Categories
2021-December-Prabandha

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

মন্টো: সাহিত্যের অন্তরালে সংগ্রাম

প্রাক্কথন: ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে অঙ্গারে এবং তৎকালীন প্রগতিশীল সাহিত্যের নানা কথা। কীভাবে আজ থেকে প্রায় একশো বছরের ওপারে চরম রক্ষণশীল সামাজিক পরিসরে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির বৃত্তে আটকে থাকা সমাজের পশ্চাদগামী পারিপার্শ্বিকতার অন্ধকার পর্দাটিকে স্রেফ কলমের জোরে ছিন্নভিন্ন করে তৎকালীন সাহিত্যের ফেনিল আবেগসর্বস্বতার বাইরে বেরিয়ে ঘোর বাস্তবকে নিয়ে প্রগতিশীল লেখালেখির সূচনা হল, এবং তা উর্দুতে। আলিগড় হয়ে উঠেছিল এই নতুন পথের কেন্দ্রবিন্দু। সঙ্গে লাহোর, দিল্লি, বোম্বাই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ লেখকের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ভারতের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন। তৈরি হয় প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ। যাঁদের হাতে তৈরি হবে দেশভাগ-বিক্ষত, ভীত, ক্লিষ্ট এই উপমহাদেশের এক নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাষ্য, এক শক্তিশালী আন্দোলন, যা পথ দেখিয়েছিল বামপন্থী প্রগতিশীলতার লড়াইকেও। আগের পর্বে লিখেছিলাম সাজ্জাদ জাহির, ডঃ রাশিদ জাহাঁদের কথা। অঙ্গারের কথা। যাকে হাতিয়ার করে ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের নতুন ধারার লেখকেরা। এই আখ্যানে সাহিত্য আঙ্গিক কিংবা ভাষারীতির বিশ্লেষণ বা তার গুণাগুণ বিচার এই কলমচির উদ্দেশ্য না, বরং সেই সময়কে ধরার চেষ্টা করা, আজকের সমকালীনতায় সেই ইতিহাসকে জানা-বোঝা, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাতকে আলোচনার পরিসরে তুলে আনার চেষ্টা মাত্র। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিপ্লবকে কীভাবে দেখব, তার একটা বাস্তব আখ্যান নির্মাণ করা। এই লেখকগোষ্ঠীর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম, অবশ্যই সাদাত হোসেন মন্টো। এইবারের কিছু কথাবার্তা সাদাত হোসেন মন্টোকে নিয়ে।

মন্টো নিন্দিত, মন্টো অভিনন্দিতও। মন্টো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত। মন্টো উন্মাদ। মন্টো অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক। বহুবার ফতোয়া এসেছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বই, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছ-বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হতাশায় ভুগেছেন, কিন্তু তাঁর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি। রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল, সহযাত্রী সবাই একযোগে মন্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি বা তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনাকে থামানো যায়নি। নিজেই মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে লিখছেন— “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মন্টো এবং তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য… মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে কে মহান গল্পকার, খোদা না সে।” মন্টো একদম এরকমই, গল্প লেখাটা যেন মন্টোর কাছে শুধু লেখা নয়, একটা চ্যালেঞ্জ, স্বয়ং খোদার সঙ্গে। মন্টোর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে গোপিনাথ নারাং লিখছেন, ”মন্টো একজন চিরবিদ্রোহী, দেশাচার আর মহিময়তার বিপ্রতীপে তাঁর অবস্থান, সে শিল্প-সাহিত্য, রীতি-নীতি কিংবা সামাজিক ধারণা, নৈতিকতা অথবা অন্য যা কিছু…।“ প্রেমচাঁদের হাত ধরে উর্দু সাহিত্যে সামাজিক বঞ্চনা আর সুখ-দুঃখের মানবিকতার যে-কর্কশ বাস্তবধর্মী আখ্যানরীতির সূত্রপাত ঘটেছিল, মন্টোর হাতে তা পূর্ণতা পায়। তিনি কলমের আঁচড়ে সমাজকে চিত্রায়িত করেছেন খোলাখুলিভাবে, মহিময়তার বিরুদ্ধে নিরন্তর কলম ধরেছেন, এতটাই তা তীব্র যে তৎকালীন সময় তাঁকে নিতে পারেনি। প্রহসনের ভারতভাগ, বিভাজন-বিদ্বেষ, দাঙ্গা, অনাচার, নির্যাতন, প্রেম-পরকীয়া, পানশালা থেকে বেশ্যাবাড়ি, মানুষের দোষ-গুণ, প্রতারণা থেকে যৌনতা… মন্টো স্পষ্ট, ঝরঝরে, বেপর্দা। এখানেই তিনি হয়তো ইসমত চুঘতাই, রাজিন্দর সিং বেদী বা কৃষন চন্দরের থেকে আলাদা হয়ে যান, তিনি লেখেন আর পুড়ে যান, পোড়ান… “স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রী উপরে থাকে আমার শরীরের তাপমাত্রা, আর তা থেকেই বুঝবেন আমার ভিতরে কী আগুন জ্বলছে।“

দেখছিলাম নন্দিতা দাশের ’মন্টো‘। একটি দৃশ্যে মন্টো মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় অ্যাসাইলামে ভর্তি হয়েছেন। সংশোধনাগারে উবু হয়ে বসে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন কিন্তু উন্মাদ মানুষগুলোর বিচিত্র আচরণ তাঁর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ সবাইকে সচকিত করে ছুটে এল মিলিটারি ট্রাক। এক লহমায় মন্টোকে ফেলে ছবি ঢুকে পড়ে মন্টোর গল্পের মধ্যে। ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের সেই দৃশ্য, যে-গল্প মন্টো বছর পাঁচেকের এই পরবাসে থাকাকালীন লিখেছিলেন… নন্দিতা দেখালেন একজন মানুষ এই ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-ভারত ডামাডোলে অস্থির হয়ে একটা গাছের ডালে চড়ে দেশভাগ নিয়ে ভাষণ শুরু করল। সে-গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষাণ সিং, রক্ষীদের অনুনয়-বিনয় বা ভয় দেখানোতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। সে নির্বিকার। মুখে রহস্যময় হিং-টিং-ছট, উপর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি বেধ্য়ানা…। হিন্দুস্থান বা পাকিস্তান কোনো দেশই তার উদ্দিষ্ট নয়, পনেরো বছর ধরে সে খুঁজছে টোবা টেক সিং নামের তাঁর গ্রামটিকে। অনেকবার রক্ষীদের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টার পরে অবশেষে সে রাজি হয় কোনো এক দিকে যেতে। একসময় হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মাঝখানে নো ম্যান্স্ ল্যান্ড-এ হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। তার গলায় সেই বিখ্যাত ছড়াটি শুরু হয়, বদলে যায় তার কথাগুলো, উপ্পর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি মুঙ্গ দি ডাল অব দি হিন্দুস্থান অউর পাকিস্তান। ক্যামেরা যুম আউট করতে থাকে, পর্দায় ভেসে ওঠে মন্টোর মুখ… ’আউর মন্টো‘।

নন্দিতা মন্টো ইয়াত-এর নতুন অর্থ তৈরি করেছেন তাঁর ছবিতে— সংবেদনশীল অথচ নিন্দিত এক শিল্পীর নিজস্ব মনোভূমি, যার কোনো স্থানিক পরিচয় নাই। এই প্রসঙ্গে আর একটি সিনেমার কথা মনে আসে, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ’মেঘে ঢাকা তারা‘। যেখানে নীলকন্ঠের আদলে ঋত্বিককে নির্মাণ করেছেন কমলেশ্বর। একইরকম আবেগতাড়িত, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা আর একজন, যাঁকে সমসাময়িক সময়, বন্ধু, রাজনীতি কেউ রেয়াত করেনি, তাঁকে নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া করেছে, বিচার বসিয়েছে। মন্টোর মতোই তিনিও বলতে পেরেছিলেন, ”আমিও বেমালুম রিফিউজি হয়ে গেলাম…“। দেশভাগ আর সীমানা, কাঁটাতার একইভাবে দু-জনকেই ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল। দু-জনেই অক্লেশে বলতে পেরেছিলেন, “আমরা তো নো ম্যানসল্যান্ডে থাকি, আমাদের কোনো ঠিকানা নাই… দেশ নাই।” তাঁরা কেউই ভাবনার জগতে কোনো বেইমানি করেননি, শুধু নির্মমভাবে ছাল ছাড়িয়ে দেখেছেন, দেখিয়েছেন ভিতরের যন্ত্রণাগুলো। ঋত্বিক আশ্রয় নিয়েছেন চলচ্চিত্রের, মন্টো গদ্যের। মন্টোর গল্পের নির্মাণকৌশল, ভাষা-ব্যবহার আর শিল্পসুষমা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে, অথচ তিনি অশ্লীল, উদ্ধত, বেহিসাবি। সারাজীবন বামপন্থী ভাবনার শরিক হয়েছেন, আবার আলি সর্দার জাফরির মতো বামপন্থী প্রগতিশীল লেখকেরা এক সময় তাঁকে বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থী। লিখেছেন, মন্টোর গল্প দূ্র্গন্ধে ভরা। ভারত বা পাকিস্থান দুই পারেই মন্টো বিপজ্জনক। আজও। অস্থির মন্টো পাকিস্তান থেকে প্রিয় বন্ধু ইসমত চুঘতাই-এর কাছে একটি চিঠিতে লিখছেন, “কোনও ভাবে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।” ভৌগোলিক অর্থে তো বটেই, দর্শনগতভাবেও শেষপর্যন্ত কাঁটাতার-ঘেরা এক না-দেশের অধিবাসী হয়ে ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকেন মন্টো।

বেঁচে আছেন কি মন্টো? প্রশ্নটা খোঁচা মারতেই থাকে।উত্তরের জন্য মন্টোর বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে ঢুকে পড়তে হয়। বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। লিখে গেছেন প্রবল উদ্যমে— ২২টি ছোটোগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিয়ো নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর দু-জন চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি আদতেই একজন সাদা-কালো চরিত্র। লেখকজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্রমশ বিপর্যস্ত মানুষটি দেশভাগকে পর্যবেক্ষণ করেছেন অন্য চশমায়, লিখেছেন সর্পিল সময়ের হিমশীতল, গা শিউরানো সব গল্পকথা। একসময় উর্দুতে ফেল করা একজন মানুষ হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আলোচিত লেখক, সাদাত হাসান মন্টো। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সমরালয়ে জন্ম ১৯১২ সালে। বাবা মৌলবি গুলাম হোসেন ছিলেন কঠোর ও বদমেজাজি। বাবার কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা একটুও পাননি, পরিবারেও উপেক্ষিত ছিলেন সবার কাছ থেকে। ভালোবাসা পেয়েছেন শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকেই, যিনি ছিলেন তাঁর আদরের ’বিবিজান‘। তারপর সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন… পাঞ্জাব থেকে আলিগড়, আলিগড় থেকে বোম্বাই, দিল্লি, লাহোর… উর্দু সাহিত্যের পরিসরে তিনি প্রকৃতই একজন অভিবাসী, নোমাড, একজন জিপসিমানুষ। অসমাপ্ত পড়াশোনার পর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় বাউণ্ডুলে জীবনযাপন থেকে লেখক মন্টো হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ’তামাসা‘ গল্প দিয়ে, বারিসাহেবের সাপ্তাহিক ’খাল্ক্‘ পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন আলিগড়ে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আলী জাফরির, যাঁর প্ররোচনায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে। মন্টোর দ্বিতীয় ছোটোগল্প ’ইনকলাব পাসান্দ‘ আলিগড় পত্রিকায় ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্যের কারণে আলিগড়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ফিরে যান লাহোরে। তারপর বম্বে। ১৯৩৫ সালে বোম্বাইয়ের ’মুসসাবের‘ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। শুরু হয় মন্টোর সক্রিয় সাহিত্যজীবন। এখানেই বিবাহ ও প্রথম সন্তান আরিফের জন্ম। এরপর ১৯৪২ সালে চলে যান দিল্লিতে, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র নাট্যকার হয়ে। শিশুপুত্র আরিফের আকস্মিক প্রয়াণে ব্যথিত মন্টো বছর দেড়েক পরেই আবার ফিরে আসেন বম্বেতে। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত ’ফিল্মিস্তান‘-এ গল্পলেখক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বম্বেতেই কাটান। লেখেন, অভিনয় করেন। এরপর দেশভাগের ছোবল। ভারত ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানে, লাহোরে। সেটা ১৯৪৮। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে। হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর কলম থামেনি, ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর ঠিক আগের দিনেও লেখেন ’কবুতর অউর কবুতরি‘ নামে একটি গল্প।

মন্টো নিজেই শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কাহিনি, ”ঠান্ডা গোস্তের মামলা প্রায় একবছর চলেছিল… এইসময় আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কী করব ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। লেখা ছেড়ে দিব কিনা ভাবছিলাম। সত্যি কথা বলতে মন এত তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে যে, ইচ্ছে হচ্ছে কোনো কিছুর একটা ব্যবস্থা হলেই লেখার চর্চাটা ছেড়ে দিয়ে কিছুকাল নিরিবিলি জীবন কাটাব। এরপর মনে কোনো লেখার ঝোঁক চাপলে তাকে ফাঁসি দেব… বাধ্য হয়ে নিজের গাঁটের থেকে নগদ টাকা সরকারের তহবিলে গচ্চা দিয়ে দরখাস্ত করলাম। বললাম আমি অমৃতসরের মোহাজির, বেকার, দয়া করে কোনো প্রেস বা সিনেমার কিয়দাংশ আমার নামে বিলিব্যবস্থা করা হোক… যখনই ইন্টারভিউ হল, আমি তাদের সাফ সাফ বললাম, আমার দরখাস্তে যা লেখা আছে তা সবই মিথ্যা, সত্য হল আমি ভারতে এমন কিছু সম্পত্তি রেখে আসিনি, শুধু একটা বাড়ি ছিল। আমি আপনাদের কাছ থেকে কোনো ভিক্ষা চাচ্ছি না, আমার মতে আমি একজন মস্ত বড়ো গল্প লেখক…

আমার কথায় তাদের সুমতি হল। কোনো একটা বরফের ফ্যাক্টরিতে অ্যালটমেন্ট পেয়েও যাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন বলল— ’এ তোমরা কী করছ? এ লোকটি যার নাম সাদাত হাসান মন্টো, আদতে একজন বামপন্থী লোক।‘ অতএব আমার দরখাস্ত নাকচ করা হল। ওদিকে এ ব্যাপার হল, প্রগতিশীল লেখক বন্ধুরা আমাকে রক্ষণশীল বলে আমার অন্নজল সব বন্ধ করার ব্যবস্থা করল … অনেক ভেবে চিন্তে আবার কলম হাতে নিলাম…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

ওই বইটিতেই ’শ্যাম‘ সম্বন্ধে সংবাদপত্রে একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক নাইয়ার বানুর এক চিঠি পান। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ”অনেক সিনেমা দেখে মনে হয় যেন কারও নগ্ন অবস্থায় বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছি, আর এটা শালীনতা বিরুদ্ধ। ‘মুরলির ধ্বনি’ আবার একটু পড়ে বলুন তো এটা কোন ধরনের লেখা? একটা লোক যত বড় পাপীই হোক না কেন, এ লেখা ছেলেমেয়েদের মাঝে থেকে সে কী করে পড়বে? সে যত বড় মদ্যপায়ীই হোক বা বেশ্যা বাড়িতে পড়ে থাকুক বা হাজারও অনাচার করুক, সে যখন মনে করবে, ’মাগী কোথায়?’ এবং না পেলে বিছানা জ্বালিয়ে দেয়, তখন কেমন লাগে? এটা কোন ধরনের মনুষ্যত্ব?… সারা জগৎ তো পুরুষদের জন্যই বরাদ্দ নয়, যে যা-তা করে বেড়াবে। নিজেরা তো অধঃপাতে যাচ্ছেই সেই সঙ্গে শিশু সন্তানদেরও সেদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘর ছেড়ে পালানোর দশা হয়েছে। এখন পুরুষদের হাতে সন্তানের ভার তুলে দেওয়া উচিত, তখন বুঝবে। বাপ ছেলেকে শেখাবে কি কিভাবে মদমত্ত হয়ে থাকতে হয়, শালী মাগী বলে মেয়েদের টেনে নিয়ে যেতে হয়? এইসব কথা খবরের কাগজে ছড়ানোর কি মানে আছে…“।

উত্তরে মন্টো লিখছেন, ”আমি যাই করি না কেন নাইয়ার বানুর প্রতি অবিচার করেছি। আমাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত… আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে নাইয়ার বানু যে ধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত তাদের প্রতি মানুষের করুণা করা উচিত। তার চিকিৎসা সম্বন্ধে মনে করি তার সামনে বোতলের মুখ খুলে মদের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে, মাথায় কাদা মেখে, মুখে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে মাতলামি করতে হবে। এরপর শাম, বিশবী সদি, রুমান ইত্যাদি পত্রিকার লেখাগুলো বিজ্ঞাপন সমেত তাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে হবে …না হলে সাদাত হোসেন মন্টোকে যেন বলা হয় নাইয়ার বানুর পুরোনো স্যান্ডেল এনে নিজের মাথায় মেরে নাইয়ার বানুর পূত-পবিত্রতাকে উদ্ধার কর…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

এভাবেই দেখেছেন মন্টো সময়কে। শ্লীল আর অশ্লীলতাকে। আপনি কি অশ্লীল? মন্টো লিখলেন, ”আমি জানি না আমাকে কেন বার বার যৌন সমস্যা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়? শিল্পে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কি সত্যিই পাওয়া গিয়েছে? পুরুষেরা অশ্লীল কাজকর্ম করলে দোষ নেই, যত দোষ সেই কাজকর্মের বর্ণনা দিলে! লোকেরা আমাকে প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত করেছেন কারণ আমার কয়েকটি গল্প যৌন-সমস্যা নিয়ে লেখা… রুটি আর পেট, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক তো চিরন্তন ও চিরস্থায়ী। রুটি আর পেটের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োজনীয়তা কার বেশি তা বলা মুশকিল। লেখক হিসাবে শুধু ঘৃণা আর বৈষম্যের বাস্তবতার সুত্রপাত কেন হয়, এবং কী পরিস্থিতিতে তার জবাব দেওয়া তা আমার গল্পে অবশ্যই পাবেন। যারা আমার গল্পে যৌন আনন্দ খুঁজতে যান, তারা হতাশ হবেন… আমার লেখনীতে যদি নারী-পুরুষের সম্পর্কের বাস্তবিক অবস্থা প্রাধান্য পায় তা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক ভিত্তিতে যদি একটি দেশকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে যদি এক-কে অন্য থেকে পৃথক করা যায়, একই আইনে যদি জমির মালিকানা হাতছাড়া হতে পারে, তবে কোনও রাজনীতি, আইন, বা বিশ্বাসের দ্বারা নারী-পুরুষকে আলাদা করা যায় না … যারা মনে করছেন সাহিত্য যৌনসমস্যা সৃষ্টি করছে, তারা ভুল করছে, আসলে যৌনসমস্যাই সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে।“

আপনার গল্পে পতিতাদের প্রসঙ্গ এত বেশি কেন?

”রেন্ডিদের কথা বলা যদি অশ্লীল হয়, তবে তাদের পেশাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। ওদের মুছে দিন, তাদের কথাও আসবে না… আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি তা হুবহু অন্যদের কাছে উত্থাপন করি। যদি এই দুনিয়ার সকল লেখক পাগল হন, তাহলে আমিও তাই।“ ’কালো শালোয়ার‘ গল্পের পটভূমি একটি পতিতার কুটির। মন্টোর সুলতানা এই কুটিরে বাস করে। সুলতানা একজন পতিতা, তার পেশা পতিতাবৃত্তি। সমস্ত শহরের পতিতালয়ের মেয়েদের মতোই সুলতানাও তার পেশা নিয়েই দিনযাপন করে। তার জন্য তার কোনো রাখঢাক নাই। অথচ সে নিন্দিত। মন্টো বলছেন, ”অনেকেই পানশালা থেকে ফিরে মন্দির ও মসজিদ-গামী হয়ে পড়েন, আমরা যদি আফিম, ভাং বা মদ্যশালার কথা উচ্চারিত করতে পারি, তাহলে ঐ সব পতিতা কুটিরের কথা কেন উল্লেখ করতে পারি না?“ মন্টো সুলতানাদের উপর কোনো মহত্ত্ব আরোপ করেন না, শুধু তাদের কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন।

মন্টোর গল্পের প্রায় সব চরিত্ররাই সুলতানার মতোই প্রান্তেবাসী। পরিত্যক্ত মানুষ, নারী-পুরুষ। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিতাড়িত, তারা কেউ দেশচ্যুত, উদ্বাস্তু, পাগল কিংবা ভবঘুরে, নেশারু, অপরাধী, বেশ্যা কিংবা দালাল, নারী শরীরের ব্যাবসায়ী, ধর্ষক, ড্রাইভার, দোকানদার, অসংগঠিত শ্রমজীবী। মন্টো তাদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের কথা বলে গেছেন। পাশাপাশি খুলে দেখিয়েছেন ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, হিংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনকে। প্রগতিশীল লেখক সংঘের সদস্য হয়েও ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি মন্টো। তাই মন্টো অনন্য।

আপনি লেখেন কেন?

”লেখকের অনুভুতি যখন আক্রান্ত হয়, তখনই সে কলম তুলে নেয়… ক্ষত থেকেই একটি গল্পের জন্ম। আজকের লেখক একজন তৃপ্তিহীন মানুষ, ঠিক যেমন একজন বেশ্যা, কিংবা ওই গাড়ির খালাসি, প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে যে আকন্ঠ নেশা করে থাকে। যে বেশ্যা সারারাত জেগে থাকার পর দিনের সময় ঘুমাতে ঘুমাতে গিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে তারই বৃদ্ধ বয়স… সেই আমার গল্পের নায়িকা…।“ রবিশঙ্কর বল লিখেছেন— “মন্টো আসলে এক ক্ষত, দেশভাগ আর প্রান্তিক মানুষের জীবনের ক্ষত।” আর একটি লেখায় মন্টো এ-ও বলছেন, ”আমি কিছু বলতে চাই, তাই আমি লিখি। আমি কিছু রোজগারের জন্য লিখে থাকি এবং রোজগার করি তাই অনেক কথা বলতে পারি। রুটি ও শিল্পকলার যে সম্পর্ক তা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো উপায় নেই, তা অনিবার্য।“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)

আপনি কী লেখেন?

”যা কিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটছে, সেই সবকিছুই লেখার বিষয় হবে।“ বার বার বলেছেন যে, যা কিছু আদি অকৃত্রিম ক্ষুধা তাই লেখার মূল উৎস, মানুষের জীবনে খাদ্য এবং যৌনতা এই দু-টি মৌলিক চাহিদাই তাঁর লেখার উপাদান… ”যেসব সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্যা রয়েছে, সবকিছুর পেছনে ঐ ক্ষুধা, চাহিদা…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘), এটাই আবার সাহিত্যের উপজীব্য। মন্টোর লেখারও। প্রতিদিনের জীবনের যা কিছু অংশ, যা যেমন তাঁকে যেভাবে স্পর্শ করেছে সেভাবেই লিখে গেছেন মন্টো।

আপনি কি প্রগতিশীল?

”না আমি প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নই, অশ্লীল বা রক্ষণশীলও নই… আমি স্রেফ একজন মানুষ। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই প্রগতিশীল হতে হয়। তাই আমি নিশ্চয় একজন প্রগতিশীল… আমি সমাজের বদলে বিশ্বাস করি, তাই আমি কমিউনিস্টও।“

এভাবেই মন্টোকে জানা হতে থাকে– তাঁর লেখা থেকে, জীবনচর্যা থেকে, সমস্ত কষ্ট-হতাশা থেকে। কোনো সন্দেহ নাই তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে দাঙ্গা আর দেশভাগ ব্যক্তি মন্টোকে দুঃখ দিয়েছে সবথেকে বেশি। লেখক মন্টোকেও। তিনি ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শুনিয়ে গেছেন রক্ত হিম করা গল্প। গল্পগুলো শোনাচ্ছেন সেই দেশগুলোতে, যেখানে ইতিহাস নির্মিত হয়, যে-দেশগুলোতে শাসকের ইচ্ছা অনুযায়ী অতীতও পাল যায়। এই ইতিহাস ক্রমাগত অস্বস্তিকর, অনিশ্চিত আর বিপজ্জনক বর্তমান তৈরি করে চলে। এর সামনে মান্টো একটা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মৃত্যুর পরেও সেই ঝাঁজ এতটুকুও কমেনি। বদলে যাওয়া ইতিহাসের আসল পাঠ নিতে গেলে মন্টোর তুলনা নেই; মন্টো নিজেও সে-কথা জানতেন। তিনি লিখে গেছেন সেইসব অমর আখ্যান। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটিকে যিনি জাত-পাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না। তাঁর আত্মার সঙ্গী ’টোবা টেক সিং‘ নামের অলীক এক ঠিকানা খুঁজতে থাকা পাগল চরিত্রটি। সে ধর্মের ভিত্তিতে বুড়োখোকাদের ভারত-পাকিস্তান ভাগ করা মেনে নিতে না পেরে এক কাল্পনিক সীমান্তরেখার দু-পাশে হাত-পা ছড়িয়ে মরে যায়। দাঙ্গায় খুন ও লুটপাটে মেতে ওঠা ইশর সিং নিজের অজান্তে মৃতের সঙ্গে সংগম করে। নিজেও ’ঠান্ডা গোস্ত‘ হয়ে যায় পরে। ’খোল দো‘ গল্পে লাগাতার গণধর্ষিতা আধমরা কিশোরী, কোনো পুরুষ এমনকী ডাক্তার সামনে এলেও দম দেওয়া পুতুলের মতো হাতড়ে হাতড়ে সালোয়ারের গিঁট খুলতে চেষ্টা করে। ’শরিফন‘ গল্পের কাশেম তার কন্যা শরিফনকে নিহত দেখে অন্ধ প্রতিশোধস্পৃহায় এক হিন্দুকন্যা বিমলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশভাগ ও তাকে ঘিরে মানবিক প্রবৃত্তির এতো জ্বলন্ত দলিল আর কোনো লেখকের লেখা হয়ে উঠতে পারেনি। কোনো পক্ষাবলম্বন না করে মন্টো কেবল লিখে রেখে গেছেন। কোনো তত্ত্ব বিশ্লেষণ নেই, কোনো বেদনাবোধও নেই যেন। ১৯৪৭-এর ভারতভাগ আর দাঙ্গার চলমান ছবি মন্টো তুলে রেখেছেন কাগজে আর কলমে! পরোয়া করেননি, অতীত যখন পালটে যাওয়ার নিরন্তর হুমকির মুখে থাকে, তখন মন্টোর লেখা আয়না হয়ে হাজির হয়েছে। হচ্ছে।

মন্টোর অন্যরকম একটি বিখ্যাত গল্প, যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, ’বু‘ (গন্ধ)। ১৯৪৪ সালে এই গল্প যখন ’আদব-এ-লতিফ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল মহল গল্পটিকে “অশ্লীল” বলে দাগিয়ে দেয়। গল্পের মূল চরিত্র যুবক রণবীরের সঙ্গে একটি নিম্নবর্গ মেয়ের ঘটে যাওয়া সংগম মুহূর্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মেয়েটি এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রণবীরের বাড়ির সামনে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। পরনে ভিজা কাপড়। রণবীর তাকে নিজের ঘরে ডেকে নেয়, কাপড় বদলানোর সময় চোলি খুলতে না পেরে মেয়েটি তার সাহায্য চায়। মন্টো সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন, ”রণবীর ওর পাশে বসে চোলির গিঁট খোলার কাজে লেগে গেল। কিন্তু কিছুতেই যখন খুলছে না, বিরক্ত হয়ে একহাতে চোলির এক প্রান্ত ধরল, আর অন্যহাতে অপর প্রান্ত ধরে সজোরে টান মারল। গিঁট খুলে গেল। রণবীরের হাত দুইপাশে সরে গেল। চোলির তলা থেকে দুটি কম্পিত স্তন বেরিয়ে এল। রণবীর মুহূর্তের মধ্যে দেখল, তার হাত দুটি সেই ঘাটিন মেয়েটির দুই স্তনে— কুশলী কুম্ভকার যেমন নরম মাটির তাল দিয়ে পেয়ালা বানায়— সেভাবেই দুটি পেয়ালার আকার দিয়ে ফেলেছে সে… ধূসর রঙের সেই যুবতীর বুক সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক আর অদ্ভুত দ্যুতিময়। কালচে গম রঙের নীচে এক ধূসর বিভার পরত ছিল যা সেই অলৌকিক দ্যুতির জন্ম দিয়েছিল…

সারা রাত রণবীর ওর শরীর থেকে অদ্ভুত রকমের গন্ধ পাচ্ছিল। সেই গন্ধ একইসঙ্গে সুগন্ধ ও দুর্গন্ধ মনে হচ্ছিল। সারা রাত সে সেই গন্ধ পান করেছে। ওর বগল থেকে, ওর বুক থেকে, ওর চুল থেকে, পেট থেকে…। ওর সর্বাঙ্গে সেই গন্ধ, সে সারারাত ভেবে কূলকিনারা করতে পারেনি এই নীচবর্ণের মেয়েটি তার এত কাছে থেকেও এত ঘনিষ্ঠ হতে পারত না যদি ওর শরীর থেকে এই গন্ধ না পাওয়া যেত। এই গন্ধ তার মন ও মস্তিস্কের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল…“

গল্পের শেষে মন্টো দেখিয়েছেন, রণবীরের নব বিবাহিতা স্ত্রী-র দুধসাদা গায়ে হেনার আতরের খুশবু। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিঃশেষ হয়ে আসা হেনার সুগন্ধের মধ্যে সেই গন্ধ রণবীর খুঁজে পেল না, যা সেদিন বৃষ্টিভেজা রাতে সেই ঘাটিন মেয়েটির ময়লা শরীরে সে পেয়েছিল। এভাবেই মন্টোর গল্পের আখ্যান এগিয়ে চলে এক অনায়াস, অকপট ভঙ্গিতে। পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে সামাজিক ট্যাবুকে টুকরো টুকরো ফেলার সাহস, যা কারোর পরোয়া করেনি। কোনো কোনো প্রগতিশীল লেখক ’গন্ধ‘-কে ’দুর্গন্ধ‘ বলেও অভিহিত করেন। অথচ একইসঙ্গে রূপকধর্মী এবং লিরিকাল, বস্তুবাদী এবং মানসিক জটিলতার বহুমাত্রিকতা মিশিয়ে এরকম গল্প এই উপমহাদেশে খুব কম লেখকই লিখেছেন। এখানেই তিনি অন্যরকম… ”যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে, আমার গল্পগুলো পড়ুন। আপনি যদি আমার গল্পকে সহ্য করতে না পারেন, তবে বুঝবেন, এই সময়টাই অসহনীয়।“

মন্টো শুধু বেপরোয়া নন, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী।— “মন্টো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সমাজের বিদ্রোহী, সাহিত্য ও আর্টের বিদ্রোহী, সমস্ত মহিময়তা অথাৎ Doxa-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহী”, লিখেছেন গোপিনাথ নারং। তিনি বারবার অচলায়তনের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন। লেখকের পেশাদারি মর্যাদা চেয়েছেন, লেখার উচিত মূল্যের কথা বলেছেন। পত্রিকা নামক ব্যাবসায় ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি করেছেন। সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছেন— ”আমি চাই বিদ্রোহ। সেই সকল লোকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যারা আমাদের পরিশ্রম করায়, কিন্তু পারিশ্রমিক আদায় করে না। আমি চাই বিদ্রোহ, সাংঘাতিক ধরনের বিদ্রোহ… আমি সেই আবরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চাই যা আমাদের পুঁজিপতিরা দীর্ঘদিন ধরে লেখকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, স্বার্থসাধনের জন্য। এই আবরণের জন্য যে চেতনা তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, আমার বিদ্রোহ সেই চেতনার বিরুদ্ধে, যা বলে লেখালেখি ব্যাপারটা নিছক একটা নেশা… আমাদের এক বিরাট যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এসো আমরা একটা সংঘ গড়ে তুলি। আমরা সকলে মিলে এক হয়ে যাই, যদি আমরা সকলে মিলে আমাদের কলমগুলি এক স্থানে রাখি, তাহলে একটা পাহাড় গড়ে তুলতে পারি…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)।

মন্টো যুক্ত হয়েছিলেন সাজ্জাদ জাহিরের উদ্যোগে গড়ে ওঠা নিখিল ভারত প্রগতিশীল লেখক সংঘে। সেখানে তিনি ও ইসমত চুঘতাই, কৃষন চন্দর বা সাহির লুধিয়ানভিদের মতো ভারতের প্রথমসারির যুক্তিবাদী প্রগতিশীল লেখক কবি নাট্যকারেরা সংগঠিত হচ্ছেন, রক্ষণশীল স্থবিরতার বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছেন। জীবনের বাস্তবতায় যা দেখছেন, তাকেই কথাশিল্পে উপস্থাপিত করছেন। মন্টোও তাই। বরং খানিকটা বেশিই ”এলাকায় পুরোদমে লুটতরাজ চলেছে। তারপরে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল, সব বিষম গরম হয়ে উঠল। ওরই মধ্যে একটা লোক কাঁধে একটা হারমোনিয়াম চাপিয়ে পরমানন্দে গান গাইতে গাইতে ছুটল … ’যব তুম হি গয়ে পরদেশ লাগকর তাইশ, ও প্রীতম পিয়ারে, দুনিয়া মেঁ কৌন হামারা…?” (’কালো সীমানা‘)। এরকমই মন্টো। দিশেহারা অক্ষরগুলোর মধ্যে মন্টো হেঁটে চলেন আগ্রহী চোখে। খুঁজতে থাকেন চরিত্র। জড়ো করেন শব্দ। পরে সেগুলোকে কাগজে সাজিয়ে নেন। যে-শব্দ, যে-কাগজ, সমস্ত লেখা মন্টোর মৃত্যুর পরেও তাকে মুছে যেতে দেয় না। হ্যাঁ, মন্টো বেঁচে থাকেন।

আপাতত শেষ করব মন্টোর একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে, ‘জবাই আর কোপ’…

“আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোঁচ দিয়ে জবাই করলাম।”

“এ তুই কী করলি!”

“কেন?”

“জবাই করলি কেন?”

“এভাবেই তো মজা!”

“মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে…”

আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মন্টোকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। সেই যে লাইনগুলোয় মন্টো লিখে রাখেন… ”যে নেতারা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ঘৃণা জাগিয়ে তোলেন, তাদের আমি এই দাঙ্গার জন্য দায়ী মনে করি… ধর্মীয় অপপ্রচারের শয়তানিতে যারা মাতে, ভারতের স্বাধীনতার সৌধ তাদের হাতে গড়া হতে পারে না। তারা শুধু আমাদের স্বাধীনতার শত্রু নয়, মানবজাতির শত্রু।“ (’ভাগ‘)। এটাই তো আজকের কথা। আজকের বিভাজিত সময়ের কথা। এই জন্যই মন্টোকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ো দরকার।

ফিরে আসি ’মন্টো‘-তে। ওই যে, এক লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মন্টো। দৃষ্টি বিষণ্ণ। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে গানের সুর…

“বোল কে লব আজাদ হ্যাঁয় তেরে…”

ঋণ:
১. সাদাত হাসন মান্টো রচনা সংগ্রহ, রবিশঙ্কর বল।
২. ‘গঞ্জে ফেরেস্তা’, সাদাত হাসান মান্টো।
৩. মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন, জাফর আলম।
৪. ‘ঠান্ডা গোস্ত’, সাদাত হোসাইন মান্টো, অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ।
৫. ‘নেকেড ভয়েস’, ‘স্টোরিজ অ্যান্ড স্কেচেস বাই সাদাত হোসেন মান্টো’, আনন্দবাজার পত্রিকা।

Categories
2021-December-Kobita

নম্রতা সাঁতরা

নদ্যম্বু


আমি জেগে থাকতে চাই,
নুড়ির মতো কিছু ব্যথা নিয়ে
ধারালো আর প্রকট—
ভোঁতা, নরম হতে
তোমার বুকের মধ্যে কিছুদূর ঘুরপাক দরকার।


অনেকটা মরার মতো শুয়ে থাকি
পারের পলি হয়ে।
চাঞ্চল্যর জন্য দরকার
একটু জল,
বর্ষাকালে ফুলে উঠে
পাড় ভাঙবে যখন—
বন্যা হবে, সেই প্রথমবার পলি গুলে যাবে জলে।


এ নিরন্তর হাওয়ার খেলা।
তোমার থেকে আমার দিকে,
আমার থেকেও তোমার।
যে যত ঠান্ডা হয়
তার থেকে হাওয়া বয়।


তোমার সাথে আমার বার্ধ্যক্যদিন এগোচ্ছে,
অনুরাগীরা আসে যায়-
ডুব দেয়, তবু মনে মনে চায় ভেসে উঠতে।
সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় শুধু কাদা।


যতই এগিয়ে চলো,
আঁচড় দাও,
হাঁটো হাজার মাইল।
সাগরের কাছে, রেখে যাওয়ার লোভ,
সাধারণ মজুরের মতো—
তোমাকেও হাত পাততে বাধ্য করে নুনের জন্য।


যারা থাকতে পারে তোমার উপর
তারা বেশির ভাগ আরোপিত,
অসম্মত বিবাহিতার মতো স্পষ্ট হয়ে যায়
মন ও বুকের ফারাক।
মনে ভাসে মাঝি— নৌকা,
বুকের মধ্যে জলাধার।

Categories
2021-December-Kobita

সৌরভ মাহান্তী

দেয়াল

শোক নাকি আনন্দ
কে যে কাকে গোপন করে?

বাইরের যাবতীয় আঘাত, রাখি সযত্নে…

জানালা

খাঁচার ভিতরে ঢুকে থাকিস

সুদিন এলে,
বুকের পাঁজরে সোনা বাঁধিয়ে দেব

ছাদ

মধ্যবিত্ত ফুটপাতের তলায়
জোৎস্না ঝরে পড়ে

যেন না-ছুঁতে পারা বাবার যন্ত্রণা…

উঠোন

তোমাকে মাড়িয়ে যাব এমন সাধ্য কই?

আলপনাতে পা দিতেই
পদবি বানাই লক্ষ্মীছাড়া

মেঝে

বিষ পেতে দিই বুকে

এক্ষুণি তো অবাধ্য শিশুর গ্রাস,
ছিনিয়ে নেবে বেহায়া লোকটি…

তুলসিতলা

নিভে যাওয়াতেই আপত্তি
দিন দিন ভরাট হয়ে উঠুক সংসার

ভুলেও ঠান্ডা করিসনে প্রদীপ

 

 

Categories
2021-December-Kobita

ইন্দ্রজিৎ নন্দী

বাদুড়কলোনি


বাদুড়ের ভালোবাসা সহজেই অনুভব করা যায়
কেন-না, শহরতলির শেষে নগ্ন মৃতপ্রায়
তাদের চিন্তাহীন ঝুলে থাকা!

সম্পর্কের ভিতরে বাড়ে তুমুল সম্পর্কতাপ।
তুমি টের পাও ঢের জীবন বেঁচে থেকে
আর বাদুড়েরা টের পায় কয়েক মুহূর্তে!
যখন অপরপ্রান্ত ভালোবাসায় ধাক্কা লেগে ফেরে আল্ট্রাসোনিক,
তাদের এই ঝুলে থাকা সম্পর্ক শান্তির কিংবা প্রেমের সমধিক।


তোমাকে আমি প্রেমিকা হিসেবে অল্পই চিনি।
যখন যখন রোদ পড়ে আসে প্রেমিক দারুচিনির,
হেমন্ত আঁকা গাছটার নিচে আমাদের দেখা হয়,
সময়টা বোধ’য় খারিফ শস্য কাটার সময়…

মাঠে ধান নেই, ইঁদুরেরা কেটে নিয়ে গেছে ঘরে
ওদিকে ঠোঁটখড় বয়ে ফেরে শালিখ শহরের
মাঠের একপাশে দারুচিনি, অন্য পাশে পিপুলের শান্ত কলোনি।
বাদুড়-মেঘের উলটো দিকে ঝুলে থাকা ন্যাসপাতি ফল যেমন
সেভাবেই আমরা ভালোবাসাটুকু চিনে নিই।


ছিল না শিমুল কাঠের ছলনা;
পর্যটক পাতা সাজিয়ে রাখে অর্জুন সামিয়ানা!
পাতার নীচে ঘুরতে আসে ট্যুরিস্টব্যাগ— অ্যাটাচিকেস,
সম্পর্কের মতো শিমুল, হাওয়া লেগে চিপকে একশেষ
পর্যটক মাথায় লাগে, গায়ে লাগে, ওড়ে
উড়তে উড়তে সারারাত জাগে, সমস্ত রাত জাগে

জাগতে জাগতে বাদুড় হয়ে যায় বাদুড়ের পড়শী পাতাটিও
যা কিছু ওড়ে তাদের বাদুড়বশে পালক ভেবে নিয়ো!


বৃষ্টি পড়লে এক ফুলের হৃদয় পুকুর হয়ে যায়
চুলের খোঁপা থেকে বয়ে চলে গন্ধরাজ নদী;
নদীর জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা রেখে
ঝরে যায় শালবন পাতা।
পাতা বয়ে গেলে নাম জানা হয় না খরস্রোতার।

নদীর মতো করে একবার সে-পাতার শরীর তুলে ধরো,
পারো! সংসারের ভিত নাড়িয়ে চলে যেতে তুমি পারো।

নড়বড়ে ভিত শিকড়ের উপর তীব্র মেঘের সংসার বানাব
আমরা দু-জন, দূর থেকে মনে হবে পাখি!
দিনশেষে আমরা আসলে ঘোরতর স্তন্যপায়ী।


একটা প্রেমের প্রতি আমরা বরাবরই উদার
যে-প্রেমে চুলে পাক ধরে জারুলপাতার
কিংবা বুড়ো পাতা পড়ে ভরে ওঠে শিউলি সরোবর;
পড়ে যায়, ডুবে যায় বুক অবধি ভিজে শাড়ির মতো,
এ-সব অনেক পুরোনো পদ্ধতি— ইতিহাস লিখিত

এক শরীরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে
প্রায়শই নিমগাছ কিংবা নিয়ামক সানন্দার তীরে
ঝুঁকে পড়া মেধা নিয়ে— জলের উপর জেলেপাড়ার নিম
বাদুড় শরীরের মতো তার ছায়া গভীর— অসীম।

অসীমের উপরে জল, নীচেও স্মৃতির মতো কালো নিমরাজি জল,
মাঝখানে তিতো অস্তিত্বের মতো সোহাগ কিংবা গাঢ়তর নিমফল।

Categories
2021-December-Kobita

প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী

লুব্ধক

জলে স্পর্শ করে গেছি, একটি নক্ষত্র রাতে নেমে এল বলে
বহুদিন পরে এল, বহু সন্ধ্যা পার করে, দৃষ্টি বিহ্বল

এল এই, নিমেষেই জ্বেলে দিল অপ্রতিম আলো
সে-আলো শরীরে মেখে, অন্ধকার হয়ে গেছে স্ফটিক স্ফটিক!

ঘনভার রাত্রি নামে, আদিগন্ত ভেসে যায় শূন্যের গহ্বরে
আমি সে-আলোর আভা মুঠো ভরে রেখে দিই শ্লোকের মতন

দ্বন্দ্ব

আমার সমস্ত দিন যদি-বা জোনাকি আলো খোঁজে
সন্ধ্যে নামে যত্র তত্র, ফিরে যায় শালিকের দল
ক্যাকোফোনি পৃথিবীর তারই মধ্যে আকাঙ্ক্ষা নিষ্ফল
তারই মধ্যে মৃদুস্বর কখনো শ্রুতিতে বেজে ওঠে
বাদামি খামের পিঠে টুকরো অক্ষর লেখা হলে,
বোধহয় সে-অক্ষরই দীর্ঘ কবিতার কোনো পাতা
কবে সে কবিতা শুরু, কবে তার বেড়েছে আকার
জানে না এখনও কেউ বন্ধ থাকা দেরাজের তাকে
তরঙ্গ বাহিত হয়ে চলে আসে আলো হাওয়া তার
এমনও মুহূর্ত আসে সমস্ত ক্লান্তিই নির্ভার
হতে চায় তার কাছে, আবার দ্বিধায় করে ভর
ভেঙে ফেলে সকালেই রাতের বানিয়ে তোলা ঘর

জন্মান্তর

তুমি ভাবো হাল ছেড়ে চলেই এসেছি
চলে তো এসেছি বহুদিনই
তবুও প্রতীক্ষমাণ জীবন আমার
ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে
পা ফেলেছি অতি সাবধানী

যে-সময় চলে যায়, দ্রুতগামী যে-সময়
পারিনি রাখতে ধরে শিখিনি কৌশল
প্রতীক্ষা শিখেছি শুধু, সামান্য সম্বল

ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে শুনি
‘এ-জন্মে ঘেঁটে গেছে সব’
শাখা প্রশাখায় তবু পরিযায়ী থেকে যাই
যে-থাকা দুরূহ সম্ভব!

অপারগতা

আবাহন নেই মানে বিসর্জন নয়
তুমি তা বোঝো না, জানি। তুমি তা জানো না
ঘুমের ভিতর থেকে যে-সব অক্ষর
ম্লান হয়ে পড়ে থাকে ঘরের কোণায়
সঙ্গহীনতার কথা তারা কিছু জানে
বাকিটুকু মিশে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায়

সমস্ত জীবন ধরে অপেক্ষা করেছি
ধীর এলে দ্রুতপাখি বড়ো অসময়ে
ভ্রমণ পিপাসু তবু বুঝতে পারো না?
পাহাড়ের বিপরীত সমুদ্র নয়!

একটি সরল বাক্য

অনন্ত ফসল খেত পারাপার করে
পৌঁছেছি তোমার কাছে, নিষ্ফল দিন!
গতিহীন এই পথে ক্ষতের উপর
বিছিয়েছি রোগশয্যা, নিরাময়হীন

আরও কি আঘাত বাকি? বাকি আছে আরও?
প্রস্তুতিও সেইমতো শুরু হোক আবারও… আবারও…

একটি সরল বাক্য বুঝে গেছি শেষে
সরল হয় না পথ।
হয় জটিল, নয় জটিলতর…

 

Categories
2021-December-Kobita

সুমন সাধু

ইনসমনিয়া

একটা বিছানা
সরু হয়ে শুয়ে আছে ঘুম
কে গান শোনাবে, কে গল্প করবে
আমি হাই তোলা সহযোগে
ফেলে রাখছি ওষুধ
এদিকে একটা শালিখ
শরীর থেকে কিছুতেই উড়তে চাইছে না

গুহার মতো অন্ধকার

ঘুম থেকে তুলে নিয়ো এক-একটি নাম
বাসন মাজার মতো বারকতক ঘষেমেজে যখন
সোনাটি খেলে যাবে নামে নামে
তখন নামের গায়ে জুড়ে বসবে পেখম
ডানা চাইলে সমুদ্র দেখিয়ো
দেখিয়ো রাষ্ট্র, উত্তাপ, দেশদ্রোহী, সমকামী জাতীয়
শব্দ বিশেষ
ঘুম থেকে উঠে তাদের নামের গায়ে লিখে দিয়ো
সমস্ত খুন আসলে গুহার মতো অন্ধকার

ঢেউয়ের প্রতি


একটা বিশাল গর্জনের লোভে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রিয় আলোকচিত্রীটির সঙ্গে। অযথা ফালতু সময় দু-জনকে খেয়ে ফেলছিল। সমুদ্রে ফাটল ধরলে বন্ধু ব্যাগ থেকে বের করে আনত ক্যামেরা। আমি আরামকেদারায় তাস খেলা সহযোগে মিলিয়ে নিতাম হরতন ইশকাপন। দু-জনের বন্ধুত্ব হত বেশ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে আলোকচিত্রী ফ্রেম খুঁজে নিত। রাজার পাশে নিত আমাকেও। সেই আমাদের প্রথম হাত ধরা। প্রথম শরীর স্থাপন।


তারপর একটা ফ্রেম এল। যেখানে ব্লার করা থাকবে সমুদ্র, গর্জন। কয়েকশো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রী। এই লং ডিসটেন্সের স্বভাবে জুড়ে বসবে পাখি। শহরের সমস্ত অবিবাহিতরা মুছে দেবে প্রথা। সেই ভাঙন থেকেই একটা লেখা লিখতে চাই।


একমাত্র সমুদ্র জানল। বাকিটা জুড়ে পড়ে থাকল গর্জন। গর্জনের কথা কেউ শুনতে পায়নি।

একার মতন একা

একা থাকার নেশা লেগে গেছে একরত্তি শরীরে
একার এই সফরে কিছু মানুষ থেকে যান তুমুল
আসেন, আর হুব্বার মতো এতিম করে দেন
ভাবি, গায়ে গতরের জোর
বন্ধুহীন এই পৃথিবীতে বন্ধুদের তরজা
জীবনানন্দীয়, নাগরিক ক্লান্তি মুছে
আমার হাত ধরে নিয়ে যায় মিছিল
ভিড়ের শহরে, একাদের খারাপ থাকতে নেই

আবার ঘুম

বাড়ির বাইরে একটা দুনিয়া যখন মজা দেখায়, তখন তোমার শয়নকক্ষে হাজির হয় ঘুম। যাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।

আয়ুরচিত

বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগলে তোমার কথা ভাবি। আমাদের একসঙ্গে পাহাড়কোলে উদ্দাম বৃষ্টিতে ভেজার কথা ছিল। তারপর অবাধ্য সর্দির জল, হাঁচি, কাশি, প্যারাসিটামল। আমাদের প্রেমের আয়ু সামান্য। যদিও শরীর এখনও তাজা আছে। তার আয়ু কি শতাধিক?

 

Categories
2021-December-Kobita

তৃণা চক্রবর্তী

পাখিদের বাড়ি

অদ্ভুত সময়
দূরের ছাদ থেকে পাশের ছাদ দেখি
রোদ এসে ভেঙে পড়ে ঘরের ভেতর অবধি
পাখির ডাকের মতো জীবন পেয়েছি কিনা জানতে চায়

কী থেকে কী হয়
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই

ব্রিজ ভেঙে পড়ে কোথাও

যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে

যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে স্পষ্ট শোনা যাবে
হাওয়ার অভিমুখে হারিয়ে ফেলা কথা
কীভাবে পৌঁছোব সেখানে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতে পারে অনেক উপরে
নেমে যেতে হতে পারে জলের ভিতর
পুরোনো কেল্লার ভাঙা ধ্বংসস্তূপে কোথাও
কোথাও একটা যেতে হবেই

হারিয়ে ফেলা শব্দ, ফিরে পাওয়া যাবে আবার
যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে এরকম একটা বিশ্বাস হয়
কীভাবে পৌঁছোব সেখানে?

বাতিল

দুঃখ পুরোনো হলে, কথাগুলো হাওয়ার
শব্দহীন কুয়াশার রাস্তায় যাতায়াতের মতো
বাতিল হয়ে যাওয়া কোনো প্রতিবাদ
ভুল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা গান

পুরোনো দুঃখ নির্জন কুয়োর মতো বোবা
তার কাছে যাও, ডাকো
পাহাড়ে নিয়ে যাবে বলো
সে বিশ্বাস করবে না

পুরোনো দুঃখের শিকড় মাটির অনেক নিচ অবধি
যেন আরেকটা গাছ
ডালপালা সব পাথরের
সেখানে থেমে আছে শীতের নিয়ম

শুধু নতুন কোনো পাতা নেই, ঝরে যাওয়ার মতো
দুঃখ পুরোনো হলে তাকে ভালোবেসো
নতুন জামা কিনে দিয়ো শেষ বারের মতো

প্রেমের কবিতার পাশে

আমি তো এভাবেই দেখি
দূরে, বাস রাস্তার থেকেও দূরে
সমুদ্রের আওয়াজ থেকে দূরে
প্রেমের কবিতার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে
মাঝখানের অনেকগুলো বছর

পুরোনো স্বপ্নগুলো উড়ে যায়
নভেম্বর থেকে, ডিসেম্বর থেকে
যত দূরে পারে, উড়ে যায়
হাতছানির থেকে, সমর্পণের থেকে
সোজাসুজি দিনের থেকে
ভূতে পাওয়া রাত্রির থেকে
দরজা ঠেলে চলে যায়
সন্ধ্যে রঙের ছাদে

যেখানে অনেকগুলো সরলরেখা
যেখানে পুরনো কবিতার পাশে ঘুমিয়ে আছে
সামান্য বয়স বেড়ে যাওয়া সেতার
তার এলোমেলো সুর ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে রাত্রি

একা

সতেরো বছর আগের অভিমান
অচেনা স্টেশন দেখবে বলে
ট্রেনে উঠে বসেছে একা

তারপর সারাটা পথ একা
জঙ্গল সরে যায়, ব্রিজের নিচ থেকে নদী
টিলার ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে পাথর

সতেরো বছর আগের পাথর
কুড়ি বছর আগের পাথর
তিন বছর আগের…

গড়িয়ে পড়তে থাকে একের পর এক
তার নীচে চাপা পড়ে যায় কথা
গুহার ভেতর ঢুকে হাহাকার করে

গুম মেরে যায় কীরকম
অচেনা স্টেশন দেখবে বলে
ট্রেন থেকে নেমে যায় একা

 

Categories
2021-December-Kobita

সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

লাল গ্রহ: ১

এ-পাড়ায় কু কথার বাস
অন্ধ তবু হাতুড়ি নাচায় আত্মঘাতী প্রেমিকার খোঁজে

বটুকের তাজা রক্ত, অন্ধের সাহস হতে চায়
দু-একটা কথার পরই স্বপ্নের ঘোর
লাল গ্রহ হেঁটে যায় বিপ্লবের নেশায়

এ-পাড়ার একটাই খুঁত, মোড় বলে কিছু নেই
বটুক সুযোগে আছে
অন্ধের হাতুড়ি কবে নিরুদ্দেশ হয়

লাল গ্রহ: ২

ভেঙেই তো গেছে
প্রতিটি বিকল্প পথ ভেঙেই ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়

খাঁচার বাঘ রোজরোজ মাংস চিবোয়
রক্ত চেটে নেয় নাকের পাশ থেকে
অহং নয়, সে তার অধিকার ছিঁড়ে খায়
আমরা লালন করি হাড় নাড়িভুঁড়ি

এ-গ্রহে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি
ধ্বংসস্তূপের মতো জমে ওঠে বাঘের উচ্ছিষ্ট

মানুষ ভোজন প্রিয়
বাঘেরও মানুষ প্রেম সংক্রামক ব্যাধি

লাল গ্রহ: ৩

ঈশ্বর ওকে প্রেমিক কোরো না
এ-গ্রহে তুমিই প্রেম
তোমারই পতনচিহ্ন পড়ে থাক

শুশ্রূষার বিকল্প নেই
মানুষ কবরে যায়, সেও এক অন্তিম শুশ্রূষা

আমি শুধু বুঝতে চাই
কতটা মায়া পড়ে আছে ওর দেহে
বন্ধু সেজে তুমি কি পারবে সে খবর এনে দিতে ?

বান্ধব বর্জিত হোক, এ এক পিতার বাসনা

লাল গ্রহ: ৪

সব মিথ্যে
চেনা লাল জানালা
জানালার ওপারে তোমার মুখ
মুখ থেকে ছিটকে আসা প্রতীক্ষার আলো
সবই মিথ্যে, অথচ সত্যের কাছাকাছি

সত্যের খুব কাছে আসলে যে কি
সে হিসেব ঘুড়ির সুতোর মতো
প্রতিপক্ষ ঘায়েল হলে তবেই কদর

কে-ই-বা মনে রাখে
গ্রহের আকাশে যেদিন প্রথম আলো এল
সেদিনও মুখ বাড়িয়েছিলে তুমি
সীমানা চিনতে, হাসি মুখে

সেও কি মিথ্যে? নাকি
সত্যের শরীর থেকে মিথ্যের পশম জেগে ওঠে।

লাল গ্রহ : ৫

এসো একটা শর্ত করি
দু-একটা সহজ বাক্য বিনিময় ছাড়া
আমরা মুখোমুখি সংঘর্ষে যাব না

কতটা সহজ হবে সে-বিলাপ
তার ভার তোমাকেই দেই
আমি শুধু সম্মতি জানাব

নতুন পোশাকে যেমন মেঘ ভেসে যায়
বিচ্ছেদের সুতো বুনো সেই সুরে
শবযাত্রী আসুক কিছু, তা নিয়ে আপত্তি নেই

শর্ত একটাই
সহজ কান্না থাক গ্রহের আকাশে

Categories
2021-December-Kobita

প্রীতম বসাক

মধ্যরাতের জীবনী

মাঝরাতে ঈশ্বরের কাছে আগুন ধার করি। চেখে দেখি পাহাড়ের আত্মকথা। অনেক ব্যর্থতা ভাগ করি। আমাদের সঞ্চয় থেকে পাখি উড়ে যায়। প্রতিটি বাক্যে জোনাকি জ্বলে নেভে। ঈশ্বর শোনান বিষের সংজ্ঞা। আমি তাকে কাব্যের জ্যামিতি শেখাই। বলি ঘাম থেকেই যে কোনো সন্তানের জন্ম। ওম দিয়ে ফসলের চোখ নরম করতে হয়। পথজুড়ে শিশুগাছ ডাকে। অতঃপর ঈশ্বর কবিতা লিখতে ওজু করেন। আর আমি বিষ মাখি চুলে। সব অক্ষর জ্যোতির্ময় হয়। সকল আমি গরল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

জ্বরের বিড়াল

পুরোনো প্রেমের-শরীর থেকে থার্মোমিটার কুড়িয়ে রাখছি। তুলে রাখছি বজ্রপাত। কিছুকাল একটা জ্বরের বিড়াল পুষেছি। দৃশ্য রেখে উড়ে গেছে চোখ। কুয়োর খুব কাছে যে বিদ্যুৎগাছ। গুঁড়ো গুঁড়ো চ্যুতিরেখা। বোতলে রাখা রাসায়নিক। আমি এযাবৎ বেচে দিয়ে মুখ রেখেছি কোমলে। আমাদেরও লেবুপাতার হৃদয় ছিল একদা। যা ঘুরেফিরে তোমার বসবাসের কাছেই ফিরিয়ে দেয়। আর আত্মহত্যার গান ধরে বুড়ো গিটারিস্ট। গৃহস্থকে জলের বাইরে স্থাপন করে। গাঁজা খায়। ধুম ছাড়ে

পাগল লিখিত বৃষ্টি

এদিকে তোমার সেই পাগল নিজেকেই পান করছে। আর আমার মানুষ-বিষয়ক গবেষণায় ঢেলে দিচ্ছে জল। আমি দুঃখগুলো ধুতে যাব এমন সময় এগিয়ে এল তোমার মোরাম-বিছানো হাত। চোখে চোখে করুণ ঝুলে ছিল বলে আমি আর ও-পথে পাখি শেখার দোকান খুলিনি। বরং আমার ঈশ্বর চিন্তার ফাটলগুলো মেরামত করেছিলাম। আর তখনই পাগলটি তার গামছা থেকে মেঘ ঝেড়ে ফেলল। গান থেকে সে তুলে নিল আশ্চর্য দরোজা।

দুঃখের জার্নাল

আমাদের দুঃখগুলোর কোনো ব্যাকরণ নেই। কোনো চলছে না চলবে না নেই। শুধু কিছু মেঘ আর মেঘের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা গতজন্মের টিনের বাক্স আছে। কবি এখানে শ্রমিকের ধর্ম ভুলে চাঁদ মেলে দেয় আর অতি প্রাচীন নদীর রজঃপথ আবার উন্মুক্ত হয়ে যায়। আমাদের ছেলেরা বৃষ্টির আঙুলে পরিয়ে দেয় দৃশ্যের অবাক। এখানে কোনো প্রক্ষিপ্ত নেই। ধংসাবশেষ নেই। মাথাউঁচু জলগাছ দুই হাত বাড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধ ডাকছে। আর ভেঙে পড়ছে আমাদের দু-পশলা ভুলভ্রান্তি।

দীনতা সমগ্র

এই আমার দীনতা সমগ্র। যদিও হৃদয়ের ফুটো সারাই করার জন্যই আমার সমুদ্র ভ্রমণ। মাছের বাজারে আমি দেখেছিলাম এ-জীবনের শ্রেষ্ঠ বণিক। নোনা জলের গল্প থেকে আঁশ বাছার সহজ সূত্র এমনভাবে বিলি করছিল যেন জীবনটাকে সে আঠারো খণ্ডে প্রকাশ করেছে। সেদিনের পর আমি কিন্তু আর বৃষ্টি কাটার সাহস করি না। স্বাস্থ্য-উদ্ধারে গিয়ে চোখে ঢাকনা দিয়ে পান করি ঢেউ-উৎসব। সেলাই করি ঠোঁটের রহস্য।

Categories
2021-December-Kobita

কৌশিক জোয়ারদার

তোমাকে ব্যর্থ করে দিতে

নতুন করে শুরু করব এবার কবিতা লিখতে ভুলে যাব
পাথরের অস্ত্র হাতে তুলে নেবো ছবি আঁকব না
হরিণের সৌন্দর্য এবং পাখির ছাল ছাড়িয়ে
লাল মাংস আমি আগুনে ঝলসে খাব
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি ঈর্ষা ও ক্রোধ
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি লজ্জা ও গ্লানি
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি গ্রন্থ ও লাঙ্গল
এই মন্ত্র এই উচ্চারণ তুমি নাও
ক্ষুধা ও খাদ্য নির্বাপিত হলে
কোন শাস্ত্র পড়ে তুমি বুঝবে শস্য-জননী
তোমাকে ব্যর্থ করে দিতে আমার এত আয়োজন

মোক্ষ

পৃথিবীর ঘাসের উপর
মুখ গুঁজে শুয়ে আছি আমি
মাটির বুনো গন্ধে আমার দু-চোখে
জঠরের অন্ধকার নেমে আসে
বৃষ্টি পড়ছে, প্রবল বৃষ্টি পড়ছে
বাসাংসি জীর্ণানি শাস্ত্রের শবের উপর
মৃত ও বিস্মৃত দেবতারা জেগে উঠছে একে একে
সিংহাসন চিবিয়ে খাচ্ছে ক্রুদ্ধ একেশ্বর
আজ নির্বাণ হবে

আয়ুহীন জীবন

মৃত্যুর জন্য যে-প্রতীক্ষা, তার নাম আয়ু
আয়ু বড়ো আলো বড়ো বেশি আলো
পৃথিবীর জল কাদা শ্যাওলায়
সরিসৃপের মতো বুক ঘষে ঘষে
আমি তোমার জঠরের অন্ধকারে ঢুকে যাব
আহা সেই অন্ধকারে ছায়া নেই ভাষা নেই তুমি নেই
এমনকী তুমিও নেই যে-অন্ধকারে
আয়ুহীন সে-জীবনে আমি মুছে যাব

ছুঁতে পারবে না

নিজেকে নৈবেদ্য করে
খেয়ে ফেলো পূজার সমস্ত আয়োজন
নিজস্ব গিরিখাত ছিল, নিজস্ব মোহনা
ভণ্ড স্রোতস্বিনী, তোমার অসহ্য অনুসরণ
তবু কেন আমার পদচিহ্ন ধরে!
কী খাবে তুমি, কী খাবে আমার?
দ্বিধার মধ্যবর্তী শূন্যতা
তুমি ছুঁতে পারবে না কখনো

সমর্পণ

কতো মুণ্ড ছিন্ন হলে পূর্ণ হবে মালা!
এই নাও পেতে দিয়েছি বুক
পদাঘাত করো
অথবা উপড়ে নাও জবার মতো হৃদয়
গর্ভে যে-বীজ ধরেছিলে জ্ঞাত হবে বলে
যে দেখে, যে দেখায়, যে নিজেকেও জানে
তার প্রত্যাহার গ্রহণ করে তুমি ছিন্নমস্তা হও