িয়া হারাধন গ্রীষ্মকালে খড়ের চালে আরামের গল্প ফাঁদে

খড়ের চালে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখির ঝাঁক বিস্মৃতির ওপার থেকে উড়ে এসে
রাজ মিস্ত্রি হারাধনের বাটি থেকে নির্ভয়ে মুড়ি খেয়ে যায়

প্রমোটার হারাধন স্বপ্ন দেখে খোলা এক আকাশের—
সে-আকাশে উঁকি মারা সারি সারি তালগাছের পাতার শীর্ষ থেকে
বাবুই পাখির বাসা ঝোলে, তাদের ধরে আনা জোনাকিতে
সেইসব বাসার খোপে খোপে সন্ধে হলে আলো জ্বলে ওঠে।

জোগাড়িয়া থেকে রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি থেকে প্রমোটার, হারাধনের বিবর্তনের ইতিহাসে
বাবুই পাখির বাসা আর খড়ের ঘরে আরামের গল্প
মিথ হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসে…

রাগের সন্তান

গেঁড়ি গুগলি খুঁজে ফেরা হাঁসের পালের পাশাপাশি
আমাদের এ-পাড়ার মেয়ে বউগুলি রোজ দুপুরের রোদে
ঝাঁক বেঁধে নেমে পড়ে নয়ানজুলিতে,
এক বেলা নিরামিষ কাটাবার মহাআয়োজনে
ছাকনি জালে উঠে আসে চুনোপুঁটি মাছ।
বাড়তি কিছু মিলে গেলে কাছাকাছি বাস স্টপ আছে,
নিমেষেই সব কিছু ফাঁকা হয়ে যাবে…

তাদের চোখের প্রান্তে ঝলসে ওঠে বাজারের আলো,
নখের দুরূহ কোণে নেল পালিশের মতো কাদা,
মরদ দেয় না কিছু, এইসব চোরা রূপটান
মেয়েদের নিজেদের উপার্জন, মরদ জানে না।
মরদেরা সারাদিন ঠা ঠা রোদে জগতের হাতে
পর্যুদস্ত হতে হতে সঞ্চয় করেছে শুধু রাগ,
সব রাগ ঢেলে দেবে অন্ধকারে রাতের শরীরে…

তাদের সন্তানগুলি, আমাদের এ-পাড়ার ছেলেপুলেগুলি
সেইসব মরদের ক্রোধজাত, জন্ম থেকে রাগের সন্তান…

বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ

মেঘেরা এখন খুব স্বাস্থ্য-সচেতন।
বিবাহিতা মেঘেরাও অষ্টাদশীটির মতো স্লিম হতে চায়,
সকাল হওয়ার আগে প্যারেডে বেরোয়,
তারপরে রোদ উঠে গেলে
ত্বকের ক্ষতির ভয়ে আর তারা বাইরে আসে না,
নেহাত বেরোতে হলে ফুলন দেবীর মতো
ওড়নায় ঢেকে রাখে মুখ।

আমাদের মতো যারা মেঘেদের বন্ধু ও স্বজন,
শনির মানত রাখি, মেঘেদের ঘরে যত কার্তিক বসাই,
কোনো কিছুতেই আর বৃষ্টি আসে না।

মনে হয়, আজকাল মেঘেরাও কন্ডোমের ব্যবহার শিখে গেছে!

শ্রীযুক্ত বদন দাস

তাঁতঘর অন্ধকার।
বদন দাসের তাঁতকলে ধুলোর চাদর বোনে নীরবতা,
মাকুর বদলে। অথচ বদন আজও হাটে যায়,
রাধামনি হাট থেকে কিনে আনা মিলের গামছা বড়ো যত্ন করে বেচে—
কেবল যে-সব দিনে হাট নেই, জাল হাতে চষে ফেলে বাড়ির পুকুর,
সন্ধ্যাবেলা এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাদুড় ধরার জাল পাতে।
লবাদের বাঁশবনে শিরিষের ডালে ঝোলা যে-সব বাদুড়
সন্ধ্যাবেলা পর্যটনে যায়, সকাল হওয়ার আগে
তাদের দু-একটি যদি কখনও না ফেরে,
বদন দাসের ঘরে উৎসবের আয়োজন লাগে।

তাঁতঘর অন্ধকার। উৎসবের শেষে
শ্রীযুক্ত বদন দাস স্তব্ধ মাকুটির মতো বসে থাকে…

বিড়ির জন্য সনেট

বিড়ির ধোঁয়ায় আছে পাঠের বিরতি,
কৈশোরের মুক্তিস্বপ্ন, চোরা সুখ, ভয়।
ধোঁয়ার বিষম দিকে চরিত্রের গতি,
‘উন্মার্গগামিতা!’— ক’ন গুরু মহাশয়

কটুগন্ধ, তেতো স্বাদ, প্রতি টানে কাশি
প্রিয় নারীটির মুখ সহসা বিকৃত
ফারাক থাকে না কিছু, আঠারো কি আশি
যুবাকে প্রবীণ লাগে, জীবিতকে মৃত!

তথাপি বিড়ির তুল্য বন্ধু নাই আর
এক ফুঁকে দূরে যায় যত ভূত প্রেত
দেহ সূক্ষ্ম হলে বাড়ে মগজের ধার
বিড়ি অর্থে শ্রমজীবী, প্রোলিতারিয়েত,

যতই নেভাতে চাক সাহেবের বুট
আগুন লুকিয়ে রাখে পাতার চুরুট।

 

 

Categories
কবিতা

নীলম সামন্ত

বারান্দা


যৌথের বারান্দায় বিচ্ছিন্ন শব্দবোধ—
পুরোনো মাটি।
দু-হাতে ভিক্ষাপাত্র;
ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে স্বস্তিক৷
কেউ কি দেখেছে?
দেওয়ালে লেগে নেই শাবকের তিল।
পুজোহীন ষষ্ঠী—
অথচ বার বার বলেছি বারান্দাই উৎসব।


বেনামি পাখি, ছড়ানো ভাত—
বারান্দা ঢুকে পড়ে বুকের ডান দিকে।
দু-একটা ব্লকেজ।
যতদূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ,
ভাঙা ইলেক্ট্রিক পোস্ট।
ডান দিকে আর একটু সরে গেলে স্পষ্ট হয়—
আধপাকা খেজুর আর গম রঙের তফাত
ঠিক ততটা যতটা
জানালা আর বারান্দার৷


রাস্তার ওপর মুখ বার করে ঝুলে থাকা বারান্দা
ঘন সবুজ
বড়ো বড়ো থাম
কাচের বাটিতে শুকনো চন্দন—
চোখ বন্ধ করলেই
অবুঝ সুবর্ণলতা।
যার দুপুর-বিকেল—
একফালি রবীন্দ্রনাথ
হিসেবের ভগ্নাংশে কোকিলের সুর
বাঁশিওয়ালার চোখ
সারারাত অন্ধকারে আঙুলে ফুল ফোটায় চৌরাশিয়া।


জীবনে সে আসার পর প্রতিটা আঙুলে
বারান্দা এঁকে বলেছিল
“তোমার একটু দখিনা বাতাস প্রয়োজন”।
এক পেয়ালা ব্ল্যাক কফি
আর একটা কাপ সহ আংটিতে
লিখে রাখছি
একাকিত্ব—
কোটেশনে ভালবাসার রেস্তোরাঁ ও রংরুট।


আঘাত আর বারান্দা পরিপূরক ধরে নিলে
নিজেকে কবর থেকে তুলে
পুড়িয়ে ফেলি
বছরের পর বছর
যা কিছু প্রস্তর
যা কিছু ভঙ্গুর
সাকুল্যান্ট সাজানো টেরিরিয়াম
দু-একটা পাহাড় হেঁটে যাবার পর
প্রচার করি
আঘাত কিংবা বারান্দা
ওক কাঠের ফায়ারপ্লেসে নিজেদের সাজিয়ে তুলছে
পরিত্যক্ত রেড ওয়াইনে।

Categories
কবিতা

রাজীব মৌলিক

খচ্চর

পায়ের তলাতে রাখা আমাদের দুঃখ
তবু কেন ঘাসফুল হয়ে ফুটল না
নদী হয়ে ছুটল না—

গড়িয়ে পড়ছে দিন; দেহ থেকে হাত
তারা কেন আদালতে গিয়ে বলল না
পড়াশোনা করে চুষে দিতে পারব না কালো দাগ।

মা-কে নিয়ে কথা হয় রোজ
ভাগাভাগি করি হাতাহাতি করি খিস্তি দিয়ে বলি
জন্ম না দিলেই বাঁড়া দেখতে হত না
খচ্চরের মুখে ঝামা ঘষে দিলে কেউ ফাঁসি হয়ে ফুটত না!

দেশকে আমার মনে হয় কেন ভিখিরির কোল
গভীর ঘুমেও ভেঙে যায় ঘুম থেকে
ডেকে ওঠে ককিয়ে যে পাড়া
বেশ্যার ভাতের ফ্যানে আমার আইন দেয় টোল।

মাজন

আমার এখন মানুষকে দেখলে ভয় হয় না
কাউকে আর অনুরোধ করে কিছু বলতে হয় না
কোনো অবিশ্বাস করার কিছু নেই

এখন আমি সরকার পক্ষের
সরকার আমাকে যা বলে আমি তাই করি
আমার নিজস্ব কোনো চোখ কান নেই
বন্ধুরাও আমার দলে যোগ দিয়েছে
আশাবাদী গোটা পৃথিবীটাই আমার সঙ্গে

যদিও আমার বাবা মা বিরোধিতা করেছে
এবং তারা সরকারের সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে
আমি সুবিধাবাদী পন্থায় বিশ্বাসী

নিজের সুখের জন্য সরকারের পতন চাইতেও পারি।

আমার কবিতা

আমার কবিতা ঘুমিয়ে পড়েছিল
খিদেয়, তৃষ্ণায়, পাঠকের অবহেলায়
সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মতো আবার জেগে উঠেছে

এখন আমার কবিতা খেতে জানে
ঘুমোতে জানে
লোকমুখে উলঙ্গ হতে জানে
কুকুরের মতো পা চাটতে জানে

আমি আশ্চর্য হই তার জাদুকরী শক্তি দেখে
আমার কবিতা কখন কুকুর হয়ে গেছে
কখন ঘেউঘেউ করা শিখল—

দেশটা কি সত্যি সত্যি কুকুরে ভরে গেল!

খেউড়

বাবাকে গালি দেওয়ার মতো শব্দ বাংলা অভিধানে নেই
তাই সরকারের মতো তার কাজকর্ম বলে গালি দিই

সে এতে মনে কিছু করে না
ভাবে ছেলে সোনার টুকরো
গালি দিলেও গায়ে লাগে না

অথচ আমি মন থেকে বাবাকে গালি দিই
আর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি

কাউকে যেন এমন হাত না দিয়ে পাঠান
যে-হাতে শুধু ইট পাথরের শব্দ লেগে থাকে

সঙ্গে একটা কালো টিপসই…

হাটবার

পশুদের হাট বসেছে আজ
সমস্ত হিংস্র পশুরা বুথে বুথে দামি গাড়ি নিয়ে ঘুরছে
আর দেখছে ছোটো ছোটো হরিণ শাবকের দল
লাইন দিয়ে বলী হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে

ব্যানারে ফেস্টুনে খোদাই করা তাদের নাম
কেউ-বা মাইকে ছড়িয়ে দিচ্ছে হুমকি
বলি হওয়ার বিভিন্ন পন্থা

আমার বাবার শরীর ভালো না
তবু সে হাটে যাবে

হাটে না গেলে গোয়ালে বলী হওয়ার মতো পশু নাই

উপত্যকা

গুষ্টিশুদ্ধ বোকাচোদা একজায়গায় জড়ো হয়েছে
এবার বাজেট তৈরি হবে—
কে কার পেটে লাথি মারবে তার প্ল্যান লিখে রাখা হবে
ভিখারির দল এ শুনে রাস্তা অবরোধ, ট্রেনে আগুন জ্বালাবে
ওদের কাজই দেশে আগুন লাগানো

এত বেশি আগুন যদি পোঁদে থাকে
তাহলে সাহস করে যা না মেরে আয়
প্ল্যানিং কমিটির পোঁদে

মরলেও লোকে বলবে
শিশুকালে বাঘিনী মায়ের দুধ পান করেছিল

বালটা আসলেই একটা মাল ছিলো…!

ডাঁসা

ডাঁসা পেয়ারার মতো তোমার ভবিষ্যৎ
অন্ধকারে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে—

তুমি জ্বলে উঠছ
গাঁজাখোরের মতো

উজ্জ্বল হয়ে উঠে আবার কেলিয়ে যাচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ
আর তাতেই বাঁড়া তুমি রেগে লবডঙ্কা
সামান্য দেশলাইয়ে বারুদ কম থাকায়
হাত উঠালে দোকানদারের উপর
হাত উঠালে মা বোনের উপর

অথচ তোমার প্রতিটি রাতজাগা জুড়ে আলো ফেলছিল
থিওরি, থিসিস, লিটেরাচার, সায়েন্স।

ভিত্তিহীন

একুশতম গোল মিটিঙেও দেশের উন্নয়নের কথা বলা হল না
আর রাজ্যটা তো বোকাচোদায় পেয়েছে
যে-ই ক্ষমতায় আসে সেই গাঁড় মারে

এবার দুর্গাপূজায় মা-কে পুরোনো শাড়িতে দেখতে হবে
অথচ উদগাণ্ডুগুলো নশ্বর দেহে কেজি কেজি সোনা পরিয়ে
পালন করবে ডি জে উৎসব।

ভাড়াটে মাগিদের নাভি দেখে নৃত্য ভুলে যাবে
কিশোরী মেয়েটি।

তবু বিদ্রোহ করবে না। রাস্তায় নামবে না একজোট হয়ে
পার্টি পার্টি করে নিজের রক্ত চুষতে দেবে—

অথচ যে-কোনো মুহূর্তে দেশটা বলদে যেতে পারত
শুধু একটা বিদ্রোহ দরকার
সমস্ত রং ভুলে একবার মাঠে নামলেই নৃপতিরা পালটে যেত।

শোঁ-শোঁ

শোঁ-শোঁ আওয়াজ করে গিলে খাচ্ছে তোমাকে আমাকে
স্বপ্নের ভেতরেরও ঢুকে পড়ছে হেলিকপ্টার
আমাদের প্রিয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী

তার শরীরে কোথাও স্বপ্ন নাই
তার মনে কোথাও পাপ নাই

সে নরক থেকে পালিয়ে এসেছে
লুসিফার তল্লাশি করেও ব্যর্থ হয়েছে

এবার আমরাও ব্যর্থ হয়েছি চিনতে
তবু সোচ্চার হচ্ছি না

আমাদের কলিজা সে কিনে ফেলেছে
জোম্বি হয়ে গেছি আমরা

নিজেদের রক্তকে ভাবছি বিরোধী মুখ।

Categories
কবিতা

দেবাশিস বিশ্বাস

নামহীন


সন্ধেই কিচিরমিচির করে যখন তার পাখি থাকে না। উঠতি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বয়স। এই বয়স নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল ভৈরব। তার দেখা ভয়ংকরতম উদাহরণ হল সে। যেমন লেকচারে জীবন পোড়ে৷ এক পোড়া ঘরে বেলুন ফাটাচ্ছে শিশুটির৷ কি না করেছে সে। বাপের সম্পত্তি হল কচ্ছপের পিঠ— তাকে ধরার বারুদে নত হয়ে গেছে। কৃত্রিম বয়স ওড়ানোর তালিম নিচ্ছে হাওয়ায়।

ভৈরব ঐ কিচিরমিচিরে দৃশ্যহীন।
মাথায় পাগড়ী থাকলেই কি হয়? কখন যে পাইথন পেঁচিয়েছে মাথায়… তার ঘণ্টা ভেঙেছে
শব্দ হয়েছে পৃথিবীর বুকে

এটা তুমি ঈগলের চিৎকার বলছ?


মাথা ঝোঁকার জন্য হলে মরে যেতাম

হাসির ভিতর আঁকা থাকত দাঁত।
এমন করেছো তুমি—
ঘরের ভিতরের হাসি ঘর থেকে বার করতে?

পুরোটা সকাল আলো পোড়াতে গিয়ে হাত পোড়ে
নক্ষত্রের পিণ্ডি মুছে হাসির ভিতরে আঁকো—
— নাহ্! জটিল হচ্ছে চিৎকার!
আমরা কেন কিড়িমিড় শব্দ করে ভয় দেখাচ্ছি তাকে!

তার হাসপাতালে ঘুরতে যেও
জটিল রোগগুলো মরে যাবে সে জানে—


কবিতা লিখলেই
মানুষের কানে চোখ বাড়ে… রোম খাঁড়া হয় প্রগাঢ় দুপুরে
ভেণ্ডি বাগানে এত সবুজ ধুয়ে গ্যাছে কেন?
কবিতা লিখলেই, প্রশ্ন আসে
উত্তর সাপের হেঁটে আসা নকল করে।
ঝুম করে কারোর হাসি পারতে বল্লেই—
তোমার হাত এত লম্বা হয় যেন মহাকাশ চুরি করে পকেটে পুরছ।

কবিতা লিখলেই,
হাসিকে থেঁতলে দিও
মানুষের কানে চোখ বাড়ে
ভেণ্ডি বাগানে


উৎসব শুরু হয়
অন্ধ তাঁবুর নির্জনে, ব্যাঙ এসে লাফ দ্যায় ঘাড়ে
তার ইউরিক চর্চা যখন ছিল না তখন অতিবর্ষায় পায়ে পাপড়ি হয়ে ফাটে…
পায়ের দোষকে মাথায় তুলো না।
পায়ের জন্যই এই হাঁটা পথ মাথাকে ন্যুব্জ করে।
তারপর ঘর আসে,

ঘরের ভিতরের হাসি ঘরেই থাকছে কেন—
ব’লে রু রু দুপুর কাঁতরাচ্ছে ভীষণ!

জবলেস

চাষের উর্বরতার জন্য কেঁচোকে নিয়ে এক নম্বরের প্রশ্ন
উত্তর দিলে সেন্ট্রাল আমায় গ্রুপডি-তে নিয়োগ করবে
আমি আমেরিকার পতাকায় ক-টি তারা মুখস্থ করেছিলাম
যাতে আন্তর্জাতিক উত্তরের জন্য দু-নম্বর বেশি পাওয়া যায়
এরকম অবস্থায় যারা পারে না
তারা সকাল থেকে সন্ধে কোনো নক্ষত্র দেখে না
ইমাজিন করুন, ওই মুহূর্তটুকু সে কেঁচোর প্রয়োজনীয়তা অথবা আমেরিকার তারা সম্পর্কে কতটা ব্যতিব্যস্ত

হাত ফাঁক করলে কল্পনা ঝরে
যুবতীরা কল্পনা খায়

এপিটাফ

বনভূমি ডেবে রাখে
হাতগাড়ি
তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া কি মুশকিল, বলো!

যদি আগুন ধরিয়ে দিই
যদি ক্রুড অয়েলের লোভে প্রিয়তম হাড়-ম্যান
নিজের অক্ষিকোটরে বিশুদ্ধ বারুদ লুকিয়ে রাখে

নিশ্চয়। ঘরের কোনাটায়
যদি আগুন ধরিয়ে দি
বনভূমি ডেবে রাখে হাতগাড়ি ও কিছু সস্তার অ্যালকোহল!

আপাতত আকাশ কাঁপিয়ে
পাখিগুলির তন্তু আঁশ পায়ুনালী
ওড়াতে ওড়াতে, আমি এক ধোঁয়াপ্রবণ শিলায় খোদাই করে রাখছি এসব—

শেষে পৃথিবীর ভাগাভাগি তেমন জটিল নয়

নিরক্ষরেখা, অক্ষাংশের হ্যালুসিনেসন ছাড়া!

অস্বস্তি

কবিতা লেখার দায়ে বানানো হয়েছে—
এরকম ভাবলে মন শ্রান্ত হয় বলছ?
যেদিন গুচ্ছ গুচ্ছ গুহ্যদ্বার থেকে কাগজ বার করে আনছি আমার এক কবি বন্ধু ইংরাজি কবিতা পড়ছেন ওয়াইনকে সাক্ষী রেখে। মহিষের তেল মেখে নেচে উঠছে দাঁড়ি। এই এক বিকাল।
একটা
হেবি ওয়েট পাথরকে মদ্য চোখে মেয়ে বানিয়ে দিচ্ছে
আর তাকে
খাওয়ার চেষ্টায়
পাহাড় কাঁপাচ্ছে, নিম্নে তার পদ্যলেখা
অস্বস্তি
পাখি বাবলা গাছে বসে হাগছে
সে হাগায় ঝগড়া হচ্ছে পশ্চিম পাড়ায়—
তাতে বীজ থাকে
ছিঁবড়া ছিঁবড়া সূর্যাস্তের খুন
দৃশ্যেরও গলার অন্দরে পাখিকঙ্কাল
মরা শালবনে
মুতে
চলে গ্যাছে বাবুল সর্দার—
দাঁতে তার শামুকের মাজন।

পাখিকে যে-কোনো গাছে হাগতে বল্লে
সে কেবল ঘুরেফিরে
এখানেই
চকচকে বিপ্লবের উপর হেগে দ্যায়
যা দিয়ে
পাখির গুহ্য চিরে
মানুষ হয়েছে
তুখোড়
গায়ক।
এখানে
কেন্দ্র ছিল বলে চিৎকার দেখাচ্ছে দূরে/প্রান্তে
ফাটা

আউট অব কভারেজ
এখন
ঝিরি ঝিরি প্রচারবিমুখ শাকাহারী কুনোব্যাং ডুব দিচ্ছে
প্রকৃতির মায়াময়
আলুথালু
উচ্চিংড়ের পাতায়
প্রশ্ন করছো এ্যাত?
চাঁদ ফেটে মহাকাশ
মহাকাশ ফেটে
ঘিলুর তেল— মহাকাল পোলতে জ্বালিয়ে ধ্যানে বসেছেন
‘হরাস’ যার ডান চোখ রোদের নক্ষত্র
কোথাও

 

Categories
কবিতা

রূপক চ্যাটার্জী

চতুর মাছ, তীর ছুঁয়েই
অতলের দিকে চলে যায়। চোখে পড়ে থাকে
রুপোলি ঝলক। কিছু সাদাসিধে ছাপোষা মাছকে ধরে,
জেলে পূর্ণ করে তার আঁশটে উল্লাস!

ভালোবাসা, পূর্ণ আস্থার নাম।
আর পূর্ণ আস্থা বলতে একটি বাবলা গাছ!
যার দেহে কাঁটার তীক্ষ্ণতা থাকলেও
তোমায় হলুদ ফুলের নাকছাবি দেখাবে ভোরবেলা।

নিজেকে খাওয়ার সংকল্প নিয়ে
বহুদিন বুড়ি ছিল অনাহারে।
ডোলভিরা খননের পর, তার ছেলেরা
বহুকষ্টে খুঁজে পেলো বুড়ির কয়লা শরীর। স্তন দিয়ে
তখনও ফোঁটা ফোঁটা সকাল টসকে পড়ছে!

তৃতীয় নেত্র খুলে দাও,
ওই পথ দিয়েই যদি, আমাদের হারানো মেরুদণ্ড পুনরুদ্ধার হয়। তবে ওটাই তলোয়ার করে
বারকয়েক শূন্যে ঘুরাব। শত্রুরা সব তো
হৃদমাঝারে বসে আছে, কাকে আর তাড়াই তবে বলো?

এক কাপ চায়ের পাশেই
তোমার বসে থাকাটা
ডারউইনবাদ এর মধ্যে পড়ে না! আমাকে অগ্রাহ্য করে,
পশমের বল থেকে উলের বুনন আরও
নিরিবিলি, আরও দক্ষ হয়েছে। আমাদের
বসন্ত গেছে বলেই, কাকতাড়ুয়ার কাঁধে বসে
কাক এসে শস্যাবর্তনের গল্প শোনায়!

 

 

Categories
গল্প

রিমি মুৎসুদ্দি

সহগমন

— “এই পাহাড়ে সব তপোবনের ঋষিরা থাকত।”

সামনের সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে উদাস বৈরাগী কথাটা বলল। সোনামণি একবার আড়চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নীচে গঙ্গার সবুজ জল দেখতে লাগল।

— দাও, মোবাইলটা দাও। ফোটো তুলি।

সোনামণির কাঁধে উদাসের হাত।

— কার ফটো তুলবা? আমার? না তুমার ঋষিদের তপোবনের? না ওই গঙ্গার?

উদাস কিছুক্ষণ ভাবে। এই জায়গাটা কি রামায়ণের যুগের তপোবন না কেউ এমনিই নাম দিয়েছে? ওদের গ্রামের বিশাই মণ্ডল কোন জঙ্গল থেকে ঘুরে এসে সব্বাইকে ছবি দেখিয়ে বলেছিল, “হেইটা হইল গিয়া রামায়ণের তপোবন। রাম লক্ষ্মণ এখানেই সব মায়াবী রাক্ষসরে বধ করছিল।”

ভাবনার মাঝে খেয়াল হল সোনামণি তো পাশে নেই? এই অচেনা অজানা জায়গায় নিমেষে সোনামণি গেল কোথায়? উদাস ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সোনামণির নাম ধরে ডাকে।

কোনো সাড়া নেই। এদিকে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে সমস্ত আকাশ জুড়ে লালিমা। উদাসের বুকের ভেতরটা হু-হু করছে।

সূর্যাস্তের সময় এখানে গঙ্গা-আরতি হয়। পাহাড় কেটে গড়া এই মন্দিরে পাহাড়ের মতোই উঁচু একটা চূড়া আছে। তার ঠিক তলায় মন্দিরের সবচেয়ে উঁচুতলায় উদাস আর সোনামণি এসেছে। এখন তেমন পর্যটক নেই। সবাই গঙ্গা-আরতি দেখতে নীচে, ঘাটে।

ওদের সঙ্গে আরও দু-জন পর্যটক উঠছিল। উদাস শুনেছে। একজন বলল, “উফ্‌ফ্‌! কী বিশ্রী গন্ধ।”

আর-একজন উত্তর দিল, “আরে সরষের তেলের গন্ধ। সামনের দু-জন সরষের তেল চপচপ করে মেখে এসেছে।”

— “গেঁয়ো বাঙালি যেখানে যাবে সেখানেই ছ্যাড়াবে। চলো নীচে যাই।”

উদাস শুনেছে ওদের কথা। যারা কথা বলছিল, তারাও বাঙালি। কিন্তু ওদের মতো গেঁয়ো নয়। তবে এরা আজব মানুষ। সরষের তেলের গন্ধ মানুষের গা থেকে বেরাবে না তো কি গোরু মোষের গা থেকে বেরাবে? কথাটা ভাবতেই উদাসের হাসি পেল। শহরের ওই মেয়েটা সরষের তেলের গন্ধে নাক কুঁচকালো। সোনামণির কালোবরণ শরীরের ওই যে পাছা ছাড়ানো চুলের ঢল তা কি সরিষার তেল ছাড়া সম্ভব? আর তেলে ঝোলে থাকে বলেই তো সোনামণির অমন গড়ন। উজানে বাওয়া নাওয়ের মতো উদাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেই এই মেয়ে। পথ জানে না সে। কেবল জানে ভাসতে ভাসতেই ও একদিন মুক্তি পাবে গত জন্ম থেকে।

সোনামণির সঙ্গে উদাসের আজ সহগমন।

সোনামণির ভরসায় গ্রাম ছেড়ে এই এতদূরে হৃষিকেশে এসেছে। এখান থেকে ওরা যাবে দিল্লি। সোনামণির চোখে স্বপ্ন। দিল্লি গেলে অনেক রোজগার। দু-জনে দু-হাতে কামাবে। নতুন বসত হবে। নতুন সংসারে উদাস আর সোনামণির কালোকুলো সব সন্তান খেলা করতে করতে বড়ো হবে। তারা সব একদিন সংসারের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে ধাক্কা খাবে আবার উঠে দাঁড়াবে। নয়তো টুসির মতো ক্রমশ মিলিয়ে যাবে পৃথিবীর জন্ম-মৃত্যুর তালে তালে।

টুসির কথা মনে আনতে চায় না উদাস। মেনকাকেও ধীরে ধীরে ভুলে যাবে ও। তুলসীতলায় মেনকা আজও প্রদীপ জ্বালাবে না। জানে ও।

প্রদীপ আর কোনোদিন উদাসের ভিটেতে কেউই জ্বালাবে না। কথাটা মনে আসতেই ও আবার সোনামণির নাম ধরে ডাকে।

— “বৈরাগী? করো কি এহানে? এখনও নীচে যাওনি?”

পিছন থেকে সোনামণি ওকে ডাকল। সামান্য হাঁপাচ্ছে।

— “তোমার লিগা নিচ থেকে আবার উঠলাম। হুই দেখ আরতি। চলো নীচে।”

ওখানে কয়েকজন পুরোহিত বিশাল বড়ো বড়ো পিতলের প্রদীপ জ্বেলে আরতি করছে। আগুনের শিখা অনেক উঁচুতে উঠেছে। আকাশ আর গঙ্গা যেন একসাথে মর্ত্যলোকের পুজো নিচ্ছে।

উদাসের হাত ধরে সোনামণি নীচে নিয়ে আসে। গঙ্গার পাড়ে আরতি দেখতে দেখতে সোনামণি নাচছে।

— “ওঁ জয় গঙ্গে মাতা”

কোথায় যেন রেডিয়োতে বাজছে। কত লোক গান গাইছে। সোনামণিও গাইছে আবার নাচছে। ওর গায়ের সরষের তেলের গন্ধে আবার কেউ বিরক্ত হবে না তো? উদাস ভাবে। মন একজায়গায় স্থির হয় না। ঘাটের সব কথা ছাড়িয়ে চোখ চলে যাচ্ছে ওই পিতলের প্রদীপের ধোঁয়ার দিকে। পণ্ডিতজি হাত উঁচু করে প্রদীপ ঘোরাচ্ছেন। কত উঁচুতে উঠছে শিখা। এবার আরও কাছ থেকে দেখে উদাসের চোখ জ্বালা করে উঠল। টুসির চিতার দাউ দাউ আগুন ওর মুখ পুড়িয়ে দিচ্ছে।

শীতের রাত শেষ হওয়ার আগেই মেনকা গোবর দিয়ে উঠোন নিকানো শুরু করেছে। আজ আবার পৌষ লক্ষ্মীর পুজোয় উপোস মেনকার। উপোস দিলে ওর রূপ যেন আরও খোলতাই হয়। বিয়ের সময় কে যেন বলেছিল, “সগ্‌গের সুন্দরীরে দিলাম তোমারে। ও-মেয়ে এত সুন্দর বলেই তো ওর নাম মেনকা।”

কে বলেছিল সে-কথা উদাসের মনে না থাকলেও কথাটা ওর মনে আছে।

নিন্দুকেরা অবশ্য বলে মেনকার বাপের বাড়ি হাবিবগঞ্জের মেয়েমানুষেরা জমিদার, সাহেবসুবো, কারখানার বাবুদের ঘরে যেত। বাগানবাড়িতেও যাতায়াত ছিল গঞ্জের মেয়েমানুষদের। হাবিবগঞ্জের বেশিরভাগ মেয়েদেরই তাই ফর্সা চাঁদপানা বাচ্চা কোলেই দেখা যেত। এইসব নিন্দেমন্দ উদাস খুব একটা পাত্তা দেয় না। হোক না জমিদার বা সাহেব সুবোর রক্তে জন্মানো। মেনকাসুন্দরী যে ওর ঘরদোর, উঠোন, আলো করে আছে। এই ওর ঢের।

পুজো আচ্চায় উদাসের টুসিকে মনে পড়ে। মেয়েটার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে বারণ করেছিল মেনকা। চাষির মেয়ে চাষির ঘরে যাক। এও বলেছিল। উদাস শোনেনি। চাষির ঘরে রোজগার কই? দেনা শোধ করতে করতেই ফসলের দাম সব শেষ। আবার দেনা। জীবনটাই দেনার চক্রে বাঁধা। শহরে চাকরি করে বাপি মণ্ডলের ছেলে। মাস গেলে বাঁধা মাইনে। মেয়ের খাওয়া পরার অভাব হবে না। অমন জামাই হাতছাড়া করা যায়?

অতদূর থেকে মেয়ে আসতে পারে না বাপের ঘরে। মেনকার তাই দুঃখ। উদাস এবার সংক্রান্তির পরেই যাবে মেয়েকে ঘরে আনতে। দুর্গাপুজোয় তত্ত্বতালাশ করে উঠতে পারেনি। বৃষ্টিতে সব ফসল নষ্ট এবার। নদীর বাধ ভেঙে বাড়িঘর সব জলের তলায়। আবার পুনর্বাসন প্রকল্পে নতুন ঘরের চাল উঠেছে। এখনও কাঁচা। কোনোমতে চলে যাচ্ছে দুটো পেট। মেয়েটাকে আনতে সাধ হয়। কিন্তু খাওয়াবে কী?

পুজোর দিনে মেনকা উদাসকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিল। আসছে হপ্তায় মেয়েকে বাড়ি আনতেই হবে। মেনকার দিব্যি উদাস ভোলেনি। শহর থেকে মেয়েকে নিয়েও এল। শহরে টুসি একরকম মন্দ ছিল না। বাপির ছেলে গোবিন্দ খুব বড়োলোক না হলেও খাওয়া-পরায় মোটামুটি রেখেছিল। পাঁচ মাসের পোয়াতি মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে এলে মেনকার আনন্দ ধরে না। মেয়েকে কী খাওয়াবে কোথায় বসাবে ভাবনায় অস্থির। তারপর একটু সুস্থির হলে ভাত রাঁধতে গেল। উদাস গেল চানকিদের বিলে মাছ ধরতে।

পুকুরে ছিপ ডুবিয়ে উদাস চুপচাপ বসে থাকে। শীতের রোদ পেয়ে জলের শ্যাওলাগুলো আরও সবুজ হয়েছে। উদাসের মনে পড়ল, আমিনাবিবির কথা। মাছ ধরতে শ্যাপলা শালুক কুড়াতে প্রায়ই আমিনা আসত। উদাসের সঙ্গে কতবার এখানে দেখা হয়েছে। চোখাচুখি হলে হাসত। এই গেল বছর শীতেই মাছ ধরতে এসে শ্যাওলা আর পাঁকে পা জড়িয়ে মারা যায় আমিনা। লোকে তাই বলে। কীভাবে মারা যায় কেউ জানে না। শরীরটা বিলের জল পেয়ে ফুলে উঠেছিল একরাত্তিরেই। আমিনার বর বর্ডার পারের জাহাজ থেকে তেল আনতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খাটছে আজ দু-বছর।

আমিনা ভরদুপুরে বিলের পারে গিয়েছিল কেন? জল ছেঁচে মাছ আনতে? না অন্য কোনো এক নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে? আর গাঁ-গেরামের মেয়ে সাঁতার জানে। বিলে ডুবে সে মরলই-বা কী করে? এই প্রশ্নটা উদাসের মাঝেমধ্যেই মনে আসে।

বুড়ো বটতলার গায়ে লাগোয়া এই বিল আগে চানকিদের পুকুর ছিল। চানকিরা ছিল এখানের সবচেয়ে ধনী গোয়ালা। গঞ্জের সবচেয়ে বড়ো মিষ্টির দোকান ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ ছিল ওদের চারপুরুষের ব্যাবসা। এখন এই প্রজন্মের দুই ছেলেই শহরে চাকরি করে। শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টির দোকান বহুদিন বন্ধ। ওখানে হরেন মণ্ডলের চালের গুদাম। চানকিদের ভিটে গোয়ালঘর পুকুর সব পোড়ো জঙ্গলের গর্ভে। ওখানে এখন বড়ো বড়ো বাঁশঝাড়, জঙ্গল। দিনমানেও এখানে অন্ধকার।সন্ধ্যে হলে একা এই বাঁশবাগানে ঢুকতে কারও সাহস হয় না।

সেবার বিলের ধারে চানকিদের বাঁশবাগানে প্রথম একটা লাশ পাওয়া গেল। কার লাশ তা গ্রামের মানুষেরা কেউই উদ্ধার করতে পারেনি। মুখটা থ্যাঁতলানো। গোপাল পাঁড়ুইয়ের ছেলে কলকাতা থেকে ফেরেনি পাঁচ বছর। গোপাল ওই থ্যাঁতলানো মুখ দেখে ডুকরে কেঁদেছিল। তারপর সবেগে, “না না না” বলে ছুটে ষ্টেশনে গিয়ে কলকাতার টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসল। তা সেই গোপাল আজও ফেরেনি গ্রামে।

আমিনার আগে বারো বছরের পদ্ম বিলের জলে শাপলা তুলতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। বিলের জল তোলপাড় করে মেয়েকে খুঁজল কানাই আর লক্ষ্মী। গ্রামের মেয়ে মরদ জোয়ান বুড়ো সবাই বিল প্রায় ছেঁচে ফেললে। তবুও পদ্মকে পাওয়া গেল না। তিন দিন বাদে পদ্মর ছোটো শরীরটা দলা পাকিয়ে পড়েছিল চানকিদের জঙ্গলের এককোণে।

এইসব নানা কারণে, কথায় উপকথায় চানকিদের বিলের বেশ দুর্নাম। মেনকা তাই বিল থেকে মাছ ধরতে বারণ করে উদাসকে। বিল-ভরা মাছ দেখে উদাস অস্থির হয়। কোনো দুর্নাম, ভয়কে সে আর পরোয়া করে না। শিকারী বেড়ালের মতো বসে থাকে।

মেনকা খেত থেকে কোচর ভরে সরষে ফুল এনেছে। টুসি বড়ো ভালোবাসে। গরম ভাতে নুন কাঁচালংকা দিয়ে মেখে মেয়েটা একথাল ভাত খেয়ে নেবে।

আয়োজন সামান্যই সরষে ফুল ভাতে আর ইচা মাছের ঝাল। উদাস বিল থেকে গামছা করে ক-টা ইচা মাছ এনেছিল। মেনকা বেশ তরিবৎ করে ঝাল রেধেঁছে। অনেক দিন বাদে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে টুসি খুব খুশি।

মেনকাকে না বলে আগেও চানকিদের বিলে ও মাছ ধরেছে। গামছা দিয়ে জল ছেঁচেই কত কুচো চুনো মাছ পেয়েছে। আজ আবার একটা পুরোনো বড়শি নিয়ে ও গেল।

মাছ ধরতে গিয়ে পেল একটা কালো রঙের মাটির পাতিল। পাতিলখানা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে উদাস। বেশ পুরোনোই হবে জিনিসটা। এখানে এমন পুরোনো জিনিস জলে ভেসে আসত আগে। সেইসব বিক্রি করে অনেকে টাকাও পেয়েছে। ইদানীং বিলের ধারে বড়ো কেউ আসে না। আবার আসে হয়তো। লোকচক্ষুর আড়ালে।

— “হেইটা কী বিলে পাইলা?”

উদাস চমকে ওঠে। পঞ্চায়েত প্রধান শিবু বাঁড়ুজ্জের ছেলে বিমান।

উদাস মাথা নাড়ে।

— “দাও। দিয়ে দাও ওটা। এগুলো সব সরকারের সম্পত্তি।”

উদাস পাতিলটা দেয় না। তর্ক করে। বিমান তখনের মতো চলে যায়। সেদিন একটাও মাছ পেল না উদাস। মনটাও বিমানের সঙ্গে তর্ক করে তেতো হয়ে রইল।

সন্ধ্যেবেলা বিমান উদাসের বাড়ি এল। পাতিলটা একবার দেখতে চাইল। তারপর নেড়েচেড়ে বললে, “এর দাম তুমি ছ-শো টাকার বেশি পাবে না। আমি আটশো দেব। আমারে দিয়ে দাও।”

আটশো টাকা কম নয় উদাসের সংসারে।

— দিব অনে। কিছু বাড়ায়ে দাও?

— বেশ। ন-শো টাকা।

টাকা ক-টা পেয়েই মেনকার হাতে দিল উদাস। ওর লক্ষ্মীপুজোর ফল মা দিয়েছে। পুজোর ক-দিন পরেই টাকাগুলো এল।

বিমান বলে গেল, ওদের বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজা আছে। মেনকাকে পাঠিয়ে দিতে। সেই শুরু, মেনকার পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে আনাগোনা।

সোনামণি মেনকার মামার মেয়ে। মেনকার সঙ্গে তেমন ভাব নেই। মেনকা ওকে দু-চক্ষে দেখতে পায় না। বলে ওর ধরণধারণ ভালো নয়। সোনামণির মা মুন্সিগঞ্জের স্টেশনপাড়ার মেয়ে। ওর মামার ও-পাড়ায় যাতায়াত ছিল। সোনামণির মায়ের কারণে মেনকার মামারবাড়ি গ্রামে একঘরে প্রায়। কেবল গঞ্জের পার্টির বড়ো নেতা সুবল মণ্ডলের সঙ্গে ওর মায়ের ভাব বলে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না এখন। মেনকা পারতপক্ষে ওদের থেকে দূরে থাকে। তাও সোনামণি মাঝেমধ্যে এসে উপস্থিত হয়। আর ও এলে টুসি খুব আনন্দ পায়। দু-জনে খুব বন্ধু। মাসি বোনঝির এই গলাগলিভাব মেনকার অসহ্য। তবুও বাধ্য হয়েই যেটুকু আদর আপ্যায়ন করে।

উদাস বরং বলে, “আহা! অতটুকু মেয়ের কী দোষ?”

এই কথা শুনে মেনকা তেলবেগুনে জ্বলে ওঠে।

সেবার রথের আগে সোনামণি এল বাড়িতে। ওদের এখানে রথের মেলায় দূর দূর থেকে লোক আসে। গ্রামের অনেকের বাড়িতেই আত্মীয় কুটম আসে মেলা দেখার জন্য। সোনামণি এসেই মেনকার এই রোজ রোজ পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ি যাওয়া নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করল। প্রথম প্রথম উদাস হেসেই উড়িয়ে দিত। কীর্তনের ভোগে লুচি পায়েস অথবা গরম খিচুড়ির লোভে, মাঝেমধ্যে একটা দুটো গাছের নারকেল, পাকা আম, লিচু, কাঁঠালি কলা আবার দুই এক টুকরো রুই কাতলার লেজা গাদা হাতে নিয়ে ঘরে ফিরত মেনকা। উদাসের লোভ লাগত। বারণ করতে পারত না। কিন্তু সোনামণির ঠাট্টা শুনে সেদিন চোখ জ্বালা করছিল।

গ্রামে ভোটের হাওয়া এসে লেগেছে এর মধ্যেই। এখন পরিবর্তন নাকি হবেই। হরেন মণ্ডল এবার ভোটে দাঁড়াবে। মানুষ হিসাবে হরেন আর শিবুর তেমন ফারাক নেই। বরং হরেন কীসের যেন ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছে। শিবু বাঁড়ুজ্জ্যেকে একহাতে কিনে আবার বিক্রিও করতে পারে। এমন তার প্রভাব প্রতিপত্তি।

মেনকার ওপর রাগ না কি শিবু বাঁড়ুজ্জ্যের ছাওয়ালের ওপর তা আজ আর উদাস মনে করতে পারে না। হরেনের একটা চালের গুদাম আছে নীলপুরার বাজারে। সেখানে অনেক লোকের আড্ডা। তারা সব হরেনের দলের কর্মী। উদাসও একদিন গেল। হরেন চা খাওয়ালে। বিড়িও দিলে।

উদাসের মনটা বড়ো খুশি হল। সে রোজ যাওয়া শুরু করল। রথের মেলায় সোনামণি আর টুসিকে ঘুরিয়ে নিয়ে এল। উদাসের মনে ফুর্তি। মেনকারও।

উদাস বোঝে না। মেনকার ফুর্তির কারণ। সোনামণি বাড়ি এলে ওর যে একটা রাগ রাগ সদা সর্তক ভাব। সারাক্ষণ মেয়েকে আগলে রাখে। এখন আর সেই ভাবটা নেই। বরং মনটা কেমন বাইরমুখো। বিমানের মায়ের কোন গুরুদেব নাকি সন্ধ্যেবেলা আসে ওখানে। নামকীর্ত্তন হয়। মেনকার রোজ যাওয়া চাই সেখানে। খালি হাতে অবশ্য ফেরে না। হাতে করে প্রসাদের মিষ্টি, ঠাকুরের ভোগ রোজই নিয়ে ফেরে। ওই খাবারটুকু খাওয়া হলেই উদাসের মাথা কেমন ভোঁ-ভোঁ করে। রাত্রে মেনকার গা ছুঁলে সরে যায় ও। বলে গুরুদেবের বারণ।

উদাসের ভেতর একটা সাপ সারাক্ষণ ফোঁসফোঁস করে। ছোবল দিতে চায়। কিন্তু সে-শক্তি ওর নেই।

একদিন অনেক রাত হয়ে গেল হরেনের চালগুদামে। সেদিন লোক বিশেষ কেউ ছিল না। হরেন ডাকল উদাসকে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করল। আড্ডায় নেশাভাঙ তো ও রোজই করে। নেশার কারণে নয়, ওর ভেতরের সাপটা ফোঁসফোঁস করতে করতে জানান দিল এই হচ্ছে বিষ। গিলে নাও। সবটা বিষ গিলে নিলে ছোবল দিতে পারবে।

উদাস ভেতরে জমে থাকা সব বিষ উগরে দিল হরেনের কাছে। গেল মঙ্গলবার বিলের ধারে ও নিজে বিমানকে আর মেনকাকে দেখেছে।

বটগাছের নীচে আধশোওয়া বিমান। আর মেনকা আঁচল দিয়ে জল ছেঁচে মাছ ধরছে। খিলখিল করে হাসছে, কথা কইছে বিমানের সঙ্গে। উদাস গিয়েছিল ওদের সামনে। উদাসকে দেখে দু-জনের সে কী হাসি। বলে নাকি, “মামী দেখ, মামা তোমারে না পেয়ে বিলের জলে খুঁজতে এয়েছে?”

— “মামী?”

উদাস ফোঁসে। মনে মনে বলে, “মেনকা তোর মামী? আর তুই কে রে হারামজাদা? কানু?”

ইচ্ছে হয় একটা বড়ো পাথর তুলে যদি ছুড়ে মারে বিমানকে? দু-জনেই এমন করে হাসে, কথা কয় যেন কিছুই হয়নি। খুব স্বাভাবিক। বিমান নাকি রোজ এখানে আসে। আবার যদি চারশো পাঁচশো বচ্ছর আগে কোনো হাঁড়ি পাতিল ভেসে আসে বিলে? এগুলোর নাকি বাইরে খুব দাম!

আর মেনকা? যে উদাসকে বিলের ধারে দুপুরবেলা আসতে বারণ করত সে এখন রোজ নিজেই মাছ ধরতে আসে। কেন?

জিজ্ঞেস করলে বলে, “বিলের হাওয়া না খেলে মনটা জুড়ায় না গো।”

উদাস ভাবে, “এ হল গিয়ে বংশের ধারা। কোন জমিদার সাহেব সুবার ফুর্তির রক্ত লেগে আছে মাগীর শরীরে!”

হরেন সেদিন হাজার টাকা দিয়েছিল উদাসকে। কাল সন্ধ্যেবেলা মেনকাকে বিলের ধারে যেভাবেই হোক পাঠাও। বিমানেরও সেখানে যাওয়ার ব্যাবস্থা করছি। তারপর বিমান আর মেনকাকে হাতেনাতে ধরে শুধু শাঁপুইপাড়া নয় আরও পাঁচটা গ্রামের লোক আর এই নীলবাজারের লোক দিয়ে যদি মার না খাওয়াই তো আমি হরেন মণ্ডলই নয়।

উদাস এ-কথা শুনেও মাথা নীচু করে বসেছিল। কী যেন ওর গলার কাছে আটকে আছে। হরেন লক্ষ করল। ওর কাঁধে হাত রেখে বললে, “আরে কোনো চিন্তা নাই। তোমার বউরে কেউ ছোঁবে না। আমার লোক সব থাকবে। তবে ছোঁড়াটাকে জব্দ করতে পারলে তোমারও লাভ আমারও ভোটে মেলা লাভ।”

সেদিন দুপুরে উদাস ভাত খায়নি। সারাদিন জ্বরের ভান করে পড়েছিল। সাঁঝাল দিয়ে মেনকা উনুনে আগুন দিতেই উদাস বললে, “একটু মাছ খাতি ইচ্ছে করে। আজ বিলে মাছ পাসনি? ইচা মাছের ঝাল রাঁধবি? দুটো ভাত পেতাম?”

মেনকা বলে, “আ মোলো যা! কী কও? তোমার জ্বর, আমি কনে যাবো? ঘরেই তো আছি সক্কাল থেকে। মাছ কনে পাব?”

“তা’লে আর ভাত খাবনি। মুখে রুচি নাই। মাছ ছাড়া খাবনি।”

“তা সকালে কইতে কী হয়? এখন এই রাত্তিরে আমি বিলে যাই আর মরি? তারপর তুমি…?”

কথাটা শেষ করেনি মেনকা। সোনামণির ফেলে যাওয়া একটা চুলের কাঁটা ছিল। সেটাকে উনুনের আগুনে ফেলে দিল। উদাস দেখল।

টুসি বলল, “ওমা? কর কি? সোনামাসির কাঁটা যে? পুড়ায়ে ফেললে?”

মেয়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেনকা ভাত চড়ায়। ওর কাজের গতি দেখে উদাস বুঝতে পারে, হরেনের কথামতো বিলের ধারে আজ ওকে পাঠানো যাবে না।

— “যখন মাগীর মর্জি হবে তখনই সে যাবে রাসলীলায়।”

গজগজ করতে করতে উদাস হরেনের গুদামে যায়। হরেন আসেনি। তবে আসর বসেছে। চালভাজা আর ধেনো মদে নেশা জমে উঠেছে। অনেক রাত হয়ে গেল। একে একে সবাই চলে গেল। উদাস বসে রইল হরেনের জন্য। অনেক রাতে হরেন ফিরেছে। ফিরেই উদাসকে জড়িয়ে ধরল। বললে, “উদাস, তোমার কুনো চিন্তা নাই। আমি জিতি, তোমারে পঞ্চায়েতে একটা পাকা কাম করে দিব। আমিই জিতব। জানো তো। পয়সা যার জোর তার। আর জোর যার মুলুকও তারই।”

হরেনে হেসে উঠল খুব জোরে শব্দ করে। উদাসের হাতে শ-পাঁচেক টাকাও দিল।

বাড়ি ফিরে মেনকার বেড়ে রাখা ডাঁটা চচ্চড়ি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আসলে নেশায় ওর ব্রহ্মতালু থেকে পা পর্যন্ত অবশ ছিল সেদিন।

পরদিন ওর খোঁয়ার ভাঙতে বেশ দেরিই হতো। কিন্তু মেনকার বুকফাটা কান্না, পড়শিদের ভিড় চিৎকারে উদাসের ঘুমই ভাঙল না, নেশাও সম্পূর্ণ ছুটে গেল।

বিলের পারে ওর পোয়াতি মেয়েটার লাশ পড়ে আছে। মেয়েটার গায়ে কাদা পাক কে যেন লেপে দিয়েছে। ওর গলায়, মুখে আঁচড়ের দাগ।

সবাই বলছে বিলের ভূত। আমিনা পদ্মর মতো টুসিকেও ধরেছে।

মেয়েটা ভরসন্ধ্যেবেলায় বিলে গেল কেন?

মেনকা চিৎকার করে ওঠে, “ওর বাপ! বাপে চেয়েছিল মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খাতে। বাপসোহাগী মেয়ে আমার। বাপের জন্য মাছ আনতে গিয়ে পরাণটা দিল।”

মেনকা আরও কী কী বিলাপ বকছিল।

সোনামণিকে নিয়ে উদাস ঘর করবে তাই মেনকাকে মেরে ফেলতে গিয়ে নিজের মেয়েটাকেই খুন করল উদাস…

উদাস কানে আঙুল দিল।

ওর চোখের সামনেই গ্রামের লোকের মুখগুলো সব পালটে গেল যেন! কারা যেন দাঁ কাটারি নিয়ে ছুটে আসছে? খুব চেনা গলায় কে যেন চিৎকার করছে, “খুনী খুনী!”

উদাস ছুটছে। ছুটে কোথায় যাবে, জানে না। তবুও ছুটছে। কার ঘরের দ্বোরে এসে যে জ্ঞান হারিয়েছে তাও বুঝতে পারেনি। জ্ঞান ফিরতে সোনামণিকে দেখল। সোনামণির বাড়িতেই দিন কয়েক ছিল।

বাতাসে খবর এসেছে শিবু বাঁড়ুজ্জে গ্রামের লোকজনকে উসেকেছে। উদাস নাকি ইচ্ছে করেই মেয়েকে অত রাতে বিলের ধারে পাঠিয়েছিল। উদাস খুনী। ওকে ধরলে ওরাই বিচার করবে। নাহলে পুলিশের হাতে তুলে দেবে।

উদাসের নিজেরও ক্রমে মনে হতে লাগল, “ও খুনী।”

মাথার ভেতরটা কেমন করে উঠত। সোনামণি এ ক-দিন উদাসকে সামলেছে। কিন্তু বেশি দিন এখানে থাকা ওর ঠিক নয়। গ্রামের লোক দু-জনকে জ্যান্ত কবর না দেয়!

সোনামণিই একদিন বললে, “বৈরাগী, চলো আমরা দিল্লি যাই। আমার এক কাকা ওখানে লেবারের কাজ করে। ওইটা তো বড়ো শহর। অনেক বড়ো। অনেক টাকা আছে ওখানে। কেবল রোজগার করতে হবে। ওখানে গেলে কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না। চলো সেথায় যাই?”

শাপুঁইপাড়া থেকে, বাংলা থেকে অনেক দূরে এই গঙ্গাপারে এসেও মেনকার বুক ফাটা চিৎকার শুনতে পাচ্ছে উদাস।

চানকিদের বিলেও যদি এরকম আরতি হত অথবা লোকজন আসত? গেরাম দেখতে, জঙ্গল দেখতে, হুসেন শাহর দেহারা দেখতে? ছোটোবেলা থেকে উদাস জানে মনসার থান এই হুসেন শাহর দেহারা খোদ বিশ্বকর্মা নাকি তৈরি করেছিল। এখানে যেমন রামায়ণ, রামকথা, লক্ষণঝুলা, রামঝুলা, জানকিঝুলা ওদের গ্রামেও তো হাসনাহাটির সাঁকো, মনসার থান, ত্রিলোকেশ্বরের আদ্যিকালের মন্দির এমনকী বেহুলার নিছিনি নগরও তো লোকে বলে এখানেই ছিল। অথচ আমাদের এখানে তো লোকে ঘুরতে বেড়াতে আসে না?

হয়তো এমন পোড়ো জঙ্গল, ভূতে পাওয়া বিল না থাকলে টুসি মরত না? হরেনের কথা শুনে সেদিন সন্ধ্যেবেলা কেন মেনকাকে বিলে পাঠাতে চেয়েছিল?

এইসব ভাবলে উদাস পাগল হয়ে যায়। মাথা ছিঁড়ে যায় আবারও।

উদাস ভাবতে পারে না বেশিক্ষণ। সোনামণি ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। একটা মস্ত কুকুর নিয়ে চার পাঁচটা ছেলে ছোকরা ছবি তুলছে ঝুলার ওপর। কুকুর না ছেলেগুলো? কাকে ভয় পেয়েছে সোনামণি?

মেয়েটার ঢলোঢলো হাসিমুখে এখন একরাশ আতঙ্ক। কুকুরটা প্রায় ওদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। শুঁকছে উদাসকে, সোনামণিকেও। ছেলেগুলো হাসছে। ছবি তুলছে। উদাসের রাগ হয় না। কেবল সোনামণির চোখে ওই ভয় আতঙ্ক ও একদৃষ্টে দেখছে।

টুসির নিথর শরীরের দিকে উদাস তাকাতে পারেনি বেশিক্ষণ। কেবল ওই খোলা চোখদুটো ওকে টানছিল। কী ভীষণ ভয় যে ছিল মেয়েটার চোখে!

সোনামণি কুকুরকে এত ভয় পায়? এত ভয় ও পাচ্ছে কেন? সোনামণির চোখদুটো ভয় পালটে যাচ্ছে।

উদাস এই ভয় সহ্য করতে পারছে না। উফ্‌ফ্‌! কী ভীষণ আতঙ্ক! এ তো সোনামণির চোখ নয়। টুসির চোখ। সোনামণির মুখ বদলে যাচ্ছে। টুসির মুখ।

ছেলেগুলো কুকুর নিয়ে চলে গেল। সোনামণি ডাকছে? উদাস কিছু শুনছে না। সোনামণি আবার ডাকছে। উদাস শুনতে পেল, “বাবা?”

Categories
গল্প

রঙ্গন রায়

নতুন পৃথিবী

ডিমের কুসুমের মতো নরম আলো নেমে আসছে। আদম চোখ খুলল। হাত দিয়ে কচলাল একটু। অসীম আকাশের নীল রং তার শরীরে নেমে আসছে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। আড় ভাঙল। পাশ ফিরতে গিয়েই দেখল সে যেখানে শুয়ে আছে তার পাশেই ধু-ধু জল। সমুদ্র। এবার চট করে উঠে দাঁড়াল সে। ওপাশ ফিরল। সেদিকে বালির রাশি আর তার পরই শুরু হয়েছে ঘন সবুজ জঙ্গল। চারিদিকে মায়াবি আলোটা বড়ো নরম। মিষ্টি আলোটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। আকাশ ও সমুদ্র যেখানে একে-অপরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে, সেদিকে একটা ছোট্ট বিন্দু দেখা যাচ্ছে। টুকটুকে লাল বিন্দু। আদম তার ফর্সা শরীরের দিকে তাকাল। বালি লেগে আছে। হাত দিয়ে গা হাত পা ঝাড়ল সে। মাথার চুলে হাত বুলাল। তারপর প্রথম পা ফেলল সমুদ্রের দিকে। আলোর বিন্দুটা যেন এক লাফে একটু উপরে উঠে পড়েছে। লাল লাল আলো লাগছে গায়ে। আদম তাকিয়ে থাকল আদিগন্ত নীল রঙের মধ্যে সদ্য জেগে ওঠা লাল রংটার দিকে। যেন একটা পিংপং বল। বলটা বড়ো হচ্ছে। জলের মধ্যে চিকচিক করছে কাচা সোনার মতো।

আদম অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মধ্যে পা ভেজাল। আঁজলা ভরে জল নিয়ে ছিটিয়ে দিল আকাশের দিকে।

ঈশ্বর এদন বাগানে পায়চারি করছিলেন। গত কয়েকদিন টানা পরিশ্রম করে ক্লান্ত তিনি। এখন কয়েকদিন বিশ্রাম নেবেন। বাগানটি তিনি মনের মতো করে বানিয়েছেন। এত সুন্দর যেন কোনো শিল্পী তুলি দিয়ে একটু একটু করে এঁকেছে। নিজের সৃষ্টির ওপর নিজেরই নজর লেগে যাচ্ছে। তিনি একটু লজ্জা পেলেন। এগিয়ে গিয়ে নারকেল গাছের তলে দাঁড়ালেন। ভীষণ জলতৃষ্ণা পেয়েছে। গাছ তলায় কয়েকটা নারকেল পড়ে আছে এদিক ওদিক। ঈশ্বর ঝুঁকে বসে একটা নারকেল তুলে নিলেন। ঝাঁকিয়ে দেখলেন ভেতরে জল রয়েছে কিনা। তারপর ভেঙে জল পান করলেন। কি মিষ্টি জলটা! প্রাণ জুড়িয়ে গেল তার।

আরাম! ভীষণ আরাম!

তিনি এবার একটা পাথরের ওপর বসলেন। ভাবলেন গতকালের কথা। আদমকে তিনি গতকালই সৃষ্টি করেছেন। নিখুঁত তার মতোই দেখতে হয়েছে। লম্বা, ফর্সা, স্বাস্থ্যবান। ছেলেটি কি আজ জেগে উঠেছে? আজ থেকেই তো তার জীবন শুরু হওয়ার কথা! এই নতুন পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার চেয়েছিলেন তিনি।

নাহ্‌! আর বেশি কিছু চিন্তা করবেন না। এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

নরম ঘাসে পা ফেলে ঈশ্বর তার অনিন্দ্যসুন্দর শ্বেতপাথরের তৈরি প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আদম ছুটছে। সমুদ্রের তীর ধরে জলের পাশে পাশে সে ছুটে চলেছে। ঠান্ডা হাওয়া লাগছে গায়ে। ভালো লাগছে তার। বেশ কিছুটা দৌঁড়নোর পর হাঁপিয়ে গেল সে। থেমে নিয়ে হাতদুটো দুই হাঁটুতে রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। তারপর সেখানেই শুয়ে পড়ল। অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে। মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে বের হল তার। ভালো। এসবই ভালো।

গায়ে সূর্যের আলো এসে লাগছে। এখন বেশ চড়া আলো। যত সময় যাচ্ছে আলো আরও জোরাল হচ্ছে। আকাশে তুলোর মতো ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। তাকিয়ে তাকিয়ে মেঘের বিভিন্ন আকৃতি দেখতে লাগল আদম। একটা মেঘ যেন অনেকটা দূরের সবুজ গাছগুলোর মতো।

তাই তো! ওই জঙ্গলের দিকটা তো এখনও দেখেনি সে! দেখতে হবে। এই সমস্ত দৃশ্যের ভেতর নিজেকে পৌঁছে দিতে হবে।

আদম উঠে দাঁড়াল। তার নগ্ন শরীর গ্রিক ভাস্কর্যের মতো সুন্দর। সুগঠিত পা ফেলে ফেলে বালির তীর থেকে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হল সে।

টু টুট টু! টু টুট টু!

কী একটা পাখি ডাকছে। পায়ের খসখস শব্দ আর সমুদ্রের শব্দ ছাড়া এই মিষ্টি শব্দটা কানে আসছে আদমের। প্রবল কৌতূহলে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

প্রথম গাছটির তলে দাঁড়াতেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার। এখানে রোদ লাগছে না। জঙ্গলের ভেতরটা কেমন যেন রহস্যময় হয়ে আছে। গাঢ় সবুজ রঙের ভেতর থেকে অনেক রকম শব্দ ভেসে আসছে। কোনোটা পাখি, কোনোটা জঙ্গলের কীটপতঙ্গ। কোনোটা-বা হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ে ওঠার শব্দ।

বনের ভেতরে চলে গেল সে। নাহ্‌! এখানে গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। আর একটু কি যাবে সে? এমন সময় এক পাল হরিণ ছুটে বেরিয়ে এল জঙ্গলের ভেতর থেকে। কয়েক পলক তাকিয়ে দেখল আদমকে। তারপর আবার ছুটে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। ভয় পেয়ে গেল আদম। সে ভেবেছিল সে ছাড়া আর কেউ দৌড়তে পারে না। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। ওগুলো কী জিনিস?

আদম ছুটে বেরিয়ে এল বন থেকে। আবার আদিগন্ত সমুদ্র। খানিক দূরে একটা উঁচু ঢিপির মতো দেখা যাচ্ছে। ওটার ওপর উঠলে কেমন হয়?

ভাবা মাত্রই ছুটল সে। এদিকে সূর্য ততক্ষণে আকাশের মধ্য ললাটে উঠে এসেছে। এখন বেশ গরম লাগছে তার। তবুও একছুটে সে ঢিপির সামনে এসে থামল। ঢিপির এক পাশে সমুদ্রের ঢেউ অবিরাম এসে আছড়ে পড়ছে। কী ভীষণ শব্দ! আদমের গা দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। ঢিপির গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠতে শুরু করল সে। তরতর করে যখন সে উপরে উঠে দাঁড়াল তখন বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল আদম। কী বিশাল সমুদ্র আর জঙ্গল। সব দেখা যায় এখান থেকে। সব।

ঝুঁকে পড়ে জলের আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে তার। ভাগ্যিস এই ঢিপিটা চোখে পড়েছিল!

এমন সময় আকাশে মেঘের আনাগোনা। ঘন কালো মেঘ। এবং কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামতে শুরু করল ঝমঝমিয়ে।

আকাশ থেকে জল পড়ছে দেখে আদম ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সে তো কিছুক্ষণ আগে যখন লাল বিন্দুটা সদ্য জেগে উঠেছে, তখন এরকমই জল হাতে করে ছিটিয়ে ছিল! তাহলে এখন কে ছেটাচ্ছে? তাহলে কি তার চেয়েও বড়ো কোনো মানুষ আছে? আবার ভয় পেল আদম। ভীষণ ভয়।
সে জানে না এরপর থেকে মানুষ নামক প্রাণীটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শুধু ভয়ই পেয়ে যাবে।

বিকেলের দিকে ঈশ্বর প্রাসাদ থেকে বের হলেন। আদমের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। কেমন কাটাল সে সারাটা দিন, সেটা জানা প্রয়োজন। এদন বাগান ছাড়িয়ে ঈশ্বরের ঘোড়া সমুদ্রের দিকে রওনা দিল। যেখানে তিনি গতকাল আদমকে তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন, গন্তব্য সেই স্থান।

ঘোড়ায় বসে থেকেও ঝাঁকুনিতে তাঁর মনে হচ্ছে এবার বয়স হয়ে গেছে। আর পারছেন না তিনি। শরীর নামক যন্ত্রটি আর চলবে না। কিন্তু তার আগে আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো করে ফেলতে হবে। খুব শীঘ্রই করে ফেলতে হবে।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দেখলেন সেখানে আদম কেন কোনো প্রাণীই নেই। অবাক হলেন না তিনি। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় যে স্বাধীন প্রাণী কখনোই একজায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। কিন্তু তাঁর পক্ষে এখন আদমকে খুঁজে বের করা বেশ কষ্টের কাজ। তবে তিনি এটাও জানেন যে রাত হলে আদমকে এখানে কীভাবে নিয়ে আসতে হয়। এখনই তার প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি। আপাতত সূর্যাস্তের রূপ আহরণ করা যাক।

ঈশ্বর ঘোড়া থেকে নামলেন। কিঞ্চিৎ সামনের বালুচরে এগিয়ে গেলেন। দূরে লাল সূর্যটা মূহুর্মূহু রং বদলাচ্ছে। সারা আকাশ জুড়ে যেন কেউ তুলির বিভিন্ন রং গুলে দিচ্ছে। শিল্পীর হাতে এখন এক দণ্ডও সময় নেই।

সূর্য ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে গেল। লাল রং নিস্প্রভ হতে হতে এক সময় টুপ করে ডুবে গেল অতল জলরাশির সীমানায়।

চোখে জল চলে এল হঠাৎ ঈশ্বরের। আবার দীর্ঘ রাতের আগে সূর্য দেখা যাবে না। আরও একটা দিন পেরিয়ে গেল। এভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দিন পার হতে থাকবে যেমন আগেও—

জলের ছায়ায় নিজেকে দেখেছিল আদম। এখন তার মতোই দেখতে আর-একটি মানুষ দেখে অবাক হল সে। আবার ভালোও লাগল। লোকটা কালো আকাশের সাদা বলটার দিকে তাকিয়ে আছে। চারিদিকে এখন নীল নীল আলো। রহস্যময় পরিবেশ। সমুদ্রের ফেনায় চিকচিক করছে আলোটা। লোকটার দিকে এগিয়ে গেল আদম।

ঈশ্বর বললেন, কেমন কাটালে আদম? এই নতুন পৃথিবী কেমন লাগছে?

আদমের মাথার ভেতর আচমকা একটা ছবি ভেসে উঠল। যেন হাজার আলোর বিস্ফোরণ ঘটছে। আর এরকমই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীর শেষ চিৎকার করছে। ভীষণ শব্দ। মাটি দুলছে। আহ্‌!
আদম বলল, আপনি কে?

— আমি তোমার বন্ধু। তোমারই মতো কেউ। তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছ?

— না।

— তাহলে?

— আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন?

ঈশ্বর বুঝলেন। মানুষ কেন, সমস্ত প্রাণীকুল একা থাকতে পারে না। সে চায় তারই মতো একজনের সঙ্গে থাকতে।

— না থাকতে তো পারব না? কেন বলো তো?

আদম শিশুর মতো বলে উঠল, এই সবই খুব ভালো কিন্তু কখনো কখনো ভয় লাগে।

মুচকি হাসলেন ঈশ্বর। তারপর বললেন, যখন আবার সকালে লাল বিন্দুটা জেগে উঠবে আকাশ ও সমুদ্রের সীমানায়, তখন তোমার মানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। তুমি সকালে যেখানে শুয়েছিলে সেখানেই শুয়ে থাকো।

ঈশ্বর ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। আদম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল লোকটা জ্যোৎস্নার আলোয় দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সকালের আলো থাকলে সে নিশ্চিত মানুষটির পেছন পেছন যেত।

নিজের মতো একজনকে ভালো লেগেছে তার।

ইভ চোখ খুলল। চারিদিকে স্নিগ্ধ একটা আলো এসে পড়েছে। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। সোনালি চুলের মধ্যে আলো এসে লাগছে। আড় ভাঙল ইভ। একপাশে অসীম জলরাশি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াল। পেছনে সবুজ রং। সামনে অসীম নীল। সময় ব্রাহ্ম মুহূর্ত। এমন সময় সে দেখল কে একজন হেঁটে আসছে তার দিকে। ঠিক তখনই মাথার ভেতর ঝলক দিয়ে উঠল একটা দৃশ্য। একজনের হাত ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে প্রচণ্ড আলোর বিস্ফোরণ, হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীর শেষ চিৎকার করছে। ভীষণ শব্দ। মাটি দুলছে। আহ্‌!

আদম ইভকে দেখছে। ইভ আদমকে দেখছে। দু-জনেই লক্ষ করল দু-জনের নগ্ন শরীর একরকম, কিন্তু একইরকম নয়। আদম এবার হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। আশ্চর্য! ইভেরও হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছে। সেও হাত বাড়াল। পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করল। যেন লক্ষ কোটি বিদ্যুৎ বয়ে গেল একে-অপরের শরীরের ভেতর। ইভের হঠাৎ হাসি পেল। আদমও হাসল। প্রশান্তির হাসি। ভালো। এসবই ভীষণ ভালো।

ঈশ্বর তার প্রাসাদে বসে দেখছেন আদম ও ইভকে। তার ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে। আদম প্রবল কৌতূহলে সমুদ্রের ধারের সেই ঢিপির মাটি খুঁড়ছে। পেছনে ইভ দাঁড়িয়ে আছে।

আদমের হাতে একটা শক্ত চারকোনা জিনিসের ছোঁয়া লাগল। আরও কৌতূহলী হয়ে পড়ল সে। পরিশ্রমে তার পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপাল থেকেও গড়িয়ে পড়ছে। এবার ইভও হাত লাগাল। দু-জনে মিলে আর-একটু খুঁড়তেই জিনিসটা বেরিয়ে এল। মোটা শক্ত একটা জিনিস। হাতে ধরা যাচ্ছে। জিনিসটা বের করতে পেরে আদমের ভীষণ আনন্দ হল। তার চেয়েও আনন্দ হল জিনিসটা স্পর্শ করে। কেন হল সে জানে না। ইভ এগিয়ে এসে জিনিসটা হাতে নিল। দু-জনের মুখেই হাসি। ভালো লাগার হাসি।

ঈশ্বরের মুখেও হাসি। পরিশ্রমের ফল হাতে পেলে মানুষ সবচেয়ে খুশি হয়। এ তো পৃথিবীর ইতিহাস। এবং এটাই ভবিষ্যৎ। ঈশ্বর তার কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখলেন আদম ও ইভ যে-জিনিসটা খুঁজে পেয়েছে তা গত পৃথিবীর ধ্বংসকারী মানুষেরই অমূল্য সৃষ্টি। বই।

Categories
গদ্য

শতানীক রায়

দিনযাপন

দিন অতিক্রম করার মধ্যে সময়ের ধীর হয়ে যাওয়াও লুকিয়ে থাকে। যেভাবে পা ফেলি আর পা মিলিয়ে যায়। যাত্রাপথ সন্ধ্যাভিমুখী। সব ধ্বংস বিধ্বস্ত করে যেভাবে জীবন নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়। অনেক অভ্যাস, নিবিড়তার অকালপ্রয়াণ ঘটে। আমরা কেউই ঘাড় উঁচু করে তার মীমাংসা করতে পারি না। অথচ এসবই দৃঢ়তার দাবি রাখে। আদৌ রাখে কি?! এমন কিছু প্রশ্নের উত্থান আর জ্বরঘোর থেকে শুরু হওয়া বোধের টানা গতি। কোন দিকে যায়। মানুষ যেদিকে নিজস্ব অভিমুখ বেছে নেয়। নরম শরীর শায়িত আছে (যেন)। এমন ভাবতে গিয়ে দেখা যায় শূন্যতা বিষয়ক অনেক দর্শন অথবা দর্শনের মৃত্যু ঘটতে শুরু করে। এখান থেকেই নতুন পথ এবং তার অন্যরকম যাত্রা।

চিহ্নে রূপায়িত হওয়া মানুষের গতিপ্রকৃতি তখন বুঝতে পারি না। আক্রান্ত হওয়া কাকে বলে, এমন সবের মধ্যেও মাত্রাতিরিক্ত ধ্বংস আত্মগোপন করে থাকে। কেউ কখনো তার শুরু নির্ধারিত করে দেয়। যেন এই পথেই পৃথিবী সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে মধুর অথচ এখানে কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয়। সবই তাই স্বভাবসিদ্ধ। ‘স্বভাব’ আর ‘সিদ্ধ’ এই দুটো শব্দ একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। এরকম কোনো শব্দের অভিঘাত মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। যেন ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও বিচরণশীল মানুষেরা ক্কচিৎ কোনো কল্পে বিচরণ করতে করতে দেখা হয়ে যায় সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গে। যার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিহিত অনাকাঙ্ক্ষা।

সময়ের স্থিতাবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অর্থহীনতা। মানুষের জীবনে সবরকম ঘটনার সঙ্গে এও বিরাজ করে। আস্তেধীরে সহজ জটিলে মিশে থাকা অর্থহীন স্রোত। মাঝেমধ্যে একটা নদী টের পাই। নদীর চিহ্ন এই পথে-প্রান্তরে জুড়ে আছে। বিকেল শেষ হচ্ছে আর সন্ধ্যায় শুরু। নদীর অদৃশ্য উপস্থিতি। বা আমার অদৃশ্য উপস্থিতি নদীর অস্তিত্বকে স্পষ্ট করছে। এমনও হতে পারে কিছুক্ষণ পরে পূর্ণ চাঁদ দেখা দেবে আকাশে। আমার আর নদীর মাঝের পথটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার চোখ অনেক অনেক বছরের সূর্যতেজ নিয়ে আছে। এই অপেক্ষারত সূর্যপ্রতিমা কাঙ্ক্ষিত চাঁদের জ্যোৎস্নাকে গিলে ফেলতে চায়। এতদিন হয়তো নদীটা পরিষ্কার ছিল না। এভাবে নদীর চারপাশের ভুবন মাটি গাছপালা সব নদীপথকে আড়াল করতে চাইছে। সূর্য আর চন্দ্রের এই খেলাকে সম্পূর্ণ অর্থহীন প্রমাণ করে দিয়ে সব যেন স্থির। মানুষ এভাবে আয়ুবর্ধক। বৃদ্ধি হতে থাকে জীবনের। মৃত্যু তবেই-না ম্লান। কিছুক্ষণ পরে রাতের নদীপথ আবছায়া হয়ে হারাচ্ছে। এক অরূপের খেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ। আমাকে এসব বুঝে নিতে হয়। অনুভূতির স্রোত যেন স্বাভাবিক না হয়। আমার কাছে এ-পথ মৃত্যুর দিকে নয় অমরত্ব যেন অবতলে নির্ধারণ করে দিয়েছে কেউ। সহস্রপাঁপড়ির পদ্ম সেখানে বিচিত্র খেলা। আর সূর্য থাকতেও তার শোষণখেলা আপাতত রুদ্ধ। পথটা কুয়াশাচ্ছন্ন। আর এই দেহ অযথা চাঁদের দিকে উঁচু হয়ে থাকে। অর্থহীন।

অনুভূতির স্ফূরণ কখনো কখনো একটা আমেজ সৃষ্টি করে। যেখান থেকে শুরু হয় একটানা দৌড়। নানারকম চিন্তা এসে বাসা বাঁধে। আসলে স্রোতটা চিরকালই অর্থহীন। এই অর্থহীনতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা থাকে শরীর ও মনের। নিজেরই অদম্যতায় নিজেকেই ছুঁয়ে দ্যাখা। আর একবার ছুঁয়ে ফেললে আবার পূর্ব মুহূর্তের মতো আবেগ শীর্ষে উঠতে থাকে। মন্দিরচূড়ায় ওঠা যায় না কখনো। অথচ ভার বহন করে চলার মধ্যে কী যে সুখ আর তৃষ্ণা কাজ করতে থাকে জানি না। শরীর থেমে থেমে অনুভব করে এই চারপাশের ঘটমান বিষয়গুলিকে যেখান থেকে শুরু হয় পুনরায় ওই ‘স্রোত’ আর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা অর্থহীনতার ধ্বনি। অন্তত ধ্বনিটুকু শোনা যায়। এর পরেও কিছু বাকি থেকে যায়। আমার সংগ্রহ করা অনেক মুহূর্ত যখন বাস্তবের স্বীকার এবং অস্বীকারের মাঝখানে থেকে সবকিছুকে মূল্যায়ন করতে থাকে। এসব মূল্যায়নে অর্থহীনতা শরীর এবং বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। তারই একটা বিকল্প বাস্তব এখানে তুলে ধরছি যার স্বয়ং অস্তিত্বও আছে আমার এই অনুভূতিমালা ব্যতীত। আমারই কবিতায় বলব—

কার প্রতি তাক করে থাকো যাকে তুমি কালী বলে ভুল করো। জ্বলন্ত প্রতীক হিসেবে ভরসা করো কাকে— এখানে আমরা একত্রিত আছি আমাদের একটা করে কবিতা থাকা উচিত প্রতিটি অঙ্গের একক উৎসরেখা শব্দমায়া দানপ্রতিক্রিয়া সঙ্গে আরও একটা করে শরীরের কবিতা বীজাধার আর— কী হতে পারে পুরোনো দরজার পাশে গজিয়ে ওঠা লতাগুল্ম ব্যতীত

“যেহেতু তার মনেই পড়ে না সে কেমন ক’রে কথা কইতে শিখেছিল—তা তার মনেই পড়ে না—”… ভাবনাস্রোত শুরু হয় এখান থেকেই। যদিও এই চিন্তার বয়ান পিটার বিক্সেল-এর। তাঁর একটা গল্পের অংশ। আর সমগ্র গল্পটা এর সঙ্গে জুড়ে থেকেও আলগা। অন্য দিকে যায়। চলার ছন্দ একরকম। মনের ছন্দ একরকম। যেভাবে সূর্যের আলো কখনো মেঘাচ্ছন্ন হয়। ফুটে ওঠে শরীরে। সময় সময় বাক্যস্ফুরণ। চলনরীতি বদলে যায়। আমি এ-সময় আয়না দেখি। দেখার ভেতর থেমে থাকা। খুঁজে চলা অন্যের ছন্দ। চারপাশে সবাই বিচিত্র বেহুঁশ। চলতে চলতে ঘোড়ার আড়াই চাল। তারপর আবার একইরকম। আয়নার ভেতর শুধুমাত্র আমার প্রতিচ্ছবি আছে এমনটা নয়। অনেক কিছু ধরা পড়ে। এঁটে যায়।

জগৎটা যে কীসের টের পাই না। আশ্চর্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন… আমি ক্রমাগত টের পাই ওসিপ মান্দেলস্তামের একটি কবিতায় যেমন একজন মানুষ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে আর তাকে কবিই প্রশ্ন করছেন, তাকে কেউ আহ্বান জানিয়ে এই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে না। পথটা ঢালু… পথটা ঢালু আর আমি নেমে যেতে থাকি। নেমেছি বা এখনও নামছি কিনা জানা নেই। কিছু দৃশ্য হারিয়ে যায়। থেমে যায়। আর উধাও হয়। তবুও রেশ থাকে। স্মৃতি এমন এক অস্ত্র যা একজন দক্ষ অস্ত্র বাহক কিংবা যোদ্ধাকেও এই অস্ত্র বিনা আঘাতেই ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, তার গতিপথের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অথচ ক্রমাগত সে জীবনের দিকে যেতে থাকে। জীবনের টান। জীবনের গল্প। স্বয়ং জীবনকেই টেনে নিয়ে যায়। আর এরকম লম্বা ঝুলে থাকা জীবনে আমি ঝুলে থাকি। আমার শরীর তখন অদ্ভুত শরীর এক। শরীরকে ঘিরে জমে ওঠে।

ভেতরে। কোথাও। মানুষ। হওয়ার। প্রস্তাব। চলে। অনেকেই হয়তো জীবনানন্দের কবিতা পড়েছেন। তবুও। আমি পড়ি নিজের মতো। আমার ভেতর কত কী যে বাসা বেঁধে আছে। কোনো এক সন্ধ্যায়। কোনো এক রাতে অন্ধকারে। যেমন অন্ধকার কখনো কখনো হয়। এ-সময় মানুষ মানুষের শরীরের দিকে দেখে ডুব দেয়। ডুব দেয় অন্ধকারে। আর বিশ্রামের প্রস্তাবে শরীরের দিকে চোখ যায়। মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অন্ধকার। পুনরায় মন অন্ধকারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই ছবি এমনই। এখানে মেঘ আছে অথচ বৃষ্টি নেই। নির্ভুল সুন্দর। আর ‘মহাপৃথিবী’র একটা কবিতা আমার কোথায় কোথায় ‘নিরালোক’ সৃষ্টি করে জানতে পারি না। এমনও হতে পারে আমার জানার ভেতর স্মৃতির শরীর অযথা লম্বা হয়, ছোটো হয়। কুঁজো হয়। বেঁটে হয়। অষ্টাবক্র ধারণা পোষণ করে। গেঁথে বসে জীবনে। আলোতে। আঁধারে। জলে। অন্তরীক্ষে।