লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

বিপ্লব চৌধুরী

টাকা মাটি মাটি টাকা

প্রেম একবারই এসেছিল। সরবে। রান্নাবাটি, কান্নাকাটি, ফাটাফাটি ঝগড়া আর তুমুল শরীরে। সন্দেহে ঝুঁকে পড়ে বার বার সে দেখত আমার মুখ। আমি তার ঘুমন্ত বুকে হাত রেখে জাগাতে চাইতাম। ভোরের আলো এসে পড়ত আমাদের কুঁচকানো বিছানায়। আমরা সিনেমায় যেতাম, নাটক দেখতাম, হেঁটে বেড়াতাম বইমেলার ভিড়ে। এইভাবে তিনটি শতাব্দী ধরে চলেছিল আমাদের দ্বিতীয় জীবন। তারপর কী যে হল। আমার প্রবাসী বন্ধু দীপেনের সাথে তার ভাব হয়ে গেল। আমার সঙ্গে আড়ি। আমি ভেঙে পড়লাম। গ্যালন গ্যালন মদ খেলাম আর ঘন ঘন গেলাম বেশ্যাপাড়ায়। প্রবাসে, দৈবের বশে যার সঙ্গে তোমার জমে উঠেছিল খেলা, একদিন ভেঙে গেল সেই খেলাঘর। তার অনেকদিন পরে টোকিয়ো নিবাসী দীপেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই উঁচু কলকাতায়, পার্ক স্ট্রিটের একটি অভিজাত বারে। তার মুখে, তোমার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। ‘হে ধরণী, দ্বিধা হও’ মনে হয়েছিল। সে নাকি তাকে বলেছিল যে, পীরিতি ভাঙনের খেসারত স্বরূপ আমি সেই ভদ্রমহিলার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়েছিলাম। শুনে প্রথমে বিদ্যুৎ চমকে উঠলেও তারপর হো-হো-হো হাসি পেয়েছিল। টাকা আমি জীবনে চাইনি, না তোমার কাছে, না আমার জীবনদেবতার নিকটে। আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। আমি চেয়েছি বাংলা মদ, বাঙালির প্রধান খাদ্য মাছ আর ভাত এবং বঙ্গভাষায় লিখিত কিছু উত্তম বইয়ের সম্ভার। টাকা আমি চাইনি কোনোদিন। আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। সাপের মতন, সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম এই পৃথিবীর মাটি।

সূর্যকে বকতে যাচ্ছি

আমার এই হন হন করে হাঁটা দেখে বুঝছ না ব্রাদার, আমি চলেছি সূর্যকে প্রবল বকাবকি করতে, চলিত বাংলায় তিরস্কার বলা হয় যাকে, ঘনঘোর শীতকাল, ডিসেম্বর মাস, অথচ দশ দিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, জামাকাপড় বিছানাপত্তর বউদের গতর থেকে ভ্যাপসা ভাপসা গন্ধ ছাড়ছে, ক্রিসমাস উপলক্ষে যারা জলদাপাড়ায় বেড়াতে এসেছে, তারা কি ট্যুরিস্ট লজের ঘরে বসে সারাদিন আঙুল চুষবে, অথবা হুইস্কি আর পকোড়া পেঁদাবে, গন্ডারের খড়গের সঙ্গে সেলফি তোলার সৌভাগ্য কি হবে না তাদের, শিকেয় উঠবে নাকি পর্যটন শিল্প আমাদের, সমস্ত পৃথিবীতে যথাযথ আলোকসম্পাতের কাজ আমি একমাত্র ওকেই দিয়েছি, তবুও উত্তরবঙ্গের প্রতি সপ্তাহব্যাপী তার এই বঞ্চনার প্রকৃত কারণ কী, জানতে চাই আমি, সে কি বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা উগ্রপন্থীদের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তার উত্তরাপন যদি খুশি করতে পারে আমাকে, আজ না হোক অন্তত কাল থেকে সে আবার পূর্ববৎ রোদ্দুরের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন আমি ওকে ক্ষমা করে দেব, জামার পকেটে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে আসব, চাঁদকে বলিস তোকে যে রামের বোতল আর দেশি মুরগির মাংস রেঁধে দেয়।

সৌর

আজ রবিবার। চলে গেল আরও একটা শীতকাল। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম একটা আরামদায়ক কম্বলকে জড়িয়ে ধরে। নীল রঙের নরম কম্বলটিও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। অন্তত সকাল ন-টা দশটার আগে যে কোনোদিনই ছাড়তে চায়নি আমাকে। আমাদের মধ্যে কোনো কথা কখনো হয়নি। তবে পাশের বাড়ির থেকে টিভির শব্দ ভেসে এসেছিল। আজকে যেমন শোনা গেল কোকিলের, সবজি আর মাছওলার ডাক। এই শীতে বরাবরের মতোই আমি পান করলাম ওল্ড মংক রাম এবং পড়লাম কিছু বাংলা বই। তার মধ্যে দু-একটি কবিতার। শীতকালে আমি কোনো কবিতা লিখি না। মেঘলা দিনে কারো কথা আর মনে পড়ে না আমার। শীতকালে আমি কুয়াশা হয়ে কোনোমতে পড়ে থাকি পৃথিবীর কোণে। নেওয়া হয় না তোমার খবর। একটা নীল কম্বলের সঙ্গে শুয়ে থাকি আমি। শীত খুব শীত করে, তাই মোজাও খুলি না। দুঃস্বপ্নে দেখি বিপজ্জনক সব পথ আর অনেক পতন। ঢকঢক করে বোতলের জল খেয়ে দমদম বিড়ি ধরাই আমি। বসে থাকি। কাশি। ভাবি, শীতকাল কবে যাবে, কেটে গিয়ে, প্রথমে বসন্ত-পলাশ আর তারপর মহামান্য গ্রীষ্ম আসবে। আমিও যে সৌরজগতের মধ্যে আছি, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

Facebook Comments

পছন্দের বই