Categories
গদ্য

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর গদ্য

অতিমারির উৎসব ও এক ছদ্মকবি

মানুষের মন বিবর্তনশীল। ঠিক তেমনই তার সৃজনশীলতাও। মনের অনুভূতি ও সৃজনশীলতার প্রক্ষেপণ অভিন্ন। ঠিক তেমনই অভিন্ন মনের অবসাদ ও সৃষ্টির অবক্ষয়। মানবজীবন স্বল্পায়ু। তবু এই স্বল্পায়ু সম্বল করেই মানুষ বলতে পারে দার্শনিক রেনে ডেকার্টের মতো ‘আমি ভাবি, তাই আমার অস্তিত্বও আছে’। আবার কখনো-বা সে বলে ওঠে ‘এ মায়া প্রপঞ্চময়’। মানুষের আয়ুকাল সীমিত হলেও তার ভাবনার পরিধি ও কল্পনার ব্যাপ্তি মহাকাশের মতোই অনন্তপ্রসারী। মনোজগৎ ও বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্প, শিল্প ও সাহিত্যর মধ্যে কোনো অন্তরায় সভ্যতার জন্মলগ্নে ছিল না। এই সীমানা প্রতীষ্ঠা আধুনিক সভ্যতার অপচেষ্টা। প্রতিটি মানুষের মনের কোণে একজন কবি লুকিয়ে থাকেই। তিনি প্রবল হিসেবি গহনাকারই হোন, বা দোর্দণ্ডপ্রতাপ একনায়ক। সারাজীবন এক পঙ্‌ক্তি কবিতা না লিখলেও মানুষমাত্রই কবি। শুধু সেই কবিত্বকে পরিস্থিতি প্রবৃত্তি ঋণীঋতির আবর্তে কেউ কেউ চিরকালের জন্য কণ্ঠরোধ করে দেন। কবিতা যে শুধু লিখতেই হবে এমন কথা কে বলল? আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির সূত্র কি পৃথিবীর সুন্দরতম কবিতার একটি নয়? বা মোৎজার্টের যন্ত্রালেখ্য! কবিমন ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব। তিনি যখন মা, তখনও তিনি কবি। আবার যখন শিশু, তখনও। তবু সেই কবি হওয়া কি সহজ? চারিপাশের অতিমারি। তার ভ্রূকুটি আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা কতটা নিস্পৃহ থাকতে পারবে সেই কবিসত্তাটি? কবি অরুণ মিত্র তাঁর ‘কবিতা, আমি ও আমরা’ প্রবন্ধ শুরু করছেন এইভাবে, ‘আমি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি। যে-সময়ে লিখি না, মাঝেসাঝে ভাবি কেন কবিতা লিখি। নিশ্চিন্ত হতে পারি এমন উত্তর কখনো পাই না। আধুনিক কবিতার কোনো লেখক কি পান? জনসমষ্টির সঙ্গে কবিতার যখন আর যোগ নেই তখন এক মোক্ষলাভ ছাড়া বস্তুত আর কোনো লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘এই ভয়াবহ সময় কে জানে, সেই ‘মোক্ষলাভ’-এর আশাতেই কি না, কয়েকটি লিখে ফেলা পঙ্‌ক্তি নিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছি এই লেখাটি।’

তখন অতিমারির খবর সবে আসতে শুরু করেছে। ইউরোপে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। উড়ে উড়ে ভেসে আসছে ভয়ের শব্দ। কোথাও লটারি করে ঠিক হচ্ছে ভেন্টিলেটর কে পাবে, কোথাও গণকবরের ওপর তৈরি হচ্ছে রাস্তা। সেইরকম এক সময়ে হাসপাতালে রাতে ডিউটির সময় একচিলতে সুযোগ পেয়ে লিখেছিলাম এই কবিতাটি।

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে যে-শব্দগুলি
আজ আমার কথোপকথন শুধু তাদেরই সাথে
আমি প্রশ্ন করি ওদের
ফাল্গুন ঝড়ের কথা
দখিনাবাতাসের কথা
জানতে চাই কবে আসবে তুষারপাত
উত্তর ফিরিয়ে দেয় রংচটা গোলাপি দেয়াল
আমি সেই উত্তর শুনতে পাই স্পষ্ট
কিন্তু তাদের অর্থ বুঝতে পারি না কিছুতেই

কবিতার সঙ্গে স্যানিটাইজার দিয়ে ভাবলাম অনেকগুলো ছোটো ছোটো স্কুলপড়ুয়া শিশুর ছবি আঁকব। কিন্তু কী হল কে জানে। ছবি শেষ হলে দেখলাম, প্রতিটি পড়ুয়ার চোখেমুখে ভয়। এটা তো আমি সচেতনভাবে চাইনি! তাহলে কি অবচেতনে আমারও মনের মধ্যে অনিশ্চয়তার ভয় ঢুকে বসেছে? যেমন লিখতে চাইনি ‘রংচটা গোলাপি দেয়াল’। আমি লিখতে চাইনি। তাহলে কে লেখাল! আমি কি তবে হ্যালুসিনেট করছি? অতিবায়বীয় অতিমারির জিনপরি ভর করছে আমার ভিতর!

এর কিছুদিন পর ঘটে গেল একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা যাঁরা মাঝেমধ্যে শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য যাই, তাঁরা জানি, সেখানকার সেবায় ব্রতি নার্সরা অধিকাংশই হয় মণিপুরী, নয় কেরলবাসী। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই সেবিকারা অসম্ভব পরিশ্রমী ও মেধাবী হন। চব্বিশ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর অনায়াসে আবার আরও এক চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করতে পারেন। ভাষাগত যে-কাঠিন্যটুকু থাকে তা অতিক্রম করতে তাঁরা হয়ে ওঠেন অতিরিক্ত স্নেহশীলা। সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা রোগিকে পরম যত্নে হাতে করে খাইয়ে দিতেও দেখেছি আমি। বিনিময়ে আমরা যারা ‘বুদ্ধিজীবী’ জাতি বলে মনে করি নিজেদের, কী দিয়েছি ওদের? সম্মান? স্বীকৃতি? অধিকার? সুরক্ষা? না। এর কোনোটাই হয়তো পারিনি দিতে। শপিংমলে ওদের দেখে আড়ালে ‘চিঙ্কি’ বলেছি, রিসেপশনে ওদের কথা বলার ধরন নকল করে টোনটিটকিরি কেটেছি। সেদিন তেমনই বেশ কিছু সিস্টারদিদিমণি অভিমান করে ফিরে গেলেন তাদের নিজের রাজ্যে। মন ভালো ছিল না আমার। একদিকে অতিমারির মনখারাপের লকডাউন। অন্য দিকে শহরের কোল খালি করে চলে যাওয়া এই সেবিকারা। সেদিন হঠাৎ লিখলাম।

পরবাস

ওরা চলে গেল শূন্য দেউল রেখে
দেউলের বুকে সময়হরণ চাকা
ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
যুদ্ধক্ষেত্রে রইল চাদর ঢাকা।

ওরা ছেড়ে গেল একবুক অভিমানে
আমাদের ব্রত বুদ্ধিজীবীর মতো
ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
দেউলের চাকা নিয়তি শরণাগত।

ময়না আর তদন্ত খুঁটে খাওয়া
আমাদের যত পথ্য শোধনাগার
ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
ওরা চলে গেল স্তব্ধ করল হাওয়া।

ওদেরকে কেউ পিছুডাক দিল না তো
এতোদিন শুধু পিছে ডাক দিয়ে গেছি
যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
ওদের দু-চোখ করেছি অশ্রুজাত।

যাতায়াত পথে অপমান ভরে দিয়ে
আমরা ওদের পরবাসে ঠেলে দিলেম
আমরা আবার নেমে আসি সমতলে
ওরা চলে যায় স্বপ্ন বোনার দেশে।

হাসপাতাল তো দেউলই আমার কাছে। মনে হল এই হঠাৎ চলে যাওয়া অনেকটা তৃতীয় পানিপথ যুদ্ধে ভরতপুরের জাঠ রাজা সুরজমলের মারাঠাদের একলা ফেলে চলে যাবার মতো। এরপর কী করে যুদ্ধে লড়ব আমরা!

ক্রমশ মৃত্যুর সরণি বয়ে আসছিল আমার দেশের দিকেও। প্রথমে কিছু বিখ্যাত মানুষ। তারপর পাশের রাজ্য। তারপর পাশের পাড়া। তারপর একদিন নিজের আত্মীয়স্বজন। মৃত্যু তখন ঘরে ঘরে। সে এক মৃত্যুনদীর স্রোত যেন। সেই বিষাদঘন আবেশে বয়ে এল নতুন মহামারি আইন। মৃত্যুর পর মৃতদেহ তার নিকটজন দেখতে পারবেন মাত্র তিরিশ সেকেন্ড। তারপর পলিথিন মুড়ে তাকে ফেলে দেওয়া হবে লাশঘরে। সেখানে মৃতদেহর স্তূপ। সেখান থেকে গণদাহর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। এই যন্ত্রণা অসহনীয়। মনোবিজ্ঞান বলে মৃত্যুর পর মৃতদেহ ঘিরে আপনজনদের আর্তি অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক। সেই আর্তিতে যাঁরা স্বজনহারা হলেন তাঁরা অবচেতনে স্বীকার করে নেন বাস্তব। মনোবিদ এলিজাবেথ কুবলার রোজ এই ঘূর্ণিপাকের কথা বলেছেন। ত্রিশ সেকেন্ডে তা কতটা সম্ভব? তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমার শিক্ষকের শাশুড়িমা মা গেলেন অতিমারির সংক্রমণে। তার মৃতদেহ কাচের দেওয়ালের ওপার থেকে দেখার অনুমতি মিলল মাত্র ত্রিশমিনিট। কিন্তু তাঁরাই বা দেখবেন কী করে? তাঁরা নিজেরাও তো তখন ঘরবন্দি। তাঁদের দেহেও সংক্রমণ। সেদিন রাতে লিখলাম এই কবিতাটি।

চরণিক

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
যাচ্ছি রেখে কৃষ্ণচূড়ার পাতা
আমার এ-পথ নদ হবে না জেনো
আমি হলাম শেষ না হওয়া খাতা

তোমার জন্য ফুলেল উঠোন রাখি
আমায় তুমি মুড়ছ পলিথিনে
আমার জন্য অন্তমিলের পদ
সাজিয়ে রেখো অন্য টুকিটাকি।

তুমি যাবে সদর সড়ক দিয়ে
তোমার জন্য খুলছি ব্যারিকেড
এতটুকুই আমার কণ্ঠনালি
আর কটা ধাপ বলব আশা নিয়ে।

তোমার জন্য সবুজ রেখে গেলাম
আমার চলা দখিন দুয়ার দিয়ে
ভোগ লেগেছে জগন্নাথের বাসায়
আমার কথা ফুরিয়ে গেল ঘিয়ে।

কবিতাটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর বেশ কিছু মানুষ প্রশংসা করলেন, কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া জানালেন। কিন্তু লক্ষ করলাম, আমার মন সেইসব স্পর্শ করছে না। নিস্পৃহ লাগছে সবকিছু। তবে কি এভাবেই শেষ হবে মানবসভ্যতা!

ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমরা। মহাকাশে চলতে থাকা যানের মতোই। আলাদা হয়ে গেল সম্পর্কর মডিউলগুলো। হাতে রসায়ন ঘষি, মুখে আবরণ পরি। এই আবরণের একটি সুবিধা। মনের অন্তরের দোলাচলকে আর কষ্ট করে লুকিয়ে রাখতে হয় না। কবিতা আসে না আর। কবিতা ফুরিয়ে আসে। ক্রমশ ক্লান্ত হই। ক্রমশ নিজেকে মনে হয় পরাভূত। তবু জাহাঙ্গীরের দরবারে একটি পাখির ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বিচ্ছিন্নতা তার মায়াজাল বিস্তার করেছে। ঘরে ঘরে অবিশ্বাস। ভাইয়ে ভাইয়ে পাড়ায় পাড়ায় অবিশ্বাস। এত বিষ নিয়ে কবি লিখতে পারেন। আমি লিখব কী করে? আমি তো ছদ্মকবি। যাত্রাপালার বিদুষকের মতো আমার বেশভূষা পাগড়ি জহরত, সবটুকুই যে ‘ছদ্ম’। ভাবতে ভাবতে লিখে ফেলি আমার শেষ কবিতা।

মস্যাধার

আমার আঙুলে আর লেখনিশক্তি নেই
তুমি সেই অন্ধকার আগলে রেখেছ কবি
আমি ভগ্ন রাজ উঠোনের একপাশে
ভগ্নচোয়াল ঘিরে জীর্ণ মলিন রাজবেশ।

আমার গোলাপবাগে বেদখল কলতান অসহ্য মনে হয় না আর।
ওদের বেড়ে উঠতে দেখি আমি আঙুলের কোনায় নিভৃতে
ওরা তুলে নেয় রং
আমারই মস্যাধার থাকে
আমার লেখনি নেই
অবিশ্বাস বাস করে সেই শূন্য ঘরটুকু জুড়ে।

লিখে ফেলি। কিন্তু মানবসভ্যতার ওপর বিশ্বাস হারাই না। মনে মনে ভাবি, আমরা কাটিয়ে উঠবই। সেদিন আবার লিখব। কারণ, যতই ছদ্মবেশ হোক, বিদূষকের চলনবলন আমার রক্তে, অনুভূতিতে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবি। আমি আবার লিখব। নতুন সূর্যের দিনে লিখব। কারণ, লেখা ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা নেই। কোনো মানুষেরই হয়তো থাকে না।

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা

শুধুমাত্র গোটা জীবনভর একটা অলীক পথের রেখা আমি লুকিয়ে রেখেছি দুপুরের বুকের ভিতর। যেন সে নিজেই এসে বলে: দগ্ধ শালিকের ডানায় এই মুখ আমি প্রথম দেখেছি! অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হব বলে কত ঝড়জল পেরিয়ে এসেছি— দেখেছি পাহাড় দেখে জটিল হয়েছি। আজও আমার সাদা পাতার কাঙালপনা, কবে সে নিজেই ফুটে উঠবে। তখন মনে পড়বে না প্রবীণ কবির ছলনা। একটি ভাঙা সাঁকো জুড়ে যাবে চারপাশে। মনে পড়বে প্রথম রোদ্দুরের স্মৃতি। মনে পড়বে বিষণ্ণ গোধূলির পিছনে লুকিয়ে আছে হলুদ বাথরুম; চারপাশে বেহিসেবি জঙ্গল। আর আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে দু-টি শরীর গভীর উত্তাপে। সেই প্রথম চোখ ফেলা হলুদ স্তনের ভাস্কর্যে। বিকেলের অভিশাপ তার মুখ বিষণ্ণ বড়দির মতো। শুধু কিছু করার ছিল না। যখন নিজের দু-হাত স্বপ্নের হত‍্যাদৃশ‍্য লেখে। আমি টের পাই ফাঁকা বাড়ির গর্ভে সন্তান এসেছে।

কথায় কথায় এসে পড়ে ছোটোবেলার গান। অনুরোধের আসর। বিবিধ ভারতী। অনিবার্য শ্রাবন্তী মজুমদার গাইছেন— ‘মাথার ঘন চুল যখন, মরুভূমি হয়ে যায়, ওয়েসিস নিয়ে আসে মরূদ্যান মেঘের ছায়ায় ছায়ায়’। একটি বিজ্ঞাপন জুড়ে এমন অপ্রত্যাশিত সুরের আশ্চর্য বিষাদে ভরে ওঠে দুপুর। আর মাঝে মাঝে ভাবি আরেকটু বড়ো হলে একদিন ওয়েসিস কিনে আনব ঝক্‌ঝকে স্টেশনারি দোকান থেকে। গুপ্তচরের মতো ঘুরে বেড়াব অলৌকিক নীল দোতলা বাড়ির জানলার ছায়ায়। অপ্রত্যাশিত চোখের আলো চোখের বাহিরে এসে পৌঁছবে একদিন। তারপর একদিন এই বাড়ি বিক্রি করে তারা উঠে যাবে সোদপুর স্টেশনের কাছে। বিকেলের পুকুরের গরম জলের ঘনশ্বাসে সেইসব উপকথা একদিন ফেলে এসেছি আমি।


মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানের শেষে শ্রোতারা মুগ্ধ। শুধু এক বৃদ্ধা পথ রোধ করে দাঁড়ালেন তাঁর। অনেক দূর থেকে এসেছেন তিনি। হাতের ঠোঙায় প্রিয় শিল্পীর জন‍্য বাড়ির তৈরি নাড়ু। হেমন্তর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বাবা কত গান গাইলে কিন্তু আমার প্রিয় গান তো গাইলে না? চোখে জল নিয়ে আবার মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে গাইলেন— ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই’। আরেকবার ফাংশন শেষ করে গাড়িতে উঠছেন হেমন্ত। হঠাৎই খালি গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি ছোটো ছেলে। বলে অসুস্থ বাবার কথা। মৃত‍্যুশয‍্যায় একবার তিনি চোখের দেখা দেখতে চান প্রিয় শিল্পীকে। হেমন্ত বিষণ্ণ ছেলেটিকে গাড়িতে তুলে নেন। তারপর হাজির হন ছোটো এক গলির জীর্ণ কুটিরে। মৃত‍্যুশয‍্যায় শুয়ে এক অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি হন শিল্পী ও শ্রোতা। পরে হেমন্ত বলেছিলেন কী এমন আছে আমার যার জন্য মানুষের এমন ভালোবাসা আমি পেতে পারি! এখনও পৃথিবীতে আছে জীবনের বিষণ্ণ সন্ধ্যায় একপশলা অপ্রত্যাশিত। না বলে আসে। না বলেই চলে যায়। মানুষ যখন টের পায় তখন হেমন্তের পৃথিবী জীবনানন্দের ডায়েরিতে লুকিয়ে পড়েছে।


সমৃদ্ধ বনান্তরে সকল শস‍্য আলো দেয়। উৎপাদন রহস‍্যের কাছাকাছি। জমির সীমানা মেপে নেয় একদা প্রাচীন মালিক। তবু কি ঝড়েজলে পাওয়া গেল তাকে? হাইরোডের পাশে গচ্ছিত ঋতুরহস‍্য। এই সমৃদ্ধি দেখছে বাঁকা চোখে শেষ কুশীলব। যখন বাতাসে বিধবা নাভির আকুলতা। বহুদিন পর ছায়ার নদী ভেঙে এগিয়ে এসেছে বনভোজন। নিজেকে তার মনে হয় নাবিক। চারদিকে জলের ভিতরে আলপথ বেয়ে যথার্থ ভ্রমণ। এবং এইসব অতিশয়োক্তি গিলে নিজের বয়স সুস্পষ্ট হয়।

এবার গরম ভাতের উপর সামান্য মাংসের ছোঁয়া পেলে আমি লিখে দেব সন্দেহজনক এই পিছনের বাড়ি। রোগা ছেলে উদাসীন জ‍্যামিতি আঁকে মাঠের দুপুরে। তারপর চৌমাথার মোড়ে ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে দু-একটি মানুষ চোখের সামনে দেখে ফেলে মৃত ধান, রক্তে মেশানো এক জন্তুর ছায়া। উৎপাদিত শহরের চারপাশে, এই ঝড়ে জলে যা কিছু আচ্ছাদিত তারা বাদলের সংসারে ভেসে ওঠে। তখন হাইরোডের দু-পাশে অকালমৃত ঝরে পড়ছে গান।

ক্রমশ ভোরের দিকে দেখে ফেলি। সায়া ও সেমিজ ফেলে অর্ধনগ্ন দেহ মিশে যায় মাটির শরীরে। শুধু গৃহস্থটুকু পড়ে রইল। একটি সোনার কলস ভরে সিন্দুকে রাখা হল চরিত্রের আমিষাশী নখ। এখন দু-টি সন্তানের দায়িত্ব, চাষবাস, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি— এক হাতে সব দিয়ে, বলুন দেখি সে কোথায় পালাল? যাত্রাপালার এই কথাগুলি ভোররাতে লণ্ঠনের পিছু পিছু চলে এসেছে আমার ঘরে। চায়ের জল চাপিয়ে তন্ন তন্ন খুঁজে চলেছে অসুখের বৃত্তান্ত।


তারপর একদিন ভোরে এসে পৌঁছল নবীন দম্পতি। নির্জন পাহাড়ের কোলে মধুচন্দ্রিমা। যে-বাংলোয় উঠেছে তারা সেখানে পর্যটক নেই। শুধু এক প্রবীণ দম্পতিকে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সকালের রোদ্দুরের ঋণ শোধ করে দেয় গোধূলির আলো। তরুণ স্বামী স্ত্রীকে সাবধান করে দেয়— যেন তাদের নতুন জীবনে ওই প্রবীণ দম্পতি আলাপ জমাতে না আসে। তবুও আলাপ হয়। একদিন সন্ধ্যায় প্রবীণ দম্পতির ঘরে চায়ের নিমন্ত্রণ আসে। নবীন দম্পতি সন্ধ্যায় পৌঁছে যথারীতি অপ্রস্তুত। বৃদ্ধা অসুস্থ। আর তাঁর মাথার পাশে বসে সেবা করে চলেছেন প্রবীণ স্বামী। সারাজীবন নিঃসন্তান, বহুবার অসুস্থ স্ত্রীকে সেবা করে আসছেন তিনি। একসময় ঘরে ফিরে আসে নবীন দম্পতি। তরুণ স্বামী টের পায় অবরুদ্ধ কান্নার স্বর। এক অপ্রত্যাশিত রূঢ় জীবনের ধাক্কায় বিশ্বাস টলে যায় তরুণীর। আজ তার যৌবন আছে। শরীরের লাস‍্য আছে। আজ ভালোবাসার কথা বলা অনেক সহজ। একদিন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই ভালোবাসা এমন অবিশ্বাস্য সুখের সন্ধান দেবে কি? না কি অর্থহীন নীরবতায় চরাচর জুড়ে নেমে আসবে অবলুপ্ত শরীরের শোক?

এমন করেই আবার একদিন গল্পের চরিত্রের মুখোমুখি হয় একজন সুদূর ‘আমি’ উদাসীন সংসারে। আমি মানুষটির সংসারে অথবা সমাজে সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেই। আসলে তার কোনো ব‍্যক্তিত্ব নেই। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত সংসারে তার কথার কোনো মূল্য দেয় না। গোটা জীবন জুড়ে শেষপর্যন্ত তিনি যেন এক অতিরিক্ত— উচ্ছিষ্ট। তবুও একদিন সকালে তিনি ফিরে পেলেন মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক নিজস্ব স্বর। বাজারে মাছওলাকে ধমকালেন। প্রতিবেশী এক কর্ণেলকে ব‍্যঙ্গের উপযুক্ত জবাব দিলেন। তারপর এসে দাঁড়ালেন বাড়ির দরজার সামনে। কলিংবেল টিপলেন। ভিতর থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করে উঠল— কে? তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুধু বললেন— ‘আমি’। এই স্বর সত‍্যিই কি চেনে তার স্ত্রী অথবা সমাজ। তবু সে আছে। গোপন অমোঘ এক শুশ্রূষার মতো এই একরত্তি জীবনে।


তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার কী? এই প্রশ্নের উত্তরে বনফুল শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য গল্প। ভাগলপুর থেকে জরুরি কাজে কলকাতা যাবেন বনফুল। কুলি নিয়ে যখন স্টেশনে পৌঁছলেন প্ল‍্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বনফুল হতাশ হয়ে বসে পড়লেন একটি বেঞ্চে। এদিকে কলকাতায় না-গেলেই নয়। ট্রেন আবার পরের দিন। হঠাৎ শুরু হল হইচই। যে-ট্রেন প্ল‍্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই ট্রেন আবার ব‍্যাক করে প্ল‍্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। নেমে এলেন ড্রাইভার। বনফুলের সামনে এসে বললেন, আমি আপনাকে ডাক্তার হিসেবে চিনি তবে আপনার সমস্ত লেখা আমি পড়েছি। আপনাকে ছুটতে দেখেই বুঝেছি আপনি কলকাতা যাবেন বলে আসছেন। তাই আমি গাড়ি ব‍্যাক করে নিয়ে এলাম। চলুন স‍্যার। একজন লেখকের জীবনে এর চেয়ে অপ্রত্যাশিত পুরস্কার আর কী হতে পারে? ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই অবিশ্বাস্য ঘটনার হয়তো আর পুনরাবৃত্তি হবে না। একজন দক্ষ ড্রাইভারের দেখা মিলবে হয়তো, কিন্তু তিনি একজন পাঠক হিসেবে লেখককে এই স্বীকৃতি দেবেন কি?

সেবার আমেরিকার বঙ্গসম্মেলনে গিয়েছেন পঞ্চাশের একজন জনপ্রিয় কবি। এইসব অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিরা চান শিকড়ের গন্ধ। কিন্তু সাহিত্যের চেয়ে গান নাচেই থাকে প্রধান আকর্ষণ। একসময় এল কবিতাপাঠের পালা। দর্শকমণ্ডলী সুযোগ বুঝে মেতে উঠলেন গল্পে। কবিতা শোনার আগ্রহ নেই। সেই কবি যখন কবিতা পড়ছেন তখন রীতিমতো হইচই চলছে। সুযোগ বুঝে কবিও মাঝখান থেকে অনেকগুলি লাইন বাদ দিয়ে কোনোরকমে কবিতাপাঠ শেষ করলেন। ফেরার সময় প্রেক্ষাগৃহের বাইরে কথা বলছেন কবি। একজন যুবক বললেন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আপনার কবিতা শুনছিলাম। কিন্তু আপনি মাঝখানে অনকগুলি লাইন বাদ দিলেন কেন? এই অবিশ্বাস্য পাঠকের জন‍্য কবির সেদিন মনে হয়েছিল তাঁর কবিতা লেখা সার্থক। এইভাবেই কাগজের নৌকো সব আলোবাতাসের জলে প্রাণ পায়।

আসুন শুনে নিই সেই অন্ধ মানুষটির কথা। রোজ অনেকটা পথ পেরিয়ে, অনেক কষ্ট করে তিনি মন্দিরে যান। প্রতিদিন একজন যুবক তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে পৌঁছে দেয় মন্দিরে। রোজ একই কাজ করতে করতে শেষপর্যন্ত কৌতূহলবশত যুবকটি সেই অন্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আপনি তো ঠাকুরকে দেখতে পান না, তাহলে রোজ রোজ এত কষ্ট করেন কেন? অন্ধ মানুষটি গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আসি তার কারণ আমি ঠাকুরকে দেখতে না পেলেও, ঠাকুর তো আমাকে দেখতে পান! এই বিশ্বাসের পাশে কোনো অবিশ্বাস নেই, অন্তরের চোখদু-টি যেন সদাজাগ্রত! তিনি জীবন দিয়ে সত‍্য করে তোলেন ‘অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে’।


এসো এই অপরিমিত শস‍্যের গায়ে হাত বোলাও। যতক্ষণ রূপকথা দণ্ডিত মানুষের আয়ুরেখা আঁকে। সূর্যাস্তে উড়ছে সব ধুলোমাখা স্মৃতি। মৃত মেয়ের কথা মনে পড়ছে যখন ওর মতো বিড়বিড় করে জুড়ে দাও অহেতুক অপাপবিদ্ধ খেলা। দণ্ডিত সবুজের দেশে কুসুমের রং। গর্ডকেশর। সেই দিনের রাজার গল্পটা বলো। যার শরীর জুড়ে পলাতক মানুষের চোখ। প্রহরীর মৃত‍্যুদণ্ড। তারপর মনে পড়ুক ঘুমের ভিতর কীভাবে বদলে গেছে পথ। সেই পথে ধীবরের জাল খেলা করে। মনে মনে একটি প্রকাণ্ড বাঘ সাক্ষী রইল তোমার রূপের। আর এক পেপে গাছের মলিন স্তনভার। বুকজোড়া দুধের পিপাসা। তারপর নীরবতা জলের সমান।

এখন সবুজ তিথি। বংশানুক্রমিক ওই ব‍্যক্তিগত অভিমান— পাঁচিলের দুষ্প্রাপ্য বই।

মৃত মেয়ের ছবির চেয়ে সুদর্শন পাখিসমাচার। গণআদালতে ছুটির মহড়া। একচিলতে রোদ্দুরের গায়ে এই মৃত বনপথ।

স্রোতের বিরুদ্ধে এই স্পর্শের হাত। লিখে রাখি। মৃতদেহ নিয়ে ম‍্যাটাডোর ছুটে য়ায় অন্ধকারে। বহুদিন খোঁজ নেই। একটা বারো বছরের না মিশে যাচ্ছে কুয়াশার ভিতর। যা কিছু দৃশ‍্যাতীত সেই দিকে দু-চোখের বাধা। এবার প্রহর মেপে ধানের উপর বসে আছে ক্লান্ত চড়াই। রূপকথা অসম্ভব দামি। নদীর জল ফিরিয়ে দিচ্ছে ঠোঁটের চুমুক।

এইসব দিনরাত মানুষের কথার পিছু পিছু উঠে বসেছে বিছানায়। বারো বছর পেরিয়ে একজন অচেনা পুরুষ দেখে ঘুমন্ত শিশুর মুখ, ছেঁড়া কাঁথা সর্বস্ব আমার। এখনও সাঁতার। ঝোলায় রয়েছে ভ্রমণ— লাল নীল টিকিটের আশ্চর্য ধুকপুক। ভেঙে পড়ার আগে এই সমর্পণ। কচুরিপানার মতো মিথ্যে লেগে আছে।

ও যদি এসেই পড়ে, ভাঙা ডানার ছায়ায় পেতে রাখে নিবিড় যৌনতা আমি তবে এলোমেলো জ্বরের বিকার। সন্তানের বুকে একশো আট রকম মিথ‍্যে বুনে ফুল ফোটাই মধ‍্যরাতে। সে এসে দেখুক একটা শরীর জুড়ে নিশিদিন মোমবাতি জ্বলে। একটা শরীর রহস‍্যের ক্রমাগত ব‍্যবহার ভুলে গেছে আজ।

একটা না-ঘটনা ছুটে যাচ্ছে কাহিনির দিকে। চারদিকে জলের অশৌচ। কথায় কথায় ঢেকে যাচ্ছে খড়ের মানুষ। অবলুপ্ত দেহ— তবুও সুন্দর তোমাকে ছেড়ে যায়নি। ছোটো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে দূরদেশের গাড়ি। তুমি বাথরুমে সাবান রেখে সেই যে ছুটে এলে…

আড়চোখের ভাষা সিগন্যাল পেরোচ্ছে। চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে যতদূর…

শেষ পাতা

Categories
গদ্য

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গদ্য

একটি রক্তিম মরীচিকা


রবীন্দ্রনাথের গান আমায় ঘুমোতে দেয় না। আশ্চর্য সুরে শব্দের প্রান্তর ছেড়ে কতবার ছুটে গেছি। তারপর একসময় দেখি শব্দের দিকে, অর্থের দিকে পৌঁছতে বড়ো বেশি দেরি হয়ে গেছে। তবুও জেগে থাকি। কত অপ্রত্যাশিত শব্দ ছুটে আসে। ভাবি আমি কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের মতো ‘শ্রাবণসন্ন‍্যাসী’-র মতো শব্দ দিয়ে গান রচনা করতে পারতাম কি? কত আশ্চর্য এক অনুভবে তিনি লিখতে পারেন— ‘ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে/অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে’। অন্ধকারের জপের মালা সেই অপ্রত্যাশিত এক অনুভূতির মায়ায় ছুটিয়ে বেড়ায়। যখন গাই— ‘ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ‍্যের পায়ে’ তখন মনেই থাকে না এই গানটির একটি কবিতা রূপ আছে ‘সানাই’ কাব‍্যগ্রন্থে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘জাগায়ো না ওরে, জাগায়ো না।/ও আজি মেনেছে হার/ক্রূর বিধাতার কাছে।’ চমকে উঠতে হয় এমন অরাবীন্দ্রিক ‘ক্রূর’ শব্দের ব‍্যবহারে। আবার যখন লেখেন ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানটি, তখন অনায়াসে কবিতারূপে ঢুকে যায় ‘উপহাসভরে’-র মতো শব্দ। শুষ্ক পাতার সাজাই তরুণী থেকে শুধুমাত্র মাইক্রোফোনের কথা ভেবে যখন ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’ লেখেন তখন ওই ছিন্ন শব্দ ঘিরেই এক অপ্রত্যাশিত ভাবনার আলিপন শুরু হয়ে যায়। ‘এসেছিলে তবু আস নাই’— এই বিরোধাভাস পেরিয়ে একদিন যখন সুর থেমে যায় তখন ফুটে ওঠে অবগুণ্ঠিত এক ছবি: ‘তখন পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু ঝরে জল,/শ‍্যামল বনান্তভূমি করে ছলোছল্।’

তারপর একদিন শুরু হল স্বর্ণযুগের গান। কয়েক দশক জুড়ে আকাশবাণীর অবশ‍্যম্ভাবী অনুরোধের আসর। ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার অনুষ্ঠানের পরিচিতিতে লেখা হল ‘আধুনিক বাংলা’ গান। ১৯৩০ সালের ২৭শে এপ্রিল। শিল্পী হৃদয়রঞ্জন রায়। রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ-নজরুল পরবর্তী গানের দিন। যখন কথায় একই রবীন্দ্র নির্ভরতা। সুর আর শিল্পীর গায়কীর আধুনিকতা কথার গায়ে লাগেনি। কিছুটা ব‍্যতিক্রমী সলিল চৌধুরী। আর মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত শব্দের ব‍্যবহার। মনে পড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটির কথা। যেখানে অনায়াসে কবিতার মতো এসে পড়ে ‘অশান্ত সৃষ্টির প্রশান্ত মন্থর অবকাশ’ কিংবা ‘একফালি নাগরিক আকাশে’-র মতো শব্দব‍্যবহার শ্রোতার কানের তোয়াক্কা না করেই। সলিল চৌধুরীর সুরে এই গানের কথা লেখেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ। এই বিমলচন্দ্র ঘোষেরই লেখা ‘শাপমোচন’ ছবির ‘শোনো বন্ধু শোনো’ গানটি। রবীন্দ্রনাথ যে-শব্দ গানে রাখেননি, এখানে অনায়াসে এল ‘ক্রূর’ শব্দটি। তিনি লিখলেন আর উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত গাইলেন— ‘জীবনের ফুল মুকুলেই ঝরে সুকঠিন ফুটপাতে/অতি সঞ্চয়ী ক্রূর দানবের উদ্ধত পদাঘাতে’। সুবীর সেনের গলায় একদিন ভেসে এল ‘নগর জীবন ছবির মতো হয়তো’ গানটি। আর সেখানে কথার একটুকরো আধুনিকতা: ‘রাজপথে পোষা কৃষ্ণচূড়ায় বসন্ত আসে নেমে/তবু এখানে হৃদয় বাঁধবে না কেউ শকুন্তলার প্রেমে।’ কৃষ্ণচূড়ার আগে পোষা শব্দের এই অপ্রত্যাশিত ব‍্যবহার বাংলাগানের কথার সামর্থ্যের একটুকরো উজ্জ্বল দলিল। কত আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সত্তরের দশকে লেখা হয়— ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলা/তুমি ভোরের বেলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে’। ভোরের বেলা হয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে একটা গোটা জীবন, একটা গোটা দশকের গান। মাঝে মাঝে মনে হয় যখন জীবনানন্দ ‘শতভিষা’ পত্রিকার পাতায় লেখেন— ‘আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;/সূর্য না কি সূর্যের চপ্পলে/পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে/পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়।’ এই অপ্রত‍্যাশিত চপ্পলের মতো শব্দটিকে ধারণের মতো শক্তি সেই পঞ্চাশের দশকে স্বর্ণযুগের বাংলা গানের ছিল কি?


কচ্ছপ বুকে নিয়ে মানুষ বেরিয়েছে অফিসের পথে। মুখের উপর দিয়ে চলে যায় লেডিস স্পেশাল। হাঁটু অবধি জড়ানো কাপড়ে একটি মৃত মানুষ বাথরুমের বিজ্ঞাপনের পাশে উবু হয়ে বসে। তবু একান্ত রোদ্দুরের অভাব এই গন‍্যমান‍্যের দেশে। বহুদূর পথ। গন্তব্য ভিজে আছে বর্ষাবাদলে। এইবার কথা হোক। শিক্ষা বিষয়ে আমাদের হাতে আছে আগ্নেয়গিরির সমান লাভা নিঃসরণ। তারপর সন্ধ‍্যার ভিড় পেরিয়ে থলেভরতি রঙিন আপেল নিয়ে বাড়ি ফেরা। ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে তোমার হলুদ বাড়ি লুকিয়ে রেখেছি অপ্রস্তুত গেঞ্জির ভিতরে। আজ উড়োজাহাজের দিনলিপি উড়ছে খেলনার চারপাশে। লিপিকর জানে রাতের শরীর দু-জনের মাঝখানে, অবুঝ সন্তান, প্রতিটি ভোরের রাতে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ।

আটটা দশের লোকাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি পানের দোকানে। বাথরুম সারি। দু-একটা ফোন আসে নগ্ন বাহু মেলে। এই বিপুল সংসারে আমি চাই নিছক অজুহাত। পালাবার নগন্য রেখা সুযোগসন্ধানী। সন্ধ‍্যার মেঘে আলোর পোকায় আমি নষ্ট হয়ে যাই।

ছলনার ডানা তুমি জানো যে-কোনো ফলের দু-দিকে রয়েছে ঢালু পথ। তর্কচূড়ামণি জানেন গাছের সন্দেহ। জানলায় বসে দেখি সামান্য উঠোনের ডালপালা সেও চলেছে পরবাসে।


আমরা মফস্‌সলের ছেলে। সেখানে তখন কথায় কথায় রুমাল, সেন্ট, পাউডার, সাবান দেখা যেত না। আমার মাসির দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে লতিকাদি। দিল্লির রাইসিনা কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কথায় কথায় পাউডার, সেন্ট মাখত লতিকাদি। আমি নীচু ক্লাসের বালক। লতিকাদির সুগন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। একদিন দেশভাগ হয়ে গেল। আমরা সপরিবারে কলকাতায় এলাম। মেসো এলেন কলকাতায় বদলি হয়ে। লতিকাদির বিয়ে হয়ে গেল। লতিকাদি আমার স্বপ্নের প্রথম রমণী। কলকাতা যাবার পথে প্ল‍্যাটফর্মে পড়ে গিয়েছিল লতিকাদির রুমাল। সেই সুগন্ধী রুমাল স্বপ্নের ভিতর বহুদিন যত্নে রেখেছিলাম আমি। আমার প্রথম প্রেম লতিকাদির কুহকে আচ্ছন্ন।

একদিন মাসি মারা গেলেন। মেসোমশাই একা। ব‍্যাঙ্কে ছেলেদের পাঠানো টাকা পড়ে থাকে। তোলার কেউ নেই। ছেলেরা বাবার দায়িত্ব নিতে চায় না। বরং পাউন্ড ডবল করে দেয়। অনিচ্ছুক লতিকাদি শেষপর্যন্ত বাবাকে হাওড়ার নিজের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে রাখে। একদিন তার চিঠি পেয়ে হাওড়ায় লতিকাদির বাড়িতে গেলাম। স্বপ্নের লতিকাদি এখন গিন্নিবান্নি। বড়োছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে। দোতলায় মেসোকে দেখে চমকে উঠলাম। লতিকাদির অত‍্যাচারে মরণাপন্ন। স্মৃতিভ্রষ্ট একজন মানুষ। লতিকাদি দুই ভাইকে বঞ্চিত করে বাবাকে দিয়ে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়। তারপর একদিন হুইল চেয়ারে বসিয়ে স্মৃতিলুপ্ত বাবাকে বেওয়ারিশ তুলে দেয় কালকা মেলে। পরদিন নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন। আমার স্বপ্নের নারী কাজ হাসিল করে বাবাকে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কত অমানবিক, কত নিষ্ঠুর। এই রমণী আজ এক পাষাণ। শুধু সেই অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুরতার সাক্ষী আমি আর একটি ডুমুর গাছ।

সকালে উঠে একদিন অমিতাভ বুঝতে পারল সে কথা বলতে পারছে না। অথচ গতকাল রাতপর্যন্ত সে কথা বলেছে। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ নয় শুধু বাষ্প বেরোচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়ল অমিতাভ। সমস্ত শব্দ তার কণ্ঠ ছেড়ে গেছে। তার কান্না পেল। তারপর চুপচাপ বসে রইল বিছানায়। স্ত্রী রমলাকে এখনই কিছু বলা দরকার। অথচ শব্দ নেই। মনোবিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও যায় না সে শেষপর্যন্ত। শুধু রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারপর অনেক দৃশ্যের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে অমিতাভ। রমলা জানতে চায় ডাক্তারের কাছে সে গেছে কি না। অমিতাভ মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ পর অপ্রত্যাশিত অমিতাভ বুঝতে পারে অনেক কথা বলছে তার হাত আর প্রতিটি আঙুল। আবার শুরু হয়েছে নতুন এক কথা বলা। চৌত্রিশ বছর পর আর এক অপরূপ আনন্দ বেদনায় বোবা ভাষার অবচেতনায় অপ্রত্যাশিত আলো এসে পড়ে। শুরু হয় না-কথার এক ভাষাতীত জীবন।

১০
কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সবসময়ই শিল্প সৃষ্টি করার আগ্রহ, চিন্তার দুশ্ছেদ‍্য অঙ্কুরিত বোঝা বহন করে বেড়াবার জন্মগত পাপ। কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে। আজও কারেন্টের বিল পড়ে আছে তোষকের নীচে। যাওয়া হয়নি। কত উদ‍্যম নষ্ট হয়ে গেছে। আজ সন্ধ‍্যার অলৌকিক বিছানা পেরিয়ে আমি টের পাই জলের অশৌচে ভরে উঠেছে শহর। সামান্য খ‍্যাতির জন‍্য মনে হয় দাঁড়াই বৃত্তের ভিতরে; তবু পথ শেষ হয় না। সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে আজ আমি ভুলে যেতে চাই সমস্ত মনোবেদনার কথা। জানলার বাইরে অসুখ। দরজা পেরিয়ে দেখি শৈশবের অন্ধকার বসে আছে হেলানো বটগাছের গায়ে। কত অপরাধ সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে ফেলেছি একদিন। আজ এতদিন পর সমস্ত উদাসীন দুপুরের চারপাশে আমি জানলা খুলে দিই। কী চেয়েছিলাম আমি! যেন সমস্ত অপ্রত্যাশিত চুম্বন এসে জড়ো হয় সভ‍্যতার উলটো দিকের সাদা পাতায়। সেই দিন ছলনার বিরুদ্ধে আমি মেলে দেব জন্মের দু-কূল ঘেরা রঙিন পোশাক। তোমার অবলুপ্ত ভাষার শরীরে পেতে দেব সাঁকো। সে আরেক জীবনের বৃত্তান্ত। যখন বাসি বিস্কুটের ছায়া পেরিয়ে উটের মালিকের জন্য আমরা দরজা খুলে দিই।

ঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বনফুল, বিমল কর, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সলিল চৌধুরী, অমিতাভ সমাজপতি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ‍্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, রাধানাথ মণ্ডল, সুকান্ত সিংহ।

প্রথম পাতা

Categories
গদ্য

ঈশিতা দেসরকারের গদ্য

সাদা রোগ

গাছে সাদা চুল। চুল জড়িয়ে আছে চোখে। কখনো তুলো কখনো উপুড় হওয়া কলমের ডগায় রামপ্রসাদী বেড়া। বেড়া বাঁধতে গিয়ে মন থেকে খসে যায় এক টুকরো আতস বাজি। স্বরলিপি না মেনে আতাফল খুলবে তার গোপন না পাওয়া। না পাওয়া থেকে যতটা জল চুঁইয়ে পড়ে; ততটুকু জমিয়ে ঢালি আমার ছাদ বাগানের পাণ্ডুলিপিতে। চুষে নেওয়ার তুমুল সাক্ষাৎকার দেখি রোজ। একটা খয়েরি সংক্রমণ আমার না লেখা কবিতা থেকে দৌড়োয় টবের কোমড়ে। টব সরালে বরাদ্দ ঘুমের স্বস্তি। স্থল পদ্মের মাথায় গুঁড়ো ক্ষত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে নুন জল খায়। জবার আঙুলে আমের কাঁধে পেয়ারা পাতার চিবুকে তোলপাড়ের ষড়যন্ত্র আমার ছাদবাগানেও। যদিও ছাদ রাষ্ট্র এখানে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলছে না; দু-এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ওদের ক্ষতি হারিয়ে যাবে চিলেকোঠার সিগারেটে। বৃষ্টির অপেক্ষায় কুচো চারা ডেপুটেশনের বিবৃতি লিখছে। নীলকণ্ঠের লতানো নাভি কিছুটা বোঝে। কিছুটা সময় এলে জবাব দেওয়া গানের রেওয়াজে মন দেয়। গাছেরা সেদ্ধ ভাত খায় শুধু। পথ্য ছাড়াই লাফিয়ে যায় মানুষের দিকে। মানুষ তখন দরজার হেরে যাওয়া দেখছে। মুখস্থ করছে আইসোলেশনের চতুর্থ সূত্র।

বাইরে তখন ধুম ফাগুনের গীতিনাট্য। রাস্তার ইটের সখ্য বেড়েছে হেলে পড়া ঘাসের। হাওয়া এলে টবে টবে খুলে যায় গাছের অন্তর্বাস। কুর্চি ফুল গা সেঁকে নেয় এই সুযোগে। পেটভরতি খিদে পুরু মেঘের মতো।

ওদের ফেলে আসা আলোয় আমার অপারগতার চিরাগ রোজ সন্ধ্যায় গীর্জার নিঝুমে জ্বলে। পোড়া বন্দরের নিঃশ্বাসে গাছ বসায় রাতের ভাত। গাছেরা শক্তিনগরের কালিমন্দিরের আলো; কুমারডাঙ্গির মসজিদের আতরের সাথে উড়ে গেল। শুকনো পাতায় আমার কুঞ্চিত প্রেম নাম। এক। অধিক। সর্বাধিক। চিরাগ জ্বলত গাছে গাছেও। জ্বালাত রতনদা। রতনদা এখন সাদা জোব্বা পরে থাকে। সাদা রোগের সাথে ম্যাচিং করে। প্রতি মাসে টবের গা ধোয় রতনদা। ছাদের উঠোন লেপে দেয়। অবাঞ্ছিত কথাবার্তা সরিয়ে শেকড়ে ঢালে তামরসের হকিকত। পাতার মাথা আঁচড়ায়। দুটো বিনুনি বাঁধে সন্ধ্যা তারা ফুল রঙে;… শেষ ট্রেকার ধরার আগে। সাদা রোগ নিরাময়ের উড়ো চুমু টাঙিয়ে রোগারে জল মিশিয়ে যন্ত্রণাকে করে ‘পাখি হুস…’।

ডেপুটেশনের খসড়ায় রতনদার অনুপস্থিতি ও অপর্যাপ্ত শস্য সংলাপ উঠে আসছে বারবার। গাছ ও রতনদা উভয়েই অদেখার অশান্তিতে কম ঘুমোয়। বেশি রাতে গাছের হৃদয় পায়চারি করাকালীন গায় ‘বনমালী তুমি; পরজনমে হইয়ো রাধা’।

লকডাউনে স্নান বেড়েছে। জলের যোগ্য সন্তান যেন আমরা। স্নানঘরে ফেনার দুঃখ দেখি। কীভাবে মুহূর্তের লাস্য নিকাশি ব্যবস্থায় ফুরিয়ে যায়। এতক্ষণ জন্মসুন্দরী কখনো দেখিনি। যাদের স্নান ঘর নেই; কলতলায় রূপসি ফেনা দ্রুত হারিয়ে যায় অনাবিষ্কৃত শ্যাওলায়।

স্নানের ঘণ্টা বাজছে চারদিকে। তারই মাঝে ডাক শোনা যায় কার যেন!… জলের পেছল আগলে দরজায় যাই। রতনদা দরজার সামনে গণসংগীত রেখে গেছে। ৪৫ দিন ঘরে বসে থাকাত পর নয় কিমি হেঁটে গ্রামের বাড়ি থেকে কাজের খোঁজে শহরের গলিতে কাজফুল কুড়োয়। পরিচিত ছাদবাগানগুলোতে গাছের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চায় টিফিনবক্স। মেহনতি হাত দরজার বাইরে হাতুড়ি খুরপির ছাঁচটুকু রাখে। গাছ জল খায়। দলা মাটি ভিজিয়ে খায়। রতনদা খায় অপেক্ষা। জলে মুড়ি ভেজানোর কৃষি কাজ শেখে। মোবাইল ক্যানভাসে রতনদা এবড়ো খেবড়ো রং জড়িয়েছে কেমন!

রতনদা হাঁটছে। হেঁটে আসে। হেঁটে ফিরে যায়। ১৮ কিমি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে। ওর বুকের হারমোনিয়াম; গুপ্তধনে ঢুকে যাওয়া পেটের গন্ধ টের পাই। হাঁফাতে হাঁফাতে ওর বলা কথারা একে-অপরের গায়ে চেপে বসছে। ঘ্যানর ঘ্যানর কোকিলের ডাককে দূরভাষ শাসন করেছে অগ্রিম। ফাগুনের ধুনকর আমার কানে গুঁজে দিয়েছে শিমুল বীজ। শ্বাসগুলো শিশুর মতো নরম। কানের পাটাতনে যে-খিদে-করতাল বাজে; আমি আজ তার সওয়ারি। ছাদে যাই। পাতায় ঝুঁকে পড়া পেটের আর্তি। তুলো ভেদ করে কার্লভাট ডিঙিয়ে চিৎকার আমার ক্লিপে মিশে গেছে কখন!

নিজেকে ছোটো করে জলের ট্যাঙ্কের নীচে বসি। লালন সমগ্র এনে দিচ্ছে না কেউ। সাঁইজি আমার কখন খেলে এই খেলা! প্রতিটা আর্তরব রতনদার। প্রতিটা শব্দে মেনে না নাওয়ার তারস্বর। রতনদা ভাত বেশি খায়। ও গাছের যত্ন করতে এলে দু-কৌটা চাল বেশি লাগে।

‘গতর খাটি তো; ভাতলা বেশি নাগে; ভাতের তানে এঠিনা কাম করতি আসি।’ হাসতে হাসতে বলে রতনদা। বলতে বলতে মুখে গ্রাস তোলার সময় রতনদাকে গ্রিক পুরুষের মতো দেখায়। এত সুন্দর দেখতে রতনদা?! রতনদার ঘেমে যাওয়া কালো পিঠে স্বদেশের সুজলা সুফলা জমিন। এই আবাদ কাজ ঈশিতা জানে না। ব্যর্থ স্বার্থপর আঙুলে একলব্যর অভিমান ঘুমের ওষুধে রান্নাবাটি খেলে কেবল। ওদিকে আরও স্পষ্ট হচ্ছে গাছের সাদা রোগ। পতাকা বদলে যাচ্ছে অধিকারের নামাবলীতে। গাছ অধিকার ফিরে ফেলে রতনদার দুয়ারে বারবার লক্ষ্মী ছাপ আঁকবে পড়ুয়া। লক্ষ্মী রতনদার বড়ো মেয়ে: যে-নামের আমাদের বাড়ির সাদা সন্ধ্যাতারাকে ডাকে রতনদা। আজান শুরু হলে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখি মাঝে মাঝে।

সাহস করে জানতে চাইনি।

জানি না কি অথই বেদনা আজানের ডালপালায় পায় রতনদা; আমি জানি না; আমার ছাদবাগানের ডালপালারা জানে ঠিক…

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বাদশ পর্ব 

আকাশপ্রদীপ ও ডিকটেটরের হাতে স্বপ্ন

হেমন্ত আসছে, বহুদূর থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে সে আসছে। বিকেলের রোদ্দুর আর হাওয়ার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে কার যেন উদাসীন কান্না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হেমন্তসন্ধ্যা বিচ্ছেদের, সে কাপ থেকে প্লেটকে আলাদা করে দেবে… নৌকা থেকে নদীকে।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

একাদশ পর্ব

হেমন্তের দিনে নস্টালজিয়া

হেমন্তের বিষাদের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার একটি ট্র্যাজেডির কথা মনে হয়, আমাদের চেনা চারপাশ থেকে অনেক দূরে আধো-আলো আধো-অন্ধকারে হিমে-ভেজা এরিনায় অভিনীত হয়ে চলেছে সেই নাটক।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক ফর্মায়েসি

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দশম পর্ব 

শরতে, উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার

পৃথিবীতে সব থেকে বেশি যে-কয়েকটি চিত্রকল্প আর উপমা ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে একটি অতি-অবশ্যই নির্জনে বনের মধ্যে সবার অগোচরে ফুলের ঝরে যাওয়া। একটি ফুলের ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়া— বিষয়টির মধ্যেই এক বিয়োগাত্মক বিষয় ঝিম মেরে বসে থাকে।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

নবম পর্ব

ব্যাবেলের লাইব্রেরি অথবা নাথিংনেস

‘অসংখ্য ষড়ভুজাকার গ্যালারি, প্রতিটির মাঝখানে নিচু-রেলিঙে ঘেরা এক একটা ঘুলঘুলি। যে কোনও ঘুলঘুলি থেকে নীচে ও উপরের ফ্লোরগুলি দেখা যায়।

Categories
গদ্য জলসাঘর ধারাবাহিক

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

ষষ্ঠ পর্ব
গওহরজান: এক সুরেলা অধ্যায়

বেনারসের ধনী সম্প্রদায়ের মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান গাইতে শুরু করার পর মালকার নাম হল ‘মালকা জান’।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

সপ্তম পর্ব

ব্যাসদেব গণেশ ও সরলবর্গীয় বনের কিছু কথা

দুর্বোধ্য অসংলগ্ন মণীন্দ্র গুপ্ত কথিত স্তন্যপায়ীর ডিমের মতো আজব অথবা গ্রটেস্ক নানা ‘প্রায়-স্বপ্ন’ আজকাল আমাকে ঘিরে ধরে মাঝে মাঝেই।