Categories
2021-December-Kobita

নিয়াজুল হক

দ্বন্দ্ব ও লড়াই

একদিন একটি কালো পানকৌড়ি দেখে
সান্ত্বনা পেলাম প্রথম

আর একদিন
একটা সাদা বক দেখে
হতাশায় ডুবে গেলাম

এই দুটো পাখির
দ্বন্দ্ব এবং লড়াই দেখতে দেখতেই

তোমার কাছে এলাম

তুমি কী করবে?
ফেলে দেবে নর্দমায়?

অথবা
প্রত্যাখ্যান করবে?

তোমার কোর্টেই
বল গড়িয়ে দিলাম

গোবরের ইমেজ

রাস্তা দিয়ে
মারতে মারতে নিয়ে যাব

পিঠে চাবকাতে চাবকাতে নিয়ে আসব

এই বর্ণমালাদের সঙ্গে দেখা হলে
মনে মনে অট্ট হেসে উঠি

এদের গন্তব্যও কোথায় জানি

এই গোবরদের
ভুয়ো বাদামের ইমেজ

কেরোসিন ঢেলে
মানুষ একদিন জ্বালিয়ে দেবে

দাগ

আলু এবং পটলের তরকারি বানিয়ে
বললাম, আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি

কিন্তু
প্রশ্ন করলাম না

আলু কোথা থেকে এল

তেমনি প্রশ্ন করিনি
তামাকের বাবা কে

জানতে চাইনি
আনারস, হাতেনাতে
বা কেরামতি-র পূর্বপুরুষ কে

আমরা জানিই না
রুবট্টন এবং রুবটন কে

একমাত্র মানুষ
দেশ হারালে, ভূমি হারালে
বাসস্থান হারালে

উদ্বাস্তু হয়ে যায়

কিছুতেই দাগ উঠতে চায় না

নীরব দর্শক

এখন বেড়ালরা
পাঁকের তলায় লুকিয়ে থাকে

পাঁক ফুঁড়ে
তালগাছের মাথায় চড়ে বসে

এই পর্যন্ত হোগলায় ছাওয়া বাড়িঘর

তারপর
তালগাছের মাথা থেকে
লাফ দিয়ে বিমানে ওঠে

উড়ে যেতে যেতে ঝাঁপ দেয় সাগরে

আর পড়ে যায়
গভীর পাতালে

এমন একটা সময় আসবে
যখন গাছগুলোই

নীরব দর্শক হয়ে উঠবে

আত্মহত্যা

হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল

হঠাৎ একটা
ঘটনা ঘটে গেল

তার পাশ দিয়ে
কয়েকটি সাদা জলের নদী বয়ে গেছে

সেই জল লাল হয়ে
সাগরে গিয়ে মিশে যাচ্ছে

এর নাম লুকোচুরি খেলা

শৈশবের সঙ্গে যার কোনো মিলই নেই

সমুদ্র গর্ভ থেকে তারা
তারা পাহাড় হয়ে জন্মায়

কাউকে না কাউকে
একদিন আত্মহত্যা করতেই হবে

মস্তক মুণ্ডন

লিখুক

লিখুক

লিখুক

আমি রাস্তা ছেড়ে দেব

ওরা
গাছ লিখুক

নদী লিখুক

সমুদ্র লিখুক

এমনকী
পাহাড়ও লিখুক ওরা

আমি রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়াব

প্রয়োজনে
রাস্তায় ছড়ানো কাঁটার গায়ে
পেট্রল ছিটিয়ে পুড়িয়ে ফেলব

আর অন্য এক ঘাটে উঠব

তার মানে এই নয়
মস্তক মুড়ব আমি

টিউকলের মতো যন্ত্রের মুখ

পিকেট শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি
অনেক আগে
ছোটোবেলায় যাকে জেনেছিলাম ঝামা হিসেবে

আর যা
প্রতিটি ঝালাইয়ে
কাজে লাগত

তারপর বাড়ি করতে এসে জোর ধাক্কা খেলাম
স্ট্রেইট পিকেট শব্দবন্ধের কাছে

মহান শিক্ষক রাজমিস্ত্রি শেখাল যেটা

জানলাম
আংশিক ঝামা-ইট অথবা
ইটের খুব কাছাকাছি ঝামাকেই

স্ট্রেইট পিকেট বলা হয়

অথচ
মহান শিক্ষক প্রসঙ্গে
বরাবর জেনে এসেছি

সাদা চক, কালো ব্লাকবোর্ড
এবং কানা উপছানো জ্ঞান

যা টিউকলের মতো একটি যন্ত্রের মুখ দিয়ে বের হয়

চেতনা

নিজেকে ভারী করে কী লাভ?

নিজেকে
এমন হালকা করতে হবে

যেন চেসিস দেখা যায়

যেন খাঁচার ভেতর দেখা যায় অচিন পাখি
যাকে ধরতে গেলে উড়ে যাবে

খামকা কী লাভ
নিজেকে ভারী করে?

নিজেকে হালকা করতে করতে
অতি সাধারণকেও আঁকড়ে ধরতে হবে

সাধারণেরও কি কোনো সীমা আছে?

সে কি অপার সমুদ্র নয়
যেখানে চেতনা জমা থাকে মানুষের?

Categories
2021-December-Story

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ছাদকাহন

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দু-খানি নয়নতারা”

বাড়ি যেখানে আকাশে মিশে যায় তার নাম ছাদ। প্রত্যেক বাড়ির কিছু উড়ুক্কু আকাঙ্ক্ষা থাকে। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি বাড়িটার ইচ্ছেমেঘ ডালপালা মেলে দেয় ছাদের শহর থেকে। ছাদে রোদ আসে, চাল শুকোয়, আবার সেই ছাদেই বৃষ্টি নামে, চাল ভিজে ভাত হয়, নরম হয় চোখ। পুরোনো বাড়ি ভূতে না পেলেও প্রমোটারে ঠিক পায়। কথাবার্তা শুরু হয়, দলিল দস্তাবেজ। মত বিনিময়। বনিবনা অথবা তার অভাব। নতুন নতুন আত্মীয় দেখা দেয় বাড়িতে। ফ্ল্যাট চাই তাদের। অসহায় প্রমোটার মেঘমল্লার শুনতে শুনতে ভাবে, এত ভাগ হলে আমি ফ্ল্যাট বেচব কাকে? চিরভঙ্গুর অথচ দণ্ডায়মান বাড়িটা ভাবে, সবক শেখাবে! কিন্তু কাকে? কী করে? ছাদের নয়নতারা গাছ পুরোনো বাড়ির নড়বড়ে ইটের ফাঁক থেকে মৃত্যুর আকাশে চাহনি চারিয়ে দেয়। নয়নতারা অসীম নক্ষত্রপথে জীবন মৃত্যুর সাহচর্যের মধ্যেও ছাদের প্রস্থানবিন্দুকে মনে রাখে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
এখন ঘরে ফিরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যাতারা”

বাড়িটার মুখে ক্যান্সার। মুখ দিয়ে খাবার নামছে না। রাইস টিউব দেওয়া রয়েছে। ছাদের মুখের ঘা অনন্তে দগদগিয়ে উঠছে। ভাঙা ইটের ফাঁকে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে। ছাদজজুড়ে লাল লঙ্কা শুকোতে দেওয়া আছে, আর দুপুরের স্নানের পর এলোমেলো খোলা চুল। বিনুনি বাঁধার দৃশ্য আজ একশো বছর ধরে মকশো করছে বাড়িখান। মানুষ বদলে যাচ্ছে, চুল বদলাচ্ছে কিন্তু বিনুনি কারুর না কারুর ঠিকই বাঁধা হতে থাকছে। ছাদের শহর আলোর ক্যামেরায় খোঁপা থেকে বিনুনির ইতিহাস লিখে রাখছে। দুপুরের ছাদ যখন টংঘর ভুলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় বিকেলের ঘনায়মান ছায়া প্রচ্ছায়ার দিকে। ঠিক সেই সময় নয়নতারার ফুল কথা বলবে কিনা বুঝতে পারে না ফিকে হয়ে আসা রোদের সঙ্গে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
ক্লান্ত হয়ে দিন ফুরোলো
এখন অবসন্ন যারা
তাদের জন্য সন্ধ্যেতারা”

কাকিমা বলতেন, কত করে বলছি, বাড়ি সারাতে না পারলে বেচে দেওয়াই ভালো। দেখবি আমি একদিন ঐ বাড়ি চাপা পড়েই মরব। মৃত্যু যেন নিশিডাকই দিয়েছিল অথচ রাত তো নামেনি তখনও? ভরদুপুরে ভূতের ঢ্যালা মারার মতোই সহসা নেমে এসেছিল এক পশলা মৃত্যু। নয়নতারার ছাদে। ফুল তুলতে গিয়ে কাকিমা যখন নীচে পড়ে যায়, ওঁর চোখের কালো সাদা হয়ে গিয়েছিল আর চোখের সাদা কালো। তবে কি সে চোখকে পুরো কালো বলব নাকি পুরো সাদা? নয়নতারা বুজে গেছিল। মুখের পান গলায় আটকে ছিল। বাড়িটা নিজেই নিজেকে ভাঙছিল একটু একটু করে। আর তার ভাঙনের খেলা দেখতে এসে নিজেরাই ভেঙে পড়ছিল অনেক অনেক মানুষ।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
কখন তুমি আসবে বল
অপেক্ষাতেই তন্দ্রাহারা
থাকবে আকাশ তারায় তারায়”

একটা ইট সরে গিয়েছিল নিজের জায়গা থেকে। বাড়িটার কিছু হয়নি। শুধু শরীর ভেঙে গেছিল পড়ে গিয়ে। মাথা, ঘাড় আর মেরুদণ্ড। কংক্রিটের ওপর যেখানে পড়েছিল কাকিমা, সেখানে তেমন রক্ত ছিল না। রক্তপাত হয়েছিল ভেতরে। রক্তপাত হয়েছিল শরীরের ভেতরে, বাড়ির ভেতরে, অদেখা কুলুঙ্গিতে রাখা না-দেখা প্রদীপের অগ্নিজ্বালা প্রথমে সংবিৎ নিয়েছিল, তারপর প্রাণ। বাড়ি ভেঙে পড়েনি শরীরের ওপর, বরং শরীর সরে গিয়েছিল বাড়ির থেকে। সেই সরণে মৃত্যুও স্মরণহীন হয়ে পড়েছিল।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল”

পোস্টমর্টেম তো হয়েছিল কিন্তু বাড়ির কি আর শাস্তি হতে পারে? হঠকারী বস্তুর মতো প্রাচীন আলয়ও হন্তারক অথচ নিরপরাধ। প্ৰোমোটার ভেবেছিল বাড়িটা অভিশপ্ত। খেয়ে নেবে সবাইকে। ফ্ল্যাট হতে দেবে না বলে খেতে শুরু করেছে। নাহ্, এ-বাড়ির কাজ না নেওয়াই ভালো। থাক বরং পড়েই থাক। যতদিন না ভেঙে পড়ে। অথচ এ-বাড়ি দুর্গম আকাশের মতো। আকাশ ভাঙে কেবল বৃষ্টিতে। নাহলে সে ফাইটার প্লেনকেও টেনে নামানোর ক্ষমতা রাখে।

“দেখছি চেয়ে প্রথম তারা”

কাকিমা একবার বলেছিল, ছেলে খেলে খেলে আধা ভেঙে ফেলেছিল জানালার কাঠ কিন্তু ছেলের কীর্তি বলে মায়াভরে আর বদলাতে পারেনি খিড়কির পাল্লা। আধভাঙাই রয়ে গিয়েছিল। কাকিমার তিন দশকের গৃহকর্ত্রী হয়ে থাকা জীবনে বাড়িটার সঙ্গে যা-ই কলহ দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন, ভালোবাসার অধিকারও বই কম ছিল না। ছাদের ইচ্ছে ভিড় করে আসা দুপুরে মায়েতে মেয়েতে রোদ পোহাতে পোহাতে পানের ভাঁজে ভাঁজে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবত। সেদিনই খালি মেয়ে সঙ্গে ছিল না যখন নয়নতারা ফুলগুলো হাতছানি দেয় ছায়ার অবনতি কোণে। মেয়ে শুধু একটা শব্দ শোনে আর তারপর বাবার চিৎকার। কাকু জল তুলছিল নীচে। হাওয়া বেয়ে কাকিমা হঠাৎ নেমে এসেছিল কুয়োর পাশের রাস্তায়। তারপর হাসপাতাল, মর্গ, থানা, শ্মশান আর তদন্তহীন থেকে যাওয়া প্রতিভঙ্গুর ইমারত।

“সে যেন চায় আমার চোখে”

ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে পথ। ছাদ ভরে গেছে নয়নতারায়। উপচে গিয়ে ছাদ বেয়ে নীচে নেমে পথ গোলাপি করে তুলছে মৃত্যুমর্মর ফুলের মিছিল। ছাদ যেন আকাশে উঠতে না পেরে মাটির দিকে নেমে গেছে। উন্নতি কোণ থেকে অবনতি কোণের অঙ্কে বিভোর বাড়িটা স্বপ্নের কামনায় নিম্নগামী। ছাদের দু-পাশে দুটো জানলা,

“তার দুখানি নয়নতারা”

Categories
2021-December-Sakkhatkar

অজিত রায়

আলাপচারি শুভম চক্রবর্তী

মানবজমিনের কত কিছুই না থাকে, যে-কারণে মনে হয় সোনা ফলুক আর নাই ফলুক, আংশিক আবাদ তো হল! ধানবাদ শহরে আমার আসা-যাওয়া নিতান্তই বিদ্যায়তনিক প্রয়োজনে। তার আগেও কয়েকবার গেছি, কিন্তু সে যাওয়া দৈনন্দিনের হল যখন তার কয়েকবছর আগেই পড়ে ফেলেছি ‘যোজন ভাইরাস’। যদি বলি যে মুগ্ধ হয়েছি অথবা এই উপন্যাসটি অসাধারণ তাহলে কিছুই বলা হয় না বলেই আমার মনে হয়। যোজন ভাইরাসের বিশিষ্টতা শুধুমাত্র তার স্বাদু নিজস্ব গদ্যের কারণে নয়, মৌলিক চিন্তার অতল গূঢ় রহস্যের কারণে নয়; উপনিষদ, অস্তিবাদ, স্যাডিজম, মনোবিকলনের তাৎপর্যপূর্ণ সমাবস্থানের কারণেও নয়, আবার উলঙ্গ করে দেওয়া নিজের আত্মার গহন অন্ধকারের জন্যও নয়। এই যে এত ‘নয়’ লিখলাম তার কারণ, যে মহৎ টেক্সটের কথা বলছি, তাকে কিছু একটা বলে দেগে দিলে অন্যায় হয়। তাই ‘নেতি-নেতি’ করেই তার কাছে পৌঁছানো, শঙ্করানুসরণে।

অজিত রায় নারকেল গাছ নন, বটগাছ। তাঁর ৩০-৪০ বছরের মননচর্চায় উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ, গবেষণাগ্রন্থ, পত্রিকা সম্পাদনা ইত্যাদি নানাবিধ বিশিষ্ট কৃতি নিয়ে তিনি বহুঝুরিবিশিষ্ট। একবারে সৎ ভাবে বললে, প্রথম দিকের কিছু লেখা বাদ দিয়ে অজিত রায় যা লিখেছেন তা আসলে প্ল্যানচেট রাইটিং। তিনি ছাড়া আর কারও কাছে সেই ভূত ধরা দেয়নি। অথবা সন্দীপনের চিঠির অংশ উদ্ধৃত করে বলা যায় ‘মনে হয় ভূতে লিখেছে’।

যোজন ভাইরাস ছাড়াও ‘জোখিম কোরকাপ’, ‘ঘামলাঘট’, ‘নিরুজের রক্ততৃষা’, ‘কৌরব ও পাপারাৎজি’, ‘রত্নিসুখের একক উপপাদ্য’ প্রভৃতি উপন্যাস তাঁর কৃতির পরিচয় বহন করছে। তাঁর ছোটোগল্পের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম, কিন্তু তাও নিদারুণ ভেদনশীল। সমগ্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য এবং ধানবাদ শহরের ইতিহাস রচয়িতা তিনি। আমরা সাধারণত যে গ্লোরিফিকেশনের অতিরঞ্জন দেখি নানাবিধ ইতিহাসগ্রন্থে তা থেকে সর্বৈব ভাবেই অজিত রায় পৃথক এবং ভয়াবহ রকমের টান্সপারেন্ট। এই সততার প্রতিদান তাঁকে যে দিতে হয়নি এমন নয়। তাঁর একমাত্র চাকরিটি স্বচ্ছ এবং গ্লোরিফিকেশনহীন ইতিহাস রচনার দায়ে চলে যায়। এবিষয়ে অজিত সাক্ষাৎকারে আরও বিস্তৃত ভাবে বলেছেন। নানান মনোজ্ঞ বিষয়ে অজিত রায় প্রবন্ধ লেখেন। তা কখনো স্ল্যাং, কখনো জগদ্রাম রায়, কখনো-বা ধানবাদের খোট্টাভাষা।

দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করছেন ‘শহর’ পত্রিকা। শহরের লেখা আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে কিন্তু শহরের যে একটি চরিত্র আছে তা আপনি অস্বীকার করলে বোধহয় ভুল হবে। এবং এই সামান্য লেখায় তাঁর বিপুল সৃষ্টির টিকিও ছোঁয়া যাবে না, যদি অবশ্য তা থাকে। আগ্রহী পাঠক তাঁর বই পড়ুন, যদি না পড়েন তা-ও আপনার কিছু ক্ষতি হবে না, কিন্তু আপনি যদি সাহিত্যরসপিপাসু হন তবে অজিত রায় পড়লে স্বতন্ত্র এক রসের স্বাদ পাবেন এটুকু বলা যায়।

অজিত’দার সঙ্গে আমার সহজ বন্ধুত্ব। বয়স এখানে ম্যাটার করে না। তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্য আমায় ভরিয়ে রাখে। এই সাক্ষাৎকার তাই প্রথাগতভাবে নেওয়া কোনো সাক্ষাৎকার নয়। বরঞ্চ ধানবাদে, ছাতনায়, পছন্দপুরে, বড়ন্তিতে, শুশুনিয়ায়, তিলুড়িতে, রামচন্দ্রপুরে, আসানসোলে, ভুলুইগ্রামে, রূপনারায়ণপুরে, বর্ধমানে, দুর্গাপুরে, বড়জোড়ায়, কলেজস্কোয়ারে, কলেজ স্ট্রিটে, বারুইপুরে এবং অনন্তে যে-সব কথাবার্তা আমাদের হয়েছিল তাই লকডাউনের মরশুমে আবার ঝালিয়ে নিলাম। অজিত রায় সাহিত্যের ফুলটাইমার। কেরানি সাহিত্যিক, অধ্যাপক সাহিত্যিক, প্রেম ভেঙে যাওয়ার সাহিত্যিক, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে অবসর বিনোদনের সাহিত্যিক বিস্তর আছে কিন্তু এরকম ফুলটাইমার আর ক-জন! আসলে অর্থোপার্জনের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের দ্বন্দ্ব-অনুপাতিক সমীকরনের কারণেই এ-সব হয় আরকী! যাই হোক সাক্ষাৎকার পড়ুন এবার তাহলে। আমি আসি।
জয় তারা।
—শুভম চক্রবর্তী

টোটাল ধামাল

“লেখালেখিই আমার জীবনপণ আর পাঠকের ভালোবাসাই আমার অর্জন।”

সাম্প্রতিক করোনাজনিত দুর্যোগের দিনে কেমন কাটছে তোমার?

আমার সেই অর্থে কিছু আলাদা কাটছে না। যেমন সারাবছর কাটে মোটামুটি সেরকমই কাটছে। সারাদিন লেখার মধ্যেই৷ দু-একটা ট্রেন চললে একবার ভুলুই, কিংবা কলকাতা ঘুরে  আসতাম। ওই ভুলুই-এর পাশেই কালিকাপুর গ্রাম… চেনো তো তুমি… ওখানে কাশীবিলাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, তিনি দ্বিতীয় জন জগদ্রাম-বিষয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে মধ্যে। আমার আগামী উপন্যাসের বিষয় আঠারো শতকের একমাত্র সম্পূর্ণ রামায়ণ রচক জগদ্রাম রায় ও তাঁর সময়, আমি এখন তাতেই ডুবে রয়েছি।

লেখালেখির প্রথম দিকটা নিয়ে কিছু বলো

আমার ছোটোবেলা কেটেছে ধানবাদ জেলার CFRI কলোনিতে। কলোনিটা মোটামুটি নব্বই ভাগ বাঙালি অধ্যুষিত ছিল। শুধু তাই নয়, প্রচুর সায়েন্টিস্ট আর শিক্ষিত মানুষের বাস ছিল। কলোনিটা চাদ্ধার থেকে ভাঁওরা, দিগুয়াডি, বারারি আর চাসনালার মতো কোলিয়ারি দিয়ে ঘেরা হলেও, আশপাশের মানে, ধাওড়া-কালচার, মুর্গা লড়াই, লণ্ডা নাচ, গালিগালাজ আর সিমেন্টের হনুমান সংস্কৃতি থেকে বেশ তফাতেই ছিল আমাদের ওই কলোনি।… তো, সেখানে রবীন্দ্র জয়ন্তী, বসন্তোৎসব, নাট্যোৎসব, যাত্রা এ-সব তো চলতই, এ ছাড়া দেশ, আনন্দবাজার, অমৃত ইত্যাদির পাশাপাশি শুকতারা নবকল্লোলও আসত… আনন্দলোক লুকিয়ে নিয়ে ঢুকত দাদা… আনন্দলোকে যেহেতু তথাকথিত কিছু খোলাখুলি ছবি থাকত তা নিয়ে বাবার স্লাইট গোঁড়ামি ছিল… বাড়িতে সুনীল-টুনীলরাও ছিল ব্রাত্য,…  দিদিরা খবরের কাগজে কাভার দিয়ে নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব পড়ত।… তো ওই সময়,… ক্লাস ৫-৬-এর পড়ার সময়ই আমি শরৎচন্দ্রের সব উপন্যাস পড়ে ফেলি। আমার বাবা ছিলেন শরৎচন্দ্রের পোকা। মানে তখনকার দিনে সেসব লেখাই মূলত পড়া হত যা খুব easily connected… চিন্তা-ভাবনার খুব একটা দরকার হয় না। সে-সময়ে বেশিরভাগ বাঙালি কিশোর ও তরুণের ফেবারিট ছিল স্বপন কুমার। ওই সময়েরই কথা, তখন আমি ভাঁওরা স্কুলে ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি, শরৎচন্দ্র-হেমেন্দ্রকুমারের অনুকরণে রোমহর্ষক সব কাহিনি দিয়ে খাতা ভরাতাম… যা মূলত ক্লাসের বন্ধুরা-বন্ধুনিরাই পড়ত… তখনই বন্ধুমহলে একটা সাংঘাতিক চাহিদা ছিল আমার সেই লেখাগুলো পড়ার। CFRI কলোনিতে শিবানী কাকিমা বলে একজন ছিলেন, একটু-আধটু গল্প-টল্প লিখতেন; তিনি এবং তাঁর হাসব্যান্ড SUCI করতেন এবং বামপন্থী চিন্তাধারা আস্থাশীল ছিলেন… তাঁরা মাঝেমধ্যে কিছু বই গুঁজে দিতেন সে-সবও প্রচুর পড়তাম। এবার ১৯৭৯ সালে স্কুলের এক ক্লাসমেট সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে একটা চটি পত্রিকা বের করি, নাম দিই ‘অনন্যা’… মানে ওই তখনকার দিনে মেয়েলি নাম দিয়েই পত্রিকার নামকরণ হাতল বেশি, যেমন অনন্যা, মিতালি, মালতি, এইসব… তাই আমাদের পত্রিকার নামও সেরকম। তো তাতে অনেকে লিখত, একজন আমাদের কলোনিরই, সুজিত মণ্ডল নাম, জীবনানন্দকে টুকে টুকে কবিতা বানাত। তারপর ২২-২৩ বছর বয়সে আমি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনি এবং কিছুদিন পর ‘আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’ পড়ি, পড়ে মনে হয় এর লেখা কেন আগে পড়িনি… এবং সন্দীপন আমার প্রথমদিকের লেখালেখিকে প্রভাবিত করেছে… সেই আগ্রাসন ছিল মারাত্মক। সন্দীপনকে আরও আগে পড়লেই ভালো হত, তাহলে আরও অনেক আগেই সেই ইনফ্লুয়েন্স থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম।

ভাগ্যিস পরে পড়েছ, তাই পরে প্রভাবিত হয়েছ , প্রথম উপন্যাসদোগলাচরিত‘- সন্দীপনীয় ইনফ্লুয়েন্স বেশ জ্বলজ্বলে

আগে পড়লেই ভালো হত৷ যত আগে প্রভাব থেকে সরতাম তত আগেই আমার নিজের লেখালেখি নিজস্ব ভাষা-খাত তৈরি হতে পারত। তো, শুধু শরৎচন্দ্র, হেমেন্দ্রকুমারই নয় আমরা যারা সেই সময়ের, মানে সত্তর-আশির দশকে লেখালেখি শুরু হয়েছিল যাদের, তাদের রেডিয়ো নাটক আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানও খুব আকর্ষণের ছিল। আমাদের, আমার তো বটেই, লেখালেখির প্রেরণাই জুগিয়েছে কলকাতা-ক-এর শনি-রবিবারের নাটক। আর, বুধবার… না কবে যেন একটা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মতো হত কলকাতা ‘ক’-এ, বাবা সেটা সবাইকে শোনানো নিয়ে খুব স্ট্রিক্ট ছিলেন… বলতেন ওই সময় রেডিয়ো থেকে নড়বি না। এইভাবে, মোটামুটি পাঁচমিশেলি প্রভাব থেকে আমার লেখক হবার সুপ্ত বাসনাটা তলায় তলায় শেকড় চারাতে থাকে।

তোমার কলেজ ইউনিভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে কিছু বলো… ‘দোগলাচরিত’ কি ওই সময়ই?

আমি গ্রাজুয়েশন করেছি ঝরিয়ার রাজ কলেজ থেকে, আর মাস্টার্স ধানবাদের পি.কে.রায় কলেজ থেকে। না, ‘দোগলাচরিত’ তো আরও দেড়-দু-বছর পরে লেখা।

বিনোবা ভাবে ইউনিভার্সিটি…

না… তখনও ওটা হয়নি… তখন এদিকে একটাই ইউনিভার্সিটি রাঁচিতে, সেটারই ক্লাস হত আমাদের পি.কে.রায়-এ। মানে এখন তো ঠিকঠাক সময়ে তোমরা পেরিয়ে যাও। তখন আমাদের মাস্টার্স ডিগ্রি কমপ্লিট হতে ৪-৫ বছর লেগে যেত… সেশন লেট করত দু-আড়াই বছর পর্যন্ত…

ওই সময় তো তুমি কবিতা লিখতে

হ্যাঁ। কবিতা তো ম্যাট্রিকের অনেক আগে থেকেই লিখতাম। ওই যেমন সব বাঙালিরাই কবি তেমনই আরকী! পরে আমার ‘অকবিতা’ নামে একটি কবিতার বই ছাপা হয়েছিল। সেটা ১৯৮৩ সনে। নিজের উদ্যোগেই করেছিলাম। নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে দেখার লোভ কার না থাকে… তখন তো ‘শহর’ হয়নি। প্রকাশনের নাম দিয়েছিলাম ‘অথচ’। সেখান থেকেই বেরিয়েছিল।

আচ্ছা, বুঝলাম তা সন্দীপনের লেখা নিয়ে এখন কী মনে হয়

দ্যাখো, এ নিয়ে আর কী বলব। একসময়ে ভালো লাগত। প্রভাবিত করত। এখন বোরিং লাগে। আর পাঁচটা লেখকের মতোই বোরিং। যেমন রবীন্দ্রনাথ।

নবারুণ?

আমায় কোনোদিনই সেভাবে টানেনি।

সুবিমল মিশ্র?

একদম ভালো লাগে না। ওই কলকাত্তাইয়া তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল যারা গালাগালি দিতে পারে না কিন্তু অকারণ কসরত করে দেওয়ার জন্য। তাদের ভালো লাগবে হয়তো। ওঁর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সময়ের চাপে এখন ছাতু ছাড়া আর কিছুই না। ওটা আমায় কোনোদিনই টানেনি।

মলয় রায়চৌধুরী?

প্রাবন্ধিক, চিন্তক হিসেবে ভালো। আর কী বলব।

তরুণ প্রজন্মের কাদের লেখা তোমায় ভাবায়

বিষম মুশকিলে ফেললে। আমার প্রজন্মের বা তার আগের হলে, চটপট কটা নাম ধরিয়ে দিতাম। তুমি নিশ্চিত গদ্যের কথা জানতে চাইছ, কবিতায় তো আমি লবডঙ্কা! যদি গদ্যের সীমায়ও বলতে চাইছো, সেক্ষেত্রে, নতুন প্রজন্মের ক-জনকেই-বা পড়েছি! কেউ কেউ হয়তো ধূমকেতুর মতো উগরে এসে নিজের নাম নথি করতে চাইল, কিন্তু অল্প খেঁচেই মনে হল বাঘ মারা হয়ে গেল, তেমন বেশ কিছু নাম এই মুহূর্তে নুন্নুড়িতে লকলক করছে। সেগুলো আর স্মরণ করতে চাই না। দু-একটা নাম, এই মুহূর্তে, যা আমার অবশ্য স্মরণীয়, করছি। অবশ্যই, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্মাত্রানন্দ। আর… আর… আর… ধরো, মৌমিতা মিত্র। মণিদীপা সেন, এবং কৌস্তভ গাঙ্গুলীকেও সুদূরপ্রসারী মনে হয়। অনিন্দ্য সান্যাল, নীহারুল ইসলাম, সৌগত বালী, সুবল দত্ত তো অনিবার্য। তোমার গদ্য বেশি দেখিনি, কিন্তু যে-ক-টা পড়েছি বুদ্ধিদীপ্ত। বুদ্ধিদীপ্ত, কবি, এবং, অথচ, এ সময়ের উপযোগী গদ্য অনেকেই হয়তো লিখছেন, কিন্তু মালঘোরে সমস্ত নাম কী মনে আসিবে! বস্তুত, এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অনেকের বিরাগভাজন হলাম। দায়ী তুমি, শুভম, তুমিই!

যাই হোক, তোমার গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা যেভাষায় কথা বলে তা তথাকথিত মার্জিত ভাষা নয় বিষয়ে তুমি কি সচেতন ভাষানির্মাণে

হ্যাঁ অবশ্যই সচেতন। দ্যাখো, আমি তথাকথিত শুদ্ধ বাংলাটা অনেকের থেকেই ভালো জানি। কিন্তু তা বহুব্যবহারে জীর্ণ৷ তাই আমার গল্প উপন্যাসের জন্য আমি নিজস্ব ভাষানির্মাণ করি।

উৎপলকুমার বসু একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিল্পী তার শিল্প প্রকরণ সো কলডস্তরের থেকে নেন এবং তাই শিল্পীর মেলামেশাও সেই স্তরে

দ্যাখো, আমার বড়ো হয়ে ওঠা ভুল শিক্ষা, ভুল সম্পর্ক, ভুল অর্থনৈতিক বনেদ থেকে; তথাকথিত সভ্য মানুষের প্রতিবেশ থেকেও আমার নেবার কিছু ছিল না। সেই প্রতিবেশের শঠতা, সভ্যতার অসভ্যতা আজীবন আমাকে কষ্ট দিয়েছে। তার চেয়ে সমাজের তথাকথিত নিচের তলার মানুষের সঙ্গে মিশতে আমি বরাবরই সহজ বোধ করেছি। তারা, মানে সেইসব সাব-অলটার্ন মানুষ অনেক বেশি স্বচ্ছ, খোলাখুলি এবং আত্মিক চেতনাসম্পন্ন। ওদের সঙ্গে মেশার জন্য বুদ্ধির কসরৎ লাগে না, পূর্বভাবনা অথবা ছলপ্যাঁচ লাগে না। বেশিই ভালো থাকা যায় মনের দিক থেকে। আর একটা লাভ, যেটা উৎপলবাবু বলেছেন, সেই ‘র’ বা সাব-অলটার্ন স্তর থেকে বাস্তব শিল্প-প্রকরণ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আমার লেখার ভাষাপ্রযুক্তি তৈরি হতে ওদের অবদান কম নয়।

এই মেশার সময় কি সচেতন থাকো, মানে প্রকরণ সন্ধান করব বলেই

সচেতন…? নাঃ, পুরোপুরি সচেতন থাকা সম্ভব নয়। আমি সজাগ হলে ওরাও নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে, এই কথাটা মাথায় থাকে। এরকম প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশেছি, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অস্তিত্ব বোধ, ভিন্ন ভিন্ন কায়দার লোকজন। কেউ বেশি খোলে, কেউ কেউ বেশ চাপা। সব মিলিয়ে ভালোই লাগে। যা পাওয়ার, পেয়ে যাই তাতেই।

নবারুণের একটি কবিতা আছে মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়‘, তোমার দ্বিতীয় উপন্যাস তারই নেমসেককী ছিল এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

রাজু নামের এক বাইশ-তেইশ বছরের গরিব বেরোজগার নবযুবক, স্বচ্ছ, সৎ, অকপট, তার সহমর্মী মানুষের (তার মৃত বাবার সুহৃদ) মাধ্যমে স্থানীয় এক নিউজপেপারের সম্পাদকের কাছ থেকে সাংবাদিক পদের অফার পায়। শর্ত হল, প্রায় কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি গণহত্যার (তারা প্রত্যেকেই ছিল এক নকশাল গোষ্ঠীর সদস্য) বিবরণ এবং মৃত যুবকদের বর্তমানে জীবিত আত্মীয়-স্বজনদের ইন্টারভিউ নিয়ে একটা জনমনোরঞ্জনকারী ফিচার লিখে দিতে হবে। রাজু কাজটিতে নেমে চারিদিক থেকে নানারকম বাধা এবং মানসিক কষ্টের সম্মুখীন হয়। শেষ পর্যন্ত কাজটি সে করতে পারে না। সমাজের ও প্রশাসনের সিস্টেমের কাছে সে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই নিয়ে উপন্যাস। নামটি নবারুণের একটি কবিতা থেকে উদ্ধৃত। বহু পরে আমি জানতে পারি নবারুণ ভট্টাচার্য একজন লেখক এবং তিনি জীবিত। বইটি পেয়ে, সাময়িক বিস্ময়ের পর, নবারুণদা আমায় বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁর ‘ভাষাবন্ধন’-এ আমাকে একটি উপন্যাস লেখার অফার দেন। অবশ্য, এর কিছুদিন পরেই তিনি প্রয়াত হন। নবারুণদার সঙ্গে কয়েকটি প্রাণবন্ত আড্ডার, এবং একত্রে মদ্যপানের স্মৃতি এখনও সজীব।

তোমারএই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নাতো ১৯৯২ প্রকাশিত হয়েছিল তারপর সেটারই অনুবাদ হিন্দিতে প্রকাশিত হয়এক জার্নালিস্ট কী মওত‘, ১৯৯৫ সালে নিজের লেখা অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে কি কোনো সমস্যা হয়েছিল? মানেলস্ট ইন ট্রান্সেলেশনমনে হয়নি?

হিন্দি আমার কাছে আদৌ ‘অন্য ভাষা’ নয়। বললে বিশ্বাস যাবে না, বাংলায় নিয়মিত এবং সিরিয়াস লেখালেখি শুরু করার আগে আমি হিন্দিতেই বেশি সড়গড় ছিলাম। ম্যাট্রিকের পর থেকে এম-এ এবং এল-এল-বি অবধি আমার মাধ্যম ছিল হিন্দি আর ইংরেজি। ‘রবিবার’, ‘হংস’, ‘ধর্মযুগ’ এ-সব পত্রিকায় নিয়মিত হিন্দিতে ফ্রিল্যান্স জার্নালিজম করেছি, এমনকী দেড় বছর স্থানীয় হিন্দি দৈনিক ‘আওয়াজে’-এর সহ-সম্পাদক পদে চাকরিও করেছি। এর ফলে বাংলা থেকে হিন্দি অনুবাদে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। বাদ দাও, মজার গল্পটা শোনো। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬, ওই সময়ে আমি একটি বেসরকারি, কয়লা মার্চেন্টের দফতরে অন্যতম একাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছি। আমার যিনি ইমিডিয়েট বস ছিলেন, মানে কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর, তাঁর স্ত্রীর ছিল হিন্দিতে শের-শায়েরি আর গপ্পো লেখার ব্যামো। আমার বস কোত্থেকে জানতে পারেন আমিও লেখালেখি করি। ফলে উনি তাঁর স্ত্রীর সদ্য-ভূমিষ্ঠ কবিতার বইটির এডিট করা, ভূমিকা লেখা এবং ছাপানোর যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে বসলেন আমায়। বইটি ছাপাতে আমি চলে গেলাম সুদূর এলাহাবাদ। ভেবেছিলাম, দু-চারদিনের মধ্যে বইটি ছাপিয়ে ফিরে আসতে পারব। কিন্তু বিস্মিল্লায় গলদ। এলাহাবাদের হরিওম প্রেসে ডিটিপির কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় ওঁদের কম্পিউটার গেল বিগড়ে। চারদিনের জায়গায় আমি সেখানে আটকা পড়ে রইলাম টানা ১২ দিন। আমার সঙ্গে ছিল আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এই মৃত্যু উপত্যকা’। সারাদিন আর কোনো কাজ না থাকায় আমি ওই উপন্যাসের হিন্দি অনুবাদ শুরু করে দিলাম। প্রতিদিন দশ-পনেরো পাতা অনুবাদ করি আর প্রেসে হ্যান্ড কম্পোজিংয়ে দিয়ে আসি। এভাবে দশ দিনের মাথায় ‘এক জার্নালিস্ট কী মৌত’ ছেপে বেরিয়ে এল হরিওম পাবলিকেশন্স থেকে। আমি ধানবাদ ফিরলাম, একটার বদলে, দুটো বই নিয়ে। আমার বইটা বাইপ্রোডাক্ট বলতে পারো।

তো যেটা বলছিলাম, মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’- একধরণের সারফেস রিয়েলেটি আছে তোমার পরের বইধানবাদ ইতিবৃত্তের উপজীব্য’- সারফেস রিয়েলিটি তো এটা কি ফেজ চলছিল বাইরের দিকে তাকানোর?

‘এই মৃত্যু উপত্যকা’ আমার সাংবাদিক জীবনের একটি গ্রাউন্ড রিয়ালিটি। ওতে বানানো গল্প খুব কম। গোড়া থেকেই আমি আত্মজীবনীমূলক লেখাই লিখতে চেয়েছি। ‘দোগলাচরিত’-ও সরাসরি নিজের জীবনের কাহিনি। কিন্তু ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ আমি বৃহত্তর দায় থেকে লিখেছি। ওই ইতিবৃত্ত লিখেছিলাম বলেই পরবর্তী কালে ‘হিরণ্যরেতাঃ’ আর ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ’ লেখাটা সহজ হয়েছিল। বাইরের দিকে তাকানো, হ্যাঁ, সেটা কিন্তু ইতিবৃত্ত থেকেই আরম্ভ। বলতে পারো, ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ আমার ব্যক্তিজীবন এবং লেখকজীবনের একটা বড়সড় টার্নিং পয়েন্ট।

বলেছিলে, ‘ধানবাদ ইতিবৃত্তলিখে তোমায় ভয়াবহ সংকটে পড়তে হয়সেই সময়ের গল্পটা যদি বলো একটু

জীবনের মতো রগড় আর জানে কে! সেটা ১৯৯৫। আগেই বলেছি, সে-সময় আমি একটি বেসরকারি, কয়লা মার্চেন্টের অফিসে একাউন্ট্যান্ট পদে চাকরি করতাম। তার আগে এবং সেইসময় আমার রাইটার্স ব্লক হয়েছিল, দীর্ঘ সাত বছর এক ফোঁটাও কিছু লিখতে পারিনি। মানসিক বিপন্নতায় ভুগছিলাম। লেখা ভুলে মনে হচ্ছিল চাদ্ধার কেমন থম মারা, ক্ষান্ত বিষণ্ণ, অকেজো মনে হচ্ছিল নিজেকে, কোনোকিছুই আর হবার নয় মনে-মনে একরকম মেনে নিয়েই লাগাতার লাত ঝেড়ে চলেছিলাম আত্মফাঁসির পাটাতনে— সেখানে, কোথাও কিছু নেই, পূর্বাভাসহীন, খেইহীন, হঠাৎ সরসরিয়ে জেগে উঠল মনের কানাচে ফেলে-রাখা একটা কাজ নিমেষে সেরে ফেলার উদগ্র তাড়া। সাত বছর পর ফাৎনা নড়ে উঠল, আবার। হঠাৎ জেগে উঠল দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে না-সেরে-ফেলা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদ। ধানবাদের প্রাচীন ইতিহাস, রাজা-রাজড়া, জেলা গড়ে ওঠার নিষিদ্ধ পোড়াগন্ধ, কয়লা মাফিয়া, আদিবাসী জনজীবন, ধানবাদের নদ-নদী পাহাড় জঙ্গল ও তাদের কান্না, যা কেউ লিখে রাখেনি আগে, লিখবে না কোনোদিন,— সেই কাজটাই নতুন করে শুরু করলাম। ততদিনে, বিশেষত, কোল-মাফিয়াদের প্রচুর কানা গলি, অন্ধ গলির সূলুক পেয়ে গেছি। খুব বিপজ্জনক ও সতর্কসাপেক্ষ ছিল ওই নিষিদ্ধ ও নেপথ্য ইতিহাস ফাঁস করে দেবার কাজ। কিন্তু রোখ চেপে গেছিল। ফলত, প্রবল প্রবলতর আবেগে উৎসাহে ক্যাটালগিং কম্পাইলিং ইন্টারপ্রিটেশন শুরু হয়ে যায়। আসলে ওই লেখার মাধ্যমে লেখকের পুনর্জন্ম ঘটছিল আমার মধ্যে। হণ্ডা-হাতে বেরিয়ে পড়ি আদিবাসী প্রান্তরে। এ গাঁ, সে গাঁ। দিনের পর দিন। সারাদিন টো-টো। রোদ মাথায়, বৃষ্টি মাথায়। খিদে পেটে। শুধু গরিব বাড়ির জল খেয়ে। সিঁদরি থেকে চিরকুন্ডা, গোমো থেকে পরেশনাথ। মধ্যে-মধ্যে ঝরিয়া কাতরাস ডিগুয়াডি নিরসা, খুঁখার লালখণ্ডি অধ্যুষিত তোপচাঁচি বনভূমি, মাফিয়া কবলিত বিস্তীর্ণ ক্কৃষ্ণাঞ্চল। তথ্য চাই, নথি চাই, দিকে দিকে ছুটছি, একা। ঠা ঠা রোদ্দুর, দরদর ঘাম, মাইলের পর মাইল, নাকে রুমাল, স্টমাকে খিদে— পরোয়া নেই। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসি, ক-খানা পৃষ্ঠা আরও। বই ছাপানোর জন্য কলকাতা রওনা দেব, এমন মুহূর্তে কুখ্যাত নিউমোথোরাক্সের হামলা। সশরীর হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা, দিনে-রাতে সাতশো টাকার দুটো করে ইনজেকশান আর গণ্ডা-গণ্ডা ক্যাপসুল, ডাক্তার ইমিডিয়েট অপারেশন করতে চান। ওদিকে ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ বাচ্চাদানির মধ্যে কাতরাচ্ছে। অচিরেই ফয়সালা নিলাম। মেজর অপারেশান চুলোয় যাক, আমি মধ্যরাতে হাসপাতাল থেকে ফেরার। কারুক্কে না জানিয়ে সোজ্জা কলেজ স্ট্রিট। ২৩ জুন ১৯৯৬, ধানবাদ শহরে সেদিন ‘ঘটনা’ একটাই। তছনছে বৃষ্টিপাতের মাঝে জেলার লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের বিস্ময়কর জমঘটে ‘ধানবাদ ইতিবৃত্তে’-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। দিকে দিকে জন-উল্লাস, সাধুবাদ, লেখককে সম্বর্ধনা, কপির পর কপি বিকে চলেছে পঁচাত্তর টাকার বই, কখনো একশোতে। এবং, এরপর যেগুলো আশংকা ছিল, বই ঘিরে তুমুল উত্তেজনা, জেলায় কসমোপলিস রিয়াকশান, কমিউনাল ফিলিং ছড়াবার দুশ্চেষ্টা, রাজনৈতিক আর মাফিয়া তল্লাটে তুমুল হইচই, উড়ো ফোন আর হুমকি— সব একে একে ঘটে যেতে লাগল, এবং পরপর। ৩১ জুলাই ১৯৯৬, চিরতরে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল আমায়, চাকরি থেকে। ঝাঁ করে চাকুর শান গলার রগ ঘষটে বেরিয়ে গেলে যেমন, সে-রাতেই দুটো বীভৎস ফোন আসে ল্যান্ডলাইনে, একপাল খুঁখার গুণ্ডা মাঝরাতে চড়াও। মুহুর্মুহু হুমকি আর মানসিক ত্রাস থেকে রক্ষা পেতে সপরিবার ধানবাদ ছেড়ে, প্রথমে জামশেদপুর, তারপর কলকাতা, অবশেষে একা দিল্লি। দীর্ঘ তিন মাস উপাংশুবাসে কাটাই। তারপর চারদিক কিছুটা শান্ত হলে ফিরে আসি ধানবাদ। তারপর আর কখনো কোনো চাকরি করিনি। ওই তিন মাসে তিনটি বইয়ের কাজ অবশ্য সেরে ফেলেছিলাম। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের তরফ থেকে ‘কিস্সা গুলাম’ নামে একটি তিনশো পৃষ্ঠার বইয়ের বাংলা তরজমা, এবং ‘পাপরাতজি’ উপন্যাসটি, তথা ‘যোজন ভাইরাস’। আল্টিমেটলি, ধানবাদ ইতিবৃত্ত বাবদ জীবনে যে-তীব্র বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটাই আমাকে গদ্যকার বা সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করল। জীবনের মতো রগড় আর জানে কে?

পাপারাৎজি তো একটা খেলার নাম, কৌরব তাকে কেন্দ্র করে তোমার ফ্যান্টাসিই তোমারকৌরব পাপারাৎজিউপন্যাসের বিষয় কৌরব বিষয়ে কী মনে হত লেখালেখির প্রথম দিকে? ইদানীং কি অভিমত বদলেছে? এরই সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আর একটি জিজ্ঞাস্য,— এই উপন্যাসের (কৌ.পা)-এর গদ্যভাষা খুব ঝকঝকে দার্ঢ্যসম্পন্ন এর পূর্বপ্রস্তুতি কী, উত্তরাধিকারই বা কী! জানতে ইচ্ছে হয়

বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতে একটা নেশার নাম ছিল ‘কৌরব’। বিশেষত, তার গদ্য। যতদিন খোদ কমল চক্রবর্তী এর সৈন্যাপত্যে ছিলেন, অন্তত গোড়ার দিকের কৌরব আফিমের মতো টেনেছিল। পরে বারীন ঘোষালের খপ্পরে পড়ে পত্রিকাটা গোল্লায় যায়। অতঃপর, কৌরব হয়ে পড়ে ‘নতুন কবিতা’-র জালভূমি; বাংলা সাহিত্যে সেই কৌরবের অবদান নাথিং-বাট-জঞ্জাল। যাই হোক ১৯৯৭ সালের শারদীয় কৌরবে আমার ‘কৌরব ও পাপরাৎজি’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিদগ্ধ পাঠক ও সমালোচক মহলে একটা নতুন সাড়া পড়ে যায়। সকলের এক কথা: ‘আহা, নতুন কোথায় থাকে!’ এবং, তখনও পর্যন্ত ‘যোজন ভাইরাস’ প্রকাশ পায়নি, ফলত ওই পাপরাৎজির গদ্য দেখেই সকলের মাথা ঘুরে হাঁ। গদ্যটা ছিল বাংলা বাজারে একেবারেই নতুন। গর্ব নয়, তথ্যরক্ষার খাতিরেই বলছি, পাপরাৎজির গদ্য আমার নিজস্ব উৎপাদন, এর পেছনে অন্য কারো বীজাধার বা নিষেক ছিল না। একেবারে হুট করেই লিখে ফেলেছিলাম, আমার সেই উপাংশুবাসের সময়ে। ধানবাদ ইতিবৃত্ত বাবদ যে-বিপর্যয় এবং আতঙ্কের বাতাবরণ আমাকে গ্রাস করেছিল, সে-সময়, দিল্লি থেকে ফেরত আসার পর, আমার স্ত্রী বাইরে থেকে তালা মেরে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে যেত, একা ডাকপিওন ব্যতিরেকে আর কেউ জানত না যে আমি বাড়ির ভেতরেই আছি। সে এসে দরজার তলা দিয়ে পোস্টকার্ড, খাম বা পার্সেল গলিয়ে দিয়ে চলে যেত। তো, সেই এক-দেড় মাসের আতঙ্কক্লিষ্ট নিভৃতবাসের দিনগুলোয় আমি ওই মজাদার গদ্যটি লিখেছিলাম। ওটা ছিল একটা প্ল্যানচেট রাইটিং। পরে আমি নিজেও সে-ভাষায় আর অনুশীলনে মন দিইনি। ব্যস, ওই বই বাবদ এর বেশি কিছুই বলব না।

১৯৯৮ সালেযোজন ভাইরাস’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়, পরবর্তী সংস্করণগুলিতে তুমি এডিট করেছ কিছু কিছুএই উপন্যাসের বীজ কোথায় উপ্ত ছিল

১৯৯৮ থেকে এ-অব্দি ‘যোজন ভাইরাস’-এর মোট ৬টি সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রত্যেকটিতে মুখবন্ধ বা ভূমিকা হিসেবে আমি একটাই কথা লিখেছি,— ‘এর ভাষার ব্যাপারটা পাঠক লক্ষ করুন!’ অথচ উপন্যাসটা শুরু করার সময় বা লেখাচলাকালে আমার আদৌ কেয়াস ছিল না যে এই ভাষা নিয়েই এত হইচই হবে! আমি সরাসরি আড্ডার ভাষায় লিখতে চেয়েছিলাম গদ্যটা। কিন্তু ওই গদ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। হ্যাঁ, আমি নিজের ভাষা বা ভাষাপ্রযুক্তির একটা নিজস্ব পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলাম। বাংলা বাজারে এই টেকনিকটা ছিল একেবারেই নতুন। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, বাংলা গদ্য একটা স্থিথাবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই ভাষার গদ্যে শব্দ ব্যবহার আর বাক্য গঠনের প্রচুর স্কোপ, কিন্তু কেউ সেদিকটা নিয়ে ভাবছে না। আমি যোভা-র মাধ্যমে যেটা করলাম, সেটা হল বাংলা ভাষার ভাণ্ডারের বা বাচ্চাদানিকে স্প্রেড করা। ছোটোবেলা থেকে নানারকম ভাষা এবং বুলির সংস্পর্শে থেকেছি। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, বিহারী বিভাষা, ঝাড়খণ্ডি বুলি ইত্যাদি সমস্ত ঢুয়ে এনে ঢুকিয়ে দিলাম যোজনে। বলতে পারো, ভাষা ও শব্দের প্রিজম্যাটিক খেলাই খেলতে চেয়েছি এই উপন্যাসে। গল্প যেটুকু, সেটা স্রেফ পাঠককে ধরে গর্তে পিলিয়ে দেবার জন্য। আর কিছু নয়। বীজটা কী ছিল, আশা করি বোঝানো গেল। আর, বলি, বইটার দ্বিতীয় সংস্করণেই যেটুকু এডিট বা কাটছাঁট করেছিলাম, গোড়ার দিকের একটা বড়ো অংশ জুড়েছিলাম মাত্র। পরবর্তী কোনো এডিশনে কোনোরকম সম্পাদনা করিনি।

‘যোজন ভাইরাস’-এর টেক্সটে ভাষা স্বতন্ত্রভাবে চোখে পড়ে, ভাবের মেশামেশি ভাষা নাকি ভাষার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, যেমন ধরো কমলকুমারের, তোমার পক্ষপাত কোনদিকে?

‘যোজন ভাইরাস’-এর ডায়াসপোরিক ভাষা-প্রযুক্তি এবং ডিসকোর্স নিয়ে বিগত বাইশ বছর ধরে পাঠক ও বোদ্ধা মহলে এত-এত কথা হয়েছে যে আমি নিজে তেমন ফিরিস্তি দেবার কখনো তাগিদ পাইনি। তাছাড়া, দ্যাখো, এই চটি বইটিতে ভাষাবয়ন আর কথনের কেরদানি নিয়ে এমন খিঁচুড়ি আছে যে, দু-চার কথায় তা সারা একেবারেই অসম্ভব। কিছু ইঙ্গিত তোমার ওপরের প্রশ্নের জবাবে দিয়েছি। এবার আরও-একটু ঝোল টানি। বিভিন্ন যতি-চিহ্নের মধ্যবর্তী গ্যাপে টুকরো-টাকরা ভাবনাগুলো— পরবর্তী অংশের সাথে মিশে, টু এন্ড ফ্রো, পরিপূরক হয়ে— এগিয়ে— বিস্তার পেয়ে— গুচ্ছ ভাবনার বহুমাত্রিকা গঠন করা, এটা যোজনের আগে বাংলা গদ্যে কেউ করেননি। ভঙ্গির মধ্যে— ভঙ্গির মধ্যে— ভঙ্গির মধ্যে ভঙ্গির খোঁজ, এটা আমি একেবারে পূর্বসূত্রহীনভাবে, সজ্ঞানত করেছি। ভাষার এই ট্রিটমেন্ট পাঠকের কাছে নতুন ঠেকেছিল বলেই, পাঠকের মনে হয়েছে— ‘পড়ো, পড়ো, পড়ো, না-পড়ে উপায় নেই।’ ভাষা বুননের এই রীতি বা ধরন আমি আমার কোনো অগ্রজের কাছ থেকে পাইনি। লেখার সময় আমি সারাক্ষণ মজে থাকতাম এই স্বকীয় আবিষ্কারটি নিয়ে। অনেকটা উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতো, বাক্য-শরীরের উদাত্তভাব, রাগরাগিনীর প্রশাখা বিস্তার, এ যে কী আনন্দের তা মুখে বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি শব্দ আর বাক্যের মাধ্যমে অর্থের দু-পিঠে একসাথে আলো ফেলতে চেয়েছি। আর, এর জন্য আমি হাতিয়ার তুলেছি সরাসরি মাটি থেকে,— লাখ লাখ শব্দ, অথচ এদের কোনো ব্যবহার নেই। আমার মূল ইন্টেনসন ছিল, সেইসব অব্যবহৃত বা স্বল্প-ব্যবহৃত শব্দগুলোর, এবং বিভিন্ন বঙ্গেতর শব্দের এমন অব্যর্থ, অনিবার্য, লাগাতার যোজনা যা ইতিপূর্বে আর কেউ, একজনও করে যাননি। বলতে পারো বাংলা গদ্যের চালুচরকি দাঁড়া আমায় দীর্ঘকাল ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ করে রেখেছিল বলেই ‘যোজন ভাইরাস’-এর জন্ম। আর, অন্য একটা কী যেন প্রশ্ন ছিল তোমার? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সে-বিষয়ে একটা কথাই বলব;— সাহিত্যের ভাষা মাত্রেই কৃত্রিম, আমরা প্রত্যেকে ভাষা ‘বানাই’। সে কমলকুমার হোন বা নবারুণ, সুবিমল বা আমি। আমরা ভাষার মাধ্যমে পঁচে-হেজে-যাওয়া চালু ভাষার শিরদাঁড়া ভাঙব বলেই নিজস্ব ভাষা বানাই, প্রযুক্তি গড়ি। ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে, তার অস্তিত্বকে আরও প্রাঞ্জল করে তুলতে, অথবা নিছক নতুন ভাষার বনেদ তৈরি করতেই আমরা ভাষার ওপর হামলা করি। ভাবি, এরকম নয়, ওরকম, একটু কম কাদা, খানিক চড়া রং, যা ছিল তা থেকে যতখানি আলাদা, নতুন করা যায়। এই আর-কী!

আচ্ছাঅজিতদা… ‘যোজন ভাইরাস’ শুরুই হচ্ছে কমল চক্রবর্তীরআমার পাপউপন্যাসের অনুসঙ্গ দিয়ে আর উপন্যাসের নায়কের নামও কমল এখানে কৌরবের কমলের আর্কিটাইপ কী স্থাপিত ছিল! নাকি নিছকই অনুসঙ্গ! কিছু বলো

সেটা নাইনটি সিক্সের জুলাই, শেষদিন। ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ লেখার দায়ে আমার যৎসামান্য গোছানো সংসার ভোগে গেল, একটু আগেই যে-বৃত্তান্ত সারসংক্ষেপে বলেছি। গা ঢাকা দিতে সপরিবার গিয়ে পৌঁছালাম এগ্রিকো বাগান, কৌরব-সেনাপতি কমল চক্রবর্তীর ঠোরে। ইতিপূর্বে, বিরানব্বুই সনে প্রথম মোলাকাত কলকাতায়, দি গ্রেট কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের সিঁড়িঘরে। তারপর এই। তো, গোড়ার আলাপেই আমরা পরস্পর বুকের ইন্ধন হয়ে গেলাম। মজাটা হচ্ছে, হিপোক্রেটদের আমি সচরাচর শনাক্ত করতে অক্ষম। আরও যেটা মজার, কমলদা শুনেছিলাম একজন হিপোক্রেটই, সেদিন কিন্তু, আসলে, সে-রাতে উনি আমার অতি-প্রিয় গদ্যকার হিসেবই পেশ করেছিলেন নিজেকে, আমার সামনে। সেই সন্ধ্যাটি আজীবন মনে থেকে যাবে। সে-সন্ধ্যায় সমগ্র জামশেদপুর জুড়ে অকথ্য গরম এবং ঝাড়খণ্ডের (তখনও অবশ্য বিহার) প্রথিতযশা লোডশেডিং। বালিশ-শতরঞ্চি নিয়ে আমরা দু-জনে বাড়ির ছাদে, চাঁদ ছিল নীলারুণ মধ্যগগনে। এরপর শুরু হল ওঁর নানানবিধ গপ্পো। বেশিরভাগই ঢপের, কিন্তু ওঁর বলার গুণে সমস্ত চমৎকার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আমি পায়ুকামী, আমি যথাতথা উলঙ্গ নাচতে পারি, পোকামাকড় চিবিয়ে খাই, নুনুর মাপ সাড়ে দশ, আমি বৃক্ষু, তুমি বৃক্ষনাথ, ফলানা-ঢেকানা। কমলদা বকে চলেছেন, আর আমি টুকে-টুকে নিচ্ছি। মানে, মনে মনে গড়ে ফেলছি ‘যোজন ভাইরাস’। এভাবেই শুরু। ওঁর ‘আমার পাপ’ তখনও পড়িনি, পরে পড়তে গিয়েও কিছু পাইনি। সুতরাং ওই বইটির কোনো অংশবিশেষও আমার এই গদ্যের গতর ছোঁয়নি। যোজনের প্রথমেই যে-বইটির জিগির এসেছে, সেটির নাম দিয়েছিলাম ‘কমলের পাপ’। এছাড়া ওই বইয়ের কোনো অংশই আমার উপন্যাসের অনুষঙ্গ নয়। তবে কমলদার কোনো কোনো ব্যাপার আমার উপজীব্য হয়েছে এবং সেগুলো ওঁর কজন ছদ্মবেশী বন্ধু, বাঘা-বাঘা কবি, বস্তুত বকধর্মী, তাঁরা প্রভূত ‘এনজয়’ করেছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছে আমি বুঝি আসলি কমল চক্কতির কাছা খুলে দিতেই এই উপন্যাস লিখেছি। ওঁরা না ‘আমার পাপে’-এর কমলকে বুঝেছেন, না ‘যোজন ভাইরাসে’-এর কমলকে। করুণা হয়। যোজনের কমল তো যথেষ্টই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, তাঁদের পক্ষে।

ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির অঢাকাঢাকি সম্পর্কএকটা গড়ে তুলতে নাপারাঅব্দি সাম্যের কোঁড় খিলবে কেমন করে !” অর্থাৎ চূড়ান্ত ট্রান্সপারেন্ট হওয়ার কথাই বলেছ যৌন স্বাধর্মীধীনতাই যে একটা চূড়ান্ত স্বাধীনতা এমন ভাবনা ছিল? যেখানে নুঙ্কুর কালার অব্দি জানা? মানে ব্যক্তির থেকে সমষ্টির দিকে যাওয়া?

পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পি.জি. করার সময় আমি জঁ পল সার্ত্রর মাদক রসে আক্রান্ত হই, এবং তার কিঞ্চিৎ-কিঞ্চিৎ রেশ পরবর্তীতে রয়ে যায়। বস্তুত, মানুষ কাকচক্ষু না হলে কমিউনিজম সফল হতে পারে না, এই ডকট্রিন আমি সার্ত্রর অস্তিত্ববাদ থেকেই হাসিল করেছিলাম। কিছুটা বুঝে, কিছু হয়তো না-বুঝেই আমি আমার গোড়ার দিকের কয়েকটি উপন্যাসে এই ডকট্রিনের ঔপযৌগিক গুরুত্ব প্রচারও করেছিলাম। ‘দোগলাচরিত’-এও আছে। যোজনে অনেকখানি পিউরিফায়েড। কিন্তু, যেহেতু আমি এখনও জীবিত, এ-কথা বললে কেউ ফেক মনে করলেও আমার কিছু করার নেই, যে, আমি মানুষে-মানুষে আজও স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। এটা ‘যোজন ভাইরাস’-এ যতখানি যৌন-অনুষঙ্গে বলতে চেয়েছি, তার চেয়ে বেশি কমল, রানী, বাবর এইসব চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো সম্পর্কে। আসলে, সম্পর্ক, নিজের সাথে নিজের এবং অন্যের, প্রকৃতির, এটা বোঝাই প্রধান, এটা খোঁজাই। কিন্তু হাজার বছরের সভ্যতা তাদের মূল্যবোধের যে-জিন চাপিয়েছে আমাদের ওপর, ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ এবং নানান দিক থেকে, সামাজিকরণের ঝুনঝুনি দেখেই আসলে লাগাতার আমাদের শেকল পরিয়েছে, সে-সব ভেঙে বেরিয়ে আসা খোলামকুচি নয়। নিজের মধ্যে হাজারও পুলিশ, আইন, রাষ্ট্র, শাসন, আগে তাদের সঙ্গে লড়াই। সমস্ত সোশ্যাল বাইন্ডিংস, অপ্রেশন মুছে যাবে, মানুষ যদি একবার, শুধু, নিজের হিপোক্রেসি দূর করতে পারে, নিজেকে প্রকাশ করে দ্যায়, খুল্লমখুল্লা। এই উপন্যাসে এ-সব কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে, কেবল, মাধ্যম হয়েছে— যৌনতা। আমি সে-অর্থে বিবাহিত নই, বলতে পারো একটা গণ্ডিহীন সীমানার মধ্যে একটা ভাঙাচোরা সম্পর্ক নিয়ে বাস করছি। আমি বরাবরই বিবাহবিরোধী। দাম্পত্য কী? —পতির দ্বারা দমিত সম্পর্কের নাম দাম্পত্য। এই প্রথা মূলত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটিকে টিকিয়ে রাখতে হেল্প করে, যে বনেদের ওপর খাড়া রয়েছে ক্ষমতা-সাম্রাজ্যবাদ, পাওয়ার ইম্পেরিয়ালিজম। বিবাহ শুধুমাত্র একমাত্রিক যৌনতাকে স্বীকৃতি দ্যায়, বহুগামীতাকে অসামাজিক ঘোষণা করে। আমাদেরকে বলে আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো দমন করতে। এই যে অবদমন, একে ভাঙার চেষ্টা হবে না কেন? বাবর শেষপর্যন্ত রানীকে চেয়েও শুতে পারল না তার সঙ্গে, তা তো ওই মূল্যবোধগুলোর কারণেই। আবার, কমলও শেষ পর্যন্ত হেরো প্রমাণ হচ্ছে। এই যে কম্প্রমাইজেশনের খেলা, এই খেলাই এই কাহিনির ভাইরাস।

এই সাংঘাতিক নিহিলিস্ট মনোভাবের জন্য কি সুবিমল জর্জ বাতাইএর সঙ্গে তুলনা টেনেছেন?

সম্ভবত তাই। যদিও তিনি এ-কথা কোথাও খোলসা করেননি। আসলে, ‘যোজন ভাইরাস’-এর এত-এত ব্যাপার-স্যাপার, কোনটা যে কাকে ছুঁয়েছে, আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

সার্ত্রর প্রসঙ্গ আনলে বলে মনে পড়ে গেল, তোমার বেশ কিছু লেখায় অস্তিবাদী দর্শনের প্রতিফলন দেখা যায়, ‘মিথ অফ সিসিফাস’এর কথাও প্রচ্ছন্নভাবে বলেছতো এই দর্শন বিষয়ে তোমার অভিপ্রায় কী একটু বলো

প্রথমেই বলি, আগেও অন্যত্র বলেছি, লেখালেখি একটা খরিশ জিনিশ। একটা জগদ্দল পাথর দেওয়া হয়েছে হাতে, তাকে ঠেলে-ঠেলে তোলা। প্রস্তুতি এটুকুই যে পাথরটা কখন হাতে আসবে। ওটা না-পাওয়া-অব্দি লেখা খোলস ছাড়ে না। তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি, সেটাই লেখার ভাবনাকে প্রেগন্যান্ট করে। এটা কতখানি ‘মিথ অফ সিসিফাস’-এর কাছাকাছি জানি না, এই বোধ কিন্তু গোড়া থেকেই আমার মনে ছায়ার মতো বাসা বেঁধে রয়েছে, ছাড়ান নেই। কামুর উপলব্ধি হয়তো আরও বৃহত্তর ব্যঞ্জনার ব্যাপার। সে ছিল তাঁর বিমূর্ত দর্শনের ধারণা। মানুষের অর্থ খোঁজা নিরর্থক, ঈশ্বরহীন দুর্বোধ্য পৃথিবীর একতা ও স্বচ্ছতা, মূল্যবোধ, এইসব ছিল আপাত দুরূহ সেই ব্যঞ্জনার নির্যাস। আমি কিন্তু ওই নিরবধি পাথর তুলে যাওয়ার কথাটা সিসিফাসের মিথ পড়ে আত্মস্থ করিনি। খুব সহজ কথা খানিক উপমা যোগে বলেছি মাত্র।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উদগ্র গোল্লাছুট জীবনের গোপনসংগোপন সত্তাই তোমাদের এক হতে দিচ্ছে না অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষের অপরবোধ থেকে আলাদা, একে কি শঙ্করের মানে শঙ্করাচার্যেরনেতি নেতিকরে মহত্তম অস্তির দিকে যাওয়া? ‘যোজন ভাইরাস’ বিষয়ে এই লাস্ট কথা প্রাচ্যপাশ্চাত্য দর্শনের কোন কোন আর্কিটাইপ তোমার খুলিতে কামড়েছিলবলো, তারপর চলো মাল খাই…

দ্যাখো, আমি কেন, বিদগ্ধ পাঠকদেরও ধারণা, ‘যোজন ভাইরাস’ যে-মাত্রার উপন্যাস, তা একজন লেখক একবারই লিখতে পারে; দ্বিতীয় দফা নৈব চ। আজ যেন এই আরোপ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, যে, উপন্যাসের অনেকটাই অবচেতন থেকে লেখা। যদি ভেবে নিতাম এই-এই কথা লিখব, এইভাবে লিখব, ইহা ভিন্ন আর কিছু লিখব না, তাহলে নির্ঘাত এই লেখা হয়ে উঠত না। আমার এই গদ্যে অনেক ভঙ্গি বা প্রকৌশলের মধ্যে অন্যতম দু-টি হল সুররিয়্যালিজম আর অবচেতনজাত ভাববোধ। কিন্তু, কেবলমাত্র আলু-মুলো পালংয়ের ঘ্যাঁট দিয়ে তো সমগ্র ভাতটা মাখা যায় না। সুতরাং, লেখকের নিজস্ব পড়াশোনার যে-কুফল, তাকে কিংখাব থেকে বের করে আনতে হল সচেতনতা, সমস্যা, দিকদারি এবং আরও কিছু চর্বিজাত পেলব ব্যঞ্জন। ষাট-সত্তর দশক থেকেই মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা ও alienation ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে চাড়া দিয়ে উঠছিল পশ্চিমে। এ দেশেও আমরা মোটামুটি তখন থেকেই বিভিন্ন ঘেঁটো সমস্যা, জেনারেশান-গ্যাপ এবং অন্যান্য social upheavals-এর মধ্যে জড়িয়ে ও জর্জরিত হয়ে পড়ছিলাম। মোটামুটি তখন থেকেই ডিভোর্স বা সঙ্গী-বিচ্ছেদ বিবাহের সমহারে প্রতীয়মান। এমনকী, সমস্যাটা বাড়তে বাড়তে আধুনিক বৈবাহিক বা দাম্পত্য জীবনে wife-swapping-এর সুদূরপ্রসারী প্রপঞ্চও আর বিস্ময়কর গণ্য হয় না। ‘যোজন ভাইরাস’-এও এই প্রপঞ্চ দর্শানো হয়েছে। যদিও নিছক ওয়াইফ সোয়াপিং বা অর্গি দেখানো আমার মংশা ছিল না। আমি এই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার খেলাফে আমার অধিগত কিয়ের্কে‌গার্দ, নীৎশে এবং সমীপকালীন সার্ত্রর নিহিলিজম এবং অস্তিবাদের ধারণাটিকে নিদান হিসেবে তাংড়াতে চেয়েছি এই উপন্যাসে। নিহিলিজমের গোড়ার কথা ছিল: একজন মানুষের নিজস্ব আবেগ, অনুভূতিই তার জীবনের অর্থ নির্দেশ করে, ধর্ম, সমাজের রীতিনীতি নয়। এখানেই জরুরি হয়ে পড়ে শঙ্করাচার্যের ‘নেতি নেতি’, বা এ যুগে, বস্তুতান্ত্রিক দ্বন্দ্ববাদের ‘নিগেশন অব নিগেশন’ তত্ত্বের। চিলেকোঠা থেকে ঝাঁট দিতে দিতে, সিঁড়িঘরের ক্রমান্বয়ী সিঁড়িগুলো ঝাঁট দিতে দিতে মানুষ নিজের মধ্যে নিজের ‘স্ব’-এর সঙ্গে মোলাকাত করবে, নেতির নেতি থেকে ঘটবে মানুষের চরিত্রের ধনাত্মক উন্মেষ। এসব কথা আমার ঘিলুতে ঢুকেছিল আই-এ, বি-এ পড়ার সময় থেকেই। আজও বিশ্বাস করি।

‘যোজন ভাইরাস’-এর পর তোমার পাতিনা ওয়েসিস প্রকাশিত হয়, সেখানে তো নগরায়নের বিরুদ্ধে একটা স্পষ্ট অবস্থান আছে তোমার অথচ তুমি নিজেই নগরের। শিল্পীমানুষ ও ব্যক্তিমানুষের এই দ্বন্দ্বকে কীভাবে দ্যাখো?

নগর বা মফস্সলে জন্ম নিলেও, এবং আগাগোড়া শহুরে কালচারে বাস করলেও, আর্বানিটির এঁটুলি আমার ঘিলুকে কখনো গ্রাস করেনি। আমায় আগাগোড়া পল্লির রাস্টিসিটি ছানি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। এই আকর্ষণের চিহ্ন ‘যোজন ভাইরাস’-এ যেমন আছে, অন্যান্য কিছু উপন্যাসও আভাসে-ইঙ্গিতে রয়েছে। ‘পাতিনা ওয়েসিস’, ‘নভাক যামিনী’ এবং বিশেষত ‘রূপকথা মগলা’ উপন্যাসে আরও একটি বৃহত্তর মাত্রা যোগ হয়েছে— অরণ্য, আরণ্যক জীবন ও আদিবাসী মানুষ। মানুষের লৌল্য ক্ষুধায় দিকে দিকে অরণ্য ন্যাড়া হয়ে পড়ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে সংস্কৃতি, জীবন, ভালোবাসা। সভ্যতার উন্নয়ন অবশ্যই কাম্য, কিন্তু সভ্যতার ‘অসভ্যতা’ আদপে প্রাণ ও প্রকৃতির বিপুল ক্ষতি করে দিচ্ছে, এটা আজ আর দৃষ্টান্ত সহযোগে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। পাতিনা ওয়েসিস ছিল সেই যন্ত্রণা, তাড়না ও উচাটনের প্রাথমিক দলিল, আমার শিল্পমন বা প্রকৃতিমনের।

পাতিনারবীজকচরিত্রটির মধ্যে একইসঙ্গে বানর মানুষ স্বভাব আছে, এই চরিত্রটি কীভাবে ভেবেছিলে?

বীজককে এত সহজভাবে শনাক্ত করা পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকেরই সবিমুগ্ধ কৌতূহল ছিল, এখনও আছে, এই চরিত্রটা আমি কোত্থেকে আমদানি করলাম! মানুষ নয়, অথচ মানুষের মতোই একটা চরিত্র। যার হাবভাব, প্রেম, কান্না, সমস্ত মানুষের মতো, অথচ সে মানুষ না। গোটা উপন্যাসে তার একটিও ডায়ালগ নেই, অথচ গোটা উপন্যাস জুড়েই সে কথা বলে গেছে। এই চরিত্রটি হুট করেই আমার মাথায় এসেছিল। পরে যে সেই-ই মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়াবে, এটা যদিও মাথায় ছিল না। হারিয়ে-চলা অরণ্য-প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনার আকুতি, এটাকে এস্ট্যাবলিশ করতেই বীজককে কনসিভ করেছিলাম। কিছু প্রখর পাঠক যোজন ভাইরাসের চেয়ে পাতিনা ওয়েসিসকেই বেশি মার্ক্স দেওয়ার পক্ষপাতি। আমার নিজের কথা এখন থাক।

‘পাতিনা ওয়েসিস’-এর পরের উপন্যাস মানে ‘কারগিল হাসিলের দিনগুলি’-তে যুদ্ধের অনুসঙ্গ আছে, এর ইনফ্লুয়েন্স কি ‘হিরোসিমা মাই লাভ’ নাকি অন্য কিছু?

‘কারগিল হাসিলের দিনগুলি’ নিছক নামেই যুদ্ধের অনুষঙ্গ বহন করেছে, বাস্তবতা এই উপন্যাসের কাহিনি, চরিত্র এবং ঘটনাপ্রবাহে দূর-দূরান্ত অবধি যুদ্ধের কোনো ছায়া নেই। যেটুকু আছে, তা কবিতার। পুরো উপন্যাসটাই নিটোল প্রেমের গল্পে নিষিক্ত। জীবনানন্দের ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব রয়ে যায়’ গোছের অনেকটা। বা, আরও সহজ করে বোঝাতে হলে, ‘হাম ন রহঙ্গে তুম ন রহোগে, ফির ভি রোহেঙ্গি নিশানিয়া’ গোছের ব্যাপার। ফারাক যেটুকু, প্লেটোনিক প্রেমকে কেবল জৈবিক ছাঁচে ঢালার প্রয়াস। মজার কথা হল সন্দীপনকে ‘হিরোসিমা’-তেও হিরোসিমা নেই, আছে মৃতের আত্মকথা। সুতরাং হিরোসিমা-র প্রভাব কারগিলে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। দুটো দুই পেরিফেরির লেখা।

তোমার অধিকাংশ লেখায় যেআত্মজৈবনিক প্রক্ষেপ আছে, এক্ষেত্রেও তা কি কাজ করেছে?

ওপরেই যেটা আভাসে বলেছি, কারগিল-এ আমার ‘আমি’-র হাজিরি প্রায় নেই বললেই চলে। সম্ভবত, এটাই প্রথম, যা আমার আত্মজীবনকে রিফ্লেক্ট করে না।

রমেশচন্দ্র শাহরকিস্সা গুলাম’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেদাসকাহিনীনামে, তার আগে তো নিজেরইএই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়অনুবাদ করেছ, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য ভাষার অন্য লেখকের অনুবাদ, অভিজ্ঞতাটা একটু বলো

আগেই বলেছি, হিন্দি আদৌ আমার কাছে ‘অন্য ভাষা’ নয়, বরং বাংলারই মতো, আর একটি ভাষা। তাই ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হিন্দিতে এবং ‘কিস্সা গুলাম’ বাংলায় তরজমা করার সময় আমাকে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। ‘কিস্সা গুলাম’ হঠাৎই হাতে পেয়েছিলাম, সেই কিস্সাটা বরং বলি। ধানবাদ ইতিবৃত্ত বাবদ জীবনে নেমে এল সমূহ বিপর্যয়, সেটা ১৯৯৬ সালের কথা, ফোনে এবং সামনাসামনি হুমকির পর হুমকি, একটা ডামাডোল অবস্থা, এ সব থেকে পালিয়ে প্রথমে কলকাতা এবং পরে দিল্লি গিয়ে একটু শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন চাকরি গেছে, আর্থিক ক্রাচ নেই, সারাদিন ধরে দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় আঁড়বাঁড় কাট কাট ঘুরে ফিরছি সামান্য একটি আয়ের আশায়। ওই সময় ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট আমাকে রমেশচন্দ্র শাহ-র এই মোটা বইটা অনুবাদের ভার দিয়ে আমার ওই দুর্দিনে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ‘কিস্সা গুলাম’ যথেষ্ট উন্নত মানের উপন্যাস, অনুবাদ করতে ভালো লেগেছিল। অনুবাদ বাবদ হাতে পেয়েছিলাম প্রায় চব্বিশ হাজার টাকার একটা চেক। ওই টাকা দিয়ে আমি ধানবাদের বাড়ির একটা অংশ কমপ্লিট করি। চব্বিশ হাজার, সে-সময় বেশ বড়ো অঙ্ক।

ওইদাস কাহিনী’-র বছরই ম্যাওড়া জোন প্রকাশিত হয়, একসঙ্গে দুটো উপন্যাসবেশ শ্রমসাধ্য

একটু ভুল হল। ‘দাস কাহিনী’ অনুবাদ করেছিলাম ১৯৯৬ সালে, সেটা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ২০০০ সনে। বরং বলতে পারো, ওই ঢাউস বইটা শেষ করার পর-পরই দুটো উপন্যাস শুরু করি, ওই উচাটনের দিনে। সে দুটো হচ্ছে, ‘পাপরাৎজি’ আর ‘যোজন ভাইরাস’। ম্যাওড়া জোন আরও পরে। হ্যাঁ, সেটাও প্রকাশ পেয়েছিল ২০০০ সনে, ওই একই বছর।

ধানবাদ একসময় বাংলারই অংশ ছিল, মানভূমের, তারপর আলাদা হয়ে যাওয়া, বাঙালি প্রধান ধানবাদের ঝাড়খণ্ডের অধীনে যাওয়া, এবং সেই অঞ্চলের বাঙালিদেরও মেড়ো বলে গণ্য করে কেলকেসিয়ান লোকেরা, এই বেদনাই তো উপজীব্য তোমারম্যাওড়া জোন’ উপন্যাসে, এখানেই তো ডায়াসপোরিক প্রাণনা উপ্ত আছেকী বলো

সৃজনশীল লেখকেরা তাঁদের লেখা খুঁড়ে বের করেন তাঁদের নিজস্ব উইট বা ইমাজিনেশান থেকে। অর্থাৎ, কল্পনা-বৃত্তি থেকে। কল্পনার তিন আনন্দ,— উদ্ভাবন, পরিশিল্পনা এবং শব্দকলাপ। এ-সব ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হলে রচনায় আসে অটোমেটিক দ্রুতি, সমৃদ্ধি এবং সৌষ্ঠব। আমার প্রায় সমস্ত উপন্যাসেই কমবেশি এ-সব সেরিব্রাল এলিমেন্ট পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো বিদগ্ধ আলোচক। অথচ, আমার সকল উপন্যাসই কমবেশি আত্মজৈবনিক। এর ঘোর প্রতিছায়া, ‘ম্যাওড়া জোন’। এতে একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে অতীত, বা ইতিহাস। তার সঙ্গে ধুয়ো দিতে আছে পর্ণা নামে এক স্মৃতিস্তম্ভ, যার চিঠি দিয়ে এই উপন্যাসের শুরু ও শেষ। অর্থাৎ, এখানে তুমি পাবে লেখকের মাল্টিপল পার্সোনার পাশাপাশি গদ্যের শরীরে মাল্টিপল টেক্সট। একসঙ্গে দু-তিনটে কাল, দু-তিনটে স্তর নিয়ে খেলা। এখানে ইতিহাস/অতীত/যা ঘটেছে + বর্তমান/ঘটমান + স্মৃতি/কনফেশন/অবচেতন/অ-ঘটমান এই সমস্ত মিলে নির্মাণ হচ্ছে এক নতুন ডায়াসপোরিক গদ্যভাষার। এতে গল্প আছে, সে-গল্প ইতিহাসের আবার অনেতিহাসেরও। লেখকের পিতামহ ও পিতা (উভয়েই কল্পিত) এই রোমাঞ্চকর বেদনাদায়ী ইতিহাসের প্রধানতম নায়ক; কিন্তু যাদের সঙ্গে রয়েছে আরেক অমোঘ চরিত্র— civilization এবং তার সাগরেদ ‘সময়’। ১৯৪৫-৫০ আর ১৯৯৫-২০০০, এই বিরাট টাইমফ্রেমকে ধরে এগিয়েছে একসঙ্গে তিনটে অসমসাময়িক কাহিনী। এখানে history restated. কীসের ইতিহাস? এই কাহিনি শেষাবধি পড়ে মনে হতে পারে এক লোমহর্ষক চক্রান্ত। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং বহু আর সব এলাকার বসতি মিলিয়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা একুনে বাইশ কোটি। ফরাসি, ইতালি ও জার্মানের তুলনায় বেশ স্লাঘাই। অথচ এই বাইশ কোটি বাঙালিকে সর্বত্র এক-নামে ডাকা হয় না। এদেরই একটা বৃহৎ অংশ আজ তথাকথিত বহির্বঙ্গে কাটা পড়ে ছটফট করছে, ক্যালকেসিয়ান বাঙালিরা যাদের হেটাভরে নাম দিয়েছেন ‘মেড়ো’ বা ‘ম্যাওড়া’। এই এলায়িত ম্যাওড়া জোনের নিছক প্রডোরম্যান ফেজে আটকে থাকা লক্ষাধিক মেড়োর বেদনা ও তার সম্মানার্থে এই চলমান অক্ষরমালার নীচে বেবাক লিখে রাখতে ইচ্ছে করে— We are not anybody, we are particular being. আমার কাছে, ‘বহির্বঙ্গ’ বা ‘ম্যাওড়া’, এতটাই যন্ত্রণার, বিবমিষার।

‘মায়ামঘর’ উপন্যাসে পাশ্চাত্য প্রাচ্যের মূলবোধজনিত দ্বন্দ্ব প্রকটিত হয়েছে, তুমি ব্যক্তিজীবনে ধরনের সংকটের সম্মুখীন হয়েছ? সেটাই কি উঠে এসেছে এখানে?

‘মায়ামঘর’-এ পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের মূল্যবোধজনিত দ্বন্দ্ব যতখানি আছে, তার ঊর্ধ্বে রয়েছে একজন একক মানুষের দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব তলস্তয়ের একটি উক্তি দিয়ে শুরু: ‘জন্ম মানে ঘুমিয়ে পড়া। তারপর জীবন জুড়ে যা ঘটে, সব স্বপ্ন।’ জীবন জুড়ে যা ঘটে, সব স্বপ্ন?— স্বপ্ন মানে গুল, ধাপ্পা, তা তো আর নয়!! এভাবেই শুরু হচ্ছে অনীশ ব্যানার্জীর স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব। জীবনের সত্যি-মিথ্যে খোঁজার ধারাবিবরণী। অনীশ ও তার স্ত্রী গীতির প্রথমে বাংলাদেশ বিমানে করে লন্ডনে যাওয়া, সেখান থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের জাম্বো জেটে ব্রাসেলস, এয়ামস্টার্ডম, রাইনল্যান্ড, ইন্সব্রুক, ভেনিস হয়ে রোম। অতঃপর শুরু হচ্ছে সেই গল্প।

চরিত্র বেশি নেই এ উপন্যাসেও। তবু গীতির পাশাপাশি রুমপি আছে, রুমপি অনীশের মেয়ে। রোম-প্রবাসী রাজের সঙ্গে তার বিয়ে হবার কথা। রুমপি কলকাতার মেয়ে, রাজ জন্ম থেকে ইউরোপীয় চালঢালে অভ্যস্ত। রাজের চমক দেখে গীতি, মানে রুমপির আটত্রিশ বছুরে মা তার গোপন প্রেম পড়ে গেল। অনীশের দ্বন্দ্বের পরিসর ক্রমশ বেড়ে চলে। না, উপন্যাসটি লেখার সময় বা আগে, আমি সে হেন মানসিক সংকটে পড়িনি বটে; কিন্তু ইদানীং তার সমীপপর্যায়ের নানান অরোন্তুদ সংকটে অবশ্যই পড়তে হয়েছে, এবং প্রায়ই পড়তে হয়। তা থেকে উদ্ধারের উপায় আমার জানা নেই। তবে, একটা কথা, সম্ভবত ক্রিয়েটিভ মনের কোনো নির্দিষ্ট মতামত বলেও কিছু থাকতে পারে না। লেখক মাত্রেই সময়ে-সময়ে মৃত এবং তার প্রতিটি রচনাই যেমন এক-একটি প্রস্থানভূমি, তেমনি তার ভাবনাও জড় বা নৈর্ব্যক্তিক নয়।

তুমি তো ভারতের বাইরে কোথায় যাওনি, রোম না গিয়েও রোমের এরকম বর্ণনা, ম্যাজিকটা কী বস

ম্যাজিক আর কী, ‘মায়ামঘর’-এ প্রেম আছে, অবৈধ সম্পর্ক আছে, আবার নস্ট্যালজিক স্মৃতিচারণও আছে। আছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। সেটা না থাকলেও কাহিনি বিন্যাসে বিশেষ কোনো বাঁধা হত না। কিন্তু এটা সে-অর্থে আরোপিতও নয়। যাই হোক। দিল্লি বাসের সময় আমি অবসর সময়ে রোমান আর্কাইভে গিয়ে সে-দেশ সম্পর্কে প্রচুর নিখুঁত বর্ণনা এবং তথ্য পাই। সেগুলো হরদম মনের ডগায় লকলক করত। তো, সাতানব্বুই সনে প্রকাশিত আমার ‘পাপরাৎজি’ উপন্যাসে পটভূমি হিসেবে রোম প্রথম ব্যবহার করি, যেটা পড়ে ওই উপন্যাসের প্রথম পাঠক কৃষ্ণগোপাল মল্লিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘তুমি ইতালি সফর করেছিলে কিনা, এ উপন্যাস পড়ে কেউ সেটা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না।’ পরের খেপে রোম এল ‘মায়ামঘর’-এ, আরও নিখুঁতভাবে। একই মন্তব্য ছিল অনেক পাঠকের। ইয়ে, তুমি জানো, প্রতিভাধর লেখকেরা এটা পারে। হা হা হা। আফ্রিকায় রেললাইন পাতার গল্প ছিল ‘চাঁদের পাহাড়’-এ। তাহলে?

তোমার লেখামাফিয়াথেকে তো টেলিফিল্ম হয়েছিল কমলকুমার বলতেন চলচ্চিত্র একাধারে চিন্ময় বাঙ্ময় শিল্প চলচ্চিত্র লিখিত সাহিত্যের ফারাক কী তোমার কাছে

একটা বিশাল সময় জুড়ে, এই সেদিন অবধি, একচক্ষু অবয়ববাদীরা শুধুমাত্র জোর দিয়ে রেখেছিলেন শব্দের ‘ধ্বনি’ এবং ‘রূপ’-এর বা পদখণ্ডের ওপর, বাক্যনির্মিতি বা syntax ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ ছিল না। আব্রাম চমস্কিই প্রথম বললেন, ভাষা-প্রক্রিয়ায় মূল ভিত্তি হল বাক্য, বাক্যের পর বাক্য সাজিয়েই আমরা কথা বলি এবং সেই সমন্বিত বাক্যমালা দিয়েই এক-একটি মানুষকে চেনা যায়,— এক্ষেত্রে, লেখককে। চলচ্চিত্র নির্মাণও একধরনের সিনট্যাক্স। কিন্তু তফাৎ আছে। সেখানে অন্বয় বা সিনট্যাক্স নিছক পদক্রম মেনে চলে না। ছবি তৈরিতে ক্যামেরা, বাজনা, আবহ, অভিনয় ইত্যাদি নির্মাতাকে সাহায্য করে। কিন্তু লেখকের কাছে এ-সবের কিছুই নেই। তার কাছে সিনট্যাক্স হল stem বা মূলের সঙ্গে উপসর্গ, বিভক্তি, প্রত্যয় ইত্যাদি যোগে গঠিত শব্দ নিয়ে বাক্য রচনার প্রক্রিয়া মাত্র। লেখার মাধ্যমে ছবি ফুটিয়ে তোলা অনেক বেশি শক্ত। লেখার ভাষা এমনই এক ভেলকিবাজ পরি যে আক্ষরিক অর্থে কিছুই বলতে দেয় না, বলতে গেলেই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়। কিন্তু, সিনেমায় সেই ভেলকিই সমস্ত কথা বলে। আপাতত, লেখার সঙ্গে চলচ্চিত্রের এই বনিয়াদি ফারাকটুকু থাকছে। হয়তো একটা সময় আসবে, যখন এই হাইফেন মুছে গেলেও যেতে পারে।

তোমার প্রায় সব লেখাই আত্মজৈবনিক, তাহলে আলাদা করে আত্মজীবনী লেখার প্রয়োজন অনুভব করলে কেন?

আসলে, আত্মজীবনী, যা আমার মনে হয়েছে নিজের ক্ষেত্রে, একটা টেকনিক বা পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা। যত উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ বা কবিতা লিখেছি এ-অব্দি, এবং কিছু ব্যক্তিগত গদ্য বা জার্নাল— যেগুলোতে আমি একটা জীবন, জীবনের অর্থ, এবং যে-উদ্দেশ্যে তার ধাবন, তাকে খোঁজার চেষ্টা করেছি; কিন্তু দেখেছি, এভাবে বাইরে থেকে নিজেকে দেখা বা জায়েজা নেওয়ায় অনেক বানানো, অনৃত আর ঝাড়ি-মারা ব্যাপার সেঁধ মেরে যায়। আবার, একা নিজেকে নিয়ে লিখতে চাইলেও, অনিচ্ছাকৃতভাবেই, হয়তো অজান্তে, প্রবল আত্মনিবিষ্ট হয়ে পড়ার ঝুঁকি। সেক্ষেত্রে লেখক পরিপার্শ্বকে স্ব-সূত্রে দেখতে ও বয়ান করতে চেয়ে নিজেকে খানিক গ্লোরিফাই করে ফেলতে পারেন ও করেন। এমনকী এক-একজন নিতান্ত ধড়িবাজ, বেহায়া আর মওকাপরস্ত লেখকের আত্মজীবনী পড়ে দেখেছি নিজেকে উদাসীন সাধু কবি ভাবুক বুদ্ধিজীবী দার্শনিক সমাজহিতৈষী বানাবার চেষ্টায় কতই-না কেরদানি সেখানে, আমি তো ভেবে ক্লান্ত হয়ে পড়ি বাঙালি লেখকরা কি এতই নিরীহ, গোবেচারা আর পাংশু জীবনযাপন করেন? আমি চাই জীবনের তামাম ফাঁপানো বেলুনে গুনছুঁচ চেপে ধরতে। আমার তথাকথিত আত্মজীবনী ‘দ্রাক্ষাপ্লেটে জোনারদানা’-য় আমি চেয়েছি আমার একান্ত ‘আমি’-কে, যাকে আমি আমার আত্মজৈবনিক লেখাগুলোতে ঠিকঠাক হাজির করতে পারিনি, সেই সংগুপ্ত ‘আমি’-কে হিঁচড়ে বের করে এনে ফ্ল্যাশবাতির মুখোমুখি একেবারে সটান দাঁড় করাতে। একজন লেখকের পক্ষে সম্পূর্ণ সৎ, আন্তরিক আর নিরাসক্ত মনোভাব নিয়ে এই হিংস্র আর কষ্টতম কাজটা করে ওঠাই, আমার মতে, তাঁর আত্মজীবনী। এবং মনে করি, নিজেকে আবিষ্কার করার এটিই সঠিক পন্থা।

অ্যাজ- ক্রিয়েটিভ পার্শন কি মনে হয়, শিল্পীর জীবন কেমন?

শিল্পীর জীবন, তা, আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, বলেছি আগেই, শিল্পী বা লেখক সময়ে সময়ে মৃত। প্রতিটি রচনার শেষে লেখকের প্রস্থান। তার বেঁচে থাকার প্রতিবেদন হল তার এক-একটি রচনা। কেন-না তাতে তার হাজার মারতোল সওয়া জীবন বিম্বিত। অথচ, সেই জরদ্‌গব পাথরটিকে ঘাড়ে বয়ে আজীবন তাকে চূড়োর লক্ষ্যে হেঁটে যেতে হবার।

আচ্ছা আর হ্যাঁ তোমার অধিকাংশ লেখাই যেহেতু আত্মজৈবনিক তাই বায়োগ্রাফিকাল ক্রিটিসিজমের একটা প্রবণতা থেকেই গেল ভবিষ্যতে, তুমি নিজে কীভাবে দ্যাখো, বায়োগ্রাফিকাল ক্রিটিসিজমকে? মানে বলতে চাইছি আমরা শিল্পীর জীবন নিয়ে শিল্পকে দেখব নাকি বিচ্ছিন্ন করে

ইঁদুরের প্রতিটি আদব ও কায়দা, প্রতিটি লাফ, ইঁদুরের অনুসারী। এদিক থেকে মানুষের এক-একটি মতো ও পিৎজা, তার হাঁটা আর রোখ মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে। এক-একজন লেখকের কত কী পরিচয় থাকে, বাঙাল ঘটি রিফিউজি কেরানি স্কুলমাস্টার অধ্যাপক ডাক্তার ইত্যাদি, এমনকী পদবি ভিন্নতা এবং পেশা বা চাকরির ধরন, এ-সবের ওপরও লেখকের চরিত্র নির্ভর করে। সুতরাং, আমি মনে করি, লেখক বা শিল্পীকে তার ব্যক্তিগত জীবন ও তার ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা অসম্ভব। পাশ্চাত্যে বায়োগ্রাফিক্যাল ক্রিটিসিজমের অজস্র নমুনা আছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মই তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ। ‘দ্য ওল্ড যান এন্ড দ্য সি’, ‘দ্য সান অলসো রাইজেজ’, ‘আইল্যান্ডস ইন দ্য স্টিম’, এ সব লেখা তাঁর যাপিত-জীবনেরই অংশ। আবার, লেখক খোদ কবুল করেননি বটে, আমরা জানি, সি-ডি ওরফে চার্লস ডিকেন্স আর ডি-সি ওরফে ডেভিড কপারফিল্ড একজনই;— স্রেফ নিজের নামটাই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে ইস্তেমাল করেছেন লেখক। গল্পটা পুরোপুরিই আত্মজৈবনিক। প্রথম দর্শনের মাতাল প্রেম ডোরার সঙ্গে মানিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ডেভিডের বৈবাহিক জীবন সুখের হয়নি,— একমাত্র ‘সে’,— মৃত্যু এসে দান করে যায় এই ‘চাইল্ড ওয়াইফের’ হাত থেকে নিষ্কৃতি। আমার তো মনে হয় বায়োগ্রাফিক্যাল উপন্যাসই বেঁচে থাকবে ঘোর ভবিষ্যতে। অভিজ্ঞানের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেল, এটা লেখকের ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি। অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয় উপলব্ধির সারাৎসারে, উপলব্ধি লেখকের চেতনায় আনে নৈর্ব্যক্তিকতা, সেটিই বাস্তবের ওপরকার সমস্ত বায়বীয় আবরণকে ছিন্ন করে। মহৎ উপন্যাসে এভাবেই লেখকের আত্মা, ঘাম, রক্ত, পুঁজ ঘুলে থাকে। তাঁর জীবনের গান ও ছন্দ, প্রেম ও বিষাদ ঘুলি মিশে থাকে। আমার এক-একটি লেখায় আত্মজীবন, কল্পনা, প্রসাদ রস আর অভিযানের ইঙ্গিত থাকে, যা আমি এনজয় করি, আবার কুরে কুরে খাইও।

আচ্ছা এই কুরে কুরে খাবার স্যাডিজম আছে বলেই কীযোজন ভাইরাস’-এর মেল শোভেনিস্ট ইগোর বিপ্রতীপে, মানে নিজেরই মেল ইগোকে তছনছ করেজোখিম কোরকাপ‘- ফেমিনিস্ট ভিউ এনে, একটু রগড় করলেনাকি সত্যিই দরকার মনে হল

‘জোখিম কোরকাপ’ মোটেও ‘যোজন ভাইরাস’-এর আদর পার্ট নয়, সেটা ছিল যৌনতা বিষয়ে মেল ভিউ আর এটা ফেমিনিস্ট ভিউ, এমন নয় মোটেও;— জীবনে অমন ঘটনা না ঘটলে হয়তো এ লেখা হত না। আবার জোখিম শুধুমাত্র মেঘনা নাম্নী কোনো নারীর কাহিনি বলতেও দায় নেয়নি, দায় নিয়েছে পৌরুষ-আতপ্ত প্রেম উন্মোচনে। এ বৃক্ষে ফল হয়ে ঝুলে আছে পুরুষের মুগ্ধতা, নারীর মন, মনন, শরীর ও শরীরাতীতে। উপন্যাসের মুখপাতে লিখেছিলাম, ‘সেই চরিত্র এমনই, খুব ধীরে পুরুষ স্বীয় অস্তিত্ব ফেরত পায়।’ এমনই রূপবান মর্যাদা দিয়েছে আকাশ রুদ্র, তার মেঘনাকে,— ‘ভাসমান বালিকা তুমি, পাখা খোলো। তুমি গঙ্গা, কলকল করো, তুমি গাছ হও মালা গাঁথব, আজ তোমার দখল নেবার দিন।’ সাহিত্যের সব প্রকরণের মধ্যে উপন্যাস এমনই যা লেখককে সমাজনির্ভর একটি সৌধ নির্মাণের প্রশ্রয় দেয়। লেখক সমাজকে উপুড়, চিৎ, সাইড বা তলা কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা ও কীভাবে দেখতে আগ্রহী তা তাঁরই প্ল্যান-নির্ভর। সেই প্ল্যানের মধ্যেই সেঁধিয়ে থাকে লেখকের দর্শন, অস্তিত্ববোধ, সমাজবোধ ও অবচেতনের কারিকুরি। এই উপন্যাসে আমি যে নারীর উপুড় প্রেমের তোড়ে পুরুষের ছদ্মবেশ ধুয়ে প্রকৃত অস্তিত্ব জেগে ওঠার বিমল ইচ্ছা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, লেখক হিসেবে সেই আমার সৃষ্টিছাড়া স্বাতন্ত্র্য। হয়তো অনেক প্রাজ্ঞ পুরুষবাদী বা নারীবাদীর ভ্রূ কুঁচকে যেতে পারে এ কারণেই। তাঁরা স্মার্ট নির্লিপ্ত কাষ্ঠল পুরুষের পাশে স্থাপন করবার পক্ষপাতি কুমড়োলতা মেয়েমানুষ, তবেই না প্রেমের ফ্রেমটা ঝলমল করবে! এই মানসিকতাকেই আমি তছনছ করে দিতে চেয়েছি এই উপন্যাসে। বলতে পারো, ছদ্ম-চিরন্তনে চিড় ধরিয়েছি।

যোজন ভাইরাস’-এ যেযৌনতা কল্পনায় জোখিম কোরকাপ–এ তা আরও বিপর্যয়ের মতো এল থ্রি সাম হয়েথ্রি সাম ইনডিভিজুয়াল সেক্স অ্যাক্ট হিসেবে কেমন? লেখার ত্রিস্তরীয় বিন্যাসের মতো না?

প্রশ্ন হিসেবে এটা ভালো। কিন্তু ‘কাজ’ চালানো হিসেবে যৌনতায় যৌথতার ভূমিকা থাকলেও, যৌনতা তো আর ফ্যাক্টরিতে হয় না, প্রাসাদেও না। তাহলে অত অত রূপকথার, মহাকাব্যের রাজারা ঋষি-মুনি দিয়ে সন্তান নামাবার বংশরক্ষাকারী প্রজেক্ট নিত না। কাজেই সংসার, সন্তানে ষোড়শ উপচারে নিজেকে সাজিয়েও মেঘনা আবিষ্কার করে, ‘সেই দ্বিজরাজ সুধাকরই রাতের চাদর টেনে নিচ্ছে, বিয়ের বেলা আটটায়। সেখানে অন্য কোনো বাড়তি সুধাকর বা মেঘনা নেই।’ আমাদের দাম্পত্য জীবনে এক-নারী বা এক-পুরুষ ব্যাপারটাও একটা আকন্দ, পচ ধরে। অন্ধকারের এদিকটা যেমন নিরঙ্কুশ সত্য, আলোর দিকেও অনুরূপ এক সত্যের বাস। তাহলে, নিছক আত্মরতি, অথবা আড়ম্বরপূর্ণ থ্রি-সাম,— কী এমন মহার্ঘ্য আসবাব? দুটোই সোনার পাথরবাটি।

আবারও যৌনতা নিয়েই প্রশ্ন করি(অজিত রায় দেখছি মারাত্মক রকমের যৌন…/সব ভূমিকাই গৌণ/আসল ভূমিকা যৌন) জোকস অ্যাপার্টজোখিম কোরকাপের প্রকাশের পরের বছর, মানে ২০০৩তে শহর থেকে একটা প্রবন্ধ সংকলন বেরোয়… ‘যৌনতার নবমুক্তিএখানে নবমুক্তি কী অর্থে? পিউরিটান ভাবনার বিরুদ্ধে একটা জোরালো স্বর সেখানে ছিলকিন্তু সে তো তার আগেও ছিলমানে নতুন কী অর্থেজানতে চাইছি

না না, দাঁড়াও, জোক্স-টোক্স নয়, আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই একধরনের গা-ছাড়ানো অপবাদ আমাকে লাগাতার শুনে আসতে হয়েছে, যৌনতা-ফৌনতা ইত্যাদি নাকি আমার লেখায় থাকে! কারা লেখে আমাকে নিয়ে এ-সব? তাদের পরিচয় কী? গলির ক্রিকেটার যেরকম, তেমনি এরা, পাড়ার লেখক। দুর, ওরা আমাকে পড়েইনি। পড়লে, যৌনতা বিষয়ে আমার দ্বান্দ্বিকতা দেখতে পেত না? বিগত এই তিন-চার দশকে আমি হয়তো অনেক কিছু করতে পারতাম-কিন্তু, অন্য দিকে না ‘পালিয়ে’ আমি যে লেখালেখিকেই আত্মস্ফূরণের আধার বা আধেয় হিসেবে ধরেছি, বরণ করেছি, লেখালেখি ঘিরেই আমার জীবনের যা-কিছু যখন, জীবনের অর্থ বা শেষ অর্থও, বলা বেশি আমার সমস্ত ভাবনা এবং খনন এই নর্মজীবন, যা আসলে কর্মজীবন,— একেই ঘিরে। তাতে যদি জীবনের ‘অনর্থ’ বেরোয়, তা-ও সই। ব্যাখ্যাহীন না-ইলাজ্ ডিপ্রেশন বা অব্যক্ত মর্মপীড়ার কথা-লেখালখি, একমাত্র লেখালখিই সে-থেকে আমাকে মানসিক উপশম দ্যায়, দিতে পারে। আমি এখন জীবন আর সাহিত্যের মাঝে হাইফেনটুকুও রাখবার পক্ষপাতী নই, এটা আমার ভেতর থেকেই এসেছে। ফলত, আমি যদি নিজেকে জানতে চাই, সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে চাই লেখার মাধ্যমেই আমাকে তা করতে হবে। নিজের বাইরের ‘স্ব’-এর সঙ্গে ভেতরকার সংগুপ্ত ‘আমি’-র ‘স্ব’-কে মেলাবার চেষ্টাসেই আমার লক্ষ্য। প্রতিমুহূর্তের বদল-খাওয়া ‘আমি’-কে ধরা। সেই ‘সত্য’ বা ‘অর্থে’র জন্যে আত্মখনন। পাশাপাশি গদ্য, শব্দকলাপ, তার মজা বা রগড়কে উপভোগ করা। এক্ষেত্রে বলব, যদি প্রশ্ন করো, যৌনতা আমাকে সৃষ্টিশীল করে কিনা, এ প্রশ্নেরও জবাব এতখানি হতে পারে যে পৃথক একটি প্রবন্ধই হয়ে যায়। তবু চেষ্টা করি। ‘যৌনতা’ তো আমাদের বানানো শব্দ, পিতৃতন্ত্রের ধারণায় খরাদ করা, এবং হালের আমদানি। আগে যখন পুরুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের ব্যাপারটা ছিল, তখন ‘যৌনতা’ ছিল না। ধর্মশাসন আর আকাডেমির ট্যাবু ব্যাপারটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে যৌনতা তার সনাতনো ঝংকারই ভুলে গেছে। উনিশ শতকের ফর্সারা হঠাৎ ধরে ফেলল যে যৌনতা জৈব-প্রজননের প্রবৃত্তিগত তাড়না হলেও, তাকে মন আর মগজ দিয়েও নাকি ‘করা’ যায়। যে-কারণে যৌনতার প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা পাচ্ছি ‘কামশক্তি’ আর ‘কর্মপ্রেরণা’ শব্দ-দুটো যদিও এই ধারণা ফ্রয়েডের লিবিডো ধারণা থেকে খুব-কিছু ফারাকে নয়। ফ্রয়েড যৌনতাকে একটা স্বয়মভূ ব্যাপার ভেবে এগিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর ‘আমি’ হয়ে গেল ‘লিঙ্গ’। মানুষের সৃজনশীলতা, ফ্রয়েড বলেছিলেন এই লিঙ্গবোধ থেকে চাগায়। এ থেকে কিছু সরে এসে, এ-যুগের তত্ত্বদর্শী মিশেল ফুকো বললেন, সমাজের যে-কোন প্রবৃত্তিগত ক্ষমতার সম্পর্ক এবং যৌন-সম্পর্কগুলো, সরাসরি আড়ালে বা আপাত-অযৌন মনে হলেও তা আসলে প্রতাপেরই স্ফূরণ। আমি এসবের কোনোটাই অগ্রাহ্য করছি না, কিন্তু যদি যৌনতা বলতে এখনো শুধু জৈবিক কামতাড়নাকেই ইঙ্গিত করা হয়, দুঃখিত, ঈশ্বরের মতো তথাকথিত যৌনতাকেও আমার ভাবনার ভারসাম্যে কোথাও বসাতে পারছি না। কেননা, ঈশ্বরের কথা বাদ দিলেও, সেই ‘যোনি’-উদ্ভূত যৌনতা আমার কাছে ততখানি যথার্থ, তার অনেক বেশি কল্পনা। একটা নিরাবয়ব ফোর্সের মতো আমার কাছে যৌনতা। এটাকে যে-যেমনভাবে ভাবতে চাইবে, তার কাছে তা-ই যৌনতা। কেউ নারীর পায়ের টো থেকে চুলের ঘ্রাণ অব্দি সর্বত্র যৌনতা পায়, কেউ-বা-যেমন উদয়ন ঘোষ, —কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনেও সেটা ফিল্ করেন। আমার এক বান্ধবীকে দেখতাম, সুন্দর-কিছুর রসময় বর্ণনাই তাকে বেসুধ করে ফেলত, জাগতিক যা-কিছু শুধু কল্পনায় ছোঁয়া যায় অথবা অনুপম কোনোকিছুর স্বপ্নই তাকে অরগ্যাজমে পৌঁছাতে দিত। ‘এই মৃত্যু উপত্যকায়’ সে-বিবরণ আছে। আমার কাছে যৌনতা খানিক ঐরকম। যৌনতা শব্দের উচ্চারণ-মাত্রে যে আমার লিঙ্গ বা যোনি মনে পড়ে ঈশ্বর বা অদৃশ্য-শক্তি বলে ভাবি, যে আমাকে ক্রিয়েটিভ রাখছে, আমার ‘আমি’কে স্টিয়ার করছে, হোক সে ‘অহং’, কিন্তু সেই সত্য তো আমি অনুভব করছি! সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘কামুক’-রাই এগিয়ে। যৌনতা, হ্যাঁ, আধুনিক অভিধায় তো তা-ই বলব । আসলে এ-দেশে, বহির্বিশ্বেও ‘তত্ত্ব’ হিসেবে যৌনতা এখন এমন পিলপিলে পর্যায়ে আছে যে বিষয়টি উত্থাপন করাই দুরূহ এবং ঝুঁকির। পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের ট্যাবু আমাদের গবেষণা আর জ্ঞানার্জনের ফাটক রুদ্ধ করে রেখেছে । ধর্ম বা আধ্যাত্ম নিয়ে আমরা যতটা ভেবেছি, অনাস্থা আর অস্থিরতার পাল্লা যেন ক্রমশ ভারী হচ্ছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেব নেই, কিন্তু অনুমান করি অ্যান্টি-আরবান মানসিকতায়, নাস্তিকদের দিকেই যেন ভিড় বাড়ছে। যুক্তির কাছে পরাস্ত প্রফেটদের দাঙ্গা-উৎপাদক শাস্ত্রের উল্লাস। ঐ ধর্ম নিয়ে যতখানি মেতেছি আমরা, তার চেয়েও বেশি দরকার যৌনতা নিয়ে । এথোপোয়েটিক্যালি ভাবতে হবে ব্যাপারটা নিয়ে। ফ্রয়েডের ‘সৃজনশীলতা’-র ব্যাখ্যাকে নারীবাদীরা মনগড়া বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ভাবতে হবে নতুন করে। কেন-না, ‘মন’ তো বস্তু-নিরপেক্ষ অন্য কিছু না। হ্যাঁ, ‘কামশক্তি’ অর্থে নয়, ‘কর্মপ্রেরণা’ বা ‘সৃজনশীলতা’ হিসেবে যৌনতাকে আমি মান্য করি। এ সব কথা বলতেই ‘যৌনতার নবমুক্তি’ সংকলনটা করেছিলাম। ওতে সার্ত্রর একটা লেখার অনুবাদ ছিল। এছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সন্দীপন, উদয়ন, সমীর রায়চৌধুরী, মলয়, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল প্রমুখের লেখাও ছিল।

ছোটোলোকের শব্দলোকনামটা কি মলয় রায়চৌধুরীরছোটোলোকের ছেলেবেলাথেকে তুলে নেওয়া…? তোমার স্ল্যাং অন্বেষার বীজ কি এখানেই পোঁতা হয়েছিলযা মহীরুহ হয়বাংলা স্ল্যাং সমুচ্চয় ঠিকুজিকোষ্ঠী‘-তে?

আমি উপন্যাস বা গদ্য লেখালেখির বাইরেও যা-কিছু করেছি, সবই কিন্তু সজাগভাবে, যা আমার লেখালেখিরই অঙ্গ বা অনুষঙ্গ। আর, আমার লেখার সমস্ত ভাষা আর তরতিব নিজস্ব যাপন থেকে আহরিত। যাপনের বিভিন্ন স্তরে যে-সব ঘটনা বা অভিজ্ঞতা বিভিন্ন সংবেগ ও গুরুতা নিয়ে হাজির হয়েছে, লেখায় সেগুলোকে পুনরুদ্ধার ওরফে লালন করে এসেছি। স্ল্যাং বিষয়ে সন্ধিৎসু হয়ে ওঠাটাও আমার ভাষা-জিজ্ঞাসার একটি অঙ্গ। বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে জোরাজুরি বাবদ কর্তিত এক বাঙালিপ্রধান বিহারি-ঝাড়খণ্ডি জেলার এক অতিশয় বেপোট কলোনিতে ‘তা’-পাওয়া এক ট্যাশ বাঙালি লেখকের সারাজীবনের আহৃত শব্দই মগজের আকুলি নিয়ে উঠে এসেছে আমার ওই ‘বাংলা স্ল্যাং : সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি’ গ্রন্থে। হ্যাঁ, ‘ছোটোলোকের শব্দলোক’ বইটিতে ঘটেছিল তার ডিম্ব-প্রকাশ। হতে পারে মলয়ের ‘ছোটলোক’ শব্দটি নামকরণে সাজশ করেছিল। সেটা কোনো গুরুত্বের কথাও নয়।

পাগলনামাতে অনেক পাগলের সম্মীলন… কৃষ্ণগোপাল মল্লিক যেমন আছেন তেমনই হালের অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়… তোমার জীবনের দেখা বহুবিচিত্র পাগলামির ভাঁড়ার থেকে কিছু খালি করো…

একদিন বারীন ঘোষাল ঘিলুতে ঢোকালেন, দ্যাখ, বাঙালিকে মাঝেমধ্যে একটু ঘেঁটে দিলে এ জাতের সামান্য উন্নয়ন হতে পারে। ফস করে লুফে নিলাম ফন্দিটা। বের হলো ‘শহরে’-এর পাগল সংখ্যা, ২০০৪। পড়ে, বারীনদা লিখলেন, ‘কাগজ জমিয়ে দেবার ব্যাপারটা কেউ তোর কাছ থেকে শিখুক। ঘ্যামা ঘ্যামা প্রবন্ধ জড়ো না করেও, সৃজনশীল সাহিত্য জড়ো না করেও শুধু পাগলামি দিয়ে এমন অসাধারণ হাওয়া বওয়ানো বাওয়াল খাড়া করা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। পাবলিক পাগলামো খুব খায়। পাবলিক শুদ্ধ সাহিত্যে বিরক্ত। দিন পাল্টেছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় তরুণ শিল্পীর মার্কিন চেতনায় উখড়ে যাওয়ার বিপক্ষে সাহিত্যিকের নিজের আওতায় এই অক্ষরহরণ বহুদিন মনে থাকবে।’ বারীনদা এ সংখ্যায় কার লেখা পড়ে শেষ উক্তিটা করেছিলেন? এই সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী, ইলিয়াস, সন্দীপন, বারীন, কমল, সমীর, তপোধীর ভট্টাচার্য, কলিম খান এবং উদয়ন ঘোষের লেখাও; রাজীব সিংহ ও সুবীর সরকারের লঘু উপন্যাস, এবং অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুজয় বিশ্বাসের রচনাও। কিন্তু, সমস্ত সরিয়ে রেখে উনি মজেছিলেন আমার ‘পাগলনামা’ উপন্যাসে। উনি এ নিয়ে বিশদে লিখেওছিলেন। কী ছিল এই উপন্যাসে? ছিল রবীন্দ্রনাথের পাগল দাদাদের কথা, ছিল কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের লাজবাব পাগলামির সারসংক্ষেপ, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যাযের একটি চিঠি, আর ছিল ছত্রে ছত্রে নিজের পাগল রাজধানীর যাবতীয় আসবাব রাস্তায় উলঙ্গ করে দেবার বেহিসাব আকুলি। এতেই খেলা জমে যায়। পদে পদে বাঙালিকে নিয়ে শ্লেষ ও স্যাটায়ার। বাঙালি জাতটাই বেশ মজাদার কিনা। প্রচণ্ড মিল শেক্সপিয়রের একটি চরিত্রের সঙ্গে। হ্যামলেট। একদিকে গগনচুম্বী বাচালতা ও আত্মম্ভরিতা, অন্যদিকে আত্মালোচনা ও আত্ম-নাকচ;— এতেই বাঙালি বিশ্বের অগ্রনায়ক। মানবেতিহাসে বাঙালির সমর্ম অবদানের পরিধি নেই। আবার এই বাঙালিই সর্বময় কুচুটে, লেংগিপ্রিয়, পরশ্রীকাতর। এ ব্যাপারে আমরা নীরদবাবুর ‘আত্মঘাতী’ অভিঘাতটিকেও আমরা লাই দিয়ে ফেলি। এটাই বাঙালির ট্র্যাজিক ফ্ল। হ্যামলেটের মতই বাঙালি মাতৃনির্ভর। পলোনিয়াসকে খুন করে ফিরলে হ্যামলেটকে ওর মা বলেছিল, ‘পাগল কোথাকার!’ মার কাছে সব ছেলেই তো পাগল, সব বাঙালি পুঙ্গবই মায়ের কাছে ‘খোকা’। আসলে বাওরামি কোনও ব্যারাম না। অযুক্তির তুলনায় যুক্তির যে খুব-একটা উপযোগিতা বা গুণ আছে, তাও নয়। ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’-এ ফুকো পাগলামিকে রোগ না বলে যুক্তি ও অযুক্তির মিশ্রণ বলেছেন। আসলে দুই জগতের ‘চেতনার নিজস্ব বলয়’ এতটাই আলাদা যে দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে বোঝাতে নারে আপনারে। এই বোঝা না-বোঝার স্তব্ধতাই হলো বর্তমান পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য। পাগলামি বা খ্যাপামি বাঙালির মজ্জাগত। জীবনের প্রত্যেক অংশে প্রত্যেক বাঙালিই কোনো না কোনভাবে আকুলতায় জড়িয়ে আছে। কেউ নাটক পাগল, কেউ গান পাগল, কেউ বই-পাগলা তো কেউ বউপাগলা। বাঙালি একদিকে হীনমন্য, ক্ষুদ্রচিত্ত, হাড়কিপ্টে; আবার বাঙালিই সমগ্র ভারতবাসীকে শিখিয়েছে কিভাবে স্ব-উপার্জিত অর্থ ও জমি দান করে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও অনাথালয় বা এক-একটি লিটল ম্যাগাজিন গড়তে হয়। এই পাগলামি আসলে সেই সাধনা সেই সব্বনেশে প্রেম সেই প্যাশন যা এক সৃষ্টির থেকে আরেক সৃষ্টির পানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথকে, এক আরম্ভের থেকে আরেক আরম্ভের দিকে ছোটায় বিনয় মজুমদারকে, এক মানুষের থেকে আরেক মানুষের দিকে ঠেলে দেয় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। বাঙালির বেঁচে থাকার অবলম্বনই এই পাগলামি। ইন্টার-ডিসিপ্লিনারির চতুরন্ত টপকে বাঙালি এখন সারা বিশ্বের উঠোন দাপাচ্ছে। রাজনীতি, খেলার মাঠ, সাহিত্য, সিনেমা, গান, বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, চতুর্দিকে বাঙালির ধুমা অ্যাটাক। সর্বত্র তার বুম্বাচাক! থিওরি অব কেঅস। যুক্তিভাঙার নেশামাত্রে মন মানছে না বাঙালির। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। হয়ে যাক পাগলামির নতুন দখলতি। হুররে! এসবই ছিল পাগলনামায়।

গল্পকবিতা‘- তো তুমি লিখেছ? কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের সঙ্গে তোমার কীভাবে আলাপবন্ধুতা ছিল?

কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, কৃষ্ণদা ওরফে গোপালদা আমার তিনখানা বইয়ের প্রুফ রিডার। দ্য স্টেটসম্যান-এর চাকরি ছাড়ার আগে রাজা সুবোধ মল্লিকের ‘দায়াদ’ কৃষ্ণগোপালের পরিচ্ছদ ছিল ফিনলের আদ্দির পাঞ্জাবি, ধপধপে ধুতি, গোপালের আ-বাহু গেঞ্জি, সবসময় খড়ি-শাদা, পকেটে ভাঁজ-চারের কেলিকা রুমাল। পায়ে নরম সোলের শৌখিন চটি, চুল হরদম পরিপাটি. বাঁদিকে সিঁথি। তেল চুক্চুকে অথচ ফাঁপানো টেরি. সদ্য কামিয়ে-আসা গাল। বাঁ-দিকের বুকপকেটে কুড়ি প্যাকের পানামা, দেশলাই। সেই কৃষ্ণ গোপালের মানসিক ক্ষমতা ছিল ঐশীপ্রমাণ। সম্পাদক ছিলেন বাঘের মতন, লেখক হিসেবেও লাজবাব। ১৯৬৭ সালের এই কে জি মল্লিককে আমি দেখিনি। নামও শুনেছি আরও অনেক পরে। ‘অধুনা’ আর ‘গল্পকবিতা’-র নেশায় ‘দি স্টেটসম্যান’-এর বড়ো চাকরি ছেড়েছিলেন কৃষ্ণদা। গল্পকবিতা’ যেদিন বন্ধ হলো, ১৯৭২, বাজারে সেদিন ৮৭ হাজার টাকা দেনা। রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের টাকা দিয়ে ৫০-৬০ হাজার শোধ, আর বাকি শোধের জন্য তখন ড্রয়ার খুলে পুরনো দলিল-দস্তাবেজ হাটকচ্ছেন। সিন্দুক খুলে হাতড়াচ্ছেন ভারী ভারী গয়না, হীরে, জহরত, চুন্নি, পান্না, মোগল আমলের মোহর, বংশানুক্রমে সিন্দুকবন্দী এন্টিক, বাড়িতে অশান্তি, চেঁচামিচি, আর উনি মেজাজ বেশি খচে গেলে গোলদিঘির পারে গিয়ে বসে থাকতেন। এই কৃষ্ণগোপালকেও আমি দেখিনি। অথচ, এই মানুষটিকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। সেটা ১৯৯২ সালের পয়লা এপ্রিল, প্রথম আলাপ হচ্ছে যেদিন, অবিকল সেই মাসর-ওঠা গামছি (লুঙ্গি?) আর খর্বকায় জীর্ণ ফতুয়া। হাতে চিনি-গোড়ানো বাসি রুটি। না-ব্রাশ শাদা চুল। ঋজু। তীক্ষ্ণ নজর। আর সর্বজন-খ্যাপানো সেই এক চোখে করুণা আর আরেক চোখে ব্যঙ্গ মিশেল খিটখিটে হাসি। এই গোপালদাকেই আমি চিনেছি, মিশেছি, ভালো লেগেছে, বিরক্তও হয়েছি তাঁর ব্যবহারে। সে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি, অনেক মজা, অনেক কান্না। স্বল্পে বোঝানো যাবে না। তবে, তোমার প্রশ্নে একটা তথ্য ভুল। আমি কখনো গল্পকবিতায় লিখিনি। যতদিনে লিখতে শুরু করেছি, ততদিনে তো পত্রিকাটা মরে ভূত।

ধানকাঠের তয়খানার পূর্বসূত্র কী ?

হ্যাঁ, ভালো কথা, যেন যা-যা লিখেছি সবের পেছনেই কোনো না কোনো ইঁদুর-হত্যার কাহিনি লুকিয়ে আছে। থাকার কথা অবশ্যই। ফ্রয়েড যেমন বলতেন, ‘আমি বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে যেখানেই পৌঁছই, দেখি এক কবি বসে আছে।’ লেখকের কাছে এর চেয়ে বড়ো পূর্বসূত্র আর কী? যা যা লিখেছি, সবেরই পেছনে একটা যুক্তি রেখে যাওয়া। এক একজন লেখককে দেখি, একটা ঐতিহাসিক, দুটো সামাজিক, তিনটে প্রেমের, দুটো পারিবারিক, একটা দেশাত্মবোধক এরকম উপন্যাসও লেখেন। যদিও আজ এভাবে লেখা মানে একটা মৃত সাহিত্যধারার রেওয়াজ মাত্র। যাঁরা ফি মুহূর্তে নতুন নতুন লেখা লেখেন, তাঁদের কাছে এক একটা লেখা মানে এক একটা segment. কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আদৌ তা নয়, আমার সমস্ত লেখালেখি আসলে একটা বিরাট continuation-এরই খণ্ড খণ্ড অংশ, অথচ তা সে-অর্থে monocentric-ও নয়। বরং পাঠকও প্রতিবার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পালটে, লেখকের angle of incidence ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন তাঁর এই কন্টিনিউয়েশনের পরিবর্তনকে। ‘ধানকাঠের তয়খানা’ তেমনি এক সম্পাদ্য। শুধু লেখার ভাষাশরীর, শব্দবয়ন, বাক্য বিন্যাসে নতুন এক কসরত রয়েছে। উপন্যাসটি প্রথমে ভিন্ননামে গল্পকারে ‘কৌরব’-এ বেরিয়েছিল, তখুনি কেউ কেউ বলেছিলেন, এর ‘গদ্যে’র কথা। গদ্য, ব্যস, তার বেশি মার্ক্স এই উপন্যাসকে আমি নিজেও দিই না।

আত্মবিস্তৃত ফিসৃত বোলো নাবাঙালি বাংলার ঐহিত্যকে ভালোই মনে রাখেদেবুদাদেবজ্যোতি রায়এর একটা সাক্ষাৎকারের পুরোটা জুড়ে বারবারবাংলাঅর্থাৎ বেঙ্গল কান্ট্রিকে কেন ফিফটি থেকে সিক্সটি করা হল নিয়ে প্রতিবাদ আছেএ-সব তো তোমার নজরে আসে নাধানবাদের স্টেশনের ঠেক, খালাসিটোলা, বারোদুয়ারি কোন কোন স্মৃতি মনে পড়ে

ছোটোবেলা থেকেই আমি পাগল ও মাতালকে অতি ভয় পেতাম। ভাবিনি নিজে কখনো মদ খাব। কিন্তু বিরাশির বইমেলায় ঢুকে সব ভণ্ডুল হয়ে গেল। প্রথম আলাপীর নাম সোফিওর রহমান। ওকে জানতাম অক্ষরের পাতায়। আমারই মতো আউটসাইডার, মোকাম মেদিনীপুর, তেরেপাখিয়া পল্লী। পাক্কা চব্বিশ ক্যারেট মাল। ভয়ানক মিশুকে আর ঠেকবাজ। আমার চেয়ে ৬-৭ বছরের বড়ো অন্তত, বিবাহিত, আর একটা বাচ্চাও আছে, তদুপরি এক এয়ারহোস্টেসের সঙ্গে ইন্টুমিন্টু চালাচ্ছে। তখুনি পাকাপোক্ত কবি, আনন্দবাজারে লাইন করে রেখেছে, সুতরাং পাকা সে অভিজ্ঞতাতেও। একটা পার্মানেন্ট লজ নিয়ে রেখেছিল এম জি রোডের মোড়ে। ওর কাগজ ‘পঞ্চমা’ ওখান থেকে প্রসূত হতো। সারাদিন এ-কবি সে-কবির বাসা, সন্ধে হলেই আনন্দবাজার। সোফিওর, সোফিওর, ওই ছিল আমার টিপস্টার। ঘোড়বাজির তামাম চোরা চোরা খবর ওর কাছ থেকেই হাসিল। সোফিওরই আমাকে কফিহাউস, আবাপ চেনায়। সুনীল, শীর্ষেন্দু, বিমল কর। উরিব্বাস, সে কী উত্তেজনা! শেষে ওর কেয়ার অফে যে দলটাকে পাই, এক-একজন তখুনি আশির দশকের ধুরন্ধর কবি— শ্রীধর মুখোপাধ্যায়, নাসের হোসেন, মল্লিকা সেনগুপ্ত, ঈশিতা ভাদুড়ি। আমি আনকোরা, চুনো। ওরাই একদিন গাঁজা পার্কে নিয়ে গিয়ে আমার নথ ভাঙল। জীবনে প্রথম মদ, হকহকিয়ে বমি করে মল্লিকার শাড়ির আঁচল বরবাদ। সোফিওরই কাঁধে চড়িয়ে প্রথম নিয়ে গেছিল খালাসিটোলা। একটু আগে শক্তি সপারিষদ উঠে গেলেন, একই টেবিলে অল্প সাফি মেরে আমি, সোফিওর, শ্রীধর, তাপস। অনেক বেলেল্লাপনা। এরপর শ্রীধর একদিন আমাকে নিয়ে, সঙ্গে পৃথ্বীশ গাঙ্গুলী। উনি স্কেচ এঁকে দিলেন আমার কাগজের জন্য। ঈর্ষায় ছিঁড়ে ফেলল জনৈক পুলিশ মাতাল। বারদুয়ারীর স্মৃতি অবশ্য ধূসর। ‘জোখিম কোরকাপ’-এর মেঘনাকে নিয়ে ছোটো ব্রিস্টল, অলিপাব বেশ কয়েকবার। ধানবাদের প্রচুর মালের ঠেক আমার স্বপার্জিত অভিজ্ঞতা। থাক। কত কী বলার আছে, এসব আর কী বলি।

তোমার লিভারের হাইমেন ফেটে যাবার শুরুর দিকের দিনগুলির কথা তো শুনলাম কিন্তু ভার্জিনিটি মানে বস্তুগত দিক থেকেই বলছি, মানসিক ভাবে নয়বস্তুগতভাবে ভার্জিনিটি হারানোর আগেই তো অধিকাংশের মানসিক ভার্জিনিটি যায় যদিওতো এই নথ ভাঙল কখনমনে পড়ে কিছু?

দাঁড়াও, দাঁড়াও, এই ধেড়ে সমাজে এসব খোলা প্রশ্ন আজও গর্হিত। অন্তত, শিল্পী-লেখকরা যত বড়োই ধাউড় বা পুঁটে শয়তান হোক না কেন, খোলাখুলি এসব প্রশ্নমালার জবাব দেন না। এত দ্বিধা, যেন তাদের অন্তর্বাসই খোলা গেল বুঝি! অনেকে সন্দীপনই বেশি পড়ে যেহেতু সেক্সের গল্প থাকে, কিন্তু তুলনা বা কবুল করার সময় ঢপ দ্যায় যে ওঁর চেয়ে নবারুণ অনেক বেশি সুখপাঠ্য; কেননা নবারুণে খিস্তিখাস্তা বেশি হলেও সেক্স থেকে মুক্ত। কমবয়সে প্রত্যেকেই পানু পড়েছে, বি এফ দেখেছে, কিন্তু বড়ো হয়ে বলে, ছি ছি, পর্ণো? সন্দীপনদা প্রকাশ্যেই বলতেন, যৌনসম্ভোগের চেয়ে মাস্টারবেট করে বেশি সুখ পাই। এটা আমাকেও একাধিক দফা বলেছেন। সন্দীপনকে টিভি প্রোগ্রামেও কবুল করতে শুনেছি, হ্যাঁ, আমি তো পর্নোগ্রাফি পড়েছি। পাশে-বসা সুবোধ সরকারের মুখ তখন দেড়েমুষে কাঁচুমাচু। যেন তিনি পড়েননি। আসলে এটা, সক্কল ভদ্দরনোকের ভয়ের কারণ। নিজের ল্যাংটোপনাকে হ্যাঙ্গারে ঝুলোতে পারার হিম্মত অনেক বঙ্গপুঙ্গবের নেই। যাই হোক। নিজের কথা বলি। হুটহাট যৌনসম্পর্ক হয়ে গেল, তা তো আর নয়। জন্মের আগে জন্মাবার প্রস্তুতি তো থাকেই। দীপ জ্বালার পূর্বে সলতে পাকাবার কাজ। সে সময়টা বাদ দিলে চলে? সেসবের সৌকর্য, সূক্ষ্ম ও জটিল ওজঃ নিয়েই তো পরবর্তী কালের তামাম হিশেবে নিকেশ, ভাবপ্রকাশের স্বাচ্ছন্দ্য, সমৃদ্ধি ও আনন্দ। তো, আমার প্রথম মুঠ মেরে দিয়েছিল, আমার চেয়ে দেড় বছরের বড়ো, মেজদা। সেবছর আমি ক্লাস নাইনে, তখনও ভাবতাম মেয়েদের একটাই ফুঁটো। এমনধারা বোকা ছিলাম আমি। তখন মনের মধ্যে, শরীরে যৌন জ্ঞানবিজ্ঞান উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে সদ্য, চুপিসারে, প্রত্যূষার আলা ফুটিবার পূর্বলগ্নে সোনার শাড়ি পরিহিতা ঊষাসুন্দরী দিগম্বরে দেখা দিয়েছেন সবে। এসব জ্ঞানবিজ্ঞান আসেও দিব্বি, মনকে জানান না দিয়ে, চোরাপথে। রঙিন ফানুস, খাট্টা আমচুর, মিঠে লংকা আর ফেনানো ঘামাচি নিয়ে। আর এসব যৌথবদ্ধভাবে এলে শরীর ঢ্যামনা আর তিষ্ঠোতে পারে না। তখন শুধু ঝড়। থেকে থেকে ঝড় আর বাওয়া ডিমের মতো বেমালুম বেমতলব বারিপাত। এই সময় হঠাৎই দৈবযোগে হাতে এসে যায় নবকল্লোলের একটি শারদ সংখ্যা। আমি প্রথম স্বহস্তে মাস্টারবেট করি ওই শারদপত্রে ছাপা হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাবিত্রী বৈষ্ণবী’ নামের একটি অতি হাস্যকর অথচ রগরগেতম নভেল পড়ে। কালক্রমে আমার মাধ্যমিক টাইমপাসের অমোঘ সঙ্গী হয়ে দাঁড়াল ওই বৈষ্ণবী। গোটা উপন্যাসে যে দ্বাদশ দফা দ্বাদশতর বিধিতে ধর্ষিত হয়ে শেষে বৈষ্ণবী হয়ে হাঁফ ছাড়ে। কিন্তু এহেন বিপাকে একাধিক প্রেমিকা নাহলে তো জীবনের উপহাস, সেটা অবশ্য পেতে পেতে স্নাতককোত্তর বয়স পর্যন্ত ওয়েট করতে হয়েছিল। তোমাদের একালে কামমহারাজ এতখানি ওয়েট করান না। তারপর মধ্যবিত্ত বাড়ির বাঙালি ছেলেদের একমাত্র যা কৃত্য, অর্থাৎ প্রাইভেট টিউটার হয়ে নীড়ে নীড়ে নীড়খোঁজা পাখির তালাশ। আমার জীবনে, সেই এক-দেড় বছরে, বললে বিশ্বাস মানবে না, গুণে গুণে উনিশটি অন্তত কন্যা আমার তরুণীর বৈঠা বয়েছিল। হ্যাঁ, তখন রেগুলার ডায়েরি লিখতাম। আজ কে হাঁ চোখে চাইল, আজ কে হাত ধরতে দিল, কার জামার তলায় হাত ভরে শিউলি কুড়োলাম, সবই। কিন্তু, বিশ্বাস করো, তখনও অবধি, ঐ তুমি যাকে নথ ভাঙা বলছ, সেটা ঘটেনি। দেখতে দেখতে জীবন একজাই পালটি খেয়ে গেল। এক অতি ঘোর মধ্যরাতে আমি বাড়িছাড়া হলাম। গিয়ে উঠলাম প্রেরণার বাসায়। তারপর দীর্ঘ ছ-বছর আর বাড়ি ফিরিনি। প্রেরণার সঙ্গে আমার লিভ টুগেদার গোছের একটা কিছু হয়েছিল। শেষাবধি সেটা সেই পচা সংসারের ছকেই বাঁধা পড়ে গেল। ব্যস, এই পর্যন্তই বলা গেল। সুযোগ সময় মতো আমার জীবনের অন্য নারীর গল্পগুলোও একদিন শুনবে।

যৌনতা এবং স্ল্যাং এমনই দুটো টুলস্ যা সবাই জানে এবং ব্যবহারও করে কিন্তু বিস্তর ছোঁকছোঁকায়, এখন তুমি যখন ২০০৩ এরযৌনতার নবমুক্তি‘- পর ২০০৬ আবারযৌনতা: সমুচয় তত্ত্বতালাশএবং ২০০৫ছোটলোকের শব্দলোক‘-এর পর ২০০৭ আবারবাংলা স্ল্যাংবের করলে তখন কী প্রাণনা ছিলযৌনতাখিস্তিখাস্তার সুড়সুড়ি দিয়ে বাজার দখল? নাকি সমাজের জড়তাকে ধাক্কা দেওয়া? নাকি ব্যক্তিগত সো কলড পার্ভার্সন?

যৌনতা শুনলে মনে হবে স্বাধীন কল্পনার চান্স নেই— যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতং গোছের। বাংলায় তাহলে যৌনতা বা যৌনতাশ্রিত ভুরি ভুরি লেখার নজির থাকত। কিন্তু, তা তো আর নয়। বাংলায় যে কজন বিরল লেখক যৌনতাকে আশ্রয় করে লিখেছেন, এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা যৌনতাকে হাজির করেছেন as they ought to be. শিল্পে-সাহিত্যে যৌনতা শুধু বাহ্যদৃশ্য বা ঘটনা নয়, তার তিনটে বিষয়— চরিত্র, আবেগ আর ক্রিয়া। এগুলো ভেতরকার জিনিস । যে-কারণে পাকা লেখক-শিল্পীদের সাহিত্য-শিল্পে ‘যৌনতা’ বিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবন, জীবনের মানসিক, আত্মিক আর দৈহিক আচার। আমার লেখায় সেটা এসেছে wit, taste, imagination, fancy, feeling এসবের বাহনে চড়ে। সেখানে কোনো অশ্লীলতা বা পর্ণোগ্রাফি নেই। আমার কোনো উপন্যাস পড়ে, কোনো পাঠকেরই শিশ্ন কিন্তু একটি বারের জন্যও স্টিফ হয়নি। বাজ অব্দি করেনি, এক বারও, নট ইভন আ সিঙ্গল মিলিমিটার। তাছাড়া আমি মনে করি, এখনকার বাংলা উপন্যাস-গল্পে যৌনতাকে হাজির করা হচ্ছে কেবলমাত্র সুড়সুড়ির অনুষঙ্গ হিসেবে। পাঠক জেনে বা না জেনে তাতে গোত্তা খাচ্ছে শুধু। চারিদিকে প্রকৃত যৌনতার হাহাকার, আমাদের দেশের প্রাচীন যোজনগন্ধ আজকের নরনারী সম্পর্কে কোথায়! আজ যৌনতা অনেক বেশি কৃত্রিম। ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন্স-এর সেখানে কোনো স্থান নেই। অথচ যৌনতা নিয়ে লেখালেখি ব্যাপারটা সৃজনশীল কল্পনা বৃত্তিরই কাজ। তা বাস্তবের হুবহু অনুকরণ বা প্রতিরূপ নয়,— যৌনতার অন্তর্বস্তু লেখকের মনে যেভাবে প্রতিভাত, তারই প্রেজেন্টেশন্। লেখার যাদু লেখকের বুদ্ধিতে নয়, অনুভবে, কল্পনাবৃত্তিতে। শিল্প সত্যের রূপাভিব্যক্তি, সত্যের ধারণামাত্র নয়। আসলে, অভিজ্ঞাত অভিজ্ঞান থেকেই যৌনতাকে দেখা দরকার, নচেৎ অন্যান্য দেখাদেখির মতোই যৌনতার জগৎটা কিন্তু অন্ধকার আর মায়ায় ঢাকাই থেকে যাবে। মায়া সৃষ্টিতে দক্ষ না হলে বড়ো সাহিত্য হয় না। এটাই হল, অমিয়ভূষণের ভাষায়, সত্ত্বগুণ। যৌনতাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা খুব দুরূহ। সবাই পারেন না। এটা এস্থেটিকের ব্যাপার। এটা আঠারো শতকের আগে অব্দি পিলপিলে পর্যায়ে ছিল। আঠারো শতকে এসে প্রথম শব্দ পাচ্ছি ‘এস্থেটিক’। যদিও ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশনের অটোনমি সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত যৌনতা নিয়ে খাঁটি এস্থেটিকের জন্ম হয়নি। ভেবে দ্যাখো, বুডিজম গিলেই কিন্তু ভারতবর্ষ সেক্স ভুলেছিল। ভুলেছিল রসশাস্ত্র, মুদ্রাব্যবস্থা, বাণিজ্য। সমাজের এলিট তবকা রাতারাতি মেতে উঠেছিল স্যালভাশনের ঠেকায়। তিন-চারশো বছর ধরে আকখা মুলুক জুড়ে শুধু চৈত, বিহার আর ধর্মসংঘ। রতি-রস-মুদ্রা-বাণিজ্য রসাতলে গিয়ে জেগে রইল, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা ছিল শ্রেষ্ঠ আকর সেই বেদ-এর বিরোধী এক ধর্মসার দর্শন— ‘বুদ্ধতত্ত্ব’। সমাজ তাতে কী পেল? ঘণ্টা। বরং হারাল অনেক। দেব-দেউল পুতুলডলে দেশ ভরল, সেক্স-পরিপন্থী সমাজে নেমে এল ঘোর নষ্টেন্দুকলা,— পারভারশান, ফ্রিজিডিটি, নন-কাল্টিভেশন আর ইনারশিয়া। এমন এক দুরূহ বিষয়কে নিয়ে লেখালেখি, একে তুমি নিছক বাজারদখলের আসবাব ভাব? আর আমার স্ল্যাং অন্বেষার কথা বলছ? এর পেছনেও আমার আত্মিক আৰ্জ। কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে, স্ল্যাং নিয়ে বাংলা ভাষায় সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা খুব-একটা দেখা যায়নি। এ-ভাষায় কোনো নির্ভরযোগ্য স্ল্যাং-অভিধানও এযাবৎ গ্রন্থিত হয়নি। এর পেছনে ভয়, লজ্জা, কলুষিত হবার আতঙ্ক— কী কাজ করছে? মানুষের নিজের কাছে কোনো লজ্জা নেই। নিজের ভেতর সম্পূর্ণ নগ্নতা সে কতবার মেলে ধরে! ইদানিং যৌনতার, কামনার অলিতে-গলিতে কত নিপুণ ও স্মার্ট হাঁটাচলা! কিন্তু সেই অন্তঃকরণ পদ্ধতি সে যখন তার দক্ষতায় যোগ্যতায় খুঁজে এনে শিল্পে বসায়, তখন তাকে রক্ষণশীল পাঁচিল বলে তার প্রকাশকে বন্ধ করে দেয়। হয়ত ‘ভয়’ই কাজ করে তার পেছনে। সৃষ্টির উদ্ভব রহস্য, উৎপাদনের গূঢ় গলি খুলে যায় তবে অনেক না-জানা না-দেখা মুখোশহীন মুখ ধরা পড়ে যাবে। পাশ্চাত্যের এনলাইটেনমেন্ট আর আর্থসমাজ আমাদের যে লবেদা পরিয়েছে তার দৌড়ে আমাদের প্যাকেজিং হয়েছে আধুনিক। তাই বোধহয় এতদিন বাংলা স্ল্যাংয়ের অর্থ সংকোচন, অর্থবিকার, বিবর্তন, তার ইতিহাস ও ব্যাকরণের গলিঘুঁজি নিয়ে যথাযথ বা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন ছাড়া ‘স্ল্যাং’গুলোর সংকলনে কেউ এগিয়ে আসেনি। মধ্যবিত্ত মাফিয়া শাসিত বাংলা সাহিত্যের বড়ো বড়ো প্ৰতিষ্ঠানগুলির ঐতিহাসিক নিশ্চুপতার কারণ তবু কিছুটা আন্দাজ করা যায়। অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিনের দুনিয়ায়, খুব নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তির সাধ আছে তো সাধ্য এই। আবার, বিদ্যায়তনিক বা আকাদেমি-স্তরে? — অজয়ের চরে সেই বিলম্বিত কচ্ছপগতি। সেখানে আবার সর্ষের মধ্যেও ভূত গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। পূর্বাচার্যদের বিরাসৎ ও চলমান স্রোতের বাইরে সম্পূৰ্ণ একক প্রয়াসে একজন গদ্যকার বাংলা স্ল্যাং নিয়ে কতদূর ও কী কী ভাবতে পারে— তার দৃষ্টান্ত ‘বাংলা স্ল্যাং: সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি’ গ্রন্থটি।

স্থানিক অতীত ঐতিহ্যের প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গী কীরকমমুগ্ধতার?… অতীত কি কোনো ওয়াণ্ডারল্যান্ড? বর্তমানের ক্ষতর শুশ্রূষা? তোমার ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালি বইটির সাপেক্ষে জানতে চাই

বুঝেছি। তুমি প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে ছুঁড়লে, যাতে তোমার সমর্থনেই উত্তরটা বুমেরাং হয়। না, ব্যাপারটা অত সহজ বা সোজাসাপ্টা নয়। ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ ছিল মানভূম বিভাজনের প্রথম ঐতিহাসিক প্রতিবাদ, আর তিন খণ্ডে ‘ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালি’ হল ধানবাদের বাঙালি-গৌরবের প্রথম সামাজিক প্রতিবেদন। দুটোতেই, বিশেষত দ্বিতীয় বইটিতে একদিকে চেনা ধানবাদের অচিন ঝাঁকিদর্শন যেমন মিলবে, অন্যদিকে তেমনি ধানবাদের একশো বছরের ইতিহাসকেও অনায়াসে ছুঁয়ে ফেলতে পারবেন পাঠক। আর, এদিক থেকে দেখলে, বঙ্গ-ইতিহাসের একটি অতিশয় ধনাঢ্য পরিচ্ছেদকেও সুস্পষ্টভাবে ধরতে পারবেন গবেষকরা। কোনো হীন নস্ট্যালজিয়া অথবা ছেঁদো সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট এই দুই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়। ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে আঞ্চলিক ইতিহাস-চর্চার একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। দেশের জাতীয় জীবনের মূল সুরটি অবিকৃতভাবে খুঁজে পেতে হলে এহেন আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার প্রয়োজনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কোনো অঞ্চল-বিশেষের প্রাচীন জনজীবন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে বিবরণ সংগ্রহের শ্রমসাধ্য কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হলে সেই ইতিহাসেই দাম আরও বেড়ে যায়। আগেই বলেছি, মানভূম বিভাজন আমার কাছে আজও এক প্যাং বা ট্রমার সমতুল। আমি কলকাতা বা বীরভূম বা কোচবিহারে জন্মালে ধানবাদের ইতিহাস লিখতাম না। সেই নিষ্ঠুর, করুণ, যাতনাময় ব্যবচ্ছেদ আজও আমাকে ব্যথিত করে। নিছক ব্যক্তি, সমষ্টি বা স্থানের ইতিহাস নয়, নিজের মাতৃক্রোড় ধানবাদের ফিরে না যেতে পারার সেই ঐতিহাসিক, দীর্ঘস্থায়ী ও পিরেনিয়াল ক্ষতই আমাকে দিয়ে এ দু-টি গ্রন্থ লিখিয়ে নিয়েছে।

অজিতদা, রত্নিসুখের একক উপপাদ্য উপন্যাসে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের বিবিধ সংকটের কথা বলেছ, ধানবাদে বসে শহর করতে গিয়ে কী যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তাই কী এই উপন্যাসের প্রত্নকাঠামো

উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে অনেকের প্রশ্ন, সংশয় লক্ষ করি। সেটা বললেই কাহিনির আভাসও পেয়ে যাবেন পাঠক। এই রচনার উপপাদ্য একটি পত্রিকাকে ঘিরে প্রবীর মজুমদারের প্যাশন, তার পাগলামি, যৌনতা, যৌনসম্বন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। নামটা, আমি চেয়েছিলাম এসবের সম্মিলিত ব্যঞ্জনা হোক। ‘মুঠ’ শব্দটা পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু ওটা নিলে পাঠক নিছক মাস্টারবেট মনে করবেন, তাই পরিহার করলাম। এরপর দেখলাম, মুঠমহাত শব্দটা পাচ্ছে। তার বাঁয়ে ‘রত্নি’ ও ডাহিন ভাগে ‘প্রগণ্ড’। ভারি ভালো লাগে, প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম বলা যায়, এরমধ্যে, ‘রত্নিসুখ’ কথাটার। দেখলাম, লেখালেখির প্রতিশব্দ হিশেবে এটার কোনো বিকল্প হয় না। এই যে সুখ, বা হস্তব্যসন, এরচে এলিজিয়ান প্লেজাৰ বুঝি দ্বিতীয় নেই। ঝক্কিদার স্তন, যোনি বা আস্ত একখানা নারীতেও পুরুষের শখ ও সুখ পরিমিত হতে পারে, কিন্তু মেঝেতে জানু পেতে নীল ও অবহস্তে, অথবা, বিছানায়, বুকে বালিশ গুঁজে, এই যে আত্মরতি, স্বীয় অষ্ঠিবান স্বহস্তে ধারণ ও সঞ্চালন, এর বুঝি সত্যিই দোসর নেই, এ সুখের। জীবন-জুড়ে শরীরীভাবে কবীর যাই করুক, কিন্তু লেখালেখিকে সে রত্নিসুখই মনে করে। সে বলে, লেখা-ফেকার মতো মগজমারির কাজ খালিপিলি আত্মদান-ফান দিয়ে হয় না। আত্মরতি মাস্ট। পরিধি কবীরের বাক্যগুলিকে মনে করত ইচ রুপি হানড্রেড। কবীর বলত,— লেখক জীবনে যা বলবে, করবে, সে কি বাড়িতে বসে স্রেফ ‘লিখে-টিখে’ সে-সব বলবে-করবে? মানে, জীবনের যাবতীয় করা-ধরা, ঝাল ও যন্ত্রণা, অপমান ও গ্লানি, তরাস ও সঞ্জীবন, তেজ ও আক্রমণ, প্রতিরোধ ও সন্ত্রাস, বিবেচনা ও ঠাকুরসেবা, স্রেফ আমার এটার ফোরস্কিনে একটু ইয়ে থাকলেই, কী-যেন বলে, এক-চিলতে ইয়ে, মানে একটু লাইফ, মানে একটু লুব্রিকেশন থাকলেই হলো,— তুমি আমারে গলায় ধাক্যান মাইরা বাহির কইরা দ্যাও,— তবু আমার রক্ত পুঁজ ঘাম ক্রোধ জ্বালা, ইভন যৌনতা, সব লিখে দিয়ে যাবে, আমার এটা, আমার এই এটা, অর্থাৎ কলমটা। এটার ডগায় অল্প ইয়ে থাকলেই হলো।… এবং জাগরণে, নিদ্রার ভেতর থেকে ডুকরে ওঠার মতো-করে সে এ সব বলে। শোনে পরিধি। তবু পরিধি শোনে। না-না, ভুল বললাম, পরিধি, তাহার, সকল কথা ‘পাঠ’ করে। কবীরের সব কথাই তর্কাতীত মনে হয় তার। অই দ্যাখো সোহাগী কেমন বিলি কেটে দিচ্ছে শয়তানের চুলের মাথায়! কথায় কথায় শরীর হতে খসছে যত এঁটেল প্রেম, জেলি আর বনমাছ ফকাফক শব্দ ছিঁড়ছে অন্ধকার উড়ছে ফাকিং হাওয়ায়, আর গোখরোর হিসের মতো রাত ও রত্নি জমে-জমে একশা। শেষে বলি, হ্যাঁ, কবীরের পত্রিকা ‘ব্রা’ আর আমার ‘শহর’-এর প্রেক্ষাপট, চরিত্র, সাফল্য, ব্যর্থতা সবই মিলে যায়।

ধানবাদে সুভাষচন্দ্র নামে তোমার একটা বই আছে, তাঁর আদর্শ সম্পর্কে কী মত তোমার?

খানিক হামবাগ হবার চান্স দিলে তুমি, শুভম। আমার লেখালেখির জার্নিটার দিকে খুচলে দিলে পাঠকদের কেটরাক্ষ। হ্যাঁ, একদিকে ‘যোজন ভাইরাস’, ‘জোখিম কোরকাপ’,  ‘নিরুজের রক্ততৃষা’, অন্যদিকে ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’, ‘হিরণ্যরেতাঃ’, আবার আরও অন্যদিকে ‘বাংলা স্ল্যাং’, ‘যৌনতা’, ‘অজাচার’— এই যে ব্যাপ্তি, এ সচরাচর একজন বাঙালি ক্রিয়েটিভ লেখকের দায়রায় থাকে না বলেই মনে হয়। এ যেন প্রাচীন গুহা থেকে মেট্রো ট্রেনের সফর। এক সীমান্তের তুলসী নিকেতন থেকে আরেক সীমান্তে আরবসাগর ছুঁতে চাওয়ার ইহা। ইহা কজনের থাকে, এই ভূতরোখ? অবশ্য, এখানে আবার সেই কৈফিয়ৎই রিপিট করতে হচ্ছে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র যদি ধানবাদে না আসতেন এবং দীর্ঘ বারো বছর এখানকার শ্রমিকদের জন্য কাজ না করতেন, আমি নেতাজীকে নিয়ে হয়তো কিছুই লিখতাম না। কিন্তু এ আমার ধানবাদ ও ঝাড়খণ্ডর সঙ্গে জড়িত এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসেরই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। তাই এরকম বইও লিখেছি। এই বইয়ে এমন অনেক তথ্য দিয়েছি যা কলকাতিয়া পণ্ডিত-প্রবররা উল্লেখমাত্র করেননি। এদিক থেকে এই বইটি আলাদা গুরুত্ব দাবি করছে বইকি। এক আন্তর্জাতিক স্তরের নেতা, যাঁর সমকক্ষ মহান পুরুষ ও দেশসেবী এদান্তি সম্ভবত আর একজনও নন, বিশ্বের বিরলতম মহান ও ক্ষমতাবান নেতাদের সঙ্গে যাঁর তুলনা, সেই বিশ্ববরেণ্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ধানবাদের মজুর শ্রেণী তথা সাধারণ মানুষের একান্ত আপনজন ছিলেন। কংগ্রেস বা ওই সর্ববিদিত গুজরাতি বেনিয়ার তুলো-চরকা আর অহিংসার নিরীহ গুড়গুড়ি খুব বেশি আচ্ছন্ন করতে পারেনি সেদিনের ধানবাদবাসীদের, তার আগেই নেতাজী সুভাষচন্দ্রের দৈবিক ও বিপ্লবাত্মক প্রতিভার জাদু গ্রাস করেছিল কয়লাকুঠির এই দেশকে। ১৯২৭ সালের ২২ অক্টোবর সুভাষ প্রথম এসেছিলেন ধানবাদে। তারপর দীর্ঘ ১২ বছর ধরে, অর্থাৎ ভারতবর্ষ থেকে তাঁর অন্তর্ধানের ঘটনাটি অবধি, ধানবাদের মাটিতে তাঁর নানান কর্মকাণ্ড। সত্যি বলতে, অন্যান্য দেশনায়কের তুলনায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে মানভূমের রাজনৈতিক ইতিহাসের যোগ অপেক্ষাকৃত নিবিড় ছিল।

ঘামলাঘট স্ল্যাং নির্ভর উপন্যাসসাবঅলটার্ন ডায়ালেক্ট প্রভূত পরিমাণেএর পিছনে জীবনঅভিজ্ঞতা পাঠঅভিজ্ঞতার মিশেলটা কেমন ছিল?

বাংলা বাজারে ইদানীং বহু সিরিয়াস বিষয় নিয়ে বই বেরোচ্ছে। কিন্তু এখনও এ ভাষায় বহুল পরিমাণে উপন্যাসের নামে যা লেখা হয় তা মূলত প্রেম ও সেক্স, দুটির সুড়সুড়ির হদ্দ অবধি। যেন এর বাইরে কিছু লেখবার নেই। টুলোদের মতে, বাঙালি লেখকদের এর বেশি এক্তিয়ারও নাকি নেই। মানে ঐ সুড়সুড়ি, ক্কচিৎ খৈনির দু-একটি চাপড় বড়জোর; শার্ট-প্যান্টুল পরা শীর্ণ-নিতম্বের বাঙালি লেখকদের (নাকি) এর বাইরে বেরুবার এলেম-ও নেই। এহেন অবস্থায় স্ল্যাং অবশ্যই উপন্যাসের বিষয় হতে পারে না। স্ল্যাং-এর এক্তিয়ারে নেই উপন্যাসের বিষয় হবার। তাই তো? অন্তত তাই অ্যাদ্দিন ভাবা হয়েছে, যে, ভাষা শব্দাদি যদি বিষয় হয় তা পণ্ডিতদের সংকলকদের ভাষাবিজ্ঞানীদের ব্যাপার। আমার ‘ঘামলাঘাট’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল কেবলমাত্র একটি স্থূল ভাবনার লেজুড় ধরে, যে, এমন উপন্যাস কি লেখা যায় না যা হবে অস্তিত্বনাশা স্ল্যাং-এর মরমি মুখপাত্র? কনটেন্টে এবং ফর্মে— উভয়ত? যদি বাংলা ভাষা লোড সামলাতে পারে ভালো নতুবা ঘামলাঘাট। আসলে, বুঝতে হবে স্ল্যাং কারে কয়। স্ল্যাং কারেও কি না। ‘স্ল্যাং’ শব্দটা যে কয়নেজ করেছিল তার অন্তত একটা রামরদ্দা পাওনা ছিল। সে হারামিটা নিগঘাত ভদ্দরলোক ছিল। ভদ্দরলোক মাত্রেই পিলহারামি। আমার খুব ছোটোবেলা থেকেই অভিধান অতি প্রিয় টাইমপাস। দেখি যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য মারাবার জন্য শব্দের স্টক খুব হ্রস্ব। যখন নিজে লেখালেখি শুরু করলাম, জেদ ধরলাম, আমি মাল তুলব সলিড জমি থেকে, কাঁকড়বাঁকড় সুদ্দু, ঘাস-আগাছার দানাও লেগে থাকবে তাতে। আর, মেইনলি বাংলা মালের ঠেক, রাস্তাঘাট, রাত বারোটার রাত, সেভেন ইয়ার ইচ, বেশ্যাখনি আর প্রাত্যহিকের পেট-লড়াই— এইসব হবে আমার লোডিং পয়েন্ট। কেননা, মাটি ছাড়া তো সাহিত্যের দানাপানি অন্য কারো জোগাবার কথা নয়। এই গোঁ থেকেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ঘামলাঘাট। বলা বেশি, এই উপন্যাস আমার সাব-অলটার্ন ভাবনাচিন্তার সবচেয়ে কাছের প্রতিভূ। আমার লেখক-জীবনের নির্যাস। আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর জীবনের বেদ একাকার হয়ে মিশে আছে এই উপন্যাসে।

ঘামলাঘটের ঢ্যামনাদার মত চরিত্রের হাতে প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস কিন্তু ব্যক্তিমানুষ যেখানে প্রতিষ্ঠান সেখানে তোমার লড়াই কি অজিত রায়?

একটু আগে যে-কথাটা বললাম। লেখককে মাটির তলাট থেকে শব্দ ওঠাতে হবে, লোড করতে হবে। তবেই স্প্রেড করবে সাহিত্যের বাচ্চাদানি। প্রান্তে আর সীমান্তে পড়ে রয়েছে থাক-থাক শব্দ, সেগুলো উঠে এসে মাত করে দেবে বাংলা সাহিত্যকে। ছারখার করে দেবে মসনদী (পড়তে পারো, ‘প্রাতিষ্ঠানিক’) শব্দের মনোপলি লটঘট। বিদ্যায়তনের শিক্ষিত হায়ার-ক্লাশার বামুন-কায়েতদের নাক-সিঁটকানো খাটা পায়খানার ওই উপচে-পড়া মলও হবে লেখ্য। সমস্তই সাহিত্যের স্বার্থে। সুয়ো শব্দরানীকে পাষণ্ডর মাফিক আক্রমণ করবে দোয়ানিয়া শব্দের রামদা। মিনিটে চল্লিশ সুয়ো-শব্দের তালিবানি বোরখা নুচে একশো দুয়োশব্দের অসহ খেমটা উত্ত্যক্ত করে মারবে ভদ্দর-সাহিত্যের তামাম লটরপটরকে। …. কিন্তু, এটা করবে কে? কে করতে পারে? ওই ভদ্দরপুঞ্জের দালাল-লেখকদের দিয়ে বাল হবে। হাল ধরতে হবে খোদ, যাঁদেরকে ওরা বলছে ছোটলোক, তাঁদেরকেই। প্রভুর শব্দভাঁড়ারকে সাবাড় করে একেবারে নতুন, অব্যবহৃত, আনকোরা শব্দের সাঁজোয়া নিয়ে প্রবেশ করা তাঁরই পক্ষে সম্ভব যিনি ঐ প্রভুর সেবাদাস ওরফে শব্দ-পালকদের সমান বা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান— অথচ নিম্নবর্গের এবং বিত্তহীন শ্রেণির। একমাত্র সেই নিচুতলার গাড়োয়ানই পারবেন শব্দের চাবকানি দিয়ে আদুরে কন্ডোমের পিলপিলে ছালটাকে উখড়ে বাংলা সাহিত্যভাষায় নতুন দ্যুতি ফিরিয়ে আনতে। আমোদহাট প্রতিষ্ঠানের পাছায় লাথি মেরে বেরিয়ে আসা ঢ্যামনাদা হলো এই উপন্যাসে সেই ভগীরথ। এবারে, ‘প্রতিষ্ঠান’ ইত্যাদি বিষয়ে আমার অন্যতর মতামত আছে, পরে কোনোদিন বলব। আজ এই পর্যন্ত।

বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা .কে. রায়ের জীবনকে আশ্রয় করে লিখেছিলে হিরণ্যরেতাঃ উপন্যাস তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেকেমন ছিল তার সঙ্গে আলাপ?

২৫ মে ১৯৩৫ থেকে ২১ জুলাই ২০১৯, এই ছিল আমার ‘হিরণ্যরেতাঃ’-র নায়ক রায়বাবু ওরফে অরুণকুমার রায় ওরফে এ কে রায়ের জীবনকাল। এর মধ্যে শেষের চল্লিশ বছর, অর্থাৎ আশির দশকের গোড়া থেকে তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি অবধি তাঁর সঙ্গে আমার ছিল একান্ত আত্মিক যোগাযোগ। তাঁর উত্থান ও অবসানের সমগ্রতা ঘিরে ছিল আমার নিভৃত উপস্থিতি। ধানবাদের পুরনো বাজার এলাকার টেম্পল রোডের হাড় বের করা সড়ক, নোংরা, ঘিঞ্জি, ঠাসাঠাসি দোকানপাট, যত্রতত্র গু-গোবর, পচা ফল ও আনাজপাতি, বাসি মাছ আর কাটা মোরগের ঠ্যাং-পাখনা— এ-সবের মাঝে একটি খাপরার চাল ছাওয়া অন্ধকার ঘুপচি ঘরে মেঝেতে চাটাই পেতে শুতেন তিন-তিন দফা বিধায়ক আর তিন দফা সাংসদ হওয়া কমরেড এ কে রায়। বাতি নেই, পাখা চলে না, বিজলির কোনো কানেকশানই নেই, এমন একটা ঘরে, দিনের পর দিন, প্রায় ৫০ বছর। লোকে বলে, পলিটিক্যাল সন্ত। আমি বলতাম,— না, আদপেই মানুষটা ব-কলমে বেজায় ঢিট ও একনম্বরের টেটন। লোকটার ছুঁচ-সুতো বলতে কেউ কোথাও নেই। গোবরছড়া দিতে কেউ নেই। কিন্তু ওষুধ ছুঁড়ে দ্যায়, ফল-দুধ খাবে না, সেবা-আদরও নেবে না। লোকটা ‘পাইয়ে দেওয়া’ রাজনীতি কোনোকালে বোঝেনি, তাই আর ভোট পায় না। পকেট হরদম গড়ের মাঠ। আরাম নেই, নেবে না। জিগ্যেস করলেই, স্মিত হেসে বলে, বিপ্লব আসুক, সব নেব। বিপ্লব আসেনি। শতশৃঙ্খল মোচনে নেমে স্বারব্ধ অপারগতার বেড়িতে বাঁধা অরুণের স্খলিত সত্তা মৃত্যুর আধ দিন আগে অবধি, অশীতিপর বয়সেও বিপ্লবের আশায় মূক ও বধির হয়ে জন্মান্ধের চাউনি তুলে ক্যালেন্ডারের অযথা উড়ন্ত পাতার দিকে চেয়ে বসে থাকত। কিন্তু, কেউ না জানুক, আমি জানি। কিছু জিনিশ যা কাছ থেকে দেখার নয়। দেখতে পাবার নয়। দেখা যায়ও না। যেমন সাহারা। যেমন আটলান্টিক। যেমন এভারেস্ট। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা তাঁর কিছুই দেখেনি। বস্তুত, রায়বাবুর ব্যক্তিত্ব সংঘর্ষ ও সংগ্রামের হব্যাশে ছাঁচ পাওয়া চব্বিশ ক্যারেট স্বর্ণের পর্যায়। হয়তো অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না, কী গ্রীষ্মে কী শীতে, তিনি এক বিদ্যুৎহীন জীর্ণ কক্ষে মেঝেতে শুধুমাত্র দরমা পেতে নিদ্রাগমন করতেন। এ জীবনচর্যা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ছিল অব্যাহত। তাঁর খাওয়া-দাওয়া ও বস্ত্র সংগৃহীত হতো কমরেডের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে। যখন যা জুটত হৃষ্টচিত্তে আহার করতেন। ছিলেন হাই ব্লাড প্রেশার ও সুগারের রুগি, কিন্তু নিতান্ত বেকাবু না-হওয়া অবধি শরীরের যন্ত্রণার কথা কারুক্কে জানতে দিতেন না। সদাই স্মিতহাস্য, বিনয়ী, মিতভাষী, মুখে বিরক্তির লেশমাত্র আর প্রকাশ পেত না। তাঁর কমদামি পাজামা-পাঞ্জাবি, জীর্ণ টায়ারের চপ্পল তথা বিদ্যুৎহীন বাড়িতে হতদরিদ্রের মতো যাপন— এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বরাবরই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। আদতেই তিনি ছিলেন কড়িফটকা। এম এল এ অথবা এম পি হিসেবে একবারও তিনি বেতন তোলেননি। তাঁর পেনশনের রাশি কোন চুলোয় জমা পড়ছে, তাও তিনি জানতেন না। প্রাক্তন সাংসদ হিসেবে গতকাল অবধি কোনোরকম প্রিভিলেজ নেননি। অন্যের স্কুটার বা বাইকের পেছনে বসে যাতায়াত করেছেন। একদা নিজস্ব সম্পত্তি বলতে একটি সেকেন্ড হ্যান্ড লজঝড় স্কুটার ছিল, যেটি কিনেছিলেন সাংসদ হবার পর, দিল্লির একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। আজীবন অকৃতদার রয়ে গেলেন, কারণ জানতে চাইলে লাজুক হেসে বলতেন, ‘কী করব বলো, লড়াই করতে করতেই সময় গেল, ফুরসৎই পেলাম না।’ বড়ো অসুখ, বড়ো যন্ত্রণা চারিয়ে দিয়ে চলে গেলেন আমার অরুণদা। হিরণ্যরেতাঃর অরুণদা। আমজনতার রায়বাবু, রায়সাহেব।

বাংলা স্ল্যাং: সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি বইটির পরিকল্পনা কখন মাথায় আসে…?… এই বইটি স্ল্যাংচর্চার বিশিষ্ট দলিলকাদের কাদের প্রেরণা ছিল এতে?

এর জবাব সম্ভবত আগেই দিয়ে দিয়েছি। বাংলা শব্দভাণ্ডারের ব্যাপ্তি এত বিশাল অথচ আমরা এখনো টুলোদের ধার্য্য করা দেড় লাখ শব্দ নিয়েই ঘোঁট পাকিয়ে চলেছি। এর বাইরে অজস্র শব্দ যেগুলো ব্যবহার করলে আখেরে বাংলা সাহিত্যেরই লাভ। কিন্তু সেটা চোখে পড়ে না। এছাড়া, দেখেছি বাংলা আভিধানিকদের মতো বাংলা স্ল্যাংকোষ নির্মাতা ও গবেষকরাও শব্দের ভেদাভেদ মানেন। সেই শব্দভেদই আমি নিজের ক্ষেত্রে পরিহার করেছি। স্ল্যাং বলে আলাদা কিছু হয় না, সবই শব্দ। এসব বোধ যবে থেকে মাথায় ঢুকেছে, আমি শব্দ আর স্ল্যাং নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি। ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাংলা স্ল্যাং নিয়ে বেশ কিছু বই বের করি। বাইরের প্রেরণা বলতে, যাঁরা স্ল্যাং নিয়ে পাঠককে উল্টোপাল্টা তাপ্পি পড়িয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এক চিরন্তন ক্ষোভই আমার এই কাজের প্রেরণা।

গুরুদাস চ্যাটার্জি তো অরুনকুমার রায় এর সহকর্মী ছিলেনমার্ডার হয়েছিলেনতার মৃত্যু পরবর্তী তোমাদের লড়াইয়ে কথা কিছু বলো মানে তোমার শহীদ গুরুদাস চ্যাটার্জি কী মার্মিক দাস্তাএর প্রেক্ষিতে

ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের প্রজ্জ্বলিত মশাল প্ৰখরতর করে তোলার ক্ষেত্রে সৎ সাহসী ও লড়াকু শ্রমিক নেতা শহীদ গুরুদাস চ্যাটার্জীর জীবন ও যুদ্ধ আমার শ্রদ্ধার মনে হয়েছিল বলেই হিন্দিতে বইটি আমি লিখেছিলাম, ‘শহীদ গুরুদাস চটার্জি কী মার্মিক দাস্তান’। খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম মানুষটাকে। ১৯৭৩ সালে নিছক চাকরি করবেন বলেই গুরুদাসদা পুরুলিয়ার চরপুটিয়া গ্রাম থেকে ধানবাদের নিরসা কোলবেল্টে এসেছিলেন। কিন্তু নকশাল আন্দোলন স্নাত তথা মার্কসবাদের মাদকাসক্ত হয়ে তিনি নিছক আট ঘণ্টার চাকরি করে জীবন কাটাবেন কেন? চাকরির পাশাপাশি এম-এল রাজনীতি এবং কয়লা শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজও চলতে থাকে। গুরুদাসের সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। জনতা আমলে কারামুক্ত নকশালদের কেউ কেউ খনি ও গ্রাম তল্লাটে গিয়ে নিপীড়িত মানুষদের জোটবদ্ধ করে বারদিগর পার্টিকর্ম শুরু করেছিলেন। অবিভক্ত CPI (ML)-এর মূল ধারার প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ-স্থানে ছিল বিনোদ মিশ্রর ‘সেন্ট্রাল কমিটি’। খনি এলাকায় নানান ছদ্মনামে বিচরণ করতেন বিনোদবাবু। নিরসায় পরিচিত ছিলেন ‘রাজুদা’ নামে। গুরুদাসের গোপন আস্তানায় রাত কাটাতেন। ততদিনে লড়াকু ও সৎ বামপন্থী নেতা হিসেবে গুরুদাসের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে, বেড়ে গিয়েছে কাজের বহরও। বিহার কোলিয়ারি কামগার ইউনিয়নের (BCKU) সদস্য ছিলেন। পরে এই সংগঠনের সম্পাদকও হয়েছিলেন। BCKU-এর ওপর মার্ক্সবাদী সমন্বয় সমিতির (MCC) এ কে রায়ের নেতৃত্ব ও প্রভাব থাকলেও তখনও অব্দি রায়বাবুর মতাদর্শে আস্থা গড়ে ওঠেনি গুরুদাসের, তলায় তলায় তিনি বিনোদ মিশ্রর প্রতিই সমর্পিত ছিলেন। কিন্তু রায়বাবুর অগ্নিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি অচিরেই ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হন গুরুদাস এবং সরাসরি MCC-র হয়ে কাজ করা শুরু করে দেন। গণমুখী কাজের মাধ্যমেই কালক্রমে গুরুদাস হাসিল করেছিলেন বিশাল জনানুগত্য। ফলত বিধানসভা নির্বাচনে নিরসা অঞ্চল থেকে MCC-র প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালে পরপর তিনটি ফলে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। ওঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো আমার, রায়বাবুর পার্টি অফিসে। দু-গালে হালকা দাড়ি, শান্ত ও সৌম্য চেহারা, আপাত শূন্যদৃষ্টিসম্পন্ন তথা স্বল্পবাক এই মানুষটি আমাদের কাছে ছিলেন প্রকৃত দাদার মতো, বিধায়ক হিসেবে ছিলেন বেপোট গোছের। কখনো কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। এমনকী সরকারি অন্যায়ের প্রতিবাদে একবার তিনি বিহার বিধানসভা থেকে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। এছাড়া নিরসা কোলিয়ারি অঞ্চলে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি, তাঁর সততা, তাঁর নির্ভীক, বেপরোয়া তথা লড়াকু মেজাজের দরুণ ভয়ানক সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল কয়লা-মাফিয়ারা। গুরুদাসের উপস্থিতি তাদেরকে প্রায় নপুংসক বানিয়ে ফেলেছিল। অবশেষে ১৪ এপ্রিল ২০০০, সেই শেষ দিনটি এল। সেসময় আমি জার্নালিজম ছেড়ে দিলেও, বামপন্থী শিবিরে এবং তাঁদের সভা-সমিতিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওই দিন, মানে ১৪ এপ্রিল ২০০০, কয়লা শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ফয়সালা নিতে কতিপয় ট্রেড ইউনিয়নের একটি যৌথ-বৈঠকে হাজির ছিলাম আমিও। বলা বাহুল্য, বৈঠকে সামিল হতে এসেছিলেন গুরুদাস চ্যাটার্জী। কিন্তু তাঁর বাড়ি ফেরা আর হয়নি। বৈঠক শেষে দুপুর দুটো নাগাদ একজনের বাইকে চড়ে তিনি রওনা দিয়েছিলেন নিরসার উদ্দেশ্যে। তার কিছুক্ষণ পরই আকাশে ঘনিয়ে আসে নিঝিম কালো ধূম। মুহুর্মুহু গর্জনিয়া ডাকে তোলপাড় চতুর্দিক। বাড়ি ফিরছিলাম আমিও, কিন্তু পুলিশ লাইন অব্দি গিয়ে কালবৈশাখীর ঝড় ও বারিপাতে সমুদয় আটকা পড়ে গেলাম। ঝড়বৃষ্টি ছাড়াতেই দেখলাম বাইকের পর বাইক, অবিরল বাইক ছুটে চলেছে গোবিন্দপুরের দিকে। আট-দশজনকে চিনতেও পারি, প্রত্যেকে MCC-র ক্যাডার। একজনকে থামিয়ে জানতে চাইলে, সেই ভয়ঙ্কর খবরটি জানতে পারলাম। গুরুদাসদা আমাদের ছেড়ে বেরিয়েছিলেন দুপুর দুটো নাগাদ। জি টি রোড ধরে সবে গোবিন্দপুরের দেউল অব্দি পৌঁছোতে পেরেছিলেন, কাঁটায় কাঁটায় তখন দুপুর ২টো ৪৫ মিনিট, হঠাৎ একঝাঁক বুলেটের বর্ষা তাঁর শরীরটিকে ফাঁড়ফোড় করে দেয় এবং মুহূর্তে লাশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে তাঁর দেহ। হাজার হাজার মানুষের মতো আমিও ভুলিনি গুরুদাসদাকে। প্রত্যেক বছর ১৪ এপ্রিল গোবিন্দপুরের দেউলিতে পালিত হয় শহীদ গুরুদাস চ্যাটার্জীর স্মরণসভা। দূর-দূরান্ত থেকে দলে-দলে ছুটে আসে মানুষের ঢল, ছুটে আসেন বামপন্থী নেতারা। ছুটে আসি আমিও, আমার কিছু বইপত্র নিয়ে। সাড়া পাই সম্যক। এবছর শুধু লকডাউনের কারণে তাতে ব্যত্যয় ঘটল।

ধানবাদ ঝাড়খণ্ডের ইতিহাস লিখেছ তুমি… ‘বহুবিকল্প ইতিহাস‘… সময়ই যার নায়ক, কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়কিন্তু ব্যাপার হল ক্রিয়েটিভ লেখকদের খুব কমজনই এধরণের কাজ করতে চানতুমি আগ্রহী হয়েছিলে কীভাবে

আগেই বলেছি, আমি ইতিহাসবিদ নই, ধানবাদে না জন্মালে আর এই আদি বঙ্গভূমির অংশটি মানভূম বিভাজনের ছুতোয় বঙ্গ থেকে জবরদস্তি ছিন্ন না হলে আমার এই জন্মভূমির ইতিহাস রচনায় আমি এতখানি মেধা, শ্রম ও সময় ব্যয় করতাম না। এই বইটি আমি নিজের জন্মভূমির ঋণ পরিশোধের মতো করে, ভালোবেসে, একান্ত অন্তস্থল থেকে লিখেছি। ক্রিয়েটিভ গল্প-উপন্যাস লেখকরা সচরাচর এধরনের কাজ করেন না। আমি করেছি। মূল লেখালেখিতেও তাতে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি হয়েছে। এই ইতিহাসের তথ্যের ওপর নির্ভর করে আমার বেশ কিছু উপন্যাস, যেমন ম্যাওড়া জোন, নভাক যামিনী, হিরণ্যরেতাঃ, গুরুদাস চ্যাটার্জির ওপর একটা উপন্যাস, এবং ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালির তিনটি খণ্ড তো লিখেছিই। এছাড়া একটা ফিল্ম স্ক্রিপ্টও লিখছি শিবু সরেনের জীবন নিয়ে, তারও ভিত্তিভূমি এই ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ এবং ‘ঝাড়খণ্ডের ইতিহাস’। কী বলবে এটা, একজন ক্রিয়েটিভ লেখকের পক্ষে মোক্ষম ডিভিডেন্ড নয়?

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসিতোমার লেখায় যেমন বিবিধ চিন্তার ছাপতোমাকে বইয়ে প্রচ্ছদ বিষয়ে তেমন চিন্তাশীল মনে হয় নাবই এর প্রচ্ছদগুলি দেখে নিয়ে কী বলবে…? এরই সঙ্গে জানতে চাই, তোমার প্রিয় চিত্রশিল্পী কারা? তাদের কাজ কীভাবে টানে তোমায়?

তুমি কেন পেইন্টিং বা ছবি আঁকার দায়রা দিয়েই বাঁধতে চাইছ আমার সামান্যযোগ্য শিল্পবোধের আখড়াটুকু? আমার ছোটোবেলার অনেকখানি জুড়ে ছিল মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ার খেলা, সে সংবাদ কে দেবে? পুজোর মরশুমে কাদা, খড়, কঞ্চি দিয়ে খুদে-খুদে দুর্গা-কালী। রং দিতাম, শোলার সাজ, চাঁদমালা, কদম। আর কলকেতলায় ছেঁড়া তেরপল খাটিয়ে পুরুতদের কপি করে ইং-বিং মন্ত্র। বড়োরা আড়ালে বলাবলি করত, ছোঁড়াটার ধম্মেকম্মে মতি তো বেশ! কে এক ভিক্কেজীবী সাধুবাবা মাকে বলেছিল, তেরা বেটা তেরা সাল কী উমর মে সনিয়াস লে লেগা। ঘণ্টা। তেরোতেই আমি চরম দুরাচারী আর ধর্ম-বিদ্রোহী হয়ে উঠি, পৈতে ছিঁড়ে ফেলি আর ছরছরিয়ে পেচ্ছাপ। সেসব ঘটনার সানুপুঙ্খ বিবরণ আজ হয়তো অবান্তর, তবে আমারও যে সামান্য শিল্পবোধ ছিল, তার সালিশি হিসেবে এই এনেকডোট নথিবদ্ধ থাকা জরুরি। একটু বড়ো হয়ে ছবিও এঁকেছি প্রচুর। বেশিরভাগই বাথরুম-সিঙ্গারের গানের মতো, তবে আমার কিছু কিছু ছবি বিভিন্ন কবি-লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদ হয়েছে। মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র গুহ, সোফিওর রহমান, ঈশিতা ভাদুড়ি, সুকুমার চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী, আরও কে কে এই মুহূর্তে মনে পড়ার যো নেই। উঠতি তারুণ্যে বেশ কিছু হিরোইনের ছবি এঁকেছিলাম। তাতে ‘সৃজন’ বলতে ছিল, কারো স্তন, কারো কপোল, কারো চিবুক, কারো কটি, কারো ঊরু এবং কারো বা জঙ্ঘা নিয়ে রচিত হতো এক-একটি তিলোত্তমা। ফলত, ছবিটি দাঁড়াত প্রাক্সিটিলিসের মডেলের মতো। যাঁর মূর্তিগুলো হতো সবিশেষ আলিঙ্গনযোগ্য। দর্শকরা বেদীর ওপর চড়ে মূর্তিকে জড়িয়ে ধরতে চাইতেন। তো, আমার ক্লাশ টেনে আঁকা এমনি এক তিলোত্তমার ছবি দুর্বিপাকে বাবার দৃষ্টিকোটায় পড়ে গিয়ে যা হালত হয়েছিল আমার, সে বৃত্তান্তও অনুল্লিখিত থেকে যাক। যদি মিথ্যে বলতে জোর না দাও, চিত্রশিল্প বিষয়ে আমার জ্ঞান যে অতিশয় শিশু-স্তরে, তা জানিয়ে রাখলাম। তবে ভয়ে ভয়ে বলি, ফরাসি কবি পোল ভালেরি যেভাবে বলেছেন, প্রাচ্য কলা সুখদা, আর গ্রিক শিল্প সুন্দর,— এটা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মান্য মনে হয়নি। ছবি বা ভাস্কর্য হুবহু অনুকরণ হলে তা কি সুন্দর শিল্প হয়ে ওঠে? তাহলে শিল্পকলা আর ফটোগ্রাফির মধ্যে ফারাক কী? গ্রিক শিল্প আদ্যন্ত প্রকৃতিপন্থী, মানে বাস্তবের হুবহু, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হুবহু বা সুষম সমন্বয়কে সুন্দর বলা ভুল। অন্যদিকে দেখি, আমার যেটুকু মনে হয়, ইন্ডিয়ান আর্টের মূল কথা হুবহু ইমিটেশন বা অনুকরণ বা নয়, ভাবনা— বরং তা ফ্যান্টাসিয়া, অতীতের ভারতীয় ভাষা ধার করে বলি, ‘ধ্যান’। তার আদর্শ বাস্তব বা প্রকৃতি নয়, অতিবাস্তব বা অতিপ্রকৃতি। আমার ভালো লাগে ভারতীয় শিল্পের এই বি-কৃতি, বি-নির্মাণ বা ডিষ্টর্শন। লেখায় যেমন জাদু-বাস্তবতা। তবে, কিছু কিছু পাশ্চাত্যের শিল্পী চোখ ও মনকে আবিল করেই। কিছু ভালো ছবি অবশ্যই দেখেছি। যেমন দ্য ভিঞ্চি, ভ্যান গঘ, পিকাসো, দালি, মিকেলএঞ্জেলো, রাফায়েল, রেনো, আরও অনেকের ছবি, সমস্ত নাম এই মুহূর্তে মনে পড়া গর্হিত বলেই মনে পড়ছে না, এঁদের ছবিতে অধিবাস্তবতা, অতিপ্রকৃতি, বিমূর্তি এ-সবের প্রতি সবিমুগ্ধ শ্রদ্ধা কখনো নিঃশেষ হবার নয়। শেষে বলি, হ্যাঁ, তোমার মতো আরও অনেকেরই অনুযোগ, আমার নিজস্ব বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যাপারে আমি তেমন চিন্তাশীল বা যত্নশীল হতে পারিনি। আসলে, এখন লেখায় এত ব্যস্ত ও মনোযোগী থাকতে হয় যে বইয়ের কভারে খাটতে পারি না। নিজে তো আর আঁকিও না। দায়সারা প্রচ্ছদ বেশ কিছু হয়েছে, অন্য কোনো শিল্পী আঁকলে বেশ হত। পরবর্তী এডিশনে অন্য শিল্পীই আঁকবেন, সে-রাস্তা খোলা।

 যোজন ভাইরাস’-এ ভাষা ছিল রগুড়ে এবং তীব্র, কিন্তু ২০১৫তে বেরোল নিরুজের রক্ততৃষা উপন্যাসের সেট্রাল যে চরিত্র সেই রক্তশূন্য মানুষটির মতই এর ভাষা ঝিমোনো এবং আত্মক্ষয়সংবেদী এখন এর আত্মজৈবনিক ইনফ্লুয়েন্স বা আত্মরতি আড়াল করা যায় না কিন্তুরক্ততৃষা কি রত্নিসুখের সাবলাইম ইটসেলফ তোমার মননে

একটা ছোট্টো কনফেশান সারি আগে। যদিও আমার বেশিরভাগ উপন্যাসই একই কন্টিনিউয়েশনের একের পর একটি ধারাবিবরণী, কিন্তু বেশির ভাগ পাঠকেরই ধারণা ‘যোজন ভাইরাস’ আমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। যাঁরা আমার গোড়ার দিকের লেখা পড়েছেন, তাঁদের অনেকের মতে ‘পাতিনা ওয়েসিসে’-র পর আর কিছু না লিখলেও আমি নাকি ‘বেঁচে’ থাকতাম। আবার যাঁরা ‘নভাক যামিনী’ এবং ‘হিরণ্যরেতাঃ’ পড়েছেন, তাঁদের চোখে ঐ-দুটি সেরা। কেউ বলেন, ‘যাতনাভূমি’। কিন্তু, আমায় যদি শোধাও, আমি বলবো, ‘নিরুজের রক্ততৃষা’। জী হাঁ, এটিই আমার বাছাইয়ে এক নম্বর। এটা সেই বিদগ্ধ পাঠকেরা বা আমি, কীসের ভিত্তিতে বললাম? স্রেফ ডিসকোর্স বা ভাষাপ্রযুক্তির দিক থেকে বিচার করে। নচেৎ, লেখকের গ্ল্যান্ডিউল তো একটাই, তাঁর আত্মা। জীবনের এতটা কাল আমি যে যে পরিস্থিতিতে জীবনকে বোধ করছি, আমার এক একটি উপন্যাস আত্মার সেই নিঃসীম তলাট থেকে উঠে আসা একধরনের ঠাস বাতাস, যা হার্টের পক্ষে মারাত্মক। এই ঠাস বাতাসকে হাপিস করতেই উপন্যাস নামক এই উদগিরণ। এই যে চাঁদমালার ঝলমলে ফ্ল্যাসবাতির তলায় আমার উপন্যাস নিয়ে পাঠক ও সমালোচকের পোস্টমর্টেম, তা কিন্তু আমি খুব গ্লকাস আলোর তলায় বসে লিখেছি। অনেকে আমার শব্দ বা ছুরিকাঁচির ব্যবহার দেখে মোহিত হয়েছেন, তাঁরা আমার আত্মার মরাকাঠের হিদিম পাননি। গদ্য, সে নিছক স্বর্গের ঘোড়া, মাটিতে নেমে এলেই ব্যালান্স গড়বড়। গদ্য তো কাহিনীর আবহ তৈরি করার জন্য, দ্য সিচুয়েশন হ্যাজ নো পোটেন্সিয়াল। যা পোটেন্সিয়াল, সেটি হলো সেই, আত্মা-নিমজ্জিত বিষণ্নতাগুলি, বেদনাগুলি, অবিকগুলি। সেটা কেউ ধরতে পারলেই লেখক হিসেবে আমার জলপানি। আমা হেন লেখকের বিড়ম্বনা হলো, তার কোনো হ্যালো নেই। আত্মজীবনের ছোটো ছোটো পরিচ্ছেদে ভাগ করা আমার এক একটি রচনা। স্মৃতি আর কষ্টের মাঝে কড়া যে সাজশ, সেই ফিকব্যথাই আমার সারাজীবনের অটাসটা। অন্তর্বেশ সমস্তই বেপর্দা। ‘নিরুজের রক্ততৃষা’ও তারই একটা খণ্ড, বা ফেজের বয়ান। আমার দেখাটাই এখানে বিবৃত। এ লেখাও, সে-কারণে, নিরপেক্ষ বা ইম্পর্শিয়াল নয়। আমার সেই মুহূর্তের জীবন ও যাপন যে যে কষ্ট বা যাতনায় বাহিত হয়েছে, গদ্যের মারফৎ সেই একান্ত বিবরণ বা ফয়সালাই জ্ঞাপন করেছে। সেই সেন্ট্রাল চরিত্রের, অর্থাৎ সেই রক্তাল্প স্বামী বা পুরুষের কেয়ার অফে। দাম্পত্যে প্রেম, প্যাশন, রোমান্স, ভালোলাগালাগি এসব সচরাচর তিরিশ দিন থেকে তিরিশ মাসের খেলা, অতঃপর নির্জিত। নির্জিত প্রেম কখনো কুহর কাটে না। তিরিশ মাসের পরও যা বেঁচে থাকে, এডজাস্টমেন্ট। প্রেম তখন পক্ষীরাজের ঘোড়া, যার হদিশ স্বর্গেও নেই, মাটিতেও নেই। সমাজে সমস্ত দাম্পত্য-সম্পর্কই যে এরকম, তা আমি বলি না। আমাদের চেয়েও ‘অফ-রিলেশানে’-র নিদর্শন আছে। আসলে দুজনেই রাজা। দুই পাগল রাজার রোখে রাজ্য ছারখার। কখনো যুদ্ধবিরতি যাপন করে পরস্পরে মিশে যায়। কে শত্রু কে মিত্র বোঝা দায়। একটু ওয়েট করো, আসছি। টয়েলেটটা কোনদিকে যেন! এই হয়েছে মনের অবস্থা। পেগটা ঢেলো না কিন্তু, আসি আগে। মালও তো কম দেখছি ….

অজিতদা, জন্মাবধি শহরে কাটালেশহরের সুযোগসুবিধা ভোগ করলেকিন্তু রূপকথা মগলাতে গিয়ে… “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও নগর / লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ প্রস্তরটাইপ গান কেন?… আর্বান অপরাধবোধ!!!

গোড়াতেই জানিয়ে দিই, ‘রূপকথা মগলা’ আদৌ কোনো শিশুতোষ আখ্যান নয়। এ আসলে সভ্যতার আগ্রাসন আর তার কান্নার প্রতিবেদন। মানুষের লৌল্যক্ষুধায় আজ আমাদের চারপাশের সমস্ত বন প্রায় শ্মশানভূমি। একদার শাল পিয়াল শিমুল কেঁদ-এর গহীন অরণ্য আজ আর নেই। নেই সেই বনের সহজ আরণ্যক-জীবন। বন্য পশুদের শেষ আশ্রয় আজ অবলুপ্তির কাঁধারে। পাহাড়-টিলার অন্দর-কন্দরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে স্বাধীন সেই জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য হাহাকার। এই কাহিনী সেই অশ্রুত কান্নার, হাজার বছরের বঞ্চনা আর অন্ধকারের। এ কাহিনি এক জাতিস্মরের, এক একক লেখকের, কিন্তু তার আবেদন আপামর সমষ্টির। এই হলো ভাবনাগত তথা গল্পগত প্রেক্ষাপট। কিন্তু, এ-সব রূপকথা তো আরও অনেকেই লিখেছেন। ‘দাও ফিরে সেই অরণ্যে’-র লেখকেরা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ-উপন্যাসের নয়াল যোজনা তাহলে কী? আমি এই উপন্যাসের গদ্য-প্যাটার্নের দিকটা খেয়াল করতে বলব। যাঁরা ‘রূপকথা মগলা’ ভালোভাবে পড়েছেন, তাঁরা মনে করেন উপন্যাসটির বিষয়-গদ্য প্যাটার্ন-ভাষার প্রয়োগ বারবার যেন উত্তরআধুনিক তত্ত্বের অধিকাংশ চাহিদাকে পূরণ করতে চায় । আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের বহু স্বতঃসিদ্ধ, স্বাভাবিক ধারণাকে প্রশ্ন করে উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব। যেমন এই যে ধরে নেওয়া হয়েছিল প্রকৃতিকে জয় করাটাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। তাকে ভোগ করা, নিজের প্রয়োজনে তাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা— এটা স্বতঃসিদ্ধ। আধুনিক মানুষকে বন্দনা করা হয়েছে এই বলে, যে, সে আর প্রকৃতির হাতের ক্রীড়নক মাত্র নয়। বরং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের কল্যাণে সে প্রকৃতিকে শাসন করতে, দখল করতে সক্ষম। উত্তর আধুনিকরা এই ‘স্বাভাবিক’ ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁদের মতে সব কিছুই মানুষ কী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে তার ওপর নির্ভর করে। কোন ডিসকোর্স থেকে সে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বুঝছে তা গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতাবাদী এনলাইটেনমেন্ট ডিসকোর্স মানুষকে প্রকৃতির প্রভু বলে নিজেকে ভাবতে শিখিয়েছে। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা এই জায়গাতেই কুঠারাঘাত দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ‘সভ্যতা’ বলে কিছু নেই। যুগে যুগে সভ্যতার অর্থকে নির্মাণ করে ক্ষমতা, প্রভুত্ব, প্রতিষ্ঠান। তাই সভ্যতার সংজ্ঞা বদলে যায়। ক্ষমতাহীনের কাছে যা সংস্কৃতি, ক্ষমতাবানের কাছে তাই-ই অসভ্যতা। যে আগে জেগে ওঠে, সে চায় অন্য সবাই জেগে উঠুকl সে নিজের জাগরণে তৃপ্ত থাকতে পারে না। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে যখন একটি সমাজকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, তখন লেখক চায় তাঁর লেখার মাধ্যমে সেই ঘুমিয়ে পড়া সমাজকে জাগিয়ে তুলতে। বেশির ভাগ সময়ই তিনি ব্যর্থ হন। বিশেষ করে তাঁর জীবৎকালে। পাঠক যখন জেগে ওঠে, তখন হয়তো লেখক মৃত। এই ভাবনা বা তত্ত্বের আলোকে ‘রূপকথা মগলা’য় আমি যা কিছু উপেক্ষিত, অবহেলিত, প্রান্তে নির্বাসিত, ক্ষুদ্র, পদদলিত, গৌণ তার মধ্যে খুঁজেছি প্রতিরোধকে। দীন-হীন জীবন্ত মানুষের বেঁচে থাকাকে, সুখ-দুঃখের কাহিনিকে, মহুলবনির মগলাকে, বুধনিকে, নগণ্য মানুষের বেদনাবোধকে। একজন লেখককে বুঝতে গেলে প্রথমে তাঁকে তাঁর পাঠকের ভিড় থেকে আলাদা করে ক্রমান্বয়ে পড়া আর পড়া এবং পড়া আর পড়া, পড়তে-পড়তে নিজের ধারণাগুলি মিলিয়ে যায়, পড়তে-পড়তে নতুন ধারণার শিষ গজায়, আবার পড়তে-পড়তে ঋতুর’ও পরিবর্তন ঘটে যায়, পাঠক পৌঁছে যায় শিল্পের ঋতুতে। সব লেখক পারেন না পাঠককে ঋতুময় করে তুলতে। কেউ কেউ পারেন ।

মানব চক্রবর্তীর লেখাতেও এই ব্যাপারটা

হ্যাঁ। শুধু মানব চক্রবর্তী কেন, কমল চক্রবর্তী, অনিল ঘড়াই, বিভূতিভূষণ, মহাশ্বেতা দেবী এমনি অনেকের লেখাতেই ব্যাপারটা আছে। সভ্যতার আগ্রাসন ও তার বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন প্রতিরোধ। কিন্তু এর মধ্যেও একটু ইয়ে আছে, সঞ্জীবচন্দ্র, বিভূতি, মহাশ্বেতা এঁরা জঙ্গল ও আদিবাসী জীবনকে দেখেছেন পুরোপুরি আউটসাইডার দৃষ্টিকোণ থেকে। কমল চক্রবর্তী দেখেছেন ইনার-আউটসাইডারের দৃষ্টিতে। কিন্তু মানব চক্রবর্তীর দেখা একেবারে ইনারসাইডারের চোখ দিয়ে। প্রকৃত ভুক্তভোগী না হলে তার অভিজ্ঞতার পানসেপনা পাতি পাঠকেরাও ধরে ফেলেন। সেটাই হয়েছে। সুখী-মধ্যবিত্ত সাহিত্য নির্মাণের অনুশাসন মেনে লেখার দরুন এঁরা আরণ্য-জীবন ও তার আকুতিকে ধুম্রাবৃত করেছেন, সেখানে ধরার ধুলোর স্পর্শ নেই। বিপরীতে, মানব চক্রবর্তী এবং আরও কেউ কেউ, যেহেতু একেবারেই আরবান নন, প্রচুর অংশে রাস্টিক, সুতরাং, কমলকুমারের ভাষা ধার নিয়ে বলতে পারি, ‘তিনি’ (পড়তে পারো, ‘তাঁহারা’), “শিবের কলমে লেখা ভাগ্য লইয়া আসিয়াছেন।”… “পিয়ারি, অন্নদাদিদি ইত্যাদি দেখিয়াছিলেন কি না তাহা ভবিষ্যৎ জানিবে না— জানিবে তিনি (তাঁহারা) বহুজন্মের পুণ্যফলে সাদা চোখে— শ্রীমাধবকে দেখিয়েছেন।” যদি একা মানবদাকেই টানতে চাও, বলব, ওঁর ‘ঝাড়খণ্ড ও তুতুরির স্বপ্ন’, ‘মারসাল হেমব্রম’, ‘ম্যাজিক ইনগট’ ইত্যাদিতে আদিবাসী, আরণ্যক-জীবন, কলকারখানা, যন্ত্রদানব, সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আক্রোশ, এসব বেশি পরিমানেই আছে। মানুষটার এই লেখকীয় প্রকৃতির সঙ্গে নিজস্ব মিল কিছু খুঁজে পাই বলেই, কেন্দুলির মেলায় পাশাপাশি হেঁটে বেড়াতে চাই একদিন।

মানবদার কথা ওঠায় মনে পড়লতোমারখানাখারাবউপন্যাসের কথামানবদার( মানব চক্রবর্তী)  প্রীতিকথন নিমডায়েরি নামে একটি উপন্যাস আছেযার বিষয়বস্তু অজাচার এবং অজাচারসংক্রান্ত মনোবিকলন খানাখারাবের বিষয়ও তো অজাচারএখন এই দুটো উপন্যাসের তুলনামূলক ভাবে বিচার করলে কী মনে হয় এদের পৃথগত্ব কোথায়?

“খানাখারাব” এক বখাটে যুবকের হারাকিরির গল্প। সে তার জীবনে জলতরঙ্গ খেলেনি ভুলেই গেছে কতকাল। ইদানিং দিনগুলো পেছলাচ্ছিল ফাজিলের মত। মনের চাঁপাফুলগাছ নাচ জুড়ে দিলেও মগজে পাষাণ হারামির শ্লেষহাস। প্রচণ্ড জালিম দুপুর, একটা কুকুর অব্দি নেই গলিটায়, শূন্য, দুপুরময় শুনশান পড়ে থাকে আমার শরীর, অনেকটা ঠিক সানথাল পল্লির ঘোলাটে পুকুর। ঝুটা পুড়ে খাক হচ্ছে, বিকেল শেষে, সন্ধের পর অল্প শুখা নেশা, ফের রাতটুকু নৈশ বাবুইয়ের শান্তবাসা। চাঁদের আলোয় ছাদের প্যারাপিট ধরে ঝুলে পড়া ফিউজ বাল্বের বিষণ্ণ ফিলামেন্ট। এমত দিনে তার একতরফা যৌনটান গজিয়ে ওঠে জ্যাঠতুত দিদি এবং সেই সাথে দিদির কিশোরী কন্যার সঙ্গে। দিদি ও বোনঝির উপমা তার কাছে একটিই— একটি স্তন উদোম আর অন্যটি কালো আঙুরের থোকায় বোজা। মাজায় জড়িয়ে একটি ছুঁইমুই, নাভিকুণ্ডে পদ্মরাগ। না, বিষয়টা যতই নিকটস্থ হোক মানবদার গল্পের সঙ্গে এ গল্পের আবহ ফিট বসে না। যদি ভুল না বলছি, মনাব চক্রবর্তীর ‘প্রীতিকথন নিমডায়েরি’তে প্রীতি আত্মহন্তা হয়েছিল; কিন্তু ‘খানাখারাবে’-র চরিত্ররা, বিশেষত বাবি এ সংক্রান্তে ডোন্ট কেয়ার। মানব’দার উপন্যাস গিল্টিতে থেমে গেছিল, আমার উপন্যাস গিল্টিবিহীন লজ্জাহীনতায়।

তুমি তো অজাচার বিষয়ে শহরের একটি সংখ্যাও করেছিলেগেঁতোপিউরিটানদের কাছ থেকে ছিছিক্কার শোনোনি ?

২০১৭-র বইমেলায় ‘শহর’ (৪০) ছিল এক মাইলস্টোন-সংখ্যা। কারণ, সংখ্যাটি এমন এক সেনসিটিভ আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল যা নিয়ে আজ অব্দি বাংলা পত্র-পত্রিকার দুনিয়ার অন্য কোনো কাগজ কখনো আলোকপাত করতে তষ্টি কিংবা সাহস পায়নি। ওই সংখ্যার বিষয় ছিল ইনসেস্ট বা অজাচার। নারী-পুরুষের পার্থিব যাপনবিধির একটি অতিশয় চোরাগোপ্তা দিক নিয়ে ছিল আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রথা, বিশ্বাস ইত্যাদি সর্বসূত্রে গ্রথিত এই বিষয়টিকে নিয়ে যথাসাধ্য সিরিয়াস আলোকপাত রয়েছে এই সংখ্যায়। কিন্তু, তুমি ঠিকই আঁচ করেছ, মাইরি, বাঙালি ভারি মজার আস্পদ। সহস্রাধিক কল্প অতিক্রম করে গেলেও, ডিম ফুঁড়ে বড়োজোর ঠোঁট, নতুবা চঞ্চু। এর বেশি বাঙালি নিজেকে অদ্যন্ত বাহির করেনি। অথচ, প্রশ্ন বলছে, আর কবে বড়ো হবি? যৌনতা, লিঙ্গতা, স্ল্যাং, অজাচার এসব নিয়ে তবে কে লিখবে, কোন এলিয়েন? এ-সব নিয়েই আমার লেখালেখি, তামাম অটাসটা। তো, না না, এখন আর কেউ প্রকাশ্যে ছিছিক্কার করতে সাহস পায় না। একসময় ছিল, অষ্ট্যাসি সনে, ‘দোগলাচরিত’ বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে একদল নিরীহ ভদ্দরলোক আচানক খেপে পাগড়ি হয়ে গেল। সে বৃত্তান্ত আজ আর রিপিট হয় না। ‘শহর’-এর ‘অজাচার’ সংখ্যাটা মাইরি খেটে করতে চেয়েছিলাম। কেউই খাটল না। প্রত্যককে ন্যাড় খসিয়ে থোড় বড়ি খাড়া খেঁচে হাতে ধরিয়ে দিল। ওই সংখ্যায় যে সিরিয়াস আলোকপাতের কথা বললাম, সেটা আমার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ। চল্লিশ পাতার ওই প্রবন্ধটা না থাকলে গোটা সংখ্যাটাই স্বাহা হয়ে যেত। বাঁচালে, বাঁচালে সেই লেখাটিই।

প্রাচ্য পাশ্চাত্য কালচারাল হেজিমনির ঠোকাঠুকি শেষ হলযাতনাভূমিতেএই সময়ের প্রেক্ষিতে ওই উপন্যাসকেউপমহাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেও কীভাবে দেখছ

‘যাতনাভুমি’ আমার একটি স্টাইল-বহির্ভুত, ব্যতিক্রমী উপন্যাস। মানে, এতে আমার বুড়ো আঙুলের ছাপ নেই বললেই হয়। যদিও এটি আমার অশেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী রচনা। প্রকাশ পেয়েছিল ‘সমান্তরাল ভাবনা’ পত্রিকায়। সম্পাদক পার্থ আচার্যও যথেষ্ট ব্যতিক্রমী। ময়রায় নাকি মিষ্টি খায় না, কিন্তু এ ময়রা নিজেও খায় না, অন্যকেও বেচে না। মিষ্টিগুলো খালিপিলি পিঁপড়েতে নিঃশেষ করে। এক্ষেত্রে, অস্রফলা আর মুষিক। হ্যাঁ, আমার এই উপন্যাসটির ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। যদ্দূর জানি গোনাগুন্তি কয়েক কপি মাত্র বিক্রি করে সংখ্যাটির সমস্ত কপি উনি সম্ভবত গোডাউনেই ড্যাম্প করে রেখে দেন। যে কারণে আমার এই বিজাতীয় সন্তানটির তারিফ বা বদনাম কারুক্কে করতে শুনলাম না। স্রেফ, মারা যাবার আগে রবিশংকর বল নাকি বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষায় একটা ব্যতিক্রমী উপন্যাস।’ সে-কথাও আমি পার্থর মুখেই শুনেছি। ব্যস, আর কেউ না। (ভাগ্যিস যেন এ সাক্ষাৎকার পার্থর নজরে না পড়ে)। তো, এই কারণেই যাতনাভূমি নিয়ে কিছু বিশদ বলতে হচ্ছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দলিত অনুন্নত জাতির ছাত্র মন্দার। তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃতত্ত্ববিদে উত্তরণ যে এক দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ভ্রান্তিতে আরেক দাসত্বের বেড়াজালে আটকে পড়ার কাহিনি— মন্দারের জীবন-পরিক্রমাকে আমি বিবৃত করেছি সেই ক্রমে। তবে এই মৌলিক অন্তর্দ্বন্দ্বকে নিছক ভারতীয় সামাজিক পরিকাঠামোর সঙ্গেই যুক্ত করে দেখিয়েছি, তা নয়, এই অন্তর্বিরোধকে প্রত্যক্ষ করেছি ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতির বৃহত্তর প্রেক্ষিতেও। মন্দার একদিকে তার স্বেচ্ছায় বিয়ে করে আনা ইতালীয় প্রেমিকাটিকেও বরদাস্ত করতে পারে না, আবার তার ভারতীয় উপমহাদেশের প্রান্তিক অথচ শাশ্বত প্রতিভূ তার বাবাকেও। উপন্যাসের কেন্দ্রমূলে রয়েছে মন্দারই, কিন্তু বাস্তবত আখ্যানের সৈদ্ধান্তিক বক্তব্য ফুটেছে ওর বাবা প্রেমচাঁদের মারফৎ। শেষাবধি বাবার দৃষ্টিভঙ্গিকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে মন্দার। এই হলো এর সেন্ট্রাল কথামালা। প্রচুর চরিত্র, প্রচুর মতবাদ, কনফ্লিক্ট, মুঠভেড়, এসব নিয়েই যাতনাভূমি।

জুভেলিনিয়া জূনুন টেক্সটের ভিজুয়ালাইজেশনের দিক থেকেও একটা অপরতাবাঁদিক থেকে ডানদিক টেক্সটের পাশাপাশিই ভার্টিক্যালি অন্য একটা টেক্সটকী অভিপ্রায় ছিল?

গূঢ় অভিপ্রায় তো তেমন কিছু ছিল না। এই বাইনারি ফর্ম ইতিমধ্যে ‘ম্যাওড়া জোন’ আর ‘নভাক যামিনী’তেও আজমাইশ করেছি। পাঠক দুটো গল্প, দুটো কাউন্টার-টেক্সট পাশাপাশি পড়বে, হয়ত ভালো লাগবে সাধারণ চালু ফর্মের বাইরে বলে, এইভাবেই আরকী।

তোমার প্রথম স্মৃতি কী?

প্রথম স্মৃতি? ফাঁসালে দেখছি। দামোদরের বালিপাড়ে বসে আখা ধরিয়ে মস্ত কড়াইয়ে মা লজেন্চুস ভাজছে, আর দুরত্যয়ে বাবা, হেঁটোধূতি, কোলে শরৎবাবু। স্মৃতি, কেন-না, স্বপ্নের স্মৃতি এমনিই হয়। বাস্তবের স্মৃতি বড়ো পাজি, নির্মম। তাই আমার জীবনে স্মৃতিহীনতার স্মৃতিই অপেক্ষাকৃত প্রখর, জাজ্জ্বল্যমান।

যেহারে উপন্যাস, সম্ভবত, গল্প তুমি কম লিখেছ অথচ, তোমার উপন্যাসকে বাদ দিয়ে গল্পগুলোকে গ্রহণ করা হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রমে এটা কি তোমাকে বিড়ম্বিত করেনি?

ইঁদুর দাঁত-নখ জুতে বিল খোঁড়ে, আর সেখানে বাস করে কাকোদর। কিছু করার নেই, অন্তত আমার তরফে কিছু করার ছিল না। আমি তো ব্যাপারটা জানতামই না। হুট করে একদিন ফেসবুকে দেখি প্রচুর মানুষ আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে অভিনন্দন জানানো উচিত, নেপথ্যে থেকে যাঁরা আমার মতো মূল-বাংলা-এরিনায়-আনফিট জীবিত লেখককে এটুকুও সম্মান পাইয়ে দিলেন, তাঁদেরকে। হরেদরে আমি খুশিই হয়েছি, ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও নথি করি। তবে, একটা কথা তো ঠিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে আমার উপন্যাস সামিল হলে, তাঁরা কি তখন ‘যোজন ভাইরাস’কে বাদ দিতে পারতেন? সে তো আর হীরামন কাকাতুয়া নয়, সর্বশতাংশে এক ঘামলাঘাটিয়া শশাদন, বাজবৈরি।

চল্লিশ বছর ধরে লেখালেখির ফিল্ডে, অথচ তোমার প্রথম গল্পসংকলন বাছাই গল্প বেরুল বছরের বইমেলায় মোট ন-টি গল্পে বিষয়, টেক্সট, ডিসকোর্স ইত্যাদির নানারকম ভ্যারাইটি লক্ষ করি সম্ভবত তোমার সেরা গল্পগুলোই এতে ঢুকেছে

যদি বলি জ্ঞান-হওয়া ইস্তক লিখে আসছি, হাসবে হয়ত। কিন্তু সত্যি, কুড়ি-বাইশ বছর বয়স অব্দি ছ-সাতটি উপন্যাস আর বোধকরি পঁচিশটির মতো ছোটোগল্প খারিজ। সেগুলো পরেও কোথাও বেরোয়নি। প্রথম ছাপা হয়েছিল কবিতা। পরে প্রবন্ধ। তারপর উপন্যাস। তারও বহু পরে, ছোটোগল্প। গল্প আমি সত্যিই খুব বেশি লিখিনি। হয়তো পঞ্চাশটার মতো হবে। বহু গল্প হারিয়ে গেছে, ছাপা গল্পগুলোও সমস্ত আর নিজের হেফাজতে নেই। আমার বিবলিওগ্রাফি অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার গ্যারান্টি পুরোদস্তুর। হ্যাঁ, আমি তো রূপ বা ফর্ম নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করি বেশি। সেক্ষেত্রে টেক্সট বা ডিসকোর্স ম্যাটার তো করবেই। কয়েকটা গল্প লিখে বেশ আরাম পেয়েছিলাম, সেগুলো বকের পাঁতির মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেছে। আর ফিরে আসবে না।

বিগত কুড়িতিরিশ বছর ধরে তোমার প্রতিটি বইয়ে তোমার গ্রন্থতালিকায় শেষে লেখা থেকেছে : ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ (যন্ত্রস্থ)’ অবশেষে উপন্যাসটা প্রকাশ পেল গতবছর, ২০১৯ সত্যিই কি লাগাতার লেগে ছিলে উপন্যাসটা লিখতে?

তাও কি সম্ভব। তাহলে তো শিবই গড়তাম। যেটা ওই নামে বই হয়ে বেরুল সেটা তো আমার সেই স্বপ্নগ্রন্থ নয়! তাহলে তার একটা-অন্তত ল্যাজ থাকত, যেটি দাহ করা হতো আমার চিতার সঙ্গে। বাস্তবত, এতখানিই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ নিয়ে। ধানবাদ ইতিবৃত্ত লেখার সময় প্রচুর তথ্য পেয়েছিলাম কয়লা আর কোল মাফিয়াদের নিয়ে। ভেবেছিলাম জীবনের সেরা কাজটা বুঝি হাতের মুঠোয়। সম্ভব হলো না। দ্রুত ওইটুকু দিয়েই রক্ষা করতে হলো প্রজেক্টটা। আসলে, পরিকল্পনা মগ্ন রাখলে কী হয়! চৈতন্য সদাই মগ্ন থাকে না। দ্য ম্যাড ম্যান হ্যাজ লুসিড ইন্টারভ্যালস। সেরকম কোনো চেতন-অবচেতন বিহ্বল অথচ সুস্থ মুহূর্তে আমি পরিকল্পনাটিকে প্রখর আদর করে দিয়ে বলি, এসো, আজ বের করে দিই, আজ তোমার মুক্তি।

তুমি গোড়াতেই জানিয়েছ, এই মুহূর্তে সাধক কবি জগদ্রামকে নিয়ে কাজ করছো একটু যদি বলো

একটুই বলা সম্ভব। জগদ্রাম রায় আমার আটপুরুষ আগের পূর্বসূরি শুধু সেজন্য নয়, কোনো হীন বংশপ্রীতি এ গ্রন্থের উৎস নয়। জগদ্রাম ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামপ্রসাদের লেখা রামায়ণ আঠারো শতকের একমাত্র ও বৃহত্তম রামায়ণ। জগদ্রামের জীবন ও কাব্য নিয়ে এতকাল পণ্ডিত প্রবররা চুপি সেধে রয়েছেন। কোনো ইতিহাস, লেখাজোখাই নেই তাঁকে নিয়ে। যেটুকু রয়েছে, সব মিথ-নির্ভর, মুগ্ধমঞ্জিরা, স্তুতিলেখ। জগদ্রাম বা তাঁর কবিপুত্রও নিজেদের বিবরণ কিছুই লিখে যাননি। কিন্তু, ইতিহাস— জীবনানন্দের ভাষায় বলি, “ইতিহাস: বিছানায় মৃতপ্রায় মুগ্ধা অন্তঃসত্ত্বার মতন;/বাকি সব সন্তানের সন্তানেরা এসে একদিন/লিখে যাবে।” কিন্তু যেখানে কিছু কিংবদন্তি আর প্রণাম-স্তুতি ছাড়া আর কোনো তথ্যসূত্রই নেই, কোনো পুরোনো বই, রেফারেন্স কিছুই নেই, সেক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? ঐতিহাসিক ভিত্তিতে খাড়া হতে না পারবে, এহেন অসার গল্প লিখে পাঠকদের মধ্যে এল্যানাস্কারের মতন ভাবুক শ্রেণীর মনোরঞ্জন করার প্রবৃত্তি নেই। এই কারণেই কাজটা আমার কাছে একটা মস্ত পাহাড়। হনুমান তো আর নই, পদে-পদে জোগাড়যন্ত্র লাগছে। আমার এই মুহূর্তের লেখার টেবিলে তিলরক্ষার জায়গা নেই, বইয়ের পালুই উপচে পড়ছে। শত শত বই ঘাঁটছি অবিরত। লাগাতার চলছে ক্যাটালগিং কম্পাইলিং ইন্টারপ্রিটেশনের কাজ। সারাটা লকজীবন ধরে এই নিয়েই কাটছে অষ্টপ্রহর। লেখালেখিই আমার জীবনপণ আর পাঠকের ভালোবাসাই আমার অর্জন।

চলো টাটা, শেষ কথা বলো, এই জীবন সম্পর্কে তোমার স্বীকারোক্তি কী?

জীবন একটা ফাঁপা বায়োস্কোপ। যত খেল দেখতে চাও, বা দেখাতে, দেখে, দেখিয়ে বিদায়। তোমার ছায়ায় রোপিত পদচিহ্নটিই তুমি। তুমি বিদায়ী, ছায়া প্রদায়ী। যা রয়ে যাবে, যেটুকু, তাই তুমি। অনেক যোজন ভুবন শেষে এই বিষ অর্জন। মানো, অথবা, না। চলো, বাই।

 

 

Categories
2021-December-Story

পীযূষ ভট্টাচার্য

স্থিরচিত্র

‘তোমাকে ঠিক ধরতে পারছি না।’

বলা যেতে পারে বাবার সঙ্গে শেষ সংলাপ এরকমই ছিল। কথাটা উড়ে এসেছিল ন্যাশনাল থার্টি ফাইভ ক্যামেরার আড়াল থেকে। ক্যামেরার অ্যাপারচার আর স্পিড কন্ট্রোলে ব্যস্ততার ছোঁয়া ছিল, কথাটির মধ্যে অনুচ্চারিত একটা উৎকণ্ঠা ছিল ক্রমে আলো মরে যাবার। কেবলমাত্র এ-কথাটির স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে পাই। অন্য কিছু কথা এর সঙ্গে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কথা তো আর জুড়ে বসে থাকবার পাত্র নয়। উড়ে গেছে।

নিজে কিন্তু আজ অবধি জানি না শেষপর্যন্ত বাবা আমাকে ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছিলেন কিনা তাঁর স্থিরচিত্র ধরে রাখবার কারবারে? নিজের বিশ্বাস, কম আলোর জন্য স্থিরচিত্রে ঢুকে যেতে পারিনি বলেই বেঁচে আছি। ফিল্মের বাদবাকি অংশ কিন্তু নিকষিত, আবার কারোর মতে এ হচ্ছে ‘নিকষিত হেম’।

নিজে কিন্তু কিছুই ধারণায় আনতে পারিনি শুধু অন্ধকারের চণ্ডী রূপের অস্পষ্ট ধারণা যা নিছক স্বপ্নের মতন, কখন বাবা ফিক্সড লেন্সের দিকে তাকাতে বলবেন— এই অপেক্ষার ভিতর ক্যামেরা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখলাম।

মনে হচ্ছিল তিনি যেন কোনো স্বপ্নের ছবি তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে নিজেই এমন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি তিনি মারা যাচ্ছেন। যখন বুঝতে পারলাম তখন দেখি আমাকে দাঁড় করানো হয়েছিল এমন এক জায়গায় যেখানে যুদ্ধবিমান মহড়ার সময় না উড়েই ভেঙে পড়েছিল। প্রতিবারই এই সময়ে কালো বকের একটা ঝাঁক উড়ে এসে বিমানের গহ্বরে প্রজননের জন্য ঘর বাঁধে। আবার মাস তিনেক অন্তর বাচ্চা-সহ উড়ে যায়। বাবা কী করে যেন খবর পেয়েছিলেন এবারে, এরা একটু তাড়াতাড়ি এসেছে— তিনি ধরেই নিয়েছেন কালো বকের মোকাবিলা করবার মতন বয়সে পৌঁছে গেছি— তাই এই সিজনের প্রথম শটটা আমার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন।

নানান কারণে বাবার খুবই পছন্দের— অসংখ্য ছবি আছে তাঁর হেফাজতে। একটি ছবিও এদিক ওদিক হবার জো নেই। কেন-না তাঁর প্রিয় বকেরা যে গোল্ডেন ফিশ শিকার করতে জানে।

অন্য সময়ে, অর্থাৎ, নভেম্বর ব্যতিরেকে কালো বক এখানে আসে না। এই সময়টি এদের প্রজননের সময়কাল। প্রজননের সময়ই টুরিস্ট আসে। আর জায়গাটা সেই সময় হয়ে ওঠে টুরিস্ট স্পট। ছবি তোলে— ছবি তোলায়। মূলত মন পড়ে থাকে শীর্ণ স্বচ্ছ মৃতপ্রায় নদীটির প্রতি। নদীতে এক হাজার বৎসর আগে প্রাচীন চীন দেশ থেকে গোল্ড ফিশ ভেসে এসেছিল— এই আসার কারণ যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে উজানে বয়ে যাওয়া মাছেদের স্বভাব। কেন-না অনুসন্ধান করে কোনো জলোচ্ছ্বাসের কথা জানাই যায়নি বলে ধরে নেওয়া হয়। হিউয়েন সাং ভারত ভ্রমণের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। বরফে ঢাকা নিজস্ব পদ্ধতিতে বানানো জারের ভিতর। নিজেকে বাঁচাতে গোল্ড ফিশ নিজের শরীরে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়িয়ে নিয়ে জ্বলে ওঠে। শুধু শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে এরকম হয়। বরফের অস্তিত্ব যতক্ষণ থাকবে ততই গোল্ডফিশ নিজের শরীরে রং বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চলবে। কিন্তু এই নদীর পাশে এসে জলে কোনো বরফের অস্তিত্ব নেই। স্বচ্ছ জারের স্বচ্ছ জলের সঙ্গে বহতা নদীর জলের পার্থক্য নেই। সেখানে গোল্ড ফিশের স্বাভাবিক রং। জ্বলে ওঠা রঙের আভাসের মধ্যে সামনে এ পথ-চলা সম্ভব ছিল তা হঠাৎই বন্ধ। রং তার সংবেদনশীলতা হারিয়ে গোল্ড ফিশ স্বাভাবিক— যখন সবকিছুই স্বাভাবিক, মাছ তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে যাক ভেবে নদীতে ছেড়ে দিয়ে রাতের আকাশে নক্ষত্রের ইশারার উপর নির্ভর করে পথ-চলা শুরু হয় আবার।

গোল্ড ফিশের জন্যও স্পটটা টুরিস্ট স্পট। নদীতে গোল্ড ফিশ অবশ্য নেই তবুও সিজন শুরু হয় নভেম্বরে। কখনো স্রোতের অভিমুখে কখনো বিপরীতে বাঁশের মাথায় নেট বেঁধে জলে দাঁড়িয়ে— ঠাঁই। এভাবে গভীর বিমর্ষতায় ডুবে গেলে হাতের নেট ছুড়ে ফেলে দেয়। তখনই বাবা সেই বিখ্যাত স্টিল ফোটোগ্রাফটি ওদের দেখায়। একটা কালো বক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরে উড়ানের ভঙ্গিমাও স্থির— দু-ঠোঁটের ফাঁকে তার শিকার গোল্ড ফিশ।

— কবেকার তোলা?

এই প্রশ্নকে ফুঁ দিয়ে জানিয়ে দেন— এখনও গোল্ড ফিশ আছে নদীতে। ‘আপনারা নেটটা না ভাসিয়ে ও দিয়ে প্রজাপতি ধরতে পারতেন?’ এবং টুরিস্টরা বুঝতে পারে বড্ড মূর্খামির কাজ হয়ে গেছে। মূর্খামিকে ধরে রাখবার জন্য ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত।

এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ার মধ্যে যেন থেকে যেত পৃথিবীর যাবতীয় নিছক অনিশ্চয়তা কেন-না ক্ষীণ স্রোতহীন নদীতে এখন আর গোল্ডেন ফিশ নেই। যেন হিউয়েন সাং-এর পদচিহ্ন ইতিহাস পুস্তকে ঢুকে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই যেন নিছক স্বাভাবিক জটিলতার জট ছাড়িয়ে সাধারণ সত্যে পৌঁছে গেছে। বাবা বেশ কিছুদিন থেকে ভাবছিলেন, ক্যামেরা যদি হাজার বছর আগে আবিষ্কার হত তবে এইসব অভিজ্ঞতার স্থিরচিত্র থাকত। আর স্থিরচিত্রের রহস্যময়তার ভিতরে বসবাস করত একটি ‘সময়’। তিনি এই সময় ঠিক কী করতে চাইতেন সেদিনও বোধগম্য হয়নি। আজও উন্নত ধরনের ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পরও নিজের ছবি নিজে দেখেও বুঝে উঠতে পারি না ছবি তোলার মুহূর্তকালে ঠিক কী ভাবছিলাম। কিছু তো একটা ভাবছিলাম কিন্তু সেটা মনে করবার চেষ্টা করলেই ভেসে ওঠে— ‘এক চক্ষু লেন্সের দিকে তাকাও।’

আমি কি বাবার নির্দেশমতো তাই করেছিলাম? নিশ্চয় করেছিলাম। বাবার নিজস্ব রূপকথার মধ্যে এক চক্ষুওয়ালা এক রাক্ষসের কথা সবসময় থাকত। উদাহরণ হিসেবে বলতেন লক্ষ্যভেদ করবার সময় একচক্ষুতেই করা হয়। অবশ্য জানি না যদি স্থিরদৃষ্টি থাকত একচক্ষু লেন্সের প্রতি আমার দুই চোখ মিলেমিশে একচক্ষু হয়ে যেত। যেহেতু ছবিটি খুঁজেই পাওয়া যায়নি আর সেহেতু ধরে নেওয়া হয়েছিল বাইরের আলো ক্যামেরায় ঢুকে অবয়বহীন কৃষ্ণবর্ণ করে ফেলেছে সবকিছু। তবু তার মধ্যে মাঝে মাঝে নিজেকে খুঁজি। কেন তা যেন বোধগম্যহীন চেতনা।

বাবা যে কেবলমাত্র মানুষের ছবি তুলবে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না, তবে এও শোনা যায়, সিজন ছাড়া অন্য দিনগুলিতে নদীতে এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকতেন— জল স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। স্থির স্বচ্ছ জলে যদি গোল্ডেন ফিশের দেখা মেলে। জলের ভিতর থাকা মাছের ছবি উঠবে কিনা তা তার জানা নেই তবু বিশ্বাস একদিন না একদিন গোল্ডেন ফিশের ছবি সে তুলবেই।

মুহূর্তে যেন বাবা এভাবে পৌঁছে যেতেন বক-যক্ষের শরীরে। হয়তো-বা এই মুহূর্তকাল নাম মাত্র পরিবর্তন। অথবা অতীতের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে প্রশ্নটাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। অথচ যুধিষ্ঠিরের প্রতি রাখা প্রশ্ন ছিল, ‘সুপ্ত হয়ে কে চক্ষু মুদ্রিত করে না?’— ‘মৎস্য নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না।’

জলের গহীনে তো অন্ধকার— গল্পের খাতিরে যদিও ধরে নেওয়া যেতেই পারে— রাতে সেই অন্ধকার পরিমাপহীন এক জ্যামিতিক অন্ধকার যার কোনো বর্গক্ষেত্র বা ব্যাসার্ধ নেই সেখানে উন্মুক্ত চক্ষুর কী কাজ? আবার যদি বেশি আলো একচক্ষু লেন্সের ভিতর দিয়ে ক্যামেরায় চলে যায় তখন পৃথিবীর ডার্করুমের সাধ্য নেই সেই কালো অন্ধকার থেকে স্থিরচিত্রে পৌঁছানো অসম্ভবকে সম্ভব করা।

কিন্তু বাবা যে কিছুতেই আমাকে তাঁর লেন্সে ধরতেই পারছিলেন না। ছবিটির সম্পূর্ণতা আনতে গিয়ে কালো-বক মুখ থুবড়ে পড়া এরোপ্লেনের ভিতরে যুদ্ধের ভগ্নাংশ ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। গোল্ডফিশের অনুপস্থিতি তাঁকে এমনই এক দার্শনিক চিন্তায় উপনীত করে যাকে বলা যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত বিচ্ছিন্নতা। যার ফলে বালুচরের ভিতরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে মুখ থুবড়ে পড়ে। নিজে কিছু বুঝতে না পেরে এক দৌড়ে বাবার কাছে পৌঁছে যাই। তখন বুঝতেই পারিনি মৃত নদীর বুকজুড়ে মাধ্যাকর্ষণের শক্তি যে কার্যকর। ভিউফাইন্ডার বা লাইটমিটারের ব্যবহার তখন জানতাম না, বোতামটা টিপে দিয়েছিলাম। বাবা যখন শুরু করে ফেলেছে তখন আমাকেই শেষ করতে হবে এরকম এক নির্বিকার জেদ আমাকে পেয়ে বসেছিল— আনাড়ি হাতে ক্যামেরা চালাতে (যা অবশ্য বাবাকে নকল করেই শেখা) শুরু করেছিলাম। তখন আমাদের পরিবারের মৃতেরা যাদের পূর্বপুরুষেরা হুড়োহুড়ি করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে। চেনা-অচেনা সব পূর্বপুরুষেরা আমাকে নাকি অভিশাপ দিয়েছিল— আমার পিছনে নাকি বাবা মারা যাচ্ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর প্রতিটি স্তরের কেন স্থিরচিত্র তুলিনি?

তখন মনে পড়ে যায় নিজের তো শৈশবের কোনো স্থিরচিত্রই তোলা হয়নি এবং তা যথারীতি কোনো অ্যালবামে রাখা হয়নি। বাবার চোখের সামনেই তো বড়ো হচ্ছি তাই তিনি ধরেই নিয়েছিলেন— এর কোনো স্থিরচিত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন ক্যামেরা জিনিসটা কী বুঝতে শুরু করলাম তখন বাবা আমাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেন। আমি কিন্তু বাবার ছিটকে যাওয়া ক্যামেরা দিয়ে যে-সব ছবিগুলো তুলেছি তার কোনো আগাম সিদ্ধান্ত ছিল না, ছবি তুলতে হয় তুলে গেছি। কোনো নতুন খেলনা হাতে পাওয়া মাত্র শিশুরা যেমনভাবে ব্যবহার করে সেভাবেই, যার কসরত বাবাকে দেখে শেখা। আর ছিল প্রথমবার হাতে ক্যামেরা তুলে নেওয়ার আনন্দ— সেই হেতু বাবার মৃত্যুর কোনো স্তর নেই সেখানে।

সেই রাতের মতন বাবা মর্গে, পরদিন পোস্টমর্টেম, তার সাথে নিরাপদ বয়ে যাওয়া সময়ের অভিজ্ঞান। আর ছিল ক্যামেরা ন্যাশনাল থার্টি ফাইভ— খুবই পুরোনো মডেলের। এইসব তুলে দেওয়ার পর বডি হ্যান্ডওভার করেছিল দারোগা।

একদম শেষে ক্যামেরার রিল ডেভেলপ করে নেগেটিভগুলো যার বেশিরভাগই কালো— শূন্যতায় ভরা। আমি পর্যন্ত নেই। আমার তোলা ছবিগুলোতে— মৃত আত্মীয়স্বজনের গলাকাটা ছবি। কিন্তু এসবের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়া যুদ্ধবিমানটিও নেই। যা সচল হয়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেন! সঙ্গী কেবলমাত্র ডিমে তা দিয়ে বসে থাকা বকেরা।

একটিমাত্র নেগেটিভের ভিতরে কিছু একটা আছে যা ডেভেলপ করলে দাঁড়ায় একটি কালো বক, যার ঠোঁটে ধরা গোল্ডফিশের কঙ্কাল কিন্তু দিগন্ত খাঁ-খাঁ করছে।

ধেয়ে আসা অন্ধকারকে এভাবে প্রকাশ করা অনুচিত— কেন-না সাদা, হলুদ, কমলা, লাল, বাদামি এবং কালো রঙের বিভিন্ন সমন্বয় মাত্র। স্থিরচিত্রে অবশ্য থাকে না, খুঁজে নিতে হয়।

Categories
2021-NOVEMBER-SHILPOKORMO

প্রতাপ হালদার

ANT

DUCK

THE PANGOLIN

SNAIL

THE BLACK WIDOW SPIDER

THE FACE 1

THE FACE 2

SHARK

CHIRPING

WATER BIRD

 

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

সোমা মুখোপাধ্যায়

প্রতিমা শিল্পী চায়না পাল

কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চল মহানগরীর ঐতিহ্য। একসময় গঙ্গার ধার ঘেঁষা এই অঞ্চলে মৃৎশিল্পের বসবাস শুরু হয়েছিল। গ্ৰাম থেকে রুজির টানে তাঁরা এসেছিলেন এখানে। হয়ে গেলেন ধীরে ধীরে এখানকার বাসিন্দা। আকাশ না দেখা অপরিসর অলিগলির মধ্যে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পী পরিবার হাজারও অসুবিধা সত্ত্বেও সারা বছর ধরে নির্মাণ করেন দেবদেবী-সহ আরও নানা রকম শিল্পকর্ম। পুরুষদের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন মহিলা শিল্পীরাও। এমন এক প্রথিতযশা অথচ সম্পূর্ণ অন্যরকম শিল্পী চায়না পাল।

আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিকে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম মহিলা মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা নির্মাণের কিছু ছবি তুলতে। ঠিক পুজোর আগেই ছিল সেই সময়। একটি পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ-সহ ওই ছবিটি জমা দেওয়া হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি অন্যের নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। প্রায় তিরিশ বছর পরে আবারও একদিন অন্য একটি কাজের সূত্রে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম সেই মহিলা শিল্পীদেরই সন্ধানে‌। সেখানে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম চায়না পালের। আমার সেই পুরোনো স্মৃতি থেকে তার বহু আগের চেহারার মিল পেয়ে একটু অন্যভাবেই কথা শুরু করি। যে-সময় আমি প্রথম চায়নাকে দেখি তার বাবা হেমন্ত পালের স্টুডিয়োতে কাজে সহায়তা করতে তখন তার খুবই অল্প বয়স। আমার পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলাম সেই চায়না পালের।

সময়ের জল অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছিল। ছোটো থেকেই চায়নার শিল্প কাজের প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল। আর এমনটা হওয়ারই কথা। কেন-না মৃৎশিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ। তাই মাটির প্রতি টান তো থাকবেই। তাছাড়া সেলাই করতেও চায়না একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিল। নিয়ম করে সেলাই স্কুলে সেলাইটাও শিখেছিলেন। সেখানেও নিজের পারদর্শীতা প্রমাণ করেছেন তিনি।

চায়নার প্রতিমা তৈরির গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। বাবাকে ছোটোখাটো কাজে সহায়তা করতেন চায়না। আর পাঁচটা কুমোর পরিবারের মেয়েদের মতোই। চায়না নিজেও জানতেন না একদিন এই পৈতৃক ব্যাবসার দায়ভার তাঁর ওপরেই এসে পড়বে। এক আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই চায়নাকে ঠাকুর গড়ার কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়।

এক বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে আচমকা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন বাবা। সে-সময় সমস্ত অর্ডারি ঠাকুরে‌ তাদের স্টুডিয়ো ভরতি ছিল। সেই পরিস্থিতিতে একটু বিচলিত না হয়ে পুরোনো কারিগরদের সঙ্গে নিয়ে চায়না শুরু করেছিল ঠাকুর গড়ার কাজ। বাবার অসমাপ্ত কাজের সুন্দরভাবেই সমাপ্ত করেছিলেন তিনি। না, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সুন্দর একচালার বাংলা প্রতিমা চায়নাকে নিয়ে গেছে অনেকদূর।

চায়নাদের পরিবারে তার অনেকজন ভাই-বোন আছে। কিন্তু সেদিন বাবারে পৈতৃক ব্যাবসাটি একমাত্র চায়নাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেদিন এই কাজে আর কেউই এগিয়ে আসেনি। চায়নার কাছে শিল্পই ধ্যান জ্ঞান। তাই সংসার জীবনে না জড়িয়ে এই ঠাকুর গড়ার কাজেই চায়না ব্যস্ত থাকেন সারাটা বছর। শুধু দুর্গাপ্রতিমা নয় লক্ষ্মী-সরস্বতী, কালী অন্নপূর্ণা থেকে আরও নানা ঠাকুর চায়না তৈরি করেন। মাটি, খর, রং, কারিগর আর মাকে নিয়ে চায়নার এক অন্যরকম সংসার। স্টুডিয়োর পেছনেই তার সামান্য আস্তানা।

চায়নার কাছ থেকে শুনেছিলাম ঠাকুরের দু-রকম মুখ হয়। বাংলা মুখ আর সাবেকি। চায়না দ্বিতীয়টাই বেশি করে থাকেন। হলুদ রঙের টানা চোখের ঐ প্রতিমাই বাংলার দুর্গার মূল রূপ। একসময়ে একচালির দুর্গা ঠাকুরের বদলে কুমোরটুলির প্রখ্যাত শিল্পী গোপেশ্বর পাল প্রতিটি ঠাকুরকে পৃথকভাবে তৈরি করা শুরু করেন। একচালার বদলে পাঁচটি পৃথক চালায় গড়লেন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ আর কার্তিক‌। কিন্তু চায়না মনে করেন ওই এক চালাতেই বাঙালির দুর্গার আসল পরিচয়। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো হওয়া চায়নার পছন্দ নয়। তিনি মনে করেন দুর্গার পরিবার-সহ এই একত্রে থাকাই যেন বাঙালির একান্নবর্তী সংসারের একটি প্রতীক।

সাবেকি দুর্গার নানা রূপকেই চায়না তুলে ধরেন। একসময় গড়েছেন শিবের কোলে বসা দুর্গা। এছাড়া কলকাতার এক প্রখ্যাত ক্লাবের পুজোর রামচন্দ্রের অকাল বোধনের প্রতিমাও একসময় তিনিই করতেন। বর্তমানে অবশ্য করেন না। এর মধ্যেই বছর তিন চার আগে রূপান্তরকামীদের পুজোয় দর্জিপাড়ায় অর্ধনারীশরীর মূর্তি তৈরি করে নজর কাড়েন সবার। একই অঙ্গে দু-টি রূপের এমন মেলবন্ধন পুজোর সময় আগে কখনো দেখেনি এই মহানগরী। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন আরও‌ একবার তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।

দোহারা চেহারার চায়না পাল সদা হাস্যমুখী। শিল্প নিয়ে আলোচনা শুনলেই তিনি মশগুল হয়ে ওঠেন। এই কারণে প্রখ্যাত শিল্পী প্রবীর গুপ্ত, ভবতোষ‌ সূতারদের সঙ্গে গুরুসদয় সংগ্ৰহশালায় চায়নার প্রতিমাও স্থান পায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশ্ববাংলা স্টোরে চায়নার তৈরি ডাকের সাজের দুর্গার মুখ বিক্রি হয়েছে। অপূর্ব এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প দেশি বিদেশি বহু মানুষের আকর্ষণের বস্তু হয়েছে।

চায়নার এই শিল্পকলা তাকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এর সঙ্গে চায়না পাড়ি দিয়েছে সুদূর চীন দেশে। আমি জানি না চায়না ওর নিজের নামের অর্থ জানে কিনা। একসময় কন্যাসন্তান বিমুখ অনেকেই নিজের কন্যা হবার পর হেলায় বলতেন আর কন্যা চাই না। সেই নামটি হয়ে দাঁড়ায় চায়না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই চায়না তার কর্মের জোরেই পাড়ি দিল চায়না, অর্থাৎ, চীন। এমন নারী ক্ষমতায়নের নজির খুব কম আছে।

আজ নারী পুরুষের রেষারেষি শিল্পীদের মধ্যে হয়তো‌ কিছুটা কমেছে। কুমোর পরিবারে পুতুল গড়া, মাটি ছানা, টুকটাক মূর্তি গড়ায় পরিবারের পুরুষ শিল্পীকে সহায়তা করা এমনসব কাজেই বাড়ির মেয়েরা করতেন। কিন্তু পূর্নাঙ্গ দুর্গা বা কালীর মূর্তি গড়া ছিল স্বপ্নের মতো। চায়না সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন।

একটা মস্ত কাজে অনেক মানুষের সহায়তা লাগে। ঠাকুর গড়াও তেমন। আমি দেখেছি চায়নাকে মূর্তি গড়তে মাটি মেখে। ছাঁচ থেকে দেবীমুখ বানাতে। অথচ নিয়ম কুমোর বাড়ির মেয়েরা চাকে হাত দেবেন না। চায়নার সঙ্গে চাকের যোগ নেই। খড়ের কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে স্বপ্ন বোনে চায়না। এর সঙ্গে বৃদ্ধা মায়ের দেখা শোনা থেকে বাজার রান্না সবটাই একা হাতে। ওকে দেখে মনে হয় যে রাঁধে সে চুল বাঁধে এ-প্রবাদের যেন সার্থক রূপায়ণ হয়েছে ওর মধ্যে।

চায়না জানান একসময় তাঁরা ঝুলনে পুতুল গড়তেন। তখন এত বিনোদন ছিল না। তাই ঝুলনের ক-দিন আগেই কুমোরটুলির প্রায় প্রতিটা ঘরেই এই পুতুল মিলত। বাড়ির মেয়েরাই ছিলেন বেশিরভাগ শাল্পী। এখনও এই কাজ তাঁকে টানে। তবে এখন অনেকটাই কমে গেছে ঝুলনের পুতুল। এর পাশাপাশি সুন্দর ছোটো একচালির দুর্গা বানানোর ইচ্ছে তাঁর। তবে প্রতিমা তৈরিতে সারাটা বছর এত ব্যস্ত থাকেন যে, এ-কাজের অবসর পান না। জগদ্ধাত্রী পুজোর পর কয়েক মাস একটু বিশ্রাম মেলে। তারপর আবার সরস্বতী গড়া শুরু।

এভাবেই দিনাতিপাত করেন আমাদের কুমোরটুলির সরস্বতী। এই কাজে অসম্ভব খুশি তিনি। তাঁর মতে সবকাজেই তো বাধা থাকে। তাকে অতিক্রম করতে হয়। তাঁর কাজের ক্ষেত্রেও তাই। ভালোবাসা দিয়ে যদি কিছু আঁকড়ে থাকা যায় তবে তার সাফল্য আসবেই।

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

অগ্রদীপ দত্ত

মা-কে লেখা চিঠি


এই ছিলে এই নেই
মানুষের কাছে তোমার রেখে যাওয়া ঋণগুলো বাকি রয়ে গেছে শুধু

এখন আর সুখী জীবন লাভের প্রত্যাশা করি না
তোমার রেখে যাওয়া ঋণগুলো
চিতায় উঠবার আগে ঠিক শোধ করে যাব

লোভ বলতে এই একটাই আমার।


কবিতা লিখে আজকাল সত্যিই বিশেষ কিছু হয় না।
না গাড়ি। না বাড়ি। ভাড়ায় দেবার মতো টাকাটুকুও উঠে আসে না

তোমারও আমার কাছে প্রত্যাশা কিছুই ছিল না কোনোদিন
শেষ দিকে শুধুই বলতে, ‘তুই একটা মানুষ হোস’

এই যে দু-কলম লিখতে পারি আজ
আমার প্রতিটা লেখাজুড়ে তোমার অস্তিত্ব—

বইয়ের পাতায় পাতায় তুমি বেঁচে আছ ভেবেই আমি লিখি
আমায় লেখায় তুমি থেকে যাবে ভেবেই আমি লিখি।


বিসর্জনের দিনগুলো বড়ো বিষণ্ণ কাটে
ঢাকের আওয়াজের মধ্যে নদীঘাটে বসে আমি প্রতিমা নয়,
প্রতিবারই তোমার মুখ ভেসে যেতে দেখি

দেখি কীভাবে শাখা পলা সিঁদুর জল লেগে মুছে যাচ্ছে শরীর থেকে
এই বিষণ্ণতার মাঝেও চিৎকার শুনতে পাই লোকের,
আশান্বিত কিছু বাক্যও হাওয়ায় পাক খেয়ে মিলিয়ে যায় অন্ধকার নদীবুকে

আসছে বছর মা আবার আসে ঠিকই
আসছে বছর শুধু তুমি আসো না।

সঙ্গী


পরীক্ষায় সবচেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছেলেটা
আশপাশে তাকিয়ে খুঁজে নিতে চায়
তার চেয়েও কম নম্বরের কোনো একজনকে


যদি কোনো সদ্য ঠকে যাওয়া প্রেমিক
অথবা প্রেমিকা শুনে ফেলে—
তাদের পরিচিত কিংবা অপরিচিত কেউ
লেঙি খেয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে…
তাদের তেতিয়ে ওঠা যন্ত্রণা অনেকটাই কমে যায়


শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে আসা
মৃত মায়ের পা ছুঁয়ে বসে থাকাকালীন
যদি কেউ এসে বলে
“আমারও অল্প বয়েসে মা…”
মা হারা ছেলেটার বুকে কি সাহস বাড়ে তবে?

 

Categories
2021-NOVEMBER-ESSAY

বিপ্লব বিশ্বাস

অপ্রমিত ঈশ্বরের বহুচিত্রল নির্মাণ ও দেবর্ষি সারগীর দশটি গল্প

শব্দকার অসীম রায় তাঁর জবানিতে বলেছিলেন, “ক্রিয়েটিভ লেখা মানেই আত্মোপলব্ধি; আত্মোপলব্ধি ছাড়া সাহিত্য নিরর্থক।… গল্পের ভাষা হবে নিরাভরণ, কম কাব্যগন্ধী। অনেক সময় ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলায় সত্য তলিয়ে যায়, ম্যানারিজম-এর কুহকে চরিত্রের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। সত্যকে ধরার প্রাণপণ চেষ্টাই তো লেখকের আত্মবিকাশের একমাত্র পথ।… সাহিত্যিকদের বেশির ভাগই বাণিজ্যের আক্রমণে মৃত।… শিল্পীর খ্যাতি মানে বইয়ের কাটতি। এক দিকে লেখকেরা খ্যাতি অর্জন করে চলেছেন, অন্য দিকে লোকে তাঁদের ভুলতে শুরু করেছে।… এভাবে লেখক খ্যাতি কুড়োলেন, কিন্তু শিল্পীর সম্ভ্রম অর্জন করতে পারলেন না।… লেখকের সৃষ্টি মানেই তাঁর চৈতন্যের বিস্তার।… যে কোনো সার্থক সৃষ্টি মানে শিল্পী যা বলতে চেয়েছেন তার আধখানা প্রকাশ।”

আবার বর্তমান আলোচনীয় গল্পকার সম্পর্কে বন্ধুস্থানীয় লেখক বলছেন, সাধারণ পাঠকমহলে তিনি খুব একটা পরিচিতি লাভ করেননি। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাসের বাণিজ্যিক সফলতার ভাঁড়ার প্রায় শূন্যই বলা যায়। আবার বাংলা গল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যে তাঁর ভূমিকা পিকাসো, পল ক্লী বা ভ্যান গখের মতোও, তা বলতেও কসুর করলেন না সেই আলোচক।

তাঁকে কেউ বলছেন বাংলা সাহিত্যের কাহলিল জিব্রান, কেউ বলছেন কলম্বাস। এতে তিনি কতটা সংকীর্তিত হলেন জানি না তবে আমরা অনেকেই যে আত্মপ্রসাদের চোঁয়া ঢেকুর তুললাম, তা নিশ্চিত। আসলে এই নিঃসার স্তোকোক্তির পরম্পরা আমাদের বিভল অর্জন। আমরা সেই কবেই বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলার স্কট, শরৎচন্দ্রকে চার্লস ডিকেন্স বানিয়ে বসে আছি। চলচ্চিত্র-জগতেও দেবানন্দকে গ্রেগরি পেক আর রাজ কাপুরকে চার্লি চ্যাপলিন বানাতে পিছপা হইনি। পশ্চিমের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি না করলে আমরা জাতে উঠি না। অথচ বাংলা সাহিত্যের অজস্র নোবেল-সম্ভাবনাময় সম্পদকে অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হইনি। উপেক্ষার আবিলতায় অবস্কর করে রেখেছি সে-সব। মান্যতা দিয়েছি আমাদের কাঁকড়া চারিত্র্যকে। ভূয়োদর্শী রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন; তাই তাঁর অর্জিত নোবেল নিয়েই আমরা লজ্জাহীন নর্তন করে যাচ্ছি আজও। সান্ত্বনাবাক্য একটাই, ইদানীং কিছু কিছু ইংরেজি তরজমা হচ্ছে বাংলা সাহিত্য সম্পদের। হয়তো দূর ভবিষ্যতে বিশ্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের সুস্বাদ বাঙালি পেতেও পারে।

তাঁর গল্পভাবনার আবর্তন ঈশ্বরকে ঘিরে। আসলে তা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পৌত্তলিক বিগ্রহ নয়। এ ঈশ্বর তাঁর একান্তব্যক্তিক আবিষ্ক্রিয়া। তাঁর বলস্বী নির্মাণ কিংবা বিনির্মাণ। এ-ক্ষেত্রে তিনি এক নবমিথের উদ্ভাবক। কিছুটা প্রতিবাত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। সুতরাং ঈশ্বর যখন তাঁর ভাবনামূলে তখন আস্তিকতা, নাস্তিকতা, সংশয়বাদের সরহদ্দে তাঁকে পড়তেই হয়। আস্তিকতা, নাস্তিকতা— দুটোই নেতিবাচক শব্দ। দুটোই দুই বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি ঈশ্বরের অস্তিত্বে, অপরটি অনস্তিত্বে। যিনি অনস্তিত্বে আস্থাবান তিনি আবার ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রকৃতি বা ওই জাতীয় কোনো কিছুতে বিশ্বাস রাখেন। উপর্যুক্ত শব্দদ্বয়ের বিপ্রতীপ শব্দ, সংশয়। ধর্মগ্রন্থভুক্ত ঈশ্বরের প্রতি যাঁর বিশ্বাস নেই অথচ অন্য কোনো অমিত ক্ষমতাবান অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস আছে তাঁকে এ-দেশে কেউই হয়তো আস্তিক বলবেন না; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তো আস্তিকই— ধর্ম মেনে চলা বা ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মোটামুটি নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর এক অলীক শক্তিতে বিশ্বাস করার বদলে কেউ যদি তাঁর নিজের মতো করে একজন ঈশ্বরের কল্পনা করতে পারেন, তাঁকেও তো আস্তিক বলাই যায়। লালন সাঁই যেমন বলেছেন, “যে মুর্শিদ (সাধারণ মানুষ) সেই তো রাসুল (মহামানব); ইহাতে নাই কোনো ভুল, খোদাও সে হয়।” এখানে লালন মুর্শিদ, রাসুল আর খোদাকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করেছেন কেন-না তাঁর মতে মানুষ ও খোদা একই রূপের দ্বিবিধ প্রকাশ। মানুষের মধ্যেই খোদা বিরাজমান। তাঁর আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। এই মতবাদ ইসলামের সমর্থন না পেলেও সুফিবাদের সঙ্গে এর মিল আছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বা স্টিফেন হকিংয়েরও এমত ঈশ্বরবিশ্বাস এবং সেই ঈশ্বর কোনো ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বর নন। হকিং বলেছেন, “একজন ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন তাহলে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়ই কিছু নিয়মকানুন বেঁধে দিয়েছেন যেখানে তিনি নতুন করে হস্তক্ষেপ করেন না, করেন না কোনো পরিবর্তন; সত্যি বলতে কি, সেই ক্ষমতাই তাঁর নেই— তাঁর কাজ শেষ হয়েছে, মিটে গেছে তাঁর ভূমিকাও।” এ-ও তো একজাতীয় ঈশ্বরভাবনা। এঁরা কি আস্তিক? আসলে এঁরা প্রত্যেকেই সংশয়ী। প্রচলিত ঈশ্বর-ধারণার প্রতি এঁদের সংশয় ছিল বলেই এঁরা নতুন এমন এক ঈশ্বরের প্রকল্প দর্শন করিয়েছেন যেটা তাঁদের দার্শনিক প্রতীতির সঙ্গে মেলে। এমন ঈশ্বরভাবনায় সুফিবাদ, ভারতীয় প্রেম-ভক্তিবাদ বা বৌদ্ধ সহজিয়াবাদের লক্ষণ স্পষ্ট। সুফিবাদ মতে আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্ট জগতের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই কারণ আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির মাঝ দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন মাত্র। এই যে সুফিবাদীরা নিজস্ব ঈশ্বর বা আল্লাহ্ সৃষ্টি করলেন তার কারণ নিজেকে সমর্পণের জন্য, স্বনিবেদনের জন্য এমন একজনের অস্তিত্ব থাকা প্রয়োজন– প্রেমময়, দয়াময়, ক্ষমাসুন্দর একজন যিনি স্বর্গের লোভ বা নরকের ভয় দেখাবেন না; অনুরাগীদের শাস্তি দেবেন না– যাঁর কাছে দাবি, অভিমান, রাগ ফলানো যায় এমনকী কোনো নির্দয়তার জন্য যাঁকে অভিযুক্তও করা যায়। তিনি ভয়ংকর নন, নন বীভৎস বা দ্বিষৎ। তিনি প্রেমময় ও সুন্দরের পূজারী– সমর্পণ আর নিবেদনই তাঁর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ববহ। রবীন্দ্রনাথে এর যথেষ্ট প্রভাব আমরা লক্ষ করি।

আবারও খানিক আইনস্টাইনে ফিরি। তিনি তাঁর Special Theory of Relativity প্রণয়ন করেন ১৯০৫ সালে, মাত্র তেইশ বছর বয়সে। এই তত্ত্বের শুরুতেই তিনি দু-টি স্বতঃসিদ্ধ (Postulates) দেন। প্রথমটি আলোর বেগ-সংক্রান্ত যা পুরো উনিশ শতক জুড়ে চলতে থাকা বিতর্কের অবসান ঘটায়। দ্বিতীয়টিতে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মসমূহকে বিশ্বের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়ে মহাবিশ্বের অসীম পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেন। তাঁর তত্ত্বের মূল কথাটি হল, পরম বলে কিছু নেই। সবকিছুই আপেক্ষিক। কোনো কিছুকে বিচার করা যায় না কেবল অন্য কোনো কিছুর সাপেক্ষে। তাঁর এই গাণিতিক তত্ত্ব ঝামেলা পাকালো দর্শনভাবনায়। সেখানেও চলে এল আপেক্ষিকতার নীতি— সবকিছুই আপেক্ষিক এমনকী ঈশ্বরও; অর্থাৎ, ঈশ্বর কোনো পরম সত্তা নয়, নয় পরম সত্যও। তিনিও আপেক্ষিকভাবে সত্য। বিশ্বাসীদের কাছে তিনি সত্য, অবিশ্বাসীদের কাছে মিথ্যা। আসলে আইনস্টাইনের সমস্ত তত্ত্বই ছিল প্রচলিত ঈশ্বর-ধারণার বিরুদ্ধে। অথচ তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে ঈশ্বরের কথা স্বয়ং তিনি বলবেন না, বলবে মানুষ। এমন সব অনিয়মী বক্তব্য কোন মগ্নতা থেকে? এঁরা মনে করেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মের জন্ম কোনো অজানা উৎস থেকে, এ-সবের পেছনে যেন কারও হাত আছে। এ এক অনুপম সমর্পণের ভঙ্গিমা। বিশ্বাসীদের মতো অবিশ্বাসী এবং সংশয়বাদীরাও ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত হন, জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে, কারো-না-কারো কাছে। হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট তথা মনুষ্য-সৃষ্ট মূর্তিমান ঈশ্বরের কাছে নয়, তবুও তিনি কোনো-না-কোনো অর্থে সমর্পিতজনের চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক মহিমময়।

লালন, ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিব, জালালউদ্দিন রূমী, আইনস্টাইন, হকিং, রবীন্দ্রনাথ— এঁরা সকলেই ছিলেন মূলত সংশয়বাদী। নিজেদের রেখেছিলেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে। জীবনের যদি কোনো মহত্তম লক্ষ্য থাকে তবে সেই উপলব্ধি অর্জন করতে হলে সংশয়ী হতেই হবে। বর্তমান আলোচনীয় গল্পকারের নীতিভাবনা সম্পর্কেও এমন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায়।

বর্তমান প্রবন্ধের সূচনামুখ হিসেবে যে-বয়ান রাখা হল এবং যে-বেপথু (ব্যাজস্তুতির ঢঙে) গল্পকার সম্পর্কে এই সংযুত উপস্থাপন তিনি দেবর্ষি সারগী— গল্পজগতে এক অনাবিদ্ধ আবিষ্করণ। সরকারি নথিতে তিনি দেবকীনন্দন আগরওয়াল। আবার তিনিই যখন কলকাতাকেন্দ্রিক দৈনিকের কলা-সমালোচক তখন শুধুই দেবকী আগরওয়াল, ‘নন্দন’ বিহীন যে-নাম শুনে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তথা প্রাবন্ধিক অশোক মিত্র মহাশয় যাকে মহিলা ভেবেছিলেন এবং এই তিনিই গল্প-উপন্যাসের বলস্বী জগতে পা রাখাকালে ছদ্মনাম হিসেবে ধারণ করলেন দেবর্ষি সারগী। আসলে ‘সারগী’ তাঁর গোত্রপদবি আর ‘দেবর্ষি’ একান্ত-পছন্দের নাম। তিনিই সম্ভবত একমাত্র রাজস্থানী যিনি বাংলা সাহিত্যের সান্দ্র চর্চা করে থাকেন। তা নিয়ে একাধিক বক্রোক্তির স্বাভাবিক শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। এবং এই একটিমাত্র সংকল্পনার জন্য তিনি ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ২০০৫ সালে ভাষা ভারতী সম্মানে মানদ হন। উক্ত বছরেই তাঁকে দেওয়া হয় ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পুরস্কার। এছাড়া ২০০৮ সালে তিনি লাভ করেন চন্দননগর ‘গল্পমেলা’ ও ২০১৫-তে পঃ বঃ সরকারের সোমেন চন্দ পুরস্কারদ্বয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আরশোলা’ বেরিয়েছিল ১৯৮৪ সালে ‘আজকাল’ পত্রিকায়। তারপর থেকে অবিরাম অগ্রগমন। এ-পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত, অপ্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ৩১; গল্পসংখ্যা কমবেশি ২৬০। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬-তে, সুবর্ণরেখা থেকে। মর্যাদাপূর্ণ প্রতিক্ষণ প্রকাশনা থেকে গল্পসংকলন বের হয় ১৯৯৮ সালে। তারপর প্যাপিরাস থেকে ২০০৫ সালে ‘গল্পকুঞ্জ’। ওই বছরই করুণা প্রকাশনী থেকে বের হয় ‘নির্বাচিত গল্প’। আর পরশপাথর থেকে ২০০৮-এ বের হয় ‘দশটি গল্প’। এখানে গল্পালোচনা থাকছে বলেই উপন্যাসের তত্ত্বতালাশ দিলাম না। ইদানীং তিনি আর নতুন করে গল্প, উপন্যাস লিখতে আগ্রহী নন। কারণ হয়তো কোনো অনুচ্চার্য নির্বিণ্ণ স্বাভিমান। স্বাবমাননা কি!? তিনি বলেন, এই রাজ্যের জেলাভিত্তিক দু-তিনজন পাঠক আছেন তাঁর। তাঁর আগ্রহী প্রকাশকদেরও এই কথাই অকপটে বলেন তিনি।

এবারে গল্পরচনা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনার কিছু ইশারা দিই। ‘গল্পকুঞ্জ’ বইয়ের ‘আমার কথা’ অংশে তিনি বলেছেন, “মানুষের জীবনভাবনার অভ্যাস তাকে সভ্য করেছে, মৃত্যুভাবনা করেছে দার্শনিক। মানুষ এমন জীব যে শুধু চিন্তা করেই বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে, গ্রিক দার্শনিক পারমিনিডিসের মতো। জীবনের যে কোনো সংকটের মতো আমি দার্শনিক সংকট নিয়ে কিছু গল্প লিখেছি। বেশ কিছু গল্পে এসেছে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ। আমি মনে করি সবকিছুর মাঝ দিয়ে মানুষ এমন কিছু খুঁজে চলেছে যা শাশ্বত ও অবিনশ্বর— যা সবকিছুর উৎপত্তির কারণ অথচ যার ধ্বংস নেই; এ রকম হয় কিছু আছে যা কাল্পনিক ও দুর্বোধ্য এবং যার নাম দেওয়া যায় ঈশ্বর। কোনো ধর্ম না থাকলেও মানুষের চলবে কিন্তু ঈশ্বরকে সম্ভবত তার দরকার। চিত্রকল্প সৃজনের মাঝ দিয়েই আমি গল্প বলতে ভালোবাসি।… অনাবশ্যক শব্দ আমাকে ক্লান্ত করে। অনাবশ্যক বর্ণনা ও সংলাপও। সাহিত্যে শব্দের জঞ্জালের মতো ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না (তুলনীয়— A big book is a misfortune – Callimacus)। শব্দই সাহিত্যের প্রাণ, শব্দই আবার তার মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠতে পারে। আমার অনেক গল্পই তাই খুব সংক্ষিপ্ত।… একমাত্র মানুষই গোটা জগতে বাস করার ক্ষমতা রাখে। সশরীরে না হলেও কল্পনায়। এটা যেমন একজাতীয় সত্য, তেমনই সত্য পৃথিবীর যেখানে যা-ই থাকুক না কেন, সবই একরকম। তাই আমার অনেক গল্পেই লোকালয় বা চরিত্রের নাম নেই— যা ঘটছে যেন গোটা জগতের পটভূমিতেই ঘটছে— এভাবেই খানিক মহাকাব্যিক আভাস দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করি।

সমস্ত শিল্পমাধ্যমে একমাত্র সাহিত্যই সবচেয়ে বেশি কল্পনা দাবি করে। নির্জন, নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ কল্পনা। সাহিত্য হইচইয়ের জিনিসই নয়। সাহিত্যের মানুষজন যেন একটু অন্য প্রজাতি” (এই কারণেই তিনি গল্প-কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেন না)।

পঃ বঃ বাংলা আকাদেমির মুখপাত্র ‘বাংলা বই’-তে ২০১৬ সালে যে-বক্তব্য তিনি রাখলেন তা তাঁর আখ্যানের অভিযান বিষয়ক যেখানে তিনি বলছেন, অ্যারাবিয়ান নাইটসের গল্প, কথাসরিৎসাগরের গল্প, ইশপের গল্প বা রূপকথার গল্পগাথা সবই অত্যন্ত প্রাচীন, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। নিছক ঘটনা শুধু আখ্যান নয়; সেই ঘটনা যখন সাহিত্য হয়ে ওঠে, শিল্প হয়ে ওঠে তখনই আমরা তাকে আখ্যান বলি। আমরা চারপাশে প্রচুর ঘটনা দেখি। সেগুলো কিন্তু আকস্মিক। তা আখ্যান হয়ে উঠবে তখনই যখন তার মধ্যে সাহিত্য তৈরি হবে, শিল্প গড়ে উঠবে। এরপর তিনি খোলামেলা বলেছেন, “আমার আখ্যানের জন্য কোনো দেশভ্রমণ করিনি, কখনো আখ্যান থেকে, চারপাশের সমাজ থেকে যে আখ্যান পেয়েছি তাও নয়। একটা চরিত্র নির্মাণ করেছি, খুবই অসুস্থ হয়ে থাকে, ক্রমাগত তাকে সারাতে চেষ্টা করে চলেছি। সেই আমাকে খুঁজে খুঁজে এনে দেয়, সেই চরিত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র বলুন, নায়ক বলুন। সে আমাকে সবকিছু এনে দেয়। সেই আমার প্রোটাগনিস্ট; সে আমাকে গল্প দেয় আর তাকে আমি আমার সত্তা, কল্পনা সবকিছু দিই।”

ইদানীংকালে গল্পের ক্ষেত্রে ফ্যানটাসির রমরমা চলছে। এক শ্রেণির লেখক-পাঠকের কাছে এই প্রকরণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। এই প্রিয়তার কারণ, তথাকথিত বাস্তববাদ আর আমাদের অভিজ্ঞতার শিল্পায়নে পর্যাপ্ত বোধ সরবরাহ করতে পারছে না। যখন প্রাত্যহিক জীবনের নানা বোধ পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে তখন ফ্যানটাসি বা জাদুবাস্তবতা পাঠকের সামনে অজস্র দ্বার উন্মোচিত করছে। জীবনের অর্থহীনতা জন্ম দিচ্ছে হতাশা আর বিবিক্তি, ফলে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যসকলের প্রক্ষেপণ অর্থহীন হয়ে এক কৃত্রিম অবাস্তবতা গড়ে তুলছে। বাস্তবতা গিয়ে পৌঁছুচ্ছে নাস্তিতে। দেবর্ষি সারগীর গল্প প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমনটাই ভণিতা রেখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রবিন পাল। প্রসঙ্গক্রমে অপর মনীষা আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাবনা খানিকটা উল্লেখ করা অযৌক্তিক হবে না। ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ‘নাস্তিকের গীতাঞ্জলি’ বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি বলছেন, একজন আধুনিক মানুষ মানে একজন নাস্তিক মানুষ। যে-মানুষ নাস্তিক নন তিনি শেষ বিচারে আধুনিক নন। কারণ, ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের মূষলাঘাতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মৃত্যু থেকেই আধুনিকতার জন্ম। যে-কারণে, তাঁর বিবেচনায় মানবেতিহাসে আধুনিকতার জন্মদিবস ১৮৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর যেদিন ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিজ’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। যাইহোক, আইয়ুব অস্তিত্ববাদী দর্শনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রাচীন দার্শনিকদের মতো তিনিও মনে করতেন যে, বিস্ময় দর্শনের সূত্রপাত। মানুষ যে কেবল জৈবজগতের অধিবাসী তা নয়, সে অধ্যাত্মলোকেরও পরিব্রাজক, তারই অভিজ্ঞান রয়েছে এই শাশ্বত বিস্ময়বোধে। দেবর্ষিও মনে করেন, মহৎ গল্প প্রকাশ করে বিস্ময়, গল্পকে মিথিক করে তুলতে পারলে বা প্যারাব্‌লকে আধুনিক জীবনে মিশিয়ে দিতে পারলে এই বিস্ময় সৃজিত হয়। তিনি আরও মনে করেন, শিল্পের কাজ নব-বাস্তবতা সৃজন, নব মিথ নির্মাণ যা হুবহু বাস্তবে নেই অথচ আছে মানুষের মনে। আশি ও নব্বই দশকের বাংলা গল্পে জীবনের অনন্ত স্বপ্ন ও আনন্দের উৎসরূপে এই নতুন মিথ নির্মাণ দেবর্ষি ছাড়া আর কেউ করেননি। বিশ্বময় নাস্তিতে যে-আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতা তাতে দেবর্ষি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি দার্শনিক প্রস্থানভূমি নির্মাণ করেছেন। বস্তুত তাঁর গল্পাবলি পড়লে বোঝা যাবে যে, প্যারাব্‌ল রচনার দিকেই তাঁর ঝোঁক তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ‘নৈঃশব্দ্য’ তাঁর একটি প্রিয় শব্দ। হোর্হে লুই বোর্হেসের ঢঙে আলো, অনুশোচনা, কান্না, দর্পণ, প্রশান্তি, স্বপ্ন, বৃষ্টি তাঁর গল্পে বার বার ঘুরে-ফিরে আসে।

ঈশ্বরকে নিয়ে খেলা করার ঝুঁকি নেবার ক্ষেত্রে দেবর্ষির দুঃসাহসিকতা উল্লেখ্য। তিনি বলেন, শিল্পক্রিয়ায় নব বাস্তবতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মনসিজ বাস্তবতার ভূমিকা প্রবল এবং সেখানে কল্পনার ভূমিকাও অতীব গুরুত্ববহ। তিনি মানুষকে বুঝতে চান তার আর্কিটাইপাল স্তর বা আদিরূপ থেকে। সচেতনভাবেই গল্পকে ঈষৎ মেটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যাগত করে তুলতে চান। তাঁর গল্প যতই এগোতে থাকে ততই তার গা থেকে খসে পড়ে চরিত্র বা স্থান-নাম; আর মৃত্যু, ধ্বংস, আত্মহনন, ভয়, বেদনা, ভূমিকম্প যেমন গভীর থেকে গভীরতর তাৎপর্য পেয়েছে তেমনই স্বপ্ন, কল্পনা, অমরতা, সুখ ও অন্বেষণের অভীপ্সা, সক্রিয়তা পাশাপাশি উপলব্ধিকে প্রসারিত করেছে।

দেবর্ষির চিন্তনে মৃত্যু না থাকলে আমাদের সুখ ও আনন্দ অপরিপূর্ণ। আবার মৃত্যুতে আস্থা না রাখলে বেদনা বা বিরহের বোধ জন্মায় না। এটাই ঈশ্বর বা ঈশ্বরহীনতার বোধ। মৃত্যু যেহেতু তাঁর গল্পে প্রতীকী তাই বলা যায় মৃত্যুতে বাইরের জগতের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন হয় বটে কিন্তু আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি সংগৃহীত হতে থাকে— মিশরীয় বা তিব্বতীয় শাস্ত্রানুযায়ী এই মৃত্যু নিয়ে আসে এক সাইকিক জার্নি। ফ্রয়েড বলেছেন, “If you would endure life, be prepared for death”. ফ্রয়েডীয় ভাবনায়, এই প্রিয় অনুকূল পৃথিবীতে ব্যক্তি তার বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্তি পেতে পারে একমাত্র মৃত্যু সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্গঠিত করে। মৃত্যু মানুষকে ধ্বংস করে কিন্তু মৃত্যুভাবনা তাকে রক্ষা করে। তাই দেবর্ষির গল্পপাঠে মনে হয় every idea about death is a version of life.

আবার তাঁর গল্পে যৌনতার অভিঘাত বা নারীর ভূমিকা নেই বললেই চলে। হয়তো গভীরতর উপলব্ধি অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব, অস্তিত্বতত্ত্ব তাঁকে এতটাই আলোড়িত করেছে যে যৌনতার সুড়সুড়ি আকর্ষিত করেনি। সমসাময়িক জীবনকে সমসাময়িকতার নিরিখে দেখানোতে তাঁর তীব্র অনীহা। তাঁর গল্পে মানুষ ও ইতরেতর প্রাণীর নৈকট্য লক্ষণীয়। তাঁর গল্পের কাঠামো সরল, নিয়ো কসমিক; যেখানে গল্প প্রতীকের আশ্রয়ে সত্যের কাছে পৌঁছুতে চায় সেখানে ভাবুকতার ভান নেই এবং এই নতুন পৃথিবী নির্মাণের তিনি নিপুণ কারিগর।

তাঁর ‘গল্পকুঞ্জ’ গ্রন্থের ভূমিকায় রাহুল দাশগুপ্তও মোটামুটি একই ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনিও বাংলা গল্পে দেবর্ষির পূর্বসূরী খুঁজে পান না। কাফকার প্যারাব্লের সঙ্গে তাঁর লেখার মিল খুঁজে পান। দেবর্ষিকে বলেন, বাংলা সাহিত্যের কাহলিল জিব্রান। যে-ঈশ্বরভাবনা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর সেভাবে আর কেউ ভাবেননি; সুতরাং সাহিত্যে ঈশ্বরকে যিনি আবার ফিরিয়ে আনলেন তিনি দেবর্ষি সারগী।

এখন প্রশ্ন হল, ঈশ্বর বলতে কী বোঝেন দেবর্ষি? তাঁর মতে জন্মগ্রহণে মানুষের হাত নেই, কিন্তু জীবন নামক সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব তখনই অর্থপূর্ণ হয় যখন ঈশ্বর বিষয়ে ইতিবাচক ভাবনা থাকে। দেবর্ষির ঈশ্বর আর অস্তিবাদীদের ঈশ্বর স্পষ্টতই ভিন্ন। দেবর্ষির নির্মিত ঈশ্বর যেখানে অপরিহার্য সেখানে অস্তিবাদীদের ঈশ্বর পরিত্যাজ্য। অস্তিবাদীদের good faith আর bad faith-এর উপকরণ ব্যবহার করেই তিনি স্বতন্ত্র ডিসকোর্সের জন্ম দিতে চান। তাঁর মতে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করাটাই গুড ফেইথ। জগতের প্রতিটি ঘটনা, বস্তু যখন অস্থায়িত্বের শিকার তখন কি মরণেই সব শেষ? এখানেই দেবর্ষির ঈশ্বর বলেন, সবই বেঁচে থাকে। টিকে থাকে। কোথায়? ঈশ্বরের স্মৃতিতে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও, গোটা জগৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তা টিকে থাকে ঈশ্বরের মনে; জগৎটাই তাঁর মগজ, তাঁর সমস্ত স্মৃতির আধার।

এতাবৎকাল প্রস্তাবনা হিসেবে যে-সমস্ত আলোচনা, উদ্ধৃতি, বিশিষ্টজনের বক্তব্য, গল্পকারের স্বাভিমত রাখলাম, সেইসব সংসৃষ্ট অভিজ্ঞান সঙ্গে করে আমরা প্রবেশ করব দেবর্ষি সারগীর গল্পের অন্তরপথে। বুঝে নেব, মিলিয়ে নেব তাঁর ভাবনানিচয়। পরবর্তী আলোচনায় আমি তাঁর তিনটি গল্পগ্রন্থ থেকে দশটি গল্প চয়ন করেছি। ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ থেকে পাঁচটি, ‘গল্পকুঞ্জ’ থেকে চারটি আর খানিক ভিন্ন ভাবনা থেকে একটিই গল্প বেছেছি ‘নির্বাচিত গল্প’ থেকে। শুরুতেই বলি, লেখকের বয়ান অনুসারী না হয়ে এই গল্পাবলির একটি বাদে বাকিগুলি খুব ছোটো নয় বা সেখানে স্থান-চরিত্রের নামেরও উল্লেখ আছে।

প্রথম আলোচনীয় গল্প ‘মৃগনাভি’ যা নিছকই চারজন সরল ডাকাতের অসরল যাপনের আখ্যান— ভিন্ন মাত্রায় দ্যোতিত হল তখনই যখন গল্পকার শুরুতেই জানিয়ে দেন যে, চারজনের একজন সনাতন হঠাৎই ডাকাতি ছেড়ে নির্বিষ যাপনের সামিল হল এবং ফলত সঙ্গীদের জ্ঞাতিরোষের অন্যায় শিকার হল। কিন্তু সে-নির্মম হত্যার মূলীভূত কারণও অধরা থেকে গেল সঙ্গীদের কাছে; পারদ যেমন ধরা যায় না, পিছলে পিছলে যায়, দুর্মূল্য হীরকখণ্ড যেমন সকলে ছুঁতে পারে না— ঠিক তেমনই সঙ্গী জংলাও খুঁজে পায় না সনাতনের গহিন কন্দরে লুকোনো আত্মসৌরভের সন্ধান; যেমন কস্তুরীমৃগ ছাড়া সন্ধান মেলে না দুর্লভ মৃগনাভির— তা সে মৃগকাজে যতই থাকুক মগ্ন হিংস্রতা।

এই গল্পে লেখক যে-সব জায়গার নাম ব্যবহার করেছেন তা তাঁর বালকবেলার পরিচিত। যেমন আরবপুর, বাথানপাড়া, কুমড়ি, নাটনা, কাঁঠালিয়া, শিকারপুর— এ-সব তাঁদের নদিয়া জেলার বাসগৃহ সংলগ্ন এলাকা যদিও গল্প-ঋদ্ধিতে এসবের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর। যাইহোক, সংক্ষেপে গল্পটা এইরকম: এক ডাকাতি-অনিচ্ছার রাতে যখন চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে তারা বসেছিল একটা ছইওয়ালা গো-গাড়ি ‘রাস্তায় পড়া তাদের চারটে ছায়া পিষে দিয়ে গেল’। এই প্রতীকী রোষ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা গাড়ির ভিতরের দরিদ্র নবদম্পতিকে আক্রমণ করে বসল। পরিচিত সন্দেহে মুন্সি বরটাকে থেঁতলে দিল যা জংলা চায়নি। না, কচি বউটাকে কচলাতেও নয়। সে ভেবেছিল ‘কচি ছুঁড়িকে না হয় বাঁচালই একদিন, বলা যায় না ঈশ্বর তার আর সব ভুলে গিয়ে হয়তো ওটাই মনে রাখবে’। কিন্তু ঘটনাচক্রে সনাতনের হেফাজতে থাকা বউটি তার অজান্তেই তার হাতে খুন হয়ে গেল। এই অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিঘাতে সনাতন অদ্ভুত এক মনখারাপি যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়। সে-সব ছেড়েছুড়ে বেমক্কা বেপাত্তা হয়ে যায়। ফিরে আসে দীর্ঘ ছ-বছর পর যখন সে এক পালটে যাওয়া সনাতন। রূপান্তরিত সনাতন সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য: “রূপান্তর চিরকাল ঘটে নেপথ্যে, গোপনে… মানুষের জীবনে নির্জনতার একটাই ভূমিকা তা হল নির্জনতা পালটে দেয় মানুষকে।” এভাবে পরিবর্তিত সনাতন ছোট্ট চায়ের দোকান দিয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলে তার কুকর্মের সাগরেদরা শুধু ক্ষুব্ধই হয় না, হয়ে ওঠে হিংস্রও। প্রথমে বাজে কথায় উসকাতে চায় অবিচল সহাস্য মানুষটিকে। সে এক আশ্চর্য হাসি যার মাঝ থেকে পূর্বসঙ্গীরা আবিষ্কার করে তাদের প্রতি স্পষ্ট বিদ্রূপ। সনাতনের মন জুড়ে ছোট্ট মাছেদের মতো তিরতির সুখ। “হাসিস কেনে সব সময়?”, ওরা জানতে চাইলে সে বলে, “হাসব কেনে? ওটা তোদের মনের ভুল।” একদিন ডাকাতি করতে গিয়ে মার খেয়ে ফেরা দলটি সনাতনের দোকানে বসলে আবার সেই হাসির আক্রমণ; কিছুতেই পিছু না-ছাড়া হাসি দেখে একজন বলে, “হাসছিস কেনে?… আমরা মার খেয়েছি বলে খুব মজা লাগছে না? আজ তোর ঠোঁটদুটো ছিঁড়েই নেব শুয়োরের বাচ্চা।” অন্তর্গত ক্রোধে ফেটে পড়ে তারা সনাতনকে মারধর করলেও হাসির উৎস খুঁজে পায় না। অধরা সনাতন এবার বলে, “আমার শরীরের মধ্যে কোথাও একটা মৃগনাভি লুকিয়ে রেখেছি। হরিণের মধ্যে ওটা যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে সুবাস ছড়ায়, আমাকেও তেমনি দিনরাত মাতিয়ে রাখে গো! দিনরাত আমোদে রাখে।” সনাতনের এই নবলব্ধ অভিজ্ঞানের ধরতাই পায় না বন্ধুরা আর তাদের রোষানলে ঘি ছিটোয় হোমগার্ড হরির সঙ্গে সনাতনের অশ্রুত বাক্যালাপ। সনাতনকে খুন করবে বলে তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়; ওর মুখের হাসি ঘুচিয়ে দখল নিতে চায় সুপ্ত মৃগনাভির। বলে, “তোর হাসি আজ জন্মের মতো মুছে দেব রে ঠোঁট থেকে।” সনাতনও এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর তারা অমানিশার শ্মশানে জংলাকে খুনের দায়িত্ব দিলে সে কাটারি দিয়ে ফালাফালা করতে থাকে সনাতনের দেহ, দেহকোষ আর উন্মত্ত চিৎকারে বলতে থাকে, “কোথায় লুকিয়েছিস রে সনাতন… কোথায় রে? ওডা আমায় দে, আমিও একটু ধারণ করি শরীরে…।” আক্রোশ আর আকুতি মিলেমিশে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “জীবনের কডা দিন আমিও একটু হেসে বাঁচি। কই রে? কোথায় ওডা কোথায় লুকিয়েছিস?” এরপর বিধ্বস্ত জংলা, হতাশ জংলা কাটারি মাটিতে ফেলে “নির্নিমেষ চেয়ে রইল সনাতনের শরীরের গূঢ় গহ্বরগুলির দিকে”। তারপর সেও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

মৃগনাভির প্রতীক এখানে জীবনের অপ্রাপণীয় প্রশান্তি যা আধুনিক যাপনের পাশবিকতার, জান্তবতার প্রতি এক প্রতিস্পর্ধী মাধুরী, অধরা অথচ ক্রমমুক্তির রক্ষাকবচও বটে। গল্পশেষের এই নৃশংস দৃশ্যের সঙ্গে সুফি সাধক মনসুর হেল্লাজের জীবনান্ত তুলনীয়। মনসুর সাধনার এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন যে আল্লাহর থেকে পৃথক করতে না পেরে নিজেকে ‘আনাল হক’ (আমিই সত্য) বলে দাবি করেছিলেন। শরিয়তের বিধানে এই গর্হিত অপরাধের জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর রক্ত থেকে, দেহের টুকরো টুকরো করা মাংস থেকে এমনকী মাংস-পোড়া ছাই থেকেও ‘আনাল হক’ ধ্বনিত হতে থাকে এবং শেষ অব্দি সেই ছাই সাগরে নিক্ষেপ করলে সাগরের জল ফুলেফেঁপে শহর ভাসাতে উদ্যত হয়। পরে তিনিই সেই শহরকে রক্ষা করেন। এ-হেন সুফিবাদী প্রভাব দেবর্ষির অনেক গল্পের নির্যাস।

দ্বিতীয়টি প্রথম বইয়ের নামগল্প ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ যা লিখিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে। এ-গল্পের প্রথম বাক্যই সিদ্ধান্তদায়ী— ‘রাজার জ্ঞানী হবার সম্ভাবনা কম’। কারণ, জ্ঞানবৃদ্ধি ঘটলে অস্বীকরণের ধৃষ্টতা গজায় এবং “রাজ্যভোগ আর অস্বীকরণ এক সঙ্গে চলতে পারে না।” গল্পের এক বিশেষ ভূমিকায় এক বৃদ্ধ পল্লবরাজ যার রাজসভায় একদিন এক যুবক এল, বাবার সঙ্গে। সে রাজকবি হতে চায়। রাজা তার কবিতা শুনতে চাইলে সে চারণকবিদের ঢঙে বলে “আমি মুখে মুখেই কবিতা তৈরি করার অভ্যেস করেছি।” অবাক রাজা ভাবে লিখে না রাখলে তো হারিয়ে যাবে! এর পরিপ্রেক্ষিতে যুবকের দৃঢ় বক্তব্য, “মহৎ ও সার্থক কবিতার লক্ষণ হল তা লোকের মুখে মুখে ফেরে (parabolic idea)।” আবার এও বলে, “মানুষ ভুলে যায় যে কবিতা তা মহৎ হয়নি বলেই ভুলে যায়।” এরপর রাজার নির্দেশমতো সে বর্ষার রূপকল্পে একটি কবিতা শোনায় এবং বলে, “বর্ষাই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ঋতু।” রাজা সন্তুষ্ট হয় না; দ্বিতীয় বারে হেমন্ত ঋতুর কবিতা শুনিয়েও সে প্রত্যাখ্যাত হয়। হয় বিমর্ষ, অপমানিত। সে এমন এক জায়গায় চলে যেতে চায় যেখানে তার প্রতিভার কদর হবে। তবুও সে তৃতীয় বারের কথা ভেবে উৎফুল্ল হয়— রাজা নিশ্চিত এবার আর তাকে ফেরাতে পারবে না কেন-না তার ধারণায় “একই লোক একই জায়গায় পরপর তিনবার বন্যায় ভেসে গেছে, পরপর তিনবার আগুনে পুড়ে গেছে, পরপর তিনবার ভূমিকম্পে আহত হয়েছে, তা কি হয় কখনও?” তাই এবার সে ভিন্নতর ভাবনা নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা রচনা করে, প্রৌঢ় রাজার তা হয়তো মন্দ লাগবে না। এই কবিতায় সে দেখাল “নারী ছাড়া জগৎ ও জীবন কেমন মরুভূমি, খাঁ খাঁ আগুনের মতো দুঃসহ”। এই কবিতা শুনে রাজা এক আশ্চর্য সুন্দরীর প্রেম-তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে কবিতাটির শক্তি স্বীকার করলেও তার রাজকবিসুলভ হয়নি বলে তাকে আবার ফিরিয়ে দিল।

চরম হতাশা আর চাপা ক্রোধে অস্থির হয়ে সে পরদিন ভোরে রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। মানুষের সান্নিধ্য তার অসহ্য ঠেকছিল। সৌমনস্য নির্জনতার আকাঙ্ক্ষায় সে এক নিঃশব্দ জঙ্গলে প্রবেশ করল আর “এই প্রথম যুবকটির ভিতর জগৎকে ক্ষমা করার এক আশ্চর্য অনুভব এল। সে মনে মনে রাজাকে ক্ষমা করল”। সঙ্গে আনা তরোয়ালের গায়ে চুমু দিল। জঙ্গলের মাঝে সে এক অর্ধনগ্ন মানুষকে দেখল। দু-জনের মাঝখানে হঠাৎ এক নেকড়ে হাজির হল যে মানুষটির পা জড়িয়ে গড়াগড়ি খেয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। মানুষটির “তকতকে নির্মল গা, মুখটা তৃণভোজী জীবেদের মতো শান্ত”। অচেনা নেকড়ে কীভাবে শান্ত হল, সেই ভাবনায় যুবকের সামনে উঠে গেল জগতের নিগূঢ় রহস্যের পর্দা। তারপর হঠাৎ সেই অচেনা মানুষটি উধাও হয়ে যায়। সে জানতে পারে “ও রকম অর্ধনগ্ন, ঘুমঘুম মানুষ এ জঙ্গলে বহু আসে। তারপর কোথায় চলে যায়”।

এদিকে রাজা যুবকটির অপেক্ষায় অস্থির হয়ে তার খোঁজে লোক পাঠিয়ে সঠিক সন্ধান পায়। তারা বলে, সে আরও সুন্দর হয়েছে। তার মুখে আলো ফেলতেই সেই মুখ আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে। রাজা আস্বস্ত হয়ে নিজেই ছদ্মবেশে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়ল এবং তার দেখা পেল। তার “তকতকে নির্মল গা, একজোড়া ঘুমমাখা রহস্যময় চোখ। আর মুখটা তৃণভোজী জীবেদের মতো শান্ত… ভেতরটা পাকা ফলের মতোই হলুদ, পরিপূর্ণ”। তার সঙ্গী এক অজগর। হতবাক রাজা কী বুঝে তৎক্ষণাৎ তাকে রাজসভাকবি নিযুক্ত করল কিন্তু রাজাকে ততোধিক হতবাক করে যুবক বলল, “আমি যে আমার সব কবিতাই ভুলে গেছি।… আমি যে আর কবিতা রচনা করতে পারি না মহারাজ।” সে আরও ধোঁয়া ছড়িয়ে বলে, “যা বলতে চাই তা আদৌ সম্ভব নয় বলেই হয়তো ভুলে গেছি।” বিস্ময়াবিষ্ট রাজা এরপর তাকে নানান প্রলোভন দেখালেও যুবকটি তাকে ফিরিয়ে দিল। রাজা রোষকষায়িত হলেও যুবক অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিবশ রাজা টলতে টলতে অন্ধকার জঙ্গলে হেঁটে চলে— পাশে পাশে এক নেকড়ে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চলে।

এ-রূপকধর্মী গল্প শিল্প রচনা-সক্ষমতার এক মনোরম প্যারাব্ল। এখানে নৈঃশব্দ্যের ভূমিকা গুরুত্ববহ যা চেতনায় প্রাখর্য আনে, অন্তর্গত সত্তাকে বসায় মুখোমুখি; উন্মোচিত করে জীবজগতের অরাল অধরা রহস্য।

তৃতীয় গল্প, ‘কমিউনিস্ট দেশের নটরাজ’ যা তিনি লিখেছিলেন ১৯৮৬-র মার্চে। পঞ্চাশের দশকে কেরালায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময়ে নটরাজ নামধারী একজনের সম্পর্কে এক কাল্পনিক বয়ান, গল্পকারের স্বকীয় ধ্যানধারণা ও কল্পিত দর্শন মোতাবেক। সেখানে গল্পকারের সাংবাদিক বন্ধুটির (আসলে গল্পকারের) মতে “সাম্যবাদের মূলমন্ত্রটা এক সময় প্রচার করবে শোষকেরাই… কাজ, নির্ঝঞ্ঝাট রোজগার, বিশ্রাম, বিনোদন এ সবের কাঠামোয় সুষ্ঠুভাবে ভাগ করে নিতে চাইবে জীবনটাকে। আর বুঝবে তাতেই বেশি শান্তি। শোষণের সঙ্গে মন ও শরীরের যে নিরন্তর চাপ জড়িয়ে থাকে এক সময় তা আর সহ্য হবে না তাদের।… অতীতে শোষকেরা খুব নিশ্চিন্তে শোষণ করতে পারত। কারণ সাধারণের ভিতর তখন সংগ্রাম চেতনা গড়ে ওঠেনি। শোষিতেরা তখন ভাবত তাদের দুঃখদুর্দশার কারণ ঈশ্বর আর তাদের পাপ”। শোষকেরা ভাবত ঠিক উলটোটা। পরে মানুষ যখন উপলব্ধি করেছে ঈশ্বর স্বয়ং শোষণকে ঘৃণা করেন তখন এ-যুগের শোষকদের মনে এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা গড়ে ওঠে। এভাবে চাপ বাড়তে থাকলে তারা নিজেরাই সমবন্টনের শ্লোগান তুলবে কেন-না “নিরন্তর আতঙ্কে ভোগার চেয়ে রাজারাও আত্মহত্যা বেশি পছন্দ করে। কিংবা দেশ ছেড়ে পালায়”। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছে কিংবা জগৎজুড়ে মানুষ এক অভিযোগহীন জীবনযাপন করছে— এরকম পৃথিবী তো ভয়াবহ। এমন বৈচিত্র্যহীন বিশ্বে আত্মহত্যা করা ছাড়া মানুষের মুক্তির আর কোনো পথ খোলা থাকবে বলে মনে হয় না। এমন সমাজ ইউটোপিয়ান। আসলে এ-কথায় তামাশা আছে। বাস্তবত রক্তাক্ত বিপ্লব ছাড়া শোষণ দূর হয় না; কিন্তু সম্পদের সমবন্টনেই যে সার্বিক সুখ লুক্কায়িত, এ অনেকটা রূপকথাসুলভ। সম্পদ-বৈভবে আখেরে মানুষ সুখী হয় না। এই গল্পে একজনের কথা আছে যে অপরূপ সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তার একান্ত ইচ্ছে জন্মেছিল, সুখলাভের জন্য জগতের সঙ্গে একাত্ম হতে। তাই “পৃথিবীর ধুলোর ভিতর, নক্ষত্রের আলোর ভিতর, গোধূলির ধীর ছায়ার ভিতর, রাত্রের অন্ধকারের ভিতর, ফুলের পরাগের ভিতর, মাটির নিচের নিশ্চিন্ত নৈঃশব্দ্যের ভিতর সে তখন গলে গলে যেতে চায়”।

এবারে নটরাজের কথা যাকে পাগলাগারদে রাখা হয়েছিল আর সেখানেই অধর্ষণীয় একাকিত্বে সে উপলব্ধি করেছিল তার চেতনার সত্যসন্ধী প্রখরতা। তার সঙ্গে সেখানে যে-বই-দু-টি ছিল তা সেই রাজ্যের সশস্ত্র বিপ্লবের ও তার সাফল্যের কাহিনি-সম্বলিত। নটরাজের বাবা সশস্ত্র বিপ্লবের অংশীদার ছিল। বেশ কিছু হত্যাশেষে সেও খুন হয়ে যায়। রাজ্যে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে নটরাজ পোস্টমাস্টারের চাকরি পায়। তার টেলিফোনে অপারেটর স্ত্রী হেমা যুক্তিবাদী মননের অধিকারী। পরবর্তীকালে তাদের সাত বছরের সন্তান দুর্ঘটনায় মারা যায়। “শীতের দুপুরের স্নিগ্ধ রোদের মতো” তাদের ছকে বাঁধা জীবন চলতে থাকে। রাজ্যের সমস্ত উৎসব থেকে ছেঁটে ফেলা হয় “সামন্ততান্ত্রিক জৌলুস ও কুসংস্কার”। ভাববাদী সাহিত্য পড়ার দিন ফুরিয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মন বড়ো আশ্চর্য। প্রাথমিক সকল চাহিদার নিবৃত্তি ঘটলে জেগে ওঠে অন্য প্রবৃত্তি। কারো কারো জীবনে টান পড়ে মাধ্যাকর্ষণের। মানুষ ছোটে সেই অসেতুসম্ভব আকর্ষণে। এভাবেই একদিন নটরাজের প্রতিবেশী একদা বিপ্লবী চন্দ্রচূড় বলে তার স্ত্রী মোট আটবার একই স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নটা হল “সাদা দাড়ি ও টাক মাথার এক বৃদ্ধ প্রতিবারই দাঁড়িয়ে থাকে এক বিশাল নির্জন মাঠের ওপর। সময়টা কেমন গোধূলি গোধূলি। আকাশে অন্ধকার”। এরপর বিপ্লবকালে মন্দির ভেঙে ফেলে সেখানে সরকারি অফিস বানানো হয়েছে; গির্জায় যিশুর মূর্তি ভাঙা হয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ে মসজিদের গায়ে হাত পড়েনি— এইসব বক্তব্য আছে। অবশ্য লেখক চন্দ্রচূড়ের মুখ দিয়ে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করে বলেন, “মন্দির না করে দিলে ঈশ্বর থাকার জায়গা পাবেন না, আমি মানি না তা।” হঠাৎই টানা বৃষ্টিতে জেরবার হয় রাজ্যবাসী, বসে বসে হাই তোলা ছাড়া কাজ থাকে না। অনেকে জীবনে প্রথম উপলব্ধি করল কাজ ছাড়া মানুষের জীবন কী ভয়াবহ, কী নিষ্ঠুর! নাগাড় স্থবির নিঃশব্দ অবস্থায় নটরাজের মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তাসূত্র গ্রথিত হতে লাগল। বিশ্বের তাবৎ বস্তুর উৎস খুঁজতে লাগল সে। ঘুরতে লাগল যত্রতত্র, সকলের অজ্ঞাতে। নটরাজের নতুন ভাবনায়, “ঈশ্বরও বিপ্লব চান।… ঈশ্বরবিশ্বাস যে আদপে শ্রেণি-অত্যাচারেরই ফলশ্রুতি, শোষকেরা ওটা ব্যবহার করেছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে আর শোষিতেরা দুর্দশা ভুলবার পথ হিসেবে— সে নিজে এক সময় বিশ্বাস করত এ মতবাদে। আজ তাদের দেশে অত্যাচার নেই। শোষণ নেই।… মানুষ খেয়ে-পরে তৃপ্তিতে আছে। তবু কী করে জাগল তার ভিতর আবার ঈশ্বর সম্পর্কে ক্ষুধা ও কৌতূহল? কেন জাগছে? কোথায় লুকিয়ে এ রহস্যের উৎস?” একদিন তার মনে জাগে, জগৎ ও জীবনের সকল সত্য দ্বিখণ্ডিত ফলের মতো। গোটা সত্যটি পেতে দুটোকেই মেলাতে হবে। সে আরও ভাবল “মানুষকে সুখী করার জন্য দরকার দুটো বিপ্লব। একটা তাদের দেশে হয়ে গেছে, অন্যটা বাকি।” মাথা বিগড়েছে ভেবে হেমা মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। নটরাজকে এক নিরিবিলি স্থানে ঘাসের ঢিবির ওপর বসে থাকতে দেখে, পাশে পড়ে থাকা শিলাখণ্ডে আঁকিবুঁকি কাটছে। তার মনে হচ্ছে এগুলোর মধ্যে মানুষ ও জন্তু লুকিয়ে আছে। আবার শিলাগুলিকে তার মনে হচ্ছে বিপ্লবকালে মন্দির থেকে ছুড়ে ফেলা মূর্তি সব। এই অবস্থায় তাকে দেখে হেমা ডিভোর্সের কথা ভাবে আর ডাক্তার ভাবে, “আদিম মানুষের শুরুর অবস্থায় আবার পুরোপুরি ফিরে যাবার আগেই সারিয়ে তোলা দরকার নটরাজকে”।

অবস্থান্তরিত ব্যক্তিত্বের জটিল বিন্যাস, গল্পের মধ্যে গল্পকথন, স্বপ্ন ও বৃষ্টির তাৎপর্যময় ভূমিকা, এ-গল্পের মূলভাব। দেবর্ষি তাঁর গল্প-বিষয়ক এক বক্তব্যে বলেন, “বাস্তবের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় ঘটনা বা মানুষ বা সংকট দেখার পর আমি ওসব নিয়ে একটি দুঃস্বপ্ন বা সুখস্বপ্নও দেখি এবং গল্প লেখার সময় ওই স্বপ্নেরই বিবরণ দিয়ে যাই।… বস্তুত স্বপ্নে যা দেখি জাগরণের বাস্তবতায় তা অবিকল খুঁজে না পেলেও স্বপ্নের স্মৃতিটা তো থেকেই যায়।”

উনিশ শতকের শৃঙ্খলিত কল্পনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন কাফকা। স্বপ্ন ও বাস্তবের ভূমিকা হয়েছিল একাকার। এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট বোঝে মানুষের সমগ্র ইতিহাস চলেছে অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে। সৌন্দর্য ও শান্তির অভাব যে কমিউনিস্ট ব্যবস্থাতেও থাকে, এই বক্তব্যেই দার্শনিক মাত্রা নিয়ে আসেন দেবর্ষি— অবধারিত ঈশ্বর-প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে।

১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি লেখেন ‘ঈশ্বর, মানুষ ও নাটক’। প্রেক্ষিত, দু-হাজার বছর আগের গ্রিসের দেলাসের নাট্যশালা দর্শন। গল্পকারের সঙ্গী ইতিহাসের অধ্যাপক পথপ্রদর্শক গ্রোসোল ও সঙ্গে তার স্বল্পবাক স্ত্রী ইসাবেলা। গ্রোসোলের মতে ভারতীয়রা প্রখর যুক্তিবাদী। তারা হেঁটে চলেছে খাঁ-খাঁ শূন্যতা আর ভগ্নস্তূপের মাঝ দিয়ে। এখানেই এক সময় বিশ্বের বৃহত্তম দাস-বাজার ছিল। দেলাসের মানুষ দাসেদের চাইতেও অধিক ঘৃণা করত কুকুরদের কেন-না তাদের প্রিয় খরগোশ আর তিতিরদের মেরে ফেলত কুকুরেরাই। তাই তারা কুকুরীদের মেরে তাদের পেট চিরে বাচ্চা বের করে আনত; তাদের ভয় ছিল “কুকুরী মরলেও পেটের ছানারা জ্যান্ত বেরিয়ে আসতে পারে।” ইসাবেলা এতে হেসে উঠলে গ্রোসোল বলে “একজন ঐতিহাসিকের চোখে সবকিছু ধরা পড়বে তা ত সম্ভব নয়। অনেক সত্যকে তাই কল্পনা করে জেনে নিতে হয়।” এ-কথায় গল্পকার-কথক বলে ওঠে, “আপনি তাহলে স্বীকার করছেন যে সত্য আবিষ্কারে কল্পনার একটা ভূমিকা আছে।… যে সত্যে বিন্দুমাত্র কল্পনার সুযোগ নেই সে সত্যে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে মানুষ।” আর থাকে ঈশ্বরের জুড়ে রাখা জীবন ও জগতের মিলিত রহস্য; এই রহস্যের পর্দা ঈশ্বর সরিয়ে নিলে চিন্তাহীন মানুষ গাছ-পাথরের মতো নিথর হয়ে যাবে। দেলাস অ্যাপোলোর জন্মভূমি। “তাঁর রাজত্বকালে জন্ম ও মৃত্যু দুটোই ছিল নিষিদ্ধ”। এক গভীর ভাবনা-উদ্রেককারী মিথিক্যাল বিধান। এরপর ক্লিয়োপেট্রার ভাঙা প্রাসাদ নজরে পড়ে। তারপর উপত্যকার মতো এক সমতলভূমি যার মাঝখানে “ঘোড়ার নালের মতো দেখতে একটা ঘেরা জায়গা”। দেলাসের নাট্যশালা। সমস্ত জগতের প্রতীক হয়ে ওঠে সেই স্থান কেন-না “জীবন ও জগৎ বুঝতে হলে নাটক ও নাট্যশালাকে বুঝে নেওয়া দরকার”। এরপর ভগ্ন নাট্যশালার সারি সারি প্রকোষ্ঠের একটা থেকে কথকের কানে “ভেসে এল কেমন ফিসফিসানির শব্দ… পরক্ষণেই বাতাস ভেদ করে মানুষের স্পষ্ট কণ্ঠস্বর”। গ্রোসোলের গলা। ইসাবেলার সঙ্গে বিশ্রী ভাষায় ডিভোর্স সংক্রান্ত বাদানুবাদ চলছে। হঠাৎ কথকের ডাকে চমকে গ্রোসোল স্বাভাবিকতার ভান করে বলে, “নাট্যশালায় এসে আমিও একটা নাটকের চরিত্র হয়ে গিয়েছিলাম। একজন খুনি স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করছিলাম।” ইসাবেলা দু-জনকেই চমকে দিয়ে বলল, “তুমি ত অভিনয় করছিলে না। তুমি সত্যি সত্যি খুন করতে চেয়েছিলে আমাকে।” পরে অবশ্য গ্রোসোলও তা স্বীকার করে যে, ইসাবেলা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে তাই ভালো লাগার ঘৃণার্হ অভিনয় সে আর করে যেতে পারছে না; এবং এ-কারণেই সে বলে, “আমি অভিনেতাদেরও ঘৃণা করি। কেন-না তাদের সব মিথ্যে। তাদের হাসি, তাদের দুঃখ, তাদের কান্না। তাদের ভদ্রতা। মঞ্চের উপর তাদের জন্ম মঞ্চের উপর তাদের মৃত্যু— সব মিথ্যা।… আমার মনে হয় ঈশ্বরও তাই। মিথ্যেবাদী অভিনেতাদের চেয়ে তিনি বরং সত্যবাদী খুনিদের বেশি পছন্দ করেন।” এ-কথায় কথক খানিক থমকে বলে, “না, ঈশ্বরও আসলে অভিনয়ই পছন্দ করেন। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর নিজেও যে সবচেয়ে বড় অভিনেতা।” এমনকী ক্রুশবিদ্ধ যিশুও “জগৎ জুড়ে নাটকের স্বার্থে কষ্ট পাওয়ার নিদারুণ অভিনয়টা করে গেলেন”। কথকের শেষ বক্তব্য গল্পের নির্যাস: “ঈশ্বর চান না খুনিরা এ রহস্য জেনে ফেলুক।” জানলে মানুষ নির্দ্বিধায় খুন করবে। এ-জগৎ এক বিশাল নাট্যমঞ্চ আর আমরা এক-একজন অভিনেতা— শেকসপিয়ারের এই উক্তি সর্বজ্ঞাত। কিন্তু তাকে নিয়ে যে ধূমল রহস্য তা জিইয়ে রাখেন গল্পকারের কল্পিত ঈশ্বর। মানুষের অভিনয়ের পদে পদে রহস্যের আবিষ্কর্তা তিনিই— সেখানে আছে ভয়, পাপবোধ। দেলাসের রহস্যময় পটভূমিতে এই দার্শনিক উপলব্ধি ধ্রুপদী ঢঙে উপস্থাপিত।

‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’ বইয়ের শেষ গল্প ‘জাদুকর’ যা লেখা হয়েছিল ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে। এ-গল্পে জাদুকরের দর্শকেরা মোহাবিষ্ট, নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয়। যে-গ্রামে জাদুকর খেলা দেখাতে এসেছে সেখানে অবস্থিত এক দুর্গম পাহাড়ে বহুকাল আগে নাকি এক কৃষ্ণবর্ণ বালক উঠে আর ফেরেনি। এখানে ঘন জঙ্গল আর নিরুষ্ণ নৈঃশব্দ্য। এখানকার এক মহিলা চল্লিশ বছর ধরে একটুও ঘুমোয়নি। এক ধনী ব্যক্তির একমাত্র পুত্রের তিরিশ পেরোনোর পর হঠাৎ মাথায় ঢুকল “বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়া সমার্থক”। এই ভাবনার ফলস্বরূপ সে অনড়, নিশ্চল জীবনমৃত্যুর মাঝামাঝি এক স্তরের জীবনযাপন করে। অপর তরুণের অবস্থা আরও দুঃখজনক। সে প্রচুর পড়াশোনা করে মস্তিষ্কের অবচেতন স্তরের একটা অংশকে সক্রিয় করে ফেলেছে। এতে করে স্বপ্নরা তার কাছে অনেক ব্যাখ্যাতীত সত্যের সন্ধান দেয়। এমনই এক বিচিত্র গ্রাম বেছে নিল জাদুকর, আর এক অন্ধকার স্থান। তার কোনো সরঞ্জাম নেই, লাগে না বিশাল মঞ্চ। দরকার এক গভীর সুড়ঙ্গের মতো গর্ত। খেলা হবে প্রতি সন্ধ্যায়। সরল একটি খেলা। প্রতিদিন দর্শকদের দেখিয়ে সে গর্তের ভিতর ফেলে দেবে একটি হীরের আংটি। তারপর প্রত্যেককে বলবে গর্তে নেমে সেটি খুঁজে নিয়ে আসতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল “আংটিটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শকারীর সমস্ত সত্তায় জমাট বাঁধবে এক এমন পরম আনন্দের ঘোর যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত সে আর কখনই হবে না”। এই জাদুকর মানুষের স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চাইলে সব নিদ্রিত মানুষকে একই সময়ে একই স্বপ্ন দিতে পারে এবং সে তাই করল। আংটিটা যে তুলে আনতে পারবে সে পাবে অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ কেন-না “আনন্দের একটা গোপন শিরা ঘুমিয়ে আছে প্রত্যেকের ভিতরই। আংটিটার ছোঁয়ায় এ শিরাটাই শুধু জেগে উঠবে, থিরথির করে নড়ে উঠবে একটু”। এবং এই স্বপ্নের প্রভাবে অনেকের মধ্যেই পরিবর্তন দেখা দিল ও রাতের স্বপ্ন সবাই ভুলেও গেল। প্রথম দুই সন্ধ্যায় জাদুকরের কাছে কেউ আসে না, আসে ফলদায়ক তৃতীয় রাতের স্বপ্নশেষে। কাতারে কাতারে লোক এল, কল্পিত আনন্দের ছোঁয়া পেতে। সে তাদের এক বৃদ্ধের কাহিনি শোনাল যাকে ডাকাতরা খুন করলেও সে তাদের ক্ষমা করেছিল। “ঐ বৃদ্ধও নাকি কোনভাবে স্পর্শ করেছিল এই আংটি”। এই বলে জাদুকর আংটি গর্তে ছুড়ে দিলেও কেউ এগিয়ে আসে না। আসলে তারা স্বপ্ন ভুলে যাবার মতো গোটা ব্যাপারটাই ভুলে গেছে। পরদিন এক শীর্ণ, তৃষ্ণার্ত লোক এসে গর্তে নামে। খোঁজার কিছুক্ষণ পর সে হাতে পেল কিছু পরিচিতজনের ছবি, কিছু অচেনা। নিজের শৈশবের ছবিও সে দেখতে পেল। তারপর বহুকাঙ্ক্ষিত আংটির স্পর্শ পেতেই তার ঘটল বিস্মরণ। অপ্রকৃতিস্থ সে-আংটি হাতে উঠে এল। অথর্ব জড়ে রূপান্তরিত হল সে। একাকী নিশ্চল বসে থাকে। “নিজের ছায়াকেও যেন কাছে ঘেঁষতে দেয় না”। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্ত্রী তাকে সচল করতে গায়ে বিছে ছেড়ে দেয়, অর্থাৎ, এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তাকে ফেলে দিতে চায়। কিন্তু তার কোনো ভাববৈকল্য ঘটল না। চারদিনের দিন সে স্বাভাবিক হল বটে কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো নয়। সে যেন একটি গাছ হয়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল, মাথায় শালিখ উড়ে উড়ে বসতে চাইছে। কেউ তার এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে সে তাকে জাদুকরের আংটি ছুঁয়ে আসতে বলছে কেন-না এই বিষয়টি অব্যপদেশ্য— নিজে অনুভব করা যায়, বোঝানো যায় না অপরকে। গাঁয়ের ক্রুদ্ধ দারোগা তার এই চ্যাংড়ামির শাস্তি দিতে চায়। তাকে ভণ্ড, কামচোর বলে গালাগাল দেয়। এরপর সেই লোক আবার জাদুকরের কাছে এসে সকলের জন্য আংটি ছোঁয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে যাতে সব্বাই ভালো হয়ে ওঠে। জাদুকর বলে, তা অসম্ভব। সে কারণ জানতে চাইলে জাদুকর স্পষ্ট বলে, “কেননা খেলতে আসার জন্য আমি প্রতিদিন যে স্বপ্নটা দিই, অধিকাংশ মানুষের বেলায় ওটা আবার আমিই ভুলিয়ে দিচ্ছি।”

আসলে এই গল্পে জাদুকর ঈশ্বরেরই প্রতীক। তিনিও নিজস্ব নিয়মে বন্দি। তিনি প্রত্যেককে ইচ্ছেমতো বাঁচার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও নিজে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন না। অথচ দেবর্ষির ঈশ্বর মানুষকে ত্যাগ করেও যান না।

একটা হত্যা কীভাবে আত্মহত্যায় পর্যবসিত হল, সেই বাঁকসমৃদ্ধ উত্তরণের আখ্যান ‘আত্মহত্যা’— ‘গল্পকুঞ্জ’ গ্রন্থটি থেকে আলোচিত প্রথম গল্প। খুন করবে বলে শ্যামকে নদীপাড়ে নিয়ে আসে দীনু আর নারান। মুখ-হাত বেঁধে, কাদায় শুইয়ে শ্যামকে তৈরি করা হয়। শ্যাম বাধা দেয় না। তারিণীর অপেক্ষায় ওরা। সে কোদাল আনবে। কুড়ুল এনেছে নারান। তারিণীর দেরি, নারানের অস্থিরতা আর তাড়াহুড়োহীন বিষণ্ণ দীনুর মাঝে অবিরাম বৃষ্টি আর শ্যামকে নিয়ে ন্যাকড়ানেকড়ি চলতে থাকে। চলতে থাকে তাকে নিয়ে আশু করণীয় কৃত্যালোচনাও— তারিণী না এলে কী করবে, সে-ভাবনাও ভেবে রাখে ঘাতকের দল। বলিপ্রদত্ত শ্যাম বউ-মেয়ের কথা ভাবতে থাকে। সাত বছরের মেয়ে পুতুলের মুছে যাওয়া পায়ের ছাপের কথা মনে পড়ে তার। সে গল্পকারের দর্শন মোতাবেক ভাবে ‘জগৎ থেকে জিনিস একে একে হারায় কিন্তু কারও মনে থেকে যায়’। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শ্যামের নানান শারীরিক অস্বস্তি হয়। এরমধ্যে বৃষ্টি-বিষাদে আক্রান্ত দীনু হঠাৎ শ্যামকে ছেড়ে দিতে চাইলে নারান তীব্র আপত্তি করে। দীনু যুদ্ধাগত এক ক্লান্ত সৈনিকের কথা মনে করে যে ভেবেছিল ‘যাদের সে মারল, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তারা একদিন আপনিই মারা যেত। তাহলে তার কৃতিত্বটা কোথায়”। বড্ড বিড়ম্বনাময় দার্শনিক প্রশ্ন! এভাবেই কি ‘জগতের প্রতিটি হত্যা অন্যদের একটু মানবিক করে দিয়ে যায়!’ শ্যামও মৃত্যু-বিষয়ক নানান ভাবনায় জারিত হয়। সে ভাবে “হত্যা করার পর থেকে হত্যাকারীকে আজীবন পেছনদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়”। এর মাঝেই তারিণী চলে আসে। জোগাড় চলতে থাকে। শ্যাম ভাবছে, সে তো মরে যাবে কিন্তু বেঁচে থাকতে সে জীবনকে জড়িয়ে যা যা করত ওরাও তাই করবে। এই আকস্মিক ভাবনায় এক দুর্বোধ্য, বেদনার্ত, প্রগাঢ় ভালোবাসার উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হল সে। শেষ মুহূর্তে নারান যখন তার মাথার ওপর কুড়ুলটা বাগিয়ে ধরে শ্যাম মুখবাঁধা অবস্থায় চিৎকার করে বলতে চায়, “নারান, থামো থামো! নিজেকে হত্যা কেন করছ গো?”

শ্যামকে হত্যা করলে আকণ্ঠ বেঁচে থাকার যে-নিঃসীম আনন্দঘন ব্যাপারস্যাপার তাকেও তো হত্যা করা হবে। তাই সে নিবৃত্ত হতে বলে হত্যাকারীদের। আবার এমনটিও ভাবা যায়, কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারীর অন্তর্জ্বালা তাকে আজীবন পিছু ছাড়ে না— তা সে যতই লুকোনোর দুশ্চেষ্টা করুক না কেন। কেন-না বাস্তবত সব শেষ হয়ে গেলেও স্মৃতিতে থেকে যায় সবই। ব্যক্তির কিংবা ঈশ্বরের।

‘নিষিদ্ধ ধর্ম’ গল্পে উত্তম পুরুষের বক্তা কোনো এক স্বপ্নঘোরে এসে পড়েছে এক অচেনা শহরপথে। সে শুনেছে এখানে প্রায় দেড়শো বছর আগে এমন একজন জন্মেছিলেন যিনি ঈশ্বরের উপস্থিতি বিষয়ে না বলে তিনি যে কোথাও অনুপস্থিত নন সেটাই যুক্তিযুক্ত ঢঙে বোঝাতেন। তাঁর যুক্তিমতে জগতের সমস্ত উপাসনালয় অর্থহীন। দীর্ঘলালিত ধারণা-বিরোধী এই ভয়ংকর মতবাদে ক্ষিপ্ত শাসক ও মৌলবাদীরা তাঁর প্রাণদণ্ড দেয় যখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ। বক্তা হাঁটছে আর তার চোখে পড়ছে মানুষের বানানো কিছু উপাসনাগৃহ যার সিলিংগুলো আকাশসমান আর আকাশের চেয়েও বিচিত্র। এক-একটি অভূতপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। পথেই এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ এবং সে তার অন্তর্গত কৌতূহল নিরসনে বৃদ্ধের সঙ্গ নিল। বৃদ্ধ খানিক ভীত, সন্ত্রস্ত। সেই অলীক মানুষটি সম্পর্কে খোলামেলা কেন, গোপনে আলোচনা করাও নিষিদ্ধ। শাসকের টহলদারের সতর্ক দৃষ্টি সর্বত্র। তবু্ও বৃদ্ধ আগন্তুককে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে সব বলল যা সে পরম্পরাগতভাবে জেনে এসেছে। সেই নির্নিয়মী অচিন্ত্য মানুষটি শুধু যে উপাসনালয়ের প্রয়োজনহীনতা বোধ করতেন তাই নয়, ঈশ্বরকে পুজো করা, তাঁকে পাওয়ার জন্য কোনো অবতারের অনুগামী হওয়া বা কোনো তীর্থক্ষেত্রে যাওয়া, সবই অদরকারি, অহেতুক বলতেন। মূলত যা দরকার তা হল “শুধু একটু স্মরণ করা যে জগতে তিনি আছেন”। সারাজীবনে অন্তত একটিবারের জন্য সান্দ্রতাপূর্ণ উপলব্ধি। তাতেই তাঁর সঙ্গে সৌহৃদ্য স্থাপিত হয়ে যাবে। কিন্তু মজা হল, এমন সরল, অনাবিদ্ধ নীতি সাধারণ মানুষের পছন্দ হল না। তারা ভাবল “এত জটিল একটা জগতের স্রষ্টা নিজে এত সহজলব্ধ হতে পারেন না”। আবার উলটো দিকে এই সহজিয়া চিন্তার কারণেই তাঁর বিস্তর অনুগামী তৈরি হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই তিনি শাসক ও মৌলবাদীদের কোপানলে পড়লেন। তাঁকে বেঁধে গুলির আদেশ দেওয়া হল, গুলি চলল কিন্তু সে-সব তাঁর দড়িতে লেগে তিনি ছিঁড়ে পড়লেন। জনতা খুশি হল। তারা চাইল তিনি শাসককে বলুন যে, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর মৃত্যু চান না। ঈশ্বরের অলৌকিকতায় বিশ্বাসী নন বলে তিনি তা বলতে রাজি হলেন না। কেন-না, তাঁর মতে, এতে ঈশ্বরের স্বসৃষ্ট নিয়মের লঙ্ঘন ঘটে। যাইহোক, দ্বিতীয় বারের হত্যা-হুকুমও ব্যর্থ হল। কাজ হল তৃতীয় বারে। এইসব কথা চলছে ঘরমধ্যে। বাইরে দু-জন সৈনিক তাদের বার্তালাপ শুনে ঘরে ঢুকে বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার ও হত্যার কথা শোনায়। আগন্তুক নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে বৃদ্ধকে মুক্তি দিতে বলে। দুই সেনা বলে, একটি শর্তেই তারা তাকে মুক্তি দিতে পারে যদি সে তার বক্তব্যের সঙ্গে আরও একটি তথ্য জুড়ে দেয়— তা হল, যে-পাঁচজন সৈনিক সেই প্রাজ্ঞ মানুষটিকে হত্যা করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল, এরা দু-জন তাদেরই একজনের বংশধর। বিদায় নেবার আগে একজন বলে, “মনে মনে আমরাও তাঁর অনুগামী”; তাদের বিশ্বাস “একদিন সবাই তাঁর অনুগামী হবে। তখন আর গোপনে নয়, প্রকাশ্যে।”

আপ্লুত, বিমোহিত আগন্তুক সে দেশেই থেকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছিল, “এই আশ্চর্য উপাসনালয়গুলো একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য তাতে ঈশ্বর গৃহচ্যুত হবেন না… কারণ, ততদিনে প্রতিটি মানুষ নিজেই এক একটা উপাসনালয় হয়ে গিয়েছে।”

এ-গল্পের প্রোটাগনিস্ট এমন এক মানুষ যার রয়েছে সত্যিকারের কৌতূহল, জ্ঞানতৃষ্ণা এবং গভীর বেদনাবোধ। গল্পকারের দর্শনে প্রতিটি মানুষ যখন উপাসনালয় হয়ে উঠবে তখন তার মধ্যে কোনো বিগ্রহ থাকবে না। থাকবে শুধু এক মনস্বী উপাত্ত উপলব্ধি যে, ঈশ্বর আছেন।

আমার অষ্টম আলোচ্য গল্প ‘ধ্বংসদর্শন’— এক অলীক দর্শন যা আচ্ছন্ন চেতনায় বিশেষ অনুভবে জেগে থাকে, থেমে যায় কালপ্রবাহ, জগতের গতি হয়ে যায় স্থির, সম্মোহন-বিমোহিত। হয়তো চরম কিছু ঘটতে চলেছে কেননা জাগতিক প্রাত্যহিকতায় সূর্যের উদয়াস্ত থমকে গেছে, থেমে গেছে নদীস্রোত, বাতাসের চলন; স্তব্ধ হয়েছে পশুপাখির ডাক-ডুক। কথা শুধু মানুষের মুখে। বিশ্ব-ধ্বংসের ভাবনায় কেউ-বা উচ্ছ্বসিত— চিৎকৃত কান্নায় মুখর হচ্ছে তারা। কেউ কেউ ধ্বংস-বিষয়ক ভবিষ্যদ্‌বাণী করছিল, বলছিল, “সব কিছুই যেহেতু আগুন থেকে সৃষ্ট তাই সব কিছুই আবার আগুন হয়ে যাবে।” একজন বলল, শূন্যতার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পৃথিবী চুরমার হয়ে যাবে, কারণ, “শূন্যতাও কোনও কঠিন পদার্থের মতো হয়ে যাবে”। সবই যেন তারা স্বপ্নে দেখেছে।

গল্পকথকের এ-রায় পছন্দ হল না। তার মতে “এ রকম ধ্বংস অর্থহীন নিষ্ঠুরতা বা খামখেয়ালি পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়”। হয়তো এই আশু সর্বাত্মক ধ্বংসের ফলে সকলেই মারা যাবে, কঙ্কালেরও অস্তিত্ব থাকবে না— নতুন জগৎ নির্মিত হবে। তখন বর্তমান অস্তিত্ব, স্মৃতি সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে— এটা বিশ্ববিধাতার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেন-না “মানুষ ধ্বংস সহ্য করতে পারে। কিন্তু যা পারে না তা হল অর্থহীন ধ্বংস সহ্য করতে”। অথচ সকলেই যেন শান্তভাবে মেনে নিয়েছে এই অর্থহীন ধ্বংসলীলা।

এমন ভাবনাব্যাকুল মুহূর্তে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। নাম জিজ্ঞেস করাতে সে বলে, “আমি নিজেই জানি না। তবে মানুষ আমাকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন করে।” এতে কারো কোনো ভাববিকার দেখা গেল না। জগতের অন্তিমকালে ঈশ্বর মানুষকে দেখা দেবেন এতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। আবার এই দর্শনের স্মৃতিও তো মুছে যাবে। ঈশ্বর তা জেনেই দেখা দিয়েছেন। অন্তর্গত অক্ষম অভিযোগ নিয়ে হঠাৎই সকলে হিংস্র পশুরূপ ধারণ করে ঈশ্বরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথকও চাইল, অবিরাম অভিশাপ আর বিদ্রূপবাক্যে ঈশ্বরকে ক্ষতবিক্ষত করতে। অবশ্য কেউই চিরন্তন ঈশ্বরভীতি বা সৌজন্যের খাতিরে তাঁর গায়ে হাত তুলল না।

কথক এবার তীব্র ব্যঙ্গোক্তিতে ঈশ্বরকে বিঁধে বলল, “জগতে তুমিই একমাত্র স্রষ্টা যার ভেতর ক্ষমতা আছে কিন্তু যুক্তিবোধ একমুঠোও নেই।” এক বয়োবৃদ্ধ বলল, “এটা খুবই দুঃখের যে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর তুমি যুক্তির জ্ঞানটা দিলে, অথচ বাস্তবে ওই জ্ঞান চরিতার্থ করার কোনও সুযোগ রাখলে না… তুমি একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন, খামখেয়ালি পাগল স্রষ্টা।” অবিকার ঈশ্বর হেঁটে চললেন। অন্যরা তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। অবিচল ঈশ্বরকে দেখে অসহায় কথকের মনে হল “যে ভাষায় ঈশ্বরকে সমালোচনা করা যায় মানুষ হয়ত সে ভাষা জানে না। ফলে ঈশ্বর হয়ত মানুষের প্রার্থনার ভাষাও কখনও বুঝতে পারেননি”। কিন্তু আক্রমণ জারি থাকল। ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে কথক বলল, “যদি একদিন সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্নই করবে, তবে সৃষ্টি কেন করেছিলে আমাদের?” এরপর তীব্র রোষে সে ফেটে পড়ল, “আমরা তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি… একদিন তুমি ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হবে তোমার সৃষ্টি নিয়ে, যার চিহ্ন তোমার স্মৃতি ছাড়া আর কোথাও থাকবে না।” এই প্রথম “ঈশ্বরের দৃষ্টিতে করুণা, ঠোঁটে অসহায় বিষাদ। তিনি হঠাৎ মুখ হাঁ করলেন এবং বড় হতে হতে তাঁর হাঁ-টা সমস্ত জগতেই বিস্তৃত হয়ে গেল”। অনেকটা বিশ্বরূপ দর্শানোর মতো। ধীরে ধীরে সমস্ত কিছু তাঁর হাঁ-এর মধ্যে ঢুকে গেল। শুধু সূর্যটা একই জায়গায় থাকল কেন-না সূর্য না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকার দূর করবে কে! এভাবে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবার আগে কথক সময়ের অস্তিত্বহীনতার মাঝে অনুভব করল, সে টিকে আছে, অর্থাৎ, সে অস্তিত্বহীন হয়নি।

অতলান্ত তৃপ্তি ও শান্তিতে আচ্ছন্ন ‘আমি’-র চেতনায় স্বপ্ন ও বাস্তবের ভেদরেখা অন্তর্হিত এই দুঃসাহসী আখ্যানে। সমস্ত ধ্বংসের মাঝেও টিকে থাকার স্বরাট উপলব্ধি কার্যত ঈশ্বর সম্পর্কে এক অক্ষীণ সংশয়ী ভাবনা; অস্তিত্ব ও চেতনার অপরাজেয় অবস্থান বিষয়ে এক অসংশয়ী উপলব্ধি এই ফ্যানটাসিতে চমৎকার ধরেছেন গল্পকার। এ এক মৌল অনুভব, ঈশ্বরের এক নবমিথ নির্মাণ।

বর্তমান আলোচনীয় গল্পাবলির মধ্যে আকারে সবচেয়ে ছোটো ‘লীলার বিস্ময়’ গল্পটি কিন্তু বিস্তারে বিপুল। প্রথম চোটেই মনে হতে পারে এখানে ‘লীলা’ কারও নাম। আসলে তা নয়। লীলা এখানে কোনো ব্যক্তি নয়— ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব বলা যায় আর বিস্মিত তিনি স্বয়ং কেন-না তিনি এমন বিশেষ কিছুর সন্ধানে বেরিয়েছেন যা হারিয়ে ফেলেছেন। না, তেমন বস্তুগত কিছু নয়; হারিয়েছেন নিজস্ব সত্তাকেই যা খুঁজতে বেরিয়ে অনুসৃত হচ্ছেন এক ধড়-মুণ্ডহীন দানোর দ্বারা। সে-বেচারা ঈশ্বরকে তার বিশাল হাতের ফাঁদে আটকে তাঁর কৃপাপ্রার্থনা করছে, দানোযোনি থেকে মুক্তি পেতে; আর তাহলেই সে ঈশ্বরকে হারানো বস্তু ও পথের সন্ধান দেবে। বিস্মিত পাঠকেরাও— কে কার কৃপাপ্রার্থী। যাইহোক, হত্যার মাঝ দিয়ে দানোকে মুক্তি দিয়ে ঈশ্বর লক্ষ্যস্থলের দিকে এগোতেই এক ব্যাকুল বৃদ্ধার কাতর আকুতি। সেও ঈশ্বরদর্শনের অপেক্ষায় নৈবেদ্য-উপচার সাজিয়ে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষারত। ঈশ্বর তার কাছেও পরবর্তী পথের দিশা জানতে চাইলেন। আপ্লুত বৃদ্ধা মিনতিপূর্বক বলল, যাবার আগে ঈশ্বর যেন তাকে পরম সত্যের রহস্যটা বলে দিয়ে যান। ঈশ্বরও বৃদ্ধার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে এগোতে থাকেন। আবারও পাঠক বিস্মিত হন, কে কার কৃপাপ্রার্থী, তা ভেবে।

এই অপার বিস্ময়ের শুরু বাল্মিকীর ঈশ্বর-জীবনী (এখানে শ্রীরামচন্দ্র!) লিখে ফেলার সূত্র থেকেই; এবং সেই জীবনীর কাহিনি অনুসারে ঈশ্বর “বেশ কিছুকাল মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকলেন”। কিন্তু কীভাবে? শ্রেষ্ঠ বিস্ময় সেখানেই। তা হল “এভাবে মানুষের মধ্যে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সময় ঈশ্বর, যেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান, নিজের ঈশ্বরত্ব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন”।

আসলে এখানেই ঈশ্বরের অধরা অবতারত্ব খর্ব হয়ে তিনি যে তাঁর সৃষ্ট মানুষদেরই একজন, সেটাই প্রকট করে গল্পকার ঈশ্বরকে মানুষের মাঝে মানুষ রূপে নামিয়ে এনেছেন— রাবীন্দ্রিক ভাবনার সঙ্গে প্রভূত মিল। তিনি যে অধরা, অজ্ঞেয় কেউ নন, তিনি যে আমাদেরই একজন এবং তিনি যে তাঁর ক্ষমতাবলে নিজেকেও ভুলে যেতে পারেন— সেটাই এখানে বিস্ময়কর প্রতিপাদন। সুফিবাদেও ঈশ্বরের সঙ্গে এমনতর নৈকট্যের আভাস প্রতিভাত।

আলোচনার দশম তথা শেষ গল্প ‘শয়তানলিপি’ যা আহৃত হয়েছে দেবর্ষির ‘নির্বাচিত গল্প’ থেকে। ঈশ্বর যে শুধুই ভালোমানুষ গড়েন না, মানুষের চেহারায় দুষ্ট শয়তানও গড়েন ও সৃজনের সামঞ্জস্য রক্ষা করেন সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই গল্প-বুনন। এই ভিন্নতর আখ্যান চার ভাগে বিভক্ত।

প্রথম ভাগে নিদ্রাহীন, নামহীন চরিত্রের অস্থির উসপিসানি। সে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় “কিন্তু টান দিতেই জিভ ও নাকে এল পচা দুর্গন্ধ”। বিরক্ত হয়ে জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে ফেলতেই তা রাস্তায় রাখা প্রতিবেশীর গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ভিতরে পড়ে ও যথারীতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সে দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে “কাকতালীয় চান্স, আকস্মিক ঘটনা”— এসব নিয়ে ভাবতে থাকে। এবার খানিক এগিয়ে ভাবে “এ রকম আকস্মিক ঘটনা থেকেই জগতের সৃষ্টি”। আকস্মিকতার হেরফের হলে জীব-জগৎও অন্যরকম হত। আকাশের রং হয়তো সবুজ হত। এর মধ্যেই গাড়িটার ভিতর থেকে ধোঁয়া উঠছে। অপরাধবোধে সে একবার জল নিয়ে গিয়ে তা নেভাতে চাইছে, আবার ভাবছে “গাড়িটা পুড়ে গেলেই বা ক্ষতি কী?” অর্থবান লোক। আবার একটা কিনে নেবে। মানুষের স্বভাবজ হিংসা প্রবৃত্তি বক্তাকেও গ্রাস করেছিল কিন্তু সেই ঈর্ষা কীভাবে জয় করতে হয় তা সে ভেবে পায় না। এমন অক্ষমতার ভাবনাই তার মধ্যে এক মতবাদের জন্ম দেয়। তা হল “যা কিছু ঘটছে তার সবই আগে থেকে নির্ধারিত ছিল”। সূর্য-চন্দ্রগ্রহণ, বেঁটে-লম্বা সবই— “ঈর্ষাপরায়ণের ঈর্ষার জ্বালা পাবারই কথা”। এতাবৎকালের ঘটনাপরম্পরা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই গাড়ি-বিষয়ক তার বিবেকদংশন ঠিক নয়। সুতরাং সে নির্দোষ।

এরপর সকালবেলায় গাড়ি পোড়ার ব্যাপারে হইচই শুরু হলে এবং তা নিয়ে সেও জিজ্ঞাসিত হলে এই দুষ্কর্মের জন্য আধ-পাগলা কোনো অনামী ভিখিরির ওপর দোষ চাপিয়ে সে মুক্ত হয়। কিছুদিন পর এক ঝড়বাদলের দিনে রাস্তায় অপেক্ষারত সস্ত্রীক তাকে সেই গাড়ির মালিক ভদ্রতাসূচক লিফ্ট দেয়। আগুন লাগার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ভদ্রলোক বলেন, “কেউ ইচ্ছে করেই লাগিয়ে দিয়েছিল।” হঠাৎ সে জানতে চায়, “মানুষকে কি আপনার একটা শুয়োরের বাচ্চা বলে মনে হয় না?” ঠিক সেই মুহূর্তে চলন্ত গাড়ির সামনে একজন এসে গেলে ভদ্রলোক জোরসে ব্রেক কষেন। গল্পের এই ভাগ শেষ হয়। নিজেকে গুপ্ত রেখে অথবা বাঁকাপথে উন্মুক্ত করে বক্তা যা বোঝাতে চেয়েছিল এই পথচারী সেই সংজ্ঞায় আরোপিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয় ভাগে কয়েকজন বন্ধু অধিকরাতে বার-এ বসে মদ্যপান করছে। হঠাৎ এক মধ্যবয়সি অদ্ভুত চাউনির লোক সেখানে ঢুকে এ-টেবিল ও-টেবিলে তাড়া খেয়ে ওদের টেবিলে বসে আর বলতে থাকে, “আপনাদের উঁচু উঁচু বাড়ির সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের রংবেরঙের গাড়ির সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের সুন্দর জামাকাপড়ের সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই। আপনাদের এত কাজ ও ব্যস্ততার সভ্যতার মুখে আমি পেচ্ছাব করে দিই।” কেউ প্রতিবাদ না করায় লোকটা বারকয়েক একই কথা গলা চড়িয়ে বলে গেল। বন্ধুদের মধ্যে যে ধনী ও রাগী ছিল সে হঠাৎ ওকে ঠেলে বলল, “বাইরে চল, পেচ্ছাব করবি।” তাকে মানব সভ্যতার শত্রু ভাবল এরা। ম্যানেজার মজা দেখে মুচকি হেসে বলল, “ব্যাটা অনেক বই পড়েছে। আগে কবিতাও লিখত।” এরপর ওরা ওকে বাইরে এনে বলে, “কর দেখি কত পেচ্ছাব করবি।” লোকটা এবার অনুনয়ের সুরে বলে, “বিশ্বাস করুন, বেঁচে থেকে একদম শান্তি পাই না। তাই ওরকম বললাম।” যাইহোক, শেষ অব্দি ওকে দিয়ে যখন পেচ্ছাব করানো গেল না তখন সেই রাগী শয়তান বন্ধুটা “নিজের প্যান্ট খুলে লোকটার মুখে পেচ্ছাব করতে লাগল”। এ-দৃশ্যের স্মৃতি অনেক পরেও বক্তার মধ্যে হাসির উদ্রেক করেছে।

তৃতীয় ভাগে একদল আলোচনা করছিল “বিশ্বযুদ্ধের পর ঈশ্বর পৃথিবীতে এলে তাঁকে কী কী ফেরত দিতে পারে। সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য, মরুভূমি, ভূগর্ভস্থ লাভা, ধানহীন মাঠ, রাতের অন্ধকার, আদিম নির্জনতা, মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব— সাধারণভাবে এগুলোই ঈশ্বর, যুদ্ধের পরও অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেতে পারেন”। এবার প্রোটাগনিস্ট এক বিশেষ বস্তুর উল্লেখ করল। “অফুরন্ত নরকঙ্কাল”। নানান বয়সের, নানান মাপের, নানান ধর্মের কঙ্কাল জোগাড় করে ঈশ্বর “মাথার মাঝখানে গর্ত হয়ে যাওয়া খুলিগুলোয় টবের মতো করে ফুলের চারা লাগাতে পারেন”। সেগুলো দিয়ে আরও অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন। পৃথিবী পুরস্কার হিসেবে এই নরকঙ্কালগুলো ঈশ্বরকে দেবে কেন-না এক সময় “মানুষ নামক একটা জীব সৃষ্টি করতে তিনি আশ্চর্য সফল হয়েছিলেন”। এখানে কি বিদ্রূপের ঢঙে ঈশ্বর-সৃষ্ট মানুষকে বা স্বয়ং তাঁকেই গল্পকার শয়তান বললেন!

চতুর্থ তথা শেষভাগে কুয়োর জলে সিংহের প্রতিচ্ছবি দেখার সেই পরিচিত গল্পটিকে পালটে দিয়ে গল্পকার বললেন, সিংহটা আসলে জানত যে জলের ছায়া তারই। কিন্তু তাকে আক্রমণ না করে সিংহের উপায় ছিল না, কেন-না সে পশুরাজ। আর “প্রকৃত রাজা শৌর্য ও ক্ষমতায় এতই একক থাকতে ভালবাসে যে নিজের ছায়াকেও সহ্য করে না”।

এমন রাজা হওয়ার সাধ এই বক্তাও ছোটোতে পোষণ করত। এই গল্পেও সিংহের ঈর্ষান্বিত শয়তানি প্রকটিত।
মূল আলোচনার এখানেই ইতি। গল্পকাঠামোয় একটা লক্ষণীয় বিষয় হল, অন্তত প্রথম দিকের গল্পে তাঁর অনুসৃত অনাবশ্যক বর্ণনা বা শব্দজঞ্জাল-বিষয়ক সুনীতি কিংবা সংক্ষিপ্ততার রীতি লঙ্ঘিত হয়েছে যদিও সামগ্রিকভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসের পরিসর পাঠকের বিরক্তি উদ্রেককারী নয় মোটেও। বানান সম্পর্কিত পূর্বতন রীতি নতুন সংস্করণে সংশোধিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যাইহোক, দেবর্ষির গল্পের অনেক পাঠকেরই ঈশ্বর-বিষয়ক আলোচনার একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিজনিত অনুযোগ লক্ষ করা যায়। আসলে চালু পথে না হেঁটে সুসন্নদ্ধ ফ্যানটাসি-আধারিত প্রেক্ষিতে জীবনের মূল্যবোধসমূহের পুনর্বিবেচনার যে তেউড়ে অথচ সরল পথে তাঁর চংক্রমণ তথা পদচারণ তা অনেকের কাছেই উদ্ভট ঠেকে। তাঁর গল্পে ধ্বংসের বর্ণনা থাকলেও তা ধ্বংসপ্রবণ নয়, রূপকল্পময় হলেও তা রঙ্গ-রূপকথা নয়। আত্মসৌরভের অন্তর্লীন বিচ্ছুরণ থাকলেও সেখানে আত্মবিনাশের কথা নেই। বরং তা আত্মদীর্ণতার শিল্পিত বয়ান। তাঁর গল্পে চেতনা প্রসারণের জাগরতনু সুযোগ বর্তমান। জীবন যখন অকার্যতায় বিক্ষুব্ধ, বিভল, আক্রান্ত মানুষ যখন আমর্ম হতাশায় খিন্ন ঠিক তখনই দেবর্ষির গল্প তাকে বরফগুঁড়ি প্রশান্তির সন্ধান দেয়। তাই আমার উচ্চণ্ড বিশ্বাস আজ সেভাবে না হলেও একদিন তাঁকে পড়তেই হবে; ছুঁয়ে দেখতে হবে সেই পারদসুলভ মৃগনাভিকে যা অত্যুজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে বাস্তবতা-আক্রান্ত পাঠকের মনে বুনে দেবে এক অজ্ঞাপনীয় স্বপ্নবীজ।

জীবনানন্দ হয়তো সেই রোমাঞ্চন-মুখরতা থেকেই লিখেছিলেন: “তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,/পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,/মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন।”

তথ্যসূত্রসম্ভার:
১) ‘লেখকের জবান’, অসীম রায়।
২) পঃ বঃ বাংলা আকাদেমির মুখপত্র ‘বাংলা বই’ (জানুয়ারি, ২০১৬)।
৩) সংশয়ীদের ঈশ্বর, আহমদ মোস্তফা কামাল, ‘এবং পরব’, প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা।
৪) ‘নাস্তিকের গীতাঞ্জলি, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাবনায়’, আলোচক, রণজিৎ দাশ, ‘চতুরঙ্গ’, বৈশাখ-আশ্বিন, ১৪১৬।
৫) ‘দেবর্ষি সারগীর গল্প’, রবিন পাল, ‘এবং মুশায়েরা’, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৯৯।
৬) ‘বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস’, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, দমদম জংশন।
৭) ‘গল্পকুঞ্জ’, দেবর্ষি সারগী, প্যাপিরাস।
৮) ‘রাজার জ্ঞানতৃষ্ণা’, দেবর্ষি সারগী, সুবর্ণরেখা।

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

শুভাগত রায়

কন্যা, তোমায়


কন্যা তোমার চোখের ভেতর দীঘল যৌবন,
হেঁটে যায় বহুদূর মায়া সীমানায়।
এইভাবে একে একে মরে গেছে মন,
সে-শরীর ভেসে আসে আবিল হাওয়ায়।
তোমার বুকের কাছে ছায়া ফেলে স্নেহ,
কবেকার বিষণ্ণতা জেগে আছে একা।
জুড়িয়ে আসে ক্লান্ত যাযাবর এই দেহ,
তমালীর বনে মনে পড়ে আমাদের শেষ দেখা।

কন্যা তোমার মুঠোর ভেতর শ্রাবণী মেঘের দল,
জমে আছে গহীন যেন উদাস গাভীর চোখ,
এই সন্ধ্যায় অলক্ষ্যতে হাত ছুঁয়েছে জল,
শিরায় শিরায় জমাট বাঁধে প্রাচীন কোন শোক।
দূরে কোথাও শুনি তোমার প্রেমিকের বাঁশি সুর,
চোখের কোলে জলের রেখা শুকিয়ে দেয় আলো,
কিশোরবেলার মতো ভেসে যাও যোজনব্যাপী দূর,
কন্যা, আমাদের কথারা সব বাকি থেকে গেল।


যাওয়ার বেলায় তাকিয়েছ ফিরে,
পিছুডাক ভুলে একা হল জলাশয়।
আয়ুরেখা ধরে বিষাদের চলাফেরা,
তোমাকে মনে পড়ে এই নীরবতায়।

উদাসী ছায়া ফেলে ফাল্গুনী দুপুর,
শীতল হাওয়ায় উড়ছে কাজললতা।
মায়াবী স্নেহে ধুয়ে যায় আদরের পথঘাট,
আমাদের ঘুমে নামে অলীক মুগ্ধতা।

নীলাভ শাড়ির ভাঁজে অপেক্ষার ধুলো,
নৌকো ফিরেছে কোথাও বহুদূরে।
বেড়ে ওঠে যত আদিম গুল্মলতা,
কুয়াশা প্রাচীন সব ব্যথাদের ঘিরে।

পলাশের দেহভারে নুয়ে পড়ে স্মৃতি,
কবেকার কিশোরী মুখ ভাসে আবছায়।
দেবীর চোখের কাছে নিভে আসে আলো,
স্মৃতিহত এই ম্লান পঞ্চমী সন্ধ্যায়।

ফিকে হয়ে এল আলোদের চলাচল,
রাত নেমে আসে কলকাতা দক্ষিণে।
নেশাতুর বালক ফিরে আসে ঘরে,
একা হয়ে আসা তারাদের পথ চিনে।

এ-শহর ঘিরে জমে বিস্মৃত উপকথা,
বিষাদের ঘুম ভাঙে বেঁচে থাকাজুড়ে।
দূরে কোথাও ফাল্গুন মরে যায়,
এই নীরবতায় কন্যা, তোমাকে মনে পড়ে।


বলা হয়নি তোমাকে কখনো,
নিমফুল ঝুঁকে ছিল ব্যথায়।
বিষণ্ণ জীবন ছুঁয়ে এসে দূরে
দাঁড়িয়ে আছ একা নীরবতায়।

আমিও ছিলাম এখানে এমনই,
যেমন জমে থাকে প্রাচীন কোনো শোক।
কী মায়ায় মিশে গেছ দেহে,
জলে ভিজে ওঠে কিশোরীর চোখ।

মনে পড়ে ম্লান রোদ্দুরে?
প্রেমিকের সাথে সেই দেখা?
গুমরে কাঁদো আজ একাকী,
দীর্ঘ রাত যেন বিষণ্ণ আয়ুরেখা।

আমার উঠোন থেকে বহুদূরে,
নিশ্চুপে জ্বলে আছে আলো।
তোমাকে খুঁজে ফিরে কতকাল,
বালকেরা কীভাবে আছে ভালো?

দুঃখেরা দাঁড়িয়ে একা নতমুখে,
দূরে নীরবে বিষাদেরা জ্বলে।
জল ছুঁইনি বহুদিন হল আজ,
কন্যা, তোমার স্পর্শ হারিয়ে ফেলব বলে।


ভুলে গেছ আমার বাড়ির কথা
আমারও তো ছিল না সে-জানা
যত কথা লিখেছিলাম এতকাল
ফিরেছে চিঠি হারিয়ে তোমার ঠিকানা

আমার শহরে এসে মনে পড়ে কিছু?
কবেকার কথারা আজ উড়ছে হাওয়ায়।
ফিরে গিয়ে একা চোখ মুছেছ কতবার!
প্রেমিককে বলোনি কী গোপন ব্যথায়।

স্মৃতিগন্ধ এসেছে ফিরে বর্ষা মৌসুমে,
শরীর নিভিয়ে রাখে অসুখের দিন।
মনে পড়ে ক্লান্তিকর দীর্ঘ আয়ুরেখা
শিখিয়েছ তুমি ব্যথারাই চিরকালীন।

সেই যে ছাতা তোমায় দিয়েছিলাম ডেকে,
আজ একলা কোণে লোটায় মলিন, আতুর।
এ-আষাঢ় শরীর বিদ্ধ করে শুধুই,
আমার এখন একাকী ভেজাই দস্তুর।

জীবন ভুলেছে কত কী বহুকাল হল,
আবছা হয়েছে সব সময়ের ঘষা কাচে।
জলের গন্ধ লেগে আছে স্মৃতিদের গায়ে,
শুধু কিছু বিচ্ছেদ চোখে লেগে গেছে।

সমস্ত জীবনজুড়ে বিস্তৃত দাহকাল,
মুছে ফেলেছ কবে আমাদের পরিচয়?
এশার নমাজে কেঁপে ওঠে বিহ্বল সন্ধ্যা,
সবকিছু কন্যা, শুধুই তোমার চলে যাওয়া মনে হয়।


আমার এখন শীতের বিকেল,
ঘনিয়ে আসছে এই অবেলায়।
পুরাতন শাড়ি একা অযতনে,
আড়ালে ভেঙে পড়ে কান্নায়।

উড়ছে হাওয়ায় ম্লান সাঁঝবাতি,
তোমারও তো আছে কারণ ঘরে ফেরার।
আমি ছিন্ন মলিন চিঠির গোছা,
বহুকাল আর খোঁজ পড়ে না যার।

দাওনি তুমি স্রোতস্বিনীর ঢেউ,
বুকের ভেতর অতলান্ত খাদ।
তোমার গৃহস্থালির পাশেই বসবাস,
ক্ষমাহীন জানি তোমাকে চাওয়ার অপরাধ।

সেই আমাদের অনেককালের দেখা,
কবরে ঘুমিয়ে যে-কথারা ছিল বাকি।
প্রেমিকের বুকে বলে ওঠো আনমনে,
‘বাতিল ছেলে, কবিতা লেখে নাকি!’

শীতের বিকেল পাশে চিঠিদের গোছা,
সন্ধ্যার মুখে জ্বলে ওঠে আলো।
মায়াবী জানি আজ তোমার সংসার,
তবুও কন্যা, এভাবেই বিদায় দিতে হল?

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

মামনি সরকার

চাঁদ, প্রেম ও অন্যান্য


গাছের কাণ্ড দেখে মনে হয়
নিজেকে আরও সংযমী করা প্রয়োজন
অথচ সেই গাছেরাই কি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে থাকে
একে-অপরকে, সংযতহীনভাবে
এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি
সূর্যের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলি
আর সবুজ প্রান্তর ক্রমশ বিবর্ণ হতে থাকে
ক্লোরোফিলের তাচ্ছিল্যতায়


রাতের পরাগ লেগে থাকে বিমর্ষ চাঁদের যোনিতে
ভোরের চোখ ফোটার আগেই বিদায় নেয় রাত
ভোর জানে না তার পিতৃপরিচয়,
মাতৃকুলবৃত্তান্ত
শুধু জানে মায়ের গায়ে লেগে থাকা
কলঙ্ককে মুছতে হলে
সূর্যকে জাগিয়ে তোলা ভীষণ জরুরি।


অমাবস্যার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে ছায়া
বধির গলির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছে পথ
ছায়াটি এবার হেঁটে চলছে পথ বরাবর
পথ এগিয়ে আসছে ছায়ার অনুসরণে
আর এই ছায়া-পথের সংরাগে জন্ম নিচ্ছে
অভিসারের গোলাপখাস


প্রচণ্ড উত্তাপে মনে হয়
এখনি গ্রহণ লেগে যাক সূর্যের বুকে,
রক্তাভ হয়ে উঠুক পৃথিবী।
প্রাণপণে এই কামনা করতে থাকা আমি
আদতেও বুঝতে পারি না
রাহু একটু একটু করে গিলে ফেলছে
আমার হৃদয়ের সর্বস্ব জ্যোতি।


ভোরের সাথে সম্পর্ক জুড়ে মনে হয়
রাতের মতো প্রতারক দ্বিতীয়টি নেই আর
তারপর ভোরও চলে যায়
নিঃসংকোচে

এই ঢ্যামনা পৃথিবীর ভালোবাসা দেখে
উপরের দিকে থুতু ছেটাই
অশ্রাব্য গালিতে ভরিয়ে দিই আকাশ-বাতাস চৌ-দিক

শেষমেষ হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়ে
বিষণ্ণ বিকেলের সাধনা করতে বসি
নিঃসংকোচে