লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুবাদ

বিনোদ কুমার শুক্ল

ভাষান্তর: রূপায়ণ ঘোষ

আমিই সেই মানুষ

আমিই সেই মানুষ
যে এই নিস্তব্ধ উপত্যকায়
মানুষের আদিম অনুভূতিগুলির মধ্যে
ক্রমাগত প্রশ্বাস নিতে থাকি।
খুঁজতে খুঁজতে একটি পাথর তুলে ফেলি
যেন সুদীর্ঘ অতীতের প্রস্তরযুগ থেকে তুলে আনা সেই পাথর!
কলকল্লোলে বয়ে যাচ্ছে যে নদী
হাতের আঁচলে তার ঠান্ডা জল পান করি,
যেন প্রাচীন পৃথিবীর জলে-
লুপ্ত স্বাদ জমা হয় অনিঃশেষ সময়ের মতো।
নদীতীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি
ইতিহাস-রহস্য ভাঙি, সম্মুখে প্রকৃতির বিবিধ পাকদণ্ডী
এই নিঃশব্দ প্রান্তরে সন্ধ্যা এলে
তার প্রথম নক্ষত্রগুলি রাখা থাকা কেবল আমার জন্য…
এখানে চতুর্দিকে শুধু প্রকৃতির নিসর্গধ্বনি
এই বিপুল চরাচরে যদি কোনো শব্দ বলে উঠি অজ্ঞাত স্বরে
জেনো সে আমার ভাষা নয়,
সে-ভাষা বেঁচে আছে মানুষের নিসর্গ-বিভঙ্গে…

যারা কখনো আমার ঘরে আসবে না

যারা কখনো আমার ঘরে আসবে না
আমি সাক্ষাতের জন্য
তাদের সকলের কাছে চলে যাব
দূরের স্রোতস্বিনী নদী কখনো আমার ঘরে আসবে না
নদীর মতো মানুষের সঙ্গে পরিচয় করতে
আমি নদীতীর ধরে হাঁটব…
সেখানে কিছুটা সাঁতার কেটে, ডুবে যাব অকস্মাৎ!

পাহাড়, টিলা, পাথুরে প্রান্তর এমনকী সরোবর
অসংখ্য বৃক্ষ, শস্যখেত—
কখনো আমার ঘরে আসবে না
শস্য আর প্রান্তরের মতো মানুষদের জেনে নিতে
গ্রামে গ্রামে, অরণ্যে-গলিতে চলে যাব।

যারা ক্রমাগত শ্রমের কারুকার্যে ব্যস্ত
অবসর দেখে নয়
আমি তাদের সঙ্গে পরিচয় করব জরুরি শ্রমের মতো…

এইসমস্ত অভিলাষগুলিকে আমি, অন্তিম চাহিদারূপে
প্রারম্ভ ইচ্ছের মতো সাজিয়ে রাখব…

আমার জঠরে আমার মগজ

আমার জঠরে আমারই মগজ
পেটের ভিতর নিজস্ব সঙ্গমে গর্ভস্থ।
এই কায়াবিদ্ধ উদর,
নিজেরই উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়ে
বেড়ে উঠি—
প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে যাওয়া এই জীবন।
ক্রমশ মাংসের বিশ্বাসে খেয়ে ফেলি হাতের নখর
চেতনার মায়ায় ভাসে ক্ষুধা ও আস্থার কারুকাজ!

এখানে আমার জঠরে আমারই মগজ
মাংসাশী অরণ্যের মতো বেড়ে ওঠে…

হতাশায় এক ব্যক্তি বসে পড়েছিল

হতাশায় এক ব্যক্তি বসে পড়েছিল
ব্যক্তিটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না
হতাশা সম্পর্কে জানতাম,
সে-কারণেই আমি লোকটির কাছে গিয়ে
ধরবার জন্য নিজের হাত এগিয়ে দিলাম
আমার হাত ধরে লোকটি উঠে দাঁড়াল
লোকটি আমার সম্পর্কে জানত না
আমার হাত এগিয়ে দেওয়াটা জানত।
দু-জনে পাশাপাশি অনেকটা হেঁটে গেলাম
আমরা দু-জনে কেউ কাউকে জানতাম না
পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া সম্পর্কে জানতাম…

একটি অচেনা পাখি

একটি অচেনা পাখিকে দেখে
পাখিদের প্রজাতির মতো মনে হল
যুদ্ধের আগেই বারুদের বিস্ফোরণের আওয়াজে
ভীত সন্ত্রস্ত যে এখানে এসে পৌঁছেছে।

হাওয়ায় এক অচেনা গন্ধ ছিল
প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য
কয়েক পা দ্রুত হেঁটে গিয়ে
আবার শ্বাস নেওয়া গেল।
যে-বাতাসে প্রশ্বাস নেওয়া সম্ভব
সে-বাতাস বায়ুর প্রজাতির মতো…

একটি মানুষ, মানুষের প্রজাতির মতো
সাইরেনের শব্দ শুনতে শুনতে
গর্তের গভীরে নেমে গেল—
গর্তের মুখেই পায়চারি করা এক গর্ভবতী নারী
মানুষের মতোই একটি জীবের জন্ম দেওয়ার জন্য
গভীর সন্তর্পণে সেই বিপুল কুহরের ভিতর নেমে যায়,
অথচ শোনা যায় কোনো এক মানুষের মৃত্যুধ্বনি।

এভাবে মানুষ হয়ে থাকার একাকিত্বে
মানুষের প্রজাতির মতো সমস্ত লোকেরা অচেনা হয়ে যায়…

রাস্তায় চলার জন্য

রাস্তায় চলার জন্য
যখন উঠে দাঁড়ালাম
পায়ের জুতোর বদলে দেখি
আমি রাস্তায় পা গলিয়ে দিয়েছি।
একটা নয়, দুটো নয়
এরকম হাজারও পথ পালটে পালটে
এবড়ো-খেবড়ো অজস্র রাস্তা ছেড়ে দিই…
অথচ বহু পথ পেরিয়ে
জীবনের কাছে ফিরে আসার ইচ্ছেরা জড়ো হয়,
হয়তো জীবনের শরীর ছুঁয়ে
কোনো রাস্তা চলে গেছে অনির্দ্দেশে—
আমি এবার এমন কোনো জুতো জোগাড় করে নেব
আমার অবাধ্য পা-দুটো যাতে নিখুঁত পরিমাপে ঢুকে যাবে…

নদী কেবল এপারে

নদী কেবল এপারে রয়েছে
অথবা ওপারে;
অদ্ভুত স্বপ্নের ভিতর দেখি
নদী ও প্রেমের মধ্যপ্রবাহ জুড়ে ছায়া পড়ে থাকে-
নদীতে ভিজে গেলে মনে হয়
বর্ষার অবিরল জলে ভিজে উঠি।
ছাতা ফেলে রেখে যদি কখনো বেড়াতে বেরিয়েছি
উন্মাদ বন্যায় উল্টে যাওয়া নৌকোর নীচে দেখি
আমাদের ঘর ভেসে আছে…

ঈশ্বর এখন পরিমাণে বেশি

ঈশ্বর এখন পরিমাণে বেশি
সর্বত্র সে অধিক হয়ে উঠেছে
নিরাকার, সাকার কিংবা তারও অধিক
ঈশ্বর এখন প্রতিটি মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে সঞ্চিত
অজস্র ভাগাভাগি শেষে
এখনও অসংখ্য বাকি আছে…
পৃথক পৃথক মানুষের কাছে
ভিন্ন ভিন্ন অধিক, বাকি রয়ে গেছে!
এই অফুরান অধিকের মাঝে
আমার শূন্য ঝোলাটি আরও নিঃশেষ করার জন্য
এক নিখুঁত ভয়-সহ ঝাড়তে থাকি
যেন তা থেকে অনন্ত নিরাকার কিছু ঝরে যায়…

এক বিশাল পাথরের উপর

এক বিশাল পাথরের উপর
আরেকটি পাথর এমন বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল
যেন এই মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে
সে-পাথরের এই মুহূর্তে গড়িয়ে পড়া— অতি পুরাতন ঘটনা
এই মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে— এ এক শাশ্বত ঘটনা
এই মুহূর্তে গড়িয়ে যাবে— এও‌ এক ভবিষ্য-বিবরণ…
অথচ যে-পাথরটির এখনই গড়িয়ে পড়ার কথা
তা যেন কত অযুত সময় থেকে গড়িয়ে পড়ে না,
আর তার নীচ দিয়ে যে নতুন রাস্তা চলে যায়
সে-পথ ধরেই এক রাখাল এসে দাঁড়ায়
কখনো গড়িয়ে না পড়া পাথরের নরম ছায়ায়।

দেওয়ালে একটা জানালা থাকত

দেওয়ালের গায়ে একটা জানালা থাকতো
একটি কুঁড়েঘর, দু-টি ধূসর টিলা, একটি নদী
আর দু-একটি পুকুর থাকত
একটা আকাশের সঙ্গে জুড়ে থাকত সবার ছোটো ছোটো আকাশ
কখনো কখনো মানুষের আসা-যাওয়া ছিল
বৃক্ষ ও পাখিরা ছিল;
জানালার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু থাকত
না থাকার মধ্যে একটা জানালা খোলা থাকত না
থাকার মধ্যে একটা জানালা খোলা থাকত

আর জানালা থেকে দূরে সরে
দেওয়ালের গায়ে একটা মানুষ লুকিয়ে থাকত…

 

Facebook Comments

অনুবাদক: রূপায়ণ ঘোষ

রূপায়ণ ঘোষের জন্ম অগস্ট ১৯৯৩ সালে, বীরভূমে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নবিদ্যা’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর।
অনুবাদের পাশাপাশি রূপায়ণ মৌলিক কবিতা ও প্রবন্ধচর্চাও করে থাকেন। তাঁর দু-টি কাব্যগ্রন্থ: ‘হে সিন্ধুরমণীরা’ এবং ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’।
বর্তমানে হিন্দি, মরাঠি, ফারসি ও রোমানিয়ান সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবেও কাজ করছেন।

পছন্দের বই