Categories
গল্প

শুভদীপ ঘোষের গল্প

শীতঘুম

বাপ ঠাকুরদার ঠিকুজি কোষ্ঠী নিয়ে ভারত সরকারের পার্লামেন্টে আনা যে-বিলটা তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর অবশেষে পাস হয়ে গেল সেই নিয়ে অনিমেষদের তর্কাতর্কির শেষ ছিল না। গোবলয়ের হিন্দুত্ব, রাডিক্যাল ইসলাম, ভারতবর্ষের পেরিনিয়াল হিন্দু মুসলমান সমস্যা এইসব নিয়ে দুপুরের খাওয়ার টেবিল গরম হয়ে থাকত। একটা ছোটোখাটো গ্রুপ ছিল অনিদের, যাবতীয় প্রলোভন, যুগের মুদ্রাদোষ এইসবের পরেও মাথার কিছু জায়গা খালি থাকত কিংবা বলা যেতে পারে জিনগত ত্রুটির কারণে এইসব অর্বাচীন ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার বদভ্যাস ছিল ওদের। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও ক্রমপাতনশীল অর্থনীতি না কি হিন্দু মুসলমান সমস্যা কোনটা আসল কোনটা বানানো, কোনটা অগ্রাধিকার যোগ্য কোনটা তুচ্ছ, হ্যাঁ বেশ মনে আছে সেই সময় খুব কথা হত এইসব নিয়ে। কিন্তু পরা-বাস্তবতার আভাস সে-সময় বাতাসে একটা কোথাও ছিলই! অনি এসে খাওয়ার টেবিলে সোমকে বলে ‘ব্যাপার মোটেই সুবিধের নয়, অলরেডি ইউরোপ ইনফেক্টেড, ইরান, ইতালি, চীন তো আছেই, এখন শুধু পায়ের নীচের গলিগুলো দিয়ে এখানে ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা, সেটা হলে কিন্তু আমাদের কমপ্লিট মারা যাবে!’ চারপাশে তাকিয়ে হাতের ভঙ্গিতে দেখায় অনি। নকশাল পন্থী যে-দলটা মার্কসবাদী লেনিনবাদী নামে পার্লামেন্টের রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় সোমের বাবা সেই পার্টির হোল টাইমার ছিল। অফিসে এসেছে থেকে অনি দেখেছে সোমও যে-কোনো ব্যাপারে সেই পার্টির ব্যাখ্যাটাই আগে দিত। কিন্তু বিগত এক-দু-বছরে এর পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যক্তিগত কোনো কারণ থাকতে পারে এবং তা হয়তো এমনই যে, তাতে ব্যক্তিগতও হয়ে যেতে পারত, তাই এই পরিবর্তন। এইসব ঠিকই ছিল, ছেচল্লিশের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও তৎপরবর্তী দাঙ্গা, চরম-নরমপন্থী কংগ্রেস, শক্তির সমতুল্যতা এই পর্যন্তও চলছিল, কিন্তু গৈরিক ভারতবর্ষের একপেশে ধারণা নিয়ে একবার তুমুল বাক্বিতণ্ডার পর থেকে অনিরা সোমেশ্বর ওরফে সোমের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা একটু বুঝেশুঝে করত। ‘আমাদের এখানে তো তেমন প্রভাব পড়বে না বলছে, ওয়েদারের জন্য’— পাশের টেবিল থেকে গলা ভেসে আসে। অনিরা যেখানে খাওয়া দাওয়া করে সেটা ওদের অফিস কমপ্লেক্সের কমনগ্রাউন্ড, ওরা কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করেছে অনেকেরই মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে। অতনুর অফিস পাশেই। অতনুও মাঝে মাঝে খেতে আসে ওদের সঙ্গে, বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে প্রতিদিন দেখা হয়। সেদিন চা খেতে বেরিয়েও ওই একই ছবি।

এর হপ্তা তিনেক পর। বিকেলের শেষ সূর্যের আলোয় অনিমেষ অফিস থেকে সময়ের আগে বেড়িয়ে পড়ে। অতনুর কাউনসেলর বলেছিল রিপ্রেশন নির্জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। এমন কোনো ইচ্ছে যা অবদমিত কিন্তু আপনাকে মাঝে মাঝেই পীড়ন করছে। মানুষের সেইসব শারীরিক ও মানসিক অভিজ্ঞতা না কি অতিদ্বেষাত্মক। নন্দনচর্চার কথা শুনে অনিকে ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘সব কিছুর শেষে দেখবেন একজন কবি বসে থাকেন’, ওঁর কথা নয়। অবাধ যোগসাজশ যদিও বলা যাবে না মানে যাকে ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন বলে, তবে অতনু বলেছিল মালটা পাক্কা চালিয়াত। অফিসপাড়ার মোড় থেকে ট্যাক্সি নিতে নিতে অনির মনে পড়ছিল এই কথাগুলো। সকালবেলা ফোন করে অতনু খবর দেয়, ওদের দলের নাটক আছে সন্ধ্যেবেলা দক্ষিণ কলকাতার একটি হলে। গোড়ার দিকে অনি সব ফ্রি পাসেই দেখতে যেত। কিন্তু ইদানীং অতনু দিনক্ষণ বলে দেয়, অনি টিকিট কেটে যায়। ওই দিন একটু দোনোমনা করে মোবাইল থেকে টিকিট কাটার সময় অনি দেখে পেছন দিকের দুটো রো মাঝখান থেকে ফাঁকা পড়ে আছে। অনি মাঝামাঝি দেখে দু-দিক থেকে আট নটা চেয়ার ছেড়ে একটা টিকিট কাটে। রুপা আসতে পারবে না, ওঁর এক পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে এরকমই জানিয়েছিল। অনি ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখে লোক সব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মনে হয়, দু-চারজন যারা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের দেখে রুমাল বের করে মুখে বেঁধে নেয়। হলে অর্ধেকেরও কম লোক, দু-দিকে সিট ফাঁকাই পড়েছিল। নাটক শুরু হওয়ার একটু আগে বাঁ-দিকের শেষ ফাঁকা সিটটায় একজন ভদ্রমহিলা এসে বসেন, মুখ মাস্কে ঢাকা। প্রায়ান্ধকারে বেশ কয়েকবার ওনার সঙ্গে চোখাচোখি হয় অনির। আলো সম্পূর্ণ নিভে যাওয়া ও মঞ্চের পর্দা উত্তোলনের মধ্যে অনি টের পায় ওনার পাশে এসে লোক বসেছে। ব্লাউজের উপরের দুটো হুক খোলা রেণু, যে-দৃশ্যে গলাকাটা ছাগলের মুণ্ডুর মতো ছটফট করতে করতে বিজন ওরফে অতনুকে বলছে, ‘নিক, নিয়ে যাক। আমার আসবাবপত্র সব বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিক ওরা!’ অনির মনে হয়েছিল এবার এই ধরনের চরিত্রে অতনুর অভিনয় বন্ধ করাই ভালো। রুবিকে, সাগরিকা হোটেলের ছাদ থেকে আগের একটি নাটকে যে-দৃশ্যে অতনু মিলোনন্মত্ত বানের শব্দ শোনাচ্ছে, সেই একই অভিব্যক্তি আবারও দেখা গেল এই দৃশ্যে। মানুষ কতদূর পর্যন্ত নীতি মেনে চলবে! নৈতিকতা তাকে যতটা অ্যালাউ করবে ততটাই তো! কিন্তু এর কী শ্রেণি নির্বিশেষে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে! সমস্ত মানসিক সমস্যার একটা মূল জায়গা দেখা যায় ভালোবাসার অভাব। ভালোবাসা নীতি নৈতিকতা মেনে চলে কিন্তু তার রেপ্রেসিভ আউটকাম আছে। এই রেপ্রেসন না থাকলে কিনশিপ তৈরি হত কী! যৌনপ্রেম সভ্যতার কোন পর্যায়ে থাকত তাহলে এতদিনে, কোন পর্যায়েই-বা এখন আছে কেউ কী হলফ করে বলতে পারে! অনি অতনুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর এক্স্যাক্ট অসুবিধেটা কী হয়?’ অতনু পরিষ্কার বলতে পারেনি। অনুমানে অনি বুঝেছিল দীর্ঘক্ষণ গুম মেরে থাকাটা সম্ভবত ওর একটা মানিফেসটেশান। বিরতির আলো জ্বলার পর অনি তাকিয়ে দেখে ভদ্রমহিলা একা বসে আছেন। এরপর আর কারো আসা টের পায়নি অনি। সো-এর পর গ্রিনরুমে যায় অনি। ভালোলাগা, খারাপলাগা, এরম এলোমেলো কিছু কথার মাঝখানে অতনু হঠাৎ অনিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর বিমলদাকে মনে আছে?’ অনি ভুরু কুঁচকে একটু ভেবে বলে, ‘বিমলদা! মানে, গোর্কির বিমলদা! অবশ্যই মনে আছে, কেন কী ব্যাপার?’ ‘সো-এর আগে ফোন করেছিলেন, ব্যস্ত আছি শুনে ফোন কেটে দিলেন, করে দেখব পরে আবার’। বিমলদার স্মৃতি রোমন্থনের তেমন সুযোগ সেদিন পায়নি অনিরা, আচমকা ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় সবাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে, ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা ক্রস করে উলটো পাড়ে যাওয়ার সময় সেই মহিলাকে অনি অতনু দু-জনেই দেখতে পায় ব্রিজের মাঝখানে, সিক্তবসনা।

এর সপ্তাহ দু-য়েক পর ‘প্যানডেমিক’ শব্দটা প্রায় খিস্তির পর্যায় পুনরুক্ত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। অতনু ও সোমের মোবাইল থেকে ক্রমাগত বিভিন্ন নিউজ ফিড আসতে থাকে অনির মোবাইলে, অনিও সেগুলি ফরওয়ার্ড করতে থাকে ইতিউতি। সংক্রমণের মরটালিটি সংক্রান্ত আলোচনায় অনি লেখে, ‘মরটালিটির প্রশ্নে এইচ আই ভির কথা মনে এল। যে-রোগ শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে আবধ্য ছিল, আমেরিকাতে আশির দশকে তা প্রায় মহামারির চেহারা নেয়। মরটালিটি রেট অল মোস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এলজিবিটি কমিউনিটিকে আইসোলেট করা হয় ও মূল অভিযুক্ত ঠাউরে কাঠগড়ায় তোলা হয় সে-সময়’। উত্তরে অতনু লেখে, ‘এতে ওই কমিউনিটির প্রতি পরবর্তীকালে অদ্ভুতভাবে সলিদারিটি বাড়ে, দে বিকেম দ্য পার্ট অফ দ্য সিস্টেম স্লোলি। প্রশ্নটা হল ‘প্যানডেমিক’-এর নাম করে যেভাবে সরকার মানুষের গতিবিধির উপর নজরদারি শুরু করেছে ইভেন বাই ইউজিং মোবাইল অ্যাপ তাতে ইফ উই আর নট কশাস, ইন দ্য ফিউচার ‘প্যানডেমিক’ চলে যাবে তার নিজের নিয়মে একদিন হয়তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে, কিন্তু রাষ্ট্র! স্বৈরতন্ত্র!’ মৌনতা সন্মতির লক্ষণ মানে অনি। এর দু-একদিন বাদে ওদের পুরানো বাড়ির দরজার সামনে বাইকে বসা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ওকে জিজ্ঞেস করে ‘১১/সি-টা কোনটা হবে?’ মুখে বাধ্যতামূলক মাস্ক ও হাতে গ্লাভস, অনি হাত দেখিয়ে দূরের একটা বাড়ি দেখিয়ে দেয়, বিষ্ণুদের বাড়ি। লোকটা চলে গেলে, উলটো দিকের ব্যালকনি থেকে রাশভারী গলা শোনা যায়, ’বাইরে থেকে ফিরেছে মনে হচ্ছে?’। দূর থেকে সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে, বেচারা প্রসন্য নায়েবকে যেন বিশ্বম্ভর জিজ্ঞেস করছেন, ‘বন্দে আলির সানাই না?’ অনি ঘরে ঢুকে যায়।

এই বিষ্ণু এক অর্থে ওর ছোটোবেলার বন্ধু। যা হয় বড়ো হয়ে যাওয়ার পর বন্ধু থাকে কিন্তু বন্ধুত্ব থাকে না। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার, অতি শীর্ণকায় চেহারা, পাজামা পরত কোমরে গার্ডার দিয়ে, অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত অন্তর্বাস পরত না অনিরা লক্ষ করেছে। একবার একমাত্র সন্ধ্যার শুকতারাকে সাক্ষী রেখে এই ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায়। প্রায় কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর জটলার মাঝখানে আচমকা প্রেতের আগমন, বাড়ির পেছন দিকের সেফটি ট্যাঙ্কের উপর এতক্ষণ বসে ছিল! উলটো দিকের বাড়ির স্নেহশীলা অবিবাহিত যে-দিদির বাড়িতে অন্তর্বাসহীন বিষ্ণুর অবাধ যাতায়াত ছিল, তিনি চোখের জল মুছে স্নেহে ওকে বুকে টেনে নেন। বাবা মায়ের মুখে ফ্লুরোসেন্ট জ্বেলে এ-ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যায় চাকরির সুবাদে। সম্ভবত এই ভোরে বাধ্যতামূলক চোদ্দ দিনের কোয়ারেন্টিইন সেন্টারকে এড়িয়ে নিরপরাধী বিষ্ণু পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি চলে আসে, তাই এই শিকারির আগমন। প্রশাসন একটিভ তাহলে, পাড়ার লোক খবর দেয় পুলিশ এসে মা ছেলে দু-জনকেই তৈরি হতে বলে গেছে, নাইসেড টেস্টের জন্য যেতে হবে সম্ভবত, বাবা আগেই মারা গেছেন। ‘এদেরকে শিক্ষিত বলে! কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই সোজা বাড়ি চলে এসেছে!’— পাশের বাড়ির গলা। পুলিশ আবার আসে, কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অনি বারান্দায় গিয়ে দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সি ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিকে চলে যাচ্ছে, ভিতরে নিরাপদ দূরত্বে বিষ্ণু আর ওর মা বসে আছেন, মুখে মাস্ক, অনি হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে রাখে, পুলিশের বাইকটা উলটো দিকের রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যায়। অনির মনে পড়ে বিষ্ণুর ঠাকুমা বেঁচে থাকাকালীন মাছ তো দূরস্থান, বিধবা ছিলেন, পেঁয়াজ রসুনও খেতেন না, এমনকী যে-জায়গায় বসে একবার আমিষ ভোজন হয়েছে জ্ঞানত তিনি সেই স্থানে গিয়ে কখনো বসতেন না। মানুষ রোগ থেকে রুগীকে কি কোনোদিনও আলাদা করতে পেরেছে, পাপ থেকে পাপী যেমন! অনি ঘরে এসে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নেয়।

এরই কিছুদিন আগে অনিদের অফিস বন্ধ হয়ে যায়। অতনুদেরও। বাড়ি থেকে কাজ, অতনুদের নয় অবশ্য। এর মধ্যে ফোনে সোমের সঙ্গে অনির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের এবং সোমের রাজনৈতিক তরজা অনির মাথা ধরিয়ে দিয়েছিল। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, রেমডিসিভির সোম জানিয়েছিল, কিছু উন্নতির কেস দেখা যাওয়াতে, ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। রেমডিসিভির না কি ভাইরাল শেডিংটাকে কমাতে সক্ষম। অনি জানায় মার্কিনদেশে সংক্রমণ সব থেকে বেশি হওয়ায় সিনিয়র সিটিজেন না হলে হাসপাতালে ভর্তি নিতে চাইছে না, লক্ষণ লঘু হলে তো আরওই নয়। অতনুর এক দিদি জামাইবাবু ওখানকার ডাক্তার, দু-জনেই সংক্রমিত কিন্তু বয়স কম বলে হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। ওনারা বাড়িতেই নিজেরা নিজেদের চিকিৎসা করেন, গোড়ায় ক্লোরোকুইন খেয়ে ওদের বমি শুরু হয়। এখন দু-জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। এই লকডাউনের মধ্যে অতনু একদিন ফোনে জানায় ওদের নাটকের দলগুলির যে-এসোসিয়েসান আছে তার বাইরে অতনুরা একটা ফান্ড তৈরি করেছে টেকনিশিয়ান ও প্রতিদিন অভিনয় করে যারা সংসার চালায় তাদের জন্য। বিমলের কথা ওঠে এই সূত্রে আবার, স্কুলের মাস্টারির বাইরে সখে থিয়েটারে অভিনয় ও ফিল্ম ক্লাব এইসব করে বেড়াতেন। এরকম বিচিত্র মানুষ অনিরা জীবনে খুব বেশি দেখেনি। ভীষণ সমস্যাশঙ্কুল জীবন কিন্তু এমন একটা অনড় ভাব ছিল, আদিরস মিশ্রিত মুখের ভাষা কিঞ্চিৎ প্রগলভতায় ভরা, অদ্ভুত ভঙ্গি কিন্তু কথার মধ্যে পারস্পেকটিভ পাওয়া যেত নানা ধরনের। স্কুলের মাস্টারমশাই হিসেবে একেবারেই ভাবা যেত না। কলকাতায় থাকতেন হেদোর কাছে, পুরানো বাড়ি ছিল নদিয়া জেলায়, রানাঘাটের কাছে। অনিদের সাথে প্রথম দেখা দু-হাজার সালের আশেপাশে। সম্ভবত গোর্কি সদনের মাসিক সিনেমা প্রদর্শনীতে। ডিসিকার বাইসাইকেল থিফ দেখার শেষে। ছবি শেষ হলে, অনিরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দীর্ঘকায় মৃণাল সেন কৌতূহলী ও নাছোড় বিমলকে বলছেন, ‘ভাবতে পারেন এ-ছবি চল্লিশের দশকে বানানো, আজও দেখলে মনে হয় এই কালকে বানানো হয়েছে!’ শোনা কথার মধ্যে যখন আকাঙ্ক্ষিত কথা থাকে তখন কথায় কথা বাড়ে। মৃণাল সেন তাঁর সাগরেদ সমেত হাঁটা দিলে বাইরে চা খেতে এসে অনিরা দেখে বিমল মৃণাল সেনের চেনা কেউ নন এবং প্রায় বিনা পরিচয়েই ওদের বলছে, ‘মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কোথাও শুনেছ অপমানে বাপ ছেলে একসঙ্গে কেঁদে ভাসাচ্ছে! এ শুধু শালা নিম্নবিত্তেরই বারমাস্যা, পৃথিবীর যেখানে যাও! আমার জানতে ইচ্ছে করে এ-ঘটনা ওঁর ছেলের জীবনেও ঘটবে কি না!’ এর মাসখানেক পরে, পরের বছর হবে হয়তো, নাম মনে নেই, ইতালির ছবি, অতনু বলে, ‘পার্সোনাল সিনেমা বলে যদি কিছু থেকে থাকে এ একেবারে তাই, একজন মানুষের অবসেসন, তার পায়ুকাম, পৃথুলা রমণীদের প্রতি আকর্ষণ এ-সব কি কোনো এস্থেটিক্স এনে দিতে পারে? কোন অ্যালকেমির জন্য লোকে এ আবার দেখতে চাইবে!’ অনিমেষ ভাবতে থাকে।

উল্লাসের হাসি-মাখা অরুণ অধর
গোপ-সীমন্তিনী-গণে চুম্বে নিরন্তর।
আলিঙ্গনে আমোদিনী নিতম্বিনী-দল,
তিমির অঙ্গের মণি করে ঝলমল।
বিশাল বক্ষেতে কিবা বিমর্দ্দিত আজি
গোপ-নিতম্বিনী-গণ-উচ্চ-কুচ-রাজি।

আমার তো এই মনে এল, এর জন্য আবার দেখব কী?’ বারোশো শতকে লেখা জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে আবৃত্তি করে শোনায় বিমল। রসময় দাস নয়, শ্রী শরচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রণীত ও প্রকাশিত গীতগোবিন্দের এই বাংলা পদ্যানুবাদটি বিমলের কাছে আছে। আজ যা রেপ্রেসেড হয় ক্ষমতার নৈতিক অনুশাসনে কাল তা আকুপাকু করে নতুন চেহারায় ফিরে আসে, সাবভারসানের চেহারা নিয়ে, ক্ষমতার অলিন্দে অন্তর্ঘাত ঘটানোর অভিপ্রায়। বিমল চুকচুক করে চায়ে চুমুক দেয় আর চোখ পিটপিট করতে থাকে, পয়সা মেটায় প্রতিবারের মতো অনিরা। ‘তোমার বাড়ি যেন কোথায় বলেছিলে?’, অতনু উত্তর দেয়, ‘রানাঘাট’। ‘রানাঘাট টকিজের পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা এঁকবেঁকে চূর্ণীর দিকে চলে গেছে ওই দিকে একসময় নিয়মিত যেতে হয়েছে বুঝলে’। মানুষের কিছু অনিবার্য অসহায়তা থাকে, যা ক্রমউন্মোচিত হতে থাকে প্রকাশের আধার পেলে। জ্যান্ত পুড়ে যাওয়ার আগে প্লেগাক্রান্ত মেয়েটির আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে পরিচালক জানতে চেয়েছিলেন, ‘ইস ইট দ্য আঙ্গেলস ওর গড ওর স্যাটান ওর জাস্ট এম্পটিনেস, হু উইল টেক কেয়ার অফ দ্যাট চাইলড?’ দ্য সেভেন্থ সীল ছবিতে, এ-দেশের মানুষ এই প্রশ্ন করার অবকাশই পায় না। সেই দিনের ও পরের দিনের বেঁচে থাকা, ব্যাধি, অপমান, কোটি কোটি মানুষের অবমানবের জীবন, তাদের জন্মান্তরের অশান্তি দিতে পারে কেবল, তার চাইতে মরনোত্তর সেটেলমেন্টের সেমিটিক ভাবনা এখন মনে হয় অনেক বেশি ভালো বোঝাপড়া, এই সন্দর্ভ তৈরি করে বিমল অনিদের সঙ্গে সেই দিন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পরপর শ্লেষ্মা দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে বিমলের, সেই সময়ই এই ডাক্তার সেই ডাক্তার ঘুরে অবশেষে যৌবনের অনিবার্য টানে রানাঘাটে আসা শুরু হয়। চম্পার সঙ্গে প্রেম তার আগে থেকেই ছিল। গোঁড়ায় কিছু না জানালেও একদিন খয়েরি রক্তের ছাপ দেখে ও চাপা কাশির দমক দেখে বিমলকে চুমু খেতে বাধা দেয় পয়োধরা চম্পা। বিমল জোর করে চুমু খায়, উপরন্তু স্তনে মুখ দেয়। এর পরেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। সম্পর্কে সম্পূর্ণ ছেদ ঘটার আগে চম্পার বাবা চেয়েছিলেন দৈবক্রমে পাওয়া এই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিমলের গায়ে অসন্মান স্থায়ীভাবে লেপে দিতে। বিমলকে কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় চূর্ণীর শেষ মাথার গলির ডাক্তারের কাছে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বিমলকে ভর্তি করে দেওয়া হয় ধুবুলিয়ার টিবি হাসপাতালে। এই শোকে বিমলের বাবার একটা ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়, দু-একদিন বাদেই উনি মারা যান। ‘সেই সময়ের কথা, ষাটের দশকের শুরুর দিক, স্ত্রেপটোমাইসিন দেওয়া শুরু হয়েছে কিন্তু ফুল প্রুফ নয়, আর ভরসা সেই চিরাচরিত রোদ্দুরের আলো আর ট্যাঁকের জোর থাকলে পশ্চিমে গিয়ে মাসের পর মাস ভালো জল হাওয়া খাওয়া আর শরীরে এন্তার রোদ লাগান।’ — অনর্গল বমনক্রিয়ার মতো, অনিদের কথাগুলো বলে যায় বিমল। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে বিমল জানতে পারে ফিমেল ওয়ার্ডে চম্পা ভর্তি হয়েছে। দাদা এসে বিমলকে বলে যায় ওর সঙ্গে দেখা করার কোনোরকম চেষ্টা না করতে। দুই বাড়ির মধ্যে অশান্তি প্রায় হুমকি হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিমলকে প্রায় দু-বছর থাকতে হয়েছিল ধুবুলিয়াতে। স্ত্রেপটোমাইসিন কাজে আসে, বিমল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু চম্পা, বিমল ছাড়া পাওয়ার বছরখানেক বাদে মারা যায়। সুস্থ হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত তীব্র মাথা ঘোরা ও বমি ছিল বিমলের নিত্তসঙ্গী। মা দাদারা বিমলকে আর পড়াশুনো করতে দিতে চায়না, পেয়ারাপাড়া গ্রামে ওদের যে জমিজায়গা ছিল তাই দেখাশুনো করতে বলে। তথাপি দু-বছরের ব্যবধানে বিমল এসে ভর্তি হয় উত্তর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি বিভাগে। পিজি বিএড দু-টিই শেষ করে অবশেষে চাকরি নেয় স্কুলে। এরই মধ্যে একদিন পেছন থেকে বিমল ভেবে ভুল করে ওর দাদার উপর কিছু লোক চড়াও হয়, কিঞ্চিৎ হাতাহাতির মধ্যেই ব্যাপারটা তখনকার মতো মিটে যায়, তাই পুনরায় পড়াশুনো করার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও কলকাতায় চলে আসার বা বলা ভালো বাড়ির লোকের পাঠানোর পিছনে আর একটা কারণ ছিল পূর্বের প্রেম ও অশান্তির আবহ থেকে বিমলকে দূরে সরিয়ে রাখা। মেয়ে ও মদের নেশা বিমলের অল্পবিস্তর থেকেই যায়। বিয়ে করে, একটি মেয়েও হয়। সখে থিয়েটারে অভিনয় এর কিছু কাল পরে শুরু হয়, নব্বই-এর দশক থেকে ফিল্ম ক্লাব, থিয়েটার ছেড়ে দিলেও ফিল্ম ক্লাবে যাতায়াত অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। গত দশকের মাঝামাঝি বেশ কিছু দিনের অ্যাবসেন্সে একদিন বিমলের এসএমএস পায় অতনু। লেখা ছিল, ‘অতনু— ১৫/০৪/২০০৬, ৭:০০ পিএম— ৯:০০ পিএম, সাডেনলি, অকারড ৩-৪ টিএসএফ ব্লাড উইথ কাফ (৫৪ ইয়ার্স এগো ১৯৬২-৬৪ ইয়ার: কেএসআর–ধুবুলিয়া–ক্রি–সদর–এমসিএইছ), মেডিক্যাল কলেজ ইমারজেনসি ডায়গনোনসিস: হেমপটিসিস (পাস্ট হিস্ট্রি + টুডে— সিমস সেম: আই ই: নরমাল); সোয়ালিং অফ ফিট; বিপি— ১২৫/৭৫; নেক্সট চেকআপ: আফটার ওয়ান উইক;’।

শেষ পাতা

Categories
গল্প

সেলিম মণ্ডলের গল্প

হাতটি

আকাশে একটিও তারা নেই। গুমোট। বৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আকাশের কি ভালো লাগে এত ভারী মেঘ বয়ে বেড়াতে? আকাশভারী মেঘের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়— অন্ধকার আকাশটা এখুনি ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে চেপে মারবে। কতদিন কিছু লেখা হয় না! পড়াতেও মনোযোগ বসে না। কতদিন নতুন উপন্যাস পড়িনি! বিছানায় নেরুদার প্রশ্নপুঁথি, মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্যসংগ্রহের প্রথম খণ্ড, উৎপলের কবিতা সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড ছড়িয়ে… কোনোটি দু-পাতা পড়ব তার ইচ্ছেও হচ্ছে না। বালিশের পাশে একটা ডায়েরি ও লাল কালো দু-খানা কলম পড়ে। ডায়েরিতে লিখি না। কাটাকুটি করি। নিজেকে যখন ভীষণ একা লাগে ওই ডায়েরির পাতায় অজস্র বক্ররেখা টানি। তারপর মুখগুলো মিলিয়ে দিই। আজ কিছুই ইচ্ছে করছে না। ল্যাপটপটা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ করে রেখেছি। স্পিকারটাও অফ। খেয়েছিও অনেকটা দেরিতে। রাতে খাওয়ার সময় একমাত্র টিভির ঘরে ঢুকি। খেতে খেতে খবরের চ্যানেলগুলো স্ক্রল করি। চ্যানেলগুলো বড্ড বোরিং। এই বিপর্যয়ে মানুষজনের কী অবস্থা তা যত না খবর করে তার থেকে বেশি খবর করে এ-সরকার কী করছে, ও-সরকার কী করছে! কোন সেলেব্রটি পেগন্যান্ট! গঙ্গায় তিমি ভাসছে!

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, মাথায় কী সব উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরছে—

তারাদের কি অভিমান হয়?

ধারে কেনা যায় কি তারার ছটফটানি?

তারাদের বিয়েতে কি চাঁদের নিমন্ত্রণ থাকে?

হঠাৎ, মনে হল পিছন থেকে কেউ একজন ঘাড়ে হাত রাখল। আমি একটুও চমকে গেলাম না। পিছন ফিরেও তাকালাম না। আমি আগের মতোই আছি। ছোটোবেলা থেকেই ঘাড় ধরতে পছন্দ করি। কেউ ঘাড়ে হাত রাখলেও ভালো লাগে। প্রেমিকার সঙ্গে যখন বেরোতাম, হাত না ধরে ঘাড় ধরতাম।

আজ আমার ভিতর কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। লাইট অফ। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। অন্ধকার আকাশে কিছুই দেখা যায় না। না-দেখাটাও অনেক সময় আনন্দের। আমরা যত না দেখব, পৃথিবী বোধহয় ততই রহস্যময় সুন্দর।

হাতটি আস্তে আস্তে আরও চাপ দিয়ে স্পর্শ করছে। আমার মন্দ লাগছে না। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। এত রাতে আমার ঘরে কেউ আসবে না। আসলেও এভাবে আচমকা এসে ঘাড়ে হাত দেবে না। কিন্তু এ-নিয়ে আমার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতাই নেই। একইরকমভাবে আকাশ দেখছি তো দেখছিই। ঘড়ির ব্যাটারি বহুদিন শেষ হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যে কেনাও হয়নি। সত্যি বলতে আজকাল ঘড়ি দেখার প্রয়োজনই হয় না। সারাক্ষণ হাতের কাছে মোবাইল থাকে। কিন্তু এখন মোবাইল কোথায় আছে জানি না। অন্ধকারে খুঁজে পাওয়াও যাবে না। মা, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে, বেশি রাত করবি না। এখন ক-টা বাজে আমার আইডিয়া নেই। রাতে খেয়েছি তাও ঘণ্টা ৩-৪ হবে। সেই সূত্রে অন্তত ২টো বা ৩টে বাজে। ঘুম আসছে না। এবার ঘুমোতে যাওয়া দরকার। আমি অনুভব করলাম ঘাড় থেকে হাতটি সরে গেছে। আকাশেও যেন মেঘের ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটি তারা। হতেও পারে দূরের কোনো জোনাকি। আমি মাঝে মধ্যেই তারার সঙ্গে জোনাকি গুলিয়ে ফেলি।

ঢক ঢক করে কয়েক গ্লাস জল খেয়ে, মোবাইলটাও খুঁজতে লাগলাম। পেলাম না। বোধহয় টিভির ঘরে রেখে এসেছি। খাটের একপাশেই কোনোরকমে বইয়ের ওপর বই চাপিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিলাম। এই বিরক্তিকর কাজ আমাকে একটি কারণে করতে হয়। যাতে মায়ের বকা না খেতে হয়।

সঠিক ক-টা বাজে, এখনও জানি না। অন্যান্য দিন শোবার সময় মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। মশারির মধ্যে চুপচাপ আছি। ঘুম আসছে না। আমার ঘরটাই মনে হচ্ছে আকাশ। একটাও তারা নেই। গুমোট। খালি ফ্যানের হাওয়ায় অল্প অল্প মশারির নড়াচড়া টের পাচ্ছি। একটা সময় আমার ঘুম নিয়ে অহংকার ছিল। বিছানায় পড়লেই ঘুমিয়ে যেতাম। আজকাল কী হয়েছে, শুলেও ঘুম আসে না। ঘুম আসে, আবার ভেঙে যায়। এখন আমি ঘরের মধ্যেই আকাশ দেখছি। কখন তারারা আসবে অপেক্ষা করছি।

এর মধ্যে একটা কালো বিড়াল এসে জানালার ধারে কুৎসিতভাবে ডাকছে। জানালার একটা পাল্লা খোলা। তা দিয়ে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বলতে— তার উজ্জ্বল দু-টি চোখ। এত তীব্র আলো মনে হচ্ছে এই তো দু-টি তারা জ্বলছে আকাশে। কিন্তু ওই ডাকটা আরও পাগল করে তুলছে। কিছুক্ষণ পর বিড়ালটা নিজেই চলে গেল।

চোখটা আস্তে আস্তে একটু ভার লাগছে। চুপচাপ আছি। আকাশটা আরও ঝাপসা হয়ে আসছে। পাশ ফিরে কোনোরকম চোখটা বুজলাম। আবার যেন পিঠে কারো হাত স্পর্শ করল। কিছুই বললাম না। এবার সে নিজে থেকেই বলল, তারাদের দেখা পাবে না। আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই কণ্ঠস্বর আমি ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

— কথা বলো।

— আজ তুমি চলে যাও। চলে যাও প্লিজ।

— তুমি তারাদের দেখা পাবে না। দেখো, আকাশ থেকে ওই অন্ধকারে ঝরে পড়ছে রক্ত। টের পাও, ওই রক্ত কাদের? শুনতে পাও কি কোনো আর্তনাদ।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। ফ্যান চলছে। ঘরের দরজা বন্ধ, পাশের ঘর অবধি শব্দ হয়তো পৌঁছায়নি। তবে কোনোরকমে নিজে সামলে বললাম, আজ তুমি চলে যাও, প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। পাশের ঘরে কিছুক্ষণ আগেই বাবার কাশির আওয়াজ পেয়েছি। জেগে যেতে পারে। ও নাছোড়। কিছুতেই যাবে না। মাথায় হাত বোলাতে থাকে আর বলে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও। মাথায় হাত বোলাতে থাকে, মাঝে মাঝে কপালে চুমু খায়। এই আদর আমার সহ্য হচ্ছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে। আমার কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি পাগল হয়ে উঠছি। রাতের পর রাত ঘুম নেই। কিছু সহ্য হচ্ছে না। গভীর রাতে স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে না। অন্ধকার গুমোট আকাশে তারা খুঁজছি!

যেভাবে হোক একে তাড়াতে হবে। না হলে আমি আরও পাগল হয়ে যাব। চিৎকার করে উঠব। কয়েকবার ঘুরে লাথি মারলাম। তার কিছুই যেন হল না। একইভাবে আমার পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। আজ রাতে আমার সঙ্গে থাকবে। গল্প করতে চায়। বিরক্ত হচ্ছি বলে চুপচাপ গায়ের গন্ধ নেবে। মাথায় হাত বোলাবে। কিন্তু সে যাবে না…

হঠাৎ, একটা শব্দ কানে এল। গেট খোলার শব্দ। একটু স্বস্তি পেলাম। মা বোধহয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠেছে। আমার ঘরে আলো জ্বললে মা এসে দেখে যায়। আজ অন্ধকার। আসার প্রশ্নই নেই। মা-কে কি ডাকব? এত বিরক্ত লাগছে কেন? মা এসে কি একে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে? আমি কি সত্যিই চাই, একে দূর দূর করতে? আজ তো প্রথম নয়, তাহলে কেন বারবার সে আসে?

কিছুক্ষণ পর আবার দু-বার আওয়াজ পেলাম। একবার বাইরের গেট লাগানোর, আরেকবার আরেকবার শোবার ঘরের সিটকানি মারার।

— তুই কি যাবি বাল?

— আমি তোমার কি ক্ষতি করছি? ঘুম পাড়িয়েই তো দিচ্ছি।

— দ্যাখ, বাল; তোর এই আদর আমি চাই না।

— তাহলে জানালার ধারে গিয়ে কেন, কেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলে?

— তা তোর কী?

— তুমি, তারার দ্যাখা চাও। অথচ, তারা তোমার কাছে এলে তাকে দূর ছাই করো।

— আমি তোর মতো তারা চাই না। নীল আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা দেখতে চাই।

— যে-আকাশে তুমিই মেঘ ঘনিয়ে আনলে সেই আকাশেই তারা দেখবে? আর যে-রাতে অন্ধকার তারাদের গিলে নেয়, সেই রাতকে, না তারাকে; তুমি বিশ্বাস করো না?

তুই তোকারি পর্যায়ের তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। আমি পাশ ফিরে একইরকমভাবেই শুয়ে আছি। ও মাথায় যতই হাত বুলিয়ে দিক, কিছুতেই ঘুম ধরে না।

ডান হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীরটা আগের চেয়ে অনেকটা হালকা লাগছে। ঘরটা আগের মতো অতটা অন্ধকার নয়। জানালার একটা পাল্লা দিয়ে অল্প অল্প আলো ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল হবে। জানালার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে— পাঁচিলে ঝিমোচ্ছে একটা পাখি। ও কি আমায় সারারাত পাহারা দিচ্ছিল? পাশেই নারকেল গাছ। প্রতিদিন কত পাখি ওর পাতায় বসে খেলা করে। পেচ্ছাপের বেগ পেয়েছে কিন্তু বালিশ ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই। তিনরাত টানা ঘুম নেই। হাতের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি গতকাল। ঘুম এতই গভীর ছিল কিছুই টের পাইনি। মাথার পাশেই পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র। মা এসে কোনোরকমে লাইট অফ করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। তবে আমার ডায়েরির একটি ছেঁড়া পাতা বুকের ওপর লেপটে ছিল। স্পষ্ট ছিল তার দাগ। মনে হচ্ছিল— সদ্য ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবী…

Categories
অনুবাদ গল্প

আসল-নকল

সংগ্রাহক: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে

ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস

[সংগ্রাহক পরিচিতি: রেভারেন্ড লাল বিহারী দে। জন্ম: ১৮ই ডিসেম্বর ১৮২৪, বর্ধমানের সোনাপলাশী গ্রামে। কয়েকবছর গ্রামের স্কুলে পড়াশুনোর পর ছোটোবেলাতেই বাবার সাথে কলকাতায় এসে ভর্তি হন, রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফের স্কুলে (এখন স্কটিশচার্চ স্কুল)। ছাত্রাবস্থাতেই খ্রীস্ট ধর্ম গ্ৰহণ। স্কুল কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতাও। আর গ্রামবাংলার জীবন সংস্কৃতি নিয়ে নিরলসভাবে রচনা করেছেন গ্রন্থ। কৃষকদের দুরবস্থা, জমিদারদের অত্যাচার নিয়ে ইংরেজিতে লিখেছেন— ‘Govinda Samanta’, ‘Bengal Peasant Life’-এর মতো গ্রন্থ। সংগ্রহ করেছেন বাংলার উপকথা। দিদিমা ঠাকুমারা যে-সব গল্প শুনিয়েছেন বংশ পরম্পরায়, সে-সব উপকথাই সংগ্ৰহ করে ইংরেজিতে প্রকাশ করলেন— ‘Folk Tales of Bengal’s’। সম্ভবত এটিই বাংলার উপকথার প্রথম কোনো সংকলন। এই গ্রন্থেরই কাহিনি— ‘The Ghost-Brahman’-এর বাংলা অনুবাদ আমি করেছি। রেভারেন্ড লাল বিহারী দে মারা যান ১৮৯২ সালে কলকাতায়।]

সে বহুকাল আগের কথা। এক গাঁয়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন। ব্রাহ্মণ কুলীন ছিলেন না। তাই বিয়ে করে সংসার পাতা তাঁর জন্য বড়ো দুঃসাধ্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণ গাঁয়ের স্বচ্ছল মানুষদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে অর্থ সাহায্য চাইতে লাগলেন, যাতে অন্তত বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করতে পারেন। বিয়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। বিয়েতে জন্য বেশি কিছু খরচ না করলেও মেয়ের বাপ মাকে কিছু অর্থ তো দিতে হবে! ব্রাহ্মণ তাই গাঁয়ের দোরে দোরে ঘোরেন, গাঁয়ের বড়ো মানুষদের তোষামুদি করে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। শেষ অবধি এদিক-সেদিক করে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় হল। তারপর এক শুভ দিনে বিবাহ সম্পন্ন করে নতুন বউকে ঘরে তুললেন। ব্রাহ্মণ তাঁর মা আর নবোঢ়াকে নিয়ে একসাথে বাস করতে থাকলেন।

কয়েকদিন বাদে ব্রাহ্মণ মাকে বললেন— ‘দেখো মা, এবার তো আমায় তোমার পাশে, বউয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। তোমাদের সুখে শান্তিতে রাখব এমন অর্থ তো আমার নেই। তার জন্য, দূর দেশে গিয়ে যা হোক কিছু কাজকম্ম করে আমি অর্থ উপার্জন করব। কয়েক বছর দূর দেশে কাটাতে হবে আমায়, যতদিন না পর্যন্ত বেশ কিছু টাকা হাতে আসে। আমার কাছে এখন যা আছে, তা তোমায় দিয়ে যাব। ততদিন এই দিয়েই কষ্টে করে চালিয়ে নাও। সেই সাথে তোমার বৌমাকেও একটু দেখে শুনে রেখো।’

তারপর একদিন মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ পথে বেরিয়ে পড়লেন। আর ঠিক সেই দিনই সন্ধ্যেবেলায় এক প্রেত হবহু ব্রাহ্মণের রূপ ধরে ব্রাহ্মণের বাড়িতে হাজির হল। নববধূ প্রেতকে নিজের স্বামী ভেবে বসল। সে তো অবাক হয়ে বলল— ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে বড়ো! এই যে বললে, কয়েক বছর তুমি বাইরে থাকবে! এত তাড়াতাড়ি মন বদলে গেল!’

ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত ইতস্তত হয়ে জবাব দিল— ‘মানে… ওই… যাত্রা করার জন্য আজকের দিনটা ঠিক শুভ নয়। তাই ফিরে এলাম আরকী! তাছাড়া হঠাৎ করে হাতে বেশ কিছু টাকাও চলে এল… তাই আর…।’

ব্রাহ্মণের মা-ও প্রেতকে নিজে ছেলে ভেবে বসলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগল না। প্রেত ব্রাহ্মণের ভেক ধরে বাড়ির কর্তা সেজে দিব্যি থাকতে লাগল— সেই-ই যেন আসল ব্রাহ্মণ। বৃদ্ধা মায়ের সন্তান, নবোঢ়ার স্বামী। ব্রাহ্মণরূপী প্রেতকে দেখতে একেবারে আসল ব্রাহ্মণের মতো। কড়াইশুঁটির দুই দানার মতো হবহু এক। আলাদা করার উপায় নেই। পাড়া প্রতিবেশীরাও তাই প্রেতকেই ব্রাহ্মণ ভেবে ভুল করল।

বেশ কয়েকবছর বাদে দূরদেশ থেকে আসল ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ঢুকেই তো তাঁর চোখ কপালে। একি! বাড়িতে হুবহু তারই মতো দেখতে আরেকজন! প্রেত দাঁত কিড়মিড় করে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করল— ‘এই, তুই কে রে! আমার বাড়িতে তোর কী দরকার! ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে উত্তর দিল— ‘আমি কে মানে! আগে বলো তুমি কে? এটা তো আমার বাড়ি। ইনি আমার মা। এ আমার বউ’।

প্রেত ব্রাহ্মণকে বলল— ‘আরে, তুই তো আজব কথা বলছিস রে! গাঁয়ের সক্কলে জানে, এ আমার বাড়ি। এরা আমার মা, বউ। বহুদিন ধরে আমরা এ গাঁয়ে আছি। আর তুই আজ কোত্থেকে এসে এমন ভান করছিস, যেন এটা তোর বাড়ি, এরা তোর মা আর বউ! তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রে ব্রাহ্মণ! যা যা, দূর হ এখান থেকে!’ এ-সব বলে প্রেত ব্রাহ্মণকেই তাঁর নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।

এমন অদ্ভুত ঘটনায় ব্রাহ্মণ বাক্যহারা হয়ে গেলেন। এখন কী করা উচিত, হতবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ভেবে কূল পেলেন না। শেষ অবধি ভেবেচিন্তে রাজার কাছে গিয়ে ব্রাহ্মণ সব ঘটনা খুলে বললেন। রাজা ঘটনার বিচার করতে এলেন। ব্রাহ্মণ আর ভেকধারী প্রেত দু-জনকে দেখেই রাজা অবাক বনে গেলেন। যেন দুই হবহু প্রতিলিপি। কী করে এ-দ্বন্দ্বের তিনি মীমাংসা করবেন সত্যিই তিনি কিছু ভেবে পেলেন না।

ব্রাহ্মণ দিনের পর দিন রাজার কাছে সুবিচারের আশায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। তাঁর বাড়ি ঘরদোর, বউ আর মাকে ফিরে পাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে, রাজাকে কত করে অনুরোধ করেন। রাজা ব্রাহ্মণকে কী বলে শান্ত করবেন বুঝে পান না। রাজা তাই প্রতিদিনই বলেন— ‘কাল এসো, দেখছি’। ব্রাহ্মণও প্রতিদিন রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে থাকেন— ‘কলির কাল! আমাকেই কি না আমার বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া হল! অন্য একটা বাইরের লোক আমার ঘরদোর স্ত্রী সবকিছু দখল করে নিল… হে ভগবান… আর রাজাই-বা কেমন! প্রজাদের সুবিচার দিতে পারেন না? আমার কপাল পুড়ল…’।

ব্রাহ্মণ প্রায় প্রতিদিনই রাজার দরবার থেকে বেরিয়ে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে পথ চলেন। পথের মধ্যে একটা ছোট্ট মাঠ পড়ে। সেই মাঠে একদল রাখাল ছেলে খেলে বেড়ায়। গোরুগুলোকে চড়তে দিয়ে, একটা বড়ো গাছতলায় জটলা করে রাখাল ছেলেরা খেলা করে। বড়ো অদ্ভুত তাদের খেলা। ছেলেদের মধ্যেই কেউ সাজে রাজা, কেউ হয় মন্ত্রী, কেউ আবার হয় কোতোয়াল। রাখাল ছেলেরা প্রায় প্রতিদিনই ব্রাহ্মণকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখে।

যে-ছেলেটি রাখালদের রাজা, সে একদিন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল— ওই ব্রাহ্মণ প্রতিদিন কাঁদেন কেন? মন্ত্রী, তুমি কিছু জানো? মন্ত্রী ছেলেটি কিছু জানত না এ-ব্যাপারে। তাই উত্তর দিতে সে অপারগ। তখন রাখাল রাজা একজন কোতোয়ালকে নির্দেশ দিলেন, ব্রাহ্মণকে তার সামনে হাজির করতে। একজন কোতোয়াল তখন ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বলল— ‘আমাদের রাজা একবার এক্ষুণি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান’। ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে— ‘কেন কী ব্যাপার! এই তো রাজামশাইয়ের কাছ থেকে এলাম। উনি তো আমায় আগামীকাল আসতে বলে ভাগিয়ে দিলেন। এখন আবার আমায় ডাকছেন কেন?’

কোতোয়াল বলল— ‘না না রাজামশাই নন। এ আমাদের রাখাল রাজা।

ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বলল— ‘রাখাল রাজা! তিনি আবার কে? বলছ যখন, চলো গিয়েই দেখি’।

ব্রাহ্মণ রাখাল রাজার কাছে এলেন। রাখাল রাজা ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর প্রতিদিন এভাবে কাঁদার কারণ জানতে চাইল। ব্রাহ্মণ সবিস্তারে তাঁর দুঃখের কথা জানালেন রাখাল রাজাকে।

রাখাল রাজা সব কিছু শুনে বলল— ‘হুম। বুঝতে পেরেছি কী সমস্যা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি নিশ্চয়ই নিজের সব কিছু ফেরত পাবেন। আপনি শুধু রাজামশায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসুন, উনি যাতে আপনার এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমাকে দেন’।

ব্রাহ্মণ আবার গেলেন রাজামশাইয়ের কাছে। রাজমশাইকে অনুরোধ করলেন, রাখাল রাজাকে তাঁর এই সমস্যা সমাধানের অনুমতি দিতে। রাজামশাই এমনিতেই ব্রাহ্মণের এই বিচিত্র সমস্যার সমাধান নিয়ে তিতিরিক্ত ছিলেন। তাই ব্রাহ্মণের অনুরোধে কোনো আপত্তি করলেন না।

ঠিক হল, আগামীকাল সকালেই এই সমস্যার নিষ্পত্তি করা হবে। রাখাল রাজা সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল। সে এক বুদ্ধি বার করল।

পরের দিন সকালে রাখাল রাজা হাজির হল। সঙ্গে সরু মুখের ছোট্ট একটা শিশি। ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণের রূপধারী প্রেত দু-জনই রাখাল রাজার বিচার সভায় উপস্থিত। রাখাল রাজা সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখল। পাড়া প্রতিবেশীদের কথাবার্তাও শোনা হল। তারপর রাখাল রাজা বলল— ‘ব্যস, অনেক কথা শুনলাম। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। এবার এক্ষুণি এ-সমস্যার নিষ্পত্তি করব। আমার হাতে এই যে-ছোট্ট শিশিটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন, দু-জন বিচারপ্রার্থীর মধ্যে যিনি এই শিশির ভেতর ঢুকতে পারবেন, আমার আদালত তাকেই সমস্ত সম্পত্তির প্ৰকৃত অধিকারী বলে ঘোষণা করবে এবং তিনিই হলেন আসল ব্রাহ্মণ। এখন দেখা যাক, কে এর মধ্যে ঢুকতে পারে’।

রাখাল রাজার এমন বিচারে ব্রাহ্মণ হতভম্ব হয়ে গেলেন। দুঃখ করে বললেন— ‘নাঃ… রাখাল রাজা, তুমি সত্যিই ছেলেমানুষ। এ না হলে কেমন বিচার! এইটুকু শিশির ভেতর কোনো মানুষ কি ঢুকতে পারে?’

রাখাল রাজা নির্বিকার কণ্ঠে বলল— ‘ও, আপনি তাহলে এর মধ্যে ঢুকতে পারবেন না? ঠিক আছে। আপনি যদি এর ভেতর ঢুকতে না পারেন, তাহলে সম্পত্তি, বাড়িঘর কোনো কিছুই আপনার নয়’।

‘আপনি কি পারেবন?’ প্রেতকে জিজ্ঞেস করল রাখাল রাজা। ‘যদি আপনি পারেন, তাহলে প্রমাণিত হবে, সম্পত্তি বাড়ি ঘর, স্ত্রী, মা সব আপনার। আপনিই আসল ব্যক্তি’।

রাখাল রাজার প্রস্তাবে, প্রেত একগাল হেসে বলল— ‘এ আর এমন কী! এ তো আমার বাঁ-হাতের খেলা’।

পরমুহূর্তেই সবাই দেখল, প্রেতের শরীর ছোটো হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

হতে হতে একটা ক্ষুদ্র কীটের মতো আকার ধারণ করল। তারপর টুক করে ঢুকে গেল শিশির ভিতর। আর রাখাল রাজা সঙ্গে সঙ্গে শিশির মুখে শক্ত করে ছিপি এঁটে দিল। ছিপির ভিতর আটকা রইল প্রেত।

রাখাল রাজা শিশিটা ব্রাক্ষণের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— ‘যান, এই শিশিটা এবার ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে সুখে বাস করুন’।

এরপর ব্রাহ্মণ নিজের বাড়িতে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। সন্তান-সন্ততিতে তাঁর সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
“আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়োলো।।”

Categories
গল্প

দীপ্তেন্দু জানার গল্প

ইমলি টোটো

এই নিয়ে কম টিটকিরি তো শুনতে হয়নি! এমনকী পাড়া-প্রতিবেশীরা চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও ছাড়েনি! আর বলবে না-ই-বা কেন? নিজের আত্মীয়-স্বজনরাই যখন বিষয়টাকে ভালো চোখে দ্যাখেনি, তখন বাইরের লোকেরা তো দু-পাঁচ কথা বলবেই।

Categories
গল্প

রঙ্গন রায়ের গল্প

স্বর্গের চেয়ে বড়ো

নাক বরাবর স্বর্গ।

কামারপাড়ার রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলেই পৌঁছনো যায়। ডায়ে বাঁয়ে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা লাগাল গণেশ। সবাই বলে স্বর্গে পৌঁছনো সোজা কথা নয়। অনেক পুণ্যি করতে হয়। গণেশও আজ সাত দিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে, সত্যিই স্বর্গে পৌঁছনো সোজা কথা নয়, তার জন্য শুধু পুণ্যি না, বুকের পাটা আর ট্যাকের জোরও লাগে।

Categories
গল্প

মুক্তিপ্রকাশ রায়ের গল্প

দাগ

অমল গোমড়া মুখে বসে ছিল। দেওয়ালে একটা হিজিবিজি দাগের দিকে তাকিয়ে। দেখলেই বোঝা যায় কোনো বাচ্চা প্যাস্টেল হাতে ইচ্ছেমতো ইকড়ি-মিকড়ি কেটেছে। আধুনিক কোনো সমালোচকের কাছে অ্যাবস্ট্রাক্টস চিত্রকলা হিসেবে এর কদর হতে পারে;

Categories
গল্প

শান্তনু ভট্টাচার্যর গল্প

হেমন্তের জোছনাবেলা

তিনি: এ-ক-শো বছর! এই একশো বছরে পৃথিবীতে কী কী হতে পারত বলে আপনার মনে হয়, যেগুলো হয়নি?

আপনি: এই গ্রহের সব মানুষ ক্রমশ দীর্ঘ হতে-হতে শেষে দৈত্যাকৃতি হয়ে উঠতে পারত, অথবা সবাই ধীরে ধীরে খর্বাকৃতি হতে-হতে শেষ অবধি হয়ে পড়তে পারত একেবারে পোকাতুল্য।… কোনো এক কারণে মনের আনন্দে সব মানুষ এমন হেসে উঠতে পারত, যে-হাসি একশো বছরেও থামত না, কিংবা কোনো নিদারুণ দুঃখে প্রত্যেকটা মানুষ এমন কেঁদে ফেলতে পারত, যে-কান্না থামত না একশো বছরেও! তারপর…

তিনি: তারপর?

আপনি: দেখুন, যে-শব্দটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না, সেই ‘তারপর’ শব্দটাই আবার এসে গেল। ‘এসে গেল’ বলাটা ভুল; এসে যাচ্ছে, এসে যায়! সত্যি বলতে কী, শব্দটাকে আমি এখনও ভীষণ ঘৃণা করি।

বাতাস বইছে। সিক্ত বাতাস। বাতাসে মিশে আছে কুয়াশা। এমন বাতাস নদীর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। হয়তো অনেক বছর আগে এখানে একটা নদী ছিল। গলায় গান নিয়ে সে-নদীর বুকে নৌকো বেয়ে যেত মাঝিমাল্লারা। কুয়াশা জড়ানো ভিজে বাতাস বয়ে যেত নদীর ওপর দিয়ে। সেই নদীটা এখন নেই। কিন্তু সেই নদী-বাতাস রয়ে গেছে এখনও!

তুমি: ঠিক কোন সময়ে আপনি চেয়ারের গুরুত্ব বুঝেছিলেন, আজ তা মনে আছে?

আপনি: সালটা মনে নেই। ওটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। তবে তারিখটা মনে আছে— ৩৩শে ফেব্রুয়ারি।

তুমি: ফেব্রুয়ারি মাসের ৩৩ তারিখ!

আপনি: বোকার মতো অবাক হয়ো না। অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় এটা নয়। ফেব্রুয়ারি মাসটা নিয়ে কখনো ভেবেছ! সবচেয়ে ছোটো এই মাসটা, অথচ কী সুন্দর! সেই সুন্দর মাসটাকে অহেতুক ছোটো করে রাখা হয়েছে। মানুষের তো এটা বিরাট ভুল! আমি সেই ভুলটা সংশোধন করেছি, পরের পাঁচটা মাস থেকে একটা করে দিন টেনে এনে। তোমাকেও বলছি, ভুলটা সংশোধন করার চেষ্টা করো।

তুমি: এই ভুল-সংশোধনের সিদ্ধান্তটা কি ওই কালো চেয়ারে বসে নিয়েছিলেন?

আপনি: আজ আর তা মনে পরে না, জানো— চার দেওয়ালের মধ্যে বসে, নাকি খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে নিয়ে ফেলেছিলাম ওই মূল্যবান সিদ্ধান্তটা। তবে, আশ্চর্যজনকভাবে এটা মনে আছে, যখন সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, তখন আমার গায়ে একটা চাদর জড়ানো ছিল। যদিও সে-দিন শহরে খু-ব শীত ছিল কি না, আজ আর তা মনে নেই। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, গায়ের সেই চাদরটা ছিল লাল রঙের। মৃত্যুর সময় লেনোর মুখ থেকে যে-লাল রঙের রক্ত বেরিয়ে এসেছিল, সেই লাল!… লেনোর মৃত্যুতে আমার মনে এখন আর কোনো শোক নেই, তবে আক্ষেপ আছে— আমার আক্ষেপ ওর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ওই রক্তটুকু নিয়ে। ওই কয়েক ফোঁটা রক্ত না-বেরিয়ে এলে আমি ওর শরীরটা ওষুধ মাখিয়ে রেখে দিতাম একটা কাচের বাক্সে। সবাই এসে দেখত। একটা ইতিহাস নির্মাণ হত!

তুমি: ইতিহাস ছাড়া মানুষ আর ঠিক কী কী নির্মাণ করতে পারে?

আপনি: মানুষ আদপে কোনো কিছুই নির্মাণ করতে পারে না‌। অনেক কিছু নির্মাণের চেষ্টা করে এবং অনিবার্যভাবে ব্যর্থ হয়। তার চরম ব্যর্থতা ইতিহাস নির্মাণে, কারণ ওই কাজে মানুষের চেষ্টা সবচেয়ে বেশি।… শুধু দুটো সত্য সে ঠিকঠাক নির্মাণ করে— প্রথমত, একটা দিন ও দ্বিতীয়ত, একটা রাত। অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষ এই নির্মাণ-কৌশল আয়ত্ত করেছে। অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে মানুষ তো বুঝে ফেলেছে, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দিন-রাত্রি নির্মাণের এই কৌশল আয়ত্ত না করে তার আর কোনো উপায় নেই!

তুমি: দিন ও রাত!… আচ্ছা, দিন-রাতের সর্বোত্তম সংজ্ঞাটা কি আপনি খুঁজে পেয়েছেন, কিংবা চেষ্টা করেছেন নিজে নির্মাণ করতে?

আপনি: না। খুঁজেও পাইনি, নির্মাণের চেষ্টাও করিনি। ব্রজ বসু মানা করেছিলেন। বলেছিলেন, দিন-রাতের সংজ্ঞা নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। এতে জীবন দগ্ধ হবার সম্ভাবনা আছে— এ-কথা শোনার পর আমি আর এগোইনি।

তুমি: ব্রজ বসু! আপনি যাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সময় বদলের সংকল্প করেছিলেন?

আপনি: হঁ— তবে সময় বদলের নয়, সময়কে ছোঁয়ায়। এবং তা সংকল্প নয়, তা ছিল প্রকল্প!

তুমি: প্রকল্প?

আপনি: প্রকল্প। প্রজেক্ট। মানুষ খুঁজে, তার দাম মেপে, দামের মূল্যে স্থান নির্ধারণ করে, সময়কে ছুঁয়ে দেখার অতি বৈজ্ঞানিক এক প্রকল্প।

বাতাস বইছে। উষ্ণ বাতাস। বাতাসে লেগে আছে তাপ। এমন বাতাস মরুভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বহু যুগ আগে হয়তো এখানে ছিল এক মরুভূমি! বেদুইনদের ক্ষিপ্র পদক্ষেপে বালি উড়ত এখানে। তাপ লেগে থাকা উষ্ণ বাতাস বয়ে যেত মরুতলের ওপর দিয়ে। এখন সেই মরুভূমি নেই। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে সেই মরু-বাতাস!

: আমরা এখন ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি বলো তো?

: আমরা তো দাঁড়িয়ে নেই।

: তাহলে কি আমরা হাঁটছি?

: জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় পর্ব— হাঁটা। হাঁটা মানেই তো কোনো এক গন্তব্য! এখন প্রশ্ন, কোথায় সেই গহিন গন্তব্য-বলয়?

: আমরা কি গন্তব্য হারিয়ে ফেলেছি?

: আমাদের কি এমন কোনো গন্তব্য ছিল, যা হারিয়ে গেছে?

: হয়তো ছিল এক ধ্রুব-গন্তব্য! ছিল এক দিক, এক দিশা!

: কিংবা ছিল শুধুই এক মেঘচিহ্ন!

: চিহ্ন! চিহ্নটাই রয়ে যায়।

: শেষ অবধি চিহ্নটাও থাকে না। চিহ্নটা মুছে গিয়ে রয়ে যায় একটা ক্ষত।

: ক্ষতটা মোছে না!

: ঠিক। ক্ষতটা মোছে না সময়ের বুক থেকে, মানুষের মন থেকেও না।

: এই ক্ষত ধারণ করে রাখার জন্য আমরা কি আমাদের মনটাকে অনেক আগেই মজবুত ধাতবে নির্মাণ করে নিয়েছিলাম?

: তুমি খুব সুন্দর করে ‘নির্মাণ’ শব্দটা উচ্চারণ করলে। শব্দটাকে আমরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছি না, তাই-না!

: আমরা কি আমাদের সেই মনটাকে আজ আর ছুঁয়ে দেখতে চাই না?

: কী পদ্ধতিতে আমরা আমাদের জীবন, আমাদের সময়, আমাদের চারপাশ, এবং আমাদের সেই মনটাকে নির্মাণ করেছিলাম, তা তোমার মনে পড়ে?

: মনে পড়া— মানে স্মৃতি!… তা যদি বলো, তাহলে বলতে হয়, হ্যাঁ, কিছু স্মৃতি সংগ্রহে আছে বটে; বহু কষ্টে, চেষ্টায় আগলে রেখেছি। বলতে পারো, লুঠ হবার ভয়ে ভরে রেখেছি গুপ্ত সিন্দুকে।

: খুব দামি একটা কথা বললে— এটা আমিও অনুভব করছি যে, একটু একটু করে আমার স্মৃতি লুঠ হয়ে যাচ্ছে। আমি প্রতিহত করতে পারছি না লুঠেরাদের। বুঝতে পারছি, ক্রমশ গরিব হয়ে যাচ্ছি আমি।… একটা গুপ্ত সিন্দুক আমাকেও সংগ্রহ করতে হবে, এখনও রয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে আগলে রাখতে।

: লুঠেরাদের চিনতে পারছ তুমি?

: হ্যাঁ, সবাইকে চিনি আমি। আমার প্রত্যেকটা সাফল্যকে যারা সবচেয়ে আগে কুর্ণিশ জানায়, আমার প্রত্যেকটা দুঃখের ওপর যারা মাখিয়ে দেয় সান্ত্বনার প্রলেপ, যারা উৎসাহের উষ্ণতা দেয় আমার প্রত্যেকটা ব্যর্থতার গায়ে, আমার প্রত্যেকটা ভুলকে যারা স্বীকৃতি জানায় ভবিষ্যতের আগাম পন্থা বলে, আমার প্রত্যেকটা বিপন্নতাকে যারা মুছে দেয় সাহস যুগিয়ে, তারাই একটু একটু করে লুঠে নিচ্ছে আমার মহার্ঘ স্মৃতিগুলো।

: সেই চিহ্নটা আবার ফিরে আসছে— যাকে ‘গন্তব্য’, কিংবা ‘দিক’, বা ‘দিশা’, যা-ই বলো! মানুষ যত সেদিকে এগোয়, ততই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় তার প্রতিপক্ষরা। অধিকাংশ সময়েই সাফল্যের নেশায় ও দৌড়ানোর ক্লান্তিতে সে চিনতে পারে না, তারা কে কাছের, কে দূরের‌।

: আসলে কিছু মানুষ, কিংবা হয়তো সব মানুষই, তার গন্তব্যটা নির্ধারণ করতে পারে না— দিক খুঁজে পায় না চলার পথে— দিশা হারিয়ে ফেলে হাঁটতে-হাঁটতে। বুঝতেই পারে না, একটা মেঘচিহ্নকে খোঁজার চেষ্টায় তার জন্য বরাদ্দ সময়টাকে সে ক্রমশ ক্ষয় করে ফেলছে তার নিজের হাতে। গন্তব্য, দিক, দিশা বলে সম্ভবত কিছু হয় না! এটা নিছকই এক অলীক মাইলস্টোন, যার পরেও অনন্ত হাঁটাপথ।

বাতাস থেমে গেছে। ভুল বলা হল— থামেনি, অন্য ধারায় বইছে। অচেনা ধারায় বয়ে চলা এ-বাতাস এক অদৃশ্য বর্ণ বহন করে— এই জাফরানি-বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি আমি। ত্বকের ওপর এমন এক অনুভূতি হচ্ছে, যা আগে কখনো হয়নি বলেই মনে হয়।

এখন আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, কীসের গন্ধ বলো তো?

তুমি হয়তো বলবে, বারুদের।

সম্ভবত আমি তখন হতাশ হব; বলব, ইস, দেখেছ, এই চেনা গন্ধটাও আমি বুঝতে পারিনি!

বুঝতে না-পারার ব্যর্থতা থেকে বোধহয় আমি তখন চুপ হয়ে যাব। আমার নীরবতা নিশ্চুপ করে দেবে তোমাকেও। থেমে যাবে আমাদের যাবতীয় বিশুদ্ধ আলাপন।… ভুল বলা হল, থামা নয়— অসমাপ্ত রইবে। ‘থামা’ শব্দটা ভালো নয়, ‘অসমাপ্ত’ কথাটার মধ্যে একটা সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে, যার রং সোনালি। সোনালি সম্ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আরও তিনটি শব্দ— ক্ষমতা, আধিপত্য, এবং প্রেম।

বড়ো রহস্যময় এই শেষ শব্দটি! এটা নাকি প্রাণীদেহের এক বিশেষ অনুভূতি, যা মস্তিষ্কের গোপন অন্ধকারে ছড়িয়ে থাকা সূক্ষ্ম কোষের ভেতর অবিরত বয়ে চলা লাল রক্তে মিশিয়ে দেয় সাদা কুয়াশা। মনোবিকারের তা নাকি এক চূড়ান্ত পর্ব!

প্রেমকে বরং বাদ দেওয়া যাক। এই মহাপৃথিবীতে কত যুদ্ধ হয়ে গেছে প্রেমকে কেন্দ্র করে, আর যুদ্ধ মানেই তো বারুদ!… বারুদের গন্ধ বাতাস বইতে পারে না— আমরা, স্বপ্নবাহী নীল মানুষেরা ‘ক্ষমতা’ আর ‘আধিপত্য’ শব্দ দুটোকে বহন করতে-করতে এটা তো খানিকটা বুঝেছি— কী বলো?

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

শান্তনু ভট্টাচার্যর গল্প

হেমন্তের জোছনাবেলা

বাতাস বইছে। জোলো বাতাস। বাতাসে মিশে আছে শীত। এমন বাতাস সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। হয়তো বহু যুগ আগে এখানে কোনো সমুদ্র ছিল! সেই সমুদ্রের বুকে নিয়ত জেগে থাকত প্রবল ঢেউ,

Categories
গল্প

সুজয় পালের গল্প

মনশোকরহিতা

“প্রত্নকীর্তিমপাবৃনু” এটি আমাদের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মোটো বা নীতিবাক্য; আপাবৃনু অর্থে উন্মোচন বোঝায়, আর আমি ঘরে বসে বসে এইসব ‘আগডুম বাগডুম’ ভাবছি। এই শব্দটার সাথে মনে পরে গেলো ছেলে ভোলানো ছড়াটার কথা— “আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাল মৃদঙ্গ ঘাগর বাজে। বাজতে বাজতে চলল ঢুলি, ঢুলি গেল ওই কমলাফুলি”… তারপর কিছু একটা ‘বিয়েটা’ ছিল মনে পরছিল না, আর সাথে সাথে মনে পড়ল ভারতীয় জাদুঘরের গ্রন্থ বিভাগের গ্রন্থাগারিক সচিব ডঃ দেবনাথ স্যারের কথা। তিনি আমাকে এই ছড়াটার ব্যাখ্যা করেছিলেন।
শাশাঙ্কের পরে গৌড়ের দায়িত্ব নেন পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধন ও কামরূপের বর্মনরাজ শ্রীকুমার ভাস্করবর্মন কিন্তু রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে তাঁদের নিজস্ব রাজধানী অনেক দূরে থাকায় সম্পূর্ণ শাসন ব্যাবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে, এই মাৎস্যন্যায় কালে প্রথমে বঙ্গ অধিকার করে খর্গরাজারা তারপর শক্তভাবে সিংহাসনে বসেন পালরাজা গোপাল আনুমানিক ৭৫০ সালে, ধর্মপাল ও দেবপালের সময় কীভাবে কনৌজ অধিকার করে পাল রাজারা সেটা আমরা সবাই খুব ভালো মতোই জানি। পরবর্তী সময়ে বংশ গৌরব ক্রমশ শিথিল হয় আর অন্তর্দ্বন্দ্ব তুমুলে ওঠে দ্বিতীয় মহীপালের সময় আনুমানিক ১০৭২ সালে। পশ্চিমের বারেন্দ্রভূমী দখলের সাথে মল্ল রাজাদের চাপ ও বাড়তে থাকে তাই রাজধানী কানসোনা থেকে কামরূপের কাছে আত্রেয়ী ও তিস্তা নিদী ঘেরা দোয়াব অঞ্চলে ডোমনে স্থানান্তরিত করেন, ইতিমধ্যে কামরূপে বর্মণ রাজাদের সরিয়ে রাজত্ব চালাচ্ছে পৌরাণিক নরকাসুর বংশভূত ম্লেচ্ছ বংশীয় রাজারা অর্থাৎ এই অঞ্চলে রাজধানী অনেক বেশি সুরক্ষিত। বর্তমান বাংলাদেশের আসাম লাগোয়া উত্তরের জেলায় নীলফামারীর একটি উপজেলার নাম ডোমার, এরই আগের নাম ছিল ডোমন নগর। সন্ধাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’ গ্রন্থে দেখতে পাই কীভাবে দ্বিতীয় মহীপাল সামরিক গৌরবে স্বল্পকালীন রাজত্ব করেছিলেন; ডোমন রাজ্যের সৈন্যদের বলা হতে ডোম সৈন্য যার বলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন নিজেরই ভাই রামপালের বিরুদ্ধে, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। সমগ্র পালবংশের রাজা হন রামপাল। এই ডোম সৈন্যদের সাহায্যে তিনি মল্লরাজ প্রকাশমল্ল ও সেনরাজ বিজয়সেনকে বহুবার পরাজিত করেছিলেন। কোনো কোনো গবেষক অনুমান করেন ছড়াটিতে ওই ডোম সৈন্যদের শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ‘আগডুম’ অর্থাৎ যে ডোমসৈন্য বাহিনী সবার আগে যায়, ‘বাগডুম’ হল যুদ্ধ কৌশলে সহজে বাগ মানাতে পারা সৈন্যদল, আর ‘ঘোড়াডুম’ হলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ডোমসৈন্য। সঙ্গে বাজে তিন ধরনের যুদ্ধবাদ্য—ঢাক, মৃদঙ্গ এবং ঘাগর বা ঝাঁঝর। মধ্যযুগের ধর্মমঙ্গলেও ডোম সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

ছেলে ভোলানো ছড়াতে প্রথম ছত্র দু-টিতে বেশ একটা বীরত্বের ছোঁয়া লেগে আছে, কিন্তু পরের ছত্রগুলো কিছু উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হয় দুটো পৃথক ছবিকে কেটে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে ছায়াচ্ছন্ন মোহময় এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে, তবেই না ছেলে ভুলবে। পালরাজাদের কীর্তির কথা চিন্তা করতে গিয়ে মনে পড়ল; পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ আর তাঁদের সুবর্নযুগে তৈরিহয়েছিল অসংখ্য বৌদ্ধবিহার ও মঠ। রাজা ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের এক মহান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ওদন্তপুরী মঠ ও বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের একটি মহান শিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে বিকশিত হয়েছিল। তাঁর সময়েই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বিখ্যাত সোমপুরা মহাবিহার যা ভারত ভূখণ্ডের সর্ব বৃহৎ বিহার হিসাবে আজও অধুনা বাংলাদেশের নওগাঁ জেলা পাহাড়পুরে বর্তমান। এই সময়ে আমরা পেয়েছিলাম বিখ্যাত বৌদ্ধ মহাগুরু চুরাশী-মাহাসিদ্ধগণকে যাঁদের সান্ধ্য ভাষায় লেখা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ও ডাকার্ণব আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়েছিলাম। আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে বঙ্গপ্রদেশে মাহাসিদ্ধ মহাগুরু সরহ পা নালন্দা থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে এক অভিনব বৌদ্ধদর্শন মতবাদ প্রবর্তন করেন যা বর্তমানে বজ্রযানদের মাহামুদ্রা হিসাবে বহুল প্রসিদ্ধ।

ইত্যাদি চিন্তনের মাধ্যমে বজ্রের ন্যায় প্রত্যুৎপন্নমতিতে মাথায় এল দেবী মূর্তির মুকুটে ওই যোগীমূর্তির কথা, একহাত কোলে রেখে অন্য হাতে তিনি বরমুদ্রা প্রদর্শন করছেন, তিনি যে কোন সাধারণ যোগী নন; স্বয়ং ধ্যানীবুদ্ধ আমোঘসিদ্ধি। কথাটা মনে পড়তেই আমার মানসপটে এক এক করে সব পরিষ্কার হতে থাকল। দেবী মূর্তির সামনের মুখ্য দুই হাতে বজ্রহুংকার মুদ্রায় অবশ্যই ছিল বজ্র ও পাশ, আর অন্য ভগ্ন হাতে ছিল মন ও দেহ শোক হরণকারী অশোকমঞ্জরী, দেবীর পোষাকের ওইগুলো ময়ূরের পালক নয় বরং গভীর শিরাবিন্যাসযুক্ত পাতা, দেবীর পদতলে থাকা ওই মানুষের অবয়ব হল বিঘ্ন-মারি, তিনি বহুল প্রসিদ্ধ আমোঘসিদ্ধি কুলজাত দেবী পর্ণশবরী।
তৎকালীন সময়ে দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্তিপেতে সঙ্ঘে দেবীর উচ্চাঙ্গ মন্ত্রপাঠ ও বহুল ভেষজ সমিধ-সহ হোম করা হত, মনে করা হয় মন্ত্রের কম্পাঙ্ক ও হোমের ধোঁয়াতে পরিশুদ্ধ হত বায়ুমণ্ডল। বয্রযানের গঠনমূলক সময়ে বহু বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবতার বিকাশ হয় বঙ্গভুমে সাথে অজস্রও মূর্তিও খোদাই হয় বিভিন্ন বিহারের উপাসনা ও সৌন্দর্যায়নের নিমিত্তে। আর সাথে এটাও সিদ্ধান্তে এলাম ওই লিপি কূটাক্ষর না বরং বৌদ্ধআদি লিপি-সিদ্ধমাতৃকা, যার প্রচলন সুদূর সময়ে চলেছিল শুধু জ্ঞানসিদ্ধ সংরক্ষণের জন্য। অচিরেই মানচিত্র দেখে বুঝলাম প্রাপ্তিস্থল থেকে খুব কাছে আছে সেই বিখ্যাত সোমপুর মহাবিহার। নির্বিঘ্নে পায় হেঁটে দু-দিনেই চলে আসার মতো পথ, তৎকালীন যুগে খুব একটা অসুবিধার ছিল বলে মনে হয় না। তবে কি সেখান থেকেই দেবিমূর্তিকে কেউ নিয়ে এসেছে? যা অতি গোপনে পূজিতা হয়েছিলেন কোনো গুপ্তসিদ্ধগণ দ্বারা। অনুমান করতে দ্বিধা হয় না যে আনুমানিক ১১৬০ সালের দিকে বল্লাল সেন পালরাজাদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করেছিলেন হিন্দুদের সাহায্যে, আর সাথে চলেছিল বৌদ্ধবিহারের সাথে অসহিস্নুতা, সম্ভবত এরম কোন সময়ে ওই মূর্তি কালের গ্রাসে চলে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ হিন্দু শীতলা দেবীর সাথে দেবী পর্ণশবরীর সামঞ্জস্যতা খুঁজে পান, মহামারির কালে শীতলাপুজার লগ্নে অপ্সরা রূপে দেবীর আগমন কি শুভ হেতু?

আজ এই অতিমারির দিনে যখন মানুষ তাঁর স্বাবাবিক সত্তাকে অস্বীকার করে ক্রমশ নিম্নপথে সমাজস্রোতের বিপক্ষে ছুটে চলেছে, শিক্ষার তকমা অশিক্ষিতদের কাছে হার মানছে, বিজ্ঞান যখন অজ্ঞতার বশীভূত, অযোগ্য যখন যোগ্যপদে আভিষিক্ত, সামাজিক দায়িত্ব যাঁদের হাতে তাঁরা নাট্যমঞ্চের কুশীলব সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের কি? উচিত না নতুন করে পৃথিবীটাকে নতুন চিন্তায় সুন্দর করে তুলি! কিন্তু সেই আমি নির্বিকার— ক্রমশ নিজের অস্তিত্বকে আলোকভেদী জলের মতো মনে করি; প্রদত্তপাত্রের আধারের আকৃতি ধারণ করি, আর বিশেষ আধারের অনুপস্থিতিতে ঘনীভূত হয়ে আত্মকেন্দ্রিক গোলক রচনা করি।

প্রথম পাতা

Categories
গল্প

সুজয় পালের গল্প

মনশোকরহিতা

মেট্রো করে বাড়ি ফেরার পথে খেয়াল করলাম জনসংখ্যা অনেকটাই কম, সম্ভবত এই ভরদুপুর বলে, ইতিমধ্যে কানে এল ভাইরাস সংক্রমণের সতর্কীকরণ ঘোষণা। শরীরের সমতাপমাত্রা যুক্তজলে স্নান করলে যেমন শরীর বোঝে না ঘটনাটা, তেমনই আমিও বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত বা না। বাড়ি এসে যথারীতি সবাই মশগুল পিসির বাড়ির পুজো নিয়ে গপ্প করতে, আমাদেরও গৃহদেবতা শীতলা আর তাই নিয়ে বাবা মা দু-জনেই গল্পের পসরা খুলল খেতে বসে। ঈশ্বর কী অদ্ভুত জিনিস, তার চিন্তাতে লোকে বাস্তব থেকে কতটাই না কল্পনার জগতে চলে যেতে পারে, এতক্ষণে কেউ প্রশ্ন করল না কেমন হয়েছে ইন্টার্ভিউ, যাকগে, যা হয় মঙ্গলের জন্যই হয়।

আমার কিন্তু একটা মঙ্গল হয়েছে, সরকার থেকে জানিয়েছে সামনের দুই সপ্তাহ ছুটি, বড়ো আপসোস হল দু-দিন আরও কাটিয়ে আসলে ভালো হত, আগামী রবিবার তো বন্ধই থাকবে সব; তারপরে আসলে ওই মূর্তিটা আবার খুঁটিয়ে দেখতাম। মূর্তির কথা মনে পরতেই মোবাইল খুলে ভালো করে দেখছিলাম, পোষাল না কম্পিউটারে ছবিটা বড়ো করে দেখলাম। ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ছবিটা কিছু বিশিষ্ট লোকজনকেও পাঠালাম, যারা এইসব নিয়ে পড়াশোনা করে। নিউজ-ফিডে আবার সতর্কবার্তা ভেসে এল, সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও।
এখন সারা ভারতবর্ষব্যাপী বনধ্ ঘোষণা হয়েছে, তবুও বিক্ষিপ্ত জনসংখ্যা চারদিকে বেরিয়ে পড়ছে ইতস্তত, পুলিশ নাজেহাল সামলাতে, সাধারণ মানুষ নির্বোধের মতো আচরণ করছে, দীর্ঘ কর্ম ব্যাস্ততার মাঝে হটাৎ করে একটা এত বড়ো শূন্য সময় পেয়ে বস্তুত সবাই গুলিয়ে ফেলেছেন রোজনামচার সূচিপত্র। এই সময়টা নিজের ঘরে থেকে খুব কাছ থেকে নিজেকে চেনার, এই সময়টা নিজের ঘরে থেকে নিজের অতীতকে আবার ফিরে পাওয়ার, এই সময়টা নিজের ঘরে থেকে যাবতীয় পূর্বত্রুটি সংশোধনের, একমাত্র; এই সময়টাই নিজের ঘরে থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের মঙ্গলার্থে, খুব সাধারণ কথাগুলো কেউ বুঝতেই চাইছে না। চারদিকে বেড়ে চলেছে রাশি রাশি মৃত্যু, আমারা যেন এখন পালন করছি এক অদৃশ্য মৃত্যুচক্রের ব্রত। সত্তার দুই দিক; জন্ম ও অজন্ম, চিরকাল তারা হরিহর আত্মা হয়ে মিলে মিশে আছে; মৃত্যু শুধু তাদের মেলবন্ধন করে।

এখন বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় লাগছে। আবার বাইরের কেউ বাড়িতে এলেও ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকছি আমরা। সব যোগাযোগ বন্ধ, এই বুঝি সংক্রমিত হয়ে পড়লাম! এই আতঙ্কে কাটছে কিছুদিন ধরেই। কত রকম হোমিওপ্যাথি, ভেষজ, টোটকা, কবজ মাদুলি বা কোনো বিশিষ্ট জ্ঞানীদের বিশেষ নিরাময়য় পদ্ধতি দেখে খুব রাগ তারপর দুঃখ ও অন্তে মায়া হল, মনে মনে বললাম ‘মূর্খ ভারতবাসীও আমার ভাই’।
বিজ্ঞানের কি অগ্রগতি বা অজ্ঞগতি এইসবের আগে দরকার সামাজিক শিক্ষা; মানুষ মানুষকে মানুষ বলে চিনবে, থাকবে সামাজিক সাম্য। কোথায় এ-সব, এর মধ্যেই সাম্প্রদায়ীকতার তকমা লেগে গেল রোগের মধ্যে। আমাদের বাংলায় আমরা “যত মত তত পথ” শুনে বড়ো হলেও নিজেদের স্বাভাব, চরিত্র আর সংস্কৃতি বরাবর অপরেরটাই যেন অনুকরণ করতে পছন্দ করি, এরম বহু উদাহরণ জেনেও কালচারাল ফিউশন বলে আত্মতুষ্টি অনুভব করি, কিন্তু নির্বোধের মতো অপর ধর্মকে ছোটো করতে মন্তব্য করি এক দফা। কেউ পরেছিলেন কাঁটা মুকুট, কেউ নিয়েছিলেন বিষবান, খ্রীষ্ট আর ইষ্ট সবই তো সমান। প্রাচীন সাধুদের কথা গ্রন্থে পড়েছিলাম, ম্যাক্সমুলার যখন ঠাকুরের জীবনী লেখেন তখন প্রতাপ মজুমদার তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেন, “রামকৃষ্ণ ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে তিনি prostitute ও drunkard-দের সঙ্গে মিশে mixed up হয়ে যান”। ম্যাক্সমুলার শুনে আনন্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলেন, “এতেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি অবতার। যীশুও ঐভাবে পতিতাদের উদ্ধার করেছেন”। কথাটা বুকে বেঁধেছিল, সত্যইতো যদি পাথর যোনিতে জন্মাতে হত তবে আকার কী হত? যদি জন্ম হতে বেজন্মা হতাম তবে ধর্ম কী হত?

বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল, এই অবস্থায় নিজের আর পরিবারের সকলকে সুস্থ রাখতে আপমর প্রচেষ্টায় সারাবিশ্ব। ঘরে বসে সুস্থ স্বাভাবিক খাবার ও দৈনন্দিন অভ্যসের এক গাদা ফর্দ ধরিয়েছেন মানবকল্যাণে যা এই দুঃসময়ে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে তুলবে।সেই ফর্দে আছে কাঁচা হলুদের ও নাম, এতে ‘কারকিউমিন’ নামক একটি যৌগের গুণে সমৃদ্ধ। এটি নানা ধরনের প্রদাহ কমায়। আমরা ভারতীয়রা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হলুদ ব্যাবহার করে থাকি বিভিন্ন সংস্কার আর আচারে। প্রাচীন সমাজব্যাবস্থা কত সহজ আর সরল ছিল, অজানেতেই কত কিছু আরোপ করেছে মানবকল্যাণে, যেমনটা ধরুন এই শেতলার হাতে ঝ্যাঁটা আর জলভরা কলসি, ব্যাপারটা যদি এভাবে ভাবা যায় বসন্তকালে যদি সমাজ পরিষ্কার রাখা যায় তবে বসন্তরোগ থেকে মুক্তি। কী অদ্ভুত! এই করোনার জন্যও তো এরমই নির্দেশনা দিচ্ছে W.H.O। প্রাচীন কালের ভালো মানুষগুলো বিজ্ঞানী না হলেও দার্শনিক ছিলেন সে সন্দেহ নেই, দেশ বিদেশ থেকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতেন বহু বিদেশী, যেমনটা এখন আমরা যাই বিদেশে পড়তে। এই একটা প্রমাণই যথেষ্ট ভারতের আকরহানীর ও ভারতীয় সমাজের চরম অবমাননার। বহু যুগ ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপোষণ ও সহজে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির মাশুল গুনছি, ঘরে বসে। যোগ্য পদে অযোগ্য প্রতিস্থাপনের ফলে সর্বত্র এক হাহাকার চলছে, মানুষ রোগের থেকে বেশি দারিদ্র্যতার ক্ষোভে মরছে। এই অতিমারি বিপদেও লোকে ধর্মের সংঘর্ষ, রাজনৈতিক কটুক্তি, চাল চুরি, আর্থিক সাহায্য লুট চালিয়ে যাচ্ছে, আর শ্রমিকশ্রেণির জন্য চুড়ান্ত অসহযোগিতা সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি, খবরের মাধ্যমে আজ আর খবর নেই আছে একরাশ সত্যিকারের অজস্র সাজানো ঘটনা। আমরা আর মানুষনেই, ভগবান এবার এসে নিঃস্ব করুক সবাইকে, ধ্বংস হোক তোষণবাদী সমাজ।

যত ঘন কালো মেঘ তত বেশি বজ্রপাত, সারা পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুহার ক্রমশ বেড়ে চলছে। খবরের কাগজে পড়লাম ‘প্রতিষেধক তৈরির প্রতিযোগিতায় প্রথম চারে আগেই নাম তুলেছে আমেরিকা, চিন, গ্রেটব্রিটেন ও জার্মানি। এবার নতুন সংযোজন ইটালি। তবে তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানবদেহের উপরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হতে আরও কিছুদিনের অপেক্ষা। ইটালির গবেষকদের দাবি, তাঁরা এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন, যা কিনা মানবকোষে নোভেল করোনা ভাইরাসের কার্যকলাপ নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। রোমে সংক্রামক ব্যাধির জন্য থাকা বিশেষ হাসপাতাল স্পাল্লানজ়ানিতে ইঁদুরের উপরে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল সফল হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। ভ্যাকসিন প্রয়োগে দেখা গিয়েছে, ইঁদুরের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীদের আশা, মানুষের শরীরেও একইভাবে কাজ দেবে প্রতিষেধকটি’। খুবই খুশির খবর, যখন আমাদের দেশে সবাই দাঙ্গা করে মরছে তখন করোনা রুখতে সম্ভাব্য চিকিৎসার তালিকায় রয়েছে আমেরিকার ওষুধ ‘রেমডেসিভিয়ার’, ব্রিটেনের ‘চ্যাডক্স ১’ ভ্যাকসিন। ‘ইটালির গবেষক দলটির সঙ্গে যুক্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার সিইও লুইজি আউরিজ়িক্কিয়ো-র কথায়, ‘‘সম্ভাব্য প্রতিষেধক আরও রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো এতটা অগ্রগতি মনে হয় না আর কেউ করেছে।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার কাজটা আমরাই প্রথম করে দেখালাম। আশা করছি, মানুষের দেহেও এটি একইভাবে কাজ করবে।’’ আউরিজ়িক্কিয়ো জানান, এই গরমের পরেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে। সেই জন্য জোরকদমে প্রস্তুতি চালাচ্ছেন তাঁরা। ইটালির নিজস্ব গবেষকদল ও প্রযুক্তির সাহায্যে ভ্যাকসিনটি তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও ইটালিতে দেশের মানুষের উপরেই করা হবে। তবে তিনি জানা নেই, তাঁদের গবেষণা সম্পূর্ণ সফল হলে, গোটা বিশ্বকেই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে তা’।

তবে এর থেকেও বেশি খুশি হয়েছি প্রকৃতির পরিবর্তনের জন্য, দীর্ঘকাল ধরে মানব সভ্যতার অসভ্যতার গ্রাসে যে-বন্যপ্রাণ তটস্থ ছিল; তারা এখন স্বাধীন আর মুক্তহয়ে সর্বত্র ঘুরে বেরাচ্ছে, বায়ুর দূষণকনা মুক্ত হয়ে আকাশ নিযুত নক্ষত্রের রাজবেশ পরেছে, মেরুপ্রদেশের ওজন গহ্বর লোপ পেয়েছে, পশ্চিমের সন্ধ্যাতারা যেন শতগুণে উজ্জ্বল হয়ে প্রকৃতির বিজয়কেতন ওড়াচ্ছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতের পরিবেশের সামঞ্জস্য বাস্তববিদ্যার প্রয়োজনে বাস্তব্যবিদ্যা-বিশেষজ্ঞগণ ২০০৭ সালে ‘Earth Hour’ মডেলের কথা বলেছিলেন। এটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন যা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (WWF) দ্বারা আয়োজিত হয়। এই ইভেন্টটি প্রতিবছর মার্চ মাসের শেষ শনিবারে রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার জন্য অপ্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ করতে উৎসাহিত করে গ্রহের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক নির্দেশ করাবে মানবসমাজকে। আমরা এইসব ভাবধারা কতজনে জানি তা সন্দেহ, আর জানলেও মানি না, মানতে পারি না, মানতে দেওয়া হয় না। আমাদের দেশে সেইসবই মানা হয় যা ভোট বাক্স বাড়াবে, ভাবতেও অবাক লাগে স্বয়ং বুদ্ধদেব সঙ্ঘের অধ্যক্ষ নির্বাচণের জন্য নাকি এই ভোট ব্যবস্থা করেছিলেন। আর আজ দেখো কী হাল! আমাদের আবার উচিত বিজ্ঞানের সাথে আবার দর্শনশাস্ত্রের পড়াশোনা শুরু করা, ১৯৭০ নাগাদ রসায়নবিদ জেমস লাভলক ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট লিন মারগুলিস এক দর্শনতত্ত্ব শিখিয়েছিলেন বিশ্বকে— ‘The Gaia hypothesis’। বলা হয়েছিল, জীবিত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা পৃথিবীতে তাদের অজৈবপরিবেশের সাথে যোগাযোগ করে একটি অতিক্রিয়া এবং স্ব-নিয়ন্ত্রক, জটিল ব্যবস্থা তৈরি করে যা গ্রহের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অবস্থাকে বজায় রাখতে এবং স্থায়ী করতে সহায়তা করে। প্রকৃতি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিজস্ব মতামতে চলে, পৃথিবীতে সমস্ত ঘটনা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র যা প্রকৃতির ইচ্ছানুযায়ী চলে; এর ওপর কারো কোনো হাত নেই। টেকনোলজির মোহমায়ায় অন্ধ হয়ে আমরা বলেছিলাম, বিজ্ঞানের সর্বোচ্চস্থিতিবাদ, সমস্ত দার্শনিকদের চিন্তায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম স্বেচ্ছাচারে, আজ তার অভিশাপে আমরা আছাড় খেয়ে পরেছি, এখনও সংযত না হলে হয়তো আরও রুদ্রমূর্তি দেখাবে প্রকৃতি।

তেমন কোনো কাজ না থাকায় আত্মীয়পরিজন ও প্রিয়জনদের ফোন করে খবর নিচ্ছি, সদ্য ফেলে আসা গৌড়ের কথা মনে করে পিসির বাড়ি ফোন করলাম, সব কিছুই কুশল মঙ্গল ওদের, তেমন নাকি রোগ ছড়ায়নি কিন্তু ওই মূর্তিটাকে নিয়ে নাকি অল্পবিস্তর সাম্প্রদায়িক কুটিলভাব ছরিয়েছে, অনেকে দাবিও করেছে মসজিদের গর্ভ খুঁড়ে মন্দিরটা বার করতে। তবে পুলিশের সুচারু পদক্ষেপে সব তুষের আগুনের মতো চাপা পরেগেছে। আবার ওই মূর্তিটার কথা মাথায় এলো, যাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম কেউই তেমন স্পষ্ট বলতে পারল না বা বলতে চাইল না। এবার নিজেই বসলাম দেখতে, প্রথমে মূর্তিটার ভাঙাটা দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল, তারপর যখন দেখেছিলাম সেটা শুধু তাকানো ছিল, তার সাথে মন বা মস্তিষ্কের সংযোগ ছিল না। কোনো কিছুকে দেখতে গেলে মনের সংযোগ খুবই প্রয়োজন, এখন অনেক সময় নিয়ে দেখতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দেবী মূর্তি নাচের ভঙ্গিমাতে পদ্মমণ্ডলের ওপর একটা ছোট্ট মানুষের অবয়বের ওপর দাঁড়ানো, কোমরে যে কাপর পরানো তাতে ময়ূরের পালকের মতো কিছু রেখা বোঝা যাচ্ছে, অধিকাংশ হাত ভাঙা, বুকের কাছে সম্ভবত দুটো হাত ছিল; ভগ্নসংযুক্তি স্পষ্ট, ডানদিকের দুটো হাতের নীচেরটা গোটা তাতে কুঠার ধরা, ওপরটা তির ধরা ছিল কারণ, বামদিকের নীচের এক হাতে ধনুক ধরা, অপরটা কব্জির পর থেকে নেই, সাথে চালের অনেকটা ভাঙা। কাঁধ থেকে আবার ওই ময়ূরের পালকের মতো রেখা, কাদামাটির জন্য সূক্ষ্ম রেখাগুলো প্রায় অস্পষ্ট কিন্তু দেবীর ভ্রূকুটি কুটিল ত্রিনেত্র আর দেবীর তিনটি মুখ যার বামদিকেরটা ভাঙা, মাথার মুকুটে অলঙ্করণ স্পষ্ট আর তাতে ফল, ফুল, একজন যোগীমূর্তি, আর আবার ওই ময়ূরের পালক। মূর্তির পিছনে কিছু লেখা; লেখাটা সংস্কৃত না, ভালো করে দেখলাম সেটা কুটিল লিপি। মূর্তির আদলতা দেখে স্পষ্ট হলাম এটা কোনো তান্ত্রিক দেবীমূর্তি। কিন্তু বাংলায় তান্ত্রিক দেবীমূর্তির এরম কোনো রূপ দেখেছি বলে মনে পড়ে না, তার ওপর কুটিলাক্ষর বহুল প্রচলিত ছিল দক্ষিণপূর্ব বাংলার নাথ, রাত ও খর্গ রাজাদের লিপিতে এবং ভাস্করবর্মার নিধানপুর-তাম্রশাসনে কুটিল লিপির প্রচলন ঘটে কামরূপ প্রদেশেও, আর সেই সময়ে তান্ত্রিক মূর্তির ততটা বিকাশ লাভ হয়নি।

শেষ পাতা