লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়

মাদল

ছোটো ছোটো টিলা। শালের জঙ্গল। মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠ। জায়গাটা ভালো লেগে গেল গৌতমের। মুখে অবশ্য ও প্রকাশ করল না।

‘একেবারে অজ জঙ্গুলে অঞ্চল। হু! গাড়ি খারাপ হওয়ারও আর জায়গা পেল না।’

বিরক্তি প্রকাশ করলেন পাল সাহেব, ওর চামচিকে-বস্।

অন্য সময় হলে ও পাল সাহেবের কথায় সঙ্গে সঙ্গেই সায় দিত। ও তাই করে থাকে, একটু আগেও গাড়িতে তাই করেছে। কিন্তু এখন কেন যেন, এতদিনের অভ্যাসটাকে ও হঠাৎ কাটিয়ে উঠল। মনে মনে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল একটা ঝাঁকড়া মতো গাছের দিকে। মউল গাছ। পাকা মউলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আঃ! জোরে জোরে ফুসফুসভরতি করে হাওয়া টেনে নিল সে। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন পাল সাহেব। পরক্ষণেই হাতের ঘড়িটা দেখলেন। ‘দেরি হয়ে যাবে’— ব্যস্তভাবে পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— ‘দত্ত সাহেবের চিঠিটা সঙ্গে আছে তো?’

‘হ্যাঁ’— অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিল ও। বোধহয় এই প্রথম ও হ্যাঁ শব্দটার পরে ‘সাহেব’ কথাটা যোগ করল না। এরা সবসময় পরস্পর পরস্পরকে সাহেব বলে সম্বোধন করে কেন কে জানে? পরস্পরকে সম্মান দেখানোর জন্য? কই, সম্মান দেখানোর জন্য তো রবি ঠাকুরকে কেউ রবি সাহেব বলে না! চোখ ফেরাতেই দেখে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে…

পরক্ষণেই, ও দেখল, ঝরনার মতো কল কল করতে করতে বাঁ-দিকের শালের জঙ্গলটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটি সাঁওতাল ছেলেমেয়ে। দু-টি মেয়ে একটি ছেলে। যুবকটির গলায় একটা মাদল ঝুলছে। এলোপাথাড়ি তাল দিচ্ছে মাঝে মাঝে। ওর সঙ্গী মেয়েটির হাতে মস্ত বড়ো কাঁসার একটা খঞ্জনীর মতো ঝাঁই। বাজাচ্ছে ঝম ঝম করে। আর সব চাইতে ছোটো মেয়েটি— প্রায় তরুণীই বলা যায়— তার হাতে কিছু নেই। পায়ে মল ঝুম ঝুম করে বাজিয়ে কাছে এসেই হাসি হাসি মুখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গৌতমের দিকে। মানুষটাকে ওর ভালো লেগেছে— এই সহজ কথাটা লুকোনোর কোনো চেষ্টাই নেই। হঠাৎ মেয়েটার খিল খিল হাসিতে গৌতমের চমক ভাঙল।

‘এ্যাই!’ পাল সাহের কর্কশ গলায় বললেন, ‘শহর এখান থেকে কত দূর?

যুবকটি সামনের দিকে আঙুল তুলে জবাব দিল, ‘হুঈ… দশ ক্রোশ হবেক।’

‘আর তোমাদের গ্রাম?’— দ্বিতীয় প্রশ্নটা গৌতমের। মেয়েটির উদ্দেশে।

‘উই তো বটে’ আবার খিল খিল করে হেসে মেয়েটি আঙুল দেখাল সামনের শালকুঞ্জের দিকে। কিন্তু কোনো গ্রাম নজরে পড়ল না গৌতমের।

‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?’, গৌতম জিজ্ঞাসা করে। অমনি খিল খিল করে হাসির ঝরনা গড়িয়ে গেল।

‘চল কেনে? যাবি?’— হেসে জবাব দিল ছেলেটি। তার কথায় স্পষ্ট আমন্ত্রণের সুর।

ঘর র র…

গাড়িটা স্টার্ট নিয়েছে আবার।
‘ঠিক হয়ে গেছে সাব’— ইঞ্জিনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতের তেল কালি মুছতে মুছতে জানাল ড্রাইভার তেওয়ারি।

‘হয়ে গেছে! যাক।’— হাঁফ ছেড়ে পাল সাহেব বললেন, ‘নাও, চল চল গৌতম। উঠে পড়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। দরজটা খুলে ওর কীটস ব্যাগটা নামিয়ে আনল। তারপর হেসে বলল, ‘না স্যার খুব একটা দেরি এখনও হয়নি। ভাগ্যকে ধন্যবাদ।’

‘এ কী, তুমি কোথায় চললে?’— পাল সাহেব এবার বুঝি রাগে ফেটে পড়বেন।

‘চললাম জীবনের খোঁজে’— ‘ননসেন্স! একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি, এ সময়ে…’

‘আমি তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি’— ওঁকে পাত্তা না দিয়ে বলে ওঠে গৌতম। ততক্ষণে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমেছে সে।

‘তুমি কি পাগল হলে গৌতম!’— রমেশ পাল হাতাশ কণ্ঠে বললেন— ‘এর জন্যে তোমার চাকরি যাবে, তা জানো?’

‘জানি’— গৌতম হাসি হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়াল। ‘চাকরিতে আমার আর প্রয়োজন নেই। ছেড়ে দিলাম।’

‘ছেড়ে দিলে!’— পাল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন। ‘কিন্তু তোমার চাকরি ছাড়া…’

‘প্রয়োজন নেই। বাকি জীবনটা এদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব’—

পা বাড়ালো সে। জ্যোৎস্নার মাঠ পেরিয়ে মউলের ছায়া থেকে সাঁওতালী গাঁয়ের দিকে এগিয়ে গেল গৌতম। যেদিকে জীবন, যেদিকে মুক্তি…

পরদিন একটু বেলায় যখন ঘুম ভাঙল ওর, মাথার মধ্যে তখনও ভারী হয়ে আছে কাল রাতের মহুয়ার নেশার রেশটুকু।

স্নিগ্ধ নিঃশব্দ সকাল। আশে পাশে কেউ নেই। মেয়েটাকেও দেখতে পেলনা সে। বোধ হয় দল বেঁধে কাজে গেছে।

বুকের নীচে ছোট্ট একটা মোচড় অনুভব করল সে, কিন্তু সেটা সুখের না বেদনার তা ঠিক বুঝতে পারল না। মাটির ঘর। তকতকে নিকোনো মেঝে। একটা শেতলপাটির ওপর শুয়ে আছে ও। মাথার কাছে ছোট্ট জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। জানলার একপাশে জলের সরাই একটা—

ঘরে আর কিছু নেই।

যেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেন আরও কিছু থাকলে ভাল হত। আরও কিছু প্রয়োজন ছিল ওর। মাথার নীচে কীটস ব্যাগটার ওপর সস্নেহে হাত বোলালো সে। তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে কবজির ঘড়িটা দেখল। বেলা আটটা দশ। পথ দশ ক্রোশ…

হাইওয়ে থেকে বাস ধরতে পারলে—

‘এখনো সময় আছে’— বিড় বিড় করে কথাগুলো উচ্চারণ করল সে।

তারপর উঠে দাঁড়াল তার কীটস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে।

বার্নিশ করা একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘামছিল গৌতম। ধিতাং ধিতাং ধিনতা ধিতাং— ক্রমশই তার বুকের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে কাল রাতের মাদলের শব্দটা। কাঁপা হাতে হাতলটা ঘুরিয়ে মাথাটা আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল সে। ধরা গলায় প্রশ্ন করল, ‘আসব স্যার?…’

Facebook Comments

পছন্দের বই