Categories
কবিতা

সৌমিক মৈত্র

প্রার্থনা…

আমার বাড়ির উঠোনে দুটো গাছ—
জবা আর করবী।

মা রোজ সকালে স্নান সেরে, লাল জবা তোলে—
ঠাকুরের পায়ে দেয়।

আমি ঠাকুরের পায়ে মাথা রেখে প্রার্থনা করি।
মায়ের পায়ে যেন সাদা করবী দিতে না হয় কখনো।

মানতাসা

কাঁটাতার ঘিরে রাখে লালচে-ধূসর আলোককুণ্ডলী।
এই বিচ্ছিন্নতা অমূলক, তবু তুমি আঁচড়ে কামড়ে ভাঙো আমায়।
বিলুপ্ত হোক প্রতিষেধক, উপশম।
রহস্যময় উপনগরীর আহত সিংহদ্বারে ছড়িয়েছে মনুষ্য লোম।

এত রক্ত কেন মাখো—
প্রকৃতির চক্রাকার দিগন্তে আহত পাখির মতো।
তুমি প্রগতির বুক কেটে অন্তর্বাহিনীকে মুক্ত করে দাও এই প্রগলভ মরুবালিকণায়।
স্থিতু হও, মিঠে খেঁজুরের গন্ধমাখা বিকেলে।
যেখানে মৃত্যু যায়—
তার পিছে পিছে তুমি কোন লোভে গেলে?

নিশি কোলাহল নির্বিকার, গ্রহণ সকালে যেন মরক লেগেছে শঙ্কিল হৃদযন্ত্রে।
এ নৈর্ঋত মেঘ আহার্যবিহীন আপরাজিতা— দু-ফোঁটা কান্নার লোভে মাটি ছুঁয়ে হয়েছে ধোঁয়াশা।
অনারম্বর তুমি, মৃত কবজি থেকে ঝুলে থাকে—
প্রিয় মানতাসা।

যন্ত্রণা…

মৃতপ্রায় শরীরে—
ব্যথার রাক্ষস জেগে ওঠে।
আঘাতের নকশায় যন্ত্রণা ফুল হয়ে ফোটে।

মিনে করা কাটা দাগ,
রক্ত শুকনো, আলপনা—
দু-ঠোঁট বাক্যহীন, বেদনার সুতো দিনে বোনা।

এ-ক্ষত নির্বোধ, ছেড়ে যায় নিঃশ্বাস, প্রাণ।
নিঃস্ব কবর, একা—
পাশে তার বিষাদখাদান।

চামড়ায় শাদা ছোপ—
ফোস্কায় জ্বলে গেছে মুখ
যার দেহে ক্ষত নেই, তার শুধু মনের অসুখ।

রহস্য!

মশলার গন্ধ লেগে চঞ্চল, লাস্য বিকেলে।
যেন ক্যাওড়া জলে ভেজা মিঠে জায়ফল।

আফগানি কেশরের হলদে লালে,
ঢাকা পড়েছে মানস সরোবরের শাদা।

তুমি তেজপাতা ঠোঁটের—
হেমন্ত ঝাঁজ মিশিয়ে দাও গন্ধহীন রাতে।

দারুচিনি দেশ ঋতুমতী হল,
তুমি এলাচের স্বাদ বলে শুকনো ঝাল মাখিয়েছ গালে।

এ-জ্বালা তীব্র নয় জেনো—
এ শুধু রঙের আড়ম্বর, মিশে থাকা
সান্ধ্য বকুলে।

প্রলেতারিয়েত

অবসর বসে থাকে, শুকনো জানালায়।
মেঠো গন্ধের শোক—
লেগে আছে রক্তাভ পায়ে।

আহতের মতো দুই মৃত চোখে মাংসের লাল,
ধূসর জানালা থেকে ঝুঁকে আছে শূন্য কপাল।

বিষাদ মাখানো চোখে, উঁকি দিয়ে চলে গেল প্রেত—
প্রলেতারিয়েত।

 

Categories
কবিতা

উমা মণ্ডল

জহর বিষয়ক—

জহরের কাল মুছে গেছে সেই কবে। পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে কখনো শুনতে পায়নি কেউই। জীবাশ্মের ছায়া তবু বেঁচে থাকে। লুকোচুরি খেলা। এই দেখা, এই ভ্রম… মরীচিকা পায়ে পায়ে ঘোরে বেখেয়ালে। কুণ্ডের ভাষায় যদি বলা যায় আগুনের আঁচ আছে। সেই যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি; তুলিরেখা মুখে অবন ঠাকুর। আসলে সে বিষ বিষয়ক শব্দবন্ধে ঘোরে ছিল বহুকাল। নতুন বৌঠান শুধু বলে গেল না কিছুই।

উড়ে উড়ে কথা বলে নিষিদ্ধ রাত্রির। গন্ধ পায় চিতাকাঠ ঘি চামড়া পোড়া আদিমের। বন্য আঁতুড়ের ঘরে জন্ম নেওয়া প্রতিমার চোখ জ্বলে গেছে আগেই; যোনির দ্বারে দারোয়ান বাঁধা। পথে কাঁটাখেত। তবু কালো প্যাঁচা মাংসাশী প্রাণী। তার প্রাণ চাই।
এই ঘণ্টা কি সতর্ক করে???? ঈশ্বরের দূত নর্দমায় বয়ে যায়। পাশে পড়ে থাকা অজন্মা ভ্রূণটি ধর্ষণের অবৈধ প্রমাণ। ওকে জহরের কালে নিয়ে যাও। আর শয়ে শয়ে অবলা বালারা ওদেরও ধরো একসাথে। বাঁধো। ঘাটে ঘাটে প্রদীপের আস্ফালন। এইভাবে পথ ব্যস্ত। রাঙা সূর্য ফুটে আছে পৃথিবীর গায়ে।

যদি ঘাড় ধরে থাকা হাতটাকে আগুনের উৎসবে তুলে দেওয়া যেত বেশ হত। কুণ্ডের কিন্তু পুরুষ বিষয়ক মাংসের চাহিদা আছে পুরাকাল থেকে। একবার জিভে নিয়েই দেখুক। অমৃত মন্থন

বিষবৃক্ষ—

এইসব উপন্যাসে দম্পতির বিছানায় চোরাকাঁটা
চকচক করে
অবকাশ যাপনের অছিলায় ডাক দেয়
খাদের ঈশানকোণে

অশনি এমনই মায়ামৃগ
কস্তুরী নেশায় পথ ডাকে
আরও কাছে, আরও কাছে
পথিকটি এখনও সরল ছকে কাটাচিহ্ন খেলে
বাঁক থেকে বাঁকে যে মৃত্যুর পরওনা নিয়ে
বাটখারা বসে আছে
সেই সংবাদপত্রের পাতা সে পড়ে ওঠেনি
আর্যভট্টের ভক্তটি শুধু সরলরেখায় বিন্দু গুনে চলে

ওগো খই এইভাবে ওড়া ঠিক নয়
পড়েছ যমের পাতা; অবসরে
ঘুম ছিল চোখে…

ফলারের সাদা খই সই পাতিয়েছে লেবু ও লঙ্কার সাথে। ওরা ভাগ্যচক্রে কালো বেড়া দেয়। বেড়ালের এঁটোমাছ নিয়ে ঝোল রাঁধে। তার সাথে রাঁধুনি মশলা। খই তাই উড়ে যায় শোকচিহ্ন নিয়ে

বার বার চিহ্ন আঁকো অবলা আমার
কবে যে খুঁটের ধার খেয়ে গেছে তোতাপাখি…
পাখি শুধু হরিনাম বোঝে; শতবার কর গুনে খাবি খায়
ওদিকে শিকড় হাত লম্বা করে ভিতে
ভূমিকম্প ডেকে আনে

দুর্গা সহায়—


আমি সেই সুর চিনি… বাঁশি থেকে উড়ে আসা পথের গানটি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে। ফেলে আসা কথা মাত্রা পেয়ে যায়

আশ্বিনের ঢেউ এসে গেল। প্রকৃতিতে শারদীয়া লেখা। কোথা থেকে জন্ম অসুখের আমাকে মনে পড়েছে। গায়ে জ্বর। সামনের খোলা জানলাটি এক পাঠাগার। শব্দগুলি উড়োচিঠি যেন। পড়ে ফেললেই হল। একলা ঘর বলে যে-বাতিস্তম্ভের নাম রাখা, বিদ্যুৎ সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। চোখ স্থির হয়

অন্য একটি চোখের ছায়া পড়ে। সেই ছায়াপথে অদৃশ্যের মায়াগন্ধ। এক অতলের ডাক। মেয়েটির জলে ভরা আয়নাটি কত কথা বলে। হে, নৈঃশব্দ্য…


দুর্গার গায়ে তাপের প্রকোপ বেড়েই চলে; তবু কাশে ভরা রেলপথ হাত তুলে ডাকে। পায়ে যাযাবর খুর বাঁধা। আর সেই চোখ, জলে ভরা সেই চোখ… নৌকা টানে ছলাৎ, ছলাৎ

জল শুধু জল… পোড়ামাটির ঈশ্বর তখন অস্থির। মাটি ধুয়ে যায়, কাঠামোও; কালাশৌচ পার করে পরিবার যাত্রা করে অন্য পথে। তখন ওরা তিনেতে বন্দি। ভিটেতে ‘কাল’ শিকড় পুঁতেছে; সর্পিল চলাফেরা। এইসব দৃশ্যপট, গোরুরগাড়ির ধুন; স্মৃতিময়…

কিন্তু সেই চোখ, জলে ভরা চোখ; দরজায় হাত রেখে ঠায়… মাটি ডাকে, ছড়া কাটা মাটি; এই ভিটে প্রদীপের সলতে তখনও নামিয়ে রাখেনি।


প্রকৃতি এখন আশ্বিনের দরজায়। কাঠামোয় মৃন্ময়ীর চোখ আঁকা হয়ে গেছে। মেঘগুলো চালচিত্র তৈরি করে একতারা সুরে। ওদের পালকে নক্ষত্রের সংসার। আমার গায়ে জ্বর। সামনের জানলায় ইতিহাস, বর্তমান… পাশে পড়ে ওষুধের ছেঁড়া নামগুলো; চোখ স্থির। হয়তো কাশের ভেলা দেখছে কিংবা রেলপথ, টানা রেলপথ…

বিন্দুতে আরম্ভ, বিন্দুতে সমাপ্তি; সব একাকার… অনন্তের পথে, লন্ঠনের আলো, জ্বর রাত; বিশল্যকরণী… বাঁশি বেজে যায়। জলে ভরা চোখ থেকে গভীরের ডুব; মায়াপথ। তল থেকে চিন্ময়ী আলোককণা সংকেত পাঠায়। দুর্গারা এখনও ত্রিশুলের শব্দ ভুলে যায়নি পুরোটা। চোখ বন্ধ হয়ে আসে; ঘুম চিরঘুম। দরজাটা বন্ধ আছে।
হে, নৈঃশব্দ্য… দুর্গা সহায়

 

Categories
কবিতা

শিবু মণ্ডল

হর-কি-পৌরি


হর-কি-পৌরি এলে সবাই হাসিখুশি থাকে। মানুষ মানুষকে দেখে। দেখে অন্যভাবে। নিজের কথা ভাবে কি না বোঝা যায় না। আমি অনেকবার এসেছি। যখনই আসি আমিও মানুষ দেখি। গঙ্গার স্রোতের মতোই আসছে আর যাচ্ছে। এক অনিঃশেষ প্রবাহ। নারীপুরুষ বালক বালিকা সকলেই ঝাঁপিয়ে চান করে। নারীরা স্নানের পর ঘাটেই কাপড় বদলায়। কেউ কেউ আড়ালে কেউ আবার প্রকাশ্যেই। তবে আমি পুরুষদের দেখি অন্য সময় রাস্তাঘাটে মহিলাদের দিকে যে-রূপ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় তেমনভাবে এখানে দেখে না। তারাও শুধু জাঙিয়া পরে স্নান করে। যে যার খুশিতে বরফগলা জলে ডুব দেয় আর আনন্দে কাঁপে।


ঘাটে একটু দূর দূর লম্বা শেকল বাঁধা থাকে। পুন্যার্থীরা সূর্যকে নমস্কার করে দু-চার ডুব দেয়। কেউ কেউ সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটলেও গঙ্গার প্রবাহের সাথে তারা অনিশ্চিত ভেসে যেতে পারে। কিন্তু কেউই যায় না। সেই শেকলটি ধরে থাকে ভয়ে। আর এমনভাবে শরীর উলটেপালটে চান করে দেখে মনে হয় নিজের সাথেই নিজে দু-টি কুমীরের মতো খেলে যাচ্ছে।


সন্ধ্যা ছ-টা বাজলেই মাইকে বেজে ওঠে অনুরাধা পড়োয়ালের কণ্ঠে— ওঁ জয় গঙ্গে মাতা…! চোদ্দো বছর হয়ে গেল আমি হরিদ্বারে আছি। তখন থেকেই দেখছি সেই একই গান বেজে আসছে। এই গানটির চেয়ে অন্য কোনো গঙ্গাস্তুতি বা তাকে নিয়ে গান হতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। গঙ্গা আরতির সময় যখন এই গানটি বেজে ওঠে তখন আমার শরীর জুড়ে এক শিহরণ জাগে— এ এক ভালোলাগারও অধিক কিছু। এক অতিপ্রাকৃতিক ভাবও বলা যেতে পারে। তখন আমি যেন সামনে বয়ে যাওয়া নদীটির জল হয়ে যাই। অথবা নদীর তরঙ্গে কাঁপতে থাকা আলো!


গঙ্গা আরতি শেষ হয়ে যাবার পরও আমি গঙ্গার পাড়েই বসে থাকি। আমার চারপাশ পুরুষের অন্তর্বাস থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে, মহিলার পোশাক ও চুল থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে থৈ থৈ দশা। ছোট্ট একটি ছেলে কিংবা মেয়ে তিলক ও শৃঙ্গারের বাটি এনে সামনে দাঁড়াবে। আমার হাসিমুখ দেখে কী বুঝবে জানি না। সে আমার কপালে তিলক ও শৃঙ্গার কেটে দিয়ে পয়সা চাইবে। অন্য সময় কেউ এভাবে পয়সা চাইলে ধমকে দিই। কিন্তু এখন আমি দশ টাকাও স্মিত মুখে দিয়ে দিই। তারপরেই আসবে একটি পুরুষ কিংবা মহিলা প্রদীপের থালা হাতে। আমি তাকেও ফিরাই না খালি হাতে।


দু-টি কিশোরী এলোচুলে বসে আছে সিঁড়ির ধাপে। তাদের ধবধবে ফর্সা পা জোড়াদু-টি গঙ্গার নীল জলে ডুবে আছে। সেলফি তুলছে তারা। সামনে দিয়ে বয়ে গেল গোলাপের পাপড়ি বোঝাই একটি পলাশ পাতা দিয়ে বানানো ডোঙা। তাতে জ্বলে আছে কর্পূর দিয়ে বানানো ক্ষণায়ু প্রদীপখানি। একটি মাঝবয়সি লোক ভিডিয়ো কলিং করে দেখাচ্ছে তার দূরদেশি আত্মীয়াকে! বয়ে যাওয়া আলো, গন্ধ ও জল দেখিয়ে প্রলুব্ধ করছে সেই দূরদেশবাসিনীকে। আমন্ত্রণ করছে তাকে ঈশ্বরের এই আপন দেশে!

 

Categories
কবিতা

বর্ণালী কোলে

প্রতারণা বিষধর সাপ


তোমারা প্রতীক্ষা করেছিলে, অবসান
আমি প্রতীক্ষা করেছিলাম, সূচনা
তোমরা আমাকে বেঁধে ফেলতে শুরু করেছিলে
আমার পায়ে বেড়ি দিয়ে
এইটুকুই আকাশ তোমার
এইটুকুই জগৎ

পৃথিবী তোমাদের দেওয়া ঈর্ষা-উপহার


একজন নারী কতটা কষ্ট পেলে
তোমার অহং শান্ত হবে, ভাবি
এত নির্লিপ্তি
এ তো খুনিদের থাকে
তুমিও তাই?
কেবলই হত্যা করো, হৃদয়
দীর্ঘ তলোয়ার, হৃৎপিণ্ডের তাজা রক্ত

ভুলে গেছি
মুখ মনে নেই
তবুও মাঝেমধ্যে মনখারাপ
কপালে, শিরায় আড়ষ্ট ব্যথা
চাবুকের দাগ


স্নেহ নেই, প্রীতি নেই
প্রেম নয়, দরদ নয়

ভয় লাগে, এখনও তার ভয় লাগে
আকাশি রঙের শাড়ি
নতুন বধূ

সিঁদুরচিহ্ন বিবাহের পরদিন মুছে নিয়েছে
মহাকাশে এখনও চাবুক
তারই শব্দ শোনে সে

তার সব বোধ
ঠিক যেন মানসিক রোগীদের চিকিৎসালয়


“শিকার” তোমার প্রতিবেশী নয়
খবরের কাগজের নারী নয়
তুমি নিজেই “শিকার”

আতঙ্কের মধ্যে থাকতে থাকতে
প্রত্যাশা হারিয়ে গেছে
জীবনের অংশগ্রহণের ইচ্ছে শেষ

মাঝেমাঝে ঈশ্বরের দিকে তাকাই
এরপর? এরপর?


এই মানুষগুলোরও মৃত্যু হতে পারে, অবাক দেখছি
চিত হয়ে শুয়ে বিশালদেহী লাশ
পচা দুর্গন্ধ বেরোয়নি এখনও
এখনও ছিটকে বেরোচ্ছে তেজ, দর্প, হুঙ্কার, ত্রাস
শাসন

একটু পর চিতায়
ছাই

স্মৃতি মৃত্যুর থেকেও বেশি বিভীষিকাময়


নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে
পিঁপড়ের মতো তোমার ওপর উঠে আসছে ওরা
তোমার বাঁচার ইচ্ছেকে ছেঁটে ফেলা
শোষণ নয়?

স্বপ্নে দেখ, রাজপথ
হাজার হাজার তুমি
মুষ্টিবদ্ধ ঘোষণা— “বাঁচতে চাই।”


প্রতারণা বিষধর সাপ। আজও
ছোবল দিয়েছে বহু বার। বিষদাঁত তার
নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করেছে টানা ছয় মাস
দংশনের পর।
ভেঙে পড়ার বিষাদ একটি ব্যর্থ সংগম।

উঠে দাঁড়াচ্ছে। চলছে সে আবার।
নীলক্ষত কিছুটা মলিন।

রোদ্দুর, পুরুষ হও, তুমি।
ওর হাত ধরো একবার।
ও প্রত্যয় ফিরে পাক।

 

Categories
কবিতা

সেখ সাদ্দাম হোসেন

সদরঘাট

জল সরে গেছে। ঠাকুরের খড়ের কাঠামো
অসাড় পড়ে আছে বালির চরে

তোমাকে মনে পড়ে
বলো, এখন কি আর প্রণাম করা চলে?
পূজার সমস্ত মাটি ধুয়ে গেছে জলে

শুভ্র বসন, নাকের নোলক— দূর কোনো বন্দরে
আমাদের সমস্ত অনুরাগ ছেড়ে যাচ্ছে ভূমি
বিসর্জন সুরে

তোমাকে মনে পড়ে
এই যে অলস বিকেল, ঠাকুরের ভেসে যাওয়া চুল
এমন ফুটে আছে— যেন বিষাদও এক ফুল

নার্স

ওই দূরে

শুকিয়ে যাওয়া বৃক্ষের ডালে
কয়েকটা পাখি এসে বসেছে
কেউ শিস দিচ্ছে

কেউ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নিচ্ছে পোকা

কুকুর


ব্যস্ততা এক কুকুর
ক্ষ্যাপাটে কুকুর
এর থেকে পালিয়ে বাঁচুন


একাকিত্ব
কুকুরের থেকেও ভয়ংকর

স্যালভেশন ৩

অসময়ে, ফুলও বড়ো ভারী লাগে
তবুও সম্ভাবনাময়, ধরো,
গাছের কালো ছায়ার উপর ছড়িয়ে দাও
ফুটে থাক—

এখন এ-সময় বড়ো প্রতারক।
শান্ত হও, একবার বোঝাও তাকে

দুঃখকে যে মেরে ফেলে, আসলে সেও ঘাতক

ইউরেকা

সমস্ত

সমস্ত দুঃখ বলার পরেও
কিছু দুঃখ থেকে যায় গোপনে

বুকের
অনেক
নীচে

পচতে শুরু করে। পচতে পচতে একদিন হঠাৎ
কেউ এসে বলে: এ তো জৈব সার। খুব উর্বর

Categories
কবিতা

সরসিজ বসু

ছান্দোগ্য বিনিয়োগ


যে কং সে-ই খং, যা খং তা-ই কং
যে রাহু সে-ই শির
        রাগরাজ, অমর মস্তক!

প্রতীকের নীচেই অন্ধকার

কথকতা অতিগ্রহ, তুশ্চু বারো আনা
সকলে একত্র হয়েও ভগবান হন না
অথচ একটু পুঁজিপাটা হলে কেউ তাঁকে ছাড়িয়ে ওঠেন


হাসিনামা লেখা হচ্ছে, লেজুড় হয়েছে হাস্যজন
এতটা জামিনযোগ্য থাকবে না এই হাস্যরস

মৃত্যুভয় ভেঙে গেছে বলে
যে-ঔদাসীন্য শেষে আসে
সুরুতেও যদি তা থাকত!

প্রশ্ন করবার বেলা সবাই মেধাবী, মহালোচ্চাগুলো
তদন্তে বাধা হয় এমন গজলও গাওয়া অনুচিত


সফরের পদে পদে আমি কত শূন্য দেখলাম
যে-দেশে যেমন শূন্য, যার কাছে যত আক্ষরিক
রক্তশূন্যতার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে
যদি কোনো অছিলায় শূন্যের শরিক হওয়া যায়,
গুজব পাগল দেশে পালাবার তাড়াহুড়ো থাকে

অবিদ্যা ও অপরের বিপরীত রতি
কত নোংরা ভোগমূল্য বাজারে ছেড়েছে!


বারে বারে আর আসা যাবে না: এই মেঠো গানে
প্রণব পুটিত করে নিলে
সেটাই দিনের বড় আপডেট হয়

হৃদয় মৌচাক নয়, গানের ছেপ্‌কায়
প্রসাদী জনমত ঘুরছে শহরে
       নির্দোষ জীবন তুমি ধুয়ে খাবে?

লজ্জাকে ললিতকলা ভাবতেই পারো


তুমি কিন্তু অনেক দূরের কোনো পায়ের আওয়াজে
পা মিলিয়ে হাঁটো,
স্বচ্ছন্দে গিলতে পারো অনেকের গলার আওয়াজ

একখানা সর্ষেপুরাণ যদি লেখা হত!

যে-কথা বলার নয় সে-কথা কোথায় পাওয়া যায়
নিজের কোলেই শুয়ে কত-না ভেবেছ!

তুমি পঙ্‌ক্তিদূষক, তোমাদের দেবতা আলাদা

Categories
অন্যান্য

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

সপ্তদশ অধ্যায়

এখান থেকে ভ্রমণ করো দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ধরে। অতিক্রম করো আঠারো ইউ ইয়েন পথ। এসে পড়বে প্রসিদ্ধ সংকশা নগরীতে। বুদ্ধ তিন মাসাধিক কাল ত্রিয়াশত্রিনশাস স্বর্গে কাটিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মায়ের মঙ্গলার্থে অনুশাসনগুলি প্রচার করেন। কথিত আছে স্বর্গ থেকে যখন তিনি পৃথিবীর পথে নেমে আসেন, প্রথম পা রাখেন এই সংকশা নগরীতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। আর শিষ্যগণের অগোচরেই রয়ে যায় সে-সব কাহিনি। স্বর্গবাসের মেয়াদ শেষ হবার সাতদিন আগে তিনি তাঁর অদৃশ্যমানতা ত্যাগ করেন।

বুদ্ধের আত্মীয় ভ্রাতা অনিরূদ্ধ ছিলেন প্রবুদ্ধ বা আলোকিত ব্যক্তি। তিনি জ্ঞানচক্ষু মেলে সুদূরে দেখতে পেলেন লোকমান, পরম পূজ্য তথাগতকে। প্রবীণ গুরু মৌদগল্যায়নকে অনিরূদ্ধ বললেন, ‘এবার তুমি যাও, তথাগতকে প্রণাম করো।’ মৌদগল্যায়ন এগিয়ে এসে বুদ্ধের চরণে নিজেকে প্রণত করলেন এবং একে-অপরকে অভিবাদন জানালেন। বুদ্ধ বললেন, ‘মৌদগল্যায়ন, আর সাতদিন পর পৃথিবীর পথে ফিরব আমি।’ এই কথা শুনে ফিরে গেলেন মৌদগল্যায়ন।

ইত্যবসরে আটটি সাম্রাজ্যের সম্রাট, তাদের মন্ত্রী, আমাত্য এবং প্রজাগণ, বুদ্ধের দীর্ঘ অদর্শনে হয়ে পড়ল ভারাক্রান্ত। এবার প্রিয় তথাগতের প্রত্যাবর্তনে সারা দেশজুড়ে সকলে মেঘরাশির মতো ঘনিয়ে এলেন। প্রত্যেকের বাসনা একটিই, পরম পূজ্যের দর্শন। একজন ভিক্ষুণী স্বগোতক্তির মতো হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আজ রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষজন সকলেই গৃহের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বুদ্ধের সন্দর্শনে। আমি একলা ভিক্ষুণী, কীভাবে দেখা পাই তাঁর?’ বুদ্ধ অন্তর্যামী। এই কাতর বাসনা জানতে পেরে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে এক মুহূর্তে সেই মহিলাকে চক্রবর্তী রাজার রূপ দিলেন। এবং তিনিই প্রথম অভিবাদন জানালেন প্রিয় বুদ্ধকে।

স্বর্গ থেকে অবতরণের সময় বুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল রত্নখচিত ধাপ-সহ তিনটি উড়ান। সপ্তরত্ন, সুবর্ণ, রৌপ্য, বৈদুর্য্য, স্ফটিক, মুক্তা, লোহিতক, মুসরগলভ দিয়ে তৈরি মধ্যবর্তী উড়ানে নেমে এলেন বুদ্ধ। ব্রহ্ম প্রস্তুত করলেন রূপার সিঁড়ি। চামরী গাইয়ের লেজ থেকে তৈরি শ্বেত মার্জনী হাতে তিনি এসে দাঁড়ালেন ডান দিকে। দৈব অধীশ্বর শিহ তৈরি করলেন রক্তবর্ণ সোনার সিঁড়ি। সপ্তরত্নে প্রস্তুত ছাতা হাতে এসে দাঁড়ালেন বাঁ-দিকে। অগণিত আমন্ত্রয়ী ঈশ্বরগণ বুদ্ধের অনুসারী হয়ে নেমে এলেন পৃথিবীতে। বুদ্ধ পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতেই তিনটি উড়ানই ভূমিতে বিলীন হল। পড়ে রইল কেবল সপ্তসিঁড়ি।

পরবর্তীতে সম্রাট অশোক সেই সিঁড়ির অন্তঃসন্ধানে খননকার্য শুরু করলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে নরকের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছোলেও কোনো তল পাওয়া গেল না সেই সপ্তসিঁড়ির। আর এর পর থেকেই সম্রাট হয়ে পড়লেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী। এই স্থানে নির্মাণ করলেন বৌদ্ধমঠ। মধ্য উড়ানে স্থাপিত হল ষোলো ফুট উচ্চতার বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তির পিছনে নির্মিত হল ত্রিশ হাত উচ্চতার একখানি প্রস্তর স্তম্ভ। আর সেই স্তম্ভের শীর্ষে আসীন হল এক সিংহ মূর্তি। আর ভিতর দিকে স্তম্ভ গাত্রে চারপাশে উৎকীর্ণ বুদ্ধের মুখশ্রী। ভিতর-বাহিরে স্তম্ভটি কাচের মতো স্বচ্ছ।

কিছু বিরূদ্ধ মতের গুরু এই স্থান নিয়ে শ্রমণদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাদানুবাদ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছোয় শ্রমণগণের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতিতে, এ-স্থানে বসবাসের অধিকার যদি কেবল শ্রমণদের থাকে, তবে এখন তার প্রমাণসাপেক্ষে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটবে। তাঁদের এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে, স্তম্ভ শীর্ষে বসে থাকা সিংহ গর্জন করে উঠল, তাঁদের অধিকারের সমর্থনে। এতে গুরুগণ নিদারুণ ভীত হয়ে পড়েন।

তিন মাসাধিক স্বর্গের ঐশ্বরিক আহার সেবন করে বুদ্ধের গা থেকে স্বর্গীয় সুগন্ধি বেরতে লাগল। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করতে শুরু করলেন। যে-স্থানে এই ঘটনা ঘটে সেখানে পরবর্তীকালে একটি স্নানাগার তৈরি করা হয়। এই স্নানঘর আজও বর্তমান। যেখানে ভিক্ষুণী, সবার প্রথম বুদ্ধের অভিবাদন করেন, সেখানে একটি প্যাগোডা স্থাপিত হয়। বুদ্ধ যেখানে সর্বসমক্ষে চুল ও নখ কাটেন, সেখানেও তৈরি হয় প্যাগোডা। এ-সকল প্যাগোডা আজও বর্তমান। দৈব অধীশ্বর, শিহ আর ব্রহ্মার উপস্থিতিতে বুদ্ধ যে-স্থানে অবতীর্ণ হন, সেখানেও নির্মিত হয় একটি প্যাগোড। শ্রমণ এবং শ্রমণীগণ মিলে এই বিহারে সহস্রজনের বাস। কিছু জন আছেন মহাযান মতাবলম্বী আর কিছু হীনযান মতাবলম্বী। একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে সকলেরই আহারের ব্যবস্থা হয়। এখানে রয়েছে একটি শ্বেত কর্ণ ড্রাগনের বাস। বিহারের শ্রমণগণের রক্ষক যেন সে-ড্রাগন। ভূমি আবাদ রাখে, নির্ধারিত ঋতুতে বৃষ্টি ঝরায়, সকল বিপর্যয় প্রতিহত করে। তাই তো শান্তির আবাস এই বিহার। শ্বেত ড্রাগনের এই সহৃদয়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, স্রমণগণ ড্রাগনের একটি বিগ্রহ স্থাপন করলেন, আর তার শয়নের জন্য স্থান প্রস্তুত করলেন। বিশেষ নৈবেদ্য দেওয়া হয় ড্রাগনের উদ্দেশে। প্রতিদিন শ্রমণদের মধ্যে থেকে তিনজনকে পাঠানো হত ড্রাগনের বিগ্রহের কাছে। সেখানে তাঁরা আহার সম্পন্ন করতেন। প্রতি বছর বর্ষাশেষে ড্রাগন নিজ রূপ বদলে হয়ে যেত সাদা কান বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকায় সাপ। সন্ন্যাসীরা যখন বিষয়টি জানতে পারলেন, ননীভরতি একটি তাম্র পাত্রে ড্রাগনটিকে রেখে দিলেন। প্রতি বছর একবার ঐ পাত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসত ড্রাগনটি।

এই দেশ সুফলা। সাধারণ মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ। তুলনারহিত এই দেশ। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁরা অতিথি সেবায় মগ্ন থাকে অনিবার।

এই মঠ থেকে পঞ্চাশ ইউইয়েন দূরে আছে আর একখানি মঠ। হুও চিং সেই মঠের নাম। হুও চিং আসলে ছিল এক অশুভ আত্মা। বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে এই আত্মার রূপান্তর ঘটে। এই স্থানে পরবর্তীতে একটি বিগ্রহ তৈরি করা হয়। বুদ্ধের শিষ্য অরহত হাত ধোওয়ার জন্য একটু জল নিলেন, আর হাতের ফাঁক গলে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। জলের এই দাগ আজও দেখা যায় এখানে। সে-জলবিন্দু বয়ে যায়নি নিম্নে। এমনকী মুছেও ফেলা যায়নি। এই জায়গাতেই বুদ্ধের আর একটি প্যাগোডা আছে। এক শুভ আত্মা প্রত্যেকদিন জলসিঞ্চন করে পরিষ্কার রাখে এই প্যাগোডা। কোনো মনুষ্য সহায়তা দরকার নেই। গোটা জায়গাটাজুড়ে ‍রয়েছে শতেক ছোটো ছোটো প্যাগোডা। দিনভর ঘুরে গুনে শেষ হয় না এই প্যাগোডাগুলি। যদি গুনতেই চাও, তবে প্রতিটি প্যাগোডার পাশে দাঁড় করিয়ে দাও একজন করে মানুষ। তারপর গুনে নাও ঐ মানুষগুলিকে।

ছয় থেকে সাতশো জন শ্রমণ নিয়ে এখানেই রয়েছে আর একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের একটি স্থানে বুদ্ধ কিছু আহার গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি নির্বাণ লাভ করেন। ঐ বিশেষ জায়গাটি গোরুর গাড়ির চাকার আকৃতির। বিহারের সর্বত্র রয়েছে সবুজ গাছপালা। কেবলমাত্র ঐ স্থানটিব্যতীত। বুদ্ধের পোশাক শুকাতে দেওয়া হত যেখানে সেই স্থানটিও সবুজহীন। সে-সব কাপড়ের দাগ এই স্থানে আজও অমলিন।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
2021-December-Anubad

সিমাস হিনি

ভাষান্তর: অরূপরতন হালদার

 

বাসা বাঁধার জমি
[Nesting-Ground]

স্যান্ডমার্টিনদের বাসাগুলো ছিল নদীর পাড়ে অন্ধকারে
অসংখ্য ছিদ্রের মতো। সে কল্পনা করল বগল পর্যন্ত তার
হাত, হাতায় মোড়া, আর সোজা, কিন্তু একবার একটা মরা
রবিনের পায়ের ঠান্ডা নখ তার হাতে লেগেছিল, আর
পাখিটার যে-ছোট্ট ঠোঁট শুধু তার নজরে এসেছিল তার
ঘনত্ব তাকে অবাক করে দিয়েছিল।

সে দূর থেকে ভেসে আসা কিচিরমিচির শুনতে পাচ্ছিল,
কিন্তু লোকজন তাকে একবার খড়ের গাদার মাথার দিকে
একটা ইঁদুরের বাসা দেখিয়েছিল, বাসার ভেতরে তুষ আর
ভুট্টার ডালপালার গুঁড়ো লেগে থাকা গোলাপি, আর্দ্র গলা
আর পিঠের শব্দ শুনেছিল সে।

সে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে রইল, একদৃষ্টে; অপেক্ষা করতে
করতে তার মনে হল যদি সে পরিত্যক্ত একটা গর্তে কান
লাগিয়ে মাটির নীচের নৈঃশব্দ্য শুনতে পেত।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘The Stations’, 1975]

জুলাই
[July]

হিম-পড়া সন্ধ্যার মধ্যে ড্রামের শব্দ বেজে উঠল, যেন
বাতাসের গম্বুজকে কেউ ডেকে উঠল মৃদুস্বরে। কিন্তু না।
ড্রামের অনেক নিচ থেকেই ড্রামের অস্ফুট স্বর যেন উঠে আসছিল।
অথচ ড্রামের শব্দ তেমন অস্ফুট নয়, বরং হাতুড়ির শব্দের
মতো জোরালো। শব্দ বিষয়ে অভিজ্ঞজনেরা ধীরে ধীরে
এর মধ্যে একটা ছন্দ খুঁজে পেলেন। পাহাড়ের মধ্যে
অনেক দূরে ঢালু অধিত্যকায় পিটিয়ে পাতলা করে ফেলা
হচ্ছিল সব পিপে আর ধাতব পাত।
পাহাড় যেন একটা পেটমোটা শব্দ উদ্গীরণ করা বাক্স,
অনুনাদী, দৈনন্দিন নির্ঘোষের বিপরীতে নীচু তারে বাঁধা,
একটা থেকে যাওয়া জোয়ারের ঢেউ যা যে-কোনো মুহূর্তে
ফেটে পড়তে পারে।
জুলাই মাসের রক্তিম সমুদ্রের ভেতর দিয়ে কমলা রঙের
ড্রামবাদকেরা তাদের স্বপ্নের মধ্যে পছন্দের মানুষটিকে
পায়। সব প্রসারণ, ফুলে ফেঁপে ওঠা যেন সংযোজিত স্বর;
সূর্যাস্তের মধ্যে কলার-শোভিত, লম্বা হাতাওলা সেইসব
মানুষ যারা নিয়তই পিছলে যায়, আর পুলিশের দল
তাদের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল অব্যবহার্য পাথুরে কয়লার মতো
বাতাস অন্ধকার হয়ে এসেছিল, মেঘাচ্ছন্ন, আর কোনো
কসাইয়ের একটা অ্যাপ্রন। রাত স্তব্ধতায় ফিরে গিয়েছিল
যেন একটা শাদা রঙের মথের মধ্যে জলের প্রবাহ, যুদ্ধ
থেকে বহু মাইল দূরে, আর একটা রক্তের গ্রন্থি এখনও
নালার ভেতর অলস, নিস্তব্ধ

[কাব্যগ্রন্থ: ‘The Stations’, 1975]

পর্যটক
[The Wanderer]

একটা অর্ধবৃত্তের মধ্যে আমরা বুড়ো অঙুলের উপর ভর
দিয়ে অধিপতির টেবিল ঘিরে চকখড়ি দিয়ে যে-রেখা টানা
আছে তার উপর দাঁড়ালাম, আর দিনের ভেতর তখন সূর্য
দুধের উপরিতল গেঁজিয়ে দিচ্ছিল, একটা জ্যামের শিশির
এক ধার গরম হয়ে উঠছিল যার মধ্যে একটা গোটা বিনের
খোলা ফেটে গিয়েছিল। অধিপতি আমাকে সামনে
ডাকলেন, আমার হাতের উপর একটা রুপোর মুদ্রা রেখে
বললেন, ‘ছুটি শেষ হলে এই লোকটি ডেরির দিকে যাত্রা
করবে, তাই ওর জন্য এটা, এটা ওর পাওয়া জলপানি…
আমরা সবাই ওকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এবার যে যার
জায়গায় ফিরে যাও।’
আমি সেই মুদ্রা-প্রদায়ীর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি
আজ, আর এই পরিযায়ী নিঃসঙ্গতা থেকে ফিরে যাওয়ার
কোনো বাসনা নেই আমার। আমি দেখেছি জ্বলন্ত হলঘর,
ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা হৃদয়, ভরে ওঠা এবং পুনরায়
শূন্য হয়ে যাওয়া বেঞ্চগুলো, আসঙ্গের বৃত্তগুলোর ফিরে
আসা এবং ভেঙে যাওয়া। সেই সময় আমি ছিলাম
একজন ধনী যুবক, যে আজ তোমাকে বলবে অস্থিরতার
কথা, রাত-পাহারা, সব পতন, আর নারীদের কেঁদে-ওঠা
চোখগুলোর কথা।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

নিভৃত
[Cloistered]

কলেজের ছোটো গীর্জাটির ঝুঁকে থাকা জানলার কাচে
আলো যেন কড়া পড়ে যাওয়া একটা অস্তিত্ব, উপাসনা-
স্থানের কৃত্রিম পাথরের চওড়া জায়গাটায় দীর্ঘ তেরচা
একটা দণ্ডের মতো জেগে আছে। কর্তব্যরত যাজক তাঁর
উচ্চারণগুলো প্রতিটা থাম আর প্লাস্টারের বিপরীতে
পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন, আর আমরা বেঞ্চির শক্ত প্রান্তে
আমাদের কনুইয়ের শক্তি মেপে নিচ্ছিলাম কিংবা সোনালি
রঙে মোড়া প্রার্থনা-পুস্তকের বেড় ছিঁড়ে ফেলছিলাম।

আমি ওই ছ-টা বছর নিয়ে একটা বেশ লম্বা একটা বই
লিখে ফেলতে পারতাম, আচার-অনুষ্ঠান আর অবসর
বিনোদন নিয়ে পাহাড়ের খাড়া দেওয়ালে একটা ফ্লেমিশ
ক্যালেন্ডার আটকানো। দেখ: আমাদের পেছনে পাহাড়-লাগোয়া
একটা সমাধিক্ষেত্র, আর নদীর ওপারে জমি চষা
চলছে, মাঝখানে একটা সুরক্ষিত শহর। এখানে এক
বিশ্বস্ত কেরানি বিশপের আংটি চুম্বন করছে, এখানে
মরশুমি ক্রীড়ার কারুকার্য, আর একজন অক্লান্ত উদ্ভাসক
এক কোণে তাঁর ডেস্কের উপর অবনত।

পড়ার হলঘরে আমার হাত শীতে কোনো লিপিকরের
হাতের মতো ঠান্ডা। অধীক্ষক পাশ দিয়ে হিসহিস শব্দের
মর্মর তুলে চলে গেলেন, স্তোস্ত্রগীতের বাষ্পের মধ্যে লীন,
তাঁর শক্ত জুতোর চাবুকের মতো ধ্বনি আলখাল্লার নীচে
আয়ত, মৃদু। এরপর আমি AB নামের সরলরেখাটিকে
দ্বিখণ্ডিত করি, আমার পা রাখার জায়গা খুঁজে পাই
লিভির প্রধান ক্রিয়াপদের মধ্যে। আমার কুড়েটা থেকে
আলো ফোটার পর আমি সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ভালো করে
আরও একবার দেখি এবং সকালবেলায় একটা বেশ
প্রফুল্ল একটা আত্মজ্ঞান সহযোগে এনামেলের জলের
পাত্রে বরফের কুচি ভেঙে রাখি।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

পশ্চিমের স্টেশনগুলো
[The Stations of the West]

গেইল্ট্যাষ্টের প্রথম রাতে সেই বৃদ্ধা রমণী আমার সঙ্গে
ইংরেজিতে কথা বলছিলেন: ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
আমি আবছায়া আলোয় একটা বিছানার পাশে বসে
দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অনর্গল আইরিশ ভাষায় শুনতে
পাচ্ছিলাম কথাদের, একটা ভাষণ যা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে
চেয়েছিলাম, তার জন্য দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে আমি
তখন ভীষণ কাতর।
আমি পশ্চিমে এসেছিলাম বিশুদ্ধ আবহাওয়া উপভোগ
করতে। স্বপ্নদর্শী যাঁরা, আমার মুখের উপর তাঁদের
শ্বাসবায়ু বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল রান্নাঘরের গন্ধ, তাঁরা
ক্রপীদের কবরের ধুলো মিশিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের
ধর্মের উপোসি লালাদের ভেতর, আর তা দিয়ে আমার
ঠোঁট লেপে দিয়েছিলেন। তাঁরা এফিটকে আহ্বান
করেছিলেন। আমি তখন আরক্তিম, আমার মুখে মাত্র
কয়েকটি কথা ফুটেছিল।
উপরের সেই ঘরটায় আমার সেইসব দিনগুলোয় যখন
চারপাশের সবকিছু মনে হচ্ছিল যেন দৈববাণীর অধীন,
আমার ভেতর সরস্বতীর কোনো বিভূতি ঝরে পড়েনি।
কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে পড়ছিল পশ্চিমের সেই স্টেশনের
কথা, শাদা বালি আর কঠিন শিলাস্তর, সেই আলোর কথা
যা তার নিজস্ব সংজ্ঞার মতো উঠে গিয়েছিল রানাফাস্ট
আর এরিগালের উপর দিয়ে, আনাঘ্রা আর কিনকাস্লাহর
উপর দিয়ে: এই নামগুলো ছিল বহনযোগ্য সেইসব
বেদীর পাথর, অবিমিশ্র প্রাকৃত উপাদান।

(ক্রপী: আইরিশ রিপাবলিকান বিদ্রোহী (সাধারণত অপভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।), এফিট: প্রাচীন এথেন্সের বিচারালয়ের সদস্য যাঁরা কিছু হত্যার মামলার বিচার করেছিলেন।)

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Stations’, 1975]

আশ্চর্য ফল
[Strange Fruit]

এই সেই কিশোরীর মাথা যেন কবর থেকে তুলে আনা লাউ।
ডিম্বাকৃতি, আলুবোখারার মতো গা, দাঁত যেন শুকনো খেজুর।
তারা তার চুল থেকে ভিজে ফার্নের পরত খুলে নিচ্ছিল
যেন সে-কেশরাশির জটা তারা উন্মুক্ত করে দেবে,
তার অটল সৌন্দর্যের মধ্যে বয়ে গিয়েছিল হাওয়া।
চর্বির মোহঘোর, নশ্বর ঐশ্বর্য:
তার ভাঙা নাক তৃণক্ষেত্রের একটা টুকরোর মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন,
তার চোখের গর্ত পুরোনো কারুকাজের মধ্যে শূন্য এক পুকুর,
ডাইওডেরাস সিকিউলাস স্বীকার করেছেন
নীচের এইসব ব্যাপারে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা:
নিহত, বিস্মৃত, নামহীন, ভয়াবহ
বালিকা যার মাথা কেটে ফেলা হয়েছে, অপ্রস্তুত করে দেওয়া কুঠার
আর স্বর্গসুখ, যা আপাতভাবে মনে হচ্ছিল ভক্তিশ্রদ্ধার ব্যাপার
তাকেও অপ্রস্তুত করে দিচ্ছিল।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘North’, 1975]

ঝিনুক
[Oysters]

আমাদের খোলাগুলো প্লেটের উপর খটখট শব্দ করছিল।
আমার জিভ যেন ভরে ওঠা মোহানা,
তারার আলোয় ভরা আমার তালু ঝুলন্ত, স্তব্ধ:
আর আমি লবণাক্ত কৃত্তিকার স্বাদ নিয়েছিলাম
কালপুরুষ জলে তার পা ডুবিয়ে দিয়েছিল।

জীবিত এবং অতিক্রান্ত
তারা তাদের বরফের বিছানায় শুয়ে থাকে
দ্বিকোষগুলি: ফেটে যাওয়া কন্দ
আর সমুদ্রের ছেনালিময় দীর্ঘশ্বাস।
অযুত তারা ছেঁড়া, খোসা ছাড়ানো, ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।

আমরা সেই সৈকতের দিকে গাড়ি ছুটিয়েছিলাম
বেলেপাথর আর ফুলগুলোর মধ্যে দিয়ে
আমরা উদ্যাপন করছিলাম আমাদের বন্ধুতা,
একটা নিখুঁত স্মৃতি যেন নির্মিত হয়ে চলেছিল
খড়ের ছাউনি আর মাটির বাসনপত্রের ঠান্ডার মধ্যে।

আল্পসের উপর দিয়ে খড় আর তুষারের মধ্যে
বস্তাবন্দি অবস্থায় রোমানরা তাদের সব ঝিনুক
দক্ষিণ থেকে রোমের দিকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল:
আমি দেখেছিলাম স্যাঁৎসেঁতে সেইসব ঝুড়ি উগরে দিচ্ছিল
পাতার ঠোঁটঅলা, সমুদ্রের লবণে বিদ্ধ
বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সেইসব ভুরিভোজ

আর আমি ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলাম এই ভেবে যে
সমুদ্র থেকে উঠে আসা কবিতা বা স্বাধীনতার মতো
উজ্জ্বল আলোয় আমার দেহ এলিয়ে দিতে পারছিলাম না।
আমি ইচ্ছে করেই আমার গোটা দিনটাকে খেয়ে ফেলেছিলাম
যাতে এর তীব্র, কটু স্বাদ আমাকে
আমার ক্রিয়া, বিশুদ্ধ ক্রিয়ার ভেতর দ্রুততর করে তোলে।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

টুম রোড
[The Toom Road]

একদিন বেশ সকালে আমি সাঁজোয়া গাড়িদের দেখলাম
কনভয়ের মধ্যে তারা শক্তপোক্ত টায়ারের উপর ভর করে
পাখিদের মতো কিচিরমিচির শব্দ করছিল,
সবার গায়ে ছিল ভুর্জের ডালপালা দিয়ে বানানো ছদ্মবেশ,
আর কানে হেডফোন গোঁজা সৈন্যরা গম্বুজের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিল।
কতক্ষণ তারা আমার রাস্তা দিয়ে এভাবে যাওয়া-আসা করেছিল
যেন তারাই এ-রাস্তার মালিক? সারা দেশ ছিল ঘুমন্ত।
আমার ছিল আসা-যাওয়ার জন্য নিজস্ব রাস্তা,
শস্যখেত, আর গবাদি পশুরা,
ট্র‍্যাক্টরগুলো খড়-টানা মই নিয়ে খোলা ছাউনির নীচে
যেন ঝাঁকিয়ে উঠছিল,
শস্যের গুদাম, ঠান্ডা হয়ে থাকা গেটগুলো, ভিজে শ্লেটপাথর,
বাইরের ছাদে ছড়িয়ে থাকা সবুজ আর লাল লতাপাতা।
পেছনের দরজায় খিল দেওয়া বাড়িগুলোর মধ্যে
আমি কার কাছে ছুটে গিয়ে জানাব
দুঃসংবাদ যে বয়ে এনেছিল তার কথা, সেই ক্ষণকালের অভ্যাগত
যে ছিল প্রত্যাশিত, তাকে কি দূরে রাখা সম্ভব ছিল?
যারা বীজ বুনেছিল, যারা সমাধিফলকগুলো খাড়া করেছিল…
হে সারথি, তোমার ঘুমন্ত বন্দুকগুলোর উপরে
এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে, যখন তুমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাও
স্পন্দমান দাঁড়ানো
সেই অদৃশ্য, দৃঢ় প্রস্তরফলক।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

জলপান
[A Drink of Water]

মেয়েটি রোজ সকালে জল নিতে আসত
যেন সেই পুরোনো বাদুড় মাঠের মাঝখানে বাতাসে টলায়মান:
পাম্পের তীব্র কাশির দমক, বালতির ঝনঝন শব্দ আর
ভরে উঠতে উঠতে সে-শব্দের ধীরে কমে আসা,
যেন তারই আগমনবার্তা। আমার মনে পড়ে
তার ধূসর রঙের অ্যাপ্রন, তার উছলে ওঠা বালতির
ক্ষতচিহ্নে ভরা সাদা এনামেল, আর উঁচু তারে বাঁধা
তার কণ্ঠস্বর যেন পাম্পের হাতলের শব্দ।
যখন পূর্ণিমার চাঁদ তার দেহের তীক্ষ্ণ কোণ পার করে
আকাশে উঠে আসে
তার জানালা দিয়ে রাত নীচে পড়ে যায়
শুয়ে থাকে টেবিলের উপর বয়ে চলা জলের ভেতর।
আমি যেখানে আরও একবার
জল পান করার জন্য মুখ নামিয়ে দিয়েছিলাম
আমি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছিলাম
তার কাপটির উপর লেখা সেই সাবধানবাণীর প্রতি
দাতাকে স্মরণে রেখো, যা তার ঠোঁট থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছিল

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

ঈর্ষা-সম্বন্ধীয় একটা স্বপ্ন
[A Dream of Jealousy]

তুমি এবং আর একজন মহিলার সঙ্গে আমি হাঁটছিলাম
গাছপালায় ঘেরা একটা বাগানের মধ্যে, ঘাসের মর্মর
চিন্তামগ্ন আমাদের নৈঃশব্দ্যের ভেতর
তার আঙুল চালিয়ে দিয়েছিল
আর গাছগুলো খুলে গিয়েছিল একটা ছায়াচ্ছন্ন
আকস্মিক উজ্জ্বলতায় যার ভেতর আমরা বসে ছিলাম।
আমার মনে হল যেন আলোর সরলতায়
আমাদের মধ্যে ভয় জেগে উঠছিল
আমরা আমাদের বাসনার কথা বলেছিলাম আর
ঈর্ষা আমাদের ঘিরে ধরছিল,
আমাদের সংলাপ যেন একটা ঢোলা আলখাল্লা
অথবা চড়ুইভাতির জন্য পেতে রাখা একটা শাদা টেবিলক্লথ
যেন একটা আচরণবিধির বই নির্জন প্রান্তরে পড়ে আছে।
‘আমাকে দেখাও’ আমি বলে উঠলাম আমার সঙ্গীকে
‘আমি যা সবচেয়ে বেশি কামনা করেছি
তোমার স্তনের উপর এলিয়ে থাকা
সেই ফিকে লাল রঙের তারা’।
সে রাজি হয়েছিল। হায়, না এইসব কবিতা
না আমার আমার বিচক্ষণতা আর ভালোবাসা
তোমার বিক্ষত দৃষ্টিকে সারিয়ে তুলতে পারে।

[কাব্যগ্রন্থ: ‘Field Work’, 1979]

Categories
অন্যান্য

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

১০

সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু, কাছে পিঠে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠেছিল। কেন-না এ-এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে। মুদিয়ালির কিশলয় গলির পেছন থেকে নিয়ে পার্টি অফিসের পেছনের কয়েক ঘর বিহারীবস্তি ছুঁয়ে ওদিকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট যে-হোগলার জলাজঙ্গলটা বিরাজিত ছিল জলের মাঝে মাঝে কয়েকখানি শিমুল আর কদমের গাছ নিয়ে, এই তো সেদিনই যেন-বা, বিশাল বিপুল এক থম মারা নির্জনতা বুকে জাগিয়ে— যে-নির্জনতা ভর দুপুর বেলাতেও মাঝ-নিশার অন্ধকার ডেকে আনত, যেখানে দিনমানে কখনো কখনো বেওয়ারিশ লাশ ভেসে উঠত এই সেদিনও, সেই জলাটা একদিন রাতারাতি ভানুমতীর জাদুতে বা ময়দানবের ছোঁয়ায় বর্তমানে মধ্যবিত্ত মানুষের একতলা বা দোতলার জমাট বসতি, পুরোনো জাগানো দুয়েকটি শিমুল বা কদম গাছ সমেত, যেগুলো আপাতত আজও বেঁচে মানুষের লোভী শানিত নখর এড়িয়ে। এখন ময়দানব কৃষ্ণ হলেও আসল ভানুমতী-জাদুকাঠিটা ছিল আসল ভগবান প্রদীপ রায়ের হাতেই! লোকে বলে আধাআধি হিস্‌সা ছিল নাকি কৃষ্ণের আর প্রদীপের। লাল পার্টির যাই বদনাম থাকুক তারা কিন্তু দলের ওপর থেকে নিচু সবাইকে দিয়ে-থুয়েই খায়। যেমন দেখতে দেখতে উবে যায় ঘেঁষকালের মাঠ, শান্তিনগরের বিপুল সেই হোগলার বন— না, সেখানে ইদানীং আর লাশ ভেসে ওঠে না, কেন-না লাল জমানার মধ্যগগনে শান্তি হি শান্তি! এবং টাকা মাটি, মাটি টাকা— এ ঈশ্বরীয় বাণীটিও বাস্তব আদল পায়! সে-সব টাকাও সমান বখরায় ভাগ হয়েছিল কৃষ্ণ আর প্রদীপের মধ্যে। যেমন উবে যায় লালার মাঠ, পাল বাগানও। শুধু আজও রয়ে যায় বাঁধা বটতলার বাবুলের গলির পেছন থেকে নিয়ে রামদাসহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত হোগলার জলা-জঙ্গলটা, যেহেতু সেখানে মাঝে মাঝে জেগে থাকা দ্বীপে চোলাইয়ের চাষ হয়, এবং অবশ্যই পার্টি, পুলিশ, প্রশাসনের নজরের আড়ালেই, যেহেতু জলাটা কলকাতা কর্পোরেশন আর মহেশতলা গ্রামপঞ্চায়তের সীমানায়, ফলে দুই থানার মাঝখানে নিশ্চিন্তে বিরাজমান! হ্যাঁ, বর্তমানে মেটেবুরুজ যেমন উন্নয়নের প্রগাঢ় শরিক হয়ে মিউনিসিপালিটির ঊর্ধ্বে উঠে কলকাতা কর্পোরেশনের বর্ধিত এলাকা— ওয়ার্ড নং ১৩৩-১৪১, মহেশতলাও ক-বছর বাদে উন্নততর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপালিটিতে উন্নীত হয়ে যাবে।

যে-কথা হচ্ছিল, সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু পুরোনো জাগানো শিমুল কিংবা কদম গাছে কোকিল ডেকেছিল, যা সেই দুপুরটাকে বিষণ্ণ ও ঘন করে তুলেছিল। আর সেই ঘন দুপুরখানি আরও ঘনান্ধ হয়ে উঠেছিল যখন কৃষ্ণ ঘরে এসেছিল, কেন-না তার শ্যাম মুখখানি ছিল কালো, থমথমে। ফলে সে-ক্ষণের ঘন আঁধার ভাঙতে সাহস হয়নি রূপার। বিস্মিত রূপা অপাঙ্গে তাকিয়েছিল কেবল, কেন-না কৃষ্ণের আজকের ফেরাটা সঠিক সময়ের ছিল। পরে স্নান করে, ভাত খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ফুকরে উঠেছিল কৃষ্ণ আপন মনে নিজেকে শোনাতেই যেন,— হেরে গেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে হারিয়ে দিল! নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে সে, মনের চাপা হাহাকারটাকেই উগড়ে দেয় যেন।

ক-দিন ধরেই শেরু নামটা শুনছে রূপা। ধানখেতি বস্তির বছর সতেরোর কিশোর সে। কিশোরই তো, তবুও তার করিশ্মায় আব্বাস-বাদশার একচেটিয়া খানদান ভেঙে চৌচির যেন। কাচ্চিসড়ক, আয়রন গেট রোড, শাহী আস্তাবল লেন, ধানখেতি, বাত্তিকল কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সে ইদানীং! অথচ কেউ তাকে দেখেনি নাকি! ডকের চোর, ট্রান্সপোর্টার, লেবার কনট্রাক্টর— সবার কাছ থেকে তোলা তুলত তার দল। যারা এতদিন আব্বাসকে দিয়ে এসেছে, তারা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ফলে দু-একটা লাশ পড়ে যায়, যে-খেলার যা নিয়ম তা মেনেই। ফলে টাকা আপনি পৌঁছে যেতে থাকে তার কাছে। সে-কিশোর, শেরু সব টাকা নাকি বিলিয়ে দেয় ধানখেতি-বাত্তিকলের গরিব সকল মানুষকে। পুলিশ অনেক বার রেড করেছে ধানখেতি বস্তি আচমকা, দিনে-রাতে। না, শেরুর টিকিটি খুঁজে পায়নি তারা। বোরখা পরা মহিলারা প্রত্যেকবারই পুলিশকে ঘিরে ধরে জানিয়েছে যে,— শেরু-এরু কিসিকো হমলোগ নাই জানিস। না, পুলিশরা বস্তির কোনো ছোকরাকেও ধরতে সক্ষম হয়নি। কেন-না সে মহিলাকুল সকল সময়েই তাদেরকে ঘিরে থেকেছে। পুলিশ জোরও করতে ভয় পেয়েছে— ডি॰সি॰ হত্যার কেসটা যে তখনও দগদগে। দ্বিতীয়ত এ-বস্তির গলির গলতা, তার ভুলভুলাইয়া! সরু সে-গলির দু-পাশে ঝুঁকে আছে বস্তির খাপরা-টালির চাল, মাথা ঠেকাঠেকি করে যেন, আবার হঠাৎ তুমি দেখলে সে-গলি শেষ হয়েছে কোনো বাড়ির উঠোনে, বেকুব তুমি জানো না যে, সে-বাড়ির লাগোয়া কাঁচা ড্রেনের পাশ দিয়ে আবার এক নতুন গলির শুরু। যদি-বা জেনে নিয়ে সে-পথ ধরে এঁকে বেঁকে এগোলে, আচমকা দেখলে তুমি সহসা হাজির একচিমটে এক খোলা প্রান্তরে, তাকে ঘিরে টালি-খাপরায় ছাওয়া দশ ঘর! ব্যস, ফেঁসে গেলে তুমি! যদি শত্রু হও, পিছন পানে ফিরতে চেয়ে দেখলে সে ড্রেন ঘেঁষা গলির আধা- অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে কয়েকটা শার্দূল চোখ সে-আঁধার চিরে! অগত্যা পুলিশকে ফিরে যেতে হয় বার বার মেন রাস্তায় খাড়া তাদের গাড়ির নিরাপদ ঘেরাটোপে। কিংবা এ এমনও চাল হতে পারে পুলিশ-প্রশাসনের আব্বাস-বাদশাকে সবক শেখানোর! হতে পারে বখরায় কম পড়ছে লালবাড়ির।

বাদশা নামটা ইদানীং শুনেছে রূপা। দেখেছেও একদিন এক ঝলক। হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সে— ছ-ফুটের ওপর লম্বা, টকটকে গায়ের রং, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো, এক কানে ঝিলিক দিচ্ছে সোনার হাত— পাঞ্জা। হ্যাঁ, বাদশার মতোই তার শান-সওকত। অল্প দিনেই আকাশ ছোঁয়া উত্থান। আব্বাসের হাত ওর মাথার ওপর, ও নাকি পরের ভোটে সবুজ দলের উমিদবার-প্রার্থী এবং জিতবেও, কেন-না আব্বাস ফ্যাক্টর। শোনা যায় সবুজ পার্টির শিয়ালদ-র ছোড়দার সঙ্গেও ওঠাবসা, বেরাদারি। তবে এটা সত্যি যে, কলকাতা-হলদিয়া ডকের অর্ধেক ট্রান্সপোর্ট, ট্রেলারের মালিক নাকি সে। আবার এদিকের জাহাজ কারখানা, রাজাবাজার ডক ইয়ার্ড, জি॰ই॰সি॰, ল্যাম্প ফ্যাক্টরি, সাবান কল— সবের লেবার কনট্র্যাক্টের অর্ধেক তার, বাকি অর্ধেক প্রদীপ রায়ের বকলমে কৃষ্ণের।

সহসা সে দুপুরের শব্দহীনতাকে চলকে দিয়ে, ফলত রূপার ভাবনাকেও, কৃষ্ণ বাঁহাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসির আঘাত হেনে হিসহিসিয়ে উঠেছিল— গো হারান হেরে গেলাম! দাঁড় করিয়ে গোল দিয়ে চলে গেল বাচ্চা ছেলেটা! মুড়ি-মুড়কির মতো পেটো। সঙ্গে শূন্যে ফায়ার! আমরা পালটা দিলে পাড়ার সাধারণ মানুষের ক্ষতি হত। সেটা আমি থাকতে হার্গিস কোনোদিন হতে দেব না। অপেক্ষায় ছিলাম, যদি প্রদীপদার বাড়ি অ্যাটাক হত তখন তো…। আর প্রদীপদা বলে কিনা,— ‘আমরা কাপুরুষ! আমাদের নাকি ফালতু পুষছে!’ একটু থামে কৃষ্ণ, যেন-বা দম নেয় ক্ষণিক ভেতরের রাগটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উগড়ে দেবে বলে।

— আমরা ফালতু! যে-যুদ্ধের যে-কৌশল— আমরা মোটে জনা দশেক আর ওরা পঞ্চাশ-ষাট জন। আগে কোনো খবর ছিল না, এমনই হঠাৎ চাল! তা তোর গোয়েন্দা-পুলিশ কি ঘাস ছিঁড়ছিল! শুধু আমরাই ফালতু! আমদের পোষে হারামিটা! কে কাকে পোষে! আমরা আছি বলেই তো তুই আছিস! শালা কালা নাগ!

ঘটনাটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতোই, যেহেতু তা চিন্তারও অতীত ছিল, কেন-না প্রদীপ রায়ের আস্তানা ফতেপুর সেকেন্ড লেনের নোনাপুকুরে, খাঁটি হিন্দু বাঙালি পাড়া, তাছাড়া কৃষ্ণের খাস তালুক— সবচেয়ে বড়ো কথা প্রদীপ রায় নামের প্রতাপ, মাটির দুর্গের আসল নবাব যে, যতই ভোটে হারুক সে, বা মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন! এ হেন প্রদীপ রায়ের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল একটা নাদান বাচ্চা ছেলে, নালায়কই যে! যা আব্বাস-বাদশারও স্বপ্নে হার্গিস আসবে না। তাও দু-আড়াই মাইল দূরের ধানখেতি থেকে উজিয়ে রামনগর লেন হয়ে, মিঠাতলাও, ব্রাহ্মসমাজ রোড, করমঞ্জিল, মুদিয়ালি ফার্স্ট লেন, মুদিয়ালি হরিসভা পার করে, ফতেপুর সেকেন্ড লেনের মতো হিন্দু পাড়ায় রঙবাজি, প্রদীপ রায়ের প্রতাপকে পায়ে দলে! এক ফুঁয়ে নিবিয়ে! বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো পেটো ফেটেছে। নাঃ, দম আছে ছেলেটার! সব্বাই একবাক্যে সেলাম ঠুকেছিল শেরুকে। এখন নেতার প্রতাপ পাংচার হলে নেতা তো সর্বহারা! সমান সত্য মস্তানের ক্ষেত্রেও। প্রতিটা মানুষ ঘরে লুকিয়ে ক্ষ্যা-ক্ষ্যা হেসেছিল, যদিও মনে মনে। ফলে গল্পের গোরু গাছ ছাড়িয়ে আকাশে ভেসেছিল।

— আবে, কালা নাগ, বাপকা আওলাদ হো বাহার নিকালিস!

— কিয়া বে শালা নাগ, চুহা বন গায়িস ক্যা!

একটা করে ডায়ালগ একটা করে পেটো।

— দেখলিস তো শেরুকা করিশ্মা!

— ইয়ে তো জাস্ট ট্রেলার থা বে নাগ কা আওলাদ। পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

এমন বলেই নাকি ওরা ফিরে গিয়েছিল পেটোর বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে, সঙ্গে শূন্যে ফায়ার। এমনকী এ-গানও নাকি ভেসে উঠেছিল পেটো-পিস্তলের সংগতে— টিপ টিপ বরষে পানি, পানিমে আগ লাগে তো…! যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমনই ঝড়ের বেগে ফিরেও গিয়েছিল ওরা, যে-ঝড়ে প্রদীপ রায়ের সাজানো বাগান একটু হলেও তছনছ হয়েছিল বৈকি!

— আরে ওই ফর্সা পানা লম্বা ছেলেটাই শেরু।

— ধুস! শেরু তো কালো।

— যাইহোক, দেখিয়ে দিল বটে ছেলেটা। সত্যি দম আছে। নইলে বাঘের গুহায় এসে এমন রংবাজি!

কথারা আড়ালে আবডালে গড়ে ওঠে, হাওয়া পায়, ভেসে যায় দূরে রং পালটে পালটে।

হ্যাঁ, মুসলিম মহল্লায় চিকন কালো প্রদীপ রায় কালা নাগ বলেই প্রখ্যাত।

তবে নাগ তো! শীতঘুমে গেলেও যখন গর্ত থেকে বের হয়ে আসে শীত-অবসানে, তখন বিষথলি তার কানায় কানায় ভরা, টনটনায় তা যতক্ষণ না এক ছোবলে সবটুকু বিষ উগড়োতে পারে সে। এর পরের সময়টা, যা শীততুল্যই যেন প্রদীপ রায়ের সাপেক্ষে, কেন-না এই সময়টা সে নির্বিকার থাকে। আর এ-শীতলতার ঘেরাটোপে সে প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরে প্রভাব চালায় নীরবে, যেহেতু এটা প্রবাদ যে, আগুনের ফুলকির পিছনে হাওয়া থাকেই! সে-হাওয়ার উত্স খুঁজতে জানতে হয়। এবং ওপর তলার একটু তল্লাশিতেই খোঁজ মেলে এ-আগুনের পিছনে সেই শিয়ালদার ছোড়দা যোগ! অতএব গোপন রফা হয় রাজায় রাজায়। তবে সে-রফা অমূল্য আপোশের, নাকি মূল্যযুক্ত পাবলিক তা জানতে পারে না। শুধু ভাসা ভাসা এটুকুই জানতে পারে যে, সবুজ পার্টির নেতা সে-কিশোরকে নাকি ডেকে পাঠিয়েছিল এক ধোঁয়ামাখা সাঁঝে তাদের বাঙালিবাজার-বিচালিঘাটের দোতলা পার্টি অফিসে— হ্যাঁ, অতি অবশ্যই ইমানের শপথ চোয়ানো গোপনে।

কাচ্চি সড়ক, বাঙ্গালিবাজার থেকে শাহী ইমামবারা, থানা, লাল মসজিদ, শ্লটারহাউস রোড তক খানদানি মেটেবুরুজ সকালে শুনশান, বেলা যত বাড়ে, দিন ঢলে, আঁধার ঘনায় ততই সে জেগে ওঠে জুলুশে-জৌলুসে। সে-সাঁঝও ছিল তেমনই জৌলুসময়। একটি দোহারা কিশোর চোখের নির্লিপ্ত ইশারায় তার সঙ্গি চারজন সদ্য যুবাকে কাছে-দূরে লোকের ভিড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তরতরিয়ে উঠে যায় পাঞ্জাছাপ পার্টি অফিসের দোতলায়। সঙ্গে সঙ্গে পানের গুমটিতে, সামনের ফুটপাথে ফলের দোকানে কয়েকজন ক্রেতার মধ্যে আলতো চোখাচোখি হলে কিছু বাদে লুঙ্গি-শার্ট পরা একজন উঠে যায় ওপরে নিঃশব্দে। কত লোকই তো এ-সময়ে পার্টি অফিসে যায় দরকারে-অদরকারে! ভেতরে লোক আছে দেখে যেন থমকায়, ইতস্তত করে, নাদান পাবলিক হেন। ততক্ষণে চোখে-চোখে যা কথা হওয়ার হয়ে গিয়েছে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে। কেন-না ঘরের ভেতর থেকে নেতাসাবের খাস চেলা খিঁচিয়ে উঠেছিল,— থোড়া ঠাহর যাও বাহার। অব জরুরি মিটিন চল রহা হ্যায়।

পিঠ ফেরানো কিশোরটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু সংকেত হানলেও হানতে পারে, যেহেতু সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়েছিল এবং একজন এলেবেলে মানুষকেই শ্লথ পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল। কিন্তু ইমান শব্দটা, ও বাইরে তার অতি বিশ্বস্ত সঙ্গীদের উপস্থিতি তাকে নিশ্চিন্ততা দিয়েছিল। কিন্তু তার অজান্তেই লোকটি সিঁড়ির লান্ডিং-এ দাঁড়িয়েছিল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে শিকারি শার্দূলহেন বিভঙ্গে। কিছু বাতচিত, কিছু চেতাবানি, কিছু লেনদেন ও উত্সাহব্যঞ্জক কথার শেষে কিশোরটি দরজা পার হয়ে সিঁড়ির মুখে ঘুরতেই শার্দূল হেন লোকটি চকিতে লুঙ্গির পেছন থেকে সাইলেনসার লাগানো পিস্তল বার করে নিঃশব্দে ছ-ছ-টা দানা গেঁথে দিয়েছিল কিশোর শেরুর শরীরে, নামে-কামে শেরই ছিল যে, সেহেতু ঘাতকজন পুলিশি শিষ্টাচারে দু-পা জোড়া লাগিয়ে স্যালুট ঠুকেছিল লুটিয়ে পড়া বীর শত্রুকে।

ততক্ষণে সিভিল ড্রেসের বাকি পুলিশরা পজিশন নিয়ে নিয়েছে পিস্তল উঁচিয়ে,— ভিড় হটাইয়ে সবলোক। জলদি। বিচালিঘাটের গলির ভেতর লুকিয়ে থাকা পুলিশ ভ্যান ত্বরিতে চলে আসে অকুস্থলে। পুলিশ দখল নিয়ে নেয় গোটা চত্বরের। ঝপাঝপ শাটার নামে দোকানে। ফুটপাথের হকারের মাল গড়াগড়ি যায়। যেমন সিনেমায় হয় তেমনই। শেরুর সঙ্গীরা বিপদের গন্ধ পেয়ে উদ্‌ভ্রান্ত মানুষের ভিড়ে বোধহয় নিঃশব্দে মিশে গিয়েছিল। ভ্যানে চেপে শেরু চলে যায় লালবাজারে। সবুজ নেতা চোখের আঁশু মুছে ধরা গলায় বলেছিল পরে সংবাদ মাধ্যমকে— কৌন থা হামকো কিয়া মালুম! উ তো উপর ভি নেহী উঠ সকা। হাম উসকা সুরত ভি নেহি দেখ সকা। সিঁড়িমেই তো পুলিশ উসকো মার দিয়া। পুলিশ কা ইয়ে গুণ্ডাগর্দিকো হমারা পার্টি অপোজ করতে হ্যাঁয়।

ততক্ষণে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ঝলসে ওঠে যে— মেটিয়াবুরুজের শেরু নামক কুখ্যাত গুন্ডা পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত আজ সন্ধ্যায়।

সে-সাঁঝে বাত্তিকল-ধানখেতিজুড়ে শকুন সান্নাটা নেমেছিল, যা থকথকে কালো।

হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে বাস্তবে ফেরে রূপা। সন্ধ্যের ধূপ-জল দিতে দোকানের বাইরে আসে সে। পাশের হলটা অভ্যাসবশত নজর টানে তার। আবছা অন্ধকার পোড়ো প্রাসাদের কঙ্কাল যেন তা। কে এক শামবাবু কিনে নিয়েছে হলটা— শামবাবুর আসল নাম রূপা জানে না, এটুকুই শুনেছে যে, সে নাকি বটতলার খুব বড়ো দর্জি ওস্তাগর— কাঁঠাল বেরিয়া রোডে হাভেলি তার। হয়তো বকলমে আব্বাসেরই লোক! ফতেপুরের অত বড়ো গ্যারেজটাও নাকি কিনে নিয়েছে, হাসপাতাল বানাবে। তার দোকানটাও কিনতে চায় সে। না, ন্যায্য দামই দেবে বলেছে, বরং বেশিই তা। বিক্রিই করে দেবে সে। কী হবে আর রেখে? নেহাত স্মৃতির অভ্যাস, তাই আসা! লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তিতে ধূপকাঠিটা গোঁজার আগে কৃষ্ণের ছবিতেও একবার ধূপ দেখায় সে।— বোকা, বড়ো বোকা ছিল লোকটা, শেরুর মতোই। রাজনীতির দাবার চালে সামান্য বোড়েই শুধু। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে জমাট বাঁধতে থাকে দোকানজুড়ে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Categories
অন্যান্য

সোমা মুখোপাধ্যায়

তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়

সংস্কৃত তন্তু থেকে তাঁত শব্দের উৎপত্তি। বাংলার তাঁত এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প। একসময় মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে পোশাকের প্রয়োজন মেটাত। ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী বসতি ও গড়ে ওঠে। মানুষ নিজের ব্যবহারের জন্য বোনা শুরু করে। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের বোনার এই পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে বাংলার তাঁতশিল্পের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই তাঁতের কাজ হয়। এর মধ্যে হুগলি জেলার ধনিয়াখালি, রাজবলহাট, বেগমপুর এইসব অঞ্চলে তাঁতের সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। এই লেখায় রাজবলহাটের এক তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়ের সঙ্গে পরিচয় করাব।

বছর তিনেক আগে রাজবলহাটে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আলপনা ভড়ের সঙ্গে। রাজবলহাটের প্রসিদ্ধি দেবী রাজবল্লভীর জন্য। সকালে পৌঁছে মন্দিরে ঘুরে প্রসাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এই সময় পরিচয় হয় আলপনা ভড়ের স্বামী রবিন ভড়ের সঙ্গে। আমার গবেষণা বিষয়ে শুনে তিনি ওঁর বাড়ি নিয়ে যান। মন্দির থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক। শুনেছিলাম রাজবল্লভীর মন্দির ঘিরে আছে তাঁতিপাড়া। ঠকঠকি তাঁতের শব্দে মুখরিত থাকে এ-অঞ্চল।

গ্ৰামের পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেটাই নিজের কানে শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম সেই প্রচলিত কথা ‘চরকার ঘর্ঘর পড়শির ঘর ঘর’। এখানে সব বাড়ির সামনে রয়েছে কাঠে জড়ানো রঙিন সুতো। রোদে শুকিয়ে নেবার জন্য। বোনার‌ নানা রঙে সুতোকে রং করে নেওয়া হয়। আগে এখানকার মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো কালো রং করা। যদিও এর ভেতর অনেক পাকা বাড়িও আছে। আর আছে অনেক টেরাকোটার বর্ষপ্রাচীন মন্দির।

রবিন ভড়ের বাড়িতে ঢুকেই সামনের ঘরে তাঁত বুনতে দেখা গেল আলপনা ভড়কে। নদিয়ার নবদ্বীপে মহিলাদের তাঁত চালানোয় নিষেধ আছে বলে শুনেছি। চাক্ষুস এভাবে তাঁতবোনা দেখার অভিজ্ঞতা এর আগে ছিল না। এখানে সকলের হাত চালানো তাঁতটাই বেশি। ওঁরা স্বামী স্ত্রী দু-জনে আমাকে পরিচিত করান তাঁত যন্ত্রটির সঙ্গে।

আমরা টানাপোড়েন শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এখানে এসে তার আসল অর্থটা জানলাম।

তাঁতের মধ্যে কুণ্ডলী আকারে সুতো টানটান করে ঢোকানো থাকে। এখানে দু-ভাবে সুতো থাকে। লম্বালম্বিভাবে থাকা সুতাগুলিকে টানা এবং আড়াআড়িভাবে থাকা সুতাগুলিকে পোড়েন বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে বোনা হয়। তাঁত হচ্ছে কাঠের ফ্রেমের একটা যন্ত্র। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

“বাংলা তাঁতযন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল— শানা, দক্তি ও নরাজ। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তার উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তার নাম মুঠ-কাঠ। শানা ধরে রাখার এই দু-খানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম দক্তি।

শানায় গাঁথা আবশ্যকমতো প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার নরাজ। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনে, সেখানে তার কোলেও একটি নরাজ থাকে— তার নাম কোল-নরাজ। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।” (এই অংশটি উইকিপিডিয়া থেকে ব্যবহার করা হয়েছে)

এই সমগ্ৰ প্রক্রিয়াটি মূর্ত করে তুলেছিলেন আলপনা ভড়। আলপনা দেবীর বাবার বাড়ি রাজবলহাটেও। তাঁরাও তাঁতের কাজ করেন। কিন্তু আলপনা দেবী কখনো বিয়ের আগে তাঁত বুঝতেন না। বিয়ের পরেই এই কাজটা তিনি নিজের চেষ্টায় শেখেন। সাধারণত তাঁতি পরিবারের মেয়েরা চরকা দিয়ে সুতো কাটার কাজটাই করে থাকেন। তাঁত বোনার কাজ করেন খুব অল্প মেয়েরাই।

পাঠক ওপরে তাঁত বোনার বিষয়ে যে-লেখাটা রয়েছে তা পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন এই কাজটা অত্যন্ত জটিল। অনেকগুলো ধাপ আছে একটা শাড়ি বোনার। সেই কাজটিই নিজের আগ্ৰহে শিখেছেন আলপনা দেবী। আমরা নারী ক্ষমতায়ণ নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু একজন ক্ষমতাময়ী নারীকে নিজের সামনে দেখে সত্যি অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই শিক্ষা তো আলপনা ভড়ের অর্জিত। কতটা আগ্ৰহ থাকলে একজন সংসারী মহিলা এটা রপ্ত করতে পারেন তা আর নতুন করে বলতে হয় না।

আলপনা দেবীদের দুই পুত্র। দু-জনেই অন্য পেশায় নিযুক্ত। এছাড়া পরিবারে আছেন রবিন ভড়ের মা ও বাবা। বাড়ির ভেতর আছে তাঁতের সুতো জড়ানোর ও সুতো কাটার যন্ত্র। আলপনা দেবীর বউমা এগুলোর কাজ কী করে করতে হয় তা দেখালেন। সঙ্গে ছিল চা জলখাবার-সহ উষ্ণ আপ্যায়ন।

রাজবলহাটের শাড়ি ও ধুতি ৮০/১০০ সুতোয় বোনা। একটু মোটা ধরনের হয় ফুলিয়া বা শান্তিপুরের তুলনায়। নকশার ক্ষেত্রেও সাবেকি নকশা অনুসরণ করা হয়। এই নকশা হল রঙ্গবতী, ডবিবুটি, দানিবুটি ইত্যাদি। সুতো মহাজনদের থেকে তাঁতিরা কেনেন। শাড়ি মোটামুটি ৪৫০ থেকে শুরু। নকশা অনুযায়ী দাম হয়। এই শাড়ি মহাজন বা হাটেই বেশি বিক্রি হয়। একটা শাড়ি দেড়দিন মতো লাগে বুনতে।

 

রাজবলহাটের তাঁতিদের আরাধ্যা রাজবল্লভী। এই দেবীর জন্য ১৪ হাত তাঁতের কাপড় লগে। যেটা এখানকার তাঁতিদের তৈরি। এই মন্দির চত্বরের দোকানে এই শাড়ি পাওয়া যায়। পুজোর জন্য এখানে সবাই শাড়ি কিনে পুজো দেয়।