Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

অলোকপর্ণা

মেহিকো

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু কুন্তলা অদিতিকে মরে যেতে দেখল ভোরবেলা। সম্ভবত অতিরিক্ত মাদকসেবনের ফলে চোখের সামনে মুখে গ্যাজলা তুলে সে নিথর হয়ে গেল, অথচ কুন্তলার ঘুম ভাঙল না। বেলা ন-টা নাগাদ চোখ খুলে সে তার পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকল চুপ করে। মনে হল, পাতাগুলো দেহের আন্দাজে একটু বেশিই বড়ো। তবে কি আরেকটু লম্বা হওয়ার কথা ছিল তার? সময়ের আগে মাসিক হয়ে না গেলে কি আরও ইঞ্চি তিন-চার লম্বা হতে পারত সে? তখনই মনে পড়ল আজকে তার ঘুমের মধ্যে অদিতি মরে গেছে।

সে ভেবে রাখল দুপুরে অদিতিকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কখনো মাদক সেবন করেছে কি না।

অদিতি আর কুন্তলা এখনও একে-অপরকে প্রিয় পাখি, ফুল, ফল, প্রিয় ঋতু ইত্যাদি ইত্যাদি মারফত চিনছে।

এ বড়োই পেলব পর্যায়।

হাওয়াশহর ছেড়ে কলকাতা ফেরার বছর দুয়েক পর কুন্তলার উপরের বারান্দায় এলে বাড়ির সামনের উঠোন বাঁধানোর কাজ চোখে পড়ে। জনা তিনেক মিস্ত্রি এটা সেটায় ব্যস্ত। মেঝে পিটিয়ে সমান করছে যে-জন তাঁর গলায় তুলসির মালা। চকিতে দীপাকে মনে পড়ে যায় তার। কেবল তুলসির মালা বলে নয়, আজকাল সমস্ত অলংকার, সমস্ত রঙিন ফুলে তার দীপাকে মনে পড়ে। লোকটা মেঝে পেটাতে পেটাতে মাঝে মাঝে চুপ করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। কী ভাবছে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করে কুন্তলা। যে-দৃষ্টি সে রচনা করেছে, তাতে নিকট নয় বরং সুদূরের আঁচ আছে। বিগত সময়ের কথা সে ভাবছে হয়তো শারদীয় রোদে মাটি পেটানোর কাজের অবকাশে। লোকটাকে তার ভালো লেগে যায়। সে তার নাম দেয় কৃষ্ণ।

আজ আকাশ বাতাস চমৎকার। শুধু অদিতির মরে যাওয়াটুকু বাদ দিতে পারলে সবকিছু খাসা।

এইসব রোদের কথা, আলোর কথা, হাওয়ার কথা তার দীপাকে জানাতে ইচ্ছে করে, অথবা সুমনকে, অথবা তুলিকেও। এইসব রোদ, আলো, আকাশ ছবিতে মুড়ে পাঠিয়ে দিতে চায় সে ওদের নাগালে।

প্রাতঃরাশ সেরে বারান্দায় এসে কুন্তলা দেখতে পেল কৃষ্ণ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ফলবতী শীর্ণ পেঁপে গাছের সামনে। উঁকি দিলে শিশুপেঁপেকে ঝুলন্ত দেখা যাবে। আজ পেঁপে গাছ কাটা পড়বে এমনটাই নির্ধারিত হয়েছে। গোটা উঠোন বাঁধাতে গেলে তা অনিবার্য। দূর থেকে পেঁপে গাছের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া কৃষ্ণকে দেখে সে চুপ করে। একটু পরে কৃষ্ণ দাঁ তুলে নিলে অকুস্থল থেকে সরে আসে কুন্তলা। পালিয়ে আসে। তার আর ক্ষমা চাওয়া হয় না। নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করে সে আর দিনের আলো অল্প নিভে যায়।

অদিতির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার যাবতীয় উদ্যমও উবে যায় কীভাবে যেন। ভয় করে, যদি ফের একঘেয়ে হয়ে ওঠে শহরটা? তার তো আর পালাবার পথ নেই!

তবু জোর করে তৈরি কুন্তলা হয়। নিজেকে সাজায় কাজলে। মেট্রোয় উঠে কানে গান ভরে দেয়। গানে গানে চোখে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে, মনে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে। লড়াই করে বিস্মৃতির সঙ্গে, লড়াই করে অন্ধকার সোঁদা কালো পাথরের সহিত যা সে সিসিফাস হয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে কোনোমতে।

বেলগাছিয়া যায় আর তার দীপাকে মনে পড়ে। আজকাল যত্রতত্র শব্দে শব্দে দীপা। কুন্তলা সংযত হয়।

অদিতির মন আজ আগের থেকে ভালো আছে। সে অনেক কিছু বলছে ব্যক্তিগত সপ্তাহ সম্পর্কে। কুন্তলা শুনছে মন দিয়ে, ভুলেও যাচ্ছে কিছু কিছু। খেয়ালবশত অদিতির হাত সে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

কুন্তলা কিছু অনুভব করে না। মনে মনে সতর্ক হয়। অদিতির আঙুলের ফাঁক দিয়ে নিজের আঙুল গলিয়ে দেয়। একফোঁটা আঠা নেই তাদের ছোঁয়ায়। হাত আলগোছে ছেড়ে দেয় সে। আলো আরও নিভে আসে।

অদিতি বলে চলে শামুক আর ব্যাঙের মাংসের কথা। হরিণ, কচ্ছপ ইত্যাদির কথাও প্রসঙ্গে এসে পড়ে। সে চুপ করে অদিতিকে দেখে, মনে পড়ে গত সপ্তাহে তারা একে-অপরকে একটি চুম্বন উপহার দিয়েছিল। অথচ আজ কোথাও কোনো আঠা নেই। অদিতির সঙ্গে মিউজিয়ামে যায় কুন্তলা। অদিতির পাশে মাথা নীচু করে হাঁটে। মনে পড়ে, তারা একদিন একটা মাঠে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি। “এই তো সেদিন অদিতি…” তার ইচ্ছে হয় বলে ওঠে, “এই তো সকালেও আলো ছিল!”

“কী বলবি বলছিলি?”

“আজ সকালে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”

“কী স্বপ্ন?”

“দেখলাম তুই মরে গেলি চোখের সামনে”

“ও আচ্ছা…”

“তুই কখনো ড্রাগ নিয়েছিস?”

“Never, I hate it”

“অদিতি,”

“বল!”

“I am not feeling anything”

“মানে?”

“মানে, স্বপ্নটা দেখার পরেও আমার ঘুম ভাঙেনি, এমনকী ঘুম থেকে উঠেও যখন কথাটা মনে পড়ল আমি চুপ করে বসে রইলাম, দুঃখ না, ভয় না, কিছুই হল না ভিতরে, am I getting bored again?”

অদিতি আর কুন্তলা চুপ করে দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে থমকে থাকে।

“কী হবে তুই বোর হয়ে গেলে?”

“আমি জানি না। আমার হাতে তো আর কোনো অপশন নেই, আমি সব ছেড়ে কলকাতা ফিরে এসেছি। এখানেও যদি এমন হয়, আমার যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আমি কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছি অদিতি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

“বোর হয়ে গেলে অন্য কোথাও যাবি, তোর তো সেই সুযোগ আছে!”

অদিতি সব সমস্যার সহজ সমাধান করে দেয়। কুন্তলা অদিতির হাত ধরে উঠতে পারে না আর।

উঁচু থেকে সে শহরটাকে দেখে, দূর থেকে দেখে। কখনো কারও বেশি কাছে আসতে নেই, এ-কথা শহরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আলো আরও কিছুটা নিভে যায়।

আলগোছে অদিতির গাল টিপে দেয় কুন্তলা, তার কাঁধে মাসাজ করে, গাড়ি প্রায় তার বাড়ির সামনে এসে পড়েছে।

অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় বৃষ্টি নামে বেশ জোরে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে থাকে সে। ছাতা খোলে না। মনে পড়ে দীপার বাড়ির ছাদের গাছগুলির কথা। তারাও এখন ভিজছে।

“What if I were a tree?”

গাছের কোথাও যাওয়ার যন্ত্রণা নেই, কোথাও পালানোর অভীপ্সা নেই। কুন্তলাদের দু-খানি পা আছে। আর আছে একটা অসহ্য মস্তিষ্ক।

সুমনের সঙ্গে কাল দেখা করার কথা তার আজ এই মুহূর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

কুন্তলার মাথার উপর দিয়ে উড়ে একটা ছোটো এরোপ্লেন উড়ে মেঘের ভিতর আত্মগোপন করল। অন্তরাল থেকেও সে তার ডাক শুনতে পেল। তার মনে পড়ল, পাসপোর্টে মেহিকোর ছারপত্র ঘুমিয়ে আছে দু-মাস হল। সেইভাবে চেষ্টা করলে কি যাওয়া যেত মেহিকোয়? গিয়েই বা লাভ কী? কিছুদিন পর তো আবার কালো বল পাথর ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের উপরে তুলতে থাকা।

কুন্তলা তুলিকে ফোন করে, জিজ্ঞেস করে, সবাই যদি এত যন্ত্রণায়, তবে মানুষ বেঁচে আছে কেন?

তুলি জানায়, আর কোনো অপশন নেই তাই। মৃত্যুটা কোনো অপশন নয়। ফোন কেটে যায়।

সিঁড়ি ভরে আছে মদের গন্ধে। অর্থাৎ সহোদরটি ঘরে ফিরেছেন। তাকে মদ্যপান সম্পর্কে সাবধান করতে কুন্তলা তার ঘরে ঢোকে।

দেখে, চোখ বুজে একটা দাঁড়ির মতো লম্বা হয়ে সে বিছানায় পড়ে আছে, তার এক হাত তার হাফপ্যান্টের ভিতর, নিশ্চুপে স্বমেহন চলছে। চুপিসারে দরজা বন্ধ করে কুন্তলা নিজের ঘরে এসে পড়ে।

কোথাও কোনো মেহিকো নেই তার জীবনে। এ-সত্য সে টের পায়।

একদিন সে সবেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। নিজেতেও। এ-কথা সে অনুভব করে সে অদিতিকে মেসেজ করে, “আমার মনে হয় না আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবেসে উঠতে পারবো অদিতি। আমি ভিতরে ভিতরে বড়ো ক্লান্ত। আমার দ্বারা নতুন করে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমার এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে কবে আমি নিজেও টের পাইনি। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে সবকিছু। কোথাও আলো জ্বলে ওঠে না। কোথাও বিস্মিত হই না। আমার কাউকে মনে পড়ে না আর।”

কুন্তলা বুঝতে পারে অদিতি মেসেজটা দেখেছে। কিন্তু সে কোনো জবাব দেয় না।

আকাশ ভেদ করে একটা উড়োজাহাজ চলে যায়। কুন্তলা চুপ করে তার ডাক শোনে। কলকাতা থেকে সমস্ত প্লেন এখন মেহিকোতে চলে যায়। সব নদী যায় মেহিকোতে বয়ে। সমস্ত ডাক এখন মেহিকো থেকে আসে আর কুন্তলা জানে মেহিকো বলে আসলে কোথাও কোনো দেশ নেই, পৃথিবীর সকল দেশ কুন্তলা এবং সকল দেশ শ্বাসরোধকারী, সকল শহর সমান অন্ধকার।

ফোনে আলো জ্বলে উঠলে সে বোঝে অদিতি উত্তর দিয়েছে। ফোন খুলে দেখে অদিতি লিখেছে, “আমারও। আমারও।”

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

শরদিন্দু সাহা

একটি সম্ভাবনার সূত্র

এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি! না বা হ্যাঁ কোনো উত্তরই তেমন দেওয়ার কথা ছিল না। কেউ তো নেই এমন উত্তরটা সুবোধের ঘাড়ে এসে চাপিয়ে দেবে। এই মুহূর্তটা এমন একটা ভাবনার দোলনায় ও দুলছে, বোঝা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে কোথায় গিয়ে থামবে কিংবা থামতে চাইবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর হয়, আবার হওয়ার জন্য অপেক্ষাও করে। অপ্রত্যাশিতভাবেই দরজাটা খুলে যায়, সুবোধ নিজে চেয়েছে কি চায়নি, সেটা নিজেও জানে না। এসে গেল হুট করে। বড়ো আজব লাগে, তাজ্জব বনে যেতে ক্ষণেক সময় নেয় না। ভাবনার সমুদ্রটা মনের দরজায় এমন করে আছড়ে পড়ে, জানে না কী জমা ছিল, বোধ, সুখ, অসুখ, জমা অন্ধকার, টুকরো আলো ঢেউয়ের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পড়ে থাকে তো তারপরেও অনেক কিছু – দৃশ্যমান ও অদৃশ্য। ও বুঝতে পারল সবটাই সত্যি। দূরে দাঁড়িয়ে যে-লোকটা সুবোধের উপুড় হওয়া প্রত্যক্ষ করছিল, ভেবেই বসল, লোকটা এমন কিছু একটা হারিয়েছে যা জরুরি ভোগ্যবস্তু বলে তো মনে হচ্ছে না, কল্পনার ইতিউতি, রেখায় কিংবা জলরঙে।

সুবোধ কিছুতেই নিজেকে এখনও সামলে উঠতে পারেনি, তবে কারা যেন জন্ম নিতে চাইছে, উপকরণগুলো আপনা-আপনি হাজির হয়ে মূর্ত হবে বলে গোল পাকাচ্ছে। নিজেদের ইচ্ছেটা তো জন্মায়নি, আকারের কথা উঠবেই বা কেন।

সুবোধ কিছু কি দেখতে চাইছিল! এই মায়াময় পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে কেন ও ভাবতে পারবে না ওই যে ছাদটা কবে থেকে এক ফাটল ধরা চতুর্ভুজ হয়ে পড়েছিল হঠাৎই চারটে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। জং ধরা টুকরো টিনগুলো দেয়ালের ছাদ হয়ে যাবে। দেয়ালের গায়ে কত তাড়াতাড়ি শ্যাঁতলা জমে সবুজ না হয়ে ঘন লাল রঙে লেপ্টে যাবে। সুবোধের চোখের সামনেই কেউ যেন ছিটিয়ে দিয়ে গেল। রমেশকে দেখল হাঁ হয়ে খুঁজছে এমন কিছু যা ওর নিজের দেখার কথা ছিল। কী আশ্চর্য! রমেশের এমন অসময়ে আগমন! ওর কি আসার কথা ছিল? এমন একটা পথের সাক্ষী হয়ে কবেই তো আর একটা পথ কেটে কেটে চলে গেছে অনেক দূরে। ফেরত যদি আসতেই হয়, এমন অনেক বস্তুর সঙ্গে সংঘাত ঘটবে, ওর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে। প্রমাণ করা এত সহজ হবে না, ও সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। সুবোধ কেন দেখল অনেকগুলো জানালা ওর দিকে ছুটে আসছে। ছোট্ট শিশুটি সেগুলো জাপটে ধরবে বলে কত আকুলিবিকুলি। রমেশ এক নরম মিষ্টি চাহনিতে ওর লাফালাফি সতৃষ্ণ হয়ে দেখছে। ওর হয়তো গ্ৰহণ বর্জনের পালার সুযোগ এসে হাজির হয়েছে যা ও অনেককাল আগে হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতছাড়া করেছে। রমেশ ভাবতে পারে এই পাওয়া আর এক পাওয়া, এই জীবন অন্য আর এক জীবন। না, না সুবোধ রমেশের এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে যাবে কেন? রমেশের পুনরাবির্ভাব যে অনস্বীকার্য এর প্রমাণের জন্য ওর দৃষ্টিই কি যথেষ্ট নয়? তাই যদি হবে, রমেশ যে ভূমির উপর এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তা এমন করে আলগা হয়ে যাচ্ছে, তার তো না-দেখার কিছু নেই। আচ্ছা, রমেশের উপস্থিতি অদৃশ্য হচ্ছে দেখে, ও কি সমুদ্রের কথা ভাবতে পারে না, পারবে নাই-বা কেন! সেই জলস্রোত কি এক জায়গায় থেমে থাকে, চলে গিয়েও তো ফিরে ফিরে আসে। রমেশের বাসনা তো ফেলনার নয়, সময়কে বন্ধু করে কত রকমের অবয়ব নিয়ে ফিরে আসে, কত বৃক্ষ, কত শাখা-প্রশাখা, কত ছায়া, কত মানুষের প্রতিধ্বনি হয়ে সে হয়তো অন্য কায়া কিন্তু ও তো রমেশই ষোলো আনা নিশ্চিত। ছাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল তো সুবোধ আর দেয়ালটা ছাদ হয়ে আশ্রয়ের ঠিকানা হল। রমেশ আর রমেশ রইল না, পরেশ হয়ে প্রদক্ষিণ করল দুই ছাদের চারপাশে। রমেশ তারস্বরে ডাকল বলেই না, অনেক কথা চালাচালি করল বলেই না, না-হয় কোনো জন্মে দেখেছে, তখন তো সুবোধের হাঁটি হাঁটি পা পা। পাড়ায় পাড়ায় অনুরোধে উপরোধে খালি গলায় গান গাইত, গাইতে গাইতে এক সময় কোথায় যে হারিয়ে যেতে চাইল, সে গল্পই তো শোনাল রমেশকে। রমেশ ওর কথায় এতই মজল, ভাবল পরেশ যদি হতে পারত, এই জীবনই তো চেয়েছিল ও। তারপর তো পরেশের বঞ্চনা, মুখ থুবড়ে পড়া, দোরে দোরে যে-জীবন চেয়ে চেয়ে বেড়িয়েছিল, সকলে থুথু ছিটিয়েছিল। এত কিছুর পরেও রমেশ পরেশ হতে চেয়েছিল। এমনকি যেটুকুনি হামবড়াই ভাব রমেশের ছিল, সেটুকুনি বিসর্জন দিয়েও সুরে সুর মেলাতে দ্বিধা করল না, যদি প্রয়োজন হয় সময়কে চুরি করতে এতটুকু দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দেবে তুড়ি মেরে। সব চাওয়া-পাওয়ার কথাই তো সুবোধ নিজের কানেই শুনল।

সংসার বড়ো মধুময় নয়, সুবোধ কি জানত না, জানত। না না, একেবারেই কোনো চাপা অভিমান ছিল না। ঘরনি পুত্র-কন্যা থাকবে না, সে আবার হয় নাকি, অদ্ভুত এক জগৎ। সকাল সন্ধ্যা যে-কথাগুলি চলত, সবই কিন্তু মিলিয়ে মিলিয়ে। শান্তি এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেত, কী জানি মনে হত এ-ঘর পালটি খেয়ে ও-ঘরে চলে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল রমেশের ইচ্ছেগুলোই পাক খেয়ে ওর মনের কোণে কোথাও বাসা বেঁধেছে। পাখির বাসা নয় যে খড়কুটোগুলো দূর ছাই করে উড়ে উড়ে চলে যাবে, শক্তপোক্ত ইঁট বালি সিমেন্ট গাঁথা, ঝড়ের সাধ্য কি তেড়েফুঁড়ে এসে তুবড়ে দেবে। কথাগুলো চলনসই, মিষ্টি তেতো ঝাল। তাতে কার কী আসে যায়। যেমন করে আসতে চায়, তেমন করে আসে। সুবোধই বলছে, শান্তিও শুনছে, যেমন করে শুনতে চায়। কেন শান্তির মনে হয় শেলফের উপরে কোথাও বসে কোকিলটা কুহু কুহু রবে ডাকছে। এমন সংসার হওয়া কি এত সহজ, দুজনেরই সহজ যোগদান এ-কথা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। শান্তি কি টের পায় ওর প্রতিটি উচ্চারণ থেকে থেকে কেমন উঁচু-নীচু হয়। শান্তি গ্যাসের নব বন্ধ করতে করতে, ছেলের দুষ্টুমির জন্য কানমলা দিতে দিতে সুবোধ বোধ হয় কোকিলের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পায় নিশ্চয়ই, না হলে এমন করে নড়েচড়ে বসে কেন। ওর গলার স্বরটা কিন্তু খাপে খাপে মিলে যায়। সবটাই কি সত্যি? কোনটা অসত্যি টের পাওয়া যে সোজা নয়, বিলক্ষণ জানে শান্তি। কোকিলটা আড়াল টপকে সোফার মাঝখানে কাচের টেবিলটার উপর বসে লেজ নাড়িয়ে শান্তির নজর কাড়ে, কথার পরে কথা সাজিয়ে এমন এমন কথা বলে, কোথায় যেন শুনেছে ও। অমনি সময় কথার ফাঁকে চলে আসে, মা, বাবা, দিদি। ওদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। কবে কোথায় চোখ বুজেছিল। যাওয়ার মুহূর্তগুলোকে চিনে নেবে এমন সাধ্য কার। ওরা অনর্গল বলে চলেছে। কোনো দৃশ্যই আর একটা দৃশ্যকে ছুঁতে চাইছে না। কেউ কারও দিকে তাকিয়েও দেখছে না, অথচ দূরত্ব যে কোনোকালে ছিল না, সেটাও ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না। শান্তি কি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, তোমার বিদায়বেলার অনুভূতিটা একবার বলো না মা। অসাড় দৃষ্টি শান্তির দু-চোখের আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে নির্বাক করে দিচ্ছে। বাবার মুখটা বেদনায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, সময়ের কথা বলবে এমন প্রবৃত্তি কোথায়। কোকিলের স্বর বড়ো ম্রিয়মাণ হয়ে শান্তির দু-পাশে ঘুরঘুর করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। এত চোখের জল দু-চোখে, সবই কী অশ্রুত, কেঁদে ভাসিয়েছিল না, বলেছিল না আমায় শক্ত করে ধরে রাখ, যেতে দিস না বোন। সুবোধকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?’ ‘তোমার ইচ্ছেগুলো আমার কল্পনায় এসে জোড়া লাগছে।’ শান্তি এই প্রথম সুবোধের কথায় কোথায় যেন স্বস্তি পেল। তবে প্রপঞ্চময় এতগুলো বছর কেমন করে ডুব দিয়ে তলদেশে তলিয়ে গেল। মা শান্তির চুলে বিলি কেটে বলল, ওই দেখ কত আলো। সূর্য নয় তো। ‘আমি কি বলেছি তাই!’

এত আলোর বন্যা। তীব্র গতি তার। কেমন অদ্ভুত রঙের ছাউনি নিয়ে ঘর বেঁধেছে। ওরাও এসেছে সেই ঘরে। অবন্তীর খেলার মাঠের গোল বৃত্তটার উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সকল সঙ্গীসাথী। ওরা এত জোরে দৌড়ল, আলোগুলো ছিটকে গেল এপাশ-ওপাশ। এই রং তার অচেনা। কথার আগুনে পুড়ে মরবে বলে বসন্ত কোন পথ দিয়ে এসেছে কে জানে। ও তো দাঁড়িয়ে ছিল বোধিবৃক্ষের নীচে, জলময় কুণ্ডলীকে ঘিরে ছিল ওর যাত্রাপথ। এমন প্রতিকূলতার যে মুখোমুখি হবে একদিন কে-ই বা জানত। সময় যে এমনভাবে পাক খাবে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে এসে এমন সাধনায় যে সিদ্ধিলাভ করবে কিংবা অবন্তী যে দাঁড়িয়ে থাকবে পথের মাঝে যে-পথের চিহ্নে লেগে থাকবে মাকড়সার জাল, বসন্তের অনুভূতি গোল পাকিয়ে তাই না হয়েছে আকাশচুম্বী। রমণীও এনেছিল ভাবনার প্রতিধ্বনি হয়ে, সে তো কমদিন নয়, উল্টোপথের ইশারা পেয়েছিল বলেই না মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেবে নিয়েছিল ও-পথে যাব না। এই বৃত্তে আসবে বলে গোপন আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই না গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়া। হাতড়ে বেড়িয়েছিল অনেকটা সময়, বুঝেই বলেছিল, ‘এসব আমার নয়।’ কী জানি কোনো আসবাবপত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছিল নাকি অন্য কোনও পাওনাগণ্ডা! কত মানুষই তো কত কিছুর পেছনে ছোটে, কে কার খবর রাখে। হৃদয়ের পরিধি মাপে, এমন দুঃসাধ্য কার! রমণীর অসময়ে আগমনীবার্তা অবন্তীকে নাড়িয়ে দেবে, বোঝাই যায়নি। জলের বৃত্তটা খেলা করছে আগুনের গোলা হয়ে, হতে পারে তো এমনটা? ভয় হয় কখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, রমণীর চেতনা ডুবসাঁতার কাটতে কাটতে কোন মাঝ সমুদ্রে যে মুখ বাড়াবে, জানবে না তো। কত তো জলজ প্রাণীদের উৎপাত, ওদের ভয়ঙ্কর দাঁত-মুখ খিঁচুনি, চিনতে পারলে তো। কপাৎ করে গিলে নেবে না চিবিয়ে চিবিয়ে, বোঝা তো মুখের কথা নয়। অবন্তী আবিষ্কার করে কতগুলো খুঁটি পোঁতা রয়েছে। কে পুঁতেছে, কখন পুঁতেছে, কেনই-বা পুঁতেছে, মুখে কুলুপ এঁটেছে। কখন আবার কথার খই ফুটবে, কেউ জানে না। অবন্তী স্তব্ধ। হাঁ করে চেয়ে আছে। জানা-বোঝার ঊর্ধ্বে, রমণী কেমন করে এত কাছাকাছি এল, বসন্তই-বা চলে গেল কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! অবন্তী শুধু বৃত্তাকারে ঘুরপাক খায়। আগুনের গোলা ছুটে চলে আসে সুযোগ বুঝে অবন্তীকে গ্ৰাস করবে বলে। কার কোন কারসাজি কে বলবে! দেখতে তো পাচ্ছে কতগুলো মানুষ উলঙ্গ হয়ে ধেই ধেই করে নাচছে। ওদের মুখনিঃসৃত কোনও শব্দই অবন্তীর কানে পৌঁছচ্ছে না।

বাড়িগুলো অনেক উঁচু। কত নালিশ বোঝাই করে এনেছে ঝোলায়। কোথায় কোন নালিশ জানালে কোন জানালার কাচ টপকে সঠিক টেবিলটাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘আমায় একটু দেখুন প্লিজ।’ অম্বালিকা ততক্ষণে মানুষের দঙ্গল থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে ছবিটাকে পাল্টে নিয়েছে নিজের মতো করে। দ্রুত পা চালিয়ে যারা সিঁড়ি টপকাতে এগিয়ে গেছে, হঠাৎই তারা মুখ থুবড়ে পড়ল। যা হবার নয় তা হল। যাদের চলন নিম্নগামী ছিল তারা কী এমন কথা ওদের কানে কানে বলল, ওরা নড়েচড়ে বসল। ঘেমে নেয়ে একশা হলে ভাবল একটু ছায়া হলে মন্দ হয় না। এত চড়া আলো হয়তো এই সময়ে বিপজ্জনক। ওদের কর্মচারী প্রফুল্ল ছাতা মাথায় বৃষ্টির ঝাপটা ভুলে গিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে, হাতে পতপত করে দুলছে ঝাণ্ডা। কবেকার কথা, বলেছিল, ‘মাহিনাটা পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিন না বাবু।’ মাথা নত করে চোখ দুটো নীচে নামিয়ে কাকুতিমিনতি করে কথাগুলো বললেও কেউ কর্ণপাত করেনি। সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি। অম্বালিকার বাপ ঠাকুরদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছিল যে-মানুষটি, ওই তো, স্বপন বাঁড়ুজ্জেই হবে, লোকটা গটগট করে হেঁটে এসে প্রফুল্লর চুলের মুঠি ধরে কষিয়ে এমন জোরে থাপ্পড় মারল চক্বর খেতে খেতে এসে ও লুটিয়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে। স্বপন যেমনটি দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। বলার কথা তো অনেকই ছিল। অম্বালিকার সখী ছিল অনুত্তমা, মনের কোণে বিতৃষ্ণা নিয়ে ও বেড়ে উঠেছিল, বুঝতেও চায়নি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ভাণ্ডারটার ফারাক, ভেবেছিল এক ঝটকায় সব নিংড়ে নেবে, তাই বলে কি এত দিনের খেলায়, ঘুমের ঘোরে এত চোখের জলে বুক ভাসানো, সান্ত্বনার বাক্যগুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত, শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল ওই স্বপন বাঁড়ুজ্জে। এই সময় অনুত্তমাই একরাশ অভিযোগ নিয়ে রাগে ফুঁসছিল কালভার্টটার উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে। শুকনো চোখে বিদ্রূপের হাসি। কী আশ্চর্য! ওই প্রাচীরের কোল ঘেঁষে লোকটা দাঁড়িয়ে কেন? এমন অশোভন হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সময়ের মুণ্ডপাত করা যায়! যায় কি? আপনারাই বলতে পারেন। যদি যায়, প্রফুল্লই-বা ওর হাতের মুঠোয় এসে গেল কেমন করে! এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। বরঞ্চ ছবিটার আদ্যোপান্ত যে-রকমটা হলে মনের কোণে দাগ লাগতে পারত, অনুত্তমা ফোঁস করে এসে লোকটার টুটি চেপে ধরবে, বংশ নির্বংশ হবে। লক্ষ্যটা কৌণিক বিন্দুতে এসে এমন করে নাচানাচি করল, লোকটা প্রফুল্লকেই গণশত্রু হিসেবে বেছে নিল। এই তো আজব কাণ্ড! প্রফুল্লর বাঁচা না-বাঁচার খতিয়ান মনের হিসেবের খাতা থেকে তো বাদই পড়ে গেছে কয়েক দশক আগে তাই না! এতটা অনমনীয় অনুত্তমা, এতটাই বিধ্বস্ত প্রফুল্ল। তাই কি স্বপন আরও বিধ্বংসী, রুখে দাঁড়িয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে। অম্বালিকার কিছুই নজর এড়ায়নি। সেনানীরা লেফট রাইট লেফট রাইট মার্চ করে এগোচ্ছে। কী জানি চুলের মুঠি ধরে দ্বিগুণ তেজে বনবন করে ঘোরানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। স্বপনের অঙ্গুলিহেলনের অপেক্ষায় সময় গুনছে। অম্বালিকার চোখে কি ছানি পড়েছে! এত কনকনে ঠাণ্ডায় এত খটখটে রোদ পুরো চাতালটাকে ঘিরে ফেলেছে কী করে! এমনটা হওয়ার সময় হয়েছে না কি হয়ে চলেছে অম্বালিকা টের পাচ্ছে না। এই প্রাচীর, প্রফুল্ল অনুত্তমারা সময়কে এমন করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল কেমন করে! অম্বালিকার চোখের পাতা পিটপিট করে, কোনো শাসনই এই দৃষ্টি মানে না।

চলো এবার নিজের দেশে যাই। একটু না হয় চিন দেবার বৃথা চেষ্টা করি না কেন? রজনী অরুণকে এমন একটা প্রস্তাব দিল যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছের ডালে পাতায় পাতায় আঁধারের প্রলেপ এসে জমছে একটু একটু করে। ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে দরজায় এসে কড়া নেড়ে জানতে চাইবে ‘তোমরা কি ঘুমের দেশে চলে গেছ? এবার কি জেগে উঠবে?’ মিনমিনে একটা স্বর ভেসে এল বুঝি। এমন কণ্ঠস্বর এর আগে রজনী কখনও শোনেনি বুঝি। কারা এসে বাসা বেঁধেছে এই নির্জনে। কোনো বনলতা, আকন্দ, ঘেঁটু ভাট কলাবতীরা গোপনে আস্তানা গেড়েছে কি না কে জানে। ওদের মিলনমেলায় জন্ম নিয়েছে কথার পরে কথা। অরুণ ফাঁকফোকর দিয়ে দেখল, গাছেরা মানুষ হতে চাইছে। আর্ত চিৎকারে ভেসে আসছে গুল্মলতার গোঙানি। ওরা চলে-ফিরে বেড়ানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করতে চাইছে। কাঠুরিয়ারা গাছ হবে বলে কত যে মন্ত্র আওড়াচ্ছে, রজনীর বোঝা দায়, তবুও কান পাতে। অরুণ মানুষকে জানোয়ার হতে এর আগে কখনও দেখেনি। এমন অভাবনীয় দৃশ্য যে প্রত্যক্ষ করবে, এমন সাধ্য ছিল না অরুণের। ও-পার থেকে এ-পারে আসার দূরত্বের মাঝখানেই ওরা শরীরটাকে বাঁকিয়ে কুকুর হতে চাইল। আবার কারও নিয়ন্ত্রণহীন ইচ্ছের দৌলতে বিড়াল হতে চাইল। মানুষটাকে বাস্তুসাপ হতে দেখল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেল কচুবনে। তাই বলে এমন দশা ঘটবে পিসতুতো মামাতো ভাইবোনেরা গাছ হয়ে যাবে! এই উত্তাল সময়ে ওরা স্থির হতে চাইছে বলে। কৈশোরে ওদের স্থির সঙ্কল্প ছিল ওরা মানুষের চেয়ে বড়ো মানুষ হবে। সেই আশায় সার জল দিয়ে ওরা অনেক ধাপ পার হল। কেউ কেউ বলল, এটাই কি পথ! কথাগুলো মন্দ লাগল না। অরুণ রজনীরা যেদিন গাছের গোড়ায় জল দিতে লাগল, শাল শিমুল গরানরা তরতর করে বেড়ে গেল, তখন ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মাঠটা কম সময়ে পার হয়ে গেল। তাতে কী এল গেল, দেখার সুখ হল না। কী আর করা! মনের সুখের আশায় রাস্তাটা পালটাতে পালটাতে কত পথ যে হাঁটল তার কি হিসেব-নিকেশ আছে। গাছেরা সমস্বরে বলল, ‘কোথায় যাও হে?’ ‘তোমরা কারা?’ ‘সে জেনে তোমাদের কাজ কী?’ ‘উপায়টা বাতলে দিতে পারি।’

গাছ হবে? আরে ঘাবড়াও কেন? মজবুত ঘরও হবে, সকল আশা পূর্ণ হবে। মুহূর্তে রজনী অরুণরা দেখল, লম্বা গাছগুলো কেমন ছোটো হয়ে যাচ্ছে। ওরা বলল, ‘আমরাও ছোটো হব।’

তরণী এসে তীরে ভিড়ল। অপেক্ষায় কারা কারা আছে কেউ আর গুনতি করেনি। যারা স্রোতের প্রতিকূলে যাবে তারাও আছে, যারা স্রোতের অনুকূলে যাবে তারাও আছে। বাজার সরকার, দোকানদার, কোয়াক ডাক্তার, কবিরাজ, শিক্ষক, ছাত্র, কারবারিদের ভিড়ে এককোনায় নীরবে দাঁড়িয়েছিল অরণি। কেন দাঁড়িয়েছিল বাকিদের কাছে অজানা, নিজেও জানে কি এই অপেক্ষা ওকে কোন গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কী যেন দেখতে চেয়েও দেখতে পেল না। উচ্ছল ঢেউ হঠাৎই টলমল করে উঠল। খুশিতে ডগমগ হয়ে পাড়ে এসে দোল খাবে এমন ইচ্ছায় ওরা লেজ দোলাল। পাড়ের কিনারে কেউ তো নেই। ওরা শুধু খলবলিয়ে চলেছে মাঝদরিয়ায়। কেউ যে হাত বাড়িয়ে গলুই থেকে হাত বুলিয়ে দেবে, এমন দৃশ্যও দেখা গেল না। বরঞ্চ তরণী যে-দিকে ছুটছে, হাওয়ার বেসামাল শব্দ কানে ভাসছে। অরণি যে-ছবিটা দেখতে পেল তরণীর দুলুনিতে পাড়ের গাছের ছায়ারা ভেঙে চুরমার হলে গাছেরা ভীত সন্ত্রস্ত হল, চিনতে চেষ্টা করল ওরা কারা! দু-চারটে বুড়ো উদবেড়াল চোখ পাকিয়ে আর কান খাড়া করে শুনল, গাছেরা কেমন করে কথা কয়। অরণির দিকে তাকিয়ে করুণ আর্তিতে জন্মের মুহূর্ত দেখার বাসনা জেগে উঠল, আবার পরখ করে যদি দেখতে পেত। ওরা গভীরে যেতে চায়। ওদের শরীরে মিশিয়ে দিতে চায় নিজেদের শরীর। ওরা জানে যে দর্পণে ওরা নিত্য মুখ দেখে ওদের ছবি নয়। অরণিও জানে ওদের বেদনা কেমন করে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। অরণি ওদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও কষে রাখে। অরণিকে ডেকে ওরা কথা কয়। ‘শান্ত সলিলের দেখা যদি পেতাম, দেখ না, তোমার পায়ে পড়ি।’ আলোয় আলোময় হয়ে মানুষের চঞ্চলতা ঘুরে মরে। এই অশান্ত পথিকের লাফঝাঁপ নিরুপায় হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন সব থেমে যাবে, ওরা ওদেরকে দেখে জেনেবুঝে নেবে কতটা বাড়লে কতটা মেলে দিলে ছায়াবীথি হবে, কতটা গুণবতী আর রূপবতী হলে ওরা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বলবে, ‘তোমরা আমাদের আত্মীয় হবে গো।’ পেছন ফিরে তাকায় না, তরঙ্গ তুললে শরীর আর শরীর থাকে না। রাতের আঁধারে নিথর হয় বটে, তাতে কেবলই সবকিছু অচেনা ঘুম ঘুম মনে হয়। অরণি ওদের কথার জালে জড়িয়ে বেবোল হয়। অরণি কী মনে করে বলেই ফেলে, ‘ও গাছ, তুমি শব্দের জন্ম দাও, প্রসববেদনায় জেগে ওঠো, তোমার কথা শুনে আমি একটুখানি কান্না করি, কথা কাটাকাটি করি, ঝগড়া করি। নদী না-হয় কান পেতে শুনুক। এসো না ত্রিনাথ হয়ে যাই।’

অঙ্গদ একদিন ঠিক করেছিল যুদ্ধে যাবে। সে কথা প্রদ্যুৎকে ঘটা করে বলেই ফেলেছিল। মাঠটা এতদিন খালিই পড়েছিল, কোনো ভ্রূক্ষেপই করেনি। দর্শকদের চিৎকারে ফিরে ফিরে দেখল, বল্লাল পাঁই পাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠ জুড়ে। উরুটা সমান তালে চলছে। বিপক্ষের দলে এমন কেউ নেই ওর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কোথায় যেন অঙ্গদের স্বপ্নটা লাফিয়ে উঠল। একটু আগেই নয় নম্বর রেজিমেন্টের দল নিজেদের কারিকুরি দেখিয়ে ব্যারাকে ফিরে গেছে। এই সুযোগে করবে বাজিমাত। একবার যাচাই করে দেখবে ও কোনো অংশে কম যায় কিনা। ওই তো পাঠশালা। ছেলেমেয়েদের হৈ হৈ রৈ রৈ কলরবে ক্লাসরুমটা শূন্য হয়ে যেন মাঠের মাঝখানে চলে এল। কে আর কার কথা শোনে। সকল প্রশ্নের উত্তর সবুজ ঘাসের বুকে লেখা হয়ে যায়। ওরা উচ্চকন্ঠে নিজের কথাগুলোই এমন করে বলতে চায় যেন এতকাল সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। অঙ্গদ আবারও চরকির মতো ঘুরপাক গেল। উল্টোপথ দিয়ে কত লোক তো গলাগলি করে ওদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অঙ্গদকে দেখল কি দেখল না, না দেখতে চাইল না – সে আর অঙ্গদ কেমন করে জানবে। অঙ্গদের বড়ো শখ ওই জলপাই রঙের পোশাক পরে শহরের বড়ো রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যাবে। মাঠটাকে যেভাবে দেখতে চাইছিল কিংবা দেখতে চাইবে তার কোনো আগাম সংকেত কেউ পৌঁছে দিতে চাইছে কিনা। মাঠটা ছিল তো বর্গাকার ধীরে ধীরে কেন ত্রিভুজ আকৃতির রূপ নিল। বল্লাল আর অঙ্গদ এই দৌড়ের খেলায় জিতবে কেমন করে? কারা ওদের স্বপ্নগুলো নিয়ে লারেলাপ্পা খেলছে। পাঠশালা আর মাঠটাও একই পংক্তিতে এসে বল্লাল আর অঙ্গদের জন্য ভিন্ন নিশানা নিরূপণ করে দিতে চাইছে। অঙ্গদ আর প্রদ্যুৎ এখন অন্য খেলায় মত্ত। পাগলা ষাঁড়টা ক্ষেপে উঠেছে। মাঠের অধিকারের নেশায় ও ঠিক করেছে এখন সকলকে গুঁতিয়ে লম্বা করে দেবে। অঙ্গদ আর বল্লালের দফারফা করে ছাড়বে। সকল যুক্তিকে ও ফুৎকারে ওড়াবে, কে আর কত নজর করবে, কানে যে ও তুলো গুঁজবেই গুঁজবে, হাসাহাসি কানাকানি চুলোয় যাক। তীব্র বেগে ও ছুটে আসছে। অঙ্গদও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ষাঁড়ের দুটো শিং, অঙ্গদ আর বল্লালের শক্ত হাতের মুঠোয়। ষাঁড় ভেবেছিল দেয়ালে ঢুঁ মারবে, হবে চিৎপটাং, সে গুড়ে বালি। তার আগেই খেল খতম। বিনা সওয়ারিতেই শিং দু-টো ফটাস। মাঠটা ওদের বোঝার আগেই কেমন করে বর্গাকার হয়ে গেল। স্বপ্নগুলো নিয়ে ওরা বনবন করে ছোটে এই ফাঁকে, ষাঁড়টার চোখদুটো ঝাপসা হলে ভাবে, ‘বাপরে এ আবার কী আজব কাণ্ড কারখানা!’

সুবোধ সারি সারি মরার শরীর আগলে রেখে যে উপলব্ধিতে ভেসে যেতে চাইল তা জীবনও নয়, মৃত্যুও নয়, কোথায় কী এমন এক সময়ের সন্ধিক্ষণ তার শুরুই-বা কোথায়, শেষই-বা কোথায়, অদ্ভুত এক শূন্যতা যা পূরণ করার উপায়ান্তর নেই। এক-একটা মাপজোকহীন বিন্দুতে যারা আপন নিয়মে খেলে বেড়াচ্ছে যেমন করে ওরা খেলবে বলে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। সৌমিত্রদাকে দেখে চমকেই গেল সুবোধ। মঞ্চের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে সংলাপ আওড়াচ্ছে, নিস্তরঙ্গ নদীর উদ্বেলতা থেমে গেলে যেমন ধীর অচঞ্চল হয় তেমনি। উচ্চস্বরে মঞ্চ দাপিয়ে আওড়াতে গেলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায়, চোখের পলকে দেখে নেয় দর্শকাসনে বসে থাকা মুখগুলো কতটা বুঁদ হয়ে আছে। ওদেরকে ধাক্বা মারবে বলেই না জোড়হাত করে মঞ্চটা প্রদক্ষিণ করে শব্দের তীক্ষ্ণতাকে বুঝতে চায়। হঠাৎই তর্জন-গর্জনে মঞ্চ কেঁপে ওঠে। দর্শকরা বিমূঢ় নির্বাক হলে সৌমিত্রদা বুঝে নেয় নিউটনের তৃতীয় সূত্র নিজের নিয়মে সংযোগ ঘটাচ্ছে, শব্দতরঙ্গ তরতরিয়ে সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার সৌমিত্রদা মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি শূন্যে ভাসিয়ে এমন সংলাপ আওড়াচ্ছে যা কিনা মনে হচ্ছে মঞ্চস্থ নাটকের বিষয়বিভ্রম। এমন উচ্চারণের সময় যে আসন্ন প্রিয় দর্শকমণ্ডলী আঁচ করতে পেরেছে কি! দর্শকাসন থেকে হাততালি দেয় অবন্তী, অম্বালিকা, অরণি আর প্রফুল্ল। মাঝখানের তিনটে সিট বাদ দিয়ে রমেশ আর শান্তি বসে গুনেই চলছে কোন আসনটা ফাঁকা, ওখানে কি নির্বান্ধব জীবনানন্দ এসে বসবে একটু পরে। অঙ্গদ আর বল্লাল সামনের সারিতে বসার সুযোগ পেয়ে গেল! উদ্যোক্তাদের ম্যানেজ করে না ভিআইপি কোটায়! তবে কি ষাঁড়ের খাতায় নাম লিখিয়েছে! কত কী-ই না হয়। সুবোধ ঢোক গেলে। সুবোধের মনটা আনচান করে। প্রাণভরে মানুষটাকে এক পলক দেখবেই দেখবে। চারধারে কথা উড়ছে। ফিসফিসানিটা নিতে না পেরে রাগে ফুঁসল। সৌমিত্রদা চিৎকার করে, ‘এই তোমাদের হাততালি দেওয়ার সময় হল, এতদিনে বৃথাই আমি শত শত রজনী পার করে এলাম।’ একরাশ অসন্তোষ নিয়ে অস্থির হয়ে বলল, ‘ভাব-অভাবের পালা সাঙ্গ হয়েছে, এবার আমি নিজের ঘরে যাব।’ সুবোধ পেছনের সারি থেকে গ্রীনরুমে ঢুকেই দেখল সৌমিত্রদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিড়বিড় করছে, ‘এদের জন্ম! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ডুব দিতেই শেখেনি, বলে কিনা পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে রস কিনবে, আবার আগাম বুকিং!’ আরে এ তো মনোময়! পার্কের জলাশয়ের পাশের আসনটায় বসে আকাশের তারা গুনছিল। রজনী অরুণকে সাক্ষী রেখে নিজের বঞ্চনার হিসেব কষছিল, আকাঙ্ক্ষিত জীবন আর ফেলে আসা জীবনের পাঠশালায় কে কোথায় কেন? এ যেন কোথায় হাজির করছে, কতকাল ধরে অজানিত, তবু সুবোধের জগৎটা নাটকের শেষ অঙ্কের মতো ঘুরে ফিরে চলে আসে। সৌমিত্রদাও আসে কি! আসে হয়তো, আসবেই হয়তো কিন্তু এখন নিশ্চুপ অন্ধকারে সৌমিত্রদার কান্নার শব্দই শুধু শোনা যায়, বাকিরা শুধু কুশীলব।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

তীর্থঙ্কর নন্দী

বটবৃক্ষদের আত্মকথা

মিলনপুরের গ্রামের রাস্তাটি মোট সাতটি পুকুরের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে সোজা থানার দিকে চলে যায়। মিলনপুর থানা খুব বিখ্যাত। থানা ছাড়িয়ে রাস্তাটি চলে গেছে সোজা বাজারের দিকে। বাজারের আগেই বিশাল এক মাঠ। মাঠের মাঝখানে বড়ো আকারের একটি বটবৃক্ষ। বৃক্ষটি স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝাঁকড়া। ঝুড়িও নেমে এসছে। ফলে সন্ধ্যা হতে না হতেই এলাকাটি বেশি অন্ধকার অন্ধকার লাগে। মানুষজনের এই অন্ধকারটি বেশ পছন্দের।

বৃত্ত এবং তৃণা মিলনপুরেই থাকে। দু-জনেরই বাড়ি বাজার লাগোয়া। তবে তৃণা থাকে সামান্য দূরে। রেশনের দোকানের কাছে। দু-জনেই শৈশব থেকে প্রচুর বটবৃক্ষ দেখে আসছে। বিভিন্ন জায়গায়। স্কুলে কলেজে যেতে আসতে। বন্ধু বান্ধবদের বাড়ির কাছাকাছি। বিভিন্ন ভ্রমণস্থলে ইত্যাদি। কিন্তু মিলনপুরের এই বৃহৎ বটবৃক্ষটি তাদের অনেক আপন। কাছের। এর নীচে বসে হাসি কান্না ভালোবাসা গল্পগাথা সব প্রাণখুলে করা যায়। কখনো এই বৃক্ষ চোখ রাঙায় না। বাড়িতে রিপোর্ট করে না। রাগ করে না। এই বটবৃক্ষ সন্ধ্যার পর ছড়িয়ে দেয় অন্ধকার। স্নেহভরা ভালোবাসা। গোপনীয়তা।

নিত্য সন্ধ্যায় বৃত্ত আর তৃণা এই বটবৃক্ষের কাছে আসে। খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে। শুরু করে কথামালা। গল্পগাঁথা। প্রেমকাহিনি। পরস্পরের ছোঁয়াছুয়ি। আবদার আহ্লাদ ধৈর্য অধৈর্যর খেলা কখনো মন কষাকষি। চোখজোড়া থেকে নেমে আসে জলবিন্দু। দুঃখ। রাগ বিরাগের গালগল্প। আবার বহুদিন শরীরের খেলা। বৃত্তর হাত চলে যায় স্তন জোড়ায়। যোনিপথে। মাংসল স্তনজোড়া তৃণার যেন খুব সুগন্ধযুক্ত। আকৃতি নরম। বৃত্তর হাত স্তনজোড়ায় পড়লে তৃণার চোখজোড়া বুজে আসে। মাথা বৃত্তর কাঁধে এলিয়ে পড়ে। আবার যোনিপথে হাত গেলে তৃণার নরম শরীর কেঁপে ওঠে। সুখে যেন কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গোঙানি আসে। বটবৃক্ষটি তৃণাকে ঝুড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আগলে রাখে। বেশি অশান্ত কামুক হতে দেয় না। তৃণাকে নির্দিষ্ট মাপে বেঁধে রাখে। একসময় রাত হলে দু-জনে উঠে পরে। বাড়ি চলে যায়।

এই শহরে নলবনের কাছে ঝাঁকড়া দু-টি বটবৃক্ষ। দু-টির মধ্যে দূরত্ব দু-শো হাত। একটি বাঁধানো। অন্যটি না-বাঁধানো। বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে নিত্য গল্পগুজব চলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। বৃদ্ধরা একটু আলাদা বসে। বৃদ্ধারা বসে একটু দূরে। নিজেদের মতন করে। এমনভাবে দুদল বসে যে কোনো দল তাদের গোপন কথা শুনতে পায় না। অথচ গল্পমালাসিঙ্গারা চলে। গল্পমালায় থাকে রস কষ বুলবুলি মস্তক।

দু-টি বটবৃক্ষই জানে নিত্য বিকাল সারে পাঁচটার পর কারা কারা আসতে পারে। বাঁধানোতে আসে সত্তরের বুড়ো নিলয় বাহাত্তরের বুড়ো অজয় পঁচাত্তরের বুড়ো জয়মাল্য আশির বুড়ো সুজয়। উলটো দিকে সত্তরের বুড়ি মাধুরী পঁচাত্তরের বুড়ি সরলাবালা আশির বুড়ি নয়নতারা পঁচাশির বুড়ি বৈজয়ন্তি। মোট আটজন বসে। বাঁধানো বটবৃক্ষ জানে এই আটজন কোনো হিসাব মিলিয়ে আসে না। চারজন চারজনের ভিতর কোনো আবেগ যুক্তি প্রেম বিরহ কিছুই নেই। আসে শরীর স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে। কেন-না এঁদের মোটামুটি সবারই ডাক প্রায় আসছে আসছে। ফলে সান্ধ্য হাঁটাচলা একটু নিজেদের ভিতর গল্প করা সবই আর-একটু বেঁচেবর্তে থাকার ওষুধ বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে বুড়োদের গল্প এখন সুগার প্রেসার প্রেস্টেট ইত্যাদি। এই বটবৃক্ষ জানে আগে অনেক তরুণদের সমাগম হত। সেই সমাগমে কি তখন নিলয় অজয় জয়মাল্য সুজয়রাই আসত! হয়তো তাই। বটবৃক্ষর স্মৃতি প্রখর। তার পাতাগুড়ি আজ থাকে কাল থাকে না। ঝড়াপাতার জন্য তার কম কষ্ট হয় না। যেমন আজ আর নিলয়ের স্ত্রী নেই। মৃগীতে মারা যায়। অজয়ের বড়োছেলে দুর্লভ আত্মহত্যা করে। বটবৃক্ষ সব জানে। বটবৃক্ষ যেন অনেকদিন আগে মাধুরীকে দেখে। শর্টকাট ফ্রক পরা। সবে ষোলোর যুবতী। ছিটকে যাচ্ছে যৌবন। ফ্রকটি ছিল সাদা কালোয়। সরলাবালা কি স্লিভলেস ব্লাউজে আসত! হতে পারে। পাতার ভিতরে এত যুবক যুবতী কাকদল যে বটবৃক্ষর খেয়ালও ক্ষীণ হয়ে যায়। শুধুই শব্দ সান্ধ্য কা কা। বটবৃক্ষ জানে নয়নতারা সরল মেয়ে। বিবাহ হয় চল্লিশ বছর আগে। ফর্সা গায়ের রং বৈজয়ন্তি খুব হেসে হেসে কথা বলত। এখনও এই বুড়ি বয়সেও বলে। ওর হাসিতে মাখানো থাকে এক মায়া প্রেম আদর।
দু-শো হাত দূরে যে-বটবৃক্ষটি সেখানে ইদানীং বসে ফ্রডেরা। মানে ঠগেরা। আগে আসত স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কলেজের ছেলেমেয়েরা। গত কুড়ি বছর ধরে আসতে থাকে ফ্রডেরা। ঠগেরা। অর্থাৎ দেশ ডিজিটাল হওয়ার পর। হয়তো কথাটি ভুল। মানুষ তো আগেও ঠগ ছিল! বটবৃক্ষ ঠগের তারতম্য বোঝে। বটবৃক্ষ প্রেম অপ্রেমের ভাষা বোঝে। কান পেতে শোনে ঠগেদের বাক্যালাপ। ইদানীং রনো রুনি আসে। হাতে দামি অ্যানড্রয়েড। অনেক বাড়তি সুবিধাও আছে মনে হয় এই সেটে। বটবৃক্ষের একদম উত্তরের কোণে দু-জনে বসে। একটু ঘন হয়ে। মনে হয় যেন প্রেমিক প্রেমিকা। কিন্তু তা না। দু-জনেই বর্তমান সময়ের ফ্রড। ঠগ। খুব চাপা গলায় দু-জনে কথা বলে। এমন চাপা যে বাতাসের কানও জড় ভোঁতা হয়ে যায়। অথচ নরম বাতাস দু-জনের আসে পাশে ঘোরাঘুরি করে। বটবৃক্ষের কচি পাতা দোল খায়। রনো রুনিকে দেশের কোণে কোণে ফ্রডেদের গল্প বলে। দু-জন দু-জনের ফ্রড বন্ধুদের কনট্যাক্ট নম্বর সেভ করে। মেসেজ করে ইত্যাদি। কবে কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে হবে কীভাবে করতে হবে কোন কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কী পরিমাণ অর্থ আছে এদের সবই ঠোঁটস্থ। মুখস্থ। এরা সপ্তাহে দু-একটি করে অ্যাকাউন্ট পুরো সাফ করে দেয়। এই সাফের পিছনে এদের প্রচুর মাথা ঘামাতে হয়। খাটতে হয়।

নিত্য নতুন রহস্যময় গল্প ভাবতে হয়। আর সেইসব রহস্যময় গল্প একদমই গাঁজাখুরি নয়। গল্পগুলি ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের কাছে বকুল ফুলের গন্ধের মতন নেশা ধরায়। নেশায় ঘোর লেগে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সব গোপন তথ্য এক এক করে দিতে থাকে। অ্যাকাউন্ট খুব মসৃণভাবে জিরো ফিগারে নেমে আসে ইত্যাদি।

ব্যস্ত শহর থেকে একটু দূরে হৃদয়পুর। একটু দূরে বলতে বাসেও যাওয়া যায়। ট্রেনেও যাওয়া যায়। বাসে গেলে এক ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে ডান দিকের ওভার ব্রিজের নীচে বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান। মাসি মেসোর। এই দোকানে মটন বিরিয়ানি দু-শো! মসৃণ আলু। নরম। মাংস যেন জিভে ঝোলানো। দাঁত কাঁপে না। দাঁতে জোরও লাগে না। হাড় থেকে নিঃশব্দে মাংস খুলে আসে। এই দোকানে বিরিয়ানি খেয়ে যদি একটু এগোনো যায় চোখে পড়ে সুড়কির রাস্তা। একটু লালচে। সেই লালচে রাস্তার পাশে মানে বিডিও অফিসের কাছাকাছি একটি বিখ্যাত বটবৃক্ষ আছে। রাস্তার পাশে বলে বটবৃক্ষের গুঁড়ির কাছে সাদা মার্কিং আছে। যারা গাড়ি নিয়ে আসে তাদের সেই সাদা মার্কিং-এ অনেক সুবিধা হয়। কেন-না রাস্তায় আলোগুলি দেখলে মনে হয় অনেক পুরোনো অথচ আলোয় রশ্মি এত নরম নিস্তেজ যে কোথায় গাছ কোথায় পুকুর কোথায় কচুবন কিছুই বোঝা যায় না।

আজ শনিবার জ্যৈষ্ঠের দশ। একটি কালো নেক্সান গাড়ি এসে থামে। গাড়িটি নতুন মডেলের। গাড়ির কাচও কালো। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কে ভিতরে। বটগাছের কাছে এসে গতি ধীর হয়ে যায়। গাছ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামে। নামে দু-জন মধ্যবয়সি মানুষ। একজন পুরুষ। একজন মহিলা। বটবৃক্ষ বেশ ভালোই চেনে দু-জনকে। নাম প্রিয়ক। প্রিয়া। বটবৃক্ষ জানে প্রতি শনি রবি দু-জন আসবেই। ঘাসে রঙিন রুমাল বিছিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নীচু স্বরে চলবে গল্প আড্ডা চুমাচুমি। বদান্যতা অসভ্যতা। বটবৃক্ষ গত তিন বছর ধরে দু-জনেরই চেনে। দু-জনেই পরকীয়াতে লিপ্ত। দু-জনেরই গোছানো সংসার আছে। নিজস্ব বাড়ি আছে। দু-জনেরই একটি করে সন্তান আছে। তবুও কেন কীসের টানে এই পরকীয়া! কেন সংসারকে ফাঁকি দিয়ে এতদূরে আসা। পরকীয়াতে গোপনীয়তা বেশি থাকে বলেই কি এত আনন্দ! মজা! অথচ পরকীয়াতে যে-রক্তমাংসের শরীর আছে সাজানো গোছানো সংসারেও তো সেই রক্তমাংসের শরীর থাকে! তবে কেন পরকীয়াতে এত আনন্দ!

হৃদয়পুরের বটবৃক্ষটি একটু পৃথক। সে সব বটবৃক্ষর সঙ্গে নিজেকে মেলায় না। এই বটবৃক্ষ অনেক বটবৃক্ষর কথা জানে। প্রিয়ক প্রিয়া নিজেদের ভিতর আলোচনা করতে করতে জানায় গত দু-বছর কোন কোন বটবৃক্ষের নীচে তারা গল্প করে। বদান্যতা করে। অসভ্যতা করে। প্রতিটি বটবৃক্ষ প্রিয়ক প্রিয়ার বদান্যতা চেনে। পরকীয়া চেনে। হৃদয়পুরের বটবৃক্ষর নীচ থেকে নেক্সান কালো গাড়ির কালো কাচে ঢাকায় বাড়ির ফেরার পথে মাসি মেসো বিরিয়ানির দোকানে একটু প্রিয়ক থামবে। থেমে প্রিয়ক নামে। প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। জানি না কেন প্রতি শনিবার রবিববার প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। বটবৃক্ষ দূর থেকে দু-জনকে দেখে। বটবৃক্ষর কি কোনো অন্তর্দৃষ্টি থাকে! তার ডালের ভিতর দিয়ে! কচি পাতার ভিতর দিয়ে! প্রিয়া একজন সংসারী মহিলা। সন্তান-সহ সুখে সংসার করে। তবুও কেন পরকীয়ার এত টান! প্রশ্নটি কিন্তু এই সমাজে কারোর কাছে নয়। একমাত্র বটবৃক্ষর কাছে। বটবৃক্ষই জানে সব উত্তর। বটবৃক্ষরাই জানে সবার উত্তর। ফলে এখানেই শেষ হল বটবৃক্ষদের আত্মকথা গল্পটি।

Categories
2023-Sharodiyo-Golpo

পাপড়ি রহমান

পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হিম আর উষ্ণবয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

টিলার উপর থেকে রাবারবাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার পূর্বে আমি ঝুক্কুর ঝুক্কুরের দুর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়। দীর্ঘকাল ফাটকবাসের পর এক্কেবারে গ্যাস বেলুনের মতো উড্ডীন হতে পারা। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো ঘটনাই ছিল সেটা। আমার আতঙ্কবাদী বাবা ওই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে দুই পা ফেলতে দিলেন। আর আমার এইরকম গ্যাসবেলুন হয়ে ওড়ার সুযোগ ঘটল রাজাকাক্কার কল্যাণে। রাজাকাক্কা মানে বাবার ফুফাত ভাই। তদুপরি তিনি ফরেস্টার বা আরও ঊর্ধ্বতন কোনো পদে কর্মরত। বাবা তাকে মোটামুটি দেবতাজ্ঞান করেন। রাজাকাক্কার মেয়ে বিউটি আপা আমার চেয়ে পাঁচ ক্লাস উঁচু। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যে কিনা আমারই ইশকুলে ভর্তি হল। আর বিউটি আপার সাথে আমার খাতির জমল দুধে ভেজানো চিতইয়ের মতো। যাতে কেবল চিত হয়ে ভেসে থাকা। উপুড় হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটল না কোনোদিন! রাজাকাক্কা আর বিউটি আপার ব্যাপক টানাহেঁচড়ায় আমার আতঙ্কবাদী বাবার দিল সামান্য নরম হল। কিন্তু বন্দুকটা রইল আমার দিকে তাক করা। এই এক আরেক বিভ্রম। ভয় আর ভালোবাসা। দোস্তি আর ঘৃণা। আমি জানি তাক করে রাখা বন্দুকের নলটি অন্যত্র সরিয়ে নিলে বাবা একেবারে অন্য মানুষ। সদ্য জন্মানো শিশুর গায়ের পেলবতা সেই মানুষের মনে সেঁটে থাকে। অচেনা রূপ-গন্ধ-আশ্রয়। অথচ অহেতুক এই বন্দুক তাক করে রাখা — বাবাকে একেবারে আতঙ্কবাদীতে পর্যবসিত করেছে।

একেবারে পরম পাওয়া এই ঝুক্কুর ঝুক্কুর। ট্রেন আমাকে নিয়ে ছুটল ম্যালা দূর! ম্যালা দূর কত দূর? এইটা একটা প্রশ্ন বটে! ম্যালা দূর যে কত দূর তা মেপে বের করা মুশকিলের বিষয়।

ঝুক্কুর ঝুক্কুর করে ট্রেন গতি নিয়ে ছুটে চলল। আর গাছেদের-পাতাদের গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মেরে যেতে লাগল। আহ! কী করে বোঝাই যে সবুজের কী অদ্ভুত গন্ধ আছে! গাছেদের-পাতাদের গন্ধ কি মাতৃজঠরের গন্ধের মতো? আমি জানি না। মাতৃজঠর মানে কী তাই তো আমি ভালো জানি না!

উথালপাথাল করা সবুজগন্ধে ভাসতে ভাসতে আমি ট্রেনের জানালায় মুখ রাখলাম। তখন দুই ধারে পাহাড়ের সারি, বনজ ঝোপ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যেতে লাগল। যেন ওরা মেঘের বিদ্যুৎ। সামান্য ঝিলিক মেরেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টি পিছলে যায় লালমাটি আর দেবদারুর বনে। ভিনদেশি ত্বক নিয়ে ইউক্যালিপটাস। তেজপাতার ডাঁটো পাতার বৃক্ষরাজি। পাহাড় আর সমতলের আলোছায়ার ভেতর দুলতে দুলতে ট্রেন আমাকে সত্যি সত্যি যদুনাথপুরে পৌঁছে দিল।

নেমে দেখি ফরেস্টের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জিপে ওঠার পর চলন্ত জিপের পেছনের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি কোথায় সেই পাহাড়ের সারি? কোথায়ই-বা রেললাইন? সব হাওয়া হয়ে গেছে। আর বিস্তীর্ণ সবুজ আমাদের ঘিরে রেখেছে। গাছেদের-পাতাদের এতটাই মেশামেশি যে, কোনটা যে কী গাছ তা-ও আলাদা করা দুরূহ। সেই নিবিড় বনরাজি, গাঢ় সবুজ গাছপালা আর পাখিদের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে দেখি সেগুনের প্রায় গোলাকার ঢাউস পাতারা আকাশচারী হয়ে আছে। ত্রিপল ঢাকা জিপের ভেতর সবুজ গন্ধ ভরে উঠলে আমি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি — একটা গাছ আমি অন্তত চিনতে পেরেছি — সেগুন!

যখন আমার অপু-দুর্গার মতো গ্রামময় এক ছেলেবেলা ছিল, তখন আমি সেগুনকে বেশ ভালোই দেখভাল করতাম। কেউ তো আর জানে না — বোশেখের ঝড়বৃষ্টির পর সেই গাছের নীচে পড়ে থাকা ছিন্নপত্র ও গোটা গোটা ফল দেখার লোভে কতদিন আমি ছুটে গেছি। সেগুনের পাতা ডলে দুই হাত রাঙিয়ে তুলেছি। ওইসব খবর কেই-বা রাখে? ওই অপু-দুর্গার জীবনে কেই-বা আমার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি করবে?

আমার আতঙ্কবাদী বাবার খপ্পরে পড়ার আগে গ্রামময়, বৃক্ষময়, বৃষ্টিময় — স্বাধীন এক ছোটোকাল আমাকে মারাত্মক সুখী করেছিল!

আমার সেই ছোটোকালেই সেগুন আমার সঙ্গী হয়েছিল। সেগুনের ফুল ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আকাশের তারকার আকৃতির। সেই ফুল নাকের পাতায় বসালেই পড়ে যেত। আমি ফের বসাতাম। এভাবেই দিনমান ফুলের উত্থান-পতন খেলায় মেতে থাকতাম। সেগুনের অনতিদূরে বাতাবিলেবুর গাছ। তাতে যখন ফুল ঝেঁপে আসত — আহা কী যে তাদের রূপ আর সুগন্ধ! আমাদের ছুটন্ত জিপের কোনো ধারেই বাতাবিলেবুর একটা গাছও নজরে এল না। শুধু গাছের গন্ধভরা, পাতার গন্ধভরা সবুজ হাওয়া কেটে কেটে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল।

জিপ থামল বেশ উঁচু একটা টিলার নীচে। নেমে দেখলাম সুদীর্ঘ সিঁড়ি টিলাটাকে দুই হাতে পেঁচিয়ে ম্যালা দূর উঠে গেছে। আমরাও আমাদের তল্পিতল্পাসহ উঠতে লাগলাম। যতই উপরে উঠতে লাগলাম চারপাশে সন্নিবিষ্ট সবুজ পাতা ছাড়া আর কোনো দৃশ্য নাই! ওই প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৃক্ষ আর আকাশ ছাড়া আর যেন কিছুই নেই!

সিঁড়ি আর শেষ হয় না। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। জলতেষ্টায় কণ্ঠ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠলে — রাজাকাক্কার সুবিশাল বাংলো।

টিলার উপরের ওই বাংলো থেকে চারপাশে তাকালে দুই-চারটা ছড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওইসব পাহাড়ি ছড়া বা ঝরনার জলে রোদ্দুর পড়ে রুপালি রঙের নহর বইয়ে দিচ্ছে।

এই যে একেবারে ছবির মতো সাজানো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি — যা দেখে মনে হয় স্বর্গ কোনোভাবেই এর চেয়ে উত্তম হতে পারে না। তবে সবচাইতে আনন্দের বিষয় এইখানে আমার আতঙ্কবাদী বাবা নাই। তার কড়া শাসন আর প্রচণ্ড মারধরের উপদ্রব নাই।

আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। আমাকে যদি আর ফিরতে না হত ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এককোণে ফেলে রাখে — অযত্নে-অবহেলায়।

পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি রোদ্দুর বাংলোটিকে স্পর্শ করে হেসে আছে। যেদিকে তাকাই সবুজের নানা রূপে একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থায় পৌঁছে যাই। আদতে এসব হল সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর। কোন্ সবুজ যে আমার নয়ন জুড়িয়ে দেবে আর আমি সেদিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকব!

বাংলো থেকে নীচে তাকালে পা শিরশির করে। বিস্তর সবুজের ভেতর আমার ঘূর্ণায়মান আঁখি হঠাৎ করে খুব কাছে এক রুপার নহরের সন্ধান পেয়ে যায়। সবুজ বনানীর মাঝখানটা চিরে যেন গলিত রুপার ধারা বইছে। আর ওই রুপালি স্রোত বহু নিম্নে সমতলভূমির ওপর সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে।

বাংলোতে দাঁড়িয়ে আমি ওই ঝরনার কল্লোল শুনছি। আহা! কে জানে মরণের পর স্বর্গ কেমন? কেউ তো ফিরে এসে বলে নাই স্বর্গের রূপ আসলেই কেমন?

কিন্তু আমি জানি এই বন-বনানীর সবুজ আর নমিত ঝরনাধারার চেয়ে স্বর্গ কিছুতেই উত্তম হতে পারে না।

রক্তবর্ণহিম

লোকালয় পেরিয়ে বহুদূরে বরমচালের রাবারবাগানটিতে যে-সবুজ রাজ্য গড়ে উঠেছে, তাতে হিমও যেন নামে একেবারে আপসহীনভাবে। কারণ সূর্যের আলো ওই অরণ্যে বা বনানীতে ছিটকি পাতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করে। রাতভর ওঁশ পড়ে পাতার উপর আর ওই ওঁশ বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপিয়ে ঝরতেই থাকে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই দেখি অপরূপ দৃশ্যাবলি। দূর্বাঘাসের ওপর অজস্র ছোটো ছোটো হীরে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।

ঘুম ভাঙার পর ঝরনা থেকে তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে হয়। প্রতিদিনের নাস্তার মেনু ঘরে তৈরি কাঁচা ছানা, হাতে বেলা রুটি, ছোলার ডালের হালুয়া। কোনো কোনো দিন গরম ভাত, ভর্তা, বাসি তরকারি। বাংলোতে কোনো পানি সাপ্লাইয়ের বন্দোবস্ত নাই। পানি আনতে হয় অনেক নীচুতে গিয়ে, ঝরনা থেকে। সেই পানি রোদের বুকে ফেলে গরম করা হয় এবং ওতেই চলে স্নান।
প্রায় বিকেলেই আমি আর বিউটি আপা হাঁটতে বেরোই। হাঁটবার জন্য আমাদের সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হয়। আমরা হাঁটি রাবারবাগানের ডানা ঘেঁষে — কখনো-বা রাবারবাগানের ভেতর। গাছেদের আর পাতাদের ঝাঁঝালো সবুজ গন্ধে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তখনও হয়তো সূর্যাস্তের ঢের দেরি। কিন্তু চারপাশে কী রকম সবুজাভ অন্ধকার। বিউটি আপা বেশ ভারী ধরনের কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে হাঁটে। আমার সেরকম উষ্ণ কোনো শীতের কাপড় নাই। আমাকে পরতে হয় আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো কোট স্টাইলের একটা জামা। সামান্য ভারী কাপড়টা — কিন্তু ভেতরে কোনো লাইলিঙের বালাই নাই। ফলে যত শীত সবটাই ওতে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে এবং ঢুকে পড়েও। আমি শীতের বিষাক্ত কামড়ে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেও কাউকে কিছু বলি না। আমার কোনো দীনতাই অন্যকে বলতে লজ্জা লাগে।

হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা বাঁ-হাতের বুড়া আঙুল মুখে পুরে চুষতে থাকে। এটা তার প্রিয়তর অভ্যাস। যখন আশপাশে কেউ না থাকে বিউটি আপা তার এই অভ্যাস বজায় রাখে।

এদিকে আমি বয়সে ছোটো ও বিউটি আপার প্রিয় বলে এই কাজটি সে আমার সামনে হরহামেশাই করে। ওইরকম সবুজাভ অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা একদিন বলে ওঠে — গন্ডারের গন্ধ পাচ্ছি।
— কী! মানে কী?
— গন্ডার নেমেছে পাহাড় থেকে। রয়েছে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই।
— কী?
— হ্যাঁ, আমি গন্ডারের গন্ধ চিনি।
শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম জারিয়ে যায়।

বন্য জীবজন্তুও তাহলে রয়েছে এই অরণ্যে? ঘন জঙ্গল কেটে রাবার চাষ করা হয়েছে — মানুষদের কিছু ঘরবাড়িও রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তা প্রায় না-থাকার মতোই। তবুও একেবারে জনমনুষ্যি নাই এমন তো নয়! এর মাঝে গন্ডার কীভাবে আসে?

চিন্তা যত দ্রুতই করি না কেন — ওই সূর্যের আলোহীন সবুজাভ বিকেলে কোনো কিছুকেই প্রতিরোধ হিসেবে দাঁড় করাতে পারি না। হয়তো আমার মতো বিউটি আপাও পারে না। আমরা জানি, জঙ্গলের আড়ালে সূর্য হারিয়ে গেলে চারপাশ কত দ্রুত ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতটাই-না ঝুঁকির। ভাবতে ভাবতেই শীত যেন হঠাৎ আমাদের আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে! আমরা জানি না — শীতের তীব্রতায় না গন্ডারের ভয়ে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ তুলতে থাকে। যদিও খুব মৃদু সে-ধ্বনি। কিন্তু বিউটি আপা বা আমি দুজনেই সে-ধ্বনি থামাতে পারি না। প্রায় দৌড়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বিউটি আপা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমার সঙ্গ ধরতে। কিন্তু আমি এত জোরে দৌড়াই যে মুহূর্তে রাবারবাগানের দীর্ঘকায় গাছগুলো দূর ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিউটি আপা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ের গতি বাড়ায়। আমরা যখন টিলার উপরে উঠি তখন ওই সবুজাভ অন্ধকার ঘন কালোতে রূপ নিয়েছে।

আমাদের ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীর গরম কাপড়ের আড়ালেই থাকে। ঝরনার তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রবল কাশির চোটে আমি একেবারে কাস্তের মতো বেঁকেচুরে যাই। আমার মনে হয় প্রচণ্ড এক হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বিউটি আপার আম্মা রসুন থেঁতো সরষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোরে মালিশ করে দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।

বিউটি আপা তার ঢাউস টেনজিস্টারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান বাজায়। একেবারে লো ভল্যুমে। আমি বলি —
আরেকটু জোরে বাজান
— না, না আর জোরে না।
— কেন?
— মানুষ শুনলে মন্দ বলবে।
গান বাজালে মানুষ মন্দ বলবে? আমি এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা পাই না। বিউটি আপাকে দেখি টেনজিস্টারের সাথে কান লাগিয়ে গান শোনে। ফলে আমাকেও কান লাগিয়ে গান শুনতে হয়। আমার কান ব্যথা করতে থাকে আর কাশিও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাচিমা আমাকে প্রতিদিনই গোসল করতে বলেন। বলেন,
— গোসল করো, গোসল করো নইলে কফ বুকে শুকাইয়া যাইব।

আমি সূর্যের নীচে ফেলে রাখা কুসুম-গরম পানিতে হররোজ গোসল করি। বিকাল হলেই রাবারবাগানের ধারে বা ভেতরে বা ঘাসময় দীর্ঘ জমির উপর হাঁটতে থাকি। সঙ্গে বিউটি আপা। আমার পরনে আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো সেই কোট। ভেতরে লাইলিঙ ছাড়া। ফলে পাহাড়-টিলা-অরণ্য-ঝরনার যত হিম সব আমার শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। আমার কাশির বেগ বাড়ে। আর ঘুঁতঘুঁতে জ্বরে আমি অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকি।

ওই পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা আর বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা ছানা — হালুয়া — রুটি কিছুই আমার জ্বর কমাতে পারে না! এমনকি আমার কাশিও না। জ্বর-কাশি নিয়েই আমি রাবার বানানোর প্রক্রিয়া দেখি। কীভাবে রাবারের বৃক্ষ কাটা হয়, কীভাবে তাতে টিনের পাত্র পেতে দেওয়া হয়, কীভাবে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে সেই রাবারের মণ্ড তৈরি করা হয়।

এদিকে চাচিমার গরম সরষের তেল আর রসুনের মালিশে আমি বিব্রত হতে থাকি। কারণ আমি দেখি আমার সমতল বুকে পক্ষীশাবকের নরম রোঁয়া উঠেছে। ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন আমাকে সংকুচিত করে তুলছে।

ধুর! চাচিমা খামোখাই এত কষ্ট করছে। আমার কাশি তো কিছুতেই কমছে না!

এদিকে অরণ্য বা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন নাই। এমনকি ঝরনাধারাও। বাংলোর উপর থেকে জলপতনের শব্দ আমি শুনতে পাই। চাচিমার আরদালি-বেয়ারারা ওই জল টিনের পাত্রে ভরে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।

আহ! একেবারে বিশুদ্ধ জল!

এই পাহাড়ের হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছতলা-বৃক্ষরাজি, তাদেরও উদ্ভাসিত তারুণ্য। আর আছে বান্দরের মেলা। প্রায়ই গাছ থেকে নেমে এসে ওরা চাচিমার নানান কিছু নিয়ে পালিয়ে যায়! ওদের ধরার সাধ্য কারও নাই। আর আছে পাখিদের বিচরণ। কত বর্ণ-গোত্রের পাখি! কত বিচিত্র তাদের কথাবার্তা! বিশাল বিশাল রক্তচোষা! ভয়ে আমি একা কোথাও যাই না।

রক্তচোষা যদি আমার সব রক্ত চুষে নেয় এই ভয়েই কিনা কে জানে আমার শরীরের রক্ত জোট বাঁধে। অবশ্য আমি তা আদৌ বুঝতে পারি না।

আমি পুনরায় ত্রিপল ঢাকা জিপগাড়িতে চেপে বসি। বিউটি আপা সজল চোখে তাকিয়ে থাকে। চাচিমা বলেন — ‘ফের আইসো বাপ। ইশকুল ছুটি হইলেই আইসো।’

আমার আতঙ্কবাদী বাবা আমাকে নিতে এসেছেন। ফের সেই ভয়াবহ কারাগার। ফের বন্দীজীবন। ফের বৃক্ষহীন নগর। বিষাক্ত হাওয়া। ট্রেন আমাকে হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিতে থাকে। বরমচালের অরণ্যে আমি কত যে কাঠবিড়ালি দেখেছি! কত পাখি আর তাদের গান!
কেন যে আমি মানুষ!

কাঠবেড়াল হলেও তো লুকিয়ে থাকতে পারতাম গাছের কোটরে।

দুই পাশের লালমাটির পাহাড় ফেলে ট্রেন কী ভীষণ জোরে ছুটে চলেছে! পাতাদের সবুজ ঘ্রাণ হাওয়া থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি কি তাকালেই দেখতে পাব ওই নিবিড় স্নেহছায়াময় সবুজ বনভূমি?
জানি — পাব না।
ফেলে আসা কোনোকিছুই মানুষ কোনোদিন অক্ষত ফেরত পায় না!

উষ্ণ বয়সি ব্ল্যাকবোর্ড

আমাদের বাগানের ঘাসগুলা কি অতটাই সবুজ?

বিউটি আপার সাথে যে-ঘাসে আমি হেঁটেছিলাম তাদের মতো?

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসেদের সবুজ হওয়া দেখি, কিন্তু কিছুতেই ওই সবুজের সাথে মেলাতে পারি না। আমাদের বাসার ভেতরে অরণ্যের ঘ্রাণ নেই — কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ থইথই করে। মা ওই তেলে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে। এদিকে তরল কাশির দমকে আমার শরীর আরও অনেক বেশি বেঁকেকুকে যায় — আমি কাশতে কাশতে দম নিতে পারি না।

আমাদের সাদা গোলাপ গাছে বিস্তর কুঁড়ি এসেছে। কয়দিন পরই ফুল ফুটিয়ে গাছটিকে এরা ঢেকে দেবে। নানা রঙের জিনিয়া আর গোলাপি সাদা দোপাটি ফুলের সারি দেখতে দেখতে আমার পাহাড়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। গন্ডারের গন্ধভরা বিকেল। আমাদের ত্রাস আর দৌড়ানো শুরু করা। ওই গভীর নির্জন অরণ্যে — ওই সবুজাভ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ত্রাণকর্তারূপী কেউ ছিল না। ফলে আমাদের দৌড়াতে হয়েছে। বেদম দৌড় যাকে বলে।

আমি আমাদের বাগানের ঘাসেদের রকম-সকম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড কাশিতে ফের বাঁকাকুকা হয়ে যাই। তরল লবণাক্ত কফ ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চমকে উঠি। দেখি রক্তের মতো কী যেন ঘাসের ভেতর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রক্ত!
সত্যিই রক্ত নাকি?
ফের কাশি ওঠে। ফেলতে ফেলতে ফের চমকাই।
রক্ত!

আহা! সেই যে হিমের বিকেল — পাহাড়ের সেই প্রচণ্ড হিম কি রক্তবর্ণ ধারণ করে আমার ফুসফুসের ভেতর বাসা বেঁধেছে!

তৃতীয়বারের কাশিতে ঘন রক্ত উঠে আসে।
আর বাগানের ঘাসে সেই রক্ত লাল ফড়িঙের মতো ঝুলে থাকে। আমি আমার আতঙ্কবাদী বাবাকে ডাকি।
— বাবা কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে!
— কী বলো? কই দেখি?
— বাগানের ঘাসে।

বাবাকে বলা হয় না ঘাসের ওপর বসে থাকা লাল ফড়িংদের পিছু পিছু আমি কত সাবধানে পা ফেলেছি। দুই হাতে ডানা দুটো যে-ই ধরতে যাব — হঠাৎ সে উড়ে গেছে! আর আমি সে-দুঃখে প্রায়ই কেঁদে ফেলেছি। আজ সেই লাল ফড়িঙের দল আমাদের বাগানের ঘাসের ওপর স্থির বসে আছে। ভারি অদ্ভুত কাণ্ড তো!

বাগানের ঘাসে রক্তচিহ্ন দেখে বাবা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যান। আমাকে আর কিছুই বলে না।
এরপর থেকে আমার ইশকুল কামাই হতে লাগল। বিকেলবেলার সাথীরা আমাদের বাসায় আসা ছেড়ে দিল। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগলাম। রক্ত ঝরে ঝরে আমার ফুসফুস প্রায় শূন্য হয়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবা প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এ-ডাক্তার, সে-ডাক্তার — ছোটো-বড়ো সব ডাক্তার জড়ো করে ফেললেন। ওষুধ-পথ্য-এক্সরে-জ্বর-চাদর এইসবের মাঝে আমার জীবন কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেল!

আমি রাতভর কাশতাম। আমার বিছানার পাশে ছাইভর্তি বাসন দিয়েছে মা। যাতে বাতাসে জীবাণু না ছড়ায়। ভোর হতে হতে রক্তে ভিজে সব ছাই দলা পাকিয়ে যেত। আমিও অবাক হতাম — আমার এতটুকুন শরীরে কী করে এত রক্ত এল?

এই যে অবিশ্রাম কাশছি — কাশির সাথে টকটকে তাজা রক্ত উঠে আসছে, তবুও কেন রক্ত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে না আমার শরীর থেকে?

সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে পড়ে যেত ইশকুলের কথা। ক্লাস টিচার রাবেয়া খাতুন ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে তারিখ লিখছেন। তার দুধসাদা আঙুলে চকখড়ি ধরে রাখা। সরু সরু চমৎকার আঙুলগুলো চকের গুঁড়োতে মাখামাখি! রাবেয়া খাতুন, আমার খাতায় প্রায়ই লিখে দেন ‘ভালো রাখা’।
‘ভালো রাখা’ মানে কী?
একদিন লিখলেন ‘রাখা’।

আমি বুঝলাম ‘ভালো রাখা’ মানে গুড ধরনের কিছু হবে। আপার নাম আসলে রাখা — রাবেয়া খাতুন। রক্তের সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে আমার শুধু ইশকুলের কথাই মনে পড়ে। খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আমার ইশকুল — আমার ক্লাসরুম আর সহপাঠীরা। এদিকে মাকে দেখি আমার খাবারের গ্লাস-প্লেট সব আলাদা করে দিয়েছে। আমার প্লেটে সে কাউকে খেতে দেয় না। অন্যদের প্লেট-গ্লাসে খেতে দেয় না আমাকেও। এটা সে এতটাই চাতুরীর সাথে করছে যে আমার আতঙ্কবাদী বাবা টেরও পান না।

আমার কি ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে?
নইলে মায়ের এত সাবধানতা কেন?
আমি একদিন খেতে বসে কেঁদে ফেলি!
বাবা চোখ লাল করে জানতে চান,
— কী হইছে? কান্দস কেন?
আমি বলি,
— আমার খাওয়ার প্লেট-গ্লাস মা আলাদা করে দিয়েছে।
— কোনটা তোর?

আমি আঙুল তুলে একটা লাল বর্ডারের প্লেট দেখিয়ে দিলে বাবা ওতে খেতে বসে যান।
বাবার মুখ দেখি থমথম করে। দেখি বাবাও কাঁদছে।

আমার উপলব্ধি হয় — আমার শরীরটা পাখির মতো হালকা হয়ে গেছে। এখন আমি যেন ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। উড়ে উড়ে বরমচালের রাবারবাগানে পৌঁছে যেতে পারি। ওইখানে যে-ঝরনা বইছে, সে জলপান করে ফিরে আসতে পারি; অথবা ওই সবুজ বনভূমির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় দোল খেতে পারি। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতে পারি পাতাদের শিরা-উপশিরা। অথবা উড়তে উড়তে ওই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। হয়তো তখন অন্ধকার ঘনায়মান। বানরের দল গাছের ডালে চুপটি করে বসে বসে অপেক্ষা করছে রাত্তিরের। অন্ধকারের ভয়ে আমার পাখি-শরীরটা নিমেষে লুকিয়ে ফেলতে পারি পাতাদের আড়ালে, যাতে কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়। আমি অরণ্যের গন্ধের ভেতর, বিশুদ্ধ হাওয়ার ভেতর, ঝরনার জলের ভেতর একাকার হতে হতে ভুলে যেতে পারি সংসার-কারাগার। যেখানে বাড়াবাড়ি শাসন, কড়া পড়ার চাপ, প্রচণ্ড মারধরে আমার ছোট্ট শরীরটা প্রায়ই নীলাভ হয়ে থাকে। সেই জখমচিহ্নের দিকে তাকিয়ে আমি সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। একটা জখম না-সারতেই আরেকটা জখমের চিহ্ন তীব্রভাবে শরীরে বসে যায়।
অবিরাম কাশি, রক্তপাত, ওষুধ, পথ্য, চাদর, বালিশ, বিছানার সঙ্গে আমার আতঙ্কবাদী বাবা সেঁটে থাকেন। আমার ভয়ানক অসুস্থ শরীরটাকে সারিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু আমি তো সেরে উঠতে চাই না। সেরে উঠলেই আমার শরীরটা আর পাখি থাকবে না। ভারী শরীর নিয়ে আমি কি আর উড়তে পারব? কিন্তু আমাকে যে উড়তেই হবে।

উড়ে উড়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ে, ওই অরণ্যে। ওই অরণ্যে আমি ফের যেতে চাই — যে-অরণ্যের হিম আমার ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আমার এই অসুস্থতা, প্রবল রক্তপাতময় শরীরটাকে আমি ওই অরণ্য ছাড়া আর কোথায়ই-বা রাখতে পারব?

ওই অরণ্যের দিনগুলোতেই তো আমার সমতল বুকে ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন জেগে উঠেছে। ওই অরণ্যই আমাকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।

এখন এই ভাঙাচোরা, মৃতবৎ, ক্ষয়িষ্ণু শরীরটাকে নিয়ে আমি আর কোথায় আশ্রয় পাব?
আমি জানি মানুষ ফিরিয়ে দিলেও অরণ্য কিছুতেই ফেরাবে না। ফেরাতে পারবে না। অরণ্যের ঠাঁই মানুষের জন্য চিরকালের।

Categories
অন্যান্য

কবিতা স্টুডিও উজান সম্মান

Categories
অন্যান্য

test1

Categories
2021-June-Golpo গল্প

চয়ন দাশ

চল্লিশ মেঝে

 ১
বেদকে পাশের রুমে ঘুমোতে দেখে এ-ঘরে এলাম। এ-ঘর আমার আর বেদের নতুন। ঘরটা আমার নতুন হাবির, কিংশুকের। পাঁচতলার উপর। সকালের দিকটা ভালো লাগে, সামনেই একটা বস্তি আছে। সিমেন্টের রাস্তা, খোপ করে টাইম কল। বস্তির মাথাগুলো কমলা আর লাল ত্রিপল মোড়ানো। মাটির কাছাকাছি মানুষের যাবতীয় আয়োজন-প্রয়োজন ছেড়ে আমরা উপরে উপরে এড়িয়ে যাচ্ছি, কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে ব্যালকোনির গ্রিলে কাক আসে, শালিখ, পায়রা— এতখানি উঠে এসে ক্যামন যেন হাঁপায় মনে হয়। আমায় দ্যাখে, একা ঘরে আমি একা। কিংশুক অফিসে, বেদও স্কুল-কোচিং- এন্ট্রান্সের প্রিপ্যারেসন নিয়ে ব্যস্ত। বাকি থাকল, আমার পরিচয়? আমি আমার নিজের একটা নাম দিয়েছি, ‘ফালতু’।

ডিভোর্সি মহিলা, চল্লিশ হতে চলল অথচ নিজস্ব একটা জীবনের পথ খুঁজে পেলাম না, চেষ্টা করিনি এমন তো নয়, জীবনের চেষ্টার ব্যর্থতার খেসারত অন্যরকম হয়। সময় পেরোয়। স্রেফ সময় পেরোয়। আশপাশের গাছগুলোর ছায়া কমে, বাবা মরে যায় মা মরে যায়, মরে যেতে পারে ভাবতেই পারিনি কোনোদিন, আজও পারি না।

ফাঁকা ঘর, ধু ধু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব সাজি। ভ্রূ আঁকি। লিপগ্লস লাগাই। আস্তে আস্তে পেটের সামনের কাপড় খুলে ফেলি, তুলে দিই। নাভির নীচে স্ট্রেচমার্কগুলো হাত বুলাই। তলপেট যোনি খুব অস্পষ্ট। কেউ কোথাও নেই। আমার নাভি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরাহ্ণকে দেখতে পাচ্ছি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আবার দেখতে পাচ্ছি কোনো একজন মেয়ের নরম হাত— পেট আর বুক নিয়ে আমার দিকে আসছে। বলছে যেন, ‘কোনোদিন এমন নরম হতে পারবে? হতে পারলে থাকো আমার সাথে…, নয়তো যা বলেছি সেটা করো’। অপরাহ্ণ আমায় থ্রিসামে ইনভল্ভ হতে বলেছিল। অপরাহ্ণর বয়স বাড়ছে, ওর শরীর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, ওর মনের ভেতরকার লিঙ্গ জেগে উঠছে, অপরাহ্ণ মনের মুখটা ওর যমজ ভাইয়ের মতো। আমায় যেন আয়নার ভেতর থেকে ডাকতে থাকে… হাত দাও, হাত বাড়াও।

অপরাহ্ণের সাথে সব সম্পর্কই মিটে গেছিল। আমার পক্ষে যতদূর যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, গেছিলাম, হাঁপ লাগলে ছেড়ে দিলাম। হল না। বেদ আমাদের ডাইভোর্সের কারণ জানে না। বেদকে জানাবও না কোনোদিন। বেদ ওর পাপাকে খুব ভালোবাসত। ওর সাথে কিংশুকের আলাপ হয়েছে, কিংশুকও চেষ্টা করছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে, পাপার জায়গাটা পাপারই থাকুক।


বেদ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম কিংশুকের রুমে, কেন-না কিংশুক আমায় নিঃশব্দে ডেকেছে। আমি জানি ও কেন ডেকেছে। আমার জন্মদিন, ফার্স্ট উইশ করবে। বিছানা থেকে ওঠার আগের মুহূর্তেও একবার অপরাহ্ণকে মনে পড়ল, ভুলতে পারিনি, যতই সে পাপ কিংবা অন্যায় করুক আমার সাথে।

কিংশুককে আমি এভাবে কোনোদিন পাইনি। আশাও করিনি এতটা কাছ থেকে ওকে দ্যাখার। ওর ধীরে ধীরে এক-একটা গিফ্ট আমায় অবশ করে দিচ্ছে। আমার দু-হাত দু’দিকে ছিটকে পড়ে আছে, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। ওর নাক ঠোঁট চোখ আমার নাভির নীচে নামতে থাকলেই মাথা ঝনঝন করতে লাগল। মনে হতে লাগল— আমি পুনরায় একা হয়ে গেছি। বাথরুমের লাল মেঝেতে উলঙ্গ হয়ে বসে আছি, মৈথুন করছি, শিরশির আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছে মুখে, দরজার ঠিক ওপারে ভাই কান পেতেছে, তবু সামলাতে পারছি না নিজেকে। একসময় দেখছি বাথরুমের বন্ধ ঘরের ভেতর চুপিচুপি কারা এসে দাঁড়িয়েছে। উলঙ্গ পুরুষ, কামার্ত সবজন। অপরাহ্ণ-অপরাহ্ণের সাথে একটা বেঁটে লোক, বস্তির ভ্যানওয়ালাটা, মাছওয়ালির বরটা, কনুই গোঁতানো বাস কন্ডাকটর, বায়োলজির স্যার… সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে। সবার লিঙ্গের মাথায় লার্ভার চাক ভেঙে টাটকা মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। বুঝতে পারছি— কিংশুক আমার হাঁটু দুটো মুড়ে দিচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে— বেদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আমার নিঃশ্বাস শুনে ফেলছে— বেদ যেন সেই বাথরুমের ভেতর ঢোকার জন্য বাথরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে।


কিংশুককে ঠেলে সরিয়ে আমি এ-ঘরে এসেছি। বেদ ঘুমাচ্ছে। ওর চোখের পাতার নীচে মণিগুলো অস্থির। হয়তো স্বপ্নে ও কোনো ইশকুলবাড়ির ভেতর আটকে গেছে, ওর একাকিত্বের সুযোগ নিতে এগিয়ে আসছে একটা রঙিন উট, ওকে ভালোবাসছে, আদর করতে করতে শূন্যের দিকে গড়িয়ে দিচ্ছে। ও আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে খাদের ভেতর থেকে, আমি হাত বাড়াচ্ছি, হাতড়াচ্ছি… কেউ নেই আমার জন্য। চাই সমস্ত পুরুষ, মানুষ থেকে গাছ হয়ে আমার কাছে আসুক। আমার তলপেটে আঙুল দিক ঠোঁট ছোঁয়াক অ্যান্ড্রোপজ একজন। আঁকড়ে ধরুক

Categories
Editorial

সম্পাদকীয়

 

প্রতি মাসে সংখ্যা প্রকাশ করা অনেকটাই পরিশ্রমের। লেখা বাছাই করা, সম্পাদনা করা, প্রুফ দেখা, পোর্টালে সাজানো… একটি সংখ্যা প্রকাশ হতে না হতে আরেকটি সংখ্যার কাজ শুরু হয়ে যায়। ‘টিম তবুও প্রয়াস’— এই কাজটি আনন্দের সঙ্গেই করে। মে সংখ্যার ভিজিটরস্ দশ হাজার পেরিয়েছে। এত পাঠকের ভালোবাসা পাব, আমরা ভাবিনি। একের পর এক মেল ঢুকছে। আমরা আমন্ত্রিত লেখা ছাড়াও সেগুলো থেকে বাছাই করছি নিয়মিত। সংখ্যার ভার যাতে লেখক না হয়, আমরা সেদিক থেকে সজাগ থাকছি। অনেক পছন্দের লেখা রাখা হচ্ছে পরবর্তী সংখ্যার জন্য।

এই সংখ্যায় শুরু হয়েছে আরও একটা নতুন ধারাবাহিক। সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘রূপসি বাংলা’। গ্রামবাংলার মহিলা চারু ও কারুশিল্পীদের জীবনকথা নিয়ে এই ধারাবাহিক। এছাড়াও কবি-প্রাবন্ধিক গৌতম বসু ও কবি-চলচ্চিত্রনির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের স্মরণে তাঁদের একটি করে লেখা পুণঃপ্রকাশ করা হল।

প্রতিটির সংখ্যার গুণগত মান যাতে ভালো হয়, আমরা চেষ্টা করব। আপনাদের পরামর্শ ও সুচিন্তিত মতামত জানাতে দ্বিধা বোধ করবেন না।

এই প্রতিকূল পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। মানুষও চেষ্টা করছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে। ভাতের খোঁজে। মুক্ত অক্সিজেনের খোঁজে। এই পাঠ আমাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দকে ত্বরান্বিত করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

শব্দ-কল্প-ঋত্বিক

[‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শব্দ ভাবনা ও ধ্বনি মন্তাজ]

সনৎ বলল, কথা আছে। চলো। নীতার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ‘না’ বলে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইতেই, সনৎ তার হাত ধরে ফেলে। বিস্মিত গলায় বলে, নীতা! নীতা সনতের চোখে প্রখর দৃষ্টির দিকে তাকায়। কয়লার ট্রেন ইঞ্জিনের এক সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল আমাদের বুকে এসে ধাক্কা মারে। সনৎ অপ্রস্তুতের মতো হাত ছেড়ে দেয়। সনতের মতো আমরাও সচকিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এই হুইস্‌লের আওয়াজে আমাদের আলাপ শুরু হয়।

এই সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল কেন ত্রস্ত করে? ছোটো জলার পাশে ঝুঁকে পড়া গাছ ও মাঠকে সঙ্গে রেখে রেললাইন চলে গেছে। মুহুর্মুহু না হলেও, এখানে ট্রেনের অবশ্যম্ভাবী আনাগোনা। এবং ঋত্বিক ইতিমধ্যেই, হুইস্‌ল বাজিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া, দু-বার দেখিয়ে ফেলেছেন। ছবির শুরুতে নীতার দাদা শঙ্করকে আমরা মাঠে বসে গান গাইতে শুনি। নীতা তার দিকে প্রশ্রয়ের চোখে তাকায়। দাদা-বোনের পশ্চাদ্‌পটে ট্রেন চলে যায় একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে। ছবি আরও কিছুটা অগ্রসর হলে, নীতা ও সনৎ ওই ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। নীতা উঠে দাঁড়াতে গেলে সনৎ হাত ধরে বলে, নীতা। ট্রেনের হুইস্‌লের আওয়াজ ভেসে আসে। নীতা বসে পড়ে। সন্ধ্যার আনত আলোয় তাদের সামনে রেখে ট্রেন চলে যায়। তারা একে-অপরের সামনে নম্র সুরে বসে থাকে।

তাহলে? তৃতীয় দৃশ্যের সঙ্গে, এই দুই দৃশ্যের মূল পার্থক্য অবস্থানের। তৃতীয় দৃশ্যের অব্যবহিত পূর্বেই নীতা কাশির দমকে রক্ত আবিষ্কার করেছে। সনৎ বিয়ে করেছে নীতার বোন গীতাকে। শঙ্কর গান গেয়ে নাম করার আশায় ঘরছাড়া। তাই ঋত্বিক এই দৃশ্যে ধ্বনি সংযোজন করেন বিশেষ মাত্রায়, যা ধ্বনি মন্তাজের রূপ নেয়। চলচ্চিত্রে মূলত দু-ভাগে ধ্বনিকে ভাগ করা হয়। যে-ধ্বনির উৎস আমরা দৃশ্যে বা শটে দেখতে পাচ্ছি— ডায়াজেটিক এবং যেক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না— ননডায়াজেটিক। প্রথমদুটো দৃশ্যে ট্রেনের চলে যাওয়া যে-শটে আমরা দেখতে পাই, সেই শটেই হুইস্‌লের ধ্বনি প্রয়োগ করেন ঋত্বিক। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে হুইস্‌লের ধ্বনি আসে দু-টি শট আগে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। হুইস্‌লের ধ্বনি শোনার পর আরও একটি শটে, নীতা ও সনৎকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখান ঋত্বিক। যে-শটে সনৎ ত্রস্ত হয়ে নীতার হাত ছেড়ে দেয়। তার পরের শটটিতে নীতা ও সনৎ ঝুঁকে পড়া গাছটির নীচে বসে থাকে। আমরা ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে পাই। এবং ঋত্বিক এই তিনটি শটকে জোড়েন দ্রুত লয়ে চলা ট্রেনের চাকার শব্দে।

অর্থাৎ, এই তৃতীয় দৃশ্যে এসে ট্রেনের হুইস্‌লের শব্দ তিনটি শটে ননডায়াজেটিক থেকে ডায়াজেটিক হয় এবং ঋত্বিক সেই ধ্বনির কম্পাঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন। যে-সনৎকে নীতা ভালোবেসে নিজের অধিকার দিয়েছিল, সনতের উন্নতির স্বার্থে ত্যাগ করবে ভেবেছিল নিজের আকাঙ্ক্ষা, সনৎ সেই অধিকার হারিয়েছে। সনতের তথা আপামর পুরুষজাতির, সম্পত্তি-মনস্তাত্ত্বিকরণের উপর এই স্বাভাবিকের চেয়ে তীক্ষ্ণ ট্রেনের বাঁশি, নিছক রেলের হুইস্‌ল হয়ে থাকে না, তা অ্যালার্মিং সাউন্ড এফেক্টে আছড়ে পড়ে। অথচ তা নিছক সাউন্ড এফেক্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। দৃশ্যটিতে ধ্বনির উৎসকে অপরূপ কম্পোজিশনে দেখিয়ে, আমাদের মননে তা মিশিয়ে দেন এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকে প্রশমিত করে শান্ত ও গম্ভীর রসে পূর্ণ সংলাপে কাহিনির খাত বইয়ে দেন ঋত্বিক।

অথচ সাউন্ড এফেক্টের সরাসরি ব্যবহার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে বিদ্যমান এবং তা বহুলচর্চিত। চাবুকের শব্দকে ঋত্বিক তিনবার তিন চরিত্রের জন্য ব্যবহার করেন, যদিও প্রেক্ষিত বদলে দেন প্রতিবার। এই চাবুকের শব্দ ননডায়াজেটিক ধ্বনি হিসেবেই প্রতিবার থাকে ও এর থেকে ক্লাসিকাল ধ্বনি মন্তাজের একটি উদাহরণ আমরা শিখে নিতে পারি। ঋত্বিক প্রতিবারই এই ধ্বনির সঙ্গে সমাপতন ঘটান দ্রুত লয়ে সেতারের বাজনে। এতে এফেক্টটি আরও তীব্র হয়।

সনতের পালটে যাওয়া বাহির ও অন্তরঙ্গকে দেখে নীতা। একইসঙ্গে সনতের বাড়িতে গীতার উপস্থিতিও সে টের পায়। ঋত্বিক কশাঘাতের ধ্বনি প্রথমবারের জন্য ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়বার আমরা এই ধ্বনি শুনতে পাই ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানের শেষে এসে। শঙ্করের ব্যথিত মুখ পর্দায় ভেসে থাকে ক্লোজ-আপে। পিছনে তিনবার সশব্দে চাবুক পড়ে। তৃতীয় তথা অন্তিম প্রয়োগ, ঋত্বিক করেন ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে, যা এই রচনার আধার, সেই দৃশ্যে। এবার নীতার চলে যাওয়ায়, সনতের অপরাধী মুখে অনবরত পড়ে কশাঘাতের আওয়াজ। অর্থাৎ নীতা, শঙ্কর ও সনৎ— কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই সাউন্ড এফেক্টের ব্যবহার, একই ভাবনায় হয় না। ভাবনার অন্তর ঘটে, যা পরিচালকের বক্তব্যকে সরাসরি আমাদের কাছে এনে দেয়।

সনতের প্রত্যাখানে নীতার চরিত্রের ট্র্যাজিকধর্মীতা আর সূক্ষ্ম থাকে না। তা রূঢ় রূপে আমাদের সামনে চলে আসে। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে কশাঘাতের ধ্বনিপ্রয়োগ যেন অনেকটাই সাহিত্যধর্মী। যেন ঋত্বিক লিখছেন, ‘সনতের কথাগুলি ও তার শীতল ব্যবহার, নীতার হৃদয়ে কশাঘাতের মতো বাজিতে লাগিল।’ এরকমটি আমরা আগে জানিনি। কাজেই এখানে এক মুখ্য চরিত্র আর এক মুখ্য চরিত্রকে কশাঘাতে আহত করেছে, সেই ভাবই বর্ণিত। তৃতীয় প্রয়োগে, চরিত্রের প্রতি পরিচালকের মনোভাবকে আমরা প্রকাশ পেতে দেখি, এই ধ্বনির বারংবার ব্যবহারে। সনতের যাবতীয় প্রতিশ্রুতির যে আর কোনো মূল্যই নীতার জীবনে নেই, সনৎও যে আদতে একটি চিরন্তন পলায়নমুখী কাপুরুষ, নীতার তা জানা হয়ে গেছে বহুকাল। তাই সনতের মুখে প্রায়শ্চিত্ত ও আদর্শের কথা, নীতার কাছে অতি অবশ্যম্ভাবী খেলো মনে হবেই। টিউবারকিউলোসিস জর্জরিত ফুসফুসের কাছে এ-আলোচনা নিছক অপ্রয়োজনীয়। তাই সনতের শেষ কথাগুলিতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে, ছাতা মাথায় তার চলে যাওয়ায়, সনৎ যেমন বুঝতে পারে, তার প্রায়শ্চিত্তের কোনো সুযোগ নেই (অন্তত নীতার কাছে সে-প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ফুরিয়েছে), তেমনি উপর্যুপরি কশাঘাতে ঋত্বিক যেন সনতকে শাস্তি দেন এই বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে।

তবে দ্বিতীয় প্রয়োগটি এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আত্মসমালোচনাময়। শঙ্কর চরিত্রটি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে, ঋত্বিকের আত্মস্বরূপ। সে-শিল্পী, ভ্যাগাবন্ড, ছেলেমানুষীতে ভরা এবং সাফল্য পাওয়ার আগের মূহূর্ত অবধি গোটা ছবিতেই সমাজের চোখে অপাঙ্‌ক্তেয়। এ হেন শঙ্করের কাছে নীতা যখন গান শিখতে চায়, বলে, বাসরে গাইতে হবে না! (গীতা ও সনতের বিয়ে)— শঙ্কর কি গান শেখায়? ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।’ অর্থাৎ, সে বুঝতে পারে। নীতার একটু একটু করে চলে যাওয়াকে সে প্রতিনিয়ত অনুভব করে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। পরিচালকের অসহায়তা এভাবেই তার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোয়। শেষ দৃশ্যে নীতারই মতো আর একটি মেয়ের চটি ছিঁড়ে যাওয়ায়, সে যেন পুনরায় নীতাকে দেখতে পায় ও কেঁদে ফেলে। গানের দৃশ্যে চাবুকের ধ্বনি, তাই ঋত্বিক যেন নিজের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেন। এই অসহায়তা ও শোষণ তিনি সহ্য করতে পারেন না।

ছবিটিতে ঝিঁঝিপোকার ডাকের প্রয়োগও লক্ষ্যণীয়। আর পাঁচটা গড়পড়তা ছবিতে ঝিঁঝিপোকার ডাক আসে পারিপার্শ্বিকের সাথে, শুধুমাত্র আর একটি ধ্বনি উপাদান হিসেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রথমার্ধেও এভাবেই এই উপাদানটিকে রাখেন ঋত্বিক। এর বদল হয় যখন নীতার ছোটোভাই মন্টুর দুর্ঘটনার খবর আসে চিঠিতে। অনেক বেশি মাত্রার কম্পাঙ্কে ব্যবহৃত হয় ঝিঁঝিপোকার ডাক। ফলে এক আশ্চর্য আধিভৌতিক এফেক্ট তৈরি করে এই ধ্বনি। ঋত্বিক এখানেই থেমে থাকেন না। এরপর যখনই নীতার মাথা ঘুরে ওঠে (যার শুরু মন্টুকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে), যখনই সে কাশিতে রক্ত পায়, যখনই তাকে একের পর এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয়, ঝিঁঝিপোকারা এক আশ্চর্য অতিরিক্ত মাত্রার কম্পাঙ্কে ডেকে ওঠে। এমনকী, ঝুঁকে পড়া গাছের নীচের দৃশ্যটিতেও, নীতা বলে, এখন ভেবে দেখছি ও-সব ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। এখন তো শুধু কাজ। পাখির কলতান ও একটি কোকিলের অনবরত ডেকে যাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে, ঝিঁঝিপোকার সেই আশ্চর্য ডেকে চলা, এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য তৈরি করে।

এ-নৈঃশব্দ্য শেষ হয় ছবির সমাপ্তিতে। ঋত্বিক ‘আয় গো উমা’ গানটির শব্দ পরিকল্পনাতেও স্থান দেন এই আধিভৌতিক ডাককে। ‘আয় গো উমা’ গানটিকে তিনি লেট মোটিফের মতো গোটা ছবিটির সাউন্ডস্কেপে ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো থিম মিউজিক তৈরি হতে দেন না।

নীতাকে আমরা কাশতে দেখি অনবরত। সে কাশি চাপতে রুমাল মুখে চাপবে এবং রক্ত আবিষ্কার করবে রুমালে। এর পূর্বে অমোঘ স্বরে, ধীর লয়ে ‘আয় গো উমা কোলে লই’ গানটি বেজে চলে। গানটি দ্বিতীয়বার শুনি এক ঝড়ের রাতে। বাবা নীতাকে বলেন, তুই জিতে গেছিস। তুই চলে যা। এরা তোকে করুণা করে। নীতা তার আদরের সম্বল ফোটোফ্রেমটি, যে-ফোটোফ্রেমে সে আর দাদা ছোটোবেলায় পাহাড়ের কোলে বসে রয়েছে, নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মুখে বিদ্যুতের আলো সরে যায়, গাছের ঝুপসি পাতা ঘন ছায়া তৈরি করে। তার মুখে এক অপার্থিব আনন্দ, মুক্তির স্বাদ যেন, খেলা করে। এ-সংসারের যাবতীয় দায়ভার তাকে আর যেন বইতে হবে না। ঝড়ো হাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে জগৎচরাচরে শোনা যায়— ‘আয় গো উমা কোলে লই, গলাতে গাঁথিয়া জুঁই।’ কন্যাকে নিজের পরম আশ্রয়ে স্থান দেওয়ার চিরকালীন মাতৃসংগীত। নীতার শেষ আশ্রয় হয় পাহাড়ের কোলে এক স্যানিটোরিয়ামে। যে-পাহাড়ে সে বার বার যেতে চেয়েছে দাদার সাথে। শেষ দৃশ্যে যখন আর একটি মেয়ের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায় নীতারই মতো, নীতার সংকটকে শঙ্কর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে পায়। গানটিকে লেট মোটিফের মতো পুনরায় ব্যবহার করে ঋত্বিক শুধু দৃশ্যত সংযোগস্থাপন করেন না, ধ্বনিগতভাবেও তৎকালীন মধ্যবিত্ত সংকটকে (যা আজও অনেকাংশে বর্তমান), আমাদের মননে গেঁথে দেন।

লেট মোটিফ হিসেবে ঋত্বিক এক মায়াবী সুরও পুনরাবৃত্তিতে রেখে দেন ছবিটির সাউন্ডস্কেপে। নীতা যখনই ছেলেবেলার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সনৎকে বা শঙ্করের কাছে আবদার করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এই সুর শোনা যায়। ছবিতে যখন প্রথমবারের জন্য নীতাকে সনতের চিঠি পড়তে দেখি, এই সুরও তখন প্রথমবারের জন্য শোনা যায়। আর আশ্চর্য, চিঠি হাতে নিয়ে নীতা, পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ছেলেবেলার ছবিটি নাড়াচাড়া করে। এ এক বিচিত্র চেতনার স্তরে ধ্বনি ও দৃশ্যের মন্তাজ, যা একলহমায় নীতার অবচেতনকে আমাদের সামনে খুলে দেয়। এই মন কেমন করা নস্টালজিক সুরের উপর্যুপরি ব্যবহারে, সনতের ভালোবাসার চিঠি ও ছেলেবেলায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি, দু-টিকে একাসনে বসিয়ে ঋত্বিক নীতার ভিতরের পুকুরটিতে ডুব দেন ও স্বচ্ছ করে তোলেন এই অবগাহন।

অথচ অবশেষে নীতা যখন পাহাড়ে পৌঁছায়, তখন শুধুমাত্র সেই সুর বাজে না। সুরটি এক গম্ভীর করুণ আলাপে বর্ধিত হয়। আর পাহাড়ে খাদে গিরিবর্ত্মে প্রতিধ্বনিত হয় এক চিরন্তন আর্তনাদ। এখানেও ধ্বনি সংযোজনে সাহিত্যধর্মীতা লক্ষ করি আমরা। ঋত্বিক যেন লিখছেন, ‘তাহার পর নীতার ব্যাকুল আর্তনাদ সেই পাহাড়ের প্রতিটি মর্মে ধ্বনিত হইতে লাগিল।’ প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে, দৃশ্যটিকে আইকনিক পর্যায়ে পৌঁছে দেন তিনি। অথচ সেই মন কেমন করা সুর আর আগের মতো বাজে না। নীতা সনতের লেখা চিঠি এতদিনে উড়িয়ে দেয় পাহাড়ে। স্মৃতি, প্রেম ও লড়াইকে ছাপিয়ে নির্দ্বিধায় সে ছড়িয়ে দেয় তার অসহায়তা ও বেঁচে থাকার স্পৃহা। মুহূর্তে অপরাজেয় মাতৃমূর্তি ত্যাগ করে সাধারণ মানবীর চাওয়া-পাওয়ায় নিজেকে ব্যক্ত করে সে। তাকে আর উপেক্ষা করা যায় না। তার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।

এই অকপট বাস্তবের চরম উদ্ভাসে, তাই সেই আশ্চর্য নস্টালজিক সুরও মূঢ় হয়ে পড়ে। শব্দ পরিকল্পনায় বলা যেতে পারে, এটি একটি অতুলনীয় মস্তিষ্ক ও মাত্রাবোধের পরিচয়। ঋত্বিক প্রতিধ্বনির সাথে মেঘের গর্জনকে মিলিয়ে দেন সেই লয়ে, যা কশাঘাতের সাউন্ড এফেক্ট তৈরির সময় করেছেন। ফলে মেলোড্রামার প্রকৃত উদ্দেশ্য, যা ঋত্বিকের অভিপ্রেত ছিল চিরকাল, তা-ই হয়। দৃশ্যটির ধ্বনি সংযোজন আমাদের রক্ত ঝরায়।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটির শব্দ পরিকল্পনাতে অভিনিবেশ করলে তাই আমরা বার বার বিভিন্ন ভার্টিকাল মন্তাজের নিদর্শন পাই। ভার্টিকাল মন্তাজ, অর্থাৎ, দৃশ্যের সাথে ধ্বনির মিলনে জন্ম নেওয়া এক নতুন অর্থ অথবা বোধ। বস্তুত দু-টি শটের পারম্পরিক সহাবস্থানে যে-মন্তাজের সৃষ্টি হয় (যাকে হরাইজন্টাল মন্তাজ বলা হয়ে থাকে), শুধু আমাদের চোখকে পরিশীলিত করে। কিন্তু দৃশ্য ও শব্দের মন্তাজ চোখ, কান তথা মস্তিষ্ককেও পুষ্ট করে প্রখর বুদ্ধিমত্তায়। এ-বস্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজও বিরল। দৃশ্যের সাথে ধ্বনির সুপরিকল্পিত মিলনে জন্ম নেয় যে-বোধ, ঋত্বিক আমাদের সেই বোধের সন্ধান দেন। ছবিটির নির্মাণে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের চেতনার নতুন স্তরে উন্নীত করে। শঙ্করের মতো আমরাও বেদনায় নীল হয়ে যাই।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

রূপায়ণ ঘোষ

চৈতন্যদর্শন: এক বৈপ্লবিক সমাজবাদ

“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়ঃ সদা হরিঃ।।”

নাহ্, এই শ্লোকটির রচয়িতা কোনো প্রাজ্ঞ পক্বকেশ পুঁথিবিদ্যাসর্বস্ব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নন। সুললিত এরকম অসংখ্য শ্লোকের রচনাকার হলেন বাংলা তথা ভারতীয় ভক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্বম্ভর মিশ্র-সমাজ ও ইতিহাস যাঁকে চিনেছে শ্রীচৈতন্য রূপে। শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে (তৃণাদপি) অর্থাৎ, তৃণের চেয়ে ক্ষুদ্র হও কিন্তু (তরোরিব) বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। যে-মানুষ অন্যকে সম্মানের চোখে, সমানের চোখে দেখেন তারই পক্ষে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দীর (১৪৮৬ খ্রিঃ) যে-সময়ে চৈতন্যদেবের জন্ম সেই সময় বাংলা তথা সমগ্র ভারতে সুলতানি শাসনের কর্তৃত্ব মধ্যগগনে। অন্য দিকে বঙ্গদেশ ও নবদ্বীপ ছিল তৎকালীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান। সেন শাসনকাল থেকে বিস্তীর্ণ গঙ্গার দু-পাশে জমি ও বিপুল অর্থৈশ্বর্য লাভ করে কুলীন ব্রাহ্মণকুল যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে নবদ্বীপ- শান্তিপুর অঞ্চল ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, দেশের নানান প্রান্ত থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা এসে এখানে অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও বিদ্যাচর্চা যেমন করতেন তেমনই বিষয়রসে আকৃষ্ট হয়ে গোঁড়ামির প্রবল উন্মত্ততাও লালন করতেন। স্মৃতিশাস্ত্র শাসিত সমাজ ছিল জাতি ও বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পুরাতন স্মৃতিব্যবস্থাগুলির মধ্যেই রোপিত ছিল প্রাচীন ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিষাক্ত বীজ। যে-মনুস্মৃতিতে নারী, শূদ্র ও কুকুরকে এক শ্রেণিতে ফেলে নিন্দা করা হয়েছে, যে-স্মৃতিশাস্ত্রে নারী ভোগবাদের অপার স্বাধীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক মদমত্ততাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেই শাস্ত্র শাসিত সমাজ যে আদতে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাহ্মণ শ্রেণির বেলাগাম অত্যাচারে প্রাণান্তকর অবস্থায় নিম্নবর্গের প্রভূত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করেন। আশ্চর্যজনকভাবে একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ক্ষমতাতন্ত্রের সমান নিদর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে। পঞ্চদশ শতকের ইতালিতে যে-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়, সেখানে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে গেল। তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪৫৩-১৪৯২), তৃতীয় চার্লস (১৪৯৬-১৫২১)-এর মতো শাসকেরা ছিলেন নিঃসন্দেহে জ্ঞানদীপ্ত তথাপি আগ্রাসী স্বৈরাচারী। ইউরোপীয় নবজাগরণের যুগেও সেখানে ক্ষমতা ও চার্চকেন্দ্রিক অন্ধসংস্কারের যে-চিত্র ফুটে ওঠে, পঞ্চদশ শতকের ভারত তার চেয়ে পৃথক কিছু নয়। ঠিক এই সময়কালে চৈতন্যদেবের সমাজ সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ- মধ্যযুগীয় ভারতের বর্বর প্রথা অবসানের সূচনামুখ।

রূপ গোস্বামী সংকলিত পদ্যাবল্যাং সংখ্যক নয়-এ গৌরাঙ্গ বলছেন,

“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো।
নাহং বর্ণী ন চ গৃহরপতির্নো বনস্থো যতির্বা।।”

অর্থাৎ, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র নই, নই গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বনবাসী এমনকী সন্ন্যাসীও নই। তাহলে তিনি কী? তিনি আদ্যোপান্ত মানবেশ্বর প্রেমে মত্ত আর এক মানুষ— যিনি কেবল মানবকে মানবরূপে, সত্যকে পরিপূর্ণ সত্য জেনে সাধনা করেছেন, সেবা করেছেন। কোনো আরোপিত ধর্মমোহের প্রয়োজন তাঁর পড়েনি। সম্মোহন সাধনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি প্রচার করেছেন প্রেমসর্বস্ব, ত্যাগসর্বস্ব ভক্তিবাদের। তাঁর কাছে আচারব্যূহে নিমজ্জিত ধর্মভাবের কোনো গুরুত্ব ছিল না, উপনিষদের ‘আনন্দরূপচেতনা’-ই হল চৈতন্যদর্শনের মূল আধার। বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘ভক্তমাল’-এ বর্ণিত গুজরাতের ঘোগা গ্রামে নটী-শ্রেষ্ঠা অসামান্যা রূপবতী বারমুখীর সম্মুখে অশ্রুসজল নয়নে তিনি উচ্চারণ করছেন— হে সখী, হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে ঈশ্বরের নিমিত্ত প্রেম সঞ্চার করো, সে-স্থানে জগতের নাম, রূপ, কর্ম সদা সঞ্চারণশীল, উহাতেই মুক্তি। আশ্চর্যের বিষয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের খিলকাণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে ধ্বনিত হচ্ছে একই স্বর—

“এষ প্রজাপতির্যদ্ধৃদয়মেতদ্ ব্রহ্মৈতৎ সর্বং তদেতৎ ত্র্যক্ষরং হৃদয়মিতি হৃ ইত্যেকমক্ষরমভিহরন্ত্যস্মৈ।।”

অর্থাৎ, হৃদয়ের ভূমিতে নাম, রূপ, কর্মের নিবাস। হৃদয়ই সর্বভূতের অধিষ্ঠান ও সর্বভূতাত্মক প্রজাপতি। অতএব সকল স্তরে, জীবে, শ্রেণিতে হৃদয়ব্রহ্মই এক এবং একমাত্র উপাস্য। যে-বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় তা হল, বেদান্ত দর্শনের উপলব্ধিকে কেবলমাত্র ভক্তিরসের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসী, শাসক, নগরনটীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বিন্যাস তো করছেনই না উপরন্তু যবন হরিদাসের ভক্ষিত খাদ্য গ্রহণ করতে করতে বিশ্বম্ভর পুলক-বেদনার পরমাশ্রয়ে সমাহিত হয়ে পড়ছেন। আবার এই গৌরাঙ্গই স-পার্ষদ গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন! ষোড়শ শতকের সেই বাংলা তখন সর্বাংশেই সুলতানি শাসনাধীন, দিল্লির মসনদে আসীন সিকন্দর লোদি, বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ। এই পরিস্থিতিতে নবদ্বীপে নাম-সংকীর্তনের দল সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠলে সেখানকার মুসলমান কাজী ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভীত হয়ে কীর্তন বন্ধের ফরমান জারি করেন। হাওয়ায় খবর রটে যায় নদীপথে নৌকাযোগে সুলতানের সেনাবাহিনী আসছে লুঠতরাজ এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও তা শেষপর্যন্ত সত্যি হয়নি, কারণ, হুসেন শাহের মতো বিচক্ষণ শাসক বরাবর সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এই পরিস্থিতিতেই চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ গণশক্তির সাহায্যে স্বৈরাচারী শাসননীতির প্রতিবাদ করেন, স-পার্ষদ কাজীর বাড়ি অবরোধ করে দুই রাত্রি অবস্থান বিক্ষোভের পর কাজী নাম-সংকীর্তনের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করবার নয় যে, নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এক্ষেত্রে কাজীর সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে বিশ্বম্ভরের আড়ম্বরহীনতা, সরল সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছিল। নবদ্বীপ এবং আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ব্রাহ্মণরা (মূলত যারা যজমানি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত) বুঝতে পেরেছিলেন তাদের সর্বাত্মক প্রতিপত্তির উপর চৈতন্যের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ‘কাজীদলন’ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কবি কর্ণপুরের গ্রন্থে এ-কাহিনির কোনো উল্লেখ নেই আবার মুরারিতে রয়েছে গৌরাঙ্গ কর্তৃক ম্লেচ্ছ উদ্ধারের কথা। কিন্তু এই ঘটনার আত্যন্তিকতা বাদ দিলেও যে-সত্য ধরা পড়ে তা হল, বিশ্বম্ভর তাঁর ধর্মপ্রচারে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন! রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ নাটকে ক্ষেমংকর নবধর্মকে বাধা দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে সৈন্য নিয়ে অভিযান করতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নবধর্মের প্রচার ও প্রসার স্তব্ধ করে দিতে ক্ষেমংকরেরা চিরকালই উৎসাহী। অনুরূপ ব্যাপার চৈতন্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত কিন্তু সম্ভবত হুসেন শাহের মতো প্রশাসকের সদর্থক উপস্থিতি এখানে যথেষ্ট কার্যকরী প্রতিভাত হয়েছিল।

লক্ষ করার বিষয় হল, কার্ল মার্কস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘Communist Manifesto’-তে শাসকের বিপক্ষে সাধারণ সর্বহারা শ্রেণির যে-গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলছেন তার অন্তত সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে বঙ্গদেশের মাটিতে চৈতন্যদেব সেই আন্দোলনের সূচনা করে ফেলেছেন। গণ-আন্দোলন সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হল, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিপীড়িত মানুষের সুবিশাল সমূহকে বিপ্লবের ছাতার তলায় একত্রিত করা। অন্য দিকে বিংশ শতাব্দীর প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক তথা দার্শনিক আলব্যের কামু বিপ্লব সম্পর্কে বলছেন—

“More and more, revolution has found itself delivered into the hands of its bureaucrats and doctrinaires on the one hand, and to the enfeebled and bewildered masses on the other.”

অথচ তার চার-পাঁচশো বছর পূর্বে মধ্যযুগীয় ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেব দু-হাতেই গণ-বিপ্লবকে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কোনো স্থান সেখানে ছিল না, রক্তের যেটুকু ক্ষয়— তার সমস্তটাই নিজের। ক্ষমতাতন্ত্রের কোনোরকম পুজো না করেই অহিংস ভক্তিবাদকে কেন্দ্রাবর্তে রেখে সমাজের একেবারে অন্ত্যজবর্গকেও সঙ্গে করে তিনি পথ হাঁটছেন, উত্তরসূরি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্যটি এখানেই। দখলের পরিবর্তে তিনি হৃদয়ের জয়ে অধিক বিশ্বাসী। মনে রাখতে হবে তৎকালীন হিন্দু সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন পঞ্চোপাসক, স্মার্ত (স্মৃ প্রত্যয় জাত, অর্থে— স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ)।

অন্ধসংস্কার, লোকবিশ্বাসের মতো ক্ষতিকর ধারণা পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য, রাজসংযোগানুসারে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রভৃতির দ্বারা সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে চালানোর লোভ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দোসর ছিল কিছু নির্বাচিত উচ্চবর্গীয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। তাদের একাধিপত্যের ফলে সমাজের বহু নিম্নবর্গীয় জাতি রাতারাতি শূদ্র বলে পরিগণিত হতে থাকেন; উচ্চ-নীচ শ্রেণির ভেদাভেদ বড়ো হয়ে দেখা দেয়— বলা বাহুল্য তা সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পক্ষে খুব একটা সুখকর অবস্থা ছিল না। বিশ্বম্ভরের সংকল্প ছিল এই সমস্ত স্ত্রী-শূদ্র-অন্ত্যজ শ্রেণিকে ভক্তির মাধ্যমে উন্নত এবং মুক্ত জীবনযাপনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সে-কারণেই তিনি নিত্যানন্দকে নীলাচল থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন, সন্ন্যাসী না হয়ে তাকে সমাজসেবক হওয়ার পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ নিত্যানন্দের অবাধ সান্নিধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি সমাজের বিবিধ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বৈষ্ণব ধর্মের ছত্রছায়ায় আসতে শুরু করেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, চৈতন্যদেব সকলকেই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন— ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র ধীরে ধীরে একীভূত হতে থাকলে সমাজের সর্বাঙ্গীন ঐক্য সাধিত হয়। চৈতন্যভাগবতের ‘কাজীদলন’ অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্ণের শ্রীধরের কুটিরে লোহার পাত্র থেকে বিশ্বম্ভর জল পান করছেন, শ্রীধর জন্মগত জাতি সংস্কারের বিধি-নিয়মে তখনও আবদ্ধ— ভয়ে সে শিউরে উঠলেও গৌরাঙ্গ নির্বিকার। পূর্বেও আমরা দেখেছি বিশ্বম্ভর আদতে ঐক্যবিধায়ক শক্তি, সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙতেই তাঁর যাবতীয় উৎসাহ এবং উদ্দীপনা। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যেন এই ঘটনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন; গোরায় দেখা যায়, চরের ঘোষপুরের নাপিতের ঘরে জল পান করে এক মুসলমান যুবক, প্রবল নীলকর সাহেব ও গোঁড়া হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে সেই নাপিত মুসলমান ফরু সর্দারের পুত্র তমিজকে ঘরে এনে রেখেছিল। উপন্যাসে দেখা যাবে গোরা এই তথাকথিত হিন্দু সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, অনুরূপভাবে চৈতন্যের আচরণেও সেই একই দ্রোহচিহ্ন; সে-যুগের প্রেক্ষিতে যা এক বিপ্লবের সমতুল্য বলা চলে।

পুরীতে অবস্থানকালে জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত জনৈক সার্বভৌম আচার্য ভগ্নিপতি গোপীনাথ ভট্টাচার্যের কাছে চৈতন্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গোপীনাথ উত্তর দেন—

“ইঁহার নাহি বাহ্যাপেক্ষা/ অতি বড় সম্প্রদায়েতে উপেক্ষা।।”

বিশ্বম্ভর যে আদ্যোপান্ত অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ ছিলেন, সমাজের সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে যে তার অবস্থান- বৃন্দাবন দাস স্থানে স্থানে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। খাণ্ডবা গ্রামের সেবাদাসী ইন্দিরা বাঈ, কিংবা নারোজি দস্যু, ভিল পান্থদের মতো ভিন্ন ভিন্ন বর্গের মানুষকে অবনমনের পথ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। আবার পুরীতেই মন্দিরের পাণ্ডারা তাঁর বিরোধিতা এমনকী ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছেন। কলিঙ্গ সেই মুহূর্তে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ কলহে পর্যুদস্ত, তদসত্ত্বেও দু-টি শক্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে চৈতন্য ও মহারাজ প্রতাপরুদ্র অপর দিকে গোবিন্দ বিদ্যাধর, জগন্নাথ দাশের মতো মন্দিরের পাণ্ডাবৃন্দ। সে-সময় প্রতাপরুদ্র দক্ষিণাঞ্চলের রাজা কৃষ্ণদেবের কাছে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন, তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সংকোচিত হয়ে আসছে। মন্দিরের সেবায়েতবৃন্দ ধীরে ধীরে নীলাচলের নিয়ামক হয়ে উঠতে শুরু করলে গৌরাঙ্গকে নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করতে হয়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে ‘প্রাধান্য ও আধিপত্যবাদ’ যেখানে শাসকের চরিত্রকে সর্বকালীন দোর্দণ্ডতা প্রদান করছিল সেখানে গৌরাঙ্গ সমাজের দুর্বল শ্রেণিদের একত্রিত করছেন, ঈশ্বরের ভক্তিবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে! কারণ, তিনি জানতেন প্রভুত্ব অধিকার করে, প্রতিপত্তি অর্জন করে রাষ্ট্রশক্তি ক্ষান্ত হয় না। তার মূল লক্ষ্য থাকে সংস্কৃতি ও সামাজিক ভাবাদর্শের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া।

কী অদ্ভুত! চৈতন্যের এই কার্যকলাপের পরবর্তীতে আধুনিক ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি আনছেন (Hegemony and Dominance) তত্ত্ব! আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে চৈতন্যের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়— “The bourgeoisie acquires all the authority of Society through the establishment of Hegemony.” (Prison Notebooks)

দু-জন পৃথক ব্যক্তি, দু-টি আলাদা মহাদেশ— মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রায় চারশো বছর। একজন ঘোষিত সমাজবাদী দার্শনিক অন্যজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; অথচ প্রায় হুবহু একই চিন্তন উদ্ভাসিত হচ্ছে দু-জনের মননে, কার্যক্রমে! একে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সময়োপযোগী উত্তরণ ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভবই নয়। আবার এই প্রবল সাম্যবাদী সন্ন্যাসী সমাজ-সংস্কারক বিশ্বম্ভর কর্ম ও ভক্তি দ্বারা দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে চান। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান সময়পর্বে ভক্ত ও ভক্তির যে-আতিশয্য চতুর্দিকে দেখা যাচ্ছে গৌরাঙ্গের ‘ভক্তি’ তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতের কথা বলে। তাতে স্নেহ, প্রেম, বাৎসল্য, মধুরতা, শান্ত, দাস্য, শখ্য উপস্থিত— এ হল চৈতন্যতত্ত্ব। এখানে হিংস্র অন্ধভক্তির কোথাও কোনো স্থান নেই।

“নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদ্গদরুদ্ধয়া গিরা।
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি।।”

রূপ গোস্বামী সংকলিত চৈতন্যের এই ছয় সংখ্যক পদাবলীটিতে সেই ভক্তি এবং ভক্তি দ্বারা মুক্তির কথা ধ্বনিত হয়। এই মুক্তি কি দেহাবসানের কথা বলে?

না, এই স্বর প্রকৃত অর্থে জাগতিক লালসা ও স্বার্থান্বেষী জীবনচর্যার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ-সাম্যের কথা বলে। এমন অশ্রুধারা যা সংবরণ করা যায় না, কথা বা বাক্ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় তার ক্রিয়া স্তব্ধ করে (এখানে ইন্দ্রিয় নিঃসন্দেহেই পঞ্চেন্দ্রিয়) সুতরাং ইন্দ্রিয় সুখের লোভ পরিত্যাগ করে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তবে কি বিশ্বম্ভর আরাধ্যের প্রাপ্তিকে সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়েই অনুভব করতে চান? না হলে কৃষ্ণনাম ব্যতীত সমাজ-সাম্যের এত বিপুল প্রচেষ্টা তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে কেন? তবে কি সাম্যবাদের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছেন পূর্বসূরির সূত্রে? ভুললে চলবে না ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে মানব-সাম্যের সর্বপ্রথম পাঠ গৌতমবুদ্ধের মহাবৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার ফসল। ‘ধম্মপদ’-এর বুদ্ধবর্গে তিনি বলছেন—

“বহুং বে সরণং যন্তি পরবতানি বনানি চ।
আরামরুকখচেত্যানি মনুসসা ভয়তজ্জিতা।।

দুকখং দুকখসমুপপাদং দুকখসস্ চ অতিককমং।
অরিয়ঞ্চটঠঙ্গিকং মগগং দুকখূপসমগমনং।
এতং সরণামাগমম্ সব্বদুকখা পমুচ্চতি।।”
(শ্লোক: ১৮৮, ১৮৯)

(মনুসসা ভয়তজ্জিতা) ‌মনুষ্যগণ ভয়বিহ্বল হয়ে বনে, পর্বতে, উদ্যানে আশ্রয় নেয়। কারণ দুঃখ থেকে, লোভ এবং হিংস্রতা থেকে উৎপত্তি হয় ভয়ের। কিন্তু এই বহির্জগতের আড়াল উত্তম আশ্রয় কখনোই নয়। তার জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখের মুক্তি। দুঃখ (দুকখং) ও দুঃখের মায়াকে অতিক্রম করে (দুকখসমুপপাদং) অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে সম্যক সত্য প্রজ্ঞার দর্শনে (সম্মপঞ্ঞায় পসসতি) মুক্তি সম্ভব। গৌতমবুদ্ধ এই সর্ব-দুঃখের পরিত্রাণকে বলেছেন (সব্বদুকখা পমুচ্চতি) আর চৈতন্য বলছেন (প্রোদ্যন্নিখিলপরমান্দপূর্ণামৃতান্ধে) সংসারের সর্বপ্রকার মায়া থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তি, কর্ম-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির এই সত্যের ক্রমানুসন্ধানই অহিংসা ও প্রেমের সামাজিক সাম্যাবস্থার একমাত্র প্রতিষ্ঠা পথ।

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার’/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।” অথবা “নীরব রাত্রি হারাইয়া বাক্/বাহির আমার বাহিরে মিশাক/দেখা দিক মম অন্তরতম/অখণ্ড আকারে।”

‘গীতাঞ্জলি’-র মর্মে মর্মে এক ও অখণ্ডতার কথা কি রবীন্দ্রনাথও বলছেন না? ‘বিহার’ শব্দের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে স্পর্শ করছেন বুদ্ধ ও চৈতন্যকে। এক অর্থে ‘বিহার’ বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান— মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণকারী সাম্যের নিরন্তর চর্চার প্রাণকেন্দ্র অন্য দিকে চৈতন্যের বিহার হল ‘প্রেমবিহার’। কীর্তনের মহাভাবে প্রতিনিয়ত শান্তি, মুক্তি এবং সাম্যের বাণীকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

এই পর্বে এসে আশ্চর্য প্রবহমানতায় আমরা লক্ষ করছি, প্রাচীন ও আধুনিক দুই কালচক্রের সমাজকে, তার বিবর্তনকে সাম্যের পারম্পর্যে জুড়ে দিচ্ছেন মধ্যযুগের আর এক লোকতান্ত্রিক দার্শনিক তথা সন্ন্যাসী। মানুষের দুঃখের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টায়, মধ্যযুগীয় সামাজিক অব্যবস্থার বিপক্ষে সরাসরি লড়াইয়ের চেষ্টায় তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামই যে চৈতন্যদেবকে আজ মহত্ত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সে-কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।