Categories
2021-July-dharabahik

মুদ্রণ যন্ত্রের আবির্ভাব

ভাষান্তর: নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়

আমরা যাঁরা পড়াশোনা করি অথবা ছোটো পত্রিকা চালাই, আমাদের বেশিরভাগ সময়েই মুদ্রণ বিষয়ের ইতিহাস জানা হয়ে ওঠে না। ‘The Foundation of Early Modern Europe, 1460-1559’, এ-বিষয়ে একটি প্রামাণ্য বই। এ-বইয়ের লেখক ইউজিন এফ রাইস (জুনিয়র) এবং অ্যান্‌থনি গ্রাফটন। এ-বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের একেবারে প্রথম অংশের উপনাম ‘The Invention of Printing’ (‘দ্য ইনভেনশন অব প্রিন্টিং’)। সেই শিরোনামের নীচের লিখিত অংশটুকু অনুবাদ করেছেন নবনীতা মুখোপাধ্যায় ও কুন্তল মুখোপাধ্যায়। লেখাটি পরিমার্জন করেছেন স্নিগ্ধা বর্ধন।

১৪৯২ এবং ১৪৯৮ সাল আমাদের চেনা। ১৪৯৮-এ ভাস্কো দ্য গামা ভারতবর্ষের মালাবার উপকূলে এসে উপস্থিত হন। এই সময়েই আরও কিছু পরিচিত আর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। ১৫০০ সালের অর্ধশতাব্দী আগে ইউরোপের মানুষ প্রথম ছাপা বই পড়তে পেল, আর ১৪৫০ থেকে ১৫২৫ সালের মধ্যে নতুন আগ্নেয়াস্ত্রগুলি যুদ্ধের পদ্ধতি পালটে দেয়। ১৫০০ সালে রোমে কোপারনিকাসের অঙ্কশাস্ত্রের উপর বক্তৃতা এবং এই সময়েই তাঁর ‘পৃথিবীর নিজের অক্ষের উপর আর সেইসঙ্গে সূর্যের চারপাশে পরিক্রমণ’ তত্ত্বের শিক্ষা দেওয়া শুরু। এই আবিষ্কার, অনুসন্ধান আর পুনরানুসন্ধান প্রভাবিত করতে পেরেছিল সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসকে। এই সমস্ত কিছু পালটাতে পেরেছিল ইউরোপের সম্পর্ককে যা ছিল তার নিজের অতীতের সঙ্গে ও অন্যান্য অ-ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে। শৈলী ও সংস্কৃতির দিক থেকে ষোড়শ শতাব্দী অবধি ইউরোপ প্রাচীন গ্রিক, রোমান আর দূর ও নিকটবর্তী প্রাচ্য সভ্যতার ছাত্র। কলম্বাস ও ভাস্কো দ্য গামা-র অভিযান সেই নির্ভরশীলতা দূর করে নতুন রাস্তা দেখায়। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাপটের সাথে সাথে ইউরোপ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা অনুশীলন ও অর্জন করছিল। ১৫০০ সালের আগে ইউরোপ শৈলী ও ভাবনার আমদানি করত; ১৫০০ সালের পর ইউরোপের মানুষ সাংস্কৃতিক লগ্নিকারী (creditor) হয়ে উঠেছিলেন।

১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরে চলন্ত ধাতব অক্ষরের (movable metal type) মাধ্যমে মুদ্রণকার্য শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে তিনটি নাম উল্লেখযোগ্য— যোহান গুটেনবার্গ (১৩৯৫-১৪৬৮), যোহান ফাস্ট (১৪০০-১৪৬৫) এবং পিটার স্কোফার (১৪২৫-১৫০২), যিনি ছিলেন ফাস্ট-এর জামাতা। এই সূত্রগুলি অপর্যাপ্ত, কখনো কখনো পরিষ্কার নয়, আর সংশয়াত্মক। অতএব মুদ্রণবিদ্যা ও অক্ষরশৈলীর পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারার জন্য কোনো একজন বিশেষ ব্যক্তিরই অবদান আছে, এ-কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে মুদ্রণের উৎস বিষয়ে আপেক্ষিকভাবে আমাদের অজ্ঞতাই বিষয়টিকে জানার উৎসাহ দেয়। এই অজ্ঞতার ফলে আমরা ভুল করে ভাবি যে, একটি জটিল প্রযুক্তি আবিষ্কারের কৃতিত্ব একজন ব্যক্তিবিশেষের। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, একটি আবিষ্কার কোনোভাবেই একটি ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। একই কথা কবিতা বা ছবির ক্ষেত্রেও যা কিনা একটি সামাজিক উৎপাদন। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বা টেলিগ্রাফের ক্রম-অগ্রগতির মতোই একটি পাঠ্যবস্তুর হুবহু নকলের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও তার উদ্ভাবন ছিল একটি সমষ্টিগত প্রয়াস। ১৪৫০ সাল নাগাদ মেইন্‌জ্‌ শহরের মুদ্রকেরা এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক প্রস্তাবনা ছিল।

পশ্চিম ইউরোপে অক্ষরশৈলীর মুদ্রণ সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দু-টি চৈনিক আবিষ্কার— ব্লক প্রিন্টিং এবং কাগজ। কাঠখোদাই শিল্প (xylography) অথবা ব্লক প্রিন্টিং-এর উদ্ভব হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে, চীনে। মুদ্রক একখণ্ড কাঠের ব্লকে উলটো করে আঁকতেন ছবি অথবা বিষয় যা তিনি হুবহু ছাপতে চাইছেন। মুদ্রক কাঠখণ্ডটিকে এমনভাবে খোদাই করতেন যাতে তা রিলিফের এবং গ্রাফিক আকার নেয়। এবং তারপর তা কাগজে বদলি করতেন। ভাবনার দিক থেকে প্রক্রিয়াটি ছিল সরল, কিন্তু প্রয়োগের সময় জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল। এছাড়া পশ্চিমী বর্ণমালার সঙ্গে এই পদ্ধতিটি ঠিক ঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১২৫০ থেকে ১৩৫০ সালের মাঝামাঝি যখন ইউরোপের সঙ্গে চীনের সংযোগ অস্বাভাবিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল, তখনই পশ্চিমে এর প্রচার হয়। যদিও মুদ্রণপ্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই, তবু এর পরোক্ষ গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছিল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি: একটি পুরোনো কাঠের ব্লক বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী কাটা এবং তারপর তাকে নতুন পাঠ্যবস্তুর বানান পদ্ধতি অনুযায়ী পুর্নবিন্যস্ত করা। এই পদ্ধতিটি মুদ্রণের ধারণাটিকে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। তবে সরাসরি বাণিজ্যিক সাফল্য শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে। খেলার তাস (অন্য একটি চৈনিক আবিষ্কার), ধর্মীয় প্রিন্ট আর স্থুল কাঠখোদাই করা বই প্রথম বাজারের গুরুত্ব বোঝায়। সম্ভাব্য লাভের উপরও জোর দেয়।

অর্থনীতির থেকেও প্রযুক্তিগত কারণে কাগজ অপরিহার্য। হাতে লেখা বই সাধারণত পার্চমেন্টের (যা ভেড়ার চামড়া থেকে তৈরি) অথবা ভেলামের (বাছুরের চামড়া) উপরে লেখা হত। এগুলি ধাতব মুদ্রণকারীরাও ব্যবহার করতেন, বিশেষত যখন লক্ষ্য উপযোগিতার থেকে উৎকর্ষের দিকে ঝুঁকে থাকত। যখন কাগজ ছিল না, সে-সময় একটি বাইবেলের মতো বড়ো বই ছাপতে প্রয়োজন হত প্রায় ১৭০টি বাছুরের অথবা ৩০০টি ভেড়ার চামড়া। কাগজ না থাকলে হয়ত বাতিল হয়ে যেত এই সম্ভবনাময় যান্ত্রিক অনুকরণের প্রক্রিয়ায় সস্তা দ্রুত এবং প্রচুর পুস্তক প্রকাশনা। আরবরা চীন থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনে কাগজ উৎপাদন করতে শুরু করে। পরের দুই শতাব্দী ধরে আস্তে আস্তে এই পদ্ধতি ইউরোপের একটি বড়ো অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন ইতালি (১২৭০), ফ্রান্স (১৩৪০), জার্মানি (১৩৯০) এবং সুইজারল্যান্ড (১৪১১)। ইউরোপের প্রধান কাঁচা মাল ছিল পুরোনো কম্বল। কাগজ প্রস্তুতকারকেরা কম্বলগুলি একটি জলশক্তি চালিত স্টাম্পিং মেশিনের নীচে রাখতেন। শনজাতীয় গাছকে জলে ভিজিয়ে নরম করে, তার থেকে তৈরি ফাইবার মেশানো হত। এরপর তাকে ভিজিয়ে রেখে একটা কাঠের ফ্রেমের বিশাল চালুনি দিয়ে ঢেলে একটা তরল মণ্ড করে ফেলা হত। এবারে সেটাকে তারজালির উপরে সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে যখন তার ছিদ্রগুলির ভিতর দিয়ে জল চালনা করা হয়, সে-সময় সেই খণ্ডগুলিকে একটি ছাপাখানায় পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে চাপ দেওয়া হত। এরপর সেই খণ্ডগুলিকে শুকিয়ে মাপ করে কাটা হত। ওয়াগনরের অপেরা ‘মেইসটারসিঙ্গার ভন ন্যুরন্বার্গ’ (von Nürnberg)-এর নায়ক চর্মকার-কবি হান্স সাক্স (১৪৯৪-১৫৭৬) এই পদ্ধতিটিকে একটি কবিতায় বর্ণনা দিয়েছেন যেটা কাগজ তৈরির প্রথম দিকের ছবি দেয় আমাদের:
এই মিলে আমি ব্যবহার করি কম্বল
এইখানে স্রোত ঘুরিয়েছে চাকা-কল
সেই জল র‍্যাগ ছিঁড়ে করে বহুখণ্ড,
তারপর জলে, পাত্রে ভেজাই মণ্ড।
ঠিকঠাক করে মোল্ড করি সেই কাগজ
সারাদিন প্রেসে জল নিঙরাই, রোজ
ঝুলিয়েছি তাকে, শুকোনোর দরকার;
বরফের মতো ফর্সা এবং চকচকে ওটা
চোখের আরাম সবার

গুটেনবার্গের যৌবনকালেই কাগজ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত আর তা পার্চমেন্টের ছয় ভাগের একভাগে বা এক ষষ্ঠাংশ দামেই পাওয়া সম্ভব ছিল।

পশ্চিমী অক্ষরশৈলী নিয়ে এল ইউরোপীয় পদ্ধতিও এবং এইসব ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক। মেইন্‌জ্‌ শহরে গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফার (Schoffer) যেভাবে মুদ্রণ করতেন তার জন্য প্রয়োজন ছিল মানানসই কালি, কালি দিয়ে কাগজে বদলি করার ছাপযন্ত্র আর ধাতুর তৈরি অক্ষর (type)। সেই ধাতুর সঙ্গে সমভাবে আর মসৃণভাবে সেঁটে থাকতে হবে কালিটিকেও। সেজন্য তার উপাদানে তেলজাতীয় পদার্থ থাকা অবশ্যই জরুরি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্লেমিশ (Flemish; ফলান্ডার দেশের বাসিন্দারা) শিল্পীরা তেলচিত্র আঁকতে শুরু করেন। তেলচিত্র বলতে তখন বোঝাত মানানসই ছাপার কালি, যার মধ্যে থাকত পিগমেন্ট অর্থাৎ, ভুষোকালি বা কাঠকয়লা গুঁড়ো এবং তিসির তেলের সাহায্যে আনা ঔজ্জ্বল্য। দ্রুতই কাঠের ছাপাখানার উত্তরসূরিও পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। যে-প্রেসে জল নিংরে বের করা হত, সেই প্রেস ব্যবহার করে নতুন মুদ্রণের ক্ষেত্রে নতুন অভিযোজনের কথা হয়েছিল। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অক্ষরের (type) আবিষ্কার— বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণের মুকুরকল্পের (Mirror Image) ধাতুনির্মিত ছাঁচের নিখুঁত নির্মাণ। এই দক্ষতা অক্ষর ঢালাইয়ের উন্নতিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে আর তা, স্পষ্টতই, ধাতুবিদ্যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন ধাতু খোদাইকারী, অথবা যিনি মুদ্রা এবং পদকের নকশা করতেন অথবা ছোটো-কিছু-তৈরিতে-দক্ষ স্বর্ণকার অথবা যাঁরা শীলমোহরের অক্ষর পেতলের উপরে খোদাই করতেন, দস্তার তৈরি পাত্রের উপরে কাজ করতেন এবং বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষ কারিগরেরা ইউরোপের বিভিন্ন অংশে টাইপ, অক্ষর, কালি, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন— এমন কল্পনা করা যায়। এও ভাবা যায় যে, মুদ্রণযন্ত্রের সঠিক উদ্ভাবন, তার কিছু পরিচিত কৌশলকে নতুন এবং কাজে সুবিধাজনক পদ্ধতিতে পালটে ফেলার নাটকীয় মিশ্রণ পদ্ধতি (যা আমাদের কাছে এখন সহজ মনে হয়, এ-সব হওয়ার আগে যা অকল্পনীয় ও দুরূহ ছিল) বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে হয়েছিল। সব শেষে, গুটেনবার্গ, ফাস্ট এবং স্কোফারই প্রথম এই নতুন পদ্ধতিকে নিখুঁতভাবে সংগঠিত করে একটা ইন্ডাস্ট্রির (Industry, শিল্প ) রূপদান করতে পেরেছিলেন। তবে যেটা নিশ্চিত, সেটা হল এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো বই মুদ্রিত হয়েছিল সঞ্চরণশীল ধাতব অক্ষরের সাহায্যে (Movable metal type) এবং সেটা হয়েছিল মেইন্‌জ্‌ শহরেই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বইগুলি এখনও টেকনিকের দিক থেকে নিখুঁত। এ থেকে এটা বলা যায় যে, মেইন্‌জের প্রকাশনা-বাড়িগুলি তাদের পূর্বসূরিদের থেকে এবং পূর্বসূরিকৃত প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে অনেকখানি দক্ষতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল। গুটেনবার্গ কৃত যে-লাতিন বাইবেল অত্যন্ত জনপ্রিয় বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে গ্রন্থপঞ্জিকারেরা যাকে বিয়াল্লিশ লাইন বাইবেল (forty-two-line Bible) বলেন (এবং তা অবশ্যি মেইন্‌জ্‌ শহরের প্রথম দিকের প্রকাশনা থেকে আলাদা করতে, কারণ, সেটা ছাপা হয়েছিল ছত্রিশ বাক্যের পাতায়) তা প্রকাশিত ও সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৪৫৫ সালে। এই বাইবেলের অক্ষরনৈপুণ্য, অক্ষর সংস্থাপনের কৌশল এবং মুদ্রণ নিখুঁত। স্পষ্টতই মেইন্‌জের মুদ্রণকারীরা মুদ্রণ প্রযুক্তিকে একটা শক্ত জমির উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যিই, পরবর্তী তিনশো বছর ধরে গুটেনবার্গের উত্তরসূরিরা খাঁজ তৈরি, ছাঁচ করা, অক্ষরঢালাই, অক্ষর বিন্যাস এবং মুদ্রণের ব্যাপারে গুটেনবার্গ যা করেছিলেন সংক্ষেপে সেটাই করছিলেন। এর পরের মুদ্রকেরাও উৎকর্ষের দিক দিয়ে ও নান্দনিকতায় এর প্রতিষ্ঠাতাদেরকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। ১৪৫৭ সালের ১৪ই অগস্ট ফাস্ট ও স্কোফার একটি সাম (The Psalms) স্তোত্র মুদ্রণ করেছিলেন। এই খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ভেলাম বা বাছুরের চামড়ার উপরে। লাল আর কালো কালিতে ছাপা অক্ষরগুলি সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছিল পাতার সঙ্গে। প্রতিটি সামের শেষে মুদ্রকেরা গর্বিতভাবে লিখেছিলেন ‘প্রথম বিশাল অক্ষরের সৌন্দর্যভূষণ-সহ’ (adorned with the beauty of large initial letters) এই অক্ষরটির ঝালরের রূপে বিন্যস্ত, যা লাল কালো রঙে বহু ফুল ও পশুর চিত্রের সাহায্যে অলঙ্কৃত হয়েছিল— সত্যিই ছিল অসাধারণ। ফাস্ট এবং স্কোফারের সাম্‌স্‌ সবচেয়ে পুরোনো সাক্ষরিত ও তারিখবিধৃত বই। সারা ইউরোপে এর সৌন্দর্যের তথা সৌকর্যের জন্য এটি এখনও অন্যতম সুন্দরী বই।

প্রথম দিকের মুদ্রিত বইগুলির একটি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক দিক ছিল। এদের পৃষ্ঠাগুলি ছিল প্রায়ই পাণ্ডুলিপির মতো দেখতে, ফলে অনভিজ্ঞ চোখে এইসব বই পাণ্ডুলিপির চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল না। স্পষ্টতই মুদ্রকের কৌশলগত, নান্দনিক এবং বাণিজ্যিক লক্ষ্য ছিল হুবহু হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা। এবং ওরা সেটা শুধু যে অলসতা অথবা খরিদ্দারের হাতে পরিচিত জিনিস তুলে দেবার জন্যেই করত, তা নয়। আসলে প্রথম দিকের প্রকাশকেরা তাঁদের আবিষ্কারের নিঁখুত সম্ভবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না; তাঁরা মুদ্রণকে একটি নতুন অথচ নির্দিষ্ট ধরনের লেখা বলে মনে করতেন (“কলম ছাড়াই লেখার কৌশল”, বলেছেন স্কোফার); তাঁরা ভাবতেন যে, তাঁদের অল্প দামে প্রচুর সংখ্যক পাণ্ডুলিপি (manuscripts) বিক্রি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহিত এই ধারণা থেকে মুক্ত না হওয়ার সমস্যাটি এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, যদিও অক্ষরশৈলীর আবিষ্কার রেনেসাঁর সবচেয়ে বড়ো ঘটনা, তবু এর প্রাথমিক উন্নতিবৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে চার্চ-সংক্রান্ত লোকজনের রুচি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। মুদ্রণের ভৌগোলিক উৎস ইতালি থেকে অনেক দূরে। অথচ পঞ্চদশ শতকে ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির ও কারুকলার কেন্দ্র ছিল এই দেশ। মুদ্রণই প্রথম প্রাদেশিক যাজকশ্রেণির মূলধনের সাহায্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল এবং এই ব্যাবসার প্রসার ছিল প্রায় ৩০০০ লোকের মধ্যে এবং খুব কম আর স্বতন্ত্র কিছু বুদ্ধিজীবি মহলে। মঠ এবং ক্যাথিড্রালের অধ্যায়গুলি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল লাতিন বাইবেলের জন্যে। আর গির্জার নিত্যকর্ম পদ্ধতির বই, তার গানের বই এবং বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত প্রার্থনা সংগীতের বই ছিল এইসব মুদ্রকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই মুদ্রণের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছিল। যেমন চার্চের ক্ষমাপত্র-র (ইন্ডালজেন্স ফর্ম) জন্য একটি বরাত থাকত। প্রকাশকদের সস্তা বইয়ের তালিকায় (স্কোফারের) প্রাধান্য পাচ্ছিল সনাতন বিষয় যেমন— বাইবেলের সহজ ব্যাখ্যা, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের কাজ, সাধুসন্তদের জীবনী আর ‘ভালভাবে বাঁচা ও সুন্দরভাবে মারা যাওয়া’-র পথনির্দেশিকা এবং বীরত্বের রোমান্স কাহিনি।

মেইন্‌জ্‌ শহরে ১৪৬০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে বিস্ময়করভাবে প্রকাশনার হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হল বইয়ের অনন্ত চাহিদা। ব্যাবসায়ী-উকিল-কারিগর-সরকারি-কর্তা-ডাক্তার-শিক্ষকদের অনন্ত চাহিদা। ইউরোপের কৃষকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং পরের কয়েক শতাব্দী ধরে সেটাই চলবে। যাজক সম্প্রদায় ও নোব্‌ল শ্রেণির মানুষ এ-কথা মেনে নিতে শুরু করেছিলেন যে, রাজদরবারে এবং দেশোয়ালি জমিদারদের কাছে চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষিত হওয়াটা জরুরি। তবে তাঁদের প্রয়োজন এতদিন মিটিয়ে আসছিল ওয়ার্কশপের বহু নকলনবীশ, যাঁরা বইয়ের সংখ্যা বাড়াতেন হাতে লিখেই। এটা ঠিক যে, মুদ্রিত বইগুলি বেশ কিছু দশক ধরে ইতালির ধনবান ও কৃষিপ্রধান নায়েবদের থেকে স্বতঃস্ফূর্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে আমরা যাকে বলি, শহরের মধ্যবিত্তশ্রেণি— তাঁদের মধ্যে, এছাড়াও অন্যান্য মানুষের মধ্যে, তাঁদের ব্যাবসা ও নাগরিকতা রক্ষার জন্যে, লেখাপড়া ও হিসেবনিকেশের প্রয়োজন হত। এইসব মানুষ ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় শহরে ও গিল্ড স্কুলে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন এবং এঁরা পঞ্চদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগ বাড়িয়ে তুলছিলেন, মুদ্রিত বইয়ের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছিল। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মধ্যযুগে শুরু হওয়ায় নিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসারই মুদ্রণের ব্যাপ্তির পিছনে কাজ করেছিল। শহরের জনসংখ্যা, বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে লাগল শিক্ষা-সচেতনতা, সম্পদ, শক্তি, আত্মসচেতনতা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক চাহিদা। বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে স্বশিক্ষিত ও আত্মসমৃদ্ধি লাভ করার জন্য যে-অদম্য উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁরা কিনে নিতেন মনোরঞ্জক ও সবরকমের দরকারি বই: ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বই, লাতিন ভাষার ও মাতৃভাষার বই, ব্যাকরণ, অভিধান, বিশ্বকোষ, অঙ্কের মৌলিক বই, জ্যোতিষশাস্ত্রের বই, ওষুধপত্র এবং আইনসংক্রান্ত, আঞ্চলিক ও সামগ্রিক ইতিহাসের বই, আত্মত্যাগের জনপ্রিয় নির্দেশিকা আর কিছু হৃদয়-স্পর্শ-করা লাতিন ক্লাসিক— ভার্জিলের ঈনিড, সিসেরোর দি অফিসিস, টেরেন্স, প্লিনি আর সেনেকা। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের আগে শহরশাসিত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি শহরের মানুষের পড়ার প্রয়োজন পরিবেশন করত। স্টেলনার (লেখার উপকরণ ও তৎসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের বিক্রেতা) বলা হত তাঁদের। তাঁরা প্রয়োজনীয় বই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতেন। বিশাল মূলধন নিয়ে এঁরা লেখক/নকলনবীশও ব্যাখ্যাকার ভাড়া করতেন, তাঁদের বিষয় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিতেন। আর এঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ করে ফেলতেন সম্ভাব্য বইয়ের বিশাল বিশাল সব তালিকা। এইসব বই ব্যক্তির অগ্রিম টাকায় অর্ডারে খুচরো দোকানে (retail) বিক্রি করা হত। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা বিশাল মাপের সব কাজ করতেন। নিজের সংগ্রহের বিজ্ঞাপন করতে ডাইবল্ড লবার (ন্যুরেমবার্গের লেখক) ব্যবহার করছিলেন প্রায় একশোটা বিভিন্ন বিষয়ের হাতে লেখা তালিকা। এ-তালিকার textগুলি তাঁর দোকানেই পাওয়া যেত। ভেসপাসিয়ানো দ্য বিসটিচ্চি ছিলেন ফ্লোরেন্সের পুস্তকবিক্রেতা (cartolaio)। এই মানুষটি মুদ্রণের যুগে বেঁচে থেকেও মুদ্রণকে ঘেন্না করতেন। ইনিই পঁয়তাল্লিশ জন ‘লেখক’ ‘লাগিয়েছিলেন’ কুড়ি মাসে প্রায় দুইশোখানি বই লিখে ফেলতে কসিমো দ্য মেদিচি-র জন্যে। এঁর কাজের ব্যাপ্তিও ছিল বিশাল। অন্য দেশের শাসক ও সুদূরের কালেক্টরের জন্যেও কাজ করতেন। যেমন— ইংল্যান্ড। ভ্যাটিকান সিটি থেকে অক্সফোর্ডের লাইব্রেরি— সব জায়গায় ভেসপাসিয়ানোর শতাধিক অসাধারণ এবং ব্যাখ্যার বই (আলো করে রয়েছে) পাওয়া যেতে পারে। গ্রন্থাগারই হোক অথবা তাঁদের খরিদ্দার— সবার পছন্দের সুষ্ঠু নির্মাণ করতে এঁরা অনেক কিছু করেছিলেন। এঁরা হিউম্যানিস্টদের নতুন ও পরিষ্কার স্ক্রিপ্ট (script) রচনার ফ্যাশন চালু করেছিলেন। শিরোনামের পাতাটি, অর্থাৎ, প্রচ্ছদটিকে সাজানো, বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে তাকে ধ্রুপদী বিষয়বস্তুর ও আবক্ষছবির ছাপ দেওয়ার ফ্যাশনও এঁদেরই চালু করা। তাছাড়া এ-সব মুদ্রণের যুগ পর্যন্ত চালুও ছিল। তাঁদের তৈরি গ্রন্থাগার এবং দোকানগুলি হয়ে উঠেছিল তাঁদের পৃষ্ঠপোষক ও বুদ্ধিজীবিদের আলোচনার ঝাঁ চকচকে কেন্দ্রবিন্দু। এইসব কেন্দ্রগুলি মঠ বা মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং এদের সমস্ত কিছুকে বাণিজ্যিক জীবনে সংহত করেছিল এই কেন্দ্রগুলি। ভেসপাসিয়ানো নন, তবে অন্যান্য কিছু বইবিক্রেতা নতুন বিশাল প্রকাশনের স্বার্থে (মুদ্রণ) নিজের অপছন্দ চেপে রাখতেন, আর কেউ কেউ এই নতুন প্রকাশনের দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

অক্ষরশিল্পের নিহিত সচলতা মুক্তি পেয়েছিল শহরের প্রচুর চাহিদা আর তৎকালীন অর্থব্যবস্থা ও তার বণ্টন পদ্ধতির সাহায্যে। ফলত দেখা গিয়েছিল বইয়ের অটল ও ক্রমবর্ধমান স্রোত। মুদ্রণ ছড়িয়ে পড়ছিল। মেইন্জ্ থেকে স্ট্রসবুর্গ (১৪৫৮), কোলন (১৪৬৫), অগস্বুর্গ (১৪৬৮), ন্যুরেমবার্গ (১৪৭০), লেইপজিগ (১৪৮১) এবং ভিয়েনায় (১৪৮২)। জার্মান মুদ্রকেরা অথবা তাঁদের ছাত্রেরা এই ‘স্বর্গীয়’ শিল্পটিকে ১৪৬৭ সালে ইতালিতে, সুইজারল্যান্ড ও বোহেমিয়ায় ১৪৬৮ সালে, ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ড্স্-এ ১৪৭০ সালে নিয়ে এলেন। ১৪৭৪ থেকে ১৪৭৬ সালের মধ্যে স্পেনে, ইংল্যান্ডে, হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ডে, ডেনমার্কে আর সুইডেনে ১৪৮২ থেকে ১৪৮৩ সালের মধ্যে। ১৫০০ সালের মধ্যে বেড়িয়ে গেল চল্লিশ হাজার সংস্করণ সমেত প্রায় ছয় লক্ষ বই; এবং আরও প্রচুর সংখ্যক বই যা সম্ভবত রোমের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে প্রকাশিতই হয়নি।

বইয়ের এতখানি সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল। সংস্কারের দিনগুলির আগে (the years before the Reformation) সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ছিল পাণ্ডিত্যের উপরে মুদ্রণের প্রভাব পাণ্ডুলিপির সবটাই নির্ভর করত লেখক/নকলকারীর শিক্ষা, দক্ষতা আর যত্নের উপরে। এবং তা সবসময়েই নিখুঁত ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সর্বোপরি এই ত্রুটি ও আস্থাহীনতা হয়ে উঠছিল ক্রমবর্ধমান, কারণ, নকলকারীর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরসূরির ত্রুটিও নকল করে ফেলছিলেন এবং তৎসহ কিছু যোগও করছিলেন। মুদ্রণের মৌলিক অবদান, অন্য দিকে ছিল এই যে, এটা থামিয়ে দিয়েছিল এই চলতে থাকা পচনপ্রক্রিয়া এবং অতীতের মহতি পাঠ্যাংশকে তাদের আস্লি সংহতির কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ এবং অবিরাম প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারছিলেন মুদ্রকেরা। মুদ্রণ সারা ইউরোপের পণ্ডিত মানুষদের একইরকম পাঠ্যবস্তু দিচ্ছিল যা নিয়ে কাজ করা যায়। সংক্ষেপে একটি নির্দিষ্ট পাতার নির্দিষ্ট বাক্যের নির্দিষ্ট শব্দের উল্লেখ করে ব্যাসেলের (Basel) একজন পণ্ডিত একটি সংশোধনের প্রস্তাব দিতে পারতেন যা তাদের সহকারীরা রোমে অথবা ফ্লোরেন্সে সঙ্গে সঙ্গে দেখে নিতে পারছিলেন অথবা পারি শহরের মঠ-সংলগ্ন গ্রন্থাগারে একজন স্কলার আবিষ্কার করছিলেন একটি পাণ্ডুলিপি যার পাঠ্যাংশ বিচার করা সম্ভব হচ্ছিল এর আগের যে-কোনো জানা পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ ও সংক্ষেপিত পদ্ধতির সাহায্যে। এসে যাচ্ছিল এইসব আবিষ্কার ও সংশোধনের থেকে একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ যা বাতিল হয়ে যাচ্ছিল আরও এবং আরও একটি সংস্করণের আবির্ভাবে। এবং এই প্রক্রিয়া ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যতক্ষণ না একটি আদর্শ পাঠ্যাংশ পাওয়া যায়। অতীত তো কখনো কখনো বোঝা হয়েও যায়। আমরা তো কাজ করতে করতেই এটা জানি এবং এর অনেকখানির জন্যে আমরা মুদ্রণের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুদ্রণ যেভাবে পাঠ্যাংশের সমালোচনা একটি সমষ্টিগত বিজ্ঞানে পরিণত করেছিল, তা একদমই একটি সাধারণ ঘটনার বিশেষ অংশমাত্র। মুদ্রণ বুদ্ধিবৃত্তির কাজটি ব্যক্তির নিঃসঙ্গ কর্ম থেকে সামগ্রিকভাবে সমবায়ী কাজে পরিণত করেছিল। যেভাবে শিল্পবিপ্লবের সময় বাষ্পচালিত যন্ত্র মানুষের শারীরিক শ্রমের থেকে বহুগুণ উৎপাদনের ক্ষমতা দেখিয়েছিল, ঠিক সেরকম মুদ্রণও একটি ব্যক্তির প্রযুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রকৃতিবিজ্ঞান ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই ব্রেইন পাওয়ারের এমন মহতি মনোযোগ লক্ষ্যণীয় ছিল না। যেমন, কোপারনিকাস উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর সৌরকেন্দ্রিক প্রকল্পের তত্ত্ব ষোলোশো শতাব্দীর প্রথমার্ধে। কিন্তু ১৫৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি তা তিনি প্রকাশ করেননি। এই প্রধান বৈজ্ঞানিক সমস্যার উপর তিনি কাজ করেন ১৫০০ সাল থেকে ১৫৪৩ সালের মধ্যে, একা একা। ১৫৪৩ সালের পরে কোপারনিকাসের মুদ্রিত বইটি সে-সময় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের নজরে আসে। তা একটি সমবায়ী সমস্যার, বিতর্কের ও পড়াশোনার বিষয় হয়ে ওঠে। এর সমাধানও খুব দ্রুত পাওয়া যায়, অথচ অন্য কোনো ক্ষেত্রে (মুদ্রণ ছাড়া) হলে অন্য কিছুও হতে পারত। এই নতুন বুদ্ধির যন্ত্রের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর সব ধরনের পাণ্ডিত্য জনসাধারণের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। উপযুর্পরি পরীক্ষানিরীক্ষা, মনোযোগী এবং সমবায়ী পরীক্ষার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত ও মুদ্রিত মহান ফলাফল বিনিময়ও জনসাধারণের কথাবস্তুর কেন্দ্র হয়। এই বিষয়ে মুদ্রণের আবির্ভাবকে কেবলমাত্র একদিকে লেখালিখির (writing) অন্য দিকে কম্পিউটারের আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

মুদ্রণ কেবলমাত্র পাণ্ডিত্যকেই যে নিখুঁত আর সম্পূর্ণ করেছে তাই নয়, এটা বিদ্যা অর্জনের পদ্ধতিটিকে করে ফেলেছিল অনেকখানি সহজ। মুদ্রণের মানের আরও উন্নতির ফলে পড়াশোনা শেখা অনেক সহজ হয়েছিল। আগে যেখানে পুস্তকাদি ছিল মঠ ক্যাথিড্রাল ও মহাবিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া অধিকার, সেইখানে একজন ব্যক্তি কিছু বইয়ের মালিক হবার ক্ষমতা পেয়ে গেছিল। মধ্যযুগের ছাত্রদের নিজেদেরকেই নিজের অভিধান তৈরি করতে হত। করতে বাধ্য করা হত। লেকচার রুমেই বেশিরভাগ সময় এদের কাটত নিজের পাঠ্যাংশের অনুলিখন শিক্ষকের কাছে নিতে নিতে। লেকচার করা মানে ছিল একটি বই চিৎকার করে পড়া যাতে ছাত্ররা সেটা লিখে নিতে পারে। এখন ছাত্ররা সেই পাঠ্যাংশ বাড়িতে পড়তে পারবে। শেখার অর্থ ছিল স্মৃতিতে ধরে রাখা। মুদ্রণ স্মৃতির মুক্তি ঘটালো। একটা ঘটনা মনে রাখার প্রয়োজন কম ছিল বিশেষত ওটা যখন শেল্‌ফের উপরে থেকে পাওয়া যেতে পারে। অক্ষরশৈলীর আবিষ্কারের প্রায় একশো বছর পরে, ১৫৮০ সালে, ফরাসি প্রাবন্ধিক মিশেল দ্য মতাঁইয়ঁ (১৫৩৩-১৫৯২) রেনেসাঁ শিক্ষাতত্ত্বের প্রধান বিষয়টিকে আলংকারিকভাবে পুনর্বিবৃত করলেন। তিনি শিক্ষার অন্তিমতাকে সংজ্ঞায়িত করলেন তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানের বাহুল্যে নয় বরং শীলিত বুদ্ধি, গভীর অনুজ্ঞা ও চর্চিত রুচিময়তায়। মঁতাইয়ঁ-র কাছে একজন পণ্ডিত ছিলেন চলন্ত বিশ্বকোষ; কিন্তু তাঁকে তিনি যথার্থভাবে পণ্ডিতই বলবেন, কারণ, মুদ্রিত দরকারি বইগুলিই তখন স্মৃতিধরের ঐতিহ্যবাহী কাজটি করে যাচ্ছে।

বিশেষত ১৫০০ সালের পরেই যেটা সমানভাবে লক্ষ্যণীয় সেটা হল মুদ্রণ কিছু ইমেজ (বাক্‌প্রতিমা/রবীন্দ্রনাথ) ও ধারণার ব্যাপ্তিকে ত্বরাণিত করেছিল। দৃশ্যশিল্প (Visual Art) পৌঁছে যাচ্ছিল নতুন ও বিশাল অংশের মানুষের কাছে। ছাপচিত্র (Engraving) ছিল ফোটোগ্রাফি আবিষ্কারের আগে যে-কোনো শিল্পকর্মের পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি (reproducing method)। এই ছাপচিত্রের প্রতিমাচিত্র ও আলংকারিক বিষয়বস্তু এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, একজন শিল্পীর কাছ থেকে অন্যান্য শিল্পীর কাছে ছড়িয়ে পড়ছিল। যেমনভাবে রটরডমের ইরাসমাজের (২) মতো পণ্ডিত ব্যক্তির প্রভাব দ্রুত ছুঁয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের প্রায় সব বুদ্ধিজীবিদের বৃত্তগদি, তেমনি মিশেলএঞ্জেলোর কাজের ছাপচিত্র (Engravings) যেমন সিস্তিন চ্যাপেলের সিলিং-এ আয়োজিত নগ্নদেহের ভঙ্গিমাগুলি, তাঁর অতিদূরবর্তী সমসাময়িকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। তবে লুথারীয় ধর্মের প্রচার সর্বপ্রথম মুদ্রণকে ভয়াবহভাবে জয়ের গন্ধ-সহ বৈপ্লবিক গুরুত্বদান করেছিল, তার ধারণার প্রসারের জন্য। সংস্কারমুখী আন্দোলন প্রচারিত হয়েছিল আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে, মুদ্রণের মতোই দ্রুততায়। তার সাহায্য ছাড়া ওইরকম হওয়া সম্ভব ছিল না। সত্যিই ষোলোশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুদ্রণের ভূমিকা ভবিষ্যতের দ্বৈত ভূমিকার কথা ইঙ্গিত করে: তার আলোকিত করা ও জনশিক্ষার ইচ্ছা এবং বৈপ্লবিক সম্ভবনা ও বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তার হিংস্র বিরোধ। কিন্তু রাষ্ট্রদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও এ ছিল রেডিয়ো ও টেলিভিশনের আবিষ্কারের আগে কাজে লাগানোর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্র।

সেইজন্য মুদ্রণের আবির্ভাবের পরে সেন্সরশিল্প (অনুমোদন) পদ্ধতি চালু হয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে এটা খুবই কম চালু ছিল। পড়াশোনাকে গণতন্ত্রী করতে গিয়ে, মুদ্রণব্যবস্থা আধুনিক সেন্সর উৎপাদন করেছিল। যাজক কর্তৃপক্ষ ও নিরপেক্ষপন্থী— দু-পক্ষই পুস্তকগুলি সেন্সর করতেন। কারণ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি রাখতে বইয়ের নিষিদ্ধকরণ ও পুড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হত। ১৪৯২ থেকে ১৫০৩ সালের কার্যকালের মধ্যেকার পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার ১৫০১ সালের একটি বুলেটিনে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে বলছেন। “মুদ্রণ কৌশল” তিনি বলছেন “খুবই প্রয়োজনীয়, যতক্ষণ সেটা প্রয়োজনের ও রুচির বইয়ের প্রসার ঘটায়; কিন্তু এটা খুবই ক্ষতিকর হতে পারে যদি একে বিষাক্ত কিছু কাজের ব্যাপ্তি ঘটানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। সেইজন্য মুদ্রকদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, যাতে তাদেরকে ক্যাথলিক বিশ্বাসবিরোধী মুদ্রিত লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা যেতে পারে। অথবা যা বিশ্বাসীদের সমস্যায় ফেলতে পারে এমন লেখাগুলিকে আনা থেকে নিরস্ত করা।” এমন ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে লুথারের ধর্মের সঙ্গে লড়াই করতে কয়েকটি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায়। এইসব তালিকাই শেষে রোমের নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় (১৫৫৯) পরিণত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরি ১৫২৬ সালে এরকম একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন। অন্যান্য প্রথম দিকের তালিকাগুলি করেছিল পারি ও লুঁভ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। নিরপেক্ষ শাহজাদারা যখন ধর্মীয় দায়বদ্ধতাকে তাদের মত থেকে শুধু আলাদা মতবিরোধী এবং রাজদ্রোহ বলতেন, সেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ঠিক ক্যাথলিক বিশপদের মতোই ভাবাবেগের সাথে বিশ্বাসীদের রক্ষা করতেন। ১৫৬০ সাল নাগাদ সবরকমের বইয়ের সেন্সরশিপ সর্বজনীনতা পেয়ে গেছিল পশ্চিম ইউরোপে। একদিকে লেখক মুদ্রক এবং প্রকাশকের লড়াই, অন্য দিকে সরকারি ও যাজক সম্পর্কিত সেন্সর সে-সংগ্রামের একদিকে ছিল। যে-সংগ্রাম ছিল বুদ্ধিগত উদারতার আর বিবেকের স্বাধীনতার। সেই সময়ে যা ছিল মৌলিক ধারণার সংঘর্ষের সময়।

Categories
2021-July-dharabahik

সোমা মুখোপাধ্যায়

আরতী পালের ঝুলনের পুতুল

তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। উলটোডাঙার মুচি বাজারের কাছে আরিফ রোডে থাকতাম। বাজারে ঝুলনের সময় মাটির পুতুল বিক্রি হত। এখান থেকেই কিনেছিলাম একটা সুন্দর পুতুল। একটি ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। পেছনে ল্যাম্প পোস্ট। ফুটপাথ আকাশি রং করা আর চৌকো খোপ কাটা। ল্যাম্প পোস্টের গায়ে রুপোলি রং। বাতিটা সাদা। ছেলেটা লাল হাফ প্যান্ট আর হলুদ জামা পরা। তার দিয়ে তৈরি ঘুড়ির সুতোয় কাগজের ঘুড়ি। সবটাই একআঙুল মাপের। অসম্ভব দক্ষ এই কাজ। বহুদিন ছিল ওটা। তারপর হারিয়ে যায়।

২০১৫ সালে মাটির পুতুলের খোঁজে গিয়েছিলাম নাগের বাজার রথের মেলায়। জমজমাট মেলায় ঘুরতে ঘুরতে সদ্য নির্মীয়মান ব্রিজের একধারে নজর চলে যায়। চমকে উঠি। সেই ছোটোবেলার ঝুলনের পুতুল সাজানো আছে। ভিড় ঠেলে উঁকি দিয়ে আর নজর ফেরাতে পারি না। রং-বেরঙের কত পুতুল। সকলেই ঐ একআঙুল সমান। আর পুতুল বিক্রি করছেন এক দম্পতি। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করে নাম জানলাম মনোরঞ্জন পাল। ফোন নাম্বার চাইতে মহিলাকে ডাকলেন। খদ্দের সামলাতে সামলাতে বললেন মহিলাটি ওঁর নাম আরতী পাল। নিমতা কুমোরটুলিতে থাকেন। নাম্বার দিলেন। আমি সেই ছোটোবেলার ঘুড়ি ওড়ানো পুতুল নিয়ে সেদিন ফিরে এলাম। এরপর গড়ে উঠল আলাপ।

সে-সময় বিশ্ববাংলা স্টোরের জন্য চলছিল বাংলার পুতুল সংগ্রহ। আমিও যুক্ত ছিলাম। সেই কারণে গেলাম কিছু দিনের মধ্যেই আরতী পালের বাড়ি। একেবারে বিরাটি যাওয়ার মূল রাস্তার পাশেই। বাড়িতে ঢোকার মুখে ছোটো ছোটো পুতুল সাজানো। কোনোটায় রং হয়েছে কোনোটায় হয়নি। এটাই ওদের স্টুডিয়ো। এখানেই নানা ঠাকুর গড়া হয়।

ঝুলনে সাজানো হলেও রথ আর ছাতুবাবুর বাজারের চড়কের মেলাতেও একসময় বিক্রি হত এই পুতুলগুলো। একখোল ছাঁচে পুতুলের দেহটা তৈরি করে সেটা শুকিয়ে খড়িমাটির গোলা লাগিয়ে তবে রং করা হয়। এই রংটা খুব সাবধানে করতে হয়। এত ছোটো পুতুল। আরতী পাল সংসারের কাজের ফাঁকে এটা করেন স্বামীর সঙ্গে। হাত লাগায় ছেলেও।

কুমোর পরিবারের মহিলারা এমন পুতুল গড়ার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই যুক্ত। কাঁচা মাটির এই পুতুলগুলোতে একদিকে আছে পৌরাণিক পুতুল আর অন্য দিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচা। মেয়েদের রান্না, মাছকাটা, শিবপুজো, মা ও ছেলে, পিওন, পুলিশ, আইসক্রিম থেকে ফুচকাওয়ালা, সবজিওয়ালা এমনকী হাল আমলের রিয়েলিটি শো থেকে জনপ্রিয় সিরিয়ালের চরিত্রের সন্ধান— সবটাই মিলবে আরতী পালের পুতুলে। আর পৌরাণিক পুতুলেতে আছে কৃষ্ণলীলা আর রামায়ণের কাহিনির দৃশ্য। রাধাকৃষ্ণ, পুতনা বধ, কালীয় দমন থেকে দশানন রাবণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে সমাজে লোকশিল্পী তাকে প্রকাশ করেন নিজের মতো করে। ঝুলনের পুতুলে তারই প্রভাব আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের একটা বড়ো অংশ এখানে রূপায়িত হয়।

এই পুতুল তৈরি কীভাবে হয় তা চাক্ষুস দেখেছিলাম ওঁদের বাড়িতে। পুতুলের মাটি আসে ডায়মন্ড হারবার থেকে সোদপুরে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এই আঠালো পলি মাটি ভালো করে চটকে নিয়ে চটা দিতে হয়, অর্থাৎ, কাঠি দিতে হয়। তারপর ছাঁচে পুতুলের দেহটা তোলা হয়। এরপর হাত দিয়ে দেওয়া হয় ‘ফিনিশিং টাচ’।

অনেকে বলেন ঝুলনে সাজানো হয় বলে এটা পোড়ানো হয় না। আরতী পাল তা মনে করেন না। তাঁর মতে তাঁদের মাটিতে এখানে চটা বা কাঠি থাকে বলে পোড়ানো‌ হয় না। কুমোরটুলি থেকে শুকনো রং কিনে আনা হয়। তেঁতুলের বিচির আঠা দিয়ে আগে জাল দিতে হয়। এই রঙের সঙ্গে আঠা মেশানো হয়। এখন যাকে মিডিয়াম বলে তেমন। এর ফলে রংটা হাতে লাগলে ওঠে না।

আরতী দেবীর মা এই পুতুলগুলো বানাতেন। ওঁর ছেলে রং করেন, চোখ আঁকেন। নারকেল মালায় রং রাখা হয়। বাজারি তুলি ব্যবহার করা হয়। ইতিমধ্যেই আরতী পালের পুতুল বেশ পরিচিত হয়েছে। বিশ্ববাংলা পার্ক স্ট্রিটের স্টোরে রয়েছে তাঁর ছবি। শিল্পী হিসেবে এ কম প্রাপ্তি নয়! এছাড়াও সরকারি বেসরকারি নানা মেলায় আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন তিনি। সারাবছর আগেও তৈরি হত এ-পুতুল কিন্তু এখন চাহিদা বেড়েছে অনেক।

আরতী পালের এই পুতুলগুলো এক অসাধারণ শিল্পকলার উদাহরণ। আমাদের রাজ্যে নানা অঞ্চলে এমন পুতুল হয়। কিন্তু আঙ্গিকের দিক থেকে আরতী পালের পুতুলের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। বাংলার মাটির পুতুলের মধ্যে একটা যুগ প্রবাহ দেখা যায়। এই পুতুলগুলো একেবারেই বাস্তবানুগ (naturalistic) কৃষ্ণনগরের মতো মডেল-এর মতো বাস্তবধর্মী নয় (materialistic) নয়। অর্থাৎ, শিল্পী যেমনভাবে তাঁর পারিপার্শ্বিককে দেখে তাঁকে নিজের মতো করে রূপায়ণ করেন। হবহু‌ তুলে ধরেন না। এখানেই আমাদের শিল্পের মূল নির্যাস ধরা পড়ে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে এই বিষয়টা ভারি চমৎকার বলেছেন—
“একবার কৃষ্ণনগরের পুতুল গড়ার কারিগর জ্যোতিকা’র একটা মূর্তি গড়ল। অমন সুন্দর চেহারা তাঁর, যেমন রং তেমন মুখের ডৌল— মূর্তি গড়ে তাকে নানা রং দিয়ে এনে যখন সামনে ধরল সে যা বিশ্রী কান্ড হল, শিশুমনও তা পছন্দ করবে না। মাটির কেষ্ট ঠাকুরের পুতুল বরং বেশি ভাল তার চোখে। পুতুলগড়া সোজা ব্যাপার নয়। তার গায়ে এখানে‌-ওখানে বুঝে একটু-আধটু রং দেওয়া, চোখের লাইন টানা, একটু খোঁচা দিয়ে গয়না বোঝানো, এ বড় কঠিন। সত্যি বলব, আমি তো পুতুল নিয়ে এত নাড়াচাড়া করলুম, এখনো সেই জিনিসটি ধরতে পারিনি। একটু ‘টাচ’ দিয়ে দেয় এখানে-ওখানে, বড় শক্ত তা ধরা। সেবার পরগনায় যাচ্ছি বোটে সঙ্গে মনীষী আছে। কোথায় রইল সে এখন একা-একা পড়ে, কী শিখল না-শিখল একবার লড়তে এলে তো বুঝব। তা সেবার খাল বেয়ে যেতে যেতে দেখি এক নৌকো বোঝাই পুতুল নিয়ে চলেছে এক কারিগর। বললুম, ‘থামা থামা বোট, ডাক্ ঐ পুতুলের নৌকো।’ মাঝিরা বোট থামিয়ে ডাকলে নৌকোর মাঝিকে, নৌকো এসে লাগল আমার বোটের পাশে। নানা রংবেরঙের খেলনা, তার মাঝে দেখি কতগুলো নীল রঙের মাটির বেড়াল। বড়ো ভালো লাগল। নীল রংটা ছাই রঙের জায়গায় ব্যবহার করেছে তারা, ছাই রং পায়নি নীলেই কাজ সেরেছে‌। অনেকগুলো সেই নীল বেড়াল কিনে ছেলেমেয়েদের বিতরণ করলুম। পুতুলের গায়ের ‘টাচ’ বড় চমৎকার।”

আরতী পালের কৃতিত্ব এখানেই। বংশ পরম্পরায় এক ধারাকে নিয়ে চলেছেন তিনি। আর তা বহন‌ করছেন ওঁর ছেলে। পড়াশোনা করে চাকরি করলেও নিজেদের পেশাকে ভোলেননি।

আরতী আর মনোরঞ্জন পালের সুন্দর সাজানো পরিবার। এক ছেলে আর মেয়ে। রয়েছে নাতনিও। স্টুডিয়ো পার হয়েই ওঁদের থাকবার ঘর। পাশেই রান্নাঘর। গেলেই অমায়িক আপ্যায়ন মেলে। কখন‌ এই শিল্পী দম্পতি যেন অনেক কাছে চলে এসেছেন। জীবন আর শিল্পের মেলবন্ধনে গড়া এই শিল্পীর পরিবার।

প্রথম পর্ব

Categories
2021-July-dharabahik

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ


বিকেল মুছে দিয়ে সন্ধ্যের মায়া সবে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, মানে নগর কলকাতায় সন্ধ্যা যতটুকু আদল পায় হ্যালোজেন আলো চিরে, সেই ততটুকু মায়া যখন নাগরিক মানুষকেও আনমনা করে তুলছে, এমনকী দোকানে বসা রূপাকেও, তখনই নীল আলোর হঠাৎ ঝলকানি রূপার দোকানের সাঁঝমায়াকে তছনছ করে দিল! রূপা সচকিত হয়ে দেখে মেয়র পারিষদ আব্বাসের এসইউভি গাড়ি রাস্তার ভিড় সরিয়ে ছুটে চলে গেল পলকে। সাঁঝের মায়ায় আচ্ছন্ন রূপা সে-নীলে আরও আনমনা যেন।

আব্বাসউদ্দিন— মেটিয়াবুরুজের বেতাজ বাদশা! ডক অঞ্চলের ডন। মাফিয়া। তবুও সরকারি গাড়ি, নীল আলোর বৈভব-বিভা! রূপা ভাবে অভ্যস্ত হাতে কাজ সারতে সারতেই। কাচ্চি সড়কে আস্তানা আব্বাসের। সে-ওয়ার্ডের বরাবরের কাউন্সিলার সে। এবং নির্দল। তবুও সরকারি তাজ তার মাথায় বরাবর। এমনই প্রভাব, এমনই নিয়ন্ত্রণ তার তামাম এ-এলাকায়। সে-ই ঠিক করে দেয় এখনকার এমএলএ কে হবে। বিরোধী দল, নাকি সরকারি দল! এখন যেমন মেটিয়াবুরুজের এমএলএ বিরোধী দলের। আব্বাসের বরাভয় যেহেতু তার ওপর, তাই। যেহেতু এমএলএ বিরোধী হলেও মুসলমান। যদিও সরকারি লাল পার্টির প্রার্থী ছিল পার্টিরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ জোনাল সেক্রেটারি প্রদীপ রায়। হিন্দু! তাছাড়াও এলাকার উড়ো কথায় একটা মৌখিক সিলসিলার কিস্‌সাও ভেসে উঠেছিল। সুতরাং সবক— এ-জবানটিও লেপ্টেছিল সে-কিস্সায়। আবার আব্বাসের টক্করও যে কেবল প্রদীপ রায়ের সঙ্গেই— সাম্রাজ্যের দখলদারিতে! মেটিয়াবুরুজে সত্তর শতাংশ মুসলমান হলেও, মুসলমানদের সত্তর শতাংশ আবার বাংলাভাষী মুসলমান। হিন্দু এলাকা তো বটেই, এমনকী বাংলাভাষী মুসলমান এলাকায়ও লাল পার্টির প্রবল প্রভাব, আর লাল পার্টি মানেই তো প্রদীপ রায়! এবারে প্রদীপ রায় দাঁড়াবে শুনে আব্বাস মস্ত চাল চেলেছিল। এক বাঙালি দর্জি মুসলমানকে বিরোধী প্রার্থী করে সে। তবুও নির্দল আব্বাসের মাথায় সরকারি নীল তাজ। রূপার মনে ভাবনারা বুজকুরি কাটে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে লোকটা নিজে কোনোদিন এমএলএ পদে দাঁড়ায় না। নিজের ওয়ার্ডের কাউন্সিলার হয়েই সন্তুষ্ট থাকে সে বরাবর। তবুও সে এলাকার বেতাজ বাদশা! কিং-মেকার!

রূপা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। সে-অবসরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ভাবনারা ভেসে আসে আবারও। মস্তান, ডন, মাফিয়া আব্বাস আজ নেতা! সরকারি বিভা তার মাথায়। অথচ তার কৃষ্ণ…! সন্ধ্যার মায়া মুছে রাত গুঁড়ি মেরে কখন যে গেঁড়ে বসেছে দোকানে রূপা জানতেই পারে না।

খদ্দেররা আসে, যায়— দোকানে জমাট রাতের অন্ধকার ঠাই নাড়া হয়। অন্ধকার চলাচল করে রূপার মনেও।

সেদিনও ছিল অন্ধকার থকথকে গাঢ, কেন-না নাইট শো তখন শেষ হয়েছে। আব্বাসের দলের চারটে ছেলে সিনেমা শেষে হল থেকে বেরোবার মুখে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে। কৃষ্ণর তো ঠেক রূপশ্রী সিনেমা হলের উলটো দিকের কানা গলিটায়। খবর ওড়ে, বাতাস পায়— মুহূর্তে পৌঁছে যায় কৃষ্ণের কানে। কে না জানে যে— রাজারা কান দিয়ে শোনে। কৃষ্ণের হিলহিলে শরীরটা তড়াক দেওয়া সোজা, খাড়া। হাতে অস্ত্র নিমেষে এঁটে বসে। চারটি ছেলেকে কৃষ্ণ শাস্তি দেয়। তবে চরম না তা, কেবল একটা শিক্ষা, একটা চেতাবনি যে, এ-এলাকা কৃষ্ণের। যাবতীয় বেয়াদপি তোমাদের পাড়ায়— পিসন, খাতুনমহলে করো, এখানে হার্গিস নয়!

যদিও সে-রাত সেখানে শেষ হয় না, বরং তা আরও পিচ্ছিল ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে। আধঘণ্টাও না— রূপশ্রী হল চত্বর ঝলসে ওঠে উপর্যুপর ঝলকানিতে, যার ফেউ হিসেবে আসে ভয় জাগানো আওয়াজ— বুম! বুম! বুম! বোমার আঘাতে রাত জেগে ওঠে। আব্বাসের দল জানান দেয় নিজেদের। বুম বুম শব্দে এই প্রথম এ-পাড়ার রাত নিশির ডাকে জেগে ওঠে, ভয়ে কাঁপে, জানলা ঝটঝট ছিটকিনি আঁটে!

তবে যেমন গর্জাল তেমন বর্ষাল না। থেমে গেল আচমকা সে-যুদ্ধ। কেন-না উলুখাগড়া এক— তার প্রাণ গিয়েছিল সে-যুদ্ধে, যুদ্ধের প্রারম্ভেই। শ্রীকান্ত পোড়ে— চাকরি না পাওয়া ভালো ছাত্র, যেহেতু ভালো তাই নিরীহও, টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল ঠিক সে-সময়েই। সে নিরীহ উলুখাগড়া না জেনেই যুদ্ধের মাঝে পড়ে যায় এবং তার মাথার আধখানা উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের বন্ধ শাটারে ঘুঁটে হেন হাসতে থাকে যেন! যা জনহীনতা আনে। ফলে নির্জন, নিস্তব্ধ রাত কেঁপে উঠে হা-হা হেসে ওঠে। হাসি মোচড় দেয়, ঘূর্ণি তোলে— সে-ঘূর্ণির টানে রাত থকথকে পাঁকপিচ্ছিল। হ্যাঁ, কৃষ্ণ জমানায় প্রথম সে-পাড়ায়। এবং শেষও। যেহেতু ভদ্র-নিরীহ পাড়া, তাই পার্টি নামক অলোখ-অমোঘ শক্তি তত্ক্ষণাত্‍ হস্তক্ষেপ করে। আর বাংলা তখন লাল রঙে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, শ্বাসরুদ্ধ তাই। মেটিয়াবুরুজও তার ব্যতিক্রম নয়। যতই এখানে বিরোধী দলের এমএলএ থাকুক না কেন, সে যেন মাটির দুর্গে অন্তরীণই, শুধু তাজটুকুই সম্বল— যেমন ছিল নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্‌ তার তাজটুকু সম্বল করে অন্তরীণ তারই নিজের হাতে গড়া মেটিয়াবুরুজে!

এখন লাল রং যেমন প্রাণেরও, তেমনই ভয়েরও প্রতীক। যে-ভয়ে সে-হত্যার সাক্ষী কেউ থাকে না। আব্বাস-কৃষ্ণ, উঠতি চরিত্র দু-জনেই পার্টির আশ্রয় পায়। প্রভুভক্ত পুলিশও অতএব নাক শুকে চলে যায়— দোষী ধরা পড়ে না। নামহীন কয়েকজনের নামে এফআইআর হয়, যেমন দস্তুর! যারা ফেরারও নাকি! আর তখন পার্টি, মানে প্রদীপ রায় এ-রায়ে শীলমোহর দেয় যে, হিন্দু এ-পাড়া কৃষ্ণের আর উর্দু জবানের কাচ্চি সড়ক-বাত্তিকল-ধানখেতি-আয়রন গেট এলাকা আব্বাসের। যদিও এ-চুক্তি আগে থেকেই অলিখিতভাবে জারি ছিলই, তবুও এবারে তাতে পার্টি, মানে প্রশাসনের শীলমোহর দেগে বসে পাকাপাকিভাবে।

সেই থেকে কৃষ্ণের এ-অঞ্চলে কি-বা রাত, কি-বা দিন থকথকে পাঁকপিচ্ছিল হয়নি আর কখনো। তবে হিলহিলে চোরা ভয়ের স্রোত বইতো নাকি মানুষের মনে! বইলেও মানুষ সে-ভয়কে গিলে নিত মনের অন্ধকারে, চোখে ফুটে উঠতে দিত না। হ্যাঁ, ভয়েই!

তখন রূপা কিশোরী— স্কুল বালিকা। থোকাবাঁধা হলেও স্কুলবালিকা তারাও তো তখন অকারণ মাথা নামিয়েই বাক্হা‌রা ত্রস্ত পায়ে পেরিয়ে যেত রূপশ্রী তলা ইশকুল যাতায়াতের পথে। কেমন একটা শিরশিরানি স্রোত যেন হিলহিলিয়ে উঠতে থাকত শিরদাঁড়া বেয়ে! কিন্তু কেন জানে না সে আজও। হয়তো রাজার দরবারের সামনে দিয়ে যেতে গেলে মনে যে-ভয় সমীহ আঁকে, তাই-ই তা! জানে না রূপা আজও। যদিও কৃষ্ণের শাসনে এ-এলাকায় শান্তিই তো বিরাজিত করত, অন্তত যতদিন সে বেঁচে ছিল ততদিন! যদিও হাওয়ায় ফিশফিশানি এ-রব চোরা বইত যে, সে ছিল শ্মশানের শান্তি!

কিন্তু আজ? কিংবা কৃষ্ণের মথুরাজয়ের আগে! রূপা যান্ত্রিক অভ্যাসে খদ্দের সামলাতে সামলাতে আঁচল দিয়ে মুখ-গলার ঘাম মোছে। সে-নরম প্রশ্রয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রূপার বুক চিরে, যা অন্ধকার ঘনিয়ে তোলে রূপার মনে আরও। ফলে দোকানে রাত ঘন হয় যেন।


আজকে পার্টির বিশেষ মিটিং আছে বোধহয়। পাশের পার্টি অফিসের মুখে সাত সকালেই জটলা। ফলে রূপার চায়ের দোকানেও ভিড় বেশ। রূপা হিমসিম খায় যেন একা হাতে। হারুর কথা মনে পড়ে— থাকলে ভালোই হত। কিন্তু…। তবুও কিন্তু শব্দটা বাস্তবতা আঁকে। এ-ভিড় তো দু-এক মাসে একবার হয়তো। বাকি দিন তো ফাঁকাই। পথ চলতি লোক বা রিকশাঅলা দু-একজন। এই তো খদ্দের। নিজেরই চলে না, তো হারুকে পোষা! হাতের ব্যস্ততার সঙ্গে রূপার মনও নড়েচড়ে। হ্যাঁ, তখন ছিল বটে দিন, যখন রূপশ্রী গমগম করে চলত। খদ্দের সামলাতে হারু হিমসিম খেয়ে যেত। অন্দরে হেঁসেলে ঠাকুর টোস্ট সেঁকে, ভেজিটেবল-ডেভিল ভেজে কূলকিনারা পেত না। সঙ্গে চায়ের জল তো একটা উনুনে ফুটেই চলেছে, ফুটেই চলেছে অনবরত! অতীতচারী রূপা মনে মনে সে-ছবি ফুটিয়ে তুলতে থাকে অভ্যস্ত ছন্দে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই। সে-বিগত ছায়া দেখতে চেয়েই সে যেন বাইরে উদাস চোখ মেলে ধরে। আর অমনি সাদা এক আম্বাসাডার গাড়ি এক প্রবল ধাক্কায় রূপাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সে-সাদা গাড়ি থেকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির কালো কুচকুচে লোকটা নেমে আসে। ওই নামাটুকু মাত্র— সঙ্গে সঙ্গেই পার্টি অফিসের মুখের জটলাটা ঝাঁক বাঁধে লোকটাকে ঘিরে। এক কমরেডের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে চলে লোকটা ধীর-নিক্তি মাপা পায়ে পার্টি অফিসের দিকে। প্রদীপ রায়— পার্টির জোনাল সেক্রেটারি। মেটিয়াবুরুজের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র! তার চিকন কালো হাতের ছোঁয়া কাঁধ দেওয়া কমরেডের মুখে কৃতার্থের ছবি এঁকে দেয় নিমেষে। মুহূর্তে সে-বিগলিত মায়া জাদু করে জোটবাঁধা বাকি কমরেডদের, কেন-না সবার মুখেই কৃতার্থের বিগলিত হাসি ঝুলে থাকে, যেন-বা লোল পড়-পড়! কেউ কেউ মনে মনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ— এ-শ্লোগানও দিয়েছিল বোধহয়, নইলে চারতলা পার্টি অফিসের মাথায় টাঙানো ন্যাতানো লাল পতাকাটা হঠাত্‍ হাওয়ায় পত্‌-পত্‌ করে উড়বেই বা কেন ঠিক সে-সময়েই! যদিও কেউ দেখে না তা। শুধু রাস্তার উলটো দিকের দেওয়ালে আবছা হয়ে আসা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন— এ-বৈপ্লবিক শপথখানি তা দেখে এবং আরও একটু অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে পার্টির এ হেন প্রতাপে!

এ-দৃশ্যে দীর্ঘশ্বাস জমে রূপার মনে এবং তা তার বুক চিরে বেরিয়েও যায় সে-লহমাই, শুধু এক-একটুকরো ছবি ভাসিয়ে দিয়ে! তখন স্কুলবালিকা। তখন জরুরি অবস্থা পেরিয়ে গাই-বাছুরকে তাড়িয়ে কাস্তে-হাতুড়ির লালরাজ সবে মৌরসিপাট্টা কায়েম করেছে। তবুও গোরুর রাখাল সবুজ যুবাদের প্রতাপের রেশ সবটুকু মুছে যায়নি। ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোডের মথুর সিং তখনও তোলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এবং পুলিশের যোগ সাজসেই বোধহয় তার প্রতাপ ক্রমশ ক্রমবর্ধিত হতে থাকে, কেন-না মথুর সিং তখনও তো সবুজ রঙাই! এবং কাস্তে-হাতুড়ির লালরঙে তখনও আদর্শের মায়া। আবার যেহেতু ক্ষমতার ধর্মই হচ্ছে তার বিস্ফার, সে-কারণেও হয়তো সে, মথুর সিং ময়লা ডিপো, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড, ফতেপুর ছাড়িয়ে তার রাজত্ব বিস্তার করে বাঁধা বটতলা, রূপশ্রী সিনেমা হল পর্যন্ত। মাঝে মাঝেই রাত-বিরেতে বোমার আওয়াজে কেঁপে ওঠে এ-তল্লাট। এবং তা অকারণেই কেন-না রাজ কায়েম করতে হলে অস্ত্রের, যা ক্ষমতার চিহ্ন, তার প্রদর্শন করতেই হয়।

আর তারপর সিনেমায় যেমন হয়, তেমনই হয়। উঠতি যুবা, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি কৃষ্ণ, নেতৃত্ব যার সহজাত— সেই কৃষ্ণ মথুর সিং-এর দলবলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন মথুর সিং-এর দু-জন সাকরেদকে পাড়ায় দেখতে পেয়ে ক্লাবের ছেলেদের জুটিয়ে তাড়া করে। প্রথমটাই বাহুবলী দু-জন এমন অভাবিত ঘটনায় আশ্চর্যই হয় যেন। কেন-না নিরীহ ডরপুক বাঙ্গালি-আদমি তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে— এ তাদের ভাবনাতেই ছিল না। ফলে কোমরে গোঁজা অস্ত্র বার করতে গিয়ে জলদিতে হাত একটু কেঁপে যাওয়ায়, কিংবা দেশি ওয়ান শটার বেইমানি করেও হয়তো সে-ক্ষণে, তাই ছুটন্ত তাদের পিস্তল হাওয়াতেই গুলি উগড়ে দেয়। বা ইচ্ছে করেই হয়তো শূন্যে গুলি ছোড়ে নিতান্তই ভয় দেখাতে পেছনে ছুটে আসা ডরপুক নাদান বাঙ্গালি বাচ্চালোগোঁকে! কিন্তু অবাক তারা দেখে যে, বাঙালিবাচ্চারা ভয় না খেয়ে দৌড়েই আসে তাদের দিকে। আগুন উগড়ে সে-মুহূর্তে খালি ওয়ান শটার পিস্তল— তাতে গুলি ভরতে তো সময় লাগবে এবং গতিও শ্লথ করতে হবে। এরকম দোনামনা ভাবনাই হোক, বা পিস্তলে গুলি ভরতে চেয়েই হোক, তাদের গতি ক্ষণিকের জন্য শ্লথ হয়ই যেন। হয়তো-বা এমন অভাবনীয় কাণ্ড তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তেমনটাও হতে পারে। মোদ্দাকথা তাদের গতি সে-ক্ষণে তেমন তীব্র ছিল না, বা আপেক্ষিকভাবে পেছনের ছুটন্ত জনতার গতির তীব্রতা বেশিই ছিল হয়তো! যাই-ইহোক, দড়াম করে একটা আধলা এসে আছড়ে পড়ে ছুটন্ত বাহুবলীর একজনের পায়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। অন্যজন সঙ্গীকে বাঁচাবে, না নিজে বাঁচবে আগে— এই দোটানায় ক্ষণিক থামেই যেন। ফলে কৃষ্ণর যাদব-বৃষ্ণী বাহিনী তাকেও পেড়ে ফেলে মুহূর্তে। আর জনতার মার দুনিয়ার বার— সেহেতু এক মস্তান নেতিয়ে পড়ে খাবি খেতে খেতে শেষ হাওয়া টানে বোধহয় সেখানেই। অন্য জনকে পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ঘণ্টাদুয়েক পার হয়ে যায়। কেন-না রাস্তার পুবপাড় কলকাতা পুলিশের দখলে, আর পশ্চিমপাড় বেঙ্গল পুলিশের কব্জায়। ফলে কে হ্যাপা পোয়াবে এ-মীমাংসাতেই ওই ঘণ্টা দুয়েক সময় যায়। এবং ফিতে মেপে দেখা যায়, যে মারা গেছে সে কলকাতা পুলিশের আওতায়। আর যে তখনও মরেনি সে বেঙ্গল পুলিশের ছায়ায়। দু-পুলিশ দু-জনের দায়িত্ব নেয় আলাদা আলাদাভাবে। ফলে কেস দাঁড়ায় না। অশনাক্ত জনগণের নামে দু-থানায় দু-টি এফআইআর হয়। সময়ের সাথে ক্রমে সে-কেস ধামা চাপা পড়ে যায়।

এবং কেস ধামাচাপা পড়তে দেওয়া হয়, কেন-না লাল রাজত্বের বিপুল শুরুয়াতের দু-বছর পার হয়ে গেছে তখন, মরিচঝাঁপি নামক শাসকের সুশাসন কিংবা সন্ত্রাসও ঘটে গেছে ততদিনে, সেহেতু লাল রং একটু রংজ্বলা যেন-বা। আর সে জ্বলে যাওয়া লালে প্রতাপান্বিত প্রদীপ রায় স্বয়ং কৃষ্ণকে ছায়া দেয়। যে-খেলায় কৃষ্ণের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বিবেচ্য বিষয় হিসাবে থাকতে পারে না, যেহেতু ক্ষমতার রাজনীতি কথাটাই শেকড় গাড়ে! থকথকে কালো সে-ছায়ার মায়ায় অতি সাধারণ, আম-কৃষ্ণ লহমায় অসাধারণ হয়ে ওঠে যেন। ক্ষমতাভিষেক হয় তার পার্টির ছত্রছায়ায়। মথুরাপতি রাজা কৃষ্ণ যেন সে। কেন-না কালো সে-ছায়া মথুর সিংকে গিলে নেয়। এতদিনে পুলিশ খুঁজে পায় তাকে! ফলে এদিকে মুদিয়ালি থেকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন, রূপশ্রী হল, বাঁধা বটতলা, তা ছাড়িয়ে ফতেপুর, ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রোড, সিমেন্ট কল মোড় হয়ে রামনগর পর্যন্ত একছত্র রাজ যেন কৃষ্ণের। আর কে না জানে যে, ক্ষমতা মানুষের চেহারায় একধরনের জেল্লা আনে। লোকে কৃষ্ণের মাথার পেছনে বিভা দেখতে পায় যেন। সে-বিভা সমীহ আঁকে মানুষের মনে। যা অচেনার দূরত্ব তৈরি করে হয়তো। তবু সে হেঁটে গেলে মানুষ বিহ্বল কথা থামায় আচমকা, কেউ-বা গদগদে দেঁতো হাসি ঠোঁটে ঝোলায়। কৃষ্ণ উপভোগ করে তা। ক্ষমতা তাকে এটুকুও শেখায় যে দীর্ঘদিন রাজ করতে গেলে প্রজাপীড়ন অচল।মথুর সিং-এর পরিণতি কিংবা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অতীতই হয়তো তার মনে এ-বোধ আনে। না, এ-এলাকায় সে কোনোদিনই সাধারণ মানুষের ওপর কোনো জুলুম করেনি। আর সে থাকতে আর কারো সাহস হয়নি কোনোদিন কোনোরকম ফণা তোলার। আর তাই মানুষগুলো এখনও তার কথা বলে। রূপশ্রী হলের উলটো দিকের নামহীন কানা গলিটা, যেখানে তার ঠেক ছিল, তার নাম লোকের মুখে মুখে আজও কৃষ্ণের গলি নামেই পরিচিত। তার মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও!

আনমনা রূপার মন সহসাই আলো আঁকে তার মুখে। আবার ওপারের বাড়ি ডিঙিয়ে ফালি রোদ তার দোকানের দরজায় উঁকি মারে এই ক্ষণে, ফলে রূপার মুখে সে-আলো স্থায়িত্ব পায়। প্রদীপ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে জটলাটা পার্টি অফিসে ঢুকে গেছে কখন, রূপার মন খেয়াল করে না তা। দোকানের হঠাত্‍ নির্জনতা তাকে বাস্তবে ফেরায়। কর্মব্যস্ততার অবসরে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলার ফুরসত পায় যেন। কিন্তু কতক্ষণই তা! হঠাত্‍ এ-নির্জন অবসর আবারও অতীতকে আঁকে রূপার মনে, যা কৃষ্ণময়!

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Categories
2021-July-dharabahik

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

অষ্টম অধ্যায়
তীর্থযাত্রীদল নদী পার করে উং ছাং দেশে এসে পৌঁছোলেন। এই দেশটি ভারতের একেবারে উত্তর দিকে। মধ্যভারতীয় ভাষাই দেশজুড়ে সার্বিকভাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যভারত মূলত চীনের মতোই। এখানকার মানুষের পোশাক আর খাদ্যাভ্যাস চীনের মানুষের মতো। বুদ্ধের প্রচলিত ধর্ম এখানে বেশ ঋদ্ধ। সন্ন্যাসীগণ যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তার নাম সেংচিয়ালান। সর্বমোট পাঁচশত সন্ন্যাসী আছেন। সকলেই হীনযান মতাবলম্বী। ভবঘুরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদল এসে পড়লে, তিন দিনের জন্য তাদের আপ্যায়নের সমস্ত দ্বায়িত্ব তখন সন্ন্যাসীদের উপর। তিন দিন পর তাদের স্থান বদলের আহ্বান জানানো হয়। কথিত আছে বুদ্ধ যখন উত্তর ভারতে আসেন তখন এই দেশেও তিনি এসেছিলেন। বুদ্ধ এখানে একটি পদচিহ্ন রেখে যান, যেটি ব্যক্তিবিশেষের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ছোটো আর বড়ো হয়ে প্রতিভাত হয়। এখনও এই পায়ের ছাপটি বর্তমান। যে-পাথরের উপর তথাগত তাঁর কাপড় শুকাতে দিতেন, যে-স্থানে তিনি দুষ্ট ড্রাগনকে রূপান্তরিত করেছিলেন। সবই এখন দর্শনীয় স্থান। পাথরটি চৌদ্দো ফুট লম্বা আর কুড়ি ফুটের বেশি চওড়া, একটি দিক মসৃণ। বুদ্ধের ছায়া অনুসরণ করে হুই চিং, তাও চেং, হুই তা নগরাহরা দেশের দিকে এগিয়ে চললেন। ফা-হিয়েন এবং অন্যান্যরা এই উ ছাং দেশেই বর্ষাকালটি অতিবাহিত করলেন। বর্ষা অন্তে আবার পথ চলা, আবার এগিয়ে যাওয়া অবিরাম দক্ষিণ প্রান্ত ধরে, যতদিন না সু হো তো দেশে এসে পৌঁছোনো যায়।

নবম অধ্যায়
বৌদ্ধধর্ম এ-দেশে জনপ্রিয়। পুরাকালে পবিত্র ইন্দ্র শক্র বোধিসত্ত্ব পাবার আশায় নিজেকে পারাবত আর শঙ্খচিলে রূপান্তরিত করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব, পায়রাটির বন্দিমুক্তিপণ হিসাবে নিজের শরীর থেকে একখণ্ড মাংস কেটে দেন। এবং সেই স্থানেই তিনি বুদ্ধ হিসাবে জ্ঞানের সর্বশেষ স্তরটি সম্পূর্ণ করেন। পরে তিনি যখন তার শিষ্যদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করছিলেন, তখন এই স্থানটিকে চিহ্নিত করেন তার বুদ্ধত্ব লাভের স্থান হিসাবে। এভাবেই এখানকার সাধারণ মানুষ জায়গাটির বিশেষত্বের কথা জানতে পারে এবং স্বর্ণ, রৌপ্যে মোড়া একটি প্যাগোডা নির্মাণ করে।

দশম অধ্যায়
এই অঞ্চল থেকে যাত্রীদল পাঁচ দিন ধরে পূর্ব দিক বরাবর ক্রমাগত হেঁটে পৌঁছোলেন চিয়েন টো উই দেশে। এ-দেশের রাজা, সম্রাট অশোকের পুত্র ফা ই। বুদ্ধ যখন বোধিসত্ত্ব লাভ করেন, তাঁর প্রতিরূপ অন্য আর একটি জীবের উদ্দেশে নিজের চোখদুটো উৎসর্গ করেন। সেই স্থানেও সোনা, রূপা খচিত একটি প্যাগোডা নির্মিত হয়। এই দেশবাসীরা মূলত হীনযান সম্প্রদায়ের।

একাদশ অধ্যায়
এই স্থান থেকে পূর্ব প্রান্ত ধরে আবার এগিয়ে চলা। সাত দিন অবিরাম চলা শেষে এসে পৌঁছানো গেল চু চা শি লো (তক্ষশিলা) নামের একটি দেশে। চীনা ভাষায় এর অর্থ ছিন্ন মস্তক। বোধিসত্ত্ব লাভের সময় বুদ্ধ তার সহ-জীবের জন্য নিজের শির উৎসর্গ করেন। এই হল এ-দেশের নাম মাহাত্ম্য। তীর্থযাত্রীদলের পথ চলা শুরু হল আবার। আরও আরও পূর্বে এগিয়ে চলা কেবল। এবার দু-দিনের সফর শেষে তারা এক আশ্চর্য দেশে এসে থামলেন। এখানে বুদ্ধ একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে খাদ্যের যোগান দিতে নিজের দেহ দান করেন। এই দু-টি জায়গাতেও মূল্যবান পাথর খচিত প্যাগোডা রয়েছে। সন্নিহিত প্রদেশ থেকে আসা রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষের মধ্যে, পূজার অর্ঘ্য দান, পুষ্প দান, প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যেন বিরামহীন এক প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যেত। এই সবকয়টি প্যাগোডা, একসঙ্গে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্যাগোডা চতুষ্টয় নামে পরিচিতি পায়।

দ্বাদশ অধ্যায়
চিয়েন তো উই প্রদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে একটানা দুই দিন ভ্রমণ করে যাত্রীদল এসে থামল ফো লু শা (বৈশালী) প্রদেশে। পূর্বে বুদ্ধ তাঁর সকল অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করেন এই দেশ। ভ্রমণকালে আনন নামক শিষ্যকে বলেন, “আমার নির্বাণলাভের পর এ-দেশের এক রাজা কণিষ্ক এই স্থানে একটি প্যাগোডা নির্মাণ করবেন।” পরবর্তীকালে কণিষ্ক তাঁর শাসনকালে রাজ্য পরিদর্শনে এলেন। পবিত্র ঈশ্বর ইন্দ্র শক্র কণিষ্কের মস্তিষ্কে একটি ভাবনার বীজ বুনে দিতে চেয়ে নিজেকে মেষপালক বালকে রূপান্তরিত করলেন। পথমধ্যে গড়ে তুললেন একখানি প্যাগোডা। রাজা বালকের কাছে জানতে চাইলেন, “কী করছ হে বালক?” বালক উত্তর দিল, “বুদ্ধের জন্য প্যাগোডা তৈরি করছি।” রাজা বালকের কাজের প্রশংসা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই চারশো ফুট উচ্চতার একখানি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। মূল্যবান পাথর খচিত তার সারা অঙ্গে। তীর্থযাত্রীরা এ-পর্যন্ত যত মন্দির, প্যাগোডা দর্শন করেছেন, দার্ঢ্য আর সৌন্দর্যে এর তুলনীয় কিছুই নেই। সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপজুড়ে এমন প্যাগোডা বোধ করি আর একটিও নেই। এটিই সর্বোচ্চ। রাজা এই প্যাগোডা নির্মাণ সম্পূর্ণ করলে দেখা গেল এর দক্ষিণ দিক দিয়ে তিন ফুট উচ্চতার কিছু ছোটো প্যাগোডা উদ্‌গত হয়েছে। বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রটি এ-দেশে রয়ে যায়। পূর্বে উয়ে শি (পুরুষপুর এর রাজা কণিষ্কের পূর্ব পুরুষ হুভিষ্কা)-এর রাজা এ-দেশ আক্রমণের জন্য এক বিশাল সৈন্যদল জড়ো করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের সেই ভিক্ষাপাত্র অপহরণ করা। যুদ্ধে পদানত করলেন এই দেশের রাজাকে। এর পর বৌদ্ধধর্মের তীব্র পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে পাত্রটি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তদনুযায়ী তিনটি সম্যক বোধের (বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ) প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন সর্বপ্রথম। তারপর একটি বিরাটকায়, সুসজ্জিত হাতির পিঠে পাত্রটি রাখা হল। এরপর হল কী! সহসা হাতিটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে এবং আর উঠে দাঁড়াবার সাধ্য রইল না তার। এবার চারটি চাকা বিশিষ্ট একটি গাড়ি প্রস্তুত করা হল। পাত্রটি রাখা হল গাড়ির উপর। গাড়ি টানার জন্য আটটি হাতি জুতে দেওয়া হল। পুনরায় হাতিগুলি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা হারালো। রাজা অনুধাবন করলেন, এই রাজ্যে পাত্রটির কালাতিক্রম সম্পূর্ণ হয়নি, তাই এই বিপত্তি। গ্লানি, অনুতাপের সীমা রইল না রাজার। ফলস্বরূপ এই স্থানে রাজা একটি প্যাগোডা নির্মাণ করালেন। আর সেইসঙ্গে একটি মঠ। পাত্রটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সৈন্যদল নিযুক্ত করলেন, আর সমস্তরকম পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করলেন।

সাত শতাধিক সন্ন্যাসী সমবেত হলেন। মধ্যাহ্নে তারা পাত্রটি বাইরে বের করলেন। এবার সকলে মিলে নানা উপচারে অর্ঘ্য সাজিয়ে নিবেদন করলেন। পূজা অন্তে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন সকলে মিলে। এর পর আসন্ন সন্ধ্যাকালে যখন ধূপ ইত্যাদি জ্বালাবার কাল উপস্থিত হল, তারা আবার পাত্রটি বাইরে নিয়ে এলেন। দুই গ্যালনের অধিক তরল এই পাত্রে রাখা যায়। বিচিত্র রঙের সমাহার আছে এতে, যদিও মূল রং হল কালো। আদতে বুদ্ধের নির্দেশে চারটি পাত্রজুড়ে এই বৃহৎ পাত্রটি তৈরি হয়। আর এই চারটি জোড় সহজেই পৃথক করা যায়। এক ইঞ্চির এক পঞ্চমাংশের সমান পুরু এই পাত্রটি স্বচ্ছ আর উজ্জ্বল।

ধনীর দেওয়া বিপুল ফুলের ঐশ্বর্য, শত, সহস্র, দশ সহস্র শস্যের নৈবেদ্যেও অপূর্ণ রইল যা, দীনহীনের ছুড়ে দেওয়া একটি দু-টি পূজার ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠল তথাগতর সেই ভিক্ষাপাত্র। পাও উন আর শেং চিন শুধুমাত্র পূজা দিয়ে ফিরে গেলেন। হুই চিং, হুই তা আর তাও চেং পূর্বেই না শিয়ে প্রদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে বুদ্ধের দন্ত, করোটি আর ছায়ার উপাসনা করলেন তাঁরা। সহসা অসুস্থ হয়ে পড়লেন হুই চিং আর তাঁর শুশ্রূষা করার জন্যে তাও শেং রয়ে গেলেন সেখানে। হুই তা একাকী ফিরে এলেন ফো লু শা প্রদেশে। সেখানে বাকিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর। এখান থেকেই হুই তা, পাও উন আর শেং চিং চীনে ফিরে গেলেন। ভিক্ষাপাত্রের মন্দিরে এসে হুই চিং-এর ভ্রমণ শেষ হল। মৃত্যু হল তার। আর এভাবেই ফা-হিয়েন এবার একাকী অগ্রসর হলেন পরবর্তী গন্তব্যে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব