Categories
2021-December-Story

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ছাদকাহন

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দু-খানি নয়নতারা”

বাড়ি যেখানে আকাশে মিশে যায় তার নাম ছাদ। প্রত্যেক বাড়ির কিছু উড়ুক্কু আকাঙ্ক্ষা থাকে। আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি বাড়িটার ইচ্ছেমেঘ ডালপালা মেলে দেয় ছাদের শহর থেকে। ছাদে রোদ আসে, চাল শুকোয়, আবার সেই ছাদেই বৃষ্টি নামে, চাল ভিজে ভাত হয়, নরম হয় চোখ। পুরোনো বাড়ি ভূতে না পেলেও প্রমোটারে ঠিক পায়। কথাবার্তা শুরু হয়, দলিল দস্তাবেজ। মত বিনিময়। বনিবনা অথবা তার অভাব। নতুন নতুন আত্মীয় দেখা দেয় বাড়িতে। ফ্ল্যাট চাই তাদের। অসহায় প্রমোটার মেঘমল্লার শুনতে শুনতে ভাবে, এত ভাগ হলে আমি ফ্ল্যাট বেচব কাকে? চিরভঙ্গুর অথচ দণ্ডায়মান বাড়িটা ভাবে, সবক শেখাবে! কিন্তু কাকে? কী করে? ছাদের নয়নতারা গাছ পুরোনো বাড়ির নড়বড়ে ইটের ফাঁক থেকে মৃত্যুর আকাশে চাহনি চারিয়ে দেয়। নয়নতারা অসীম নক্ষত্রপথে জীবন মৃত্যুর সাহচর্যের মধ্যেও ছাদের প্রস্থানবিন্দুকে মনে রাখে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
এখন ঘরে ফিরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যাতারা”

বাড়িটার মুখে ক্যান্সার। মুখ দিয়ে খাবার নামছে না। রাইস টিউব দেওয়া রয়েছে। ছাদের মুখের ঘা অনন্তে দগদগিয়ে উঠছে। ভাঙা ইটের ফাঁকে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে। ছাদজজুড়ে লাল লঙ্কা শুকোতে দেওয়া আছে, আর দুপুরের স্নানের পর এলোমেলো খোলা চুল। বিনুনি বাঁধার দৃশ্য আজ একশো বছর ধরে মকশো করছে বাড়িখান। মানুষ বদলে যাচ্ছে, চুল বদলাচ্ছে কিন্তু বিনুনি কারুর না কারুর ঠিকই বাঁধা হতে থাকছে। ছাদের শহর আলোর ক্যামেরায় খোঁপা থেকে বিনুনির ইতিহাস লিখে রাখছে। দুপুরের ছাদ যখন টংঘর ভুলে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় বিকেলের ঘনায়মান ছায়া প্রচ্ছায়ার দিকে। ঠিক সেই সময় নয়নতারার ফুল কথা বলবে কিনা বুঝতে পারে না ফিকে হয়ে আসা রোদের সঙ্গে।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
ক্লান্ত হয়ে দিন ফুরোলো
এখন অবসন্ন যারা
তাদের জন্য সন্ধ্যেতারা”

কাকিমা বলতেন, কত করে বলছি, বাড়ি সারাতে না পারলে বেচে দেওয়াই ভালো। দেখবি আমি একদিন ঐ বাড়ি চাপা পড়েই মরব। মৃত্যু যেন নিশিডাকই দিয়েছিল অথচ রাত তো নামেনি তখনও? ভরদুপুরে ভূতের ঢ্যালা মারার মতোই সহসা নেমে এসেছিল এক পশলা মৃত্যু। নয়নতারার ছাদে। ফুল তুলতে গিয়ে কাকিমা যখন নীচে পড়ে যায়, ওঁর চোখের কালো সাদা হয়ে গিয়েছিল আর চোখের সাদা কালো। তবে কি সে চোখকে পুরো কালো বলব নাকি পুরো সাদা? নয়নতারা বুজে গেছিল। মুখের পান গলায় আটকে ছিল। বাড়িটা নিজেই নিজেকে ভাঙছিল একটু একটু করে। আর তার ভাঙনের খেলা দেখতে এসে নিজেরাই ভেঙে পড়ছিল অনেক অনেক মানুষ।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
কখন তুমি আসবে বল
অপেক্ষাতেই তন্দ্রাহারা
থাকবে আকাশ তারায় তারায়”

একটা ইট সরে গিয়েছিল নিজের জায়গা থেকে। বাড়িটার কিছু হয়নি। শুধু শরীর ভেঙে গেছিল পড়ে গিয়ে। মাথা, ঘাড় আর মেরুদণ্ড। কংক্রিটের ওপর যেখানে পড়েছিল কাকিমা, সেখানে তেমন রক্ত ছিল না। রক্তপাত হয়েছিল ভেতরে। রক্তপাত হয়েছিল শরীরের ভেতরে, বাড়ির ভেতরে, অদেখা কুলুঙ্গিতে রাখা না-দেখা প্রদীপের অগ্নিজ্বালা প্রথমে সংবিৎ নিয়েছিল, তারপর প্রাণ। বাড়ি ভেঙে পড়েনি শরীরের ওপর, বরং শরীর সরে গিয়েছিল বাড়ির থেকে। সেই সরণে মৃত্যুও স্মরণহীন হয়ে পড়েছিল।

“সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল”

পোস্টমর্টেম তো হয়েছিল কিন্তু বাড়ির কি আর শাস্তি হতে পারে? হঠকারী বস্তুর মতো প্রাচীন আলয়ও হন্তারক অথচ নিরপরাধ। প্ৰোমোটার ভেবেছিল বাড়িটা অভিশপ্ত। খেয়ে নেবে সবাইকে। ফ্ল্যাট হতে দেবে না বলে খেতে শুরু করেছে। নাহ্, এ-বাড়ির কাজ না নেওয়াই ভালো। থাক বরং পড়েই থাক। যতদিন না ভেঙে পড়ে। অথচ এ-বাড়ি দুর্গম আকাশের মতো। আকাশ ভাঙে কেবল বৃষ্টিতে। নাহলে সে ফাইটার প্লেনকেও টেনে নামানোর ক্ষমতা রাখে।

“দেখছি চেয়ে প্রথম তারা”

কাকিমা একবার বলেছিল, ছেলে খেলে খেলে আধা ভেঙে ফেলেছিল জানালার কাঠ কিন্তু ছেলের কীর্তি বলে মায়াভরে আর বদলাতে পারেনি খিড়কির পাল্লা। আধভাঙাই রয়ে গিয়েছিল। কাকিমার তিন দশকের গৃহকর্ত্রী হয়ে থাকা জীবনে বাড়িটার সঙ্গে যা-ই কলহ দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন, ভালোবাসার অধিকারও বই কম ছিল না। ছাদের ইচ্ছে ভিড় করে আসা দুপুরে মায়েতে মেয়েতে রোদ পোহাতে পোহাতে পানের ভাঁজে ভাঁজে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবত। সেদিনই খালি মেয়ে সঙ্গে ছিল না যখন নয়নতারা ফুলগুলো হাতছানি দেয় ছায়ার অবনতি কোণে। মেয়ে শুধু একটা শব্দ শোনে আর তারপর বাবার চিৎকার। কাকু জল তুলছিল নীচে। হাওয়া বেয়ে কাকিমা হঠাৎ নেমে এসেছিল কুয়োর পাশের রাস্তায়। তারপর হাসপাতাল, মর্গ, থানা, শ্মশান আর তদন্তহীন থেকে যাওয়া প্রতিভঙ্গুর ইমারত।

“সে যেন চায় আমার চোখে”

ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে পথ। ছাদ ভরে গেছে নয়নতারায়। উপচে গিয়ে ছাদ বেয়ে নীচে নেমে পথ গোলাপি করে তুলছে মৃত্যুমর্মর ফুলের মিছিল। ছাদ যেন আকাশে উঠতে না পেরে মাটির দিকে নেমে গেছে। উন্নতি কোণ থেকে অবনতি কোণের অঙ্কে বিভোর বাড়িটা স্বপ্নের কামনায় নিম্নগামী। ছাদের দু-পাশে দুটো জানলা,

“তার দুখানি নয়নতারা”

Categories
2021-December-Story

পীযূষ ভট্টাচার্য

স্থিরচিত্র

‘তোমাকে ঠিক ধরতে পারছি না।’

বলা যেতে পারে বাবার সঙ্গে শেষ সংলাপ এরকমই ছিল। কথাটা উড়ে এসেছিল ন্যাশনাল থার্টি ফাইভ ক্যামেরার আড়াল থেকে। ক্যামেরার অ্যাপারচার আর স্পিড কন্ট্রোলে ব্যস্ততার ছোঁয়া ছিল, কথাটির মধ্যে অনুচ্চারিত একটা উৎকণ্ঠা ছিল ক্রমে আলো মরে যাবার। কেবলমাত্র এ-কথাটির স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে পাই। অন্য কিছু কথা এর সঙ্গে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কথা তো আর জুড়ে বসে থাকবার পাত্র নয়। উড়ে গেছে।

নিজে কিন্তু আজ অবধি জানি না শেষপর্যন্ত বাবা আমাকে ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছিলেন কিনা তাঁর স্থিরচিত্র ধরে রাখবার কারবারে? নিজের বিশ্বাস, কম আলোর জন্য স্থিরচিত্রে ঢুকে যেতে পারিনি বলেই বেঁচে আছি। ফিল্মের বাদবাকি অংশ কিন্তু নিকষিত, আবার কারোর মতে এ হচ্ছে ‘নিকষিত হেম’।

নিজে কিন্তু কিছুই ধারণায় আনতে পারিনি শুধু অন্ধকারের চণ্ডী রূপের অস্পষ্ট ধারণা যা নিছক স্বপ্নের মতন, কখন বাবা ফিক্সড লেন্সের দিকে তাকাতে বলবেন— এই অপেক্ষার ভিতর ক্যামেরা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখলাম।

মনে হচ্ছিল তিনি যেন কোনো স্বপ্নের ছবি তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে নিজেই এমন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি তিনি মারা যাচ্ছেন। যখন বুঝতে পারলাম তখন দেখি আমাকে দাঁড় করানো হয়েছিল এমন এক জায়গায় যেখানে যুদ্ধবিমান মহড়ার সময় না উড়েই ভেঙে পড়েছিল। প্রতিবারই এই সময়ে কালো বকের একটা ঝাঁক উড়ে এসে বিমানের গহ্বরে প্রজননের জন্য ঘর বাঁধে। আবার মাস তিনেক অন্তর বাচ্চা-সহ উড়ে যায়। বাবা কী করে যেন খবর পেয়েছিলেন এবারে, এরা একটু তাড়াতাড়ি এসেছে— তিনি ধরেই নিয়েছেন কালো বকের মোকাবিলা করবার মতন বয়সে পৌঁছে গেছি— তাই এই সিজনের প্রথম শটটা আমার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন।

নানান কারণে বাবার খুবই পছন্দের— অসংখ্য ছবি আছে তাঁর হেফাজতে। একটি ছবিও এদিক ওদিক হবার জো নেই। কেন-না তাঁর প্রিয় বকেরা যে গোল্ডেন ফিশ শিকার করতে জানে।

অন্য সময়ে, অর্থাৎ, নভেম্বর ব্যতিরেকে কালো বক এখানে আসে না। এই সময়টি এদের প্রজননের সময়কাল। প্রজননের সময়ই টুরিস্ট আসে। আর জায়গাটা সেই সময় হয়ে ওঠে টুরিস্ট স্পট। ছবি তোলে— ছবি তোলায়। মূলত মন পড়ে থাকে শীর্ণ স্বচ্ছ মৃতপ্রায় নদীটির প্রতি। নদীতে এক হাজার বৎসর আগে প্রাচীন চীন দেশ থেকে গোল্ড ফিশ ভেসে এসেছিল— এই আসার কারণ যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে উজানে বয়ে যাওয়া মাছেদের স্বভাব। কেন-না অনুসন্ধান করে কোনো জলোচ্ছ্বাসের কথা জানাই যায়নি বলে ধরে নেওয়া হয়। হিউয়েন সাং ভারত ভ্রমণের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। বরফে ঢাকা নিজস্ব পদ্ধতিতে বানানো জারের ভিতর। নিজেকে বাঁচাতে গোল্ড ফিশ নিজের শরীরে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়িয়ে নিয়ে জ্বলে ওঠে। শুধু শরীরে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে এরকম হয়। বরফের অস্তিত্ব যতক্ষণ থাকবে ততই গোল্ডফিশ নিজের শরীরে রং বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চলবে। কিন্তু এই নদীর পাশে এসে জলে কোনো বরফের অস্তিত্ব নেই। স্বচ্ছ জারের স্বচ্ছ জলের সঙ্গে বহতা নদীর জলের পার্থক্য নেই। সেখানে গোল্ড ফিশের স্বাভাবিক রং। জ্বলে ওঠা রঙের আভাসের মধ্যে সামনে এ পথ-চলা সম্ভব ছিল তা হঠাৎই বন্ধ। রং তার সংবেদনশীলতা হারিয়ে গোল্ড ফিশ স্বাভাবিক— যখন সবকিছুই স্বাভাবিক, মাছ তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে যাক ভেবে নদীতে ছেড়ে দিয়ে রাতের আকাশে নক্ষত্রের ইশারার উপর নির্ভর করে পথ-চলা শুরু হয় আবার।

গোল্ড ফিশের জন্যও স্পটটা টুরিস্ট স্পট। নদীতে গোল্ড ফিশ অবশ্য নেই তবুও সিজন শুরু হয় নভেম্বরে। কখনো স্রোতের অভিমুখে কখনো বিপরীতে বাঁশের মাথায় নেট বেঁধে জলে দাঁড়িয়ে— ঠাঁই। এভাবে গভীর বিমর্ষতায় ডুবে গেলে হাতের নেট ছুড়ে ফেলে দেয়। তখনই বাবা সেই বিখ্যাত স্টিল ফোটোগ্রাফটি ওদের দেখায়। একটা কালো বক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শরীরে উড়ানের ভঙ্গিমাও স্থির— দু-ঠোঁটের ফাঁকে তার শিকার গোল্ড ফিশ।

— কবেকার তোলা?

এই প্রশ্নকে ফুঁ দিয়ে জানিয়ে দেন— এখনও গোল্ড ফিশ আছে নদীতে। ‘আপনারা নেটটা না ভাসিয়ে ও দিয়ে প্রজাপতি ধরতে পারতেন?’ এবং টুরিস্টরা বুঝতে পারে বড্ড মূর্খামির কাজ হয়ে গেছে। মূর্খামিকে ধরে রাখবার জন্য ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত।

এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ার মধ্যে যেন থেকে যেত পৃথিবীর যাবতীয় নিছক অনিশ্চয়তা কেন-না ক্ষীণ স্রোতহীন নদীতে এখন আর গোল্ডেন ফিশ নেই। যেন হিউয়েন সাং-এর পদচিহ্ন ইতিহাস পুস্তকে ঢুকে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই যেন নিছক স্বাভাবিক জটিলতার জট ছাড়িয়ে সাধারণ সত্যে পৌঁছে গেছে। বাবা বেশ কিছুদিন থেকে ভাবছিলেন, ক্যামেরা যদি হাজার বছর আগে আবিষ্কার হত তবে এইসব অভিজ্ঞতার স্থিরচিত্র থাকত। আর স্থিরচিত্রের রহস্যময়তার ভিতরে বসবাস করত একটি ‘সময়’। তিনি এই সময় ঠিক কী করতে চাইতেন সেদিনও বোধগম্য হয়নি। আজও উন্নত ধরনের ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পরও নিজের ছবি নিজে দেখেও বুঝে উঠতে পারি না ছবি তোলার মুহূর্তকালে ঠিক কী ভাবছিলাম। কিছু তো একটা ভাবছিলাম কিন্তু সেটা মনে করবার চেষ্টা করলেই ভেসে ওঠে— ‘এক চক্ষু লেন্সের দিকে তাকাও।’

আমি কি বাবার নির্দেশমতো তাই করেছিলাম? নিশ্চয় করেছিলাম। বাবার নিজস্ব রূপকথার মধ্যে এক চক্ষুওয়ালা এক রাক্ষসের কথা সবসময় থাকত। উদাহরণ হিসেবে বলতেন লক্ষ্যভেদ করবার সময় একচক্ষুতেই করা হয়। অবশ্য জানি না যদি স্থিরদৃষ্টি থাকত একচক্ষু লেন্সের প্রতি আমার দুই চোখ মিলেমিশে একচক্ষু হয়ে যেত। যেহেতু ছবিটি খুঁজেই পাওয়া যায়নি আর সেহেতু ধরে নেওয়া হয়েছিল বাইরের আলো ক্যামেরায় ঢুকে অবয়বহীন কৃষ্ণবর্ণ করে ফেলেছে সবকিছু। তবু তার মধ্যে মাঝে মাঝে নিজেকে খুঁজি। কেন তা যেন বোধগম্যহীন চেতনা।

বাবা যে কেবলমাত্র মানুষের ছবি তুলবে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না, তবে এও শোনা যায়, সিজন ছাড়া অন্য দিনগুলিতে নদীতে এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকতেন— জল স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। স্থির স্বচ্ছ জলে যদি গোল্ডেন ফিশের দেখা মেলে। জলের ভিতর থাকা মাছের ছবি উঠবে কিনা তা তার জানা নেই তবু বিশ্বাস একদিন না একদিন গোল্ডেন ফিশের ছবি সে তুলবেই।

মুহূর্তে যেন বাবা এভাবে পৌঁছে যেতেন বক-যক্ষের শরীরে। হয়তো-বা এই মুহূর্তকাল নাম মাত্র পরিবর্তন। অথবা অতীতের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে প্রশ্নটাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। অথচ যুধিষ্ঠিরের প্রতি রাখা প্রশ্ন ছিল, ‘সুপ্ত হয়ে কে চক্ষু মুদ্রিত করে না?’— ‘মৎস্য নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না।’

জলের গহীনে তো অন্ধকার— গল্পের খাতিরে যদিও ধরে নেওয়া যেতেই পারে— রাতে সেই অন্ধকার পরিমাপহীন এক জ্যামিতিক অন্ধকার যার কোনো বর্গক্ষেত্র বা ব্যাসার্ধ নেই সেখানে উন্মুক্ত চক্ষুর কী কাজ? আবার যদি বেশি আলো একচক্ষু লেন্সের ভিতর দিয়ে ক্যামেরায় চলে যায় তখন পৃথিবীর ডার্করুমের সাধ্য নেই সেই কালো অন্ধকার থেকে স্থিরচিত্রে পৌঁছানো অসম্ভবকে সম্ভব করা।

কিন্তু বাবা যে কিছুতেই আমাকে তাঁর লেন্সে ধরতেই পারছিলেন না। ছবিটির সম্পূর্ণতা আনতে গিয়ে কালো-বক মুখ থুবড়ে পড়া এরোপ্লেনের ভিতরে যুদ্ধের ভগ্নাংশ ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। গোল্ডফিশের অনুপস্থিতি তাঁকে এমনই এক দার্শনিক চিন্তায় উপনীত করে যাকে বলা যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত বিচ্ছিন্নতা। যার ফলে বালুচরের ভিতরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে মুখ থুবড়ে পড়ে। নিজে কিছু বুঝতে না পেরে এক দৌড়ে বাবার কাছে পৌঁছে যাই। তখন বুঝতেই পারিনি মৃত নদীর বুকজুড়ে মাধ্যাকর্ষণের শক্তি যে কার্যকর। ভিউফাইন্ডার বা লাইটমিটারের ব্যবহার তখন জানতাম না, বোতামটা টিপে দিয়েছিলাম। বাবা যখন শুরু করে ফেলেছে তখন আমাকেই শেষ করতে হবে এরকম এক নির্বিকার জেদ আমাকে পেয়ে বসেছিল— আনাড়ি হাতে ক্যামেরা চালাতে (যা অবশ্য বাবাকে নকল করেই শেখা) শুরু করেছিলাম। তখন আমাদের পরিবারের মৃতেরা যাদের পূর্বপুরুষেরা হুড়োহুড়ি করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে। চেনা-অচেনা সব পূর্বপুরুষেরা আমাকে নাকি অভিশাপ দিয়েছিল— আমার পিছনে নাকি বাবা মারা যাচ্ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর প্রতিটি স্তরের কেন স্থিরচিত্র তুলিনি?

তখন মনে পড়ে যায় নিজের তো শৈশবের কোনো স্থিরচিত্রই তোলা হয়নি এবং তা যথারীতি কোনো অ্যালবামে রাখা হয়নি। বাবার চোখের সামনেই তো বড়ো হচ্ছি তাই তিনি ধরেই নিয়েছিলেন— এর কোনো স্থিরচিত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন ক্যামেরা জিনিসটা কী বুঝতে শুরু করলাম তখন বাবা আমাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেন। আমি কিন্তু বাবার ছিটকে যাওয়া ক্যামেরা দিয়ে যে-সব ছবিগুলো তুলেছি তার কোনো আগাম সিদ্ধান্ত ছিল না, ছবি তুলতে হয় তুলে গেছি। কোনো নতুন খেলনা হাতে পাওয়া মাত্র শিশুরা যেমনভাবে ব্যবহার করে সেভাবেই, যার কসরত বাবাকে দেখে শেখা। আর ছিল প্রথমবার হাতে ক্যামেরা তুলে নেওয়ার আনন্দ— সেই হেতু বাবার মৃত্যুর কোনো স্তর নেই সেখানে।

সেই রাতের মতন বাবা মর্গে, পরদিন পোস্টমর্টেম, তার সাথে নিরাপদ বয়ে যাওয়া সময়ের অভিজ্ঞান। আর ছিল ক্যামেরা ন্যাশনাল থার্টি ফাইভ— খুবই পুরোনো মডেলের। এইসব তুলে দেওয়ার পর বডি হ্যান্ডওভার করেছিল দারোগা।

একদম শেষে ক্যামেরার রিল ডেভেলপ করে নেগেটিভগুলো যার বেশিরভাগই কালো— শূন্যতায় ভরা। আমি পর্যন্ত নেই। আমার তোলা ছবিগুলোতে— মৃত আত্মীয়স্বজনের গলাকাটা ছবি। কিন্তু এসবের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়া যুদ্ধবিমানটিও নেই। যা সচল হয়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যেন! সঙ্গী কেবলমাত্র ডিমে তা দিয়ে বসে থাকা বকেরা।

একটিমাত্র নেগেটিভের ভিতরে কিছু একটা আছে যা ডেভেলপ করলে দাঁড়ায় একটি কালো বক, যার ঠোঁটে ধরা গোল্ডফিশের কঙ্কাল কিন্তু দিগন্ত খাঁ-খাঁ করছে।

ধেয়ে আসা অন্ধকারকে এভাবে প্রকাশ করা অনুচিত— কেন-না সাদা, হলুদ, কমলা, লাল, বাদামি এবং কালো রঙের বিভিন্ন সমন্বয় মাত্র। স্থিরচিত্রে অবশ্য থাকে না, খুঁজে নিতে হয়।