Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

শব্দ-কল্প-ঋত্বিক

[‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শব্দ ভাবনা ও ধ্বনি মন্তাজ]

সনৎ বলল, কথা আছে। চলো। নীতার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ‘না’ বলে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইতেই, সনৎ তার হাত ধরে ফেলে। বিস্মিত গলায় বলে, নীতা! নীতা সনতের চোখে প্রখর দৃষ্টির দিকে তাকায়। কয়লার ট্রেন ইঞ্জিনের এক সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল আমাদের বুকে এসে ধাক্কা মারে। সনৎ অপ্রস্তুতের মতো হাত ছেড়ে দেয়। সনতের মতো আমরাও সচকিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। এই হুইস্‌লের আওয়াজে আমাদের আলাপ শুরু হয়।

এই সুতীক্ষ্ণ হুইস্‌ল কেন ত্রস্ত করে? ছোটো জলার পাশে ঝুঁকে পড়া গাছ ও মাঠকে সঙ্গে রেখে রেললাইন চলে গেছে। মুহুর্মুহু না হলেও, এখানে ট্রেনের অবশ্যম্ভাবী আনাগোনা। এবং ঋত্বিক ইতিমধ্যেই, হুইস্‌ল বাজিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া, দু-বার দেখিয়ে ফেলেছেন। ছবির শুরুতে নীতার দাদা শঙ্করকে আমরা মাঠে বসে গান গাইতে শুনি। নীতা তার দিকে প্রশ্রয়ের চোখে তাকায়। দাদা-বোনের পশ্চাদ্‌পটে ট্রেন চলে যায় একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে। ছবি আরও কিছুটা অগ্রসর হলে, নীতা ও সনৎ ওই ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে বসে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। নীতা উঠে দাঁড়াতে গেলে সনৎ হাত ধরে বলে, নীতা। ট্রেনের হুইস্‌লের আওয়াজ ভেসে আসে। নীতা বসে পড়ে। সন্ধ্যার আনত আলোয় তাদের সামনে রেখে ট্রেন চলে যায়। তারা একে-অপরের সামনে নম্র সুরে বসে থাকে।

তাহলে? তৃতীয় দৃশ্যের সঙ্গে, এই দুই দৃশ্যের মূল পার্থক্য অবস্থানের। তৃতীয় দৃশ্যের অব্যবহিত পূর্বেই নীতা কাশির দমকে রক্ত আবিষ্কার করেছে। সনৎ বিয়ে করেছে নীতার বোন গীতাকে। শঙ্কর গান গেয়ে নাম করার আশায় ঘরছাড়া। তাই ঋত্বিক এই দৃশ্যে ধ্বনি সংযোজন করেন বিশেষ মাত্রায়, যা ধ্বনি মন্তাজের রূপ নেয়। চলচ্চিত্রে মূলত দু-ভাগে ধ্বনিকে ভাগ করা হয়। যে-ধ্বনির উৎস আমরা দৃশ্যে বা শটে দেখতে পাচ্ছি— ডায়াজেটিক এবং যেক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি না— ননডায়াজেটিক। প্রথমদুটো দৃশ্যে ট্রেনের চলে যাওয়া যে-শটে আমরা দেখতে পাই, সেই শটেই হুইস্‌লের ধ্বনি প্রয়োগ করেন ঋত্বিক। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে হুইস্‌লের ধ্বনি আসে দু-টি শট আগে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। হুইস্‌লের ধ্বনি শোনার পর আরও একটি শটে, নীতা ও সনৎকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখান ঋত্বিক। যে-শটে সনৎ ত্রস্ত হয়ে নীতার হাত ছেড়ে দেয়। তার পরের শটটিতে নীতা ও সনৎ ঝুঁকে পড়া গাছটির নীচে বসে থাকে। আমরা ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে পাই। এবং ঋত্বিক এই তিনটি শটকে জোড়েন দ্রুত লয়ে চলা ট্রেনের চাকার শব্দে।

অর্থাৎ, এই তৃতীয় দৃশ্যে এসে ট্রেনের হুইস্‌লের শব্দ তিনটি শটে ননডায়াজেটিক থেকে ডায়াজেটিক হয় এবং ঋত্বিক সেই ধ্বনির কম্পাঙ্ক স্বাভাবিকের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলেন। যে-সনৎকে নীতা ভালোবেসে নিজের অধিকার দিয়েছিল, সনতের উন্নতির স্বার্থে ত্যাগ করবে ভেবেছিল নিজের আকাঙ্ক্ষা, সনৎ সেই অধিকার হারিয়েছে। সনতের তথা আপামর পুরুষজাতির, সম্পত্তি-মনস্তাত্ত্বিকরণের উপর এই স্বাভাবিকের চেয়ে তীক্ষ্ণ ট্রেনের বাঁশি, নিছক রেলের হুইস্‌ল হয়ে থাকে না, তা অ্যালার্মিং সাউন্ড এফেক্টে আছড়ে পড়ে। অথচ তা নিছক সাউন্ড এফেক্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। দৃশ্যটিতে ধ্বনির উৎসকে অপরূপ কম্পোজিশনে দেখিয়ে, আমাদের মননে তা মিশিয়ে দেন এবং তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকে প্রশমিত করে শান্ত ও গম্ভীর রসে পূর্ণ সংলাপে কাহিনির খাত বইয়ে দেন ঋত্বিক।

অথচ সাউন্ড এফেক্টের সরাসরি ব্যবহার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে বিদ্যমান এবং তা বহুলচর্চিত। চাবুকের শব্দকে ঋত্বিক তিনবার তিন চরিত্রের জন্য ব্যবহার করেন, যদিও প্রেক্ষিত বদলে দেন প্রতিবার। এই চাবুকের শব্দ ননডায়াজেটিক ধ্বনি হিসেবেই প্রতিবার থাকে ও এর থেকে ক্লাসিকাল ধ্বনি মন্তাজের একটি উদাহরণ আমরা শিখে নিতে পারি। ঋত্বিক প্রতিবারই এই ধ্বনির সঙ্গে সমাপতন ঘটান দ্রুত লয়ে সেতারের বাজনে। এতে এফেক্টটি আরও তীব্র হয়।

সনতের পালটে যাওয়া বাহির ও অন্তরঙ্গকে দেখে নীতা। একইসঙ্গে সনতের বাড়িতে গীতার উপস্থিতিও সে টের পায়। ঋত্বিক কশাঘাতের ধ্বনি প্রথমবারের জন্য ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়বার আমরা এই ধ্বনি শুনতে পাই ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানের শেষে এসে। শঙ্করের ব্যথিত মুখ পর্দায় ভেসে থাকে ক্লোজ-আপে। পিছনে তিনবার সশব্দে চাবুক পড়ে। তৃতীয় তথা অন্তিম প্রয়োগ, ঋত্বিক করেন ঝুঁকে পড়া গাছের নীচে, যা এই রচনার আধার, সেই দৃশ্যে। এবার নীতার চলে যাওয়ায়, সনতের অপরাধী মুখে অনবরত পড়ে কশাঘাতের আওয়াজ। অর্থাৎ নীতা, শঙ্কর ও সনৎ— কিন্তু প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই সাউন্ড এফেক্টের ব্যবহার, একই ভাবনায় হয় না। ভাবনার অন্তর ঘটে, যা পরিচালকের বক্তব্যকে সরাসরি আমাদের কাছে এনে দেয়।

সনতের প্রত্যাখানে নীতার চরিত্রের ট্র্যাজিকধর্মীতা আর সূক্ষ্ম থাকে না। তা রূঢ় রূপে আমাদের সামনে চলে আসে। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে কশাঘাতের ধ্বনিপ্রয়োগ যেন অনেকটাই সাহিত্যধর্মী। যেন ঋত্বিক লিখছেন, ‘সনতের কথাগুলি ও তার শীতল ব্যবহার, নীতার হৃদয়ে কশাঘাতের মতো বাজিতে লাগিল।’ এরকমটি আমরা আগে জানিনি। কাজেই এখানে এক মুখ্য চরিত্র আর এক মুখ্য চরিত্রকে কশাঘাতে আহত করেছে, সেই ভাবই বর্ণিত। তৃতীয় প্রয়োগে, চরিত্রের প্রতি পরিচালকের মনোভাবকে আমরা প্রকাশ পেতে দেখি, এই ধ্বনির বারংবার ব্যবহারে। সনতের যাবতীয় প্রতিশ্রুতির যে আর কোনো মূল্যই নীতার জীবনে নেই, সনৎও যে আদতে একটি চিরন্তন পলায়নমুখী কাপুরুষ, নীতার তা জানা হয়ে গেছে বহুকাল। তাই সনতের মুখে প্রায়শ্চিত্ত ও আদর্শের কথা, নীতার কাছে অতি অবশ্যম্ভাবী খেলো মনে হবেই। টিউবারকিউলোসিস জর্জরিত ফুসফুসের কাছে এ-আলোচনা নিছক অপ্রয়োজনীয়। তাই সনতের শেষ কথাগুলিতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে, ছাতা মাথায় তার চলে যাওয়ায়, সনৎ যেমন বুঝতে পারে, তার প্রায়শ্চিত্তের কোনো সুযোগ নেই (অন্তত নীতার কাছে সে-প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ফুরিয়েছে), তেমনি উপর্যুপরি কশাঘাতে ঋত্বিক যেন সনতকে শাস্তি দেন এই বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে।

তবে দ্বিতীয় প্রয়োগটি এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আত্মসমালোচনাময়। শঙ্কর চরিত্রটি, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটিতে, ঋত্বিকের আত্মস্বরূপ। সে-শিল্পী, ভ্যাগাবন্ড, ছেলেমানুষীতে ভরা এবং সাফল্য পাওয়ার আগের মূহূর্ত অবধি গোটা ছবিতেই সমাজের চোখে অপাঙ্‌ক্তেয়। এ হেন শঙ্করের কাছে নীতা যখন গান শিখতে চায়, বলে, বাসরে গাইতে হবে না! (গীতা ও সনতের বিয়ে)— শঙ্কর কি গান শেখায়? ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।’ অর্থাৎ, সে বুঝতে পারে। নীতার একটু একটু করে চলে যাওয়াকে সে প্রতিনিয়ত অনুভব করে। কিন্তু কিছু করতে পারে না। সে বেদনায় নীল হয়ে যায়। পরিচালকের অসহায়তা এভাবেই তার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোয়। শেষ দৃশ্যে নীতারই মতো আর একটি মেয়ের চটি ছিঁড়ে যাওয়ায়, সে যেন পুনরায় নীতাকে দেখতে পায় ও কেঁদে ফেলে। গানের দৃশ্যে চাবুকের ধ্বনি, তাই ঋত্বিক যেন নিজের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেন। এই অসহায়তা ও শোষণ তিনি সহ্য করতে পারেন না।

ছবিটিতে ঝিঁঝিপোকার ডাকের প্রয়োগও লক্ষ্যণীয়। আর পাঁচটা গড়পড়তা ছবিতে ঝিঁঝিপোকার ডাক আসে পারিপার্শ্বিকের সাথে, শুধুমাত্র আর একটি ধ্বনি উপাদান হিসেবে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র প্রথমার্ধেও এভাবেই এই উপাদানটিকে রাখেন ঋত্বিক। এর বদল হয় যখন নীতার ছোটোভাই মন্টুর দুর্ঘটনার খবর আসে চিঠিতে। অনেক বেশি মাত্রার কম্পাঙ্কে ব্যবহৃত হয় ঝিঁঝিপোকার ডাক। ফলে এক আশ্চর্য আধিভৌতিক এফেক্ট তৈরি করে এই ধ্বনি। ঋত্বিক এখানেই থেমে থাকেন না। এরপর যখনই নীতার মাথা ঘুরে ওঠে (যার শুরু মন্টুকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে), যখনই সে কাশিতে রক্ত পায়, যখনই তাকে একের পর এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হতে হয়, ঝিঁঝিপোকারা এক আশ্চর্য অতিরিক্ত মাত্রার কম্পাঙ্কে ডেকে ওঠে। এমনকী, ঝুঁকে পড়া গাছের নীচের দৃশ্যটিতেও, নীতা বলে, এখন ভেবে দেখছি ও-সব ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। এখন তো শুধু কাজ। পাখির কলতান ও একটি কোকিলের অনবরত ডেকে যাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে, ঝিঁঝিপোকার সেই আশ্চর্য ডেকে চলা, এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য তৈরি করে।

এ-নৈঃশব্দ্য শেষ হয় ছবির সমাপ্তিতে। ঋত্বিক ‘আয় গো উমা’ গানটির শব্দ পরিকল্পনাতেও স্থান দেন এই আধিভৌতিক ডাককে। ‘আয় গো উমা’ গানটিকে তিনি লেট মোটিফের মতো গোটা ছবিটির সাউন্ডস্কেপে ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো থিম মিউজিক তৈরি হতে দেন না।

নীতাকে আমরা কাশতে দেখি অনবরত। সে কাশি চাপতে রুমাল মুখে চাপবে এবং রক্ত আবিষ্কার করবে রুমালে। এর পূর্বে অমোঘ স্বরে, ধীর লয়ে ‘আয় গো উমা কোলে লই’ গানটি বেজে চলে। গানটি দ্বিতীয়বার শুনি এক ঝড়ের রাতে। বাবা নীতাকে বলেন, তুই জিতে গেছিস। তুই চলে যা। এরা তোকে করুণা করে। নীতা তার আদরের সম্বল ফোটোফ্রেমটি, যে-ফোটোফ্রেমে সে আর দাদা ছোটোবেলায় পাহাড়ের কোলে বসে রয়েছে, নিয়ে ঝড়ের মধ্যেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। তার মুখে বিদ্যুতের আলো সরে যায়, গাছের ঝুপসি পাতা ঘন ছায়া তৈরি করে। তার মুখে এক অপার্থিব আনন্দ, মুক্তির স্বাদ যেন, খেলা করে। এ-সংসারের যাবতীয় দায়ভার তাকে আর যেন বইতে হবে না। ঝড়ো হাওয়ার শব্দকে ছাপিয়ে জগৎচরাচরে শোনা যায়— ‘আয় গো উমা কোলে লই, গলাতে গাঁথিয়া জুঁই।’ কন্যাকে নিজের পরম আশ্রয়ে স্থান দেওয়ার চিরকালীন মাতৃসংগীত। নীতার শেষ আশ্রয় হয় পাহাড়ের কোলে এক স্যানিটোরিয়ামে। যে-পাহাড়ে সে বার বার যেতে চেয়েছে দাদার সাথে। শেষ দৃশ্যে যখন আর একটি মেয়ের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায় নীতারই মতো, নীতার সংকটকে শঙ্কর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে পায়। গানটিকে লেট মোটিফের মতো পুনরায় ব্যবহার করে ঋত্বিক শুধু দৃশ্যত সংযোগস্থাপন করেন না, ধ্বনিগতভাবেও তৎকালীন মধ্যবিত্ত সংকটকে (যা আজও অনেকাংশে বর্তমান), আমাদের মননে গেঁথে দেন।

লেট মোটিফ হিসেবে ঋত্বিক এক মায়াবী সুরও পুনরাবৃত্তিতে রেখে দেন ছবিটির সাউন্ডস্কেপে। নীতা যখনই ছেলেবেলার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সনৎকে বা শঙ্করের কাছে আবদার করে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এই সুর শোনা যায়। ছবিতে যখন প্রথমবারের জন্য নীতাকে সনতের চিঠি পড়তে দেখি, এই সুরও তখন প্রথমবারের জন্য শোনা যায়। আর আশ্চর্য, চিঠি হাতে নিয়ে নীতা, পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ছেলেবেলার ছবিটি নাড়াচাড়া করে। এ এক বিচিত্র চেতনার স্তরে ধ্বনি ও দৃশ্যের মন্তাজ, যা একলহমায় নীতার অবচেতনকে আমাদের সামনে খুলে দেয়। এই মন কেমন করা নস্টালজিক সুরের উপর্যুপরি ব্যবহারে, সনতের ভালোবাসার চিঠি ও ছেলেবেলায় পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি, দু-টিকে একাসনে বসিয়ে ঋত্বিক নীতার ভিতরের পুকুরটিতে ডুব দেন ও স্বচ্ছ করে তোলেন এই অবগাহন।

অথচ অবশেষে নীতা যখন পাহাড়ে পৌঁছায়, তখন শুধুমাত্র সেই সুর বাজে না। সুরটি এক গম্ভীর করুণ আলাপে বর্ধিত হয়। আর পাহাড়ে খাদে গিরিবর্ত্মে প্রতিধ্বনিত হয় এক চিরন্তন আর্তনাদ। এখানেও ধ্বনি সংযোজনে সাহিত্যধর্মীতা লক্ষ করি আমরা। ঋত্বিক যেন লিখছেন, ‘তাহার পর নীতার ব্যাকুল আর্তনাদ সেই পাহাড়ের প্রতিটি মর্মে ধ্বনিত হইতে লাগিল।’ প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে, দৃশ্যটিকে আইকনিক পর্যায়ে পৌঁছে দেন তিনি। অথচ সেই মন কেমন করা সুর আর আগের মতো বাজে না। নীতা সনতের লেখা চিঠি এতদিনে উড়িয়ে দেয় পাহাড়ে। স্মৃতি, প্রেম ও লড়াইকে ছাপিয়ে নির্দ্বিধায় সে ছড়িয়ে দেয় তার অসহায়তা ও বেঁচে থাকার স্পৃহা। মুহূর্তে অপরাজেয় মাতৃমূর্তি ত্যাগ করে সাধারণ মানবীর চাওয়া-পাওয়ায় নিজেকে ব্যক্ত করে সে। তাকে আর উপেক্ষা করা যায় না। তার সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।

এই অকপট বাস্তবের চরম উদ্ভাসে, তাই সেই আশ্চর্য নস্টালজিক সুরও মূঢ় হয়ে পড়ে। শব্দ পরিকল্পনায় বলা যেতে পারে, এটি একটি অতুলনীয় মস্তিষ্ক ও মাত্রাবোধের পরিচয়। ঋত্বিক প্রতিধ্বনির সাথে মেঘের গর্জনকে মিলিয়ে দেন সেই লয়ে, যা কশাঘাতের সাউন্ড এফেক্ট তৈরির সময় করেছেন। ফলে মেলোড্রামার প্রকৃত উদ্দেশ্য, যা ঋত্বিকের অভিপ্রেত ছিল চিরকাল, তা-ই হয়। দৃশ্যটির ধ্বনি সংযোজন আমাদের রক্ত ঝরায়।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটির শব্দ পরিকল্পনাতে অভিনিবেশ করলে তাই আমরা বার বার বিভিন্ন ভার্টিকাল মন্তাজের নিদর্শন পাই। ভার্টিকাল মন্তাজ, অর্থাৎ, দৃশ্যের সাথে ধ্বনির মিলনে জন্ম নেওয়া এক নতুন অর্থ অথবা বোধ। বস্তুত দু-টি শটের পারম্পরিক সহাবস্থানে যে-মন্তাজের সৃষ্টি হয় (যাকে হরাইজন্টাল মন্তাজ বলা হয়ে থাকে), শুধু আমাদের চোখকে পরিশীলিত করে। কিন্তু দৃশ্য ও শব্দের মন্তাজ চোখ, কান তথা মস্তিষ্ককেও পুষ্ট করে প্রখর বুদ্ধিমত্তায়। এ-বস্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজও বিরল। দৃশ্যের সাথে ধ্বনির সুপরিকল্পিত মিলনে জন্ম নেয় যে-বোধ, ঋত্বিক আমাদের সেই বোধের সন্ধান দেন। ছবিটির নির্মাণে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের চেতনার নতুন স্তরে উন্নীত করে। শঙ্করের মতো আমরাও বেদনায় নীল হয়ে যাই।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

রূপায়ণ ঘোষ

চৈতন্যদর্শন: এক বৈপ্লবিক সমাজবাদ

“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনিয়ঃ সদা হরিঃ।।”

নাহ্, এই শ্লোকটির রচয়িতা কোনো প্রাজ্ঞ পক্বকেশ পুঁথিবিদ্যাসর্বস্ব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নন। সুললিত এরকম অসংখ্য শ্লোকের রচনাকার হলেন বাংলা তথা ভারতীয় ভক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্বম্ভর মিশ্র-সমাজ ও ইতিহাস যাঁকে চিনেছে শ্রীচৈতন্য রূপে। শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে (তৃণাদপি) অর্থাৎ, তৃণের চেয়ে ক্ষুদ্র হও কিন্তু (তরোরিব) বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু হওয়া আবশ্যক। যে-মানুষ অন্যকে সম্মানের চোখে, সমানের চোখে দেখেন তারই পক্ষে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। পঞ্চদশ শতাব্দীর (১৪৮৬ খ্রিঃ) যে-সময়ে চৈতন্যদেবের জন্ম সেই সময় বাংলা তথা সমগ্র ভারতে সুলতানি শাসনের কর্তৃত্ব মধ্যগগনে। অন্য দিকে বঙ্গদেশ ও নবদ্বীপ ছিল তৎকালীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান। সেন শাসনকাল থেকে বিস্তীর্ণ গঙ্গার দু-পাশে জমি ও বিপুল অর্থৈশ্বর্য লাভ করে কুলীন ব্রাহ্মণকুল যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে নবদ্বীপ- শান্তিপুর অঞ্চল ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, দেশের নানান প্রান্ত থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা এসে এখানে অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও বিদ্যাচর্চা যেমন করতেন তেমনই বিষয়রসে আকৃষ্ট হয়ে গোঁড়ামির প্রবল উন্মত্ততাও লালন করতেন। স্মৃতিশাস্ত্র শাসিত সমাজ ছিল জাতি ও বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পুরাতন স্মৃতিব্যবস্থাগুলির মধ্যেই রোপিত ছিল প্রাচীন ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিষাক্ত বীজ। যে-মনুস্মৃতিতে নারী, শূদ্র ও কুকুরকে এক শ্রেণিতে ফেলে নিন্দা করা হয়েছে, যে-স্মৃতিশাস্ত্রে নারী ভোগবাদের অপার স্বাধীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক মদমত্ততাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সেই শাস্ত্র শাসিত সমাজ যে আদতে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাহ্মণ শ্রেণির বেলাগাম অত্যাচারে প্রাণান্তকর অবস্থায় নিম্নবর্গের প্রভূত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করেন। আশ্চর্যজনকভাবে একই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ক্ষমতাতন্ত্রের সমান নিদর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে। পঞ্চদশ শতকের ইতালিতে যে-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়, সেখানে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে গেল। তৃতীয় ফ্রেডরিক (১৪৫৩-১৪৯২), তৃতীয় চার্লস (১৪৯৬-১৫২১)-এর মতো শাসকেরা ছিলেন নিঃসন্দেহে জ্ঞানদীপ্ত তথাপি আগ্রাসী স্বৈরাচারী। ইউরোপীয় নবজাগরণের যুগেও সেখানে ক্ষমতা ও চার্চকেন্দ্রিক অন্ধসংস্কারের যে-চিত্র ফুটে ওঠে, পঞ্চদশ শতকের ভারত তার চেয়ে পৃথক কিছু নয়। ঠিক এই সময়কালে চৈতন্যদেবের সমাজ সংস্কারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ- মধ্যযুগীয় ভারতের বর্বর প্রথা অবসানের সূচনামুখ।

রূপ গোস্বামী সংকলিত পদ্যাবল্যাং সংখ্যক নয়-এ গৌরাঙ্গ বলছেন,

“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো।
নাহং বর্ণী ন চ গৃহরপতির্নো বনস্থো যতির্বা।।”

অর্থাৎ, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র নই, নই গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বনবাসী এমনকী সন্ন্যাসীও নই। তাহলে তিনি কী? তিনি আদ্যোপান্ত মানবেশ্বর প্রেমে মত্ত আর এক মানুষ— যিনি কেবল মানবকে মানবরূপে, সত্যকে পরিপূর্ণ সত্য জেনে সাধনা করেছেন, সেবা করেছেন। কোনো আরোপিত ধর্মমোহের প্রয়োজন তাঁর পড়েনি। সম্মোহন সাধনার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি প্রচার করেছেন প্রেমসর্বস্ব, ত্যাগসর্বস্ব ভক্তিবাদের। তাঁর কাছে আচারব্যূহে নিমজ্জিত ধর্মভাবের কোনো গুরুত্ব ছিল না, উপনিষদের ‘আনন্দরূপচেতনা’-ই হল চৈতন্যদর্শনের মূল আধার। বৈষ্ণব গ্রন্থ ‘ভক্তমাল’-এ বর্ণিত গুজরাতের ঘোগা গ্রামে নটী-শ্রেষ্ঠা অসামান্যা রূপবতী বারমুখীর সম্মুখে অশ্রুসজল নয়নে তিনি উচ্চারণ করছেন— হে সখী, হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে ঈশ্বরের নিমিত্ত প্রেম সঞ্চার করো, সে-স্থানে জগতের নাম, রূপ, কর্ম সদা সঞ্চারণশীল, উহাতেই মুক্তি। আশ্চর্যের বিষয় বৃহদারণ্যক উপনিষদের খিলকাণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে ধ্বনিত হচ্ছে একই স্বর—

“এষ প্রজাপতির্যদ্ধৃদয়মেতদ্ ব্রহ্মৈতৎ সর্বং তদেতৎ ত্র্যক্ষরং হৃদয়মিতি হৃ ইত্যেকমক্ষরমভিহরন্ত্যস্মৈ।।”

অর্থাৎ, হৃদয়ের ভূমিতে নাম, রূপ, কর্মের নিবাস। হৃদয়ই সর্বভূতের অধিষ্ঠান ও সর্বভূতাত্মক প্রজাপতি। অতএব সকল স্তরে, জীবে, শ্রেণিতে হৃদয়ব্রহ্মই এক এবং একমাত্র উপাস্য। যে-বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় তা হল, বেদান্ত দর্শনের উপলব্ধিকে কেবলমাত্র ভক্তিরসের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসী, শাসক, নগরনটীর মধ্যে কোনো পার্থক্য বিন্যাস তো করছেনই না উপরন্তু যবন হরিদাসের ভক্ষিত খাদ্য গ্রহণ করতে করতে বিশ্বম্ভর পুলক-বেদনার পরমাশ্রয়ে সমাহিত হয়ে পড়ছেন। আবার এই গৌরাঙ্গই স-পার্ষদ গণ-আন্দোলনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন! ষোড়শ শতকের সেই বাংলা তখন সর্বাংশেই সুলতানি শাসনাধীন, দিল্লির মসনদে আসীন সিকন্দর লোদি, বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ। এই পরিস্থিতিতে নবদ্বীপে নাম-সংকীর্তনের দল সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠলে সেখানকার মুসলমান কাজী ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভীত হয়ে কীর্তন বন্ধের ফরমান জারি করেন। হাওয়ায় খবর রটে যায় নদীপথে নৌকাযোগে সুলতানের সেনাবাহিনী আসছে লুঠতরাজ এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও তা শেষপর্যন্ত সত্যি হয়নি, কারণ, হুসেন শাহের মতো বিচক্ষণ শাসক বরাবর সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে এই পরিস্থিতিতেই চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ গণশক্তির সাহায্যে স্বৈরাচারী শাসননীতির প্রতিবাদ করেন, স-পার্ষদ কাজীর বাড়ি অবরোধ করে দুই রাত্রি অবস্থান বিক্ষোভের পর কাজী নাম-সংকীর্তনের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করবার নয় যে, নিমাইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এক্ষেত্রে কাজীর সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে বিশ্বম্ভরের আড়ম্বরহীনতা, সরল সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছিল। নবদ্বীপ এবং আশেপাশের অঞ্চলের ধনী ব্রাহ্মণরা (মূলত যারা যজমানি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত) বুঝতে পেরেছিলেন তাদের সর্বাত্মক প্রতিপত্তির উপর চৈতন্যের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ‘কাজীদলন’ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কবি কর্ণপুরের গ্রন্থে এ-কাহিনির কোনো উল্লেখ নেই আবার মুরারিতে রয়েছে গৌরাঙ্গ কর্তৃক ম্লেচ্ছ উদ্ধারের কথা। কিন্তু এই ঘটনার আত্যন্তিকতা বাদ দিলেও যে-সত্য ধরা পড়ে তা হল, বিশ্বম্ভর তাঁর ধর্মপ্রচারে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন! রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ নাটকে ক্ষেমংকর নবধর্মকে বাধা দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে সৈন্য নিয়ে অভিযান করতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নবধর্মের প্রচার ও প্রসার স্তব্ধ করে দিতে ক্ষেমংকরেরা চিরকালই উৎসাহী। অনুরূপ ব্যাপার চৈতন্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত কিন্তু সম্ভবত হুসেন শাহের মতো প্রশাসকের সদর্থক উপস্থিতি এখানে যথেষ্ট কার্যকরী প্রতিভাত হয়েছিল।

লক্ষ করার বিষয় হল, কার্ল মার্কস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘Communist Manifesto’-তে শাসকের বিপক্ষে সাধারণ সর্বহারা শ্রেণির যে-গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলছেন তার অন্তত সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে বঙ্গদেশের মাটিতে চৈতন্যদেব সেই আন্দোলনের সূচনা করে ফেলেছেন। গণ-আন্দোলন সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হল, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিপীড়িত মানুষের সুবিশাল সমূহকে বিপ্লবের ছাতার তলায় একত্রিত করা। অন্য দিকে বিংশ শতাব্দীর প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক তথা দার্শনিক আলব্যের কামু বিপ্লব সম্পর্কে বলছেন—

“More and more, revolution has found itself delivered into the hands of its bureaucrats and doctrinaires on the one hand, and to the enfeebled and bewildered masses on the other.”

অথচ তার চার-পাঁচশো বছর পূর্বে মধ্যযুগীয় ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেব দু-হাতেই গণ-বিপ্লবকে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কোনো স্থান সেখানে ছিল না, রক্তের যেটুকু ক্ষয়— তার সমস্তটাই নিজের। ক্ষমতাতন্ত্রের কোনোরকম পুজো না করেই অহিংস ভক্তিবাদকে কেন্দ্রাবর্তে রেখে সমাজের একেবারে অন্ত্যজবর্গকেও সঙ্গে করে তিনি পথ হাঁটছেন, উত্তরসূরি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে মৌলিক পার্থক্যটি এখানেই। দখলের পরিবর্তে তিনি হৃদয়ের জয়ে অধিক বিশ্বাসী। মনে রাখতে হবে তৎকালীন হিন্দু সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন পঞ্চোপাসক, স্মার্ত (স্মৃ প্রত্যয় জাত, অর্থে— স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ)।

অন্ধসংস্কার, লোকবিশ্বাসের মতো ক্ষতিকর ধারণা পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য, রাজসংযোগানুসারে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রভৃতির দ্বারা সমাজকে নিজস্ব পদ্ধতিতে চালানোর লোভ ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। দোসর ছিল কিছু নির্বাচিত উচ্চবর্গীয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। তাদের একাধিপত্যের ফলে সমাজের বহু নিম্নবর্গীয় জাতি রাতারাতি শূদ্র বলে পরিগণিত হতে থাকেন; উচ্চ-নীচ শ্রেণির ভেদাভেদ বড়ো হয়ে দেখা দেয়— বলা বাহুল্য তা সমাজতান্ত্রিক ঐক্যের পক্ষে খুব একটা সুখকর অবস্থা ছিল না। বিশ্বম্ভরের সংকল্প ছিল এই সমস্ত স্ত্রী-শূদ্র-অন্ত্যজ শ্রেণিকে ভক্তির মাধ্যমে উন্নত এবং মুক্ত জীবনযাপনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সে-কারণেই তিনি নিত্যানন্দকে নীলাচল থেকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন, সন্ন্যাসী না হয়ে তাকে সমাজসেবক হওয়ার পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ নিত্যানন্দের অবাধ সান্নিধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি সমাজের বিবিধ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বৈষ্ণব ধর্মের ছত্রছায়ায় আসতে শুরু করেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, চৈতন্যদেব সকলকেই সাদরে গ্রহণ করেছিলেন— ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র ধীরে ধীরে একীভূত হতে থাকলে সমাজের সর্বাঙ্গীন ঐক্য সাধিত হয়। চৈতন্যভাগবতের ‘কাজীদলন’ অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্ণের শ্রীধরের কুটিরে লোহার পাত্র থেকে বিশ্বম্ভর জল পান করছেন, শ্রীধর জন্মগত জাতি সংস্কারের বিধি-নিয়মে তখনও আবদ্ধ— ভয়ে সে শিউরে উঠলেও গৌরাঙ্গ নির্বিকার। পূর্বেও আমরা দেখেছি বিশ্বম্ভর আদতে ঐক্যবিধায়ক শক্তি, সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙতেই তাঁর যাবতীয় উৎসাহ এবং উদ্দীপনা। ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যেন এই ঘটনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন; গোরায় দেখা যায়, চরের ঘোষপুরের নাপিতের ঘরে জল পান করে এক মুসলমান যুবক, প্রবল নীলকর সাহেব ও গোঁড়া হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে সেই নাপিত মুসলমান ফরু সর্দারের পুত্র তমিজকে ঘরে এনে রেখেছিল। উপন্যাসে দেখা যাবে গোরা এই তথাকথিত হিন্দু সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, অনুরূপভাবে চৈতন্যের আচরণেও সেই একই দ্রোহচিহ্ন; সে-যুগের প্রেক্ষিতে যা এক বিপ্লবের সমতুল্য বলা চলে।

পুরীতে অবস্থানকালে জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত জনৈক সার্বভৌম আচার্য ভগ্নিপতি গোপীনাথ ভট্টাচার্যের কাছে চৈতন্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গোপীনাথ উত্তর দেন—

“ইঁহার নাহি বাহ্যাপেক্ষা/ অতি বড় সম্প্রদায়েতে উপেক্ষা।।”

বিশ্বম্ভর যে আদ্যোপান্ত অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ ছিলেন, সমাজের সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে যে তার অবস্থান- বৃন্দাবন দাস স্থানে স্থানে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। খাণ্ডবা গ্রামের সেবাদাসী ইন্দিরা বাঈ, কিংবা নারোজি দস্যু, ভিল পান্থদের মতো ভিন্ন ভিন্ন বর্গের মানুষকে অবনমনের পথ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছেন। আবার পুরীতেই মন্দিরের পাণ্ডারা তাঁর বিরোধিতা এমনকী ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছেন। কলিঙ্গ সেই মুহূর্তে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ কলহে পর্যুদস্ত, তদসত্ত্বেও দু-টি শক্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে চৈতন্য ও মহারাজ প্রতাপরুদ্র অপর দিকে গোবিন্দ বিদ্যাধর, জগন্নাথ দাশের মতো মন্দিরের পাণ্ডাবৃন্দ। সে-সময় প্রতাপরুদ্র দক্ষিণাঞ্চলের রাজা কৃষ্ণদেবের কাছে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছেন, তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সংকোচিত হয়ে আসছে। মন্দিরের সেবায়েতবৃন্দ ধীরে ধীরে নীলাচলের নিয়ামক হয়ে উঠতে শুরু করলে গৌরাঙ্গকে নিয়মতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই আরম্ভ করতে হয়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে ‘প্রাধান্য ও আধিপত্যবাদ’ যেখানে শাসকের চরিত্রকে সর্বকালীন দোর্দণ্ডতা প্রদান করছিল সেখানে গৌরাঙ্গ সমাজের দুর্বল শ্রেণিদের একত্রিত করছেন, ঈশ্বরের ভক্তিবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে! কারণ, তিনি জানতেন প্রভুত্ব অধিকার করে, প্রতিপত্তি অর্জন করে রাষ্ট্রশক্তি ক্ষান্ত হয় না। তার মূল লক্ষ্য থাকে সংস্কৃতি ও সামাজিক ভাবাদর্শের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া।

কী অদ্ভুত! চৈতন্যের এই কার্যকলাপের পরবর্তীতে আধুনিক ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি আনছেন (Hegemony and Dominance) তত্ত্ব! আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে চৈতন্যের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়— “The bourgeoisie acquires all the authority of Society through the establishment of Hegemony.” (Prison Notebooks)

দু-জন পৃথক ব্যক্তি, দু-টি আলাদা মহাদেশ— মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রায় চারশো বছর। একজন ঘোষিত সমাজবাদী দার্শনিক অন্যজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; অথচ প্রায় হুবহু একই চিন্তন উদ্ভাসিত হচ্ছে দু-জনের মননে, কার্যক্রমে! একে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সময়োপযোগী উত্তরণ ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভবই নয়। আবার এই প্রবল সাম্যবাদী সন্ন্যাসী সমাজ-সংস্কারক বিশ্বম্ভর কর্ম ও ভক্তি দ্বারা দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে চান। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান সময়পর্বে ভক্ত ও ভক্তির যে-আতিশয্য চতুর্দিকে দেখা যাচ্ছে গৌরাঙ্গের ‘ভক্তি’ তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতের কথা বলে। তাতে স্নেহ, প্রেম, বাৎসল্য, মধুরতা, শান্ত, দাস্য, শখ্য উপস্থিত— এ হল চৈতন্যতত্ত্ব। এখানে হিংস্র অন্ধভক্তির কোথাও কোনো স্থান নেই।

“নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদ্গদরুদ্ধয়া গিরা।
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি।।”

রূপ গোস্বামী সংকলিত চৈতন্যের এই ছয় সংখ্যক পদাবলীটিতে সেই ভক্তি এবং ভক্তি দ্বারা মুক্তির কথা ধ্বনিত হয়। এই মুক্তি কি দেহাবসানের কথা বলে?

না, এই স্বর প্রকৃত অর্থে জাগতিক লালসা ও স্বার্থান্বেষী জীবনচর্যার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ-সাম্যের কথা বলে। এমন অশ্রুধারা যা সংবরণ করা যায় না, কথা বা বাক্ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় তার ক্রিয়া স্তব্ধ করে (এখানে ইন্দ্রিয় নিঃসন্দেহেই পঞ্চেন্দ্রিয়) সুতরাং ইন্দ্রিয় সুখের লোভ পরিত্যাগ করে সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তবে কি বিশ্বম্ভর আরাধ্যের প্রাপ্তিকে সমাজ-সংস্কারের মধ্যে দিয়েই অনুভব করতে চান? না হলে কৃষ্ণনাম ব্যতীত সমাজ-সাম্যের এত বিপুল প্রচেষ্টা তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে কেন? তবে কি সাম্যবাদের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছেন পূর্বসূরির সূত্রে? ভুললে চলবে না ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে মানব-সাম্যের সর্বপ্রথম পাঠ গৌতমবুদ্ধের মহাবৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার ফসল। ‘ধম্মপদ’-এর বুদ্ধবর্গে তিনি বলছেন—

“বহুং বে সরণং যন্তি পরবতানি বনানি চ।
আরামরুকখচেত্যানি মনুসসা ভয়তজ্জিতা।।

দুকখং দুকখসমুপপাদং দুকখসস্ চ অতিককমং।
অরিয়ঞ্চটঠঙ্গিকং মগগং দুকখূপসমগমনং।
এতং সরণামাগমম্ সব্বদুকখা পমুচ্চতি।।”
(শ্লোক: ১৮৮, ১৮৯)

(মনুসসা ভয়তজ্জিতা) ‌মনুষ্যগণ ভয়বিহ্বল হয়ে বনে, পর্বতে, উদ্যানে আশ্রয় নেয়। কারণ দুঃখ থেকে, লোভ এবং হিংস্রতা থেকে উৎপত্তি হয় ভয়ের। কিন্তু এই বহির্জগতের আড়াল উত্তম আশ্রয় কখনোই নয়। তার জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃখের মুক্তি। দুঃখ (দুকখং) ও দুঃখের মায়াকে অতিক্রম করে (দুকখসমুপপাদং) অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে সম্যক সত্য প্রজ্ঞার দর্শনে (সম্মপঞ্ঞায় পসসতি) মুক্তি সম্ভব। গৌতমবুদ্ধ এই সর্ব-দুঃখের পরিত্রাণকে বলেছেন (সব্বদুকখা পমুচ্চতি) আর চৈতন্য বলছেন (প্রোদ্যন্নিখিলপরমান্দপূর্ণামৃতান্ধে) সংসারের সর্বপ্রকার মায়া থেকে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তি, কর্ম-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির এই সত্যের ক্রমানুসন্ধানই অহিংসা ও প্রেমের সামাজিক সাম্যাবস্থার একমাত্র প্রতিষ্ঠা পথ।

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার’/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।” অথবা “নীরব রাত্রি হারাইয়া বাক্/বাহির আমার বাহিরে মিশাক/দেখা দিক মম অন্তরতম/অখণ্ড আকারে।”

‘গীতাঞ্জলি’-র মর্মে মর্মে এক ও অখণ্ডতার কথা কি রবীন্দ্রনাথও বলছেন না? ‘বিহার’ শব্দের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ একইসঙ্গে স্পর্শ করছেন বুদ্ধ ও চৈতন্যকে। এক অর্থে ‘বিহার’ বৌদ্ধ শ্রমণদের বাসস্থান— মুক্তি, শান্তি ও কল্যাণকারী সাম্যের নিরন্তর চর্চার প্রাণকেন্দ্র অন্য দিকে চৈতন্যের বিহার হল ‘প্রেমবিহার’। কীর্তনের মহাভাবে প্রতিনিয়ত শান্তি, মুক্তি এবং সাম্যের বাণীকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

এই পর্বে এসে আশ্চর্য প্রবহমানতায় আমরা লক্ষ করছি, প্রাচীন ও আধুনিক দুই কালচক্রের সমাজকে, তার বিবর্তনকে সাম্যের পারম্পর্যে জুড়ে দিচ্ছেন মধ্যযুগের আর এক লোকতান্ত্রিক দার্শনিক তথা সন্ন্যাসী। মানুষের দুঃখের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টায়, মধ্যযুগীয় সামাজিক অব্যবস্থার বিপক্ষে সরাসরি লড়াইয়ের চেষ্টায় তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামই যে চৈতন্যদেবকে আজ মহত্ত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সে-কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Categories
2021-June-Essay প্রবন্ধ

গৌতম অধিকারী

চৌগাছার নীলবিদ্রোহ: ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়

বাংলাদেশের সংগঠিত নীলবিদ্রোহের ইতিহাসে চৌগাছার বিদ্রোহ গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্রোহের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বর্তমানে চৌগাছা নামে একটি গ্রামের মানুষ ছিলেন। ফলে চৌগাছার বিদ্রোহরূপেই এর পরিচিতি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য এই যে চৌগাছার কৃষকরা বিদ্রোহে অংশ নিলেও প্রতিরোধটি শুরু হয় গোবিন্দপুরে, বর্তমানে নদিয়া জেলার চূর্ণী-তীরবর্তী র্হাঁসখালি ব্লকে যার অবস্থান। বিদ্রোহের প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৮৮০ সালের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় এই বিদ্রোহের প্রথম পরিচিতি প্রকাশিত হয়। রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘A Story of Patriotism in Bengal’। লিখেছিলেন নীলবিদ্রোহের অন্যতম সুহৃদ ও অগ্রণী মানুষ শিশিরকুমার ঘোষ। পরবর্তীতে রচনাটি তাঁর ‘Pictures of Indian Life’ গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। সত্যিকারের কথা হল, এই লেখাটির সূত্রেই বাঙালি গবেষক সমাজ প্রথম চৌগাছার ঐতিহাসিক বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু আমার মনে এই বিষয়ে অন্তত দু-টি ছোট্ট প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে, নীলবিদ্রোহের এত বড়ো লড়াইটা শেষপর্যন্ত প্রচারের আলোয় আসতে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল কেন? দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহের স্থান হিসেবে কোন জায়গাটিকে ধরা হবে? তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে, এই বিদ্রোহের যে-বিশেষ গুরুত্বের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, সমসময় সে-বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল না!

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ প্রণেতা সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, চৌগাছার অবস্থান যশোরের জেলার ঝিকরগাছা থানাধীন। পক্ষান্তরে ‘নদীয়া কাহিনী’-র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক সিদ্ধান্ত করেছেন নদিয়া জেলার চূর্ণী তীরবর্তী গ্রাম চৌগাছা, যার আজকের অবস্থান কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে। কোনো সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্তে আপাতত আমি যাচ্ছি না। শুধু জানিয়ে রাখি পরবর্তীতে এই বিষয়ে যে-সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, তার কোনোটাই শিশিরকুমারের বর্ণিত ঘটনার বাইরে নয়। এবং এইসব লেখাপত্রে চৌগাছার স্থানিক পরিচয় থেকে শুরু করে বিদ্রোহের আসল চরিত্র ও ঘটনা সম্পর্কে গবেষকমহল নিজেদের পছন্দমতো ব্যাখ্যা দিতেই আগ্রহী হয়েছেন। ফলে চৌগাছার নীল বিদ্রোহ বলে কথিত বিদ্রোহের আসল ঘটনা ইতিহাসের আড়ালে গেছে হারিয়ে। হারানো সেই ইতিহাস-অনুসন্ধানে প্রথমে আমরা শিশিরকুমারের রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

শিশিরকুমার জানাচ্ছেন, চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও পোড়াগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস দু-জনেই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীলকুঠিতে কর্মরত দেওয়ান। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছিলেন ছোটো জমিদার (a small Zeminder) এবং দিগম্বর বিশ্বাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মহাজন’, যিনি টাকা ও ধান খাটাতেন সুদের বিনিময়ে (lent money and paddy on interest)। অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা নীলচাষের অংশভাগ, এবং এই সূত্রে উপার্জিত অর্থে সমৃদ্ধ গৃহস্থও বটে। নীলকুঠিতে দেওয়ান হিসেবে চাকরি করতে করতেই তাঁদের মধ্যে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে বিরূপ মানসিকতার জন্ম হয়। কারণ, শিশিরকুমারের মতে— “they were men of indomitable perseverance and courage.” সবচেয়ে বড়ো কথা— “They were, besides, men of heart, and has large share of the intelligence which generally characteristics a Bengali gentleman.” এবং এ-জন্য তাঁরা দেওয়ানের চাকরি ছাড়েন। আর শিশিরকুমার মনে করেছেন— “they were obliged to leave service in disguist, as Dewans of indigo factories, who hearts, had to do in those days.” খুব স্পষ্ট যে সময় ও কালের আহবানে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীলচাষিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন এবং নেতৃত্ব দেন। নেতৃত্ব দেন শুধু নয়, “সম্ভব হলে তাদের একেবারে দেশ-ছাড়া করবার শপথ নিয়েছিলেন।”

কিন্তু নিছক নীলচাষিদের প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা থেকে দিগম্বর বা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস নীলবিদ্রোহের পথে হেঁটেছিলেন, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পুলক চন্দ তাঁর ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন— “বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠির নীলকর হোয়াইটের সঙ্গে মহাজনি কারবারকে কেন্দ্র করে বিশ্বাসের ছিল এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মহাজনিতে তখন তাঁদের প্রবাহী পুঁজি (floating capital) ছিল কম করেও লাখ টাকা। সুতরাং ঐ অঞ্চলে ধানচালের ব্যবসার একচেটিয়া কারবার করার পথে বিশ্বাসেরাই ছিলেন বড়ো বাঁধা।” আবার নীলকর হোয়াইটও নীলচাষের পাশাপাশি ধানের কারবারে অর্থ লগ্নি করতেন। তিনি চাইলেন বিশ্বাসদের মজুদ ধান কিনে নিতে। বিরোধ বাঁধল চুক্তির শর্তাবলীতে। তখন হোয়াইট শক্তি প্রয়োগ করে ধান লুঠ করার চেষ্টা করে এবং বিশ্বাসদের কাছে যে সব চাষী ধার-কর্জ নিয়েছিল, তাদের উপর প্রভাব খাটাতে শুরু করেন কর্জ শোধ না করতে। বোঝা যায়, প্রথম দিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার কারণেই বিশ্বাসেরা নীলকরদের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়। পুলক চন্দের এই বক্তব্যে ‘অন্য সূত্র’ কথাদুটো থাকলেও সূত্রটি স্পষ্ট নয়। যদিও স্বয়ং শিশিরকুমার তাঁর লেখাটিতেও বিশ্বাসদের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন— “In the village Chougatcha, district Nadia, lived two gentlemen babus Vishnu Charan Biswas and Digambar Biswas. They were both men of some property: Babu Vishnu Charan Biswas was a small zamindar, and Babu Digambar Biswas, a Mahajan, that is lent money and paddy with the interest.” ফলে এইসব কারবারকে কেন্দ্র করে সেকালে নীলকর ও স্থানীয় জমিদার ও ভূমধ্যকারীদের মধ্যে হামেশাই বিরোধ লেগে থাকত। এক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবুও এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, টিঁকে থাকার প্রয়োজন এবং আহত মর্যাদা রক্ষার তাগিদ থেকে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস কোমর বেঁধে নীলবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নিষ্ঠায় তাঁরা রেখে যান বিরল দৃষ্টান্ত এবং তাঁদের নেতৃত্বে প্রবল গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্বার্থপর কথা ভেবে পিছিয়ে আসেননি, হারিয়েছেন সর্বস্ব।

গ্রামে গ্রামে চাষিদের কারণে নীলচাষ বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বাসেরা সরাসরি। জানতেন নীলকর সাহেবরা সহজে ছাড়বে না। হিংস্র আক্রমণ নেমে আসবে নিশ্চিত জেনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন, সশস্ত্র চাষিবাহিনীর পাশাপাশি বরিশাল থেকে দক্ষ লাঠিয়াল আনিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে বিষ্ণুচরণের গ্রাম চৌগাছা ছাড়া সাড়া মিলল আর মাত্রা একটি গ্রাম থেকে। শিশিরকুমার লিখেছেন— “All the villages declined to join them except one, and to that village they sent eight spearsmen for its protection. The planter, who was thus defied, resolved to nip the rebellion in the bud, and collect about a thousand men, about one hundred of whom were regulars. Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম অবশ্য শিশিরকুমার উল্লেখ করেননি।

চাষিদের এই প্রস্তুতির খবর নীলকর হোয়াইটের অগোচরে থাকার কথা নয়। অঙ্কুরেই বিদ্রোহকে দমন করতে তার শিবিরেও সাজো-সাজো রব। বিভিন্ন জায়গা থেকে এক হাজার পেশাদার লাঠিয়াল সংগ্রহ করে তৈরি হলেও বাহিনী। ধুরন্ধর হোয়াইট রটিয়ে দিল এক নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ করা হবে চৌগাছা গ্রাম। শিশিরকুমারের বর্ণনা— “The planters spread a rumour to the effect that they would attack the village Chougatcha on a certain day,…” বাস্তবে হোয়াইট তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন ঐ গ্রামটির দিকে, যেখানেই নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের শক্তিশালী প্রস্তুতি। কিন্তু গুজবের শিকার হয়ে গাঁয়ের চাষিরা আটজন শড়কিওয়ালার মধ্যে চারজনকে আগেই চৌগাছা আক্রমণ প্রতিহত করতে পাঠিয়েছিল। ফলে কম শক্তিতে কিছুটা হলেও তারা প্রাণপণ লড়াই করেছিল। পরাজিত হবার পর বিধ্বংসী অত্যাচার নেমে আসে গ্রামে, চলে অবাধ লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষে আহত হয়ে মারা যায় একজন লাঠিয়াল।

প্রথম পরাজয়ের আঘাতে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়তো ভেঙে পড়ত, কিন্তু ভাঙেনি, “এক অশেষ সৌভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতি”-র কারণে, শিশিরকুমারের ভাষায়— “So the first battle was lost, and the combination might have collapsed, but for an extremely lucky circumstances.” সেটি হল, এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছিলেন আর. এল. টোটেনহাম নামে এক উৎসাহী যুবক। এই ঘটনার বিচারের ভার পড়ে তাঁর হাতে। তিনি হোয়াইটকে দোষি সাব্যস্ত করে তিনশো টাকা জরিমানা আদায় করেন। যে-সময়ে নীলকর সাহেবদের সমস্ত অপরাধ সহজেই মাফ করে দেওয়াটাই ছিল রেওয়াজ, সেই সময়ে সামান্য হলেও এই শাস্তিবিধান কৃষকদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। গ্রামে গ্রামে নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রচার তুঙ্গে ওঠে, তৈরি হয় সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিরোধের একটা স্তরে নীলকর সাহেবরা মিথ্যে মামলায় চাষীদের সর্বস্বান্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে, এদের মামলার খরচ, বিপন্ন সংসারের দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে দিগম্বর বিশ্বাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন এই সময় রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী খানিকটা হলেও দিগম্বর বিশ্বাসের পাশে দাঁড়ান।

কিন্তু যে-আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং চাষিদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য এতটা আত্মত্যাগের পথে হেঁটেছিলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস, তা অবশ্য অচিরেই সফল হয়। শিশিরকুমার লিখেছেন— “Another village joined them, and another. Within the course of a year and-a-half they found the factory tottering. The ryots had become then the stronger party. The tidings spread far and wide that the indigo ryots had fought and won against planter.” কাঠগড়া থেকে লোকনাথপুর সব কুঠির অধীন বিরানব্বইটি গ্রামের চাষী-প্রজারা ঘোষণা করে দিল, “বুনব না নীল”। শিশিরকুমারের অভিমত, ১৮৬০-এর নীলচাষ-বিরোধী আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই চৌগাছা থেকেই। শিশিরকুমারের আক্ষেপ উচ্চারিত হয়েছিল প্রবন্ধের একদম শেষে। তিনি লিখেছেন— “Their [Vishnu Charan and Digambar Biswas] names are not even known, and this is the first time that we are induced to give publicity to their doing.”

শিশিরকুমারের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, এই আন্দোলনের সমকালে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। এমনকী নীলচাষিদের একান্ত সুহৃদ শিশিরকুমারও হয়তো সবিস্তার অবগত ছিলেন না। কিন্তু আমরা জানি, এই ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে কর্মবীর শিশিরকুমার তাঁর বড়দার প্রয়াণে কিঞ্চিৎ মানসিক অসহাতার শিকার হয়ে এসেছিলেন নদিয়া জেলার হাঁসখালিতে, বাস করতেন চূর্ণীপাড়ের কালীপাড়ার এক পরিত্যক্ত নীলকুঠিতে। এখানে বসেই ‘শ্রীঅমিয়নিমাই চরিত’ লেখার প্রেরণা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এখানে এসেই সবিস্তারে হয়তো শুনে থাকবেন চূর্ণীপাড়ের নীলবিদ্রোহের কাহিনি, যা লিপিবদ্ধ করলেন ‘A story of patriotism of Bengal’ প্রবন্ধে। চৌগাছার নীলবিদ্রোহ সম্পর্কে পরবর্তীতে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর একমাত্র আকর এই প্রবন্ধটি। কিন্তু শিশিরকুমারের প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে না পড়ে অনেকেই চৌগাছার বিদ্রোহের স্থান সম্পর্কে নিজের নিজের বক্তব্য হাজির করেছেন, তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। আমরা চেষ্টা করব আর কিছু পার্শ্ব উপাত্ত ও শিশিরকুমারের প্রবন্ধের ভিত্তিতে গভীরতর সত্যে পৌঁছুতে। তার আগে অবশ্যই বিভ্রান্তির জায়গাগুলো একটু সামনে আনা দরকার।

‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদার লিখেছেন— “যশোরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন।… চৌগাছা কাঠগড়া কুঠির অন্তর্গত।” ‘যশোর জেলার নীলচাষ: নীলকর ও নীলচাষী সম্পর্ক’ নামের অতীব তথ্যপূর্ণ একটি গ্রন্থে সতীশচন্দ্র মিত্র মজুমদারের কথাকেই অনুসরণ করেছেন লেখক মোঃ রেজাউল করিম। যশোরের ইতিহাস-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘যশোরাদ্য দেশ’-এর রচয়িতা হোসেন উদ্দিন হোসেনও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের বাসস্থান ও বিদ্রোহ-স্থান হিসেবে ‘ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে’-র কথাই বলতে চেয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, যশোরের কাঠগড়া কানসার্ণের অন্তর্ভুক্ত একটি নীলকুঠি চৌগাছা এবং তার অবস্থান কপোতাক্ষ তীরে। কিছু শিশিরকুমারের বক্তব্য থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের লড়াইটা শুরু হয়েছিল বাঁশবেড়িয়া কুঠিবাড়ি নীলকর হোয়াইট সাহেবের বিরুদ্ধে প্রথম। আর নিশ্চিতভাবেই বাঁশবেড়িয়া কুঠির অবস্থান নদীয়ার জেলার মধ্যে। চাকরিসূত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের সম্পর্ক কাঠগড়া কুঠিবাড়ি সঙ্গী ছিল, কেন-না তাঁরা একাধিক কুঠির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বাসদের বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল পালটে যেতে পারে না। সব চেয়ে বড়ো কথা স্বয়ং শিশিরকুমারের লেখাতেই বিদ্রোহের প্রস্তুতি-অঞ্চল হিসেবে মনে করিয়ে দিয়েছেন— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.” নদিয়ার সদর শহর কৃষ্ণনগর থেকে আট-দশ মাইল দূরের এই গ্রামটির নাম আমরা প্রথম জানতে পারছি মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার. বি. ক্লিং-এর গবেষণাগ্রন্থ ‘The Blue Mutiny: The Indigo Dusturbances of Bengal’ থেকে। ব্লেয়ার তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘The Conspirators’ শিরোনামে মহেশচন্দ্র দত্ত, লালচাঁদ সাহা, রতন মণ্ডল প্রমুখের পরপরই লিখেছেন— “Two other minor landlords and moneylenders who became leaders of the peasants had become legendary heroes in Bengal. They were Digambar Biswas and Bishnu charan Biswas, leading Indian employees of the Bansbaria concern in Nadia District.” (pp. 95) অর্থাৎ, ব্লেয়ার আমাদের নিশ্চিত করে দিলেন আরও একবার বাঁশবেড়িয়া কানসার্ণের বিরুদ্ধেই বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, কপোতাক্ষ-তীরের কাঠগড়া কানসার্ণের বিরুদ্ধে নয়। এর পর ব্লেয়ার আবার লিখছেন— “On September 13, 1859, white sent more than hundred Lathials, some mounted on elephants to attack Govindapur.” শিশিরকুমার কথিত— “Mind All this preparation were being made within eight to ten miles of the sadar. station, the town of Nadia.”-ই যে গোবিন্দপুর তাতে বোধ করি কোনো সন্দেহ থাকে না। আর গোবিন্দপুরের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও কপোতাক্ষ তীরের ঝিকরগাছা থানার চৌগাছায় বসে যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা এই, স্বয়ং শিশিরকুমার ছিলেন ঝিকরগাছা থানার পলুয়া-মাগুরার মানুষ, তাঁর অঞ্চলের নীলবিদ্রোহে শুধু নয় গোটা বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। নিজের বাড়ির পাশের বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐ ১৮৫৮-১৮৫৯-এ সংঘটিত বিদ্রোহ সম্পর্কে কুড়ি বৎসর তাঁর অন্ধকারে থাকার কথা নয়।

কৃষ্ণনগর সদর শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরের গোবিন্দপুর বাংলাদেশের সগংঠিত নীল বিদ্রোহের প্রথম রণক্ষেত্র, সংঘাত শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে বগুলা নীলকুঠির অত্যাচারকে কেন্দ্র করে শ্যামনগরের কাল্লু মণ্ডল, আমীর মণ্ডলের নেতৃত্বে। তার বিকশিত রূপের হাল ধরলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস। আর রণক্ষেত্র-কুরুক্ষেত্র তীর্থের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর। যে-সংঘাতের কয়েকদিন পরে আহতাবস্থায় শহিদ হন একজন সড়কিওয়ালা‌। সংগঠিত নীলবিদ্রোহের প্রথম শহিদের নামে আজও বাঙালি জানে না। কিন্তু ঐ বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই শহিদ হয়েছিলেন আর একজন ছোটো ভূমধ্যকারী-গোপাল তরফদার। ইতিহাসে তাঁর কথাও রয়ে গেল উপেক্ষিত।

হাঁসখালির ভূমধ্যকারী ছোটো জমিদার গোপাল তরফদার গোবিন্দপুর আক্রান্ত হওয়ার সময়ে লড়াইয়ের প্রথম সারিতেই ছিলেন। এই সময় কৃষ্ণনগর থানার দারোগা হিসেবে কর্মরত ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু। নীল কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যদাতা এই পুলিশ আধিকারিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘নবজীবন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ (শ্রাবণ ১২৯৩-শ্রাবণ ১২৯৪)। পরের বছর বাংলা ১২৯৫, অর্থাৎ, ইংরেজি ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ঢাকা থেকে এটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানেই, একমাত্র সেখানেই রয়েছে গোপাল তরফদারের শহিদ হবার কাহিনি। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন— “… হাঁসখালির গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদার। সেই ব্যক্তি তাহার গ্রামের প্রজাবর্গের সাহায্যে কুঠির বিরূদ্ধাচরণ করাতে একদিবস রাত্রে একটি হস্তীসমেত কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক গোবিন্দপুর গ্রাম আক্রমণ করিয়া দীন দরিদ্র চাষী প্রজাদিগের যথাসর্ব্বস্ব লুঠপাট এবং অপচয় করে এবং অবশেষে তরফদারকে যৎপরোনাস্তি বে-ইজ্জত করিয়া ধরিয়া লইয়া যায়।” এই সময় নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আর. এস. টটেনহাম (পরে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি)। তাঁর সাহায্যে নানান চেষ্টা করেও গোপাল তরফদারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গিরিশচন্দ্র গোপাল তরফদারের পরিণতি সম্পর্কে লিখেছেন— “অবশেষে শুনিলাম, যে ধরিবার সময় গোপাল তরফদারকে আঘাত করিয়া ধরা হইয়াছিল এবং সেই অবস্থায় তাহাকে নানা স্থানে চালান করাতে, সেই ক্লেশে তাহার মৃত্যু হয় এবং তাহার মৃতদেহ তাহার বন্ধুবান্ধবের হস্তে পড়িতে না পারে, সেই জন্য তাহা নীলের গিঠির দ্বারা জ্বালাইয়া ভস্মসাৎ করিয়া ফেলা হয়।”

খুব সংগতভাবেই শিশিরকুমার তাঁর রচনায় চৌগাছা নীল বিদ্রোহের ব্যাপক প্রভাব এবং সেক্ষেত্রে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক না কেন এই বিদ্রোহের ব্যাপকতায় গোপাল তরফদারের শহিদ হবার ঘটনা ইতাহাসের উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। গোপাল তরফদারের গুম-মৃত্যুর ঘটনায় যে চাষিসমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তার প্রতক্ষ্যদর্শী গিরিশচন্দ্র বসু লিখেছেন— “কিন্তু গোপাল তরফদারের মৃত্যুই নীলকরের কাল হইল‌… গোপাল মরিয়া যেন কৃষ্ণনগর এবং যশোহর জেলার সমুদয় প্রজাকে খেপাইয়া তুলিল। নীলকরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব দাবানলের ন্যায় হুহু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ‘মোরা আর নীল করবো না’ বলিয়া প্রজারা যে সুর ধরিল, তাহা আর কেহ নিরস্ত করিতে পারিল না।” অবস্থা এমন হয়েছিল যে, যে-সাহেবদের ইঙ্গিতে শত শত লাঠিওয়ালা-সড়কিওয়ালা‌ দাঁড়িয়ে পড়ত, তারাই ভয়ে “স্বীয় স্বীয় প্রাণরক্ষার নিমিত্ত গবর্ণমেন্টকে কৃষ্ণনগর ও যশোহর জেলার স্থানে স্থানে অশ্বারোহী সেনা আনিয়া স্থাপিত করিতে বাধ্য করিয়াছিল।”

ফলাফল এ-কথা বোধহয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই নীলবিদ্রোহের মগজ যদি হয় চৌগাছা, প্রতিরোধের নাম হাঁসখালি-গোবিন্দপুর।

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ

সোমা মুখোপাধ্যায়

গয়নাবড়ি শিল্পী পুতুল অধিকারী

পুতুল অধিকারী

আমরা বলি মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এই মাছের ঝোল-সহ নানা রান্নাকে সুস্বাদু করতে ব্যবহার করা হয় নানা কিছু। তার অন্যতম হল বড়ি। কলাই, মুসুর, মুগ, মটর নানা ডালের বড়ি। একসময় মা ঠাকুমারা ভালো করে বেটে হাতে করে দিতেন। ব্যাবসার জন্য এখন যন্ত্রের আমদানি। তবু বড়ির রমরমা সব সংসারেই।

বাঙালির প্রিয় হল ভাত ডাল দিয়ে বড়িভাজা খাওয়া। আর এই ভাজা বড়ির এক বিশেষ রূপ গয়না বড়ি বা নকশা বড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, তমলুক এইসব অঞ্চলের মা বউদের তৈরি। এই বড়ি শুধুমাত্র ভাজা হয়। আর এর তৈরির পদ্ধতিও আলাদা।

 

গয়নাবড়ি

বেশ কয়েকবছর ধরে নানা সরকারি মেলায় পূর্ব মেদিনীপুরের স্টলে দেখতাম একজন মহিলা সুন্দর গয়নাবড়ি বিক্রি করতেন। ওঁর নাম পুতুল অধিকারী। গয়নাবড়ি কেনার সূত্র ধরেই আলাপ আর তারপরে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে তিনি হয়ে যান পুতুলদি। মহিষাদল ব্লকের ঘাগড়া গ্রামের সাদামাটা গৃহস্থ বধূ পুতুলদি শুধু একজন বড়ি শিল্পীই নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। বহু মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। দেখিয়েছেন তাঁদের রোজগারের রাস্তা। মা ঠাকুমার অন্দরের এক রত্নকেই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবার মাঝে। এভাবেই সবলা মেলা, সরস মেলা হয়ে পুতুল অধিকারী দিল্লির প্রগতি ময়দানেও তাঁর গয়নাবড়ির সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

গয়নাবড়ি তৈরির একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এই বড়ির জন্য লাগে বিড়ি কলাই। আষাঢ় শ্রাবণে এই গাছ বুনে আশ্বিন মাসের দিকে উপড়ানো হয়। এই তিন মাসে গাছ হয়ে কলাই পেকে যায়। এরপরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিয়ে একটা ভারী কিছু দিয়ে কলাইগুলোকে মাড়িয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, কলাইগুলোকে বের করে নেওয়া হয়। এরপরে ওগুলো জাঁতায় পেষা হলে ওগুলো ভেঙে দু-খোলা হয়। এরপর সকালে ভিজিয়ে দিয়ে বিকেলে একটা একটা করে খোলা বেছে বাটা হয়। ব্যাবসার বড়ির ডাল মিক্সিতে বাটা হয়। ঘরের বড়ির জন্য শিলে বাটা হয়। এই ডাল বাটা ঠান্ডা জায়গায় অনেকক্ষণ রেখে দিতে হয়। কারণ, মজে গেলে তবেই ফেটালে তা একেবারে নরম তুলতুলে হয়।

গয়নাবড়ি

আমাদের মেয়েদের নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি এই রান্না আর তার উপকরণ বানানোতে ছড়িয়ে আছে। গয়নাবড়িতেও তার প্রভাব আছে। একসময় ডাল বেটে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া হত যাতে ভালোভাবে মজে যায়। এখন সবাই ফ্রিজে রাখে। আর ফেটানোর পরে অল্প একটু মিশ্রণ একটা জলভরতি জায়গায় দেওয়া হয়। যদি তা‌ ভেসে থাকে তবেই তা ঠিকমতো ফেটানো হয়েছে বলে ধরা হয়। আর যদি ডুবে যায় তাহলে আবার ফেটাতে হয়। এটা একটা প্রারব্ধ জ্ঞান।

ডাল ঠিকমতো ফেটানো হলে শুরু হয় গয়নাবড়ি দেবার বিশেষ পর্ব। খুব ভোর থেকে এই বড়ি দেওয়া শুরু সকাল অবধি তা চলে। এমনি বড়ির ক্ষেত্রে এই ডালবাটা থেকে নিয়ে আঙুলের সাহায্যে বড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু গয়নাবড়ির নিয়ম একেবারেই আলাদা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হল টিনের চোঙ। একটা পলিথিন বা কাপড়ে ছোটো ফুটো করে এই চোঙটা ঢোকাতে হবে। এরপর ঐ ডালবাটা পলিথিন বা কাপড়ে নিয়ে চোঙের মাধ্যমে নকশা ফুটিয়ে তুলতে হবে পোস্ত ছড়ানো বড়ি দেবার পাত্রে। পোস্ত দেওয়ার ফলে বড়ি শুকিয়ে গেলে তুলতে অসুবিধা হবে না। যাঁরা বড়ি দেন তাঁরা মন থেকে নকশা করে চলেন। এই কারণেই তাঁরা শিল্পী। এই নকশা যত সূক্ষ্ম হবে গয়নাবড়ি তত দেখতে এবং খেতেও ভালো হবে। সাধারণত এক কেজি ডালে ৮০-৮৫টা বড়ি হয়। ব্যাবসার বড়ির ক্ষেত্রে ১০০-১২৫টা মতো করা হয়। ইদানীং অনেকেই গয়নাবড়িতে চালবাটা মিশিয়ে যেন‌ তেন প্রকারেণ একটা কিছু তৈরি করে বাজারে বিক্রির জন্য। এই বড়ি দৃষ্টিনন্দন তো নয় উপরন্তু মোটা এবং স্বাদেও ভালো হয় না।

ডাল ফেটানোর ওপর গয়নাবড়ি কতটা হালকা হবে তা নির্ভর করে। আবার হালকা হলেই সুন্দর নকশা হয়। আঞ্চলিক ছড়াতেও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে—

‘চায়ের সাথে পলকা বড়ি
আতিথেয়তার নেইকো জুড়ি’

‘গয়না বড়ি এতোই হালকা
তেল জোগাতে পকেট ফাঁকা’

আবার গয়নাবড়ি উপহারের সামগ্ৰি তাও এইসব ছড়ায় তার প্রতিফলন দেখা যায়—

‘মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সাথী হল গয়নাবড়ি’

গয়নাবড়ির আদর্শ সময় শীতকাল। শীতের মিঠে রোদে মেয়েরা দলবেঁধে এই বড়ি দেন। সাধারণত কার্তিক মাসের পেড়ো ষষ্ঠী থেকে শুরু করে ফাল্গুনের শিবরাত্রি অবধি এর সময়কাল। আসলে এর পরে গরম পড়ে যায়। আর বর্ষায় তো বড়ি হবেই না। ভারি সুন্দর লাগে আমাদের এই মরসুম বা ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে খাবার তৈরির সম্পর্ক। এটাই হয়তো প্রাচ্যের বিজ্ঞান ভাবনা। যা মায়েরা লোকাচার নামে অভিহিত করেন।

একসময় অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে দিয়ে পুতুল অধিকারী তাঁর ব্যাবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কাঠের ব্যাবসায়ী। বিবাহ সূত্রে তিনি ঘাগড়া গ্ৰামের বাসিন্দা হন। সংসারের অভাব অনটনে তিনি মানুষের এই নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং এক পরম্পরার শিল্পকে নিয়ে আসেন রোজগারের মাধ্যমরূপে। শুরুতে আশেপাশের বাজার আর অফিস কাছারিতে গিয়ে গিয়ে বড়ি বিক্রি করতে থাকেন। ২০০৪ সালে তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। শুরু হয় সরকারি মেলায় যোগদান। না, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এই সূত্র ধরেই নানা জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে। দুই সন্তান আর নাতি-নাতনির ভরা সংসারের সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন মেয়েদের সংসারের হাল ধরবার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। শিল্পী থেকে হয়েছেন‌ উদ্যোগপতি। গয়নাবড়ির পাশাপাশি তিনি মশলাবড়ি, সাদা ডালের বড়ি, চালকুমড়ো বাটার বড়ি এইসব তৈরি করেন। তবে তাঁর পরিচিতি গয়নাবড়ির কারণেই।

‘সবলা’ মেলায় পুতুল অধিকারী (বাঁ-দিকে)

পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে এই গয়নাবড়ি প্রথম দেখি প্রায় কুড়ি বছর আগে। আমাদের অফিসের কাজে গিয়ে ফেরার পথে একজন সহকর্মী উপহার দিয়েছিলেন। একটি বাড়ির লাগোয়া দোকানে ছিল। ঐ বাড়ির মেয়েরাই করতেন। একটা ছোটো সস্তা পিচবোর্ডের বাক্সে অপটু হাতে সেলোফেন কাগজে মুড়ে আঠা লাগানো। আসলে এটা এত পলকা যে সহজে নষ্ট হয়ে যায়। যাইহোক তখন জেনেছিলাম এটি স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয়। বেশি করে রপ্তানির কথা ওঁরা ভাবছেন। সে-সময়ে আমাদের যিনি অফিসার ছিলেন তিনি বলেছিলেন মজা করেই যে, এই গয়নাবড়ি একেবারেই ক্ষণস্থায়ী শিল্প। সত্যি এর শৈল্পিক দিকটা এত সুন্দর যে, এটা খেতে ইচ্ছে করে না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ এটিকে কলাভবনে সংরক্ষিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর ‘নকশি বড়ি’ নামটা দিয়েছিলেন অবন ঠাকুর। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই গয়নাবড়িকে বঙ্গমাতার ভাঙা ঝাঁপির রত্ন বলেছেন।

১৯৩৪ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে পড়তেন মেদিনীপুরের সেবা মাইতি। তাঁর মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবীর তাঁকে উপহার পাঠানো গয়নাবড়ি দেখে তাঁদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

“শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী ও শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবী কল্যাণেয়ষু,
তোমাদের হাতে প্রস্তুত বড়ি পাইয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিলাম। ইহার শিল্পনৈপুন্য বিস্ময়জনক। আমরা ইহার ছবি কলাভবনে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছি। তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিবে।

শুভাকাঙ্খী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতি ২১শে মাঘ/১৩৪১”

এই ঘটনাটি যেন একটা আঞ্চলিক ছড়াকেই মনে‌ করায়—

“উপহারে নকশা বড়ি
সাফল্য আনে পুরোপুরি।”

প্রয়াত লোকসংস্কৃতিবিদ নির্মলেন্দু ভৌমিক ব্রতের আলপনার মাঝে গয়নাবড়ির উৎস লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, “গয়না হল স্ত্রীলোকের অন্যতম কামনার বিষয়। তাই ব্রতের আলপনায় ব্যবহৃত সেই ভঙ্গিটি এবং সংলগ্নতার বিষয়টি গয়নাবড়ি তৈরির অনুপ্রেরণা হতে পারে।”

গয়নাবড়িকে আঞ্চলিক সীমানা পার করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পুতুল অধিকারীকে অবশ্যই কুর্ণিশ জানাতেই হয়। এক বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারি তিনি। তাঁর দল ঘাগরা সন্তোষী স্ব স্বসহায়ক দলের একজন সাধারণ সদস্য তিনি। এছাড়া উনি একজন সংঘনেত্রী। এই সংঘের নাম ‘কিসমৎ নাইকুন্ডি নতুনভাবে জীবন বহুমুখী প্রাথমিক মহিলা সংঘ সমবায় লিমিটেড।’ এছাড়া নানা অ্যাকটিভিটি ক্লাস্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এর মধ্যে আছে ব্লক স্তরে খুশি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার এবং বুথ স্তরে ঘাগড়া কৈলাসনাথ গয়নাবড়ি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের বড়ি তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে কীভাবে তার বিপণন সবটাই শেখান পুতুল অধিকারী। এই কাজে তাঁর বউমা সুস্মিতা অধিকারীও তাঁকে সহায়তা করেন। এছাড়াও পাটজাত নানা সামগ্রী তিনি তৈরি করেন। নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নিদর্শন শিল্পী পুতুল অধিকারী।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা:
১. সন্তোষ কুমার কুন্ডু, বাংলার পেশাভিত্তিক লোকায়ত কুটিরশিল্প, লালমাটি, কলকাতা, ২০১৯।
২. কমলকুমার কুন্ডু, গয়নাবড়ি: এক অনুপম শিল্প নিদর্শন, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৪।
৩. বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রীমতী রঞ্জনা মন্ডল, গবেষক।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

কিংকর দাস

পুরাতনী প্রজ্ঞা অথবা পরম্পরাগত জ্ঞান

১৯৬৯ সালের ২১শে জুলাই ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে মার্কিন চন্দ্রযান অ্যাপোলো ইলেভেন ঈগল যন্ত্রাংশ থেকে বেরিয়ে চঁদের মাটিতে পা রাখলেন প্রথমে নীল আর্মস্ট্রং এবং পরে এডউইন অলড্রিন। আমার বয়স তখন সাত। আমার দাদার সতেরো। তখন অডিয়োভিসুয়াল মিডিয়ার দবদবা শুরু হয়নি। বিশ্ব ও পারিপার্শ্বিক সচেতনতা সম্পর্কে ছাত্রসমাজ ততখানি সবজান্তা সর্বস্ব মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। তবে চাঁদে মানুষের পদার্পণ ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা— সে-ঘটনায় সারা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় উঠেছিল। আমার দাদাও তার ব্যতিক্রম নয় এবং দাদা কৌতূহলবশত আমার ছোটো দাদুকে ঈষৎ টিপ্পনি কেটে বলেছিল— কই দাদু, তোমার চন্দ্রদেবের দেশে তো মানুষ গিয়ে পৌঁছাল— তো সেখানে তোমার চন্দ্রনাথ তো দূরের কথা প্রাণের টিকিটি পর্যন্ত দেখা মিলল না। দাদার এমনতর প্রশ্ন শুনে অশীতিপর আমার ছোটো দাদু মুচকি হেসে বলেছিল— অর্বাচীন কিশোর, পুরাণে দ্বাদশ চন্দ্রের উল্লেখ আছে, যে-চন্দ্রগৃহে চন্দ্রদেবের বাস সেখানে মানুষের সাধ্য কী পা রাখার। এ-বিষয়ে আমার দাদু একা নয়। এরকম অনেক মানুষের সন্ধান পেয়ে যাবেন যাদের বৌদ্ধিক ধারণায় বিশেষ বিশেষ বিষয় সম্পর্কে পুরাতনী প্রজ্ঞাটি এমনই অটল এবং অনড় যে, সেই সম্পর্কিত ধারণাটি তাঁরা লালন পালন করেন এমন নয়, তাকে অভ্রান্ত বলে মনে করেনও এবং তাকে নির্বিশেষ করে তুলতে চান— বংশপরম্পরাগত বা যুগ যুগ ধরে লালিত সাবেকি বা চিরাচরিত জ্ঞানচর্চার ফলশ্রুতির নিরিখে।

আমার যেখানে বাড়ি— সেই খড়গপুরের মালঞ্চগ্রামের চণ্ডিপুর পাড়ায়। সেই পাড়াতে বাড়ি রহমত মিঞার। রহমত একজন ধর্মপ্রাণ সরল মনের মানুষ। মক্তব পর্যন্ত তার পড়াশোনা। আপনি রহমতকে জিজ্ঞাসা করুন— চাঁদে মানুষ যাওয়ার প্রসঙ্গে, তা হেসে কুটোকুটি হবে সে। কারণ, মৌলবী সাহেবের পুরাতনী প্রজ্ঞা মোতাবেক বিদিত— চাঁদে গিয়েছিল মাকড়শা আর মহম্মদ আকবর। আর রহমতের সাবেকি জ্ঞানে— সে-ধারণা অটুট এবং চিরস্থায়ী। দু-টি ক্ষেত্রে পুরাতনী প্রজ্ঞা ও সাবেকি বা চিরাচরিত জ্ঞান আপ্তবাক্য তুল্য হয়ে গেছে এবং তা অনুশীলিত হয়েছে— পরম্পরাগত বিশ্বাস—বশবর্তী হয়ে। কোনো ক্ষেত্রেই সত্যতার যাচাই, কার্য-কারণের শৃঙ্খলাগত সূত্রে পরীক্ষিত হয়নি এবং তাদের ধারণায় বৌদ্ধিক স্তরে বিষয়টি প্রজ্ঞা বলে বিবেচিত হয়েছে আর সে-প্রজ্ঞা যেহেতু প্রাচীন ও সনাতন বলে মান্যতা পেয়েছে— তাই যুক্তি শৃঙ্খলা খুঁজতে যাওয়া তাদের কাছে অবান্তর বলে মনে হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এদের কাছে যুক্তি শৃঙ্খলাক্রমটি সর্বতোভাবে বীজগণিতীয় আংকিক পদ্ধতির সমস্যা সমাধানের জন্য ধার নেওয়ার মতো কিছু একটা, যেমন x = y কিন্তু x = y কখনো হতে পারে না। x ও y দু-টি ভিন্ন বস্তু বা অবস্থা বা পরিচায়কবাহী সত্তা, সুতরাং x ও y স্বতন্ত্র। কোন মতেই অভিন্ন নয়। একে-অপরের পরিপূরক বা সম্পূরকও নয়, তবুও একটিকে অপরটির কোনো এক অর্থে সর্বতোসমান ধরে সত্যের সমীপবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু সত্য নামক বিষয়টি যে চূড়ান্ত কোন বিষয় বা সিদ্ধান্ত নয়— তা আমার দাদুর বা রহমত মিঞার বোধে ধরা পড়ে না। এ-জন্য নচিকেতা যখন যমকে প্রকৃত সত্য কাকে বলে এমনতর প্রশ্ন করে বসে, তখন যম বাবাজীবনের তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-র মতো অবস্থা; কেন-না সত্যের সেবক-পালক ও ধারক ধর্মরাজ যম ভালোভাবেই জানতেন— ‘সত্য’ নামক বিষয়টা বড়োই গোলমেলে— তা সরল ও একরৈখিক নয় বরং বহুমাত্রিক জটিল ও কূট; তাই আমতা আমতা করে জোড়াতালি গোছের কিছু একটা বলে, ভুজুং ভাজুং করে নচিকেতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কেন-না তিনি তো জানেন— তিনি এমন বলতে পারছেন না যে, সত্য মানে যাহা প্রকাশমান, তাহলে সত্যের অপলাপ করা হবে, যেহেতু অপ্রকাশমান সত্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে— যাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার বা বর্জন করতে হয়; আবার এমনও বলতে পারছেন না যাহা সত্য তাহাই সত্য, তাহলে এক্ষেত্রে কার্যকারণের যুক্তি শৃঙ্খলাকে অস্বীকার করতে হয়। তাই পুরাতনী প্রজ্ঞা আর সাবেকি জ্ঞানের অভ্রান্ততা বিষয়ে আলোচনাক্রমটি সত্যতার যথার্থতা চেয়ে বসে।

পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও বিশ্লেষণে বিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সত্যের বন্ধনটি যদি সোজা না হয়— তাহলে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যে কতখানি ভ্রমাত্মক হতে পারে তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মান বিজ্ঞানী কখ্‌-এর জীবাণুর জন্ম সংক্রান্ত পরীক্ষাটি, কখ্ একটুকরো খড় ফ্লাস্ক বন্দি করে দেখিয়েছিলেন বাইরের কোনোরূপ সংস্পর্শ ছাড়াই ফ্লাস্কের ভিতরে জীবাণুরা কীভাবে আপনা-আপনি জন্মাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কখ্-এর পরীক্ষণে কার্যকারণ সূত্রের সত্যটি যথাযথভাবে অনুশীলিত না হওয়ায়— বিষয়টি যে অভ্রান্ত নয়— তা অচিরেই প্রমাণ করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। কখ্-এর সিদ্ধান্তরূপ প্রজ্ঞাটি ততদিন অভ্রান্তরূপে বিবেচনা পেয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত না পাস্তুর কখ্-এর ঐ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছিলেন— ফ্লাস্কের ভিতরে ঢোকানো খড়ের কুটোটি জীবাণু মুক্ত ছিল না। ফলে ট্রাডিশনাল নলেজ এবং পুরাতনী প্রজ্ঞার বিষয়টি যে সর্বাত্মক নির্বিরোধ— নিঃসংশয়— সন্দেহহীন— অভ্রান্ত এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এ-দুয়ের মধ্যে যুক্তি প্রতিযুক্তির শৃঙ্খলাক্রমটি যত বেশি বেশি করে সংঘটিত হতে থাকবে— তত বেশি করে সত্যের সমীপবর্তী হওয়া সম্ভবপর হবে। আর তা যদি বেদবাক্য তুল্য আপ্তবাক্যরূপে প্রতীতি লাভ করে, তাহলে বিষয়টি আপাত বিরোধশূন্য বলে পরিগণিত হলেও তা সত্য থেকে (কেন্দ্রাভিগ) সেনট্রিফুগাল হয়ে পড়ে এবং যুগ যুগ ধরে এমন ভ্রমময় প্রজ্ঞাকে সত্য রূপে গ্রহণ করে বসে আর ট্র্যাডিশেনাল থটপ্রসেস তা লালিত হতে হতে ধ্রুবরূপে বিশ্বাস লাভ করে অনুশীলিত হতে থাকে। এ-কথা তো ঠিক যে কোপারনিকাস ও গ্যালিলিও, পূর্ব পৃথিবীতে যারা জন্মেছেন এবং পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন— তারা এটাই জেনে গেছেন সূর্য নামক জ্যোতিষ্কটি পৃথিবী নামক গ্রহের চারপাশ জুড়ে ঘুরে চলেছে। আদপে ‘সত্য’ শব্দটি সম্পর্কে জনমানসে আজন্মলালিত ভ্রান্ত বদ্ধমূল ধারণাটি— সত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানলাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে— ফলে wisdom এবং knowledge এ-দু-টি বিষয় একধরনের চরম ও চূড়ান্ত বা পরম মান্যতা লাভ করে বসে। প্রকৃতপক্ষে বস্তুগত জগৎ থেকে আদিম মানুষ কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে আকস্মিক ঘটনাকাণ্ডে জ্ঞান অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল, তারপর সেই অধীত জ্ঞানকে অনুশীলন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানী প্রজ্ঞায় পরিণত করে— সেই বিশেষ জ্ঞানকে সাধারণ জ্ঞানে পর্যবসিত করেছে। এই বিশেষকে সবিশেষ বা নির্বিশেষ করে তোলাই ছিল primitive society-র সভ্যতার সাথে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যে কিন্তু তা সচেতনকৃতভাবে সংঘটিত হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। বরং কিছুটা জ্ঞানে, কিছুটা ব্যবহারিক প্রয়োজনে এবং কিছুটা অজানিতভাবে সাধিত হয়ে থাকলেও— সে-প্রয়াস নিশ্চয় বা অনড় ছিল না— তা মন্থর হলেও গতিশীল ছিল। গতিশীলতার এই প্রেক্ষিতটি গড্ডালিকা প্রবাহ অনুসরণকারী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জনমানসে অনুভূত হয়নি। হয়নি বলেই আজও অধিকাংশ জনমানসে বিজ্ঞান ও সত্য সমার্থকবাচক অভিধার প্রতীতি জন্ম দেয়। আমরা কলকাতার দেওয়ালে বড়ো বড়ো হরফে লিখিত লেখন দেখেছি— মার্কসবাদ সত্য— কারণ, ইহা বিজ্ঞান। যাঁরা এটা লেখেন তাঁরাও ‘সত্য’ সম্পর্কিত বিষয়টির অর্ধসত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে। কেন-না সামাজিক সত্য কখনোই পদার্থবিদ্যা বা রসায়ণ বিদ্যার সত্যের ধ্রুবকের মতো সমপদবাচ্য হতে পারে না। তাছাড়া সত্য চির-অব্যাভিচারী বিষয়ও নয়। নিয়ত ব্যাভিচারী বলেই তার স্থিরাঙ্ক নির্ণীত হতে পারে না। আসলে সত্য সম্পর্কিত এই যে স্থাণু ধারণা— তার এইরূপ প্রেক্ষিতটি তৈরি হয়— অন্ধভাবে— হওয়ায় এবং সত্যকে একটি চরম ধ্রুবকরূপে গণ্য করার মধ্য দিয়েই। ফলে অনেক সময় আপাত সত্যকেই চূড়ান্ত সত্য বলে বিবেচনা করে বসে। এর ফলে দৃষ্টিগোচর জগতেও যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে— তেমনি আপাত দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়— এমন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। দৃশ্যগ্রাহ্যতার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি নিরসনের বিষয়টি আপাত দৃশ্যগ্রাহ্য নয়— এমন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিভ্রান্তির স্থায়িত্ব যত দীর্ঘতাপ্রাপ্ত হবে তার ফলও যে তত মারাত্মক বা বিষময় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে। শরবতওয়ালা তার কাচের জলভরা গ্লাসে ক্ষুদ্র আকারে শরবতী লেবুটিকে রেখে প্রকৃত আয়তন সম্পর্কে গ্রাহকের মনে যেরূপ ভ্রান্তির সৃষ্টি করে সে-ভ্রান্তি আপতিক; কেন-না লেবুর প্রকৃত অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগোপন থাকছে যতক্ষণ পর্যন্ত লেবুটি জলভরা পাত্রের মধ্যে নিমজ্জমান। জল থেকে লেবুটি তুলে ফেললেই ভ্রান্তির নিরসন ঘটে। এক্ষেত্রে আপাত দৃশ্যমানজনিত যে-বিভ্রম তা সুদূরপ্রসারী নয়। কিন্তু আজও আমাদের সমাজ জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলির জন্ম পুরাতনী প্রজ্ঞার যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না থাকার ফলে সামাজিক জীবনে যে-বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে— তার বিষফল আমরা এখনও ভোগ করে চলেছি। সেইরকম একটি সামাজিক প্রেক্ষিত এই আলোচনার প্রতিপাদ্য।

বৈদিক সমাজে শ্রেণিবিন্যাসের বর্গ বিভাজন নির্ণয় হয়েছিল শ্রম-চরিত্র অনুসারে। কালক্রমে সেই শ্রেণি বর্গবিন্যাস জাতিসত্তায় সমার্থবাচক হয়ে উঠল। প্রজ্ঞা বলে সেদিনকার সেই বর্গীকরণ হয়েছিল সেবা ও কায়িক শ্রমের নিরিখে-জন্ম সূত্রে নয়। অর্থাৎ, ব্রহ্মবিদ্যা জানা ও বোঝা ও অধী করার বোধ সম্পন্ন মস্তিষ্কই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য বলে গণ্য হবেন। আর এই মান্যতা সমাজই তাকে দিয়েছিল— ঈশ্বর নয়। তিনি ঈশ্বর-বিকল্প প্রতিভূরূপে গণ্য হচ্ছেন একটি সামাজিক তথা রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রয়োজনে, ক্ষত্রিয়বর্গের— চাষবাসের তথা খাদ্য উৎপাদনের শ্রমজীবি হিসেবে বৈশ্য বর্গের যেমন প্রয়োজন হয়েছিল— তেমনই দরকার ছিল সমাজের এই তিন বর্গের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় অন্যান্য কায়িক শ্রমনির্ভর কাজকর্মের জন্য— শূদ্র বর্গের। মনে রাখতে হবে দ্রব্য বিনিময় প্রথার মধ্য দিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্র তখন প্রসারমান তাই তখনও পর্যন্ত বণিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটেনি, তাই জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণত্ব— ক্ষত্রিয়ত্ব— বৈশ্যত্ব বা শূদ্রত্ব অর্জন ঘটবে— শ্রেণি বর্গ বিভাজনের সময় এমনতর কোনো ঘোষণাই ছিল না। তাই ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণই হবে— এমনতর বিধান বেদেও উল্লেখ নেই। কায়েমী চক্রের নিজ নিজ শ্রেণি-স্বার্থের তাগিদে মেধার বিষয়টি উপেক্ষা করে স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিলেন। ফলে যে-মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে চতুঃবর্গের সৃষ্টি হয়েছিল— তা পর্যবসিত হল জাতপাতের সংকীর্ণ জাতিবাচক শ্রেণিগোত্রে। সে-কারণে ব্রহ্মবিদ্যার লেশটুকু না থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণের সন্তান— ব্রাহ্মণের পদবাচ্য হয়ে উঠল— ঠিক তেমনিভাবে ক্ষত্রিয়— বৈশ্য— শূদ্রদের বেলাতেও সেই বাস্তব সমানভাবে সত্য হয়ে উঠল। যুগ যুগ ধরে একটি প্রজ্ঞা (wisdom)-এর বিকৃত ব্যবহারে পরম্পরাগত (Traditional) জ্ঞানে (Knonwledge) প্রকৃত বাস্তবটি আড়ালে থেকে গেল। আমরা পেলাম জাতপাতের বিন্যাসে এক অভিশপ্ত সমাজ। যেখানে জন্মসূত্রে একধরনের মানসিক পঙ্গুত্বের শিকার হল শূদ্র বর্গের নবজাতকেরা। বিশেষ করে— সেবাদাস উপশ্রেণির শূদ্রেরা। আজও তার রকমফের ঘটেনি। রামমোহন রায় পুরোহিতদের বেদকেন্দ্রিক ভণ্ডামির মুখোশটিকে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়ে সংস্কৃত না জানা আমজনতার জন্য বেদান্ত সমূহের বাংলাতে অনুবাদ করেছিলেন— সেই ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অলস বাঙালিকুল সেদিকে মুখ তুলে তাকায়ওনি, ফলে ব্রাত্যজনদের হাহাকার বেড়েছে বৈ কমেনি। গান্ধীজি যতই তাদের হরিজন বলে আখ্যায় বিভূষিত করুক না কেন— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘মেথর’ নামক কবিতাতে তাদের যতই শুচিশুভ্র বলে গৌরবান্বিত করুক না কেন— বর্গীকরণে বিষবৃক্ষের শিকড় এত গভীরে নিমজ্জিত যে, কেবল ব্রাত্যজনের পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে শ্রেণিকক্ষের বাইরের দালানে বসে পড়াশোনা করতে হয়েছে ভারতের সংবিধানের জনককে।

আসলে মূল সমস্যাটিকে বৌদ্ধিক স্তরে বিবেচনা করে তার সঠিক নিরসনের নির্দ্ধারণ না করে বাইরের দিক থেকে গৌরবের প্রলেপ দেওয়ার ব্যাপারটি মারাত্মক রকমের হাস্যকর ও ক্ষতিকারক। হাস্যকর সে-কারণে গান্ধীজির ‘হরিজন’-রা ফিরে গেছে দলিত ঘরে। আর ক্ষতি? আজও আমাদের শিশুপাঠ্যে ‘সমাজবন্ধু’ শীর্ষক একটা চ্যাপ্টার আছে— যেখানে ‘কুমোর-কামার-মুচি-মেথর-ছুতোর-ঝাড়ুদার-ডোম ইত্যাদি’ শ্রেণির কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা আছে এবং শিশুমনকে এও জানানো হচ্ছে যে, আপাত নিকৃষ্ট এইসব কাজগুলি ওইসব শ্রেণির লোকেরা করে বলেই তারা মহান। মহানত্ব প্রকাশের নমুনা এর চাইতে আর কি ভালো হতে পারে। অথচ ধরুন, কোনো একটি সরকারি স্কুলে লটারিতে এক ব্রাহ্মণের ছেলে এবং কোনো এক সাফাইকর্মীর ছেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও শ্রেণিকক্ষে যে-প্রতিস্পর্ধী সাহস নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্নের উত্তর ব্রাহ্মণ ছেলেটি যেভাবে মাথা তুলে দিতে পারে— ব্রাত্যজনের পরিবারের সন্তানটি ঠিক সেইভাবে মাথা তুলতে পারে না। পারে না অনেক সময় শিক্ষকদের কারণেও। কেন-না বহুকাল আগেই সমাজ তার মাথা নত করে দিয়েছে। এই নত করার পেছনে এক সচেষ্ট ভ্রান্তি আছে। যে-ভ্রান্তির জন্ম হয়েছিল wisdom-এর হাত ধরে। যে-wisdom আজ পোক্ত ও পুরাতন আর Traditional Knowledge তার ধারক ও বাহক। তাই wisdom মাত্রই চূড়ান্ত অভ্রান্ত এমনটা নাও হতে পারে— আবার সেই wisdom, traditional knowledge দ্বারা যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত হলেও তা অভ্রান্ত না-ও হতে পারে। শবকে কাঁধে বহন করা হয় সৎকারের উদ্দেশ্যে, কিন্তু বহু যুগ ধরে আমরা জাতপাতের যে-শবকে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছি তার সৎকার কবে হবে কে জানে। আর তাই তো আমার দাদু কিংবা রহমত মিঞার traditional knowledge-টি বেশ পাকাপোক্তভাবেই বেঁচে বর্তে থাকে— যুগ যুগ ধরে।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

সোমা মুখোপাধ্যায়

বাংলার পুতুল ও লোকপ্রযুক্তি

বাংলার পুতুল নিয়ে অনেকেই গবেষণালব্ধ সুন্দর কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন তারাপদ সাঁতরা, আশিস বশু থেকে সাম্প্রতিক সময়ের বিধান বিশ্বাসের মতো নামিদামি মানুষেরা। পুতুল নিয়ে বই লিখতে গিয়ে আর শিল্পীদের জীবনচর্চা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি এই পুতুলের মধ্যেই রয়েছে বাংলার লোক প্রযুক্তির এক মূল্যবান দলিল যা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতোই এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত হয়েছে।

আগুনের ব্যবহার থেকেই মানুষের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন শুরু হয়। একসময় অরণ্যচারী যাযাবর মানুষ কৃষি আবিষ্কার করে স্থায়ী বসতি বিস্তার করে। বাংলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পাণ্ডুরাজার ঢিপি থেকে আবিষ্কৃত খৃপূ আনুমানিক ১২০০ অব্দের মাটির টেপা পুতুল আর একসার জালবন্দি মাছ ও মুখে সাপ ধরা ময়ূরের চিত্রায়িত মাটির তৈজসপত্রের ভাঙা টুকরো থেকেই প্রমাণ হয় যে, সেই সময় এই অঞ্চলে মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিল।

চাষের সঙ্গে বাসের যে একটা সম্পর্ক তা সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন। অর্থাৎ, মানুষ যাযাবর জীবন থেকে চাষের বা কৃষিকাজের মাধ্যমেই স্থায়ী জীবনে থিতু হয়ে বসে। নিপুণ হাতে গড়ে তার গৃহস্থালী আর সেই গৃহস্থালির নানা কিছু বা চারপাশটাকে সুন্দর করে তোলে তার নান্দনিক ভাবনার দ্বারা। নব্য প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষের মনে কৃষি কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই নান্দনিক ভাবনার আগমন হয়েছিল এ-কথা জানা যায় ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট গবেষকদের রচনায়। মানুষ তার জীবনের তাগিদে নানা প্রযুক্তিকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল। ঠিক যেমন অরণ্যচারী মানুষ শিকারের তাগিদে পাথরের হাতিয়ার বানিয়েছিল আর কৃষিকার্যের ফলে মানুষ তার কৃষিকাজের নানা সরঞ্জামের সঙ্গে সঙ্গে ঘর-গৃহস্থলির নানারকম সরঞ্জাম তৈরির জন্য নানা প্রযুক্তির আবিষ্কার করেছিল। তেমনি তার নান্দনিক ভাবনার ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি অদ্ভুতভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

কৃষিজীবী মানুষ তার ঘর গৃহস্থালীকে সাজাতে প্রথমে এই নান্দনিক ভাবনার রূপায়ণ করেছিল ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। এরই সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়েছিল ধর্মাচরণ যেখানে বিভিন্ন ব্রত কথাতে আলপনা তার মনোভাবকে ফুটিয়ে তুলেছিল। প্রকৃতির চারপাশের বিভিন্ন উপাদান ছিল তার এই ভাবনার মূল বিষয়। এর পর এসেছিল নিজের অবয়বকে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। মানুষ তার নিজের অবয়বকে ফুটিয়েছে ব্রত আলপনার বিভিন্ন রেখার মাধ্যমে। দশ‌ পুতুল ব্রতের আলপনায় বা সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় কয়েকটি রেখার মাধ্যমে মনুষ্য শরীরের একটা অবয়ব আমরা দেখি। এর থেকেই ধীরে ধীরে তা মাটির পুতুলের মাধ্যমে একটা মূর্তির রূপ নিতে পেরেছিল।

একখণ্ড নরম মাটির তাল থেকে হাতের সাহায্যে টিপে টিপে প্রথমে মাতৃকা মূর্তি রচনা করেছিল মানুষ। এই মাতৃকামূর্তিগুলোর শুধু বাংলায় নয় সারা পৃথিবীতেই বহু বছর ধরেই খোঁজ পাওয়া যায়। লক্ষ করলে দেখা যায় প্রথমে এগুলোর কোনো চোখ নাক মুখ ছিল না। প্রকটিত স্ত্রীঅঙ্গ, অর্ধ সমাপ্ত দু-টি হাতের অংশ আর নীচের অংশটা বসানোর জন্য একটু ঘাগড়ার মতন করা। এরপর কাঠি দিয়ে তাতে অলংকরণ করা হয়েছিল। পেছনে থাকত একটা খোঁপার মতো বস্তু আরও পরে দু-টি ছোট্ট মাটির অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল চোখ। হাতের ওপর জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বা কোলে দেওয়া হত ছোটো ছোটো একইরকম প্রতিকৃতি যা তার শিশু বলে মনে করা হত। সারা বাংলার নানা জায়গাতেই এই মাটির টেপা পুতুল তৈরি হতে দেখা যায়।

কিন্তু কাঁচা মাটি তো বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তাই মানুষই আবিষ্কার করেছিল তাকে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করতে। প্রথমে এখনকার কুমোরদের যে-ভাটি বা পোন‌ বলি তা ছিল না। একটা ছোটো জায়গায় বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে দিয়ে এই পুতুলগুলো পোড়ানো হত। এখনও পশ্চিম মেদিনীপুরে পটুয়ারা ছোটো মালশায় বিভিন্ন জ্বালানি খরকুটো ও তুষের আগুনে এই পুতুলগুলো পোড়ান। এছাড়াও প্রত্যন্ত গ্ৰামাঞ্চলে অনেক গৃহস্থবাড়িতে নাতি-নাতনিদের জন্য মা ঠাকুরমারা রান্না শেষে পরন্ত উনুনের আঁচে এই মাটির পুতুল পুড়িয়ে থাকেন। মানুষ নিজেই নিজের নান্দনিক ভাবনাকে যথাযথ রূপ দেয়ার জন্য নিজের মতো করে তার প্রযুক্তিগত কৌশল আবিষ্কার করেছিল এ-কথা বলা যেতে পারে।

টেপা পুতুলগুলো হাতে করে করতে অনেক সময় লাগত। তাই একটা সময় পর দেখা যায় যে, কীভাবে একইসঙ্গে অনেকগুলো পুতুল তৈরি করা যেতে পারে। সেই ভাবনার প্রতিফলনে তৈরি হয়েছিল মাটির ছাঁচ। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে এমন ছাঁচের সন্ধান মিলেছে। প্রথমে একখোল পরে দু-খোল ছাঁচে এই পুতুল তৈরি এখনও পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন কুমোরপাড়ায় বা কুমোরপরিবারের বাড়িগুলোতে গেলে।

সংখ্যায় যখন অধিক এই পুতুলগুলো তৈরি হতে থাকে তখন কুমোররা আর ছোটোখাটো জায়গায় তাদের পোড়ানোর জন্য রেখে দিত না। মাটির অন্যান্য সরঞ্জাম পোড়ানোর জন্য যে-ভাটি ব্যবহার করা হয় সেখানে এই পুতুলগুলোকে পোড়ানোর প্রচলন হতে থাকে। এতে একসঙ্গে অনেক পুতুল অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করা যায়। পূর্ব মেদিনীপুরের পটুয়াদের মধ্যে এইরকম ছাঁচের পুতুল দেখা যায়। আবার হাওড়ার নরেন্দ্রপুর এর রানী পুতুল বা বিভিন্ন দেবদেবীর যে-পুতুল সেগুলো এই একখোল ছাঁচে তৈরি হয়। অনেক পুতুলে চাকের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন এখনও উত্তর দিনাজপুরের কুনুরে রাজবংশী মেয়েরা যে-ষষ্ঠী পুতুল করেন তার নীচের অংশটা তৈরি হয় তাকে বাকিটা হাত দিয়ে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক প্রযুক্তির ছাপ পড়ে এই পুতুল নির্মাণে একইসঙ্গে হাত, চাক আর ছাঁচের ব্যবহারে সুন্দর নান্দনিক পুতুল তৈরি দেখা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের মির্জা বাজারে দেওয়ালি পুতুলের ক্ষেত্রে। পুতুলের মুখ আর দেহের নীচের অংশটা তৈরি হয় চাকে, মুখটা ছাঁচে আর বাকি অংশটা এবং চক্রাকারে লাগানো প্রদীপ সবটাই তৈরি হয় হাতে। মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়ার পুতুল এই একই পদ্ধতিতে তৈরি হয়।

এবার আসা যাক পুতুলের রঙের প্রসঙ্গে। মানুষ দীর্ঘদিন কিন্তু বিবর্ণ পুতুল তার খেলার সামগ্রী হোক বা পুজোর উপকরণ তা দেখতে পছন্দ করেনি। সেই কারণেই ভেষজে রঙে রাঙিয়ে নিতে শুরু করে এই মাটির পুতুল। আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে সাদা রং, শিম পাতা থেকে সবুজ, হাঁড়ির ভুসো থেকে কালো তেলাকুচ ফল থেকে লাল, হলুদ বেটে হলদে এমন সমস্ত রং দিয়ে পুতুলকে রাঙাতে থাকেন শিল্পী। তবে এরও একটা পদ্ধতি আছে। খড়িমাটির সঙ্গে তেতুল বিচির আঠা মিশিয়ে তার একটা প্রলেপ দেওয়া হয় প্রথমে। তারপর তাতে এই রংগুলো ধরানো হয়। বর্তমানে অবশ্য অনেকেই বাজারি রং ব্যবহার করে থাকেন, কারণ, ভেষজ রং দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

তবে একেবারে প্রাথমিক দিকে এই পুতুলের রংটা কেমন ছিল তা বোঝা যায় কাঠালিয়ার পুতুলের ক্ষেত্রে। এখানে মূলত তিনটি প্রাথমিক রং লাল সাদা কালো এই দিয়েই পুতুলকে রাঙিয়ে নেন শিল্পী দুধের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে তাকে মোলায়েম করা হয় আর সাদা রঙের সঙ্গে অভ্র দিয়ে তার একটা চকচকে ভাব আনা হয়। ডোরাকাটা অলংকরণ যা পৃথিবীর সর্বত্রই একেবারে প্রাথমিক অলংকরণ হিসেবে আমরা জানি তা এই কাঁঠালিয়ার পুতুলেও দেখা যায়। একসময় বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের একেবারে পারদ এর খনিজ হিঙ্গুল নামের এক লাল পদার্থ মেশা মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি হত সেই পুতুল পুতুল যদিও এখন তাতে নানা রঙের ব্যবহার হতে দেখা যায়।

এর পাশাপাশি শুধু মাটির রংকে মজবুত করে তাকে পুরোপুরি পুতুল তৈরি চল রয়েছে বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়া-সহ বিবরদা উলিয়ারা আর নানা জায়গায়। এইখানে এক বিশেষ বনক রং তৈরি করেন শিল্পী। জঙ্গল থেকে আনা বিশেষ মাটি থেকে এক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে এই হলুদ রং তৈরি হয়। পুতুলের অবয়ব কাঁচা মাটিতে তৈরি করে তার ওপরে এই বনক লাগিয়ে রোদে শুকিয়ে ভাটিতে পোড়ালে এক অদ্ভুত চকচকে রং ধারণ করে পুতুলগুলো। শিল্পী নিজেই এক আবিষ্কারে এই ভাটির ধোঁয়া বেরোনোর জায়গাটি বন্ধ করে দিয়ে তৈরি করেন কালো রঙের মাটির পুতুল। পাঁচমুড়ার ঘোড়া ষষ্ঠী পুতুল-সহ বর্তমানে আরও নানারকম পুতুল বিশ্বের বাজারেও বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। যদিও আশপাশের পূর্বোল্লিখিত কেন্দ্রগুলোতেও ওই একইরকমভাবে এইসব পুতুল তৈরি হয়। পাঁচমুড়ায় বিশাল বিশাল ভাটিতে যৌথভাবে কুমোররা তাদের সমস্ত মাটির পুতুলগুলো একসঙ্গে পুড়িয়ে থাকেন। অর্থাৎ এটি যে একসময় গ্রামীণ কৌম জীবনের যৌথ প্রযুক্তি ছিল তা বলতে আর দ্বিধা বোধ হয় না।

ডোকরা

মাটির পুতুলের পাশাপাশি শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য ধীরে ধীরে আরও অনেক মাধ্যমে পুতুল তৈরি হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তালপাতার সেপাই। তালপাতা কেটে তাকে মানুষের আকৃতি বা পশুপাখির আকৃতি দিয়ে সুতা দিয়ে সেলাই করে একটা বাঁশের কঞ্চিতে এমনভাবে আটকে দেয়া হয় যাতে কঞ্চিটি নাড়ালেই সেই পুতুলটির হাত পা ছুঁড়তে থাকে। এছাড়া মাটির মূল অবয়বের ওপর ধাতুর ঢালাই করে তৈরি হয় ডোকরা শিল্প। যদিও তার খুবই জটিল মাধ্যম তবুও একেবারে খাঁটি লোকায়ত প্রযুক্তিতে তা তৈরি হয়। পুরোনো কাপড় দিয়ে তার ভেতরে পুরে সুঁচ সুতো দিয়ে সেলাই করে মা দিদি মায়েরা অবসরে বানাতেন কাপড়ের পুতুল। তোমার নেট তাকেই আধুনিকভাবে রূপ দান করা হয়। তেমনি পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘা অঞ্চলে সমুদ্র ধার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুককে বাক্যটিকে আঠা দিয়ে জুরে তাতে সামান্য বাজারি রং লাগিয়ে সুন্দর পুতুল তৈরি করেন ওইসব অঞ্চলের শিল্পীরা।

মাটির পরেই নমনীয় মাধ্যম হল কাঠ। এই কাঠ দিয়েও কিন্তু বাংলার নানা অঞ্চলের শিল্পীরা সুন্দর পুতুল তৈরি করে থাকেন বর্ধমানের নতুনগ্রাম কাঠের গৌরনিতাই রাজা-রানি পুতুলের জন্য বিশ্ববিখ্যাত তেমনি হাওড়া তো একসময় থোরের রস পড়ে এইরকম পুতুল হত। পুরুলিয়া বাঁকুড়া প্রতি জেলাতে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন উৎসবে এই কাঠের পুতুলের সন্ধান মেলে। খুব সামান্য যন্ত্রের মাধ্যমে এই পুতুলগুলো তৈরি করেন শিল্পীরা আর একসময় ভেশজ রং ব্যবহার হত তাকে রাঙানোর জন্য পরে এসেছে বাজারি রং।

পুতুল নির্মাণশৈলীর প্রযুক্তি যদি লক্ষ করা যায় তাহলে সেখানে যুগের ক্রমবিবর্তন আমরা লক্ষ করতে পারি কীভাবে মানুষ নিজের জীবনযাপনের মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা তার ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগিয়েছে তা এই পুতুলগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। বিষয়ে বৃষ্টিতেও গবেষণায় ভবিষ্যতে আরও অনেক তথ্যই সামনে নিয়ে আসতে পারবে।

তথ্যসূত্র:
১। তারাপদ সাঁতরা, পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র কলকাতা ২০০২।
২। সোমা মুখোপাধ্যায়, বাংলার পুতুল, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, ২০১৮।

Categories
2021-May-Essay প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়

জাপানি কবিতার কয়েকটি ফর্ম

হাইকু
(Haiku)

ধ্রুপদী জাপানি কবিতা হাইকু।

তিনটি পর্বে রচিত এই কবিতা, পর্বগুলির মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ৫, ৭ ও ৫ (মোট ১৭) ‘অন’। অন হল জাপানি ধ্বনি-একক, Mora বা ‘কলা’-র সমতুল্য।

জাপানে পরম্পরাগতভাবে একটি উল্লম্ব পঙ্ক্তিতে হাইকু লেখার রীতিই স্বীকৃত। ইংরেজি ও অন্য ভাষায় তিন লাইনের হাইকু লেখার চল দেখা যায়, মাত্রাগণনায় কলা-র বদলে কেউ কেউ ব্যবহার করেন ৫-৭-৫ ‘দল’ (Syllable)।

কোনো দৃশ্য, যা আমাদের চেতনায় মূহূর্তে উদ্ভাসিত করে সত্যকে, প্রণোদিত করে হাইকুকে। হাইকু-মুহূর্তই এই হ্রস্বকবিতার প্রাণ, স্বল্প উচারণে প্রকৃতির দু-টি ছবির কাব্যিক প্রকাশে তা ফুটে ওঠে। ছবিদুটো জোড়া থাকে ‘কিরেজি’ দিয়ে; কিরেজিকে বলা যায় ছেদশব্দ, তা ছবিদুটোর ভেতর সমান্তরাল-ভাব বা জাক্সটাপজিশন তৈরি করে। হাইকুর অপরিহার্য অংশ হল কিরেজি; আর একটি ‘কিগো’। কিগো হল ঋতু-সম্পর্কিত শব্দ, যা নেওয়া হয় ‘সাইজিকি’ বা কিগো-অভিধান থেকে।হাইকুতে একটি কিগো থাকবেই।

হাইকুতে সাধারণত থাকে না কোনো মানুষের কথা, মানবিক ক্রিয়াকর্মের বিষয়। পরম্পরাগত জাপানি হাইকুতে থাকে না কোনো যতিচিহ্ন, অন্ত্যমিল, রূপক, চিত্রকল্প বা অন্য কোনো অলংকার। শুধু প্রকৃতির দু-টি ছবি আর তাদের অন্তর্গত অভিঘাতে জন্ম-নেওয়া বোধ— এই হল হাইকু।

হাইকু তাই ঋতুর কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, মুহূর্তের কবিতা, সত্যের কবিতা। জেন ধর্মবিশ্বাস ও যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এর। গুরুত্বপূর্ণ হাইকুকাররা এই ধর্মাবলম্বী।

জাপানি কবিতা ‘রেঙ্গা’-র প্রারম্ভিক স্তবক ‘হোক্কু’-র থেকে এর জন্ম। মাসাওকা সিকি (১৮৬৭খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) এই আঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন। মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ), ইয়োসা বুসান (১৭১৬ খ্রিস্টাব্দ-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ), কোবায়াসি ইসা (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ) ও সিকি-কে শ্রেষ্ঠ হাইকুকার হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকু লিখেছেন অজস্র কবি, লেখা হয়েছে অসংখ্য তিন-পর্বের আলোকিত শব্দসুষমা।

আমাদের সঙ্গে এই আঙ্গিকের পরিচয় করান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ)। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাপান ভ্রমণকালে তিনি এর সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং ‘জাপানযাত্রী’ (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে এর সম্পর্কে লেখেন, সঙ্গে বাসোর দু-টি হাইকুর অনুবাদ:

পুরোনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ,
জলের শব্দ।

এবং

পচা ডাল,
একটা কাক,
শরৎকাল।

বিশ্বকবি অবশ্য এই লেখাগুলিকে ‘হাইকু’ না, ‘তিন লাইনের কাব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলা হাইকুর প্রথম বই সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র-এর ‘জাপানী ঝিনুক’ (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলা ভাষায় হাইকুচর্চার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নানা কবি লিখেছেন নানা সময়ে। সবক্ষেত্রে যে হাইকুর নিয়মবিধি ঠিকঠাক পালিত হয়েছে এমন নয়।

তবে বাংলাতে নিয়মনিষ্ঠ হাইকুও আমরা পাই:

মাতাল চাঁদ
নিশার দারোয়ান
দাঁতাল শীত
(মুজিব মেহদী)

হাইকুকে বাংলা ভাষার উপযোগী করে মুজিব মেহদী (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ- ) ‘বাইকু’ ফর্মটি তৈরি করেছেন। তাঁর লেখা:

বাগানে ভর্তি হলাম পাখিদের ক্লাসে
শিখছি পাতা কাঁপানো ও ফুল ফোটানো
এখনো অনেক দূরে পাতাঝরা দিন
(বাইকুসহায়/৪৯)

বাংলা হাইকু বা বাইকু তিন লাইনের কবিতা, কিন্তু কাঠামোগতভাবে মুক্ত, অর্থাৎ, কলাবৃত্তে ৫-৭-৫ রীতির অনুসারী নয়; এটি মুক্তক হাইকু হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

সারা পৃথিবীর কবিরাই মেতেছেন হাইকুর সৌব্দর্যে। হাইকু থকে জন্ম নিয়েছে আরও নানা ফর্ম। বিষয়ের দিক থেকেও হাইকু এখন অনেক বেশি প্রসারিত ও মানবিক।

হাইবুন
(Haibun)

সম্মিলিত গদ্য আর কবিতার একটি ফর্ম হাইবুন। এর জন্ম জাপানে। প্রথমে থাকে গদ্যটি, যা হতে পারে ভ্রমণকথা, দিনপঞ্জি, আত্মজীবনী, নিবন্ধ, গদ্যকবিতা— এইরকম কিছু। আর তার পরে থাকে একটি হাইকু।

১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মাৎসুও বাসো (১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ-১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর শিষ্য কোরাই-কে লেখা একটি চিঠিতে হাইবুন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। বাসোর ‘গভীর উত্তরের দংকীর্ণ পথ’ (ওকু নো হোসোমচি) বইতে আমরা বেশ কিছু হাইবুন পাই। তা থেকে:

নাতোরি নদী পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেন্দাই-তে। সেই সময়ে তো লোকজন ঘরের চালের নীচে নীল আইরিশ টাঙিয়ে রাখে। একটা সরাইখানা খুঁজে নিয়ে কাটিয়েছিলাম চারপাঁচটা দিন।
কিমোন নামে এক আঁকিয়ে থাকত শহরটায়। তাঁর নিখাদ শিল্পবোধের ব্যাপারে শুনেছিলাম, আলাপও হল। কবিতায় উল্লেখিত জায়গাগুলোর খোঁজে তিনি অনেকগুলো বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন, বলেছিলেন আমাকে। সে সব ঠিকঠাক চিনতে পারা বেশ কঠিন। একদিন আমাদের নিয়ে গেলেন তেমনই কিছু জায়গা দেখাতে। ক্লোভারের ঝোপে ভরা মিয়াগিনো-র মাঠ; ভাবলাম, শরতে দেখতে কেমন হবে। তখন তো তামাদা, ইয়োকোনো, সুৎসুজি-গা-ওকা-র চারপাশে পিয়েরিসের ফুল। আমরা গেলাম এক পাইনবনের ভেতর দিয়ে, এত ঘন যে সূর্যের আলো একদমই ঢুকতে পারে না। নাম জানলাম, কোনোসিতা [গাছের তলা]। শিশির এখানে বহুকাল থেকেই পুরু খুব, একটি কবিতায় ভৃত্য তার মনিবকে বলছে, খড়ের টুপি নেওয়ার কথা। দিন শেষ হওয়ার আগে ইয়াকুসিদো আর তেনজিনের মঠে প্রার্থনা করলাম আমরা।

আসার সময় কিমোন আমদের মাৎসুসিমা, সিওগামা আর স্থানীয় কিছু জায়গার স্কেচ উপহার দিলেন। আর দিলেন ঘন আইরিশ-নীল ফিতেওলা দু-জোড়া খড়ের চটি। এই সব উপহার থেকেই বোঝা যায়, একজন মানুষের রুচি কতটা সমৃদ্ধ।

পায়ে বেঁধেছি
আইরিশের ফুল—
চটির ফিতে

পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য হাইবুন লিখেছেন ইয়োসা বুসোন, কোবায়াশি ইসা, মাসাউকা সিকি প্রমুখেরা।

জাপানের বাইরেও হাইবুনের চর্চা আমরা দেখতে পাই। আমেরিকান কবিজেমস মেরিল (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর ‘অন্তরের স্থান’ (The Inner Room)-এর ‘প্রস্থানের গদ্য’ (Prose to Departure) প্রথম দিকের ইংরেজি হাইবুনের একটি উদাহরণ।

বাংলাতেও সম্প্রতি আমরা হাইবুন নিয়ে উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি।

সেনরু
(Senryu)

৫-৭-৫-এর আর একটি জাপানি কবিতার ফর্ম সেনরু। হাইকুর মতো মাত্রাগঠন হলেও সেনরু হাইকু থেকে আলাদা।

হাইকুর মতো কিরেজি (ছেদ-শব্দ) ও কিগো (ঋতুগত শব্দ) থাকে না এতে।

হাইকুর বিষয় প্রকৃতি, মানুষ স্থান পায় না।

সেনরু মানুষের কথা নিয়েই, বলা যায় ‘মানবিক হাইকু’। মনুষ্যচরিত্রের অসংগতি এখানে উপজীব্য।

হাইকুর প্রশান্তি, গাম্ভীর্য থাকে না সেনরুতে। বরং স্থূল রসিকতা লেখা হয় তির্যক ভঙ্গিতে।

কারাই হাচিমন (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ-১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ, ছদ্মনাম সেনরু, কারাই সেনরু নামেও পরিচিত) এইরকম হাস্যরস আর বিদ্রুপাত্মক ছোটো কবিতাগুলির সংকলন ‘হাইফুইয়ানাগিদারু’ প্রকাশ করেন যা সে সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেনরু ও অন্য সম্পাদকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধ্রুপদী হাইকু আর পাঠকের মন ভোলাতে পারছে না, মানবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে একটু মজার কবিতা হিসেবে সেনরু পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়।

কারাই সেনরু-র সংকলন থেকে একটি সেনরু:

ধরেছি যাকে
ডাকাত ভেবে এ কী
খোকা আমার

হাইকুর মতো বিষয় ও উপস্থনা নিয়ে নিয়মের নিগড় নেই এতে, ছন্দকাঠামো মেনে অনেকটা উন্মুক্ত মনে এই ধারায় পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা লিখে চলেছেন। এবং এই ধারাটি আজ যথেষ্টই জনপ্রিয়।

বাংলাতেও সেনরু লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বল্প কথায় শাণিত বিদ্রূপে এই ফর্ম বাংলা কাব্যজগতে বেশ মানিয়ে যায়।

নাটক শেষ
মৃত সৈনিকটি
শুয়েই আছে

বা

ভাজা মাছটি
উলটে খেয়ে নেয়
ভেজা বেড়াল

কাতাউতা
(Katauta)

জাপানি কবিতার আর একটি ফর্ম কাতাউতা, তিন পর্বে রচিত, পর্বগুলির মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৫ অন; কখনো ৫-৭-৭ অনেও লেখা হয়েছে এই কবিতা।

কাতাউতা প্রেমের কবিতা, প্রিয়জনের উদ্দেশে লেখা, অন্ত্যমিলহীন।

ওঠো, ও প্রেম
ঘৃণার ঢেউ থেকে
না রবে বিছানাতে?

অষ্টম শতাব্দীর পর থেকে এই ফর্মের ব্যবহার বিরল। সম্প্রতি নানা ভাষায় নতুন করে এর চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাতেও প্রেমের অনুকবিতা হিসেবে এই ফর্ম গৃহীত হতে পারে:

চোখের জলে
শেষ হয় না নুন
সাগর তোমার কে?

কাতাউতাকে বলা হয় ‘অর্ধেক কবিতা’, পরপর দু-টি কাতাউতা মিলে তৈরি হয় সেদোকা।

সেদোকা
(Sedoka)

সেদোকা দু-টি কাতাউতার সমষ্টি। মাত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭। সাধারণত অন্ত্যমিল থাকে না। প্রথম তিন লাইনে একটি দৃশ্য বর্ণিত হয় আর পরের তিন লাইনে অন্য প্রেক্ষিত থেকে দেখা হয় দৃশ্যটিকে। দু-টি অংশের মধ্যে একটি শাণিত ছেদ থাকে আর অংশদুটো স্বতন্ত্র কবিতা হিসেবে পড়া যায়। কখনো তা সংলাপধর্মী, প্রথম অংশে প্রশ্ন, উত্তর পরে।

একে ‘শীর্ষ-পুনরাবৃত্তির কবিতা’ও বলা হয়।

জাপানি কবি কাকিনোমোতো নো হিতোমারো (৬৬২ খ্রিস্টাব্দ-৭০৮ বা ৭১০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সেদোকাগুলির জন্য খ্যাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ অংশে বলেছেন সেদোকার বিষয়ে, আছে একটি উদাহরণও:

সাগরতীরে
শোণিত-মেঘে হল
নিশীথ অবসান
পুবের পাখি
পূরব মহিমারে
শুনায় জয়গান

অন্ত্যমিল আছে। আর সে-বিষয়ে কবিগুরুর মন্তব্য, “বাঙালি পাঠকের অভ্যাসের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া নিজের অনুকৃতিগুলির মধ্যে একটু মিলের আভাস রাখা গেছে।”

অষ্টম শতাব্দীর জাপানি কাব্যসঞ্চয়ন ‘মানিওশু’-তে কাতাউতা-র দেখা মেলে। পরবর্তীতে এর চর্চা প্রায় বিলোপ পায়। ছয় লাইনে, তিন-তিন দুই স্তবকে, মোট ৩৮ মাত্রায় (৫-৭-৭-৫-৭-৭) সেদোকা লেখার প্রয়াস ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষায়।

এর সৌন্দর্য বাংলা ভাষাতেও ফুটে উঠতে পারে:

এক শেয়াল
গোধূলির উঠোন
পেরিয়ে গেল ছুটে

বোঝা গেল না
সেইদিকে খাবার
না পেছনে খাদক

মনদো
(Mondo)

আর একটি জাপানি ফর্ম মনদো।

জেন ধর্মানুশীলন থেকে এর উৎপত্তি। লেখা হয় দু-টি তিন লাইনের স্তবকে।

প্রথম স্তবকে প্রশ্ন, উত্তর পরেরটিতে। মত্রাবিন্যাস ৫-৭-৭-৫-৭-৭ অন, বা কখনো ৫-৭-৫-৫৭-৫ অন।

সাধারণত দু-জন কবি লেখেন একটি একটি করে স্তবক।

সংলাপমূলক কবিতা হিসেবে বাংলায় এর ব্যবহার আমরা আশা করতে পারি।

মেঘ তো কালো
বৃষ্টিফোঁটা কেন
এমন ধবধবে?

মাটির দিকে
যা কিছু নেমে আসে
বাড়তি ঝেড়ে ফেলে

তনকা
(Tanka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতা আর একটি ফর্ম ‘তনকা’-র পাঁচটি পর্ব লেখা হয় যথাক্রমে ৫-৭-৫-৭-৭ অন মাত্রাবিন্যাসে। অনুবাদে, জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায় পাঁচটি লাইনে প্রকাশিত হয় তনকা। ওপরের ৫-৭-৫-এর অংশটিকে বলা হয় ‘কামি-নো-কু’ আর নীচের ৭-৭-এর অংশটিকে ‘সিমো-নো-কু’।

মনিওশু-তে দীর্ঘ কবিতাকে চোকা আর হ্রস্ব কবিতাকে তনকা বলা হত। পরবর্তীতে সাধারণভাবে হ্রস্ব কবিতাকে ‘ওয়াকা’ বলা শুরু হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানি কবি মাসাওকা সিকি (১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ-১৯০২ খ্রিস্টাব্দ) তনকা সম্পর্কিত ধারণার পুনর্মূল্যায়ণ করেন।

সিকির লেখা:

সেই লোকটি
মুকুরে হত দেখা
আর সে নেই
নষ্ট মুখ দেখি
অশ্রু ঝরে যায়

তাকুবোকু ইসিকায়া (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)-র লেখা একটি তনকা:

পুব সাগরে
ছোট্ট এক দ্বীপে
সাদা বালিতে
অশ্রুভেজা মুখে
খেলি কাঁকড়া নিয়ে

বাংলা তনকাচর্চাও আমরা লক্ষ করছি বেশ কিছুদিন। তা লেখা হয় পাঁচ পঙ্‌ক্তিতে, পর্বের চরিত্র বজায় রেখে।

হাসির মাঝে
একটু করে থামি
আর দম নি’
নীরবতার ফাঁকে
কান্নাকে লুকোই

সমনকা
(Somonka)

জাপানি কবিতার আরেকটি ফর্ম সমনকা। দু-টি তনকা নিয়ে রচিত হয় সমনকা।

সমনকায় তনকাদুটোর কেন্দ্রীয় ভাবনা প্রেম আর তা লেখা হয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথোপকথনের চালে, প্রথমটির যে-বক্তব্য তার প্রতক্রিয়া থাকে দ্বিতিয়টিতে। নরনারীর প্রেম ছাড়াও অন্য সম্পর্কভাবনায় এই শৈলীর কবিতা পাওয়া যায়।

এতে শিরোনাম থাকে, অন্ত্যমিল থাকে না। দু-জন কবি মিলে একটি সমনকা লেখেন।

ফর্মটি বেশ পুরোনো, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত সমনকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

৭০০ খিস্টাব্দের আশেপাশে মিকাতো নো সামি ও তাঁর স্ত্রীর রচিত একটি সমনকা:

বাঁধো, শিথিল
না বাঁধলে দীর্ঘ
প্রিয়ার চুল
দেখি না আজকাল
বেঁধে রেখেছে সে কি?

বলে সবাই
এমন লম্বা যে
বাঁধাই ভালো
যেটুকু দেখো তুমি
খোঁপায় জড়িয়েছি

সমকালীন বাংলা প্রেমের কবিতায় এই কবিতার আবেদন হয়ে উঠতে পারে চিত্তাকর্ষক। আর দুই কবি, প্রেমিক-প্রেমিকা যদি লেখেন একটি একটি করে স্তবক, তাহলে তো কথাই নেই:

মেঘের গায়ে
কার সে স্বাক্ষর
ফুটে উঠল
এমন আঁকাবাঁকা
চিনতে পারছ কি?

তা আমারই তো
তোমার ছোঁয়া লেগে
জ্বলেছে হাত
আর সে বিদ্যুতে
আঙুল গেছে কেঁপে

চোকা
(Choka)

পরম্পরাগত জাপানি কবিতার ফর্ম চোকা। লেখা হয় পর্যায়ক্রমে ৫-৭-৫-৭ অনে। শেষে থাকে ৫-৫-৭-এর একটি পর্ব। ‘মানিওশু’তে সংকলিত এই চোকাটির রচয়িতা কবি ইয়ামানোউ নো অকুরা (৬৬০? খ্রিস্টাব্দ-৭৭৩? খ্রিস্টাব্দ):

তরমুজ তো
খেলেই মনে পড়ে
বাচ্চাদের,
আরও মনখারাপ
বাদাম খেলে,
ভাবনাগুলো আসে
কোত্থেকে যে?
রাতের পরে রাত
ঘুম আসে না চোখে।

এই চোকাটির পরে আছে অকুরারই লেখা একটি তনকা যাকে হানকা বা অনুকথন বলতে পারি:

দাম কত হে
কণক, রূপা, হীরে?
অমূল্য না,
সন্তানের সাথে
তুলনীয় তো নয়

রবীন্দ্রনথ ঠাকুরের ‘ছন্দ’ বইয়ের ‘সম্পূরণ’ আমরা একটি চোকা পাই:

সাহসী বীর
দেখেছি কত অরি
করেছে জয়।
দেখিনি তমাসম
এমন ধীর—
জয়ের ধ্বজা ধরি
স্তবধ হয়ে রয় ।।

দোদোইৎসু
(Dodoitsu)

৭-৭-৭-৫ মাত্রাবিন্যাসের জাপানি কবিতা দোদোইসু। বিষয় প্রেম বা মানবিক ব্যাপার-স্যাপার। ভাবনার একটি মোচড় থাকে সাধারণত।

অনুবাদে একটি:

যখন রেগে যাই
নাড়াই পেয়ালাটি
নড়ে চোখের জল
দীর্ঘশ্বাস?

এদো (১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) কালখণ্ডের শেষ দিকে এর উদ্ভব। মনে করা হয় জাপানি লোকসংগীত থেকে বিকশিত এই ফর্মটি।

জাপানি ছাড়াও অন্য ভাষার কবিরা এই আঙ্গিক নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বাংলাতেও এর সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সচেষ্ট হতে পারি:

তোমার প্রতিটি না
সম্মতির কাছে
চোখ বন্ধ করে
দাঁড়িয়ে থাকে

বুসোকুসেকিকা
(Bussokuseki)

জাপানের নারা শহরের ইয়াকুসি মন্দিরে সুপরিচিত স্তম্ভ বুসোকুসেকি-কাহি। সেখানে রয়েছে একুশটি কবিতা খোদিত ‘বুদ্ধের পদচ্ছাপ’। কবিতাগুলি ৫-৭-৫-৭-৭-৭ মাত্রার, বুদ্ধের গুণগান, জীবনের অনিত্যতা ও বৌদ্ধমতের প্রচার সংক্রান্ত।

২০ সংখ্যক রচনাটি:

ঝোড়ো আকাশে
ক্ষণিক বিদ্যুৎ
এই শরীরে
মৃত্যুমহারাজ
দাঁড়িয়ে চিরকাল
কাঁপব না কি ভয়ে?

ইয়াকুসি মন্দির স্থাপিত হয় ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কবিতাগুলি রচনাকাল তার আশেপাশে। এই মন্দির ছাড়া কয়েকটি সংকলনে আমরা এই জাতীয় কবিতা দেখতে পাই। একে বলা যায় ওয়াকার আদিরূপ।

জাপ্পাই
(Zappai)

হাইকুর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে আমরা জানি, কিন্তু তার বাইরে, সতেরো অন-মাত্রার অন্য কবিতাও আমরা দেখলাম। সতেরো অনের যে-সব কবিতা হাইকুর প্রকৃত নিয়মনিষ্ঠ ও কারুকৃতির চরিত্রের সাথে মানায় না তারাই হল জাপ্পাই। জাপ্পাইয়ের ঐতিহ্যও সমৃদ্ধ, এটি একটি স্বতন্ত্র আঙ্গিক; হাইকু লেখার ব্যর্থ প্রয়াস থেকে যে জাপ্পাই নয়, বুঝতে পারা যায়। আবার তা সবসময় সেনরুর মতো বিদ্রূপাত্মক হয় না।

৫-৭-৫ মাত্রার সঙ্গে ৭-৭-এও লেখা হয় জাপ্পাই।

অলসভাবে
শুনি ভোরবৃষ্টি
সেই মাঝির
(মিসাতোকেন)

চোখ-মু-কান নাই
বউ সৎমা বেশ
(ইসায়িতা ইয়ুমিকো)

বাংলায় হাইকু হিসেবে লেখা অনেক কবিতাই এই শ্রেণির। আবার সতেরো মাত্রার বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে তিন লাইনে লেখা কবিতা হিসেবে জাপ্পাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মন ও মন
আয়নার দুপাশে
ছুঁতে পারে না

সিনতাইসি
(Shintaishi)

জাপানি ভাষায় ‘সিনতাইসি’ শব্দটির অর্থ ‘নব আঙ্গিকের কবিতা’; হাইকু, তনকার মতো পরম্পরাগত জাপানি কবিতার মাত্রাবিন্যাস ও আঙ্গিকের বাইরে লেখা এই কবিতাকে, বলা যেতে পারে মুক্ত কবিতা। উদীয়মান সূর্যের দেশে ‘মেজি’ (১৮৬৮ খৃস্টাব্দ-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ) যুগে ‘আধুনিক’ অনুভূতিকে প্রকাশের তাগিদে এর উদ্ভব।

সিনতাইসি ধ্রুপদী জাপানি ভাষায় লিখিত। ওচিয়াই নাওবুমি ( ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ-১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই রীতির উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর লেখা ‘কোজো সিরাগিকু নো উতা’ (সাদা তারাফুল/White Aster) কাব্যকে এর প্রারম্ভিক উদাহরণ ধরা হয়।

শুরুর লাইনগুলি:

আসো পর্বতের এক জনমানবশূন্য দূর গ্রামে সূর্য অস্ত যাচ্ছে
আর ক্রন্দনরত পাখিরা পড়ছে ঘুমিয়ে
বৃষ্টির জলে-ভেজা কয়েকটি নীচু গাছ; শোনা যাচ্ছে দূরের মন্দিরের ঘণ্টা
একটি বাড়ির দুয়ারে বছর চোদ্দর এক মেয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে
বাবা গেছেন পশুশিকারে
সে খুবই ছোট্ট, কিন্তু তার মুখ দেখে মনে পড়ে সুন্দর এক ফুলের কথা
হাওয়ায় এলোমেলো তার চুল, বাবার চিন্তায় বেশ কয়েকদিন ঘুম হয়নি তার

এই মেয়েটির কাহিনিই এই ‘সাদা তারাফুল’-এর বিষয়।

Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

অন্তর আর বাহির। আশাকরি তাঁর নগ্নতার প্রেক্ষিতটা কেমনভাবে দেখা উচিত কিছুটা বোঝা গেল।

উওমেন স্টাডিস, সোসিওলজি এইসব ডিসিপ্লিনের পোকা মাথায় রেখে লাল দেদের বাক পড়তে গেলে খণ্ড দর্শন হবে। তিনি দল গড়েননি, ভক্তও দলও নন। তিনি মুখে মুখে বাক রচনা করেছেন কিন্তু প্রথাগত ঢং-এ কাব্য লেখেননি। কিন্তু মুখে মুখে যা বলেছেন সেইসব বাকের কাব্য সুষমা বজায় রাখতে একজন সচেতন কবির সৃষ্টির মতোই শব্দের নিপুণ প্রয়োগ করেছেন, ছন্দ বেঁধেছেন। তাঁর বাক গভীর দর্শন ও ভাবের সুতোয় গড়া তবু প্রথাগতভাবে তিনি কবি বলে পরিচিত নন তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন কবীরও তো দোঁহা বলার কারণে নিছক কবি পরিচয়ে সুখ্যাত নন কিন্তু তাঁর দোঁহা কী কাব্য মাধুর্যহীন? হলে’তো কেবল একজন গুরুর মতাদর্শের দাসত্ব করার কারণেই অনেক আগেই লোকমানসের হৃদয় থেকে ঝরে যেত। লাল দেদ, কবি এবং একজন ইন্টেলেকচুয়ালের সব বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় শিশুকাল থেকে একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনের মধ্যে বড়ো হয়েছেন এবং সেই পরম্পরার টানে সাধিকা হয়েছেন, কিন্তু সেটা ছিল তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু একজন একাধারে বড়ো কবি ও ইন্টেলেকচুয়াল তো কোনো ডিসিপ্লিনকে নিছক রিপ্রেজেন্ট করে ক্ষান্ত হতে পারেন না, সে-সব বিপ্লবী বা রিফর্মিস্টদের কাজ। এমন মন নিয়ে অনেকেই লাল দেদ, কবীর পড়েন, কিন্তু বিশ্বাসের কাব্যময়তাকে না বুঝে আবোলতাবোল বলেন, লেখেন।

“ইম পাড় লাল্লি ভা’নি তিম হৃদি আঁখ”

লাল্লা যা বলেছে—

“তোমার হৃদকমলে তা আখর চিহ্ন হয়ে আছে”

এরপরে যেটা বলার লাল দেদ গান লেখেনেনি এবং তিনি যে গান গাইতেন এমন কোনো তথ্য কোনো মান্য সংকলনে নেই। অনেক পরে মুখে মুখে চলে আসা তাঁর বাক কাশ্মীরের সুফিয়ানা কালাম-এ গীত হত, তার মানে এই নয় এগুলো গান অথবা লাল দেদ গান গাইতেন। জয়লাল কাউলের কথায়, “কখনো কখন গ্রীয়ারসন বাকগুলোকে, গান বলে উল্লেখ করেছেন। এটা বলা দরকার যে-কোনো পদ এবং সে-প্রেক্ষিতে, বা কোনো টেনে আনা গদ্যাংশও সুর লাগিয়ে গীত হতেই পারে, এবং তা গানে পর্যবসিত হয়, কিন্তু যে-অর্থে নানকের স্তব গুরুবাণী, বা মীরার ভজন বা অন্যান্য ভক্তিবাদী সাধক-কবিদের গান, সেই নিরিখে লাল দেদের বাক গান হিসেবে গীত হবে সেই উদ্দিষ্টের কারণে ‘গান’ নয়। বা বলা যেতে পারে প্রচলিত লোকগান (চকরি) বা কাশ্মীরি ভস্তন গানগুলো যেমন নিজেরাই শিল্পানুগ জিগিরেই গান হয়ে ওঠে, এই বাকগুলো নিজেরাই গান হয়ে ওঠে না। লাল দেদের বাকগুলো প্রধানত ভারী ভাবনার নিগূঢ়তায় আর গভীরতায়, কিন্তু সে-অর্থে সাংগীতিক গুণসম্পন্ন নয়। এগুলো গান হয়ে বিস্ফোট ঘটানোর চেয়ে আমাদের অন্তরের দিকে তাকাতে বলে, বলে চিন্তা করতে আর প্রতিবিম্বিত হতে। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাকগুলি প্রায়শই আমাদের আতুর অনুভবকে নাড়া দেয়।”

“আমি সাতবার হ্রদটিকে দেখেছি শূন্যে উধাও হয়ে যেতে”

কাশ্মীরি ভাষাকে গড়ে তোলার গড়ার কারিগর হিসেবে, এবং ভাষা ও সাহিত্যে এই দুই ক্ষেত্রে লাল দেদের যা ভূমিকা তার প্রেক্ষিতে আধুনিক কাশ্মীরির জননী হিসেবে লাল দেদকে দাবি করার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। কেবল মাত্র কালানুক্রমে নয়, বরং আধুনিক কাব্যের মেজাজ ও শৈলীর নিরিখে তিনি কাশ্মীরি ভাষার আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রথমা। তাঁর কবিতা আধুনিক, কারণ তা জায়মান আজও। বস্তুত তিনি কাশ্মীরিদের, তাঁদের মাতৃভাষাকে এবং গণজন হিসেবে নিজেদের আত্মাকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছেন। লাল দেদের জীবনকালের পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে কাশ্মীরি ভাষা হয়তো সুলতানদের বা সামন্ত প্রভুদের কৃপা পায়নি, হয়তো এটি সরকারি ও উচ্চকোটির ভাষা, ফারসির, দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও একে দাবিয়ে রাখা যায়নি, কারণ, এর পিছনে ছিল গণজনের সমর্থন এবং লালা দেদের বাকের প্রভাবে, সাধারণ কাশ্মীরি লোকেরা, যারা এতদিন নিজেদের মাতৃভাষায় লেখা পদগুলোকে কেবল গুপ্তবিদ্যা মনে রাখার কারণে, অথবা সেইসব গুপ্তবিদ্যাকে ধরে রাখতে, স্মৃতিবৃদ্ধির ব্যবহারিক হিসেবে লিখত, তাদের গভীরতম ভাবনা আর অনুভবকে নিজেদের মাতৃভাষায় ব্যাক্ত করতে, ব্যবহার করতে শুরু করল। সে-কারণেই হিন্দু কী মুসলমান এমন একজনও কাশ্মীরি নেই যার জিভের ডগায় লালা দেদের কোনো-না-কোনো বাককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথবা এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে না। লালা দেদের বাকেই প্রথমবার কথ্য ও লৌকিক কাশ্মীরি ভাষা ও বুলি, ধর্মীয় বা রাজকার্যের ধরাবাঁধা পথে নয়, ব্যবহৃত হয়েছিল আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা ভাবনা ও অনুভবকে ব্যক্ত করতে। জয়কাল কাউলের ভাষায়, “উচ্চকোটির সঙ্গে সাধারণের, বিশেষত সাধারণের নিজেদের মধ্যে, যোগাযোগের তিনি নতুন নতুন প্রণালী খুলে দিয়ে ছিলেন। তাঁর গুরুত্ব কেবলমাত্র ঐতিহাসিক নয়। অন্তর্নিহিত কারণ হল, তিনি কাশ্মীরি ভাষার আজও অবধি মান্য অগ্রগণ্য কবিদের একজন হিসেবে রয়ে গেছেন এবং কাশ্মীরি ভাষার এক কারীগর, যা একজন অসাধারণ মৌলিক কবিই পারেন, এমন একজন কবি যাঁর কবিত্ব, স্যার রিচার্ড টেম্পলের ভাষায় ‘বহ্নিমান, পোড়ায় এমন এক ভাবনার রক্তিম আগুন।” আর গ্রীয়ারসনের বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণে, লাল দেদের বাক হল, “পূর্বে কেবল যা তত্ত্বে আবদ্ধ ছিল তেমন এক ধর্মের বাস্তবিক অনুশীলন করে দেখানো, প্রাণবন্ত ও চিত্রল ভাষার এক বিবরণে। ভারতবর্ষের অন্যতম অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রণালীর ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনার প্রামাণিকতাকে কায়া দিতে, যা অবশ্যই ভিত্তি গড়ে দেবে, এর অবদান অনন্য। এখানেই আধ্যাত্মিকতার দস্তাবেজ বা প্রমাণ হিসেবে এর স্বাতন্ত্র্য নিহিত, এবং আপনি যদি, একইসঙ্গে কবিতা ও আধ্যাত্মিকতার ব্যবহারিক মূল্যের প্রতি তীব্র অন্বেষী হন, তবে মৌলবী রুমির ভাষায়, নিহিত যা—

“এমন দৃষ্টি দিয়ে, যা বাকের শক্তিকে বৃদ্ধি করে
অনুপ্রাণিত বাক দিয়ে, যা দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ করে।”

এবং এটা আমাদের হৃদয়ের গরাদহীন জানালাগুলো খুলে দেয় আত্মার “পরিরেখাহীন অপরিমেয় দৃশ্যমানতা”-র দিকে।

লাল দেদ কোথায় আলাদা, এটা বুঝতে তাঁর মানস-শিষ্য নুর-উদ-দিন ঋষি বা নুন্দ ঋষির সুরুখ বা বাকের (যা ঋষিনামা বা নুরনামা পুঁথি হিসেবে লিখিত হয় নুন্দ ঋষির মৃত্যুর প্রায় দু-শো বছর পরে, এবং সুফি সাধকদের ক্ষেত্রে এমনটা প্রায়শই হতে দেখা গেছে) সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, বিষয়ের দিক থেকে তাঁর সুরুখ ছিল মুখ্যত নীতিমূলক এবং স্বরের দিক থেকে উপদেশমূলক যেখানে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে বলেছেন, বলেছেন এর সুখময়তা নিয়ে এবং মানুষকে আত্মসংযম ও ভক্তি কীভাবে কর্ষণ করতে পারে সে-ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রাজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি আর বলিষ্ঠ কথনে ঋদ্ধ করেছে ভাষাকে এবং প্রবাদতুল্য হয়ে উঠেছে। রহমান রাহির ভাষায়, “কিন্তু লাল দেদ হলেন আলাদা: এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যালোপদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে বাগধারার শক্তিতে, এবং ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত বাক্যালংকার আজও অতুলনীয় যা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে… তাঁর বাকে পাই রহস্যময় সত্যের প্রতি এক স্বপ্রত্যয়নকারী প্রগাঢ় চেতনাকে, যা ঈশ্বর-উপলদ্ধিকারী সন্তের পরিচায়ক।” রহমান রাহি, আরও স্পষ্ট তুলনা টেনেছেন তার ভাষায়, “এমনকি শেখ নুর-উদ-দিন’এর বাক, যাকে সুরুখ বলে, ভাবের দিকে ভাসা ভাসা এবং বিষয়বস্তু লাল দেদের বাকের সঙ্গে মেলে, যদিও লালা দেদের বাকের সঙ্গে তুলনীয় নয়। লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, যেখানে শেখের সুরুখ গতায়ু ছাইয়ের স্ফুলিঙ্গ। উভয়ের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এই দুই রহস্যবাদী কবির। শেখের সুরুখে যতটা নীতিমূলক ততটা জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে না, তাঁর সুরুখ আমাদের মর্মে আঘাত করে হৃদয়ে আলোড়ন তোলে না। যে-উপমা ও রূপক তিনি ব্যবহার করেছেন তা বিশদকারী ও ব্যাখ্যামূলক কিন্তু যাপিত অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জল প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি।” “এর বাইরেও, ছন্দোগত তফাত আছে, লাল দেদের বাকের তুলনায়, সুরুখগুলো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ও নির্ভুল, স্পষ্টত ফারসি বাহার (মাত্রিক)-এর ধাঁচায় নির্মিত। লাল দেদের বাকগুলো অনেকখানি নমনীয় ও শিথিল, এবং স্যার গ্রীয়ারসন তাঁর বাকে বাচনভঙ্গির (শ্বাসাঘাতের) ওপর জোর দেওয়াটাকে বুঝতে পেরেছেন, প্রতি প্যারা বা লাইনের ওপর চারবার শ্বাসাঘাত। যদিও লালা দেদের বাকের ক্ষেত্রে যা হয়ছে তা নুন্দ ঋষি বা অন্যদের ক্ষেত্রেও হয়েছে, অর্থাৎ, অনুগামীরা, চারণেরা, নকলনবীশিরা, নুন্দ ঋষির মৃত্যুর সময় থেকে দু-তিনশো বছর গত হবার পরেও যখন সুরুখগুলো নুরনামায় লিখিত হল, সেই একই দূষণ ঘটিয়েছিল। পরিচিত শব্দ দিয়ে মূল শব্দের বদল, এমনকী কখনো আরও ‘উত্তম’ কোনো শব্দ, যেমন, এমনটা একটা শব্দ যা ধর্মীয় গোঁড়ামির পক্ষে বেশি উপযুক্ত, এতে সুরুখটিকে ছন্দের দিক থেকে আরও নির্ভুল করে তোলে, যদিও তা পদটির অন্তর্গতভাবকে উন্নতভাবে প্রকাশ করতে দরকারি ছিল না।

“সুই মাস মে’ লাল্লি কভ পানুনুই বাক”

“আমি, লাল্লা, আমি নিজের বাকের সুরা পান করেছি।”

মানুষ পুরোনো কিছু রাখে না, লাল দেদ প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি, যেমনটা পাহারের গুহার ছবি প্রাচীন কিন্তু পুরোনো হয়নি বলে দেখি, আর এটাই চলমান নতুনত্ব। লাল দেদের কবিতা মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী কবিদের বচন বা কবিতা থেকে আলাদা, তিনি কৃষ্ণের বঁধুয়াদের, যেমন দক্ষিণ ভারতের সন্ত অন্ডাল এবং রাজপুতানার রাজকুমারী মীরার প্রেক্ষিতে ছিলেন এক সম্পূর্ণ বিপরীত গোত্রের। তিনি সম্ভবত, আমরা বলতে পারি, সমস্ত ‘স্ত্রী’ ঈশ্বর অন্বেষীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরুষালী। ভক্তিবাদী কবিতার চেয়ে বরং লালা দেদের অবদান হল আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সংকলনে আর অন্তরদৃষ্টিতে। তিনি লোকজনকে অনায়াসে প্রাপ্ত কোনো ধর্ম দেননি, তিনি যাকে বলে, “অনতিশীল সন্ত-কবি” ছিলেন না। তিনি মধ্যযুগের প্রথম নন বরং প্রাচীন ভারতের সন্তদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর বাক অনেকখানি উপনিষদের মতো, ডঃ ভি রাঘবন যেমন বলেছেন, “‘মধ্যযুগের সন্ত-কবিদের’ ভক্তিবাদী গানের মতো নয়, বরং প্রবচনাত্বক এমনকী কখনো বিরল আধ্যাত্মিক পর্যবেক্ষণে অঙ্গীভূত রহস্যপূর্ণ।” লাল দেদের বাক যাপিত আলিঙ্গন, মধ্যযুগের অন্যান্য ভক্তিবাদী সন্তদের প্রেক্ষাপট হয়তো প্রায় এক কিন্তু লাল দেদের কাব্যিক ভাষা নির্মাণে, কিছু একটা প্রভাবিত করেছে যা বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে অন্যান্যদের থেকে। লাল দেদের জীবনের কেন্দ্রীয় ঘটনা হল প্রতিভাস, তার সর্বোত্তম পাওয়া, কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। তবুও তিনি যেন নিজের সঙ্গে তর্ক জোড়েন, এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে, কিছু একটা আছে, যা আমাদের জানতে হবে। জয়লাল কাউলের ভাষায়, “… তাঁর বাকের ছন্দ অনেক অবিন্যস্ত আর অন্তমিলের বিন্যাস অনেক বেশি অসম। এ-কারণে সম্ভবত অনুমানপূর্বক ঝুঁকি নিয়ে বলা যায় লাল দেদের বাক, এমনি মূলের গঠনেও, কাশ্মীরি ভাষার পুরোনো থেকে নবরূপে রূপান্তরে একটা গুরুত্বপূর্ণ আখর চিহ্ন… নিছক ভাবনা কী মতবাদ বা অভিজ্ঞতা কবিতা নয়। তারা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন কবির কল্পনার “শরীরি জোর” থাকে, সেটাই সে-সবকে মূর্ত করে, এবং “আকার দেয়”। এখানে কল্পনা ভিন্ন চেহারায় গভীর আধাত্মিকবোধের শব্দ ও রূপকে আর তাদের দীপ্তিতে একজনের অনুভূত সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রকাশিত। এছাড়া অন্য আরেকটা ভাব আছে যা সত্যি। তাঁর বাকগুলো বারে বারে পড়লে, অন্তরে একটা শ্রদ্ধার ভাব উদ্ভুত হয় এবং শোধনের নীরব প্রক্রিয়ায় গহন আত্মোপলব্ধি জায়গা করে নেয়।” সে-কারণেই তাঁর প্রভাব এমন কালোত্তীর্ণ ও সুদূরপ্রসারী, যদিও তিনি কোনো কৌম, উপদল বা সম্প্রদায় গড়েননি, যেখানে তাঁর অগ্রপথিক, মহান শৈব দার্শনিক ও গুরুরা একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। লাল দেদ এক পৃথক গোত্রের যাঁর কাছে জীবন তার অর্থ হারিয়েছে, আর মৃত্যু হারিয়েছে তার আতঙ্ক। লাল দেদের স্বয়ং এই ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’, সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। “তসু না বো না ধ্যায়ে না ধ্যান…” এখানে না সে আছে, না আমি/না, ‘ভঙ্গি চিন্তার’,/না দরকার নেই ধ্যানের,/এমনকী সবকিছুর স্রষ্টাও ভুলে গেছেন।

লাল দেদ সাহিত্যে বা দর্শনে ইচ্ছাকৃত কোনো অবদান হিসেবে বাকগুলো রচনা করেননি, না তিনি গেয়েছিলেন এইসব বাক, না ভক্তিমূলক শ্লোক বা গান কীর্তনের জন্যে কিছু করেছিলেন, যেমনটা করেছিলেন পরবর্তীর সাধক-গায়কেরা। তিনি না ছিলেন ধর্মপ্রচারক বা সংস্কারক। তাঁর বাকগুলো ছিল প্রধানত তাঁর আত্মার প্রসারণ, তাঁর অন্তরের অভিজ্ঞতার এক প্রকাশ, বা কখনো, সেটা যদিও খুবই কম ঘটেছে, তা হল তাঁর চারপাশের বহির্জগতের ঘটমানতা। এ হল আন্তরকিতার মোহর ছাপ আর রহস্যোপলদ্ধির প্রাবল্য আর কাব্যিক প্রকাশের সত্যতা, যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনন্যসাধারণ বাগধারার শক্তিতে। ঘরোয়া কিন্তু বাহুল্যবর্জিত, এক অতুলনীয় বিভা তাঁর বাককে মানুষের মনে ও কাশ্মীরি সাহিত্যে চিরায়ত করেছে। তিনি শিব ও শক্তিকে দূর থেকে অমৃত সারসের মতো মিলিত হতে দেখেন কিন্তু তিনি সেখানেই থামেন না। প্রকৃতি আর পুরুষ, নাম আর রূপের সদা পরিবর্তনের প্রকাশ আর স্ব-স্থায়ীত্বের নির্লিপ্ততার সাক্ষী হওয়া, সম্পূর্ণ দুটো অসম বাস্তবতা নয়, না অখণ্ড চিৎ নিষ্ক্রিয়। লাল দেদের ‘স্বয়ং’-এর ব্যাপারে প্রতক্ষ্য উপলব্ধি ছিল, ‘সহজ’। সবকিছুকে নিয়ে, এক সত্তার মধ্যে সার্বিক ঐক্যের একাত্মতা। তিনি বলেন—

“তারপর, আমি ভেতরের আলো বাইরে ঝাড়লাম।”

না, লাল দেদ বিতৃষ্ণা থেকে মানব শরীর অন্তর্নিহিত পাপী এবং দুষ্ট এমন কিছু বলেন এবং না তিনি কঠোর সংযম বা শরীরের রিপুদমনের পরামর্শও দেন, বরং বলেন—

“শীত থেকে বাঁচতে কাপড় চাপাও
খুদা নিবৃত্ত করতে খাবার খাও”

তিনি বলেন শরীর আধ্যাত্মিক বিকাশের এক যান, এটা একটা ধর্মাক্ষেত্র, ধর্মের জমিন।

“যখন বেঁচে, তখন তাঁকে দেখতে পাও না
তবে মরার পর তাঁকে দেখবে কেমনে”

অথবা

“এটাই ঈশ্বরের আবাস
আমি দেখেছি তাঁকে আমার নিজের গেহে”
‘এই যে শরীর’ তিনি বলেন, “এর আলো আর দ্যুতি আছে।”

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

জয়ন্ত ঘোষালের প্রবন্ধ

‘এই রহস্যকে সহ্য করতে হচ্ছে’

“সামসারাস আয়াস তাপসি
বোধা-প্রকাশা লো বুম সহজ”

“এসেছি বসুন্ধরায় এক তপস্বিনী আমি,
‘আমি’-র পথে ‘বোধ’ আলো দেখিয়েছে আমাকে”

লাল দেদের সঙ্গে কিংবদন্তি আর আশ্চর্য গল্পের সহবাস জন্ম থেকেই। পণ্ডিত আনন্দ কাউল (১৮৬৮-১৯৪১), তাঁর জন্ম সম্পর্কিত এমন কিছু অদ্ভুত কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছিলেন। যেমন, তাঁর পূর্বজন্মে লাল দেদের বিয়ে হয়েছিল পানদ্রেনথানের জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে, যেখানে তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের এগারোতম দিন, কহ্নেথুর অনুষ্ঠানে, তাঁদের পারিবারিক পূজারী সিদ্ধা শ্রীকান্তকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই শিশুটা আমার কে?’— ‘কেন?’, সিদ্ধা বলেন, ‘এ তো তোমার ছেলে’।— ‘না’, লাল দেদ বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি মারা যাব আর মারহম গ্রামে এক বাচ্চা ঘোটকি হয়ে জন্ম নেব, এই এই চিহ্ন নিয়ে। যদি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে উৎসুক হন, এক বছর পরে মারহম গ্রামে এসে দেখতে পারেন।’ শ্রীকান্ত সেই গ্রামে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সেই চিহ্ন-সংবলিত বাচ্চা ঘোটকির সন্ধানও পান। তাকে প্রশ্ন করতেই, সেই বাচ্চা ঘোটকি তাঁকে বলল যে, সে এখুনি মারা যাবে। সে বলে, আরও ছয় মাস পর ভেজিব্রর গ্রামে কুকুরছানা হয়ে সে জন্ম নেবে আবার, আর তিনি সেখানে গিয়েই তখন তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। অবিলম্বে, হঠাৎ করে, নিকটবর্তী ঝোপ থেকে একটি বাঘ তীব্র বেগে এসে বাচ্চা ঘোটকিটিকে খেয়ে ফেলে। শ্রীকান্তের উৎসুকতা অত্যন্ত প্রবুদ্ধ হয়ে পড়ায়, তিনি কেবল ভেজিব্রর গ্রামে নয় তাঁকে অনুধাবন করতে যেখানে চিহ্ন-সংবলিত কুকুরছানা দেখতে পাওয়া গেল সেখানে গেলেন আর সেখানে গিয়ে তিনি কুকুরছানাটিকে আবার কোন জন্মে অন্য কোথায় দেখা হবে, এই প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর এটা চলল তাঁর ষষ্টজন্ম অবধি। তারপর, সপ্তমবার, লাল দেদের পুনর্জন্ম হল পানদ্রেনথানের সেই একই পরিবারে, যেখানে তিনি প্রসবের এগারোতম দিবসে মারা গিয়েছিলেন। যেখানে বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হল পাম্পোরের দ্রাঙ্গাবালমহলে বসবাসকারী নিচাভাট নামের ব্রাহ্মণ পরিবারের এক যুবকের সঙ্গে। যে-পাম্পোর হল রাজা অজতপুরার মন্ত্রী পদ্মর (৮১২-৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপন করা প্রাচীন পদমপুর। এটা তখন, যখন তাঁর বাপের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, বধূবেশী লাল্লা শ্রীকান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেন: ‘ছেলেটি আমার কোনো এক পূর্বজন্মে আমার কোলে জন্ম নিয়েছিল, আপনি জানেন সেই আজ এখানে আমার বর।’ শ্রীকান্তের সব মনে পড়ে যায় আর বিস্মিত হয়ে পড়েন।

সন্তবৃত্তের কিংবদন্তিগুলোর সূত্রের খোঁজ পাওয়া অথবা তাদের গুরুত্ব, যদি কিছু থাকে, অনুধাবন করা সবসময় সহজ হয়ে ওঠে না। মৃত্যুর পরে আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি এবং পুনর্জন্মে লাল দেদ বিশ্বাস করতেন। তাঁর বাকেও নিজের পূর্বজীবনের ঘটনাবলির উল্লেখের নজির আছে। এই নিত্য সময়কালের ধারায় তিনি স্মরণ করেন, তিনি জগতের এবং অন্যান্য সব বিদ্যমান বস্তুর লয় প্রত্যক্ষ করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের পুনর্গঠনও। আরও অনেক কিংবদন্তি আছে লাল দেদকে নিয়ে, যেমন, শ্রীকান্ত ‘চান্দ্রায়ণ’ নিয়েছিলেন, এ হল চল্লিশ দিনের উপবাস আর রিপু দমনের উগ্র প্রায়শ্চিত্ত। একদিন সকালে লাল্লা তাঁর বাড়ি আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন কোথায় ছিলেন তিনি। তিনি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন এ-কথা জানার পর, লাল্লা মৃদু বিদ্রূপের সঙ্গে বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখছিলাম তার ঘোড়াটা লাথাচ্ছে নন্দমার্গের তৃণভূমিতে।’ সামান্য ভিন্ন আরেকটি মন্তব্য পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ, নন্দমার্গে তার ঘোড়াটাকে নুন খাওয়াচ্ছিল।’ শ্রীকান্ত তার মন্তব্য শুনে অপমানিত বোধ করলেন, কারণ, তাঁর মন সত্যিই উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, গ্রীষ্মকালে তৃণভূমিতে তাঁর ঘোড়াটাকে অন্য একটা ঘোড়া লাথি মারছে। তারপর লাল দেদ সিদ্ধাকে প্রায়শ্চিত্ত প্রকৃত কেমন হওয়া উচিত তার নমুনা করে দেখান, তিনি মাথার উপর একটা মাটির হাঁড়ি রাখেন আর অন্য একটা হাঁড়ি পায়ের উপর এবং ক্ষীয়মান চাঁদের মতো, তাঁর শরীর ক্ষীয়মান হতে থাকে, পনেরো দিনের দিন ঘোর অমাবস্যায় তাঁর শরীরের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না এক ফোঁটা কম্পমান পারদ ছাড়া, তারপর শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় তাঁর শরীর আবার পূর্ণতা পায় ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিনে। আশ্চর্য হয়ে গুরু জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁড়ির মধ্যে সর্বদা পারদের মতো তরলটা কী ছিল?’ ‘এটা ছিলাম আমি,’ লাল দেদ উত্তর দেন। অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা মন ও অহম, শরীরের সব উপাঙ্গ কর্তিত করেও আমি কাঁপছিলাম এই ভেবে যে, আমি হয়তো গৃহীত হব না, নিছক আত্মরিপু দমনে কোনো মুক্তি নেই। শেষমেশ ঈশ্বরের কৃপায় তা মেলে। গুরু বুঝতে পারেন শিষ্যা গুরুকে পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুসলিম আখ্যানকার, পীর গুলাম হাসানও এই কাহিনির অন্য এক চেহারা দিয়েছেন। বলা হয় লাল দেদ শুদ্ধাচারি শব্দ আবৃত্তির প্রথাগত ভঙ্গির বদলে রহস্যময় আচার, নফি-ও-ইসবত, (অর্থাৎ, না বা ‘লা ইলাহ’, ও হ্যাঁ বা ‘ইল্ল-লাল-লাহ’), করে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের নমুনা এক মুসলিমের কাছে পেশ করেছিলেন।

লাল দেদ ধার্য আচার আর অনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনিয়তা এমনকী বিগ্রহ ও ছবি পুজোকেও ছাপিয়ে গেছিলেন। বস্তুত, মূর্তি পুজো, বলি, তীর্থযাত্রী হয়ে দেবতার থান ও পবিত্র স্থানে যাওয়া, নিছক শাস্ত্র আওড়ানো, উপবাস, বা নির্দিষ্ট আচার, এ-সব বাহ্যিক ক্রিয়া করেই যারা তৃপ্ত হতেন তাদের ভর্ৎসনাও করতেন। আসলে অসার ক্রিয়াকর্মকে গুরুত্ব না দেওয়াটা একজন শৈব যোগিনীর কাছে না ছিল কিছু অধর্ম, না ছিল অস্বাভাবিক। ত্রিক পন্থার গুরু বা আগমরাও এমনটাই বলছেন। যোগী তাঁর প্রাত্যহিক অর্চনা, মন্ত্রোচ্চারণ ও জল ব্যতিরেকেই করেন, তাঁর হোমও জপমালা ছাড়াই, তাঁর ধ্যান এমনি আচারহীন সম্পাদন, ফুল ও আনুষাঙ্গিক জিনিসের পুজো ব্যতিরেকেই তাঁর যজ্ঞ। ত্রিক মতে, মালা জপা কী ঠাকুরের নামোচ্চারণ এবং পুজোর নিমিত্তে শ্লোক আওড়ানো এ-সব নিম্ন স্তরের অর্চনা, আবার হোমে ও পুজোয় নৈবেদ্য চড়ানো আরও নিম্নের থেকেও নিম্ন স্তরের অর্চনা। নিম্ন মেধার লোকের কাছে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান বিগ্রহে অথবা প্রতীক চিহ্নে আর একইরকম নিরর্থক উপবাসের তুচ্ছ মান ও মূল্য। ঈশ্বরকে সাধনা করতে হবে সেই একজনের মতো ভেবে যার হাত পা পেট বা কোনো অঙ্গই নেই, কেবল সচ্চিদানন্দ ও প্রকাশ।

ধর্মের আনুষ্ঠানিক ভক্তির এই অন্তঃসারশূন্যতাকে লাল দেদ তাঁর বাকে এভাবে দেখান—

“হে মূর্খ, প্রকৃত কাজ নিহিত থাকে না
উপবাস বা কী অন্য অনুষ্ঠানিক আচারে
অথবা
মূর্তি নিছক পাথর
মন্দিরও পাথর বৈ কিছু না
মাথা থেকে পা অবধি পাথর।”

একদিন লাল দেদ বড়ো মাটির শঙ্কু আকৃতি (তাগারা) ঘড়ার মধ্যে বসেছিলেন আর মাথায় চাপিয়ে ছিলেন অনুরূপ আরেকটি ঘড়া, আর নিজে ছিলেন এই দুই-এর মধ্যে লুক্কিয়ায়িত। যারাই তাঁকে এমনটা করতে দেখেছিলেন হতভম্ব হয়েছিলেন এবং এর কিছুক্ষণ পরে ওপরের ঘড়াটা সরানো হলে তাঁরা দেখেন সেখানে আর কিচ্ছু নেই আর এই কিবংদন্তি অনুয়ায়ী এইভাবেই তাঁর মহাপ্রস্থান হয়।

লাল দেদ চলে গেলেন, কোনো প্রথাগত পরম্পরা না রেখেই। তাঁর দেহটি যেখানে পোড়ানো বা কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানে কোনো সমাধি বা মন্দির অথবা মকবরা কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। স্মৃতিচিহ্ন বলতে একটা তরাগ বা জলাশয়, এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা লাল্লা তরাগ বলে পরিচিত ছিল, যেখানে অমরনাথ যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা ডুবকি দিত।

“মারায়াম না কুনহ তা মারা না কাঁসি
মারা নেচ তা লাসা নেচ”

“আমার কাছে জীবন মৃত্যু সমান
আনন্দে বাঁচা আর আনন্দে মরা
আমি কারোর জন্যে শোকাহত নই,
না শোকাহত কেহ আমার জন্যে।”

আমার গুরু এক নিদান দিয়েছেন কর্মবিধির—

“চোখ না ফিরিয়ে চেয়ে থেকো অন্তরের দিকে,
সেঁটে রেখো অন্তরাত্মায় অটল।”

আমি, লাল্লা, হৃদয়ে নিয়েছি নিদানখানি, নগ্ন তাই জগৎময় আমি নৃত্য করেছি শুরু—

আমাদের পক্ষে লাল দেদের জীবন ও তাঁর বাকের সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তাঁর জীবনকাহিনি রহস্যে আর কিবদংন্তির চাদরে ঢাকা, যাদিও আজও নানা কাশ্মীরি প্রবাদে ও লৌকিক বুলিতে এমন কিছু বাক্য পাওয়া যায় যা লাল দেদের জীবন সম্পর্কিত কোনো-না-কোনো কিবদংন্তির সঙ্গে জুড়ে আছে। তাঁর মুখে মুখে বলা বাক বলে যা পরিচিত সে-সবের প্রামাণিকতা নিয়েও নানা দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।

লালা দেদ, না কিছু লিখে রেখে গেছিলেন, না কেউ স্বকর্ণে শুনে সে-সবের প্রতিলিপি করে রেখেছিলেন। তাঁর সমকালে তো দূর, যে-প্রাচীন কাশ্মীরিতে লাল দেদ বলেছিলেন, তা কখনো কেউ লিখে রেখেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। যে-কাশ্মীরি ভাষায় লাল দেদের বাকগুলো প্রাপ্ত হয়েছিল তা আধুনিক কাশ্মীরি এবং কালের প্রভাবে, নিরক্ষর চারণ কবিদের বদলে যাওয়া ধর্মীয় আনুগত্যের চাপে, ফারসি শব্দের ভেজালে, হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের পূর্বতন যোগ ও ত্রিক পন্থায় ব্যবহৃত নানা শব্দ ও আচার বিস্মৃত হওয়ায় মূলের শব্দ ও বাক্য অর্থ হারিয়ে ফেলায় প্রাপ্ত বাকগুলো বহু ক্ষেত্রেই মূলের থেকে সরে এসেছিল এবং তাপ্পি বা গোঁজ শব্দ জায়গা করে নিল অনেকখানি, ফলত লাল দেদের বাকের প্রামাণিকতার দ্বন্দ্ব জারিই থাকল, এবং নুন্দ ঋষির ‘নুরনামা’ কী রূপ ভবানীর ‘রহস্যাপদেশা’-য় অন্তর্ভুক্ত অনেক বাকই লালা দেদের বাক বলেও প্রচারিত ও পরিচিত, এমনকী এর উলটোটাও ঘটেছে।

যদিও লালা দেদের পক্ষে কিছু লেখা বা লিখিত কোনো পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া কোনো অসম্ভব কিছু ছিল না। তিনি লিখতে চাননি, হয়তো এটাই একমাত্র কারণ। উদাহরণস্বরূপ লাল দেদের প্রায় সমকালের শিথিকান্তার মহান্যায়াপক্ষার পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি যেমন পাওয়া গেছে। লালা দেদ না প্রকাশের জন্য কিছু লিখেছেন, না করেছেন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখার মতো কিছু। বস্তুত, তিনি বাকগুলো শুধু আওড়াতেন এবং সে-সময়ের প্রথানুযায়ী, মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এ-সবই আমাদের অনুমান। কেউ, হয়তো লিপিবদ্ধ করেছিলেন সে-সব বাকগুলো ছাড়াও আরও কিছু, অন্য কয়েকটি, যা তিনি হয়তো ঘটনাচক্রে নিজে অথবা অন্যের থেকে শুনেছিলেন। এবং এভাবেই চলেছে যতদিন না এ-সব কথকতার অঙ্গীভূত হয়ে গ্রাম্য ভ্রামণিক চারণদের গানে, এবং পরবর্তীতে আজও কাশ্মীরি ধ্রুপদি সংগীত, সুফিয়ানা কালামে মজলিস-এ-মা’রিফিম, বা সুফি বা আধ্যাত্মিক অন্বেষীদের জমায়েতের শুরুতে পবিত্র আবাহন হিসেবে গীত হতে শুরু করল। এত দুষণ সত্ত্বেও লাল দেদের বাক বেঁচে রয়েছে এবং এর মধ্যেও অন্তত প্রায় শ-দেড়েকের বেশি বাককে লালা দেদের বাক বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু কেউ কেউ বলতেই পারেন সেটারই বা কী প্রামাণিকতা?

আমাদের লালা দেদের বাকের অন্তর্গত নিজস্ব প্রমাণাদির কাছে ফিরে আসতে হবে, এর যা কিছু প্রমাণকারী বলো, নিহিত আছে এর ভাষ্যে ও শৈলীতে। তথাপী এরও অনেকানেক সীমাবধ্যতা আছে। রাজরাজাদের উত্থান পতনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত গ্রাম্য নারী লাল্লার বাকে সমসাময়িক ঘটনাবলীর কোনো ইশারা বা প্রাসঙ্গিক উল্লেখ নেই অথবা না আছে কোনো ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট দিনাঙ্ক। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ধারণের, জন্য আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে শুধু লাল দেদের কিছু রচনাশৈলীর প্রমাণ আর ছন্দ এবং চিন্তার বিন্যাস ও গুনাগুণ, যেভাবে এগুলো কোনো একটা ভাব প্রকাশে সংগঠিত হয়েছিল, এক কথায়, লাল দেদের শৈলীর বিশিষ্টতা। এগুলো আর অন্য কিছু নয়, তাঁর বাক থেকে, অন্যের দ্বারা রচিত বা ভ্রমবশত তাঁর নামে প্রচারিত বা লাল দেদের শৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করে না এমন রচনাগুলো থেকে তফাত করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, কোনো একটি বাক যে সামগ্রিক ছাপ রেখেছে তার বৈশিষ্ট্যগুলোর সামগ্রিকতার বিচারে। যে-কাশ্মীরি সাহিত্যই আমাদের সমকালে পাই না কেন, তার সঙ্গে লাল্লার বাকের পূর্বের ও পরবর্তীর ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক তুলনা করতে গেলে যেটা দরকার তা হল, তাঁর যুগের পূর্বের ও পরের কাশ্মীরি সাহিত্যের নানাবিধ গ্রন্থ পাঠের সক্ষম জ্ঞান, এছাড়া, প্রাচীন কাশ্মীরি ভাষা থেকে ছিঁড়ে আনা টুকরোগুলো যা ত্রিক দর্শনের বিবিধ পুঁথিগুলোর প্রশ্নাবলীগুলোর মধ্যে নিহিত। সন্দেহাতীতভাবে, লাল্লার বাক রচিত হয়েছিল, যাকে সঠিকভাবে বলতে পারি প্রাচীন কাশ্মীরিতে, কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে এসেছে যে-ভাষায় তা আশ্চর্যজনকভাবে আধুনিক। এগুলো মুখে মুখে ছড়িয়েছে এবং বদল ঘটেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভাষার বদল ঘটেছে যেমন সেই মোতাবিক। তবু লালা দেদের বাক সমন্ধে স্যার গ্রীয়ারসনের অনুধাবন করেছেন, “লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং গানগুলোর ছন্দময়তা অটুট রেখেছিল বহুসংখ্যক সেকেলে প্রকাশভঙ্গিগুলো। এবং আমি এখানে যুক্ত করতে পারি, এই সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছিল কারণ কিছু পুরুষ ও নারী গুরুশিষ্য পরম্পরার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেই সরাসরি সূত্র, অর্থাৎ, গুরু ও শিষ্যের পরম্পরা, বাকগুলোকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত করেছিল, তাঁদের প্রাত্যহিক প্রত্যুষের প্রার্থনার অঙ্গ হয়ে, তাদের নিজ-পাঠের। স্পষ্টত, এঁরা, তাঁরা, যাঁরা এগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন, ধার্মিক যত্নে ও যথার্থতায়, এমনি অনেক শব্দ ও বাক্যবন্ধের অর্থ না বুঝেও, “এবং তাদের সেই শততা ছিল, বিরত ছিলেন, বাকগুলোকে বোধগম্য করার জন্য কোনো অনুমানমূলক সংশোধন থেকে।” এ-কারণেই স্যার গ্রীয়ারসন বলেন, “এই ধরনের সরংক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে লিখিত পাণ্ডুলিপির চেয়েও বেশি মূল্যবান।”

লাল দেদ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই উলঙ্গ হয়ে ঘুরতেন এমন একটা প্রসঙ্গকে সামনে রেখে আলোচনা করাটা একটা খারাপ সংস্কার। শুনেছি উলঙ্গিনীর গান বলে একটি গানের সিডিও বেরিয়েছে। এভাবে লাল দেদকে দাগানো অনুচিত বলে মনে করি, কেন-না লাল দেদের বাকগুলোর কাব্যগুণ বিচার করতে গেলে, প্রাচীন ভারতীয় কবিতার ছন্দকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে যিনি বলেছেন, তাঁর মেধা ও মননকে, জানতে হবে তাঁর সময়কালীন ইতিহাস ও বাকগুলির সঙ্গে অদ্বৈতবাদী ত্রিকপন্থা শৈবসাধনার ‘প্রতি-অভি-জ্ঞান’-এর ধারণার সম্পর্ককে, যে-ধারা পুষ্ট হয়েছিল কাশ্মীরি শৈব তন্ত্রের বিখ্যাত দার্শনিক অভিনবগুপ্তের দ্বারা। আবার বুঝতে হবে, লাল দেদের বাকের কাব্য মাধুর্য ও গভীর দার্শনিক বোধ কেমন করে সুফি সিলসিলা ‘ঋষি পন্থা’-র বিশিষ্ট সাধক নুর-উদ-দিন ঋষি ও সামগ্রিকভাবে ঋষি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। সে-সব বুঝেই এগোতে হবে। সেখানে তাঁর পোশাক নিয়ে কাব্য আলোচনা শুরু হলে একধরনের শহুরে সাবঅর্ল্টান-স্টাডিসের চেহারা নেয়, ফলত সাহিত্য আলোচনা যে-পথে হওয়া দরকার সে-পথ হারিয়ে যায়। ভারতের শৈব সাধনার নানা ধারা সমন্ধে যাঁরা কিছুমাত্র খবর রাখেন তাঁরা জানেন লাল দেদ বা আক্কা মহাদেবীরা নগ্ন ছিলেন বা নগ্ন হয়ে ঘুরতেন এটা একটা তথ্য মাত্র না হলেও, সেইসব কাব্যধারার রসাস্বাদনের জন্য মূল বিচার্য বিষয় নয়। একটি ইংরাজি সংকলনও আছে ন্যাকেড সেইন্ট, এরকম নামে। এতে একটা ওপর ওপর দেখানো সহানুভূতি তৈরি করার চেষ্টা চলে, যে-সবের ধার ধারতেন না লাল দেদ। কিংবদন্তিগুলোর নির্যাস নিয়ে বাকগুলো পড়তে হবে কোন পূর্বনির্ধারিত কোনো মতবাদের তোয়াক্কা না করেই। প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করেছে শৈব পন্থাগুলো, দার্শনিক বিতণ্ডা করেছে, খারিজ হয়েছে সমকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিবৃত্তে বা সন্তবৃত্তে। আনন্দ কাউলের অনুবাদ ও টীকা থেকে দেখতে পাই তিনি সুলতানদের ক্ষমতার বলে ইসলামীকরণের নিমিত্তে নতুন ধর্মান্তরিতদের দিয়ে চরবৃত্তি করানোকেও কটাক্ষ করেছেন। দুই ধর্মের প্রথাগত মেইন্সট্রিম তাই তাঁকে শতকে পর শতক নাকচ করেছে। লাল দেদের সেই নগ্নতা, নিয়ে মানী গবেষক জয়লাল কাউল কি লিখেছেন দেখি— “একটা কিংবদন্তি গড়ে ওঠে, এবং নাছোড় হয়ে থাকে যে, তিনি ঘুরে বেড়ান নগ্ন হয়ে, নৃত্য করে, গান গেয়ে পরমানন্দ ক্ষিপ্ততায়, যেমন করতেন পুরাণের হিব্রু নবি আর তুলনামূলকভাবে এখনকার দরবেশরা, যে তিনি ঘুরে বেড়াতেন প্রায় নগ্ন হয়ে। সেটা সত্য হতেই পারে কিন্তু তিনি যে দরবেশদের মতন ঘূর্ণনাচ নেচে বেড়াতেন, এটা এমন এক প্রতিবেদন যে, কাশ্মীরি শব্দ নৎসুনের সঙ্গে যায় না। শব্দটা বোঝায়, কোনো কোনো প্রসঙ্গে নৃত্য করা, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হয় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ঘুরে বেড়ানো বোঝাতে; বাকের প্রেক্ষিতে পরের অর্থটাই বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাঁর কাছে বেশি মূল্যবান ছিল যে, তাঁর অন্তরাত্মার জন্য তিনি আর নিজের বহিরাবরণের দিকে ফিরে তাকাবেন না। সেই জন্যই তাঁর কিছুই মনে হবে না, যদি তিনি নগ্ন হয়েই চলে যান যেদিকে খেয়াল তাঁকে নিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কী-ই-বা আছে নৃত্য করার? যার জন্য তিনি অন্তরের দিকে চেয়ে থাকবেন? এটা ঠিক প্রত্যয়জনিতও নয়। পরে সত্যিই একটা সময় আসে যখন তাঁর নৃত্যের সেই প্রেক্ষিত তৈরি হয়ে যায়। “পরমানন্দে ঈশ্বরের সঙ্গে বিত্তবিনিময়ের”: মে’ সে’ তা পানাস দ্যুতুম শোহ। কিন্তু তখনও সেটা আসেনি, সে-সময় আসেনি। তখনও অবধি তাঁর গুরুর বাণী, আত্মজ্ঞান অর্জন করতে পার্থিব এই জগৎকে হারিয়ে ফেলতে হবে, যা ছিল তাঁর কাছে এক বেদনাদায়ক ‘সব হারানোর ফোসকা (রাভান তভ’ল)”। গ্রিয়ারসন যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন ভাবাটা ভাষার ওপরে জুলুমই হবে অতিশয়। উপরন্তু, এই শ্লোকের কল্যাণেই এর পর থেকে পাম্পোরের পদ্মাবতী লাল দেদ (লাল ঠাকুরমা) বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁর পেটের নীচ দিকের থলথলে ভাবের জন্য, যা ঢিলে হয়ে তাঁর তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে ঝুলে থাকত। তাঁর নামের বিষয়ে এই তথ্য মেনে নেওয়া যদিও খুব কঠিন। বা, সাম্প্রতিক কিছু লেখকের যেমন অনুমান, লাল্লা লীলা বা লোল শব্দদ্বয়ের অপভ্রংশ। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পক্ষে এমন ভাবনা অন্যায্য। লাল্লা, মনে হয়, প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটা নাম। আর, খুব সম্ভবত এটা ছিল তাঁর কুমারী নাম। তিনি এই নাম ব্যবহার করতেন তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলার সময়, এই নামটা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজেকে উল্লেখ করার সময়। যেমন, যখন তাঁর বন্ধুদের তিনি বলেছেন, “লালি নালাবথ সালি না যানহ”, যেখানে নিজেকে বললেন, লালি, (লাল্লাকে), সে-সময় লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন, একজন গৃহবধূ, ‘পরিব্রাজক তপস্বিনী’ নন। তাছাড়াও, নিজের বাকে নিজেকে যখন উল্লেখ করেছেন, তিনি এই একই নাম, লাল (বা লালি, লা’লি, যেটা কাশ্মীরি ব্যাকরণে অন্য আরেক রূপ) ব্যবহার করেছেন, আর এই নাম তাঁর ১৮৪টি বাকে অন্ততঃপক্ষে ২১বার উচ্চারিত হয়েছে, ১০৯টি গ্রিয়ারসনের, ৭৫টি আনন্দ কাউলের। শব্দচর্চায় এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মূল কাশ্মীরি ভাষায় লাল বা লাল্লা-র উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন।”

শেষ পাতা

Categories
প্রবন্ধ

অলক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সমন্বয় মাইহার ব্যান্ড

ভারতীয় সংগীতের প্রতিটি অলিগলি আলাউদ্দিনের শ্রুতিতে উজ্জ্বল তো ছিলই। তার সঙ্গে তিনি মিশিয়ে ছিলেন বাংলার লোকায়ত মেজাজকে। বাংলার মাঠ ঘাট এমনকী ফুটপাথেও তো তাঁর কেটেছে বহু বিনিদ্র রাত। এছাড়াও ছিল প্রত্যক্ষভাবে ব্যান্ডে বাজানোর অভিজ্ঞতা। দেশি ও বিদেশি যন্ত্রে। হাবু দত্তর থিয়েটারে বিভিন্ন দেশি যন্ত্রের বাজানোর অভ্যাস, ফোর্ট উলিয়ামের এক সাহেবের কাছে বেহালায় নিখুঁত পশ্চিমী হার্মনির শিক্ষা, উজির খাঁর থিয়েটার দলে পার্শ্বসংগীত সংযোজনার দায়িত্ব— এ-সবই চলছিল শাস্ত্রীয় গানবাজনা অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গেই। সে-অভিজ্ঞতা মাইহার ব্যান্ডে আশীর্বাদ হয়ে গেল। সারাজীবন ঘুরেছেনও প্রচুর। দেশের বাইরে অনেক জায়গায়। ভলগা নদীর পাড়ে বসে বেঁধেছিলেন ‘ভলগা ধুন’। সুরের সেই নিরীক্ষা অসামান্য। পাশাপাশি ‘কাফি ধুন’ (ওয়েস্টার্ন)— শুনতে কিছুটা সোনার পাথরবাটি মনে হলেও জ্যাজ-এর রিদম আর কাফির আরোহণ-অবরোহণের কাটাকাটি সুরানুলেপন— এতেই চমৎকার বৃন্দাবাদন। আসলে পাশ্চাত্য হার্মনিকে অত্মস্থ করতে আলাউদ্দিনের সময় লাগেনি বেশি। ‘দেশ’ রাগটিকে দুইভাবে ভাবলেন আলাউদ্দিন। প্রথমে ছয় মাত্রার সাধারণ দাদরায় কোমল বা শান্ত ছবি। এবং সেই অনুযায়ী সম্মিলিত বৃন্দবাদনে খানিক নমিত স্বরানুশীলন। তারপরে তার চেহারা অন্য। একই সরগমে ঝোড়ো ‘দেশ’। এ-হেন অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই আনকোরা। নিরীহ সব দেশি যন্ত্রে আমাদের অভ্যস্ত শ্রবণ একক যন্ত্রসংগীত শুনতেই শিখেছে কেবল। ব্যান্ড বা অর্কেস্ট্রা বলতে সাধারণভাবে এখন বোঝায় বিপুল গ্র্যাঞ্জারকে। রিলায়েন্স কাপ বা সাফ গেমসে কত যন্ত্রীর সহযোগিতায়, সর্বাধুনিক স্টুডিওতে কত লক্ষ টাকার বিনিময়ে কী মহৎ সৃষ্টি সম্ভব হল, সে নিয়ে কাগজে স্কুপ রিপোর্টিং-এর ছড়াছড়ি। তাদের পাশে মাইহার ব্যান্ডের জায়গা না হওয়ারই কথা।

একদিক থেকে তা বোধহয় ভালোই হল। বাংলার কীর্তনের অমন বিশ্বাসযোগ্য সমবেত রূপ এমন সান্তুর, অনুভূতিকে উসকে দেওয়া প্রসন্নতায় শোনাতে পারতেন কি তাহলে মাইহার ব্যান্ডের সদস্যরা? অ-প্রচারেই ওঁদের গৌরব। ‘সখি বহে গেল বেলা’-র আকর সংগীত বাংলা পুরাতনীর ‘উঠিতে যুবতী বসিতে যুবতী’। তাকে বন্দিশ করেই এই কম্পোজিশন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যে-নলতরঙ্গ বিপুল বিক্রমে ঝড়ের গতিতে দেখিয়েছে তার সাধ্যের নমুনা, এই মধ্যলয়ের দাদরা কম্পোজিশনে তার ভূমিকা তখন কেবলমাত্র মন্দিরায়। আশ্চর্য মমতায় কতিপয় মধ্যপ্রদেশীয় যুবক কীর্তনের মূল মেজাজের উজ্জ্বল উদ্ধারে নেমে পড়েছে যেন। চেলোর গাম্ভীর্যের পাশাপাশি সেতার, সরোদ আর বেহালার ক্ষীণ সুর (ইচ্ছে করেই আঙুলে তার চেপে ধরে স্বরকে অর্ধস্ফুট করছিলেন ওরা), প্রায় থেমে আসা তবলার শীতল সৌন্দর্য সুরস্রষ্টার ভাবনা আর শিল্পীদের অধ্যাবসায়ের জ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছিল যেন। আর শুনেছি ‘মালকোষ’, ‘মালহূয়া কেদার’, ‘সিংহ’, ‘ইমন’, ‘হেমবেহাগ’। শুধু মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানেই নয়, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন বা কালীঘাট কালীবাড়ির আয়োজনেও। নিবেদনের মুনশিয়ানায় বাস্তবিকই চমৎকৃত হতে হয়।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাকেই ওদের এক-আধজনের সময় সুযোগ মতো পাকড়াও করেছি। রামলাখন পাণ্ডে। চোস্ত ইংরেজি বলেন। কোনো স্কোপ যদি পাওয়া যায়, এই আশায় এটা ওটা প্রশ্ন করতে করতে তাকিয়ে দেখি জুটে গেছে আমার মতো অনেকেই। তাঁদের একজন, আগ্রহের অতিশয্যেই সম্ভবত এগিয়ে দেয় এক নামি ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট। এবং সঙ্গে সঙ্গে— ‘না দাদা, বহুত শুক্রিয়া। আই লাইক দিস ভেরি মাচ’ বলেই জামার পকেট থেকে বের করেন আদি অকৃত্রিম একটি বিড়ি। ভিড় হটিয়ে ওঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পথে মনে হচ্ছিল, এইভাবেই বোধ করি ওঁরা সবরকম প্রলোভন জয় করে স্বস্থানে আছেন আজও। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিখেছেন পাণ্ডেজি। কিছু স্মৃতিচারণ আশা করছিলাম। স্পষ্ট জানালেন— ‘না ভাই, বলার মতো তেমন কিছু নেই। দেখলেই পালাতাম। অসম্ভব ভয়। আমিও শিখব না, উনিও শেখাবেন’। বলেই পিঠের দিকে নির্দেশ করেন। বহু চড়-কিল আর অপার স্নেহস্পর্শের দাগ সেখানে। কথার মাঝেই হাজির শৈলেন শর্মা। মধ্য-ত্রিশের ছটফটে ব্যক্তিত্ব। ওঁর নলতরঙ্গ বাদনের মতোই। জানালেন— ‘আমার কিন্তু মনে আছে। বাবা প্রথমে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সরোদ। তো, কিছুতেই সুর বেরোয় না। আর যা বেরোয় তাই বেসুরো। বাবা হঠাৎ এমন এক প্রশ্ন করলেন যা শুনে আমার মতো অনেকেই হতবাক। শুনবেন সে-কথা? ওঁর প্রশ্ন ছিল, শরীরে দুধ কোথায় থাকে? লজ্জায় কান-চোখ লাল, তবু মার খাওয়ার ভয়ে নির্দেশ অনুযায়ী দেখাই। ব্যাস, অমনি আমার কানটি ধরে বলেন, মা যেমনভাবে দুধ খাওয়ায় ছেলেকে, হাতে সরোদ নিতে হবে ঠিক সেই ভঙ্গিতে। এই হলেন বাবা’। বেশ গুছিয়ে বলে শৈলেন। ওঁকেই প্রশ্ন করি, আপনারা তো লেখাপড়া শিখেছেন, স্বরলিপি-পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তবে কেন এইসব অমূল্য সুরারোপকে নোটেশনে আনছেন না? ভেবেছিলাম, বেকায়দায় পড়ে যাবেন এ-প্রশ্নে। উলটে আমাকেই ফেলে দিলেন বেকায়দায়। পৃথিবীর প্রধান অর্কেস্ট্রা দলগুলির বিষয়ে সুনিশ্চিত খবর রাখেন ওঁরা। তুলনায় এলেন এইভাবে— ‘বাজানোর পদ্ধতি হল দুটো, একটা অ্যাকটিভিটিস, অপরটি আবহন। নোটেশন-ভিত্তিক বিবিধ ক্রিয়াকলাপে গড়ে ওঠে প্রথমে ধরনের পদ্ধতি। আর আমরা স্মৃতির দরজায় ঘা মেরে সুরকে আবাহন করি। দুইয়ের একটা পার্থক্য থাকবে না? এবার আসি আপনার প্রশ্নের উত্তরে। আমরা সকলেই বাজাতে জানি একাধিক যন্ত্র। মানে, আজ আমি যদি অসুস্থ থাকি, কাল রাম সুমন সেতারব্যাঞ্জো ছেড়ে নলতরঙ্গে এসে ঠিক কাজ চালিয়ে দেবে। এছাড়া, প্রতিদিনের অভ্যাসে কোনোরকম ভুলচুক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পণ্ডিতজিও এ-সবের বিরুদ্ধে। স্বরলিপি একবার হয়ে গেলে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার পরিবর্তন বিরাট প্রমাণ হিসাবে পরে গণ্ডগোল বাঁধাতে পারে। তার থেকে আমাদের শ্রুতিই বেশি অথেনটিক; আর সত্যি কথা বলতে কি, এতে মেধা বাড়ে, বাড়ে শ্রদ্ধাবোধ, সংগীতকে সর্বদাই ভালোবাসতে হয়। তাই, বাবার যা কম্পোজিশন ছিল তা আজও অটুট আছে। একটি সরগমও পালটে যায়নি। অনেকে বলেছেন, এর জায়গায় অমুক করলে ভালো শোনাত। আমাদের পণ্ডিতজি বলেন, গীতাকে কেউ পালটাতে পারবে? কেউই নয়। বাবার শেখানো সব কিছুই আমাদের কাছে সাক্ষাৎ গীতা। শত চেষ্টাতে তা পারব না পালটাতে’। চমৎকার কথা বলেন গিরিধারীলালও, অথচ কিছুতেই ওঁর সামনাসামনি হতে পারছি না। কোনোমতে পাওয়া গেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ৫৭ হরিশ মুখার্জি রোডে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই ধরতে হবে গিরিধারীলালজিকে। খেয়েদেয়ে অনেকে বেড়িয়ে পড়বেন কলকাতা দেখতে। বিশ্রাম নেবেন খালি গিরিধারীলাল। বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছে যাই যথাসময়ে। কিন্তু কোথায় তাঁরা? শুনলাম বাহাদুর খাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন সবাই। আর দুপুরে ধ্যানেশ খাঁর ওখানে সকলের নেমন্তন্ন। তবে, গিরিধারীলাল বলে গেছেন, এখুনি ফিরবেন। সুতরাং রকে বসে ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা। অতঃপর ধ্যানেশ খাঁর বাড়ি থেকে খবর আসে, বাবা আলাউদ্দিনের দুর্লভ ভিডিয়ো দেখছেন ওঁরা। কেউ আসবেননা এখন। বিফল মনোরথ যাকে বলে। কিন্তু জাগছিল বিস্ময়ও। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় ছোটো-বড়ো যে-কোনো শিল্পীর আগ্রহ ওপার। এখনও খ্যাতিমান গায়ক-বাদকের ছাপার হরফে কাগজের পাতায় নিজের নাম কিংবা ছবি দেখতে কী কাণ্ডই না বাধান! অথচ, মাইহারে এই মানুষগুলি, টিভি-র ক্যামেরা, সংবাদপত্রের শিরোনাম, বিদেশ ভ্রমণ— এ-সব লোভ থেকে মুক্ত আছেন! পরক্ষণেই ভাবি, বাবা আলাউদ্দিনকে দেখেছেন ওঁরা। এর পাশে যাবতীয় আকর্ষণ তো নিতান্তই তুচ্ছ!

সুতরাং পরদিন আবার দৌড়। দুরদর্শন জোগাড় করেছেন মাইহার সরকারের অনুমতি। প্রসাদ স্টুডিয়োতে করে রাখলেন রেকর্ডিং, তিনটি আইটেমের। তাই ন-টার আগেই বেড়িয়ে পড়েছেন ওঁরা। ভবানীপুরের প্রসাদ স্টুডিয়োতে আজ খালি অডিয়ো-রেকর্ডিং। পরে একদিন ছবি তোলা হবে। উপস্থিত অন্য সকলের সঙ্গে হতবাক হয়ে গিয়েছেন খোদ স্টুডিয়ো-কর্তৃপক্ষও। যে-রেকর্ডিং দিন গড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত নিত্যদিন বিরক্তি উৎপাদন করে, তা শেষ কয়ে গেল লাঞ্চের আগেই। রিহার্সাল দরকার হয়নি, একবারের জন্যেও কোনো যন্ত্র ভুল বাজেনি। তাই প্রথম টেকেই ওকে। সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরেই ওঁরা ছোটেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামী লোকেশ্বরানন্দজির ডাকে আজ বিবেকানন্দ হলে ওঁদের বাজনা। সুতরাং গিরিধারীলালকে আজ ছাড়ার প্রশ্ন নেই। আলাউদ্দিনের বাড়ি ‘মদিনামঞ্জরী’-তেই থাকেন উনি। আর তো কেউ দেখার নেই। সাত বছর বয়সে ধরেছিলেন বাবার হাত। তখন ওঁর সঙ্গী রাজা ব্রিজনাথ সিং। বয়সে ব্রিজনাথ অবশ্য অনেক বড়ো। ছিলেন আমাদের তিমিরবরণও। আর কার কার কথা মনে পড়ে? খানিক ঘুরেই বিস্তৃত করি প্রসঙ্গ। একটু যেন ভাবেন, খানিক থামেনও। তারপর— ‘আনোয়ার খাঁ, রামস্বরূপ, ঝুররালাল, দশরথ প্রসাদ… আউর কেউ কোই’। কীভাবে শেখাতেন বাবা? বলতে না বলতে উত্তর— ‘বহুত পিটতা’। তারপরই খানিক লজ্জা পেয়ে বোধহয়— ‘সকলকেই শিখতে হত সবকিছু। রিহার্সাল হত বাবার বাড়িতে। কেউ হয়তো রিহার্সালে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র গিয়েছে, বাবা ঠিক সেখানে হাজির। বাবাকে দেখে সে দৌড় লাগিয়েছে, দৌড়াচ্ছেন বাবাও। তাঁকে ধরে বকে-মেরে, যন্ত্রের সামনে বসিয়ে শেষে আদর। আর খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সর্বক্ষণই শুধু এই বাজনা। বাবা শেখাতেন গান গেয়ে। আমাদের তা তুলতে হত যন্ত্রে, গলাতেও। না পারলে দেখিয়ে দিতেন যন্ত্রেই। ভোরবেলা নিয়ম করে রোজ শুরু করতাম পরপর ‘আহির ভায়রো’ আর ‘যোগিয়া’ দিয়ে।

অনেকের কাছেই আছে এক বড়ো মাপের ভুল ধারণা, মাইহার ব্যান্ডের মোট সদস্য সংখ্যা না কি আশি-পঁচাশি। সে-প্রসঙ্গ তুলতেই ফোকলা দাঁতে হেসে ফেলেন গিরিধারীলাল। মোট পনেরোজন, ঝুররালালই শুধু আসতে পারেননি। মাইহার সরকারের অবশ্য একটা স্কুল আছে। তবে তার সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক একেবারেই নেই। সরকার ওঁদের দিয়েছেন রিহার্সালের জায়গা। সেখানে অনুশীলন চলে রোজ, সকাল আটটা থেকে এগারোটা। ছুটির দিনেও। যন্ত্র দেন সরকার। ‘শুধু একটা জিনিসই সেই মাপে পাই না আমরা,’ বলছিলেন দুই তবলিয়া। অনুষ্ঠানের টাকায় তাঁদের কোনো অধিকার নেই। ব্যক্তিগতভাবে বাজানোর ক্ষেত্র কম। সারা মাসের পরিশ্রমের বদলে ওঁরা পান গ্রাসাচ্ছাদনের ন্যুনতম ভাতা— সরকারি স্কেলে। ওঁদের দাবি অবশ্য কিছু বেশিই। এ নিয়ে অসন্তোষ যে ক্রমশ দানা বাঁধছে, তা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

সেতারব্যাঞ্জোর তার পরীক্ষা করছেন রামসুন্দর চৌরাশিয়া। চন্দ্রসারং সারাঙ্গা— এইসব যন্ত্র নিয়ে কথা চালানোর ইচ্ছে। বললেন— ‘বাহাদুর খাঁর বাবা আয়েত আলী খাঁ মাইহারে গিয়ে বাবাকে উপহার দিলেন ওঁর উদ্ভাবন সেতার-সারোদ। একটিই যন্ত্র। বাবা তাতে লাগালেন চামড়া, দিলেন ব্যাঞ্জোর এফেক্ট। তৈরি হল নতুন যন্ত্র সেতার-ব্যাঞ্জো। প্রথমে বাজাতেন রামস্বরূপ। এখন আমি। ‘হেমন্ত’, ‘হেম বেহাগ’, ‘মরাগ মঞ্জরী’— এ-সবই ছিল বাবার প্রিয়। আমিও শিখেছি ওঁর কাছে’। কোনো বিশেষ ঘটনা? মহাজাতি সদনের কথা আগেই জানি। উনি দিলেন আর এক খবর। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে গুরুপূর্ণিমায় সকলে গিয়েছেন ওঁর বাড়িতে বাজাতে। পাণ্ডেজি (রামলাখন পাণ্ডে) হঠাৎ বলে বসলেন, আমরা ‘মেঘ’ বাজালেই বৃষ্টি হয়। ‘অমনি সকলের ধরাধরি। বেকায়দায় ফেলা যাবে, এমনটাও কেউ কেউ ভেবেছিলেন নিশ্চিত। রোদ আর আকাশের নীলে বৃষ্টি বা মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। মুখ কাঁচুমাচু করে বাজনা সুরু করেছি, অর্ধেকও হয়নি বাজানো। এমন বৃষ্টি নামল যে, ঘরদোর সব বানভাসি। অনুষ্ঠানই চালানো যায়নি।’ কী এর ব্যাখ্যা?

সে-প্রশ্নে বা প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো দরকারও বোধহয় থাকে না। বিশেষত, যারা সামনাসামনি শুনছেন মাইহার ব্যান্ড। প্রচলিত রাগ-রাগিণীর অচেনা বন্দিশের পাশাপাশি মাইহার ব্যান্ডের পাঁচ যুগের যত্নসঞ্চিত যক্ষের ধনে আড়াইশোরও বেশি রাগিণী, যেগুলির সৃষ্টিকর্তা বাবা আলাউদ্দিন। কাজে কাজেই এ-সিদ্ধান্তে আসা বোধহয় অনুচিত হবে না। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য সংগীতকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে তাদের মধ্যে মিলমিশ খাওয়ানোর সাম্প্রতিক যে-চেষ্টা ক্রমবর্ধমান, তা সার্থকতায় সম্পূর্ণ করে গেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, তার জন্য গাল বা বগল বাজানোর দরকার পড়েনি। মাইহার ব্যান্ডের এখনকার প্রজন্ম সেই মিশ্রণকে শুদ্ধ এবং অবিকৃত রাখার কাজে দৈনিক মহড়ায় প্রাণপাত করেছেন। আত্মপরিচয়ের গ্লানি ছাপিয়ে সংগীতকেই ওঁরা করে তুলেছেন পরিচয়ের হাতিয়ার। পৃথিবীর গানবাজনার ইতিহাসে এ-উদাহরণ দ্বিতীয়টি মিলবে কি? সেই পরিণাম স্বীকৃতি অবশ্য ওঁরা আজও পাননি। যেমন পাননি বাবা আলাউদ্দিন। আর তাই আলাউদ্দিন খাঁর জন্মের একশো পঁচিশতম বর্ষে সুদূর মাইহার থেকে ছুটে এসে যাঁরা শুনিয়ে গেলেন অবিস্মরণীয় সংগীত, তাঁরা হয়তো দেখেও গেলেন, মহাজাতি সদন অর্ধেক ভরেনি। এই বিস্মৃতির কোনো ক্ষমা নেই।

প্রথম পাতা