Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

গৌতম অধিকারী

চৌগাছার নীলবিদ্রোহ: ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়

বাংলাদেশের সংগঠিত নীলবিদ্রোহের ইতিহাসে চৌগাছার বিদ্রোহ গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্রোহের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বর্তমানে চৌগাছা নামে একটি গ্রামের মানুষ ছিলেন। ফলে চৌগাছার বিদ্রোহরূপেই এর পরিচিতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য এই যে চৌগাছার কৃষকরা বিদ্রোহে অংশ নিলেও প্রতিরোধটি শুরু হয় গোবিন্দপুরে, বর্তমানে নদিয়া জেলার চূর্ণী-তীরবর্তী র্হাঁসখালি ব্লকে যার অবস্থান। বিদ্রোহের প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৮৮০ সালের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় এই বিদ্রোহের প্রথম পরিচিতি প্রকাশিত হয়। রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘A Story of Patriotism in Bengal’। লিখেছিলেন নীলবিদ্রোহের অন্যতম সুহৃদ ও অগ্রণী মানুষ শিশিরকুমার ঘোষ। পরবর্তীতে রচনাটি তাঁর ‘Pictures of Indian Life’ গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। সত্যিকারের কথা হল, এই লেখাটির সূত্রেই বাঙালি গবেষক সমাজ প্রথম চৌগাছার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু আমার মনে এই বিষয়ে অন্তত দু-টি ছোট্ট প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে, নীলবিদ্রোহের এত বড়ো লড়াইটা শেষপর্যন্ত প্রচারের আলোয় আসতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল কেন? দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহের স্থান হিসেবে কোন জায়গাটিকে ধরা হবে? তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে, এই বিদ্রোহের যে-বিশেষ গুরুত্বের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, সমসময় সে-বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল না!

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, চৌগাছার অবস্থান যশোরের জেলার ঝিকরগাছা থানাধীন। পক্ষান্তরে ‘নদীয়া কাহিনী’-র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক সিদ্ধান্ত করেছেন নদিয়া জেলার চূর্ণী তীরবর্তী গ্রাম চৌগাছা, যার আজকের অবস্থান কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে। কোনো সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তে আপাতত আমি যাচ্ছি না। শুধু জানিয়ে রাখি পরবর্তীতে এই বিষয়ে যে-সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার কোনোটাই শিশিরকুমারের বর্ণিত ঘটনার বাইরে নয়। এবং এইসব লেখাপত্রে চৌগাছার স্থানিক পরিচয় থেকে শুরু করে বিদ্রোহের আসল চরিত্র ও ঘটনা সম্পর্কে গবেষকমহল নিজেদের পছন্দমতো ব্যাখ্যা দিতেই আগ্রহী হয়েছেন। ফলে চৌগাছার নীল বিদ্রোহ বলে কথিত বিদ্রোহের আসল ঘটনা ইতিহাসের আড়ালে গেছে হারিয়ে। হারানো সেই ইতিহাস-অনুসন্ধানে প্রথমে আমরা শিশিরকুমারের রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

শিশিরকুমার জানাচ্ছেন, চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও পোড়াগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস দু-জনেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীলকুঠিতে কর্মরত দেওয়ান। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন ছোটো জমিদার (a small Zeminder) এবং দিগম্বর বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মহাজন’, যিনি টাকা ও ধান খাটাতেন সুদের বিনিময়ে (lent money and paddy on interest)। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা নীলচাষের অংশভাগ, এবং এই সূত্রে উপার্জিত অর্থে সমৃদ্ধ গৃহস্থও বটে। নীলকুঠিতে দেওয়ান হিসেবে চাকরি করতে করতেই তাঁদের মধ্যে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে বিরূপ মানসিকতার জন্ম হয়। কারণ, শিশিরকুমারের মতে— “they were men of indomitable perseverance and courage.” সবচেয়ে বড়ো কথা— “They were, besides, men of heart, and has large share of the intelligence which generally characteristics a Bengali gentleman.” এবং এ-জন্য তাঁরা দেওয়ানের চাকরি ছাড়েন। আর শিশিরকুমার মনে করেছেন— “they were obliged to leave service in disguist, as Dewans of indigo factories, who hearts, had to do in those days.” খুব স্পষ্ট যে সময় ও কালের আহবানে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীলচাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন এবং নেতৃত্ব দেন। নেতৃত্ব দেন শুধু নয়, “সম্ভব হলে তাদের একেবারে দেশ-ছাড়া করবার শপথ নিয়েছিলেন।”

কিন্তু নিছক নীলচাষিদের প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা থেকে দিগম্বর বা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীলবিদ্রোহের পথে হেঁটেছিলেন, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পুলক চন্দ তাঁর ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন— “বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠির নীলকর হোয়াইটের সঙ্গে মহাজনি কারবারকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসের ছিল এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাজনিতে তখন তাঁদের প্রবাহী পুঁজি (floating capital) ছিল কম করেও লাখ টাকা। সুতরাং ঐ অঞ্চলে ধানচালের ব্যবসার একচেটিয়া কারবার করার পথে বিশ্বাসেরাই ছিলেন বড়ো বাঁধা।” আবার নীলকর হোয়াইটও নীলচাষের পাশাপাশি ধানের কারবারে অর্থ লগ্নি করতেন। তিনি চাইলেন বিশ্বাসদের মজুদ ধান কিনে নিতে। বিরোধ বাঁধল চুক্তির শর্তাবলীতে। তখন হোয়াইট শক্তি প্রয়োগ করে ধান লুঠ করার চেষ্টা করে এবং বিশ্বাসদের কাছে যে সব চাষী ধার-কর্জ নিয়েছিল, তাদের উপর প্রভাব খাটাতে শুরু করেন কর্জ শোধ না করতে। বোঝা যায়, প্রথম দিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার কারণেই বিশ্বাসেরা নীলকরদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়। পুলক চন্দের এই বক্তব্যে ‘অন্য সূত্র’ কথাদুটো থাকলেও সূত্রটি স্পষ্ট নয়। যদিও স্বয়ং শিশিরকুমার তাঁর লেখাটিতেও বিশ্বাসদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন— “In the village Chougatcha, district Nadia, lived two gentlemen babus Vishnu Charan Biswas and Digambar Biswas. They were both men of some property: Babu Vishnu Charan Biswas was a small zamindar, and Babu Digambar Biswas, a Mahajan, that is lent money and paddy with the interest.” ফলে এইসব কারবারকে কেন্দ্র করে সেকালে নীলকর ও স্থানীয় জমিদার ও ভূমধ্যকারীদের মধ্যে হামেশাই বিরোধ লেগে থাকত। এক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবুও এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, টিঁকে থাকার প্রয়োজন এবং আহত মর্যাদা রক্ষার তাগিদ থেকে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস কোমর বেঁধে নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নিষ্ঠায় তাঁরা রেখে যান বিরল দৃষ্টান্ত এবং তাঁদের নেতৃত্বে প্রবল গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্বার্থপর কথা ভেবে পিছিয়ে আসেননি, হারিয়েছেন সর্বস্ব।

গ্রামে গ্রামে চাষিদের কারণে নীলচাষ বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বাসেরা সরাসরি। জানতেন নীলকর সাহেবরা সহজে ছাড়বে না। হিংস্র আক্রমণ নেমে আসবে নিশ্চিত জেনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন, সশস্ত্র চাষিবাহিনীর পাশাপাশি বরিশাল থেকে দক্ষ লাঠিয়াল আনিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে বিষ্ণুচরণের গ্রাম চৌগাছা ছাড়া সাড়া মিলল আর মাত্রা একটি গ্রাম থেকে। শিশিরকুমার লিখেছেন— “All the villages declined to join them except one, and to that village they sent eight spearsmen for its protection. The planter, who was thus defied, resolved to nip the rebellion in the bud, and collect about a thousand men, about one hundred of whom were regulars. Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম অবশ্য শিশিরকুমার উল্লেখ করেননি।

চাষিদের এই প্রস্তুতির খবর নীলকর হোয়াইটের অগোচরে থাকার কথা নয়। অঙ্কুরেই বিদ্রোহকে দমন করতে তার শিবিরেও সাজো-সাজো রব। বিভিন্ন জায়গা থেকে এক হাজার পেশাদার লাঠিয়াল সংগ্রহ করে তৈরি হলেও বাহিনী। ধুরন্ধর হোয়াইট রটিয়ে দিল এক নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ করা হবে চৌগাছা গ্রাম। শিশিরকুমারের বর্ণনা— “The planters spread a rumour to the effect that they would attack the village Chougatcha on a certain day,…” বাস্তবে হোয়াইট তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন ঐ গ্রামটির দিকে, যেখানেই নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের শক্তিশালী প্রস্তুতি। কিন্তু গুজবের শিকার হয়ে গাঁয়ের চাষিরা আটজন শড়কিওয়ালার মধ্যে চারজনকে আগেই চৌগাছা আক্রমণ প্রতিহত করতে পাঠিয়েছিল। ফলে কম শক্তিতে কিছুটা হলেও তারা প্রাণপণ লড়াই করেছিল। পরাজিত হবার পর বিধ্বংসী অত্যাচার নেমে আসে গ্রামে, চলে অবাধ লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে আহত হয়ে মারা যায় একজন লাঠিয়াল।

প্রথম পরাজয়ের আঘাতে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়তো ভেঙে পড়ত, কিন্তু ভাঙেনি, “এক অশেষ সৌভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতি”-র কারণে, শিশিরকুমারের ভাষায়— “So the first battle was lost, and the combination might have collapsed, but for an extremely lucky circumstances.” সেটি হল, এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছিলেন আর. এল. টোটেনহাম নামে এক উৎসাহী যুবক। এই ঘটনার বিচারের ভার পড়ে তাঁর হাতে। তিনি হোয়াইটকে দোষি সাব্যস্ত করে তিনশো টাকা জরিমানা আদায় করেন। যে-সময়ে নীলকর সাহেবদের সমস্ত অপরাধ সহজেই মাফ করে দেওয়াটাই ছিল রেওয়াজ, সেই সময়ে সামান্য হলেও এই শাস্তিবিধান কৃষকদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। গ্রামে গ্রামে নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে ওঠে, তৈরি হয় সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিরোধের একটা স্তরে নীলকর সাহেবরা মিথ্যে মামলায় চাষীদের সর্বস্বান্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে, এদের মামলার খরচ, বিপন্ন সংসারের দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে দিগম্বর বিশ্বাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন এই সময় রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী খানিকটা হলেও দিগম্বর বিশ্বাসের পাশে দাঁড়ান।

কিন্তু যে-আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং চাষিদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য এতটা আত্মত্যাগের পথে হেঁটেছিলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস, তা অবশ্য অচিরেই সফল হয়। শিশিরকুমার লিখেছেন— “Another village joined them, and another. Within the course of a year and-a-half they found the factory tottering. The ryots had become then the stronger party. The tidings spread far and wide that the indigo ryots had fought and won against planter.” কাঠগড়া থেকে লোকনাথপুর সব কুঠির অধীন বিরানব্বইটি গ্রামের চাষী-প্রজারা ঘোষণা করে দিল, “বুনব না নীল”। শিশিরকুমারের অভিমত, ১৮৬০-এর নীলচাষ-বিরোধী আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই চৌগাছা থেকেই। শিশিরকুমারের আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছিল প্রবন্ধের একদম শেষে। তিনি লিখেছেন— “Their [Vishnu Charan and Digambar Biswas] names are not even known, and this is the first time that we are induced to give publicity to their doing.”

শিশিরকুমারের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, এই আন্দোলনের সমকালে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। এমনকী নীলচাষিদের একান্ত সুহৃদ শিশিরকুমারও হয়তো সবিস্তার অবগত ছিলেন না। কিন্তু আমরা জানি, এই ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে কর্মবীর শিশিরকুমার তাঁর বড়দার প্রয়াণে কিঞ্চিৎ মানসিক অসহাতার শিকার হয়ে এসেছিলেন নদিয়া জেলার হাঁসখালিতে, বাস করতেন চূর্ণীপাড়ের কালীপাড়ার এক পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে। এখানে বসেই ‘শ্রীঅমিয়নিমাই চরিত’ লেখার প্রেরণা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এখানে এসেই সবিস্তারে হয়তো শুনে থাকবেন চূর্ণীপাড়ের নীলবিদ্রোহের কাহিনি, যা লিপিবদ্ধ করলেন ‘A story of patriotism of Bengal’ প্রবন্ধে। চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে পরবর্তীতে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর একমাত্র আকর এই প্রবন্ধটি। কিন্তু শিশিরকুমারের প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে না পড়ে অনেকেই চৌগাছার বিদ্রোহের স্থান সম্পর্কে নিজের নিজের বক্তব্য হাজির করেছেন, তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। আমরা চেষ্টা করব আর কিছু পার্শ্ব উপাত্ত ও শিশিরকুমারের প্রবন্ধের ভিত্তিতে গভীরতর সত্যে পৌঁছুতে। তার আগে অবশ্যই বিভ্রান্তির জায়গাগুলো একটু সামনে আনা দরকার।

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদার লিখেছেন— “যশোরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন।… চৌগাছা কাঠগড়া কুঠির অন্তর্গত।” ‘যশোর জেলার নীলচাষ: নীলকর ও নীলচাষী সম্পর্ক’ নামের অতীব তথ্যপূর্ণ একটি গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদারের কথাকেই অনুসরণ করেছেন লেখক মোঃ রেজাউল করিম। যশোরের ইতিহাস-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘যশোরাদ্য দেশ’-এর রচয়িতা হোসেন উদ্দিন হোসেনও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের বাসস্থান ও বিদ্রোহ-স্থান হিসেবে ‘ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে’-র কথাই বলতে চেয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, যশোরের কাঠগড়া কানসার্ণের অন্তর্ভুক্ত একটি নীলকুঠি চৌগাছা এবং তার অবস্থান কপোতাক্ষ তীরে। কিছু শিশিরকুমারের বক্তব্য থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাঁশবেড়িয়া কুঠিবাড়ি নীলকর হোয়াইট সাহেবের বিরুদ্ধে প্রথম। আর নিশ্চিতভাবেই বাঁশবেড়িয়া কুঠির অবস্থান নদীয়ার জেলার মধ্যে। চাকরিসূত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের সম্পর্ক কাঠগড়া কুঠিবাড়ি সঙ্গী ছিল, কেন-না তাঁরা একাধিক কুঠির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বাসদের বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল পালটে যেতে পারে না। সব চেয়ে বড়ো কথা স্বয়ং শিশিরকুমারের লেখাতেই বিদ্রোহের প্রস্তুতি-অঞ্চল হিসেবে মনে করিয়ে দিয়েছেন— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম আমরা প্রথম জানতে পারছি মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার. বি. ক্লিং-এর গবেষণাগ্রন্থ ‘The Blue Mutiny: The Indigo Dusturbances of Bengal’ থেকে। ব্লেয়ার তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘The Conspirators’ শিরোনামে মহেশচন্দ্র দত্ত, লালচাঁদ সাহা, রতন মণ্ডল প্রমুখের পরপরই লিখেছেন— “Two other minor landlords and moneylenders who became leaders of the peasants had become legendary heroes in Bengal. They were Digambar Biswas and Bishnu charan Biswas, leading Indian employees of the Bansbaria concern in Nadia District.” (pp. 95) অর্থাৎ, ব্লেয়ার আমাদের নিশ্চিত করে দিলেন আরও একবার বাঁশবেড়িয়া কানসার্ণের বিরুদ্ধেই বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, কপোতাক্ষ-তীরের কাঠগড়া কানসার্ণের বিরুদ্ধে নয়। এর পর ব্লেয়ার আবার লিখছেন— “On September 13, 1859, white sent more than hundred Lathials, some mounted on elephants to attack Govindapur.” শিশিরকুমার কথিত— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.”-ই যে গোবিন্দপুর তাতে বোধ করি কোনো সন্দেহ থাকে না। আর গোবিন্দপুরের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও কপোতাক্ষ তীরের ঝিকরগাছা থানার চৌগাছায় বসে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা এই, স্বয়ং শিশিরকুমার ছিলেন ঝিকরগাছা থানার পলুয়া-মাগুরার মানুষ, তাঁর অঞ্চলের নীলবিদ্রোহে শুধু নয় গোটা বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। নিজের বাড়ির পাশের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐ ১৮৫৮-১৮৫৯-এ সংঘটিত বিদ্রোহ সম্পর্কে কুড়ি বৎসর তাঁর অন্ধকারে থাকার কথা নয়।

কৃষ্ণনগর সদর শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরের গোবিন্দপুর বাংলাদেশের সগংঠিত নীল বিদ্রোহের প্রথম রণক্ষেত্র, সংঘাত শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে বগুলা নীলকুঠির অত্যাচারকে কেন্দ্র করে শ্যামনগরের কাল্লু মণ্ডল, আমীর মণ্ডলের নেতৃত্বে। তার বিকশিত রূপের হাল ধরলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস। আর রণক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র তীর্থের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর। যে-সংঘাতের কয়েকদিন পরে আহতাবস্থায় শহিদ হন একজন সড়কিওয়ালা‌। সংগঠিত নীলবিদ্রোহের প্রথম শহিদের নামে আজও বাঙালি জানে না। কিন্তু ঐ বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই শহিদ হয়েছিলেন আর একজন ছোটো ভূমধ্যকারী-গোপাল তরফদার। ইতিহাসে তাঁর কথাও রয়ে গেল উপেক্ষিত।

হাঁসখালির ভূমধ্যকারী ছোটো জমিদার গোপাল তরফদার গোবিন্দপুর আক্রান্ত হওয়ার সময়ে লড়াইয়ের প্রথম সারিতেই ছিলেন। এই সময় কৃষ্ণনগর থানার দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। নীল কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতা এই পুলিশ আধিকারিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ (শ্রাবণ ১২৯৩-শ্রাবণ ১২৯৪)। পরের বছর বাংলা ১২৯৫, অর্থাৎ, ইংরেজি ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ঢাকা থেকে এটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানেই, একমাত্র সেখানেই রয়েছে গোপাল তরফদারের শহিদ হবার কাহিনি। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন— “… হাঁসখালির গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদার। সেই ব্যক্তি তাহার গ্রামের প্রজাবর্গের সাহায্যে কুঠির বিরূদ্ধাচরণ করাতে একদিবস রাত্রে একটি হস্তীসমেত কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক গোবিন্দপুর গ্রাম আক্রমণ করিয়া দীন দরিদ্র চাষী প্রজাদিগের যথাসর্ব্বস্ব লুঠপাট এবং অপচয় করে এবং অবশেষে তরফদারকে যৎপরোনাস্তি বে-ইজ্জত করিয়া ধরিয়া লইয়া যায়।” এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর. এস. টটেনহাম (পরে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি)। তাঁর সাহায্যে নানান চেষ্টা করেও গোপাল তরফদারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গিরিশচন্দ্র গোপাল তরফদারের পরিণতি সম্পর্কে লিখেছেন— “অবশেষে শুনিলাম, যে ধরিবার সময় গোপাল তরফদারকে আঘাত করিয়া ধরা হইয়াছিল এবং সেই অবস্থায় তাহাকে নানা স্থানে চালান করাতে, সেই ক্লেশে তাহার মৃত্যু হয় এবং তাহার মৃতদেহ তাহার বন্ধুবান্ধবের হস্তে পড়িতে না পারে, সেই জন্য তাহা নীলের গিঠির দ্বারা জ্বালাইয়া ভস্মসাৎ করিয়া ফেলা হয়।”

খুব সংগতভাবেই শিশিরকুমার তাঁর রচনায় চৌগাছা নীল বিদ্রোহের ব্যাপক প্রভাব এবং সেক্ষেত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক না কেন এই বিদ্রোহের ব্যাপকতায় গোপাল তরফদারের শহিদ হবার ঘটনা ইতাহাসের উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। গোপাল তরফদারের গুম-মৃত্যুর ঘটনায় যে চাষিসমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তার প্রতক্ষ্যদর্শী গিরিশচন্দ্র বসু লিখেছেন— “কিন্তু গোপাল তরফদারের মৃত্যুই নীলকরের কাল হইল‌… গোপাল মরিয়া যেন কৃষ্ণনগর এবং যশোহর জেলার সমুদয় প্রজাকে খেপাইয়া তুলিল। নীলকরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব দাবানলের ন্যায় হুহু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ‘মোরা আর নীল করবো না’ বলিয়া প্রজারা যে সুর ধরিল, তাহা আর কেহ নিরস্ত করিতে পারিল না।” অবস্থা এমন হয়েছিল যে, যে-সাহেবদের ইঙ্গিতে শত শত লাঠিওয়ালা-সড়কিওয়ালা‌ দাঁড়িয়ে পড়ত, তারাই ভয়ে “স্বীয় স্বীয় প্রাণরক্ষার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টকে কৃষ্ণনগর ও যশোহর জেলার স্থানে স্থানে অশ্বারোহী সেনা আনিয়া স্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছিল।”

ফলাফল এ-কথা বোধহয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই নীলবিদ্রোহের মগজ যদি হয় চৌগাছা, প্রতিরোধের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর।

Categories
2021-June-Interview সাক্ষাৎকার

নিত্যব্রত দাস

“যিনি বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে লিখতে চান, তাঁর জানা উচিত শব্দ ছাড়া বাস্তব ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের কোনো বোধ নেই। …কবিতা, যার হাত নেই, তার হাত ফিরিয়ে দেয়।”

আলাপচারিতায় কমলকুমার দত্ত ও সন্তু দাস

নিত‍্যব্রত দাস— এই নামটির সঙ্গে বাংলা কবিতাজগতের খুব স্বল্প কিছু পাঠকের পরিচয় আছে। অল্প লেখেন, যতটুকু লেখেন তারও বেশিরভাগটা নিজেই বাতিল করেন। ‘দাহপত্র’ ছাড়া আর কোনো পত্রিকায় (দু-একটি ব‍্যতিক্রম ছাড়া) তাঁর লেখা দেখা যায় না। কবিতা ছাড়াও গদ‍্য লিখেছেন, যে-গদ‍্যের সঙ্গে বাংলা আবহমান গদ‍্যের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষটিও লুকিয়ে থাকতেই স্বস্তি বোধ করেন। তাঁকে কোনো মঞ্চে কবিতা পড়তে দেখা যায় না, জোর দিয়েই বলা যায় ভবিষ‍্যতেও দেখা যাবে না। এমনই একজন কবির সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে রইল, সৌজন‍্যে ‘দাহপত্র’।

কবি বলে নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই ছোটোবেলার বিশেষ ভূমিকা থাকে। আপনার ছোটোবেলার কথা বলুন, কেমন ছিল আপনার বালকবয়স, শৈশবকাল? তার ছায়া কীভাবে পড়ছে এখন? কীভাবে বয়ে বেড়াচ্ছেন?

এই জিজ্ঞাসা একটা অস্পষ্ট বিষয় নিয়ে। আমার তেমন পরিচ্ছন্ন অতীত নেই। পরিচ্ছন্ন অতীত কী, সেটা বর্তমানে এসে বুঝেছি। যদি আমার এমন অতীত থাকত, কোনো ভাইবোন নেই, স্কুলের সহপাঠী কাকা কাকিমা কেউ নেই, নদীর উত্তরের বাঁকে উঁচু পাড়ের ওপরে বসে সারাদিন মাছ ধরতাম, আমাকে কেউ দেখত না। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে আসতাম। বাড়িতে শুধু ঠাকুমা।

যত বয়স বাড়ত তত উজানে যেতাম, নতুন বাঁকে, টিলার মতো উঁচু পাড়ে, পৃথিবী থেকে দূরে। যদি আমি কথা বলতে না পারতাম, মূক হতাম। মূক হয়ে কথা বলতে পারতাম না, তা নয়। কথা বলতে পেরে মূক হয়ে থাকতাম। একপাল ভেড়া পাহাড়ের গায়ে চরিয়ে বেড়াতাম, যেখানে রাত নামত সেখানে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুমের মধ্যে ভেড়ার লোমের গন্ধ আসত। যদি আমি ক্লীব হতাম, নারী বিষয়ে উদাসীন। যদি ক্লীব না হয়েও ক্লীবের মতো নারী বিষয়ে উদাসীন থাকতাম। দিনের আলোর চেয়ে স্বল্প আলোয় একমনে বই পড়াও ছিপ দিয়ে মাছ ধরা।

তেমন অতীত আমার নেই। কোলাহল, বড়ো হতে গিয়ে একের পর এক যুদ্ধ, পরাজয়। পরিচ্ছন্ন অতীত বলতে আজকের মতো জীবন, নির্বিকার, নিশ্চেতন, প্রয়োজনশূন্য। এমন যদি ছোটোবেলা থেকে হতাম। ‘বলাই’ পড়ে একা একা কাঁদতাম। যদি সেই কান্নাকেও ভালোবাসতাম। জেদ করে থাকতাম, বুড়িয়ে যাওয়া গোরুদুটো আমার একার, তাদের ছেড়ে যাব না। যদি কৃষ্ণনগরে না আসতাম গঙ্গা পার হয়ে। বা, কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাবার কেউ না থাকত, আমার খেয়াল রাখার কেউ না থাকত। গোরুদুটোকে গাছের পাতা খাওয়াতাম।

সে-সব কিছু হয়নি। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল নিয়ম। আমার ইচ্ছে নিয়ম হয়ে ওঠেনি। বেড়ে ওঠা, বড়ো হওয়া, ঠিক হওয়া, বেঠিক না হওয়া, ভালো হওয়া। ভালো আমি হইনি, পরিচ্ছন্ন অতীতের স্বপ্ন আমাকে টেনেছে, আমার বর্তমানকে দু-ভাগ করেছে। নষ্ট করেছে। বিষময় করে তুলেছে ভালো হওয়া। এরপর আমি কলোনির টিনের চালায় গরিবদের সঙ্গে জীবন কাটাবার স্বপ্ন দেখি। ইউনিভার্সিটির জীবনে এসে নিজেকে দেখাশুনো না করার স্বাধীনতা অর্জন করি আর নষ্ট হতে থাকি। তিনতলা বাড়ি বানাই, একতলা দোতলা নেই। শূন্যে ঝুলে নেই তিনতলার ঘর।

যেখানে চরিত্রহীন নারী, কুৎসিত নারী, ভালো-মন্দের বিচারশূন্য মানুষ। দু-বেলা খেতে না পাওয়া অপগণ্ডদের দেশ। আমি নষ্ট হইনি নষ্ট হতে গিয়ে। নষ্ট হয়েছি ভালো হতে গিয়ে। প্রথম থেকে নিজের খারাপ হতে চাওয়া, নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকা যদি সমর্থন করতাম, যদি আমাকে দেখার কেউ না থাকত, অনাথ হতাম, বাধা দেবার কেউ না থাকত, আমি গোড়া থেকেই ভালো কী তার প্রশ্ন তুলতাম। নিজের ভালো নিজে নির্বাচন করে নিতাম।

যা ভালো তার সবই ছিল গঙ্গার এপারে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্র। ওই ভালো আমি হতে চাইনি। ধীরে ধীরে আমার অক্ষমতা যখন প্রকট হয়ে ওঠে, তখন ওই ভালোরাও আমাকে আর চায় না, প্রত্যাখ্যান করে। আমার অসুখের ওপর আগ্রহ ছিল ছোটোবেলা থেকে। অসুখ ডেকে আনতে হত না। এমনিই ঘন ঘন আসত। এলে কাঁথা আসত, বারান্দার চৌকিতে শুয়ে থাকা আসত। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি, দিন আপনি গড়িয়ে যাচ্ছে, সূর্য উঠে নেমে যাচ্ছে। রাত হয়ে এলে ঘরে ফেরা সুতির মশারির ভেতরে। জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম উজানের জলে। রথের মেলায় হারিয়ে নিরুদ্দেশ হবার সখ ছিল। জীবনে কতবার যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। নিয়ম আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আর ভয়। এই নিয়ম আমার সর্বনাশ করেছে। ব্যাখ্যা প্রমাণ কারণ অস্বীকার করতে চেয়ে সেগুলোর আয়ত্তে চলে এসেছি। কা-কা বুলি আমার প্রথম।

যে-অতীতটা সত্যি, সেই অতীত ঘষে ঘষে মুছেও গেছে। চেষ্টা করলেও সেগুলোয় আমার অধিকারের ছাপ দেখতে পাই না। কোনো কাহিনি মন দিয়ে পড়ে উঠতে পারি না। জানা মনে হয়, স্বাদ নেই মনে হয়। কী ঘটবে সে-বিষয়ে নির্বিকার। আগে এমন ছিল না। এ এক অস্থায়ী অসুখ যা ক্রমশ স্থায়ী হয়ে এসেছে। আগে তবু পারতাম। তখন ছোটো ছিলাম হাতে অনেক কাজ ছিল। এ, ও ডাকত। মরার মতো ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত শুনতে পেতাম কেউ-না-কেউ ডাকছে। ভেজা জিনিসগুলো শুকিয়ে তোলার কাজ, শুকনো জিনিসগুলো ভিজিয়ে দেওয়া। যেগুলোর রং নেই সেগুলোতে রং বুলোনো, যেগুলোর আছে সেগুলোর ঘষে ঘষে রং তুলে দেওয়া। এই কাজগুলো একসময় অর্থহীন হয় পড়ে। একঢালা বালি দেখলে গর্ত খুঁড়ে তার স্থিতি নষ্ট করা, কিছুক্ষণ পরে গর্তের স্থিতি নষ্ট করে দিতে আবার বুঁজিয়ে দেওয়া— ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে পড়ে। তখন ব্যস্ত ছিলাম বিপুল সেই কাজগুলোয়। কাছের জিনিস দূরে রেখে আসা, দূরের জিনিস কাছে এনে জড়ো করা একটা কাজ ছিল। দূরের জিনিসগুলো কাছে আনা শেষ হবার আগেই সময় পেরিয়ে যায়। মহীউদ্দিন জানত দূরের জিনিস কাছে না আসার সমস্যা। মহীউদ্দিন পাহাড়ে পৌঁছুতে পারে না— ‘এখনও পৌঁছাই নাই কর্তা, আরও দূরে গেল পেত্নিটা’। আমাদের বাড়িগুলোও ছিল দূর দূর শিমুলগাছের নীচে। শিরীষগাছ পেরিয়ে অনেক দূর গেলে নজরে আসত মাটির কোঠাবাড়ি। বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যা কিছু দেখতাম সব দূরে। অনেক দূর থেকে ধীরে ধীরে রিকশা আসত।

যেখানে থাকতাম সেখানে আমাদের অনেক নাম হয়েছিল। সে-সুনাম রক্ষা করতে পারিনি। আধভাঙা জিনিসগুলো তেমনিই রয়ে গেল। অর্ধেক ঘষে রং তোলা জিনিসগুলো, অর্ধেক ভেজানো, অর্ধেক শুকিয়ে তোলা। আমাদের পরে আর কেউ হাত লাগায়নি। জিনিসগুলো এত ব্যক্তিগত ছিল আমাদের। আসার সময় দরজা আবজে রেখে এসেছি, শেকল দিইনি এই আশায় কেউ-না-কেউ আসবে, আমি আসব। এসে কাজগুলো হাতে নেব।

ছোটোবেলায় তেমন বই ছিল না। পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার অনুমতিও ছিল না। আজ নিজের জীবনের কাহিনি মনে করে বলতে সেই সমস্যা হচ্ছে যা গল্প উপন্যাসের কাহিনি পড়তে গিয়ে হয়ে এসেছে। অন্যের লেখা কাহিনি পাঠের মতো পীড়া দিচ্ছে। মনে করতেও চাইছি না। এত ক্লান্ত লাগে যে পারলে নিজের কোনো শৈশব ছিল, কৈশোর ছিল, সে-কথা স্বীকার না করি। সেগুলো আমার নয়, অন্যের, প্রতিপক্ষের। মানুষের অতীত এমনিই তার কঠিন প্রতিপক্ষ।

কাহিনিমূলক গদ্য পড়তে অসুবিধে হবার একটা কারণ হয়তো কাহিনিতে ব্যবহৃত বাক্য, শব্দরা, আর তাদের গঠনশৈলী, বহুব্যবহৃত। পড়ে আর নতুন করে কিছু অনুধাবন হয় না। কাহিনি দিয়ে যে-সত্য উদ্ঘাটন হবার কথা তা দিয়ে আর কিছু উদ্ঘাটিত হয় না। বারোমেসে, প্রত্যাশিত সে-সব কাহিনি। অনেকদিন হল সেই ভাষা, বক্তব্য বেহাল হয়ে আছে, সারাই হয়নি, পরিবর্তন হয়নি। দিনের পর দিন দেখা ছবি দেখতে দেখতে রং উঠে যায়। তাই-বা বলি কী করে। সুপারভাইজারের ল্যান্ড সার্ভেয়ারের সঙ্গে পাতার পর পাতা সংলাপ পড়তে আমার ক্লান্তি আসেনি, ক্যাসেল-এ।

আরও মনে হয় কাহিনি কিছু নিদান দিতে চায়, উপদেশ দেয়, নির্দেশ করে। সেগুলোর আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যা হয় হোক। সত্যের জগৎ ওদের থাক, কর্তব্যের জগৎ, আদর্শের জগৎ। আমি যেমন আছি, আদর্শশূন্য দিকশূন্য গন্তব্যশূন্য, তেমনই থাকি। রাজনৈতিক সিস্টেমগুলো যেমন অসার, তেমনই অসার অনুবর্তী এই সমাজটা। ভালো অনেকদিন পেরিয়ে এসেছি। ভালোর সমাজে ভিড় অনেক, অনেক প্রশংসা। রবার্ট ফ্রস্ট-এর একটা লেখা আমি ঘুরিয়ে জয়ন্তকে লিখেছিলাম, ‘অন্যের কথায় যাদের খুব অসন্তোষ, তারা অনর্গল কথা বলে অন্যের সেই কথা চাপা দিয়ে রাখে।’ জানি না যে-কাহিনিমূলক গদ্যের কথা বলছি, সেগুলো এই দোষে দোষী কি না। নিজের কোনো কাজের প্রতি স্পৃহা দেখলে আজ নিজের জন্য কষ্ট হয়, লজ্জা হয়। চাই না আমার এখনও কোনো স্পৃহা অবশিষ্ট থাকে, কোনো আকাঙ্ক্ষা। অপেক্ষা করাটা আমার কাজ। অপেক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আমার জন্য নির্দিষ্ট লাইন। সারাজীবন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে আমার এ-জীবনের কাজ সম্পন্ন হবে।

মিলান কুন্দেরার একটা উপন্যাসের প্রথম দিকে একটা মেয়ে স্টেশনে সুটকেস ফেলে রেখে চলে যায় যার মধ্যে তার নতুন জীবন শুরু করার মতো সম্ভার ছিল। আমি উপন্যাসটা বার কতক পাতা উলটে পড়ার চেষ্টা করে না পেরে শেষে সুটকেসটা নিয়ে সরে আসি। আজও আমার সঙ্গে আছে। আর সেই জনশূন্য স্টেশনে সারা শীতের রাতে একা একটা কালো সুটকেস পড়ে থাকা। যে-সুটকেসে হয়তো একটা মেয়ের পোশাক-আশাক লিপস্টিক, আয়না, পার্স, ফোন নাম্বার লেখা ডায়েরি, একটা টিফিন কৌটো। আমি চার লাইনের বেশি দীর্ঘ কবিতাও পড়ে উঠতে পারি না। কোনো লাইনে যা লেখা অন্য লাইনগুলো তার বিরুদ্ধে যেতে চায়। দীর্ঘ কবিতার বিরুদ্ধে এই মামলা বহুদিন জারি হয়ে আছে। মীমাংসা হলেও এক পক্ষ মানতে নারাজ। লিখেই চলেছেন পাতার পর পাতা।

অনেকগুলো গ্রাম, শহরে ছোটোবেলা কেটেছে। তীর্থস্থানগুলো বালুরঘাট, করণদিঘি, কানকি, ইসলামপুর, রামগঞ্জ, কৃষ্ণনগর। বাবা বদলি হতেন, আমাদের জায়গা বদল হত। জন্মেছিলাম যদিও কোচবিহারের কোনো গ্রামে। এখনও সামান্য মনে পড়ে। পাহাড়ি ঝোরার ধারে পাশাপাশি দুটো কাঠের ঘর। একটা ঘরে সিলিং থেকে ঝোলানো ভুট্টা। সামনে একটা ভুট্টার খেত। উঁচুমতো একটা জমিতে। ওপারে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা। তার ওপারে জঙ্গল। জঙ্গল ভেঙে যেতে হত। মাকে জোঁকের ভয়ে গামবুট পরতে দেখেছি। হাতে লাঠির মাথায় নুনের পুঁটলি। বাহাদুর বলে আমাদের একজন আর্দালি ছিল। মাউথ-অর্গ্যান বাজাত। জন্মস্থানে জীবনের প্রথম দু-আড়াই বছর কেটেছে সম্ভবত। তারপরে বালুরঘাটে আসি ঠাকুমার আয়ত্তে।

তখন থেকে ঘোরাঘুরি শুরু, সঙ্গে অসুখ— জ্বর, মাম্পস, ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি। হাইওয়ে দেখলে বালুরঘাটে যায় ভাবার আনন্দ। বেশিরভাগটা বালুরঘাটে কেটেছে। একটা নদী, নদীর ধার ছিল। ঘাটে ঘাটে নতুন নাম। আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বালুরঘাটে। গোখরো সাপকে গোমা সাপ, ডাহুককে ডাক পাখি বলার দেশ। বৃষ্টিকে সেখানে বৃষ্টি বলত। বছরের বেশিরভাগ বর্ষাকাল। জ্বরে মাটির বারান্দার চৌকিতে শুয়ে আছি, ঠাকুমা শিউলিপাতার রস করছে। হাঁ করে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার পথ্য বার্লি। পৃথিবী বলতেও ছিল ছোটো ওই নদীটা। বালুরঘাট খুব দরিদ্র, অপ্রতুল আধাশহর। মানুষজন রোগা, কালো। বাড়িগুলো টিনের। উঠোনের শিউলি গাছে কম ফুল, ঝাড়ের বাঁশ খুব রোগা বলে খুঁটির কাজে অনুপযুক্ত। এতদিন পরে কেটে ফেলা শিউলি গাছে আজ বেশি ফুল ফোটে।

পাড়ার মুদির দোকান ছিল কালো ছোপধরা, গুড় তামাকের গন্ধ মেশা বাতাসে। বুড়ো দোকানি চৌকিতে বসে হুঁকো খেত। শহরটা ছিল বৃষ্টির আয়ত্তে। শুরু হলে নাগাড়ে এক সপ্তাহ কম করে বৃষ্টি হত। নদী পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে প্রতি বছরই বন্যা বাধাত। বেশ কয়েকবার বন্যায় ঘর ভেঙেছে। উঠোনের মধ্যে দিয়ে জল বয়ে যেত খরস্রোতে। কোনো এমন সময়ের কথা মনে পড়ে না যখন শহরটা রোদে ঝকঝক করছে। অতীতের সূর্য স্মৃতিতে ভিজে দেয়ালে টাঙানো রং ওঠা সূর্যের ছবি।

শহরটার অনেক গোপন জায়গা ছিল। কেয়াফুল ফুটত। খবর পেতাম কেয়া ফুটেছে। সারা বছর জঙ্গল হয়ে থেকে যখন ফুল ফুটত তখন আমি অনেক দূরে। দেখা হত না। আজও কেয়াফুল আগের মতো টুকি খেলে, আগের মতো হারিয়ে থাকে। রাত হলে নদীটায় তিন চারজন শিশু, কিশোর হাতে বাতি নিয়ে পাড় দিয়ে হাঁটে। ঠান্ডা জলের ওপরে ঘোরে কাঁপা কাঁপা আলোর শিখা। ভাই বোন মিলে আমরা তিন চারজন নদীতে সতরঞ্চি পেতে দখল নেবার চেষ্টা করেছি। চলে আসার পর দখল নেবার সতরঞ্চি ভেসে যায়, বৈঠক ভেস্তে যায়। শুনেছি ডাহুকের মুখে, সে এ-ঘাট ও-ঘাটে রাত হলে খোঁজে মানুষ-ডাকপাখিদের। আমরা ক-জন ভাই-বোন জলেই মানুষ। জলে কেউ মানুষ হয় না, মাছ হয়, ডাহুক হয়, বিসর্জনের প্রদীপের শিখা হয় কাঁপা কাঁপা জলের ওপরে।

এক-একটা কারণ থাকে পিছিয়ে যাবার। একটা কারণ পেছনের আকর্ষণ। আর একটা সামনের দিকের আকর্ষণহীনতা, সামনের সারিতে যাবার উপায়হীনতা। আমার ভালোর দিকে সামনের দিকে যাবার উপায় ছিল না। আমি লাইন দিতে পারতাম না। লাইনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে বেরিয়ে আসতাম। লাইন দিয়ে দাঁড়ানো মানুষ দেখলে মনে হত লাইনের প্রথম দিকটা হেঁটে হেঁটে পেছন দিকে চলে যাচ্ছে। এনসিসি-র লাইনের বাইরে দাঁড়ানো ছড়ি হাতে কর্নেল জরিপ করে হেঁটে যাচ্ছেন সামনে থেকে পেছনে। অতিষ্ঠ হয়ে লাইনের বাইরে চলে যেতাম।

দুর্গাপুজো যে ফুরিয়ে আসছে সেদিন আন্দাজ করিনি। করি কিছুটা বড়ো হবার পর। বড়ো হওয়া মানে ছাড়াছাড়ি হওয়া— নদীর সঙ্গে, অসুখের সঙ্গে। যতদিন জলে ভেজা থাকে ততদিন আসক্তি থাকে, ঘেন্না থাকে, লোভ থাকে, ভয় থাকে। জল শুকিয়ে গেলে শুকনো ফুল চৈত্রের বাতাসে ভেসে মাটিতে মিশে যায়। বড়ো হলে ছায়া বড়ো হয়। দীর্ঘ হয়। বাবা-মা বেশিরভাগ সময় কাছে থাকেননি। কাকা-কাকিমা, ঠাকুমা, বুড়িয়ে আসা দুটো গোরু ছিল। সন্ধ্যের আগেই ঘনিয়ে আসত অন্ধকার। মাদুর ছিল, লণ্ঠন ছিল। চারিদিকের অন্ধকারে এত ভয় মিশে থাকত যে চুম্বকের মতো কাছে টানত লণ্ঠনের শিখা। ক্রমাগত উস্কে জাগিয়ে রাখতাম। বিশ্বটা ছোটো ছিল যা বাড়তে বাড়তে অপরিষ্কার হয়ে এসেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে। পরিসীমা দেখা যায় না। একটা বিস্তৃত খাল, বিস্তৃত অন্ধকার। পরিসীমাহীন এই শূন্যে সেই থেকে জলের ফোঁটার মতো সামান্য কিছু, শুকনো একটা কাঠি খুঁজে বেড়িয়েছি আঁকড়ে ধরতে। বিমলা তেমনই একটা জলের ফোঁটা।

এই বালুরঘাটেই তৈরি হচ্ছিল বিমলা। কাচ ছেটানো পুকুরে স্নান করতে আসত। কখন রঙিন কাগজের রিকশায় গাছের আড়াল দিয়ে চলে যেত। বালুরঘাটেই তৈরি হয়েছিল আমারই কবিতার সেই খড়ের চালা। যার বারান্দায় সন্ধ্যের পর পেঁয়াজ কাটতে কাটতে গৃহিনী বঁটি কাত করে বাড়ির পেছন দিয়ে কার ডাক পেয়ে চলে যায়। কুপি চিতার মতো জ্বলে। বা, এ-বাড়িতে সন্ধ্যের সময় চুল বাঁধায় শুকিয়ে যায় ও-বাড়ির রজনিগন্ধা। এইসব নিষিদ্ধতার জন্ম যদিও পরে, কিন্তু এর পটভূমি রচিত হয়েছিল বালুরঘাটের নদীপাড়কে ঘিরেই। এখানেই কোথাও ছিল সেই বৈষ্ণবী। সাদা পোশাক, ভরতি রমণী। আর তার আশ্রম হেমন্তের ধানখেতের মাঝখানে। সেই কবিতাগুলো ছাপাইনি। গড়নের ত্রুটি ছিল।

সন্ধ্যের পর থেকেই পৃথিবী চলে যেত দুরাত্মাদের আয়ত্তে। তাই ঘুম ছিল গাঢ়। টের পেতে দিত না। ‘সুনীতি বুক ডিপো’-র পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাবার আগে নদী পেরুতে হত। শীতকালে বাঁশের সাঁকো, অন্য সময় নৌকোয় পারাপার। ফরাশে এসে দাঁড়াত গুরুচরণের নৌকো। কয়েকবার নৌকোয় উঠতে গিয়ে জলে পড়ে যাই। ভেজা জামাকাপড় পরেই স্কুলে যাই। আজ যেমন আছি তেমনই ছিল আমার শৈশব, কৈশোর, ইউনিভার্সিটির দিনগুলো। পরাজিত, ক্লান্ত। মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া মানে এনকাউন্টার, বোঝাপড়া, অবশ্যম্ভাবী পরাজয় একচেটে।

ভাবি যদি জন্ম থেকেই এমন বয়স্ক হতাম। কম শুনতে পাচ্ছি, কম দেখছি, চলাচল করছি না, বসে আছি বিকেলের বারান্দায়। কেউ গ্রাহ্য করত না, পড়ে থাকতাম আসবাবের মতো। মন নেই, হৃদয় নেই। লাঠি হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো মানে চারপাশে জমে উঠতে থাকা এনকাউন্টারগুলো এড়িয়ে সরে যাওয়া। সেই ইউনিভার্সিটির বয়স থেকে আজ অব্দি কোনো পুজো দেখিনি। কলকাতার পুজো কী জানি না। পুজোর দিনগুলোতে মনে হয় ভারত বন্‌ধ, কেউ নেই। একা আছি। হস্টেল ছুটি পড়ায় চার দিন একা তিনতলার জানালায় বসে কাটিয়েছি। সকলের মধ্যে দেখলে আমাকে মনে হয় আমি একা। একা থাকলে মনে হয় সঙ্গে আরও অনেকে, তাদের সঙ্গে দেয়া-নেয়া করছি, আমাকে সজীব দেখাচ্ছে।

কবিতা কখন আক্রমণ করল? আক্রান্ত হবার প্রথম অভিঘাত মনে পড়ে?

কবিতার অসুখের গোড়ায় থাকে শব্দকে, বাক্যকে, পঙ্‌ক্তিকে চিনে ফেলা। চেনা শব্দ, বাক্য দিন দিন অহেতুক, অর্থহীন হয়ে ওঠা। যা বলছি, শুনছি সেগুলো অর্থহীন, সার নেই। তারা আর কিছু বলে না, শোনায় না। নিত্যনতুন শব্দগঠন দিয়ে একই ভাবনাকে নতুন করে, সুখময়, দুঃখময় করে জোগান দেওয়াই কবিতা। তার কোনো জাগতিক মূল্য আছে কি নেই নির্বিচারে। তাই পুরোনো কবিতা কবিতা নয়। আমি পড়িনি কেউ লিখে রেখেছেন, যেদিন পড়ব আমাকে সে শিক্ষিত করে মরে যাবে, তার গঠনশৈলী, শব্দগুলো।

যুগ যুগ ধরে কবিতা লেখা হয়ে থাকলেও এ-কথা ঠিক যে, কবিতা কী সে-কথা কেউই ভালো করে বলতে পারবেন না। একসময় বেশ সুবিধে ছিল যখন পর্ব মেনে লেখা, বা, অন্ত্যমিলের লেখাকে কবিতা বলে ধরা হত। তার অসারতা ফাঁস হবার পর থেকে কবিতার সংজ্ঞা জটিল হয়েছে। হয়েছে গদ্য পদ্য বিভাজনের সমস্যা। কবিতা ধরেছিল যেদিন থেকে আমি সরে যেতে থাকি। ইউনিভার্সিটি থেকে, হস্টেল থেকে। যেদিন থেকে ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে ন্যায্যমূল্যের পৃথিবী। এমন হতে পারে যে, আগে কবিতা এসেছিল, কবিতাই আমাকে সরিয়ে এনেছে। মনে আছে, ড্রয়িং পেপারের উলটোদিকেও পেনসিলে কবিতা লিখেছি। এখন বলতে পারি না কী লিখতাম, কেমন লিখতাম। তবে হাতেখড়ি তখনই। হাঁটা দূরত্বে বালিগঞ্জ লেক। সেখানে গিয়ে বসে থেকেছি লেখার খোঁজে। এই সময়টায় প্রাণপণ খুঁজেছি ইতরদের সমাজ, ইতর হতে চেয়ে। একটা টালির বাড়ির খোঁজ। টালির ঘর, সামনে একফালি ঘাস বিছোনো জমি, একটা টিউবওয়েল, ভাঙা চাতাল। জনমিনিষ্যি নেই। বেড়া দিয়ে ঘেরা, জংলি গাছ দিয়ে। ঘরের চৌকিতে উপুড় হয়ে লেখার অধিকার। আজ শুনি সে নাকি নতুন নয়, আমার একার নয়, সকলেরই একই খোঁজ। এর জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত যাই। লেখার একটা টেবিলের সন্ধানে।

আমিই শুধু স্বপ্ন দেখে আসছি, আমাকে কেউ যেন দেখতে না পায়। আমার যা দেখার সেগুলো দেখা শেষ, আর দেখার জন্য আমাকে পৃথিবীতে আসতে হবে না।

কবিতা এসেই নেশার মতো চেপে ধরে চারিদিকের জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলতে শুরু করে, মানুষের মুখ অস্পষ্ট করে দেয়। নিত্যনতুন সব জিনিসকে, আপাততুচ্ছ জিনিসকে মূল্যবান করে তোলে। নিজের জীবনের ব্যথা-বেদনা অবশ করে দেয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি। তারপর থেকে পার্থিব যত কাজ করেছি, করেছি অনুপস্থিত থেকে। খুব কম কেউ, বা কেউই নয়, টের পেত আমার অনুপস্থিতি। নিজের বোনা জালে দিনে দিনে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। আবদ্ধ অংশের মধ্যেই ছিল এক বস্তুর সমান শূন্যতা। বনের ভেতর দিয়ে জ্যোৎস্নায় রাস্তা যা গাছের ডাল থেকে বাঁচতে মাথা নীচু করে এদিক-ওদিক কাটিয়ে বন পার হয়ে নদীতে বিছিয়ে যায়, সেই রাস্তা আসলে শূন্য যা বস্তুর সমান। সেই শূন্যের অধিকারী হওয়ার সাধনায় দিন কাটিয়েছি। বোর্হেসের একটা কবিতার শেষ লাইনও এরকম— ‘আমার যা নেই তা দিয়ে গেলাম যে নেই তার হাতে’। সেটা তাঁর মৃত্যু প্রসঙ্গে। আমার জীবিত অবস্থার স্বপ্নের চেয়ে আলাদা।

কবিতার পাশাপাশি আপনি গদ্যও লিখেছেন, লিখছেন। কবিতায় বলা যাচ্ছে না এমন কোনো কারণ রয়েছে গদ্য লেখার পেছনে? এই প্রশ্নের কারণ আপনার গদ্য পাঠকের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

আমার কবিতাও পাঠকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, ভালো মন্দ যাইহোক, হওয়া উচিত ছিল। আমার গদ্য হয়েছে, বলছেন, সেটাও হওয়া স্বাভাবিক। গদ্য যেমন লিখি তেমনটা আমি চাই না লিখি। তাছাড়া গদ্যগুলো একটার থেকে আর একটা এত আলাদা, বোঝা যায় না তার রকমটা কী। গদ্য কেমন হবে তার একটা ভাসা ভাসা ধারণা এখন তৈরি হয়েছে। যদিও সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারি না, যে-ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটা ঠিক কি না। তবে কবিতায় যা লেখা যায় না তাই যে-গদ্যে লিখি সেটা বলার পূর্বশর্ত এই যে, আমি কবিতাই লিখতে চাই তা নয়। গদ্যে যা লিখি, সে-গদ্যেরই বিষয়। কিছু কিছু অংশ কবিতার গায়ে ঘেঁষে যে আসে সেটা গদ্যের দুর্বলতা মনে হয়। আবার এও মনে হয় তেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের মধ্যেই হয়তো নিহিত আছে গদ্য আর কবিতার তফাত কী। জাপানি লেখক ওগাওয়া ইয়কো-র লেখায় দেখেছি মাঝেমাঝেই কবিতা ছুঁয়ে যেতে। সেটা গদ্যে উনি ব্যবহারও করেছেন ঠিকভাবে। গদ্যের ক্ষতি হয়নি।

কই আর তেমন লিখেছি। গুটিকতক। লিখছিই-বা কোথায়। একে লেখা বলে না। সামান্য লিখেছিলাম। এখন তাও বন্ধ হয়ে আছে অনেকদিন। লেখক হয়ে ওঠার জন্য যে-নির্জনতা দরকার সেটা অর্জন করে উঠতে পারিনি। এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কোনো উপায় নেই চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া। লেখা ছাড়া আমার করার কিছু নেই। লিখতে আমাকে হবেই। না লিখলে রেলের কেবিন-এর মতো গায়ে সেঁটে যাবে abandoned। অনেকদিন হল এই অবস্থা। সামনে কোনো মুক্তির উপায় নেই। জীবনের বেশিরভাগ গেল দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। জিতলাম না।

যা লিখেছি, যেটুকু, সেটুকু বড়োজোর চর্চা। সব লেখাই আসলে চর্চা। লেখা আসলে ধারাবাহিক অনুশীলন। লেখ, কাট, ফেলে দাও। কোনো লেখা একদিন দু-দিনের বেশি শান্তি দেয় না। আমি নিজের গদ্য নিজে সমর্থন করি না। যেমন করি না গল্প উপন্যাস বলে এতদিন যেসব ছাপা হয়ে আসছে সেগুলো। পাঠকের কাছে যেগুলো পৌঁছোচ্ছে। যে গদ্য আমি লিখেছি তার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পরে আজ দেখছি সেগুলো ঠিকভাবে হয়নি। ঠিক উপায় সেটা নয়। ঠিক কী উপায়, তার একটা আবছা ধারণা তৈরি হয়েছে। তেমন করে লিখে উঠতে পারিনি এখনও। তবে এটা ঠিকই যে, যা লিখেছি, যেভাবে লিখেছি, সেটা ঠিক ছিল না। যেমন যেভাবে লেখা হয়ে এসেছে এতদিন, সেটা একেবারেই ঠিক ছিল না। স্বপ্ন দেখি আমি সেই গদ্য লিখে উঠতে পারছি। লিখছি, কাটছি, টাইপ করছি, প্রিন্ট করছি। ফেলে দিচ্ছি। এই স্বপ্নটা বাস্তবে হয়ে ওঠা খুব শক্ত। যেখানে যেতে চাই সেই জায়গাটা আদৌ আছে কি না, থাকলেও স্থায়ীভাবে আছে কি না, এই চোখ দিয়ে দেখতে পাব কি না। জায়গাটা আছে সেই বিশ্বাস নিয়ে খুঁজছি, জায়গাটা আছে সেই বিশ্বাসও খুঁজছি।

“রাস্তায় যেতে যেতে বহুদিন আগের বন্ধু, কলেজ জীবনের, সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়। ওর পার্ট ওয়ানে অনার্স কাটা যাবার পর থেকে ওর সঙ্গে কারও বিশেষ দেখা হয়নি। কলেজই ছেড়ে দেয় একসময়। সকলের কাছেই সুহাস অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাতে ওর নিজেরও ভূমিকা ছিল। ও নিজেও আরও অস্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিল নিজেকে। ততদিনে জিনিসের দাম বেড়েছে, সবজির রং ওঠা। দেশটা গ্রীষ্মপ্রধান হয়ে উঠেছে। সেই সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মুখোমুখি। চিনতে পেরে প্রবল উৎসাহে এগিয়ে আসে সুহাস। আমি গাছের নীচে সরে দাঁড়াই। ও কিছু বলার আগে ‘মা আর নেই’ কথাটা বলতে গিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে মুখে বাধে”। এই কথাগুলো বলা কবিতার এক্তিয়ারে পড়ে না। আমি একথা কবিতায় বলতে না পেরে গদ্যে লিখতাম তা নয়। এটা গদ্যেরই বিষয়। আমি আমার আগের গদ্য পড়তে পারি না। বানানো মনে হয়। পুরোনো কবিতা, অন্ধকারবয়সি, লকডাউন, লকডাউন ২ থেকে তবু পারি এখনও। এই লেখাগুলো এখনও পরিত্যক্ত বলে মনে হয় না।

আমার গদ্য পাঠকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, সেটা হয়তো ঠিকই। কিন্তু এতে বোঝা যায় না, সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন। কেউ কেউ প্রশংসা করেন। সেই প্রশংসা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। প্রায় কেউই যে পড়েন না, এতে আমার সুবিধেই হয়। যতদিন কারো চোখে না পড়ে, ততদিনে লেখাগুলো আরও শুধরে নিতে পারি। এরকম করতে করতেই একসময় লেখা থেমে যাবে। অপ্রস্তুত লেখাগুলো পড়ে থাকবে। তাদের হয়ে বলার, সংশোধনের কেউ আর পেছনে থাকবে না।

কবিতার জন্ম ও মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার ধারণা জানতে চাই।

কবিতার জন্ম সম্বন্ধে ধারণা, কোনো কিছু সম্বন্ধে ধারণাই বড়োজোর সম্ভাবনামূলক। কী করে কবিতা জন্ম নেয় সেটা জানা যায় না। কেউই জানতে পারে না। মনের মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়ে ছিল, কোনো সামনে ঘটা ঘটনাকে আশ্রয় করে শব্দরূপ পেয়ে কবিতায় আসে, সেটা জানা যায় না। কোনো একটা বিশেষ কবিতা হঠাৎ করেও লেখা হয়ে যায়। পরে পড়ে দেখা গেল মনে হচ্ছে সে ভিনদেশি। আমার লেখাই নয়, গভীর ভালো লাগার জন্ম দিয়েছে। অনেক কবিতা আসলে অনেক কিছু নয়, সামান্য কিছু। হাতে গুনতি কয়েকটা জিনিস। একটা কবিতা তাই আগের কবিতা থেকে নতুন শুধু ভঙ্গিতে, নয়তো আরও সংক্ষিপ্ততায়। বাড়ির পেছনের বকুল গাছে সুলতার ওড়না গলায় আত্মহত্যা নতুন কিছু নয়। যদি কবিতায় সার্থকভাবে আসতে হয়, নতুনভাবে গড়ে নিতে হবে। আমরা চিরকাল পেছনে ফেলে আসা জিনিসগুলো খুঁজছি। কবিতা কিছু এনে দিচ্ছে, ছুঁইয়ে দিচ্ছে। সে দিচ্ছে সকলকেই। যারাই ঠিক লিখছেন। অটোয় যেতে যেতে মাথায় এসেছিল, ‘ধ্যান চেয়ে, বস্তু চেয়ে, ছায়া চেয়ে, গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত’। কিছু চোখে পড়েছিল বলেও হয়তো নয়। এক বিচিত্র রসায়নে তৈরি হয়ে ছিল ভেতরে।

কবিতার মৃত্যু কিন্তু সুনিশ্চিত। জন্মের পর থেকেই তার মরে যাবার তোড়জোড়। মরেও যায় সঙ্গে সঙ্গেই। পৃথিবীর প্রতিটা পাওনাই তাই। সন্তানের কাঁধে হাত দিলেও স্পর্শ মরে যায়, হাত সরিয়ে নিতে হয়। হাত বুলোতে হয়। তার অর্থ বিভিন্ন নতুন স্পর্শবিন্দু ছোঁয়া, বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করা। কবিতার মৃত্যু হয় কবিতাটা মাথায় পৌঁছোনোর পর থেকে। সব ক-টা আঙ্গিক একে একে উপলব্ধ হবার পর। তাই নতুন কবিতা।

কবিতার ক্ষেত্রে আপনার পূর্বসূরী কে বা কারা? এবং কেন?

আমার সম্ভবত কোনো পূর্বসূরী নেই। ঠিক বলতে পারি না। তবে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি পাঠ্য বইয়ের বাইরে। খুব কম পড়েছি। পাঠ্য বইটাও মন দিয়ে পড়িনি। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ থেকে গেছেন গানের আড়ালে। ‘শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে’-র আড়ালে। কিছুকাল কাফকার ডায়েরি পড়েছিলাম। খাপছাড়াভাবে। চোদ্দো সালটায় পড়েছিলাম ওঁর তিনটে উপন্যাস। ট্রায়াল, আমেরিকা, আর ক্যাসেল। ট্রায়াল যদিও আগেও পড়েছি বাংলা অনুবাদে। তাহলেও এটা বলা কি ঠিক হবে যে ওঁরা আমার পূর্বসূরী? বা, উনি আমার পূর্বসূরী? আমার ‘প্রসন্ন হাতি’, ‘অশুভ মোমবাতি’ পড়লে এখন বুঝতে পারি সে-অর্থে ওগুলোর কোনো পূর্বসূরী নেই। এত আনকোরা, কাঁচা। পরে যে শুধরে শুধরে আসছি তার পেছনে থাকে আগের লেখা। তারাই পূর্বসূরী হয়ে দাঁড়ায়। সেটা সকলের ক্ষেত্রেই ঘটে। নিজের আগের লেখা তাকে শিক্ষিত করে। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তবে আমার বিষয়টা একটু আলাদা এই জন্য যে, আমাকে বাংলা সাহিত্যের কেউ দীক্ষা দেয়নি। নিইওনি, পাইওনি।

আমি ভূমেনদার হয়ে জীবনানন্দের কবিতার খাতা অনেক ঘেঁটেছি। ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে মাইক্রোফিল্ম থেকে খাতায় লিখে এনেছি। বাড়িতে টাইপ করেছি। সেই সুবাদে ওঁর অনেক লেখার সঙ্গে সম্যক পরিচয় হয়। কারো কবিতা পরপর পড়লে মনে হয় একইরকম, উলটেপালটে লেখা। আসলে তা নয়। ওঁর অনেক আবিষ্কার। নিজে সৃষ্টি করেছেন। যার ছায়ায় আজকের বাংলা কবিতা। হয়তো আমারও। আমি পনেরোটা খাতা থেকে কপি করেছিলাম। পরের দিকে ওঁর লেখা কিছুটা পালটাতে দেখেছি। কবিতা মুখের কথার কবিতা হয়ে উঠছিল। কবিতায় উনি খুবই ব্যক্তিত্ববান। আমি বিশ্বাস করি প্রতিভা বলতে যে-সব গুণের সমষ্টি বোঝায়, তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব, সততা, এই দুটো জিনিসও পড়ে। অঁরি মিশো, ব়্যাঁবো, রেনে শ— এঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ছিল যা কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। জীবনানন্দেরও। জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও আমার পূর্বসুরী সে-কথা টের পাইনি। যুক্তি বলে আমাদের সকলের লেখার গোড়ায় জীবনানন্দ। আমি কবিতায় এসেছি আড়াআড়ি, নিজের মতো, নিজের সময়ে।

আপনার অনেক কবিতাতেই বাক্যগঠন এমন, মনে হয় অনুবাদ কবিতা পড়ছি।

অনুবাদ কবিতার গড়ন হয়তো নির্ভর করে মূল ভাষার গড়নের ওপর। যদি কেউ সেই গড়ন রেখে দেন, বাংলার মতো করে পালটে না নেন। অনুবাদ কবিতা বলতে মূলত ইংরেজি থেকে অনুবাদই বোঝানো হয়ে থাকবে। ওই ভাষা থেকে অনুবাদই বাংলায় বেশি হয়। এই প্রশ্নের সঙ্গে তেমন কিছু কবিতার উল্লেখ করলে ভালো হত। না হলে বোঝা মুশকিল হবে অবাঙালি কী ধরন রয়ে গেছে। ফরাসি কবি রেনে শ-এর কবিতার গড়ন লক্ষ করলে দেখা যায়, তাঁর কবিতার মূলেই আছে তাঁর বাক্যের গঠন। সিধে বাংলামাফিক করে নিলে কবিতাটাই মরে যায়। সেটা কোনো ভাষার বৈশিষ্ট্য নয়। কবির বৈশিষ্ট্য। জানি না তেমন আমার কবিতায় কোথায় আছে। তবে এটা ঠিক বাংলা, ইংরেজি কোনো ভাষাই তেমন আয়ত্তে নেই। কাজ চালানোর মতো জানি। কিছু কবিতা আমার ইংরেজিতে লেখা। পরে অনুবাদ করে বাংলায় ছাপিয়েছি। কিছু কবিতা এখনও পড়েই আছে ইংরেজিতে যা মনোমতো অনুবাদ করে উঠতে পারিনি। মনোমতো অনুবাদ না করে উঠতে পারারই কথা। পারলে আগেই বাংলায় লিখতাম। তবে আমার বিশ্বাস, যেগুলো প্রথমে ইংরেজিতে লেখা, সেগুলোর এই দোষ হয়নি। যদি হয়ে থাকে তবে পাঠককে বলতে হবে সুধী পাঠক। তবে সেটার সম্ভাবনা খুবই কম।

সর্বজ্ঞ বলছিল, নদী পেরোতে গেলে আগে ভাষা পেরোতে হয়, ধ্বনি পেরোতে হয়, পার হতে হয় উচ্চারণ করা ঠোঁট, উচ্চারণ না করা ঠোঁটের নিথরতা, চোখের ভাষা। তাহলে নদী পার হওয়া যায়। সকলের নদী, নিজস্ব নদী। ভাষা না পার হলে, ধ্বনি পার হতে না পারলে, টেলিগ্রাফিক কোডের মতো খটাখট শব্দ কানে আসে। নদী পেরোনো অধরা থেকে যায়।

আপনার কবিতায় অনস্তিত্বের অস্তিত্ব, অনুপস্থিতের উপস্থিতির বিষয়ে এক ধরনের ঝোঁক লক্ষ করা যায়। সে-বিষয়ে কিছু বলুন।

বাড়িয়ে লেখা, যা নেই তা লেখা, সেটা কবিতার প্রয়োজন। মানুষ মুখে যা বলে সেটাই বাস্তব। আমরা মুখে বাক্যগঠন করে যা বলি। বলার পরে গড়ে ওঠে, সত্যি হয়ে ওঠে। বাস্তব ঘটনা তাকে অনুসরণ করে। The flowering hawthorn was my first alphabet, এ-কথা যিনি লিখেছেন, তিনি জানেন সেটা সত্যি নয়। কোনো ফুল কারো বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হতে পারে না। কিন্তু লেখাটার পরে হয়। উনি সত্যি করে নেন। যে পড়েন তার কাছেও ফুটন্ত ফুল তার বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হয়ে ওঠে। যিনি বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে লিখতে চান, তার জানা উচিত শব্দ ছাড়া বাস্তব ঘটনা সম্বন্ধে মানুষের কোনো বোধ নেই। Wittgenstein কোথাও লিখেছিলেন, You learned the concept of pain when you learned language. ভাষায় বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য হয়তো বিপুল সমুদ্রকে একটা বোতামে বন্দি করা যাতে সে বোধগম্য হয়, নাড়াঘাঁটা করা যায়। নিয়ে যাওয়া যায় চামচে করে। কবিতার উদ্দেশ্যও তাই, শব্দের মতো। কবিতা যার হাত নেই, তার হাত ফিরিয়ে দেয়। মিলান কুন্দেরা লিখেছিলেন, our unappeased yearning to return হল নস্টালজিয়া। কবিতা সেইখানে ফিরিয়ে আনে। বাস্তব অবাস্তবের ধার ধারে না। আমি মাকে ভালোবাসি, এটা বলার পরে যা অনুভব তৈরি হয়, তার সঙ্গে বাস্তবের মাকে ভালোবাসার কোনো মিল নেই। অন্য কোনো বাস্তবও নেই। বাক্য যা বলেছে সেটাই ভালোবাসা, ততটুকু। আমাদের দুঃখ বেদনার মূলেও আছে শব্দ ব্যবহারের দৈন্য। যদি আমার ছেলেবেলা এক কি দু-কথায় বর্ণনা করতে পারতাম, অনেক ব্যথার উপশম ঘটাত। পেরে উঠি না, যতক্ষণ পেরে উঠি না, সে কুয়াশা রচনা করে ব্যথা দিতে থাকে। যত কবিতা তত বেদনামুক্তি। কবিতা যত তৈরি হয়, তা মানুষের অদেখা বেদনার কণামাত্রও নয়।

কিন্তু একটা জিনিস অপরিষ্কার থেকে যায় যে, প্রশ্নকর্তার কাছে কি জিনিসটা সত্যিই খুব অভিনব, নতুন? আমিই শুধু করি? ‘হারিয়ে যাওয়া কালো সুটকেসটা পড়ে আছে যেখানে, ইচ্ছে করে হারিয়ে গিয়ে সেখানে চুপ করে বসে থাকি’।— এই লাইন কি কবিতায় নতুন, এটুকু অবাস্তবতা? সে তো প্রায় সকলের লেখাতেই থাকে। কবিতাকে না লেখার জন্য ধরে বেঁধে রাখাও যায় না। সে বাদামি রঙের চিল দেখে লিখবেই, ‘সোনালি ডানার চিল’।

এটা ঠিক যে, অন্য বিষয়ের মতো আমি এক্ষত্রেও ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না স্বপক্ষের যুক্তি। মানুষ ভাবতে চায়, সেই ভাবনার শক্তি নিহিত থাকে নিজেরই মধ্যে। ফলে ভেবে উঠতে পারে না। নিজেকে সে সারাজীবন দেখতেও পায় না (Still, it may be that man wants to think, but cannot. — Heidegger)।

একটি কবিতা লেখা হবার পরে কতটা কাটাছেঁড়া করেন? কবিতাটি পত্রিকায় ছাপা হবার পরে যখন কবিতার বইয়ে যায় তখনও পালটে যেতে থাকে? কবিতার বই প্রকাশ পাবার পর কি নিশ্চিন্ত বোধ করেন?

কবিতা খুবই নশ্বর। আকারে, প্রকারে, আয়তনে, শব্দ ব্যবহারে। শেষ যেখানে ছাপা হয়েছে সেখানে বসেও সন্দেহের চোখে তাকায়। এপাশ ওপাশ দেখে, অন্যখানে সরে বসতে চায়। এর একটা কারণ কবিতায় সত্যিই উপস্থিত কোনো উন্নতির সুযোগ। আর একটা কারণ হয়তো, তার সেভাবে আর উন্নতির সম্ভাবনা নেই, কিন্তু বসে বসে তার বয়স হয়ে মলিন হয়ে যাওয়া। হয় তখন তাকে পরিত্যাগ করো, প্রকাশককে ডেকে বলো এটা আমার লেখা নয়, কিংবা সুযোগ থাকলে লুকিয়ে ফেল যেখানে ছাপা হয়ে আছে সেখান থেকে।

কিছু কবিতা অবশ্য একবার লেখার পর আর পালটায় না। ‘বিশ্ব যেমন নীরব, আমি যদি সরব হতাম সে-নীরবতার অন্তর্ভূত!’ বা ‘নারী আসলে রক্তমাংসের আবরণের নীচে গভীর গন্ধের পেটিকোট’। তেমন কবিতা।

যদিও এটা কোনো প্রোটোকল কি না জানি না, অনেক কবিই কবিতা একবার যেভাবে ছাপা হয় আর পালটান না দেখেছি। পত্রিকা থেকে বই, বই থেকে সংকলন। তাঁদের স্বপক্ষের একটা যুক্তি, যা লিখেছ তার দিকে ফিরে না তাকিয়ে নতুন লেখা লেখ। পুরোনো নিয়ে সময় নষ্ট করো না। এই যুক্তির স্বপক্ষে আমি তদবির করতে পারি না। পরবর্তীকালে মন যাতে খারাপ না হয় তার জন্য কবিতা টাইপ করে এক বছর ফেলে রাখার যুক্তি আমার কাছে বেশি সাবলীল মনে হয়।

ছাপা হবার আগে বিস্তর কাটাছেঁড়া সে তো আছেই। আমার একটা conversion rate বার করলে হয়তো জানা যেত যে, প্রতি একশোটা কবিতা থেকে একটা কবিতা শেষ অব্দি ছাপার ঘরে পৌঁছোয়। এটা অবশ্য একেবারেই অসম্ভব কিছু নয়। একটা বই, ধরুন চার ফর্মার, তৈরি হতে স্বাভাবিক সময় নেওয়া উচিত দু-বছর। সেখানে আমার গত একবছরে বই হয়েই বেরিয়েছে চারটে। এতে নিজের কবিতার প্রতি সুবিচার করা হয় না।

আমরা এতক্ষণ যে-প্রশ্নগুলো করেছি, তার প্রত্যুত্তরে আপনি যা যা বললেন, সেগুলোর যদি মূল্যায়ন করেন।

এতক্ষণ করা প্রশ্নগুলো সম্বন্ধে বললে বলতে হয় কোনো প্রশ্নই যেন করেননি, প্রত্যুত্তরে আমিও যেন কিছু বলিনি। এড়িয়ে গেছি। যে-আমি অতি সাধারণ, আটপৌরে, সেটা সযত্নে এড়িয়ে গেলাম। যা লিখলাম উত্তরের অছিলায় সেগুলো আমার নয় অন্য কারো, অন্য কেউ তার অধিকারী। আমি সে-সব নিজের বলে স্বপ্ন দেখেছি। এটা হতেই হত। এরকমই হয়। আমাদের ইতিহাসের ওপরে সামান্য অধিকারও আমাদের নেই। যে-ইতিহাস বিবৃত, তা শুধু স্বপ্ন। এই জীবনটা যেমন জীবনের বিজ্ঞাপন, আগাগোড়া মিথ্যে প্রবঞ্চনা, তেমনই। যা বললাম সেগুলো অসত্য, কিন্তু ভুল নয়। মিথ্যেও সম্ভবত নয়। যে-অধিকার আমি কায়েম করেছি, তার কিছু অন্যায়, কিছু ভুল। বাকি সব সত্যি, ঠিক। এও ঠিক যা আমি এড়িয়ে গেলাম, বললাম না, সেগুলো ফুটে রইল ছত্রে ছত্রে, ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমি আরও একবার ধরা পড়ে গেলাম। হানি হল আমার সযত্ন-লালিত সম্মানের।

আপনাদের প্রশ্ন এক অর্থে নির্দোষ। কিছু খোলসা করতে চায়নি। আমি ধরা দিই, চায়নি। ডিঙির যতটুকু জলে ডুবে থাকে ততটুকু গভীরতাই আপনাদের প্রশ্নে। চায়নি আরও গভীরে ঢুকে খুঁজে বার করে জলের নীচের ভাঙা শাঁখা, খেলনাপাতি। সেগুলো পড়ে থেকেছে আপনারা আঘাত করেননি। বৈঠা আর জলের আঘাতের নরম কোলাহলই শেষে রয়ে গেল, বোঝা গেল না আকাশে চিল উড়তে উড়তে মাটির মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নীচে ছড়িয়ে পড়ার ভয় পারস্পরিক ছিল কি না।

নিজে কিছু বলুন।

বলছি। হাত থেকে জল কিছুতে মোছে না। মুছে আসি।

পুরুষ মানুষের জীবনে একজন গাছরমণী প্রয়োজন হয়। দরজার বাইরে শুয়ে থাকবে, নিজের দাবি আর ভবিষ্যৎ বিষয়ে চিন্তাশূন্য, পুরুষের নাক ডাকার মতো কন্ঠস্বর, পা ফেলে হাঁটার সময় যে মাড়িয়ে যায়, যে একা খায়, একা ঘুমোয়, হাই তোলে, কখনো স্নান করে, গায়ে কচ্ছপের গন্ধ। এ-জীবনটায় আমার আনুকূল্য অনেক, প্রতিকূলতা কম ছিল। গাছরমণীর হদিস না পাওয়ার আনুকূল্য, নদীর থেকে কখনো দূরে বাস না করার আনুকূল্য, ভাঙা টিউবওয়েলের পাশে খালি বালতি নিয়ে বসে থাকার আনুকূল্য, অনর্গল সুখের হাসির, মুখের হাসির জলের মতো বয়ে যাওয়ার, নিজের দুঃখে কাতর হয়ে কান্নার সৌভাগ্য, যখন তেমন দুঃখ থাকে না, কান্না দিয়ে কষ্টের নির্মাণ করার, আয়নার সঙ্গলাভের আনুকূল্য। আর, প্রতিকূলতার মধ্যে শুধু চিরকাল নদীর পাশে বাস করার প্রতিকূলতা। নিজেকে রক্ষা করার বিষয়ে আমার নিষ্ক্রিয়তায় আমি কৃতজ্ঞ। জীবনে বেঁচে থাকার অছিলায় যে আনুকূল্য গ্রহণ করার কথা, সেগুলো নেবার অস্বীকারে। আমি আরও কৃতজ্ঞ এইজন্য যে, অনেক আগে আমি ঘোষণা করেছি, আমি বেঁচে নেই, যা সম্পত্তিই থেকে থাকুক আমার, সেগুলোর হয় মূল্য নেই, বা সে-সব অনিশ্চিত মূল্যের। তাই সে-সব ধূলিসাৎ করে বাতাসে মিশে যাচ্ছি।

ছোটোবেলায় আমার বোন মারা যাবার পর বোন যা-যা ভালোবাসত মা সেসব ছেড়ে দেন। মা আর জীবনে রসগোল্লা খাননি, আম খাননি। সারাজীবন সাদা শাড়ি পরেছেন। আমি সেই অভিজ্ঞতার জ্ঞান দিয়ে গঠিত। মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হবার পর মায়ের কাছে রুমাল কেনার টাকা চাইলেও মা বলতেন, ‘পরের মাসে কিনিস, বাবা’— এই সংলাপ দিয়ে। আটাকলের পেছনের দেয়ালে ঋতুর পর ঋতু পড়ে থাকা প্রতিমার চালার জলে শিশিরে ভিজে নষ্ট হতে থাকা দিয়ে। এইসব অভিজ্ঞতার অনিশ্চিত মাটি দিয়ে তৈরি। ঋতু পালটে বর্ষা আসে। পাড়ার রাস্তার ধারে কালো কুকুর মরে পড়ে থাকে। গন্ধ হচ্ছে দেখে কয়েকজন মিলে কুকুরটা ফেলে দিয়ে আসে ভাগাড়ে। কিছুদিন পর পাড়ায় বিয়ের আসর বসে। যারা কুকুর ফেলতে গেছিল, তারা কালো চাদর গায়ে সার বেঁধে খেতে বসে হাত ধুয়ে। আমি এই অভিজ্ঞতা দিয়ে গঠিত।

বাড়ি থেকে সকালবেলা বেরিয়ে এসেছি। সেটা আমার ব্যর্থতা। ডান দিকে কাঠের দোকান। একটা লোক কাঠ কাটছে, পেরেক পুঁতছে। সেটা আমার আর একটা ব্যর্থতা। বাঁ-দিকের ফাঁকা জমিটা শুনছি বিক্রি হয়ে গেছে। জঙ্গল সাফাই হচ্ছে। বাড়ি তৈরি হবে। সেটা আমার ব্যর্থতা। দু-জন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে সেটা আমার ব্যর্থতা ভেবে ভয়ে তাদের দিকে তাকাইনি। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে চলেছে সেগুলো সব আমার ব্যর্থতা, কোনো কাজ আমাকে নেয়নি। মানুষের বড়ো হয়ে ওঠা, নামি হয়ে ওঠা, ছোটো হয়ে যাওয়া, কোনো কিছুর সঙ্গে আমি থাকিনি।

এতসবের পরে তাও যা পেয়েছি তা যথেষ্টর চেয়ে বেশি। বাজারে মাছ কাটা বড়ো বড়ো বঁটিগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার হয়ে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি। বছরের পর বছর ধরে বঁটিগুলো দিয়ে জলজ প্রাণী হত্যা হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার অছিলায়। জালে ধরা পড়ার সময় তারা হয়তো তখন শ্যাওলা খুঁজছে, জলের ভেতরে পোকামাকড় খুঁজছে, বা, আরও কোনো স্বগোত্রীয় প্রাণকে খুঁজছে। আমাকে তেমন কেউ ধরে নিয়ে যায়নি। আলো-হাওয়ায় বেঁচে আছি ঘরের মধ্যে নিজের ঘর তৈরি করে। মাকড়সার ছবি এঁকে। আমার বাড়ি ফেরার ঠিকানা আছে। একটা জানালা আছে। এক বিষয় ফুরোনোর পর আর এক বিষয় নিয়ে বেঁচে থাকা আছে। নিজেকে বার বার পালটে নেবার অধিকার আছে। হোক না আমার অতীত অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার, সকলের মতো। কোনো বৈশিষ্ট্য না-ই থাক।

সারা সকাল তোমাকে দেখিনি বলার মতো সম্পর্ক যদি নাও থাকে, যদি অলিগলি দিয়ে লুকিয়ে যেতে গিয়ে বার বার দেখা হয়ে যায় যার ভয়ে গলিতে ঢুকেছি তার সঙ্গে, যদি মনে থাকে অন্ধকারেও মাথাব্যথার অনুভব হয়, তবুও আমার যা পেয়েছি সে-সব গ্রহণ করার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে, পরম ভক্তির সঙ্গে। যা পাইনি তার জন্য আক্ষেপ করার কথা নয়। আক্ষেপে সেই বস্তু মেলে না। যা মেলার কথা, পাওনা যা, তার হানি হয়। কম করে মেলে। যতগুলো কবিতা আমি লিখেছি ততগুলো নবীন দেশের আমি মালিক। যার কোনোটায় আমি বাস করি না। বাস করি আমার মালিকানার শেষ দেশ থেকে নতুন আর এক অনাবিষ্কৃত দেশে যাবার রাস্তায়।

যদি এমন হত, একটা মানুষের পরিচয় শুধু তার খুঁতটুকু, সেটুকুই তার অবশিষ্ট থাকে, দৃশ্যমান অংশটা শুধু তার খুঁত, তাকে যতটুকু দেখা যায় সেটুকু তার যা নেই তার সমষ্টি, তাহলে আমি তাই। ‘অলোক সেন-এর বাড়ির দরজা খুললে দেখা যায় অলোক সেন চেয়ারে ঠায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। দরজা বন্ধ থাকলে চেয়ার ফাঁকা, অলোক সেন সেখানে নেই।’

কোথাও যাবার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটতে হয়। বাসে উঠতে হয়। বাস থেকে নেমে অটো ধরতে হয়। অটো থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পৌঁছোবার ঠিক আগে অনুতাপ আসে। কেন এলাম। কেন গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম না, জিরিয়ে নিতাম গাছের মতো। নীচ দিয়ে যেত হাতবদল করা সম্ভার, অন্ধকার হলে কেউ নীচে বসে মালা বিক্রি করত। প্রতিটা যাত্রা আমার এক-একটা বক্তব্য, এক-একটা অভিমত। প্রতিটা অভিমত একটা করে যাত্রা। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। সেই অভিমত শেষ মুহূর্তে পালটে যেতে চায়। কোথাও পৌঁছে প্রতিবার মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকি। এখন সাক্ষাৎকারের শেষে এসে যা যা এতক্ষণ বলেছি সেগুলোর ভার বয়ে, সেগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে মাথা নীচু করেই চলে গেলাম।

নিত্যব্রত দাসের নির্বাচিত কবিতা

*
এ যদি খেলার সংসার হয়, এখনও
একটু সামনে এসে দূরেই দাঁড়াও, এখনও
তোমাকে সোনার সংসার ডাকে, প্রতিদিন
এক-একবার নতুন, আরও নতুন, আমার
অজ্ঞাত প্রশ্নের অজ্ঞাত জবাব হও

এখনও না-দেখা রুপোর শেকল, না দেখা
খোঁড়ার গলি, এখনও পরিমাণমতো ভেঙে
আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাঙো…

*
এত শান্ত হয়ে আছে তবু এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আমার
অন্ধকার হয়ে এল চোখ, ঘেমে উঠল হাতের তালু।
দেখা দিতে বারণ করেছিলাম স্পষ্ট করে, এলে মানা করেছিলাম জানাতে,
বলেছিলাম দুর্গম কোনো দেশে বা অনভিপ্রেত কোনো
সন্ধ্যায় না যায় যেন, কেউ না আনে মৃত ফোটোগ্রাফারের ফোটো
আমার কাছে, শরীরে কাটার চিহ্ন যেন না থাকে কোথাও, চোখে
কাজল পরার বা না পরার স্পষ্টতা। সবে চোখ মুছেছে, না থাকে যেন
তারও চিহ্ন সদ্যফোটা হাসিমুখে, যেন খানিকটা জন্মায় অতীতে,
এদিকের ভাষা পায় খানিকটা। অর্ধেক পাওয়া জন্ম বাকি অর্ধেক অজন্ম
সংহার করে এসে, বলেছিলাম বিকেলবেলা।

*
পাশের ফ্ল্যাটের গঙ্গা মারা গেল কয়েক বছর হল,
মেঝেতে অনেকদিন ছড়িয়ে রইল ভিজে গঙ্গার পা, তার জলের বালতি,
নোংরা শায়ার লেস, কোলাপ‌‌্সিব্ ল গেটে আটকে। তার আধখাওয়া
হাওয়াইয়ে পরপুরুষের পা গলিয়ে থাকার লোভ জানাজানি
হয়ে গেল চার মুখে।

ও বেঁচে থাকতে টুকটুক শব্দ বন্ধ দরজার পেছনে ঘুরত,
সে কি ছিল দেশলাই জ্বেলে আলো জ্বালাবার ?
আসলে সে কি নিরন্তর বৃষ্টি ছিল, আচার অনাচারের, কূল অকূলের
নিরন্তর যুদ্ধের অবৈধ স্মৃতি, এক শতাব্দী পরে ফাঁকা ঘরের দরজা খোলার
খাঁ-খাঁ করা মোমবাতির আগুনের সূচনা?

*
ক্ষমা কোথায় অনেকদিন খবর পাই না
আগে দেখতাম ক্ষমা সামনে দিয়ে গেল কয়েকবার,
ফিরে এল। এখন দেখি না।
এখন ক্ষমা বিশেষ কোথাও যায় না, ফেরেও না।
মেঘ করে মিশে থাকে আশেপাশে। আঁচড়ে দিয়েছ কেউ
পানপাতার মুখটা, থমকে গেছে বিদ্যুৎ চমকানো।

কলসি নেই বললে শুনি কলসিতে ঘরঘর শব্দে জল ভরে
নদী নেই বললে ঘোর বন্যায় কলসি নেই, ঘড়া নেই বলে
চারিদিকে রব তুলে অতীব ভয়াল বেগে ছুটে যায় নদী।

জ্যোৎস্নার নদীতে তখন ক্ষমা গান গাইতে গাইতে বেয়ে
যায়— ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।

*
দ্বিধা এসে থেকে থেকে ফিরে গেছে একবার,
ফুটিয়ে গেছে নিজের নাম যেখানে একেলা বসেছিল এসে।
এতদিনে ঢেকেও গেছে কিছুটা প্রতীক্ষার ঘামে।
দ্বিধা দ্বিতীয়বার আসবে কোনো একদিন, তার পরেও হয়তো
আসবে অনেকবার। একসময় আর আসবে না দ্বিধা।

তখনও আমাকে থাকতেই হবে বসে, মাটিতে যেখানে গুনগুন
করে গেছে মাছি, কখন সেখানে দ্বিধা আসে। বসে থাকতে হবে যখন,
ততদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে দ্বিধা এসেছিল, আর কেউ আসেনি,
আসবে না, দ্বিধাই শেষ এসেছিল আমার কাছে। দ্বিধাদের কারো সঙ্গে
আমার দেখা হয়নি বেশি আলোয় চিমনি ভেঙেছিল।

*
এই সকালের পেছনে রাত ছিল নিশ্চয়ই; কাল রাতে কোথায়
ছিলাম! মনে পড়ে, রাত দুটোর সময়, তখন শিয়ালদায়,
বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ন আলোয় এসে অন্ধকারে চলে যাবার ফাঁকে উঁচু
বাতি ঘুরিয়ে দেখছিলাম শহর কলকাতা। শহরটা দ্বিতীয়বার ঘুমিয়ে
পড়ার পর বিডন স্ট্রিট দিয়ে কালো একটা ছাগল ছিপছিপে বৃষ্টিতে
ভিজতে ভিজতে হাঁটছিল। ফিরছিল, না কি শুধু হাঁটছিল!

*
কাল সারারাত আমার বুকের বোতাম নিশানা করে ছিল এক হাত
ছোটো জানালাটা। কেউ নাশ করে না আমাকে, বুক ভরে থাকে বরং
পরিত্রাতার নিঃশ্বাসে। যে-হত্যা মৃত্যুর চেয়ে আদিম, আমাকে শাসায়।
আমার চেয়ে প্রবীণ তালা বন্ধ করে রাখে।
*
নিশাচরের মতো আছি সারাদিন, মহী, একটু ভালোবাসিস
আমাকে। ক্ষমা করিস গঙ্গাকে, যে, ছেঁড়া কাপড়গুলোর নিবৃত্তি
হল না। গোপন করিস না, এই দাঁতের পাটি কার। কে ক্ষয়
করেছে লাল গোলাপ, কে হীন করেছে তাকে দামে শৈবালে,
কে দিয়েছে তাকে অন্তিমের মর্যাদা। বলে দিস, এক কপর্দকও
অবশিষ্ট নেই আর, যা দিয়ে নিজের জামাকাপড় কিনি।

*
আবার গিঁট খুলেছি, এসো, এই মহিলাটিই অসভ্য সেই বিমলা।
কোন মাঠের টিকিট কেটেছে লুকিয়ে, আমাকে জাগিয়ে রেখে কখন
হারানো আংটির খোঁজে চলে যাবে কোন মোগলসরাই, টের পাব না
এক ঘুমে কত মাঠ, চরাচর, গিঁট খুলে এই জেগে থাকায়
কত ঘুম মৃত্যুর মতো গভীর।

*
আমি ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন, একটা সময়কাল।
আর, একটা চড়ুইয়ের পুর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি
সেই বিপাশায়, যে এ-সবের মালিক ছিল।

*
নিজের ভিটে, শহর সিউড়ির ওপর দিয়ে যাবার সময়
প্রতিবার জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যাই, ‘আমি নেই’,
কে মুছে দিচ্ছে শুকনো শালপাতা দিয়ে ঘষে। বাস
পার হয়ে যাচ্ছে, কে আঁকছে গরম পিচের গন্ধ, জানালায়
বাড়ানো মানুষের মুছতে থাকা মুখ।

*
না, আর ছুঁতে এসো না, এখানে যে নেই। দেখো, আলনায় আছে
পাঁচটা আঙুল রাখা।— কী রঙের বৃষ্টি পড়ে, কার বাসার, কোন বিশ্বে
মলিন দেখায় চাঁদ, কোথায় দেখায় গভীর সে-গর্ত!
যাও, রাত কোরো না, ফিরে যাও বরং।

এক কি দু-মুঠো ঘাস, এক কি দু-শব্দের বিরোধিতা, বাসনে শব্দের
আপত্তি, হারিয়ে যাওয়া তোমার গায়ের এক কি দু-দিনের গন্ধ,
এসবের সংস্রবের জ্যোৎস্নায় মাখন কাটবে অনেকদিন। খেয়াল রেখো
সে যেন না কাটে। শেষ দু-এক বছরের নীরবতার স্নিগ্ধতা উড়ে বেড়াক বাতাসে,
যে ক-টা আঙুল ভিজল, যে-যে রঙের বৃষ্টি!
বোধ হয় ট্রেন ছাড়ল। যাই, বইতে শুরু করল গঙ্গা।

*
নারী আসলে রক্তমাংসের শরীরের আবরণের নীচে
গভীর গন্ধের পেটিকোট।

*
অর্ধেক অন্ধকার কী জানো খোটো মিঞা, অর্ধেক প্রশ্ন কী?
অর্ধেক সময় আধখানা মুসলমান, একবেলা আসা, একবেলা
না-আসা অন্ধকার থানার পাশে, ফুল ছেঁড়ার সময় কেঁপে ওঠা
অর্ধেক মেঘ? অর্ধেক সময় দোতলার জানালার পাশে শিরীষগাছের
নীচে সাইকেল খোটো মিঞার?— অর্ধেক খোটো মিঞা কী জানো?

*
নেমপ্লেট বাড়ির, অতিদূর জনহীন এক স্টেশন।

*
১৩৭৬ সালের পঞ্জিকার হলুদ পাতায় কান পাতলে শুনি সে
আগের ছিয়াত্তরেও এমনিই বিবর্ণ ছিল, এমনিই পোকায় কাটা দাগ,
এত কাগজের গুঁড়ো। জলপাইবাগানের মাটিতে ঘোড়ায় টানা
গাড়ির চাকার এমনিই নিঃশেষ। জলপাইফলের স্বাদে মিশে থাকা
একই মর্গের গন্ধ। এমনিই দেয়ালে হেলানো বহু বছরের সাইকেলের
ফাটা টায়ারে মাটির দাগ। যারা নেই পঞ্জিকার পাতা ঘিরে
তাদের বাটিতে চুমুক দেবার শব্দ এমনিই।
*
কে জানে দ্বিতীয় বাড়ির ভেতরে অবস্থান ছিল প্রথম বাড়ির।
বাড়ি ছেড়ে এসে আজ দেখি জানালা খোলা, আলো পড়েছে
বিছানায়। সিঙ্কের কল চুপ করে আস্তে আস্তে জলের ফোঁটা ফেলে।
সাদা শনের চুল মাথায় বুড়ি দু-হাত ছড়িয়ে ধেয়ে আসত।
কে জানত সে বুড়ি ছিল না, সমুদ্র ছিল, পেছনে ঠিক ধেয়ে এসেছে
বৃষ্টির ফোঁটা। ফেনায় ভেসেছে হাতাখুন্তি, কাঠের হাতল, প্রথম
বাড়ির সাক্ষী। আজ এ-বাড়ির পাঁচিলে ছায়া রেখে গেল রোদ,
সুদর্শনার চোখ হেলান দিয়ে আছে।

*
মেঘকে আঘাত করে বৃষ্টি, আকাশকে ফাঁকা নীল করে দেয়,
ক্ষতি করে মেঘে মহিষ-হাঁটা সিঁড়ির। গাছের ডালকে মেরে ফেলে
ফুল ফোটা। তোমাকে শুধু মনে পড়লেও ক্ষতি হয়
তোমার জানালায় আনমনে তাকিয়ে থাকার।

*
চল্লিশটা কবিতা লেখার জন্য হাটে হাটে চল্লিশজন বর খুঁজে
একজনও স্ত্রী মেলেনি।

*
প্রতিবার বিমলার সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় রাস্তায়
একের-পর-এক মাঠ পড়ে। লেভেল ক্রসিং পার হতে হয়,
সামনে দিয়ে ট্রেন পার হবার সময় অন্য পাশে রাত নেমে যায়।
বিমলা্র বাড়িতে যাবার রাস্তায় সার দিয়ে বসে নকল চাবি বানায়
হারানো চাবির মিস্ত্রি, বিহারি দেহাতিরা।

*
খালি হাতে ফিরে যাবার দুঃখ ছাড়া
অন্য কোনো দুঃখ কোনোদিনই ছিল না।

*
কুড়ি বছর পিছিয়ে থাকা আমার জানালায় আবছা করে লেখা
১৯৯৯। কাকার জানালা আরও পেছনে, ১৯১৫। বিমলার জানালা
দু-শতাব্দী পিছিয়ে, ১৭১৭, কাঠের ফ্রেমের ওপরে ৭ সংখ্যা মোছা
মোছা। রিকশাওয়ালার ঘর নেই, শুধু রাস্তা। বয়স নেই, শুধু
কিলোমিটার। কাঠে সংখ্যা খোদাইয়ের শব্দ, পায়ে
সংখ্যা মোছার গতি।

*
কুড়ি বছর পিছিয়ে থাকা আমার জানালায় আবছা করে লেখা
১৯৯৯। কাকার জানালা আরও পেছনে, ১৯১৫। বিমলার জানালা
দু-শতাব্দী পিছিয়ে, ১৭১৭, কাঠের ফ্রেমের ওপরে ৭ সংখ্যা মোছা
মোছা। রিকশাওয়ালার ঘর নেই, শুধু রাস্তা। বয়স নেই, শুধু
কিলোমিটার। কাঠে সংখ্যা খোদাইয়ের শব্দ, পায়ে
সংখ্যা মোছার গতি।

*
একটা ঘানি ছিল এখানে, কার্নিশে ছিল ডিশ-অ্যান্টেনা,
ডাঁই করা বিচুলির ঢিবি ছিল উঠোনের পাশে। আমগাছের
নীচের অন্ধকারে অশ্রু-সামলানো এক-যুগ ছিল সঞ্চিত।
থাকা-না-থাকার হেতু ছিল— বিশ্বাস হয় না।
*
ট্রেনগুলো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাবার সময়
বহু অন্ধকার গুহা পার হয়ে আসে।

*
কোনো নারীর পক্ষে কুপি হাতে ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে
ঘর শূন্য করে তোলা সম্ভব নয়।

প্রকাশিত কবিতার বই

অশুভ মোমবাতি (২০১৫, দাহপত্র)
ইনস্টাগ্রামের বাড়ি (২০১৭, দাহপত্র)
অন্ধকারবয়সি (২০১৯, আক্ষরিক)
নানা রঙের কাঠের হাত (২০২০, শুধু বিঘে দুই)
লকডাউন ১, ২ (ইপাব) (২০২০, আক্ষরিক)
মমিদের রাস্তায় (ইপাব) (২০২১, আক্ষরিক)

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ

সোমা মুখোপাধ্যায়

গয়নাবড়ি শিল্পী পুতুল অধিকারী

পুতুল অধিকারী

আমরা বলি মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এই মাছের ঝোল-সহ নানা রান্নাকে সুস্বাদু করতে ব্যবহার করা হয় নানা কিছু। তার অন্যতম হল বড়ি। কলাই, মুসুর, মুগ, মটর নানা ডালের বড়ি। একসময় মা ঠাকুমারা ভালো করে বেটে হাতে করে দিতেন। ব্যাবসার জন্য এখন যন্ত্রের আমদানি। তবু বড়ির রমরমা সব সংসারেই।

বাঙালির প্রিয় হল ভাত ডাল দিয়ে বড়িভাজা খাওয়া। আর এই ভাজা বড়ির এক বিশেষ রূপ গয়না বড়ি বা নকশা বড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, তমলুক এইসব অঞ্চলের মা বউদের তৈরি। এই বড়ি শুধুমাত্র ভাজা হয়। আর এর তৈরির পদ্ধতিও আলাদা।

 

গয়নাবড়ি

বেশ কয়েকবছর ধরে নানা সরকারি মেলায় পূর্ব মেদিনীপুরের স্টলে দেখতাম একজন মহিলা সুন্দর গয়নাবড়ি বিক্রি করতেন। ওঁর নাম পুতুল অধিকারী। গয়নাবড়ি কেনার সূত্র ধরেই আলাপ আর তারপরে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে তিনি হয়ে যান পুতুলদি। মহিষাদল ব্লকের ঘাগড়া গ্রামের সাদামাটা গৃহস্থ বধূ পুতুলদি শুধু একজন বড়ি শিল্পীই নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। বহু মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। দেখিয়েছেন তাঁদের রোজগারের রাস্তা। মা ঠাকুমার অন্দরের এক রত্নকেই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবার মাঝে। এভাবেই সবলা মেলা, সরস মেলা হয়ে পুতুল অধিকারী দিল্লির প্রগতি ময়দানেও তাঁর গয়নাবড়ির সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

গয়নাবড়ি তৈরির একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এই বড়ির জন্য লাগে বিড়ি কলাই। আষাঢ় শ্রাবণে এই গাছ বুনে আশ্বিন মাসের দিকে উপড়ানো হয়। এই তিন মাসে গাছ হয়ে কলাই পেকে যায়। এরপরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিয়ে একটা ভারী কিছু দিয়ে কলাইগুলোকে মাড়িয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, কলাইগুলোকে বের করে নেওয়া হয়। এরপরে ওগুলো জাঁতায় পেষা হলে ওগুলো ভেঙে দু-খোলা হয়। এরপর সকালে ভিজিয়ে দিয়ে বিকেলে একটা একটা করে খোলা বেছে বাটা হয়। ব্যাবসার বড়ির ডাল মিক্সিতে বাটা হয়। ঘরের বড়ির জন্য শিলে বাটা হয়। এই ডাল বাটা ঠান্ডা জায়গায় অনেকক্ষণ রেখে দিতে হয়। কারণ, মজে গেলে তবেই ফেটালে তা একেবারে নরম তুলতুলে হয়।

গয়নাবড়ি

আমাদের মেয়েদের নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি এই রান্না আর তার উপকরণ বানানোতে ছড়িয়ে আছে। গয়নাবড়িতেও তার প্রভাব আছে। একসময় ডাল বেটে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া হত যাতে ভালোভাবে মজে যায়। এখন সবাই ফ্রিজে রাখে। আর ফেটানোর পরে অল্প একটু মিশ্রণ একটা জলভরতি জায়গায় দেওয়া হয়। যদি তা‌ ভেসে থাকে তবেই তা ঠিকমতো ফেটানো হয়েছে বলে ধরা হয়। আর যদি ডুবে যায় তাহলে আবার ফেটাতে হয়। এটা একটা প্রারব্ধ জ্ঞান।

ডাল ঠিকমতো ফেটানো হলে শুরু হয় গয়নাবড়ি দেবার বিশেষ পর্ব। খুব ভোর থেকে এই বড়ি দেওয়া শুরু সকাল অবধি তা চলে। এমনি বড়ির ক্ষেত্রে এই ডালবাটা থেকে নিয়ে আঙুলের সাহায্যে বড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু গয়নাবড়ির নিয়ম একেবারেই আলাদা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হল টিনের চোঙ। একটা পলিথিন বা কাপড়ে ছোটো ফুটো করে এই চোঙটা ঢোকাতে হবে। এরপর ঐ ডালবাটা পলিথিন বা কাপড়ে নিয়ে চোঙের মাধ্যমে নকশা ফুটিয়ে তুলতে হবে পোস্ত ছড়ানো বড়ি দেবার পাত্রে। পোস্ত দেওয়ার ফলে বড়ি শুকিয়ে গেলে তুলতে অসুবিধা হবে না। যাঁরা বড়ি দেন তাঁরা মন থেকে নকশা করে চলেন। এই কারণেই তাঁরা শিল্পী। এই নকশা যত সূক্ষ্ম হবে গয়নাবড়ি তত দেখতে এবং খেতেও ভালো হবে। সাধারণত এক কেজি ডালে ৮০-৮৫টা বড়ি হয়। ব্যাবসার বড়ির ক্ষেত্রে ১০০-১২৫টা মতো করা হয়। ইদানীং অনেকেই গয়নাবড়িতে চালবাটা মিশিয়ে যেন‌ তেন প্রকারেণ একটা কিছু তৈরি করে বাজারে বিক্রির জন্য। এই বড়ি দৃষ্টিনন্দন তো নয় উপরন্তু মোটা এবং স্বাদেও ভালো হয় না।

ডাল ফেটানোর ওপর গয়নাবড়ি কতটা হালকা হবে তা নির্ভর করে। আবার হালকা হলেই সুন্দর নকশা হয়। আঞ্চলিক ছড়াতেও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে—

‘চায়ের সাথে পলকা বড়ি
আতিথেয়তার নেইকো জুড়ি’

‘গয়না বড়ি এতোই হালকা
তেল জোগাতে পকেট ফাঁকা’

আবার গয়নাবড়ি উপহারের সামগ্ৰি তাও এইসব ছড়ায় তার প্রতিফলন দেখা যায়—

‘মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সাথী হল গয়নাবড়ি’

গয়নাবড়ির আদর্শ সময় শীতকাল। শীতের মিঠে রোদে মেয়েরা দলবেঁধে এই বড়ি দেন। সাধারণত কার্তিক মাসের পেড়ো ষষ্ঠী থেকে শুরু করে ফাল্গুনের শিবরাত্রি অবধি এর সময়কাল। আসলে এর পরে গরম পড়ে যায়। আর বর্ষায় তো বড়ি হবেই না। ভারি সুন্দর লাগে আমাদের এই মরসুম বা ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে খাবার তৈরির সম্পর্ক। এটাই হয়তো প্রাচ্যের বিজ্ঞান ভাবনা। যা মায়েরা লোকাচার নামে অভিহিত করেন।

একসময় অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে দিয়ে পুতুল অধিকারী তাঁর ব্যাবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কাঠের ব্যাবসায়ী। বিবাহ সূত্রে তিনি ঘাগড়া গ্ৰামের বাসিন্দা হন। সংসারের অভাব অনটনে তিনি মানুষের এই নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং এক পরম্পরার শিল্পকে নিয়ে আসেন রোজগারের মাধ্যমরূপে। শুরুতে আশেপাশের বাজার আর অফিস কাছারিতে গিয়ে গিয়ে বড়ি বিক্রি করতে থাকেন। ২০০৪ সালে তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। শুরু হয় সরকারি মেলায় যোগদান। না, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এই সূত্র ধরেই নানা জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে। দুই সন্তান আর নাতি-নাতনির ভরা সংসারের সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন মেয়েদের সংসারের হাল ধরবার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। শিল্পী থেকে হয়েছেন‌ উদ্যোগপতি। গয়নাবড়ির পাশাপাশি তিনি মশলাবড়ি, সাদা ডালের বড়ি, চালকুমড়ো বাটার বড়ি এইসব তৈরি করেন। তবে তাঁর পরিচিতি গয়নাবড়ির কারণেই।

‘সবলা’ মেলায় পুতুল অধিকারী (বাঁ-দিকে)

পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে এই গয়নাবড়ি প্রথম দেখি প্রায় কুড়ি বছর আগে। আমাদের অফিসের কাজে গিয়ে ফেরার পথে একজন সহকর্মী উপহার দিয়েছিলেন। একটি বাড়ির লাগোয়া দোকানে ছিল। ঐ বাড়ির মেয়েরাই করতেন। একটা ছোটো সস্তা পিচবোর্ডের বাক্সে অপটু হাতে সেলোফেন কাগজে মুড়ে আঠা লাগানো। আসলে এটা এত পলকা যে সহজে নষ্ট হয়ে যায়। যাইহোক তখন জেনেছিলাম এটি স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয়। বেশি করে রপ্তানির কথা ওঁরা ভাবছেন। সে-সময়ে আমাদের যিনি অফিসার ছিলেন তিনি বলেছিলেন মজা করেই যে, এই গয়নাবড়ি একেবারেই ক্ষণস্থায়ী শিল্প। সত্যি এর শৈল্পিক দিকটা এত সুন্দর যে, এটা খেতে ইচ্ছে করে না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ এটিকে কলাভবনে সংরক্ষিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর ‘নকশি বড়ি’ নামটা দিয়েছিলেন অবন ঠাকুর। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই গয়নাবড়িকে বঙ্গমাতার ভাঙা ঝাঁপির রত্ন বলেছেন।

১৯৩৪ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে পড়তেন মেদিনীপুরের সেবা মাইতি। তাঁর মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবীর তাঁকে উপহার পাঠানো গয়নাবড়ি দেখে তাঁদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

“শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী ও শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবী কল্যাণেয়ষু,
তোমাদের হাতে প্রস্তুত বড়ি পাইয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিলাম। ইহার শিল্পনৈপুন্য বিস্ময়জনক। আমরা ইহার ছবি কলাভবনে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছি। তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিবে।

শুভাকাঙ্খী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতি ২১শে মাঘ/১৩৪১”

এই ঘটনাটি যেন একটা আঞ্চলিক ছড়াকেই মনে‌ করায়—

“উপহারে নকশা বড়ি
সাফল্য আনে পুরোপুরি।”

প্রয়াত লোকসংস্কৃতিবিদ নির্মলেন্দু ভৌমিক ব্রতের আলপনার মাঝে গয়নাবড়ির উৎস লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, “গয়না হল স্ত্রীলোকের অন্যতম কামনার বিষয়। তাই ব্রতের আলপনায় ব্যবহৃত সেই ভঙ্গিটি এবং সংলগ্নতার বিষয়টি গয়নাবড়ি তৈরির অনুপ্রেরণা হতে পারে।”

গয়নাবড়িকে আঞ্চলিক সীমানা পার করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পুতুল অধিকারীকে অবশ্যই কুর্ণিশ জানাতেই হয়। এক বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারি তিনি। তাঁর দল ঘাগরা সন্তোষী স্ব স্বসহায়ক দলের একজন সাধারণ সদস্য তিনি। এছাড়া উনি একজন সংঘনেত্রী। এই সংঘের নাম ‘কিসমৎ নাইকুন্ডি নতুনভাবে জীবন বহুমুখী প্রাথমিক মহিলা সংঘ সমবায় লিমিটেড।’ এছাড়া নানা অ্যাকটিভিটি ক্লাস্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এর মধ্যে আছে ব্লক স্তরে খুশি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার এবং বুথ স্তরে ঘাগড়া কৈলাসনাথ গয়নাবড়ি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের বড়ি তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে কীভাবে তার বিপণন সবটাই শেখান পুতুল অধিকারী। এই কাজে তাঁর বউমা সুস্মিতা অধিকারীও তাঁকে সহায়তা করেন। এছাড়াও পাটজাত নানা সামগ্রী তিনি তৈরি করেন। নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নিদর্শন শিল্পী পুতুল অধিকারী।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা:
১. সন্তোষ কুমার কুন্ডু, বাংলার পেশাভিত্তিক লোকায়ত কুটিরশিল্প, লালমাটি, কলকাতা, ২০১৯।
২. কমলকুমার কুন্ডু, গয়নাবড়ি: এক অনুপম শিল্প নিদর্শন, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৪।
৩. বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রীমতী রঞ্জনা মন্ডল, গবেষক।

Categories
2021-June-Swaron

গৌতম বসু

সেনেট হলে কবিসম্মেলন

বাংলা কবিতার দু-টি ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী চেহারা আমরা দেখতে পাই, রাজবেশ আর কাঙালবেশ। একে-অপরের যতটা কাছে এরা, ঠিক ততটাই দূরে। কেবল পারস্পরিক দূরত্বেরই প্রসঙ্গ কেন উত্থাপন করলাম, এদের মধ্যে বৈরীভাব, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থাও প্রবল।

কল্পনা করা যাক, গোরা স্থাপত্যের ওই তেজস্বী নিদর্শন, কলেজ স্ট্রিটের সেনেট হল, অক্ষত আছে এবং কবিতাপাঠের এক বিপুল আয়োজন করা হয়েছে সেখানে; আহ্বায়ক, আয়োজক এবং সঞ্চালক ‘সোনার তরী’ প্রণেতা তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! অর্বাচীন ভাষায় রচিত কাব্যের সঙ্গে ঋষি বাল্মীকি, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও কালিদাসের কিছুমাত্র সংস্রব না-থাকারই কথা, কিন্তু অতিবিশিষ্ট আয়োজকের আমন্ত্রণ তাঁরা কেউই উপেক্ষা করতে পারেননি। মূলত উৎসাহ প্রদান এবং কিছু পরিমাণে কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য, তিন ভগবানই বিশেষ অতিথিরূপে উপস্থিত রয়েছেন। কবিতাপাঠ চলছে। কাহ্ন, জয়দেব, বড়ু চণ্ডীদাস, আলাওল প্রভৃতি পূর্বগামী কবিরা তাঁদের স্বনির্বাচিত লেখা পাঠ সমাপ্ত করে ফিরেও এসেছেন শ্রোতার আসনে; কেউ আত্মবিশ্বাসী, কেউ কুণ্ঠিত, কেউ বিরক্ত। এখন, কবিতা পাঠ করছেন, থুড়ি, ঢাকঢোল কাঁসা সহযোগে গান গাইছেন কবিওয়ালা গোরক্ষনাথ। সঞ্চালক মহাশয় ব্যক্তিগতভাবে, কপট প্রতিযোগিতায় উৎসাহী, কবিওয়ালাদের বিনোদনসর্বস্ব হইহট্টগোল পছন্দ করেন না মোটেই, কিন্তু কলকাতা মহানগরীতে বসে তো আর কবিওয়ালাদের উপেক্ষা করা যায় না, তিনি মাথা নীচু করে বসে-বসে ভাবছেন, আমার কারণে স্বয়ং বেদব্যাসকে কী কষ্টটাই না পেতে হচ্ছে! বেদব্যাস প্রসন্ন, অবিচলিত ও শান্ত। বিনোদনের যে-কদর্য চেহারা তিনি দেখে এসেছেন তার প্রতিতুলনায় এই চ্যাঁচামিচি সহ্য করা অতিসামান্য শাস্তি তাঁর কাছে, গায়ে আঁচড়ও কাটে না।

সহনশীলতা মধুসূদনের বহু চারিত্র্যগুণের মধ্যে পড়ে না, তিনি অকস্মাৎ উঠে পড়ে গট্মট্‌ বেরিয়ে এলেন অলিন্দে। সভাস্থলে ধূমপান নিষিদ্ধ; ধ্বস্ত মেজাজ পুনরুদ্ধারের জন্য পকেট থেকে তাঁর প্রিয় পাইপখানা বার করলেন মধুসূদন, তামাক গুঁজতে-গুঁজতে এদিক-ওদিক তাকালেন৷ দেখলেন, কয়েক গজ দূরে, অলিন্দের থামের ছায়ায় এক শীর্ণকায় প্রৌঢ় উবু হয়ে বসে আছেন। ঈশান যুগী। কোঁচড় থেকে সাবধানে একখানা বিড়ি বার করে আনতে-আনতে ঈশান যুগী মধুসূদনের কৌতুকমিশ্রিত কৌতূহলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। হাতটা তাঁর, কোঁচড়েই রয়ে গেল।

‘Another poet?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন মধুসূদন।

বাঙলা কবিতার রাজবেশ আর কাঙালবেশ। ২০০৯।

পুনর্লিখন: ১৪২৩/২০১৭, গদ্যসংগ্রহ (আদম)

 

ঋণ: পঙ্কজ চক্রবর্তী

Categories
2021-June-Prose গদ্য

দেবব্রত শ্যামরায়

বাবাকে নিয়ে, ব্যক্তিগত

একজন সাধারণ মানুষ কত নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারে। নিঃশব্দ৷ আড়ম্বরহীন। বড়ো মানুষ চলে গেলে কাগজে লেখালেখি হয়। তাঁর কাজ নিয়ে কত আলোচনা। যুবা নায়ক আত্মহত্যা করলে গুণমুগ্ধরা দীর্ঘদিন কাঁদে। স্বাভাবিক। নামহীন মানুষের সে-সব বিড়ম্বনা নেই। তার জীবনের মতোই তার মৃত্যুও বড়ো মূল্যহীন৷ সে আর কোথাও নেই, দেহে নেই, আত্মায় নেই, তার জড় উপাদানগুলি ভেঙেচুরে পঞ্চভূতে লীন। সারা জীবন সংসার ঠেলে যাওয়া ছাড়া তার বৃহত্তর কোনো কাজ নেই। প্রিয়জনের স্মৃতি ছাড়া তার আর কোনো বাসভূমি নেই। সেই স্মৃতিও ক্রমশ ধূসর হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে একদিন। পুরোনো জামাকাপড় দিয়ে দেওয়া হবে একে-তাকে৷ চশমাটা শুধু পড়ে থাকবে তাকের কোণায়। এই নিভৃত, নিরুপদ্রব মুছে যাওয়াটাই প্রকৃতির ভারি পছন্দের জিনিস। এই মহাবিশ্বে বিরাট বিপুল নক্ষত্র বা ধরা যাক ছোটো কোনো ফুল, সবই টুপটাপ ঝরে যায়। এই লেখাটি লিখিত হওয়ার সময়েও খুব কাছে, হয়তো-বা বহু আলোবছর দূরে খসে গেল কেউ, তার খবর পৌঁছোল না কোথাও। এই নীরবতা যাপনই প্রকৃতির অভ্যেস। একমাত্র মানুষই ব্যতিক্রম— স্বজনবিয়োগে মানুষই বোধহয় সবচেয়ে বেশি কাঁদে, কেঁদে কেঁদে আঁকড়ে ধরতে চায়।

কোভিড আমার বাবাকে সহসা এই নীরবতা এনে দিল। কোভিড-মৃত্যু, তাই কোনো শ্মশানবন্ধু নেই। রাত দুটোর কোভিড-নির্ধারিত শ্মশান প্রায় জনশূন্য, শুধু ভাগীরথীতীরে দু-একটা কুকুর আর ভিনগ্রহী জীবের মতো পিপিই-পরা দু-জন শ্মশানকর্মীর ঘোরাফেরা যেন কোনো অচেনা ভবিষ্যতের এক ডিসটোপিক পৃথিবীর ছবি আঁকছে। এই নীরব প্রস্থান পিতার কাঙ্ক্ষিত ছিল কিনা জানি না, তবে স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আচার-অবিশ্বাসী সন্তান সামান্য স্বস্তি পেল। মুখাগ্নি নেই, মন্ত্রপাঠ নেই, ব্রাহ্মণ নেই। নির্জন পবিত্র শোক ছাড়া বাইরে থেকে আরোপিত কিছু নেই। মনে হল, নিজের জন্যেও ঠিক এমনই নিরাভরণ বিদায় চায় সে।

বিদায় মুহূর্তটি শান্ত, নিরুপদ্রব— এই ভুল ভেঙে যেতে বেশি দেরি হল না। পিপিই-পরা সৎকারকর্মীরা অচিরেই নানা পরিষেবার দরপত্র খুলে বসলেন। কালো প্লাস্টিক সরিয়ে মৃতের মুখ দেখার মূল্য পাঁচশো, দাহের পর মৃতের নাভিকুণ্ডটি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে চাইলে তার জন্য নগদ হাজার দুয়েক। তাঁরা জানায় যে শোকার্ত পরিজনকে তাঁরা বিরক্ত করতে চায় না, কিন্তু অনন্যোপায়, কারণ, নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কোভিড বডি নিয়ে তাঁদের ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে, অতএব এই সামান্য উপরিটুকু তাঁদের প্রাপ্য। না, কোনো পরিষেবাই আমার দরকার নেই, শুধু বাবার চলে যাওয়াটুকু দূর থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে চাই। তা সম্ভব নয়, কেন-না ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। অতএব পকেটে যা ছিল তা দিয়ে বকশিস মিটিয়ে যখন বেরিয়ে আসি, ততক্ষণে স্বয়ংক্রিয় কনভেয়ারে অমোঘ চুল্লির ভেতরে ঢুকে গেছে প্লাস্টিকসমেত বাবার শরীর। অবিভক্ত ভারতের নারায়ণগঞ্জ জেলার কুমুন গ্রামে একাশি বছর আগে যে-শিশুটির জন্ম হয়েছিল, দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে দিদির হাত ধরে এপারে এসে জীবনভর যে-সংগ্রামের শুরু, তার সৎ ও পরিশ্রমী জীবনের শেষতম পার্থিব চিহ্নটি এক শরতের রাতে পানিহাটির গঙ্গাতীরে একটি কোভিড শ্মশানে চিরতরে মুছে গেল। আর কোভিডকালে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য স্বজনহারা মানুষের সঙ্গে একই সুতোয় জড়িয়ে গেল আমার নাম।

ভিড় করে আসে স্মৃতি। স্মৃতিতে ভর করে আর আত্মীয়স্বজনের কাছে শোনা কথা থেকে নির্মাণ করে নিই মানুষটিকে। কোন মানুষটার কথা বলি, কোন মানুষটাকেই-বা বাদ দিই! যে-মানুষটাকে কচি বয়সেই দাদা-দিদিদের সঙ্গে উদ্বাস্তু কলোনির রাস্তায় জলের লাইনে দাঁড়াতে হত। স্কুলফেরতা গোবর কুড়োতে হত তাঁকে, মা ঘুঁটে দেবেন বলে। সেই মানুষটা ব্যারাকপুরে দেবীপ্রসাদ স্কুলে অনেকবার অংকে একশো পেয়েছে, নব্বইয়ের নীচে কোনোদিন পায়নি। যে-মানুষ উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই নিজের খরচ চালাতে নিয়মিত টিউশনি করত, এমনকী নিজের ক্লাসের ছেলেদেরও পড়াতে পারত। সেই মানুষটাকেই একদিন বাড়ির ওপর চাপ কমাতে পড়াশুনোর পার্ট দ্রুত গুটিয়ে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হতে হয়, টেকনিকাল স্কুলের সার্টিফিকেট নিয়ে আপন দক্ষতায় চাকরি জোটে সাহেবি ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানিতে। পদোন্নতি হচ্ছিল, হঠাৎ সাহেবি কম্পানি এ-দেশে ব্যাবসা গুটোনোয় চাকরি যায়। আর পরের চাকরি না করে হাতেকলমে কিছু করার তাগিদে কিছু সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন কিনে শুরু হয় একান্ত নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্স। ইতিমধ্যে জীবনে প্রেম এসেছে। কালো লোককে কোনোদিনই পছন্দ ছিল না মায়ের। ফুচকাওলার রং কালো বলে ফুচকা না খেয়ে পয়সা ফেরত নিয়েছিল বর্ণবৈষম্যবাদী মা। এহেন মায়ের কালো প্রেমিক ও স্বামী জুটল। অতঃপর একটি সন্তান। সব কিছুর মধ্যে হুগলি শিল্পাঞ্চলের কয়েকশো অতিক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগের মধ্যে একটি হয়ে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নেয় বাবার কারখানা। সংকটও আসে, কখনো অর্থনৈতিক, কখনো-বা রাজনৈতিক। উত্থানে-পতনে, ঘাতে-প্রতিঘাতে এইভাবেই জীবন এগিয়ে চলে। জীবন যেরকম…

জীবন এরকমই। উনিশ অথবা বিশ। জনমানুষের তুচ্ছ যাপনের ভিড়ে আরও একটি সামান্য জীবনের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা কী-ই-বা প্রয়োজন? সন্তানের আগ্রহ থাকতে পারে, কিছুটা পক্ষপাতও। কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবনেই তো এমন কাহিনি আছে, তাতে জিত আছে, হার আছে, কিন্তু সে-সবই বড়ো আটপৌরে৷ তাতে কোনো অতিরিক্ত বীরত্ব নেই, সমাজ-সংসারে হইচই ফেলে দেওয়া প্রথাভাঙা কৃতিত্ব নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, বরং কিছুটা অসহায় ভীরুতাই থেকে যায়, ঠিক যেমন নকশাল আমলে প্রতি রাতে আপিস ও তারপর টিউশনি সেরে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরত বাবা আর গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করত এক নববধূ।

কিন্তু আজ যখন বাবা নেই, মনে হচ্ছে, বাবার সঙ্গে বসে আরও কিছুটা সময় কাটানো উচিত ছিল আমার। আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানোর খাতিরেই না হয় পাশে বসে দেখা উচিত ছিল বাবার পছন্দের সিরিয়াল। জানা হল না বাবার অনেক কিছু! আমি জানতে পারলাম না, কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি, বাবার পছন্দের রং কী? আদৌ ‘পছন্দের রং’ শব্দবন্ধটা নিয়ে কোনোদিন কিছু ভেবেছে কিনা আমার সাদামাটা বাবা। জানা হল না, এ-জীবনে তাঁর কোনো অপ্রাপ্তির বোধ রয়ে গেল কিনা! হ্যাঁ, আন্দামানের গল্প শুনে কথায় কথায় একবার ঘুরতে যেতে চেয়েছিল বাবা। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজারো বাধ্যবাধকতার চাপে সে-সব নিয়ে কথা হয়নি আর। ঠিক যেমন জানা হল না, আর একটিবার বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে নিজের গ্রামের মাটিতে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল কিনা! সম্ভবত না, বাবা পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে ভালোবাসত না তেমন। সকালের বাজার, বসবার ঘরে নিজের চেয়ার ও টেবিলে খবরের কাগজ, চায়ের ফ্লাস্ক আর টিভির রিমোট নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছিল অবসরের দিনগুলো। বাবার হাতে অনেক সময় ছিল কথা বলার জন্য, আমারই শোনার সময় ছিল না তেমন। তাই অনেক কিছুই ভালো করে জানা হল না, বাবা…!

ঠিক যেমন জানা হল না… কোভিড হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে জীবনের শেষ সাতদিন একা একা শুয়ে, কষ্ট পেতে পেতে, চেতন থেকে অচেতনের দিকে ক্রমশ ডুবে যেতে যেতে, কার কথা ভাবছিল লোকটা? মায়ের কথা? উজানের কথা? কার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছিল, শেষবারের মতো কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল বাবার?

কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার পর বাজারে গেলে বাবা মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেত। এক ঘণ্টা… দু-ঘণ্টা। আমি বাড়ি থাকলে মা-র ঘ্যানঘ্যান সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে পড়তাম। হন্যে হয়ে বাবাকে খুঁজতাম।

আমাদের সবুজ মফস্সলে রাস্তার দু-ধারে সকালের রোদে বাজার বসত। আশেপাশের গ্রাম থেকে তাজা শাকসবজি আর মাটিমাখা ডিম নিয়ে আসতেন চাষি-বউ। খুব ভোরে ঘোষেদের পুকুরে জাল পড়ত। ওপার বাংলার রোদে-জলে পুষ্ট বাবার নিয়মিত মাছ না হলে চলত না। শাকও কিনত প্রচুর। বাজারের থলে উপচে পড়ত কলমি, পালং, আলোরং কুমড়ো ফুলে। মা-র মুখ ভার হত। এত শাক আনো কেন? নষ্ট হয় তো! বাজারে গিয়ে বাবার প্রথম কাজ ছিল এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘোরা। বাজার করার এটাই নাকি প্রথম সূত্র। বাজার করার আগে বাজারকে হাতের তালুর মতো চিনে নিতে হয়। দেখতে হয় কার কাছে আজ ভালো কী কী এসেছে, কী তার দাম। তারপর বাজার করা শুরু।

শুরু হত বটে, কিন্তু বাজার করা শেষই হত না অনেক সময়। বাজারের মাঝখানে ঢুকে পড়ত গল্প। রাজনীতির আলোচনা। গরম চায়ের গেলাস। সকাল হলেই আমাদের শান্ত শহরতলির রাস্তা ভরে উঠত সাইকেলের ঘণ্টিতে৷ জার্মান সিলভারের সস্তা টিফিন বাক্স চটের ব্যাগে ঝুলিয়ে সাইকেল চেপে আশেপাশের কলকারখানায় পৌঁছে যেতেন পানিহাটি শিল্পাঞ্চলের মানুষজন। ঠিক আটটায় জুটমিলের ভোঁ বাজত। পাড়ায় কোনো-না-কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসত বিনুনিবাঁধা বালিকার গলা সাধার আওয়াজ৷ চায়ের দোকানের কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত হেমন্তের অলস সকাল। রাস্তার পাশে সেদিনের গণশক্তি আটকানো থাকত বাঁশের চটায়। বাবা একাধিক খবরের কাগজ পড়ে, চা খেয়ে, চেনাজানা নানা মানুষের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরত। বাড়ির কাছাকাছি এলে অবশ্য হাঁটার গতি বেড়ে যেত৷ অপেক্ষমান মায়ের রাগত মুখটা মনে পড়ত বোধহয়। যেদিন মনে পড়ত না আমি গিয়ে খুঁজে আনতাম। বাবাকে পেতাম কোনো চায়ের দোকানে, খবরের কাগজের ঠেকে অথবা ধীরে ধীরে সংখ্যায় কমতে থাকা বন্ধুদের আড্ডায়।

বহুদিন আর সাইকেলের ঘণ্টি কোরাস শোনা যায় না। মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। বেশিরভাগ কারখানা ভেঙে তৈরি হয়েছে টাউনশিপ। বাস্তু-অনুমোদিত অ্যাপার্টমেন্ট্স। সত্তর শতাংশ গ্রিনারি। এছাড়া যে-সব কারখানার জমিজমা নিয়ে মামলা চলছিল, সেগুলোও এক এক করে কিনে নিয়েছেন এলাকার এমএলএ-র জামাই। গোডাউন তৈরি হবে। পথের দু-ধারে মাথা তুলেছে আরও কিছু শ্রীহীন আবাসন। রাস্তা থেকে উঠে এমনই এক আবাসনের নীচে ঢুকে গেছে পুর বাজার। কৃত্রিম আলোয় ছলকে উঠছে মৃত মাছের চোখ। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কাতলার ট্রাক ঢুকেছে রাতের শহরে।

আজ বাজারের সামনে ফ্ল্যাটের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। বাবার ক্রিমেশন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমি তখন হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি একটা জেরক্সের দোকান!

মানুষ বুড়ো হলে হঠাৎ একসময় আকাশের তারা হয়ে যায়। উজানের দাদা অর্থাৎ, ঠাকুরদাও তারা হয়ে গেছে— বছর পাঁচেকের শিশুটিকে শোকে কিছু আস্বস্ত করার তাগিদে বিষয়টা এইভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে এসব বলার পর থেকে আরেক নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে৷ এখন সে যার নামই শোনে— মার্ক জুকেরবার্গ থেকে মমতা ব্যানার্জি— একবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেয়, দুর্দৈবক্রমে এঁরা কেউ স্টার হয়ে গেছেন কিনা! বালাই ষাট!

যাইহোক, শিশুদিবসে উজানের ইশকুল থেকে অনলাইনে বাড়ির কাজ এসেছিল— এক পাতা হাতের লেখা— আই লাভ চাচা নেহেরু। চাচা নেহেরু কে? চাচা নেহেরু কি তারা হয়ে গেছে? হ্যাঁ, তা হয়েছে। করোনায়? না না, অনেকদিন আগেই। চাচা নেহেরুর সঙ্গে কি আমার দাদার দেখা হয়েছে? আমি ভাবতে চেষ্টা করি, নেহেরু যখন রাণাঘাটে উদ্বাস্তু শিবিরে এসেছিলেন, বাবারা ততদিনে ব্যারাকপুর সদরবাজারে, মুসলিমদের খালি করে চলে যাওয়া মহল্লায়। অর্থাৎ, জীবিত অবস্থায় কারো সঙ্গে কারো দেখা হয়নি। কিন্তু উজান আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দেয়, ওই যে চাচা নেহেরু আর দাদা গল্প করছে। আমি সন্ধ্যের আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাই। দেশভাগের ক্ষত পুষে রাখা ও একসময় সক্রিয়ভাবে আরএসএস করা আমার বাবা আজ নেহেরুকে দেখে খুশি হচ্ছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নাকি আজকের রামরাজত্বে নেহেরুকে সামনে পেয়ে তিনি একটু খুশিই হচ্ছেন? মনে আছে, আঠাশ বছর আগের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি-ভাঙাকে জাস্টিফাই না করতে পারলেও আমার মতো বিষণ্ণ ও ক্রুদ্ধ হতে পারেননি আমার বাবা। তারপর থেকে ক্রমশ বুড়ো হতে থাকা বাবাকে যত আঁকড়ে ধরেছি আমি, পুত্রের থেকে পিতা, রাজনৈতিক বোধে ও দৃষ্টিকোণে, ততই দূরতর হয়েছেন। সে-দূরত্ব আর ঘোচেনি।

উজান আঙুল দিয়ে দেখায়, দাদার পাশে অন্য ছোটো তারাটা কে বলো তো বাবাই? কে রে? ওটা পদ্মাপিসির শাশুড়ি। আমি হেসে ফেলি। পদ্মাদি, উজানের পদ্মাপিসি আমাদের পরিবারের গৃহপরিচারিকা। সম্প্রতি বৃদ্ধা শাশুড়ি মারা যাওয়ায় অশৌচ পালনের জন্য পদ্মাদি কাজে আসতে পারেনি বেশ ক-দিন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, দুই বিরুদ্ধমতের পুরুষ কথা বলছেন, তর্ক করছেন। আর এক অনামা বৃদ্ধা চুপচাপ তাঁদের জন্য দু-কাপ গরম চা করে দিচ্ছেন। মৃত্যুর পরেও গৃহপরিচারিকার জীবন থেকে তাঁর মুক্তি হল না, এই ভেবে তিনি দুঃখিত হচ্ছেন। তাঁর দীর্ঘশ্বাসে তারার আলো কাঁপছে।

সকালের বৃষ্টিধোয়া গঞ্জের বাজার। কাঁচা আমলকি একশো গ্রামের দাম পঁচিশ টাকা। অর্থাৎ, আড়াইশো টাকা কিলো। বেশ দাম! আমি আমলকি কোনোদিনই পছন্দ করতাম না তেমনভাবে। বাবা ভালোবাসতেন। দুপুরে খাবার পর আমলকি কেটে অল্প অল্প নুন ছুঁইয়ে খেতেন। মাকে দিতেন৷ আমাকেও জোর করতেন খাওয়ার জন্য। কখনো খেতাম, কখনো খেতাম না। আমলকি খাওয়ার পর এক গেলাস জল খেলে মুখটা মিষ্টি হয়ে যায়। আজ হঠাৎ আমলকি খেতে ইচ্ছে করল। বাবার স্মৃতি ক্রমশ ধূসর হচ্ছে। আমি খুব চেষ্টা করেও আজকাল আর মনে করতে পারছি না বাবার সবগুলো ওষুধের নাম। এক বছর আগেও যা ঠোঁটস্থ ছিল। অন্য দিকে আমি আস্তে আস্তে বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি। সেই একইভাবে চুলে পাক ধরছে আমার। একইভাবে বাজার ঘুরে ব্যাগভরতি সবজি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। বাবা প্রায় সব সবজিওয়ালা মাছওয়ালাদের নামে চিনতেন। তাঁদের বাড়ির খবরাখবর জানতেন। আমিও চিনতে শুরু করেছি অনেককেই। একটাই কারণ— বৎসরাধিক কোভিডকালে ও বাবার অবর্তমানে আমার বাজার যাওয়াটা অনেকটাই বেড়ে গেছে। সৌমেন সকালে ডিম বিক্রি করে৷ বিকেলে টোটো চালায়। গত লকডাউনে ব্যাবসা লাটে ওঠায় বাজারে মাছ নিয়ে বসেছিল কেউ কেউ। তাঁদের অনেকে এ-বছর ফিরে গেছে পুরোনো পেশায়। অটো বন্ধ ছিল যখন, সিনেমাহলের সামনে চিকেন তন্দুরের ঠেলা বসিয়েছিল রতন। বেশ সস্তা। ভালো রোজগারও হচ্ছিল। কিন্তু ওরা চিরকালের মার্কামারা বাম পরিবার বলেই নাকি তৃণমূল-নিয়ন্ত্রিত ব্যাবসায়ী সমিতি আনলকের শুরুতেই তন্দুর উঠিয়ে নিতে বলেছে, রতন সেদিনই বলছিল।

যে-কথা বলছিলাম, আমি বাবার মতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আত্মা জলে ভেজে না, আগুনে পোড়ে না…। আত্মা বুড়ো হয় শুধু। ক্রমশ আমার হাঁটার গতি কমবে। শান্ত হয়ে আসবে হরমোন। মাঝেমধ্যে খিটখিট করব। ফুল সাউন্ড দিয়ে টিভি দেখব, এতটাই যে বিরক্ত হবে বাড়ির লোক। আর আমলকি খেতে ভালো লাগবে খুব। একশো গ্রাম ওজনে পাল্লায় চারটে মাত্র আমলকি। তাদের সবুজ শরীরে সবে হলুদ রং ধরেছে। আজ খাওয়া-দাওয়া সেরে অল্প নুন লাগিয়ে খাব৷ বসার ঘরে রাখা কাঠের চেয়ারটা ফাঁকা। সপ্তাহ মাস বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। বর্ষা আসতে এখনও কয়েকদিন দেরি। একটুকরো অসময়ের মেঘ ঝুলে রইল শেষ দুপুরের আকাশে।

Categories
2021-June-Golpo গল্প

শমীক ষাণ্ণিগ্রাহী

সবাই মিথ্যে বলে

আমার লেখা এটা প্রথম গল্প। গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

আমার লেখা এটা প্রথম গল্প। তাই অনেক ভাবনাচিন্তা করে, সময় নিয়ে, দু-দিন অফিস কামাই করে লেখাটা শেষ করেছি।

প্রথমে গল্পটা আমি রিয়াকে পড়তে দিলাম।

রিয়া পড়ল। একবার দু-বার তিনবার। শেষে বলল, ভালো লেগেছে।

শুনে আমি খুশি হলাম। কথাটা বলতে রিয়া গতকাল রাত্রের রান্না বন্ধ রেখেছিল। এই কথাটা শুনতে আমাকে গতকাল রাত্রের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে আনতে হয়েছে। যাইহোক গল্পটা রিয়ার ভালো লেগেছে।

গল্পটা বাবাকেও একদিন পড়তে বললাম।

পরদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কেমন লাগল?

বাবা ছোট্ট উত্তর দিয়ে বললেন, পড়ছি। তারপর হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন।

তার পরদিন আবার জিজ্ঞেস করতে বাবা, পড়ছি। বলেই হাঁটতে বেরিয়ে গেলেন।

এভাবে একদিন দু-দিন তিনদিন করে করে পুরো সপ্তাহ কেটে গেল।

রোববার সকালের দ্বিতীয় দফা চা খেতে খেতে বাবা জানালেন গল্পটা তিনি পড়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগল? বাবা সেই আগের মতো ছোট্ট উত্তর দিলেন, ভালো। বলে খবরের কাগজে মন দিলেন।

গল্পটা বউয়ের ভালো লাগল

গল্পটা বাবার ভালো লাগল

গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

কয়েকদিন পর গল্পটা পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠালাম।

আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম গল্পটা মনোনীত হবার জন্য।

অপেক্ষা করতে করতে একমাস কেটে গেল।

প্রায় ভুলেই গেছিলাম যে, আমি কোনো গল্প লিখেছি। ভুলেই গেছি যে, আমার লেখা প্রথম গল্পটা আমি কোনো পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়েছিলাম।

রিয়া ভুলে গেছে আমার গল্পটা কখনো পড়েছে কিনা।

বাবা ভুলেই গেছেন আমি একটা গল্প লিখেছি বলে।

বাড়িতে একদিন চিঠি এল আমার নামে। আমার নামে চিঠি প্রায় আসে না বললেই চলে। যা আসে সব বাবার নামেই। যাইহোক চিঠিতে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক জানিয়েছেন যে, গল্পটা তাদের মনোনীত হয়েছে। এবং সেটা জুলাই সংখ্যায় ছাপা হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হলে যথা সময়ে লেখক কপি আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

গল্পটা ছাপা হবে জেনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। সঙ্গে আরও একটা নতুন খবর।

গল্পটার জন্য আমাকে সাম্মানিক দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে মিশিয়ে আমি খুব খুশি। আমার লেখা প্রথম গল্পটা শহরের সেরা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে।

রিয়া হাসি হাসি মুখে বলল, খুব ভালো খবর। টাকাটা পেলে আমাকে একদিন খাওয়াতে নিয়ে যেতে হবে।

বাবা শুনে বললেন, ভালো খবর। সামনের মাস থেকে তুমি তাহলে নতুন গল্প লিখতে শুরু করে দাও।

প্রথম গল্পটা লিখে আমি খুব মজা পেয়েছি।

গল্পটা লিখে আমার নিজেরই খুব ভালো লেগেছে।

আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার দ্বিতীয় গল্পটার জন্য।

জুলাই এল। শহরে গরম বাড়ল। লোডশেডিংও বাড়ল। মিউনিসিপ্যালিটির সাপ্লাই জলের টানাটানি বাড়ল। হিসেব করে জল খরচ করার কথা বাবা বার বার মনে করিয়ে দিতে লাগলেন।

পত্রিকা প্রকাশিত হল। অতি উৎসাহে আমি বইয়ের দোকানে গিয়ে এক কপি কিনেই আনলাম।

সূচিপত্রে আমার নামটা জ্বলজ্বল করছে।

সামনের মাস থেকে আমাকে আরও নতুন গল্প লিখতে হবে।

আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার দ্বিতীয় গল্পটার জন্য।

 

Categories
2021-June-Golpo গল্প

অনুপম মুখোপাধ্যায়

আন্ডারপাস এবং প্লাস্টিকের চেয়ার

বাড়ির কাছে একটা আন্ডারপাস। সন্ধ্যের পর সেটা একরকম শুনশান থাকে। মাথার উপর দিয়ে বিরাট বিরাট লরি যায়, বাস যায়, টেম্পো, ম্যাটাডোর, পিক আপ ভ্যান, ফিনফিনে মোটরবাইক যায়, রয়্যাল এনফিল্ড যায়। আন্ডারপাসের ভিতরে একঠায় একটা আলো জ্বলে থাকে, খাঁ-খাঁ করে। ওটা তৈরি হয়েছিল স্কুলের ছেলেমেয়েদের সুবিধার জন্য। এক বছরের উপর হয়ে গেল স্কুল বন্ধ।

কিছুদিন আগেও দেখতাম সন্ধ্যেবেলায় চেয়ার পেতে আন্ডারপাসটার মুখে একজন দশাসই পুরুষ বসে আছেন। বাড়ির সামনে। কিন্তু ওঁর বাড়ির লোককে ওঁর পাশে কখনো দেখিনি। একদম একা। বিরাট চেহারা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। ঘাড়টা ঝুঁকে থাকত বুকের উপর। একটা লুঙ্গি কোনোক্রমে কোমরে আটকানো। মাঝেমধ্যে পায়চারি করতেও দেখতাম, মনে হত কষ্ট করে পা ফেলছেন। আজ শুনলাম তিনি কয়েকদিন হল মারা গেছেন।

“স্ট্রোক?”

“না। কোভিড। বডি দ্যায়নি পুলিশ।”

ঠিক বিশ্বাস হল না। পাড়ার আর একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, “আরে ওর তো বিভিন্নরকমের প্রবলেম ছিল। হার্ট। কিডনি। সে-জন্যই গেছে।”

“পুলিশ বডি দিল না কেন?”

“সে পুলিশ আজকাল অমনই করছে। সন্দেহ হলেই কোভিড পেশেন্ট বলে বডি দিচ্ছে না।”

“সন্দেহ কেন? টেস্ট হয়নি?”

“অত জানি না।”

মৃত্যু এমনই একটা অবাক শূন্যস্থান তৈরি করে। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে একটা দোকান থেকে রোজ রাত্তিরে সিগারেট কিনতাম। নিয়মিত অভ্যাস ছিল। একদিন দেখলাম দোকান বন্ধ। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার? এর কি শরীর খারাপ-টারাপ?”

“মরে গেছে।”

“সে কী! কী হয়েছিল?”

“বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বিষ খেয়েছে।”

সেই চমক আমার আজও কাটেনি। দিব্য হাসিখুশি লোক। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে এটাই বিশ্বাস করা মুশকিল। সে ঝগড়া তো করলই, আবার বিষ খেল, মরেও গেল! সেই রাত্তিরে মাথার উপর তারায় ভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ওর দোকান থেকে কেনা আমার সব সিগারেটের আগুন যেন সেখানে জ্বলছে, ইয়ার্কি মারছে।

এখন আন্ডারপাসটার কাছে গেলে একটা ফাঁকা প্লাস্টিক চেয়ার চোখে পড়বে।

লোকটার ওজন ঐটুকু একটা চেয়ার কী করে রাখত, তখন অবাক হতাম, এখনও অবাক হয়েই ভাবছি।

সন্ধ্যেবেলায় একটু হাঁটতে না বেরোলে চলে না। লকডাউন চলছে। সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। লোকজন রাস্তায় নেই। যারা মহামারিকে ভয় পায় না, তারাও পুলিশকে ভয় পায়। পুলিশের মার পুরোদমে চলছে শহরে। কোনো কিছু না ভেবেই তারা লাঠি চালিয়ে দিচ্ছে শুনছি। আমাকে বেরোতেই হয়। সন্ধ্যেবেলায় একটু বাইরের হাওয়ায় না বেরোলে দম আটকে আসে। যতই অসামাজিক হোক, আত্মবিধ্বংসী হোক, কিছু ক্ষেত্রে তো করার কিছু থাকে না।

আন্ডারপাসটা পেরিয়ে দেখলাম প্লাস্টিকের চেয়ারে আজ ভদ্রলোকের ছেলে বসে আছে। অশৌচের পোশাক পরে আছে। এরও চেহারাটা খুব মোটার দিকে। হয়তো একদিন বাবার মতোই ওবেসিটি ধরবে একেও। অমনই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকবে, কষ্টেসৃষ্টে নড়াচড়া করবে।

একবার এই ছেলেটার সঙ্গে আমার রাস্তায় তর্ক হয়েছিল। হঠাৎ করে আমার মোটরবাইকের সামনে এসে হাজির হয়েছিল। আমি ব্রেক কষতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। ছেলেটা নিজের দোষ স্বীকার করেনি।

সেই থেকে এর সঙ্গে দেখা হলেই মনটা কিছুটা তেতো হয়ে যায়।

আজ তবু দাঁড়ালাম। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে। ছেলেটা মুখে মাস্ক পরে নেই। বাড়ির সামনে রাস্তা থাকলেও সেখানে কেউ মাস্ক পরতে চায় না। বাড়ি আর নিরাপত্তা যেন দুটো অবিচ্ছেদ্য ধারণা।

বললাম, “খবরটা আমি আজ শুনলাম। উনি কি তাহলে কোভিডেই…”

“না না, বাবার অনেকরকমের অসুস্থতা ছিল। কোত্থেকে কোভিডের গুজবটা রটেছে কে জানে! আসলে এখন কেউ মারা গেলেই কোভিড ভেবে নিচ্ছে লোকজন।”

“তবে যে শুনলাম বডি… ইয়ে… দেহ দ্যায়নি পুলিশ!”

ছেলেটা বিরক্ত মুখে বলল, “কে বলল? আমি নিজে মুখাগ্নি করেছি। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।”

“ওহো…”

আমি আর না দাঁড়িয়ে পা বাড়ালাম। আজ সম্ভবত ছেলেটার সঙ্গে তিক্ততা আরও বাড়ল। এরপর রাস্তাঘাটে দেখা হলে মুখটা আরও বিস্বাদ লাগবে।

ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছি। নিজের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দু-পাশে বাড়িঘর পড়ছে। ভিতরে আলো জ্বলে আছে। কথাবার্তা আবছা শুনতে পাচ্ছি। রান্নাবান্নার আওয়াজ। টিভির শব্দ। রাস্তায় কুকুরগুলো এখন কেউ গেলেই মুখ তুলে দেখে নিচ্ছে লোকটা কে। এখন সন্ধ্যের পর থেকে সারা শহরের রাস্তায় কুকুরগুলোই প্রভুত্ব করে।

নদীর ধারে এসে পড়ল রাস্তাটা। একদম নির্জন। এখানে কুকুরও নেই। শুনশান হাওয়া দিচ্ছে একটা।

একটু কাশলাম। সেই শব্দ নদীর ওপার থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।

কী খেয়াল হল, হাততালি দিলাম।

নদীর ওপার থেকে হাততালিটা ফিরে এল।

জানতাম আসবে।

Categories
2021-June-Golpo গল্প

শুভ্র মৈত্র

একটি নিখোঁজ মেয়ের কাহিনি

ঠিকঠাক বলার জন্য আর একটু কাছে থাকার দরকার ছিল। মাঝে ঐ গাড়াটার জন্য তা সম্ভব নয়। স্থানীয় মুখে গাড়া, আসলে ছিল একটা খাঁড়ি। শোনা যায় একসময় নাকি কালিন্দ্রি নদী এই খাত দিয়েই বইত, তারপর লক গেট করে দেওয়ায় নদী আর নেই, শুধু খাতটা থেকে গেছে। এখন দূর থেকে দেখলে মজা লাগে।মানুষগুলি যেতে যেতে হঠাৎ হাপিশ, তারপর একটু বাদে হুশ করে ভেসে উঠল আবার। মানে ওই গর্তের মধ্যে নেমে আবার উঠে যাওয়া। গ্রামে ঢোকার মুখে এই গাড়া যেন মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে ওদের। মানে সবাইকে টাউনে যেতে নামতে হয়, আবার উঠতে হয়। গাঁয়ে ফেরার সময়ও তাই। জলের স্মৃতি শুধু ঝালিয়ে দেয় বর্ষার সময়। জল জমতে জমতে আস্ত একটা নদী হয়ে দাঁড়ায় যেন। সে-সময় রোডে যাওয়া খুব দিকদারি। এই গ্রামের মানুষ তা জানে। প্রথমে কয়েকদিন কাদা জল পার হয়ে, তারপর অঞ্চলের দেওয়া নৌকা। সেও তো আবার রমেশ ঘাটোয়ালের মর্জির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এই খাঁড়ি এ গাঁয়ের সাথে জুড়ে আছে। যে-কারণে মানুষ চট করে বেরোতে পারে না, মানে টাউনে যাওয়ার জন্যও একটা আলস্য ঝাড়তে হয়। আবার ওই গাড়াটার জন্যই সহজে পুলিসও ঢুকতে পারে না। অবশ্য পুলিস এসেছিল সেই কবে, যখন রাসু-র বাবার গলাকাটা শরীরটা সকালে ওর নিজেরই দাওয়ায় দেখেছিল সবাই। পুলিস কে সেই উত্তর দিকের নঘরিয়া গিয়ে তারপর পিছন দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল গ্রামে। তাও নেহাৎ ধুলা ছাড়া কিছু ছিল না, নইলে জলের সময় কাদাতেই আটকে যেত গাড়ির টায়ার। ঐ বিরক্তিতেই বুঝি পুলিস আর আসে না, গাঁয়ের বিচার গাঁয়েই করে নেয় মানুষ।

তা ওই গাড়াটার জন্যেই পদ্মর মাকে ঠিকঠাক ঠাহর করা যায়নি। শেষমেষ কতদূর যেতে পেরেছিল পদ্মর মা, তা নিয়ে কেউই তেমন নিশ্চিত নয়। তবে মন্ত্রীর কাছে যাওয়ার জন্য বাসে উঠতে পদ্মর মাকে দেখেছে এ-তল্লাটের বেশ কয়েকজন। “হামি কী কহ্যেছি তবে, পষ্ট দেখনু, পমিস এল, মেলাই ভিড়, তাও বুড়ি ঘুস্যে গেল”। মানে ওই ‘প্রমিস’ বাসের পা-দানিতে পা রাখা পর্যন্ত জামিলের স্বাক্ষ্যই প্রামাণ্য। তারপরে হেল্পার ছোঁড়া ওকে ভিতরে ঢুকিয়েছিল কিনা, বা কন্ডাক্টর বলেছিল কিনা পরের স্টপ নারায়ণপুরে জায়গা হবে, পদ্মর মা ওর ওই কাঁধের ঝাপসা ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিনা রড ধরে, না বসতে পেরেছিল সীটে— সেটা কেউ বলতে পারে না।

তবে তপনা, মানে সুধা মাস্টারের ছেলে তপোধন, বলেছিল, “পদ্মর মা বাসে একবার পা ঠেকাতে পারলে, বসার জায়গাও পেয়্যা লিবে।” তা এই ঢিমে আঁচের সাঁঝবেলাতে তপনার কথায় আপত্তি করার মতো কিছু খুঁজে পেল না গণেশের চাটাইয়ে বসা মানুষগুলি। আসলে পদ্মর মাকে যারা চেনে— অবশ্য পাঁচকড়িটোলার কেই-বা ওকে চেনে না—সবাই জানে, রিলিফের ত্রিপল হোক বা চিড়া-গুড়, বা হাজরা বাড়ির কালীপূজার ভোগের মাংস— পদ্মর মা কখনো খালি হাতে ফেরে না। তূণে বুড়ির নানান অস্ত্র। প্রথমে ছেঁড়া শাড়িটা আরও খানিক ছিঁড়ে নিয়ে কান্নাকাটি, চোখের জল এমনিই আসে, কাজ না হলে পদ্মর নামে মানত চড়ানোর অজুহাত এমনকী স্বপ্নে পাওয়া আদেশও আছে পদ্মর মায়ের ব্যাগে। যত সব ঢ্যামনামি! মেয়েমানুষরা গলতে পারে, ব্যাটাছেলেদের জানা আছে এ-সব নাটক। কেউ পাত্তা দেয় না। অবশ্য না দিয়েই-বা উপায় কী? এর পরেই তো রাখা আছে ওদের জন্য শাপশাপান্ত। লাইনে ওর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার বাপ ঠাকুর্দা যৌবনে ঠিক কী কী অনাচার করেছিল, বা কার বউয়ের স্বভাব কতটা খারাপ, ঠিক কতদিনের মধ্যে ওলাওঠা হয়ে মৃত্যু হবে তার— নাহ্, এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয় না পদ্মর মাকে।

তা এহেন পদ্মর মা ভিড় বাসে উঠে ঠিকই বসতে পারবে এ নিয়ে খুব সন্দেহ প্রকাশ করার লোক পাওয়া গেল না। কিন্তু সংশয়টা অন্য জায়গায়, ঠিক সংশয় না বরং ভরসা বালা যায়। সদার মুখের বিড়ির ধোঁয়ার সাথে সেটাই বেরিয়ে আসে, “গাঁয়ের মাতব্বরি কী আর সবখানে চলব্যে? মন্ত্রী কি আর গাঁয়ের সুবল মেম্বার যে গেনু আর সরসরিয়ে ঘুঁস্যে গেনু!” এমনিতে সদার কথায় সায় দেওয়ার লোক হাতে গোনা, কিন্তু এই কথাটায় নড়ে উঠল অনেকগুলো মাথাই। আসলে কেউই চায় না সত্যি মন্ত্রীর কাছে যাক পদ্মর মা। নিজের চোখে মন্ত্রী দেখার অভিজ্ঞতা এখানে কারোর নেই ঠিকই, কিন্তু সবজি নিয়ে শহরের রাস্তায় বিক্রি করা তারিকুলকে তো জানাতেই হবে টাউনের হালচাল সে অনেক জানে, “মনতিরির সাথে দেখা করব্যে! হুঁহ, কতটি পুলিস থাকে মনতিরি এল্যে, জানা আছে?” মাথাগুলি আবারও নড়ল খানিক। তাতে অবশ্য জানা আছে না নেই তা ঠিক বোঝা গেল না। এটাও তেমন নিশ্চিত নয় যে, পুলিস দেখে পদ্মর মা খানিক থমকাবে কিনা। “আরে পুলিসের কথা ছেড়্যাই দাও, দুই দিনের জন্য মনতিরি জেলায় পা দেছ্যে, তার কত কাম! এ-সব প্যাঁচাল শুনার সময় আছে? ডাকব্যেই না”, আফতাবের সারুভাই নাকি টাউনের এক নেতার গাড়ি চালিয়েছিল কয় মাস, ফলে আফতাবের মতামতকে ফেলে দেওয়া যায় না। সবাই বেশ ভরসা পেতে চায়।

বুড়িকে পছন্দ করে না কেউ। করবেই-বা কী করে? একা মেয়েছেলে, তবু একটুও সম্ভ্রম আছে কারো প্রতি? সে মেম্বার হোক আর মাস্টার, কাউকে রেয়াত করে না পদ্মর মা। ডিলার যে ডিলার, সবাই এত তোয়াজ করে, পদ্মর মা যেন খড়গহস্ত, “ক্যানে পাব না ডাল? চাল মেপ্যে দিবা, কহ্যে দিনু!” কেউই সাহস করে তর্ক জুড়তে পারে না পদ্ম’র মায়ের সাথে, ফের কী থেকে কী বেরিয়ে আসে! ভয় শুধু সেটাই নয়, আসলে এই নিস্তরঙ্গ গাঁয়ে শেষ যে-ঘটনা ঘটেছিল, সেটাও তো এই বুড়ির সাথেই। আর সেটা নিয়েই এবারে মন্ত্রীর কাছে দরবার করবে পদ্মর মা।

পদ্মর মা নাকি এমন ছিল না কয়েক বছর আগেও। গ্রামের বয়স্করা বলে। তারাও কেউ পদ্মর বাবাকে দেখেনি, তবে পদ্ম হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, যখন গাঁয়ের ইশকুলে যেত ও, জামাটা অত টাইট হয়নি, তখনও নাকি ওর মা মেয়ের জন্য দুধ চাইতে যেত ঘোষেদের বাড়ি মাথায় ঘোমটা দিয়েই। কেউ কেউ মুখ ঝামটা দিয়েও নাকি পার পেয়ে যেত। যেটুকু গালিগালাজ তা বরাদ্দ থাকত তা ওই পদ্ম আর ওর মরে যাওয়া বাবার জন্য। মেয়েকে নিয়ে কীভাবে চলতো পদ্মর মায়ের তা অবশ্য কেউ হলফ করে বলতে পারে না। চার কুড়ি পার করে দেওয়া হারানের ঠাকুমা বা সুকেশ জ্যাঠাও না— চলে যেত আরকী! দিন তো আর থেমে থাকে না, চলেই! কিন্তু এখন চাটাইয়ে বসা লোকগুলোর এ-সব কথা শুধুই শোনা। ওরা জানে পদ্ম যখন ইশকুল থেকে ফিরত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত পদ্মর মা, কোনো চিল শকুন যেন ভিড়তে না পারে। শুধু কি তাই, ছুটি হতে দেরি হলে সটান ইশকুলে গিয়ে হাজির হয় পদ্মর মা, “মিয়াছেল্যাদের ছেড়্যে দাও মাস্টার!” সব মেয়েদের কথা মুখেই বলা, আসলে পদ্মকে ছেড়ে দিক। সাধন-নিত্যদের স্পষ্ট মনে আছে, মাথায় প্রায় তাদের ছুঁয়ে ফেলা পদ্ম লজ্জা পেত।

সেবারের বৃষ্টিটাই সব ওলটপালট করে দিল মা-মেয়ের জীবনে। মণ্ডলবাড়ির ছাগল নিয়ে চড়াতে গেছিল পদ্মর মা, রোজকার মতোই। ফিরেও আসত ঠিক সময়েই মানে পদ্মর ইশকুল থেকে ফেরার আগেই, কিন্তু বৃষ্টিটাই সব ভণ্ডুল করে দিল। গাঁয়ের মাথায় পাকুড় গাছের তলায় ছাগল নিয়ে দাঁড়ানো পদ্মর মাকে নাকি বাড়ি ফেরতা অনেকেই দেখেছিল। তবে কিছু কথা হয়নি, ওই বৃষ্টির মধ্যে কী কথাই-বা হবে, সবার তো ঘরে ফেরার তাড়া। বৃষ্টি একটু ধরলে, মণ্ডলবাড়ি ছাগল ঢুকিয়ে, কাঁঠাল পাতা বাবুদের মুখের কাছে ধরে ফিরতে ফিরতে প্রায় অন্ধকার। গাঁয়ের সব পথ মুখস্থ, অন্ধকারে যা কিছু নিয়ে গাঁয়ের মানুষ ভয় পায়, তারা অবশ্য তখনও পদ্মর মাকেই ভয় পেত। তাই ঘরে ফিরতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ঐ অন্ধকারে চোখে খানিক ঘোলা লেগেছিল বটেই। নইলে দাওয়ায় রাখা ডালের বড়ি যে ঘরে তোলা হয়নি, সে কি আর নজরে পড়ত না? পদ্ম আর তার মরা বাপের পূর্বপুরুষরা কি আর ছাড় পেত সেই সন্ধ্যায়?

ঘরে কুপি জ্বলেনি, সেটা টের পেয়েছিল পদ্মর মা। আর টের পেতেই “ক্যারে পদ্ম, কোন নাগরের জন্য ঘর আন্ধার কর‍্যে…?” বলে সম্ভাষণটা করতেই যাবে, কিন্তু গলাটা যেন তার আগেই চেপে ধরল কেউ। মনের ভিতর কু গাইল কেউ। শুধু ডেকে উঠতে পেরেছিল “পদ্ম…”। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক নরম ছিল সেই ডাক, পদ্মর শুনতে পাওয়ার কথা নয়, কেউই শুনতে পায়নি। কিন্তু পদ্মর মা নিজের বুকে নিজের ডাক শুনেছিল বার বার। সাড়া পায়নি।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর কাদা রাস্তায় ছপছপ করে পায়ের শব্দ শোনা গেছিল, বাড়ি ফিরেছিল আটকে থাকা মানুষ। বৃষ্টি থেমে গেলে মেঘগুলোর বড়ো গায়ে লাগে, ক্ষোভে গড়গড় করতে থাকে, ওই শব্দেই বোধহয় বড়ো মৌলবীর আজানের আওয়াজ শোনা যায়নি এ-পাড়া থেকে, তবে শাঁখের শব্দ শুনেছিল এই হাজরাপাড়ার মানুষ। শুধু পদ্মর মা যে-আওয়াজটা শুনতে চাইছিল, তা শোনা গেল না কিছুতেই। ঘরের ভিতর থেকে না, পিছনের জঙ্গল থেকে না, পায়ের সাথে লেপ্টে যাওয়া কাদার থেকে, পাকুড় গাছের ভেজা শরীর— পদ্মর গলাটা শোনা গেল না কোথাও।

গাঁয়ের মানুষ অবশ্য সেই জল কাদা ভেঙেও বেরিয়েছিল, খোঁজাখুঁজি করেছিল এদিক সেদিক। আর পদ্মর মায়ের সাথে হ্যারিকেন নিয়ে গেছিল ঠিক ছয়জন। খোঁজাখুঁজির ফাঁকে সবার মুখেই এসেছিল মেয়ের চালচলনের কথা। ঢলানি স্বভাবের কথা বলেছিল। বলেনি আরও অনেক কিছু, পদ্মর ময়লা জামার নীচে এর মধ্যেই উঁচু হয়ে যাওয়া বুকের কথা বলেনি, গায়ের সাথে সেঁটে যাওয়া ভেজা জামার নীচে খাঁজের কথা বলেনি, বেটি বলে ডেকে গায়ে হাত বোলানোর কথা বলেনি, পদ্মর সিঁটিয়ে যাওয়ার কথা— নাহ্, ভেবেছিল শুধু, মুখে বলেনি। জঙ্গলে, ঝোপের আড়ালে খুঁজছিল পদ্মকে, ওর বেমক্কা বেড়ে যাওয়া শরীরটাকে। খুঁজতে খুঁজতে গাড়ার কিনার অবধি এসে থমকে যায় সবাই। তখন অনেক জল। অবশ্য ডিঙিটা বাঁধাই ছিল ঘাটে। রমেশ ঘাটোয়ালকে বললে সে কি আর নফরকে ডিঙি খুলতে দিত না? কিন্তু কেউ আর সাহস করেনি। পদ্মর মা নিজেও কেমন থম্ মেরেছিল, হাঁটছিল খানিক ঘোর লাগা মানুষের মতো। আর মেয়েকে ডাকছে না, ওর হয়ে পদ্মর নাম ধরে ডাকার দায়িত্ব তখন ওই ছয়জনের। ডাকের তেমন জোর ছিল কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। কালকেও নিজের বউয়ের পাশে রাতে শোয়ার সময় কতজন পদ্মর ডবকা শরীরটাকে ভেবেছে, সেটাও যেমন জানা যায়নি।

শোনা যায় ঠিক তখনই নাকি ওই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটেছিল। ঘোরের মধ্যে চলতে চলতে গাড়ার কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পদ্মর মা, আর সবার মতোই। দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে। হ্যারিকেনের আলোয় কয়েকজন দেখার চেষ্টাও করেছিল জলে কিছু ভাসতে দেখা যাচ্ছে কিনা। মানে পদ্মর ডবকা শরীরটা, উঁচু হয়ে ওঠা প্রাণপণ লুকিয়ে রাখা বুকদুটো, পায়ের উপর থেকে অনেকটা সরে যাওয়া ফ্রক— উঁকি মেরেছিল সবাই। আর ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পদ্মর মা। স্থির চোখে তাকিয়েছিল মানুষগুলোর দিকে। কেমন ছিল সেই চোখ, তা কেউ পরে বর্ণনা করেনি, তবে সেই দৃষ্টিতে নাকি এমন কিছু ছিল, যা মুহূর্তে স্থবির করে দেয় সবাইকে। সবার পা আটকে গেছিল মাটিতে, কিছুক্ষণ নড়তে পারেনি কেউ।

সব ঘোরই কেটে যায়। বাড়িও ফিরেছিল সবাই। কিন্তু ফেরার পথে কেউ কোনো কথা বলেনি। পদ্মর মাকে নিয়ে নয়, পদ্মর স্বভাব চরিত্র নিয়েও নয়। এমনকী নিজেদের মধ্যেও কথা বলেনি কেউ। সেদিন গাড়ার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলির স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিল। না, স্বাভাবিক বলতে যা বোঝায়, তা ওরা হতে পারেনি। ঘরের বউরা জানে, তাদের মরদরা সেই রাত থেকেই আর স্বাভাবিক হয়নি। সে-জন্য তারা পদ্মর মাকে দায়ী করে কিনা জানা না গেলেও, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই পদ্মর মা যে একা হয়ে গেল তা সবাই জানে। গাঁয়ের বাকি লোক যে কেউ পরদিন সকাল থেকে পদ্মকে খুঁজতে যায়নি, সেটার পিছনে ছিল ওই দৃষ্টিটা। সেই আবছা অন্ধকারে চোখ দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তবু ছয়জনই নাকি দেখেছিল পদ্মর মায়ের সেই ঘোলাটে চোখদুটো কী এক আশ্চর্য রং নিয়েছিল সেই রাতে!

কেউ আসেনি, কাউকে ডাকেওনি। কিন্তু সেই রাত থেকে যে-খোঁজটা শুরু হয়েছিল, সেটা থামেনি আজও। গ্রামের মানুষ জানে। এত বছর পরেও কোন মুলুকে কোন নতুন গুরুদেব এসেছেন, কে শুধু মায়ের কপাল দেখেই বলে দেবে মেয়ে কোথায়, কোন থানে মানত করলে নির্ঘাৎ ফল— পদ্মর মায়ের বিরাম নেই। থানা পুলিস তো সেই কবেই শেষ, আর যায় না। গ্রামে না আসার নানান অজুহাত দিয়েছিল পুলিস। টাউনের থানায় কোন পুলিস নাকি পদ্মর স্বভাব নিয়ে খারাপ ইঙ্গিত করেছিল, পদ্মর মা থানায় বসেই সেই ‘আবাগির ব্যাটা’-র বাপ মায়ের ঠিকুজি কুষ্ঠি খুলে বসে। পুলিসের আশা ছেড়ে দিতে হল, কিন্তু খোঁজ থামল না বুড়ির। গাঁয়ের মানুষের বাপ-বাপান্ত করা সেই যে শুরু হল, খোঁজ পাওয়ার নামে কত-না মুল্লুক ঘুরে বেড়ায় আজও। কোন কোন থানে যে মানত করেছিল বুড়ি, নিজেরও মনে নেই আর।

বছরের চাকা তো একবার ঘুরে থামে না, ঘুরেই চলে। সেই রাতে পদ্মকে খুঁজতে যাওয়া মানুষগুলির গায়ের চামড়া কুঁচকে আসে, কেউ কেউ মায়া কাটিয়েও ফেলে বউ বাচ্চা সংসার, গ্রাম— সব কিছুর। এত বছরে আর কেউ সেই রাতের কথা তোলেনি। ঝাপসা হয়ে এসেছে স্মৃতি। বগলের কাছে সেপ্টিপিন লাগানো ফ্রকে পদ্মর মুখ-চোখ সব আবছা হয়ে যায় সবার কাছে, উঁচু হয়ে ওঠা বুকদুটোও। শুধু পদ্মর মা এখনও খোঁজে, মাঝে মাঝে গ্রামের বাইরে যায় কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে, দুই তিনদিন দেখা যায় না। তারপরে একদিন আবার ভুস করে জেগে ওঠে গাড়ার ভিতর থেকে।

সেই বর্ষার পরে অনেকগুলি হা-ঘরে গ্রীষ্ম গেছে, গাড়ার জল শুকিয়ে নীচের ফাটা চামড়া বেরিয়েছে কতবার, সেই শুকনো গর্তে বাচ্চারা খেলার সময় লুকিয়েছেও কত! আবার ভরেও গেছে জলে। থইথই নৌকা। দু-একটা সরপুঁটি ছাড়া ভরা বর্ষাতেও কিছু দেয় না গাড়া। তবু পদ্মর মা ঘুরেফিরেই দোষ দিত এই গাড়াকে। আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকাত গাঁয়ের ব্যাটাছেলেদের দিকে। যেন ভেতরটা পড়ে ফেলতে চায়। দেখে নিতে চায় পদ্মর শরীরের একটুও দেখা যাচ্ছে কিনা কারো বুকের ভিতর।

নাহ্, পদ্মকে কে খেয়েছে তা এখনও বলেনি বুড়ি, কিন্তু পদ্ম হারিয়ে যাওয়ার পরে কথা ফোটা ছেলেরাও মাঝে মাঝে নিজেদের দায়ি ভাবে ওই না দেখা বৃষ্টির রাতটার জন্য।

আধন্যাংটো বাচ্চার দল অবশ্য কোনোদিনই নিয়ম মানেনি, আর তাদের হিংস্রতারও কোনো পরিসীমা নেই। মাঝে মাঝে পিছনে ধাওয়া করে বুড়িকে ক্ষেপাত, ক্ষেপানো খুব সোজা, শুধু পদ্মর নাম বলতে হয়, আর তাতেই বুড়ি শাপশাপান্ত করে বাচ্চাদের বাপ-ঠাকুর্দা-সহ কয়েক প্রজন্মকে। তবে বেশিক্ষণ চলে না এই গালিবর্ষণ। বড়োরা দেখতে পেলে শাসন করে শিশুদের, ধমক দিয়ে নিয়ে যায় ঘরে। নিজের মনেই কথা বলতে বলতে একসময় শান্ত হয় পদ্মর মা।

এ-মুলুক সে-মুলুক ঘুরতে ঘুরতেই সেদিন খবর নিয়ে এল টাউনে মন্ত্রী আসবে। আসছে সোমবারের পরের সোমবার। গাঁয়ের কেউ জানে না। এমনকী সুবল মেম্বারও না। জানার কথাও না। মেম্বার শুধু মাঝে সাজে ঐ নঘরিয়া অঞ্চল অফিসে যায়। কিন্তু পদ্মর মা যাবে। দেখা করবে মন্ত্রীর সাথে। এ-সব কথা কেউ জিজ্ঞেস করে নি, বুড়ি নিজে থেকেই বলেছিল। রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে বলেছে, পুকুরে চান করতে গিয়ে বলেছে। সবাই জেনেছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি, কী জিজ্ঞেস করবে মন্ত্রীকে। শুধুই কি পদ্মর খোঁজ নেবে না আরও কিছু নালিশ আছে গাঁয়ের লোকের বিরুদ্ধে। আর এত বছর পরে পদ্মকে পাওয়া গেলেও, ওকে চিনতে পারবে কেউ? গ্রামের কেউ প্রশ্ন করেনি, আসলে মন্ত্রী মানে কী ওরা জানে না কেউ। পুরোনো মানুষগুলি নেই, কিন্তু পুরোনো ভয়টা যেন ফিরে এসেছিল মন্ত্রীর নাম শুনে।

সন্ধ্যা আরও জাঁকিয়ে বসছে গ্রামের পশ্চিম কোণের আমগাছটার মাথায়।সাধন-তারিকুল-সদারা নিজেদের মধ্যে যে-কথাগুলো দিনের আলোয় বলাবলি করে—যেমন এ-বছর আমের ফলন, মাটি কাটার কাজ— এখন সেগুলো নেই। এই চাটাইয়ের আলাপ থাকে মেয়েছেলে আর গোপন ইচ্ছেগুলি নিয়ে। নিজেদের ঘরের পানসে বিবিদের কথা তুলতে চায় না কেউ। “মণ্ডলের ছোটোবিবির রস হয়েছ্যে খুব। মরদটা তো বিদেশ, ঝরাব্যি নাকি সদা?”, খ্যাক খ্যাক করে হাসে সবাই। মতিন মিয়াঁর বেওয়া বিটি বাচ্চাটাকে নিয়ে বাপের ঘরেই থাকে। সাধন নাকি নিজে চোখে দেখেছে কার্তিক গয়লার সাথে গুজুরগুজুর করে। “ক্যানে বে, গেরামে কি আমরা নাই? চান্স দিয়্যাই দেখুক না একবার!”, আবার হাসি। ক্রমশ গভীর হয় গলা।

টিনের মগ থেকে খুড়িতে ঢেলে দিচ্ছে গণেশ, “জামিলচাচা তোমার তিন খুড়ির দাম বাকী আছে কিন্তু!”— আব্বে, পেয়ে যাব্যি, হামি কি ভেগ্যে গেনুৈ ঠিকই তো, গনেশ ছাড়া সবাই মাথা নাড়ে। আর গনেশও জানে, এখন বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বলতে নেই যে, এই এক কথা কতদিন ধরে শোনাচ্ছে জামিল। সকালেই চেয়ে চিনতে নিতে হবে। সবটাই যে পাওয়া যায় তা নয়, তবে খানিক লস ধরেই এ-ব্যাবসায় নামতে হয়। সম্পর্ক ভালো রাখা বেশি জরুরি। এই যেমন জামিলের ভাইই তো রেশনের চালটা জোগাড় করে দেয়!হিসাব কি আর গণেশ জানে না, এতদিন ধরে এ-লাইনে আছে! কাচের গেলাস তো কবেই বাদ দিয়েছে, এখন মাটির খুড়ি। প্রথম প্রথম আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু তারপর তো অভ্যাসও হয়ে গেল সবার। “হ্যাঁ রে গণশা, এত ফিকা লাগছে ক্যানে? দুইটা টেনেও নেশাই জমে না”, সাধনের কথায় হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই— “ঠিক ঠিক, একবারে ধক নাই। ফিকা!” গণেশ জানে এখন চুপ করে থাকতে হয়, প্রায় রোজই এই সময়টা এমন কথা ওঠে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারা সবাই বলবে, “নেশাই হল না” আর পরদিন সন্ধ্যা লাগতেই আবার এসে ভিড় করবে।

এতক্ষণ ধরে কেউ অবশ্য পদ্মর মাকে নিয়ে আর রা করেনি। বুড়ি যে মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাবে না, সেই বিশ্বাসটা অনেকটাই ঘন এখন। হেজে যাওয়া শরীরগুলোর উপর পড়ে থাকা ছেঁড়া কাঁথার মতো অন্ধকার নেমে এসেছে।

দূরে বড়ো রাস্তাটা দেখা যায়। ওখানে আলো আছে। মাঝে মাঝে এক-আধটা গাড়ি দাঁড়ায়, কাউকে নামিয়ে দিয়ে যায়। অবশ্য সন্ধ্যার পরে এই স্ট্যান্ডে নামার লোক প্রায় থাকেই না।

— “ক র‍্যে জগা, উঠব্যি না?”— হ্যাঁ রে এই তো এইটা মেরেই উঠি। অবশ্য দু-জনের কারো মধ্যেই ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। গণেশ জানে, এখন তিন চার বিড়ি ধরে চলবে এই উঠি উঠি খেলা, চাটাই খালি হতে হতে পিছলি বিলে শেয়ালের ডাক।

শেষমেষ ঘরের দিকে রওনা দেয় সবাই। গণেশের চট খালি হল। এদিকে আলো নেই, তাতে অবশ্য বয়েই গেছে ওদের। সদারা সবাই গন্তব্য জানে। ঘরে কুপি জ্বালিয়ে বসে আছে বউ, ভাতের মতো ঠান্ডা। জড়ানো গলায় আফতাব ধরে, “বলম পিচকারি যো তুনে মুঝে মারি…” টাউনের হলে হিন্দি বই দেখার নেশা আছে ওর। পা খুব সোজা পড়ছে না কারো। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই। মুখস্থ এই গাঁয়ের রাস্তা। ঐ সামনের পাকুড় গাছটা থেকে তারিকুলরা উত্তর দিকে চলে যাবে। এদিকে বাড়ি ঘর খুব বেশি নাই। মাঠের মধ্যে দিয়েই আসছিল সবাই এতক্ষণ। শর্টকাট। এবার রাস্তায় উঠবে। রাস্তায় উঠেই কচুর ঝোপের এই জায়গাটায় এসেই সবার একসাথে পেচ্ছাপ পায়… ছড়ছড়…। ছোটোবেলার কাটাকুটি খেলার কথা তোলে সাধন, একসাথে হেসে ওঠে সবাই। “তোর অজগর তো একবারে ঢোঁড়্যা হয়্যে আছে বে, ঝিম ধরা, মুত ছাড়া আর কিছু নাই”, আবার খ্যাকখ্যাক হাসি। ফিকে চাঁদ আকাশে, কোনো শব্দ নেই কোথাও। মুখ দেখা যাচ্ছে না কারো, একটা ছায়া। দূর থেকে রোডে এখনও দু-একটা আলো দেখা যাচ্ছে, আসলে শহরের ঘড়িতে এখনও সন্ধ্যা, গ্রামেই রাত। কেউ আর বাড়ির বাইরে নেই। অনেকের এতক্ষণে একঘুম সারা।

গণশের ঘর থেকে ফেরা ওদের মনে অবশ্য রঙের কমতি নেই। “আফতাবের ঘোড়া পুরা রেডি, বিবিকে নিদ পারতে দিব্যে না”, আবার হাসি। “আব্বে ছাড়, সেই ধক নাই আর বিবির। পদ্মর মতো ডাঁশা মাল কি আর আমাদের নসিবে জুটবে?” সেই পদ্ম চলে এল আবার। কেউ দেখেনি, তবু আসে। ওই বুক, থাই, শরীরের খাঁজ সব আসে ওদের চোখে। অনেকদিন আগে দেখা, বা না দেখা, শরীরটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ওদের। দিনের আলোয় আসে না, আসতে দেয় না, কিন্তু রাতের এই ছমছমে আবছা অন্ধকারে এসে ঘাই মারে বুকের ভিতর। “গেরামে আর তেমন মাগী কোথায়?” আর্তনাদের মতো শোনায় জগার গলা। কী একটা উড়ে গেল পাকুড় গাছটা থেকে। রাতজাগা কোনো বাদুড় হবে বোধহয়। কেমন শিরশির করে ওঠে সবার। এতক্ষণের খুশি ভাবটা হঠাৎ উধাও। চুপ করে গেছে সবাই। মুখে কিছু বলে না কেউ, কিন্তু ঘরের রাস্তাটা আজকে যেন বেশিই লাগছে, কীভাবে যেন পায়ে জোর আনার চেষ্টা করে সবাই। ঝিঁঝির ডাক আরও জোরে বাজছে কানে।

— “আব্বে, সদা… কে ব্যে ওটা?”— সাধনের জড়ানো গলাতেও কী যেন ছিল। শুধু ওর হাত অনুসরণ করেই সবার চোখ আটকে গেল সামনে। গাড়া থেকে উঠে আসছে একটা শাড়ি পড়া শরীর, কাঁধে ব্যাগ। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বলতে হবে না ওটা কে। উঠে আসছে, যেমন করে হাঁটে। ঘাড় তেড়িয়ে একবগ্গা। কাছে আসছে ক্রমশ। দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই, কেউ আর এগোতে পারছে না। চোখটায় নজর আটকেছিল সবারই। একটা অদ্ভুত রং, এই দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। সদা’র পা’টা বোধহয় আটকে গেল। সারাদিনের ভ্যাপসা গরম ভাবটা আর নেই। কেমন একটু শীত শীত করছে। আফতাব-তারিকুল কেউ কারো দিকে তাকায়নি, নইলে দেখতে পেত, মাটিতে পা বসে গেছে সবারই। বুকের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। সাধনের জিভে নোনতা স্বাদ, বমি হওয়ার আগে যেমন হয়। এগিয়ে আসছে ওই মূর্তিটা গ্রামের দিকে, ওদের দিকে। সদারা এই রাতে ছয়জন, হাতে লণ্ঠন নেই শুধু…।

Categories
2021-June-Golpo গল্প

দেবকুমার সোম

প্রতিটা খুনই আসলে রাজনৈতিক

হোম মিনিস্টারের মোবাইল ফোনটা কাকে ডাকাতি করেছে। রোববার সকাল। শীতরোদের আমেজ নিতে ব্যালকনিতে নিউজপেপার আর গরম চা নিয়ে মন্ত্রীমশাই বসেছিলেন। পাশেই ছিল অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ব্যালকনির গ্রিল ছিল খোলা। তিনতলার ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের ব্যালকনি ঘোঁষে দাঁড়িয়ে আছে পাশের আবাসনের নধর নারকোলগাছ। মন্ত্রীর মন ছিল কাগজ আর চায়ে। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে ধাঁ করে নারকোলগাছ থেকে উড়ে এসে কাকটা মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে গেল। গেল, গেল, গেল। ধর, ধর। হোম মিনিস্টার চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর তীব্র চিংকারে ভয় পেয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন তাঁর গিন্নি। ছেলেটা তখনও বিছানায় ল্যাদ খাচ্ছিল। সেও তড়াক লাফিয়ে এক ছুটে ব্যালকনিতে। মন্ত্রীর বউমা মনযোগ দিয়ে হাতে নেলপলিশ লাগাচ্ছিল। শ্বশুরের আর্তস্বরে তার হাত থেকে নেলপলিশের শিশিখানা পড়ে গেল। সে সোফা থেকে ঘাড়টা জিরাফের মতো দীর্ঘ করে একবার বোঝার চেষ্টা করল। মন্ত্রীর পাঁচ বছর বয়সের নাতি,— সেও ছুটে এল বাথরুম থেকে হেগো পোঁদে।

সকলেরই চোখ গোল গোল। মাগো! এও কি কেউ কখনো শুনেছে? কাকে চামচ চুরি করে, ছুরি চুরি করে, তা বলে মোবাইল! তুমি এত বেখেয়ালে থাকো কী করে? তোমার চোখের সামনে থেকে কাকটা মোবাইলটা তুলে নিয়ে গেল। মন্ত্রীর বউ আর পাঁচজন বাঙালি বউ থেকে পৃথক নন।

আর নিল তো নিল, একেবারে ধাঁ। বাবা, ইউ আর নো মোর আ সাধারণ পারসেন। তুমি এখন হোম মিনিস্টার।

তাহলে বল এখন লোকের কাছে মুখ দেখানো যাবে? ছেলের কথায় মা জনসমর্থন পান।

মন্ত্রীমশাইয়ের বিরক্ত বোধ হয়। মালটা চুরি হয়ে গেল, আর তোমরা দাঁত ক্যালাচ্ছ! তাঁর মাথা ঠিক থাকে না। আর থাকবেই-বা কী করে? ফোনের মধ্যে কত কী যে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে রাজ্যের সব নেতা-নেত্রীদের গোপন হোয়াট্সঅ্যাপ। শিঞ্জিনির কিছু হট ছবি। পানু ভিডিয়ো। অনেকগুলো গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেইল্স। সবচেয়ে বড়ো কথা ডকুমেন্ট। প্রচুর ডকুমেন্ট। হায় হায় কারো হাতে পড়লে কী হবে। দাদু, তুমি তো পুলিশ মন্ত্রী। গুলি ছুড়তে পারলে না: নাতিটা মন্ত্রীমশাইয়ের হাত ধরে টান দেয়। বউমা, ও বউমা, দেখছ না তাতান হেগো পৌঁদে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ছুচিয়ে দাও। মন্ত্রীগিন্নি চিল্লে ওঠেন।

কাকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। নারকোলগাছের লম্বা লম্বা পাতার মধ্যে ওর বাসা। সেখানে সেঁদিয়ে গেছে। মন্ত্রীমশাইয়ের ছেলে তার ফোন থেকে ফোন করে। মন্ত্রীর ফোনটা বেজে যায়। ওঁ জয় জগদীশো হরে। সোয়ামি জয় জগদীশো হরে। ওঁ জয় জগদীশো হরে। ব্যালকনি থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ফোনের চিৎকারে কাকটা তার পাতাঘেরা বাসার বাইরে আসে।

ওই তো। ওই তো হারামজাদাটা। নামা মালটাকে। হোম মিনিস্টার খেঁকিয়ে ওঠেন।

কিন্তু কে নামাবে? কাকে নামাবে?

তখনই চাঁদুদাকে বলেছিলাম, ও-সব নারকোলগাছ-টাছ হাটাও। তুমি তখন শুনলে না আমার কথা। এবার বোঝো। ছেলে সুযোগ পেয়ে পুরোনো ঝাল ঝাড়ে।

হ্যাঁরে হারামজাদা। তোর চাঁদুদা ফ্ল্যাট তৈরি করতে গিয়ে পাশের বাড়ির নারকোলগাছটা কাটত আর গাছ খুন করার দায়ে আমার পোলিটিক্যাল কেরিয়ারটা মায়ের ভোগে যেত। এই যে ঘরে বসে বেকার ফুটুনি ঝাড়িস, তখন পারতিস ম্যাও সামলাতে। শালা, ছেলে না অপজিশন পার্টির লোক। দাদু, ওই কাকটাকে চিনতে পেরেছ? তাতানের ফের মঞ্চে প্রবেশ। গত মাসে ওর বাসাটাতেই আমরা গুলতি মেরেছিলাম।

কাকপরিবারের সঙ্গে হোম মিনিস্টারের ঝামেলা নতুন নয়। এখন যেখানে আবাসনটা দাঁড়িয়ে আছে একসময় সেখানে পুকুর ছিল। পুকুর পাড়েই অন্য গাছেদের মধ্যে ছিল এই নারকোলগাছটা। প্রমোটার চাঁদুদা রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে ক্রমে পুকুর ভরাট করে বিল্ডিং তোলেন। হোম মিনিস্টার প্রায় জলের দামে বারোশো স্কোয়ার ফুটের একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যান। কিন্তু তাঁর পড়শি থেকে যায় নারকোলগাছসমেত কাক পরিবার। অনুমান এই কাক পরিবারটা উদ্বাস্তু নয়। আর তারা উদ্বাস্তু হতেও চায় না। ফলে প্রথম থেকেই দু-তরফেই আকচা-আকচি শুরু হয়। মানুষগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসায় শুরু হয় অন্তর্ঘাত। মন্ত্রীমশাইয়ের স্ত্রী ব্যালকনিতে ফুলের টব রাখলে কাকগুলো বিনা প্ররোচনায় উড়ে এসে ফুল ছিঁড়ে নষ্ট করে। রোদে বাসন শুকাতে দিলে চামচ-ছুরি উধাও করে দেয়। কাকের জ্বালাতন থেকে বাঁচতে ব্যালকনিতে লোহার গ্রিল লাগানো হল। ফলে কাকেরা সপরিবারে চিৎকার আর লাফান-ঝাপান শুরু করে দিল। সুযোগ পেলেই চোরাগোপ্তা গেরিলা ফাইট চলতেই থাকল। ফলে দাদু আর নাতি শঠ করে একদিন একটা গুলতি জোগাড় করলেন। ছাদে উঠে এলোপাথাড়ি গুলতি চালিয়ে কাকের কিছু ডিমও ভাঙলেন। এমন রাষ্ট্রবাদী প্রতিঘাতে কাকেরা মুষড়ে পড়েছিল। আজ আবার বেশ কিছুদিন পরে চরম আঘাত।

হোম মিনিস্টারের চিৎকার-চেঁচামিচিতে তাঁর দেহরক্ষীরা ফ্ল্যাটে চলে এল। মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, একটা লোক জোগাড় করতে যে কিনা ভালো গাছি। সে নারকোলগাছে উঠে মোবাইলটা কাকের বাসা থেকে উদ্ধার করে আনবে। কিন্তু শহরে হুট বলতে গাছি পাওয়া যাবে কোথায়? খবর ছুটল ওলা-উবেরের বেগে। শেষে লোকাল থানার বড়োবাবু একটা ক্ষীণজীবী লোককে ধরে নিয়ে এলেন। একে কোথ থেকে পাকড়াও করলেন। মন্ত্রী বেশ অবাক।

আর বলবেন না ছ্যার। থানার লক্-আপে ছিল। ছিঁচকে মাল। তবে ভালো গাছি। বড়োবাবু বুক ফুলিয়ে জবাব দেন। এই কেষ্টা এই নারকোলগাছটার মগডালে উঠে ছ্যারের মোবাইলটা ফিরিয়ে আন।

দেখিস বাবা, সাবধান। কাকগুলো বড়ো খচ্চর। হোম মিনিস্টারের সাবধান বাণী। তবে গাছি লোকটা যতই করিৎকর্মা হোক, কাকের সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাকে গাছে উঠতে দেখে প্রথমেই তারা পিরিচ-পিরিচ করে ও ছড়াতে লাগল। লোকটার খালি গায়ে সাদা সাদাটে-হলদে গুয়ে ভরতি হয়ে গেল। লোকটা তবুও অদম্য। তাকে কাছাকাছি উঠে আসতে দেখে কাক পরিবার সাঁ করে নীচে নেমে লোকটার চোখ খুবলে নিতে চাইল। পিঠে নখের আঁচড়ে রক্ত বইয়ে দিল। লোকটা দক্ষ। কিন্তু এমন গেরিলা ফাইটে সে দিশেহারা হয়ে ওপর থেকে ঝুনো নারকোলের মতো ধপ্ করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ফলে ফের আর একটা কেলেঙ্কারি। মিডিয়া জানলেই চিত্তির!

ঘণ্টা খানেক ভালো মতো শুশ্রূষা করার পরে লোকটাকে ফের লক্-আপে চালান দেওয়া গেল। পার্টির ছেলেরা এর মধ্যে খবর পেয়ে গেছে। তারা দল বেঁধে এসে নারকোলগাছটাকে গোড়া থেকে বাঁকাতে লাগল। উদ্দেশ্য ঝাঁকুনির চোটে যদি ফোনটা নীচে পড়ে।

শালা, গান্ডু আর কাকে বলে। রাগে ফেটে পড়েন হোম মিনিস্টার। ওরে শুয়োরগুলোকে কেউ বোঝাও অত ওপর থেকে পড়লে আমার ফোনটার আর কিছু থাকবে না।

দাদা, ফায়ার বিগ্রেড ডাকব? পার্টির তরুণ-তুর্কি নেতা কানের কাছে ফিশফিশ করে।

কেন ভাই! হোম মিনিস্টার ঘাবড়ে যান। আমার পোঁদে কি আগুন লেগেছে? না, ছোটোবেলায় টিনটিন কমিক্সে পড়েছিলাম, কুট্টুস এমন তিনতলায় আটকে যেতে ফায়ার বিগ্রেড এসে তাকে উদ্ধার করে। আমাদের কুটুস নেই, মোবাইল আছে।

এই কে আছিস, এই আঁতেলটাকে হাটা তো এখান থেকে।

দেখতে দেখতে সূর্য মাথার ওপরে উঠতে থাকে। নারকোলগাছের ছায়াও ক্রমে ছোটো, আরও ছোটো। কাকগুলো মোবাইল পাহারা দিচ্ছে। বাসা ছেড়ে নড়ার নাম নেই।

স্যার, আমি একটা ডিভাইস ইনভেন্ট করেছি। মন্ত্রীর সেক্রেটারি আই.এ.এস. বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস ছাত্র ছিলেন। হোম মিনিস্টারের পড়াশুনো খুব বেশি দূর নয়। ফলে লোকটাকে এড়িয়ে চলতেই তিনি পছন্দ করেন। তবুও সেক্রেটারির কথায় তাঁর চোখ চিক্ চিক্ করে ওঠে।

ডিভাইসটা আর কিছুই নয়, দুটো লম্বা বাঁশকে পরপর দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। তার এক মাথায় বেশ বড়ো একটা মেটালের আঁকশি। অনেকটা মানুষের পাঁচ আঙুলের থাবার মতো। কৌশল হল, বাঁশটা নারকোলগাছে কাকেদের বাসা বরাবর নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর আঁকশি দিয়ে সম্পূর্ণ বাসাটা তুলে আনা হবে।

পরিকল্পনা দেখে সকলেই ফের উৎসাহী হয়ে ওঠে। প্রথমে ছাদ থেকে। তারপর বারান্দা থেকে অনেকবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় দুটো বাঁশ জোড় দিয়েও কাকের বাসার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সাকুল্যে পাঁচটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাঁশ বাঁধা হয়। তারপর কাকের বাসা অবধি যখন আঁকশি পৌঁছাল, ততক্ষণে মড় মড় শব্দ উঠেছে। বাঁশের বাঁধন পলকা হয়ে গেছে। সেক্রেটারি আই.এ.এস. ফলে ফের তিনি ত্রুটিগুলো ঠিক করলেন। আবার আঁকশি ওঠানো গেল। কিন্তু এতদূর থেকে আঁকশিতে বাসা তুলে আনা গেল না।

শালা বিজ্ঞানের ব জানে না বালের সেক্রেটারি হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা পেছন থেকে ফুট কাটে। ডাইনামিক্স পড়েছে! পলিটিক্যাল সায়েন্স আর ফিজিক্স এক হল!

মরার আগেই যার মড়ার খবর করে দেয়, সেই মিডিয়াকূল এর মধ্যে এসে হাজির। আজ বিকেলে হোম মিনিস্টারের একটা প্রেস কনফারেন্স রয়েছে। গত পরশু পুরুলিয়ায় ফসলের দাম না পাওয়া চাষিরা হাই-ওয়ে আটকালে পুলিশের গুলিতে তিনজন মারা যায়। বিরোধীরা হোম মিনিস্টারের রেজিগনেশন দাবি করেছে। আজকে বিকেলে সেই নিয়ে প্রেস কনফারেন্স। তারপর সন্ধ্যেবেলায় টিভি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশন। আবাসনের ভেতরে দু-চারটে ওবি ভ্যান আর বুম হাতে ছেলেমি মেয়েগুলো হামলে পড়েছে। চলছে লাইভ টেলিকাস্ট। সঙ্গে রানিং কমেন্ট্রি। এরই মধ্যে একটা চ্যানেল আবার স্টুডিয়োতে কিছু আঁতেল জোগাড় করে ঘটনার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক, মানসিক এবং যৌবিক বিশ্লেষণ শুরু করেছে। পায়ে পায়ে পার্টির নেতারাও এসে হাজির। এত লোকের জন্য চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করতে প্রমোটার চাদু আর তাঁর সিন্ডিকেটের লোকজনের হাঁপ ধরে গেল।

এভাবে দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিমে। কিন্তু বিজ্ঞান, ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্রপতঞ্জলিতেও না উদ্ধার হল হোম মিনিস্টারের মোবাইল ফোন। না পারা গেল কাকেদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে সরাতে। ফলে, একে একে উদ্দেশ্য ও বিধেয়ও নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ক্রমে কেটে পড়লেন। হোম মিনিস্টার আজ সকাল থেকেই গৃহবন্দি। মাঝে একবার মুখ্যমন্ত্রীর ফোন এসেছিল। তিনি খিস্তি করে মা-বোন এক করে দিয়েছেন।

ফলে সকলে চলে গেলে মন্ত্রীমশাইয়ের আবাসন ফের স্বাভাবিক হয়ে আসে। সারাদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পরে হোম মিনিস্টার ক্লান্ত, হতাশ, রিক্ত তাঁর বারোশো স্কোয়ার ফুটের ভূগোলে ফিরে আসেন।

সারাদিন এ তাকে, সে একে বিস্তর দোষারোপ করে পরিবারের সকলেই এত ক্লাস্ত আর নতুন কোনো প্রসঙ্গ উঠে আসে না। সারাদিন প্রায় খাওয়া-দাওয়া হয়নি। ছেলে হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে আসে। সকলেই আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। সারাদিন নারকোলগাছ-নারকোলগাছ করে হোম মিনিস্টারের মাথা এখন ঘুরছে।

রাত তখন ঠিক কত জানা নেই। হঠাৎ কাকের চিৎকারে হোম মিনিস্টারের ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে বিছানায় জেগে ওঠেন। নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখেন তাঁর স্ত্রী খুব কুৎসিংভাবে ঘুমিয়ে। কাকটা ব্যালকনি থেকে ডাকছে। তিনি উঠে যান। এ কি সকালে যেখান ফোনটা তুলে নিয়েছিল কাকে, সেটা সেখানেই! কাকটা তাহলে এত কাণ্ড করে শেষমেষ ফেরত দিয়ে গেল। তিনি খুব দ্রুত হাতে তুলে নেন মোবাইল ফোনটা। সুইচ্ড অফ। অন করার জন্য সুইচ টিপতেই অন্ধকার ব্যালকনি আলো ঝলমল করে ওঠে। সেই ঝলমলে আলোর ছিটে লাগে হোম মিনিস্টারের দু-চোখে। কিন্তু এ কী! ফোনটাকে রি-সেট করে দিয়েছে। না আছে মুখ্যমন্ত্রী থেকে রাজ্যের সব নেতা-নেত্রীদের গোপন হোয়াট্সঅ্যাপ। শিঞ্জিনির হট ছবিগুলো। পানু ভিডিয়ো। গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস। কিংবা ডকুমেন্ট। মন্ত্রীমশাইয়ের ফোন ফ্যাকটরি রি-সেট হয়ে গেছে। কেবল স্ক্রিন সেভার হিসেবে স্ক্রল হচ্ছে গোটা গোটা বাংলায় লেখা একটা বাক্য— প্রতিটা খুনই আসলে রাজনৈতিক।

Categories
2021-JUNE-KOBITA কবিতা

অর্ঘ্যকমল পাত্র

ধ্রুপদী

আমার বন্ধুরা কত কথাই বলে, তোমাকে দেখলে
তোমার বন্ধুরা কত কথাই বলে, আমাকে দেখলে

অথচ,
আমি তোমাকে দেখলে চুপ
তুমি আমাকে দেখলে চুপ

আমাদের বন্ধুরা কত কথাই না বলে
আমাদের দেখলে…

অপেক্ষা

সে আসতে পারে শেষ মুহূর্তে—
এই কথা ভেবে
আমি মুহূর্তকে আর-ও দীর্ঘ করে রাখি

যে-কোনো মুহূর্তে সে আসবেই—
এই কথা ভেবে
আমি মুহূর্তকে বড়ো বেশি ছোটো করে ফেলি

এবং এর ফলে
মুহূর্তেরা ভেঙে যায়
টুকরো করে আমাকে!

অসুখ

যে-বৃষ্টি তুমি চেয়েছিলে
যে-বৃষ্টিতে তুমি ভিজেছিলে সারারাত

সে-বৃষ্টিকে চোখেও দেখিনি আমি।
আমি কেবল চেয়েছিলাম
তার গন্ধ…
এই
এবং বৃষ্টির গন্ধে
ঘুমিয়ে পড়েছি সারারাত…

তৃতীয় বিশ্ব

পাহাড়ের গল্প মাঝেমধ্যেই শুরু হয়
পাহাড়ের গল্প কোনোদিনই শেষ হয় না

এবং যাদের কোনোদিন-ই
কোনো পাহাড় দেখা হয়নি
পাহাড়ের গল্প শুনে
তাদের ভিতরে ভিতরেও

একটা বিশাল পাহাড় জেগে ওঠে

যে-সব আর কিনে দেওয়া হল না

চুড়ি
শুধুমাত্র শৌখিন সৌন্দর্য
বেশিদিন থাকে না

ভেঙে যায়। চুরমার…

টিপ
সংস্কারে বিশ্বাস নেই। জানি।
অসতর্কতার মতো পুনরাধুনিক তুমি

অগত্যা তোমার কপালে
পরিয়ে দিতে চাই না— আমার চিহ্ন

কাজল
এ যেন তোমার
উতলা চোখের বালি।

কোনো কোনো ঢেউ আসে
ঘেঁটে দেয়…

লিপস্টিক
সে তো
ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়া মেজোবোন

শুধু গান ধরলেই
উজ্জ্বল লাগে সব কিছু!