Categories
2021-NOVEMBER-TRANSLATION

চার্লস বুকাওস্কি

বারবিকিউ সস দিয়ে যিশু

ভাষান্তর: শুভঙ্কর দাশ

পেট্রল পাম্পের কাছেই হিচহাইকারটা দাঁড়িয়েছিল যখন ওরা তাকে গাড়িতে তুলে নিল। তাকে বসানো হল পিছনের সিটে ক্যারোলিনের সাথে।

গাড়ি চালাচ্ছিল মাররি। ফ্র্যাঙ্ক তার হাতটা সিটের পেছনে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে হিচহাইকারের দিকে ফিরে তাকাল।

‘তুমি কি হিপি?’

‘আমি জানি না। কেন?’ জিজ্ঞেস করল অল্পবয়সি তরুণটি।

‘আসলে হিপিদের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ। ওদের ব্যাপারে আমরা অভস্থ।’

‘তাহলে আমাদের আপনার অপছন্দ নয়?’

‘আরে না না, আমরা হিপিদের ভালোইবাসি! তা তোমার নাম কী?’

‘ব্রুস।’

‘ব্রুস। বাহ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।‘

ব্রুস মাথা নাড়িয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কতদূর যাচ্ছেন?’

‘পুরোটাই যাব আমরা, তোমাকে নিয়ে পুরোটাই যাব আমরা বাচ্চে।’

মাররি হেসে উঠল হা হা করে।

ব্রুস জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি হঠাৎ হাসছেন কেন?’

‘মাররি ওরকম সবসময় ভুল সময়ে হাসে। কিন্তু ও আমাদের গাড়ির চালক। আর ও খুব ভালো চালক। ও আমাদের নিয়ে যায় উপকূলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত। অ্যারিজোনা, টেক্সাস, লুসিয়ানার বুক চিরে। আর ও কখনোই ক্লান্ত হয় না। আর ও ঠিকই আছে তাই না সোনা?’ সে ক্যারোলিনকে জিজ্ঞাসা করে।

‘একদম তাই আর ব্রুসও বিন্দাস।’ সে ব্রুসের হাঁটুতে হাত রেখে অল্প চাপ দেয়। তারপর ঝুঁকে এসে তার গালে একটা চুমু খায়।

‘কিছু কী খেয়েছ তুমি বাচ্চে?’

‘না, আমার বেশ খিদে পেয়েছে।’

‘ঘাবড়ো না। আমরা শিগ্গির গাড়ি থামিয়ে কিছু খাব।’

ক্যারোলিন সমানে হেসে চলেছে ব্রুসের দিকে তাকিয়ে। ‘ও সত্যি খুব ভালো। খুব ভালো।’ ব্রুস টের পেল ক্যারোলিনের হাতটা আস্তে আস্তে তার পা বেয়ে নেমে আসছে তার লিঙ্গের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্যাপারটায় গা লাগাচ্ছে না আর মাররি গাড়ি চালিয়ে চলেছে। তারপর ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গ ঘঁষতে শুরু করল আর হাসতে লাগল।

‘গত রাতে কোথায় ঘুমিয়েছিলে তুমি বাচ্চা?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল।

‘গাছের নীচে। খুব ঠান্ডা ছিল। আর তাই মন ভালো হয়ে গেল যখন সূর্য উঠল।’

‘তুমি ভাগ্যবান। রাতে কোনো জন্তু তোমাকে গিলে ফেলেনি ভাগ্যিস।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি বলতে চাইছি তোমার ওই অত চুলের ভেতরে তোমাকে একটা সরস বাচ্চার মতো লাগছে।’

‘একদম তাই’ ক্যারোলিন জবাব দেয়। সে সমানে ব্রুসের লিঙ্গ ধরে উপর নিচ করতে থাকে। সেটা শক্ত হতে থাকে ক্রমে।

‘তোমার কত বয়স ব্রুস?’

‘১৯।’

‘তুমি গিন্সবার্গ, কেরুয়াক পড়েছ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু ওঁরা বিট জমানার। আমরা ভালোবাসি রক এবং লোকসংগীত, আমার জনি ক্যাশকেও ভালো লাগে। আর ববি ডিলান, অবশ্যই…’

ক্যারোলিন ব্রুসের জিপার খুলে ফেলে ওটা বার করে ফেলেছে। তারপর সে তার জিভ ছোঁয়ায়, আর জিভটা ওপর নিচ করে লিঙ্গ বরাবর। ফ্র্যাঙ্ক এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই ঘটছে না।

‘তুমি বার্কিলি অবধি এসেছ?’

‘এসেছি তো। বার্কিলি, ডেনভার, সান্টা বারবারা, ফ্রিস্কো…’

‘তুমি কি মনে করো একটা বিপ্লব ঘটবে?’

‘হ্যাঁ, হতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই আর। বুঝতে পারছেন…’

ক্যারোলিন ব্রুসের লিঙ্গটা তার মুখে পুরে নিয়েছে। বাচ্চাটা আর কোনো কথা বলতে পারে না।

মাররি অবশেষে পিছন ফিরে তাকায়, তারপর হা হা করে হেসে ওঠে। ফ্র্যাঙ্ক একটা সিগারেট ধরিয়ে দেখতে থাকে।

‘হে যিশু’, বাচ্চাটা বলে ওঠে, ‘হে ভগবান, যিশু!’

ক্যারোলিন ঝাঁকাচ্ছিল। তারপর সে পুরোটাই মুখের ভেতর পেল। শেষ হল ব্যাপারটা। ব্রুস সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। জিপারটা টেনে বন্ধ করেছে।

‘কীরকম লাগল, বাচ্চা?’

‘সত্যি বলতে, ভালোই লেগেছে।’

‘সবসময় এমন একটা গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা ঘটে না আর তাছাড়া ব্যাপারটা এখনও শেষ হয়নি। এটা স্রেফ একটা শুরু। দাঁড়াও এবার আমরা খাবার জন্য থামব।’

মাররি আবার হেসে উঠল।

‘ওনার ওভাবে হাসাটা আমার ভালো লাগছে না’, বলল ব্রুস।

‘সব কিছু তো আর ঠিকঠাক হয় না। এই তো সুন্দর একটা চোষণ পেলে।’

তারা আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে চলল।

‘খিদে পাচ্ছে মাররি?’

মাররি এই প্রথম কথা বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘বেশ বেশ, একটা ভালো জায়গা পেলেই আমরা গাড়ি থামাব।’

‘আশা করি দ্রুত ওটা পাওয়া যাবে’, বলল মাররি।

‘আমার মনে হয় ক্যারোলিনের খিদে পায়নি। ও তো সবে লাঞ্চ খেলো।’

‘আমি কিছুটা ডেসার্ট খেতে পারি যদিও’, ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘আমরা শেষ কখন খেয়েছি যেন?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করে।

‘গত পরশু’, উত্তর দেয় ক্যারোলিন।

‘সে কী?’ জিজ্ঞাসা করে ব্রুস, ‘গত পরশু?’

‘হ্যাঁ, বাচ্চা, কিন্তু যখন আমরা খাই, সত্যি আমরা খাই— আরে এই তো। এই জায়গাটা তো ভালোই মনে হচ্ছে। প্রচুর গাছগাছালি, একদম ফাঁকা। গাড়িটা রাস্তা থেকে নীচে নামাও মাররি।’

মাররি রাস্তার ধারে গাড়িটা থামায় আর ওরা সবাই বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে, আড়মোড়া ভাঙে।

‘তোমার দাঁড়িটা খুব সুন্দর বাচ্চা। আর ওই একমাথা চুল। নাপিতেরা তোমার থেকে খুব বেশি কিছু নিতে পারেনি, তাই না?’

‘আমার মনে হয় কেউই পারেনি নিতে’।

‘কেয়াবাৎ বাচ্চে। বেশ, মাররি একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলো রোস্ট করার জন্য। একটা শিক তৈরি রাখো। দু-দিন কেটে গেছে এবার তো আমার পেটের অবস্থা করুণ’।

মাররি ট্রাঙ্কটা খোলে। ভেতরে ছিল একটা বেলচা। কাঠ এমনকী কয়লাও। সব কিছুই ছিল যা ওদের দরকার। ও সেগুলো বয়ে নিয়ে চলল গাছগাছালির ভেতর। অন্যান্যরা গাড়িতে গিয়ে উঠল। ফ্র্যাঙ্ক-এর দেওয়া জ্বলন্ত তামাক ঘুরতে লাগল হাতে হাতে আর একটা স্কচের বোতল। মদটা স্মুথ কিন্তু বাচ্চাটার বার দুয়েক জলের বোতলের প্রয়োজন হল।

‘আমার সত্যি ব্রুসকে পছন্দ’, বলল ক্যারোলিন।

‘আমারও ওকে পছন্দ’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘তাতে কী, আমরা কি ওকে ভাগ করে নিতে পারি না?’

‘নিশ্চয়ই’।

ওরা সবাই কথা না বলে মদ খেয়ে চলল। তারপর ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠল, ‘চলো সব এতক্ষণে মাররি নির্ঘাত সব রেডি করে ফেলেছে।’

ওরা বাইরে বেরিয়ে ফ্র্যাঙ্কের পিছু পিছু চলল গাছগাছালির দিকে। ক্যারোলিন আর ব্রুস হাত ধরাধরি করে। ওরা যখন সেখানে পৌঁছোল দেখল মাররির কাজ প্রায় শেষ।

‘ওই জিনিসটা কী?’ বাচ্চাটা জিজ্ঞাসা করল।

‘ওটা একটা ক্রুশ। মাররি নিজে বানিয়েছে। দারুণ হয়েছে তাই না?’

‘মানে আমি বলতে চাইছি ওটা কী জন্য?’

‘মাররি বিশাস করে ধর্মীয় আচারপদ্ধতিতে। ও একটু ওরকম আমরা এটা মজা করে মেনে নি।’

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলে, ‘আমার খিদে পায়নি। আমার মনে হয় আমি রাস্তা ধরে কিছুটা এগোই হাঁটতে হাঁটতে’।

‘কিন্তু আমাদের খিদে পেয়েছে বাচ্চা’।

‘বেশ, কিন্তু আমার…’

ফ্র্যাঙ্ক বাচ্চাটার পেটে ঘুসি মারল একটা আর সে ঝুঁকে গেল সামনের দিকে, মাররি তার কানের পেছনে একটা গদা দিয়ে মারল। ক্যারোলিন পাতা দিয়ে একটা বালিশ বানাল আর বসে রইল আর তখন ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি বাচ্চাটাকে হেঁচড়ে নিয়ে চলল ক্রুশের দিকে। ফ্র্যাঙ্ক ব্রুসকে ক্রুশে ঠেসে ধরে রাখল আর মাররি বাচ্চাটার বাঁ-হাতের পাতায় একটা বড়ো পেরেক গেঁথে দিল। তারপর তারা তার ডান হাতের পাতায় গাঁথল।

‘তুমি কি পায়ের পাতায়ও পেরেক লাগাবে?’ জিজ্ঞাসা করল ফ্র্যাঙ্ক।

‘না, আমি ওতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বড্ড বেশি কাজ।’

ওরা বসে পড়ল ক্যারোলিনের পাশে আর মদের বোতল দেওয়া নেওয়া শুরু হল।

‘এখানে ওদের সূর্যাস্তটা বড়ো সুন্দর, তাই না?’ জিজ্ঞাসা করল ক্যারোলিন।

‘হ্যাঁ। ওদিকে তাকাও। গোলাপী আর আস্তে আস্তে যা লাল হচ্ছে। তোমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে মাররি’।

‘হ্যাঁ তো। আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে। তোমার কী মনে হয়?’

‘আমি স্রেফ জিজ্ঞাসা করছিলাম। রাগ কোরো না আবার’।

‘তোমরা সারাক্ষণ আমাকে একটা বোকাগাধা বলে মনে করো। সত্যিই আমার সূর্যাস্ত ভালো লাগে’।

‘বেশ। তর্ক করব না আমরা। বা হয়তো আমাদের তর্ক করার দরকার আছে। কারণ, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।’

‘তাই?’ বলল মাররি।

‘হ্যাঁ। আমি বারবিকিউ সস খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি ওই স্বাদে ক্লান্ত একেবারে। আর তাছাড়া কোথাও একটা পড়েছিলাম ওটা বেশি খেলে ক্যান্সার হতে পারে।’

‘কিন্তু কথা হল, আমার বারবিকিউ সস ভালো লাগে। আর আমি সারাক্ষণ গাড়ি চালাই, সমস্ত কাজ আমি করি, তাই আমাদের বারবিকিউ সস খাওয়া উচিত’।

‘তোমার কী মনে হয় ক্যারোলিন?’

‘আমার কিছু আসে যায় না, সস দিয়ে বা সস ছাড়া। এখন খাবার খেতে পেলেই হল’।

বাচ্চাটা ক্রুশে নড়াচড়া করা শুরু করেছে। সে পা ছড়ায় দাঁড়াবে বলে, সে উপর দিকে তাকায়। তারপর নিজের হাতটা দেখতে পায়।

‘হে ভগবান। এ আমার কী করেছেন?’

তারপর ব্রুস চিৎকার করে উঠল। সেটা ছিল একটা লম্বা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের কাকুতি। তারপর সে চুপ করে গেল।

‘মাথা ঠানৃডা রাখো বাচ্চা’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘হ্যাঁ ঠিক’, বলল মাররি।

‘মনে হয় না এখন ও আরেকটা চোষণ চাইবে, তাই না ক্যারোলিন?’

ক্যারোলিন হেসে উঠল।

‘শুনুন’, বাচ্চাটা বলল, ‘আমাকে দয়া করে ক্রুশ থেকে খুলে নামিয়ে দিন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই যন্ত্রণা— খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি দুঃখিত যে, আমি চিৎকার করেছি। দয়া করে আমাকে নামান। দয়া করুন, দয়া করুন, হে পরমেশ্বর, আমাকে নামান!’

‘বেশ, মাররি ওকে নামাও।’

‘হে ঈশ্বর, ধন্যবাদ!’

মাররি ক্রুশের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর বাচ্চাটার মাথা ঠেলে দিলো পেছন দিকে তারপর তার ঘাড়ের শিরা একটা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে কেটে দিল। তারপর সে একটা পেরেক-তোলা হাতুড়ি দিয়ে বাঁ-হাতের পাতার পেরেকটা ধরে টানতে লাগল। সে খিস্তি দিল বিড়বিড় করে।

‘এই অংশটা সবসময় খুব কঠিন।’

তারপর মাররি বাচ্চাটাকে নামিয়ে তার জামাকাপড় খুলছিল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে দিল একপাশে। তারপর ছুরি দিয়ে কাটতে লাগল বাচ্চাটাকে। পাঁজরের নিচ থেকে টেনে পেট বরাবর কেটে ফেলল।

‘চলে এসো’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘এই অংশটা আমি দেখতে পছন্দ করি না।’

ক্যারোলিন আর ফ্র্যাঙ্ক উঠে চলে গেল জঙ্গলের ভেতর। যখন ওরা ফিরে এল তখন মাররি বাচ্চাটাকে শিকে গেঁথে রোস্ট করছে।

‘শোনো মাররি।’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘বারবিকিউ সস-এর কী হল?’

‘আমি ওটা দিতে যাচ্ছিলাম। ওটা দিতে হয় মাংস রাঁধার সময় যাতে করে সঠিক স্বাদটা পাওয়া যায়, তুমি তো সেটা জানো।’

‘একটা কথা বলি। এই ব্যাপারটা নিয়ে টস করা যাক। তুমি রাজি আছ মাররি?’

‘বেশ। ক্যারোলিন তুমি এদিকে এসো। তুমি মাংসটা উলটেপালটে রোস্ট কর, আমরা ততক্ষণ টস করে নি।’

‘ঠিক আছে।’

‘একবারই কল করবে’, বলল ফ্র্যাঙ্ক। ‘কল করবে যখন কয়েনটা বাতাসে ঘুরছে।’

ফ্র্যাঙ্ক কয়েনটাকে অনেক উঁচুতে টোকা মেরে পাঠাল।

‘হেডস!’ চেঁচিয়ে উঠল মাররি।

কয়েনটা এসে পড়ল। ওরা এগিয়ে গেল দেখতে।

হেডস ছিল।

‘ধোর বাঁড়া’, বলল ফ্র্যাঙ্ক।

‘তুমি যদি খেতে না চাও তাহলে খাবার দরকার নেই তোমার’, বলল মাররি।

‘আমি খাব,’ উত্তর দিল ফ্র্যাঙ্ক।

পরের দিন সকালে তারা চলেছে গাড়ি চালিয়ে। গাড়ির সামনে বসে আছে ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি, আর পেছনের সিটে ক্যারোলিন। সূর্য উঠে গেছে অনেকটা। ক্যারোলিন পেছনের সিটে বসে আছে একটা হাত নিয়ে। হাতের আঙুলের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

‘এই মেয়েছেলে খেতে পারে বটে, আমি এমন দেখিনি’, বলে ওঠে মাররি।

‘হ্যাঁ, আর প্রথম চাখাটা তো ওই চেখেছে। ছেলেটা গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে’।

ফ্র্যাঙ্ক আর মাররি দু-জনেই হা হা করে হেসে ওঠে।

‘এইসব বাজে কথা কিন্তু, এক্কেবারে বাজে কথা!’

ক্যারোলিন গাড়ির কাচ নামিয়ে হাতটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলে।

‘আমার পেটটা বড্ড ভরে গেছে’, মাররি বলে, ‘আমি আর একটাও হিপি দেখতে চাই না।’

‘তুমি একই কথা বলেছিলে ২ বা ৩ দিন আগে’ ফ্র্যাঙ্ক বলে ওঠে।

‘আমি জানি, আমি জানি…’

‘ওই দেখো! আস্তে চালাও! আমার মনে হয় আমি আর একজনকে দেখছি! হ্যাঁ, দেখো, দাঁড়ি, চটি, সাজগোজ’।

‘এটাকে বাদ দাও ফ্র্যাঙ্ক’।

হিপি তাদের দিকে বুড়ো আঙুল নাড়িয়ে লিফট চায়।

‘গাড়িটা থামাও মাররি। দেখা যাক না ও কতদূর যেতে চায়।’

ওরা গাড়ি থামায়।

‘কতদূর যাবে বাচ্চে?’

‘নিউ অরলিয়ন্স।’

‘নিউ অরলিয়ন্স? ওতে আমাদের কম করে যেতে ৩ বা ৪ দিন লেগে যাবে। বেশ উঠে পড়ো, বাচ্চা। যাও পিছনে গিয়ে বোসো আমাদের সুন্দরী ভদ্রমহিলার সাথে।’

হিপি গাড়িতে উঠে পড়ে আর মাররি গাড়ি চালাতে শুরু করে।

‘তোমার নাম কী, বাচ্চা?’

‘ডেভ।’

‘ডেভ। বাহ্‌ সুন্দর নাম। আমি ফ্র্যাঙ্ক। যে গাড়ি চালাচ্ছে ও হল মাররি। আর তোমার পাশের ওই সুন্দরী মাগিটার নাম ক্যারোলিন।’

‘আপনাদের সবার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে’, বলল ডেভ আর তারপর ক্যারোলিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

‘তোমার সাথে দেখা হয়ে আমরাও খুশি হয়েছি’, হাসল ক্যারোলিন।

মাররি ঢেকুর তুলল আর তখনই ক্যারোলিন তার হাতটা রাখল ডেভের হাঁটুর উপর।

[এই লেখাটা নিয়ে বলতে গিয়ে বুকাওস্কি বলেছিলেন, এই গল্পটার মূল ভিত্তি আমেরিকার টেক্সাসে ঘটা একটা ঘটনার নিউজ রিপোর্ট। পরে পুলিশ যখন ওদের ধরে তখনও মেয়েটার হাতে ছিল একটা মাংসের টুকরো। সে-মাংস কীসের তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না।]

Categories
2021-NOVEMBER-DHARABAHIK

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

নার্সিং হোমে কৃষ্ণ ঢুকতেই তার হাতে সদ্যজাতকে তুলে দিয়ে, যেমন দস্তুর নার্স বলেছিল— দাদা, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। কৃষ্ণ লজ্জা মাখানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে তার প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছিল। দেখতে দেখতে সে-হাসি যেন গর্বিত পিতার হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, কেন-না সদ্যজাত প্রাণটি সে-আশ্রয়ে বন্ধ চোখেই ঠোঁটে হাসি এঁকেছিল, অন্তত অবাক রূপার চোখে তেমনতরই প্রতিভাত হয়েছিল তা। নার্সের হাতে সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক খাবলা একশো টাকার নোট বার করে পাশে টতস্থ আয়ার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। নার্সটি আবারও ফুটে উঠেছিল— দাদার দিল্‌ই আলাদা! কম কথার মানুষ কৃষ্ণ হাতের ইশারা করেছিল, সে-ইঙ্গিতে নার্স ও আয়া তত্ক্ষণাৎ কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলে কৃষ্ণ রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল— কী, আমারই জিত হল তো! পরক্ষণেই শিশুটির বদ্ধমুঠিতে হাত রেখে স্বগতোক্তি করেছিল— আমার উদিতা, আমার দি-তা!

হ্যাঁ, লোকটা পাগলের মতো মেয়ে চেয়েছিল প্রতিটা আদরের মুহূর্তে। ভাবে রূপা। আর, আর যেদিন ছোট্ট উদিতা দা-দা, ডা-ডা বলতে বলতে বা-বা বলে প্রথম যেদিন বুলি এঁকেছিল তার পাতলা নরম ঠোঁটে, লোকটা পাগল হয়ে উঠেছিল যেন। মেয়েকে নিয়ে এমন লোফালুফি করতে শুরু করে যে, রূপা ভয় পেয়ে ধমকেই উঠেছিল— থামো, পড়ে গেলে…! দেখছ না কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে!

— হাঃ হাঃ! আমার মেয়ে কিনা ভয় পাবে! কৃষ্ণের মেয়ে ভয় পাবে!

প্রথম থেকেই অল্প আওয়াজে বা জোরে দোলালেও ছোট্ট প্রাণটি ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। তখন তো কিছু বুঝতে পারেনি রূপা বা কৃষ্ণ কেউই…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা, সে-টানেই যেন চেতনে ফেরে রূপা। খেয়াল করে কখন যেন সন্ধ্যের আঁধার গুঁড়ি মেরে ক্রমে গ্রাস করার তালে আছে তার দোকান ঘরটিকে। সে উঠে আলো জ্বালে সুইচ টিপে। কালিপরা টিউব লাইটটা বার কয়েক দপ দপ করে জ্বলে উঠলে, ম্লান আলো তবুও ঝলকে ওঠে কৃষ্ণের ফোটোর কাচে। সে-ঝলকানি তাকে ডাকলে, রূপা উঠে গিয়ে ফোটোটা আঁচল দিয়ে আলতো মুছে দেয়, মায়ামাখা হাতে। সে-মায়ায় কৃষ্ণের হাসি ফুটে উঠলে সে তার মুখের ছায়া ভেসে উঠতে দেখে যেন! নাঃ, সামনের অনেকগুলো চুলেই পাক ধরেছে যেন। পরক্ষণেই তার নিজের ছায়াকে মুছে সেখানে ফুটে ওঠে অন্য নবীনার মুখ— সুদীপ্তা, ছোটো মেয়ে তার।

— একটু কলপ তো করতে পার, নাকি? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? একটু থামে, তারপর আবার বলে ওঠে সুদীপ্তা, যা ইদানীংকার বাঁধা লব্জ তার— আমি তো আছি।

সবসময় শাসনে রাখে ছোটো মেয়েটি তাকে। পুরো বাপের স্বভাব পেয়েছে সে, অল্প কথা, কাটা কাটা, ওজনদার—তেমনই লম্বা দোহারা চেহারা। ছোটোমেয়েই তার ভরসা, আবার ভয়ও।

রূপা ফিরে নিজের জায়গায় আসতেই সামনের রাস্তা চোখ টেনে নেয় তার, যে-চোখে ভেসে ওঠে গোরার মুখ, আড়চোখে তার দোকানের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে হনহানিয়ে হেঁটে যায় সে। রূপার মুখে চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

— কাপুরুষ! কোন লজ্জায়ই-বা সে তার চোখে চোখ রাখে ?

ভাবে রূপা। আর অমনি দড়াম করে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণের চেলা গোরার সে দিনের আধখানা বাক্য—বৌদি, দা-দা… । যা সে দিনের আঁধারকে চিরে আরো ঘনবদ্ধ করে তুলেছিল, যা আজকের ঘনায়মান অন্ধকারকে টলিয়ে ভাসিয়ে তুলেছিল আলো ঝলমল সে-আওয়াজ— দশ কা বিশ… দশ কা বিশ…!

কৃষ্ণর পর, বাবলু, তারপর গোরা… নাঃ, রূপশ্রী হলের দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পারেনি সে। নির্লজ্জ, কাপুরুষ! যদিও কালের নিয়ম, ভিডিয়োর যুগ, হল্‌ চলছে না তেমন আর তবুও!

রূপা বাইরে এসে পাশের হল চত্বরের কালো অন্ধকারে চোখ চাড়ে, একবুক দীর্ঘশ্বাসকে চেপে ধরে।

— বৌদি, তিনটে চা।

সে-ডাকে রূপা দোকানে ফেরে, বর্তমানেও।

হ্যাঁ, কৃষ্ণের পর বাবলু, সে-ই কিছুদিন কৃষ্ণের তাজ ধরে রেখেছিল, দাপটে— তবে ওই কিছুদিনই। বাবলুর পর গোরা… গলির ছিঁচকে গুণ্ডা শুধুই, পাড়ার লোকের ওপর যত জুলুম! প্রদীপ রায়ের পা চাটা ভেড়ুয়া… ভোটের জন্য অমন কত কুত্তা, ভেড়ুয়া প্রদীপ রায় পোষে! কৃষ্ণের নাম ডুবিয়ে ছেড়েছে একেবারে! রোজ কৃষ্ণের গলিতে সন্ধ্যে লাগলেই মদ গেলা কতকগুলো চামচা জুটিয়ে আর মেয়ে দেখলেই টিটকারি দেওয়া। বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার! অথচ সাবানকলে ওর চাকরি কৃষ্ণই করে দেয়! লোকে ঠিকই বলে— চুহা এক নম্বরের! কোর্টে গিয়ে বেমালুম বলে কিনা, ও কিছুই দেখেনি! বেশ করেছে আখতারের ছেলেরা কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে ওর! সে-দাগ আজও মোছেনি। তবুও দাগীবাজ হয়েও ছুটকো গুণ্ডামি গেল না! সবই ওই কালো লোকটার আশকারায়। ভোটে জেতে না, তবুও তাবড় নেতা নাকি প্রদীপ রায়, এলাকা ছাড়িয়ে গোটা কলকাতার জেলা কমিটির নেতা নাকি লোকটা! রাগে গনগনে হয়ে ওঠে রূপার মুখটা, গ্যাসের আগুনেরও উসকানি হয়তো কিছুটা, তবুও।

ভিডিয়োর যুগ এলেও তখনও সিনেমা হলের রমরমা ফিকে হয়নি। তবে রূপশ্রীতে আর বাংলা ছবি লাগে না। পরি হলে তো কবেই বাংলা বই দেখানো বন্ধ। পি-সন, কমল, খাতুনমহলে তো, যেহেতু খাস উর্দু এলাকার তাই বরাবরই হিন্দি ছবি। রূপশ্রীই একমাত্র বাঙালি হিন্দু পাড়ার হল। হিন্দি সিনেমার টানেই হোক, আর কৃষ্ণের পর তেমন দাপুটে নেতা না থাকার কারণেই হোক, বা পার্টির প্রশ্রয়েই হোক উর্দুভাষী মুসলমানদের ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমে, এ-তল্লাটে আখতারের ক্রমশ দখলদারি জারির শুরুয়াতই যেন তা। যা বাঙালি দর্শকদের হল থেকে দূরেই রাখে তখন। তেমনই এক সাঁঝকালে হলের তত্কালীন বকলমা মালিক গোরা কিছু উর্দুভাষীকে সবক শেখাতেই, যেহেতু তারা হলের গায়ে খৈনির পিক ফেলেছিল, যেন-বা বহুকাল আগের রিপিট শো— তবে এবার উলটপুরাণ, সবক শেখানেঅলা নিজেই সবক শিখে যায়! গোরা হাত তোলা মাত্র ত্বরিতে ওদের একজন লুঙ্গির গেঁজে লুকানো পিস্তলের বাঁট দিয়ে গোরার কপালে দাগা বুলিয়ে দেয়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে—শুন বে! অবসে ই ইলাকা হামরিস। আখতার ভাই কা। ইয়ে ভাই কা সির্ফ ওয়ার্মিং সমঝিস। কাল সে ইধার তুঝকো দেখিস তো… । এই চেতাবনি দিয়ে গোরাকে এক ধাক্কা। যা ছিটকে ফেলে দেয় গোরাকে তার তাজ সমেত। কে যেন এক কলি গেয়ে ওঠে দেওয়ালে গুটখার পিক ফেলে—চুম্মা, চুম্মা ! দে দে মুঝে চুম্মা! গোরা ডানে, বাঁয়ে তাকায়, নিজের সঙ্গী কাউকে দেখতে পায় না। শুধু তার চারপাশে দুদ্দাড়িয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের ছুটে যাওয়া দেখে। দিবালোকে না হলেও, গোরার এ পতন প্রকাশ্যই, নিশালোকের মায়াবী আলোয় যা আরো পল্লবিত হয়। ফলে লজ্জায় বেশ কিছুদিন এ মুখো হয় না সে আর। শান গেলে যে কোনো ক্ষমতাবানই পঙ্গু। বস্তুত বাবুলের পরে কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা যখন ছত্রকার!

রূপার মুখে আনমনে একটা মশা ঢুকেছে যেন। বাইরে এসে নীরবে থুথু ফেলে ড্রেনে– ওয়াক থু! সাঁঝ পেরোলে তার দোকান একটু জমজমাট থাকে সকালের মতোই, বুড়োদের কল্যাণে। ঘরে বসে কাঁহাতক সময় কাটে? তাই সকাল, সাঁঝে রূপার দোকানে তাদের আড্ডা। রূপার বেশ ভালোই লাগে। বাইরে মুসলিম ছেলেদের দঙ্গল—যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছেই।

— হবে নাই বা কেন? ওদের মহল্লায় সবই তো বোরখা ঢাকা! এক বুড়ো ক্ষ্যা-ক্ষ্যা করে হেসে কথাগুলো ছিটকে দেয়।

— হ্যাঁ, তবে থাকত যদি কৃষ্ণ আজ! আমাদের পাড়ার মেয়ে-বউদের তো…

তবে তার কথা মাঝখানেই আটকে যায়, যেহেতু বাইরে বাইকের আওয়াজ থামিয়ে বেজে ওঠে ভারিক্কি গলা—ভাবিজি, দো চায়ে।

আচ্ছা আখতারকে কী করে তোল্লাই দিচ্ছে প্রদীপ রায়, আব্বাসের জামাই জেনেও, যতই লাল পার্টির হোক না কেন আখতার? আর আব্বাসেরই বা কী চাল? মাটির দুর্গের উর্দু মহল্লায় তো আব্বাসের ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। রাজনীতির চাল বোঝে না রূপা। কৃষ্ণও কি বুঝতো?

দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাস দুটো এগিয়ে ধরে রূপা দুই খদ্দেরের দিকে।

৯ 

–নেতা! ঝাঁটের নেতা!

দুপুরবেলা ঘরে এসে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে কৃষ্ণ। গায়ের ভিজে জামাটা খাটের ওপর ছুঁড়ে দেয় সে। এ সময়ে রূপা চুপ করে থাকে। ওকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। তবে আজ বড় রকমের কোনও গণ্ডগোল সেটা বুঝতে পারে রূপা, কেননা ঘরে কৃষ্ণ কখনো মুখ খারাপ করে না। আর আজ মানুষটা ঘরে আসতে স্বস্তিও পেয়েছে ও। নইলে সাত সকালেই ঘটনাটার খবর পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ এক রকম ছুটেই প্রায়। বাবলুই খবরটা নিয়ে এসেছিল। ফাতেপুর ভিলেজ রোডে দাঙ্গা লেগেছে নাকি! তারপর থেকে লোকের মুখে , টিভির খবর শুনে রূপার মনটা আনচান করছিল। ঘর-বার করছিল সে। পথঘাট নিমেষে শুনশান হয়ে পড়েছিল। দোকানে ঝটাপট শাটার নেমেছিল। হিন্দু পাড়ার ভিলেজ রোড যেখানে বাত্তিকল-ধানখেতির মুসলমান বস্তির ভুলভুলাইয়ায় গোত খেয়েছে, সেখানে নাকি ডি॰সি॰ পোর্টকে খুন করা হয়েছে। মনটা তাই অস্থিরই ছিল সকাল থেকে রূপার। এখন ঘরের মানুষ ঘরে ফেরায় আপাত স্বস্তি পায় সে। ঠান্ডা সরবতের গেলাস নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরে রূপা।

মেজাজ একটু ঠান্ডা হলে স্নান করে ভাত খেতে খেতে বৃত্তান্তে ফেরে কৃষ্ণ।

— জানো, খবর পেয়েই তো ছুটলাম প্রথমে পার্টি অফিসে। দলবল নিয়ে যেতে চাইলাম স্পটে। প্রদীপদা বলে কিনা যেতে হবে না, ওটা সেটিং কেস। শরিকি অন্য দলের মামলা! দাঙ্গার নাম করে সামান্য ডাবপাড়া নিয়ে ফালতু ঝগড়া বাঁধিয়ে একটা হিন্দুর ঝুপড়িতে আগুন ধারায় আনিস। ডকের ছিঁচকে চোর কাঁহিকা! সব সাজানো নাটক! খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে আসে—হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে কথা! ডি॰সি॰ পোর্টও ছুটে আসে। পুলিশও সে যোগসাজসে ছিল। বাত্তিকলের গলির ভুলভুলাইয়ায় ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশ ফোর্স পেছনে সরে আসে, ততক্ষণে ডি॰সি॰ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে একা, কেবলমাত্র বডিগার্ড সঙ্গী।

থামে কৃষ্ণ। এক গ্রাস ভাত ঢোকায় মুখে, কিছুটা চিবিয়ে, ঢোক গিলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,— ঢ্যামনা করিমের চাল সব। ডি॰সি॰টা সৎ ছিল কিনা! ডকের সব চুরি বন্ধ করে দিয়েছিল কড়া হাতে। তাই প্লান করে ডি॰সি॰কে ফাঁদে ফেলে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে আনিসের দল, সঙ্গে নিরীহ বডিগার্ডকেও। শালা, করিম আবার মন্ত্রী! ওই তো একটা দু-গাছা লোকের দল! আমরা না জেতালে ভোটে জিতবার মুরোদও নেই! ডকের ডাকাত তো ও! সুভাষ বোসের নাম ডুবিয়ে ছাড়ল! ছিঃ! মাঝখান থেকে কয়েকটা নিরীহ হিন্দুর ঘর পুড়ল।

কৃষ্ণ জল খায়। ভাত মাখতে মাখতে বলে আবার,— তেমনি আমাদের প্রদীপদা! বললাম, আমাদের এলাকা। হিন্দুরা পড়ে পড়ে মার খাবে আর আমরা দেখব? তো, লোকটা বলে কিনা, ‘রাজনীতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাজনীতি অন্য জিনিস, সবাই পারে না’।

ভাত নাড়াচাড়া করে কৃষ্ণ। রূপা বোঝে, লোকটা মনে মনে আঘাত পেয়েছে খুব। নইলে কম কথার মানুষটাকে এত কথায় পায়!

— আমাদের ঘাড়ে চেপে উনি নেতাগিরি করবেন, আর আমরাই রাজনীতি জানি না!… মানুষের বিপদে যদি মানুষের পাশে না-ই দাঁড়াতে পারলাম, তবে কীসের…। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণ। ফলে সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি বাতাসটা আরও একটু লু টেনে আনে যেন বাইরে থেকে।

রূপা মৃদুস্বরে শুধু এটুকুই বলতে পারে,— ও কী? অর্ধেক ভাত যে পড়ে রইল!

— নাঃ, খিদে নেই আজ আর। বাথরুমে গিয়ে হাত ধোয়। ফিরে এসে খাটে হেলান দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়।

— ওরা দু-জন ঘুমোচ্ছে নাকি? দিদি খেয়েছে?

— হ্যাঁ, দিদি ওদেরকে ওপরে নিয়ে শুয়েছে।

— তুমি খাবে কখন? বেলা তো হয়েছে।

— এবার খাব। একটু থামে রূপা, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। তারপর রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে,

— পুলিশের অত বড়ো অফিসারকে খুন করেছে… পুলিশ ছাড়বে না নিশ্চয়!

সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে কথা ক-টা উড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ,— ধু-স-স! বললাম না মন্ত্রী লেভেলে সেটিং আছে। তাছাড়া এই ডি॰সি॰-র জন্য পুলিশেরও হিস্যায় টান পড়েছে কিনা!

সত্যিই তাই হয়, অর্থাৎ, কিছুই হয় না। যদিও সেদিন সন্ধ্যে থেকেই কার্ফু জারি হয়, লালবাজার পুরো উঠে আসে ভিলেজ রোড আর ধানখেতির বস্তিতে। আনিসকে ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করা হয়, মানে করানো হয় এবং আগে থেকে ছকা ছক অনুযায়ীই, নইলে ধানখেতি-বাত্তিকলের ভুলভুলাইয়া থেকে কাউকে বের করে আনা পুলিশের কম্ম নয়! যেমন ক-বছর পরে পারেনি শেরুকেও। বোকা আনিস রাজনীতির বোড়ে হয়ে গড়াগড়ি যায়, সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ হিন্দু ছেলেও। না হলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে চক্রান্তটা সাজাবে কেমন করে মন্ত্রী-পুলিশের ঘোঁট!

আহা! কী অল্পবয়সি ডি॰সি॰র বউটা! আর বাচ্চাটাও কী ফুটফুটে! খবরের কাগজে ছবি দেখেছিল সে। দুপুরের খদ্দেরহীন দোকানে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা। অভ্যাসবশে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। এইবার দোকান বন্ধ করবে সে। আর বেচারা আনিস! সে বোধহয় মুখ খুলেছিল নেতার গদ্দারি ধরতে পেরে। পুলিশ তার পেটে এমন লাথি কষায় যে পায়খানার দ্বার দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নাকি বেরিয়ে গিয়েছিল! সে-মামলা আজও চলছে এত বছর পরও— সাক্ষী পাওয়া যায়নি নাকি কোনও! একটা করুণ হাসি আবছা ফুটে ওঠে রূপার ঠোঁটে। সেদিন রাত্রে মানুষটার গলায় আফসোস ঝরে পড়েছিল— আমাদের কাঁধে ভর দিয়েই নেতাগিরি… অথচ আমরাই রাজনীতির বোড়ে শুধু। মন্ত্রী-রাজারা দরকারে আমাদের খেয়ে নেয় আমাদের অজান্তেই! বেচারা আনিস… বোকা, বোকাচো-!

আচ্ছা কৃষ্ণের সঙ্গে প্রদীপ রায়ের কি কোনো দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল? নইলে…! সামান্য ঘরোয়া নারী জানেনি সে কিছুই! কেন-না কম কথা বলা লোকটা কখনো এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি। ঘর আর বার তার কাছে আলাদাই ছিল। কোনো হতাশায়, নিরুপায়তায় যেটুকু ধরা দিত স্বেচ্ছায় তার কাছে সেটুকুই কেবল!

একটু জোরেই যেন দোকানের দরজা বন্ধ করে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-INTERVIEW

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

“রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে।”

আলাপচারিতায় পার্থজিৎ চন্দ

দ্বিতীয় পর্ব

পার্থজিৎ: আপনি সংগীতের অন্দরমহলের মানুষ। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ খুলে একটা গান (‘সন্ধ্যা হল মা গো’) পড়তে পড়তে দেখলাম রবীন্দ্রনাথ ‘স্নেহ’-র আগে ‘অতল কালো’ ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ যে-কোনো ভাষার যে-কোনো সময়ের মহান কবিদের মধ্যে থাকবেন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনানন্দের পর রবীন্দ্রনাথের কাব্য-কবিতার বিষয়ে এক বড়ো অংশের শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে উদাসীনতা তৈরি হল… জীবনানন্দীয় আধুনিকতাকেই তারা একমাত্র আধুনিকতা বলে মনে করতে শুরু করল।
বিশ্বদেব: এ নিয়ে কী বলব আমি জানি না, তবে আধুনিক হওয়ার জন্য খুব বেশি চেষ্টা করার দরকার আছে কি? যে-কোনো বড়ো কবিই তাঁর সময়ে নতুন এবং সে-জন্যই আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে আধুনিক ছিলেন, চণ্ডীদাসও তাই-ই ছিলেন।

পার্থজিৎ: আমি আরও স্পেসিফিক করে একটু আপনার থেকে জানতে চাই দু-একটি বিষয়… যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির সমস্যা নেই, ছবি কতটা বাঙালি বোঝে জানি না, কিন্তু ছবি নিয়েও সমস্যা নেই… ছোটোগল্প থেকে শুরু করে প্রবন্ধ উপন্যাস ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা নেই; কিন্তু জীবনানন্দ-পরবর্তী সময়ে একদল গবেষক-পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয়ে একধরনের উদাসীনতা তৈরি করতে সমর্থ হলেন।
বিশ্বদেব: আমি তোমার প্রশ্নটি বুঝতে পারছি… তবে তুমি যে বলছ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঙালির কোনো সমস্যা নেই, আমার কিন্তু কারণ হিসাবে অন্য কথা মনে হয়… আসলে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা বা চর্চা বাঙালির কমে এসেছে। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তাই। আমার ব্যক্তিগত মত, একটা দুটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের পর ওই উচ্চতার প্রবন্ধও আর লেখা হয়নি। যে-বাঙালি গান শোনেন তাঁদের মধ্যে ক-জন মন্তব্য করবার মতো স্তরে আছেন সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। এক সময়ে জীবনমুখী গান নামে একটা প্রবণতা শুরু হয়েছিল (শেষও হয়ে গেছে মনে হয়…), এমনকী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কিছু মানুষ, যাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁরা গান বোঝেন, ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আন্ডারএস্টিমেট করতে শুরু করেন। অনেকের মতো আমিই বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথের মহত্তম সৃষ্টি হচ্ছে তাঁর গান… আরও একটা জায়গা… তাঁর নাটক।

পার্থজিৎ: হ্যাঁ, এগুলো তো আছেই, তবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে সচেতন উদাসীনতা মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়…
বিশ্বদেব: আসলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে-কাহিনিধর্মিতা তাকে এ সময়ের কবিতার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ডিসকোয়ালিফিকেশন বলে ধরা হয়। কিন্তু আমি নিজেও বুঝতে পারি না মানুষ কেন এমন এক ভার্ডিক্ট বা ডিকটামকেই অ্যবসলিউট মনে করে! কাহিনি মানেই আর সব উপাদান ছেড়ে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, অথচ ‘কিনু গোয়ালার গলি’ তো এখনও আমার কাছে অদ্ভুত হৃদয়স্পর্শী কবিতা। কিন্তু ইউরোপ তো টেনিসন বা কোলরিজের কাহিনিধর্মী কবিতা সম্পর্কে এ-কথা বলে না… তারা জানে কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসে ওই বিষয়টা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা আজকে যাকে আধুনিক কবিতা বলছি তার সেই ফর্মকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে হয়েছে। অথচ তুমি একবার ভাবো সেই যে কবিতা… রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আজিকে হয়েছে শান্তি জীবনের ভুলভ্রান্তি…’ (‘মৃত্যুর পর’)… কল্পনা করা যায় এই লেখা! এ যেন হঠাৎ কোথা থেকে মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল, অথচ কী গভীর রহস্যময়… কী গভীর বেদনা। আসলে কি জানো, বীণা যে বাজবে তার আগে তাকে বেঁধে রাখতে হবে তো… রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেজে ওঠা কি সোজা কথা?

পার্থজিৎ: মানে পাঠককেও তৈরি হয়ে উঠতে হবে অবিরত…
বিশ্বদেব: হ্যাঁ, এটাই… এটাই। না বাঁধলে রেসোনেট করবে কী করে? এ-প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ল, আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের কথা… কিরানার বাড়িতে রয়েছেন আব্দুল করিম খাঁ সাহেব। বাংলার একজন সংগীতসাধক গেছেন তাঁর কাছে গানের আরও পাঠ নিতে। তো হল কী বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখলেন মাথায় পাগড়ি পরা একজন লোক গাছের নীচে বসে ‘সা…সা’ সেধে চলেছেন। সামনে একটা তানপুরা রাখা রয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সংগীতসাধক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’ …যে-লোকটি গাছের নীচে বসে সুরসাধনা করছিলেন তিনি বললেন, ‘বোসো… আমিই আব্দুল করিম খাঁ…’। সংগীতসাধকের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘আপনি যদি আমার গুস্তাকি মাফ করেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করব? এটা কী করছিলেন আপনি? আপনার মতো একজন শিল্পী এতক্ষণ ধরে ‘সা…সা’ করে চলেছেন…!’ আব্দুল করিম বললেন, ‘আমি সুরচর্চা করছি, সা-কে খুঁজছি… এই দেখ…’। বাংলা থেকে করিম সাহবের খোঁজে যাওয়া সংগীতসাধক দেখলেন, তানপুরার উপর ছোট্ট একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখলেন আব্দুল করিম খাঁ… তারপর ‘সা…’ ধরলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তানপুরার তার থেকে লাফিয়ে পড়ে গেল কাগজটা। এই হচ্ছে পারফেকশন, এই হচ্ছে আব্দুল করিম খাঁ-র সঙ্গে বেজে ওঠা… কিন্তু তার জন্য তো বাঁধতে হয়েছে তানপুরার তার। যে-বাঙালির বাংলার সংস্কৃতির প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই সে রবীন্দ্রনাথকে বুঝবে কী করে? একটু অন্যরকমভাবে বললে বলতে হয়, আমাদের বোধের টেস্টবাড্‌সগুলিই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজে খুব সামান্য লেখক, কিন্তু সারাজীবন এর বাইরে যেতে পারলাম না; যাবার প্রয়োজনই হয়নি আমার। আমি বাংলার যে-কোনো প্রান্তে বসে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রান্তসীমা পর্যন্ত দেখতে পাই। আমার বাংলা এত সুন্দর, এত মহৎ। বাংলার প্রতি এই ভালোবাসা কোথায় এখন? রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে যে-অপূর্ব লালিত্য রয়েছে, তার সুরের মধ্যে যে-বিস্তার রয়েছে তাকে ঠিকঠাক আবিষ্কার করতে না-পারলে ওই জীবনমুখী গানই হবে। আবার শুনলাম কোনো এক শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিত নাকি মন্তব্য করেছেন, ওঁর সবই ভালো, শুধু সুরগুলি ভালো নয়। তাঁর এতই স্পর্ধা যে, রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বদলে তিনি গাইতে চেষ্টা করবেন।

পার্থজিৎ: এই মূঢ়তার দিকে তাকিয়ে শুধু ক্ষমা করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার আছে বলে তো মনে হয় না…
বিশ্বদেব: একজন মানুষ তার অস্তিত্বের বিন্দুটিকে অস্বীকার করে কবি কেন, কিচ্ছু হতে পারেন না। আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে এই বাংলার অনুভবই তো বয়ে চলেছে। ধরো একটা কোকিল যেভাবে গায় একটা কাক সেভাবে গাইতে চেষ্টা করলে কিছুতেই পারবে না। কিন্তু এটিই কি একমাত্র সত্যি? একটা কোকিলও কি কাকের মতো গাইতে পারবে? যে-মানুষ প্রকৃত সৌন্দর্যপিপাসু সে জানে কাকের ডাকও কত মধুর।

পার্থজিৎ: আপনার ‘গাছের মতো গল্প’ বইটি পড়তে গিয়ে বার বার দেখছিলাম, আমি নরনারীর প্রেমের কথাই বলছি, টলটলে এক প্রেম… সে-প্রেম ছায়া ফেলে যাচ্ছে আপনার জীবনে… কিন্তু সেখানে যৌনতার প্রকাশ্য উদ্‌যাপন উল্লেখ্যভাবে কম। আপনার কবিতায় যৌনতা এসেছে জলের ভেতর মিশে থাকা জলরং আলোর মতো। এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কথা হচ্ছিল, তিনি প্রেম ও পূজার মধ্যে অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন… আপনিও কি প্রেম ও পূজার মধ্যে এই অভিন্নতা দেখতে পেয়েছিলেন?
বিশ্বদেব: একদম… শুধু একটা কথা বলি, আমার মনে হয় যা সত্য সে-সম্পর্কে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ, কোনো সত্যই আমি ঘটাইনি। দ্বিতীয়ত, যা গভীর শ্রদ্ধার ও আনন্দের তা নিশ্চিতভাবে ঐশ্বরিক। অনাদি অনন্ত সৃষ্টির যে-রহস্য… এই সৃষ্টিকে যে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে… সে-যৌনতা কখনো নিন্দনীয় হতে পারে? আমি নিন্দনীয় হতে পারি… আমার মনকে নিন্দনীয় করে তুলতে পারি; কিন্তু ওই সত্য কখনো নিন্দনীয় হতে পারে না।

পার্থজিৎ: এর মধ্যে পাখোয়াজ ও সেতার বেজে যাবার আনন্দ রয়েছে তাহলে…
বিশ্বদেব: একদম, বললেন যখন একটা কথা বলি… ধরুন বেহাগ… তার মধ্যে কি শুধু অন্য রসগুলিই এল? শৃঙ্গার এল না? আমাদের শাস্ত্রে যে-নবরসের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রস-শ্রেষ্ঠ হল শৃঙ্গার… ফলত আমি নিজে একে অপবিত্র মনে করি না। বসন্তে যখন সারা প্রকৃতি নেচে ওঠে, মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, কোকিলের কুহুতান শুনি তখন কি তার মধ্যে শৃঙ্গার রস থাকে না? শৃঙ্গার বাদ দিয়ে একে কল্পনা করলে তো তা অপূর্ণ হতে বাধ্য। আমি নিজে কখনো এর থেকে দূরে থাকতে চাইনি; আবার এর মধ্যে মানুষের আরোপিত যা কিছু কদর্যতা তার থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। সত্যি কথা বলতে, আমার ভাবনাতেও এই কদর্যতা আসে না। এটা যে আমি খুব মহৎ মানুষ বলে হয়ে থাকে তা নয়; আসলে আমি জানি যে একবার ওই কদর্যতা প্রবেশ করলে আনন্দটা হারিয়ে যাবে। বেহাগ আমার প্রিয়তম রাগ; কিন্তু বেহাগের মধ্যে তো কোনো কদর্যতা নেই। আমি আরও বলতে চাই, প্রশ্ন করতে চাই, যে-কোনো নারীর নগ্ন মূর্তি কি কদর্য? সে-সৌন্দর্য ঐশ্বরিক। শৃঙ্গারকে যারা নিন্দনীয় বলে মনে করেন তারাই একে কদর্য করে তোলেন।

পার্থজিৎ: শাস্ত্রীয় সংগীতে আপনার সুগভীর দখল, আপনি কি কোনো গুরুর কাছে শিষ্যত্ব নিয়ে সংগীতশিক্ষা করেছিলেন?
বিশ্বদেব: সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য, আমি কলেজ থেকে পাস করে বেরোবার ঠিক আগে অল্প সময়ের জন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলাম পণ্ডিত সুভাষ রায়চৌধুরীর কাছে। তিনি আগ্রা ঘরাণার ওস্তাদ আতা হোসেন খাঁ-র শিষ্য ছিলেন। যদিও আমি তার আগে থেকেই রাগ ইত্যাদি চিনতে পারতাম।

পার্থজিৎ: অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না যে, আপনি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌহিত্র। শৈশব যৌবনের অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আপনার কেটেছে। যে-গুটিকয়েক বাঙালি লেখক চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাঙালির অন্দরমহল পর্যন্ত প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তার মধ্যে তারাশঙ্কর অন্যতম। তাঁর লেখার গান ও সুরের ব্যবহার উল্লেখ্য। আপনার কি কোথাও মনে হয় যে, এটা আপনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎসাহ ও ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছে?
বিশ্বদেব: আমার গানের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীত, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর মাধ্যমে… তারপর ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি-র গান… রাধিকামোহন মৈত্রর সরোদে মজে ছিলাম খুব। তারাশঙ্করের যে-গান, সে-সম্পর্কে আমার একটু অন্য ধরনের অনুভূতি আছে। ওঁর লিরিক্স অসামান্য, ওই জীবন যে উঁনি শুধু দেখেছেন তাই নয়, সমস্ত রস গ্রহণ করেছেন। ওই গানটির কথা বার বার মনে পড়ে, রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘তোমার আয়না বসান চুড়িতে…’।

পার্থজিৎ: এই গান তো বাংলার কোণে কোণে বাজত রেডিয়োতে। মানুষ কান পেতে থাকত…
বিশ্বদেব: আর একটা গান… ‘ভালোবেসে মিটিল না সাধ… জীবন এত ছোট ক্যানে…’।

পার্থজিৎ: আমি বহু বহু মানুষকে এর উৎস না-জেনে ব্যবহার করতে শুনেছি… এটা একটা লবজ হয়ে গেছে বাংলায়…
বিশ্বদেব: মানুষের জীবনে এর থেকে বড়ো প্রশ্ন আর কী আছে! এবং দেখ কী সরলভাবে বললেন… আমি তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে বলব, কী জটিল বিষয় নিয়ে তিনি লিখলেন, কিন্তু প্রকাশের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই।

পার্থজিৎ: সেই সুদূর বীরভূমের গ্রাম থেকে উঠে এসে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠা… এই জার্নি তো আপনি দেখেছিলেন…
বিশ্বদেব: আমি খুব কাছ থেকে দাদুকে দেখেছি। আমরা কাছেই থাকতাম, পাইকপাড়া আর টালার দূরত্ব। তারপর বাষট্টি সালে আমার বাবা মারা যেতে আমরা দাদুর টালার বাড়িতে এসে উঠলাম। আমি জীবনে খুব বেশি বড়ো সাহিত্যিককে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাইনি; কিন্তু এই একটি মানুষকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছিলাম একজন সাহিত্যিকের সব থেকে বড়ো মূলধন হল তার বিশ্বাসের ভূমি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তাঁর সততার লক্ষণ। তারাশঙ্কর অনেক কিছুই জানতেন না; হ্যাঁ, জানতেন না… বিজ্ঞানে তাঁর সামান্য ধারণা ছিল, বিশ্বের বড়ো বড়ো সাহিত্যিকদের বই পড়ে ফেলবার মতো পণ্ডিতি তাঁর ছিল না… তা হলে তিনি কীসের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন? একটা মাত্র গ্রন্থ যার থেকে সমস্ত জ্ঞান গ্রহণ করতে হয়— সে-গ্রন্থের নাম জীবন। তারাশঙ্কর ঠিক ওই গ্রন্থ থেকেই তাঁর পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। আমার সামনেও একটি মাত্র গ্রন্থই খোলা থাকে— সেটি জীবন। আমি নিজেও বহু গ্রন্থ পাঠ করি এমন নয়, ভাবি বেশি। তার অনুষঙ্গে কিছু বই পড়ি। তাতে আমার অভিযাত্রা অনেক বেশি আনন্দের হয়।

পার্থজিৎ: সৃষ্টির সময়ে, মানে ধরুন একটা লেখার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন বা ভয়ংকর রকম ডুবে রয়েছেন… সে-সময়ে ঠিক কেমন দেখেছেন তারাশঙ্করকে?
বিশ্বদেব: আমরা তখন খুব ছোটো, আমরা বাগবাজারের একের এক আনন্দ চ্যাটার্জ্জী লেনের ভাড়াবাড়িতে… মানে দাদুর ভাড়াবাড়ি… দাদুর বাড়ি তৈরি হচ্ছে টালায়… আমার মনে আছে বাগবাজারের ভাড়াবাড়ির দোতলায়, একটা সাবেককালের ডেস্ক নিয়ে এক চিলতে বারান্দায় লিখে চলেছেন তারাশঙ্কর। আমি, আমার দিদি শকুন্তলা ও আমার এক মামাতো ভাই— তিনজনে লাফালাফি তুলকালাম কাণ্ড করছি। কোনো দিনের জন্য সেই ঋষি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়েছেন বলে আমার মনে পড়ে না। সাবেককালের খাটের বাজু ধরে ঝুলোঝুলি করছি আর সেই খাটে বসেই উঁনি লিখছেন; বিরক্ত হতে দেখিনি। বাংলা সাহিত্যের মণিমুক্ত তখন সেখানে তৈরি হচ্ছে। পরে যখন ওঁর আরও নামডাক হল, মনে পড়ে সকালবেলা একটু লেবু-চা-বিস্কুট খেয়ে বসতেন। একটা বাঘছাল ছিল দাদুর, সম্ভবত তাঁকে ওটি দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনারায়ন রায়… সে-সময়ে দেখতাম তাঁর চোখে এক অদ্ভুত উদাস দৃষ্টি। বেসিক্যালি গ্রামের মানুষ, ফলে লোকদেখানো ভড়ং ছিল না।

পার্থজিৎ: এটিই কি তাঁর সব থেকে বড়ো কবজকুণ্ডল হয়ে উঠল? এই নাগরিক ভড়ং থেকে দূরে থাকার ফলে অক্ষরের মাধ্যমে তাঁর প্রকাশ আরও যথাযথ হল এবং মানুষ তাঁকে গ্রহণ করল দু-হাত ভরে?
বিশ্বদেব: একজন নাগরিক মানুষও বড়ো সাহিত্যিক হতে পারেন অবশ্যই; আমার মনে হয় একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত-না স্বাধীন হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজের কাজের প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেন না। সাধনার শেষতম কথা আপন মনে থাকা। এই আপন মনে কেউ থাকে না, সব পরের মনে থাকে।

পার্থজিৎ: উনিশশো অষ্টআশি সালের সতেরোই মে— এটি আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সেদিন আপনার চেতনার অনন্ত বসন্তোৎসব শুরু হয়ে গেল। তার কিছু আগে স্বামী ধ্রুবানন্দজির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ, আজ কি কোথাও মনে হয় যে, এগুলি সবই পূর্ব-নির্ধারিত?
বিশ্বদেব: আসলে পূর্ব-নির্ধারিত কথাটির মানে আমার কাছে আজও পরিষ্কার হল না। ধরুন আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, যেতে যেতে একটা জায়গায় দেখলেন একটি থাম রয়েছে। আপনি কি থামটিকে পূর্ব-নির্ধারিত বলবেন? আপনি যদি ওই জায়গাটি দিয়ে অতিক্রম না-করতেন তা হলে থামটিকে দেখতেই পেতেন না। এমনভাবে ভেবে দেখি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতীত থেকে অনাদি অনন্ত ভবিষ্যৎ— সবই চিরন্তন। এর পরিবর্তন নেই, ফলে নির্ধারণেরও কোনো প্রশ্ন নেই। ঈশ্বরই সব করেন, তাঁর পূর্ব-পর বলে কিছু নেই… তিনি তো আর সময়ের অধীন নন। আমি শুধু বলতে পারি, এই জীবনকে আমি দেখলাম, বুঝলাম… বুঝলাম, দেহের ভেতর যে আছে বাইরেও সে আছে। আসলে বাইরে-ভেতর বলেও কিছু নেই… জগতে কিছু হয়নি, কিছু হবেও না… অনাদিকাল থেকে জগতের একটি স্থির ছবি আছে। সেই স্থির ছবির আভাস আমরা থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিতে পাই।

পার্থজিৎ: আপনার সঙ্গে কথা শুরু করলে অসংখ্য জিজ্ঞাসা মনে আসে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ঠিক এখন যেমন মনে হচ্ছে, মৃত্যুবোধ বা মৃত্যুচেতনা যে-কোনো শিল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হয়তো সব শিল্পের শুরুও এখান থেকে। আপনি মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে কখনো দেখেছেন?
বিশ্বদেব: আসলে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে মৃত্যু যে কত কাছে আছে এটা সে বুঝতে পারে না। আমার নিজের জীবনে সাংঘাতিক বিপদ ঘটেছে বেশ কয়েকবার, মোটর-অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে দু-বার, তাছাড়া ক্যানসার পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু এই কোভিড অতিমারির সময়ে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। সেটা মনে হয় সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়; যদিও একটা কথা প্রচলিত হয়ে আছে খুব গূঢ় অনুভবের কথা মানুষকে বলতে নেই। তা হলে কি আমি মানুষের সঙ্গে শুধু অগভীর অনুভব ভাগ-বাটোয়ারা করব? আমি মৃত্যুকে দর্শন করলাম কিছুদিন আগে… আমি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলাম, দীর্ঘদিন খুব কষ্টের ভেতর ছিলাম। আমি এ-বাড়ির একদম শেষ ঘরে শুতাম, আমার স্ত্রী দূরত্ব বজায় রেখেও যথাসম্ভব দেখাশোনা করতেন পরম যত্নে। একদিন রাত্রে আমি ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাচ্ছি; হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, অসম্ভব আঘাত অনুভব করলাম। সব অন্ধকার হয়ে গেল; পরক্ষণে বুঝলাম আমার স্ত্রী খুব কাছে থেকে বার বার বলছেন, ‘তুমি পড়ে গেছ… তুমি পড়ে গেছ’। আমি দেখছি আমার দেহ-টা পড়ে আছে ওই জায়গায় আর আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি… আমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি… আমার থেকে পাঁচ-সাত হাত দূরে বড়ো প্রদীপের শিখা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রদীপ নেই; শুধু শিখা। অদ্ভুত সোনালি-লাল এক আলোর আভা আর অন্ধকার। আমি তাকে অনুসরণ করছি, করিডোর যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে দেওয়াল ভেদ করে বাঁ-দিকে চলে গেলাম; অনুভব করলাম এক আশ্চর্য ঠান্ডা ও শান্ত প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়েছি। ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ; ডান দিকে একটি পাহাড়। কিছু কালো কালো মানুষ মাথায় ভাঁড়ের মতো জিনিস নিয়ে অন্ধকারে হেঁটে চলেছে। তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম ডান দিকের পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে আসছেন শ্রীকৃষ্ণ। নীলাভ গাত্রবর্ণ, হাতে বাঁশি… আমি কৃষ্ণকে চিনি। আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল, আমার চশমাটা পাচ্ছিলাম না। চশমা হারিয়ে গেছে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কৃষ্ণ নামছেন আর তাঁর চোখে আমার সোনালি চশমা। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘প্রভু, এই জিনিস কি তোমাকে মানায়?’
তিনি বললেন, ‘তুমি যে বললে তোমার চশমা হারিয়ে গেছে? তাই আনলাম… এই নাও। কিন্তু তুমি এখানে কেন? ফিরে যাও…’
তাঁর কথা কোনো অনুরোধ নয়, স্টেটমেন্ট নয়… এক সত্য রয়েছে তার ভেতর। অনুভব করলাম ঘুরে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছি, দেহের ভেতর ঢুকে গেলাম আবার।
এখন এটা শুনে একজন আমায় বলেছিলেন, ‘এটা আপনার মনে হয়েছে…’। তিনি সব থেকে সত্যি কথাটাই বলেছেন; কারণ, আমি এমন কিছু বলিনি যা আমার মনে হয়নি। যা মনে হয়নি তা বলাটাই মিথ্যাভাষণ। কিন্তু অনেকে যে-অর্থে এটাকে ‘বাস্তব নয়’ বলেন আমি জানি না এর থেকে বেশি বাস্তব আর কী। বাস্তবকে চিনতে গেলে তো তাকে মনে হতেই হবে। আমি নেই অথচ জগৎ আছে এটা ভাবা যায় না; জগৎ ও আমি একসঙ্গে আছি এটাই চিরন্তন অনুভূতি।

পার্থজিৎ: একদম শেষে এসে আপনি আর একটি মারাত্মক প্রসঙ্গের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, ‘মনে হওয়া’ ও ‘ফলসহুড’কে এক করে দেখার যে-চেষ্টা তার দিকে আমাদের অন্যভাবে তাকাতে বাধ্য করলেন…
বিশ্বদেব: এই অবিশ্বাসের যুগে বিশ্বাসকেই অনুসরণ করেছি সারাজীবন। জ্ঞানের প্রধান তিনটি লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়— বিশ্বাস, বিশ্বাসের কারণ ও তার বাস্তবিক সত্যতা। এই তিনটিকে পৃথক করে দেখা হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে অবজেক্টিভ কন্ডিশন, এই সাবজেক্টিভ কন্ডিশনকে অবজেক্টিভ কন্ডিশন থেকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা এখন সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে, সন্দেহের চেহারা নিয়েছে। এটা কোনো দার্শনিক-সন্দেহ নয়, হিংসা থেকে উৎপন্ন হওয়া সন্দেহ।

পার্থজিৎ: আপনি যে-অনন্ত আনন্দ ও আলোকিত জগতের মধ্যে রয়েছেন, যার স্পর্শ আমরা পাচ্ছি তা আরও অনেক অনেক দিন ধরে যেন পাই— এই চাওয়া। আপনার সঙ্গে কথা ফুরায় না…
বিশ্বদেব: ‘আমি যদি না থাকি’— এ-বেদনার কোনো অর্থ হয় না; এই আনন্দের ভেতর আমি খুব সুন্দর বেঁচে আছি। জীবনের অপূর্ণতা যা মনে হত একদিন, এখন আর তা মনে হয় না… জীবন খুব পূর্ণ।

প্রথম পর্ব

Categories
2021-NOVEMBER-PROSE

সম্প্রীতি চক্রবর্তী

ভূত কৌতুক: সাহিত্যে ও চলচিত্রে বাঙালি ভূতের চরিত্রায়ন

একটা বাংলা horror film-এর কথা ভাবুন। হিন্দি মূলস্রোতের মতো সাদা শাড়ি, বিরহ গান আর পাঁচটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য মনে পড়ছে কি? একাকিনী বিধবা প্রলোভন দেখায় অমাবস্যার রাতে? নাকি বাংলা ভূত বলতে শ্যাওড়া গাছের মগডালে বসা চিতল মাছের পেটি হাতে শাকচুন্নি? ঘাড় মটকাবে, যদি না সে মাছ পায়, নিদেনপক্ষে একটা মোয়া বা নাড়ু তো লাগবেই! আসলে বাঙালি ভূতের পরতে পরতে একটা ব্যঙ্গকৌতুক রয়েছে, বাংলা সিনেমা বা সাহিত্যে তারই খানিক নাগাল পাওয়ার চেষ্টা এই প্রবন্ধে।

আজকের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বা ‘গয়নার বাক্স’ যেখানে ভূতে মোহর জোগায় পরিচালক কে, বা যক্ষের ধনের সন্ধান দেয় আটপৌরে তোতলা গৃহ স্ত্রীকে, তার পূর্বসূরি খুঁজলে পেয়ে যেতে পারেন যমালয় জীবন্ত মানুষ বা চার মূর্তি। মানলাম সেটা যমপুরি, ঠাকুর দেবতাদের সঙ্গে খানিক রঙ্গরসিকতা কিন্তু এখানেও যে পরলোক আর হাস্যরস মিলে মিশে আছে। চার মূর্তিতে আপাতদৃষ্টিতে ভূত নেই, সে যতই টেনিদা বাংলোর কেয়ারটেকারকে দেখে ভিরমি খাক, তবু ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি হয় স্বামী ঘুটঘুটানন্দের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টায়। চারমূর্তি জঙ্গলঘেরা বাসায় অনেকটাই ভীত সন্ত্রস্ত। তবে ক্লাসিক ছবি অবশ্যই ‘ভূতের রাজা’, যার হাসি চিরমলিন। তিনটি গুপি বাঘা ছবিতেই ভূতের রাজাকে হাসি ছাড়া কল্পনা করতে পারেন? ভূতের নাচ একবারেই ভয়াবহ নয়, পেট মোটা পাদ্রী ভূত যখন নাচে তখন পেছনের আবহসংগীত লক্ষ করেছেন? চমক রয়েছে, সঙ্গে অভিনবত্ব, তবে নেই কোনো শীতল শিহরণ। এইসব ভূতই অতি সজ্জন ও পরোপকারী। বাংলা ধারাবাহিকেও তার প্রভাব এসে পড়ল। দু-টি পপুলার বাংলা বিনোদনের চ্যানেলে ‘ভূত ঠাকুমা’ আর ‘ভূত দাদু’ পেশ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তারা পুরোনো আমলের পোশাক পরে ধারাবাহিকের মূল চরিত্রকে সাহায্য করে, কখনো হাসির উদ্রেক ঘটায়, কখনো প্রেমে পড়ে, হুকো সেবন, প্রাতঃভ্রমণ কিছুই বাদ নেই। ‘ভূতের ভবিষ্যত’-এ তো অশরীরীর মজলিস, তাও প্রত্যেক সংলাপে হাসি পায়, ক্ষুরধার হিউমার যাকে বলে। ‘গয়নার বাক্স’-তে মৃত পিসিশাশুড়ি নাতবউমাকে আপন করে নেয়। কিছুদিন আগে কৌশিক গাঙ্গুলি ‘খাদ’ নামক একটি সিনেমা বানান, তাতেও আদপে ভূতেদের আনাগোনা, (যদিও মৃত্যু রহস্য উন্মোচন সিনেমার একেবারে শেষে) কিন্তু ভয়ের বদলে সেখানে আলাদা আলাদা জীবন-ছবি অঙ্কিত হয়েছে।

কোথাও গিয়ে বলাই যায়, বাঙালি ভূত আর যা-ই পারুক ভয় দেখাতে পারে না। কারণ, তারা হাসি ফোটায় দর্শকের মুখে, কখনো বুদ্ধিমত্তার জোরে, কখনো নিজেই সং সেজে। সিনেমা থেকে সরে গিয়ে ছোটোবেলার উপকথা হাতরালেও মামদো, ব্রহ্মদৈত্যর কথা মনে পড়ে, যাদের উপস্থিতি রক্তপিপাসু নরখাদক এর চেয়ে ক্ষুধার্ত চেহারার জানান দেয় বেশি। গোপাল ভাঁড়ের গল্প বা অন্য রূপকথায় ভূতের প্রসঙ্গ এসেছে বার বার, কিন্তু ঘাড় মটকাবার বদলে তারা বেছে নিয়েছে বিয়েবাড়ির মিষ্টি চুরির মতো কাজ, বা কোনো বাচ্চার নিত্যসঙ্গী হয়েছে চুপিচুপি। ঠিক এই কারণেই ছেলেবেলায় ভয় বলতে কখনো বাঙালি ভূত মাথায় আসেনি।

ভূত আর হাস্যরসের মধ্যে আদপে সম্পর্কটা কী? সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি, বাংলা সাহিত্য কি বলছে?

সেখানেও কিন্তু অলৌকিকতা আর হাসি এক ভাবে মিলে মিশে আছে। তিন জনের লেখা উল্লেখ করি, troilokyanatherডমরু চরিত, সুকুমার রায়ের ভুতুড়ে খেলা এবং আরও অনেক পরের হলেও শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু ধর এক আশ্চর্য চরিত্র। অবাস্তব ঘটনা তার নিত্য সঙ্গী, যার জেরে সে এক সামান্য দর্জি থেকে জমিদার হয়ে উঠতে পেরেছে, বিবিধ অলৌকিক, বিদঘুটে কাহিনী সে শোনায় তার বন্ধু মহলে, সকলে তাঁকে সমিহ করে এবং আমরা পাঠকরাও সেই গল্পে মজি বার বার। ‘ডমরু চরিত’-এর একটি গল্পের শিরোনাম ‘ছোটখাটো ভালো মানুষ ভূত’, এই পর্বে ডমরুর সাক্ষাৎ হয় এক ভীতু ভূতের সঙ্গে। সে আশেপাশে কোনো মানুষ হাচলে কাশলে ভয় পায়, কুকুর ডাকলে পলায়ন করে, ডমরুর হাতে ভেটকি মাছ দেখেও সম্ভ্রমে তা চাইতে পারে না। ইংরেজিতে একটা বিখ্যাত সিনেমা ছিল, ‘ক্যাস্পার’, এক ছোটো সাদা ভূতের গল্প। ত্রৈলোক্যনাথের ছোটো ভূত তাকে মনে করিয়ে দেয়। ডমরুর ভীতু ভূত তারই সঙ্গে গ্রামের পথে হাঁটা চলা করে, রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি মারে আর ঘুলঘুলি দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাছ ভাঁজা নেয়, তবে যদি রাঁধুনে নিজে থেকে হাতে তুলে দেয়। ভদ্র, শিষ্ঠ ভূত, নিজে কাড়াকাড়ি করতে পছন্দ করে না। এবারে চলে আসুন মা ভূত আর ছানা ভূতের গপ্পে। সুকুমার রায়ের ভূতুড়ে খেলায়, পান্ত ভূতের ছানা তার মায়ের কোলে খেলা করে। মা তাঁকে কত নামে ডাকে, ‘নোংরা মুখো সুটকো’, ‘বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বৃষ্টি ‘গণেশ ঠাকুর ময়দা ঠাসা নাদুস’’। ভূত তো কী হয়েছে, সেও গরমিকালে বৃষ্টির স্বস্তি বোঝে, গণেশ ঠাকুরের মতো নাদুসনুদুস বাচ্চার স্বপ্ন দেখে আবার ময়দার কোমল ডেলা ভেবে শিশুকে কোলে তোলে যত্নে। দেবতার মানবায়ন বলে একটি কথা আছে, বাংলা হিন্দু পৌরাণিক গল্পে তার নজির মেলে বার বার। এখানে শিবদুর্গা যেন আর পাঁচটা দম্পতির মতো নিত্য কলহে জড়ায়, রাধাকৃষ্ণের প্রেম হয়ে ওঠে অতি মানবিক। আমার তো মনে হয় এই বাংলায় ভূতেদের ও মানবায়ন ঘটেছে। এর সব থেকে উৎকৃষ্ট নজির কিন্তু শীর্ষেন্দুর ‘গোঁসাইবাগান’।

বুরুন অঙ্কে তেরো পেয়ে ফেল করেছে, বাড়িতে সে এক ঘরে, কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। মনের দুঃখে গোঁসাই ডাকাতের বাগানে গিয়ে তার সাক্ষাৎ হয় নিধিরাম ভূতের সঙ্গে। নিধিরাম দু-শো বছর ধরে সেই জঙ্গলে রয়েছে, হাত পা ইয়া লম্বা করে, অদৃশ্য হয়ে, একেবারে ছোট্ট হয়ে হোমিওপ্যাথির শিশির মধ্যে ঢুকেও সে বুরুনকে ভয় দেখাতে ব্যর্থ হয়। হতাশ হয়ে ভূত বাবাজি তার অসীম সাহসী বন্ধুকে সাহায্য করতে উদ্যত এবার। করালি স্যারের টিউশনে ভূত বুরুনের হয়ে অঙ্ক কষে দেয়, স্কুলে ক্রিকেটে বুরুনের হাতে ব্যাট দিয়ে অদৃশ্য ছক্কা মারে, এমনকী তার বাড়িঘর ঝাড়পোঁছ পর্যন্ত করে দেয়।

এইসব বাঙালি ভূতের গল্পে কেউ স্নেহশীলা মা, কেউ-বা পরোপকারি বন্ধু আবার কেউ ভূতের একমাত্র স্বধর্ম বর্জন করে নিজেই ভয় পেয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার মানুষের আদলে তৈরি ম্যাজিক জানা এক প্রজাতি, সিনেমা হোক বা গল্প এই ধারা চলছে শতকের পর শতক।

বাংলার ভয়, অশ্রু, কষ্ট মিলে মিশে যায় রঙ্গব্যঙ্গে, কৌতুকে। আমরা হাসি খিলখিলিয়ে, ভূত চতুর্দশী হোক বা নিশিদিন কোনো অমাবস্যা।

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সংগীতা এম. সাংমা

 

ওয়ানগালা একটি উৎসব

পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ করে জীবনযাপন করা গারো জাতি বা সমতলের গারো, যারা কাঁদা-মাটিতে চাষ করে— তাদের উৎসবগুলো অনুষ্ঠিত হয় ফসলকে কেন্দ্র করে। ফসল রোপণ থেকে ঘরে তোলা অবধি বিভিন্ন উৎসব পালন করে গারো জনজাতি।

তার মধ্যে ‘ওয়ানগালা’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি বর্ষার শেষে এবং শীত শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ, সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয়। ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ হল নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করার সামগ্রী এবং ‘গালা শব্দটির অর্থ হল উৎসর্গ করা।

‘সাংসারিক’ ধর্মে বিশ্বাসী এই জাতি দেব-দেবীর স্মরণে ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার উদ্দেশ্যেই এই উৎসব ধুমধাম করে পালন করে। গারোরা এই প্রাচীন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মকে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য একদিনের জন্য হলেও ওয়ানগালা পালন করে থাকে। এই উৎসবের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং লোকশ্রুতি।

মনে করা হয় প্রাচীনকালে মানুষ জীবন-ধারণের জন্য আলু, বনকচু, বিভিন্ন ধরনের মূল ইত্যাদিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ধান, ভুট্টা, গম ও অন্যান্য শস্য তখন মানুষের কাছে অজানা ছিল। সেই যুগে পৃথিবীতে গিসিল বল গিত্তল রিকগে সামল জাফাং মনল (Gisil Bol Gitol Rikge Samol Japhang Monol) নামে এক বিশালাকায় গাছ ছিল। সেই গাছের চব্বিশটি শাখা ছিল। বারোটি শাখা পূর্ব দিকে এবং বাকি বারোটি ছিল পশ্চিম দিকে। প্রতিটি শাখা এক-একধরনের ফলে পরিপূর্ণ ছিল। এক শাখায় ছিল সর্বপ্রকারের মুল্যবান খনিজ যেমন- হিরে, সোনা, রুপো। অন্য শাখায় ছিল বিভিন্ন শস্যাদি যেমন– ধান, তুলো, রেশম-সহ আরও অনেক কিছু। সেই বৃক্ষের অন্য আর একটি শাখায় ছিল আশ্চর্যরকমের বিভিন্ন প্রজাতি আর রঙের ধান— নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি ইত্যাদি।

আ-জারেকছি জাপা নামের এক জায়গায় এইসব রঙিন ধানের একটি বাগান ছিল যার নাম Gliting Dinge Rane Dingje.

অবাক করার বিষয় হল এই শাখা থেকে কেউ ধান পেড়ে নিতে পারত না। একদিন বাতাসের দেবতা জারু মে-আ জাবাল ফান্তে অখখুয়াংসি জাফাত চংসি (Jaru Me.a Jabal Pante Okkhuangsi Japat-Chongsi) এবং ঝড় ও শিলার দেবতা মিখখা তেম্মা স্তিল রংপা (Mikka Temma Still Rongma) একসঙ্গে শক্তিশালী পায়ের ঝাঁকিতে সেই আশ্চর্য ধানের কিছু বীজ মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু গারোরা ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। এদিকে নিউ নিকিসের দেবী, নামছিল আ-নিং নকসিক চিনিং নমিন্দিল আ-নিং ডিপারি চিনিং ডিপারা (Ah-ning Noksik Chining Nomindil Ah-ning Chining Dipera) মাটি থেকে সেই ধানের বীজ তুলে এ নিজের বাগানে রোপণ করে। পরবর্তীকালে মিসি সালজং তার কাছ থেকে বীজ ধার নিয়ে ধান চাষ করে।

ওয়ানগালা নৃত্যের একটি দৃশ্য, ছবি : গুগুল

একদিন মিসি সালজং হাটে যাওয়ার পথে দেখা হয় রাসং (আ-নি-আপিল ফাচিনি গালাফা) নামে এক লোকের সঙ্গে, তার হাতে ছিল একখানি নিড়ানি যা দিয়ে সে মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন আলু ও বন্যমূল সংগ্রহ করত। রাসং-কে বেঁচে থাকার জন্য নিত্য পরিশ্রম করতে হত। তার পরনে ছিল গাছের বল্কল। পোশাক ছিল খুবই জীর্ণ ও ধুলো মাটি দিয়ে ঢাকা। রাসং তাই মিসি সালজংকে দেখে লজ্জা পেয়ে পাশের একটা পাথরের পেছনে লুকিয়ে পরে। এরপর মিসি সালজং তাকে বেরিয়ে আসতে বলে। তার সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা দুজনে ‘দংক্রেং’ নামক গাছের নিচে দুপুরের খাবার খেতে বসে।

মিসি সালজং ভাত ও মাছ খেত কিন্তু রাসং এসব খাবার সম্পর্কে জানত না। সে শুধু বনের ফল-মূল, আলু এসবই খেত। তাকে দেখে মিসি সালজং খুব দুঃখ পেল এবং তাকে জিজ্ঞেস করল সে ঝুম চাষ করতে জানে কিনা। রাসং বলল বন পুড়িয়ে ঝুম চাষ জানে। ধানচাষ সম্পর্কে জানে না। মিসি সালজং দয়ার বশে বলে যে, তিনি তার জন্য ধানের বীজ পাঠাবে। রোপণ করে ফসল যখন পাবে তখন যেন প্রথম ফসলের কিছু অংশ ভোগ করার পূর্বে তার নামে উৎসর্গ করে। এমনটা যেন প্রতি বছর করা হয়।

মিসি সালজং বাড়ি ফিরে প্রতিশ্রুতিমতো তার চাকর নক খলজসিকসককে দিয়ে ধানের বীজ রাসং-এর জন্য পাঠাল। কিন্তু সেই চাকর হিংসা করে আধা শুকনো বীজ রাসং-কে এনে দিল। এদিকে রাসং খুব উৎসাহ ও আগ্রহের সঙ্গে বীজ রোপণ করে দেখা শুনা শুরু করল কিন্তু কিছুতেই বীজ অঙ্কুরিত হল না। রাসং রেগে গিয়ে মিসি সালজং-এর স্বর্গীয় বার্তাবাহী দূত দিমরে, চুন, বাং শেও বাং দিংকে নিজের কাছে বন্দি করে রাখল। এর পর মিসি সালজং তার দূতদের ছেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করে এবং তার বদলে উত্তম বীজ দেবার প্রতিজ্ঞা করে।

এরপর রাসং আবার আগ্রহের সঙ্গে চাষ করা শুরু করে এবং দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বৃষ্টিতে বীজ থেকে চারা গজিয়ে উঠল। এভাবে ধানগাছ যখন পরিপুষ্ট হয়ে উঠল, কিন্তু ধানকাটার সময় Mattengke Mesewal-এর এক শয়তান চাকর ধান চুরি করে কেটে মিসি সালজং-এর কাছে মিথ্যে অভিযোগ জানায়, যে, রাসং ফসল দেবতার জন্য কিছু তো রাখেইনি বরং লুকিয়ে ফসল তুলতে শুরু করেছে। মিসি সালজং এতে ভীষণ রেগে রাসং-সহ তার পুত্র এবং বার্তাবাহকদের বন্দি করল।

রাসং অনুনয় করে সব জানালো কীভাবে তাদের সম্পর্কে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছে এবং মুক্তি প্রার্থনা করলে। মিসি সালজংকে মুক্তি দিয়ে রাসং-এর সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক করল।

বাড়ি ফিরে রাসং ফসল তুলে কিছু অংশ ধূপ ও মদ সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে মিসি সালজং-এর উদ্দেশে উৎসর্গ করল। এভাবেই রাসং তার আচিক আহ সংয়ের ভূমিতে জন্মানো ফসল উৎসর্গিত করে মিসি সালজংকে সন্তুষ্ট করল। মিসিসালজং আশীর্বাদ করে বলল—

“এইলোক এবং তার বংশধরদের ভূমিতে বেড়ে উঠুক এই শস্য, তার বংশ যেন চির আশীর্বাদ পেয়ে থাকে। প্রতিবছর পৃথিবীতে আমার আগমনের সময় হোক এ নৈবেদ্য উৎসর্গ”।

বর্তমান সময়ে গারোদের বেশিরভাগ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার দরুন নতুন ফসল যিশু খ্রিস্টের উদ্দেশে উৎসর্গ করে। বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর ভূমিজাত সবরকম শস্যের দশমাংশ ও অগ্রিমাংশ তাকে নিবেদন করবার কথা বলেছে। কারণ, তিনিই তাদের ফসল উৎপাদনের সামর্থ্য দেয়। তাই বাইবেল এবং পুরোনো ধর্মদুটোকে মিলিয়ে গারো সম্প্রদায় এই উৎসবটি পালন করে।

বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত এই উৎসব। যেমন— ওয়ানমা, রংচয়া, দ্রুয়া, ঘুরে ওয়াতা ইত্যাদি।

কৃষি নির্ভর গারো জাতি বারোমাসই কৃষিতে নিযুক্ত থাকে। শীত বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা চাষের স্থান নির্বাচন করে। তখন জুমাং সিআ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এরপরে সর্ব প্রকার ফসলের দেবী কিরি রক্ষিমকে মর্ত্যে আসবার জন্য আহ্বান জানানো হয় আসিরকআ অথবা গিচ্ছিপং রকআ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তৃতীয় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে আগালমাকা যার মাধ্যমে গারোরা নকমা কর্তৃক ভাগে পাওয়া চাষের জমির ঝোপঝাড় আগাছা পরিষ্কার করে। চতুর্থ পর্যায়ে বেড়ে ওঠা সবুজ শস্য খেতে পালন করা হয় মি আমুয়া বা মেজাক সিমআ। এর পরে পালিত হয় রংচুগালা, এই অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র দেবী কিরি রক্ষিমকেই নয় মিসি সালজং-সহ অন্যান্য দেব-দেবীদেরকেও সন্মান জানায়। ষষ্ঠতম অনুষ্ঠান হল জামেগাপা বা মেদংরাউনা যা ওয়ানগালার প্রাক্কালে পালন করা হয়।

বছরের শেষ এবং প্রধান উৎসব হবার কারণে ওয়ানগালা প্রতি বছর সমষ্টিগতভাবে পালন করা হয়। গ্রামের সকলের খাদ্য শস্য ঘরে তোলা হয়ে গেলে নকমা (গ্রাম প্রধান) সবাইকে ডেকে ওয়ানগালার দিন তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে ঘর বাড়ি গোছানো এবং মেরামত করা, অন্যান্য গ্রাম থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা— সবই জোরকদমে শুরু হয়ে যায়। যুবক-যুবতীরারা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজিয়ে নাচ গানের মহরা দেয়। এই উৎসব মূলত তিনটে ধাপে সম্পন্ন হয়—

১. রুগালা— এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত ১৫ই কার্তিকে পালন করা হয়। অর্থাৎ, ধান কাটবার পরে। এই দিন ভোরবেলায় নকমা ‘আসিরাক্কা’ বা জমি চাষের আগে পূজা করে মন্দ শক্তি দূর করবার স্থানে গিয়ে সালজং দেবতার পূজা করে। দুপুরে প্রথমেই ‘নক-গাত্তা’ বা ‘ঘরে তোলা’ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ধান বা ফসলাদি ঘরে তোলা হয়। এরপর গ্রামবাসী সকলে নকমা বা সমাজ/গ্রাম প্রধানের বাড়িতে সমবেত হয়। নকমা প্রথমে ভাণ্ডার দেবী রংদিক মিৎদে এবং গৃহ দেবতা নকনি মিৎদের পূজা করে এবং মিসি সালজং দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে। এর পর একে একে গ্রামের সবার বাড়িতে পর্যায়ক্রমে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

২. সাসাৎ সওয়া— এই অনুষ্ঠানটি করবার একটি উদ্দেশ্য হল সালজং দেবতার প্রতি ধূপ প্রজ্বলন করা। এই দিন রাজকীয় বেশে নকমা এবং খামালেরা (পুরোহিত) প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নৃত্য-গীতরত লোকেদের মাঝে কৃত্রিম ঘোড়ায় চড়ে নাচ করে। এটিকে ‘গুরে রদিলা’ বলা হয়। পুরোনো বিশ্বাস ‘সাসাৎ সওয়া’ বা ধূপ জ্বালানোর মাধ্যমে পরবর্তী বছর কেমন কাটবে সেটা গণনা করা হয়ে থাকে। যেমন— যখন ধূপ জালানো হয় তখন যদি ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে, এ-বছর ভালো কাটবে না। মনে করা হয় সামনে মহাবিপদ। ধূপ জ্বালানোর সময় যদি আগুন না জ্বলে শুধু ধোঁয়া নির্গত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে, আগামী বাছর খুব ভালো কাটবে।

৩. দামা-গগাতা বা জল ওয়াতা বা রুস্রাতা— এটি অনুষ্ঠানের শেষ দিন এবং দেবতাদের বিদায় দেওয়া বা শেষবারের মতো নৈবেদ্য উৎসর্গ করার দিন। এই দিন সবার বাড়িতে সালজং দেবতা এবং রক্ষিম দেবীর উদ্দেশে মদিরা এবং ধূপ উৎসর্গ করে প্রার্থনা এবং তাঁদের বিদায় জানানো হয়। সন্ধ্যের আগেই যুবকেরা বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে নকমার বাড়িতে ফিরে আসে এবং নকমা ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। নকমার ঘর থেকেই অনুষ্ঠানের সূচনা এবং সমাপ্তি দুটোই সম্পন্ন হয়।

গারোরা এই ওয়ানগালা আরও দুটো উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে। প্রথমত, উৎপাদিত ফসল বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পঙ্গপাল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যাধি, মহামারি, রোগ-জীবাণুর হাত থেকে মুক্তি পেতে। গারোরা বিশ্বাস করে এই উৎসবকালে আসংততা নামে এক অদৃশ্য শক্তি উপস্থিত থাকে। সে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে থাকে।

ওয়ানগালার নিয়ম রীতি, সমবেত ভোজন, নৃত্য-গীত এসব মনের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এবং বাহ্যিক বিষয়। দেবদেবীদের ভুলে না যাওয়া, তাদের স্মরণ করা, তাদের আশীর্বাদের প্রতিদানে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তাদের মান্য করে জীবনযাপন করাই ওয়ানগালার নিগূঢ়তথ্য ও আসল বিষয়।

সহকারী লেখক: গৌতম সরকার

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সুশীল রাভা

লোকধর্মের পিঠস্থান: আদি কামাখ্যাধাম

কথায় আছে “বিশ্বাসে মিলে বস্তু তর্কে বহুদূর”।লোকধর্মের মূল ভিত্তি হল অন্তর্নিহিত আত্মার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই জন্মায় ভয়, ভীতি ও ভক্তি। ভক্তি থেকে সৃষ্টি হয় নানাপ্রকার দেবদেবীর কল্পিত রূপ। সেই কল্পিত রূপই স্থান-কাল বিশেষে প্রতিষ্ঠা পায় থান, ধাম, মন্দির প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বস্তুত সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ লোকবিশ্বাসের অন্তরালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোকধর্মের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো সেইসবের পীঠস্থান অথবা লোকধর্মের মিলনক্ষেত্রে বলেও প্রচলিত। নবগঠিত আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম ব্লকের অন্তর্গত মধ্য কামাখ্যাগুড়ি গ্রামে অবস্থিত ‘আদি কামাখ্যাধাম’ তারই একটি নিদর্শন। শতাব্দী প্রাচীন এই ধামটি কে বা কারা, কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র নেই। তবে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে ধামটি নাকি কোচবিহারের রাজবংশের কোনো এক রাজা শিকার করতে এসে ধামটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কোন রাজা বা কোন রাজ-আমলে ধামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কোনো লিখিত সূত্র নেই। বস্তুত সেইসময় লিখিত তথ্যের অভাবে কোচবিহার মহারাজগণের বহু ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে। তথাকথিত গবেষকগণও বিষয়গুলি এড়িয়ে গেছেন।

এই জনশ্রুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এলাকার জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানদের বক্তব্য থেকে জানা যায় আদি কামাখ্যধামটি নাকি বুড়া রাজার আমলে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু কে বুড়া রাজা, তার নামই-বা কী ছিল, তার কোনোটাই বলতে পারেননি। তবে প্রত্যেক বক্তাই রাজা বাদ্য-বাজনা সহকারে শিকারের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই সূত্রে এটা অনুমান করা যায়, যে, খুব সম্ভবত মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলেই ধামটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কারণ, কোচবিহার মহারাজগণের শিকার কাহিনি পর্যালোচনা করে জানা যায় সেই সময়কালে একমাত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই আধুনিক পদ্ধতিতে রুচিসম্মত সরঞ্জাম নিয়ে শিকার যাত্রায় যেতেন।

কোচ রাজবংশের মহারাজদের মধ্যে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক রুচিশীল। তাঁর রাজত্বকালেই কোচবিহার রাজপ্রাসাদসহ রাজনগর আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণ মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে কোচবিহার রাজবংশের আধুনিক রূপকার বলে বর্ণনা করেন। জানা যায় মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক থেকে তিন সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে শিকার যাত্রায় বেরোতেন। শিকার করার আধুনিক সরঞ্জাম-সহ মনোরঞ্জনের গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্র সঙ্গে রাখতেন। বিশেষত সাময়িক অবকাশ যাপন ও অবসাদ কাটানোর জন্য গান-বাজনা এবং হাস্যকৌতুক ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম উপাদান। কোনো কোনো সময় ম্যাজিক শো-ও দেখানো হত। শিকার অভিযানে বেরিয়ে যেখানেই রাত্রিযাপন করত, সেখানেই গানবাজনা ও হাস্যরসে গমগম করত। ফলে স্থানটি এক জমকালো উৎসবে পরিণত হত।

কোচবিহার ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬৩-১৯১১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার মধ্যে ১৮৭১ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর শিকার করার রেকর্ড রয়েছে। এই ৩৭ বছরে তিনি ৩৬৩টি বড়ো বাঘ, ৩১১টি চিতা বাঘ, ২০৭টি গণ্ডার, ৪৮টি বাইসন, ৫৩৩টি হরিণ, ৮১২টি অন্যান্য জীবজন্তু মেরেছিলেন।

মহারানি সুনীতি দেবীও একজন দক্ষ শিকারি ছিলেন।সেই সময় তিনি টাকোয়ামারী (বর্তমান-আটিয়ামোচড়) জঙ্গলে ১১টি বাঘ শিকার করেছিলেন। উল্লিখিত ধামটি ছিল টাকোয়ামারী বনাঞ্চলেরই অন্তর্গত। বস্তুত বনাঞ্চলটি অতীতে ভুটান-সহ অসমের মানস অভয়ারণ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সূত্রে এই অঞ্চলটি ছিল বন্য জীবজন্তুদের অবাধ বিচরণভূমি। ধাম অবস্থিত অঞ্চলটিও ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। ফলে কোচবিহারের শিকার বিলাসী মহারাজগণ প্রায়শই আসত শিকার করতে এই অঞ্চলে।

জনশ্রুতিতে রয়েছে একসময় রাজা শিকার করতে এসে, বর্তমান ধাম অবস্থিত নিকট স্থানে নল, খাগড়াবেষ্টিত একটি কর্দমাক্ত নালা (ডোবা) পার হতে গিয়ে রাজার হাতির চারটি পা কাদায় ডেবে যায়। মাহুত অনেক চেষ্টা করেও হাতিটিকে তুলতে পারেননি। ফলে সেইসময় রাজা অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিশেষত তাঁর এই প্রিয় হাতির করুণ দশা দেখে রাজা একপ্রকার ভেঙেই পড়েছিলেন। সেই সময়েই জঙ্গলের পাশেই বস্তিতে বসবাসকারী একজন বৃদ্ধ ‘কোচা-হুজি’, অর্থাৎ, কোচ (রাজ্য) জনগোষ্ঠীর গুণিন কবিরাজ, জঙ্গলে হাতির চিৎকার এবং মানুষের গুঞ্জন শুনে কৌতূহলবশত ধীরে ধীরে ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসেন। ‘হুজি’ দেখতে পান রাজার হাতি হাওদা সহ কাদায় ডেবে গেছে।

হাতির এই অবস্থা দেখে, হুজি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে রাজাকে বলেন— “মহারাজের অনুমতি হলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।

বিচলিত রাজা হুজির কথা শুনে কিছু না ভেবেই একটু বিরক্তির সুরেই বলেন— “কী উপায় আছে তাড়াতাড়ি বলো”।

হুজি রাজার অনুমতি পেয়েই কাঠিতে গণনা করে বলে দেন, যে, এখানে কামাখ্যা মায়ের পুজো দিতে হবে। পুজো দিলেই হাতি উঠে দাঁড়াবে। বিচলিত ও উদ্বিগ্ন রাজা হুজির কথা শুনেই তৎক্ষণাৎ পূজার আয়োজন করার নির্দেশ দেন হুজিকেই। হুজি রাজার আদেশ পেয়ে আনুষঙ্গিক উপাচার জোগাড় করে তন্ত্রমতে ভক্তি ভরে কামাখ্যা মায়ের পুজো করেন। সেই সময় সূর্য প্রায় অস্তগত। অগত্যা রাজা পাশেই একটা উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে প্রিয় হাতির ওঠার অপেক্ষায় রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নিশিরাতে কিছু একটা শব্দে রাজার ঘুম ভেঙে যায়। সেইসময় রাজার একজন প্রহরী (সেপাই) ছুটে এসে খবর দেন মহারাজের হাতি কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে। রাজা তাঁবু থেকে বেরিয়েই দেখেন, তাঁর প্রিয় হাতিটি সত্যি সত্যিই কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে।

রাজা এইরূপ অলৌকিক ঘটনা দেখে দেবীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে ভক্তিভরে প্রণাম করে ঘোষণা করেন— “এখন থেকে প্রতি বছর অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে এই স্থানে কামাখ্যা মায়ের পূজা করা হবে। আর এই পূজার খরচ কোচবিহার রাজকোষ থেকে পাঠানো হবে”।

বস্তুত তখন থেকেই অদ্যাবধি ধামের পূজা প্রচলিত নিয়মেই চলে আসছে। তবে কোচবিহার রাজকোষ থেকে কত দিন ধামের পূজার খরচ বহন করা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মূলত এলাকার অধিবাসীরাই চাঁদা তুলে ধামের পূজা প্রচলন ধরে রেখেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদি কামাখ্যা ধাম অবস্থিত অঞ্চলটি অতীতে প্রাচীন কামরূপ (রত্নপীঠ) এর অন্তর্গত ছিল। এই প্রাচীন কামরূপ বা রত্নপীঠকে বলা হত তন্ত্র প্রধান দেশ। সেই দেশের অধিবাসীগণ ছিলেন মাতৃতান্ত্রিক এবং তন্ত্রে মন্ত্রে প্রসিদ্ধ। কামাখ্যা ছিল তাদের উপাস্য দেবী। সেই সূত্রে আদ্যাশক্তি কামাখ্যাদেবীর প্রভাব ছিল কামরূপের সর্বত্র বিরাজমান। উল্লিখিত ধামটি বলা চলে তারই একটি নিদর্শন। কোচ মহারাজাগণ ছিলেন আদ্যাশক্তি কামাখ্যা দেবীর উপাসক ও পরমভক্ত। সেই সূত্রে উল্লিখিত ধামটি কোচবিহার মহারাজগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

জনশ্রুতি রয়েছে কামাখ্যা দেবীর নামেই নাকি এই জনপদের নাম হয়েছে কামাখ্যাগুড়ি। ‘গুড়ি’ শব্দের অর্থ অবস্থান। কামাখ্যা এবং গুড়ি শব্দদু-টি মূলত মঙ্গোলীয় শব্দ বলে ভাষা তথা সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। এখানে কামাখ্যা দেবীর অবস্থান ঘটেছিল বলেই জায়গার নাম হয় কামাখ্যাগুড়ি।

এই স্থানের নাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোনো তথ্যসূত্র না থাকলেও ইংরেজ গবেষক ডি. এইচ. ই. সন্ডার্স ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্সের প্রথম সেটেলমেন্ট জরিপের রিপোর্টে ধামটির কথা উল্লেখ করে গেছেন।

তিনি বলেছেন— “There was an idol, kamakhya thakur under a palash tree here. The taluk thus obtained its name- it is entirely under jungle”

এই শব্দগুলি তর্জমা করলে দাঁড়ায়— এখানে একটি পলাধঃ গাছের নীচে কামাখ্যা ঠাকুরের মূর্তি (থান) ছিল। তাই অঞ্চলটি এই নাম লাভ করে।

সন্ডার্সের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রমান হয় স্থানটি অতি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ধাম। ধামের প্রধান দেবী কামাখ্যা হলেও পাশাপাশি আরও আঠারোটি অনুসারী লৌকিক দেবদেবী রয়েছে। তাদের মধ্যে শীতলী, পাগলী, জোকা-জুকি, বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর, মুড়িয়া মাশান, (বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর এরা প্রত্যেকেই মাশান) রাখাল ঠাকুর, বুড়াঠাকুর, ভোটমুনি, সত্যপীর, বাসুকি, মনসা-সহ শিব, গঙ্গা ও লক্ষ্মী নারায়ণ আছে। উল্লিখিত দেব-দেবী তন্ত্রমতে এবং হুজি, অর্থাৎ, তান্ত্রিক দ্বারা পূজিত হন।

ধামের পূজা নাকি এক-দু-বছর বন্ধ ছিল। তার ফলে গ্রামে এক মহামারী কলেরার প্রকোপ শুরু হয়। জানা যায় সেই সময় গ্রামের বহু শিশু ও বৃদ্ধ মারা যান। সে-সময় গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়েছিল। এই মহামারি কলেরার হাত থেকে রক্ষা পেতেই গ্রামের অধিবাসীগণ তৎকালীন গাঁতবুড়া রাজবর রাতার নেতৃত্বে গ্রামের অশুভ শক্তিকে বিদায় করতে ‘হাংসবায়’, অর্থাৎ, গ্রাম পূজার আয়োজন করেন। সেই সময়ই গ্রামের প্রধান দেবী কামাখ্যা-সহ গ্রামের লৌকিক দেব-দেবী ও উপ-দেবতাগণের পূজা করে নদীতে ভেলা ভাসানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য অশুভ শক্তিকে বিদায় করা। সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করে অপশক্তি এবং কু-দৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচতেই, অর্থাৎ,ৈ সামগ্রিক মঙ্গলকামনার্থে মায়ের ভেলা ভাসানো হয়। ফলত তখন থেকেই রীতি মেনে অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে ১১ আষাঢ় প্রতি বছর এই ধামের পূজা হয়ে আসছে। লৌকিক নিয়মে অম্বুবাচি তিথিতে পূজা করা হয় বলেই এই পূজাকে আমোতি/আমতি পূজাও বলা হয়।

ধামের মহাপূজার ১৫-২০ দিন আগে থেকেই বিশেষ দিন দেখে লৌকিক নিয়মে প্রত্যেক দেবদেবীর নামে বাঁশ জাগানো হয়। বাঁশের বিশেষত্ব ১০-১৫ ফুট লম্বা চিকন (সরু) বাঁশ সুন্দর করে মাটিয়ে দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী লাল শালু ও সাদা শালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বাঁশের মাথায় ত্রিশূল বা চামর (চঙর) লাগানো হয়। যেমন প্রধান দেবী কামাখ্যার বাঁশ লাল-শালু কাপড় ও ত্রিশূলযুক্ত। দেবীরই বিকল্প রূপ-মা কালীর বাঁশ হয় অনুরূপ কাপড়ে মোড়ানো মাথায় কালো চঙর (চামর) লাগানো। অনুরূপভাবে আরও অন্যান্য দেব-দেবীগণের নামেও বাঁশ সাজানো হয়। এই বাঁশগুলো তন্ত্রমতে মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে শুদ্ধিকরণ করে জাগিয়ে তোলা হয়। বাঁশ জাগানোর বিশেষত্ব এই বাঁশ জাগানোর পরে কোনো তুলা রাশি ব্যক্তি হাতে নিলে, সেই ব্যক্তিটির ভর জাগে। এইরূপ অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য ধামের পুজোর দিন বহু মানুষের সমাগম ঘটে। বাঁশগুলো জাগানোর পর প্রত্যেক দেব-দেবীর থানে রেখে দেওয়া হয়। অম্বুবাচির আগেরদিন পর্যন্ত বাঁশগুলো নিয়ে গ্রামের আবালবৃদ্ধ মিলে ঢোল-করকা (বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে প্রতিদিন নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন।

অনুরূপভাবে মা বোনেরাও প্রধান দেবী মা কামাখ্যার যোট নিয়ে নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন। মায়ের যোট বহন করা হয় কোনো অকুমারী (?) মেয়ের দ্বারা। বিশেষত অকুমারী মেয়ের মাথায় যোটটি বসিয়ে নগর পরিভ্রমণ করেন এবং মাগন তোলেন। সেই মাগনের চাল বিক্রি করে মূল পূজার উপকরণ সামগ্রী ক্রয় করা হয়।

তেল, সিঁদুর, ধূপ-ধুনা, আতপচাল, কলার থাতি, ফুল, দূর্বা প্রভৃতি উপাচার সহ দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী হাঁস, মুরগি, কবুতর ও পাঁঠা বলি বা উৎসর্গ করে দেওয়া হয়। মহাপূজা হয় প্রতি বছর ১১ আষাঢ় অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে। সেইদিন বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের কাছে মানত করতে। বিশেষত কেউ আসেন সন্তান লাভের জন্য, কেউ-বা আসেন পারিবারিক শান্তি বা রোগমুক্তির দিশা নেওয়ার জন্য। বস্তুত মহাপুজোর দিন একাধিক ভত্তরীয়া ভর জাগেন। সেই ভত্তরীয়ার মাধ্যমে দেব-দেবীগণ ভক্তদের নানা সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন। সেই দিন ভত্তরীয়াগণ এক অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেন। প্রত্যেকেই স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক অলৌকিক শক্তিতে ভর করেন। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য! ভত্তরীয়াগণ অলৌকিক শক্তিতে ভর করে পাঁঠা, কবুতরের মুণ্ড ছিঁড়ে তাজা রক্ত পান করে থাকেন। এইরূপ দৃশ্য দেখে মনে হয় ধামের দেব-দেবী আজও অতি সক্রিয় এবং জাগ্রত।

বিশেষত এই মহাপূজার মধ্য দিয়েই ভেলা ভাসিয়ে ধামের পুজোর সমাপ্তি ঘটানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য সমস্ত আপদ-বিপদ ও অশুভ শক্তিকে বিদায় দেওয়া।

ভেলার বিশেষত্ব, পাঁচটি কলাগাছ একত্রিত করে গেঁথে ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলার বৈশিষ্ট্য মাঝের কলা গাছটি বাড়তি রেখে দুই সাইডের দু-টি করে কলাগাছের মাথা তেড়া করে দিয়ে ভেলার মাথা চোখা করা হয়। ভেলার মাঝখানে নৌকো ঘরের ন্যায় ছই টাঙিয়ে ঘর বানানো হয়। সেখানেই অশুভ শক্তির বিনাশক মহাকালীর পুজো সাজানো থাকে। পূজা করা হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে হুজি, অর্থাৎ, তন্ত্রসিদ্ধ পূজারী দ্বারা। এই পুজোয় পাঁঠা ও কবুতর উৎসর্গ করে বাদ্য বাজনাসহকারে ভেলাটি পালকির ন্যায় বহন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পুজোর পনেরো-কুড়িদিন আগে জাগানো বাঁশগুলোও বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই রীতি আজকের দিনেও প্রচলিত রয়েছে।

ভেলা সাজান এবং তন্ত্রমতে পূজা

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে তৎকালীন মাড়েয়া (ধামের প্রধান) ভগলু রাভার নেতৃত্বে ধামে প্রথম মূর্তি পূজার শুরু হয়। এর পূর্বে শুধু থান বা ঢিবির উপরেই পূজা করা হত।

দেবী সিংহবাহনের উপর শায়িত শিবের নাভিপদ্ম থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মে আসন করে বসা দেবীর ৬টি মাথা, ১২টি হাত, ২টি পা এবং দশ হাতে বিভিন্ন অস্ত্রে সুসজ্জিত। দেবীর দুই পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু দণ্ডায়মান। এইরূপ অদ্ভুত আকৃতির দেবীর পাশাপাশি আরও অনেক লৌকিক দেব-দেবী আছে। তার মধ্যে মুড়িয়া মাশান ও বাগসুর অন্যতম। এহেন লোকধর্মের ঐতিহ্যবাহী ধামের পুজোরীতি মেনে শতাধিক বৎসর ধরে চলে আসলেও সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনোরকম দৃষ্টিপাত করা হয়নি। পায়নি কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পায়নি কোনো সরকারি-অনুদান অথচ এই ধাম বা মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারত পর্যটনকেন্দ্র বা সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন রইল।

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

মনোরঞ্জন উরাও

ওঁরাওদের কয়েকটি উৎসব

কথায় আছে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, ওঁরাওদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটে থাকে। ওঁরাও সমাজের মানুষেরা সাধারণত উৎসব প্রিয় হয়। অন্যান্য উপজাতিদের মতো এরাও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানান সংস্কার ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান পালন করে। ওঁরাওদের কয়েকটি বিশেষ উৎসব হল— করম পূজা, আষাঢ়ী পূজা, বড়ভূত বা মান্‌খা পূজা, সহরাই বা গোয়াল পূজা, পুনামাণ্ডী, সারহুল, ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা, খারিয়ানি ও ফাগুয়া পূজা প্রভৃতি। তবে ওঁরাও সমাজে সমস্ত পুজো পার্বণে ‘ভেলোয়া ফারী বা ডাণ্ডাকাট্টানা’ নামক অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকে। পুজো পদ্ধতি এক এক জায়গায় এক এক রকম হয়ে থাকে। মূলত ওঁরাও সমাজের মানুষেরা প্রকৃতি পূজারি। প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরকে অনুভব করে। এই সমাজের নব্বই সতাংশই কৃষিজীবি। তাই তাদের বেশিরভাগ পুজো-পার্বণ হয় বৃক্ষ এবং ফসলকে কেন্দ্র করে।

করম বা কারাম উৎসব:

ওঁরাও সমাজে একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব হল ‘করম বা কারাম উৎসব’। ভাদ্রমাসের শুক্লাপক্ষের একাদশী তিথিতে এই উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। এটি মূলত প্রকৃতির পূজা তথা গাছের পূজা। করম পুজোর সাতদিন আগে থেকে ওঁরাও সমাজের কুমারী মেয়েরা দাতন ‘কাঠিগেঙে’ নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ বোনা ছোটো টুপা বা ডালা বালি দিয়ে ভরতি করে। তারপর গ্রামের প্রান্তে এক জায়গায় ডালাগুলিকে রেখে ‘জাওয়া’ গান গাইতে

করম পূজা, ছবি: গুগল

গাইতে তিন পাক ঘোরে। এর পর তেল ও হলুদ দিয়ে মোটর, মুগ, ছোলা, কুর্তী ও ভুট্টা বীজ মাখানো হয়। এসব কাজ কুমারী মেয়েরা করে থাকে। একে ‘জাওয়া মা’ বলে।

গ্রামের বয়স্কদের নির্দিষ্ট করা একটি জায়গায় দু-টি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়। যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর বা ধরম ঠাকুর হিসাবে পূজিত হয়। করম পুজোর দিন করম গাছকে নতুন কাপড় পরিয়ে গাছকে আলিঙ্গন করে, ধূপ ও সিঁদুর দিয়ে পূজো করে ডাল কাটার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়। তারপর নতুন কপড় পরে উপবাসী তিনজন যুবক তিনটি ডাল কেটে নিয়ে আসে। একই ভাবে নববস্ত্র পরিহিত তিন জন কুমারী মেয়ে যুবকদের কাছ থেকে ঐ ডাল উপাসনা দেবীর কাছে নিয়ে আসে। ওঁরাও সমাজের পুরোহিত তথা মাহাত সেগুলো নিয়ে পূজা অর্চনা শুরু করে।

কুমারী মেয়েরা করম পুজোর দিনে সারাদিন উপবাস করে সন্ধ্যার পর একটি থালায় ফুল ফল-সহ পুজোর নৈবেদ্য সাজিয়ে করম ডাল যেখানে আছে সেখানে গিয়ে পুজো দেন। ঐ সময় ওঁরাও রমণীরা গানের মাধ্যমে ধরিত্রী তথা বসুমাতা তথা ভূমিদেবীর কাছে প্রার্থনা জানায় যে, এ-বছর যেন ভালোভাবে বৃষ্টি হয়। ফসলে যেন পোকা না হয়। ফসল যেন ভালো হয়। এছাড়াও সকল পরিবারের সুখ সমৃদ্ধিও কমনা করে থাকে। পূজার মাহাত পূর্ব উল্লেখিত ধর্মা কর্মার গল্প সকলকে শুনিয়ে থাকে। সেইসঙ্গে সারারাত ধরে চলে নাচ গান।

পরের দিন সকালে মেয়েরা ‘জাওয়া’ থেকে অঙ্কুরিত বীজ গুলোকে তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়িতে নিয়ে এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম গাছটিকে জলে ভাসানো হয়ে থাকে। পুজোর পরে মেয়েরা পরস্পরকে করম ডোর বা রাখি পরিয়ে দেন।

আষাঢ়ী পুজো:

আষাঢ় মাসে জমিতে বীজ বপনের আগে এই উৎসব হয়। মূলত বৃষ্টির উদ্দেশে এই পূজা করা হয়। গ্রামের সকলে মিলে এই পুজো করে থাকে। আষাঢ় মাসে এই পুজো হয় বলে একে আষাঢ়ী পুজো বলে। ওঁরাও সমাজের বেশিরভাগ লোক কৃষিজীবি। তাই তারা জমিতে হালচাষের আগে ভূমিমাতাকে হিসাবে পুজো করে থাকে। ওঁরাও সমাজের কারো মতে মাটির নীচে থাকা অনেক ছোটো ছোটো জীব তাদের নাঙলের আঘাতে মারা যায়। তাই ধরিত্রী মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই পূজা। এই পুজোর উপকরণ হিসাবে থাকে কলা, বাতসা, আম, কাঁঠাল, জবাফুল, দুব্বা ঘাস, আতপচাল। পায়রা, ছাগল, পাঠাও বলি হয়। এই দিনে ঘর বাড়ি গোবর-মাটি দিয়ে মোছার পর একটি পুরোনো কুলোর মধ্যে ঝাটা, গোবরের তৈরি ঘুটোতে আগুন ধরিয়ে তাতে কয়েকটি শুকনো লঙ্কা ছিটিয়ে বড়োরা বাচ্চাদের গায়ে হালকা ধোঁয়া দেয়। তাদের বিশ্বাস এতে অশুভ শক্তির আক্রমণ থেকে বাচ্চারা রক্ষা পাবে।

পাড়ার মহিলারা (মা অথবা দিদা) সেই পুরোনো কুলোয় ঝাটা-সহ গোবরের ঘুটো রাখা কুলোটি বাড়ি থেকে দূরে ফেলে আসে। তারপর সকলে পুকুরে স্নান করে বাড়ি ফেরে।

সোহরাই বা গোয়াল পূজা:

ওঁরাওদের আর একটি উৎসব হল ‘সোহরাই পরব’ বা ‘গোয়াল পূজা’। সোহরাই পরবটি কার্তিক মাসের কালি পুজোর পরের দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির গৃহপালিত পশু,
দিন পালন করা হয়। বিশেষ করে সেই দিনে বাড়ির

সোহরাই বা গোয়াল পূজোর ছবি, ছবি : গুগল

গৃহপালিত পশু, অর্থাৎ, গোরু ছাগলদের পূজা দেওয়ার রীতিই হল সহরাই পরব। এই দিন সকাল থেকে এই পুজো শুরু হয়। সেই দিন ঘরবাড়ি গোবর দিয়ে মুছে গোয়াল ঘর থেকে বাইরের আঙিনা পর্যন্ত চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। আলপনার মাঝে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সেই দিন গোরু ছাগলদের পুকুরে স্নান করান হয়।

মোটর, ছোলা, মাসকলাই, এবং চাল-সহ সেদ্ধ করা হয়। যাকে ওঁরাওদের ভাষায় ‘দানাভাত’ বলে। পুজোর দিন সকালে গোরু ছাগলকে স্নান করিয়ে সর্ষের তেল মাথায় সিঁদুর দেওয়ার পর দানাভাতের সঙ্গে হাড়িয়ার জল পাত্রে নিয়ে প্রত্যেক গোরু ছাগলকে একটু একটু করে খাওয়ানো হয়। তারপর বাড়ির সকলে প্রসাদ হিসাবে দানাভাত মুখে দেয়।

একটি লাল মোরগ গোয়াল ঘরে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই মোরগের মাংস দিয়ে গোয়াল ঘরে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। ওঁরাও সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই খিচুড়ি বাড়ির সকলের না-খাওয়া পর্যন্ত কাউকেই বিতরণ করা যাবে না। পুজোর শেষে চলে বাড়ির বয়স্কদের হাড়িয়া খাওয়া। এভাবেই পূজা সম্পন্ন হয়।

ডাণ্ডা কাট্টানা বা ভেলোয়া ফারি উৎসব:

ডাণ্ডা কাট্টানা একপ্রকার শুদ্ধিকরণ উৎসব। ওঁরাও সমাজের সবক্ষেত্রেই সকল বিষয়েই পবিত্রতা রক্ষা করে চলা আবশ্যক। তাই প্রতিটি শুভ কাজে তারা ডাণ্ডাকাট্টানা পূজা করে থাকে। নতুন বাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে গৃহপ্রবেশ বা যে-কোনো শুভ কাজের সূচনাতে যেমন নারায়ণ পূজা বা সত্যনারায়ণ পূজা করা হয় তেমনই ওঁরাওরা ‘ডাণ্ডা কাট্টানা’ অনুষ্ঠান করে থাকে।

এই অনুষ্ঠান যে-কোনো দিন সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে করা হয়। ওঁরাওরা তাদের যে-কোনো শুভ কাজের প্রারম্ভে, অর্থাৎ, বিবাহ অনুষ্ঠান, সদ্যজাত শিশুর আঁতুর, শ্রাদ্ধ, করম পার্বনের সমাপ্তিতে ভোর রাত্রে, শস্য ঝাড়াই-এর পর, বাঁধ নির্মান, পুকুর খনন, কুয়ো খনন, গৃহনির্মাণ, গৃহপ্রবেশ প্রভৃতি কাজের সূচনাতে এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। ডাণ্ডা কাট্টানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ধার্মেস (ঈশ্বর), চালা আয়ো (ধরিত্রী মাতা), বিইড়ি বেলাস (সূর্যদেব), তাদের পূর্বপুরুষ ও অন্যান্য দেবদেবীর পুজো করে থাকে।

তাদের বিশ্বাস এই অনুষ্ঠান কেউ না করলে, সে অশুচি থেকে যায়। সমাজের কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা কোনো প্রকার শুভ কাজে কিংবা কোনো পুজো পার্বনে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। সংসারের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রাপ্তির জন্য এবং গ্রহের প্রতিকূল প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য এই শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান করা উচিত বলে তারা মনে করে।

জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও অন্যান্য শুভকর্ম অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার পদ্ধতি যেমন ভিন্ন তেমনই পুজোর সামগ্রী বিসর্জন দেওয়ার নিয়মও আলাদাভাবে পালিত হয়ে থাকে। এই পুজোর প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হল— একটি নতুন কুলা, আতপচাল, উনুনের পোড়া মাটি, একটি দেশি মুরগির ডিম, একটি মাটির প্রদীপ, কাঠকয়লার গুঁড়ো, কাঁঠাল পাতার তিনটি ঠোঙা, আতপ চালের গুড়ি, দেশি মদ বা হাড়িয়া, এক ঘটি জল ও ভেলোয়া কাঠি বা চিরচিটি গাছ (লঙ্কা গাছের মতো ছোটো গুল্মজাতীয় গাছ) ইত্যাদি।

বয়স্ক ব্যক্তিরাই এই পুজোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। গোবর দিয়ে নিকানো পরিষ্কার জায়গায় ওঁরাও পুরোহিত পূর্ব দিক মুখ করে আসন পেতে বসে। তার পেছনে দুই দিকে বসে বয়স্ক ব্যক্তিরা। পুরোহিত নিজের কোলে একটি কুলো বসিয়ে তার মধ্যে আতপচাল ও ডিম রাখে। তার আগে লাল, সাদা, কালো রং ব্যবহার করে নিম্নের নকশা অনুযায়ী ডাণ্ডা কাট্টানার চিত্র আঁকা হয়। এই রং গুলোর এক একটি অর্থ আছে। একটি রং আরাধ্য দেব-দেবীর আহ্বান বা বিতাড়ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ডাণ্ডা কাট্টানা চিত্রের মাঝখানে পূর্ব পশ্চিম লম্বা করে ভেলোয়া দণ্ড রাখা হয়। এই ভেলোয়া দণ্ডের মাঝখানে আতপ চাল গুড়োর ঠোঙাটি রাখা হয়। এর পর ওঁরাও পুরোহিত আতপালের মাঝখানে ডিমটি রেখে মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। পুজো শেষে আতপচাল গুড়ির সঙ্গে ডিম মিশিয়ে উনানের আঁচে সিদ্ধ করে প্রসাদ বানানো হয়। এই প্রসাদ সকলের মধ্যে বিতরণ করা হয় কিন্তু এই প্রসাদ মহিলাদের গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।

ডাংরী উৎসব:

ডাংরী পরবটি ফাল্গুন মাসে কেঁচো মাটি থেকে বের হওয়ার আগে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বয়স্ক বুড়ি ছাগল বলি দেওয়া হয়। ওঁরাও সমাজে এই অনুষ্ঠানটি করে বাড়ির সকলে সুস্থ থাকার জন্য। ওঁরাওরা মনে করে ডাংরী পুজো করলে বাড়ির সকলে রোগ মুক্ত হয়। কালী মায়ের নামে ডাংরী পরবটি করা হয়। এই অনুষ্ঠানের দিন পুজোর সমস্ত উপকরণ একসঙ্গে একটি পাত্রে সাজিয়ে নিয়ে বাড়ির বাইরে খোলা মাঠে গিয়ে পূজা শুরু হয়। পুজোর পর বুড়ি ছাগলের মাংস খিঁচুড়ি বানানো হয়। তারপর খোলা মাঠে নিমন্ত্রিত সকলকে প্রসাদ হিসাবে খেতে দেওয়া হয়। সকলের খাওয়ার পর অবশিষ্ট খাওয়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ওঁরাও সমাজে। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলারা খোলা মাঠে বসেই হাড়িয়া পান করে।

পুনামাণ্ডী পরব:

পুনামাণ্ডী পরবটি অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার আগে করা হয়। বয়স্ক পুরুষরা সকলে মিলে এই পরবের দিন ঠিক করে। পুজোর দিনে ঘরবাড়ি গোবর এবং মাটি দিয়ে মোছার পর আঙিনায় লালমাটি এবং চালের গুড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এই পুজোতে মাটির তৈরি হাঁড়ি, কলসি, ছোটো হাঁড়ি, বাঁশের তৈরি কুলা এবং ঝাটার প্রয়োজন হয়। এই উপকরণগুলো আলপনা দেওয়া স্থানটিতে সাজিয়ে রাখা হয়। তারপর বাড়ির বড়োরা একটি থালায় কলা, বাতাসা, ধূপ, সিঁদুর এবং একটি ধান কাঁটা যন্ত্র নিয়ে নিজের জমিতে পুজো দিয়ে একগোছা ধান মাথায় করে নিয়ে পাট্টায় মারা হয়।

খারিয়ানি উৎসব:

একটি পারিবারিক উৎসব হল ‘খারিয়ানি উৎসব’। খারিয়ানি উৎসবটি মাঘ ফাল্গুন অথবা বৈশাখ মাসে পালন করা হয়। এই পরবে প্রধান উপকরণ হিসাবে একটি সাদা মোরগ এবং একটি কালো মোরগ প্রয়োজন। পুজোর দিন বাড়ির বড়োরা উপবাস করে। এটি পরিবারের নিজস্ব পুজো। ঘরের এককোণে মোরগদুটোকে পুজো করে বলি দেওয়া হয়। তারপর সেই বলি দেওয়া দুটো মোরগ দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দুই জায়গায় খিঁচুড়ি বানানো হয়। কালো মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পরিবারের সকলে খান এবং সাদা মোরগের মাংস দিয়ে বানানো খিঁচুড়ি পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়।

দাসাই কারাম:

দাসাই কারাম উৎসবটি দুর্গাপূজার দশমীর দিনে করা হয়। চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে, হাড়িয়া, ধূপ, সিঁদুর ও তিনটি কলাপাতা ইত্যাদি সামগ্রী প্রয়োজন হয়। দাসাই কারাম পরবটি অনুষ্ঠিত হওয়ার এক মাস আগে থেকে গ্রামের নাচের আসরে ছোটো বড়ো সকলে সন্ধ্যায় খাওয়ার পর ঢোল মাদল নিয়ে নাচ গান করে। এইভাবে একমাস ধরে চলতে থাকে নাচ গান। পুজোর দিন সন্ধ্যা বেলা চালের গুঁড়োর তৈরি তেলের পিঠে প্রসাদ রূপে তিনটি কলাপাতায় করে পুজোর স্থানে রেখে ধূপ, সিদুর, ও হাড়িয়া দিয়ে বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিরা পূর্বপুরুষের নাম উচ্চারণ করে পুজো দেন। গ্রামের সকলে পুজো সেরে তেলপিঠে এবং বড়োরা হাড়িয়া খেয়ে নাচের আখড়ায় সমবেত হয়ে মাদল ও ঢোল বাজিয়ে নাচ গান করেন।

কাড়াভূত পূজা বা মানখা পূজা:

ওঁরাও সমাজের একটি শরীক বা বংশকেন্দ্রিক উৎসব হল ‘কাড়াভূত’ পূজা বা ‘মানখা পূজা’। এই পূজায় প্যারা বা মহিষ বলি দেওয়া হয়। ‘ওঁরাও’ ভাষায় মানখা শব্দের অর্থ মহিষ। এই পূজা সাধারণত এক যুগ, অর্থাৎ, বারো বছর পর একবার করা হয়। এই পূজা কোনো পরিবারে একবার করলে তিনপুরুষ করতে হয় না। এটি একটি শরীক বা বংশের পূজা। বংশ পরম্পরায় এই পুজো ওঁরাও সমাজে চলে আসছে। যে-কোনো মাসের অমাবস্যা রাতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সকলের সুখ, শান্তি, অসুখ এড়ানো, অভাব অনটন থেকে মুক্তি আশায় এই পূজা করা হয়। ওঁরাও মাহান এই পূজা করে থাকে। মাহান মহিষটিকে বস্ করে। ওঁরাও মাহান মহিষটিকে মন্ত্র করে মাঠে ছেড়ে দেয়। তারপর মহিষটি একাই পূজা স্থানে চলে যায়। এভাবেই এই উৎসবটি সম্পূর্ণ হয়। একে খুঁটি পূজাও বলে।

এছাড়াও ওঁরাও সমাজে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু সংস্কারকে কেন্দ্র করে কিছু উৎসব পালন করা হয়। শ্রাদ্ধকর্মের সময় বাড়ির সকল পুরুষ, শিশুর মস্তক-মুণ্ডন করে টিকি রাখা ওঁরাও সমাজের রীতিতে আছে। কিন্তু বর্তমান কালে বয়স্ক পুরুষরাই ছোটো মাপের ঠিকি রাখে। মহিলাদের প্রসবের ষষ্ঠ দিনে বাচ্চাদর মাথার চুল নেড়া করে প্রসূতিকে স্নান করিয়ে সুদ্ধ করা হয়। কাটা চুল কলার ভেলায় রেখে গঙ্গা দেবীর নামে নদীতে, পুকুরে বা ডোবায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর নামকরণের বিচিত্র অনুষ্ঠান পালন করা হয। কলার ভেলায় রেখে জলে ভাসিয়ে মাতৃবংশ ও পিতৃবংশের নামে আতপচাল ফেলে ‘জোড়ালাগান’ খেলে শিশুর নাম রাখা হয়। ওঁরাও সমাজে শুভ ক্রিয়া-কর্মে ধাতুর পাত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। অশুভ শক্তির নজর এড়াবার জন্য শিশুর কোমরে কালো সুতোর সঙ্গে চামড়া, লোহার পাত বা গাছের শেকড় বেঁধে দেওয়ার রীতি রয়েছে। একবছর বয়স হলে কন্যা সন্তানের কান ফুটো করা সামাজিক রীতি। পুত্র সন্তান বিবাহের উপযোগী হলে আগুয়া (ঘটক) মারফত ছেলের পিতা কন্যা বাড়িতে সংবাদ পাঠায়। কন্যার পিতা স্থান-দিন নির্ণয় করে আগুয়ার (ঘটক) মধ্য দিয়ে বিয়ের কথা চলতে থাকে। বিবাহের কথা চলাকালীন কন্যার গোত্র ও ছেলের গোত্র দু-পক্ষেরই জেনে নেওয়া খুব প্রয়োজন। একই গোত্রের বিবাহ নিষিদ্ধ। গোত্র এক হলে ধরে নেওয়া হয় যে, পূর্বে কোনো কালে তাদের পিতৃবংশ ও মাতৃবংশ একই পরিবারের একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান ছিল। কোনো এক কালে তাদের পূর্ব পিতৃবংশ ভাই-দাদা ছিল। গোত্র এক হলে ওঁরাও সমাজের বিশ্বাস নতুন যুবক-যুবতী একই মাতৃ গর্ভজাত সন্তান, অর্থাৎ, ভাই-বোন সম্পর্ক।

সাক্ষাৎকার

১. রবি এক্কা, বয়স ৫০, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

২. ঝারিয়া কুজুর, বয়স ৫৮, গ্রাম ফুলবাড়ি, গঙ্গারামপুর দঃ দিনাজপুর।

৩. অজিত লাকড়া, বয়স ৪৫, গ্রাম কাজীভাগ, তপন দঃ দিনাজপুর।

৪. বন্ধন লিণ্ডা, বয়স ৬২, বালুরঘাট, দঃ দিনাজপুর।

৫. মুংলী কুজুর, বয়স ৪৬, গ্রাম বুধইচ, তপন দঃ দিনাজপুর।

 

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

ভাস্বতী রায়

নন্দোৎসব: দধিকাদো ও পুরাতন রাজবংশী সংস্কৃতির অবক্ষেপ

করতোয়া নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা খ্রিস্টাব্দ পূর্বের প্রাচীন সাম্রাজ্য পৌণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপের অন্যতম আদি বাসিন্দা হল রাজবংশী। সুপ্রাচীন ও কঠোর সামাজিক ব্যবস্থা্র নিগড়ে গড়া কৃষিজীবী এই সমাজে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মপ্রাণ রাজবংশী সমাজের সমস্ত উৎসবে অনুষ্ঠানে জড়িয়ে আছে বেদ পুরাণের আখ্যান কিংবা রাজবংশী লোকপুরাণের কোনো ‘কিচ্ছা’। সমস্ত উৎসব তাই ঈশ্বরকে স্মরণ রেখে। প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনে সেইসব আখ্যান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলেছে রাজবংশী সমাজ। দীর্ঘকাল ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই শ্রুতি কাহিনিগুলোর মাধ্যমে রাজবংশী সমাজে এই উৎসবগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়।

পাশাপাশি বসবাসকারী নানা উপজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে রাজবংশী সংস্কৃতির আদানপ্রদান ও সর্বোপরি বিশ্বায়নের (গ্লোবালাইজেশন) প্রভাবে উৎসব অনুষ্ঠানগুলো তাৎপর্য হারাচ্ছে। আবার কোথাও নবকলেবরে পালিত হচ্ছে কোনো উৎসব। কোথাও-বা বিকৃতি হচ্ছে। বস্তুত বর্তমান সময়ে উৎসবগুলোর অস্তিত্ব সংকটে। তেমনই এক উৎসব হল নন্দোৎসব। বৈষ্ণব মতবাদে দীক্ষিত রাজবংশী পরিবারে এই উৎসব পৃথক গুরুত্ব বহন করলেও সমগ্র রাজবংশী সমাজ এই উৎসবে মেতে ওঠে। এই উৎসবের আগাগোড়া বাৎসল্যভাবের প্রাধান্য দেখা যায়।

জন্মাষ্টমীর পরের দিনের অনুষ্ঠান, রাজবংশীরা যাকে বলে ‘দধিকাদো’। এই দুই দিনের অনুষ্ঠান একযোগে ‘নন্দোৎসব’ বলে অভিহিত হয়। রাজবংশী সমাজে বিশ্বাস, যে, পিতা ও পুত্রকে একযোগে এই উৎসব পালন করা উচিত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উপলক্ষে হয় জন্মাষ্টমী। এই দিন ‘বত্ত’ (ব্রত > বত্ত) থাকা হয়। দিনে উপবাসে থেকে পূজা অর্চনা শেষে নিশি যাপন পালন করা হয়। এইসময় কৃষ্ণের বাল্যলীলাকে সামনে রেখে নানান ভক্তিমূলক গান পরিবেশিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনাম, কৃষ্ণজন্মের নানান ‘কিচ্ছা’ (আখ্যান) বর্ণনা করা হয়। এর পরদিন, অর্থাৎ, নবমীর দিন আনন্দ উৎসব। এই দিন রাজবংশী সমাজে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বছরের অন্যতম আনন্দ উৎসব এই দিন। এই দিন পালনের ক্ষেত্রে রাজবংশী সমাজে বৈচিত্রের শেষ নেই। রাজবংশী সমাজে এই দিনটিকে বলা হয় ‘দধিকাদো’। এই দিনে দধি অর্থাৎ, দই বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমস্ত ক্ষেত্রে। সারাদিন নানান উৎসবে ও আনন্দে ভরে থাকে ছোটো থেকে বড়ো সকলে। কয়েকটি পর্যায়ে অনুষ্ঠানগুলি সমাপন হয়।

ধর্মীয় কারণবশত কিংবা রাজবংশী সমাজ কৃষিপ্রধান হওয়ার জন্য বিশেষত এই দিনে গোরু ও গোয়ালঘরের পরিচর্যা করা হয়। সকালে গোয়ালীঘর বা গোশালা পরিষ্কার করে ধুয়ে-মুছে গোরু বাছুরদের স্নান করিয়ে রাখা হয়। আবার এই ভাদ্র মাসটি রাজবংশী সমাজে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নানান সংস্কারে, প্রবাদে প্রবচনে ভাদ্র মাসের গুরুত্ব উঠে এসেছে। এইসময় সাধারণত কৃষি সংক্রান্ত কাজ বিশেষ থাকে না। সময়ের বেশ আগেই (ধান বোনা) ‘রোয়া গারা’ শেষ হয়ে যায়। পাট ছোলা, ধোওয়া ও শুকোনোর কাজও সমাপ্ত কিংবা একেবারে শেষের পর্যায়ে। তাই কৃষি যন্ত্রগুলো ধুয়ে শুকিয়ে তুলে রাখা হয়। রাজবংশী মতে এই সময় কৃষিকাজ বাদ দিতে হয়। রাজবংশী প্রবাদ অনুযায়ী ‘ভাদরের তের, হাল কিসসি ছাড়ো’।

ভাদ্র মাসে নববধূ যায় ‘নাইওর’-এ, অর্থাৎ, পিত্রালয়ে। এই যাওয়াকে বলে ‘ভাদরকাটানি’। আবার রাজবংশী লোকপুরাণ মতে ভাদ্র মাসে হয় ‘সিং-এর বিয়াও।’ ‘সিং’ বিয়ে করতে যায় দক্ষিণ দেশে। সিংয়ের সঙ্গে ‘বোঝা উভা’, অর্থাৎ, তল্পিবাহক হিসেবে যায় সমস্ত পক্ষীকুল। বিশেষত ‘ঢাডো সারো’ ও ‘ত্যাল সারো’ (দুই প্রজাতির শালিক পাখি)। আবার রাজবংশী বিশ্বাস মতে ‘ভাদই সাতাও’, অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে-বৃষ্টিপাত হয় তাতেই শীতকালের সূচনা। ফলে এই দিন গোরু বাছুরকে স্নান করানোর প্রথা বেশ পুরোনো।

এরপর হয় নন্দোৎসবের মূল অনুষ্ঠানের সূচনা।

সবার প্রথমে হয় স্নান উৎসব। বাড়িতে বাল গোপালের বিগ্রহে দধি দুগ্ধে স্নান করানো হয়। এরপর নানা উপচারে পূজা ও ভোগ হয়। নিরামিষ ভোগে থাকে বিশেষত ‘ঢ্যাপের চালের নাড়ু মলা’ (শাপলা ফুলের বীজ থেকে একপ্রকার চাল হয়) ‘বজ্রার নাড়ু’ (একধরনের বৃহৎ আকারের ভুট্টা) ও তালের রসের তৈরি নানা পদ। এর মধ্যে অন্যতম হল তালের নাড়ু, মালপোয়া, মণ্ডা, তালের পাতিজরা, তালের খিরসা আর সিন্নি। ভোগ নিবেদন হয়ে গেলে শুরু হয় ‘দধিকাদো’ খেলা।

মন্দির প্রাঙ্গনে এই খেলার সূচনা হয়। এই খেলার আসরের এককোণে একটি ছোটো মাটির ঢিপি স্থাপন করা হয়। কেউ কেউ এর ওপরে গোপালের বিগ্রহ স্থাপন করে। দুধ জল দিয়ে এই স্থানে ফল, দই, খই দিয়ে পূজা করা হয় তিনজোড়া ফল আর একজোড়া কড়িকে। তেল ও সিঁদুর দিয়ে মঙ্গল চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। সেই স্থানে চতুষ্কোণ বা গোলাকার করে বিশাল এক অঞ্চলের মাটি কেটে নরম করে রাখা হয়। পুজো হয়ে গেলে ঐ নরম মাটিতে পঞ্চগব্য (দুধ, দধি, ঘৃত, গোময়, গোমূত্র) ঢেলে খানিকটা কাদা বানানো হয়। একে বলে ‘কাদো দেওয়া’। আগে থেকে এনে রাখা জল ঢেলে সম্পূর্ণ অংশটিকে কাদা করা হয়। ‘মারেয়া’ (সংকল্পকারী) বা গৃহকর্তা এর পর ‘খেলানটি’ বা ‘খেলাটু’, অর্থাৎ, খেলোয়াড়দের হাতে খেলার সামগ্রী ফলগুলো তুলে দেয়। এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘কাদো ছাড়ি দেওয়া’। এরপর শুরু হয় নানান প্রকার খেলা। তবে শুরুটা হয় ‘নাইকোল খেলা’ দিয়ে।

উৎসর্গীকৃত নারকেল জোড়ার একটি নিয়ে প্রথম খেলা শুরু করতে হয়। কাদো খেলা বা নাইকোল খেলা দিয়ে কাদো খেলার প্রথম সূচনা হয়। খেলায় মেয়েরা সমস্ত জোগান দিলেও এই খেলা মূলত পুরুষ ও বালকেদের। একটি নারকেলকে ঘিরে শুরু হয় দুই পক্ষের মল্লযুদ্ধ। সঙ্গে শুরু হয় ঢাক ও ‘করকা’-র বাদ্য। একজন নারকেলটি চার হাতে পায়ে আঁকড়ে ধরে আর অপরজন সেটাকে তার হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দর্শক যে-কোনো একটি পক্ষ নেয়। প্রয়োজনে জুটি বেঁধে খেলায় অবতীর্ণ হয়। সকলে প্রবল উৎসাহে এই খেলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মেতে থাকে।

অপাদমস্তক কাদায় গড়াগড়ি করে খেলা হয়। ক্রমাগাত জল ঢেলে কাদার পিচ্ছিলতা বজায় রাখা হয়। মল্লযুদ্ধের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ নিয়ে শুরু হয় বাজি ধরা। এইভাবে নারকেল, ‘জম্বুরা’ (বাতাবি লেবু), পানিকুমরা বা পুর (চালকুমড়ো) নিয়ে মল্লযুদ্ধ হয়। এরপরে হয় কড়ি খেলা। এক প্রতিযোগীর হাতের মুঠোতে ধরা থাকে দু-টি কড়ি। তার মুঠো থেকে সেটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে প্রতিপক্ষজন। এছাড়া ঐ কাঁদায় অনেকে লাউ বা কুমড়োর বীজ ছড়িয়ে দেয়। কে কতগুলো সংগ্রহ করতে পারে তারও প্রতিযোগিতা হয়।

দধিভাণ্ড একটি সমবেত খেলা। ‘নাইকোল খেলা’-র মতো প্রতিযোগিতা নেই এতে। খুব উঁচু দু-টি গাছের মাঝে একটি দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। সেই দড়ি থেকে ঝুলতে থাকে একটি ‘হাণ্ডি’ (হাড়ি)। সেই হাণ্ডিকে পেড়ে আনতে হয় বা ভাঙতে হয়। একের কাঁধে অপরজন দাঁড়িয়ে মনুষের পিরামিড বানিয়ে ঐ উচ্চতায় পৌঁছুতে হয়। এই পিরামিড বানিয়ে ওপরে ওঠার পদ্ধতিকে বলে ‘কলোর গছ’ (কলা গাছ)।

চিত্র ঋণ : গনেশ মান মুখিয়া

বাঁশের খেলায় একটি বাঁশের ‘ঝিক মাঠে’, অর্থাৎ, ডাল-পালা ভালোভাবে কেটে তাতে তেল জল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। সেই বাসের মাথায় উঠে পেরে আনতে হয়ে ওপরে বাঁধা পুরস্কার।

এছাড়াও আরও নানা ধরনের খেলা হয়।

এই অনুষ্ঠানে মাদক দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বর্জিত। বড়োদের খেলা শেষে ছোটো শিশুদের নামিয়ে দেওয়া হয় ঐ কাঁদায়। তারা আপন মনে কিছুক্ষণ কাঁদায় খেলে। মায়েরা দাঁড়িয়ে শিশুর খেলা দেখে। এরপর একের পর এক খেলা চলতে থাকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। সমস্ত রাজবংশী পুরুষেরা এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অংশগ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ‘বেলা’ (সূর্য অর্থে) যেতে শুরু করলে খেলা শেষ হয় ঐ তিনজোড়া ফল ‘গতান’ দেওয়ার মাধ্যমে, অর্থাৎ, ঐ তিন জোড়া ফল ও একজোড়া কড়ি ‘মারেয়া’-র হাতে ফেরত দিতে হয়। নারকেলগুলোকে প্রসাদ হিসেবে রাখা হয়। চালকুমড়ো গুলোকে প্রসাদ হিসেবে রান্না করা হয়। এরপর খেলোয়াড়রা সবাই স্নান করে এসে প্রথমে ঐ নারকেলের ‘পাকা প্রসাদ’ গ্রহণ করে। খেলোয়াড়দের প্রসাদ গ্রহণ হয়ে গেলে নিমন্ত্রিত ও প্রতিবেশী সকলে প্রসাদ গ্রহণ করে। সবশেষে গৃহকর্তা। পরদিন ‘শিতলি সেবা’ ও নিয়মভঙ্গ।

চিত্র ঋণ : সুমিত সা

নানা কারণে এই প্রাচীন ধর্মীয় উৎসবগুলো বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে। এর নানাবিধ কারণ আছে। বর্তমানে নিষ্ঠার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা, বাজি ধরা, আকর্ষণীয় পুরষ্কার এই উৎসবগুলোর অনেকটা অংশজুড়ে আছে। পুরোনো নিয়মগুলির বহু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তন কতটা ভালো, না, বিকৃত হচ্ছে— সে-প্রসঙ্গে বিতর্ক আছে। তবে এই পরিবর্তন বা সংকটের সম্ভাব্য কিছু কারণ আলোচনা করছি।

যেমন—

১) বিশ্বায়নের প্রভাবে ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে, বিশেষত টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভিন্ন ধারার সংস্কৃতির সংস্পর্শে রাজবংশী সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

২) কৃষিপ্রধাণ রাজবংশী সমাজ পূর্বে কৃষিকর্ম ও গো-পালন ছাড়া অন্য জীবিকার সাথে যুক্ত ছিল না। ফলে কৃষিকাজের দিনপঞ্জির সাথে উৎসবগুলোর যোগসূত্র ছিল গভীর। কিন্তু, বর্তমানে বিভিন্ন জীবিকা, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে একপ্রকার ছন্দপতন ঘটেছে।

৩) বর্তমান রাজবংশী সমাজের সেই পরম্পরাগত রীতিকে অনুসরণের জন্য সামাজিক নিয়ম ও কঠোরতা আর নেই। ফলে নন্দোৎসবের মতো উৎসব তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে তা স্বাভাবিক।

সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। প্রতিবেশীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান সজীব সংস্কৃতির লক্ষণ। রাজবংশী সংস্কৃতিও এই ধারা বজায় রেখেছে। রাজবংশী সমাজে বরাবর রক্ষণশীলতার পরিবর্তে আদানপ্রদানের মনোভাব স্পষ্ট। নন্দোৎসব তাই বিলুপ্ত নাও হতে পারে। কে জানে হয়তো নবকলেবরে আরও মুখর হয়ে উঠতে পারে।

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

সঞ্চিতা টোটো

টোটোদের ‘অউচু’

ভারতের আদিম লুপ্তপ্রায় ও উপজাতি টোটো। সম্ভবত খুব কম সংখ্যক জনসংখ্যার জনগোষ্ঠী। এয়ার মাদারীহাট বীরপাড়া ব্লকের টোটোপাড়া গ্রামে বসবাস করে। অন্যান্য উপজাতিদের মতোই টোটোদেরও নিজস্ব উৎসব-পার্বণ আছে। নিজেদের মতো পালন করে। আদিম. অর্থাৎ, প্রকৃতিকে এরা বিশ্বাস করে। এদের উৎসবগুলো হয় প্রকৃতিকেন্দ্রিক।

টোটোদের সবচেয়ে বড়ো পার্বণ হল ‘অউচু’। অউচু একটি উৎসবের ছাতার মতো। এর মধ্যে অনেকগুলো উৎসব পালিত হয়। কয়েকদিন ধরে এই উৎসব চলতে থাকে। ঠিক দুর্গা পূজার মতো। এক-একদিন এক-এক ধরনের উৎসব হয়। অনুষ্ঠানের ধরনও আলাদা আলাদা। উৎসবগুলোতে সবাই মিলিত হয়—

যেমন—

১) দিনাং-দি-ওয়াও

২) গোরো-য়া,

৩) মান্‌কা।

তবে শুরুটা হয় লাঠি-জাং-ওয়া দিয়ে। লা-জাং-ওয়া হল কোনো কিছু পার্বণ শুরু করার আগে সবাইকে নিয়ে ‘দেমসা’ (Gathering place for any religion/social event Or issue related to society) জড়ো হয়ে পার্বণের দিনকাল নির্ধারণ করার দিন। এইদিন কাইজিগন্নু-সহ গ্রামের সব গোত্রের লোকেদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ‘অউচু’-র দিনগুলো ঠিক করা হয়। অনুষ্ঠানে লাচিজাং-ওয়াক কে হবে সেটা সেই দিন গোত্রের লোকেদের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের জানানো হয়। এর পর শুরু হয় আসল অনুষ্ঠান।

গ্রামে বর্ষা আসার আগে থেকে সকলেই মাঠের কাজ প্রায় সেরে নেয়। যেমন— রান্নার খড়ি জোগাড় করা, সুপারি গাছ লাগানো, গাছে সার দেওয়া, ভুট্টা লাগানো, ফসল কাটা, মারুয়া বোনা ইত্যাদি।

বর্ষাকালে মনে হয় যেন আমাদের এই গ্রামে বৃষ্টি একটু বেশিই পড়ে। নদীনালা সবসময় ভরে থাকে। গ্রামের বাইরে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বললেই হয়। তখন টোটোদের দুর্দশার শেষ থাকে না।

আং রো

লাচিজাং-ওয়া-র সাত দিনের মধ্যেই দিনাং-দি-ওয়ার উৎসবের দিন ঠিক হয়। এইদিন সকালের দিকে নিজেরা বাড়ি থেকে দেমসার দিকে রওনা হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকে কাস্তে। তারপর সকলের জমায়েত হলে পরিষ্কারের কাজগুলো শুরু হয়। আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে। অনেকে নিজেদের বাড়ির আশেপাশেও পরিষ্কার করে। এই কাজ সমবেতভাবে হয়। টোটোরা দলবদ্ধভাবে এরকম অনেক কাজ করতে থাকে নিজেদের হিতের জন্য।

এই দিন থেকে সাত অথবা নয় দিন পর ঠিক হয় ‘গোরো-য়া’ পূজার দিন। ‘গোরো-য়া’ পূজা খুব ধুমধাম করে বয়। এতে একটা মোরগ লাগে। সেই মোরগ বলি দিয়ে পূজা করা হয়।

এই পূজাতে পুরোহিত গোত্র অনুযায়ী মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। এবং একসঙ্গে প্রায় একগোত্রের অনেক বাড়ির পূজা করেন একের পর এক একইভাবে।

এইদিন ‘গোরো-য়া’ পূজার পাশাপাশি অন্য দেবতাদের নামেও পূজা হয়। যেমন— তাদেংতি (নদীর নাম), যইপতি (?) ইত্যাদি।

পুজো শেষ না হওয়া অবদি পুরোহিত খালি পেট থাকে। উপবাস করে। টোটোদের বিশ্বাস তাতে এই সমাজের ভালো হয়। এইসব পুজো করা হয় দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। যাতে সেই দেবতার রাগ না হয়। কোনো পরিবারের উপর সেই রাগ অভিশাপ হয়ে না পড়ে এই বিশ্বাসে।

মুরগি-মোরগ বলি দেওয়া হয় দেবতার চাহিদা অনুযায়ী। সেটা পুরোহিতই বলে দেয় কোন দেবতার জন্য কোন ধরনের মুরগী বলি দেওয়া হবে। সে বলে দেওয়ার পর সেই মতো মুরগি দেওয়া হয়। মুরগি বলি দিয়ে সেটিকে রীতিমতো পরিষ্কার করে কয়লার আগুনে পোড়ানো হয়। দেবতার জন্য এই খাবার তৈরি করে কলাপাতা করে উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গকৃত সেই মাংস আমাদের কাছে পুজোর প্রসাদের মতো। একে বলা হয় নাং-সা (Nag-Sa)। এর পর সেই মাংস প্রসাদ হিসেবে টোটোরা গ্রহণ করে।

টোটোর প্রতি বছরের কোনো না কোনো সময়ে পারিবারিক পুজো করে থাকে। এই পূজাকে ‘গোরো-য়া’ বলে। গোরো-য়া পুজো খুব জাঁকজমক করে উদ্‌যাপন হয়। ‘অউচু’ উৎসবেরই একটা বিশেষ দিনে এই পূজা করা হয়। ‘গোরো-য়া’-কে অনুসরণ করে ঠিক তিন দিনের মাথায় পালন করা হয় ‘মানকা’ (Manka) উৎসব।

গারোয়া

‘মানকা’ পূজা করা হয় বিশেষ করে মেয়ের বাপের বাড়ির লোকেদের জন্য। এই দিন বিবাহিত মেয়েরা, তার বাবা আর দাদা-ভাইদের জন্য ভাত দিয়ে আসবে। বেশ আনন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠান হয়। রান্না করা ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মুড়ে বাপ ও ভাইয়ের বাড়ি দিয়ে আসে। মানকা প্রতি বাড়িতেই হয়। এতে সবাই যোগ দেয়।

ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মোড়াকে বলে অঙ-রো (Ong-ro)। ‘অঙ-রো’-র সংখ্যা বাবা ও ভাইয়ের বাড়ির পুরুষের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। আসলে এই দিন মেয়েরা বাবা আর ভাইদের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করে ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার মাধ্যমে।

মায়েরা ভোরবেলাতে উঠেই ঘরে আলো জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে। সকাল হতেই ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার পার্বণ চালু হয়ে যায়। মায়েরা বিশেষত ঘরে বসে অঙ-রোলং-ওয়ার বা কলাপাতায় ভাত মোড়ার কাজটা করে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সেগুলো নিয়ে মায়ের কথা মতো মামার বাড়িতে দিয়ে আসে কাপড়ে মুড়ে। টোটোদের কাছে এই দিনগুলো খুবই আনন্দের হয়।

তারা তাদের প্রতিদিনের কর্মরত জীবন থেকে একটু বিরতি পায় এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাড়িতে একসঙ্গে সময় কাটায়। উপভোগ করে। মান্‌কার আগে অনেক আয়োজন করতে হয়। যেমন— বড়ো উনুন তৈরি করা, হাঁড়ি জোগাড় করা, কলাপাতা কেটে নিয়ে আসা, পরিষ্কার করে উনুনের উপর রাখাই ত্যাদি।

অবশেষে এই দিনটিতে সেই কলাপাতায় কিছু সেদ্ধভাত আর কিছু রান্না মাংসের টুকরো মুড়ে দিয়ে আসতে হয়। সকালের মধ্যেই এই দেওয়া নেওয়া সমাপ্ত হয়ে যায়। কাজ গুটিয়ে নিয়ে। দুপুরটা বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যায় আবার দেমসায় জড়ো হতে হয়।

কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। নির্দিষ্ট গোত্রের লোকেদের দিয়ে। তারপর গান-নাচের পর্ব শুরু হয়। এইভাবে আমাদের আউচু শেষ হয়ে যায় সে-বছরের মতো।

পরের বছরের জন্য আবার অপেক্ষা করতে থাকি…

Categories
2021-Utsob-Krorpotro

জয়দেব বাউরী

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব

ছোটনাগপুর মালভুমির পালামৌ-হাজারীবাগ অঞ্চল থেকে মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পৃথক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দামোদর নদের দুই তীর বরাবর। ছড়িয়ে পড়েছিল কাঁসাই, শিলাই, দ্বারকেশ্বর— এদিকে দামোদর থেকে অজয়ের দুই তীরবর্তী অঞ্চলে। পশ্চিম রাঢ়ের একটা বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে ছিল মুণ্ডারী থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এই জনগোষ্ঠীর পদচারণা। তখনও তারা ছিল পশুশিকারী, গাছের ফল ভক্ষণকারী। বকের মাছ শিকারকে অনুসরণ করে হয়ে উঠেছিল মৎস্যশিকারী। এই জনগোষ্ঠীই বাউড়ী জনগোষ্ঠী।

নৃতত্ত্বের এই সামান্য অনুষঙ্গের প্রয়োজন হল এ-জন্যই যে, মুণ্ডাড়ী জনগোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাউড়ী জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানের বেশ কিছু সাযুজ্য রয়েছে আজও। যেমন— বাঁধনা পরব, কাঠিনাচ, শালগাছের পুজো, মাদল বাজিয়ে নাচগানের অনুষ্ঠান, উলকি নেওয়া, শিকার যাত্রা প্রভৃতি। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠী তার জীবনযাত্রার সুদীর্ঘকালের ধারায় এসেছে বৌদ্ধসংস্কৃতির সংস্পর্শে, আরও পরবর্তীকালে এসেছে হিন্দুসংস্কৃতির সংস্পর্শে। আক্ষরিক অর্থে তারা পরিণত হয়েছে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে। ফলত, তার আদিসত্তা, আদি আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব-সংস্কৃতিতে ঘটে গেছে নানান সংযোজন, সংমিশ্রণ ও বিয়োজন। তেমনি ঘটেছে প্রতি-সংযোজনও। কিন্তু, বিগত শতাব্দীর নব্বই পরবর্তী বিশ্বায়ন হাওয়ায় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে তার সংস্কৃতির অবয়ব। তবে আদি উৎসবের একটি-দু-টি আজও কিন্তু টিকে আছে স্ব-মহিমায়। অন্যগুলি ক্রমে ক্রমে ম্রিয়মান কিছুটা।

আষাঢ়ী পরব

বাউরী জনজাতির মূল পরবগুলো কৃষি ও শস্যকেন্দ্রিক। আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে বর্ষা আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ‘আষাঢ়ী পরব’। নতুন উদ্যোমে ধান রোপণের কাজ পুরোপুরি শুরু করার পূর্বে টানা দু-তিন দিন পরবে মাতে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। হিন্দুধর্মে এই একই সময়ে পালিত হয় অম্বুবাচী। কিন্তু, বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এ যেন আকাশ ও ভূমির বন্দনা। বর্ষা আগমনের আনন্দ উদযাপন। কেন-না, মাটি-সংলগ্ন বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা সেই কৃষি-সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই। এখনও প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখন প্রায় সকলেই ভূমিহীন খেতমজুর, কেউ কেউ ভাগচাষি। তাই ‘আষাঢ়ী-পরব’ নিয়ে উন্মাদনা এতটুকুও কমেনি।

নতুন প্রজন্মের যে-সব ছেলেরা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ হয়ে বাইরে কাজ করতে যায়। তারাও ঘরে ফিরে আসে এই সময়। বাড়িতে আসে কুটুমজন, মেয়ে-জামাই। সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড় কেনার চেষ্টা করে সকলেই। কোথাও কোথাও কালকুদরা, বিসাঁই বা ভৈরবের থানে হয় শূকর বলি। ঘরে ঘরে ভাত পঁচিয়ে মদ রাখে মহিলারা। হাঁড়িয়া। বাখুলে বাখুলে সম্মিলিতভাবে কেনা হয় শূকর। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয় তার মাংস। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কাজ বন্ধ রাখে এ-সময়। কুটুমজন, প্রতিবেশীদের নিয়ে মাংস-মদ-গান-বাজনায় আষাঢ়ী-র আনন্দ উদ্‌যাপনে মেতে ওঠে বাউরী পাড়া। কোথাও কোথাও আষাঢ় মাসের সংক্রান্তির দিন পালিত হয় এই ‘আষাঢ়ী পরব’।

কিন্তু, বিগত দুই দশকে এই চিত্র বেশ কিছুটা বদলেছে। শতাংশের বিচারে অতি নগন্য হলেও শিক্ষার আলোয় আসতে পেরেছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশ। অনেকেই সক্ষম হয়েছে মদের আকর্ষণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে। শূকরের মাংসও অনেকে ঘৃণা ভরে অপছন্দ করে। ফলত পরবের উন্মাদনা একই থাকলেও রুচি ও খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। আবার পরবতী প্রজন্মের যারা মদপ্রেমী তারা হাঁড়িতে রাখা নিজেদের তৈরি মদের প্রতি উদাসীন। তাদের পছন্দ ‘বোতল’। তাই আষাঢ়ী পরবকে কেন্দ্র করে ঘরের মহিলাদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে যে একটা প্রস্তুতি চলত মদ রাখা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তা একেবারেই কমে এসেছে। চল্লিশের কম বয়সি মহিলারা এই শিল্পকর্মটিতে হয়ে পড়েছে একেবারেই অদক্ষ। অবশ্য প্রয়োজনও তো পড়ে না। নিকটবর্তী গঞ্জ থেকে ‘বোতল’ আসে। এখন বাখুলে বাখুলে মাদলও বাজে না আগেকার মতো। নিজেদের গান-বাজনার পরিবর্তে অনেক জায়গাতেই শব্দ-দূষণ ঘটিয়ে অ্যাম্পিলিফায়ারে বাজতে থাকে জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি সিনেমার গান। তবে পরব নিজে আছে পরবের মতো।

মনসাপুজো

ধান রোপণের কাজ সম্পূর্ণ হবার পর কোথাও শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তি কোথাও আবার ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে মনসাপুজো হয়। শুধু বাংলা নয়, সর্পদেবীর পুজো বা আরাধনা নানা আঙ্গিকে ছড়িয়ে রয়েছে সারা দেশজুড়েই। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর মনসাপুজোয় বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করা যায়। প্রতিটি গ্রামে রয়েছে মনসার থান। একমাত্র মনসারই মূর্তি পুজো করে বাউরী জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাড়ায় পাড়ায় খড়মাটি অথবা কংক্রিটের ঠাকুর ঘর রয়েছে একমাত্র মনসারই। অন্য সব দেবতা বা ‘বুড়ি’-র অবস্থান গ্রামের আশেপাশে খোলা-আকশের নীচে, গাছের তলায় বা বনজঙ্গলের ধারে, ঝোপেঝাড়ে।

প্রায় মনসা থানের পাশেই থাকে ভৈরবের থান। মনসার পুজোয় বসার আগে ভৈরবের পুজো করা হয়। পুজোর আগের দিন হয় ‘বার’। হাঁড়ি-বাসন মেজে ‘বেরো’-র জন্য বারের ভাত রান্না করে মহিলারা। দুপুরে নখ, চুল-দাড়ি কেটে, স্নান করে বারের ভাত খায় ‘বেরো’। তারপর উপবাস। ভোরের বেলা সূর্য ওঠার আগে কেউ গুড়-চিড়া খায়। পুজোর দিন সারা বেলা উপবাস করার পর সন্ধ্যায় ঘট নিয়ে পুকুরে যায় ‘বারি’ আনতে। ঘাটপুজো করে জল নেয় ঘটে। সারিবদ্ধ ফিরে আসার সময়ই ভর আসে কোনো-না-কোনো ‘বেরো’-র। পথে না আসলেও থানে গিয়ে আসবেই। কারো উপর ‘ভর’ করে ভৈরবরাজ। কারো উপর ‘ভর’ করে স্বয়ং মনসা! তখন সবল পুরুষরা জড়িয়ে ধরে তাদের উন্মত্ততাকে সামাল দেবার চেষ্টা করে। অথবা থানজুড়ে আছাড়-পিছাড়ি দিয়ে উন্মত্ততা প্রকাশ করতে থাকে। দাঁত কিড়মিড় করে ঢাকিকে বলতে থাকে ‘বাজা’। ঢাকের বাজনা আর ‘ভরণমত্ত বেরো’-র উন্মাদনা! পাশে দাঁড়ানো লোকজন, অন্যান্য বেরোরা বলে ওঠে ‘খেলুক’। উন্মত্ততা থামিয়ে ভরমত্ত বেরো একসময় নিজেই বলতে থাকে নানা ক্ষোভের কথা। পুজো নিয়ে সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টির কথা, পাড়ার মঙ্গল অমঙ্গলের কথা। রাতভর তিনবার পুজো হয়। শেষ পুজো হয় ভোরের দিকে। অর্থাৎ, রাতজুড়ে জাগরণ। এই জাগরণের ঐতিহ্য রয়েছে বাউরী জনগোষ্ঠীর টুসু-ভাদু-মকর পরবেও।

বাউরী জনগোষ্ঠীর আদি ঐতিহ্যের ধারায় গানবাজনা সব পরবেরই অঙ্গ। মনসাপুজোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকে শুরু হত ‘জাত’ গাওয়া। এখন কেবল বার, পুজো আর পান্নার দিন গাওয়া হয়। মনসা-কাহিনির বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে এই গান গাওয়া হলেও নিজেদের অভাব-দারিদ্র্যের কথাও উঠে আসে এবং তা আলাদাভাবে গীত হয় কখনো কখনো। পান্নার দিন ছাগবলি দিয়ে পুজো সম্পন্ন হয়। তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে উপবাস ভাঙে সম্পূর্ণরূপে।

গোয়ালপুজো

ভাদ্র মাসে মনসাপুজোর পরদিনই হয় গোয়াল পুজো। পাঁকুড় গাছের ডাল কেটে খানিকটা কাঠের পুরোনো পুতুলের আঙ্গিকে বানানো হয় ঠাকুর। গোয়ালঘরে টাঙানো হয় শালুক ফুল। খই-মুড়কি-সিঁদুর-কাজল-হলুদ-তেল আর শালুকের উপচারে পুজো করে বাখুলেরই কোনো পুরুষ। ক-দশক আগেও মাদল বা ধামসা বাজিয়ে গাওয়া হত গান। এখন বিলুপ্ত সেইসব গান ও গানের মানুষেরা।

ভাদুপুজো

ভাদ্র মাসের সংক্রন্তির দিন হয় ভাদুপুজো। বাউরী সংস্কৃতির ধারায় অনেক পরের দিকে সংযোজন ঘটেছে ভাদুর। তার একটি জনশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে। দেবী নয় বরং বাড়ির কন্যারূপেই পূজিতা হয় ভাদু। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে কলঙ্গার মধ্যে গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে, কোথাও কোথাও আবার একটি পাত্রের উপর ফুল রেখে এক মাস ধরে চলে ভাদুর আরাধনা। এটি ভাদুর বিমূর্ত এবং আদি রূপ। ভাদ্র-সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে ভাদুর মূর্তি নিয়ে আসা হয় ঘরে। এই মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছে অনেক পরে। বাউরী জনগোষ্ঠীর পঞ্চকোটী, মানা এবং মূলা বাউরীদের মধ্যে ভাদুপুজো নিয়ে উন্মাদনা সবচেয়ে বেশি। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা সংক্রান্তির রাতে ভাদুর জাগরণ করে। ভাদু গীত গায়। পরদিন সকালে দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে বিসর্জন দেয় পুকুরে বা নদীতে। এ-সময় এক ভাদুদল আর এক ভাদুদলের উদ্দেশে করে গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেওয়া চলে।

ভাত বাড়ানো ও বাঁদনাপরব

এটি বাউরী জনগোষ্ঠীর একটি আচার। কিন্তু বাউরী জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু আচারের সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনুষ্ঠান, উৎসব। এই ‘ভাত বাড়ানো’ হয় কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায়। শক্তিদেবী কালিকার পুজোর দিন সকালের দিকে। মেয়েরা রান্নার হাঁড়িবাসন পুকুরে নিয়ে গিয়ে মাজে। স্নানটান করে এসে রান্না বসায়। বাড়ির বয়সে বড়ো কোনো পুরুষ স্নান সেরে এসে সেই রান্নার নানা পদ এক একটি পেনেটি পাতায় সাজায়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদন করে সেইসব আহার্য্য। এই আচারটিই ‘ভাত বাড়ানো’। এ-দিনই সন্ধ্যাবেলায় হয় ‘ইঁজোপিঁজো’। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা পাটকাঠি জ্বালিয়ে, কুলো বাজিয়ে মশা তাড়ায়। পুড়ে যাওয়া পাটকাঠির অবশিষ্ট অংশ পুকুর বা ডোবার কাদায় পুঁতে দেয়।

কিন্তু এই আচারটিই অন্য এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন পরদিনই জাঁকিয়ে বসে বাঁদনা পরব। অন্যান্য আদি জনগোষ্ঠীর থেকে বাউরী জনগোষ্ঠীর বাঁদনা বেশ কিছুটা অন্যরকম। হয়তো-বা বৌদ্ধ-সংস্পর্শ পেরিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুতে পরিণত হওয়ার জন্যই। গোয়ালের সবচেয়ে বয়স্ক গোরুটির শিঙে হলুদ-তেল মাখানো হয় প্রথমে। তারপর গোয়ালের অন্য গরুদের। সব গোরুগুলির সারা পিঠেই আলতার ছাপ মারা হয় বাটিতে কাপড় জড়িয়ে। দুয়ারে কাঁঠাল পাতা রেখে জ্বালানো হয় প্রদীপ। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি গোরুর বিবাহ।

পুরুষরা মাদল বাজিয়ে কাঠি-নৃত্য করে। গান গায়। সেই গানে থাকে কৃষির অনুষঙ্গ এবং অন্য নানা প্রসঙ্গও। পাড়ার মনসাথানে নৃত্য-বন্দনা করে যায় গ্রামের ‘গোলাঘর’ তথা অন্যান্য উচ্চবর্গের বাড়িতে নাচ দেখাতে ও ‘আদায়’ করতে। সেই ‘আদায়’ সংগ্রহ করে পাড়ারই কারো উঠোনে পান-ভোজনে বসে আর প্রায় রাতব্যাপী গাইতে থাকে গান। কখনো ঝুমুর, কখনো ‘ডাঙাল্যা’।

চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-মকর-এখ্যান-টুসু পরব

শস্য খামারে উঠে যাবার পর শুরু হয় বাউরী জনগোষ্ঠীর অন্যতম বড়ো পরব ‘চাঁওড়ি-বাঁউড়ী-মকর-এখ্যান-টুসু পরব’। বাংলা তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রদেশে হয় মকর সংক্রান্তি উদ্‌যাপন। বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব শুরু হয় ‘চাঁওড়ি’-র দিন থেকেই। এই দিন থেকে পরবের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজার থেকে। মহিলারা স্নান সেরে পিঠেপুলির জন্য ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে গুঁড়ো কোটে। অল্পবয়সি মেয়েরা এই দিন বা তার আগের কোনো হাটবারের দিন টুসুর চৌডল কিনে আনে। ছেলেরা অনেক আগে থেকেই ‘মকরকুঁড়ে’-র জন্য খেঁজুরপাতা কেটে মাঠে শুকোতে দিয়ে রাখে। পরব উদ্‌যাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির দিন হল এই ‘চাঁওড়ি’।

পরদিন ‘বাঁওড়ি’ থেকে শুরু আসল পরব। এদিন মহিলারা স্নান সেরে পিঠে তৈরি করে। পুরুষরা ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর প্রস্তুতি নেয়। পাড়ার আশেপাশে ফাঁকা মাঠে শালাপাতা, শালডালে কুঁড়ে বানায় গানবাজনা আমোদ-স্ফূর্তির জন্য। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঢোল-ধামসা-মাদল নিয়ে পাড়ার ‘মরদ’-রা হাজির হয় সেখানে। চালা হয় বাড়িতে রাখা হাঁড়ির মদ। উনোন বানিয়ে বান্না হয় ‘চাট’। শুরু হয় ঝুমুর গান। একজনের একটা গান শেষ হয় তো অন্যজন আরেকটা শুরু করে। ধামসা-মাদলে মাতোয়ারা হয়ে এভাবেই রাতব্যাপী বাঁওড়ি জাগায় বাউরী-পুরুষরা। কিন্তু সংস্কৃতির বিশ্বায়নের হাওয়ায় ‘বাঁওড়ি’ জাগানোর এই চিত্রটিও অনেকটাই কমে এসেছে এখন।

টুসু ভাসান: গুগ্‌ল ইমেজ

বাঁওড়ির বিকেলে আশপাশের ফাঁকা মাঠে বা পুকুর পাড়ে শুকনো খেঁজুরপাতি-পোয়াল দিয়ে ‘মকরকুঁড়ে’ বানায় ছেলেরা; সংক্রান্তির সকালে স্নান সেরে আগুন পোহাবে বলে। এদিন কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এমনকী অন্যান্য জিনিস কারো বাড়িতে ফেলে রাখে না। অন্য কারো বাড়িতে থাকলে তা ঘরে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় ‘দেনি তোলা’ ধান আঁটি থেকে খড় নিয়ে ধান-চালের পুঁড়ো, মরাই, কৃষিযন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসের উপর চাপিয়ে রেখে ‘বাঁওড়ি বাঁধে’। বাড়িতে রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগেই এই বাঁওড়ি বাঁধার কাজটি সম্পন্ন করে নিতে হয়। সকালে মকর স্নানের সময় সেইসব বাঁওড়ি বাঁধা খড় ঘটির ভেতর ঢুকিয়ে পুকুরে জলে ভাসিয়ে আসে। স্নানের পর মকরকুঁড়ে জ্বালিয়ে আগুন পোহায়।

বাঁওড়ির রাত্রেই থাকে মেয়েদের টুসু বা তুষুর জাগরণ। পৌষ মাসের প্রথম দিনই টুসুপাতে অল্পবয়সি মেয়েরা। মাটির সরার উপর সারি দিয়ে বসানো প্রদীপ। মেয়েরা কুমোর ঘর থেকে কিনে আসে এই টুসু। এর পর এক মাসব্যাপী প্রতি সন্ধ্যায় টুসুর গান গেয়ে আরতি করে। অল্পবয়সিদের সঙ্গে যোগ দেয় বাড়ির ও বাখুলের বড়োরাও। বাঁওড়ির সন্ধ্যায় লুচি-সুজি-মিষ্টি-গুড়-চিড়া দিয়ে টুসুর ভোগ প্রস্তুত করে। সারারাত সমবেতভাবে গান গেয়ে টুসুর জাগরণ করে। ‘পহরে পহরে’ পুজো দেয়। কুয়াশা ছড়ছড় ভোর হতে না হতে টুসুকে মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে বাধ বা নদীর দিকে যায় ভাসাতে। এ-সময় একদল আর এক দলকে খানিকটা টিজিং করেই গান গায়। গানে গানে পাল্লা দেয় পরস্পর।

মকরের পরের দিনই এখ্যান। এই এখ্যান দিনেই বনবাদাড়, ঝোপঝাড়ে যে-সব দেবতা আছে তাদের সকলেরই পুজো হয়। মায়ুন্দাবুড়ি, বিসাঁই, কুদরা, বড়াম— এইসব দেবদেবীর থানে ষাঁড়া বলি হয়। মাটি খুঁড়ে পাথর দিয়ে উনোন বানিয়ে মাটির হাঁড়ি-সরায় রান্না হয় ভোগ। মোনোই খিঁচুড়ি। মুনিস-কামিন-মানদ্যার-ভাগীচাষিরা ‘গোলাঘর’ পরিবর্তন করে অন্য ‘গোলাঘরে’ কাজে যোগ দিতে পারে। পুরোনো গোলাঘরে মুজরি-টজুরি বাড়ানো নিয়েও কথা হতে পারে। বাউরী জনগোষ্ঠীর কাছে এই ‘চাঁওড়ি-বাঁওড়ি-টুসু-মকর-এখ্যান’ পরব আসলে এক কৃষিবর্ষ বিদায় এবং আরেক কৃষিবর্ষকে বরণের উৎসব।

ছাতুবাড়ানো ও গাজন

চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে ছাতু বাড়ানো হয়। বাড়ির বয়সে বড়ো পুরুষরা-মহিলারা সকাল থেকে উপবাস করে। ঘর থেকে শাল বা পলাশ পাতায় ছাতু-গুড়-কাঁচা আম নিয়ে পুকুরে যায়। ডুব দেবার পর পেনেটি বা পদ্ম পাতায় সেই ছাতু-গুঁড়-কাঁচাআমের অংশ রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়।

চৈত্র সংক্রান্তির শিবের গাজনে বাউরী জনগোষ্ঠীর পুরুষরা ভক্তা হয়। চড়কে ওঠে। বাণ ফোঁড়ানোর মতো নানা কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে দেবতাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে।

বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দু-টি প্রধান অক্ষ হল— ‘আষাঢ়ী’ ও ‘বাঁওড়ি’। প্রথমটি, সমস্ত সৃজনের উৎস, রাঢ়ের কৃষির সম্ভাবনার প্রধানতম আকর বর্ষাকে বরণ ও তার আগমনে আনন্দ উদ্‌যাপন। দ্বিতীয়টি হল শস্যের পূর্ণতা প্রাপ্তির পর খামারে ওঠা ও শস্যদেবী টুসু ঘিরে আনন্দ উদ্‌যাপন। অর্থাৎ, একটি কৃষি পর্যায়ের সূচনা এবং তার পরিসমাপ্তি এই দু-টি প্রধান বিন্দুতে স্থিত যেন বাউরী জনগোষ্ঠীর উৎসব। অন্যান্য পরবগুলি যেন আনুষঙ্গিক। নানাভাবে তা বাউরী জনগোষ্ঠীর জীবন ও চিত্তকে নান্দনিক উৎকর্ষতা দান করেছে।

ঋণ

১। রাঢ় সভ্যতা— সুনীল কুমার দাস।
২। রাঢ়ের জনজাতি ও লোকসংস্কৃতি— ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা।
৩। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়— ড.অতুল সুর।