Categories
2021-NOVEMBER-POEM

অরিত্র সোম

মৃতদেহ বাঁচিয়ে রাখো


লাথি মারার জন্য
মৃতদেহ বাঁচিয়ে রাখো অজিতেশ
হাতের কাছে ছোটো ছোটো মানুষের ভিড়
আরও ছোটো হতে হতে
আমাদের আয়ু ধরে নেমে যাচ্ছে
এ-শহর বৃক্ষশূন্য— পিপীলিকার আত্মহত্যা
এখনও ছুঁতে পারলে না
অজিতেশ


জানো না
শাদা শালু থেকে কেমন
একটার পর
একটা
নারীদেহ জড়িয়ে পড়ছে বুকের ওপর
ভুলে যাচ্ছি নিঃশ্বাস, টকটক স্বভাব
গা-টা শুঁকে অনেকক্ষণ আগেই
মঞ্চ থেকে বিদেয় নিয়েছে
                 কুকুরের দল
নির্বান্ধব স্বভাব— অজিতেশ তুমি
চাতালের পাশে উবু হয়ে কেটে নিচ্ছ ছক
আড়ালে নষ্ট পাঁইট, পাঁচ মিনিট পর
তোমার ভেতর সেঁধিয়ে যাবে…

এবং ভুলে যাচ্ছ চাকুর গল্প


জটা অহরহ, অখণ্ড মাতাল চিত্তে
চিতা ঘাঁটো— শুকনো আহ্লাদে
নৌকা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়
ছায়া ভাসে; অজিতেশ

এখনও, সময় আছে?

শহুরে বুক খুলে তুমি দেখে নিতে পারো অপমান
যেভাবে প্রতিটা রাস্তার মোড়ে
খণ্ড খণ্ড লিফলেট বিলিয়ে গেছে মহাত্মা
যেভাবে আমরা সরতে সরতে বেছে নিয়েছি
চটচটে আঠালো কোণ
একটা চেয়ার, ব্যর্থ কবিতা, নাইলন…

অজস্র মুটে-মজুরের দেশে, আমাদের হাত থেকে
এভাবেই ঝরে পড়ছে
রক্তোন্মাদ ছারপোকা

অন্ধ মুহূর্তের কথা

এখানে স্বাধীন রাত। তোমার দরোজার সামনে, ব্রণপড়া পায়রার সমাধি।
সবই দেখতে পাচ্ছ— কিন্তু এই মুহূর্তে
নেমে আসার
সাহস
               কেউ দিচ্ছে না।
ঘুমোতে চাইছ; কেউ তোমায় বুঝিয়ে দিচ্ছে না
নীহারিকার স্বপ্ন।
এলোমেলো পাতা জুড়ে অস্থির অবগাহন সহ্য করতে করতে
মাটি ভাগ হচ্ছে।
আমি বুঝতে পারছি বলে পার্সেলে লিখে দিচ্ছি নতুন বইয়ের নাম।
কালো পোশাক তোমার— মহাপয়ার— এবং
আয়নার দিকে তাকিয়ে
তুমি টেলিফোনে কেটে দিচ্ছ মুহূর্ত

নীহারিকার জন্ম হবে। কানে কানে এটুকু বলব বলে
এখনও

দূরত্বে, জেগে আছি

নির্বাক-১

সমস্ত কালো থেকে সাদা সরিয়ে নিলে
যেটা পড়ে থাকে

একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে— আমি শুধু
তার কথা ভাবছি

নির্বাক-২

একটা ক্লান্ত গ্রামোফোন

ধুলোয়
উড়ে
যাচ্ছে

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

সায়ক দাস

আত্মহত্যা ১

ছাদের কাছাকাছি যাও
লাল অস্তগামী সূর্যের আরও
কা
ছা
কা
ছি
শরীরকে বানিয়ে ফেলো
পাখির পেট

তোমার থেকে এক পা দূরে
যে দাঁড়িয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে
হেসে যাচ্ছে ক্রমশ,
তাকে আলিঙ্গন করো!

অক্টোবর

আলো দিয়ে কাটিয়ে ফেলো যাবতীয় ভয়
আলো দিয়ে কাটিয়ে ফেলো
যা

তী
য়
না-পাওয়া,

যে-রংচটা হলদে ছোপ ছেলেটা
তোমায় দেখে যাচ্ছে অনেকক্ষণ

অক্টোবর তার বাবার মতো ক্ষয়িষ্ণু
অক্টোবর তার বাড়ির মতোই ভগ্ন

সাইকো-কিলার

বসন্ত ছড়িয়ে আছে তোমার জানলার পাশে
রং, গন্ধ তোমায় সাহায্য করছে
ভুলে যেতে যাবতীয় ক্ষোভ—

তোমার বাবার ভাতের থালা ফেলে দেওয়া,
তোমার মায়ের তোমাকে আটকে রাখা
একটা ছোট্ট ঘরে!

বসন্তকে আলিঙ্গন করো
ভুলে যাও সকল ক্ষোভ, অভিমান
ফ্রিজ খুলে বের করে আনো
এক সপ্তাহের বাসি কাঁচা মাংস!

আপনজন আদতে স্বর্গের মতোই সুস্বাদু!

একটি (অ)প্রেমের কবিতা

তুমি তো সব জানতে
বলো তুমি কি কিছুই জানতে না!
তবুও কেন এই নদীর কাছাকাছি
যা

য়া

তবুও কেন আমার থেকে এই

রে

রে
থাকা

মুখপুড়ি, তোকে ভাসিয়ে দিলে
জন্নত নসিব হত আমার!

সংসারধর্ম

ঘুমের মধ্যে
আমি বাবাকে আর
বাবা আমাকে
জড়িয়ে ধরে…

ঘুমের মধ্যেই
বাবার স্বপ্নে আমি
আর আমার স্বপ্নে বাবা
ঢুকে পড়ে।

আমি দেখি, কীভাবে চুন ওঠা সংসারের
প্রতিটা হিসেব করতে করতে
কাঁধ আরও ঝুঁকে যাচ্ছে বাবার

বাবা আমার স্বপ্নে ঢুকে দেখে
আমি শুধু কবিতার খাতা নিয়ে…!

ঘুম থেকে উঠে
বাবাকে আমার বটগাছ মনে হয়
আর বাবা আমায় খিস্তি দিয়ে
ঠিক বট ফলের মতোই
ফেলে দেয়
আরেকটা শেষ না-হওয়া স্বপ্নে!

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

শোভন মণ্ডল

কাঁটাতার

আবহাওয়ার কোনো পূর্বাভাস নেই

ফুল তার নিজগুণে জড়িয়ে নিচ্ছে রং
ভাঙনের পাড়ে খেলা করে কয়েকটা পানকৌড়ি
তাদের নিঝুম চোখে রাতের শিশির লেগে আছে
যে-পথে নেমে এসেছে অন্ধকারের ঝালর
যে-দিকে নোনতা আলপথে থেমে থাকে আবাদ
তার গোপন সাকিন আজও অজানা অচেনা

কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে ভাবি
সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা টলটলে পুকুরের বুকে কীসের উচ্ছ্বাস?
পানিফলের গায়ে লেগে আছে যে-জল তার কি কোনো নিজস্ব ধর্ম আছে?

অন্য প্রেম

পশুর সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ের চূড়ায়
মাথার সামনে এই দ্যাখো সুউচ্চ খড়্গ
অহংকারে নাড়িয়ে নিচ্ছি নিরেট মাথা
চোখের ভেতর জ্বলে উঠছে বীভৎস আগুনের লেলিহান শিখা
ধুমসো কালো শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে অসভ্যতার অন্ধকার

গর্জন করছি, যাকে বলে পশুনাদ
তুমি কি শুনতে পারছ সেইসব শব্দ?
অনুভব করছ অজানা রোমাঞ্চ?

তুমি তো জেনে গেছ
কীভাবে বুক পেতে নিতে হয় প্রেমের হিংস্রতা

অরণ্যের দিন

এভাবে বিষণ্ণ থেকো না
পাতা ঝরে যায়
বেলা শেষ হলে অরণ্যের মুখ কালো হয়ে আসে
সবই তো দৈবাৎ হারিয়ে যাওয়া ফসলের গান
আজও ডেকে যায়
ফুল ফোটে পুরোনো গাছে
অগোচরে থেকে যায় ছায়ার দাগ
শুধু এই দ্যাখো, বিশুদ্ধ বনভোজনের মাঝে আমরা পাত পেড়ে বসে আছি

বিষণ্ণ থেকো না
দু-দণ্ড ভালোবাসা বেড়ে দিয়ো

কথা নয়

আমার কথার কোনো মায়া নেই
অগোচরে থেকে যায় গভীর নীরবতাগুলো
আজও অ্যান্টাসিডের মতো গিলে খাই তীব্র শিখা
তফাতে পড়ে থাকে আমারই অবচেতন
ঘোরানো সিঁড়ির বাঁকে জড়িয়ে যায় জিভ
নিভে যাওয়া বাতিগুলো হঠাৎ জেগে ওঠে
কচলানো পাতিলেবু হয়ে কেবলই গোপন আস্বাদ
বাকি তো বলেইছি, অবচেতন… অবচেতন…

আমার কথার কোনো মায়া নেই
শুধু মন্দিরে দাঁড়ালে, আনমনে দাঁড়ালে
কথা নয়, মুখ দিয়ে মন্ত্র নির্গত হয়…

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

সাফওয়ান আমিন

কালিসন্ধ্যার মিহি ডাক

গাঢ় জোছনার সাধ নেই, সে তো বহুদূর, বহু কথার বিনিদ্র যাপন তত্ত্ব— এখন তো খাচ্ছিই খুঁটে খুঁটে গাঢ় অমাবস্যার রং!

আজ শুধু ওটুকুই হোক, আপসে তোমাকে ভাবার চিরন্তন ও নির্জন পথের খাঁসা বুঁদরোদন— প্রেমের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেখা যায় কি, কালিসন্ধ্যার মিহিমিহি ডাক? তবে আমার কালিসন্ধ্যাটা ফিরে আসুক; আমি নৃত্য করি তাঁর মায়াবুকে—

আজ শুধু ওটুকুই হোক, সারল্য নন্দন যেভাবে আমাকে গেঁথে নিয়ে হাঁটে, নিগূঢ় রহস্যে, নির্জন পথের সাথে—কলাপাতার আবছায়ায় মর্মর যে-ধ্বনি পাও, তা কি চন্দনের, নাকি পৃথিবী মাতানো খোশবুবক্সের? (আফিমের মতো মনে হল) প্রেয়সীর আঁচলের বাউলি ঝাপ্টা কিনা! আমাকে ওটা দাও, গাঢ় জোছনা চাই না।

বহু বৃষ্টি ভেজার সন্ধ্যায়, তুমি ভেতরে আমি জানালায়— বেদানা-রঙা চোখের কানা-কুয়া উড়ে গেল যবনের হাওয়ায়, জীবনের ভেতর— ভাবছি যদি ফিরে আসে প্যারাফিন নিয়ে, তবে কুমকুমে ভরে যাবে করপুট!

জানি, নখের যৌবন এলে ছেঁটে দিতে হয়; এসেছে কষ্টের যৌবন, সুযোগেই কাটব, চিন্তার কিছু নাই। সাক্ষী রাখো এই কালো মিহি রং, সকল কল্যাণ খেলা করবে তোমাকে ঘিরে— তুমি আশা পেলে, আমি বর্ষার সমস্ত বৃষ্টির কোলে, শুধু তোমারই নাম লিখে দিলাম!

অসময়ে একদিন ঘুমঘোর থেকে জেগে দেখি, সানাই বাজে, তোমার পায়ে আলতা, গায়ে লাল টুকটুকে শাড়ি… আমার কেবল দেরি হয়ে যায়!

আজ সারাদিন বিষ্যুদবার; তোমার দিকে চেয়ে আছে—

দাপুটে সুখের দিন খুব গতিতেই নেমে যায় নীচে— বাতাসে যে-প্রেম বেজেছিল বাঁশের কঞ্চির পরশে পরশে, তা কি ক্ষয়ে গেল এত সহজে? ভেবেছি, দারুচিনি বিদিত করবে তোমার সন্ধ্যাবাটির সালুন সহযোগে— অথচ মেলেনি বহুকাল গাঢ় জোছনার দেখা। আকস্মিক বিপর্যয় ভেবে নেই ফড়িঙের, ইঁদুরের মৃত্যুকে আর তোমার প্রস্থানের স্বর!

যেন যে-ফড়িং দোয়েলের, যে-ইঁদুর চিলের তাতে নেই কারো অনুযোগ— কিন্তু ইঁদুর, ফড়িঙের তো ঠিকই আছে ঘোরবিরোধ। ভাবি আমারও কি?

যদি জলের শরৎ ঘনার দিনে শীত আসে, তবে নিয়ম ভেঙে যায়, মনে হয় অলৌকিক কোনো ধাঁধার পর্ব মেতেছে কোনো পথিকের সাথে— তোমার জানালার পথ থেকে যতদূর গ্যাছে পথ, আমি সে-পথে হেঁটেই হয়েছি পথিক। চুড়ির শব্দ, কুমকুমের ঘ্রাণই আমার পথ নির্দেশক; আমি হেঁটে যাই সে-সবের ইশারায়… কোনো এক ঘোরভেদী সন্ধ্যায় তোমার জানালায় গিয়ে টের পাই; এক সহজ সত্য!

‘তুমি সূর্য মেনে, আমি গাছ হয়ে প্রত্যহ হেলে যাই— কিন্তু গাছ তুমি মালিক বদলিয়েছ!’

যেদিন তোমায় প্রথম দেখি, পরনে ছিল বাসন্তী রাঙা শাড়ি। যতটুকু আস্ফালন ও ডাকাডাকিতে ডাহুকের সর্বনাশ হয়, আমারও তাই হল— আর প্রেম প্রবেশিকার প্রথম পর্বে প্যাঁচার স্বরে চমকে গেলাম দু-জন, মিহি কাজল রঙের সন্ধ্যা ছিল তখন! সেই সাঁজে পাখিরা কি ফেরেনি গান গেয়ে? উঠানের সেই লাল শবরি গাছটা, তোমার তিলের রাখত যে খোঁজ, তার সাথে কি হয়নি দেখা আমার হররোজ—? আশ্চর্য যে-কল্পতরু তোমার খোঁপায় গাঁথা, তার কি আর মনে আছে, সকল সন্ধ্যে কথা?

ডাঙার ভয় মাছের চিরকালীন; আমার প্রেমের— তাই যত গতিকের আহাজারি। আর ফেলেই তো রেখেছি সমস্ত ভোঁতা অলোকরোদন, বিষণ্ণ মিনজিরি! আফসোস শুধু, তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে থাকাটুকুন, কালিসন্ধ্যার নামে দলিল হয়ে গ্যাছে—

পুরো তিথিঙ্ক ভেবে নেবার পর, ভেবেছিলাম তোমার চাঁদবদনের সুকৌশল নিয়ে— নেশার মতো পরে থাকত আমার চোখ ওদিকেই। দিন পেরুচ্ছে, রাত আসছে; তুমি দাড়িয়ে ঠায়, উঠানটায়, আমি মোহগ্রস্ত তখন তাকিয়ে থাকতেই! সেইসব শিরিষ-কাগজে ঢেলে আজ কেমন মুছে দিতে গিয়ে, ক্ষত হয়ে যায়, হৃদয়—!

জানি, জীবন সহজ ও বিশুদ্ধতা চায়! তাই তোমার অধরখানি শত অভিমান চেপে বসে আছে আমার দিকে—

অথচ আমি রাজহংস; পালক আছে, উড়তে পারি না।

নামে রাজ; কামে বেভুল সরাজ— কেন এই বেঁচে থাকা?

আহত সুরের পাঠ চলছে যেখানে প্রতিনিয়তই—

স্নো-কুমকুম, জরির চুমকির যে-আদিকাব্য, তার মূলে আছে আলেখ্য এক প্রেম! জানো তো ঠিকই, শুকনো পাতার মর্মর আমাদের দুশমন— তোমার বাপে সহসাই টের পায়, আমাদের প্রেম সেদিনের মতো শেষ হয়ে যায়! এই সমস্ত আদিকথা তো ফুরিয়েছে কবেই, ভাবি আজ কোনো এক ধীবরের কথা;

যে কিনা স্বপ্নে এঁকেছিল এক সোনালি উজ্জ্বল মাছ

অথচ তা ভেসে গ্যাছে সূর্যের পিছু পিছু অন্তের দিকে—

মেঘ যে কেন এতদূর থেকে ডাকে, কাছে এসে ভিজিয়ে দিলেই পারে— দীর্ঘমেয়াদি এই মনখারাপের মওসুমে

‘La Vita E Bella’ উচ্চারণ একপ্রকার মূর্খামি! এ-সত্য জানার পরেও, চুইঝালের ঘ্রাণে কারো সালুনের বাটি মনে পড়ে— রেডিয়ো তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে উঠি জরির নকশায়—

এনার্কিজমেও ততটা তেজ নেই, যতটা তরুণ কবির ফুঁসে ওঠায়— এখানে প্রবীণ কবিরা যেন স্পিডব্রেকার, ঠিক তোমার বাবারই মতো! আমি বিদ্রোহের মঞ্চে, বলয় ভাঙার ইচ্ছায়, তোমারে নতুন করে আলিঙ্গনের ভাবনায়…

এনার্কিজমে শিখেছি, “ভাঙলেই কেবল সৃষ্টি হয়”

আসলেই কি ভাঙতে পারতেছি? বহু ক্ষান্ত, সংশয়ে বলতে ইচ্ছা হয়; Bella Ciao! Bella Ciao! Bella Ciao!

‘ফোটালে যে ফুল, সে ফুল শেফালি।’ বিভ্রম তো মোটেও নয়, যা ঘটেছে তা প্রেম। কেয়াবৃক্ষের পরশে যতটুকু আভা পেলে, সবটুকুই সত্য সম্পর্কের দিকে হেঁটে যাওয়া স্বপ্ন—

সে-স্বপ্নের শুঁড়িপথে যে-জাহাজ যাচ্ছে, তার গতি নির্ণয় শেষে বলে দেওয়া যায়, গন্তব্য পাবে কিনা! ভাবি, জাহাজ তো চালাচ্ছ তুমি, তবে গতি কেন এত ধীর? জানলাম সমাজ ধরেছে পাছাড় টেনে, সংশয় তাই গন্তব্য নিয়ে— যাইহোক, কেয়াবৃক্ষের পরশে স্বপ্ন আবার জাগ্রত হোক,

জাহাজঘাটে আমি বসে আছি— শাওনে আসবে বলেছিলে!

১০

আজ সমস্ত সন্ধ্যার মধ্যে জপি শুধু এইটুকুন মন্ত্র— “আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দু-জনে…” ভালো লাগে ভাবতে, আমি মোটামুটি জোনাকির রাত, তোমার শিওরে জেগে থাকি, ভিজে যায় মন, মিহি কাজল রং ঘিরে!

আজ কবরফুলে ছড়ায়েছে স্মৃতি ছাতিমফুলের এক্সট্রিম সেন্টের মতো— আমি বসে বসে কালিসন্ধ্যায় সেইসব দেখছি! দ্যাখো, বহু প্রতীক্ষার অবসান শেষে তুমি ঠিক রয়েছ আমার পাশাপাশি। ঝিঁঝিপোকারা করছে নৃত্য, আমাদের মিলন সন্ধিক্ষণে— এসেছে কতিপয় শৃগালও; গাইছে গান বহু সুরে সুরে;

আহা! আজ আমি বহু ঘোরে— এই বীভৎস সুন্দর আজ আমাকে খেতে চাচ্ছে, আমি রাজি; খাও হে বীভৎস, খাও:

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত

একাদশী

অন্ধ আকাশে উজ্জ্বল চন্দ্রবিন্দু ঝুলিয়ে,
জোৎস্না ‘চ’ থেকে ‘ছ’-এর দিকে
বৈঠা হাতে এগোয় অভিকর্ষের টানে।

‘দ’-এ দূরত্ব; ‘দ’-এ দৃষ্টি।

আমরা স্বাধীন জোৎস্না উপভোগ করে,
ওর ত‍্যাগ করা একাধিক শয‍্যা-কে কলঙ্ক বলে ডাকি।

অনুরণন

মাঝরাতে আলো নেভার পর,
প্রতিটি শরীর দেশ হয়ে ওঠে।
এক নিঃশ্বাসে আওড়ে নেয় পররাষ্ট্র নীতির সারমর্ম।
চৌষট্টি খোপের বিছানায় সেঁধিয়ে যায়
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য।
এখানে শুধু আমদানি হয়।
আর রপ্তানিতে বজ্রপাতের ভয়।
মখমলের সীমানায় ভাগ হয় আত্মপ্রকৃতি।
পাশবালিশের দুই ধারে দুইটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র আবদ্ধ
এক জীবনের হার না-মানার চুক্তিতে।

পাসওয়ার্ড

ইস্তক দেখছি, চোখের সামনে একটি জায়ান্টস্ক্রিন ঘোরাফেরা করছে।
শুধু আমার নয়, সবার।
তবুও কিছু দৃশ্যে
কেউ কেউ কী সুন্দর, সুনিপুণ ভাবে চোখ বন্ধ রাখে।
ভাবে, অন‍্যরাও বুঝি এর স্বাদ হতে বঞ্চিত।
সুযোগের সদ্‌ব্যবহার ঠিক তখনই ঘটে।
যাবতীয় গোপনীয়-নিষিদ্ধ যা-কিছু আছে কুড়িয়ে
মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রেমিক, প্রেমিকা, বন্ধু, বান্ধবী
সকলকে বোরের মতো সামনে দাঁড় করিয়ে দিই পাহারায়।
আর এরাই এই ডিজিটাল যুগে ক্রমশ,
মানুষ থেকে পাসওয়ার্ড-এর এক-একটি বিন্দু হয়ে ওঠে।

পদোন্নতি

একে-অপরের উন্নতির পাশ দিয়ে যাতায়াত করি

অজানা সময়, অজ্ঞাত পরিচয়

ঘরে সবকিছুর মান শূন্য

ধনাত্মকে গিয়ে ঋণাত্মকে ফেরা

উন্নতির দূরত্ব স্থির

আফসোস

সেটি কমে গেলে পথ বলে আর কিছুই থাকবে না।

ইনসমনিয়া

ঘুম না-আসার দায় রাতের উপর চাপিয়ে দিই

আণুবীক্ষণিক স্মৃতিচারণ

দেখতে দেখতে পৃথিবীর সমস্ত ভরকেন্দ্রের মালিকানা পেয়ে চোখ বুজতে ভয় হয়

ঘুমোলে নিজেকে দেখতে পাই না বলে জেগে থাকি পাহারায়

আর ঘুমন্ত মুখ দেখে ভাবি

সে তার পরিচয়কে এত সহজে সরিয়ে রাখে কীভাবে?

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

নিমাই জানা

শিথিল বরফের চাঁদ

রাতের নক্ষত্রেরা মেঘলা পথে হাঁটলেই সকলে অন্ধ মুনির আলখাল্লায় আমলকি বন দেখতে পায়
যৌগিক পুরুষ হয়েও আমি কোনো পার্বত্য নারীর কথা বলিনি, যারা ডুয়ার্সের অতলান্ত গভীর খাত থেকে তুলে আনে চা পাতার ভেজা শহর
আমি তাদের নরম বিভাজিকার গ্রাম্য রাস্তা থেকে তুলে আনি নদীপথের পিচ্ছিল গিরিখাত
দু-দণ্ড প্রশান্ত সাগরের চুমুকে গজিয়ে ওঠা শিরা রক্তের সংবহন খুঁজে বেড়াই শিথিল বরফে

দ্রাক্ষাফল ও সেলেনিয়াম ওষুধ

কে ঐ আত্মহত্যার সেলেনিয়াম ওষুধ খায় ক্রমশ ভাঙা খুদকণা, ভাতের পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে
দীর্ঘতর হয় এই লোমকূপের ছায়া
আমি এক প্রকাণ্ড বাবার ছায়ার নীচে বসে জমাট পাথরকুচি পাতায় আমার যৌনঘর ভেঙে সিমেন এনালাইসিস করছি
সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে মৃত নক্ষত্রদের হাতে করে নিয়ে আসি এই দ্রাক্ষাফুলের ভেতর
তাদেরকে জবজবে সাদা আতপ চালের হায়ারোগ্লিফিক শিখিয়ে চলি মধ্য প্রহরের পর কোনো শান্ত নারী ধ্রুপদী সংগীতে ডুবে যায় পশ্চিম দিকে মুখ রেখে

ধাতব ও পুরুষ অথবা কর্কট ছায়া

কালো মানুষের গর্ভ আর জরায়ু উলটো হচ্ছে কালো পাথরের মতো
আমি এক পরিচ্ছন্ন ছেঁড়া গামছা থেকে ভাঁজ করা লিবিডো অসুখ বের করি
রাতের পরিরা ঘুমোতে গেলে আমি ক্রমশ ধাতব ও বিষধর কর্কট পোকা বিছানায় উপুড় করে রাখি
নরম শেকড় থেকে সব পার্বত্য কথার বিয়োগচিহ্ন ভেঙে পাললিক পাথর সাজাই ভূগোল মায়ের দেহে
আমার কৌতূহল ভেঙে দিচ্ছেন মহাজন, দুটো আঙুলের ফাঁকে এত রাজকীয় তরল পোশাক গায়ে শাড়িটি ক্রমশ অনুর্বর হয় সুদর্শন পুরুষটির জন্য

মানচিত্র অথবা বৃত্তের কথা

ঈশ্বরী উলঙ্গ হয় আমার বৃত্তের পরিধির উপর
আমিও কালো রঙের মানচিত্র এঁকে দিই আমার ঠোঁটের উপর
জনৈক মৃৎশিল্পী পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের কবিতা রাখে আমার ছেঁড়া হাফহাতা পলিয়েস্টার জামার ভেতর, ঘামের গন্ধে দ্বিতীয় ছায়াটি নড়ে ওঠে জলের মতো
আমি সনাতন ঋষির জন্য দুটো সর্পগন্ধা, একটি নীল অপরাজিতা ও সহস্র বন্ধ্যা জলাভূমি রেখে এসেছি দেহ ত্বকের নীচে নরম শালুক ঢেকে
গর্ভাধান পুষ্ট হচ্ছে ক্রমশ

রাইবোজোম অথবা দুইজন মেডিকেটেড নার্স

আমি স্নায়ুর অস্ত্রোপচারের পর দু-টি পুরুষ নার্স তিনটি এক কোয়া রসুনের গল্প বলতেই অস্ত্রোপচার রুমের বাইরে আমার তিন শতক আগের উদ্ভিদ প্রেমিকার দেখা পেলাম
মেডিকেটেড নারীর সাথে দেবালয় ঘুরে এলাম আমার গায়ে নীল চাদর আর দুটো পুরুষ ফুলের গন্ধ অথচ আমি বেড়ে উঠছি না রাইবোজোম পুরুষের গায়ে, শীতল নদীর কখনো সংগমের পর্যায়ক্রম হয় না
এখনও শিথিল হয়ে আছি সংগমের পর, কোনো রাত্রিকালীন মহাযুদ্ধ অথবা প্রলয়ের পর কোলাহল মুখর নাইট্রোজেন স্নান করে ফিরলাম বৃষ্টির পর
সকলেই তরল বিষধর দাঁতে চম্পক নারীদের সাথে প্যাগোডা ভ্রমণ করছেন

কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সূর্যোদয়ের দ্বিঘাত

ফাঁকা ঘরে একাকী কেউ ফাঁসির কাঠ আর কীটনাশকের সরল সমাধান করছে দ্বিঘাত দিয়ে
বিছানার গোখরো ফেলে যাচ্ছে উচ্ছিষ্ট খোলস কাঞ্চনজঙ্ঘা আজ বড়ো চকচকে আজ সূর্যোদয়ের আগে
আমি রাতের গ্রাম্য নারীদের মতো ভেজা কাপড় হয়ে ঝুলে আছি তরল অসদ বিম্ব আমার কোনো পার্শ্বীয় পরিবর্তন নেই
দেহটি নিরাকার, চোখটি বাইফোকাল, নাভিটি থার্ড ডিগ্রির

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

কৌশিক দাস

দেশ-সংকলন

বিকল্প

ভিড় করবেন না

আপনারা সবাই সরে দাঁড়ান
বড়োবাবু আসছেন

বড়োবাবু আসছেন
চেয়ারটা পরিষ্কার রাখুন

কী কাণ্ড হাতল কই!
এক কাজ করুন, আপনাদের হাতগুলোই দিন

নিউটন

গুলির কোনো ধর্ম নেই,
সে চোখ বুজে মালিকের ট্রিগার শোনে

মালিকের কোনো ধর্ম নেই,
সে শোনে উপরওয়ালার কথা

উপরওয়ালারও কোনো ধর্ম নেই
সে শুধু বোঝে চারপায়ার সিংহাসন

সিংহাসনের অবশ্য একটি ধর্ম আছে,
সে কেবল প্রতিটি বস্তুকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে।

নল

কেমন গোলমেলে যাচ্ছে
দিনগুলো

বন্দুকের নলটা ভেঙে এনে সেখানে
চোখ রেখেছে ছেলেটা

আর তাকে খেলার ছলে ট্রিগার শেখাচ্ছে
পলিটিক্যাল বস্ত্র বিতরণ।

দেশ

হাসপাতালে শুয়ে আছ

অনেকেই শুয়ে থাকে যেভাবে

একটা রাগ চটা বেড— আড়াইজন মানুষ

কষ্ট কিছুটা ঝুঁকে আছে নীচে

নার্স আসবে— নিজেকে শক্ত করো

সামান্যই তো ইনজেকশন— এত ভয়!

কিছুক্ষণ আগেই যে গুলি খেলে!

আমি আর কুকুর

আমি একটা কুকুরকে নিয়ে কবিতা
লিখতেই পারি যেমনটা লেখে এখনকার
কবিরা কুকুরের একটা লেজ নিয়ে

কিন্তু আমি লিখছি না তার কারণ ওই
কুকুরটাই

চার রাস্তার মোড়ে রোদের মধ্যে শুয়ে
আছে। গায়ের অনেকটা জুড়ে পচন ছড়িয়েছে
— এই কথাগুলো নিয়েই কবিতা লেখা যায়

কিন্তু আমি লিখছি না কারণ আমার যেন
মনে হচ্ছে জলীয় আর করুণ চোখ নিয়ে
আমিই চার রাস্তার মোড়ে পচতে থাকা শরীরটা
নিয়ে কুকুরের দিকে তাকিয়ে আছি।

দেশ ২

কবরের সামনে কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর
যেটা সবার আগে চলে আসে সেটা হল উঠে পড়া

সামনের রাস্তাটা ঠিকানার দিকে গেছে;
তুমি তো রাস্তা ছুঁয়ে বাড়ি ফিরে যাবে

ফিরে গিয়ে বেলচাটুকু জেনো: তার গায়ে
নিরহং মাটি লেগে আছে!

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

অনির্বাণ মজুমদার

ডিসেম্বরের স্মৃতি


তাই শিরোধার্য তোমার মমত্ববোধ
নরম আস্তানা ছেড়ে বহুকাল অনিদ্রায়, বিষাদবন্দরে—

বিরোধিতা আমার কম্ম নয়,
লিখে রাখি অলক্ষ্যে, সবটুকু, অভিমান বাদে
মাঝপথে প্রস্থান ভালো কিনা, সে-বিষয়ে ভাবি
ভাবনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে জনসৈকতে।

ফুটপাথ-শ্বাস পাতার শিকলে মেশে
ঝড় নেই, ঝড়ের সময় ঠিক হয়নি এখনও

সূর্যোদয়ের ভয়ে
পাউরুটির ফাঁকে লুকোয় মাখন
স্নেহ কি ভেজেনি গর্ভজাত আলোর প্রপাতে?
অপচয় হল তবে শত্রুতার, ঠিক-ভুল জ্ঞানে

সহসা গ্রহণ লাগে
চাকা বদলাতে নামি জনশূন্য বিষাদবন্দরে।


কাঁঠালবাগানে আয়ুকারকের স্থূল মাছিগুলো
সরল বিপথগামী খরগোশ কোণে জড়সড়,
চা-কাপে ভাসে প্রজাপতির আদুরে ডানা
দেশলাই জ্বলে ওঠে, হাওয়া এল নীরব উঠোনে—

সাইকেলে ফিরে আসে আহত ভাবুকদের শিখা
অনেক বছর ধরে একাকী পাগল থাকে ঘরে…
প্রাচীন সংকেত চিনেছিল পশুরাও, অগোচরে
বাকি সব হারিয়েছে ঘড়ির অসম ব্যবহারে।

এখানে কিচ্ছু নেই, ফলের অলস শাঁস
জানে তার পরিণতি, তবু
নিজেকে মেলেছে ধরে ইভের সরল অভিনয়ে

আয়ুপথ ধরে ওরা আগুনের দিকে ভেসে চলে।


অবিরাম কথকতা, সহৃদয় নিমের জঙ্গল
অতিপরিচিত বাতাসের দোলা— তুলনারহিত
কুঠার ও শাবলের পেশাদার কথোপকথন;
নৈঋত— নীচে, কয়েক প্রজন্মের অব্যবহৃত জাঁতি,
নাড়ির অমোঘ টান— নিয়তিও হেরে সংযত
রাতপাহারায় পরশ্রীকাতর চাঁদের
অসংখ্য প্রহরী,
তাদের অন্তর্ঘাত সমাচারে
মুচলেকা দিয়েছে বাঁদর— নিছক কৌতূহলে…

সাজানো বাসর শেষে অগত্যা হেসেছে নাগর!

পাতা খসে অপমান-খলপ্রত্যাশে,
যেভাবে ক্ষমতা বুঝে নীরবে আঘাত করে ওরা
একমনে রুপোর জাঁতি: ঝাঁপ দেয় কাছে পেলে
কোমল সুপুরি।

খয়েরি ঘোড়ার দঙ্গল চলে প্রমোদবিহারে।


মৌনব্রত অবসর নিয়েছিল পাহাড়ের কাঁধে
অন্ধকার সমতলে নিশ্চিন্ত হৃদয়ের বাস—
স্মৃতির নেশায় শেরপার দৃঢ় আরোহণ,
আকাশের কাছাকাছি, দুঃখ যত মিথ্যে হয়ে যায়…

অভিমানে হারায় গাছের ফাঁকে আহত শিকার
বুনোফুল, রোমকূপে সম্মোহনের নির্যাস,

নেকড়ের অভিজাত সাহচর্যের ছোঁয়ায়
বোবা মেয়ে নেচে ওঠে, ঐশ্বরিক ইঙ্গিতে।
পায়নি, পায়নি টের— শব্দের প্রত্যাখ্যানে
অনাহূত ছায়ার আগমন!

শেখেনি ক্ষমার পরিষেবা, এই কথা স্বজনবিদিত
সতর্ক শ্বাস আর রক্তের শর্ত বিমূঢ়
নেকড়ে অদৃশ্য হয় নরকের নিঃশব্দ নীলে।


আর্সেনিকের দিন শেষ হয়ে এল কি তবে?
অভ্যেস অহেতুক কাগজ কুড়োনো কবেকার
রাত্রের কুকুরেরা সূত্রের সন্ধানে ব্রতী
ভিজে খঞ্জনি, শীতের বিহ্বল কীর্তন,
মোজাইকে মিলিয়েছে ইঁদুরের ছোট্ট তীক্ষ্ণ লাফ…

বন্দির চোখে সূর্যের নিষ্ঠুর আলো
দৃষ্টি ফেরালো?

পোকাদের উৎসবে কখনো নিমন্ত্রণ পেলে
সম্মতি জানিয়ে উপহার তল্লাশে মাছি!

ঘরের বাইরে যেন না যায় ভালোবাসাবাসি…

অযথা ভয়ের জামা পরে কেন এই মানুষেরা?
আতঙ্ক চিরকাল বহুদুর্ঘটনাবিলাসী।

অগ্রাহ্য করে তাই বহুরূপী ভক্তির টানে
মুক্তির অগ্রাধিকার চায় নিজের আসনে,
হায়নার লালারসে ধুয়ে গেছে সূক্ষ্ম প্রমাণ—

সময় ধাক্কা মারে আর্সেনিকের বোকা হাওয়ায়…


হুজুর
আবার বলছি এ-রণক্লান্ত দেহে
নির্বাসন মকুব হল না?

আগুনের থেকে আরও পাওয়া বাকি ছিল,
মাংসের থেকে আরও চাওয়া বাকি ছিল
গত ক্রিসমাসে আমি গুনেছি মাশুল—
সবিনয়ে,

চিরকাল কেউ ভালো না…

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

তন্ময় ভট্টাচার্য

পুত্রশোকাতুরা

পুত্রশোকাতুরা নারী, তাঁর ব্যথা কতটুকু জানি!
শুধু কি মৃত্যুর শোক? সন্তানের অযোগ্যতা নয়?
গৃহসূত্রে বেঁচে থাক বাংলার পিতৃপরিচয়
দিনান্তে, ভাতের পাতে, কীভাবে সংসার চলে, তাতে—

আত্মশোকাকুল যুবা কোনোদিন বুঝিবে নিশ্চয়!

নসিব

তোমাকে, স্মৃতির দেশে…
স্মৃতিরও রায়ট, খানদানি

দিবারাত্র ঝিকঝিক, কু এবং সীমানা-স্টেশন

কোথায় যে চলে যাও
ফেরত আনতে গিয়ে দেখি পর্দা, নসিব হয়েছ

একটি বেয়াড়া স্মৃতি
খুদগর্জ
থমথমে
একা

শাদা পৃষ্ঠা

‘এতদিন হয়ে গেল, ওসব কি মনে রাখলে চলে!’
এই বলে, বই ছেড়ে চলে গেল প্রেমের কবিতা

শিরোনাম একা-একা কিছুদিন চেষ্টা করেছিল
তারপর, অন্য কোনো বই দেখে, প্রতিপত্তি দেখে
যেই-না এগোতে যাবে— টান পড়ে সেলাইয়ে, পাতায়

কবিতা, শরীরইচ্ছা, বিজ্ঞাপনে ভুল থেকে যায়

নিঃসঙ্গতা

জীবন, আশ্চর্য কিছু হতে পারত। সেই সূত্রে
সাজিয়ে নিতাম দীক্ষা, ঝোড়ো রাত, অনিদ্রাকুসুম

জীবন, সচরাচর হয়ে রইল। ঘর থেকে
আরেকটি ঘর— ফের আরেকটি— সাড়াশব্দহীন—

পায়ে পা লাগিয়ে ভাবছি
আমাদের ঝগড়া হল খুব

ভূগোল অথবা মানববিদ্যা

এইসব ভয়ংকর কথা, তারও ভিতরকার কথা থেকে একটা ছোট্ট খাঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে ঘন জনবসতির মধ্যে দিয়ে। অথবা খাঁড়িই পুরোনো; স্বভাব পালটাবে না জেনে দু-পাশ থেকে চেপে ধরেছে মানুষ। দু-হাজারের বন্যায় একবার চমকে দিয়েছিল। আটাত্তরেও। তার আগের কথা কারোরই মনে নেই বিশেষ। পলি পড়তে পড়তে ক্রমশ বুজে এসেছে গলা। খাঁড়িটি, নদীর কাছে ফিরে রোজ চুপ করে বসে। ভয়ংকর কথাগুলো যাহোক মসৃণ করে বলে। নদী বোঝে, শেষ হল। তারও গলা ধরে আসতে থাকে।

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়

জলরঙের ছবি


জলের কাছে এসে খুলে রাখছ সাবালক বয়স। উঠানে খোঁপা খোলা রোদ। পুরানো ক্যালেন্ডারের পাতায় ঘুড়ি আঁকতে গিয়ে দেখলে— দূরে সাইকেল ঠেলে হেঁটে যাচ্ছে কেউ। হঠাৎই মনে পড়ল— বাতিল টায়ারের সাথে তোমারও কিছু কথা ছিল। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছ না— শেষ কবে দেখেছিলে, এঁটোলাগা অ্যালুমিনিয়ামের বাসন কীভাবে একা পড়ে আছে।

এখন তুমি নদী আঁকবে। পাথরের চাতালে পুয়ালদড়ির মতো পড়ে থাকবে একটা ঢ্যামনা সাপ। দূরে দূরে কিছু গাছপালার দৃশ্য। মাছের কাঁটার মতো বাতিল অ্যান্টেনা জড়িয়ে শুয়ে থাকবে অনেক পুরানো একটা হলুদ বাড়ি।

তুমি জল ঢেলেই যাচ্ছ। কিছুতেই রং উঠছে না।


সম্পর্ক থেকে উড়ে যাচ্ছে পরপুরুষ বক। পুকুরের চরিত্র নিয়ে কথা উঠতেই অনেক দূর জল গড়ালো। মেঘের পাশে মেঘ এল। নিরাপত্তা নিয়ে কেউই তেমন ভাবিনি। হাতে হলুদ সুতো বেঁধে বিশ্বাস করেছিলাম— উচ্ছেদের পর আমাদের আশ্রয় হবে শামুকবাড়ি।

এই ছবিতে কোনো রং নেই। তবু জলের বিরহ নিয়ে আমরা অনেকদূর যাব।


পুরানো তানপুরা থেকে সন্ধ্যা উঠে এল। গতজন্মের ভুলভ্রান্তির পাশ দিয়ে খালি-পায়ে হেঁটে ফিরছে কয়েকটা ছায়া। শ্যাওলাপড়া কুয়োর চাতালে দীর্ঘদিন পায়ের ছাপ নেই। শুকনো লঙ্কার মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। জেগে উঠছে সামবেদ। কয়েকটা হোঁচট খাওয়া সরগম।

নিভে যাওয়া হ্যারিকেনের রং দিয়ে বিষাদ আঁকছ তুমি। ক্লান্তি থেকে ক্যানভাসের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে অন্ধকার।

ছবিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে ছবি।

সান্ধ্য

মালা চন্দনের দিকে ঝুঁকে আছে সন্ধ্যার রেওয়াজ। এ-সংগীতে পিতার জন্মটুকু অবৈধ। পুরানো কাঁসার বাসন থেকে বাল্যপ্রেমের দাগ তুলতে তুলতে, গোপালের সান্ধ্যভোগ নুনে পুড়িয়ে ফেলেছে মা। আয়োজনহীন অন্ধকার। হাতবদল হয়ে আসা কুয়োর পাশে বৈচিত্র্যহীন বালিকার মুখ। সংগম ফেলে উড়ে গেছে খয়েরি চড়ুই। এসব কথা লেখা নেই কোথাও। তবু পাথরের ঘণ্টা বাজছে দূরে।

তৃষ্ণা নেই। অথচ নামগানের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে উদাসীন। পোড়া সলতের গন্ধ গায়ে মেখে, রক্তশূন্য বাতাসার পাশে শুয়ে আছে ঐহিক পাপ।

বৈকালিক

বাদাম খেতের পাহারায় অসতর্ক ঘুমিয়ে পড়েছে অনার্যবালিকা। লাল শালুকের ডাঁটার মতো দু-পায়ের নীচে সরু হয়ে আসছে রোদের শেকল। উলটো পালটা হাওয়া দিচ্ছে। ধুলো উড়ছে। এ-জন্মের পাতা উড়ে যাচ্ছে ও-জন্মের দিকে। ঘুমের ভেতর যেন তার কষ্ট হচ্ছে খুব। যেন পিতলের নাভিতে বেজে উঠছে রাক্ষসবাদ্য।

কেউ কাউকে দেখছে না। সংকটকালীন একটা খরগোশ পালিয়ে যাচ্ছে প্রথম ঋতুর দিকে।