Categories
2021-NOVEMBER-POEM

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

যখন সে জোনাকির দীর্ঘশ্বাস


এত যে ধ্রুবচোখ— নাম কী শান্তি না অপার

চিতানদীর মোহনায় দাহ জ্বলে অশেষ
বার বার কায়া মিশে যায় অর্বাচীন

পিছিয়ে সেই শূন্যতা শুকনো মাঠের কোলে সাদা বক
সম্পর্কে সমস্ত ওমধ্বনি আচ্ছন্ন আলোকরেখায়
অথবা আরও চায় মধ্যরাত—
কাছে বসে প্রতিপল চাঁদের ওজন
অন্তরাল আর নীরবতা ছুঁয়ে যায় কেবল

কাছে থাকি স্মৃতিতন্তুকাল


নদীর রাত ফিরে আসলেই জেগে ওঠে মহাকাশ
পরজন্মের কাছে হেঁটে যায় নীলিম আর পরম

এ-দুয়ের ভিতর শূন্য এক চৌম্বক আবেশ
মেঘমালা নামে এবং নির্বাসিত পাখি উড়ে যায়

আলোর কোলাহল শেষে কয়েকটা ধাপ সিঁড়ি
যতই উঠছি নেমে যাচ্ছি আরও গভীরে
টনটন করা পেশিতে শুয়ে থাকার আর্তি

অসুস্থের ছায়া তবু জেগে থাকে সুস্থতার উপর


বকুলপারের বাঁক দেখলেই সুগন্ধ হয়ে যাই
সমস্ত রং জড়িয়ে ধরে ঝিরঝির শিশির মায়া
বিষুবরেখায় দৌড়ে যায় রৈখিক সময়

আরও কিছু পথ, বাগেশ্রী রাগ বাজে
আঁকা বাঁকা ডালপালার ভিতরে উন্মুক্ত অশ্রু
ভারশূন্য দিঘির পাড়ে দাহিত নেপচুন

পরম কিছু যাতায়াত সহজপাঠ থেকে সূর্যাস্ত
সে-পথের একটু দূরেই সুস্মিত শ্মশান
তার নির্জন আলোয় অকপট খেয়াঘাট

আর শীতার্ত প্রদীপ


তার হয়ে পড়ি যখন সে জোনাকির দীর্ঘশ্বাস
বার বার সাধকের স্তোত্র ও শরীর
বিষুবরেখায় শূন্যজ সময় অকপট ছায়াটুকু

কোন এক শিয়রে সাদা দাগ ইতিউতি বাষ্প
সারাবেলাটি উড়ে গেল দিপদিপ নীল বর্ণ
প্রার্থনা থেকে প্রতিফলিত হল অনতিদূর

অবশ্য উত্তর নেই নেই কিছু প্রশ্নও—
আবছা স্নায়ুর আঁচড় কেটেছি সে-সব দাগে
মন্দ নয় ভেবে নদী পার করিয়ে দিই কিছু হসন্ত
ক্লান্ত আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে

জন্ম চাই চেতনা, ভীষণ সাঁতার


পাতা ঝরার আঘাত নিয়ে ভেসে আসে অনঙ্গ সংগীত
প্রতিবর্ত হৃৎস্পন্দনে কত সম্পর্ক
কোথায় হারায় অপেক্ষা—
পাখিরাও জানে কোমল বাতাস
তির্যক রোদ্দুরে এলোমেলো ছায়াপথ

চলে যান তিনিও
ভূমির সমান্তরাল আর নিসর্গ নিশ্বাস
যাত্রাপথে বেজে ওঠে নীল সেমিকোলন

চিৎশোয়া মহাকাশ নিয়ে
টেরাকোটা পেন্সিলে আঁকিনি কিছুই
খয়েরি ইচ্ছায় বসে থাকি প্রার্থনা আশ্রয়

 

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

অনিকেশ দাশগুপ্ত

পরিহার

একটি বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার জন্য শত অব্দের এই ধীর মৃত্যু
মেষপালিকার নীল চক্ষু থেকে পাহাড়ি ঝোরার দিকে
চাপা গোঙানির মতো অনুশীলনের ত্রিকোণ বর্ণমালা বয়ে গেছে
এই-ই সেই রাত্রিকালীন প্যারেডের অগভীর কণ্ঠস্বর,
ঝিলাম খেত—
বজ্রভরতি উপত্যকার একটি সেলোফেন ফুলের প্রদোষে আমাদের
চিহ্নিত মুখ অবনমিত হতে হতে রেখাঙ্কিত চৌরাস্তার ড্রিলগুলি
এখনও ছিনিয়ে নেয় বহু কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র, উচ্ছ্বল পাত্রের ভেতর তারই ছায়া
একক সত্তার দাগে দ্যাখো অবরুদ্ধ যত আকাশ-নীল এরোড্রোমে
দীর্ঘ রোবোটিক প্রস্রাবের স্ব-হুঙ্কার, সিজদার অমলিন কড়িকাঠজুড়ে
সন্দিগ্ধ আগুনের ভাষান্তর কেবলই উন্মত্ত
ক্রেতা-বিক্রেতার বিগত স্বর্ণালী, ধুলো-কোটের ভেতর উবু হয়ে বসে
সূর্যের নশ্বর স্বাদ খাদানে গড়ে তোলে মনোহর উপনিবেশ

পসরা

দুঃসহ এই অ্যাম্ফিথিয়েটারে সুদূর বাতাসের
বুদ্বুদ একদিন হাজির হয়েছিল
আমাদের প্রস্তাবসমূহ নিয়ে—
স্বপাতুর আগুনে দ্যাখো, আমি পুড়ে যাচ্ছি না
ছিঁড়ে যাচ্ছে না আমার তন্তুময় উপাদান

ধ্বংস শৃঙ্খলের ওই যে বাঁশিটি
অণু মুক্ত, যেভাবে বাঁক নেয় প্রগাঢ় অন্ধকারের দিকে
ধীর গতিময়তা, ধরাচক্র, এক নিমেষের যত আলোয়
জোনাকি সদৃশ তুমিও কি দেখোনি মৃত গর্ভের আনোখা ঊর্ণা
এক পাক্ষিক অমরতা এমনও তো আছে খানিক
স্নেহ গ্রন্থিজুড়ে যত ব্যবচ্ছেদকাম

আপামর ভগ্নাবশেষের ভেতর জনাকীর্ণ ছায়াগুলির মতো
অচঞ্চল, নিবিড় ছড়ে ওঠে মেলোডি,
কাঠুরের লন্ঠন চিড়ে ফেলে অরণ্য অনুষঙ্গ
এখানে উচ্চারণের মতন নিঃসঙ্গ
পড়ে থাকে চন্দ্রারোপিত চাতাল
পাশবালিশের ছিদ্র বেয়ে মিথুন অশ্বেরা গ্রহান্তরের সেই
অকল্পে, নিয়ত ব্যঞ্জনায় নিজেদের বিনিময় করে

কৃষিভঙ্গিমা

আধ শতাব্দীর পুরোনো নোঙর থেকে মৃত বুদ্বুদ ওঠে
সমবায় ছায়ার পাশ দিয়ে তির্যক বেরিয়ে পড়েছি আমি
যৌনপরবশ দোয়াবে চমৎকার গাঁথা হয়েছে বর্শাবিদ্ধ সেই আঙ্গিক
সমুদ্রের নোনা চুম্বনে ধূসর মমির মতন
উষ্ণতম ঊর্ণার দিকে উড়ে গিয়েছিল যে-পাথরখণ্ড
সময়ের ত্রিকোণ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে সে বিভ্রান্ত ফার্নেসে
নীল অবগাহনে চিত্রল হয়ে ওঠে নগরশেষের জ্ঞানলোক
অপ্রাকৃত গোধূলি পারে আর্চের মতো তার অধিষ্ঠান

দর্শক

কাঠগড়ার নীলিমা এভাবেই গল্পে-গল্পে ফুরিয়ে আসে
ক্ষমার্হ অন্ধকারের দিকে
একভাবে চেয়ে আছি যারা
গিলোটিন-অনুরক্ত প্রতিটি ভোরে সময়ের নিঃসঙ্গতা টের পাই

আত্ম-বিহ্বল দর্শকের গা থেকে ঝরে পড়া নির্ভার পালকটিকে
স্থাপন করেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো অন্য কোনো ইতিহাসে
স্তম্ভিত জানলার মুখে ঘুরে যাচ্ছে মুগ্ধ বাতি

সামুদ্রিক পঙ্‌ক্তি আর সোঁদা গন্ধের পৃষ্ঠার ফিকে আলো নিয়ে
ঠিক এভাবেই অপ্রিয় দূরত্বের অযুত কৃষ্ণরথ
পেরিয়ে যাব অমোঘ ভোরে

যন্ত্রণা

অন্ধকারে দাউদাউ জ্বলে ওঠা বাড়িটির জন্য
একটি বিস্মিত চাহনির গৈরিক টুকরোগুলো জড়ো করছি আশৈশব
মৃত ঘাসফুলের ওপর দিয়ে হেলেদুলে চলে গেছে সরীসৃপ
সর্বৈব অযৌন লাল ফুলের কৌটায় আকাঙ্ক্ষিত প্রসবের জন্য

ধোঁয়ার মতো চারপাশের দৃশ্যে একটি বালখিল্যতার মরু
সাদা ফ্রকের দহন, আর বিকেলের টিলার কদর্য আঙুলেরা
কীভাবে অপ্রস্তাবে ফিরে আসে আগুনে, একইরকম দগ্ধ

মৃদু স্বরের কুয়োপারে কেউ
এমন বিচ্ছিন্ন দৃশ্যগুলিকে বুঝে নিতে চাইছে
চাবিঘরের ত্রস্ত প্রসন্নতা অন্তত একটিবার
ঝলমল করে উঠছিল তখন, অনুনয়ের সুরে

Categories
2021-NOVEMBER-POEM

অমিতরূপ চক্রবর্তী

আরশি

আমার অন্ধকার থেকে কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে ওঠে তোমার উদ্দেশে। শেষ সন্ধ্যার রং এখন ফেটে, থেতলে যাওয়া জামের মতোই। কান্নার মতো টিপটিপে বৃষ্টি ধরে গিয়ে এখন শুধু উষ্ণ, উষ্ণতর নিঃশ্বাস জেগে আছে সবদিকে। মানুষের মুখ মানুষেরই মতো, ইতিউতি আলোয় দেখা যায়। আরও দেখা যায় মমতা চুইয়ে পড়া স্তন, সস্তা বাক্যের শেষে বসে থাকা আরক্তিম ঠোঁট। ইতিউতি আলোয় দেখা যায় জাহাজে চড়ে রাত্রি পাড়ি দেবার আগে এমন সব মানুষের ভিড়, দু-হাতে ডিম আঁকড়ে আছে। আজ হয়তো আমাদের পায়ে পা লেগে আলো আলো হবে না কোনো দিক। সবকিছুই অচঞ্চল থাকবে। ঠোকা খেয়ে খেয়ে একটি ক্যালেন্ডার ট্রাপিজ খেলোয়াড়ের মতো উড়বে। আকাশ থাকবে পাখির বুকের মতো সাদা হয়ে। তাতে কালো চাঁদ মরু অতিক্রম করবে। এই তো, এমনই সবকিছু। অচঞ্চল, অনুমেয়। রাত্রি পেরোলে যে নতুন ডাঙা, পায়ের নীচে মাটি— তা কি অন্যরকম? গলিতে নিশ্চয়ই তেমনই ইউরিনাল— যার কোনো দেওয়াল নেই। চাষাড়ে জঙ্ঘার মতো সব বাড়ির দেওয়াল। রাস্তায় কথা ছুটছে আগুনকে পরাস্ত করে, আলোকে পেছনে ফেলে— এমনই? বিরাট গহ্বরের মতো যোনি লোকসমক্ষে আড়াল করা? কতগুলি জিনিস আজ চিরদিনের জন্য লুপ্ত হয়ে গেল। অথচ আমার মনে হচ্ছে দ্যাখো, এই তো, এখানেই রাখা ছিল। এভাবেই বোধহয় মানুষ সহনশীল হয়। লোহার চেয়েও সহনশীল, পাথর অপেক্ষা পাথর। শীতল অপেক্ষা শীতল। নৈঃশব্দ্য অপেক্ষা নৈঃশব্দ্য

নিজের ছিরিছাঁদ ছুঁয়ে দেখি বিমর্ষ গালে আমার কোনো জন্মের কাটা দাগটি এখনও আছে। তার ইতিহাস উইয়ের পেটে গিয়ে এখন হয়তো বিশাল চড়ার মতো পড়ে আছে। তাতে ঘরবাড়ির আগমনও বিস্ময়কর নয়। কবেকার কথা, নয়? আজ কান্নার মতো বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৃথিবী নতজানু হয়ে ভিজছে। গাছপালার গা বেয়ে একটি দিনের কাঁচা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কাটা দাগের জন্ম থেকে এ-জন্মে এসেছি তোমার কনিষ্ঠা ধরে। খানিকটা অন্ধের মতো। তাই পথঘাট-অলিগলি আমার মনে নেই। পেছনে কী কী রেখে এলাম— তাও মনে নেই। এখন তো আমি পাথর অপেক্ষা পাথর। শীতল অপেক্ষা শীতল। নৈঃশব্দ্য অপেক্ষা নৈঃশব্দ্য— নয়? অবশিষ্ট মানুষের সঙ্গে আমার বহু মিল আছে। ওদের চোখের মতোই আমারও চোখ। ঠোঁটের ফাটল। পায়ুকামী ঘোড়ার মতো সব হাতের আঙুল। ঝুরি নামানো বটগাছের মতো একটা অভিজ্ঞ দেহ। কপালে, চুলে পরিমিত তাপ— যা তোমার পছন্দের। এখন এই পড়ে, থেতলে যাওয়া জামের মতো সন্ধ্যার পথ ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখছি উড়ন্ত কানের পেছনে মানুষ অকারণে ছোটে। এই যে অ্যাত প্রাঞ্জল আয়োজন— তা কি যথেষ্ট নয়? ফটকের আড়ালে সিঁড়ি। সিঁড়ির পরে একটু ক্ষুদ্র বারান্দা, তারপরেই সেই দেওয়ালে মাংস লেপা ঘর। তোমার নির্বোধ আচরণ। শক্ত দড়িতে বাঁধা নুন-ভাতের শরীর। গাধার পিঠে চড়ে কেমন বসে থাকা একটা বিমূঢ় চাঁদ। এই কি যথেষ্ট নয়? নিরাবরণ হবার পর তোমার সেই বিশাল গহ্বরের মতো যোনি— যাতে শুধু সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠা চলে

এই কি যথেষ্ট নয়? সব দেশে, সব কালে এই কি যথেষ্ট নয়?

কলি

অন্য কোনোদিনও হয়তো তোমার দিকে তাকিয়ে দেখব এমন-ই একটা শীর্ণ হলুদ আলো একা একা জ্বলে আছে। আশেপাশের অন্ধকার তাতে খানিকটা পীতাভ। অন্য দিনটি হতে পারে এই বছরের ছোটো ছোটো মাছের মতো দিন, সপ্তাহ বা মাসগুলি পেরিয়ে গেলে। প্রগলভ ঘোড়ার মতো এইসব দিন, সপ্তাহ বা মাসগুলি পেরিয়ে গেলে। যে-হাওয়া আসন্ন কাল থেকে উচ্ছ্বসিত ডালপালা অতিক্রম করে আসে, তার গায়ে কেমন বোটকা গন্ধ। যেন গরম রক্তের পশু তাকে ছেড়ে এইমাত্র উঠে গেল। আসন্ন কাল যেন কতগুলি উন্নাসিক জাহাজের পল্টন। মানুষকে ক্ষুদ্র করে দেয় বা ক্ষুদ্র করে দেখায়। তোমার ঊরুতে কখনো হাত রাখলেও আমার এমনই মনে হয়। তোমার অকূল সব বিস্তারের কাছে কী ক্ষুদ্র, কী অসহায় আমি। তোমার অননুমেয় উচ্চতার কাছে, তোমার পরিণামদর্শিতার কাছে। তাই প্রগলভ ঘোড়ার মতো এই দিনগুলো। ছুটন্ত, বেপরোয়া ক্ষুরের মতো এই দিনগুলো। তোমার চোখে তাই হয়তো একটা শীর্ণ হলুদ আলো নিঃস্ব থেকে ঝুল খেয়ে নেমে একা একা জ্বলে, জ্বলে থাকে। চারপাশের ভুষো চাদরের মতো অন্ধকার তাতে একটু বুঝি পীতাভ হয়। হয়তো এই-ই আঁকড়ে কেউ কেউ যেন-বা ধীবর জাতির— বেঁচে থাকে। এমনই একটা শীর্ণ হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে, লতানো গলার সাহায্যে সবটুকু ঔৎসুক্য নিয়ে। গুটিয়ে যাওয়া ছোট্ট লিঙ্গ নিয়ে অথবা পরিত্যক্ত পাখিবাসার মতো হাড়-পাঁজর নিয়ে। আমিও কি তেমনই? শীর্ণ হলুদ আলো? অগণন তারার নীচে দুঃখিত কোনো ছায়া?

অথচ পৃথিবীতে তুষারপাত হয়। কর্তব্যনিষ্ঠ নদীর পাশে ঝরে থাকে কত প্রবাদ, কত রঙিন গাছের পাতা। পরনের হাওয়াই তাতে রেখে দিলে, তাকেও রঙিন তৃপ্ত পাতাদের মতোই মনে হয়। গরিষ্ঠ দেশে একি খুব আশ্চর্যের? খুব বিস্ময়ের? দরজায় যারা আড়ি পেতে ভেতরের নৈঃশব্দ্য শোনে— তাদেরও দেহকাণ্ড দু-পায়ের ভরে উঁচু হয়ে থাকে। অন্য মুখের মতো তাদেরও কি মুখ নয়? নীল শিরায় ঢাকা মস্তিষ্ক নয়? ভবনের মতো শরীরের গাঁথুনি নয়? অথচ পৃথিবীতে তুষারপাত হয়। জল জমাট বাঁধে, আবার গলেও যায়। নেটের বোরখা পরা মসলিন মহিলার মতো রোদ আসে। আকাশে আনন্দিত কাটাকুটি রেখে ওড়ে পাখি। প্রগলভ ঘোড়ার মতো এই দিনগুলি হয়তো-বা বহুদূরে অরবে ছুটতে থাকবে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাদের হয়তো-বা মনে হবে কোনোদিন আদ্যন্ত শিশুতোষ গল্পের মতো। মনে হবে? লতানো গলার সাহায্যে সবটুকু ঔৎসুক্য নিয়ে, এগিয়ে দিয়ে যারা বেঁচে আছে— তারাও কি এমনই ভাবে? মাছের অন্তর বোঝার মতো তারাও কি বুঝতে পারে এসব? এই গরিষ্ঠ দেশের ভাষা? ও শীর্ণ হলুদ আলো, আমি কি কোনো ধূর্ত শিকারিকে অনুকরণ করি বা করছি? তার রঙে, তার রেখায় আত্মাকে অলংকৃত করি? কূট বিষ রাখি দাঁতে? অতিকায় পাহাড়ের মতো পরিণামদর্শিতা, মমতাময় স্তনের দিকে কখনো হেঁটে ওঠা কাঠপিঁপড়ে বা জানালার বাইরে কখনো কুয়াশায় মোড়া ভোর দেখা দিলে মানুষ কি দেহবদল করে দেহান্তরে যায়? গরিষ্ঠ দেশের ভাষা পিঙ্গল, সবুজ বা কখনো রক্তবর্ণ। কখনো-বা পরিচ্ছন্ন ধূসর

বোঝে তা? সবাই লহমা খরচ করে বুঝে ফেলে?

ট্রাপিজ

দ্যাখো কেমন শূন্যে ঝুলে আছি। বিমানের জানালা থেকে মাটিকে যেমন পার্সিয়ান মাদুরের মতো মনে হয়, তেমনই দেখতে পাচ্ছি আমি আমার সংসারটিকে। আমার ধ্যাস্টানো বিছানা, মাথার চাপে চেপ্টে থাকা বালিশ, চারপেয়ে কাঁকড়ার মতো টেবিলটা বা নীরবে জল-তাপ সহ্য করে যাওয়া নকল ফুলগুলো। আর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত হেঁটে বা উড়ে বেড়ানো তোমাকে। উইয়ের ঢিবির মধ্যে একটি মানুষ বসে থাকে— তাকে। শূন্যে হাতড়ে হাতড়ে আমি সংসারের ওপরে যেতে চেষ্টা করি। ছায়া যদি পড়ে, একচিলতে সীসে রং মেঘের ছায়া। তুমি একটু শান্তি পাবে। ঘন ঘন আঁচলে মুখ মুছতে হবে না আর। এভাবে ঘন ঘন মুখ মুছতে মুছতে কখন যে তোমার মুখে বাঘের আঁচড়ের মতো লম্বা, তির্যক দাগ পড়েছে, তুমি তো জানোই না। চোখের নীচে কী বিশাল চরাচর। বাথরুমের মাথায় কেমন আদুরে একটা কী পাখি যেন এসে বসেছে। মাথা কাত করে জানো, তোমাকেই বোধহয় দেখছে। একটি ঘরে একা একা আলো-পাখা ঘুরে যাচ্ছে। বসার কৌচে সাদা কভারের ঝুল উড়ছে তাতে। তুমি দ্যাখোনি? শোনো, তোমাকে বলি বুকের কিন্তু ওপরের দিকে অনেকটা হাঁ। আমাদের ধস্তাধস্তি, হাঁচর-কামড়ের সব দেখা যাচ্ছে। পাখিটা যদি কোনো আত্মা হয়? সব কথা কিন্তু চাউর হয়ে যাবে! মৃতরাও পরলোক থেকে ফিরে এসে শুনে যাবে সে-কথা! উইয়ের ঢিবির ভেতরে যে-মানুষ, তার শর্করাহীন খাওয়া হল? জানো, গতরাতে তোমার চোখ উপড়ে নিতে যে-আঙুল ব্যবহার করেছিলাম— সে-আঙুলে এখন তীব্র ব্যথা

আহা, জানালা দিয়ে কেমন একদল ময়ূরের মতো রোদ ঘরে ঢুকেছে। এই শূন্য থেকে সংসারটাকে মনে হচ্ছে অবিকল একটা নদীপাড়ের জঙ্গল। মাথায় কী প্রদীপ্ত আকাশ, সভ্যতাবিরোধী মেঘ। বিছানায়, ঘরের মেঝেতে বা বারান্দায় কত পাতা ঝরে ঝরে পড়ে আছে। সেখানেই কোনো একটা কিছুর সম্ভাবনায় মৌমাছি এসেছে। তুমি যেন বনরমণী। কালো পিঠে চকচক করা মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ডে ভর দিয়েই তো তুমি আমাকে আক্রমণ করো। টিরানোসোরাসের মতো উড়ে আসো লম্বা লম্বা পাখা মেলে। আমি তো তেমন সশক্ত নই, তাই পাখার ঝাপটেই এমনভাবে টুকরো হয়ে যাই— যা কাউকে বলার নয়। যা একান্ত তোমার আমার। কোনো শাসক, কোনো রাষ্ট্রনায়কের নয়। কোনো ধর্মের নয়, কোনো দেশের নয়, কোনো শান্তি মিছিলেরও নয়। শুধু তোমার আমার। কুলুঙ্গিতে রাখা প্রদীপের মতো বা আড়ালের ওপারে জ্বলা মোমের মতো। আমি কখনো নীল অজস্র কণা দিয়ে তৈরি হাতে তোমাকে ছুঁই। তোমার ভাপ, অন্ধকার ছুঁই। নিতম্বে ছোটো ছোটো শাবকদের স্পর্শ করি— তা তো আমার সীমানা ছাড়িয়ে তোমারও সীমানায় পড়ে। তখনই তো তুমি শিউরে ওঠো, ওঠো না? সব রোমকূপ তাঁবুর মতো দাঁড়িয়ে যায়। নাকের অঞ্চল পেরিয়ে ঠোঁটে ঘাম চলে আসে, নোনতা নোনতা ঘাম— যা কোনো শাসকের নয়, রাষ্ট্রনায়কের নয়। কোনো ধর্মের নয়, কোনো দেশের নয়, কোনো কাঁটাতারের নয়। তুমিও তো ভাবো আমারই মতো, নয়?

শিউরে উঠতে উঠতে। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে। শ্রান্ত, ধিকিধিকি আগুনের মতো কখনো বারান্দায় দেওয়ালে বন্ধনহীন ঠেস দিয়ে

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

ষষ্ঠদশ অধ্যায়

আবার চলা শুরু। এবার দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে। আশি ইউ ইয়েন-এর কিছু কম পথ অতিক্রমকালে তীর্থযাত্রীদল অনেক মঠ, অনেক মন্দির পার করে এলেন। আর পার করে এলেন সে-সব মঠের দশ সহস্র সন্ন্যাসী-সঙ্গ। এই সমস্ত স্থান পেরিয়ে অবশেষে তাঁরা এসে পৌঁছোলেন মথুরা রাজ্যে। এ-স্থানে পৌঁছাতে অতিক্রম করতে হল যমুনা নদী আর তার দুই তীরের কুড়িটি মঠ আর মঠের তিন সহস্র সন্ন্যাসী। বৌদ্ধধর্ম ক্রমেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের ছোটো বড়ো সমস্ত রাজ্যে সকল রাজার রয়েছে বৌদ্ধধর্মে দৃঢ় বিশ্বাস। সন্ন্যাসীদের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনকালে রাজাগণ প্রত্যেকেই খুলে রাখেন রাজমুকুট। এর পর রাজপরিবারের সকল সদস্য আর মন্ত্রীরা নিজেদের হাতে সন্ন্যাসীদের খাইয়ে দেন। আহার পর্ব সমাধা হলে সন্ন্যাসীদের মূল আসনের বিপরীতে মাটিতেই বেছানো হয় কার্পেট আর সেখানেই সকলে উপবেশিত হন। সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে কেউই বসার জন্য বিশেষ আসন ব্যবহার করেন না। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই এইসকল রাজাদের মধ্যে পূজার আচরণ বিধির চল শুরু হয়। এর দক্ষিণে আছে আর এক দেশ, নাম তার মধ্য রাজ্য। এখানে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। বরফবিহীন এ-রাজ্যের মানুষ সচ্ছল, সুখী। নিষেধহীন জীবন। যারা রাজার জমি চাষ করে তারা যথেষ্ট পারিশ্রমিক পায়। এ-রাজ্য ছেড়ে কেউ চলে যেতে চাইলে যেতে পারে, ইচ্ছে হলে থাকতেও পারে। কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ-রাজার শাসনব্যবস্থা শোষণহীন। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কেবলমাত্র অপরাধীর জরিমানার বিধান র‍য়েছে। এমনকী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহের শাস্তি, ডান হাত কেটে নেওয়া। রাজার দেহরক্ষীদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট বেতন। রাজ্যজুড়ে কেউ প্রাণ হত্যা করে না। পেঁয়াজ, রসুন ভক্ষণ বা মদ্যপান কোনোটাই করে না এ-রাজ্যের মানুষ।

এ-সকল আলোর মাঝেও রয়েছে একটি অন্ধকার। চণ্ডাল জাতির মানুষদের এখানে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়। জনসমাজ থেকে এরা দূরে বাস করে। মূল নগরে বা বাজারে এলে এরা নিজেদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে একটি কাঠের টুকরো দিয়ে নিজেদেরই শরীরে আঘাত করতে থাকে। এতে সবাই চিনে নেয় তাদের আর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দূরে দূরে থাকে। এ-দেশে শূকর বা পক্ষী জাতীয় প্রাণী পালন করে না কেউ। গবাদিপশুর বিষয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। বাজারে না আছে কোনো মাংসের বিপণি, না কোনো ভাটিখানা। কেনাবেচা চলে কড়ির বিনিময়ে। কেবলমাত্র চণ্ডাল জাতির মানুষরাই শিকার করে এবং মাংস কেনাবেচা করে।

বুদ্ধের নির্বাণলাভের সময় থেকেই এইসকল দেশগুলির রাজা, বয়োজ্যেষ্ঠগণ, এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রজনেরা নিজ নিজ স্থানে বিগ্রহ স্থাপনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল সন্ন্যাসীগণের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন, গৃহ, ভূমি, বাগিচা ইত্যাদি দান করা। আর দেওয়া হত কর্মক্ষম ব্যক্তি ও বৃষ, চাষাবাদ করার জন্যে। এসবের স্বত্বাধিকারের দলিল লেখা হত এবং রাজাগণ পুরুষানুক্রমে তাঁর পরবর্তী রাজাকে এই দলিল সঁপে যেতেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একইভাবে থেকে যেত এগুলি। এই দলিল ধ্বংস করার কথা ভাবে এমন দুঃসাহস হত না কারো। সন্ন্যাসীগণ যেখানেই যাক না কেন বাসগৃহ, শয্যা সামগ্রী, আহার্য, পোশাক কোনো কিছুরই অভাব হত না। তাঁরা ধর্মীয় দান ধ্যানের বদান্যতায়, অথবা ধ্যান-মগ্ন হয়ে এসবের দখল অনায়াসে পেয়ে যেতেন। কোনো আগন্তুক সন্ন্যাসী সহসা এসে উপস্থিত হলে, পুরাতন আবাসিক সন্ন্যাসীগণ তার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করতেন। ভিতর ঘরে বহন করে নিয়ে যেতেন তাঁর পোশাকআশাক আর ভিক্ষাপাত্র। পা ধোয়ার জল এবং প্রলেপ দেওয়ার জন্য তেল এনে দেওয়া হত এরপর। আর দেওয়া হত সন্ন্যাসীদের জন্য নির্ধারিত পরিমিত আহার্যের চেয়ে কিছু বেশি আহার-পানীয়। অচিরেই অতিথি সন্ন্যাসী যখন বিশ্রাম কক্ষে আসতেন, তাঁরা তাঁর বয়স আর সন্ন্যাস লাভের ক্ষণটি জানতে চান। এরপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো সকল শয্যা দ্রব্যাদি-সহ তাঁকে একটি কক্ষ দেওয়া হয়।

এই সন্ন্যাসীদের বাসস্থানগুলির নিকটেই সারিপুত্র, মোগালান আর আনন্দের উদ্দেশে প্যাগোডা স্থাপন করা হয়। অভি ধর্ম, পঞ্চ শীল আর বৌদ্ধ সূত্রাবলীর সম্মানে গড়ে তোলা হত মিনার। মাসাধিক কাল একই স্থানে বসত করলে, ধর্মভুক্ত সকল পরিবারগুলি মিলে ঐ সন্নাসীর স্বীকৃতি দান ও পূজা নিবেদনের আয়োজন করতেন। তাঁরা ভোজনের বন্দোবস্ত করতেন আর সকল সন্ন্যাসীগণ সমবেত হয়ে বুদ্ধের শৃঙখলাগুলি ব্যাখ্যা করতেন। সব সমাধা হলে তাঁরা সারিপুত্রের প্যাগোডায় এসে বিচিত্র সব সুগন্ধি ধূপ আর ফুলের অর্ঘ্য নিবেদন করতেন। নিশিভোর জ্বালিয়ে রাখা হত দ্বীপ। এতে সকলের পূজায় যোগদানের পথ প্রশস্ত হয়। সারিপুত্র আদতে ছিলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। একদা বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চেয়ে কাতর মিনতি জানান। মোগালান আর কাশ্যপ, তাঁরাও একইভাবে বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অধিকাংশ মহিলা ভিক্ষুগণ আনন্দের প্যাগোডাতে গিয়ে নিজেদের পূজা নিবেদন করতেন, কারণ, আনন্দই বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে, মহিলাদের সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি
আদায় করেন। আর নবীন ব্রতী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মূলত আরহতের পূজা করতেন। অভি ধর্মের গুরু যাঁরা ছিলেন তাঁরা অভিধর্মের পূজা করতেন। শৃঙ্খলার গুরু পূজা করতেন শৃঙ্খলাকে। এই পূজা বছরে একবারই করা হত। প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব একটি দিন ধার্য্য করা থাকত।

মহাযান মতে প্রজ্ঞাপারমিতা, মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বরের পূজা করা হত। সন্ন্যাসীরা যখন ফসল ঘরে তুলত, অগ্রজ, মধ্যবিত্ত, ব্রাহ্মণ, সকলেই বিভিন্ন উপচার, যেমন বস্ত্র ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। শমনগণ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে একে-অন্যের হাতে উপহারগুলি তুলে দিতেন। বুদ্ধের নির্বাণ লাভের সময় থেকেই, পবিত্র ভ্রাতৃত্ব বোধের প্রতি এই মহান শিষ্টাচারগুলি চলতে থাকে অনিবার। সিন তো নদীর অগভীর অংশ থেকে দক্ষিণ সাগর দিয়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার লি পথ অতিক্রম করলে পরে এসে পড়বে দক্ষিণ ভারতের সীমানায়। এ-দেশ একেবারে সমতল। পর্বত গাত্র চিরে বেরিয়ে আসা সুগভীর ধারা স্রোত নেই এখানে, আছে কেবল ক্ষুদ্রকায় কিছু নদী।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

শাকিলা আজিজ্জাদা

ভাষান্তর: পৌষালী চক্রবর্তী

দূর থেকে দেখি

আবার আমি একা পড়ে গেছি
পেছনে কেউই দাঁড়িয়ে নেই
পায়ের তলার থেকে মাটি টেনে নিয়েছে
এমনকী সূর্যের কাঁধও আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে

আমার নাভিরজ্জু বাঁধা ছিল
চলে আসা রীতিনীতির আলখাল্লার গিঁটে
আমার কেশগুচ্ছ প্রথমেই কাটা পড়েছিল
লিপির অনুশাসনের বেসিনের উপর
আমার কানের কাছে প্রার্থনার মতো কেউ ফিসফিস করে
‘তোমার পিছনের ও পদতলের মাটি সারাজীবনের মতো নিঃস্ব হয়ে যাক’

সে যাক গে, একটুখানি উপরেই
একখণ্ড ভূমি থেকে যাবে
যে-পবিত্রতর অন্য কোনো ভূমির থেকে
শয়তান যা যাচ্ঞা করতে পারে আমার থেকে

সূর্য আমার কাঁধে হাত রাখলে
আমি বিচ্ছিন্ন করেছি আমার পদযুগল, সহস্র এক বার,
যা কিছু পিছনে ফেলে এসেছি, সেইসব কিছু, থেকে।

নির্জনতা

তোমার হাতের সব রেখার মধ্যে
তারা লিখে রেখেছে সূর্যের ভাগ্য

ওঠো,
তোমার হাতদুটো তোলো—

দীর্ঘ রাত্রি আমার দম বন্ধ করে দেয়

কাবুল
জুন, ১৯৯৪

আমার কণ্ঠস্বর

এক দূরের দেশ থেকে আমি এসেছিলাম
পিঠে এক ভিনদেশি ন্যাপস্যাক নিয়ে
ঠোঁটে নিয়ে নীরবতার গান

যখন আমি আমার জীবনের নদী বেয়ে ভ্রমণ করেছি
আমি দেখেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর
(জোনার মতো)
গিলে নিয়েছিল একটি তিমি
মাছ

আর সেই থেকে আমার জীবনটা বেঁচে ছিল আমার স্বরে

কাবুল
ডিসেম্বর, ১৯৮৯

ইয়ালদা

আমার যন্ত্রণা হয়েছিল
যখন একবাটি মাখা ময়দার তালের মধ্যে
তোমার বাহুযুগল মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম

আর দেখছিলাম তুমি
একফালি লম্বা কাপড় ব্যবহার করছ
পাকা আঙুরের মতো তোমার স্তন বেঁধে নিতে

তোমাকে দেখেছি শিশুকে পরিত্যাগ করতে,
তোমার মুখের কোণ ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে
আমি যন্ত্রণা পেয়েছি।

তোমার ছায়ার দিকে ছুড়ে মারা একটি পাথরও
ঠোঁটে রক্ত বার করে আনার জন্য যথেষ্ট
যে পাথর ছুড়েছিল তার মুখে,
অবশিষ্ট লালা দিয়ে, আমি থুতু ছিটিয়েছি।

কথারা শুকিয়ে গেছে তোমার মুখের মধ্যে
ধীরে ধীরে বয়ে যেতে গিয়ে, বছর
হয়ে গেছে ধুলো আর ধোঁয়া

যাওয়ার সময় তারা পা টেনে টেনে হাঁটছিল
কিন্তু তোমার বাপের বাড়ির রাতগুলিকে
ঝুলন্তই ছেড়ে গিয়েছিল।

এপিটাফ

কার নিভে আসা শ্বাস
ঘুমোচ্ছে
তোমার ওই হ্যাজেল গাছের মতো চোখে?

কীরকমভাবে ছোট্ট শিশুর চাউনি
তোমার ট্রিগারের সামনে শূন্য হয়ে যায়?

কীভাবে তোমার হৃৎস্পন্দন চলে
যখন তরুণী মেয়ের হৃদয় তোমার তালুতে ধরা
আর পা-দুটো রক্তাক্ত?

পাহাড়ের মানুষ!
কোন পরিণতিতে তোমার পদতলের
খাড়াই পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে?

ধুলোয় ধূসর তোমার কোঁকড়ানো চুলের জন্য,
স্তনবৃন্ত পুড়ে গেলে
কীরকম লাগবে মেয়েদের,
কী ভাববে মা তার ছেলেকে?

বলো,
কার দু-চোখের গভীরে
তোমার নিভন্ত শ্বাস শান্তি খুঁজে পাবে?

ঈশ্বরের নিদর্শনসমূহ

একটি জানালার হৃদয়ে তুমি ফ্রেমের মতো বাঁধা পড়ে আছ

তার কাঁধের উষ্ণতা
তোমার আঙুলডগে জমাট বাঁধে

স্ট্রিটলাইটের নীচে
বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় তার পদচিহ্নগুলি

তোমার নোটবই বন্ধ
কিন্তু তার চিন্তারাশি পিছলে গিয়ে
পুনরায় যোগ দেয় বিলীয়মান রাতের সঙ্গে।

আর সেখানেই, একটি রাতচরা বিড়ালের ছায়া, হারিয়ে যায়।

প্রথম শ্লোকের মতো কার্যকরী
হাফেজকে তুমি
রেখে দাও পিছনের জানালায়।

তোমার হাতকে দৌড় করাও
রেশমি রুমালের ওপর দিয়ে
কোণায় কোণায় গিঁট বেঁধে
মুড়ে নেওয়া হয় বইরূপ আদি জননীকে

একটি রুপোলি শালের নীচে
তোমার কাঁধ, পাঠ্যের নীরব
ছন্দ হেন, কেঁপে যায়।

প্রাচীন শ্লোকের যত মোড়কের নীচে
পচে ওঠে ঈশ্বরের চিহ্নগুলো।

কনের ঘোমটাটি

আমার বিয়ের সাজ আমি টাঙিয়ে রেখেছি
সাদা রঙের স্মৃতির এক হুকে
তার কাঁধের ওপর আমার রেশমতুল্য দৃষ্টিপাত

তার বুকের থেকে আমি ছিঁড়ে নিয়েছি আমার হৃদয়
সেখানে এখনও দুধের গন্ধ

সে হয়তো জেগে যেত
আমার গ্রীবায় তার স্পন্দমান আঙুলেরা
তার বাহুজুড়ে সেই পুরাতন লাস্যের কলকল।

আমার হৃদয় আমি উপড়ে এনেছি
কিন্তু আমার দু-চোখে শুধু সে
তার চওড়া ও উজ্জ্বল পশ্চাদ্দেশ
বরের শালে জড়ানো

আমি নিজেকে আর মনে করাতে চাই না
পরবর্তী শ্বাসেই
সে উড়িয়ে দেবে ঘোমটার আবরণ

আমি আর গুনব না
তার শ্বাসগুলি

ভূমা

পৃথিবী তার উষ্ণ বাহুদু-টি বাড়িয়ে দেয়
আমাকে জড়িয়ে নিতে
পৃথিবী আমার মা
তিনি আমার এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর
দুঃখ বোঝেন।

আমার এই বিচরণ
এক বুড়ো কাকের মতো
যে জয় করেছে
কম্পমান পপলার গাছের সুউচ্চ শাখা
একদিনে একহাজার বার

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে প্রতিদিন ঊষাকালে
নিজের কালো চঞ্চু ডুবিয়ে নেয়
সূর্যের পবিত্র কুয়োয়

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে উড়া দেয় শয়তানের ডানা নিয়ে

অথবা জীবন নিজেই এক শয়তান
ধূর্ত লোককে জাগায় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে

জীবন যেন-বা বিষাদগ্রস্ত পৃথিবীর মতো
যে তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে

আর তাই আমি ধন্যবাদ দিই
‘বিজয়’-এর প্রান্তসীমায়।

পেশোয়ার শহর
জুলাই, ২০০২

একটি পালক

সেপিদেহ্-র জন্য

যেভাবে আমার স্বপ্ন
তোমার পদক্ষেপের শব্দ শোনে
যখন তুমি প্রবেশ করো
ধীরে, ধীরে, আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে

পাতের তলায় তুমি হামাগুড়ি দাও
বিড়ালছানার মতো, তোমার দু-চোখ
আমাকে পান করে।

ঘুমন্ত বা জাগ্রত
আমার স্বপ্নের রেশম তুমি ভাঁজ করো।

যে-মুহূর্তে
তোমার হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরে
তুমি দ্রুত বালিশের ওপর ঘুমিয়ে পড়ো।

আর আমি, আধো ঘুমে, আধো জেগে থাকি
যে-মুহূর্তে স্বপ্ন নিঃশেষিত হয়
তুমি আমাকে ভরে তোলো, পুনরায়।

অপেক্ষায় থাকা বিড়ালটি

এই শব্দগুচ্ছ
তারা ভালোভাবে নেয়নি

দয়া করে বোলো না যে, স্বর্গের দরজা
আমার ওষ্ঠাধরের মাঝে খোলে।

আমার দুই বুকের মাঝের ফাটলে
ঈশ্বর স্বয়ং হালকা চালে হেঁটে যান

আমি আসব

এবং আবার
তোমার শ্বাস আমার মধ্যে শ্বাস নেবে
তোমার ফুসফুস ভরে উঠবে
আমার সুগন্ধে
তোমার জিভের থেকে
বৃষ্টি, বৃষ্টি, শুধু বৃষ্টি
আবার ঝরবে আমার গায়ে

আমি দিয়ে দেব

এবং এই সময়ে
যখন তুমি আসো, চকচকে চোখে
আর ঝুঁকে পড়ো, আমাকে দু-ফালা করে দিতে

সংশয়ের ছায়ামাত্র থাকবে না তোমার

সেই কালো বিড়ালের মতো, যে
লুকিয়ে থেকে লাফ দেয়
আর আমার পথ বরাবর চলে যায়
তোমার দুয়ারে এসে চড়াই শিকার করে
যতক্ষণ না সে
নিজেকে হতভম্ব আর ফাঁদে পড়া ভাবছে

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

কৌশিক মিত্র

ডাউনস্ট্রিম

ফরতাবাদের সুরমা অ্যাপার্টমেন্টের ১২ নং ফ্ল্যাটটা একটি আপাত কলহ অথবা কথা-কাটাকাটির পর স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক চিলতে বারান্দা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া চারিয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তায়, রাস্তাটা নাকবরাবর গিয়ে মিশে যাবে গড়িয়া স্টেশন রোডে। বাঁ-দিকে এগিয়ে একটু গেলেই হরিমতী গার্লস। ধোঁয়াটা ততদূর যাবে না, যাওয়া সম্ভব নয় বলেই। কিন্তু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকল হরিমতী গার্লস স্কুল। সোনারপুর ব্লকের খাদ্য দপ্তরের পরিদর্শক অনিন্দ্য এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি মেয়ে সোনাইকে কোথায় ভর্তি করবে, কাছাকাছি হরিমতীর প্রাইমারি সেকশনে না কি আইসিএসই-র কোনো স্কুলে! চার বছর হয়ে গেল সোনাইয়ের। শিখার আপত্তি বোর্ড বা মিডিয়াম নিয়ে ততখানি নয়, যতটা অনিন্দ্যর গড়িমসি নিয়ে। অনিন্দ্য এই জায়গাটায় এসে বড়ো কনফিউজ্ড‌।ইংরেজি না বাংলা, আইসিএসই-তে না পড়লে কতখানি ক্ষতি হতে পারে সোনাইয়ের, সবাই কি হাসাহাসি করবে সোনাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ছে বলে। মন বিদ্রোহ করে ওঠে মাঝে মাঝে! যদি পড়াতে নিজেকেই হয়, তাহলেও বছরে কম-সে-কম চল্লিশ থেকে ষাট হাজার টাকা স্কুলে দিতে হবে। কেন??? কেরোসিনের ডিলার হরি পালের মুখটা মনে পড়ে যায়, কী খুশিতেই না এসে মিষ্টি খাইয়েছিল নাতনিকে নামজাদা এক আইসিএসই বোর্ডের স্কুলে ঢুকিয়ে। এই সোশাল প্রেসার অনিন্দ্যকে গুটিয়ে রাখে। পাটুলির এক বিখ্যাত স্কুল থেকে ফর্মটা তুলে ফিল-আপ করে জমা দেবে কি দেবে না এটাই সে ভেবে যেতে থাকে। শিখার আপত্তি সংগত, এরপর দেরি করলে তো হরিমতীর শিশু শ্রেণিতে ঢোকাও মুশকিল হয়ে যাবে, ক্লাস ওয়ানে তো আবার লটারি।

অফিস থেকে অটোয় ফেরে অনিন্দ্য। অভ্যাসবশত, স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে যায় বরদাপ্রসাদ হাই স্কুলের উলটো দিকের ইউনিক বুক স্টোর্স-এ। দোকানের মালিক নির্মলবাবুর ফেয়ার প্রাইস শপ আছে। দুই ছেলে এই দোকানটা দেখে, আবার ব্লকে খাতাপত্র সইয়ের জন্যও তারা প্রায়ই অনিন্দ্যর কাছে যায়। স্বভাবতই ছেলেদুটোর সঙ্গে অনিন্দ্যর সখ্যতা জমে যায়, নকাই তো অনিন্দ্যরই বয়সি ফিজিক্সে অনার্স, প্রচুর টিউশনও পড়ায়, মকাই একটু ছোটো। বেশিরভাগ সময়ে ইউনিকে মকাই-ই থাকে। খুব বেশিদিন অনিন্দ্য সোনারপুরে পোস্টিং পায়নি, সুতরাং আবাসনের বাইরে তার পরিচিতি কম, খুব একটা মিশুকে না হওয়ার কারণে সে এ-জায়গায় পিছিয়ে পড়ে, আবার ভেতরের আড্ডাবাজ মানুষটিকে সামলাতে না পারায় ইউনিক স্টোর্স তার গল্প করার একটা ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়।

একটু আগেই ইউনিকে ঢুকেছে অনিন্দ্য। সন্ধ্যা নামছে। মেট্রোর গতিবিধিতে এই চত্বর এখন সর্বদাই সরগরম। কেন-না ঠিক পেছনেই কবি নজরুল। নির্মলবাবু মাঝে মাঝে দোকানে এসে বসেন। আগে কী ছিল, এখন কী হয়েছে এসব গল্প নির্মলবাবুর কাছ থেকে শুনতে ভালোবাসে অনিন্দ্য। আপাতত দোকানের সামনে ভিড় দেখে তার থমকে যাওয়া— হঠাৎ মকাই তাঁকে দেখতে পেয়ে যায়— ‘স্যার, এদিক দিয়ে আসুন।’ দোকানে ঢুকে একটা টুলে জমাট হয়ে যায় অনিন্দ্য।

এক সুবেশা চড়া মেক আপ নেওয়া ভদ্র মহিলার সঙ্গে মকাইয়ের তর্ক চলতে থাকে—

— ‘ম্যাডাম, আমি তো আগেই বলেছি অক্সফোর্ডের হার্ড বাইন্ড খাতা, একদিকে ছবি, রং পেনসিলের কাজ, অন্য দিকে টাইপড প্রিন্ট আউট নিয়ে সাঁটানো— পাঁচশোর এক পয়সা কমে দিতে পারব না।’

— ‘কিন্তু গাঙ্গুলীবাগানের মডার্ন সাড়ে তিনশো করে নিচ্ছে কী করে?’

— ‘ছবিটা তাহলে বাড়িতে এঁকে নিতে হবে ম্যাডাম।’

ভদ্রমহিলা ব্যাজার। ‘কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?’

— ‘তিনশো।’— ভদ্রমহিলা তিনটে কড়কড়ে একশো টাকার নোট বার করেন।

বিলে লেখা শুর হয়।— দান্তে, মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো, মোৎজার্ট, নেপোলিয়ন, আমুন্ডসেন… মকাইয়ের বিড়বিড় অথচ নির্লিপ্ত উচ্চারণ চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ঠ।

‘অন্বেষা সেনগুপ্তের নামে বিলটা করুন। ক্লাস ফোর। হ্যাঁ, মোবাইল নাম্বার… না না, স্কুলের নাম লেখার দরকার নেই কিন্তু কবে দেবেন?’ হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখবেন, দু-শোর ওপর ওয়ার্ড যেন না হয়! ম্যাক্স দু-শো দশ। আমি কিন্তু দেখে নেব।

— ‘বেশ। আজ বুধবার! শনিবার বিকেলে পাবেন।’

ভদ্রমহিলা চলে গেছেন। মকাইয়ের সঙ্গে অনিন্দ্যর টুকটাক কথা শুরু হয়।

— ‘কী ব্যাপার মকাই? ফোরের একটা মেয়েকে দান্তের উপর দু-শো শব্দে রচনা লিখতে হবে?’ আহা! রবীন্দ্র সদনে লিট্ল‌ ম্যাগাজিন মেলা থেকে কেনা কমল মুখোপাধ্যায়ের শিলীন্ধ্র-র দান্তে সংখ্যাখানা অনিন্দ্যর মগজে ঝিলিক দিল। এখনও পুরোটা পড়ে ওঠা গেল না।

— ‘না, স্যার রচনা-টচনা নয়। সিম্পল প্রোজেক্ট!’

— ‘প্রোজেক্ট ব্যাপারটা আগেও শুনেছি। তা একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা দান্তের উপর প্রোজেক্ট করবে?’

— ‘স্যার, ওভাবে ভাবছেন কেন? এখন স্কুল, পেরেন্টস, টিচার সবাই চাচ্ছে ছেলে-মেয়ে অল স্কোয়ার হোক। দান্তে থেকে প্রোগামিং সবকিছুই মগজে লোড করে নিতে হবে’—

— ‘বুঝলুম। তা তোমার ভূমিকাটা কি এখানে, বাচ্চাদের বকলমে তুমি এসব তৈরি করো নাকি?’

— ‘না স্যার, আমার সময় কখন? সব লোক আছে। খাতা-পেনসিল তো পাইকেরি রেটে কেনা। একটা ছেলে আছে, ইরেজিতে এমএ করেছে বিদ্যাসাগর থেকে ডিসট্যান্সে, দু-চারটে সাইট ঘেঁটে এসব তৈরি করে একেবারে স্পেসিফিকেশন মতো টাইপ করে প্রিন্ট-আউট দিয়ে চলে যায়। এক দিদি আছেন, বাচ্চাদের পড়ান, ভালো ছবি আঁকেন তার কাজ খাতায় ছবি, লেখাগুলো পেস্ট করে, ছবির পাশে অলঙ্করণের কাজটা করা— ব্যস প্রোজেক্ট রেডি।’

অনিন্দ্য ফিরে গেল ছোটোবেলায়। সেটা সম্ভবত ১৯৮৮। সে ওয়ানে। মা তখনই বিএড করতে গিয়েছিল, শ্রীমন্ত কাকু মা বিএড-এর প্র্যাকটিস টিচিঙের প্র্যাকটিকাল খাতা অলঙ্করণ করছে। তখন বিএড-কে বিটি বলা হত। যতদূর মনে পড়ছে রুল টানা অংশে প্রথমে লেখা ছিল শিক্ষক ক্লাসে যে-পিসটি পড়াতে চলেছেন সেটি কীভাবে উপস্থাপনা করবেন তারই বিবরণ-নমুনা হিসেবে সম্ভবত: ‘ভোরাই’ কবিতাটা ছিল। হায়, সে-খাতাগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল!

— ‘রেট’ কীরকম দাও?

— ‘কম্পাইলেশন আর প্রিন্ট আঊট একশো পঁচিশ, ছবি আঁকা-সাঁটানো পঁচাত্তর।’

— ‘খাতা, মলাট স্টিকার নিয়ে তাহলে আড়াইশো। বাবা! তোমার তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফিট।’

— ‘খাতা পেন বই বেচে লাভ নেই স্যার। বই/খাতা এখন স্কুল থেকে নেওয়া মাস্ট। দোকান টিকিয়ে রেখেছে প্রোজেক্ট আর ইশকুল।’

— ‘বাঃ, এ তো দেখছি একেবারে ইন্ডাস্ট্রি!’

— ‘ঠিকই স্যার! কোর নয়, তবে ডাউনস্ট্রিম!’

ফিলড আপ ফর্ম নিয়ে আপাতত, সেই বিখ্যাত স্কুলের সামনে অপেক্ষমান অনিন্দ্য। গেটের অদূরে ভুট্টাওয়ালা, পাশে সুদৃশ্য চশমার দোকান। সে জানে, ফর্ম জমা দিলে সোনাইকে অ্যাডমিশন টেস্টে বসতে হবে। সিলেবাস দেওয়া আছে— ‘এ’ থেকে ‘জেড’ বড়ো ও ছোটো হরফে লেখা, ‘অ’ থেকে ‘ন’ পর্যন্ত লেখা এবং ‘ওয়ান’ থেকে ‘ফিফটি’ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারা— মোটের উপর এই হল সিলেবাস। এতে উতরোলে বাবা মা ক্যান্ডিডেট-সহ তিনজনকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হতে হবে। তাতে কর্তৃপক্ষ খুশি হলে তবে অ্যাডমিশনের পরোয়ানা।

অনিন্দ্য টাইম মেশিনে করে ফিরে যাচ্ছিল ব্লকের স্থায়ী সমিতির মিটিঙে। নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ স্থায়ী সমিতির তরফ থেকে বক্তব্য রাখছিলেন সিডিপিও শুভাশিস গোস্বামী— শুভাশিস অনিন্দ্যদেরই সমসাময়িক— ৩-৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য প্রথাগত শিক্ষা-প্রণালীকে এড়িয়ে ব্যবহারিক এবং বিনোদনমূলক শিক্ষাদান যে কত প্রয়োজনীয় সে-কথাটাই বোঝচ্ছিল শুভাশিস, ব্লকের (প্রোজেক্টের) ২০ খানা শিশুয়ালয়ে (মডেল আইসিডিএস সেন্টার) পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়ে গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ২৫টির কাজ শেষের মুখে, ওয়ার্কারদের সিনিতে (চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট) অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নেওয়ার পর্ব সমাধা। শুভাশিসের সঙ্গেই নিছক আগ্রহের বশেই হরিনাভীর কাছে একটা শিশুয়ালয়ে তার যাওয়া, বাচ্চাগুলোর জন্যে ট্রফি নিয়ে গিয়েছিল সে। সে এক আজব দেশ। সেই ফ্ল্যাশব্যাক এখন তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছিল।

সমস্যা হচ্ছে সোনাই পারছে না ঙ, ঞ লিখতে, এ-র মাত্রা কেন সে দেবে না এটা তার কাছে খুব দুর্বোধ্য, ওয়ান থেকে ফিফটি সিরিজে চিনলেও র‍্যান্ডম সিলেকশনে অসুবিধেয় পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কুঁচকে যাচ্ছে দিনদিন! কয়েকদিন আগেও অফিস থেকে ফিরে বাপ মেয়ের সঙ্গে টিনটিন নিয়ে বসত। রোজ তিন পাতা। টানটান হয়ে থাকত মেয়েটা! বাবা থার্কেটা দুষ্টু, কেন ও ক্যাপ্টেন আর টিনটিনকে ছেড়ে দিয়ে চলে এল। ‘তিব্বতে টিনটিন’— শেষের পাতা। চ্যাংকে নিয়ে ফেরার পথে টিনটিন, ক্যাপ্টেন আর কুট্টুস। সোনাইয়ের চোখে জল টলটল— ‘এ কী রে কাঁদছিস কেন’— মেয়ে ছুটে পাশের ঘরে চলে যায়। আবার ফেরে— ‘বাবা, ইয়েতিটা কী করবে এবার? ও যে একা হয়ে গেল!’

ইনস্পেকটর সাহেব অনিন্দ্য বসুরায়, এখন বড়ো একা, তার চোখের সামনে একের পর এক বিভীষিকা। হাতের ফাইলটা খুলে সে ফর্মটা একবার দেখে। সামনের পাতায় সোনাইয়ের পাসপোর্ট ছবিখানা বড়ো করুণ ঠেকে। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— ‘লা ভিতা নুওভা’— সে নিজেকে এখন দান্তে আলিগিয়েরির সঙ্গে তুলনা করল। আপাতত ইনফার্নোর সামনে। একজন ভার্জিলের বড়ো দরকার ছিল এ-মুহূর্তে। পথ প্রদর্শক! পাশের দোকান থেকে একটা ছোটো ফিল্টার উইলস নিয়ে ধরায় সে, হঠাৎই চমক— ‘স্যার কী ভাবছেন এত? মেয়েকে এখানে ভর্তি করবেন নাকি?’

কেরোসিনের এজেন্ট অমিত চক্রবর্তীর ছেলে বাপি।— ‘চলুন স্যার অফিসে দিয়ে আসি।’

— ‘আপনি এখানে?’

— ‘একটু ব্যাঙ্কের কাজে এসেছিলুম আর কী। আমার মেয়েও এখানেই পড়ে স্যার! এখন ক্লাস ফোর, নিশ্চিন্তে ভর্তি করে দিন— খুব ভালো জায়গা। খরচাপাতিও কম। আর কিছু না হোক মেয়ে অন্তত ইংরেজিটা ফড়ফড় করে বলতে শিখবে। ব্যস আর কী চাই?’

— ‘কীরকম খরচাপাতি?’

— ‘বছর দুই আগে একজনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলুম, তখন ঐ অ্যাডমিশন চার্জ, টার্মিনাল ফীজ, টিউশন ফিজ, অ্যানুয়াল চার্জ, বইখাতা এসব নিয়ে হাজার বাহান্ন পড়েছিল, এখন আর কত হবে ষাট-পঁয়ষট্টি হবে বড়োজোর! ওসব নিয়ে টেনশন নেবেন না স্যার—ডিসকাউন্ট করিয়ে দোব।’

— ‘না মানে, কি জানেন তার আগে অ্যাডমিশন টেস্ট, ইন্টারভিউ এসব আছে তো, তাতে পাশ করা চাই।’

বাপি হো হো করে হাসতে শুরু করে— ‘স্যার টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা! আপনি আমাদের সাহেব— আর এই স্কুলের সামনে এসে আপনি টেনশন নেবেন, আর আমাকে দেখতে হবে! ম্যায় হুঁ না! ওসব টেনশন পাবলিকের জন্য। ছাড়ুন স্যার! আগে বলুন কী খাবেন লস্যি না স্প্রাইট!’

স্কুলের গেটের মধ্যে দিয়ে একঝলক তাকাল অনিন্দ্য! আলাদা করে একটা টেন্ট খাঁটানো হয়েছে, সামনে বড়ো করে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে ‘অ্যাডমিশন কাউন্টার’।

অনিন্দ্য ধীরপায়ে গিলোটিনের দিকে এগিয়ে গেল।

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শুভজিৎ ভাদুড়ী

ঈশ্বর আর মানুষেরা

এক
সবে মাত্র দু-বার গাড়ি চলেছে। দু-বার গাড়ি খালি করে এসে তিন নম্বর বার গাড়ি লোড করার কাজ চলছিল। অর্ধেক ভরা হয়েছে এমন সময় থানা থেকে বড়োবাবু এসে হাজির। আবুল দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। বড়োবাবুকে দেখে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। ‘কার গাড়ি?’ বড়োবাবু এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন। এসব প্রশ্ন করার সময় বড়োবাবুর গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবুল খানিকটা দ্বিধা আর ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিল, “ছ্যার, আমার ছ্যার।”

“বালি তুলছিস কেন? বালি তোলা নিষেধ আছে জানিস না?”

আবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই বড়োবাবুর সঙ্গে থাকা একজন কনস্টেবল বলল, “জানে না আবার! এরা সব জানে।”

বড়োবাবু চোখ নাচিয়ে আবুলের দিকে তাকালেন। যে তিনজন ঠিকা শ্রমিক গাড়িতে বালি ভরার কাজ করছিল তারা কাজ থামিয়ে বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে ধরা বেলচা। সেপ্টেম্বর মাস। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। বেলা বারোটার রোদ্দুরে সবারই গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বড়োবাবু ঠিক এখানে আসেননি। একটা কাজ সেরে এই পথেই ফিরছিলেন। পথে দূর থেকে বালির গাড়ি চোখে পড়াতে এখন এসে দাঁড়িয়েছেন। গোটা রাজ্যে এখন বালি মাফিয়া, বালি চোরে ভরে গিয়েছে। এই নিয়ে থেকে থেকে ওপর মহল থেকে চাপ আসে। খবরের কাগজে লেখালেখি হয়।

“এটা তো চরার বালু নয় ছ্যার।” আবুল বলল। সে-কথা অবশ্য ঠিকই। বড়োবাবু চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলেন। এখান থেকে বুড়িতোর্ষার সেতু দেখা যাচ্ছে বটে, তবে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর তো হবে। এসব জমি হয়তো নদীর চর নয়। চাষের জমি। ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে এখানে অল্প ভিড় হতে শুরু করেছে। আশেপাশে খাটছিল এমন ছেলে ছোকরা, বৃদ্ধ এমনকী কোলে বাচ্চা নিয়ে শীর্ণ কায়া কয়েকটা মেয়ে বউও এসে হাজির। কোথায় যে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরা, আসলে পুলিশের পোশাকটাই এরকম, বড়োবাবু ভাবলেন। এত চোখে পড়ে আর সবাইকে একেবারে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

“চরের বালি না হোক, বালি তো! কার অনুমতি নিয়েছিস গাড়ি লাগানোর আগে? কাগজ দেখা।”

“কাগজ তো, আসলে…” আবুল আমতা আমতা করে,— “…ছ্যার, করা হয়নি ছ্যার।”

“তবে?” বড়োবাবু গলার জোর বাড়িয়ে বলেন, “নিয়ে যাব গাড়ি উঠিয়ে থানায়?”

গাড়ি থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ জানে আবুল। খানিক পয়সা খসবে আর দিনমান ভোগান্তি।

ইতিমধ্যে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে একজন যুবক। হাতে একটা কোদাল। বেশ আঁটসাঁট তামাদি চেহারা। একগাল দাড়ি। পরনে কেবল নীল চেকচেক লুঙ্গি। খালি গা। বুকে বড়ো বড়ো লোম। এখন ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। এ লালচান। বলল, “নিজের জমি থেকে বালা সরানোও দোষের?”

বড়োবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ কানে এল তার, “নেতারা সব নদী থেকে বালা তুলে নিল, তাদের ধরতি পারেনা! হুজ্জুতি করার জন্যি এই গরিবগুলানকেই পায়।”

লালচান কিছু বলছে না। কেবল দেখছে বালি পড়ে সাদা হয়ে থাকা জমিতে মাঝখানে কেবল কিছুটা খাবলা। সবে মাত্র দুই ট্রলি বালি পার করা গিয়েছে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি। এই বছর যেন বিপত্তির আর শেষ নেই। প্রথমে বন্যার জল ঢুকে ঘর বাড়ি সব ভাসিয়ে দিল। এত প্রবল বন্যা লালচান বহুদিন পর দেখল। রাজ্য সড়কের ওপর দিয়ে হুহু করে জল বইছে। জমি বাড়ি সব জলের তলায় পড়ে থাকল আধা মাস। সারা বচ্ছর বয়সের গাছপাথর না থাকা বুড়ি ঠাকুমার মতো রোগা হ্যাংলা শরীর যে, বুড়িতোর্ষা নদীর সে কিনা আঠারো বছরের সোমত্থ যুবতীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। জল নামলে দেখা গেল জায়গায় জায়গায় চাষের জমিতে ঢের নদীর বালি এসে জমা হয়েছে। এখন এই বালি না সরালে চাষ হবে কী করে! আর চাষ না হলে খাবে কী?

লালচানের সম্পত্তি বলতে এই তিন বিঘা চাষের জমি। বছরে কখনো লোকের জমিতে শ্রম দিয়ে আর কখনো নিজের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করে সংসার চলে। ঘর-ভরা সংসার। বাপ, মা, বউ, তিন-তিনটা ছেলেপুলে। সব মিলিয়ে মোট সাতটা উদগ্র হাঁ করে থাকা পেট। সেই পেট ভরার জন্য জমিতে ফসল হওয়াটা জরুরি। ফসল না হলে শুধুমাত্র লোকের জমিতে বাড়িতে গতর ঝড়িয়ে ওই পেট ভরা অসম্ভব। নিজের পেটে খিদের জ্বালা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু যখন ওই একরত্তি বাচ্চাগুলা পেটের জ্বালায় হামলাবে তখন? চুপ করে বসে দেখবে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে!

লালচান তাই তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গেল, “এরা কী বলতেছে আবুল?”

আবুল হাত দেখিয়ে লালচানকে শান্ত হতে বলে। আবুল বলেছিল, নিজের থেকেই বলেছিল, যে ও বালুটা সরিয়ে দেবে। ওর নিজের ট্র্যাক্টর আছে। লাফাবাড়িতে একজনের নতুন ঘর উঠছে। ভিটে উঁচু করার জন্য বালু দরকার। আবুল লালচানের জমি থেকে বালু সরিয়ে ওখানে দেবে।

পয়সা যা পাবে সেটা ওর লাভ হবে, আর তাছাড়া লালচানেরও উপকার হবে। এখন এতে দোষের কী আছে সেটা লালচানের মাথায় ঢুকছে না। সে চিৎকার করে এইসব বলছে।

বড়োবাবু সামান্য হলেও দ্বিধাগ্রস্থ। চাইলে গাড়িটাকে তিনি থানায় তুলে নিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু বালি চুরি আটকানো তার একার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জেলা স্তরের বিভিন্ন সরকারি মিটিং-এ তাকে এই নিয়ে কথা শুনতে হয় তাই তিনি গা ঘামিয়েছেন। তবে নদীর চর থেকে তুললে তিনি ধরতেন অবশ্যই। কিন্তু বন্যার জলের সঙ্গে আসা এবং চাষের জমিতে ফেলে যাওয়া বালুর ক্ষেত্রে নিয়মটা ঠিক কী এ-ব্যাপারে তার সঠিক ধারণা নেই। আবার এতটা সময় নষ্ট করে শুকনো হাতে ফিরে যাবেন এটা ভাবতেও তার ভালো লাগছে না।

দুই
সুরঞ্জন ভাবছিল এবার অফিস থেকে বেরোবে। বেলা দেড়টা বাজতে চলল। আজ সে অফিসে আসতই না। কিন্তু একটা জরুরি কাজ ছিল বলে আসতে হয়েছিল। কাজটা সেরে নিয়েই ফেরার কথা ছিল। আজ সকালের ট্রেনে ওর স্ত্রী এসেছে কলকাতা থেকে। সুরঞ্জন নিজেও কলকাতার ছেলে।

এতদিন চাকরিসূত্রেও কলকাতার আশেপাশেই ছিল, গতবছর বদলি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের একপ্রান্তে এই কোচবিহার জেলায় এসে পড়েছে। এখানেই এক ব্লকের ভূমিরাজস্ব আধিকারিক। ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ফ্যামিলি আসেনি। আসবেই-বা কী করে! ওর বউ তো কলকাতায় চাকরি করে।

সামনের কম্পিউটার বন্ধ করে সবে চেয়ার ছেড়ে উঠেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল— ওসি।

“বলুন।”

“একবার সাউদের বস-এ আসতে পারবেন? বালির গাড়ি ধরেছি।”

অনিচ্ছে থাকলেও মুখের ওপর একেবারে না করতে পারল না সুরঞ্জন। পদাধিকার বলে সে ওসি-এর থেকে উচ্চ। কিন্তু থানার সঙ্গে তাদের একটা ভালো সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়, কতরকম দরকার অদরকারে লাগে। সে বলল, “ক-টা গাড়ি?”

“একটাই।”

“আসছি। একটু থাকুন।”

বালি মাফিয়াদের নিয়ে সারা রাজ্যেই বেশ অস্থিরতা চলছে। উত্তরবঙ্গের এই জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় মাফিয়াদের দাপট এখানে অনেক কম। তবে যেদিকে চলেছে রাজ্য তাতে পরিবেশ অশান্ত হতে সময় লাগবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো শাসক দলের নানান মাপের নেতাদের যোগসাজশ পাওয়া যায়। আর এদিকে প্রশাসনিক সভায় নির্বিচারে ভূমিরাজস্ব দফতর চোর অপবাদে গালাগাল খেতে থাকে। তাদের অকর্মণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ ব্লকের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিসের নিজস্ব একখানা গাড়ি নেই। বাইরের লোকের মোটর সাইকেলই ভরসা।

সত্যি বলতে কী থেকে থেকে বেশ লজ্জা লাগে! সুরঞ্জন যেতে যেতে ভাবছিল। বুড়িতোর্ষার সেতুর ওপর থেকেই জটলাটা চোখে পড়ল। বাইক থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন জটলাটার কাছে এল। তারপর খানিক হই হট্টগোলের মাঝে সবটুকু শুনে বলল, “বালি বন্যার জলের সঙ্গেই আসুক আর যাই হোক বালি উঠানো বে-আইনি। বালি তোলার কোনও অনুমতি আমরা দেবনা। আর এগুলো জমির শ্রেণি কি? নদী বা সিকস্থি নয়তো?”

হাঁ হাঁ করে উঠল লালচান। তার সঙ্গে গলা মেলালো আরও অনেকে। সমবেত কণ্ঠস্বর জানান দিল জমি চাষেরই বটে। শ্রেণি ডাঙ্গা। সে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শোনো বালু তোলা যাবে না। কাজ বন্ধ। যেটুকু কাজ হয়েছে এর জন্য রয়্যালটি লাগবে। ফাইন হিসাবে দিতে হবে।”

লালচান বলল, “ছ্যার, বালি না সরান দিলে চাষ কীভাবে হবে? বিছন মাটি না পেলে ফসল হয়?”

কথাটা যে ন্যায্য তা সুরঞ্জনও জানে। কিন্তু সে কী করবে? তারও তো হাত পা বাঁধা। দিন সময় ভালো না। এখানকারই এক সাংবাদিক সারাক্ষণ খবরের জন্য ছোঁকছোঁক করে। তিলকে তাল বানিয়ে খবর ছাপায়। সে-সব খবর দেখিয়ে উপরমহল কৈফিয়ত চায়। কী দরকার অকারণ নিজের ওপর ঝামেলা ডেকে আনার। তাছাড়া একজনকে দয়া দেখালেই সব একেবারে পেয়ে বসবে। তবে এরা একেবারেই হদ্দ গরিব। কিন্তু এদের থেকে তো আর ফাইন নেবে না, ফাইন দেবে যে-ছেলেটা গাড়ি লাগিয়েছে সে। কী যেন নাম, আবুল শুনল বোধহয়। তবে সেও যে এই কাজটা করে বিশেষ কিছু পয়সা করবে তেমন নয়। নিজের সামান্য কিছু লাভ রেখে এ আসলে একধরনের সামাজিক উপকার। জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেওয়া। তাই এদের থেকে ফাইন নিতে যে ইচ্ছে করছে সেটাও নয়। কিন্তু এখন এই পুলিশের সামনে একেবারে কোনো ফাইন ছাড়া ছেড়ে দিলে ওরা হাসাহাসি করবে। পরে কোনো দরকারে ওদের ডাকলে খোঁটা দিয়ে কথা শোনাবে। তাই পুঞ্জীভূত অসন্তোষের মাঝে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন হাত তুলে বলল, “এই বালির গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে কাগজে ছবি উঠবে। এলাকার লোকেরাই বালি চুরির অভিযোগ করবে। তখন আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি।

কোনো বালি কোথাও সরানো যাবে না। আর যেটুকু কাজ অন্যায়ভাবে হয়েছে তার জন্য ফাইন দিতেই হবে।”

সমবেত ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলে সে আরও গলার জোর বাড়িয়ে বলল, “টাকা তো আর আমাকে দিচ্ছ না। সরকারি রসিদ পাবে। সরকারকে টাকা দিচ্ছ। আর না হলে থানার লোক আছে গাড়ি উঠিয়ে নিতে বলছি। যা হবে তা আইন মেনেই হবে।”

মুখে আইনের কথা বললেও সুরঞ্জন জানে এসব আসলে আইনের ফাঁক। আইনে ঠিক এরকম কথা বলা নেই। সরকার এক-একটা ভূমিরাজস্ব অফিসে রাজস্ব আদায়ের বড়ো বড়ো লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেয়। সেই ‘টার্গেট’ পূরণ করতে এইভাবে নরমে গরমে কিছু আদায় করতেই হয়।

যাদের মুখের জোর বেশি, যারা তুলনামূলক অসহিষ্ণু, যাদের নেতা ধরা আছে তাদের সামনে গুটিয়ে থাকে দফতর। কত কত বাংলা ইট ভাটা সরকারকে এক পয়সা রাজস্ব না দিয়ে মুনাফা করে চলে। কত ‘সেয়ম’ জমি ‘দুয়েম’ জমি পুকুর হয়ে যায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। কত ‘পুকুর’ দিনের আলোয় ‘বাস্তু’ হয়ে যায় আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে।

শেষমেষ আরও কিছু কথা কাটাকাটির পর দু-হাজারে রফা হল। সুরঞ্জন রসিদ বই বার করে খসখস করে লিখে দিল ‘আনঅথরাইজড এক্সট্র্যাকসন অফ আর্থ’। হ্যাঁ, “আর্থ”। পাগল নাকি যে “স্যান্ড” লিখবে। অ্যামাউন্ট লেখার সময় থানার বড়োবাবু একটু নাক সিটকালো। নীচু গলায় বলল, “এত কমে ছেড়ে দিলেন! থানায় নিয়ে গেলে মিনিমাম দশ নিতাম।”

সুরঞ্জন অবশ্য সে-কথায় বিশেষ কান করেনি। কারণ, লালচান তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছে, “এবার তালে বালাটা পার করতে পারব?”

“একদম না। এটা অন্যায়ভাবে যে কাজটা হয়েছে তার জন্যে ফাইন। কাজ করার পারমিশন না। আর একবারও গাড়ি চলবে না।”

“পারমিশন কে দেবে তাইলে?”

“কেউ দেবে না।” ফাঁপা সরকারি দম্ভের বুটজুতো বালির ওপর মসমস করে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে আবুলের গলা আলতোভাবে তার কানে এল, “বেকার বেকার খানিকটা টাকা খসল, তবে ভাবিয়েন না। ভোর রাতে গাড়ি লাগাব।”

তিন
প্রেম! কী গভীর প্রেম তার! কী গোপন সহবাস! এ-শরীর সে বানায়! এ-মাটি সে বানায়! তাঁর শরীরের ঘাম টুপটুপ করে গিয়ে পড়ে তৃষ্ণার্ত বুকে! ঘামে বুক না ভিজলে সঙ্গম হয় না। নরম হয়! নরম! নরম হতে হতে হাঁ করে থাকে বিছনের জন্য। তখন আর শুধু প্রেম থাকে না। থাকে পূজাও।

হাত জোর করা আকুল আকুতি। হে আমার ফসল ঘরে এসো। হে আমার ঈশ্বর ঘরে এসো। ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ। দাও। দাও। দাও।

একটানা শব্দটা সুরঞ্জনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবু সে নিজেকে অটুট রেখেছে। আট বছর পেরিয়ে গিয়েছে বিয়ে হওয়া। বোধহয় কলকাতার কোনো গাইনি কোনো ফারটিলিটি ক্লিনিক আর বাকি নেই। সব দেখানো হয়ে গেছে। প্রায় তো মেনেই নিয়েছে ভাগ্য বলে। তবু আজও কেন যে এই প্রক্রিয়াটা দহন করে! কেন কেবল আনন্দ হয় না! আজ কি আরও বেশি করে যন্ত্রণা হচ্ছে? সংগম অসম্পূর্ণ রেখে নিজেকে স্ত্রীর শরীর থেকে পৃথক করল সুরঞ্জন। তারপর ওর পাশেই পা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর মাথা নামিয়ে বসল। ওর পাশে এখন ওর স্ত্রীর নগ্ন নির্জন দেহস্তব্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হঠাৎ মনে হল ওরা চলে আসার পর লালচান কি ওর জমির পাশে ঠিক এভাবেই বসে ছিল? ওকে কি তবে লালচানের মতো দেখাচ্ছে! ও নিজেই কি আসলে লালচান? না না, তা কী করে হয়! লালচানের জীবনে ওর ভূমিকাটা তো সেই অদৃশ্য অদেখা ঈশ্বরের মতো! যার অঙ্গুলি হেলনে উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়! অনন্ত সম্ভাবনার ওপর যে বালি ছড়িয়ে দেয়! তবে কি ও নিজেও ঈশ্বর! তাই-বা কীভাবে সম্ভব! ও নিজে তো এই বিরাট সমাজব্যবস্থা আইন ব্যবস্থার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটবৎ অংশ যে শিশুর মুখস্থ করা পড়া আওরানোর মতো সমাজের দুর্বোধ্য নিয়মগুলোর চর্বিতচর্বণ করে। ঈশ্বর তো সে যে অদেখা অলভ্য। যার কেবল আকাঙ্ক্ষা করা যায় ভ্রূণ রূপে, কুঁড়ি রূপে। মনে হতেই, সুরঞ্জন, আবার নেমে গেল স্ত্রীর শরীরে, যেভাবে কুমীর জলে নামে।

প্রেম! কি গভীর তার প্রেম! কি গোপন তার পুজা! যেন নিজের যৌনাঙ্গটাকে বেলচার মতো করে চালাচ্ছে সুরঞ্জন। প্রাণপণ। যেন নিজের সমগ্রটাকেই সে একটা বেলচার মতো করে চালাচ্ছে। সে একা নয়। তার সঙ্গে আরও অনেক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, বন্ধাত্ব বিশেষজ্ঞ। ফারটিলিটি ক্লিনিকের বড়ো বড়ো সাইন বোর্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। মাটি খুঁজে বার করতে হবে। ফসল ঘরে এসো। এসো ঈশ্বর।

ক্লান্তি

ক্লান্তি

ক্লান্তি!

শরীরজুড়ে নেমে আসে ঘুম। বালির শরীর। বালির বিছানা। যখন দু-হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা নিস্তব্ধ দেহ, বাইরে ভোর হচ্ছে।

লাফাবাড়িতে যাদের ভিটায় বালি দেওয়ার কথা ছিল তাদের দিয়েও এক গাড়ি বেঁচেছে বলে আবুল ওটা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের কাঁচা আলোয় দেখা গেল ওই যে গাড়িটা বুড়িতোর্ষার সেতু পেরিয়ে গেল।

জমির বুকে হাত রেখেছে লালচান। রং দেখছে। বুকের ওপর জন্মানো আগাছা দেখে ও মাটির মন বোঝে। তবে এখন তো সব খাঁ-খাঁ। যেন ওর সামনে নতজানু হয়ে বসেছে সেই অষ্টাদশী কিশোরী। জড়সড়। আগে আড় ভাঙতে হবে। মুখোমুখি বসেছে লালচান। দু-হাতে ঘাঁটছে। আবার প্রণামও করছে। ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এসো, এবার ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ…

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

গিনিপিগ

এই লোকটা, সেই লোকটাই— যাকে চিনতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। তবে কি মানুষকেও গবেষণার জন্য গিনিপিগ করা যায়? তাহলে লোকটাকে একটা গিনিপিগই বলি। এই যে ‘বলি’— শব্দটায় একজন বক্তা আছেন। তিনিও লোকটার মতো একজন মানুষ। মানুষই মানুষকে বোঝে। অবিকল হাত পা, মাথা, পেট, বুক, জনন, প্রেম, চুম্বন সবই মানুষের আছে বলে, অন্য মানুষকে বোঝা সহজেই সম্ভব। কিন্তু গিনিপিগ? সে-তো খুদে একটি চঞ্চল প্রাণী! সারা শরীরময় ইট-সাদা, সাদা-কালো গোলাকার দাগ। ওগুলো এক-একটি পৃথিবী। ওইসব পৃথিবীতে বারংবার মহামারি গেছে, এসেছে। ওরা সবকিছুকেই ঝেঁটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে আবারও গবেষণাগারের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নিয়েছে।

এইসবের কোনো বিচার নেই। গিনিপিগকে শুয়োরের বাচ্চা বললে ও কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। চুপচাপ গবেষণাগারের জেলখানার কয়েদি হয়ে মিটিমিটি হাসে। একজন মানুষ গিনিপিগকে বোঝে না বলে, আগের সেই ‘আমি-বক্তা’ এইবার গিনিপিগ হওয়ার চেষ্টা শুরু করল।

বউকে বলল— ও বউ, খেতে দাও। বউ ওমনি তাড়াতাড়ি পাকের ঘর থেকে এক থালা গরম ভাত আর কলমির গন্ধভরা জলের থেকে আবিষ্কৃত শাকের মৃতদেহ নিয়ে স্বামীর ভাতের থালার ওপরটা দেখতে দেখতে উঠোন পেরিয়ে দাওয়াতে উঠে গেল। সাদা ভাতের ওপর সবুজ কলমির শাক ততক্ষণে জলে ভাসা মৃতদেহ হয়ে গেছে। এক হাতে বউটার জলের ঘটি। ওই হাতের বগলে গোঁজা তালপাতার হাতপাখা। পাখার হাওয়ায় ভাত জুড়োবে। জুড়োবে বউয়ের মন।

আহা! স্বামী বলে কথা! জন্মজন্মান্তরের বোঝাপড়া! বউকে কখনো সখনো জড়িয়ে ধরলে লোকটার যৌবন ফিরে আসে।

যৌবন কি সত্যিই ফিরে আসে? এসবও গিনিপিগের মতোই গবেষণার বিষয়। তবে, মহাজনের কাছে হাওলাত বরাত বন্ধ হয়ে গেলে লোকটা বউকে পেটায়। মারতে মারতেই বনবন করে গাছের মগডালে উঠে যায়। আবারও সরসর করে নীচে নেমে আসতে গিয়ে পঞ্চায়েতি বিচারকদের দেখে পাতার আড়ালে চলে যায়। অর্থাৎ, লোকটা তখন একটা গিনিপিগ। ওকে আড়াল করতে সারা শরীরে পেটাইয়ের ব্যথা নিয়ে এবার ওর গিনিপিগ বউ দরজার খুঁটিতে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া আঁচলে মুখ চেপে বলে— তিনি বাড়ি নাই।

গিনিপিগ সন্ধ্যাকালে সরসর করে নীচে নেমে আসে। নিজের যৌবনকে আদর করে ডেকে নিজেকেই বলে— আয়…

রাত বাড়লে আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা চাঁদের কামিনী কাঞ্চন। গিনিপিগ তাঁর বউ গিনিপিগকে জড়িয়ে ধরে ফিরে যায় যৌবনের গবেষণা করতে। কেন, কেন তাদেরকে শিকার করে একদল মানুষ?

আবারও সকাল হয়। গতকালকের রাতের অভিজ্ঞতাকে নোটপ্যাডে মনে মনে লিখে রেখে গিনিপিগ জনমজুরি খাটতে যায়।

বউ চুলাতে রান্না বসায়। কাঁচা-পাকা পাতা পোড়ার গন্ধে বউয়ের হাতের কারসাজিতে জলে ভাসতে ভাসতে আসা রান্না করা ঢোলকলমির শাক করোনাতে মৃত্যু হওয়া লাশ হয়ে যায়।

এই লাশটাও কেউ ছিল। একদিন ওর ঘর ছিল। বউ ছিল। জলে ভাসা কলমির দামের মতো সংসার ছিল। বউ শাকভাত রান্না করে লোকটাকে খেতে দিত। রাত হলে আদর করত! আরও কত কিছু করত বউটা, ওই মৃতদেহর জন্য!

চিন্তায় ছেদ পড়ে। সারাদিন খেটেখুটে স্বামী স্ত্রী খেতে বসেছে। বেলাবেলি খেলে গরিবের একবেলার খাবারেই দু-বেলার স্বাদ মেটে। এসব সরকার জানে না। সরকারের ঘর থেকে আসা ফ্রী রেশনের চালের ওপর গিনিপিগেরা তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। আটা কিম্বা ফ্রি গম দশ টাকা কেজিতে বিক্রি করলে বিনা পুঁজির ব্যাবসাতে লক্ষ ঘরে আসে। বিদ্যুতের ব্যবহার শিখে গেছে ওরা। আর সেখানেও বিপিএল -দের টিকিয়ে রাখার ভোটব্যাংকের শুভকামনায় দুটো বাল্ব আর একটা পাখার মিটার রিডিঙের কাঁটা শূন্যতেই দাঁড়িয়ে থাকে। গিনিপিগদের বরাদ্দকৃত জমানো কেরোসিন তেল শহর থেকে আগত তেল ক্রেতাদের কুড়ি টাকা লিটারে বিক্রি করে দেয়। ওই তেল দিয়ে করোনাকালে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাস মালিকেরা মোবিলের সঙ্গে মিশিয়ে বাস চালায়। পরিবেশে দূষণ বাড়িয়ে তোলে সেই তেল পোড়া কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস। গ্যাসের ধাক্কায় গিনিপিগের শরীরের গোল গোল চাকা চাকা সাদাকালো পৃথিবীতে ধস নামে।

তাতে কিছুই এসে যায় না গিনিপিগদের। বাঁচা মানে বর্তমান। কার কী ভবিষ্যৎ হবে, কে বলতে পারে?

বিনা পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণ করতে করতে এভাবেই চঞ্চল প্রাণীগুলো সামনের দিকে এগোয়।

এতক্ষণে বউ গিনিপিগ এঁটো থালাগুলো জড়ো করে বয়ে নিয়ে যায় সেই জলের কাছে। মাজাঘষা সারতে সারতে রাত বাড়ে। জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে সনাক্তকরণ হয়ে গেছে ততক্ষণে। এটা করোনা বডি। দৌড়ে এসে স্বামীকে জানায় সে। এতে স্বামী গিনিপিগের কোনো হেলদোল নেই। কেন-না, এই সময়টাতে সে নিশ্চিন্তমনে ভাবতে বসে। এঁটো হাত শুকিয়ে কাঠ! চোখে নেশা ধরানো জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে এখন চিতায় তোলা হবে। পাশাপাশি আরও চিতা। চিতাতে শায়িত প্রতিটি বডিই গিনিপিগের। গণচিতার আগুনের ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে গেছে।

এতক্ষণে গিনিপিগ বউ গিনিপিগকে বলল— জোরে নয়। এটা আমাদের দু-জনের মৃতদেহগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে শেষের কথা বলো— “বলো হরি, হরি বোল! রাম নাম সাথ হ্যায়…”

Categories
2021-NOVEMBER-STORY

সুরঞ্জন প্রামাণিক

গল্প নেই শহরের মানুষ

ইদানীং সমীরণ যে-কোনো চরিত্রকে শর্ট-ফিল্মের ছোটো ছোটো ফ্রেমের মধ্যে ধরতে চাইছে বা বলা যায় চিত্রনাট্যের ফ্রেমে আটকে দেখতে চাইছে বা বলা ভালো দেখছে। যেমন এখন, ওই দেখুন তার দু-হাতে ফ্রেমমুদ্রা। আনুভূমিক বুড়ো আঙুলদু-টি পরস্পরের দিকে আস্তে আস্তে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আর সমীরণের দৃষ্টি অনুসরণ করলে আপনি দেখতে পাবেন একজন বয়স্ক মানুষ মাথা নীচু করে ধীরে হাঁটছেন।

মানুষটা ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে সমীরণ আপনাকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, আমরা লোকটাকে দেখলাম কি না, ‘যেন কী এক ভার বইছেন, না?’

আপনি ভাবতেই পারেন সমীরণ বুঝি তার দেখাটা আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথবা আপনার সেরকম মনেও হতে পারে। আপনি সায় দিলেন।
এবার সমীরণ তার বসার ভঙ্গি বদলে আপনার মুখোমুখি, ‘আচ্ছা বলুন তো, এই মনে হওয়া কীভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করা যায়!’ এটা সমীরণের গুণ। সে দর্শক-পাঠকের কাছ থেকে নিয়ে তাঁদেরই ফিরিয়ে দেয়। তার কথায় এ একধরনের ‘মাধুকরী’। সৃষ্টির জন্য। ভোগের জন্য নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সমীরণ যত না শিল্পী তার চে’ অনেক বেশি দার্শনিক। আর এ-কারণে আমি তার ভক্ত। তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তার সহযোগী হতে চাই।

ফ্রেমমুদ্রায় সমীরণ ও পাশে বসা তার বন্ধুকে দেখে এসব আমার মনে ঘটল এবং একটা গাধা ঢুকে বেরিয়ে গেল ওই ফ্রেম থেকে। আমার মনে হল সমীরণকে কিছু বলা দরকার।

তার আগে ফ্রেমবন্দি বয়স্ক মানুষটার গল্প বলে নিতে হবে। মানুষটার গল্প মানে আমাদেরও গল্প। মানুষটার নাম বিধু, বিধুভূষণ। একসময় বিধুদা আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এই চায়ের দোকানে বসেই তিনি আড্ডা দিতেন। বিধুদাকে গল্পবাজ বলা যাবে কিনা জানি না। তিনি অবশ্য গল্পের টানেই এখানে আসতেন। গল্পের ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া ছিল তাঁর নেশা। নেশাটা কোথায় বলুন তো! গল্প আবিষ্কার করা। বুঝলেন না তো! মানে গল্পের মধ্যে নানা গল্প তিনি দেখতে পেতেন। আমরা চমৎকৃত হতাম। বিশেষ করে লেখক। একবার সমীরণই তিন-তিনটে নতুন গল্পের সম্ভাবনা দেখে ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল, কী এক আবেগে বিধুদাকে প্রণাম করে বসে। একবার হল-কী— কারো একটা গল্প পড়ার পর বিধুদার মুখ কেমন বে-বোধার মতো হয়ে গেল সেদিন। ম্যানুস্ক্রিপ্টে আরও একবার চোখ বুলিয়ে যেন নিজের মনেই নীচের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন। তাঁকে হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন, কথাটা এখনও মনে আছে, ‘খবরের কাগজের ঘটনা নিয়ে গল্প— ঘটনার বাইরে নতুন কোনো গল্প পাওয়া গেল না ভাই!’

তার পর অদ্ভুত সব বদলে যেতে থাকল। আমি গল্প লিখতে পারছিলাম না। সমীরণের গল্পেও বিধুদা আর নতুন গল্প পাচ্ছিলেন না। তাঁরও আসা কমে গেল। এর মধ্যে আমাদের অনেকেই কম্পুটারে লিখতে শুরু করেছি। মানে হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টের দিন শেষ। এসব জেনে বুঝেই হয়তো তিনি আর আসেন না। জানি না তিনি ফেসবুক সাহিত্যের কথা জানেন কি না। মাঝে একদিন পথে দেখা। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ভালো নেই!’

‘কেন কী হয়েছে?’

আমার মুখের দিকে, বলা ভালো চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘গল্প লিখছ?’

আমি বললাম, ‘না।’

‘তুমি ভালো আছ?’

আমার কথা না শুনেই তিনি বললেন, ‘কী করে ভালো থাকবে! গল্প না থাকলে কি ভালো থাকা যায়? আচ্ছা ভাই আসি!’

সেদিন তাঁকে বেশ ঋজুই মনে হয়েছিল। এটা মনে হতেই সমীরণকে আর গাধার কথা না বলে বললাম, ‘তুই বরং বিধুদার সঙ্গে কথা বল! ক্যারেক্টারকে তো ভিতর থেকে জানতে হবে। সবচে’ বড়ো কথা, বিধুদাকে তুই প্রজেক্ট করতে চাইছিস কেন, এটা ভালো করে বুঝতে গেলে তো বিধুদাকে স্টাডি করা দরকার।’

সমীরণ কী ভেবে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, বিধুদা এই সমাজে বেঁচে থাকার বৈধতা হারাচ্ছেন!’

‘কেন, এরকম মনে হচ্ছে কেন তোর?’

‘একদিন বিধুদাকে বলতে শুনলাম, একদা ডাকসাইটে নেতাকে বলছেন, তোমরাই তো এই পরিবেশ তৈরি করেছ কমরেড! আর আমাকে কয়েকদিন আগে বললেন, শুনেছ আদালত চত্বরে এক পাগলিকে ধর্ষণ করা হয়েছে? এই ক-দিন আগে এক পাগলকে কী যেন বলে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ কপালে— খুন করা হয়েছে— এর মধ্যে কি কোনো গল্প আছে? দেখো তো লিখতে পারো কিনা! তিনি একটা ক্লু দিলেন— একটা মানুষ এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সে কিন্তু বলতে পারছে না— এই দুষ্কৃত নগর আমার দেশ না!’ এই ব্যাপার দুটো মিলে সমীরণের মনে হচ্ছে বিধুদার বেঁচে থাকার বৈধতা আর থাকছে না।

একটু ভেবে আমি বললাম, ‘মানে তুই আশংকা করছিস!’

‘আশংকার কথা ভাবিনি, তুই কী মনে করে বললি?’

‘কথাদুটো তো বিগত-বর্তমান উভয় সরকারের সমালোচনা হয়ে যাচ্ছে!’

‘ঠিক!’

‘আর সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহ— এক ওয়ান ফাইন মর্নিং আমরা শুনব, মাঝরাতে পুলিশ বিধুদাকে তুলে নিয়ে গেছে…’

সমীরণ অন্যমনস্ক। আমার মনে হল আমি তাঁকে ভাবাতে পেরেছি। সে কোনো নতুন দৃশ্য ভাবছে।
কথামতো বিধুদাকে চায়ের দোকানে ডেকে নিলাম। বললাম, ‘একটা অণুগল্প লিখেছি!’ বিধুদা কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সমীরণ বলল, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে―’

‘বলো!’

‘আপনি কী এত চিন্তা নিয়ে হাঁটেন?’

‘কী দেখে তোমার মনে হল, আমি খুব চিন্তা নিয়ে হাঁটি!’

‘আপনার পথহাঁটা দেখে…’

বিধুদা একটু হাসলেন। তাচ্ছিল্যের না কি ব্যঙ্গের ঠিক বোঝা গেল না।

‘…যেন পৃথিবীর ভার আপনার কাঁধে, হারকিউলিস উপমা হয়ে আসে।’

নিজের মনেই আমি সমীরণকে তারিফ করলাম। গাধা নয়, হারকিউলিস তার মনে হওয়ার যথার্থ চিত্ররূপ।

‘আসলে হয়েছে কি, আমার চোখ ভালো নেই— সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হয় তাই মাথা নীচু করে পথ চলতে হয়—’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘তবে চিন্তা আছে, ছেলের চিন্তা ছেলে-বউয়ের চিন্তা— ঘরে নিত্য অভাব। খবরের কাগজের খারাপ খবর যেন ঘটে যাবে ওদের জীবনে— চিন্তা হয়, তোমাকে তো বলেছি… চিন্তা হয় কোথাও গল্প নেই দেখে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘দাও দেখি গল্পটা!’

গল্পটা পড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই লিখেছ, শহরের বিত্তবানের চিন্তায় আমরা ভাবনা প্র্যাকটিস করছি। ধরে নেওয়া গেল, একটিও ভালো মানুষ নেই আমাদের শহরে। ভালো মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগীর মতো, সে-কারণে ভালো মানুষ সাসপেক্টে পুলিশ একজনকে তুলে নিয়ে গেছে যাতে অন্য মানুষ আক্রান্ত না হয়। ভালো! কিন্তু এসবই তো নেগেটিভ বাস্তবের প্রসারণ— ‘একটিও ভালো মানুষ নেই’ এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে কেউ গল্প ভাবতেই পারে, আমি ভাবতে পারছি না। আচ্ছা, ভালো মানুষের পক্ষে বাস্তব তৈরি হতে পারত নাকি?’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

সমীরণের হাতে ফ্রেমমুদ্রা, সে পায়ের ছবি ধরতে চাইছে। বিধুদা ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শহর হোক-কি গ্রাম— তুমি কি মনে করো গরিব মানুষেরা চিন্তা করতে পারেন না?’

উত্তরের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তিনি চলে যাচ্ছেন। সমীরণের চোখ যেন দৃশ্যশূন্য। আর আমি উত্তর খুঁজছি…

Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

মার্সেল প্রুস্ত

স্মৃতি
[Memory]

ভাষান্তর: সঞ্চয়িতা পাল চক্রবর্তী

খয়েরি উর্দি ও সোনালি বোতামে সজ্জিত একজন চাকর বেশ শীঘ্রই দরজাটি খুলে দিল এবং আমাকে একটি ছোটো বসার ঘরের দিকে এগিয়ে দিল— যে-ঘরে ছিল পাইন কাঠের প্যানেলের কাজ, দেওয়ালে ঝোলানো ছিল ছাপা সুতির কাপড় এবং যে-ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যেত। আমি সেই ঘরে ঢুকতেই এক বেশ সুপুরুষ তরুণ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে শীতলভাবে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আবার নিজের আরামকেদারায় বসে, ধূমপান করতে করতে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন। আমি একটু অস্বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়েই রইলাম, বলা যায় আমি এখানে কী অভ্যর্থনা পেতে চলেছি সেটাই ভাবতে লাগলাম। এতগুলো বছর পরে, এই বাড়িতে এসে আমি কি ঠিক কাজ করলাম, যেখানে তাঁরা হয়তো অনেক আগেই আমাকে ভুলে গেছেন? এই আতিথ্যময় বাড়িটি যেখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের, গভীর, কোমল মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি?

বাড়ির চারপাশের যে-বাগানটি এবং একদিকে তৈরি হওয়া সেই অলিন্দটি, চিত্র-বিচিত্র চিনামাটির পাত্রে সজ্জিত ও খোদাই করা লাল ইটের দুই মুরুজ, লম্বা আয়তাকার জানালাগুলো যেখানে আমাদের বর্ষার দিনগুলি কাটিয়েছিলাম এবং এমনকী এই ছোট্ট বসার ঘরের সাজসজ্জাও— যেখানে আমাকে এখুনি নিয়ে আসা হল— কিছুই পালটায়নি। কতক্ষণ পরে এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক অবিন্যস্তভাবে ঢুকলেন। তিনি বেঁটে এবং কুঁজো। তাঁর অনিবিষ্ট দৃষ্টি তার মধ্যে এক নির্মোহ অভিব্যক্তি এনেছিল, আমি তখনই মসিয়ে দে এন-কে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। আমি অনেকবার আমার নাম বললাম: কিন্তু তাঁর কোনো স্মৃতি উঠে এল না। আমার আরও বেশি অস্বস্তি হতে শুরু করল। আমাদের দৃষ্টি যেন আটকে গেল, আমরা কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বৃথাই তাঁকে কিছু সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম: তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি তাঁর কাছে একজন অচেনা মানুষ।যেই আমি চলে যাচ্ছিলাম, দরজাটি খুলে গেল: “আমার বোন ওডেট”, একটি দশ-বারো বছরের মিষ্টি মেয়ে তার নরম সুরেলা ভাষায় বলে উঠল, “আমার বোনের এক্ষুণি মনে পড়ল যে, আপনি এখানে ছিলেন। আপনি কি এখানে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান? তাতে তিনি খুব খুশি হবেন!” আমি ছোট্ট মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম এবং আমরা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে আমি সত্যি ওডেটকে পেলাম। একটি বড়ো মোটা কম্বল ঢাকা দিয়ে একটি অনাচ্ছাদিত সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর এতই পরিবর্তন হয়েছে যে, আমি তাঁকে চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ত! তাঁর মুখাবয়ব প্রলম্বিত হয়েছে এবং তাঁর অন্ধকার চোখ যেন তাঁর নিস্তেজ মুখকে বিদ্ধ করেছে। একসময় সে বেশ সুন্দরী ছিলেন এখন আর তা নয়। একটু যেন দ্বিধাগ্রস্তভাবেই তিনি আমাকে পাশে বসতে বললেন। আমরা একাই ছিলাম। “আমাকে এই অবস্থায় দেখে তুমি নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছ”, অনেকক্ষণ পরে তিনি বললেন। “আসলে আমার ভয়ংকর অসুস্থতার পর থেকে, এই যেমন তুমি দেখছ, এরকমভাবে কোনো ছটফট না করে শুয়ে থাকতে হয়। আমি অনুভূতি আর দুঃখ নিয়েই বেঁচে আছি। আমি গভীরভাবে ওই নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি, যে-সমুদ্রের এই অসীম শৌর্য আমার কাছে মনোমুগ্ধকর। এই ঢেউগুলো যেন আমার মনে আসা কত মন খারাপের চিন্তা, কত আশা যা আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি পড়ি, আসলে আমি অনেক পড়ি। কবিতার সুর আমার মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব সজীব হয়ে ওঠে। সত্যি তুমি কত ভালো যে, এত বছর পরেও আমাকে ভোলোনি এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ! আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে! আমি আগের থেকে অনেক ভালো অনুভব করছি। আমি এটা বলতেই পারি— পারি না কি?— যখন আমরা এত ভালো বন্ধু ছিলাম, তোমার কি মনে পড়ে এই জায়গাতেই আমরা টেনিস খেলতাম? আমি তখন বেশ সমর্থ ছিলাম; আমি সুখী ছিলাম। আজ আমার সেই সামর্থ্যও নেই; আমি আর সুখীও হতে পারব না। আমি যখন দেখি ভাঁটার টানে সমুদ্র সরে সরে যায়, অনেক দূরে, আমার তখন ভাঁটার স্রোতে আমাদের একা হাঁটার কথা মনে পড়ে। আমি যদি খুব দুষ্ট, খুব স্বার্থপর না হতাম, তবে আমার সেই মুগ্ধ মুহূর্তগুলির স্মৃতি আমাকে সুখী রাখার জন্য যথেষ্ট হত। কিন্তু, তুমি জানো, আমি যেন নিজেকে ছাড়তেই পারি না, এবং কোনো কোনো সময় আমার নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও, আমার ভাগ্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি। এই একাকিত্ব আমাকে উদাস করে তোলে, কারণ, সেই মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি একা। আর বাবা, আমার কথা ভাবার জন্য বাবা বড়োই বৃদ্ধ ও অসুস্থ। আমার ভাই এক নারীর কাছে ভয়ংকরভাবে প্রতারিত হয়ে চরম আঘাত পেয়েছিল। সেই থেকে সে একাই থাকে। কোনো কিছুই তাকে ভোলাতে ও সান্ত্বনা দিতে পারে না। আমার ছোটো বোনটি এতটাই তরুণ, তাছাড়া আমাদের তাকে নিজের মতো সুখে বাঁচতে দিতে হবে।”

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। তাঁর বিশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর সেই বহুকাল পুরোনো মিষ্টি অভিব্যক্তি তিনি আবার ফিরে পেলেন। আবার তিনি সুন্দরী হয়ে উঠলেন। তিনি কী সুন্দরী ছিলেন! আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম: তাঁকে বলতে চাইতাম, আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি… আমরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাড়ছিল, তাই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এবার তাঁকে বিদায় জানাতেই হবে, চোখের জলে আমার গলা রুদ্ধ হয়ে এল। সেই লম্বা অলিন্দ দিয়ে আমি হেঁটে গেলাম। সেই সুন্দর বাগানের নুড়িপথ আর আমি পেরোব না। আমি সমুদ্রতীরে নেমে পড়লাম; সেখানে কেউ ছিল না। শান্ত, নির্মোহ ভাঁটার জলের ধারে বিষণ্ণ আমি বেড়াতে লাগলাম। সূর্য অদৃশ্য হয়েছে; কিন্তু তার বেগুনি আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।