Categories
গল্প

পাপড়ি রহমানের গল্প

জলময়ূরীর সংসার

মাদারজানি গ্রামের সকলে কালেভদ্রে কদমফুল চোখে দেখে! এ-তল্লাটেই কোনো কদমের গাছটাছ বিলকুল নাই। অথচ ঝুলমুলির কিনা খামাখাই কদমফুলের কথা স্মরণে আসে! তার সইয়েরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর ঝুলমুলির আঙুলে চোখ ধরা মেয়েটির কপালে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো টোকা মেরে যায়! ঝুলমুলি তাকে ছেড়ে দিলে সে চোখ কচলে তাকায়। কিন্তু কে তার কপালে টোকা দিয়ে গেছে সে তা কিছুতেই বলতে পারে না। এমনকী অনুমানও করতে পারে না।

ঝুলমুলি ফের অন্য একজন সইয়ের চোখ দুই হাতে আড়াল করে ডাক দেয়—

‘আয়রে আমার কদমফুল’

একই ফুলের নাম ধরে বারংবার ডাকাতে ‘ফুলটোক্কা’ খেলা ভণ্ডুল হয়ে যায়।

ঝুলমুলির সইয়েরা বিরক্ত হয়। কিন্তু তা তারা প্রকাশ করতে চায় না। ফলে খেলা কেন ভুণ্ডুল হল তা ঝুলমুলিও ধরতে পারে না। সইয়েরা ঘরে ফেরার কালে আড়নয়নে ঝুলমুলির বিনুনির আগার পদ্মফুলের দুলুনি দেখে। বিকেলের মরা আলোতে ফুলটা ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঝুলমুলির গায়ের কুচকুচে কালো রংকে ওই ফুলটাই যেন গোলাপি আভাযুক্ত করে তুলেছে! মাদারজানির সকলেই দেখে, ছলিমুদ্দির কুচকুচে কালো মেয়েটা হঠাৎ করে গোলাপি রঙে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে!

বাঘিয়ার বিলে হঠাৎ করে এতসব ভজঘট শুরু হয় যে, ছলিমুদ্দির তৃতীয় মেয়েটির কথা মাদারজানির লোকেরা প্রায় বিস্মৃত হয়ে যায়। এমনকী তার বিনুনির আগায় দেখা নেতানো পদ্মফুলের কথাও তাদের আর স্মরণ হয় না! বা হঠাৎ করে কেন তার কুচকুচে কালো মুখে গোলাপি আভা ফুটে উঠেছিল, সে-কথাও তাদের আর মনে থাকে না! অবশ্য ঝুলমুলির কথা বিস্মৃত না হয়ে তাদের উপায়ও থাকে না। কারণ, ততদিনে বাঘিয়ার বিলের পদ্মবনে নতুন কিছু পক্ষীর আগমন ঘটেছে। পানকৌড়ি, কানিবক আর ধলাবকের মাঝে ওইসব পক্ষীরা মাথা নেড়ে নেড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মাথায় ময়ূরের মতো ঝুঁটি আর লেজের দিকে ছড়ানো পুচ্ছও তখন নেচে ওঠে! এই পাখিগুলার গায়ে্র বরণ কোকিলের মতো কালো। কিন্তু কণ্ঠ বেসুরো! তারা পদ্মফুলের পাপড়ি খেয়ে বেঁচে থাকে। পদ্মপাতা জোড়া দিয়ে সংসার পাতে। পদ্মের বড়োসড়ো পাতার উপর তিড়িংবিড়িং করে নেচে বেড়ায়। আর জোড়া বেঁধে মিলন হলে নারী পাখিটার ডিম দিতে লাগে চব্বিশ দিন। এই চব্বিশ দিনই থাকে তার সংসারের আয়ু। ডিম পাড়া সারা হলে সংসার ফেলে অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যায়। তখন নারীটির পরিত্যক্ত পুরুষসঙ্গীটি আর কী করে? নিয়ম করে সে-ই ডিমে তা দেয়। তা দিয়ে দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। মাদারজানির লোকেরা এমন আজব-গজব কায়-কারবার দেখে একেবারে তবদা মেরে যায়! ইতোপূর্বে এমন করে বিল জুড়ে পদ্মফুল ফুটতে তারা দেখে নাই। এমনকী ডিম না-ফুটিয়ে অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত পক্ষীও তারা দেখে নাই!

ঝুলমুলির চোখে বিস্ময়ের পাহাড় জমতে থাকে।

মেয়ের আনমনা ভাব লক্ষ করে আম্বিয়া খাতুন কী ভাবে সেই জানে? সে নিজ থেকেই মেয়েকে বলে— এইগুলা হইল জলময়ূরী। পানির মইদ্যে সংসার পাতে। পানিতই সংসার ভাঙে। ফের পানিতেই পয়দা দেয়। পানির ফুল খাইয়াই এরা বাঁইচা থাহে।

ঝুলমুলির চক্ষে তখন বিস্ময় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। বাঘিয়ার বিলের রহস্য দেখতে দেখতে সে এতটাই বেভুলো হয় যে, নিজের তলপেটটা কখন ঢিবি হয়ে ওঠে সে খেয়াল করে না। ঢিবি হতে হতে ফুলে ওঠে। এতটাই ফুলে ওঠে যে, ঝুলমুলি সেই পেটের আড়ালে পড়ে যাওয়া নিজের দুইখানা পা-ও দেখতে পায় না।

আম্বিয়া খাতুন একদিন মেয়ের ওই বেঢপ পেট দেখে চমকে ওঠে!

ঝুলমুলির ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভাবে সেই জানে?

ঝুলমুলির কালো শরীরে মারের দাগ স্পষ্ট বুঝা না গেলেও কালসিটে চিহ্ন দেখে মাদারজানির লোকেরা জড়ো হয়ে যায়। ঝুলমুলিকে এমন মারধর কে করল তা জানতে তারা ছলিমুদ্দির উঠানে ভিড় জমায়। এত লোকজনের জমায়েত দেখে ঝুলমুলির মনে হয়— আইচ্ছা বিলের বাড়ন্ত পানির বেবাক কি আমাগোরে উডানে ঢুইক্যা পড়ল? নইলে এমুন কইরা ঢেউয়ের শব্দ হুনা যাইতাছে ক্যান?

ঝুলমুলি যাকে ঢেউয়ের শব্দ মনে করে তা আদতে আম্বিয়া বেগমের কান্না। মুখের ভেতর আঁচল গুঁজে দিয়ে সে চাপা কণ্ঠে কেঁদে চলে আর বলে—

হায় হায় গো! আমাগোরে এত বড়ো সব্বোনাশ কে করল গো?

অকস্মাৎ মাদারজানির লোকেদের ঝুলমুলির বিনুনির কথা মনে পড়ে। লম্বা বিনুনির আগায় ঝুলন্ত পদ্মফুলের কথা মনে পড়ে। এবং সেই সাথে তারা এটাও স্মরণ করতে পারে যে, একদা ছলিমুদ্দির কন্যা ঝুলমুলির মুখমণ্ডলে গোলাপি আভা দেখা দিয়েছিল। যার ফলে ছলিমুদ্দির কালোকিষ্টি মেয়েটা অপূর্ব লাবণ্যে ঝলমল করে উঠেছিল।


মাদারজানি গ্রামের লোকেরা যা হোক একটা কিছু বিহিতের চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয় না। ইস্কান্দারও অবশ্য প্রথম প্রথম কিছুই স্বীকার করতেই চাইল না। সেও নানান কিছুর দোহাই দিতে থাকে। যেমন—

দেইহুন তহন এমুন মাছ উজাইয়া আইল, ঝাঁকে ঝাঁক মাছ। এত মাছ! আমি তো কস্মিনকালেও এত মাছ দেহি নাই। এমুন মাছের আমদানি দেইখ্যা আমার মাথাত কিছু গণ্ডগোল পাহাইয়া থাকতে পারে। আমার কাছে তহন ওই কালি ঝুলমুলিরেই কিনা এক্করে পরি মনত অইছিল! দেইহুন মাইনষের হগল কামেই মাইনষের আত থাহে নাহি? এই যে বাঘিয়ার বিল পদ্মফুলে সয়লাব অইয়া গেল এইডাও তো আঁতকা ঘটনা মানে কুনু গায়েবী ব্যাপারেও অইতে পারে! তাই আমিও হয়তো মাছেগুলার কারবারে বা পদ্মফুলের ঘোরে পইড়া এই কামডা কইরা ফেলাইতে পারি।

মাদারজানির লোকেরা তখন একসাথে কথা বলে উঠে। এত লোক কথা বললে কিছুই বুঝার উপায় থাকে না, শুধু গমগম শব্দ শোনা যায়। আর ইস্কান্দার পলকে বুঝে যায় ঘটনা গুরতর! অবশ্য এমনও হতে পারে যে, সে হয়তো ঝুলমুলির ম্লান-মলিন-ক্লান্ত চেহারা দেখে নিজের সংযুক্তি স্বীকার করে নেয়। হয়তো ঝুলমুলির গর্ভস্থ শিশুটির জন্য তার মন দয়ার্দ্র হয়ে ওঠে। বা ঝুলমুলির নিঃশব্দ অশ্রুপাত তাকে বিচলিত করে তোলে! ইস্কান্দার নিজের সন্তানের জন্য এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ঘটনার ইতি ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সালিসি ক্রমশ নিষ্পত্তির দিকে এগোতে থাকলে জমির চেয়ারম্যান একেবারে বেঁকে বসে। ওই চালচুলাহীন ছলিমুদ্দির মেয়ে কোনোদিন তার ছেলের বউ হতে পারে না। সে ইস্কান্দারকে তেড়েফুঁড়ে মারতে গেলে গ্রামবাসী বাধা দেয়।

আরে করতাছুইন কী? ভাই না ভালা, হোনেন এইবার মাতাডা ঠান্ডা কইরা ভাইব্যা দেহুন। এহন এই মাইয়াডার গতিক কী অইব? মাইয়াডার তো জলে কুম্ভির আর ডাঙ্গায় বাঘ খাড়াইয়া রইছে। মাইয়াডা অহন যাইব কই?

লোকজনের এইসব উপযাচক কথাবার্তায় উপশম কিছু হয় না, উলটা চেয়ারম্যানের মেজাজ টঙ হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু জনরোষের ভয়ে তেমন গলা চড়ে না তার।

বাপের তোপের মুখে দাঁড়িয়ে ইস্কান্দার রা করতে পারে না। যেহেতু সেও এখনও বেকার, বিষয়টা সহসা সে একাকী সামলাতে পারবে তেমনও তার মনে হয় না। প্রায় বোবা হয়ে থাকা ইস্কান্দারকে জমির চেয়ারম্যান প্রায় হিড়িহিড়িয়ে টেনে নিয়ে যায়। কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ সে দেয় না! ইস্কান্দারও ঠিক সদ্যোজাত বাছুরের মতো বাপের পিছু পিছু হেঁটে চলে যায়। ইস্কান্দার জানে, জমির মিয়া এই বিষয় কিছুতেই মেনে নেবে না! ছলিমুদ্দির হাড়হাভাতে ঘরের ওই কালোকোলো মেয়েকে সে পুত্রবধূ রূপে কিছুতেই গ্রহণ করবে না।

জমির চেয়ারম্যান সত্য সত্যই তার রোখ থেকে এক পা-ও নড়ে না। মাদারজানির লোকেরা বিষম সংকটে পতিত হয়। এক্ষণে তারা কী করবে? ছলিমুদ্দির পাশে গ্রামের দুই/একজন দাড়িয়ে যায়। মেম্বার লস্করের পুত্র তাজুল লস্করও দাঁড়িয়ে যায়। সে-ই দুই/একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে ঝুলমুলিকে মামলা ঠুকতে বলে। মামলা করার সংবাদ শুনে জমির চেয়ারম্যান রাতের অন্ধকারে ছলিমুদ্দির বাড়িতে আসে। যা হোক কিছু একটা যদি দফা রফা করা যায়— কোর্টকাছারি বড়ো হুজ্জতের ব্যাপার।

আম্বিয়া খাতুন আঁচলে মুখ ঢেকে বিনবিনিয়ে কাঁদে। এত বড়ো সব্বোনাশ কি টেকা দিয়াফয়সালা করন যায় নাহি? চেয়ারম্যান সাহেব কী কয় এইগুলা? মাইয়াডা এম্নেই কালা। এত বড়ো কলংকের পরে তারে আর বিয়া করব কেডায়?

রাগে-দুঃখে অপমানে আম্বিয়া খাতুন ঝুলমুলির পিঠে গাম্মুরগুম্মুর করে দুই ঘা বসিয়ে দেয়।

মরারশুকির কপালে কি আজরাইলও জুটে না? যা মর গিয়া। গলায় দড়ি দিয়া মর গিয়া। আমারই দুষ। আমিই তোরে আস্কারা দিয়া মাতায় উডাইছি।

ঝুলমুলি বুঝতে পারে না মা কেন তাকে মরতে বলছে? সে মারা গেলে গর্ভের বাচ্চাটার কী হবে? তাহলে তো সেও মারা যাবে।

বাংলা সিনেমায় কতবার সে দেখেছে নায়ক এসে ঠিকই নায়িকাকে উদ্ধার করে। ইস্কান্দার ঠিকই তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু ঝুলমুলির এই আশা দিবাস্বপনের মতোই মিলিয়ে যায়। ইস্কান্দার আসে না। বদলে দুই লাখ টাকায় কিছু একটা রফা হয়। রফাটা কী হয় তা ঝুলমুলি জানতে পারে না।

আম্বিয়া খাতুনের ফোঁপানিও ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। আঁচল চেপে কান্নার বদলে তার মুখে পানের রস টসটস করে।


চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া সেই দুই লাখ টাকায় তরমুজের ফলন বাড়ে। তবে এই ফলন ছলিমুদ্দির জমিতে নয়। আম্বিয়া খাতুনের বোনের ছেলে শফিকুল্লাহ সুদের বিনিময়ে ওই টাকাটা নিয়ে তরমুজের ক্ষেতিতে লাগিয়েছে। ঝুলমুলির ইজ্জতের দামে তরমুজের কালচে রূপ পরিমিত মাটি-সারে খোলতাই হয়। সবুজ সবুজ পত্র-শাখা ফনফনিয়ে বাড়ে। শফিকুল্লাহ সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে!

এইবার ফলন ভালো অইলে খালুজানরে সুদের কিছু টেকা বেশি দিয়া আইমু। বাচ্চাডার খায়-খইরচা আছে। মাইয়াডাও ঘাড়ের উপর চাইপ্যা আছে।

ঝুলমুলির কোলে কুসুমকলি খলখলিয়ে হাসে। কুসুমকলির উচ্ছ্বল হাসির মাঝেই মাদারজানিতে ফের বাদলার কাল এসে পড়ে। আসমান ফুটো করে অবিরাম জল ঝরে পড়ে। আর বাঘিয়ার বিলে জল থইথই করে। কচুরিপানার বেগুনি রঙের ঘোর পাশ কাটিয়ে এন্তার পদ্মফুলও ফোটে। মাদারজানির জোয়ান ছেলে-ছোকরারা ফের জাল-পলো-বঁড়শি নিয়ে বিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেম্বারের তাগড়া ছেলে তাজুল লস্কর কই-শিঙ্গির ঝাঁক তুলে খালুই ভরে ফেলে। কই-শিঙ্গির সাথে সে কিছু ভুতকিয়া মাছ জালে তোলে। ওই ভুতকিয়া মাছ মারার কোন ফাঁকে জলে ডুব দিয়ে সে একটা পদ্মফুলও তুলে আনে। সেদিন ঝুলমুলির লম্বা বিনুনির আগায় ফের গোলাপি রঙের আভা দেখা দেয়।

মাদারজানির লোকেরা চমকে ওঠে! তাদের পলকে মনে পড়ে যায় ঝুলমুলির কন্যা কুসুমকলি জন্মানোর পূর্বে তারা এ-মতো দৃশ্য দেখেছিল!

বাঘিয়ার বিলের জলস্তম্ভ দেখে ঝুলমুলি ফের উদাস হয়। ঢেউয়ের পর ঢেউ দেখে সে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। এবার তার বিনুনির আগায় ঘন ঘন পদ্মফুলের শোভা দেখা যায়। এর কয়েকদিন বাদেই চেয়ারম্যান বাড়িতে আচনক শিশুর কান্না শোনা যায়। শিশুর কান্না শুনে মাদারজানির লোকেরা উন্মুখ হয়ে ওই বাড়ির দিকে ধাবিত হয়।

একদিন মেম্বারের ছেলে তাজুল লস্করকে মাদারজানির কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে ছলিমুদ্দির কন্যা ঝুলমুলিকেও কোথাও কেউ দেখে না।

বাঘিয়ার বিলে আগের মতোই ঢেউয়ের পর ঢেউ ওঠে। ঢেউয়েরা যখন ভেঙে পড়ে তখন পদ্মফুলের ছেঁড়াখোঁড়া পাপড়ি ভাসতে দেখা যায়। আর পদ্মের বিশাল বিশাল সবুজ পাতার উপর জলময়ূরীরা আনন্দিত চিত্তে নেচে বেড়ায়…

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

পাপড়ি রহমানের গল্প

জলময়ূরীর সংসার

জামগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দুই পা সামনে ছড়িয়ে বসেছিল ঝুলমুলি। তার চোখের সামনে বাঘিয়ার বিলের থইথই জলরাশি। হাওয়া বেগে বইলে সমস্ত বিল যেন মুহূর্তে দুলে ওঠে। তারপর তারা ঢেউ হয়। ইয়া বড়ো বড়ো মস্তপানা ঢেউ। ঢেউ হয়, আর ছুটে যায় দূরে, বহুদূর। একেবারে দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। এ-মতো দৃশ্য শুধুমাত্র বাদলার কালেই দেখা যায়। উইন্যার মরশুমে কাদাপ্যাকলার রাজত্ব। তখন বিলের রুগ্ন চেহারা। কিছু জলজ উদ্ভিদ বেঁচে থাকার আশায় আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। কিছু শাদা ঘাস তখন মাথাডগা বের করে ভালো করে দুনিয়া দেখতে চায়। এই ঘাসেরা বাদলার কালে জলের তলায় ডুবে থেকে নিজেদের সবুজ বরণ খুইয়ে বসে আছে। এতক্ষণে দুনিয়াদারি দেখতে দেখতে ফের তারা সবুজ হয়ে উঠবে। ফের তারা তরতরিয়ে বিস্তার করে চলবে নিজেদের বংশ। বাঘিয়ার বিলের এমন রকমসকম ঝুলমুলি কোমরে কালোতাগা বাঁধা অবস্থা থেকেই দেখে এসেছে। রোগবালাই দূরে রাখার জন্য মা একটা কালোতাগা ঝুলমুলির কোমরে বেধে দিত। তাগার সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘুঙ্ঘুট। উঠানময় দৌড়ে বেড়ানোর সময় ওই ঘুঙ্ঘুট টুংটুং করে বেজে যেত। আর মা আম্বিয়া খাতুন কাজ ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত ঝুলমুলির উদোম গতর— মেয়েটার গায়ের রং মাজা হবে। গরিবের সংসারে কালো মেয়ের বড়ো অনাদর। কালো মেয়ে পরের ঘরে বিদায় করা বড়ো ঝক্কির। টিভি, মোটরসাইকেল দিতে চাইলেও কালো মেয়ের বাজারদর চড়া হয় না। সেরকম পাত্রও জোটে না। যদিও-বা জোটে তাও ম্যালাই দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হয় তারা! টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলের সঙ্গে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে বসে। ঝুলমুলির মা মেয়ের উদ্দাম চলা দেখেও তাই খুশি হতে পারত না। মনে শঙ্কা বাসা বাধত— কাইল্যা মাইয়াডারে পার করুম কেমতে?

কিন্তু ঝুলমুলির মায়ের নানান আশঙ্কা সত্ত্বেও ঝুলমুলি বড়ো হতে থাকে। তার দেহে লাবণ্য এসে হামলে পড়ে আর ঝুলমুলি সেয়ানা হয়ে ওঠে। আম্বিয়া খাতুনের মেয়ের এই ঝলমলে ছিরিছাঁদ দেখে মনে মনে আঁতকে ওঠে—

মরারশুকির গতরে য্যান বাইস্যা মাসের নয়া পানির মাছেগো খলবলানি। এত উজাইও না গো মা-জননী! বেশি উজাইলে বোয়াল মাছের প্যাডের ভিতর চইল্যা যাইবা, নইলে শইল মাছ তুমারে গিল্যা খাইব। তহন আর বারাইতে পারবা না। মাছের প্যাডের ভিতরের মাছ কবে আর তার নিজের পরান ফিরত পাইছে?।

না, আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু তার ভাবনা সে মনের লাটাইয়ে পেঁচিয়ে রাখে। এই লাটাইয়ের সুতার সন্ধান সে কিছুতেই দেবে না ঝুলমুলিকে। দিলে মেয়েটা আর নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারবে না। তার বাড়বাড়ন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। মেয়েটা অন্তত নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক। জমিনে শুয়ে থাকা মিষ্টিকুমড়ার ডগা যেমন আপন গতিতেই বাড়ে, লকলকিয়ে তরতরিয়ে বাড়ে— ঝুলমুলি না হয় তেমনিভাবেই বেড়ে উঠুক। আম্বিয়া খাতুন এমন ভাবে, কিন্তু ছলিমুদ্দি এমন ভাবে না, বা ভাবতে পারে না। এর আগে দুই মেয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলি যখন সেয়ানা হয়েছিল, তখনও সে এমন ভাবে নাই। বা ভাবতে পারে নাই। দুই মেয়ের বিয়ে দিতে হালের চারটা বলদ ছলিমুদ্দিকে বিক্রি করতে হয়েছিল। গোয়াল ঘরের দিকে তাকালে আজও তার দুই নয়ন জলে ভরে যায়। গোরু বিক্রির টাকায় একটা হাতঘড়ি আর টেলিভিশন দেয়া গিয়েছিল। বাকি টাকায় ছেলেপক্ষকে শাদাভাতে গোরুর মাংসের সুরুয়া ঢেলে কোনোরকমে খাওয়ানো গেছে। এ নিয়ে মঞ্জুলি আর ফুলকলির শ্বশুরবাড়ি কম কথা শোনায় নাই!

‘মুরগার রুস্টের কতা কি আবার কইয়া বইল্যা নিতে অয় নাহি? বেবাক বিয়াতেই তো এইগুলা আকছার খাওন দেয়।’

ছলিমুদ্দি রা করতে গিয়েও যেন গিলে ফেলেছে। কষ্টেমষ্টে নিজেকে সামলেছে। মাইয়ার বাপ অইলে নীচা অইয়া থাকতে অয়! নীচা মাইনষেগো এত রাওউও করলে চলে নাহি?

নীচা মাইনষেগো মাতাডা আরও নীচা কইরা রাহন নাগে। মাতাডা মাটির লগে মিসমার কইরা রাহন নাগে। ছলিমুদ্দি তাই নীচা কইরাই রাখে নিজের মাথাডা। নীচাই রাখতে চায়। কিন্তু তাও কি মঞ্জুলি আর ফুলকলির সুখ মেলে? মেলে না! ছলিমুদ্দি তো কম চেষ্টা চালায় নাই। কথা সত্য, মুরগার রোস্ট সে খাওয়াতে পারে নাই। জনা পঞ্চাশেক লোক খাওয়ার পরেই মাংসের হাড়িতে টান পরে যায়। কিন্তু কী-ই-বা করবে ছলিমুদ্দি?

ভালো কোম্পানির টেলিভিশনের দাম তো তার একটা বলদ বিক্রির দামের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কাল্লা, ধলা, লাল্লি আর সফেদাকে বিক্রি করতে গিয়ে ছলিমুদ্দির বুক ফেটে গিয়েছে। ছলিমুদ্দির ঘরদোর এতদিনে শূন্য-ময়দান। সহায়-সম্পত্তির খুদকুঁড়োও কোথাও পড়ে নাই। দিনমান হা হা করে ছলিমুদ্দির দুয়ার-আঙিনা। বাঁশঝাড়ে হাওয়া জোরে বইলে মনে হয়, কে যেন কেঁদে চলেছে! কে যেন গুনগুনিয়ে অথচ গোপনে কেঁদেই চলে। ছলিমুদ্দির মন মিথ্যে বলে না বা হয়তো তার কানও ভুল শো্নে না। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার হাম্বা হাম্বা রবের সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও গলা মিলিয়ে কাঁদে। ছলিমুদ্দির কানে তেমনভাবেই পৌঁছায়। ছলিমুদ্দি ইদানীং মানুষ আর জন্তুর বিভেদ করতে পারে না। সে কীভাবেই-বা বিভেদ করবে? ছলিমুদ্দির কাছে তো মানুষ আর জন্তুর মূল্য প্রায় সমান কাতারে। আর তার ঘরদোরও শূন্য ময়দান। কাল্লা, ধলা, লাল্লি, সফেদার সাথে সাথে মঞ্জুলি আর ফুলকলিও তার চোখের আড়ালে চলে গেছে! এটা ভেবেও ছলিমুদ্দি্রমন বড়ো বেচান হয়।

‘যাগো এত্তদিন বুকে ধইরা আগলাইয়াছি, হেরা দেহি বেবাকেই আমারে ফালায়া থুইয়া গেলগা! আমার কুনদিহে লাভ কিডা অইল? আমার আপনার আর থাকল কী? লাল্লির চক্ষু দুইটা দিয়া ক্যামতে যে পানি পড়বার নাগছিল! বুবা জানোয়ার, কিছু কইয়া যাইতে পারে নাই। মাইয়া দুইটার চক্ষু দিয়া পানি পড়বার নাগছিল, হেরাও তো আমারে ভালা কি মন্দ কি কুনু কতাই কইয়া গেল না!’

এ-সব ভেবে ভেবে কোনো কোনো রাতে ছলিমুদ্দি একেবারে বেঘোর কেঁদে ওঠে। তখন হয়তো আম্বিয়া খাতুনের ঘুম ভেঙে যায়। ছলিমুদ্দি তখন জোর করে কান্নার ফুঁপানি বন্ধ করতে চায়, কিন্তু দম ফুরিয়ে যাবার মতো করে নতুন কান্না তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। আম্বিয়া খাতুন পরম মমতায় সোয়ামির পিঠে হাত রাখে। ধীরে ধীরে আঙুল বুলিয়ে বলে—

‘কীয়ের নাইগ্যা আফনে কাইন্দা মইরুন কন তো? হারাদিন তো ভালাই থাহুন। রাইত অইলেই কি জন্মের দুস্ক আফনেরে সজাগ কইরা তুলে? কীয়ের দুস্কে আফনে কাইন্দুন এমুন কইরা?’

ছলিমুদ্দি তখন বউয়ের এতসব প্রশ্নের জবাব দেবার অবস্থায় থাকে না। এত দুঃখ গলায় চেপে রেখে কোন মানুষই-বা কথা বলতে পারে? ছলিমুদ্দি আম্বিয়া খাতুনের উপর মনে মনে বিরক্ত হয়—

‘কীয়ের সোমসার যে আমি করি? হেয় তো বেবাকই জানে আর বুঝে, তাও কী না আমারে জিগায়? ঘুইরা ফিরা পত্যি আমার দুস্ক তালাশ করে! এই যে আমাগোরে বাড়িঘর, উঠান সব কেমতে ধূ ধূ ময়দান অইয়া গেল হের তালাশি তার মনে নাইক্কা। কিমুন বেহুশি মাইয়ানুক! যে কুনুদিন অন্তরের ভাও বুঝে না হের লগে জনমভর সোমাসার কেমতে করে মাইনষে?’

ছলিমুদ্দির অবিশ্রাম অথচ লুকানো কান্নার খোঁজখবর না করেই আম্বিয়া খাতুন ফের ঘুমে মরে যায়। নাকি দুম করে ঘুম এসে তাকে মেরে ফেলে? খানিক আগেই যে টসটসিয়ে কথা বলল, ভালোমন্দের খবরবার্তা জানতে চাইল, তার এমন আঁতকা ঘুমিয়ে পড়া দেখে ছলিমুদ্দির কান্না ফুরিয়ে যায়। ছলিমুদ্দি অনুভব করে, তার সকল কান্না কেমন ধুন্দুমার মিলিয়ে গেছে! তখন হয়তো পূবের আকাশে সামান্য শাদা শাদা আলো ফুটে উঠছে। ওই শাদাটে আলোর নীচে উঠানের জোয়ান শিউলি গাছটা বেশুমার ফুলেদের পাপড়ি মেলে দিয়েছে। ততক্ষণে আম্বিয়া খাতুনের খোঁয়াড়ের বড়ো রাতাটাও জেগে উঠেছে! জেগে উঠে ঘাড়ের কালো-সোনালি-খয়েরি রঙা পালক ফুলিয়ে সূর্যোদয়ের প্রথম বাগ দিচ্ছে।

এইবার আষাঢ় নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘিয়ার বিলে জল একেবারে উপচে উঠতে লাগল। ঝুলমুলি বিলের এরকম বাড়-বাড়ন্ত রূপ ম্যালাদিন চক্ষে দেখে নাই। ঝুলমুলি দেখেছে, লিলুয়া বাতাসে বিলের ছোটো ছোটো ঢেউদের জেগে উঠতে। তারপর তারা মৃদুমন্দ গতিতে, আয়েশ করে ক্রমশ সরে গেছে তীরের দিকে। অথবা ঢেউদের বুকের ভেতর, ঢেউদের শরীরের ভিতর দুলে দুলে মিশে যেতে। কিন্তু এইবার বাদলার জল ঝরে পড়ামাত্রই বিলের চেহারা গেল আমূল পালটে! স্বচ্ছ জলের স্তম্ভ ভেঙেচুরে চক্ষে একেবারে ধান্দা লাগিয়ে দিল। বাঘিয়ার বিলে রুই-কাতলা আর মৃগেলের পাখনা-লেজের ঝাপটানিতে রুপালি ঝিলিক উঠল ঘনঘন। শিঙ্গি-মাগুর আর পুঁটির ঘাঁইয়ে বুরবুরি উঠতে লাগল পার ঘেঁষে। ফি বছর শাদা শাদা এন্তার শাপলার মাঝে কিছু বেগুনি পানার ফুল অনাহূতের মতো তাকিয়ে থাকে। এবার কি না একেবারে অন্য দৃশ্য! পদ্মফুলের বড়ো বড়ো পাতা ছাতার মতো ভেসে রইল বিলের চারধারে। আর ফুটল অগণন ফুল। শাদা শাপলার ফুটে থাকাকে ম্লান করে পদ্মের গোলাপি আভা ঢেকে দিল স্বচ্ছ জলের বিস্তীর্ণ চাদর। ঝুলমুলির চক্ষে বিস্ময় আর ধরে না! আচানক এতকিছু দেখে শুনে তার মাথাটাও যেন আর আগের মতো কাজ করে না!

‘ই-ই-রে! এইডা কুন জমানা আইল? এতকাল দেখতাছি এই বিলের ছুরত! আইজ কুন কারণে হে্র ছুরত বদলায়া যায় রে? কত মাছের ঝাইকের খলবলানি আর ল্যাজ নাড়ানি দেইখ্যাই না সিয়ান অইলাম, অহন কিনা দেখি মাছগুলান ফাল দিয়া টানে উইঠা আইবার চায়! জাল ফেলাইলেই অহন খালুই ভইরা নেওন যাইব মনে লয়! বঁড়শিতে আদার দিলেই টপাটপ মাছ উইডা আইব!’

ঝুলমুলির আন্দাজ একেবারে মিথ্যে নয়। ছলিমুদ্দি এর মাঝে জাল ফেলে খালুই দুই মাছ নিয়ে গেছে। মাদারজানির মানুষজন ঝাপ্পুরঝুপ্পুর করে মাছ ধরার কায়দা-কানুন আবিষ্কার করে চলেছে।

ঝুলমুলির চক্ষু ভরা বিস্ময়ের মাঝে মাদারজানির জোয়ান ছেলে-ছোকরারাও জাল ফেলে। বঁড়শিতে আদার দিয়ে টপাটপ মাছ টানে তুলে আনে। ওই দলে জমির চেয়ারম্যানের পুত্র ইস্কান্দারকেও দেখা যায়, সে-ও জলে নেমে খুইয়া জালে কইয়ের ঝাঁক তুলে আনে। মাছগুলার লাফালাফির ফাঁকে খুব সন্তর্পনে একটা পদ্মফুলও উপড়ে আনে সে। ওই পদ্মফুল শোভা পেতে দেখা যায় ঝুলমুলির লম্বা বিনুনির আগায়।

ইস্কান্দারের তুলে আনা পদ্মফুল কোন ফাঁকে-বা কেন ঝুলমুলি বিনুনির শোভা বাড়ায় তা কেউ খেয়াল করে না। এমনকী আম্বিয়া খাতুন ও ছলিমুদ্দির চোখেও তা পড়ে না। ঝুলমুলির কালো মুখে কোথা থেকে যেন হলদেটে আলোর ছটা এসে পড়ে! ঝুলমুলির সইয়েরা বহুদিন বাদে তাকে ‘ফুলটোক্কা’ খেলতে দেখে। এক সইয়ের চোখ দুই হাতের আঙুলে ভালো করে চেপে ধরে ঝু্লমুলি ডাক ছাড়ে—

টাপটুপানি লোহারকাঠি
বৃন্দাবনে টিয়াপাখি
ছুটলোরে ছুট!
কচুর পাতা হলদি
ছুঁইয়া আয় জলদি
কোন ঘরে চোর গেছে ‘সাবধান!’

বলেই জোরে ডাক দেয়—
‘আয়রে আমার কদমফুল!’

শেষ পাতা

Categories
গল্প

লোকগল্প

আরও কিছু আছে বাকি

গল্প কথক: পার্থ হাজরা
সংগ্রহ ও লেখা: সুব্রত ঘোষ

কোন এক গ্রামে এক শখের সাধক বাস করতেন। সামান্য মন্ত্র বিদ্যার চর্চা করতেন তিনি। সাধক এবং সংসারী মানুষটির তাই জীবন নিয়ে কৌতূহল কম ছিল না। চাষাবাদ করে কোনো মতে দিন চালিয়েই খুশি থাকতে পারতেন না। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। আর নিজের মন্ত্র প্রয়োগ করে দেখতেন পশু পাখি গাছপালা এমনকী মানুষের উপর। এই কারণেই তাকে এড়িয়ে চলত গ্রামের লোক। এমনি একদিন বেড়াতে বেড়াতে তার চোখে পড়ল একটা মড়ার মাথার খুলি কাত হয়ে আলের ধারে পড়ে আছে। খুলি দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হায়, জীবনের এই তো পরিণতি হবে একদিন। এই ভেবে বিমর্ষ হয়েই ভাবলেন এই খুলি এখানে এল কী করে! কাছে পিঠে শ্মশান নেই। চোত-গাজন শেষ হয়েছে মাস চার হল। পচা ভাদ্র শুরু হবে এবার। ধরম পুজোও মিটে গেছে। গাজনের দলের কেউ যদি ভুল করে ফেলে গিয়েও থাকে খোঁজ খোঁজ রব উঠবে। তবে কি শেয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে এল? না, কাঁচা খুলি নয়। শুকনো খুলি। একটা কাঠি দিয়ে খুলিটা নাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে হল তার। কাঠি দিয়ে নেড়ে সোজা করতেই খুলিটার মুখোমুখি হতে হল তাকে। মানুষের মাথার খুলি। কিন্তু খুলির কপালের লেখন যেন তিনি পড়তে পারলেন। মন্ত্রবলে একটু চেষ্টা করেই পড়তে পারলেন লেখাটা— লেখা আছে— ‘আরও কিছু আছে বাকি’। এর পরেও বাকি থাকে কিছু জীবনে? মৃত্যুই জীবনের শেষ পরিণতি। তারপর আর কী? কর্মফলের কারণে আবার ফিরে আসা নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে। কিন্তু সেই আত্মা তো নশ্বর শরীর ছেড়ে গিয়েছে। জড় দেহ মিশে যাবে পঞ্চভূতে। এই খুলির তবে এমন কোন পরিণতি বাকি আছে? একটা সিদ্ধান্ত নিতে মানুষটি বিচলিত হলেন। কিন্তু নিজের কৌতূহলের কাছে হার মানলেন শেষ পর্যন্ত। এই খুলির শেষ পরিণতি না দেখে তিনি ছাড়বেন না। চারপাশে তাকিয়ে দেখে হেঁট হয়ে কুড়িয়ে নিলেন খুলিটা। খুব দ্রুত বেঁধে ফেললেন গামছায়। ঝুলিয়ে নিলেন পিঠে। তারপর হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে। বাড়ি না গিয়ে তিনি গিয়ে ঢুকলেন গোয়াল ঘরে। খুলিটাকে তুলে রাখলেন গোয়াল ঘরের মাচার ওপর, সবার চোখের আড়ালে।

কেউ খেয়াল না করলেও তার স্ত্রী খেয়াল করল স্বামীর চরিত্রে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আরও যেন সংসার বিমুখ হয়ে গেছে মানুষটা। জোর করে কাছে টানলেও কাছে আসতে চায় না। একদিন ভোর রাতে স্বামীকে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে সন্দেহ হল তার। একদিন গোয়াল ঘর থেকে ঘেমে নেয়ে বের হতে দেখল স্বামীকে, ফলে সন্দেহ আরও বাড়ল। একদিন দেখল স্বামী গোয়াল ঘরের মাচার উপর বসে আছে, সে যেতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। যে এক আড়া মঁইটা দেওয়াল লেপতে নিয়ে এসেছিল সে গোয়াল ঘর থেকে, দেখল ভর দুপুরে তার স্বামী সেই মঁই নিয়ে গোয়াল ঘরে ঢুকল, আবার কিছুক্ষণ পরে মঁই কাঁধে ফিরে এল বাড়িতে। সন্দেহ তখন মানুষ ছেড়ে গোয়াল ঘরের মাচার দিকে ধাবিত হল। একদিন স্বামী মাঠের দিকে যেতেই স্ত্রী ছুটে গেল গোয়ালে। মাচায় উঠে একটু খুঁজতেই সে দেখতে পেল খুলিটাকে। এই খুলির টানে মানুষ যুবতী স্ত্রী ছেড়ে ভোর রাতে গোয়াল ঘরের মাচায় ছুটে আসে!! সন্দেহ একটা হত। আজ তীব্র হল। এ নিশ্চয়ই তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকার খুলি। তন্ত্র মন্ত্রের নামে এইসব হচ্ছে দু-জনে। মরেও শান্তি দিচ্ছে না, এখনও তার আর তার স্বামীর মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে!! এর একটা হেস্তনেস্ত না হলেই নয়। খুলিটাকে বাড়িতে এনে শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভেঙে মশলার মতো বেটে ধুলো বানিয়ে ফেলল সে। তাতেও তার রাগ কমল না। সেই ধুলো ঝেটিয়ে ফেলে দিয়ে এল পাঁদাড়ে। যাক, এবার গিয়ে প্রেমিকার মুখোমুখি বসুক মাঝরাত্তিরে গোয়াল ঘরের মাচার ওপর।

সাধক মানুষটি এই ভেবেই চিন্তিত ছিলেন যে একটা মড়ার খুলির এমন কী পরিণতি বাকি থাকতে পারে। বিদ্যা তার গুরুমুখী নয়। মেলার মাঠে কেনা দশ বিশ টাকার বশীকরণ সংক্রান্ত পুঁথি পাঠেই সীমাবদ্ধ তার তন্ত্র মন্ত্রের জগৎ। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল তার মনে মনে। মড়ার খুলির কপালের লেখন পড়তে পেরে তার আস্থা জন্মেছিল নিজের উপর। কিন্তু গোয়াল ঘরের মাচায় রোজ ওঠেন আর হতাশ হন এই দেখে যে খুলির কোনো পরিবর্তন হয়নি। দিন কয়েক যেতে না যেতেই আবার দেখতে ইচ্ছে করে। ছুটে যান। মাস খানেক কেটেও গেছে। আজ মাঠ থেকে ফিরে মাচায় উঠে চমকে উঠলেন তিনি। খুলি গেল কোথায়? সন্দেহের তির ছুটল স্ত্রীর দিকে। ছুটে এলেন বাড়িতে। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন— “মাচায় একটা খুলি রাখা ছিল। তুমি জান সেটা কোথায়?” স্ত্রী তাকে ভর্ৎসনা করে খুলির পরিণতির কথা বলে জানাল— “যাও কেন, গিয়ে বসো মাচার ওপর। যেটুকু ওর সাধ বাকি ছিল আজ মিটিয়ে দিয়েছি। আর তুমি যদি ফের ঐ মাচামুখ হয়েছ তবে তোমাকেও আস্ত রাখব না।”

গল্প সংগ্রহের স্থান: গ্রাম মোহনপুর, থানা নানুর, জেলা: বীরভূম, ২০১৮

Categories
গল্প

যশোধরা রায়চৌধুরীর গল্প

সেইসব বাড়িয়ে বলা গল্পগুলো

বাড়িয়ে বলা ছাড়া আমাদের হাতে আর কী-ই-বা ছিল, বলো। প্রতিদিন একশো হাজারটা আড়াল রচনা করা, প্রতিদিন ঊনসত্তরটা মিথ্যে বলা, প্রতিদিন আমাদের জীবনের গল্পকে একটু একটু করে ঘন করে দানাদার করে তোলা এবং জনসমক্ষে পেশ করা।
একটা নীল ফুল ছাপ ছাপ, বড়ো বড়ো ফুলের হালকা শাড়ি, ভয়েল না কী বলে যেন। সেই পরে গা ধুয়ে বিকেলে চুল আঁচড়ে আসত দিদিভাই। আর চোখ বড়ো করে করে গল্প বলত। গান গাইতে বসত তারপর। কিন্তু ওই বিকেলের ফেলা সময়টুকু ওর নিজের সঙ্গে কাটত, আমারও, আমরা বারান্দায় দাঁড়াতাম, আমরা হাসাহাসি করতাম, গল্প করতাম। “ছেলে দেখতাম।” ক্যাবলা ছেলে স্মার্ট ছেলে কালো ছেলে ফর্সা ছেলে সিগারেট খাওয়া ছেলে খেলোয়াড় ছেলে রোথো ছেলে সব দেখতাম।

দিদিভাই তখন এইভাবেই গল্প করত। কলেজের গল্প। যা ঘটেছে আর যা ঘটেনি সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে দিদিভাই বলত। আমি ইশকুলে তখন মাত্রই ক্লাস এইট। ভূগোল বইয়ের তলায় শরদিন্দুর প্রেমের গল্প লুকিয়ে পড়ছি। প্রতিভা বসু, আশুতোষ, বিভূতি মুখুজ্জে। প্রেমের শিহরণ আমার জানা নেই তখনও। দিদিভাই আমাকে ওর বন্ধুদের প্রেমের কথা বলত।

নিজে প্রেম করার সাহস ছিল না। ওর মা বাবা তাহলে পিঠের ছাল তুলে দেবে না? কলেজটা যে কো এড, তাতেই তো সবার কত আপত্তি। ঠিক বিকেল ছ-টার মধ্যে ঘাম মুছতে মুছতে গিয়ে কাকিমা দাঁড়ায় মোড়ের কাছে। দিদিভাই বাস থেকে নামলে গলির পথটা পাহারা দিয়ে দিয়ে নিয়ে আসবে। তখন কুলফিওয়ালার হাঁক শোনা যায়নি, কিন্তু রাস্তার বাতিগুলো জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে একটা আঁকশি হাতে লোক। ঝুপসি মতো সন্ধ্যে নামতে নামতে কলেজের সঙ্গে একটাই সংযোগ রক্ষাকারী বাস এসে দিদিভাইকে নামিয়ে দেয়। ঠিক কলেজ-টার শেষ ক্লাসের সঙ্গে বাস রাস্তাটুকুর সময় যোগ করলে যে-সময়টা হয় সেই সময়ে।

আমার হাসি পায়। দিদিভাই চাইলে তো ক্লাস ও কাটতে পারে। দিদিভাই দুষ্টুমি করে খাবার ফেলে, পাত থেকে ঝিঙে বা তেতো নিয়ে জানালার বাইরে ফেলতে পারে লুকিয়ে, এমনকী বাথরুমে দুধের গেলাস নিয়ে ফেলে দিতে পারে দুধ। সব কাকিমাকে লুকিয়ে। আর প্রেম করতে পারে না?

যার এত ইন্টারেস্ট অন্যদের প্রেমে?

দিদিভাই, নিজে প্রেম করত কিনা আমি আজ আর জানি না। জানি, একেবারে কিচ্ছু নেই যে-সম্পর্কে সে-সম্পর্ককেও বাড়িয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলতে পারত ও। মুখচোরা, কালো, কোঁকড়ানো চুলের দিদিভাই বাড়িতে হম্বিতম্বি করে ভাইবোনেদের ওপরে। কলেজে চুপটি করে যেত আর নোট নিয়ে চলে আসত। বড়োজোর শেষ দিকের এক-দু-খানা ক্লাস কেটে ক্যান্টিনে গিয়ে চপ আর চা সাঁটাত, অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যে চোরা চোখে চাইত নিজের পছন্দের পলাশদার দিকে। এই ছিল দিদিভাইয়ের দৌড়।

দিদিদের ক্লাসের তাপসীদি তখন হোস্টেলে থাকে। সে হোস্টেলের গল্প শুনে ততদিনে পুরো পেকে গেছি আমি। তাপসীদিদের দুষ্টুমি। সিগারেট খাওয়া। অবিবাহিতা মোটা আর কালো (এই মোটা আর কালো শব্দদুটো বলার সময়ে ছেলে আর মেয়ে সবার মধ্যে কী পৈশাচিক উল্লাস যে কাজ করে!) সুপার ম্যাডামের গোঁফ আছে কি নেই সে-গল্প… একদিন হুট করে দিদিমণির ঘরে ঢুকে পড়ে সুপার ম্যাডামকে ব্লাউজ খোলা অবস্থায় দেখে ফেলার উল্লাস আর নিষিদ্ধতা… সে-সব বলার মধ্যে কত যে পেজোমি আর গুল্লি গুল্লি চোখের মজা ঢেলে ফেলত দিদিভাই।

তবু ছাপোষা আমরা। আমাদের জীবন ছাপোষাই হয়ে গেল তাই, তাপ্পর।

দিদিভাইকে বিয়ে দেওয়া হল। কথায় বলে, হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে, দুষ্টু মেয়ে জব্দ হয় বিয়ে দিয়ে দিলে। দিদিভাই ঠিক সময়ে খেত না, সকালে দাঁত মাজতে ভুলে যেত। খবরের কাগজের হেডলাইন আর প্রথমপাতাটা উলটে দ্বিতীয় পাতার কোণায় রিপ কার্বি আর অরণ্যদেব পড়ে সকালে ওর কাজ সারা। হরলিক্স কোনোদিন তলানি খেত না। তা নিয়ে কাকিমা খিটখিট করত। দিদিভাই বিকেলে বারান্দা থেকে আমার সঙ্গে গল্প আর ছেলেদেখা শেষ করে গান নিয়ে বসত কিন্তু তাতেও ফাঁকি। পড়াশুনো তো চিরদিন অন্যমনস্কভাবেই করে গেল। ক্লাস্ত ওয়ান থেকে টেন অঙ্ককে ভয় পেয়ে পেয়ে ইলেভেনে হোম সায়েন্স…। এই আমার দিদিভাই।
তবু তার কী ভীষণ জাঁদরেল আর সুপণ্ডিত এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। কে জানে কী কপালে। আসলে কাকা আর কাকিমার প্রচেষ্টায়।

যে-প্রচেষ্টায় কাকিমা দুপুরে ঘুমোত না, উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পর, দুপুরে খেয়ে উঠে গল্পবই না পড়ে রাশি রাশি জ্যাম জেলি আর আচার বানাত, ছাতে দিত তারপর ছাত থেকে পাড়ার সমস্ত দুষ্টু ছেলে আর মেয়েদের খর চোখে নজরদারি করত, চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে দুপুরের আধো অন্ধকার ঘরটিতে বসে সেলাই ফোঁড়াই করত, দূর থেকে ও বাড়ির টুম্পা ছেলেদের সঙ্গে চিরকুট চালাচালি করছে দেখে ভুরু কুঁচকে বলত হুঁ! সেই একই অধ্যবসায়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাকিমা চলে যেতে ঠিক ছটায় আমাদের সরু গলি পেরিয়ে বাসরাস্তায়, দিদিভাইকে বাস থেকে নামিয়ে সঙ্গে করে আনতে। সেই অধ্যবসায়েই চেনা পরিচিত থেকে শুরু করে কাগজের বিজ্ঞাপন সর্বত্র নজরদারি করে দিদিভাইকে এক অসামান্য পরিবারের রূপহীন, অর্ধটাকওয়ালা, কোলকুঁজো, ভারী চশমার পড়ুয়া পাত্রে পাত্রস্থ করল। পাত্রের বাবা মা দু-জনেই অধ্যাপক এবং প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের। বাবা অবিশ্যি মারা গেছেন সম্প্রতি। মা একাই ছেলেকে ব্যবস্থা করে বিয়ে দিচ্ছেন।

বিয়ের সন্ধ্যেতে দিদিভাই যখন সাজছিল তখন বান্ধবী আর বোনেরা, পাড়ার মেয়েরা হই হই করে বর দেখতে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল মুখ চুন করে। এরকম গল্প করে তিলকে তাল করতে পারা দিদিভাইটা, ওর বর রাজেশ খান্না বা নিদেনপক্ষে আমাদের শমিত ভঞ্জ বা স্বরূপ দত্তের মতো দেখতে হতেই হবে। দিদিভাইয়ের চোখ খঞ্জনার মতো ছিল, নাক সরু আর মোটের ওপর মুখশ্রী তো ভালোই। সেই মিষ্টি দিদিভাই বরের ছবি দেখে কতটা কষ্ট পেয়েছিল এখন বুঝি। তখনও বুঝেছিলাম।

ভয় ও পেয়েছিল। এতদিনের সিনেমা দেখা, এতদিনের দারুণ সব গল্পবই, এতদিনের কলেজের প্রেম প্রেম ভাব, পলাশদার প্রতি চোরা চাউনি, সবের পর, এই পণ্ডিত, বয়সে আট বছরের বড়ো রাগি রাগি দেখতে বরের চেয়েও, তাদের ওই সুবিশাল নামডাকের পরিবারে গিয়ে ভর্তি হতে হবে ভেবেই দিদিভাই কুঁকড়ে গেসল।

দিদিভাইয়ের শাশুড়ি ছিলেন এম এ পাশ। সদ্য বিধবা, তবে একাই একশো। ভীষণ ব্যক্তিত্ব। চোখা চেহারা। অধ্যাপক হিসেবে দারুণ নামডাক।

অথচ দিদিভাইকে বি এ থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দেবার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল। বিদ্বান ছেলের বিয়ে দিতে ওঁরা সুশিক্ষিতা মেয়ে খোঁজেননি কেন? রূপসীও খোঁজেননি?

দিদির পাকাদেখার দিন আমি চারটে কমলাভোগ আর দুটো সিঙাড়া সাঁটাতে সাঁটাতে শুনেছিলাম দিদির হবু শাশুড়ি বলছেন, রূপ বিদ্যে দিয়ে কী করব আমি বলো তো? সে-সবের তো অভাব নেই আমাদের বাড়িতে? আমার শুধু একটা ঘরোয়া মেয়ে চাই, বাড়ির সব দায়িত্ব নিতে পারবে… নিজের মেয়ের মতো রাখব।

দিদিদের বাড়ির সদর দরজার চাবির দুটো ডুপ্লিকেট ছিল। একটা বাড়িতে থাকত। অন্যটা নিয়ে বেরুত জামাইবাবু। আর তৃতীয়টা দিদির ননদের কাছে থাকত। বেল টিপে মাকে বিরক্ত করবে না সে, সুন্দরী শিক্ষিতা উচ্চ পদে কর্মরতা ননদ দিনের যে-কোনো সময় “নিজের বাড়িতে” আসবে বলে ওর কাছে থাকত। ইয়েল লকের চাবি ঘোরালেই সে-বাড়ি ঢুকতে পারত।

দিদি বাজারে গেলে, শপিং, ছেলেকে স্কুলে দেওয়া… বা নিজের বাপের বাড়িতে কাকু কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে এলেও… নাহ্, ফিরে গিয়ে বেল টিপে বসে থাকত সিঁড়িতে। ভেতরে, অনেক দূর থেকে হাওয়াই চটি, ঘরে পরার, ফটর ফটর আওয়াজ করে শাশুড়ি আসতেন। লেখাপড়ার টেবিল থেকে উঠে আসতে হয়েছে বলে রীতিমত বিরক্ত। তবু, দিদির হাতে কখনো আরেকটা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারেনি।

এই মুহূর্তে দিদিভাই শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে। একা, সম্পূর্ণ একা। দিদিভাই মরণাপন্ন। একটু আগেই ফোন করেছিল ওদের কাজের লোক। দিদির মোবাইল ঘেঁটেই আমার নম্বর পেয়েছে।

ডাক্তার আমাকেই জিগ্যেস করলেন, ওঁর আধার কার্ড কোথায়? আইডেন্টিটি কার্ড কিচ্ছু আনেনি তো।

কে আনত? কাজের লোক ? জামাইবাবু? জামাইবাবু নিজের কার্ড ও খুঁজে পান কিনা সন্দেহ।

দিদি একা শুয়ে আছে। আমি এসেছি। আমার নিজের গল্প, নিজের সমস্যা, নিজের শ্বশুরবাড়ি, সব সামলে, পেছনে রেখে। দিদি টার্মিনাল। কত বোতল রক্ত যেন লাগবে। কতগুলো টেস্ট যেন করতে হবে। কে করায়, কে দায় নেয়?

এই শেষ সময়টা ওর বর পাশে নেই। ছেলেও বিদেশে। জামাইবাবুকে ফোন করি একটা। ওদিক থেকে বিস্রস্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত গলা শোনা যায়। বয়স যেন এক লাফে অনেক বছর বেড়ে গেছে জামাইবাবুর।

কে?

আমি, টুনি। জামাইবাবু দিদির ত রক্ত লাগবে/
অ্যাঁ, রক্ত?
দিদির আই কার্ডটা কি কেউ এসে দিয়ে যেতে পারে নার্সিং হোমে?
কেউ- কেউ ত-তো নেই টুনি। আমার, আমার না, নার্ভ ফেইল করছে টুনি।
তাহলে-তাহলে-দু-মুহূর্ত ভেবে নিই আমি। আচ্ছা জামাইবাবু আমিই যাচ্ছি আপনাদের ওখানে।

যাই। দ্রুত ট্যাক্সি ডেকে নিই। মুখে হু হু করে হাওয়া লাগছে আর আমার কান্না আসছে। ছোটবেলার সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দিদিভাইয়ের বানিয়ে বলা গল্পগুলো। বড় বড় চোখ করে। তেঁতুলের আচার চুরি করে এনে কাকির ভাঁড়ার থেকে।

ওদের বাড়িতে ছটা আলমারি। তার তিনটে লোহার। জামাইবাবু জানেন না দিদির আধারকার্ড কোথায় আছে। দিদিভাইই ত সব গুছিয়ে রাখে ।

ও-ও জানত।
পাস্ট টেন্স কেন বলছে জামাইবাবু? মাথাটা কি একেবারে গেছে?

চাবি কোথায় থাকে? চাবিগুলো? লকারে থাকা সম্ভব। দিদির বেডরুমে ঢুকে ড্রয়ার হাঁটকাই আমি।

সারাবাড়িতে, দিদির ঘরে, দেওয়ালে কত ফোটো। দিদির একটাও নেই। জামাইবাবুর অল্পবয়সের ডিগ্রি সেরিমোনির ছবি। ওদের ছেলের অসংখ্য নানা বয়সের। আর বাইরের ঘরে দেখে এসেছি মাসিমা মেসোমশাইয়ের ছবি। স্টুডিওতে তোলা মেধাবী মহিলাটি… শিক্ষিতা, সে যুগের এম এস সি। দিদির ননদের ও আছে। দিদি শুধু নেই। না ওই তো ভুটুকে জড়িয়ে ধরে একটা অস্পষ্ট।

ওহ, ওর বোধ হয় আধার হয়নি জানো টুনি। সেই সময়ে তো আসলে ভুটুর মাধ্যমিক, ও পড়াচ্ছিল। বলেছিল পরে কখনো করিয়ে নেবে। আর হয়নি।

দিদিভাইয়ের আধার নেই। আইডেন্টিটি কার্ড নেই। প্যান, ইলেকশন আই কার্ড? সেসব নেই? সেসব কোথায়?

হাত কাঁপছে জামাইবাবুর । করুণা হয় আমার ওঁর দিকে তাকিয়ে। জামাইবাবু বিদ্বান মানুষ। কোনোদিন জীবনের কোনো প্রাক্‌টিক্যাল সিদ্ধান্ত নিতে শেখেননি। ত্রিশ বছর বয়স অব্দি মায়ের শাসনে, মায়ের সিদ্ধান্তে চলেছেন। বিয়ের পরও, মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, মাতৃমুখাপেক্ষিতা ঘোচেনি।

দিদিভাই ধীরে ধীরে নিজের কালো হবার, বিদ্যাহীন হবার অপরাধ বোধ নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির সেবাতে সার্বিকভাবে আত্মনিয়োগ করেছিল। আর দক্ষতায়, যত্নে, প্রাণপণ চেষ্টায় পুতুলের মতো কর্মপটু আর অনিবার্যভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল ওদের সংসারে।

ফলত জামাইবাবু কখনো কুটো নাড়েননি। বছর দশেক আগে দিদিভাইয়ের শাশুড়ি মারা যাবার দিন ওঁকে হাউ হাউ করে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছিলাম। দিদিভাই সেদিন সমাগত আত্মীয়দের বড়ো বড়ো ট্রে ভর্তি করে চা আর সরবত এনে দিচ্ছিল। সে ব্যস্ততায় আমি শুধু লক্ষ করেছিলাম দিদিভাইয়ের মুখটা শুকনো। সাদা শাড়ির ভেতরে রুগ্ন একটা শরীর। কপালে দু-তিনটি চুল রুপোলি হয়ে এসেছে।

তুমি কিছু খাবে না?

দিদিভাই জামাইবাবুর সামনেও চা ধরেছিল। জামাইবাবুর চোখ দুটো ফুলে লাল, জবাফুলের মতো। মাথা নেড়ে না বলেছিল। সবাই ঘিরে ধরেছিল তাকে। আহা উহুর বন্যা। দিদিভাইয়ের পিসিশাশুড়ি বলেছিলেন, বউমা ওকে ডাবের জল টল কিছু দাও। এত বড়ো আঘাত…

ঐদিন মনে হয়েছিল দিদিও আর বেশিদিন বাঁচবে না। কিন্তু ঐ যে আমাদের বাড়িয়ে বলা স্বভাব। আমরা সবকিছু নাটকীয় করে ফেলি। সবকিছুকে বানিয়ে তুলি গল্পের মতো…

সেইদিনের পর দিদির শাশুড়ির শ্রাদ্ধের দিন, তার পরদিন, খুব খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। জামাইবাবু নিজের মায়ের সম্বন্ধে বই বার করেছিল একটা। আত্মীয়রা, নিজে , লিখেছিল স্মৃতিকথা। কত পন্ডিত, শিক্ষিত মানুষ ওই পরিবারে। ওঁর ছাত্রছাত্রীরাও লিখেছিল বইকি। দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে মাসিমার ফ্যান ক্লাব।

দিদির ছেলে ভুটু ঠাকুমার ডিজিটাল ছবির কোলাজ বানিয়ে ল্যাপটপে লাগিয়ে লুপে চালিয়ে রেখেছিল।

দিদিভাই মারা গেলে ওর ছবির কোলাজ বানাবে, ভুটু?

Categories
গল্প

হিন্দোল ভট্টাচার্যর গল্প

ভয়

“তুমি তো গল্প লিখতে বসে কোনও গল্পই রাখোনি। পাতার পর পাতা লিখে গেছ! একটি কাক তোমাকে লক্ষ্য করছে, এটা তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরির বিষয়বস্তু হতে পারে, কিন্তু এটা কোনো গল্প নয়”
“কিন্তু তরুণদা, আমি সকালবেলা উঠে দেখলাম একটা পোকা হয়ে গেছি, সেটা যদি একটা…”
“আরে সব বিষয়ে যদি তোমার কাফকা এসে পড়েন, কাম্যু এসে পড়েন, তার্কোভস্কি এসে পড়েন, তাহলে তো মুশকিল হে! তুমি তো এই কলকাতায় বসে গল্পটা লিখছ একটা খবর কাগজের সাহিত্যপত্রের জন্য। বাঙালিদের জন্য। বাঙালি পামুক পড়ে, দস্তুভয়স্কি পড়ে কিন্তু চায় শরৎরচনাবলি। তোমাকে আসল পাঞ্চটা করতে হবে এখানে। শরৎ এবং জয়েসে। না হলে তো এখানে জায়গাই পাবে না। কথাটা বলবে কোথায়?”

“কিন্তু দাদা, আমার জীবনে তো গল্প নেই। আমি আর বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারব না”।

“আহা! লক্ষ করো। ঢুকে যাও মানুষের ভিতরে। বস্তির মানুষেরা কেমনভাবে বেঁচে আছে। সাব অলটার্ন মানুষের জীবন কেমন! তোমার জীবন সম্পর্কে কারো কোনো আগ্রহ নেই। আর কোন কাক কার দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তা বাংলা সাহিত্যের বিষয় হতে পারে না।”

“কিন্তু তরুণদা, যদি, বিষয়টা একটা রিভেঞ্জ হয়”

“ওরে বাবা, হিটলারের বার্ডস নাকি?”

গল্পটা ছাপা হয়নি। পার্থর একমাত্র এমন একটা লেখা সেই গল্প, ছাপা হয়নি। অবশ্য ছাপা যে হবে না, তা রুমেলা বলে দিয়েছিল আগেই। কারণ, গল্পের মধ্যে এমন কিছুই ছিল না, যা গল্পটাকে গল্প করে উঠতে পারে। কিন্তু পার্থর নিজের আর যে-কোনো কাহিনি নেই। আর যে গল্পও নেই। সে গল্প লিখবে কেমন করে? পার্থ শুধু জানে, সে ঠিক যেমনভাবে দেখে, তা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আর সে যে-জীবনযাপন করে না, সেই জীবন সম্পর্কে লেখার অধিকারীও সে না।

“নিজের থেকে বেরোও পার্থ। কত চরিত্র, তাদের মধ্যে আত্মার মতো ঢুকে পড়। একজন লেখক তো আসলে একটি বিদেহী আত্মা, যে, মানুষের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তার পর তার পোশাকগুলো পড়ে থাকে। সে থাকে না। সেই পোশাকগুলো কী? তার লেখা বিভিন্ন চরিত্র।”

“মানছি তরুণদা, কিন্তু, এত চরিত্র যার আশেপাশে কোনোদিন ছিল না, তার জীবনে গল্প নেই বলছেন? মানে, তার একটা বাগানের গাছ বা পোষা কুকুর কিংবা অপরিচিত কাক তার গল্পের চরিত্র হতে পারে না?”

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। একটা অসম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ নিয়ে পার্থর গল্প পার্থর ব্যাগের মধ্যেই ঘুরতে থাকল। কারণ, পার্থর মতোই পার্থর গল্পেরও আর অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল না।

কিন্তু এগুলিও পার্থর ভয়ের কারণ নয়। অবশ্য রুমেলা ঠিকই ধরেছিল, পার্থ আজকাল নিজেকেই ভয় পাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, তত যেন আরও বেশি করে এই ভয় চেপে বসছে পার্থর মনের ভিতরে। যেমন শীতকালের হালকা লাল রঙের রাস্তার আলোর সঙ্গে কুয়াশা মিলেমিশে একধরনের আলোর জন্ম দেয়। সেই আলোর চরিত্র একটাই। আর তা হল বিষাদ। পার্থ যে মানুষের চেয়ে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, এ-কথা পার্থর নিজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। বরং, সে ক্রমশ বুঝতে পারল মানুষের প্রতি তার একধরনের বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে মনের ভিতরে। কিন্তু তাকে দেখতে কাক কিংবা শেয়াল বা কুকুরের মতো হয়ে যায়নি।
“কী বলছ, তোমাকে তোমার মতো দেখতে লাগছে কিনা?”

“হ্যাঁ, মানে, আমাকে কি আমার মতোই দেখতে লাগছে রুমেলা?”

আর ঠিক সে-সময়ে ডেকে উঠবে একটি কোকিল অযাচিতভাবে, সেটা পার্থ বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি বলেই সে চমকে উঠেছিল। রুমেলা উঠে পড়েছিল চেয়ার ছেড়ে আর তার পরেই তার সেই মন্তব্য, যা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল পার্থ। আর সেটি হল— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

এইটুকু পড়ার পরে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন একটা বিভ্রান্তিকর গদ্য ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারছেন না। কারণ, লেখাটি প্রথম বাক্য ছেড়ে আদৌ কোথাও এগোয়নি। পার্থও এগোত না, যদি না সেদিন রাতেই বাড়ি ফেরার সময়ে সে বুঝতে পারবে পাড়ার কুকুরগুলো আর তাকে দেখে তেড়ে আসছে না। আর এ-কথা খেয়াল করা মাত্র, তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাবে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে সব। আস্তে আস্তে পরিচিত সকলের কাছ থেকেই তার তৈরি হয়েছে এক দূরত্ব। এমনকী মানুষ দেখলে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে আজকাল। একধরনের বমি আসছে। জ্বর আসছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তরুণদা হোক বা রুমেলা বা বাজারের শংকরদা, বা, বাসের ভিড়। মানুষের কাছ থেকে দূরে একা থাকলেই সে স্বস্তি পাচ্ছে। যদি প্রকৃতির রোষ গিয়ে পড়ে মানুষের উপর, তাহলে সেও সেই রোষের কবলে পড়বেই। হয়তো একদিন সারিবদ্ধভাবে আক্রমণ করবে সমস্ত পাখি, সব কুকুর, সব বাঘ এমনকী সব ছাগল। এমন একধরনের অবাস্তবিক বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য কোনও রূপকথা বা কোনো গল্প বা কোনো চলচ্চিত্রও তৈরি থাকবে না নিশ্চয়। ফলে, না লিখতে পারার একাকিত্ব পার্থকে ঘিরে ধরবে। রাত একটার ফাঁকা রাস্তায় বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে এ-সব কথা ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ছিল রুমেলার সেই প্রশ্ন— “তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। অন্তত রাত একটায়। রাস্তার মোড়ের মাথায় ওই চার পাঁচটা কুকুরের ঠিকানা। সেখান থেকে ঠিক পাঁচশো কি এক কিলোমিটার তাদের সীমা। এই সীমার মধ্যেই তাদের জন্ম, যুদ্ধ, প্রেম, যৌনতা, মৃত্যু। রাতে যখন পার্থ ফেরে, তখন চেনা মানুষ হলেও তার দিকে তাকিয়ে একবার মুখ তোলে কুকুরগুলো। গলার ভিতর দিয়ে একটা চাপা ক্রোধের গরগর শুনতে শুনতে ঘামতে থাকে পার্থ। সেজানে, তাকে যদি আক্রমণ করে কুকুরগুলো, তাহলে, তার কিছুই করার নেই। কিন্তু প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কুকুরগুলো এবং তাদের সন্তানসন্ততিরা তাকে আক্রমণ করেনি কখনো। কিন্তু সেদিন ওই মোড়ের মাথা টিপে রোবার সময় যখন কুকুরগুলো একবার মুখ তুলেও তার দিকে তাকালো না, তখন পার্থ আন্দাজ করতে পারছিল কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। আর সে-সিদ্ধান্ত বদ্ধমূল হল, যখন দূর থেকে একটা তারই উচ্চতার লোক তার দিকে এগিয়ে এল ক্রমশ। ওই ফাঁকা রাস্তায়, সাধারণত কেউ উলটো দিক থেকে আসে না। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয়টি ছিল অন্য। লোকটিকে অবিকল তার মতোই দেখতে। আর তাকে দেখেই আবার তার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে গেল পার্থর। এটা তো কোনো কাহিনি নয়, একেবারে একটি গল্প হয়ে যাচ্ছে। একটি অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্প। কিন্তু ঘটনাটি ঘটছে। সেভাবে ভাবতে গেলে, আমাদের জীবনও একটা অত্যন্ত খারাপ মাথামুণ্ডুহীন গল্পের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা হয়তো সেইসব গল্পগুলিকে নানা রঙের নানা দৈর্ঘ্যের সুতোয় বেঁধে সেগুলিকে একটা যুক্তির রূপ দিই মাত্র। ভাবতে ভালোবাসি, যে জীবনের একটা কোনো মানে আছে। কিন্তু প্রকৃতির সে-দায় নেই। পার্থর মনে হল প্রথমে, এই দেখাটা সম্পূর্ণভাবেই আজগুবি। কিন্তু তার এই মনে হওয়া পালটে গেল তখন, যখন সেই লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “এটা ঠিক করছ না পার্থ। তুমি মানুষ না, ক্রমশ একটা জন্তু হয়ে যাচ্ছ। আমি তো মাকে জন্তু হতে দেব না”।

পার্থ প্রাণপণে বোঝাতে চাইল একবার, যে সে জন্তু হতে চাইছে না। পরমুহূর্তেই তার মনে হল, এই ভুলটা সে করতে পারে না। সে ফিসফিস করে বলে উঠল— আমি জন্তু। তুমিও জন্তু। তুমি আমাকে ধ্বংস করছ। আর আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছি।

পার্থর কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই সে শুনতে পেল পাড়ার সমস্ত কুকুর একসঙ্গে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। পার্থর মতোই দেখতে কিন্তু পার্থ নয় লোকটিকে একযোগে কুকুরগুলো আক্রমণ করল। লোকটি পালাতে পালাতে গলিটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে হারিয়ে গেল। লোকটির সঙ্গে হারিয়ে গেল কুকুরগুলোও।

পরদিন সকালে রুমেলা চা দিতে দিতে পার্থকে বলল— কাল রাতে এ-পাড়ায় নাকি চোর এসেছিল। তবে এ-পাড়ার কুকুরগুলো বাঘের বাচ্চা। লোকটাকে ছাড়েনি।

“মানে?” পার্থর বুকের ধুকপুকানি আবার বেড়ে গেল।

“লোকটার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। পুলিশ শণাক্ত করেছে দাগী চোর।

“চোর?”

“হ্যাঁ”

“কী করে শণাক্ত করল? লোকটা তো ভালো লোকও হতে পারে। একটা আস্ত মানুষকে কুকুরগুলো ছিঁড়ে ফেলল?”

“তুমিও তো রাতে ফেরো। অবশ্য কুকুরগুলো চেনা মানুষকে কিছু করে না”।

“আমি মানুষ?”

“কেন? কী যে হয় তোমার!”

“তুমি নিশ্চিত আমি মানুষ? জন্তুনই?”

‘‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?”

প্রশ্নটা শুনে, একটু মনে মনে অস্বস্তিতেই পড়ে গেল পার্থ। আসলে, রুমেলার এই এক সমস্যা। যখন তখন এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেগুলি সে খুব ভেবেচিন্তে করছে বলে মনে হয় না, অথচ, হয়তো ভেবেচিন্তেই করে রুমেলা। কারণ, রুমেলাকে খুব একটা বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমেলা যে-সব বোঝে, তার প্রমাণ রাখতে একটা বাক্যাংশই যথেষ্ট। কিন্তু ও বেশিক্ষণ একবাক্য নিয়ে পড়ে থাকে না। যেমন, জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে রুমেলা প্রসঙ্গই পালটে ফেলে বলল, “দেওয়ালের গায়ে কেমন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে, তাই না?”

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

হিন্দোল ভট্টাচার্যর গল্প

ভয়

‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ?’

প্রশ্নটা শুনে, একটু মনে মনে অস্বস্তিতেই পড়ে গেল পার্থ। আসলে, রুমেলার এই এক সমস্যা। যখন তখন এমন সব প্রশ্ন করে বসে, যেগুলি সে খুব ভেবেচিন্তে করছে বলে মনে হয় না, অথচ, হয়তো ভেবেচিন্তেই করে রুমেলা। কারণ, রুমেলাকে খুব একটা বোকা ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমেলা যে-সব বোঝে, তার প্রমাণ রাখতে একটা বাক্যাংশই যথেষ্ট। কিন্তু ও বেশিক্ষণ এক বাক্য নিয়ে পড়ে থাকে না। যেমন, জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে রুমেলা প্রসঙ্গই পালটে ফেলে বলল, ‘দেওয়ালের গায়ে কেমন মানুষের মুখ ফুটে ওঠে, তাই না?’

পার্থ বলল, হুঁ। কিন্তু তার মনে রুমেলার কথাটি গুনগুন করছে। যেন এক চেপে রাখা আশ্চর্য দমকা বাতাস আবার হুহু করে উঠছে বুকের ভিতর।

‘তুমি কি নিজেকে ভয় পাচ্ছ’?

এই সত্যি কথাটা রুমেলার সামনে স্বীকার করার ক্ষমতা পার্থর নেই। বিকেলের আলোটা ক্রমশ মায়াবী হয়ে উঠেছে। এই সময়টা এমন হয়। আবাসনের পশ্চিম দিক এখনও খোলা। তাই অনেকটা আকাশ দেখা যায়। জীবনানন্দের পাখিদের দেখাও যায়। রুমেলা অবশ্য একদিন ভুল ভাঙিয়ে বলেছিল, ওরা বিকেলের ঘরে পেখা পাখি, জীবনানন্দ দেখেছিলেন।

পার্থ যে রুমেলাকে ভয় পায়, তার কারণ যে, রুমেলা পার্থর স্ত্রী তা নয়। বরং, তাদের দু-জনের মধ্যে একটা আশ্চর্য সম্পর্ক। আর সে-সম্পর্কের কথা রুমেলা জানে না। পার্থও জানত না। কিন্তু একদিন রাতে সব হিসেব পালটে গেল।

পার্থ যে কয়েকদিন ধরেই একটু ভয়ে ভয়ে আছে, এ-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না তার নিজেরও। কিন্তু ঠিক কাকে ভয় পাচ্ছে, এ-বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ ছিল না। হতে পারে, তার কাগজের অফিসের সম্পূর্ণ পরিবেশ, আবার হতে পারে সেই চিফ রিপোর্টার। আবার এও হতে পারে, মাথার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঘনিয়ে আসা চাকরি চলে যাওয়ার ভয়।

অফিস থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউইয়ে চা খেতে বেরিয়েছিল পার্থ। ক্রসিং-এর জায়গাটায় গাড়ি সিগন্যাল পেলেই খুব জোরে চলতে শুরু করে দেয়। সেদিনও শুরু করে দিয়েছিল। চা-টা সবে এক সিপ দিয়েছে, আর শুনতে পেল একটা গাড়ির ব্রেক কষা আর একটা কুকুরের চিৎকার।

এমন একটা জায়গায় চায়ের দোকানটা, যেখান থেকে রক্তাক্ত সেই কুকুরটার দেহ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। একটা কুকুরই তো মারা গেল, বিশেষ কিছুই নয়। একটা সাধারণ রাস্তার নেড়ি কুত্তা। অল্প পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য থেমেছিল ট্র্যাফিক। কিন্তু তার বেশি কিছুতেই নয়। সাধারণ একটা রাস্তার নেড়িকুত্তার জন্য বেশিক্ষণ থেমে থাকা যায় না। কিন্তু পার্থর বুকের ভিতরে ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল। চায়ের ভাঁড়টা হাতে ধরে রাখতে পারছিল না পার্থ। গরম চা চলকে গেল। আঙুলের উপরে গরম চা-টা পড়তেই আর ভাঁড়টা হাতে ধরে রাখা সম্ভব ছিল না পার্থর পক্ষে।

পায়ের তলার মাটি সরে যেতে সাধারণত কেউই দেখেনি। কিন্তু পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া একটা চেনা বাক্য হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। পার্থ এটুকু বুঝেছিল সেদিন, পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ। অথচ, কোনো কারণ ছিল না এই অহেতুক ভয়ের। কেউ তাকে শাসানি দেয়নি, কোনো টার্মিনাল লেটার আসেনি, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, পরিবারের কারোর সামনে অপারেশন নেই, হাসপাতালে ভর্তি নয় কেউ, পরকীয়া ঘটেনি জীবনে, রুমেলাও বলেনি ডিভোর্সের কথা, যদিও তার এ-কথা বলে ওঠার অনেকগুলো যুক্তি থাকাটা খুব স্বাভাবিক। এ-সব কিছুই হয়নি।

কিন্তু পার্থর পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। বুকের ভিতরে শুরু হয়েছে এক অদ্ভুত ছটফটে অস্থির ভাব। এক শূন্যতা মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকে অধিকার করে নিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত জানলাকে তার মনে হচ্ছে যে-কোনো সময়ে ভেঙে পড়ে যেতে পারে। যেন জল উঠে এসেছে বিপদসীমায় আর একটা গোটা শহর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ঘাটে। কিন্তু এত সব রুমেলাকে বোঝানো সম্ভব নয়। রুমেলা আশাবাদের মতো করে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে উড়ে উড়ে বেড়ায়। কাজ না থাকলেও কোনো-না-কোনো কাজের মধ্যে ডুবে যায়। অথবা অকারণ তর্কের বিষয় খুঁজে বের করে। তা, সে মাছের বাজারদর হোক বা পরিবেশ দূষণ। রুমেলার এই চরম পজিটিভ এনার্জিও মাঝেমধ্যে সহ্য হয় না পার্থর। এক-একদিন ঘুমন্ত রুমেলার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় লাগে। মনে হয়, এই কি সেই রুমেলা, নাকি বহু আগে সে পরিবর্তিত হয়ে গেছে?

এই কথা পরদিন রুমেলাকে জিজ্ঞেস করতেই রুমেলা বলেছিল, “আমরা কি কেউ কখনোই একইরকম থাকি? তুমিও কি আছ? আজকের তুমি কি কালকের তুমিই থাকবে? এক ঘণ্টা পরেও কি তুমি এক ঘণ্টা আগের মতো থাকবে?”

“আমি তার কথা বলিনি রুমেলা। আমি তোমাকে কি হারিয়ে ফেলছি?”

“এ তো একটা প্রেমের গল্প হয়ে গেল। দাম্পত্যে আস্তে আস্তে নেমে আসা শীত। মাল্যবান আর কারুবাসনা থেকে একটু বেরোলে হয় না? ইলিয়াসেও তো ঢুকতে পার একটু!”

“তোমার কি মনে হয় আমাদের জীবনটা একটা ফিকশন?”

“আবার একটাতে আটকে আছ পার্থ। একটা নয়, অনেকগুলো ফিকশন। যেমন, কোনো নদীই আসলে অনন্তকাল ধরে একা নয়, অনেক। নদী মরে যাচ্ছে, আবার জন্ম নিচ্ছে। আবার সে-নদী প্রবাহিতও হচ্ছে। অনেক, অনেক, অনেক।”

“আমাদের চরিত্রগুলো তো আলাদা”।

“আমাদের জন্ম মৃত্যু বেঁচে থাকা ভালোবাসা যৌনতা সবকিছুই আলাদা। অনুভূতিই আলাদা। ফলে ফিকশনও আলাদা।”

“একটা কোনো গল্প নয়?”

“মনে হয় না”

কিন্তু এই এতকিছুর সঙ্গে পার্থর ভয় পাওয়ার কোনো সম্পর্কই তৈরি হত না, যদি না, পার্থ বুঝতে পারত গোটা মানবসভ্যতাই রয়েছে আর কয়েক মাসের জন্য। বেশ কিছুকাল ধরেই সে বুঝতে পারছিল সমস্ত জন্তু জানোয়ার তার দিকে ঘৃণা আর তিক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আবার কারো কারো চোখে রয়েছে এক অতিরিক্ত বিদ্রূপ। যেমন, যে কাকটা রোজ সকালে আসে বিস্কুট খেতে, সে আসার পর, পার্থ বিস্কুট দিল। কিন্তু কাকটা বিস্কুট মুখে তুলল না। বরং মুখ তুলে রাগত স্বরে কয়েকবার কা কা করে ডেকে চলে গেল। এমনকী কুকুরগুলিও এড়িয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হল। অফিস যাওয়ার পথে সমস্ত কাক বা শালিখ বা কুকুর বা বিড়াল তার দিকে তির্যকভাবে তাকাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল পার্থর। সে সেদিন এর কারণ বুঝতে পারছিল না। আর ঠিক তার পরেই কুকুরটার অমন দুর্ঘটনা। কুকুরটা মরে পড়েছিল, কিন্তু তার তির্যক দৃষ্টি ছিল তারই দিকে। রাস্তায় থেঁতলে যাওয়া কুকুরটার সেই মৃত অথচ অর্থবহ চোখের দৃষ্টি পার্থ সম্ভবত যতদিন বেঁচে থাকবে, মনে থাকবে। যদিও ভুলতে পারলেই ভালো লাগবে তার।

রুমেলা এত সব কিছুই জানে না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারে পার্থর মধ্যে একধরনের পরিবর্তন হয়েছে। কেমন যেন ফ্য্যাকাশে হয়ে গেছে পার্থ। এমনকী, পার্থর ভিতরে আর সেই স্পৃহা নেই, যে-স্পৃহা, তাকে একসময়ে বেশ উজ্জ্বল ছাত্র করে তুলেছিল। শুধু উজ্জ্বল ছাত্রই না, যে-কোনো বিষয়ে পথে নামতে যে একবিন্দু ভাবত না, কলেজস্ট্রিটের প্রায় প্রতিটি লিফলেটে যার অদৃশ্য কলম থেকে ঝরে পড়তে যুক্তি আর ভাবনার অনুচ্ছেদ, সেই পার্থ এখন কলমের দিকে ঘেঁষতে পারছে না। টেবিলের সামনে বসে কেমন যেন শব্দহীন একটা অস্তিত্ব হয়ে গেছে। সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে, রাতে, ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় কখনো ঘরের আলো জ্বালত না পার্থ। কিন্তু গত এক মাস ধরে ঘরের আলো জ্বেলে তারপর বাইরের আলো জ্বালছে পার্থ। পার্থ ঘুম থেকে উঠলে গোটা ফ্ল্যাটের আলো জ্বলে ওঠে। কাকে ভয় পাচ্ছে পার্থ? কেন ভয় পাচ্ছে?

“জানো, রুমেলা, পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্তত এই মানবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধ্বংসের পিছনে আছি আমরাই। আমার বারবার মনে হয় এই পৃথিবীটা আমাদের উপরে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু কীভাবে তা জানি না। হয়তো পাখিরা আক্রমণ করবে। একদিন দেখব মাটি ফেটে সব সাপেরা শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথবা কুকুরেরা আর মানুষকে ভালোবাসছে না। সমস্ত জন্তুজানোয়ার-পাখিরা ব্যারিকেড করে দিয়েছে। ঘিরে ধরে আমাদের আক্রমণ করছে। ওরা কত সহজেই আত্মহত্যা স্কোয়াড গড়ে তুলতে পারে জানো না। কারণ ওরা মরতে ভয় পায় না। জাটিঙ্গা পাখিদের দেখনি? নিদেনপক্ষে পিঁপড়ের যখন পাখা গজায়, তখন?”

রুমেলাকে জড়িয়ে ধরে এক ছুটির গোধূলিতে বলেছিল পার্থ। রুমেলা বুঝতে পারছিল অবস্থা বেশ ভয়ংকর। পরিচিত ডাক্তার পরিতোষদাকে ফোন করাও হল। কিন্তু পার্থ গেল না।

“তুমি গেলে না কেন ডাক্তারের কাছে? বুঝতে পারছ না তোমার একধরনের অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজর্ডার তৈরি হয়ে গেছে?”

“ওহ্‌ রুমেলা, আমরা বড়ো বেশি অসুখ সম্পর্কে জেনে গেছি। কিন্তু আমরা নিজেরাই অসুখ নয় তো?”

পার্থ, এই ভাবে এবং এইভাবে ক্রমশ নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল যে সে নিছক এক হত্যাকারী ছাড়া আর কিছু নয়। আর এর শাস্তি তাকে পেতেই হবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। কারণ, তার মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির আর মানুষের প্রতি কোনো দয়ামায়া অবশিষ্ট নেই। থাকতে পারে না। এই কথা রুমেলাকে বারবার বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পার্থ বলাই ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ, রুমেলা স্থির করে নিয়েছিল এইসব কথায় আর সে পাত্তাই দেবে না। কথাগুলো যত সত্যই হোক না কেন, তা যদি ক্রমশ তার মনের ভিতরে গেঁড়ে বসে যায়, তাহলে তার পক্ষে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মুশকিল।

ফলে, রুমেলা আর পাত্তা দিত না পার্থর এই সব কথাবার্তায়। পার্থও ক্রমশ একা হয়ে পড়তে শুরু করে নিজের ভিতরে ভিতরে। তার পক্ষে আর কারো সঙ্গে এইসব বিষয়ে আলোচনা করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশ এবং ক্রমশ তার মনে হয় একটি আরশোলা মায় একটি পিঁপড়েও তাকে ঘৃণা করছে। শুধু তাকে নয়, গোটা মানবসমাজকেই ঘৃণা করছে। কিন্তু এক আশ্চর্য লজিক অনুসরণ করে তাকেই বেছে নিয়েছে ঘৃণা প্রকাশের জন্য।

— এইসব তুমি কী লিখেছ পার্থ? সম্পাদক করুণ এবং কিছুটা রাগী চোখে তাকিয়েছিলেন পার্থর দিকে।

সম্পাদক শ্রী তরুণ সামন্ত। তাদের কাগজের সাহিত্যবিভাগের একজন নামজাদা লোক। নিজে ভালো গদ্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার। মানে, একধরনের ফিল গুড ব্যাপার তাঁর লেখার মধ্যে কাজ করায়, তাঁর লেখা বেশ পপুলার। পার্থ যে-দু-চারটে গল্প লিখতে পেরেছে, তার কারণ তরুণবাবুর সাহচর্য। তিনি পার্থকে যথেচ্ছ প্রশ্রয় দিয়েছেন। অবশ্য এও শুনিয়ে বা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি, যে এইসব পরীক্ষামূলক লেখালেখিরও একটা সীমা আছে। গল্প থেকে বেরোতেই পারো তুমি, কিন্তু কাহিনি থেকে বেরিয়ে গেলে চলবে না। ফের তোমাকে ঘুরে আসতে হবে গল্পের ভিতরেই। কারণ, পাঠক শেষ পর্যন্ত একটা নিটোল গল্প চায়।

শেষ পাতা

Categories
গল্প

বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর গল্প

দংশন

মৈনাক খুব আদর করে রুমির মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, ঘেঁটে দিচ্ছিল এদিক ওদিক। এই চুল নষ্ট হয়ে যাবে, এটা করছ কি?

আমি ক-দিন ছুটি নিই রুমি? 

এই তো এতদিন ছুটি নিলে আমার অ্যাক্সিডেন্টের পরে? বেড়াতে যেতে চাও কোথাও?

না, না এমনিই, তুমি বড়ো একা থাকো সারাদিন।

একা কোথায়? এই যে বললাম কুমড়ো পটাশের সঙ্গে কীরকম ভাব হয়েছে আমার! বলতে বলতে থমকে গেল রুমি। মৈনাক, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করোনি? ভাবছ ডিপ্রেশানে পাগল হয়ে যাচ্ছি? নিজের অজান্তেই গলা উঁচুতে চলে গেল, চিঁরে গেল উপরে উঠে। হাতের কাছে কিছু থাকলে ছুঁড়েই দিত বুঝি।

তেমন কিছু করল না রুমি, আবার বললও না শিঞ্জিনির কথা। এরকম ভারী নামের প্রাণীটি আসলে একটা ফড়িং। এত সুন্দর ফড়িং আগে কোনদিন দেখেনি রুমি। তুঁতে রঙের শরীরে কালো রঙ্গের ডানা, হয় না কি এমন? ঠিক মনে হয় তুঁতে পাড়ের কালো তাঁতের শাড়িতে কোনো সুন্দরী মেয়ে। ওর ডানা চালানোর ঝিনঝিন আওয়াজেই হয়তো শিঞ্জিনি নামটা টপ করে মাথায় এসে গেছিল। ফড়িংটা প্রথমে বুঝতেও পারেনি যে, এটা ওরই নাম। এর তো আবার গোল্লা দুটো চোখ ছাড়াও মাথার উপরে তিনটে। তবু যতদূর সম্ভব সব চোখকেই নিজের মায়ায় জড়ানোর চেষ্টায় রুমি ফিসফিস করে ডেকেছিল শিঞ্জিনি, শিঞ্জিনি! বারবার, অনেকবার। আঙুলের ডগায় একদানা চিনি রেখে লোভাতেও চেষ্টা করছিল। এখন রোজ আসে। তার যেমন ইচ্ছে হুকুমও তামিল করছে শিঞ্জিনি। হাতের তালু বাড়িয়ে দিলে সেখানেই বসে পড়ে। রুমির গালের কাছে ঘুরে ঘুরে তার ডানার গান শোনানোর চেষ্টা করে। তারপর রুমি যেই বলে, ব্যাস অনেক হয়েছে তখুনি আবার শান্ত হয়ে হাতের পাতায়। রুমি কি ওকে সত্যিই জাদু করেছে? না হলে আসে কেন রোজ সকাল হলেই? ফুলে ফুলে বসা ভুলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় রুমির সঙ্গে!

এদের কথা মৈনাককে আর বলে না রুমি। এরা তার গোপন ঘর। না হলে মৈনাক সকালে কফি ঢালতে ঢালতে যখন জিজ্ঞেস করল আর কার কার সঙ্গে আলাপ হল তোমার রুমি? কোনো পাখি বন্ধু হয়নি?

শিঞ্জিনির কথা বলেনি রুমি, বলেনি কানাইয়ের কথাও। কানাই একটা কেন্নো, কিন্তু ছোটোবেলায় দেখা কেন্নোগুলোর থেকে একটু আলাদা। গায়ের রং গাঢ় বাদামি, পায়ের রং হলদে মতন। দুটো দাঁড়া আছে। একদিন টেবিলের গা বেয়ে উঠছিল। ছোটোবেলায় কেন্নো দেখলে গা ঘিনঘিন করত রুমির। একবার মা গল্প শুনিয়েছিল কার না কি কানের ফুটো দিয়ে কেন্নো ঢুকে গেছিল আর সেই কেন্নো মাথায় ঢুকে ঘর সংসার পেতেছিল। তারপর বহুদিন রুমি কানে আঙুল চাপা দিয়ে শুয়েছে, সুযোগ পেলেই জুতোর তলায় পিষে মেরেছে পথ চলতি কেন্নোকে। আজ কিন্তু নিজের ক্ষমতা যাচাই করার লোভ সামলাতে পারল না। হুইল চেয়ার থেকে ঝুঁকে নিজের মাথাটা ওর কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করেছিল, এই তুই কে রে? কেন্নোটা চলা থামিয়ে শুঁড় ঘুরিয়েছিল রুমির দিকে। দেখেই রুমির শরীরে এক খুশির ঝিলিক। বুঝতে পারছে! রুমির চোখের দৃষ্টি ছুরির ধার পেল যেন। একা থাকলে মাথার ভাবনারা সরাসরি চোখে পৌঁছে যায় অনায়াসে।

কেন্নো যে এমন করে পোষ মানবে ভাবলেই অবাক হয় রুমি। ওর প্রতিটা কথা বোঝে। আঙুল বাড়িয়ে দিলে সুড়সুড় করে হাতে উঠে আসে। আঙুলে করে চোখের সামনে তুলে আনে ওকে, আমাকে যেন আবার দাঁড়া বসিয়ে দিস না কানাই। নিজের মনেই হেসে খানখান হল রুমি।

বাইরে এসবের কোনো প্রকাশ নেই রুমির।

তুমি আজকাল এত কম কথা বলো, কেন রুমি?

মৈনাকের অস্থির কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করল রুমি। তোমার আর আমার জগৎ যে আলাদা হয়ে গেছে মৈনাক। আমাকে ছাড়িয়ে চলে গেছ তুমি। যেটা বলল না সেটা হল তুমি চলমান, আর আমি একটা হুইল চেয়ারে বন্দী। তোমার মহান হওয়া মানায়, লোক দেখানো বউ সোহাগ করে বাহবা পাবে। আমার জন্য শুধুই আহা উহু। এ-সব অবশ্য কিছুই বলল না রুমি, ভাবনাগুলো অনেক গভীরে টগবগ করে ফুটল শুধু।

আর ক-দিন রুমি, সেদিন ডাক্তার কী বললেন? তোমার পা সেরে এসেছে একদম। আর মাসখানেক হয়তো, তারপর তোমার প্রস্থেটিক পা লেগে গেলে তুমি আবার আগের মত—

আগের মতো কিছুই হবে না আর, রাত্রে শোবার সময় খুলে রেখেই তো শোব, তাই না?

নিজের অজান্তেই বাঁ-পাটাকে চেয়ারের আড়ালে লুকোনর চেষ্টা করে মৈনাক। আচ্ছা আমি কী করতে পারতাম বলো তো?

আমি কি কিছু বলেছি? তোমার যেমন লিয়ার সঙ্গে কফি শপে বসে গল্প করার করো না বসে। বারণ করেছি?

মানে?

ছন্দাদি আছে মৈনাকের অফিসে, সেদিন ফোন করে কথায় কথায় বলছিল, এই তো সেদিন মৈনাককে দেখলাম সাদা ছুঁড়িটার সঙ্গে কফি খাচ্ছে। ওইভাবেই কথা বলে ছন্দাদি সাদা ছুঁড়ি, কাল্লু ভাই, চিঙ্কি চামকি। আগে সবার সঙ্গে বসে এইরকম কথায় রুমির ঠোঁটে হাসি খেলত না, মনে মনে বিরক্ত হত। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল বোধহয় এই খবরটা দেওয়ার জন্যই ছন্দাদি আরও ফোন করেছে। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, নামও জেনেছিল। লিয়া।

রুমির নৈঃশব্দ্যে আরও রেগে গেল মৈনাক। তুমি কি বাড়িতে বসে বসে এই সবই ভাবছ রুমি? অফিসে কতজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, আগেও বলেছি তো। অফিসের কাফেটারিয়াতেও এমনি অনেক মিটিং থাকে।

চাপা কথার কয়েক ফোঁটা পাথর ঠেলে ছিটকে বেরোল এবার। তোমার বুদ্ধদেবপনাগুলো লিয়া, ক্যাথি আর শর্মিলাদের জন্য তুলে রাখো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার হুইল চেয়ারে বসে থাকার কপাল, থাকব। তাই বলে কৃষ্ণলীলা বন্ধ করতে বলিনি তোমায়।

মৈনাক রুমির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ওর বাঁ-হাত রুমির ডান হাঁটুতে, ডান হাত রুমির গালের উপর আলতো করে রাখল মৈনাক। আজকে অফিসের ধড়াচুড়ো চাপায়নি, হাফপ্যান্ট আর টি শার্টে এখনও। তাই ঘাসে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে বসতে তুমি এমন করে? নিজের মনেই বলল রুমি। এরকম গা বাঁচানো আলগা আদর করা সহজ। যার হয়েছে শুধু সেই বোঝে। মৈনাকের আবেগ কিছুতেই উষ্ণ করতে পারছিল না রুমিকে। মৈনাকের সকাল বেলার উপচে পড়া ভালোবাসায় গা রিরি করে রুমির। কই রাত্রে শোবার সময় তো তাকে খুঁজতে আসে না মৈনাকের হাত, বরং সে এগোতে চাইলেও সরে যায়। বলে আরও ক-দিন যাক। আমার পায়ে ব্যথা লেগে যাওয়ার ভয় না হাতি! বোঝে না যেন রুমি। তার চেয়ে বলুক না কেন মুখে, এক পা না থাকা মেয়ের শরীর বিছানায় বিসদৃশ লাগে তার।

আমি কী করলে তুমি খুশি হও রুমি? যতদিন তুমি নিজের পা না পাচ্ছ, আমি বাড়ি থেকে কাজ করি?

হ্যাঁ, নিজের পা! এই উপহাসটা বুকের মধ্যে চেপে মুখে বলল, সে তো করবেই, না হলে আর আমার উপর নজর রাখা হবে কী করে?

মৈনাকের চোখ বিস্ময়ে স্তিমিত হয়ে গেল, একটু কি জলের ছোঁয়া? তাহলে তোমাকে আমি অফিসে পৌঁছে দিই, তুমি আবার অফিস শুরু করো।

আমি ঘণ্টা দুয়েকের বেশি বসে থাকতে পারি না মৈনাক, ক্লান্ত হয়ে পড়ি। না হলে বাড়ি থেকেই অফিস শুরু করতাম। মৈনাকের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রুমি, বেশি তাকালেই ওর মনটা নরম হয়ে যাচ্ছিল। মৈনাক ওর মাথা গুঁজে দিয়েছে রুমির কোলের মধ্যে, ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে ইচ্ছে করছিল। ওকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি হয়তো সত্যিই ভালো মৈনাক, আমিই আর পারছি না। এই পৃথিবীটা ঘুরে বেরাচ্ছে, আর আমি স্থবির হয়ে আছি। ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু এ-সব কিছুই না বলে চোখ সরিয়ে নিল রুমি। তখনই দেখল গুটি গুটি পায়ে কানাই আসছে। ঘাস সরিয়ে সরিয়ে টেবিলের পায়া অতিক্রম করে। একটু ঝুঁকে পড়ল রুমি, হাতের পাতা রাখল এবার মৈনাকের মাথায়। আদর বুঝে মৈনাক নিজের মাথাটাকে আরও গুঁজে দিল রুমির কোলের মধ্যে। কেমন অদ্ভূত একটা ঝিলিক এবার রুমির চোখে। ফিসফিস করে বলল, দে কানাই দে।

এমন বাধ্য ছেলে! দিল ঠিক দাঁড়াটা বসিয়ে মৈনাকের পায়ে।

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর গল্প

দংশন

বাগানের ঘাসগুলো এখনও ভেজা। ভোরের শিশির নয়, বাগানের মাঝে মাঝে রাখা স্প্রিনক্লারগুলো সকালের আলো ফোটার আগেই জল ছড়িয়েছে খুব। হোস্টাস, ব্লু বেল আর অ্যানিমোনের সদ্য ফোটা পাপড়িগুলোয় জল টলমল করছে। পেরিয়ে যেতে যেতে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে রুমির। বিশেষ করে অ্যানিমোনের ঝুঁকে পড়া গোলাপি পাপড়িতে। হয়তো সেই ইচ্ছেটা শরীরে সামান্য চাঞ্চল্য জাগায়, না থাকা পায়ের কড়ে আঙুলটা একটু ঝুঁকে পড়ে বাঁ-দিকে। মৈনাকের দেখতে পাওয়ার কথা না, তবু কী করে বুঝল কে জানে! মাথা ঝোঁকাল রুমির কানের কাছে, ফুল তুলে দেব তোমায় ক-টা?

মৈনাকের এই সময়ে বেরোনোর তাড়া থাকে। এরপর ইন্টারস্টেটে বড্ড ভিড়। অফিসের ব্যাজ বুকে, কাঁধে ল্যাপটপ ঝুলিয়ে এই সময় হন্তদন্ত হয়ে বেরোত মৈনাক। রুমির যাওয়া থাকত আরও এক ঘণ্টা বাদে। রুমি মৈনাকের গলায় সেই ব্যস্ততা চাইছিল। নিস্তরঙ্গ অবয়বের অভ্যন্তরে কুয়ো খুঁড়ে খুঁড়ে খোঁজার প্রচেষ্টায় সেটাই মনে করিয়ে দেয়, তোমার দেরি হয়ে যাবে না?

মৈনাকের গলা ব্রিয়সে বানের মতো নরম। হাসিটাও। সকালবেলা বাগানে বসে তোমার সঙ্গে কফি খাওয়াটা সারাদিনের জন্য টনিকের কাজ দেয়।

বাব্বা, কথায় কী মাখন! কই আগে তো বসতে না। রুমি জানে। রুমি বোঝে এত নরম কথা, এটা ভালোবাসার উষ্ণতা নয় কিছুতেই। দয়া। পবিত্র, শীতল।

বাগানের অনেকটা জুড়ে হিকরির ডালপালা ছড়ানো। তার ঠিক নীচেই লোহার টেবিল, দু-দিকে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। অনেক সাধ করে রুমি কিনেছিল, কিন্তু এতদিন ব্যবহার হত না সেরকম। রুমির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মৈনাক হুইল চেয়ারটা টেবিলের অন্য দিকে লাগিয়ে দিল। টেবিলের উপর কফির পট, দুটো কাপ, দুধের পাত্র, একটা প্লেটে কফি কেক আর ব্লু বেরি স্কোন রেখে গেছিল আগেই। মৈনাক চেয়ার টেনে লম্বা দুই কাপে কফি ঢেলে রুমির কফিতে দুধ মেশায় মন দিয়ে। নিজের কফিতে দুধ খায় না কোনোদিনও।

রুমির কোলে টপ করে একটা বাদাম পড়ল। গাছের তলায় এই সময় অনেক বাদাম পড়ে। যদিও এগুলো বিটারনাট, তেতো। ওদের জন্য অখাদ্য। কিন্তু কাঠবেড়ালিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কফিতে প্রথম চুমুক দেওয়ার আগেই এক জোড়া কাঠবেড়ালি ছুট্টে চলে গেল মৈনাকের পায়ের তলা দিয়ে।

দেখো, তোমার কুমড়োপটাশ গুড মর্নিং বলতে চলে এসেছে সকাল সকাল।

এই কথাটা রুমিকে আর গোমড়া থাকতে দিল না। পরিচিতির তৃপ্তি মুখে ছড়িয়ে বলল, না, না এরা কুমড়োপটাশ না। কুমড়োর চোখটা লালচে, একেবারে অন্য রকম। ওরা আমাকে দেখলে পালায় না কক্ষনো।

ওরে ব্বাস, তুমি তো ওদের উপরে তোমার বশীকরণ মন্ত্র চালিয়েছ দেখছি। মৈনাকের গলা থেকে হাসি উঠে এল। দিন দিন ওরা আমার কম্পিটিটার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মানে? ভ্রূ কুঁচকে তাকাল রুমি।

হাসিটাকে তবু ধরে রেখে রুমির চোখে চোখ রাখল মৈনাক, আমি সব সময়েই জানি তোমার চোখে জাদু আছে। মনে নেই, মা বিয়ের পরে পরে মেজোমাসিকে বলেছিল আমার ছেলেটাকে কী মন্ত্র যে পড়িয়েছে, শুধু বউয়ের কথায় ওঠে বসে। তুমিই তো শুনতে পেয়ে আমাকে বললে। তখন সে কী রাগ তোমার।

আগেও মৈনাক এরকম কথা বলেছে আর ওরা দু-জনে সেই নিয়ে কত হাসাহাসি। এখন শুধুই রুমির বাঁ-পায়ের হাটুর নীচে চুলকানি পায়। কিন্তু চুলকানো কিংবা হাত বোলানোর কোন উপায় না থাকায় মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে। কফিতে হালকা চুমুক দিতে দিতে মৈনাক চেয়ে থাকে, রুমির মুখের আলো ছায়ার কারণ জানতে পালটা প্রশ্ন করে না। বরং এই সময়ে ছুরি দিয়ে কফি কেক স্লাইস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বেশি বেশি। রুমির মুখের রেখাগুলো একটা একটা করে মুছে গেলে এক খণ্ড কেক ধরে রুমির মুখের সামনে। অপেক্ষা করে থাকে রুমির পাতলা ঠোঁটের আড়াল পেরিয়ে মুক্তোদানা দাঁতের ফাঁক হওয়ার জন্য। রুমি মুখ যতসম্ভব চেপে মৈনাকের চোখে চোখ বিঁধিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা আমার একটা পা না হয় নেই, কিন্তু হাত তো আছে। নিজে খেতে পারি না?

কোনো কার্পণ্য না করেই হাসল মৈনাক। সেটা তো আমাকে খাওয়ানোর জন্যে।

আমাকে এত বেশি বেশি ভালোবাসছ কেন মৈনি? আমার বাঁ-পাটা কাটা গেছে বলে?

এই প্রশ্নটা তো প্রথম শুনল না। তাই কেক ধরা মৈনাকের হাত একটুও কাঁপল না। মৈনাক রুমির চোখ থেকে চোখ না সরিয়েও দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিল। রুমির চুলে জড়ানো দুলহীন কানের লতি, গলায় না বলা শব্দের ওঠানাবা, ঠেলে আসা কণ্ঠার হাড়, পেস্তা সবুজ ছোটো হাতা টি শার্ট যার বুক জোড়া অ্যান আরবার ম্যারাথন ২০১৮ লেখাটা কালো সাদা চেক ফ্লানেলের পাজামার নেতিয়ে পড়া বাঁ-পায়ের সঙ্গে অহেতুক কৌতুক জুড়েছে— এই সমস্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৈনাকের চোখ রুমির অন্তঃকরণে ঢুকতে চাইছিল। থেমে থেমে যখন বলল, আমি তোমাকে আনতে যেতে পারতাম, যাইনি। তাই দোষটা আমার ছিল বলে ভাবতেই পারো। কিন্তু ভালোবাসা ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কষে হয় না রুমি। কথাটায় গোপন কৃষ্ণ গহ্বরের আলগোছ টান। তাই তাড়াতাড়ি মুখের হাসিতে নতুন কথা মেশালো মৈনাক, তোমার বাঁ-পাটা সত্যি তো যায়নি, তুমি তো ওর নড়া চড়া বেশ টের পাও এখনও।

ডক্টর হিল তো বলে ফ্যান্টম লেগ। না থেকেও রয়ে গেছে। নতুন পা লাগানোর পরেও থাকবে কী না কে জানে! কবে লাগাবে ওরা?

রুমির প্রস্থেটিক্স লেগ তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু হাঁটুর তলাটা পুরোপুরি সেরে না ওঠা অবধি দেবে না। তিন মাস তো হয়ে গেল, দেখো আর ক-দিন। ডক্টর হিল তো ছ-মাসের কথা বলেছিল। বলতে বলতে মৈনাক উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার ঝুঁকে পড়ে রুমির গালে হালকা চুমু এঁকে দিল। রোদ উঠে গেলে ঘরে চলে যেও কিন্তু। না হলে মুখ পুড়ে যাবে একদম।

হিকরির ছায়া অনেক দূর ছড়ায়। তাছাড়া রুমি হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়া খুঁজে নিতে পারে চাইলেই। কিন্তু মৈনাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অবধি টেবিলের পাশ থেকে একটুও নড়ে না রুমি। মৈনাকের গাড়ি এখন ছুটবে ইন্টারস্টেটের গতিময়তায়, মৈনাক দেখতে দেখতে সেঁধিয়ে যাবে একটা কর্মব্যস্ত দিনের পেটের ভিতর। রুমির দিন আস্তে আস্তে সরতে থাকবে রোদের সঙ্গে। রুমি হাতের স্কোনের বাকিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাগানের ঘাসে। একটু বাদে গিয়ে তুলে গার্বেজ বিনে ফেলতে হবে আবার। নোংরা একদম সয় না রুমির।

ক-দিন আগে রুমিরও একটা ছোটার জীবন ছিল। মৈনাকের থেকেও বেশি। সেরকমই এক ব্যাস্ত দিনের শেষে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছিল। নতুন কিছু নয়, সপ্তাহে দুই একবার তাকে তো যেতেই হত। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই ইকোরস রোডে এমনভাবে অ্যাকসিডেন্টটা হল। তিন মাস হয়ে গেছে, তবু ভাবলেই ভয়ে ভিতর থেকে চেপে ধরে। বাগানের চেয়ারে বসেও সিঁটিয়ে যায় রুমি।

সেদিন একটু বেশিই টায়ার্ড ছিল, খুব সকালের ফ্লাইটে ফ্লোরিডা গেছিল। ফোনে মৈনাক বলল, আমি আসব তোমায় নিতে? মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, তার হয় ওরকম মাইগ্রেনের থেকে। কিন্তু গাড়ি পারকিং-এ, সেটাই-বা কি করে হয় বলে রুমি না করে দিয়েছিল। মৈনাক যদি আর একটু জোর করত সেদিন! কেন করলে না মৈনাক?

এইসময় কাঠবেড়ালিটা আবার দৌড়ে এল। এবার কুমড়োটা। থমকে দাঁড়িয়ে লালচে চোখে জুলজুল করে চেয়ে আছে রুমির দিকে। রুমি হাতের কাছে বিটারনাট খুঁজে খুঁজে রাখে ওর জন্য, কে জানে তাকেই গাছ বলে ভাবছে কী না! গলার মধ্যে হাসল রুমি। হাত ঘষটে টেবিলের উপরে রাখা বিটারনাটগুলো থেকে দুটো তুলে নিল, চোখ সরাসরি কুমড়োর চোখে। কাঠবেড়ালির কি পলক পড়ে না? না কি রুমিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে থাকে মৈনাকের মতো? এটা ভাবতেই নিস্তরঙ্গ সকালে দুষ্টুমি ছড়িয়ে পড়ল। আরও ঘন চোখে তাকাল কাঠবেড়ালিটার দিকে। কাঠবেড়ালির দুটো চোখ থাকে দু-দিকে, নিজের দৃষ্টিতে বেঁধে ওদের চাহনি ঠিক কপালের মাঝখানে আনার চেষ্টা করল রুমি। তারপর দুই হাতের বিটারনাট কুমড়োর দুই দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চোখের ইশারা করল ডান দিকে। কী আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো মাথা ঘুরিয়ে ছুটল ডান দিকে!

ও কি সত্যিই ওর ইশারা বুঝতে পারল? সেকি কাঠবেড়ালি ট্রেন করতে পারছে? পারুক না পারুক সকালবেলার স্নিগ্ধতা বেড়ে গেল নিঃসন্দেহে। এই কথাটা রসিয়ে রসিয়ে বলেছিল মৈনাককে সন্ধ্যাবেলায়। ও হাসতে হাসতে বলল, বলেছিলাম না তোমার চোখে জাদু আছে। তুমি বাঁ-দিকে ছুঁড়ে ডান দিকে যেতে বললেও যেত ঠিক।

ধ্যাৎ, তাই আবার হয় না কি?

মুখে বললেও পরের দিন সকালে কথাটা বিনবিনিয়ে উঠল রুমির মাথায়। দেখি না কি হয় ভাব নিয়েই আজকে কুমড়োর জন্যে একটা বিটারনাট হাতে নিয়েছিল রুমি, চোখের ইশাড়ায় বাঁ-দিক দেখিয়ে ডান দিকে গড়িয়ে দিয়েছিল এবার। রুমির শরীরে একটা আনন্দের স্রোত কুলকুল করে বয়ে গেল যখন বোকা কাঠবেড়ালিটা ছুট্টে চলে গেল বাঁ-দিকে। কিছুক্ষণ বাদে লেজ তুলে ফিরে এল। ওর চাহনিতে তখন কেমন বোকা বোকা ভাব, যেন বলছে ঠকালে কেন? ওকে তখন কোলে তুলে গুচুম গুচুম করতে ইচ্ছে করছিল রুমির।

সত্যিই কি তার চোখ? না কি মনের থেকে কোনো তরঙ্গ সিঁধিয়ে যাচ্ছে কাঠেবেড়ালির মাথায়। কুমড়ো কি তার মনের কথা বুঝতে পারে? এইসব ভাবতে ভাবতে ডেকেই ফেলল একবার। প্রথমে আস্তে, ফিসফিস করে, তারপর জোরে। কুমড়ো কুমড়ো! ও যখন সত্যি লেজ তুলে দৌড়ে এল খুশির থেকেও অবাক হল বেশি। ওকে তো আগে কখনো ডাকেনি, ওর এই নাম নিয়ে মৈনাকের সঙ্গে আলোচনা করেছে শুধু। তাহলে ও রুমির কথা বুঝতে পারে? ওর লালচে চোখে চোখ রেখে বলল এবার, কোলে আয় কুমড়ো। রুমির ডান হাতের পাতা বাড়ানো ছিল ডান হাটুর উপরে। তার উপর ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে এক লাফে কোলে চলে এল রুমির। কী নরম হয় ওদের শরীর, ঘন রোমের মধ্যে হাত চালাতে চালাতে বিস্ময়ে জেরবার হচ্ছিল রুমি। একটা কাঠবেড়ালি তার কথা বুঝতে পারছে? সেটা কি শুধু কুমড়ো বলে, ওর কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে? না কি সে-ক্ষমতা আসলে রুমির? যে-কোনো কাঠবেড়ালিই কি বুঝতে পারবে তার কথা? মনে হতেই এবার গলা ছেড়ে ডাক দিল পটাশ, পটাশ! পটাশ এমনিতে লাজুক, এমন কিছু গা ঘেঁষাঘেঁষি করে না কুমড়োর মতো। কিন্তু রুমিকে অবাক করে দিয়ে ছুটে এল পটাশও। দুই কাঠবেড়ালি কোলে নিয়ে কী বকবক করছিল রুমি সে কি নিজেই জানে?

শেষ পাতা

Categories
গল্প

কুলদা রায়ের গল্প

লক্ষ্মী দিঘা পক্ষী দিঘা

গোলরুটির চেয়ে গোলারুটিই বেশি মজার। বড়ো মামী এ ব্যাপারে ফার্স্টক্লাস। নানারকমের গোলারুটি বানাতে তার জুড়ি নেই। আটা গুলে তার মধ্যে পিঁয়াজ কুচি দিয়ে পিয়াজ রুটি। কাঁচা মরিচ দিয়ে মরিচ রুটি। আর কালো জিরা দিলে বেশ টোস্ট টোস্ট ভাব আসে।

আজিমার পছন্দ শুকনো মরিচ। এটা ছোটোদের জন্য একেবারে নো। তাদের জন্য গুড়ের ঢেলা। না পেলে ছেঁচকি শাক। কখনো পুঁই রুটি। পুঁইশাক কেটে গোলা রুটির মধ্যে ছেড়ে দেবেন। ভাপে সিদ্দ হবে। তার বর্ণ দেখে দেখে, ‌ওগো মা, আঁখি না ফেরে।

এ-বাড়ির পুরোনো আদ্যিকালের কড়াইটার একটা হাতল নাই। ৯ মাস পুকুরে চোবানো ছিল। সারা দিনমান পুকুরে ডুবে ডুবে খুঁজে বের করে এনেছিল নিমুইমামা। আজিমা পেয়ে মহাখুশি। বলেছিল, পলানোর সুমায় হাতলডাও ছেলো। দেখ, খুঁইজা পাস কি না। আবার ডুব দে মন কালী বলে।

মামা ডুবে ডুবে পিতলের ঘণ্টা পেয়েছিল। আজিমা মুখ ব্যাজার করে বলেছিলেন, এইটা দিয়া কী করুম।

— ক্যান পূজা করব। ঘণ্টা বাজাইয়া আরতি দিবা।

— পূজা তো হারা জীবন ভইরাই করছি। তবুও তো সব হারাইছি। ভিটা ছাড়ছি। বাপকাগারা বেঘোরে মরছে। পূজা কইরা লাভ কী রে বাপ। হাতলডা খোঁজ।

হাতলডা খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাতল ছাড়াই এই কড়াইতে বড়ো মামী সুন্দর করে গোলারুটি ভাজতে পারে। ছেঁচকি শাক রানতে পারে। ভাতউয়া টাকির ঝোল বেশ তেড়মেড়ে হয়। সুযোগ হলে ফস ফস করে ফ্যান ত্যালানিও করা যায়। আর কী চাই। শুধু কড়াইটা ধরতে হবে একটু সাবধানে। সাবধানের মাইর নাই। নিমুই মামা বলে, সময় আইলে আরেকটা নতুন কড়াই কেনা হবে।

মামী ফিস ফিস করে বলে, ওগো সুমায়, তুমি সত্যি সত্যি আসিও। হ্যালা কইরো না বাপ।

আজামশাইর কিছু বাহ্যে সমস্যা আসে। তার জন্য গোলারুটির বদলে রান্না হয় নোঠানি। আটার ভাত। সঙ্গে থানকুনির ঝোল। শিংমাছ দিতে পারলে বেশ হয়।

আজা মশাই পেঁপে গাছটার নীচে বসে নোঠানি খেতে খেতে দেখতে পেলেন, আগামি ঋতু এলে মাঠে মাঠে ধান ফলবে। আর তরী বেয়ে রবীন্দ্রমশাই বেড়াতে আসবেন। ঘাটে এসে ঝরঝরে গলায় বলবেন, দুটো ফেনা ফেনা ভাত রাঁধতে বলো তো হে। মেলা দিন পরে জুত করে খেতে চাই।

খেয়ে দেয়ে তিনি গগন হরকরার খোঁজে বের হবেন। তার ইচ্ছে আজামশাই আজ তার সঙ্গে থাকুক। কিন্তু আজা মশায়ের মনটা আজ খারাপ। রবীন্দ্রমশাইকে তিনি বেশ মানেন। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তিনটি আগেভাগে মরে গেছে। বউটাও নাই। চৌদ্দটি হলে আরেকজন রবীন্দ্রকে পাওয়া যেত। সেটা সম্ভব হল না। আজা মশাই অবশ্য নিজে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বারো-তে তাকে থেমে যেতে হয়েছে। আজ হাহাকার জাগে।

রবীন্দ্রমশাই রিনরিনে গলায় বলবেন, চিন্তা কোরো না বনিকবাবু। কেউ না কেউ পারবে। অপেক্ষা করতে হবে।

এই বলে কবিমশাই নাও ছেড়ে দেবেন। দাঁড় টানবেন। রাশি রাশি ধান তার নাও ভরা। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে-তরী। একটু কাত হলেই জলের মধ্যে ভুস। এর মধ্যে আজামশাই চেঁচিয়ে বলছেন, সাবধানে যাইয়েন গো মশাই।

ধান কই। সব শুকনো খড়। বন্যায় সব শেষ। খড় ডুবলে ক্ষতি কী!

নৌকা ততক্ষণে আড়াল হয়ে হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রমশাই শুনতে পেলেন কি পেলেন না বোঝা গেল না। শুধু দূর থেকে ভেসে এলো— আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আসতে আসতে গানটি আবার বহু দূরেই ভেসে যাচ্ছে। এরপর খুব চুপ। কয়েকটা দাঁড় টানার শব্দ শুধু। ছপ। ছঅপ। ছঅঅপ।

এইবার আজা মশাইয়ের ডাক পড়েছে। আজিমার জন্য গন্ধ ভাদুল তুলতে যেতে হবে। দুপুরে ভাতউয়া টাকির সঙ্গে রান্না হবে। টাকি বঁড়শিতে ধরা পড়েছে। বড়মামী দুটো রসুন কোঁয়া খুঁজতে লেগেছে। সঙ্গে ধানী লঙ্কা। রসুন কোথায়? ঘরের চালের আড়ায়। আড়াটি দরমার বেড়ার। তার উপরে পুরোনো রসুন শুকিয়ে কড়কড়া। কবেকার বলা মুশকিল।

ততক্ষণে উত্তরপাড়ার সালাম মামা এসেছে। বরইতলা থেকে ঊঠোনে আসতে আসতে সামান্য হেঁকে বলছে, নিমুই, বাড়ি আছিস?

নিমুই মামা বাড়ি নেই। তালতলা গেছে। পথে জাঙ্গালিয়া যাবে। শেখ বাড়ি ঘুরে আসবে। তালতলায় ফেলা পাগলার থানে পৌঁছাবে।

সালাম মামার কাঁধে ধামা। আজা মশায়ের পেছন দিয়ে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে এসেছে। কাঁধ থেকে ধামাটি রেখেছে। আজিমা চল্লায় ধানী লঙ্কা খুঁজছে। মামী রসুনের আশায় ঘরের মধ্যে আড়ার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটা টিকটিকির কঙ্কাল পায়ের কাছে ঝরে পড়েছে।

চুলার পাশে হাতল ভাঙা কড়াই। সেখানে একটা গোলারুটি ঢাকা দেওয়া। নিমুই মামা এলে খাবে। ঢেঁকির উপরে চোখ বুজে আছে তিলকি বিড়াল। ধামা দেখে বলল, মিঁয়াও।

এই বাড়িটির উঠোন পশ্চিমে নীচু হয়ে নেমেছে পুকুরে। সেখানে রোদ্দুর থিকথিক করছে। তারপর শূন্য মাঠ। দূরে জাঙ্গালিয়া গাঁও দেখা যায়। মেঘের পরে তালতলা। সেখানে নিমুই মামা গেছে।

সালাম মামা ঢাকনা তুলে এক টুকরো গোলারুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়েছে। মুখটা ভরে গেছে। এ-স্বাদের বাক্য নাই। আরেক টুকরো খাবে কি খাবে না ভাবতে ভাবতে দেখতে পেল, বড়ো মামী ঘর থেকে রান্নাঘরে এসে পড়েছে। সালাম মামাকে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল, খাও না সালাম দাদা, খাইয়া নেও।

— কার জন্যি রাখছিলা গো বড়ো ভাবী?

— নিমুই— নিমুইর জন্যি।

বড়ো মামীর খিদে পেয়েছে। তার কপালে ফোঁটা নেই। পেটের মধ্যে কে একজন গোটা গোটা উসক করছে। বলছে খিদে, খিদে খিদে। তবু রুটির টুকরোটি সালাম মামার হাতে গুঁজে দেয়। বলে, খাও।

সালাম মামা গোলারুটি খেতে খেতে বলে, তুমার হাতে অমেত্ত আছে। শিখলা কোথায়?

— ইন্ডিয়ায়। রিফুজি ক্যাম্পে। ৯ মাস ছিলাম।

— ও। সালাম মামা গোলারুটি চিবোয়। এক মাথা ঘুরিয়ে পেঁপে গাছটার দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপর বলে, ও, ইন্ডিয়ায়। আমিও গেছিলাম। বছর তিন আগে।

আলগোছে হাঁটুর নীচু হাত রাখে। হাঁটুতে একটা গুলির দাগ আছে। মাঝে মাঝে টাটায়। শেখ বাড়ির বড়ো শেখই প্রথম দেখেছিল। রক্ত ঝরছে। সালাম মামা গুলি করতে ব্যস্ত। ব্যথা ট্যাথা টের পাচ্ছে না। নিমুই কাঁধে নিয়ে না ছুটলে সব শেষ হত। এর মধ্যে শকুন উড়ে এসেছিল। বুকটা শিউরে ওঠে। সালাম মামা আস্তে করে বলে, ফেলা পাগলা কী কয়?

— কিছু কয় না।

— এই অভাব কি যাবে?

— শুধু আশমান পানে চায়। মুখে বাক্যি নাই।

শুনে সালাম মামা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। রান্নাঘরের পিছনে বেড়াটা ভেঙে পড়েছে। উত্তরে নালাখালায় নলবন দেখা যায়। শুকনো পাকা। খটখটে। পটপট করে শব্দ হয়।

ধামাটি মামীর কাছে ঠেলে দিতে দিতে বলে, আম্মায় দিছে। লক্ষ্মী দিঘার পয়া চাল। আর নাই। কইছে, বিনার পোলা আইছে মামাবাড়ি। হ্যারে কি খালি গোলারুটি দেওন যায়? একটা কুড়হা হলে ভালো হত। কুড়হা আছেও। উমে বসেছে। এখন ক-দিন কুক কুক করে না। ক-দিন পরে বাচ্চা ফুটবে। এখন কুড়হা দেওন যায় না।

মামীর চোখ ভিজে আসে। পেটের মধ্যে কচি কুড়হা নড়েচড়ে। মাথাটি ঘুরিয়ে মাটির হাড়ির সন্ধান করে। মেলা দিন পরে দিঘা ধানের ভাত রান্না হবে। ভাতউয়া টাকির সালুন হবে। রসুন হলে স্বাদে গন্ধে হবে অমেত্ত। আড়ার উপরে রসুন। রোদে কড়কড়া। গন্ধে পোকা পলায়— পিশাচ দৌড়ায়। খাম বেয়ে কেউ না কেউ পেড়ে দেবে।

সালাম মামা তখন উঠে পড়েছে। বটবাড়ি যেতে হবে। সেখানে একটা লঙ্গরখানা খোলার আলাপ আছে। বড়ো মামীকে জিজ্ঞেস করল, বাপের বাড়ির খবর পাইছ কিছু?

— সেখানে শকুন নামছে। গেল সপ্তায় শুনতি পাইছি।

— চিন্তা কইরো না ভাবি। ফেলা পাগল বাক্যি দেবেন। শকুন তো শকুন— শকুনের বাপেও খাড়াতি পারবি না। চইল্যা যাবেআনে।

সালাম মামা পশ্চিম দিকে পুকুর পাড়ের দিকে নেমে যাচ্ছে। আজা মশাই ততক্ষণে গন্ধ ভাদুলের কথা কিছুটা ভুলে গেছেন। কিছুটা ঝিমুনিতে পড়েছেন। মাথার উপরে পেঁপে গাছে ফুল নাই। ক-টা দড়ি দড়ি পেঁপে ঝুলে আছে।

এ-সময় ঝিমের মধ্যে আজা মশাই মাথাটা নীচু রেখেই বলে উঠেছেন, সালাম আইছিস?

সালাম মামা পুকুর পাড় পার হয়ে যাচ্ছে। পেছন ফেরার ইচ্ছে নেই। যেতে যেতে বলছে, আমি আসি নাই। আসি নাই।

আজা মশাই আরও আরও গভীর ঝিমের মধ্যে ডুবে যান। ডুবে যেতে যেতে বলেন, কবে আসবি রে বাপ?

— জানি না। জানি না।

আজা মশাই ঝিমের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে পড়তে পড়ে যান না। দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে দেন। কানদুটো হাঁটুতে চেপে ধরেছেন। গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে গলা থেকে। রোদ্দুর এইবার মাথার উপরে উঠে যায়। আকাশটা খনখনে করে ওঠে।

এই ছন্ন ভাবটা পেঁপে গাছটার পছন্দ নয়। শ্মশান শ্মশান লাগে। ফিস ফিস করে বলে, মাস্টার মশাই ঘুমাইলেন নি কি?

আজা মশাই হাউশী ছাড়েন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ। দুটো ফেনা ভাত হলে রবীন্দ্র মশাইকে নেমতন্ন করা যেত। কবি মানুষ। কোনোদিন খেতে চান না। আজ চেয়েছিলেন। আজা মশাই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখেই উত্তর দেন— না, ঘুমাই নাই। ঘুমাই কী কইরা?

চারদিকে বিল। মাঝখানে এই বাড়িটা। খাঁ খাঁ করে। পেঁপে গাছ বলে, কিছু কথা কই আপনের লগে?

— আজা মশাই, মাথা নাড়ে। বলেন, কইয়া কইয়া তো জীবন গেল। কইয়া লাভ কী?

আজা মশাই বিড় বিড় করেন। পেঁপে গাছের গা শির শির করে। ফির ফির করে জানতে চায়—

এই গেরামে আপনেরা আইলেন কুন সুমায়?

— চার পুরুষ আগে।

— হ্যার আগে আছিলেন কোথায়?

— ভুষণায়। নদ্যা জেলায়। রানি ভবানীর কালে।

— সেখান থিকা আইলেন ক্যান?

— শকুন নামছেল।

— শকুন কী করে?

— মরা ধরা খায়।

— তারপর কী করে?

— আসমানে ওড়ে।

— আশমানে যাইয়া কি করে?

— আবার নাইমা আসে। মাঠে ঘাটে বাড়িতে নাইমা আসে।

— তারপর কী হয়?

— আমরা পলাই।

— পলান ক্যান?

— পলান ছাড়া এই জীবনে আর কুনো উপায় আছে রে বাপ?

এইটুকু শুনে পেঁপে গাছটার পাতা নড়া থেমে যায়। দড়ি দড়ি পেঁপেগুলো সামান্য কাঁপে। কাঁপতে থাকে। ঘরের আড়ায় রসুন শুকোচ্ছে। আরেকটা টিকটিকি গড়িয়ে পড়ে। গন্ধ ভাসে। আজা মশাই এইবার আর কোনো কথা বলেন না। মুখটা হাঁ। হাঁ-এর মধ্যে অন্ধকার। বহু পুরোনো। এই অন্ধকারের কটু কটু ঘ্রাণ আছে।

এই ঘ্রাণ লক্ষ্মী দিঘা ধানের। মাটির হাড়িতে ফেনা ভাতের মধ্যে এই ঘ্রাণ পটর পটর করে। পটর পটর থেকে টগবগ হয়ে যায়। শোনা যায়।

এইবার পাড়া জুড়াবে। রসুন শুকোচ্ছে।

Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

শীতঘুম

তৎক্ষণাৎ ফোন করে বিমলকে পায় না অনিরা। সপ্তাহখানেক বাদে ফোনে পায়। শরীর যদিও একটু দুর্বল তথাপি ভালো আছেন। ডাক্তার অনেকটা এরকম বলেছেন বিমল জানায়, স্ত্রেপটোমাইসিন টিবির জার্মকে ঠিক মেরে ফেলে না, ওটা জার্মগুলোর চারপাশে একটা শেল তৈরি করে, বলের মতো, জার্মগুলো কনশিল্ড থাকে নির্জীব ও নির্বিষ হয়ে ওই বলয়ের ভিতরে, আজীবন। মানুষটি ওইভাবেই পুরোপুরি সুস্থ জীবন কাটিয়ে দিতে পারে উইথ অল নরমাল একটিভিটিস। অনেক সময় অনেকদিন বাদে, ওইরকম একটা দুটো শেল ড্রপলেটের সাথে বাইরে এসে পরে। এর কিছু মাস পরে আবার বিমলের সাথে দেখা হয় ওদের হিচককের বার্ডস দেখতে গিয়ে। পীড়নের উপকরণ হিসেবে তৈরি করা অস্ত্র ছাড়া, মানুষ যে পৃথিবীর যে-কোনো ক্রিচারের কাছেই নিতান্ত অসহায় এবং সবচেয়ে দুর্বল একটি প্রাণী, ফিকশানের মুনশিয়ানার বাইরে গিয়ে অন্ধকারে কালো কালো মাথাগুলির কতজন সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলা মুশকিল, কিন্তু বিমলকে সেদিন অনিদের বয়েসের ভারে ওই প্রথমবারের জন্য ন্যুব্জ ও কিঞ্চিৎ দুর্বল বলে মনে হয়েছিল। কখনো কখনো নিবিষ্ট অতীত অন্বেষণের মধ্যে ভবিষ্যতের নিরুচ্চার দাগ থেকে যায় কোথাও যেন! ফিটন গাড়িতে অপু যেরকম তাঁর আশা ও সর্বনাশ দু-টিই দেখতে পেয়েছিল অপর্ণার চোখের কাজলে!

এরপরেও আরও বছর দু-য়েক ওদের দেখা সাক্ষাৎ ছিল। এরই মধ্যে অনি অতনু চাকরিতে ঢোকে, অনির অন্যান্য সময় কমে আসে, অতনু যদিও এবং অনস্বীকার্য যে, খানিকটা বিমলের অনুসরণেই থিয়েটারে সখের অভিনয়ে ঢোকে, কিন্তু বিমলের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমেই শূন্য হতে থাকে। আরও প্রায় তিন চার বছর পরে দু-হাজার তেরো চোদ্দ সাল নাগাদ, অতনু অনিকে জানায় বিমলকে অনেকবারের চেষ্টায় শেষমেশ পাওয়া গেছে। বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়ে দীর্ঘ কথোপকথনের ভিতর দিয়ে অতনু জানতে পারে বিমলের শরীর পুনরায় ওই ড্রপলেটের ঘটনাটার পর থেকেই ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, বছর চারেক আগে ওর লিউকেমিয়া ধরা পড়ে! ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালে ভর্তি হন। দীর্ঘ চিকিৎসা চলে কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। সামুহিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গোটা পরিবার। যাবতীয় আশা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে ঠিক সেই সময় ওই নির্দিষ্ট লিউকেমিয়াটির ওষুধ আচমকা বেরোয় জার্মানিতে। হেয়ারপিন লিউকেমিয়া। কলকাতায় খবর আসে কিন্তু ওষুধ আসে না। প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা ধারদেনা করে ওষুধটা আনানো হয় মুম্বাই থেকে। প্রাণদায়ী হয়, কিন্তু ডাক্তাররা জানিয়ে দেন এর একটা পর্যায়ক্রমিক সারভাইবালের ব্যাপার আছে। বিমলকে পাঁচ বছরের মাথায় আবার টেস্ট করে দেখতে হবে যে, ব্যাপারটা উইদিন রেঞ্জ আছে কি না, যদি থাকে তাহলে এর লংজিভিটি বেড়ে দাঁড়াবে দশ বছর, অতঃপর একই প্রক্রিয়া। এইসব কথার মধ্যেই অতনুকে বিমল নির্লিপ্তভাবে জানায় যে, চিকিৎসার খরচের জন্য সে বউ মেয়েকে কিডনি পর্যন্ত বেঁচে দিতে ফোর্স করেছিল, সে-সবের অবশ্য দরকার পরেনি শেষ পর্যন্ত।
জানালায় ধাক্কা লাগার শব্দে অনির ঘুম ভেঙে যায়। অনি একটু উঠে ধাক্কা দিয়ে জানালা খুলে দেখে বাইরে ঝড় হচ্ছে। বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখে রুপা ঘুমে অচেতন, আবার জানালায় শব্দ। রুপা জেগে থাকলে নির্ঘাত এই প্রথম ভোরেও হপ্তা তিনেক আগের ঘটে যাওয়া সাইক্লোন ও তৎ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির স্মৃতি আর একবার রোমন্থন করত। জানালা ভেজিয়ে দিয়ে মোবাইল ফোনটা খুলে দেখে ভোর চারটে। রাত দুটো নাগাদ সোমেশ্বরের দুটো ফিড এসেছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার গুলি, সংক্রমণের চাপ গ্রাম ভারতে ক্রমবর্ধমান, সামলাতে হিমশিম অবস্থা এবং দুই, নৈহাটি অঞ্চলে রাস্তায় যে-ময়ূর দু-টিকে সন্তর্পণে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল ও গান্ধীনগরের রাস্তায় যে-হরিণগুলিকে, বনদপ্তর জানিয়েছে তাদের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিয়েছে! অনি অবজ্ঞা ভরে ফিডদুটোকে সরিয়ে দেয়, দেশে সংক্রমণের সংখ্যা যবে লাখ সোয়া লাখ ছাড়িয়েছে তবে থেকে এসবের খবর রাখা ও বন্ধ করে দিয়েছে, কানে ঘাড়ে ভালো করে জল দিয়ে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।

ঘুম ভেঙে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে, উঠবে উঠবে করছে, সাড়ে সাতটা বাজে, মোবাইল বেজে ওঠে।

‘ঘুম থেকে উঠেছিস!’— অতনু

‘বলো?’

‘কুন্দনন্দিনী, মনে পড়ছে?’— অতনু

‘কে!?’— ঝাঁঝালো গলা

‘আরে খানদানী খানদানী, বিমলদা বলেছিল, হাঃ হাঃ এবার মনে পড়বে। পরশু রাস্তার মাঝখানে আমায় ধরে ফোন নাম্বার দিল, নতুন নাম্বার, বলল বিমলদার খুব দরকার। আমার কৌতূহলি চোখ দেখে শরীর নাচিয়ে বলল ‘যোগাযোগ আছে, আরে এই গতরটাকে এড়ানো অত সহজ না কি!’, আমার বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি অবশ্য কোনো কথাই’— অতনু

‘সাতসকালে এ-সব শোনানোর জন্য ফোন করেছিস বলে তো মনে হয় না, যোগাযোগ হয়েছিল কি?’

‘আমায় করতে হয়নি, নিজেই ফোন করেছিলেন গতকাল রাতে, অল্প কথা তো কোনোকালেই বলতে পারেন না, যেতে বলছেন তোকে আমাকে শিগগিরি, বললেন, ‘রক্তের কথা রক্তের সম্পর্কের বাইরে তো তোমাদেরই বলেছি, কিন্তু এটা আর কেউ জানে না গলা একটু জড়ানো মনে হল যদিও’— অতনু

‘কথাটা কি বলবি তো?’

‘সলিডারিটি ট্রায়ালের ব্যাপারটা জানিস তো? হু যেটা করে বিভিন্ন সময়ে। এই সংক্রমণের মধ্যে অক্সফোর্ড, ইতালি, ইসরায়েল কোথাওই ভ্যাকসিন ট্রায়াল অবশ্য তেমন ফলপ্রদ হয়নি। ভারতেও না কি শুরু হয়েছে কিছুদিন হল। বললেন কীভাবে হয় জানি কি না, বলে নিজেই বলতে শুরু করলেন!’— অতনু

‘হ্যাঁ জানি পদ্ধতিটা, দু-তিনটে গ্রুপে ভাগ করা হয় নন-ইনফেকটেড পারসনদের, একটা গ্রুপকে ভ্যাক্সিনাইজড করা হয় আরেকটা গ্রুপকে করা হয় না, অ্যান্ড দে আর অ্যালাউড টু বি এক্সপসড উইথ দ্য ইনফেকটেড পিপল, কিছুদিন পরে দুটো গ্রুপ থেকেই দেখা হয় কতজন ইনফেকটেড হল, তার উপর মানে সেই ডেটার উপর সাম্পলিং আর ইনফারেন্স করা হয় কতটা এফেকটিভ সেটা বোঝার জন্য, মাইক্রোবায়োলজিস্টদের কাজ, ডাক্তারদের খুব তেমন ধারণা থাকে না। অঙ্কে আমাদের পিজি পর্যন্ত পড়তে হয়েছিল স্ট্যাটিস্টিকসটা। কিন্তুউ!’

আকাশে বিদ্যুতের বলিরেখা আর তার শব্দের মধ্যে যে ক্ষণের উৎকণ্ঠা থাকে সেইরকম যেন, ‘উনি ওই ট্রাইয়ালে যেতে চান, বললেন, ‘আমার তো আর কিছু নেই’, শরীরের যা হাল, তাই নিজে আসার আগে উনি চান যাতে আমরা গিয়ে সরজমিনে ওনার হাল হকিকত একবার দেখে আসি’— অতনু

ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য, ‘কী অদ্ভুত! তুই কী বললি?’

‘না বলিনি’, তবে উনি বললেন, ‘আহত স্যার ফিলিপ সিডনি, জুটফেন নামক যুদ্ধে, জলের পাত্র তুলে দিচ্ছেন এক সৈনিকের হাতে, সম্ভবত রন এম্বেলটনের ইলাসট্রেশান ছিল, একটা এক্সেবিসানে এ-ছবি দেখে আমরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, তোমাদের মনে আছে? আজ কেন জানি না অনেকটা সেরকম অনুভূতি হচ্ছে কথাটা জানিয়ে।’’— অতনু

অনি চিরকাল দেখেছে জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ওর ভাবনাগুলো কীরকম যেন হয়ে যায়! অপঘাতে মৃত্যুর খবর শুনেছে কিন্তু নিজে কখনো অপঘাতে মৃত মানুষ দেখেনি, বাজ পড়ে মৃত্যুর খবর শুনেছে কিন্তু বাজ পড়া মৃতদেহ কখনো দেখেনি, এমনকী বাজে পোড়া গাছ পর্যন্ত নয়, এইসব মনে আসতে থাকে।

এর সপ্তাহখানেক বাদে দোনোমনা করে একবার যাওয়া স্থির করে ওরা, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না। যা এতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা গিয়েছিল, কোটিকোটি অসহায় পরিযায়ী মানুষের ক্রমান্বয় পদধ্বনিতে সেই গ্রাম ভারত এবং বাংলার গ্রাম লাল তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ে অবশেষে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

প্রথম পাতা