Categories
প্রবন্ধ

রঘু জাগুলিয়ার প্রবন্ধ

তুমি নীরবতা, সাঁঝের প্রদীপ

নদীর ভাঙা-গড়ার মধ্যে যে-জীবন অন্তর্নিহিত, আবহমান, সেই জীবন নরম ও নিবিড় পলিমাটির চেয়ে যে-আঠালো— মনে হয় সে কোনো ভোরের আলোর মতো অস্পষ্ট,

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ ফর্মায়েসি

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

চতুর্থ পর্ব

ত্রিভাষণ
(The Triversen)

Categories
প্রবন্ধ

গৌতম গুহ রায়ের প্রবন্ধ

জহর সেনমজুমদারের কবিতা, কবিতার অন্তর্ঘাত

গত নভেম্বরে আমরা একসঙ্গে ঢাকা লিট ফেস্টে, তারপর আমাদের বন্ধু কবি শামীম রেজার উদ্যোগে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার। সাথী তরুণ ও প্রাণ-উন্মাদনায় ভরপুর কবি জাহিদ সোহাগ, বাংলা কবিতার নতুন বাতাস। এক সন্ধ্যায়, তখন সূর্য ডুবে গেলেও সেই রক্ত আভা সাগরের ঢেউ ধরে রেখেছে। আমরা সেই ক্রমশ ম্লান হয়ে আসা আলো ও সাগরের জলের অদ্ভুত রূপের দিকে তাকিয়ে শুনছিলাম জহরদার কবিতার কথা, কবিতা, সেই সময় বাস্তবিকই এক পরাবাস্তব জগতে হাজির হয়েছিলাম আমরা তিন প্রজন্মের তিনজন, হয়তো বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই, ভেজা ভেজা চারদিক। জহরদা পড়ছেন,

“সমুদ্রের ঠোঁটের দিকে এইমাত্র সন্দেহবাতিক সূর্য ঝাঁপ দিয়েছে। তোমরা কি
দেখতে পেয়েছ? সবুজ লন্ঠন হাতে উদ্ভ্রান্ত এক প্রেমিক আজও
প্রেমিকার পিঠ থেকে রিপুর দাগ তুলছে তো তুলছেই। এসব কথাই
বলতে চাই আজ। এসব কথাই যেন আত্মজীবনী, দেহের ভেতর
বৃষ্টির যৌন আকুতি ধরে রাখে। মায়ের যোনিতে নীল অপরাজিতা রেখে
তান্ত্রিক বাবা সাধনা করে। আর বালকবৃন্দ সেই অপরাজিতার আদলে
ঘুড়ি তৈরিতে মন দেয়। আমরাও দেব। কিন্তু কোথায় দেব?…”

এক আধোভেজা আলো অন্ধকারে তিন প্রজন্মের তিন অনার্য সন্তান তাঁদের দলপতিকে কেন্দ্রে রেখে শুনছে কীভাবে রচিত হয় কল্পবাস্তবের ভাষ্য। খুব আত্মগত উচ্চারণে দলপতি আক্ষেপে মাথা নাড়ছেন, না, না, কিচ্ছু হচ্ছে না, আমাদের সেই ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপ’-এর ছবি আঁকা হচ্ছে না, সেই ভাষ্যের কাছে কোথায় আর পৌছাতে পারছি? এই আক্ষেপ জহর সেনমজুমদারের চালিকাশক্তি, এই অতৃপ্তিই তাঁকে করে তোলে ভিন্ন রকমের। তাই দেখি আশির দশকে প্রকাশিত একাধিক কবিতার বই তাঁর কবিতাযাত্রা থেকে তুলে নিতে। তার থেকে কিছু কবিতার দু-একলাইন পরে রেখে দিলেও প্রায় নতুন করেই পুরোনো কবিতাগুলো আবার পুনর্লিখনে তৃপ্তি খোঁজেন কবি। আবার তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ‘অন্তর্গত রচনা’ থেকে উদ্ধৃতি দিতে হয়, “লিখবার পর, লেখা হয়ে যাবার পর, প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন, মনে হয়, দারুণ লিখলাম, জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখলাম; কয়েক সপ্তাহ পর, আরও আরও কয়েক পর, যখন কবিতাগুলো আবার পড়লাম, তৎক্ষণাৎ মনে হল— খুব একটা মারাত্মক কিছু নয়, ভালো— তবে ততখানি যেন অন্তর্গত সংরচনায় খুব বেশি ভালো বলে মন যেন মানতে পারছে না; সুতরাং পরিমার্জন দরকার; বেশ কিছুদিন পর, আরও আরও বেশ কিছুদিন পর, পরিমার্জন করতে গিয়েই চৈতন্যে আঘাত নেমে আসে; ঝুঁটি বাধা মন ঝুঁটি নেড়ে বলতে থাকে, না, কিচ্ছুটি হয়নি, কিচ্ছু না;… কালে যাকে লিখিত মুগ্ধতায় শ্রেষ্ঠ কবিতা মনে হয়েছিল, সময়ের পর্বে পর্বান্তরে একসময় শূন্য মনে হয়; সব শূন্য মনে হয়…”। এই অতৃপ্তিই জীবন্ত রাখে কবিকে। জহর সেনমজুমদার তাই জীবন্ত কবি, যে ক্রমাগত লিখে যান এবং সেই লেখাগুলোর মুখোমুখি হন। নিজের মুখোমুখি যে-কবি হন না তিনি পাঠকের মুখোমুখি হতেও ভয় পান, জহর সেনমজুমদার তাঁর কবিতার পাঠকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগে থাকেন। তাই প্রতিটি পাঠক হয়ে ওঠেন তাঁর আত্মীয়স্বজন, কবির ‘আমি’-র সঙ্গে থাকেন পাঠক ‘আমরা’। এক বিষাদ তাকে জড়িয়ে রাখে তাই, ‘আত্মকথা’-য় তাই লেখেন,

“তুমি ভুবনেশ্বরী, আমাকে চন্দ্রত্বক দাও আমাদের চন্দ্রত্বক দাও,
… নুন আর দংশন নিয়ে আমরা প্রতিদিন স্বপ্নের ভেতর শব যাত্রা করি
আঁধার অতৃপ্ত আমাদের ষষ্ঠ আঙ্গুল একদিন আমাদের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ছেড়ে
ঘুমন্ত লেখকের হাতে চলে যায়, আমাদের আত্মকথা কোনোদিন লেখা হয় না
ব্যর্থ এই জীবনের কুহু ও কেকায় আমরা শুধু উথালপাথাল করি
চিরদিন উথালপাথাল করি”

কবিতা যতটুকু উন্মোচিত হয়, কবি যতটা উন্মোচন করেন, তার সমান্তরালে একটা বৃহত্তর উন্মোচনহীন পরিসর রয়েও যায়। এই উন্মোচন না করা পরাজগৎ পাঠকের জন্যে উন্মুক্ত থাকে। এই শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের দ্বিবাচনিকতা; এর ক্রমন্মোচনের রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি কবির আদি বয়ানে রয়ে যায়। কবিতা বা কবির গদ্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অন্তর্নাট্য একাধিক স্তরে ব্যক্ত হয়ে থাকে। আমরা জহর সেনমজুমদারের ‘হৃল্লেখবীজ’ থেকে যে-কোনো যায়গা তুলে আনতে পারি:

“দুর্মর জীবনাবেগে, মানুষ হিসাবে, যখনই কান্না ও ক্রোধের ভেতর দিয়ে নানা সময় পারাপার করি, তখনই মনে পড়ে যায় পাগলা দিলীপকে; কুমোরপাড়া ছাড়িয়ে, বেণুদের বাড়ির পথেই ওর বাড়ি; মাঝে মাঝেই দেখতাম হাঁটতে হাঁটতে ওর পাজামার দড়ি ছিঁড়ে গেছে আর ও জিভ কেটে দাঁড়িয়ে আছে;…
এই দিলীপ, কোথায় গিয়েছিলি?/— অজু মুখার্জির বাড়ি;/— কেন?/কান্না আনতে;/মানে?/— অজু মুখার্জি কাল রাতে মারা গেছে তো… গোপাল গোবিন্দ সক্কলে খুব কাঁদছে… কান্নায় ঘর ভরে গেছে… কান্না আনতে সকাল সকাল ওখানেই গিয়েছিলাম…”

“একবার নয়, দু-বার নয়, পাগলা দিলীপের কাছে থেকে বহুবারই এই একই কথামালার নিঃসংকোচ পুনরাবৃত্তি শুনেছি; যতবার শুনেছি— ততবারই স্তম্ভিত বিস্ময়ে শুধু চমকে চমকে উঠেছি; দরকারে অদরকারে মানুষমাত্রই মানুষের বাড়ি যায় নানা জিনিস আনতে; কিন্তু কোনো মানুষ যে অন্য কোনো মানুষের বাড়ি শুধু কান্না আনতে যায়, যেতে পারে— কোনোদিনও ভাবতে পারিনি;…

আমিও ভেবেছি পাগলা দিলীপের মতো আমিও যদি এইভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কান্না একজায়গায় জড়ো করে আনতে পারতাম, আমিও যদি সাড়ে চুয়াল্লিশ লক্ষ কান্না এক জায়গায় জড়ো করে একান্তে নিজের কাছে রাখতে পারতাম;…” — এখানেও আমরা উল্লেখিত পাঠকৃতির মধ্যে অনবরত এই আত্মবিভাজিত সত্তার দর্পনে যুযুধান জগৎ ও জীবনের ফেনিল ও তীব্র ‘অপরতা’-র উন্মোচন লক্ষ করি। এই যে উন্মোচন ঘটল সেটাই আসলে পাঠকের স্বতন্ত্র স্বেচ্ছা নির্মিত ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপ’। রুদ্ধ প্রতিবেদন থেকে মুক্ত প্রতিবেদনে উত্তরণের এই যাত্রা পাঠকের একক নয়, অনুঘটকের ভূমিকায় থাকেন কবি স্বয়ং। পিয়ের মাশারের মতো পাঠকেরও জিজ্ঞাসা থাকে: what it tacitily implies, what it does not say, এই জিজ্ঞাসা থেকেই নিজস্ব পাঠকৃতি গড়ে তোলার অবকাশ পেয়ে যান পাঠক, অবকাশ করে দেন কবি।

জহর সেনমজুমদারের কবিতায় আমরা দেখেছি যে, তিনি কুহকের বাস্তবতা, রহস্যের পরাবাস্তবতার জগৎ তৈরি করলেও সমাজ ও সময়ের গর্ভকেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর নাড়ীর বন্ধনকে ছিন্ন করে ‘তুরীয় নির্মাণে’ ব্রতী হন না, এই বন্ধনকে অস্বীকারও করেন না তিনি। তাঁর কবিতা ও গদ্য জুড়ে তাই রক্তমাংসের, স্নায়ুতন্ত্রের স্পন্দন পাওয়া যায়, নিসর্গ নির্মিতির ক্ষণেও তাই তিনি অনুভব করেন গর্ভযন্ত্রণার কান্না ও খুশী।

আমরা জানি যে, কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যুগে যুগে নানা ফতোয়া জারি হয়েছে। নানা তত্ত্ব নানা ফ্রেমে ও ফ্রেমহীনতার বন্ধনে তাকে বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছে ক্ষমতা, কিন্তু মজার ব্যাপার হল এইসব মৌলবাদী ফতোয়া সত্ত্বেও কবিতা কিন্তু নিজের মতো করে টিকে থাকে এবং সেই টিকে থাকা স্বতন্ত্র, নিজস্বতায় ঋদ্ধ। ভাষা যেমন চলমান বলেই বেঁচে থাকে, স্থবির হলেই তার মৃত্যু, কবিতাও স্বাভাবিকভাবেই এই চলমানতাকে বহন করেই বাঁচে। কবিতার ভাষা চলনের শক্তিতে হয়ে ওঠে কখনো উচ্চকিত কখনো নিজেই সংকেত লিপির মতো সংহত। অস্তিত্ব ও অনস্তিস্ত্বের সেতু বন্ধন করে কবিতা। কবিতা টিকে থাকে মাতব্বরদের ছুড়ি কাঁচির পরোয়া না করে। সে কাউকে রেয়াত না করেই নিজের মতো হেসে ওঠে, বা কেঁদে ওঠে নিঃশব্দে বা সশব্দে। জহর সেনমজুমদারের কবিতা এই ‘ফতোয়া’ উপেক্ষা করে নির্মিত স্বাতন্ত্র্যের উজ্জ্বল পতাকা। তাই তিনি অনায়েসে লিখে ফেলেন,

“…
স্কুল কাকে বলে? স্কুল তো মরা মথ, মরা সাপ, মরা
হৃৎপিণ্ডকে গীটারের মতো বাজায়। অথচ এইতো কদিন আগে
পুকুর থেকে লাফ দিয়ে উঠে এসে একটা মাগুর মাছ
স্কুলের মধ্যে ঢুকলো এবং চোখ উলটে মরে গেলো।
আমি সেই মাগুর মাছটার দুটো সাক্ষাৎকার নিয়েছি।
একটি জীবিত অবস্থায়। অপরটি মৃত অবস্থার।

মৃত অবস্থায় সে প্রথমে কিছু বলতে চায় নি। তারপর
অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর মাগুর মাছ বলল:
এ-পৃথিবী আবহমান গাধাদের, ভাঁড়েদের …
স্ত্রীপাখিদের মৃতদেহ থেকে এ-পৃথিবীর জন্ম…
গাধাদের তৈরি হারমোনিয়ামে ফুল ফোটে…
এ-পৃথিবী জামাপ্যান্ট পড়ে কিন্তু আসলে সে মড়া…”

ঋত্বিকের কথামতো, আমাদের সমাজ সঠিক অর্থেই অপ্রেসিভ, ব্রুটাল ও মস্তিষ্কহীন। ব্যবসায়ী, দালাল, পুলিশ, বেশ্যা, মিথাবাদী রাজনীতিক, ষড়যন্ত্রকারী গুপ্তচর বাহিনী ও খবরের কাগজের তুলে আনা প্রাতিষ্ঠানিক কবি-লেখক দ্বারা ধর্ষিত এই অনড় এস্টাব্লিশমেন্ট। তবে গত কয়েক দশকে পশ্চিমের বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কবিতা বা সাহিত্যচর্চার কলকাতাকেন্দ্রিক প্রভাব ও প্রতাপশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণরেখার বাইরে বা সমান্তরালে গোটা বাংলা থেকেই অজস্র লিট্‌ল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে। এর একটা বিরাট অংশের লেখকই কলকাতার ওই প্রাতিষ্ঠানিক দাদাগিরিকে অগ্রাহ্য করার সাহস রেখেছে, এক্ষেত্রে উল্লেখ করছি যে, অনেকেই কলকাতার ভৌগলিক বৃত্তের অধিবাসী হলেও এই ‘কলকাতার’ বাসিন্দা নন, তাদের মনন ও যাপনে বাংলার মুক্ত পরিসর রয়ে গেছে। বর্তমানের এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের সমান্তরাল প্রতিবাদের ভাষা মুখ্যত কবিতার সম্পূর্ণ জগৎ। প্রতিবাদের এই উচ্চারণ যেন জীবনানন্দ ঘোষিত পথ, “মরণের পরপারে বড় অন্ধকার/এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো” বলেই তাঁর কাছে সমস্ত সৃষ্টির চিৎকারকে মনে হয়েছিল “শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর”। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থের দাপটই যে কবির মোক্ষ নয় এ-সময়ের নতুন কবিতার ভাষা অন্বেষণে থাকা পাঠকের কাছে স্বীকৃত জহর সেনমজুমদার বা নির্মল হালদারেরা তার উদাহরণ। যেমন তাঁদের বুকে বুক দিয়ে রয়েছেন শামশের আনোয়ার, তুষার রায়, ভাস্কর চক্রবর্তী, অনন্য রায়েরা।

কবিতার মধ্যে দৈনন্দিন বাস্তবতার সঙ্গে সমান্তরাল অথচ বাস্তবতা থেকে উৎসারিত এক নতুন ও পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পুনর্গঠিত পরাজগতের সঙ্গে এই কবিরা আমাদের পরিচয় করান। “ব্যক্তিচেতন ও যৌথ নিশ্চেতনার দ্বিবাচনিকতায় কর্ষিত কবিতার পরিসর কার্যত স্থাপত্যের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। যথাপ্রাপ্ত জগতের আলোআঁধারিতে মধ্যস্থতা করে শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের অন্যান্য নির্ভরতাকে এবং অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পারম্পর্যকে অভ্যাসের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি দিচ্ছেন ইদানীন্তন কবিরা” (তপোধীর ভট্টাচার্য)। একদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রাতিষ্ঠানিকতার নিরন্তর প্রতিরোধ এবং অন্য দিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার প্রতিস্পর্ধী অবস্থান ও ধারাবাহিকতার সন্ধান— এই দুই দ্বান্দ্বিকতা জহর সেনমজুমদারের মতো কবিদের কবিতায় বিচিত্র উচ্চাবচতা ও কৌণিকতা যুক্ত করেছে। জহরের কবিতার নিরন্তর পাঠ ও পুনঃপাঠের মধ্য দিয়েই চলমান বাংলা কবিতার অনেকান্তিকতাকে অনুভব করতে পারি। বুঝতে পারি কতটা বিপজ্জ্বনক এই কবি, স্থিতাবস্থার পক্ষে। তাঁর ‘বিপজ্জনক ব্রহ্ম বালিকাবিদ্যালয়’-এর শেষ পর্বে পড়ি: “২১ জন ছাত্রী— পেছনে লাল বৃষ্টি। পিছনে পাঁজরপঞ্জিকার খোলা পথ, খোলা বিশ্ব। মায়ের দোকান থেকে ক্রমাগত ঋতু কিনতে কিনতে ক্লান্ত। বলছে— আর কিনবো না। হোক। ঋতুবন্ধ হোক। নেংটি ও ধাড়ির মাঝখানে ক্রমশ ব্যাপ্ত হয়ে যায় বিপজ্জনক গর্ভস্তব্ধ টাইমটেবিল। কেউটে ও হেলের মাঝখানে নিজের শরীরে ডানা লাগায় ব্রহ্ম বিদ্যালয়। সম্ভোগসংক্রান্ত মোম ফেটে যাচ্ছে লকলকে চ্যানেলগুলোর ভেতরে। মহাকাশ চুইয়ে আবার নামছে ছোট ছোট অন্ধকার। ঘুমন্ত অন্ধকার।” এই অন্ধকার ঘিরে থেকে কবিতাকে মুক্ত করার, আলোকিত কবিতায় দ্বান্দিকতায় আমরা খুঁজে পাব কবিকে। এখান থেকেই আমরা প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক জহর সেনমজুমদারের কাছে যেতে পারব।

কবি জহর সেনমজুমদারের বাইরেও স্বতন্ত্র ব্যাপ্তি নিয়ে আছেন প্রাবন্ধিক জহর সেনমজুমদার, অধ্যাপক JSM, খোলা মনের ও অন্তর থেকে পাশে থাকা এক স্বজ্জন মানুষ, বন্ধু জহরদা। ব্যক্তি ও স্রষ্টার এখানে কোনো সংঘাত নেই। জীবনানন্দের কবিতা আলোচনায় তিনি লিখেছেন, “জীবনানন্দ তো সেই জাতের কবি, যিনি স্বয়ং জানেন— একজন কবিকে সব সময় পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করতেই হয়, কবিতাকে ‘নতুন সংস্থানের ভিতর নিয়ে গিয়ে’ প্রদীপকেই পরিবর্তন করে দিতে হয়। যিনি ‘স্বয়ং’ জানেন— ‘কবিও সঞ্চয়ী’। আর সেই সঞ্চয় প্রবণতাই একজন কবিকে পাখির ডানায় ভাসমান করে নিয়ে যায় দূর দেশের কোনো কবির কাছে, কবিহৃদয়ের কাছে।” এই সঞ্চয় কবিকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, যে ‘আত্ম’-বিশ্বাস আক্রমণের ও বিজয়ের শক্তি দেয়:

“দূর থেকে দেখলাম, তোমার শান্ত জল তোমাতেই সারারাত অবলীন হয়ে আছে
তোমার জল, আমি শুধু তার কিয়দংশ ব্যবহার করি, ক্রমশ অন্ধকার
জলে ভরে যায়, একদিন আমিও দেখলাম ভাঙা নৌকায় তোমারই চাঁদকে
লুকিয়ে রেখে আমাদের গ্রামের বোবা বালিকাটি দুই হাত দিয়ে স্তব্ধ এই
বনপথ ক্রমাগত পবিত্র করছে, একটি বনপথ আরও আরও বনপথে পরিণত হয়
তোমার জল তোমার বালিকা তোমার বনপথ দেখতে দেখতে মনে হয়, মৃত্যু এলেও
আমাদের জীবন কোথাও কক্ষনো পালিয়ে যাবে না, চরাচর আমাদের, শুধু আমাদের
চরাচর আমাদের, শুধু আমাদের”

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

গৌতম গুহ রায়ের প্রবন্ধ

জহর সেনমজুমদারের কবিতা, কবিতার অন্তর্ঘাত

“এই কবিতাগুলি যেন ডানা ভাঙা, বন্ধ্যা ফুসফুসের ভেতর সারারাত জেগে আছে চারদিকে ভাঙা রিক্সা, চারিদিকে ভাঙা চাঁদ, দুইজন অজ্ঞ নারী রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে একটি কুকুরের সঙ্গে কথা বলছে;

Categories
প্রবন্ধ

ঝিলিক কর্মকারের প্রবন্ধ

বাংলা পুঁথি সংগ্রহে বিশ্বভারতীর অবদান

পুঁথিভিত্তিক গবেষণার জন্য বিশ্বভারতীর পুঁথি বিভাগের কাজের সূচনা হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে। ঘটনাক্রমে বিশ্বভারতীতে বৈজ্ঞানিকভাবে পুঁথি সম্পাদনা শিক্ষার

Categories
প্রবন্ধ

বিপ্লব চক্রবর্তীর প্রবন্ধ

ফ্যাতাড়ুর চোখে নবারুণ

‘লাল ঝাণ্ডা যখন জ্বলে ওঠে তখন তার নাম হয় হালাল ঝাণ্ডা’— যে-কথাগুলো বলত গল্পের গিনি। গল্পের কথক আর গ্যাঁড়া থাকে একটা অ্যাক্সিডেন্টে চুরমার হয়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে… সে-তল্লাটে ক্ষমতাবান লালার রাজ চলে… ওর আটাকল, গাড়ি সারানোর দোকান, হোটেল রয়েছে। রেশন দোকানও ছিল… কথকের ভাষায় ‘শালা হারামির নাম নিলে জিভ পচে যায়।’ আর ছিল বাস-লরির মালিক কর্নেল সিং। একটি ছেলের পেটে লাথি মেরে… মেরে ফেলে… টাকা দিয়ে এলাকার সকলের মুখ সিল করে দেয়… এদের এই দাপটের বিরুদ্ধে কথক, গ্যাঁড়া, পিটার, গিনিদের মতো অপাঙ্‌ক্তেয়দের চলে প্রতিরোধ… যেভাবে গিনি বলে, ‘ঘাবড়াবি না শালা। পুলিশের লাঠি ঝাঁটার কাঠি ভয় করে না কম্‌নিস্ট পার্টি। শালা লালাকা রাজ যিত্‌না দিন রহেগা— সব ভুখা মরেগা—’…

বা ধরো ‘মিউচুয়াল ম্যান’ গল্পের কথক— যে কি না আবার মিউচুয়াল ম্যান হতে চায়। (মিউচুয়াল ম্যান কোনো নাম নয় এটি একটি পদ বা উপাধি। দূরে কাছে মিলিয়ে তিনটি ব্ল্যাক মদের ঠেক আছে। মদের ঠেক তিনটির মধ্যে দু-টি পড়েছে কলকাতা পুলিশ এবং অপরটি পড়েছে বেঙ্গল পুলিশের থানায়। এদের মধ্যে একটিতে আবার কলকাতা এবং বেঙ্গল উভয় থানার পুলিশ-ই রেড করে। ‘এবার আসবে মিউচুয়াল ম্যান— তিনটি ঠেকেরই এক মিউচুয়াল ম্যান…পুলিসকে ঠেকের নামে কেস দিতে হয়। এসব গভরমেন্টের নিয়ম… এইসব কেস যে খাবে সে কে? সে হল মিউচুয়াল ম্যান। অবশ্য ওখানেই বেল দিয়ে ছাড়াবার ব্যবস্থাও থাকে… মিউচুয়াল ম্যান পার কেস পাবে সত্তর টাকা। আর সেইসঙ্গে যে কোনো ঠেকে দুবেলা চোলাই ফ্রি।’) গল্পের সেই কথকের মতো—

“ফোয়ারার সামনে, দুনিয়ার সামনে সব চিটিংবাজ, ঢপবাজ লাফড়াবাজের সামনে দাঁড়িয়ে সিনায় পুরো ডিজেল নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে চিল্লিয়ে… জানো, আমি কে? আমি দুই থানায় কেস খাই, তিন ঠেকে চোলাই। আমি হলাম, আলবাল ফেকলু পাচু কেউ নয়, আসলি মিউচুয়াল ম্যান”…

আমরাও বলব একদিন— ভণ্ড মেকিদের উপর দাঁড়িয়ে— যে-প্রত্যয় আমাদের আছে… যা আমরা হতে চাই। চেয়ে এসেছি। হতে দেওয়া হয়নি।

‘কাঙাল মালসাট’-এর ৪ নং পরিচ্ছেদে সেই তোবড়ানো গাল-খোঁচা দাড়ি-আধবুড়ো ড্রাইভার তাই বন্ধু আমার… যার চার বছরের ছেলে মরে যায় ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায়। বেঁচে থাকলে সে জোয়ান হত… এদের জন্য আমরা লড়ব না? বা ‘বিকল্প রণনীতি’-র মহীতোষ নাতিকে নামি স্কুলে ভর্তি করতে পারে না বটে, গল্পের শেষে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করিয়ে নাতিকে বড়ো মানুষ করবার প্রত্যয় তার রয়ে যায়… আমাদেরও তো জীবনে তাই বিকল্প রণনীতি তৈরি করতে বঞ্চিত হতে হতে…

আর সবকিছু মিলেমিশে ছাপিয়ে গিয়ে পরম প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠে আমার নবারুণের ফ্যাতাড়ুরা। জানো তো, এক অধ্যাপক যার কাজ ছিল (এখনও) তরুণ সদ্য নেট কুয়ালিফাইড ছাত্রদের মাথা খাওয়া। গবেষণা প্রবন্ধ ছাপিয়ে দেওয়ার নামে নিজের ইচ্ছেমতো তাদের ব্যবহার করা… তার ওমুক স্যারের দশ কপি বই বেচে দাও, তমুক দাদার ১৫ কপি পত্রিকা প্রচার করে যাও… সদ্য একটা কলেজে তখন পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম… ছাত্রদের মাঝে প্রচার করো তার বে-নামে লেখা মানে বইয়ের… আর লোভ দেখানো শুরু হয়, বড়ো পত্রিকায়-বড়ো প্রকাশনী সংস্থায় আমার লেখা ছাপিয়ে দেওয়ার… আমার বই প্রকাশ করে দেবে, তাকে সহ-সম্পাদক না করলে নাকি বড়ো কোনো অধ্যাপক লেখা দেবেন না। বারো-পনেরো হাজার টাকা দিলে পত্রিকার আই এস এস এন জুটিয়ে দেবে সেই ‘মহান অধ্যাপক’… নবারুণের ফ্যাতাড়ু আর চোক্তাররা আমায় সাহাস জুগালো। শিখালো এইসবের প্রতিরোধের… একা লড়াই করে পত্রিকার আর এন আই ও তারপর আই এস এস এন জোগাড় করে ছাড়লাম… একটা পয়সা কাউকে দিতে হয় না… কোনো দালালকে না… এই দালালশ্রেণির আমরা তখন নাম দিলাম ‘ব্রয়লার অধ্যাপক’… নবারুণ ‘সব শেষ হয়ে যাচ্ছে’-তে যেমন লিখেছিলেন—

“চারিদিকে শুয়োর ও গরুদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে জুডাস সংস্কৃতির অসংখ্য ক্লোন। এইসব ক্লোনেরাই দৃশ্যমান প্রত্যহ, সকাল বিকেল রাত্রি। ক্লোনেরাই সরবরাহ করে চলেছে ব্রয়লার নাটক, ব্রয়লার উপন্যাস, ব্রয়লার কবিতা, ব্রয়লার ছবি, ব্রয়লার সমালোচনা, ব্রয়লার পত্রিকা।”

নবারুণ লেখেননি ‘ব্রয়লার অধ্যাপক’-দের কথা… ক্লাস না নিয়ে টিউশনবাজি করে এদের কাজ ফি বছর পঙ্গু ছাত্র তৈরি করা… এরাই কলেজে কলেজে মড়োলিপনা চালাচ্ছে… ছাত্রদের নোটের নামে গাঁজাখরি গিলিয়ে খুশি করে দিচ্ছে… নিজেকে প্রমাণ করছে মহান অধ্যাপক… পরীক্ষায় কী কী প্রশ্ন আসবে তাও তাদের জানা। কোন অধ্যাপকের কাছে কত বেশি টিউশন পড়ে আর কে ভালো সাজেশন দিতে পারে— বিচারের এই মাপকাঠিতে সমাজে প্রামাণ হয় কে কত বড়ো অধ্যাপক… আর যারা সত্যিকারের সৎশিক্ষা দিতে চাইছে তারা এই ‘ব্রয়লার অধ্যাপক’-দের নিষ্পেষণে বনে যাচ্ছে ফ্যাতাড়ু… যেহেতু আমি সেই সময় ছিলাম কনট্রাকচুয়াল তাই নিজেকে মনে হতো ফ্যাতাড়ুর ফ্যাতাড়ুর… আমরা তিনজনে একটা ভাঙাচোরা প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারে থাকতাম। কলেজে ছিল টি আই সি। যা টাকা পেতাম বাড়ি ভাড়া করে থাকার সাধ্য আমাদের ছিল না, আর দূ্রত্বের কারণে বাড়ি থেকে যাতায়াতও করা যেত না। আমাদের মধ্যে একজন ছিল ইউ জি সি প্রজেক্ট ফেলো। আমি বাংলার আর একজন সংস্কৃতের কনট্রাকচুয়াল (আমরা দু-জনেই বর্তমানে সহ-অধ্যাপক)। নতুন প্রিন্সিপাল এলে আমাদের থাকতে হল ছাত্রদের সঙ্গে হোস্টেলে… কমন পায়খানা বাথরুম… একটা ছোট্ট ঘরে আমরা তিনজন। ওঃ, কী সব যন্ত্রণাময় দিন! দেখছি, প্রিন্সিপালের সেই ভাঙাচোরা কোয়ার্টার ঝাঁ-চকচকে হচ্ছে… আর আমাদের সময়ের ফার্নিচারগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে… আমদের দিন কাটছে পেচ্ছাব আর ড্রেনের গন্ধে… আমাদের মধ্যে সেই ইউ জি সি প্রজেক্ট ফেলো বন্ধুর টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেল… আর আমি মালদার কোনো কলেজে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে গেলাম… প্রতিটা ইন্টারভিউয়ে আমায় স্রেফ লাথ মেরে বের করে দেওয়া হচ্ছিল… কোনো ঠিকঠাক প্রশ্ন করা নয়। ঠান্ডাভাবে যেন স্রেফ রেপ করে দেওয়া হলো… একমাত্র আমি বুঝছি সেটা… আবার কোথাও আগে থেকেই জেনে যাচ্ছি, কার চাকরি হবে… আমরা তিনজনেই এই সময় নবারুণের ‘ফ্যাতাড়ু বিংশতি’ পড়ছি… আর নিজেদের মধ্যে খিল্লি করে নিজেদের ব্যর্থতার ঘা-এ মলম ডলছি… আমাদের চারপাশের নানা শ্রেণির ব্রয়লারদের নিয়ে পুরন্দর ভাট স্টাইলে কবিতা লিখে নিজেদের মধ্যে পাঠ করছি… ওদের মতো গলার স্বর বসাচ্ছি নবারুণের মল্লিনাথ, মালতিলতা, মেঘু বৌদিদের চরিত্র পাঠে… ‘ফ্যাতাড়ু বিংশতি’ বইয়ের সেই ‘অর্থাভাবে ফ্যাতাড়ু’ গল্পের শেষাংশ! টয় ইমপোর্ট কোম্পানির সেই অসৎ ব্যবসায়ীকে নাস্তানাবুদ করার মহানন্দে প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় ফ্যাতাড়ুরা… রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা টাই-কোট-প্যান্ট পরা প্রায় সাহেব এক্সিকিউটিভ যুবকের কাছে ফ্যাতাড়ু মদন, ডি এসের কুড়িয়ে পাওয়া কাগজে লেখা— ‘মি. ঢনঢনিয়া, জি. এম, টয় ইমপোর্ট কোম্পানি’… সেখানে ‘জি এম’-এর ফুল ফর্ম জানতে চায়। আর যুবকটি স্বাভাবিকভাবে যখন জানায় ‘জি এম’ মানে জেনারেল ম্যানেজার… তখন মদনের সেই অপ্রত্যাশিত প্রত্যুৎত্তর, ‘দেখলে তো, তোমরা বলচিলে হয় গাঁড় মারানি নয় গাঁড় মাজাকি।… কত বলি ইংরিজিটা শেকো, তা না বাঁড়া…’ এসব পড়ে পড়ে আমরাও বিস্তর আমোদ করেছি… ঢনঢনিয়া আমাদের কাছে তখন ব্যবসায়ী নয়, আমাদের আশাপাশের সেইসব ব্রয়লার, ইনটেলেকচুয়াল ক্রিমিনাল অধ্যাপক… ফ্যাতাড়ুরা বুদ্ধিবলে তাদের মারছে… আমরা দারুণ শক্তি পাচ্ছি।

একইভাবে আনন্দ পেয়েছি ‘কবি সম্মেলনে ফ্যাতাড়ু’ পাঠে। ফ্যাতাড়ু কবি পুরন্দরকে সেখানে কবিতা পাঠ করতে দেওয়া হবে না। মালতিলতাকে ডি এস বলে ওঠে, ‘অন্য লোক হলে আপনাকে রেণ্ডি, খানকি এইসব বলত। আমরা মা-বোনদের ইজ্জত দিতে জানি। তাই আপনার মতো বেঁড়ে খানকিকে বেঁড়ে খানকি বললাম না।… গোঁড়গেল কী জানেন? জলা জায়গায় ঝোপঝাড়ে থাকে। সাপ খায়। সেই গোঁড়গেলের ন্যাজ দিয়ে কান খুঁচিয়েছেন। এবারে কেঁদে-কঁকিয়ে কুল পাবেন না।’

আমরাও কেঁদেছি। সেই ‘মসোলিয়ম’ উপন্যাস। সাহিত্য-সম্রাট বজরা ঘোষ! বজরা ঘোষ মদন, ডি এস, পুরন্দরকে দেখাচ্ছে ‘মেমবাতির আলো’। ডি এস জিজ্ঞেস করায় জানাচ্ছে, তার পরবর্তী উপন্যাসের কথা— ‘খানদানি খানকি’। বজরা ঘোষ স্ত্রীকে নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বইটা বেরুলে সে বড় পুরস্কারের আশায় আছে… কিন্তু গোলাপ মল্লিকের ছাদে ফ্যাতাড়ুদের যখন দাঁড়কাক জানায়, তিন বছর আগেই বজরা বউ পেটে ক্যানসার হয়ে মারা গেছে! বজরা আজও ক্যানসার হাসপাতালে প্রতিরাতে সেকেন্ড গেটের সিঁড়িতে বসে থাকে। ব্যাগে থাকে যশোরের চিরুনি, লক্ষ্মীবিলাস তেলের শিশি। মাথার কাঁটা। ক্লিপ। একটুখানি খালি হরলিক্সের বোতল… দাঁড়কাকও জানায়, বজরা কোনো পুরস্কার পায়নি, কেউ ওর লেখা পড়ে না। কেউ ওর নাম জানে না। ফ্যাতাড়ুরা যেন বজরাকে এ-সব না জানায়। তাহলেই বজরা মরে যাবে। দাঁড়কাক, বনবেড়াল, গোলাপ মল্লিক-সহ ফ্যাতাড়ুরাও কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকে উপন্যাসের লেখকও… লেখক প্রতিশ্রুতি দেয়, এই কান্না যতটা পারবে তারা উশুল করে নেবে…

বর্তমানে এক কলেজ শিক্ষিকা হলুদ সাংবাদ উপস্থাপনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকাকে তুমুল হেনস্তা করেছিল… আমরাও সেই সময় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল এই হেনস্তার জবাব আমরা দেবো। আমরা ফ্যাতাড়ু। আমরা প্রতিশোধ নিই… আর নিয়ে তবে ছাড়ি…

নবারুণ লিখেছিলেন—

“আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
এখানে বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে
এবং লেখকেরা উদ্ভাবিত হয়
* * *
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যেখানে অবশ অক্ষরমালা চিবোতে চিবোতে
কবিরা গরু হয়ে যায়
উল্টোটাও যে হয় না এমনও বলা যায় না’’
— ইতরের দেশ

প্রকৃত লেখকের সম্মান নেই—

“কবিরা যত লাথি খেতে পারে
ফুটবলও পারে না

কুকুরেরা যখন হাল্লাক হয়ে পড়ে
কবিরা তখনও রাস্তায়
ফেলে দেওয়া ডটপেন কুড়োচ্ছে

মাথা মুড়োনো, চুলকানি মাখা
জিভ দিয়ে ঢালা ঘোল চাটছে
সকলেই বোঝে অনুভবে
অসফল চোর বা অনুভবী কবি হবে

এসব সিদ্ধান্ত কিন্তু চূড়ান্ত নয়
কবিশ্বায়ন বুঝি
কিন্তু কবি হারামি ও অপরূপ খচ্চরও হয়’’
— ‘কবিশ্বায়ন’, মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা

এই কবিতা আমাদের চিরকাল শক্তি জোগাবে। জুগিয়েই যাবে। সৎ সাহিত্য, সৎ সাহিত্যচর্চা, সৎ পত্রিকা সম্পাদনায় সাহস জুগিয়ে যাবে… নিরন্তর শোষিত হতে হতে মরে যাইনি। নবারুণ পাঠ বাঁচিয়ে রেখেছে। রাখছে লড়াই করতে শিখিয়েছে… প্রকৃত মানুষকে, জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। শেখাচ্ছে… তাই তার প্রয়াণ দিবসে এই লেখা না লিখে পারলাম না… নবারুণ-সাহিত্যের নিবিড় পাঠ ও চর্চা, গবেষণা চলবে… আরও চরিত্র-সময়-চারপাশের কথা আলোচিত হবে… নবরুণে মৃত্যু নেই। চরিত্রদেরও মৃত্যু নেই… আমাদের শেষ করে দেওয়া সহজ না। জোর করে কোনো সৎ প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দেওয়াও তাই যাবে না… আর আমরা যদি একটি প্রগতিশীল সমাজের স্বপ্ন দেখি তাহলে মানুষের প্রতি শোষণ নয় মানুষকে মানুষের মতো মর্যাদা দিতেই হবে। শোষিত বা আপাত নিরীহ মানুষ-ও কিন্তু আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটাবার ক্ষমতা রাখে। পাঁচুগোপালের মতো প্রত্যেক নীরব শোষিতের বুকের খাঁচায় একটি ঘুমন্ত রিভলভার পোষা আছে, যা শোষক জানে না। ‘বেবি কে’ সিরিজের মতো আমরাও কখন হয়ে উঠব এক একটা মলোটভ ককটেল। কারণ, নবারুণের কথামতো— আমরাও যে এই সোসাইটির অনার চাই না। তাই যে-কোনো পর্যায়ই হোক না কেন শোষণের মাত্রা নিরন্তর বাড়তে থাকলে বুলেট কিন্তু নির্গত হবেই। নবারুণের সাহিত্য পাঠের বিস্ফোরণের যে ঝুঁকি আমাদেরমতো পাঠক কিন্তু একদিন নেবেই। নেবেই…

প্রথম পাতা

Categories
প্রবন্ধ

বিপ্লব চক্রবর্তীর প্রবন্ধ

ফ্যাতাড়ুর চোখে নবারুণ

২০১০ সালের মে মাসের কোনো এক দিনে এক অধ্যাপক আমাকে ভয় দেখিয়ে বলে, ‘তোমাকে পিষে মেরে ফেলব’… যেহেতু তার নেপোটিজম আমি সমর্থন করছিলাম না…

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ ফর্মায়েসি

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

দ্বিতীয় পর্ব

কিমো
[Kimo]

ইসরায়েলে উদ্ভুত একটি কবিতার ফর্ম কিমো।

এর তিনটি পঙ্‌ক্তি, যথাক্রমে ১০, ৭, ৬ দলমাত্রার (Syllable)।

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

প্রথম পর্ব

‘রজনীগন্ধা’ ও ভবিষ্যতের স্মৃতি

তিনটি বিস্ময়কর ‘ড্যাস’ চিহ্নের সামনে বেশ কয়েকদিন বসেছিলাম। বারবার ঘুরে ফিরে চলে এসেছিলাম তাদের কাছে,

Categories
প্রবন্ধ

কৌশিক জোয়ারদারের প্রবন্ধ

দার্শনিক মনন অথবা ভাবা প্র্যাকটিস

এই যে একটা কথা শুনেছি— সকলেরই নাকি একটা দর্শন আছে এবং সে-অর্থে সকলেই দার্শনিক, এর চেয়ে বাজে কথা আর কিছু হয় না। জীবনের যে-কোনো একটা উদ্দেশ্য থাকলেই সেটাকে জীবন-দর্শন বলে না।