Categories
2021-Aug-Story

সরিতা আহমেদ

আশ্রয়

অফিসে ঢোকার মুখেই মেয়েটাকে চোখে পড়ল ইন্সপেক্টর মাইতির। কব্জি উলটে দেখলেন— দুপুর আড়াইটা। থানা থেকে এগারোটায় বেরোনোর সময়ই মেয়েটিকে ওভাবেই বসে থাকতে দেখেছিলেন। এত বেলা হল, এখনও সে ওই বেঞ্চটায় ঠাঁই বসে আছে! ওড়নার খুঁট আঙুলে পেঁচিয়ে ইতিউতি ঠান্ডা চোখে তাকাচ্ছে, যেন তাড়া নেই কোনো। এক ঝলক দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি অভুক্ত, কিন্তু চোখদুটোর আগুন যেন নেভেনি এখনও।

কনস্টেবল বড়ুয়ার কাছে জানা গেল, মেয়েটি ‘সারেন্ডার’ করতে এসেছে।

সারেন্ডার!

— কী কেস?

“স্যার, কেসটাই তো ভালো বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা একটা মোবাইল জমা দিয়েছে ঐ টেবিলে। বলছে, সব নাকি মোবাইলে বলা আছে।”

— ইন্টারেস্টিং। আর কিছু বলেনি?

“না… মানে হ্যাঁ, ওই তো বলছে সারেন্ডার করতে এসেছে। আসলে সকাল থেকে আপনারাও ছিলেন না। বড়োবাবুও গেছেন মিটিঙে। আমি আগের কেসটা নিয়ে একটু ব্যস্ত… মানে, সেই জন্যই… তবে আমি বলেছিলাম, ‘মোবাইলটা রেখে যা। স্যার এলে ওনাকে দিয়ে দেব।’ কিন্তু ও বলছে এখানেই বসে থাকবে যতক্ষণ না ঐ রেকর্ডিং শোনা হচ্ছে। বুঝুন, কোনো মানে হয় স্যার!”

— হুম্‌, বুঝলাম। ঠিক আছে আমি মোবাইলটা দেখছি। ততক্ষণ মেয়েটিকে কিছু খেতে দিন। নিজে থেকে মুখ না খুললে বেশি জোড়াজুড়ি করা ঠিক হবে না। আগে দেখি রেকর্ডিংটা কী, তারপর বাকি ব্যবস্থা হবে।

“আমি প্রতিমা মাঝি। এবারে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছি। আমি সারেন্ডার করতে চাই, কারণ, কাকাদের বাড়ির সবার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছি। চমকে গেলেন! সব বলছি। আচ্ছা, সরকার থেকে নাকি কয়েদি পড়ুয়াদের সাহায্য করে। সত্যি? আমার কেসটা একটু দেখবেন, স্যার।

হাতিপোতা গ্রামে আমার বাবা ‘একশো দিন’ শ্রমিক ছিল, আর মা দু-বাড়ি রান্নার কাজ করত। আমিও মাঝে মাঝে খেটে দিতাম। দাদা নাইনে উঠে স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে কাজে যোগ দেয়। অভাব থাকলেও বাবা কোনোদিন চায়নি আমাদের স্কুলছুট করতে। তাই দাদা ড্রপ আউট হতেই আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন দ্বিগুণ বেড়ে গেছিল। বলত, “বেটি, বড়ো হয়ে তুই অফিসার হবি, কেমন!” দিব্যি চলছিল টানাটানির সংসার। কে জানে কবে মা ধীরে ধীরে বদলে গেল। আমার সোজাসিধা মা যে কিনা স্বামী আর সংসার ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝত না, সে-ই পালিয়ে গেল আমাদের ফেলে। দু-বছর হয়ে গেল আজ অবধি মাকে দেখিনি। জানেন স্যার, মাধ্যমিকে আমি খুব খারাপ নাম্বার পাইনি। স্কুলে সবাই বলেছিল সায়েন্স নিতে, কিন্তু বাড়ির ওইরকম বিচ্ছিরি পরিবেশে সায়েন্সের কথাটা বলতেই পারলাম না। মা চলে যাওয়ার পরে আমার হাসিখুশি বাবাটা কেমন যেন হয়ে গেল। সকালেই উঠেই কাজে যাওয়া আর কাজ থেকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়া— এর বাইরে আমরা কেমন আছি, আদৌ আছি কিনা সে-সব দিকে তাকাবার যেন সময়ই পেত না মানুষটা।

জানেন, দাদাকে ধমকানোর সাহস শুধু মায়ের ছিল। মা চলে যেতেই দাদাটাও যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো পাগলা হয়ে গেল। কাজেও কামাই করতে লাগল। রাতদিন অন্য পাড়ার নানারকম লোকেদের সাথে কী কী সব বাজে আড্ডায় মেতে থাকত। দিন যত যাচ্ছিল নানারকম গুন্ডা টাইপের লোকের সঙ্গে ওর মেলামেশাও বাড়ছিল। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, “কাজে গেছিলাম। তুই বুঝবি না।”

আমি কিন্তু একটু একটু বুঝতে পারছিলাম যে, দাদা কোনো খারাপ দলে ভিড়ে গেছে। একদিন ঠিক আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসবে দাদার খোঁজে। বাবা কিন্তু কিছুতেই মানতে চাইত না এ-সব। এইসবের মধ্যেই একদিন “বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি”, বলে দাদা সত্যিই বেপাত্তা হয়ে গেল।

এ-বছরের গোড়ায় বাবার একটা ছোটো অ্যাক্সিডেন্ট হল। পায়ের ঘাটা এমন বিষিয়ে গেছিল যে, টানা দু-মাস কাজে যেতে পারেনি। মার্চের মাঝামাঝিতে কে যেন খবর দিল নয়া ‘মজদুর-লিস্ট’ বেরিয়েছে যাতে বাবার নাম নেই। কোথায়, কার কাছে দরবার করলে সমাধান হবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লকডাউন শুরু হয়ে গেল। এমনিতেই মায়ের আর দাদার শোকে পাগলাটে হয়ে গেছিল বাবা, লকডাউনে টানা তিন মাস রাতদিন ঘরে থাকতে থাকতে উন্মাদ হয়ে উঠল যেন। ওষুধপত্র আর সংসার খরচে জমানো টাকাও দ্রুত ফুরাচ্ছিল! মাঝে মাঝে কাঁদতে কাঁদতে এমন ছটফট করত যে, আমি সামলাতে পারতাম না। এরকমই একদিন সকালে উঠে দেখি, উঠানের বাঁশে ফাঁস লাগিয়েছে বাবা।

হাসপাতালে যে নিয়ে যাব, তার সময়টুকুও দিল না।

করোনাকালে লোকে আত্মহত্যা করলেও নাকি লাশের দায়িত্ব কেউ নেয় না। পুলিশ এল, ঘর তোলপাড় করে ছানবিন করল, তারপর ‘সুইসাইড’ লিখে কেস বন্ধ করে দিল। কিন্তু আমার কী হবে— তার উত্তর কেউ দিল না। জানি, বাবা সারাজীবন অশান্তি সয়েছে। মরেই হয়তো শান্তি পেতে চেয়েছিল। সেটুকুও কি জুটবে না! তাই যে কাকা আমাদের কোনোদিনই পাশে দাঁড়ায়নি— তাদেরই হাতে পায়ে ধরতে বাধ্য হলাম। দাদাকে মৃত বাবার খবরটুকুও দেওয়া হল না। সবাই বলল, ফাঁকা বাড়িতে একলা থাকা ঠিক না— তাই ‘বাবার কাজ’ মেটার পরে কাকার বাড়িতেই উঠতে হল। খাওয়া থাকার বদলে ঘরের সব কাজই করতাম। ওপর ওপর সব ঠিক থাকলেও, ওদের কথাবার্তায় মনের খটকা দিন দিন বাড়ছিল।

জানেন স্যার, শত অভাবেও নিজেকে কোনোদিন এত অসহায় লাগেনি। কিন্তু বাবা নামের বটগাছটা মরে যেতেই বুঝলাম মাথার উপর থেকে বড়ো ছাতাটা এ-জন্মের মতো সরে গেছে। কাউকে ভরসা করতেই ভয় লাগে। ভয়টা সত্যি করতেই যেন ঝড়টা এল— ‘আমফান’। চোখের সামনে দেখলাম আমাদের বাড়িখানাকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল দানবটা। ভেবেছিলাম সময় করে ট্র্যাঙ্ক থেকে নিজের পড়ার জিনিস, ব্যাঙ্কের বই সব গুছিয়ে আনব।

কিন্তু ভাগ্য! মায়ের রান্নাঘর যেখানে ছিল সেখানে এখন পাঁকভরতি ডোবা। ওদিকে রোজ মাইকে ঘোষণা হচ্ছে “আমরা থাকব ঘরে/করোনা পালাবে দূরে”। রাতারাতি ঘরহীন হওয়া লোকজন এ-সব শুনে হাসবে না, বলুন!

গত সাতদিন ধরে এক নয়া বিপদের আঁচ পাচ্ছি। ওদের বাড়িতে এক বুড়ো আসা-যাওয়া করছে। মেয়েদের দিকে লোকটার নজর একদম ভালো না। সেদিন লোকটার সঙ্গে কাকা বেজায় ঝামেলা করে এসে বেদম পিটিয়েছিল আমাকে। নেশার ঘোরে বলা কথায় বুঝেছিলাম, ওরা আমাকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে। কান্নাকাটি করতেই, কাকী বোঝাতে লাগল, “তুই একা নাকি। আরও কত মেয়ে যাচ্ছে। বড়ো শহর, বড়ো কাজ। অল্প খাটনি, অনেক টাকা। লাইফ একেবারে সেট!”

অনেক চেষ্টাতেও যখন আমি রাজি হলাম না, তখন কাকী আর দিদি মিলে খুব মারল, একদিন খেতে না দিয়ে ঘরে আটকে রাখল। বুঝলাম যে-করেই হোক পালাতে হবে আমায়। কিন্তু পালাতে গেলেও তো টাকা চাই। ব্যাঙ্কের বই আমফানে উড়িয়ে নিয়েছে, ‘শিক্ষাশ্রী’ আর ‘কন্যাশ্রী’-র টাকা তোলার কোনো উপায় দেখছি না। স্কুলও বন্ধ, টিচারদের কাছে সাহায্য নেব সেই সুযোগও নেই। এদিকে প্রমাণ ছাড়া তো থানায় আসাও মানা, সে আমি বাবার কেসের সময় খুব বুঝেছিলাম।

কাকাদের হাতে রোজ মারধর গালিগালাজ খেতে খেতে কীভাবে কাটিয়েছি সে আমিই জানি। তাই শেষমেষ আজ ওদের রাতের খাবারে কীটনাশক মিশিয়ে দিয়েছি। খুব অল্প মাত্রায়। বড়ো চাষি ওরা, ওটুকু বিষ জোগাড়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন সবাই খুব বমি করছে। বিষটা খুব ধীরে কাজ করে। ভোর হতে এখনও দেরি, তাই এই কথাগুলো গুছিয়ে রেকর্ড করলাম।

এবার ফোন করব হাসপাতালে। তারপর যাব থানায়। না স্যার, আমি ফেরার আসামি হব না। কারণ, আমি জানি, বাইরের দুনিয়ার থেকে এই মুহূর্তে জেলই আমার সবচেয়ে নিরাপদ ঠিকানা হতে পারে। ভাবছেন হয়তো, এলামই যদি তবে কেন আগে এলাম না থানায়? কী হত স্যার, বিনা প্রমাণে আপনারা বিশ্বাস করতেন আমায়?

দু-দিন আগেও ১০০ নাম্বারে ডায়াল করেছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম আমায় ওরা পাচার করে দিচ্ছে— কেউ পাত্তাই দেয়নি। তাই এবার ভাবলাম, বড়ো কিছু করে তবেই আসব আপনাদের কাছে।

জেলে শুনেছি খাওয়া-থাকা-কাজের পাশাপাশি লেখাপড়ারও সুযোগ মেলে। দেবেন আমাকেও লেখাপড়ার সুযোগ? আমার বড়োলোক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। দাদার মতো ভুল পথে গেলে হাতে যা টাকা আসত তাতে দামি জীবন পেতে পারতাম, মায়ের মতো পালিয়ে গেলেও হয়তো পেতাম। কিন্তু আমি সারাজীবন সরল সিধা বাবার মতো হতে চেয়েছি। আমার সেই ভালো মানুষ বাবা, যে বলত আমাকে বড়ো হয়ে অফিসার হতে হবে। দেবেন আমায় বড়ো হতে?

সাব-ইন্সপেক্টর মিঃ ঘোষের সঙ্গে দু-জন কনস্টেবলকে সিটি হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়ে এবং অডিয়ো ফাইলটার দুটো কপি করতে বলে মাইতিবাবু প্রতিমার কাছে গেলেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এত অল্পবয়সি মেয়ে এমন মরিয়া হয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে! কেসটা ভালো করে স্টাডি করতে হবে।

— খেয়েছ কিছু?

শান্ত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রতিমা মাথা হেলালো। তারপর বলল, “আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন না তো?”

— বলছি, তার আগে বলো এই ফোনটি কার?

‘কাকীমার’ বলেই হাতজোড় করে তাড়াতাড়ি বলে উঠল “ওদের কিছু হবে না স্যার। ওরা হাসপাতালে আছে। বেঁচে যাবে। কিন্তু দয়া করে ওদের কাছে ফিরে যেতে বলবেন না স্যার।”

— তুমি জানো, যা কিছু তুমি বলেছ তা যদি সত্যি হয় তবে বেশ কঠিন সাজা হবে তোমার।

ইন্সপেক্টর মাইতিকে অবাক করে দিয়ে প্রতিমা বলল, “জানি। সাজা না হলে জেলে থাকব কী করে?”

— তুমি জেলে থাকতে এত আগ্রহী! স্ট্রেঞ্জ! তোমার একটুও ভয় করছে না?

শান্ত দৃষ্টিতে প্রতিমা কিছুক্ষণ ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর পায়ের আঙুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে কেটে কেটে বলল, “ভয় করছিল বলেই তো আপনার কাছে এসেছি।”

আর্কাইভে যেতে যেতে আর একবার প্রতিমার দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর মাইতি। শেষ বিকেলের অদ্ভুত এক জেদি আলো শ্যামলা মুখটায় পড়েছে। আর্কাইভে ঢুকতে ঢুকতে বার বার তাঁর মনে হচ্ছিল এটা বোধহয় দামোদর মাঝির কেসের লিঙ্ক। দ্রুত হাতে ফাইলের স্তূপ ঘাঁটতে লাগলেন তিনি। এই অঞ্চলে এমন কিছু কাজের চাপ থাকে না। দু-একটা চুরি কিংবা মোলেস্টেশনের কেস আসে অবশ্য। কাঙ্ক্ষিত ফাইলটি খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরি হল না তাঁর। মাত্র দেড় মাস আগের সুইসাইডের ঘটনা। মেয়েটির বয়ানের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। সুইসাইড নোটের খোঁজে খানাতল্লাশি চালিয়ে সেরকম কিছুই মেলেনি তাঁদের, তবে মাইতি বাবুর হাতে এসেছিল একটা পাতলা নোটবুক। ফাইলের মধ্যে সেটিও আছে। এতদিন খুলে দেখার দরকার পড়েনি, তবে আজ দেখলেন। এটি প্রতিমা মাঝির কবিতার খাতা।

পড়তে পড়তে তিনি বুঝলেন এতে প্রতিমা শুধু কবিতা নয়, স্বপ্নেরও চাষ করেছে। অপটু কাঁচা হাতে লেখা ছন্দহীন লাইনগুলোর পরতে পরতে ভাষার জড়তা স্পষ্ট। তবে তাতে বক্তব্যের আড়ষ্টতা নেই। ভাঙা টালির ফুটো দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদকে হয়তো দশ টাকার কয়েনের মতোই লাগে, তবে তাতে জোছনার বন্যা আটকানো যায় না। এ যেন তেমনই।

ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বহু বছর আগে ফেলে আসা এমনই কিছু স্মৃতি হুড়মুড় করে মাইতিবাবুর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল।

সেই স্মৃতিতে আছে, জলপাইগুড়ির এক মলিন বোকাসোকা যুবকের ছবি— নিজের বাড়ি থেকে যাকে অন্যায়ভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ভিন জাতে বিয়ে করার দোষে। আর আর এক বাড়ি থেকে কেস দেওয়া হয়েছিল তাদের নাবালিকা মেয়েকে ফুসলিয়ে পালিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

স্ত্রীর সঙ্গে আলাদা হয়ে একা জেলের কুঠুরিতে বসে বসে ছেলেটি কেবল নিজের দোষ খুঁজত।

“মিনতিকে একবার দেখতে দেবেন না, স্যার?”— প্রথম দিকে এর উত্তরে “ও বাড়ি চলে গেছে” বলে কাটিয়ে দিলেও, দিনের পর দিন একই প্রশ্নে বিরক্ত জেলার তাকে বেধড়ক মারধর করত। তবু প্রশ্ন করা থামাত না সে। আদালত চত্বরে একশো পুলিশের ঠেলাঠেলি সত্ত্বেও মিনতি তার হাত জড়িয়ে কেঁদে উঠেছিল— “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না গো। আর পেটেরটাও যে রাক্ষুসে খিদে নিয়ে আছড়িপিছড়ি করছে। তুমি না থাকলে…” ওই শেষবারের মতো দেখেছিল পানপাতার মতো মুখের ছোটোখাটো মেয়েটিকে। যাকে বড়ো ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে।

আর সেই ভালোবাসার দিব্যি কেটেই যুবকটি বিশ্বাস করত মিনতিরা তাঁর জন্য কোথাও-না-কোথাও নিশ্চয় আছে। তাই হয়তো প্রতিবার মার খাওয়ার পরে সে চিৎকার করে উঠত, “আমি কি বিনা দোষেই সাজা কাটব, স্যার! একটা সুযোগ দিন। নইলে জেল ভেঙে পালিয়ে যাব ঠিক। মিনতিকে একটিবার দেখে আসি, পাকাপাকি একটা দোষ না হয় করেই আসি।”

বিড়বিড় করতে করতে কতবার সে জেল পালিয়ে মিনতির জানলায় দাঁড়াত, কতবার সে ভাবত জেলই যখন হল তখন বিনা দোষে কেন হল! কতবার যে তার আঘাতের গায়ে আলো ছড়িয়ে চাঁদ ডুবে যেত কালো রাতের বুকে। তবু প্রশ্ন করা থামাত না সে। যাকে সামনে পেত একই কথা বার বার বলত, “বলো না গো, আঠারো বছর পুরলেও কি মিনতি আমার হবে না? ও যে আমার বিয়ে করা বউ গো।” কেউ বলত প্রেমে পাগল হেয়ে গেছে ছোকরা, কেউ বলত আকাট বোকা, মূর্খ লোক। যে যা-ই বলুক, সে জীবনের শেষদিন অবধি এ-কথাই বিশ্বাস করেছিল হয়তো-বা তার অন্তহীন প্রশ্ন করার বোকামিটাই তাকে তপনবাবুর নজরে ফেলে দিয়েছিল।

আর সে-জন্যই কলকাতা শহরের হাজারটা কেসের ভিড়ে তার হেরে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, বাতিল হওয়া কেস আবারও দিনের আলো দেখল। বাকিটা ইতিহাস।

বউ-ছেলেকে ফিরে পেয়ে যেন পৃথিবী জিতে নিয়েছিল সে। ভেসে যাওয়ারই কথা ছিল তাদের। কিন্তু তপনবাবুর মতো সজ্জন ব্যারিস্টারের নেক নজরই তাদের মুঠোয় খড়কুটো জুটিয়ে দিল কোনো যাদুবলে মোটর গ্যারাজে কাজ পেল সে। মেকানিক-কাম-দারোয়ান। মালিকের কৃপায় গ্যারাজের কোনায় পাতা হল সংসার। যাতে সম্বল বলতে ছিল তাদের সততা, মুক্তির স্বপ্ন আর শান্তি বলতে ছিল একটা ডায়রি। ছেলেকে দিবারাত্র মুড়ে রাখা নিরাপদ কাঁথাটায় বাপের স্বপ্নের নকশাগুলোর খোঁজ, যদিও মিলেছিল বহু বছর বাদে। ততদিনে সেই জেলখাটা মোটর মেকানিকের ছেলে ইন্সপেক্টর হয়ে গেছে।

ইতিহাস কি এভাবেই বার বার ফিরে আসে, মানুষের সামনে আয়না হয়ে?

থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথেও প্রশ্নটা তাড়া করছিল মাইতিকে। আরও একজন কয়েদির পালভাঙা জীবনে কি আর একটা তপন সিনহা হাল ধরতে পারেন না!

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল হঠাৎ। গাড়িটা একটু আগেই জ্যামে আটকে ছিল। আনলক ফেজ শুরু হতেই রাস্তায় ভিড় বেড়েছে। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা প্রতিমা যেন হঠাৎ একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। পেছনের তারজালি আঁটা শার্সিতে মুখ চেপে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে কি! ইন্সপেক্টর মাইতি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালেন। গাড়ি তখন শম্বুক গতিতে পার হচ্ছে ‘নেতাজী বালিকা বিদ্যামন্দির’। ছ-মাস ধরে সব স্কুল বন্ধ। গেটের ভেতর থেকে এক বিরাট ছাতিমগাছের মাথা বেরিয়ে আছে। রাস্তা থেকে স্কুলের সামনেটায় ধুলো আর আগাছা ভরে গেছে। তারই মধ্যে শান্ত পাহাড়ের মতো নির্লিপ্ত ঔদাসীন্য নিয়ে স্কুলবাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে দেখার মতো কিছুই নেই। তবু সেটা থেকে প্রতিমার পলক পড়ছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অপলক দেখেছে সে।

— “কী রে, এটা তোর স্কুল?”

প্রশ্নটা বোধহয় শুনতে পেল না প্রতিমা। নাকি অস্ফুটে বলল কিছু! মুখে চেপে বসে থাকা কালো মাস্কে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলেন না মাইতিবাবু। কিন্তু ওর চোখের দিকে চেয়ে তিনি স্থাণু হয়ে গেলেন। প্রতিমার ডাগর দু-চোখে তখন যেন শুষে নিতে চাইছে বাইরের পৃথিবীর সবটুকু আলো, সবটুকু হাসি, সবুটুকু স্বপ্ন।

“একদিন এখানে ঠিক ফিরে আসব”— বাঙময় চোখের ভাষা পড়তে ভুল হল না ইন্সপেক্টর মাইতির।

এমন উজ্জ্বল চাহনির জেদি পরিন্দাকে আইনের খাঁচায় পুরে ডানা কেটে ফেলবে, পুলিশ ভ্যানের ক্ষুদ্র তারজালির এত সাধ্যি কোথায়! প্রতিমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে শক্ত চোয়ালে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখতে লাগলেন তিনি।

Categories
2021-Aug-Story

অলোকপর্ণা

রাজু ও নোনতা লোক

লোকটাকে ঠিক বাবার মতো দেখতে। রাজু লক্ষ করে দেখেছে। রোজ সকালে নোনতা মুখে রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে চলে যায়। অর্থাৎ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে লোকটার চলে যাওয়া দেখে রাজু প্রতিদিন। লোকটা যায়, কিন্তু ফেরে না। রাজু তার ফিরে আসা দেখেনি কোনোদিন। রাজু জানে লোকটাকে চলে যেতে কেমন দেখতে লাগে, লোকটার ফিরে আসা কেমন— রাজু জানে না। রাজুর বাড়ির সামনের দিয়ে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা সকাল সকাল শুধু চলেই যায়, ফেরে না।

কোথায় যায়? নিশ্চয়ই কাজে। কীসে যায়? ট্রেনে নিশ্চয়। স্টেশন তো বাঁ-দিকেই। যে-সময় লোকটা নোনতা মুখে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যায়, সে-সময় স্টেশনে গেলে আপ বনগাঁ লোকাল আর ডাউন শিয়ালদা লোকাল বারো বগি আসে পরপর। লোকটা হয়তো শিয়ালদা যায়। লোকটা হয়তো বনগাঁ যায়। রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা রোজ সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে দ্রুত হেঁটে যায়।

লোকটার চারটে জামা, সবক-টা হলদেটে। লোকটার দুটো ফুল প্যান্ট, একটা খয়েরি, একটা ধূসর। লোকটার খয়েরি চামড়ার জুতোজোড়া মাসে দু-বার পালিশ হয়। হাতের রুপোলি চেনের ঘড়ি লোকটার পিঠে থেকে থেকে চাবুক মারে। লোকটার চুল ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে পাট করে রাখা। রোজ সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে স্টেশনে যাওয়ার সময় রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটাকে কেউ বলে না, যে-হলদে রং তার গায়ে বেমানান।

রাজু লোকটাকে দেখে এসে কলতলায় মুখ ধুয়ে ফেলে। তারপর মাঝে মাঝে মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দেওয়ালে নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবার ছবি ১৯৮৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর থেকে ঝুলছে। নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবা কোথাও যায় না, না ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে, না বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে, শুধু ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। নোনতা মুখে।

¬¬তার পাশেই ইদানীং মায়ের ছবিটা, যা রাজু লক্ষ করে না। মায়ের বেশি বয়সের ছবির পাশে বাবার অল্প বয়সের ছবি বসবাস করতে করতে বাবাকে একসময় মায়ের ছোটোভাই বা যুবক বয়সে হারিয়ে যাওয়া ছেলের মতো দেখায়। হয়তো নকশাল আমলে পুলিশের গু খেয়ে মৃত। অথবা পথদুর্ঘটনায়। অর্থাৎ, পথদুর্ঘটনায়।

রাজুর আর মনে থাকে না, নোনতা লোকটার মতো দেখতে মানুষটা রাজুর বাবা। মায়ের ছোটো বয়সে হারানো ভাই বা ছেলের মতো, নোনতা লোকটার মতো দেখতে রাজুর বাবার ছবি রাজুদের দেওয়াল থেকে ঝুলে থাকে। রাজু ছবিদের ঝুলে থাকা দেখতে দেখতে সকালের চা খায়।

আর ভাবে, এখন নিশ্চয় লোকটা দমদম ক্যান্টনমেন্ট, অথবা বামুনগাছি।

অথবা বৃষ্টির কারণে ট্রেন লেট করায় ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মনে কান খাড়া করে রেল লাইন দেখছে।

লোকটার অপেক্ষা ভাবতে গিয়ে রাজু গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিভ আংশিক পুড়িয়ে ফেলে।

কোনোদিন সকালে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যাওয়ার সময় লোকটা ব্রাশমুখে রাজুকে লক্ষ করে না। কোনো দিকে না তাকিয়ে স্টেশনের তরফে নোনতা মুখে ধেয়ে যায়। লোকটার মুখ সকাল সকাল নোনতা হয় কীভাবে? লোকটার বউ অভিযোগ করে না এই নিয়ে? কেন হররোজ লোকটা নোনতা মুখে ঘর থেকে বেরোয় আর ফিরে আসে না? রাজু নিজের মনেই গুম হয়ে থাকে। রাজু জানে না লোকটাকে হাসলে কেমন দেখায়। রাজু তবু জানে লোকটাকে হাসলে কেমন দেখায়।— বাবার মতো। এভাবেই রাজু জানে লোকটাকে কাঁদলে, রাগ করলে, কষ্ট পেলে কেমন দেখতে লাগে। তবু রাজু জানে না। রাজুর বেশি বেশি জানতে লোভ হয়।

একদিন সকালে রাজুর বাড়ির সামনের রাস্তায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আর ঠিক সেই সময়েই ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে হেঁটে যাচ্ছিল বাবার মতো দেখতে লোকটা। প্রবল বর্ষায় দুটো পথকুকুরের সাথে লোকটা তার নোনতা মাথা বাঁচাতে রাজুদের খোলা বারান্দায় আশ্রয় নিল।

রাজু বলল, “ভিতরে এসে বসতে পারেন,”

লোকটাকে ভেলকি দেখাবে বলে রাজু নিয়ে এল তার মায়ের ঘরে, যেখানে দেওয়াল থেকে মায়ের পাশাপাশি যুবক বাবার ছবি লেগে আছে। লোকটা চুপ করে বসল চেয়ারে। খয়েরি প্যান্টটা পরেছে সে আজ, তারই পিছনের পকেট থেকে আরও খয়েরি একটা রুমাল বের করে মাথা, কপাল, দুহাত থেকে জলকণা মুছে নিল। রাজু বলল, “চা খাবেন?”

“না না, দরকার নেই,”

“আমি খাব এখন, আপনার জন্যেও আনি,”

রাজু মন দিয়ে চা করে। বেশি বেশি চিনি দেয়। লোকটার হাতে সেই চা পৌঁছে দিয়ে দেওয়ালের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে এমনভাবে যাতে যে-কেউ ভদ্রতাবশত প্রশ্ন করে, “আপনার বাবা মা?”

“আপনার মা বাবা?”, নোনতা লোকটা জানতে চায়।

রাজুর চোখ চকচক করে ওঠে। নোনতা লোকটা এবার নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে, যখন সে বুঝবে তাকে হুবহু রাজুর বাবার মতো দেখতে। রাজু প্রতিক্ষা করে।

“আপনার মা বাবা?” লোকটা আবার সহজ প্রশ্ন করে, অবাক হয় না।

রাজু উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, আমার বাবা অহিভূষণ সরকার, মা উমা সরকার। বাবা কর বিভাগে কাজ করতেন। ১৯৮৫ সালের ১লা ডিসেম্বর তিন দিনের জ্বরে মারা যান।” বলে রাজু ফের নোনতা লোকটার অবাক হওয়ার অপেক্ষা করে। তবু লোকটা অহিভূষণ সরকারের সঙ্গে নিজের মুখের মিল খেয়াল করে না।

রাজু চুপ করে চায়ে চুমুক দেয়, প্রতি চুমুকে সে আশা করে লোকটা এইবার তার বাবার সাথে নিজের মুখের মিল টের পাবে। বাইরে বৃষ্টি উত্তরোত্তর বাড়ছে। রাজু জানে ছাদের ফাটা জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়া আরম্ভ হবে এবার।

এই সুযোগ, অহিভূষণ সরকারের ছবির সামনে লোকটাকে বসিয়ে রেখে রাজু উঠে দাঁড়ায়, “আপনি বসুন, আমি বালতি নিয়ে আসি।”

দু-হাতে দুটো বালতি আর একটা মগ নিয়ে ফিরে সে দেখে লোকটা এখনও চুপচাপ চা খেয়ে চলেছে।

ঘরের তিনটে জায়গায় নিপুণ লক্ষ্যভেদে দুটো বালতি ও একটা মগ রেখে দিয়ে রাজু চেয়ারে এসে বসে। কাছ থেকে লোকটাকে দেখতে সহজ লাগছে রাজুর। হলদে জামা খয়েরি প্যান্ট। হাতের রুপোলি ঘড়ি। লোকটার নখগুলো দেখে রাজু। কেজো নখ। না ধূর্ত, না ভোঁতা। রাজু আরাম পায়। এতদিনে কাছ থেকে লোকটার আগাপাশতলা সে দেখতে পাচ্ছে। আরামে রাজুর আনন্দ হয়, সে বলেই ফেলে, “আপনার সাথে কিন্তু আমার বাবার মুখের খুব মিল,”

লোকটা অন্যমনস্ক ছিল, ফিরে এসে অবাক চোখে বলল, “তাই?”

রাজু বুঝল লোকটা অবাক হওয়ার ভাণ করছে, আসলে অবাক হয়নি। লোকটা এখন রাজুর বাবাকে মন দিয়ে দেখার ভাণ করছে। লোকটা এখন নিজেদের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়ার ভাণে মাথা নাড়ছে। বালতি আর মগে জল পড়ার টপ টপ আওয়াজ শুরু হল।

লোকটার মুখ এখন আর নোনতা নয়, মিঠে লাগছে রাজুর। চিনির প্রলেপ দেওয়া। মেকি। উগ্র গন্ধ পারফিউম যেমন ফুলের গন্ধের ভাণ করে, লোকটা তেমন অবাক হওয়ার ভাণ করে রাজুর সকালটা একটু একটু করে চালাক করে দিচ্ছে।

একটা চালাক বৃষ্টির সকালে অবাক হতে চাওয়া একটা লোকের সামনে বসে আছে রাজু, হাতে চায়ের কাপ। চা খাওয়া শেষ, দূরে বালতিতে ছাদ ফেটে বৃষ্টির জল জমা হওয়ার শব্দ। দেওয়ালে রাজুর সদ্যপ্রয়াত মা, এবং অহিভূষণ সরকার।

এর মধ্যেই লোকটা চায়ের কাপ হাতে উঠে দাঁড়াল। ভাণ করল রান্নাঘর খোঁজার, বলল, “কোথায় রাখব,”

“আমাকে দিন” বলে রাজু হাত বাড়ালো আর লোকটার চামড়া ছুঁয়ে দিল তার হাত।

রাজুর চোখে মুখে চড় চড় করে একটা বাজ পড়ল। রাজু টের পেল— লোকটারও তাই।

রাজু দাবার ঘুটির মতো হিসেবি পায়ে রান্নঘরে এসে চায়ের দুটো কাপ পাশাপাশি নামিয়ে রেখে আবার অংকের মতো হিসেব করে করে মায়ের ঘরে ফিরে এসে দেখল লোকটা এখনও বজ্রাহত স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

রাজু যেভাবে তাকে রেখে গেছিল, সেভাবেই।

কাছাকাছি ফের বাজ পড়ল কোথাও।

রাজুর ঠোঁটের ভিতর লোকটার নোনতা ঠোঁট মিশে যাচ্ছে। রাজুর পেশিতে পেশিতে লোকটার বাজ পড়ছে। বালতিতে টপ টপ করে রাজুরা জমা হচ্ছে। অহিভূষণ সরকার এবং উমা সরকারের ছবির সামনে নোনতা লোকটা রাজুকে গিলে ফেলছে টপাটপ। রাজু জোর টান মেরে লোকটার হলদে শার্ট চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল।

বোতামেরা মাটিতে কিছুক্ষণ লুটোপুটি খায়। দূরে জল পড়ার টপ টপ শব্দ হতে থাকে।

রাজুর দুনিয়া নোনতা হয়ে যায়।

লোকটাকে খানিকটা বাবার মতো দেখতে, হুবহু নয়। রাজু বোঝে এখন। রোজ সকালে নোনতা মুখে রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে এখনও চলে যায়। দাঁত ব্রাশ করতে করতে লোকটার চলে যাওয়া দেখে রাজু প্রতিদিন।

কোথায় যায়? নিশ্চয়ই কাজে। কীসে যায়? ট্রেনে নিশ্চয়। স্টেশন তো বুকের বাঁ-দিকেই। যে-সময় লোকটা নোনতা মুখে ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে যায়, সে সময় স্টেশনে গেলে আপ রাজু লোকাল আর ডাউন রাজু সরকার লোকাল বারো বগি আসে পরপর। লোকটা হয়তো রাজুতে যায়। লোকটা হয়তো রাজুতে আসে। রাজুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে নোনতা লোকটা একবারও রাজুর দিকে ফিরে তাকায় না।

লোকটা এখন তিনটে হলদে জামা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। লোকটার দুটো ফুল প্যান্ট, একটা ধূসর, একটা খয়েরি— যাতে সেদিন রাজু লেগে গেছিল। রোজ সকালে, ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে নোনতা মুখে চোয়াল শক্ত করে স্টেশনে যাওয়ার সময় রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটাকে কেউ বলে না, রাজু তাকে হাঁ করে দেখছে।

লোকটা যায়, কিন্তু ফেরে না। রাজু তার ফিরে আসা কোনোদিন দেখেনি। রাজু জানে লোকটাকে চলে যেতে কেমন দেখতে লাগে, লোকটার ফিরে আসা কেমন দেখায় তা রাজু জানে না।

সেই যে একদিন এসেছিল, তারপর রাজুর জীবন থেকে দূরে, আরও দূরে রাজুর বাবার মতো দেখতে লোকটা সকাল সকাল শুধু চলেই যায়, রাজুর কাছে কোনোদিন ফিরে আসে না। আসবে না।

রাস্তায় আকাশ ভেঙে পড়লেও না। কাছে-দূরে কোথাও বাজ পড়লেও না। রাজু রাজুতে মিশে থাকে। এখনও নোনতা হয়ে থাকে।

মুখ ভরা পেস্টও নোনতা হয়ে যায়। মুখ ধুয়ে ফেলতে ফেলতে রাজু ভাবে– “আজকাল সবাই টুথপেস্টে নুন দিচ্ছে নাকি রে বাবা”

Categories
2021-Aug-Story

ঝুমুর পাণ্ডে

ভিখারি বুড়োউয়া

এক

বলবেন নাই বাবু কাল হামি দুইটা মার্ডার করলাম।

মার্ডার?

হঁ বাবু তার বাদে নিজেও মার্ডার হইলাম।

ভোটবাবু পান চিবোতে ছিল। এখন সব পানসুপুরি গলায় আটকে গেল। আজকাল সব দামি দামি গাড়ি চলছে এই জংলা রাস্তা দিয়ে। আহা রে কত রঙের, কত কিসিমের গাড়ি, ভোটপরব বলে কথা। কত মানুষ এখন বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে। শ্যামবতীর ঘরের মদ ছেড়ে বিলাতি ঢালছে গলায়। তবে অবশ্য বিলাতি এক দু-জনের ভাগ্যেই জুটছে। জুটুক। বিলাতি মালে কি আর নেশা হয়? আর ঠিকমতো নেশা না হলে আর খাওয়া কেনে?

হঁ ভালা।

হঁ ভালা খাওয়া কেনে?

নিজের মনে মনেই দু-তিনবার আওড়াল ভিখারি।

হই দেখ ভিখারি বুড়োউয়া যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো আবার বলে— ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। বুড়োউয়া বলছিস। ব্যাগ কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল ভিখারি। কী বললিস। বুড়োউয়া? হামি বুড়োউয়া। তোদের মাই বুড়োউয়া বাপ বুড়োউয়া। তোদের চৌদ্দোগোষ্ঠী বুড়োউয়া। বুড়োউয়া বলছে। বয়স হামার দুই কুড়িও হইল নাই বুঝলিস। হামার দাঁতে সোহাগা লাগাইছিলি ওই রামধনীর মায়ের কথায়। হই যে পাতি তোলে রামধনীর মা। হঁ। দাঁত একটায় দরদ হতেছিল। হ্যাঁ সত্যিই রোজ ভেরেন্ডার কষ দিয়ে দাঁতন দিয়ে ঘষত তবুও। আর সোহাগা লাগাতেই দাঁতগুলো নাকি পড়ে গেল সব খসখস করে।

তখন বাচ্চাগুলো বলত পিছু পিছু— ফোকলা বুড়হা যাচ্ছে। ফোকলা বুড়া হুতোমপেঁচা। আর বাচ্চাগুলোর দোষ কী? ওদের সব শিখিয়ে দেয় ওই যে নকলা! নকলা রিকিয়াসন। যেমন একবার বাসন্তীর মাকে বলার জন্য শিখিয়েছিল বাচ্চাদের। ওকে দেখলেই বাচ্চাগুলো বলত—

বাসন্তীয়াকে মায়ি

শাগ রোটি খায়ি…

তবে রাগত না বাসন্তীর মা। উলটে সবাইকে দাঁড়িয়ে বলত— দে লেইকন দে। শাক রোটি দে। খাইব।

বড়ো হাসিখুশি থাকত এই বাসন্তীর মা। জঙ্গল থেকে মাটি খুঁড়ে জংলি আলু আনত। জংলি বেগুন আনত। আনত কচু শাক। বাবুভাজি। কিন্তু একবার রক্ত আমাশা হয়ে মরে গেল বাসন্তীর মা। বাসন্তীরও জানি কোথায় বিয়ে হয়ে গেল।

ভিখারির প্রায় কাঁধ ঘেঁষে একটা গাড়ি চলে গেল। একটু হলেই মরত। কী গাড়ি কী জানি। আজকাল তো কত কিসিমের গাড়ি। সব গাড়ির নামও জানে না ভিখারি। আগে তো ওই বাস, ট্রাক আর জিপগাড়ি। সাহেবেরও একটা জিপগাড়ি ছিল। কখনো কখনো ওকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে হত। ভিখারিও কত বার ধাক্কা দিয়েছে। কখনো কখনো বাসগাড়িও বড়োরাস্তায় খারাপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে বাচ্চারা ছুটত ধাক্কা দিতে। ওই ধাক্কা মারাটাই একটা বিরাট মজা ছিল ওদের কাছে। অনেকক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পর গাড়িটা যখন চলতে শুরু করত তখন আহা রে কী যে আনন্দ হত, মনে হত যেন কত বড়ো যুদ্ধ জয় করল। তবে যুদ্ধ আর কোথায় দেখল ভিখারি। ওই যাত্রা দেখতে গিয়ে দেখত। ওরা অবশ্য গান বলত, কেউ নাচও বলত। বগলে পিঁড়ি নিয়ে মা যেত মাথায় চুপচুপ করে গন্ধ তেল মেখে। সর্দার সুমন্ত তখন লাঠি দিয়ে বলত হেই হাল্লা। হেই হাল্লা। স্টেজে তখন পেট্রোমাক্স বাতির আলোয় যুদ্ধ চলত। আহা রে তরোয়াল নিয়ে সে কী যুদ্ধ। একবার তো ওই যুদ্ধ করতে করতে রাজার ধুতি খুলে গেল। ওই যে পোস্টমাস্টার ছিল গো কী যেন নাম বউয়ের বিয়ের বেনারসি শাড়ি এনে ধুতি করে পরে রাজা সেজেছিল। সে আর এক বৃত্তান্ত। নিজেরাও চুরি করা আলতা, সিন্দুর ঠোঁটে গালে মেখে গাছের ডাল দিয়ে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলত। সে কী আনন্দ। সে কী উত্তেজনা। ওইরকম খেলতে খেলতেই একদিন খবর পেল চা ঘরে মেশিনে পাতি ঢালতে ঢালতে বাপের হাত ঢুকে গেছে মেশিনে। ওই দিনের কথা মনে হলে এখনও গা-টা থরথর করে কাঁপে। মা তখন চলে গেছিল বাপের ঘরে। আবার একটা গাড়ি হুস্ করে গেল। বড়োরাস্তা দিয়ে। এখন আল ধরে হাঁটছে ভিখারি। দুটো বাচ্চা ছেলে ওদিকে কাঁকড়ার গর্তে হাত ঢুকিয়েছে। একজন হাত দিয়ে টেনে একটা কাঁকড়া বের করে আনল। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া।

তোদের মা বুড়োউয়া। বাপ বুড়োউয়া।

বাচ্চাগুলো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে।

হামি বুড়হা লাগি?

তোর চুল যে গো ধলা। দাঁতও নেই একটাও।

সত্যিই জন্ম থেকেই ভিখারির চুলটা সাদা। মানে একদম রুপালি রং। গায়ের রংটা আবার কালো। কে জানে কার কোন সাহেবের জিন বহন করছে ভিখারি। এদিকে মানে এই চা বাগানে অনেকের রং কালো। সোনালি চুল। কেউ সাদা রং নিয়ে জন্মেও পরে রোদে-জলে কাজ করতে করতে রংটা কেমন তামাটে হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো এখন আর একটা কাঁকড়া বের করল। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। না— এদের সঙ্গে মুখ চালিয়ে আর লাভ নেই মিছেমিছি। ওদিকে কাজললতা তুলছে পরাণের মা। ছেলাগিলান বহুত বদমায়েশ হয়েছে হঁ। দেখনো কেমন বুড়োউয়া বলছে। হামি বুড়োউয়া লাগি। তুহেই বলনো গো?

আরে তোর জনম দেখলি। তোর ধাই কলৌতি এখনও বাঁচে আছে। নিজের হাতে রান্ধাবাড়া করে খাছে। বলনো ভালা। আর তোখে মানুষ… কাজললতাগুলো এখন শাড়ির আঁচলে বেঁধে নিচ্ছে পরাণের মা। রোদটা এখন বেশ তেতে উঠেছে। পরাণকে বললাম যা জালটা লিয়ে। দুটা পুটি চিংড়ি ধরে আন। হামি কাজললতা লিয়ে আসছি। বাকিন যেই উ বাহরাইল একটা ভুটের গাড়ি উওয়াকে উঠায় করে লিয়ে গেল।

এ মা কাঁহা গেল গো?

কী জানি বাবা। কাল তো পয়সা পায়ে একটা মুরগি কিনেছিল।

খাইলি?

নাই। নাই। রান্ধার বাদে ওই ভুটের ইয়ার গিলানেই সব খায়ে লিল।

এ মা?

হঁ বাদে হামি তো খালি ঝোল দিয়ে ভাত খাইলি।

বাচ্চাগুলো আবার বলছে ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া।

বল বল কত বলবিস বল? ওদিকে এখন গান গেয়ে গেয়ে আসছে শ্যাম রবিদাস।

সারাদিন রোজি করলি

এক রুপিয়া পাইনু হো

দাদা হো তেনি সাদা দা।

এখন কোনে এক রুপিয়ার যুগ আছে গো? ব্রিটিশ যুগের গান বলছিস? শ্যাম রবিদাসের এ-সব কিছুই কানে ঢুকছে না। আবার গাইছে আরও জোরে জোরে—

বারো আনা কে চাওল কিনলু

চার আনা কে দাল হো

দাদা হো তেনি সাদা দা…

এই শ্যাম রবিদাসের চারা বাড়ির কাছে কিছু জমি ছিল চা বাগানের ইংরেজ সাহেবের দেওয়া। কিন্তু এই দেশি সাহেব কয়েক বছর আগে সব জমি হাতিয়ে নিল। একটা ঘোড়া ছিল ওটাও মরল। বউও বিছানায়। হাঁটতে পারে না। এইসব দুঃখেই বোধহয় শ্যাম রবিদাস সবসময় গান করে। রাতে ঢোলকও বাজায়। তখন ওর সাঙ্গপাঙ্গরাও জড়ো হয়। আগে শীতটা যাব যাব করলেই সেই ফাগুন মাসে একজন হিজরা এসে ওর ঘরে থাকত। লম্বা বিনুনি ডান হাতে দুলাতে দুলাতে বাঁ-হাত কোমরে রেখে নাচত আর ভাল লাগে না বাবু বান্ধা কবির তরকারি। শ্যাম তখন ঢোলক ছেড়ে হারমোনিয়মের রিড ধরত। ভিখারি তখন বোতাম ছাড়া প্যান্ট এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে কুল খেতে খেতে ওদের পিছু পিছু ঘুরত। আকাশের দিকে তাকালো। অনেক সাদা সাদা মেঘ। দল ছাড়া একটা বক একা একা উড়ে যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে শ্যামবতী দেখি কতটা গুগলি নিয়ে আসছে কচুপাতায় করে— আবার গান গাইছে—

ঝিঙ্গা ফুল উড়িল বাতাসে গো

হাতে ধরি চুমা খাব তোখে

ঝিঙ্গা ফুলে মধু আছে…

গুগলি কাঁহা পাইলিস?

গান থেমে গেল শ্যামবতীর।

হামার মাও বলে গুগলি লিয়ে দিতে।

হঁ তো দিস নাই কেনে লিয়ে? হইতো চারা বাড়ির নালায় কত ঘুরাঘুরি করছে। ঝিনুকও আছে।

সচ বলছিস?

সচ না তো কী? খাকড়িও আছে।

বুড়হা মা চোখে দেখছে না। কতদিন থেকে। তবু শাকপাতা ছিঁড়ে আনে। আনে জংলি বেগুন। চাম কাঁঠালের বিচি কুড়োয়। সবই আন্দাজে। আগে তো জংলি আলু খুঁড়ে আনত জঙ্গল থেকে। খাম আলু, চুন আলু। মা-বেটা মিলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে খেত। বউটা তো আর দুদিনও থাকল না। চলে গেল। আবার কী কাণ্ড। আবার সাঙা করে এখানেই এসেছে। ওই পল্টু চারা বাড়িতে নম্বরে জল খাওয়ায়। ওই পল্টুর সঙ্গেই সাঙা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। লজ্জায় না ঘৃণায় কে জানে। পল্টু অবশ্য দেখলেই বলে কেমন আছ ভায়া? আর কীর্তনেও মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। গাঁজার ছিলিমটা যখন কীর্তনে এক হাত থেকে আর এক হাতে ঘুরে তখন ছিলিমটাও এগিয়ে দেয় পল্টু। পঞ্চায়েতের ঘরে টিভি দেখতে যেত সে অনেক আগে। যখন রবিবারে সারা হপ্তায় শুধু একটা সিনেমা তখন পঞ্চায়েতের ঘরে গিয়ে মাটিতে পাশাপাশি বসে টিভিতে সিনেমা দেখত। কত মানুষ গিজগিজ করত। তবু পল্টু ওর পাশেই বসত। আর আজ কিনা ওর বউকে সাঙা করল? করুক। ওর আর কী দোষ? বউটাই তো ছেডে চলে গেল। আর ঝগড়া না কাজিয়া। যাওয়ার সময় ওর মায়ের রুপার হাঁসলিটাও নিয়ে গেল। যাক। কী আর করা। সব কিছুকে কি ধরে রাখা যায়? কিছু কিছু জিনিস তো এমনি আলগা হয়ে খসে পড়ে। ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। আবার কারা বলছে। কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। ব্যাগ কাঁধে দুটো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ভিখারি। না, কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। বেজন্মার ছেলারা। হেই কে বলছিস বাইরাহ। হঁ বাইরাহ বলছি। কতবার ভাবে ভিখারি মুখ খারাপ করবে না, তবু ওই বুড়োউয়া শুনলেই মাথাটা কেমন চনচন করে উঠে। এক একবার মনে হয় হাতের সুখ মিটিয়ে নেয় দু-চার থাপ্পড় মেরে। যেমন সেই সনৎ মাস্টারের ইশকুলে পড়ার সময় বাচ্চাগুলো বলত দে দে ভিখারি আইসেছে। এক টুকুন ভিখ আনে দে। কেউ বলত— চাল লিবি ন পয়সা লিবি? অন্যরা তখন কেউ হি হি কেউ হো হো কেউ বা হা হা করে হাসত। ওই জন্য শেষে দ্বিতীয় ভাগ পড়েই ইশকুল ছাড়ল ভিখারি। আর যায়নি। সনৎ মাস্টার ঘরে এল। তবু না। বাগানে লেড়কা দফায় কাজে ঢুকল। নম্বরে গেলেই সাথীরা বলত ভিখারি আইল হি হি হি… আর একবার করমপূজায় নাচ হচ্ছিল— সবাই হাত ধরাধরি করে নাচছিল—

পাতি তুললি কিনি কিনি

কলে ওজন দিয়েছি

নয় পণ পাতি ছয় পণ হইল

হায় রে মনের দুখে রয়েছি…

বীরসা বাজাচ্ছিল মাদল। ভিখারি ওর বাঁশের বাঁশিটা নিয়ে গেছিল। যেটা বাগাল বুড়োর সঙ্গে গোরু চরাতে চরাতে বাজাত। এ মা যেই বাঁশিটা বের করল। ওই যে সনাতন আজকাল চারাবাড়িতে চা বানায়। ওই সনাতন বলল ভিখারি আইল। ভিখারি।

এ মা কাঁহা লে বাঁশি মাঙে আনলি রে ভিখারি। বলে, হো হো করে হাসল। ভিখারির মেজাজটা এত খারাপ হয়েছিল। শেষে অতি কষ্টে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। সুধবি তখন গান ধরেছিল—

ফুটেছে শালুকের ফুল

গহন জলে আছে

ও সই আনে দে হামাকে

সুধবির জন্য মনটা আগে কেমন আকুলি বিকুলি করত। কিন্তু পাত্তাই দিত না সুধবি। এখনও দেয় না। মরদটা তো ওর রোজ রাতে মদ খেয়ে হল্লা করে। মারপিটও করে। কোনোদিন সুধবিও দু-চার ঘা বসিয়ে দেয়। বীরসা তখন মাদল বাজায়। আহা রে গহিন রাতে মাদলটা শুনলে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। দাদির কথা খুব মনে পড়ে। টুসু রাখত দাদি। তখন রোজ সন্ধ্যের সময় গান হত। কেউ সাদা মলতে মলতে কেউ পান চিবোতে চিবোতে গান ধরত—

হামদের টুসু মুড়ি ভাজে

শাঁখা ঝলমল করে গো

তোদের টুসু বড়ো বেহায়া

আঁচল পাতে মাঙ্গে গো

ছি ছি লাজ লাগে না

সবাই আবার একসঙ্গে গাইত ছি ছি লাজ লাগে না। দাদি আবার গান বাঁধতেও পারত। টুসুকে নিয়ে ছোটোবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে গাইত—

ছোটোবাবুর ভাঙা ঘরে

ভূতে ঢেলা মাইরেছে

কে দেইখেছে কে দেইখেছে

জনার বেটি দেইখেছে…

চা ঘরে শব্দ হচ্ছে। ফ্যাক্টরি চলছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে চা-পাতার ঘ্রাণ। প্রাণভরে গন্ধটা বুকে ভরল ভিখারি।

ভিখারি বুড়োউয়া। ভিখারি বুড়োউয়া। হই দেখ ভাইলে ভিখারি বুড়োউয়া যাছে। ও তো কারো সাতে পাঁচে থাকে না তবু কেন যে লোকে ওর পেছনে লাগে। কে জানে? এই তো কাল ভোট অফিসের সামনে সাত পাঁচ কথা বলছিল লোকে। শেষে ওই যে নাম হ্যাঁ তো নানকা বলল— কত পয়সা পাইলি এবার ভিখারি?

কীসের পয়সা?

আরে ভোটের পয়সা।

ভোটের?

হঁ ভোটের পয়সা মাঙলি নাই? মাঙলি নাই ভিখারি?

তখন মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারেনি ভিখারি। দু-ঘা বসিয়ে দিয়েছিল। শেষে পচা আর বিকর্ণ আসতে ওদেরও দু-ঘা দিয়েছিল। তাই না ভোটবাবুকে বলছিল কাল তিনটা মার্ডার করলাম বাবু। তবে ওরাও কি আর ছাড়ল? ওরাও বেশ ভালোই মার দিল। এখনও শরীরের ব্যথাটা যায়নি। লম্বা শ্বাস ফেলল ভিখারি। ওর এই ভিখারি নামটা কি ও নিজে ধারণ করেছে! ওর দাদিই না আগের ওর তিন-চারজন ভাই-বোন জন্মের পর পরই মরে যেতে ওর নাম ভিখারি রেখেছিল তাতে ওর কী দোষ? আবার আকাশে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। ওদিকে তাকাল ভিখারি। আহা রে পাখিদের জীবনটা কত সুন্দর। আহা রে ভিখারি যদি পাখি হতে পারত? এখন জঙ্গলের কাছে চাম কাঁঠাল গাছটার নীচে চলে এসেছে। এখানেই তো নানকার কচি মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল কোন নানুষ নেকড়ে আহা রে… আজও ধরা পড়ল না প্রকৃত দোষী। একটু সময় এখানে থম মেরে দাঁড়াল ভিখারি। কত পাখি ডাকছে। এদিক দিয়েই তো পুঞ্জির রাস্তা। যেখানে ভোটবাবুর সেন্টার। জোরে জোরে পা চালায় ভিখারি…

দুই

মার্ডার হয়ে গেল।

কে? কে মার্ডার হল?

ওই যে গো ভিখারি। ভিখারি বুড়োউয়া।

এ মা কে মারল গো ওকে।

এই সাদা-সিধা ভোলাভালা মানুষটাকে?

কী জানি কে মারল।

আহা রে আহা রে…

কিন্তু যে-কারণে মারল ওদের উদ্দেশ্য তো আর সফল হবে না।

কেন? কেন?

আরে ও তো হিন্দুও ছিল না মুসলিমও না বাঙালিও না; বিহারি, অসমীয়া, নেপালি, নাগা, বড়ো, মিজো, মণিপুরিও না।

তবে কী ছিল? কী ছিল ভিখারি বুড়োউয়া? ও তো চা বাগানের লেবার ছিল গো। কুলি।

কুলি মনসার বেটা ভিখারি। ভিখারি বুড়োউয়া। তবে ভুল করে মেরেছে।

হতে পারে! হতে পারে!

আরে গত পরশুই তো ভোটবাবুর ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতেছিল গো।

হ্যাঁ গো হ্যাঁ।

আর পুলিশও ধরল কিনা নিরপরাধ নানকা, পচা আর বিকর্ণকে।

ধুর। ধুর। ধুর।

বীরসা আবার মাদল বাজায়…

সুধবি আবার গান ধরে—

ও ভাই প্রাণের লখন

জানিলে আসিতাম না আর।

পঞ্চবটী বন।