Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বর্ণালী কোলে

কাব্য বিবর্জিত কবিতা


কবিতা যে কোথায় আরম্ভ হয় আমরা কেউ কী জানি। গল্প কোথায় শুরু। একঘেঁয়ে
‘ভালো’ ও ‘খুব ভালো’ কমেন্ট লেখার থেকে মুক্তি পাওয়ার মুক্তাঞ্চল কোথায়। যেখানে
অন্তত বৃষ্টির মতো অনায়াস নিজেকে বলা যায়। আঘাত করতে ভয় পাও? সত্য
জানালে তোমার পায়ের নীচের ভূমি চোরাবালুকায় পরিণত হবে ও তার মধ্যে ক্রমশ
নিজে কবরস্থ হয়ে যাবে তার ভয় পাও? তোমার সেই দাপট কোথায়। তোমার সেই
শক্তি কোথায়, যেখানে এক হাতে, নিজস্ব হৃদয়ে ইমারত বানিয়ে অনায়াসে অট্টহাস্য
করা যায়!
তুমি মিথ্যাচারী, এটা মেনে নাও। তোমার বাঁচাও কোথাও অভিনয়, মেনে নাও।


এইটুকু স্বীকারোক্তির পর কবিতার দ্বিতীয়াংশ শুরু। সেদিন দুপুরে তোমার
ঘরে তুমি একা। আকাশ ঘিরে মেঘ। ঠিক যেন রবীন্দ্র-কবিতা, তরুছায়ামসীমাখা,
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা। জানালার বাইরে সবুজ প্রান্তর। দূর-দিগন্তরেখায় বৃষ্টি। ঘন কুয়াশায়
নিবিড়তা। ধানক্ষেতে ঢেউ। ঢেউ বেয়ে বেয়ে সে আসছে। তোমার মৃত বন্ধু। ঠিক জানালার
কাছে এসে দাঁড়াল। তুমি জাল দেওয়া জানালার এপারে বসা নন্দিনী। উলটো রক্তকরবী।
জালের বাইরে রাজা। বহুদিন পর। বৃষ্টি এনেছে। হাওয়া।বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছে কোথায়। এত জল, এত জল। বাপ্তাইজ সম্পূর্ণ তোমার।
এরপর, এরপর থেকে প্রিয় হল ক্রুশ!


যখন জ্বর আসছিল, কেঁপে কেঁপে, বাইরে চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা, আর তুমি তোমার
সর্বাঙ্গ চাদরে মুড়ে নিচ্ছিলে, তখন তুমি পুলকিত কোথাও, তুমি হেমন্তের
জাতক। বাড়িতে তুমি সম্পূর্ণ একা। মাথার পাশে, জল, থার্মোমিটার আর পাইরেজেসিক।
বেহুঁশ তুমি, অথচ রোমাঞ্চিত। কার্তিকের শেষে এনই হিমেল হাওয়া, এমনই শীত
শীত। দ্রুত সন্ধ্যা নামে। প্রদীপের আলোয় মায়াজন্ম, জাতিস্মর ও আলাদিন। কাঁপতে
কাঁপতে আরও চাদর টেনে নিচ্ছে তুমি। আরও গুটিয়ে যাচ্ছ তুমি। অথচ বুঝতে পারছ
কোজাগরী পার হয়ে নক্ষত্ররা স্থির হচ্ছে… জন্মমাস আসন্ন তোমার।


দামী প্রিন্টেড কটন। মাচিং ব্লাউজ।
তার সাজানো গোছানো বাড়ি, সাজানো অশ্বের মুখ সর্বদা পূর্ব দিকে ধাবমান।
কর্তা অফিসে। মেয়ে কলেজ। প্রতিবেশীরা কেউ পাহারায় নেই। দোকানের
খরিদ্দার চলে যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে তড়িৎ, তার
পূর্বতন, বলা যায় তার চিরন্তন প্রেমিক, ওপরে।
তারপর..
খোলা আাঁচল গড়িয়ে লাবণ্য নামে। ঘোড়ার ঈষৎ দিক পরিবর্তন।

আলনায় ভাঁজ করা মেয়ের টি-শার্টের ওপরে লেখা বাণীরা মৃদুমন্দ হাসে… লেস স্লিপ, মোর
ড্রিম।


আপনি বোধহয় নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে কখনও ভালোবাসেননি। অন্যকে ভালোবাসাটাও
তাই একপ্রকার নিজের মধ্যেই ঘোরাফেরা করা। নিজেকে নিয়ে এত থাকলে সুতোর মতো
নিজের মধ্যে জড়িয়ে যেতে হয়। অজস্র গিঁট। খুলতে গিয়ে নিজেকেই কেটে কেটে বাদ।

দেখি আপনাকে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি দূরত্বটাও। দুটো আলাদা নদী। দুটো আলাদা নৌকো। পৃথক
গতিপথ। কখনো কখনো প্রতিবেশীর মতো পাশাপাশি, কয়েক মুহূর্ত। কুশল বিনিময়।
ক্ষণিকের। এইটুকু। দুই নদীর মাঝে পথ। রোদ্দুর ও ছায়া। ওইটুকুই মায়া।

দেখছেন তো, শাড়ি পরে পরে কেমন দীর্ঘাঙ্গী হচ্ছি দিন দিন।
নিজেকে কেবল-ই মনে হচ্ছে ‘সুচরিতা’।
ঠিক ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ। গোরার প্রেমিকা!

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

সুতপা চক্রবর্তী

মাতার আদেশ হয়, পিতা যান ভিক্ষাপাত্র নিয়ে
পৃথিবী ভ্রমিয়া আসি তুলি দেন অন্নপূর্ণা মা’য়ে

রোগের নগর, শোকপল্লী একে একে কালবেলা
মাতার চরণে ঢালি দেন পিতা ব্রহ্মাণ্ডের মেলা

সন্তান সন্ততি সব প্রাচীরের কোণে পড়ে রয়
আকাশ ফাটিয়া অন্ন পড়ে, মানবের ক্ষয় হয়

মাতার আদেশে পিতা মম জগতের আয়ু পান
ভিক্ষার পাত্রটি ঢলে পড়ে শিঙ্গা ভেঙ্গে খানখান

নগর নগরী নট নটী চন্দ্র সূর্য লতাফুল
পিতার বসন উড়ে যায় মানুষের উপকূল

চরণে ভ্রমর আসে, ফুলে আসে মধুরূপী জল
মাতার আদেশ হয়, পৃথিবীর চক্ষু টলোমল

অন্নের সমান ধন নাই, পৃথিবীর পানে চাই
সকলি অলীক! মোহমায়া,মায়া কাটি— কেটে যাই

বৃষ্টিতে আগুন জ্বালি শরীরের বাড়ি বহুদূর
সুরের আবেশে মেতে ওঠে রজনীরা, আহা সুর

বাজিয়া উঠিল জলেস্থলে গাঢ় নিশীথের বুকে
হাজার জোনাকি পাক খেয়ে যায় তীব্র রতিসুখে

ভৈরব নগরী নীলকণ্ঠ পলাশের থোকা ফুল
রজনী সাপিনী ফোঁস করে খুলে তার এলো চুল

রজনী আঁধার চকমকি নুড়ি,কড়ি খেলে যাই
বৃষ্টির আগুন সর্বনাশা জলবাড়ি পুড়ে ছাই

উঠান জুড়িয়া চাঁদ বসে, জলে পড়ে তার ছায়া
জন্মের ভিতরে জন্ম ঘুরে;দেখি সব শূন্য, মায়া…

বৃক্ষের আড়ালে তারা দেখি, জমিনের আঁকা বাড়ি
মাটিতে আঙুল পড়ে জাগে লক্ষ জোনাকির শাড়ি

সুরের ভিতরে কান পাতি, জোনাকির আলো পাই
খাঁচার ভিতরে চেনা পাখি খাঁচাটিকে ভেঙ্গে খাই

নয়ন পথের পরে,চক্ষুগামী হয় স্বর্ণ দেহ
আঁচলে মাসিক ঋতু মুখ ঢাকে, দেখে নাই কেহ

লাজের বরণ খুলি, একে একে গত হয় দিন
মাসিক ফুলের চক্রবাঁকে প্রজাপতি হয় লীন

হাজার রকম ডানা মেলি, চক্ষু খুলি, চক্ষু মুদি
বুকের ভিতর অশ্রু ঝরে পড়ে, অশ্রু দিয়ে বাঁধি

প্রতিটি মাসের শেষে ঘরে পলাশের ফুল ফোটে
আগুন রঙের ফুল দেয় বৃক্ষ, তীব্র বেগে ছোটে

নয়ন পথের দিকে; ধানজমি আস্ত জলাশয়
শূন্যের ভিতরে শূন্য আঁকি, আঁকি অনন্ত হৃদয়

বৃক্ষের গোড়ায় জল দাও, মাসিকের দাও পানি
আঁচলে সুপুরি বাঁধি,চক্ষু খুলে কড়ি দিয়ে কিনি

সোনার শরীরে লালফুল ফোটে, মুখ রই ঢেকে
নয়ন পথের স্বর্ণ দেহ ছাইচাপা পড়ে থাকে

থামতে চাইনি আকাশের মাঝে; একদল পাখী
ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখে গেলো আমাদের আঁকিবুঁকি

বনের ভিতরে বৃক্ষ পুঁতি, লুকলুকি তুলে খাই
পাখীরা আমার সই হয়, আঁচলের তলে ছাই

শেফালি ফুলের লক্ষ তারা ভোররাতে ফুটে রয়
বাঁশের সাজির সারা গায়ে মৃদুমন্দ বায়ু বয়

উঠানে বালক উঠে আসে, বালিকারা আঁকে ছক
মাটির উপরে পাথরের টান, তেঁতুলের টক

কর্মের পুরুষ পূজা পেয়ে যান লক্ষ্মী বারে বারে
মাটিতে চালের গুঁড়ি দিই, জন্ম যায় দূরে সরে

রাতের আঁধারে বনশিশু, নরশিশু সাথে খেলে
রজনী সাপিনী ফোঁস ফোঁস করে এঁকে বেঁকে চলে

গহীন বনের গাঢ় ঘরে পৃথিবীর ঘুম পায়
জন্মের সমান মৃত্যুসখা মম জন্ম খেয়ে যায়

আলোর প্রদীপ নিয়ে বসে আছে মহাকাল পিতা
চরণে ডমরু তাঁর বেজে ওঠে রুনুঝুনু; মাতা

আসিলে বৈঠক বসে, মেনকার পুত্রী ভাত খায়
মাটির গেলাসে ব্রহ্মান্ডের ছায়া পড়ে, থালা যায়

সরিয়া; মেনকা পুত্রী তিনি আলোফুল শিবজায়া
চৌদিকে রন্ধন বাটী কৈলাসের বঁধূ মহামায়া

গরাসে গরাসে ভাত তুলে মুখে দেন; গালভরা
পানের ডাবর; পৃথিবীর চোখ ছলোছলো, হারা

মণির ভেতরে বসে আছে পিতা, মহাকাল ঘোর
আলোর প্রদীপ তার নিভে আসে তপ্ত বালুচর

মাটির থালায় ভাত ওঠে, পেটে ওঠে নাড়ি ধন
মেনকা পুত্রীর চোখে জল আসে, আসে শুভক্ষণ

আলোর প্রদীপ নিয়ে, ব্রহ্মাণ্ডের ছায়া পড়ে, হায়!
চরণে ডমরু তাঁর রুনুঝুনু বাজে— বেজে যায়

 

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

রাজীব দত্ত

পোড়া মাটির গজল


দেখলাম, ছাদে; গাছের ছায়া, তার ভিতর একটা বিড়াল রোদ পোহাচ্ছে। এই যে গাছ, আমি তার বাঁকা হয়ে নামা ডালে একটা সাপ ভাবলাম। উড়কাপোড়া সাপ। সাপের হিস হিস শব্দের অনেক দূরে, গাছের গোড়ায় একটা মেয়ে। বোবা

সাপ, বিড়াল, মেয়ে কেউ কাউকে চিনে না


আলো চেটে চেটে খেল একটা সাপ

সাপটা অন্ধ


ফুলের ছায়ায় যারা দাঁড়িয়ে আছে
তাদের চিনি না

ফলের পাশে যারা তাদেরও না

না চেনার অহমে দাঁড়িয়ে একটা ছবি ভাবছি
যার শিল্পী ছবিটাকে এখনো দেখেননি
অন্ধ বলে, বিকেলে

আমাকে ও শিল্পীকে পাহারা দিচ্ছে ফুল ও ফল
বাগানের বাইরে নিয়ে যাবে বলে


খোলা চিতার ছাই ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়

বৃষ্টি আসুক


সংঘবব্ধ আলো তোমাকে ঘিরে রেখেছে
তুমি বাড়ি ফিরবে কীভাবে?


একজন ছাতিম গাছের নিচে
অত্যন্ত একটা মানুষ

ভাষা শিখছে

যাতে সহজ হতে পারে


পায়রা নামল ধানে;

একটা গাওয়া গান ঈশ্বর খুঁজতে বেরুলো,

রোদের ভিতর—

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

ধ্রুবন সরকার

ব্রেইল-এ লেখা আমলকি গাছ


এই যে সব ফেলে আসি বারবার, তোমার কাছে… রাত্রির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখি, শ্লোগান, শেষমেষ ধোঁয়া আর পুরোনো আগুনে… ঘরে রাখা মাটির কলসি, ঘট, উল্টে গেছে । ডানায় বীজ-শব্দ, ভাগ হওয়া ক্ষুধা। দু-তিন বার ডুবে গেলেও অবৈধ লুকোচুরি, খেলার ঝোঁক। আমি সব পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে ফেলছি তোমার থেকে, সব আতরের দাগ, আদরের ক্ষত, চাঁদের নদী-মোহনা, আমার আশ্রয়। সূর্য পুড়ে পুড়ে কালো হচ্ছে, আমার কনুই। ডালের গায়ে গেঞ্জিটা মেলে দিলাম, গলার কাছে ছেঁড়া। কমলকুমার ছবির খাতা থেকে রং ঢেলে দিয়েছেন। আমার দু’হাতে ভোরের অন্ধকার, পেনসিলের শিষ। সিঁড়ি-ধোয়া জল গড়াচ্ছে উঠোন, সদর দরজায়। আমি পুরোনো তারা খুঁজছি, আলো। দোর-খোলা নদীর জল পূর্ণকুম্ভে, একা। বটতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ব্রিজের দিকে মুখ করে ঝগড়া করছি তোমার সঙ্গে। বন-জঙ্গল, ঘাস-লতার নীচ দিয়ে চাঁদের ছোটো ছোটো কালো দাগ হেঁটে বেড়াচ্ছে। সারা দুপুর ভেবেছি বৃষ্টি আসবে, তোমার মতো তারাও আজ কতটা বাগানের গাছ আর কতটা মাটি ভিজবে, তার হিসেব মেলাতে মেলাতে চলাঘর এঁকেছে, টিনের তোরং। মাঝরাতে যখন তোমায় এসব লিখছি, দু’চোখের পাতার শিশির অজানা পাথরে, চুপিসাড়ে নিয়মের ভাগ চিহ্ন আর বিয়োগের যত কাল দেশ, একক অনুমানে, শরীরের ডালপালায়। রাতচরা পাখিটা এইমাত্র দৌড়ে গেল, তোমার এদিক-ওদিক। নতুন যে এল তোমার জীবনে, বলেছ তাকে আমার কথা? কেমন ভালোবাসতে আমায়? কেমন ধোয়া হাতে তৃষ্ণার জল, রঙচটা মিনার বেয়ে ফেনাভাত। দুপুরের আঠালো রোদ আর বাটি-পোস্তর সুঘ্রাণ এখনও প্লাস্টিকের টেবিলে, বড্ড টানটান। মধ্যমার কুয়াশা সরিয়ে পাখির পা পড়েছে, তৃতীয় মনে। শূন্য চোখে সব হারানো গান শোনা যায়। আজও তুমি আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলে না, কোথাও। আজও আমি বৃষ্টির কথা ভেবে, খেয়াঘাট, নৌকোর সম্পর্কে। আর ঘেয়ো মনের ওপর দাঁড় এঁকে চলা ডিঙিটা… ভেসে যাচ্ছে, তুমুল প্রশ্রয়ে।


আমাদের কাছে একা হয়ে যাওয়াটা আসলে কিছু নয়। আমরা তো একাই, ঘুরতে ঘুরতে প্রবাহ, প্রবাহের ক্ষয়ে লম্বা ছায়া… ফুল, সুগন্ধি… সূর্য যেদিকে অস্ত যায়, সেদিকেই হেঁটে গেছে। এসব আসলে তেমন কিছু হয়ে ওঠে না কখনও। আমরা সবাই ঐদিকেই হাঁটি… ঘুম না এলে স্লিপিং পিল… পিল ভাবলে আরও কিছু মনে হয়। টুপটুপও পিল নিত… আমরা দুজন একসঙ্গে অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর। না ঘুমোনো রং বলতে আলোধোয়া খয়েরি। আচ্ছা, খয়েরি আর বাদামি খুব কাছাকাছি, তাই না? না হলেও কিছু যায়-আসে না। তবে, বিস্কুটের রঙে ভেজা একটা দিন… নিজে অদৃশ্য হয়ে ভাবি… চারকোলে আঁকা কালো-সাদা ঘুম, কানের লতি বেয়ে নেমে আসছে আলো, আশ্চর্য ত্রিপলের কোণ, ভেজা ছাদ, জলঢোড়া। পাশে মুখচোরা মস্ত গর্ত, ভেতর থেকে লাজুক বাঁশ মুখ বার করে রেখেছে। শুধু কালো গর্তটাই ছবিতে রয়েছে, আর পিল না খাওয়া পাখির পালক। এটাও তেমন কিছু নয়, আসলে পালকের পাশে মরা পাখিটার শরীর পড়েছিল।

দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে যায়, কুড়িয়ে নেওয়া যায় না। রবীণদা যেদিন চলে যান, সেদিনও আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। আগের রাতগুলো পোড়া মনসাপাতা যেন। আকন্দ গাছে থোলো থোলো অন্ধকার। অন্ধকার মানে কতগুলো কাকের গায়ে-গা দিয়ে বসা। বর্ষার দিনে ছাতা উপুড় করে তাতে জল ধরেছি, কাগজের নৌকো ভাসিয়ে যন্ত্রণার স্বাদ, তাড়না, আঙুল ডুবিয়ে প্রতিসরণের দূরতর দেশে ইউটোপীয় উপাদান খুঁজে চলা। জীবনের অন্তর্গত নৌকোয় যেতে যেতে ভেবে নেওয়া, যে আমার পাশেও একজন শুয়ে আছে, জলের ওপর, যার বুক বলতে ঢেউয়ের ওঠানামা। যদি মনে করি এসবও কবিতা, তবে অবশ অংশেরা দু-চারটে গাছ, শখের ছবি, শব্দের ছবি। সেসবের অনুলিপি করবে বলে, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন।

এসব তেমন কিছুই নয়, হারিয়ে যাওয়া বিন্দুর স্বর, আবীর। সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, কিভাবে কান্না থামাতে হয়। ছায়াপথ অন্ধ মানুষদের হাতে পর্বতের ভাষা, কালো সামুদ্রিক রং, বৈভবে শিস দেওয়া দেওয়াল গেঁথে দিয়েছে।


এখন রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে না, আজ থেকে তাই একটা খেলা খেলব ঠিক করেছি। লেবুপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পেছনের বাগানের পাশে সব ভুল শুধরে নেব। জুতোর ফিতের কাছে পাঁজরের কত হাড় পড়ে থাকে। রেলে-কাটা মানুষের পা খসে যায়। চিতা থেকে গড়িয়ে গেলে, আবার ধরাধরি করে তাকে কাঠের বিছানায় শুইয়ে অর্ধেক ব্যথার কথা মনে করিয়ে দিই। ভ্রূজোড়া ঠোঁটের নীচে রেখে চুমু খায় টুপটুপ। আমাদের পেট-বুক জুড়ে আজ ঐকিক নিয়ম। লেবুপাতার রসলাগা মধ্যমা চুষে চুষে আরও বেশি তেতো স্বাদ।

আজ নিঁখুত একটা গন্ধ উড়ে আসছে কোথা থেকে… নিয়মের সূত্র… সূত্রের ঘাম… ঘামের ফোঁটা…


ছায়া আমার চেয়ে অনেক দূরের স্বর স্পর্শ করে। ঝোপের শব্দ আর বুনো রং শুঁকতে শুঁকতে ভাবে, বুকের ভেতর ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে যাওয়া মাছরাঙার গন্ধ হাতের তালুতে ঘষে নি-ই। লন্ঠন ভেবে কত কিছুই তো জমিয়ে রাখলাম… করুণ আলোছায়া, তেলরং। টুপটুপের ভালো নাম ছিল আলো। গর্তে ফিরে যাওয়ার আগে সে প্রতিবার শাড়ি ও আকাশের মুদ্রা আঁকত, খেজুরপাতার ছায়া।

রং ও রেখা বেড়ে চলেছে, পাতার ঘুমও। এখন রোদের চোখের দিকে চাইলেই বুঝি কালো শেকলের নীচের জবা গাছটা কেন চোখ বন্ধ করে। জামগাছের হাওয়া কবরের আলগা মাটি অক্লেষে ছুঁয়ে যায়। ঐ তো, তোমার পায়ে আটকানো কুয়োতলার ছায়া, ছিঁড়ে ছিঁড়ে, স্নান সেরে ভেসে যায়। কপালে জপমন্ত্র ঠেকিয়ে মা অন্নত্যাগ করে, গঙ্গার দিকে মুখ ক’রে… দু-মুঠো আতপ চাল। বাবা চলে যাওয়ার আগে থেকেই মা সাদা কাপড় পড়ছে, সমরকাকু মারা যাওয়ার পর। পাশ দিয়ে জিওল মাছ লাফিয়ে যায়, মাছওলার সাইকেলের হাঁড়ি থেকে। চোয়াল শক্ত হয়ে কুড়িয়ে আনা কাঠ… উল্টোরথের ঘোড়ার জিন টান দিয়ে ফিরে যায়, ডাকে না। রোদের তেজ বাড়লে লাল্টুদের পেয়ারা গাছে দুটো শালিক এসে বসে, আর মা-এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, রোমকূপে জোড়া আঁশের মতো। আমি দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করি। যেসব দিনে পেট নরম হয়, ওই গাছের কচি পাতা সেদ্ধ করে জল… বাঘছালের রং। বাসি মুখে অর্ধেক জল , দেওয়ালে ঝোলানো চৈত্র-রাত। ঘুমের ওষুধ প্রিয় আঙুলের মতো, ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সাইকেলের রডে জড়িয়ে থাকা রোদ হয়ে, কালস্রোত আর হাতের আঙুলের ধূসর ঝোলায়।

সেদিনও ছিল একলা বৈশাখ, সকালে ফোন করেছিলাম। টুপটুপ বলেছিল, আজ যখন প্রথম তোমার ফোন এল, সারাদিন না-জানি কতকিছু…। আর ঐ দিনই বাবা চলে গিয়েছিলেন। একটা ছোটো ছবি আমায় দিয়ে বলেছিল, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বাঁধিয়ে দিও। পারিনি। যতবার ছবিটা বড়ো করেছি ততবার সূর্যমুখীর প্রতিটা পাপড়ি কুঁকড়ে গেছে। আমরা আবার কি হারাব, বলো? চুলের দশদিক ধুয়ে গেছে চালধোয়া জলে। শ্বাস নিচ্ছি… জপের চেয়েও নিঁখুত পরম্পরায়, আয়নার বিন্যাসে। শ্বাস ছাড়ছি, নিয়মিত ভেদহীন এক কুঁড়ে ঘরে। আলো সেখানে বেড়ার ফাঁকে, মাটি স্পর্শ না করেও… ধুলোর কাছে, পর্দা ও পুরুষে।

তার চেয়ে আমার ঘুমের অসুখ-ই ভালো। প্রতি ঘোষ-অঘোষ বর্ণ জলের মতো ভেসে যাবে, চিহ্ন বদলাবে ঘোড়ার পিঠের। টুপটুপের কালো শাড়ির আঁচলে পীতরক্ত, গিঁট বেঁধে রাখা। নিজের চেয়ে আপন কোনো ভষ্মাধার খুঁজে পাইনি কখনও, যা অনন্ত আশ্রয় হতে পারে। তুমি অনেক নদীর কথা শুনিয়েছ, অনেক বয়ে চলা… তাদেরও খুঁজে পাইনি। আমি পৌঁছনোর আগেই পথটা শেষ হয়ে গেছে।

প্রতিদিন একটা বুনো পাথরে দাঁড়িয়ে আমার ফিরে চলা দেখি। দূর থেকে মনে হবে রিলিফ স্কাল্পচার, ধানের শিষ। অজস্র আশ্রয় মিশে আছে দূরশব্দে। আগাছার আঙুলগুলো এবার ছড়িয়ে পড়ুক ঘরময়। কত বছর বাদে আজ তুমি চেয়ার টেনে বসলে, ভারী বোতলের চওড়া বুকে কলমির দাগ। তোমার যন্ত্রণা টানটান সেলোফেনে মুড়ে চোখের স্নায়ু, হাতের পাতা আলাদা করে রাখছি। কে তবে প্রিয় বলো, ভেজা হাওয়ার শব্দ? অর্ধেক নদীকথার ফুসফুস? সেই কালো শাড়িটার মতো যে রঙমুক্ত একফালি পাল্লা ফাঁক করে রেখেছে? ফিতে বাঁধা ব্লাউজটা, ওর সাথেই তো পড়বে ভেবেছিলে? আর তাই বিকেলবেলা বেড়িয়ে স্টেশনধার… সারা রাস্তা আমরা জেগেছিলাম। সেদিন সবুজ রং কিনেছিলে বোধহয়। আর দড়ি বাঁধা পিঠ। কালো শাড়িটার সাথে মিলল না বলে পড়াও হয়নি।

আমার পা পিছিয়ে যাচ্ছে, তোমার ধুলোয়। শরীরের জয় পরাজয় ভেবে তুমিও বর্ণহীন। শ্রেয় রেণুশ্লোকে মেলে ধরেছ আঁচল, আমি ডুব দিইনি।

আজ উৎসর্গের পাতায় সব ঘুম ডিঙিয়ে বলো… সিন্ধুজল, আর মৃত পাখির পালক। চোখ আটকে যায় তোমার পুনর্যাপী ঘরে। সেখানে আজও নিভিয়ে দেওয়া আলো, তাসের দেশ আর তোমার কালো শাড়িটার রং পড়ে আছে।


আমাদের হাতের অমলতাস আর সঙ্কীর্তনের যাদব ফকির এক মানুষ নন। পঞ্চভুবনের আচার সংস্কারে আমি অনেকবার তার মুখের দিকে চেয়েছি। নাট-মন্দিরের সব নকশায় সে কাঁচা-পাকা ধানের ভেতর ঘাসপোকার আলপনা খুঁজে পেয়েছিল। চৌপথি থেকে ডানহাতের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূরের মন্দির-ঘরে ঘন্টার আওয়াজ। রোজা রাখার দিনেও কাছে গিয়ে শুধু ত্রৈরাশিক গুণ, চিহ্ন, ভাগের অবশেষ আর সিঁড়িভাঙা অভাবি সর্বনাম… নিজেকে খুঁজে খুঁজেই দিন শেষে অন্তরীণ দাহ নিয়ে ফিরে যায়। জোড়া পাঁকালমাছ বৈশাখের জ্বরে ঘোলা চোখে চেয়ে দেখে, আমার কুশের আংটি দে-ঘাটের ধাপ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে… কলাপাতার ছেঁড়া ডোঙায় আতপ, কলা, কালো তিলের চটকানো মণ্ড নিয়ে। যারা শেষমেষ শ্মশানগাছে পায়রার দল খুঁজে পায়, মাজারের পাশের জমিতে কিরিচ ও তন্তুজ অভ্যাসে পাঁচিল গেঁথে রাখে, তারাই হাতের রঙিন কাচ টুকরো টুকরো করে কবরের চারপাশ সাজিয়ে দেয়। আমপাতায় আলতারং, পাটি বিছিয়ে তার ওপর খোলা পিঠ, দাঁতের দাগ, জরির শব্দ… কম পাওয়ারের আলো জ্বেলে। মরা সাপের দেহের মতো লম্বা হয় রাত।

নিরন্তর অন্ধদিনে ক্ষুরের আড়াল ধরে ধরে আমার বড়ো হওয়া। জানলা খুলে বসেছি, নিঃশঙ্ক ভয় আর সংকটে গা পুড়ে যাচ্ছে। উত্তরের পাহাড়ের গায়ে একটা শালগাছ জন্মেছে। অবৈধ। গোপনে বলে এসেছি তছনছ হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারে এবছর কোনো জন্মদিন থাকবে না, কোনো ভুলের চিহ্ন। অন্ধকার ঢুকে পড়েছে খোপকাটা ঘরগুলোয়। আজ আওয়াজের চেয়েও তীব্র টান অনুভব করছি কমলকুমারের ছবির খাতায়।

বাঁকা সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কামিনীর ঝোপ। গাছের শেকড় গা থেকে নীচের দিকে ঝুঁকে তারপর মাটির ওপর দিয়ে সহজিয়া ভঙ্গিতে…। ফিঙেটা নাচতে নাচতে আড়াল থেকে বেরিয়ে কী যেন খুঁটে নিচ্ছে… পাতা ও আমার নির্লিপ্তি। বিউগল ফেলে ছিঁড়ে যাওয়া ঝিল্লির স্রোত সরল আত্মরতি ভেঙে ভেঙে ছাইয়ের গাদায় নাভিকুণ্ড খোঁজে। তুমি যা চেয়েছ টুপটুপ, আমিও কি তা চাইনি? মাটির অন্ধকার, কনকনে রক্তজাল, পৌরুষে বিষয়ী হয়ে ওঠা মেঘ, অলৌকিক মায়াধ্বনি, দীর্ঘ অভ্যাসে অনিদ্রা ছুঁড়ে দেওয়া নির্জন গলি, ধোঁয়ার গাদ, সেঁকোবিষ। ছায়া বেয়ে ওঠা জলের নীচে আমাদের সংসার, নহবত বাজিয়ে। জলে ডুবে নেই ভেবে নারী ও নক্ষত্রের ঘট ভেঙে যায়। পূর্ণগ্রাস আছড়ে পড়ে একরোখা শালুর আঁচলে।

এমন বিকেলে তোমার বুকে হাত রেখে কেঁপে উঠেছিল আকন্দের ডাল, যেন যত্ন করে বাঁধিয়ে দিয়েছি আমাদের ফুলের দিন, মেঘে আসা জল। তুমি আমার চেয়ে আরও আগে থেকে কষ্ট পাও, করবী আঠায়। আজ যদি সত্যিই বৃষ্টি হয়, সেই জলে ধুয়ে যাবে গোয়ালঘর। মাঠ খুঁজে নেওয়া মেথি ফুল স্নান করবে। তোমার শরীরে ফসল ফলবে আজ, যা আমি খেয়াল করিনি, মুখ বুজে আসা বর্ষার দিনে।

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

অর্ণব রায়

সংসাররাত্রিকোরাস

রাতের প্রথম যামে মার্জারপ্রভাতগীত,
মৎস্যঅন্নলোভে দরোজা আঁচড়ায়ন ও প্রবল লুটোপুটি,
তৎসহ যে রাগিনী গৃহস্থের দুয়ারে অনুষ্ঠিত হয়
তার দর্শক ও শ্রোতা কিছু শুকনো পাতার ওপর একটি বিপুল ব্যাঙ
আর প্রবল প্রতাপশালী রাত। পাহারাওলাদের শ্বাসবায়ু
হুইসেলে, হাত সাইকেলে, নজর গৃহের দিকে থাকে। তারা
ধর্তব্যের মধ্যে নেই।

অনুকম্পা নিতান্ত সুলভ। সকালেই পাওয়া গেছিল। ভাত
ও দুধের রূপে। এখনও পাওয়া যেবে। পায়ে মুখ ঘসাঘসি ওলটপালট
ইত্যাদি কিছু সঙ্গত লাগবে। তার আগে কিছু আরশোলা টিকটিকি
পোকা ও ইঁদুর। রাতের প্রথম যামে
শিকার ও শিকারীর যৌথসংগীত।

দ্বিতীয়ার্ধে নিদ্রাকর্ষণ। অন্ততঃ চেষ্টা। না আসে তখন ব্যবস্থা
অন্য। ইতিমধ্যে কোলাহল আলাদা মাত্রা নিয়েছে। কিছু বালক মার্জার সহ
একত্রে মনোবাসনা ব্যক্ত করতে চায়। সঙ্গতে টিকটিকি। বালকদের শিশুটি
বেড়ালের মৎস্যটি সংসারের দুধের বাটিটি— একসাথে বেজে চলেছে
দরোজার ওপারে।

পৃথিবীর কোনও ফাটলবশে মায়ায় চড়ে এরা আসে। গৃহস্থকে দায়ী
করে অকালে চলে যাবে বলে বুঝি— এরকম বুঝে নিদ্রার বুকের
কৃষ্ণবর্ণ কুঞ্চিত লোম ধরে টানাটানি। বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগে অভিভূত হওয়া।

নববিধান, সুসমাচার


ভিক্ষান্নে কি জীবন বাঁচে? তাই দু-চারটে হত্যা, মা।
প্রতি শনি-মঙ্গলে লোকালয়ে আসতে হয়। গুরুর আদেশ।
তাছাড়া সেলাই করা কাপড় পরতে মানা। না মা,
আমাদের গেরুয়া নয়। গেরুয়া সব মঠ মিশনের। আমাদের
এই বর্ণহীন। না, সাদা না, কালো না। বর্ণহীন।
হ্যাঁ, রক্ত লেগে যাবার ভয় তো থাকেই। তাছাড়া
আজকাল এত মানুষ বেড়ে গেছে! খুব সাবধানে
চলতে হয়। দড়ি, দড়িই ভালো মা। পেছন থেকে। গলায়।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শুধু চালই দিন। প্রত্যেক হপ্তায় কি আর
ডাল আলু ব্যাঞ্জন জগাড় থাকে! আমাদের মা ভিক্ষান্নে জীবন।
অত বাছবিচার করলে হবে?


হিমচতুর্দশীর রাতে আমাদের করোটি গুনে গুনে ঘরে তোলা হয়।
আমাদের গুরুমা, নিজ বেশবাশ সামলে হাড়ের ফটফটে
মেঝেতে আমাদের অন্ন দেন। সে অন্ন খাবার নিমিত্ত নয়।
অশুভসংযোগে সে অন্ন ত্যাজ্যজ্ঞানে শরীরের বাঁ
দিকে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। অন্নে পুষ্ট শরীর
সেই সঙ্গে একটু একটু করে ত্যাগ হয়। মানুষের সংযোগ
তবু থেকে গেলে আমরা তাকে দেহের মায়া মনে করে
যতদিন দেহ আছে, লক্ষীর ভাঁড়ের খুচরোজ্ঞানে
রেখে দিই। শবানুগমনে খরচ করি।


কাহিনীও আমাদের আরাধ্য। বিশেষ কল্পনাবশে
তার বিশেষ সাকার মূর্তি জেগে ওঠে। সমবেত মানসপট
তখন আমাদের আচমনঘর। ধোঁয়া, উনুনের তাপ ও
আন্তরিক ইচ্ছার চাপে তিনি দৃশ্যমান হন। কী তার রূপ
বেরোবে তা নিয়ে জল্পনার শেষ থাকেনা সন্ধ্যে থেকে।
আরাধ্য বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সকড়ি দেবতা।
দর্শন হলে হাত ধুতে হয়, ছুঁয়ে দিলে একজীবন চান
করবার বিধান। না মা, আমাদের যেসব বইপত্তর,
যা আমরা মেলাটেলায় বিলি করে থাকি, সেখানে এই দেব্‌তার
কথা পাবেন না। গৃহস্থে এনার আরাধনা করতে পারবে না।
সইবে না।


প্রতিটি শ্বাস ঘৃণাভরে নিতে হবে। প্রতিটি শ্বাসের
ঘৃণা দমে দমে পাকিয়ে দেহভান্ডে পরতে পরতে জমা হবে।
কালো চটচটে, অল্প অল্প দানা। এই আমাদের নিত্যকর্ম।
দেহ থেকে শ্বাস বের হলে যেন সেই জমে থাকা ঘৃণার
ওপরের বাস্প বের হয়, এমনই আশ্রমের আদেশ।
আমাদের সাধনা ঘৃণায় সুস্থিত হওয়া। আমাদের ইষ্ট আত্মলোপ।

মধ্যবিন্দু

আকাশে রাত। পৃথিবী কথার ভারে ঝুলে আছে।
ভয়াবহ মনোযোগে কপালের মধ্যবিন্দু পুড়ছে ধীরে।
সুগন্ধ ধোঁয়া ঘনিয়ে উঠছে কপালের ঘর ঘিরে,
সে ঘরে হাঁটু বুকে নিয়ে বসে আছে চারখানি জোয়ান পুরুষ,
আর কোনও আসবাব নেই সেই সাদা চুনকাম করা ঘরে, শুধু দেওয়াল
তোমার হাত পিছু থেকে ধরে ধরে রাতের শুরুতে এই ঘরে এলাম,
বিবাহের পরেও তোমাদের গ্রামে তোমার কক্ষে রাত কাটানো মানা—
এরকম স্বপ্নে বহুবছর পরে, ঠিকঠাক দশবছর পরে তোমাদের দাওয়ায়
চারপাই পেতে ন্যাড়া পাহাড়ের কোলে শুতে হবে শুনে রাত থাকতে থাকতে
এখানেই চলে এলাম। এখানে পাহাড়ের কপাল, ঠিক মধ্যবিন্দু পুড়ছে
আর রাতের তারার মাঝে অগুনতি তারার মাঝে মানুষের কথার ভারে
ভারী আরও ভারী হয়ে ধীর ও ক্লান্ত অনিচ্ছায় ঘুরছে পৃথিবী—

কারা যেন এখানেই থাকে। আমি ভেদ করে যে চারজন বসে
আছে, তারা থাকে, তারা বাদে আরও কারা যেন এখানেই থাকে,
আমাদের মধ্যবিন্দু দিয়ে যাতায়াত করে, ঘরের কাজ করে,
মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে বলে, বোধহয় আরও কেউ এখানেই
থাকে। কথার ওপরে কথা চেপে চেপে ভার। ঘোরে। আকাশে
রাতের ওপারে আরও আরও রাত

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

অঞ্জলি দাশ

প্রেম

জানো না কোথায় ব্যথা, কালো জল কতটা ডোবায়,
স্বপ্ন নামধারী এক শবরের তীর বিদ্ধ এ হৃদয়
উথাল পাথাল হলে, তোমাদের কেন বা এতটা লাগে?
কৃষ্ণ এক নাম বৈ তো নয়,
আসলে নিষিদ্ধ গাথা লিখি আর মুছে ফেলি,
পাড়া প্রতিবেশী জানে কতবার ডুবে ডুবে
বিষ খেয়ে অমৃত বলেছি।

এ শরীর জ্বলন্ত প্রদীপ
যে কোনো মুহূর্তে তাকে শবসাধনার কাজে
নিয়ে যেতে পারে সন্তজন…
যৌথ যাপন ক্রিয়া, রতি বা আরতি সবই এক রীতি;
দাহকাজ শেষ করে যেভাবে আত্মজন দাঁতে কাটে মায়া,
যা পোড়ে তা বাহ্য সন্তাপ।
অন্তরের বহ্নি তুমি জানো, পুড়েছ তো কতবার কতজন্ম ধরে।

জলছাপ

বৃষ্টিরাত চাই যতোবার, রাত একা আসে

বিষাদের খোলাচিঠি ফেলে রেখে মেঘ উড়ে যায়

শুধু চোখ ভেজে…
রং নেই, হাহাকারও নেই, জলে লিখি আত্মকথন।

অশ্রু ভেজা
অন্ধকার আর সঘন একাকী রাত
পরষ্পর নৈকট্যের তীব্রতায় ক্ষয়ে যেতে যেতে
সামান্য বিষের ছোঁয়া নীল হয়ে লেগে থাকে
ফুরোনোর আগে।
কিছু কি ফুরোতে দাও রাত্রিচর ঘুম?
গ্লানি ও বিষাদ, প্রেমে
ঝাপসা হয়ে আসা স্পর্শ এফোঁড় অফোঁড় করে রোজ।
রঙিন তরল নামে,
প্রবচন এক ঋতু মাটিকে অদ্ভুত রাখে, মাটি বীজ নেয়;
তপ্ত শরীর, শেষবেলা অভুক্ত বৃষ্টি এসে লিপ্ত হয়।

গোটানো ডানার নীচে
ভাঙা শামুকের মতো ক্ষত ঢাকতে গিয়ে মনে পড়ে যায়,
জলছাপ অক্ষরের গায়ে জ্বর ছিল।

ক্ষত

আঘাত মানেই শিল্প, কেননা সে আয়ুষ্মন
তাকে তুমি মুছতে পারো না কিছুতেই।
বিপন্নতা নিজেকে যখনই ভাঙে,
চিড় ধরা সম্পর্কের চোরা স্রোতে গুলে যায় তুচ্ছতার রং,
যাতে কোনো ছবি হতে নেই।

দু-চোখের ব্যাপ্তি জুড়ে মেঘ আসে, রোদে পুড়ে যায়।
তোমাকে ভেজাবে বলে বৃষ্টি আসেনি কোনোদিন;
ঘরে ফেরা অশ্রুস্রোতই তোমার তৃষ্ণার কাছে ঋণী।

মুখের প্রতিটি রেখা ভেঙে পড়ছে গানের বিস্তারে,
তুমি আলাপ বোঝোনি।

মাঝপথে সুর থেমে গেলে অপ্রস্তুত স্বরলিপি, ভাঙা গান,
খোলামকুচির মতো, ব্যথা গিলে আগলে রেখেছ
যাতে মনে থাকে একদিন ভেঙেছিলে ঘর ও জলের পাত্র।

বিষাদ সঞ্চয়

কিচ্ছু ফেলিনি,
সামনে এগোলে পিছনে যে অন্ধকার
বিচ্ছেদের মতো লেগে থাকে, তার কাছে সব জমে আছে।
ভাঁটায় যাওয়ার আগে,
টুকরো টুকরো নদী স্নান জুড়ে বানানো যে জলের শরীর,
সে-ই জানে ভুলে যেতে কতটা বিষাদ লাগে,
কতটা অশ্রু দিয়ে ধুতে হয় সুখ।

দুঃখদিনের চিঠি ছিঁড়ে ফেললে কথারা যেভাবে
শুধু স্পর্শ হয়ে আঙুল জড়িয়ে রাখে,
নদী জানে সেই সুখ, মোহনা অব্দি সে-ই সঙ্গে থাকে।
তীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার ভিন্ন রাগ, ভিন্ন যন্ত্রনার ঘোর।
তারপর অন্য নামে, অন্য বাঁক, কেউ যাকে ভুলেও দেখে না কোনোদিন।

ভাঙা গান

গান থেকে টেনে তুলি তাকে, তার ছিঁড়ে যায়…
ভাঙা সুর ছড়িয়েছে আগুন অবধি।
চোখে জল, খিদে জাগছে খাদে;
রাত চলে গেছে তবু শরীরে শরীর নেই।

দুপুরের ঘুমে ভাত ফুটছে, সূর্য ডুবলে বেড়ে দেবে পাতে।
অতিথি সামান্য নয়, খিদের মহিমা জানে।
সন্ধেবেলা প্রতিদিন আগুন বাড়ন্ত, খিদে বাড়ে
ধুলোর মতন ওড়ে অন্নব্যাঞ্জনের সুখ…
আগুনকে সাক্ষী রেখে শরীর পোড়ায়,
প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে আজ তারসপ্তকে হাততালি হবে।

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বিজয় দে

জুলাইপঞ্জি ০২

(৬ই জুলাই ২০২৩-১০ই জুলাই ২০২৩)

৬ই জুলাই ২০২৩ বৃহস্পতিবার

আমার গর্ব আমার মুখের ভাষা
তবুও একটা পর্ব সর্বনাশা

আমি বমি করলে তুমি জমি হারাবে
আমি জিতলে তুমি বর্গাচাষা

৭ই জুলাই ২০২৩ শুক্রবার

কোনো কোনো শুক্রবার শেষ হতে চায় না
যেমন আজ

যেমন সগৌরবে সপ্তমী তিথি
যেমন সনাতন শুক্লপক্ষ
যেমন সাত রাতের জমানো স্বপ্ন নিয়ে একদিন

পাঠ্যপুস্তকের ভেতরে আমাদের জন্মদিনের ইতিহাস
লেখা চলতেই থাকে; শেষ হয় না

ইতিহাসের ভেতরে লেখা যে-কোনো একটি অক্ষর
আমি সেই অক্ষরটির শুধুমাত্র একটি নিরীহ মাত্রা…

বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন একটা গোটা শ্রাবণ মাস
যা কখনও শেষ হবে না

৮ই জুলাই ২০২৩ শনিবার


“যো ওয়াদা কিয়া হো নিভানা পড়েগা”

তাজমহলে ঢুকেই প্রথম এই গানটির কথা
মনে পড়েছিল; অন্য কোনো কথা নয়

ছায়াছবিটি দেখিনি। গান শুনেছি। তাতে কী?
সে তো সম্রাট শাজাহানকেও দেখিনি; সে তো
বিবি মমতাজের সঙ্গেও আমার দ্যাখা হয়নি

কেউ আগে বা পরে; সবাই নিশ্চই একমত হবেন
আমরা কিন্তু তিনজনই একই দেশের অধিবাসী

এইটুকু ভেবে মহলের মার্বেল-পাথরের গায়ে
হাত রাখি সযতনে


সাদা ধবধবে পাথরের ছাদ-বারান্দা। আর সেখানে
নীল-রঙা পিওর সিল্কের শাড়ি; যাচ্ছে-আসছে

ঘুরতে ঘুরতে সে হঠাৎ একটা জোরালো ডাক দিয়ে বলল—
“দ্যাখো দ্যাখো, ওই হচ্ছে যমুনা নদী”

হ্যাঁ, দেখলাম, ইতিহাসের পেছন দিকে একটা রোগা-মতন নদী
বহিয়া যাইতেছে

নদী আছে কিন্তু শূন্য; আচ্ছা, ওখানে একটা নৌকা থাকলে
দৃশ্যের কী ক্ষতি হোতো?

যদি আজ বর্ষার তিস্তা নদীর মতো
এই যমুনা নদীতে কাঠ ভেসে আসতো…

৯ই জুল্লাই ২০২৩ রবিবার

খাওয়ার সময় মুখে এত শব্দ হয় কেন
এখন তো ভাত খাচ্ছ, তাহলে কেন শব্দ হবে?

কবিতা লেখার সময় কি তোমার কোনো শব্দ হয়?

এখন তোমাকেই বলি, সশব্দে যারা একদিন
প্রেমে লিপ্ত হয়েছিল
তাদের প্রেম কিন্তু বেশি দিন টেকেনি

জন্মের শব্দ হতে পারে
কিন্তু মৃত্যুর কোনো শব্দ কি তুমি কোনোদিন শুনেছ?

১০ই জুলাই ২০২৩ সোমবার

খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো…ঘুম-পাড়ানি গান
ঘর-বাড়ি দুলছে

তবে খোকা এখনও ঘুমোলো কিনা জানি না
মেয়েটি কিন্তু দুলতে দুলতে ঘুমের দিকে ঢলে পড়ছে

‘বোকা মেয়ে’… সে বললো
‘আহা,তোমার পেটের ভেতর যে-পাড়ায় খোকা থাকত
সেটার নাম কি শান্তিপাড়া?’

‘যদি হয় শান্তিপাড়ার খোকা
আমার আদর থোকা থোকা’

“যাচ্ছে কারা শান্তিপাড়া, আবার কবে বছর পরে”
ঘুমের ভেতরে খোকাদের মিছিল চলছে

Categories
2023-Sharodiyo-Kobita

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

পাঠক

চামড়া-কুঁচকানো মুখে অজস্র জটিল বলিরেখা।
কাঠের চেয়ারে একা বসে থাকে…
গলিটির শেষে বাড়িটির
শেষ ঘর। জানলা খোলা। জানলায় দেখি বুড়োটির ফেসবুক।

সে ডুবে থাকে সারাদিন। বই পড়ে―
দেখি সেই চামড়া বাঁধানো
কীট দষ্ট একই বই, যেটি তাঁর প্রিয়,
মনে হয়
তাঁর শেষ বুক।

সংশয়

সারারাত
কবিতা থই থই করছে অন্ধকারে।

রোজ
রাত বাড়ে সারা রাত। জলের মতোন
কবিতাও বেড়ে ওঠে। আকাশ অবধি
ছোটছোট মেঘপুঞ্জ, তারা
আসলে কবিতাই?… ভাবি

নাকি অন্য কিছু?

কিন্তু কি? আর বলতে ওই
অন্ধকার
আর জাননার অন্যপারে আমি, বিশ্ব।
নাকি অন্য কেউ?

সুখ

ভোরের ইঁদারা। তার পাশে
এক
ঢ্যাঙা তাল গাছ।

বেলা বাড়ে। উঠোন পেরিয়ে
তার ঝাঁকড়া মাথার ছায়া
উঠে আসে মাটির দাওয়ায়
পিঁড়ি পাতা।
সুখে বিশ্ব খায়―

বগি থালে ডাল, ভাত, মাছ…

আবহমান

আমার সংসার
সেতো ঈশ্বরই চালায়।
রোজ ভোরে
পাখি গায় ডালিমের ডালে।
মনে মনে
সাড়া দিই। কখনো উঠোনে
দ্বিপ্রহর স্থির। শুধু এক
পুরাতন যাঁতা ঘোরে…
ঈশ্বরী চালায়।
তার কোলে
শিশু বিশ্ব। বুকে দুধ খায়।

দরজা

দুপুর পড়ন্ত হয় বুকের ভিতরে।
সোনালি রোদের ছায়া দীর্ঘ… ক্রমে উঠোন ছাড়িয়ে
চলে যাবে যেখানে যাবার।

সবই ঠিক।
বস্তুত বাড়িটি, ক্রমে পড়ে আসা উঠোনের ছায়া,
এখন বিকেল নামছে, বোঝা যায়,
আরও যতদূর
স্মৃতিপটে পরিস্ফুট ছবিগুলি আসলে কি ঠিক
শুধু মাত্র ভিতরেই?
নাকি বাইরে?… যত ভাবি ―

দরজা কই?
কান পেতে থাকি। কোনো দিন যদি শব্দ হয়,
কেউ
চুপি চুপি তালা খোলে―

ক্লিক্…

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

সোহম দাস

টিকটিকি

সকালে বাথরুমে গিয়ে কমোডে বসার পরেই টিকটিকিটাকে দেখতে পেল মণি।

আজ খানিক তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙেছে তার। অন্যদিন আটটার আগে চোখ খুলতেই চায় না। আজ একেবারে এক ঘণ্টা আগেই। অবশ্য কারণও আছে। গতকাল রাত আটটা অবধি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকতে হয়েছে। না থেকে উপায়ও ছিল না। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বা বলা ভালো, তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে টিকে থাকতে গেলে এ-পথ ছাড়া উপায় নেই।

ক্যাম্পাস থেকে একবার থানায় যেতে হয়েছিল তাকে আর পড়শি বিভাগের অয়নেন্দুদাকে। অয়নেন্দুদা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। থানায় যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে ক্যাব বুক করে তুলে দিয়ে মণি নিজে যখন বাড়ি ফিরল, তখন বাজে সাড়ে দশটা। ফিরে এসে চান করে, কোনোরকমে দু-টো রুটি আর একটু আলুভাজা খেয়ে এগারোটায় শুয়ে পড়েছে সে। শরীর আর দিচ্ছিল না।

কৃতি অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবে বলে উসখুস করছিল। মণি ওর হাত দুটো ধরে বলে দিল – “আজ নয়, বুড়ি, কাল বলব সব। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে। আজ শুয়ে পড়ি।”

মণির চোখের ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে বুড়ি ওরফে কৃতি আর কিছু বলেনি।

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার দরুন ঘুমও ভাঙল নির্ধারিত সময়ের আগে। জানলার সিলে রাখা চশমাটা নিয়ে সে আগেই মোবাইলটা খুলে দেখেছে। নেট পরিষেবা চালু করতেই একগুচ্ছ নোটিফিকেশন। চারটে নিউজ লিঙ্ক, বেশ কয়েকটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, একটা মেইল, ইত্যাদি ইত্যাদি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মধ্যে অয়নেন্দুদার মেসেজ দেখে সেইটেই কেবল খুলল সে। গতকাল রাতেই পাঠানো। তিনি লিখেছিলেন – “পৌনে এগারোটা নাগাদ ফিরলাম। তুই ফিরেছিস তো ঠিকঠাক? কাল আমার যেতে দেরি হবে। তোর বৌদির চেক-আপ আছে সকালে। তোরা আমার জন্য ওয়েট করিস না, যেমন শিডিউল আছে, শুরু করে দিস।”

অয়নেন্দুদাকে যথাযোগ্য উত্তর পাঠিয়ে মণি উঠে পড়েছিল। বর্ষার সময়ে সকালবেলায় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, ফলে কৃতি শোওয়ার সময়ে বালিশের পাশে হালকা চাদর রেখে দেয়। ভোরে উঠে গায়ে জড়িয়ে নেয়। আজ মণি আগে উঠেছে, ফলে, দেখতে পেল, চাদরটা কৃতির গা থেকে সরে গিয়েছে। মণি বড়ো যত্নের সঙ্গে আদরের স্ত্রীর গায়ে চাদরটা আবার দিয়ে দেয়। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। কাল রাতে বড়ো দুশ্চিন্তায় ছেয়ে ছিল ওই মুখটা, দরজাটা খুলতেই সেটা লক্ষ করেছিল মণি। কিন্তু, সত্যিই সে কাল বড়ো ক্লান্ত ছিল, সারাদিনের লড়াইয়ের কথা আর বলতে ভালো লাগছিল না। এখনও কি সেই দুশ্চিন্তা লেগে আছে ওই মায়াবী মুখে? না, অন্তত মণি সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি।

কৃতির ওঠার সময় ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে সাতটা। উঠেই সোজা বাথরুমে আসবে, আধঘণ্টার আগে বেরোবে না। এ-সব অন্যদিন মণি জানতে পারে না, তখন সে গভীর ঘুমে। আজকে পরিস্থিতি আলাদা। মণি তাই সময় নষ্ট না করে বাথরুমে এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মোবাইলটা। মোবাইলের স্ক্রিন দেখতে দেখতে দিব্যি কমোডের কাজ সারা হয়ে যায়। অবশ্য এই মোবাইল আনার ব্যাপারটা করতে হয় কৃতিকে লুকিয়ে। জানতে পারলেই চেঁচাবে। আজ ঘুমোচ্ছে যখন, তখন সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্তি।

অন্যদিন দেরি করে বাথরুমে আসে, শরীরের নিজস্ব ঘড়িটাও সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। ফলে, কমোডে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরও কোনও নিঃসরণ নেই। মণি সময় কাটাতে মোবাইলটা খোলে।

গতকাল রাতে নেট আর চালু করেনি সে। ফেসবুকে আরও নতুন কী তত্ত্ব প্রকাশিত হল, কে জানে! কমোডে বসে তাই প্রথমেই ফেসবুকটা খুলেছিল সে। একটা চেনা নামের প্রোফাইলের লেখা দেখে সেটাই আগে পড়বে বলে ঠিক করে। দু-লাইন সবে পড়েছে, এমন সময়ে টিকটিকিটা এসে পড়ল তার পায়ের ওপর। বাথরুমের দেওয়ালের গায়ে সাদা টাইলস বসানো। টিকটিকিটা সেই মসৃণ টাইলসের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কোনও কারণে। কোনও কারণে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিল, ফলে পতন।

আর, পড়বি তো পড়, একেবারে মণির ডানপায়ের পাতার ওপরে।

চমকে উঠল মণি। ডান পা-টা নড়ে উঠল তার। সঙ্গে সঙ্গে তার পা ছেড়ে প্রাণীটা বাঁ-দিকের কোণে ছুটল। ওখানে মেঝেতে ঝাঁঝরির মুখ। ঠিক তার উপরেই কল ফিট করা আছে। কলের সঙ্গে যুক্ত করা আছে একটা হ্যান্ড শাওয়ার। ঝাঁঝরির সামনে গিয়ে থেমে গেল টিকটিকিটা।

মণি বাঁ পা-টা মেঝেতে ঠুকল একবার। টিকটিকি দেখলেই এমন করা তার আশৈশব অভ্যাস। ঝাঁঝরিতে লোহার শিক বসানো। জং ধরে গিয়ে তাদের আসল রং বহুবছরই বিলুপ্ত। একটা শিকের মাঝখান থেকে ভাঙা। সেখানে দিব্যি একখানা ফাঁক তৈরি হয়ে আছে। মণির পা ঠোকায় ভয় পেয়ে সেই ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে গেল মাঝারি আকারের সরীসৃপটা।

তারপর, সোজা নামতে শুরু করল গর্তের নীচের দিকে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল মণির। আর কিছুটা নামলেই যে ঘন অন্ধকার, সে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ওর ছোট্ট শরীর। অজান্তেই মণির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “হে—!”

ভয়ের চোটে খানিক জোরেই চেঁচিয়ে ফেলেছিল মণি। কিন্তু, ‘ই’ শব্দটা বেরিয়ে আসার আগেই সে নিজের মুখ চেপে ধরল। কৃতি এখনও ওঠেনি, এই চিৎকারে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়!

যদিও দু-টো ঘটনার কোনোটাই ঘটল না। টিকটিকিটা তলিয়ে গেল না, বরং অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীরকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে আটকে থাকল গর্তের দেওয়ালে। কৃতিরও ঘুম উঠে পড়ার কোনও লক্ষণ শুনতে পেল না মণি।

ঝাঁঝরির নীচে গাঢ় অন্ধকার। কলের জল, হাত-ধোওয়া জল, সাবানগোলা জল, প্যান-ক্লিনার ভরা জল, সব গিয়ে জমা হয় ওই অন্ধকারে। তারপর, পাইপলাইনের গিরিখাত বেয়ে হারিয়ে যায়। পাইপ কেবল অন্ধকারকে ধরে রাখে, জলকে নয়।

টিকটিকিটা এখন সেই অন্ধকারের একটু উপরে আটকে রয়েছে। গত দশ বছরের জল পড়ে পড়ে গর্তের দেওয়ালে জন্মেছে ঘন শ্যাওলা। ওই শ্যাওলার দেওয়ালে চারহাত আঁকড়ে টিকটিকিটা স্থির হয়ে আছে।

কিন্তু কতক্ষণ ওভাবে থাকবে? জলের মতো ও-ও যদি ওই অন্ধকারে হারিয়ে যায়? সেক্ষেত্রে পাইপের মধ্যে দম আটকে মারা যাবে সরীসৃপটা। তার অভিঘাত কী কী হতে পারে?

মণি ভাবার চেষ্টা করল।

প্রথমত, নিঃসৃত জলের মতো ওর খুদে মৃতদেহ পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, পাইপের মুখে গিয়ে আটকে যাবে, সঙ্গে হয়তো আটকে দেবে জলের অবাধ প্রবাহকে। তাতে কি গোটা অ্যাপার্টমেন্টের জলের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এটা মণির সত্যিই জানা নেই। অনেক বিষয়ের মতো এটাও অজানা রয়ে গিয়েছে! আজকে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত গত দশ বছরে এমন কিছু ঘটেওনি যাতে এই ভাবনা তার মনে উদয় হয়। ফ্ল্যাটটা কেনার সময়ে পাইপলাইন সিস্টেমটা নিয়ে আরেকটু বিশদে জেনে নেওয়া দরকার ছিল। মণি কেমন অসহায় বোধ করে।

আজকেই কোনও ইঞ্জিনিয়ার-বন্ধুকে ধরে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে পাইপলাইনের কার্যপ্রণালীটা।
দ্বিতীয়ত, টিকটিকিটা মরে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর শরীরে পচন ধরবে। ইংরাজিতে যাকে ‘রাইগর মর্টিস’ বলে। পুরো প্রক্রিয়াটা সেই স্কুলবেলায় জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল, এতদিনে ভুলে যাওয়ারই কথা। তবে এটুকু মনে আছে, ব্যাপারটা ধাপে ধাপে হয়। কোনও একটা ধাপে, গন্ধ বেরোনো শুরু হয়। বোধহয়, দ্বিতীয় কি তৃতীয় ধাপেই। টিকটিকি মরলে কতক্ষণ পরে গন্ধ বেরোনো শুরু হবে, সেটা সে জানে না। এদের শরীরে বিষ থাকে বলেও শুনেছে মণি, সেক্ষেত্রে ওই শরীর-পচা গন্ধে জলের লাইনটাই পুরো বিষাক্ত হয়ে যাবে কিনা, সেটাও তার অজানা।

বন্ধুতালিকায় কোনও প্রাণীবিদ নিশ্চয়ই আছে, সে-রকম একজনকে পাকড়ে এই খুদে সরীসৃপদের ফিজিওলজিটাও জেনে নিতে হবে, আজকেই।

এই দুটো ভাবনা ছাড়া আরও একটা চিন্তা আচ্ছন্ন করে ফেলল মণিকে। টিকটিকি মরে যদি গন্ধ ছড়ায় পাইপলাইন জুড়ে, প্লাম্বার ডাকা হবে, সে এসে খুঁজে বার করবে গন্ধের উৎস, অনুসন্ধানে ধরা পড়বে মণির বাথরুমের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপলাইনেই টিকটিকি মরেছে, অ্যাপার্টমেন্টের সমস্ত লোক তাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মণি কোনও ঠিকঠাক জবাব দিতে পারবে না, সমস্যা সমাধানে কমিটির মিটিং ডাকা হবে। পুরো পরিষ্কারের খরচটা মণিকেই দিতে হবে হয়তো, অথবা, অন্য কোনও সমাধানও উঠে আসতে পারে। এই যেমন, পাবলিক নুইসেন্সের অভিযোগ তুলে তাকে ফ্ল্যাট ছাড়ার আইনি নোটিশ ধরানো।

দশবছর আগে তৈরি হওয়া এই ফ্ল্যাটে পাঁচবছর আগে এসেছে সে আর কৃতি। চারিদিক খোলামেলা দেখে পছন্দ হয়েছিল তাদের। কৃতি স্বভাব-মিশুকে, দিনচারেকের মধ্যেই উপরতলা, নিচতলার কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। বাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বর কী করে, তুমি কী করো, এতবছর বিয়ে হয়েছে, এখনও ওই ব্যাপারে কিছু ভাবোনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, মণির পুরো নামটা তখনও তারা জানতে পারেনি। সেটা জানল দিনকয়েক পরে, যখন কাঠের দরজায় নেমপ্লেট বসল, ফ্ল্যাট – ২সি, তার নীচে পরপর দুজনের নাম – কৃতি চ্যাটার্জি, মণিরুজ্জামান মণ্ডল। সেটার পর থেকেই কৃতি লক্ষ করেছে, লোকজনের হাবেভাবে খানিক পরিবর্তন, আর সেভাবে সহজ হতে পারছে না কেউ। মণিকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছিল। মণি তখন অত পাত্তা দেয়নি, স্বাভাবিক অস্বস্তি, কিছুদিন পরে কেটে যাবে, এমন বলে আশ্বাস দিয়েছিল স্ত্রীকে। কিন্তু আজকে, এই ঘটনার ছুতো পেয়ে তাদের যদি এখন উঠে যেতে বলে, তখন আবার বাসা খোঁজা… মণি আর ভাবতে পারল না, শক্ত হয়ে এল তার শরীর।

কিন্তু আইনি নোটিশ কি এভাবে ধরানো যায়? বন্ধু কিংশুককে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে, কিংশুক এখন বড়ো বড়ো কোম্পানির লিগ্যাল প্রসিডিওর দেখাশোনা করে। কোনও পরামর্শের প্রয়োজন হলেও ও-ই দিতে পারবে।

মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হাতে মোবাইলটা ধরাই ছিল। খেয়াল হতেই মনে পড়ল, এতক্ষণ ধরে সে বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করার কথা ভেবে চলেছে, অথচ, গুগলের কথাটা একবারও ভাবেনি। এসব অস্বস্তিকর ব্যাপার বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করলে হাসির খোরাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অন্য সন্দেহও ধেয়ে আসতে পারে। আজকাল কিছুই অসম্ভব নয়। তার চেয়ে গুগলে সার্চ করাই তো ভালো বিকল্প। সেক্ষেত্রে জানাজানি হওয়ার কোনও বিপদ নেই। জানলে জানবে কেবল গুগলের সার্ভার।
কিন্তু ব্রাউজার খুলে সার্চ করতে গিয়ে মণি দেখে, তার আঙুল সরছে না। ভয়ে দুশ্চিন্তায় তার হাত বুঝি অসাড় হয়ে গিয়েছে।

মোবাইলে সময় দেখাচ্ছে, সাতটা কুড়ি। মণি বাথরুমে ঢুকেছে সাতটা দশের একটু আগে। মাত্র এগারো-বারো মিনিটেই এত কিছু ঘটে গেল!

কয়েক মিনিট পরে কৃতিও উঠে পড়বে, উঠে পড়ে সোজা বাথরুমে আসবে। বাথরুমে মোবাইল নিয়ে আসার মতো টিকটিকি প্রাণীটিকেও সে চরম অপছন্দ করে। ঘেন্নাই করে, বলা যায়।
সে উঠে পড়ার আগে যা করার করতে হবে।

কোনো একটা কার্যকরী উপায় ভাবা দরকার। কিন্তু, উপায় ভাবতে গেলে আগে মনকে শান্ত করতে হবে। এবং, মন শান্ত করতে হলে এই একগোছা দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, সকালের পায়খানার মতো।

অতএব, মণি অন্য ভাবনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল।

টিকটিকিটা এখনও ঠায় সেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ ওভাবে… না, ভাবতে গিয়েও মাঝপথে ভাবনা বন্ধ করে দিতে চাইল মণি। কথার মতো ভাবনাকেও যে এভাবে আটকানো যায়, ওই পাইপলাইনের কার্যপ্রণালী বা টিকটিকির শারীরবিদ্যার মতো এটাও এতক্ষণ অবধি মণির অজানা ছিল। অন্যভাবে ভাবলে টিকটিকিটা ওই গর্তে সেঁধিয়ে গিয়ে মণির একপ্রকার উপকারই করছে।
এ-কথাটা মনে উদয় হতেই তার ভালোলাগাটা বাড়ল। বুকের ধুকপুকানিটাও খানিক কমল বোধহয়। শরীরের সার্বিক কাঁপুনি ভাবটাও কমল। এই তো, ভালো দিকগুলো দেখতে পাচ্ছে সে।

টিকটিকিটা প্রথম যখন গর্তে সেঁধোল, সেই মুহূর্তটায় ফিরে গেল মণি। সোজা ঢুকে যাচ্ছিল নীচের দিকে, কিন্তু বিপদ বুঝে নিয়েই কী অসম্ভব গতিতেই না আবার সঠিক দিকে ঘুরিয়ে নিল শরীরটাকে! খুদে জীবের এমন সহজাত ক্ষমতাকে তারিফ না করে কি থাকা যায়?

খালধারের রাস্তার সেই চড়াই পাখিটার কথাই যেমন। মণির নিশ্চয় মনে আছে। তখন সে কলেজে পড়ে। বাড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে কলেজ, সাইকেলেই যাতায়াত। একদিন বিকেলে ফেরার পথে ঘটেছিল ঘটনাটা। খালধারের রাস্তায় একটা কাগজফুলের গাছ ছিল, সে গাছ থেকে চড়াই পাখিগুলো উড়ে উড়ে যেত রাস্তার অন্য পাশে। কী যে উদ্দেশ্য ছিল, তা মণি জানত না। সেদিন, ওদেরই মধ্যে একজন, বেশ নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে এসে পড়ে মণির সাইকেলের চাকার একদম সামনে। সাইকেলের ধারালো, জং-ধরা স্পোকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মোলায়েম পালকশরীর, এই ভেবে সেদিনও মণি ‘হেই’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।

কিন্তু, সেদিনও মণিকে অবাক করে দিয়ে ছোট্ট চড়াইটা দেহটাকে দিব্যি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল কাগজফুলের গাছটায়। মণি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়েছিল সাইকেল নিয়ে। ঘোর কাটতে চাইছিল না তার। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে তখন অবিরাম রিক্সা, সাইকেল, বাইক। কেউ বুঝছেই না, এইমাত্র কী অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল, তার একমাত্র সাক্ষী অন্নদাচরণ কলেজের বি. এ. ইংলিশের ছাত্র মণিরুজ্জামান। দু-একজন কেবল তার ‘হেই’ শুনে এ-দিকে তাকিয়েছিল, তার বেশি কোনও ভাবান্তর ঘটেনি খালপাড়ের নিস্তরঙ্গতায়।

এই ধরনের ক্ষমতার নিশ্চয়ই কোনও বৈজ্ঞানিক নাম আছে, সে নাম গালভরাও হতে পারে। কিন্তু তখন সে এসব ভাবেনি। তার মাথায় ঘুরছিল অন্য এক ভাবনা।

আব্বার আব্বাকে সে দেখেনি। গল্প শুনেছে মাত্র। সে লোকটা যৌবন বয়সে কংগ্রেস করত, সত্যাগ্রহী হয়েছিল, খদ্দরের ধুতি ছাড়া পরত না। জেলও খাটে কয়েকবার। ’৪৭-এর পর পেট চালাতে একখানা দর্জির দোকান দেয়। চরকা সরে গিয়েছে ততদিনে, সেই জায়গায় বসেছে সস্তার সেলাই মেশিন। মফঃস্বল শহরের একচিলতে পাড়ার একচিলতে দোকানঘরে সকাল-বিকেল খং খং শব্দে সেলাই মেশিন চলত। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য কেবল বিশ্রাম। দোকানঘরের খোলা জানলা দিয়ে প্রায়ই ঢুকে আসত দু-একটা চড়াই, ডিসি পাখার ব্লেডে ঘ্যাচাং-ঘ্যাচ কাটা পড়ত তারা, দাদুর সাদা ধুতিতে লেগে যেত রক্তের দাগ। দাদি নাকি অনেক চেষ্টা করেও সে দাগ তুলতে পারত না!

ওই চড়াইগুলো বুঝি খালধারের চড়াইদের চেয়ে আলাদা হত, তাদের অমন রিফ্লেক্স ছিল না, তাই কাটা পড়ত যখন-তখন, এরকমই একটা কিছু মাথায় এসেছিল সেদিন।

টিকটিকিরাই তো চড়াইদের পূর্বপুরুষ। সেই যে জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল একসময়ে, জার্মানির ব্যাভেরিয়া অঞ্চলে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল আর্কিওপটেরিক্স নামের এক প্রাণীর ফসিল। সরীসৃপ থেকে পাখিতে রূপান্তরপর্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। অনেকেই বলে, ডানাওয়ালা ডাইনোসর। এমন ক্ষিপ্র প্রতিবর্ত ক্ষমতা হয়তো এদের থেকেই পেয়েছে পাখিরা, তেমনটা ভাবতে ক্ষতি কী!

খুদে জীবটা এখনও সেভাবেই আটকে রয়েছে গর্তে। সেই একইরকম স্থির। মণি অনুভব করল, সে আগের থেকে খানিক স্বাভাবিক বোধ করছে। ব্রাউজারে এবার খোঁজ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। গুগলটা খুলে সার্চ বারে টাইপ করতে গিয়ে আবারও থেমে গেল। এবার আর আঙুলে অসাড়তা নেই, থেমে যাওয়ার কারণ অন্য। একাধিক ভাবনা সে ভেবে ফেলেছে এই কয়েক মিনিটে। কোনটা আগে খুঁজবে?

এক মুহূর্ত স্থির থেকে টাইপ করল – “can house geckos hold on to mossy surface?”

অজস্র লিঙ্ক খুলেছে। কিন্তু কোনোটাতেই ঠিকঠাক ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হল না। একটা লিঙ্কে পাবে ভেবে খুলতে গিয়ে দেখে, ৪০৪ এররের খবর। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “ধ্যার, বাঁ…”

সময় আরও খানিক এগিয়ে এসেছে। সাতটা ছাব্বিশ। এবার কৃতি উঠে পড়বে। উঠে মণিকে পাশে না পেলে মনখারাপ হবে তার। যেদিন যেদিন মণি আগে উঠে পড়ে, সেদিনগুলোয় কৃতি ভারী খুশি হয়, চট করে বিছানা ছাড়তে চায় না। স্বামীর বুকে মাথা রাখে, দু-জনে মেশামেশি করে থাকে কিছুক্ষণ। তার উপর কাল রাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল মণি, সেই অপরাধও জমা হয়ে আছে।

এবার উঠে পড়তেই হবে। এতক্ষণ ধরে কমোডে বসে থাকা অনুচিত কাজ, এতে পাইলসের সম্ভাবনা বাড়ে। কোনও একটা কাগজে পড়েছিল।

কিন্তু, টিকটিকিটার ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। হ্যান্ড শাওয়ারটা হাতে তুলে নিয়ে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল মণি। জমে থাকা বর্জ্য শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতিটাই এখন সারা মন-শরীর জুড়ে। ভয়ের আঘাতে কখন যে আপন নিয়মেই সে বর্জ্য খুঁজে নিয়েছে তার নিজস্ব নির্গমনপথ, সেটা মণি বোধহয় বুঝতেও পারেনি। টিকটিকিটা এই উপকারটাও করে দিল।

হ্যান্ড শাওয়ারের কাজ সেরে সেটাকে যথাস্থানে রেখে ছোটো হয়ে আসা গোলাপি টয়লেট সোপটা দিয়ে হাত ধুতে থাকে মণি। কলের হাতলটা অল্পই ঘুরিয়েছে সে, জল পড়ছে অত্যন্ত ধীরে। তাতেই দিব্যি হাত ধোয়া হয়ে যাচ্ছিল। সাবানগোলা ফেনাজলের ফোঁটা গিয়ে পড়ে টিকটিকিটার গায়ের ওপর। চমকে চমকে ওঠে সেটা। দীর্ঘ সময়ের নিস্তব্ধতার পর এই মৃদু স্পন্দন দেখে মণি ভরসা পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও এক ভয় তাকে ছেঁকে ধরে। আকস্মিক চমকানিতে টিকটিকিটার যদি হাত ফস্কে যায়!

কলটা বন্ধ করে দেয় সে। হাত সরিয়ে নেয় ঝাঁঝরির উপর থেকে। দেওয়ালের আংটায় রাখা তোয়ালেতে হাত মুছে সে এবার উঠে পড়ে।

চান করার কলের নীচে একটা ঝাঁটাকাঠি পড়ে আছে, এটা বাথরুমে ঢুকেই লক্ষ করেছিল সে। বাথরুমে ঝাঁটাকাঠি থাকার কথা নয়, কে ফেলেছে, কেন ফেলেছে, এসব নিয়ে সেই মুহূর্তে মাথা ঘামায়নি মণি, কিন্তু এখন এটা কাজে লাগতে পারে। কাঠিটা ভেতরে ঢুকিয়ে যদি পিছন থেকে টিকটিকিটাকে আলতো খোঁচানো যায়, তাহলে হয়তো উঠে পড়ার চেষ্টা করতে পারে।
কিন্তু তাতে কি সত্যিই কাজ হবে? নাঃ, অত ভাবার সময় নেই এখন। সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই।
মণি বারমুডাটা পরে নিয়ে, সিস্টার্নের ওপরে রাখা মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে, এগিয়ে যায় ঝাঁঝরির দিকে। উবু হয়ে বসে। কাঠি ধরা ডানহাতটা গর্তের কাছে আনে। আর, ঠিক তখনই…

রবি শাস্ত্রীর বিখ্যাত ‘ট্রেসার বুলেট’-এর গতিতে বেরিয়ে এল টিকটিকিটা। তারপর, আরও একটু গতি বাড়িয়ে ছুটে চলে গেল সিঙ্কের আউটলেট পাইপটার নীচে। ওখানে ডাঁই করে রাখা আছে দু-খানা বড়ো আকারের রং রাখার প্লাস্টিকের ডিব্বা, তিনখানা ছোটো রং রাখার টিন, এক জার টয়লেট ক্লিনার, এক জার ডিসইনফেকট্যান্ট সারফেস ক্লিনার, দু-বোতল মিউরিটিক অ্যাসিড, সঙ্গে আরও এটা-সেটা। সেগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে।

মণি পিছন ঘুরে আর তাকে দেখতে পেল না।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়

যারা অফুরন্তভাবে মৃত

আমি মরে যাবার পর আমার ছেলে একদম কাঁদেনি। এর সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে দুটো সম্ভাব্য কারণ আন্দাজ করতে পারি। এক, আমার ছেলে হয়তো কাঁদতেই জানে না। দুই, আমার ছেলেকে আমি ‘পাপ’ বলেছিলাম একবার। এবার যদি এক নম্বর কারণের ব্যাখ্যা দিই তাহলে বলতে হয়, ছোটোবেলা থেকে আমার ছেলে কম মারধর, কম লাথি-ঝ্যাঁটা তো খায়নি আমার কাছে, কিন্তু একবারের জন্যও ওকে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। যত মেরেছি, যত অত্যাচার করেছি তত ভাবলেশহীন মুখে, তত যন্ত্রণাহীন মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এছাড়া, শুধু আমি নয়, অন্য লোকেও চিরকাল ওকে দেখ-মার করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কাঁদা তো দূরের কথা, এতটুকু শুকনো মুখে কোনোদিন বসে থাকতে দেখিনি আমার ছেলেকে। আর, ওর এই কোনো কিছু তোয়াক্কা না করা মনোভাবটাই আমার ভেতরে ক্রমাগত একটা জ্বালার জন্ম দিত। ফলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতাম আমি। যাইহোক, এবার আসি দ্বিতীয় কারণের ব্যাখ্যায়। তবে তার আগে একটা ঘটনা বলি।

একদিন অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে আমার ছেলের আমাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। রোগা প্যাংলা আট বছরের একটা বাচ্চা, কিন্তু বেশ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল! আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি পাশ ফিরি। দেখি, আমার মাথার শিয়রে বসে আছে। মারওয়াড়িবাবুর বাড়ি ওভারটাইম করে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে, নাকেমুখে দুটো ভাত তরকারি গুঁজে, বোধহয় ঘণ্টাখানেক হয়েছে কি হয়নি আমি শুয়েছি, আর মরেছি। কিন্তু ওর ধাক্কা দেওয়াতে আমার কাঁচা ঘুমটা গেল চটকে, ফলে খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মুখ দিয়ে— “ধ্যার ল্যাওড়া, কী হয়েছে কী?”— বেরিয়ে এল। তখন দেখি ও আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখাচ্ছে। ওপর দিকে মানে সিলিঙের দিকে। চোখে তখন ঘুমে শেকল পরিয়ে রেখেছে, পিচুটি ভ্যাদভ্যাদ করছে, তার ওপর ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের নীল রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। ফলে ওই প্রায় আধিভৌতিক পরিবেশে প্রথম চোটে কিছুই বুঝতে পারলাম না ও কী বলতে চাইছে, কিংবা কী দেখাতে চাইছে। তাই বাধ্য হয়ে বিছানায় উঠেই বসলাম। ভালো করে কচলে কচলে চোখ পরিষ্কার করলাম। তারপর হাতড়ে হাতড়ে বেড সুইচ টিপে ঘরের বড়ো আলোটা জ্বালালাম। আর দেখলাম, ঘরের অ্যাসবেস্টসের সিলিং ধরে রাখা লোহার খাঁচার একটা রডের সাথে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরটা বেঁধে ফাঁস তৈরি করে, সেই ফাঁস গলায় পরে আমার বউ ঝুলছে। মুহূর্তের আপাদমস্তক চমকে ওঠায় আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম তখন। তবে ওই প্রথম। ওইই শেষ। কিন্তু ওই জড়িয়ে ধরাটা এখনও আমার শরীরে, যে-শরীর আর নেই সেই শরীরেই, যেন লেগে রয়েছে! তবে ওর ওপর আমার যা আক্রোশ, তাতে তো ওই স্পর্শ লেগে থাকার কথা নয়! যাইহোক, মুহূর্তের জড়িয়ে ধরা, মুহূর্তেই ছেড়ে দেওয়া। তারপর, একটি আত্মহত্যা পরবর্তী ঝুটঝামেলা সামলানো। চলতে থাকল। বেশ কয়েকদিন ধরে। পুলিশ তো প্রথমে আমাকে আটক করেও নিয়ে গেল! মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছি এই সন্দেহে। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যখন বেরোল, মর্গের ডাক্তার যখন নিশ্চিত করল, যে শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, হত্যা নয়, এটা আত্মহত্যাই, তখন হাজত থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু আমার বউ কেন গলায় দড়ি দিল তা জানতে পারলাম না। আমার বউয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন ছিল? সেই নিয়ে আমি আদৌ কোনোদিন ভাবিত ছিলাম না। কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে, এরকম জায়গায় চলে গিয়েছিল কি ব্যাপারটা? কে জানে! দু-চারদিন ভাবার পর আমি ভাবা বন্ধ করে দিলাম। ওদিকে পুলিশও দু-চারদিন পরেই হাত তুলে নিল।

এর পর বেশ কিছু মাস কেটে গেল। দুর্গাপুজো এল। আমি যে-মারওয়াড়ি ব্যবসাদারের বাড়ি বাজার সরকারের চাকরি করতাম তিনি লোক ভালো। বউ আত্মহত্যা করা স্বত্তেও, তিন দিন হাজতবাস করা স্বত্ত্বেও উনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি, উলটে পুজোর সময় ডবল বোনাস দিলেন। বললেন— “মা তো নেহি রহি যো পূজাকে ওয়াক্ত বচ্চে কো সাজায়েগি, তুমহি উসে অচ্ছে সে কপড়ে খরিদকে দেনা”— এই বলে, খুব সুন্দর একটা খামে পুরে ক্যাশটা আমার হাতে দিলেন। ক্যাশ মাইনে, ক্যাশ বোনাস, এছাড়াও উপরি বোনাস। সেটাও ক্যাশ। চল্লিশ হাজার টাকা ক্যাশ তখন আমার পকেটে। পা আর মাটিতে পড়ছে না। কী করি? কী করা উচিত এখন এতগুলো টাকার সাথে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় এল বউ মরে যাওয়ার পর থেকে আর কারও সাথে শোয়া হয়নি আমার। তাই যেমন ভাবা, তেমন কাজ। রেড লাইট থেকে একটা বেশ্যা তুললাম। বাড়ি নিয়ে এলাম। শুলাম। যেদিন প্রথম শুলাম সেদিনও বহু জায়গায় মণ্ডপে পেরেক পোঁতা শেষ হয়নি। সেদিন ছিল পঞ্চমী। আর সেদিন থেকে শুরু করে টানা নবমী পর্যন্ত আমি শুলাম। গোটা দুর্গাপুজোটা আমি ওই এক্সট্রা বোনাসের দশ হাজার টাকা খরচ করে একটা মেয়েছেলের শরীর ভাড়া করে আনলাম ভোগের জন্য। তারপর, সারারাত কাটানোর পর বিজয়া দশমীর দিন সকালে যখন ওই বেশ্যা ফিরে যাচ্ছে তখন হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেটাকে এবার পুজোয় কোনো নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়নি। তাই দুপুরে চান খাওয়া সেরে, বিকেল বিকেল বাড়ি থেকে বেরোলাম। রাস্তায় তখন সারি সারি নতুন জামা। নতুন প্যান্ট। নতুন জুতো। আনন্দ-বিসর্জনের পথে। তখন সেই সমস্ত নতুন জামা-নতুন প্যান্ট-নতুন জুতোদের পেরোতে লাগলাম আমি। ঢাকের বাদ্যি পেরোতে লাগলাম। তাসা পার্টির বাজনা পেরোতে লাগলাম। ঝকমকে আলো পেরোতে লাগলাম। আলোর তলার ছায়া পেরোতে লাগলাম। পেরোতে পেরোতে একসময় দেখতে পেলাম খুব ছোট্ট একটা জামাকাপড়ের দোকান তখনও খোলা। ফাঁকা। কোনো খদ্দের নেই। ভেতরে একজন বৃদ্ধ কর্মচারী বসে আছে কেবল। প্রতিমা নিয়ে ম্যাটাডোর বেরিয়ে যাবার পর যেভাবে প্যান্ডেলে একটা নিঃসঙ্গ প্রদীপ জ্বলে; ঠিক সেইভাবে। যাইহোক, গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই দোকানে। তারপর বেছে বেছে খুব সস্তা দামের একজোড়া জামা-প্যান্ট কিনতে গিয়েও কিনতে না পেরে, বেশ দাম দিয়েই একটা পাজামা-পাঞ্জাবীর সেট কিনে ফেললাম। তারপর ফিরতে লাগলাম; আবার সেই ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে। আর ফিরতে ফিরতে হঠাৎ, ওই বেশ্যা আর আমার, একদিনের বেশ লম্বা একটা সংলাপ আমার মাথার মধ্যে ফিরে এল।

“শেষপর্যন্ত আর জানতে পারোনি না?”

সপ্তমীর দিন। রাত্রিবেলা। শোয়া পর্ব মিটলে বিরিয়ানি আর থাম্বস্‌ আপ নিয়ে খেতে বসেছি আমি আর ওই বেশ্যা। পাশের ঘরে ছেলেটাকেও এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর এক বোতল কোল্ড ড্রিংক দিয়ে এসেছি। তবে খেয়েছে কি না দেখিনি। আমার পাড়ার রতনের দোকানে মটন বিরিয়ানিটা রাঁধে ভালো। আয়েশ করে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার ভাড়া করা মেয়েছেলের প্রশ্নে খাওয়ায় ছেদ পড়ল। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—

“কী জানতে পারার কথা বলছ?”

“তোমার বউ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল?”

মেজাজটা গেল খিঁচড়ে। খাওয়ার সময় এসব কথা কেন যে বলে এইসব আহাম্মক মেয়েছেলেগুলো! বললাম—

“তোমার কি খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই যে এখন এসব কথা তুলছ?”

আমার বলার মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা ছিল, কিন্তু দেখলাম ভবি ভোলার নয়। পাঁঠার টেংরি চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করেই চলল—

“জানতে ইচ্ছে হয়নি?”

“নাহ্‌”।

“কেন?”

“এমনিই”।

জোরের সাথে বললাম। কিন্তু তারপরেও সেই বেশ্যা বলে—

“আচ্ছা তুমি কি তোমার বউকে সন্দেহ করতে?”

“সন্দেহ করতে যাব কোন দুঃখে?”

“করতেই পারতে! হতেই তো পারত যে অন্য কারও সাথে ওর লটরপটর ছিল। সেখান থেকে হয়তো ব্ল্যাকমেল করছিল। তাই ভয় পেয়ে সুইসাইড করে ফেলেছে!”

“একদম ফালতু কথা বলবে না। আমার বউ মোটেও ঐরকম ছিল না!”

“বাবা! এখনও এত টান!”

কথাটা বলে, একটা বাঁকা হেসে, ঢকঢক করে গলায় খানিকটা কোল্ডড্রিংক ঢেলে দিল বেশ্যাটা। তবে এর পরেই, থাম্বস্‌ আপের বোতলটা নামিয়ে রেখে অদ্ভুত গম্ভীর গলায় বলল—

“তাহলে দায় তো তোমারই। অস্বীকার করো কোন সাহসে? মারধোর করতে না তো?”

কেন জানি না, এই কথাটা শোনার পর আমার খাওয়া থেমে গেল। মনে হল, পুলিশের পর আমি যেন দ্বিতীয়বার আটক হলাম এই মহিলার কাছে। খুব ধীরে ধীরে বললাম—
“তুমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো পাড়ায়, কোনোদিন আমি আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছি কি না! কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি কি না!”

“কিন্তু ভালোবাসতে কি?”

“নাহ্‌… তা আর বাসতাম না।”

এই কথাটা এত সহজে এই বেশ্যাটাকে বলে দিলাম, অথচ কোনোদিন নিজের কাছেই বলার ধক ছিল না! এই অতি সাধারণ, শরীর বিক্রি করা মহিলা ঠিক যেন মনের ডাক্তার! কালো জল, যার বাইরে থেকে তল বোঝা যায় না, তার ভেতরে হাত চুবিয়ে পোড়খাওয়া মনোবিদের ভূমিকাতেই যেন ঘুলিয়ে দিল সে সবকিছু, আর মারল শেষে মোক্ষম ঘা—

“কিন্তু ছেলেটাকে এরকম দূরছাই করো কেন? ওর কী দোষ?”

“দোষ নেই?”

“আছে! ওর জন্মের ওপর ওর হাত ছিল বুঝি?”

এই প্রশ্নে আমি চুপ। আবার ওই মহিলা—

“আর অস্বীকার করতে পারবে যে ওর এইরকম জন্মের জন্যে তুমি তোমার বউকেই দুষতে?”

নাহ্‌! আমার বিরিয়ানি খাওয়া ঘুচল। মেয়েটা মুখ পড়তে পারে। ওর সামনে আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। পাঁঠার মাংসের সাথে সাথে এবার আমার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে খেতে শুরু করবে। আমি তাই খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। তারপর আরও একটু বেশি রাতের দিকে চুক্তি অনুযায়ী যখন আমরা আর-এক প্রস্থ সংগমরত, তখন আমার বুভুক্ষু পুরুষাঙ্গ নিজের ভেতরে নিতে নিতে বেশ্যা বলে উঠল—

“তোমার ছেলে দুর্ভাগ্য জড়িয়ে জন্মেছে। ওকে পাপ বলে দাগিয়ে আর ওকে বাঁচিয়ে মেরে রেখো না।”

আমার তক্ষুনি মনে পড়ল একদিন আমার বউয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় আমি আমার ছেলের মুখের ওপরেই বলেছিলাম—

“সালা ঢ্যামনা কোথাকার! কোত্থেকে একটা পাপ এসে জুটেছে কপালে!”

এই বলে ওর পায়ের কাছে এক দলা থুতু ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর অনেক রাতে যখন নিজেই গেটের চাবি খুলে বাড়ি ঢুকলাম, শুনতে পেলাম বাথরুমে বসে আমার বউ গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর বলছে— “আমি আর তোকে আগলে রাখতে পারব না বাবা, কিন্তু এবার আমি নিজেকে বাঁচাব।”

প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু পরে যখন আরও রাত্তিরে আমার ছেলের ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরের ফাঁসের সঙ্গে আমি আমার বউকে ঝুলতে দেখলাম, বুঝতে পারলাম আমার বউ আসলে কত ভীতু ছিল! নিজের সন্তানকে সে আর অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারছে না বলে নিজেই পিঠটান দিয়ে পালাল! অবশ্য আমার বউ যে ভীতু এটা আমার, হাসপাতালে ছেলের জন্মের পর পরই নিশ্চিত হয়ে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। ডাক্তার যখন বলেছিল—

“আপনাদের ছেলের সেক্স ডিটেক্ট করা যাচ্ছে না।”

“তার মানে ডাক্তারবাবু?”

“ওর যৌনাঙ্গের জায়গায় ভ্যাজাইনা আর পেনিস দুটোরই হিন্ট আছে।”

কথাটা শুনে আমার বউ সাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও তো ছেলের গর্ভধারিণী! ওর কি কলিজায় আরও জোর নিয়ে আসা উচিত ছিল না? উচিত কি ছিল না পক্ষীমাতার মতো তার সন্তানকে সব বিষ থেকে আগলে রাখা? আর সে মা হয়ে এ-কাজ পারল না বলেই না আমার মনে ধীরে-ধীরে ধীরে-ধীরে বিষের পাহাড় জমতে লাগল আমার ছেলের জন্য।

কিন্তু আমারও কি উচিত ছিল না এই আগলে রাখার শ্রমে আমার বউকে সাহায্য করা! কিন্তু এখন আর এসব ভেবে লাভ কী? মরে গিয়ে আত্মোপলব্ধি খুব সহজ কাজ। করতাম যদি বেঁচে থাকতে! তাই আমার মতন এরকম বাপ মরে গেলে ছেলেই বা কেন কাঁদবে! তবে ঠিক আমার ওপর ঘৃণা থেকেও নয়, ছেলে আমার এমনিতেই কোনোদিন কাঁদবে না। ছোটো থেকেই আমি, আমরা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি ওর পক্ষে কান্নাকাটি করা আসলে বিলাসিতা। আমার ছেলে অত বিলাসী নয়।

আর শেষে বলি কীভাবে মরে গেলাম। ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে খেয়াল নেই কখন একটা তুমুল উত্তেজনার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ শুনি চারিদিক থেকে অনেকের মিলিত ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর। “এই ধর ধর সামলে… মাগো রক্ষা করো… এ কী সর্বনাশ হয়ে গেল মা…” এইরকম সব কথার টুকরো কানে ভেসে আসছে। ঠাহর করে দেখি বাঁশের মাচায় করে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল একদল বেহারা। পথে কোনোভাবে কারও পা বেসামাল হয়ে পড়ায় গোটা মাচাটাই মাঝখান থেকে ভেঙে বেসামাল হয়ে গেছে, এবং প্রায় একতলা বাড়ির সমান উঁচু প্রতিমা তখন মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ার উপক্রম হয়েছে। কাঠামোর পিছনে দড়ি বেঁধেও স্থির রাখা যাচ্ছে না, মাচাও রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। এদিকে অত টানাটানিতে প্রতিমার দেহে তখন চিড় ধরতে শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে উত্তেজনা, হাহাকার বেড়েই চলেছে। আর আমি তখন নিজের অজান্তেই এক অমোঘ টানে এগিয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছি প্রতিমার পায়ের কাছে। চিড় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর আমার চোখের সামনে অন্য একটা পুরোনো ছবি স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার ছেলে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে ফিরে এসেছে। সেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ‘যেমন খুশি সাজো’ বিভাগে আমার ছেলে নাম দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসেছে সেই পোশাকেই। পরনে সস্তার জরির শাড়ি। লাল রঙের। সস্তার গয়না। ইমিটেশনের। আর পিঠের সঙ্গে বাঁধা, পিচবোর্ড দিয়ে তৈরি দশটা হাত। হাতে অস্ত্র নেই। সেদিন আর আমার মাথার ঠিক থাকেনি। মেরে মেরে বুকে, গলায় দাগ ফেলে দিয়েছিলাম। ঠিক এই ভঙ্গুর মৃৎপ্রতিমার মতো। আমার বউ চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ওই চণ্ডাল মূর্তি দেখেছিল। এই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়ানো এই অসহায় গণর মতো।… আবার একপ্রস্থ হই হই রব উঠল চারিদিকে। সেই রবে ভয়ের মাত্রা আগের চতুর্গুণ। আমি দেখলাম কাঠামোর পিছনে দড়ি ধরে দাঁড়িয়েছিল যারা তারা একে একে দড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। আর পারছে না। মানুষ তো, কত আর সহ্য করবে? দেবীই ভেঙে যাচ্ছেন!…

একসময় দেবীমূর্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। সামনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন মানুষের ওপর। সামনে দাঁড়ানো সেই বেশ কয়েকজন মানুষের মধ্যে আমিও ছিলাম।