লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সাক্ষাৎকার

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

“একটা সময়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম কোনো এক মহাশক্তি আমার এই বিজ্ঞান-সাধক হয়ে ওঠাটাকে ঠিক সমর্থন করছে না।”

আলাপচারিতায় পার্থজিৎ চন্দ

প্রথম পর্ব

পার্থজিৎ: আমি সম্প্রতি ‘আবহমান’ পত্রিকায় আপনার কয়েকটি হাইকু পড়লাম, আজ সকালেও আপনার একটি হাইকুর সামনে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। হাইকুটি হল— ‘নদীটি/তার নিরক্ষর তীর/গুনছে ঢেউ’। হাইকু-র রহস্যময়তাকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। আপনার ছোটোবেলায় বাড়িতে বিদ্যাচর্চার এক মহৎ পরিসর ছিল, আবার বাংলার কৌম-সমাজকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কোথাও কি মনে হয় এই দুইয়ের সংমিশ্রণ আপনার বেড়ে ওঠা, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে?

বিশ্বদেব: নিশ্চিতভাবেই সেটা করেছে, তবে আমি প্রথমেই স্পষ্টভাবে বলতে চাই, পারিবারিক সূত্রে আমার যা অর্জন তার মধ্যে আলাদা করে কোনো গৌরবের ব্যাপার নেই… ওটা সবাই নিজের মতো করে পায়। কিন্তু পারিবারিক সূত্রে আমি অর্জন করেছিলাম এক আস্তিক্যবোধ। বুঝেছিলাম জীবনে শুধুমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন করা ও তার উত্তর খোঁজার জন্য আমি আসিনি, সামগ্রিকতার একটা উত্তর আছে… আমাকে সেটারই সন্ধান করে যেতে হবে। যে-কবিতাটির কথা তুমি বললে, সেখানেও আমি তারই সন্ধান করতে চেয়েছি।

পার্থজিৎ: যে-আস্তিক্যবোধের কথা আপনি বললেন, আপনার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি (গাছের মতো গল্প) পাঠ করতে করতে আমার মনে হয়েছে যত পরিণত বয়সের দিকে আপনি গেছেন তত তীব্র হয়েছে আপনার এই সন্ধান…

বিশ্বদেব: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই, এখানে বলে নেওয়া দরকার আমি সৃষ্টি আর স্রষ্টার পৃথক অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না… সৃষ্টি ও স্রষ্টা একই। অথচ কী আশ্চর্য দেখ, মানুষের যত বয়স বাড়ে তত যেন তার কাছে সৃষ্টি ও স্রষ্টা আলাদা হয়ে যায়, যদিও আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উলটো হয়েছে। একটি কবিতায় আমি লিখেছিলাম এক কুম্ভকারের কথা যে একটি কলসি গড়ছে; আসলে যে গড়ছে সেও এক মাটির তৈরি কুম্ভকার। সে নিজের শরীর থেকে মাটি দিয়েই ক্রমাগত ওই কলসটা গড়ে তুলছে এবং কলসটা যখন শেষ হল তখন আর কুম্ভকার নেই; শুধু কলস রয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আমার ঠিক এমনই মনে হয়, মনে হয় পরমেশ্বর যেন তাঁর শরীর থেকে উপাদান নিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি করলেন। ‘দার্শনিক বোধ’ কথাটি উচ্চারণ করব না, শুধু বলব এটিই আমার সর্বস্ব।

 

পার্থজিৎ: জীবনের প্রথম দিকে আপনি বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু ছাত্র ছিলেন, বাড়িতে সমবয়সিদের সঙ্গে ল্যাবরেটরি বানিয়ে রীতিমতো রকেট বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। আপনার আত্মজীবনী পড়তে পড়তে বার বার মনে হয় সেই জীবন আর পরবর্তী সময়ের জীবন দর্শনের মাঝে যেন একটা প্যারাডাইম শিফট ঘটে গেছে। একে কি আপনি কোনো ‘শিফ্‌ট’ হিসাবে চিহ্নিত করবেন? না কি এটি একটি ন্যাচারাল কন্টিনিউয়েশন?

বিশ্বদেব: দেখ আমি কী বলছি সেটা খুব বড়ো কথা নয়, কারণ, আমি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে বিশ্বজগতের অংশ বলে মনে করছি ততক্ষণ এটা তো ন্যাচারাল বটেই। তার ভেতর অন্তর্নিহিত সে-সত্য, যে-নিয়ম তাই আমাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে। বিজ্ঞানের আস্বাদন আমার কাছে খুব প্রিয় একটা বিষয়, এখনও দিনে যতক্ষণ আমি কবিতার কথা ভাবি তার থেকে বেশি বিজ্ঞানের কথা ভাবি। কিন্তু একটা সময়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম কোনো এক মহাশক্তি আমার এই বিজ্ঞান-সাধক হয়ে ওঠাটাকে ঠিক সমর্থন করছে না। তাও আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমি বহুদিন সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছি। এখন বুঝতে পারি আমি তো মুক্তজীব, আমি যেভাবে কবিতা লিখি সেভাবেই যদি বিজ্ঞানের চর্চা করি তাতেই-বা ক্ষতি কী! কিছু পাবার জন্য কবিতা লিখিনি কোনোদিন, কিছু পাবার জন্য বিজ্ঞানচর্চাও করিনি।

পার্থজিৎ: আপনার একদম প্রথম দিকের একটি লেখা ‘মধ্যরাতের হল্ট’, আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি কবিতা। যতবার কবিতাটি পড়ি ততবার এক রহস্যজনক ডুয়ালিটির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। এই কবিতাটির একদম প্রথম দিকে আপনি লিখলেন, ‘ভুল করে নেমে গেছি, এখানে এখন খুব রাত’। আবার শেষের দিকে লিখলেন, ‘তোদের ভুলেই/আমি এই মাঝরাতে নেমে গেছি অমিতাভ’। রহস্যের উন্মোচন করতে পারি না, কিন্তু মনে হয় আপনি খুব গূঢ় কোনো ইঙ্গিত রেখে গেছেন এখানে…

বিশ্বদেব: অমিতাভ-র কথা এল বলে একটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন, এই কথাটা কখনো কোথাও বলা হয়নি। অমিতাভ চক্রবর্তী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, অসামান্য কবি ছিলেন। এত বড়ো কবি ছিলেন… কিন্তু তিনি পরবর্তীকালে আইএএস হয়ে বড়ো পদে চাকরি করতে চলে যান। ব্যস্ততার জন্য আর কবিতার ততটা চর্চা করেননি পরের দিকে। অকালে চলেও যান অমিতাভ; সেই অমিতাভ-র কথাই এই কবিতায় বলেছিলাম আমি। একদম প্রথম দিকে, যখন আমি তীব্রভাবে বিজ্ঞানচর্চায় মেতে তখন অমিতাভ কেমিস্ট্রি অনার্স ছেড়ে পলিটিকাল সায়েন্সে অনার্স নিয়ে পড়া শুরু করল। কবিতা লেখার ব্যাপারে অমিতাভ-র কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কবিতায় তার কথা উল্লেখ করলেও কবিতার শরীরে এসে সে কিন্তু আর সেই ‘অমিতাভ’ থাকেনি। সে-সময়ে আমার বার বার মনে হত, কোথাও একটা ভীষণ ভুল হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে প্রচণ্ড বিপন্ন মনে হত। মনে হত যে-কোনো মুহূর্তে ওই অন্ধকার একটা স্টেশনে আমি নেমে যেতে পারি। অথবা অন্য সবাই আমাকে ভুল করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিচ্ছে… খুব স্পষ্ট করে বিষয়টা আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না হয়তো। এ-প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলতে হয়, ছেলেবেলায় আমরা কলকাতা থেকে লাভপুর যেতাম… বাবার একটা বিলাসিতা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে চাকরি করার কারণে সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকতেন বাবা… পুজোর সময়ে কয়েকদিনের জন্য লাভপুর যাবার আনন্দ। কলকাতা থেকে মাত্র একশো কুড়ি মাইল রাস্তা; কিন্তু বাবা বরাবর আমাদের চার ভাইবোন আর মাকে নিয়ে লাভপুর যেতেন একটি ফার্স্ট ক্লাস কামরা রিজার্ভ করে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। লাভপুর যাওয়া আমার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠতম অনুভবগুলির মধ্যে একটি, এটার জন্য সারা বছর দিন গুনতাম। হয়তো দশ দিন থাকতাম। আমি ট্রেনে সারারাত জেগে থাকতাম, মধ্যরাতে কোনো নাম-না-জানা স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াত ট্রেন। এখন মনে মনে ভাবি ভাগ্যিস গয়া প্যাসেঞ্জার ছিল… তাই ওইটুকু রাস্তা যেতে অত দীর্ঘ সময় লেগে যেত। সেখান থেকেই ওই অনুভূতিটি আমার মধ্যে কাজ করতে শুরু করে… কোনোদিন হয়তো আমাকে মাঝরাতের কোনো হল্ট-স্টেশনে নেমে যেতে হবে। আজ আর একটা কথাও বলা দরকার, আমার কবিতা নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করেন তাই কবিদের কাছেই এ-কথাটা মন খুলে বলা যায়… আমাকে ‘অফিসিয়ালি’ বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র থেকে সরে না-আসতে হলে আমি হয়তো একদিন বিজ্ঞানীই হতাম। যে-প্রশংসা কবিতার জন্য পেয়েছি তা হয়তো বিজ্ঞানের জন্য পেতাম। এই বিপন্নতার থেকেই হয়তো ‘তোদের ভুলে’ কথাটির উঠে আসা… আমাদের ঘিরে থাকা সমাজ মানুষ ইত্যাদি আমাকে যে বিপন্নতা উপহার দিয়েছে তার থেকে। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষকে খুব কোমল-নরম স্বভাবের কোনো জীব বলেও মনে করতাম না আমি। আমি মানুষের মধ্যে ভায়োলেন্স খুব বেশি দেখতাম আর ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে পড়তাম। ভয়ে ভয়েই থাকতাম…

পার্থজিৎ: যে-লাভপুরের কথা বললেন আপনি, তা যেন বাংলার কৌমসমাজের ছায়া হয়ে মিশে গেছে আপনার কবিতায়। একটি কবিতার কথা এই মুহূর্তেই মনে পড়েছে ‘বিনোদ নট্টের ঢোল’; কবিতাটিতে যেন নটরাজের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে।

বিশ্বদেব: আমার অনুভব যে তোমাকে ছুঁয়েছে এটা খুব ভালো লাগল… আহা, এ যে কী আনন্দ…

পার্থজিৎ: আপনি কি সেই বীরভূমকে এখনও বুকের মধ্যে নিয়ে ঘোরেন?

বিশ্বদেব: একদম, একদমই তাই…আমাকে যদি অধিকার দেওয়া হত আমি বীরভূমকেই ভূস্বর্গ বলতাম। বীরভূমের লাভপুর গ্রাম হাজার বছরের পুরানো গ্রাম… তার ভেতর যে কত রহস্যময়তা। বাবার মৃত্যুর পর আমরা মামারবাড়ি, অর্থাৎ, তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে থাকতে শুরু করি। মা গল্প বলতেন, একটা গল্প থেকে আর একটা গল্প… গ্রামের একটা কথা থেকে আর একটা কথা। আমার একটা কবিতায় আছে ‘ও খোকার মা/ঝুমঝুমি লিবি?’… আসলে ওই পঙতিটিও আমার নয়। পঙতিটি আমার বলেছিলেন মা… সে-সময়ে বীরভূমে বাজিকর মেয়েরা আসত। তারা দুপুরবেলায় মাটির ঝুমঝুমি বিক্রি করতে আসত গ্রামে। আমি এখনও ভাবি কেন তারা দুপুরবেলাতেই আসত… নিজঝুম জৈষ্ঠ্যের দুপুর… বাজিকর রমণীরা দুপুরে ডেকে উঠত, ‘ও খোকার মা ঝুমঝুমি লিবি?’। বাড়ির ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে পড়ত, কারণ, তাদের বাজিকর-রা ছেলেধরা বলে ভয় দেখানো হত। মনে রাখতে হবে একটা সমাজ, একটা গ্রাম শুধুমাত্র কয়েকটা বাড়ি বা মানুষ মিলে গড়ে তোলে না, সেখানে অনেক সত্য, অনেক মিথ্যা, অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে… এটাকে না-বুঝলে একটা সমাজকে বোঝা যায় না। এখন একটা জিনিস দেখি, লাভপুরেও দেখি… সব গ্রামকে কেন শহর হয়ে যেতে হবে আমি বুঝি না। আর দ্বিতীয় দুঃখ হল সমস্ত সংস্কারের মধ্যে জাগতিক সত্য আর মিথ্যাকে খুঁজতে আমরা বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের এখন একমাত্র জানতে চাওয়া কোনো বিষয় ‘সায়েন্টিফিক্যালি ট্রু’ কি না… কিন্তু সায়েন্টিফিক ট্রুথই যে একমাত্র সত্য এটাও তো প্রমাণিত নয়। আনফরচুনেটলি আমাদের এই গতে-বাঁধা পথেই শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। কী আশ্চর্য ‘এটা বিজ্ঞানের যুগ’ এমনটা শুনি আজকাল; কিন্তু ভেবে দেখ এক সময়ে দর্শনের খুব উন্নতি হয়েছে, সাহিত্যের উন্নতি হয়েছে, গণিতের উন্নতি হয়েছে। সেগুলিকে কি আমরা দর্শনের যুগ, সাহিত্যের যুগ, গণিতের যুগ ইত্যাদি বলি? আসলে ‘এটা বিজ্ঞানের যুগ’ বলে গ্রাম থেকে গ্রামে কৃষকের বাড়ি থেকে বাড়িতে সাংঘাতিক এক ভ্রম ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পার্থজিৎ: সেভাবে দেখলে হোমো সেপিয়ান্সের পাথর থেকে ধাতুতে যাওয়া, আগুনের আবিষ্কার… সবটাই তো বিজ্ঞানের যুগ…

বিশ্বদেব: বটেই তো… সত্যি কথা বলতে কি মা যে শিশুকে দুধ খাওয়ান সেটা কি তিনি বিজ্ঞান জানেন বলে করেন? তা তো নয়… প্রকৃতির ভেতর প্রতিটি ঘটনা একটা কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে আছে এটা একটা বিশ্বাস। কিন্তু আমি এখনও কী করে খুব জোর দিয়ে বলব যে, এই কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে থাকাটা এম্পিরিকাল ট্রুথ! কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই হবে এটা কি একেবারে লজিকাল ট্রুথ? আমি জানি না… তবে আমার মনে হয় এ-সব প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন পাওয়া যাবে না। তবে আমি নিশ্চিতভাবে জানি, বুঝতে পারি স্টিফেন হকিং যাকে থিয়োরি অফ এভ্রিথিং বলেছেন তা আসলে চিন্ময় হতে বাধ্য।

পার্থজিৎ: সম্প্রতি ধ্যানবিন্দু থেকে প্রকাশিত আপনার গদ্যের বইটিতে (বিজ্ঞান ও অন্তিমতত্ত্ব) এই কথাটিই বার বার ফিরে এসেছে… এই কথায় আমরা নিশ্চয় পরে আবার ফিরে আসব, শুধু এখন অন্য একটি কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। আমাদের সভ্যতার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই যে-মিথ রূপকথা ছড়া… এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলে। অনেক সময়েই আমরা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু কবি পারেন, যেমন আপনি ‘নাপিতবাড়ি’ নামে একটি কবিতায় সরাসরি ছড়ার ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম, মনে হয়েছিল ছদ্মআধুনিকতা ও অনুচ্চ দর্শন থেকে আমাদের যে-দেখা তাকে আপনি পরাজিত করতে করতে চলেছেন… আর একটা কথাও মনে হয়, আমাদের শিল্প-সাহিত্যে কলোনিয়াল ছায়া দীর্ঘ হয়ে উঠল, ওর‌্যাল ট্র্যাডিশনগুলি লুপ্ত হয়ে গেল। আমাদের ইনডিজিনাস খোঁজগুলি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল…

বিশ্বদেব: কথাটা তুমি চমৎকারভাবে বলেই দিলে, ইনডিজিনাস খোঁজ…আসলে খোঁজটা তো নিজেকেই…নিজেকেই খুঁজে চলা। মানুষের জীবনকে বিষিয়ে দিচ্ছে ‘সংকট’; সে কিছুতেই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে কনসিসটেন্ট মনে করছে না। এর কারণ, আমরা যে-জগৎটাকে দেখি সে-জগৎটাকে আসলে অন্যরকমভাবে দেখতে চাই। প্রথমেই জগৎ সম্পর্কে এই চাওয়াটা থেকে বেরোতে হবে। আমার কলকাতার টালাপার্কের কাছে বাসা থেকে দেখা একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে… এক ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক… মাঝখানে একটি তিন-চার বছর বয়সের শিশু… শিশুটি মা-বাবার হাত ধরে রয়েছে… গাড়ি যাচ্ছে। শিশুটির কিন্তু কোনো দিকে খেয়াল নেই, সে চারদিকের গাছপালা ঘরবাড়ি গাড়িঘোড়া দেখছে। মা বাবার হাত ধরে সে নির্বিকার রাস্তাও পেরিয়ে গেল… এক অদ্ভুত অনুভূতির সামনে দাঁড়ালাম আমি। বুঝতে পারলাম একেই বলে নিশ্চিন্ততা, একেই বলে বিশ্বাস। আমাদের এই জেনারেশন হাত ধরতে শিখলাম না… যা পরম সত্য তাকে শুধুমাত্র আনস্মার্ট বলে বর্জন করলাম।

পার্থজিৎ: যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, এই পরম সত্যটি ‘আনস্মার্ট’… সেটিকে আনস্মার্ট প্রতিপন্ন করবার জন্য যে-খোঁজের প্রয়োজন আমরা সেটাও করলাম না…

বিশ্বদেব: এটা তো সত্যিই তাই, আমরা কোনো খোঁজ করলাম না। আরও একটা বিষয়, আমি বিশ্বাস করি একজন মানুষের মস্তিষ্কের নানা স্তরে তার অস্তিত্ব থাকে। যেমন আমি এই মুহূর্তে যেভাবে কথা বলছি পাঁচ মিনিট আগেও সে-স্তরে ছিলাম না। এর কোনোটির মধ্যেই কিন্তু কোনো হিপোক্রেসি নেই… প্রত্যকেটা স্তরেই মানুষ থাকতে পারে। থাকতে হয় তাকে। উচ্চতম স্তরের সন্ধান অধিকাংশ মানুষ পায় না। আমাদের অস্তিত্বেরও একটা ট্রান্সফর্মেশন হয়, তার খোঁজ না করেই আমরা শুধু বর্জন করে দিলাম এটা হাস্যকর। অনেকেই নিজেদের বিজ্ঞান-মনস্ক ইত্যাদি বলে জাহির করেন, কিন্তু তারা যে খুব ভালো বিজ্ঞান বোঝেন বা জানেন এমনও নয়।

পার্থজিৎ: সমস্যাটা সেখানে আরও বেশি…

বিশ্বদেব: আমার মতে এগুলো সব কন্টিনিউয়াস… একজন রাখাল যদি গোরু চরানোতে খুব দক্ষ হয়ে ওঠেন তবে তিনি ক্রমশ ক্রমশ বংশী ধরবেন… আমার এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বের যে-কোনো বিন্দুতে মানুষ ব্রহ্মদর্শন করতে পারে। যে-কোনো বিষয়ের ভেতরে সত্য অনুসরণের পথ পেতে পারে।

পার্থজিৎ: আপনার একটি কবিতা ‘দরজা’, সেখানে আপনি একটি পোকার কথা বলছেন… পোকাটি চাতাল পেরিয়ে চলেছে। পোকাটি কিছুটা দিশাহারা। কবিতাটিতে দু-বার একটি লাইন ব্যবহৃত হয়েছে… ‘প্রতিক্ষার প্রান্তে খোলে আলকাতরামাখানো কপাট’… এখানে এসে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ব্যক্তি কি তার চৈতন্য দিয়ে একদিন খুলে ফেলতে সমর্থ হয় সে-দরজা? না কি তার চেতন-অবচেতনের বাইরে রয়েছে এক উন্মোচন প্রক্রিয়া? একটা প্রতিক্ষার অন্তে খুলে যায় সে-দরজা…

বিশ্বদেব: তুমি একটু ফাঁদে ফেলে দিয়েছ আমাকে… তুমি যখন চৈতন্য বলছ তখন আমার উত্তর দেবার কিছু নেই। কিন্তু যদি বলো জীব কি খুলে ফেলতে পারে সেই দরজা তবে আমি বলব যে, জীব পারে না সেটা। যেমন ধরো, এই মুহূর্তে আমি যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি এর সবটা কি আমি নিজে আয়োজন করেছি? আমি নিজে কিছুটা করেছি, তুমি মনে করতে পারো তুমি আয়োজন করেছ… এবার ধরা যাক, আমার যদি জন্মই না-হত তা হলে কি আমাদের এই কথাবার্তা সম্ভব হত? এই যে অপূর্ব এক ‘কারুকাজ’, বস্ত্রের উপর হাজারও নকশা… বুটি… সব যেন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে আছে। ভালো করে ভাবলে বোঝা যাবে, কোনো নকশা বা বুটিরই আলাদা কোনো স্বাধীনতা নেই। কোন বিন্দুতে কে থাকবে তা নির্ধারিত হয়েছে… তাকে বিশ্বচৈতন্য, রস, ঈশ্বর যে-কোনো নামেই ডাকতে পারো। কবিতার ওই গুবরে পোকাটাও নিজে খোলেনি আসলে… আরও একটা কথা, এখানে আলকাতরা-মাখানো কপাটের মধ্যে মৃত্যুর ঈঙ্গিতও রয়েছে কিন্তু। এই কপাট আমার দেখা। গ্রামের দিকে দরজায় সবসময় আলকাতরা মাখানো হত, আমাদের বাড়িতে যদিও আলকাতরা মাখানো দরজা ছিল না; সেটা আমি দেখতাম অজন্তাপিসিদের বাড়ি… আমাদের বাড়ির পিছনেই সেই বাড়ি। ভীষণ নির্জন, দোতলায় টানা বারান্দা আর কাঠের রেলিং… সব মিলিয়ে খুব ভয় লাগত, এ-সব মিলেমিশেই হয়তো কবিতায় এসেছে ওই দরজার কথা…

পার্থজিৎ: আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আর একটা বিষয় নিয়েও কথা উঁকি দিচ্ছে মনে… এ-সময়ের বেশ কিছু দার্শনিক, ফিজিসিস্ট বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অ্যনথ্রোপিক ডিজাইন রয়েছে… এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সেলফ-ডিজাইন্ড এভাবেই, যেন একটা সময়ে উন্নত কনসাসনেস-সম্পন্ন জীবের আগমন ঘটবে। এটা খুবই জানা কথা, ওঁরাও বলছেন বিগ-ব্যাং-এর মুহূর্তে যদি এক সেকেন্ডের এক মিলিয়নভাগের এক ভাগ এদিক ওদিক হত তো ব্রহ্মাণ্ডের চেহার এমন হত না। আপনার কি কোথাও মনে হয় যে, ব্রহ্মাণ্ড আসলে সেলফ-ডিজাইনড একটা বিষয় আর যাক একটা অংশ আমরা?

বিশ্বদেব: তুমি যে-বইটার কথা বললে, ধ্যানবিন্দু থেকে প্রকাশিত সেখানে এ নিয়ে অনেক কথাই লিখেছি। সব থেকে আশ্চর্য, একজন মানুষকে সারাজীবনে ফাইনাইট নাম্বার অফ ফ্যাক্টস-ই দেখে যেতে হয়। ফলে অসীমকে অবজার্ভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সেটা কোনোদিন হবেও না। ফলত যে-বিষয়টা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে দুটো বিন্দুকে আমি যে-সূত্র দিয়ে গাঁথব তা কখনো সসীম হবে না; সেটা অসীমে গিয়ে ঠেকবে। যেমন দুটো বিন্দুকে আমি সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করতে পারি, বৃত্ত দিয়ে যুক্ত করতে পারি, উপবৃত্ত দিয়ে যুক্ত করতে পারি… আসলে অসংখ্যভাবে যুক্ত করতে পারি। ইনফ্যাক্ট সেটা অনন্ত সংখ্যক উপায় হবে। যুক্ত করার প্রতিটি পদ্ধতির যদি একটা করে সমীকরণ থাকে তা হলে দুটি রেখাকে যুক্ত করার সমীকরণ অসংখ্য। প্রতিটিই এক-একটা তত্ত্ব। ফলে এই বিশ্বজগৎকে আমরা যতটাই দেখি না কেন, অনন্ত সংখ্যক তত্ত্ব পাব আমরা। হকিং মহান বিজ্ঞানী, কিন্তু তিনি যাকে থিয়োরি অফ এভ্রিথিং বলছেন আমি তাকে অন্তিমতত্ত্ব বলতেই ভালোবাসি… সেই অন্তিমতত্ত্ব হচ্ছে চৈতন্যময়। সে-অন্তিমতত্ত্ব আসলে স্বাধীন, তাকে কেউ গভর্ন করে না…করতে পারে না। তার কোনো আচরণের সম্পর্কেই ‘কেন’ এই প্রশ্নটাই চলে না। তার ইচ্ছা… সাঁই আমার কখন হাসে কখন কাঁদে কে জানে…

পার্থজিৎ: আপনি ‘কূট’ নামে একটি কবিতায় লিখছেন, ‘উপরে নিকষ গাব আন্দোলিত আকাশ ত্রিকাল/অতল তালের শব্দ। আগে ঢিপ, কিংবা আগে তাল?’। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমাদের এই বাংলারই এক কবি তো গূঢ় প্রশ্ন করেছিলেন, যখন ব্রহ্মাণ্ড ছিল না তখন মা মুণ্ডমালা কোথা থেকে পেলেন… এখন প্রশ্ন হল, সেই কবি তো কোনো প্রমাণিত সত্যের উপর দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন করেননি। তা হলে কি এক বোধকে আশ্রয় করে এই রহস্যের ভেতর প্রবেশ করা সম্ভব?

বিশ্বদেব: আহা, সাধক কমলাকান্ত…আসলে বোধ ছাড়া তো আর কিছুই নেই। এ-জগৎ কীরকম কেউ প্রশ্ন করলে আমি কী বলব? যেমন দেখি সেটা বলব? না, যেটা দেখতে পাই না সেটা বলব? যে-অবজেক্টিভ রিয়েলিটির কথা বলা হয় এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্স তো তার কাছাকাছিই। আমি আমার ‘বিজ্ঞান ও অন্তিমতত্ত্ব’-এ এই কথাই বলেছি বার বার। হাইসেনবার্গের যে-প্রিন্সিপাল অফ ইনডিটারমিনেসি সেটা আমাদের প্রথম আভাস দিল যে, তুমি বাবা যেই হও এ-জগতের কিছুকেই তুমি নির্ভুলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না… একটা অজ্ঞানতার জায়গা আছে। কোনো কিছু কেন ঘটবে সেটা বলতে পারি না… যা খুশি ঘটতে পারে… কিন্তু সেটা কার ইচ্ছায় ঘটে? বিজ্ঞান এখানে এসে হাত তুলে দিচ্ছে, বলছে আমি ঠিক বলতে পারব না ঠিক কী ঘটে। এমন কথাও অনেকে বলেন যে, ওই অনিশ্চয়তা আসলে চিহ্নিত করে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে যে-প্রশ্নটা আমরা করে চলেছি সেটাই ভুল। আমরা এই জগৎকে এই মুহূর্তে যেভাবে দেখছি পরমুহূর্তে ঠিক কীভাবে দেখব সে-সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।

পার্থজিৎ: ‘আবহমান’-এ প্রকাশিত হাইকু-র কাছে ফিরে আসি একটু… জেন দর্শন, বার বার বলা হয় sitting quietly and doing nothing বা Spring comes and grass grows by itself… এই যে আপনাআপনি গজিয়ে ওঠা ঘাস…এর মধ্যে যে ‘তাঁর’ ইচ্ছারই প্রকাশ… সেদিকেই কি আপনি ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন?

বিশ্বদেব: একদম সেটাই… আর একটা কথা বলতে চাই, এ-কথাটা কার কেমন লাগবে জানি না কিন্তু এখন আমি একটা ঘোরের মধ্যে থাকি… আমাকে কে কী মনে করবেন জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি মানুষের এই অবস্থায় এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ততা, এক পরম-আনন্দের অবস্থা থাকে… এখন আমার গুরুদেব ওই শিশুটি যে বাবা-মায়ের হাত ধরে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছিল। আমি ক্রমশ সেই শিশু হওয়ার দিকে এগোচ্ছি। এখন আমি বুঝতে পারি কিছু করার জন্য আমার ছটফট করার কোনো কারণ নেই, কিছু না-করার জন্যও আমার ছটফট করার কারণ নেই… শুধু যেটা প্রয়োজন তা হল সমর্পণ। জলে পড়ে গেলে ভেসে যাওয়া যেতে পারে, স্রোতের অনুকূলে বা প্রতিকূলে সাঁতার কেটে যাওয়া যেতে পারে… আমি শুধু বলছি, আমি গাছের পাতার মতো, টুপ করে খসে পড়ব। তারপর নদী তার ইচ্ছায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে… ওই খসে পড়াটা আমার হয়ে গেছে। আমার অবাক লাগে আধুনিক মানুষ গর্বের সঙ্গে ওই অসম্পূর্ণ তত্ত্বের (থিয়োরি অফ এভ্রিথিং) কথা বলে, কিন্তু একটি সম্পূর্ণ তত্ত্ব ‘বেদান্ত’… তার দিকে ঘেঁষে না। মানুষ এখন অসম্ভব ব্যাকুল হয়ে যেটা খুঁজছে সেটা আনন্দ নয়, বিজ্ঞানের চাবি। এই জায়গাটে আমার খুব আপত্তি।

পার্থজিৎ: আমার মনে হয় মানুষ আসলে খুব সরলরৈখিক শর্টকাট একটা পথ খুঁজছে, সে মনে করছে সেই পথটিই তাকে (হয়তো) অনন্তের সন্ধান দেবে… সব রহস্যের উন্মোচন ঘটবে সে-পথ ধরেই। আপনি বললেন আপনি প্রায় দ্বিতীয় শৈশবে পৌঁছে গেছেন। প্রথম দিকেই আপনি বলেছিলেন, কোনো কিছু পাবার জন্য আপনি কবিতা লেখেননি। কিন্তু অস্বীকার করার তো উপায় নেই আমাদের সাহিত্যের কলকাতাকেন্দ্রিকতা আছে, পুরস্কারের রাজনীতি আছে, ক্ষমতার আস্ফালন আছে। যদিও এ-সবের সঙ্গে একজন কমলাকান্ত একজন রবীন্দ্রনাথ একজন জীবনানন্দের কোনো লেনাদেনা নেই। ‘মানচিত্র ‘৯৭’ নামে আপনার একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে যেখানে আপনি খুব ধীরস্থির অভিজাত ভঙ্গিতে এই নশ্বরতাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম থেকেই এ-সমস্ত পকেটসগুলো থেকে নিজের আত্মাকে নিজের সত্তাকে রক্ষা করবার কবজকুণ্ডল কী ছিল আপনার?

বিশ্বদেব: আমি স্পষ্টভাবে বলি— আমি নিজেকে রক্ষা করিনি, আমাকে ঈশ্বর রক্ষা করেছেন। আরও স্পষ্টভাবে বলি— কবিতা লেখার যে-আনন্দ, সে-আনন্দ যে একবার পাবে সে এইসব কোলাহলের মধ্যে যাবে না। আমি কবিতার ভেতরে থেকে, চিন্তার ভেতর থেকে যে-আনন্দ পাই কোলাহলের ভেতরে গিয়ে একশোটা পুরস্কার পেলেও সে-আনন্দ আমি পাব না। তুমি কি সেইসব মানুষের সমাজে যাতায়াত করবে যাদের ভাষার একবর্ণও তুমি বোঝো না? আমি এদের ভাষা বুঝি না; আমি এত আধুনিক নই। আমি সেকেলে মানুষ, আমার মনে হয়েছে সেকালের মানুষের মধ্যে এতটা ভেজাল ঢোকেনি। জানো, আমি একসময় আকাশবাণীতে চাকরি করতাম, আমাদের বলা হত এই যে এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা সব কিন্তু যন্ত্রের জন্য, আপনাদের জন্য কিছুই না। রাস্তায় ট্রাক যাচ্ছে, ট্রাকের নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই… কিন্তু তার স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকা ড্রাইভারের চিন্তার অন্ত নেই। রাস্তায় হেঁটেচলে বেড়ানো মানুষের চিন্তার অন্ত নেই…মানুষ এই অবস্থাটা তৈরি করছে আর তার নাম দিচ্ছে আধুনিকতা। আমার ‘অনন্তমূলের খোঁজে’ বইটিতে একটি ছবি আছে, বনের মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে আর একটা ছোট্ট কুটির… একলা বসে আছি। আমার ইহজাগতিক সুখের ওটাই চরমসীমা। আমার কোনও গতি নেই, দুর্গতিও নেই… কোনো কিছু ‘করার’ বাসনাও নেই, ‘না-করার’ বাসনাও নেই। অনেকে এ-সব শুনে আঁতকে উঠে বলতে পারেন তা হলে তো সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে… আমি শুধু বলব সভ্যতার নামে আমরা যা গড়ে তুলেছি তাকে ঠিক সভ্যতা বলা যায় না। প্রকৃত সভ্যতা হলে সেখানে শান্তি বিরাজ করত, কারণ, শান্তির থেকে মূল্যবান তো আর কিছুই নেই।

পার্থজিৎ: আপনি যখন ‘ঢেঁকিঘর’ লিখছেন তখন সেখানে সৃষ্টি প্রলয় মহাকাল মহাকালী ইত্যাদি বিষয় বার বার ছায়া ফেলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তন্ত্রের এক জগৎ আপনার ভেতর ডালপালা মেলছে। আপনি কি সে-সময় তন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন?

বিশ্বদেব: এগুলো বীজ-রূপে থাকতে পারে কিছু, কিন্তু আমি নিজে পড়ার থেকে ভাবতে বেশি ভালোবাসি। যাঁরা তন্ত্র-সংক্রান্ত বই লিখেছেন, চর্চা করেছেন তাঁরা প্রকরণের ভেতর দিয়ে গেছেন। আমি এ-সবের মধ্য দিয়ে যাইনি। আমি একটা সাধনাই বুঝি— প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অতিক্রম করে আরও ভালো মানুষ হয়ে ওঠা। অন্য কারোকে অতিক্রম করা অন্যায়, সে-ভাবনা মনে আনতে নেই। ঈশ্বর মানুষের কাছে একটাই কামনা করেন— মানুষ প্রকৃত মানুষ হবে। ঈশ্বর কুকুরের কাছে কামনা করেন— কুকুর কুকুর হবে… সাপ সাপ হবে… হাতি হাতি হবে… গাছ গাছ হবে… এই তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। তাই-ই হয়ে আছে; একমাত্র মানুষই অন্য কিছু হবার চেষ্টা করে।

পার্থজিৎ: যে-আনন্দের কথা বললেন, শিল্প তো সেই আনন্দেরই প্রকাশ। একজন শিল্পী যখন সেই আনন্দিত স্তরে পৌঁছান তখন কি তাঁর কাছে ফর্মের সব কারিকুরি ফিকে হয়ে যেতে শুরু করে? কনটেন্ট-ই কি তখন মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর কাছে?

বিশ্বদেব: আমার নিজের ধারণা, ফর্ম আসলে আপনি আসে। কবিতার শরীর, আত্মা এ-সবকে আমি পৃথক করে দেখতে পারি না। কবিতা কীভাবে আসে সে এক গূঢ় রহস্য। কার্ল পপার যেমন বলেছিলেন, একটা সায়েন্টিফিক থিয়োরির মূলে ধারণার আদি বীজটি একজন বিজ্ঞানীর মনে কীভাবে অঙ্কুরিত হয়, সেটা তাঁর কাছে রহস্য। আমাদের চৈতন্যের গুহাগাত্রে খোদিত রয়েছ অপরূপ যে-সব কারুকার্য, আমরা তাকে দেখছি… তারপর তাকে পুনর্লিখন করছি। কবি, বিজ্ঞানী, শিল্পী… সকলেই তাই করে থাকেন, তাছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। দেখ, শিশু জন্মানোর আগে পর্যন্ত বাবা-মা জানেনও না যে, তার গায়ের রং কেমন হবে, তাকে দেখতে কেমন হবে, তার হাত-পা কেমন হবে… অথচ শিশু জন্মায়। কবিতাও একটি নিটোল ভাবকে অনুসরণ করে। এমনই এক রহস্যময় পদ্ধতিতে লিখিত হয়… কবির ভূমিকা সেখানে আমেরিকা আবিষ্কারে কলম্বাসের ভূমিকার থেকে বেশি বা কম কিছু নয়। ‘আমার’ থেকে যেমন আমার শরীরকে আলাদা করা যাবে না, আমি কবিতার ক্ষেত্রেও সে-কথা বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি কবিতা জন্ম নেয় তার ফর্মকে নিয়েই।

ক্রমশ…

Facebook Comments

আলাপচারি: পার্থজিৎ চন্দ 

জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার এক শিল্পাঞ্চলে, বেড়ে ওঠা মিশ্র ও বহুভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। অল্প বয়সে লেখা প্রথম প্রকাশিত হলেও বেশ কয়েক বছর স্বেচ্ছায় লেখা থেকে দূরে চলে যাওয়া। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে পরপর; প্রকাশিত হয়েছে শিল্প ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে বহু প্রবন্ধ। বেশ কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে ও পাঠকের সমাদর পেয়েছে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, শিক্ষকতা করেন একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। শখ- নানা বিষয়ের বই পড়া ও গান শোনা।

পছন্দের বই