Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ

সোমা মুখোপাধ্যায়

গয়নাবড়ি শিল্পী পুতুল অধিকারী

পুতুল অধিকারী

আমরা বলি মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এই মাছের ঝোল-সহ নানা রান্নাকে সুস্বাদু করতে ব্যবহার করা হয় নানা কিছু। তার অন্যতম হল বড়ি। কলাই, মুসুর, মুগ, মটর নানা ডালের বড়ি। একসময় মা ঠাকুমারা ভালো করে বেটে হাতে করে দিতেন। ব্যাবসার জন্য এখন যন্ত্রের আমদানি। তবু বড়ির রমরমা সব সংসারেই।

বাঙালির প্রিয় হল ভাত ডাল দিয়ে বড়িভাজা খাওয়া। আর এই ভাজা বড়ির এক বিশেষ রূপ গয়না বড়ি বা নকশা বড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, তমলুক এইসব অঞ্চলের মা বউদের তৈরি। এই বড়ি শুধুমাত্র ভাজা হয়। আর এর তৈরির পদ্ধতিও আলাদা।

 

গয়নাবড়ি

বেশ কয়েকবছর ধরে নানা সরকারি মেলায় পূর্ব মেদিনীপুরের স্টলে দেখতাম একজন মহিলা সুন্দর গয়নাবড়ি বিক্রি করতেন। ওঁর নাম পুতুল অধিকারী। গয়নাবড়ি কেনার সূত্র ধরেই আলাপ আর তারপরে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে তিনি হয়ে যান পুতুলদি। মহিষাদল ব্লকের ঘাগড়া গ্রামের সাদামাটা গৃহস্থ বধূ পুতুলদি শুধু একজন বড়ি শিল্পীই নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। বহু মেয়েদের নিয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। দেখিয়েছেন তাঁদের রোজগারের রাস্তা। মা ঠাকুমার অন্দরের এক রত্নকেই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সবার মাঝে। এভাবেই সবলা মেলা, সরস মেলা হয়ে পুতুল অধিকারী দিল্লির প্রগতি ময়দানেও তাঁর গয়নাবড়ির সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

গয়নাবড়ি তৈরির একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এই বড়ির জন্য লাগে বিড়ি কলাই। আষাঢ় শ্রাবণে এই গাছ বুনে আশ্বিন মাসের দিকে উপড়ানো হয়। এই তিন মাসে গাছ হয়ে কলাই পেকে যায়। এরপরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিয়ে একটা ভারী কিছু দিয়ে কলাইগুলোকে মাড়িয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, কলাইগুলোকে বের করে নেওয়া হয়। এরপরে ওগুলো জাঁতায় পেষা হলে ওগুলো ভেঙে দু-খোলা হয়। এরপর সকালে ভিজিয়ে দিয়ে বিকেলে একটা একটা করে খোলা বেছে বাটা হয়। ব্যাবসার বড়ির ডাল মিক্সিতে বাটা হয়। ঘরের বড়ির জন্য শিলে বাটা হয়। এই ডাল বাটা ঠান্ডা জায়গায় অনেকক্ষণ রেখে দিতে হয়। কারণ, মজে গেলে তবেই ফেটালে তা একেবারে নরম তুলতুলে হয়।

গয়নাবড়ি

আমাদের মেয়েদের নিজস্ব লোকপ্রযুক্তি এই রান্না আর তার উপকরণ বানানোতে ছড়িয়ে আছে। গয়নাবড়িতেও তার প্রভাব আছে। একসময় ডাল বেটে হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেওয়া হত যাতে ভালোভাবে মজে যায়। এখন সবাই ফ্রিজে রাখে। আর ফেটানোর পরে অল্প একটু মিশ্রণ একটা জলভরতি জায়গায় দেওয়া হয়। যদি তা‌ ভেসে থাকে তবেই তা ঠিকমতো ফেটানো হয়েছে বলে ধরা হয়। আর যদি ডুবে যায় তাহলে আবার ফেটাতে হয়। এটা একটা প্রারব্ধ জ্ঞান।

ডাল ঠিকমতো ফেটানো হলে শুরু হয় গয়নাবড়ি দেবার বিশেষ পর্ব। খুব ভোর থেকে এই বড়ি দেওয়া শুরু সকাল অবধি তা চলে। এমনি বড়ির ক্ষেত্রে এই ডালবাটা থেকে নিয়ে আঙুলের সাহায্যে বড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু গয়নাবড়ির নিয়ম একেবারেই আলাদা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হল টিনের চোঙ। একটা পলিথিন বা কাপড়ে ছোটো ফুটো করে এই চোঙটা ঢোকাতে হবে। এরপর ঐ ডালবাটা পলিথিন বা কাপড়ে নিয়ে চোঙের মাধ্যমে নকশা ফুটিয়ে তুলতে হবে পোস্ত ছড়ানো বড়ি দেবার পাত্রে। পোস্ত দেওয়ার ফলে বড়ি শুকিয়ে গেলে তুলতে অসুবিধা হবে না। যাঁরা বড়ি দেন তাঁরা মন থেকে নকশা করে চলেন। এই কারণেই তাঁরা শিল্পী। এই নকশা যত সূক্ষ্ম হবে গয়নাবড়ি তত দেখতে এবং খেতেও ভালো হবে। সাধারণত এক কেজি ডালে ৮০-৮৫টা বড়ি হয়। ব্যাবসার বড়ির ক্ষেত্রে ১০০-১২৫টা মতো করা হয়। ইদানীং অনেকেই গয়নাবড়িতে চালবাটা মিশিয়ে যেন‌ তেন প্রকারেণ একটা কিছু তৈরি করে বাজারে বিক্রির জন্য। এই বড়ি দৃষ্টিনন্দন তো নয় উপরন্তু মোটা এবং স্বাদেও ভালো হয় না।

ডাল ফেটানোর ওপর গয়নাবড়ি কতটা হালকা হবে তা নির্ভর করে। আবার হালকা হলেই সুন্দর নকশা হয়। আঞ্চলিক ছড়াতেও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে—

‘চায়ের সাথে পলকা বড়ি
আতিথেয়তার নেইকো জুড়ি’

‘গয়না বড়ি এতোই হালকা
তেল জোগাতে পকেট ফাঁকা’

আবার গয়নাবড়ি উপহারের সামগ্ৰি তাও এইসব ছড়ায় তার প্রতিফলন দেখা যায়—

‘মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সাথী হল গয়নাবড়ি’

গয়নাবড়ির আদর্শ সময় শীতকাল। শীতের মিঠে রোদে মেয়েরা দলবেঁধে এই বড়ি দেন। সাধারণত কার্তিক মাসের পেড়ো ষষ্ঠী থেকে শুরু করে ফাল্গুনের শিবরাত্রি অবধি এর সময়কাল। আসলে এর পরে গরম পড়ে যায়। আর বর্ষায় তো বড়ি হবেই না। ভারি সুন্দর লাগে আমাদের এই মরসুম বা ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে খাবার তৈরির সম্পর্ক। এটাই হয়তো প্রাচ্যের বিজ্ঞান ভাবনা। যা মায়েরা লোকাচার নামে অভিহিত করেন।

একসময় অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে দিয়ে পুতুল অধিকারী তাঁর ব্যাবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কাঠের ব্যাবসায়ী। বিবাহ সূত্রে তিনি ঘাগড়া গ্ৰামের বাসিন্দা হন। সংসারের অভাব অনটনে তিনি মানুষের এই নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং এক পরম্পরার শিল্পকে নিয়ে আসেন রোজগারের মাধ্যমরূপে। শুরুতে আশেপাশের বাজার আর অফিস কাছারিতে গিয়ে গিয়ে বড়ি বিক্রি করতে থাকেন। ২০০৪ সালে তৈরি করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। শুরু হয় সরকারি মেলায় যোগদান। না, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এই সূত্র ধরেই নানা জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে। দুই সন্তান আর নাতি-নাতনির ভরা সংসারের সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন মেয়েদের সংসারের হাল ধরবার দিশা দেখিয়েছেন তিনি। শিল্পী থেকে হয়েছেন‌ উদ্যোগপতি। গয়নাবড়ির পাশাপাশি তিনি মশলাবড়ি, সাদা ডালের বড়ি, চালকুমড়ো বাটার বড়ি এইসব তৈরি করেন। তবে তাঁর পরিচিতি গয়নাবড়ির কারণেই।

‘সবলা’ মেলায় পুতুল অধিকারী (বাঁ-দিকে)

পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে এই গয়নাবড়ি প্রথম দেখি প্রায় কুড়ি বছর আগে। আমাদের অফিসের কাজে গিয়ে ফেরার পথে একজন সহকর্মী উপহার দিয়েছিলেন। একটি বাড়ির লাগোয়া দোকানে ছিল। ঐ বাড়ির মেয়েরাই করতেন। একটা ছোটো সস্তা পিচবোর্ডের বাক্সে অপটু হাতে সেলোফেন কাগজে মুড়ে আঠা লাগানো। আসলে এটা এত পলকা যে সহজে নষ্ট হয়ে যায়। যাইহোক তখন জেনেছিলাম এটি স্থানীয়ভাবেই বিক্রি হয়। বেশি করে রপ্তানির কথা ওঁরা ভাবছেন। সে-সময়ে আমাদের যিনি অফিসার ছিলেন তিনি বলেছিলেন মজা করেই যে, এই গয়নাবড়ি একেবারেই ক্ষণস্থায়ী শিল্প। সত্যি এর শৈল্পিক দিকটা এত সুন্দর যে, এটা খেতে ইচ্ছে করে না। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ এটিকে কলাভবনে সংরক্ষিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আর ‘নকশি বড়ি’ নামটা দিয়েছিলেন অবন ঠাকুর। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই গয়নাবড়িকে বঙ্গমাতার ভাঙা ঝাঁপির রত্ন বলেছেন।

১৯৩৪ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে পড়তেন মেদিনীপুরের সেবা মাইতি। তাঁর মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুরমা শরৎকুমারী দেবীর তাঁকে উপহার পাঠানো গয়নাবড়ি দেখে তাঁদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

“শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী ও শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবী কল্যাণেয়ষু,
তোমাদের হাতে প্রস্তুত বড়ি পাইয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিলাম। ইহার শিল্পনৈপুন্য বিস্ময়জনক। আমরা ইহার ছবি কলাভবনে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছি। তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিবে।

শুভাকাঙ্খী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতি ২১শে মাঘ/১৩৪১”

এই ঘটনাটি যেন একটা আঞ্চলিক ছড়াকেই মনে‌ করায়—

“উপহারে নকশা বড়ি
সাফল্য আনে পুরোপুরি।”

প্রয়াত লোকসংস্কৃতিবিদ নির্মলেন্দু ভৌমিক ব্রতের আলপনার মাঝে গয়নাবড়ির উৎস লক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, “গয়না হল স্ত্রীলোকের অন্যতম কামনার বিষয়। তাই ব্রতের আলপনায় ব্যবহৃত সেই ভঙ্গিটি এবং সংলগ্নতার বিষয়টি গয়নাবড়ি তৈরির অনুপ্রেরণা হতে পারে।”

গয়নাবড়িকে আঞ্চলিক সীমানা পার করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পুতুল অধিকারীকে অবশ্যই কুর্ণিশ জানাতেই হয়। এক বিশাল কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারি তিনি। তাঁর দল ঘাগরা সন্তোষী স্ব স্বসহায়ক দলের একজন সাধারণ সদস্য তিনি। এছাড়া উনি একজন সংঘনেত্রী। এই সংঘের নাম ‘কিসমৎ নাইকুন্ডি নতুনভাবে জীবন বহুমুখী প্রাথমিক মহিলা সংঘ সমবায় লিমিটেড।’ এছাড়া নানা অ্যাকটিভিটি ক্লাস্টারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এর মধ্যে আছে ব্লক স্তরে খুশি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার এবং বুথ স্তরে ঘাগড়া কৈলাসনাথ গয়নাবড়ি অ্যাক্টিভিটি ক্লাস্টার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের বড়ি তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে কীভাবে তার বিপণন সবটাই শেখান পুতুল অধিকারী। এই কাজে তাঁর বউমা সুস্মিতা অধিকারীও তাঁকে সহায়তা করেন। এছাড়াও পাটজাত নানা সামগ্রী তিনি তৈরি করেন। নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নিদর্শন শিল্পী পুতুল অধিকারী।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা:
১. সন্তোষ কুমার কুন্ডু, বাংলার পেশাভিত্তিক লোকায়ত কুটিরশিল্প, লালমাটি, কলকাতা, ২০১৯।
২. কমলকুমার কুন্ডু, গয়নাবড়ি: এক অনুপম শিল্প নিদর্শন, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৪।
৩. বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রীমতী রঞ্জনা মন্ডল, গবেষক।

Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


রূপা সকালে আগে দেওয়াল থেকে তার কৃষ্ণের ফোটোটা নামায়। পেছনে জমা ঝুলকালি পরিষ্কার করে। পরম মমতায় নিজের আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে ছবির ওপর জমা তেলকালির ধূসরতা মুছে দিতে থাকে সে। যেন তার কৃষ্ণের পরশ পায় সে-আদরে। হ্যাঁ, আদরই দেয় রূপা কৃষ্ণকে, তার রাজাকে কত-কত দিন পর। চোখ ভিজে ওঠে তার। ফোটোটা যথাস্থানে ঝুলিয়ে একটা গোড়ের মালা পরিয়ে দেয় ছবিতে। তার ঝাপসা চোখে গোড়ের মালা অতীত আঁকে।

উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়েই যেন! এক সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণ হাজির তাদের বাড়ি।

— কাল সকালে রেডি থাকবে। সকাল দশটা। এই নাও।

একটা সুদৃশ্য, কলকাতার বড়ো দোকানের ব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দেয় কৃষ্ণ।

— শাড়ি আছে। গয়নাও। কাল সকালে রেডি থাকবে। কাল বিয়ে করব আমরা। কালিঘাটে।

রূপা কী বলবে? সে নির্বাক প্রস্তরমূর্তি যেন বা। শুধু বুকের ভেতরটা তিরতির কেঁপে জানান দিচ্ছিল যে, সে বেঁচে আছে, মরেনি। যদিও ভয়, ভালোবাসা, জয়— জীবনের তীব্রতম আকুতিতে সে মরেই যেতে চেয়েছিল সে-সাঁঝে!

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির নিথর বাবার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলেছিল কৃষ্ণ— এটা রাখুন। সামান্য টাকা। বড়োমেয়ের বিয়ের ঠিক করুন। সব দায় আমার।

কাটা-কাটা স্বরে উচ্চারণ ভাসিয়ে কৃষ্ণ পিছন ফিরেছিল। এমনই কাটা-কাটা কথাতে অভ্যস্ত ছিল সে। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই বলাই তার অভ্যাস। ঘরের চৌকাঠে পা দিয়ে চকিতে মুখ ঘুরিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে কথা ক-টাও—রামুকে দু-দিন পর দেখা করতে বলবেন আমার সঙ্গে। আমার ঠেকে। সকাল আটটায়। সাবান কলে লোক নেবে।

বেরিয়ে যায় কৃষ্ণ আঁধার ঠেলে বস্তির কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখকে পাত্তা না দিয়েই। রাত চিরে বাইক গর্জে উঠেছে ততক্ষণে।

পরের দিন সকালে সাদা প্যান্টের ওপর ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবিতে আর গোড়ের মালায় কী অপূর্বই দেখতে লেগেছিল তার কৃষ্ণকে— যেন স্বয়ং কেষ্ট ঠাকুরটিই!

কালিঘাট মন্দির থেকে ওরা সদলবলে পার্ক স্ট্রিটে বড়ো হোটেলে গিয়েছিল। রূপার জীবনে প্রথম অত বড়ো হোটেলে খাওয়া। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বার বার আড়চোখে দেখেছিল সে তার রাখাল রাজাকে। আনন্দে-আহ্লাদে!

গোড়ের মালায় আর সকালের নবীন রোদে কৃষ্ণের ফোটোটা ঝলমল করে ওঠে। যেন হাসে রূপার দিকে তাকিয়ে। এমনিতে গম্ভীর, চোখজোড়া সদা চঞ্চল, যা আভাস দেয় তার মন কোথাও স্থির না, ডাঙা পাচ্ছে না এমনই ভাসমান— সে গম্ভীর কৃষ্ণ হাসত খুবই কম। তবু রূপার মনে হত একমাত্র তার কাছে এলে যেন দাপুটে লোকটা কোথাও ডাঙা পেত, যা ভরসা, আশ্রয়ই হয়তো। তার মুখে হাসির সজল মায়া জাগৎ রূপার সান্নিধ্যেই যেন। তেমনি তো হেসেছিল সেদিন। যেদিন কৃষ্ণ প্রথম মায়া এঁকেছিল তার মনে, তার পরের দিন কলেজে ফি দিতে গিয়ে দেখে তার সারা বছরের ফি মেটানো হয়ে গেছে। তবে কি সে, সে-ই! সদ্য ফোটা রূপার মনে দোলা ছিল! লজ্জায় মাথা তুলতে পারে নি কলেজের অফিস কাউন্টারে। ক্লার্ক নৃপতিবাবু কি হেসেছিল!

কলেজ ছুটির পরে ফেরার পথে লজ্জায় মুখ নামিয়েই রূপশ্রী হল পার হচ্ছিল সে। কেন-না এই হলের আশেপাশেই তো ওদের আড্ডা। তখন বিকেল মায়া সাজাচ্ছে আকাশে। সে-মায়ায় এক কালো ছায়া ঢেকে নেয় তাকে— কেমন চমক দিলাম!

হে ধরণী দ্বিধা হও— এমনই যেন রূপার ভঙ্গিমা তখন। তবু অপাঙ্গে তার ঝিলিক হেনেছিল এক নিরুচ্চার হাসির উদ্ভাস। সে-উদ্ভাসই যেন আজ এই সকালে ঝিলিক হানে পৌঢ়া রূপার চোখে। ঝাপসা চোখে সহসা সকাল মুছে সাঁঝমায়া! রূপশ্রী হল আলো ঝলমল সুর বোনে— দশ কা বিশ! দশ কা বিশ! হারু হিমসিম খায় খদ্দের সামলাতে!

রূপার সজল চোখে ছায়া ফেলে সে-জলরঙা ছবির মায়ালু পেলবতাও। কৃষ্ণ কথা রেখেছিল। তার দিদির বিয়ের সব খরচ কৃষ্ণই দিয়েছিল। রামু সাবান কলে আজও চাকরি করে। ভালই মাইনে পায়। শুধু তাই-ই নয়, তার পরের বোনের বিয়ে, ছোটোভাইয়ের ল্যাম্প ফ্যাক্টরিতে চাকরি— সব দায়িত্ব যেন কৃষ্ণেরই। অথচ…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা।! আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। ফলে সকল সজলতা মুছে আলো ঝলমল সে-সন্ধ্যা হারিয়ে যায়। সকালের নবীন সে-রোদ তখন খর। দোকান সাজায় রূপা খদ্দেরর আশায়।

দু-একজন করে খদ্দের আসে। চা চায় তারা, খায়। গুলতানি মারে। বৃদ্ধ কিছু মানুষের আড্ডাখানাও যেন তার এই দোকান। রিটায়ার্ড, ঘরে সময় কাটে না। দোকানে আসে, ঘণ্টাখানেক গল্পগুজব করে। বাঘ মারে, হাতি মারে— বাতের গল্প আর নিজেদের বাতিল জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। বার দুয়েক চায়ের অর্ডার দেয়। রূপা কিছু বলে না। রূপশ্রী হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তেমন খদ্দের হয় না আর। বাজার এলাকা তো নয়! ওই স্থানীয় লোকজন, পাশের পার্টি অফিসের লোকজন আর পথ চলতি দু-একজন— এই তো তার খদ্দের! বুড়ো লোকগুলো এলে ফাঁকটা অনেকটাই ভরে ওঠে। ভালো লাগে রূপার। ভালো লাগে যখন এমনই কথা ভেসে ওঠে ওদের চায়ের তৃপ্ত চুমুকে মিশে। কাটা। কাটা।

— মানুষ ছিল একটাই সে-সময়! আর নাই।

— হ্যাঁ, রাজা মানুষ। যে কোনো সমস্যায় তার দরবারে একবার হাজির হলেই হল।

ফলে গল্প গজায়, পল্লবিত হয়, মিথের মাহাত্ম্য ডানা মেলে।

— ওই তো সেবার! হালদার পাড়ার পাঁচু রিকশাঅলা, মেয়ের বিয়ের জন্য ধরলে— এমন বিয়ে হল যে তেমন তেমন বড়োলোকও হার মেনে যায়!

— আর দীনু মিস্ত্রির বাগানের ওই অনন্ত গো! জাহাজ কলে কাজ করতে করতে মরে গেল যে। তার বিধবা কৃষ্ণকে ধরতেই এক মাসের মধ্যে চাকরি পাকা তার ছেলের।

— ফতেপুরের শিবু ছেলেটা! ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল। ভর্তির টাকা দিল তো কৃষ্ণই!

এমনতর গল্পের মাহাত্ম্য দোকানের চিলতে ঘরে মাথার ওপর পাক খায়, খেয়েই যায় ঘুর্ণিয়মান পাখার সঙ্গে! আর সে মাহাত্ম্যে হঠাত্‍ একফালি উড়ো সাদা মেঘ সূর্যকে ঢাকে যেন। সে-সকাল মলিন হয় সহসা। সে-ছায়ায় কথারা গলা নামায়। যেন কৃষ্ণের বিধবা না শোনে। দুঃখ না পায়!

— ও তো মস্তানি করতো ডকে, কারখানার চৌহুদ্দিতে। ওটা ছিল তার রাজপাট।

— পাড়ায় কিন্তু সে কোনোদিন কিছু করেনি। তার জন্য পাড়ায় আমরা শান্তিতেই ছিলাম সে সময়। ফোস করে সমবেত নিঃশ্বাস পড়ে যেন। সে-নিঃশ্বাসের অভিঘাতেই যেন মেঘ ভেসে যায়, সূর্য স্বমহিম হয়।

আর ঠিক সে সময়েই কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ছায়া বিলিয়ে সূর্য ঢোকে। সূর্য মিত্র। নকশাল ছিল নাকি সে! আলজাইমার রুগি। হাত-দুটো সবসময় কাঁপে। তবুও ডান হাতটা তার সর্বদা পকেটে গোঁজা থাকে। বোমা ফেটে ডানহাতের তালুটা নাকি তার নেই। যদিও সে তালুহীন হাত কেউ কোনোদিন দেখেনি। না দেখলেও ওটা সত্যই।

অন্যেরা শশব্যস্ত হয়ে সরে বসে বেঞ্চে জায়গা করে দেয় তাকে। সমীহ করে সবাই তাকে। নাকি মায়া! যেমন রূপার মায়াই হয় জীর্ণ লোকটাকে দেখে! ব্যর্থ বিপ্লব! ব্যর্থ মানুষ। শুধু সমাজ পালটানোর স্বপ্নে যৌবনটাকে পচিয়ে দিয়েছে জেলে! রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার কৃষ্ণও তো তাই! না, বিপ্লব সে করেনি। কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল সেও তো! যদিও ক্ষমতার রাজনীতি, তবুও যথাসাধ্য গরিবকে সাহায্য তো কৃষ্ণও করত! তবুও কৃষ্ণ খুনি, গুন্ডা, মস্তান! যদিও এলাকার লোকের চোখে কৃষ্ণ কোনোদিন বিকৃত হয়ে কেষ্টা হয়নি। লোকের মুখে কৃষ্ণদা সম্বোধনে সমীহই ছিল। তবুও…।

রূপা জানে সূর্য মানুষটা চিনি ছাড়া লিকার চা খায়। ও চা এগিয়ে দেয় সূর্যের দিকে। টেবিলে নামিয়ে রাখে। সঙ্গে প্লেটে দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটও।

মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা নিশ্চুপ কথার জাল বোনে। সে নিঃশব্দতাকে বাড়িয়ে সূর্য ম্লান হাসি হাসে মুখ তুলে। ফলে নৈঃশব্দ্য জমাট বাঁধে আরও।

অগত্যা রূপই এগিয়ে আসে সে জেকে বসা নৈঃশব্দ্য তাকে ভাঙতে অন্য দিনের মতোই।

— সূর্যদা শরীর এখন ভাল তো?

— ওই চলে যাচ্ছে বোন। কাঁপা কাঁপা গলা এ-উচ্চারণও বোনে,— তোমরা সব ভাল তো!

— হ্যাঁ, দাদা চলে যাচ্ছে, চালাতে তো হয়ই!

কথা পড়তে পায় না আর। একজন লুফে নেয় কথাখানা।

— এই-ই হল আসল কথা! দিন চলে যায়, চালাতে হয়।

ফলে কথার টানে কথা বাড়ে।— সত্যি কী দিন ছিল বলো তো তখন?

— এই যে সূর্য বিপ্লব করেছিল ধান্দার জন্য? না, সমাজের ভালোর জন্যই তো!

— আমাদের কৃষ্ণর কথাই ধরো না কেন? গরিবের কত উপকার করেছে ও।

— আর এখন? রাজনীতি মানে ধান্দা, নিজের আখের গোছানো শুধু! গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালান্স-প্রমোটিং! ছিঃ ছিঃ! সমাজটা উচ্ছন্নে গেল একেবারে।

কথারা এমনই জাগে ঘরময়। পাখার হাওয়ায় লাট খায়। রূপার কানে গুঞ্জন তোলে। কিন্তু কিছুই সে শোনে না। তার মন অন্য ভাবনা বোনে। কী পেল ওরা? কৃষ্ণ-সূর্য! কৃষ্ণ তো নেই-ই আর। সূর্য থেকেও নেই। জেল ফেরত লোকটা রাজনীতির রা আর কাড়ে নি। সব স্বপ্নকে হারিয়ে মৃত মানুষই যেন সে। জেল তার সকল জীবনীশক্তিকে নিংড়ে ছিবড়ে করে দিয়েছিল। অথচ সে আগুনে সময়ে সূর্য যেন জ্বলন্ত সূর্যই, মধ্যাহ্নের। তার বিভায় মেয়েরা পাগল ছিল। তার পরে সূর্যগ্রহণ কালে সে আলো জেলের অন্ধকারে হারিয়ে গেলে, মুছে গিয়েছিল সকল জীবন্ত গান। শুধু জেগেছিল মনীষা। প্রতীক্ষায় ছিল তার সূর্যের গ্রহণমুক্তির। গ্রহণ কেটে গেলে সে সূর্যকে বরণ করে নিয়েছিল। অতদিন পরও। ততদিনে মনীষা সরকারি চাকুরে। এলাকার পাঁচজনে ধন্য ধন্য করেছিল এ প্রেমের শুভ পরিণতিতে। তারপরেও কিন্তু থেকেছিল। মনীষা জ্বলন্ত সূর্যকেই ভালবেসেছিল বোধহয়! গ্রহণলাগা এ সূর্য হয়তো আকাঙ্ক্ষিত ছিল না তার! ফলে প্রেম উবে গিয়েছিল কবছরেই, শুধু দাম্পত্যের অভ্যাসটুকুই টিকেছিল— করুণায়, দয়ায়। যা টিঁকে আছে আজও পরগাছার মতো। মনীষা তো জেনেবুঝে ভালবেসেই গ্রহণ করেছিল লোকটাকে। সরকারি চাকরি। যা মাইনে পায় তাতে তো স্বচ্ছলতা উপচে পড়ার কথা সংসারে। যেমন পুরুষ মানুষরা একার আয়েই তো স্বচ্ছল! তবে কি বিদুষী, বিপ্লবী মনীষার মনেও পুরুষতান্ত্রিকতার থাবা! রূপা ভাবে। মনীষা কি অন্য কিছু আশা করেছিল মানুষটার কাছে! বড়ো নেতা হবে? মন্ত্রী হবে? কে জানে? ভাবনারা পাক খায় দোকানের আলো আঁধারিতে, টাল খায় পাখার একঘেয়ে ঘুরে চলায়।

রূপাও কি কিছু চেয়েছিল তার কৃষ্ণের কাছে? নিভন্ত মন কোনো সংকেত আঁকে না। সামান্য নারী সে শুধু চেয়েছিল তার মানুষটা ঠাকুর-ঠাকুর করে বেঁচে থাকে যেন। কিন্তু…! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা গোপনে। পাখার হাওয়া ভারী হয়ে ওঠে। পরগাছা জীবন, তবুও সূর্য মানুষটা তো বেঁচে আছে! মনীষার হয়ে রূপা মনে মনে আদর দেয় জীর্ণ মানুষটাকে! দেওয়ালে ঝোলানো মানুষটা হাসে যেন— তেমনই মনে হয় রূপার!

ভাবে আর টুকটাক খদ্দের সামলায় রূপা। বেশিরভাগ জনই বাইরে দাঁড়িয়ে চা খায়। চা ফুটে উঠতে থাকে আগুনে। উথলায়। রূপা অভ্যস্ত হাতে হাতা দিয়ে উথলে ওঠা ডেকচির চাকে থিতু করে। কিন্তু তার মন! উথলে ওঠে, উথলে উঠতেই থাকে। খদ্দেরের আনাগোনা ছায়া আঁকে দোকানের আবছায়া পরিসরে। কথারা জেগে ওঠে, ভাসে। অভ্যাস্ত হাত তার মনহীন যন্ত্রের মসৃণতায় যেন খদ্দের সামলায়। মন তার ভেসে চলে যায় সেই সত্তরে! মনে মনে হাসে রূপা! রোগা-প্যাংলা লোকটা, দোখনের কোনো এক গ্রামে, কাঁধে রাইফেল মাঠের আল ভেঙে রাত চিরে হাঁটছে! দৃশ্যটা মনে হতেই মনের হাসি অজান্তেই রূপার ঠোঁটে আশ্রয় পায়। সচেতন রূপা সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে তা। খুবই সরল সাধসিধে সূর্যদা! এই লোকটা বিপ্লবী! মানুষ খুন করেছে? করতে পারে অমন নরম লোকটা! অথচ রটনা তো তেমনই!

যেমন রটনা এও যে কৃষ্ণ নাকি খুনি! খুন করে কত লাশ নাকি শান্তিনগরের হোগলাবনে, ব্রূকলিন, সিকলেনের ঝিলে গুম করে দিয়েছে! ওরা নাকি সব ছিল তার বিরোধি দলের গুণ্ডা! কৃষ্ণের বিরোধি, নাকি পার্টির বিরোধি! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা। মাথার ওপর পুরোনো পাখাটা একঘেয়ে একটানা ঘুরেই চলে গরম হাওয়ার ঘূর্ণি তুলে। ঘূর্ণি ওঠে রূপার মনেও। কিন্তু কে খুন হল, কার লাশ গায়েব হল কেউ জানে না তা! পুলিশও কোনো রা কাড়েনি। তবুও রটনা— কৃষ্ণ খুনি! পার্টির প্রশ্রয়ে খুন হওয়া মানুষগুলো সমাজ-সংসার থেকে মুছে যায়। পুলিশের ডায়েরি থেকে যায় সফেদ-সাদা!

রূপার ভাবনা টাল খায়, কেন-না টলতে টলতে সূর্য কাঁপা হাতে পকেট থেকে টাকা বার করে কাউন্টারে রাখে। তারপর দোকানের আলো-আঁধারিকে দুলিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায় বিপ্লবী সূর্য। রূপা তাকিয়ে থাকে টলায়মান সে-অতীতের ছায়ার দিকে। তাকিয়েই থাকে, কিন্তু চোখ তার ছবি আঁকে না, সেখানে তখন অন্য আলো-আঁধারির ছায়া— খুনি সূর্য বিপ্লবী! আর তার কৃষ্ণ গুণ্ডা! মস্তান! খুনি!

রূপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আবারও। রাস্তায় গরম হাওয়া বয়। সে-হাওয়ায় প্লাস্টিকের বাতিল এক প্যাকেট উড়তে উড়তে ঠেক খায় রূপার দোকানের চৌকাঠে।

প্রথম পর্ব

Categories
2021-May-Translation অনুবাদ ধারাবাহিক

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

প্রথম অধ্যায়

ফা-হিয়েন পূর্বে যখন চঙান প্রদেশে ছিলেন, বৌদ্ধ গ্রন্থের তিনটি ভাগের মধ্যে শৃঙ্খলা বিষয়টির অসম্পূর্ণ অবস্থা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এবং পরবর্তীতে হাঙ শির দ্বিতীয় বছর অর্থাৎ কিনা ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হুই সিঙ, টাও চেঙ, হুই জিঙ ও আরও কয়েকজন মিলে ভারতবর্ষ ভ্রমণ স্থির করলেন। উদ্দেশ্য, বাকি বৌদ্ধ শৃঙ্খলাগুলি সংগ্রহের চেষ্টা করা। চঙান থেকে যাত্রা শুরু করে পর্বত পেরিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছলেন সিয়েন কুই রাজার রাজ্যে। ইতিমধ্যে বর্ষা আগত, তাই বর্ষাকাল তাঁরা এখানেই কাটালেন। বর্ষা শেষে আবার শুরু হল পথচলা। এবার এসে থামলেন নু তান রাজার রাজ্যে। সেখান থেকে ইয়াং লু পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে সৈন্য কবলিত স্যাঙ ইয়ে শহরে এসে উঠলেন। স্যাঙ ইয়েতে তখন চলছে রাজদ্রোহ, এবং পথ দুর্লঙ্ঘ্য। ফলত তার বৌদ্ধ অতিথিদের বিষয়ে রাজা বেশ উদবিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক স্বরূপ তখন তিনি নিজস্ব ব্যায়ে তাঁদের সেখানেই রেখে দিলেন। সেখানে দৈবক্রমে তাদের সাক্ষাৎ হল পথ চলতে চলতে পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া চি ইয়েন, হুই চেন, সেং শাও, পাও উন, সেং চিঙ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে। এবারের বর্ষাকাল অতিবাহিত হল এখানেই। তারপর বর্ষা অন্তে আবার চলতে থাকা। এবার এসে পৌঁছানো গেল তুন হুয়াং। এখানে রয়েছে সংরক্ষিত শিবির; পূর্ব থেকে পশ্চিমে আশি ফুটের মতো, আর উত্তর থেকে দক্ষিণে চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি এই শিবির। মাসাধিক সময় এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন-সহ পাঁচজন পরিব্রাজক এবার যাত্রা আরম্ভ করে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন। বাকিরা রইলেন সেখানেই। এভাবে পাও উন আর তার সাথীদের সঙ্গে আর একবার বিচ্ছেদ হল ফা-হিয়েনের।

তুন হুয়াং শিবিরের অধ্যক্ষ, গোবি মরুভূমি অতিক্রমের সমস্ত আবশ্যক সামগ্রী তাঁদেরকে দিলেন। মরুভূমিতে অশুভ আত্মার বাস আর হাওয়ায় উত্তাপ। এ-হাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার অর্থ ভয়ংকর মৃত্যু। আকাশে নেই কোনো পাখির কলরব, মাটিতে নেই কোনো পশুপ্রাণী। একটি পথের চিহ্ন খুঁজে চেয়ে থাকো অনিমেষ। পথ মেলে না। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল মৃত মানুষের ক্ষয়াটে হাড়। এই যেন গন্তব্যের দিশা, এই যেন একমাত্র পথের সংকেত। সতেরো দিন প্রাণপণে হেঁটে প্রায় পনেরোশো লি পথ অতিক্রম করে অবশেষে এসে পড়া গেল মাখাই মরুভূমি।

দ্বিতীয় অধ্যায়

এ-ভূমি উষর, এবড়ো-খেবড়ো। চীনাদের মতো এখানকার লোকেদের পোশাকও মোটা, অমসৃণ; পার্থক্য একটাই এরা পশম আর টেকসই মোটা কাপড় ব্যবহার করে। এই রাজ্যের রাজা বৌদ্ধে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি। এখানে প্রায় চার হাজার সন্ন্যাসী আছেন এবং সবাই হীনযান মতাবলম্বী।

রাজ্যের সাধারণ মানুষ এবং সাধু সন্তদের মধ্যে ভারতবর্ষের ধর্ম সর্বব্যাপী বর্তমান। কিন্তু তাদের অভ্যাসের ক্ষেত্রে রুক্ষতা ও পরিমার্জনার একটা প্রভেদ দেখা যায়। এ-অঞ্চল থেকে পশ্চিমে যত এগোনো যায়, যে-সব দেশ অতিক্রম করবে তা সবই প্রায় একরকম। প্রভেদ একটাই যে, টারটার উপভাষায় তারা কথা বলে তা সর্বত্র সমান নয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ সকলেই ভারতীয় পুথি অধ্যয়ন করেন, এবং ভারতীয় কথ্যভাষার চর্চা করেন। মাসাধিক কাল এখানে অতিবাহিত করার পর ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীরা উত্তর-পশ্চিম দিক ধরে চলা শুরু করলেন। পনেরো দিন একটানা ভ্রমণের পর পোঁছলেন উ-ই নামের একটি দেশে। এই উ-ই প্রদেশের চার হাজারের অধিক সন্ন্যাসীগণ, সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ধর্মাচরণ যথাযথ পালন করা হত। চীন দেশ থেকে শ্রমণেরা যখন এখানে এসে পড়লেন, দেখা গেল এ-দেশীয় সন্নাসীদের আচার অনুষ্ঠানে তাঁরা খানিকটা অনভ্যস্ত। ফু সিং তাং ও কুঙ, সানের সুরক্ষা পেয়ে ফা-হিয়েন দুই মাসেরও কিছু বেশি সময় এখানে কাটিয়ে যান। এর পর তিনি পাও উন আর বাকি সঙ্গীদের কাছে ফিরে আসেন। এর পর সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, এই প্রদেশের মানুষেরা নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি কৃত্য এ-সবের কোনো চর্চা রাখে না। আগন্তুকের প্রতি এদের আচরণে বড়োই শীতলতা। পরবর্তীতে চি ইয়েন, হুই চিয়েন, এবং হুই ওয়েই ভ্রমণের উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কাও চাং প্রদেশে ফিরে যান। তবে ফা-হিয়েন ও তাঁর দলের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেহেতু ফু আর কুঙ সান সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন তাই তাঁরা অবিলম্বে দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে যাত্রা আরম্ভ করলেন। জনশূন্য এ-প্রান্তর। স্থল বলো, আর জল, পথ কেবল দুর্গম। এ-পথের নির্মমতা তুলনা রহিত। এই রাস্তা পেরোতে যে-অসম্ভব কষ্ট তাঁরা ভোগ করেছিলেন তা উপমার অতীত। পথের নিষ্ঠুরতায় কেটে গেল এক মাস। তারও দিন পাঁচেক পর তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেন উ টিয়েন।

তৃতীয় অধ্যায়

সমৃদ্ধশালী, সুখী দেশ। মানুষ সচ্ছল, শ্রীমন্ত। ধর্মবিশ্বাস তাঁদের কাছে স্বীকৃত, সকলেই বৌদ্ধ ধর্মে ধধর্মান্তরিত। ধর্মীয় সংগীতেই পরিতৃপ্তি খুঁজে পেত তারা। কয়েক হাজার সন্ন্যাসী, বেশিরভাগই মহাযান সম্প্রদায়ের। সকলের খাদ্যের যোগান আসত একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসত করত মানুষ আর প্রত্যেক বাড়ির দরজার সামনে ছোটো প্যাগোডা তৈরি করত যার সবচেয়ে ছোটোটির উচ্চতা কুড়ি ফুট। পর্যটক শ্রমণদের জন্য ঘর তৈরি করে রাখত। যে-সব শ্রমণেরা তাদের অতিথি হয়ে আসত তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব এই ঘরে রাখা থাকত। যারাই এসে পৌঁছত, সকলেই পেত আতিথ্য। দেশের রাজা, ফা-হিয়েন আর তাঁর সঙ্গীদের স্বাচ্ছন্দবাস স্থির হল চু মা টি নামক মঠে। মঠটি মহাযান সম্প্রদায়ের। বৌদ্ধ ঘণ্টার শব্দে তিন হাজার সন্ন্যাসী একত্রিত হলেন আহারের উদ্দেশ্যে। ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁদের আচরণ গভীর ও শিষ্টাচারপূর্ণ। সুবিন্যস্ত ক্রমান্বয়ে তাঁরা আসন গ্রহণ করলেন। এ-সবই হল নিঃশব্দে। আহারপাত্রে ঝংকার উঠল না কোনো, খাদ্যের জন্য সশব্দে ডাকলেন না কোনো পরিচারককে, কেবলমাত্র ইঙ্গিত করলেন হাত দিয়ে। হুই চিং, তাও চেং আর হুই তা কাশগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল, কিন্তু ফা-হিয়েন আর অন্যেরা তিন মাস যাবৎকাল সেখানে রইলেন প্রতিমূর্তির শোভাযাত্রা দেখবার জন্য। ছোটোখাটো মঠগুলি বাদ দিলে এখানে বৃহৎ মঠের সংখ্যা তাও দাঁড়াবে গোটা চোদ্দোয়। পক্ষকাল অন্তর এ-সব মঠের সন্নাসীরা শহরের রাস্তায় জলছড়া দেন, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন। এর পর মূল সড়কপথগুলিকে সাজিয়ে তোলেন। শহরে প্রবেশ দ্বারের উপর দিয়ে বিছিয়ে দেন অলংকৃত, সুদৃশ্য এক মস্ত শামিয়ানা। রাজা তাঁর রানঔফ এবং মহিষীদের নিয়ে এখানে বসত করেন কিছুকাল। চু মা টি মঠের সন্নাসীরা মহাযান সম্প্রদায়ের। আর রাজাও এই মহাযান তত্ত্বে গভীর শ্রদ্ধাবান। শোভাযাত্রার সূচনায় আছেন সন্নাসীগণ। শহর থেকে তিন চার লি দূরত্বে চতুঃচক্র বিশিষ্ট প্রতিকী যান তৈরি করা হত। তিরিশ ফুটের বেশি উচ্চতার এই যানটিকে দেখে মনে হত চলন্ত পটমণ্ডপ। সাতটি মূল্যবান দ্রব্যে খচিত এই সজ্জা, সোনা, রূপা, পান্না, স্ফটিক, চুনী, তৃণমণি, আর অকীক। চূড়ায় শোভা পাচ্ছে আন্দোলিত পতাকা আর কারুচিহ্নিত চন্দ্রাতপ। যানের একেবারে মধ্যভাগে স্থাপিত রয়েছে মূর্তি। সঙ্গী দুই সেবক বোধিসত্ত্ব। মূল বিগ্রহের পরেই রয়েছে বাকি উপদেবতাদের প্রতিমূর্তি। সোনা, রূপায় মণ্ডিত এই মূর্তিগুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে শূন্যে। শহরের প্রধান দ্বার থেকে বিগ্রহ যখন একশো কদম দূরে রাজা নামিয়ে রাখলেন রাজমুকুট, পরে নিলেন নতুন পোশাক। এর পর হাতে ফুল ও সুগন্ধি অর্ঘ্য সাজিয়ে খালি পায়ে চললেন প্রতিমা সন্দর্শনে। রাজ সেবকগণ রাজার অনুসারী হল। ফুল ছড়িয়ে, সুগন্ধি জ্বালিয়ে ভূমিতে আনত হলেন রাজা।

বিগ্রহ শহরে প্রবেশের মুখে রানি ও মহিষীগণ প্রবেশ দ্বারের উপর থেকে রংবেরঙের ফুল ছুড়তে থাকলেন দূর পর্যন্ত। যেন মেঘদল হতে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে সে-ফুল। আর এভাবেই রচিত হচ্ছে পূজার অর্ঘ্য। প্রতিটি মঠের বিগ্রহযান ভিন্ন ভিন্ন। আর প্রত্যেকের জন্য ধার্য করা আছে আলাদা দিন। পক্ষকালের হিসেবে প্রথম চন্দ্রোদয়ের দিন থেকে শুরু হয় আর শেষ হয় চৌদ্দোতম দিনে। শোভাযাত্রার সম্পূর্ণ সমাপ্তি শেষে রাজা ও রানি ফিরে গেলেন তাদের রাজপ্রাসাদে। শহর ছাড়িয়ে সাত আট লি গেলেই পড়বে একটি মঠ। নাম তার ওয়াং সিন। আশিটি বৎসর আর তিন রাজার রাজত্ব ব্যায় হয়ে যায় এই মঠ নির্মাণে। দুইশো পঞ্চাশ ফুট উচ্চে খোদাই করে খচিত রয়েছে সোনা রূপা। এই সুউচ্চ নির্মাণের বিশালতাকে পরিপূর্ণ করেছে নানা রত্নের সমাহার। উচ্চ মিনারের পিছনেই আছে চমৎকার সজ্জিত একটি উপাসনা গৃহ।

কড়িবরগা, থাম, দরজা, জানালা সকলই স্বর্ণে মোড়া। আর আছে শ্রমণদের থাকার ঘর। সে-সবের সজ্জা ভাষার অতীত। পর্বতের পুব প্রান্তের ছয়টি রাজ্যের রাজা তাঁদের মূল্যবান মণিরত্নময় অর্ঘ্য দান করেন এই মঠে।

চিত্রঋণ: গুগল

Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


ধুতি-পাঞ্জাবির শক্ত কাঠামোটা মাথা হেলাল, যেন আনমনেই। সেই ছন্দেই অভ্যাসবশে পায়ের ভারী বুটজুতোজোড়া তাল ঠুকল। ঠকাস! একইসঙ্গে কালো একটা পুলিশ ভ্যান গড়গড় আওয়াজ তুলল সহসা। সেই সঙ্গেই ব্যাং-ব্যাং-ব্যাং— নিঃশব্দে আগুন ঝলসে উঠল রয়্যাল টকির ফাঁকা গেটে। রক্ত মেখে চারটে লাশ গড়িয়ে পড়ল সে-টকির গেটে! ফলে খাস সাহেব কলকাতার সে-এলাকায় হঠাত্‍ই সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল। কিছু লোক দৌড়ে গেল। আশেপাশের ছাদের টিভি-অ্যান্টেনায় বসে থাকা কিছু কাক ঝিমুনি ভেঙে উড়াল দিল দিগ্বিদিক—আকাশে পাক মারতেই থাকল। সন্ধ্যের এই আঁধারসাজে তিনটে লোক টকির গেট ছাড়িয়ে পুলিশ ভ্যানের আড়ালে হঠাত্‍ই উবে গেল। পুলিশ ভ্যানের কালো অন্ধকারই হয়তো তাদের মুছে দিল। কেন-না সে-ক্ষণেই ভ্যানটি গড়াতে শুরু করেছিল।

রাস্তার চলন্ত মারুতি গাড়িটা হঠাত্‍ই হর্ন দেওয়ায়, আচমকাই— গাড়ির হেডলাইট আছড়ে পড়ল যেন দোকানে টাঙানো ফোটোটার ওপর। ছবির লোকটাকে ঝলকে আলোকিত করে, পরক্ষণেই আঁধার এঁকে গাড়িটা ছুটে চলে গেল তার গন্তব্যে। ফলে ফাঁকা নিস্তব্ধ দোকানে সন্ধ্যের আঁধার জমাট হল সহসা। উলটো দিকে কাউন্টারে বসা মানুষটা সে-অভিঘাতে সামনে টাঙানো ফোটোটার ওপর চোখ মেলে। পরক্ষণেই গাড়ির ছুটন্ত আলোর মুছে যাওয়া তাকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে রাস্তায়। ততক্ষণে বাস-রিকশা-মানুষের জটলায় সে-গাড়ি হারিয়েই যায় প্রায়। তবুও চেনা গাড়ি তাই, মানুষটা বাধ্য হয় গাড়িটাকে চিনে নিতে— দীনদার গাড়ি না!

এই চকিতে চিনে নেওয়া দোকানের অন্ধকারকে আরও ঘন করে যেন। মানুষটা চেয়ার ঠেলে উঠে কাউন্টার ছেড়ে উলটো দিকে ধায়। শাড়ির খুঁট দিয়ে ফোটোটার ঝুলকালি মোছে পরম মমতায়। অভিমান চোখে নুন ছড়ায়। জলহীন কান্নায় বোবা উচ্চারণ ফোটে— কাল একটা মালা কিনতে হবে সকালে! ফলে অন্ধকার জমাট হয় আরও। আবার হয়ও না। কেন-না তক্ষুনি আঁধার ঠেলে দু-জন খদ্দের ঢোকে দোকানে। বেঞ্চিতে বসে।

— বউদি দুটো চা হবে!

— একটু বসুন, দিচ্ছি। বিস্কুট, কেক কিছু লাগবে?

— হ্যাঁ, দুটো বিস্কুটও দিন।

রূপা, দোকানের মালকিন, গ্যাস জ্বালায়। সে-ইন্ধনে সহসা চারদিকে আলো ফুটে ওঠে যেন। দোকান লোকে লোকারণ্য। চা, ঘুগনি, ভেজিটেবল-এগ চপ, টোস্ট— টেবিলে টেবিলে হারু দিয়ে উঠতে পারে না, হিমশিম খায়।

চাপা গলায় আওয়াজ ওঠে— দশকা বিশ! দশকা বিশ! ব্ল্যাকার নিমু হিসহিসিয়ে ওঠে। নব্বই পয়সার লাইনে মারামারি প্রায়। ম্যাটনি শো ভেঙে ইভনিং শো শুরু হল বলে! অমিতাভ বচ্চনের মারকাটারি সুপারহিট হিন্দি বই! মায়াময় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রূপার মুখ। সে-মায়ায় পাশের রূপশ্রী হলের জীর্ণ কঙ্কালটা জেগে ওঠে ঘুম ভেঙে। আলো মেখে সত্যিই রূপশ্রী যেন সে!

হ্যাঁ, রূপশ্রী সিনেমা হলের খাতায়-কলমে অন্য মালিক থাকলেও, বকলমায় আসল মালিক তো কৃষ্ণনাথই! দীননাথ তারই ছোটোভাই। রূপা তার দেওরকে দীনদা বলতেই অভ্যস্ত প্রথম থেকেই!


তখন সদ্য কলেজ। আঠারোর ফোটা কলি। হ্যাঁ, কৃষ্ণকলিই! যেহেতু ছিপছিপে রূপা কালোর দিকেই ঢলে ছিল। আদর করে যাকে শ্যামবর্ণ বলে। সত্যিই কি রূপা আদরের ছিল কারও তখন! সামান্য ডিমঅলা বাবার পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় সে! বস্তির গরিব ঘরে দিন আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে আদর থাকে না, থাকতে নেই! তবুও তো কনেদেখা আলোয় সাজে আকাশ কোনো কোনো দিন। সাজায় চরাচরময় প্রকৃতিকে, যা আলো আঁকে মানুষের মনে। মন যেহেতু মানুষেরই নিজস্ব ধন— মানুষ অজান্তে রেঙে ওঠে সে-আলোয়। রাঙা মন নবীন হয় যদি, তবে লজ্জাও পায়। যেমন সে-বিকেলে কনেদেখা আলোয় রূপার নবীন মনখানি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নীরবে লাজরাঙাই যেন। মুদিয়ালি হরিসভা পেরিয়ে, মুখার্জিদের বাড়ি ছাড়িয়ে, বাঁশঝোপের নির্জনতা যখন ফতেপুর সেকেন্ড লেনে—কোথায় যেন চ্যাংড়া সিটি বেজে উঠেছিল— টি-ই-উই! একবারই। কেন-না দ্বিতীয়বার বেজে ওঠার মুখে সে-ধ্বনি রক্তাক্ত। মুখ না তুলেই রূপা বুঝেছিল কেউ যেন গলির আধা অন্ধকারে প্রাণপণে হারিয়ে গেল। রূপার তৃতীয় নয়ন, যা নারীরই, অনুভব করেছিল তার ওপর লম্বা ছায়ার মায়া। যে-মায়া বলেছিল— যাও, বাড়ি যাও নিশ্চিন্তে। আর কেউ কোনোদিন কিছু বলবে না তোমায়!

রূপার আড় নয়নে তখন ব্রজের সে-রাখালের ছায়া! হ্যাঁ, কৃষ্ণনাথই! রূপার বুক ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল। সন্ধ্যার সে-ঈশ্বরীয় আলোয় ঢেউ তুলে রূপা হেঁটে গিয়েছিল ধীরে বাড়ির পানে। বাড়ির পানেই কি? নাকি রাখালরাজার বাঁশির টানে ব্রজের পানে— পবিত্র রজ উড়িয়ে। জানেনি রূপা সেদিন। হয়তো জেনেওছিল!

কিন্তু এ যে কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ! ব্রজের কানাই সে তো নয়! রূপা বুঝেছিল তা দিন গড়ালে। এখন রূপা রাস্তা দিয়ে, গলি দিয়ে হাঁটে, দিনের আলোয়, সন্ধ্যের আবছায়ায়— যেন রাজেন্দ্রানি সে। সে অনুভব করে তা। নারীর তৃতীয় নয়নে সে বোঝে যে, কেউ যেন লুকিয়ে অনুসরণ করছে তাকে। প্রথম প্রথম ভয়ই পেত সে— কৃষ্ণ যে মস্তান! গুণ্ডা! যুদ্ধবাজ! রাজা সে! তাকে ভয় পাওয়া যায়, সমীহ করা যায়, ভালোবাসা যায় কি? একদিনের ভাবনা ছিল না তা, বহু দিনের পথ চলতি ভাবনারা জড়ো হয়ে এমন মুরতিই পরিগ্রহ করেছিল তার মনে। কখনো দিনের সমারোহে, কখনো সাঁঝের মায়ায়। আর সে-মায়ার সমারোহে কৃষ্ণের যোদ্ধাসাজ মুছে একদিন রূপার মনে পীত বসন উঁকি দিয়েছিল। সে সোনালিহলুদ এক বাদল সাঁঝে যেন ময়ূরপুচ্ছের ঝলমলানি পাখনা মেলেছিল। ময়ূরের মতো নেচে উঠেছিল রূপার মন! হঠাত্‍ই সাঁঝের সে-আবছা ছায়ায় মিশে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সজলকৃষ্ণ একখণ্ড মেঘই যেন। কৃষ্ণ! ভয়ে-বিস্ময়ে ভিজে গিয়েছিল রূপা। দুরুদুরু চোখে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণপানে। না, না, কৃষ্ণ কেন? রাজা, রাখালরাজাই যেন। কেন-না সে সজলকৃষ্ণে নিবেদন ছিল। একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলেছিল সে-মায়া,

— আজ তোমার জন্মদিন। এটা নাও।

সে-নিবেদনে দূরবর্তী সন্ধ্যের ছায়ারা ঠাইনাড়া হয়েছিল যেন উল্লাসি-বিভঙ্গে। তারা যে কৃষ্ণের যাদব, বৃষ্ণীর দল! রূপা যদিও দেখেনি তা। কেন-না তখন তার চোখে ভালোবাসা-ভয়-বিস্ময় একত্রে সজল ছায়া এঁকেছিল। লোকটা জানল কী করে তার জন্মদিনের কথা? মনের কথা সে-অন্তর্যামী কৃষ্ণ পড়তে পেরেছিল। বলেছিল— কলেজে গিয়ে জেনেছি।

যদিও আসল জন্মদিবস আজ নয় তার। তখনকার নিয়ম মেনেই খাতায়কলমে তা সত্য শুধু। জন্মদিন সে পেরিয়ে এসেছে গত হেমন্তে। এমন কথা মনেই এঁকেছিল রূপা, প্রকাশ্যে কেবল এ-উচ্চারণটুকুই ফুটেছিল তার ঠোঁটে— এ আমি নিতে পারব না।

— কেন? জলদস্বর ঘন হয়েছিল শুধু।

— বাড়িতে কী বলব? তিরতির কেঁপেছিল রূপা।

— বলবে, কৃষ্ণ দিয়েছে।

— তবুও…। রূপার গলায় যেন বালির চরা, যদিও চোখে নদীর ফল্গুমায়া।

— তাহলে আমিই গিয়ে দিয়ে আসব বাড়িতে তোমার। সে-জলদ স্বরে অনুরণন ছিল যেন। রূপা আলগা হাত মেলে দিয়েছিল, যে-হাতে কৃষ্ণের বরাভয় আঁকা হয়েছিল সে-আলোক সাঁঝে।হ্যাঁ, আলোক সাঁঝই তা, কেন-না রূপার মনে প্রথম বর্ষার নূপুর ধ্বনি, কেকা রব। মেঘ চিরে বজ্রের ঝিলিক, যা সমীহ জাগিয়েছিল।

রূপা সে-উপহারটুকু বুকের কোণে লুকিয়ে হাঁটা দিয়েছিল মাথা নীচু করে নিশ্চুপে। শব্দহীন প্রতিটি পদক্ষেপে তবুও আঁকাছিল সে-নীরব ধ্বনি— কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! সে-ধ্বনিতে মহিম ছিল সন্ধ্যাখানি, যাকে ঈশ্বরীয় রূপদানে কোনো বাড়িতে শাঁখও বেজে উঠেছিল সহসা!

তবুও বাড়িতে যোদ্ধা কৃষ্ণকে লোকানো যায়নি। রূপার বাবা গর্জে উঠেছিল যেন— মস্তানের সঙ্গে পিরিত! তুই তো যাবিই, সঙ্গে আমরাও গুষ্ঠিশুদ্ধ সবাই জাহান্নমে যাব!

সে-কীর্তনে দোহারকি করেছিল রূপার মা যেন— হায়! হায়! হা আমার পোড়া কপাল!

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বাদশ পর্ব 

আকাশপ্রদীপ ও ডিকটেটরের হাতে স্বপ্ন

হেমন্ত আসছে, বহুদূর থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে সে আসছে। বিকেলের রোদ্দুর আর হাওয়ার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে কার যেন উদাসীন কান্না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হেমন্তসন্ধ্যা বিচ্ছেদের, সে কাপ থেকে প্লেটকে আলাদা করে দেবে… নৌকা থেকে নদীকে।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক সোনালি হরিণ-শস্য

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

একাদশ পর্ব

হেমন্তের দিনে নস্টালজিয়া

হেমন্তের বিষাদের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার একটি ট্র্যাজেডির কথা মনে হয়, আমাদের চেনা চারপাশ থেকে অনেক দূরে আধো-আলো আধো-অন্ধকারে হিমে-ভেজা এরিনায় অভিনীত হয়ে চলেছে সেই নাটক।

Categories
জলসাঘর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

 একাদশ পর্ব

ভিলানেল
(Villanelle)

উনিশ পঙ্‌ক্তির কবিতা ভিলানেল, ছয়টি স্তবকের। প্রথম পাঁচটি স্তবক তিন পঙ্‌ক্তির এবং শেষেরটি চার পঙ্‌ক্তির।

Categories
জলসাঘর ধারাবাহিক প্রবন্ধ

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

আগমনী ও বিজয়া সংগীত

বাংলার ঋতুচক্রে শরৎ ঋতু তথা আশ্বিন মাস বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসবের আগমন বার্তা বয়ে আনে। বর্ষা শেষের মেঘমুক্ত আকাশ ও মাঠে মাঠে কাশ ফুলের অনাবিল সৌন্দর্য উৎসবের চিত্রকল্প সৃষ্টি করে।

Categories
গদ্য ধারাবাহিক ফর্মায়েসি

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দশম পর্ব 

শরতে, উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার

পৃথিবীতে সব থেকে বেশি যে-কয়েকটি চিত্রকল্প আর উপমা ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে একটি অতি-অবশ্যই নির্জনে বনের মধ্যে সবার অগোচরে ফুলের ঝরে যাওয়া। একটি ফুলের ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়া— বিষয়টির মধ্যেই এক বিয়োগাত্মক বিষয় ঝিম মেরে বসে থাকে।

Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ ফর্মায়েসি

অনিন্দ্য রায়ের ধারাবাহিক: ফর্মায়েসি

দশম পর্ব

থান বাউক
(Than bauk)

মায়ানমারের একটি কবিতার ফর্ম ‘থান বাউক’।
এই বর্মীয় কবিতা তিন লাইনের। প্রতিটি লাইন চার সিলেবলের।