Categories
2021-Aug-Dharabahik

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো পার হয়ে গেছে, তবুও শরতের সাদা ভাসা মেঘ হঠাত্‍ হঠাত্‍ই জলে নেয়ে সে জল ঝরিয়ে দিচ্ছে শহরের বুকে— এখানে, ওখানে, সেখানে। যেন-বা বিদায় বেলায় চোখের জল প্রাণপণ চাপতে গিয়েও চাপতে পারছে না! যেমন এ-মুহূর্তে হঠাত্‍ই দিনের আলোকে মুছে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি ঝরছে। রূপা আনমনে বৃষ্টির ঝরে যাওয়া দেখে। দেখে রাস্তার ওপারে কৃষ্ণের গলির মুখে কালিপুজোর প্যান্ডেলের সদ্য বাঁধা বাঁশের কাঠামোটার ভিজে যাওয়া। বৃষ্টির ঝরা জলের ছোঁয়ায়ই যেন ভিজে ওঠে রূপার চোখ। আঁচল চাপা দিয়েও সে চোখের জলের ঝরে যাওয়া মুছে দিতে পারে না, যেহেতু স্মৃতিরা ঝরে পড়ে সে-জলে ভিজে। ভাগ্যিস, দোকানে খদ্দের নেই এখন! রূপা চোখ থেকে আঁচল না সরিয়েই মনে মনে লজ্জা পায়। সজল অতীত ভিড় করে আসে মনে।

শক্তিশ্রী। কৃষ্ণের গলির মুখের ওই কালিপুজোর ভিজে যাওয়া রংচটা ব্যানারের লিখন— আয়োজনে: শক্তিশ্রী, তেমনটাই জানান দিচ্ছে। যদিও জৌলুসহীন এ-পুজো বর্তমানে নামপরিচয়হীন অনেক পুজোর একটা হয়েই টিকে আছে। শক্তিহীন শক্তি পুজোই কি? ভাবে রূপা। সেদিন যখন কৃষ্ণরাজ, তখন সত্যিই শক্তির আরাধনাই শক্তিশ্রীর এ-কালিপুজো। হয়তো শক্তির প্রদর্শন, কৃষ্ণের জাঁক— শক্তি আরাধনার বকলমে, তবুও। যদিও এখনও যেমন, তখনও শক্তিশ্রী নামটি আঁধারেই ঢাকা ছিল, কৃষ্ণের শক্তির ঔজ্জ্বল্যে। মুখ ফেরতা নাম ছিল কৃষ্ণের কালিপুজো। কী জাঁক সে-পুজোর তখন! গোটা এলাকার সমস্ত পুজো ছাপিয়ে জেগে উঠেছিল এ-পুজো। যেমন প্যান্ডেল, তেমনই আলোর জেল্লা— চন্দননগরের। বিসর্জনেও রাস্তার দু-ধারে লোক থোকা বেঁধে থাকত যেন! ১০৮ ঢাকি, লাইটের গেট, ব্যান্ড, সঙ্গে ছৌ নাচও। কিন্তু প্রতিমা ছিল সাবেকিই— শ্যামাকালি নয়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা দক্ষিণা কালীই তা, যা পুজোর নিষ্ঠায় জাগ্রত হয়ে উঠত যেন সে-অমা রাতে। না, পুজোর আচারে কোনোরকম আপোশে নারাজ ছিল তার কৃষ্ণ। ফলে লোকের মুখ ফেরতা সে-নাম—কৃষ্ণের কালী যেন টেক্কাই দিত সোমেন মিত্তির বা ফাটা কেষ্টর কালীকে। কৃষ্ণের কালী! নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে ওঠে যেন রূপা, কৃষ্ণের বিধবা যে। কৃষ্ণকালী, কালীকৃষ্ণ, হরগৌরী— পুরুষ-প্রকৃতি! তার পুরুষের সে কি প্রকৃতিই ছিল! রূপার অজান্তেই তার আঁচলচাপা ঠোঁটজোড়া হাসি আঁকে।সে-হাসিতেই যেন তখনই শরতের উড়োমেঘ ভেসে গিয়ে বৃষ্টি মুছে নির্মল রোদ হেসে উঠেছিল বাইরে।


— হরে কৃষ্ণ! ভিক্ষা দেবে মা!

দোকানে সকালের খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত রূপা চমকে মুখ তুলে তাকায় সে বৃদ্ধ ভিখারির দিকে। এদিকে ইদানীং ভিখারি আর আসে না তেমন। তাছাড়া কৃষ্ণনাম, যা নরম করে তোলে যেন তাকে। সে, রূপা, কৃষ্ণের বিধবা— ভিখারিকে এক টাকার একটা কয়েনই বাড়িয়ে দেয়। সিকি প্রত্যাশী ভিখারি ষোল আনায় অভিভূত। দাতাকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করে—দীর্ঘজীবী হও মা। ঈশ্বর মঙ্গল করুক তোমার।

আর দীর্ঘজীবন! বাঁচতে আর চায় না সে।… কিন্তু তবুও দুই মেয়ে তার। তাদের জন্যই এ-লড়াই! ভাবে রূপা, আর সে ভাবনার টানে বুক কাঁপানো এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও ঢোক গিলে তাকে চেপে দেয় সে। কেননা আজ দোকানে সকাল থেকেই ভিড়। সামনে কর্পোরেশন ভোট। আজ তাই মিছিল বেরোবে লাল পার্টির। এ-ওয়ার্ডের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবে তা। ফলে সকাল থেকেই পার্টির গলির মুখটায় লাল রঙের থকথকে ভিড়।

তখনও ছিল ভোটের মরসুম। না, তখন গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ কলকাতা কার্পোরেশনের আওতায় ছিল না— ছিল স্বতন্ত্র গার্ডেনরিচ মিউনিসিপালিটি, যেমন বেহালা বা যাদবপুর। যে-অঞ্চল ছিল লাল দুর্গ। লাল জমানার পরবর্তীতে যখন লাল সরকার বুঝল যে, নগর কলকাতা তেমন লাল নয় আর, সে-সময় নগর কলকাতাকে দখলে রাখতে পাশের গার্ডেনরিচ-বেহালা-যাদবপুরকে নগর কলকাতার গায়ে জুড়ে দেওয়া হল। চলতি ভাষায় আদি কলকাতা কর্পোরেশনের অ্যাডেড এরিয়া এ তিন অঞ্চল। ১০১ থেকে ১৪১ ওয়ার্ড— তার মধ্যে ১৩৩ থেকে ১৪১ গার্ডেনরিচ অঞ্চলে। এতটুকুই জানে রূপা, এটুকু জেনেছিল সে কৃষ্ণের কাছে। এখন মহানাগরিক তকমায় কর বাড়া ছাড়া, উন্নয়নের বান ডেকেছিল কিনা সে ভিন্ন বিষয় এবং তর্কেরও! সামান্য রূপা জানে না তা। ই ন কি লা ব জি ন্দা বা দ!

হঠাত্‍ তীব্র স্লোগানে রূপার চিন্তা ছিঁড়ে যায়। সে দেখে যে, তার দোকান কখন ফাঁকা হয়ে গেছে সে খেয়ালই করেনি। শুধু তার ভাবনার ফাঁকফোকরে এতক্ষণ যান্ত্রিক অভ্যস্ততায় খদ্দের সামলে গেছে মাত্র! স্লোগানের তীব্রতায় বাস্তব তাকে সামনের রাস্তায় আছড়ে ফেলে যেন। গোটা রাস্তা জুড়ে, যতদূর চোখ যায় শুধু লাল আর লাল। আকাশও ঢেকে গেছে যেন সে রক্তলালে! সহসা এক ভয় ঘিরে ধরে রূপাকে— লাল যেমন জীবনের মায়া বোনে, তেমনই মৃত্যুর ছায়াও বিছায় তা! রূপার ভীত চোখে ভেসে ওঠে তার কৃষ্ণের সাদা আবরণ জুড়ে চটচটে রক্তের থকথকে জমে ওঠা, যা লালই তো! যে-লালে কয়েকটা মৃত মাছির আটকে থাকা! গোটা শরীরটা শিউড়ে ওঠে রূপার যেন! সে-কম্পন চোখ বন্ধ করে কানে হাত দিয়ে কাউন্টারের টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসতে বাধ্য করে রূপাকে। মিছিল চলে গেলে হঠাত্‍ই এক নিস্তব্ধতা বিরাজিত হয় যেন সে-চত্বরে। সে-স্বস্তিতে চোখ মেলে তাকায় রূপা। তার বিহ্বল দৃষ্টি আটকে যায় সামনে ঝোলানো কৃষ্ণের ফোটোর দিকে। সে-সময়ের কৃষ্ণ— যখন মথুরা বিজয় অন্তে সদ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া রাজা কৃষ্ণ, যে বিরাট অথচ সরলও!

সরল! হ্যাঁ, সরল বলেই তো কৃষ্ণ ফাঁদে পড়ে যায়। নাকি বোকাই ছিল সে! হয়তো-বা নিয়তিই তা। যে-নিয়তির টানে রূপাও…!

নাঃ! আর ভাবতে পারে না রূপা। কত ভাববে সে! আর সে-মুহূর্তে তার ভাবনার জাল কেটে বেরিয়ে আসেও রূপা, কেন-না বুড়োর দলটি দোকানে ঢোকে সে-সময়— একটু দেরিতেই যেন আজ। হয়তো মিছিলের অভিঘাত আটকে রেখেছিল তাদের।

— দেখলে কী বিশাল মিছিল!

— হ্যাঁ, চারদিক লালে লাল যেন!

— কর্পোরেশনের ভোট মানেই তো ভয়। আবার কোনো ঝুটঝামেলা হয় কিনা! এখানে তো রাজ্যের পুলিশ আর হোম গার্ড। সেন্ট্রাল ফোর্স তো আর এ-ভোটে আসবে না!

— আরে সেটাই তো শাপে বর। এক তরফা ভোট হবে। বিরোধীদের কোমরের সে-জোর কোথায় যে ঝামেলা পাকাবে? বাধা না দিলে তো আর অশান্তির ভয় থাকে না।

— আমি বাবা ভোটে নেই। গরমে অত কষ্ট করে লাইন দিয়ে দেখব যে, আমার ভোট পড়ে গেছে আগেই!

মিছিল, ভোট, ঝামেলা— শব্দগুলো যেন আট পা ষোলো হাঁটু দিয়ে আবারও ভাবনার জাল বিছায় রূপার মনে। তখনও ছিল ভোটের মারসুম। মিউনিসিপ্যালিটির ভোট। যে-কালো ছায়া সদ্য মথুরাধিপতি কৃষ্ণকে শীতলতার, শান্তির আশ্রয় দিয়েছিল, সেই কালো ছায়াই ক-দিন পর কৃষ্ণকে গিলে খায়। প্রদীপ রায়ের ঔজ্জ্বল্যতা থেকে আর পরিত্রাণ মেলে না কৃষ্ণের, যতই সে তার নিজের এলাকার একছত্র অধিপতি হোক না কেন। সুতো বাঁধা থাকে কৃষ্ণকালো প্রদীপ রায়ের আঙুলেই চিরকাল। ফলে মথুরা বিজয়ের কিছু দিন বাদেই একদিন কালো সে-ছায়া আছড়ে পড়ল কৃষ্ণের ওপর এমনই ভঙ্গিমায়।

— সামনে মিউনিসিপ্যালিটির ভোট জানো তো?

— হ্যাঁ, দাদা।

— হিন্দু পাড়ার দুটো ওয়ার্ড তোমার এলাকায় পড়ে। তার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।

সদ্য যুবা, সরল কৃষ্ণ এ-হেঁয়ালির মানে বুঝতে না পেরে কথা হাতড়ে বেড়ায়। কোনোরকমে বলে ওঠে সে।

— আমি তো পার্টির মেম্বার নই!

কেন-না তখনও রাজনীতির ছায়া না মাড়ানো কৃষ্ণের কাছে রাজনীতি মানে রাজনীতির নেতা-ক্যাডারদের বিষয়ই। সে তো পার্টির মেম্বার নয়। লাল জমানার সকালবেলায় সে জানে তাদের মতো আমজনতার কাছে রাজনীতি মানে পাঁচ বছরে একবার ভোট দেওয়া এবং না দিতে পারাও— যখন বুথে গিয়ে বোকাবদনে দেখবে যে, তার ভোটটা আগেই পড়ে গেছে। সে-সময়ে কৃষ্ণের অভিজ্ঞতায় ভোট মানে টুকটাক ফলস্ ভোটও। কোনো এক কায়দায় আঙুলের গণতান্ত্রিক পবিত্র ছাপটা মুছে নিয়ে ক্যাডার বাহিনীর স্লিপ হাতে ভোটের লাইনে বার বার দাঁড়িয়ে যাওয়া। এবং দিনের শেষে হাসতে হাসতে হিসাব মেলানো কে ক-টা ফলস্ ভোট দিতে পেরেছে— দশটা-বিশটা! আর ভোট মানে মিছিল-মিটিং। কিন্তু এ-সব প্রক্রিয়াই তো পার্টি মেম্বার, ক্যাডারদের কাজ। সে তো তখনও পার্টির কেউ নয়! এও শুনেছে শ্রদ্ধায়, যে, লাল পার্টির মেম্বার হওয়াও নাকি সহজ নয় তেমন। ফলে তার অবাক জিহ্বায় এ-উচ্চারণই উথলে ওঠে— আমি তো পার্টির মেম্বার নই!

হঠাত্‍ই বিহ্বল কৃষ্ণকে এক হা-হা হাসি বা হাওয়ার গর্জনও যেন-বা, চমকে দিয়ে আরও কালো চটচটে ছায়ায় তাকে ডুবিয়ে দেয়, কেন-না প্রদীপ রায় হেসে কৃষ্ণের কাঁধে তার হাত রেখেছিল পার্টির আলো-আঁধারি ঘরে। আর সে হা-হা রব অনুরণন তুলেছিল ছোটো সে-ঘরে আরও একটু আঁধার লেপে, কেন-না সে-ঘরে জোট বাঁধা মেজ-সেজ-ছোটো নেতা বা নেতা নয় এমন গোটা কয়েকজনা হেসে উঠেছিল একতালে।

— দেখ্, বোকা ছেলের কাণ্ড দেখ। অথচ এ-ছেলে দু-দুটো মানুষের খুনি, মার্ডার কেসের আসামি!

প্রদীপ রায়ের চোখে শার্দুল চাহনি ঝিলিক হেনেছিল। সে-চাহনির ফাঁদে পড়ে হরিণ যেন, কৃষ্ণ কেঁপে উঠেছিল— সে খুনি! কিন্তু নিজের হাতে তো সে খুন করেনি!

কৃষ্ণের ভাবনাকে জমাট বাঁধার সুযোগ না দিতেই প্রদীপ রায়ের সাদা পাঞ্জাবির ঘেরাটোপ থেকে বার হওয়া হাতটা কৃষ্ণের কাঁধে থাবার মতই চেপে বসেছিল।

— শোনো কৃষ্ণ, তাই তো তোমাকে ডেকেছি। আজ থেকে তুমি আমাদের পার্টি ক্যাডার— অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্য। ভোটের দুয়েক দিন আগে থেকে এই দুটো ওয়ার্ডে অপোনেন্টের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের একটু বোঝাবে শুধু…।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বার করে প্রদীপ রায়।একজন তড়িঘড়ি লাইটার জ্বালে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ধোঁয়ার মতোই ভাসিয়ে প্রদীপ রায় বাকি কথাগুলো কৃষ্ণের দিকে তাক করে।

— আর ভোটের দিন একটু চমকানো সকাল সকাল। সে-সব বুঝিয়ে বলে দেবে গোপাল তেওয়ারি তোমাকে ভোটের আগে। ভয় নেই। তোমার সঙ্গে গোপাল তো থাকবেই, সঙ্গে আমাদের অ্যাকশন স্কোয়াডের অন্য ছেলেরাও। আপাতত তোমার কাজ আমাদের সঙ্গে মিছিল-মিটিং-এ থাকা। সে প্রোগ্রাম সময় মতো তোমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। তুমি শুধু তোমার ক্লাবের ছেলেদের তোমার সঙ্গে ডেকে নেবে।

কেটে কেটে কথাগুলো উচ্চারণ করে প্রদীপ রায় নিষ্পলক চোখে, তার চাহনির আওতার বাইরে কৃষ্ণকে যেতে না দিয়ে। সিগারেটে টান দেয় ধীরেসুস্থে।

কৃষ্ণর কাঁধ থেকে হাতটা আলগা তুলে তার পিঠে আলতো দুটো চাপড় মারে সে-জোনাল নেতা। হাসে। আবার বলে, যেন-বা শেষ নিদান তা।

— আশা করি বুঝতে পেরেছ আমার কথা। বুঝদার ছেলে বলেই তো তোমাকে আমি নিজে ডেকে পাঠিয়েছি।আর… আবারও সিগারেটে টান দিতে একটু থামে সে-নেতা, যেন কৃষ্ণকে বুঝে ওঠার সুযোগ দিতেই। আলতো ধোঁয়ার সঙ্গে অসম্পূর্ণ কথাটা শেষ হয় এমনই নির্ভার ভঙ্গিমায়।

— আর আমি তো আছি। ভয় নেই কোনো। আমি থাকতে, আমাদের সরকার থাকতে পুলিশ যমজ খুনের খাতা খুলবে না কোনোদিন। যাও এবার। সময়মতো তোমাকে সব প্রোগ্রামই জানিয়ে দেওয়া হবে।

শেষ টান দিয়ে সিগারেটের শেষটুকু গুঁজে দেয় টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে। হাত নাড়িয়ে ধোঁয়া তাড়ায় প্রবল প্রতাপান্বিত সে-নেতা। কৃষ্ণের মনে হয় যেন-বা তাকেই মাছি তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে দেয় সে-ভঙ্গিমায়। বোকা হেসে নমস্কার করে পিছু হটে সে এক শরীরিক যান্ত্রিকতায় যেন, কেন-না তার মস্তিষ্কে সহস্র বোলতা হুল ফোটায় নেতার শেষ বাণীখানি— যমজ খুনের খাতা!

কিশোরী রূপা তখন তো দেখেছিল কৃষ্ণের দাপট। ভোট দেওয়ার বয়স তার হয়নি, ফলে বুথমুখো হওয়ার প্রশ্নও তার ছিল না। তবু রূপা সে ভোটের দিন সকালে তার সেকেন্ড লেনের বাড়ির জানলার ফাঁক দিয়ে শুধু দেখেছিল কয়েকজন যুবকের হেঁটে যাওয়া, যে-হাঁটায় দাপট ছিল। তার আগেই সে শুনেছিল সাতসকালে রূপশ্রী সিনেমার সামনের রাস্তায় পর পর দুটো বোমা পড়ার কথা। যা কেবল নিরীহ ভোটারদের একটু চমকানো, যেন চেতাবনি— হে ভোটার, ভালো মানুষের পো তোমরা, কী দরকার ভোট দিতে গিয়ে বাপোত্তর প্রাণটা খোয়ানোর? নিজে বাঁচলে বাপের নাম— এ-প্রবাদে বিশ্বাসী অনেকে ভোট দিতে যায়ও না। আবার ভোট দান গণতন্ত্রের মহান কর্তব্য— এ-মতগতে বিশ্বাসী যারা, তারা বেলা একটু গড়ালে, সময় থিতোলে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়।অনেকের দাঁড়ানোই সার হয়, কেন-না বুথে ঢুকে দেখে তার হয়ে কেউ গণতন্ত্রের মহান কর্তব্যটি আগেই সেরে রেখে গেছে। থতমত তারা মুখ কালো করে ঘরে ফিরে যায়, জনান্তিকে ক্ষোভ ঝরায়—আরে আমি সেই কবে থেকে লাল পার্টি করি, তবুও আমাকে বিশ্বাস নেই! বিরোধিরা মনে মনে গজরায়— শালা! এ তো গনতন্ত্রের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো! পাবলিকের স্মৃতি যেহেতু বড়োই তরঙ্গায়িত জলবত্‍, ফলে সময়ের পলিতে সত্তরের সিদ্ধার্থ-ইন্দিরার জমানা তার মনে ফিকেই বর্তমানে। আর যারা ভোট দিতে সক্ষম হয়, তারা মহান কর্তব্য সমাধানে কৃতার্থ মুখে বাড়ি ফিরে মাংস ভাত খায়— ভোটের দিন ছুটি কিনা! এ-বিক্ষোভে বা আনন্দের আতিশয্যে অনেকে দেখে বা দেখেও না যে কী করে এক নেতার উত্থান হয়! মুদিয়ালি মোড় থেকে বাঁধা বটতলা হয়ে ফতেপুর সেকেন্ড লেন— কৃষ্ণ দাপিয়ে বেড়ায়, তার বুকে পার্টির লাল ব্যাজ জ্যোতি উগড়ায়। নতুন এক নেতার তত্ত্বাবধানে পার্টির ছেলেরা বুথে বুথে নীরবে লাইনে দাঁড়ায়, ভোট দেয়, আবার দাঁড়ায়। এবং দিন শেষে নির্বিঘ্নে শান্তিতে ভোট-উত্সব শেষ হলে সাইন্টিফিক রিগিং তত্ত্ব প্রথম বারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গার্ডেনরিচ মিউনিসিপ্যালিটি লাল দল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় দখল করে, যার চেয়ারম্যান— প্রদীপ রায়। হ্যাঁ, তার ওয়ার্ডে নির্দল আব্বাসও জিতেছিল উদীয়মান সূর্যের প্রতীকে, কাচ্চি সড়কে। যেখানে দুপুর নাগাদই লাল শরিক ছোটো এক পার্টি তাদের প্রার্থী তুলে নেয়— নির্বিচার বোমাবাজি ও ছাপ্পাভোটের অভিযোগে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

Categories
2021-Aug-Dharabahik

সোমা মুখোপাধ্যায়

নিশারানির কন্যাশ্রী পুতুল

বাংলায় বিভিন্ন ধরনের পুতুল রয়েছে। একসময় কাদামাটি দিয়ে প্রথম পুতুল বানিয়ে ছিল মানুষ। ধীরে ধীরে নানা মাধ্যমে তা তৈরি হতে থাকে। এভাবেই পুরোনো কাপড় দিয়ে একসময় পুতুল তৈরি করা শুরু হয়। সে-সময় বাইরের বিনোদন অন্দরে প্রবেশ করেনি তখন এগুলোই ছিল মেয়েদের বিনোদনের মাধ্যম। এতে তাদের সৃষ্টিশীলতাও প্রকাশ পেত। তাই সংসারের অবসরে এমন কাপড়ের পুতুল বানাত মেয়েরা। একসময় এই কাপড়ের পুতুল মেয়েদের রুজি রোজগারের অবলম্বন হয়ে যায়। আজ এমন স্বাবলম্বী এক গৃহবধূর শিল্প কথা শোনাব।

কোচবিহার জেলার মহিষবাথানের বাসিন্দা নিশারানি একজন গৃহবধূ। ছাপোষা সংসারে দুই মেয়ে এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়েই দিন কাটাতেন। পয়সার অভাবে মেয়েদের পুতুল কিনে দেবার সাধ থাকলেও সাধারণ ছিল না। তাই মেয়েরা পুরোনো কাপড় দিয়েই নিজেদের খেলার পুতুল তৈরি করত। কাপড়ে তুলো ভরা পুতুলগুলো দাঁড়াতে পারত না। তাই মেয়েরা স্কুলে চলে গেলে সংসারের কাজ সেরে নিশারানি সেই পুতুলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে করতে একদিন নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে গেলেন। মাধ্যম এই কাপড়ের পুতুল।

বছর পাঁচেক আগে কলকাতার রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চোখ আটকে গিয়েছিল কারুভাষায় নিশারানির কন্যাশ্রী পুতুলে। স্কুলের শাড়ি পরে হাতে বই খাতা নিয়ে বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছে কন্যাশ্রীরা। এই পুতুল জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। তাই এখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল। আমি দপ্তরের কর্মীদের কাছ থেকে তখনই নিশারানির ফোন নম্বর নিয়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর তৈরি হয় এক আত্মীয়তা।

ছোটোবেলায় দিদিমাকে দেখতাম এই কাপড়ের পুতুল তৈরি করতে। পুতুলের দেহের নানা অংশ কেটে নিয়ে তুলো পুরে সেলাই করে জুড়ে জুড়ে রূপ দিতেন। উল বা কাপড়ের পাড়ের সুতো দিয়ে চুল, চোখ নাক মুখ করতেন। নিশারানির পদ্ধতী এক কিন্তু আরও সৌখিন আরও নিপুণভাবে তৈরি এই পুতুলগুলো। আর আছে উদ্ভাবনী শক্তি।

সে-সময় সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প শুরু করেছেন। নিশারানি তাকেই রূপ দিলেন। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এমনটাই তাঁরও স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণ করলেন নানা ধরনের কন্যাশ্রী পুতুল। সবাই অবাক হয়ে গেল দেখে। কন্যাশ্রী দিবসে সরকারি দপ্তরে আমন্ত্রিত হয়ে প্রদর্শনীতে সাজালেন পুতুল। পাশাপাশি সবুজসাথ-সহ আরও প্রকল্পকে রূপ দিলেন।

এর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিও স্থান পেল তাঁর ভাবনায়। তিনি নিজে রাজবংশী। তাই রাজবংশী বিয়ের বৈরাতি নৃত্য স্থান পেল তাঁর ভাবনায়। এই সমাজে বর এলে এয়োস্ত্রীরা নাচে গানে বরকে বরণ করেন এর নাম বৈরাতি নৃত্য। পুতুলের মাধ্যমে তাঁকে রূপায়ণ করলেন তিনি। পাশাপাশি বিয়ের বিভিন্ন দৃশ্য তুলে ধরলেন। স্থান পেল আদিবাসী সংস্কৃতির ঝলকও।

সমাজে এখনও রয়েছে মেয়েদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার আর কুপ্রথা। নিশারানি তাঁর পুতুলের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধেও প্রচার করেছেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রয়েছে তাঁর পুতুল।

আমার সঙ্গে নিশারানির দেখা হয় বেশ কয়েক বছর আগে।দমদমে ছেলের বাড়িতে এসেছিলেন। ছেলে আর বউমা দু-জনেই কলকাতায় চাকরি করেন। রয়েছে একটি ছোটো নাতি। দোহারা চেহারার সদালাপী নিশারানি প্রথম আলাপে বুঝতেই দেননি আমাদের প্রথম এই দেখা হচ্ছে। বেড়াতে এসেও সঙ্গে আনতে ভোলেননি পুতুলের সরঞ্জাম। আমাকে একটা সুন্দর কন্যাশ্রী পুতুল উপহার দিয়েছিলেন। আর কথা বলতে বলতেই তৈরি করছিলেন পুতুল।

নিশারানি একাই এই পুতুল তৈরি করেন। অন্যদের মতো তাঁর কোনো দল নেই। আর এই পুতুলগুলো একেবারেই সবটাই কাপড় দিয়ে তৈরি। এখানে কোনো মাটির মুখ বা কাঠের কাঠামো তিনি ব্যবহার করেন না। তাঁর পুতুল দেখলেই আলাদাভাবে চেনা যায়।

Categories
2021-Aug-Dharabahik

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

ত্রয়োদশ অধ্যায়

পশ্চিম প্রান্ত বরাবর ১৬ ইউ য়েন চলার শেষে তীর্থযাত্রী দল এসে পড়লেন না শিয়ে দেশের সীমান্তে। এ-দেশের শি লো শহরের একটি বৌদ্ধবিহারে বুদ্ধের করোটি রাখা আছে। এর পুরোটাই সোনায় আর সাতটি মূল্যবান পাথরে মোড়া। এই করোটির প্রতি এ-দেশের রাজার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। পাছে চুরি যায় সেই ভয়ে রাজা, শহরের মুখ্য পরিবারগুলির মধ্যে থেকে আটজনকে নিযুক্ত করেছেন পাহারা দেওয়ার জন্য। এঁদের প্রত্যেকের কাছে রয়েছে আলাদা আলাদা তালা। প্রত্যেক সকালে এই আটজন একত্রিত হয়ে নিজের নিজের সিলমোহরগুলি প্রথমে পর্যবেক্ষণ করেন তারপর একে একে দ্বার খোলা হয়।সে-কাজ সম্পূর্ণ হলে সুগন্ধি জলে হাত ধুয়ে নেন সকলে। তারপর করোটিখানি বের করে এনে মঠের বাইরের দিকে একটি বেদীর উপরে অধিষ্ঠিত করেন। এটিকে মূল্যবান সপ্ত দ্রব্যে তৈরি একখানি গোলকের উপরে রাখা হয়।আর উপরে কাচ দিয়ে ঢাকা থাকে।এসবের পুরোটাই জমকালো মুক্তা আর রত্ন খচিত। করোটী খানি হলদে সাদা রঙের,চার ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত এবং মধ্যবর্তী স্থান উত্থিত।প্রতিদিন দেহাংশটি বাইরে আনার পর,বিহারের দ্বায়িত্বে থাকা সন্ন্যাসী, উঁচু মিনারে উঠে প্রথমে বিরাট এক ভেরি, তারপর শঙখ বাজান।আর সব শেষে ঝনঝন রবে বাজাতে থাকেন কাঁসর। এই সমবেত ধ্বনি শুনতে পেলেই রাজা বিহারের পথে অগ্রসর হন।ফুল আর সুগন্ধি সহযোগে পূজা সম্পন্ন করেন।পূজা শেষে সকলে একে একে আভূমিনত প্রণাম করে, প্রস্থান করেন। পূর্ব দ্বার দিয়ে প্রবেশ এবং পশ্চিম দ্বার দিয়ে প্রস্থান করে, রাজা প্রতিদিন সকালে একইভাবে নিজের পূজা নিবেদন করেন। তারপর রাজা তার রাজ দরবারের কাজ আরম্ভ করেন। বিদ্বান ও প্রবীণ ব্যক্তিগণ প্রথমে এখানে পূজা সম্পন্ন করেন তারপর নিজ নিজ কর্মে মনোনিবেশ করেন। এই হল নিত্যদিনের সূচি। কোনোদিন এর কোনো নড়চড় হয় না।সকল পূজা সমাধা হলে করোটিখানি আবার বিহারের অন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।

বিহারের অভ্যন্তরে আছে একটি স্বতন্ত্র প্যাগোডা। এটি মূল্যবান সপ্ত দ্রব্যে তৈরি, পাঁচ ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট। প্যাগোডাটি কখনো খোলা হয়, কখনো-বা আবার বন্ধ থাকে। বিহারের মূল ফটকের সামনের দিকে প্রতিদিন সকালে ফুল আর ধূপ বিক্রেতার আনাগোনা শুরু হয়, যাতে পূজা দিতে আসা ভক্তগণ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের কাছ থেকে কিনতে পারেন। এ-দেশের অন্যান্য রাজা যারা আছেন, তারাও নিয়মিত তাদের অমাত্যদের প্রতিনিধি হিসেবে পূজা নিবেদন করতে পাঠান এই বৌদ্ধ বিহারে।বিহারটি চল্লিশ কদম বর্গাকৃতি বিশিষ্ট। স্বর্গ, মর্ত্য কেঁপে উঠলে, ধরনী দ্বিধা হলেও এই স্থানটি রইবে অবিচল।

এখান থেকে উত্তরে এক ইউ ইয়েন দূরত্ব অতিক্রম করে তীর্থযাত্রী দল, না শিয়ের রাজধানীতে এসে পৌঁছোল। এখানে বোধিসত্ত্ব পাঁচটি বৃন্ত বিশিষ্ট ফুল নিবেদন করেছিলেন দীপংকর বুদ্ধকে। বুদ্ধের দাঁতের স্মারক নিয়ে তৈরি প্যাগোডা রয়েছে এ-শহরে। করোটির উদ্দেশে যেভাবে পূজা করা হয় সেই একই উপচারে পূজা দেওয়া হয় এই প্যাগোডাতেও।

এখান থেকে চলে যাও এক ইউ ইয়েন উত্তরপূর্বে, গিয়ে পড়বে একটি উপত্যকার প্রবেশ মুখে। এখানে রাখা আছে বুদ্ধের রূপদস্তায় তৈরি যষ্টি। এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একখানি বিহার আর এখানেই পূজা করা হয় দণ্ডটিকে। গো-শির চন্দনে প্রস্তুত এই দণ্ড, ১৬-১৭ ফুট দীর্ঘ। একটি কাঠের খাপের ভিতরে রাখা আছে এটি। শত বা সহস্র জন মিলেও এই খাপ থেকে দণ্ডটিকে সরানো যায় না।

এই উপত্যকায় পশ্চিম দিক বরাবর দিন চারেকের পথ পেরোলে এসে পৌঁছোনো যাবে এক বৌদ্ধ বিহারে। এখানে পূজিত হয় বুদ্ধের সংহাতি বা কাসায় বস্ত্র। কথিত আছে যে, এ-দেশ যখন অত্যধিক খরার কবলে পড়ে, রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিগণ ও সাধারণ মানুষজন মিলে বুদ্ধের বস্ত্রটি বাইরে বের করে আনে এবং পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে। অনতিবিলম্বে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়।

এই স্থান থেকে অর্ধ ইউ ইয়েন দূরে, শহরের দক্ষিণ দিকে আছে একটি গুহা। বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে এই গুহা। বুদ্ধ তার ছায়া রেখে যান এই গিরি-গুহা গাত্রে। দশ কদমের অধিক দূরত্ব থেকে দেখলে, স্বর্ণাভ বর্ণের একখানি, উজ্জ্বল, ঝলমলে, বুদ্ধের পূর্ণাবয়ব সিল্যুয়েট ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যত এগিয়ে যেতে থাকবে এই ছায়ার দিকে, তত অস্পষ্টতা ঘিরে ফেলবে তোমায়। রইবে কেবল ছায়া, কেবল একফালি আঁধার।তথাগত রইবেন অধরা।

পড়শি রাষ্ট্রগুলি থেকে সম্রাটগণ সবচেয়ে দক্ষ চিত্রকর পাঠালেন এই ছায়া অনুসরণে একখানি ছবি আঁকাবার উদ্দেশ্যে। হায়! সব নৈপুণ্যের অতীত তিনি। কেউ পারল না ছবিতে তাঁকে বাঁধতে। এ-দেশের মানুষের বিশ্বাস, তথাগত তাঁর সহস্র জন্মের ছায়া রেখে যাবেন এই গুহা গাত্রে। বুদ্ধ যখন জীবিত ছিলেন, এই ছায়া-স্থল থেকে একশো কদম পশ্চিমে একটি জায়গায় নখ কাটেন আর শির মুণ্ডন করান। এর পর ভবিষ্যতে প্যাগোডার আদর্শ নমুনা হিসাবে তার শিষ্যদের সহায়তায় সত্তর-আশি ফুট উচ্চতার একটি প্যাগোডা নির্মাণ করান।এই প্যাগোডা বর্তমানে বিদ্যমান। এর পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একখানি মন্দির। আর এই মন্দিরে থাকেন সাতশো জন সন্ন্যাসী।

চতুর্দশ অধ্যায়

ক্রমে শীত তার হিমের পসরা সাজিয়ে হাজির হল। এ-ঋতুর দ্বিতীয় চাঁদে ফা-হিয়েন আর তাঁর দু-জন সহযাত্রী মিলে আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে শুরু করলেন।পার করলেন বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। শীত গ্রীষ্মের প্রভেদ নেই কোনো। চির তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণি। পর্বতের উত্তর গাত্র ছায়াবৃত, তাই ভয়ংকর ঠান্ডা। যখন হাওয়া বইতে শুরু করে, হাড় পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। কাঁপুনির চোটে মুখ খোলা দুষ্কর। দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হয়ে একাকার, তাই নীরব থাকাই যেন বাধ্যতামূলক। হুই চিং-এর আর এগোবার ক্ষমতা নেই, মুখের ভিতর ফেনা। অতি কষ্টে ফা-হিয়েনকে বললেন, “আমার আর উদ্ধার নেই, আর বাঁচব না আমি। তুমি এগিয়ে যাও, যতক্ষণ পারো। নতুবা আমরা সকলে একসঙ্গে প্রাণ হারাব।” মৃতদেহের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ফা-হিয়েন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বলতে লাগলেন, “ভ্রমণের মূল পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত করা যাবে না। এই ছিল ভবিতব্য!” সকলের উদ্যম যেন সত্যিই নিঃশেষিত। তারপরও নিজেদেরকে আরও একবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলা শুরু।পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করে দক্ষিণ ঢালে এসে পৌঁছলেন তাঁরা। অবশেষে এসে পড়া গেল আফগানিস্তান। তিন হাজার সন্ন্যাসী আছেন এ-রাজ্যে। সকলেই মহাযান ধর্মাবলম্বী। এবারের বর্ষা এ-দেশেই কাটল। আর বর্ষা অন্তে আবার বেরিয়ে পড়া দক্ষিণ প্রান্ত ধরে। এবার এসে পৌঁছোলেন তাইওয়ান প্রদেশে। এখানেও রয়েছেন তিন হাজারের বেশি সন্ন্যাসী। তবে এখানে সকলেই হীনযান সম্প্রদায়ের। এই স্থল থেকে ঠিক তিন দিন ভ্রমণ করে তাঁরা আরও একবার হিন-তো নদী পার করলেন। এই নদীর দুই তীর একেবারে সমতল।

পঞ্চদশ অধ্যায়

নদীর অপর তীরে আছে পি-তু নামের একটি দেশ। এখানে বৌদ্ধধর্ম তার সকল সমৃদ্ধি নিয়ে বর্তমান, তা সে হীনযান হোক বা মহাযান। এ-দেশের মানুষেরা যখন দেখল সুদূর চীন থেকে একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসেছেন, বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না তাদের। এই ব্যাপারটি দারুণ প্রভাবিত করল সাধারণ মানুষকে। সংসার ত্যাগী হয়ে একজন বিদেশির পক্ষে এই সুদূর পরবাসে ধর্ম সন্ধান, এ একপ্রকার অকল্পনীয় তাদের কাছে। তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর বন্দোবস্ত করলেন তারা। অতিথিদের প্রতি তাদের আচরণ ছিল বুদ্ধের নীতি অনুসারী।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব