কবিতা
বিজয় দে
লোকারণ্য একাদশ
লোক ও পোক
“কবিতার ঘরে এখন লোক বসে রয়েছে”। এবং
“আপনি তো কবিতার লোকই নন”…
এই দু-টি বাক্য থেকে বাংলা সাহিত্যের একখণ্ড ইতিহাস
অন্তত পাঁচ-ছ-পৃষ্ঠা তো লাগবেই
বুঝতেই পারছেন, খরচা আছে, কেন-না এটা অনেক
ঝামেলাজনক কাজ
আর এটাও বুঝে নিন, খরচের হিসেব কিন্তু
কাউকে দিতে পারব না
খাকি রঙের অসুখ
“আগে লোক হও তারপর শ্লোক”…।
— তাহলে তো স্যার, আমি কিন্তু কিছুই হচ্ছি না
আগে তুমি বুড়ো আঙুলের টিপছাপ হও
তারপর পাপ ও পুণ্যের কথা ভাবা যাবে
তুমি কোথায় থাকো জানি না, কিন্তু তুমি কি জানো
প্রতিদিন একটু একটু করে কিছু কিছু নতুন পৃথিবী তৈরি হচ্ছে
বরং তুমি পুরোনো পৃথিবীর কোনো ভাঙাচোরা ডাকঘর
হয়ে যাও
— হ্যাঁ স্যার, তবে আমার কিন্তু খাকি রং নেই
আমার শুধু খাকি রঙের অসুখ আছে
চরিত্র
গাছের বর্ণনার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে লোকে ভুল বোঝে
ভাবে, এই লোকটার চরিত্রের কোনো মা-বাপ নেই
যেমন সকলে লেখে, তেমনই একদা আমি একটি গাছ লিখেছিলাম
এবার কী হল, গাছ কেটে লিখলাম ‘একটি লোক’
গাছের বর্ণনার দিকে তাকাতে তাকাতে
কখন যে বৃক্ষের শোকদিবস লিখেছিলাম, জানি না
তারপর থেকে চরিত্র নিয়ে আরও টানাটানি
আমি কিন্তু এটাও জানি, গাছও কখনো কখনো গোপনে
লোকারণ্যের শোকবার্তা লেখে
বাজার
একটি লেখা ঠিকমতো শেষ করতে পারলে
বাজারের ভিড় থেকে অনেকেই হৈহৈ করতে করতে
আমার ঘরে চলে আসে
কিন্তু আমার ঘরে আর কতটুকুই-বা জায়গা
তাই তাদের সদলবলে এক রহস্যময় গলির ভেতরে নিয়ে যাই
তারপর সেখানে, আলো ও ছায়া নামে দুই রহস্যময়ীকে
সাক্ষী রেখে যা যা বলি, প্রকৃতপক্ষে সেটা একটা
আলাদা হাসির গল্প; সেটা পরে বলা যাবে
গলির ভেতরে ঢুকে গেলে
আমার অবশ্য নিজের লেখালিখি কিছুই মনে পড়ে না
বরং বাজারের কথা বেশি শুনতে শুনতে ঘরে ফিরে আসি
লোকরহস্য
লোক এবং রহস্য; দু-টি শব্দ পাশাপাশি বসতেই
পুস্তকের ভেতরে দাউদাউ
প্রচুর আগুন লেগে গেল
এই আগুনের কথা রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন লিখেছিলেন কি?
এ-যাবৎ লিখিত আমাদের সমস্ত পুস্তক আদতে প্রস্তাবমাত্র
যা-কিছু লেখা হয়, সবই পুস্তক-প্রকাশের পর’
দূরে পুস্তক থাকুক, দূরে মস্তক; লোকের ভেতরে লেলিহান আগুন
আর আগুন লাগলে লাগুক
রহস্য ঢেলে ঢেলে, আশা রাখি, সব আগুন নিভিয়ে দেব
হে পত্রলেখক
“কবিতার উত্তর দিকে ঘর আর দক্ষিণ দিকে কবিতার দুয়ার
এসব দেখতে দেখতে জীবন প্রায় ফুরিয়ে এল”
চিঠির শেষটুকু ছিল ঠিক এরকম; তারপর
জানা যায়, পত্রলেখকের হাত হইতে সাধের কলমটি
খসিয়া পড়িল
ভুল। ভুল। এটা প্রমাণিত, কলম কারোর হাত থেকে খসে পড়ে না
কলম তো এতটা গাড়ল নয়, আসলে সে কখনো কখনো
লেখকের চোখের আড়ালে চলে যায়
হে পত্রলেখক, তুমি দীর্ঘদিন কবিতার উত্তর-দক্ষিণ লিখে যাচ্ছ
কিন্তু কখনো কোনোদিন কবিতার ভেতরের
নিভৃত কবুতর লিখতে পারোনি
অসহ্যলোক
অসহ্যলোক নামে আমাদের জীবনে নিশ্চই একটা কিছু আছে
তা নইলে আমি আর জানব কী করে
শোনা যায়, অসহ্যলোকে সবাই যার যার নিজের কাছ থেকে
অন্তত সাত হাত দূরে থাকতে চায়
এদিকে গা বাঁচিয়ে চলতে চলতে সারা গাঁ যে উজাড় হয়ে যাচ্ছে
সেটি যেন কেউ টের পাচ্ছে না
এখনও কেউ জানে না, বিগত যুদ্ধের সময় কেউ কেউ
নিজস্ব তিরগুলি নিজের দিকেই ছুড়ে দিয়ে
কোথায় উধাও হয়ে গেল
আরও শোনা যায়, অসহ্যলোকে পাপ ও পুণ্যের
কোনো সীমারেখা নেই
অসহ্যলোক; চেতনার সব শেষে দাঁড়িয়ে
সবার আগে সে যেন এক নিম চৈতন্য…
ভুল হলেও, ভাবতে ভালো লাগে, আমাদের লেখালিখি এখান থেকেই শুরু…
ভাঙা গন্ধ ভাঙা দেশ
ছাল ছাড়াতে ছাড়াতে সম্পূর্ণ স্বাধীন
একপাতা ইতিহাস একপাতা ভূগোল
কখনো এরকম একেকটি দিন
এলে ভালো হয়
তবু লোক আর স্বাধীন হয় না, হচ্ছে না। ফলে
নিজস্ব পতাকাটি নিজের গোপনেই মানুষ হতে থাকে
পতাকা ওড়ানোর সামর্থ্য নেই, তাই শুধু পতাকার ওপরে দুর্বলতা
সাহস লেখে সাহস লেখে
ছাল ছাড়ানোর সময় যে ভাঙা ভাঙা গন্ধ নাকে ভেসে আসে
তখন গন্ধে গন্ধে নিজের ভাঙা দেশের কথা মনে হয়
লক্ষ্মীর পা
এ-দেশে যত মেঘ আছে, সব একসঙ্গে জড়ো করলে
তোমার একটি মাত্র ডানা; এই টুকুই
আরেকটি ডানার খোঁজে এ-দেশের সব প্রেম আর প্রেম
আকাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
বড়ো প্রেম ছোটো প্রেম, মেঘে মেঘে যেন
যুদ্ধকালীন তৎপরতা
কিন্তু যত প্রেম আছে আকাশে
সব জড়ো করলেও তোমার পায়ের একটি পাতাও হবে না
তবু এ-দেশে কেউ কেউ লক্ষ্মীর পা-কে প্রেমপত্র লেখে
ভোরবেলা সকালবেলা
“নমস্কার। শুভ সন্ধ্যা”
সামান্য উচ্চারণ কিন্তু অসামান্য আলো
যেন পুরোনো দিনের সকাল হচ্ছে
সকাল মানে, যখন কোনো কিছু আর লুকোনো যায় না
তখনই সকাল। তখন প্রত্যেকটি মুখ যেন একেকটি শুভেচ্ছা
তুমি যদি মঞ্চ বা রোমাঞ্চ বলো, তাহলে সকাল
কিংবা তুমি যদি বলো, হে চঞ্চল পঞ্চায়েত
তাহলেও নিশ্চিত সকাল
শুধু এই, এইটুকু; এর জন্যে সমস্ত জপমালা
এবং অপমান পেরিয়ে আমি এখন
আমার দেশের সকল গোপন কথা…
আমি তো এতদিনে সব ভোরবেলা প্রস্তুত-প্রণালী
জেনে ফেলেছি। এখন ভোরবেলা ভোরবেলা
নাম ধরে ডাকলে মাঝরাত্তিরেও সকাল এসে হাজির হবে
কবিগর্জন কবিগুড়ি
কবিগর্জন নামে একটি স্টেশন।
কিংবা কবিগর্জন নামে একটি স্টেশনের ছবি
এ-দেশের বাতাসে উড়ছে। লাফ দিয়ে ছবিটা ধরতে চাইলেও
সেটি তখন এক অচেনা রঙিন ঘুড়ি… দাঁত বার করে হাসতে থাকে
সেখানে তোমার কি নাম লেখা আছে? লেখা থাকুক
সে তখন এক অলীক কবিগুড়ি স্টেশন হয়ে
তোমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে
স্টেশনে একজন কবি আসন পেতে বসে আছেন; তাকে তুমি চেনো
তার কিন্তু কোথাও যাওয়া নেই শুধু আসা…
এদিকে স্টেশনের ভেতর থেকে অজস্র যাত্রীর ক্রমগুঞ্জন শোনা যায়
কিন্তু কাউকেই দ্যাখা যায় না
তো, আসন ছেড়ে সেই কবি যখন একবার উঠে দাঁড়ালেন,
তখন দ্যাখা গেল, কোনো ছবি নেই, ঘুড়িও নেই
একটি লেজঝোলা পাখি রেললাইন বরাবর উড়ে যাচ্ছে…
কবিগর্জন থেকে কবিগুড়ি… লিখে রাখো তুমি
এই হচ্ছে আমাদের অনন্ত ও একমাত্র ওড়াউড়ি

বিজয় দে
জন্ম নথি অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি ১৯৫১। নতুন পাড়া, জলপাইগুড়ি। কিন্তু যতদূর জানা যায়, জন্ম এই ইংরেজি বছরের বাংলা সন অনুযায়ী ৫ই শ্রাবণ, শুক্রবার, সপ্তমী তিথি। পিতা গণেশচন্দ্র এবং মাতা সুনীতিবালা-র জ্যেষ্ঠ সন্তান। স্ত্রী কাকলি এবং দুই সন্তান— দৃশ্যমান ও দীপ্যমান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশু নিকেতন প্রাথমিক, ফণীন্দ্রদেব ইনস্টিটিউশন এবং আনন্দচন্দ্র কলেজ; বিজ্ঞানে স্নাতক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন, বর্তমানে কর্মজীবন থেকে অবসর জীবনযাপন করছেন। প্রিয় পথ বিনাগুড়ি চা বাগান যাওয়ার রাস্তা। প্রিয় স্থান দমনপুর রেলঘুমটি। প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। পেয়েছেন ‘চারুচন্দ্র সান্যাল স্মৃতি স্মারক’ (১৯৯৮), ‘মল্লার পত্রিকা স্মারক’ (২০১৪), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি ‘বিভা চট্টোপাধ্যায় স্মারক’ (২০১৮)। প্রকাশিত বই: ‘হে থুথু হে ডাকটিকিট হে অরণ্য’ (১৯৮৫), ‘কাঠুরিয়া আন্তর্জাতিক’ (১৯৯৪), ‘বম্বে টকি’ (২০০০), ‘বাবলিবাগান’ (২০১৫), ‘জঙ্গলসূত্র’ (২০১৬), ‘কামরাঙ্গা এবং ট্রামলাইন’ (২০১৬), ‘হাতবোমা’ (২০১৭), ‘কবির স্বপ্ন জ্বলে সাপের মাথায়’ (২০১৭), ‘সকল বৃক্ষের চুমুক’ (২০১৮)।