Categories
2021-December-Prabandha

অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত

মন্টো: সাহিত্যের অন্তরালে সংগ্রাম

প্রাক্কথন: ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে অঙ্গারে এবং তৎকালীন প্রগতিশীল সাহিত্যের নানা কথা। কীভাবে আজ থেকে প্রায় একশো বছরের ওপারে চরম রক্ষণশীল সামাজিক পরিসরে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির বৃত্তে আটকে থাকা সমাজের পশ্চাদগামী পারিপার্শ্বিকতার অন্ধকার পর্দাটিকে স্রেফ কলমের জোরে ছিন্নভিন্ন করে তৎকালীন সাহিত্যের ফেনিল আবেগসর্বস্বতার বাইরে বেরিয়ে ঘোর বাস্তবকে নিয়ে প্রগতিশীল লেখালেখির সূচনা হল, এবং তা উর্দুতে। আলিগড় হয়ে উঠেছিল এই নতুন পথের কেন্দ্রবিন্দু। সঙ্গে লাহোর, দিল্লি, বোম্বাই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ লেখকের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ভারতের প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন। তৈরি হয় প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ। যাঁদের হাতে তৈরি হবে দেশভাগ-বিক্ষত, ভীত, ক্লিষ্ট এই উপমহাদেশের এক নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাষ্য, এক শক্তিশালী আন্দোলন, যা পথ দেখিয়েছিল বামপন্থী প্রগতিশীলতার লড়াইকেও। আগের পর্বে লিখেছিলাম সাজ্জাদ জাহির, ডঃ রাশিদ জাহাঁদের কথা। অঙ্গারের কথা। যাকে হাতিয়ার করে ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের নতুন ধারার লেখকেরা। এই আখ্যানে সাহিত্য আঙ্গিক কিংবা ভাষারীতির বিশ্লেষণ বা তার গুণাগুণ বিচার এই কলমচির উদ্দেশ্য না, বরং সেই সময়কে ধরার চেষ্টা করা, আজকের সমকালীনতায় সেই ইতিহাসকে জানা-বোঝা, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিঘাতকে আলোচনার পরিসরে তুলে আনার চেষ্টা মাত্র। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিপ্লবকে কীভাবে দেখব, তার একটা বাস্তব আখ্যান নির্মাণ করা। এই লেখকগোষ্ঠীর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম, অবশ্যই সাদাত হোসেন মন্টো। এইবারের কিছু কথাবার্তা সাদাত হোসেন মন্টোকে নিয়ে।

মন্টো নিন্দিত, মন্টো অভিনন্দিতও। মন্টো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত। মন্টো উন্মাদ। মন্টো অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক। বহুবার ফতোয়া এসেছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বই, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছ-বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হতাশায় ভুগেছেন, কিন্তু তাঁর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি। রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল, সহযাত্রী সবাই একযোগে মন্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি বা তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনাকে থামানো যায়নি। নিজেই মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে লিখছেন— “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মন্টো এবং তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য… মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে কে মহান গল্পকার, খোদা না সে।” মন্টো একদম এরকমই, গল্প লেখাটা যেন মন্টোর কাছে শুধু লেখা নয়, একটা চ্যালেঞ্জ, স্বয়ং খোদার সঙ্গে। মন্টোর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে গোপিনাথ নারাং লিখছেন, ”মন্টো একজন চিরবিদ্রোহী, দেশাচার আর মহিময়তার বিপ্রতীপে তাঁর অবস্থান, সে শিল্প-সাহিত্য, রীতি-নীতি কিংবা সামাজিক ধারণা, নৈতিকতা অথবা অন্য যা কিছু…।“ প্রেমচাঁদের হাত ধরে উর্দু সাহিত্যে সামাজিক বঞ্চনা আর সুখ-দুঃখের মানবিকতার যে-কর্কশ বাস্তবধর্মী আখ্যানরীতির সূত্রপাত ঘটেছিল, মন্টোর হাতে তা পূর্ণতা পায়। তিনি কলমের আঁচড়ে সমাজকে চিত্রায়িত করেছেন খোলাখুলিভাবে, মহিময়তার বিরুদ্ধে নিরন্তর কলম ধরেছেন, এতটাই তা তীব্র যে তৎকালীন সময় তাঁকে নিতে পারেনি। প্রহসনের ভারতভাগ, বিভাজন-বিদ্বেষ, দাঙ্গা, অনাচার, নির্যাতন, প্রেম-পরকীয়া, পানশালা থেকে বেশ্যাবাড়ি, মানুষের দোষ-গুণ, প্রতারণা থেকে যৌনতা… মন্টো স্পষ্ট, ঝরঝরে, বেপর্দা। এখানেই তিনি হয়তো ইসমত চুঘতাই, রাজিন্দর সিং বেদী বা কৃষন চন্দরের থেকে আলাদা হয়ে যান, তিনি লেখেন আর পুড়ে যান, পোড়ান… “স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রী উপরে থাকে আমার শরীরের তাপমাত্রা, আর তা থেকেই বুঝবেন আমার ভিতরে কী আগুন জ্বলছে।“

দেখছিলাম নন্দিতা দাশের ’মন্টো‘। একটি দৃশ্যে মন্টো মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় অ্যাসাইলামে ভর্তি হয়েছেন। সংশোধনাগারে উবু হয়ে বসে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছেন কিন্তু উন্মাদ মানুষগুলোর বিচিত্র আচরণ তাঁর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ সবাইকে সচকিত করে ছুটে এল মিলিটারি ট্রাক। এক লহমায় মন্টোকে ফেলে ছবি ঢুকে পড়ে মন্টোর গল্পের মধ্যে। ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের সেই দৃশ্য, যে-গল্প মন্টো বছর পাঁচেকের এই পরবাসে থাকাকালীন লিখেছিলেন… নন্দিতা দেখালেন একজন মানুষ এই ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-ভারত ডামাডোলে অস্থির হয়ে একটা গাছের ডালে চড়ে দেশভাগ নিয়ে ভাষণ শুরু করল। সে-গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষাণ সিং, রক্ষীদের অনুনয়-বিনয় বা ভয় দেখানোতে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। সে নির্বিকার। মুখে রহস্যময় হিং-টিং-ছট, উপর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি বেধ্য়ানা…। হিন্দুস্থান বা পাকিস্তান কোনো দেশই তার উদ্দিষ্ট নয়, পনেরো বছর ধরে সে খুঁজছে টোবা টেক সিং নামের তাঁর গ্রামটিকে। অনেকবার রক্ষীদের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টার পরে অবশেষে সে রাজি হয় কোনো এক দিকে যেতে। একসময় হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মাঝখানে নো ম্যান্স্ ল্যান্ড-এ হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। তার গলায় সেই বিখ্যাত ছড়াটি শুরু হয়, বদলে যায় তার কথাগুলো, উপ্পর দি গুড় গুড় দি অ্যানেক্স দি মুঙ্গ দি ডাল অব দি হিন্দুস্থান অউর পাকিস্তান। ক্যামেরা যুম আউট করতে থাকে, পর্দায় ভেসে ওঠে মন্টোর মুখ… ’আউর মন্টো‘।

নন্দিতা মন্টো ইয়াত-এর নতুন অর্থ তৈরি করেছেন তাঁর ছবিতে— সংবেদনশীল অথচ নিন্দিত এক শিল্পীর নিজস্ব মনোভূমি, যার কোনো স্থানিক পরিচয় নাই। এই প্রসঙ্গে আর একটি সিনেমার কথা মনে আসে, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ’মেঘে ঢাকা তারা‘। যেখানে নীলকন্ঠের আদলে ঋত্বিককে নির্মাণ করেছেন কমলেশ্বর। একইরকম আবেগতাড়িত, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা আর একজন, যাঁকে সমসাময়িক সময়, বন্ধু, রাজনীতি কেউ রেয়াত করেনি, তাঁকে নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া করেছে, বিচার বসিয়েছে। মন্টোর মতোই তিনিও বলতে পেরেছিলেন, ”আমিও বেমালুম রিফিউজি হয়ে গেলাম…“। দেশভাগ আর সীমানা, কাঁটাতার একইভাবে দু-জনকেই ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল। দু-জনেই অক্লেশে বলতে পেরেছিলেন, “আমরা তো নো ম্যানসল্যান্ডে থাকি, আমাদের কোনো ঠিকানা নাই… দেশ নাই।” তাঁরা কেউই ভাবনার জগতে কোনো বেইমানি করেননি, শুধু নির্মমভাবে ছাল ছাড়িয়ে দেখেছেন, দেখিয়েছেন ভিতরের যন্ত্রণাগুলো। ঋত্বিক আশ্রয় নিয়েছেন চলচ্চিত্রের, মন্টো গদ্যের। মন্টোর গল্পের নির্মাণকৌশল, ভাষা-ব্যবহার আর শিল্পসুষমা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে, অথচ তিনি অশ্লীল, উদ্ধত, বেহিসাবি। সারাজীবন বামপন্থী ভাবনার শরিক হয়েছেন, আবার আলি সর্দার জাফরির মতো বামপন্থী প্রগতিশীল লেখকেরা এক সময় তাঁকে বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থী। লিখেছেন, মন্টোর গল্প দূ্র্গন্ধে ভরা। ভারত বা পাকিস্থান দুই পারেই মন্টো বিপজ্জনক। আজও। অস্থির মন্টো পাকিস্তান থেকে প্রিয় বন্ধু ইসমত চুঘতাই-এর কাছে একটি চিঠিতে লিখছেন, “কোনও ভাবে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।” ভৌগোলিক অর্থে তো বটেই, দর্শনগতভাবেও শেষপর্যন্ত কাঁটাতার-ঘেরা এক না-দেশের অধিবাসী হয়ে ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকেন মন্টো।

বেঁচে আছেন কি মন্টো? প্রশ্নটা খোঁচা মারতেই থাকে।উত্তরের জন্য মন্টোর বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিগত জীবনের বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে ঢুকে পড়তে হয়। বেঁচেছেন মাত্র ৪৩ বছর। লিখে গেছেন প্রবল উদ্যমে— ২২টি ছোটোগল্পের সংকলন, ১টা উপন্যাস, রেডিয়ো নাটকের ৭টা সংগ্রহ, ৩টা প্রবন্ধ সংকলন আর দু-জন চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি আদতেই একজন সাদা-কালো চরিত্র। লেখকজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্রমশ বিপর্যস্ত মানুষটি দেশভাগকে পর্যবেক্ষণ করেছেন অন্য চশমায়, লিখেছেন সর্পিল সময়ের হিমশীতল, গা শিউরানো সব গল্পকথা। একসময় উর্দুতে ফেল করা একজন মানুষ হয়ে ওঠেন উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আলোচিত লেখক, সাদাত হাসান মন্টো। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে সমরালয়ে জন্ম ১৯১২ সালে। বাবা মৌলবি গুলাম হোসেন ছিলেন কঠোর ও বদমেজাজি। বাবার কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা একটুও পাননি, পরিবারেও উপেক্ষিত ছিলেন সবার কাছ থেকে। ভালোবাসা পেয়েছেন শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকেই, যিনি ছিলেন তাঁর আদরের ’বিবিজান‘। তারপর সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন… পাঞ্জাব থেকে আলিগড়, আলিগড় থেকে বোম্বাই, দিল্লি, লাহোর… উর্দু সাহিত্যের পরিসরে তিনি প্রকৃতই একজন অভিবাসী, নোমাড, একজন জিপসিমানুষ। অসমাপ্ত পড়াশোনার পর অমৃতসরের রাস্তায় রাস্তায় বাউণ্ডুলে জীবনযাপন থেকে লেখক মন্টো হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ’তামাসা‘ গল্প দিয়ে, বারিসাহেবের সাপ্তাহিক ’খাল্ক্‘ পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন আলিগড়ে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আলী জাফরির, যাঁর প্ররোচনায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। যুক্ত হন ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনে। মন্টোর দ্বিতীয় ছোটোগল্প ’ইনকলাব পাসান্দ‘ আলিগড় পত্রিকায় ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্যের কারণে আলিগড়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ফিরে যান লাহোরে। তারপর বম্বে। ১৯৩৫ সালে বোম্বাইয়ের ’মুসসাবের‘ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। শুরু হয় মন্টোর সক্রিয় সাহিত্যজীবন। এখানেই বিবাহ ও প্রথম সন্তান আরিফের জন্ম। এরপর ১৯৪২ সালে চলে যান দিল্লিতে, অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র নাট্যকার হয়ে। শিশুপুত্র আরিফের আকস্মিক প্রয়াণে ব্যথিত মন্টো বছর দেড়েক পরেই আবার ফিরে আসেন বম্বেতে। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত ’ফিল্মিস্তান‘-এ গল্পলেখক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বম্বেতেই কাটান। লেখেন, অভিনয় করেন। এরপর দেশভাগের ছোবল। ভারত ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানে, লাহোরে। সেটা ১৯৪৮। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে। হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর কলম থামেনি, ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর ঠিক আগের দিনেও লেখেন ’কবুতর অউর কবুতরি‘ নামে একটি গল্প।

মন্টো নিজেই শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সেইসব অভিজ্ঞতার কাহিনি, ”ঠান্ডা গোস্তের মামলা প্রায় একবছর চলেছিল… এইসময় আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কী করব ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। লেখা ছেড়ে দিব কিনা ভাবছিলাম। সত্যি কথা বলতে মন এত তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে যে, ইচ্ছে হচ্ছে কোনো কিছুর একটা ব্যবস্থা হলেই লেখার চর্চাটা ছেড়ে দিয়ে কিছুকাল নিরিবিলি জীবন কাটাব। এরপর মনে কোনো লেখার ঝোঁক চাপলে তাকে ফাঁসি দেব… বাধ্য হয়ে নিজের গাঁটের থেকে নগদ টাকা সরকারের তহবিলে গচ্চা দিয়ে দরখাস্ত করলাম। বললাম আমি অমৃতসরের মোহাজির, বেকার, দয়া করে কোনো প্রেস বা সিনেমার কিয়দাংশ আমার নামে বিলিব্যবস্থা করা হোক… যখনই ইন্টারভিউ হল, আমি তাদের সাফ সাফ বললাম, আমার দরখাস্তে যা লেখা আছে তা সবই মিথ্যা, সত্য হল আমি ভারতে এমন কিছু সম্পত্তি রেখে আসিনি, শুধু একটা বাড়ি ছিল। আমি আপনাদের কাছ থেকে কোনো ভিক্ষা চাচ্ছি না, আমার মতে আমি একজন মস্ত বড়ো গল্প লেখক…

আমার কথায় তাদের সুমতি হল। কোনো একটা বরফের ফ্যাক্টরিতে অ্যালটমেন্ট পেয়েও যাচ্ছিলাম, এমন সময় একজন বলল— ’এ তোমরা কী করছ? এ লোকটি যার নাম সাদাত হাসান মন্টো, আদতে একজন বামপন্থী লোক।‘ অতএব আমার দরখাস্ত নাকচ করা হল। ওদিকে এ ব্যাপার হল, প্রগতিশীল লেখক বন্ধুরা আমাকে রক্ষণশীল বলে আমার অন্নজল সব বন্ধ করার ব্যবস্থা করল … অনেক ভেবে চিন্তে আবার কলম হাতে নিলাম…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

ওই বইটিতেই ’শ্যাম‘ সম্বন্ধে সংবাদপত্রে একটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক নাইয়ার বানুর এক চিঠি পান। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ”অনেক সিনেমা দেখে মনে হয় যেন কারও নগ্ন অবস্থায় বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছি, আর এটা শালীনতা বিরুদ্ধ। ‘মুরলির ধ্বনি’ আবার একটু পড়ে বলুন তো এটা কোন ধরনের লেখা? একটা লোক যত বড় পাপীই হোক না কেন, এ লেখা ছেলেমেয়েদের মাঝে থেকে সে কী করে পড়বে? সে যত বড় মদ্যপায়ীই হোক বা বেশ্যা বাড়িতে পড়ে থাকুক বা হাজারও অনাচার করুক, সে যখন মনে করবে, ’মাগী কোথায়?’ এবং না পেলে বিছানা জ্বালিয়ে দেয়, তখন কেমন লাগে? এটা কোন ধরনের মনুষ্যত্ব?… সারা জগৎ তো পুরুষদের জন্যই বরাদ্দ নয়, যে যা-তা করে বেড়াবে। নিজেরা তো অধঃপাতে যাচ্ছেই সেই সঙ্গে শিশু সন্তানদেরও সেদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘর ছেড়ে পালানোর দশা হয়েছে। এখন পুরুষদের হাতে সন্তানের ভার তুলে দেওয়া উচিত, তখন বুঝবে। বাপ ছেলেকে শেখাবে কি কিভাবে মদমত্ত হয়ে থাকতে হয়, শালী মাগী বলে মেয়েদের টেনে নিয়ে যেতে হয়? এইসব কথা খবরের কাগজে ছড়ানোর কি মানে আছে…“।

উত্তরে মন্টো লিখছেন, ”আমি যাই করি না কেন নাইয়ার বানুর প্রতি অবিচার করেছি। আমাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত… আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে নাইয়ার বানু যে ধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত তাদের প্রতি মানুষের করুণা করা উচিত। তার চিকিৎসা সম্বন্ধে মনে করি তার সামনে বোতলের মুখ খুলে মদের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে, মাথায় কাদা মেখে, মুখে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে মাতলামি করতে হবে। এরপর শাম, বিশবী সদি, রুমান ইত্যাদি পত্রিকার লেখাগুলো বিজ্ঞাপন সমেত তাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে হবে …না হলে সাদাত হোসেন মন্টোকে যেন বলা হয় নাইয়ার বানুর পুরোনো স্যান্ডেল এনে নিজের মাথায় মেরে নাইয়ার বানুর পূত-পবিত্রতাকে উদ্ধার কর…“ (’গঞ্জে ফেরেস্তা‘)

এভাবেই দেখেছেন মন্টো সময়কে। শ্লীল আর অশ্লীলতাকে। আপনি কি অশ্লীল? মন্টো লিখলেন, ”আমি জানি না আমাকে কেন বার বার যৌন সমস্যা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়? শিল্পে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কি সত্যিই পাওয়া গিয়েছে? পুরুষেরা অশ্লীল কাজকর্ম করলে দোষ নেই, যত দোষ সেই কাজকর্মের বর্ণনা দিলে! লোকেরা আমাকে প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত করেছেন কারণ আমার কয়েকটি গল্প যৌন-সমস্যা নিয়ে লেখা… রুটি আর পেট, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক তো চিরন্তন ও চিরস্থায়ী। রুটি আর পেটের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর নারী-পুরুষের মধ্যে প্রয়োজনীয়তা কার বেশি তা বলা মুশকিল। লেখক হিসাবে শুধু ঘৃণা আর বৈষম্যের বাস্তবতার সুত্রপাত কেন হয়, এবং কী পরিস্থিতিতে তার জবাব দেওয়া তা আমার গল্পে অবশ্যই পাবেন। যারা আমার গল্পে যৌন আনন্দ খুঁজতে যান, তারা হতাশ হবেন… আমার লেখনীতে যদি নারী-পুরুষের সম্পর্কের বাস্তবিক অবস্থা প্রাধান্য পায় তা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক ভিত্তিতে যদি একটি দেশকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে যদি এক-কে অন্য থেকে পৃথক করা যায়, একই আইনে যদি জমির মালিকানা হাতছাড়া হতে পারে, তবে কোনও রাজনীতি, আইন, বা বিশ্বাসের দ্বারা নারী-পুরুষকে আলাদা করা যায় না … যারা মনে করছেন সাহিত্য যৌনসমস্যা সৃষ্টি করছে, তারা ভুল করছে, আসলে যৌনসমস্যাই সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে।“

আপনার গল্পে পতিতাদের প্রসঙ্গ এত বেশি কেন?

”রেন্ডিদের কথা বলা যদি অশ্লীল হয়, তবে তাদের পেশাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। ওদের মুছে দিন, তাদের কথাও আসবে না… আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি তা হুবহু অন্যদের কাছে উত্থাপন করি। যদি এই দুনিয়ার সকল লেখক পাগল হন, তাহলে আমিও তাই।“ ’কালো শালোয়ার‘ গল্পের পটভূমি একটি পতিতার কুটির। মন্টোর সুলতানা এই কুটিরে বাস করে। সুলতানা একজন পতিতা, তার পেশা পতিতাবৃত্তি। সমস্ত শহরের পতিতালয়ের মেয়েদের মতোই সুলতানাও তার পেশা নিয়েই দিনযাপন করে। তার জন্য তার কোনো রাখঢাক নাই। অথচ সে নিন্দিত। মন্টো বলছেন, ”অনেকেই পানশালা থেকে ফিরে মন্দির ও মসজিদ-গামী হয়ে পড়েন, আমরা যদি আফিম, ভাং বা মদ্যশালার কথা উচ্চারিত করতে পারি, তাহলে ঐ সব পতিতা কুটিরের কথা কেন উল্লেখ করতে পারি না?“ মন্টো সুলতানাদের উপর কোনো মহত্ত্ব আরোপ করেন না, শুধু তাদের কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন।

মন্টোর গল্পের প্রায় সব চরিত্ররাই সুলতানার মতোই প্রান্তেবাসী। পরিত্যক্ত মানুষ, নারী-পুরুষ। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিতাড়িত, তারা কেউ দেশচ্যুত, উদ্বাস্তু, পাগল কিংবা ভবঘুরে, নেশারু, অপরাধী, বেশ্যা কিংবা দালাল, নারী শরীরের ব্যাবসায়ী, ধর্ষক, ড্রাইভার, দোকানদার, অসংগঠিত শ্রমজীবী। মন্টো তাদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের কথা বলে গেছেন। পাশাপাশি খুলে দেখিয়েছেন ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, হিংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনকে। প্রগতিশীল লেখক সংঘের সদস্য হয়েও ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি মন্টো। তাই মন্টো অনন্য।

আপনি লেখেন কেন?

”লেখকের অনুভুতি যখন আক্রান্ত হয়, তখনই সে কলম তুলে নেয়… ক্ষত থেকেই একটি গল্পের জন্ম। আজকের লেখক একজন তৃপ্তিহীন মানুষ, ঠিক যেমন একজন বেশ্যা, কিংবা ওই গাড়ির খালাসি, প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে যে আকন্ঠ নেশা করে থাকে। যে বেশ্যা সারারাত জেগে থাকার পর দিনের সময় ঘুমাতে ঘুমাতে গিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে তারই বৃদ্ধ বয়স… সেই আমার গল্পের নায়িকা…।“ রবিশঙ্কর বল লিখেছেন— “মন্টো আসলে এক ক্ষত, দেশভাগ আর প্রান্তিক মানুষের জীবনের ক্ষত।” আর একটি লেখায় মন্টো এ-ও বলছেন, ”আমি কিছু বলতে চাই, তাই আমি লিখি। আমি কিছু রোজগারের জন্য লিখে থাকি এবং রোজগার করি তাই অনেক কথা বলতে পারি। রুটি ও শিল্পকলার যে সম্পর্ক তা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো উপায় নেই, তা অনিবার্য।“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)

আপনি কী লেখেন?

”যা কিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটছে, সেই সবকিছুই লেখার বিষয় হবে।“ বার বার বলেছেন যে, যা কিছু আদি অকৃত্রিম ক্ষুধা তাই লেখার মূল উৎস, মানুষের জীবনে খাদ্য এবং যৌনতা এই দু-টি মৌলিক চাহিদাই তাঁর লেখার উপাদান… ”যেসব সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্যা রয়েছে, সবকিছুর পেছনে ঐ ক্ষুধা, চাহিদা…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘), এটাই আবার সাহিত্যের উপজীব্য। মন্টোর লেখারও। প্রতিদিনের জীবনের যা কিছু অংশ, যা যেমন তাঁকে যেভাবে স্পর্শ করেছে সেভাবেই লিখে গেছেন মন্টো।

আপনি কি প্রগতিশীল?

”না আমি প্রগতিশীল বা কমিউনিস্ট নই, অশ্লীল বা রক্ষণশীলও নই… আমি স্রেফ একজন মানুষ। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই প্রগতিশীল হতে হয়। তাই আমি নিশ্চয় একজন প্রগতিশীল… আমি সমাজের বদলে বিশ্বাস করি, তাই আমি কমিউনিস্টও।“

এভাবেই মন্টোকে জানা হতে থাকে– তাঁর লেখা থেকে, জীবনচর্যা থেকে, সমস্ত কষ্ট-হতাশা থেকে। কোনো সন্দেহ নাই তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে দাঙ্গা আর দেশভাগ ব্যক্তি মন্টোকে দুঃখ দিয়েছে সবথেকে বেশি। লেখক মন্টোকেও। তিনি ভারত ভাগের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শুনিয়ে গেছেন রক্ত হিম করা গল্প। গল্পগুলো শোনাচ্ছেন সেই দেশগুলোতে, যেখানে ইতিহাস নির্মিত হয়, যে-দেশগুলোতে শাসকের ইচ্ছা অনুযায়ী অতীতও পাল যায়। এই ইতিহাস ক্রমাগত অস্বস্তিকর, অনিশ্চিত আর বিপজ্জনক বর্তমান তৈরি করে চলে। এর সামনে মান্টো একটা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মৃত্যুর পরেও সেই ঝাঁজ এতটুকুও কমেনি। বদলে যাওয়া ইতিহাসের আসল পাঠ নিতে গেলে মন্টোর তুলনা নেই; মন্টো নিজেও সে-কথা জানতেন। তিনি লিখে গেছেন সেইসব অমর আখ্যান। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় ভালবাসার কাঙাল সেই মানুষটিকে যিনি জাত-পাত-ভাষা-ধর্মের বা দেশকালের বিভেদ মানতেন না। তাঁর আত্মার সঙ্গী ’টোবা টেক সিং‘ নামের অলীক এক ঠিকানা খুঁজতে থাকা পাগল চরিত্রটি। সে ধর্মের ভিত্তিতে বুড়োখোকাদের ভারত-পাকিস্তান ভাগ করা মেনে নিতে না পেরে এক কাল্পনিক সীমান্তরেখার দু-পাশে হাত-পা ছড়িয়ে মরে যায়। দাঙ্গায় খুন ও লুটপাটে মেতে ওঠা ইশর সিং নিজের অজান্তে মৃতের সঙ্গে সংগম করে। নিজেও ’ঠান্ডা গোস্ত‘ হয়ে যায় পরে। ’খোল দো‘ গল্পে লাগাতার গণধর্ষিতা আধমরা কিশোরী, কোনো পুরুষ এমনকী ডাক্তার সামনে এলেও দম দেওয়া পুতুলের মতো হাতড়ে হাতড়ে সালোয়ারের গিঁট খুলতে চেষ্টা করে। ’শরিফন‘ গল্পের কাশেম তার কন্যা শরিফনকে নিহত দেখে অন্ধ প্রতিশোধস্পৃহায় এক হিন্দুকন্যা বিমলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশভাগ ও তাকে ঘিরে মানবিক প্রবৃত্তির এতো জ্বলন্ত দলিল আর কোনো লেখকের লেখা হয়ে উঠতে পারেনি। কোনো পক্ষাবলম্বন না করে মন্টো কেবল লিখে রেখে গেছেন। কোনো তত্ত্ব বিশ্লেষণ নেই, কোনো বেদনাবোধও নেই যেন। ১৯৪৭-এর ভারতভাগ আর দাঙ্গার চলমান ছবি মন্টো তুলে রেখেছেন কাগজে আর কলমে! পরোয়া করেননি, অতীত যখন পালটে যাওয়ার নিরন্তর হুমকির মুখে থাকে, তখন মন্টোর লেখা আয়না হয়ে হাজির হয়েছে। হচ্ছে।

মন্টোর অন্যরকম একটি বিখ্যাত গল্প, যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, ’বু‘ (গন্ধ)। ১৯৪৪ সালে এই গল্প যখন ’আদব-এ-লতিফ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল মহল গল্পটিকে “অশ্লীল” বলে দাগিয়ে দেয়। গল্পের মূল চরিত্র যুবক রণবীরের সঙ্গে একটি নিম্নবর্গ মেয়ের ঘটে যাওয়া সংগম মুহূর্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মেয়েটি এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় রণবীরের বাড়ির সামনে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল। পরনে ভিজা কাপড়। রণবীর তাকে নিজের ঘরে ডেকে নেয়, কাপড় বদলানোর সময় চোলি খুলতে না পেরে মেয়েটি তার সাহায্য চায়। মন্টো সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন, ”রণবীর ওর পাশে বসে চোলির গিঁট খোলার কাজে লেগে গেল। কিন্তু কিছুতেই যখন খুলছে না, বিরক্ত হয়ে একহাতে চোলির এক প্রান্ত ধরল, আর অন্যহাতে অপর প্রান্ত ধরে সজোরে টান মারল। গিঁট খুলে গেল। রণবীরের হাত দুইপাশে সরে গেল। চোলির তলা থেকে দুটি কম্পিত স্তন বেরিয়ে এল। রণবীর মুহূর্তের মধ্যে দেখল, তার হাত দুটি সেই ঘাটিন মেয়েটির দুই স্তনে— কুশলী কুম্ভকার যেমন নরম মাটির তাল দিয়ে পেয়ালা বানায়— সেভাবেই দুটি পেয়ালার আকার দিয়ে ফেলেছে সে… ধূসর রঙের সেই যুবতীর বুক সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক আর অদ্ভুত দ্যুতিময়। কালচে গম রঙের নীচে এক ধূসর বিভার পরত ছিল যা সেই অলৌকিক দ্যুতির জন্ম দিয়েছিল…

সারা রাত রণবীর ওর শরীর থেকে অদ্ভুত রকমের গন্ধ পাচ্ছিল। সেই গন্ধ একইসঙ্গে সুগন্ধ ও দুর্গন্ধ মনে হচ্ছিল। সারা রাত সে সেই গন্ধ পান করেছে। ওর বগল থেকে, ওর বুক থেকে, ওর চুল থেকে, পেট থেকে…। ওর সর্বাঙ্গে সেই গন্ধ, সে সারারাত ভেবে কূলকিনারা করতে পারেনি এই নীচবর্ণের মেয়েটি তার এত কাছে থেকেও এত ঘনিষ্ঠ হতে পারত না যদি ওর শরীর থেকে এই গন্ধ না পাওয়া যেত। এই গন্ধ তার মন ও মস্তিস্কের প্রত্যেক স্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল…“

গল্পের শেষে মন্টো দেখিয়েছেন, রণবীরের নব বিবাহিতা স্ত্রী-র দুধসাদা গায়ে হেনার আতরের খুশবু। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিঃশেষ হয়ে আসা হেনার সুগন্ধের মধ্যে সেই গন্ধ রণবীর খুঁজে পেল না, যা সেদিন বৃষ্টিভেজা রাতে সেই ঘাটিন মেয়েটির ময়লা শরীরে সে পেয়েছিল। এভাবেই মন্টোর গল্পের আখ্যান এগিয়ে চলে এক অনায়াস, অকপট ভঙ্গিতে। পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে সামাজিক ট্যাবুকে টুকরো টুকরো ফেলার সাহস, যা কারোর পরোয়া করেনি। কোনো কোনো প্রগতিশীল লেখক ’গন্ধ‘-কে ’দুর্গন্ধ‘ বলেও অভিহিত করেন। অথচ একইসঙ্গে রূপকধর্মী এবং লিরিকাল, বস্তুবাদী এবং মানসিক জটিলতার বহুমাত্রিকতা মিশিয়ে এরকম গল্প এই উপমহাদেশে খুব কম লেখকই লিখেছেন। এখানেই তিনি অন্যরকম… ”যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি, তার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় না থাকে, আমার গল্পগুলো পড়ুন। আপনি যদি আমার গল্পকে সহ্য করতে না পারেন, তবে বুঝবেন, এই সময়টাই অসহনীয়।“

মন্টো শুধু বেপরোয়া নন, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী।— “মন্টো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সমাজের বিদ্রোহী, সাহিত্য ও আর্টের বিদ্রোহী, সমস্ত মহিময়তা অথাৎ Doxa-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহী”, লিখেছেন গোপিনাথ নারং। তিনি বারবার অচলায়তনের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন। লেখকের পেশাদারি মর্যাদা চেয়েছেন, লেখার উচিত মূল্যের কথা বলেছেন। পত্রিকা নামক ব্যাবসায় ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবি করেছেন। সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেছেন— ”আমি চাই বিদ্রোহ। সেই সকল লোকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যারা আমাদের পরিশ্রম করায়, কিন্তু পারিশ্রমিক আদায় করে না। আমি চাই বিদ্রোহ, সাংঘাতিক ধরনের বিদ্রোহ… আমি সেই আবরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চাই যা আমাদের পুঁজিপতিরা দীর্ঘদিন ধরে লেখকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, স্বার্থসাধনের জন্য। এই আবরণের জন্য যে চেতনা তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, আমার বিদ্রোহ সেই চেতনার বিরুদ্ধে, যা বলে লেখালেখি ব্যাপারটা নিছক একটা নেশা… আমাদের এক বিরাট যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এসো আমরা একটা সংঘ গড়ে তুলি। আমরা সকলে মিলে এক হয়ে যাই, যদি আমরা সকলে মিলে আমাদের কলমগুলি এক স্থানে রাখি, তাহলে একটা পাহাড় গড়ে তুলতে পারি…“ (’গল্পলেখক ও অশ্লীলতা‘)।

মন্টো যুক্ত হয়েছিলেন সাজ্জাদ জাহিরের উদ্যোগে গড়ে ওঠা নিখিল ভারত প্রগতিশীল লেখক সংঘে। সেখানে তিনি ও ইসমত চুঘতাই, কৃষন চন্দর বা সাহির লুধিয়ানভিদের মতো ভারতের প্রথমসারির যুক্তিবাদী প্রগতিশীল লেখক কবি নাট্যকারেরা সংগঠিত হচ্ছেন, রক্ষণশীল স্থবিরতার বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছেন। জীবনের বাস্তবতায় যা দেখছেন, তাকেই কথাশিল্পে উপস্থাপিত করছেন। মন্টোও তাই। বরং খানিকটা বেশিই ”এলাকায় পুরোদমে লুটতরাজ চলেছে। তারপরে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল, সব বিষম গরম হয়ে উঠল। ওরই মধ্যে একটা লোক কাঁধে একটা হারমোনিয়াম চাপিয়ে পরমানন্দে গান গাইতে গাইতে ছুটল … ’যব তুম হি গয়ে পরদেশ লাগকর তাইশ, ও প্রীতম পিয়ারে, দুনিয়া মেঁ কৌন হামারা…?” (’কালো সীমানা‘)। এরকমই মন্টো। দিশেহারা অক্ষরগুলোর মধ্যে মন্টো হেঁটে চলেন আগ্রহী চোখে। খুঁজতে থাকেন চরিত্র। জড়ো করেন শব্দ। পরে সেগুলোকে কাগজে সাজিয়ে নেন। যে-শব্দ, যে-কাগজ, সমস্ত লেখা মন্টোর মৃত্যুর পরেও তাকে মুছে যেতে দেয় না। হ্যাঁ, মন্টো বেঁচে থাকেন।

আপাতত শেষ করব মন্টোর একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে, ‘জবাই আর কোপ’…

“আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোঁচ দিয়ে জবাই করলাম।”

“এ তুই কী করলি!”

“কেন?”

“জবাই করলি কেন?”

“এভাবেই তো মজা!”

“মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে…”

আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মন্টোকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। সেই যে লাইনগুলোয় মন্টো লিখে রাখেন… ”যে নেতারা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ঘৃণা জাগিয়ে তোলেন, তাদের আমি এই দাঙ্গার জন্য দায়ী মনে করি… ধর্মীয় অপপ্রচারের শয়তানিতে যারা মাতে, ভারতের স্বাধীনতার সৌধ তাদের হাতে গড়া হতে পারে না। তারা শুধু আমাদের স্বাধীনতার শত্রু নয়, মানবজাতির শত্রু।“ (’ভাগ‘)। এটাই তো আজকের কথা। আজকের বিভাজিত সময়ের কথা। এই জন্যই মন্টোকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ো দরকার।

ফিরে আসি ’মন্টো‘-তে। ওই যে, এক লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মন্টো। দৃষ্টি বিষণ্ণ। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে গানের সুর…

“বোল কে লব আজাদ হ্যাঁয় তেরে…”

ঋণ:
১. সাদাত হাসন মান্টো রচনা সংগ্রহ, রবিশঙ্কর বল।
২. ‘গঞ্জে ফেরেস্তা’, সাদাত হাসান মান্টো।
৩. মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন, জাফর আলম।
৪. ‘ঠান্ডা গোস্ত’, সাদাত হোসাইন মান্টো, অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ।
৫. ‘নেকেড ভয়েস’, ‘স্টোরিজ অ্যান্ড স্কেচেস বাই সাদাত হোসেন মান্টো’, আনন্দবাজার পত্রিকা।