Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ ফর্মায়েসি

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

প্রথম পর্ব

নয়ার/ননেট
(Nonet)

৯ লাইনের কবিতা ননেট। লাইনগুলিতে ক্রমে কম হতে থাকে দল (Syllable).

Categories
জলসাঘর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

প্রথম পর্ব

বরসে বাদরিয়া সাবন কী

Categories
প্রবন্ধ

ঝিলিক কর্মকারের প্রবন্ধ

মানবচরিত্র রাম: রবীন্দ্রভাবনায়

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যা প্রকাশ হয়নি তা সাহিত্য নয়। কিন্তু পরবর্তীতে বললেন প্রকাশই শেষ কথা নয়, শেষ কথা হল মানুষকে প্রকাশ। সমগ্র মানবকে প্রকাশের চেষ্টাই সাহিত্যের প্রাণ।

Categories
অনুবাদ প্রবন্ধ

রাস্কিন বন্ডের প্রবন্ধ

পাহাড়ের ভূতের গপ্পো

অনুবাদ: গৌরব বিশ্বাস

এ-দুনিয়ায় যেখানেই আপনি যান, সব অঞ্চলেই কোনো-না-কোনো অলৌকিক কাহিনির খোঁজ পাবেন। সিমলা পাহাড়ে যেমন ভূতুড়ে রিক্সা।

Categories
প্রবন্ধ

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

আমাদের এখানেই ভাবুন না, যদি সত্যজিৎ রায় শুধু লেখক হিসাবে থাকতেন, সিনেমা না বানাতেন, তিনি অস্কারের বদলে নোবেলটাই পেতেন। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই কথা তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদারের ক্ষেত্রেও। ঋতুপর্ণ ঘোষ একজন খুবই বড়ো লেখক হতে পারতেন, আমার বিশ্বাস, যদি চাইতেন, এবং এই সাধনাতেই থাকতেন। আজও টালিগঞ্জে যে-পরিচালকরা সিনেমা বানাচ্ছেন, আজ থেকে ৭০ বছর আগে হলে তাঁরাই বাজারচলতি বাজারফাটানো উপন্যাসগুলো লিখতেন, যেমন একদা বিমল মিত্র লিখেছেন। বলা বাহুল্য, এঁদের শক্তি আজকের পুজো সংখ্যার উপন্যাস লেখকদের চেয়ে ঢের বেশি, সে যতই তাঁরা টুকলি-সিনেমা বানান, চমকসর্বস্ব হন। এঁরা উপন্যাসের লাইনে থাকলে, আমি লাইন শব্দটাই বলছি এখানে, পুজো সংখ্যার বাজারটা এঁরাই শাসন করতেন। আবার, আজ যদি জন্মাতেন, বিমল মিত্র বা গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয়রা উপন্যাস না লিখে হয়তো সিনেমাটাই বানাতেন, অথবা, আমার মনে হয় ডেইলি সিরিয়াল ওঁদের কাপ অফ টি হয়ে উঠত।

আজ যদি একটা উপন্যাস অবলম্বনে খুব সহজে সরাসরি সিনেমা হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই উপন্যাস সিনেমার কাছে দাসখত লিখে দিয়েই শুরু ও শেষ হয়েছে। বুঝতে হবে সে আসলে উপন্যাস নয়, একটা চিত্রনাট্যের আকরিক মাত্র। সিনেমার জন্য যে-কাহিনি দরকার হয়, সেই কাহিনি সাধারণত বেশ সস্তা দরের হয়। যেমন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তাঁর দু-টি সিনেমার গল্প নিয়েছেন শংকরের উপন্যাস থেকে, উপন্যাসগুলো সিনেমাগুলোর তুলনায় রদ্দি। পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ আর সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ কিন্তু একই কাহিনি নয়, দুটো আলাদা টেক্সট, এবং প্রায় প্রতিস্পর্ধী। আবার দেখুন, পরশুরামের ‘পরশপাথর’-ও সত্যজিতের সিনেমার তুলনায় আকরিক মাত্র। সত্যজিৎ রায় কোনোদিনই কি স্পর্ধা করতেন ‘ভূষণ্ডীর মাঠে’-র চলচ্চিত্রায়ণের? ওটা অসম্ভব। শিবরামের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আমার মনে হয় না ওই লেখকের সিগনেচার কাজ, বরং ঋত্বিক ঘটক ওটাকে অন্য স্তরে তুলে দিয়েছিলেন।

নরমাক ম্যাকার্থির ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ থেকে চার-চারটে অস্কার পাওয়া সিনেমা হয়েছে। সেই সিনেমায় যতটা পরিচালক কোয়েন ব্রাদার্স আছেন, ম্যাকার্থি নেই। আপনি গুগলে এই নামটা সার্চ করলে সিনেমাটাই দেখাবে, বইটা অনেক তলায়। এটার কারণ সিনেমার রমরমা। ম্যাকার্থির এই বইটার তুলনায় তাঁর অন্যান্য উপন্যাস সম্ভবত অনেক ভালো। বইটা থেকে সিনেমাটা অনেক আলাদা হয়েই ভালো। এটাও বলা যায়, ম্যাকার্থির এই ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’ নিজে আবার ১৯৭৩-এর সিনেমা ‘চার্লি ভ্যারিক’-এর সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। বুঝুন কাণ্ড! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উপন্যাসের চিত্রায়ণও রাবীন্দ্রিক হয়নি, স্বয়ং সত্যজিৎ ব্যর্থ হয়েছেন, পূর্ণেন্দু পত্রী ব্যর্থ হয়েছেন, তপন সিংহ বা ঋতুপর্ণ ঘোষও পারেননি। বিদেশে দেখুন, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ যে সিনেমা হয়েছে, এতে কেউ কেউ রেগে গিয়ে বলেছেন উপন্যাসটার অপমান হয়েছে। উইলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ যে সিনেমা হয়েছে, দেখে আমার তো ধন্যবাদ দিতেই ইচ্ছে করেছে। আবার হেমিংওয়ের ‘স্নোজ অব কিলিমাঞ্জারো’ বা ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ যে সিনেমা হয়েছে, আমাদের আফশোসই হয়, কেন হল, হওয়ার কি কোনো দরকার ছিল! অথচ, আমাদের লেখকরা তাঁদের উপন্যাস থেকে সিনেমা হলে নিজেদের বেশ সার্থক জ্ঞান করেন, ফেসবুকে শ্লাঘা প্রকাশ করেন প্রায় লালমোহন গাঙ্গুলি হয়ে যান অনেকেই। সিনেমার গল্প লেখার জন্য কিন্তু আলাদা পেশাদার রাইটার রাখা হত ক্ল্যাসিক যুগের হলিউডে।

আজকের উপন্যাস লিখিত হবে সিনেমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যে-সিনেমা তার মুকুট কেড়ে নিয়েছে, তাকে হারাতেই হবে, এটাই আমি মনে করি, প্রয়োজন হলে তার অস্ত্রেই তাকে হারাতে হবে। সিনেমা যেন উপন্যাসকে হাইজ্যাক না করে, কিন্তু সিনেমার যা কিছু মালকড়ি, সেটাই বরং কেড়ে নিতে হবে। কিন্তু কেড়ে নেবে কারা? বাংলা উপন্যাসে আজও ভণ্ডামির শেষ নেই।

সফট কোর যৌন বর্ণনার মাধ্যমে আজও যে পাঠক জোটে, সেটা বাণিজ্যিক কাগজ দেখলেই বোঝা যায়। হার্ডকোর কিন্তু নৈব নৈব চ। কেন বলুন তো? হার্ড কোর একবার এসে গেলে পাঠক আর সেক্সের সুড়সুড়ির জন্য সাময়িকপত্র কিনবে না। স্মার্টফোন তো তাকে এমনিতেই হার্ডকোর দিচ্ছে! সে বাংলা উপন্যাসে সাব্লিমেশনের টানে আসে। এই কারণেই আমি ‘পর্ণমোচী’ লিখেছিলাম। সেক্স নিয়ে এই অন্তহীন ভণ্ডামির অবসান হওয়া উচিত। ‘নীতা তার প্লেট থেকে শেষ স্ট্রবেরিটা মুখে চালান করে দিল।’— এমনই সব বাক্যে বাজারমুখী বাংলা উপন্যাস শুরু হয়। এই বাক্যেও তো শুরু হতে পারে— ‘সায়ন্তনীর ভেজা যোনির ফাঁকে একটা আলগা চুল ঢুকে ছিল, ছিন্নমূল, সেটাকে দু-আঙুলে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে স্মরণজিৎ মেঝেতে ফেলে দিতে গেল, কিন্তু, আঙুলে লেগে যাওয়া রসে আটকে আছে, যেমন শৈশবের কিছু দাঁত খুলে এলেও মাড়ি থেকে খসতে চাইত না।’ এটাই দরকার। কারণ, সমাজের শোধন লেখকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আপনার ফাকিং ভালো লাগলে আপনি পর্নহাব দেখুন, উপন্যাস পড়তে এলে উপন্যাসের জন্যই আসবেন। সেটা একমাত্র করা যায় হার্ডকোরের মাধ্যমেই, বিষে বিষক্ষয়। আফটার অল, কোন সমাজের জন্য লিখছি, সেটা মাথায় রাখতেই হবে। কবি পারেন সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিখতে, ঔপন্যাসিক যে সেটা পারেন না, সেটা তাঁর দায় নয়, তাঁর দায়রা হয়তো।

কবিতার সঙ্গে উপন্যাসের কোনো লড়াই নেই। কোনো শিল্পমাধ্যমেরই কবিতার সঙ্গে কোনো লড়াই থাকতেই পারে না। কবিতা হল শিল্পের মাদার জেশ্চার। যেখান থেকেই একটা শিল্পমাধ্যম শুরু হোক, তার অবসান কবিতায় মিশে গিয়েই হয়, ওটাই মোহনা। কিন্তু, এটাও ঘটনা, মোহনার কাছে নদীর জলে লবণাক্ত স্বাদ থাকে, সেই স্বাদ উৎসে থাকে না, নদী অনেক দূর বহুদূর প্রবাহিত হয়ে গেলেও তার জলে ওই লবণাক্ত স্বাদ থাকে না। মোহনার লবণ যে তাকে সারা শরীরেই বয়ে বেড়াতে হবে, এমন ধারণা বেশ অবান্তর বলেই মনে হয়। আজকাল অনেকেই উপন্যাসের উৎস আর মোহনা এক করে ফেলছেন। কবিতার লবণ তাঁদের উপন্যাসে এতই বেড়েছে, যে প্রায় অপেয় হয়ে উঠেছে।
একটা উপন্যাসই যদি কবিতা হয়ে যায়, সে যদিও কবিতাই হয়ে ওঠা তার সার্থকতা সাব্যস্ত করে নিয়ে লিখিত হয়ে থাকে, সেই উপন্যাস পড়া যায় না। মানুষ একটানা দেড় ঘণ্টা হয়তো সঙ্গম করতে পারে, কিন্তু, দেড়দিন বা দেড়মাস ধরে একটানা সঙ্গম করা অসম্ভব, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুই কামুক-কামুকীও সেটা পারবেন না। লোহার তৈরি লিঙ্গ আর যোনিও ক্ষয়ে যাবে। কবিতার মধ্যে যে আনন্দ, যে বিষাদ, তা সহ্য করা যায় কবিতার মাপ ছোটো বলেই। মহাকবিতা বা দীর্ঘকবিতার মধ্যে দেখবেন কবির আবেগের তীব্রতা প্রচুর কমে যায় এবং অঢেল গদ্যগুণ এমনকী গল্পগুণ প্রবন্ধগুণ এসে মিশে যায়, না হলে সেটা পড়া যায় না, লেখাও যায় না।
জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ বা ‘ফিনিগানস ওয়েক’-এর প্রসঙ্গ যদি তোলেন, সেগুলোও কিন্তু কবিতা নয়, উপন্যাসই, যেমন আগে বললাম, উপন্যাস কীভাবে লিখিত হয় এবং লিখিত হয় না তার ডকুমেন্টেশন। এবং জয়েসের কোনো উত্তরসূরী কিন্তু তৈরি হননি। উনি যে-কাজ করে গেছেন, সেটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো লোক মেলেনি, কারণ একজন লেখকের কাজ তিনি ছাড়া কেউই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। বলা হয় অগণিত লোক নাকি জয়েসকে অনুসরণ করেছেন, নাম করা হয় জেমস ব্লিশ, অ্যান্থনি বার্জেস, ফিলিফ ডিকের। কিন্তু, আপনিই বলুন, এই তিনটে নাম আপনি কি শুনেছেন? জেমস ব্লিশের লেখা ‘আ কেস অফ কনসেন্স’ বা ‘ব্ল্যাক ইস্টার’ কি আপনি পড়েছেন, বা পড়তে চাইবেন? আমি চাইব না।

আপনি যেমন যখন কবিতা লিখছেন, আপনাকে কবিতা লিখতেই হয়, আপনি যখন উপন্যাস লিখছেন, আপনাকে একটা গল্প বলতেই হবে, অথবা, একই ফ্রেমে একাধিক গল্প বলতে হবে। অতিসরলীকরণ মনে হল কি? কিছু করার যে নেই। এর কোনো অন্যথা হতে পারে না। হলে সেটা অস্বাভাবিক কিছুই হবে। গল্প বলাকে কি আপনি খুব সস্তা আর সোজা কাজ মনে করছেন? মহাশয়, মহাশয়া, আপনি আজ যদি একটা উপন্যাসে গল্প বলতে বসেন, সত্যিই যদি একটা অপূর্ব গল্প আপনি বলতে চান, যে-গল্প তার মধ্যে রেখেছে আত্মঘাতের বোমা, একটা উপন্যাসের ফ্রেমের মধ্যে সেটা তৈরি করতে আপনার গাঁড় ফেটে যাবে। আজ সকল গল্প বলা হয় গেছে। কোন গল্প এখন বসে আছে বলুন তো আপনার বলার অপেক্ষায়? পারবেন একটা নতুন গল্প বলতে, যা পৃথিবীতে এই প্রথম বলা হল, এই ২০২০-তে? আর এই চ্যালেঞ্জটা এড়িয়ে গিয়ে আপনি যদি প্রকরণসর্বস্বতার দিকে যান, যদি নিজেকে এই বলে ভোলাতে চান যে আপনি আপনার সময়ের জন্য লিখছেন না, ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য লিখছেন, আপনি চালাকির মোড়কে ঢেকে বোকামিই করছেন। ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য লিখবে ভবিষ্যতের লেখকরাই, আপনাকে সেখানে দরকার নেই। ভবিষ্যতের উপন্যাস লেখা হবে আপনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, ভুলে গিয়েই। আমাকেও ভুলে গিয়ে আমার পরের লেখক লিখবে। আমি ভালো করেই জানি সেটা।

আগের পাতা
Categories
প্রবন্ধ

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের সেই বাজারচলতি লেখকরা এইসব দুর্দ্ধর্ষ বই লিখে বড়োলোক হয়ে গিয়েছিলেন। আজও এঁদের নাম মুছে যায়নি। যেমন বিমল মিত্র, তিনিই তো আজ যে ডেইলি সিরিয়াল চলে তার বিকল্প প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর ঢাউস সব উপন্যাসের মধ্যে, তিনিও তো প্রচুর পয়সা করেছিলেন উপন্যাস লিখে। আছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁর ‘কলকাতার কাছেই’ ‘পৌষফাগুনের পালা’ আর ‘উপকণ্ঠ’ নিয়ে, একটার পর একটা বুঁদ হয়ে পড়ার বই, কিন্তু মস্তিষ্কের কোনো মেহনত ছাড়াই। সেইসব লেখকরা ১লা বৈশাখে প্রকাশকের দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন পেতেন। সেই বইগুলো এখনও বই দোকানে পাওয়া যায়, কারণ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের সেই ‘মাঝারি’ পাঠকরা আজও মৃত হননি, তাঁদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাঁরা আজও বিদ্যমান, এবং এঁদেরই বইয়ের তাকে বাঙালি মহাপুরুষের লিঙ্গোত্থানের এবং বিচির লোম কামানোর ইতিহাস আজ সগর্বে শোভিত। নিমাইবাবুর ‘মেমসাহেব’ আর বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-কে এঁরা বাপ-কাকা-মা-কাকীমার মুখ থেকে গ্রহণ করেছেন। মুখে মুখে এভাবেই একটা বই অনেক পথ চলে যায়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ লেখেন-টেখেনও। বলে রাখি, আমি নিজেও এই বইগুলো কিনেছি, পড়েছি, কারণ শুধু বাংলা উপন্যাস লেখা নয়, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসটা নিয়ে আমার যারপরনাই কৌতূহল আছে। আপনিও নিশ্চয়ই সেই কৌতূহলেই বইগুলো কিনে থাকবেন।

কিন্তু, ‘মেমসাহেব’ আর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র মধ্যে কী পার্থক্য আছে যে আমি প্রথমটাকে মুছে দিতে চাইছি পাঠকের মন থেকে? আমি মুছে দিতে চাইলেও সে মুছবে না। তার নিজের জোর আছে। আবহাওয়া আছে। উত্তম-অপর্ণার সুপারহিট সিনেমাও আছে। কিন্তু যেটা নেই, তা হল সেই গুণ যার ধ্বংস নেই— নিজেকেই ধ্বংস করার টান। এটা আসে কল্পনাশক্তির সেই সীমাকে পেরিয়ে যেখানে বাস্তব আর স্বপ্নের ভেদ ঘুচে যায় এবং একজন পাঠক চিরকালের মতো একটা অন্য জগতে ফেঁসে যায়। ইউরোপজুড়ে অজস্র লোহার পেরেক পাওয়া গেছে, দাবি করা হয়েছে সেগুলো দিয়েই নাকি যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, পাওয়া গেছে অনেক বর্শা, সবগুলোর ক্ষেত্রেই দাবি যে, সেই বর্শা দিয়েই নাকি যিশুকে খোঁচা মারা হয়েছিল। সেগুলো অনেক চার্চে উপাসিত হয়। লোকজন প্রচুর মানে, তীর্থযাত্রায় যায়, এবং মানত করে, সেই ইচ্ছা হয়তো পূর্ণও হয়ে যায়, ইচ্ছার নিজগুণেই হয়ত। তাহলেও, সেগুলো আদৌ সেই পেরেক বা বর্শা যে নয়, এটা স্বতঃসিদ্ধ। পেরেকত্বের কোনো ঘাটতি থেকে এটা হয় না, এটা হয় পেরেকের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নশ্বরতা আর অবিনশ্বরতার টানাপোড়েনে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ আর ‘মেমসাহেব’- প্লটভিত্তিক উপন্যাস দুটোই। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রায়ই নিজেকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছে, লেখক নিজের অনিশ্চয়তা নিয়ে খেলেছেন, কিন্তু ‘মেমসাহেব’-এ আত্মঘাতী প্রবণতা একেবারেই নেই, লেখক জানেন তিনি কী লিখছেন, ঘটনা অনেক বেশি প্রকট, লেখা অনেক বেশি সাবলীল, পাঠককে টেনে রাখার মতো যথেষ্ট জটিলতা আছে, টেনশন আছে। কিন্তু, ‘মেমসাহেব’-এ সেই শাশ্বত লোহা নেই যা একটা পেরেককে যীশুর রক্তের সঙ্গে যুক্ত করে, যদি সত্যিই কোনো ঐতিহাসিক যীশু ছিলেন কখনো, সেই মর্চেও নেই। ‘শাশ্বত’ সবটাও আজকাল বড্ড ইউরোপীয় শোনায়, যাই হোক, যীশুকে উদাহরণ করেই তো বললাম।

আমি সেই উপন্যাসকেই বরণ করে নিতে চাই যে-উপন্যাসের মধ্যে নিজেই নিজেকে নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা আছে। একজন সুখী লেখকের দুঃখের কাহিনি নয়, একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখকের সুখের গল্প নয়। একটা উপন্যাস যখন আপনি লিখছেন, আপনি একটা পৃথিবী তৈরি করছেন। পৃথিবী তৈরি করার প্রথম এবং সবচেয়ে বড়ো বাধাটা হল, পৃথিবীটা তৈরি হতেই চায় না, তার নিজের মধ্যে তৈরি হওয়ার কোনো সাধ থাকে না, কারণ তৈরি হতে গেলে তাকে বিস্তর যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। নিজেকে নষ্ট করে দিতে চায় একটা নির্মীয়মান উপন্যাস প্রত্যেক শব্দচয়নে, প্রত্যেক বাক্যগঠনে। এটাকে গ্রাফিকভাবে দেখিয়ে গেছেন জেমস জয়েস তাঁর উপন্যাসগুলোয়, দেখিয়েছেন মার্সেল প্রুস্ত, দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ‘চতুরঙ্গ’-এ, দেখিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কারুবাসনা’ বা ‘জলপাইহাটি’-র মতো সৃষ্টিগুলোয়, যেগুলো আসলে উপন্যাস কীভাবে লেখা হয় তার ডকুমেন্টেশন, এবং, একইসঙ্গে, কীভাবে লেখা হয় না।

পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস লেখা হয়েছিল, যদি ধরেই নেওয়া যায় তার নাম ‘দন কিহোতে’, উপন্যাস কাকে বলে সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেই। পৃথিবীর প্রথম যে-কোনো কিছুর দোষগুণ পরবর্তীদের ধারণ করতেই হয়। আজও একটি উপন্যাস লেখা হতে পারে একমাত্র উপন্যাস কাকে বলে সেটা পুরোপুরি ভুলে গিয়েই, পুরোপুরি যদি অসম্ভব হয়, সাধ্যমত ভোলার চেষ্টা অনিবার্য।

কিন্তু, এই ভুলে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি আপনার উপন্যাসটা লিখতে বসে সেই উপন্যাসগুলোর কথা মনের মধ্যে ছকে রেখে দেবেন যেগুলো বিংশ শতাব্দীতে লেখা হয়েছিল, এবং সেগুলোর গায়ে জুটেছিল ‘পরীক্ষামূলক’ ‘নিরীক্ষামূলক’ ‘অন্যধারার’ ‘সমান্তরাল’ ইত্যাদি তকমা। দুটো শতাব্দীর মধ্যে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজন্ম নয়, প্রায় দুই প্রজাতির মানুষের দেখা মেলে। ১৮৬০-এর বাংলা উপন্যাস যেমন ১৯৬০-এ লেখা যায় না, ১৯৬০-এর বাংলা উপন্যাসও ২০২০-তে লেখা যেতে পারে না, তা সেই ১৯৬০-এর উপন্যাস যতই বিস্ফোরক হোক, যতই প্রাসঙ্গিক থাকুক, আজও তার পাঠক তৈরি হোক বা না হোক, আপনাকে সেই উপন্যাসকে নেগেট বা খারিজ করেই নিজের উপন্যাসে ঢুকতে হবে। যা হয়ে গেছে তা আর আনা হওয়ানোই উপন্যাস লেখার অনিবার্য শর্ত, হয়তো যে-কোনো শিল্পসাহিত্যেরই এটা প্রাথমিক শর্ত, এবং এটা পালন করতেই হয়। এটা পালন করার জন্য একজন তারকাটা সাহিত্যিককে লাগে, যে প্রচলিত কোনোকিছুকেই মানতে চায় না, সেই প্রচলিত ভালো হোক বা খারাপ, যেমন চাকরি করা ভাদ্রবউ তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভাশুরের সামনে ঘোমটা দ্যায় না, আবার বুকও খোলে না। ফেমিনিস্টরা রেগে যাবেন না প্লিজ। আজকাল অতিসংবেদনশীলতার অসুখে ধরেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি জাতিকে। সে যাক। চ্যালেঞ্জটা এখানেই।

সৃষ্টির সর্বনাশ করে ধাঁচা। বিধাতারও কোনো ব্লু প্রিন্ট ছিল না দুনিয়া বানানোর। সিমুলেশন যেটা হয়েছে সেটাতে তাই তাঁর নিজের খেলার আনন্দ রয়ে গেছে। আজ যেমন পুজো সংখ্যার বাণিজ্যিক উপন্যাস একটা গতানুগতিক ধাঁচাকে আশ্রয় করেই লিখিত হয়, যে-ধাঁচা বানিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, সমরেশ বসু, আশাপূর্ণা দেবীরা, শুধু পলেস্তারা আর রং বদলে দিলেই চলে, আজকাল তথাকথিত পরীক্ষামূলক উপন্যাসও কিন্তু একটা ধাঁচাই মেনে চলে, সেই চরম প্রেডিক্টেবল ধাঁচার প্রণেতা কখনো নবারুণ ভট্টাচার্য, কখনো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। প্লটভিত্তিক উপন্যাস একদিন যেমন বাংলা সাহিত্যের অভিশাপ হয়ে উঠেছিল, আজ কিন্তু প্লটবিহীন উপন্যাস একইভাবে গড্ডলিকায় পর্যবসিত হয়েছে, যদিও আজও তার ঠাঁই হয়নি বাজারচলতির পঙক্তিতে। বাজারের বাইরে আরেকটা বাজার বসানোর চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। পাঠক তো মূল বাজার থেকেই পালিয়ে গেছে টেলিভিশনের দিকে বহুদিন, এখন আবার হাতের মুঠোয় সিনেমা দেখার যুগ চলছে।

যে কোনো ধাঁচাই অসহ্য। আশাপূর্ণা দেবী বা বিমল করের ধাঁচার চেয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়েরটা যে অনেক মূল্যবান ও মহার্ঘ্য ধাঁচা এ তো একটা ট্রাইবাল কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এই যে ট্রাইব, যাদের টোটেমের নাম ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ বা ‘কাঙাল মালসাট’, তাদের আমরা চিনি, তারা নাস্তিক কিন্তু গীতা বা কোরান পড়েনি, তারা ঋত্বিকভক্ত এবং সত্যজিৎবিদ্বেষী, তারা ওম পুরীর ভক্ত ও অমিতাভবিদ্বেষী, তারা নেশারু কিন্তু হাঁড়িয়া খায় স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসাবে, তারা দান করে ফেসবুকের জন্য সেলফি তুলে, তারা গাঁজার কলকেতে টানও দ্যায় ফেসবুকের জন্য সেলফি তুলেই, সমবেত মদ্যপানের ছবি পোস্ট করে নিজেদের বিপ্লবী হিসাবে প্রত্যয়িত করতে চায়, তারা মার্কসিস্ট কিন্তু কোনো অসুস্থ রিক্সাচালকের সঙ্গে তুমুল দরকষাকষিই তাদের খাঁটি ক্লাস স্ট্রাগল, তারা ভাবে বাংলাভাষা তাদের অপেক্ষায় আছে কিন্তু এই ভাষার বানান এবং ব্যাকরণে তারা সিদ্ধহস্ত নয়, নিজেদের গাঢ় লাল বা সিপিয়া টোনের ব্যধিগ্রস্ত চেহারাটাই তাদের পত্রিকা-বইয়ের প্রচ্ছদ আর শিল্পীসত্তার ব্র্যান্ড ভ্যালু ঠিক করে দ্যায়। এই ট্রাইবটার দ্বারা বাংলা সাহিত্যের কোনো কল্যাণ হবে না, বরং পাঠক ব্যাপারটা আরো দূরেই সরে যাবে।

পাঠকের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিতে উপন্যাস লেখক বাধ্য। একটা মহাকাব্য যেমন এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর নায়ককে উপস্থিত করে এবং সেই জনগোষ্ঠীর এক সারসংক্ষেপ পেশ করে, যেটা খণ্ডকবিতা বা দীর্ঘকবিতার পক্ষে অসম্ভব, উপন্যাসও এক বিশেষ বা সাধারণ সমাজের এক চলচ্চিত্র আমাদের আমনে তুলে ধরে, সে ব্যক্তিগত হতে পারে না, ব্যক্তিগত যে হতে পারে না, লেখকের চোখে যে নৈর্ব্যক্তিকতা থাকতেই হবে, এই শর্ত তাকে পালন করতেই হবে, অন্যথায় সে-উপন্যাস হবে না। উপন্যাস হল এক কাল্পনিক ও বাস্তবিক সমাজ, একইসঙ্গে। পাঠক সেখানে গিয়ে বাস করতে পারবেন, কিছুক্ষণ বা কিছুদিন, বা সারাজীবন। যেমন সমতলের মানুষ পার্বত্য উপত্যকায় বেড়াতে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়ার কথা ভাবে, থেকেও যায় কিছুদিন, তেমন পাগলা হলে সারাজীবনই। এই মুহূর্তে যদি আপনি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েন, যদি পড়েন করমাক ম্যাকার্থি, স্টিফেন কিং, অরহান পামুক বা পাওলো কোহেলোর লেখা দেখবেন, তাঁরা পাঠককে বিভ্রান্ত করেন না। আমাদের এখানে তথাকথিত অল্টারনেটিভ লেখকদের দেখলে মনে হয় পাঠকদের সঙ্গে তাঁদের একরকম শত্রুতাই যেন আছে, তাঁরা সবাই লেখকদের লেখক হতে চান। এতে সুরাহা কিছু হয় না। বাজারি পত্রিকার লেখকদের এতে তাঁদের সস্তা লেখাগুলো লিখে যাওয়ার নৈতিক সুবিধাই বরং হয়ে যায়।

আমি যে চলচ্চিত্রের কথাটা বললাম একটু আগেই, সেটা খেয়াল রাখুন। উপন্যাস স্বয়ং এক চলচ্চিত্র। সে ঘটমান। সে নাটকের বিকল্প হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। আজও সে কবিতার ভাষায় লেখা হোক বা খবরের কাগজের ভাষায়, সে কিন্তু নাটকেরই বিকল্প। এবং, এই কারণেই সে সিনেমার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। সিনেমার অবকাশ তার চেয়ে অনেক বেশি, জনপ্রিয়তা তার চেয়ে অনেক বেশি, এ এক পোয়েটিক জাস্টিস অবশ্যই। উপন্যাস নিজে একদা নাটকের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল অনেক কিছু, নাটক অনেক রিক্ত হয়ে পড়েছিল উপন্যাসের জনপ্রিয়তার ফলে। আজ সিনেমা অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে উপন্যাসের হাত থেকে, হাত ফাঁকা করে দিতেই চেয়েছে।

পরের পাতা
আগের পাতা
Categories
প্রবন্ধ

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ

এই ২০২০ খৃস্টাব্দে বাংলা উপন্যাস লেখার ব্যাপারে দু-চারটে কথা

এই গদ্যে আমি উপন্যাস নিয়েই কথা বলব। প্রথমেই যে-প্রশ্নটা ওঠে, আপনি কি সন্তানের বাবা অথবা মা?

Categories
প্রবন্ধ

অরূপ চক্রবর্তী

বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর

আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগেই আমাদের এই প্রিয় শহর, প্রাণের শহর, গানের শহরে জন্মেছিলেন এক কিংবদন্তি মানুষ শরীরে যাঁর ছিল রাজবংশের নীল রক্তের ধারা,

Categories
প্রবন্ধ

রাজদীপ সেন চৌধুরীর প্রবন্ধ

আমেরিকান কবি: জয় হার্জো

সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিদের মধ্যে আমি জয় হার্জোকে দীর্ঘ সময় পড়তে গিয়ে দেখেছি তাঁর ব্যাপ্তি সুদূর, এই কারণে যে— তাঁর জন্ম, শৈশব এবং বেড়ে ওঠা যে-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে

Categories
প্রবন্ধ

শীর্ষা মণ্ডলের প্রবন্ধ

করোনা ভাইরাস এবং কোভিড-১৯

২০১৯-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের এক লোকাল সামুদ্রিক খাদ্যবাজার। এখানে সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর মাংস বিক্রি হয়।