Categories
2021-Aug-Godyo

তন্ময় ভট্টাচার্য

প্রত্নক্ষেত্র ও আত্মসমীক্ষা

 

যার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিইনি কোনোদিন, শুধুমাত্র ‘চাই’ বলে অনুপ্রবেশের মানে হয় না। একটা সময় পর থ মেরে যেতে হয়, মেনে নিতে হয় অক্ষমতাকেই। এই যে আমি— পায়ের নীচে প্রভূত সম্ভাবনা অথচ কোনোদিন খননের অধিকার পাব না, আফশোস ও দীর্ঘশ্বাস মেশানো একটা জীবন কাটিয়ে দেব শেষতক— এর যৌক্তিকতা কী? হয় সরে আসি, নয়তো যোগ্যতার পরীক্ষা দিই। আর যদি দুটোর কোনোটাই না হয়?

তখনই অসহায় লাগে। এত শর্ত মেনে তো প্রেম আসে না। তার মহাসমারোহে শুধুই আবিষ্কারের নেশা। থাকবে না বোঝার পর, স্মৃতিতে ডুব। কিন্তু যদি থেকে যায়? একগুঁয়ে সেই প্রেমই যদি বাধ্য করে থাকতে? শর্তহীন, দাবিহীন সম্পর্কের বিপদ এখানেই। সঙ্গ ছাড়া কিছুই চাই না তার। আমিও, মায়া ও অভ্যাস জড়ানো একটা পঞ্জিকা উলটে-উলটে যাই রোজ। বিচ্ছেদের কোনো তিথি লেখা নেই?

বিচ্ছেদ ও মিলনহীন এই দিনকালেই দাঁড়ালাম ইতিহাসের সামনে। স্পষ্ট জানি, এ-লেখা আদতে অনধিকারীর কড়চা। ব্যক্তিগত মোলাকাত ছাড়া কোনো গুরুত্বই নেই। কিন্তু ব্যক্তির যে-গুরুত্ব, তাকেই-বা অস্বীকার করি কী করে!

যেমন অস্বীকার করতে পারিনি আনুলিয়াকেও। নামটা লিখে হঠাৎই মনে হল, পারস্যদেশের কোনো রাজকন্যের নাম হতে পারত। আনুলিয়া। দ্বিতল গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁকই দিয়ে প্রসাধন। দূরদেশি ঘোড়সওয়ার আমি, দেখতাম পরিখার ওপার থেকে। অথচ সত্যি-সত্যি যখন হাজির হলাম, দেখি রাজকন্যে নয়, কিন্তু তার চেয়ে কমও নয় কিছু। যেন বাংলার আবহমান যুবতী— স্খলিত পদক্ষেপে প্রদীপ হাতে চলে যাচ্ছে হাজার বছরের অতীতে।

এভাবে সময় পিছিয়ে দেওয়া যায়? আলো-আঁধারিতে দাঁড়ানো যায় চুর্ণী নদীর পাড়ে? ভাঙা দেওয়ালে হাত রেখে বলে ওঠা যায়, ‘ভালো থেকো’? অধিকারের সীমা জানি বলেই, এর বেশি উচ্চারণ সম্ভব হবে না কোনোদিন।

আনুলিয়া। নদিয়ার এক গ্রাম। কাছেপিঠের বিখ্যাত স্থান হিসেবে নাম নেওয়া যায় রানাঘাটের। কিন্তু এত জায়গা থাকতে হঠাৎ আনুলিয়াতেই গেলাম কেন? কেনই-বা তীব্র এক অপরাধবোধ-মিশ্রিত আনন্দ নিয়ে ফিরে আসা? কোন রহস্য চেনালো সে?

ভাবছিলাম খনন-পরবর্তী কোনো প্রত্নক্ষেত্রের কথা। ধরা যাক মহেঞ্জোদাড়োই। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৩ সালে আবিষ্কার করলেন, অসংখ্য প্রত্নবস্তুর সঙ্গে পরিচিত হল বিশ্ববাসী। মহেঞ্জোদাড়োর সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেল রাখালদাসের নাম। কিন্তু সেই খননের আগে? যখন দুটো-একটা মৃৎপাত্র, মূর্তি, ভাঙা ইট ইঙ্গিত দিচ্ছিল প্রাচীন কোনো সভ্যতার? স্থানীয় মানুষরা কুড়িয়ে পাচ্ছিলেন অনাদিকালের চিহ্ন? শতবর্ষ পেরিয়ে সেই ইতিহাস ধূসর। শুধু মহেঞ্জোদাড়ো কেন, যে-কোনো প্রত্নক্ষেত্রের জন্যেই এ-কথা প্রযোজ্য। একবার খুঁড়ে সামনে তুলে আনলেই জল্পনার শেষ।

মাটি এক আশ্চর্য পর্দা। নারীর মতো। কখন কী আড়াল করে রাখে, রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবল হয়ে ওঠে ভেদের ইচ্ছা। এই যে আনুলিয়া— বছরের পর বছর ধরে ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে, খনন হলেই তো সব স্পষ্ট। বিশ্বের কাছে উঠে আসবে প্রাচীন এক জনপদের গল্প। কিন্তু তার আগের দিনগুলো কেমন? একের পর এক ইশারা অথচ ছুঁতে পারছি না কিছুতেই— এমন প্রত্নক্ষেত্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা? একদিন খনন হবে ঠিকই। সেদিন আমাদের মনে রাখবে না কেউ। ইতিহাস লিখবে না— খনন-পূর্ববর্তী দিনগুলোয় এক অপাঙ্‌ক্তেয় যুবক ছুটে গিয়েছিল শুধুমাত্র শিখে নেবে বলে। কী শিখতে চেয়েছিল সে? কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রকাশ্যে আনার আগে, কীভাবে দিয়ে যেতে হয় অস্তিত্বের টুকরো-টুকরো ইঙ্গিত। কবিতার মতো?

ইচ্ছে ছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক হব। প্রাচীন কোনো সভ্যতার স্তূপ থেকে খুঁড়ে বের করব অতীতচিহ্ন। আমার হাতেই আবিষ্কার পাবে কোনো যক্ষিণীমূর্তি। সন্ধ্যেপ্রদীপ। লক্ষ্মীর ভাঁড় কিংবা পাথুরে ফলক। পাকেচক্রে ভেসে গেছি বহু দূরে। করুণ চোখে তাকিয়ে থেকেছি কৈশোরের স্বপ্নের দিকে। ইতিহাসকে জড়াতে চেয়েছি বার বার। আবিষ্কার খুঁজেছি কবিতায়। বহতাদিকে দেখি। বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়। কবিতা লেখেন, আবার সিন্ধু সভ্যতার লিপি বিশ্লেষণ করে তুলে আনেন সেকালের ভাষাসূত্র। এমন একটা জীবন হতে পারত। বদলে অনধিকারীর মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা আর দেখে যাওয়া— এর বেশি কী-ই-বা পারলাম!

সেটুকুও কি পারলাম ঠিকমতো? আনুলিয়ায় দাঁড়িয়ে এ-কথাই মনে হচ্ছিল বার বার। সে-কারণেই, এই লেখাতেও, আনুলিয়ার ইতিহাস তুলে ধরতে চেয়েও ঘুরিয়ে দিচ্ছি কথা। নতুন কী-ই-বা বলব! বিভিন্ন বইয়ে পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ, স্থানীয় গবেষকদের মুখে শোনা কথা, নিজের টুকরো-টুকরো দেখা— এ-দিয়ে লেখা সাজিয়ে তোলা যায় সহজেই— কিন্তু তাতে আমার ভূমিকা কতখানি! অনেকেই লিখেছেন, অনেকে লিখবেনও। সেই ভিড়ে একজন না থাকলে ইতিহাসচর্চার ক্ষতি হবে না বিশেষ।

তবু যেন মনে হয়, লিখে রাখা প্রয়োজন। পুনরাবৃত্তি? তাই সই। আমি আনুলিয়া তথা রানাঘাটের বাসিন্দা নই। হলে হয়তো সম্পৃক্ততা বাড়ত অনেকখানি। নিজ উদ্যোগেই খুঁজে বেড়াতাম সেকালের প্রত্নসম্পদ। কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্বে বসে এর বেশি কী-ই-বা করণীয়! বিস্তারে লেখার পক্ষপাতী নই। যাঁরা বছরের পর বছর এ-নিয়ে পরিশ্রম করছেন, তাঁদের কাজকে ছোটো করা হয় তাহলে। নিছক ভূমিকার মতো, গদ্যের খাতিরেই, ইঙ্গিত দেওয়া যাক।

আনুলিয়ার প্রাচীন নাম অনলগ্রাম। বাস করতেন হীনযানী বৌদ্ধরা। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিস্তারের আগে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে যেমন বৌদ্ধদের নিদর্শন পাওয়া যায়, আনুলিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘নদীয়া-কাহিনী’-র লেখক কুমুদনাথ মল্লিক ১৯১০ সালেই বলে গেছেন— “বঙ্গের অন্যতম প্রাচীন স্থান বৰ্ত্তমান রাণাঘাটের সন্নিহিত আনুলিয়া গ্রামের বাৎসরিক কাৰ্ত্তিক সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত ধৰ্ম্ম-গাজন… মনোযোগ দিয়া দেখিলে স্পষ্টই প্রতীতি হইবে যে বৌদ্ধধৰ্ম্ম দেশ হইতে এখনও সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয় নাই।” এমনকী, শতাব্দীকাল ধরে আনুলিয়ার বারোয়ারিতলায় যে-বিষ্ণুমূর্তি প্রতিষ্ঠিত, ১৮৮৫ সাল অবধি সেখানে একটি বুদ্ধমূর্তি ছিল বলে জানাচ্ছেন কুমুদনাথ।

বুদ্ধমূর্তির উল্লেখ থেকে স্পষ্ট, আনুলিয়ায় একসময় বৌদ্ধ প্রভাব ছিল। বাংলার পাল রাজবংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ফলে, পালযুগ পর্যন্ত আনুলিয়ায় বৌদ্ধচর্চা প্রকাশ্যেই হত, তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না।

অবস্থা বদলায় সেন আমলে এসে। আনুলিয়া থেকে লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসন-সহ সেন যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট— সেন আমলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হয়ে উঠেছিল আনুলিয়া। প্রসঙ্গত, যে-বিষ্ণুমূর্তিটির কথা উল্লেখ করলাম আগে, তা সেন আমলের। অর্থাৎ, একাদশ-দ্বাদশ শতকের। গ্রামের এক গাছতলায় নিত্যপূজা করেন গ্রামের বাসিন্দারাই।

এই পর্যায়ে পৌঁছে একটা প্রশ্ন জাগে। গ্রামের নাম আনুলিয়া, ‘অনলগ্রাম’-এর অপভ্রংশ। কিন্তু অনলগ্রাম কেন? অনল শব্দের এক অর্থ অগ্নি। গ্রামের আদি বাসিন্দারা অগ্নি-উপাসক ছিলেন? কিংবা যাগযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত কোনোভাবে? কিন্তু বুদ্ধ-প্রভাবিত গ্রামের বাসিন্দারা অগ্নি উপাসক— কিন্তু-কিন্তু লাগছে ভেবে। আরও দুটো সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়। আনুলিয়ায় পালযুগ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ বৌদ্ধ প্রভাব। সেন যুগে এসে হিন্দুত্ব খানিক আরোপিত হল কি? দখল ও প্রভাব বিস্তারের জন্য বৌদ্ধদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল? সেই থেকে অনলগ্রাম?

এ নিছকই অনুমান। এও হতে পারে, সেন আমলে বিষ্ণুর উপাসনা থেকেই ‘অনলগ্রাম’ নাম হয়েছে। বিষ্ণুর আর এক নাম ‘অনল’। আর সেন যুগের অসংখ্য নিদর্শনের পাশাপাশি আবিষ্কৃত হয়েছে বিষ্ণুমূর্তিও। দুয়ে-দুয়ে চার করা যায়। এও হতে পারে, তুর্কি আক্রমণের সময় গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তুর্কি সৈন্যরা। সেহেতু অনলগ্রাম। এ-সবই অনুমান মাত্র। কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই কিছুরই।

কিন্তু তুর্কি আক্রমণ! কষ্টকল্পিত কি? একদমই নয়। গ্রামের লোকশ্রুতি, সেন আমলে বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরা আক্রমণ করেছিল আনুলিয়া। সেই যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় গ্রামটি। প্রমাণ? আনুলিয়ার নিকটবর্তী জনপদ ‘গুড়পাড়া’। সম্ভবত ‘গোরপাড়া’-র অপভ্রংশ এই নাম। ২০০০ সালের বন্যায়, গ্রামের উঁচু এক ভূমিরূপের মাটি গলে বেরিয়ে এসেছিল কিছু কঙ্কাল। হাড়ের আকৃতি, দৈর্ঘ্য দেখে অনুমান, তাঁরা প্রত্যেকেই ছয়-সাড়ে ছয় ফুটের। গড় বাঙালির দৈর্ঘ্য এমন হতে পারে না। তাছাড়া, বাঙালি হিন্দু হলে দাহ করা হত, কবর নয়। কিন্তু এত জায়গা থাকতে হঠাৎ আনুলিয়াতেই তুর্কি আক্রমণ হল কেন?

সে-ইতিহাসে ঢুকতে গেলে লেখার গতি পালটে যাবে। সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি, অনুমান করা হয়, আনুলিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে দেবগ্রামই ছিল লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী। অথচ পণ্ডিতরা এতদিন নবদ্বীপকেই লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী বলে এসেছেন। বিভিন্ন ইঙ্গিত, প্রমাণ, দেবলগড় তথা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ থেকে কিন্তু উঠে আসে অন্য কথাই। দেবগ্রামে খনন হলে হয়তো বাংলার ইতিহাসের একটা অধ্যায় বদলে যাবে চিরতরে। কিন্তু দেবগ্রাম নিয়ে আলোচনা এই লেখার লক্ষ্য নয়। পরে কোনোদিন, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে…

আনুলিয়ায় ফিরি। চুর্ণীর ধারে-ধারে ছড়িয়ে অজস্র প্রত্নসম্পদ। পাল-সেন যুগের মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরো। নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন ইটের দেওয়াল। কী কী পাওয়া গেছে, সে-সবের উল্লেখ চর্বিতচর্বণ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু আরও যা যা যেতে পারে, তার সম্ভাবনা জেনে আশ্চর্য হতে হয়। এখনও উদাসীন আর্কিয়োলজিকাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া। একদিন সমস্ত রহস্যের উদ্‌ঘাটন হবে। বাংলার নতুন ইতিহাস লেখার সেই দিনকালে, আজকের এই অধ্যায় হারিয়ে যাবে না তো? খননের আগের ইতিহাসকে মনে রাখে ভবিষ্যৎ?

এ-প্রসঙ্গেই মনে পড়ে বিশ্বজিৎদার কথা। বিশ্বজিৎ রায়। গত দশ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে উদ্ধার করছেন আনুলিয়া-দেবগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস। বিভিন্ন প্রত্নবস্তু নিয়ে গড়ে তুলেছেন স্থানীয় মিউজিয়ামও। আমার বরাবরই মনে হয়, যে-কোনো প্রত্নক্ষেত্রের প্রাণভোমরা লুকিয়ে থাকে এই আঞ্চলিক ঐতিহাসিকদের কাছেই। চন্দ্রকেতুগড়, আউশগ্রাম, সুন্দরবন— প্রতিটি জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে আঞ্চলিক ঐতিহাসিকরা গড়ে তুলেছেন দুরন্ত এক-একটি মিউজিয়াম। গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছেন, নিছক মাটির ঢেলার আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা তাঁদের ছাড়া সম্পূর্ণ হত না। কিন্তু তারপর? যদি কখনো এএসআই আসে? খননের পর যুগান্তকারী কিছু উদ্ধার করে সাবাসি নিয়ে চলে যায়? ফুটনোটের এককোণে হয়তো পরে থাকবেন স্থানীয় ঐতিহাসিকরা। যাঁরা বছরের পর বছর শুধু ইতিহাসরক্ষার দায় নিয়ে সংগ্রহ করে গেছেন একের পর এক প্রত্নবস্তু, আর স্বপ্ন দেখেছেন— কোনোদিন এএসআই এসে স্বধর্ম পালন করবে।

বিশ্বজিৎদা না থাকলে আনুলিয়াকে এভাবে চেনা যেত না। এক-একজন থাকেন, যাঁদের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায় সে-অঞ্চলের ইতিহাসচর্চা। অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই এক ব্যক্তি কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন বিভিন্ন সম্ভাবনার। ভূগোলের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন ইতিহাসের ভুলে-যাওয়া অধ্যায়। লিপিবদ্ধ করে রাখছেন সবকিছু। আনুলিয়ার ইতিহাস নিয়ে আমার যাবতীয় বাক্‌সংযম এই লোকটির জন্যেই। কিছু লিখতে গেলে নিজের ক্ষুদ্রতা প্রকট হয়ে ওঠে, মনে পড়ে বিশ্বজিৎ রায়ের মুখ। ওঁর নিমজ্জনের পাশে আমার উপস্থিতি নিছক কৌতূহলীর।

নদিয়া বরাবরই আমার প্রিয়তম জেলা। মূলত চৈতন্যযুগ ও পরবর্তী বিভিন্ন বাঁকের মাধ্যমে সহজিয়াদের উত্থান ও বিকাশের কারণে। ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির সেইসব অধ্যায় আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে নদিয়াকে। কিন্তু যাকে ভালোবাসি, তার অজানা গুণ হঠাৎ সামনে এলে ভালোবাসা যেমন বেড়ে যায়, আনুলিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটনা খানিক তেমনই। অগত্যা, “যে-গুণে তোমারি বেঁধেছ কিশোরী তার শোধ দিতে নাই।”

কথা গোটানোর আগে, আর একবার ফিরে তাকাই নিজের দিকে। ইতিহাস ও আবিষ্কারের প্রতি এই যে ব্যর্থ নেশা, উৎস কী? মনে পড়ে কৈশোরে পড়া এক বইয়ের কথা। হাতে চলে এসেছিল হঠাৎই। পড়ার আগের ও পরে মনের ফারাক বোঝা যায় স্পষ্ট। বছর পনেরো আগের সেই কিশোর স্বপ্ন দেখেছিল, একদিন সেও বেরিয়ে পড়বে সারেং-এর ভরসায়। সমুদ্দুর পেরিয়ে, হাজির হবে জঙ্গলঘেরা কোনো পরিত্যক্ত জনপদে। লতাপাতায় ঢাকা স্থাপত্যের আড়াল থেকে কুড়িয়ে আনবে ভুলে-যাওয়া দিনের ইতিহাস। ঘরকুনো বাঙালি আমি, কল্পনার বাইরে কিছু করে ওঠা হবে না— বুঝে গেছি এতদিনে। কিন্তু সেই কল্পনারও যে ইন্ধন, রেলগাড়িতে চাপিয়ে দেড়ঘণ্টা দূরের আনুলিয়াতে টেনে নিয়ে গেল যা— তাকে অস্বীকার করলে কৈশোর ক্ষমা করবে কি?

উনিশ-বিশ শতকের বাঘা-বাঘা ব্যক্তিদের লেখা পড়ি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, নগেন্দ্রনাথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মিত্র, সুকুমার সেন। কিন্তু এ-সবেরও আগে, এক কিশোরের মনে ইতিহাসচিন্তার বীজ বুনে দিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘হীরে মানিক জ্বলে’ না পড়লে জীবন অন্যরকম হত। ভালো না মন্দ, জানি না। তবে অন্যরকম হত, নিশ্চিত। না-হওয়া সম্পর্কের মতো। হল না বলেই কল্পনা করা যায়। হয়ে গেলে, ভাবার অবসর থাকে না তত…