Categories
2021-December-Kobita

নম্রতা সাঁতরা

নদ্যম্বু


আমি জেগে থাকতে চাই,
নুড়ির মতো কিছু ব্যথা নিয়ে
ধারালো আর প্রকট—
ভোঁতা, নরম হতে
তোমার বুকের মধ্যে কিছুদূর ঘুরপাক দরকার।


অনেকটা মরার মতো শুয়ে থাকি
পারের পলি হয়ে।
চাঞ্চল্যর জন্য দরকার
একটু জল,
বর্ষাকালে ফুলে উঠে
পাড় ভাঙবে যখন—
বন্যা হবে, সেই প্রথমবার পলি গুলে যাবে জলে।


এ নিরন্তর হাওয়ার খেলা।
তোমার থেকে আমার দিকে,
আমার থেকেও তোমার।
যে যত ঠান্ডা হয়
তার থেকে হাওয়া বয়।


তোমার সাথে আমার বার্ধ্যক্যদিন এগোচ্ছে,
অনুরাগীরা আসে যায়-
ডুব দেয়, তবু মনে মনে চায় ভেসে উঠতে।
সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় শুধু কাদা।


যতই এগিয়ে চলো,
আঁচড় দাও,
হাঁটো হাজার মাইল।
সাগরের কাছে, রেখে যাওয়ার লোভ,
সাধারণ মজুরের মতো—
তোমাকেও হাত পাততে বাধ্য করে নুনের জন্য।


যারা থাকতে পারে তোমার উপর
তারা বেশির ভাগ আরোপিত,
অসম্মত বিবাহিতার মতো স্পষ্ট হয়ে যায়
মন ও বুকের ফারাক।
মনে ভাসে মাঝি— নৌকা,
বুকের মধ্যে জলাধার।

Categories
2021-December-Kobita

সৌরভ মাহান্তী

দেয়াল

শোক নাকি আনন্দ
কে যে কাকে গোপন করে?

বাইরের যাবতীয় আঘাত, রাখি সযত্নে…

জানালা

খাঁচার ভিতরে ঢুকে থাকিস

সুদিন এলে,
বুকের পাঁজরে সোনা বাঁধিয়ে দেব

ছাদ

মধ্যবিত্ত ফুটপাতের তলায়
জোৎস্না ঝরে পড়ে

যেন না-ছুঁতে পারা বাবার যন্ত্রণা…

উঠোন

তোমাকে মাড়িয়ে যাব এমন সাধ্য কই?

আলপনাতে পা দিতেই
পদবি বানাই লক্ষ্মীছাড়া

মেঝে

বিষ পেতে দিই বুকে

এক্ষুণি তো অবাধ্য শিশুর গ্রাস,
ছিনিয়ে নেবে বেহায়া লোকটি…

তুলসিতলা

নিভে যাওয়াতেই আপত্তি
দিন দিন ভরাট হয়ে উঠুক সংসার

ভুলেও ঠান্ডা করিসনে প্রদীপ

 

 

Categories
2021-December-Kobita

ইন্দ্রজিৎ নন্দী

বাদুড়কলোনি


বাদুড়ের ভালোবাসা সহজেই অনুভব করা যায়
কেন-না, শহরতলির শেষে নগ্ন মৃতপ্রায়
তাদের চিন্তাহীন ঝুলে থাকা!

সম্পর্কের ভিতরে বাড়ে তুমুল সম্পর্কতাপ।
তুমি টের পাও ঢের জীবন বেঁচে থেকে
আর বাদুড়েরা টের পায় কয়েক মুহূর্তে!
যখন অপরপ্রান্ত ভালোবাসায় ধাক্কা লেগে ফেরে আল্ট্রাসোনিক,
তাদের এই ঝুলে থাকা সম্পর্ক শান্তির কিংবা প্রেমের সমধিক।


তোমাকে আমি প্রেমিকা হিসেবে অল্পই চিনি।
যখন যখন রোদ পড়ে আসে প্রেমিক দারুচিনির,
হেমন্ত আঁকা গাছটার নিচে আমাদের দেখা হয়,
সময়টা বোধ’য় খারিফ শস্য কাটার সময়…

মাঠে ধান নেই, ইঁদুরেরা কেটে নিয়ে গেছে ঘরে
ওদিকে ঠোঁটখড় বয়ে ফেরে শালিখ শহরের
মাঠের একপাশে দারুচিনি, অন্য পাশে পিপুলের শান্ত কলোনি।
বাদুড়-মেঘের উলটো দিকে ঝুলে থাকা ন্যাসপাতি ফল যেমন
সেভাবেই আমরা ভালোবাসাটুকু চিনে নিই।


ছিল না শিমুল কাঠের ছলনা;
পর্যটক পাতা সাজিয়ে রাখে অর্জুন সামিয়ানা!
পাতার নীচে ঘুরতে আসে ট্যুরিস্টব্যাগ— অ্যাটাচিকেস,
সম্পর্কের মতো শিমুল, হাওয়া লেগে চিপকে একশেষ
পর্যটক মাথায় লাগে, গায়ে লাগে, ওড়ে
উড়তে উড়তে সারারাত জাগে, সমস্ত রাত জাগে

জাগতে জাগতে বাদুড় হয়ে যায় বাদুড়ের পড়শী পাতাটিও
যা কিছু ওড়ে তাদের বাদুড়বশে পালক ভেবে নিয়ো!


বৃষ্টি পড়লে এক ফুলের হৃদয় পুকুর হয়ে যায়
চুলের খোঁপা থেকে বয়ে চলে গন্ধরাজ নদী;
নদীর জন্য এক পৃথিবী ভালোবাসা রেখে
ঝরে যায় শালবন পাতা।
পাতা বয়ে গেলে নাম জানা হয় না খরস্রোতার।

নদীর মতো করে একবার সে-পাতার শরীর তুলে ধরো,
পারো! সংসারের ভিত নাড়িয়ে চলে যেতে তুমি পারো।

নড়বড়ে ভিত শিকড়ের উপর তীব্র মেঘের সংসার বানাব
আমরা দু-জন, দূর থেকে মনে হবে পাখি!
দিনশেষে আমরা আসলে ঘোরতর স্তন্যপায়ী।


একটা প্রেমের প্রতি আমরা বরাবরই উদার
যে-প্রেমে চুলে পাক ধরে জারুলপাতার
কিংবা বুড়ো পাতা পড়ে ভরে ওঠে শিউলি সরোবর;
পড়ে যায়, ডুবে যায় বুক অবধি ভিজে শাড়ির মতো,
এ-সব অনেক পুরোনো পদ্ধতি— ইতিহাস লিখিত

এক শরীরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে
প্রায়শই নিমগাছ কিংবা নিয়ামক সানন্দার তীরে
ঝুঁকে পড়া মেধা নিয়ে— জলের উপর জেলেপাড়ার নিম
বাদুড় শরীরের মতো তার ছায়া গভীর— অসীম।

অসীমের উপরে জল, নীচেও স্মৃতির মতো কালো নিমরাজি জল,
মাঝখানে তিতো অস্তিত্বের মতো সোহাগ কিংবা গাঢ়তর নিমফল।

Categories
2021-December-Kobita

প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী

লুব্ধক

জলে স্পর্শ করে গেছি, একটি নক্ষত্র রাতে নেমে এল বলে
বহুদিন পরে এল, বহু সন্ধ্যা পার করে, দৃষ্টি বিহ্বল

এল এই, নিমেষেই জ্বেলে দিল অপ্রতিম আলো
সে-আলো শরীরে মেখে, অন্ধকার হয়ে গেছে স্ফটিক স্ফটিক!

ঘনভার রাত্রি নামে, আদিগন্ত ভেসে যায় শূন্যের গহ্বরে
আমি সে-আলোর আভা মুঠো ভরে রেখে দিই শ্লোকের মতন

দ্বন্দ্ব

আমার সমস্ত দিন যদি-বা জোনাকি আলো খোঁজে
সন্ধ্যে নামে যত্র তত্র, ফিরে যায় শালিকের দল
ক্যাকোফোনি পৃথিবীর তারই মধ্যে আকাঙ্ক্ষা নিষ্ফল
তারই মধ্যে মৃদুস্বর কখনো শ্রুতিতে বেজে ওঠে
বাদামি খামের পিঠে টুকরো অক্ষর লেখা হলে,
বোধহয় সে-অক্ষরই দীর্ঘ কবিতার কোনো পাতা
কবে সে কবিতা শুরু, কবে তার বেড়েছে আকার
জানে না এখনও কেউ বন্ধ থাকা দেরাজের তাকে
তরঙ্গ বাহিত হয়ে চলে আসে আলো হাওয়া তার
এমনও মুহূর্ত আসে সমস্ত ক্লান্তিই নির্ভার
হতে চায় তার কাছে, আবার দ্বিধায় করে ভর
ভেঙে ফেলে সকালেই রাতের বানিয়ে তোলা ঘর

জন্মান্তর

তুমি ভাবো হাল ছেড়ে চলেই এসেছি
চলে তো এসেছি বহুদিনই
তবুও প্রতীক্ষমাণ জীবন আমার
ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে
পা ফেলেছি অতি সাবধানী

যে-সময় চলে যায়, দ্রুতগামী যে-সময়
পারিনি রাখতে ধরে শিখিনি কৌশল
প্রতীক্ষা শিখেছি শুধু, সামান্য সম্বল

ঘাসের সবুজে আর নরম হৃদয়ে শুনি
‘এ-জন্মে ঘেঁটে গেছে সব’
শাখা প্রশাখায় তবু পরিযায়ী থেকে যাই
যে-থাকা দুরূহ সম্ভব!

অপারগতা

আবাহন নেই মানে বিসর্জন নয়
তুমি তা বোঝো না, জানি। তুমি তা জানো না
ঘুমের ভিতর থেকে যে-সব অক্ষর
ম্লান হয়ে পড়ে থাকে ঘরের কোণায়
সঙ্গহীনতার কথা তারা কিছু জানে
বাকিটুকু মিশে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায়

সমস্ত জীবন ধরে অপেক্ষা করেছি
ধীর এলে দ্রুতপাখি বড়ো অসময়ে
ভ্রমণ পিপাসু তবু বুঝতে পারো না?
পাহাড়ের বিপরীত সমুদ্র নয়!

একটি সরল বাক্য

অনন্ত ফসল খেত পারাপার করে
পৌঁছেছি তোমার কাছে, নিষ্ফল দিন!
গতিহীন এই পথে ক্ষতের উপর
বিছিয়েছি রোগশয্যা, নিরাময়হীন

আরও কি আঘাত বাকি? বাকি আছে আরও?
প্রস্তুতিও সেইমতো শুরু হোক আবারও… আবারও…

একটি সরল বাক্য বুঝে গেছি শেষে
সরল হয় না পথ।
হয় জটিল, নয় জটিলতর…

 

Categories
2021-December-Kobita

সুমন সাধু

ইনসমনিয়া

একটা বিছানা
সরু হয়ে শুয়ে আছে ঘুম
কে গান শোনাবে, কে গল্প করবে
আমি হাই তোলা সহযোগে
ফেলে রাখছি ওষুধ
এদিকে একটা শালিখ
শরীর থেকে কিছুতেই উড়তে চাইছে না

গুহার মতো অন্ধকার

ঘুম থেকে তুলে নিয়ো এক-একটি নাম
বাসন মাজার মতো বারকতক ঘষেমেজে যখন
সোনাটি খেলে যাবে নামে নামে
তখন নামের গায়ে জুড়ে বসবে পেখম
ডানা চাইলে সমুদ্র দেখিয়ো
দেখিয়ো রাষ্ট্র, উত্তাপ, দেশদ্রোহী, সমকামী জাতীয়
শব্দ বিশেষ
ঘুম থেকে উঠে তাদের নামের গায়ে লিখে দিয়ো
সমস্ত খুন আসলে গুহার মতো অন্ধকার

ঢেউয়ের প্রতি


একটা বিশাল গর্জনের লোভে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রিয় আলোকচিত্রীটির সঙ্গে। অযথা ফালতু সময় দু-জনকে খেয়ে ফেলছিল। সমুদ্রে ফাটল ধরলে বন্ধু ব্যাগ থেকে বের করে আনত ক্যামেরা। আমি আরামকেদারায় তাস খেলা সহযোগে মিলিয়ে নিতাম হরতন ইশকাপন। দু-জনের বন্ধুত্ব হত বেশ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে আলোকচিত্রী ফ্রেম খুঁজে নিত। রাজার পাশে নিত আমাকেও। সেই আমাদের প্রথম হাত ধরা। প্রথম শরীর স্থাপন।


তারপর একটা ফ্রেম এল। যেখানে ব্লার করা থাকবে সমুদ্র, গর্জন। কয়েকশো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রী। এই লং ডিসটেন্সের স্বভাবে জুড়ে বসবে পাখি। শহরের সমস্ত অবিবাহিতরা মুছে দেবে প্রথা। সেই ভাঙন থেকেই একটা লেখা লিখতে চাই।


একমাত্র সমুদ্র জানল। বাকিটা জুড়ে পড়ে থাকল গর্জন। গর্জনের কথা কেউ শুনতে পায়নি।

একার মতন একা

একা থাকার নেশা লেগে গেছে একরত্তি শরীরে
একার এই সফরে কিছু মানুষ থেকে যান তুমুল
আসেন, আর হুব্বার মতো এতিম করে দেন
ভাবি, গায়ে গতরের জোর
বন্ধুহীন এই পৃথিবীতে বন্ধুদের তরজা
জীবনানন্দীয়, নাগরিক ক্লান্তি মুছে
আমার হাত ধরে নিয়ে যায় মিছিল
ভিড়ের শহরে, একাদের খারাপ থাকতে নেই

আবার ঘুম

বাড়ির বাইরে একটা দুনিয়া যখন মজা দেখায়, তখন তোমার শয়নকক্ষে হাজির হয় ঘুম। যাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।

আয়ুরচিত

বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগলে তোমার কথা ভাবি। আমাদের একসঙ্গে পাহাড়কোলে উদ্দাম বৃষ্টিতে ভেজার কথা ছিল। তারপর অবাধ্য সর্দির জল, হাঁচি, কাশি, প্যারাসিটামল। আমাদের প্রেমের আয়ু সামান্য। যদিও শরীর এখনও তাজা আছে। তার আয়ু কি শতাধিক?

 

Categories
2021-December-Kobita

তৃণা চক্রবর্তী

পাখিদের বাড়ি

অদ্ভুত সময়
দূরের ছাদ থেকে পাশের ছাদ দেখি
রোদ এসে ভেঙে পড়ে ঘরের ভেতর অবধি
পাখির ডাকের মতো জীবন পেয়েছি কিনা জানতে চায়

কী থেকে কী হয়
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই

ব্রিজ ভেঙে পড়ে কোথাও

যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে

যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে স্পষ্ট শোনা যাবে
হাওয়ার অভিমুখে হারিয়ে ফেলা কথা
কীভাবে পৌঁছোব সেখানে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতে পারে অনেক উপরে
নেমে যেতে হতে পারে জলের ভিতর
পুরোনো কেল্লার ভাঙা ধ্বংসস্তূপে কোথাও
কোথাও একটা যেতে হবেই

হারিয়ে ফেলা শব্দ, ফিরে পাওয়া যাবে আবার
যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে এরকম একটা বিশ্বাস হয়
কীভাবে পৌঁছোব সেখানে?

বাতিল

দুঃখ পুরোনো হলে, কথাগুলো হাওয়ার
শব্দহীন কুয়াশার রাস্তায় যাতায়াতের মতো
বাতিল হয়ে যাওয়া কোনো প্রতিবাদ
ভুল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা গান

পুরোনো দুঃখ নির্জন কুয়োর মতো বোবা
তার কাছে যাও, ডাকো
পাহাড়ে নিয়ে যাবে বলো
সে বিশ্বাস করবে না

পুরোনো দুঃখের শিকড় মাটির অনেক নিচ অবধি
যেন আরেকটা গাছ
ডালপালা সব পাথরের
সেখানে থেমে আছে শীতের নিয়ম

শুধু নতুন কোনো পাতা নেই, ঝরে যাওয়ার মতো
দুঃখ পুরোনো হলে তাকে ভালোবেসো
নতুন জামা কিনে দিয়ো শেষ বারের মতো

প্রেমের কবিতার পাশে

আমি তো এভাবেই দেখি
দূরে, বাস রাস্তার থেকেও দূরে
সমুদ্রের আওয়াজ থেকে দূরে
প্রেমের কবিতার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে
মাঝখানের অনেকগুলো বছর

পুরোনো স্বপ্নগুলো উড়ে যায়
নভেম্বর থেকে, ডিসেম্বর থেকে
যত দূরে পারে, উড়ে যায়
হাতছানির থেকে, সমর্পণের থেকে
সোজাসুজি দিনের থেকে
ভূতে পাওয়া রাত্রির থেকে
দরজা ঠেলে চলে যায়
সন্ধ্যে রঙের ছাদে

যেখানে অনেকগুলো সরলরেখা
যেখানে পুরনো কবিতার পাশে ঘুমিয়ে আছে
সামান্য বয়স বেড়ে যাওয়া সেতার
তার এলোমেলো সুর ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে রাত্রি

একা

সতেরো বছর আগের অভিমান
অচেনা স্টেশন দেখবে বলে
ট্রেনে উঠে বসেছে একা

তারপর সারাটা পথ একা
জঙ্গল সরে যায়, ব্রিজের নিচ থেকে নদী
টিলার ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে পাথর

সতেরো বছর আগের পাথর
কুড়ি বছর আগের পাথর
তিন বছর আগের…

গড়িয়ে পড়তে থাকে একের পর এক
তার নীচে চাপা পড়ে যায় কথা
গুহার ভেতর ঢুকে হাহাকার করে

গুম মেরে যায় কীরকম
অচেনা স্টেশন দেখবে বলে
ট্রেন থেকে নেমে যায় একা

 

Categories
2021-December-Kobita

সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

লাল গ্রহ: ১

এ-পাড়ায় কু কথার বাস
অন্ধ তবু হাতুড়ি নাচায় আত্মঘাতী প্রেমিকার খোঁজে

বটুকের তাজা রক্ত, অন্ধের সাহস হতে চায়
দু-একটা কথার পরই স্বপ্নের ঘোর
লাল গ্রহ হেঁটে যায় বিপ্লবের নেশায়

এ-পাড়ার একটাই খুঁত, মোড় বলে কিছু নেই
বটুক সুযোগে আছে
অন্ধের হাতুড়ি কবে নিরুদ্দেশ হয়

লাল গ্রহ: ২

ভেঙেই তো গেছে
প্রতিটি বিকল্প পথ ভেঙেই ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়

খাঁচার বাঘ রোজরোজ মাংস চিবোয়
রক্ত চেটে নেয় নাকের পাশ থেকে
অহং নয়, সে তার অধিকার ছিঁড়ে খায়
আমরা লালন করি হাড় নাড়িভুঁড়ি

এ-গ্রহে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি
ধ্বংসস্তূপের মতো জমে ওঠে বাঘের উচ্ছিষ্ট

মানুষ ভোজন প্রিয়
বাঘেরও মানুষ প্রেম সংক্রামক ব্যাধি

লাল গ্রহ: ৩

ঈশ্বর ওকে প্রেমিক কোরো না
এ-গ্রহে তুমিই প্রেম
তোমারই পতনচিহ্ন পড়ে থাক

শুশ্রূষার বিকল্প নেই
মানুষ কবরে যায়, সেও এক অন্তিম শুশ্রূষা

আমি শুধু বুঝতে চাই
কতটা মায়া পড়ে আছে ওর দেহে
বন্ধু সেজে তুমি কি পারবে সে খবর এনে দিতে ?

বান্ধব বর্জিত হোক, এ এক পিতার বাসনা

লাল গ্রহ: ৪

সব মিথ্যে
চেনা লাল জানালা
জানালার ওপারে তোমার মুখ
মুখ থেকে ছিটকে আসা প্রতীক্ষার আলো
সবই মিথ্যে, অথচ সত্যের কাছাকাছি

সত্যের খুব কাছে আসলে যে কি
সে হিসেব ঘুড়ির সুতোর মতো
প্রতিপক্ষ ঘায়েল হলে তবেই কদর

কে-ই-বা মনে রাখে
গ্রহের আকাশে যেদিন প্রথম আলো এল
সেদিনও মুখ বাড়িয়েছিলে তুমি
সীমানা চিনতে, হাসি মুখে

সেও কি মিথ্যে? নাকি
সত্যের শরীর থেকে মিথ্যের পশম জেগে ওঠে।

লাল গ্রহ : ৫

এসো একটা শর্ত করি
দু-একটা সহজ বাক্য বিনিময় ছাড়া
আমরা মুখোমুখি সংঘর্ষে যাব না

কতটা সহজ হবে সে-বিলাপ
তার ভার তোমাকেই দেই
আমি শুধু সম্মতি জানাব

নতুন পোশাকে যেমন মেঘ ভেসে যায়
বিচ্ছেদের সুতো বুনো সেই সুরে
শবযাত্রী আসুক কিছু, তা নিয়ে আপত্তি নেই

শর্ত একটাই
সহজ কান্না থাক গ্রহের আকাশে

Categories
2021-December-Kobita

প্রীতম বসাক

মধ্যরাতের জীবনী

মাঝরাতে ঈশ্বরের কাছে আগুন ধার করি। চেখে দেখি পাহাড়ের আত্মকথা। অনেক ব্যর্থতা ভাগ করি। আমাদের সঞ্চয় থেকে পাখি উড়ে যায়। প্রতিটি বাক্যে জোনাকি জ্বলে নেভে। ঈশ্বর শোনান বিষের সংজ্ঞা। আমি তাকে কাব্যের জ্যামিতি শেখাই। বলি ঘাম থেকেই যে কোনো সন্তানের জন্ম। ওম দিয়ে ফসলের চোখ নরম করতে হয়। পথজুড়ে শিশুগাছ ডাকে। অতঃপর ঈশ্বর কবিতা লিখতে ওজু করেন। আর আমি বিষ মাখি চুলে। সব অক্ষর জ্যোতির্ময় হয়। সকল আমি গরল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

জ্বরের বিড়াল

পুরোনো প্রেমের-শরীর থেকে থার্মোমিটার কুড়িয়ে রাখছি। তুলে রাখছি বজ্রপাত। কিছুকাল একটা জ্বরের বিড়াল পুষেছি। দৃশ্য রেখে উড়ে গেছে চোখ। কুয়োর খুব কাছে যে বিদ্যুৎগাছ। গুঁড়ো গুঁড়ো চ্যুতিরেখা। বোতলে রাখা রাসায়নিক। আমি এযাবৎ বেচে দিয়ে মুখ রেখেছি কোমলে। আমাদেরও লেবুপাতার হৃদয় ছিল একদা। যা ঘুরেফিরে তোমার বসবাসের কাছেই ফিরিয়ে দেয়। আর আত্মহত্যার গান ধরে বুড়ো গিটারিস্ট। গৃহস্থকে জলের বাইরে স্থাপন করে। গাঁজা খায়। ধুম ছাড়ে

পাগল লিখিত বৃষ্টি

এদিকে তোমার সেই পাগল নিজেকেই পান করছে। আর আমার মানুষ-বিষয়ক গবেষণায় ঢেলে দিচ্ছে জল। আমি দুঃখগুলো ধুতে যাব এমন সময় এগিয়ে এল তোমার মোরাম-বিছানো হাত। চোখে চোখে করুণ ঝুলে ছিল বলে আমি আর ও-পথে পাখি শেখার দোকান খুলিনি। বরং আমার ঈশ্বর চিন্তার ফাটলগুলো মেরামত করেছিলাম। আর তখনই পাগলটি তার গামছা থেকে মেঘ ঝেড়ে ফেলল। গান থেকে সে তুলে নিল আশ্চর্য দরোজা।

দুঃখের জার্নাল

আমাদের দুঃখগুলোর কোনো ব্যাকরণ নেই। কোনো চলছে না চলবে না নেই। শুধু কিছু মেঘ আর মেঘের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা গতজন্মের টিনের বাক্স আছে। কবি এখানে শ্রমিকের ধর্ম ভুলে চাঁদ মেলে দেয় আর অতি প্রাচীন নদীর রজঃপথ আবার উন্মুক্ত হয়ে যায়। আমাদের ছেলেরা বৃষ্টির আঙুলে পরিয়ে দেয় দৃশ্যের অবাক। এখানে কোনো প্রক্ষিপ্ত নেই। ধংসাবশেষ নেই। মাথাউঁচু জলগাছ দুই হাত বাড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধ ডাকছে। আর ভেঙে পড়ছে আমাদের দু-পশলা ভুলভ্রান্তি।

দীনতা সমগ্র

এই আমার দীনতা সমগ্র। যদিও হৃদয়ের ফুটো সারাই করার জন্যই আমার সমুদ্র ভ্রমণ। মাছের বাজারে আমি দেখেছিলাম এ-জীবনের শ্রেষ্ঠ বণিক। নোনা জলের গল্প থেকে আঁশ বাছার সহজ সূত্র এমনভাবে বিলি করছিল যেন জীবনটাকে সে আঠারো খণ্ডে প্রকাশ করেছে। সেদিনের পর আমি কিন্তু আর বৃষ্টি কাটার সাহস করি না। স্বাস্থ্য-উদ্ধারে গিয়ে চোখে ঢাকনা দিয়ে পান করি ঢেউ-উৎসব। সেলাই করি ঠোঁটের রহস্য।

Categories
2021-December-Kobita

কৌশিক জোয়ারদার

তোমাকে ব্যর্থ করে দিতে

নতুন করে শুরু করব এবার কবিতা লিখতে ভুলে যাব
পাথরের অস্ত্র হাতে তুলে নেবো ছবি আঁকব না
হরিণের সৌন্দর্য এবং পাখির ছাল ছাড়িয়ে
লাল মাংস আমি আগুনে ঝলসে খাব
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি ঈর্ষা ও ক্রোধ
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি লজ্জা ও গ্লানি
হে অগ্নি তোমাকে নিবেদন করি গ্রন্থ ও লাঙ্গল
এই মন্ত্র এই উচ্চারণ তুমি নাও
ক্ষুধা ও খাদ্য নির্বাপিত হলে
কোন শাস্ত্র পড়ে তুমি বুঝবে শস্য-জননী
তোমাকে ব্যর্থ করে দিতে আমার এত আয়োজন

মোক্ষ

পৃথিবীর ঘাসের উপর
মুখ গুঁজে শুয়ে আছি আমি
মাটির বুনো গন্ধে আমার দু-চোখে
জঠরের অন্ধকার নেমে আসে
বৃষ্টি পড়ছে, প্রবল বৃষ্টি পড়ছে
বাসাংসি জীর্ণানি শাস্ত্রের শবের উপর
মৃত ও বিস্মৃত দেবতারা জেগে উঠছে একে একে
সিংহাসন চিবিয়ে খাচ্ছে ক্রুদ্ধ একেশ্বর
আজ নির্বাণ হবে

আয়ুহীন জীবন

মৃত্যুর জন্য যে-প্রতীক্ষা, তার নাম আয়ু
আয়ু বড়ো আলো বড়ো বেশি আলো
পৃথিবীর জল কাদা শ্যাওলায়
সরিসৃপের মতো বুক ঘষে ঘষে
আমি তোমার জঠরের অন্ধকারে ঢুকে যাব
আহা সেই অন্ধকারে ছায়া নেই ভাষা নেই তুমি নেই
এমনকী তুমিও নেই যে-অন্ধকারে
আয়ুহীন সে-জীবনে আমি মুছে যাব

ছুঁতে পারবে না

নিজেকে নৈবেদ্য করে
খেয়ে ফেলো পূজার সমস্ত আয়োজন
নিজস্ব গিরিখাত ছিল, নিজস্ব মোহনা
ভণ্ড স্রোতস্বিনী, তোমার অসহ্য অনুসরণ
তবু কেন আমার পদচিহ্ন ধরে!
কী খাবে তুমি, কী খাবে আমার?
দ্বিধার মধ্যবর্তী শূন্যতা
তুমি ছুঁতে পারবে না কখনো

সমর্পণ

কতো মুণ্ড ছিন্ন হলে পূর্ণ হবে মালা!
এই নাও পেতে দিয়েছি বুক
পদাঘাত করো
অথবা উপড়ে নাও জবার মতো হৃদয়
গর্ভে যে-বীজ ধরেছিলে জ্ঞাত হবে বলে
যে দেখে, যে দেখায়, যে নিজেকেও জানে
তার প্রত্যাহার গ্রহণ করে তুমি ছিন্নমস্তা হও

Categories
2021-December-Kobita

নিয়াজুল হক

দ্বন্দ্ব ও লড়াই

একদিন একটি কালো পানকৌড়ি দেখে
সান্ত্বনা পেলাম প্রথম

আর একদিন
একটা সাদা বক দেখে
হতাশায় ডুবে গেলাম

এই দুটো পাখির
দ্বন্দ্ব এবং লড়াই দেখতে দেখতেই

তোমার কাছে এলাম

তুমি কী করবে?
ফেলে দেবে নর্দমায়?

অথবা
প্রত্যাখ্যান করবে?

তোমার কোর্টেই
বল গড়িয়ে দিলাম

গোবরের ইমেজ

রাস্তা দিয়ে
মারতে মারতে নিয়ে যাব

পিঠে চাবকাতে চাবকাতে নিয়ে আসব

এই বর্ণমালাদের সঙ্গে দেখা হলে
মনে মনে অট্ট হেসে উঠি

এদের গন্তব্যও কোথায় জানি

এই গোবরদের
ভুয়ো বাদামের ইমেজ

কেরোসিন ঢেলে
মানুষ একদিন জ্বালিয়ে দেবে

দাগ

আলু এবং পটলের তরকারি বানিয়ে
বললাম, আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি

কিন্তু
প্রশ্ন করলাম না

আলু কোথা থেকে এল

তেমনি প্রশ্ন করিনি
তামাকের বাবা কে

জানতে চাইনি
আনারস, হাতেনাতে
বা কেরামতি-র পূর্বপুরুষ কে

আমরা জানিই না
রুবট্টন এবং রুবটন কে

একমাত্র মানুষ
দেশ হারালে, ভূমি হারালে
বাসস্থান হারালে

উদ্বাস্তু হয়ে যায়

কিছুতেই দাগ উঠতে চায় না

নীরব দর্শক

এখন বেড়ালরা
পাঁকের তলায় লুকিয়ে থাকে

পাঁক ফুঁড়ে
তালগাছের মাথায় চড়ে বসে

এই পর্যন্ত হোগলায় ছাওয়া বাড়িঘর

তারপর
তালগাছের মাথা থেকে
লাফ দিয়ে বিমানে ওঠে

উড়ে যেতে যেতে ঝাঁপ দেয় সাগরে

আর পড়ে যায়
গভীর পাতালে

এমন একটা সময় আসবে
যখন গাছগুলোই

নীরব দর্শক হয়ে উঠবে

আত্মহত্যা

হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল

হঠাৎ একটা
ঘটনা ঘটে গেল

তার পাশ দিয়ে
কয়েকটি সাদা জলের নদী বয়ে গেছে

সেই জল লাল হয়ে
সাগরে গিয়ে মিশে যাচ্ছে

এর নাম লুকোচুরি খেলা

শৈশবের সঙ্গে যার কোনো মিলই নেই

সমুদ্র গর্ভ থেকে তারা
তারা পাহাড় হয়ে জন্মায়

কাউকে না কাউকে
একদিন আত্মহত্যা করতেই হবে

মস্তক মুণ্ডন

লিখুক

লিখুক

লিখুক

আমি রাস্তা ছেড়ে দেব

ওরা
গাছ লিখুক

নদী লিখুক

সমুদ্র লিখুক

এমনকী
পাহাড়ও লিখুক ওরা

আমি রাস্তা ছেড়ে সরে দাঁড়াব

প্রয়োজনে
রাস্তায় ছড়ানো কাঁটার গায়ে
পেট্রল ছিটিয়ে পুড়িয়ে ফেলব

আর অন্য এক ঘাটে উঠব

তার মানে এই নয়
মস্তক মুড়ব আমি

টিউকলের মতো যন্ত্রের মুখ

পিকেট শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি
অনেক আগে
ছোটোবেলায় যাকে জেনেছিলাম ঝামা হিসেবে

আর যা
প্রতিটি ঝালাইয়ে
কাজে লাগত

তারপর বাড়ি করতে এসে জোর ধাক্কা খেলাম
স্ট্রেইট পিকেট শব্দবন্ধের কাছে

মহান শিক্ষক রাজমিস্ত্রি শেখাল যেটা

জানলাম
আংশিক ঝামা-ইট অথবা
ইটের খুব কাছাকাছি ঝামাকেই

স্ট্রেইট পিকেট বলা হয়

অথচ
মহান শিক্ষক প্রসঙ্গে
বরাবর জেনে এসেছি

সাদা চক, কালো ব্লাকবোর্ড
এবং কানা উপছানো জ্ঞান

যা টিউকলের মতো একটি যন্ত্রের মুখ দিয়ে বের হয়

চেতনা

নিজেকে ভারী করে কী লাভ?

নিজেকে
এমন হালকা করতে হবে

যেন চেসিস দেখা যায়

যেন খাঁচার ভেতর দেখা যায় অচিন পাখি
যাকে ধরতে গেলে উড়ে যাবে

খামকা কী লাভ
নিজেকে ভারী করে?

নিজেকে হালকা করতে করতে
অতি সাধারণকেও আঁকড়ে ধরতে হবে

সাধারণেরও কি কোনো সীমা আছে?

সে কি অপার সমুদ্র নয়
যেখানে চেতনা জমা থাকে মানুষের?